(মাহবুবুল আলমের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে নেয়া)
Table of Contents
অন্ধকার যুগ নিয়ে বিতর্ক
অন্ধকার যুগ বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের শুরুতেই ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগ’ বলে একটি বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যের অস্পষ্ট আঙিনায় যথােপযুক্ত আলােকপাত না করেই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের প্রতি যথার্থ মর্যাদা না দেওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে বিতর্কের ধূম্রজাল সৃষ্টি করার উদ্যোগ এতে লক্ষ করা যায়। অতীত দিনের লুপ্ত সাহিত্যের সম্পদ অনুসন্ধান প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়ে যায় নি। গবেষণা কর্মের মাধ্যমে নিত্য নতুন তথ্যের আবিষ্কার করে সাহিত্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অনেক অবকাশ এখনও রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১২০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময় মধ্যযুগ বলে চিহ্নিত। এর মধ্যে ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত দেড় শ বছরকে কেউ কেউ অন্ধকার যুগ বা তামস যুগ বলে অভিহিত করেছেন।
বাংলায় তুর্কি বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমান শাসনামলের সূত্রপাতের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোন উল্লেখযােগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয় নি অনুমান করে এ রকম সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলার সেন বংশের শাসক অশীতিপর বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নদীয়া বিনা বাধায় জয় করে এদেশে মুসলমান শাসনের সূত্রপাত করেন। ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গৌড়ের সিংহাসন দখল করে দিল্লির শাসনমুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার পুত্র সেকান্দর শাহের আমলে বড়ু চণ্ডীদাসের আবির্ভাব হয়। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন।
মুসলমান শাসনের সূত্রপাতে দেশে রাজনৈতিক অরাজকতার অনুমান করে কোন কোন পণ্ডিত অন্ধকার যুগ চিহ্নিত করেছেন।
- এ ধরনের ইতিহাসকারেরা বিজাতীয় বিরূপতা নিয়ে মনে করেছেন, “দেড় শ দু শ কিংবা আড়াই শ বছর ধরে হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালানাে হয় কাফেরদের ওপর। তাদের জীবন-জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির ওপর চলে বেপরােয়া ও নির্মম হামলা। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা এর পরেও মাটি কামড়ে টিকে রইল, তারা ত্রাসের মধ্যেই দিনরজনী গুণে গুণে রইল। কাজেই, ধন জন ও প্রাণের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে প্রাণ নিয়ে সর্বক্ষণ টানাটানি, সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার বিলাস অসম্ভব। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্মেষ-বিকাশের কথাই ওঠে না।’
- ড. সুকুমার সেনের মতে, মুসলমান অভিযানে দেশের আক্রান্ত অংশে বিপর্যয় শুরু হয়েছিল।
- গােপাল হালদারের মতে, তখন বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি তুর্ক আঘাতে ও সংঘাতে, ধ্বংসে ও অরাজকতায় মূৰ্ছিত অবসন্ন হয়েছিল। খুব সম্ভব, সে সময়ে কেউ কিছু সৃষ্টি করবার মত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রেরণা পায় নি।’
- কেউ মনে করেন এ সময়ে বাংলার ওপর দিয়ে বারম্বার হরণকারী বৈদেশিক তুর্কিদের নির্মম অভিযান প্রবল ঝড়ের মত বয়ে যায় এবং প্রচণ্ড সংঘাতে তৎকালীন বাংলার শিক্ষা সাহিত্য সভ্যতা সমস্তই বিনষ্ট ও বিলুপ্ত হয়ে যায়।’
- ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “শারীরিক বল, সমরকুশলতা ও বীভৎস হিংস্রতার দ্বারা মুসলমানেরা অমানুষিক বর্বরতার মাধ্যমে বঙ্গসংস্কৃতির ক্ষেত্রে তামসযুগের সৃষ্টি করে। তিনি মনে করেন, বর্বর শক্তির নির্মম আঘাতে বাঙালি চৈতন্য হারিয়েছিল এবং ‘পাঠান, খিলজি, বলবন, মামলুক, হাবশি সুলতানদের চণ্ডনীতি, ইসলামি ধর্মান্ধতা ও রক্তাক্ত সংঘর্ষে বাঙালি হিন্দুসম্প্রদায় কূর্মবৃত্তি অবলম্বন করে কোন প্রকারে আত্মরক্ষা করছিল। তিনি আরও লিখেছেন, ‘তুর্কি রাজত্বের আশি বছরের মধ্যে বাংলার হিন্দুসমাজে প্রাণহীন অখণ্ড জড়তা ও নাম-পরিচয়হীন সন্ত্রাস বিরাজ করছিল ।… কারণ সেমিটিক জাতির মজ্জাগত জাতিদ্বেষণা ও ধর্মীয় অনুদারতা।…১৩শ শতাব্দীর প্রারম্ভেই বাংলা মুসলমান শাসনকর্তা, সেনাবাহিনী ও পীর ফকির গাজীর উৎপাতে উৎসনে যাইতে বসেছিল। শাসনকর্তগণ পরাভূত হিন্দকে কখনও নির্বিচারে হত্যা করে, কখনও বা বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে এদেশে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে আরম্ভ করেন।…হিন্দুকে হয় স্বধর্মত্যাগ, না হয় প্রাণত্যাগ, এর যে কোন একটি বেছে নিতে হত।” ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমানদের সম্পর্কে লিখেছেন, “শারীরিক বল, সমরকুশলতা। ও বীভৎস হিংস্রতার দ্বারা বাংলা ও তার চতুস্পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলামের অর্ধচন্দ্রখচিত পতাকা প্রােথিত হল। খ্রিঃ ১৩শ হতে ১৫শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত প্রায় দুই শত বছর ধরে এই অমানুষিক বর্বরতা রাষ্ট্রকে অধিকার করেছিল; এই যুগ বঙ্গসংস্কৃতির তামসযুগ, য়ুরােপের মধ্যযুগ The Dark Age-এর সাথে সমতুলিত হতে পারে।”
- ভূদেব চৌধুরীর মতে, ‘বাংলার মাটিতে রাজ্যলিপ্সা, জিঘাংসা, যুদ্ধ, হত্যা, আততায়ীর হস্তে মৃত্যু নারকীয়তার যেন আর সীমা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর প্রজাসাধারণের জীবনের উৎপীড়ন, লুণ্ঠন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ধর্মহানির সম্ভাবনা উত্তরােত্তর উৎকট হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই জীবনের এই বিপর্যয় লগ্নে কোন সৃজনকর্ম সম্ভব হয় নি।”
- এ সব পণ্ডিত মুসলমান শাসকদের অরাজকতাকেই অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ভূদেব চৌধুরী তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’ গ্রন্থে অন্ধকার যুগের সমর্থকদের মনােভাব এভাবে তুলে ধরেছেন : ‘বখতিয়ার খিলজি মুসলিম বিজেতাদের চিরাচরিত প্রথামত বিগ্রহ-মন্দির বিধ্বস্ত করে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন নতুন মসজিদ। মাদ্রাসা ও ইসলামিক শিক্ষার মহাবিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করে, বিধর্মীদের ধর্মান্তরিত করে ধর্মীয় উৎসাহ চরিতার্থ করেন। বিদেশি তুর্কিদের শাসনসীমা থেকে দীর্ঘকাল শাসিতেরা পালিয়েই ফিরেছে; পালিয়েছে প্রাণের ভয়ে, মানের ভয়ে, এমন কি ধর্ম সংস্কারের বিলুপ্তির ভয়ে। বস্তুত, বখতিয়ারের জীবনান্তের পরে তুর্কি শাসনের প্রথম পর্যায়ের নির্মমতা ও বিশৃঙ্খলার প্রাবল্যের দরুন এই পলায়ন প্রবণতা আরও নির্বারিত হয়েছিল। ১৩৪২ সালে ইলিয়াস শাহি সুশাসন প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত বাঙালির সার্বিক জীবন এক অন্ধকার যুগ। নীরব্ধ বিনষ্টির ঐতিহ্যে ভরপুর হয়েছিল। স্বভাবতই জীবনের সংশয়ে কালজয়ী কোন সর্জনকর্ম সম্ভব হয় নি। নিছক গতানুগতিক ধারায় যা কিছু রচিত হয়েছিল, তাও সর্বাত্মক ধ্বংসের হাত থেকে প্রায়ই রক্ষা না পাবারই কথা। প্রধানত এই কারণেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আনুমানিক ১২০০ সাল থেকে চৌদ্দ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। কাল সৃজনহীন ঊষরতায় আচ্ছন্ন বলে মনে হয়।”
বলা হয়ে থাকে, ক্ষমতালােভী বিদেশাগত মুসলমান আক্রমণকারীরা বিবেচনাহীন। সংগ্রাম শাসন আর শােষণের মাধ্যমে দেশে এক অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল। চারুজ্ঞান বিবর্জিত জঙ্গীবাদী বস্তুবাদী শাসকদের অত্যাচারে সাহিত্য সৃষ্টি করার মত সুকুমার বৃত্তির চর্চা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংঘর্ষের ফলে বাঙালির বহির্জীবনে ও অন্তৰ্জীবনে ভীতি বিহ্বলতার সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমান শাসনের সূত্রপাত এদেশের জন্য কোন কল্যাণ বহন করে এনেছিল কিনা তা সর্বাগ্রে পর্যালােচনা করে বিতর্কের অবতারণা করা উচিত ছিল।
প্রকৃত পক্ষে বাংলা সাহিত্যবর্জিত তথাকথিত অন্ধকার যুগের জন্য তুর্কিবিজয় ও তার ধ্বংসলীলাকে দায়ী করা বিভ্রান্তিকর। এ সময়ের যে সব সাহিত্য নিদর্শন মিলেছে। এবং এ সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার যে সব তথ্য লাভ করা গেছে তাতে অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় না। অন্ধকার যুগের দেড় শ বছর মুসলমান শাসকেরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন এ কথা সত্য নয়। ইলিয়াস শাহি আমলের পূর্ব পর্যন্ত খিলজি বলবন ও মামলুক বংশের যে পঁচিশ জন শাসক বাংলা শাসন করেছিলেন তাদের কারও কারও রাজত্বে সাকুল্যে পনের-বিশ বৎসর মাত্র দেশে অশান্তি ছিল, অন্যদের বেলায় শান্ত পরিবেশ বিদ্যমান ছিল বলে ইতিহাস সমর্থন করে। তৎকালীন যুদ্ধবিগ্রহ দিল্লির শাসকের বিরুদ্ধে অথবা অন্তর্বিরােধে ঘটেছে বলে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে নি। ফলে তাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার কোনও কারণ ঘটে নি। বরং এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি শিক্ষাদীক্ষা, ধর্মকর্ম, আচারব্যবহার, আহারবিহার প্রভৃতির প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশবাসীর মধ্যে ইসলামি পরিবেশ গড়ে উঠছিল। মুসলমান শাসকেরা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক পৃষ্ঠপােষকতা দান করেছেন। তাদের উৎসাহ দানের ফলেই বাংলা ভাষা যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। নইলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ‘অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ’ – বলে ধর্মীয় বিষয় দেশীয় তথা বাংলা ভাষায় প্রচারের যে নিষেধবাণী উচ্চারণ করেছিল তাতে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাহীন ছিল। মুসলমান শাসকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সে দুর্দিন থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
- তাদের পৃষ্ঠপােষকতার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই ড. দীনেশচন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ই বঙ্গভাষার এই সৌভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার মতে, মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হতেই আসুন না কেন, এ দেশে এসে সম্পূর্ণরূপে বাঙালি হয়ে পড়িলেন।
- ভারতে মুসলমান শাসকগণের ব্যাপক অবদানের কথা বিবেচনা করে ক্ষিতিমােহন সেন মন্তব্য করেছেন, “তারা দেশী ভাষার সমাদর ত করেছেনই. সংস্কৃতেরও সমাদর করেছেন।”
- বাংলার মুসলমান আগমনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ড. মুহমদ, এনামুল হক মন্তব্য করেছেন, “সেনদের কাছ থেকে মুসলিম তুর্কিরা বাংলা দখল করলেন কূটনীতি শৌর্যবীর্য ও জ্ঞানগরিমার শ্রেষ্ঠত্বে। তখনকার দিনের নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় মাপকাঠিতে তারা কোন অপরাধ করেন নি। ফলে নির্যাতিত ও নিগৃহীত মানুষ মানুষের প্রাপ্য ইসলামি মর্যাদা পেল; সংস্কৃতের দৈব-আসন টলে গেল; ফারসি এসে তার স্থান দখল করল; আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার আপনভূমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল।” তার মতে, তুর্কি কর্তক বঙ্গবিজয় এক মহা অপরাধ বলে গণ্য হােক বা এ বিজয়কে নরহত্যা লুণ্ঠন ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা বলে চিহ্নিত করা অথবা এই বাংলা সাহিত্য বর্জিত যুগের জন্য তুর্কিবিজয় ও তার ধ্বংসলীলাই দায়ী’–এ ধরনের ধারণা কোন ভাবেই সমর্থনযােগ্য নয়। তাই তিনি বলেন, এ সময় বাংলার মানুষ নিজের সুখদুঃখের কাহিনি নিজের ভাষায় লেখে নি, কিংবা নিজের বিরহমিলনের গান নিজের কথায় রচনা করে নি,—এমন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির কথা ভাবতেও পারা যায় না।’
স্মরণ রাখা দরকার যে, মুসলিম শাসনামলে রাজক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলেও বাঙালির জীবনব্যবস্থা মােটামুটি অচঞ্চল ছিল। তখন রাজনৈতিক বিরােধ রাজধানী আর দুর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাঙালির ব্যবহারিক জীবনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর কোন হস্তক্ষেপ করা হয় নি। মুসলিম শাসকগণের সহানুভূতিশীল আচরণ এবং ইসলাম ধর্মের উদার নীতির ফলে সৃষ্টিশীল জীবন পদ্ধতি গড়ে তােলা সহজ ছিল। এ প্রসঙ্গে মুসলমান শাসকগণের উদারতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকের মতামত উল্লেখ করা যায়।
- ক্ষিতিমােহন সেন বলেছেন, এ দেশে এসে মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপিয়েছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ ও মন্দিরের জন্য বহু দানপত্র দিয়াছেন।’
- ড, সুকুমার সেন বলেছেন, ‘রাজ্য শাসনে ও রাজস্ব ব্যবস্থায় এমন কি সৈন্যাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। গৌড়ের সুলতানেরা মুসলমান হলেও রাজকার্য প্রধানত হিন্দুর হাতেই ছিল।’
- স্টুয়ার্টের মতে, অধিকাংশ আফগানই তাদের জায়গিরগুলাে ধনবান হিন্দুর হাতে ছেড়ে দিতেন। এই জায়গিরগুলাের ইজারা ধনশালী হিন্দুরা নিতেন এবং তারা ব্যবসা বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভােগ করতেন।
- বিনয় ঘােষ লিখেছেন, ‘পাঠান রাজত্বকালে জায়গিরদারেরা দেশের ভেতরে রাজস্ব আদায়ের কাজে হস্তক্ষেপ করেন নি। দেশে শাসন ও শান্তিরক্ষার জন্য হিন্দুদের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হত।’
- রাজত্ব স্থায়ী করার গরজেই শাসিতদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা দানে শাসকবর্গ তৎপর হয়। মুসলমান বিজয়ের প্রথম দেড় শ বছর মসনদ নিয়ে কাড়াকাড়ির আশঙ্কা ছিল বলে সিংহাসনাভিলাষীরা সামন্ত, সর্দার ও ভূঁইয়াদের স্বপক্ষে টানার জন্য দেশে সুশাসন চালাবার চেষ্টা করতেন। ড, যদুনাথ সরকার বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘বখতিয়ার রক্তপিপাসু ছিলেন না, অকারণে প্রজাদের ওপরে উৎপীড়ন কিংবা ব্যাপক বিধ্বংসে তার কোন আগ্রহ বা আনন্দ ছিল না।’
- মুসলিম শাসকগণের অবদান সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. দীনেশচন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাজকার্যাবসানে মুসলমান সম্রাটগণ পত্র মিত্র-পরিবেষ্টিত হয়ে হিন্দু শাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন ।… মুসলমান সম্রাট ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের কৌতুহল নিবৃত্তির জন্যই রাজদ্বারে দীনাহীনা বঙ্গভাষার প্রথম আহ্বান পড়েছিল।’ এসব মন্তব্য থেকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি মুসলিম শাসকগণের আনুকূল্য ও অনুরাগ সম্বন্ধে সহজেই ধারণা করা যায়।
- অন্ধকার যুগের সমর্থনে ভূদেব চৌধুরী মন্তব্য করলেও তিনি তার বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা প্রথম পর্যায় গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৩শ শতাব্দীতে যারা বাইরে থেকে বাংলা আক্রমণ করেছিলেন, অতদিনে সেই তুর্কি শাসকেরাই দেশীয় ঐতিহ্যের পরিপােষক রূপে নতুন ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। সুশাসন সূত্রে এই সব বিদেশি শাসনকর্তা প্রজাসাধারণের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণেই কেবল তৎপর হয়েছিলেন না, দেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পুনর্বিকাশেও অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিলেন।’
তথাকথিত অন্ধকার যুগের সাহিত্যসৃষ্টির কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি এ কথাও সত্য নয়। এ সময়ে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক নিদর্শন পাওয়া না গেলেও অন্যান্য ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির নিদর্শন বর্তমান থাকাতে অন্ধকার যুগের অপবাদের অসারতা প্রমাণিত হয়। এ সময়ের প্রথমেই প্রাকৃতপৈঙ্গলের মত প্রাকৃত ভাষার গীতিকবিতা গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ এবং এর ‘কলিমা জলাল’ বা নিরঞ্জনের রুম্মা’, ডাক ও খনার বচন, হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘সেক শুভােদয়ার’ অন্তর্গত পীর-মাহাত্মজ্ঞাপক বাংলা ‘আর্যা’ অথবা ‘ভাটিয়ালী রাগেণ গীয়তে’ নির্দেশক বাংলা গান প্রভৃতি এ সময়ের বাংলা সাহিত্যসৃষ্টির নমুনা হিসেবে উল্লেখযােগ্য। রাহুল সংকৃত্যায়ন এই সময়ে রচিত কিছু ‘চর্যাপদ সগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন।
শূন্যপুরাণ
রামাই পণ্ডিত রচিত ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ ‘শূন্যপুরাণ’ । রামাই পণ্ডিতের কাল ১৩শ শতক বলে অনুমিত হয়। শূন্যপুরাণ ধর্মীয় তত্ত্বের গ্রন্থ – গদ্যপদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য। বৌদ্ধধর্মের ধ্বংসােন্মুখ অবস্থায় হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিলন সাধনের জন্য রামাই পণ্ডিত ধর্মপূজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে বৌদ্ধদের শূন্যবাদ এবং হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে। শূন্যপুরাণে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ কবিতাটি থেকে প্রমাণিত হয় যে তা মুসলমান তুর্কি কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের পরের, অন্তত ১৩শ শতাব্দীর শেষের দিকের রচনা। এতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সদ্ধর্মীদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচার কাহিনি বর্ণনার সঙ্গে মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ এবং ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর রাতারাতি ধর্মান্তর গ্রহণের কাল্পনিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে অপরিণত ধারণা থেকে মনে হয় যে এ দেশে ইসলাম সম্প্রসারণের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি রচিত। ব্রাহ্মণ্য শাসনের অবসান এবং মুসলিম শাসন প্রচলনের পক্ষে মত প্রকাশিত হওয়াতে এতে তৎকালীন সামাজিক অবস্থার পরিচয় মেলে। এর ভাষার কিছু নিদর্শন : “আপনি চণ্ডিকা দেবী তিই হৈলা হায়া বিবি,/ পদ্মাবতী হৈলা বিবি নূর।/ জথেক দেবতাগণ সভে হয়্যা একমন/ প্রবেশ করিল জাজপুর॥/ দেউল দেহারা ভাঙ্গে কাড়্যা ফিড়া খাএ রঙ্গে/ পাখড় পাখড় বােলে বােল।/ ধরিয়া ধর্মের পাএ রামাঞি পণ্ডিত গাএ/ ই বড় বিষম গণ্ডগােল॥”
সেক শুভােদয়া
রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘সেক শুভােদয়া সংস্কৃত গদ্যপদ্যে লেখা চম্পুকাব্য। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ‘সেক শুভােদয়া খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীর একেবারেই গােড়ার দিককার রচনা।’ গ্রন্থটি রাজা লক্ষণ সেন ও শেখ জালালুদ্দীন তাবরেজির অলৌকিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত। শেখের শুভােদয় অর্থাৎ শেখের গৌরব ব্যাখ্যাই এই পুস্তিকার উদ্দেশ্য। এতে নানা ঘটনার মাধ্যমে মুসলমান দরবেশের চরিত্র ও অধ্যাত্মশক্তির পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার যে সব নিদর্শন আছে তা হল পীর-মাহাত্মজ্ঞাপক বাংলা ছড়া বা আর্যা, খনার বচন ও ভাটিয়ালি রাগের একটি প্রেমসঙ্গীত । আর্যার সংখ্যা তিনটি এবং এগুলাে বাংলা ভাষায় প্রাপ্ত পীর মাহাত্ম-জ্ঞাপক কাব্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। হিন্দু কবির দৃষ্টিতে পীরদরবেশগণের ওপর জাগ্রত দেবমাহাত্ম্য আরােপিত হয়েছে। সেক শুভােদয়ার প্রেমসঙ্গীতটি নিম্নরূপ :
“হঙ জুবতী পতিএ হীন।/ গঙ্গা সিনায়িবাক জাই এ দিন॥/ দৈব নিয়ােজিত হৈল আকাজ।/ বায়ু ন ভাঙ্গএ ছােট গাছ ॥/ ছাড়ি দেহ কাজ্জ মুঞি জাঙ ঘর।/ সাগর মৈদ্ধে লােহাক গড় ||/ হাত জোড় করিঞা মাঙ্গো দান ।/ বারেক মহাত্মা রাখ সম্মান ॥/ বড় সে বিপাক আছে উপত্র ॥/ সাজিয়া গেইলে বাঘে ন খাএ ॥/ পুন পুন পাএ পড়িআ মাঙ্গো দান ।/ মৈদ্ধে বহে সুরেশ্বরী গাঙ্গ ।।/ শ্রীখণ্ড চন্দন অঙ্গে শীতল ।/ রাত্রি হৈলে বহএ আনল ॥/ পীন পয়ােধর বাঢ়ে আগ ।।/ প্রাণ ন জায় গেল বহিঞা ভার ॥/ নয়ান বহিঞা পড়ে নীর নিতি ।/ জীএ ন প্রাণী পালাএ ন ভীতি ॥/ আশে পাশে স্বাস করে উপহাস ।/ বিনা বায়ুতে ভাঙ্গে তালের গাছ ॥/ ভাঙ্গিল তাল লুম্বিল রেখা।/ চলি যাহ সখি পলাইল শঙ্কা ॥”
আধুনিক বাংলায় রূপান্তর : ‘আমি পতিহীন যুবতী, দিনে গঙ্গায় স্নানের জন্য যাই । দৈবযােগে অকাজ হল, বায়ু ছােট গাছ ভাঙে না। কাজ ছেড়ে দাও, আমি ঘরে যাই । সাগরের মধ্যে লােহার গড়। হাত জোড় করে ভিক্ষা মাগি—হে মহাত্মা, একবার সম্মান রাখ। এ যে বড় বিপাক, এক উপায় আছে। সাজগােজ করে গেলে বাঘে খায় । পুনঃ পুনঃ পায়ে পড়ে ভিক্ষা মাগি, মাঝখানে সুরেশ্বরী গাঙ বইছে। শ্রীখণ্ড চন্দনে অঙ্গ শীতল, রাত হলে অনল বইতে থাকে। পীন পয়ােধর, আগুন বাড়ে। ভার বয়ে গেল, প্রাণ যায় না। নিত্য নয়ন বয়ে অশ্রু ঝরে। প্রাণ জীবিত থাকতে চায় না, ভয়ও পলায় না। আশে পাশে শ্বাস উপহাস করে, বিনা বায়ুতে তালের গাছ ভেঙে যায় । তাল। গাছ ভাঙল, রেখা লম্বা হল । সখি চলে যাও, শঙ্কা পালিয়ে গেল।”
‘সেক শুভােদয়া’ গ্রন্থের প্রেমসঙ্গীতটিকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়। প্রাচীন যুগে ব্যক্তিমানসের যে প্রতিফলন এতে ঘটেছে তা অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সেক শুভােদয়া গ্রন্থে প্রাচীন আমলের সমাজচিত্রেরও পরিচয় মেলে।
উপসংহার
বাংলা সাহিত্যের এসব নিদর্শনের সাহায্যে সে আমলকে বন্ধ্যাত্বের অপবাদ থেকে রেহাই দেওয়া চলে। প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদের পরে হয়ত এমন কিছু কাব্যের অনুশীলন চলেছিল যার ফলে মধ্যযুগের প্রথম গ্রন্থ বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মত উৎকর্ষপূর্ণ কাব্যসৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। যথার্থ ধারাবাহিক চর্চা না হলে সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধিত হত না বলে ধারণা করা হয়। এ কারণে তথাকথিত সাহিত্য-বিবর্জিত যুগের অস্তিত্ব স্বীকার করা অনুচিত।
অন্ধকার যুগের কিছু কিছু সাহিত্যসৃষ্টির নমুনা পাওয়া গেলেও তা যথেষ্ট নয়। এই স্বল্পতার কতিপয় কারণও নির্দেশ করা চলে। সম্ভবত তুর্কি বিজয়ের পূর্বে বাংলা লেখ্য ভাষার মর্যাদা পায় নি। বাংলা তখন ধর্মপ্রচার ও রাজ্যশাসনের বাহন ছিল না। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে বৌদ্ধরা বিতাড়িত হলে অবহেলিত বাংলা ভাষার প্রতি মনােযােগ দানের লােকের অভাব হয়ত ছিল। সব যুগেই দেখা গেছে যে শাসন ব্যবস্থায় ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেই তার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। মুসলমানদের আগমনের আগে সংস্কৃতের প্রাধান্য এবং পরে বিদেশি ভাষা ব্যবহারের ফলে রাজকার্যে তখনকার অপরিণত বাংলা ভাষার গুরুত্ব বিবেচিত হয় নি। ধর্মমত প্রচারের ক্ষেত্রেও এই বৈশিষ্ট্য বিবেচিত।
অন্যদিকে বাংলা ভাষার প্রাথমিক অবস্থার অপূর্ণতার জন্য সকলের কাছে তা গৃহীত হতে পারে নি। প্রাকৃতজনের মুখে তখন বাংলায় গান গাথা ছড়া প্রভৃতি রচিত হচ্ছিল; কোন উচ্চবিত্তের লােক বাংলায় সাহিত্য রচনায় আগ্রহ দেখায় নি। ১৩শ-১৪শ শতকে বাংলা ভাষার গঠনযুগ চলছিল। তাই ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন। বাংলা বার, তের ও চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ অবধি লেখ্যভাষার স্তরে উন্নীত হয় নি। এটি হচ্ছে বাংলার স্বীকার প্রাপ্তির কাল ও মৌখিক রচনার কাল। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মন্তব্য উল্লেখযােগ্য। তিনি বলেছেন, ১৩শ ও ১৪শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা অপভ্রংশ অবস্থা থেকে বাংলার আঞ্চলিক মূর্তিতে আত্মপ্রকাশিত হচ্ছিল। তখনও তার রূপ স্থিতিস্থাপক,—কখনও অপভ্রংশ-ঘেঁষা কখনও পরবতযুিগের বাংলা ঘেঁষা। রাহুল সাংকৃত্যায়ন কর্তৃক আবিষ্কৃত নতুন চর্যাপদ ও কৃষ্ণকীর্তনের ভাষাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।’ তুর্কি মুসলমানেরা যখন এদেশে শাসনের সূত্রপাত করেন তখন এদেশে সংস্কৃতেরই প্রাধান্য ছিল। তখনকার শিক্ষিত মাত্রই সংস্কৃতশিক্ষিত। সাধারণ মানুষের ভাষার সঙ্গে তৎকালীন শাসকশ্রেণীর সংযােগ স্থাপন সে আমলে সহজে সম্ভব হয় নি। তাই প্রথমাবধি বাংলা সাহিত্যের উন্নতি বিধানে শাসকগণের সচেষ্ট হওয়া সম্ভব ছিল না। পরে যখন তারা বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে তৎপর হন তখন তারা সংস্কৃত থেকে সাহিত্যসৃষ্টি বাংলায় অনুবাদ করিয়েছেন।
দেশে রাজনৈতিক অরাজকতা বিদ্যমান থাকলেও সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব বলে মনে করা যায়। সে আমলের রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করতে পারে নি। তাছাড়া দেশের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও সাহিত্য সৃষ্টি করা যে সম্ভব হয়েছে তা বিভিন্ন আমলে সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে উপলব্ধি করা যাবে। আকবর-জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দেশে মােগল-পাঠান তথা রাজশক্তি-সামন্ত শক্তির মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। শাজাহানের আমলে হার্মাদদের আক্রমণে বাংলা বিপর্যস্ত হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের আমলে বাণিজ্যে ইউরােপীয় বণিকদের দৌরাত্ম্যে জনগণ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ১৩৫০ সনের মন্বন্তরে দেশে চরম দুর্যোগ নেমে। এসেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যায় দেশে জনজীবনে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযােগ চলেছিল। এসব অশান্ত ও প্রতিকূল পরিবেশে বাংলা সাহিত্যের চর্চা অবরুদ্ধ হয় নি। তুর্কি শাসকেরা অত্যাচারী হলে কেবল সাহিত্যের বিকাশই বাধাগ্রস্ত হত না, হিন্দুঞ্জীবনের সমস্ত কার্যকলাপ স্তিমিত হয়ে যেত। কিন্তু সে আমলে তা না হয়ে যথারীতি জীবন ধারা অগ্রসর হয়েছে।
দেশজ মুসলমানরা বরাবরই বাংলা ভাষায় কথা বলে এসেছে। মুসলমানদের শাসনামলে তা অবহেলিত হওয়ার কথা নয়, কিন্তু অপরিণত রূপের জন্যই তা মুসলমানদের হাতে ব্যবহৃত হয় নি।
তথাকথিত অন্ধকার যুগে এদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা বিবেচনা করলে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাদের অনীহা বা বিরূপতার কোন কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। বরং নানা কারণে নির্যাতিত জনগণের প্রতি শাসকদের যেমন সহানুভূতি ছিল, তেমনি অবহেলিত সাহিত্যের প্রতি উদার সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। এই কারণে অন্ধকার যুগের বিতর্কটি নিতান্তই অর্থহীন মনে করা উচিৎ।
এ সব যুক্তির বাইরে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য অন্ধকার যুগের অস্তিত্বহীনতার পক্ষে রায় দেয়। এই আমলের সাহিত্যসৃষ্টির নিদর্শন না পাওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে। এদেশের মানুষের চিরন্তন জীবনযাপন ব্যবস্থা, এখানকার আবহাওয়া, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা আকস্মিক দুর্ঘটনার ফলে এই সময়ের কোন সাহিত্য নিদর্শনের অস্তিত্ব বর্তমান থাকা হয়ত সম্ভবপর হয় নি। চর্যাগীতি, সেক শুভােদয়া ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের একটি করে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এগুলাের এই একটি মাত্র নমুনা যদি না পাওয়া যেত তবে এ সব সাহিত্যও লােকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেত। তাই মনে করা যায় যে, এ সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে থাকলেও তার অস্তিত্ব হয়ত লুপ্ত হয়ে গেছে।
ড. আহমদ শরীফ তথাকথিত অন্ধকার যুগে বাংলা সাহিত্যের কোন নিদর্শন না পাওয়ার কারণগুলাে এভাবে একত্রিত করেছেন :
- ক. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন হয় নি বলে বাংলা তুর্কি বিজয়ের পূর্বে লেখ্য ভাষার মর্যাদা পায় নি।
- খ. তের-চৌদ্দ শতক অবধি বাংলা ভাষা উচ্চবিত্তের সাহিত্য রচনার যােগ্য হয়ে ওঠে নি।
- গ. সংস্কৃততর কোন ভাষাতেই রসসাহিত্য চৌদ্দ শতকের পূর্বে রচিত হয় নি। তুর্কি বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাংলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেক কাল গড়ে ওঠে নি।
- ঘ. তের-চৌদ্দ শতকে সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দু শাসিত মিথিলায়, তাই এ সময় বাংলায় সংস্কৃত চর্চা বিশেষ হয় নি।
- ঙ, আলােচ্য যুগে বাংলায় কিছু পুঁথিপত্র রচিত হলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপিকরণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। আগুন-পানি উই-কীট তাে রয়েইছে।
- চ. লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, সেক শুভােদয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।
- ছ, চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বার শতক হয়, তাহলে তের-চৌদ্দ শতক বাংলা ভাষার গঠন যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়কার কোন লিখিত রচনা না থাকারই কথা।
- জ. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাংলা। বাংলায় লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কিবিজয়ের পূর্বের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না।
এ সব কারণে পণ্ডিতগণ মনে করেন তথাকথিত অন্ধকার যুগ চিহ্নিত করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তাই ১২০০ সাল থেকেই মধ্যযুগ শুরু হয়েছে মনে করা সমীচীন। এ সময় থেকে অপরিণত রূপের প্রাথমিক পর্যায় থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উৎকর্ষের পথে অগ্রসর হয়েছে। পূর্বাপর নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বাংলা সাহিত্যে যে ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ করা যায় তাতে অন্ধকার যুগের দাবি সহজেই উপেক্ষা করা চলে।
Leave a Reply