(সম্প্রসারিত হতে পারে)
Table of Contents
ভূমিকা
যুক্তিগুলোর দুর্বলতা : ঈশ্বর ধর্মের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। কাজেই ঈশ্বর অস্তিত্বশীল কিনা স্বাভাবিক ভাবে এই প্রশ্ন সকলের মনে জাগে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য বহু পূর্বেই দার্শনিকবৃন্দ কতকগুলো যুক্তি উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত এইসব গতানুগতিক যুক্তিগুলোর বর্তমান যুগে আর তেমন গুরুত্ব আছে বলে অনেকে মনে করেন না। ঈশ্বরের অমূর্ত ধারণা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা বা জগতের অমূর্ত ধারণা থেকে অনুমানের মাধ্যমে জগৎ থেকে স্বতন্ত্র কোন ঈশ্বরের ধারণায় উপনীত হওয়া অনেকেই এখন অসম্ভব বলে মনে করেন। এমন কথা বলা যায় না যে, যাদের মনে ধর্মবিশ্বাস অনুপস্থিত, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বিষয়ক যুক্তিগুলো তাদের মনে ধর্মবিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। একথা হয়ত বলা যেতে পারে যে, এই যুক্তিগুলো ধর্মবিশ্বাস সৃষ্টি করার তুলনায়, যে ধর্মবিশ্বাস মানবমনে পূর্ব থেকে উপস্থিত, তাকে সুদৃঢ় করার পক্ষে কার্যকর হতে পারে। কোন ধর্মসম্বন্ধীয় পূর্ব অনুমিত বিষয় থেকে প্রমাণগুলো উদ্ভুত হয় নি। যে পূর্ব অনুমিত বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রমাণগুলোর উদ্ভব সেগুলো সাধারণ ও অমূর্ত (general and abstract), এবং যুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে যে স্থায়ী অসুবিধা দেখা দিয়েছে তাহল, যে মূর্ত সত্তার (concrete reality) অস্তিত্ব প্রমাণ করা যুক্তিগুলোর লক্ষ্য, সেই যুক্তিগুলোর সিদ্ধান্তের মধ্যে আশ্রয়বাক্যের তুলনায় অধিক কিছু নিহিত। অর্থাৎ কিনা, যুক্তিগুলো যে আশ্রয়বাক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে তা আশ্রয়বাক্যগুলোর তুলনায় ব্যাপকতর, যা অবরােহ অনুমানের নিয়মবিরােধী। এই প্রসঙ্গে গ্যালােয়ে বলেন, “ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক যুক্তিগুলো যারা উপস্থাপিত করেছিলেন, তাদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল, তারা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চান এবং যৌক্তিক চিন্তনের মাধ্যমে তারা তাতে উপনীত হবার প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল এই যে, তারা উপায় ও লক্ষ্যের মধ্যে যে বৈষম্য বর্তমান ছিল, সেই সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন না।” (G. Galloway; The Pailosophy of Religion; Page 381)।
যুক্তিগুলোর গুরুত্ব : এই যুক্তিগুলো এত বেশি আলােচিত হয়েছে এবং এগুলোর এত বেশি সমালোচনা হয়েছে যে, এই সম্পর্কে নতুন কিছু বলা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। তবু এগুলোর আলোচনার প্রয়োজন আছে, কেননা এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের বস্তুর যথার্থতা সম্পর্কে যৌক্তিক প্রমাণের উপস্থাপনা করার চেষ্টা করে এই যুক্তিগুলো দেখায় যে, চিন্তন কিভাবে বিশ্বাসের সহায়ক হতে পারে। মানবমন কিভাবে সঠিক এবং অকাট্য যুক্তির সাহায্যে ধর্মবিশ্বাসের সত্যতাকে নিজের কাছে সমর্থনযােগ্য করে তুলতে পারে, এই যুক্তিগুলো তার উপায় নির্দেশ করে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণবিষয়ক বিভিন্ন যুক্তিগুলোর সংক্ষিপ্ত আলােচনা ও সমালোচনা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত সমস্যাদির প্রকৃতিকে বুঝে নেবার পক্ষে সহায়ক হবে এবং যখন আমরা বুঝে নিতে পারব, কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কোন সমাধানগুলো কার্যকর হয়নি, তখন সেক্ষেত্রে নতুন সমাধানের কথা হয়তো আমরা চিন্তা করতেও সক্ষম হব। এইচ. ডি. লুইস (H. D. Lewis) বলেন, ‘পরম্পরাগত যুক্তিগুলোর যত্নকৃত পরীক্ষণ বর্তমানে ছাত্রদের পক্ষে খুবই শিক্ষাপ্রদ হতে পারে।’ (H.D. Lewis : Philosophy of Religion – Page 157)। কেয়ার্ড বলেন, সাধারণত প্বমাণ বলতে যা বোঝায় সেই দিক থেকে বিচার করলে, এই যুক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রায়শই যেসব অভিযােগ করা হয়, তারা সেই সব অভিযােগের যােগ্য। কিন্তু মানুষের আত্মা যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঈশ্বরের জ্ঞানে, উপনীত হয় এবং সেখানে তার সর্বোত্তম প্রকৃতির পরিপূর্ণতা খুজে পায়, তার বিভিন্ন স্তরগুলোর সন্ধান করতে গিয়ে ধর্ম যে যুক্তি দেয়, যেগুলো তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে, তার বিশ্লেষণের দিক থেকে বিচার করতে গেলে, এই প্রমাণগুলো যথেষ্ট মল্যের অধিকারী।” (J. Caird: An Introduction to the Philosophy of Religion : Page 125)।
তত্ত্ববিষয়ক যুক্তি (The Ontological Argument)
যুক্তিটির মূল বক্তব্য
প্রথমে যে যুক্তিটি আমরা আলোচনা করব সেটি হল তত্ত্ববিষয়ক যুক্তি (Ontological Argument)। এই যুক্তিটি গভীর দার্শনিক সমস্যার সৃষ্টি করে এবং আলােচনায় অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাব যে, অন্যান্য যুক্তিগুলো এই যুক্তির সত্যতাকে প্রচ্ছন্নভাবে স্বীকার করে নিয়েছে। তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটি বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তিটির মূল বক্তব্য হল এই যে, ঈশ্বরের ধারণার (idea of God) মধ্যেই ঈশ্বরের বাস্তবতা (reality of God) নিহিত। ঈশ্বরের ধারণা হল এক অভিনব ধারণা, কাজেই তা নিছক ধারণা হতে পারে না। সেজন্য এই যুক্তি ঈশ্বরের ধারণা থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে সচেষ্ট হয়। আমাদের মনে ঈশ্বরের ধারণার উপস্থিতি তার সত্তা বা অস্তিত্ব প্রমাণ করে। চিন্তন বা ধারণা থেকে অস্তিত্বে উপনীত হওয়া বা অস্তিত্বের সিদ্ধান্ত করাই হল এই যুক্তিটির সার কথা। এই যুক্তিটি বিভিন্ন চিন্তাবিদ যেমন আনসেল্ম (১০৩৩-১১০৯ খ্রি.), বোনাভনচুর (Bonaventure, ১২২১-৭৪ খ্রি.), দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রি.), লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬ খ্রি.), এবং হেগেল (১৭৭০-১৮৩১ খ্রি.) উপস্থাপিত করেছেন। তবে এই যুক্তিটির উল্লেখযােগ্য উপস্থাপক হলেন আনসেল্ম এবং দেকার্ত। আনসেল্মের সময়েই এই যুক্তিটির সমালােচনা করা হয় এবং পরবর্তীকালে টমাস একুইনাস এবং ইমানুয়েল কান্ট এই যুক্তিটির সমালোচনা করেন।
আনসেল্মের যুক্তি
আনসেল্মের মতে ঈশ্বরের ধারণা : কান্টারবেরীর আনসেল্ম ঈশ্বরের ধারণাকে কিভাবে ব্যক্ত করেছেন, প্রথমে তা দেখা যাক। তিনি খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের ধারণাকে ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, “এ হল এমন সত্তা যার থেকে বৃহত্তর কিছু ধারণা করা যায় না (a being than which nothing greater can be conceived)”। এটা স্পষ্ট যে, “বৃহত্তম” (greater) বলতে আনসেল্ম মনে করেন অধিকতর পূর্ণ (more perfect), দৈশিক দিক থেকে বহত্তর (spatially bigger) নয়। একটা বিষয় লক্ষ্য করার রয়েছে, সবচেয়ে পূর্ণ সত্তা যা রয়েছে (that there is) তার ধারণা, এবং সবচেয়ে পূর্ণ সত্তা যার ধারণা করা যেতে পারে, তার ধারণা, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটির উপর তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, কেননা যদিও সংজ্ঞানুসারে এটা সত্য যে সবচেয়ে পূর্ণ সত্তা যা আছে তা অস্তিত্বশীল (the most perfect being that there is exists), তাকেই যে আনসেল্ম ঈশ্বর বলেছেন এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। কাজেই সবচেয়ে পূর্ণ সত্তা যা আছে তাকে ঈশ্বররূপে বর্ণনা না করে, আনসেল্ম ঈশ্বরকে বর্ণনা করেছেন সেই পূর্ণ সত্তা রূপে, যার থেকে অধিকতর পূর্ণ সত্তার ধারণা করা যায় না।
সেন্ট আনসেল্ম (St. Anselm) যুক্তিটিকে এভাবে উপস্থাপিত করেছেন (আনসেল্মের প্রোসলজিওন গ্রন্থের (Proslogion) চ্যাপ্টার ২-৪ এ এটি পাওয়া যাবে) –
- যুক্তিটির প্রথম রূপ (First Form of the Argument) : আমাদের মনে এক পূর্ণ সত্তার (Perfect Being) ধারণা আছে। এই পূর্ণ সত্তা হল ঈশ্বর। ঈশ্বরের ধারণা এমন যার থেকে পূর্ণতম ও মহত্তম কিছু চিন্তা করা যায় না (a being than which nothing greater can be conceived)। কিন্তু এই পূর্ণ সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার না করলে তা কিভাবে পূর্ণ হতে পারে? অস্তিত্ব পূর্ণতার অন্তর্গত। যার অস্তিত্ব নেই তাকে পূর্ণ বলা যায়না। শুধু চিন্তায় যার অস্তিত্ব আছে তার তুলনায় চিন্তায় এবং বাস্তবে যার অস্তিত্ব আছে তা পূর্ণতর। আমাদের মনে যে পূর্ণ সত্তার ধারণা আছে বাস্তবে তার যদি অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে আমরা অপর এক পূর্ণ সত্তার ধারণা করতে পারি যার বাস্তবে অস্তিত্ব আছে। তাহলে শেষােক্ত সত্তা প্রথমটির তুলনায় অধিকতর পূর্ণ হবে। যেহেতু ঈশ্বর পূর্ণতম বা মহত্তম তার অস্তিত্ব শুধুমাত্র চিন্তায় নেই, বাস্তবেও আছে। কাজেই ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।
- যুক্তিটির দ্বিতীয় রূপ (Second Form of the Argument) : আনসেল্ম তার ‘Proslogion’ গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদে যুক্তিটিকে আবার ব্যক্ত করেছেন। তবে সেখানে শুধুমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলেন নি, ঈশ্বরের অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের (necessary existence) কথা বলেছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে এমন ভাবে সংজ্ঞা নির্দেশ করা হয়েছে যে, ঈশ্বর অস্তিত্বশীল নয় – এমনভাবে ঈশ্বরকে ধারণা করা যায় না। অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের যে ধারণা তার মূল কথা হল নিজে নিজে অস্তিত্বশীল (self-existent) হওয়া। যেহেতু ঈশ্বরের পূর্ণতা অসীম, তিনি কালে বা কালের দ্বারা সীমিত নন, (is not limited in or by time)। কাজেই কোন বিশেষ কালে ঈশ্বরের অস্থিত্বশীল হওয়া এবং কোন বিশেষ কালে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া, এই দুই সম্ভাবনাকেই বাতিল করা যায়। কাজেই ঈশ্বরের নাস্তিত্ব অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই – এমন হওয়াটা অসম্ভব।
আনসেল্মের যুক্তির সমালোচনা : আনসেল্মের সমসাময়িক চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেকেই আনসেল্মের যুক্তিটির আলােচনা করেন। আনসেল্মের সমসাময়িকদের মধ্যে গনিলাে (Gaunilo) নামে একজন ফরাসী সন্ন্যাসী ‘A Book or behalf of the Fool’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করে আনসেল্মের প্রদত্ত যুক্তির উত্তর দেবার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। গনিলো আনসেল্মের সঙ্গে একমত যে, ঈশ্বরের ধারণা অনিবার্যভাবে তার মনে বর্তমান। কিন্তু তিনি বলেন যে, এর থেকে সিদ্ধান্ত করা অসম্ভব যে, ঈশ্বর বাস্তবে অস্তিত্বশীল। তিনি আরও বলেন যে, যদি কেউ তাকে এমন একটি অত্যাশ্চর্য দ্বীপের কথা ব্যক্ত করতেন যেটি এই জগতে স্বর্গের মতোই সুন্দর, তাহলে তার পক্ষে এই দ্বীপের ধারণা মনে গঠন করা এবং তাকে মনে জাগরুক রাখা সহজ হত। কিন্তু মনের এই ধারণা থেকে তিনি কখনও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন না যে, দ্বীপটি বাস্তবে অনিবার্যভাবে অস্তিত্বশীল।
আনসেল্মের অভিযােগের উত্তর : আনসেল্ম গনিলাের সমালােচনার উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, দ্বীপ সম্পর্কে গনিলাে যুক্তি নির্ভুল এবং একটিমাত্র ক্ষেত্র ছাড়া অপর সব ক্ষেত্রেই এটি সত্য হবে। আনসেল্ম মনে করেন যে ঈশ্বরের ক্ষেত্রটি একটা বিশেষ ধরনের ক্ষেত্র। দ্বীপের ক্ষেত্রে যেমন অন্যান্য ক্ষেত্রেও, আমরা তাদের অস্তিত্বের কথা যেমন চিন্তা করতে পারি তেমনি তাদের নাস্তিত্বের কথাও চিন্তা করতে পারি। কেননা দ্বীপ হল এই জগতের একটা অংশ-একটি পরনির্ভর সত্তা (a dependent reality)। দ্বীপের নাস্তিত্বের চিন্তার মধ্যে কোন বিরােধিতা (contradiction) নেই। কাজেই আনসেল্মের বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। কিন্ত আনসেল্ম মনে করেন যে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। ঈশ্বরের বেলায় ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথা ধারণা করা যায় না। কারণ এক্ষেত্রে আমরা কোন দ্বীপ, অশ্ব বা বিদ্যালয়ের কথা চিন্তা করছি না যা সেই ধরণের বস্তুর মধ্যে মহত্তম এবং পূর্ণতম (the greatest and most perfect)। আমরা এমন কিছুকে চিন্তা করছি, সেটা যাই হােক না কেন, সব সত্তার মধ্যে মহত্তম এবং পূর্ণতম। একমাত্র ঈশ্বরের ক্ষেতেই চিন্তার অস্তিত্ব (existence in thought) থেকে বাস্তব অস্তিত্বে (existence in eality) উপনীত হওয়া সম্ভব। আনসেল্মের নীতি, ধারণা করা যায় এমন সবচেয়ে পূর্ণ সত্তার ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য, কেননা এই ঈশ্বরের অনন্ত এবং অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব (eternal and independent existence) আছে।
দেকার্তের যুক্তি
প্রথম যুক্তি : পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় পরে অনুরূপ যুক্তি উপস্থাপিত করতে গিয়ে ফরাসী দার্শনিক দেকার্ত যে তা একটু ভিন্ন আকারে উপস্থাপিত করবেন এইটাই প্রত্যাশিত। দেকার্ত মনে মান করলেন যে, আনসেল্মের উপরিউক্ত প্রমাণ দোষযুক্ত। সেখানে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাস্তবতা, অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রমাণিত হয় নি। দেকার্তের মতে আনসেল্মের প্রমাণ থেকে তার প্রমাণ ভিন্ন। পূর্ণ সত্তা ঈশ্বরের ধারণা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবীভাবে নিতে হয় না। ঈশ্বরের ধারণার মধ্যে কেবল যে অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিহিত আছে তা নয়, অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব (necessary existerice) ঈশ্বরের পূর্ণতম সত্তার ধারণার অন্তর্ভূক্ত। দেকার্ত ছিলেন একজন গাণিতিক। কাজেই গণিত থেকে তিনি একটি উদাহরণ নিয়ে তার বক্তব্য বােঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, আমি এমন একটা ত্রিভুজের কথা কল্পনা করতে পারি, যার কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। কিন্তু, যদিও এই ত্রিভুজটি আমার কল্পনার ওপর নির্ভরশীল, তবু এই ত্রিভুজের এমন কিছু গুণ আছে, যেমন –“ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দই সমকোণের সমান” – যা আমার কল্পনার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং বলা যেতে পারে যে কল্পনা পূর্ণতম সত্তার ধারণার নিরপেক্ষ। ‘ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান’ – এই গুণ বা বৈশিষ্ট্যটি যেমন ত্রিভুজের ধারণার মধ্যেই নিহিত বা এটি যেমন ত্রিভুজের একটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য তেমনি পূর্ণতম সত্তার ধারণার মধ্যেই তার অস্তিত্ব নিহিত অর্থাৎ অস্তিত্ব পূর্ণতম সত্তার এক অনিবার্য বৈশিষ্ট্য (যে বৈশিষ্টোর দ্বারা ত্রিভুজের সংজ্ঞা নির্দেশ করা হয় সেই বৈশিষ্ট্য ছাড়া যেমন ত্রিভুজটি ত্রিভুজ নয়, তেমনি অস্তিত্ব ছাড়া ঈশ্বর, ঈশ্বর নয়। পার্থক্য হল এই যে, ত্রিভুজের বেলায় আমরা কোন ত্রিভুজের অস্তিত্বের বিষয়টি অনুমান করে নিতে পারি না, কেননা অস্তিত্ব ত্রিভুজত্বের সারধর্ম (essence) নয়। কিন্তু পূর্ণতম সত্তার ক্ষেত্রে আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি, কেননা অস্তিত্ব হল একটি প্রয়েজনীয় গুণ যেটি ছাড়া কোন সত্তা সীমাহীন ভাবে পূর্ণ ছতে পারে না।)। কাজেই পূর্ণতম সত্তা অস্তিত্বশীল নয় একথা বলা হলে বক্তব্যের মধ্যে সেই বিরােধিতা দেখা দেবে, ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান নয় বললে, যে বিরােধিতা দেখা দেয়। ত্রিভুজের প্রকৃতিই হল এমন যে তার তিনটি কোণ দুই সমকোণের সমান। অনুরূপভাবে পূর্ণতম সত্তার প্রকৃতিই হল অস্তিত্বশীল হওয়া। তিনটি কোণ মিলে যেমন অবশ্যম্ভাবীভাবে দুটি সমকোণের সমান হয়, তেমনি পূর্ণতম সত্তা অবশ্যম্ভাবীভাবে অস্তিত্বশীল। কাজেই পূর্ণতম সত্তার ধারণা থেকে আমরা তার বাস্তব এবং অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। যে সত্তার অস্তিত্ব নেই, তা কখনও অসীম এবং পূর্ণ হতে পারে না। পূর্ণতার ধারণা ছাড়া অন্য কোন ধারণার অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বহীন পূর্ণ সত্তার ধারণা যৌক্তিক অসঙ্গতিপূর্ণ। উপরিউক্ত যুক্তি ছাড়া দেকার্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য আরও কয়েকটি যুক্তি দিয়েছেন। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, অস্তিত্ব ঈশ্বরের ধারণার অন্তর্ভূক্ত এবং এই অন্তর্ভূক্ত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। (“In short, reality belongs, and is clearly perceived to belong to the very notion of God.” – G. Galloway: The Philosophy of Religions; Page 382)।
দ্বিতীয় যুক্তি : প্রতিটি কার্যেরই একটা কারণ আছে। নিছক শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না – এটি একটি স্বতসিদ্ধ বচন। কাজেই ঈশ্বরের ধারণারও একটা কারণ আছে। কার্যের মধ্যে যতখানি সত্যতা থাকবে, কারণের মধ্যেও ততখানি সত্যতা থাকবে, অর্থাৎ কার্য উৎপন্ন করার মতাে কারণকে ততখানি পর্যাপ্ত হওয়া দরকার। যার মধ্যে বেশি সত্যতা আছে বা যা সবচেয়ে পুর্ণ, তা কখনও কম সত্যতা আছে বা তার চেয়ে কম পূর্ণ, এমন বিষয়ের কার্য হতে পারে না। কাজেই ঈশ্বরের ধারণার কারণ আমি হতে পারি না যেহেতু আমি একজন সীমিত অপূর্ণ সত্তা। ঈশ্বরের ধারণা হল পূর্ণ অসীম সত্তার ধারণা। কাজেই কোন অসীম গুণ সত্তা, অর্থাৎ ঈশ্বর আমার মনের মধ্যে এই ধারণা সংস্থাপিত করেছেন। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।
তৃতীয় যুক্তি : তৃতীয় যুক্তিটি প্রায় দ্বিতীয় যুক্তিটির মতোই, অর্থাৎ দেকার্ত অন্য আর একভাবে উপরিউক্ত যুক্তিটিকে উপস্থাপিত করেছেন। এই যুক্তির ক্ষেত্রে দেকার্ত নিজের অপূর্ণতা এবং সেই অপূর্ণতার জ্ঞান থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করতে চান। দেকার্তের যুক্তি হল এই যে, তিনি কখনও নিজের সৃষ্টিকর্তা হতে পারেন না, যেহেতু তার পূর্ণতার ধারণা আছে এবং তিনি জানেন যে, তিনি নিজে অপাণ। তিনি যদি নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতেন বা নিজের অস্তিত্বের কারণ হতেন তাহলে তার মনে যে পূর্ণতার ধারণা আছে তিনি তার কারণ হতেন অর্থাৎ তিনি ঈশ্বরের মতো পূর্ণ হতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি অপূর্ণ, সেহেতু তিনি নিজেকে সৃষ্টি করেন নি। কাজেই দেকার্ত সিধান্ত করলেন যে, তিনি এবং অন্যান্য সসীম জীব, (যদি একান্তই, তাদের কোন অস্তিত্ব থাকে) নিশ্চই ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট, যে ঈশ্বর এক পূর্ণ সত্তা এবং যার থেকে সব সসীম জীব উদ্ভূত। কাজেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এবং তিনি স্বয়ংসৃষ্ট।
যুক্তিটির সমালোচনা
ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে দেকার্তের যুক্তিগুলোকে নানাভাবে আলোচনা করা হয়েছে –
- প্রথমত, দেকার্ত বিনা প্রমাণেই ধরে নিয়েছেন যে আমাদের মনে ঈশ্বরের ধারণা আছে। তিনি যদি দেখাতে পারতেন যে ঈশ্বরের ধারণা হল এমন ধারণা যেটি আমরা চিন্তা করতে বাধ্য, অর্থাৎ কিনা একটি অনিবার্য ধারণা, তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে তার যুক্তি আরও জোরালাে হত।
- দ্বিতীয়ত, দেকার্তের ঈশ্বরের ধারণা একটি সদর্থক বা ভাবাত্মক ধারণা। কিন্তু, অভিজ্ঞতাবাদীরা মনে করেন যে পূর্ণতা, অসীমতা প্রভৃতি ধারণা নঞর্থক বা অভাবাত্মক (negative) ধারণা। এই শব্দগুলো কেবলমাত্র কোন বিষয়ের অনুপস্থিতিই নির্দেশ করে। দেকার্ত অসীম তার ধারণাকেই সদর্থক ধারণা রূপে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। (তবে এই প্রসঙ্গে গ্যালোয়ের মন্তব্য হল, ‘ঈশ্বর’ পদটি যে বৈশিষ্ট্যসূচিত করে ‘অসীম’ পদটি তার ভানায় অনেক কম বৈশিষ্ট্য সূচিত করে (the term Infinitive connotes much less than is signified by God)। তবে যুক্তিটির একেবারেই কোন গুরুত্ব নেই বলে গ্যালােয়ে মনে করেন না। যুক্তিটি একটি বিষয় নির্দেশ করে যে, ঈশ্বরের নিজের জন্যই মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের জ্ঞানের অস্তিত্ব। মানুষের মধ্যে তার ধারণার পর্যাপ্ত হেতুও তিনি নিজেই (… that man’s knowledge of God is due to God himself. He is the sufficient reason of the idea of himself in man))।
- তৃতীয়ত, দেকার্ত অস্তিত্বকে একটা গুণ হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু অস্তিত্ব কি একটি গুণ? কোন টেবিলের চতুষ্কোণত্ব বা লালবর্ণের গুণ আছে বলা যেতে পারে, কিন্তু টেবিলের ‘অস্তিত্ব’রূপ গুণটি রয়েছে কি অনরূপভাবে বলা যেতে পারে? টমাস একুইনাস মনে করেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে তত্ত্ব বিষয়ক যুক্তিটি অস্তিত্বকে গুণ হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু অস্তিত্ব গুণ নয়, চতুকোণত্ব বা লালবর্ণ যে অর্থে গুণ, সেই অর্থে নিশ্চই নয়। ‘অস্তিত্বশীল হওয়া’ যদি ঈশ্বরের গুণ হয়, তবে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল কিনা এই প্রশ্ন অবান্তর হয়ে পড়ত। এই কারণেই যুক্তির দিক থেকে যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা সম্ভব, তেমনি যুক্তির দিক থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করাও সম্ভব।
- চতুর্থত, কোন কিছু সম্পর্কে আমার নিছক চিন্তা বা ধারণাই তার বাস্তব সত্তা প্রমাণিত করে না। কাজেই চিন্তার বিষয়টি যদি ‘অস্তিত্ব’ হয় তাহলেই যে প্রমাণ বা যুক্তিটি বেশ জোরালো হল তা নয়। নিছক অস্তিত্বের ধারণা প্রকৃত বা বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ নয়। খাদ্য বা বস্ত্রের নিছক ধারণা যথাক্রমে খাবার টেবিলটিকে খাবার দিয়ে ভরিয়ে তােলে না বা অনাবৃত দেহকে আবরণের দ্বারা উত্তপ্ত করে তােলে না।
- পঞ্চমত, কান্ট এবং কান্ট পরবর্তী দার্শনিকবৃন্দ দেকার্তের প্রথম প্রমাণটির কঠোর সমালোচনা করেছেন। দেকার্তের প্রথম যুক্তিটি দুটি ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত – (১) অস্তিত্ব পূর্ণতার অত্যাবশ্যকীয় গুণ এবং (২) পূর্ণতম সত্তার ধারণা থেকেই অভিজ্ঞতার সহায়তা ছাড়া, শুধুমাত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে, তার বাস্তব অস্তিত্ব অনুমান করা যেতে পারে। কান্ট দেখালেন যে অস্তিত্বের নিছক ধারণা কোন বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণ করে না। ঈশ্বরের ‘ধারণা’ থেকে ঈশ্বরের অস্থিত্বের ধারণা করা যেতে পারে – ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্ব অনুমান করা যেতে পারে না। দেকার্ত অস্তিত্বের ধারণার (idea of existence) সঙ্গে বাস্তব অস্তিত্বকে (real existence) গুলিয়ে ফেলেছেন। কান্টের মতে অস্তিত্বের ধারণা এবং বাস্তব অস্তিত্বের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা বৈশ্লেষিক নয় সংশ্লেষক। অস্তিত্বের ধারণা থেকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তব অস্তিত্বে উপনীত হওয়া যায় না। কোন কিছুর বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হলে, বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়ােজন। ধারণা থেকেই যদি বাস্তব অস্তিত্ব পাওয়া যেত তাহলে, কান্ট বলেন, আমার পকেটে একশত ডলার আছে ধারণা করলেই আমার পকেটে একশত ডলারের বাস্তব অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করতাম। কিন্তু বাস্তবে তা দেখি না। তেমনি ঈশ্বরের ধারণা থেকে কখনও ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে না। আমার মনে একশত ডলারের ধারণ কখনই আমায় পকেটে বাস্তবে অস্তিত্বশীল একশত ডলারের ধারণার অনুরূপ নয়। কান্ট দেখাতে চাইলেন যে, অস্তিত্বশীল কোন বস্তুর ধারণা বস্তুটির নিছক ধারণার ক্ষেত্রে নতুন কিছু যােগ করে দিতে পারে না (the conception of a thing as existing adds nothing fresh to the bare conception of it)। মনে মনে আমরা যে পূর্ণতম সত্তার ধারণা করি, ধারণা হিসেবে তার মধ্যে কোন অভাব নেই, যদিও বাহ্যজগতে তার অস্তিত্ব নেই। এখন বাস্তব বা অস্তিত্বশীল হওয়ার বৈশিষ্ট্যটি এই ধারণার সঙ্গে যােগ করে নিয়ে ধারণাটিকে উন্নত করা যায় না।
‘অস্তিত্ব’ নিয়ে কান্ট, রাসেল ও হিকের বক্তব্য
কান্ট : দেকার্তের বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে কান্ট যে দেকার্তের বক্তব্যকে প্রথমেই সরাসরি অস্বীকার করলেন তা নয়। তিনি দেকার্তের এই দাবী অস্বীকার করতে চাইলেন না যে, একটা ত্রিভুজের ধারণাকে বিশ্লেষণ করলে যেমন তার তিনটি কোণের অস্তিত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করা চলে না, তেমনি ঈশ্বরের ধারণাকে বিশ্লেষণ করলে তার অস্তিত্বের ধারণা যে সেই ধারণার অন্তর্ভুক্ত, তা অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু কান্টের বক্তব্য হল, তাই বলে কি এটা মেনে নিতে হবে, বা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে যে, উদ্দেশ্যে তার বিধেয় সহ বাস্তবে অস্তিত্বশীল? বিশ্লেষণের দিক থেকে যে বিষয়টি সত্য, তা হল, যদি কোন ত্রিভুজ থাকে, তার অবশ্যই তিনটি কোণ থাকবে এবং যদি কোন অসীম গুণ সত্তা থাকে তার অস্তিত্ব থাকবে। কান্ট বলেন, “ত্রিভুজের কথা বলা এবং ভার তিনটি কোণকে অস্বীকার করা আত্মবিরােধিতা দোষে দুষ্ট। কিন্তু তিনটি কোণ সহ ত্রিভুজকে অস্বীকার করার মধ্যে আত্ম-বিরোধিতা নেই। সব নিরপেক্ষ অবশ্যম্ভাবী সত্তা সম্পর্কে ঐ একই কথা প্রযােজ্য। কান্ট আরও গভীর সমালােচনায় অগ্রসর হয়ে যে মৌলিক ধারণাটির উপর দেকার্তের যুক্তিটি প্রতিষ্ঠিত সেটিকেই অস্বীকার করলেন। কান্ট যেটি অস্বীকার করতে চাইলেন সেটি হল অস্তিত্ব, ত্রিভুজের মতোই একটি বিধেয়, কেউ যার অধিকারী হতে পারে বা কারও মধ্যে যার অভাব থাকতে পারে বা কোন কোন ক্ষেত্রে যাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। কান্ট বলেন যে, অস্তিত্বের ধারণা, কোন বিশেষ বস্তুর ধারণাতে বা কোন এক জাতীয় বস্তৱ ধারণাতে, কিছু যোগ করে দিতে পারে না। কাল্পনিক একশত ডলারের সংখ্যার সঙ্গে বাস্তবে এক ডলারের সংখ্যার দিক থেকে কোন পার্থক্য নেই। যখন বলা হয় ডলারের অস্তিত্ব রয়েছে বা তারা মিথ্যা নয়, তখন আমরা ডলারের ধারণাকে জগতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি। যখন বলা হয় ‘ক’-এর অস্তিত্ব রয়েছে তখন তার অর্থ এই নয় যে, ‘ক’-এর অন্যান্য গুণের মতো অস্তিত্বও তার একটি গুণ। আসলে যা ব্যক্ত করা হয় তা হল ‘ক’-এর বাস্তুব জগতে অস্তিত্ব রয়েছে।
রাসেল : বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell)-ও ‘অস্তিত্ব’ শব্দটির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন যে, ব্যাকরণের দিক থেকে ‘অস্থিত্ব’ শব্দটি বিধেয় হলেও, যৌক্তিক দিক থেকে (logically) এটি একটি ভিন্ন ক্রিয়া সাধিত করে। যখন বলা হয়, ‘গরু অস্তিত্বশীল’, তখন গরুর ক্ষেত্রে ‘অস্তিত্ব’ এই গুণটি প্রয়োগ করা হয় না। বরং এই কথা বােঝান হয় যে, জগতে এমন বস্তু আছে যার ক্ষেত্রে ‘গরু’ – এই শব্দটির মাধ্যমে আমরা যা বর্ণনা করতে চাই, তাকে প্রয়োগ করা যেতে পারে। অস্তিত্ব (existence) পুর্ণতার কোন গুণ নয়। পুর্ণতম সত্তার ধারণা থেকেই পূর্ণতম সত্তার অস্তিত্বের ধারণা পাওয়া যেতে পারে কিন্তু তাতে পূর্ণতম সত্তার বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। ‘অস্তিত্ব’ যদি পূর্ণতার কোন গুণ হয় এবং ঈশ্বর যদি পুর্ণতম সত্তা হন তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হয়। কিন্তু অস্তিত্ব পূর্ণতার কোন গুণ নয়। কোন গুণের অধিকারী হতে হলে একটা বস্তুকে প্রথমে অস্তিত্বশীল হতে হবে। অনুরূপভাবে ‘পূর্ণতা’ গুণের অধিকারী হতে হলে প্রথমে ঈশ্বরকে অস্তিত্বশীল হতে হবে। কাজেই ঈশ্বরের পূর্ণতা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। যা ‘অস্তিত্বশীল’ তাতে অস্তিত্ব গুণ আরােপ করা একই বিষয়ের পুনরুক্তি ছাড়া কিছুই নয়।
জন হিক : জন হিক এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, আনসেল্ম এবং দেকার্ত ধারণা করেছিলেন যে ঈশ্বরের সংজ্ঞায় “অস্তিত্বকে ঈশ্বরের যোগ্য গুণ বা বিধেয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বা অবশ্যই করা উচিত। তা যদি হয় তা হলে তত্ত্ব হিসেবে যুক্তি বৈধ। কেননা ধারণার যােগ্য, সর্বাপেক্ষা পূর্ণ সত্তার, অস্তিত্ব রূপে গুণের অভাবের কথা স্বীকার করা চলে না। কিন্তু অস্তিত্ব শব্দটি ব্যাকরণের দিক থেকে বিধেয় রূপে গণ্য হলেও, আসলে এটি যে বিষয়টি ব্যক্ত বা ঘােষণা করতে চায়, তা হল, এটি একটি বর্ণনা, যা বাস্তবে কোন কিছুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই বিষয়টি স্বীকার করে নিলে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটিকে বৈধ গণ্য করা চলে না। অস্তিত্ব যদি ‘বিধেয়’ (predicate) হয়, তাহলে এটি ঈশ্বরের সংজ্ঞা নিরপেক্ষ বিধেয় রূপে গণ্য হতে পারে না এবং ধারণার যােগ্য এমন পূর্ণতম সত্তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে কিনা, এই প্রশ্ন থেকেই যায়। হিক বলেন, “ঈশ্বরের সংজ্ঞা ঈশ্বর সম্পর্কে কারও ধারণা ব্যক্ত করে, কিন্তু এইরূপে কোন সত্তার বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না।”
তত্ত্ববিষয়ক যুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকের মন্তব্য
হেগেল : কান্টের এই অভিযােগের উত্তরে অবশ্য একথা বলা যেতে পারে যে, অস্তিত্ব বলতে যদি কান্ট ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের বিষয়বস্তু হিসেবে বিশেষ বস্তুর অস্তিত্বের কথা বুঝে থাকেন (যেমন, কান্টের ডলারের উদাহরণ) তাহলে নিছক চিন্তা বা ধারণা থেকে অস্তিত্ব অনুমান করা যায় না। এই সব বস্তু সম্ভাব্য (contingent) বা সাপেক্ষ, কাজেই তাদের ধারণা থেকে তাদের অবশ্যম্ভাবী (necessary) অস্তিত্ব অনুমান করা যেতে পারে না। কিন্তু এমন কতকগুলো বিষয় আছে, যাদের সম্পর্কে এই নিয়ম খাটে না। বিশেষ করে একটি ধারণা আছে, যার ধারণাই তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে, এবং এই ধারণা হল এক বিশ্ব আত্ম-চেতনার (Universal self-consciousness) বা পরম ধীশক্তির ধারণা। হেগেলের মতে যুক্তির আত্ম-চেতনার কথা বলতে গেলেই পব থেকে বিশ্ব-আত্মচেতনার কথা স্বীকার করে নিতে হয়। কাজেই বিশ্ব-আত্ম-চেতনার ধারণার মধ্যেই তার বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ নিহিত। চিন্তাকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে না নিলে, কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে বলা যেতে পারে না। একটা চেতনাকে পূর্ব থেকে ঘীকার করে নেয়ার প্রয়ােজন আছে যার জন্য এবং যাতে সব কিছুর অস্তিত্ব। কিন্তু সেই চেতনা কোন যুক্তি বিশেষের চেতনা নয় যার নাস্তিত্ব চিন্তা করা অসম্ভব নয়। কাজেই সব জ্ঞান এবং চিন্তার জন্য পূর্ব থেকে কোন বিশ্বচেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়, যা সব ব্যক্তি-বিশেষের আত্মার অন্তর্বর্তী, যা সব আত্মার, সব চিন্তার বস্তুর ঐক্য এবং এই ক্ষেত্রে চিন্তা থেকেই আমরা অস্তিত্বে উপনীত হতে পারি। কেননা এই ধারণা ছাড়া চিন্তাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই ধারণার বাস্তবতা চিন্তার পক্ষে এতই মৌলিক বিষয় যে, একে সন্দেহ করার অর্থ হল – সব চিন্তা, সব অস্তিত্বের ধ্বংস সাধন করা। তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটির যথার্থ অর্থ হেগেল উপলদ্ধি করেছিলেন এবং চিন্তা (thought) ও সত্তার (reality) অভিন্নতার মাধ্যমেই তিনি তা প্রকাশ করেছেন। দেকার্ত যেভাবে তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটিকে উপস্থাপিত করেছেন, সেটি দুর্বল। যদি দেকার্ত হেগেলের মতো দেখাতে পারতেন যে, আমাদের আত্মসচেতনার সঙ্গে ঈশ্বরের ধারণা অবশ্যম্ভাবীভাবে যুক্ত, তাহলে তার যুক্তিটির মূল্য সম্যকভাবে প্রতিষ্ঠিত হত।
গালােয়ে : গ্যালােয়ে বলেন যে, তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটিকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক প্রমাণ রূপে গ্রহণ করা না গেলেও, যুক্তিটির মধ্যে কিছুটা সত্যতা নিহিত আছে। যদি ঈশ্বরের বদলে আমরা এমন এক শুদ্ধ সত্তার (Being) কথা কল্পনা করি যিনি সব সত্তার (reality) সমষ্টি, তাহলে এইরূপ ধারণাকে নিছক আমাদের মনের কাল্পনিক ধারণা মনে করা কঠিন হবে। কারণ চিন্তন সত্তা নির্দেশ করে এবং সত্তা ছাড়া চিন্তন অর্থহীন। কোন সত্তা (Being) না থাকলে চিন্তাও থাকবে না এবং তাই যদি হয় তাহলে সবচেয়ে বাস্তব সত্তা (most real being) বা সত্তার সমষ্টি (a sum of reality) বলে কিছু নেই বলাটা অর্থহীন হবে। এই জাতীয় ধারণার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। এই জাতীয় ধারণাকে অস্বীকার করাও চলে না। তবে গালোয়ে বলেন, মানুষ তার যে বিশ্বাস সম্পর্কে অন্য বিষয়ের ভিত্তিতে সুনিশ্চিত, সেই বিশ্বাসকে যেভাবে মানুষ নিজের কাছে সমর্থন করার চেষ্টা করছে তারই একটি কৃত্রিম উপায় তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটির দ্বারা নির্দেশিত হয়েছে।
লোটজা : তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিকে যদি এই রূপে দেওয়া হয় তাহলে এটাকে যথার্থ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু তাহলে এটা কোন ধর্মীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবে না। আসলে তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে গিয়ে লােটজা (Lotze) যা বলেছেন তা অনুধাবন করতে হবে। লােটজা বলেন, এই যুক্তিটি নির্দেশ করে যে, পরমসত্তা, যা পরমমূল্য, তা নিছক মনের একটা ভ্রান্তি, এটা বিশ্বাস করার অনিচ্ছা মানুষের মনেই নিহিত।
কেয়ার্ড : কেয়ার্ডের মতে তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটির প্রকৃত অর্থ হল যে, আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে আমাদের সমগ্র চেতনজীবন একটি বিশ্বচেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত, যা নিছক মনের ধারণা নয় এবং যা তার অনিবার্য অস্তিত্বের প্রমাণ নিজেই বহন করে বেড়ায়।
কার্ল বার্থ : এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, কোন কোন ধর্মতত্ত্ববিদ বা ঈশ্বরতত্ত্ববিদ, যেমন কাল বার্থ (Karl Barth) মনে করেন যে, আনসেল্ম প্রদত্ত ব্যক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের কোন প্রচেষ্টা নয়। এই যুক্তির মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরের নিজেকে প্রত্যাদিষ্ট করার ব্যাপারে যে তাৎপর্য বর্তমান, তাকে প্রকাশ করা – সেটি হল ঈশ্বর-বিশ্বাসী ব্যক্তি ঈশ্বরকে যেন ধারণাযােগ্য পূর্ণতম সত্তা থেকে কোন অংশে ছোট বলে গণ্য না করে।
বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক বা আদি কারণ-বিষয়ক যুক্তি (The Cosmological or Causal Argument)
যুক্তিটির মূল বক্তব্য
গ্যালোয়ের মতে, ‘এই যুক্তিটি জগতকে প্রদত্ত বিষয়রূপে গ্রহণ করে, জগতের ব্যাখ্যার জন্য জগতের প্রকৃতি থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্বের অনুমান করে।’ (G. Galloway: The Philosophy of Religion – Page 387)। এই যুক্তিটি খুবই প্রাচীন। এই চিন্তাধারার ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাই অ্যারিস্টোটলের (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.) ‘Timoeus’-গ্রন্থে যেখানে তিনি বলেছেন যে, প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু নিশ্চই কোন কারণের দ্বারা সৃষ্ট। অ্যারিস্টোটল সবপ্রথম এই যুক্তিটিকে উপস্থাপিত করেন। ১৩শ শতকের চিন্তাধারার বিকাশে অ্যারিস্টোটলের চিন্তাধারার একটি উল্লেখযােগ্য অবদান থাকায় মধ্যযুগীয় দর্শনে এই যুক্তিটির পুনরাবির্ভাব ঘটে। টমাস একুইনাসের বিখ্যাত পাঁচটি প্রমাণ এই যুক্তিটিরই ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ। তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটির তুলনায় এই যুক্তিটিকে অধিকতর কার্যকর মনে হয়, কেননা দৈনন্দিন জীবনকে ভিত্তি করেই যুক্তিটি উপস্থাপিত হয়েছে। তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির মত ঈশ্বরের ধারণা থেকে তার আভ্যন্তরীণ তাৎপর্য উদঘাটনে সচেষ্ট না হয়ে একুইনাসের যুক্তিগুলো এই জগতের কিছু সাধারণ বৈশিষ্টোর ভিত্তিতে যে বিষয়টি ব্যক্ত করতে চেয়েছে তা হল, এই জগতের যেসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমরা দেখছি, সেই বৈশিষ্ট্য সহ এই জগতের অস্তিত্বের কথা বলা যেত না যদি না কোন পরমসত্তা, যাকে আমরা ঈশ্বর বলে অভিহিত করতে পারি, তার অস্তিত্ব না থাকত। প্রথম যুক্তিটির ক্ষেত্রে তিনি গতি (motion) থেকে গতির আদিম প্রবর্তক {Prime Mover), দ্বিতীয় যুক্তিটির ক্ষেত্রে কার্যকারণ থেকে আদি কারণের, তৃতীয় যুক্তির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সত্তা থেকে অবশ্যম্ভাবী সত্তার, চতুর্থ যুক্তির ক্ষেত্রে মূল্যের ক্রম থেকে সব নিরপেক্ষ মুল্য বা মান (Absolute Value}-এর এবং পঞ্চম যুক্তিটির ক্ষেত্রে প্রকৃতিতে উদ্দেশ্যের ভিত্তিকে কোন ঐশ্বরিক পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনে সচেষ্ট হয়েছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই যুক্তির বিভিন্ন রূপ আছে। কিন্তু, সবকটি যুক্তিই কার্যকারণ নীতির {Principle of Causation) উপর ভিত্তি করেই উপস্থাপিত হয়েছে।
যুক্তিটির বিভিন্ন রূপ ও সমালোচনা
বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক বা আদি কারণ-বিষয়ক যুক্তির প্রথম রূপ : কার্যকারণ নীতির উপর ভিত্তি করে এই যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে। কার্যকারণ নীতি অনুসারে প্রত্যেক কার্যেরই কোন-না-কোন কারণ আছে। বিনা কারণে কোন কার্যের উদ্ভব সম্ভব নয়। কাজেই এই সৃষ্ট জগতেরও কোন কারণ আছে। সৃষ্ট জগতের কারণ কোন সসীম বস্তু হতে পারে না। কেননা তাহলে তার আবার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। জগতের কারণ অসীম (infinite) হওয়া প্রয়োজন। এই কারণ হল ঈশ্বর।
প্রথম রূপের সমালােচনা :
- (১) জগৎ সসীম ও সান্ত, তার কারণ, অসীম অনন্ত ঈশ্বর কিভাবে হতে পারে। অসীম ও সর্বনিরপেক্ষ কারণ থেকে সসীম কার্যের সিদ্ধান্ত করা যায়। কিন্তু সসীম কার্য থেকে অসীম কারণের অস্তিত্ব অনুমান করা যায় না। ন্যায় অনুমানে সিদ্ধান্ত কখনও আশ্রয় বাক্য থেকে ব্যাপকতর হতে পারে না। কাজেই সান্ত ও সসীম বস্তু থেকে অনন্ত ও ও অসীম ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিধান্ত করা সম্ভব নয়।
- (২) ঈশ্বর যদি হন অনন্ত সত্তা, সালে এই জগতের অস্তিত্ব কি তার অনন্তত্বের হানি ঘটিয়ে তাকে সসীম ও সান্ত বস্তুতে পরিণত করবে না?
বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক বা আদি কারণ বিষয়ক যুক্তির দ্বিতীয় রূপ : প্রতিটি কার্যের যদি একটা কারণ স্বীকার করা যায়, তাহলে সেই কারণের আবার একটা কারণ স্বীকার করতে হয়। এই জগতের অসংখ্য বস্তু বা ঘটনা পরস্পরের সঙ্গে একই কারণ-শৃঙ্খলে যুক্ত। কাজেই এই জগত হল কার্যকারণের এক নিরবচ্ছিন্ন শৃঙ্খল। কিন্তু প্রত্যেক কারণের যদি একটা কারণ সন্ধান করতে হয় এবং এর যদি কোন শেষ সীমা না থাকে তাহলে অনবস্থা দোষ (infinite regress) ঘটবে। কাজেই অনবস্থা দোষ এড়াবার জন্য কোন আদি কারণ স্বীকার করে নিতে হয়, যা হবে স্বয়ম্ভু, (causa sui), অর্থাৎ অন্য কোন কারণের কার্য নয়। এই আদি কারণ হল ঈশ্বর।
দ্বিতীয় রূপের সমালোচনা :
- কান্ট : কান্ট এই যুক্তি নিয়ে অভিযোগ এনেছেন। কান্ট বলেন, কার্যকারণ নীতির উপর ভিত্তি করে যদি আমরা ঈশ্বরকে সন্ধান করার জন্য সচেষ্ট হই, তাহলে আমরা খেয়ালখুশিমত কার্যকারণ শৃঙ্খলের কোন একটি জায়গায় হঠাৎ থেমে যেতে পারি না। তাহলে যে নীতির উপর ভিত্তি করে আমাদের যাত্রা শুরু, তাকে অগ্রাহ্য করা হবে।
- কেয়ার্ড : কেয়ার্ডও মনে করেন যে, সান্ত ও সসীম বস্তুর অস্তিত্বের ভিত্তিতে কোন অসীম কারণের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সান্ত ও সম্ভাব্য কার্য থেকে সান্ত ও সম্ভাব্য কারণের অনুমান করা যেতে পারে বা এই ধরনের কারণের সীমাহীন ক্রমের (endless series) কথা চিন্তা করা যেতে পারে কিন্তু যেহেতু ভ্রান্ত অসীমতা (faise infinity) নিয়ে মন স্থির হতে পারছে না, সেহেতু এই কারণ ক্রমের কোন জায়গায় হঠাৎ থেমে গিয়ে যদি বলা হয় যে, এই একটি কারণ পাওয়া গেল যা স্বয়ম্ভূ, যা শর্তহীন এবং অসীম, তাহলে এ হবে খেয়ালখুশির ব্যাপার। ভ্রান্ত অসীমতাকে চিন্তা করার মানসিক অক্ষমতাকে এড়ানাের জন্য হঠাৎ কোন একটি নামকে টেনে আনা এবং সেটি প্রকৃত অমীমকে (true infinity) নির্দেশ করছে মনে করা, আসলে যুক্তির নিস্ফলতাকে মেনে নেওয়া।
অ্যাকুইনাসের সমসাময়িকদের দ্বারা এই রূপের সম্প্রসারণ ও তার সমালোচনা : একুইনাসের সমসাময়িক কয়েকজন দার্শনিক একুইনাসের যুক্তিটিকে সমর্থন করার অভিপ্রায়ে তাকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাদের ব্যাখ্যা হল, কোন একটি ঘটনা বােধগম্য হয়, যখন সেটিকে অন্য আর একটি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে ব্যাখ্যা করা হয় এবং সেটিকে যখন অপর আর একটি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত করে ব্যাখ্যা করা হয়। কাজেই শেষ পর্যন্ত এমন একটি সত্তাকে স্বীকার করে নিতে হয়, যা নিজেকে নিজে ব্যাখ্যা করতে পারে (self-explanator), যেহেতু এর অস্তিত্বই সমগ্রের চরম ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হয়। এই জাতীয় কোন মত স্বীকার না করলে বিশ্বজগৎ হয়ে পড়বে এক দুর্বোধ্য শৃঙ্খলাবিহীন ঘটনা মাত্র। কিন্তু একুইনাসের সমর্থকদের দ্বারা উপস্থাপিত, একুইনাস প্রদত্ত যুক্তিটির পরিবর্তিত রূপটির ক্ষেত্রেও দুটি অসুবিধা দেখা দেয় –
- প্রথমত, যুক্তিটির ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন যেন দেখা দেয় যে, হয় এই বিশ্বজগতের কোন আদি কারণ মেনে নিতে হবে নতুবা বিশ্বজগত শেষ পর্যন্ত দুর্বোধ্য থেকে যাবে। কিন্তু এমন কোন কথা আছে কি যে, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে একটিকে ছেড়ে আমাদের অপর একটিকে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করতে হবে?
- দ্বিতীয়ত, জন হিকের মতে এই যুক্তি বলতে চায় যে কোন ঘটনার কারণ সম্পর্কীয় শর্ত নির্দেশ করা মানে হল ঘটনাটিকে বােধগম্য করা। কিন্তু সমসাময়িক বিজ্ঞানই বলে যে কারণ সম্পর্কীয় নীতি পরিসংখ্যানগত সম্ভাব্যতার কথাই ব্যক্ত করে। তাছাড়া দার্শনিক হিউমের অভিমত অনুসারে কার্যকারণ নিয়ম ঘটনার প্রত্যক্ষযােগ্য পারম্পর্যকেই বুঝিয়ে থাকে। এই জাতীয় ব্যাখ্যা মেনে নিলে টমাস একুইনাসের সমর্থকবৃন্দের দ্বারা উপস্থাপিত যুক্তিকে সমর্থন করা যায় না।
বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক বা আদিকারণ বিষয়ক যুক্তির তৃতীয় রূপ :
বিঘতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির তৃতীর রূপটি জগতের সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়। আমাদের দৈনন্দিন সভজ্ঞতায় আমরা যেসব বস্তু প্রত্যক্ষ করি, সেই সব বস্তুর আবশ্যিক. অস্থিত্ব নেই (do not exist of necessity)। যে টেবিলটিকে অস্তিত্বশীল দেখছি, সেটি অস্তিত্বশীল না হলেও পারত। এই সব বস্তুর সম্ভাব্য অস্তিত্ব (contingent existence) রয়েছে। কাজেই আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কাছে প্রদত্ত যে জগৎ তার কোন নির্ভরতা নেই। এই জগৎ কেবলমান্ত সম্ভাব্য। তাছাড়া এই জগৎ দেশ ও কালের দ্বারা সীমিত। কাজেই কোন অনিবার্য (necessary), স্ব-নির্ভর, সনিরপেক্ষ সত্তা আছে, যা হল ঈশ্বর। কাজেই ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।
কার্যকাৱণ নীতির দিক থেকে ব্যক্ত করতে গেলে বলতে হয় এ হল সেই যুক্তি বলছে, যা অনিবার্যভাবে অস্তিত্বশীল নয় তা অস্তিত্বের জন্য অপরের উপর নির্ভরশীল। কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত সান্ত ও সসীম বস্তুর ক্ষেত্রে যেহেতু অনবস্থা দোষ দেখা দেয়, সেহেতু আমাদের এমন এক সত্তার কথা চিন্তা করতে হয় যা অন্যের উপর নির্ভর করেনা, অস্তিত্বশীল এবং যা হল স্বয়ম্ভু। সসীম বস্তু যেহেতু সম্ভাব্য এবং অপর্যাপ্ত, সম্ভাব্য বস্তুর অস্তিত্বের কারণ তার মধ্যে নিহিত নয়। কিন্তু কেন সেটি অস্তিত্বশীল তার অবশ্যই একটা কারণ থাকবে। সেহেতু এই জগতের আড়ালে এমন এক সত্তার সন্ধান করতে আমরা প্রণােদিত হই, যা স্থায়ী এবং অনিবার্য, যার আবশ্যিক অস্তিত্ব (necessary existence) আছে, যা সব কিছুর কারণ, বস্তুত যা কার্যকারণ নীতির ভিত্তিরূপ। সম্ভাব্যতার ধারণার মধ্যে ঈশ্বরের ধারণা প্রচ্ছন্নভাবে বর্তমান। সম্ভাব্য বললেই যা সম্ভাব্য নয়, অর্থাৎ অনিবার্য, তার প্রশ্ন এসে পড়ে।
লোটজার সমালোচনা : লোটজা আদি কারণের ধারণাতে ‘আবশ্যিকর্তা’ বা ‘অনিবার্যতা’ গুণটির আরােপে আপত্তি জানিয়েছেন। তার মতে আদি কারণ অনিবার্য হতে পারে না, কারণ যা অপরের উপর নির্ভরশীল নয় তা কখনও অনিবার্য হতে পারে না। কিন্তু আদি কারণ কোন কিছুর উপর নির্ভর হতে পারে না। কাজেই আদি কারণ শর্তহীন হতে পারে, কিন্তু অনিবার্য নয়। আদি কারণকে ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করার মাধ্যমে এই যুক্তি যা করেছে তা নিছক অনুমানমুলক। আদি কারণই যে ঈশ্বর সেই সিদ্ধান্তের সমর্থনে যুক্তি কোথায়? তাছাড়া এই যুক্তি ব্যাখ্যা করতে পারে না, কেন এবং কখন এই জগৎ কার্যরূপে অস্তিত্বশীল হয়েছিল। এই যুক্তি শধুমাত্র একটা সত্তার নির্দেশ করে, কিন্তু তার বণনাকে এড়িয়ে যায়। এই সত্তা ঈশ্বর হলেও হতে পারে, কিন্তু যুক্তিটি তা প্রমাণ করতে পারে না।
সাম্প্রতিককালে এর বিরুদ্ধে আনিত যুক্তি : সাম্প্রতিককালে এই যুক্তিটির বিরুদ্ধে দর্শনের দিক থেকে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা হল এই যে, অবশ্যম্ভাবী সত্তার (necessary being) ধারণা দুর্বোধ্য। কেননা কোন বস্তু নয়, শুধুমাত্র বচনই যৌক্তিক দিক থেকে অবশ্যম্ভাবী (logically necessary) গণ্য হতে পারে। কাজেই যৌক্তিক দিক থেকে অবশ্যম্ভাবী বা অনিবার্য এমন কোন সত্তার কথা বলা, ভাষার অপব্যবহার মাত্র। কিন্তু বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির ক্ষেত্রে এই অভিযােগ আনা চলে না। কেননা, যুক্তিটিতে কোন যৌক্তিক দিক থেকে অনিবার্য সত্তার (logically necessary being) কথা বলা হয় নি। ঘটনাগত বা তথ্যগত অনিবার্যতার (factual necessity) কথা বলা হয়েছে, ঈশ্বরের ক্ষেত্রে যা নিজে নিজে অস্তিত্বশীল হওয়ার বিষয়টিকে সূচিত করে। এই কারণে ঈশ্বররূপে অনিবার্য সত্তার ধারণার কথা বলা হলে এমন মনে করা যুক্তিসঙ্গত হবে না যে, এমন কথা বলা হচ্ছে ‘ঈশ্বর অস্তিত্বশীল’ হল যৌক্তিক দিক থেকে এক অনিবার্য সত্য (a logically necessary truth)।
সংশয়বাদীদের জন্য গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয় : দ্বিতীয় যুক্তিটির ক্ষেত্রে যেমন, তৃতীয় যুক্তিটির ক্ষেত্রেও যুক্তিটির রূপ দাঁড়িয়েছে এরকম – হয় কোন অনিবার্য সত্তার অস্তিত্ব আছে, কিংবা বিশ্বজগৎ শেষ পর্যন্ত দুর্বোধ্য থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথম বিকল্পটিকে স্বীকার করে নেয়া যায় যদি দ্বিতীয় বিকল্পটিকে মেনে নেয়া না যায়। অর্থাৎ কিনা, এমন কথা বলা যে, বিশ্বজগৎ দুর্বোধ্য নয়, কাজেই অনিবার্য সত্তার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সংশয়বাদীরা দ্বিতীয় বিকল্পটিকে অস্বীকার করা দুরে থাকুক, সেটিকে স্বীকার করেন। তাহলে আর বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটি সংশয়বাদীদের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে একটি গ্রহণযােগ্য যুক্তি হয়ে ওঠে না।
বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক বা আদিকারণ বিষয়ক যুক্তির চতুর্থ রূপ : মার্টিন্যু এই যুক্তিটির উপস্থাপক। কারণের ধারণার উপর এই যুক্তিটি প্রতিষ্ঠিত, এবং কারণের ধারণায় বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যার সাহায্যে এই যুক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়। ঐতিহাসিক দিক থেকে আমরা কারণ সম্পর্কে চারটি ধারণা পাই –
- (১) কারণ হল কোন দ্রব্য (substance)
- (২) কারণ হল কোন ঘটনা (phenomenon)
- (৩) কারণ হল কোন শক্তি (power)
- (৪) কারণ হল কোন ইচ্ছা (will)। সময় সময় ইচ্ছাকে (will) কারণরূপে গণ্য করা হয়। আত্মচেতনার (self-conscicusness) ক্ষেত্রে আমরা ইচ্ছারূপ শক্তি সম্পর্কে সচেতন, যা বাহ্য জগতে পরিবর্তন ঘটায়।
মার্টিন্যু্যু (Martineau) মনে করেন যে, এই জগতের কারণ বা ভিত্তি হল আমাদের ইচ্ছার মতো কোন ইচ্ছা। এই রকম কোন কারণকে স্বীকার করে নিলেই আমরা কারণের কারণ সন্ধান করা রূপে যে অনবস্থা দোষের উদ্ভব ঘটে, তাকে এড়াতে পারি। আমাদের কাজের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমরা ঐ কাজের ক্ষেত্রে আমাদের যে ইচ্ছাকে প্রয়োগ করি তার সাহায্যে তার ব্যাখ্যা দেই। অনুরূপভাবে এই জগৎ যদি ঈশ্বরের কার্য হয় তাহলে তার ব্যাখ্যা হিসেবে ঈশ্বরের প্রযুক্ত ইচ্ছার কথা আমরা ব্যক্ত করতে পারি। সুতরাং ঈশ্বর জগতের কারণ এই অর্থে যে, ঐশ্বরিক ইচ্ছা হল একটা শক্তি যা প্রাকৃতিক জগতে অন্তঃস্যূত এবং সব জাগতিক ঘটনার নিয়ামক নীতিরূপে ক্রিয়া করে। কাজেই মার্টিন্যু আদি কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন।
ভারতীয় ন্যায়দর্শনে আদি কারণ-বিষয়ক যুক্তি
মূল বক্তব্য : এই জগতের যাবর্তীয় যৌগিক পদার্থ যেমন – সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, সমুদ্র, পর্বত প্রভৃতি পরমাণুর সংযােগের ফলে উদ্ভুত। এগুলো হল কার্য, যেহেতু এগুলো অংশের সমষ্টি বা সমন্বয় এবং দ্বিতীয়ত, এগুলোর অবান্তর মহত্ব বা সীমিত পরিসর (limited dismension) আছে। দেশ, কাল, আত্মা প্রভৃতি কার্য নয়, যেহেতু এরা অসীম দ্রব্য এবং অংশের সংযােগে গঠিত নয়। ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, মরৎ-এর পরমাণু এবং মন কোন কারণের কার্য নয়। কারণ এরা সরল, অবিভাজ্য ও অসীম দ্রব্য। এসব ছাড়া জগতের অন্য সব যৌগিক দ্রব্য কোন কারণের কার্য। কারণ দু’প্রকার – নিমিত্ত কারণ এবং উপাদান কারণ বা সমবায়ী কারণ। জগতের যাবর্তীয় যৌগিক পদার্থের উপাদান কারণ ক্ষিতি, অপ, তেজঃ ও মরুৎ প্রভৃতির পরমাণু হলে প্রশ্ন আসে এদের নিমিত্ত কারণ বা কর্তা কে। এইসব বস্তুগুলোর উপাদান কারণগুলো নিজে নিজেই সংযুক্ত হতে পারে না। যদি কোন কর্তা এইসব উপাদান কারণগুলোর মধ্যে সংযোগ সাধন না করে, তাহলে এই সব সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে আমরা যে সামঞ্জস্য, শৃঙ্খলা, সূক্ষ্ম কলাকৌশল লক্ষ্য করি তা কখনও সম্ভব হত না। সুতরাং এরূপ অনুমান করা যেতে পারে যে, এমন কোন কর্তা আছে যার জ্ঞান, চিকীর্ষা ও কৃতি আছে। অর্থাৎ এই উপাদান কারণগুলো কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে, সেই সম্পর্কে তার অপরােক্ষ জ্ঞান আছে এবং উদ্দেশ্য সাধনের ইচ্ছা ও ক্ষমতা আছে। সেই কর্তা অবশ্যই সবজ্ঞ হবেন। কারণ যিনি সর্বজ্ঞ তার পক্ষেই উপাদান বা পরমাণুগুলো সম্পর্কে অপরোক্ষ জ্ঞান থাকা সম্ভব। সুতরাং এই সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ কর্তা ঈশ্বর ভিন্ন আর কেউ নন।
মার্টিন্যুর যুক্তির সাথে সাদৃশ্য : নৈয়ায়িকদের এই যুক্তির সঙ্গে মার্টিন্যু্যর আদি কারণবিক যুক্তির সাদৃশ্য আছে। মার্টিন্যু জাগতিক কার্যকারণ নীতিকে কেন্দ্র করে তার পরম ভিত্তিরূপে এক চেতন নীতিতে উপনীত হয়েছেন। অনুরূপভাবে নৈয়ায়িকগণ জাগতিক কার্য থেকে শরু করে জাগতিক কারণের কথা চিন্তা করেন এবং জগতের অচেতন জড় উপাদানগুলোর সংযােজক কারণ রূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির সামগ্রিক সমালোচনা
- (১) সংক্ষেপে বলতে গেলে এই যুক্তিটির ভিত্তি হল একটি আদি কারণের (first cause) ধারণা। কিন্তু আদি কারণের এই ধারণা খুবই দুর্বল। কেননা আদি কারণের ধারণা অনুমান করে নেয়, যখন কার্য অর্থাৎ জগতের অস্তিত্ব ছিল না, তখনও আদি কারণ রূপে স্বয়ম্ভু ঈশ্বর অস্তিত্বশীল। কিন্তু, এই অভিমত যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কেননা কার্যকারণ নীতির প্রকৃতি আলােচনা করলে জানা যাবে যে, কার্য ও কারণ একই অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার দুটি দিক (two aspects of one continuous process)। কার্য ছাড়া কারণ অর্থহীন। কাজেই এই যুক্তি যেভাবে কার্যকারণ নীতিকে প্রয়ােগ করতে চায় তা মােটেও বিজ্ঞানােচিত নয়।
- (২) কার্যকারণ নীতি অনুসারে প্রতিটি কার্যের কারণ থাকবে। তার থেকে কি এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে স্বয়ম্ভু ঈশ্বর আদি কারণ?
- (৩) কারণের ধারণার সাহায্যে আমরা অভিজ্ঞতায় প্রদত্ত বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সংযােগ প্রতিষ্ঠা করি এবং তাদের সংগঠিত করি, কাজেই যে ঈশ্বরকে এই অভিজ্ঞতার জগতের অতিবর্তী বলে মনে করা হয়, কোন ব্যাখ্যা বা যুক্তি ছাড়া তার ক্ষেত্রে এই ধারণাটি প্রযুক্ত করা উচিত নয়।
- (৪) জগৎ কার্য, কিন্তু তার কারণ স্বরূপ অসীম ও অনন্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। অসীম ঈশ্বরকে জগতের কারণ বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে কিন্তু এই বিশ্বাসকে যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করা কঠিন।
- (৫) এই যুক্তি অনুমান করে নেয় যে, কারণের বহুত্ব নয়, কারণের একত্বই কার্যকারণ ক্রমের সম্পর্কে যথার্থ মতবাদ। যেহেতু জগতে কার্যকারণ ক্রম বহু, এটা সিদ্ধান্ত করা যুক্তিযুক্ত নয় যে, সব কার্যকারণ ক্রম একটি মাত্র কারণে এসে শেষ হয়েছে। আদি কারণের বহুত্ব অনুমান করতে বাধা কোথায়?
- (৬) কারণ শৃঙ্খলের আদি কারণরূপে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল, যদি এমনটা অনুমান করে নেওয়া হয় তাহলে এরকম প্রকল্পের বিশেষ প্রয়ােজন আছে মনে হয় না। কারণ, এটুকু অনুমান করে নিলেই যথেষ্ট হবে যে, কার্যকারণ শৃঙ্খলের কোন শুরু নেই।
- (৭) গ্যালােয়ে বলেন, প্রমাণ ছাড়া এই জগত রূপ উপাত্তকে (data) সম্ভাব্য বলে অনুমান করা ন্যায়সঙ্গত নয়, এবং যদি তাই হয় তার থেকে এই সিদ্ধান্ত করা চলবে না যে, জগৎ সম্পূর্ণভাবে সম্ভাব্য। তাছাড়া এটা বােধগম্য নয় যে, সম্ভাব্য ঘটনার দ্বারা পূর্ণ জগৎ কিভাবে অনিবার্য সত্তা থেকে নিঃসৃত হয়।
- (৮) আধুনিক কালে এই যুক্তিটির বিরুদ্ধে একটি অভিযােগ উত্থাপিত হয়েছে। বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ক যুক্তি অনুসারে ঈশ্বর অনিবার্যভাবে অস্তিত্বশীল। অনিবার্য এই অর্থে যে তার নাস্তিত্ব ধারণাতীত। ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথা চিন্তা করা হল, বৃত্তাকার বর্গক্ষেত্র চিন্তা করার অনুরূপ। বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তি যখন বলে যে, ঈশ্বর অবশ্যই অস্তিত্বশীল হবে (God must exist), তখন ‘ঈশ্বর কি অস্তিত্বশীল?’ – এই প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তি এই প্রশ্নেরই উত্তর দিতে চায়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি স্বতসিদ্ধ বিষয় হয় তাহলে বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির অবতারণা হয়ে পড়ে অবান্তর বিষয়। ঈশ্বর কি অস্তিত্বশীল? এই প্রশ্ন যখন উথাপন করা হয় তখন ঈশ্বর অস্তিত্বশীল হতে পারে, নাও হতে পারে – এই দুই অভাবনাকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। নতুবা প্রশ্নটি উত্থাপন করার কোন প্রয়ােজন দেখা দেয় না।’ এই অভিযােগটিকেই অন্য ভাবে উপস্থাপিত করে বলা হয় যে, কোন সত্তার অস্তিত্ব কিভাবে স্বতসিদ্ধ হতে পারে? সব সত্তার প্রকৃতি কি এই নয় যে এটি অস্তিত্বশীল হতে পারে, নাও হতে পারে? বৃত্তের গােলাকার হওয়াটা স্বতসিদ্ধ কিন্তু কোন বিশেষ বৃত্তের অস্তিত্ব কখনও স্বতসিদ্ধ হতে পারে না।
- (৯) কান্ট এই যুক্তিটির বিরুদ্ধে একটি অভিযােগ এনেছেন। ‘অনিবার্যভাবে অস্তিত্বশীল’ ঈশ্বর যদি এই জগতকে সৃষ্টি করে থাকেন, যে জগৎ হল সম্ভাব্য, তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, এই জগতের মধ্যেও কিছুটা অনিবার্যতা (necessity) থাকবে। কারণ এটা মনে হয় যে, অনিবার্য সত্তা অনিবার্যভাবেই জগতকে উৎপন্ন করবে (the necessary being must necessarily produce the world)। যদি এই জগতের উৎপাদন অনিবার্য না হয়, তাহলে প্রশ্ন দেখা দেবে ‘কেন অনিবার্য সত্তা জগতকে সৃষ্টি করেছিলেন?’
- (১০) বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তি ঈশ্বরকে এক অনিবার্য সত্তা রূপে কল্পনা করে, যা জগতের অতীত এবং অতিবর্তী (beyond and above the world)। কিন্তু যে অনিবার্য সত্তা জগতের অতীত ও অতিবর্তী, তার জগতের সম্পর্কে করণীয় কিছু আছে বলে মনে হয় না। কাজেই সেই অনিবার্য সত্তাতে কিভাবে জগতের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে?
- (১১) কেয়ার্ড বলেন, বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তি যে অসীম বা অনিবার্য সত্তার কথা বলে, সেই সত্তা প্রকৃতপক্ষে অসীমও নন, অনিবার্যও নন। তিনি অসীম নন, কেননা অসীম সত্তা-বহির্ভূত জগতের সদর্থক অস্তিত্ব অসীম সত্তাকে সীমিত করবে। তিনি অনিবার্য নন কেননা জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক কার্যের সঙ্গে কারণের সম্পর্ক। কিন্তু অকারণ সম্বন্ধের ক্ষেত্রে কার্য যেভাবে কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, কারণও সেইভাবে কার্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যদি এই যুক্তি অনিবার্যতা প্রমাণও করে, সক্ষেত্রে এই অনিবার্যতা ‘অস্তিত্বের অনিবার্যতা’ হবে না, শুধুমাত্র কারণের অনিবার্যতা হবে। গ্যালােয়ে বলেন, “অভিজ্ঞতার ঘটনা থেকে আমরা অভিজ্ঞতার একটা ভিত্তি সন্ধান করব, এই নীতি যুক্তিযুক্ত হলেও, বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তি এই নীতিকে ভ্রান্তভাবে এবং একপক্ষীয়ভাবে কার্যকর করেছে। উপাত্ত থেকে যাত্রা শুরু করে এই যুক্তি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে চায় এবং এমন একটা পদ্ধতি প্রয়ােগ করতে চায় যেটি লক্ষ্যে পৌঁছতে বাধার সৃষ্টি করে। এই প্রমাণকে যদি ত্রুটিমুক্ত করা হয়। তবুও এটি আমাদের জগৎ-অতিবর্তী কোন ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারে না।
কেয়ার্ডের কাছে যুক্তিটির মূল্য
এই যুক্তির সমর্থনে বলা যেতে পারে যে, যদিও এই যুক্তি এক অসীম সত্তার (ঈশ্বরের) অনিবার্য অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, তবু এর নিজস্ব একটা মূল্য আছে। এই যুক্তি ঈশ্বরকে সন্ধান করার জন্য মানব মনে এক দুর্বার আকুলতার সৃষ্টি করে। কেয়ার্ড মনে করেন, মন যে পদ্ধতিতে অসীম সত্তাকে উপলদ্ধি করার পথে চালিত হয়, এই যুক্তিটি হল সেই পথে একটি স্তর। জগতের সসীমতা ও ক্ষণস্থায়িত্ব প্রত্যক্ষ করার সময়ই মন এই অসীম সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রচ্ছন্নভাবে সচেতন। মানুষ সসীমকে অস্বীকার করি কারণ আধ্যাত্মিক জীব হিসেবে আমরা অসীম সম্পর্কে সচেতন এবং তাকে সন্ধান করার জন্য দুর্বার আকুলতা অনুভব করি। কাজেই যৌক্তিক প্রমাণ হিসেবে ব্যর্থ হলেও বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ক প্রমাণের তাৎপর্য হল এই যে, এই যুক্তির মাধ্যমে আমরা একটি উচ্চতর ও সমৃদ্ধতর ধারণায় উপনীত হতে পারি। সসীমকে অস্বীকার করে যে অসীমে আমরা উপনীত হই তা যথার্থ অসীম নয়। কারণ যথার্থ বা প্রকৃত অসীম সসীমকে বিলুপ্ত করে দেয় না, তাকে নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে, তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেয়। কাজেই চিস্তন এমন ধারণার অবেষণ করে, যে নিজেরও ব্যাখ্যা দেয় এবং সসীম জগতেরও ব্যাখ্যা দেয়। এই রকম একটা ধারণায় উপনীত হবার প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করি পরিণাম বা উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যুক্তির মধ্যে।
পরিণাম বা উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যুক্তি (Teleological Argument)
যুক্তিটির মূল বক্তব্য
মনে হয় ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক যতগুলো যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে, পরিণাম বা উদ্দেশ্য সম্বন্ধীয় যুক্তি সবচেয়ে জনপ্রিয়। ইংরেজি ‘Teleological’ শব্দটি গ্রীক ‘Telos’ থেকে উদ্ভূত ধার অর্থ হল, পরিণাম বা উদ্দেশ্য (end)। কাজেই পরিণামমূলক বা উদ্দেশ্যমূলক বিশ্বজগত হল এমন জগৎ বা কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন সৃষ্ট। পরিণাম বা উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যুক্তি উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে একজন সর্বজ্ঞ সত্তার বা উদেশ্যসাধনকর্তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যিনি এই জগতের মধ্য দিয়ে তার কিছু লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সিদ্ধ করেন। জগতের নিয়ম, শৃঙ্খলা, সামঞ্জস্য, ঐক্য স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে, বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই এই জগতের সৃষ্টি। এই জগতের স্রষ্টা কোন সুদক্ষ কারিগর যিনি অসীম ও অনন্ত শক্তিসম্পন্ন। এই জগৎ তার উদ্দেশ্য সাধন করছে। এর স্রষ্টা হলেন ঈশ্বর।
প্রকৃতির মধ্যে, বিশেষ করে জীবজগতের মধ্যে এই উদ্দেশ্য বা পরিণতির অনেক দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়, যা অবশ্যই নির্দেশ করে যে প্রকৃতির আড়ালে কোন উদ্দেশ্য সাধনকর্তার অস্তিত্ব আছে। এই উদ্দেশ্য বা পরিণতির অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্ন প্রকারের পরিবেশ ও কর্মের উপযােগী করে নির্বাচিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোতে এমন সুসামঞ্জস্য বর্তমান যে, আমাদের মনে হয় যেন তাদের ঐ ভাবেই নির্বাচন করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক উপযােগিতার সম্পর্ক রয়েছে, যার ফলে প্রাণীরা বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। প্রাণীরা যাতে আত্মরক্ষা করতে পারে তার জন্য কারও আছে ধারাল নখ, কারও আছে শিং। শীতপ্রধান মেরু অঞ্চলে ভালুকদের আছে বড় বড় লােম। জগতের সর্বত্রই রয়েছে এমন এক সূক্ষ্ম, সুনিপুণ নির্বাচন ব্যবস্থা যার দ্বারা প্রমাণ হয় যে এই জগৎ উদ্দেশ্যমূলক। স্থলচর জীবদের রয়েছে ফুসফুস যাতে তারা শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে। কিন্তু মাছ যাতে জলে দ্রবীভুত বাতাস গ্রহণ করতে পারে তাই তার রয়েছে অন্য ধরনের শ্বাসযন্ত্র ফলিকা। পাখিদের শরীরের হাড় হালকা, যাতে তারা বাতাসে কম ওজনের জন্য উড়তে সক্ষম হয়। দুর্বল প্রাণীরা হয় সতর্ক এবং ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন। কাজেই তাদের দুর্বলতা সত্ত্বেও তারা বেঁচে থাকতে পারে। জগৎ জুড়ে এই উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব একজন উদ্দেশ্য সাধনকর্তার অস্তিত্বের অনুমানকে অনিবার্য করে তােলে এবং এই উদ্দেশ্য সাধনকর্তা হলেন ঈশ্বর। উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে সঙ্গতি, নির্বাচন (selection), সংযােগ (combination) এবং ক্রমিক স্তরভেদ (gradation) প্রকৃতিতে উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আমাদের এই দেহের বিভিন্ন অঙ্গগুলো এমনভাবে সুবিন্যস্ত যে এদের বৃদ্ধি ও বিকাশের মধ্যে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য আছে। দেহের বিভিন্ন অঙ্গগুলো একই সময়ে স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। জীবদেহের গঠনের মধ্যে অংশের এবং সমগ্রের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সামগ্রিক ঐক্য, গঠন সম্পর্কিত সামঞ্জস্য, বিভিন্ন অঙ্গের পারস্পরিক উপযোগিতা নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক। জগতের বিভিন্ন বস্তু, যেমন জড়বস্তু, উদ্ভিদ, নিম্নতর প্রাণী এবং মানুষ – এদের মধ্যে যে ক্রমিক স্তরভেদ লক্ষ্য করা যায়, সেখানে থেকে এই যুক্তির দাবিকারকরা প্রমাণ করতে চান, এই জগৎ উদ্দেশ্যমূলক।
যান্ত্রিক অভিব্যক্তিবাদ উপরের এই বিষয়গুলোকে আকস্মিক বলে মনে করে এবং এগুলোর মধ্যে উদ্দেশ্য নিহিত আছে বলে ধারণা করে না। কিন্তু এই যুক্তির দাবিকর্তারা বলেন, সমস্ত কিছুকেই আকস্মিক গণ্য করার অর্থ হল আকস্মিকর্তার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করা, যা মতবাদ হিসেবে সন্তোষজনক নয়। তাদের কাছে এটা অসম্ভব মনে হয় যে, এই জগতের শৃঙ্খলা এবং সৌন্দর্য নিছক আকস্মিকতারই সৃষ্টি এবং অন্ধ প্রাকৃতিক শক্তির পরিণাম। তাদের মতে জড় জগৎ প্রাণিজগতের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে এবং নিম্নতর প্রাণী তার থেকে উচ্চতর কোন জটিল সত্তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে, কাজেই প্রকৃতির মধ্যে উচ্চতর যান্ত্রিক এবং নিম্নতরের ক্রমিক স্তরভেদ আছে, এবং শেষ পর্যন্ত আমরা সৃশটির সর্বোচ্চ স্তরে-চেতন মানব মনে উপনীত হই। তাদের মতে, অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে আমরা বুঝে নিতে পারি যে প্রকৃতির এই বৈশিষ্ট্য কোন বধিময় ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ। এভাবে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, এক বুদ্ধিময় ইচ্ছাশক্তি এই সুশল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ জগতের সৃষ্টিকর্তা!
আধুনিক যুগে উইলিয়াম পেলে (Willian Paley) তার ‘Natural Theoogy’ গ্রন্ধে পরিণাম বা উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যুক্তির সমর্থনে তার বক্তব্যকে উদাহরণের সাহায্যে উপস্থাপিত করেছেন। একটি ঘড়ির উপমার সাহায্যে তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন যে, একটি মরুভূমিতে ভ্রমণ করতে করতে যদি দেখা যায় যে কোনও একটা বড় পাথর পড়ে রয়েছে তাহলে ওর উপস্থিতিকে আকস্মিক বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ বাতাস, বষ্টি, উত্তাপ, আগ্নেয়গিরি পকীয় ক্রিয়া প্রভৃতির দ্বারা তা সৃষ্ট মনে করা যেতে পারে। কিন্তু ঐ মরুভূমিতে কোথাও একটি ঘদ্ধি পড়ে থাকতে দেখলে কিন্তু অনুপ সিদ্ধান্ত করা চলে না। একটি দড়ির গঠনের জটিলতা, তার অংশগুলোর বিন্যাস এবং একটি লক্ষ্য সিদ্ধ করার জন্য অংশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা প্রভৃতি সকল কিছুই নির্দেশ করে যে, অংশগলির গঠন এবং অংশগুলোকে একত্রিত করে একটি কার্যকর যন্ত্রে পরিণত করা কখনই আকস্মিক ঘটনা হচ্ছে পারে না। ঘড়িটির নির্মাতা হিসেবে কোন বুদ্ধিমান সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার না করে আমরা পারি না। অর্থাৎ ঘড়িটির নির্মাণের ব্যাপারে কোন বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের ক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। পেলে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন যে, এই প্রাকৃতিক জগতও একটি জটিল যন্ত্র এবং ঘড়ির মতোই কোন বুদ্ধিময় সত্তার দ্বারা পরিকল্পিত। সৌরজগতে গ্রহগুলোর আবর্তন, পৃথিবীতে ঋতুচক্র, প্রাণীর জটিল দেহাবয়ব এবং তার দেহের বিভিন্ন অংশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক উপযােগিতা সবই উদ্দেশ্য সাধনকর্তার অস্তিত্ব নির্দেশ করে। মানুষের মস্তিষ্কে সহস্র কোষের সুসংহতভাবে ক্রিয়া করা, চক্ষুর গঠন ও কৌশল এবং তার ক্রিয়া, সকল কিছুই প্রমাণ করে যে, একখণ্ড প্রস্তর যেমন প্রকার শক্তির যান্ত্রিক এলােমেলো ক্রিয়ার দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে, উপরিউক্ত জটিল সূক্ষ্ম বস্তুগুলো সেভাবে উৎপন্ন হতে পারে না।
যুক্তিটির সমালােচনা
কিন্তু এই মতবাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপিত হয়েছে –
- (১) জগতে নিয়ম, শৃঙ্খলা, সামঞ্জস্য যেমন আছে তেমনি অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, অসামঞ্জস্যেরও বহু দৃষ্টান্ত বর্তমান। এই মতবাদের সমর্থকরা এই নঞর্থক দৃষ্টান্তগুলো উপেক্ষা করেছেন।
- (২) সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাহায্যে জগতের অনেক উদশ্যকে প্রাকৃতিক কারণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। জীবদেহের উপযােগিতার বিষয়টিকে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। স্পষ্টতই এই অনুমান ঈশ্বরের অনুমানের তুলনায় সহজ ও সরল। সহজ ও সরল বলে উভয় অনুমান বা প্রকল্পের তুলনায় জীবন সংগ্রামের প্রকল্পটি বিজ্ঞানীদের মতে গ্রহণযােগ্য।
- (৩) জগৎ প্রক্রিয়ার মধ্যে কোন উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব রয়েছে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তা প্রমাণ করা কঠিন। কাজেই এই যুক্তির বিরুদ্ধে অভিযােগ আনা যেতে পারে যে, মানুষের মনের বিচারবুদ্ধির পূর্ব থেকেই কোন উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে, জগতের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে তার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করে। তাছাড়া জগতের মধ্যে অন্তঃস্থিত উদ্দেশ্যের ধারণা বিচারবুদ্ধির দিক থেকে প্রয়োজনীয় মনে করা হলেও তার দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।
- (৪) কান্ট এই যুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতে গিয়ে বলেছেন যে, এই যুক্তি যে ধরনের ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার প্রত্যাশা করে, তা করতে পারে না (it does not. prove the kind of god it is presurnablyex rected to prove)! অর্থাৎ কিনা, এমন এক স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পাবে না যিনি জগতের মধ্যে শুধু শৃঙ্খলা ও উদ্দেশ্যের প্রতিষ্ঠা করেন না, যে জগতে শৃঙ্খলা ও উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত করেন তাকেও সৃষ্টি করেন। পরিণামবিষয়ক যুক্তি একজন মহৎ উদ্দেশ্যসাধনকর্তায় কথা বলে, কিন্তু যার ওপর উদ্দেশ্যকে প্রয়োগ করা হবে তাকে কিভাবে পাওয়া গেল তার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এই কারণেই অনেক সময় পরিণামমূলক যুক্তির সঙ্গে বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটিকে সংযুক্ত করে এর ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যাই করা হােক না কেন, তার দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।
- (৫) এই যুক্তি ঈশ্বরকে সাধারণ যন্ত্রীর মতাে কল্পনা করে, ফলে ঈশ্বরকে অনন্ত বলা যায় না। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান সত্তা হন তাহলে তিনি যে উপাদানের সাহায্যে ক্রিয়া করেন তার দ্বারা তিনি সীমিত হচ্ছেন, এ কিভাবে সম্ভব?
- (৬) কেয়ার্ড এই যুক্তির এটি নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, যে ঈশ্বরের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে আমরা লক্ষ্য বা পরিণাম প্রত্যক্ষ করি। কাজেই লক্ষ্য বা পরিণামের ভিত্তিতে আমরা কিভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলতে পারি? কেয়ার্ড এই যুক্তির দ্বিতীয় এটির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন যে, এই যুক্তিমতে ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক নিছক খেয়াল খুশির সম্পর্ক। এই জগতের অনন্ত জ্ঞানের প্রকাশ প্রত্যক্ষ করতে হলে, এই জগতের এবং জগতের যা কিছু আছে, সব কিছুর অস্তিত্ব ঈশ্বরের প্রকৃতির মধ্যেই সধান করতে হবে, ঈশ্বরের খেয়ালখুশি, ইচ্ছা ও শক্তির মধ্যে নয়। আমরা পূর্ব থেকে যদি ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হই, তাহলে আমরা ঈশ্বরের প্রকৃতির সঙ্গে তার কাজের কোন সম্পর্ক প্রত্যক্ষ না করলেও, সব কিছুই যে ঈশ্বরের অনন্ত জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত করতে পারি, কিন্তু বিপরীত দিক থেকে এই প্রক্রিয়াকে আমরা চিন্তা করতে পারি না। তাছাড়া শুধুমাত্র ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হলেই চলবে না, আমাদের আরও জানতে হবে, যাকে আমরা ঈশ্বর বলছি সেই ঈশ্বর অস্তিত্বশীল কিনা-এটাই আসল প্রশ্ন। কোন কার্য প্রত্যক্ষ করে এবং সেটিকে ইচ্ছা বা শক্তির পরিণাম অনুমান করে আমরা তার স্রষ্টার যথার্থ প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুই অনুমান করতে পারি না, অস্তিত্ব সম্পর্কে তাে নয়ই।
- (৭) এই মতবাদ দ্বৈতবাদের সৃষ্টি করে, কাজেই দ্বৈতবাদের সব দোষত্রুটি এই মতবাদে দেখা দেবে।
- (৮) যারা উদ্দেশ্য বা পরিণতির বিরােধিতা করেছেন মার্টিন্যু তাদের মতবাদ বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তিনি বলেন যে, জাগতিক কারণ, বা স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন উদ্দেশ্য বা পরিণামের প্রতিকল্প গণ্য হতে পারে না। আকস্মিক পরিবর্তন, প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যােগ্যতমের বাঁচার অধিকার প্রভৃতি নীতি, আদি কারণ কোন পদ্ধতিতে ক্রিয়া করে তার বর্ণনা সূচিত করতে পারে, কিন্তু আদি কারণের প্রতীক রূপে তাদের গ্রহণ করা যায় না। যান্ত্রিক অভিব্যক্তিবাদীরা ভুলবশতই চিন্তা করেন যে, যেহেতু তারা জগৎ এবং জগৎ প্রক্রিয়ার ক্রমবিকাশ দেখাতে পারেন সেহেতু কোন বুদ্ধিময় ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব স্বীকারের আবশ্যকীয়তার প্রয়ােজন নেই। যান্ত্রিক প্রক্রিয়া জগৎ প্রক্রিয়ার প্রারম্ভ ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্ত যখন প্রক্রিয়া একবার শুরু হয়ে যায়, তখন সেটি কিভাবে অবিরতভাবে চলতে থাকে, তার ব্যাখা দিতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার, যার সাহায্যে যান্ত্রিক অভিব্যক্তিবাদীরা অস্তিত্বশীল প্রজাতিগুলোকে ব্যাখ্যা করতে চান, তা অসফল মনে হয় কেননা নির্বাচন ও বর্জন প্রক্রিরা তখনই ক্রিয়া করতে পারে যখন নির্বাচন ও বর্জনের বিবরণগুলো পূর্ব থেকেই আছে অনুমান করে নেওয়া যায়। কিন্তু কিভাবে তারা অস্তিত্বশীল হয় তার ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন, যে ব্যাখ্যা যান্ত্রিক মতবাদ দিতে পারে না।
- (৯) ডেভিড হিউম তার ‘Dialogues Concerning Natural Religion’ গ্রন্থে পরিণাম বা উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যুক্তির কঠোর সমালােচনা করেছেন। তার যুক্তিগুলো হলো –
- (ক) এই বিশ্বজগৎ কোন উদ্দেশ্যের পরিকল্পনা মনে জাগিয়ে তোলে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা বিশ্বজগতের অংশগুলোর মধ্যে বেশ কিছু মাত্রায় সামঞ্জস্য নেই, এমন বিশ্বজগতের কথা ভাবাই যায় না। পাখির ডানা রয়েছে অথচ মাছের মতো তারা বাতাসে উড়তে পারছে না, এমন পাখি সৃষ্ট হতে পারে না। একটি পরিবেশে কোন প্রাণীর সুদীর্ঘকাল অবস্থিতি, শৃঙ্খলা এবং পারস্পরিক উপযােগিতা নির্দেশ করে, যাকে কোন উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনার ফলস্বরূপ মনে করা যেতে পারে। কিন্তু সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কোনভাবে এটি সংঘটিত হতে পারে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। হিউম এই প্রসঙ্গে জড় পরমাণু গতির সাহায্যে এই জগৎকে সৃষ্টি করেছে, এমন ভাবনার কথাও ব্যক্ত করেছেন।
- (খ) বিশ্বজগতের সঙ্গে ঘড়ি বা গৃহের উপমা উপমা হিসেবে খুবই দুর্বল। এই বিশ্ব জগৎ কোন বৃহৎ যন্ত্র নয়। একে একটি সুবৃহৎ নিষ্ক্রিয় জীব বা কোন উদ্ভিদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিণাম সম্পর্কে যুক্তি খাটে না, কেননা উদ্ভিদ সচেতন পরিকল্পনার ফল কিনা বিতর্কের বিষয়। কেবলমাত্র বিশ্বজগতকে মানুষের তৈরি কোন যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা হলেই, কোন বুদ্ধিমান উদ্দেশ্যকর্তার অস্তিত্ব অনুমান করা যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
- (গ) যদিও বা যুক্তিযুক্তভাবে এই বিশ্বজগতে স্রষ্টা হিসেবে কোন ঐশ্বরিক পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্বের কথা অনুমান করা চলে তবু, এই ঈশ্বর যে সবশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, দয়াময় হবেন এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না। সসীম জগতের অস্তিত্বের ভিত্তিতে কোন অসীম স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুমান যুক্তিসঙ্গত নয়। বিশ্বজগতের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করে এক ঈশ্বরের ক্ষেত্রে বহু ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করা যেতে পারে বা বিশ্বজগতে অকল্যাণের অস্তিত্ব দেখে সব শক্তিমান দয়াময় ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত নাও হতে পারে।
যুক্তিটির মূল্যায়ন
কেয়ার্ড বলেন যে, পরিণাম বিষয়ক যুক্তির বিরুদ্ধে অভিযােগ করা হয়েছে যে, এক্ষেত্রে ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের যে সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে তা বাহ্য এবং খেয়ালখুশির সম্পর্ক। জগতের নিজস্ব যদি কোন উদ্দেশ্য না থাকে এবং এই জগৎ যদি জগৎবহির্ভূত ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সাধন করে, তাহলে এই পরিণতিবাদ হবে বাহ্যপরিণতিবাদ বা বহিরুদ্দেশ্যবাদ। বহিরুদ্দেশ্যবাদ সন্তোষজনক মতবাদ নয়, বহিরুদ্দেশ্যবাদ দ্বৈতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই মতবাদ স্বীকার করে নিলে জগৎ-বহির্ভূত ঈশ্বর জগতকে সীমিত করবে। ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রীর সম্পর্কের তুল্য হবে। তাছাড়া ঈশ্বর-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র জগৎসত্তার উপর ঈশ্বরের দ্বারা উদ্দেশ্য আরােপ করা কিভাবে সম্ভব?
কিন্তু বহিরুদ্দেশ্যবাদ ছাড়া আর এক ধরনের উদ্দেশ্যবাদ আছে যা হল অন্তঃস্থিত উদ্দেশ্যবাদ বা আন্তর পরিণতিবাদ (Internal teleology)। এই মতবাদ অনুসারে জগতের উদ্দেশ্য জগতের মধ্যেই নিহিত অর্থাৎ জগতের অন্তঃস্থিত এক পরম চেতনময় সত্তার উদ্দেশ্যই জগতের মধ্য দিয়ে প্রকাশমান। কান্ট যদিও এই মতবাদের যৌক্তিকতাকে স্বীকার করেন নি, তবু তিনি এই যুক্তিটির প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, “এই প্রমাণটি সব সময়ই শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করার যোগ্য। এটি সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে সুস্পষ্ট এবং মানবজাতির সাধারণ বিচারবুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি প্রকৃতির আলোচনাকে প্রাণবন্ত করে তােলে, যেমনভাবে এটি ঐ উৎস থেকেই নিজের অস্তিত্ব ও চির নতুন প্রাণশক্তি গ্রহণ করে। আমাদের পর্যবেক্ষণশক্তি নিজে থেকেই যাদের সন্ধান করতে পারত না, এই যুক্তি সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের নির্দেশ দেয় এবং পথনির্দেশক একটা বিশেষ ধরনের ঐক্যের ধারণার মাধ্যমে (by means of the guiding concept of a special unity) আমাদের প্রকৃতির জ্ঞানকে প্রসারিত করে, যে ঐক্যের নীতিটি প্রকৃতি-বহির্ভূত। এই জ্ঞান প্রকৃতির এক পরম সৃষ্টিকর্তায় আমাদের বিশ্বাসকে এত দৃঢ় করে যে, ঐ বিশ্বাস এক দমনীয় সুদঢ় প্রত্যয়ে পরিণত হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক কোন যুক্তিই কান্টের এতটা প্রশংসা লাভ করেনি।
ম্যাকগ্রেগর (MacGregor) এই যুক্তিটির মল্য নিরূপণ করতে গিয়ে বলেন, “যে শৃঙ্খলা ও উদ্দেশ্যের উপস্থিতির সম্মুখীন আমরা হই, তাকে ব্যাখ্যা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে যদি আমরা এক মহৎ উদ্দেশ্য সাধনকর্তা বা পরিকল্পকের অস্তিত্বের অনুমান না করি। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, এই যুক্তি এই ধরনের সত্তার অস্তিত্ব নির্দেশ করে, কিন্তু সাধারণত ‘প্রমাণ’ বলতে যা বােঝায়, সেই অর্থে তাকে প্রমাণ করতে পারে না।” (G. MacGregor : Introduction to Religious Philosophy; Page 119)।
গ্যালােয়ে মন্তব্য করেছেন, পরিণাম সম্পর্কিত যুক্তি বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তিরই একটি সম্প্রসারিত রূপ বা তার বিশেষ প্রয়ােগ ছাড়া কিছুই নয় (the teleological proof is rather an exten sion or a special application of the cosmological proof)। বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির মতোই পরিণাম সম্পর্কিত যুক্তি অনুমান করে যে, জগতের একটা বিশেষ দিক বা বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমানের প্রয়ােজন আছে। বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে জগতকে একটি কার্য রূপে গ্রহণ করে, যুক্তিটি তার কারণকে প্রমাণ করতে চায়, যে কারণ ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ নয়। পরিণাম সম্পর্কিত যুক্তিকে বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির একটি সম্প্রসারিত রূপ বলে গ্রহণ করা হয়, কেননা পরিণাম সম্পর্কিত যুক্তি অনুসারে এই জগতের সামঞ্জস্য ও শৃঙ্খলা উদ্দেশ্যের প্রতীক এবং ঈশ্বর এই উদ্দেশ্যসাধন-কর্তা। কাজেই প্রথম যুক্তির ক্ষেত্রে কার্য থেকে কারণে অগ্রসর হই এবং দ্বিতীয় যুক্তির ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য থেকে উদ্দেশ্যসাধন-কর্তাতে উপনীত হই। অন্য ভাষায় বলা যেতে পারে যে, উভয় যুক্তির ক্ষেত্রে শুরু এবং সিদ্ধান্ত প্রায় একই ধরনের। সেজন্যই এই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, পরিণাম বিষয়ক যুক্তি বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ক যুক্তির সম্প্রসারিত রূপ।
প্রথম তিনটি যুক্তির সমালোচনা
ইতিপূর্বে আমরা যে তিনটি যুক্তি আলোচনা করেছি, কান্টের মতে এই যুক্তিগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। পরিণাম সম্পর্কিত যুক্তি বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তি তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির উপর নির্ভরশীল। কোন কোন দর্শনের ইতিহাস রচয়িতা যুক্তিগুলোকে তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির; আবার কেউ বা বিশ্বতত্ত্ববিষয়ক যুক্তিরই পরিবর্তিত রূপ বলে গণ্য করেছেন। এই সকল যুক্তির বিরুদ্ধে যে সাধারণ অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তাহল এই যে, যে মনে ধর্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়নি, সেই মনে এই সব যুক্তি ধর্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে সফল হয় না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের স্বীকৃতি আদায় করার ক্ষমতা এই সব যুক্তির নেই। বিশ্বাসের রাজ্য থেকে বােধের রাজ্যে যিনি উপনীত হতে ইচ্ছুক, তেমন ব্যক্তিও এইসব যুক্তির দুর্বলতা স্বীকার করেছেন। কেননা, এই যুক্তিগুলোর উপস্থাপকবৃন্দ একটি যুক্তির পরিপূরক হিসেবে আর একটি যুক্তিকে প্রয়ােগ করেছেন যে পদ্ধতি স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে, কোন একটি পদ্ধতিকে স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণ করলে সেটি হবে অপর্যাপ্ত। যে যুক্তি নিজে নিজেই পর্যাপ্ত বা সার্থক তাকে শক্তিশালী করার জন্য বা তার সমর্থনে, তার সঙ্গে অপর যুক্তি যোগ করার প্রয়ােজন হয় না। যাই হােক না কেন, এটা স্পষ্ট যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যেসব যুক্তি আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি, সেগুলোর কোনটিই স্বতন্ত্রভাবে চূড়ান্ত বা সিদ্ধান্তমূলক নয়। এই যুক্তিগুলো সম্পর্কে একথা বলা যেতে পারে যে, একটি অপরটিকে সহায়তা করে, কিন্তু কোন একটিই স্বতন্ত্রভাবে লক্ষ্য সিদ্ধ করতে পারে না। আসলে স্বীকার করতেই হবে যে, এই যুক্তিগুলো প্রমাণ নয়। এরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে না, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা নির্দেশ করে মাত্র। অন্য বিষয়ের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এই যুক্তিগুলো সেই সিদ্ধান্তকে কিছুটা সুদঢ় করে এইমাত্র। কিন্তু কোনমতেই এই শক্তিগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে সুনিশ্চিত প্রমাণরূপে গৃহীত হতে পারে না। গ্যালােয়ে মন্তব্য করেন, “চিরাচরিত প্রমাণগুলোর আশ্রয়বাক্যগুলো এমন নয় যে তাদের যৌক্তিক সিদ্ধান্তরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পাওয়া যেতে পারে।” (“…the premises of the traditional proofs are not such that could yield the existence of God for their logical conclusion.” – G. Galloway: The Philosophy of Religions; Page 391)।
নৈতিক যুক্তি (The Moral Argument)
যুক্তিটির মূল বক্তব্য ও বিভিন্ন দিক
এই যুক্তিটির কিছু রূপ হলো –
- বস্তুগত নৈতিক নিয়মের ভিত্তিতে কোন ঐশ্বরিক নৈতিক নিয়ম রচয়িতার অস্তিত্ব অনুমান করা বা
- নৈতিক মূল্যগুলোকে বস্তুগত (objective) গণ্য করে তার কোন অতীন্দ্রিয় উৎস বা ভিত্তির অনুমান করা বা
- যুক্তির মধ্যে বিবেক (conscience)-এর অস্তিত্বের ভিত্তিতে, এই বিবেকের উৎস হিসেবে কোন অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্ব অনুমান করা ইত্যাদি।
নৈতিক যুক্তির কোন কোন রূপ যদিও প্রাচীন তবু কান্টের নামের সঙ্গেই যুক্তিটি বিশেষ করে জড়িত।
নৈতিক বিশ্বজগৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব নির্দেশ করে : কান্টের মতে মানুষের নৈতিক চেতনা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসকে সমর্থন করে। নৈতিক যুক্তি দেখাতে চায় যে মানুষের নৈতিক অভিজ্ঞতা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নির্দেশ করে। যেভাবে যুক্তিটি উপস্থাপিত হয়েছে তা এরকম – নৈতিক মূল্য বস্তুগত এই অর্থে যে তারা মানবপ্রকৃতির প্রয়োজনীয় গুণ। সুতরাং মানবপ্রকৃতি এই জগতের একটা বাস্তব অংশ, মানুষ মনে করে সে এবং তার মূল্যগুলো বাস্তব এবং তাই এই বিশ্বজগৎ একটি নৈতিক বিশ্বজগৎ (a moral universe)। প্রয়ােজন, কামনা, বাসনা, স্বার্থ, মানুষের প্রকৃতি বা সমাজের গঠনের সাহায্যে নৈতিক মূল্যের ব্যাখ্যা দেয়া যায় না বা অন্য কোন ভাবেও তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, যদি না সেই ব্যাখ্যাকে কোন অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত করা না হয়। অর্থাৎ নৈতিক মূল্যের অপ্রাকৃতিক ভিন্ন কোন প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। এই বিশ্বজগতে মানুষ এবং মঙ্গলের আদর্শের (ideal of goodness ) স্থান আছে, যা মানুষের প্রকৃতির একটা মৌলিক গুণ। কিন্তু এই বিষয়টি স্বীকার করে নিলে, আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে এক চেতন বৌদ্ধিক সত্তার অস্তিত্ব আছে যিনি নৈতিক জীব হিসেবে মানুষের নৈতিক চেতনাকে বিকশিত করেন। এই অতিমানবীয় শক্তি (super-human power) অবশ্যই চেতন এবং বোধিক হবে, যিনি উদ্দেশ্যের কথা চিন্তা করেন এবং সেগুলোকে সিদ্ধ করার জন্য সচেষ্ট হন। সংক্ষেপে, তিনি হবেন একজন পুরুষ (person)। এই পুরুষই হল ঈশ্বর। কাজেই নৈতিক মূল্যকে বস্তুগত গণ্য করলে অবশ্যম্ভাবীভাবে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। নৈতিক বিশ্বজগৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব নির্দেশ করে।
কর্তব্যের চেতনা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সূচিত করে : এই যুক্তি অনুসারে, এই নৈতিক বিশ্বজগতে মানুষের অবশ্যই কর্তব্য সম্পাদনের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু কর্তব্য করার স্বাধীনতা থাকলেও, মানুষের পক্ষে এই জীবনেই তার সব কর্তব্য সম্পাদন করা সম্ভব নয়। নৈতিক বাধ্যতাবােধের সব দাবীকে এই জীবনে পূরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। কাজেই এই জীবনের পরেও একটা ভবিষ্যৎ জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়, এজন্য মানুষকে অমর হতে হবে। এছাড়া আমাদের মধ্যে এই ধারণা কাজ করে যে, আমাদের কর্তব্যের চেতনা, বিশেষ করে পরমকল্যাণকে লাভ করার প্রতি আমাদের কর্তব্যের চেতনা নিছক ভ্রান্তি নয় – এমন একটি সুনিশ্চিত আশ্বাস আমাদের মধ্যে কাজ করে। এই যুক্তি মতে, এই সুনিশ্চিত আশ্বাস ঈশ্বর ছাড়া লাভ করা যায়না। কতব্য সম্পাদনের জন্য মানুষের অনন্ত জীবন এবং ঐশ্বরিক সমর্থনের আশ্বাস প্রয়োজন। এই যুক্তি মতে, মানুষ তার পরমকল্যাণকে লাভ করতে না পারলে তার নৈতিক জীবন নিছক ভ্রান্তি হয়ে পড়ে, কিন্তু মানুষ তার পরমকল্যাণকে লাভ করতে পারবে – সেই আশ্বাস একমাত্র ঈশ্বর দিতে পারে, তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। কান্ট বিচারশক্তিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন (১) শুদ্ধ বিচারশক্তি (pure reason) এবং (২) ব্যবহারিক বিচারশক্তি (practical reason)। শুদ্ধ বিচারশক্তি তথ্য সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। ব্যবহারিক বিচারশক্তি আমাদের একাধিক কর্মপন্থার মধ্যে কোন একটিকে নির্বাচন করতে এবং কোন ইচ্ছাকৃত কার্য করতে সহায়তা করে। উপর্যুক্ত যুক্তিটির প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, কান্টের মতে, তাত্ত্বিক দিক থেকে (theoretically) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে গেলেই সেই যুক্তি আত্মবিরােধিতা দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যবহারিক বিচারশস্তির স্বীকার্য সত্য হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যেতে পারে।
সুখের দিক থেকে যুক্তি : কান্ট বলেন যে আমাদের নৈতিক চেতনা এই দাবি জানায় যে, ধার্মিক অবশ্যই সুখী হবে। কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তিকে আমরা সাধারণত সুখী হতে দেখি না। সাধারণ মানুষের পক্ষে সব ধার্মিক ব্যক্তিকে সুখী করা সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রায়শই দেখা যায়, ধার্মিক ব্যক্তিরা এই জীবনে বহু দুঃখ কষ্টের দ্বারা পীড়িত হন এবং অধার্মিক ব্যক্তিরা উন্নতির চরম শিখরে আরােহণ করে। কাজেই কোন ভবিষ্যৎ জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় যেখানে সব অন্যায়ের সংশােধন করা হয় এবং ধার্মিক ও অধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের নিজ নিজ কাজের প্রতিফল লাভ করে। তাছাড়া যেহেতু এই জীবনে যেমন ধার্মিকতা ও সুখের মধ্যে কোন অনিবার্য সংযােগ নেই, তেমনি এই জীবনকে একটি ভবিষ্যৎ জীবনের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেও সেই অনিবার্যতার সন্ধান পাওয়া যাবে না যা ধার্মিকতাকে সুখের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। কাজেই কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয় যিনি নিরপেক্ষ বিচারক হিসেবে ধার্মিকর্তা ও সুখের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবেন। কাজেই ধার্মিক ব্যক্তিকে জীবনে সুখী করা না গেলেও ঈশ্বর পরকালে তাকে সুখী করতে পারেন। কাজেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়।
মার্টিন্যুর যুক্তি (Martineau’s argument) : মার্টিন্যুর মতে নৈতিক দায়িত্ব ও নৈতিক আদর্শ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। মানুষের নৈতিক দায়িত্ব কার কাছে? সসীম মানুষের কাছে হতে পারে না, কারণ সসীম মানুষের পক্ষে মানুষের সব অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত হওরা সম্ভব নয়। কাজেই এই দায়িত্ব কোন সর্বজ্ঞ অসীম পূর্ণ সত্তার কাছে। এই সত্তাই ঈশ্বর। তাছাড়া নৈতিক আদর্শের পূর্ণতা কোথায়? নিশ্চই কোন সত্তার মধ্যে এই আদর্শ পূর্ণতা লাভ করেছে। তা না হলে এই নৈতিক আদর্শ অবাস্তব ও মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। এই আদর্শ ঈশ্বরে পূর্ণতা লাভ করেছে, সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়।
ভারতীয় দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে প্রদত্ত নৈতিক যুক্তি : এখানে ন্যায় দর্শন ও যোগ দর্শনের নৈতিক যুক্তি উল্লেখ করা হলো। ন্যায় দর্শন ও যোগ দর্শন দুটোই আস্তিক দর্শন।
- ন্যায়দর্শনের নৈতিক যুক্তি : এই জগতের বিভিন্ন মানুষের অবস্থার মধ্যে আমরা তারতম্য লক্ষ্য করি। কোন ব্যক্তি জ্ঞানী, কোন ব্যক্তি মূর্খ; কেউবা সুখী, কেউ-বা দুঃখী; কেউ-বা ধনী, কেউ-বা দরিদ্র। মানুষের অবস্থার এই তারতম্যের কারণ কি? মানুষ নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী ফলভােগ করে। ‘যেমন কর্ম সম্পাদন, তেমন ফলভোগ” – এই নৈতিক কর্মবাদই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই নীতি অলঙ্ঘনীয়, কোন ব্যক্তির পক্ষেই এই নীতিকে লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। কার্যকারণ নীতি অনুসারে প্রতিটি কার্যেরই একটা কারণ আছে এবং এই নিয়ম নৈতিক জগতে কর্মবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছে। জীবের সৎকর্ম ও অসৎকর্ম সম্পাদনের ফলে পুণ্য এবং পাপরূপ অদৃষ্টশক্তির আবির্ভাব ঘটে। জীবের সঞ্চিত পাপ-পুণ্যকেই অদৃষ্ট বলা যেতে পারে। এই অদৃষ্টের জন্যই জীবের সুখ ভােগ এবং দুঃখ ভােগ, কিন্তু এই অদৃষ্টশক্তি অচেতন। তার পক্ষে কমফল অনুযায়ী কার কতটুকু প্রাপ্য তা বিচার করা সম্ভব নয়। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে যে, এমন কোন সবজ্ঞ বা সর্বশক্তিমান নিয়ামক কত আছেন যিনি এই অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রিত করেন এবং জীবের কর্ম অনুযায়ী তার পাপ-পুণ্যের বিচার করে তার ফলভােগের ব্যবস্থা করেন। এই কর্তা কে? ঈশ্বরই হলেন এই কর্তা বা অধিষ্ঠাতা।
- যোগদর্শনের নৈতিক যুক্তি : যােগদর্শনে এই নৈতিক যুক্তিটিকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। জীবের কর্মফলানুযায়ী এই জগৎ সৃষ্টির জন্যেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়। জীবের পক্ষে নিজের অদৃষ্টকে নিজে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব নয়, কারণ জীবের জ্ঞান সীমিত এবং জীব যেহেতু নিজের অদৃষ্ট সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত নয়, তার পক্ষে নিজের অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব নয়। প্রকৃতি এবং কর্ম থেকে জাত যে অদৃষ্টশক্তি উভয়ই অচেতন। সুতরাং তাদের পক্ষেও জীবের অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রিত করে এই শৃঙ্খলাপূর্ণ, সুসমঞ্জস ও নিয়মসঙ্গত জগৎ সৃষ্টি সম্ভব নয়। সুতরাং কোন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, পূর্ণ, সগুণ ও সক্রিয় পুরুষের পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব, এই পুরুষ হলেন ঈশ্বর।
নৈতিক যুক্তির মূল্যায়ন ও সমালোচনা
যুক্তিটির গুণ : ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে প্রদত্ত যুক্তিগুলোর মধ্যে নৈতিক যুক্তিকেই সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি বলে সাধারণত গণ্য করা হয়। বস্তুত, এই যুক্তিটির যথেষ্ট গুরত্ব আছে মনে করা যেতে পারে যদি নৈতিক মূল্যকে নিছক কাল্পনিক বস্তু রূপে গণ্য না করে এই জগৎশৃঙ্খলার বাস্তব গুণ বলে গণ্য করা হয়। মানুষ এবং তার মূল্য যদি প্রকৃতই বাস্তব হয়, যদি নিছক অবভাস (appearance) না হয়, যদি তার মুল্যগুলো যথার্থই কোন পরম এবং অনন্ত তাৎপর্যের প্রকাশক হয়, সংক্ষেপে, এই জগৎ যদি প্রকৃতই নৈতিক জগৎ হয়, তাহলে এই জগতের পরিচালকরূপে কোন পরমাত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, নৈতিক মূল্যকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কী? সত্যই কি আমরা নৈতিক মূল্যকে বাস্তব বলে গণ্য করতে পারি? মানুষ তার নৈতিক জীবনে আদর্শকে লাভ করার জন্য সংগ্রাম করে, কিন্তু এই আদর্শকে তার অভিজ্ঞতার মধ্যে সে পরিপূর্ণভাবে উপলদ্ধি করতে পারে না, কেননা এই আদর্শ তার অভিজ্ঞতার অতিবর্তী। কিন্তু যদিও এই আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে উপলদ্ধি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবু এই আদর্শকে সে বাস্তব মনে করে এবং এই আদর্শের আলােকেই সে মানুষের আচরণের মূল্যায়ন করে। তার কাছে মনে হয় আদর্শের যথার্থই বাস্তব ভিত্তি আছে এবং এই আদর্শ মানুষের অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ, তার মনে হয় এই জগতের শৃঙ্খলা অংশত নৈতিক শৃঙ্খলা, তাই মঙ্গল বা কল্যাণ প্রকৃতই বস্তুগত এবং বস্তুর প্রকৃতির গুণবিশেষ। এসব কারণে অনেকে মনে করেন যে, নৈতিক যুক্তি যদিও ঈশ্বরের অস্তিত্বের সুনিশ্চিত প্রমাণ নয়, তবু নাস্তিকদের ঈশ্বরের অস্তিত্ব-বিরােধী যুক্তির সদর্থক উত্তর। এই যুক্তি ব্যক্তিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের যৌক্তিক অধিকার দান করে। ১৯শ শতাব্দীতে এবং ২০শ শতাব্দীর প্রথমভাগে এই যুক্তিটির যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এর কারণ হল, যুক্তিটি শক্তিশালী, আকর্ষণীয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এটি দৃঢ় বিশ্বাস জাগ্রত করতে সক্ষম। তর্কবিজ্ঞানসম্মত যুক্তির কথা বাদ দিলে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তার বিকাশে এর অভিনব গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্যান্য যুক্তির মতোই এটি ঈশ্বরের অস্তিত্বে স্বীকৃতি দেবার জন্য মানুষকে বাধ্য করতে অসমর্থ হয়। যা অন্যান্য যুক্তিগুলো পারে না, এই যুক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ-সম্পর্কিত সমস্যাটির প্রতি মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করে। আসল কথা, যে মানুষের মন ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে প্রস্তুত, এমন কোন যুক্তির কথা আমরা চিন্তা করতে পারি না, যা তার কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে।
যুক্তিটির বিরুদ্ধে ম্যাকগ্রেগরের বক্তব্য : ম্যাকগ্রেগর (MacGregor) এই যুক্তির সমালােচনায় বলেন, ‘ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এমন ব্যক্তির কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার যুক্তি রূপে এটি চক্রক দোষে দুষ্ট। কারণ অবিশ্বাসী ব্যক্তিটি যদি নৈতিক মূল্যের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন, তাহলে যুক্তিটির প্রবর্তকবাদ নিশ্চল সমাপ্তির মুখে উপনীত হন।’ (G. MacGregor : Introduction to Religious Philosophy : Page 126)। তিনি আরও বলেন, “নৈতিক যুক্তির বিরুদ্ধে অভিযােগগুলো তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। শেষােক্ত যুক্তির সমর্থকবৃন্দ যেমন ঈশ্বরের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধের আশ্রয়ের সন্ধান করেন, তেমনি নৈতিক যুক্তির সমর্থকবৃন্দ ঈশ্বরের মধ্যে মানুষের জীবনে উপলব্ধ মূল্যগুলোর আশ্রয়ের সন্ধান করেন।” (a home in God for values as these are experienced in human life)। তিনি বলেন, “কান্ট যেভাবে নৈতিক যুক্তিটিকে উপস্থাপিত করেছেন সেটি অন্যান্য যুক্তিগুলো যেভাবে তর্কবিজ্ঞানসম্মত যুক্তিগুলোর সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেভাবে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে নৈতিক ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত।” (প্রাগুক্ত পৃ. ১২৭) কান্টের মতে মানুষের নৈতিক চেতনা এবং নৈতিক মর্যাদা ঈশ্বরকে এক স্বীকার্য সত্য রূপে স্বীকার ভরার দাবী জানায়। কিন্তু আমার নৈতিক চেতনা এবং নৈতিক মর্যাদা তা দাবি করলেও আমি আমার নাস্তিক বন্ধুকে তার নৈতিক চেতনা এবং নৈতিক মর্যাদাও তাই দাবি করছে, এই মতে স্বীকৃতি জানাতে বাধ্য করতে পারি না। ঈশ্বরে অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে নৈতিক যুক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করতে পারে না (as a part of the existence of God the moral argument cannot compel assent)।
যুক্তিটির বিরুদ্ধে ওয়াটারহাউসের বক্তব্য : কান্টের নৈতিক যুক্তির সমালােচনায় ওয়াটারহাউসের (Waterhouse) বক্তব্য হল যে, কান্ট ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন, তাই এই যুক্তির অবতারণা। বিচারবুদ্ধি যে সেই বিশ্বাসের ভিত্তি যুগিয়ে দিতে পারে, কান্ট নিজেই সেই ধারণাকে বাতিল করে দিয়েছেন। তার নিজের কর্তব্যবোধ তাকে কর্তব্যবােধের বিষয়টির উপর গুরত্ব আরোপ করে এমন সিদ্ধান্ত টানতে প্রণোদিত করেছিল, যে সিধান্ত যুক্তিযুক্তভাবে আশ্রয়বাক্য থেকে নিঃসৃত হয় না।
নৈতিক যুক্তির বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ : এই যুক্তির বিরুদ্ধে অন্যান্য যেসব অভিযােগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো হল –
- ১। নৈতিক মূল্যের কোন প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। কোন ব্যাখ্যা দিতে গেলে তার অপ্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতেই হবে – এরকম বক্তব্যের অর্থ হলো যে বিষয়টিকে প্রমাণ করতে হবে তাকে বিনা বিচারে স্বীকার করে নেওয়া।
- ২। জন হিক নৈতিক যুক্তির সমালােচনায় বলেন যে, নৈতিক মূল্য আমাদের মনে ধর্ম সম্পর্কিত বিশ্বাস যা ঈশ্বরে বিশ্বাস জাগ্রত করে, একথা মেনে নিলেও, একে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে একটি সন্তোষজনক শক্তি রূপে গ্রহণ করা যায় না। নৈতিক বাধ্যতাবোধের সাবভৌম কর্তা হলেন ঈশ্বর অর্থাৎ আমাদের নৈতিক বাধ্যতাবোধ ঈম্বরের কাছে – এমন সিদ্ধান্ত বিতর্কমূলক এবং যদি এটা স্বীকার করে নেওয়াও যায় যে, নৈতিক মূল্যের উৎস হল কোন অতীন্দ্রিয় সত্তা, সেই সত্তা যে কোন অসীম, সর্বশক্তিমান, স্বয়ম্ভূ, সর্বোত্তম পুরুষ, জগৎ স্রষ্টা ঈশ্বর , তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে।
- ৩। ধার্মিককে সুখী হতেই হবে এমন প্রমাণ কোথায়? গালােয়ে (Galloway) কান্টের এই যুক্তির সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, “এই সবকিছু খুবই কৃত্রিম। যে উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে মানুষ একজন ঈশ্বরকে স্বীকার করে নেবে, এই যুক্তি সেই উদ্দেশ্যের মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনা নয়, বা এই যুক্তি কান্টের নিজেরই যুক্তিবাক্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় যে, যে সুখকে তিনি অভিজ্ঞতামূলক এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় বলে গণ্য করেন তাকে পরমকল্যাণের একটি উপাদানের স্তরে উন্নীত করা হবে।” নৈতিক দায়িত্বের জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলে নৈতিকতা স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা দোষদুষ্ট হবে। তাছাড়া যদি কেউ নৈতিক বাধ্যতাবােধের বিষয়টিকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (social sanctions)-এর সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে চান তাহলে কান্টের কিছুই বলার থাবে না।
জাস্ট ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিজ : জাস্ট ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিজ বা ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প নামক কগনিটিভ বায়াসের কারণে মানুষের মনে হয় কোন অতিপ্রাকৃত সত্তা বা মেকানিজম জগতের নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছে। এর ফলে ভালরা পুরস্কৃত ও মন্দরা শাস্তি লাভ করবে। মনস্তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণাসমূহের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এরকম বায়াসের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই বায়াসের কারণে মানুষ এই দুঃখদুর্দশাময় পৃথিবীর নানান ভোগান্তির ফলে নিজের মনে সৃষ্টি হওয়া মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন বা সাইকোলজিকাল ডিসট্রেস থেকে নিজেকে রক্ষা করে। এর কারণেই মানুষের মনে হয় জগতে একটি ন্যায়বিচারক সত্তা বা কৌশল বিদ্যমান যা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু বাস্তবে এরকম কোন সত্তা বা মেকানিজম দ্বারা ন্যায্য বিশ্ব রক্ষিত হয়না।
বিশেষ ধরনের ঘটনা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি (The Argument from Special Events and Experiences)
অনেকে দাবী করেন যে এমন অনেক বিচিত্র ঘটনা এবং অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে ঘটে, যার প্রাকৃতিক বা লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। এই সব বিশেষ ধরনের ঘটনা বা অভিজ্ঞতা বহুক্ষেত্রেই সাধারণের কাছে প্রত্যক্ষগােচর হয়। যেমন নানা ধরনের লৌকিক ঘটনা, ব্যক্তির অলৌকিকভাবে প্রার্থনা পুরণ এবং অভীষ্ট সিদ্ধির ঘটনা প্রভৃতি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে বলে অনেকে মনে করেন। এছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা, যা ঈশ্বরের অস্তিত্বব প্রমাণ করে বলে অনেকে ধারণা করেন। যুক্তিগত ঈশ্বর-সাক্ষাৎকারের বা ঈশ্বর-দর্শনের অভিজ্ঞতা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে রহস্যপূর্ণ সচেতনতা, স্বপ্নে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা, ঈশ্বর সান্নিধ্যের অলৌকিক অভিজ্ঞতা, অলৌকিকবাণী শ্রবণ করা, ভাবাবেশ, দিব্যদষ্টি প্রভৃতির অভিজ্ঞতা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে সার্থক যুক্তি বলে অনেকে মনে করেন।
এর সমালােচনায় জন হিক বলেন যে, ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা যদি ঘটে এবং সেগুলো যদি যুক্তির প্রত্যক্ষগােচর ঘটনা হয় তাহলে সেই যুক্তি যতই সংশয়বাদী হােন না কেন, তার মধ্যে ঈশ্বরে বিশ্বাস জাগ্রত হয়। কিন্ত এইরূপ ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেননি তাদের কাছে উপরিউক্ত ঘটনাগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে সাধারণ যুক্তিরূপে গণ্য হতে পারে না। ঐ জাতীয় ঘটনার প্রাকৃতিক বা লৌকিক ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টাই তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হবে। ডেভিড হিউম ‘অলৌকিক’-এর সমালোচনায় যা বলেছেন তা প্রণিধানযােগ্য (An Enquiry concerning Human Understanding, See Chapter X (ON MIRACLES)) –
- প্রথমত, ইতিহাসে এমন কোন অলৌকিক ঘটনার কথা জানা যায় না যে ঘটনা বহু সংখ্যক ব্যক্তি, যাদের জ্ঞান, শিক্ষা, বুদ্ধি, বিদ্যা সন্দেহাতীত, তাদের দ্বারা সত্যই অলৌকিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
- দ্বিতীয়ত, অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাসের একটা সাধারণ প্রবণতা মানুষের মধ্যে দেখা দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে আবেগ ও অতিরিক্ত বিশ্বাস প্রবণতাকে সংযত করে অলৌকিক ঘটনাগলিকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে তাদের প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হয় না।
- তৃতীয়ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, হিউমের অভিমত, অলৌকিক ঘটনার অভিজ্ঞতা অজ্ঞ ব্যক্তিদের হয়ে থাকে।
- চতুর্থত, কোন অলৌকিক ঘটনার অভিজ্ঞতার কোন প্রমাণ প্রদত্ত হলে অসংখ্য ব্যক্তিকে তার বিরােধিতা করতে দেখা যায়।
পরমনােবিদ্যা (Parapsychology) নামে একটি ছদ্মবিজ্ঞানশাখা রয়েছে, যা বিজ্ঞানের ভেক ধরে দূরদর্শন, পূর্বজন্ম-স্মৃতির অভিজ্ঞতা প্রভৃতি অলৌকিক ঘটনার প্রাকৃত ব্যাখ্যা দিতে সচেষ্ট, এবং এগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ ধরনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান, সেই সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, এই সব অভিজ্ঞতা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অকাট্য যুক্তি বলে গণ্য হতে পারে না। কোন যুক্তির একটা বিশেষ ধরনের অভিজ্ঞতা হতে পারে, কিন্তু এর নির্ভুল ব্যাখ্যা ধর্মতত্ত্ব-ঈশ্বরতত্ত্ব নয়, বরং মনোবিজ্ঞানই দিতে পারে, মানুষ কেন ভুলভাবে এসব অলৌকিক অভিজ্ঞতা লাভ করে তাই মনোবিজ্ঞান তুলে ধরার চেষ্টা করে। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, যে বিশেষ ঘটনা বা বিশেষ অভিজ্ঞতা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করছে বলে দেখানো হয় তাকে যে অন্যভাবে দেখানো বা উপস্থাপিত করা যায় না এমন নয়। সেক্ষেত্রে ঐ বিশেষ ঘটনা বা বিশেষ অভিজ্ঞতাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ সম্পর্কিত অকাট্য যুক্তি বলে গণ্য করা চলে না।
ভারতীয় দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বিষয়ক আরও কতকগুলো যুক্তি
(ক) শাস্ত্রের প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তি (Argument from the authoritativeness of the scriptures) : ন্যায় দর্শনে ও যোগ দর্শনে এই যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে। নৈয়ায়িকদের মতে শাস্ত্রের প্রামাণ্য সব ধর্মেই স্বীকৃত। বেদ প্রামাণ্য গ্রন্থ ও বেদের সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়। কিন্তু বেদকে প্রামাণ্য মনে করার কারণ কি? উত্তরে বলা হয়, বেদের প্রামাণ্য হল আপ্ত-প্রামাণ্য। বেদের রচয়িতা কোন জীবাত্মা নয়, কোন সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান আত্মাই বেদের কর্তা, সাধারণ মানুষের ভ্রমপ্রমাদাদি থাকার জন্য তারা বেদের রচয়িতা হতে পারে না। একমাত্র ঈশ্বর যদি বেদ রচনা করেন, তবেই বেদ অভ্রান্ত ও প্রামাণ্য হতে পারে। এ ছাড়াও বেদে বহু, অলৌকিক বিষয়ের উল্লেখ আছে। এই সব অলৌকিক বিষয় কোন সাধারণ জীবের প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে না। সুতরাং অলৌকিক শক্তিসঙ্গম, সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ কোন পরমাত্মাই বেদের কর্তা। যেহেতু তিনি সর্বজ্ঞ, সেহেতু তিনি ত্রিকালজ্ঞ। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং যাবতীয় অলৌকিক বিষয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান তার আছে। এই সব পরমাত্মাই হলেন ঈশ্বর। এই যুক্তির সমস্যা হলো এখানে বেদকে দিয়েই বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা অযৌক্তিক, আর তারপর বেদের ওপর ভিত্তি করে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
(খ) শ্রুতির যুক্তি (The Argument from the Testimony of Sruti) : বেদে ঈশ্বরকে পরমাত্মা, পরমপুরুষ, পরমতত্ত্ব ও জ্ঞানকর্তারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বেদে ঈশ্বরকে সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়কর্তারূপে, জীবাত্মার নিয়ামক কর্মফলদাতারূপে, বিশ্বজগতের নৈতিক শাসনকর্তারূপেও বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে যেহেতু শ্রুতি অভ্রান্ত প্রমাণ এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে সেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, যুক্তি শাস্ত্রের প্রামাণ্য স্বীকার করে নেবে কেন? এই প্রশ্নের যথার্থ কোন উত্তর দেওয়া সহজ নয়। তবে নৈয়ায়িকরা বলেন যে, যারা প্রত্যক্ষভাৱে ঈশ্বরকে উপলদ্ধি করতে সমর্থ হননি তাদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের আপ্তবচনের উপর নির্ভর করাই শ্রেয়, যেহেতু শাস্ত্রে ঋষিদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকারের উপলব্ধির কথা লিপিবদ্ধ আছে, সেহেতু শাস্ত্রগুলোকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করা উচিত। এখানে ঋষির জ্ঞানকে অযৌক্তিকভাবে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হয়, ঋষি সত্যদ্রষ্টা এমন দাবি করে শ্রুতি বা বেদকে প্রামাণ্য দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে ঋষির জ্ঞানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা অযৌক্তিক, ঋষির জ্ঞান সত্য তারই বা প্রমাণ কী? এছাড়া আধুনিক ভাষাতত্ত্ব শ্রুতির পেছনে থাকা ওরাল ট্রেডিশন নিয়ে, কিভাবে এই ওরাল ট্রেডিশন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে হতে বেদের মত গ্রন্থের উদ্ভব ঘটাতে পারে তা দেখিয়ে দেয়।
(গ) অনবচ্ছেদ নীতির ভিত্তিতে যুক্তি (Argument from the Law of Continuity) : এই নীতি অনুসারে যা কিছু তারতম্যযুক্ত তার একটা সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন স্তর স্বীকার করতে হয়, যেমন পরিমাণ। অল্পতার সর্বনিম্ন স্তর হল পরমাণু, আর বৃহতের চরম সীমা আকাশ। সেইরূপ জ্ঞান এবং শক্তির ক্ষেত্রেও এই তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। কারও জ্ঞান এবং শক্তি কম, কারও তুলনায় কিছু বেশি, কারও আরও বেশি, এইভাবে আমরা চরম সীমায় উপনীত হই। সুতরাং, এমন কোন পুরুষ আছেন যার মধ্যে জ্ঞান ও শক্তি চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে। সাধারণ পুরষের জ্ঞান ও শক্তি সীমিত। সুতরাং ঈশ্বর হলেন পুরুষবিশেষ, যিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান; তিনি জ্ঞান ও শক্তির পরাকাষ্ঠা। পরিমাণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্নের ভিত্তিতে জ্ঞান ও শক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্নকে কল্পনা করা হয়েছে, চরমসীমার কল্পনা করা হয়েছে যাকে ঈশ্বর হিসেবে সূচিত করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে চরম সীমা কল্পনা করলে চরম সীমারও উপর চরম সীমা কল্পনা করা যায়, এভাবে অসীম পর্যন্ত ভাবা যায়। আর এখানে এমন ঈশ্বর কল্পনা করা যায় বলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এভাবে যুক্তিটি তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা নিয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
(ঘ) পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগকর্তারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ ( Argument from the association and disassociation of Purusa and Prakriti) : যোগশাস্ত্রকারের মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার অন্যতম প্রমাণ হল, ঈশ্বরই পুরুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সংযােগ ঘটিয়ে প্রকৃতির অভিব্যক্তিকে সম্ভব করে তােলেন। সাংখ্যমতে পুরুষ ও প্রকৃতির সংযােগহেতু এই জগতের অভিব্যক্তি। পুরুষ ও প্রকৃতি দুটি নিত্য স্বতন্ত্র বিরুদ্ধস্বভাবসম্পন্ন সত্তা। পুরুষ চেতন, কিন্তু নিষ্ক্রিয়। প্রকৃতি অচেতন, কিন্তু সক্রিয়। পুরুষ ও প্রকৃতি – এই দুটি বিরুদ্ধ স্বভাবসম্পন্ন নিত্য সত্তার মধ্যে কিভাবে সংযোগ ঘটতে পারে? একমাত্র কোন সর্বজ্ঞ শক্তিমান পূর্ণ চেতন পুরুষের দ্বারাই সংযোগ ঘটানো সম্ভব। এই পুরুষ কোন সাংসারিক জীব হতে পারে না। এই পুরুষ হল ঈশ্বর। আধুনিক বিজ্ঞানে এরকম নিষ্ক্রিয় চেতনশীল পুরুষ ও সক্রিয় চেতনাহীন প্রকৃতির অস্তিত্ব মানা হয়না, এদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় এমন এভিডেন্সও দেয়া যায়নি, এদের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
(ঙ) শঙ্করের ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক প্রমাণ (Sankara’s proof of God) : শঙ্করের মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। পাশ্চাত্য দার্শনিক কান্টও অনুরূপ সিধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক সব প্রমাণই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা নির্দেশ করে মাত্র। যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ঈশ্বরের বাস্তবতাকে প্রতিপন্ন করা যায় না, কেননা ঈশ্বর অভিজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধির অতিবর্তী। সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যেই ঈশ্বরের বাস্তবতা প্রতিপন্ন হতে পারে। এতির মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা, পালনকর্তা ও ধংসকর্তা। ঈশ্বরের বাস্তবতা, শঙ্করের মতে কোন যৌক্তিক সত্য, বা স্বতসিদ্ধ সত্য নয়, বরং অভিজ্ঞতার দিক থেকে স্বীকার্য সত্য, যেটির ব্যবহারিক উপযােগিতা আছে।
ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক যুক্তিগুলোর সামগ্রিক মূল্যায়ন
ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক যুক্তিগুলো আলোচনা করে দেখা গেল যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে এগুলো ব্যর্থ। বার্গ বলেন, “পরিচিত প্রমাণগুলো হয় প্রমাণ হিসেবে ব্যর্থ, কিংবা যা তারা প্রমাণ করে তা ধর্মের ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কিছু।” (W.G. De Burgh: Towards Religious Philosophy; Page 40)। যুক্তিগুলো কম বা বেশি মাত্রায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা সূচিত করে। কিন্তু যারা অকাট্য যুক্তির সন্ধান করেন, সেসব ব্যক্তিদের মনে এই যুক্তিগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস জাগ্রত করতে ব্যর্থ হয়। প্রমাণ বলতে বােঝায় বক্তব্য বিষয়ের মধ্যে যৌক্তিক সংযােগ (logical connection) এবং জগৎ ও জগতের প্রকৃতি থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করার অর্থ হল, আশ্রয়বাক্যে যা নেই তার অধিক কিছু সিদ্ধান্তে স্বীকার করে নেয়া, যার ফলে সিদ্ধান্ত হয়ে পড়ে আশ্রয়বাক্যের তুলনায় ব্যাপকতর। ধর্ম যে ঈশ্বরেরর কথা বলে, কোন অবরােহ যুক্তির সাহায্যে তাকে লাভ করা সম্ভব নয়।
তবে প্রমাণ হিসেবে ব্যর্থ হলেও এই যুক্তিগুলো একেবারে মুল্যহীন নয়। এই যুক্তিগুলো দেখায়, ধর্মবিশ্বাসের দাবীকে বিচারবুদ্ধি কিভাবে সমর্থন করতে পারে এবং ভাবনাত্মক চিন্তনের দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে কিভাবে সমর্থন করা যেতে পারে। অর্থাৎ মানুষ কিভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, এবং এই বিশ্বাসের কারণে তারা কিরকম চিন্তা-ভাবনার আশ্রয় নেয় ও তাকে ভ্যালিডেট করার চেষ্টা করে, মানবচিন্তনের এইসব দিকগুলো এই যুক্তিগুলো থেকে ফুটে ওঠে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তিগুলো মানুষের মনে এই বিশ্বাস জাগায় যে, তার ধর্ম কোন অবিচারবুদ্ধিজনিত মনােভাব (non-rational attitude)-এর প্রকাশক নয়। যুক্তির সাহায্যে ঈশ্বরে উপনীত হবার এই প্রচেষ্টা মানবাত্মার একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রবণতা, একে ধর্মীয় চেতনার কেন্দ্রীয় বিষয়রূপে গণ্য করা যেতে পারে। এই প্রবণতা মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তাকে তার পরিবেশের, তার জগতের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে চায়। আর এভাবে পরমসত্তাকে ঈশ্বর বলে অভিহিত করে, তার মধ্যেই মানুষ চিন্তন ও জীবনের গভীরতর ভিত্তির সন্ধান লাভ করতে চায়। কোন ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি যে এই যুক্তিগুলোর সাহায্যেই তার লক্ষ্যে উপনীত হতে সমর্থ হয়, তা নয়। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। সে এই যুক্তিগুলোর পথে অগ্রসর হয় কেননা এই জগৎ তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। মানুষের সুনিশ্চিত বিশ্বাস যে, জগৎ অপূর্ণ এবং কোন গভীরতর সত্তার প্রয়োজন আছে, যে এই অপূর্ণতা দূর করে তাকে পূর্ণ করে তুলবে। কি চিন্তন, কি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা উভল্পের কাছেই এই জগৎ এক বিরাট অতৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবং সেই কারণে মানুষ এই জগতকে অতিক্রম করে যেতে চায় এবং এই জগতের যথার্থ ব্যাখ্যা ও মূল্যের সন্ধান করতে উৎসুক হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক প্রমাণগুলো এই ব্যাখ্যা দেখার চেষ্টা করে। ধর্মপ্রবণ মনের সাধারণ গতির লক্ষণ ও প্রতীক হিসেবে এই যুক্তিগুলোর মূল্য অস্বীকার করা যায় না। লুইস বলেন, “… সর্বযুগের কোন কোন মহান চিন্তানায়ক সহ অতীতে বহু ব্যক্তির মনের ওপর যুক্তিগুলো যে ছাপ রেখে গেছে, এই ব্যাপারটি আকস্মিক নয়। যদিও যুক্তিগুলো খুব কার্যকর হতে পারেনি তবু যুক্তিগুলোর কোন কোন প্রদত্ত বিবরণ আমাদের চিন্তাকে সঠিক পথে চালিত করে এবং আমাদের ঈশ্বরোপলব্ধির ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ের নির্দেশ করে (Point to something of the utmost importance for our understanding of God) (H.D. Lewis : Philosophy of Religion ; page. 157)।
তথ্যসূত্র
- ডঃ প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত, ধর্মদর্শন, ব্যানার্জী পাবলিশার্স, ২০০৮
- H.D. Lewis, Philosophy of Religion, St. Paul’s House, 1975
- G. MacGregor, Introduction to Religious Philosophy, Houghton Mifflin Co., 1959
- G. Galloway, The Philosophy of Religions, Generic, 1979
- J. Caird, An Introduction to the Philosophy of Religion, James Maclehose and sons, 1889
- John H. Hick, Philosophy of Religion, Prentice-Hall, 1970
অপূর্ব বিশ্লেষণ। বাংলা ভাষায় এমন লেখা পড়ে অনেক আনন্দিত হলাম
অনেক সুন্দর ভাই।
অসাধারণ