বৈদিকোত্তর ভারতে প্রতিবাদী ও সংস্কারধর্মী আন্দোলন

ভূমিকা

বৈদিকোত্তর যুগে ধর্মীয় ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে। যাগ-যজ্ঞ-প্রধান ও ব্যয়বহুল বৈদিক ধর্ম আর লােকদের তেমন আকৃষ্ট করতে পারল না। বরঞ্চ এর বিরুদ্ধে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এক দল মনে করলেন, যাগ-যজ্ঞের বিশেষ উপযােগিতা নেই, সভক্তি আরাধনায় ঈশ্বর প্রসন্ন হন ও ভক্তের মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। অর্থাৎ তারা বৈদিক ও অবৈদিক দেব-দেবীদের স্বীকার করেছেন কিন্তু যাগ-যজ্ঞের উপর গুরুত্ব আরােপ করেননি। সে কারণে তাদের প্রগতিবাদী বা সংস্কারপন্থী বলা যায়। সংস্কারপন্থীরা তাদের উপাস্য দেবতা ভেদে শৈব ও ভাগবত এই দুটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন। তাদের প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল উত্তর ও পশ্চিম ভারত। অন্য দল মনে করলেন, ঈশ্বর আছেন কী নেই – এই প্রশ্ন নিরর্থক। মুক্তিই হল মানুষের অভীপ্সিত লক্ষ্য। এর জন্য যাগ-যজ্ঞের প্রয়ােজন নেই, পুরােহিতেরও দরকার নেই। অনেক বৈদিক বিধানের প্রতিবাদ করেছেন বলে তাদের প্রতিবাদী বলা হয়। বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিকেরা ছিলেন প্রতিবাদীদের দলে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পূর্ব ভারতেই প্রতিবাদী আন্দোলন বেশি জনপ্রিয় হয়।

প্রতিবাদী আন্দোলনের পটভূমি

বৈদিক যুগের শেষপর্ব থেকে উত্তর ভারতের আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটতে থাকে যা জনগণের ধর্মীয় জীবনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এর একটি হল বর্ণভিত্তিক সামাজিক বিভাজন। এই বিভাজন জন্মগত, কর্মভিত্তিক নয়। সমাজের সবচেয়ে উঁচুতে ছিলেন ব্রাহ্মণেরা। ব্রাহ্মণের পুত্রই ব্রাহ্মণ হতেন। যজমানি ও অধ্যাপনা তাদের পেশা ছিল। তারা ছিলেন সুবিধাভােগী গােষ্ঠী। তাদের সাধারণত রাজস্ব থেকে রেহাই দেয়া হত। অপরাধ করলেও তাদের অন্যান্যদের তুলনায় লঘু দণ্ড দেয়া হত। ব্রাহ্মণদের পরেই ছিল ক্ষত্রিয়দের স্থান। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন, প্রশাসনিক কাজকর্ম চালাতেন, কৃষক ও বণিকদের কাছ থেকে রাজস্ব ও শুল্ক আদায় করতেন। চাষ-আবাদ, পশুপালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বৈশ্যদের জীবিকা। রাষ্ট্রের আর্থিক দায়িত্ব প্রধানত এদেরই বহন করতে হত। সমাজে সকলের নীচে ছিলেন শূদ্রেরা। বেশির ভাগ শূদ্রকেই খেত-খামার ও কারখানায় ক্রীতদাসের মতাে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হত। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ছিলেন অস্পৃশ্য, অশুচি। শূদ্রদের মধ্যে কিছু লােক কৃষিকার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তারা সংখ্যায় নগণ্য ছিলেন। সমাজে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আধিপত্য অন্যান্য গােষ্ঠীর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায় ও প্রশাসন পরিচালনায় ক্ষত্রিয়দের মুখ্য ভূমিকা ছিল অথচ তাদের তুলনায় রাষ্ট্রের সযােগ-সুবিধা ব্রাহ্মণেরাই বেশি ভােগ করতেন এবং উৎপন্ন সম্পদের বিরাট একটা অংশ তারাই আত্মসাৎ করতেন। তেমনি বৈশ্য ও ধনী শূদ্ররা দেখলেন তারাই সম্পদ উপার্জন করছেন, রাষ্ট্রের আর্থিক দায়-দায়িত্ব পালন করছেন অথচ সমাজে তাদের যথােপযুক্ত প্রতিপত্তি নেই। সমাজের এই শ্রেণিবৈষম্য বঞ্চিত গােষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিক্ষোভ সৃষ্টি করে। জন্মের উপর জোর দেয়া হয়েছে বলে বৈদিক ধর্ম সম্পর্কে তাদের মনে বিরূপ মনােভাব দানা বেঁধে ওঠে। তারা এমন একটি ধর্মের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন যে ধর্মে কোনও বর্ণ বিশেষের প্রাধান্য থাকবে না, থাকবে কর্মের প্রাধান্য। 

এই পর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকার আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল কৃষিকর্মের বিকাশ। আর্যবসতির বিস্তার এবং লাঙলে লােহার ফলার ব্যাপক ব্যবহারের ফলেই কৃষির বিকাশ হয়। কৃষি ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য গােসম্পদ রক্ষার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। কিন্তু বৈদিক যাগ-যজ্ঞে পশু বলির বিধান আছে। এক অশ্বমেধ যজ্ঞেই কম করে ৬০০টির মতাে বলদ বলি দেয়া হত। এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যজমান পুরােহিতকে অসংখ্য গরুও দান করতেন। সাধারণত কৃষকদের কাছ থেকেই বলপূর্বক গরু ও বলদ সংগ্রহ করা হত। এর ফলে একদিকে যেমন চাষ-আবাদের ব্যাপক ক্ষতি হত তেমনি অন্যদিকে চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে কৃষকদের অশেষ দুর্দশা ভােগ করতে হত। সত্য বলতে কী, যাগ-যজ্ঞ-বহুল বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের উপর জগদ্দল পাথরের মতাে চেপে বসেছিল। এই সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে পড়ে। এমন কিছু করা দরকার হয়ে পড়েছিল যাতে অকারণ পশুহত্যা নিবারিত হয়, কৃষকদের হয়রানি বন্ধ হয়।

কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়। রাজগৃহ, বারাণসী, চম্পা, গয়া, শ্রাবস্তী প্রভৃতি স্থানে অনেক নতুন শহর গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে মুদ্রার ব্যবহারও শুরু হয়। দেশের এই অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে যে সম্পদ অর্জিত হয় তা প্রধানত বণিক সম্প্রদায়ের হাতে পুঞ্জীভূত হয়। আর্থিক সমৃদ্ধি তাদের আত্মসচেতন করে। তারা চেয়েছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে তারা সে আশ্বাস পাননি। বরং তাদের উপর নানা প্রকার বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থাদিতে যে শুধু সমুদ্রযাত্রাকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা নয়, কুসীদজীবীদেরও নিন্দা করা হয়েছে। অথচ ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্যের তাগিদে যেমন সমুদ্রযাত্রা অপরিহার্য ছিল, তেমনি সুদের বিনিময়ে অর্থ লগ্নিরও প্রয়ােজনীয়তা ছিল। সে সময় রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকত। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে এই সংঘর্ষের অবসান ঘটানাে জরুরি হয়ে দেখা দেয়। 

ব্রাহ্মণদের পুরানাে আভিজাত্য, বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্রমবর্ধমান আর্থিক সমৃদ্ধি, ক্ষত্রিয়দের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এবং জনসাধারণের সীমাহীন দারিদ্র সমাজের ভারসাম্য বিঘ্নিত করে; হিংসা, দ্বেষ ও স্বার্থান্ধতার বিষবাষ্পে সমাজের বাতাস দূষিত হয়। অবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণির মধ্যে সম্প্রীতি, মৈত্রী ও সহযােগিতার বাতাবরণ সৃষ্টি প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। এর জন্য দরকার ছিল অসুস্থ কামনা বা তৃষ্ণার বিনাশ এবং সত্য, প্রেম, সদিচ্ছা ও সংযমের অনুশীলন। মানুষের মধ্যে এই মানবিকতা জাগরণের ডাক দিলেন দুই মহামানব – বুদ্ধদেব ও মহাবীর। প্রায় একই সময় সমস্যাসংকুল চিন ও ইরানে দেবদূতের মতাে যথাক্রমে আবির্ভূত হলেন কনফিউসিয়াস ও জরথুস্ত্র।

বৌদ্ধধর্ম

গৌতম বুদ্ধ 

নেপালের কপিলবস্তুর এক সম্ভ্রান্ত, ক্ষত্রিয়, শাক্য বংশে বুদ্ধদেবের জন্ম হয়। তার জন্মস্থান অবশ্য কপিলবস্তু নয়, প্রাচীন লুম্বিনী বা বর্তমান রুম্মিনদেঈ গ্রাম। সাধারণত মনে করা হয়, কপিলবস্তু নেপালে অবস্থিত। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের বস্তী জেলায় এই প্রাচীন শহরটির অবস্থানের সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করা যায় না। বস্তী জেলার পিপড়াওয়া গ্রামে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের কয়েকখানি লেখ পাওয়া গেছে। লেখগুলোতে বলা হয়েছে, ‘ওং দেবপুত্ৰবিহারে কপিলবস্তুভিক্ষুসংঘস’। এর থেকে মনে হতে পারে, পিপড়াওয়ার দেবপুত্র বিহারের কাছাকাছি কোনও এক স্থানে কপিলবস্তু অবস্থিত ছিল। (Indian Archaeology 1972-73-A Review, পৃ. ৩৩)। বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোদন, মা মায়াদেবী। কোনও কোনও প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে শুদ্ধোদনকে কপিলবস্তুর রাজারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সে সময় শাক্যরাজ্য হয় কোসলের অধীনস্থ ছিল নয় স্বাধীন গণরাজ্য ছিল। 

গণরাজ্যে একজন রাজা থাকেন না, অসংখ্য রাজা সমবেতভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। বুদ্ধের চনাকালে কপিলবস্তু স্বাধীন থাকলেও শুদ্ধোদন কখনই সেখানকার একচ্ছত্র রাজা ছিলেন না। বুদ্ধদেবের জীবনী :প্রথম জীবনে বুদ্ধদেব গৌতম এবং সিদ্ধার্থ নামে পরিচিত ছিলেন। গৌতম গাত্রে জন্ম হওয়ায় তিনি গৌতম। তার জন্মকালে সকলের আশা পূর্ণ হয়েছিল বলে তিনি সিদ্ধার্থ। শাক্যবংশে জন্ম বলে তিনি শাক্যসিংহ। বােধি বা সম্যক জ্ঞানলাভের পর তার বুদ্ধ নামকরণ। সত্য উপলব্ধি করেছিলেন বলে তিনি তথাগত। তার জন্মের পূর্বেই দৈবজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তিনি রাজচক্রবর্তী হবেন কিংবা সংসারত্যাগী মহাজ্ঞানী সাধক হবেন। 

গৌতমের জন্মের সাত দিন পর তার মা মারা যান। তার মাসী তথা বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী তাকে পুত্রস্নেহে পালন করেন। ছেলেবেলা থেকেই গৌতমের মনে বৈরাগ্য দেখা দেয়। পাছে পুত্র গৃহত্যাগী হন এই ভয়ে শুদ্ধোদন সংসারের দিকে তার আকর্ষণ বাড়াবার সব আয়ােজনই করেন। যথাসময় যশােধরা (মতান্তরে গােপা) নামে এক শাক্য (মতান্তরে কোলিয়) কন্যার সঙ্গে গৌতমের বিবাহ হয়। ক্রমে তার এক পুত্র হয়, তার নাম রাখা হয় রাহুল। বৈরাগ্য যার অন্তরে, ভােগ ও মায়ার বন্ধনে তিনি ধরা দেবেন কেন? অনিবার্য যা, তাই ঘটল একদিন। ভােগ-বিলাসের মােহ ও পিতা-স্ত্রী-পুত্রের মায়ার বন্ধন কাটিয়ে গৌতম গৃহত্যাগ করলেন মুক্তির সন্ধানে। বৌদ্ধ সাহিত্যে তার গৃহত্যাগের দু’রকম বর্ণনা আছে। ললিতবিস্তর, বুদ্ধচরিত প্রভৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে। রাতের বেলায় আত্মীয়স্বজনদের অজ্ঞাতে ঘােড়া কণ্ঠকের পিঠে চড়ে সারথি ছন্দকের সঙ্গে তিনি গৃহত্যাগ করেন। পথে কণ্ঠক ও ছন্দককে বিদায় দিয়ে মুণ্ডিত মস্তকে কাষায় বস্ত্র পরে ভিক্ষুর বেশে তিনি পথচলা শুরু করেন। অরিয়পরিয়েসনসুত্তে এক কাহিনির অবতারণা আছে। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় গৌতম তার সন্ন্যাসগ্রহণের সংকল্পের কথা শুদ্ধোদন ও গৌতমীকে বলেছিলেন। কিন্তু তাদের অনুমতি না পেয়ে তিনি একাকী বাড়ি ছেড়ে চলে যান। গৌতমের গৃহত্যাগের ঘটনাকে মহাভিনিষ্ক্রমণ বলে। তখন তার বয়স ২৯ বছর। 

গৌতমের সন্ন্যাস গ্রহণের কারণ সম্পর্কে সুত্তনিপাতে বলা হয়েছে, গৃহীজীবন বন্ধনময়, দুঃখ-কষ্টে ভরা। এই জীবনের প্রতি গৌতমের বিতৃষ্ণা জন্মে। পক্ষান্তরে মুক্ত, বন্ধনহীন সন্ন্যাস জীবনের প্রতি তার আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলেই তিনি গৃহত্যাগ করেন। অর্থাৎ, হঠাৎ আবেগের বশে নয়, অন্তরে ক্রমবর্ধমান বৈরাগ্যের তাড়নায় তিনি সংসার ত্যাগ করেন। ললিতবিস্তরে গৌতমের সংসার ত্যাগের অন্য কারণ বলা হয়েছে। এই গ্রন্থে আছে, প্রথম দিন জরাগ্রস্ত লােক, দ্বিতীয় দিন রুগ্ন ব্যক্তি, তৃতীয় দিন মৃতদেহ ও চতুর্থ দিন সৌম্যকান্তি সন্ন্যাসী দেখে গৌতমের মনে প্রবল বৈরাগ্য জন্মে এবং তিনি গৃহত্যাগী হন। কিন্তু এ কল্পনার রঙে বােনা এক কাহিনি। ঊনত্রিশ বছরের একজন পরিণত যুবক জীবনে কখনও জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু দেখেননি, এ কথা বিশ্বাসযােগ্য নয়।

সে যাই হােক, সত্যের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে গৌতম এলেন লিচ্ছবি গণরাজ্যের রাজধানী বৈশালীতে। শহরের উপকণ্ঠে ছিল ঋষি আরাড় কালামের আশ্রম। কালামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিনি যােগ অভ্যাস করেন। কিন্তু এটি তার অভীষ্ট সিদ্ধির অনুকূল নয় জেনে তিনি রাজগৃহে গিয়ে রুদ্রক রামপুত্রের নির্দেশে সাধনা আরম্ভ করেন। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে সে আশ্রম ছেড়ে তিনি উরুবিল্ব বা বর্তমান বােধগয়ায় চলে যান। সঙ্গে ছিলেন তার পাঁচ সতীর্থ। উরুবিল্বে এসে গৌতম কৃচ্ছসাধন শুরু করেন। এ সাধনা চলল দীর্ঘ ৬ বছর। তার গৌরবর্ণ দেহ মলিন হল, চক্ষু কোটরাগত হল, শরীর অস্থিসার হল। শেষে একদিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। অবশেষে তার ধারণা দৃঢ় হল, অনাহারে থেকে শরীরকে কষ্ট দিয়ে সম্বােধি লাভ হয় না, কষ্টই সার হয়। এ যেন জলেভেজা কাঠে আগুন জ্বালার ব্যর্থ চেষ্টা। চিত্তশুদ্ধ হলে শরীরকে কষ্ট না দিয়েও প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা যায়। এরপর তিনি জীবনরক্ষার জন্য অন্নগ্রহণ করেন। তার কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে তার পাঁচজন সঙ্গী তাকে ছেড়ে চলে যান। কয়েকদিন পর গয়লানী সুজাতার হাতে পরমান্ন খেয়ে নৈরঞ্জনা বা ফল্গুনদীর তীরে এক বট বা অশ্বত্থ গাছের তলায় তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন। মনে তার অটল সংকল্প – “ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং/ ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।/ অপাপ্য বােধিং বহুকল্পদুর্লভাং/ নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।।” অর্থাৎ আমার শরীর শুকিয়ে যাক, ত্বক, অস্থি ও মাংস লয় পাক, তবু দুর্লভ বােধি লাভ না করে এ আসন আমি ছাড়ব না। অর্থাৎ বুদ্ধত্ব অর্জন না করে গৌতম তার ধ্যান ভঙ্গ করবেন না।

অবশেষে বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রকৃত জ্ঞানের নির্মল আলােকে তার দেহ, মন উদ্ভাসিত হল। আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিকমার্গ, প্রতীত্যসমুৎপাদ প্রভৃতি তত্ত্ব তার মানসলােকে প্রতিভাত হল। তার অন্তরের অজ্ঞান, অবিদ্যা নির্বাপিত হল। তার চিত্ত সংস্কারমুক্ত হল। নির্বাণ লাভ করলেন তিনি। তার বুদ্ধ পরিচয়ের সেই শুরু। তখন তার বয়স ৩৫ বছর। কিন্তু বােধগয়ায় নয়, ঋষিপত্তনে (বর্তমান সারনাথে) বুদ্ধ সর্বপ্রথম তার ললিতবাণী প্রচার করেন। শ্রোতারা হলেন তার পাঁচজন প্রাক্তন সতীর্থ – বপ্র (বৌদ্ধ গ্রন্থ ললিতবিস্তারে তাকে বাষ্প বলা হয়েছে), ভদ্রিয়, অশ্বজিৎ, মহানাম ও কৌণ্ডিন্য। এই ঘটনা ধর্মচক্রপ্রবর্তন নামে খ্যাত। বুদ্ধের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে তার সতীর্থরা সকলেই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই পাঁচজন শিষ্য নিয়ে সারনাথে প্রথম বৌদ্ধসংঘ গড়ে উঠল। 

এরপর বুদ্ধ চারদিকে ধর্মপ্রচারে বের হলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়, লােকানুকম্পায়’ তার এই ধর্মপ্রচার। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। এই উপলক্ষে তিনি কজঙ্গল, চম্পা, গয়া, বােধগয়া, নালন্দা, রাজগৃহ, পাটলিপুত্র, বৈশালী, কপিলবস্তু, শ্রাবস্তী, কৌশাম্বী, বেরঞ্জা ইত্যাদি নানা স্থান পরিদর্শন করেন। রাজগৃহ, শ্রাবস্তী ও কৌশাম্বীর মতাে বড় শহরে বুদ্ধ বার বার এসেছেন, দীর্ঘদিন সেখানে বর্ষা যাপন করেছেন। কপিলবস্তুতে গিয়েছেন পিতার বিশেষ অনুরােধে। কুশীনগরে গিয়েছিলেন জীবনের একেবারে শেষ লগ্নে। চম্পায় তিনি বার কয়েক গিয়েছেন কিন্তু কখনও বর্ষা যাপন করেননি। 

ধর্মপ্রচারের মাধ্যমরূপে বুদ্ধ সংস্কৃত ভাষাকে গ্রহণ করলেন না, গ্রহণ করলেন লােকভাষা মাগধী প্রাকৃতকে। বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তার এটি অবশ্যই একটি কারণ। সে যুগের অনেক নামকরা পণ্ডিত তার কাছে তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। বুদ্ধের দু’জন প্রধান শিষ্য ছিলেন উপালি এবং অভয়রাজকুমার। এরা পূর্বে তীর্থঙ্কর মহাবীরের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু মহাবীরের সঙ্গে বুদ্ধের কখনও দেখা হয়েছিল কিনা জানা যায় না। প্রতিপক্ষকে স্বমতে আনার জন্য বুদ্ধ কখনও কখনও অলৌকিক শক্তি প্রয়ােগ করেছেন। বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবগ্গ‌ থেকে জানা যায়, বােধগয়ায় কাশ্যপ ভাইদের বশে আনার জন্য বুদ্ধ শেষ অস্ত্র হিসাবে তার অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। এতে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়।

নাপিত-চণ্ডালিনী থেকে আরম্ভ করে রাজা-মহারাজ পর্যন্ত সমাজের নানা স্তরের লােক তার ধর্মমত গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অনেকে গৃহত্যাগ করে প্রব্রজ্যা নিয়ে সংঘে যােগদান করেন। এদের ভিক্ষু বা শ্ৰমণ বলা হত। তার প্রব্রজিত শিষ্যদের সামনের সারিতে ছিলেন শারিপুত্র, মৌদগল্যায়ন, আনন্দ, মহাকাশ্যপ, মহাকাত্যায়ন ও উপালি। মহাকাশ্যপ ছিলেন ব্রাহ্মণ, আনন্দ ক্ষত্রিয় এবং উপালি নাপিত। তার প্রথম পাঁচজন প্রব্রজিত শিষ্যরা সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। পুত্র রাহুলের দীক্ষার ভার বুদ্ধ শারিপুত্রের হাতে তুলে দেন। 

প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে মহিলারা সংঘে যােগ দিন, বুদ্ধের তা অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু আনন্দ ও মহাপ্রজাপতির বিশেষ অনুরােধে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন। মহিলাদের সংঘে যােগদানের অনুমতি দিলেও বুদ্ধ সংঘে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার মেনে নেননি। দুই-একটা উদাহরণ দিলেই কথাটি স্পষ্ট হবে। ভিক্ষুরা উপযুক্ত মনে করলে যে কোনও ব্যক্তিকে সংঘে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারতেন। কিন্তু ভিক্ষুণীদের সে অধিকার ছিল না। ভিক্ষুণীরা ভিক্ষুদের কোনও উপদেশ দিতে পারতেন না, ভিক্ষুরাই নির্দেশ বা উপদেশ দান করতেন। ভিক্ষুদের সে নির্দেশ বা উপদেশ ভিক্ষুণীদের অবশ্যই পালন করতে হত। শুদ্ধোদনের মৃত্যু হলে মহাপ্রজাপতি সংঘে যােগ দেন ও পরে অর্হৎত্ব লাভ করেন। 

বুদ্ধের গৃহী শিষ্যদের মধ্যে বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলেন মগধের রাজা বিম্বিসার, অজাতশত্রু, রাজবৈদ্য জীবক, শ্রাবস্তীর বণিক অনাথপিণ্ডদ, বৈশালীর বারবণিতা আম্রপালী এবং শ্রাবস্তীর গৃহবধূ বিশাখা। শ্ৰমণদের জন্য প্রয়ােজনমতাে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান করে তারা বৌদ্ধধর্মের প্রসারের পথ প্রশস্ত করেছেন। বিম্বিসার ও জীবকের বদান্যতায় রাজগৃহে যথাক্রমে বেণুবনবিহার ও জীবকারাম নির্মিত হয়। অনাথপিণ্ডদের দানে শ্রাবস্তীতে জেতবন ও গন্ধকুটি বিহার গড়ে ওঠে। বিশাখা শ্রাবস্তীতে পুর্বারাম বিহার নির্মাণ করেন। আম্রপালী পরবর্তিকালে ভিক্ষুণীসংঘে যােগদান করেন। 

উত্তরে কপিলবস্তু থেকে দক্ষিণে কৌশাম্বী এবং পূর্বে কজঙ্গল থেকে পশ্চিমে বেরঞ্জা, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বুদ্ধ তার ধর্ম প্রচার করেছেন দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। জীবনের একেবারে পড়ন্ত বেলায় বুদ্ধ কুশীনগর ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। মহাপরিনিব্বানসুত্তে বলা হয়েছে, কুশীনগর যাওয়ার পথে বুদ্ধ পাবা শহরে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি কর্মকার চুলের অতিথি হন। চুলের বাড়িতে শূকরের মাংস খেয়ে বুদ্ধ অতিসার রােগে আক্রান্ত হন। আনন্দ ও অন্য কয়েকজন শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে অসুস্থ শরীরে তিনি শেষে কুশীনগরে উপস্থিত হন। সেখানেই তার দেহাবসান হয়। বুদ্ধের দেহাবসান পরিনির্বাণ বা মহাপরিনির্বাণ নামে খ্যাত। তখন তার বয়স ৮০ বছর, অজাতশত্রুর রাজত্বের অষ্টম বছর। 

বুদ্ধদেবের মহাপ্রয়াণের পর কত শত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে! কিন্তু শান্তি, সাম্য, মৈত্রী ও অহিংসার প্রবক্তা এই মহামানব আজও বিশ্ববন্দিত, বিশ্ববরেণ্য। তিনি মানবজাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন মনুষ্যতের উদ্বোধন ঘটাতে, নিরলসচিত্তে শ্রেয়ের অনুগামী হতে তিনি বলেছেন, “বয়ধম্মা সংখারা, অপ্‌পমাদেন সম্পাদেথ”, অর্থাৎ যা সৃষ্ট, যা জাত, তা ব্যয়ধর্মের অধীন, তা অনিত্য। তার্থাৎ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু মানুষকে মুক্তির লক্ষ্যে পৌছতে হবে। এর জন্য সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে। বুদ্ধের এটিই শেষ উপদেশ।

বুদ্ধদেবের সময়

বুদ্ধের পরিনির্বাণের তারিখ সম্পর্কে নানা মুনি নানা মত প্রকাশ করেছেন। এই প্রসঙ্গে ৫৪৪, ৪৮৬, ৩৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ইত্যাদি বিভিন্ন তারিখের কথা বলা হয়েছে। পরিনির্বাণের তারিখ সম্পর্কে প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে পরস্পরবিরােধী উক্তি থাকায় এই বিপত্তি। ৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভ করেন, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই মত খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু দীপবংসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বুদ্ধের পরিনির্বাণের ২১৮ বছর পর অশােকের রাজ্যাভিষেক হয়। আনুমানিক ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশােকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে বুদ্ধের পরিনির্বাণের তারিখ আনুমানিক ৪৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। বুদ্ধের পরিনির্বাণের উপরের দু’টি তারিখের মধ্যে ৫৭ বছরের ব্যবধান।

প্রাচীন চিনা সাহিত্যে বিনয়পিটকের এক অতি পুরােনাে পাণ্ডুলিপির কথা আছে। প্রসঙ্গত বলা হয়েছে, বহু হাত বদলের পর পাণ্ডুলিপিটি চিনের ক্যান্টন শহরে সংরক্ষিত হয়। প্রতি পরিনির্বাণ বার্ষিকীতে একটি করে বিন্দুচিহ্ন ওই পাণ্ডুলিপিতে আঁকা হত। ৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের এক গণনায় পাণ্ডুলিপিতে ৯৭৫টি বিন্দুচিহ্ন দেখা যায়। বুদ্ধের পরিনির্বাণ এবং ৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে ৯৭৫ বছরের ব্যবধান রয়েছে তা এতে প্রমাণিত হয়। এই হিসাবে বুদ্ধ ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেহত্যাগ করেন। এই তারিখ এবং দীপবংসে বুদ্ধের পরিনির্বাণের তারিখ প্রায় এক। অন্য কোনও নিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দকেই বুদ্ধের পরিনির্বাণকাল বলে গণ্য করতে হবে। বুদ্ধ ৮০ বছর জীবিত ছিলেন। ফলে তিনি ৫৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, এরূপ ধারণাই সংগত মনে হয়। বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে এ মহামানবের জন্ম।

বুদ্ধের ধর্মমত বা বৌদ্ধধর্ম

ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে বুদ্ধের শিষ্য অশ্বজিৎ তখন রাজগৃহে। সেখানে তার সঙ্গে শারিপুত্রের আলাপ হয়। শারিপুত্র এবং তার বন্ধু মৌদ্‌গল্যায়ন তখন পরিব্রাজক সঞ্জয়ের শিষ্য। অশ্বজিৎকে শারিপুত্র জিজ্ঞেস করেন, কে তার গুরু, কী তার ধর্মমত। উত্তরে অশ্বজিৎ বলেন, “যে ধর্মা হেতু প্ৰভবা হেতুং তেষাং তথাগতাে হ্যবদৎ। তেষাং চ যাে নিরােধ এবংবাদী মহাশ্রমণঃ॥” ধর্ম হেতু হতে উৎপন্ন। এখানে ধর্মের অর্থ বস্তু বা ঘটনা। যেমন জন্ম-মৃত্যু। প্রতিটি বস্তু বা ঘটনার পিছনে কারণ আছে। এই কারণ বুদ্ধ আবিষ্কার করেছেন। বস্তু বা ঘটনার নিরােধ আছে, বুদ্ধ তাও বলেছেন। দু’চারটি কথায় অশ্বজিৎ কত সুন্দরভাবে বুদ্ধের ধর্মমত ব্যাখ্যা করেছেন। 

আর্যসত্য, প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং অষ্টাঙ্গিকমার্গ – এই তিন তত্ত্বের উপর বুদ্ধের ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত। প্রতীত্যসমুৎপাদ ও অষ্টাঙ্গিকমার্গ আসলে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও চতুর্থ আর্যসত্যেরই বিশ্লেষণ। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, বুদ্ধের সামগ্রিক ধর্মমত আর্যসত্যের মধ্যে নিহিত। আর্যসত্য চারটি। প্রথম সত্য দুঃখ। জীবন দুঃখময়। জরা, ব্যাধি ও মুত্যর আক্রমণে জীবন ক্ষত-বিক্ষত; শােক, অনুতাপ ও দুঃখের আগুনে জীবন দগ্ধ। জন্মগ্রহণের অর্থ দুঃখকে আহ্বান করা। কিন্তু পুনর্জন্ম রােধ করলে দুঃখের অবসান হয়। দ্বিতীয় সত্য সমুদয়। এটি প্রতীত্যসমুৎপাদ বা হেতুপ্রত্যয় নীতি থেকে উদ্ভূত। দুঃখ যেমন আছে, দুঃখের কারণও আছে। পুনর্জন্ম দুঃখের। পুনর্জন্মের কারণ সংসারের প্রতি আসক্তি। আসক্তি জন্মায় চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক ও মন – এই ছ’টি ইন্দ্রিয় হতে। ইন্দ্রিয় কোনও বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না। এ জ্ঞান মানুষের নেই। ফলে তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর প্রতি তীব্র আসক্তি বা তৃষ্ণা থাকে। এই আসক্তি বা তৃষ্ণার ফলেই মানুষ বার বার জন্মগ্রহণ করে অশেষ দুঃখ-কষ্ট ভােগ করে। 

ততীয় আর্যসত্য হল নিরােধ। এই নিরােধ দুঃখের নিরােধ, আসক্তি-তৃষ্ণার নিরােধ। আসক্তি তা নিবারিত হলে পুনর্জন্ম রােধ হয়, দুঃখের অবসান হয়। “নিরােধগামী মার্গ বা নিরােধের পথ হল চতুর্থ আর্যসত্য। এই পথ অসংযত ভােগের পথ নয়, আবার কঠোর তপস্যা বা শারীরিক নির্যাতনের পথও নয়। দুই অন্তের মধ্যবর্তী এই পথ। তাই এর নাম মধ্যম মার্গ। আটটি অঙ্গ আছে বলে একে অষ্টাঙ্গিকমার্গও বলে। অঙ্গগুলো হল সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকলন, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্মান্ত বা কর্ম, সম্যক আজীব বা জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। সম্যক দৃষ্টির অর্থ চার আর্যসত্যের যথার্থ জ্ঞান। দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, তার নিরােধ আছে। অষ্টাঙ্গিকমার্গ তথা প্রেম, করুণা, মৈত্রী ও শুভ কর্মের পথেই দুঃখের নিরােধ, এই সত্য অন্তরে উপলব্ধি করতে হবে। সকলের প্রতি মৈত্রী ও করুণা প্রদর্শনের অঙ্গীকারই সম্যক সংকল্প। রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ ও কামনা জয় করে জিতেন্দ্রিয় হতে হবে। এই জিতেন্দ্রিয় হবার অঙ্গীকারও সম্যক সংকল্প।  সত্য, প্রিয় ও মিত কথাই সম্যক বাক্য। মিথ্যা বলা, কটু কথা ও বাচালতা ত্যাগ করতে হবে। কল্যাণকর কর্মই সম্যক কর্মান্ত বা কর্ম। জীবহত্যা, চুরি ও ব্যভিচার বর্জন করতে হবে। সৎ জীবিকাই সম্যক আজীব বা জীবিকা। সমাজের ক্ষতি করে এমন সব জীবিকা নিন্দনীয়। সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা বলতে চারটি বিশেষ মানসিক প্রক্রিয়া বােঝায়। এগুলো হল কুচিন্তার পরিহার ও বিনাশ এবং সদিচ্ছার উন্মেষ ও বিকাশ। দেহ-মনের স্বরূপ স্মরণ রাখাই সম্যক স্মৃতি। দেহ কয়েকটি অপবিত্র ও নশ্বর পদার্থে তৈরি। ইন্দ্রিয় সুখের ফাঁদে মন স্বভাবতই ধরা দিতে চায়। ইন্দ্রিয় বন্ধন থেকে মনের মুক্তির কথা অহরহ চিন্তা করতে হবে। চিত্তের একাগ্রতাই সম্যক সমাধি। চিত্তের এই একাগ্রতা মনের চঞ্চলতা দূর করে। 

চারটি আর্যসত্য ও অষ্টাঙ্গিকমার্গের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে জীবের তৃষ্ণা ও অবিদ্যা দূর হয়। এবং শেষে পরমপদ নির্বাণ লাভ হয়। সংস্কার থেকে চিত্তের মুক্তিই হল নির্বাণ। জীবনের প্রতি মানুষের যে প্রবল আসক্তি বৌদ্ধমতে তাই সংস্কার। চিত্ত সংস্কারমুক্ত হলে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়, মানুষের পুনর্জন্মের আর কোনও সম্ভাবনা থাকে না। নির-পূর্বক বা ধাতু হতে নির্বাণ শব্দ নিষ্পেন্ন। নির উপসর্গের অর্থ অবসান, লয়, বিলুপ্তি। ‘বা’ ধাতুর অর্থ জ্বলা, প্রদীপ্ত করা। নির্বাপিত (অগ্নি, দীপ), এই আক্ষরিক অর্থে নির্বাণ। ইন্ধনের অভাবে যেমন অগ্নি বা প্রদীপ নির্বাপিত হয়, তেমনি বাসনা ও আসক্তি বা সংস্কারের বিনাশে দুঃখের অবসান হয়, পুনর্জন্মের নিরােধ হয়। মুক্তি বলতে যা বােঝায়, বৌদ্ধদের নিকট তাই নির্বাণ। মুক্তি হচ্ছে বাসনা ও আসক্তি হতে মুক্তি। নির্বাণও তাই। বলা হয়, ছন্দ-রাগ-বিনােদনং নিবনম। বাসনা ও আসক্তির বিনাশই নির্বাণ। ‘নিৰ্বানং… সন্ত্র গন্থপ্‌পমােচনম্‌’। সর্বপ্রকার বন্ধন হতে মুক্তিই নির্বাণ। ‘ভবনিরােধা নিব্‌বানম্‌’। ভব, অর্থাৎ পুনর্জন্মের নিরােধই নির্বাণ। ‘রাগক্খ‌য়াে দোসক্খ‌য়াে মােহক্খ‌য়াে নিব্বানম্‌’। রাগ, দ্বেষ ও মােহের ক্ষয়ই নির্বাণ। ‘তণহায় বিপ্‌পহানেন নিব্‌বানম্‌’। তৃষ্ণার বিনাশই নির্বাণ। নির্বাণ কিন্তু নিষ্ক্রিয়তা বা শূন্যতা নয়। পয়ত্রিশ বৎসর বয়সে শাক্যমুনি নির্বাণ প্রাপ্ত হন কিন্তু জীবনের অবশিষ্ট ৪৫ বৎসরকাল তিনি নিরলসভাবে বিপুল কর্মযজ্ঞের তানুষ্ঠান করেন। নির্বাণপ্রাপ্তির পরও করণীয় কর্ম থাকে কিন্তু প্রারব্ধ কর্মের রজ্জুবন্ধনে আবদ্ধ হতে হয় না। কৃতকর্মের বন্ধন তখনই থাকে যখন সে কর্মের মূলে থাকে বাসনা, থাকে রাগ, দ্বেষ ও মােহ। রাগ-দ্বেষাদি হতে বিমুক্ত হয়ে নির্বাণপ্রাপ্ত হলে আর নতুন বাসনার সৃষ্টি হয় না। নির্বাণপ্রাপ্ত মহামানবদের অবস্থা ভর্জিত বীজের মতাে। বীজ একবার ভাজা হলে তাতে আর অঙ্কুর বের হয় না। তেমনি নির্বাণপ্রাপ্ত মহাজনও আর কৃতকর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না। নির্বাণ পর্যায়ে যে কর্মোদ্যোগ তার লক্ষ্য লােকহিত, লােককল্যাণ। তখন জীবন এক অনাস্বাদিত কল্যাণ ও মঙ্গলের আলােকে উদ্ভাসিত থাকে, পরম আকাঙ্ক্ষিত চরম পরিপূর্ণতার আনন্দ সাগরে নিমগ্ন থাকে। বৌদ্ধদের কাছে নির্বাণ যা বুদ্ধত্বও তাই। 

নির্বাণ লাভের চারটি স্তর – স্রোতাপন্ন, সকৃদাগামী, অনাগামী ও অর্হৎ। যিনি নির্বাণ লাভের সাধনার স্রোতে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন তিনি স্রোতাপন্ন। যাকে নির্বাণ লাভের জন্য পৃথিবীতে আর একবার মাত্র জন্মগ্রহণ করতে হবে তিনি সকৃদাগামী। এ জন্মেই যিনি নির্বাণ লাভ করবেন তিনি অনাগামী। যিনি নির্বাণ লাভ করেছেন তিনি অর্হৎ। কিন্তু এই নির্বাণ যাদের লক্ষ্য তারা হলেন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। গৃহী সাধারণ নির্বাণ মার্গের যাত্রী নন। এদের জন্য বুদ্ধের পৃথক অনুশাসন। এ ক্ষেত্রে তিনি শ্রদ্ধা, ভক্তি, মৈত্রী ও করুণার মতাে। মানবিক গুণের বিকাশের উপরই জোর দিয়েছেন, সৎ জীবন যাপনের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেছেন। মায়ের মমতা নিয়ে সকলের প্রতি মৈত্রীভাব পােষণের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, হিংসা, ক্রোধ ও শত্রুতাকে প্রেম, ভালােবাসা দিয়ে জয় করতে হবে, পাপ কাজ থেকে বিরত হতে হবে, চিত্ত শুদ্ধ রাখতে হবে, মধুরভাষী হতে হবে, মা-বাবা ও অন্যান্য গুরুজনদের প্রতি সেবাপরায়ণ হতে হবে, দাস-দাসী সকলের প্রতি সদয় হতে হবে, আচরণে অহিংস হতে হবে। দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধের ধর্মমতে জাত-পাতের কোনও গুরুত্ব নেই, গুরুত্ব আরােপিত হয়েছে কর্মের উপর। তার প্রবর্তিত ধর্মে যাগ-যজ্ঞেরও কোনও স্থান নেই। আত্মােন্নয়নমূলক কর্মকে কেন্দ্র করে, বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ও যাগ-যজ্ঞের গুরুত্ব অস্বীকার করে, কার্যত তিনি বৈদিক ধর্মের বিরােধিতাই করেছেন। স্বীকার করতে হয়, বৈদিক ধর্মের প্রতিবাদী ধর্মরূপে বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব হয়েছে। 

আর একটি ক্ষেত্রে বুদ্ধ বৈদিক ধর্মের বিরােধিতা করেছেন। বেদ-উপনিষদে জীবাত্মার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, আত্মা নিত্য, ধ্রুব ও অপরিবর্তনীয়। আরও বলা হয়েছে, দেহের বিনাশ আছে, কিন্তু আত্মার ক্ষয় নেই। বুদ্ধ এ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, আত্মা বলতে কিছু নেই। জীব আসলে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পাঁচটি উপাদান বা স্কন্ধের সমষ্টি। এই পাঁচটি স্কন্ধের সংমিশ্রণে আত্মবােধ উৎপন্ন হয় কিন্তু স্কন্ধগুলোকে বিশ্লেষণ করলে আত্মা নামে কোনও সৎ বস্তু পাওয়া যায় না। ঈশ্বর আছেন কী নেই, এ প্রশ্নেরও বুদ্ধ কোনও সদুত্তর দেননি। তিনি বলেছেন, ঈশ্বর থাকুন বা না থাকুন, মানুষের দুঃখ কষ্ট আছে এবং থাকবে। একমাত্র কর্মের দ্বারাই দুঃখ-কষ্টের নিরসন হয়। কর্মই জীবের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। যিনি যেমন কর্ম করেন তিনি তেমন ফলভােগ করেন। ফলের মধ্যে সব ফলই সমান নয়। কোনওটি তেতাে, কোনওটি নােনা, কোনওটিবা মিঠে। মূল বীজের ভেদেই এই পার্থক্য। তেমনি মানুষের মধ্যে কেউ ধনী, কেউ গরিব, কেউ দুর্বল, কেউ সবল, কেউ নির্বোধ, কেউ বুদ্ধিমান। কর্মবীজের ভেদেই মানুষে মানুষে এই পার্থক্য। মুক্তকণ্ঠে বুদ্ধ কর্মবাদের মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন। আসলে বেদের সঙ্গে বুদ্ধের যে বিরােধ তা মূলত বেদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। বেদের জ্ঞানকাণ্ড তথা উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে বুদ্ধের মতের অনেক মিল আছে। উপনিষদের ঋষিরা বলেছেন, মানুষের চরম লক্ষ্য হল মােক্ষ বা মুক্তি। এই মুক্তি দুঃখ থেকে মুক্তি, আত্মার বন্ধনমুক্তি। বুদ্ধও মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন, তুষার নিবৃত্তি চেয়েছেন, দুঃখের নিরসন চেয়েছেন। তিনি এই মুক্তির নাম দিয়েছেন নির্বাণ। উপনিষদের ঋষিরা বলেছেন, যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে মােক্ষ আসে না, মােক্ষ আসে আত্মােপলব্ধির পথে। আত্মাই সত্য, এই আত্মার মৃত্যু নেই, পরিবর্তন নেই। কিন্তু মন ও দেহের সঙ্গে আত্মা একাত্ম হয়ে আছে। দেহাতীত সেই আত্মাকে খুঁজে পেতে হবে।

নির্বাণে যাগ-যজ্ঞের কোনও ভূমিকা নেই, এ কথা বুদ্ধ বার বার বলেছেন। বুদ্ধ মনে করেন, আত্মা বলে কোনও পদার্থই নেই, আছে আত্মবােধ। তাই আত্মােপলব্ধি নির্বাণের পথ হতে পারে। নৈরাত্মক পথে অষ্টাঙ্গিকমার্গের অনুশীলনে স্কন্ধের বিযুক্তীকরণের ফলে নির্বাণ লাভ হয়। অর্থাৎ, জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে বুদ্ধের কোনও বিরােধ নেই, বিরােধ পথ নিয়ে। হিংসা, দ্বেষ ও স্বার্থমগ্ন পৃথিবীকে বুদ্ধ নতুন এক পথের সন্ধান দিয়েছেন। এ পথ সহযােগিতা ও মৈত্রীর পথ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ। পৃথিবী দুঃখে পূর্ণ। বিষয়-বাসনার তৃষ্ণা থেকে এই দুঃখের জন্ম। তৃষা মানুষকে স্বার্থান্ধ করে, মিথ্যা কথা, পরনিন্দা ও কটু বাক্যে প্ররােচিত করে, চুরি, হত্যা ও ব্যভিচারে প্রবৃত্ত করায়, অসৎ পথে চালিত করে। তুফার আকর্ষণে অন্যকে বঞ্চিত করে। মানুষ বিষয়ভােগে প্রবৃত্ত হয়। যারা বঞ্চিত তারা হতাশাগ্রস্ত, দুঃখমগ্ন। যারা সুবিধাভােগী, তারা লালায়িত, অতৃপ্ত। কিন্তু এ পথ ধ্বংসের পথ। এতে মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, সমাজে উত্তেজনা বাড়ে, সমাজ ভেঙে পড়ে। তৃষ্ণার বিনাশেই সকলের শান্তি। সদাচার, সত্য, প্রেম, সদিচ্ছা ও সংযমের মধ্য দিয়ে তার বিনাশ হয়। মানুষের যখন এ জ্ঞান জন্মাবে, তখনই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে। অন্যথায় হিংসা, বিদ্বেষ ও কলহ চলতেই থাকবে। যেমন নির্বাণমাগী সাধকের কাছে, তেমনি সাধারণ মানুষের কাছে বৌদ্ধধর্মের অসীম গুরুত্ব।

বৌদ্ধসংঘ

ভিক্ষুদের সংগঠিত ও সুসংহত করার উদ্দেশ্যে বুদ্ধ সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। সংঘ ত্রিরত্নের একটি রত্ন। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ নিয়ে ত্রিরত্ন। সংঘে প্রবেশের প্রথম পর্যায়ে প্রার্থীকে প্রব্রজ্যা নিতে হত। ১৫ বছরের অনূর্ধ কেউ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারতেন না। প্রব্রজিতকে শ্ৰমণ বলা হত। এ পর্যায়ে প্রব্রজিতকে নিষ্ঠা সহকারে দশটি বিশেষ বিধি পালন করতে হত। বৌদ্ধশাস্ত্রে এ বিধিসমূহ দশশীল নামে পরিচিত। শ্রমণজীবন সমাপ্ত হলে এবং অন্তত ২০ বছর বয়স হলে তাকে উপসম্পদা দেয়া হত। উপসম্পদাপ্রাপ্ত শ্রমণ ভিক্ষু নামে পরিচিত হতেন। ভিক্ষু সংঘের পূর্ণ অধিকার লাভ করতেন। ভিক্ষুদের আহার-বিহার, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বুদ্ধ বেশ কিছু অনুশাসন প্রবর্তন করেন। বিভিন্ন সময় কয়েকটি নিয়ম বাতিল করে নতুন বিধান তিনি প্রবর্তন করেন। সংঘজীবনের এসব নিয়মকানুন ও বিধি ব্যবস্থার কথা বিনয়পিটকে বিশদভাবে বলা হয়েছে। শীল দশটি হল (১) প্রাণিহত্যা পরিত্যাগ, (২) অদত্ত দ্রব্য বর্জন, (৩) অব্রহ্মচর্য পরিহার (৪) মিথ্যা বলা থেকে বিরতি, (৫) সুরা, মেরেয় ও মদ বিসর্জন (৬) বৈকালীন ভােজন পরিত্যাগ, (৭) নাচ, গান, বাজনা, কৌতুকাদি বর্জন, (৮) মালা, সুগন্ধি ও অলঙ্কার পরিহার, (৯) সুখকর শয্যা বর্জন ও (১০) সােনা, রূপা ও প্রতিগ্রহে নিরাসক্তি। প্রথম পাঁচটি শীল উপাসক-উপাসিকাদেরও অবশ্য পালনীয়। এই পাচটি শীল পঞ্চশীল নামে পরিচিত।

প্রতি মাসে দু’বার করে উপােসথ অনুষ্ঠান হত। অনুষ্ঠানটি হত চতুর্দশী না হয় পঞ্চদশী তিথিতে। বিহারের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বসবাসকারী সব ভিক্ষুরা সে তিথিতে সমবেত হয়ে অনুশাসনমূলক প্রতিমােক্ষসূত্র আবৃত্তি করতেন (প্রতিমােক্ষ, প্রাতিমােক্ষ উভয় পদই শুদ্ধ), নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আলােচনা করতেন, ক্ষেত্রবিশেষে দণ্ডের বিধান দিতেন। ধর্মের আলােচনাও হত সে দিন। ব্যভিচার, চুরি, নরহত্যা ও শক্তির অপব্যবহার, এই চারটি কাজ গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হত। এর কোনওটিতে দোষী সাব্যস্ত হলে ভিক্ষুকে সংঘ থেকে বহিষ্কৃত করা হত। ভিক্ষু স্বেচ্ছায় যে কোনও সময় সংঘ ত্যাগ করে সংসার-জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে পারতেন। ভিক্ষুরা কোনও এক স্থানে স্থায়িভাবে বসবাস করতেন না, স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু বর্ষাকালের তিন মাস তারা নির্দিষ্ট একস্থানে অবস্থান করতেন। একে বর্ষাবাস বলে। প্রবারণা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্ষাবাসের সমাপ্তি ঘটত।

সংঘের কাজকর্ম চলত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। প্রতিটি ভিক্ষুই সংঘের কাজে মতামত প্রকাশ করতে পারতেন। বিরােধ দেখা দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােটে বিরােধের নিষ্পত্তি হত। মত গ্রহণের মাধ্যম হিসাবে শলাকা বা টিকিটের ব্যবহার ছিল। কখনও কখনও সংঘে অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করত। বুদ্ধের উপস্থিতিতেই একবার কৌশাম্বীতে ভিক্ষুদের মধ্যে বিরােধ তীব্র হয়। ভিক্ষুদের কোন্দলে বিরক্ত হয়ে বুদ্ধ কয়েকদিনের জন্য বিহার ছেড়ে চলে যান। দেবদত্ত নামে তার এক আত্মীয় ভিক্ষুসংঘে বিভেদ সৃষ্টি করেছিলেন কিন্তু তাতে সংঘের বিশেষ ক্ষতি হয়নি।

সংঘের ইতিহাস

বুদ্ধ তার উপদেশাবলি লিপিবদ্ধ করে যাননি। এগুলো তার শিষ্য-প্রশিষ্যদের মুখে মুখে উচ্চারিত হত। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার নামে প্রচলিত উপদেশাবলির যাথার্থ্য সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়। এ সন্দেহ দূর করার জন্য রাজা অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপােষকতায় রাজগৃহের সপ্তপণী গুহায় এক সভার আয়ােজন হয়। পাঁচশাে ভিক্ষু সে সভায় যােগ দেন। স্থবির মহাকাশ্যপ সভাপতিত্ব করেন। এটি প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি নামে খ্যাত। দুটি পিটক বা আধারে বুদ্ধের বচন সংকলিত হয় এ অধিবেশনে। ভিক্ষু আনন্দ ধর্ম বিষয়ে বুদ্ধ-বচন আবৃত্তি করেন। উদ্ভব হল সুত্তপিটকের। সংঘের নিয়ম-কানুন ও ভিক্ষজীবনের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে বুদ্ধের অনুশাসন আবৃত্তি করেন ভিক্ষু উপালি। বিনয়পিটকের সংকলনের সেই সূত্রপাত। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্করণের যে সকল সুত্ত ও বিনয়পিটকের সন্ধান পাওয়া যায় তা নিঃসন্দেহে এই আদি সংকলন দু’টির সংশােধিত ও পরিবর্তিত সংস্করণ। অজাতশত্রুর রাজত্বকালে আদৌ কোনও বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এ সন্দেহ অমূলক।

কালের গতির সঙ্গে বুদ্ধের ধর্মমত যথেচ্ছ ব্যাখ্যাত হতে থাকে। ভিক্ষুরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দু’টি দলে বিভক্ত হন। প্রাচ্য ভিক্ষুদের প্রধান কেন্দ্র ছিল বৈশালী ও পাটলিপুত্র। কৌশাম্বী, পাঠেয় ও অবন্তি ছিল পাশ্চাত্য ভিক্ষুদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পাশ্চাত্য ভিক্ষরা ছিলেন রক্ষণশীল, প্রাচীনপন্থী। প্রাচ্য ভিক্ষুরা সংঘের নিয়ম-কানুন ও ভিক্ষু-জীবনের আচার-ব্যবহারে কিছুটা পরিবর্তন আনতে চাইলেন। বিরােধ নিষ্পত্তির জন্য রাজা কালাশােকের (মতান্তরে কাকবণী) উৎসাহে বুদ্ধের পরিনির্বাণের ঠিক একশাে বছর পর বৈশালীতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক সভা বসে। ৭০০ জন ভিক্ষু এ সভায় যােগ দেন। এটিই দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি। সভাপতিত্ব করেন মহাস্থবির যশ। বিক্ষুব্ধ ভিক্ষুরা সভায় দশ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এই দশ দফা প্রস্তাব ‘দসবত্‌থু’ নামে পরিচিত। ‘দসবত্থু‌’ পালি শব্দ। এর অর্থ দশ বস্তু। প্রস্তাবগুলোতে প্রয়ােজন মতাে খাদ্য সংরক্ষণ, দিনে দু’বার ভােজন, এক সীমায় একই স্থানের বদলে বিভিন্ন স্থানে উপােসথ ব্রত পালন, পূর্ব অনুমােদন ছাড়া কাজ করার অধিকার, সােনা-রূপার উপহার গ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্ন দাবির কথা বলা হয়। কোনও কোনও বৌদ্ধগ্রন্থে বলা হয়েছে, ভিক্ষু মহাদেবের পাঁচ দফা প্রস্তাব আলােচনার জন্য এই দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল। তিব্বতি ও চিনা সূত্রে মহাদেবের এই পাঁচ দফা প্রস্তাব বা তত্ত্বের উল্লেখ আছে। তত্ত্বগুলো হল : অর্হৎ অপাপবিদ্ধ নন, তিনি যে অর্হৎ তা তিনি অবহিত নাও হতে পারেন, অর্হতের মন সংশয়মুক্ত নয়, গুরুর সান্নিধ্য ছাড়া অর্হৎত্ব অর্জিত হয় না এবং ধ্যানস্থ অবস্থায় বিস্ময়সূচক শব্দের উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সত্য প্রতিভাত হয়।

সে যাই হােক, বিরােধ নিষ্পত্তির জন্য এ সভায় প্ৰতি গোষ্ঠী থেকে ৪ জন করে মােট ৮ জনের এক কার্যকরী সমিতি গঠন করা হয়। অনেক আলাপ-আলোচনার পর এই সমিতি প্রকাশ্যে প্রাচ্য ভিক্ষ্যদের বিরুদ্ধে রায় দেন। এতে বিক্ষুব্ধ ভিক্ষুরা সভা ছেড়ে চলে যান। কয়েক দিনের মধ্যে বৈশালীর উপকণ্ঠে মহাবনের কূটাগারশালায় এক সভায় তারা মিলিত হন। এই অধিবেশন মহা সঙ্গীতি নামে খ্যাত। মহাসঙ্গীতিতে যোগ দেয়ায় বিক্ষুব্ধ প্রাচ্য ভিক্ষুদের নাম হয় মহাসংঘিক (মহাসংঘিক ও মহাসাংঘিক দু’টি বানানই শুদ্ধ), তাদের আচার্যবাদীও বলা হয়। রক্ষণশীল ভিক্ষুরা থেরবাদী বা স্থবিরবাদী নামে পরিচিত হন। এ ভাবে বৌদ্ধ সংঘে দুটি শাখা বা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল। মহাসংঘিকরা মহাকাশ্যপকে তাদের গুরুপদে বরণ করেন। স্থবিরবাদীদের গুরু হলেন মহাকাত্যায়ন। বুদ্ধ হলেন উভয় সম্প্রদায়েরই পরম গুরু।

বৌদ্ধ সংঘে ভেদ এখানে থামল না। ক্রমে ক্রমে মহাসংঘিকরা সাতটি উপগােষ্ঠীতে বিভক্ত হলেন। উপগােষ্ঠীগুলো হল একব্যবহারিক, চৈত্যিক, কৌক্‌কুট্টিক (গােকুলিক) (কৌক্‌কুটিক ও কুক্কু‌টিক একই), বহুশ্রুতীয়, প্রজ্ঞপ্তিবাদী, পূর্বশেল এবং অপরশৈল। নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্থবিরবাদীরা মহাসংঘিকদেরও ছাড়িয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে ১১টি উপসম্প্রদায়ের উদ্ভব হল। মহীশাসক, বাৎসীপুত্রীয়, সান্ত্ৰিতীয়, ষাগরিক, ভদ্রানীয়, ধমোত্তরীয়, সর্বাস্তিবাদী, ধর্মগুপ্তক, কাশ্যপীয়, হৈমবত ও সংক্রান্তিক বা সৌত্রান্তিক উপসম্প্রদায়গুলো এ ভাবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু এসব পরবর্তি কালের ঘটনা।

বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র

বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে দু’চারটি কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্রকে ত্রিপিটক বলে। পিটক কথার অর্থ ঝুড়ি বা পাত্র। ত্রিপিটকের অর্থ তিন ঝুড়ি বা পাত্র। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের তিনটি ভাগ – সূত্রপিটক, বিনয়পিটক ও অভিধর্মপিটক। সম্প্রদায়ভেদে বৌদ্ধদের পৃথক পৃথক ত্রিপিটক। বর্তমানে কেবলমাত্র স্থবিরবাদীদেরই পালি ভাষায় লেখা সম্পূর্ণ ত্রিপিটকের সন্ধান পাওয়া গেছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের সম্পূর্ণ ত্রিপিটক আজও পাওয়া যায়নি, যা পাওয়া গেছে তা খণ্ডিত, আংশিক। তবে সে ত্রিপিটকে পালি ভাষার ব্যবহার নেই। সর্বাস্তিবাদীদের ত্রিপিটকের ভাষা মিশ্র সংস্কৃত বা বৌদ্ধ সংস্কৃত, সাম্মিতীয়দের অপভ্রংশ, মহাসংঘিকদের প্রাকৃত। এখানে একটি কথা বলার আছে। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের ত্রিপিটক নামকরণ বা ত্রিধা বিভাজন প্রক্রিয়া অবশ্যই পরবর্তিকালের ঘটনা। আদিতে অর্থাৎ প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতির সময় বৌদ্ধশাস্ত্র দুটি বিভাগে বিন্যস্ত হয়। এদের একটি সুত্ত বা সূত্র, অন্যটি বিনয়। প্রথমটি ধর্ম সম্পর্কিত বুদ্ধ-বচনের সংকলন। দ্বিতীয়টি ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের আচার-ব্যবহার-মূলক বুদ্ধ-বচন-সংগ্রহ। দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির সময়ও বৌদ্ধশাস্ত্রের এই দ্বিধা বিভাজন অপরিবর্তিত থাকে। অবস্থার পরিবর্তন ঘটল তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতিকালে। মােগগলিপুত্ত তিস্স‌ের (মতান্তরে উপগুপ্তের) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে সম্মেলনে অভিধর্ম নামে নতুন একটি বিভাগের উদ্ভব ঘটল। ধর্ম বিষয়ক বুদ্ধ-বচন তথা সূত্রের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও দর্শন এ বিভাগে সন্নিবিষ্ট হয়। বৌদ্ধশাস্ত্র কালক্রমে ত্রিপিটক নামে পরিচিত লাভ করল। 

ত্রিপিটকের ক্রম সম্পর্কে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। সাধারণত মনে করা হয়, ত্রিপিটকের প্রথম ভাগ সূত্র, দ্বিতীয় ভাগ বিনয় এবং তৃতীয় ভাগ অভিধর্ম। কিন্তু বৌদ্ধদের নিজেদের মতে ত্রিপিটকের প্রথম ভাগ বিনয়পিটক, সূত্রপিটক তার পর। সূত্রপিটকে আছে ধর্মের অনুশীলন, বিনয়পিটকে আছে সংঘের নিয়মাবলি ও আচার-ব্যবহারের বর্ণনা, আর অভিধর্মে আছে ধর্মের বিশ্লেষণ ও দর্শন। সূত্রপিটকের পাঁচটি ভাগ – দীঘনিকায়, মজ্ঝি‌মনিকায়, সংযুক্তনিকায়, অঙ্গুত্তরনিকায় এবং খুদ্দকনিকায়। নিকায়ের অর্থ আবাস, শব্দাবলি। যে নিকায়ে বা আবাসে দীর্ঘাকৃতির সূত্রসমূহ সন্নিবিষ্ট তা দীর্ঘনিকায়। সেরূপ মজ্‌ঝিমনিকায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে মধ্যমাকৃতির সূত্র। দীঘনিকায়ে আছে ব্রহ্মজালসুত্ত, সামঞ্‌ঞফলসুত্ত ইত্যাদি ৩৪টি দীর্ঘপ্রমাণ সূত্রের সমাবেশ। সূত্রগুলোর মধ্যে কোনও যােগসূত্র নেই, প্রতিটি সূত্র স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ। মজ্ঝি‌মনিকায়ে ১৫২টি মধ্যমপ্রমাণ সূত্র অন্তর্ভুক্ত। সংযুক্ত ও অঙ্গুত্তরনিকায়ে যথাক্রমে ৫৬ এবং ২৩০টি সূত্র আলােচিত হয়েছে। দীর্ঘ, মজুঝিম, সংযুক্ত এবং অঙ্গুত্তর এক একটি পৃথক গ্রন্থের নাম। কিন্তু খুদ্দক বলতে পনেরােটি বিশেষ গ্রন্থ বােঝায়। গ্রন্থগুলো হল খুদ্দকপাঠ, ধম্মপদ, উদান, ইতিবৃত্তক, সুত্তনিপাত, বিমানবত্থু‌, পেতবত্থু‌, থেরগাথা, থেরীগাথা, জাতক, নিদ্দেস, পটিসম্ভিদামগ্‌গ, অপদান, বুদ্ধবংস ও চরিয়াপিটক। খুদ্দকনিকায়ের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থাবলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হয়তাে এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না –

  • খুদ্দকপাঠ : ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নয়টি সূত্রের এক উৎকৃষ্ট হস্তপুস্তিকা এই খুদ্দকপাঠ। এর সাতটি সূত্র বৌদ্ধজগতে জাদুমন্ত্ররূপে পরিচিত।
  • ধম্মপদ : বৌদ্ধদের গীতারূপে পরিচিত ধর্ম ও নীতি সম্পর্কিত ৪২৩টি গাথার সংকলন ধম্মপদ। সংকলনটি যমক, অপমাদ ইত্যাদি ২৬টি বর্গে বিভক্ত।
  • উদান : সৌমনস্য বা প্রসন্নতাসূচক সূত্রই উদান। উদান সংকলনে এরূপ আশিটি সূত্র সন্নিবিষ্ট হয়েছে। বেশির ভাগ সূত্ৰই গাথায় রচিত। এসব সূত্রে কীর্তিত হয়েছে বৌদ্ধজীবনে আদর্শ ও নির্বাণের মাহাত্ম্য।
  • ইতিবুত্তক : গদ্যে ও পদ্যে বুদ্ধদেবের উক্তিরূপে রচিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ২১২টি সূত্রের সংকলন ইতিবুত্তক। সরল ও সাবলীল ভাষায় রচিত এই সূত্রগুলোতে নৈতিকতার আদর্শ প্রচারিত হয়েছে।
  • সুত্তনিপাত : গাথায় রচিত ৭০টি সূত্রের সংগ্রহ সুত্তনিপাত। এসব সূত্রে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি বিরূপতা, অপরদিকে তেমনি ঘােষিত হয়েছে বৌদ্ধধর্মের জয়গাথা।
  • বিমানবত্‌থু : গ্রন্থটিতে ৮৫টি গাথা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গাথাগুলোতে বর্ণিত হয়েছে দেবতাদের দিব্যাবাসের কাহিনি।
  • পেতবত্‌থু : একান্নটি গাথার এ গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে প্রেত-কাহিনি, অসৎ কর্মের ফলে মানুষের। প্রেতরূপে জন্মগ্রহণ ও অশেষ দুঃখ ভােগের কাহিনি।
  • থেরগাথা : বৌদ্ধসাহিত্যে জ্ঞানবৃদ্ধ ভিক্ষুদের থের বা স্থবির বলে। এই থেরদের রচিত ১৩৬০টি গাথার সংকলন থেরগাথা।
  • থেরীগাথা : কতিপয় পূতশীলা স্থবিরার ৫২২টি গাথার সংকলন থেরীগাথা। ছন্দমাধুর্যে, উপমাবৈচিত্র্যে ও কাব্যরসের সমুজ্জ্বল ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের বেশির ভাগ গাথাই রসােত্তীর্ণ গীতিকবিতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
  • জাতক : জাতক শব্দের আক্ষরিক অর্থ যে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ সাহিত্যে জাতক বলতে বােঝায় গৌতম বুদ্ধের পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত। বলা হয়, বুদ্ধদেব গৌতমরূপে জন্মগ্রহণ করার পূর্বে ৫৪৭ বার বােধিসত্ত্বরূপে আবির্ভূত হন। বুদ্ধদেবের এক একটি পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে এক একটি জাতক। জাতগ্রন্থে এরূপ ৫৪৭টি জাতক সন্নিবিষ্ট হয়েছে, এক একটি জাতকের পাঁচটি করে অঙ্গ প্রত্যুৎপন্ন বা বর্তমান কাহিনি, অতীত বস্তু বা অতীত কাহিনি, গাথা বা শ্লোক, ব্যাকরণ বা টীকা এবং সমাধান বা সংযােগ বা বর্তমান কাহিনির নায়কদের সঙ্গে এদের পূর্বজন্মের শনাক্তকরণ। জাতকে ভারতের যে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক চালচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তার কালসীমা ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ২য় খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • নিদ্দেস : এটি একটি টীকাগ্রন্থ বিশেষ। সুত্তনিপাতের কয়েকটি সূত্রের বিশদ আলােচনা আছে এ গ্রন্থে। গ্রন্থটির দু’টি ভাগ – মহানিদ্দেস ও চুল্লনিদ্দেস। কথিত আছে, শারিপুত্র এই টীকা গ্রন্থ রচনা করেন।
  • পটিসম্ভিদামগ্ন : জ্ঞান, স্মৃতি, কর্ম, আর্যসত্য মৈত্রী, যৌগিক ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত নানা বিষয় প্রশ্নোত্তরচ্ছলে এই গ্রন্থে বিশ্লেষিত হয়েছে।
  • অপদান : পালি অপদান বা সংস্কৃত অবদানের অর্থ মহৎ কর্ম, কীর্তি। গাথার রচিত এ গ্রন্থে বুদ্ধ ও বহু স্থবির-স্থবিরাদের কীর্তিকলাপ বর্ণিত হয়েছে। সমগ্র অপদান ৫৯টি বর্গে বিভক্ত। প্রতি বর্গে দশটি করে কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থখানির ৫৫টি বর্গই স্থবির সম্পর্কিত। ফলে এ গ্রন্থে ৫৫০জন স্থবির ও ৪০ জন স্থবিরার জীবনকাহিনি পরিবেশিত হয়েছে। ভগবান বুদ্ধের সঙ্গে স্থবির-স্থবিরাদের সম্পর্কের কথাও ব্যক্ত হয়েছে এ গ্রন্থে।
  • বুদ্ধবংস : গাথায় রচিত এ গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে গৌতম বুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী ২৪ জন আদি বুদ্ধের জীবনবৃত্তান্ত। সর্বসমেত ২৬টি পরিচ্ছেদে গ্রন্থখানি সমাপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ পরিচ্ছেদে আলােচিত হয়েছে গৌতম বুদ্ধ ও আদি বুদ্ধদের দেহাবশেষ বন্টনের কাহিনি।
  • চরিয়াপিটক : ৩৫টি জাতক-কাহিনি এ গ্রন্থে কবিতার আকারে পরিবেশিত হয়েছে। এটি অশােকোত্তর পর্বের রচনা।

সুত্তবিভঙ্গ, খন্ধকা ও পরিবার – এই তিন ভাগ বিনয়পিটকের। বিনয়পিটকের যেটি বুনিয়াদ সেই প্রতিমােক্ষ সুত্তবিভঙ্গেই সন্নিবিষ্ট। প্রতিমোক্ষেই সুত্তবিভঙ্গের প্রাণ। বিভঙ্গের অর্থ ভেঙে ফেলা বা ভেঙে-চুরে ব্যাখ্যা করা। বিনয়পিটকের এই বিভাগে প্রতিমােক্ষের অনুশাসন ভেঙে-চুরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিমােক্ষের মূল সূত্র সহ টীকা বলতে যা বােঝায় তা এই সূত্তবিভঙ্গ। পালি প্রতিমােক্ষে ২২৭টি সূত্র আছে। এক একটি নিয়ম নিয়ে এক একটি সূত্র। প্রতিমােক্ষে বর্তমানে ২২৭টি নিয়মের উল্লেখ আছে। প্রথমদিকে সম্ভবত ১৫২টি নিয়ম লিপিবদ্ধ ছিল। খন্ধকার দু’টি ভাগ – মহাবগ্গ‌ ও চুল্লবগ্গ‌। মহাবগ্গ‌ে বর্ণিত হয়েছে ভগবান বুদ্ধের বােধিজ্ঞান লাভ হতে সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচারের ইতিবৃত্ত, সংঘের উৎপত্তি ও বিকাশের কাহিনি ও বহু নীতিমূলক আখ্যান। চুল্লবগ্গ‌ে লিপিবদ্ধ হয়েছে বুদ্ধের জীবনী, সংঘের ইতিবৃত্ত এবং প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতির ইতিহাস। তবে চুল্লবগ্গ‌ের সঙ্গীতি বিষয়ক অধ্যায় দু’টিকে অনেকে প্রক্ষিপ্ত মনে করেন। সুত্তবিভঙ্গ ও খন্ধকার তুলনায় অনেক অর্বাচীন গ্রন্থ পরিবার। একবিংশ পরিচ্ছেদে গ্রন্থখানি বিন্যস্ত। গ্রন্থটি সম্ভবত শ্রীলঙ্কায় রচিত। বিনয়ের দুরূহ বিষয়গুলো অতি সুন্দর ও প্রাঞ্জলভাবে এ গ্রন্থে পরিবেশিত হয়েছে। সুত্তবিভঙ্গ ও খন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশের এটিই একমাত্র চাবিকাঠি। অভিধম্ম বা অভিধর্মপিটকের সাতটি ভাগ – ধম্মসংগণি, বিভঙ্গ, কথাবত্‌থু, পুগ্‌গলপঞ্‌এত্তি, ধাতুকথা, যমক ও পট্‌ঠান। অভিধর্মের এই সাতটি ভাগ বা গ্রন্থ বৌদ্ধশাস্ত্রে সপ্ত প্রকরণ নামে পরিচিত –

  • ধম্মসংগণি : এ গ্রন্থে চিত্ত, চৈতসিক, রূপ ও নির্বাণের মতাে ধর্মের বিভিন্ন বিষয়, তাদের স্বরূপ, কৃত্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষিত হয়েছে।
  • বিভঙ্গ : ধর্মের বিভিন্ন বিষয় বা পদার্থগুলোকে সংশ্লেষণ করা হয়েছে বিভঙ্গ গ্রন্থে।
  • কথাবত্‌থু : মােগ্‌গালিপুত্ত তিস্স‌ এ গ্রন্থখানি সংকলিত করেন। ২৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত এ গ্রন্থে বিভিন্ন বৌদ্ধ মতবাদ বিশ্লেষিত হয়েছে।
  • পুগ্‌গলপঞ্‌এত্তি : সম্যক বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ, আর্যপুদ্গল ইত্যাদি বিষয়ের আলােচনা আছে এ গ্রন্থে। 
  • ধাতুকথা : ১৪টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত এ গ্রন্থে স্কন্ধ, ধাতু ও আয়তনের মতাে বিষয়গুলো প্রশ্নোত্তরচ্ছলে সবিস্তারে আলােচিত হয়েছে। যে পাঁচটি উপাদান হতে ধর্ম বা বস্তুর উৎপত্তি হয় তাই স্কন্ধ। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পাঁচটি স্কন্ধ। ধাতু বলতে বােঝায় বস্তুর মূল সত্তা। আয়তনের অর্থ ইন্দ্রিয়।
  • যমক : যমক শব্দের অর্থ যমজ বা যুগল। এ গ্রন্থে এমন সব শব্দের বিশ্লেষণ আছে যাদের ভিন্নার্থে পুনরাবৃত্তি হয়।
  • পট্ঠা‌ন : বিশাল আয়তনের এই গ্রন্থটি মহাপ্রকরণ নামেও পরিচিত। প্রতীত্যসমুৎপাদের ১২টি নিদান এ গ্রন্থে ২৪টি প্রত্যয়ের আকারে অতি সরলভাবে পরিবেশিত হয়েছে। 

উপরের বর্ণনা সবই স্থবিরবাদীদের ত্রিপিটক সম্পর্কিত। মিশ্র সংস্কৃতে বা বৌদ্ধ সংস্কৃতে রচিত সর্বাস্তিবাদীদের ত্রিপিটক সম্পর্কেও দু’চারটি কথা বলা যায়। কাশ্মীরের গিলগিটে ও মধ্য এশিয়ার কয়েকটি স্থানে এ ত্রিপিটকের কিছু কিছু খণ্ডিতাংশ আবিষ্কৃত হয়েছে। পালি ত্রিপিটকের মতাে এ ত্রিপিটকেরও তিনটি প্রধান ভাগ – আগমপিটক, বিনয়পিটক ও অভিধর্মপিটক। পালিতে যা সুত্ত (সংস্কৃত সূত্র), সংস্কৃতে তা আগম। আগমপিটক, পাঁচটি ভাগে বিভক্ত – দীর্ঘাগম, মধ্যমাগম, সংযুক্তাগম, একোত্তরাগম ও ক্ষুদ্রকাগম। ক্ষুদ্রকাগমের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলো সম্ভবত সুত্রনিপাত, উদ্মন, ধর্মপদ, স্থবিরগাথা, বিমানবস্তু ও বুদ্ধ বংশ। বিনয়পিটকের চারটি ভাগ – বিনয়বিভঙ্গ, বিনয়বস্তু, বিনয়ক্ষুদ্রক ও বিনয়ােত্তরগ্রন্থ। ভিক্ষু-প্রাতিমােক্ষ ও ভিক্ষুণী-প্রতিমােক্ষ বিনয়বিভঙ্গের অন্তর্গত। পালি অভিধম্মের মতাে সংস্কৃত অভিধর্মেও সাতখানি গ্রন্থ। গ্রন্থগুলো জ্ঞানপ্রস্থানসূত্র, সঙ্গীতিপর্যায়, প্রকরণপাদ, বিজ্ঞানকায়, ধাতুকায়, ধর্মস্কন্ধ ও প্রজ্ঞপ্তিশাস্ত্র। সংস্কৃতে রচিত এসব শাস্ত্রগ্রন্থকে সহজবােধ্য করার জন্য পরবর্তিকালে বহু টীকা-টিপ্পনী লেখা হয়। এসব টীকা-টিপ্পনী বিভাষা নামে পরিচিত। এরূপ একটি টীকাগ্রন্থ অভিধর্মকোষ। অভিধর্মের উপর অতি প্রামাণ্য টীকা এটি। এর রচয়িতা আচার্য বসুবন্ধু।

পালি ত্রিপিটকের সংকলন-কাল

পালি ত্রিপিটকের সংকলন ও রচনার কাজ শুরু হয়। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর এ কাজ শেষ হয় শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষ পাদে বট্টগামণির রাজত্বকালে। ত্রিপিটকের কয়েকটি গ্রন্থের রচনাকাল সম্পর্কে আরও একটু স্পষ্ট ধারণা করা যায়। মহাবগ্গ‌ে ও চল্লবগ্গে‌ তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি সম্পর্কে কোনও কথা বলা হয়নি। এ থেকে অনুমান করা যায়, গ্রন্থ দু’খানি প্রাক-অশােকপর্বের রচনা। চুল্লবগ্গ‌ে সুত্তবিভঙ্গ ও পঞ্চ নিকায়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এ থেকে বােঝা যায়, সুত্তবিভঙ্গ ও পঞ্চনিকায় আরও পূর্ববর্তী। চুল্লবগ্গ‌ে অভিধম্মপিটকের কোনও উল্লেখ নেই। অশােকের রাজত্বকালেই এই পিটক সংকলিত হয়। কথাবত্‌থু রচনা করেন মােগ্ললিপুত্ত তিস্স‌। কথাবত্‌থুর পূর্বে বিনয়, সুত্ত ও অভিধম্মের অপরাপর গ্রন্থগুলো প্রচলিত ছিল। নিকায়গুলোতে এমন কোনও স্থানের উল্লেখ নেই যা কলিঙ্গ অঞ্চলের পূর্বে বা দক্ষিণে অথবা গােদাবরী নদীর পশ্চিমে বা দক্ষিণে অবস্থিত। নিকায়গুলো অশােকের পূর্বে রচিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, বিনয়পিটকের সিংহভাগ এবং সুত্তপিটকের প্রথম চারটি নিকায় আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে সংকলিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষ পাদে পালি ত্রিপিটক শ্রীলঙ্কায় তার চূড়ান্তরূপ লাভ করল। তখন সেখানে বট্টগামণি রাজত্ব করছেন।

বৌদ্ধধর্ম প্রসারের কারণ

বৌদ্ধধর্ম প্রথম দিকে পূর্ব ভারতেই আবদ্ধ ছিল কিন্তু কালক্রমে এই ধর্ম ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর নানা দেশেও বৌদ্ধধর্মের বিস্তার হয়। যে ধর্ম প্রথম দিকে শুধু আঞ্চলিক ধর্মমাত্র ছিল তা ক্রমে বিশ্বধর্মে রূপান্তরিত হয়। বৌদ্ধধর্মের এই ব্যাপক প্রসারের কয়েকটি কারণ আছে –

  • বুদ্ধদেব মানবিক গুণের বিকাশের উপরই জোর দিয়েছেন, দার্শনিক তত্ত্বের বাতাবরণ সৃষ্টি করে তিনি তার ধর্মমতকে জটিল করে তােলেননি। তার উপদেশ ছিল সহজ ও মর্মস্পর্শী। ফলে বৌদ্ধধর্ম সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 
  • ব্রাহ্মণ্যধর্মের তুলনায় বৌদ্ধধর্ম ছিল অনেক বেশি উদার ও গণতান্ত্রিক। বুদ্ধদেব জাত-পাতের বিচার করেননি, জন্মের উপরও গুরুত্ব দেননি। ফলে সমাজের নিচুতলার লােকদের তিনি সহজেই আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন।
  • ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থাদিতে বৈশ্য ও শূদ্রের উপর নানা প্রকার বিধি-নিষেধ আরােপ করা হয়েছে। এসব গ্রন্থে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হয়েছে, তেজারতি নিন্দিত হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর এ ধরনের বিধি-নিষেধ আরােপ করা হয়নি। ফলে বৈশ্য ও শূদ্র সম্প্রদায়ের নিচুতলার লােকেরা যেমন, তেমনি সম্পন্ন ব্যক্তিরাও বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী হন। অনাথপিণ্ডদের মতাে সে যুগের কয়েকজন ধনী বণিকের সঙ্গে বুদ্ধদেবের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
  • ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজে নিচুতলার লােকদের উদ্বুদ্ধ করার কোনও আন্তরিক চেষ্টা হয়নি, তাদের উপেক্ষাই করা হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধদেবের দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে ছিল অনেক মানবিক, উদার। তিনি পাপ ত্যাগের ডাক দিয়েছেন, কিন্তু পাপীকে ত্যাগ করতে বলেননি। পিতার দরদ দিয়ে তিনি গণিকা আম্রপালীকে আশ্রয় দিয়েছেন, সহৃদয়তার সঙ্গে অঙ্গুলিমালের মতাে নৃশংস দস্যুদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। অসীম মমতা নিয়ে তিনি তথাকথিত অনেক অশুচিকে দীক্ষিত করেছেন। পতিত, অবহেলিতদের তিনি শুনিয়েছেন আশার বাণী, তাদের উৎসাহ দিয়েছেন শুভকর্মপথে এগিয়ে চলতে।
  • যে নারীসমাজকে ব্রাহ্মণ্যধর্ম গৃহকোণে বন্দি করে রেখেছিল, সেই নারী সমাজের সামনে বৌদ্ধধর্ম এক বৃহত্তর জীবনের আদর্শ তুলে ধরে। বৌদ্ধধর্ম নারী জাতিকে সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে, তাদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করে। নারীসমাজে সংগত কারণেই বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
  • ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্র সবই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এ ভাষা সর্বসাধারণের ভাষা নয়, শিক্ষিতজনের ভাষা। তাছাড়া সকলের বেদপাঠের অধিকার ছিল না। ফলে প্রকৃত অর্থে ব্রাহ্মণ্যধর্ম সাধারণের ধর্ম হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বুদ্ধদেব প্রথম থেকেই তার ধর্মকে মাটির কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি সংখ্যালঘুর ভাষা সংস্কৃতের পরিবর্তে মগধের আঞ্চলিক ভাষা মাগধী প্রাকৃতে ধর্মপ্রচার করেছেন। ফলে বৌদ্ধধর্মের আবেদন হয় সর্বজনীন।
  • বৌদ্ধধর্মের প্রসারের একটা প্রধান কারণ হল রাজা-মহারাজ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপােষকতা। মগধের রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্ৰু, কোসলের রাজা প্রসেনজিৎ ও কৌশাম্বীর রাজা উদয়ন ধর্মপ্রচারের জন্য বুদ্ধদেবকে সক্রিয় সাহায্য করেন। তাছাড়া শাক্য, লিচ্ছবি, মল্ল, ভর্গ, কোলিয় প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির লােকেরাও বৌদ্ধধর্মের প্রসারে এগিয়ে আসেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচারে মৌর্যসম্রাট অশােকের অবদান বােধহয় সবচেয়ে বেশি। তার চেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম শুধু ভারতের মধ্যেই প্রসারলাভ করল না, পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তারই ঐকান্তিকতায় বৌদ্ধধর্ম বিশ্বধর্মে রূপান্তরিত হল। কুষাণসম্রাট কণিষ্ক বৌদ্ধধর্মের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তার আগ্রহে বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়া ও চিনে বিস্তার লাভ করে। বৌদ্ধধর্মের প্রসারে থানেশ্বরের রাজা হর্ষবর্ধন, পালরাজ ধর্মপাল ও তার পুত্র দেবপাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

একটা কথা। যাগ-যজ্ঞ উপলক্ষে নির্বিচারে পশুহত্যা, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠা, নারীজাতি ও সমাজের নিচুতলার মানুষদের দুর্গতি এসব ঘটনা তাে পূর্ব ভারতের মতাে উত্তর ও পশ্চিম ভারতেও ছিল। তবু বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য প্রতিবাদী ধর্মগুলো প্রথম দিকে পূর্ব ভারতেই আবদ্ধ থাকে এবং পরে তা অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর পেছনে কারণ আছে –

  • এক, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের তুলনায় বৈদিক সংস্কৃতি পূর্ব ভারতে অনেক পরে প্রসারলাভ করে। ফলে এই অঞ্চলে বৈদিক সংস্কৃতির ভিত দুর্বল থেকে যায়। 
  • দুই, বুদ্ধদেব ও মহাবীর উভয়ই পূর্ব ভারতের অধিবাসী ছিলেন। তারা স্বাভাবিক কারণে পূর্ব ভারতকে কর্মক্ষেত্ররূপে বেছে নেন।
  • তিন, সে সময় উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল পারসিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্ব ভারতে বন্ধুভাবাপন্ন রাজারা রাজত্ব করছিলেন বলে সে অঞ্চলে প্রতিবাদী ধর্মগুলো সহজেই প্রসার লাভ করে।

বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তির কারণ

যে বৌদ্ধধর্ম ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রবল প্রতিপক্ষরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সারা ভারতে প্রসার লাভ করেছিল তা খ্রিস্টীয় ১২শ শতক নাগাদ এ দেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়। অথচ শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, লাওস, তাইল্যান্ড, তিব্বত, জাপান প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম আজও জনপ্রিয়। নিজের জন্মভূমি থেকে বৌদ্ধধর্মের এই নির্বাসন কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়, এর অনেক কারণ আছে –

  • বৌদ্ধধর্ম ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিবাদী ধর্মরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মে যাগ-যজ্ঞের বিধান আছে, জাত-পাতের বিচার আছে, পশুবলির বিধি আছে, ঈশ্বরচিন্তার নির্দেশ আছে। বুদ্ধদেব এসব জিনিসের বিরােধিতা করেছেন। ঈশ্বর আছেন কী নেই, এ প্রশ্ন তিনি নিরর্থক মনে করেছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনেক ভাব ও মত অনুপ্রবেশ করে। শক-কুষাণ যুগ থেকে বৌদ্ধরা ঈশ্বরজ্ঞানে বুদ্ধের মূর্তিপূজা শুরু করেন। ক্রমে তাদের মধ্যে আরও অনেক দেব দেবীর পূজা প্রচলিত হয়।
  • বৌদ্ধসমাজে যে জাতির বিচার একেবারেই ছিল না তা নয়। পক্ষান্তরে যুগের হাওয়ায় ব্রাহ্মণ্যধর্মেও অনেক পরিবর্তন আসে। যাগ-যজ্ঞের আর তেমন গুরুত্ব থাকে না। চাষ-আবাদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে গােসম্পদ সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। বুদ্ধকে আর প্রতিপক্ষ ভাবা হয় না, তাকে ব্রাহ্মণ্যদেবতা বিষ্ণুর এক অবতার বলে মেনে নেওয়া হয়। ফলে সাধারণের চোখে বৌদ্ধধর্ম তার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে, সে ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই এক শাখারূপে পরিচিত হয়। 
  • যে নৈতিকতা ছিল বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র কালক্রমে বৌদ্ধধর্ম তা থেকে দূরে সরে আসে। বুদ্ধদেব ভিক্ষুদের সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের কথা বলেছেন। কিন্তু পরবর্তিকালে শ্রমণেরা আরামপ্রিয় ও বিলাসী হয়ে পড়েন। বৌদ্ধমঠগুলো যতই সমৃদ্ধ হতে থাকে ভিক্ষুরা ততই ভােগৈশ্বর্যের দিকে আকৃষ্ট হন। শুধু তাই নয়, পরবর্তিকালে বুদ্ধের নীতিমূলক ধর্ম রূপান্তরিত হয় মন্ত্রযান, বজ্রযান, সহজযান ইত্যাদি ধর্মে। নৈতিকতার পরিবর্তে দেখা দিল মন্ত্র, তন্ত্র ও গুহ্যসাধনার প্রাধান্য। ফলে সমাজে বৌদ্ধধর্মের আর সে প্রভাব থাকল না। 
  • একদিন বৌদ্ধ শ্রমণদের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগ ছিল, কিন্তু পরে সে যােগসূত্র ছিন্ন হয়। মঠে যতই ধন-সম্পদ আসতে থাকে ততই তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বুদ্ধদেব সাধারণের ভাষা প্রাকৃতে উপদেশ দিতেন। কিন্তু পরবর্তিকালে বৌদ্ধশাস্ত্রাদি প্রাকৃতে নয়, শিক্ষিতজনের ভাষা সংস্কৃতেই রচিত হতে থাকে। সমাজের সাধারণ লােকদের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের বিচ্ছেদ দেখা দেয়।
  • অনেকে বৌদ্ধধর্মের ঐকান্তিক দুঃখবাদকে এর তিরােধানের এক প্রধান কারণরূপে চিহ্নিত করেছেন। বুদ্ধদেব জীবনের দুঃখের দিকটাকেই বড় করে দেখেছেন। তিনি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বার্ধক্য, জরা ও মৃত্যু জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। সবই তাে দুঃখের। কিন্তু মানুষ দুঃখ চায় না, সে চায় সুখ ও আনন্দ। বৌদ্ধধর্মের দুঃখতত্ত্ব মানুষকে তেমন উজ্জীবিত করতে পারল না। ব্রাহ্মণ্যধর্ম মানুষকে জানাল যে জীবন দুঃখের নয়। এক একটি জীবন যেন এক একটি সােপান। একটির পর একটি জীবনের সােপান বেয়ে মানুষ এগিয়ে চলে আত্মােপলব্ধির পথে, সে এগিয়ে চলে পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলনের লক্ষ্যে।
  • সংঘনায়কদের দলাদলি বৌদ্ধধর্মকে দুর্বল করে তােলে। বুদ্ধদেব কোনও উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যাননি। তিনি চেয়েছিলেন শ্রমণেরা আত্মদীপ, আত্মশরণ, ধর্মদীপ ও ধর্মীরণ হবেন; তার অবর্তমানে তার প্রচারিত ধর্ম-বিনয়ই সকলকে পথ দেখাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। এক এক সংঘনেতা এক এক রকম ধর্মব্যাখ্যা করতে থাকেন। ফলে বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্ব ও মতবাদ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়; নানা মত, নানা দল-উপদলের সৃষ্টি হয়। খ্রিস্টধর্মে যেমন পােপ, ইসলামে যেমন খলিফা, বৌদ্ধধর্মে তেমনি একজন মুখ্য পরিচালক থাকলে তিনি এ বিরােধ মেটাতে পারতেন, বৌদ্ধ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারতেন। কিন্তু তা না হওয়ায় সংঘাত বেড়েই চলে, সংঘও দুর্বল হয়।
  • বৌদ্ধধর্ম যে এক সময় ভারতে জনপ্রিয় হয়েছিল তার এক প্রধান কারণ ছিল রাজা মহারাজদের পৃষ্ঠপােষকতা। বাংলা-বিহারের পাল রাজারাও বৌদ্ধধর্মের প্রসার ও উন্নতির জন্য চেষ্টা করেছেন। এদের পর আর কোনও শক্তিমান রাজা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেননি। বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাদের হয়তাে কোনও বিদ্বেষ ছিল না, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিই তাদের পক্ষপাতিত্ব ছিল। 
  • কুমারিলভট্ট ও শঙ্করাচার্যের মতাে বৈদান্তিক ধর্মপ্রচারকদের আবির্ভাব বৌদ্ধধর্মের পক্ষে শুভ হয়নি। তারা বৌদ্ধ মতবাদ খণ্ডন করেন, বেদ-বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেন। তাদের সমকক্ষ কোনও পণ্ডিত বৌদ্ধ সমাজে ছিলেন না বললেই চলে। ফলে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা কমে আসে। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব বাড়ে।
  • তুর্কি আক্রমণ বৌদ্ধধর্মের অবলুপ্তির আর একটি কারণ। তুর্কি আক্রমণের ফলে অনেক বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয়েছে, অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু নিহত হয়েছেন। ১২শ শতকের শেষের দিকে এমনি এক তুর্কি সেনাপতি মহম্মদ বখতিয়ার দুর্গ ভেবে বিহারের ওদন্তপুরী মহাবিহার ধ্বংস করেন। সৈন্য সন্দেহে যাদের তিনি হত্যা করেন তারা ছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু। পূর্ব ভারতে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক বৌদ্ধ শ্রমণ নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেন। তারা সঙ্গে করে প্রচুর বৌদ্ধশাস্ত্র নিয়ে যান। সেসব দেশে এখনও সেই পুঁথিগুলো রক্ষিত আছে। 
  • অনেকে মনে করেন শুঙ্গরাজ পুষ্যমিত্র, হূণরাজ মিহিরকুল ও বঙ্গেশ্বর শশাঙ্কের মতাে পরাক্রান্ত রাজাদের বিদ্বেষ বৌদ্ধধর্মের পতন ডেকে আনে। প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে এদের বৌদ্ধ নির্যাতনের অনেক বিবরণ আছে। এ বিবরণ অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয়। পুষ্যমিত্র যে রাজবংশের লােক সেই শুঙ্গদের আমলেই মধ্যপ্রদেশের ভারহুতে বৌদ্ধস্থূপ নির্মিত হয়েছিল। অশােক যে সাঁচী স্থূপ নির্মাণ করেন তার সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজও এ সময় হয়। শশাঙ্ক যে ঘাের বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন তারও কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। তিনি যদি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসই করবেন তাহলে নালন্দা বৌদ্ধ বিহারটি তার মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল দীপ্যমান থাকে কী করে? মিহিরকুল তার বৌদ্ধ প্রজাদের নির্যাতন করতে পারেন কিন্তু সারা ভারতের বৌদ্ধ সমাজের উপর তার কতটুকুই বা প্রভাব পড়েছিল? 
  • সন্ন্যাসিনীদের মঠে প্রবেশের পর থেকে বৌদ্ধধর্মের পতন ত্বরান্বিত হয়। সন্ন্যাসিনীরা থাকায় মঠের আবহাওয়া কলুষিত হয়ে পড়ে, ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের জীবনে অনাচার ও উচ্চুঙ্খলতা দেখা দেয়। পালি চুল্লবগ্‌গ হতে জানা যায়, বুদ্ধ একবার কথাপ্রসঙ্গে তার প্রিয় শিষ্য আনন্দকে বলেছিলেন, ‘মঠে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে পারলে সদ্ধর্ম হাজার বছর টিকে থাকত। তা না হলে এ ধর্ম বড় জোর পাঁচশাে বছর বেঁচে থাকবে।’ তা সত্ত্বেও বুদ্ধদেব মহিলাদের সংঘে প্রবেশাধিকার দেন। এতে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের পথই প্রশস্ত হয়। (এর জন্য মহিলারা দায়ী নন। পরিচালন ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলায় ঘাটতি দেখা না দিলে এ অবক্ষয় রােধ করা যেত)।

এ সব কারণে বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে ভারত থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়।

জৈনধর্ম

ভূমিকা

বৌদ্ধধর্মের তুলনায় জৈনধর্ম অনেক প্রাচীন। জৈন সাহিত্যে ২৪ জন তীর্থঙ্কর বা ধর্মগুরুর উল্লেখ আছে। এদের প্রথম ২৩-জন বুদ্ধদেবের পূর্ববর্তী। তীর্থঙ্করদের মধ্যে অনেকেই হয়তাে কাল্পনিক চরিত্র, ধর্মের প্রাচীনত্বের দাবিতে তাদের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু ২৩ তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন তা সকলেই স্বীকার করেন। পার্শ্বনাথের পূর্ববর্তী তীর্থঙ্করেরা হলেন (১) আদিনাথ, (২) অজিতনাথ, (৩) সম্ভবনাথ, (৪) অভিনন্দননাথ, (৫) সুমতিনাথ, (৬) পদ্মপ্রভ, (৭) সুপার্শ্বনাথ, (৮) চন্দ্রপ্রভ, (৯) সুবিধিনাথ, (১০) শীতলনাথ, (১১) শ্রেয়াংশনাথ, (১২) বাসুপূজ্য, (১৩) বিমলনাথ, (১৪) অনন্তনাথ, (১৫) ধর্মনাথ, (১৬) শান্তিনাথ, (১৭) কুন্‌থুনাথ, (১৮) অরনাথ, (১৯) মল্লিনাথ, (২০) মুনিসুব্রত, (২১) নমিনাথ ও (২২) নেমিনাথ। পার্শ্বনাথ বুদ্ধদেবের প্রায় ২০০ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। অনেকের অবশ্য ধারণা, পার্শ্বনাথের জন্মের বহু পূর্ব থেকেই জৈনধর্ম প্রচলিত ছিল। প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু অববাহিকার বিভিন্ন স্থানে পাওয়া সিলমােহরে কায়ােৎসর্গ ভঙ্গিমার বেশ কিছু মূর্তি অঙ্কিত আছে। তাদের মতে এগুলো আসলে প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ বা আদিনাথেরই প্রতিকৃতি। এ মত বেশির ভাগ পণ্ডিতই স্বীকার করেন না।

বুদ্ধ থেকে যেমন বৌদ্ধ, জিন থেকে তেমনি জৈন।‘জি’ ধাতু থেকে জিন পদ নিষ্পন্ন। জয়ী, এই অর্থে জিন। রাগ, দ্বেষাদি রিপু যিনি জয় করেছেন, তিনি জিন, জয়ী বা সিদ্ধপুরুষ। জিনদের প্রচারিত ধর্ম এই অর্থে জৈনধর্ম। এই জিনদের কয়েকজন তীর্থঙ্করও অর্থাৎ তীর্থঙ্করেরা সকলেই জিন কিন্তু জিনদের সকলেই তীর্থঙ্কর নন। সংসার-সাগররূপ তীর্থ যিনি তারণ বা পার করেন তিনিই তীর্থঙ্কর। আবার তীর্থ বলতে সাধু, সাধ্বী, শ্রাবক ও শ্রাবকা এই চার শ্রেণির ধার্মিক লােকদের বােঝায়। এদের দীক্ষিত করেছেন যিনি তিনিও তীর্থঙ্কর।

পার্শ্বনাথের জীবনী

তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের জীবন-বৃত্তান্ত ১৫শ শতকের রচনা ভবদেবসূরীর পার্শ্বনাথচরিত গ্রন্থে সবিস্তারে আলােচিত হয়েছে। বারাণসীর এক অভিজাত পরিবারে পার্শ্বনাথের জন্ম হয়েছিল। তার পিতার নাম অশ্বসেন, মায়ের নাম বামা। অযােধ্যার রাজকন্যা প্রভাবতীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। প্রকৃত জ্ঞান লাভের জন্য ৩০ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে তিনি তপশ্চর্যা গ্রহণ করেন। তপশ্চর্যার ৮৪তম দিনে তার সাধনা পূর্ণ হয়, তিনি কেবলজ্ঞান লাভ করেন। সুদীর্ঘ ৭০ বছর ধরে উত্তর ভারতের নানা স্থানে তিনি তার ধর্মমত প্রচার করেন। স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে অনেকেই তার ধর্মমত গ্রহণ করেন। একশাে বছর বয়সে সম্মেতশিখরে (ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলার পরেশনাথ পাহাড়) তিনি দেহত্যাগ করেন। চতুর্যাম বা চারটি বিধানের নির্দেশ দিয়েছেন পার্শ্বনাথ। বিধানগুলো হল অহিংসা, সুনৃত, অস্তেয় ও অপরিগ্রহ। অহিংসার অর্থ প্রাণী হত্যা না করা। সুনৃতের অর্থ সত্য কথা বলা। অস্তেয়ের অর্থ দানগ্রহণের অধিকার ও চুরি না করা। অপরিগ্রহের অর্থ আসক্তির নিবৃত্তি। এই বিধানটিকে অনেকে সম্পত্তি ত্যাগ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যা যথাযথ নয়। সাধু-সাধ্বীদের শ্বেতবস্ত্র পরার সপক্ষে বিধান দিয়েছেন পার্শ্বনাথ।

মহাবীরের জীবনী

জৈনদের বিশ্বাস পার্শ্বনাথের মৃত্যুর ২৫০ বছর পর ২৪তম বা সর্বশেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের জন্ম হয়। আসলে মহাবীরের জন্মতারিখ সম্পর্কে দু’টি মত আছে। একটি মতে তার জন্ম ৫৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, অন্য মতে ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। প্রথম মতটির বিপক্ষে কিছু বলার আছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায়েরা (The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960), পৃ. ৭০০) শেষােক্ত মতটিই গ্রহণ করেছেন।

কল্পসূত্র, ভগবতীসূত্র প্রভৃতি জৈনগ্রন্থে মহাবীরের জীবনী বর্ণিত আছে। বৈশালীর উপকণ্ঠে। কুণ্ডগ্রামে এক অভিজাত জ্ঞাতৃ পরিবারে তার জন্ম হয়। তার পিতা সিদ্ধার্থ, মা এক অভিজাত লিচ্ছবি পরিবারের কন্যা ত্রিশলা। জৈনগ্রন্থাদিতে ব্রাহ্মণ ঋষভের পত্নী দেবনন্দাকেও মহাবীরের মা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি যখন দেবনন্দার গর্ভে তখন ইন্দ্রদেবের নির্দেশে হরিণেগমসি তাকে ত্রিশলার গর্ভে স্থানান্তরিত করেন। কখন থেকে এ কাহিনি প্রচলিত হয়েছিল বলা শক্ত। তবে মথুরার এক প্রাচীন ভাস্কর্যে এই ঘটনার বর্ণনা আছে।

মহাবীরের আসল নাম বর্ধমান। নাত বা জ্ঞাতৃ বংশে জন্ম বলে তার আর এক নাম নাতপত্র বা জ্ঞাতৃপুত্র। গােত্রের নাম থেকে তাকে কাসবও বলা হয়। বৈশালীতে জন্মেছিলেন বলে তিনি বেসালিয় বা বৈশালীয়। বিদেহে তার জন্ম, তাই তিনি বেদেহদিন্ন বা বৈদেহদত্তপুত্র। যথা সময় যশােদার সঙ্গে মহাবীরের বিবাহ হয়। তার একটি কন্যা হয়, নাম অণজ্জা বা প্রিয়দর্শনা। মহাবীর যে বিবাহ করেছিলেন, সে কথা দিগম্বর সম্প্রদায়ের জৈনরা স্বীকার করেন না। তারা মনে করেন, মহাবীর আজন্ম ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। 

গৃহত্যাগ করলে পিতা-মাতা মনে আঘাত পাবেন বলে মহাবীর তাদের জীবদ্দশায় সংসার ধর্মই পালন করেন। কিন্তু তারা মারা গেলে আর সে বাধা থাকল না। তখন অগ্রজ নন্দিবর্ধনের অনুমতি নিয়ে শীতের প্রারম্ভে তিনি গৃহত্যাগ করেন। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর মহাবীর গৃহত্যাগ করেন, এ মত শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের। দিগম্বর সম্প্রদায়ের অভিমত, পিতা-মাতার জীবিতকালেই মহাবীর গৃহত্যাগ করেছিলেন। সে যাই হােক, গৃহত্যাগের সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। এর ১৩ মাস পর আর এক শীতে তিনি তার পরিধেয় বস্ত্রখানিও বিসর্জন দিলেন। এর পর শুরু হয় তার স্থান থেকে স্থানান্তরে দিগম্বর পরিব্রাজকের জীবন। একই সঙ্গে চলে কঠোর তপশ্চর্যা। ১২ বছর কঠোর সাধনার পর ঋজুপালিকা নদীর তীরে ভূম্ভিক গ্রামের কাছে এক শাল গাছের নিচে তিনি কেবলজ্ঞান লাভ করেন। এই জৃম্ভিক গ্রাম পরেশনাথ পাহাড়ের কাছে, না উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। সে যাই হােক, এর পর তার ধর্মপ্রচারকের জীবন শুরু হয়। 

বুদ্ধদেব এক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন কিন্তু মহাবীর তা করেননি। পার্শ্বনাথ প্রমুখ আচার্যরা যে ধর্ম প্রচার করেছেন, সেই ধর্মের প্রসারই ছিল তার লক্ষ্য। তবে মহাবীর প্রচলিত জৈনধর্মের সংস্কার করেছিলেন। তার পূর্বাচার্যরা চতুর্যামের কথা বলেছিলেন। কিন্তু মহাবীর নতুন একটি বিধান সংযােজন করেন। মহাবীরের সংশােধিত ও সংযােজিত বিধানগুলো জৈন সাহিত্যে পাঁচটি মহাব্রত বলে বর্ণিত হয়েছে। পাঁচটির মধ্যে চারটিই পুরােনাে। সেগুলো হল অহিংসা, সুনৃত, অস্তেয় ও অপরিগ্রহ। মহাবীরের নতুন বিধানটি হল ব্রহ্মচর্য। অনেকের ধারণা, জৈনধর্মে ব্ৰহ্মচর্যের বিধান একেবারে নতুন নয়। পার্শ্বনাথেরা যে অপরিগ্রহের বিধান দিয়েছেন, তার মধ্যে ব্রহ্মচর্যের পরােক্ষ উল্লেখ আছে। তারা মনে করেন, পূর্বাচার্যরা ইঙ্গিতে যার আভাস দিয়েছেন মহাবীর তার সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন মাত্র। পার্শ্বনাথেরা জৈন সাধুদের জন্য বহির্বাস অনুমােদন করেছিলেন কিন্তু মহাবীর সাধুদের বস্ত্রত্যাগের পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে তিনি অবশ্য কোনওরূপ কঠোরতা দেখাননি। বহির্বাস গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়টি তিনি সাধুদের নিজস্ব অভিরুচির উপর ছেড়ে দেন। ফলে বহির্বাসকে কেন্দ্র করে জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও বিভেদ বা তিক্ততা সৃষ্টি হয়নি। পরে কিন্তু মুখ্যত এই বিষয়টিকে উপলক্ষ করেই জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্কের ঝড় ওঠে; শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর-এ দুটি সম্প্রদায়ে জৈনরা বিভক্ত হন। শ্বেতাম্বর সাধুরা শ্বেতবস্ত্র পরতেন। মহাবীরের অনুগামী বিবস্ত্র সাধুরা দিগম্বর নামে পরিচিত হলেন। বহির্বাস ছাড়া আরও কয়েকটি বিষয়ে উভয় পক্ষে মতভেদ ছিল। এ বিবাদ ছিল চলমান ও নিশ্চল পদার্থের সংখ্যা, মহিলাদের অর্হৎত্বের যােগ্যতা, অর্হৎদের খাদ্যাখাদ্য, মহাবীর বিবাহিত না চিরকুমার, এমন সব বিষয়কে কেন্দ্র করে –

  • ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে দিগম্বর সম্প্রদায় যথেষ্ট রক্ষণশীল। তুলনায় শ্বেতাম্বর সম্প্রদায় অনেক  উদার।
  • দিন্নম্বর সন্ন্যাসী সর্ব প্রকার আসক্তি থেকে মুক্ত। বস্তু-পরিধানও এক প্রকার আসক্তি। তাই দিগম্বর সন্ন্যাসী বহির্বাস বর্জন করেন। কিন্তু শ্বেতাম্বর সন্ন্যাসীর শ্বেতবস্ত্র পরিধানে কোনও বাধা নেই।
  • দিগম্বর সম্প্রদায়ের অভিমত, নারী জাতির পক্ষে মােক্ষলাভ অসম্ভব; নারীকে মােক্ষলাভ করতে হলে তাকে পুনরায় পুরুষরূপে জন্মগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু শ্বেতাম্বর জৈনরা নারী-পুরুষে এ পার্থক্য স্বীকার করেন না।
  • তেমনি মহাবীর বিবাহিত ছিলেন, এ কথা শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের জৈনরা বিশ্বাস করেন। কিন্তু দিগম্বর জৈনদের অভিমত মহাবীর আজন্ম ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন।

যাই হোক, এসব পরবর্তী কালের ঘটনা। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মহাবীর পূর্ব ভারতের নানাস্থান ভ্রমণ করেন। বছরের ৮ মাস তিনি স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াতেন আর বর্ষার ৪ মাস কোনও এক শহরে অবস্থান করতেন | চম্পা, বৈশালী, রাজগৃহ ও মিথিলায় তিনি বার বার বর্ষাযাপন করেছেন । শ্রাবস্তী ও পাবাপুরীতেও তিনি একবার করে বর্ষাযাপন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গও তিনি ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু সেখানে তিনি সে রকম সাড়া পাননি। শােনা যায়, সেখানকার লােকেরা তার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলেন (জৈনগ্রন্থ আচারাঙ্গসূত্রে এই কাহিনির উল্লেখ আছে। এই প্রসঙ্গে রমেশচন্দ্র মজুমদার রচিত History Of Ancient Bengal (Calcutta, 1971), পৃ. ২৫ দ্রষ্টব্য)। 

সমাজের নানা স্তরের লােক মহাবীরের ধর্মমত গ্রহণ করেন। তার ধর্মপ্রচারক জীবনের প্রথম পর্বের একজন শিষ্য মংখলিপুত্ত গােসাল। দীর্ঘ ৭ বছর তিনি মহাবীরের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু গুরুর সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় গােসাল শেষে আজীবিক নামে এক স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করেন বা আজীবিক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তবে গোসাল মহাবীরের শিষ্য ছিলেন, এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন না। তারা মনে করেন, মহাবীরই প্রথম জীবনে গােসলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাদের অভিমত, গােসলের প্রভাবেই মহাবীর বহির্বাস বর্জনের সংকল্প করেন। মগধরাজ বিম্বিসার মহাবীরের অনুরাগী ছিলেন। বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুও যে মহাবীরের অনুরাগী ছিলেন জৈন সাহিত্যে তার উল্লেখ আছে। গণধর নামে পরিচিত তার ১১ জন প্রধান শিষ্য সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন। মহাবীরের শিষ্যদের মধ্যে ইন্দ্রভূতি সকলের শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তার শিষ্যাদের পুরােভাগে ছিলেন চন্দনা। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে মহাবীর পূর্ব ভারতের নানা স্থানে জৈনধর্ম প্রচার করেন। অবশেষে নালন্দা জেলার পাবা বা বর্তমান পাবাপুরীতে ৭২ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। ঘটনাটি ঘটে আনুমানিক ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কথিত আছে তার মৃত্যুর রাতে মল্ল ও লিচ্ছবিরা তার সম্মানে দীপাবলি অনুষ্ঠান করেন।

জৈনধর্মের মূল তত্ত্ব 

অবসর্পিণী ও উৎসর্পিণী কাল : জৈনরা মনে করেন, বিশ্ব বর্তমানে ক্রমাবনতির মধ্য দিয়ে চলছে। এই ক্রমাবনতির পর্ব শুরু হয়েছে সুদূর অতীতে, ‘সুষম সুষম’ যুগে, ‘অবসর্পিণী’ কল্পের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে। তারপর ‘সুষম’, ‘সুষম দুষম’ ও ‘দুষম সুষম’ যুগ পার হয়ে বিশ্ব বর্তমানে ‘দুষম’ যুগে এসে উপনীত হয়েছে। কিন্তু মানুষের অবস্থা ক্রমশ খারাপই হয়েছে। মহাবীরের দেহাবসানের ৩ দিন পর থেকে এ যুগ আরম্ভ হয়েছে, চলবে ২১ হাজার বছর ধরে। এ যুগে কোনও তীর্থঙ্কর জন্মাবেন না, এক জন্মে কেউ মােক্ষলাভও করবেন না। এর পর অর্থাৎ ‘দুষম দুষম’ যুগে মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হবে। মানুষের আকার ও আয়ু দুই-ই যাবে অনেক কমে। এ যুগেই অবসর্পিণী কল্পের অবসান হবে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উৎসর্পিণী বা আরােহণ কল্প শুরু হবে বলে সৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। ‘দুষম দুষম’ যুগে ‘উৎসর্পিণী’কল্পের আরম্ভ আর ক্রমােন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ‘সুষম সুষম’ যুগে যখন মানুষের চরম উন্নতি ঘটবে, তার সব আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি হবে, তখনই হবে সে কল্পের পরিসমাপ্তি। অবসর্পিণী কল্পের মতাে সে কল্পেও ২৪ জন তীর্থঙ্কর জন্মাবেন, আর জন্মাবেন ১১ জন রাজচক্রবর্তী, যেমনটি এ কল্পেও জন্মেছেন। উৎসর্পিণী কল্পের অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু হবে অবসর্পিণী কল্প। এভাবে অনাদিকাল ধরে চলবে অবসর্পিণী ও উৎসর্পিণী, এই কল্প দু’টির পর্যায়ক্রমে আগমন ও নিষ্ক্রমণ। অবরােহণ ও আরােহণ বা আরােহণ ও অবরােহণ, বিরামহীন এ ধারায় চলবে বিশ্বলীলা। 

জীব বা আত্মার মুক্তি : জীব বা আত্মার মুক্তিই হল জৈন ধর্মের সার কথা। আত্মা তার নিজের প্রকৃতিতে পরিপূর্ণরূপে চৈতন্যময়। সে অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত শক্তি, অনন্ত দর্শন ও অনন্ত আনন্দের আধার। কিন্তু নানা রকম বাধার জন্য আত্মার এ গুণগুলো বিকশিত হয় না। প্রধান বাধা হল কর্ম। কর্মের জন্য আত্মার মধ্যে নানা রকম আকাঙক্ষা জন্মায়। আকাঙক্ষা পরিতৃপ্তির জন্য আত্মা দেহ গঠন করে। এ দেহ জড় দেহ। জড় দেহ অসংখ্য পরমাণুর সমষ্টি মাত্র। পুদ্গল হচ্ছে সেই পরমাণু। পুদ্গল সংগ্রহ করে আত্মা দেহ গড়ে তােলে। আত্মায় পুদ্গলের অনুপ্রবেশকে ‘আস্রব’ বলে। পুদ্গলের সংস্পর্শে এসে আত্মা তার শুচিতা হারায়, নানা ভাবের শিকার হয়। এরা আত্মাকে বন্ধন করে, তাই কষায়। কষায় ৪ প্রকার – ক্রোধ, মান, মায়া ও লােভ। এদের বন্ধনে পড়ে আত্মার আর স্বাভাবিক চেতনা থাকে না, সে তখন সংসারে আবদ্ধ জীবরূপে সীমিত জ্ঞান নিয়ে সংসার যন্ত্রণা ভােগ করে।

মোক্ষলাভের উপায় : মােক্ষ পেতে হলে পুদ্গল থেকে মুক্তি পেতে হবে। দু’টি উপায়ে এটি সম্ভব। এক, আত্মায় নতুন পুদ্গলের অনুপ্রবেশ রােধ করতে হবে। দুই, যে পুদ্গল পূর্বে সঞ্চিত হয়েছে, তাকে নিঃশেষে ক্ষয় করতে হবে। প্রথম ক্রিয়াটির নাম ‘সংবর’। দ্বিতীয়টি ‘নির্জরা’। পুদ্গল থেকে মুক্তি আয়াস-সাপেক্ষ। ত্রিরত্নের সার্থক অনুশীলনে এ সাধনার সিদ্ধি। ত্রিরত্ন বলতে জৈনরা বােঝেন সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান ও সম্যক চারিত্র। সম্যক দর্শনের অর্থ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। এ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস তীর্থঙ্করদের তত্ত্বে ও শিক্ষায় অন্ধ ভক্তি নয়, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের মূলে থাকবে যুক্তি, বিচার ও মনন। তীর্থঙ্কররা মুক্ত পুরুষ, সম্যক জ্ঞানের আধার তারা। তাদের উপদেশাবলি অধ্যয়ন ও অনুশীলনেই সম্যক জ্ঞান অর্জিত হয়। সম্যক জ্ঞানের আলােকে জীবন যাপনের নাম সম্যক চারিত্র। এর জন্য প্রয়ােজন ৫টি মহাব্রতের অনুশীলন। মহাব্রতগুলো হল অহিংসা, সুনৃত বা সত্য, অস্তেয়, অপরিগ্রহ ও ব্রহ্মচর্য। সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান ও সম্যক চারিত্রের অনুশীলনের ফলে কর্মের ক্ষয় হয়। ফলে আত্মা পুদ্গলের সংযােগ থেকে মুক্ত হয়ে নিজের প্রকৃতি ফিরে পায়। আত্মার কৈবল্য প্রাপ্তি হয়। এ অবস্থায় আত্মা অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত দর্শন, অনন্ত শক্তি ও অনন্ত আনন্দের অধিকারী হয়। 

কৈবল্যজ্ঞান তথা মােক্ষলাভ সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্য হতে পারে কিন্তু শ্রাবক-শ্রাবকা বা গৃহীদের নয়। যে আচরণবিধি সন্ন্যাসীরা পালন করবেন তা সাধারণ গৃহীর সাধ্যের বাইরে। তাই গৃহীদের জন্য জৈনধর্মে পৃথক আচরণবিধি। এগুলো অনুব্রত, গুণব্রত ও শিক্ষাব্রত – এই তিন ভাগে বিভক্ত। অনুব্রতগুলো আসলে পঞ্চ মহাব্রতের সহজ ও শিথিল রূপ। উদাহরণস্বরূপ ব্ৰহ্মচর্যের কথা বলা যায়। সন্ন্যাসীরা এটি কঠোরভাবে পালন করবেন। গৃহীদের এটি পালনীয় কিন্তু পতি-পত্নীর ক্ষেত্রে বিধানটি প্রযােজ্য নয়। ভােগলিপ্সা, পাপচিন্তা ও অকারণে অধর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য গৃহীদের প্রতি ৩টি বিশেষ নির্দেশ আছে। এ নির্দেশগুলোকে গুণব্রত বলে। তাছাড়া গৃহীদের প্রতি আরও ৪টি বিশেষ বিধান আছে। গৃহীদের প্রতিদিন উপাসনায় বসতে হবে। তাদের কামনা-বাসনা ক্রমশ কমাতে হবে। মাঝে মাঝে কর্মবিরতি ও উপবাস পালন করতে হবে। খাদ্য ও বস্ত্র দিয়ে সাধুদের সাহায্য করতে হবে। এ বিধানগুলো শিক্ষাব্রত নামে পরিচিত।

স্যাাদ্‌বাদ : পরমতসহিষ্ণুতা জৈনধর্মের এক বড় বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে স্যাাদ্‌বাদ নামে এক তত্ত্বে। এই তত্ত্বে একদিকে যেমন জীবের জ্ঞানের আপেক্ষিকতার কথা বলা হয়েছে, তেমনি অপরদিকে অন্য জ্ঞানের সম্ভাবনাও ব্যক্ত হয়েছে। যদি বলা হয় ‘ঘটঃ অস্তি’ তাহলে এই উক্তিতে ঘটের বিদ্যমানতা স্বীকার করা হয়। কিন্তু এই স্বীকৃতি নিরপেক্ষ নয়। একটি ঘটের বিদ্যমান কোনও এক বিশেষ স্থান ও কালের প্রেক্ষিতেই স্বীকার করা হয়। তেমনি যদি বলা হয় ‘ঘটঃ নাস্তি’ (ঘট অবিদ্যমান) তাহলে ঘটের অবিদ্যমানতা কোনও এক বিশেষ স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে স্বীকার করা হয়। এই অবিদ্যমানতা নিরপেক্ষ নয়। কোনও এক বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই এই অস্বীকৃতি। সর্বকালে সর্বদেশে কোনও একটি ঘটের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব থাকতে পারে না। ঘটের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব সম্পর্কিত এই জ্ঞান আপেক্ষিক। জ্ঞানের এই আপেক্ষিকতা প্রকাশের জন্য জৈনরা ‘ঘটঃ অস্তি’ বা ‘ঘটঃ নাস্তি’ এর পরিবর্তে ‘স্যাদ ঘটঃ অস্তি’ বা ‘স্যাদ ঘটঃ নাস্তি’ এরূপ অবধারণ করেন। অপূর্ণ জীবের জ্ঞান আপেক্ষিক এই সত্য বােঝাতেই ‘স্যাাদ্‌বাদের’ অবতারণা (অপূর্ণ জীবের জ্ঞান আপেক্ষিক, কিন্তু কেবল জ্ঞানের অধিকারী যিনি তার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযােজ্য নয়)। কোনও কোনও বিদ্বজ্জন ‘স্যাদ’ কথাটিকে ‘হতে পারে’, ‘হয়তাে’ অর্থে গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু জৈনধর্ম সংশয়বাদী নয়, অজ্ঞেয়তাবাদীও নয়। ‘হতে পারে’ ও ‘হয়তাে’ কথা দু’টিতে সংশয়ের ভাব আছে। সে কারণে ‘স্যাদ’ কথাটিকে ‘আপেক্ষিকভাবে বা কোনও ভাবে’ অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্যাাদ্‌বাদের সাতটি অবয়ব, তাই এর আর এক নাম সপ্তভঙ্গী-নয়। স্যাাদ্‌বাদে যে সাত প্রকার আপেক্ষিক অবধারণ স্বীকৃত তা নিম্নরূপ : 

  • ১. স্যাাদ্‌ অস্তি : আপেক্ষিকভাবে একটি বস্তু সৎ অর্থাৎ বিদ্যমান;
  • ২. স্যা নাস্তি : অপেক্ষিকভাবে একটি বস্তু অসৎ অর্থাৎ অবিদ্যমান;
  • ৩. স্যাাদ্‌ অস্তি চ নাস্তি চ : আপেক্ষিকভাবে একটি বস্তু সৎ ও অসৎ;
  • ৪. স্যাাদ্‌ অব্যক্ত : আপেক্ষিকভাবে একটি বস্তু অব্যক্ত (স্থান কাল নিরপেক্ষ); 
  • ৫. স্যাাদ্‌ অস্তি চ অব্যক্ত চ : আপেক্ষিকভাবে একটি বস্তু সৎ (দেশ ও কাল সাপেক্ষে) ও অবর্ণনীয় (দেশ ও কাল নিরপেক্ষে); 
  • ৬. স্যাদ নাস্তি চ অব্যক্তম চ : আপেক্ষিকভাবে একটি বস্তু অসৎ ও অবর্ণনীয়; 
  • ৭. স্যাাদ্‌ অস্তি চ নাস্তি চ অব্যক্তম্ চ : আপেক্ষিকভাবে একটি বস্তু সৎ (দেশ ও কাল সাপেক্ষে), অসৎ (দেশ ও কালের ভিন্নতায়) ও অবর্ণনীয় (দেশ ও কাল নিরপেক্ষে) সত্য বহুমুখী ও আপেক্ষিক, এই বাণীই প্রতিফলিত হয়েছে স্যাাদ্‌বাদ তত্ত্বে।

অনেকান্তবাদ : সত্যের বহুমুখিতা ও পরমতসহিষ্ণুতার অভিব্যক্তি ঘটেছে জৈনদের আর একটি তত্ত্বে, অনেকান্তবাদে। অনেকদিক-বিশিষ্ট অর্থে অনেকান্ত। প্রতিটি বস্তুর অসংখ্য ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য। বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনও একটি বা কয়েকটি জানলেই বস্তুটির সম্পূর্ণ জ্ঞান হয় না, হয় আংশিক জ্ঞান কিন্তু আংশিক জ্ঞানও তাে জ্ঞান, সেটিও তাে সত্য। অথচ অজ্ঞানী মানুষ মনে করেন, কোনও বস্তু সম্পর্কে তার জানা বৈশিষ্ট্যই ওই বস্তুটির একমাত্র ধর্ম। এভাবে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বা সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে প্রবল মতবিরােধ গড়ে ওঠে। জৈনধর্ম বলছে কোনও বস্তুর একটি মাত্র দিক নেই, আছে অনন্ত দিক; বস্তুর যে কোনও দিক সম্পর্কে কোনও ব্যক্তির জ্ঞান যত সীমিতই হােক, উপেক্ষণীয় নয়। জ্ঞানের এই আপেক্ষিকতাকে জৈন শাস্ত্রে কতিপয় দৃষ্টিহীন ব্যক্তির হস্তিদর্শনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কয়েকজন অন্ধব্যক্তি একটি হাতির বিভিন্ন অঙ্গ স্পর্শ করে তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমগ্র হাতিটির বৈশিষ্ট্য বর্ণনার চেষ্টা করেন। একজন হাতির কান স্পর্শ করে  বলেন, হাতি কুলাের মতাে; একজন হাতির একটি পা স্পর্শ করে বলেন, হাতি স্তম্ভের মতাে। একজন হাতির শুঁড়ে হাত দিয়ে বলেন, হাতি ময়াল সাপের মতাে, একজন হাতির লেজে হাত দিয়ে বলেন, হাতি দড়ির মতাে, একজন হাতির দেহের একদিকে স্পর্শ করে বলেন, হাতি প্রাচীরের মতাে, অপর এক ব্যক্তি হাতির কপালে হাত দিয়ে বলেন, হাতি বক্ষদেশের মতাে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা আংশিক সত্য, কারাের অভিজ্ঞতাই একমাত্র সত্য নয়, কোনও অভিজ্ঞতাতেই বস্তুর পরিপূর্ণতার প্রতিফলন নেই। তেমনি একটি ধর্ম বা দর্শন একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ ও জীবনের বিচার করে, কোনও বিচারই পূর্ণ নয়। এক একটি ধর্ম বা দর্শন সত্যের বা বস্তুর এক এক দিক প্রকাশ করছে, কোনও মতই ভ্রান্ত নয়, আবার কোনও মতই পূর্ণতাত্মক নয়।

জৈন সংঘ : বুদ্ধদেবের মতাে মহাবীরও সংঘ গঠন করেন। এমনও হতে পারে, পার্শ্বনাথের আমলে সংঘের প্রতিষ্ঠা হয়, মহাবীর তাকে আরও সুগঠিত ও শক্তিশালী করেন। সংঘ পরিচালনার ভার মহাবীর তার প্রধান শিষ্য বা গণধরদের হাতে তুলে দেন। প্রতি গণধরের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট ছিল। বৌদ্ধদের নারী ও পুরুষদের জন্য একই সংঘ ছিল কিন্তু জৈনদের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষদের পৃথক সংগঠন ছিল। বৌদ্ধ সংঘে উপাসক-উপাসিকারা যেন পরবাসী ছিলেন। জৈন সংঘে কিন্তু গৃহী ভক্তদের বিশিষ্ট স্থান ছিল। কয়েকটি বিষয়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে জৈন সাধুদের বেশ মিল ছিল। বৌদ্ধদের মতাে জৈন সন্ন্যাসীরাও বর্ষার চারটি মাস বিশেষ একস্থানে বাস করতেন, অন্যান্য সময় পরিব্রাজকের বৃত্তি গ্রহণ করতেন। উভয় সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের জীবন যাপনে পার্থক্যও বড় কম ছিল না। জৈন শ্রমণ কোনও গৃহস্থের বাড়িতে অবস্থান করেন না, বৌদ্ধদের সে রকম কোনও বাধা নেই। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মাছ-মাংস খেতে পারেন, জৈন শ্রমণদের তা বারণ।

জৈন সাহিত্য : মহাবীর তার ধর্মোপদেশ লিখে রেখে যাননি, গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে তা প্রচলিত থাকে। মহাবীরের উপদেশাবলি সম্ভবত ‘চতুর্দশপূর্ব’ নামে এক গ্রন্থে প্রথম সংকলিত হয়। পরে ভদ্রবাহু কয়েকখানি নিযুক্তি বা টীকা রচনা করেন। ‘কল্পসূত্র’ নামে আর একখানি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। ভদ্রবাহুর শিষ্য স্থূলভদ্র ১১ খানি ‘অঙ্গ’ ও ‘দৃষ্টিবাদ’ নামে আর একখানি গ্রন্থ সংকলন করেন। এর অনেক পর খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে শ্বেতাম্বর শ্রমণেরা গুজরাতের বলভীনগরে সমবেত হয়ে স্থবির দেবর্ধিগণির নির্দেশনায় জৈন শাস্ত্র সংকলন করেন। এই শাস্ত্র জৈন আগম বা জৈন সিদ্ধান্ত নামে পরিচিত। জৈন আগম বা জৈন সিদ্ধান্ত অঙ্গ, উপাঙ্গ, প্রকীর্ণ, ছেদসূত্র, মূলসূত্র ইত্যাদি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। এক এক ভাগে কয়েকটি করে গ্রন্থ আছে। ‘অঙ্গ’ ভাগে রয়েছে। ‘আচারাঙ্গসূত্র’ ও ‘দৃষ্টিবাদ’ সমেত ১১ খানি গ্রন্থ। ১২ খানি গ্রন্থ নিয়ে ‘উপাঙ্গ’। ‘প্রকীর্ণ’ গ্রন্থের সংখ্যা ১০, ‘ছেদসূত্র’৬ খানি। ‘মূলসূত্র’ পর্যায়ের গ্রন্থ ৪ খানি। এছাড়া আরও কয়েকটি গ্রন্থ আছে। যাদের ‘পরিশিষ্ট’ বলে চিহ্নিত করা যায় এরূপ একখানি গ্রন্থ ‘অঙ্গবিদ্যা’। গ্রন্থগুলোর কয়েকখানি এখন আর পাওয়া যায় না। সব কটি গ্রন্থই অর্ধ মাগধী ভাষায় রচিত। এসব গ্রন্থ নিয়েই শ্বেতাম্বর শাস্ত্র। কিন্তু দিগম্বর সম্প্রদায় মনে করেন, এ শাস্ত্র অর্বাচীন, অপ্রামাণিক। তাদের বিশ্বাস, প্রাচীন জৈন শাস্ত্র সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত ও নষ্ট হয়ে গেছে। তারা কয়েকখানি গ্রন্থকে শাস্ত্ৰতুল্য ও প্রামাণিক বলে মনে করেন। এ গ্রন্থগুলো চার ভাগে বিভক্ত প্রথমানুযােগ, করুণানুযােগ, দ্রব্যানুযােগ ও চরণানুযােগ। চারটি ভাগ আছে বলে গ্রন্থগুলোকে সাধারণভাবে ‘চতুর্বেদ’ বলে। মহাবীরের দেহান্তরের পর তার শিষ্য ইন্দ্রভূতি জৈন সংঘের অধ্যক্ষ হন। ১২ বছর ওই পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর রাজগৃহে তার মৃত্যু হয়। এর পর সংঘের নায়ক হন সুধর্মা। সুধর্মার পর তার শিষ্য জম্বু সংঘের অধিনায়ক হন। জৈনরা মনে করেন, ২৪ জন তীর্থঙ্কর ও ১১ জন গণধরের পর একমাত্র জন্ধুই কেবলজ্ঞান লাভ করেছিলেন। তাদের বিশ্বাস, অবসর্পিণী কল্পে অন্য কারাের পক্ষে কেবলজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়।

ভারতের বাইরে জৈনধর্ম প্রসার না হওয়ার কারণ : প্রথমত, ভারতের বাইরে জৈনধর্ম কখনও প্রসার লাভ করেনি। এর কারণ ছিল। ধর্মপ্রচার করেন মুনিরা, উপাসক-উপাসিকারা নন। জৈনশাস্ত্রে মুনিদের গমনাগমনের উপর নানা প্রকার বিধি-নিষেধ আরােপ করা হয়েছে। মুনিদের সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ, তাদের তিন নদী পাড়ি দেয়াও বারণ। এর ফলে জৈন মুনিদের পক্ষে বিদেশ গমন অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া, জৈন সন্ন্যাসীদের জীবন কঠোরতা ও কৃতা সাধনের জীবন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কঠোর অনুশাসনে বাধা, কোনওরূপ শিথিলতার স্থান সেখানে নেই। বিদেশে থেকে সেসব বিধি-নিষেধ সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব ছিল না। ফলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিদেশে গিয়েছেন কিন্তু জৈন মুনিরা কখনও বিদেশের মাটিতে পদার্পণ করেননি। 

জৈনধর্মের জনপ্রিয়তার কারণ : বৌদ্ধধর্ম আজ ভারত থেকে প্রায় অবলুপ্ত কিন্তু জৈনধর্ম এখনও সজীব। এর কারণ আছে। জৈনধর্ম কখনও ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করেনি, উপরন্তু সে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনেক কিছুই আত্মসাৎ করে নিজের পুষ্টিসাধন করেছে। এ ভাবে জৈনরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের কাছ থেকে মন্দির নির্মাণ, মূর্তি পূজা, ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর পূজা, জাতিভেদ ও পৌরােহিত্যপ্রথা গ্রহণ করেছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি সম্প্রীতি ও সদিচ্ছার মনােভাবই জৈনধর্মকে দীর্ঘজীবন লাভে সাহায্য করেছে। তাছাড়া, জৈন মুনিরা উপাসক-উপাসিকাদের সঙ্গে বরাবরই নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। উপাসক-উপাসিকারা সংঘে নিয়মিত যাতায়াত করতেন, সেখানে তাদের শ্রদ্ধা ও মর্যাদার চোখে দেখা হত। ফলে জৈন সন্ন্যাসী তথা সংঘের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যােগ বরাবরই অটুট ছিল। বৌদ্ধধর্ম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল কিন্তু জৈনধর্মের বেলায় তা ঘটেনি। 

আজীবিক ধর্ম

ভূমিকা

বৌদ্ধ ও জৈনদের মতাে আজীবিকরা সে যুগের আর এক প্রতিবাদী সম্প্রদায়। কেন এই সম্প্রদায়ের নাম আজীবিক সে সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকে মনে করেন, অন্যের দানে জীবন ধারণ করতেন বলে তাদের নাম আজীবিক। আবার জীবন ধারণ বা জীবিকা অর্থেও আজীব পদের ব্যবহার দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে মনে হতে পারে, বিশেষ ধরনের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত বলে তাদের আজীবিক বলা হত। 

মংখলিপুত্ত গােসাল ও তার ধর্মমত

আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে, তা নিয়েও পণ্ডিতেরা সহমত নন। কেউ কেউ মনে করেন, মখলি বা মংখলিপুত্ত গােসল বা মস্করিপুত্র। গােসাল আজীবিক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। কারাের কারাের ধারণা, নন্দবৎস এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। গােসাল আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হােন বা না হােন তিনি যে এই সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রথম জীবনে গােসাল মহাবীরের সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন। কিন্তু পরে গুরুর সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি আজীবিক সম্প্রদায় গঠন করেন বা এই সম্প্রদায়ে যােগদান করেন। বুদ্ধদেব এবং মহাবীর উভয়েই কিন্তু নীতিভ্রষ্ট ও বিপথগামী বলে গােসলের নিন্দা করেছেন। এতে মনে হয়, বুদ্ধদেব ও মহাবীরের জীবিতকালে গাঙ্গেয় ভূভাগে গােসাল খবট জনপ্রিয় ছিলেন। শােনা যায়, মহাবীরের মৃত্যুর ১৬ বছর পূর্বে তার দেহাবসান হয়। যদি আনুমানিক ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবীরের মৃত্যু হয়, তাহলে ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গােসাল পরলােক গমন করেন এরূপ ধারণা সংগত বােধ হয়।

গােসাল তথা আজীবিক সন্ন্যাসীরা যে মতবাদ প্রচার করেছেন তাকে এক কথায় নিয়তিবাদ বলা যায়। আজীবিক সন্ন্যাসীরা মনে করেন, মানুষ তার সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্যের জন্য দায়ী নয়। নিয়তি বা অদৃষ্ট, সংগতি বা পরিস্থিতি এবং স্বভাবের বশে জীবের এ অবস্থান্তর। মানুষ দুর্বল ও নির্বীর্য। নিজের শক্তিতে সে তার দুঃখের অবসান ঘটাতে পারে না। নিজের কৃতকর্মের দ্বারা তার দুঃখের ক্ষয়বৃদ্ধি হয় না। শীল, ব্রত, তপস্যা ও ব্রহ্মচর্যের অনুশীলনেও দুঃখের নাশ হয় না। ছােটো-বড়, পণ্ডিত-মূখ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ৮৪ লক্ষ বার জন্মগ্রহণ করতে হবে। একটি একটি করে সব কটি জীবনচক্র অতিক্রম করার পর অবশেষে জীবের দুঃখের অবসান হবে।

ব্রত পালন ও জীবন ধারণে আজীবিক সন্ন্যাসীরা কঠোরপন্থী ছিলেন। নগ্নদেহী এসব সন্ন্যাসীদের ভিক্ষাই ছিল অবলম্বন। তারা পাত্র হাতে ভিক্ষায় বের হতেন না। দু’হাত পেতে তারা ভিক্ষান্ন গ্রহণ। করতেন এবং হাতরূপ পাত্র থেকেই খাবার খেতেন। স্বহস্তে চুল উপড়ে ফেলা এবং উত্তপ্ত ধাতুপিণ্ডকে হাতে ধারণ করার মতাে কয়েকটি কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আজীবিক শ্রমণের দীক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হত। আজীবিক সন্ন্যাসীদের হাতে বাঁশের লাঠি থাকত বলে তাদের একদণ্ডী বলা হত। অনেক সময় তারা উপবাসের মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করতেন। ব্রহ্মচর্য আদর্শের প্রতি তাদের কোনও শ্রদ্ধা ছিল না। বণিকদের মধ্যে অনেকেই আজীবিকধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সে যুগের অনেক মহিলাও এই ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের সাফল্যের কারণ

সমকালীন সমাজে প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জাতি-ধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদী ধর্মগুলোর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের সাফল্যের পিছনে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল। 

  • যাগ-যজ্ঞবহুল বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের উপর জগদ্দল পাথরের মতাে চেপে বসেছিল। কৃষি ও পরিবহনের স্বার্থও এতে বিঘ্নিত হয়। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পশুহত্যা নিন্দা করে ও অহিংসার বাণী প্রচার করে প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের নেতারা সমাজের নির্যাতিত মানুষদের কাছে পরিত্রাতারূপে দেখা দিলেন। সাধারণ মানুষ মুক্তির সন্ধান পেলেন, সহজেই নতুন ধর্মমতে আকৃষ্ট হলেন। 
  • খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বণিকশ্রেণি শক্তিশালী ও আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যসমাজে জন্ম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বণিক সম্প্রদায় আর্থিক সমৃদ্ধি সত্ত্বেও অবহেলিত থাকে। পক্ষান্তরে বুদ্ধ ও মহাবীর জন্মের পরিবর্তে কর্মের উপর প্রাধান্য আরােপ করায় তারা স্বাভাবিক কারণেই বৌদ্ধধর্ম ও জেনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রতিবাদী ধর্মগুলোতে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ও ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের সমর্থন না থাকায় ক্ষত্রিয়রাও এই ধর্মগুলোর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। 
  • ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে নীচুতলার লােকেরা ধিকৃত হয়েছেন, তাদের উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত করার কোনও আন্তরিক চেষ্টা হয়নি। বারবণিতাদের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ধর্মশাস্ত্রকার গৌতম তাদের তীব্রকণ্ঠে নিন্দা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেবের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক মানবিক, উদার। তিনি পাপ বর্জন করতে বলেছেন কিন্তু পাপীকে ত্যাগ করতে বলেননি। পিতার দরদ নিয়ে তিনি বারবণিতা আম্রপালীকে আশ্রয় দিয়েছেন, ব্রাহ্মণসমাজপতিদের মতাে তাকে একঘরে করেননি। তেমনি তিনি আশ্রয় দিয়েছেন অসুলিমালের মতাে নিষ্ঠুর দস্যুকে, অসীম মমতা নিয়ে তথাকথিত অস্পৃশ্য অশুচিদের তিনি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। পতিতদের তিনি শুনিয়েছেন আশার বাণী, তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন শুভকর্মপথে অগ্রসর হতে।
  • ব্রাহ্মণ্যধর্মের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি নারীসমাজকে একেবারে গৃহকোণে বন্দি করে রেখেছিল। পরিবারের বাইরে যে বৃহত্তর সামাজিক জীবন, তার সঙ্গে নারীদের কোনও যােগ ছিল না। তাদের উচ্চশিক্ষার পথও বন্ধ হয়। প্রতিবাদী ধর্মগুলো নারীজাতির সামনে এক বৃহত্তর জীবনের আদর্শ তুলে ধরে, তাদের উপর সামাজিক দায়িত্ব অর্পণ করে, উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করে। রক্ষণশীল ও সংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ্যধর্মের তুলনায় প্রতিবাদী ধর্মগুলো অনেক সামাজিক ও যুগােপযােগী হওয়ায় নারীসমাজ ও সমাজের নিচুতলার লােকদের কাছে এদের জনপ্রিয়তা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়।
  • ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্র সবই সংস্কৃত ভাষায় লেখা। সংস্কৃত সর্বসাধারণের ভাষা নয়, শিক্ষিতজনের ভাষা। তাছাড়া বেদপাঠে সকলের অধিকার ছিল না। ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রকৃত অর্থে কখনােই সাধারণের ধর্ম হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বুদ্ধ, মহাবীর প্রভৃতি ধর্ম প্রচারকরা প্রথম থেকেই তাদের ধর্মকে লােকায়ত ধর্মের রূপ দিতে চেয়েছেন। এই কারণে তারা সংখ্যালঘুদের ভাষা সংস্কৃতের পরিবর্তে মগধের আঞ্চলিক ভাষা মাগধী প্রাকৃতে ধর্মপ্রচার করেছেন। ফলে প্রতিবাদী ধর্মগুলোর আবেদন হয় সর্বজনীন, শাশ্বত। 

পূর্বভারতে উদ্ভব ঘটে ছড়িয়ে পড়ার কারণ

যাগ-যজ্ঞ উপলক্ষে নির্বিচারে পশুহত্যা, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের আত্মসচেতনতা, নারীজাতি ও সমাজের নিচুতলার মানুষদের দুর্গতি, এসব ঘটনা তাে পূর্ব ভারতের মতাে উত্তর ভারতেও ছিল। তবু প্রতিবাদী ধর্মগুলো প্রথম দিকে পূর্ব ভারতেই আবদ্ধ থাকে এবং ধীরে ধীরে তা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। এর দু’তিনটি কারণ নির্দেশ করা যায় –

  • এক, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের তুলনায় বৈদিক সংস্কৃতি পূর্ব ভারতে অনেক পরে প্রসার লাভ করে। ফলে এ অঞ্চলে বৈদিক সংস্কৃতির ভিত দুর্বল থেকে যায়। 
  • দুই, মহাবীর ও বুদ্ধদেব উভয়েই পূর্ব ভারতের অধিবাসী ছিলেন। সে কারণে পূর্ব ভারতকেই তারা তাদের কর্মক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। 
  • তিন, এ সময় উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল পারসিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্ব ভারতে বন্ধুভাবাপন্ন রাজারা রাজত্ব করছিলেন বলে সে অঞ্চলে প্রতিবাদী ধর্মগুলো সহজেই প্রসার লাভ করে।

সংস্কারধর্মী আন্দোলন

ভূমিকা

যখন প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলন জোর কদমে এগিয়ে চলছিল তখন বৈদিক ধর্মের প্রগতিবাদী প্রবক্তারা আর নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারলেন না। বৈদিক ধর্মকে কালােপযােগী ও জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তারা প্রচলিত বৈদিক ধর্মের সংস্কার সাধন করেন তারা। ঘােষণা করলেন, ধর্মে যাগ-যজ্ঞের বিশেষ উপযােগিতা নেই, সভক্তি আরাধনায় ঈশ্বর প্রসন্ন হন, ভক্তের বাসনা পূর্ণ করেন। তারা বৈদিক দেব-দেবীর প্রাধান্য স্বীকার করেছেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেক লৌকিক দেব-দেবীকেও বৈদিক দেব-দেবীর সঙ্গে একাত্ম বলে ঘােষণা করেছেন। এই নতুন ব্রাহ্মণ্যধর্ম তার গােষ্ঠীপরিচয় হারিয়ে সর্বজনীন ধর্মরূপে আত্মপ্রকাশ করল। প্রগতিবাদী বা সংস্কারপন্থীরা তাদের উপাস্য দেবতাভেদে শৈব ও ভাগবত এই দুটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত হলেন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতই ছিল তাদের প্রধান কর্মক্ষেত্র।

ভাগবত বা বৈষ্ণবধর্ম

ভাগবত বা বাসুদেবক সম্প্রদায় কৃষ্ণের উপাসক ছিলেন। বাসুদেব কৃষ্ণ এক ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে থাকতে পারেন। যদু বা যাদব গােষ্ঠীর বৃষ্ণি বা সাত্বত শাখায় তার জন্ম হয়। তার পিতা বসুদেব, মা দেবকী। বাসুদেব কৃষ্ণ ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী নন, বরং সাধারণ মানুষ – এমন ধারণাই জনস্মৃতিতে তা বহুদিন টিকে ছিল। এর বড় প্রমাণ ছান্দোগ্য উপনিষদ এবং মহাভারত। ছান্দোগ্য উপনিষদে তিনি একজন শিক্ষার্থীরূপে বর্ণিত হয়েছেন। তার আচার্য ঋষি ঘাের আঙ্গিরস, মা দেবকী। আচার্যের কাছেতিনি তপস্যা, দান, আর্জব, অহিংসা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। মহাভারতের অনেক স্থানে বাসুদেব কৃষ্ণ একজন মানুষরূপেই বর্ণিত হয়েছেন। সেখানে কখনও তিনি এক কুশলী রাজনীতিজ্ঞ, আবার কখনওবা এক সংঘমুখ্য। অনেকের বিশ্বাস, বাসুদেব কৃষ্ণ খ্রিস্টপূর্ব ৭ম বা ৬ষ্ঠ শতকে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু বাসুদেব কৃষ্ণকে আরও পূর্ববর্তী বলে মনে হয়।

বাসুদেব কৃষ্ণ কালক্রমে জনসমাজে দেবতাজ্ঞানে পূজিত হতে থাকেন। মানুষ বাসুদেব কৃষ্ণ কখন দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হলেন তা বলা শক্ত। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী রচনার পূর্বেই যে বাসুদেবকে ঘিরে একদল উপাসক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল তা নিশ্চিত। অনেকে মনে করেন, পাণিনির সময় বাসুদেবের একক পূজা প্রচলিত ছিল না, বাসুদেবের সঙ্গে অর্জুনের পূজা হত। কিন্তু এর বিপরীত সিদ্ধান্তও সম্ভব। সে ক্ষেত্রে বাসুদেব ও অর্জুনকে ঘিরে দু’টি স্বতন্ত্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। ধীরে ধীরে অর্জুনক সম্প্রদায় তার নিজস্ব সত্তা হারিয়ে বাসুদেবক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। 

বাসুদেবক বা ভাগবত সম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। এর একটি কারণ বাসুদেব কৃষ্ণ ও বৈদিক দেবতা বিষ্ণুর অভেদত্ব কল্পনা। এর ফলে একদিকে যেমন বাসুদেব কৃষ্ণের আভিজাত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হল, অন্যদিকে তেমনি বিষ্ণু-অনুরাগীদের যােগদানের ফলে ভাগবত সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি ঘটল। ঋগবেদে পশুপালক বলে বিষ্ণুর এক পরিচয় দেয়া হয়েছে। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে গােবিন্দ নামকরণের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর পশুপালক রূপটিই প্রতিফলিত হয়েছে। বৈদিক বিষ্ণুর এই পশুপালক চরিত্রই বাসুদেব কৃষ্ণের উপর আরােপিত হয়েছে।

বাসুদেব কৃষ্ণ ও দেবতা নারায়ণের সমীকরণও ভাগবত সম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির আর একটি কারণ। সম্ভবত পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা ছিলেন নারায়ণ। মহাভারতের শান্তিপর্বে নারায়ণকে হরি ও কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যক গ্রন্থে বাসুদেব কৃষ্ণ, বিষ্ণু ও নারায়ণকে এক ও অভিন্ন দেবতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। গ্রন্থখানি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের রচনা। এর থেকে মনে হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে বা তার কিছু পূর্বে বাসুদেব-কৃষ্ণ, বিষ্ণু ও নারায়ণপন্থী তিনটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় মিলেমিশে এক বৃহত্তর সম্প্রদায়রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই বৃহত্তর সম্প্রদায় পরবর্তী কালে বৈষ্ণব নামেই সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিষ্ণু থেকেই সম্প্রদায়ের নাম বৈষ্ণব। এই সম্প্রদায়ের মূল দেবতা হচ্ছেন বিষ্ণু যিনি নারায়ণ ও বাসুদেব কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন। বৈষ্ণব ধর্মের মূল কথা ভক্তি যার মনােজ্ঞ বর্ণনা আছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অনেক পরবর্তী কালের রচনা।

শৈবধর্ম

বাসুদেব-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে যেমন এক উপাসক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি, তেমনি রুদ্র-শিবকে ঘিরে ধীরে ধীরে এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। রুদ্র ঋগবেদের এক গৌণ দেবতা। তিনি ভীতিপ্রদ। ঝড়-ঝক্কা, অশনি, অগ্নি ও ব্যাধির কারক তিনি। আদি বৈদিক সাহিত্যে শিবের উল্লেখ নেই। তার উল্লেখ আছে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ও পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে। কিন্তু প্রাচীন তামিল সাহিত্যে সিবন বা চিবন নামে এক দেবতার কথা বলা হয়েছে। তামিল সিবন বা চিবনের সংস্কৃত প্রতিশব্দ হচ্ছে শিব। অনেকে মনে করেন, তামিল দেবতা সিবন বা চিবনের অনুকরণে বৈদিক আর্যরা শিবের রূপ কল্পনা করেন। অর্থাৎ শিব আদিতে এক তামিল দেবতা ছিলেন কিন্তু পরে তিনি আর্য সমাজে দেবতারূপে গৃহীত হন। সকলেই যে এ মত স্বীকার করেন তা নয়। কেউ কেউ মনে করেন শিব মূলত এক বৈদিক দেবতা কিন্তু পরে তার উপর এক বা একাধিক তামিল ও আঞ্চলিক দেবতার চরিত্র আরােপিত হয়। 

সে যাই হােক, প্রথম দিকে রুদ্র ও শিব দু’জন স্বতন্ত্র দেবতা ছিলেন। যজুর্বেদের শতরুদ্ৰীয় অধ্যায়ে রুদ্রের শত নামের উল্লেখ আছে কিন্তু সেখানে শিবের কথা নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে রুদ্র ও শিবের স্বাতন্ত্র লােপ পায়। দুই দেবতা এক অভিন্ন দেবতারূপে স্বীকৃত হন। শিব ও রুদ্রের একাত্ম হওয়ার ঘটনা ঠিক কখন ঘটল তা বলা যায় না। তবে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, কৌষীতকি ব্রাহ্মণ প্রভৃতি গ্রন্থে শিব ও রুদ্রের অভেদত্ব বর্ণিত হয়েছে। এসব গ্রন্থাদিতে রুদ্র ও শিবকে মহাদেব, মহেশ্বররূপে কীর্তিত করা হয়েছে। তবে রুদ্র ও শিবের এই সমীকরণ খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকেও সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছিল বলে মনে হয় না। পাণিনি তার অষ্টাধ্যায়ীতে রুদ্রের প্রতিশব্দরূপে ভব, শর্ব ও মৃড় পদের ব্যবহার করেছেন। তিনি শিবেরও উল্লেখ করেছেন কিন্তু রুদ্র অর্থে নয়। ‘শিবাদিভ্যোহণ্‌’ বলে তার একটি সূত্র আছে। এই সূত্র অনুসারে শিব পদের সঙ্গে অপত্যার্থে অ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘শৈব’ পদ নিষ্পন্ন হয়। শিবের পুত্র এ অর্থে যেমন শৈব, তেমনি শিবের ভক্ত বা অনুরাগী, এ অর্থেও শৈব। অর্থাৎ অষ্টাধ্যায়ী রচনার পূর্বেই যে এই সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল পাণিনির সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। রুদ্র ও শিবের একাত্মতা তখনও কিন্তু সমাজে সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেনি। পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে রুদ্র-শিবের পূজার উল্লেখ আছে শতপথ ব্রাহ্মণে। বাজসনেয় সংহিতায় ইঙ্গিত আছে, আফগানিস্তান ও পামির অঞ্চলেও রুদ্র-শিবের পূজা প্রচলিত ছিল। এ সময় শিবলিঙ্গ পূজার প্রচলন ছিল কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে।

গৌণ দেব-দেবী

অন্যান্য দেব-দেবীর মধ্যে ইন্দ্র, ব্রহ্মা, অগ্নি, সূর্য ও অম্বিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বাজসনেয়ি সংহিতায় অম্বিকাকে রুদ্রের বােন বলা হয়েছে। পরবর্তিকালে কিন্তু শিবের পত্নীরূপেই অম্বিকা পরিচিত হন। তৈত্তিরীয় আরণ্যক ও কেন উপনিষদে উমা ও পার্বতীর উল্লেখ আছে। তারা তখনও দুই স্বতন্ত্র দেবী।

আস্তিক দর্শনসমূহ

এ প্রসঙ্গে ছয়টি আস্তিক দর্শন সম্পর্কে কিছু আলােচনা করা যায়। এই ছয়টি দর্শনই বেদের প্রাধান্য স্বীকার করে। কিন্তু তারা যে সকলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে তা নয়। এই ষড়দর্শনের মধ্যে আছে সাংখ্য ও যােগ, ন্যায় ও বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা।

সাংখ্য-দর্শন : সাংখ্যমতে যত জীব, তত আত্মা বা পুরুষ। এই আত্মা বা পুরুষ দেহাতিরিক্ত এক চৈতন্যসত্তা। সে নিষ্ক্রিয়, নির্বিকার, নির্গুণ, তার কোনও পরিণাম নেই। তার সুখ, দুঃখ, মােহ যেমন নেই, তেমনি আনন্দও নেই। এই পুরুষ যখন জগতের উপাদান কারণ বা জড় প্রকৃতির সংযােগে আসে, তখন সে প্রকৃতির সুখ, দুঃখাদি গুণকে নিজের গুণ বলে মনে করে। বিষয়টি অনেকটা রক্তজবার স্ফটিকে প্রতিবিম্বিত হওয়ার মতাে। স্ফটিক স্বচ্ছ কিন্তু রক্তজবার সান্নিধ্যে তাকে লাল বলেই মনে হয়। অর্থাৎ লাল ফুলের রঙ স্ফটিকে আরােপিত হয়। সেরূপ পুরুষ নিজে গুণাতীত হলেও প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসায় প্রকৃতির গুণে আবদ্ধ হয়। সে নিজের স্বরূপ বিস্মৃত হয়। প্রকৃতির দুঃখকে নিজের দুঃখ মনে করে জর্জরিত হয়। দুঃখ তিন ধরনের – আধিভৌতিক, আধ্যাত্মিক ও আধিদৈবিক। যে দুঃখ বাইরের জগৎ হতে ঘটে, তা আধিভৌতিক। যে দুঃখ দেহ বা মনের মধ্যে ঘটে তা আধ্যাত্মিক। অপ্রাকৃত বস্তু থেকে যে দুঃখ তা আধিদৈবিক।

বিবেকজ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান লাভ করলে জীব পুরুষ ও প্রকৃতির স্বরূপ বুঝতে পারে। তখন পুরুষ ও প্রকৃতির সংস্রব বিচ্ছিন্ন হয়, পুরুষ স্ব-স্বরূপে ফিরে যায়। এর ফলে জীবের জাগতিক দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ হয়, জীব মুক্তি বা অপবর্গ লাভ করে। এই অবস্থায় জীবের সঞ্চিত কর্মফল বিনষ্ট হয়, কিন্তু প্রারব্ধ কর্মফল বাকি থাকে। এই ফলটুকু ভােগ না করা পর্যন্ত জীবকে দেহ ধারণ করতে হয়। কিন্তু দেহের বিনষ্টির পর আর সে জন্মবন্ধনে আবদ্ধ হয় না। এই অবস্থাই বিদেহ মুক্তি। তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার পর দেহবিনাশের পূর্ব পর্যন্ত অবস্থা জীবন্মুক্তি। তত্ত্বজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান লাভের দ্বারাই মােক্ষলাভ সম্ভব, ঈশ্বর কল্পনা অবান্তর। তত্ত্বজ্ঞান আসে তত্ত্বাভ্যাসের মাধ্যমে, ত্যাগ বা অন্য কোনও উপায়ে নয়। তত্ত্বাভ্যাসাৎ নেতি নেতীতি ত্যাগাৎ বিবেকসিদ্ধিঃ।

যােগ-দর্শন : যােগ বা পাতঞ্জল দর্শন সাংখ্য-দর্শনের প্রকৃতি ও পুরুষতত্ত্ব স্বীকার করে, পুরুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে তার স্বাভাবিক শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত সত্তায় ফিরিয়ে আনাকেই জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে করে। যােগমতে শুধু তত্ত্বাভ্যাসের দ্বারা এই লক্ষ্যে পৌঁছানাে যায় না, এর জন্য যােগসাধনার প্রয়ােজন। যােগসাধনার আটটি সােপান – (১) যম, (২) নিয়ম, (৩) আসন, (8) প্রাণায়াম, (৫) প্রত্যাহার, (৬) ধারণা, (৭) ধ্যান ও (৮) সমাধি। যমের অর্থ সংযত আচরণ। নিয়মের অর্থ নিয়মানুবর্তিতা। এ দু’টি পর্যায়কে প্রস্তুতিপর্ব বলে। এর পর শুরু হয় চিত্তবৃত্তিনিরােধের বিভিন্ন প্রক্রিয়া। প্রথম প্রক্রিয়া বা পদক্ষেপ হল আসন। তেমন ভাবে বসতে হবে যাতে মনে স্থিরতা আসে। তারপর প্রাণায়াম। এতে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রিত হয়। বিশেষ বিষয়ের উপর মন নিবিষ্ট হয়। পরের পদক্ষেপ প্রত্যাহার। এই প্রক্রিয়া মনকে বহির্বিশ্ব হতে সরিয়ে এনে নিজের মধ্যে আবদ্ধ রাখে। তারপরের পদক্ষেপ ধারণা। একটি বিশেষ ভাবকে মনে চিন্তা করে তার উপর মনের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাই হল ধারণা। ধারণার গভীরে তন্ময় হয়ে ডুবে যাওয়াই হল ধ্যান। ধ্যানের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়াই হল সমাধি। সমাধির প্রাথমিক অবস্থায় মন বহির্বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন হলেও জ্ঞানশক্তি কাজ করে। একে সবিকল্প বা সংপ্রজ্ঞাত সমাধি বলে। সমাধির গভীর স্তরের নাম অসংপ্রজ্ঞাত বা নির্বিকল্প বা নিবজি সমাধি। এই অবস্থায় চিত্তবৃত্তির নিরােধ হয়, পুরুষ প্রকৃতি হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়, পুরুষ তার প্রকৃত রূপের মধ্যে ফিরে যায়। যােগ-দর্শন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। যােগমতে যােগসাধনায় যেমন জীবের সিদ্ধিলাভ হয় তেমনি ঈশ্বরের অনুগ্রহেও মােক্ষলাভ সম্ভব। কিন্তু এই ঈশ্বর ভক্তিবাদের ঈশ্বরের মতাে পরিপূর্ণ মহিমময় নন, তিনি এক অনন্যসাধারণ পুরুষ, যিনি অন্য সাধারণ পুরুষের মতাে ক্লেশদ্বারা পীড়িত নন, কর্মফল যাকে তাড়না করে না, আশয় বা পরজন্মের সংস্কার যাকে আবদ্ধ করে না।

ন্যায়-দর্শন : ন্যায়-দর্শনের আর এক নাম অক্ষপাদ-দর্শন। এই দর্শন মােক্ষকেই পুরুষার্থ বলে স্বীকার করে। আত্মার বন্ধনমুক্তিতেই মােক্ষ লাভ হয়। যতক্ষণ আত্মা শরীর, ইন্দ্রিয় ও মন বা বিজ্ঞানের সংযােগে থাকে ততক্ষণই আত্মার বদ্ধাবস্থা। এই সংযােগে আত্মাতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, সখ-দুঃখ অনুভূত হয়। অথচ জ্ঞান আত্মার স্বাভাবিক গুণ নয়, সুখ-দুঃখও আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম নয়। আত্মার সঙ্গে দেহ ও ইন্দ্রিয়াদির সম্বন্ধ ছিন্ন হলেই আত্মা জ্ঞানহীন শুদ্ধ সত্তারূপে বিরাজ করে। তখনই হয় আত্মার মুক্তাবস্থা। এই অবস্থায় সুখ-দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়, জীব মােক্ষ বা অপবর্গ লাভ করে। মােক্ষ লাভ হয় শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে। শাস্ত্রবাক্য শােনা হল শ্রবণ। মনন হল শাস্ত্ৰবাক্যের যথার্থ অর্থগ্রহণ এবং সেই অর্থ নিয়ে চিন্তা করা। একান্তচিত্তে তারই ধ্যান হল নিদিধ্যাসন। এই ত্রিবিধ স্তরের সমন্বয়ে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়াদির অতীত এক শুদ্ধ আত্মার উপলব্ধি হয়। এর ফলে মিথ্যাজ্ঞান ও তজ্জনিত দোষ ও প্রবৃত্তির বিলুপ্তি ঘটে। প্রবৃত্তির বিনাশে নতুন কর্মফল আর উৎপন্ন হয় না, পূর্ব কর্মফলও ভােগের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। কর্মফলের সমাপ্তিতে পুনর্জন্ম রােধ হয়, দুঃখেরও নিবৃত্তি হয়। ন্যায়-দর্শন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। ন্যায়মতে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন কিন্তু তিনি জগতের আদি উপাদান পরমাণু সৃষ্টি করেন না। ঘট মাটি দিয়ে তৈরি হয়। মাটি ঘটের উপাদান কারণ। কুম্ভকার ঘট তৈরি করেন। কুম্ভকার ঘটের নিমিত্ত কারণ। কুম্ভকার মৃত্তিকা দিয়ে ঘট নির্মাণ করেন কিন্তু তিনি মৃত্তিকা তৈরি করেন না। ঈশ্বরও তেমনি স্থিত উপাদানের দ্বারাই জগৎ সৃষ্টি করেন। ঘট নির্মাণের পর কুম্ভকারের দায়িত্ব শেষ হয় কিন্তু জগৎ সৃষ্টির পর ঈশ্বরের দায়িত্ব শেষ হয় না। তিনি জগৎ সৃষ্টির পর তার সৃষ্টিকে রক্ষা করেন, প্রয়ােজন হলে তাকে ধ্বংস করেন। জীবের কর্মফল সে নিজেই ভােগ করে। এই নিয়ম রক্ষা করাই হল ঈশ্বরের কাজ। জগতের প্রতিটি জীব যাতে নিজ নিজ কর্মফল ভােগ করে এবং এই কর্মফল যাতে বিনষ্ট বা হস্তান্তর না হয় সেদিকে ঈশ্বরের সতর্ক দৃষ্টি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রতিটি কার্যেরই একটি কারণ আছে। জগৎ একটি কার্য পদার্থ। জগতেরও একটি কারণ আছে। সেই কারণই ঈশ্বর। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।

বৈশেষিক-দর্শন : বৈশেষিক-দর্শনকে ঔক্য-দর্শন বা কণাদ-দর্শনও বলে। এই দর্শন আত্মাকে নিত্য, বিভু ও বহু বলে স্বীকার করে। আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়াদির সংযােগে জ্ঞান, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ, প্রভৃতি গুণ আয়াতে আশ্রয় লাভ করে। যা আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযােগ ঘটায় তা হল মন। সেই মন অণুপরিমাণ, নিত্য। আত্মার নিজের কোনও ইচ্ছা, দ্বেষ বা দুঃখ নেই, কিন্তু মনের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযােগ ঘটলে ইচ্ছা, দ্বেষ ইত্যাদি গুণ আত্মাতে অনুভূত হয়। পদার্থের সাক্ষাৎ জ্ঞানে আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়াদির সংযােগ ছিন্ন হয়, আত্মা তার স্বরূপে অবস্থান করে, আত্মার বন্ধনদশার অবসান হয়। ন্যায়-দর্শনের মতাে বৈশেষিক-দর্শনও মােক্ষ বা অপবর্গকে জীবের পুরুষার্থ বলে গণ্য করে। বৈশেষিক-দর্শনে ঈশ্বরকে সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান সত্তারূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, জীবের কর্মফল ভােগের কথা বলা হয়েছে। তবে ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের মধ্যে কিছু পার্থক্যও আছে। এই পার্থক্য পদার্থ ও প্রমাণের সংখ্যা নিয়ে। ন্যায়মতে পদার্থ ষােলােটি কিন্তু বৈশেষিকমতে পদার্থ সাতটি। ন্যায়-দর্শনে প্রমাণ চারটি কিন্তু বৈশেষিক-দর্শনে প্রমাণ দু’টি – প্রত্যক্ষ ও অনুমান। তবে এ পার্থক্য আপাত, প্রকৃত নয়। ন্যায় ও বৈশেষিকের মধ্যে পদার্থের সংখ্যা নিয়ে যে পার্থক্য তার মূলে রয়েছে দর্শন দু’টিতে পদার্থ কথাটির ভিন্ন পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার। তেমনি ন্যায়ে উপমান ও শব্দ প্রমাণ নামে যে দু’টি অতিরিক্ত প্রমাণের কথা বলা হয়েছে তা বৈশেষিকমতে অনুমান প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত।  

পূর্ব মীমাংসা : পূর্ব মীমাংসাকে মীমাংসা দর্শনও বলে। জৈমিনির মীমাংসাসূত্র এই দলের মূল গ্রন্থ। এর ভিত্তি বেদের কর্মকাণ্ড। মীমাংসামতে আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় হতে ভিন্ন। এই আত্মা নিত্য ও সর্বগত। কিন্তু কর্মফল ভােগের জন্য আত্মা দেহ ধারণ করে, দুঃখময় সংসারজীবন যাপন করে। মীমাংসা বলে স্বর্গলাভ বা স্বর্গবাসই হল জীবের পুরুষার্থ। মীমাংসকেরা স্বর্গ বলতে সংসার-দুঃখের অতীত এক অলৌকিক অবস্থা বােঝেন। এই স্বর্গের জন্য জ্ঞানের প্রয়ােজন নেই, ঈশ্বর উপাসনারও দরকার নেই। দরকার বেদবিহিত যজ্ঞকর্মের অনুষ্ঠান। যজ্ঞ-অনুষ্ঠানের ফলে আত্মায় এক শক্তি সঞ্চারিত হয়। এই শক্তির নাম ‘অপূর্ব’। বীজের মধ্যে অঙ্কুরােদগমের এক অদৃশ্য শক্তি থাকে। অপূর্ব অনেকটা সেই অদশা শক্তির মতাে। এই শক্তিতে জীবের মৃত্যুর পর আত্মার স্বর্গবাস হয়। বেদবিহিত কর্মে যেমন পণ্য, নিষিদ্ধকর্মে তেমনি পাপ। পাপের ফলে আত্মাকে নরকবাস করতে হয়। মীমাংসাসূত্রকার জৈমিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। যজমান যজ্ঞানুষ্ঠানের দ্বারা যে স্বর্গলাভ করেন তার পেছনে তার অর্জিত ‘অপূর্ব’ কাজ করে, সেখানে ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা। নেই। সৃষ্টিকার্যেও ঈশ্বরের কোনও হাত নেই। অনেকে বলেন, জৈমিনি ঈশ্বর মানেন না, সে কথা ঠিক নয়। তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে নীরব থেকে গেছেন। কর্মকে প্রাধান্য দেয়ার উদ্দেশ্যেই তার ঈশ্বর সম্পর্কে এই নীরবতা।

উত্তর মীমাংসা : উত্তর মীমাংসার আর এক নাম বেদান্তদর্শন। বেদান্ত বা উপনিষদের উপর নির্ভর বলেই এই শেষােক্ত নামকরণ। বেদান্তমতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যিনি নিমিত্ত ও উপাদান কারণ তিনিব্রহ্ম বা পরমাত্মা। তিনি সর্বভুতে বর্তমান। তাকে বাদ দিলে জগতের আর কিছুই থাকে না। তিনি সব কিছু ব্যাপ্ত করে আছেন, সব কিছু ধারণ করে আছেন, সব কিছুর অন্তরে বিরাজ করছেন। নিজের আনন্দের জন্যই তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন। স্থূল ইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে জানা যায় না, কোনও জাগতিক বস্তুর সাথেই তার তুলনা হয় না। তিনি সকলের দ্রষ্টা কিন্তু নিজে অদৃষ্ট থাকেন। তিনি শ্রোতা কিন্তু স্বয়ং অশ্রুত। তিনি অজর, অমর, স্থাণু, নির্বিকার, নিমিত্তাতীত, সর্বাতীত। এই অদ্বিতীয়, নির্বিশেষ,ব্রহ্মকে জানাই ব্রহ্মবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞান। জীব নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, কর্তৃত্ব – ভােক্তৃত্বশূন্য সদামুক্ত এক সত্তা। কিন্তু অবিদ্যার ফলে সে নিজের স্বরূপ ভুলে যায়। তখন সে ‘এই আমি’ ‘এটি আমার’, ইত্যাদি অনুভবের দ্বারা বন্ধনে জর্জরিত হয়ে অশেষ দুঃখ ভােগ করে। ব্রহ্মলাভ হলেই জীবের দুঃখ থেকে নিবৃত্তি হয়। ব্রহ্মলাভই হল পুরুষার্থ। কিন্তু এই ব্রহ্মলাভ সাধনাসাপেক্ষ। এর জন্য প্রয়ােজন শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন। অনরলস সাধনায় ব্রহ্মকেই নিখিল জগতে একমাত্র নিত্য ও অবিনশ্বর বলে মনে হয়; অন্য সব কিছু অনিত্য ও বর্জনীয় বলে প্রতিভাত হয়; ঐহিক ও পারলৌকিক সুখভােগের প্রতি বৈরাগ্য জন্মে; শীতােষ্ণ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান যে কোনও অবস্থায় চিত্ত ভাবান্তররহিত হয়। জীব ও ব্রহ্মের অভেদত্বের জ্ঞানের আলােকে অন্তলোক উদ্ভাসিত হয়। আত্মজ্ঞানলাভের ফলে অবিদ্যাজনিত প্রপঞ্চজ্ঞানের নিবৃত্তি হয়, দুঃখের বিনাশ হয়, ব্রহ্মত্বের প্রাপ্তি হয়। 

লােকায়ত বা চার্বাক-দর্শন : ষড়দর্শনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির একটি দর্শনও গড়ে ওঠে। এই দর্শন লােকায়ত বা চার্বাক-দর্শন। এই দর্শন ও সম্প্রদায় বার্হস্পত্য নামেও পরিচিত। বৃহস্পতি হতে বাৰ্হস্পত্য। সম্ভবত বৃহস্পতি এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। যা প্রত্যক্ষ হয় না, তার অস্তিত্ব এই দর্শন স্বীকার করে না। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় না। পরজন্মের কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তাই পরজন্মও স্বীকৃত নয়। কর্মফলও স্বীকৃত হয় না। আত্মা বা চৈতন্য দেহাতীত কোনও বস্তু নয়, তা দেহেরই গুণ। গুড়, চাল ইত্যাদি থেকে যেমন মাদকতা গুণ উৎপন্ন হয়, দেহ হতে তেমনি চৈতন্যের উদয় হয়। দেহ চারটি মৌলিক জড় পদার্থের সংযােগে গঠিত। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ হল সেই চারটি মৌলিক পদার্থ। দেহের বিনাশের সঙ্গে আত্মা বা চৈতন্য বিনষ্ট হয়। তার আর পুনর্জন্মের কোনও সম্ভাবনা থাকে না। আত্মা বলে যখন পৃথক কোনও সত্তা নেই, ঈশ্বর ও পরজন্মের যখন কোনও অস্তিত্ব নেই, তখন পাপ-পুণ্যের কোনও তাৎপর্য থাকে না। অতএব যথাসম্ভব ইন্দ্রিয় সুখ ভােগ করে নেওয়াই হল মানুষের পুরুষার্থ। পরলােকে কল্পিত সুখের আশায় ইহ জীবনের সুখ ত্যাগ করা মূর্খতা। যত দিন মানুষ বাঁচবে, তত দিন সে সুখ ভােগ করবে, প্রয়ােজনে ঋণ করেও ঘি খাবে – “যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।/ ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।” 

গ্রন্থপঞ্জি

  • অনুকূলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় : বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম (কলকাতা, ১৯৬৬)
  • অমূল্যচন্দ্র সেন : জৈনধর্ম (কলকাতা, ১৩৫৮)
  • কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায় : ভারতসংস্কৃতিতে ভগবান কৃষ্ণ (কলকাতা, ১৯৮৯)
  • দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে (কলকাতা, ১৩৯৪)
  • মহেন্দ্রলাল সরকার : যােগ পরিচয় (কলকাতা, ১৩৫৬)
  • বিমলাকান্ত মুখােপাধ্যায় : বেদান্তদর্শন (কলকাতা, ১৯৯০)
  • সত্যজ্যোতি চক্রবর্তী : সায়ন-মাধবীয় সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম ও ২য় খণ্ড (১৩৮৩-৮৬)
  • Barua, B. M. : Aji vikas (Calcutta, 1920)
  • Basham. A. L. : History and Doctrines of the Ajivikas (Delhi, 1981)
  • Bhandarkar, R. G. : Vaishnavism, Saivism and Minor Religious Systems (Poona, 1928)
  • Chatterjee, A. K.: A Comprehensive History of Jainism (Calcutta, 1978)
  • Chatterjee, S. & Datta, D. M.: An Introduction To Indian Philosophy (Calcutta, 1968)
  • Das Gupta. S. N.: A History of Indian Philosophy, Vols. I-V (Delhi, 1975)
  • Dutt, N.: Early Monastic Buddhism (Calcutta, 1971)
  • Eliot Charles: Hinduism and Buddhism (London, 1921)
  • Gopalan. S.: Outlines of Jainism (New Delhi, 1973)
  • Goyal. S.R.: A History of Indian Buddhism (Meerut, 1987)
  • Keith, A. B.: Religion and Philosophy of the Veda and Upanishads (Cambridge, 1925)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960)
  • Niyogi. M. B.: The Vedic Background of Buddha-Dharma (Sagar, 1968)
  • Pande, G. C.: Studies in the Origins of Buddhism (Delhi, 1983)
  • Rapson, E. J. (Ed.): The Cambridge History of India, Vol. I (Delhi, 1955)
  • Rhys Davids, T. W. Early Buddhism (Delhi, 1976)
  • Sinha. K. P.: The Philosophy of Jainism (Calcutta. 1990)
  • Stevenson, S.: The Heart of Jainism (Oxford, 1915)
  • Verma, V. P. : Early Buddhism and its Origins (New Delhi, 1993)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.