Table of Contents
এম্পিডক্লিস (Empedocles, ৪৯৪–৪৩৪ খ্রি.পূ.)
জীবন-চিত্র
কর্মজীবন, মৃত্যু ও অলৌকিকত্ব : এম্পিডক্লিস অ্যানাক্সাগােরাসের সমসাময়িক ছিলেন। গ্রীক দর্শনের লেখক জেলার (Zeller) বলেন যে, পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি ও অতীন্দ্রিয়বাদের যে সমন্বয় প্রত্যক্ষ করা যায়, তার গভীরতর রূপ দেখা যায় এম্পিডক্লিসের দর্শনে। এম্পিডক্লিস, সিসিলি দ্বীপের দক্ষিণ তীরবর্তী স্থানে অবস্থিত একারাগাস বা এগ্রিজেন্টাম নগরের একজন অধিবাসী ছিলেন। তিনি যে শুধু দার্শনিক ছিলেন তা নয়, তিনি একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক এবং কবিও ছিলেন। তিনি একটি বিশিষ্ট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মকাল সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। তবে তিনি নিজে খ্রি.পূ. ৪৪৩-৪৪ অব্দে প্রতিষ্ঠিত থুরি নগরটি পরিদর্শন করতে যান এমন কথা জানা যায়। কেউ কেউ বলেন, তিনি খ্রি.পূ. ৪৯৪ অব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং খ্রি.পূ. ৪৩৪ অব্দে তিনি মারা যান। তিনি একজন রাজনীতিবিদও ছিলেন, কারণ তিনি যেখানকার অধিবাসী ছিলেন সেখানকার রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানকার গণতান্ত্রিক দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। পিথাগােরাসের মত তিনিও এক শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি নানা ধরনের অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করতে পারতেন বলে লােকে বিশ্বাস করত। কখনও বা যুদ্ধের দ্বারা, কখনও বা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দ্বারা, বলা হত যে তিনি বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। ত্রিশ দিন ধরে মৃত মনে হয়েছে এমন এক রমণীকে তিনি পূণর্জীবন দান করেছিলেন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনী গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে একটি কাহিনী হল, তিনি নিজেকে দেবতা প্রতিপন্ন করার জন্য এটনা আগ্নেয়গিরিতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, যাতে লােকে মনে করে যে তিনি মৃত্যুর পর স্বর্গে গেছেন এবং দেবতা মনে করে লােকে তাকে সম্মান প্রদর্শন করে। (ম্যাথু আরনল্ড- এর কবিতা Enopediocles on Actina এই বিষয়বস্তুকে ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে।) আবার এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, আসলে তিনি ফেলােপােনিয়াসে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে কখনও ফিরে আসেননি। যাই হােক না কেন, কিভাবে তার মৃত্যু ঘটেছিল, তা সুনিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তিনি এগ্রিজেন্টাম নগরের গণতন্ত্রের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে নির্বাসিত হন। কথিত আছে চিকিৎসাবিদ্যায় তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
দর্শন
কাব্যের মাধ্যমে দর্শনের প্রকাশ : পারমিনাইডিস এবং অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকদের মত এম্পিডক্লিস তার দার্শনিক ও অন্যান্য চিন্তাধারাকে কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। লুক্রিটিয়াস (Lucretius) এম্পিডক্লিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তিনি কবি হিসেবে এম্পিডক্লিসের খুব প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে মতভেদ দেখা যায়। যেহেতু তার এই কাব্যগ্রন্থের অংশবিশেষমাত্ৰ এখন পাওয়া যায়, সেহেত কবি হিসাবে তার কৃতিত্বের বিষয়টি সংশয়ের ব্যাপার। এম্পিডক্লিস বৈজ্ঞানিক আলােচনার সঙ্গে ধর্মের অতীন্দিয়তার আলােচনাকে যুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকার্য পিথাগোরাসের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কার্যের পথে অগ্রসর হয়নি। পিথাগােরাস ছিলেন একজন গাণিতিক আর চিকিৎসাশাস্ত্রেই এম্পিডক্লিসের সমধিক আগ্রহ ছিল।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ব্যাখ্যা দেবার ব্যাপারে আগ্রহ : এম্পিডক্লিসের রচনা থেকে একটা বিষয়-পরিস্ফুট হয় যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ব্যাখ্যা দেবার ব্যাপারেই তার আগ্রহ ছিল বেশি। এই দৃশ্যমান জগতের আড়ালে অন্য কোন সত্তার অস্তিত্ব আবিষ্কারে তার আগ্রহ ছিল না। ইতােপূর্বেও অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকরা বস্তুর দৃশ্যমান রূপ অর্থাৎ অবভাস (Appearance) এবং বস্তু-আসলে-যা অর্থাৎ স্বরূপত বস্তু (Reality)-এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। এই পার্থক্য করতে গিয়ে কেউ কেউ স্বরপত বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন এবং সিদ্ধান্ত করেছেন যে, তা কেবলমাত্র মানুষের বুদ্ধির (Reason) দ্বারা জ্ঞেয়। আবার সােফিস্ট সম্প্রদায় এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, বস্তু যেরপ প্রতিভাত হয় সেরূপ নয়। তবে বস্তু আসলে কি তা নিরূপণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার কেউ কেউ এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বস্তুর দৃশ্যমান রূপের আড়ালে কোন অদৃশ্যমান সত্তার অস্তিত্ব নেই এবং তারা মনে করেন, প্রত্যক্ষগ্রাহ্য জগতের মধ্যেই সত্য নিহিত। কাজেই এই অভিমতের সমর্থকবৃন্দ কোন অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা এবং তার সমর্থনে জটিল অমূর্ত যুক্তি উপস্থাপনের তুলনায় অভিজ্ঞতাতেই সমধিক আগ্রহী। এম্পিডক্লিসের ছিল এই শেষােক্ত দৃষ্টিভঙ্গি।
ব্রাম্বের মন্তব্য : গ্রীক দর্শনের লেখক ব্রাম্ব বলেন যে, “তার এমন এক কল্পনা শক্তি ছিল যার দ্বারা তিনি বহুবিধ ধারণাকে একত্র সংযুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন – এমনই ব্যাপার যে বহু পরবর্তী পাঠক তার রচনার মৌলিকতা উপলব্ধি করতে সমর্থ হননি।” তার দার্শনিক ধারণাগুলোর মধ্যে মৌলিক উপাদান সংক্রান্ত মতবাদ এবং জীববিদ্যার প্রাকৃতিক নির্বাচন সংক্রান্ত মতবাদ দুটি পরবর্তীকালের দার্শনিক ধারণাগুলোর উপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু ব্রাম্ব বলেন, “তার রচনায় গ্রীক কাব্য সম্পর্কে তার তীব্র মন্তব্য, চিকিৎসাবিদ্যা এবং কল্পনামূলক মননের যে সংযােগ লক্ষ করা যায়, তাই হল সবচেয়ে আকর্ষণীয়।” বস্তুত, এম্পিডক্লিসের ছিল বহুমুখী অবদান– দর্শনে, জীববিদ্যায় , সাহিত্যে, রসায়নশাত্রে, চিকিৎসাশাসেত্র, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে এবং গণিত ছাড়া নানা বিষয়ে। এজন্য ব্রাম্ব বলেন, এম্পিডক্লিস তার বহুমুখিতার জন্যই আধুনিক পাঠকের কাছে বিস্ময়কর। (R.S. Brumbaugh: The Philosophers of Greece: Page 69)
স্টেইসের মন্তব্য : এম্পিডক্লিসের দর্শন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে স্টেইস বলেন যে, তার দর্শনের প্রকৃতি ছিল সর্বদর্শন সংগ্রহকারী হওয়া। এক হিসেবে এই মন্তব্য যথার্থ। কেননা এম্পিডক্লিসের পূর্বে গ্রীক দর্শনে যে বিচিত্র এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পরস্পর বিরােধী দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল তাদের সমন্বয় সাধনেই ব্রতী হয়েছিলেন। দার্শনিক এস্পিডক্লিস কাজেই তিনি নতুন কোন দর্শনের উদ্ভাবক এমন কথা বলা চলে না।
সত্তা জড়াত্মক, পারমেনাইডিস ও হেরাক্লিটাসের নীতির সমন্বয়সাধন : পারমেনাইডিসের দার্শনিক চিন্তার ভাববাদী এবং জড়বাদী, উভয় প্রকার ব্যাখ্যাই সম্ভব, যদিও অনেকের মতে, তার সত্তা জড়াত্মক। এম্পিডক্লিসও জড়বাদী ব্যাখ্যা গ্রহণ করে সত্তাকে জড়াত্মক (Material) বলেই মনে করলেন। এছাড়াও এম্পিডক্লিস পারমিনাইডিসের মূল চিন্তা অর্থাৎ ‘সত্তা’ সম্পর্কীয় ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। পারমিনাইডিসের মতে, সত্তার উৎপত্তিও নেই, ধ্বংসও নেই। সত্তা অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। আবার সত্তা অ-সত্তাতে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে না। যা আছে তা বরাবরই তাই থেকে যায়। কাজেই জড়ের শুরুও নেই, শেষও নেই। জড় হল অবিনশ্বর, স্বয়ম্ভু। এম্পিডক্লিস মনে করলেন পারমিনাইডিস ঠিক কথাই বলেছেন। আবার অপরপক্ষে হেরাক্লিটাসের মতবাদও তার কাছে যথার্থ বলে মনে হল। জগতের বিভিন্ন বস্তু সব সময়ই পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনকে কোন মতেই অস্বীকার করা চলে না, বা নিছক ভ্রম প্রত্যক্ষণ বা অলীক বলে বাতিল করে দেওয়া যায় না। কাজেই এম্পিডক্লিসের প্রকৃতির ব্যাখ্যা, হেরাক্লিটাস এবং পারমিনাইডিসের মাধ্যমে যথাক্রমে অন্তহীন পরিবর্তন এবং অন্তহীন স্থিরতা (eternal change and eternal invariability) – উভয়ের মধ্যে মধ্যস্থতার এক প্রচেষ্টা। শুধু পরিবর্তনই সত্য– এও যেমন সত্য নয়, তেমনি বস্তুর আবির্ভাব ও তিরােধান এরও ব্যাখ্যার প্রয়ােজন আছে। কাজেই পারমেনাইডিসের সত্তা যা অপরিণামী, তার নীতি এবং হেরাক্লিটাস এর পরিবর্তন ও গতির নীতি, এই উভয় নীতির সমন্বয় সাধনের প্রয়ােজন। এম্পিডক্লিস একটি নীতির সাহায্যে এই সমন্বয় সাধনে সচেষ্ট হলেন। এই নীতিটি হল, যখন বস্তুর পরিণাম বা পরিবর্তনের কথা বলা হয়, বস্তুর উৎপত্তি বা তার বিলুপ্তির কথা বলা হয়, তখন সমগ্র হিসেবেই বস্তুর উৎপত্তি এবং তার বিলুপ্তির কথা বলা হয়। কিন্তু বস্তু যে জড়কণার (Material Particles) দ্বারা গঠিত, তাদের উৎপত্তি বা বিনাশ কিছুই নেই, তারা অবিনশ্বর। এম্পিডক্লিসের এই চিন্তারই রূপায়ণ আমরা দেখতে পাই পরবর্তীকালে অ্যানাক্সাগোরাস এবং পরমাণুবাদীদের চিন্তাধারায়।
সত্তা অপরিণামী : যাকে সৃষ্টি এবং ধ্বংস বলে অভিহিত করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে অনাদি এবং অপরিণামী মূল দ্রব্যের সংযােগ ও বিয়ােগ (mixture and separation of eternal and unchangeable basic substances)। আয়ােনিয়ার দার্শনিকবৃন্দের মতে, জগতের সব বস্তুই কোন মূল জড় উপাদান থেকে উদ্ভূত। যেমন থেলিসের মতে, এই জড় উপাদান হল জল, অ্যানাক্সিমিনিসের মতে বায়ু। থেলিস এবং অ্যানাক্সিমিনিস প্রমুখ দার্শনিকবৃন্দ বিশ্বাস করতেন যে, এক ধরনের জড় উপাদান অন্য ধরনের জড় উপাদানে, যেমন জল ক্ষিতিতে এবং বায়ু অগ্নিতে রূপান্তরিত হতে পারে। কিন্তু পারমিনাইডিস মনে করেন, সত্তা অপরিণামী। সেহেতু এক ধরনের জড় উপাদান আর এক ধরনের জড় উপাদানে রূপান্তরিত হতে পারে না।
মৌলিক উপাদান চারটি : এম্পিডক্লিস পারমিনাইডিসের মতবাদকে তার নিজের মত করে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হলেন এবং তার মৌলিক উপাদান সম্পর্কীয় মতবাদ উপস্থাপিত করলেন। এই মতবাদ অনুসারে মৌলিক উপাদান হল চারটি – ক্ষিতি (Earth), অপ (Water), তেজ (Fire), এবং মরুৎ (Air)। অবশ্য উপাদান (Element) কথাটি এম্পিডক্লিস ব্যবহার করেননি। এই শব্দটি পরবর্তীকালের আবিষ্কার। তিনি উপাদানগুলোকে ‘সব কিছুর মূল’ (Roots of all) বলে অভিহিত করেছেন। বার্নেট (Burnet) এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, এ হল এম্পিডক্লিসের পক্ষে মাইলেশিয়ার দার্শনিকবৃন্দ যে অভিমতে বিশ্বাসী ছিলেন সেই প্রাচীন বা সেকেলে অভিমতে পুনরায় ফিরে যাওয়া। তাছাড়া অন্যান্য তিনটি উপাদানের সঙ্গে ক্ষিতিকেও একই স্তরভুক্ত করার বিষয়টিও প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিচায়ক। এই চারটি উপাদান হল অপরিবর্তনীয় এবং মৌলিক। এদের পারস্পরিক মিশ্রণ থেকেই জগতের যাবতীয় মূর্ত বস্তুর উৎপত্তি। উপাদানগুলোর সংযােগ এবং বিয়ােগ থেকেই যাবতীয় বস্তুর উৎপত্তি এবং ধ্বংস। কিন্তু উপাদানগুলোর উৎপত্তিও নেই, ধ্বংসও নেই। তারা সব সময় অপরিণামী থেকে যায়। এই অবিভাজ্য উপাদানগুলোতে প্রকৃতির বর্ণমালার অক্ষর (the letter of an alphabet by nature) বলে মনে করা যেতে পারে। (Empedocles called them “roots”, “stoicheia”, “letters” are used in this sense for the first time by Plato – Brumbaugh: The Phisocophers of Greece.). পারমিনাইডিস সত্তাকে অপরিণামী বলে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এম্পিডক্লিসের মতে এই সত্তা হল জড়াত্মক। আবার এই বিশ্বজগতে পরিবর্তনের যে অস্তিত্ব রয়েছে, আমাদের ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষই তার প্রমাণ বহন করে। কপলস্টোনের ভাষায় পারমিনাইডিসের দর্শন এবং ইন্দ্রিয়ের সাক্ষ্য প্রমাণ – এই উভয়ের মধ্যে মধ্যস্বতা করেছিলেন এম্পিডক্লিস। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এম্পিডক্লিসের দর্শনে শূন্য স্থানের কোন অস্তিত্ব নেই। শূন্য ঘন হল শূন্যতা, কিছুই নয়, অদৃশ্য। সব উপাদানই স্থান জুড়ে আছে। উপাদানগুলোর একটা সুনির্দিষ্ট বিস্তৃতি আছে এবং প্রতিরােধের শক্তি আছে।
মূল উপাদানের জড় বস্তুতে রূপান্তর গ্রহণের ব্যাখ্যা : একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দেয়, মূল উপাদানগুলো কিভাবে অন্যান্য জড় বস্তুর রূপ গ্রহণ করে? আয়ােনিয়ার দার্শনিকবৃন্দ এর কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। উপাদানের সংযুক্তি বা মিশ্রণ এবং বিযুক্তির সঙ্গে জড়িত রয়েছে গতির প্রশ্ন এবং এর জন্য প্রয়ােজন কোন গতিশীল শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া। আয়ােনিয়ার দার্শনিকবৃন্দ অনুমান করে নিলেন যে, গতির জন্য প্রয়ােজনীয় শক্তি জড়ের মধ্যেই নিহিত। যেমন, অ্যানাক্সিমিনিসের মূল উপাদান ‘বায়ু’ তার অন্তর্নিহিত শক্তির সাহায্যেই অন্য জড় বস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু এম্পিডক্লিস এই মতবাদ স্বীকার করে নিতে চাইলেন না। কারণ জড় যেহেতু নিশ্চেষ্ট ও নির্জীব, তার মধ্যে গতির অস্তিত্ব সম্ভব নয়। কাজেই কোন সক্রিয় শক্তি বাইরে থেকে জড়ের উপর ক্রিয়া করছে, এরূপ সিদ্ধান্তই তিনি সমীচীন মনে করলেন। আবার সংযুক্তি এবং বিযুক্তি, যেহেতু দুটি পরস্পরবিরােধী ক্রিয়া, দুটি বিরােধী শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতেই হয়। তিনি এই দুই শক্তির নাম দিলেন রাগ (Love) ও দ্বেষ (Hate), সঙ্গতি এবং অসঙ্গতি। এম্পিডক্লিস এই শক্তিগুলোকে প্রাকৃতিক এবং জড় শক্তিরূপে গণ্য করেছেন।
রাগ ও দ্বেষ চারটি উপাদানকে সংযুক্ত করে : রাগ ও দ্বেষ চারটি উপাদানকে একত্র করে বিভিন্ন জড়বস্তু গঠন করে। দ্বেষ বা সংঘাত (Strife) উপাদানগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে বস্তুর সত্তার বিনাশ সাধন করে। জগতে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ যে যান্ত্রিক শক্তির ক্রিয়া, তারই প্রকাশ এম্পিডক্লিসের রাগ ও দ্বেষ। এম্পিডক্লিসের মতানুসারে জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস চক্রবৎ সংগঠিত হয়, এই অর্থে যে, নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে জগতের সৃষ্টি ও প্রলয় ঘটে। কাজেই এক হিসেবে জগতের পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় কোন আদি বা অন্ত নেই।
জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস কিভাবে সংঘটিত হয়? : এই সৃষ্টি ও প্রলয় প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কোথাও থেকে আমাদের শুরু করতে হবে। শুরুতে অর্থাৎ আদিম মণ্ডলে (Sphere) সমস্ত উপাদানগুলো, অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ সম্পূর্ণভাবে একত্র মিশ্রিত বা ঐক্যবদ্ধ ছিল। বিশেষ বিশেষ মূর্ত বস্তুর সৃষ্টির জন্য তখনও তারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি। মন্ডলের যে কোন অংশে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ – এর সমান পরিমাণেই অস্তিত্ব ছিল। আদিতে রাগ (Love) বা সঙ্গতি (Harmony) সমগ্র মন্ডলে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি হিসেবে ক্রিয়মান ছিল। সমগ্র মন্ডলটিকে বলা হত ‘পরমানন্দময় ঈশ্বর’ (Blessed God)। যেহেতু দ্বেষের তখনও পর্যন্ত কোন আবির্ভাব ঘটেনি, তাই সৃষ্টি ও শুরু হয়নি। দ্বেষ কিন্তু মন্ডলের বাহিরে সর্বক্ষণ অস্তিত্বশীল ছিল। মন্ডলে দ্বেষের আবির্ভাবের ফলেই উপাদানগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থা শিথিল হতে আরম্ভ, অর্থাৎ দ্বেষ ক্রমশ পরিধি থেকে কেন্দ্রের দিকে প্রবেশ করতে শুরু করল। তার ফলে উপাদানগুলোর বিচ্ছিন্ন হবার বা তাদের ঐক্যবন্ধন শিথিল হওয়ার বিষয়টি শুরু হয়ে গেল। এই প্রক্রিয়া চলতে লাগল যতক্ষণ পর্যন্ত না সমজাতীয় উপাদানগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানগুলো পরস্পরের থেকে একেবারে পৃথক হয়ে গেল। যেমন, সব জলকণা এক জায়গাতে এবং সব অগ্নিকণাগুলো এক সঙ্গে জড় হল। এইভাবে যখন বিচ্ছিন্ন হবার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হল তখন দ্বেষেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং রাগ সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হল। কিন্তু রাগ আবার তার কাজ শুরু করে দেয়। বিচ্ছিন্ন উপাদানগুলোকে রাগ একত্রিত করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বজগৎ আবার তার পূর্বাবস্থায় উপনীত হয়। এরপর দ্বেষ আবার তার কাজ শুরু করে।
চক্রবৎ রাগ ও দ্বেষের ক্রিয়া চলতে থাকে : এইভাবে চক্রবৎ রাগ ও দ্বেষের ক্রিয়া চলতে থাকে। প্রশ্ন হল, এই প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে আমাদের বর্তমান জগতের অস্তিত্বের কথা ভাবা যায়? তার উত্তরে বলা যেতে পারে যে, আদিম গােলক এবং উপাদানগুলোর সমপূর্ণভাবে ঐক্যবন্ধন শিথিল হওয়া – এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থায় হল আমাদের এই জগৎ। দ্বেষ (Hate) ক্রমশ গােলকের মধ্যে প্রবেশ করে রাগকে বহিষ্কৃত করার জন্য সচেষ্ট হয়। এই গােলকের মধ্য থেকে যখন আমাদের এই জগৎ গঠিত হতে থাকে, তখন বায়ু হল প্রথম উপাদান যেটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তারপরে তেজ, তারপর ক্ষিতি। জগতের চক্রবৎ ঘূর্ণন বা আবর্তনের বেগের জন্যই তার থেকে জল নিষ্পেষিত হয়। আকাশের দুটি অংশ। এক অংশ অগ্নি এবং সেটিই হল দিন। অপর অংশ হল অন্ধকার জড় যার মধ্যে অগ্নি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং এই হল রাত্রি।
জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস : এম্পিডক্লিস আত্মার জন্মান্তরবাদ বা দেহান্তরপ্রাপ্তি বিষয়ক মতবাদে বিশ্বাসী। ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি অতীতে একজন বালক, বালিকা, গুল্ম , পাখি এবং সমুদ্রে বসবাসকারি মৎস্য ছিলাম। এই প্রসঙ্গে কপলস্টোন (Copleston) মন্তব্য করেন যে, এম্পিডক্লিসের এই মতবাদ তার সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেননা সব বস্তুই যদি জড়কণার দ্বারা গঠিত হয় এবং মৃত্যুতে যদি তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে অমরত্বের অবকাশ কোথায়? এম্পিডক্লিস হয়ত তার দার্শনিক এবং ধর্ম সম্বন্ধীয় মতবাদের মধ্যে অসঙ্গতির বিষয়টি লক্ষ করেননি।
চিন্তন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য না করা : অ্যারিস্টটলের মতানুসারে এম্পিডক্লিস চিন্তন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। চিন্তন তার মতে দেহেরই ক্রিয়া, যে দেহ উপাদানের দ্বারা গঠিত। এম্পিডক্লিসের ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ সম্পর্কীয় মতবাদ অনুসারে একই ধরনের পদার্থ দ্বারা একই ধরনের পদার্থ জ্ঞাত হয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে অবস্থিত উপাদানের সঙ্গে আমাদের বাইরে অবস্থিত উপাদানের মিলন ঘটে। আমাদের মধ্যে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ যথাক্রমে বাইরে অবস্থিত ক্ষিতি, অপ, তেজ: ও মরুৎকে জানে। চাক্ষুষ-প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে, যেহেতু চক্ষু অগ্নি এবং জলের দ্বারা গঠিত, চক্ষুর মধ্যে অবস্থিত অগ্নি এবং জলের প্রবাহ (Effluence) বাহ্য বস্তুতে অবস্থিত জল প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়।
ঈশ্বরতত্ত্ব : এম্পিডক্লিস ঈশ্বরতত্ত্বেরও আলােচনা করেছেন। লৌকিক দেবদেবীতে বিশ্বাসের কোন স্থান এম্পিডক্লিসের ঈশ্বরতত্ত্বে নেই। ঈশ্বরকে তিনি পবিত্র, বাক্যের অতীত চিৎপদার্থ রূপে বর্ণনা করেছেন। এই পবিত্র চেতন সত্তা তার চিন্তার দ্বারাই সমস্ত জগতে ব্যাস্ত হয়ে আছেন এবং তার নীতিই সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রসঙ্গে জেলার (Zeller) বলেন যে, এম্পিডক্লিস ঈশ্বরকে ব্রহ্মাণ্ড গােলকের সঙ্গে অভিন্ন বলে বিশ্বাস করতেন। (E. Zeller: Outlines of the History of Greek Philosophy: Page, 59). তিনি মনে করতেন, জড় জগতের ঊর্ধ্বে অবস্থিত ঐশ্বরিক অস্তিত্বই প্রকৃত জীবন, পার্থিব জীবন শান্তিরই নামান্তর।
গুরুত্ব ও সমালোচনা
গ্রীক দর্শনে এম্পিডক্লিসের অবদান : রাসেল বলেন, বিজ্ঞানের বাইরে এম্পিডক্লিসের মৌলিকতার পরিচয় চারটি উপাদান সম্পর্কীয় মতবাদ এবং পরিবর্তন ব্যাখ্যা করার জন্য রাগ (Love) এবং সংঘাত (Strife) এই দুই নীতির ব্যবহারের মাধ্যমে পাওয়া যায়। সমালােচকদের মতে, পরবর্তীকালের দর্শনের উপর এম্পিডক্লিসের প্রভাব ছিল অসামান্য। জড় জগতকে কয়েকটি সীমিত সংখ্যক উপাদানে পরিণত করে এবং নির্দিষ্ট গাণিতিক অনুপাতে তাদের মিশ্রণের কথা বলে তিনি আধুনিক রসায়নশাত্রের প্রতিষ্ঠাতা রূপে গণ্য হয়েছিলেন। প্রাণীদের উৎপত্তির যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করার জন্য অ্যানাক্সিমেন্ডারের সঙ্গে যুক্তভাবে তাকে খ্যাতনামা জীববিজ্ঞানী ডারউইনের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়। অতীন্দ্রিয়বাদ হিসেবে তিনি গ্রীক দ্বৈতবাদীদের মধ্যে ছিলেন সর্বাপেক্ষা কৌতুহলকর এবং উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব এবং কবিদের কাছে তিনি ছিলেন এক শক্তিশালী মােহিনী শক্তি।
এম্পিডক্লিসের দর্শন সম্পর্কে ব্রাম্বের মন্তব্য : তবে এম্পিডক্লিসের দার্শনিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতির কথা উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন সমালােচকবৃন্দ। ব্রাম্ব বলেন, “এম্পিডক্লিসের মধ্যে দর্শন এবং রসায়নশাত্রের মিশ্রণ দেখা যায়, যা রসায়নশাস্ত্রবিদ বা দার্শনিক, কারও কাজেই প্রীতিপ্রদ নয়।” দর্শনের দিক থেকে এম্পিডক্লিসের সুনির্দিষ্টভাবে চারটি উপাদানের উল্লেখের বিষয়টি সন্তোষজনক নয়। কারণ, যেহেতু উপাদানগুলোর বিস্তৃতি এবং আকার আছে তার থেকে অনুমান করে নিতে হয় যে, এমন কোন সাধারণ পদার্থ আছে যা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য গুণ এবং অনুমেয় আকারগুলোকে ধারণ করে আছে। আর এই রকম যদি কোন সাধারণ উপাদান থাকে, তাহলে পারমিনাইডিস যে যুক্তির বলে পরিবর্তনকে অস্বীকার করেছিলেন, সেই যুক্তি অনুসরণ করে আমাদেরকেও কি পরিবর্তনকে অস্বীকার করতে হয় না? উপাদানগুলোর যদি বিস্তৃতি থাকে তারা অবিভাজ্য হয় কিভাবে? বিজ্ঞানের দিক থেকে অনেকে এম্পিডক্লিসের মতবাদের উৎকর্ষ সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেন, যদিও তার রাসায়নিক উপাদান এবং রাসায়নিক সূত্রের মূল্য অনেকেই স্বীকার করেন। যেভাবে তিনি উপাদানগুলোর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন, অনেকেই তা নির্ভরযােগ্য বলে মনে করেন না। বিশ্লেষণিক পদ্ধতি প্রয়ােগ না করে তিনি তার নিজের ভাবনা চিন্তাকেই বাইরে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিকের পক্ষে সাক্ষাৎ পর্যবেক্ষণকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র কল্পনার উপর নির্ভর করা যুক্তিযুক্ত নয়।
ডিমােক্রিটাস (Democritus, ৪২০-৩৭০ খ্রি.পূ.) ও অন্যান্য পরমাণুবাদী দার্শনিকবৃন্দ (The Atomists)
হেরাক্লিটাস এবং পারমিনাইডিস তত্ত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় পরমাণুবাদে। মাইলেশিয়ার দার্শনিকবৃন্দ জড় সম্পর্কে যে অভিমত পােষণ করতেন, সেই অভিমতের ক্ষেত্রে এলিয়ার দার্শনিক পারমিনাইডিস এবং জেনাের যুক্তি প্রয়ােগ করে, লিউসিপ্পাস এবং ডিমােক্রিটাস এক নতুন দর্শনের প্রবর্তন করলেন, যা জড়বাদ (Materialism) নামে পরিচিত। পরমাণুবাদীদের মূল বক্তব্য হল শূন্য দেশে গতিশীল এবং পরপর সংঘাতে রত, নিরেট অবিভাজ্য জড়কণার দ্বারাই সব সত্তা গঠিত। পরমাণু মতবাদের এই হল দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক বিবৃতি। পরবর্তীকালে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের হাতে পরমাণুবাদ যে রূপ পরিগ্রহ করেছিল, লিউসিপ্পাস ও ডিমােক্রিটাসের পরমাণুবাদ নিঃসন্দেহে তার থেকে ভিন্ন। পরমাণু সম্পর্কে পরবর্তী দার্শনিক ধারণা বা ২০শ শতাব্দীর পরমাণুবাদী পদার্থ সম্পর্কীয় মতবাদের সঙ্গে উপরিউক্ত দার্শনিকবৃন্দের পরমাণুবাদকে পৃথকভাবে দেখাটাই হবে সমীচীন।
পরমাণুবাদী দর্শন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা লিউসিপ্পাস : পরমাণুবাদী দর্শন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মিলিটাসের লিউসিপ্পাস (Leucippus)। বার্নেট বলেন, “কারণ তিনিই হলেন প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যক্তি যিনি থেলিসের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন।” লিউসিপ্পাসের জীবন বৃত্তান্ত থেকে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তার জন্মদিবস, মৃত্যুদিবস কোনটিই সঠিকভাবে নিরূপিত হয়নি। তার জন্মস্থানও অনিশ্চিত। তার জন্মস্থান রূপে মিলিটাস, আবদেরা, এলিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ করা হয়েছে। এমন কি থিয়ােফ্রেস্টাস (Theopharstus), যিনি লিউসিপ্পাসকে ‘পারমিনাইডিসের দর্শনের একজন সহযােগী’ বলে উল্লেখ করেছেন, লিউসিপ্পাস সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট সংবাদ দিতে পারেননি। তবে এরূপ ধারণা করা হয় যে, তিনি দার্শনিক এম্পিডক্লিস এবং অ্যানাক্সাগােরাসের সমসাময়িক ছিলেন। বস্তুত লিউসিপ্পাস বলে কোন দার্শনিকের যথার্থই কোন অস্তিত্ব ছিল কিনা, এমন প্রশ্নও কেউ কেউ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল এবং থিয়ােফ্রেস্টাস লিউসিপ্পাসকে পরমাণুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতারূপে স্বীকার করেন। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস রচয়িতা বার্নেট এবং কপলস্টোন উপরিউক্ত অভিমত সমর্থন করেন। থিয়ােফ্রেস্টাস লিউসিপ্পাসকে পারমিনাইডিস দর্শন সম্প্রদায়ের একজন সভ্যরুপে বর্ণনা করেন। ডায়ােজিনিস রচিত লিউসিপ্পাসের জীবনী থেকে জানা যায় যে, তিনি জেনাের শিষ্য ছিলেন।
ডিমােক্রিটাস
ডিমােক্রিটাসের পরিচয় : পরমাণুবাদী দর্শন সম্প্রদায়ের অন্যতম খ্যাতনামা দার্শনিক ডিমােক্রিটাস ও পরমাণুবাদী দর্শন সম্প্রদায়ের অন্যতম খ্যাতনামা দার্শনিক হলেন ডিমােক্রিটাস (Democritus)। তিনি (৪২০-৩৭০ খ্রি.পূ. অব্দ) থ্রেস প্রদেশে আবদেরা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। এক সঙ্গতিপন্ন পরিবারে তার জন্ম হয়। তিনি ছিলেন যথার্থ পণ্ডিত ব্যক্তি এবং অনেক গ্রন্থের রচয়িতা। তার বক্তৃতা করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। জ্ঞানলাভের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা তাকে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে বিভিন্ন জাতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেছিল এবং তার আর্থিক সঙ্গতি এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। তিনি মিশর, ব্যাবিলােনিয়া , পারস্যদেশ প্রভৃতি বহু স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। ডিমােক্রিটাসের মৃত্যুদিবস সঠিকভাবে নিরূপিত হয়নি। তবু অনেকের মতে, তিনি শত বছরের বেশি জীবিত ছিলেন। কারও কারও মতে পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক দার্শনিকদের মধ্যে পাণ্ডিত্যে, বক্তৃতা করার ক্ষমতায় ও সূক্ষ্ম বিচারশক্তিতে তিনি অধিকাংশের থেকে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কথিত আছে তরুণ বয়সে ডিমােক্রিটাস প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার, জন্য এথেন্সে গিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যানাক্সাগোরাস ডিমােক্রিটাসের সাক্ষাৎ দেওয়ার সময় পাননি। তাই হতাশ হয়ে ডিমােক্রিটাস লিখেছিলেন : “আমি এসেছিলাম কিন্তু কেউ আমায় চিনল না।”
লিউসিপ্পাসের সাথে সম্পর্ক : লিউসিপ্পাসের অনেক পরবর্তী সময়ে ডিমােক্রিটাসের আবির্ভাব। ডিমােক্রিটাস ছিলেন লিউসিপ্পাসের শিষ্য। লিউসিপ্পাস রচনাকে পৃথকভাবে চিনে নেবার কোন উপায় নেই। কেননা ডিমােক্রিটাসের রচনাবলীর সঙ্গেই সেগুলো প্রকাশ করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কাজেই কোন রচনা গুরুর এবং কোন রচনা শিষ্যের অর্থাৎ কিনা, পরমাণুবাদী দর্শনে কার কতটুকু অবদান সেটা পৃথকভাবে নিরূপণ করতে থিয়ােফ্রেস্টাস পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে কেউ সফল হয়নি। তবে এই প্রসঙ্গে স্টেইস (Stace) যে কথা বলেছেন তা সত্য হতে পারে। তার মতে, পরমাণুবাদী দর্শনের মূল বিষয়গুলো লিউসিপ্পাসেরই রচনা। ডিমােক্রিটাস সেগুলোর প্রয়ােগ সাধন করে পরমাণুবাদী দর্শনের ব্যাপকতা সাধন করেন, সেগুলোর বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন এবং পরমাণুবাদকে একটি উল্লেখযােগ্য মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রীক দর্শনের লেখক ব্রাম্ব সেই কথাই বলেছেন। ডিমােক্রিটাসের সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যা এবং প্রয়ােগের মধ্য দিয়েই পরমাণুবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত ও প্রভাববিশিষ্ট হয়ে ওঠে।
অধিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা
রাসেলের মন্তব্য : এই প্রসঙ্গে বাট্রান্ড রাসেল যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তার উল্লেখ করা যেতে পারে। তার মতে, লিউসিপ্পাস এবং ডিমােক্রিটাসের সাধারণ দর্শনের মৌলিক ধারণাগুলো লিউসিপ্পাসেরই অবদান তবে এগুলোর বিশদ ব্যাখ্যার ব্যাপারে উভয়কে পরস্পরের থেকে বিযুক্ত করা কদাচিৎ সম্ভব এবং রাসেলের মতে, সেই ধরনের প্রচেষ্টার কোন গুরুত্ব নেই। (B. Russell: History of Western Philosophy: Page-85.)। পারমিনাইডিসের অদ্বৈতবাদ (Monism) এবং এম্পিডক্লিসের বহুত্ববাদ (Pluralism)-এই দুই এর মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্যই, যদি ডিমােক্রিটাসের কথা বলা নাও হয়, লিউসিপ্পাস পরমাণুবাদ প্রতিষ্ঠার দিকে চালিত হয়েছিলেন। ডিমােক্রিটাস অনেক পরবর্তীকালের দার্শনিক। তিনি সক্রেটিসের সমসাময়িক। কাজেই প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিক রূপেই তাকে গণ্য করে তার দার্শনিক মতবাদ আলােচনা করা হলে কালানুক্রমানুসারে দার্শনিকদের দার্শনিক মতবাদ আলোচনা করার রীতিকে লঙ্ঘন করা হয়। তাই বার্নেট, কপলস্টোন প্রমুখ গ্রীক দর্শনে, লেখকবৃন্দ ডিমােক্রিটাসের মতবাদ পরে আলােচনা করেছেন। কিন্তু অনেকে লিউসিপ্পাসের মতবাদের সঙ্গেই ডিমােক্রিটাসের মতবাদ আলােচনা করেছেন। ব্রাম্ব এর স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন যে, একদিক থেকে এটা করা খুবই যুক্তিযুক্ত। কারণ প্রকৃতির কলাকৌশল এবং জড় উপাদানকে বােঝার জন্য মিলিটাসের দার্শনিকদের প্রচেষ্টাকে যে ধারণাগুলো সঙ্গতিপূর্ণ সম্পূর্ণতার পথে চালিত করে সেগুলোর চূড়ান্ত সমন্বয়সাধন করেন ডিমােক্রিটাস।’
কপলস্টোনের মন্তব্য : কপলস্টোন মন্তব্য করেন যে, ‘পরমাণুবাদী দর্শন হল এম্পিডক্লিসের দর্শনের যৌক্তিক বিকাশ। এম্পিডক্লিস পারমিনাইডিসের মতবাদ ও হেরাক্লিটাসের মতবাদের সমন্বয় সাধনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এম্পিডক্লিসের মূল তত্ত্ব হল, চরম ভবন (Absolute Becoming) বলে কিছু নেই। সত্তা অ-সত্তাতে বা অ-সত্তা সত্তাতে পরিবর্তিত হতে পারে না। আবার হেরাক্লিটাস যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তাকেও অগ্রাহ্য করা যায় না, কেননা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর পরিবর্তন অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়। তাকে অস্বীকার করা চলে না। এম্পিডক্লিস পরিবর্তনের সমস্যাটি সমাধান করার জন্য চারটি উপাদানের কথা বলেছেন, যে উপাদানগুলো হল জড়-কণা, কিন্তু তিনি তার জড়-কণা সম্বন্ধীয় মতবাদকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি মতবাদটির যৌক্তিক বিকাশ-সাধনে সচেষ্ট হলেন না। এম্পিডক্লিস জড়-কণাগুলোর সংজ্ঞা যথাযথভাবে নির্দেশ করলেন না, তাদের প্রকৃতি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন না। কাজেই জড়কণাগুলো সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব হল না। তাছাড়া এম্পিডক্লিসের মতবাদ পরিমাণের সাহায্যে গুণগত পার্থক্যের ব্যাখ্যাও কোন যৌক্তিক পরিণতি লাভ করেনি।
রাগ ও দ্বেষ কাল্পনিক ও অবাস্তব : এম্পিডক্লিসের মতে, তার চার উপাদানেরই শুধুমাত্র গুণগত পার্থক্য আছে। অন্যান্য যাবতীয় গুণ, এই চার উপাদানের কণাগুলোর অবস্থান ও বিন্যাসের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এম্পিডক্লিসের দেখা উচিত ছিল যে, সকল প্রকার গুণই কণাগুলোর অবস্থান ও বিন্যাসের উপর নির্ভর করে। যেমন, এম্পিডক্লিস সবরকম ভবন (Becoming)-কেই জড়-কণার গতির পরিণতি রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। পরমাণুবাদীরা এম্পিডক্লিসের এই ত্রুটি সংশােধন করে এম্পিডক্লিসের কণা-সম্পর্কীয় মতবাদকে তার যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাবার জন্য সচেষ্ট হলেন। কাজেই সমালােচকদের দৃষ্টিতে এম্পিডক্লিসের দর্শন একটা পরিবর্তনমূলক স্তরে অবস্থিত। পরমাণুবাদীদের কাজ হল এম্পিডক্লিসের যান্ত্রিকবাদী ও জড়বাদী দর্শনকে তার যুক্তিসিদ্ধ বা যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এছাড়াও এম্পিডক্লিস কণাগুলোর গতিশক্তিকে ব্যাখ্যা করার জন্য যে দুটি শক্তি-রাগ ও দ্বেষের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো কাল্পনিক ও অবাস্তব। যথার্থ যান্ত্রিকতাবাদী দর্শনে তাদের কোন স্থান থাকতে পারে না। পরমাণুবাদীরা এই ত্রুটি সংশােধনেও সচেষ্ট হলেন।
কিভাবে পরমাণুর উৎপত্তি? : কিভাবে পরমাণুর উৎপত্তি হয়েছিল অ্যারিস্টটল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দ পদার্থের বহুত্ব ও গতি স্বীকার করতেন না। কেননা শূন্য দেশের কল্পনা ছাড়া পদার্থের বহুত্ব ও গতি ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের মতে, শূন্য দেশের ধারণা করা সম্ভব নয়। লিউসিপ্পাস স্পষ্টই স্বীকার করলেন যে, শূন্য স্থান না থাকলে গতি সম্ভব নয়। যেহেতু গতি ও পরিবর্তনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না, সেহেতু তিনি শূন্য দেশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ দেশের (Full Space) অস্তিত্ব স্বীকার করলেন। তার মতে, দেশের অস্তিত্ব আছে। তবে তা শূন্য নয়, পূর্ণ; দেশ অসংখ্য ক্ষুদ্র দ্রব্যের দ্বারা পূর্ণ, যেগুলো তাদের ক্ষুদ্রতার জন্য প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়। এগুলোই শূন্য স্থানে গতিশীল হয়। এদের সংযােগ, বিয়ােগ ও পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে জগতের যাবতীয় বস্তুর উৎপত্তি, ধ্বংস ও স্থিতি সম্ভব হয়।
পরমাণুর পরিচয় : লিউসিপ্পাস এবং ডিমােক্রিটাস এম্পিডক্লিসের জড়-কণা সম্পর্কীয় মতবাদের বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হলেন। তাদের মতে, জড়কে যদি ক্রমাগত বিভক্ত করা হয় তাহলে বিভক্ত করতে করতে এমন একটা অবস্থায় এসে উপনীত হতে হবে যখন আর তাদের বিভক্ত করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত অবিভাজ্য এককে উপনীত হওয়া যাবে, তারাই হল পরমাণু। কাজেই পরমাণু হল জড়ের অন্তিম উপাদান, জড়ের অবিভাজ্য অংশ। এরা সংখ্যায় অসংখ্য এবং এত ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা এদের প্রত্যক্ষ করা যায় না। এম্পিডক্লিসের মতে, জগতের উপাদান ক্ষিতি, অপ, মরুৎ ও তেজ চার ধরনের জড়কণা। কিন্তু পরমাণুবাদীদের মতে, সব জড় কণাই এক ধরনের। তাদের আকৃতি ও আয়তন ভিন্ন, কিন্তু তাদের কোন গুণগত পার্থক্য নেই। কোন পরমাণু বৃহদাকারের বা কোনটা ক্ষুদ্রাকার। কিন্তু গুণের দিক থেকে সকলেই এক ধরনের, যেহেতু পরমাণুর কোন গুণগত পার্থক্য নেই। যাবতীয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুর গুণের উৎস হল পরমাণুর অবস্থান এবং বিন্যাস। এভাবে পরমাণুর প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করে পরমাণুবাদীরা এম্পিডক্লিসের মতবাদের প্রথম অসঙ্গতি দূর করতে সচেষ্ট হলেন। পরমাণুর কোন গুণ নেই, একথা আগে বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের একটা গুণ স্বীকার করে নিতেই হয়, তাহল তাদের ঘনত্ব বা অভেদত্ব (Solidity or Impenetrability)। কারণ পরমাণু অবিভাজ্য। পরমাণুর ওজনের প্রশ্নটি পরে আলােচনা করা হয়েছে।
শূন্যস্থানের অস্তিত্বের স্বীকার : পরমাণুগুলো পরস্পরের থেকে পৃথকভাবে অবস্থান করে এবং তাদের এই পারস্পরিক পার্থক্যের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ভিন্ন ধর্মবিশিষ্ট কোন পদার্থের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়। এই পদার্থই শূন্য স্থান বা দেশ (Empty Space)। তাছাড়া বস্তুর গুণ ও পরিবর্তন ব্যাখ্যা করার জন্য যদি পরমাণুগুলোর পারস্পরিক সংযুক্তি ও বিযুক্তিকে স্বীকার করে নিতে হয়, তাহলে শূন্য স্থানের অস্তিত্বও অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হয়। কারণ শূন্য স্থান স্বীকার করে না নিলে পরমাণুগুলো কোথায় গতিশীল হবে? লিউসিপ্পাস হলেন প্রথম দার্শনিক যিনি পরিপূর্ণ সচেতনতার সঙ্গেই শূন্য স্থানের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পিথাগােরাস শূন্যকে বাতাসের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছিলেন কিন্তু লিউসিপ্পাসের শূন্যস্থান প্রকৃতই শূন্যগর্ভ স্থান বা ফাঁকা স্থান। পরমাণুবাদীদের দৃষ্টিতে শূন্যস্থানের বাস্তব অস্তিত্ব আছে যদিও তাদের ভৌতিক অস্তিত্ব নেই।
পরমাণু কিভাবে গতিশীল হয়? : এখন প্রশ্ন হল পরমাণু কিভাবে গতিশীল হয়? পরমাণুর সংযােগ ও বিয়ােগের সাহায্যেই যদি সবকিছুর উৎপত্তি ও ধ্বংসকে ব্যাখ্যা করতে হয় তাহলে কোন গতিশক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়। এরই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, পরমাণুর ওজন আছে কি? পরমাণুর ওজন স্বীকার করে নিলে, পরমাণুর গতি (Motion) সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। কারও কারও মতে ডিমােক্রিটাস পরমাণুর আকার ও আকৃতির বিষয়টি স্বীকার করে নিলেও, পরমাণুর কোন ওজনের অধিকারী করেননি। কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে, পরবর্তীকালের গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস পরমাণুর গতি ব্যাখ্যা করার জন্য পরমাণু ওজনের অধিকারী বলে মনে করেছিলেন। এপিকিউরীয় দার্শনিকবৃন্দ মনে করতেন যে, ওজনের জন্যই অসীম দেশে (Infinite Space) পরমাণুগুলো অনবরত নিম্নদিকে পতিত হত। কিন্তু পরমাণুবাদী ডিমােক্রিটাস শূন্যস্থানে কোন ‘উপর নীচ’ বা ‘মধ্যস্থান’-এর কথা স্বীকার করেননি এবং এক হিসেবে ডিমােক্রিটাসের চিন্তাধারা এই বিষয়ে যুক্তিযুক্ত, কেননা আসলে ‘উপর’ ‘নীচ’ বা ‘মধ্যস্থান’ আমাদেরই কল্পনা, এর কোন অস্তিত্ব নেই। তাহলে ডিমােক্রিটাস পরমাণুর গতিশক্তিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন? অ্যারিস্টটলের মতে, সূর্য থেকে সূর্যরশ্মি যেমন এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনিভাবে পরমাণুগুলো এদিকে ওদিকে ধাবিত হয়।
অনন্ত জগতের সৃষ্টি : পরমাণুবাদীদের মতে, ভারী পরমাণুগুলো হাল্কা পরমাণুর তুলনায় শূন্যস্থানে দ্রুত পতিত হয়। কিন্তু আমরা জানি এই অভিমত সত্য নয়, কেননা এগুলো একই বেগে হয়। যাই হােক না কেন পরমাণুবাদীদের মতে, ভারী পরমাণুগুলো দ্রুত হবার সময় হাল্কা পরমাণুগুলোকে আঘাত করে একপাশে এবং ঊর্ধ্বে সরিয়ে দেয়। পরমাণুগুলোর এই পারস্পরিক আঘাতের ফলে, অসমতল আকৃতিবিশিষ্ট পরমাণুগলি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, যার ফলে একটা ঘূর্ণি বা আবর্ত (Vortex)-এর সৃষ্টি হয় এবং একটি জগৎ সৃষ্টি হতে থাকে। যেহেতু দেশ অসীম এবং অন্তহীনভাবে পরমাণু পতিত হতে থাকে, সেহেতু সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, অনন্ত জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। অনন্ত জগতের মধ্যে আমাদের এই জগৎ একটি জগৎ। পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত পরমাণুগুলো যখন পরস্পর থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, তখন আমাদের এই অস্তিত্বশীল জগৎ-ও ধ্বংস হয়ে যায়। অবশ্য পরমাণুর গতিশীলতার এই ব্যাখ্যা একান্তভাবে নির্ভর করছে তাদের ওজনের অধিকারী হওয়ার ওপর।
অধ্যাপক বার্নেট-এর অভিমত : অধ্যাপক বার্নেট (Burnet)-এর মতে, পরমাণুবাদীরা পরমাণুর ওজন আছে কখনও মনে করেননি এবং ওজনের ব্যাপারটি এপিকিউরীয় দার্শনিকদের দ্বারা পরবর্তীকালে সংযােজিত হয়। কিন্তু পরমাণুর ওজন স্বীকার করে না নিলে তাদের পতনের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে পরমাণুবাদীরা কিভাবে আদিম বা মূল গতিকে ব্যাখ্যা করলেন, তা একটা সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এই সমস্যার সমাধান করার জন্যই বার্নেট বলেন, “সবচেয়ে নিরাপদ হল এই কথা বলা যে, এটা হল এই পথে বা ঐ পথে একটা বিশৃঙ্খল গতি”। কিন্তু বার্নেটের এই উক্তি অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য, বিশৃঙ্খল গতি (Confused Motion)-র কোন অর্থ হয় না। বার্নেটের কথা মেনে নিলে পরমাণুবাদীরা মূল গতির উৎপত্তির কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বলেই সিদ্বান্ত করতে হয়।
জগৎ বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং এটি যান্ত্রিক : পরমাণুবাদীরা গতির ব্যাখ্যার জন্য এম্পিডক্লিসের মত রাগ ও দ্বেষ-রূপ কোন শক্তি বা সমসাময়িক দার্শনিক অ্যানাক্সাগােরাসের বিশ্ব-ধী বা বুদ্ধিকে স্বীকার করে নেননি। কোন গতিশক্তিকে অনিবার্যভাবে অনুমান করে নিতে হবেই একথা লিউসিপ্পাস কখনও ভাবেননি। শুরুতে শূন্যস্থানে পরমাণু অবস্থান করত এবং তার থেকেই এই অভিজ্ঞতার জগতের সৃষ্টি। পরমাণুবাদী দর্শনে পরমাণুদের আদি-অন্তহীন গতিই ছিল জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরমাণুবাদীরা সব গতিকেই অনিবার্য বা অবশ্যম্ভাবী বলে গণ্য করতেন। সেই কারণে অ্যানাক্সাগোরাস গতির ব্যাখ্যায় যে বিশ্ব-ধী বা বুদ্ধিকে স্বীকার করেছেন, ডিমােক্রিটাস তা অস্বীকার করেছেন। জগৎ কোন বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। জগতের সব ঘটনাই উদ্দেশ্যহীন যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পরমাণুবাদীদের বিরুদ্ধে কেউ কেউ এমন অভিযােগ এনেছেন যে তারা সবকিছুর মূলে আকস্মিকতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। বরং এমন কথা বলা যেতে পারে যে, তারা ছিলেন কঠোর নিয়ন্ত্রণবাদী, যারা বিশ্বাস করতেন যে, সব কিছুই জাগতিক নিয়মানুযায়ী ঘটে। ডেমােক্রিটাস স্পষ্টই অস্বীকার করেছিলেন যে, কোন কিছু আকস্মিকতাবশত ঘটতে পারে। লিউসিপ্পাস এমন কথা বলেছেন বলে বলা হয় যে, ‘কোন কিছুই শুধু শুধু ঘটে না। যা কিছু ঘটে তার একটা হেতু আছে, একটা আবশ্যকতা আছে। এটা সত্য যে জগৎ আদিতে যেমন কেন তেমন হল, অন্যরকম হল না, এর কোন কারণ লিউসিপ্পাস নির্দেশ করেননি। হয়ত আকস্মিকতাকেই তার হেতু নির্দেশ করেছেন, কিন্তু জগৎ অস্তিত্বশীল হবার পর তার ভবিষ্যৎ বিকাশ যান্ত্রিক নিয়মের দ্বারাই অপরিবর্তনিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হত, এরূপ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন।
আদি-অন্তহীন গতিকে স্বীকার : পরমাণুবাদীরা জগতের উৎপত্তির বা জাগতিক ঘটনার ক্ষেত্রে আকস্মিকতাকে (Chance) অস্বীকার করেছেন অথচ এক আদি-অন্তহীন গতিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই কারণে অ্যারিস্টটল পরমাণুবাদীদের সমালােচনা করেছেন, কারণ তার মতে পরমাণুবাদীরা গতির উৎস এবং প্রকৃতি কোনটাই ব্যাখ্যা করেনি। বস্তুত, লিউসিপ্পাস এক আদি অন্তহীন গতি-স্বীকার করেছেন। তিনি পরমাণুতে গতির আবেগের বিষয়টি আকস্মিক বলে গণ্য করেছিলেন – এমন সিদ্ধান্ত করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। আসলে গতি আদি অন্তহীন এবং এই গতি চলতে থাকে। কপলস্টোন মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, আমাদের মতে, মন এ-জাতীয় মতবাদে সায় দিতে ইতস্তত করে এবং লিউসিপ্পাস যাকে আদি অন্তহীন বলে গণ্য করেছেন তাকে স্বীকার করে নিতে চায় না। কিন্তু এটা একটা আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা যে তিনি নিজে এই আদি-অন্তহীনকে নিয়ে পরিতুষ্ট ছিলেন এবং যিনি নিজে গতিহীন হয়েও অন্যকে গতিশীল করেন এমন কোন আদি সত্তাকে স্বীকার করেননি।
আদি গতির ব্যাখ্যা : অ্যারিস্টটল এবং অন্যান্য দার্শনিকবৃন্দ লিউসিপ্পাস এবং ডিমােক্রিটাসের সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তারা মূল বা আদি গতির কোন ব্যাখ্যা দেননি। এই প্রসঙ্গে রাসেল মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, পরমাণুবাদীরা তাদের সমালােচকবৃন্দের তুলনায় অনেক বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। কারণকে কোন একটা কিছুকে কেন্দ্র করে অবশ্যই প্রথম শুরু হতে হবে এবং যেখান থেকেই শুরু হােক না কেন মূল উপাত্ত (Data)-এর কোন কারণ নির্দেশ করা চলবে না। এই জগৎ কোন স্রষ্টার সৃষ্টি যদি একথা বলা হয়, তাহলে স্রষ্টার কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না, স্রষ্টা অব্যাখ্যাত থেকে যাচ্ছে। রাসেল বলেন, পরমাণুবাদীদের মতবাদ প্রাচীনকালে যে সব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার তুলনায় আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত মতবাদের অনেক কাছাকাছি। রাসেল উদ্দেশ্যমূলক কার্যকারণ সম্পর্কের সাহায্যে ব্যাখ্যা এবং যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্কের সাহায্যে ব্যাখ্যা-এই দুই–এর পার্থক্য বিশদভাবে আলােচনা করে দেখিয়েছেন যে, আদি বা মূল গতির ব্যাখ্যা না দেওয়ার জন্য পরমাণুবাদীদের মতবাদ ত্রুটিপূর্ণ নয়। রাসেলকে অনুসরণ করে বিষয়টির আলােচনা করা যেতে পারে।
পরমাণুবাদীদের গতির ব্যাখ্যা না দেয়া ত্রুটিপূর্ণ নয় : সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল যেমন উদ্দেশ্য বা পরিণতিমূলক কারণের সাহায্যে জগতের ব্যাখ্যা করেছেন, পরমাণুবাদীরা তা করেননি। প্রশ্ন হল, ‘পরিণতিমূলক কারণ’ (Final Cause) বলতে কি বােঝায়? কোন একটি ঘটনার পরিণতিমূলক কারণ হল ভবিষ্যতের একটি ঘটনা যার জন্য ঘটনাটি ঘটে। মানুষের ক্ষেত্রেই এই ধারণা প্রযােজ্য। যেমন রুটিওয়ালা রুটি তৈরি করে কেন? কারণ মানুষ ক্ষুধার্ত হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া হয় সেটি কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে। কোন ঘটনা সম্পর্কে যখন প্রশ্ন করা হয় কেন? তখন দুটি বিষয় বােঝাতে পারে। একটা হল এই ঘটনাটি কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছে বা বােঝাতে পারে অগ্রবর্তী ঘটনাটি কি, যা এই ঘটনাটি ঘটাল? প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল, লক্ষের বা উদ্দেশ্যের সাহায্যে ব্যাখ্যা (Teleological Explanation) বা পরিণতিমূলক কারণের সাহায্যে ব্যাখ্যা। শেষের প্রশ্নের উত্তর হল, যান্ত্রিক ব্যাখ্যা (Machanistic Explanation)। অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় যে যান্ত্রিক কারণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দিকে চালিত করে, পরিণতিমূলক কারণ তা করে না। পরমাণুবাদীরা যান্ত্রিক অর্থাৎ উদ্দেশ্যের প্রসঙ্গ অবতারণা না করে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত এবং যান্ত্রিক উত্তর প্রদান করত। কিন্তু নবজাগরণ পর্যন্ত পরমাণুবাদী পরবর্তী দার্শনিকবৃন্দের উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নেই অধিকতর আগ্রহ ছিল। এই সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রাসেল বলেন যে, উভয় প্রশ্নের ক্ষেত্রেই একটা সীমারেখা আছে যাকে প্রায়ই সাধারণ চিন্তন এবং দর্শনের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়। কোন প্রশ্নটিই বােধগম্যভাবে সমগ্র সত্তা সম্পর্কে; ঈশ্বর সম্পর্কে উত্থাপন করা চলে না, কেবলমাত্র তার অংশ সম্পর্কে উত্থাপন করা যেতে পারে। উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অনেক সময় একজন স্রষ্টার কথা বলা হয়, প্রকৃতির মধ্য দিয়ে যিনি তার উদ্দেশ্য উপলদ্ধি করেন। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করেন কি উদ্দেশ্য স্রষ্টার উদ্দেশ্যের দ্বারা সিদ্ধ হয়, প্রশ্নটি হয়ে পড়ে অধার্মিকোচিত প্রশ্ন। তাছাড়া এই প্রশ্নটি হয়ে পড়ে অর্থহীন, কেননা, সেক্ষেত্রে আমাদের অনুমান করে নিতে হয় যে স্রষ্টা অপর কোন এক মহত্তর স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিলেন যার উদ্দেশ্য তিনি সিদ্ধ করেছেন। কাজেই উদ্দেশ্যের ধারণাটি সত্তার মধ্যেই প্রযােজ্য, সমগ্র সত্তার ক্ষেত্রে নয়। যান্ত্রিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও সেই একই অসুবিধা দেখা দেয়। একটি ঘটনা অপর একটির দ্বারা সংঘটিত হল। সেটি অপর আর একটির দ্বারা সংঘটিত হল এইভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু যদি সমগ্রের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা যায়, আমরা আবার সেই স্রষ্টায় এসে উপনীত হব, যিনি হবেন অকারণ বা স্বয়ম্ভু। কাজেই সব কার্যকারণ সম্পর্কীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রথম শুরু বা আরম্ভটি হবে অবাধ বা বিধিবহির্ভূত, কাজেই রাসেল মন্তব্য করেছেন যে, আদি বা মূল গতির ব্যাখ্যা দেওয়াটা পরমাণুবাদীদের পক্ষে কোন ত্রুটির ব্যাপার হয়নি। অবশ্য রাসেলের এই মন্তব্য সকলেই যে স্বীকার করে নেবেন, এমন মনে হয় না।
পৃথিবী বাতাসে ভাসমান : জগতের বিশদ বিবরণ দিতে গিয়ে লিউসিপ্পাস পিথাগােরীয় দর্শন সম্প্রদায়ের জগৎ বিষয়ক অভিমত, অর্থাৎ কিনা, জগৎ গােলাকার, এই অভিমত বর্জন করে অ্যানাক্সিমিনিসের অভিমত গ্রহণ করলেন যে, এই পৃথিবী খঞ্জনীর মত বাতাসে ভাসমান।
লৌকিক দেবদেবীর ধারণার ব্যাখ্যা : যান্ত্রিক কার্যকারণের দ্বারা সব জাগতিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য পরমাণুবাদীরা লৌকিক দেবতা ও ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। ডেমােক্রিটাসের মতে, ভয়ই মানুষের মনে দেব-দেবীতে বিশ্বাসের সূচনা করেছে। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, ধূমকেতু মনে যে ভীতির সঞ্চার করে তার জন্যই মানুষ দেব-দেবীতে বিশ্বাস করে। দেব দেবীতে বিশ্বাস না করলেও ডিমােক্রিটাস মনে করতেন যে বায়ুতে মানুষের মতই জীব অবস্থিত, যারা মানুষের থেকে বৃহদাকার এবং দীর্ঘায়ু। এরাই মানুষের মনে দেবতার ধারণা সৃষ্টি করে।
আত্মা পরমাণু দ্বারা গঠিত, চিন্তন ভৌতিক প্রক্রিয়া, জন্মান্তরবাদে অবিশ্বাস : ডিমােক্রিটাস ছিলেন একজন একনিষ্ঠ জড়বাদী, সেই কারণে তিনি মনে করতেন আত্মা পরমাণুর দ্বারা গঠিত এবং চিন্তন হল একটি ভৌতিক প্রক্রিয়া। এই বিশ্বজগতে কোন উদ্দেশ্যের স্থান নেই, বিশ্বজগতে রয়েছে শুধু পরমাণু যেগুলো যান্ত্রিক নিয়মের দ্বারা চালিত হয়। পরমাণুবাদীরা বিভিন্ন পরমাণুর আকার, আকৃতি এবং অবস্থানের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের জড়বস্তুর উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন। কাজেই তাদের মতে, আগুনের উপাদান হল মসৃণ গােলাকার পরমাণু। আত্মা হল শুদ্ধ এবং সূক্ষ্ম অগ্নি। কাজেই আত্মার উপাদানও হল মসৃণ গােলাকার পরমাণু। মৃত্যুর অর্থ হল আত্মার উপাদান যে পরমাণু সেগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া। কাজেই পরমাণুবাদীরা পরজন্মে বা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী নয়।
সমালােচনা : পরমাণুবাদীদের মতবাদ সম্পর্কে নানারকম সমালােচনা রয়েছে।
- প্রথমত, পরমাণুবাদী জগতে কোন মতবাদ স্বীকার করা বা অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। সবই অনিবার্যতার নিয়ম অনুসারে ঘটলে, মানুষ যা চিন্তা করে তা পূর্ববর্তী অবস্থার অবশ্যম্ভাবী যান্ত্রিক ফলস্বরূপ হবে। তাই সেক্ষেত্রে অন্য ব্যক্তি তার মতবাদ স্বীকার করে নিক – এই প্রশ্ন ওঠে না।
- দ্বিতীয়ত, শুন্য দেশের ধারণা কোন বােধগম্য ধারণা নয়। ডিমােক্রিটাস এর মত আমরা যদি মনে করি যে, শূন্য দেশ হল অ-সত্তা (Not-being) , তাহলে শূন্য দেশে গতিশীল পরমাণুকে শূন্য দেশ পৃথক করছে বলা যায়না।
সৃষ্টিতত্ত্ব দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন অগ্রগতির সূচনা করে না : প্রশ্ন হল , পরমাণুবাদীদের সৃষ্টিতত্ত্ব কি দর্শনের ক্ষেত্রে কোন নতুন অগ্রগতির সূচনা করে? এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, পরমাণুবাদীদের সৃষ্টিতত্ত্ব দর্শনের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতির সূচনা করে না। তবে একথা বলা যায় যে, পরমাণুবাদী দার্শনিক লিউসিপ্পাস এবং ডিমােক্রিটাস সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক চিন্তাধারাকে তাদের যৌক্তিক সিদ্ধান্তের দিকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন এবং সৃষ্টিতত্ত্বের শুদ্ধ যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেবার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। বিশ্বজগতের যান্ত্রিক জড়বাদী ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টা আধুনিককালে বহ দার্শনিকদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। তবে এই প্রসঙ্গে কপলস্টোন-এর বক্তব্য খুবই প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেন, “লিউসিপ্পাস এবং ডিমােক্রিটাসের চমৎকার প্রকল্প কোন মতেই গ্রীক দর্শনের শেষ কথা নয়। পরবর্তীকালের গ্রীক দার্শনিকরা দেখার জন অপেক্ষা করে রইলেন যে, জগতের ঐশ্বর্য সর্বক্ষেত্রে পরমাণুর যান্ত্রিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবসিত হতে পারে না।”
জ্ঞানতত্ত্ব
প্রােটাগােরাস যে জ্ঞান সম্পর্কীয় সমস্যা উত্থাপন করেছিলেন, তিনি সেই সমস্যার প্রতি মনােযােগী হলেন। সােফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদ যা ভাল ও মন্দকে আপেক্ষিকরূপে গণ্য করে এবং যার ফলে মানুষের আচরণের সমস্যা হয়ে ওঠে জটিল। সেই জটিলতার প্রতিও ডিমােক্রিটাস আগ্রহী না হয়ে পারলেন না।
প্রত্যক্ষণ সম্পর্কীয় মতবাদ : ডেমােক্রিটাস প্রত্যক্ষণ সম্পর্কীয় একটি মতবাদ উপস্থাপিত করেন এবং তার প্রদত্ত বিবরণটি যান্ত্রিক। ইতােপূর্বে এম্পিডক্লিস বস্তু থেকে যে প্রভাব বা উদ্দীপনা দর্শনেন্দ্রিয়ে উপনীত হয় , তার কথা বলেছেন। পরমাণুবাদীদের মধ্যে এই সব প্রভাব বা উদ্দীপনা হল পরমাণু, এরা হল প্রতিরূপ (Images) যেগুলো বস্তু থেকে অনবরত নির্গত হচ্ছে। ব্যক্তির বিশেষ ইন্দ্রিয়গুলো হল প্রবেশ পথ; এই প্রবেশ পথের মধ্য দিয়ে প্রতিরূপগুলো প্রবেশ করে। প্রতিরূপগুলো পরমাণুর তৈরি। বস্তু তাদের প্রতিরূপগুলো দেশে (Space) অভিক্ষিপ্ত করে। এই প্রতিরূপগুলো কোন একটি ইন্দ্রিয় পথে যেমন, দর্শনেন্দ্রিয় পথে প্রবেশ করে আত্মাতে প্রবিষ্ট হয়, যে আত্মাও পরমাণুর দ্বারা গঠিত। প্রতিরূপগুলো যখন বাতাসের মধ্য দিয়ে যায় তখন বাতাসের দ্বারা বিকৃত হতে পারে। সেকারণে খুব দূরের বস্তু আমাদের দৃষ্টিগােচর নাও হতে পারে। বর্ণ বা রঙের বৈষম্যের (derence of colour) ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ডিমােক্রিটাস বলেন যে, প্রতিরূপের স্থূলতা ও সূক্ষ্মতাই বর্ণ বৈষম্যের কারণ। শ্রবণক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরুপ ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়। শব্দমান বস্তু থেকে পরমাণুর স্রোত নির্গত হয়ে শব্দমান বস্ত এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের মধ্যবর্তী বাতাসে গতির সৃষ্টি করে যার ফলে শব্দ শুত হয়। স্বাদ, গন্ধ, সর্শ সবই অনুরূপভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। দার্শনিকদের মতে, ডিমােক্রিটাসও মনে করতেন যে, উষ্ণতা, স্বাদ, বর্ণ প্রভৃতি গুণগুলো প্রকৃতপক্ষে বস্তুতে অবস্থিত নয়, আমাদের ইন্দ্রিয়ের জন্যই সেগুলোর উদ্ভব। কিন্তু ওজন, ঘনত্ব প্রভৃতি গুণগুলো প্রকৃতই বস্তুতে অবস্থিত।
বস্তুর গৌণগুণগুলো বস্তুগত নয়, মনােগত : সাধারণত বস্তুর দু’ধরনের গুণের কথা বলা হয়ে থাকে। যেমন, প্রাথমিক (Primary)-বস্তুর আকৃতি, আয়তন, ওজন এবং গৌণ (Secondary)-যেমন, বস্তুর বর্ণ , স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি। ডিমােক্রিটাসের সমসাময়িক দার্শনিক প্রােটাগোরাসের মতানুসারে যে ব্যক্তি সংবেদন লাভ করছে তার কাছে সব সংবেদনই সমানভাবে সত্য। কাজেই কোন বস্তু ‘ক’-এর কাছে মিষ্ট হতে পারে, আবার সেই একই বস্তু ‘খ’-এর কাছে টক মনে হতে পারে। ডিমােক্রিটাস ঘােষণা করলেন যে, বিশেষ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ সব সংবেদনই মিথ্যা, কেননা ঐসব সংবেদনের অনুরূপ কোন বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ আমাদের সংবেদন হল সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি সাপেক্ষ, যদিও তারা বাহ্য ও বাস্তব পরমাণুর দ্বারা সংঘটিত হয়। কিন্তু এই পরমাণুকে বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায় না। অন্ততঃপক্ষে বস্তুর গৌণ গুণগুলো বস্তুগত নয়, মনােগত।
জ্ঞানের শ্রেণীকরণ : জ্ঞান দু’প্রকার – অ-জারজ (True Born) এবং জারজ (Bastard)। দর্শন, শ্রবণ, রাসণ, ঘ্রাণজ এবং স্পৰ্শন বিষয়ক জ্ঞান দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। প্রথম প্রকার জ্ঞান দ্বিতীয় ধরনের জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু যেহেতু আত্মা পরমাণুর দ্বারা গঠিত এবং যেহেতু সব জ্ঞান হল বাইরে থেকে আসা এবং পরমাণুর সঙ্গে জ্ঞানকর্তার সংযােগ, সেহেতু ইন্দ্রিয় এবং চিন্তনের মধ্যে কোন চরম ভেদরেখা টানা সম্ভব নয়।
নীতিতত্ত্ব
ডেমােক্রিটাস এর কিছু কিছু নীতিবাক্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, কিন্তু পরমাণুবাদের সঙ্গে তাদের কোন বৈজ্ঞানিক সংযােগ নেই এবং পরমাণুবাদ থেকে তাদের অবরােহের আকারে নিঃসৃত করা সম্ভব নয়। কাজেই তাদের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তারা ডেমােক্রিটাসের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ উক্তি মাত্র। তার আচরণ সম্পর্কীয় মতবাদের মূলে রয়েছে তার শান্তি (Happiness) বা আনন্দের ধারণা। তার মতে, মানুষের আচরণের লক্ষ হল শান্তি বা আনন্দ এবং সুখ ও দু:খই শান্তি নির্ধারণ করে। মানুষের শান্তি জাগতিক ঐশ্বর্যের ওপর নির্ভর নয়। অধিক পরিমাণে আনন্দ পাওয়া এবং কষ্টকে যতদূর সম্ভব এড়ান – এই হবে মানুষের আচরণের লক্ষ। ইন্দ্রিয় সুখ যথার্থ সুখ নয়। যা সত্য এবং কল্যাণকর, তা সকল মানুষের ক্ষেত্রে একই ধরনের, কিন্তু সুখ ব্যক্তিভেদে পৃথক। আমাদের মঙ্গল বা হিত লাভের জন্য, প্রফুল্লতা লাভের জন্য সচেষ্ট হতে হবে, যা আত্মার একটি অবস্থা। এই অবস্থা লাভের জন্য প্রয়ােজন বিভিন্ন ধরনের সুখকে ওজন করে, বিচার করে ও তাদের মধ্যে প্রভেদ করে দেখা। সঙ্গতি বা সামঞ্জস্যের নীতির দ্বারা আমাদের পরিচালিত হওয়া প্রয়ােজন। এই নীতির দ্বারা আমরা দেহের শান্তি-স্বাস্থ্য এবং আত্মার শান্তি প্রফুল্লতা লাভ করতে পারি। আত্মার সম্পদের মধ্য দিয়েই প্রধানত এই প্রশান্তি লাভ করা যায়। কাজেই ডেমােক্রিটাসের মতে, মানুষের শান্তি জাগতিক সম্পদের উপর নির্ভর নয়, অন্তরের বা আত্মার সম্পদ অর্থাৎ আত্মার উপর নির্ভর। সংযম এবং সরলতার মাধ্যমেই প্রশান্তি এবং প্রফুল্লতা লাভ করা যায়।
জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে প্রােটেগােরাস এবং মানুষের আচরণ সম্পর্কে সােফিস্টরা যে সমস্যার সৃষ্টি করেছিলেন ডেমােক্রিটাসের প্রত্যক্ষণ সম্পর্কীয় মতবাদ এবং নীতিতত্ত্ব প্রমাণ করে যে, তিনি সেই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্ত তিনি যে তার প্রদত্ত মতবাদের মাধ্যমে সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছেন এমন মনে করার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই।
গুরুত্ব
রাসেলের মন্তব্য : ডেমােক্রিটাস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রাসেল বলেন যে, তার মতে, ডেমােক্রিটাস হলেন গ্রীক দার্শনিকদের মত সর্বশেষ দার্শনিক যিনি একটি বিশেষ দোষ বা ত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন যা পরবর্তীকালে সব প্রাচীন এবং মধ্যযুগের চিন্তাধারাকে দূষিত করেছিল। এ পর্যন্ত যে সব দার্শনিকদের আলােচনা করা হয়েছে, তারা নিরাসক্তভাবে জগতকে বােঝার চেষ্টা করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন জগতকে বােঝা একটা মহৎ ব্যাপার এবং এই ধরনের আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া তাদের পক্ষে জাগতিক চিন্তা শুরু করার সাহসই হত না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রধানত বৈজ্ঞানিক, অবশ্যই তাদের সময়ের প্রচলিত সংস্কার যদি না তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করত। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক নয়, কল্পনাপ্রবণ, উৎসাহপ্রবণ এবং ঝুঁকি নেবার আনন্দে ভরপুর, তারা সব কিছুতেই আগ্রহী ছিল, যেমন – উল্কা, গ্রহণ, ঘূর্ণিঝড়, ধর্ম, নৈতিকতা ইত্যাদি। তাদের এই জানার ব্যাপারে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সঙ্গে শিশুসুলভ আগ্রহের সমন্বয় ঘটেছিল। কিন্তু রাসেলের মতে, এরপর থেকেই যেন অবস্থার অবনতি ঘটল। ডেমােক্রিটাস এর পরে বিশ্বজগতের তুলনায় মানুষের উপরই অত্যধিক গুরুত্ব আরােপিত হল। সােফিস্টদের সঙ্গে সঙ্গেই এল সংশয়বাদ – নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টার তুলনায় আমরা কিভাবে জানি তারই আলােচনা। তারপর সক্রেটিসের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এল নীতিবিদ্যার উপর গুরুত্ব। প্লেটো ইন্দ্রিয়ের জগতকে বর্জন করে নিজের দ্বারা সৃষ্ট শুদ্ধ চিন্তার জগতের গুরুত্বের কথা ব্যক্ত করলেন। অ্যারিস্টটল উদ্দেশ্যে বিশ্বাস স্থাপনাকে বিজ্ঞানের মূল ধারণা হিসেবে ব্যক্ত করলেন। রাসেল মনে করেন প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের প্রতিভা সত্ত্বেও তাদের চিন্তন এমন ত্রুটিপূর্ণ ছিল যা বিশেষভাবে ক্ষতিকর হয়েছিল। তাদের পরে চিন্তার সজীবতা বিলুপ্ত হল, এবং ধীরে ধীরে লৌকিক সংস্কারের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হল; এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা ঘটল, যা শেষ পর্যন্ত মধ্য যুগের দর্শনে পরিলক্ষিত হল।
অ্যানাক্সাগোরাস (Anaxagoras, ৫০০ – ৪২৮ খ্রি.পূ.)
জীবন-চিত্র
দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাস বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দ্বৈতবাদকে আরও বিকশিত করেন। অ্যানাক্সাগোরাস খ্রি.পূ. ৫০০ অব্দে এশিয়া মাইনরে ক্লাসেমিন নগরে এক সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে তিনি প্রভৃত সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন, কিন্তু জ্ঞান অর্জনের দূর্বার আগ্রহ এবং বিজ্ঞান ও দর্শনের চর্চায় তিনি এমনই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে তার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে তিনি তেমন মনােযােগ দিতে পারেননি। সব রকম রাজনীতি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে তিনি পুরােপুরিভাবে গবেষণা কার্যে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। জেলারের মতানুসারে তিনি হলেন প্রথম বিশুদ্ধ মননশীল চিন্তাবিদ্ যিনি বিশ্বজগতের জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই জীবনের কার্য এবং লক্ষকে আবিষ্কার করেছিলেন এবং এর নৈতিক ফলাফল সম্পর্কেও পুরােপুরি সচেতন ছিলেন। তার স্বভাবের মধ্যে দুটি বিষয়ের সংযােগ লক্ষ করা যায়, অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা এবং মননক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা। কি কারণে তিনি তার জন্মস্থান পরিত্যাগ করার জন্য সঙ্কল্প করেছিলেন, তা জানা যায়না। তিনি ক্লাসেমিন নগর পরিত্যাগ করে এথেন্সে বসবাস করতে শুরু করেন এবং প্রায় বিশ বছর তিনি এথেন্সে বসবাস করেছিলেন। এই এথেন্সই পরে গ্রীক দার্শনিক চিন্তার একটি প্রখ্যাত কেন্দ্রস্থল হয়ে দাড়ায়। তিনি আয়ােনিয়ার দর্শনকে এথেন্সে নিয়ে যান। তিনিই এথেন্সে দর্শনের প্রায় গােড়া পত্তন করলেন এবং তার পর থেকেই এথেন্স দর্শনের একটি বিখ্যাত কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এথেন্সে অ্যানাক্সাগোরাস অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি, যেমন – পেরিক্লিস, ইউরিপাইডিস, আরকিলাস প্রভৃতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন কূটনীতিজ্ঞ পেরিক্লিসের বন্ধু। এথেন্সের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধনে পেরিক্লিস দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলেন এবং এই কারণে পরামর্শদাতা বৈজ্ঞানিক হিসেবে তিনি তরুণ অ্যানাক্সাগোরাসকে এথেন্সে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এথেন্সে একটি রাজনৈতিক দল ছিল পেরিক্লিসের শত্রুপক্ষ। যদিও অ্যানাক্সাগোরাস কোন সক্রিয় রাজনীতিতে যােগদান করেননি, তবু পেরিক্লিসের সঙ্গে তার বন্ধুত্বই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। পেরিক্লিসের সঙ্গে শত্রুতা থাকার জন্য তার শত্রুপক্ষ বিপক্ষ রাজনৈতিকদল অ্যানাক্সাগোরাসকেও জব্দ করার জন্য সঙ্কল্প করল। তারা অ্যানাক্সাগোরাসের বিরুদ্ধে নাস্তিক ও ঈশ্বর নিন্দার অভিযােগ নিয়ে এল। এই অভিযােগের বিষয়বস্তু হল, অ্যানাক্সাগোরাস প্রচার করেছেন যে, সূর্য একটি উজ্জ্বল প্রস্তরখন্ড এবং চন্দ্র মৃত্তিকার দ্বারা তৈরি। সৌর জগতের গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীর চতুর্দিকে আবর্তিত হচ্ছে। প্রথমে অ্যানাক্সাগোরাসের এই তত্ত্ব উপহাসেরই বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল; প্রস্তরখন্ড কিভাবে আকাশে অবস্থান করতে পারে? কিন্তু খ্রি.পূ. ৪৬৭ অব্দে সিসিলিতে একটি বিরাট উল্কাপাত হল। তখন অনেকেই তরুণ বিজ্ঞানীর মতবাদে কিছুটা সত্যতা আছে বলে সিদ্ধান্ত করলেন। অনেকে ধারণা করলেন যে, এই ঘটনাই পেরিক্লিসকে এথেন্সে অ্যানাক্সাগোরাসকে আমন্ত্রণ জানাতে প্রণােদিত করেছিল।
যাই হােক না কেন, অ্যানাক্সাগোরাসের বিরুদ্ধে ঈশ্বরনিন্দার অভিযােগ আনা হল। বস্তুতপক্ষে গ্রীকবাসীরা, এমন কি পরবর্তীকালে দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল পর্যন্ত সৌর জগতের গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে ঐশ্বরিক সত্তা বা দেবতা বলে মনে করতেন। শত্রুদলের উদ্দেশ্য হল অ্যানাক্সাগোরাসকে আঘাত করে পেরিক্লিসকে আঘাত করা। অ্যানাক্সাগোরাসের বিচার হল। বিচারের সঠিক ফলাফল জানা যায় না। তবে শােনা যায় যে তার অপরাধের জন্য তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সম্ভবত পেরিক্লিসের সহায়তায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং এথেন্স থেকে তিনি এশিয়া মাইনরে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি মিলিটাসের একটি কলােনী লেম্পসেকাস-এ বসবাস করতে লাগলেন। সেখানে তিনি একটি চতুষ্পাঠী (School) প্রতিষ্ঠা করলেন। এথেন্স থেকে যখন তিনি লেম্পসেকাসে গেলেন তখন একজন খ্যাতনামা নাগরিক হিসেবে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান হল। ৭২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার স্মৃতি রক্ষার জন্য বাজারে একটা স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা করা হল। কিন্তু অ্যানাক্সাগোরাসের একান্ত ইচ্ছা ছিল যে তার মৃত্যুর পর তার মৃত্যুদিবসে স্কুলের ছেলেমেয়েদের যেন ছুটি দেওয়া হয়। তার এই অনুরােধ মৃত্যুর পরে রক্ষা করা হয়। অ্যানাক্সাগোরাস তার দার্শনিক অভিমত একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু তার অংশবিশেষই এখন মাত্র পাওয়া যায় এবং সেই অংশটুকু তার রচনার প্রথম অংশ। সক্রেটিসের সময় গ্রন্থটির বহুল প্রচার ছিল বলে জানা যায়। অ্যানাক্সাগোরাসের মতে, হেরাক্লিটাসের ন্যায় অগ্নির মত কোনাে একটি উপাদানকে মূল উপাদান বা প্রধান বলে মানার প্রয়ােজন নেই। সমস্ত দ্রব্যের একটি মৌল কারণ থাকে। এগুলো অনেক প্রকারের হয়। এদের মিলনে নতুন দ্রব্যের জন্ম হয়।
দর্শন
সত্তা অপরিবর্তনীয় : এম্পিডক্লিসের মত অ্যানাক্সাগোরাসও পারমিনাইডিসের মতবাদ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, সত্তা (Being)-এর উৎপত্তিও নেই, ধ্বংসও নেই, সত্তা অপরিবর্তনীয়। কোন কিছু উৎপন্নও হয় না, ধ্বংসও হয় না। যা আছে তাই সংযুক্ত হয়, বিযুক্ত হয়। কাজেই এম্পিডক্লিস এবং অ্যানাক্সাগোরাস, উভয় দার্শনিকই স্বীকার করেন যে জড় স্বয়ম্ভু এবং অবিনাশী। উভয়েই পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার জন্য জড়ের আনুষঙ্গিক উপাদানের মিশ্রণ অমিশ্রণের দ্বারা বস্তুর উৎপত্তি এবং ধ্বংসকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াসী। অ্যানাক্সাগােরাস মনে করেন যে, উৎপত্তি এবং ধ্বংসের কথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা কোন কিছুই উৎপন্ন বা ধ্বংস হয় না। পূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল বা পূর্বস্থিত বস্তুর মিশ্রণ এবং অমিশ্রণই হল একমাত্র প্রক্রিয়া, যাদের যথাক্রমে সংযুক্তি এবং বিযুক্তি বলাই সমীচীন। সব জড়ই সমানভাবে মৌলিক, পরমাণুবাদীদের মতে, বস্তুর মূল উপাদানই হল জড়কণা বা পরমাণু, যারা সকলেই একজাতীয়। অ্যানাক্সাগােরাস পরমাণুবাদীদের এই অভিমত গ্রহণ করলেন না। আবার এম্পিডক্লিস যে চারটি মূল উপাদান – ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ-এর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেন, অ্যানাক্সাগোরাস তাকেও গ্রহণ করতে পারলেন না। এম্পিডক্লিসের মত অ্যাকসাগােরাসও অসংখ্য স্ব-নির্ভর উপাদানের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেন যাদের তিনি আখ্যা দিলেন বীজ (Seeds)। এম্পিডক্লিস, ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎকে চারটি মূল উপাদান বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু অ্যানাক্সাগােরাসের মতে, এরা মূল উপাদান নয়। এরা যৌগিক বস্তু (Compounds)। অ্যানাক্সাগোরাসের মতে, সব জড়ই সমানভাবে মৌলিক এবং স্বয়ম্ভূ, অর্থাৎ অপরের থেকে উদ্ভূত নয়। উদাহরণস্বরূপ-স্বর্ণ, মৃত্তিকা, জল, কাঠ, সবই মৌলিক জড়। এদের কোনটিই যেমন অপর কিছু থেকে উদ্ভূত হয় না, তেমনি অপর কিছুতে পরিবর্তিত হতে পারে না।
জড় সকল অবস্থাতেই বিভাজ্য : অ্যানাক্সাগােরাস পরমাণুবাদীদের অভিমত স্বীকার করে নিতে পারলেন না যে, জড়কে ক্রমাগত বিভক্ত করতে করতে এমন অবস্থায় উপনীত হওয়া যায় যখন জড়কে আর বিভক্ত করা চলে না। তার মতে, জড় সকল অবস্থাতেই বিভাজ্য। অ্যানাক্সাগােরাসের মতে, সমগ্রের যে-কোন অংশ যা সমগ্রের সঙ্গে গুণের দিক থেকে এক জাতীয়, অবশ্যই মৌলিক এবং স্ব-নির্ভর হবে। এম্পিডক্লিস মনে করতেন যে, জড় হল ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ-এই চারটি উপাদানেরই কিছু কিছু অংশের একত্র মিশ্রণ। কিন্তু অ্যানাক্সাগোরাস এম্পিডক্লিসের এই বক্তব্য মেনে নিতে পারলেন না। অ্যানাক্সাগোরাস বলেন, ‘চুল কি করে, যা চুল নয়, তার থেকে উদ্ভূত হতে পারে বা মাংস, যা মাংস নয়, তার থেকে উদ্ভুত হতে পারে’? অ্যানাক্সাগােরাস তাই মনে করেন যে, এম্পিডক্লিসের চারটি উপাদান মৌলিক মােটেই নয়, ভিন্ন গুণসম্পন্ন অনেক রকম জড়কণার মিশ্রণ। জগৎ-প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে – এখনও পর্যন্ত অ্যানাক্সাগােরাসের দর্শনে এমন কিছু অভিনবত্ব লক্ষ্য করা যায়না, যার জন্য তার দর্শন পূর্ববর্তী এম্পিডক্লিস ও পরমাণুবাদীদের দর্শনের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে। বরং স্টেইসের মন্তব্য এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযােগ্য। যখন তিনি বলেন যে, সুস্পষ্টতা এবং যৌক্তিক সঙ্গতির বিচারে বরং অ্যানাক্সাগােরাসের দর্শন পূর্ববর্তী এম্পিডক্লিস এবং পরমাণুবাদীদের দর্শনের অনেক নীচের স্তরের।
অ্যানাক্সাগোরাসের চিন্তার ক্ষেত্রে মৌলিকতা ও নাউস : কিন্তু এই গতি-শক্তির প্রশ্নের ব্যাপারে অ্যানাক্সাগােরাসের চিন্তার ক্ষেত্রে মৌলিকতা ও অভিনবত্ব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অ্যানাক্সাগোরাস এই গতি-শক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এমন এক নীতির কথা উল্লেখ করলেন, যা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব অবদান এবং নিঃসন্দেহে দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন। তিনি বললেন, এম্পিডক্লিস গতিশক্তিরূপে যে রাগ ও দ্বেষ (Love and Hate)-এর কথা উল্লেখ করেছেন তা যেমন একাধারে অবাস্তব এবং উদ্ভট, তেমনি অপরদিকে পরিপূর্ণভাবে ভৌতিক (Physical) শক্তি। পরমাণুবাদীরাও যে গতিশক্তির কথা কল্পনা করেছেন তাও সমপূর্ণভাবে জড়শক্তি। কিন্তু অ্যানাক্সাগােরাস সম্পূর্ণ নতুনভাবে এই জড়-শক্তির কথা চিন্তা করলেন। তার মতে, এই গতি-শক্তি জড়শক্তি বা ভৌতিক শক্তি নয়, এই শক্তি হল অ-জড় বা অ-ভৌতিক শক্তি। তিনি এই গতিশক্তিকে ‘নাউস’ (Nous) অর্থাৎ মন বা বুদ্ধি বলে অভিহিত করলেন। অর্থাৎ বুদ্ধি বা বুদ্ধির নীতিই প্রথম একত্রে অবস্থিত জড় উপাদানে ক্রিয়া উৎপন্ন করে জগতকে গঠিত বা সুবিন্যস্ত করে। এই মন (Mind) বা বুদ্ধি (Intelligence) যেমন গতির উৎস তেমনি আমাদের মধ্যে জ্ঞানের উৎস। অ্যানাক্সাগোরাসের এই, গতি-শক্তি সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রথমত, জগৎ-নিয়ামক এক বুদ্ধির কথা অ্যানাগােরাস চিন্তা করলেন কেন? দ্বিতীয়ত, এই প্রকৃতি কি?
নাউসের ধারণার কারণ :
- জগৎ জুড়ে রয়েছে উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার অনুভব : অ্যানাক্সাগােরাস জগতের বাহ্য পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য, সঙ্গতি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যার জন্য জগৎ নিয়ামক বুদ্ধিকেই উপযােগী মনে করেছিলেন। কেননা ঐ বিষয়গুলো অন্ধ জড়-শক্তির দ্বারা যথাযথভাবে ব্যাখ্যাত হতে পারে না। জগৎ বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত। উপায় ও লক্ষ্যের মধ্যে অভিযােজনের (Adaptation) বহুবিধ দৃষ্টান্ত জগতের দিকে লক্ষ করলেই চোখে পড়ে। জগৎ জুড়ে রয়েছে উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। অন্ধ জড়শক্তি জড়-উপাদানের উপর ক্রিয়া করে গতি ও পরিবর্তন উৎপন্ন করলেও, সুশৃঙ্খল, সুসঙ্গতিপূর্ণ কোন জগৎ সৃষ্টি করতে পারে না। যা শৃঙ্খলা ও সঙ্গতি নিয়ে আসতে পারে তা হল বুদ্ধি। কাজেই কোন জগৎ নিয়ামক বুদ্ধির অস্তিত্ব আছে, যার নাম দিলেন তিনি ‘Nous’। অ্যানাক্সাগােরাস বলেন, বড় ছােট সব বস্তু, যার জীবন আছে, তার উপর নাউসের ক্ষমতা আছে।
- মৌলিক বহুত্ব স্বীকারের প্রয়ােজন : অ্যানাক্সাগােরাস দেখলেন যে জগতকে যদি ব্যাখ্যা করতে হয়, একটা মৌলিক বহুত্বকে স্বীকার করে নিতে হয়। কাজেই তিনি জগতের এমন একটা অবস্থার কথা ভেবে নিলেন যেখানে সব জিনিসই একত্র অবস্থান করছিল, সংখ্যা এবং ক্ষুদ্রতার দিক থেকে যা অন্তহীন। এর অর্থ হল , মৌলিক পদার্থ বা জড় অন্তহীনভাবে বিভাজ্য। কাজেই শুরুতে কোন অবিভাজ্য জড়কণার অস্তিত্ব ছিল না। শুরুতে সব ধরনের জড় অবিন্যস্তভাবে একত্র মিশে ছিল। যেহেতু সব এক সঙ্গে মিশে ছিল, কাউকেই তার ক্ষুদ্রতার জন্য অন্যের থেকে পৃথক করা সম্ভব ছিল না। সবই ছিল সমগ্রের মধ্যে। অভিজ্ঞতাতে যে সব বস্তু দেখা যায় তাদের উৎপত্তি শুরু হল যখন সব ধরনের জড়ের একত্র মিশ্রণ হল এবং সমজাতীয় জড়, সমজাতীয় জড়ের মধ্যে মিশ্রিত হল। একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা বুঝে নেয়া যাক-ধরা যাক স্বর্ণ। শুরুতে মৌলিক মিশ্রণে স্বর্ণের জড়কণা অন্য কণার সঙ্গে মিশে ছিল। কিন্তু যখন স্বর্ণের কণাগুলো একত্রিত হল, তখন সেখানে অন্য জড়কণা থাকলেও স্বর্ণের জড়কণার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে, তাকে স্বর্ণ বলেই চেনা যেতে লাগল। অনুরূপভাবে, সব রকম জড়ের মিশ্রণের সময় কাষ্ঠের কণাগুলো একত্রিত হয়ে কাষ্ঠ বলে চেনা যেতে লাগল। স্বর্ণ বা কাষ্ঠের ক্ষেত্রে বা অন্যান্য সব অভিজ্ঞতায় দৃষ্ট বস্তুতে সব রকমের জড়কণা আছে। তবু তারা এমনভাবে মিশ্রিত হয় যে, এক ধরনের জড়কণা প্রাধান্য লাভ করে এবং সেই জড়কণা অনুযায়ী বস্তুটির পরিচয় নির্দিষ্ট হয়। অ্যানাক্সাগােরাসের মতে, সব কিছুতেই অন্য কিছু কিছু পরিমাণে রয়েছে। প্রত্যেক কিছুকে সেই নাম দেওয়া হয় যার মধ্যে সেই জিনিস অধিক পরিমাণে আছে, যদিও প্রকৃতপক্ষে তার মধ্যে সব কিছু রয়েছে। বরফে সাদা এবং কাল, উভয় বর্ণই বর্তমান, কিন্তু তাকে সাদা বলার কারণ বরফে কালাের তুলনায় সাদার প্রাধান্য।
- পারমিনাইডিসের সত্তা ও ইন্দ্রীয়-প্রত্যক্ষণযোগ্য বাস্তবের সমতাবিধান : অ্যানাক্সাগোরাসের এই মতবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কপলস্টোন বলেন যে, অ্যানাক্সাগোরাসের পক্ষে পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেওয়া সহজ ছিল না। তৃণ যদি মাংসে পরিণত হয় তাহলে তৃণের মধ্যে মাংসের কণা থাকবেই কেননা অ্যানাক্সাগােরাস নিজেই বলেছেন, যা মাংস নয় তার কাছ থেকে কিভাবে মাংস আসতে পারে? আবার তৃণের মধ্যে তৃণকণার প্রাধান্য না থাকলে তাকে তৃণ বলে চেনা যাবে কি করে? এই ভাবেই অ্যানাক্সাগোরাস পারমিনাইডিস এর সত্তা সম্পর্কীয় মতবাদ এবং ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় যে পরিবর্তন আমরা দেখি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকে ভ্ৰম-প্রত্যক্ষ বা অধ্যাস (Illusion) বলে বাতিল না করে উভয়ের সমন্বয় সাধনে সচেষ্ট হলেন। আবার আর একটি সমস্যা, সেটি হল গতির উৎসের সমস্যা। প্রথমে জগতের সব বস্তু একত্রে ছিল এবং তারপর বৈচিত্র্যময় বহুত্বের অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থায় যাবার উপায় কি? এম্পিডক্লিস এবং পরমাণুবাদীদের ক্ষেত্রে যেমন, এক্ষেত্রেও একটা গতিশক্তিকে স্বীকার করে নিতে হবে যার ফলে অমিশ্রণরূপ বা বিযুক্তি হল আদিঅন্তহীন এবং আত্ম-শাসিত, কোন কিছুর সঙ্গেই মিশ্রিত নয়। সব জীবিত বতুতে মানুষ, ইতরপ্রাণী, উদ্ভিদে, নাউসের অবস্থান এবং সব কিছুতে এটি একই রকম। অ্যানাক্সাগোরাস নাউসের সমরূপতার কথা ব্যক্ত করেছেন। যাদের মধ্যে নাউস বর্তমান তাদের মধ্যে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা নাউসের জন্য নয়, তা দেহের পার্থক্যের জন্য, যা নাউসের পরিপূর্ণ ক্রিয়া-শক্তিকে ক্ষেত্র বিশেষে বাধা দান করে বা ক্ষেত্র বিশেষে সহায়তা করে। মানুষের মধ্যে যেমন নাউস আছে, ইতর প্রাণীদের মধ্যেও নাউস আছে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে যে আপাত শ্রেষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয় তার কারণ মানুষ হস্তের অধিকারী , ইতর প্রাণীরা তা নয়। উভয়ের মধ্যে যে বুদ্ধিগত পার্থক্য তা আসলে দৈহিক পার্থক্য। সমগ্র আবর্তনের উপর নাউস এর ক্ষমতা ছিল যার জন্য এটি শুরুতে আবর্তিত হতে আরম্ভ করেছিল। সব জিনিসের মধ্যে নাউস-ই সঙ্গতি এনে দিয়েছে।
নাউসের প্রকৃতি : নাউসের প্রকৃতি সম্পর্কে এখন যে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে তা হল নাউস কি জড়-শক্তি, না অ-জড় (Non Imaterial) শক্তি? এই নিয়ে বিভিন্ন সমালােচকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়। অ্যারিস্টটল (Aristotle), জেলার (Zeller), আর্ডম্যান (Erdman), স্টেইস (Stace), কপলস্টোন (Copleston) প্রমুখ লেখকবৃন্দের অভিমতানুসারে নাউস হল অ-জড় বা আধ্যাত্মিক শক্তি, কিন্তু অপরপক্ষে গ্রোটে (Grote), বার্নেট (Burnet) প্রমুখ লেখকবৃন্দ মনে করেন যে, অ্যানাক্সাগোরাস নাউসকে জড়শক্তি বা প্রাকৃতিক শক্তিরূপে ধারণা করেছেন।
- বার্নেট : বার্নেটের বক্তব্য হল, অ্যানাক্সাগোরাস ‘নাউস’-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে তাকে ‘সব বস্তুর চেয়ে সূক্ষ্ম এবং বিশুদ্ধ’ (Thion. and Purest of all Things) এবং দেশ জুড়ে থাকে (Occupying Space) বল আখ্যাত করেছেন। তাছাড়া তিনি তাকে আবার “অমিশ্রিত’ (Unmixed) বলে বর্ণনা করেছেন। বার্নেটের বক্তব্য হল, নাউস সম্পর্কে উপরিউক্ত বর্ণনা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, নাউস কোন অজড় নীতি নয়। কেননা জড় বস্তু সম্পর্কেই এই বর্ণনা যেমন সূক্ষ্ম, অমিশ্রিত পদগুলো প্রযােজ্য হতে পারে। কেননা জড় বস্তই দেখা অধিকার করে থাকে। সেই কারণেই বার্নেট মন্তব্য করেন যে, অ্যানাক্সগােরাস নাউসকে অন্য জড় বস্তুর তুলনায় বিশুদ্ধতর বলে বর্ণনা করলেও কোন অ-ভৌতিক শক্তির (Incorporeal Force) ধারণা গঠনে সক্ষম হননি।
- জেলার ও স্টেইস : কিন্তু জেলার একথা বলেছেন যে, অ্যানাক্সাগােরাস যেভাবে নাউসের বর্ণনা করেছেন তা সুস্পষ্টভাবে নাউসের অ-ভৌতিক প্রকৃতি নির্দেশ না করলেও, তিনি তাকে অ-ভৌতিকই বােঝাতে চেয়েছেন। স্টেইসের অভিমতও হল এই যে অ্যানাক্সাগোরাস তার নাউসকে একটি অজড় বা অ-ভৌতিক নীতি রূপেই ধারণা করেছেন, যদিও তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এমন একটি শব্দের প্রয়ােগ করেছেন যা জড় বস্তুর বা ভৌতিক দ্রব্যের ক্ষেত্রেই সাধারণত প্রযুক্ত হয়। তার অভিমতের সমর্থনে তিনি বলেছেন যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধারণাকে প্রকাশ করার জন্য যে ভাষার প্রচলন হয়েছে। অতীন্দ্রিয় চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য অনেক সময় দর্শনে সেই ভাষার প্রয়ােগ করতে হয়। তাছাড়া প্রাকৃতিক ধারণাকে প্রকাশ করার জন্য প্রাকৃতিক উপমার ব্যবহার দর্শনে বিশেষভাবে প্রচলিত। যেমন, যখন কেউ বলে যে, ঐ লােকটির মন বেশ পরিষ্কার, বা এই ব্যক্তির মনের তুলনায় ঐ ব্যক্তির মন অনেক বড়, তখন তাকে জড়বাদী বলা চলে। কাজেই নাউসের ক্ষেত্রে ছােট, বড়, সূক্ষ্ম – এই সব শব্দের প্রয়ােগ প্রমাণ করে যে, অ্যানাক্সাগোরাস নাউসকে ভৌতিকরূপে ধারণা করেছিলেন। আর অ্যানাক্সাগােরাস যদি ‘নাউসকে দৈশিক বলে ধারণা করেও থাকেন, তাহলেও তিনি তাকে জড়াত্মক বলে গণ্য করেছেন, এরূপ সিদ্ধান্ত সমীচীন নয়। কেননা মনের অ-দৈশিকতার (Non-spatiality) ধারণা একান্তভাবেই আধুনিককালের ধারণা, ডেকার্টের পূর্বে যে ধারণা বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করেনি। কাজেই এই প্রসঙ্গে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত করাই যুক্তিসঙ্গত হবে যে, অ্যানাক্সাগোরাস তার আধ্যাত্মিকতার ধারণাকে ব্যক্ত করতে গিয়ে আধ্যাত্মিক এবং ভৌতিক পদার্থ সম্পর্কে ভালভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। মন যে অভৌতিক পদার্থ সেই বিষয়টি তিনি সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারেননি এবং জড় ও মনের যে বিরােধিতার কথা আধুনিককালে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অ্যানাক্সাগােরাস এগুলোর পার্থক্যের বিষয়টিও তেমন সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেননি। কপলস্টোনের মতে, তার এই অক্ষমতার জন্য তাকে একজন গোড়া জড়বাদী বলে আখ্যাত করা সমীচীন হবে না। বরং এমন কথা বলাই যুক্তিযুক্ত হবে যে, তিনিই সর্বপ্রথম একটা আধ্যাত্মিক এবং বৌদ্ধিক নীতির প্রবর্তন করেন, যদিও এ নীতি এবং যে জড়কে ঐ নীতি গঠিত করে বা গতিশীল করে তোলে, তার পার্থক্যটুকু তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হননি।
নাউস কিভাবে কাজ শুরু করে? : এই আলােচনার শুরুতে একটা কথা মনে রাখা দরকার, নাউস জগৎ-সৃষ্টিকারী নয়, জগৎ সংগঠনকারী বুদ্ধি। নাউসের সহ–অবস্থানকারী পূর্বস্থিত জড়ের সুসংগঠিত অবস্থা, অর্থাৎ তার মধ্যে শৃঙ্গলা, বিন্যাস দেখেই অ্যানাক্সাগোরাস নাউসের ধারণা করেছিলেন। অ্যানাক্সাগোরাসের মতে, শুরুতে বিভিন্ন ধরনের জড় এলােমেলােভাবে পরস্পরের সঙ্গে মিশে ছিল। এই অবিন্যস্ত জড়পুঞ্জের মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় নাউস একটি আবর্ত (Vortex) উৎপন্ন করল। কাজেই নাউসের কাজ হল চক্রাকারে ঘূর্ণনের কাজটা শুরু করে দেওয়া, জড়পুঞ্জের বাইরে এই আবর্ত নিজেকে বিস্তৃত করে দিতে লাগল। যেমন, জলের মধ্যে পাথরের টুকরাে নিক্ষেপ করলে একটা আবর্তের সৃষ্টি হয়, ক্রমশ সেটা নিজেকে ছড়িয়ে দিতে থাকে, তেমনি একটা গতি আর একটা গতির সৃষ্টি করতে থাকে, সেই গতি পরবর্তী গতি সৃষ্টি করতে থাকে, এই গতির কোন শেষ নেই, এই গতির ফলেই সমজাতীয় পদার্থ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। স্বর্ণ স্বর্ণের সঙ্গে, কাঠ কাঠের সঙ্গে যুক্ত হয়। একটা বিষয় লক্ষ করা দরকার, নাউসের কাজ হল প্রথম গতিটা আরমভ করে দেওয়া। একবার আবর্ত সৃষ্টি হলে পরবর্তী গতি সেই আবর্তের দ্বারা সৃষ্টি হয়, যা চারপাশের জড়কে তার নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে আসে। প্রথমে উত্তপ্ত, শুষ্ক এবং হালকা কণাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে উপরিভাগের বায়ু গঠিত করে। তারপর শীতল, আর্ল, অন্ধকার এবং ঘন কণাগুলো একত্রিত হয়ে নিম্নভাগের বাতাস উৎপন্ন করে। ঘূর্ণনের ফলে এই নিম্নভাগের বাতাস কেন্দ্রমূলে চলে আসে এবং তার থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। এভাবে বস্তর উৎপত্তির ব্যাপারে তিনি অনিবার্যতা এবং আকস্মিকতাকে বর্জন করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তার সৃষ্টিতত্ত্বে কোন ঈশ্বরের অবতারণা তিনি করেননি।
পৃথিবী ও চন্দ্র সম্পর্কে ধারণা : অ্যানাক্সিমিনিসের মত অ্যানাক্সাগোরাসও মনে করেন যে, পৃথিবী একটা সমতল চাকতির মত বাতাসে ভাসমান। সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো আসলে প্রস্তরের স্তুপ, যেগুলো ঘূর্ণনের গতির ফলে পৃথিবী থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। চন্দ্র পৃথিবীর তৈরি এবং সূর্যের আলােক প্রতিফলিত করে। চন্দ্র কোথা থেকে আলাে পায় , অ্যানাক্সাগােরাস হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তার কারণ যথাযথভাবে নির্দেশ করলেন। তিনি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অ্যানাক্সাগােরাস বিশ্বাস করতেন যে, এই জগৎ ছাড়া আরও জগতের অস্তিত্ব আছে এবং তাদেরও নিজস্ব সূর্য এবং চন্দ্র আছে। এই সব জগতেও প্রাণীর বসবাস রয়েছে। আবহাওয়াতে যে সব জীবাণুর অবস্থান, তাদের সাহায্যেই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন।
নৈতিকতা ও জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা : নৈতিকতা এবং ধর্ম নিয়ে যে তিনি খুব চিন্তা করতেন, তা মনে হয় না, সম্ভবত তিনি একজন নাস্তিক ছিলেন। তার অভিযােগকারীরা তার বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযােগ এনেছিলেন। রাসেলের মতে, তার পূর্ববর্তী দার্শনিকবৃন্দের মধ্যে পিথাগােরাস ছাড়া অন্যান্য সকলেই তাকে প্রভাবিত করেছিল। এম্পিডক্লিসের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি ক্ষেত্রেও পারমিনাইডিসের সমান প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্ৰত্যক্ষণ সম্পর্কে অ্যানাক্সাগোরাসের মতবাদ এম্পিডক্লিস এবং পরমাণুবাদীদের মতবাদ থেকে ভিন্ন। অসদৃশ জড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হলেই প্রত্যক্ষণ সম্ভব হয়।
গুরুত্ব ও সমালোচনা
গুরুত্ব :
- ব্রাম্ব : ব্রাম্বের অভিমতানুসারে গ্রীক দর্শন অ্যানাক্সাগোরাসের তিনটি নতুন ধারণার অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছিল। এই তিনটি ধারণা হল –
- প্রথমত, জড় যে একটা অবিচ্ছিন্ন পদার্থ (Continum), এটা হল জেনাের হেঁয়ালিগুলোকে এড়িয়ে যাবার একটা উপায়, কেননা এর দ্বারা দেশকাল অন্তহীনভাবে বিভাজ্য, এটা স্বীকার করে নেয়া হয়।
- দ্বিতীয়ত, তিনি মন সম্পর্কে একটা নতুন ধারণা উপস্থাপিত করলেন এবং জাগতিক পরিকল্পনায় তার স্থান নতুনভাবে নির্দেশ করলেন। কেননা অন্যান্য বস্তু পরস্পরের সঙ্গে মিশ্রিত হলেও, মন অমিশ্রিত বা শুদ্ধ (Pure) থাকে। জড় ও মনের দ্বৈতবাদ উপস্থাপিত না করলেও, তার অবদান দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
- তৃতীয়ত, মনই যে জড়ের মধ্যে গতি উৎপন্ন করে এই কথা বলে তিনি জড় ও মনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের এক নতুন উপায়ের কথা ব্যক্ত করলেন।
- বস্তুত দর্শনের ইতিহাসে অ্যানাক্সাগোরাসের প্রসিদ্ধি বা গুরুত্ব তার ‘নাউস’ সম্পৰ্কীয় মতবাদের জন্য, এই বিষয়টি সকলেই স্বীকার করেছেন। তিনিই প্রথম দার্শনিক যিনি ভৌতিক এবং অ-ভৌতিক-এর মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য করলেন। গ্রীক দর্শনের প্রথম যুগে দার্শনিকদের চিন্তা বর্হিজগতকে নিয়েই সীমাবদ্ধ; বাহ্য জগতে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিতেই তারা প্রয়াসী।
- স্টেইস : কিন্তু স্টেইস (Stace) বলেন, “মন সম্পর্কে অন্তর্দর্শনমূলক আলােচনায় আত্মনিয়ােগের এই যে পট পরিবর্তন অ্যানাক্সাগােরাসের নাউস-এ তাই দেখা যায়।” অ্যানাক্সাগােরাস দর্শনের ক্ষেত্রে মনের সমস্যাকে একটা সমস্যারূপে উপস্থাপিত করলেন। দর্শনে ধারণার প্রবর্তনও অ্যানাক্সাগোরাসের একটি উল্লেখযােগ্য অবদান। যান্ত্রিকতাবাদ (Mechansim) ঘটনার কারণ নিরূপণ করে ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে চায়। কিন্তু কেন ঘটনা ঘটছে, ঘটনা ঘটার পেছনে উদ্দেশ্যটা কী, শুধুমাত্র কারণের দ্বারা তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, সেটা লক্ষ বা উদ্দেশ্য আবিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে হয়। অ্যানাক্সাগােরাস খুব সুস্পষ্টভাবে এটা অনুধাবন করতে না পারলেও, অস্পষ্টভাবে এ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যবাদের নীতিই পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে পরবর্তীকালে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। ব্রাম্ব বলেন যে, অ্যানাক্সাগোরাস বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক পরিবর্তনের সূচনা করেন। নাউস সম্পর্কে তার আলােচনা বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে জড় থেকে গতিতে আগ্রহের সৃষ্টি করে।
- রাসেল : বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, ‘দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাস যদিও পিথাগােরাস, হেরাক্লিটাস বা পারমিনাইডিসের সমকক্ষ ছিলেন না, তবু তার যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তিনি ছিলেন আয়ােনিয়ার অধিবাসী এবং আয়ােনিয়ার বৈজ্ঞানিক এবং বুদ্ধিবাদী ঐতিহ্য তিনি বজায় রেখেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এথেন্সের অধিবাসীদের কাছে দর্শনের প্রবর্তন করেছিলেন এবং তিনিই সর্বপ্রথম ভৌতিক পরিবর্তনের প্রাথমিক কারণরূপে মনকে নির্দেশ করেছিলেন। অবশ্য অন্যত্র তিনি বলেছেন যে, ঠিক প্রথম সারিতে তার স্থান নির্দেশ করা চলে না। কিন্তু এ কথা স্বীকার্য যে, এথেন্স-এ দর্শনকে নিয়ে আসার ব্যাপারে সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে এবং সক্রেটিসের মানস গঠনে যে সব প্রভাব সহায়ক হয়েছিল, তাদের মধ্যে নাউসের অন্যতম প্রভাবরূপে গুরুত্ব রয়েছে। (B. Russell: History of Western Philosophy: Page-81, 83).
সমালোচনা : কিন্তু সমালােচকবৃন্দ অ্যানাক্সাগােরাসের দর্শনের ত্রুটির কথাও উল্লেখ করেছেন –
- অ্যারিস্টোটল, সক্রেটিস ও স্টেইস : তিনি জড় ও মনের বৈপরীত্য এমনভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন যে, তার মতবাদ নিছক দ্বৈতবাদে পর্যবসিত হয়েছে। কেননা তিনি জড় ও মনকে অনন্তকাল ধরে সহ-অবস্থানকারী বলে নির্দেশ করেছেন। অদ্বৈতবাদীদের পথ অনুসরণ করে তিনি একটিকে আর একটি থেকে উদ্ভূত বলতে প্রয়াসী হননি। অ্যারিস্টটল বলেন যে, জগৎ গঠনের ব্যাপারে Nous বা মন একটা বহিস্থ যন্ত্ররূপে কার্য করেছে এবং কেন কোন কিছু অবশ্যম্ভাবীরূপে অস্তিত্বশীল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যখন অ্যানাক্সাগােরাস অপারগ তখনই তিনি মনকে টেনে এনেছেন। কিন্তু অন্যান্য ব্যাপারে মনের প্রতি তিনি উদাসীন। তাকে কোন কিছুর কারণরূপে নির্দেশ করতে তিনি আগ্রহী নন। যখন তিনি পেরেছেন তিনি যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হয়ত এই কারণেই সক্রেটিস অ্যানাক্সাগোরাসের দর্শনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যাশা করে হতাশ হলেন যে, যখন তিনি দেখলেন যে, অ্যানাক্সাগােরাস মনের ভূমিকা যথাযথভাবে নির্দেশ করেননি। বস্তুর বিন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি তাকে কারণরূপে নির্দেশ করেননি। গতির উৎস ব্যাখ্যার জন্যই তিনি মনের প্রবর্তন করেছিলেন। কাজেই বস্তুর প্রথম গতি বা আবর্তের গঠন তিনি মনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু একবার আত্মা সৃষ্টি হবার পর পরবর্তী গতি ঐ আবর্তের সাহায্যেই ব্যাখ্যা করেন। কাজেই অ্যানাক্সাগোরাসের ‘Nous’ প্রথম গতি ব্যাখ্যার জন্য আর এক যন্ত্রবাদের উদাহরণ। সেই কারণে স্টেইস (stace)-এর মতে, অ্যানাক্সাগােরাসের উদ্দেশ্যবাদ (Teleology) শেষ পর্যন্ত এক নতুন ধরনের যন্ত্রবাদে পরিণত হয়েছে।
- কপলস্টোন : কপলস্টোন মন্তব্য করেন যে, যদিও অ্যানাক্সাগােরাস তার নীতিকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে বিফল হয়েছিলেন, তবু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা নীতি গ্রীক দর্শনে প্রবর্তন করার কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে, যে নীতি, ভবিষ্যতে এত চমৎকার ফল দান করবে।
- ব্রাম্ব : ব্রাম্ব বলেন, “অ্যানাক্সাগােরাসের যতখানি কৃতিত্ব লাভ করার কথা, সেই তুলনায় তিনি যে কম কৃতিত্ব লাভ করেছেন সেই সম্পর্কে বর্তমানে যে কারণটির কথা বলা হয়, তা হল আমাদের এই শতাব্দীতেই হােয়াইটহেড-পূর্ব দার্শনিকবৃন্দ, অ্যানাক্সাগােরাস যে চিন্তাধারা অনুসারে জগতকে জড় হিসেবে না দেখে প্রক্রিয়া (Process) হিসেবে দেখতেন, সেই চিন্তাধারা অনুসরণ করতে পারেননি।” অ্যানাক্সাগােরাস আয়ােনিয়ার বুদ্ধিসত্তা ও বৈজ্ঞানিক ধারণাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন।
তথ্যসূত্র
- B. Russell: History of Western Philosophy: Page-81, 83
- E. Zeller: Outlines of the History of Greek Philosophy: Page, 59
- R.S. Brumbaugh: The Philosophers of Greece: Page 69
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৭৬-১০৫
Leave a Reply