(রণদীপম বসুর ব্লগ থেকে সংক্ষিপ্ত ও পুনর্বিণ্যস্ত করে লেখা হয়েছে, আরও বৃদ্ধি পাবে, তথ্যসূত্রসমূহ লেখাটির মধ্যেই রয়েছে)
Table of Contents
ভূমিকা
লিঙ্গ হিসেবে শিব
হিন্দুধর্মে বহুদেবতাবাদ প্রচলিত থাকলেও হিন্দু সমাজ মূলত পঞ্চদেবতার উপাসক। এই পঞ্চোপাসক সম্প্রদায় হলো – শৈব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য ও বৈষ্ণব। আবার সম্প্রদায়গতভাবে ভগবান শ্রীবিষ্ণু ও শিব ঠাকুরের পূজা মূর্ত ও অমূর্ত বা বিমূর্তরূপে শালগ্রাম শিলায় ও শিবলিঙ্গে বহুল প্রচলিত। এর মধ্যে শিবলিঙ্গ পূজা সমাজ জীবনে এতটাই জনপ্রিয় যে, জনমানসে তার মূর্তিরূপই ক্রমবিলীয়মান। এ প্রসঙ্গে মহাশায় অক্ষয় কুমার দত্ত বলেন – ‘শিবের সাথে অন্য অন্য দেবতার একটি বিষয়ে বিশেষ বিভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। তার সর্বাবয়বের প্রতিমূর্তি অতীব বিরল; ভারতবর্ষের সকল অংশেই তার লিঙ্গ-মূর্তিতেই তার পূজা হয়ে থাকে। তা সর্বত্র এরূপ প্রচলিত যে, শিবের উপাসনা বললে শিবের লিঙ্গ-মূর্তির উপাসনাই বুঝতে হয়। শিবালয় ও শিব-মন্দির সবই কেবল ঐ মূর্তিরই আলয়। শৈবতীর্থে কেবল ঐ মূর্তিরই মহিমা প্রকাশিত আছে। স্বতন্ত্র একটি বৃহৎ পুরাণ ঐ মূর্তিরই গুণ-কীর্তনের উদ্দেশ্যে বিরচিত হয়েছে।’ – (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় : দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮৯, চলিতকৃত)। উল্লিখিত ঐ স্বতন্ত্র পুরাণটি হলো লিঙ্গপুরাণ। এই লিঙ্গপুরাণে দুই প্রকার শিবের বিষয় লিখিত আছে – অলিঙ্গ ও লিঙ্গ। যেমন – “স্থূল, সূক্ষ্ম, জন্ম-রহিত ও সর্ব-ব্যাপী মহাভূত-স্বরূপ লিঙ্গ শিব জগতের কারণ ও বিশ্ব-রূপ। তিনি অলিঙ্গ-শিব থেকে উৎপন্ন হয়েছেন।” (লিঙ্গপুরাণ তৃতীয় অধ্যায়)। অন্যদিকে বিদ্যেশ্বর সংহিতার মতে – “ব্রহ্ম যেমন নির্গুণ ও সগুণ দুই প্রকারই হন, তেমনি নিষ্কল শিব নিরাকার লিঙ্গরূপী এবং সগুণ শিব সাকার রূপধারী।” (বিদ্যেশ্বর-সংহিতা)। এই উদ্ধৃতিতে স্পষ্টতই ব্রহ্মবাদী বেদান্ত ধারণারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়, তবু প্রজননমূলক বিশ্বাসাশ্রিত লিঙ্গ ধারণা যে বেদান্তের চেয়ে বহু বহু প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক সময়কালে নিহিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রাচীন জনমানসে এই লিঙ্গের সাথে কখন কিভাবে কোথায় শিব নামক বেদবাহ্য এক বিপুল পূজ্য দেবতার ধারণার একাত্মতা ঘটেছে এবং কালে কালে দেবতামূর্তি ছাপিয়ে তার প্রতীকী লিঙ্গমূর্তি রূপটাই এতো জনপ্রিয় ও বহুল পূজ্য হয়ে ওঠেছে সেটা নিশ্চয়ই গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। কেননা ঐ লিঙ্গপুরাণের সপ্তদশ অধ্যায়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, মহাদেবের সৃজন-শক্তিই লিঙ্গ। যেমন – “মহেশ্বর লিঙ্গী এবং তার প্রকৃতি অর্থাৎ সৃজন-শক্তি লিঙ্গ বলে খ্যাত।” (লিঙ্গপুরাণ সপ্তদশ অধ্যায়)
লিঙ্গের অর্থ, প্রকারভেদ ও মাহাত্ম্য
লিঙ্গকে মহাপ্রতীক মেনে যারা দেবতা শিবকে পরমেশ্বরজ্ঞানে উপাসনা করেন তাদেরকে বলা হয় শৈব। এই শৈবদের মধ্যেও তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি ও সাধনাচারের পার্থক্যপ্রসূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ভেদ রয়েছে। রয়েছে ধ্যান-ধারণাগত পার্থক্য ও আচার-বিচারে বৈচিত্র্য। লিঙ্গায়েৎ শৈব সম্প্রদায়ের মতে লিঙ্গ নিষ্কল ব্রহ্মের প্রতীক। কোন কোন পন্ডিতের মতে, মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই তারা নাকি এরূপ লিঙ্গার্চনা শুরু করেন। তবে শৈব সম্প্রদায়গুলোর নিজেদের মধ্যকার তত্ত্বীয় অভিন্নতা হলো, এরা পরমেশ্বর শিবকেই সৃষ্টির আদিদেবতা বলে স্বীকার করেন এবং লিঙ্গকে তারই সূক্ষ্ম প্রতীক হিসেবে গণ্য করেন। ‘লী’ ধাতুর অর্থ লয় পাওয়া এবং ‘গম’ ধাতুর অর্থ বহির্গত হওয়া। কৌলজ্ঞাননির্ণয়ে তাই বলা হয়েছে – ‘যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যার মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই লিঙ্গ।’ (কৌলজ্ঞাননির্ণয়-৩/১০)। স্কন্দপুরাণেও প্রায় একইরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার মতে – “শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন।” (বা. স. উত্তরভাগ- ২৭/১২)। লিঙ্গপুরাণ, শিবপুরাণ ও স্কন্দপুরাণেই শিব ও শিবলিঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। পুরাণের স্বাভাবিক ধারা অনুসারে লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন প্রকার শিবমূর্তির বর্ণনা এলেও এবং সেই সব মূর্তির পূজাদির কথা বলা হলেও লিঙ্গার্চনার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। শিবের লিঙ্গমূর্তির পূজা না করার জন্যই যে তারকাসুরের ধ্বংস হয়েছিল সেকথা জানিয়ে পিতামহ ব্রহ্মা অতপর বলছেন – “যে নিজের অভিষ্ট সিদ্ধি করতে চায়, সে লিঙ্গ পূজা করবে। কারণ সমস্ত জগৎ লিঙ্গাধীন এবং লিঙ্গে সমগ্র জগৎ অধিষ্ঠিত। দেব, দৈত্য, দানব, যক্ষ, বিদ্যাধর, সিদ্ধ, রাক্ষস, পিতৃপুরুষগণ, মুনি, কিন্নর সকলেই লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে পূজো করে সিদ্ধ হবে। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।” (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৩/৬-৯)। লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গার্চনের বিবরণ আছে। বলা হচ্ছে, – ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা স্বাধিকারানুসারে লিঙ্গ প্রস্তুত করে দেবতাদের দেন। বিষ্ণু ইন্দ্রনীলমণি নির্মিত লিঙ্গ পূজা করতে লাগলেন। ইন্দ্র পদ্মরাগের লিঙ্গ, কুবের সোনার লিঙ্গ, বিশ্বদেবগণ রজতলিঙ্গ, অষ্টবসু চন্দ্রকান্তমণির লিঙ্গ, বায়ু পিতলের, অশ্বিনীকুমার যুগল মাটির, বরুণ স্ফটিকের, দ্বাদশাদিত্য তামার, চন্দ্র মুক্তার, অনন্তাদি নাগেরা প্রবালের, দৈত্য ও রাক্ষসেরা লোহার, গুহ্যকেরা ত্রৈলোহিক, প্রমথেরা লোহার, চামুণ্ডাদি মাতৃগণ বালির, নিরুতি কাঠের, যম পান্নার, রুদ্রগণ ভস্মের, পিশাচেরা সীসার, লক্ষ্মী বৃক্ষের, কার্তিক গোময়ের, শ্রেষ্ঠ মুনিরা কুশাগ্র নির্মিত, বামারা পুষ্পলিঙ্গ, মনোন্মনী গন্ধদ্রব্য নির্মিত লিঙ্গ, বাগদেবী রত্নময় লিঙ্গ, দুর্গা বেদিসমেত স্বর্ণলিঙ্গ পূজা করেন।
লিঙ্গপুরাণের মতোই শিবপুরাণের জ্ঞানসংহিতার পঞ্চবিংশ অধ্যায়ে প্রায় একই প্রকার কথা পাওয়া যায়, যেমন – “হে দেবগণ, সর্বদুঃখ নাশের জন্য শঙ্কর যে সেবনীয় তা তোমরা পূর্বে দেখেছো এবং এখনও দেখছো, তাহলে কেন আবার সেই কথা জিজ্ঞাসা করছো? এই বিষয়ে দেবেশ্বর মহাদেব আমার ও ব্রহ্মার কাছে বিশেষ রূপে বলেছেন। তোমরা দেখেছো যে তারক পুত্রগণ লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে অনাদর করে সবান্ধবে বিনষ্ট হয়েছে। আমি প্রথমত তাদের মায়ায় মোহিত করে দূর করে দিলাম এবং পরে যখন তারা শিবকে অবজ্ঞা করতে লাগলো তখন সকলে বিনষ্ট হলো। অতএব হে সুরেশ্বরগণ, যদি সর্বদা সুখবাসনা থাকে, তাহলে সব সময় লিঙ্গমূর্তিধর মহাদেবকে পূজা করা উচিত। দুঃখ দূর করার জন্য দেবতাদেরও সর্বলিঙ্গে অন্তর্যামিরূপে প্রতিষ্ঠিত শিবকে পূজা করা উচিত। (শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা-২৫ অ/২২-২৮)। এই শিবপুরাণেও লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১ অংশের শ্লোকের অনুরূপ বক্তব্যে বলা হয়েছে যে – “ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা স্বাধিকারানুসারে বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গ নির্মাণ করেন ও দেবতাদের প্রদান করেন।” (জ্ঞানসংহিতা-২৫/৩৮)। এই বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গ প্রসঙ্গে লিঙ্গপুরাণের চুয়াত্তর অধ্যায়ে বিশদভাবে বর্ণিত আছে। যেমন – “দ্রব্য উপাদানভেদে লিঙ্গকে প্রথমত ছয় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং তাদের আবার চতুঃচত্বারিংশ বা চুয়াল্লিশ ভাগে বিভাগ করা হয়েছে। প্রথমে শৈলজালিঙ্গ বা প্রস্তরনির্মিত লিঙ্গ চার প্রকার, দ্বিতীয় রত্নজ লিঙ্গ সাত প্রকার, তৃতীয় ধাতুজ লিঙ্গ আট প্রকার, তারপর দারুজ বা কাষ্ঠনির্মিত লিঙ্গ ষোড়শ প্রকার, পঞ্চমে মৃন্ময় বা মৃত্তিকানির্মিত লিঙ্গ দুই প্রকার এবং ষষ্ঠত রঙ্গ বা রাং নির্মিত রিঙ্গ সাত প্রকার।” (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৩-১৬)।
বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গের বিবরণ শাস্ত্রে শ্রুত হলেও এটাও বলা আছে যে সমস্ত প্রকার লিঙ্গের পূজনে একই ফল লাভ হয় না। যেমন – “রত্ন নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা শ্রীলাভ হয়, শৈলজ (প্রস্তর নির্মিত) লিঙ্গ সর্বসিদ্ধি দায়ক, ধাতুর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ সাক্ষাৎ ধনদ, কাঠের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ ভোগ ও সিদ্ধি দান করে, মৃন্ময় লিঙ্গ সর্বসিদ্ধিদায়ক ও শুভ। প্রস্তর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ অতি উত্তম এবং ধাতুর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ মধ্যম প্রকৃতির।” (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৭-১৮)। কেবল যে দ্রব্যের প্রকারগত ভিন্নতার কারণে লিঙ্গপূজা ভিন্ন ফলদায়ক হয় তাই নয়, লিঙ্গের আকৃতিগত ভিন্নতার কারণেও ফলভিন্নতা হতে পারে। যেমন লিঙ্গপুরাণ মতে – “লিঙ্গের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। লিঙ্গের মূলে বাস করেন ব্রহ্মা, মধ্যে বিষ্ণু ও উপরে ওঙ্কাররূপী মহাদেব রুদ্র। ত্রিগুণাত্মিকা মহাদেবী হলেন লিঙ্গবেদি। যে ব্যক্তি বেদি সমেত লিঙ্গ পূজা করে, তার সর্ব দেবদেবীর পূজা ফল লাভ হয়।” (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৯-২১)।
শিব সংক্রান্ত বিভিন্ন আখ্যানাদি বিভিন্ন পুরাণে ছড়িয়ে আছে। শৈব পুরাণগুলো শিবকেই প্রাধান্য দিতে চায় বলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রভৃতির মুখে শিবমাহাত্ম্য স্তুতি স্থাপন বসানো হয়েছে। আর সেখানে শিব মানেই শিবলিঙ্গের মাধ্যমে তার অবস্থিতিই প্রধান। তাছাড়া পঞ্চোপাসক সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই লিঙ্গপূজাকে জনপ্রিয় করার বিভিন্ন কায়দা শাস্ত্রকারেরা নিয়েছেন। এজন্য অর্থবাদের দ্বারা বলা হয়েছে যে – “লিঙ্গপূজা না করে অন্য দেবতার পূজা করলে সেই পূজা বিফল হবে এবং সেই পূজক অন্তে নরকে যাবে।” সেই কারণেই ঐ তন্ত্রে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়কেই বিল্বপত্রের দ্বারা লিঙ্গপূজা করে, তারপর অন্যপূজায় ব্রতী হতে বলা হয়েছে। কিন্তু লিঙ্গপূজা করতে বললেই পূজা হবে না, কেননা লিঙ্গের বহু প্রকারভেদ, পূজার মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধও রয়েছে। সেগুলো জানার প্রয়োজনও রয়েছে।
গৌরীপট্ট ও যোনির সাথে লিঙ্গের সম্পর্ক
উল্লেখ্য, বর্তমানে গৌরীপট্ট সংবলিত যে কৃত্রিম শিবলিঙ্গ দৃশ্যমান হয়, বেদবিহিত পৌরাণিক ব্যাখ্যায় – লিঙ্গের তিন ভাগের মধ্যে – শিবলিঙ্গে গৌরীপট্টের উপরের অংশকে রুদ্রভাগ বলে, মাঝের অংশ অর্থাৎ গৌরীপট্টের অঞ্চলকে বিষ্ণুভাগ এবং গৌরীপট্টের নিচের অংশকে ব্রহ্মভাগ বলে। কিন্তু সকল লিঙ্গে – বিশেষ করে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট লিঙ্গে – এই গৌরীপট্ট দেখা যায় না। শিবলিঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গৌরীপীঠ বা গৌরীপট্টের কথা এসে যায়। শাক্তচিন্তা প্রসূত বেদবাহ্য ব্যাখ্যায় এই গৌরীপট্টকে যোনিও বলা হয়। যোনিমুদ্রার আকৃতিও গৌরীপট্টের মতো। লিঙ্গোপাসনাকে যারা যৌন উপাসনা বলেন তারা স্ত্রী ও পুং জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক হিসেবেই যোনি ও লিঙ্গকে দেখাতে চান। প্রাণতোষিনী তন্ত্রের একটি বচনে বলা হয়েছে – লিঙ্গ ব্রহ্মস্বরূপ সাক্ষাৎ মহেশ্বর এবং যোনি জগন্ময়ী মহামায়া। নিরুত্তর তন্ত্রেও প্রায় একই কথা পাওয়া যায় – “লিঙ্গরূপে স্বয়ং মহাকাল এবং যোনিরূপে দেবী কালিকা অধিষ্ঠিত।”এভাবে শিব ও শক্তির অভেদের কল্পনা করেই নারদ-পঞ্চরাত্রের একটি বচনে তাই দেখা যায় – “যেখানে লিঙ্গ (শিব) সেখানেই যোনি (শক্তি), যেখানে যোনি সেখানেই শিব।” লিঙ্গ যেহেতু পিতৃত্বের এবং যোনি মাতৃত্বের প্রতীক, তাই (গৌরীপট্ট সমন্বিত) লিঙ্গ একই সঙ্গে পিতামাতার প্রতীক। লিঙ্গপুরাণের উত্তরভাগেও (১১/৩১) আমরা এধরনের মতবাদের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই – “উমাদেবীকে লিঙ্গপীঠ রূপে এবং মহাদেব শঙ্করকে লিঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত সুর ও অসুরেরা তার পূজা করে থাকেন।”
বেদপন্থীরা যে যোনিরূপ গৌরীপট্টের ব্যাখ্যা অন্যভাবে দিয়ে থাকেন, তা ইতপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রের ব্যাখ্যায় (ঋক-১/১০৪/১) সায়ণাচার্য যোনিকে যজ্ঞবেদী হিসেবে অর্থবাদ করেছেন। যেমন – “হে ইন্দ্র, তোমার বসবার (অবস্থানের) জন্য যে বেদি (যোনি) প্রস্তুত হয়েছে শব্দায়মান অশ্বের ন্যায় সেখানে উপবেশন কর। অশ্ববন্ধন রশ্মিবিমোচন করে অশ্বদের মুক্ত করে দাও, সে অশ্ব যজ্ঞকাল সমাগত হলে দিন রাত তোমাকে বহন করে।” (ঋগ্বেদ-সংহিতা-১/১০৪/১)। পরবর্তী চিন্তায় সেই বেদীকে দক্ষতনয়া উমা গৌরীর সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। এই যোনি বা বেদির উপর প্রজ্বলিত অগ্নি হলেন লিঙ্গ। মহাভারতকারও যে সমস্ত পুরুষের প্রতীক হিসাবে লিঙ্গকে এবং সমস্ত নারীর প্রতীক হিসেবে যোনিপীঠকে বিবেচনা করতেন, তা উপমন্যু কথিত শিবলিঙ্গ কথা থেকে বোঝা যায়। সেখানে বলা হয়েছে – “সমস্ত পুরুষ ঈশান এবং সমস্ত স্ত্রীমূর্তিই উমা। শিবশক্তির পুরুষ এবং স্ত্রী এই দুই তনুর দ্বারা জগৎ ব্যাপ্ত।” (মহাভারত-১৩/১৪/২৫৩)। একই কথা শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ে পাওয়া যায়। সেখানে ৫৫ শ্লোকে বলা হয়েছে – “পুরুষ মাত্রেই সেই দেব-দেব শঙ্কর এবং স্ত্রীমাত্রেই দেবী শঙ্করী। সমস্ত স্ত্রী-পুরুষ সেই ভব-ভবানীর বিভূতি।”
শিব-শক্তির সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে এখানে যেসব কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে যে তন্ত্রের বীজ রয়েছে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না, এবং হয়তো পঞ্চম-মকারের কথাও এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ভগবতীর যোনিরূপ ধারণের কারণ সম্পর্কে পুরাণের আখ্যায়িকাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। দেবী ভাগবতে এই আখ্যানের কথা যেমন আছে তেমনি শিবতত্ত্বপ্রদীপিকায় ‘শৈবে’ বলে উদ্ধৃত অংশে বিস্তৃতভাবে সেই আখ্যান পাওয়া যায়। ঐ আখ্যানে বলা হয়েছে (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়) – ‘দারুকবনে শিবভক্ত ঋষিরা যখন ত্রিসন্ধ্যা শিবপূজা ও শিব আরাধনায় রত তখন তাদের ভক্তি পরীক্ষার জন্য শিব দিগম্বর মূর্তিতে নিজের লিঙ্গটি (পুং জননেন্দ্রিয়) ধারণ করে ঋষিপত্নীদের কাছে উপস্থিত হয়ে নানা রকম ভাবভঙ্গী দেখাতে লাগলেন। বিপ্র নারীরাও তার সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। এমন সময় ঋষিরা সমিধ আহরণের জন্য সেই বনে উপস্থিত হয়ে স্ত্রীদের এরূপ কাণ্ড দেখে উলঙ্গ পুরুষটির কাছে বার বার তার পরিচয় জানতে চাইলেন। পুরুষটি আত্ম-পরিচয় না দেওয়ায় ক্রোধোন্মত্ত হয়ে তারা অভিশাপ দিলেন যে ‘তোমার লিঙ্গ ধরাতলে নিপতিত হোক’। অগ্নিতুল্য শিবলিঙ্গ ধরাতলে পতিত হয়ে সব ধ্বংস করল এবং তা স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল সর্বত্র ঘুরতে লাগল ও সবকিছু ধ্বংস করতে লাগল। তখন দেবতা ও ঋষিরা ভয় পেয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন এবং সব ঘটনা জানালেন। ব্রহ্মা তখন দেবতাদের কাছ থেকে সব ঘটনা জানলেন এবং বললেন – যতক্ষণ না ঐ লিঙ্গ স্থির হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ত্রিজগতের মঙ্গল হবে না। এরপর তিনি ঋষিদের উপদেশ দিলেন গিরিজা দেবীর আরাধনার জন্য। যদি গিরিজা দেবী যোনিরূপ ধারণ করে ঐ লিঙ্গ ধারণ করেন তাহলেই কেবলমাত্র ঐ লিঙ্গ স্থির হবে। অষ্টদশ পদ্মের মণ্ডলে কিভাবে দেবীর আরাধনা করতে হবে তাও ব্রহ্মা উপদেশ দিলেন। পার্বতী যোনিরূপ ধারণের পর শিবলিঙ্গ তাতে আধারিত হল এবং জগৎ শান্তি পেল।’
শিবলিঙ্গের প্রকারভেদ, মাহাত্ম্য ও ব্যাখ্যা
শিবলিঙ্গের প্রকারভেদ
প্রাথমিকভাবে শিবলিঙ্গ দুই প্রকার – কৃত্রিম ও অকৃত্রিম। এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের দ্বারা যেমন কৃত্রিম ও অকৃত্রিম শিবলিঙ্গ নির্মিত হয়েছে, তেমনি তাদের আকৃতিও বিভিন্ন প্রকার হয়েছে। এইসব আকৃতি অনুসারে বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গের বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে। ফলে শালগ্রাম শিলা চেনার জন্য যেরূপ বিভিন্ন প্রকার চক্রজ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তেমনি শিবলিঙ্গ পরিজ্ঞানের জন্যও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এই সব গ্রন্থ পর্যালোচনা করলে শিবলিঙ্গের অসংখ্য নাম ও আকৃতির বিবরণ পাওয়া যায়। শাস্ত্র অনুযায়ী শিবলিঙ্গ দুই প্রকার – কৃত্রিম ও অকৃত্রিম। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট স্বয়ম্ভুলিঙ্গ, বাণলিঙ্গ ইত্যাদিকে অকৃত্রিম লিঙ্গ বলে। প্রাণতোষিণী তন্ত্রে বলা হয়েছে – “লিঙ্গ দুই প্রকার, অকৃত্রিম ও কৃত্রিম; স্বয়ম্ভূ ও বাণ-লিঙ্গ প্রভৃতি যে সকল লিঙ্গ মনুষ্য দ্বারা নির্মিত হয়নি, তার নাম অকৃত্রিম লিঙ্গ।” (প্রাণতোষিণী) আর ধাতু, পাথর ইত্যাদি দিয়ে মানুষের তৈরি শিবলিঙ্গকে কৃত্রিম লিঙ্গ বলে। এই কৃত্রিম ও অকৃত্রিম উভয় ধরনের লিঙ্গই আবার দুই প্রকার – চল ও অচল। যে লিঙ্গকে প্রয়োজনে স্থানান্তরিত করা যায় তাকে চল বা সচল লিঙ্গ এবং যে লিঙ্গকে প্রয়োজনে স্থানান্তরিত করা যায় না তকে অচল লিঙ্গ বলে। সাধারণত কৃত্রিম লিঙ্গের মধ্যে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গকে অচল লিঙ্গ বলে। অকৃত্রিম শিবলিঙ্গ পাঁচ প্রকার – স্বয়ম্ভূলিঙ্গ, দৈবলিঙ্গ, গোললিঙ্গ, আর্যলিঙ্গ ও মানসলিঙ্গ। লিঙ্গশাস্ত্র অনুযায়ী – “কৃত্রিম হোক আর অকৃত্রিমই হোক সমস্ত শিবলিঙ্গই চল ও অচল ভেদে দ্বিবিধ। যে লিঙ্গকে স্থানান্তরিত করা যায় না তা অচল লিঙ্গ আর যাকে স্থানান্তরিত করা যায় তা চল লিঙ্গ। অকৃত্রিম শিবলিঙ্গকে আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়, যথা – স্বয়ম্ভূলিঙ্গ, দৈবলিঙ্গ, গোললিঙ্গ, আর্যলিঙ্গ ও মানসলিঙ্গ।”
স্বয়ম্ভূলিঙ্গ : শাস্ত্র অনুযায়ী দশদিক্পালের থেকে উৎপত্তি হয়েছে দশ প্রকার স্বয়ম্ভূলিঙ্গের। এইসব অকৃত্রিম স্বয়ম্ভূলিঙ্গের লক্ষণ বর্ণনায় বলা হয়েছে – “যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গ বহুছিদ্রযুক্ত নানা বর্ণযুক্ত এবং ভূগর্বে যার তল খুঁজে পাওয়া যায় না তারাই স্বয়ম্ভূলিঙ্গ। এইসব লক্ষণ যদি স্বয়ম্ভূলিঙ্গে না থাকে, তাহলে তা লক্ষণচ্যুত বলে বুঝতে হবে। যে সব স্বয়ম্ভূলিঙ্গের মস্তক শঙ্খের মত আবৃতি বিশিষ্ট তাদের বলে বৈষ্ণবলিঙ্গ। যে লিঙ্গের মস্তক পদ্মের মত আকৃতিবিশিষ্ট তার নাম ব্রাহ্মলিঙ্গ। যার মস্তকভাগ ছত্রের মত তাকে বলে ঐন্দ্রলিঙ্গ। শিবলিঙ্গের দুটি মস্তক থাকলে সেই লিঙ্গকে বলে আগ্নেয় লিঙ্গ। তিনটি পদচিহ্ন থাকলে তাকে বলে যাম্যলিঙ্গ। খড়্গরে মত আকৃতিযুক্ত লিঙ্গকে বলে নৈর্ঋতলিঙ্গ। কলসের মত আকৃতিযুক্ত লিঙ্গকে বলে বারুণলিঙ্গ। ধ্বজচিহ্ন যুক্ত হলে (ঢেউখেলানো) সেই লিঙ্গের নাম বায়বীয় লিঙ্গ। যে লিঙ্গের মধ্যে গদাচিহ্ন অঙ্কিত দেখা যায় তার নাম কৌবের লিঙ্গ। যদি ত্রিশূল চিহ্ন অঙ্কিত থাকে তাহলে সেই লিঙ্গকে বলে ঈশানলিঙ্গ। এভাবে দশদিকপাল থেকে দশরকম স্বয়ম্ভূলিঙ্গ প্রকাশিত হয়েছে।” এছাড়াও বিভিন্ন দেবতার চিহ্নযুক্ত বহু ধরনের স্বয়ম্ভূলিঙ্গ আছে। তবে এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে না যে, প্রাকৃতিক ঘটনায় সৃষ্ট বস্তুপুঞ্জে ভক্তিবাদীর দৃষ্টিতে যতই অপ্রাকৃত ধারণা সঞ্জাত আধ্যাত্মিক ভাবনা থাকুক না কেন, গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গিতে এর পেছনের যে বিজ্ঞানাশ্রিত ভক্তি-নিরপেক্ষ পুরাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও থাকতে পারে এটি আমাদের ভুলে যাওয়া চলে না। তাই এক্ষেত্রে অশোক রায়ের মন্তব্যটি প্রাসঙ্গিক, – ‘সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণে যে-কোনও ধরনের শিলাতে যদি সুলক্ষণ যুক্ত ও লিঙ্গাকৃতি দেখা যায়, তবে সেই শিলাকেই স্বয়ম্ভূলিঙ্গ বলে। বিভিন্ন ধরনের শিলার বর্ণও তাই বিভিন্ন। প্রকৃতির প্রকোপে (Weathering effect-এর ফলে) শিলাগাত্র মসৃণ না হওয়ারই কথা। তারপর তা নিত্যদিনের পূজা-অর্চনা ও অঙ্গমার্জনার ফলে ধীরে ধীরে মসৃণ হয়ে যায়। অনেক সময় আবার লিঙ্গের যে অংশে ভক্তের হাত বেশি পড়ে সেই অংশ অতি মসৃণ হয়ে যায়, বাকি অংশ থাকে অমসৃণ কর্কশ; ফলে লিঙ্গে একই সাথে রুদ্র ও শিবরূপ অনুভূত হয়। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক শিলা সুনিপুণ লিঙ্গাকৃতি না হওয়াই স্বাভাবিক, ফলে তাতে নানা ধরনের চিহ্ন (আকৃতি অনুযায়ী) অনুভূত হয় এবং সেই লক্ষণ চিহ্ন অনুযায়ী স্বয়ম্ভূলিঙ্গের নামকরণ হয়ে থাকে। তাই ভক্তের চোখে ভগবান বিভিন্ন নামরূপে ধরা দেন।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৩০৩)।
দৈবলিঙ্গ : স্বয়ম্ভূলিঙ্গের পর দ্বিতীয় প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গ দৈবলিঙ্গের লক্ষণ বর্ণনায় শাস্ত্রকার বলছেন – “যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গে করসংপুটের চিহ্ন (হাতের ছাপ-এর মতো দাগ) দেখা যায়, যাতে শূল টঙ্গনামক খড়্গ, চন্দ্রকলা চিহ্ন ও রেখাচিহ্ন থাকে এবং যা ছিদ্রবিশিষ্ট ও উন্নতান্নত (অমসৃণ) দীর্ঘাকৃতি এবং যদি লিঙ্গে গৌরীপট্ট না থাকে অর্থাৎ লিঙ্গে ব্রহ্মভাগ, বিষ্ণুভাগ ও রুদ্রভাগের পৃথক লক্ষণ দেখা না যায়, তাকে দৈবলিঙ্গ বলে।” এখানে উল্লেখ্য, লিঙ্গের গৌরীপট্টের ওপরের দিককে বলে রুদ্রভাগ, এখানে রুদ্রের অবস্থান। গৌরীপট্ট অংশের নাম বিষ্ণুভাগ, এখানে বিষ্ণুর অবস্থান এবং গৌরীপট্টের নিচের অংশ হলো ব্রহ্মভাগ। যদি গৌরীপট্ট না থাকে, তাহলে এরূপ তিন অংশের বিভাগ সম্ভবপর হয় না। সুতরাং এই তিন ভাগ বিবর্জিত লক্ষণাক্রান্ত লিঙ্গকে দেবলিঙ্গ বলে। আর যেহেতু এটিও অকৃত্রিম প্রাকৃতিক লিঙ্গ, তাই পুরাতত্ত্বের দৃষ্টিতে ভাবলে, পাললিক শিলায় স্তরায়ণ চিহ্ন প্রায়শই প্রকটভাবে দেখা যায়। বিশেষত, যদি পলি অধঃক্ষেপণ মোটাদানার হয়। এই স্তরায়ণ চিহ্নই আসলে উপরে বর্ণিত লিঙ্গের রেখা চিহ্ন। এছাড়া মোটা দানার পলি অধঃক্ষেপের ফলে সৃষ্ট শিলা সর্বদাই অমসৃণ ও ছিদ্রযুক্তই হয়ে থাকে।
গোললিঙ্গ : এরপর শাস্ত্রকারের ভাষায় তৃতীয় প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম গোললিঙ্গ বা গোলকলিঙ্গের লক্ষণ হিসেবে বলা হয়েছে – “যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গের আকৃতি চালকুমড়ার মতো, অথবা নাগরঙ্গ (কমলালেবু) ফলের মতো কিংবা কাকের ডিমের মতো যার মাথার দিকটা (ফলক) তার নাম গোল লিঙ্গ।” বেনারসের বিখ্যাত ‘তিল ভাণ্ডেশ্বর’ শিবলিঙ্গকে গোলকলিঙ্গের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আর্যলিঙ্গ : আর চতুর্থ প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম আর্যলিঙ্গের লক্ষণে শাস্ত্রকার বলছেন – “যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গে ব্রহ্মসূত্র চিহ্ন বা যজ্ঞোপবীত লক্ষণ দেখা যায়, যার মূল ভাগ স্থূলকায় অর্থাৎ লিঙ্গের আকৃতি নারকেল-এর মতো, অথবা যার মধ্যভাগ স্থূল অথচ লিঙ্গটি কদবেল বা তালের মতো দেখতে তাকে বলে আর্যলিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গ ঋষিবাণলিঙ্গ নামেও পরিচিত। এরমধ্যে মধ্যভাগ স্থূল লিঙ্গই শ্রেষ্ঠ।” প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, – ‘বিজারক পরিবেশে পলি অধঃক্ষেপণ হলে অক্সিজেনের অভাবে কোনও অক্সাইড যৌগ তৈরি করতে পারে না। তার বদলে তৈরি হয় সালফাইড যৌগ। সাধারণত এই ধরনের শিলার বর্ণ হয় কালো বা ধূম্রবর্ণ। কালো রং-এর কাদা পাথরে বা তা থেকে সৃষ্ট শেল পাথরে সাদা কোয়ার্টজ-এর স্তর প্রায়শই দেখা যায়। পাললিক শিলায় এই স্তরায়ণকে ‘কোয়ার্টজ ভেন’ বলে। এই কোয়ার্টজ ভেনই শিব লিঙ্গে সাদৃশ্যতাবশত হয়েছে যজ্ঞোপবীত বা ব্রহ্মসূত্র চিহ্ন।’ – (অশোক রায়)
মানসলিঙ্গ : পঞ্চম প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গ হলো মানসলিঙ্গ। মানসলিঙ্গকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয় – রৌদ্রলিঙ্গ, শিবনাভিলিঙ্গ এবং বাণলিঙ্গ।
- রৌদ্রলিঙ্গ : রৌদ্রলিঙ্গ প্রসঙ্গে ‘বীরমিত্রোদয়’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে – “নদীর গতিবেগে গড়িয়ে চলা নুড়িগুলো পরস্পর ঘষা খেতে খেতে পাথর যদি সমতল ও মসৃণ হয়ে লিঙ্গরূপ ধারণ করে তাহলে সেই লিঙ্গকেই রৌদ্রলিঙ্গ বলে।” এ প্রসঙ্গে শাস্ত্রকার বলেন – “নদীপ্রবাহ থেকে যে লিঙ্গের উদ্ভব, যা বাণলিঙ্গাকৃতি তাকেই বলে রৌদ্রলিঙ্গ। নর্মদা নদীর স্রোত থেকে উৎপন্ন অথচ বাণলিঙ্গের মতো আকৃতি বিশিষ্ট লিঙ্গকেও রৌদ্রলিঙ্গ বলে। রৌদ্রলিঙ্গ চার প্রকার হয়ে থাকে – শ্বেত, রক্ত, পীত এবং কৃষ্ণ। ব্রাহ্মণেরা শ্বেতবর্ণ, ক্ষত্রিয়েরা রক্তবর্ণ, বৈশ্যেরা পীতবর্ণ এবং শূদ্রেরা কৃষ্ণবর্ণ লিঙ্গের পূজা করলে সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। কৃষ্ণবর্ণের লিঙ্গে সব জাতির পক্ষেই পূজিত ও শুভ। নর্মদা নদীতে জাত রৌদ্রলিঙ্গ বাণলিঙ্গের মতোই ফলদায়ক।
- শিবনাভিলিঙ্গ : বীরমিত্রোদয় অনুসারে যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গে রমণীয় বেদিকা দেখা যায়, মহর্ষিগণ তাকে শিবনাভিলিঙ্গ বলেন। এ প্রসঙ্গে শাস্ত্রকার বলেন – “শিবনাভিলিঙ্গ উত্তম, মধ্যম ও অধম ভেদে তিন প্রকার। চার আঙুল উচ্চতাযুক্ত এবং সুন্দর বেদি সমন্বিত লিঙ্গ হলো উত্তম শিবনাভিলিঙ্গ। তার অর্ধেক অর্থাৎ দু-আঙুল উচ্চতাযুক্ত এরূপ লিঙ্গ মধ্যম প্রকৃতির এবং এর অর্ধেক পরিমাণ অর্থাৎ এক আঙুল উচ্চতাযুক্ত লিঙ্গ হলো অধম প্রকৃতির শিবনাভিলিঙ্গ। অপরাপর অন্যান্য লিঙ্গ অপেক্ষা শিবনাভিলিঙ্গ শ্রেষ্ঠ বলে মহর্ষিরা মনে করেন। সকলেরই যথাবিধানে এই লিঙ্গে পূজা করা কর্তব্য।”
- বাণলিঙ্গ : অন্যান্য লিঙ্গের তুলনায় শাস্ত্রে বাণলিঙ্গের প্রশংসাই অধিক পাওয়া যায়। মেরুতন্ত্র-এ নর্মদা নদীর স্রোতমধ্যস্থিত সচল স্বয়ম্ভূলিঙ্গকে বাণলিঙ্গ বলা হয়েছে। এই বাণলিঙ্গে সর্বদা সদাশিবের অধিষ্ঠান। অন্ন-জল বা যে-কোনও বস্তু বাণলিঙ্গে অর্পিত হলে তা-ই প্রসাদরূপে গ্রহণ করা যায়। বলা হয় যে, রুদ্রাক্ষ ও শিবলিঙ্গ যত স্থূল হয় ততই প্রশস্ত, কিন্তু শালগ্রাম শিলা ও বাণলিঙ্গ যত সূক্ষ্ম হবে ততই উৎকৃষ্ট। বাণলিঙ্গের নামকরণ সম্পর্কে শাস্ত্রে দুই রকম মতবাদ পাওয়া যায় – “বাণাসুর শিবপূজার জন্য যে লিঙ্গসমূহ নির্মাণ করেছিলেন সেগুলোর নাম হয়েছিল বাণলিঙ্গ। এই মতানুসারে বাণাসুরের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ হলো বাণলিঙ্গ। আরেকটি মতে বলা হয়েছে যে, বাণ শব্দের অর্থ হলো শিব। এই শিব বা বাণের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ হলো বাণলিঙ্গ।” একইভাবে বীরমিত্রোদয়-এও বলা হয়েছে – “স্বয়ং সদাশিবের নাম বাণ। বাণ শব্দে বাণ রাজাও বোঝায়। সেই বাণ রাজা কর্তৃক স্থাপিত হওয়াতে, বাণ-লিঙ্গ বলে খ্যাতি হয়েছে।”
বাণলিঙ্গ ও এর মাহাত্ম্য ও পূজাপদ্ধতি
বাণলিঙ্গের উৎপত্তি সম্পর্কে আখ্যায়িকা : বাণলিঙ্গের উৎপত্তি সম্পর্কে শাস্ত্রে একটি আখ্যায়িকা পাওয়া যায়। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থের ভূমিকায় কৃত ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনা অনুসারে – “পুরাকালে সর্বপ্রকার ক্রোধ জয়কারী ও শিবপূজায় রত মহাদেবের এক প্রিয় ভক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিপুণ এক শিল্পী। প্রত্যেকদিন স্বহস্তে তিনি শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করে ও পূজা করে তা প্রতিষ্ঠা করতেন। এভাবে প্রত্যহ শিবপ্রতিষ্ঠার দ্বারা দিব্য শত বৎসর কেটে গেল। তার একান্ত ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শঙ্কর তার কাছে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ‘হে বাণ, তোমার ওপর আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি কী বর প্রার্থনা কর তা জানাও। আমি এক্ষুনি তোমাকে সেই বর দেব’। বাণ শিবের কথায় তুষ্ট হয়ে তাকে প্রণাম করে বল্লেন – ‘হে ভগবান্! শাস্ত্রমতে শুভ লক্ষণযুক্ত শিবলিঙ্গ নির্মাণ করতে আমার প্রত্যেকদিন খুব কষ্ট হয়। অতএব আপনি সন্তুষ্ট হয়ে শুভলক্ষণ যুক্ত কিছু লিঙ্গ আমাকে দিন। ঐসব লিঙ্গের অর্চনার দ্বারা যেন আমার সমস্ত অভিলাষ পূর্ণ হয় এবং আমি কৃতার্থ হই।’ জগৎকারণস্বরূপ মহাদেব বাণের এরূপ প্রার্থনা শ্রবণের পর কৈলাশ পর্বতের শিখরে গিয়ে চোদ্দ কোটি শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করলেন। এই প্রত্যেকটি লিঙ্গই সিদ্ধলিঙ্গ এবং এদের পূজা করলে প্রতিটি মানুষেরই উন্নতি লাভ হয়। তারপর মহাদেব সেই লিঙ্গগুলো এনে বাণকে দান করলেন। বাণ তখন থেকে আর লিঙ্গ প্রস্তুত করতেন না। শিবপ্রদ ঐ লিঙ্গগুলোর থেকেই প্রত্যেকদিন এক একটি লিঙ্গকে প্রতিষ্ঠা করতেন এবং পূজা করতেন। নিজের রাজধানীতে এই বিশালসংখ্যক লিঙ্গকে নিয়ে গিয়ে চিন্তা করলেন যে মানবদের সিদ্ধির জন্য মহাবেগযুক্ত নদীর মধ্যে এই লিঙ্গগুলোকে রক্ষা করা উচিত। এরূপ চিন্তা করে বিভিন্ন পবিত্রস্থানে তিনি লিঙ্গগুলোকে রেখে এলেন। শিবপ্রদত্ত এই বাণলিঙ্গগুলো যেখানে যেখানে রেখে আসা হয়েছিল সেই সেই স্থলেই বাণলিঙ্গ পাওয়া যায়। বাণ কোন্ কোন্ স্থানে কত পরিমাণ লিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন তার একটি বিবরণ শাস্ত্রকারেরা লিপিবদ্ধ করেছেন – “তিন কোটি লিঙ্গ কালিকাগর্তে, তিন কোটি শ্রীশৈলে, এক কোটি কন্যকাশ্রমে, এক কোটি মাহেশ্বরক্ষেত্রে, এক কোটি কন্যাতীর্থে, এক কোটি মহেন্দ্রাচলে, এক কোটি নেপালে এবং অন্যান্য স্থানে অবশিষ্ট গুলোকে রক্ষা করলেন। নদীর স্রোতে ভেসে আসা বা পর্বতে কুড়িয়ে পাওয়া এইসব লিঙ্গকেই বাণলিঙ্গ জ্ঞানে সাধকেরা পূজা করে থাকেন।”
পার্থিব লিঙ্গ হিসেবে বাণলিঙ্গ ও এর মাহাত্ম্য : কেবলমাত্র প্রস্তর নির্মিত লিঙ্গেই যে শিবপূজা হয় তা নয়, মাটির দ্বারা শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে তার উপরেও শিব পূজার বিধান শাস্ত্রে পরিলক্ষিত হয়। মাটির দ্বারা নির্মিত লিঙ্গকে বলে পার্থিব লিঙ্গ। বিভিন্ন কামনায় বিভিন্ন প্রকার পার্থিব লিঙ্গের পূজা বিধি আছে। এই প্রকার লিঙ্গ নির্মাণ, তার পরিমাপ, লিঙ্গ গঠনকালে মাথার উপর বজ্রস্থাপন এবং পূজার সময় বজ্রমোচন ইত্যাদির বিধিবিধান ও মন্ত্র বাংলায়র পঞ্চোপাসক ব্রাহ্মণগণ বিশেষভাবে অবহিত। পার্থিব শিবলিঙ্গ পূজা করলেও তাকে বাণলিঙ্গ রূপেই পূজা করা হয়ে থাকে। বলা হয়, কোমল বস্তু দিয়ে নির্মিত লিঙ্গের মধ্যে পার্থিব লিঙ্গই শ্রেষ্ঠ। আর কঠিন বস্তু দিয়ে নির্মিত লিঙ্গের মধ্যে পাষাণ-নির্মিত লিঙ্গই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য দামী প্রস্তর বা ধাতুর দ্বারাও লিঙ্গ নির্মিত হতো। এদের মধ্যে ক্রমিক উৎকর্ষের কথা আলোচনা করতে গিয়ে মেরুতন্ত্রে এরূপ ক্রমোৎকর্ষের যে তালিকা পাওয়া যায়, সেখানে বস্তুত বাণলিঙ্গের মাহাত্ম্যই বর্ণিত হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে – “কোমল পদার্থের দ্বারা যত লিঙ্গ প্রস্তুত করা হয় তার মধ্যে পার্থিব লিঙ্গই সর্বশ্রেষ্ঠ, আর কঠিন বস্তু দিয়ে নির্মিত লিঙ্গের মধ্যে প্রস্তর নির্মিত লিঙ্গ শ্রেষ্ঠ। প্রস্তর নির্মিত লিঙ্গের থেকেও স্ফটিক নির্মিত লিঙ্গ শ্রেষ্ঠ, আবার স্ফটিকলিঙ্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ হলো পদ্মরাগমণি নির্মিত লিঙ্গ। পদ্মরাগনির্মিত লিঙ্গের চেয়েও কাশ্মীর লিঙ্গ, তার থেকেও পুষ্পরাগনির্মিত লিঙ্গ, তার চেয়ে ইন্দ্রনীলমণি গঠিত লিঙ্গ, তার চেয়ে গোমেদ নির্মিত লিঙ্গ, তার চেয়ে হীরক লিঙ্গ, তার চেয়ে স্বর্ণনির্মিত লিঙ্গ, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ পারদনির্মিত লিঙ্গ এবং পারদ লিঙ্গের (শাস্ত্রে পারদকে রুদ্রের বীর্য বলে) থেকেও বাণলিঙ্গ সর্বশ্রেষ্ঠ। এককোটি রত্নলিঙ্গ পূজা করলে যে ফল পাওয়া যায় একটিমাত্র বাণলিঙ্গ পূজার দ্বারা সেই ফল পাওয়া যায়। কোটি বাণলিঙ্গ পূজার ফল একটি পারদ লিঙ্গের পূজাতে লাভ হয়।” উল্লেখ্য, এই শ্লোকে একবার বাণলিঙ্গ পারদলিঙ্গের থেকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, আবার পরক্ষণেই বলা হয়েছে একটি পারদলিঙ্গ পূজার দ্বারা কোটি বাণলিঙ্গের পূজার ফল লাভ হয়। পণ্ডিতেরা বলেন, এতে কোন বিরোধ নেই। কেননা তাদের মতে, এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে যে কৃত্রিম পারদলিঙ্গের তুলনায় অকৃত্রিম বাণলিঙ্গ শ্রেষ্ঠ। আবার পারদ যেহেতু শিববীর্য তাই পারদলিঙ্গ কৃত্রিম বাণলিঙ্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ একথা বলতে চাওয়া হয়েছে। বাণলিঙ্গের মাহাত্ম্য এখানেই শেষ নয়। বীরমিত্রোদয়ধৃত-কালোত্তর অনুযায়ী – ‘বাণলিঙ্গের লক্ষণ বিষয়ে প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে আছে যে, নর্মদা, গঙ্গা, যমুনা ও অন্যান্য পুণ্যৎ নদীর উৎপত্তিস্থলে বাণলিঙ্গ স্থাপিত আছে। সর্বার্থদায়ক সদাশিব সর্বদা সেসব বাণলিঙ্গে অধিষ্ঠান করেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ যে যে বাণলিঙ্গের পূজা করেছেন, সেই সেই লিঙ্গে সেই সেই দেবতার চিহ্ন সমুদয় প্রকটিত আছে। কথিত আছে যে, বাণলিঙ্গ পূজা করলে ভোগ ও মোক্ষ লাভ হয়। বাণলিঙ্গে গৌরীপট্ট যোগ করলেও চলে, আবার না করলেও চলে কারণ, বাণলিঙ্গে শিবের সাথে শক্তির নিরন্তর অবস্থান। স্বভাবতই গৌরীপট্ট বাণলিঙ্গে অন্তর্নিবিষ্ট আছেন। আবার বাণলিঙ্গের অভিষেক সংস্কার, আবাহন, প্রতিষ্ঠা ও বিসর্জন নেই কারণ, বাণাসুর বা অন্যান্য দেবগণ নিজ নিজ পূজিত বাণলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেই রেখেছেন। আবার তারা যে সমস্ত বাণলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাতে কোনওরকম স্পর্শ দোষও হয় না।’ (অশোক রায়)
অস্বয়ম্ভূলিঙ্গ হিসেবে বাণলিঙ্গ ও এর লক্ষণ-চিহ্ন : বাণাসুর ও অন্যান্য দেবতারা যে যে লিঙ্গ অর্চনা করেছেন, সেই সেই লিঙ্গ তাদের নিজ নিজ লাঞ্ছন চিহ্নে চিহ্নান্বিত হয়ে নামরূপলক্ষণে বাণলিঙ্গের বিভিন্ন প্রকারভেদ স্বরূপ মানুষের কাছে পূজ্য হয়েছে। এগুলো বস্তুত অস্বয়ম্ভূলিঙ্গ। শাস্ত্রকারের ভাষায় সেই সেই লিঙ্গ পূজনের বিশেষ ফলশ্রুতির কথাও বলা হয়েছে। যেমন – “বজ্রাদি চিহ্নে চিহ্নিত বাণলিঙ্গকে ইন্দ্রলিঙ্গ বলে এবং এই লিঙ্গ পূজনে সাধক সাম্রাজ্য লাভ করে এবং তার মনোবাসনা সিদ্ধ হয়। যে বাণলিঙ্গ গোলাকৃতি পাশচিহ্নযুক্ত এবং ভ্রমরের মতো কালো তাকে বারুণলিঙ্গ বলে এবং এই লিঙ্গ পূজনে সত্ত্বগুণ ও সুখসৌভাগ্যাদি বৃদ্ধি হয়। শালগ্রামশিলাতে যেরূপ চক্রচিহ্ন থাকে সেরূপ চিহ্ন এবং শশাঙ্ক চিহ্ন থাকলে সেই লিঙ্গকে বলে বৈষ্ণব লিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গ পূজার দ্বারা শ্রীবৃদ্ধি হয়। বৈষ্ণবলিঙ্গে যদি পদ্ম, স্বস্তিক ইত্যাদি চিহ্ন অঙ্কিত থাকে তাহলে তার পূজার দ্বারা বিভূতি লাভ হয়। বাণলিঙ্গে যদি শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, শ্রীবৎস, কৌস্তুভ, সিংহাসন, গরুড়, বিষ্ণুপদ ইত্যাদি চিহ্ন থাকে, তাহলে সেই লিঙ্গকেও বৈষ্ণবলিঙ্গ বলে এবং এরূপ লিঙ্গ পূজার দ্বারা সাধক সর্বপ্রকার ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হন। জলের মতো স্বচ্ছ এবং উষ্ণস্পর্শ হলে সেই লিঙ্গকে আরুণলিঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়। আরুণলিঙ্গও সাধকের মঙ্গল সাধন করে। শক্তি চিহ্ন লিঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে এবং আগুনের মতো তেজসম্পন্ন হলে সেই লিঙ্গকে বলে আগ্নেয়লিঙ্গ। এরূপ শিবলিঙ্গের পূজার দ্বারা তেজের অধীশ্বর হওয়া যায়। যে লিঙ্গ কৃষ্ণ বা ধূম্রবর্ণ, নির্মল নয় বরং ধ্বজাসদৃশ (ঢেউ খেলানো) এবং যার মস্তকে ধ্বজ ও মুষলচিহ্ন থাকে সেরূপ অসমতল লিঙ্গ বায়ুলিঙ্গ নামে খ্যাত। যে লিঙ্গের মাঝখানে তূণ, পাশ বা গদার চিহ্ন থাকে তাকে বলে কুবেরলিঙ্গ। যদি লিঙ্গগায়ে অস্থি বা শূলচিহ্ন বর্তমান থাকে এবং লিঙ্গের বর্ণ হিমমণ্ডলের (সাদা বরফের) মতো হয়, তাহলে সেই লিঙ্গকে রৌদ্রলিঙ্গ বলে।” এছাড়াও হেমাদ্রিধৃত লক্ষণ কাণ্ডে – দেবর্ষি নারদ পূজিত একাদশ রুদ্র বাণলিঙ্গের প্রধান প্রধান লক্ষণ-চিহ্নের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে নয় প্রকার চিহ্ন-লক্ষণের বর্ণনা নিম্নরূপ, যেমন – “নারদের মতে – যে বাণলিঙ্গ মধুর মতো পিঙ্গলবর্ণ এবং যাতে কৃষ্ণবর্ণ কুণ্ডলিনী বিদ্যমান তাকে বলে স্বয়ম্ভূলিঙ্গ। সিদ্ধযোগীরা এই প্রকার লিঙ্গের পূজা করে থাকেন। নানা বর্ণযুক্ত যে লিঙ্গে জটা ও শূলচিহ্ন বর্তমান থাকে, তাকে বলে মৃত্যুঞ্জয়লিঙ্গ। সমস্ত সুরাসুরই এই লিঙ্গকে নমস্কার করে। কৃষ্ণবিন্দু যুক্ত দীর্ঘাকৃতি ও শুভ্রবর্ণ বাণলিঙ্গকে নীলকণ্ঠলিঙ্গ বলে। এই লিঙ্গ সুর ও অসুর সকলেরই পূজ্য। ত্রিনেত্রচিহ্ন শোভিত শুক্লবর্ণ, শুক্লাভাযুক্ত ও শুক্ল কেশরচিহ্ন সমন্বিত বাণলিঙ্গকে বলে ত্রিলোচনলিঙ্গ। এর পূজা করলে সর্বপাপ বিনষ্ট হয়। স্থূল, অগ্নির মতো উজ্জ্বল অথচ কৃষ্ণবর্ণ আভাযুক্ত এবং জটাজুটচিহ্ন বর্তমান থাকলে, সেই লিঙ্গকে বলে কালাগ্নিরুদ্রলিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গ সর্বজীবের পূজ্য। যে বাণলিঙ্গ মধুর মতো পিঙ্গল আভাযুক্ত, শ্বেত যজ্ঞোপবীত চিহ্ন শোভিত এবং শ্বেতপদ্মের উপর অধিষ্ঠিত চিহ্নযুক্ত ছাড়াও শোভন চন্দ্ররেখা ও প্রলয়ান্ত্র চিহ্ন দৃষ্ট হলে, সে লিঙ্গকে ত্রিপুরারিলিঙ্গ বলে। যে বাণলিঙ্গ শুভ্রবর্ণ পিঙ্গল জটাজুট যুক্ত এবং ত্রিশূল ও মুণ্ডমালা চিহ্ন শোভিত, তাকে বলে ঈশানলিঙ্গ। এই লিঙ্গ পূজনে সমস্ত অভিপ্রায় সিদ্ধ হয়। ত্রিশূল ও ডমরুচিহ্ন শোভিত যে বাণলিঙ্গের অর্ধাংশ শুভ্রবর্ণ ও অর্ধাংশ রক্তবর্ণ, তাকে অর্ধনারীশ্বরলিঙ্গ বলে। এরূপ বাণলিঙ্গ সর্বদেবপূজ্য এবং ঈপ্সিতফলপ্রদ। ঈষৎ লোহিতবর্ণ, স্থূল, দীর্ঘ, সুদৃশ্য ও উজ্জ্বল হলে সেই বাণলিঙ্গকে বলে মহাকাললিঙ্গ। এই লিঙ্গের পূজার দ্বারা ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই পুরুষার্থ চতুষ্টয় লাভ হয়। বাণলিঙ্গের যেসব চিহ্নের কথা বলা হলো তার সবগুলোই একটি লিঙ্গে থাকবে এমন কথা নেই, তবে এসব চিহ্নের একটি মাত্র চিহ্ন থাকলেও তা বাঞ্ছিতসিদ্ধি দান করে।”
বাণলিঙ্গ বর্ণ ও আকৃতিভেদে পূজ্য : নর্মদা নদীর জলে প্রাপ্ত যে সমস্ত বাণলিঙ্গ দেখা যায় সেই সব অকৃত্রিম বাণলিঙ্গ বিভিন্ন প্রকার রঙের হয়ে থাকে। তবে প্রত্যেক প্রকার লিঙ্গ প্রত্যেকের পূজ্য নয়। শাস্ত্রানুসারে বিশেষ বর্ণের লিঙ্গ বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির পূজ্য। যেমন – “কপিলবর্ণের বাণলিঙ্গ পূজা করলে অর্থ লাভ হয়। তবে মোক্ষার্থীরা মেঘের মত বর্ণের লিঙ্গ পূজা করবেন। কিন্তু যে লিঙ্গ অতি লঘু বা অতি স্থূল অথচ কপিল বর্ণ (হলদে বা মেটে হলদে) তার পূজা গৃহীর পক্ষে কর্তব্য নয়। ভ্রমরের মতো কৃষ্ণবর্ণ লিঙ্গ (অতি লঘু বা অতি স্থূল হলেও) গৃহস্থের পূজা করা কর্তব্য।” অকৃত্রিম বাণলিঙ্গগুলো যদিও একই নর্মদা নদীর জলে একইভাবে সৃষ্ট, তবুও শাস্ত্রে কিছু লক্ষণযুক্ত বিশেষ বিশেষ আকৃতির বাণলিঙ্গকে পূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এইসব অপূজ্য এক এক ধরনের লিঙ্গ পূজার দ্বারা এক এক প্রকারের অমঙ্গল লাভ ঘটে। এইসব অনিষ্টকর লক্ষণযুক্ত অপূজ্য বাণলিঙ্গকে অনিষ্টকর লিঙ্গ বা ত্যাজ্য বাণলিঙ্গ বলে। কিরূপ লিঙ্গের পূজায় কিরূপ অমঙ্গল ঘটে তা শাস্ত্রকারেরা একত্র নিবন্ধ করেছেন। যেমন – “কর্কশ বাণলিঙ্গের পূজা করলে স্ত্রীপুত্র ক্ষয় হয় এবং চিপিট (চ্যাপ্টা) লিঙ্গের পূজার দ্বারা গৃহভঙ্গ হয়। একপাশমাত্র আছে (একপার্শ্বাস্থিত) এরূপ লিঙ্গের পূজা করলে সেই পূজকের স্ত্রী, পুত্র, গাভী, ধন ইত্যাদি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মাথাভাঙা (শিরসি স্ফুটিত) বাণলিঙ্গের পূজা করলে ব্যাধি ও মৃত্যুলাভ ঘটে। ছিদ্রযুক্ত লিঙ্গের পূজা করলে বিদেশ গমন ঘটে। যে লিঙ্গের মস্তকে পদ্মকোষের মতো কর্ণিকা থাকে তার পূজা করলে পীড়া হয়। যে লিঙ্গের ছিদ্রের পাশটা অত্যন্ত উঁচু তার অর্চনা করলে গোধন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যে বাণলিঙ্গের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ অথবা বক্র বা যে লিঙ্গ ত্রিকোণাকৃতি তার পূজা করতে নেই। যে বাণলিঙ্গ অত্যন্ত স্থূল, অত্যন্ত কৃশ বা অতি খর্ব তা সুলক্ষণ চিহ্নান্বিত হলেও গৃহীর পক্ষে সেরূপ লিঙ্গ পূজ্য নয়। তবে ওইসব লিঙ্গ পূজা মোক্ষকামীর পক্ষেই হিতকর।” এছাড়াও শাস্ত্রকারের ভাষায় – “শিবলিঙ্গ যদি লাঠির মতো লম্বা হয় বা জিহ্বার মতো লম্বা হয় তাকে বলে যাম্যলিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গকে পূজা করতে নেই। এধরনের লিঙ্গ স্থাপন করলে বা পূজা করলে সাধকের নিশ্চিত মৃত্যু হয়। খড়গের মতো আকৃতি বিশিষ্ট লিঙ্গকে বলে রাক্ষস লিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গের পূজা করলে মোক্ষলাভ হয়। তবে রাক্ষস লিঙ্গের গা যদি কাঁকরের মতো কর্কশ হয় এবং মাঝখানটা চ্যাপা থাকে, তাহলে সেই লিঙ্গকে নৈর্ঋতলিঙ্গ বলে। এই লিঙ্গের পূজোর দ্বারা অলক্ষ্মী লাভ হয়। সেই কারণে গৃহস্থের পক্ষে এরূপ লিঙ্গ পূজা করা উচিত নয়।”
কৃত্রিম লিঙ্গ ও তার মাহাত্ম্য : এতক্ষণ আমরা অকৃত্রিম বা প্রাকৃতিক লিঙ্গের লক্ষণ ও পূজা-মাহাত্ম্য দেখলাম। এবার কৃত্রিম লিঙ্গ সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে। কৃত্রিম লিঙ্গ শব্দের অর্থ ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ। কৃত্রিম লিঙ্গ শিলা, ধাতু, মাটি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে, তাই পৃথিবীতে কৃত্রিম লিঙ্গের সংখ্যা অসংখ্য। ইতপূর্বে শৈলজ ও ধাতুনির্মিত লিঙ্গের উল্লেখ করা হয়েছে। এখন বিশেষ বিশেষ কিছু জিনিস দিয়ে তৈরি কৃত্রিম লিঙ্গের আরও কিছু শাস্ত্র-নির্দেশনা দেখতে পারি, যেমন গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে – “অশ্বগন্ধাযুক্ত কুসুম দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করলে নবখণ্ডা পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য ভোগের পর গণাধিপত্য লাভ করা যায়। যে ব্যক্তি যথাযথ ভক্তির দ্বারা ধুলিনির্মিত শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করে পূজা করে সে বিদ্যাধরপদ প্রাপ্ত হয় এবং শিবতুল্য হয়ে থাকে। কপিলা ধেনুর গোময় ভূপতিত হবার পূর্বেই তা আহরণ করে তার দ্বারা শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করে পূজা করলে শ্রীলাভ করা যায়। অতএব শ্রীকামী এভাবে লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন। শ্রীকামী ব্যক্তি যবের দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন, পুষ্টিকামী ব্যক্তি গোধূম দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন এবং পুত্রকামী ব্যক্তি শালিধান্য দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন। মধু জমে চিনির মতো শক্ত হলে, তার দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে যে পূজা করে, তার আরোগ্য লাভ হয়। লবণ, হরিতাল এবং ত্রিকূট দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার পূজা করলে বশীকরণ সিদ্ধ হয়। গব্যঘৃত দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার পূজা করলে বুদ্ধিবৃদ্ধি ঘটে। লবণ নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা সৌভাগ্য লাভ হয়। মৃত্তিকা নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা সর্বকামনা পূর্ণ হয়। তিল বেটে তার দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে পূজা করলে অভীষ্টসিদ্ধি হয় এবং তুষ দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে মারণকার্য সিদ্ধ হয়ে থাকে। ভস্ম নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে সর্বপ্রকার অভীষ্ট লাভ হয়। গুড় দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে প্রীতি বৃদ্ধি পায়। চন্দন প্রভৃতি গন্ধ দ্রব্যের দ্বারা লিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করলে বহু গুণের অধিকারী হতে পারা যায়। শর্করা বা চিনির দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে সুখ লাভ হয়। বাঁশ গাছের অঙ্কুরের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা বংশ বৃদ্ধি ঘটে থাকে। গোময় বা গোবর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে সর্বপ্রকার রোগ তকে আক্রমণ করে। কেশ, অস্থি ইত্যাদি নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে যাবতীয় শত্রু বিনষ্ট হয়। পিষ্ঠনির্মিত লিঙ্গ ক্ষোভন ও মারণকার্যে প্রশস্ত। কাষ্ঠ নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা দারিদ্র হয়। পিষ্ঠসম্ভব লিঙ্গ বিদ্যাদান করে। দধি, বা দুগ্ধ দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে কীর্তি, শ্রী ও সুখলাভ হয়। ধান্য নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে ধান্য লাভ এবং ফল নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে ফল লাভ ঘটে। পুষ্পজ লিঙ্গ পূজা করলে দিব্য ভোগ লাভ করা যায়। ধাত্রীফল নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা মুক্তিলাভ হয় এবং ননী (নবনীত) দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা কীর্তি ও সৌভাগ্যবৃদ্ধি ঘটে। দুর্বাকাণ্ডের দ্বারা লিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করলে অপমৃত্যু নিবারিত হয়। কর্পূর নির্মিত লিঙ্গে পূজা করলে ভুক্তিমুক্তি প্রাপ্তি ঘটে। চারপ্রকার অয়স্কান্ত নির্মিত লিঙ্গে পূজা করলে সিদ্ধি পাওয়া যায়।”
অচল শিবলিঙ্গ : এতক্ষণের আলোচনায় বিভিন্ন পর্যায়ের সাধক ও পূজকদের পূজ্য নানা প্রকারের কৃত্রিম ও অকৃত্রিম শিবলিঙ্গের প্রসঙ্গ আলোচিত হলেও যেসব বিখ্যাত ‘অচল’ শিবলিঙ্গ গোটা ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রাচীনকাল থেকে অগণিত মন্দির, তীর্থ ও লক্ষকোটি ভক্ত জনগোষ্ঠীর নিত্য কোলাহল-সমাকীর্ণ অনড় শিবক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশিত হয়ে আছে, সেসবের উল্লেখ না হলে বস্তুত সাধন-পরম্পরায় প্রাধান্য অর্জনকারী এই শৈব সাধনা তথা লিঙ্গ পূজার মূল স্পন্দনটাকে উপলব্ধি করা যাবে না। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনায় এগুলোর বিশাল বিস্তৃত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয় বা উদ্দেশ্যও তা নয়। কেননা, শিবপুরাণের জ্ঞানেশ্বর-সংহিতার আটত্রিশ অধ্যায়ে ঋষিরা সূতের কাছে লিঙ্গের বিষয়ে যখন জানতে চেয়েছেন তখন তিনি বলেছেন – “এই পৃথিবীতে লিঙ্গের সংখ্যা পরিমাপ করা যায় না। সমগ্র জগৎ যেমন লিঙ্গময় তেমন সমগ্র পৃথিবীও লিঙ্গময়। যা কিছু দেখা যায়, বর্ণনা করা যায়, স্মরণ করা যায় সবই শিবস্বরূপ, শিব ছাড়া আর কিছুই নেই। লোকেদের উপকারের জন্য ভগবান শম্ভু বিভিন্ন স্থানে লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মানুষের পক্ষে সেই সমস্ত লিঙ্গের সংখ্যা নিরূপণ কিভাবে সম্ভব।” (শিবপুরাণ-জ্ঞানসংহিতা-৩৮/১৬-২২)।
জ্যোতির্লিঙ্গ ও এর ব্যাখ্যা
জ্যোতির্লিঙ্গ : এর পরেই এখানে কয়েকটি জ্যোতিলিঙ্গের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। স্থাপিত লিঙ্গের সংখ্যা অসংখ্য হলেও প্রচলিত মতে জ্যোতিলিঙ্গের সংখ্যা বারোটি অর্থাৎ – দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গ। শিবপুরাণে বলা হয়েছে – “দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ হলো – সৌরাষ্ট্রে শ্রীসোমনাথ, শ্রীশৈলে শ্রীমল্লিকার্জুন, উজ্জয়িনীতে শ্রীমহাকাল, পরমেশ্বরে শ্রীওঙ্কারেশ্বর, হিমালয়পৃষ্ঠে শ্রীকেদারনাথ, শ্রীভীমাশঙ্কর, বারাণসিতে শ্রীবিশ্বেশ্বর, গৌতমীতটে শ্রীত্র্যম্বকেশ্বর, চিতাভূমে শ্রীবৈদ্যনাথ, দারুকাননে শ্রীনাগেশ্বর, সেতুবন্ধে শ্রীরামেশ্বর এবং শিবালয়ে শ্রীঘুশ্নেশ্বর।” (জ্ঞানেশ্বর-সংহিতা-৩৮/১৭-১৯)। প্রাচীনকালে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তিরাশি/চুরাশিটা মন্দিরে দেবাদিদেব মহাদেবের পূজার জন্যে বিখ্যাত ছিল বলে জানা যায়। স্কন্দ পুরাণের আবন্ত্যখণ্ডে বিভিন্ন তীর্থে অবস্থিত চুরাশি প্রকার লিঙ্গের বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে উমা শিবকে জিজ্ঞাসা করেছেন – “আপনি যে চতুরশীতি লিঙ্গের কথা বলেছেন তা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করুন, আমি সর্বপাপ হর ঐ সকল লিঙ্গের কথা শুনতে চাই।” (স্কন্দপুরাণ-আবন্ত্যখণ্ড-১/১৯)। মহাদেব তখন বিস্তৃতভাবে সেই সব লিঙ্গের বিবরণ ও তার পূজা ফলের কথা বলেছেন। বিভিন্ন তীর্থের বর্ণনা প্রসঙ্গে শিবের কথাও এখানে এসেছে। এর মধ্যে কিছু মন্দির সেসময় নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হলেও বেশিরভাগই প্রাচীন, অতি প্রাচীন ও মহা প্রাচীন। যেমন স্বয়ং কাশী বিশ্বনাথই স্মরণাতীত কাল থেকে অনাদি লিঙ্গ বা অবিমুক্তেশ্বররূপে পূজিত হয়ে আসছিলেন, পরে জ্যোতির্লিঙ্গরূপে হলেন – বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ। এরপরে হয়তো আরো হাজার বছর কেটে গেছে। ৭ম শতকে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠ সংগঠক বলে কথিত শঙ্করাচার্য ওই সুপ্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে বারোটা মন্দিরকে জ্যোতির্লিঙ্গ বলে আখ্যা দিলেন। শিবপুরাণ ও নন্দীপুরাণে কথিত আছে – ‘আমি সর্বত্র বিরাজমান হলেও এই বারোটি স্থানে (সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওংকারেশ্বর ও অমলেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমাশংকর, ত্রম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ বা বৈজনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর, বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ, বিমলেশ্বর ও ঘৃশ্লেশ্বর) জ্যোতির্লিঙ্গরূপে বাস করি।’
জ্যোতির্লিঙ্গ শব্দের প্রচলন ও বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের ব্যাখ্যা : জ্যোতির্লিঙ্গ শব্দটার প্রচলন সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল কৈলাস শৃঙ্গ-কে শিবলিঙ্গরূপে অভিষেক করার সময় থেকে। তারপর সেই ধারা বেয়ে সমতলের প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ হলেন – কাশী বিশ্বনাথ। তারপর ছড়িয়ে পড়লো সারা ভারতের তিরাশিটা স্থানে। এর মধ্যে বারোটাকে শঙ্করাচার্য মান্যতা জ্ঞাপন করলেন। ভক্তের টানে দেবাদিদেব মহাদেব ওইসব স্থানে আবির্ভূত হয়ে জ্যোতির্লিঙ্গরূপে অবস্থান করছেন বলেই বিশ্বাস। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে যুক্তিসংগত কারণেই এই শিবপুরাণ ও নন্দীপুরাণ ৭ম শতকের পরেই রচিত বলে মনে হয়। তবে সারা ভারতের প্রতিটা কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা শত শত শিবলিঙ্গের মধ্যে কেন ওই বারোটা শিবলিঙ্গই জ্যোতির্লিঙ্গের মান্যতা পেলো, সে সম্পর্কে আচার্য শঙ্করের কোনও ব্যাখ্যা আছে বলে জানা নেই। স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মকে সংগঠিত করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সারা ভারতের বিভিন্ন হিন্দু তীর্থস্থানগুলোতে বৈদিক মতে পূজা পদ্ধতির প্রচলন করেন। এছাড়াও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত তীর্থস্থানগুলোকে দেখভাল করার জন্যে ভারতবর্ষের চারকোণায় চার-চারটে মঠও প্রতিষ্ঠা করেন। অশোক রায়ের মতে, শঙ্করাচার্য সম্ভবত এই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আর্য ও অনার্য প্রভাবিত ও পূজিত তীর্থস্থানগুলোর (তিরাশিটা) মধ্যে থেকে সেই যুগে জনপ্রিয়তার নিরিখে মান্যতা জ্ঞাপন করেছিলেন। নইলে অনার্য প্রভাবিত তীর্থস্থানগুলো (বৈদ্যনাথ/বৈজনাথ, ভীমাশংকর, নাগনাথ ও ঘৃশ্লেশ্বর ইত্যাদি) একই সাথে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের শিরোপা কিভাবে পেলো তার আপাত ব্যাখ্যা মেলে না।
জ্যোতির্লিঙ্গের ধারণা সৃষ্টির ব্যাখ্যা : তবে জ্যোতির্লিঙ্গের সৃষ্টির ধারণার বিকাশ কিভাবে ঘটতে পারে বা ঘটেছে, অশোক রায় যেভাবে তার বিজ্ঞানসম্মত সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তাকে যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নিতে বাধা দেখি না। কেননা – ‘মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথে বা তার আশপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাপহীন, আলোহীন (প্রধানত লোহা, নিকেল ও সিলিকেট-এর বিভিন্ন যৌগের) অসংখ্য ধূলিকণা। এদের প্রধান উৎস হল ধূমকেতু। যদিও কিছু ধূলিকণা সৌরজগতের সৃষ্টির সময়কাল থেকে পড়ে থাকা পদার্থ। আবার কখনও কখনও গ্রহাণুর সংঘর্ষজাত টুকরো। এরা পৃথিবীর কক্ষপথের উপরে বা তার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পৃথিবী নিজের কক্ষপথের সেই বিশেষ জায়গায় এলেই এরা (পৃথিবীর আকর্ষণে) সেকেন্ডে ৫০-৭০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০-১৫০ কিমি উপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পৃথিবীর উপরে আছড়ে পড়ে। এই বিপুল গতিবেগে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে উদ্ভূত প্রচণ্ড তাপে যখন তারা জ্বলে ওঠে তখনই তাদের আমরা দেখতে পাই। এদের বলে উল্কা (Meteor)। এই উল্কাপিণ্ডের (Meteoroid) বেশিরভাগই জ্বলতে জ্বলতে নেমে আসার পথেই নিঃশেষ হয়ে যায় (পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০ কিমি উপরে)। চলতি কথায় এর নাম ‘তারা খসা’ (Shooting Star)। জ্বলে ওঠা উল্কাপিন্ড তার আশপাশের বাতাসকে উত্তপ্ত ও আয়নিত করে, ফলে কখনও কখনও উল্কা নিঃশেষ হয়ে গেলেও আকাশে থেকে যায় তার আভা (Meteor trail), কোনও উল্কা মিলিয়ে যায় অতি দ্রুত, আবার কেউ কেউ বিস্ফারিত হয়ে তৈরি করে অগ্নি গোলক (Fire ball বা bolides)। রাতের আকাশের যে অংশ থেকে উল্কাগুলো ছুটে আসে বলে মনে হয় সেই অংশকে বলে ‘দীপ্তিকেন্দ্র’; আর যে নক্ষত্রমন্ডলীতে এই দীপ্তিকেন্দ্রের অবস্থান তারই নামে রাখা হয় উল্কাবৃষ্টির নাম। … এই মহাজাগতিক পদার্থগুলো সমস্ত গ্রহেই চিরকালই পড়ে আসছে। পৃথিবীর উপরে বাতাসের এক পরিমণ্ডল থাকায় তার সাথে সংঘর্ষের ফলে বেশিরভাগ উল্কাই নেমে আসার পথেই জ্বলতে জ্বলতে নিঃশেষ হয়ে যায়। কদাচিৎ দু’-একটা ওই বিপুল বেগ নিয়ে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে। তখন সেখানে ঘটে এক – প্রলয় কাণ্ড (একই সাথে ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড ও প্রবল বিস্ফোরণ)। ভারতবর্ষের ‘লোনার হ্রদ’ এইরকমই এক বিশাল উল্কাপাতের ফলে সৃষ্ট। সেখানে উল্কা মাটির এত গভীরে চলে গেছে যে তার হদিশ আজও মেলেনি। সাইবেরিয়াতেও এইরকমই এক উল্কাপাতের কথা জানা যায়। সম্প্রতি নজরে এল নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন গত ৭ নভেম্বর ২০০৫-এ চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়েছে এক ১২ সেমি চওড়া উল্কা। তার গতিবেগ ছিল ২৭ কিমি প্রতি সেকেন্ডে। এই বিপুল বেগে চাঁদের বুকে উল্কাটি আছড়ে পড়ায় যে বিস্ফোরণ ঘটে তার শক্তি ছিল ৭০ কেজি T.N.T-এর সমান। … ‘এই ধরনের বড়সড় উল্কাপাতের ঘটনা পৃথিবীতে কদাচিৎ ঘটে। জ্বলতে জ্বলতে প্রায় নিঃশেষিত কিছু টুকরো অনেক সময়ই পড়ে। যদিও তার ফলে সেই অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় যথেষ্ট। … যাই হোক যে কথা বলার জন্য উল্কাপাতের ঘটনার প্রস্তাবনা তা হল – আদিমকাল থেকেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা প্রত্যক্ষ করেছে এই অতি প্রাকৃত ঘটনাকে। ফলে ভয়ে, বিস্ময়ে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, দূর থেকে স্তব-স্তুতি করে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে এই জ্যোতির্ময় অগ্নিগোলককে। ক্রমে ঠাণ্ডা হয়ে এলেও সাহস হয়নি কাছে যাওয়ার। ফলে বারংবার প্রণতি জানিয়েছে দূর থেকে। তারপর একসময় কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে স্তুব-স্তুতি-প্রণতি জানিয়ে ও সবশেষে ওই মহাশক্তিধরের উপরে জল ঢেলে তাকে শান্ত করার প্রয়াসও চালিয়েছে। … সাধারণত এই উল্কাপিণ্ডগুলো দেখতে হয় কালো মসৃণ ও ডিম্বাকৃতি। এতে প্রধানত লোহা ও নিকেল ছাড়া বিভিন্ন সিলিকেট যৌগও থাকে। তাই এর ওজনও হয় অন্য সাধারণ পাথরের থেকে বেশি। ফলে দেবদত্ত ও দৈবগুণসম্পন্ন বলে প্রতিষ্ঠা পেতে দেরি হয় না। কালক্রমে তা দেবত্বের মান্যতাও লাভ করে – ভয়ে ও ভক্তিতে। শুরু হয়ে যায় তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক ও চিকিৎসার কাজে এই অতি দুর্লভ জিনিসের ব্যবহার। কালস্রোতে তা শিবত্বের সাথে লীন হয়ে যায়। অতি প্রাচীন শৈব সম্প্রদায়ের ভ্রাম্যমাণ তীর্থিকেরা এই অতি দুর্লভ বস্তুকে সযত্নে সংগ্রহ করে বিভিন্ন শৈব তীর্থস্থানে শিবলিঙ্গের মণি বেদিকায় তা প্রোথিত করে দেয়। তাদের মধ্যে সেই সময়ে যেসব শৈবতীর্থের শিবলিঙ্গ জনমানসে প্রসিদ্ধি লাভ করে সম্ভবত তাদের মধ্যে থেকেই আচার্য শঙ্কর বারোটা স্থানকে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মান্যতা জ্ঞাপন করেন।’ – (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৬৩-৬৫)। এই সম্ভাব্য কারণের মধ্যে কতটুকু সত্য নিহিত থাকতে পারে তার বিচার হয়তো একদিন সময়ই করবে। তবে শিবলিঙ্গের আর এক শাস্ত্রিয় বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে। স্কন্দপুরাণের মাহেশ্বর খণ্ড থেকেও শিবলিঙ্গ সম্পর্কে অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন শিবতীর্থের দীর্ঘ তালিকা ও বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে এইসব তীর্থ সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত ছিল। সে বিবরণ এখানে বাহুল্য। বাস্তবতা হলো, লিঙ্গ পূজা যে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-মধ্য-পশ্চিম সমগ্র ভারতেই বিস্তৃত ছিল তা এইসব তীর্থ তালিকা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়। বর্তমান ভারতবর্ষেও এমনকি এই বাংলায়ও তুলনামূলক বিচারে শিবক্ষেত্রেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কোন্ সময় থেকে এই লিঙ্গপূজার উদ্ভব এবং সেই সঙ্গে শিবলিঙ্গের এই অমূর্ত বা বিমূর্ত রূপের পেছনে কোন্ প্রাচীন বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গি লুকিয়ে আছে, গবেষকের ভক্তিনিরপেক্ষ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তা অনুসন্ধান করা আবশ্যক বৈকি।
শিবলিঙ্গের প্রাক্-বৈদিক নিদর্শন
সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত লিঙ্গ ও যোনির ভিত্তিতে লিঙ্গ ও শক্তির উপাসনা সম্পর্কিত ধারণা ও বিতর্ক
বিজ্ঞানীরা মনে করেন জীব বিবর্তনের এক ও একমাত্র কারণ হলো – প্রকৃতি, যা নিত্য পরিবর্তনশীল। তার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সময়ের স্রোতে এগিয়ে চলার ইতিহাসই মানবসভ্যতার ইতিহাস। ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি অতি সুপ্রাচীন কাল থেকে বেশ কয়েকটা অধ্যায়ে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। এগুলোকে যদি কালের নিরিখে পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়, তা হলে শুরু করতে হয় প্রাগৈতিহাসিক পর্ব থেকে – আদি প্রস্তর যুগ, মধ্য প্রস্তর যুগ ও নব প্রস্তর যুগ। এরপরে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা – তাম্র-প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ও লৌহ যুগ। লৌহ যুগেই সমাজ জীবনে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যার ফলশ্রুতিতে আজও আমরা বহুবিবর্তিত হয়েই চলেছি। ভারতবর্ষে তাম্র-প্রস্তর থেকে ব্রোঞ্জ যুগ অবধি সভ্যতাকে বলা হয় হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা। আর এরপরে বৈদিক সভ্যতা, যার সূচনা তাম্র সভ্যতা থেকে শুরু করে লৌহযুগ অবধি বিস্তৃত।
এ-পর্যায়ে প্রাক্-বৈদিক হরপ্পা সভ্যতার ধর্মবিশ্বাসের নিদর্শন হিসেবে প্রত্ন-নিদর্শনস্বরূপ যে কতকগুলো মাতৃকামূর্তি, লিঙ্গ ও যোনির কিছু অনুকৃতি এবং একটি পুরুষ দেবতা অঙ্কিত কয়েকটি সীল পাওয়া গেছে, এই তিন ধরনের নিদর্শন বস্তুত একটি অখণ্ড ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় বহন করে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। লিঙ্গ ও যোনির উপস্থিতি একটি উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস-কেন্দ্রিক ধর্মের সূচনা করে – যেগুলো যথাক্রমে ওই পুরুষ দেবতা ও মাতৃকাদেবীর প্রতীক। এ থেকে পণ্ডিতেরা অনুমান করেছেন যে, এগুলো পরবর্তীকালের সুবিস্তৃত শিব ও শক্তির ধারণার পূর্বাভাস। তাছাড়া বেদোত্তর ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে লিঙ্গ উপাসনা এবং তার সঙ্গে শিবের যে গভীর ও ব্যাপক সংযোগ চোখে পড়ে, এই প্রভাব যে আকস্মিক হতে পারে না বরং তার পেছনে সুদূর কোন এক প্রাগৈতিহাসিক অতীত অনুমেয়, সেটিও মনে রাখা আবশ্যক। তাই এ বিষয়ের সম্যক অনুসন্ধান করতে আমাদেরকে প্রাচীন প্রত্ন-নিদর্শনগুলোর আনুপূর্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তার পর্যায়ক্রমিক যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলে প্রয়োজন হয় এ যাবৎ আমাদের নাগালে থাকা প্রাচীন সাহিত্য-রচনাগুলোর যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণাদির। এ প্রেক্ষিতে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ – ‘কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে ঋগ্বেদ প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে আর্যদের ধর্মানুষ্ঠানের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা সেকালকার সমস্ত ভারতীয়দের ধর্মজীবনের পূর্ণ পরিচয় নয়। ভারতবাসীদের ভেতরে যে প্রধান দুই ভাগ ছিল – আর্য ও অনার্য, সেকথা বিস্মৃত হলে চলবে না। সেই সময়কার অনার্যদের ধর্মক্রিয়া কিরূপ ছিল তা জানবার প্রকৃষ্ট উপায় নেই। বেদ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে এর আংশিক রূপ কখনও কখনও নির্ণয় করা যায় বটে, কিন্তু তা অনার্যদের বিরুদ্ধপক্ষের দ্বারাই বর্ণিত রূপ। বৈদিক ঋষিরা অনার্যদেরকে ‘রাক্ষস’, ‘যাতু’, ‘যাতুধান’, ‘অনাস’, ‘মূরদেব’, ‘শিশ্নদেব’ ইত্যাদি নানাবিধ নিন্দাসূচক আখ্যা দিয়াছেন। সর্বশেষ আখ্যাটির অনেক আধুনিক পণ্ডিত কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা যদি গ্রহণ করা যায়, তা হলে একশ্রেণীর অনার্যগণদ্বারা আচরিত একটি বিশিষ্ট ধর্মকার্যের বিষয়ে আমরা কিছু জানতে পারি। এই অনার্যেরা যে সৃজনশক্তির মূল উৎস এক ‘পিতৃদেবতা’র জননযন্ত্র (লিঙ্গ)-কে ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক বলে পূজা করত তা অনুমান করা অসঙ্গত হয় না। ‘মূরদেব’ কথাটির অর্থ কোনও কোনও আধুনিক পণ্ডিত ‘মূর্তিপূজক’ বলে মনে করেন। তাদের এই অর্থ সঠিক বলে গৃহীত হলে, সে সময়কার অনার্যদের মধ্যে মূর্তিপূজা যে তাদের ধর্মকার্যের অন্যতম প্রধান অঙ্গরূপে প্রচলিত ছিল তা অনুমিত হতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে পরবর্তীকালে এই দুটি অনুষ্ঠানই বিশেষ বিশেষ ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যূনাধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু সেখানকার প্রাক্-আর্যদের ধর্মজীবন সম্বন্ধে এটাই সম্যক্ ও সবিশেষ পরিচয় নয়। আরও কিছুর ইঙ্গিত ব্রাহ্মণ্য ও ব্রাহ্মণ্যেতর, যথা – বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি, – প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করা যায়। এরও বহুপূর্ববর্তী কালের প্রাক্-বৈদিকযুগের এমন অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে যেগুলো থেকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম প্রান্তের প্রাক্-আর্য অধিবাসিগণের ধর্মজীবন সম্বন্ধে আমরা কিছু কিছু জানতে পারি। ঋগ্বেদে জুগুপ্সিত শিশ্নদেবদের কথা এইমাত্র বলা হয়েছে। সিন্ধু উপত্যকায় এবং বেলুচিস্তানের নালপ্রদেশে এমন কতকগুলো দ্রব্য পাওয়া গিয়েছে যেগুলোর ‘লিঙ্গ’ বা ‘যোনির’ প্রতীক ব্যতীত অন্য কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া সঙ্গত মনে হয় না। অনেকেই স্বীকার করেন যে এগুলো এখানকার প্রাচীন অধিবাসিগণের পূজানুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত। পৌরাণিক শিবের আদিপুরুষের পরিচয় আমরা এখানকারই কয়েকটি শিলমোহর থেকে প্রাপ্ত হই, এবং এও অনুমান করতে পারি যে শিশ্ন-প্রতীক (লিঙ্গ) পূজা এই কালের আদি-শিবের পূজার একটি অঙ্গ ছিল।… এই লিঙ্গ-পূজাই কি করে শিব-পূজার প্রধান বৈশিষ্ট্যরূপে পরিগণিত হয়েছিল পৌরাণিক ও তান্ত্রিক যন্ত্রপূজার (শক্তিপূজার অন্যতম অঙ্গ) আদিমতম নিদর্শন বোধ হয় সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত মধ্যে ছিদ্রবিশিষ্ট বৃত্তাকার ছোট বড় প্রস্তরগুলোতেই দেখা যায়। আর একটি কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এখানকার শিলমোহরগুলোর গায়ে উৎকীর্ণ নানা চিত্র ও ছোট কিংবা কিছু বড় মৃন্ময় বা প্রস্তরনির্মিত মূর্তিবিশেষ এবং অন্য বহু প্রকার নিদর্শন আমাদেরকে স্পষ্টই জানিয়ে দেয় যে সেকালের সিন্ধুতটবাসীগণ দেবতা ও দেবতা-প্রতীকসমূহের পূজা করত। তাদের ধর্মকার্যে যজ্ঞাদি বৈদিক ক্রিয়ার কোনও স্থান ছিল না। এদের দ্বারা আচরিত পূজানুষ্ঠানই দেশের আদিম জনসাধারণের ধর্মানুষ্ঠানকে বিশেষরূপে প্রভাবিত করে।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১-২, চলিতকৃত)।
শাক্ত-সাধনা সম্পর্কিত আলোচনায় এটি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, প্রাক্-বৈদিক ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সিন্ধু-ধর্মের প্রধানতম উপাদান হলো উর্বরতামূলক আদিম জাদুবিশ্বাস বা তার স্মারক। আর এ-বিশ্বাসের মূলসূত্র অনুসারে মানবীয় ফলপ্রসূতা ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা একই সূত্রে বাঁধা। স্বভাবতই আদিম মানুষদের মধ্যে প্রচলিত এই বিশ্বাসমূলক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে – এবং এই বিশ্বাস-উদ্ভূত নানান প্রচলিত ধর্মের ক্ষেত্রেও – জনন-অঙ্গের উপর বিশেষ গুরুত্ব-আরোপণের পরিচয় পাওয়া যায়। সিন্ধু-ধর্মও যে স্বভাবতই তার ব্যতিক্রম নয়, তার প্রমাণ হলো সমগ্র সিন্ধু-সাম্রাজ্য জুড়ে আবিষ্কৃত অজস্র লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি। জন মার্শাল প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এগুলোর বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন এবং প্রায় একবাক্যে এগুলোকে সিন্ধু-ধর্মের পরিচায়ক বলেই গ্রহণ করেছেন। এ-প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক আলোচনার সুবিধার্থে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি – ‘ভারতবর্ষের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে প্রধানত সিন্ধুনদ ও তার দুই একটি অববাহিকা আশ্রয় করে বহুকাল পূর্বে (অনেকের মতে বৈদিক যুগ আরম্ভ হবার বেশ কিছু আগে) যে বিশিষ্ট নাগর সভ্যতা গড়ে ওঠে তার অনেক নিদর্শন হরপ্পা, মহেঞ্জো-ডারো, নাল প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। নিদর্শনগুলো সেখানকার সুপ্রাচীন অধিবাসীদের জীবনধারার ভিন্ন ভিন্ন দিকের উপর প্রভূত আলোকপাত করে। তাদের শিল্প ও সংস্কৃতি, পৌর ও ধর্ম জীবন, আর্থিক ও সামাজিক সংগঠন ইত্যাদি বিষয়ে এই নিদর্শনগুলো আমাদেরকে অনেক তথ্য প্রদান করে। এদের মধ্যে নরম পাথর (steatite), এক জাতীয় মৃত্তিকা (faience) প্রভৃতি দ্রব্যে নির্মিত ‘শিলমোহর’ (sealings) বা ‘শিলকবচ’ (seal amulets) গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহেঞ্জো-ডারোতে প্রাপ্ত এরকম একটি চতুষ্কোণ শিলমোহরের গায়ে উৎকীর্ণ চিত্র বোধ হয় প্রাচীন সিন্ধুতটবাসীদের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে কিছু পরিচয় দেয়। এতে ত্রিমুখ, দ্বিশৃঙ্গ, দ্বিভুজ, নাতিউচ্চ আসনের উপর যোগাসনে উপবিষ্ট একটি মূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়। বসার বিশিষ্ট ভঙ্গী দেখে মনে হয় যে এটি পরবর্তী কালে বর্ণিত কূর্মাসন; মূর্তিটির বহুবলয় ভূষিত দুটি বাহু পূর্ণ প্রসারিত এবং জানুদ্বয়ে ন্যস্ত; এর কণ্ঠে ও বক্ষে কয়েকটি মালা (গ্রৈবেয়ক) লম্বমান; এর শৃঙ্গমধ্যস্থ শিরোভূষণ দীর্ঘ ও ঊর্ধ্বে কিঞ্চিৎ প্রসারিত; মূর্তির উভয় পার্শ্বে হস্তী, ব্যাঘ্র, গন্ডার ও মহিষ – এই চার প্রাণী অঙ্কিত রয়েছে; আসনের নীচে দুটি মৃগ এবং একটি পুস্তকাধার(?) চিত্রিত আছে; শিলমোহরের উপর দিকে বাম পার্শ্বে একটি মনুষ্যমূর্তি রেখাকারে অঙ্কিত আছে। এই মূর্তি যে মহেঞ্জো-ডারোর প্রাচীন অধিবাসীদের দ্বারা পূজিত এক দেবতার প্রতিকৃতি এ বিষয়ে স্যার জন মার্শাল নিঃসংশয় ছিলেন। কূর্মাসনে আসীন মূর্তির আর একটি বৈশিষ্ট্য ঊর্ধ্বলিঙ্গতা (এটি খুব স্পষ্ট নয়), এবং উপরে বর্ণিত অন্যগুলো এই দেবতার পরিচয় প্রদানে মার্শালকে সাহায্য করেছিল। তিনি একে পৌরাণিক শিবের আদি প্রতীক বলে বর্ণনা করেছিলেন। তার এ মত যদিও সকল পণ্ডিত গ্রহণ করেন নি, তবুও এর বহু পরবর্তী কালের মহাযোগী ও পশুপতি রূপে কল্পিত শিব দেবতার আদিম নিদর্শন রূপে গণনা করা খুব অযৌক্তিক নয়। … মহেঞ্জো-ডারোতে প্রাপ্ত আরও কতিপয় শিলমোহরে অনুরূপ দেবতা মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। সেখানকার আর একটি শিলমোহরে বোধ হয় এই দেবতারই অন্য এক রূপ প্রদর্শিত আছে। এখানেও দেবতা যোগাসনে উপবিষ্ট (আসন ঠিক কূর্মাসন নয়), এবং এর উভয় পার্শ্বে মিশ্র মানব ও সর্পাকৃতি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত দুটি নাগমূর্তি দেখা যায়। একেও পরবর্তী যুগের নাগ পরিবেষ্টিত শিবের আদিম রূপায়ণ বলে মনে করা বিশেষ অসঙ্গত না হতে পারে। অপর কয়েকটি শিলে মনুষ্যমুখবিশিষ্ট মেষ, ঐরূপ অর্ধ হস্তী ও অর্ধ বৃষ প্রভৃতি বহু মিশ্রাকৃতি (hybrid) মূর্তি স্বতই আমাদেরকে পরবর্তী কালের মিশ্রাকৃতি শিবগণসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হরপ্পাতে পাওয়া একটি পোড়া মাটির (terracotta) শিলে অঙ্কিত চিত্র এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। অপর দু একটি দৃশ্যের সাথে এতেও যোগাসনে উপবিষ্ট এবং নাতিদীর্ঘ ও ঊর্ধ্বে প্রসারিত শিরোভূষণ যুক্ত, নানা প্রাণী পরিবেষ্টিত এক দেবতা মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। শিলমোহরের পেছনের দিকে প্রদর্শিত বৃষমূর্তি ও ত্রিশূলধ্বজ, দ্বিতল গৃহের সম্মুখে দণ্ডায়মান অপর এক মনুষ্য (দেবতা ?) মূর্তির ও যোগাসনে উপবিষ্ট মূর্তিটির পরিচয় প্রদানে সাহায্য করে। এম.এস. বৎস অনুমান করেছিলেন যে দ্বিতল গৃহ একটি দেবায়তন, এবং আসীন ও দণ্ডায়মান মূর্তিদ্বয় মার্শাল বর্ণিত আদি শিবের বিভিন্ন রূপায়ণ (M. S. Vats, Excavations at Harappa, pp. 129-30)। এ অনুমানের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না, কারণ বৃষ এবং ত্রিশূল, পরবর্তী কালের শিব দেবতার বিশেষ লাঞ্ছন। এ অনুমান সত্য হলে প্রাচীন সিন্ধুতটবাসীদের পূজার দেবতা এই আদি শিবের কি নাম ছিল তা জানবার কোনও উপায় অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়নি। শিলমোহরগুলোর গায়ে খোদিত চিত্রাত্মক লিপিমালার (pictographs) যদি সর্বজনগ্রাহ্য পাঠোদ্ধার সম্ভব হত তা হলে হয়ত আমরা তা জানতে পারতাম। … প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার অপর কয়েকটি নিদর্শন বোধ হয় এই দেবতার পূজা-প্রতীক সম্বন্ধে আরও কিছু ইঙ্গিত প্রদান করে। নরম প্রস্তর বা পোড়া মাটিতে নির্মিত হ্রস্বাকৃতি এমন কতকগুলো দ্রব্য পাওয়া গিয়েছে যেগুলোকে লিঙ্গ-প্রতীক বলে মার্শাল মনে করেন। এদের আকৃতি ও গঠনপ্রণালী এই অনুমান সমর্থন করে, এবং এটি মনে করা অসঙ্গত নয় যে সিন্ধুতটবাসীদের অনেকে এদেরকে তাদের দ্বারা পূজিত পিতৃদেবতার পূজা-প্রতীক রূপে ব্যবহার করতেন।… মহেঞ্জো-ডারো, হরপ্পা প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত এই নিদর্শনগুলোর উক্তরূপ ব্যাখ্যা সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি সত্য, কিন্তু এ মত গ্রহণ করলে ঋগ্বেদে জুগুপ্সিত শিশ্নদেব বলে বর্ণিত প্রাচীন জনগণের সঙ্গত পরিচয় পাওয়া যায়। অবশ্য সে ক্ষেত্রে শিশ্নদেব কথাটির অর্থ শিশ্নপূজক বলে ধরে নিতে হবে।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২১-২৩)
প্রসঙ্গত, সিন্ধু-সভ্যতার সাথে বৈদিক আর্য-সভ্যতার পার্থক্য নিরূপণকারী বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে গিয়ে ড. অতুল সুরের বক্তব্য হলো – ‘অনেকেই বলেন যে সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য সভ্যতা অভিন্ন। কিন্তু এটা যে ভ্রান্ত মত সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই দুই সভ্যতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করলেই এটা বুঝতে পারা যাবে। দুই সভ্যতার মূলগত পার্থক্যগুলো নীচে দেওয়া হল :
- ১. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল ও মাতৃকাদেবীর আরাধনা করত। আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না ও শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দা করত। আর্যরা পুরুষ-দেবতার উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর পূজার কোন আভাসই আমরা ঋগ্বেদে পাই না।
- ২. আর্যরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। এখানে বলা দরকার যে, ঘোড়ার কোন অশ্মীভূত (fossilized) অস্থি আমরা সিন্ধু সভ্যতার কোনও কেন্দ্রে পাতিনি। সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা সীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবর্দের প্রতিকৃতি ক্ষোদন থেকে বুঝতে পারা যায়। পশুপতি শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে বলীবর্দের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়।
- ৩. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা নগরবাসী ছিল। আর্যরা নগর নির্মাণ করত না। তারা নগর ধ্বংস করত। সেজন্য তারা তাদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের নাম পুরন্দর রেখেছিল।
- ৪. আর্যরা মৃতব্যক্তিকে দাহ করত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকরা মৃতকে সমাধিস্থ করত।
- ৫. আর্যদের মধ্যে লিখন-প্রণালীর প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের মধ্যে লিখন-প্রণালী সুপ্রচলিত ছিল।
- ৬. সিন্ধু সভ্যতা যে আর্য সভ্যতা নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃৎপাত্র। কুরু-পাঞ্চাল দেশ অর্থাৎ যেখানে আর্য সভ্যতা বিস্তারলাভ করেছিল, সেখানকার বৈশিষ্ট্যমূলক মৃৎপাত্রের রঙ ছিল ধূসর বর্ণ। সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহ থেকে যে-সব মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর রঙ ‘কালো-লাল’।
- ৭. সিন্ধু সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। আর্যরা প্রথমে কৃষিকার্য জানত না। এটা আমরা শতপথ-ব্রাহ্মণের এক উক্তি থেকে জানতে পারি।
- ৮. সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা হাতির সঙ্গে বেশ সুপরিচিত ছিল। আর্যদের কাছে হাতি এক নতুন জীববিশেষ ছিল। সেজন্য তারা হাতিকে ‘হস্তবিশিষ্ট মৃগ’ বলে অভিহিত করত। বস্তুত হাতিকে প্রাচ্য ভারতের পালকাপ্য নামে এক মুনিই প্রথম পোষ মানিয়েছিলেন।
এসব প্রমাণ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, আর্য সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতা এক নয়।’- (ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়)
আর বাঙলার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার ঘনিষ্টতা দেখাতে গিয়ে ড. সুর আরো বলেন – ‘ভারতে তাম্রাশ্ম সভ্যতার অভ্যুত্থানের মূলে ছিল তামার ব্যবহার। বাঙালীরাই সেই তামা তাম্রাশ্ম সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে নিয়ে যেত। বাঙালীরা যে সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে উপস্থিত ছিল, তার প্রমাণ আমরা পাঁচটি সূত্র থেকে পাই – (১) মাতৃদেবীর উপাসনা, (২) মৎস্য-ভক্ষণ, (৩) হস্তীর সাথে পরিচয়, (৪) ধান্যের ব্যবহার এবং (৫) শিব ও শিবলিঙ্গের আরাধনা। … মৎস্যভক্ষণ বাঙালীরই বৈশিষ্ট্য। মহেঞ্জোদারোতে যে বঁড়শি পাওয়া গিয়েছে তা থেকে স্বতই প্রমাণিত হয় যে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে এমন এক শ্রেণী ছিল যারা মৎস্য ভক্ষণ করত। মহেঞ্জোদারোতে আমরা হস্তীর প্রতিকৃতি পেয়েছি। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে নিবদ্ধ কিংবদন্তী অনুযায়ী হস্তী প্রাচ্যভারতের পালকাপ্য মুনি কর্তৃক পালিত জন্তু। তিনিই প্রথম হস্তীকে বশ করেন ও হস্তীবিদ্যা সম্বন্ধে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। বাঙলাদেশই হাতির আদিম নিবাস। মহেঞ্জোদারোতে হাতির উপস্থিতি বাঙলাদেশের সঙ্গে ওই সভ্যতার সম্পর্ক সূচিত করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মহেঞ্জোদারোর ‘সীল’সমূহে উৎকীর্ণ হাতির প্রতিকৃতির সঙ্গে প্রাচীন বাঙলার উৎকীর্ণ পাঞ্চ-মার্ক মুদ্রায় প্রদর্শিত হাতির বিশেষ মিল আছে।’- (ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়)
বাঙালির প্রিয় ও প্রধান খাদ্য চাউল তথা ধান্য, আর মাতৃকাপূজা সম্বন্ধে বললে এটা তো সর্বজনস্বীকৃত যে, বাঙলাই মাতৃদেবীর পূজার লীলাকেন্দ্র। তাছাড়া সমগ্র বাঙলা অঞ্চল জুড়ে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মন্দিরে মন্দিরে শিব ও শিবলিঙ্গের আরাধনার তো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই শিব বা শিবলিঙ্গের পূজার সাথে সমগ্র সিন্ধু-সাম্রাজ্য জুড়ে আবিষ্কৃত অজস্র লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি প্রাপ্তির কারণে তাকে লিঙ্গ-উপাসনার সমার্থক করে ফেলায় যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। এক্ষেত্রে বিষয়টির বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা আবশ্যক বৈকি। ড. অতুল সুরের বক্তব্য অনুযায়ী – ‘হিন্দুধর্মে শিব ও শক্তি যে মাত্র নরাকারে পূজিত হন, তা নয়; লিঙ্গ ও যোনি হিসাবেও পূজিত হন। সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন অধিবাসীরা যে লিঙ্গ-যোনি উপাসক ছিলেন তা সেখানে প্রাপ্ত মণ্ডলাকারে গঠিত প্রতীকসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায়। এছাড়া, আমরা সেখানে প্রস্তরনির্মিত পুরুষলিঙ্গের এক বাস্তবানুগ প্রতিরূপ পেয়েছি। সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরাই যে ঋগ্বেদে বর্ণিত সমৃদ্ধিশালী নগরসমূহের আর্য-বৈরী ‘শিশ্নোপাসক’ সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।’ এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্যেও সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ঋগ্বেদে শিশ্নদেব বা লিঙ্গ-উপাসকেরা নিন্দিত হয়েছে। যেমন – “হে ইন্দ্র, যাতুগণ যেন আমাদের হিংসা না করে। হে বলবত্তম ইন্দ্র, তারা যেন আমাদেরকে বেদীস্থ ব্যক্তিদের থেকে পৃথক না করে। প্রভু ইন্দ্র যেন বিষম প্রাণীর শাসনে যেন আমাদেরকে উৎসাহ দেন এবং শিশ্নদেবগণ যেন আমাদের ঋতকে পরাজিত না করে।” (ঋক-৭/২১/৫)। কিন্তু এখানে এই শিশ্নদেব বলতে ঠিক কাদেরকে বোঝানো হয়েছে? এক্ষেত্রে শিশ্নদেব বলতে শিশ্নপূজক বলে ধরে নিতে অধিকাংশ পণ্ডিত আগ্রহী। যদিও বলা আবশ্যক যে, সায়নাচার্য তার ঋগ্বেদ-ভাষ্যে তার অর্থ অন্যরূপ করেছেন। তার মতে শিশ্নদেব শব্দ কামুক ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তিগণকেই বোঝাতো। এক্ষেত্রে অন্য একটি ঋক থেকে হয়তো এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে। যেমন – “তিনি সুচারু গতিতে গমনপূর্বক যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। সর্ববস্তুর দাতা (সেই ইন্দ্র) দিতে উদ্যত হয়ে যুদ্ধে অবস্থিত হন। তিনি নিজতেজে অবিচলিতভাবে শিশ্নদেবগণকে হত্যা করতে করতে পরাভূত করে শতদ্বারবিশিষ্ট শত্রুপুরী হতে ধন অপহরণ করেন।” (ঋক-১০/৯৯/৩)। অতএব অনুমান হয়, ঋগ্বেদে যাদের শিশ্নদেব বা লিঙ্গ-উপাসক বলে উল্লেখ করা হয়েছে তারা শুধুই যে ইন্দ্র-আক্রান্ত ও আর্যদল-লুণ্ঠিত হয়েছিলো তাই নয়, তারাই ছিলো ঐশ্বর্যপূর্ণ শতদ্বার-বিশিষ্ট শত্রুপুরীর অধিবাসীও। কিন্তু বৈদিক আর্যরা কি সিন্ধু-সভ্যতার পুর বা নগর ছাড়াও আর কোনো ঐশ্বর্যপূর্ণ পুর বা নগর ধ্বংস করেছিলো? প্রখ্যাত বিদ্বান-গবেষক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেন – ‘এ-জাতীয় কল্পনার পক্ষে প্রত্নতত্ত্বে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং পাবার কোনো ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনাও নেই। অপরপক্ষে, হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া অজস্র লিঙ্গ ও যোনি-মূর্তি থেকে অবশ্যই প্রমাণ হয় ওই প্রাচীন ঐশ্বর্যপূর্ণ নগরবাসীরা শিশ্নদেব বা লিঙ্গ-উপাসক ছিল। অতএব এখানেও সাহিত্যমূলক সাক্ষ্যের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্বমূলক সাক্ষ্যের পূর্ণ-সঙ্গতি দেখা যায় : সিন্ধু-অধিবাসীদেরই ঋগ্বেদ-উল্লিখিত শিশ্নদেব বলে সনাক্ত করতে হবে।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৫)।
অন্যদিকে সিন্ধু-সভ্যতাকে আর্য-কীর্তি বলে প্রতিপন্ন করার আশায় হয়তো এমন কল্পনা করা যেতে পারে যে ঋগ্বেদ-নিন্দিত ওই শিশ্নদেব বলতেও আর্য-গোষ্ঠিভুক্ত কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষই বুঝতে হবে। সেক্ষেত্রে শিশ্নদেবদের সঙ্গে শতদ্বারবিশিষ্ট পুরের সম্পর্ক বিবেচনায় নিলে এ-কথা কল্পনা করা একান্তই অসম্ভব যে প্রাচীন আর্যরাও নগর-সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো। যদিও পরবর্তী কালের বৈদিক সাহিত্যে – বিশেষত যজুর্বেদ, ‘ব্রাহ্মণ’-সাহিত্য এবং শ্রৌতসূত্রে – উর্বরতামূলক জাদু-বিশ্বাসের প্রচুর স্মারক দেখা যায়, এক্ষেত্রে বৈদিক মানুষদের অর্থনীতিতে কৃষিকাজের ক্রমবধমান গুরুত্বের সঙ্গে এর সম্পর্ক অনুমেয় বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ঋগ্বেদে ওই শিশ্নদেবদের প্রতি মনোভাব যত বিরূপই হোক না কেন পরবর্তীকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসকে এ-মনোভাব খুব একটা প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয় না। কেননা উত্তরকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম প্রধান পরিচয় বলতে ওই লিঙ্গ-উপাসনাই। এই উপাস্য লিঙ্গ সাধারণত শিবলিঙ্গ – বা শিব বলেই অভিহিত হয়। আর তাই ওই লিঙ্গ-উপাসনাকে শৈব-সাধনার পরিচায়ক বলে গ্রহণ করানোর উৎসাহ অকারণ মনে হয় না। এবং এই উৎসাহের পরিণাম হিসেবেই হয়তো প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ মার্শাল কর্তৃক অনুমিত হয়েছে, ‘শক্তি-সাধনার মতোই শৈব-সাধনারও সূত্রপাত প্রাচীন প্রাক্-বৈদিক সিন্ধু যুগে এবং বেদোত্তর ভারতবর্ষীয় ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও শক্তি-সাধনার মতোই ওই শৈব-সাধনার অবিচ্ছিন্ন প্রভাব টিকে থেকেছে।’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, – ‘মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত একটি সীলে ত্রিমুখ, দ্বিশৃঙ্গ, যোগাসনে উপবিষ্ট (সম্ভবত কূর্মাসনে) একটি মূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়। মূর্তিটির দুই বাহু বলয়বিশিষ্ট পূর্ণ প্রসারিত ও হাঁটুর উপর ন্যস্ত। বক্ষঃদেশে কয়েকটি মালা বিদ্যমান। মূর্তিটির দু’পাশে চারটি প্রাণী অঙ্কিত আছে – হস্তী, ব্যাঘ্র, গণ্ডার ও মহিষ। এই মূর্তিটিকে স্যার জন মার্শাল পৌরাণিক শিব-পশুপতির আদি প্রতীক বলেছেন, এবং এ বক্তব্য অনেকেই সমর্থন করেছেন। আর একটি সীলে এই দেবতা যোগাসনে উপবিষ্ট, দুপাশে দুটি নাগজাতীয় মূর্তি দেখা যায়। হরপ্পায় প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির সীলে যোগাসনে উপবিষ্ট, শিরোভূষণযুক্ত এবং নানা প্রাণী পরিবেষ্টিত এক দেবতাকে দেখা যায়। সীলের পেছন দিকে প্রদর্শিত বৃষ মূর্তি ও ত্রিশূলধ্বজ, মূর্তিটির উপবেশনভঙ্গী প্রভৃতি শিবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। … ‘কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেওয়া এক কথা, প্রমাণিত হওয়া আর এক। প্রথমোক্ত সীলটির উপর মার্শাল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ বিষয়ে তার প্রধান যুক্তি হল সীলটির উপর অঙ্কিত নানা চিহ্ন থেকে শিব কল্পনার বিভিন্ন পৌরাণিক উপাদানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে প্রচলিত কয়েকটি নির্বাচিত পৌরাণিক উপাদান অবলম্বন করে প্রাচীনকালের কোন চিত্রকে অবধারিতভাবে শিবমূর্তি বলে শনাক্ত করা সম্ভবপর নয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যেরও মূল্য আছে, যা হচ্ছে সমগ্র হরপ্পা সভ্যতা জুড়ে আবিষ্কৃত অজস্র লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি। উত্তরকালের ভারতীয় ধর্মে লিঙ্গ বলতে প্রধানত শিবলিঙ্গই বোঝায়। আলোচ্য সীলের মূর্তিটি পৌরাণিক শিব হোক আর নাই হোক সমগ্র হরপ্পা সভ্যতা জুড়ে যে অজস্র লিঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মূর্ত সাক্ষ্য উপেক্ষণীয় হতে পারে না।’ – (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১৯৭-৯৮)।
এক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে, সিন্ধু যুগেও ওই উপাস্য লিঙ্গ-মূর্তিকে উত্তরকালের মতো শিব-মূর্তি বা শিব-লিঙ্গ আখ্যা দেয়া হতো কিনা তা জানা নেই; অন্তত সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধারের পূর্বে এ-বিষয়ে কোনো সুনিশ্চিত অনুমানেরও সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, উত্তরকালে ওই ‘শিব’ নামটিকে কেন্দ্র করে যে অসংখ্য পৌরাণিক কল্পনার জটিলতা সৃষ্ট হয়েছে, এই পৌরাণিক উপাদানগুলোর নির্ভুল ইতিহাস নির্ণয় করাও হয়তো একান্তই অসম্ভব। অতএব প্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতায় মার্শাল কর্তৃক দাবীকৃত ‘শৈব’-সাধনার স্বাক্ষর কতোটা গ্রহণযোগ্য?
দেবীপ্রসাদ বলেন, – ‘সিন্ধু-যুগে প্রচলিত শৈব-ধর্মের নজির হিসেবে মার্শাল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত কোণা-ভাঙা একটি সীলের উপর। এ-বিষয়ে তার প্রধান যুক্তি হলো, সীলটির উপর অঙ্কিত নানা চিহ্ন থেকে শিব-কল্পনার বিভিন্ন পৌরাণিক উপাদানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় – অতএব ওই সীলের কেন্দ্রস্থ মূর্তিটিকে অবধারিতভাবেই শিবমূর্তি বলে গ্রহণ করতে হবে।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৬)।
একইভাবে প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. অতুল সুরও মনে করেন – ‘সিন্ধু উপত্যকার প্রাগার্য অধিবাসিগণ যে মাত্র মাতৃদেবীর পূজা করতেন, তা নয়। সুমের ও মধ্য-প্রাচীর প্রাচীন অধিবাসীদের ও বর্তমানকালের ভারতীয় হিন্দুদের মত তারা সৃজন-শক্তির আধার হিসাবে এক পুরুষ দেবতারও উপাসনা করতেন। মহেঞ্জোদারো থেকে যে তিন-মুখবিশিষ্ট এক দেবতার উৎকীর্ণ মূর্তি এক সীলের ওপর পাওয়া গিয়েছে, তার দ্বারা এটা প্রমাণিত হচ্ছে। এই দেবতা সিংহাসনের উপর আসীন। তার বক্ষ, কণ্ঠ ও মন্তক উন্নত। তার এক পা অপর পায়ের উপর আড়াআড়িভাবে স্থাপিত, তার দুটি হাত বিস্তৃতভাবে হাঁটুর উপর স্থাপিত। তিনি পর্যঙ্ক-আসনে উপবিষ্ট হয়ে, ধ্যানস্থ ও উর্ধ্বলিঙ্গ। তার উভয়পার্শ্বে চার প্রধান দিক-নির্দেশক হিসেবে হাতি, বাঘ, গণ্ডার ও মহিষের প্রতিমূর্তি অঙ্কিত। তার সিংহাসনের নীচে দুটি মৃগকে পশ্চাৎদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাওয়া যায়। এখানেই যে আমাদের আদি-শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বস্তুত পরবর্তীকালের শিবের তিনটি মূলগত ধারণা, আমরা এখানে দেখতে পাই – তিনি (১) যোগীশ্বর বা মহাযোগী, (২) পশুপতি, ও (৩) ত্রিমুখ।’- (ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়)
কিন্তু শিবের মতো জনপ্রিয় দেবতাকে নিয়ে কল্পিত প্রচুর পৌরাণিক কাহিনীর জটিলতার মধ্য থেকে পরবর্তীকালে প্রচলিত কয়েকটি নির্বাচিত পৌরাণিক উপাদান অবলম্বন করে প্রাচীন কালের কোনো চিত্রকে অবধারিতভাবে শিবমূর্তি বলে সনাক্ত করা সুসঙ্গত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। তাছাড়া সিন্ধু-যুগের অন্যান্য এমন সীলও পাওয়া গেছে যার কেন্দ্রস্থ মূর্তিটি আলোচ্য সীলেরই অনুরূপ, কিন্তু সে মূর্তির সঙ্গে মার্শাল-আলোচিত সীলে পাওয়া পৌরাণিক উপাদানের সম্পর্ক নেই; হয়তো বা অধুনা-অজ্ঞাত-কোনো পৌরাণিক কাহিনীর সম্পর্ক-মুলক ইঙ্গিত থাকা অসম্ভব নয়। তারচেয়ে বরং ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-উপাসনার যে ব্যাপক ও গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তার সঙ্গে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া অজস্র লিঙ্গমূর্তি যে প্রাগৈতিহাসিক অতীতের ইঙ্গিত দেয়, তার যোগসূত্র অন্বেষণের মধ্যেই হয়তো বা এর সমাধান লুকিয়ে আছে। উত্তরকালের প্রথা অনুসারে এই উপাস্য লিঙ্গমূর্তিগুলোকে আমরা যদি শিবলিঙ্গ অ্যাখ্যা দিতে সম্মত হই তা হলেই এই দিক থেকেই সিন্ধু ধর্মে শৈব-সাধনার আদি-রূপ স্বীকারযোগ্য হতে পারে।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন, সিন্ধু-যুগের ওই ধর্ম-বিশ্বাসে লিঙ্গ-উপাসনার এমন গভীর ও ব্যাপক প্রভাব কেন? উত্তর-লাভের মূলসূত্রটা আমরা ইতপূর্বেই দেখেছি – ‘অন্যান্য নানা দেশের নানা ধর্ম-বিশ্বাসের মতোই আমাদের দেশের এই প্রাগৈতিহাসিক ধর্মবিশ্বাসটিও এক আদিম উর্বরতামূলক জাদু-বিশ্বাস থেকেই জন্মলাভ করেছিল। সেই আদিম পর্যায়ের মানুষ প্রাকৃতিক উৎপাদিকা-শক্তির বাস্তব রহস্য উদ্ঘাটন করতে শেখেনি, প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকেও মানবীয় ফলপ্রসূতার অনুরূপ বলেই কল্পনা করেছিল এবং মানবীয় প্রজননের সান্নিধ্যে বা সাহায্যে প্রাকৃতিক উৎপাদিকা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করার আয়োজন করেছিল। অতএব আদিম মানুষদের মধ্যে প্রচলিত এই জাদুবিশ্বাসমূলক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানবীয় জননাঙ্গ ও তার অনুকরণের বিবিধ প্রয়োগ চোখে পড়ে; প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলো থেকে তার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়নি – সিন্ধু যুগের ধর্মবিশ্বাস থেকেও নয়।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৭)
সিন্ধু-ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য মাতৃপ্রাধান্য
আবার সিন্ধু-ধর্মের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য যে মাতৃপ্রাধান্য – মার্শালের এ-সিদ্ধান্ত অবশ্য-স্বীকার্য। অথচ পৌরাণিক ইঙ্গিতের উপর নির্ভর করে পূর্বোল্লিখিত সীলের তথাকথিত শিব-মূর্তিকে তিনি পুরুষ দেবতা বলেই সনাক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু আলোচ্য সীলের মূর্তিটি পৌরাণিক শিব হোক-বা-নাই-হোক সমগ্র সিন্ধু-সাম্রাজ্য জুড়ে যে-অজস্র লিঙ্গ বা শিবলিঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মূর্ত সাক্ষ্য কিছুতেই উপেক্ষণীয় নয়, এবং এগুলো অবধারিতভাবেই পুরুষাঙ্গের নিদর্শন। অতএব, ওই মাতৃপ্রধান ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে এগুলোর নিদর্শন অন্তত কোনো-এক আপাত-অসঙ্গতির পরিচায়ক বলেই প্রতীত হয়। তাই এখানেও প্রশ্ন, সিন্ধু-যুগের শক্তি-সাধনায় – ওই বসুমাতা বা শাকম্ভরীর উপাসনায় – এই পুরুষতত্ত্বের তাৎপর্য কী হতে পারে? এক্ষেত্রে পরবর্তী কালের ভারতবর্ষীয় শাক্ত ধর্ম এই প্রশ্নের উপর কী ধরনের আলোকপাত করে তা খুঁজতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলী থেকে প্রথমে প্রাসঙ্গিক বক্তব্যাংশের উদ্ধৃতি টানেন – ‘তন্ত্রের শাক্ত সাধকগণ বলেন যে, শিব তো স্থাণু-সদৃশ একটা বিদ্যমানতার দ্যোতকমাত্র, তার উপাসনা করি কোন্ হিসাবে। শক্তি না থাকলে শিব তো শব, অথচ শক্তি-শূন্যে শিব হতেই পারেন না। অতএব শিব আছেন, মাথার উপর থাকুন, আমরা মায়ের – আদ্যাশক্তির – উপাসনা করব। কারণ, তিনিই তো সব – তিনি মেধা, তিনি মায়া, তিনি লজ্জা, তিনি ক্ষমা, তিনি বুদ্ধি, তিনি ধৃতি, তিনি বিদ্যা, তিনি ছায়া, তিনি শান্তি, তিনি ক্ষান্তি – তাকে পূজা করব না তো কার পূজা করিব?’
অতপর দেবীপ্রসাদ বলেন – ‘অতএব দেখা যায়, উত্তরকালের শাক্ত-তত্ত্ব ঐকান্তিক অর্থে মাতৃপ্রধান হলেও তার মধ্যে শিব বা পুরুষতত্ত্বের যে কোনো-ভাবেই হোক না কেন একটা স্থান থেকে গিয়েছে। শক্তিই প্রধান, শক্তিই মূলতত্ত্ব, তবুও অন্তত গৌণ অর্থে শিব বা পুরুষ-তত্ত্বও স্বীকৃত হয়েছে। স্বভাবতই এই প্রসঙ্গে সাংখ্য-দর্শনের কথা মনে পড়ে : প্রকৃতিই প্রধান তবু পুরুষও সত্য – যদিও এই পুরুষ অপ্রধান এবং উদাসীন মাত্র।… আপাতত মন্তব্য হলো, পরবর্তীকালের শাক্ত-ধর্মকে যদি সিন্ধু-ধর্মেরই রেশ বলে স্বীকার করা হয় তা হলে অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে সিন্ধু-যুগের ওই প্রাগৈতিহাসিক শাক্ত-ধর্মের মধ্যেই আলোচ্য বৈশিষ্ট্যের বীজ ছিল – হয়তো তারই মূর্ত নিদর্শন হলো ওই বসুমাতামূলক ধর্মবিশ্বাসের স্মারকগুলোর মধ্যে যোনি-মূর্তি ছাড়াও লিঙ্গ-মূর্তি বা শিবলিঙ্গগুলো। অতএব সিন্ধু-ধর্মেও এই শিবলিঙ্গ নির্দেশিত পুরুষ তত্ত্বের স্থান গৌণ – অপ্রধান এবং উদাসীন – বলেই অনুমেয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৮)
যদিও অবশ্যই উত্তরকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে শক্তি-সাধনা ও শৈব-সাধনার মধ্যে পার্থক্য ও প্রভেদ ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং শৈব-ধর্মে ওই শিব বা পুরুষ-তত্ত্ব স্বভাবতই স্বাতন্ত্র্য এবং প্রাধান্য লাভ করেছে, কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সেখানেও ওই আদিম মাতৃতত্ত্বের – শক্তির বা প্রকৃতির – গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়নি। যেমন উদাহরণস্বরূপ, শৈব-সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘হর’ বা ‘শিব’ (ঈশ্বর) সৃষ্টির নিমিত্ত-কারণ মাত্র; সৃষ্টির উপাদান-কারণ বলতে ‘মায়া’ বা ‘প্রকৃতি’। এদিক থেকে অনুমান হয়, উত্তরকালের শৈব-সাধনায় শিব বা পুরুষতত্ত্বের উপর যতোখানিই আপেক্ষিক গুরুত্ব আরোপিত হোক না কেন তা থেকে ওই আদিম মাতৃপ্রধান বা প্রকৃতিপ্রধান বিশ্বাসের চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়নি বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। অবশ্যই উত্তরকালের ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে ওই মাতৃপ্রধান বিশ্বাসের অকৃত্রিম ও প্রকৃষ্টতম পরিচয় শক্তি-সাধনা বা তন্ত্র সাধনাতেই – এই তন্ত্র-সাধনা পরবর্তীকালে যতই জটিল ও পল্লবিত রূপ গ্রহণ করুক না কেন।
এ পর্যায়ে এসে আমাদেরকে একটি আপাত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, সিন্ধু-সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের আদিম কৃষিভিত্তিক সমাজ অবশ্যই মাতৃপ্রধান। কিন্তু নগর-সভ্যতার সুউন্নত পর্যায়েও সমাজ-ব্যবস্থা মাতৃপ্রধান ছিলো এমনটা বলার উপায় নেই। উন্নততর কৃষিকাজের পর্যায়ে গৃহপালিত পশুর সাহায্যে লাঙল দেবার ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কৃষিকাজে পুরুষের ভূমিকাই প্রধান হয়ে ওঠায় ক্রমশ সমাজ-ব্যবস্থাও পুরুষ প্রধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমাজ-ব্যবস্থায় মাতৃ-প্রাধান্য ক্ষুণ্ন ও পরিবর্তিত হলেও ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে মাতৃপ্রাধান্যের সুস্পষ্ট স্মারক রয়ে গেছে। তার সাথে পুরুষবাচক কিছু কিছু সহায়ক উপজীবিকা যুক্ত হয়েছে হয়তো, যদিও তা অপ্রধান। যেহেতু কৃষিভিত্তিক উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসগুলো বরাবরই মাতৃপ্রাধান্যমূলক, তাই সেটি অক্ষুণ্ন থেকেই হয়তো পরবর্তীকালে সেখানে প্রকৃতির সমরূপী প্রজননমূলক জাদুবিশ্বাস হিসেবে আচার-বিশ্বাসে প্রতীকি লিঙ্গ-সাধনার বিষয়টি কালক্রমে ঢুকে গেছে। তারপরও তার অপ্রাধান্যের কারণেই হয়তোবা সেই সিন্ধুবাসীদেরকে পরবর্তীকালের আধিপত্যবাদী আর্য-প্রচারকরা ঋগ্বেদে শিশ্নদেব বলে বিদ্রুপ ও নিন্দা করেছেন।
সাংখ্য দর্শনে মাতৃকাশক্তির ধারণার প্রভাব ও এর সাথে ব্রহ্মবাদী বেদান্তের ধারণার সংঘাত
তবে ওই সুপ্রাচীন মাতৃপ্রধান বা প্রকৃতিপ্রধান ধর্ম-বিশ্বাসের সুস্পষ্ট দার্শনিক পরিণতি প্রাচীন সাংখ্য-দর্শনে ঘটেছিলো বলেই অনুমান হয়। এবং যেহেতু ওই প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুসারে আদি-মাতৃকা বলতে বসুমাতা বা পৃথিবী, সেই কারণেই এ-তত্ত্বের দার্শনিক পরিণতি হিসেবে সাংখ্যদর্শনেও সৃষ্টির আদি কারণ বলতে জড়-রূপা প্রকৃতি বা প্রধান বা মায়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘পুরুষ’-তত্ত্ব পরিচয় পাওয়া যায় এই দর্শনে। সাংখ্য-দর্শনের আদি-অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে ওই ‘পুরুষ’-তত্ত্বের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, সাংখ্যর পুরুষ ‘অপ্রধান’ ও ‘উদাসীন’ বলেই প্রখ্যাত – উত্তরকালের শাক্ত-সাধকদের কাছে যেমন শক্তিই প্রধান, যদিও ‘শিব আছে, মাথায় থাকুন – কিন্তু শক্তি-শূন্য শিব তো শবের মতোই’। তবে এ-প্রসঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, পুরুষ-প্রধান বৈদিক ঐতিহ্যের দার্শনিক পরিণতির ক্ষেত্রে তথা উপনিষদের চিন্তাধারায় পুরুষই চরম তত্ত্ব, শেষ সত্য। যেমন কঠ-উপনিষদে বলা হয়েছে – “‘মহৎ’-এর চেয়ে ‘অব্যক্ত’ (‘প্রকৃতি’) শ্রেষ্ঠ, অব্যক্তের চেয়ে ‘পুরুষ’ শ্রেষ্ঠ। পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নয়। তিনিই শেষ, তিনিই পরা গতি অর্থাৎ চূড়ান্ত পরিণতি।” (কঠোপনিষদ-১/৩/১১)। ঋগ্বেদের ‘পুরুষ-সূক্তে’ (ঋগ্বেদ-১০/৯০, শক্তি-সাধনা অধ্যায়ে এই পুরুষ-সূক্তের উদ্ধৃতি ও আলোচনা করা হয়েছে) এই চিন্তাধারার সূত্রপাত মনে করা হয় এবং ঔপনিষদিক দর্শনে তার চূড়ান্ত পরিণতি। স্বভাবতই বৈদিক চিন্তাবিকাশের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ‘পুরুষ’ শব্দের অর্থ অপরিবর্তিত নয়। যেমন ছান্দোগ্য-উপনিষদে দেখা যায় এই ‘পুরুষ’ এক জ্যোতির্ময় ‘অ-মানব’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন – “তারা (যারা মৃত্যুর পর অর্চিলোক প্রাপ্ত হন) সেখান (অর্চি, দিন, শুক্লপক্ষ, উত্তরায়ণের ছয় মাস) থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রে এবং চন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ-লোক প্রাপ্ত হন। সেই স্থানে [ব্রহ্মলোক থেকে] এক ‘অমানব-পুরুষ’ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। এই পথই দেবযান অর্থাৎ দেবলোকের পথ।” (ছান্দোগ্য-৫/১০/২)। এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায়, এই যে অমৃতময় ‘পুরুষ’ চিৎস্বরূপ, তিনি ব্রহ্ম বা আত্মার সঙ্গে অভিন্ন – “এই আত্মা অর্থাৎ দেহ যাবতীয় বস্তুর মধু। যাবতীয় বস্তুও এই দেহের কাছে মধুস্বরূপ। এই দেহে যে তেজোময় অমৃতময় পুরুষ আছেন আর দেহ মধ্যে যে জীবাত্মারূপী তেজোময় অমৃতময় অধ্যাত্ম পুরুষ আছেন – দুই-ই এক। তিনি অমৃত, তিনি ব্রহ্ম। তিনিই সব কিছু।” (বৃহদারণ্যক-২/৫/১৪)।
কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, উপনিষদ-প্রতিপাদ্য ওই পরব্রহ্ম বা পরমতত্ত্বকে বোঝাবার উদ্দেশ্যেও প্রাচীন ‘পুরুষ’ শব্দটি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যার করা সম্ভব হয়নি। এবং উপনিষদের স্থান-বিশেষে এমন ইঙ্গিত থেকে গিয়েছে যা থেকে অনুমান হয় এই অমূর্ত দার্শনিক তত্ত্বটির নিচে একান্ত মূর্ত ও মানবাত্মক অর্থ ঢাকা পড়ে আছে। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে লক্ষ্যণীয় – “প্রকৃতি নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল, কেউ বা সাদা আবার কেউ বা কালো। একজন অজ্ঞান জীব এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা ভোগ করে। কিন্তু আরেকজন বুদ্ধিমান এবং বিচারশীল ব্যক্তি পূর্ব পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন তিনি বুঝেছেন যে এই স্থূল জগৎ অজ্ঞান-অবিদ্যারূপী ক্ষণস্থায়ী; সেই কারণেই তিনি এই জগৎকে ত্যাগ করেন।” (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)। তাই দেবীপ্রসাদ বলেন – ‘স্বভাবতই উপনিষদের চিন্তাধারায় চিন্ময় ব্রহ্ম অর্থে পুরুষ-তত্ত্বের উপর এ-জাতীয় ঐকান্তিক গুরুত্ব আরোপণের ফলে জড়রূপা প্রকৃতি বা মায়া, অজ্ঞান বা অবিদ্যা-বোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই মায়া-নিবৃত্তিই উপনিষদে পরম-পুরুষার্থ বলে ঘোষিত। অতএব অত্যন্ত সুপ্রাচীন কালেই – উপনিষদের যুগেই – ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট মতাদর্শগত সংঘাত পরিলক্ষিত হয় : একদিকে আদিম মাতৃপ্রধান বিশ্বাসের দার্শনিক পরিণতি হিসেবে জড়রূপা প্রকৃতি বা মায়াকে প্রধান বলে গ্রহণ করবার পরিচয়, অপর দিকে আদিম পুরুষপ্রধান বিশ্বাসের দার্শনিক পরিণতি হিসেবে প্রকৃতি বা মায়াকে অবিদ্যা বা মিথ্যা বলে উপেক্ষা করে চিন্ময় পুরুষ বা ব্রহ্মকেই পরম-সত্তা বা পরম-তত্ত্ব বলে গ্রহণ করবার পরিচয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৯)। পরবর্তীকালের দার্শনিক আলোচনায় ব্রহ্মবাদী বেদান্ত-দর্শন ও প্রাচীন সাংখ্য-দর্শনের মধ্যকার দার্শনিক সংঘাতের তাৎপর্যটাও যে এখানেই লুকায়িত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বেদান্তদর্শনের সূত্রগ্রন্থ ‘ব্রহ্মসূত্রে’ বিরাট অংশ জুড়ে সাংখ্য-খণ্ডনের আয়োজন এ-কারণেই। এছাড়া প্রাচীন নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বরে রূপান্তরের প্রয়াস এবং সমান্তর দর্শন হিসেবে সেশ্বর-সাংখ্য হিসেবে পরিচিত যোগ-দর্শনের জন্ম-বৃত্তান্তও খুব সম্ভবত এখানেই জড়িয়ে আছে।
সিন্ধু-ধর্মে যোগসাধনা
এ-প্রেক্ষিতে সিন্ধু-ধর্মের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ আবশ্যক। ‘সীলের উপর অঙ্কিত যে-মূর্তিকে মার্শাল পৌরাণিক শিব বলে সনাক্ত করতে চেয়েছেন সেটি প্রকৃত শিব-মূর্তি হোক আর নাই হোক তার আসন-ভঙ্গির বৈশিষ্ট্য অবশ্যই লক্ষণীয়। কেননা পরবর্তী কালের ধর্ম-সাধনার ক্ষেত্রে এরই নাম যোগাসন – যোগ-সাধনার আসন-ভঙ্গি। বস্তুত মার্শাল নিজেও এই আসন-ভঙ্গিকে যোগাসন বলেই সনাক্ত করেছেন। তার যুক্তি হলো, পুরাণের শিব ‘যোগী’ অতএব আলোচ্য মূর্তির ওই যোগাসন থেকেও তাকে শিবমূর্তি বলেই গ্রহণ করতে হবে। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, সিন্ধু সভ্যতার অন্যান্য সীল এবং কোনো কোনো ভগ্ন প্রস্তরমূর্তিতে এই আসন ভঙ্গিরই পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব এই মূর্ত প্রমাণগুলোর দিক থেকে আমরা অনুমান করতে বাধ্য, যে সিন্ধু যুগেও ‘যোগ’-সাধনা প্রচলিত ছিল, কিংবা উত্তরকালে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘যোগ’ সিন্ধু-ধর্মের মধ্যেই তার সুস্পষ্ট সূত্রপাত দেখা যায়।… কিন্তু সিন্ধু-ধর্মে যোগ-সাধনার নিদর্শক হিসেবে শুধুমাত্র এগুলোর উপরই নির্ভর করবার প্রয়োজন নেই। বস্তুত এগুলো আবিষ্কৃত হবার অনেক আগেই রমাপ্রসাদ চন্দ মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত দু’টি প্রস্তরমূর্তির বিশেষত চোখের ভঙ্গি থেকে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেয়েছিলেন। তার মতে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় ভাস্কর্যে যোগী-মূর্তি রচনার যে-বিশিষ্ট রীতি দেখা যায় তার সঙ্গে মহেঞ্জোদারোর ওই প্রস্তরমূর্তিগুলোর অত্যন্ত নিকট সাদৃশ্য সুস্পষ্ট।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৯-৮০)।
কী সেই সাদৃশ্য? রমাপ্রসাদ চন্দ বলছেন (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮০) – ‘The only part of the statuettes that is in fair state of preservation, the bust, is characterized by a stiff erect posture of the head, the neck and the chest, and half-shut eyes looking fixedly at the tip of the nose. This posture is not met with in the figure sculptures, whether pre-historic or historic, of any people outside India; but it is very conspicuous in the images worshipped by all Indian sects including the Jainas and the Buddhists, and is known as the posture of the `yogin’ or one engaged in practicing concentration.’ অতএব সিন্ধু-ধর্মে যোগ-সাধনার পরিচয় উপেক্ষা করা যায় না। অবশ্যই পরবর্তীকালে এই সাধন-পদ্ধতি অত্যন্ত পল্লবিত রূপ গ্রহণ করেছে এবং পরবর্তীকালে ‘যোগ’ নামের একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক সম্প্রদায়েরও পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সিন্ধু-যুগে যোগ-সাধনা কতখানি পল্লবিত ও জটিল রূপ গ্রহণ করেছিলো এবং ‘যোগ’ নামের কোনো দার্শনিক সম্প্রদায় একান্তই গড়ে উঠেছিলো কিনা সে-কথা প্রত্নতত্ত্বমূলক গবেষণার বর্তমান পর্যায়ে – বিশেষত সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধারের পূর্বে – আমাদের পক্ষে জানতে পারা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু – ‘একটি কথা অবশ্যই অবধারিতভাবে প্রমাণ হয় : উত্তরকালে এই যোগের রূপ ও রূপান্তর যেমনই হোক না কেন, একে যেভাবে শ্রুতিমূলক বা বেদমূলক বলে দাবি করা হয়েছে তা ঐতিহাসিকভাবে একান্তই অবাস্তব; কেননা বাস্তব ঘটনা হলো শ্রুতি – এমনকি ঋগ্বেদ-সংহিতা – রচিত হবার সহস্রাধিক বছর পূর্বেই এবং আর্য-পূর্বদের মধ্যেই এই সাধন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে বৈদিক ঐহিহ্যের বাহকেরা যে-অর্থেই এবং যে- কোনো কারণেই এই সাধন-পদ্ধতিকে স্বীকার এবং গ্রহণ করুন না কেন, একে প্রকৃতপক্ষে শ্রুতিমূলক বা বেদমূলক বলে কল্পনা করবার কোনো রকম সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮১)
যোগ যে আদিতে কোনো-এক অ-বৈদিক বা বেদ-বহির্ভূত সাধন-পদ্ধতি ছিলো – বিশেষ করে মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের পর – বিদ্বান ও পণ্ডিতদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই। ওই অ-বৈদিক সাধন-পদ্ধতির ইতিহাস যে কতো প্রাচীন এ-বিষয়েও সংশয় নেই। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতা যে বৈদিক আর্যদের আক্রমণেই বিধ্বস্ত হয়েছিলো – একথা অনুমিত হবার পর আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে বৈদিক সাহিত্যের কয়েকটি সাক্ষ্য বিষয়ে নতুন করে বিচার করবার প্রয়োজন হয়েছে। যেমন, কৌষীতকি উপনিষদে প্রতর্দনের প্রতি ইন্দ্র যখন আস্ফালন করে বলছেন – “আমি ত্রিশীর্য ত্বষ্টৃপুত্রকে হত্যা করেছি; আমি অরুণ্মুখ যতিদেরকে সালাবৃকের অর্থাৎ নেকড়ের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছি। অনেক সন্ধিকে লঙ্ঘন করে আমিই স্বর্গে প্রহ্লাদের অসুরদলের অসুরদের, অন্তরিক্ষে পুলোমার আর পৃথিবীতে কালখঞ্জের অনুচরদের নিধন করেছি। এত বিশাল বিশাল কাজ করেও আমার একটা কেশও কারো নষ্ট করার সাধ্য হয়নি।” (কৌষীতকি-৩/১)। এখানে ত্রিশীর্ষ বিশেষণটি চিত্তাকর্ষক, কেননা সিন্ধু-সভ্যতার যে-মূর্তিটিকে মার্শাল যোগী-শিব বলে সনাক্ত করতে চেয়েছেন সেটিও সম্ভবত ত্রিশীর্ষ এবং সিন্ধু-সভ্যতার অন্যান্য সীলেও তিনটি শিংযুক্ত মূর্তি পাওয়া গেছে বলে দেবীপ্রসাদের ভাষ্য। যদিও এই ত্রিশীর্ষ বিষয়ক উপনিষদীয় উদ্ধৃতির প্রকৃত পৌরাণিক ব্যাখ্যা বহুলাংশেই বিতর্কসাপেক্ষ। কেননা, পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী ত্বষ্ট্রা মানে বিশ্বকর্মা এবং ত্রিশীর্ষ ত্বষ্ট্রাপুত্র হলো বিশ্বরূপ। কিন্তু ইন্দ্রের উপরিউক্ত উক্তির মধ্যে আরও চিত্তাকর্ষক বক্তব্য হলো, আমি অরুণ্মুখ যতিদেরকে সালাবৃকের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছি। সালাবৃক মানে নেকড়ে বা হায়না, অরুণ্মুখ মানে বেদনার্ত-মুখ হওয়া সম্ভব। কিন্তু ‘যতি’ মানে কী? এর সাধারণ অর্থ করা হয় তপস্বী। তবে মুণ্ডক-উপনিষদ এবং গীতার উক্তি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় এই যতিরা প্রকৃত যোগ-সাধকই ছিলো। কেননা এই গ্রন্থগুলোতে যোগ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যতিদের সুস্পষ্টভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। যোগসূত্র অনুসারে যোগ-এর আটটি অঙ্গ – “যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই আটটি হলো যোগের অঙ্গ।” (যোগসূত্র : ২/২৯)। মুণ্ডক উপনিষদে যতিদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে – “যারা বেদান্তশাস্ত্রের মর্মার্থ জেনেছেন, সন্ন্যাস ও যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে যেসব যতির চিত্তশুদ্ধি হয়েছে, তারা এই জীবনেই আত্মাকে উপলব্ধি করেন এবং মৃত্যুকালে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন” (মুন্ডক-৩/২/৬)। “কায়মনোবাক্যে সত্যের অনুসরণ ও ব্রহ্মচর্য অভ্যাসের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করতে হয়। দেহের মধ্যে সেই জ্যোতির্ময় পরমাত্মার উপলব্ধির মাধ্যমে যতিরা শুদ্ধ ও অনাসক্ত হয়।” (মুন্ডক-৩/১/৫)। আর গীতায় বলা হয়েছে যতিরা ‘প্রাণায়াম-পরায়ণাঃ’, তারা কাম-ক্রোধ-বিযুক্ত ও সংযতচিত্ত, তারা যোগ-ধারণাসম্পন্ন। যেমন – “যতিরা ত্যাগ, তপস্যা, প্রাণায়াম, প্রত্যার ও স্বাধ্যায় ইত্যাদি যোগরূপ সাধনা করেন (গীতা-৪/২৮)। তারা প্রাণ ও অপান বায়ুর দ্বারা গ্রহণ, আহুতি ও রুদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে পূরক, রেচক ও কুম্ভকরূপ প্রাণায়াম-পরায়ণ যোগ-সাধক (গীতা-৪/২৯)। কাম-ক্রোধ-বিযুক্ত ও সংযতচিত্ত যতিগণ জীবিতাবস্থায় ও মৃত্যুর পরে উভয়ত ব্রহ্ম-নির্বাণ লাভ করেন।” (গীতা-৫/২৬)।
অতএব এসব উদাহরণ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, যতিরা যোগ-সাধক। যোগ-সাধনার প্রধান লক্ষণগুলো যতিদের মধ্যে দেখা যায়। তাহলে তাদের প্রতি ইন্দ্রের ওই আক্রোশ কেন? এখানে উল্লেখ্য, ইন্দ্র যে যতিদেরকে হায়নার মুখে সমর্পণ করেছিলেন তার স্মৃতি শুধুমাত্র কৌষীতকি উপনিষদের মধ্যেই আবদ্ধ নয়; তৈত্তিরীয় সংহিতা (তৈঃ সঃ-৩/৩/৭/৩, ২/৫/১/১), ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (ঐঃ ব্রাঃ-৭/২৮), শতপথ ব্রাহ্মণ (শ ব্রাঃ-১/২/৩/২, ১২/৭/১/১), পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ (পঃ ব্রাঃ-১৪/১১/২৮) এবং জৈমিনীয় ব্রাহ্মণেও (জৈঃ ব্রাঃ-১/১৮৫-৬) বারবার একই কথা পাওয়া যায় – ইন্দ্র যতিদের সালাবৃকের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া যতিরা যে অত্যন্ত প্রাচীন কালের যোগ-সাধক ছিলো – ঋগ্বেদে তাদের উল্লেখ থেকে এ-কথা সহজেই অনুমতি হয়। যেমন – “হে বীর্যবান ইন্দ্র, তোমার নিকট পূর্ব-যুগের প্রজ্ঞাবিশিষ্ট ব্যক্তিদের অপেক্ষা অধিক অন্ন যাঞ্চা করছি। যতিদের নিকট থেকে ভৃগুদের ধন প্রদান করে তার দ্বারা কণ্বের পুত্রকে রক্ষা কর।” (ঋগ্বেদ-৮/৩/৯)।
টীকাকার সায়ণের ব্যাখ্যা অনুসারে ‘যতি’র অর্থ হলো, কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন যজ্ঞবিহীন জনগণ। তৈত্তিরীয় সংহিতা থেকে কৌষীতকি উপনিষদ পর্যন্ত যতিদের প্রতি ইন্দ্রের যে বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হতে পারে না। কিন্তু যতিদের প্রতি ইন্দ্রের এই নিষ্ঠুরতা কেন? ১৯২৯ সালেই শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ এই প্রশ্নের একটি উত্তর দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালের প্রত্নতত্ত্বমূলক আবিষ্কারের আলোয় সে-উত্তরের গুরুত্ব বণিত হয়েছে বলেই অনুমিত হয়। শ্রীযুক্ত চন্দের বক্তব্যটি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত তর্জমাসহ (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮২-৩) উদ্ধৃত করা যেতে পারে – ‘The only possible answer to this question is, that yatis were not originally priests of the Vadic cult like the Bhrigus and the Kanvas, but of non-Vedic rites practiced by the indigenous pre-Aryan population of the Indus Valley, in the legend of the slaughter of the Yatis by Indra we probably hear an echo of the conflict between the native priesthood and the intruding Rishis in the proto-historic period. If this interpretation of the legend is correct, it may be asked, what was the religious or magico-religious practice of the Yatis? In classical Sanskrit Yati denotes an ascetic. The term is derived from the root `yat’, to strive, to exert oneself, and is also connected with the root `Yam’, to restrain, to subdue, to control. As Applied to a priest, etymologically Yati can only mean a person engaged in religious exercise such as `tapas’, austerities, and `yoga’…. The marble statuettes of Mohenjo-daro with head, neck and body quite erect and half shut eyes fixed on the tip of the nose has the exact posture of one engaged in practicing Yoga. I therefore propose to recognize in these statuettes the image of the Yatis of the proto-historic and pre-historic Indus Valley intended either for worship or as votive offering. Like the Rishis of the pre-Regvedic and early Regvedic period, these Yatis, who practiced Yoga were also primarily magicians.’ অর্থাৎ, ‘সংক্ষেপে, বৈদিক সাহিত্যে যতিদের প্রতি যে ইন্দ্র-আক্রোশের পরিচয় পাওয়া যায় তার একমাত্র ব্যাখ্যা হলো, যতিরা বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানের অনুগামী ছিল না; তারা সিন্ধু-উপত্যকার স্থানীয় আর্য-পূর্ব জনসাধারণের অ-বৈদিক ধর্মানুষ্ঠান পালন করত। ইন্দ্রের যতি-হত্যা কাহিনীতে সম্ভবত ইতিহাস-আভাসিত যুগে স্থানীয় পুরোহিতশ্রেণীর সঙ্গে আগন্তুক ঋষিদের সংঘর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। কাহিনীটির এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হলে প্রশ্ন উঠবে, যতিদের ধর্মানুষ্ঠান বা যাদু অনুষ্ঠানমূলক আচরণের প্রকৃতি কী ছিল? ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতে যতি শব্দের অর্থ হল তপস্বী।… পুরোহিত-বোধক হিসেবে যতি শব্দের একমাত্র তাৎপর্য হলো তপস্যা এবং যোগমূলক ধর্মানুষ্ঠানে নিরত মানুষ।… মহেঞ্জোদারোর মর্মর-মূর্তিতে যোগাসনের নির্ভুল পরিচয় পাওয়া যায়, মাথা, গলা ও দেহের কঠিন ঋজুভাব, অর্ধনিমীলিত চোখ নাসিকাগ্রের উপর নিবদ্ধ। অতএব এই মূর্তিকে সিন্ধু-উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক এবং ইতিহাস-আভাসিত যুগের যতির মূর্তি বলে সনাক্ত করতে পারি।… ঋগ্বেদ-পূর্ব এবং ঋগ্বেদ সূচনা যুগে বৈদিক ঋষিদের মতোই ওই যোগী যতিরাও প্রধানতই ম্যাজিসিয়ান বা জাদুকর ছিল।…’
‘যোগ এবং যোগীদের বিরুদ্ধে বৈদিক ঋষিদের ওই প্রাচীন বিরূপতা সত্ত্বেও কালক্রমে কীভাবে এবং কেন বৈদিক ঐতিহ্যেই যোগ-সাধনার গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছিল – এ প্রশ্ন অবশ্যই জটিল। কিন্তু আপাতত মন্তব্য হলো, সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে যোগ-সাধনার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় এবং এই সভ্যতা আর্য-আক্রমণেই বিধ্বস্ত হয়েছে; অতএব বৈদিক ঋষিদের রচনায় সিন্ধু-সভ্যতার যোগীদের বিরুদ্ধে আক্রোশের পরিচয় থাকাই স্বাভাবিক। অপরপক্ষে, যতি বলতে প্রাচীনকালের যোগসাধক বোঝাতো এবং বৈদিক সাহিত্যে বারবার এই উপাখ্যানই পাওয়া যায় যে ইন্দ্র অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করেছিলেন। অতএব এ-ক্ষেত্রেও প্রত্নতত্ত্বমূলক এবং সাহিত্যমূলক সাক্ষ্যের মধ্যে সঙ্গতি খুঁজতে হলে শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দের ওই পুরানো অনুমানটিকে স্বীকার করতে হয়। এবং এই দিক থেকে প্রাচীন সিন্ধু-ধর্মের সঙ্গে বৈদিক-ধর্মের সংঘাত চিত্রটিও পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। কেননা, সিন্ধু-ধর্মের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বলতে মাতৃ-উপাসনা, লিঙ্গ-উপাসনা এবং যোগ-সাধনা। অপর পক্ষে বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায়, ইন্দ্র প্রাচীন পূজনীয়া মাতৃদেবীকে আক্রমণ ও বিধ্বস্ত করেছেন, শিশ্ন-দেবদের শতদ্বার-বিশিষ্ট নগর লুণ্ঠন করেছেন এবং যতি বা যোগীদের নেকড়ের মুখে সমর্পণ করেছেন। বৈদিক মানুষেরা সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংস করে থাকে তা হলে তাদের সাহিত্যে সিন্ধু-ধর্মের বিরুদ্ধে এ-জাতীয় আক্রোশের পরিচয় থাকাই স্বাভাবিক।’- (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৩)
অতএব, কৃষিজীবীদের যে-উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস থেকে এই সুপ্রাচীন আর্য-পূর্ব সিন্ধু-ধর্মবিশ্বাসে বসুমাতা-উপাসনা এবং শিশ্ন-উপাসনার উদ্ভব হয়েছিলো তারই মধ্যে যোগ-সাধনার আদি এবং আদিম রূপটির সূত্র অনুসন্ধান করা আবশ্যক। এবং সিন্ধু-ধর্মের এই তিনটি বৈশিষ্ট্য পরস্পর-নিরপেক্ষ বা স্বতন্ত্র নয়, যদিও পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই সিন্ধু-ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ বহুলাংশেই পরস্পর-বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র রূপ গ্রহণ করে উত্তরকালে শক্তি-সাধনা, শৈব-সাধনা এবং যোগ-সাধনায় পরিণত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষীয় তথা এতদঞ্চলের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এগুলোর প্রভাব যে কতো ব্যাপক ও গভীর তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। আর্য-আক্রমণের ফলে ওই প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা বিধ্বস্ত হলেও ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্র থেকে তার প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি। বিলুপ্ত যে হয়নি তা মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের বক্তব্য থেকেও তার আভাস মেলে – ‘An enquir into the ancient cultures would show that the cult of `Sakti’ is very old in India as in other parts of the world. And it is quite possible that it existed along with Saiva and Pasupata cults in the days of the pre-historic Indus-Valley civilization.’… `The cult of `Sakti’ produced a profound influence on general Indian thought. A topographical surveyof India would show that the country is scattered over with numerous centers of `Sakti-sadhana’. It was widespread in the past and has continued unbroken till today.’ অর্থাৎ : ‘প্রাচীন সংস্কৃতি সংক্রান্ত অনুসন্ধানের ফলে দেখা যায়, শাক্ত পূজা-পদ্ধতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সুপ্রাচীন। খুব সম্ভব, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু-সভ্যতাতে শৈব ও পাশুপত পূজাপদ্ধতির পাশাপাশি এই শাক্ত পূজাপদ্ধতিও বর্তমান ছিলো।…শাক্ত-পূজাপদ্ধতি সামগ্রিকভাবে ভারতীয় চিন্তাধারার উপর অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। স্থানবিবরণের দিক থেকে ভারতবর্ষের আলোচনা করলে দেখা যায়, দেশের উপর অসংখ্য শক্তিসাধনার কেন্দ্র ছড়ানো রয়েছে। অতীতে এই শাক্ত-ধর্ম অত্যন্ত প্রবল ছিলো এবং আজকের দিন পর্যন্ত তা অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলে আসছে।’ (সূত্র: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৮২)
আর যেহেতু ভারতীয় দর্শনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো যে, তা সব সময় সাধন-পদ্ধতি ও ধর্মবিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারেনি, তাই এতদঞ্চলের দর্শন-চর্চা ও ধর্ম-সাধনাও অনেকাংশেই একাকার হয়ে থেকেছে। ফলে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সিন্ধু-ধর্মের প্রভাব যদি সত্যিই ব্যাপক ও গভীর হয় তাহলে উত্তরকালের দর্শন-চর্চাও যে সম্পূর্ণভাবে সিন্ধু-যুগের প্রভাব-নিরপেক্ষ হয়েছিলো, অন্তত সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার না-হওয়া পর্যন্ত এমন কথা কল্পনা করার সঙ্গত কোনো কারণ নেই বলেই মনে হয়। আর ধর্মবিশ্বাস ও সাধন-পদ্ধতি তো সমাজ-সংস্কৃতির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবেই জড়িত। এ-কারণেই হয়তো ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দিতে গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ড. অতুল সুর উদ্ধৃতি মন্তব্য করেন – “হিন্দু সভ্যতার গঠনের মূলে বারো-আনা ভাগ আছে সিন্ধু উপত্যকার প্রাক্-আর্য সভ্যতা; আর মাত্র চার-আনা ভাগ মন্ডিত আর্য সভ্যতার আবরণে।”
নব্যপ্রস্তর যুগে উর্বরতাভিত্তিক যাদুবিদ্যার উদ্ভব ও লিঙ্গ
এখানে উল্লেখ্য, সম্ভবত আমাদের অনুমান করবার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে যে, সিন্ধু সভ্যতা আর্য সভ্যতার ন্যায় আগন্তুক সভ্যতা ছিলো না। এ সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ ভারতবর্ষেই ঘটেছিলো। আমরা জানতে পারি যে, মূলগতভাবে সিন্ধু সভ্যতা ছিলো তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতা (chalcolithic civilization)। তার মানে, প্রস্তর যুগের শেষে এই সভ্যতার ধারকদের মধ্যে তামার ব্যবহার প্রচলিত হয়েছিলো। তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার অভ্যুদয়ে তামা-ই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। মিশর, সুমের, সিন্ধু উপত্যকার সর্বত্রই সভ্যতার প্রথম প্রভাতে তামার ব্যবহার দেখা যায়। আর গবেষকদের বয়ান থেকে এটাও জানা যায় যে, বাঙলাই ছিলো সে-যুগের তামার প্রধান আড়ত। তামার বৃহত্তম খনি ছিলো বাঙলাদেশেই। বাঙলার বণিকরাই ‘সাত সমুদ্দুর তেরো নদী’ পার হয়ে ওই তামা নিয়ে যেতো সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রসমূহে বিপণনের জন্য। এজন্যই বাঙলার সবচেয়ে বড় বন্দরের নাম ছিলো ‘তাম্রলিপ্তি’। তাম্রাশ্ম যুগের অনেক দ্রব্য আজও বাঙালী হিন্দু পরিবারের ঠাকুরঘরে দেখতে পাওয়া যায়, যেমন – পাথর ও তামা দিয়ে তৈরি থালা-বাটি-গেলাস ও তামার কোষাকুষি ইত্যাদি। অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার সঙ্গে প্রস্তর যুগ পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরবিন্যাস হরপ্পায় পাওয়া যায়। প্রস্তর যুগের যে স্তর থেকে তাম্রাশ্ম যুগের উদ্ভব হয়েছিলো, নৃতত্ত্বের ভাষায় তাকে আমরা নবোপলীয় যুগের (neolithic) সভ্যতা বলি। এই নবোপলীয় যুগের মানুষই প্রথম ভূমিকর্ষণ ও স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু করে। তা ছাড়া, নবোপলীয় যুগের মানুষরা পশুপালন করতো, মৃৎপাত্র তৈরি করতো, বস্ত্রবয়ন করতো ও নিজেদের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য যে-সকল আয়ুধ বা যন্ত্রাদি ব্যবহার করতো, সেগুলোকে বেশ মসৃণ বা পালিশ করতো। বস্তুত নবোপলীয় যুগেই প্রথম সভ্যতার সূচনা। গ্রাম-বাঙলার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ধামা, চুবড়ি, কুলা, ঝাপি, বাটনা বাটার শিল-নোড়া ও শস্য পেষাইয়ের জন্য জাঁতা ইত্যাদির ব্যবহার আধুনিক নগর-সভ্যতার প্রভাবে অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসলেও আজও অনেক স্থানেই এগুলো নবোপলীয় যুগের কৃৎকৌশলের সাক্ষ্য বহন করছে।
লিঙ্গপূজার সূচনা যে এই নবোপলীয় যুগেই হয়েছিলো এবং কিভাবে তার সম্ভাব্য সূত্রপাত ঘটেছে, এ-বিষয়ে একটি নৃতাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছেন ড. অতুল সুর এভাবে –‘পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে ভারতের বিস্তৃত ভূখন্ডে প্রত্নোপলীয় যুগ থেকে নবোপলীয় ও পরে তাম্রাশ্ম যুগ পর্যন্ত সভ্যতার একটা ধারাবাহিকতা ছিল। …অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের মানুষ হয় নদীর ধারে, আর তা নয়তো পাহাড়ের ওপরে বা পাহাড়ের ছাউনির মধ্যে মাটির ঘর তৈরি করে বাস করত। এসব জায়গায় কোন কোন স্থানে আয়ুধ-নির্মাণের কারখানাও পাওয়া গিয়েছে। তা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সে-যুগের মানুষ সম্পূর্ণভাবে যাযাবরের জীবন যাপন করত না। তার মানে, এ যুগের মানুষ সমাজবদ্ধ হবার চেষ্টা করছিল। সেটা বুঝতে পারা যায় কয়েক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে তাদের চিত্রাঙ্কন থেকে। এ চিত্রগুলো তারা খুব সম্ভবত ঐন্দ্রজালিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত। অর্থাৎ তাদের মধ্যে ধর্মেরও উন্মেষ ঘটছিল।
এই স্থায়ী বসতিস্থাপনের প্রবণতা নবোপলীয় যুগেই বিশেষভাবে প্রকটিত হয়। তারা পশুপালন ও কৃষির উপযোগী স্থানেই বসতিস্থাপন করত। কৃষির উদ্ভব কিভাবে ঘটেছিল, সেটা এখানে বলতে চাই। ভূমিকর্ষণের সূচনা করেছিল মেয়েরা। পশুশিকারে বেরিয়ে পুরুষের যখন ফিরতে দেরি হত, তখন মেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে প্রাণধারণ করত। তারপর তাদের ভাবনা-চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা। সন্তান-উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেইহেতু তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে, পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি (পরবর্তীকালে আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা ‘ভূমি’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমি কর্ষণ করতে থাকে। (Przyluski তার ‘Non-Aryan Loan in Indo-Aryan’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’ – এই তিনটি শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন)। মেয়েরা এভাবে ভূমি কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল। পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। তারা লক্ষ্য করল লিঙ্গরূপী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active। Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর যে প্রথম ‘নবান্ন’ উৎসব হল, সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গপূজা ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা।’- (ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়)
‘প্রৎসিলুসকি (Przyluski) দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’ ও ‘লাঙ্গল’ শব্দদ্বয় অস্ট্রিক ভাষার অন্তর্ভুক্ত শব্দ, এবং ব্যুৎপত্তির দিক থেকে উভয় শব্দের অর্থ একই। তিনি বলেছেন যে পুরুষাঙ্গের সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ‘লিঙ্গ’ শব্দটি অস্ট্রো-এসিয়াটিক জগতের সর্বত্রই বিদ্যমান, কিন্তু প্রতীচ্যের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহে এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি আরও বলেছেন যে সংস্কৃত ভাষায় যখন শব্দ দুটি প্রবিষ্ট হল, তখন একই ধাতুরূপ (‘লনগ্’) থেকে লাঙ্গুল ও লিঙ্গ শব্দ উদ্ভূত হয়েছিল। অনেক সূত্রগ্রন্থ ও মহাভারত-এ ‘লাঙ্গুল’ শব্দের মানে লিঙ্গ বা কোন প্রাণীর লেজ। যদি ‘লাঙ্গল = লাঙ্গুল’, এই সমীকরণ স্বীকৃত হয়, তা হলে এই তিনটি শব্দের (লাঙ্গল, লাঙ্গুল ও লিঙ্গ) অর্থ-বিবর্তন (semantic evolution) বোঝা কঠিন হবে না। কেননা, সৃষ্টি প্রকল্পে লিঙ্গের ব্যবহার ও শস্য-উৎপাদনে লাঙ্গল দ্বারা ভূমিকর্ষণের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সাদৃশ্য আছে। অস্ট্রিকভাষাভাষী অনেক জাতির লোক ভূমিকর্ষণের জন্য লাঙ্গলের পরিবর্তে লিঙ্গ-সদৃশ খনন-যষ্টি ব্যবহার করে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক হিউবার্ট ও. ময়েস বলেছেন যে মেলেনেসিয়া ও পলিনেসিয়ার অনেক জাতি কর্তৃক ব্যবহৃত খননযষ্টি লিঙ্গাকারেই নির্মিত হয়। মনে হয়, ভারতের আদিম অধিবাসীরাও নবোপলীয় যুগে বা তার কিছু পূর্বে এরকম যষ্টিই ব্যবহার করত, এবং পরে যখন তারা লাঙ্গল উদ্ভাবন করল, তখন তারা একই শব্দের ধাতুরূপ থেকে তার নামকরণ করল।’- (ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়)
ধারণাগতভাবে বিষয়টা যদি যৌক্তিক বিচারে স্বীকারযোগ্য হয় তাহলে মাতৃপূজা ও লিঙ্গপূজার সমন্বিত ভারতীয় শক্তিবাদের তাত্ত্বিক পরিকল্পনার উৎস-বীজটা যে সেই সুপ্রাচীন সিন্ধুযুগের অনার্য সমাজ-উদ্ভূত ধর্মবিশ্বাসেরই বিবর্তিত পরম্পরার স্মারক-চিহ্ন, তা বোধকরি অস্বীকার করা যাবে না। এক্ষেত্রে আরেকটি কৌতুহলজনক উদাহরণ হলো – ‘আমরা লিঙ্গের যেসব প্রতিরূপ পেয়েছি, তা দাক্ষিণাত্য থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা খুবই বিচিত্র ব্যাপার যে একপ্রকার লিঙ্গ-উপাসনা, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে নিবদ্ধ কিংবদন্তী অনুযায়ী দাক্ষিণাত্যের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। সূত্রসংহিতায় বলা হয়েছে যে দৈত্যরাজ বাণ মহাদেবের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি প্রতিদিন স্বহস্তে একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করে, তার অর্চনা করতেন। শতবর্ষ এরকম পূজা করবার পর মহাদেব তার প্রতি বিশেষ প্রীত হয়ে তাকে এক বর দিয়ে বলেন – ‘আমি তোমাকে চৌদ্দ কোটি বিশেষ গুণ-সম্পন্ন লিঙ্গ দিতেছি। এইসকল লিঙ্গ নর্মদা ও অন্যান্য পুণ্যসলিলা নদীতে পাওয়া যাবে। ভক্তগণকে এইসকল লিঙ্গ মোক্ষদান করবে।’ হিমাদ্রি যাজ্ঞবল্ক্যকে উদ্ধৃত করে তার ‘চতুর্বর্গচিন্তামণি’ গ্রন্থে বলেছেন : ‘এইসকল লিঙ্গ অনন্তকাল ধরে অবিরাম নর্মদা নদীর স্রোতে আবর্তিত হবে। প্রাচীনকালে নৃপতি বান ধ্যানস্থ হয়ে মহাদেবের আরাধনা করলে, মহাদেব প্রীত হয়ে লিঙ্গরূপ ধারণ করে পর্বতের উপরে অবস্থান করেন। সেই কারণে এই লিঙ্গকে বাণলিঙ্গ বলা হয়। এক কোটি লিঙ্গের অর্চনা করে উপাসক যে ফল পাবেন, একটি বাণলিঙ্গ অর্চনা করলেও সেই ফলই পাবেন। নর্মদা নদীর তীরে প্রাপ্ত বাণলিঙ্গের অর্চনা করলে মোক্ষলাভ উপাসকের করায়ত্ত হয়।’- (ড. অতুল সুর / ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়)
বাণলিঙ্গের উপাসনার সঙ্গে বাণের নাম সংযুক্ত থাকাটা খুবই অর্থবহ বলে গবেষকদের ধারণা। কেননা বাণ বঙ্গদেশের রাজা ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলেন যে বর্তমান বাণগড়-ই বাণরাজার রাজধানী ছিলো। বাণের পিতা ছিলেন অসুররাজ বলি। মহাভারত অনুযায়ী অসুররাজ বলির মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভেই অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড্র প্রভৃতি জাতিগুলোর আদিপুরুষের জন্ম হয়েছিলো। বলি শিবেরই উপাসক ছিলেন। সুতরাং শিবপূজার সঙ্গে বঙ্গদেশের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বস্তুত বর্তমানেও লিঙ্গরূপী শিবের মন্দির বাংলায় যতো দেখা যায়, ভারতের আর কোথাও তত দেখা যায় না। শিব যে প্রাগার্য দেবতা তা পণ্ডিতমহলে সর্বজন-স্বীকৃত। আবার এদেশের ধর্মবিশ্বাসে শিব মাতৃদেবীর ভর্তা। মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব বাংলাতেই ঘটেছিলো। এবং এখনও তা যেরূপ জনপ্রিয়, শিবের গাজন উৎসবও (বিশেষ করে নিম্নকোটির লোকদের মধ্যে) সেরূপ জনপ্রিয়। এবং তা হয়তো প্রাগার্যকাল থেকেই চলে আসছে। ঋগ্বেদে লিঙ্গ-উপাসকদের প্রতি ঘৃণা-প্রকাশ ও কটুক্তি থেকেই বোঝা যায় যে লিঙ্গ-উপাসনা প্রাগার্য সভ্যতার অবদান। আর তাই – ‘বেদোত্তর ভারতের ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে লিঙ্গ উপাসনা এবং তার সঙ্গে শিবের গভীর ও ব্যাপক সংযোগ চোখে পড়ে। এ প্রভাব আকস্মিক হতে পারে না বলেই সুদূর কোন এক প্রাগৈতিহাসিক অতীত অনুমেয়। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত লিঙ্গসমূহ স্বভাবতই সেই প্রাগৈতিহাসিক অতীতের ইঙ্গিত দেয়। উত্তরকালের প্রথা অনুসারে এই উপাস্য লিঙ্গগুলোকে যদি আমরা শিবলিঙ্গ আখ্যা দিতে সম্মত হই, তাহলে এই দিক থেকেই সিন্ধুধর্মে শৈব সাধনার আদিরূপ স্বীকারযোগ্য হতে পারে। তাই এই অনুমান অসঙ্গত নয় যে শক্তিসাধনার মত শৈব-সাধনারও সূত্রপাত প্রাক্-বৈদিক যুগে এবং বেদোত্তর ভারতের ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও শক্তি-সাধনার মত শৈব-সাধনাও অবিচ্ছিন্ন প্রভাবে টিকে থেকেছে।’ – (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১৯৮)।
শিবের ধারণার সাথে তার লিঙ্গপ্রতীক যে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে সেটি হয়তো এ পর্যায়ে আমাদের ধারণায় অস্পষ্ট নয়। কিন্তু কী করে লিঙ্গ ও শিব কোন এক ব্রাহ্ম-মুহূর্তে এক হয়ে গেলেন তার অনুমান করতে গিয়ে প্রাপ্ত দৃশ্যমান উপাদানের বিচ্ছিন্ন নিদর্শন দিয়ে মানবসভ্যতার একটি সুপ্রাচীন অবিচ্ছিন্ন প্রাগৈতিহাসিক পরম্পরার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাক্ষ্য-প্রমাণের যে অনুক্ত ঘাটতিগুলো থেকে যায়, তার জন্যে প্রয়োজন হয় যৌক্তিক অনুমানভিত্তিক কিছু নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিন্যাসের। আমাদের আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় এটাও গুরুত্বপূর্ণ বৈকি।
মানববিকাশের নৃতাত্ত্বিক ধারায় লিঙ্গোপাসনার পটভূমি
মানবজাতি ও মানবসভ্যতার বিকাশ
মানবসভ্যতা বিকাশের ভূমিকা : ইতপূর্বে আমরা যদিও পর্যায়ক্রমিক আলোচনায় মাঝেমধ্যে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত কিছু কিছু প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি টেনেছি, তবুও আলোচনার স্পষ্টতার জন্যে মানবসভ্যতার বিবর্তন ধারার প্রাথমিক আরও কিছু আলোচনা বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিষয়গত ধারণার স্পষ্টতার লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বিদ্বান লেখকদের পূর্বাপর নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার একটা সমন্বিত সার-সংক্ষেপ এখানে বিবৃত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। নৃতাত্ত্বিকেরা হাতিয়ারের ক্রমবিকাশের ধারা অনুশীলন করে মানবসভ্যতার বিকাশের ঐতিহাসিক যুগের যে ধারা চিহ্নিত করেছেন তা হলো যথাক্রমে – প্রস্তর যুগ, তাম্রযুগ, ব্রোঞ্জ যুগ এবং লৌহ যুগ। কেননা এই হাতিয়ারের ক্রমবিকাশের ধারা অনুশীলন করলেই ব্যবহারকারীদের ক্রমবিবর্তন অনুশীলন করা যায়। আর প্রগৈতিহাসিক প্রত্ন-প্রাচীন প্রস্তর যুগকে আবার উপবিভাগে ভাগ করা হলো – প্রত্নপ্রস্তর বা আদি-প্রস্তর যুগ, মধ্য-প্রস্তর যুগ ও নব বা নব্য-প্রস্তর যুগ। কিন্তু হাতিয়ার তৈরি ছাড়াও শিকারের প্রয়োজনে মানুষ জোট বাঁধতে বাধ্য হলো। ফলে, ভাবের আদান-প্রদানের প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু হলো ভাষার ব্যবহার। জোটবদ্ধ জীবনে প্রথমে জৈবিক প্রয়োজনে, তারপর ধীরে ধীরে দেখা দিলো পরিবারের প্রয়োজনীয়তা। প্রকৃতির সাথে নিয়ত সংগ্রামশীল মানুষ পর্যায়ক্রমে শিখলো কাঁচা ও পোড়া মাটির ব্যবহার। তারপর একে একে আয়ত্ত করলো তামা, ব্রোঞ্জ ও সবশেষে লোহার ব্যবহার। ‘এরমধ্যে যেসব জিনিস বিনষ্ট হওয়ার তা কালের প্রভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। আর যা নষ্ট হওয়ার নয় তা চাপা পড়ে রইলো – মাটির তলায় বা পৃথিবীর পাঠশালায়, কালের লিখন হয়ে।’
মানব-সংস্কৃতির সূত্রগুলোর ব্যাখ্যা-বিন্যাস : মানবসভ্যতা বিকাশের এই ধারা সারা পৃথিবীতে এতই সুশৃঙ্খল ও সাদৃশ্যপূর্ণ যে তা দেখে নৃতাত্ত্বিক ও পণ্ডিত মহলের প্রশ্ন জন্মেছে যে, পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর (সিন্ধু থেকে নীলনদ-এর মধ্যে) বৈসাদৃশ্য থেকে সাদৃশ্যই এত বেশি যে (স্থানভেদে একটু আধটু অদল-বদল হলেও মূলত এক) কতগুলো সম্ভাবনার কথা ভাবতেই পারা যায় যে, এইসব অত্যুন্নত প্রাচীন সভ্যতাগুলো কি কোনও এক অতিপ্রাচীন সভ্যতারই শাখা-প্রশাখা! নাকি এরা সকলেই কোনও এক অতি প্রাচীন সভ্যতার দেশ-কাল-পাত্রভেদের প্রকাশস্বরূপ! সর্বত্রই দেখা যায় যে, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে মানবসভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশের ধারা (স্থান-কাল-পাত্রভেদে একটু-আধটু অদল-বদল হলেও) মূলত প্রায় একইরকম, কারণ সর্বত্র প্রকৃতিই হলো তার এক ও অদ্বিতীয় পাঠশালা। তাই ক্রমবিকাশের সারণি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল – এখানে বিশৃঙ্খলার কোনও স্থান নেই। কালের নিয়মে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে, সেই প্রাকৃতিক নিয়মের বৈশিষ্ট্য হলো, যত প্রাচীন তত নিচে, আর নবীনের স্থান তার উপরে। ফলে গভীরতাই হলো প্রাচীনত্ব পরিমাপের সাধারণ সূত্র, আর নৃতাত্ত্বিক পরিভাষায় একেই বলে স্তরক্রম (Straticgraphic column)। এই স্তরক্রম থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শনের সূত্র-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্রন্থিত মানব-সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিক সূত্রগুলোর ব্যাখ্যা-বিন্যাস করা হয়।
হোমো গণের উদ্ভব : জীব বিকাশের কোনও এক ধারা বেয়ে এসেছে মানুষ। সে তখন নিশ্চয়ই আজকের মতো দেখতে ছিল না। সে ছিল অরণ্যচারী, লোমশ, উলঙ্গ, রিপুতাড়িত জান্তব প্রাণী বিশেষ। মানুষের সমস্ত ভালো-মন্দ গুণাবলিই ছিল তার মধ্যে ভ্রূণ অবস্থার মহাসুষুপ্তিতে। শুধুমাত্র বাঁচার আকাঙ্ক্ষায়, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ও জৈবিক তাগিদে সে আয়ত্ত করেছিল পারিপার্শ্বিকতাকে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার হাত থেকে বাঁচার জন্যে বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন লক্ষণ ও নানা বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়ে উঠে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হচ্ছিলো। এদেরই এক শাখা থেকে ক্রমে উদ্ভূত হয়েছিলো নরাকার জীব বা প্রাইমেট। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে মানুষের পূর্বপুরুষ এপ-ম্যান বা কপি-নরদের আবির্ভাব হয় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ বছর আগে। তারপর পঁচিশ লক্ষ বছর আগে নরাকার জীবেদের মধ্যে মানুষের লক্ষণযুক্ত জীবের আবির্ভাব ঘটে। তবে এরা প্রকৃত নর নয়, এরাও কপি-নর বা এপ-ম্যান বিশেষ। বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষ ‘হোমো গণের’ (Genus) আবির্ভাবও প্রায় ওই একই সময়ে। এরপর ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ বা প্রাগৈতিহাসিক মানব বা আদিম মানবের আবির্ভাব হয় তিন থেকে পাঁচ লক্ষ বছর আগে, খুব সম্ভবত গুঞ্জ-মিন্ডেল তুষার যুগের অন্তর্বর্তী সময়ে। আর সবশেষে আধুনিক (বিজ্ঞ) মানুষ ‘হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স’-এর আবির্ভাব হয়েছে মাত্র পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। আর তারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে মাত্র পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে।
তুষার যুগ, বাইপেডালিজম, দৃষ্টিশক্তি, হাতিয়ার, আগুন : নৃবিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে প্রায় ৬ লক্ষ থেকে ১০ হাজার বছর আগে অবধি পৃথিবীতে এসেছে চার-চারটে তুষার যুগ, যা মানব সভ্যতার ধারাকে করেছে ক্রমত্বরান্বিত। যাদেরকে চিহ্নিত করা হয় গুঞ্জ, মিন্ডেল, রিস ও উয়র্ম নামে। আর দুই তুষার যুগের মধ্যিখানে অন্তর্বর্তী উষ্ণ যুগ। এক তুষার যুগে অরণ্য ধ্বংস হয়ে গিয়ে অন্তর্বর্তী যুগে দেখা দিলো তৃণভূমি। তখন নরাকার বৃক্ষচারীর দল মাটিতে নেমে এসে ক্রমশ দু’পায়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। আর তখনই তার হাত দুটো চলাফেরার প্রয়োজন থেকে হলো চিরমুক্ত। আর দৃষ্টিশক্তিও হলো ক্রমেই সুদূরপ্রসারী। এই দৃষ্টিশক্তিই তাকে দূরের জিনিস দেখতে ও বিপদের সময় দূরে ছুটে পালাতে সাহায্য করলো। বিপদে পড়লে পালানোই ছিলো আদিম মানবের ধর্ম, রুখে দাঁড়ানো নয়। আর এক হিমযুগের প্রভাবে, শুধুমাত্র বাঁচার প্রয়োজনে তাকে আশ্রয় নিতে হলো গুহায়। গায়ে জড়াতে হলো শিকার করা পশুর ছাল, এবং অবশ্যই তা লজ্জা নিবারণের জন্যে নয়। পেটের জ্বালা তাকে বাধ্য করলো পশুশিকারে। আত্মরক্ষার প্রয়োজন ও শিকারের তাগিদে প্রথমেই সে শিখলো হাতের কাছের সবচাইতে সহজলভ্য জিনিস পাথরকে ব্যবহার করতে, তৈরি হলো – হাতিয়ার। হাতিয়ার তৈরি ছাড়াও শিকারের প্রয়োজনে মানুষ জোট বাঁধতে বাধ্য হলো। শিখতে হলো আগুনের ব্যবহার। শুরু হয়ে গেলো মানব সভ্যতার জয়যাত্রা। এরকমই কোনও এক সময়কালে আদিম মানবের গুহা ও তার আশপাশ থেকে এমন কতকগুলো প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে যা পরবর্তীকালের ধর্মের সাথে সম্বন্ধযুক্ত বলে নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা।
পাথরের ব্যবহার ও প্রাচীন প্রস্তর যুগ : অরণ্যচারী আদিম গুহামানবেরা পাথরের ব্যবহার ও আগুনের ব্যবহার শিখে ফেলে প্রায় লক্ষাধিক বছর আগে। এই সময় থেকেই আদি প্রস্তর যুগের সূত্রপাত বলে ধরা হয়। ‘আদি-প্রস্তর যুগের নিদর্শনগুলো সাধারণত ‘কোয়ার্টস’ পাথরের তৈরি বলে ওই সময়কার সভ্যতাকে অনেকেই ‘কোয়ার্টাইট সভ্যতা’ বলে থাকেন। মাদ্রাজ, ওয়াঙ্গাল, গুল্টুর ছাড়া কুডাপ্পাতেও প্রচুর পরিমাণে ওই সময়কার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান মিলেছে গোদাবরী অঞ্চলে ও নর্মদা অববাহিকার উপত্যকায়। ১৮৭২ সালের এক সমীক্ষায় নর্মদা অঞ্চলে কোয়ার্টস পাথরের তৈরি হাত কুঠার ও অন্যান্য যেসব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে ভারতবর্ষে নর্মদা অঞ্চলেই সর্বপ্রাচীন মানবসভ্যতার বসতি ছিল। এ ছাড়াও ওখানকার একই নুড়ি পাথরের স্তর থেকে পাওয়া গিয়েছে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মোষ, ঘোড়া, ভালুক, গণ্ডার, জলহস্তী, হাতি ও কুমিরের কঙ্কাল। আর গোদাবরী অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের তৈরি কোয়ার্টস ও অ্যাগেট পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি ছুরি। এগুলো সবই আদি-প্রস্তর যুগের গোড়ার দিকের নিদর্শন বলেই প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা। … এর পরবর্তী সময়ে, প্রায় ওই একই সময়কালের ‘আদিম গুহামানবের’ গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে – কুর্ণুল জেলায়। সেখানেও পাওয়া গিয়েছে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নানান প্রাণীদের কঙ্কাল। নর্মদা ও গোদাবরী অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো প্লাইস্টোনিন যুগের গোড়ার দিককার; আর কুর্ণুল জেলার গুহা অন্ত-প্লাইস্টোনিন যুগের নিদর্শন বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। … এ ছাড়াও উত্তর ভারতের জন্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের ঝিলাম, চেনাব, তাউই ও পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেলার ‘সোয়ান’ বা ‘সোহান’ (Sohan) নদী ও এইসব নদীর উপনদীর অববাহিকা অঞ্চল ও তার আশপাশ থেকে আদি-প্রস্তর যুগের যে সমস্ত নিদর্শন উদ্ধার হয়েছে তাকে প্রত্নতাত্ত্বিক পরিভাষায় বলে – Sohan Industry বা সোহান কারিগরি। অনুমান করা হয় যে এই কারিগরি এক বিস্তীর্ণ সময়কালের নিদর্শন, যার শুরু প্রথম অন্তর্বর্তী তুষার যুগ থেকে, আর শেষ, তৃতীয় অন্তর্বর্তী তুষার যুগে এসে।’ – (অশোক রায়/ বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৭০,৭২)
মধ্য-প্রস্তর যুগ : মধ্য-প্রস্তর যুগে এসে এতোদিনের পূর্ব-অভিজ্ঞতায় মানুষ তার প্রয়োজন অনুযায়ী বড় পাথরকে ভেঙে টুকরো করে নিয়ে হাতিয়ার তৈরি করার কারিগরি বিদ্যা অর্জন করে ফেলেছে। এই যুগের এইসব ছোট ছোট পাথরের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র ও হাতিয়ারগুলোকে ‘পিগমি টুলস’ বলে। প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়া এই কারিগরি বিদ্যা দিয়ে সূক্ষ্মদানার পাথরকে টুকরো করে ঘসে মেজে কখনও বা তাতে বন্য জন্তুর হাড়ের হাতল লাগিয়ে বা গাছের ডাল ভেঙে তাতে জুড়ে দিয়ে নিজের প্রয়োজনানুগ করে তুলতো। ‘এ যুগের নিদর্শনও দক্ষিণ ভারতের তিন্নিভেল্লী ও হায়দরাবাদ সহ প্রায় সব কটা জেলাতেই দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও গুজরাত, কাথিওয়াড়, মধ্য-ভারত ও ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলেও একই সময়কালের খুব ছোট ছোট পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। … আদি ও মধ্য-প্রস্তর যুগের নিদর্শন ভারতে বিক্ষিপ্তভাবে নর্মদা, গোদাবরী, মধ্য-ভারত ও দক্ষিণ ভারতের কয়েকটা কোয়ার্টজাইট এলাকা ও পরিশেষে সিলিকেট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও নিম্ন-প্রস্তর যুগ বা নব-প্রস্তর যুগের নিদর্শন কিন্তু সারা ভারতের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য জায়গা হল দক্ষিণ ভারতের বোলারী, মাইসোর ও হায়দরাবাদ। এ ছাড়াও বিন্ধ্যপর্বত, বাঘেলখণ্ড, মধ্য-ভারত, গুজরাট, রেওয়া, মির্জাপুর, ছোটনাগপুর, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বর্মা, ইন্দোচিন ও মালয় উল্লেখযোগ্য।’ – (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৭৩)। মূলত নব-প্রস্তর যুগে মানুষ অভিজ্ঞতায় আরও সমৃদ্ধ হয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বড় পাথরকে ভেঙে টুকরো করে, তাকেই আবার ঘষে-মেজে প্রয়োজনানুগ করে তুলতে শিখেছে। আর এই যুগের সভ্যতা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ার ফলে যেখানে যেমন ধরনের পাথর মেলে তাকেই তারা কাজে লাগাতে শিখেছে। আদিম মানবের এই হাতিয়ারে উন্নতির সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতিও যে সমভাবে বিকশিত হচ্ছিল সে দিকটা ভুলে গেলে চলবে না।
নব্যপ্রস্তর যুগ, কৃষির উদ্ভব ও নগর সভ্যতা : শিকারের অপ্রতুলতায় শুধুমাত্র খিদের জ্বালায় প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্য অবস্থায় আপনা আপনি গজিয়ে থাকা শস্যদানা আহরণ ও পরবর্তীকালে ভিজে মাটিতে তা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই কৃষিকার্যের সূচনা। তাই উর্বরা শক্তির প্রসন্নতা ও কৃষির সাফল্যের প্রয়োজনে দেব ধারণা বিবর্তিত হয় – প্রকৃতি (নারী) ও পুরুষে। দশ হাজার বছর আগে মানুষ কৃষিকার্য ও পশুপালন করতে শেখে। এই সময়কালকে বলা হয় মধ্য-প্রস্তর যুগ। আর নিম্ন-প্রস্তর যুগ বা নব-প্রস্তর যুগে এসে অর্থাৎ আট হাজার বছর আগে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে গ্রাম, সমাজ, গোষ্ঠী ও পরিবার। আর নাগরিক সভ্যতা? সে মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগেকার কথা। এটি তাম্রাশ্ম যুগের অবদান। কৃষিকার্যের অরুণালোকে আদিম মানবের শিকারজীবী-যাযাবর-আরণ্যক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। গড়ে ওঠে স্থায়ী বাসভূমি। প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বিবর্তিত হয় পিতৃতান্ত্রিকতায়। ভারতবর্ষে এই সভ্যতার কালানুক্রমিক পরিপুষ্টি ও চরমোৎকর্ষতা দেখা যায় – সিন্ধু সভ্যতায়। যার পরিণতিতে সেখানে নগরায়ণ, কারিগরিবিদ্যা, বহির্বাণিজ্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন ও শিল্পকলা চিন্তার এক আশ্চর্য উত্তরণ ঘটে। এ ছাড়াও সেদিনকার সেই ধর্মচিন্তা – যেমন মাতৃদেবীর পূজা, আদি শিব, লিঙ্গ ও যোনি পূজা, সূর্য পূজা, নাগপূজা, পশুপূজা ও বৃক্ষ বা অশ্বত্থ পূজা ইত্যাদি – পরবর্তীকালে হিন্দু সভ্যতার দেবদেবী ধারণা গঠনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তবে আদিম মানবেরা কবে কখন সর্বপ্রথম অতিপ্রাকৃতের কাছে ভয়ে মাথা নুয়েছিলো সেটি বলা সম্ভব না হলেও আদিম মানবের মাথা নোয়ানোর বিষয়টি কিভাবে শুরু হয়েছিলো তারও একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন নৃবিজ্ঞানীরা। তা বুঝতে আমাদেরকে আরেকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।
মৃতদেহ সৎকার, সমাধিক্ষেত্র ও ধর্মের উদ্ভব : আদিম মানবগোষ্ঠীর সভ্যতা ও তার সংস্কৃতির নানাদিক নিয়ে নৃবিজ্ঞানীরা প্রচুর গবেষণা পর্যালোচনা করেছেন। তার মধ্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মৃতদেহ সৎকার ব্যবস্থা। একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ মৃতদেহকে জঙ্গলে ফেলে দিতো। এর পরের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারেরাই করতো। একদিন এই ব্যবস্থা হলো অচল। তখন মৃতদেহকে মাটিতে গর্ত করে চাপা দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হলো। কিন্তু তাতেও দেখা দিলো অসুবিধা। বন্য জন্তুরা মাটি খুঁড়ে শবদেহকে বের করে আনে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া হলো গর্তের উপরে বড়ো-সড়ো একখানা পাথর চাপিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। জানা যায়, এরকমই এক সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে কোলার জেলায়। তাতে প্রায় চুয়ান্নটি এ ধরনের সমাধির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও মাদ্রাজ, বোম্বাই, মাইসোর ইত্যাদি অঞ্চলে এই একই ধরনের সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এরপর মানবসভ্যতা যখন আরও বদলালো বা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলো, তখন এই সৎকার ব্যবস্থাও কিছুটা বদলালো। মৃতদেহ দাহ করে সেই দগ্ধাবশেষ মাটি চাপা দিয়ে দেওয়ার প্রথা চালু হলো। তবে সর্বক্ষেত্রে পূর্ণদগ্ধ না হলেও অর্ধদগ্ধ দেহাবশেষ মাটির পাত্রে ভরে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হতো, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শবদেহ অর্ধদগ্ধই থেকে যেতো। এরকমই এক বিশাল শ্মশান বা সমাধিক্ষেত্র পাওয়া গেছে তিরুণাভেলীর আদিচেনালুরে। এই সমাধিক্ষেত্র নব-প্রস্তর যুগের নিদর্শন বলে মনে করা হয়। এরও পরবর্তীকালের সমাধিতে যথাক্রমে তামা, ব্রোঞ্জ, লোহা ও সোনার অলঙ্কার ও অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রী দেখতে পাওয়া গেছে সিন্ধুপ্রদেশের ব্রহ্মণ্যবাদ অঞ্চল থেকে। ‘প্রাথমিকভাবে, মৃত প্রিয়জনের পুঁতে দেওয়া শবদেহ বন্যজন্তুর হাত থেকে রক্ষার প্রয়োজনেই শুরু হয়েছিল সমাধিক্ষেত্রে পাথরের ব্যবহার, ক্রমে তা প্রথায় দাঁড়িয়ে যায়। সাধারণ পাথর তখন আর শুধুমাত্র পাথর থাকে না। সে উত্তরিত হয় – প্রিয়জনের, দলপতি বা গোষ্ঠীপতির সমাধির স্মারক চিহ্নরূপে। এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন চলতে চলতে চলতে একসময় মানুষই পাথরে আরোপ করে বিশিষ্টতা। আর তখন স্মারক প্রস্তর বিশিষ্টতা লাভ করে – স্মৃতিচিহ্নরূপে, যার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে প্রিয়জনের প্রতীকরূপে (আজও যেমন হয় প্রিয়জন বা শ্রদ্ধেয় জনের Photograph বা তৈলচিত্র) অমূর্ত বা বিমূর্ত প্রতীকরূপে সাধারণ পাথর তখন অসাধারণত্বের মাত্রা (Dimention) লাভ করে। শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে, ভালবাসায়, নিজের, পরিবারের বা গোষ্ঠীর পরম প্রয়োজনীয় মুহূর্তের ত্রাতারূপে মানুষ তখন আকুলভাবে প্রণতি জানায় এই পাথরের কাছে। ক্রমে এ ব্যবস্থাও কায়েমি হয়। এদিকে জীবন ও মৃত্যুর ধোঁয়াশা আজও এক অনন্ত কুহেলিকা। ফলে, সমাধি-প্রস্তরে আত্মার অবস্থান অতি সহজেই মান্যতা লাভ করে। তখন আত্মা-প্রস্তর পুজ্য ও প্রণম্য হয়ে ওঠে পিতৃ-দেবতার বা মাতৃদেবীর প্রতীক রূপে।’
‘এ ছাড়াও, সেদিনের সেই অসহায় মানুষগুলো এতদিন ধরে প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে বাঁচার জন্যে একটা প্রকৃতিদত্ত অবলম্বনের অনুসন্ধান করে আসছিল আকুলভাবে। আজ তা এই বিমূর্ত রূপের আধারে আধারিত হতে পারল সঠিকভাবে। শ্মশানের সাথে তার (শিব ঠাকুরের) এই অতি প্রাচীন কালের সম্পর্ক আজও বর্তমান। তাই বলা হয় শিব শ্মশানচারী। এর বহু বহু পরবর্তীকালে মানুষ তার শ্মশানচারতার দার্শনিক ব্যাখ্যা দিল – তিনি সুখে-দুঃখে সমদর্শী ও বিগতস্পৃহ।’ – (অশোক রায়/ বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৭৬)।
ধর্মের বিবর্তন
গুহাচিত্র, ইন্দ্রজাল, অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ও ধর্ম : শিকার ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে খাদ্যের অভাব যখন কিছুটা ঘুচলো – তখন জীবনে এলো অবসর। তখন প্রায়-অন্ধকার গুহার গায়ে মানুষ গুহাচিত্র অঙ্কন করলো; চিত্রাঙ্কন করলো পাহাড়ের গায়েও। নৃতত্ত্ববিদেরা মনে করেন এই সমস্ত চিত্রগুলো অঙ্কিত হয়েছিলো ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে। এই ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়াই আদিম মানবের প্রাচীনতম ধর্ম। প্রকৃতির প্রলয়ংকরতা ও বিরূপতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই আদিম মানব অতিপ্রাকৃতের কাছে মাথা নুইয়েছে – ভক্তিতে নয় ভয়ে। খুব সম্ভবত এইসময় থেকেই ‘প্রাগৈতিহাসিক শিবের’ সূচনা। কারণ এখান থেকেই আজকের দেবাদিদেবের কয়েকটা মূল ভাবনার সূত্রপাত। এই ধারণা আরও স্পষ্ট হলো, যখন দেখা গেলো পাহাড়ের গায়ে বা প্রায়ান্ধকার গুহার দেওয়ালের গুহাচিত্র। ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার অনুষঙ্গ হিসাবেই এই সবের সৃষ্টি। যা ছিলো আদিম মানবের প্রাচীনতম ধর্ম। আর এ থেকেই ধীরে ধীরে বিকশিত হয় চিকিৎসাবিদ্যা-ওঝা-গুনিন ইত্যাদি ও ধর্মচেতনা। ‘ভুরখাইমের ‘সোশ্যাল থিওরি’-র মতে ধর্ম মানুষের সমাজবিন্যাস ও জীবনচর্চার সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং আদিবাসীদের সমাজবিন্যাস ও জীবনচর্চার দিকে তাকালে আমরা প্রাচীন মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচরণের খানিকটা হদিস পাব। বর্তমান ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে প্রাধান্য পায় ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। সাধারণত আমরা তাদের ‘জড়োপাসক’ বলি, ‘জড়’ বলতে আমরা চেতনাবিহীন ও প্রাণশক্তি রহিত পদার্থকেই বুঝি। কিন্তু জড়ের কল্পনা আদিবাসী সমাজে নেই। তারা লক্ষ করেছে মানুষ যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন সে নড়াচড়া করে, কথা বলে ও শব্দ করে। কিন্তু মারা গেলে তার এই শক্তি লুপ্ত হয়ে যায়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তখন তারা ভাবে যে মৃত ব্যক্তির প্রিয় অথবা আত্মার সঙ্গে যেসব পদার্থ সংশ্লিষ্ট তার আত্মা সেসব তথাকথিত জড় পদার্থের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তখন তারা সেসব পদার্থের মধ্যে (মৃত ব্যক্তিকে চোখে দেখতে না পেলেও) তার আত্মাকে অশরীরীরূপে কল্পনা করে।’ – (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৭৬-৭)
ভারতবর্ষে নব্যপ্রস্তরযুগীয় ও আদিবাসী ধর্ম : ড. অতুল সুরের বর্ণনায় – ‘নবোপলীয় যুগেই কৃষি ও বয়নের উদ্ভব হয় এবং মানুষ পশুপালন করতে শুরু করে। এ যুগের ধর্মীয় আচার সম্বন্ধে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা নেই। তবে প্রত্ন-প্রস্তর যুগের মানুষের মত তারা ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিত ও মৃতব্যক্তির সমাধির ওপর একখানা লম্বা পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দিত। এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত পাথর আমরা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি প্রভৃতি জেলায় লক্ষ্য করি। সেগুলোকে ‘বীরকাঁড়’ বলা হয়।’ – (ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, পৃষ্ঠা-২৭)। দক্ষিণ ভারতের আদিবাসীদের মধ্যেও এইরকম পাথরের ফলকের ব্যবহার আছে। দেখা যায় নীলগিরিতে কুডুম্বা ও ইরুলা উপজাতির মধ্যে। তারা এই ফলককে ‘বীরকল্লু’ বলে; যার অর্থ – ‘বীরপুরুষদের স্মৃতিফলক’। এককথায়, এগুলো হচ্ছে সমাধির ওপর স্মৃতিফলক। ছোটনাগপুরের হো, মুণ্ডা ও খেরিয়া উপজাতির লোকেরাও এই স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পরবর্তীকালে বাংলায় মানুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর গ্রামের বাইরে যে ‘বৃষকাষ্ঠ’ স্থাপন করা হয়, সেগুলো এরূপ প্রস্তরফলকেরই কাষ্ঠনির্মিত উত্তর-সংস্করণ বলে ড. অতুল সুরের অভিমত। পরবর্তীতে এই বীরকাঁড়, বীরকল্লু বা বৃষকাষ্ঠই বিবর্তিত হলো যূপস্তম্ভে। অশোক রায় বলেন, স্বামী বিবেকানন্দের মতে, এই যূপস্তম্ভই হলো শিবলিঙ্গের সনাতন রূপ।
প্রকৃতির সাথে নারী-পুরুষ সম্পর্কের যোগ : বিবর্তনের ধারায় মানুষ যেদিন প্রাণময় সত্তা থেকে মনোময় সত্তায় উন্নীত হলো, সেই সেদিন থেকেই পশুর সাথে মানুষের পার্থক্য দেখা দিলো। পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝেছে প্রকৃতিতে সমগ্র জীবজগতের মধ্যে মাত্র দুটোই সত্তা – নারী ও পুরুষ। আর এই দুই সত্তার পারস্পরিক মিলনের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টির ধারা বহমান। নিজের জীবনেও সে এই রিপুতাড়নের উদগ্রতা অনুভব করেছে, দেখেছে জীবজগতেও এই সত্য কত সূক্ষ্মভাবে নিঃশব্দে নীরবে কাজ করে চলেছে। হয়তো ‘একইসঙ্গে সে একথাও অনুভব করতে শুরু করেছে যে তার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বিরাজ করছে মূলত দুটো শক্তি, আর এই দুইয়ের উৎসও ওই একই – প্রকৃতি। যার প্রথমটা হলো মাথার উপরে মহাবিচিত্রতায় ভরা সদা পরিবর্তনশীল এক অনন্ত জগৎ, আর অপরটি হল সে নিজে যার উপর অবস্থান করছে – সেই বসুন্ধরা। এই জগতও বহু বিচিত্রতায় পরিপূর্ণ – অনন্ত জিজ্ঞাসায় ঠাসা। একই সাথে সে এ কথাও অনুভব করেছিল যে, তার মাথার উপরের জগৎটা অনেক বেশি শক্তিমান – সদা পরিবর্তনশীল নিত্য সক্রিয় ও অনন্ত ক্রিয়াশীল। তার পরাভবের কাছে নতজানু হয়ে থাকে ধরিত্রী। এই ধরিত্রীর বুকেই বেড়ে উঠেছে তাবৎ জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগৎ, যা তাকে খাদ্য ও শিকার জোগায়। আকাশের রুদ্ররোষের হাত থেকে রক্ষা করে – ঠিক যেন মায়ের মতো। তখনই তার মনে এক ভাবের উদয় হল – দুনিয়াটা কি তার পরিচিত (নারী-পুরুষের) জগতেরই এক মহাবিশাল রূপ? সেখানে সন্তানের মতোই প্রতিদিন প্রতিপালিত হচ্ছে সে নিজে? সৃষ্টি-রক্ষা ও পালনের ত্রিগুণাত্মিকা ধরিত্রী হলেন – মাতৃস্বরূপা? আর আকাশ যে তার পরুষতাগুণের কারণেই হল পুরুষের প্রতীক। … ‘এতদিনের অচেনা জগৎটা এবারে যেন একটু বোধগম্য মনে হল তার কাছে। যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে,… তখন জীবনচক্র চলে সুখে, স্বচ্ছন্দে। মাতা বসুন্ধরা তার সবুজ আঁচল বিছিয়ে সকলকে লালন-পালন করেন একসাথে। কিন্তু যখনই আকাশের হয় ক্রোধ, সে তখন ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত, তুফান ডেকে পৃথিবীকে দলে-মুচড়ে, দাপিয়ে-ঝাঁপিয়ে, লণ্ড-ভণ্ড করে তোলে। গাছ-পালা, মানুষ, পশু-পাখি সকলেই তখন অসহায় – থরহরি কম্পমান। এইরকমই কোনও এক বিপদসংকুল মুহূর্তে, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কার মাথায় যেন খেলে যায় এক কথা। আকুল আবেগে আছড়ে পড়ে আত্মাপ্রস্তরের কাছে – ভক্তিতে নয় – ভয়ে। শুধুমাত্র বাঁচার তাগিদে, জীবনের চরম সংকট মুহূর্তের ত্রাতারূপে আত্মাপ্রস্তর প্রণম্য হল, পূজিত হল – গোষ্ঠী, পরিবার ও নিজের বিভিন্ন শুভাশুভ কামনায়।’ – (অশোক রায়/ বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ)। একই সংকটকালে অনেকের মনেই একথা জেগেছিল কিনা বলার উপায় নেই, কিন্তু যে ঘটনাটা নেহাতই আকস্মিকভাবে ঘটে গেছে তা-ই ক্রমশ প্রথায় পরিণত হয়ে দাঁড়ালো। তখন আর তা দেশ-কালের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকলো না। আত্মাপ্রস্তরের উত্তরণ ঘটলো বিশ্বাত্মা বা পরমাত্মায়। একদা প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর বস্তু ‘উপলখণ্ড’। বিবর্তনের পথে একদিন মানুষের হাতে উঠেছিলো – হাতিয়ার হয়ে – বিশিষ্টতা লাভ করেছিলো – অন্ত্ররূপে; উৎসারিত রুদ্ধ আবেগের ফল্গুধারাস্নাত হয়ে – গোষ্ঠী, সমাজ, পরিবার ও নিজের মঙ্গল কামনায় অথবা প্রকৃতির রুদ্ররোষ আর তার কোপানল থেকে বাঁচার আকুল আকাঙ্ক্ষায় সেই উপলখণ্ডই আবার মহিমান্বিত হলো – আত্মাপ্রস্তররূপে; পূজিত ও প্রণম্য হলো, আর্তত্রাণের গরিমায় – বিশ্বাত্মারূপে। … তারপর মানবসভ্যতার ক্রমসোপান বেয়ে, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে (আকৃতির একটু-আধটু অদল-বদল করে) সর্বত্রই (সিন্ধু থেকে নীলনদ, এমনকী আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যেও) সৃষ্টির বীজরূপে ‘বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং’ সমগ্র মানবজাতির আদি পিতা ও আদি মাতা বা জগৎ পিতা বা জগন্মাতারূপে সর্বজন পূজ্য হল।’ – (অশোক রায়/ বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৭৯)
কৃষিভিত্তিক সমাজে মাতৃতন্ত্র থেকে পিতৃতন্ত্র ও প্রজননকেন্দ্রিক যৌন অনুষ্ঠান : কৃষিভিত্তিক মানবসভ্যতার একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় গোষ্ঠীবদ্ধ যে মানবসমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, সময়ের বিবর্তনে ক্রমে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলো। পুরুষেরা শিকারের সন্ধানে দলবদ্ধভাবে দূর থেকে দূরান্তরে গেলে ঘরে খাদ্যের ভাঁড়ারে টান পড়তো। সন্তানদের ও নিজের খাদ্য-চাহিদা মেটাতে বনের ফল-মধু-ফুল ইত্যাদি সংগ্রহ করেই চলতো খুন্নিবৃত্তি। যখন সেখানেও টান পড়লো, খিদের জ্বালায় নজর পড়লো তৃণভূমিতে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক অবস্থায় গজিয়ে ওঠা শস্যদানার উপর। তা দিয়েই নিজের ও সন্তানের খিদের জ্বালা মিটতো। ক্রমে এই সংগৃহিত শস্যদানা ভিজে মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় শস্য উৎপাদন করা সম্ভব হলো। এরপর তাদের চিন্তাধারায় এলো এক যুগান্তকারী দার্শনিকতা। নিজেদের জীবনে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তো চিরকালই জানা, সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগালো। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থাতেও শস্য উৎপাদন করে, তাই বসুন্ধরাকে মাতৃরূপে কল্পনা করে ভাবতে লাগলো – পুরুষ যদি নারীরূপী ক্ষেত্রকে কর্ষণ করে, তবে অবশ্যই সেখানে শস্য উৎপাদিত হবে। তখন তারা পুরুষের প্রতীক স্বরূপ এক লিঙ্গ যষ্টি বানিয়ে ভূমিকর্ষণ করলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রে নারীকে ‘ক্ষেত্র’ বা ভূমি বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। আর পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ ‘কর্ষণ যষ্টি’ বা ‘খনন যষ্টি’ আজও অনেক আদিম সমাজে ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’ – এই তিনটে শব্দ যে একই ধাতুরূপ থেকে নিষ্পন্ন তা ইতপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। এভাবে মেয়েরাই প্রথম পৃথিবীর বুকে শস্য উৎপাদন করলো এবং ক্রমে পুরুষেরাও কৃষিকর্মে মেয়েদের সহায়ক হলো। কৃষির সাথে প্রজনন প্রক্রিয়ার সম্পর্ক বুঝতে পারার পর কৃষির সাফল্যের জন্য ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া কৃষি সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডে প্রযুক্ত হলো। ফলে নানা ধরনের প্রজনন-কেন্দ্রিক যৌন অনুষ্ঠানের উদ্ভব হতে থাকে। যেমন, নিউ গিনির আদিম অধিবাসীরা এখনও কৃষির সাফল্যের জন্যে কৃষিভূমিতেই মৈথুন-ক্রিয়ায় রত হয়। এটাকে তারা কৃষি সম্পর্কিত একটা অনুষ্ঠান বলেই মনে করে। একেই বলে উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস। আমাদের দেশে সংবৎসর জুড়ে যেসব নানান মেয়েলি ব্রত-অনুষ্ঠানের প্রচলন এখনও গ্রাম-বাংলায় দৃশ্যমান হয় তার প্রায় সবগুলোই এই উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসেরই ক্রমবিবর্তিত পরম্পরা। খুব সম্ভবত এই কারণেই ফসল তোলার পর আদিম মানুষের যে প্রথম ‘নবান্ন’ উৎসব হলো, তা এক যৌন মহোৎসবে পরিণত হলো, আর সেই উৎসবেই জন্ম নিলো – লিঙ্গপূজা ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা বা যোনি-পূজা। নব-প্রস্তর যুগে এভাবেই লিঙ্গপূজার সূচনা হয়, যা পরবর্তীকালে শিব ও শক্তিতে পরিণতি লাভ করে। এভাবেই কৃষির সাথে লিঙ্গ ও যোনির সম্পর্ক অতি প্রাচীনকাল থেকে স্থাপিত হয়, যা আজও শিব ও শক্তি রূপে বহমান।
পরবর্তীতে শিবের বিবর্তন, গণদেবতা হয়ে ওঠা ও প্রতীকীকরণ : নব-প্রস্তর যুগের পর এলো তাম্র-প্রস্তর যুগ। পৃথিবীর সমন্ত প্রাচীন সভ্যতাগুলো এই যুগেরই নিদর্শন। ভারতে তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বা মহেনজোদারো – হরপ্পা সভ্যতা বলে। সিন্ধু সভ্যতাতেও শিব ও শক্তির পূজা যে হতো এই ধারণা এখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেখানে লিঙ্গমূর্তি ও যোনিচিহ্ন আলাদা আলাদাভাবেই পূজিত হয়েছে। একইভাবে আদি শিব ও আদি মাতার মূর্তিও পুজিত হতো। কিন্তু বর্তমানে শিবলিঙ্গকে আমরা যেরূপে দেখি সেই জগৎ পিতা ও জগন্মাতার যুগল প্রতীকের সমন্বয় সাধন করা তখন সম্ভব হয়নি। কেবল তাই নয়, পরবর্তীকালের আর্য সভ্যতাতেও ওই সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়নি। যদিও (আমরা পরে দেখবো) যজুর্বেদের কালে কৃষ্ণ ও শুক্ল যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় ও রুদ্রাধ্যায় পর্বে দেবাদিদেবের দার্শনিক চর্চা চরম শিখরে ওঠে ওই সময়েই তিনি পরমাত্মায় পর্যবসিত হন। কালে বৈদিক সভ্যতা বিবর্তিত হয় পৌরাণিক যুগে এসে। এই সময়েও ওই সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়নি। বরং লিঙ্গরূপে আরও একান্ত বাস্তবানুগ ও বিশাল রূপ পরিগ্রহ করে পরবর্তীকালের রুচির সাপেক্ষে শালীনতার সীমারেখা অতিক্রম করলেও কিন্তু এই সময়েই তিনি (শিব) সামাজিকভাবে সমগ্র ভারতে আমজনতার কাছে গণদেবতারূপে পূর্ণতা লাভ করেন। গুপ্ত যুগের ঠিক শেষে ৬ষ্ঠ শতকে এসে লিঙ্গমূর্তি ও যোনি চিহ্নের প্রতীকীকরণ ও সমন্বয় সাধন করে সনালিকা গৌরীপট্ট সমন্বিত আজকের শিবলিঙ্গরূপ পরিগ্রহ করে। তার এই প্রতীকীকরণ রূপ সমগ্র ভূ-ভারতে এতোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, লিঙ্গ ব্যতীত আজ তার (শিবের) মূর্তি পূজন প্রায় অপসৃতই বলা যায়।
বৈদিক সাহিত্যে শিব ও তার বিকাশ
বৈদিক যুগে শিব, রুদ্র ও তাদের একীভূতকরণ
বৈদিক যুগে শিব ও রুদ্র : বৈদিক যুগের প্রথম স্তরে অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্যের প্রধান ও প্রাচীনতম সাহিত্য ঋগ্বেদে বস্তুত শিবকে পাওয়া যায় না। তার প্রতিরূপ রুদ্রকে ঋগ্বেদের কয়েকটি সূক্তে স্তূয়মান হিসেবে পাওয়া যায়। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের মতে – ‘‘শিব’ শব্দ এই সময়ে কতিপয় বৈদিক দেবতার বিশেষণ রূপে ‘মঙ্গলদায়ক’ অর্থে ব্যবহৃত হত। উত্তর বৈদিক সাহিত্যে যে ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ পদ পাওয়া যায়, সেখানেও এটি পরম ব্রহ্মের বিশেষণ রূপে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিক থেকে শব্দটি এক বিশেষ দেবসত্তাকে বোঝাতে আরম্ভ করে।… কিন্তু রুদ্রই যে পৌরাণিক শিবের আদি বৈদিক প্রতিরূপ সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৫)। আর দীনেশ চন্দ্র সেন-এর ভাষায় বৈদিক রুদ্রের রূপ হলো – ‘বেদের রুদ্রদেব বিনাশের দেবতা, তার জটাজুট অগ্নিশলাকার মতো। তার নৃত্যের নাম – তাণ্ডব; তাতে বিশ্ব বিকম্পিত হয় ও গ্রহরা কক্ষচ্যুত হয়ে ব্যোমপথে বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করে। রুদ্রের নিঃশ্বাসের জ্বালা – জগতের শ্মশান। তার শূলাগ্রে বিদ্ধ হয়ে দিগ্হস্তীরা আর্তনাদ করে ওঠে। তার নেত্রশাসনে চিত্ত-শ্মশানে কামদেব পুড়ে ছাই হয়। তার মুখোচ্চারত প্রণব প্রলয়ের গান – বিনাশের ঝঞ্ঝা। তা জগতকে পুঞ্জীভূত ধুলোয় পরিণত করে। তার বিষাণ-বাদনের তালে তালে চতুর্দশ মৃত্যু নৃত্য করতে থাকে।’ –(বৃহৎ বঙ্গ)।
শিব ও রুদ্রের একীভূতকরণ : ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, ‘পণ্ডিতদের অনুমান – আদিম মানব গোষ্ঠীর মধ্যে গাছ, পাথর, বিভিন্ন জন্তু পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এরূপ কোন ‘জন্’ বা গোষ্ঠী হয়তো লম্বাটে পাথরকে শিব হিসাবে পূজা করতেন, যা পরবর্তী কালে বেদের রুদ্র দেবতার সঙ্গে এক হয়ে গেছেন। ডক্টর জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিঙ্গপূজাকে ‘ট্রাইবাল’দের থেকে আসা বলেই মনে করেন। পরবর্তীকালে প্রত্ন-নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত কয়েকটি শিবলিঙ্গের গায়ে শিবমূর্তি অঙ্কিত করে বা শিবের প্রতীক ত্রিশূল, পরশু ইত্যাদি অঙ্কিত করে উভয়ের ঐক্য বোঝানো হয়েছে। মূর্তি অঙ্কিত লিঙ্গকে বলে মুখলিঙ্গ। এধরনের মুখলিঙ্গ অতি প্রাচীনকালের প্রত্ন-নিদর্শনে তত বেশি পাওয়া যায় না। কাজেই লিঙ্গ-শিব-রুদ্রের মিশ্রণ অপেক্ষাকৃত আধুনিক।’ – (ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-৯)। তার মানে, লিঙ্গের সাথে শিবের সম্বন্ধ যেভাবেই ঘটুক, দেবতা হিসেবে শিবের চরিত্র ও রূপ-কল্পনায় বৈদিক রুদ্রের বৈশিষ্ট্য এক হয়ে মিশে গেছে বলেই পণ্ডিতদের ধারণা।
ঋগ্বেদে রুদ্র
ঋগ্বেদের রুদ্র : এভাবে ঋগ্বেদের রুদ্র পরবর্তীকালের শিবের সঙ্গে অভিন্ন বলে ঘোষিত হলেও তিনি একটি পৃথক ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। আমরা দেখতে পাই, ঋগ্বেদে রুদ্র হলেন অন্তরীক্ষের দেবতা। রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে ঋগ্বেদে মাত্র তিনটি স্বতন্ত্র সূক্ত রয়েছে। তবে দেবতা হিসেবে ঋগ্বেদে তার বিশেষ প্রাধান্য না থাকলেও রুদ্রের পরিকল্পনায় বিবিধ বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কোথাও তিনি উগ্র, ক্রোধপরায়ণ ও পশুর ন্যায় ভয়ঙ্কর, এবং এই রূপেই বিস্তীর্ণ জগতের রক্ষাকর্তা। যেমন – “যে রুদ্র হব্য সম্বলিত আহ্বান দ্বারা আহুত হন, আমি স্তোত্রদ্বারা তাকে অপগত-ক্রোধ করব। কোমলোদর, শোভন আহ্বানবিশিষ্ট বভ্রুবর্ণ ও সুনাসিক রুদ্র আমাদের যেন তার জিঘাংসাবৃত্তির বিষয়ীভূত না করেন। … দৃঢ়াঙ্গ, বহুরূপ, উগ্র ও বভ্রুবর্ণ রুদ্র দীপ্ত হিরণ্ময় অলঙ্কারে শোভিত হচ্ছেন। রুদ্র সমস্ত ভুবনের অধিপতি এবং ভর্তা, তার বল পৃথককৃত হয় না। হে অর্চনার্হ, তুমি ধনুর্বাণধারী; হে অর্চনার্হ, তুমি নানারূপবিশিষ্ট ও পূজনীয় নিষ্ক ধারণ করেছ; হে অর্চনার্হ, তুমি সমস্ত বিস্তীর্ণ জগৎকে রক্ষা করছ, তোমার চেয়ে বেশি বলবান আর কেউ নেই। হে স্তোতা, প্রখ্যাত রথস্থিত, যুবা, পশুর ন্যায় ভয়ঙ্কর ও শত্রুদের বিনাশক, উগ্র রুদ্রকে স্তব কর। হে রুদ্র, আমরা স্তব করলে তুমি আমাদের সুখী কর, তোমার সেনা শত্রুকে বিনাশ করুক।” (ঋক-২/৩৩/৫, ৯-১১)। আবার কোন কোন দৃষ্টান্তে রুদ্রের স্তুতি সুস্পষ্ট আতঙ্কজনিত বলেই প্রতীয়মান হয়। তাই ঋগ্বেদে বারবার এরকম প্রার্থনা উচ্চারত হতে দেখা যায় – “হে রুদ্র, আমাদের মধ্যে বৃদ্ধকে বধ করো না, বালককে বধ করো না, সন্তান জনয়িতাকে বধ করো না, গর্ভস্থ সন্তানকে বধ করো না, আমাদের পিতাকে বধ করো না, মাতাকে বধ করো না, আমাদের শরীরে আঘাত করো না। হে রুদ্র, আমাদের পুত্রকে হিংসা করো না; তার পুত্রকে হিংসা করো না, আমাদের অন্য মানুষকে হিংসা করো না, আমাদের গো ও অশ্ব হিংসা করো না। হে রুদ্র, ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের বীরদের হিংসা করো না, কেননা আমরা হব্য নিয়ে সর্বদাই তোমাকে আহ্বান করি। … হে বীরগণের ক্ষয়কারক, তোমার কৃত গোহত্যা ও মানুষহত্যা দূরে থাকুক, আমরা যেন তোমার দত্ত সুখ পাই। আমাদের সুখী কর, হে দীপ্তিমান রুদ্র, আমাদের পক্ষ হয়ে কথা বলো, তুমি উভয় পৃথিবীর স্বামী, আমাদের সুখ দাও।” (ঋক-১/১১৪/৭, ৮, ১০)।
উদয়চন্দ্রের মতে শিবে রুদ্রের মিশ্রণ ও মন্দের সাথে রুদ্রের সম্পর্ক : এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রণিধানযোগ্য বক্তব্যটি হলো, – ‘লৌকিক শিবের মধ্যে বৈদিক রুদ্র ভাবনা এক সময় মিশে গিয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায় যে বৈদিক রুদ্রই শিবেতে মিশেছেন। প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক মূর্তিকে ঋগ্বেদে রুদ্র বলা হয়েছে। আকাশের বিদ্যুৎ তার হাতের বাণ, ধ্বংসাত্মক মরুতেরা তার পুত্র (মরুৎদের তাই ঋক্ সংহিতায় ‘রুদ্রিয়াসঃ’ বলা হয়েছে। ঋ.সং. ১/৩৮/৭; ১/৬৪/২; ১/১১৪/৬; ২/৩৪/১০ ইত্যাদি মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) শুধু তাই নয় – মহামারী, রোগ, বিষ ইত্যাদি অনিষ্টকারক সব কিছুর সঙ্গেই রুদ্রকে যুক্ত করা হয়েছে। এই দেবতাকে আর্যরা এত ভয় পেতেন যে এনার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, এবং সেজন্য বেদ মন্ত্রকে বিকৃত ভাবে উচ্চারণের বিধানও দেওয়া হয়েছে। লৌকিক ধর্মে গণেশ এবং শনিদেবতা সম্পর্কে এরূপ বিধান পাওয়া যায়। বিঘ্নের দেবতা গণেশকে পুরাণে ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা দ্রষ্টব্য)। শনিকেও একই কারণে ‘বারের ঠাকুর’ বলা হয়। এই সব লৌকিক দেবতাকে লোকে যেমন ভয়ে পূজা করে, তেমনি রুদ্রকেও ভয়ে স্তুতি করা হত। এই কারণেই হয়তো ঋগ্বেদে রুদ্রের স্তুতি অত্যন্ত কম। রুদ্র দেবতা বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে যজুর্বেদে একটা বিরাট স্থান অধিকার করেছেন।’ – (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৩)।
রুদ্রের কল্যাণের দিক : তবে রুদ্রের একটি কল্যাণের দিকও আছে। ঋগ্বেদে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ভিষক রূপে খ্যাত। তাই তিনি শুধুই আতঙ্ক-নিরসনের আশায় নয়, পার্থিব কল্যাণ-কামনায়, বিশেষ করে রোগ-নিরাময়কারক ওষধি প্রভৃতির কামনায়ও স্তুত হয়েছেন। যেমন – “হে রুদ্র, তুমি সুখী হও, আমাদের সুখী কর; তুমি বীরদের ক্ষয়কারী, আমরা নমস্কারের সাথে তোমার পরিচর্যা করি। পিতা মনু যে রোগসমূহ হতে উপশম ও ভয়সমূহ হতে উদ্ধার পেয়েছিলেন, হে রুদ্র, তোমার উপদেশ হতে যেন আমরা তা পাই।… পিতা আশির্বাদ করবার সময় পুত্র যেরূপ তাকে নমস্কার করে, সেরূপ হে রুদ্র, তুমি আসবার সময় আমরা তোমাকে নমস্কার করছি। হে রুদ্র, তুমি বহুধনদাতা এবং সাধুলোকের পালক, আমরা স্তব করলে আমাদের ঔষধ প্রদান কর।… হে মরুৎগণ, তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। … হে রুদ্র, আমরা যেন তোমার দত্ত সুখকর ওষধিদ্বারা শতবর্ষ জীবিত থাকতে পারি। তুমি আমাদের শত্রুগণকে বিনাশ কর, আমার পাপ একেবারে বিদূরিত কর এবং সর্বশরীরব্যাপী ব্যাধিপুঞ্জকে বিদূরিত কর।” (ঋক-১/১১৪/২, ২/৩৩/২, ১২, ১৩)।
রুদ্রের সাথে মরুৎগণের সম্পর্ক : ঋগ্বেদের নানা জায়গায় রুদ্রের সঙ্গে মরুৎগণের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় রুদ্রের সঙ্গে মরুৎগণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মরুৎগণও অন্তরীক্ষের দেবতা, তবে একটি দেবতা নন – একদল দেবতা, এবং সর্বত্রই দল হিসেবে তাদের উল্লেখ। এই কারণে তাদের নামের সঙ্গে ‘গণ’ শব্দ সংযুক্ত। বিভিন্ন সূক্তে রুদ্রকে মরুৎগণের পিতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন – “পশুপালক যেরূপ সায়ংকালে পশুস্বামীদের তাদের পশু ফিরিয়ে দেয়, হে রুদ্র, আমি সেরূপ তোমার স্তোত্র তোমাকে অর্পণ করছি। হে মরুৎগণের পিতা, আমাদের সুখ দান কর, তোমার অনুগ্রহ অতিশয় সুখকর এবং কল্যাণকর, আমরা তোমার ক্ষণ প্রার্থনা করি। … হে মরুৎগণের পিতা (রুদ্র), তোমার প্রদত্ত সুখ আমাদের নিকট আসুক, তুমি সূর্য দর্শন হতে আমাদের পৃথক করো না, আমাদের বীর পুত্রগণ শত্রুদের অভিভূত করুক। হে রুদ্র, আমরা যেন পুত্র পৌত্রাদিতে অনেক হয়ে উঠি। … মধু হতেও অধিক মধুর এ স্তুতি বাক্য মরুৎগণের পিতা রুদ্রের উদ্দেশে উচ্চারত হচ্ছে, এতে (স্তোতার) বৃদ্ধি সাধন হয়। হে মরণরহিত রুদ্র, মনুষ্যদের ভোজনরূপ অন্ন আমাদের প্রদান কর এবং আমাকে আমার পুত্রকে ও তার তনয়কে সুখ দান কর।” (ঋক-১/১১৪/৯, ২/৩৩/১, ১/১১৪/৬)।
রুদ্রাস ও রুদ্রিয় হিসেবে মরুৎগণ : ঋগ্বেদের অন্যত্র রুদ্র-পুত্র অর্থে মরুৎগণকে ‘রুদ্রাসঃ’ বলা হয়েছে এবং কোথাও আবার ‘রুদ্রিয়গণ’ হিসেবে স্তুত হয়েছে। যেমন – “হে শত্রুহিংসক মরুৎগণ, দ্যুলোকে তোমাদের শত্রু নেই, পৃথিবীতেও নেই। হে রুদ্রপুত্রগণ ! তোমরা একত্রিত হও, (শত্রুদের) ধর্ষণার্থে তোমাদের বল শীঘ্র বিস্তৃত হোক। … দীপ্তিমান ও বলবান রুদ্রীয়গণ সত্যই মরুভূমিতেও বায়ুরহিত বৃষ্টি দান করেন। … হে মরুৎগণ, তোমরা যখন পৃশ্নির উধঃ দোহন করেছিলে, যখন স্তুতিকারীর নিন্দুককে হিংসা করেছিলে এবং ত্রিতের শত্রুদের বধ করেছিলে, হে অহিংসনীয় রুদ্রপুত্রগণ, সে সময়ে তোমাদের বিচিত্র ক্ষমতা সকলেই জেনেছিল। (ঋক-১/৩৯/৪, ১/৩৮/৭, ২/৩৪/১০)।
পৃশ্নি মাতার সন্তান মরুৎগণ : আবার ঋগ্বেদের অন্যত্র এই মরুৎগণকে ‘পৃশ্নিমাতরঃ’ অর্থাৎ পৃশ্নি মাতার সন্তান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং কোথাও কোথাও মরুৎগণের মাতা পৃশ্নি উল্লেখও রয়েছে। যেমন – “সমস্ত মরুৎ দেবগণকে সোমপানার্থে আহ্বান করি, তারা উগ্র ও পৃশ্নির সন্তান। (ঋক-১/২৩/১০)। হে সুবর্ণবক্ষ মরুৎগণ, যেহেতু সেচন সমর্থ রুদ্র পৃশ্নির নির্মল উদরে তোমাদের উৎপন্ন করেছেন; অতএব আকাশ যেরূপ নক্ষত্রে শোভিত হয়, তোমরা সেরূপ স্বীয় আভরণে শোভিত হও। তোমরা শত্রভক্ষক ও জলপ্রেরক, তোমরা মেঘস্থ বিদ্যুতের ন্যায় শোভিত হও। (ঋক-২/৩৪/২)। আমি তাদের উৎপত্তিক্রম অনুসন্ধান করায়, জ্ঞানী মরুৎগণ আমাকে এ উত্তর দিয়েছেন; তারা বলেছেন পৃশ্নি তাদের জননী, বলশালী মরুৎগণ বলেছেন অন্নদাতা রুদ্র তাদের জনক। (ঋক-৫/৫২/১৬)। এ সমস্ত মরুৎ এক সময়ে উৎপন্ন, সুতরাং পরস্পর জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠভাব বর্জিত হয়ে ভ্রাতৃভাবে ও সমৃদ্ধি সহকারে বর্ধিত হয়েছেন। নিত্যতরুণ, সৎকর্মের অনুষ্ঠানকারী মরুৎগণের পিতা রুদ্র ও জননী দোহনযোগ্যা পৃশ্নি মরুৎগণের নিমিত্ত দিন সকল অনুকুল করুন। (ঋক-৫/৬০/৫)।”
পৃশ্নি একটি গরুর নাম : ঋগ্বেদ অনুসারে পৃশ্নি একটি গরুর নাম। ফলে মরুৎগণকে ‘গোমাতরঃ’ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন – “আদিত্য পিতা মাতা স্বরূপ দ্যাবাপৃথিবীর পুত্র। তিনি ধীর এবং ফলপ্রদায়ী তিনি স্বীয় প্রজ্ঞাদ্বারা সমস্ত ভূতগণকে প্রকাশ করছেন। তিনি পৃশ্নি ধেনু ও সেচন সমর্থ বৃষকে প্রকাশ করছেন ও দ্যুলোক হতে নির্মল জল দোহন করছেন। (ঋক-১/১৬০/৩)। সোভরি ঋষিগণের শব্দদ্বারা হিরণ্ময় রথের মধ্যদেশে মরুৎগণের বাণ ব্যক্ত হচ্ছে। গোমাতৃক সুজন্মা, মহানুভব মরুৎগণ আমাদের অন্ন ভোগ ও প্রীতিপ্রদ হোন। (ঋক-৮/২০/৮)।”
মরুৎগণকে গোমাতৃক পরিকল্পনার ব্যাখ্যা : কিন্তু মরুৎগণকে গোমাতৃক জাতীয় পৌরাণিক কল্পনার কারণ কী হতে পারে? ‘পৃশ্নি’ অর্থ হলো নানা বর্ণযুক্ত। তাহলে নানা বর্ণযুক্তা মরুৎগণের এই মাতা কে? বেদ-টীকাকার সায়ণের ভাষ্যে পৃশ্নি অর্থ পৃথিবী। আবার কোথাও তিনি ‘পৃশ্নি’ শব্দের অর্থ শুক্লবর্ণ করেছেন। কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃত অভিধান ‘নিঘণ্টু’ অনুযায়ী পৃশ্নি অর্থে আকাশ। তবে আধুনিক পণ্ডিত গবেষকরা অনুমান করতে চেয়েছেন, বৈদিক কবিরা এখানে আকাশের বৃষ্টিদায়িনী মেঘকে দুগ্ধদায়িনী গরুর সঙ্গে তুলনা করেছেন, অতএব গোমাতৃক অর্থে মরুৎগণ প্রকৃতপক্ষে মেঘতনয় বলেই কল্পিত। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, সুবিশাল ঋগ্বেদ সাহিত্যে বহু কবি বহুভাবে এই দেবতাদের নিয়ে বহু কল্পনা করেছেন; তাই মরুৎগণের উৎপত্তি-প্রসঙ্গে কোন এক অদ্বিতীয় সিদ্ধান্তের সাহায্যে সমস্ত নজিরের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া সুকঠিন। কেননা, এই মরুৎগণই কোথাও ‘সিন্ধু-মাতরঃ’ বলে কল্পিত, আবার বর্ণনা-বিশেষে তারা কোথাও ‘স্বয়ং-উৎপন্ন’ কিংবা কোথাও ‘স্বর্গ-তনয়’ হিসেবেও কল্পিত হয়েছেন। যেমন – “জল প্রেরণকারী মেঘের ন্যায় সিন্ধুমাতার সন্তানেরা (মরুৎগণ) নদী নির্মাণ করেন। বিদীর্ণকারী অস্ত্রশস্ত্রের ন্যায় সকলি তারা ধ্বংস করেন। বৎসল মাতার শিশুদের ন্যায় তারা ক্রীড়া করেন। বহুলোকসমূহের ন্যায় তারা দীপ্তিসহকারে গমন করেন। (ঋক-১০/৭৮/৬)। স্বয়ং-উৎপন্ন, স্বাধীনবল, কম্পনশীল মরুৎগণ যে মূর্তিমান হয়ে অন্ন ও স্বর্গের জন্য প্রাদুর্ভূত হচ্ছেন। অসংখ্য এবং প্রশংসনীয় ধেনু যেরূপ দুগ্ধদান করে, জলোর্মির ন্যায় তারা সেরূপ হয়ে জলদান করেন। (ঋক-১/১৬৮/২)। এ মরুৎগণ পূর্বে মনুষ্য ছিলেন, পুণ্যদ্বারা দেবতা হয়েছেন, এরা শরীর শোভার্থে অলঙ্কার ধারণ করেন। বিস্তর সৈন্য একত্র হয়েও মরুৎগণকে অতিক্রম করতে পারে না। আমরা এখনও স্তব করি নি বলে এ সকল দ্যুলোকের পুত্রগণ অর্থাৎ মরুৎগণ এখনও দেখা দেন নি, মহাবল পরাক্রান্ত এ সকল অদিতি সন্তানগণ এখনও বৃদ্ধিযুক্ত হন নি। (ঋক-১০/৭৭/২)।”
রুদ্র ও শিব উভয়ের সাথেই গরুর সম্পর্ক : তবে বৈদিক কবিদের এই কল্পনা যত বিচিত্রই হোক না কেন, রুদ্রের সাথে গরু বা গো-মাতার সম্পর্ক এবং পরবর্তীকালের শিব-কল্পনায় শিবের বাহন বা লাঞ্ছন হিসেবে যে গরু তথা বৃষ বা বলীবর্দের উপস্থিতি রয়েছে, কিংবা শিবের অন্যতম প্রধান অনুচর নন্দী যে মূলত বৃষ-কল্পনা সেটিও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। কেননা, বৃষের সঙ্গে শিবের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন। এক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যোগী শিবের মূর্তির সঙ্গে বৃষমূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া ঋগ্বেদের একাধিক মন্ত্রেও বৃষের সঙ্গে রুদ্রের যে সম্পর্কের কথা পাওয়া যায়, কয়েকটি ক্ষেত্রে রুদ্রকেই বলা হয়েছে বৃষভ। যেমন – “আমি প্রার্থনা করছি, অভীষ্টবর্ষী (বৃষভ) মরুৎবিশিষ্ট রুদ্র আমাকে দীপ্ত অন্নদ্বারা তৃপ্ত করুন। রৌদ্রতপ্ত ব্যক্তি যেরূপ ছায়া লাভ করে, আমি সেরূপ পাপশূন্য হয়ে রুদ্রদত্ত সুখ লাভ করব এবং রুদ্রের পরিচর্যা করব।” (ঋগ্বেদ-সংহিতা-২/৩৩/৬)। এখানে বৃষভ-এর বেদার্থে অভীষ্টবর্ষী বলা হয়েছে। এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, – ‘কাম্যবস্তুর বর্ষক হিসাবে বৃষভ শব্দটিকে টীকাকারেরা ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে মনে করেন যে রুদ্রের বৃষভ বা ষাঁড় রূপের কথাই এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে। দেবতাদের পশুরূপ কল্পনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। হয়তো এর মধ্যে টোটেম বিশ্বাস বা অন্য কোন প্রকার বিশ্বাসের কথাও লুকিয়ে আছে। পরবর্তী কালের ইতিহাসে পূজিত পশুরা বিভিন্ন দেবতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন এবং তাদের বাহনে পর্যবসিত হয়েছেন। বৃষভও এভাবেই শিবের বাহনে পরিণত হয়েছেন অনেক পরে।’ এছাড়া দেবতার বাহনদের বিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, – ‘প্রসঙ্গত বলা চলতে পারে যে শতপথ ব্রাহ্মণ ইত্যাদি গ্রন্থে রুদ্রের পশু হিসাবে আখু বা ইঁদুরের উল্লেখ আছে। এই পশুটি ছেদনের প্রতীক বা ধ্বংসের প্রতীক। শিবের পুত্র হিসাবে পরবর্তী পুরাণাদি সাহিত্যে গণেশ এই বাহনকে লাভ করেছিলেন।’ – (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-৯)।
যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে রুদ্রের চরিত্রের বিকাশ
তৈত্তিরীয়-সংহিতায় : ঋগ্বেদের পর যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় নামক অংশে (যেখানে রুদ্রের শতনাম কীর্তিত আছে) তার চরিত্রের প্রভূত বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এই নামগুলোর মধ্যে কয়েকটি তার উগ্র রূপ ব্যঞ্জনা করে, কয়েকটি আবার তার মঙ্গলময় সত্তার দ্যোতক। এই দুই রূপ তার ঘোর ও শিব বা শান্ত তনু। যেমন, কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয়-সংহিতার চতুর্থ কাণ্ডের পঞ্চম প্রপাঠকের প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে – “হে রুদ্র, তোমার কোপকে নমস্কার করি, তোমার বাণকে নমস্কার করি এবং তোমার ধনুর্বাণ যুক্ত বাহুযুগলকে নমস্কার করি। এগুলো শত্রুর প্রতি প্রবৃত্ত হোক, আমার প্রতি নয়। হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময় ইষু আছে, তোমার যে কল্যাণপ্রদ ধনু আছে, এবং যে শান্ত ইষুধি আছে, তাদের দ্বারা আমাদের সুখী কর। হে রুদ্র, তোমার অনুগ্রহকারিণী তনু, আমাদের প্রতি যেন ঘোর রূপ না হয়। হে গিরিশ, তোমার সুখকর রূপ আমাদের কাছে প্রকাশ কর। হে গিরিশ, যে বাণ শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য হস্তে ধারণ করেছ, হে কৈলাস-গিরির পালক রুদ্র, তোমার সে বাণ আমাদের প্রতি শান্ত কর, তোমার বাণ আমাদের পুত্রাদি ও পশুদের যেন হিংসা না করে। হে গিরিশ, তোমাকে পাবার জন্য আমরা মঙ্গলকর স্তূতিরূপ বাক্যের দ্বারা প্রার্থনা করছি, যাতে সকল মানুষ ও গব্যাদি পশু রোগরহিত হয়ে শোভন মন লাভ করে। হে রুদ্র, সকলের ভেতর আমাকে অধিক বল। তুমি দেবতাদের মধ্যে মুখ্য ও তাদের পালনে সক্ষম। ধ্যান মাত্রে সকলের রোগের উপশম কর জন্য তুমি চিকিৎসক। তুমি সর্প, ব্যাঘ্র ও রাক্ষস জাতিদের বিনাশক। আদিত্যরূপ রুদ্র উদয়কালে অত্যন্ত রক্তবর্ণ, উদয়ের পরে নানা বর্ণে অন্ধকারাদির নিবর্তক রূপে অত্যন্ত মঙ্গলরূপ রুদ্রের সহস্র সংখ্যক রশ্মি পূর্বাদি দিকে বিস্তৃত হয়েছে, সে রশ্মিরূপ রুদ্রগণের ক্রোধ-সদৃশ তীক্ষ্ণত্ব ভক্তি ও নমস্কারের দ্বারা আমরা নিবারণ করব। যে রুদ্র কালকূট বিষ ধারণে নীলগ্রীব; সে রুদ্র লোহিত বর্ণরূপে মণ্ডলবর্তী হয়ে উদয় ও অস্ত সম্পন্ন করছেন, সে রুদ্রকে গোপগণ, জল আহরণকারিণী গ্রাম্য রমণীগণ এবং গো-মহিষাদি সকল প্রাণী দর্শন করে। সকলের দর্শন দেবার জন্য রুদ্রদেব আদিত্য মূর্তি ধারণ করেছেন, তার কৈলাসবর্তী রুদ্ররূপ বেদশাস্ত্রে অভিজ্ঞজন দেখে থাকে। সে রুদ্র আমাদের দর্শন দানে সুখী করুন। সে নীলগ্রীব, সহস্রাক্ষ, বৃষ্টিকর্তা রুদ্রকে নমস্কার করছি। এ রুদ্রের দ্বারা ভৃত্য তাদের সকলকে নমস্কার করছি। হে ভগবান রুদ্র, ধনুর্ধারী তোমার ধনুর জ্যা খুলে ফেলে ও তীক্ষ্ণ বাণের ফলাগুলো ইষুধির মধ্যে রেখে আমাদের প্রতি অনুগ্রহপূর্বক শান্ত হও।” (তৈত্তিরীয়-সংহিতা-৪/৫/১)।
বাজসনেয়ী-সংহিতায় : অন্যদিকে রুদ্রের শতনাম কীর্তিত শুক্লযজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী-সংহিতার রুদ্রাধ্যায় নামক ষোড়শ অধ্যায়ে নিম্নোক্ত (১৬/১-৫) মন্ত্রে বলা হয়েছে – “হে দুঃখনাশক জ্ঞানপ্রদ রুদ্র, তোমার ক্রোধের উদ্দেশে নমস্কার, তোমার বাণ ও বাহুযুগলকে নমস্কার করি। হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময়, সৌম্য, পুণ্যপ্রদ শরীর আছে, হে গিরিশ, সে সুখতম শরীরের দ্বারা আমাদের দিকে তাকাও। হে গিরিশ, শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য তুমি হস্তে যে বাণ ধারণ করেছ, হে প্রাণিগণের ত্রাতা, তা কল্যাণকর কর, পুরুষ ও জগতের হিংসা করো না। হে গিরিশ, মঙ্গলময় স্তুতি বাক্যে তোমায় পাবার জন্য প্রার্থনা জানাই যাতে জগতের সকলে নীরোগ ও শোভনমনস্ক হয়। হে অধিকবদনশীল, আমায় সর্বাধিক বল, তুমি সকলের পূজ্য ও স্মরণমাত্র দেবগণের হিতকারী ভিষক। হে রুদ্র, সকল সর্প ব্যাঘ্রাদি বিনাশ করে অধোগমনশীল রাক্ষসীদের দূর করে দাও।” বাজসনেয়ী সংহিতার শতরুদ্রীয় ১৬ অধ্যায়ের অন্য মন্ত্রগুলো বাহুল্য বিবেচনায় উদ্ধৃত করা হয়নি। তবে এই শতরুদ্রীয় অধ্যায় বর্তমান আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, পরবর্তীকালের পৌরাণিক যুগের দেহী শিবের কল্পনায় যেসব বিচিত্র পৌরাণিক কাহিনীর পরস্পর সমন্বয় ঘটেছে সেগুলোর কল্পবীজ যে যজুর্বেদের এসব মন্ত্রের মধ্যে উপ্ত ছিলো তা বোধকরি বলা বাহুল্য হবে না। বেদের রুদ্র যেমন ব্যাধি, মৃত্যু ও অমঙ্গলের কারক, তাকে তুষ্ট করলে তিনি সেগুলোর প্রতিকারও করেন।
গর্জনকারী, অন্ধকার বিজারণকারী ও রোদনকারী রুদ্র : ড. উদয়চন্দ্রের ভাষ্যে – ‘রুদ্র দেবতার নামকরণ প্রসঙ্গে বেদ ও বেদাঙ্গে নানা প্রকার কল্পনা করা হয়েছে। বাজসনেয় সংহিতায় তার সম্বন্ধে – ‘উচ্চৈঃ ঘোষঃ’ (১৬/১৯) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যাস্ক এখানে থেকেই অনুমান করেন যে গর্জনকারী হলেন রুদ্র – ‘রুদ্রো রৌরীতি সত’ (নিরুক্ত ১০/৫)। বেদ ব্যাখ্যাকার সায়ণাচার্য অন্যভাবে রুদ্রকে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে যিনি অনন্তকাল সকলকে কাঁদান তিনিই রুদ্র – ‘রোদয়তি সর্বমন্তকালে ইতি রুদ্রঃ’ (১/৪৩/১ ঋক্ভাষ্য)। যিনি শত্রুদের কাঁদান তিনি রুদ্র – ‘রুৎ সংসারাখ্যং দুঃখং তং দ্রাবয়তি অপগময়তি বিনাশয়তি ইতি রুদ্রঃ’ (১/১১৪/১ ঋক্ভাষ্য)। দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে রুদ্র শব্দকে নির্বাচন করার চেষ্টা সায়ণভাষ্যে পরিলক্ষিত হয় – ‘রুৎ শব্দাত্মিকা বাণী তৎপ্রতিপাদ্যা আত্মবিদ্যা বা তমুপাসকেভ্যো রাতি দদাতি ইতি রুদ্রঃ’ (১/১১৪/১ ঋক্ভাষ্য।) অর্থাৎ রুৎ শব্দের অর্থ শব্দাত্মিকা বাণী বা আত্মবিদ্যা; যিনি উপাসকদের সেই আত্মবিদ্যা দেন তিনিই রুদ্র। ঐ মন্ত্রেরই ভাষ্যে রুদ্র শব্দের আর একটি নির্বচনে বলা হয়েছে – যা আবৃত করে, সেই অন্ধকার হল রুৎ; সেই রুৎ বা অন্ধকারকে বিজারণকারী হলেন রুদ্র (রুণদ্ধি আবৃনোতি ইতি রুৎ অন্ধকারাদি। তৎ দৃণাতি বিদারয়তি ইতি রুদ্রঃ)। এই মতটি তান্ত্রিক বেদভাষ্যকার মহীধরের ভাষ্যের প্রতিধ্বনি। বাজসনেয়ী সংহিতার ১৬/১ মন্ত্রের ভাষ্যে মহীধর রুদ্র সম্পর্কে বলেছেন – ‘বরণৎ রুৎ জ্ঞানং রাতি দদাতি রুদ্রঃ। অথবা পাপিনো নরান্ দুঃখভোগেন রোদয়তি রুদ্রঃ’। রুদ্র নিজে রোদন করেন বলেই তার এরূপ নামকরণ হয়েছিল বলে সায়ণ ১/১১৪/১ ঋক্-মন্ত্রের ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন এবং সেই সংক্রান্ত একটি আখ্যায়িকার কথাও বলেছেন।’ – (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৪)
অথর্ববেদে রুদ্র : অথর্ববেদে রুদ্রের কয়েকটি নাম পাওয়া যায় যথা – রুদ্র, শর্ব, উগ্র, ভব, পশুপতি, মহাদেব ও ঈশান। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের বর্ণনায় – ‘প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে মহাভারতেও রুদ্র-শিব দেবতার দুই তনুর কথা একটি শ্লোকে বলা হয়েছে – দ্বে তনূ তস্য দেবস্য ব্রাহ্মণাঃ বেদজ্ঞাঃ বিদুঃ। ঘোরামন্যাং শিবামন্যাং…। অথর্ববেদে রুদ্র দেবতার সাত মুখ্য নাম যথা – রুদ্র, শর্ব, উগ্র, ভব, পশুপতি, মহাদেব এবং ঈশান; দেবতা এই সাতটি নামে বিভিন্ন দিকের প্রাণিগণের সংরক্ষক। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ভব নামধারী দেবতা পূর্বদিকের মধ্যভাগে স্থিত আর্যগোষ্ঠী হতে বহিষ্কৃত ব্রাত্যদেরকে রক্ষা করে থাকেন। শতপথ ব্রাহ্মণে রুদ্র ঊষাদেবীর পুত্র বলে বর্ণিত হয়েছেন এবং প্রজাপতি এক এক করে তাকে আটটি নাম প্রদান করেন। অথর্ববেদোক্ত সাতটি নামের সাথে অশনি (বজ্র) নাম যোগ করে তালিকার সংখ্যা পূরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে রুদ্র, শর্ব, উগ্র ও অশনি দেবতার ঘোর রূপ এবং বাকী কয়টি যথা ভব, পশুপতি, মহাদেব এবং ঈশান তার মঙ্গলময় রূপ ব্যঞ্জনা করে। শতপথ ব্রাহ্মণের কয়েকটি অংশে রুদ্রকে অগ্নির আর এক রূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্বোক্ত আট নাম অগ্নির এবং এই বিভিন্ন নামে দেবতা ভিন্ন ভিন্ন দেশে পরিচিত ছিলেন। পূর্বদেশের লোকেরা তাকে শর্ব নামে এবং বাহীকেরা তাকে ভব নামে অভিহিত করত। রুদ্র সম্বন্ধে এই সকল এবং অন্যান্য শাস্ত্রীয় প্রমাণ আলোচনা করে এটি অনুমান করা যায় যে এই দেবতার পূর্ণ রূপায়ণে বিভিন্ন সমগোষ্ঠীয় দেবসত্তার সাথে এর সংমিশ্রণ বিশেষ কার্যকরী হয়েছিল।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৬)। ‘ঐতরেয়, শতপথ, তাণ্ড্য এবং গোপথ ব্রাহ্মণে প্রজাপতির অগম্যাগমনের জন্য রুদ্রকে তার শাস্তিদাতা-রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। শাংখ্যায়ন, কৌষীতকি প্রভৃতি ব্রাহ্মণেও রুদ্রের বিভিন্ন নামের উল্লেখ আছে।’ – (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১৯৯)
প্রসন্ন মূর্তি, শরীরী সত্তা, ক্রোধ থেকে উদ্ভব, ইন্দ্র-অগ্নির সাথে একীভূতকরণ, দেবতাদের সম্মিলিত রূপ : এক্ষেত্রে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিঙ্গ পুরাণের ভূমিকায় (পৃষ্ঠা-১৪-৫) বলছেন, – ‘ঋগ্বেদে বিশেষত যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় রুদ্রের একটি প্রসন্ন মূর্তির পরিচয়ও পাওয়া যায়। ঋক্-সংহিতার ১/৪৩/১, ১/১১৪/৫, ২/৩৩/২, ৫/৪২/১১ ইত্যাদি মন্ত্রের বিভিন্ন বিশেষণ এক্ষেত্রে স্মরণীয়। বেদের বিভিন্ন বিশেষণ পর্যালোচনা করলে রুদ্রের একটি শরীরী সত্ত্বার পরিচয়ও পাওয়া যায়। ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি দেবতার সঙ্গে কোথাও কোথাও রুদ্রকে এক করে দেখাবার চেষ্টা থেকে এবং পরবর্তী পুরাণগুলোতে উল্লিখিত শিবের শতনাম, সহস্র নাম ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে এই দেবতার আড়ালে অনেক লৌকিক ও বৈদিক দেবতা একাত্ম হয়ে গেছেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে বেদেই সহস্র সহস্র রুদ্রের কথা আমরা পাই। … ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩/৩/৯, শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/৪/১-৪ প্রভৃতি অংশে কথিত রুদ্রোৎপত্তির কাহিনী এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের স্মৃতিতে আসে। প্রজাপতি পশুরূপে নিজের কন্যাকে ধর্ষণ করলে দেবতারা রেগে গেলেন এবং তাদের সম্মিলিত ক্রোধ থেকেই রুদ্রের আবির্ভাব হল। রুদ্র বাণাঘাতে প্রজাপতিকে বধ করলেন। (পরবর্তী পুরাণগুলোতে এই কাহিনীকে একটু ভিন্ন ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে শিবের ক্রোধ থেকে উৎপন্ন হয়ে বীরভদ্র দক্ষ প্রজাপতিকে বধ করেছেন)। সমস্ত দেবতার তেজ থেকে সম্মিলিত ভাবেই যে কাত্যায়নী দেবীর এভাবেই উৎপত্তি ঘটেছিল তা মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে প্রথম অধ্যায়ে বলা আছে। গীতার একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপও সমস্ত দেবতার সম্মিলিত রূপ। এভাবেই সমস্ত দেবতাকে মিলিয়ে দিয়ে একটা বিশ্বদেব কল্পনার প্রক্রিয়া বৈদিক যুগ থেকে শুরু হয়ে পৌরাণিক যুগ হয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত যে সক্রিয় ছিল তাতে সন্দেহ নেই। … বিভিন্ন দেবতাকে একের মধ্যে মিশিয়ে দেবার প্রক্রিয়া যে কেবল মাত্র শৈব কাল্টেই ঘটেছিল এমন নয়, বৈষ্ণব ও শাক্ত কাল্টেও একই প্রকার প্রক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করি। ভয়ংকর রুদ্রের প্রসন্ন মূর্তির কথা এবং অঘোর সৌম্য তনুর কথা বাজসনেয়ী সংহিতায় আছে (১৬/২)। এখানেই রুদ্রের শিবতর রূপের কথা আছে এবং দক্ষিণ মুখের কথা আছে। রুদ্রাধ্যায়ে রুদ্রকে ‘ক্ষেম্য’ (১৬/৩৩) বা সমস্ত কুশলের মধ্যে বিদ্যমান বলা হয়েছে। রুদ্রাধ্যায়ে উক্ত ১৬/৪০ মন্ত্রের ‘তার’ নামটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উবট এবং মহীধর প্রায় একই প্রকার কথা বলেছেন – সংসার থেকে তরিয়ে দেন বলেই তিনি ‘তার’। এই প্রসঙ্গেই পাঠকের তারক বা তারকেশ্বর নামটি স্মরণে আসতে পারে। রুদ্রের শিবময় তনুর অনেকগুলো রূপের কথাই বাজসনেয়ী সংহিতার নিম্নোক্ত মন্ত্রে পাওয়া যায় – ‘নমঃ শংভবায় চ ময়োভবায় চ নমঃ শংকরায় চ ময়স্করায় চ নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।’ (বাজসনেয়ী-সংহিতা-১৬/৪১)
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উগ্র রুদ্র, ধীরে ধীরে মঙ্গলময়, যজুর্বেদে আশুতোষ: ঐতরেয় ব্রাহ্মণে – রুদ্র অত্যন্ত উগ্রস্বভাব এবং দুর্ধর্ষ, তার নাম উচ্চারণ করাও বিপজ্জনক। রুদ্র কথাটা রুদ্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন যার অর্থ রোদন। রোদন করেন বা অন্তিমকালে রোদন করান, ভগিনী অম্বিকা তার ধ্বংসকার্যের সহায়িকা। তিনি রীবগণকে ধ্বংস করেন বলে – ক্ষয়দ্বীয়। হাতে বজ্র তাই – বজ্রবাহু। এহেন মহাশক্তিমান দেবতার কোপানল থেকে বাঁচার তাগিদে মানুষ কাতর মিনতি জানাতো – তবে ভক্তিতে নয়, ভয়ে। কিন্তু মানুষের মন বুঝি এতে ভরে না। সে এই অমিত শক্তিধরকে চায় – কল্যাণসুন্দর রূপে পেতে। ফলে রুদ্র ধীরে ধীরে জনমানসে বিবর্তিত হন – মঙ্গলময় শিবে। আর পরিশেষে আশুতোষ রূপ পরিগ্রহ করেন যজুর্বেদে এসে। রুদ্রাধ্যায়ের এ মন্ত্রে রুদ্রকে – ‘নমঃ উগ্রায় চ ভীমায় চ’, অর্থাৎ উগ্র ও ভীম এই দুই ভীষণত্ববোধক যেমন বলা হয়েছে, তেমনি আবার মঙ্গলবাচক বিশেষণে প্রণতি জানিয়ে বলা হয়েছে – “শম্ভুকে নমস্কার, সুখভবকে নমস্কার। শঙ্করকে নমস্কার, সুখকরকে নমস্কার। শিবকে নমস্কার, শিবতরকে নমস্কার।” এখানে শম্ভব, ময়োভব, শঙ্কর, ময়ষ্কর ও শিব – প্রতিটা শব্দের একই অর্থ – কল্যাণ সুন্দর মঙ্গলময় রূপ। এ শুধু শিবই নয়। ‘শিবতর’ অর্থাৎ অধিকতার মঙ্গলদায়ক ও কল্যাণজনক। এবং পরবর্তীতে শ্বেতাশ্বতরোপনিষদেও ঋষি প্রার্থনা করেছেন যে – রুদ্রের যে মঙ্গলময় দক্ষিণ মুখ আছে তা যেন তাকে নিত্য পালন করেন – ‘রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্’ (৪/২১)।
রুদ্রের বিভিন্ন রূপ : রুদ্র শব্দটির মধ্যে যেমন ধ্বংসাত্মক তনুটির পরিচয় আছে তেমনি শিব শব্দের মধ্যে মঙ্গলময় সত্তার পরিচয় আছে। রুদ্রের বিভিন্ন রঙ ও রূপের কথা বেদ থেকেই আমরা পাই। – ‘বাজসনেয়ী সংহিতায় (১৬/৬,৭) আদিত্য রূপে রুদ্রের স্তুতি আছে। রুদ্রাধ্যায়ের মতে তিনি সহস্রাক্ষ, আদিত্য, শিপিবিষ্ট, সোম ও সূর্য। তিনি রক্তবর্ণ (১৬/৩৯), পীতবর্ণ (১৬/১৭), কপিলবর্ণ (১৬/৬)। এই স্তবেই তাকে নীললোহিত ও নীলগ্রীব (১৬/৭,৮) বলা হয়েছে। এই বিশেষণটিই পরবর্তী কালে সমুদ্রমন্থনে বিষ পানের ফলে শিবের নীলকণ্ঠ হবার আখ্যানের ভিত্তিভূমি হিসাবে কাজ করেছে। অনুরূপ ভাবে পশুপতি, ত্রিপুরারি (পৌরাণিক ত্রিপুর দহন বৃত্তান্ত দ্রষ্টব্য), ক্ষেত্রপতি (মঙ্গলকাব্যে চাষী শিবের বৃত্তান্ত দ্রষ্টব্য) ইত্যাদি বৈদিক বিশেষণগুলোও পুরাণের গল্পে পল্লবিত হয়ে শৈব পুরাণগুলোতে নতুন মাত্রা এনেছে। এইসব কারণের জন্যই প্রাচীন পুরাণ পরম্পরা বলেছে – ‘ইতিহাস-পুরাণাভ্যাম্ বেদম্ সমুপবৃংহয়েত্’। রুদ্রাধ্যায়ে উক্ত (১৬/১৮) ‘অন্নানাং পতি’ বিশেষণ থেকেই অন্নপূর্ণাপতি শিবের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেছেন।’ – (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৬)
যজুর্বেদের কালে রুদ্র অনার্যদেরও দেবতা : এখানে উল্লেখ্য, – ‘যজুর্বেদের কালে রুদ্র কেবল দ্বিজাতির বা আর্যদেরই দেবতা ছিলেন তা নয়; এই সময় তিনি অনার্য জাতির অন্ত্যজ জাতিরও দেবতা ছিলেন। তাই এই (রুদ্রাধ্যায়) সূক্তে অনেক অনার্য জাতি, অন্ত্যজ ও নীচ বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ঐতিহাসিক তথ্যের দিক দিয়ে এই অধ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনার্য জাতি, দস্যু, পার্বত্য জাতি ও অন্ত্যজ জাতির উপাস্য ও পালক বলে উল্লেখ থাকায় অধিকাংশ পণ্ডিতজন মনে করেন – রুদ্র প্রথমে অনার্য আদিবাসীদের উপাস্য দেবতা ছিলেন; পরবর্তীকালে আর্যরা তাদের থেকে এই দেবতাকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন বলেই ঋগ্বেদ সংহিতায় রুদ্র ছিলেন অন্ত্যজ দেবতা। এরপর আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষণের ফলে অনার্য প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এই দেবতাকে তারা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন – সর্বপূজ্য কল্যাণসুন্দর রূপে। আর এই যজুর্বেদের কালেই তিনি পরমাত্মায় পর্যবসিত হন। কারণ এই সময়ে তিনি শুধুমাত্র সাধু-সজ্জনদেরই আরাধ্য দেবতা ছিলেন তা নয়। তিনি একই সাথে অসাধু, চোর, দস্যু, গাঁটকাটা সিধেল চোর, সশস্ত্র চোর, নিশাচর দস্যু, মানুষ মারা দস্যু, উষ্ণীষধারী দস্যু (পাগড়ি পরা ডাকাত), পার্বত্য দস্যু, ধনুর্বাণধারী দস্যু ও শস্য অপহরণকারী দস্যুদেরও উপাস্য দেবতা ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ছুতোর, কামার, কুমোর, নিষাদ, যাযাবর, বেদে, ব্যাধ ইত্যাদিদেরও দেবতা ও পালক রূপে পূজিত ছিলেন। এমনকী তিনি গো, অশ্ব, কুকুর ইত্যাদি সমস্ত গৃহপালিত পশুদেরও পতি বা পালকরূপে পরিচিত – পশুপতি।’ – (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৩৯)
যজুর্বেদে রুদ্রের নির্গুণ পরমেশ্বরে রূপান্তর ও সূর্যের সাথে একাত্মতা : এভাবেই যজুর্বেদ সংহিতায় রুদ্র সগুণ দেবতার লক্ষণ অতিক্রম করে সর্বপূজ্য নির্গুণ পরমেশ্বরে পর্যবসিত হয়েছেন, যেখানে সমস্ত বিরোধের অবসান, সমস্ত দ্বন্দ্বের ঐক্যসমাবেশ, সমস্ত বৈপরীত্যের সমন্বয়। এই রুদ্রাধ্যায়েই তিনি যাবতীয় দার্শনিক রুপ-লক্ষণ, লাঞ্ছন চিহ্ন ও বিবিধ নামরূপে স্তুত হয়ে পরমেশ্বরে পর্যবসিত হলেন। ‘শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা কাব্য হিসাবেও অপূর্ব। রুদ্রাধ্যায় থেকে বহু দৃষ্টান্তই দেওয়া যায়। এই অধ্যায়ে রুদ্র দেব পশুপতি, শম্ভু, শিব, শংকর, কৃত্তিবাস, গিরিশ, ক্ষিতিকণ্ঠ, নীলগ্রীব, কপর্দী ইত্যাদি নামে স্তুত হয়েছেন। ঋগ্বেদের রুদ্র কেবল বজ্রের দেবতা, কিন্তু যজুর্বেদে তিনি কেবলমাত্র বজ্রই নন সূর্যের সাথেও তার অভিন্নতা দেখানো হয়েছে। তাই সূর্যের উদয় থেকে অস্তকালীন অবস্থার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ অনুযায়ী রুদ্রের এক একটা নাম হয়েছে। উদয় ও অস্তের সময় সূর্যের সহস্র সহস্র রশ্মি বা কিরণ সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়; তাই ঋষি কল্পনায় সূর্যের বিম্বটি মস্তকসদৃশ। আর তার চতুর্দিকে প্রসারিত কিরণমালা – দীর্ঘ জটাজুট সদৃশ। তাই জটার প্রতিশব্দ (কপর্দ) অনুযায়ী রুদ্র হলেন – কপর্দী (রুদ্রাধ্যায় ষষ্ঠ মন্ত্র)। সপ্তম মন্ত্রে তিনি নীলকণ্ঠ। যা অস্তগামী সূর্যের রূপ থেকে এসেছে। ঋষি কবি বলছেন – ‘আদিত্যদেব যখন অস্তাচলে গমন করেন তখন গগনমণ্ডল রঙের মহোৎসবে মাতিয়া ওঠে। স্বর্ণবর্ণ সূর্যবিম্বের চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত গাঢ় সিন্দুরবর্ণে পশ্চিমগগন রক্তিম রাগে রঞ্জিত হয়, কেবল সূর্যবিম্বের মধ্যস্থলে নীল বর্ণ রেখা দৃষ্ট হয়।’ এই মধ্যস্থলই কবি কল্পনায় কণ্ঠদেশ, আর সেই কণ্ঠদেশে নীল রং দেখায় বলেই ওই অবস্থায় সূর্যের নাম – নীলকণ্ঠ বা নীলগ্রীব। তাই ঋষি কবি বন্দনাগীত গাইছেন – ‘ওই যে নীলকণ্ঠ রক্তিমবর্ণ সূর্যরূপী রুদ্রদেব গগনপটে ধীরে ধীরে গমন করছেন, তার অপরূপ রূপে আকৃষ্ট হয়ে গোধূলি লগ্নে মাঠ হতে গোরুর পাল নিয়ে গোষ্ঠে প্রত্যাবর্তন কালে মুগ্ধ হয়ে গোপালেরা তাকে দর্শন করে। গ্রামের ললনাবৃন্দ সায়ংকালে সরোবরের জল নিতে আসিয়া মুগ্ধ হয়ে রুদ্রের এই অতুলনীয় রূপ দেখতে থাকে।’ – (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ)। যজুর্বেদের দুই শাখা – কৃষ্ণ যজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা এবং শুক্ল যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী সংহিতা। কৃষ্ণ যজুর্বেদের পঠন-পাঠন প্রচলন ও চর্চা সাধারণভাবে দেখা যায় দাক্ষিণাত্যে, আর শুক্ল যজুর্বেদের চর্চা সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়েই (উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে)। বাংলার অধিকাংশ যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণই শুক্ল যজুর্বেদীয় গোষ্ঠীর।
অথর্ববেদের যুগে মহাকালের ধারণার মিশ্রণ : অথর্ববেদের যুগ বা তার আগে থেকেই রুদ্র শিবের সঙ্গে মহাকাল সংক্রান্ত একটা ধারা মিশতে থাকে বলে বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা মনে করেন। রুদ্রকে সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা বলা হয়েছে। অথর্ববেদের কালসূক্তে (উনবিংশ কাণ্ডের ষষ্ঠ অনুবাকের অষ্টম ও নবম সূক্ত) আমরা কালের স্রষ্টা রূপের পরিচয় পাই। কালেই সব কিছু উৎপন্ন হয়, আবার কালেই সব বিলীন হয়। যেমন – “সে কালই এ চরাচর সর্ববস্তু উৎপন্ন করেছে (অথবা নিজের উৎপাদিত সকল প্রাণীকে তিনিই সর্বতোভাবে পোষণ করেন)। সে কালই সমস্ত ভুবন ব্যাপ্ত করেছে। সে কালই এ ভুবনের জনক হয়ে পুত্ররূপে অবস্থান করছে। সে সকলের উৎপাদক সর্বগত কাল ছাড়া অন্য উৎকৃষ্ট তেজ আর নেই। কালরূপ পরমাত্মা ঐ দ্যুলোক সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এ পরিদৃশ্যমান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কালই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কালাবচ্ছিন্ন জগৎ আশ্রয় করে আছে। কালরূপ পরমাত্মা এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কালের প্রেরণায় সূর্য তাপ দেয় অর্থাৎ জগৎ প্রকাশ করে। কালের আশ্রয়ে সকল বিশ্ব অবস্থান করছে। কালে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় দর্শন করে (অথবা কালেই চক্ষুষ্মান সর্বেন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাতা স্ব স্ব ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার করে থাকে)। সে কালরূপ পরমাত্মায় জগৎ সৃষ্টির কারণ-রূপ মন অবস্থান করছে। তাতেই সকল জগতের অন্তর্যামী সূত্রাত্মা প্রাণ অবস্থান করছে। অথবা সকল প্রাণীর মন, প্রাণ, নাম সেই কাল-স্বরূপে অবস্থান করছে। বসন্তাদি রূপে আগত সে কালের দ্বারা সকল প্রজাগণ (সৃষ্টি পদার্থ) নিজ নিজ কার্যসিদ্ধির জন্য তুষ্ট হচ্ছে। সে কালরূপ পরমাত্মা সমস্ত স্রষ্টব্য জগতের কামনা করেছিলেন। তার সৃষ্ট এ জগৎ সে কালেই প্রতিষ্ঠিত। সে কালই দেশকালাবচ্ছিন্ন সচ্চিৎ সুখাত্মক পরমার্থতত্ত্ব ব্রহ্মরূপে পরমেষ্ঠীকে (পরম স্থান সত্যলোকে স্থিত চতুর্মুখ ব্রহ্মাকে) পালন করেন। … কালরূপ পরমাত্মাই সৃষ্টির আদিতে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে উৎপন্ন করেছিলেন। সে কালই প্রজা সৃষ্টি করেন। স্বয়ম্ভূ কশ্যপ সকলের দ্রষ্টা অষ্টম সূর্য এবং তার সন্তাপক তেজ সে কাল থেকে উৎপন্ন হয়েছে।” (অথর্ববেদ-১৯/৬/৮/৪-৭,৯,১০)। এবং – “সর্বজগৎকারণ পরমাত্মা থেকে ব্রহ্মাণ্ডের আধাররূপ জল উৎপন্ন হয়েছিল। সেরূপ সে কাল থেকে যজ্ঞাদি কর্ম, কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদি তপস্যা ও পূর্বাদি দিকসকল উৎপন্ন হয়েছিল। প্রেরক কালের দ্বারা সূর্য উদয় লাভ করে এবং আবার কালে বিলীন হয় অর্থাৎ অস্তাগমন করে। কালরূপ পরমাত্মার প্রেরণায় বায়ু প্রবাহিত হয়, তার দ্বারাই মহতী পৃথিবী দৃঢ়রূপে স্থাপিত হয়েছে এবং মহান দ্যুলোক কালরূপ আধারে নিহত আছে। কালরূপ পরমাত্মা থেকে ঋক্, যজুঃ ও সামমন্ত্রগুলো উৎপন্ন হয়েছে। কালই ইন্দ্রাদি দেবগণের জন্য অক্ষয় ভাগরূপে যজ্ঞ (প্রকৃতি-বিকৃতিরূপ সোমযাগ) উৎপন্ন করিয়েছিলেন। বাক্যের ধারক (গায়ক) গন্ধর্বগণ ও অন্তরিক্ষচারণী অপ্সরাগণ কালাধারে অবস্থান করছে। সমস্ত লোকই (সর্বজগৎ ও তদধিবাসী প্রাণিগণ) কালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথর্ববেদ-স্রষ্টা দীপ্যমান পরমাত্মার অঙ্গোদ্ভূত অঙ্গিরা দেব এবং অথর্বা দেব স্বজনক কালেই অবস্থান করছে। ভূলোক, স্বর্গলোক, পুণ্যলোক ও দুঃখরহিত অন্য সকল লোক, স্বকারণ, দেশকালাদির দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন সত্যজ্ঞানানন্তাদিরূপ পরমাত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত করে, (এ সূক্তদ্বয় প্রতিপাদ্য) পরম কাল-দেব সকল স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগৎ ব্যেপে অবস্থান করছেন।” (অথর্ববেদ-১৯/৬/৯/১-৫)। এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বলেন, – ‘বেদের এই মহাকাল তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মহাভারতকার শিব সম্পর্কে বললেন – ‘সকালঃ সোহন্তকঃ মৃত্যুঃ স যমঃ’ (৭/২০১/২০৪)। মহানির্বাণ তন্ত্রেও আদ্যাকালীকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাল শব্দের এই প্রকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে – ‘বেদ ও মহাভারতের সঙ্গে তন্ত্র বা শৈবাগমের মহাকালের হয়তো রূপগত পার্থক্য আছে, হয়তো আর্যেতর কোনো জনের দেবভাবনা থেকে শৈবাগমের কালচিন্তা আসতে পারে, তবে তার ওপর বৈদিক চিন্তার অভিষেক ঘটেনি এমত মনে হয় না।’
ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদের যুগে রুদ্রের বিকাশ
রুদ্রের মহাদেব বা মহেশ্বর হয়ে ওঠা : বেদ-সংহিতার যুগ অর্থাৎ ঋগ্বেদ-যজুর্বেদ-অথর্ববেদ হয়ে রুদ্রের এই ক্রমবিবর্তিত ধারায় ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদের যুগে এসে রুদ্রের অন্যতম নাম মহাদেব হিসেবে বৈদিক দেবগণের মধ্যে হয়তো তার প্রধানতম স্থান সম্বন্ধে ইঙ্গিত প্রদান করে। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ের দশম শ্লোকে তাকে মহেশ্বর না মে অভিহিত করে বলা হয়েছে – তিনি প্রকৃতি রূপ মায়ার অধীশ্বর এবং এই বিশ্বভুবন তারই বিভিন্ন রূপ বা অবয়বের দ্বারা পরিব্যাপ্ত – “প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বরকে মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ।” (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।
রুদ্র থেকে ব্রহ্মভাবনা : বস্তুত, ইতোমধ্যে আমরা যা লক্ষ্য করেছি, রুদ্র ভাবনা ক্রমে একটা বিশাল ব্রহ্ম ভাবনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। অথর্বের ব্রাত্য ধারার মধ্যে দিয়ে উপনিষদে এসে এই ভাবনা পরিপূর্ণভাবে ব্রহ্মবাদে বিলীন হয়। শৈব বেদপন্থী টীকাকারেরা এই ধারার দ্বারা বহুল পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে – আরেকটি ধারা – বেদবিরোধী শৈব ধারার চলার পথ আবার ভিন্ন। বস্তুত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে দেবতা রুদ্র ক্রমশ সর্বপ্রধান দেবতা, এবং একেশ্বর হিসেবে কীর্তিত হতে দেখা যায়। আমরা দেখতে পাই, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে রুদ্রশিব ও ব্রহ্ম এক পর্যায়ে চলে গেছেন। ঋষি বলছেন – “হে রুদ্র, তুমি মৃত্যুঞ্জয়। যে জন্মাদি মৃত্যুভয়ে ভীত সেই তোমার শরণ নেয়। তোমার প্রসন্ন মুখ আমার দিকে ফেরাও এবং নিয়ত আমাকে রক্ষা কর।” (শ্বেতশ্বতর-৪/২১)।
শ্বেতাশ্বতরে রুদ্র এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বর : উপনিষদকারের মতে একমাত্র ঈশ্বর ভগবান রুদ্র ব্যতীত আর কেউ নন। যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতার ১৬/২,৩ ইত্যাদি মন্ত্রকে এখানে শ্বেতাশ্বতরে ৩/৫,৬ মন্ত্ররূপে ব্রহ্মপরত্বে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বেদান্ত মতে ব্রহ্মই যেমন এক এবং সত্য, তেমনি শ্বেতাশ্বতরের মতে রুদ্রই হলেন একতম। এক ও অদ্বিতীয় রুদ্র স্ব-শক্তির সাহায্যে বিশ্ব চরাচর নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনি স্রষ্টা, পালনকর্তা এবং সংহারকর্তা, – প্রলয়কালে তার মধ্যেই সমস্ত ভুবন আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন – “এক সেই পরমেশ্বর কে, যার দ্বিতীয় কেউ নেই ? তিনি হলেন রুদ্র। প্রতি জীব-হৃদয়ে তার অবস্থান – তাই পরমাত্মা। তিনিই তার সেই ঐশ্বরিক শক্তি-বুদ্ধি দিয়ে জগৎকে শাসন করছেন। সেই শক্তির কোন ব্যাখ্যা চলে না। ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করে প্রতিটি মানুষের অন্তরে তিনি অবস্থান করছেন, আবার গোপা অর্থাৎ রক্ষাও করছেন। আবার অন্তিমকালে এলে সংহার-মূর্তিতে তিনিই সব সংহার করছেন।” (শ্বেতাশ্বতর-৩/২)।
শিব রুদ্রের বিশেষণ : এখানে উল্লেখ্য, যোগী সম্প্রদায়ের শ্বেতাশ্বতর ঋষির দ্বারা রচিত এই উপনিষদটি উপনিষদ্ ভাগের শেষ পর্বের রচনা। পুরাণবর্ণিত কল্প ও কল্পযুগের কথা যেমন এখানে আছে, তেমনি যোগাচারের ও যোগসিদ্ধির প্রথমাবস্থার কথাও এখানে বলা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ব্রহ্মের রূপ হিসেবে রুদ্রকে এখানে দেখানো হলেও ‘শিব’ শব্দটি তখনো (শ্বেতাশ্বতর রচনাকালে) রুদ্রের নামে পর্যবসিত হয়নি, তা বরাবরই বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। শ্বেতাশ্বতরে রুদ্রকে নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে, যেমন মহাদেব, মহর্ষি, ভগবান, ঈশ, ঈশান এবং শিব। তবে শেষোক্ত নামটি (শিব) রুদ্রের উপাধি বা বিশেষণ হিসেবেই মাত্র কয়েকটি স্থলে উল্লিখিত হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন – “তিনি সর্বানন – জগতের সব মুখই তার মুখ। জগতের প্রাণীমাত্রেরই মাথা, গলা – তারই শির-গ্রীবা। প্রাণীর ভেতরে সেই গুহা, যার নাম বুদ্ধি, তিনি আছেন সেই গুহায়। সর্বব্যাপী এবং সর্বগত শিবস্বরূপ মঙ্গলময় তিনি ভগবান।” (শ্বেতাশ্বতর-৩/১১)। “ঘিয়ের উপর হালকা সরের মতো একটা সারবস্তু ভেসে থাকে। ঈশ্বর সেই অতি সূক্ষ্ম সারবস্তুর মতো, যিনি বিশ্বের একমাত্র কর্তা, যিনি প্রতিটি জীবকে তার কর্ম অনুসারে প্রাপ্য ফল দান করেন। অন্তরাত্মা হয়ে এই পরমেশ্বর সকলের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন। তিনিই করুণাঘন পরমেশ্বর শিব। সেই পরমেশ্বরকে জানতে পারলে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।” (শ্বেতাশ্বতর-৪/১৬)। “ভাব-গ্রাহ্য তিনি, খ্যাত তিনি অশরীরী বলে; সৃষ্টি-লয়ের কারণ যিনি পঞ্চপ্রাণ দশ-ইন্দ্রিয় এবং মন নিয়ে ষোড়শ কলার স্রষ্টা, সেই মঙ্গলময় (শিব) দেবকে যারা জানেন, তাদের আর দেহাভিমান থাকে না – দেহত্যাগের পর আর দেহও ধারণ করতে হয় না।” (শ্বেতাশ্বতর-৫/১৪)।
ভক্তি ও পূজার পাত্র, ঈশ্বরবাদ, পাতঞ্জল যোগের সাথে মিল : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র এমন ভাবে বর্ণিত হয়েছে যাতে তিনি যে উপনিষদকারের ভক্তি ও পূজার পাত্র ছিলেন তা অনুমান করা যায়। এতে ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক একেশ্বরবাদ এবং প্রাচীনতর গদ্য উপনিষদগুলোর নৈর্ব্যক্তিক ব্রহ্মবাদ একত্র মিলিত হলেও, ঈশ্বরবাদেরই প্রাধান্য সূচিত হয়েছে। ড. উদয়চন্দ্রের বক্তব্য অনুযায়ী, পাতঞ্জল যোগের সঙ্গে কয়েকটি ক্ষেত্রে মিল থাকায় আধুনিক পণ্ডিতেরা শৈব মতাবলম্বী এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদকে যোগোপনিষদগুলোর আদি গ্রন্থ বলে অনুমান করেন।
শ্বেতাশ্বতরের বাইরে শিব নিয়ে ব্রহ্মভাবনা : ডঃ উদয়চন্দ্র আরও বলেন, রুদ্রকে নিয়ে ব্রহ্মভাবনা শ্বেতাশ্বতরেতে ব্যাপক রূপ নিলেও তৈত্তিরীয় আরণ্যক থেকেই এর একটা সূত্র পাওয়া যায় (তৈ. আ. ১০/১৬)। সেখানে রুদ্রকে সর্বভূতাত্মা, বিশ্বাত্মক ও বিশ্বোত্তীর্ণ বলা হয়েছে। বায়বীয় সংহিতার (৪/৭০-১৪১) বিভিন্ন অংশের সঙ্গে শ্বেতাশ্বতরের প্রচণ্ড মিল। শ্বেতাশ্বতরকে সামান্য উল্টেপাল্টে এগুলো লেখা। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের ভাষ্যে, এভাবেই ক্রমশ শিব নামের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আর্যেতর জাতির দ্বারা পূজিত অনুরূপ দেবতার যখন বৈদিক রুদ্রের সাথে মিলন ঘটে তখন মিশ্র দেবতা শিব নামেই পরিচিত হন।
অথর্বাশিরস্ উপনিষদে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ রুদ্র-শিব উপাসনা, বৈদিক ও পৌরাণিক দেবতাদের সাথে একাত্মতা ও ব্রত-অনুষ্ঠান : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র শিবকে কেন্দ্র করে যে একেশ্বরবাদী প্রবণতা দেখা যায়, তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে অনেক পরবর্তীকালে রচিত অথর্বাশিরস্ উপনিষদে। – ‘এতেই সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ রুদ্র-শিব উপাসনার অন্যতম প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে রুদ্র বিভিন্ন বৈদিক দেবতা, যথা ব্রহ্মা প্রজাপতি, অগ্নি, ইন্দ্র, সোম, বরুণ প্রভৃতির সাথে একাত্মীভূত হয়েছেন ত বটেই, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি পৌরাণিক দেবতা, যথা স্কন্দ, বিনায়ক, উমা (কেনোপনিষদে উমার নাম প্রথম পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি মহাকাব্য ও পুরাণের যুগেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন) প্রভৃতিও তার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ বলে গৃহীত হয়েছেন। গ্রন্থকারের মতে সপ্ত লোক, পঞ্চ মহাভূত, অষ্ট গ্রহ (তথাকথিত গ্রহের সংখ্যা আদিতে আট, পরে কেতু এই সংখ্যায় যুক্ত হলে নব গ্রহ পূরণ হয়), কাল, অমৃত প্রভৃতি সবই ইঁহার বিভিন্ন রূপ। তিনি বিশ্বস্রষ্টা ও জগৎপিতা এবং সংহারকর্তা। তার এই রূপ কল্পনায় সুস্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ দেখা না গেলেও রুদ্রোপাসকদের এক বিশেষ ব্রতের কথা এখানে বলা হয়েছে। এর নাম পাশুপত ব্রত, এবং এই ব্রতের অনুষ্ঠানে ‘অগ্নিরিতি ভস্য বায়ুরিতিভস্ম জলমিতি ভস্ম স্থলমিতি ভস্ম ব্যোম ইতি ভস্ম সর্বংহ বৈ ইদং ভস্ম মনঃ এতানি চক্ষুংষি ভস্মানি’ মন্ত্র পাঠ করে উপাসক তার সর্বাঙ্গে ভস্ম স্পর্শ করাইতেন। এই ব্রত পালনের ফলে উপাসক পশুপাশ হতে মুক্ত হতেন (পশুপাশবিমোক্ষণ) এবং ঐশী শক্তির অধিকারী হতেন।’ – (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/ পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৯)
শ্বেতাশ্বতরে শিবের সঙ্গে লিঙ্গ ও যোনির সম্পর্ক ও বিতর্ক : বলা বাহুল্য, শৈব ধর্ম-সম্প্রদায়গুলোর প্রধান দেবতা শিবের আদিম রূপ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করলে বোঝা যায় যে তা মূলত এক কাল্পনিক দেবসত্তাকে অবলম্বন করেই বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু কিভাবে লিঙ্গ ও যোনি প্রতীক পূজা শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো তার ইঙ্গিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ (রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর মহাশয়) মনে করেন। যেমন শ্বেতাশ্বতরে বলা হয়েছে – “প্রকৃতি, আকাশ ইত্যাদি সবকিছু যে কারণ (যোনি) থেকে উৎপন্ন হয়েছে, আবার প্রলয়ের সময় যে কারণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সেই কারণেরও কারণ হলেন মায়ার অতীত পরমানন্দময় এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর। সেই নিয়ন্তা, বরদা, পূজ্য দেবতাকে নিশ্চিতভাবে যে সাধক উপলব্ধি করেছেন, মনের চোখ দিয়ে হৃদয়-আকাশে দেখেছেন তিনি চিরশান্তি লাভ করেছেন।” (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)। “যিনি এক হয়েও বিশ্বের যোনিতে-যোনিতে অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুতে, সমস্ত রূপে, সমস্ত উপাদানে বা উৎপত্তির কারণে কারণ হয়ে আছে, যিনি সৃষ্টির বা কল্পের শুরুতে সর্বজ্ঞ ঋষি কপিলকে উৎপন্ন করে ধর্ম, জ্ঞান, ঐশ্বর্য দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন এবং তার জন্ম-মুহূর্তটিকেও দেখেছিলেন, তিনি জীব বা জীবাত্মা নন – পরমাত্মা, পরমেশ্বর।” (শ্বেতাশ্বতর-৫/২)। তবে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে – ‘এই দুটি শ্লোকেরই প্রথম চরণে ঈশান (শিব) দেবতাকে প্রতি যোনিতে অধিষ্ঠিত থাকার বর্ণনা দেখে ভান্ডারকরের মনে এরকম সংশয় জেগেছিল। কিন্তু এখানে যোনি যে স্ত্রীচিহ্ন অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে মূল কারণ বীজ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্বমূলক প্রমাণও আমাদের এই উক্তি সমর্থন করে। লিঙ্গপ্রতীকের আদিমতম ও কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালের যে সব নিদর্শন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়েছে, এগুলোর কোনওটিতেই লিঙ্গ ও যোনি একত্র করে দেখানো হয়নি। এই দুটি পূজা প্রতীকের একত্র সমাবেশ আমরা গুপ্ত ও তৎপরবর্তী যুগের নিদর্শনগুলোতেই পাই, – তখন এর শিশ্নাকৃতি অনেকাংশে প্রচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং এটি ক্রমশ সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়েছিল। গুপ্তপূর্ব কালের এবং খ্রিস্টপূর্ব যুগের যে সব শিবলিঙ্গ বা তার চিত্র মুদ্রায় বা শিলমোহরে দেখা যায়, সেগুলোতে পরবর্তী কালের যোনিপট্ট দেখতে পাওয়া যায় না, এবং এদেরকে ঊর্ধ্বোত্থিত মুক্তমুখচর্ম পুংলিঙ্গের আকারে রূপায়িত দেখা যায়। গোপীনাথ রাও মহাশয় খ্রিস্টপূর্ব যুগের এরকম একটি পরশু ও মৃগধারী দ্বিভুজ শিবের আকৃতি সংযুক্ত সুদীর্ঘ শিবলিঙ্গ অন্ধ্র প্রদেশের গুডিমল্লম গ্রামে আবিষ্কার করেছিলেন। তা অদ্যাবধি পূজা পাইয়া আসতেছে। এতে কোনও যোনিপীঠ বা যোনিপট্ট নেই।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩৬)।
শ্বেতাশ্বতরের রচয়িতা সাংখ্য দার্শনিক কপিল? : উল্লিখিত স্ত্রোত্রদ্বয়ের একটি পুনরায় উল্লেখ করা যাক – “যিনি এক হয়েও বিশ্বের যোনিতে-যোনিতে অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুতে, সমস্ত রূপে, সমস্ত উপাদানে বা উৎপত্তির কারণে কারণ হয়ে আছে, যিনি সৃষ্টির বা কল্পের শুরুতে সর্বজ্ঞ ঋষি কপিলকে উৎপন্ন করে ধর্ম, জ্ঞান, ঐশ্বর্য দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন এবং তার জন্ম-মুহূর্তটিকেও দেখেছিলেন, তিনি জীব বা জীবাত্মা নন – পরমাত্মা, পরমেশ্বর।” (শ্বেতাশ্বতর-৫/২)। এখানে কৌতুহলের বিষয় হলো, উপনিষদ ঋষি বলছেন, সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি জ্ঞানগর্ভ কপিলকে উৎপন্ন করলেন. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও ভগবান বলেছেন, ঋষিদের মধ্যে কপিল এবং দর্শনের মধ্যে আমি সাংখ্য। তাহলে কি বুঝতে হবে যে, জগৎস্রষ্টা পরমেশ্বরের প্রথম সৃষ্টি সাংখ্যদর্শনের দ্রষ্টা ভগবান কপিল মুনি? আবার এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই অন্যত্র বলা হয়েছে – তার প্রথম সৃষ্টি হিরণ্যগর্ভ। তাহলে কি কপিল বলতে হিরণ্যগর্ভকেই বোঝানো হয়েছে? পণ্ডিতদের মতে এখানে কপিল মুনি নন, স্বয়ং কনকবর্ণ হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মাকেই বোঝানো হয়েছে।
বিদ্বানদের মতে শ্বেতাশ্বতরে লিঙ্গ অর্থ : বিদ্বানেরা বলেন, সাধনার দার্শনিক উপলব্ধিতে লিঙ্গ মানে সূক্ষ্ম শরীরের প্রতীকী রূপ। কেননা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেরই নিম্নোক্ত শ্লোকে সূক্ষ্ম শরীরকে লিঙ্গ শরীর বলা হয়েছে – “আগুনের উৎস কাঠ। অর্থাৎ কাঠের ভেতরেই আগুন আছে। কিন্তু সেই আগুন তখনি দেখা যায় যখন একটি কাঠকে আরেকটি কাঠের সঙ্গে ঘষা হয়। না ঘষলে কি সেই শক্তি কাঠের মধ্যে থাকে না? অবশ্যই থাকে। সেইরকম প্রণবের মধ্যেই আত্মা আছেন। তাই প্রণবের দ্বারা আত্মাকে মনন করলেই তার উপলব্ধি হয়।” (শ্বেতাশ্বতর-১/১৩)। তার মানে, পরমেশ্বর মহেশ্বর সর্বব্যাপ্ত হয়েও সূক্ষ্ম লিঙ্গশরীরে অবস্থান করেন বলে তাকে দেখা যায় না, উপলব্ধির মাধ্যমে তাকে অনুভব করতে হয়। অর্থাৎ লিঙ্গশরীর মানে সূক্ষ্ম শরীর, যা বাস্তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। কিন্তু এই উপলব্ধির জন্য যে উচ্চমার্গের ধ্যান ও গভীর সাধনার প্রয়োজন হয় তার জন্যেও প্রাথমিকভাবে দরকার হয় কোনো বাহ্যিক প্রতীকী মাধ্যম। এই মাধ্যমই কি লিঙ্গপ্রতীক? এ প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন – ‘শিবের সূক্ষ্মমূর্তি হলেও তার বাহ্য প্রতীক হিসাবে শিবলিঙ্গকে পূজা করা হত। এক্ষেত্রে লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন। শিবপূজকরা তাদের দেহে বিশেষ প্রকার তিলকাদি ব্যবহার করতেন। একেও লিঙ্গ বলা হত। পৌরাণিক যুগে ত্রিপুণ্ডক, ত্রিশূল বা লিঙ্গায়েৎ-দের শিবলিঙ্গ ধারণের মতই তখনও শৈবরা বিশেষ চিহ্ন বা লিঙ্গ ধারণ করতেন। পাশুপতসূত্রের – ‘লিঙ্গধারী’ (১/৬) অংশের ব্যাখ্যা কালে কৌণ্ডিন্য বলেন – বর্ণাশ্রমীদের যেমন স্ব স্ব আশ্রমের চিহ্ন থাকে, অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর যেমন দণ্ড, কমণ্ডুল, যজ্ঞোপবীত ইত্যাদি থাকে, তেমনি পশুপতেরাও ভষ্মালেপন, নির্মাল্যধারণ ইত্যাদি লিঙ্গ ব্যবহার করবেন। শিবের চিহ্ন বা লিঙ্গ হিসাবেই তাই শিবলিঙ্গ ধারণ করা হত, কারণ শিবের প্রতীক লিঙ্গ এবং শিব প্রকৃতপক্ষে একই।’ – (ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ)।
মহাকাব্যের শিব ও লিঙ্গ
মহাভারতে শিব ও লিঙ্গের পার্থক্যের নিদর্শন : বস্তুত কখন কিভাবে শিবের প্রতীক লিঙ্গ অর্থাৎ শিশ্ন বা পুং জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক হিসেবে একীভূত হলো তার সন তারিখ সুনির্দিষ্ট উল্লেখ করে বলা এখন আর সম্ভব না হলেও মহাকাব্যের যুগে এসে যে এই একীভূত ধারণা ইতোমধ্যেই দানা বেঁধে ফেলেছে তার সাক্ষ্য মহাভারতে আর অস্পষ্ট নয়। লিঙ্গপুরাণে লিঙ্গমূর্তিতে শিব পূজার কথা যেমন আছে, তেমনি তার অপর বিভিন্ন মূর্তির কথাও আছে। প্রাচীন ভারতে শিব পূজার ব্যাপক প্রচলন থাকলেও লিঙ্গমূর্তিতে তার পূজার প্রচলন উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে হয়তো ততটা ছিলো না। মহাভারতের যুগে মূর্তিতে ও লিঙ্গে উভয় আধারেই শিবপূজা হতো, তবে প্রথমটিই ছিলো ব্যাপক। তার মানে খ্রিস্টপূর্ব কালেই শিব ও লিঙ্গ এই উভয় ধারণার ভিন্ন ভিন্ন উপস্থিতি ছিলো এবং উভয়কে সমন্বিত করার প্রয়াসও অস্পষ্ট নয়। কেননা, লিঙ্গার্চনাকে বিভিন্ন আখ্যানের দ্বারা প্রাধান্য দেবার চেষ্টা মহাভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিলক্ষিত হয়। এজন্য ব্যাসদেব বিভিন্ন প্রকার অর্থবাদের সাহায্য নিয়েছেন। যেমন মহাভারতের একটি আখ্যানে দেখা যায় – দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামা মহাদেবের তপস্যার দ্বারা অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করলেন। আবার কৃষ্ণার্জুনও জন্মান্তরে নরনারায়ণ রূপে তপস্যা করে মহাদেবের বর পান। অথচ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র অর্জুনের কাছে ব্যর্থ হলো কেন? একথা ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করা হলো। উত্তরে ব্যাসদেব জানালেন – কৃষ্ণার্জুন তপস্যাকালে লিঙ্গে শিবার্চনা করতেন এবং অশ্বত্থামা প্রতিমায় অর্চনা করতেন, তাই ‘জন্মকর্মতপো যোগে’ অশ্বত্থামা তাদের মতো হয়েও তাদের সমান ফল পেলেন না। এভাবে লিঙ্গার্চনাকে প্রাধান্য দেবার চেষ্টা মহাভারতের অনেক স্থলেই পরিলক্ষিত হয়। যেমন, দ্রোণপর্বের এক স্থলে বলা হচ্ছে – “ভবকে (শিবকে) সমস্ত বস্তুর মধ্যে অবস্থিত জেনে যিনি লিঙ্গে শিবার্চনা করেন তারই আত্মযোগ এবং শাস্ত্রযোগ শাশ্বত হয়।” (মহাভারত-৭/২০০/৯৩)। ‘লিঙ্গার্চনাকে মহাভারতকার ব্যাসদেব সূক্ষ্ম জ্ঞানীর কর্ম বলে মনে করেছেন এবং মূর্তি পূজাকে অসূক্ষ্ম জ্ঞানীর কর্ম বলেছেন। টীকাকার নীলকণ্ঠ উভয় পূজার দার্শনিক পার্থক্য দেখাতে গিয়ে দক্ষ সংহিতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। তার মতে লিঙ্গপূজক ইন্দ্রিয় এবং বিষয় থেকে মনকে প্রত্যার করে ব্রহ্মস্বরূপ (শিবেতে) নিবিষ্ট করে তন্ময় হন বলে শাশ্বত ব্রহ্মজ্ঞান পান। মূর্তিপূজক তা পান না। দক্ষ প্রজাপতি তাই শিবকে বলেছেন – ‘যা মূর্তয়ঃ সূসূক্ষ্মাস্তে ন মহং যান্তি দর্শনম্’ (মহা-১২/২৮৯/৯৫)। অর্থাৎ তোমার যেসব সুসূক্ষ্মমূর্তি তাদের আমি দর্শন পাই না।’ – (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ)।
স্বতন্ত্র লিঙ্গ ও যোনি ও মহাভারতে লিঙ্গের প্রাধান্যের উল্লেখ : গোড়ার দিকে লিঙ্গ ও যোনি স্বতন্ত্রভাবে পূজিত হতো তা ইতপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা – ‘প্রাক্-গুপ্ত যুগের যে সব শিবলিঙ্গ বা তার চিত্র মুদ্রায় বা সীলে দেখা যায়, সেগুলোতে পরবর্তীকালের যোনিপট্ট অনুপস্থিত। এই যুগের একটি বিশেষ মূর্তির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এই মূর্তিটি অন্ধ্রপ্রদেশের গুড়িমল্লম গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। মূর্তিটি একটি পরশু ও মৃগধারী দ্বিভুজ শিবের। সংশ্লিষ্ট লিঙ্গটি ঊর্ধ্বোত্থিত, মুক্তমুখচর্ম পুরুষাঙ্গের আকারে রূপায়িত। মথুরা ও লক্ষ্ণৌ সংগ্রহশালায় খ্রীষ্টীয় প্রথম তিন শতকের যে সকল যোনিপট্টহীন শিবলিঙ্গ রক্ষিত আছে সেগুলো মুক্তমুখচর্ম পুরুষাঙ্গের পুরোদস্তুর অনুকরণ। উজ্জয়িনীতে প্রাপ্ত খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতকের একটি মুদ্রার একদিকে শিবের মনুষ্য মূর্তি, অপর দিকে তার লিঙ্গ মূর্তি অঙ্কিত আছে। শৈবধর্মে তান্ত্রিক প্রভাবের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গ ও যোনির যুক্তরূপ অধিকতর জনপ্রিয় হয়। … শিবলিঙ্গের সঙ্গে যোনিপট্ট যুক্ত হবার পর লিঙ্গের মুক্তমুখচর্ম ধরনের কিছু পরিবর্তন ঘটে। ক্রমশ পূজাপ্রতীক রূপে লিঙ্গ আশ্চর্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। মহাভারতের অনুশাসনপর্বে দেখা যায় যে উপমন্যু কৃষ্ণের সম্মুখে এই বলে শিবের গুণগান গাইছেন যে শিবই একমাত্র দেবতা যার লিঙ্গ ব্যাপকভাবে পূজিত হয়। পূজাপ্রতীক হিসাবে লিঙ্গ এতদূর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে প্রতি শিবমন্দিরের গর্ভগৃহে প্রধানতম এবং মুখ্য পূজার বস্তু হিসাবে লিঙ্গই অধিষ্ঠিত হয়। শিবের মনুষ্য মূর্তি গৌণ হয়ে ওঠে। ইলোরার কৈলাস মন্দিরের গর্ভগৃহে যে মূল দেবতাটি স্থান পেয়েছেন তিনি হচ্ছেন লিঙ্গ, মনুষ্য মূর্তিগুলোর স্থান অন্যান্য গৌণ স্থানে। একথা ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের ক্ষেত্রেও সত্য।’ – (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১৯৮-৯৯)
বৈদিক যুগে রুদ্রের সাথে শিবের মিশ্রণের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা
প্রসঙ্গক্রমে এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য। স্মরণাতীত কাল থেকেই রুদ্র পূজকদের সাথে যারা রুদ্রকে পূজা করতেন না তাদের একটা সংঘাত ছিলই। কারণ চিরকালই আর্যদের মধ্যে সকলেই বৈদিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। আবার কিছু লোককে বিভিন্ন সময়ে বৈদিক সংস্কৃতি থেকে বহিষ্কার করাও হয়েছিল। এদেরকে বলা হতো ‘বাহীক’ বা ‘ব্রাত্যজন’ (সে যুগে ‘ব্রাত্য’ বলতে বেদবহির্ভূত সমস্ত আর্য-অনার্য মানুষকেই বোঝানো হতো)। ফলে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির প্রয়োজনে এইসব ব্রাত্যজনেরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে যথেচ্ছভাবে মেলামেশা করে এক বেদবহির্ভূত জনগোষ্ঠীর সূচনা করে। যাতে আর্য-অনার্য সকলেরই স্থান ছিল। আর তৎকালীন সমাজে এরা সংখ্যায় নিতান্ত কমও ছিল না। এছাড়া প্রাগার্য সমাজ জীবনে আদি শিবের পূজা ব্যবস্থা ছিল। সেই ধারায় অনার্য সমাজেও শিবের পূজা হতো। কিন্তু বৈদিক আর্যদের রুদ্র পূজন পদ্ধতি অবৈদিক পূজা ব্যবস্থা থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে আর্য সমাজের রুদ্র ব্রাত্য ও অনার্যদের কাছে পূজনীয় ও সম্মানীয় ছিল না; তাই সামাজিক বৈরিতা বশে ব্রাত্য ও অনার্যদের সাথে বৈদিক আর্যদের তীব্র বিরোধ থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক।
এ অবস্থায় প্রাগার্য পূজিত দেবতা আর্য সংস্কৃতিতে কীভাবে ও কেন অনুপ্রবেশ করলো, সে বিষয়টি নিশ্চয়ই কৌতুহলজনক। এ সম্পর্কে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন বলেন, – ‘খুব সম্ভবত আর্যগণ যখন এদেশে আসেন তখন তাদের সাথে নারীর সংখ্যা বেশী ছিল না, তাই তাদের এদেশীয় আর্যপূর্ব জাতির কন্যাগ্রহণে কোন আপত্তি ছিল না। ক্রমে তারা এত শূদ্র কন্যাকে ঘরে নিলেন যে হয়তো নারীদের মধ্যে অধিকাংশই হলেন বেদে অনধিকারিণী শূদ্রা। হয়তো, এইসব শূদ্র কন্যারাও পতিগণের বৈদিক ধর্ম অপেক্ষা পিতৃকুলের প্রাচীন ধর্মই বেশী পছন্দ করতেন। তাই তারা নিজেরাও যাগ-যজ্ঞাদিতে যোগ দিতে বিশেষ উৎসুক ছিলেন না। পরবর্তীকালে এইসব শূদ্র নারী (পত্নীরাই) আর্য সমাজে বৈদিক দেবতার পরিবর্তে অনার্য দেবগণের পূজা প্রবেশ করিয়েছিলেন।’ এখানে শূদ্র নারী বলতে সেন মহাশয় বোধকরি অনার্য নারীকেই বুঝিয়েছেন। কেননা ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিভেদ তথা সমাজ-বিভাঁজনকারী বর্ণাশ্রমের কোনরূপ সাক্ষ্য অন্তত বেদ-সংহিতার যুগে কোথাও পাওয়া যায় না। এটি পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণ্য কায়েমীবাদী ধারণা। তবে বস্তুতই নবাগত আর্যরা যে নারীর অপ্রতুলতায় এদেশের মেয়েদের উপর ভীষণ লোভী ছিলেন তার সাক্ষ্য ঋগ্বেদ-সংহিতায় অপ্রতুল নয়। অন্ন ও বিভিন্ন ধন প্রার্থনার পাশাপাশি স্ত্রী পাওয়ার জন্য ইন্দ্রের কাছে অনবরত প্রার্থনা জানাতো, যেমন – “তিনি আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করুন, তিনি ধন প্রদান করুন, তিনি স্ত্রী প্রদান করুন, তিনি অন্ন নিয়ে আমাদের নিকটে আগমন করুন। (ঋ-১/৫/৩)। হে অশ্ববান ইন্দ্র, তুমি আমাদের সামনে এস এবং আমাদের প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শন করো না; হে বিবিধ ধনদাতা, আমাদের প্রতি অনুকুল হও, কারণ তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর অন্য কিছুই নেই; তুমি পত্নিহীন ব্যক্তিগণকে পত্নী প্রদান করেছ। (ঋ-৫/৩১/২)।” এই অনার্য নারীরা আর্য সমাজে কেবল যে অনার্য দেবগণের পূজা প্রবেশ করিয়েছিলেন তাই নয়, আদিম মানব সমাজে একসময়ে মেয়েরাই যেমন চাষাবাদের প্রবর্তন করেছিলো তেমনি আর্য সমাজে বস্ত্র বয়ন ও কৃষিকার্যের প্রবর্তন ও প্রচলনও করেছে এই অনার্য রমণীরা। বস্ত্রবয়ন সম্পর্কে ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলে বৈদিক আর্যরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে তারা বস্ত্র বয়ন করতে জানে না – “আমি তন্তু অথবা ওতু জানি না, কিম্বা সতত চেষ্টাদ্বারা যে বস্ত্র বয়ন করে তার কিছুই অবগত নই।” (ঋ.স.-৬/৯/২) (যদিও টীকাকার সায়ণ বলেন, এস্থলে তন্তু শব্দদ্বারা বৈদিক ছন্দসমূহ, ওতু শব্দদ্বারা যজুসমূহ ও বাগকার্য এবং উভয়ের সংঘটনদ্বারা বস্ত্র অর্থাৎ যজ্ঞ বুঝতে হবে।)”। এবং – “আমাদের সাধু কর্মফলের চিরপ্রদায়ী উষা ও নক্ত রূপ অগ্নি, বয়নকুশল রমণীদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর সাহায্যার্থে গমনাগমন করে যজ্ঞের রূপ নির্মাণার্থে পরস্পরকে আনুকূল্য করে বিস্তৃত তন্তু বয়ন করছেন। তারা অত্যন্ত ফলপ্রদ এবং উদকবিশিষ্ট।” (ঋক-২/৩/৬) (টীকাকার বলেন যে সেকালে দুজন নারী’তে টানা ও পোড়েন’ সঞ্চালন করে বস্ত্র প্রস্তুত করতো।)”।
এদেশে আসবার আগে আর্যদের আদিম বাসস্থান খুব সম্ভবত ছিল শীতপ্রধান দেশে। সেখানে শরীরকে গরম রাখবার জন্যে তারা মাংসাশী ছিলেন। শিকারই ছিল তাদের প্রধান কিংবা একমাত্র পেশা। হয়তো দেবতার নামে কোনও এক বিশেষ জীবকে উৎসর্গ দিয়ে আরম্ভ করেছিলো – নরমেধ যজ্ঞ। তারপর ক্রমিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতার মধ্যে দিয়ে আরম্ভ হয় অশ্বমেধ, গোমেধ, মেষমেধ ও ছাগমেধ যজ্ঞও। এরপরই তারা ভূমিকর্ষণ করে শস্য উৎপাদনের জ্ঞান লাভ করে। এর সাক্ষ্য হিসেবে ‘শতপথ ব্রাহ্মণের’ প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয়, তৃতীয়, সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে বলিদান সম্বন্ধে এক বিস্ময়কর বর্ণনা পাওয়া যায় বলে অশোক রায় উল্লেখ করেছেন, – ‘প্রথমত, দেবতারা একটি মনুষ্যকে উৎসর্গ করলেন, তার উৎসর্গীকৃত আত্মা অশ্বদেহে প্রবেশ করল। দেবতারা অশ্বকে বলিরূপে উৎসর্গ করলেন; উৎসর্গীকৃত আত্মা বলীবর্দে প্রবেশ করল। বলীবর্দকে উৎসর্গ করা হলে, ওই আত্মা মেষদেহে প্রবিষ্ট হল; মেষ উৎসর্গীকৃত হলে, তা ছাগদেহে প্রবিষ্ট হল। ছাগ উৎসর্গীকৃত হলে, পৃথিবীতে প্রবেশ করল। দেবতারা পৃথিবী খনন করে ধান্য ও যব আকারে ওই আত্মাকে পেলেন। তদবধি সকলে এখনও ধান্যাদি কর্ষণ দ্বারা পেয়ে থাকেন।’ উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, রুদ্র বৈদিক সাহিত্যের শুরুতে, ঋগ্বেদ-সংহিতায়, মাত্র তিনটি সূক্তে স্তুত হয়েছেন। সেই বৈদিক সাহিত্যেরই মধ্য গগনে, কৃষ্ণ ও শুক্ল যজুর্বেদে তিনি রুদ্রাধ্যায় ও শতরুদ্রীয়তে দার্শনিকতার চরমোৎকর্ষতা দিয়ে স্তুত হয়ে পরমাত্মায় পর্যবসিত হয়েছেন। ঋগ্বেদে যিনি অত্যন্ত অপ্রধান দেবতা, তিনিই কেমন করে হয়ে গেলেন পরমাত্মা? বিষয়টির প্রমাণ হিসেবে ক্রমবিবর্তনিক সাহিত্য নিদর্শন ইতোমধ্যেই উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বৈদিক সাহিত্যের আকার-আয়তন প্রকৃতই সাগর সমতুল্য। মানব-সভ্যতার সমান্তরালে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকাল থেকে ক্রমবিকাশের যে সাহিত্য-নিদর্শন তার মধ্যে সুপ্ত ও সংরক্ষিত আছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে তার যথার্থ অনুসন্ধানের মাধ্যমে বহু আপাত অব্যাখ্যেয় প্রশ্নের সন্ধান অসম্ভব নয় বলেই বিদ্বান গবেষকদের অভিমত। লিঙ্গ ও আদিশিব এবং রুদ্রের ধারণার ক্রমবিকাশ ও তাদের একাত্ম হওয়ার ধারাবাহিক পথপরিক্রমার সামান্য কিছু নিদর্শন এখানে উপস্থাপন করা হলেও আরো বহু বিচিত্র নিদর্শন যে এই সাহিত্যের ভাঁজে ভাঁজে অক্ষত ও পূর্ণরূপে লুকিয়ে আছে এ ব্যাপারে বেদজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। যথাযথ অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে সেগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি সামাজিক রূপরেখা অঙ্কন করা মোটেও অসম্ভব নয়।
এটা এখন স্বীকৃত যে, ভারতবর্ষে আগমনের পূর্বে আর্যরা তাদের আদিম বাসভূমি থেকেই ছিলেন প্রকৃতি পূজক। অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশরূপকেই তারা বিভিন্ন দেবতার রূপ-কল্পনায় স্তুতি-বন্দনা করতেন। ভারতবর্ষে এসে যখন তারা পঞ্চনদের অঞ্চলকে তাদের বিজয় অভিযানের পাদমঞ্চ করে এগিয়ে চললেন তখন এদেশ একেবারে জনশূন্য ছিল না। আর্য ও অনার্য এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাগার্য সংস্কৃতি ছিল মোটামুটিভাবে বৈষয়িক সংস্কৃতি, আর আর্যদের ছিল যাজকীয় আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি। প্রাগার্যদের মধ্যেও দেব উপাসনা ও যাজকীয় ব্যাপার ছিল হয়তো, তবে তা আর্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে শুরু হলো বিরোধ ও লড়াই। যেহেতু নবাগত আর্যরা ঘোড়ার ব্যবহার জানতো, যা প্রাগার্যদের কাছে ছিল অপরিচিত, ফলে ক্ষিপ্র গতিময়তার কাছে পরাভূত হতে হলো এদেশের উন্নত সভ্যতায় সভ্য ভূমিপুত্রদের। সর্বস্ব হারিয়ে যারা বেঁচে ছিলেন খাদ্য সংগ্রাহক-যাযাবর-আরণ্যক জীবনে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন তারা। আর্যরা স্ত্রীধনকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করলো। ফলে অনার্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিঃশব্দ অনুপ্রবেশ ঘটলো আর্য সমাজজীবনে। এইসব অনার্য নারীদের সংস্পর্শে-প্রভাবে আর্যরা ধীরে ধীরে সংস্কৃত হলো। সৃষ্টি হতে থাকলো বৈদিক সাহিত্যসম্ভার। যদিও একাজ তারা তাদের আদিম বাসভূমি থেকেই শুরু করেছিলেন, তবুও অনুকূল পরিবেশে, স্থায়ী বসবাসের সুস্থতায় অর্গলমুক্ত হয়ে স্বতস্ফূর্ত নির্ঝরিণীর রূপ নিলো। বলা বাহুল্য, সেই স্ত্রীধন আর্য সমাজ জীবনকে ক্রমশ সংস্কৃত করে তুললেও তাদের সেই অনার্য সংস্কৃতি আর্য সমাজ জীবন ও সংস্কৃতিকে উভয়-সংকটে ফেলে দিলো। কেননা আর্যরা কখনওই মূর্তি পূজক ছিলো না, কিন্তু প্রাগার্য সভ্যতার দেব-দেবীরা বিশেষত তাদের গণ-দেবতা ‘আদি শিব’ অনার্য সমাজজীবনে মূর্তিরূপে ও লিঙ্গ প্রতীকে সর্বদাই পূজিত হতেন। তাকে অস্বীকার করলে একদিকে যেমন নষ্ট হয় গৃহশান্তি, অন্যদিকে বাড়ে জনরোষ। শেষপর্যন্ত যা হলো, প্রকৃতি পূজক আর্যরা প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশরূপের চৈতন্যসত্তাকে বিভিন্ন দেবতারূপে স্তুতি বন্দনা করতেন, সেই প্রকৃতির যে ভয়াল-ভয়ঙ্কর রূপ, যাকে স্তব-স্তুতি করে তুষ্ট করতে না-পারলে সৃষ্টি যায় রসাতলে, তারই অধীশ্বর হলেন রুদ্রদেব। তিনি ভয়ঙ্করের দেবতা, অমিত শক্তির অধিকারী, তিনিই হলেন ‘আদি শিবের’ বৈদিক সমীকরণ। এই সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে হয়তো একটা আপোসরফার আপাত সমাধান হলো। তাই ঋগ্বেদ সংহিতায় দেখা যায় বৈদিক রুদ্র একজন অত্যন্ত অপ্রধান দেবতা। যার উদ্দেশে রচিত হলো মাত্র তিনটি শ্লোক বা সূক্ত, যেখানে ইন্দ্রের নামে রয়েছে অন্তত আড়াইশ সূক্ত।
সময়ের সাথে সাথে বৈদিক সাহিত্য ধীরে ধীরে পল্লবিত হতে থাকে সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদে। কায়িক শ্রম থেকে বিযুক্ত আর্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা ব্যস্ত হয়ে রইলেন সংহিতা ও ব্রাহ্মণের কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদের জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে। ফলে দুই শাখারই ক্রমপুষ্টি হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। এসব চর্চা ছিল অত্যন্ত মুষ্টিমেয় কিছু সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে দেশের যে বিপুল সংখ্যক জনগণ তারা ছিল এসব কিছুর থেকে বাইরে, নিতান্ত অপাঙক্তেয়ের দলে। প্রথম থেকেই যেহেতু বৈদিক আর্যরা অবৈদিক মানুষদেরকে অবজ্ঞার চোখেই দেখতেন, সেই ক্ষোভ ক্রমে পুঞ্জীভূত হয়ে প্রতিবাদে পরিণত হয়। তাছাড়া সেই সময়ে বৈদিক যাগ-যজ্ঞ, ক্রিয়া-কর্মগুলো এতো বিস্তৃত ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছিলো যে তা রাজ-রাজড়া ছাড়া সাধারণ মানুষের সাধ্যের অতীত হয়ে গিয়েছিল। এ তথ্য আমরা যজুর্বেদের শুল্ব সূক্ত থেকে জানতে পারি। ফলে অথর্ববেদে দেখা দেয় বৈদিক যাগ-যজ্ঞের পরিবর্তে আভিচারক ক্রিয়াকর্ম। শুরু হয় তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, বশীকরণ, মারণ, উচাটন, তাবিচ-কবট ও মাদুলি। এভাবে সমাজে আবার জনপ্রিয় হলো ওঝা, গুনিন ইত্যাদিরা। আর এই সবই এলো প্রাগার্য-অনার্য সভ্যতার অতি প্রাচীন ধারা বেয়ে। এতদিন বৈদিক সাহিত্যে যা ছিল একান্তই অবহেলিত ও অপাঙক্তেয় রূপে, তাই-ই আবার সমাজ জীবনে ফিরে এলো নব কলেবর ধারণ করে – সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের বহু কাঙ্ক্ষিত উপায় হয়ে। এছাড়াও সাধারণ মানুষের ধর্ম-কর্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটাতে শুরু হয়ে গেলো – পূজা। যা ব্যয়বহুল যাগ-যজ্ঞের পরিবর্তে সরল অনাড়ম্বর ভক্তি নিবেদনের পদ্ধতি রূপে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। একটু অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে দেখলে তার প্রমাণ আমরা পরবর্তীকালের প্রাচীন সাহিত্য-নিদর্শনেই খুঁজে পেতে পারি।
প্রাচীন সাহিত্যে শিব
পাণিনির অষ্ট্যাধ্যায়ী ও পতঞ্জলির মহাভাষ্যে রুদ্র ও শিব : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের পরবর্তী কালের যে সব সাহিত্যে রুদ্র ও শিবের উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে পাণিনির অষ্ট্যাধ্যায়ী ও পতঞ্জলির মহাভাষ্য প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বলেন – ‘পাণিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের বৈয়াকরণিক, পতঞ্জলি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের।… পাণিনি তার ব্যাকরণগ্রন্থের এক সূত্রে (৪, ১, ৪৯) দেবতার এই কয় নামের কথা বলেছেন, যথা – রুদ্র, ভব, শর্ব এবং মৃড়। এর সবগুলোই আমরা বৈদিক সাহিত্যে পাই (মৃড় নামটি যজুর্বেদোক্ত শতরুদ্রীয় স্তোত্রে রুদ্রের শত নামের অন্যতম)। এই তালিকায় শিবের নাম পাওয়া না গেলেও, আমরা শিবের নাম অপর এক সূত্রে পাই। পাণিনির ‘শিবাদিভ্যোন’ সূত্রে (৪, ১, ১১২) শিবের উল্লেখ রয়েছে। পতঞ্জলি তার মহাভাষ্যে রুদ্র ও শিবের নাম কয়েকবার করেছেন। রুদ্র সম্বন্ধে তিনি দুইবার বলেছেন যে দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি হত; অপর দুই স্থলে রুদ্রের কল্যাণকর ভেষজের কথা বলা হয়েছে (শিবা রুদ্রস্য ভেষজী)। শিবের উল্লেখও তিনি দুইবার করেছেন। পাণিনির সূত্র ‘দেবতাদ্বন্দ্বে চ’ (৬, ৩, ২৬) ও এর কাত্যায়ন কৃত বার্তিক ‘ব্রহ্মপ্রজাপত্যাদীনাং চ’ এর ভাষ্যকালে তিনি দ্বন্দ্ব সমাসের তিনটি উদাহরণ দিয়াছেন, যথা ব্রহ্ম-প্রজাপতি, শিব-বৈশ্রবণৌ এবং স্কন্দ-বিশাখৌ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন যে এরকম দেবতার নাম সম্বলিত দ্বন্দ্ব সমাস বেদে পাওয়া যায় না। এ উক্তি যথার্থ, কারণ প্রজাপতি ব্যতিরেকে অপর দেবতা কয়টি অবৈদিক। মহাভাষ্যকার এই প্রসঙ্গেই শিব, বৈশ্রবণ, স্কন্দ ও বিশাখ দেবতাদেরকে লৌকিক দেবতাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পাণিনির অন্যতম সূত্র ‘জীবিকার্থে চাপণ্যে’ (৫, ৩, ৯৯)-র ভাষ্যকালে পতঞ্জলি স্কন্দ ও বিশাখের মূর্তির সাথে শিবের মূর্তির কথা বলেছেন। পাণিনির আর এক সূত্রের (৫, ২, ৭৬) ব্যাখ্যানে তিনি শিবের ভক্তদেরও উল্লেখ করেছেন।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩০-৩১)
এবং এ বিষয়ে অন্যত্র আলোচনা করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকক্রমে তিনি আবার বলেন, – ‘ভক্তিকেন্দ্রিক ধর্ম-সম্প্রদায়গুলো সাধারণত কোনও বৈদিক দেবতাবিশেষকে আশ্রয় করে আত্মপ্রকাশ করেনি। শিব ও যক্ষনাগাদি লৌকিক দেবতা-গোষ্ঠী বা বাসুদেব-কৃষ্ণ প্রভৃতি মনুষ্যপ্রকৃতি দেবতাদেরকে কেন্দ্র করেই এই সকল উপাসকমণ্ডলী ক্রমশ গঠিত হয়। খৃষ্ঠপূর্ব যুগের প্রসিদ্ধ বৈয়াকরণিক পতঞ্জলি নানাবিধ দেবতাকে প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। তার মহাভাষ্যে পাণিনির অন্যতম সূত্র ‘দেবতাদ্বন্দ্বে চ’ (৬, ৩, ২৬) ব্যাখ্যা করার কালে এই বিভাগ দুটির ‘বৈদিক’ ও ‘লৌকিক’ নামকরণ করেছেন। প্রথমটির উদাহরণস্বরূপ তিনি ব্রহ্মা ও প্রজাপতির নাম করেছেন, এবং দ্বিতীয় বিভাগভুক্ত দেবতাগণের মধ্য থেকে শিব ও বৈশ্রবণ (যক্ষপতি কুবেরের অন্য নাম)-কে বেছে নিয়েছেন। ব্রহ্মা-প্রজাপতিকে কেন্দ্র করে কোনও ভক্তসম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি, কিন্তু শিব ও গণপতিকে (গণপতিই যক্ষনাগের সংমিশ্রণ) কেন্দ্র করে ভক্ত সম্প্রদায় সংগঠিত হয়।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩)। তার মানে, ইতপূর্বে আমরা শিবের একটা বৈদিক ধারার পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করলেও বস্তুত প্রাচীন রচনাকার-কর্তৃক প্রাক্-আর্য জনগোষ্ঠীর লৌকিক দেবতা হিসেবেই তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে করে ইতপূর্বে প্রাক্-বৈদিক অনার্য বিশ্বাস বা ধারণাসম্মত যে প্রাচীন দেবসত্তায় আদিম উপাসনার অনুমান করা হয়েছে পাণিনি ও পতঞ্জলির সাক্ষ্য থেকে তারই সম্ভাব্য সত্যতার আভাস মেলে। প্রকৃতপক্ষে শৈবধারায় একটি বেদসম্মত এবং একটি বেদবাহ্য রূপের পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি। এক ধারায় তিনি ব্রহ্মণপ্রিয়, ধাতা, বিধাতা, ব্রহ্মা বিষ্ণুরও আদি ইত্যাদি যে সব কথা মহাভারতাদি, পুরাণ ও বেদে বলা হয়েছে তার মধ্যে আছে বেদগ্রাহ্য রূপের পরিচয়। অন্যদিকে দক্ষযজ্ঞের কাহিনী, ত্রিপুরদহন কাহিনী ও দর্শন এবং শিবের গণদেবতা সংক্রান্ত ধারণার মধ্যে অবৈদিক স্বরূপটিকে অনুসন্ধান করতে হবে বলে মনে হয়।
মহাভারতে রুদ্র-শিব আর্য-ধর্মের বাইরে ও বর্ণাশ্রমবিহীন পাশুপত সম্প্রদায় : মহাভারতের একটি আখ্যানে দেখা যায়, দক্ষ প্রজাপতি রুদ্র শিবকে বাদ দিয়ে যজ্ঞ আরম্ভ করলে দধীচি মুনি তাকে সতর্ক করে বলেছিলেন যে শিবহীন যজ্ঞ পণ্ড হয়ে যাবে। কিন্তু দক্ষ তা শুনলেন না। তিনি বললেন – ” একাদশ স্থানে বাসকারী শূল ও জটাধারী একাদশ রুদ্র আমাদের আছেন, এছাড়া তো অন্য কোন মহেশ্বরের কথা আমরা জানি না।” (মহাভারত-১২/২৮৩/২০)। এ থেকেই বোঝা যায় যে এই রুদ্র-শিব তখনও যজ্ঞকারী আর্য-ধর্মের বাইরে ছিলেন। আর মহাভারতোক্ত পাশুপত ব্রতের বিবরণ থেকেও তাকে বেদবাহ্য বলেই মনে হয়। ‘একথা ঠিক যে শতরুদ্রীয় মন্ত্রে পশুপতির কথা আছে এবং তিনি বৈদিক দেবমণ্ডলীর অন্তর্গত, কিন্তু তার পূজাবিধির দিক থেকে বৈদিক ও অবৈদিক দুটি স্পষ্ট ধারা ছিল। পাশুপত শৈবরা বর্ণাশ্রম মানতেন না এবং তাদের উৎকট আচার কিছু ছিল। বর্ণাশ্রমীরা এসব সহ্য করতেন না। তাই শৈব পাশুপতদের প্রতি অনেক ক্ষেত্রেই তারা বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন – ‘শৈবং পাশুপতং দৃষ্টবা সচেলম্ জলমাবিন্নেত্’ ইত্যাদি উক্তি তার প্রমাণ। পাশুপত ধর্মই সর্বপ্রাচীন শৈবধর্ম বলে মনে হয়।’ – (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৭)।
শিব নিয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক নিদর্শন : শৈব-সম্প্রদায় প্রসঙ্গে এই পাশুপত ও অন্যান্য সম্প্রদায় বিষয়ে ভিন্নভাবে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আমরা বরং এ-মুহূর্তে প্রাচীন সাহিত্যে শিব বিষয়ক আরও কিছু নজির খুঁজে পেতে পারি। মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্ত তার ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে শৈব-সম্প্রদায় বিষয়ক প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বলছেন – ‘অশোক ও জলোক নামে কাশ্মীর-রাজ্যের দুজন রাজা ছিলেন। শ্রীমান হ,হ,উইলসনের অবলম্বিত বিচারপদ্ধতি অনুসারে স্থূল রূপ গণনা করে দেখলে, তারা খ্রীঃ পূঃ ৭ম বা ৬ষ্ঠ শতকে বিদ্যমান ছিলেন বলতে হয়। তারা উভয়েই অত্যন্ত শিব-ভক্ত বলে কীর্তিত হয়েছেন – “বিজয়েশ্বর, নন্দীশ ও ক্ষেত্র জ্যেষ্ঠেশ শিবের অর্চনায় সেই সত্যবাদী (জলোক) রাজা সতত প্রতিজ্ঞারূঢ় ছিলেন।” (রাজতরঙ্গিণী প্রথম তরঙ্গ)। কেবল রাজতরঙ্গিণীর এই বচন এ বিষয়ের একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু এ-কথা বলতে পারা যায় যে, যদি ভারতবর্ষের দক্ষিণখণ্ডে খ্রীঃ পূঃ ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে শিবের আরাধনা প্রচারত হয়ে থাকে, তা হলে তার উত্তরখণ্ডে ঐ সময়ে ঐ ধর্ম প্রচলিত থাকা সর্বতোভাবেই সঙ্গত, তার সন্দেহ নাই। উল্লিখিত গ্রন্থে তারও পূর্বে কাশ্মীরপ্রদেশে শৈবধর্ম বিদ্যমান ছিল বলে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তা প্রমাণান্তর দ্বারা সিদ্ধ না হলে নিশ্চিত বলে পরিগৃহীত হতে পারে না।’ – (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়)। তবে খুব বেশি না হলেও, প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে যে বিভিন্ন স্থলে শিবের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে তার প্রমাণ মেলে। ‘ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এসবের নজির টেনে বলেন – ‘বৌদ্ধ দীঘনিকায় গ্রন্থে ঈশানের উল্লেখ আছে, এছাড়া বিভিন্ন পালি গ্রন্থে কখনও কখনও শিবের নাম পাওয়া যায়। ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে বৌদ্ধ নিদ্দেস গ্রন্থে দেব নামক যে দেবতাটির উপাসকদের কথা বলা হয়েছে, আসলে তিনি শিব কেননা শ্বেতাশ্বতরে শিবের একটি নাম দেব। পরবর্তীকালে হিউয়েন সাং শিবকে দেব বা ঈশ্বরদেব বলে উল্লেখ করেছেন। আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতকে রচিত বৌদ্ধ মহামায়ূরী গ্রন্থে শিবপুর এবং ভীষণ নামক নগরদ্বয়ের পালক-দেবতা হিসাবে শিব ও শিবভদ্রের উল্লেখ আছে।
গ্রিকদের বর্ণনায় শিবের নিদর্শন : গ্রীক লেখকগণ এদেশে শিবপূজার ব্যাপকতা লক্ষ্য করেছিলেন এবং নিজেদের দেবতা ডায়োনিসাসের সঙ্গে তার সাদৃশ্য কল্পনা করেছিলেন।’ – (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২০০)। গ্রীক লেখকদের এরকম আরেকটি নমুনার কথা জানা যায় মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্যে। তিনি বলছেন – ‘খ্রীষ্টাব্দ আরম্ভের পূর্ব ৪র্থ শতকে গ্রীক্ সম্রাট আলেকজন্ডারের একজন গ্রীক (মেগাস্থিনিসের কথা বলছেন), মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের সভায় দূত-স্বরূপে উপস্থিত হন। ঐ সময়ে তাদের সমভিব্যারী বিচক্ষণ ব্যক্তিরা হিন্দুদের আচার-ব্যবহার ধর্মাদি যেরূপ দর্শন করেন, গ্রীসদেশীয় বহুতর গ্রন্থকারদের পুস্তকে তার সবিস্তার বৃত্তান্ত বিনিবেশিত আছে। তারা লেখেন, হিন্দুরা বাক্কাস (বা ডায়োনিসাস) ও হার্কিউলিস্ নামক দুই দেবতার বহুপ্রকার উপাসনা করে থাকেন। কিন্তু এই দুটি দেবতা গ্রীকদের উপাস্য, হিন্দুদের নয়। বোধহয়, তারা হিন্দুদের যে দুটি দেবতাকে নিজেদের বাক্কাস ও হার্কিউলিস্ দেবতার সদৃশ জ্ঞান করেছিলেন, তাদেরকেই ঐ দুই নাম দিয়ে গিয়েছেন। ভারতবর্ষীয় মহাদেবের মতো গ্রীসদেশীয় বাক্কাস-দেবেরও লিঙ্গ-পূজা বিস্তৃতরূপে প্রচলিত ছিল। অতএব গ্রীকেরা মহাদেবকেই বাক্কাস দেব বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন। এ-কথা সর্বতোভাবে অনুমান-সিদ্ধ বা নিতান্ত সম্ভাবিত বলতে পারা যায়।’ – (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, পৃষ্ঠা-৩-৪)। উল্লেখ্য, গ্রীকবীর আলেকজান্ডার ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বকালে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। ঐ সময়কালে ভারতবর্ষে যে শিব পূজার প্রচলন ছিল তার ঐতিহাসিক প্রমাণ উল্লেখ করতে গিয়ে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন – ‘ভারতবর্ষের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে যে শিব পূজার বিশেষ প্রচলন ছিল, তা আমরা সুপ্রাচীন বৈদেশিক গ্রন্থ হতে জানতে পারি। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিদেশী ঐতিহাসিকগণ বলেছেন যে পঞ্চনদ প্রদেশের একাংশে, বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা নদীর (ঝিলাম ও চিনাব নদী, তাদের গ্রন্থে এই দুই নদীর নাম –Hydasoes ও Acesines, সংস্কৃত বিতস্তা এবং অসিক্লীর গ্রীক রূপ) সঙ্গমের নিকট শিবয় (শিবি) (Sibae, Siboi) নামক এক জাতীয় লোক বাস করত। এরা খুব সম্ভব শিবপূজক ছিল…। হেক্যাটিয়স নামক খ্রিস্টপূর্ব যুগের এক গ্রীক গ্রন্থকার বলেছেন যে বৃষভ (শিবের পশুমূর্তি, পরে তার বাহন রূপে কল্পিত) গান্ধার প্রদেশের অধিবাসীদের অন্যতম প্রধান দেবতা ছিল।
পরবর্তী বৈদেশিক আধিপত্য ও তৎপরবর্তীকালের শিবের নিদর্শন : বৃষরূপী দেবতার মূর্তি পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম প্রদেশের যবন, শক, পহ্লব প্রভৃতি সেখানকার প্রাচীন যুগের (খৃঃ পূঃ ২য় শতক হতে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক) বৈদেশিক রাজগণের রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রায় উৎকীর্ণ দেখতে পাওয়া যায়। শকরাজ মোঅস (Maues), পহ্লব রাজ গন্ডোফেরিস (Gondophares) এবং কুষাণ রাজ বিম কদফিস (Wema Kadphises) ও কণিষ্ক প্রভৃতির মুদ্রায় শিবের মনুষ্য মূর্তি খোদিত দেখা যায়। এই সমস্ত সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্ব গত প্রমাণ বৌদ্ধ গ্রন্থ মহামায়ূরী ও মহাভষ্যের উক্তি পূর্ণরূপে সমর্থন করে।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩১-৩২)। এ প্রেক্ষিতে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যত্র আরও বলছেন – ‘উজ্জয়িনীতে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের একটি লেখবিহীন তাম্রমুদ্রার একদিকে আছে শিব দেবতার দণ্ড কমণ্ডলুহস্ত দ্বিভুজ মনুষ্য মূর্তি, পার্শ্বে তার বাহন বৃষভ (দেবতার পশুমূর্তি) এবং অপরদিকে দেখা যায় স্থলবৃক্ষের সম্মুখে তার অনুরূপ লিঙ্গ মূর্তি। মথুরা, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি উত্তর প্রদেশস্থ শহরের চিত্রশালায় খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতকের যোনিপট্টবিহীন এমন সব শিবলিঙ্গ রক্ষিত আছে, যেগুলো হতে উচ্ছ্রিত মুক্তমুখচর্ম মনুষ্যলিঙ্গের সাথে তাদের আশ্চর্য সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এই সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে শিবলিঙ্গ পূজার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে লিঙ্গপূজা বৌদ্ধ স্তূপপূজা হতে উদ্ভূত হয়েছিল। আদি মধ্য ও মধ্যযুগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদ্ধ পূজা সংক্রান্ত স্তূপগুলোর মেধি ও দীর্ঘাকৃতি অণ্ডের সাথে গুপ্তপরবর্তী কালের রূপান্তরিত শিবলিঙ্গের আপাতদৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য অনুভূত হয়। কিন্তু মনে রাখা আবশ্যক যে এই দুই বিভিন্ন পূজা প্রতীকের কোনওটিই গুপ্ত বা প্রাক্-গুপ্ত কালের নয়। প্রাক্-গুপ্তযুগের উপরিলিখিত এবং অনুরূপ অন্যান্য শিবলিঙ্গগুলোর আকৃতির বিষয় স্থিরচিত্তে বিবেচনা করলেই এদের যথার্থ তাৎপর্য সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকে না। শিবলিঙ্গ পূজার উৎপত্তি যে এক পিতৃ-দেবতার সৃজন-শক্তিকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল তা গোপীনাথ রাও মহাশয় বহু অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পৌরাণিক ও তান্ত্রিক গ্রন্থাদির সাহায্যে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন (Elements of Hindu Iconography, Vol. II, pp. 61-2)। ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন অধিবাসীদের একাংশের মধ্যে প্রচলিত এরকম এক বিশেষ ধর্মানুষ্ঠানের জন্য আধুনিক কালের ভারতীয়দের মধ্যে কেউ কেউ লজ্জা পেয়ে থাকেন। এ মনোভাব নিতান্ত অস্বাভাবিক নয়। বৈদিক ও তার পরবর্তী যুগের বহু ভারতীয় মনে হয় এ অনুষ্ঠান সমর্থন করতেন না। বিশাল মহাভারতের দু একটি অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন অংশেই শিবলিঙ্গ পূজার সমর্থন পাওয়া যায়। শিবের আকৃতি বর্ণনা কালে মহাকাব্যকার বলেছেন – ঊর্ধ্বকেশ মহাশ্যেপঃ নগ্নো বিকৃতলোচনঃ। অনুশাসন পর্বের কৃষ্ণ-উযপমন্যুসংবাদ পর্বাধ্যায়েই আমরা প্রথম লিঙ্গ ও যোনি পূজার স্পষ্ট সমর্থন পাই। কিন্তু এখানেও লিঙ্গ-যোনির যুক্ত রূপের কোনও স্পষ্ট উল্লেখ নাই, – তা অনেক পরবর্তী কালের তান্ত্রিক গ্রন্থেই লিপিবদ্ধ আছে।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩৬-৮)।
শিবলিঙ্গের আকৃতির পরিবর্তন : প্রাচীন ভারতীয় মনীষীদের মধ্যে অনেকে এক বিশিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়ের এই মুক্তমুখচর্ম শিশ্নাকৃতির লিঙ্গ পূজা পদ্ধতি সুচক্ষে দেখতেন না এবং এ সম্পর্কে তারা প্রথম দিকে উদাসীনতা ও নিরবতা অবলম্বন করতেন স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু তাদের এই উপেক্ষা ও অসমর্থন এই পূজা পদ্ধতিকে অপসারিত করতে যে পারেনি তার প্রমাণ কালক্রমে এই পূজার উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি। এ প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত হলো – ‘এই শক্তি বৃদ্ধির মূলে তান্ত্রিক উপাসনার ক্রমবিকাশ বর্তমান থাকলেও, লিঙ্গ প্রতীকের আমূল রূপ পরিবর্তন ঘটায় আপাতদৃষ্টিতে এর অশ্লীলতার ভাব সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়ে যায়, এবং এই প্রতীক পূজা শৈব ও স্মার্তদের মধ্যে অধিকতর প্রিয় হয়ে উঠে। ক্রমশ তা পূজাপ্রতীক রূপে এত অধিক জনপ্রিয় হয়ে পড়ে যে তা প্রতি শিবমন্দিরের গর্ভগৃহে প্রধানতম ও মুখ্য পূজার বস্তু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। শিব দেবতার অসংখ্য মনুষ্যমূর্তি, তার অগণিত লীলার প্রকাশ, এই সব মন্দিরের বিভিন্ন অংশে গৌণ স্থান অধিকার করতে বাধ্য হয়। যারা ঈলোরার কৈলাস মন্দির দেখেছেন তারা আমার এই উক্তির পূর্ণ সমর্থন করবেন। সুবৃহৎ গর্ভগৃহে বিশালকায় লিঙ্গের ভগ্নাবশেষ অবস্থিত, আর মন্দিরের অন্যান্য অংশে দেবতার অগণিত লীলামূর্তি রক্ষিত আছে। ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের মূর্তিসংস্থানও এই রূপ। শিবলিঙ্গ পূজার এত অধিক জনপ্রিয়তা সম্ভব হয়েছিল গুপ্ত ও তৎপরবর্তী যুগ হতে, কারণ গুপ্তকাল হতেই লিঙ্গ প্রতীকের আকৃতি পরিবর্তিত হতে থাকে, এবং ক্রমশ তা এমন রূপ ধারণ করে যাতে এর আদি প্রকৃতি বহুলাংশে প্রচ্ছন্ন হয়। কিন্তু শিবলিঙ্গ নির্মাণের বিধি প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় মূর্তিশাস্ত্রে তার ঊর্ধ্বাংশে (রুদ্র বা পূজাভাগে) ব্রহ্মসূত্র পাতনের যে ব্যবস্থা লিখিত আছে তাতেই এর প্রকৃত রূপ সম্বন্ধে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শিবলিঙ্গ পূজা বিষয়ক আরও একটি কথা এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক। বহু প্রাচীনকাল হতে স্বর্গত পিতৃপুরুষাদির স্মারক হিসাবে স্তম্ভ স্থাপন প্রথা পৃথিবীর সর্ব দেশে প্রচলিত আছে। ভারতবর্ষেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শিবলিঙ্গ পূজার সর্বাধিক প্রচলনের মূলে এই প্রথাও মনে হয় কিছু পরিমাণে কার্যকরী হয়েছিল। সাধু মহাত্মাদের সমাধি বা শ্মশানমন্দিরে এবং স্বর্গত নৃপতিবর্গের (বিশেষ করে রাজপুতানা অঞ্চলে) শ্মশানক্ষেত্রে তাদের নামে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও পূজার ব্যবস্থা এ বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করে।’- (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩৮-৯)।
পঞ্চোপাসনায় শিব : বস্তুত প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই শিব দেবতার, তা সে যে-নামেই হোক বা যে প্রতীকেই হোক, উপাসনার এই আদিম পরম্পরা বহমান ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারই ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টপূর্ব কালের কিছু ঐতিহাসিক সাক্ষ্য এই অনুমানকেই প্রতিষ্ঠিত করে এবং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমাদের কাছে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর খ্রিস্টোত্তর কালে তা ক্রমে কেবল স্পষ্টতরই নয়, বরং পূর্ণরূপে শিব বা শিবলিঙ্গ পূজার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার সাক্ষ্যপ্রমাণ মেলে। যেমন – ‘ধর্মসম্প্রদায়গুলোর ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ প্রয়োজন। বরাহমিহির প্রণীত বৃহৎসংহিতা গ্রন্থের দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠাপন সংক্রান্ত অধ্যায়ে (সুধাকর দ্বিবেদী সম্পাদিত সংস্করণ, ৫৯ অধ্যায়) বৈষ্ণব, সৌর, শৈব, শাক্ত, ব্রাহ্ম, বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়সমূহের প্রধান প্রধান দেবমূর্তিগুলোর বিভিন্ন মন্দিরের গর্ভগৃহসমূহে প্রতিষ্ঠা করা সম্বন্ধে কয়েকটি সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে। বরাহমিহির বলছেন – ‘বিষ্ণুর (মূর্তি) ভাগবতগণ, সূর্যের মগেরা, শিবের (মূতি-শিবলিঙ্গ) ভস্মমণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ (অর্থাৎ পাশুপতেরা), মাতৃকাদের মণ্ডলক্রমবিদ্গণ (অর্থাৎ শাক্তেরা), ব্রহ্মার বেদবিদ্ ব্রাহ্মণগণ, সর্বহিতকারী প্রশান্তমন দেবতার (অর্থাৎ বুদ্ধের) শাক্যগণ (বৌদ্ধেরা), জিনদের দিগম্বর জৈনগণ – এই বিভিন্ন মূর্তিসকল তত্তং দেবতা-পূজকেরা সেই সেই দেবতা-মূর্তির (প্রতিষ্ঠা) ক্রিয়া নিজ নিজ সম্প্রদায় নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী করবেন’। উৎপলাচার্য এই শ্লোকটির উপর যে ভাষ্য করেছেন, তা থেকে জানা যায় যে ভাগবতেরা পাঞ্চরাত্র বিধি অনুসারে বিষ্ণুর, মগদ্বিজেরা সৌরদর্শন বিধানানুযায়ী সূর্যের, পাশুপতেরা বাতুলতন্ত্র বা অন্য শৈবতন্ত্রনির্দেশানুসারে শিবের, (তান্ত্রিক) পূজাক্রমবিদ (শক্তি-পূজকগণ) নিজ নিজ কল্পবিহিত ব্যবস্থানুযায়ী বিভিন্ন দেবীমূর্তির, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা বেদোক্ত বিধিদ্বারা ব্রহ্মার, বৌদ্ধেরা পারমিতাক্রমানুসারে বুদ্ধের এবং জৈনেরা জৈনদর্শনানুযায়ী জিনদের মূর্তিসকল প্রতিষ্ঠা করবেন। বৃহৎসংহিতার রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতক এবং উৎপল খ্রিস্টীয় ১০ম শতকের লোক ছিলেন। ধর্মসম্প্রদায়গুলোর উপরিলিখিত সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে ব্রাহ্মণ্য পঞ্চোপাসনার মধ্যে অন্তত চারটির, যথা বৈষ্ণব, সৌর, শৈব এবং শাক্তের, সম্যক প্রচলন খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের বহু পূর্বে হয়েছিল। গণপতির পূজা সে সময়ে কোনও না কোনও প্রকারে বর্তমান থাকলেও, একটি বিশিষ্ট উপাসক সম্প্রদায় হিসাবে গাণপত্য সম্প্রদায়ের উদ্ভব তখনও হয়নি। ব্রহ্মাকে কেন্দ্র করে একটি পৃথক উপাসকমণ্ডলীর প্রবর্তন করার প্রচেষ্টার কথা পূর্বে বলা হয়েছে। বৃহৎসংহিতার উল্লিখিত উদ্ধৃতি হতে এ অনুমান কিছু পরিমাণে সমর্থিত হয়। তবে সে প্রচেষ্টা বিশেষ ফলবতী হয়নি। এও লক্ষ্য করার যোগ্য যে বৃহৎসংহিতাকার ব্রাহ্মণ্য ধর্মসম্প্রদায়গুলোর সমপর্যায়ে বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায় দুটিকেও ফেলেছেন। এতে কোনও অসামঞ্জস্য হয়নি, কারণ এই দুটি সম্প্রদায়ভুক্ত উপাসকগণের ধর্মাচরণের মূলসূত্র ছিল ভক্তিবাদ, এবং মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত নিজ নিজ ইষ্টদেবতার মূর্তিপূজন ছিল তাদের অন্তর্নিহিত ভক্তির বাহ্য প্রকাশ।’ – (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/ পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪-৫)।
বৈদিক গ্রন্থে কোথাও প্রতিমাপূজার অভাব ও শিবের প্রতিমাপূজার সূত্রপাত : প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো – বৈদিক গ্রন্থে কোথাও প্রতিমাপূজার কথা নেই। প্রতিমাপূজা বস্তুত পুরাণের বিশেষত্ব। বর্তমানে প্রচলিত পূজা পুরাণ ও তন্ত্রের দান। তা হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে – ‘কোন সময় থেকে ভারতবর্ষে প্রতিমা পূজা প্রচলিত হয়। একথা নিশ্চিতভাবে বলা খুবই শক্ত হলেও খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের আগেই প্রতিমা পূজা ও মন্দির সুপ্রচলিত হয়েছে, একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ পতঞ্জলি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে শিব, স্কন্দ ইত্যাদি দেবতার প্রতিমা বিক্রির কথা লিখেছেন। চিতোরের নাগরী শিলালিপিতে (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০-২৫০) বাসুদেব ও সংকর্ষণের মন্দিরের কথা উল্লেখ আছে। সম্ভবত এই হল বৈষ্ণব মতের অস্তিত্বের সর্বপ্রাচীন শিলালিপি। এই শিলালিপি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বলে সংস্কৃত শিলালিপির প্রাচীনতম নিদর্শন বলে স্বীকৃত।’ – (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ)। এ প্রেক্ষিতে শৈবদের প্রধান পূজাপ্রতীক শিবলিঙ্গের প্রচলন সম্পর্কে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন – ‘শৈবদের প্রধান পূজাপ্রতীক শিবলিঙ্গের প্রকৃতি ও প্রচলন বিষয় অনুশীলনকালে আমি দেবতার অসংখ্য লীলামূর্তির উল্লেখ করেছি। লিঙ্গ প্রতীক ও লীলামূর্তিগুলো শিবের পঞ্চকৃত্যের (সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, প্রসাদ বা অনুগ্রহ এবং তিরোভাব) মধ্যে অন্তত তিনটির, যথা সৃষ্টি, সংহার ও অনুগ্রহের রূপ দান করে। লিঙ্গ প্রতীক দেবতার সৃজন-শক্তি বা প্রথম কৃত্যেরই বাহ্য রূপ। অপর দুটি কৃত্যের ও দেবতার অন্য সব বৈশিষ্ট্যেরও শাস্ত্রসঙ্গত রূপায়ণ মধ্যযুগীয় শিল্পীরা নানাভাবে করেছিলেন।… শিবের মানবোচিত মূর্তি সকল প্রধানত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। বৈদিক ও বেদপরবর্তী সাহিত্যে রুদ্র-শিব দেবতার দুই রূপের (উগ্র ও সৌম্য) বর্ণনার কথা পূর্বে বলা হয়েছে। শিবমূর্তির অধিকাংশ এই দুই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এদের মধ্যে আবার এক বৃহত্তর সংখ্যা দেবতার সম্বন্ধীয় কোনও না কোনও পৌরাণিক কাহিনীর রূপ প্রদান করে। মূর্তিগুলোর অল্পাংশ দুরূহ শিবতত্ত্বেরও কিঞ্চিৎ পরিচয় দেয়। শেষোক্ত প্রতিমাসমূহের এবং উগ্র ও সৌম্য বিভাগদ্বয়ের কয়েকটির ভিত্তিমূলে সাধারণত কোনও পৌরাণিক কাহিনীর অস্তিত্ব নাই।’- (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩৯)। আমাদের বর্তমান আলোচনার মুখ্য বিষয় শিব পূজার প্রচলন যে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের বহু পূর্বেই হয়েছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে মহাকাব্যের যুগেই অর্থাৎ মহাভারত ও রামায়ণের সময়কালে আমরা শিব ও লিঙ্গের একাত্তীকরণের পাশাপাশি তার পূজা প্রচারের বিস্তৃতি দেখতে পাই। মহাভারত ও রামায়ণের বহু স্থানে শিব ও তার অনুগামীদের উল্লেখ আছে এবং এই দেবতার প্রাধান্য ও সম্যক প্রতিষ্ঠার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে বৈষ্ণবদের মত শৈবরাও এই দুটি মহাকাব্য নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা প্রয়াস পেয়েছিলেন এবং সুবিধামত মহাকাব্যদ্বয়ের এখানে ওখানে শিবের মাহাত্ম্যের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন।
ঋগ্বেদ পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে শিবের বিভিন্ন নাম অর্পণ : এই যে দেবতা, – ‘তিনি একাধারে রুদ্র, শিব ও মহাদেব; তিনি গিরীশ, গিরিত্র, কপর্দী, কৃত্তিবাস (যার পরিধানে পশুচর্ম), হর (যিনি হরণ অথবা সংহার করেন), ভব। এই সকল নাম ঋগ্বেদ পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তাতে অর্পিত দেখা যায়। এ যুগেও তিনি এই সব নামে অভিহিত হয়েছেন ত বটেই, পরন্তু আরও নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের দ্বারা তিনি চিহ্নিত হয়েছেন। মহাকাব্যদ্বয় ও প্রধান প্রধান পুরাণগুলোতে তার সম্বন্ধে বহু কাহিনী ও কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, যাদের মধ্যে অন্তত কোনও কোনওটির উৎপত্তি স্থল শেষের দিকের বৈদিক সাহিত্যে নির্ণীত হয়। গজাসুর বধ করে শিব কর্তৃক গজচর্ম পরিধানের পৌরাণিক গল্প আমরা শত রুদ্রীয়তে প্রদত্ত রুদ্রের অন্যতম নাম ‘কৃত্তিবাস’ হতে উৎপন্ন মনে করতে পারি।
শিবের দক্ষযজ্ঞ বিনাশ কাহিনীর উৎস : শিবের দক্ষযজ্ঞ বিনাশ কাহিনীর উৎস বোধ হয় তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণে পাওয়া যায়। দেবতারা বলির পশু নিজেদের মধ্যে ভাগ করছিলেন। তারা রুদ্রকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, অর্থাৎ তাকে ভাগ দেননি (দেবাঃ বৈ পশূন্ ব্যভজন্ত। তে রুদ্রমন্তরায়ন ; ৭, ৯, ১৬)। এই কাহিনী রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদিতে কোথাও স্বল্প পরিসরে কোথাও বা অতি বিস্তৃত আকারে বর্ণিত দেখা যায়। দক্ষ প্রজাপতি অনুষ্ঠিত দৈব যজ্ঞে সকল দেবতা নিমন্ত্রিত হলেও রুদ্র-শিব নিমন্ত্রিত হননি, কারণ বৈদিক যজ্ঞের ভাগে তার কোনও অধিকার ছিল না। শিবের স্ত্রী দক্ষের অন্যতম কন্যা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিনা নিমন্ত্রণে স্বামীর নিষেধসত্ত্বেও পিতৃগৃহে আসিয়া পিতার নিকট পতিনিন্দা শ্রবণে দেহত্যাগ করলে, শিব ক্রুদ্ধ হয়ে দক্ষযজ্ঞ বিনাশ করেন এবং বৈদিক দেবতাগণের, দক্ষের, ও যজ্ঞে উপস্থিত ব্রহ্মর্ষিগণের প্রভূত শাস্তি বিধান করেন। এই কাহিনীর সর্বাপেক্ষা সংক্ষিপ্ত বিবরণ রামায়ণের আদিকাণ্ডে পাওয়া যায় (১, ৬৬, ৭…)। মহাভারতের সৌপ্তিক ও শান্তিপর্বে এর অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত বর্ণনা দেখি। শান্তিপর্বোক্ত আখ্যানে দধীচী মুনি রুদ্র-শিবের পক্ষ নিয়ে দক্ষ ও যজ্ঞে সমবেত বৈদিক দেবতা ও ঋষিগণের সাথে বিতণ্ডাকালে রুদ্র মহেশ্বরকে পশুভূৎ, স্রষ্টা, জগৎপতি, সকলের প্রভু এবং প্রকৃত যজ্ঞভোক্তা বলে বর্ণনা করেছেন। এর উত্তরে দক্ষ প্রজাপতির একটি উক্তি লক্ষ্য করার বিষয়। দক্ষ বলছেন যে শূলধারী জটামুকুটবিশিষ্ট একাদশ রুদ্র আছেন বটে, কিন্তু মহেশ্বরকে আমি জানি না (সন্তি নো বহবো রুদ্রাঃ শূলহস্তাঃ কপর্দিনঃ। একাদশ স্থানগতাঃ নাহং বেদ্মি মহেশ্বরম্)। এখানে যেন বৈদিক রুদ্র থেকে পৌরাণিক রুদ্র-শিবকে পৃথক্ করা হয়েছে।’ – (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/ পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩২-৩৪)।
ত্রিমূর্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা : মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের মতে, – ‘রামায়ণ ও মহাভারত কেবল বৈদিক ধর্মের বৃত্তান্ত নয়। এই উভয়ই বৃক্ষরুহা-সমাকীর্ণ বিশাল বৃক্ষের ভূমিস্বরূপ। বৈদিক ধর্ম রূপ প্রাচীনতর তরুস্কন্ধে পৌরাণিক ধর্মরূপ প্রবল বৃক্ষরুহা বদ্ধমূল হয়ে ঐ মহাবৃক্ষকে নিস্তেজ করে ফেলছে, এরকমই দৃষ্ট হয়ে থাকে। ঐ অভিনব ধর্মের মতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও তদীয় শক্তি সমুদায়ই প্রধান দেবতা ও মনুষ্যের প্রধান উপাস্য। ঐ তিনটি দেবতার সমবেত নাম ত্রিমূর্তি। পৌরাণিক ও তান্ত্রিক মতানুযায়ী ব্যাখ্যানুসারে, এ ত্রিমূর্তি ওঙ্কারের প্রতিপাদ্য।… মহাভারতের ব্রহ্মার মহিমা অপেক্ষাকৃত খর্ব দেখা যায়; শিব ও বিষ্ণু-উপাসনারই প্রাদুর্ভাব দৃষ্ট হয়। স্থানে স্থানে ব্রহ্মার পূর্ব মহিমার কিছু কিছু নিদর্শনও লক্ষিত হয়ে থাকে। এই অনতি প্রাচীন মতে বৈদিক দেবগণ একবারে অগ্রাহ্য নয়, কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট পদে অবস্থাপিত হয়েছেন। ইন্দ্র দেবরাজ বলে লিখিত বটে, কিন্তু ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব তদপেক্ষা অতিমাত্র উচ্চতর পদে প্রতিষ্ঠিত।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা-১৮০)।
রামায়ণ ও মহাভারতে শিব : রামায়ণে শিব শিতিকণ্ঠ, মহাদেব, রুদ্র, ত্র্যম্বক, পশুপতি ও শঙ্কর নামে আখ্যাত হয়েছেন। উমার সঙ্গে শিবের বিবাহের তপস্যার কাহিনী, শিবের অভিশাপে কন্দর্পের দেহহীন হবার কাহিনী, কার্তিকেয়ের জন্মের কাহিনী, গঙ্গা আনয়নের জন্য শিবের উদ্দেশে ভগীরথের তপস্যার কাহিনী, সমুদ্র মন্থনে শিব কর্তৃক গরল পানের কাহিনী প্রভৃতি রামায়ণে স্থান পেয়েছে (রামায়ণ-১/২৩, ১/৩৫, ১/৩৮, ১/৪৫)। মহাভারতেও ওই সকল কাহিনী বর্তমান। অনুশাসনপর্বে কৃষ্ণ কর্তৃক শিবের উপাসনার কাহিনী আছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মহাভারতে বেদ, সাংখ্য, যোগ এবং পাঞ্চরাত্রের পাশাপাশি পাশুপত-শৈব ধর্মের স্বতন্ত্র স্বীকৃতি। দক্ষযজ্ঞ ভঙ্গের পর শিব দক্ষকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা হচ্ছে পাশুপত ধর্ম। মহাভারতের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক বলে রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রমুখ পণ্ডিতদের অভিমত। আর রামায়ণ মহাভারতের পূর্ববর্তী বলে মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের পর্যবেক্ষণসুলভ অভিমত। আমরা যদি উভয়টিকে সমকালবর্তী বলেও ধরে নেই, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য অনুযায়ী – ‘অনুমান করা যেতে পারে পূর্বতন যুগের রুদ্র, শিব ও সমজাতীয় দেবতাদের বিচ্ছিন্ন উপাসনা খ্রিস্টীয় ১ম থেকে ৪র্থ শতকের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেছিল এবং বিচ্ছিন্ন পূজাপদ্ধতি, আচার অনুষ্ঠান ও ধ্যানধারণাসমূহ সংহতি লাভ করেছিল। এটা শৈব ধর্মের দ্বিতীয় পর্যায় বা পাশুপত ধর্ম নামে খ্যাত।’ – (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২০১)
খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে বাংলায় নবব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা, আর্য-অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণ : এখানে বলা বাহুল্য হবে না, প্রাচ্যদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে, গুপ্ত রাজাদের আমলে। কিন্তু এই ধর্ম আর্য ঐতিহ্যমণ্ডিত ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নয়। এই সময় যারা দলে দলে বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছিল, তারা নিমজ্জিত হয়েছিল আর্যেতর সমাজ প্রতিষ্ঠিত পুরাণাশ্রিত ধর্মের স্রোতে। এই ধর্ম বৈদিক ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক ধারা। যেখানে বৈদিক দেবতামণ্ডলী চলে যায় পেছনের সারিতে, আর তাদের বদলে সৃষ্টি হয় নতুন এক দেব-মণ্ডলীর; যার শীর্ষে অবস্থান করছেন – ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। আবার তাদেরও শীর্ষে এক নারী দেবতার অবস্থান – শিবজায়া দুর্গা। শিব অনার্য দেবতা, ব্রহ্মাও অবৈদিক দেবতা; আর বিষ্ণু বৈদিক যুগের অগুরুত্বপূর্ণ বৈদিক দেবতা হলেও, তার রূপান্তর ঘটেছিল আর্যেতর সমাজের দ্বারা। ফলে ভগবান শ্রী বিষ্ণুর সহধর্মিণী হলেন এক অনার্য দেবতা শিবকন্যা – লক্ষ্মী। ‘বেশিরভাগ পুরাণই রচিত হয়েছিল এই সময়েই। মহাভারত রচনা, বেদ সংকলনও এই সময়েই হয়েছিল। আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংশ্লেষণ ও সমন্বয়ে সূচিত হয় এক নতুন সংস্কৃতির ধারা, যা আজও সমগ্র ভারতে হিন্দু সভ্যতা, হিন্দু ধর্ম বা হিন্দু সংস্কৃতি বলে পরিচিত। অবতারবাদের সূচনাও এই সময়েই হয়েছিল, যার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে (৭ম শতকে) শ্রীশ্রী আদি শংকরাচার্যের স্তোত্রে। পরবর্তীকালে বাংলায় এই স্তোত্রকে জনপ্রিয় করেছিলেন – কবি জয়দেব। … আর্যরা এদেশে আসার আগে এই দেশ জনমানবহীন ছিল না। সুপ্রাচীন কাল থেকে যেসব প্রাচীন জাতিগুলো এদেশের মাটিতে (প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে) তাদের আপন আপন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি নিয়ে বসবাস করে আসছিল, তারাই এ দেশের ভূমিপুত্র। এরা বিভিন্ন কৌম, গোষ্ঠী, (Ethnic Group) বা বৈচিত্র্যময় শাখা ও ঝাড় (Clan)-এ বিভক্ত। যার সাথে তাদের হৃদয়তাড়িত সামাজিক মানসিক ও ধর্মীয় পরম্পরা, চিরায়ত মূল্যবোধ, পবিত্র বংশধারার প্রতীক বা টোটেম জড়িত। যা তাদের দিয়েছে ধারাবাহিক সুরক্ষা ও বাঁচার রসদ। বিভিন্ন জীবজন্তু, পশুপাখি ইত্যাদি যেমন, হরিণ, বাঘ, মোষ, পাখি, মাছ, নাগ বংশধারার প্রতীক হিসেবে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। একে জীবন দিয়ে রক্ষা করাটাই পবিত্র কর্তব্য-কর্ম বলে মনে করে।’ – (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৮২)। এবং আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন-এর মতে – ‘এভাবে নানা উপাস্যের দ্বারা নানাবিধ মানবমণ্ডলী পরিচিত হয়ে উঠেছে অথবা সেসব মানবমণ্ডলীর নামে তাদের দেবতারা প্রখ্যাত হয়েছেন। পরবর্তীকালে আর্য-অনার্যের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ফলে, যে যে মানবমণ্ডলীর মধ্যে যে দেবতা পূজিত হলেন, হয়তো সেই দেবতার বাহন ওই মানবগোষ্ঠীর আদি লাঞ্ছন চিহ্ন বা টোটেম। তাই শিবের উপাসক প্রোষ্ঠ অর্থাৎ বৃষ বা ষণ্ড। আবার নাগেরাও ছিল শিবের উপাসক। বিষ্ণুর উপাসক গরুড়।’ – (জাতিভেদ)। এভাবেই হয়তো শ্রীবিষ্ণুর অবতারমণ্ডলীতে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ও নৃসিংহ ভারতের আদিবাসী সমাজের টোটেম-ভিত্তিক দেবতারা স্থান পেলেন। এবং আরও লক্ষ্য করার বিষয় যে, সেই যুগে যে ধর্মীয় মহাসমন্বয় হয়েছিল তাতে বেদ-বিদ্বেষের প্রবক্তা ‘বুদ্ধ’ শ্রীবিষ্ণুর অবতার ‘বুদ্ধদেব’ রূপে পূজিত হলেন।
উত্তর-বৈদিক পুরাণ সাহিত্য
পুরাণ ও পুরাণ উদ্ভবের কাল : মানবসমাজ বিবর্তনের ধারায় আগুনের আবিষ্কার ও ব্যবহার যেমন নবদিগন্তের সূচনা করে, তেমনিভাবেই লোহার আবিষ্কারও (আনুমানিক দশম-নবম খ্রিস্টপূর্ব) আনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ফলে পুরাতনী সমাজব্যবস্থা নতুনভাবে বিন্যস্ত হতে থাকে। চাষাবাদ, ব্যবসাবাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির সাথে সাথে সমাজের বৃত্তি বিভাজনও পুনর্বিন্যস্ত হতে থাকে। সমাজে অন্তর্দ্বন্দ্ব চিরকালই ছিল, এবং তা ছিল মূলত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা দখলের লড়াই-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতির সাথে সাথে আর্থিক বলে বলীয়ান বৈশ্য শ্রেণির উদ্ভব হলো। তারাও ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে তৃতীয় শক্তি রূপে নিজেদের জড়িয়ে ফেললো। বস্তুত এই সময় থেকেই সনাতনী সমাজব্যবস্থা ধারাবাহিক অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে বিভিন্ন সংকটের মধ্যে পড়তে থাকে। এইসব আঘাতকে সামাল দিয়ে সমাজকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টাতেই বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বহুলভাবে সমৃদ্ধ ও ক্রমবিবর্তিত হতে থাকে, যার ফসল হলো বিপুল বৈদিক সাহিত্যসম্ভার ও বেদমূলক উত্তর-বৈদিক সাহিত্য – পুরাণ। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের গভীরে যাওয়ার আগে পুরাণ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ ধারণা অবগত হওয়া আবশ্যক। পুরাণ শব্দের অর্থ পূর্বতন। তাই বলা হয় – ‘পুরাভরম্ ইতি পুরাণম্’, অর্থাৎ যা পুরনো দিনের কথা – তাই পুরাণ। সে অনুযায়ী পূর্বতন ঘটনাবলির বিবরণ করা পুরাণের উদ্দেশ্য হতে পারে। কিন্তু আমরা পুরাণ-সাহিত্য বলতে প্রচলিত যে পুরাণ ও উপ-পুরাণগুলোকে বুঝি সেগুলো কোনভাবেই অধিক প্রাচীন নয়। এগুলো প্রায় সবই গুপ্তযুগের সৃষ্টি। যদিও বেদের উপনিষদ ভাগ অন্যান্য ভাগ অপেক্ষা নব্য, কিন্তু ভারতীয় পণ্ডিতদের মতে এগুলোও পুরাণের চেয়ে প্রাচীন। বাস্তবিকই প্রচলিত পুরাণ ও উপপুরাণগুলো সেসব প্রামাণিক উপনিষদের পরে সঙ্কলিত হয়েছে। কিন্তু পুরাণের উল্লেখ পূর্বেকার সাহিত্যগুলোতে পাওয়া যায়, যেমন –
- উপনিষদে পুরাণের কথা : অথচ বেদের অন্তভাগ বেদান্ত বলতে যে উপনিষদ ভাগকে বুঝি সেই প্রাচীন উপনিষদগুলোতেও পুরাণের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন – “তিনি বললেন, ভগবন্! আমি ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, আথর্বণ নামক চতুর্থ বেদ এবং পঞ্চম বেদ-স্বরূপ ইতিহাস-পুরাণ জ্ঞাত আছি।” (ছান্দোগ্যোপনিষদ্- সপ্তম প্রপাঠক)। এবং, “এই পরমাত্মা থেকে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ইতিহাস ও পুরাণ উৎপন্ন হয়েছে।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)।
- রামায়ণে পুরাণের কথা : আবার হিন্দু সমাজে রামায়ণ ও মনুসংহিতা পুরাণ অপেক্ষা পুরাতন গ্রন্থ বলে প্রবাদ আছে। বাস্তবিকই তা-ই। কিন্তু রামায়ণের স্থানে স্থানে অযোধ্যাধিপতি রাজা দশরথের সারথি সুমন্ত্র পুরাণবিৎ বলে বারবার পরিকীর্তিত হয়েছে। যেমন – “এই কথা বলে, পুরাণজ্ঞ সুমন্ত্র অন্তপুরের দ্বারদেশে উপস্থিত হলেন এবং সেই সতত-অবারিতদ্বার-গৃহ মধ্যে প্রবেশ করলেন।” (অযোধ্যাকাণ্ড- ১৫ সর্গ/ ১৯ শ্লোক)।
পূর্বেকার সাহিত্যে পুরাণের উল্লেখ নিয়ে অক্ষয় কুমার দত্তের ব্যাখ্যা : এ প্রেক্ষিতে মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্ত বলেন – ‘এরকম, উক্ত কাণ্ডের (অযোধ্যাকাণ্ড) ষোড়শ সর্গের প্রথম শ্লোকে সুমন্ত্রের পুরাণাভিজ্ঞতা বালকাণ্ডের নবম সর্গের প্রথম শ্লোকে সুমন্ত্র কর্তৃক পুরাণকথন এবং ঐ কাণ্ডের অষ্টাদশ সর্গের বিংশ শ্লোকের ও অযোধ্যাকাণ্ডের ষষ্ঠ সর্গের ষষ্ঠ শ্লোকের টীকায় ‘সুতাঃ পৌরাণিকাঃ’ বলে সুতগণের পুরাণ-ব্যবসায় উল্লিখিত হয়েছে। এই সকল স্থলের পুরাণ শব্দ কদাচ বর্তমান পুরাণ হওয়া সম্ভব নয়।’ – (উপক্রমণিকা, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, পৃষ্ঠা-১৯০)। এবং মনুসংহিতার মধ্যেও পুরাণ ও ইতিহাস-অধ্যয়নের ব্যবস্থার কথা জানা যায়, যেমন – “শ্রাদ্ধ ক্রিয়াতে ব্রাহ্মণদেরকে বেদ, ধর্মশাস্ত্র, আখ্যান, ইতিহাস, পুরাণ ও খিল নামক শাস্ত্র শ্রবণ করাবেন।” (মনুসংহিতা-৩/২৩২)। অতএব, মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের মতে, – ‘প্রচলিত পুরাণ সমুদয় অপেক্ষায় প্রাচীনতর বলে সুপ্রসিদ্ধ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, কল্পসূত্র, উপনিষদ্, রামায়ণ ও মনুসংহিতায় যখন পুরাণের প্রসঙ্গ আছে, তখন সেই পুরাণ কদাচ প্রচলিত পুরাণ হতে পারে না। অধুনাতন অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও অষ্টাদশ উপপুরাণ রচিত বা সঙ্কলিত হবার পূর্বে অন্যরূপ গ্রন্থবিশেষ পুরাণ বলে প্রচলিত ছিল বলতে হবে। … মহাভারতেরও মধ্যে লিখিত আছে, এতে ইতিহাস ও পুরাণের স্বার্থ সমর্থন করা গিয়েছে। এবং মহাভারতে বর্ণিত অনেকানেক নির্দিষ্ট উপাখ্যান পৌরাণিক কথা বলে লিখিত হয়েছে। … এই সমস্ত পর্যালোচনা করে দেখলে স্পষ্ট প্রতীতি হয়, এক্ষণকার প্রচলিত পুরাণ ও মহাভারত রচিত বা সঙ্কলিত হবার পূর্বে পুরাতন কথা বিষয়ক গ্রন্থ-বিশেষ পুরাণ ও ইতিহাস নামে প্রসিদ্ধ ছিল। ফলত পূর্বে যে অন্য পুরাণ ছিল, এক্ষণকার প্রচলিত পুরাণের মধ্যেও তা স্পষ্টরূপে লিখিত আছে।… পুরাণের মধ্যেই এরূপ একটি উপাখ্যান সন্নিবেশিত আছে যে, প্রথমে বেদব্যাস একখানি পুরাণ-সংহিতা প্রস্তুত করে সূত-কুলোদ্ভব লোমহর্ষণকে প্রদান করেন ; লোমহর্ষণ তদনুসারে এক সংহিতা এবং তার তিন শিষ্য তিন সংহিতা প্রস্তুত করেন ; এই চার সংহিতার সার সঙ্কলন পূর্বক বিষ্ণুপুরাণ রচিত হয়।’ – (উপক্রমণিকা, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, পৃষ্ঠা-১৯১)। বিষ্ণুপুরাণোক্ত ঐ পুরাণ-সংহিতা কিরূপ ছিল তা এতকাল পরে নিরূপণ করা অসাধ্যই বলা যায়। বিষ্ণুপুরাণকর্তা লিখেছেন, বেদগ্রাহ্য আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা, কল্পশুদ্ধি এই চার বিষয় নিয়ে পুরাণ-সংহিতা প্রস্তুত করেন। কিন্তু এই বিষয় চারটি কী? ঐ পুরাণের টীকাকার লিখেছেন – “স্বয়ং দৃষ্টি করে যে সকল বিষয় কথিত হয়েছে তার নাম আখ্যান, পরম্পরা শ্রুত কথার নাম উপাখ্যান, পিতৃ-বিষয়ক ও পৃথ্বী-বিষয়ক গীত ও অন্যান্য কোন কোন গীতের নাম গাথা এবং শ্রাদ্ধ-কল্পাদি নিরূপণের নাম কল্পশুদ্ধি।” তার মানে, কোনো বিষয় প্রত্যক্ষ দর্শন করে, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা হিসেবে কারো কাছে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করাকে বলে আখ্যান। অপরের কাছে শোনা কোনো বিষয় বা ঘটনার বর্ণনা হলো উপাখ্যান। পিতৃপুরুষদের কথা অথবা পুরাতন কোনো ঘটনা স্মরণ রাখার জন্য লোকমুখে প্রচলিত যে শ্লোক তার নাম গাথা।
গুপ্তযুগে পুরাণের রচনার সূত্রপাত এবং অষ্টাদশ পুরাণ একজন বেদব্যাসের রচনা নয় : পুরাণের কোনও কোনও অংশ অতি প্রাচীন, হয়তো বেদেরও সমকালীন, কিন্তু তা বর্তমান আকারে সংকলিত হয়েছে মাত্র দেড় হাজার বছর আগে। গুপ্ত যুগকেই পুরাণ রচনার স্বর্ণযুগ বলে। কারণ বেশিরভাগ পুরাণই এই সময় রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে আঠারখানাকে পুরাণ বা মহাপুরাণ বলে, আর বাকি আঠারখানাকে উপপুরাণ বলে। তবে সর্বত্রই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে পুরাণগুলোর ও মহাভারতের রচনাকর্তা বলা হয়েছে। দেবীভাগবতের মতে – “সত্যবতীর পুত্র ব্যাসদেব আঠারটি পুরাণ রচনা করার পর সেই পুরাণতত্ত্বকে আরও ব্যাখ্যা করার জন্য মহাভারত রচনা করেছিলেন।” কিন্তু ব্যাসদেব আদৌ পুরাণগুলোর রচয়িতা কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কারণ –
- পুরাণেই উল্লেখ যে সকল পুরাণ ব্যাসদেবের রচনা নয় : এক্ষেত্রে মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের উপক্রমণিকায় (পৃষ্ঠা-১৯৭-৯৮) তার মূল্যায়ন খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলছেন – ‘এক্ষণে বেদ-শাস্ত্রের যেরূপ বিভাগ ও শৃঙ্খলা প্রচলিত আছে, তা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কৃত বলে প্রসিদ্ধ। সমুদায় অষ্টাদশ পুরাণ ও সমগ্র মহাভারত তারই প্রণীত বলে বিখ্যাত আছে। কিন্তু রচনা ও ধর্ম সম্বন্ধীয় মতামত প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন পুরাণের এত বিভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায় যে সমস্ত পুরাণ একজনের রচিত বলে কোন ক্রমেই স্বীকার করা যায় না। ফলত এখনকার অষ্টাদশ পুরাণের এক পুরাণও যে বেদব্যাসের রচিত নয়, তা পশ্চাৎ নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হবে। মহাভারত যে এক জনের বিরচিত নয় তা ইতিপূর্বে প্রদর্শিত হয়েছে। বেদব্যাস অষ্টাদশ পুরাণের রচনাকর্তা এ প্রবাদও যে অপেক্ষাকৃত আধুনিক, পুরাণের মধ্যেই তার নিদর্শন লক্ষিত হয়ে থাকে। তাতে এরকম লিখিত আছে যে, বেদব্যাস একখানি পুরাণ-সংহিতা প্রস্তুত করে সূত-কুলোদ্ভব লোমহর্ষণকে প্রদান করেন, এবং লোমহর্ষণ তা নিজ শিষ্যদেরকে শিক্ষা দেন। বিষ্ণু, ভাগবত ও আগ্নেয় পুরাণে এই কথাটি সুস্পষ্টরূপে লিখিত আছে। এক্ষেত্রে বিষ্ণুপুরাণ থেকে উদ্ধৃত হচ্ছে – “পুরাণার্থবিৎ বেদব্যাস আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কল্পশুদ্ধি নিয়ে একখানি পুরাণ-সংহিতা রচনা পূর্বক সুপ্রসিদ্ধ শিষ্য সূতকুলোদ্ভব লোমহর্ষণকে প্রদান করলেন। সুমতি, অগ্নিবর্চ্চাঃ, মিত্রায়ু, শাংশপায়ন, অকৃতব্রণ ও সাবর্ণি নামে তার ছয় শিষ্য ছিল। তন্মধ্যে কাশ্যপ সাবর্ণি, শাংশপায়ন – এরা এক একখানি পুরাণসংহিতা করেন। লোমহর্ষণ লৌমহর্ষণিকা নামে যে সংহিতা প্রস্তুত করেছিলেন, তাই এ তিনের মূল।” (বিষ্ণুপাুরণ- ৩/৬/১৬-১৯)। এ প্রেক্ষিতে দত্ত মহাশয় আরও বলছেন – ‘উল্লিখিত পুরাণ-সঙ্কলন বিষয়ক উপাখ্যানের সমুদায় কথা যথার্থ কিনা, তা নিঃসংশয়ে নিরূপণ করা সুকঠিন বটে, কিন্তু কোন সময়ের পণ্ডিতেরা যে বেদব্যাসকে কেবল একখানি পুরাণসংহিতার কর্তা বলে বিশ্বাস করতেন এবং তার অষ্টাদশ পুরাণ রচনা বিষয়ক উপাখ্যান যে তার বহুকাল পরে রচিত হয়, তা পূর্বোক্ত বচন-দর্শনে স্পষ্ট প্রতীত হতেছে। তিনি যে দুখানি সংহিতা করেছিলেন, তা কোন পুরাণে লিখিত নাই। বরং বিষ্ণুপুরাণের অন্তর্গত পূর্বোক্ত বচনে স্পষ্ট লিখিত আছে, বেদব্যাস একখানি পুরাণ-সংহিতা করে লোমহর্ষণকে প্রদান করেন। লোমহর্ষণ তদনুযায়ী একখানি সংহিতা রচনা করেন এবং তার শিষ্য কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সকলে এক একখানি সংহিতা প্রস্তুত করে যান।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা-১৯৯)।
- ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে পরষ্পরবিরোধী মতামত : তাছাড়া, পুরাণগুলো পাঠ করলে দেখা যায়, ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে এমন পরস্পরবিরুদ্ধ মতামত ও ঘোরতর নিন্দাবাদ প্রকাশিত রয়েছে যে, সেসব নিন্দা এক মতাবলম্বী এক ব্যক্তি কর্তৃক বিরচিত হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। এক্ষেত্রে সেগুলোর কিছু নমুনা উপস্থাপন করা যেতে পারে (সূত্র: ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, উপক্রমণিকা পৃষ্ঠা-২৩১-২৩২), যেমন – “যে ব্যক্তি মোহবশত বিষ্ণু ভিন্ন অন্য দেবতার উপাসনা করে, সে পাষণ্ড হবে। বিষ্ণু ভিন্ন অন্যের নির্মাল্য গর্হিত। যে অজ্ঞ ব্রাহ্মণ একবার মাত্রও শিবাদির প্রসাদ-সামগ্রী ভোজন করে, সে নিশ্চিত চণ্ডাল। সে নরকাগ্নিতে কোটিসহস্র কল্প দগ্ধ হয়।” (পদ্মপুরাণ। উত্তরখণ্ড। ৭৮ অধ্যায়।)। “যারা শিব-নিন্দা করেন, তাদের ধ্যান, হোম, তপ, জ্ঞান ও যজ্ঞাদিক-বিধি সমুদায় শীঘ্র নষ্ট হয়।” (কুর্মপুরাণ। ২ অধ্যায়।)। “যে গ্রন্থেতে অনেকানেক অসুর-বধের সাথে ভগবতী কালিকার মাহাত্ম্য-বর্ণন আছে, পণ্ডিতেরা তাকেই ভাগবত বলে জানেন। কলিযুগে বৈষ্ণবাভিমানী ধূর্ত দুরাত্মা লোক সকল ভগবতীর মাহাত্ম্য-যুক্ত গ্রন্থকে ভাগবত না বলে অন্য ভাগবত কল্পনা করবে।” (স্কন্দ পুরাণ)। “সৌর, গাণপত্য, শক্তি, শৈবাদির হস্তে বৈষ্ণব অন্নজল গ্রহণ করবে না। বিষ্ণু-ভক্তে শৈব-শাক্তাদির সংসর্গ করবে না ও তাদের নিকট প্রার্থনা করবে না। তাদের দ্রব্য পুরীষ-তুল্য।” (পদ্মপুরাণ। উত্তরখণ্ড। ১০০ অধ্যায়।)। পুরাণোক্ত এসব বিষয় পর্যালোচনা করে অক্ষয় কুমার দত্তের পর্যবেক্ষণ হলো – ‘পুরাণের বিষয়ে যা কিছু লিখিত হইল, সমস্ত পর্যালোচনা করে দেখলে, বেদব্যাসকে প্রচলিত পুরাণ সমুদায়ের রচয়িতা বলে কোন মতেই বিশ্বাস করা যায় না; প্রত্যুত, স্বধর্মানুরক্ত পণ্ডিতগণ কর্তৃক স্ব স্ব ধর্মানুযায়ী ধর্ম-প্রণালী-প্রচলন উদ্দেশে তার নামে সেই সমস্ত প্রচার করা হয়েছে এইটিই প্রতীয়মান হয়ে উঠে। আর এক রূপ প্রমাণেও তাই প্রতিপন্ন করে দিতেছে। ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে পরস্পর এরূপ বিরুদ্ধ এবং ঘোরতর নিন্দাবাদ ও বিষময় বিদ্বেষভাব প্রকাশিত রয়েছে যে, সে নিন্দা এক মতাবলম্বী এক ব্যক্তি কর্তৃক বিরচিত হওয়া কোন রূপেই সম্ভব নয়।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা-২৩০-৩১)।
অষ্টাদশ পুরাণ ও মহাপুরাণের ধারণা, রামায়ণ ও মহাভারতের অবস্থান : সে যাক, বেদব্যাস পুরাণ-সংহিতা একত্র করুন বা নাই করুন, যে সময়ে এই পুরাণ-সংকলন-বিষয়ক আখ্যানটি রচিত হয়েছিল, সে সময়ের প্রচলিত পুরাণ এরকমই ছিল বলতে হয়। বহুকাল পূর্বে পুরাণের এরকম অবস্থা থাকা হয়তো সম্ভব, কিন্তু তার পরেই যে অধুনাতন পুরাণগুলো সংকলিত হয়েছে এমনও নয়। বরং এটাই সম্ভব যে, পুরাণগুলো ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে এসেছে এবং তাতে কালে কালে নতুন নতুন বিষয় বিনিবেশিত হয়েছে। তবে এই আঠারটি মহাপুরাণের তালিকায় কোন্ কোন্ পুরাণ থাকবে সে বিষয়ে পুরাণগুলোর মধ্যেই মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। সেই মতভেদ আলোচনা আমাদের অভীষ্ট নয় বিধায় আমাদের প্রাথমিক ধারণার সুবিধার্থে কেবলমাত্র দেবী ভাগবতোক্ত মহাপুরাণের তালিকাটি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। যেমন – “সূত বললেন – হে মুনিশ্রেষ্ঠগণ, আমি সত্যবতীপুত্র ব্যাসদেবের কাছে যেমন যেমন শুনেছি, তেমনিভাবে পুরাণগুলোর নাম বলে যাচ্ছি, আপনারা শুনুন। ‘ম’ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ হয়েছে দুটি পুরাণ – মৎস্য, মার্কণ্ডেয়; ‘ভ’ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ হয়েছে দুটি পুরাণ – ভবিষ্য, ভাগবত; ‘ব্র’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে তিনটি পুরাণ – ব্রহ্ম, ব্রহ্মাণ্ড ও ব্রহ্মবৈবর্ত; ‘ব’ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ হয়েছে চারটি পুরাণ – বামন, বায়ু, বিষ্ণু এবং বরাহ; ‘অ’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে একটি – অগ্নি; ‘ন’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে একটি – নারদ; ‘প’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে একটি – পদ্ম; ‘লিং’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে একটি – লিংগ; ‘গ’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে একটি – গরুড়; ‘কূ’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে একটি – কূর্ম; এবং ‘স্ক’ দিয়ে আরম্ভ একটি – স্কন্দ। এগুলোই হলো আঠারটি পুরাণ।” পরবর্তীকালে সম্ভবত উপপুরাণগুলো রচিত হওয়ার পর তার থেকে প্রধান পুরাণগুলোকে পৃথক করে বোঝাবার জন্য মহাপুরাণ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব, এই আঠারটি মহাপুরাণ হলো – (১) ব্রহ্ম পুরাণ, (২) পদ্ম পুরাণ, (৩) বিষ্ণু পুরাণ, (৪) শিব পুরাণ, (৫) ভাগবত পুরাণ, (৬) নারদ পুরাণ, (৭) মার্কণ্ডেয় পুরাণ, (৮) অগ্নি পুরাণ, (৯) ভবিষ্য পুরাণ, (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, (১১) লিঙ্গ পুরাণ, (১২) বরাহ পুরাণ, (১৩) স্কন্দ পুরাণ, (১৪) বামন পুরাণ, (১৫) কূর্ম পুরাণ, (১৬) মৎস্য পুরাণ, (১৭) গরুড় পুরাণ ও (১৮) ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। এগুলো হয় বৈষ্ণব, নয় শৈব, কিংবা শাক্ত মতানুসারী। তাই বলা হয়, পুরাণ হলো – বেদমূলক উত্তর বৈদিক সাহিত্য গ্রন্থ। বেদের শিক্ষাকে আখ্যান ও রূপকের সাহায্যে সাধারণ মানুষের কাছে মনোরম করে জনসমাজে প্রচার করা। যার ফলে এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যই সবচেয়ে বেশি। তাই পুরাণের অপর নাম হলো – পঞ্চম বেদ। রামায়ণ ও মহাভারতকেও এই একই অর্থে পুরাণ বলা হয়। যদিও মহাভারতের আদিপর্বের প্রথম অধ্যায়ে ব্যাসদেব মহাভারতকে সর্বশাস্ত্রের সার এবং চারবেদের তুলনায় আরো মহৎ সৃষ্টি বলে বর্ণনা করেছেন, আধুনিক গবেষকদের মতে আদিপর্বের এই সব আত্মপ্রচারমূলক অংশ অনেক পরের রচনা। মহাভারতের সামাজিক প্রতিষ্ঠার পর ঐসব অংশ সংযোজিত হয়েছে বলে তারা মনে করেন। তবুও মার্কণ্ডেয় পুরাণে প্রথম অধ্যায়ে মহাভারতকে একই সঙ্গে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষশাস্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং সমস্ত শাস্ত্রের মধ্যে একে শ্রেষ্ঠ বলে কীর্তন করা হয়েছে – “এই মহাভারতই একমাত্র শাস্ত্র যেখানে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ পৃথক পৃথক ভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন অস্ত্রের মধ্যে বজ্র যেমন শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রিয়দের মধ্যে মন যেমন প্রধান, তেমনি সমস্ত শাস্ত্রের মধ্যে মহাভারতই হলো সর্বোত্তম।” (মার্কণ্ডেয় পুরাণ)।
বেদপাঠের অনধিকারের সাথে পুরাণ রচনার সম্পর্ক, বেদের নিচে পুরাণের অবস্থান : এখানে আরেকটি বিষয় স্মর্তব্য। বেদের যুগে দ্বিজাতি ছাড়া অপর কারো বেদপাঠের অধিকার ছিল না। তাছাড়া অত্যন্ত জটিল বিচার সাপেক্ষ বেদ শাস্ত্র সকলেই বুঝতে পারবে না বলেও ধরে নেওয়া হতো। এমনকি মেধাহীন ব্রাহ্মণ সন্তানদেরও গুরুরা বেদের সামান্য দু’চার কথা শিখিয়ে গুরুগৃহ থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। সমগ্র বেদ তাদের শেখানো হতো না। অথচ বেদের মূল তত্ত্বগুলো না জানলে হিন্দুধর্মের তাৎপর্য বোঝা এবং সঠিকভাবে পূজা-পাঠ করা অসম্ভব। এই কারণেই সকলে যাতে বেদের তত্ত্বকথা গল্পের এবং ইতিহাসের মাধ্যমে বুঝে নিতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই পুরাণশাস্ত্র রচিত হয়েছিল বলে কথিত হয়। ভাগবত পুরাণে তাই ব্যাসদেব বলছেন – “শূদ্র, স্ত্রীলোক এবং নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণদের (ত্রয়ী) বেদ শেখানো হতো না বা শোনানো হতো না। এদেরকে কৃপা করে বেদ শাস্ত্রের জ্ঞান দেবার জন্যই ব্যাসদেব মহাভারতাদি পুরাণ রচনা করেছেন।” (ভাগবত-পুরাণ)। অন্যান্য পুরাণেও এ-কথার প্রতিধ্বনি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, দেবী ভাগবতেও একই কথা বলা হয়েছে – “কলিযুগের ব্রাহ্মণদের আয়ুষ্কাল অত্যন্ত অল্প এবং বুদ্ধির স্বল্পতা দেখে, তাদের সহজেই বেদ শাস্ত্রের জ্ঞান দেবার জন্য ব্যাসদেব যুগে যুগে পুরাণ রচনা করেন। স্ত্রী, শূদ্র এবং অধম ব্রাহ্মণদের বেদ শ্রবণের অধিকার নেই দেখে, তাদের মঙ্গলের জন্যই ব্যাসদেব পুরাণ সংহিতা রচনা করেন।” (দেবী-ভাগবত)। ভারতীয় পণ্ডিতেরা পুরাণশাস্ত্রকে শাস্ত্রীয় মর্যাদা দিলেও এবং অষ্টাদশ বিদ্যাস্থানের মধ্যে গ্রহণ করলেও, পুরাণের প্রকৃত ক্রমিক স্থান কিন্তু বেদের নিচে। বেদ অপৌরুষেয় শাস্ত্র, অর্থাৎ বেদ কারো রচনা নয়। ব্রহ্মের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতো তা চিরকালই আছে। তা অনাদি অনন্তকাল ধরে লোকের মুখে মুখে গুরুশিষ্য পরম্পরা ক্রমে চলে আসছে। কিন্তু পুরাণ পৌরুষেয় অর্থাৎ কোনো পুরুষের রচনা। ব্যাসদেব পুরাণ রচনার পর তার শিষ্যদের সেই পুরাণ পড়ান এবং এই শিষ্যদের দ্বারাই পরম্পরাক্রমে তা প্রচারত হয়। এই কারণে বেদ শ্রুতি প্রস্থান এবং পুরাণ স্মৃতি প্রস্থান। যদি কোনো পুরাণের কথা বেদ বিরোধী হয়, তাহলে সেই পুরাণশাস্ত্রের বচন প্রামাণ্য বলে গ্রাহ্য হবে না। সেক্ষেত্রে বেদের কথাকেই প্রমাণ হিসেবে ধরতে হবে। এটাই বেদবিহিত শাস্ত্র বিধান।
পুরাণের পাঁচ লক্ষণ : অমরসিংহের অমরকোষ অনুযায়ী পুরাণের পাঁচ লক্ষণ – পুরাণং পঞ্চলক্ষণং। এই পাঁচ লক্ষণ কী কী, তা ঐ গ্রন্থের টীকায় বলা হয়েছে – “পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ হলো – (১) সর্গ (সৃষ্টি), (২) প্রতিসর্গ (প্রলয়ের পর নবসৃষ্টি), (৩) বংশ (দেবতা ও মহর্ষিগণের বংশ তালিকা), (৪) মন্বন্তর (চৌদ্দজন মনুর শাসন বিবরণ) ও (৫) বংশানুচরিত (রাজবংশাবলি)”। এই পঞ্চলক্ষণযুক্ত প্রামাণিক গ্রন্থ হচ্ছে বিষ্ণু পুরাণ, কূর্ম পুরাণ ও বায়ু পুরাণ। কিন্তু কোন কোন পুরাণে এই পঞ্চলক্ষণের অল্পই নিদর্শন পাওয়া যায়। তার পরিবর্তে সেখানে দেবদেবীর মাহাত্ম্য ও ব্রত নিয়মাদি অন্যান্য পারমার্থিক বিষয় সবিশেষ বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া আবার কোনও কোনও পুরাণে আরও বেশি লক্ষণ আছে। যেমন স্কন্দ পুরাণে এতো বিভিন্ন বিষয়ের সমাবেশ আছে যে, শুধুমাত্র একেই একটা ‘বিশ্বকোষ’ বলা যায় বলে অনেকেই মনে করেন। সমস্ত পুরাণগুলো সংস্কৃত শ্লোকে, কদাচিৎ সংস্কৃত গদ্যে রচিত। এখানে কর্ম, ভক্তি, যোগ ও জ্ঞান এইসব বিষয়ে শিক্ষা থাকলেও পুরাণে ভক্তি-ধর্মের শিক্ষাই মুখ্য, কারণ তা জনগণের সদ্য কল্যাণকারক ও সহজেই অনুকরণীয়।
বৌদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় পৌরাণিক সাহিত্যের উদ্ভব : আমরা জানি, সম্রাট অশোকের কাল থেকে প্রাক্-গুপ্ত যুগ অবধি প্রায় পাঁচ-ছয়শো বছর ধরে দেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল প্রাবল্য দেখা দেয়। দলে দলে সাধারণ ও নিম্নকোটির মানুষেরা ধর্মান্তরিত হতে থাকে। সনাতন ধর্মের উপর বৌদ্ধ ধর্মের এই আঘাতকে সামাল দেওয়া তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের জন্য অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। তাছাড়া এই সময় থেকেই সনাতনী সমাজব্যবস্থা ধারাবাহিক অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে বিভিন্ন সংকটের মধ্যে পড়তে থাকে। ফলে এইসব আঘাতকে সামাল দিয়ে সমাজকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টাতেই বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বহুলভাবে সমৃদ্ধ ও ক্রমবিবর্তিত হতে থাকে; যার ফসল হলো আজকের বিপুল বৈদিক সাহিত্যসম্ভার ও বেদমূলক উত্তর-বৈদিক সাহিত্য – পুরাণ। বস্তুত এ জন্যেই পরবর্তীকালের পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভব। আর্য-অনার্য-ব্রাত্য ধর্মের চূড়ান্ত সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ। তখন আর্য ও অনার্য জাতির ঐতিহ্য, দেবতাবাদ, পূজা-পার্বণ সূত বা মাগধদের মুখে মুখে চলে আসা রাজকাহিনী ও শক্তিধর পুরুষদের কাহিনী ও সমস্ত কিছুকেই একত্রিত করে বর্তমানে প্রচলিত পুরাণের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা। তবে এ সমস্ত গাথা কথা যেহেতু আর্য প্রতিভায়, আর্য ভাষায় গ্রথিত হয়েছে, তাই এতে আর্য প্রাধান্য ও প্রভাব আছে বিস্তর। এই পুরাণগুলো নব-সংস্কৃতি ও নব-সভ্যতার ধারক ও বাহক। যা পরবর্তীকালের হিন্দুধর্ম, হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু সংস্কৃতি।
পুরাণ-কথক বা পুরাণ-সংকলক সূত বা মাগধ ব্যক্তিবিশেষ নয় : এখানে বলে রাখা ভালো, প্রাক্-বৈদিক কাল থেকেই এদেশে রাজ অনুগৃহীত কিছু মানুষ ছিল, যাদের কাজ ছিল – দেশে দেশে গিয়ে প্রাচীন কালের কথা, রাজা-রাজড়াদের বীরত্বের কথা, প্রাচীন রাজবংশাবলির কথা বিভিন্ন আখ্যানের মাধ্যমে একত্রিত করে জনগণের মধ্যে প্রচার করা। এদের বলা হতো সূত বা মাগধ। সূত যে জাতি-বিশেষের নাম স্মৃতি ও পুরাণে তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যেমন –
- কল্কিপুরাণ : “সেইরূপ, সূত-পুত্র লোমহর্ষণ স্বেচ্ছানুসারে নৈমিষ ক্ষেত্রে বলরামের গদা দ্বারা হত হয়েছিলেন।” (কল্কিপুরাণ- ২৭ অধ্যায়)।
- নৃসিংহ পুরাণ : “ব্যাসশিষ্য সূত লোমহর্ষণ সচ্ছন্দে উপবিষ্ট হলে, সর্বাগ্রে ভরদ্বাজ মুনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন।” (নৃসিংহ পুরাণ- প্রথম অধ্যায়)।
- কূর্ম পুরাণ : কূর্ম পুরাণে লিখিত আছে, সূত বংশোদ্ভব লোমহর্ষণ বলছেন – “আমার বংশে যে সকল সূতের উৎপত্তি হয়েছিল, তাদের বেদে অধিকার ছিল না ; তারা ভগবানের আজ্ঞানুসারে পুরাণ ব্যবসায় করতেন।” (কূর্মপুরাণ- ১২ অধ্যায়/৩৮-৩৯)।
- মহাভারত : পুরাণজ্ঞ সূত লোমহর্ষণের ন্যায় তার পুত্র উগ্রশ্রবারও যে সূত সংজ্ঞা প্রাপ্তি ঘটে তারও দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেমন – “শৌনক উগ্রশ্রবাকে বললেন সূত, তুমি অতি ভাগ্যবান এবং সুবক্তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ভগবান শুকদেব যে পবিত্র ভাগবত-কথা কীর্তন করেছিলেন, তুমি আমাদের সমীপে তা বর্ণন কর। শৌনক বললেন, তুমি যা যা বললে, সমুদায় শ্রবণ করলাম। এক্ষণে আস্তীকের জন্ম-বৃত্তান্ত জানতে অভিলাষ হয়েছে। সূত উগ্রশ্রবা এই বাক্য শ্রবণ করে শাস্ত্রানুসারে বলতে লাগলেন।” (মহাভারত-আদিপর্ব- ৪০ অধ্যায়/ ৬ শ্লোক)।”
পুরাণ কথন ছিল সূত বা মাগধ নামে বংশানুক্রমিক জাতিবিশেষের ব্যবসা : অতএব, কেবল সূত নামক ব্যক্তি-বিশেষ পুরাণ-বক্তা ছিলেন এ কথা কোনভাবেই প্রামাণিক নয়। বস্তুত পুরাণ-কথন সূত নামক জাতি-বিশেষের ব্যবসা ছিল এটাই সর্বতোভাবে যুক্তিসিদ্ধ। কেননা, পুরাণে সূত জাতির যেরূপ বৃত্তি নিরূপিত আছে, তা বিবেচনা করে দেখলেই প্রথম প্রকার পুরাণের স্বরূপ ও তাৎপর্যার্থ কিঞ্চিৎ জ্ঞাত হওয়া যায়, যেমন –
- বিষ্ণুপুরাণ : “সদ্যোজাত পৃথু রাজার শুভ যজ্ঞে সোমাভিষব-ভূমিতে ভূপতির জন্মদিবসেই সূতের উৎপত্তি হল এবং জ্ঞানবান মাগধও সেই মহাযজ্ঞে উৎপন্ন হলেন। পিতামহ ব্রহ্মা এই যজ্ঞের দেবতা। তখন মুনি সকলে তাদের উভয়কে বললেন, তোমরা এই বেণ-তনয় পৃথু রাজার স্তুতি কর, এটাই তোমাদের যথার্থ কার্য এবং তিনি তোমাদের স্তুতির উপযুক্ত পাত্র।” (বিষ্ণুপুরাণ- ১ অংশ/ ১৩ অধ্যায়/ ৫০-৫৩ শ্লোক)।
- বহ্নিপুরাণ : “সেই ঋষিগণ সূত ও মগধকে বললেন, তোমরা এই ভূপতির স্তব কর। সূত ও মাগধ তাদের কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে মহাত্মা পৃথুর সৎকীর্তি সমুদায় কীর্তন করে তাদের কল্যাণ কামনা করলেন।” (বহ্নিপুরাণ/ পৃথুর উপাখ্যান নামক অধ্যায়)।
- বায়ু ও পদ্মপুরাণ : বায়ু ও পদ্মপুরাণেও সূতের এই ধরনের বৃত্তান্ত আছে। এই দুই পুরাণে লিখিত আছে, সূতের দুই প্রকার বৃত্তি নিরূপিত ছিল – পুরাণ-কীর্তন ও ক্ষত্রিয়-কর্ম। রামায়ণ ও মহাভারতেও তাদের সারথ্য কর্ম ও রাজবংশের যশোবর্ণন এই উভয় বৃত্তি থাকার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের দ্বারাই রাজ-বংশাবলি-বিবরণ ও এবিষয়ক কিছু কিছু পুরাবৃত্ত রক্ষিত হয়ে পুরাণ নামে প্রসিদ্ধ হয়।
- মহারভারত : অক্ষয় কুমার দত্ত বলেন, রামায়ণের অন্তর্গত সুমন্ত্রের পৌরাণিক কথা তার দৃষ্টান্তস্থল। আর মহাভারতের অনেক স্থানে বংশ বিশেষের কীর্তনই যে পুরাণ বলে লিখিত আছে তারও এই কারণ। যেমন, মহর্ষি শৌনক বলছেন – “পুরাণে সমুদায় মনোহর কথা ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের আদি-বংশের বৃত্তান্ত আছে। পূর্বে আমরা তোমার পিতার সন্নিধানে সে সমস্ত কথা শ্রবণ করেছি।” (মহারভারত-আদিপর্ব- পঞ্চমাধ্যায়/২ শ্লোক)।
সূত ও মাগধ আসলে কারা : বস্তুত এই সূত ও মাগধরাই ছিলেন সেকালের রাজ-ঐতিহাসিক। এরাই পুরনো দিনের কথা, গাথা, প্রশস্তি ও আখ্যানগুলোকে পরম্পরাগতভাবে উত্তরকালের কাছে পৌঁছে দিতো। তাই সমাজে এদের বেশ মান্যতাও ছিল। এটাই ছিল আমাদের দেশের ইতিহাস রক্ষার প্রাচীন ব্যবস্থা। যদিও এই ব্যবস্থায় শ্রোতা ও বক্তার কল্পনার দৌড়ে অনেক সময়ই বাস্তবতার সীমারেখা হারিয়ে যেতো। আজ আমরা যাকে ক্রিটিক্যাল বৈচারক ইতিহাস বলি সে যুগে এ রকম কোনও নৈষ্ঠিক ব্যবস্থা চালু ছিল না। বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পর এই সমস্ত আখ্যান ও উপকথাগুলো ‘জাতক’ কাহিনির রূপ ধারণ করে। জাতক কাহিনিগুলো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৌদ্ধধর্ম মহাসম্মেলনে সংকলিত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, তৃতীয় মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (২৬৯-২৩২ খ্রিস্টপূর্ব)। এখানে বলা বোধ করি বাহুল্য হবে না যে, কোন বৈদিক আখ্যানকে বিস্তৃততর রূপ দিয়ে নিজের মত করে সাজানোর যে প্রয়াস পুরাণ সাহিত্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তা কোন্ প্রেক্ষিতে কিংবা কেন এমনটা হতে হলো সে বিষয়ে কিছুটা প্রাক্-ধারণা না থাকলে পূর্বকালীন পৌরাণিক গাথা বা সুপ্রাচীন উপাখ্যান থেকে পরবর্তীকালের অধুনাতন পুরাণ সাহিত্য রচনা বা সংকলনের কার্যকারণ ও গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবন করা যাবে না। শ্রদ্ধেয় গিরীন্দ্রশেখর বসু’র ভাষ্যে, – ‘পুরাকালে ভারতবর্ষ বহু খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক রাজার সভায় একজন করে মাগধ থাকতেন। মাগধগণ নিজ নিজ প্রভু রাজার বংশ-বিবরণ ও কীর্তিকলাপ জেনে রাখতেন। স্টেট হিস্টরিয়ন (State Historian) বললে আমরা যা বুঝি, মাগধ তাই। পূর্ববর্ণিত সূতগণ বিভিন্ন দেশের মাগধগণের কাছ থেকে সমসাময়িক ‘হিস্টরি’ সংগ্রহ করতেন। কোন মাগধ নিজ প্রভু সম্বন্ধে কোন অত্যুক্তি করে থাকলে বা প্রভুর কোন দোষ গোপন করে থাকলে সূতগণ তা সংশোধন করতেন। এজন্যই সূতগণকে সত্যব্রতপরায়ণ বলা হয়েছে। সূতগণ সকল রাজারই বংশবিবরণাদি জানতেন। পুরাকালে রাজা ও ঋষিগণ প্রায়ই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতেন। যজ্ঞে নানা দেশ হতে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ও বিদ্বান ঋষিগণ নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন। যজ্ঞে সূতগণ আগমন করে নিজ নিজ সংগৃহীত বিবরণ পাঠ করতেন। এই সূতোক্ত কাহিনী লিপিবদ্ধ করে রাখা এক শ্রেণীর ঋষির কার্য ছিল। পরম্পরাপ্রাপ্ত সূত-কাহিনী ঋষিগণ কর্তৃক গ্রন্থাকারে নিবদ্ধ হয়ে পুরাণ নামে পরিচিত হয়েছিল।’ – (পুরাণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, গিরীন্দ্রশেখর বসু অগ্রন্থিত বাংলা রচনা, পৃষ্ঠা-১৫০)। তাই অশোক রায়ের মতামত হলো, – ‘বেদের সময়কাল বা তারও আগেকার পুরাবৃত্ত, ইতিবৃত্ত, আর্য-অনার্য জাতির রূপকথা, নীতিকথা, ব্যবহারিক জ্ঞান, দর্শন, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিদ্যা, তার ভূয়োদর্শন ও সমস্ত চিন্তার ফল, তার ভাবজগৎ, কর্মজগৎ ও যা কিছু শ্রেষ্ঠ উদ্দীপনাময় ও অনুপ্রেরণাময় তার সবকিছু নিয়েই সৃষ্টি হল ভারতের অপূর্ব বিশ্বকোষ বা পুরাণ গ্রন্থরাশি। এতে অলংকারশাস্ত্র, ব্যাকরণশাস্ত্র, বৈদ্যশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, নীতিশান্ত্র এমনকি বিজ্ঞান ও ভূগোল পর্যন্ত এতে পাওয়া যায়। তাই শ্রদ্ধেয় গিরীন্দ্র শেখর বসু ও ড. রামগোপাল দেবদত্ত ভান্ডারকার মনে করেন – পুরাণ সমূহের মধ্যেই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। এফ. ই. পর্জিটার মনে করেন – বেদ অপেক্ষা পুরাণের ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বেশি। এল. ভি. বার্নেটেরও ওই একই মত। শ্রীমতি রমিলা থাপারও ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস হিসাবে পুরাণগুলোর বিশেষ গুরুত্ব আছে বলে মনে করেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ড. ভিনসেন্ট স্মিথ দেখিয়েছেন – মৎস্য পুরাণে অন্ধ্র-রাজগণের বংশতালিকা ও তাদের রাজত্বকাল সঠিকভাবে দেওয়া আছে।’ – (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৫)।
পুরাণে ইতিহাস ও পুরাণ নিয়ে বিভ্রান্তি : তবুও পুরাণের কাহিনীগুলোতে যেসব অভিনব আখ্যানাদি দেখা যায় তাতে করে আমাদের কাছে বস্তুতই পুরাণের কোন্ অংশ পুরাণ আর কোন্ অংশ ইতিহাস তা রহস্যময় বলেই মনে হয়। তবে উপনিষদের মধ্যে যে পুরাণ ইতিহাসের প্রসঙ্গ আছে, সে বিষয়ে বেদ-টীকাকার সায়নাচার্য বলেছেন – “বেদের অন্তর্গত দেবাসুরের যুদ্ধ বর্ণনা প্রভৃতির নাম ইতিহাস, আর সৃষ্টি প্রক্রিয়া-বিবরণের নাম পুরাণ।” ঋগ্বেদ-উপোদ্ঘাত)। শঙ্করাচার্যের মতও প্রায় অভিন্ন। তিনি বলেছেন – “উর্বশী পুরুরবার কথোপকথনাদিস্বরূপ ব্রাহ্মণ-ভাগের নাম ইতিহাস, আর সৃষ্টি প্রক্রিয়া-ঘটিত বৃত্তান্তের নাম পুরাণ।” (বৃহদারণ্যক-উপনিষদের চতুর্থ ব্রাহ্মণের ভাষ্য)।
পুরাণের প্রধান উদ্দেশ্য শিব, বিষ্ণু ও তাদের শক্তিগণের মহিমাকীর্তন ও এর ফলে সৃষ্ট পরষ্পরবিরোধিতা : পুরাণ ও উপপুরাণ কেবল মনঃ-কল্পিত অভিনব বিষয়েই পরিপূর্ণ এমন নয় বলে অক্ষয় কুমার দত্তের অভিমত। তিনি আরও বলেন, – ‘ঐ সমুদায় এবং তাদৃশ পুনরুদ্দীপ্ত ধর্ম-প্রণালীর অনুযায়ী অন্য অন্য গ্রন্থ-রচয়িতারা পূর্বতন ঋষি, মুনি, রাজগণাদি সংক্রান্ত প্রাচীন বিষয় সমুদায় সঙ্কলনপূর্বক নিজ নিজ গ্রন্থে সন্নিবেশ করেছেন এবং শৈব-বৈষ্ণবাদি নতুন নতুন উপাসক-সম্প্রদায় সংক্রান্ত বহুবিধ বিষয়ের সাথে সংযুক্ত করে তাদের নানারূপ অভিনব বেশ সম্পাদন করে গিয়েছেন।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, পৃষ্ঠা-২৩৪)। বস্তুত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এই ত্রিমূর্তির উপাসনা প্রচার এবং বিশেষত শিব, বিষ্ণু ও তাদের শক্তিগণের মহিমা-কীর্তন ও আরাধনা-প্রচলন করাই সমস্ত পুরাণ ও উপপুরাণের প্রধান উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্য হলো – ‘মহাভারত ও পুরাণ-কর্তাদের নিজ নিজ মত-প্রভাব-প্রচার ও সম্প্রদায়-বর্ধন-সাধন উদ্দেশে পুরাণ-বিশেষে ও উপাখ্যান-বিশেষে দেবতা-বিশেষের সমধিক মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। এই হেতু, অমাবস্যা ও পৌর্ণমাসী পরস্পর যেরূপ বিপরীত পদার্থ, ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সেইরূপ পরস্পর-বিরুদ্ধ মত সমুদায় প্রবর্তিত হয়েছে। শৈব গ্রন্থকার মহাদেবকে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্রষ্টা, বৈষ্ণব গ্রন্থকার বিষ্ণুকে ব্রহ্মা ও মহাদেবের সৃজন-কর্তা এবং শাক্ত গ্রন্থকার ভগবতীকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব তিনেরই উৎপাদন কর্ত্রী বলে বর্ণন করেছেন।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, উপক্রমণিকা পৃষ্ঠা-২৩৪)। বিষয়টি অবশ্যই আকর্ষণীয় ও কৌতুহলোদ্দীপক। আমাদের এই কৌতুহল নিবৃত্তির লক্ষ্যে পরস্পর-বিরোধী এই পুরাণ-সাহিত্যের কিছু নমুনা উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
- শৈব মতাবলম্বী লিঙ্গপুরাণ : যেমন, শৈব মতাবলম্বী লিঙ্গপুরাণের মতে, শিব ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর জন্মদাতা বলে বর্ণিত হয়েছে – “পরে মহাদেব বললেন, সুরশ্রেষ্ঠ (ব্রহ্মা ও বিষ্ণু)! আমি (নারায়ণের স্তবে) সন্তুষ্ট হয়েছি। আমি মহাদেব; আমাকে নির্ভয়ে দর্শন কর। পূর্বকালে, তোমরা দুই মহাবল (পুরুষ) আমার শরীর হতে উৎপন্ন হয়েছ। এই লোক-পিতামহ ব্রহ্মা আমার দক্ষিণ পার্শ্বে ও জগতের আত্মাস্বরূপ হৃদয়োদ্ভব বিষ্ণু আমার বাম পার্শ্বে প্রসূত হন।” (লিঙ্গপুরাণ-১৭/১-৩)।
- ভাগবত কর্তা ভাগবত-পুরাণ : অন্যদিকে ভাগবত কর্তা ভাগবত-পুরাণে বলছেন – “আমি (অর্থাৎ ব্রহ্মা) তা (অর্থাৎ বিষ্ণু) কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে সৃজন করছি এবং মহাদেব তার নির্দেশক্রমে সংহার করছেন।” (ভাগবত-২/৩/৩০)।
- বিষ্ণুপুরাণ : বিষ্ণুপুরাণে বলা হচ্ছে – “তার (অর্থাৎ ব্রহ্মার) ক্রোধানলে প্রদীপ্ত ভ্রূকুটী-কুটিল ললাট-দেশ হতে মধ্যাহ্ন কালের সূর্যপ্রভার ন্যায় প্রভা-বিশিষ্ট রুদ্র উৎপন্ন হলেন।” (বিষ্ণুপুরাণ-১/৭/১০)।
- মহাভারত : আবার মহাভারতের অনুশাসনপর্বে বলা হচ্ছে – “যিনি সর্বত্র-ব্যাপী অথচ কোথাও দৃষ্টিগোচর নন, যিনি ব্রহ্মা বিষ্ণু ও দেবরাজের সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু এবং ব্রহ্মা অবধি পিশাচ পর্যন্ত দেবগণ যার উপাসনা করেন, আমি সেই ধীমান মহাদেবের গুণ-বর্ণনে অশক্ত।” (মহাভারত-অনুশাসনপর্ব-১৪/৩-৫)।
- মার্কণ্ডেয়-পুরাণ : অপরদিকে অনেক পুরাণেই ভগবতীকে শিব-ভার্যা বলে উল্লিখিত আছে, অথচ আবার মার্কণ্ডেয়-পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যচণ্ডী-মধুকৈটভবধপ্রকরণের ৮৩ ও ৮৪ শ্লোকে তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব তিনেরই জননী বলে বর্ণিত হয়েছেন – “তুমি আমার (অর্থাৎ ব্রহ্মার), বিষ্ণুর ও মহাদেবের শরীর উৎপাদন করেছ। অতএব কে তোমার স্তব করতে সক্ষম হতে পারে?” (মার্কণ্ডেয়-পুরাণ)।
এভাবে ভক্ত-বিশেষের ভক্তি-প্রভাবে কোন পুরাণ উপাখ্যানে শিব, কোথাও বিষ্ণু এবং কোথাও বা ভগবতী সর্বপ্রধান দেবতা হিসেবে পরিকীর্তিত হয়েছেন। স্বমত-পক্ষপাতী পর-মত-দ্বেষী পণ্ডিতেরা প্রতিপক্ষের উপাস্য দেবের মহিমা খর্ব করে নিজ নিজ উপাস্য দেবতার মহিমা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই যে ঐ সমস্ত উপাখ্যান ও পরস্পর-বিরুদ্ধ মতামতগুলো উদ্ভাবন করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। আবার আপাত বিদ্বেষহীন বা সমন্বয়বাদী স্মার্ত পণ্ডিতেরা সেসব মতামত নিজেদের রুচি বিরোধী দেখে বিরোধ-নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সবগুলোকে সামঞ্জস্য-সাধনের উদ্দেশ্যে অন্যত্র এমন ভাব প্রকাশ করেছেন যে, যিনিই ব্রহ্মা, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই মহেশ্বর।
পুরাণ-শাস্ত্রে শিব ও লিঙ্গ
পৌরাণিক যুগে লিঙ্গ পূজার বিস্তৃতি : আমরা দেখতে পাই, পৌরাণিক যুগে পরম শিব ও পরব্রহ্মতত্ত্ব প্রচারের পর থেকে লিঙ্গপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে। পণ্ডিতদের মতে এই সময়টা গুপ্ত যুগ। কারণ পরবর্তী কালের মন্দিরগুলোতে মূলত লিঙ্গমূর্তিই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে মানবাকার মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিষয়গত ধারণার লক্ষ্যে অধ্যায়ের শুরুতেই শিব ও লিঙ্গ বিষয়ে এ দুয়ের অদ্বয়ত্ব, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের জন্য শৈব মতানুসারী পুরাণগুলোতে উপস্থাপিত লিঙ্গের পূজা ও তার বৈচিত্র্য ও প্রকারভেদ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে বিধায় এখানে সেগুলোর পুনরুক্তির দরকার নেই। তবে এটা জানা যায় যে, – ‘কেবল ভারতবর্ষেই নয়, ভারতের সীমা ছাড়িয়ে কম্বোজ, চম্পা প্রভৃতি রাজ্যেও লিঙ্গ পূজার প্রচলন ঘটেছিল। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী তার ‘South Indian Influences in the Far East’ গ্রন্থে কম্বোজ ও চম্পায় লিঙ্গরূপী শিবের উপাসনার কথা বলেছেন। ঐতিহাসিক ইলিয়টের মতে প্রায় ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধে কম্বোডিয়ায় লিঙ্গপূজার প্রচলন ছিল। কম্বোডিয়া অউথিয়া, লোপচুরি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ দেবতাদের সঙ্গে সঙ্গে রাম, বিষ্ণু, শিব, গণেশ, স্কন্দ, উমা, লক্ষ্মী প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য দেবতার মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। থাইল্যান্ড অঞ্চলে প্রাপ্ত শিবের ত্রিশূল, ঐ অঞ্চলে শৈব ধর্মের প্রসারের কথাই বলে।’ – (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১১)।
লিঙ্গের আবির্ভাব সম্পর্কে পুরাণ ও শিবের আদিরূপ স্তম্ভমূর্তি, জননেন্দ্রীয় ভিন্ন অন্য দিক, স্তূপ বা বৌদ্ধস্তূপের সাথে সম্পর্ক : ইতপূর্বে আমরা দেখেছি যে, শৈব তন্ত্র ও পুরাণের অনুযায়ী লিঙ্গার্চক সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হলো, শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন এবং যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যার মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই লিঙ্গ। লিঙ্গের আবির্ভাব সম্পর্কে লিঙ্গপুরাণের সপ্তদশ অধ্যায়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের বিবাদাত্মক একটি আখ্যান কথিত হয়েছে। সেই কাহিনীতে বলা হয়েছে – শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার নিয়ে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে বিরোধ থেকে ক্রমশ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বাধলো। তখন তাদের মোহ দূর করার জন্য শিব অনল স্তম্ভ রূপে তাদের দুজনের মাঝখানে আবির্ভূত হলেন – “প্রলয়-সমুদ্রের মধ্যে রজোগুণ-প্রভাবে আমাতে (অর্থাৎ ব্রহ্মাতে) ও বিষ্ণুতে বিরোধ হতেছিল, এমন সময়ে সেই বিরোধ-ভঞ্জন ও প্রবোধ-প্রদান জন্য শত-সংখ্যক কালাগ্নি স্বরূপ ও সহস্র অগ্নিশিখা তুল্য দীপ্তিমান্ লিঙ্গ উৎপন্ন হইল।” (লিঙ্গপুরাণ সপ্তদশ অধ্যায়)। প্রজাপতি ব্রহ্মার বয়ানে লিঙ্গপুরাণের বাকি উদ্ধৃতাংশটি এরকম – ‘আমরা দুজনেই তখন রজোগুণে আবিষ্ট হবার ফলে প্রলয় সমুদ্রের মধ্যে লোমহর্ষক এক মহাযুদ্ধ আমরা আরম্ভ করলাম। আমাদের পারস্পরিক বিবাদ বন্ধ করে প্রবোধের জন্য সেই সময় উভয়ের সম্মুখে আবির্ভূত হল ভাস্বর লিঙ্গ। এই লিঙ্গের আভা সহস্র শিখায় সমুজ্জ্বল অগ্নির মতই ছিল ভয়ঙ্কর। আদি মধ্য ও অন্তহীন, ক্ষয় ও বৃদ্ধিশূন্য, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত ও বিশ্ববীজস্বরূপ সেই লিঙ্গের উজ্জ্বল সহস্র শিখা দেখে মোহিত হয়ে ভগবান বিষ্ণু আমাকে বললেন – এই অগ্নির কিভাবে উৎপত্তি হল তা আমাদের পরীক্ষা করা দরকার। আমি এই অগ্নি স্তম্ভের নীচের দিকে যাচ্ছি, তুমি ওপরের দিকে যাও। সেই সময়েই ভগবান হরি তার বরাহরূপ প্রকাশ করেছিলেন। আমিও আকাশে উড়ে যাবার জন্য তখন হংসরূপ গ্রহণ করলাম।… লিঙ্গের স্বরূপ জানার জন্য শুভ্রবর্ণ হংসরূপ ধরে আগুনের মত রক্তচক্ষু ও সুন্দর পাখা যুক্ত হয়ে আমি বায়ুর মত বেগে ওপরে উড়তে লাগলাম। নারায়ণও দশযোজন বিস্তৃত শতযোজন আয়ত মেরুপর্বতের মত নীল কাজলের মত বিশাল বরাহ মূর্তি ধারণ করেছিলেন। তখন তার তীক্ষ্ণ ধারাল দাঁতগুলো সূর্যরে মত চক্চক্ করছিল, নাসিকা ঘোর গর্জন করছিল এবং হাত-পা গুলো বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করছিল। এভাবে তিনি পাতালে প্রবেশ করলেন। তৎসত্ত্বেও শূকর রূপ ধারণকারী বিষ্ণু লিঙ্গের মূল কোথায় তা সামান্য পরিমাণেও বুঝতে পারলেন না। এদিকে আমিও অনন্ত আকাশে উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, অথচ লিঙ্গের অন্ত কোথায় তা বুঝতে পারলাম না। অবশেষে অহঙ্কার-বশত নীচের দিকে নেমে এলাম। দেবতাদের উৎপত্তির বীজস্বরূপ বিষ্ণুও পরিশ্রান্ত হয়ে ভয়-কম্পিতনেত্রে শীঘ্রই মাটির তলা থেকে উপরে উঠে এলেন। মায়ার দ্বারা মুগ্ধ বিষ্ণু আমার সঙ্গে মিলিত হবার পর আমরা উদ্বিগ্ন মনে ভগবান শম্ভুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং তাকে প্রণাম করলাম।’ – (লিঙ্গ পুরাণ পূর্বভাগ, সপ্তদর্শ অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩১-২)। শিবপুরাণের বিদ্যেশ্বর সংহিতা (৩/২৭-৬১, ৫/১১, ৭/১৯-২০ ইত্যাদি) অংশের কাহিনীতে এবং লিঙ্গপুরাণ ইত্যাদির কাহিনীতেও শিবের স্তম্ভমূর্তির কথা আছে। তাই অনেক পণ্ডিত এই স্তম্ভ মূর্তিকেই শিবের আদিরূপ বলে মনে করেন। তাছাড়া আখ্যানগুলোর মৌলিক ঐক্য থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে বিন্যাসগত পার্থক্য আছে। তবে কোনও আখ্যানেই কিন্তু লিঙ্গকে জননেন্দ্রিয়ের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না। অতএব সাধারণ ভাবে পৌরাণিক ধারায় লিঙ্গোপাসনার অন্য একটা দিক আছে। পুরাণ আখ্যান অনুযায়ী আদ্যান্তহীন সেই স্তম্ভের শেষ ব্রহ্মা বিষ্ণু খুঁজে পেলেন না। শিবপুরাণে শিব তাই ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে বলেছেন – “জগৎবাসীর দর্শন ও পূজনের জন্য এই আদি ও অন্তহীন স্তম্ভ ক্ষুদ্ররূপ ধারণ করবে। ভোগাবহ এই লিঙ্গ একাধারে ভুক্ত ও মুক্তির সাধন। এই লিঙ্গের দর্শন, স্পর্শন ও ধ্যানের দ্বারা জীবের জন্ম বন্ধ ঘুচে যায়।” (শিবপুরাণ)। এ কারণে – ‘বৈদিক যূপ উপাসনা থেকেই শিবলিঙ্গের উৎপত্তির কথা অনেকে বলতে চেয়েছেন। শূলগব যজ্ঞের স্মারক হিসাবে যূপের পাশে উৎকীর্ণ বৃষমূর্তি যৌধেয়দের মুদ্রায় আবিষ্কৃত হয়েছে। আনন্দকামারস্বামী স্তম্ভপূজন থেকেই শিবলিঙ্গের উৎপত্তির কথা বলেছেন। কুষাণযুগের শেষ দিককার একটি চতুর্ভুজ দণ্ডায়মান শিবমূর্তির গায়ে স্তম্ভের মত প্রতীক দেখা যায়। … খ্রিস্টপূর্ব ২য় ও ৩য় শতকের মুদ্রার থেকে একথা যেমন একদল প্রমাণ করতে চান, তেমনি ভারতীয় ও বিদেশী শাসকদের মুদ্রার থেকে শিবপূজার আদি উৎসকে একদল আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। কারো কারো মুদ্রায় বৃষ ও যূপ অঙ্কিত দেখে তাদেরই শিব ও শিবলাঞ্ছন হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন অনেকে।” (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)।
বৌদ্ধস্তূপের সাথে লিঙ্গের সম্পর্ক? : ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলছেন, ‘বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত স্তূপ পূজা থেকে লিঙ্গ পূজার উদ্ভব ঘটেছে বলে একদল পণ্ডিত মনে করেন। আপাত ভাবে বৌদ্ধস্তূপের সঙ্গে শিবলিঙ্গের আকারগত সাদৃশ্য অস্বীকার করা যায় না। বৌদ্ধ যুগেই সাচীস্তূপ প্রভৃতির এবং পরবর্তী কালের সারনাথ, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি স্থানে স্তূপ পূজার প্রচলন ছিল এবং এখনও আছে। লিঙ্গকে যেভাবে অক্ষত, চন্দন, পুষ্প, ধূপ, দীপ প্রভৃতি দ্বারা অর্চনা করা হয় বোধিসত্ত্বাবদানকল্পলতাতেও সেই ভাবেই স্তূপ অর্চনার বিধান পরিলক্ষিত হয়। সাচীস্তূপ অবশ্য বুদ্ধকায়স্বরূপ বৌদ্ধ স্মৃতি মন্দিরেরই নিদর্শন। মনে রাখতে হবে যে শিবলিঙ্গও কিন্তু সেই অর্থে শিবপ্রতীক। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত ফলকগুলো যদি সত্য সত্যই শিবলিঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু বৌদ্ধস্তূপ অর্চনা থেকে লিঙ্গ পূজার প্রচলন ঘটেছিল – একথা বলা যাবে না, কারণ বৌদ্ধপর্বের বহু পূর্ব থেকেই সেক্ষেত্রে লিঙ্গপূজার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।’ এবং লিঙ্গপূজার উৎপত্তি যে বৌদ্ধপর্বের বহু পূর্বেই ঘটেছে ইতপূর্বের আলোচনা থেকে আমরা এই ধারণা ইতোমধ্যেই পেয়েছি।
পুরাণ ও তন্ত্রের শিবের ওপর বেদের প্রভাব : পুরাণের রচনাকাল মূলত গুপ্তযুগেই এবং লিঙ্গ পুরাণের রচনাকাল মোটামুটি ৭০০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা হয়। তবুও ভারতীয় পরম্পরা অনুসারে পুরাণগুলো বেদেরই প্রবর্ধিত রূপ। ড. উদয়চন্দ্রের মতে, – ‘তাই অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে যে – ‘পুরাণম্ বেদসম্মতম্’। পুরাণগুলো দুভাবে বৈদিক তথ্যকে ব্যবহার করেছে – (১) কোন বৈদিক আখ্যানকে বিস্তৃততর রূপ দিয়ে নিজের মত করে সাজিয়ে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেমন উমা হৈমবতীর কেনোপনিষদযুক্ত আখ্যান লিঙ্গ পুরাণে ১/৫৩/৫৫-তে আমরা পেয়েছি। (২) আবার বৈদিক মন্ত্রগুলোকে বিভিন্ন পূজা পদ্ধতির সঙ্গে পুরাণগুলো যুক্ত করেছে। লিঙ্গপুরাণে উল্লিখিত মন্ত্রগুলো আমরা নিম্নলিখিত বৈদিক গ্রন্থে পেয়ে থাকি – ঋগ্বেদের মূল অংশ, ঋগ্বেদের খিল অংশ, সামবেদ, অথর্ববেদ, মাধ্যন্দিন বাজসনেয়ী সংহিতা, বাজসনেয়ীসংহিতা, তৈত্তিরীয়সংহিতা, মৈত্রায়নী সংহিতা, কাঠক সংহিতা, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, মহানারায়ণ উপনিষদ্, নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদ্, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র, হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ইত্যাদি। মন্ত্রগুলোকে কোথাও কোথাও বিশেষ সংজ্ঞার দ্বারা বিধান করা হয়েছে, কখনো আদি অংশ উদ্ধৃত করে বিধান দেওয়া হয়েছে আবার কখনো বা মন্ত্রমধ্যস্থ অংশ তুলে হয়তো পর পর কয়েকটি মন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়েছে। এখানে যজুর্বেদের তথা কৃষ্ণযজুর প্রভাব বেশী বলেই মনে হয়েছে। … বিভিন্ন সময়েই লিঙ্গপুরাণে রুদ্রাধ্যায়ের মন্ত্র উদ্ধৃত হয়েছে এবং শতরুদ্রীয় ইত্যাদির কথাও প্রায়ই বলা হয়েছে। ‘ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্। উর্বারুকমিব বন্ধনাত্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাত্।’ ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্রকে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বলা হয়ে থাকে এবং (লিঙ্গপুরাণের) উত্তর ভাগের ৫৪ অধ্যায়ে একেই মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বলা হয়েছে। তন্ত্রের যামল ধারায় কিন্তু এই মন্ত্রকে মৃত্যুঞ্জয় বলা হয়নি। তাদের মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র আরো ছোট এবং মন্ত্রটি তান্ত্রিকমন্ত্র। বর্তমানে অনেক পুরোহিতকে (বিশেষত বাংলার বাইরেকার) লিঙ্গপুরাণোক্ত মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের সঙ্গে তন্ত্রোক্ত মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জুড়ে নিয়ে জপ করতে দেখেছি। হয়তো তন্ত্র ও বেদের মিশ্রণের ফলেই এরূপ ঘটেছে। লিঙ্গ পুরাণেও অনেক ক্ষেত্রে বৈদিক মন্ত্রটির আগে তন্ত্রোক্ত মন্ত্র পুটিত করে পাঠের বিধান পরিলক্ষিত হয়। যেমন উত্তর ভাগের ৫১ অধ্যায়ে শত্রুজয়ের জন্য ব্যবহৃত গায়ত্রী মন্ত্রের পূর্বে ‘ওঁ ফট্ জহি হুং ফট্ হিন্দি ভিন্দি জহি হন হন স্বাহা’ ইত্যাদি যুক্ত করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রের অবয়ব শাক্তদের বগলামুখী মন্ত্রের কথাই মনে করায়। এভাবেই প্রত্যেকটি মন্ত্রের আলোচনা হলে একটা নতুন দিকের আভাস পাওয়া যাবে বলেই মনে হয়। বৈদিক এবং ধর্মশাস্ত্রধৃত মন্ত্রগুলো সাধারণ ভাবে লিঙ্গপুরাণের পূর্বভাগে এসেছে এবং তন্ত্রোক্ত মন্ত্রের প্রাধান্য উত্তর ভাগে এসেছে। পাশুপতাদি শৈবধারাকে কেউ কেউ বৈদিক ধারা বলেছেন আবার কেউ কেউ অবৈদিক ধারা বলেছেন। সমন্বয়ধর্মী ব্রাহ্মণ্য রচনা পুরাণে যখন এসব ধারা বিধৃত হয়েছে, তখন তার উপর বৈদিক শান্তিবারির প্রলেপ অবশ্যই পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই লিঙ্গপুরাণে খাঁটি অবৈদিক শৈব ধারার পূর্ণ পরিচয় অবিকৃত ভাবে বোধ হয় পাওয়া যাবে না।’ – (ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ)।
পুরাণ সাহিত্যের উৎস বা পুরাণ রচনার কার্যকারণ : কিন্তু এখানে বলা বোধ করি বাহুল্য হবে না যে, কোন বৈদিক আখ্যানকে বিস্তৃততর রূপ দিয়ে নিজের মত করে সাজানোর যে প্রয়াস পুরাণ সাহিত্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তা কোন্ প্রেক্ষিতে কিংবা কেন এমনটা হতে হলো সে বিষয়ে কিছুটা প্রাক্-ধারণা না থাকলে পুরাণ সাহিত্যের উৎস বা পুরাণ রচনার কার্যকারণ ও গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবন করা যাবে না। তাই অতি সংক্ষেপে বিষয়টার কিঞ্চিৎ বিবৃতি দেয়া যেতে পারে। এখন পর্যন্ত যেটুকু জানা যায় সেই মতে, বৈদিক আর্যরা ভারতবর্ষের পশ্চিমদিক থেকে ক্রমশ পূর্বদিকে সরে এসে তাদের আর্যাবর্তের সীমারেখাকে ক্রমপ্রসারিত করেছে। কিন্তু শুরুতে তারা একই সাথে উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকেও প্রসারিত হতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তখন তো সেই দেশ একেবারে জনশূন্য ছিল না, ফলে সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রবল প্রতিরোধের সামনে আর্যদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়। সে যাত্রায় তাদের দাক্ষিণাত্য ও কাশ্মীর উপত্যকা অভিযান ব্যর্থ হয়। আর এই পরাজয়ের প্রত্যাঘাতে আর্য-সমাজজীবনে নিশ্চয়ই গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়। আমরা প্রাচীন ঋগ্বেদ-সংহিতায় দেখি বলা হচ্ছে – “হে ইন্দ্র, তুমি কারা আর্য এবং কারা দস্যু তা বিশেষরূপে অবগত হও। ঐ ব্রত বা যজ্ঞবিরোধীদের নিগ্রহ করে যজ্ঞানুষ্ঠাতা যজমানের অধীন কর। তুমি শক্তিশালী, অতএব যজ্ঞ-সম্পাদকদের সহায় হও। আমি তোমার হর্ষজনক যজ্ঞে তোমার সেই কর্ম প্রশংসা করতে ইচ্ছা করি।” (ঋগ্বেদ-১/৫১/৮)। উল্লেখ্য, মনুসংহিতার রচনাকালে আর্যাবর্তের যে সীমানা চিহ্নিত করা হয় তা হলো – “উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল এবং পূর্বে পূর্বসমুদ্র ও পশ্চিমে পশ্চিমসমুদ্র, এই চতুঃসীমাবদ্ধ ভূভাগের নাম পণ্ডিতেরা আর্যাবর্ত বলে জানেন।” (মনুসংহিতা-২/২২)। অমরকোষেও লিখিত আছে যে, বিন্ধ্য ও হিমালয় পর্বতের মধ্যগত দেশ আর্যাবর্ত অর্থাৎ আর্যদের স্থান ছিল।’ – আর্যাবর্ত পুণ্যভূমির্মধ্যং বিন্ধ্যহিমাগয়োঃ।- (অমরকোষ)। আর এই আর্যাবর্তে কারা বসবাস করবে, তাও মনুসংহিতায় বলে দেয়া হয়েছে এভাবে – “দ্বিজাতি অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরা এই সকল দেশে বসতি করবেন, শূদ্রেরা ব্যবসায় অনুরোধে যথা তথা বাস করতে পারে।” (মনুসংহিতা-২/২৪)। তার মানে কি এই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরাই আর্যাবর্তের অধিবাসী আর্য? আর শূদ্রেরা অনার্য? অন্তত মনুবচন রচনাকালে যে তা-ই ছিল এটা অস্বীকারের উপায় নেই। কেননা, অথর্ববেদ-সংহিতায় সমগ্র লোককে দুইভাবে ভাগ করার নির্দেশনাই দেয়া আছে এভাবে – “সমগ্র লোক শূদ্র ও আর্য এই দুইভাগে বিভক্ত।” (অথর্ববেদ-৪/১২০/৪)। শতপথ ব্রাহ্মণে ও কাত্যায়ন-প্রণীত শ্রৌতসূত্রেও এই বক্তব্যে প্রতিধ্বনি করে বলা হয়েছে – শূদ্রার্যৗে চর্মণি পরিমণ্ডলে ব্যযচ্ছেতে।- (কাত্যায়ন-শ্রৌতসূত্র-১০/৩/৭)। এবং এই কাত্যায়নকৃত সূত্রের অর্থে ভাষ্যকার বলেন – “আর্য শব্দের অর্থ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণ; চতুর্থ বর্ণের নাম শূদ্র।” মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের মতে, – ‘বোধ হয়, শূদ্রবর্ণ আর্যবংশীয় নয়; আর্যরো ভারতবর্ষে এসে শূদ্রনামক অনার্য-জাতি-বিশেষকে আপনাদের সমাজ-ভুক্ত করে লন।’ আর এজন্যেই বোধকরি বর্ণবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজাধিকারী মনুসংহিতায় আর্য ও অনার্য এই উভয় কুলের পরস্পর বিভিন্নতা সুস্পষ্ট করে বিধান দেয়া হয়েছে – “আর্য পুরুষের ঔরসে ও অনার্যা নারীর গর্ভে যে সন্তান জন্মে, সে সন্তান শাস্ত্রোক্ত-গুণযুক্ত হলে আর্যত্ব প্রাপ্ত হয়। আর অনার্য পুরুষের ঔরসে আর্যা স্ত্রীর গর্ভে যে পুত্র জন্মে, সে নিশ্চয়ই অনার্য।” (মনুসংহিতা-১০/৬৭)। আর্য-সমাজজীবনে গভীর সংকটের অন্যান্য উপাদান হিসেবে আমরা আরও জানতে পারি যে, এই আর্যাবর্তে প্রথম থেকেই আর্যদের মধ্যেও সকলেই কিন্তু বৈদিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিল না। এ ছাড়া আরও ছিল বিভিন্ন সময়ে বৈদিক আর্যসমাজ থেকে বহিষ্কৃত কিছু মানুষ, যাদের ‘বাহীক’ বলা হতো। এইসব দলছুটেরা সমাজে ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করতো এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে সর্বস্তরের মানুষের সাথে যথেচ্ছভাবে মেলামেশা করে এক অবৈদিক জনগোষ্ঠীর সূচনা করে। এইসব বেদবহির্ভূত জনগোষ্ঠীতে আর্য-অনার্য সকলেরই স্থান ছিল। এদেরকে সমগ্রভাবে বলা হতো – ‘ব্রাত্যজন’। সংহিতা ও ব্রাহ্মণের নৈষ্ঠিক ক্রিয়াকলাপকে প্রথমেই তারা অস্বীকার করে উপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বের জ্ঞানকাণ্ডকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে জনমানসে এক অদ্ভূত মোহের সৃষ্টি করেছিল। ফলে বহু সাধারণ মানুষ এদের প্রতি আকৃষ্ট হয় – যা এক সময়ে বৈদিক সমাজের এক সংকট হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়াও বৈদিক যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকর্মগুলো ক্রমশ বহু বিস্তৃত হয়ে অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রচুর বলিদানের প্রথাও প্রচলিত ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে চাষাবাদের উৎকর্ষের সাথে সাথে কৃষির জন্য প্রয়োজন হলো প্রচুর গো-ধনের। ফলে যাগযজ্ঞের নামে বিপুল গোধনের অপচয়ের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগোষ্ঠী প্রতিবাদী হতে শুরু করলে বৈদিক সমাজ সংগঠকদের কাছে এটাও এক নতুন সামাজিক সংকটের সৃষ্টি করে। আবার পাপপুণ্য, কর্মফল ও জন্মান্তরবাদ ইত্যাদি বিষয় নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। কারণ এ সময়ে লোকায়ত চার্বাক দর্শনের চমৎকারিত্বে বহু লোক আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও ছিলেন জাবালি ও অন্যান্যরা। তাদের দর্শনের কথা ও যুক্তিগুলোর চমৎকারিত্বে রয়েছে তাৎক্ষণিক প্রভাব ও মোহগ্রস্ততা। সমাজের কিছু ব্যবস্থার বিরুদ্ধে উত্থাপিত তাদের যুক্তি ও তীক্ষ্ণ সমালোচনায় বৈদিক জনমানসে সৃষ্ট বিভ্রান্তি সামাজিক সংকট ও অস্থিরতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হলো বহুত্ববাদী ও নিরীশ্বরবাদী কপিলের সাংখ্য দর্শনের সুস্পষ্ট বক্তব্য – প্রমাণের অভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করা গেল না এবং তাবৎ স্থাবর ও জঙ্গম (জীব ও জড় জগৎ) পঞ্চভূতের থেকে সৃষ্ট হয়ে আবার পঞ্চভূতেই লীন হয়ে যায়। তা হলে আত্মা কী? আর তার অবস্থানই বা কোথায়? আর এই তত্ত্বের নিরীখে পুনর্জন্মবাদ টেকে কী করে? কপিলের এই লোকায়তমুখী সাংখ্যদর্শন তখন জনসমাজে বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফলে বৈদিক সমাজের বাঁধনও আলগা হয়ে যায়। এই গভীর সংকট কাটিয়ে সাধারণ মানুষকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় সমাজ সংগঠকদের বহু পরিশ্রম করে বহু দার্শনিকতার অবতারণা করতে হয়। এতে করে বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিও নতুন নতুন সংকটের মোকাবিলায় ক্রমসমৃদ্ধ হতে থাকে। এমনিতেই সাধারণ মানুষ দ্বন্দ্বদীর্ণ শ্রেণিভিত্তিক সমাজে খুব একটা সুখে-শান্তিতে ছিল না। তার উপর প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ ও নানা অশান্তি লেগেই থাকতো। সে তুলনায় অপরদিকে অনার্য জীবনযাত্রা ছিল গোষ্ঠীবদ্ধ সরল ও অনাড়ম্বর। ফলে বহু মানুষ এই সরল অনাড়ম্বর গোষ্ঠীবদ্ধ সুখী জীবনযাত্রার দিকে আকৃষ্ট হতে থাকলো। এতেও সমাজে আরেকধরনের সংকটের সৃষ্টি হতে থাকে। এইসব সামাজিক সংকটকে কাটিয়ে ওঠবার উপায়ও ভেবেচিন্তে বের করতে হয়। এদিকে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবকালীন সময় থেকে সনাতনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেখা দেয় প্রবল প্রতিবাদী আন্দোলন। সে যুগে অনেকগুলো প্রতিবাদী সংগঠন সনাতন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে জৈন, বৌদ্ধ ও আজীবিকেরাই প্রধান। এদের সঙ্গে ছিল বেদ-বহির্ভূত আর্যরা। তারাও সংখ্যায় নিতান্ত কম ছিল না। এইসব আঘাতের মুখে সনাতনী ব্যবস্থা অত্যন্ত সংকটের মুখে পড়ে গেলো। দলে দলে লোক ওইসব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করছে। এই অবস্থাকে সামাল দেওয়ার জন্যে তখন সনাতন ধর্মে যেসব বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলো, জানা যায়, তার মধ্যে একটা হলো – ব্রাত্যস্তোম বা শুদ্ধি যজ্ঞ। এই যজ্ঞে সকল ব্রাত্যজন হবিপ্রদান করে, সনাতন ধর্মে দীক্ষিত হয়ে, সকলের সাথে সমাসনের অধিকার পায়। আমরা আগেই দেখেছি যে, আর্য সমাজে প্রায় গোড়া থেকেই অনার্য রক্তের সংমিশ্রণ হয়েছিল। তখন থেকেই তারা প্রাগার্য সমাজের অনুকরণে শ্রেণিবিভাগ, গোত্রবিভাগ ইত্যাদি করে বলে মনে করা হয়। তবে তখনও তাদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল না। আর তাও যেটুকুও বা ছিল তাতে লোকে সচ্ছন্দে এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে উন্নীত হতে পারতো। তাই দেখা যায় জাবালি, সত্যকাম, মহীদাস ঐতরেয়-কে নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত করে নেওয়া হয় তাদের গুণ কর্মের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। – ‘এই সময়ে সমাজে একজন শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারত’ (কপিল স্মৃতি ৮৯৬ ও ৮৯৭ শ্লোক দ্রষ্টব্য)। ব্রাহ্মণের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ত্রী মন্ত্রের রচয়িতা ক্ষত্রিয় কুলজাত বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণ্যত্ব লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ সে যুগে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ্যত্ব একান্তই জন্মার্জিত বা রক্তের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল ছিল না। যথাযথ সংস্কারের উপরেই তা একান্ত ভাবে নির্ভরশীল ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, সে যুগে আর্য সমাজজীবনে সামাজিক সচলতা বা সোশ্যাল মোবিলিটি ছিল।… এ ছাড়াও অনার্যদের প্রধান দেবতা ছিলেন ‘আদি শিব’, যা পরবর্তীকালে সমগ্র ব্রাত্যজনের গণদেবতা। ঋগ্বেদ সংহিতাতে তিনি বৈদিক রুদ্রের সমীকরণ হয়ে খুবই অপ্রধান দেবতারূপে স্তুত ছিলেন। সেই দেবতাকে সনাতনী ধর্মে প্রাধান্য দিয়ে সামনের সারিতে নিয়ে আসা হল – আমজনতাকে আকৃষ্ট করবার একমাত্র আকুল অবলম্বন হিসাবে।— বৈদিক সংস্কৃতির মহিমা মণ্ডিত হয়ে রুদ্রদেব সনাতনী ধর্মকে রক্ষা করবার একমাত্র উপায় হিসাবে যজুর্বেদের দুই শাখাতেই বিপুলভাবে স্তুত হয়ে দার্শনিকতার চরমোৎকর্ষতা লাভ করে পরমাত্মায় পর্যবসিত হলেন। তাই রুদ্রাধ্যায়ের প্রতিটা মন্ত্রেই যে কবিত্ব শক্তি ও দার্শনিকতার পরাকাষ্ঠা দেখা যায় তা আজও বৈদিক সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। … কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা করা গেল না। যে অতুলনীয় কবিত্বশক্তি ও অসাধারণ দার্শনিকতা দিয়ে ‘গণদেবতাকে’ বন্দনা করা হল, তা সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধির জগতের অনেক অনেক ঊর্ধ্বের কথা। ফলে সাধারণ মানুষ এতে আকৃষ্ট হল না। তারা চায় তাদের প্রাণের ঠাকুরকে প্রাণের ভক্তি আর উষ্ণতা দিয়ে বাঁধতে। পেতে চায় আরও আরও নিবিড় করে। ফলে প্রচেষ্টা যতই মহৎ ও মহাকালের সম্পদ হোক না কেন, তা দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটল না।’- (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৪)। এই তাৎক্ষণিক প্রয়োজন না-মেটার প্রেক্ষিতে তখন অন্য উপায়ের কথা ভাবা হতে লাগলো, যা দিয়ে সমাজকে আবার নতুনভাবে সংগঠিত করে তোলা যায়। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে রাজ অনুগৃহীত কিছু মানুষ ছিল, যাদের কাজ ছিল – দেশে দেশে গিয়ে প্রাচীন কালের কথা, রাজা-রাজড়াদের বীরত্বের কথা, প্রাচীন রাজবংশাবলির কথা বিভিন্ন আখ্যানের মাধ্যমে একত্রিত করে জনগণের মধ্যে প্রচার করা। এদেরকে বলা হতো সূত বা মাগধ – ইতপূর্বে যাদের কথা আলোচিত হয়েছে – এরাই ছিলেন সেকালের রাজা-রাজড়াদের রাজ-ইতিহাসবক্তা। এরাই পুরনো দিনের কথা, গাথা, প্রশস্তি ও আখ্যানগুলোকে পরম্পরাগতভাবে উত্তরকালের কাছে পৌঁছে দিতো। সমাজে এদের বেশ মান্যতাও ছিল। এটাই ছিল আমাদের দেশের ইতিহাস রক্ষার প্রাচীন ব্যবস্থা। যদিও এই ব্যবস্থায় শ্রোতা ও বক্তার কল্পনার দৌড়ে অনেক সময়ই বাস্তবতার সীমারেখা হারিয়ে যেত। অশোক রায়ের ভাষ্যে – ‘আজ আমরা যাকে (ক্রিটিক্যাল) বৈচারক ইতিহাস (‘ইতিহ-আস’ হল ইতিহাস) বলি সে যুগে এ রকম কোনও নৈষ্ঠিক ব্যবস্থা চালু ছিল না। … বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পর এই সমস্ত আখ্যান ও উপকথাগুলো ‘জাতক’ কাহিনির রূপ ধারণ করে। জাতক কাহিনিগুলো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৌদ্ধধর্ম মহা সম্মেলনে (তৃতীয় মহাসম্মেলন সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ২৬৯-২৩২ খ্রি. পূ.) সংকলিত হয়ে যায়। এরপর সম্রাট অশোক থেকে প্রাক্-গুপ্ত যুগ অবধি, এই পাঁচ-ছয়শো বছর ধরে দেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল প্রাবল্য দেখা দেয়। দলে দলে সাধারণ ও নিম্নকোটির মানুষেরা ধর্মান্তরিত হতে থাকে। সনাতন ধর্মের উপর বৌদ্ধ ধর্মের এই আঘাতকে সামাল দেওয়ার জন্যেই পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভব। আর্য-অনার্য-ব্রাত্য ধর্মের চূড়ান্ত সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ। তখন আর্য ও অনার্য জাতির ঐতিহ্য, দেবতাবাদে, পূজা-পার্বণ সূত বা মাগধদের মুখে মুখে চলে আসা রাজকাহিনি ও শক্তিধর পুরুষদের কাহিনি ও সমস্ত কিছুকেই একত্রিত করে পুরাণের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা। তাই বলা হয় – পুরাভরম্ ইতি পুরাণম্। অর্থাৎ যা পুরনো দিনের কথা – তাই পুরাণ। তবে এই সমস্ত গাথা কথা যেহেতু আর্য প্রতিভায়, আর্য ভাষায় গ্রথিত হল, তাই এতে আর্য প্রাধান্য ও প্রভাব আছে বিস্তর। এই পুরাণগুলো নব-সংস্কৃতি ও নব-সভ্যতার ধারক ও বাহক। যা পরবর্তীকালের হিন্দুধর্ম, হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু সংস্কৃতি।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৫)।
বেদে হিন্দুধর্মের প্রতিমাপূজার অনুপস্থিতি : বলা বাহুল্য, বর্তমানে হিন্দুধর্মে যে প্রতিমাপূজা ভারতবর্ষের সর্বত্র দেখা যায়, বেদে তার কোনও উল্লেখ নেই। সেখানে দেবতারা মন্ত্রময়ী ও অপুরুষবিৎ। প্রাগার্য বা অনার্যরাই মূর্তি পূজা করতো। অথচ তাদের দেব-দেবীরাই পৌরাণিক যুগে আর্য প্রজ্ঞায় মহিমান্বিত হয়ে এক-একটা গুণকে আশ্রয় করে, এক এক দেবদেবীর মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে। যেহেতু মাটি বা ধাতুর প্রতিমায় দেবতার আবির্ভাব, তাই তার পাদ্য-অর্ঘ্য, ধূপ-দীপ, পুষ্প-পত্র ও নৈবেদ্য দিয়ে অর্চনা করা হয়েছে। দেবতার তৃপ্তির জন্য বাদ্য, গীত ও নৃত্য ইত্যাদি আড়ম্বরের আয়োজন করা হয়েছে। ফলে বৈদিক দেবতারা বৈদিক উপাসনা-পদ্ধতির মতোই ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, যদিও পৌরাণিক দেবতারা একেবারে বেদ-বহির্ভূত সম্পূর্ণ নতুন দেবতা হয়তো নন, কিন্তু আমরা জানি যে, ঋগ্বেদের দেবসভায় তাদের স্থান ছিল নিতান্ত অপ্রধান ও নগন্য। তাহলেও প্রশ্ন আসে – মন্ত্রদ্রষ্টা আর্য ঋষি ও ব্রহ্মজ্ঞানীর প্রজ্ঞা কেন এই অধমাধম মূর্তি পূজাকে সাদরে গ্রহণ করলো ! অশোক রায়ের ভাষ্যেই এর উত্তর খোঁজা যেতে পারে, –‘খুব সম্ভবত প্রতিমা শব্দটার মধ্যেই তাদের চিন্তার মূল সূত্র পাওয়া যায়। প্রতিমার অর্থই – প্রতিমূর্তি, কল্পিত শরীর বা Image যা আসল বা স্বরূপ নয়; কিন্তু আসলের ছায়ায় তারই গুণাবলম্বনে রূপ-কল্পনা মাত্র। কবিরা যেমন প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষকে স্পষ্ট করে বোঝাবার জন্যে উপমার আশ্রয় নেন। মুনিরাও তেমনি অপ্রত্যক্ষ, অরূপ কিন্তু গুণময়কে বোঝানোর জন্যে গুণাশ্রয়ে রূপের কল্পনা করে থাকেন। শাস্ত্রে আছে – ব্রহ্ম যদিও চিন্ময়, অপ্রমেয়, তবু সাধকের হিতের জন্যে তারও রূপ কল্পনা করা হয়। নির্গুণ ও অশরীরী, ব্রহ্মসদ্ভাব উত্তম, ধ্যানভাব মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম, বাহ্য পূজা অধমেরও অধম। কিন্তু এতে ব্রহ্ম সান্নিধ্য আসে; তাই নিষ্ক্রিয়তা, নাস্তিকতা বা ব্রহ্মবিমুখতা থেকে সহস্রগুণ বরণীয়। মহানির্বাণ তন্ত্রে আছে – ধ্যান, ধারণা বা স্তুতিরূপ অন্তপূজা; প্রতিমা পূজা বাহ্যপূজা, তা যে অধম তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রূপ, চিহ্ন বা প্রতীক অথবা শব্দ-আশ্রয় না করে অশব্দ, অস্পর্শ, অলিঙ্গ, অরূপ, অব্যয়ের ধারণা ও আরাধনা করতে পারেন কয়জন। সাধারণ মানুষের পক্ষে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য না নিয়ে অতিরিন্দ্রিয়কে অনুভব করা সম্ভব কী?’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৭)। রূপ দর্শনেন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য বিষয়, অবশ্যই তা অনেক স্থূল। কিন্তু পুরাণকারেরা হয়তো মনে করলেন – প্রথম অবস্থায় সগুণ-সাকার ঈশ্বরের গুণাবলিকে রূপ-প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারলে সাধারণ লোকের পক্ষে রূপাশ্রয়ে গুণের উপলব্ধি করা সহজ হবে। তাই সাধকেরা রূপাবলম্বনে উপাসনা করতে করতে অরূপ-জ্যোতি ও পরে স্বরূপ-সত্তার উপলব্ধি করেন। চঞ্চলচিত্ত মানুষ দেবতা বা ইষ্টের শ্রীমূর্তি ধ্যানের পথ ছেড়ে বাহ্য বিষয়ে বা বাহ্য রূপের নেশায় ধাবিত হয়। এই অবস্থায় অভ্যাসযোগ অবলম্বনীয়। ক্রমাগত অভ্যাস যোগের দ্বারা চিত্তের বিক্ষেপ হয় প্রশমিত। বাহ্য রূপের প্রতি সংসারী জীবের যে স্বাভাবিক প্রবণতা তখন তা মুছে যেতে থাকে। ক্রমে ইষ্টমূর্তিতে চিত্ত লয়প্রাপ্ত হয়। পরে তন্ত্রের আলোচনায় এই মূর্তি কল্পনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হয়েছে। তবে ভাব কিভাবে রূপ পরিগ্রহ করে তার দৃষ্টান্ত দেখাতে গিয়ে অশোক রায়ের বর্ণনায় – ‘ভাব কীভাবে রূপ পরিগ্রহ করে সরস্বতীর মূর্তি লক্ষ করলেই তা সহজেই বোঝা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় তিনি আর্য ঋষি প্রজ্ঞায় ছিলেন – অম্বিতমে দেবী তমে বা নদীরূপী দেবীরূপী চ। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনিই জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বিদ্যার আলোকে সমস্ত অবিদ্যার অন্ধকার দূরীভূত করেন। তাই তিনি সর্বশুক্লা – এক অখণ্ড জ্যোতিস্বরূপা। তার বর্ণ শুক্ল, বসন শুক্ল, আসনের হংস ও পদ্মও শুক্ল; তিনি শুদ্ধ সত্ত্বগুণময়ী – তাই জ্যোতির্ময়ী। তার এক হাতে পুস্তক, যা যাবতীয় বিদ্যার প্রতীক, অপর হাতে বীণা, যা মহানাদ বা প্রণব; অথবা গীতবাদ্য ইত্যাদি, যা সুকুমার কলার প্রতীক। যোগীগণের প্রস্ফুটিত মানস-শতদলে শুদ্ধ বিদ্যার অধিষ্ঠঅন। নীর ত্যাগ করে ক্ষীর গ্রহণ করতে পারে যে মরাল, সেই তার বাহন।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৯)। এভাবে পরমেশ্বরের একেকটা গুণকে আশ্রয় করে একেকটা দেবদেবীর রূপ কল্পনা হতে হতে পৌরাণিক যুগে দেবদেবীর সংখ্যা অগণিত পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। তবে দেবদেবীর সংখ্যা যাই হোক, শাস্ত্রকারেরা দেবতার একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বকে কখনোই বিস্মৃত হননি। তাই ইষ্ট দেবতা শিব, বিষ্ণু অথবা শক্তি যিনিই হোন না কেন, আরাধনার সময় প্রত্যেক দেবতাই সৃষ্টি-স্থিতি ও লয়কারী – সর্বশক্তিমান, সর্বগুণাধার পরমেশ্বর রূপেই অর্চিত হয়ে থাকেন। ভক্তের রুচিভেদ ও প্রকৃতিভেদের জন্যই এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের বহুরূপের উপাসনা দেখা যায়। তবে পৌরাণিক যুগে দেব-পরিকল্পনার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো – ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর – এই ত্রিমূর্তি বা ত্রয়ী। আবার এই ত্রিমূর্তিই এক দেহে লীন হয়ে – পরমাত্মা পরমেশ্বর। যিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের নিয়ন্তা। এ দেবতা নতুন, তার রূপকল্পনাও নতুন, এমনকি পূজাবিধিও নতুন। এখানে বৈদিক যাগ-যজ্ঞ বা উপনিষদের অরূপের ধ্যান-ধারণা আর নেই। এই পৌরাণিক কল্পনায় আমরা দেখি – ‘ধ্যান-স্তিমিত-লোচন, চতুরানন ব্রহ্মা রক্তপদ্মে উন্নত উজ্জ্বল দেহ, বাম করে কমণ্ডলু, দক্ষিণ করে যজ্ঞের স্রুব বা হাতা, অপর দুই হাতে জপমালা ও অভয় মুদ্রা। তার বামে সাবিত্রী দেবী, দক্ষিণে সরস্বতী, সম্মুখে বেদরাশি, পুরাভাগে ঋষিগণ বেদধ্বনি করছেন। তিনি দেবতা ও অসুরদের পিতামহ, তিনি প্রজাপতি, তিনি কখনও হংসপৃষ্ঠে আরোহণ করে থাকেন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, অনাদি অনন্ত কাল ধরে নিরন্তর অসংখ্য জগৎ ও জীবসৃষ্টি করে চলেছেন।’ বৈদিক বিষ্ণু এখন পৌরাণিক বিষ্ণু-নারায়ণ। জ্যোতির্ময় সবিতৃ মণ্ডলের মধ্যে পদ্মাসনে উপবিষ্ট, তার হিরন্ময় অঙ্গে কেয়ূর, কিরীট, কুণ্ডল ও হার। তিনি চতুর্ভুজ; তার চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। তিনি সর্বদা জগৎপালক।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০০)।
পুরাণপূর্ব শিব নিয়ে পূর্বোক্ত আলোচনাগুলোর সংক্ষিপ্ত রিভিশন :
- আদিবাসী সমাজে ‘বীরকাঁড়’, সৃজন শক্তির প্রতীক রূপে ‘লিঙ্গযষ্টিতে’ : আর দেবাদিদেব মহেশ্বর শিব? ইতপূর্বেই আলোচনা হয়েছে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের ‘সমাধি প্রস্তর’ এক সময়ে বিবর্তিত হয় – আত্মা প্রস্তরে, যা আজও আদিবাসী সমাজে ‘বীরকাঁড়’ বলে পরিচিত। তারপর ভূমিকর্ষণের প্রয়োজনীয়তায় সৃজন শক্তির প্রতীক রূপে ‘লিঙ্গযষ্টিতে’।
- সিন্ধু সভ্যতায় পশুপতি, লিঙ্গরূপে পূজিত : তারপর সিন্ধু সভ্যতায় আমরা আদি শিবকে দেখতে পাই – পশুপতি রূপে। এখানে তিনি কেবল একাই নন, একই সাথে পূজিত হতে দেখি আদি মাতাকেও। সেখানে তারা যে সৃজন শক্তি ও উর্বরা শক্তির প্রতীক লিঙ্গ ও যোনি রূপে আলাদা আলাদাভাবে পূজিত হতেন, এ-বিষয়ে বিদ্বান মহলে সকলেই প্রায় নিঃসন্দেহ।
- ঋগ্বেদের কালে অপ্রধান ধ্বংসের দেবতা রুদ্র, রুদ্রের বিশেষণ হিসেবে শিব : এরপর বৈদিক যুগে ঋগ্বেদের কালে তিনি শিশ্নদেব রূপে নিন্দিত হলেও, পরবর্তীকালে বৈদিক দেবমণ্ডলীতে একজন অত্যন্ত অপ্রধান ধ্বংসের দেবতা রুদ্ররূপে স্তুত। এ সময় শিব কথাটা ছিল রুদ্রের বিশেষণ।
- উপনিষদে মঙ্গলময় রূপ পরিগ্রহণ, দার্শনিক প্রকাশ, শিবের বিশেষণ হিসেবে রুদ্র : এরপর উপনিষদে – বিশেষ করে শ্বেতাশ্বতরে – কিছু কিছু জায়গায় তিনি একটু একটু করে মঙ্গলময় রূপ পরিগ্রহ করতে থাকেন। কিন্তু যজুর্বেদের দুই শাখাতেই তিনি বিপুলভাবে স্তুত হয়ে পরমাত্মায় পর্যবসিত হন। এই সময়েই তার মঙ্গলময় রূপে দার্শনিক প্রকাশ চরমোৎকর্ষ লাভ করে। ইতপূর্বে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে ঋগ্বেদের যুগে শিব কথাটা ছিল রুদ্রের বিশেষণ, আর এখন রুদ্র শব্দটা হয়ে দাঁড়ালো শিবের বিশেষণ। ফলে যজুর্বেদের রুদ্রাধ্যায়ে তিনি বন্দিত হলেন – “শম্ভুকে নমস্কার, সুখভবকে নমস্কার। শঙ্করকে নমস্কার, সুখকরকে নমস্কার। শিবকে নমস্কার, শিবতরকে নমস্কার।” এখানে শম্ভব, ময়োভব, শঙ্কর, ময়ষ্কর ও শিব – প্রতিটা শব্দের একই অর্থ – কল্যাণ সুন্দর মঙ্গলময় রূপ। এ শুধু শিবই নয়। ‘শিবতর’ অর্থাৎ অধিকতার মঙ্গলদায়ক ও কল্যাণজনক। অশোক রায়ের ভাষ্যে, এই সময় তিনি বৈদিক অগ্নিদেবতারও কয়েকটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিবরূপে লীন হন। তাই বলা হয় – শিব বা মহেশ্বর রজতগিরির ন্যায় শুভ্র। তার পঞ্চমুখ ও ত্রিনয়ন, ললাটে চারুচন্দ্র, পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম। পদ্মাসীন এই দেবতা সতত অমর-গণ কর্তৃক বন্দিত হয়ে বরাভয় হস্তে নিখিলের ভয় হরণ করছেন। মহাপ্রলয়ের তাণ্ডবে মত্ত হয়ে তিনিই রূদ্ররূপে বিশ্বসংহার করে থাকেন। শিবের বাহ্যরূপ বিচার করলে অনার্যভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু আর্য প্রতিভা তার সমগ্র তত্ত্ব-বিচার করে তাদের প্রজ্ঞায় তাকে সংস্কৃত করেছেন, শুদ্ধ করেছেন। রূপকাশ্রয়ে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়ে মোহনীয় ও বরণীয় করেছেন; আর সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্-এর প্রকাশে সম্পূর্ণ করার প্রয়াস নিয়েছে। কারণ – ‘আর্যপ্রজ্ঞা অনুভব করেছিল, অগণিত অনার্য ও ব্রাত্য নরনারীর নিত্য-পূজিত এই শ্মশাসচারী উন্মত্ত গণদেবতাই ধর্ম সংকটের কালে একমাত্র ত্রাতা। যখন সাধারণ মানুষ বৈদিক যাগ-যজ্ঞ, ক্রিয়াকর্ম, আচার-অনুষ্ঠানের বিপুল ব্যায়বাহুল্যতা ও ক্রিয়াসর্বস্বতায় বীতশ্রদ্ধ, তখন মানুষের কাছে তিনিই এই সবের (যাগ-যজ্ঞ, ক্রিয়া-কর্মের) ঊর্ধ্বের একমাত্র গণদেবতা। যার পূজায় নারী-পুরুষ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল, পণ্ডিত-মূর্খ সকলেরই সমান অধিকার। ভক্তি ছাড়া তার পূজায় আর অন্য কোনও উপচারই লাগে না। শুধু একটা বেলপাতা, শুধু একটু জল, তাতেই আশুতোষের পরম তুষ্টি। তাই আর্য ঋষিপ্রজ্ঞা তাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন। বৈদিক রুদ্র দেবতার অঙ্গীভূত করে শিব দেবতাকে তারা নতুন ভাবে প্রকাশ করলেন। এর আগেও তারা একবার প্রকাশ করেছিলেন – যজুর্বেদে।’ (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০১)।
পুরাণে আর্য প্রজ্ঞায় শিবের অনার্যরূপের মহিমান্বিত প্রকাশ : ‘কিন্তু বর্তমান রূপই হল শিবঠাকুরের পৌরাণিক রূপ। তার প্রত্যেকটা ভূষণ ও আচারকে অপূর্ব দার্শনিক রূপকাশ্রয়ে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়ে এমনভাবে মহিমান্বিত করলেন যা সকলের কাছে গ্রহণীয়, আদরণীয় ও বরণীয় হয়ে সমগ্র হিন্দু জনমানসে পরমাত্মার রূপ পরিগ্রহ করল।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০১)। তার যে অনার্য রূপের পরিচয় ছিল, তিনি কখনও ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত, আবার কখনও বা উলঙ্গ; কণ্ঠে সর্পমালা, বৃষভ তার বাহন, পর্বতে তার বাস, ভূতপ্রেত নিয়ে শ্মশানে-মশানে তার বিচরণ; আর চিতাভস্ম গায়ে মেখে তিনি বিষ, সিদ্ধি বা ধুস্তুর সেবন করেন – এই কথাগুলোকেই দার্শনিকতায় মহিমামণ্ডিত করে বলা হলো – ‘চতুষ্পদ ধর্মরূপী বৃষই হল বৃষভ দেবতার বাহন। তিনি উলঙ্গ নন, দিগম্বর – দিক ব্যাপি অম্বর যার। তিনি বিশ্বব্যাপী ভূমা। তার আবার বসন হবে কী করে? প্রপঞ্চ – পরাঙ্মুখ মহাযোগী। তিনি বাঘাম্বর ও বাঘাম্বরেই ধ্যানাসীন। পৃথিবীর যত ভয়স্থান, যত দুঃখ, যত ব্যাধি, যত বিপদ ও যত অমঙ্গল, এমনকী বিষধর সর্প এই সমস্ত কিছুকেই নিজ অঙ্গে অঙ্গভূষণ করে, জটায় কিরীট-ভূষণ করে, পরম মঙ্গলময় শিব যেন নির্বিকার। তার অগণিত রত্ন-ভাণ্ডার তিনি স্পর্শও করেন না। সেবক কুবের তা ভোগ-রক্ষা করে চলেছেন। শ্মশানের চিতা বিভূতি অঙ্গে মেখে সংহারের দেবতা সৃষ্টির ক্ষণভঙ্গুরত্ব ও সংসারের নশ্বরত্বই যে এই জগতের চরম পরিণাম, একান্ত বৈরাগ্যভরে তা ঘোষণা করছেন। দেবাসুরের (সংসার?) সমুদ্র মন্থনে যখন অমৃত উঠল তখন কেউই শিবকে স্মরণ করল না। তারপর যখন বাসুকী নাগের উদ্গীর্ণ কালকূট, হলাহল বা গরলে বিশ্ব-বিনাশ হয় হয়; তখনই একমাত্র তিনিই সেই হলাহলকে পান করে বিশ্বকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। পরম মঙ্গলময় দেবতা তিনি, তাই জগতের সমস্ত অমঙ্গল বিষকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে – নীলকণ্ঠ বা নীললোহিত। … তার তৃতীয় নেত্র হল – প্রজ্ঞানেত্র। যোগীরাজের যোগসিদ্ধিজাত এই জ্ঞাননেত্র। তাই এই নেত্রজাত জ্ঞানবহ্নি দ্বারাই তিনি রতি-সহায় মদনকে ভস্মীভূত করে উমার পরিণয়-প্রসঙ্গে কামের দৌত্যকে অস্বীকার করলেন। এই জ্ঞাননেত্রের কেবল উপরিভাগই ভক্তের প্রতি অমৃত-বর্ষী স্নিগ্ধ চন্দ্রকলায় দীপ্যমান। তারই জটিল শীর্ষ অবলম্বন করেই ভূলোকে গঙ্গাবতরণ হয়। হিমালয়ের গভীর অরণ্যানী তারই জটাজালের আভাস। সেই জটারণ্যের জালে ঘুরে ঘুরে সুরধুনি মন্দাকিনীর মর্ত্যে অবতরণ। বুদ্ধদেবের ধ্যান-প্রশান্ত রূপের মহিমাই তাকে সংসার-বিরাগী যোগীরাজরূপে পরিচিত করেছে। তিনিই তন্ত্রের মহাভৈরব, বেদের মহারুদ্র। আবার তিনিই নটরাজ রূপে বিশ্ব-সৃষ্টি লীলায় ও প্রলয়-তাণ্ডবে উন্মত্ত। বামে উমাকে সঙ্গিনী করে তিনিই সাংখ্যের প্রকৃতি ও পুরুষরূপে প্রকাশিত। তিনিই আদর্শ গৃহী। দশদিকে দশভূজ বিস্তার করে সিংহবাহিনী অসুরমর্দিনী মহাশক্তি দুর্গা তার গৃহিণী। ঋদ্ধি ও বিদ্যা স্বরূপা লক্ষ্মী ও সরস্বতী তার দুই কন্যা। বল ও সিদ্ধিরূপী কার্তিক ও গণেশ এই দুই পুত্রকে নিয়ে মহাগৃহী শংকর। … তার হস্ত-ধৃত ত্রিশূল জীবের ত্রিতাপ বিনাশকারী, তিনি জ্ঞানেশ্বর, সাক্ষাৎ পরমজ্ঞানী। শিবশক্তির ভেদ ঘুচিয়ে তিনিই বেদান্তের অদ্বৈত ব্রহ্ম; রজতগিরিনিভকান্তি পরম জ্যোতি স্বরূপে প্রকাশমান। এই পুরুষ থেকেই মঙ্গলজাত বলে তিনি – শিব ও শম্ভু; মঙ্গলময় বলে – শংকর। তিনি আশুতোষ, মৃত্যুঞ্জয়; ভূজগভূষণ, নীলকণ্ঠ; তিনিই স্মরহর, চন্দ্রশেখর; আবার তিনিই গঙ্গাধর, পরমেশ্বর, তিনিই পরমব্রহ্ম। … তার কত নাম, কত রূপ; কত কাহিনি তাকে আশ্রয় করে পর্বতে, নদীতটে, অরণ্যে, নগরে ও গ্রামে। কত শত কুৎসিত কাহিনি প্রেত-পিশাচের মতো তাকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে তার ইয়ত্তা নেই। সত্যিই তিনি দেবাদিদেব মহাদেব। সর্বভাব, সর্বধর্ম ও সর্বজ্ঞতা তার মধ্যেই এসে মিশেছে, যেন মানুষের কল্পনার চূড়ান্ত পরিস্ফূর্তি এখানেই। তাই শৈব সাধকেরা উদার মন্ত্রে বলেন – যত্র জীব তত্র শিব।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০২)।
আদি পিতা ও আদি মাতার পৃথক পূজা, পৌরাণিক যুগেও সমন্বয়ের অভাব : পৌরাণিক কল্পনায় এই পুরো বিষয়টা আর্য প্রজ্ঞায় ও সংস্কৃতিতে রচিত হয়েছিল বলেই ব্রাহ্মণ্যবাদের মূর্ত প্রতীক ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে স্থান দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ স্বর্গ – বৈকুণ্ঠে, এবং সেখানে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মা লক্ষ্মীর সাথে অধিষ্ঠিত। আর শিব ঠাকুরের স্থান হলো মর্ত্যরে মেরুপর্বত – কৈলাসে। সেখানে তার সাথে অধিষ্ঠিতা হলেন – শিবজায়া মা দুর্গা। বলা হয়, পৌরাণিক যুগের আরেক শ্রেষ্ঠ অবদান হলো মার্কণ্ডেয় পুরাণের শ্রীশ্রীচণ্ডী। পরে শক্তি-সাধনা প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। তবু বর্তমান আলোচনায় খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাংলায় শরৎকালে ঘরে ঘরে যে মহাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, আজ তা বাঙালি হিন্দুর জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মতো শ্রীশ্রীচণ্ডীও হিন্দু-সম্প্রদায়ের নিত্য পাঠ্য গ্রন্থ। তবে এর মাহাত্ম্য অন্যরকম। অশোক রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, এখানে মহাদেবীর তিনটি চরিত্র দেখা যায়। প্রথম চরিতে মধু-কৈটভ-বধ; মধ্যম চরিতে মহিষাসুর-বধ; আর উত্তর চরিতে শুম্ভনিশুম্ভ-বধ। ‘মধ্যম চরিতে – মহিষাসুর স্বর্গভূমি অধিকার করলে, ক্রুদ্ধ দেবতাদের দেহসম্ভূত তেজরাশি পুঞ্জীভূত হয়ে এক জ্বলন্ত পর্বতের রূপ ধারণ করে। সেই মিলিত মহাতেজ থেকেই নারীরূপে মহাশক্তির আবির্ভাব। আর এই মহাশক্তিই দেবগণ দ্বারা পূজিতা হয়ে, মহিষাসুর বিনাশ ও স্বর্গভূমি উদ্ধার করেন। তিন চরিতে দেবীর চারটে স্তব আছে, যার মহিমা অতুলনীয়। চৈতন্যই শক্তি, আর শক্তির বহুবিধ প্রকাশই হল – সৃষ্টি। এই শক্তিই মায়া; যার প্রভাব কেউই অতিক্রম করতে পারে না। তাই জগতের সমস্ত প্রাণী ও মানুষ মহামায়ার প্রভাবে মোহিত হয়ে নিজ নিজ কার্য করে চলেছে। কিন্তু কে এই দেবী? মুনি বলেন – তিনিই সৃষ্টিকারিণী, স্থিতি ও সংহারকারিণী শক্তি; মহাবিদ্যা, মহামায়া ও মহাসুরী তিনিই; তিনি কালরাত্রি ও মোহরাত্রি; তিনি শ্রী, লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষান্তি; তিনি সৌম্যা, সৌমরতা থেকেও অতীব সুন্দরী; সৎ, অসৎ যাবতীয় বস্তুর তিনিই একমাত্র শক্তি – দেবী পরমেশ্বরী। … পুণ্যবানের ঘরে তিনি – লক্ষ্মীস্বরূপা; পাপাত্মার ঘরে – অলক্ষ্মীস্বরূপা। বুদ্ধিমানের হৃদয়ে – বুদ্ধি, সাধুর অন্তরে – শ্রদ্ধাস্বরূপা। তিনি সর্বভূতে মাতৃরূপে ও সর্ববিধ শক্তিরূপে অবস্থিতা। তিনিই বিশ্বের বীজ, পরমা মায়া। সমস্ত বিদ্যা ও সমস্ত নারী তারই রূপভেদ। সমগ্র জগৎ তারই প্রভাবে সম্মোহিত। একমাত্র তিনি প্রসন্না হলেই মানুষের মোহমুক্তি সম্ভব। তাই কথাতেই বলা আছে – একৈবাহহং জগত্যত্র দ্বিতীয় কা মমাপরা – এ জগতে আমি একাই বর্তমান, আমার আবার দ্বিতীয় কে? বহুরূপে দেবী একাই জগৎ-খেলা খেলিতেছেন।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৩)। সে যাক্, আমরা যদি শিব প্রসঙ্গে আসি তাহলে এ পর্যায়ে এসে বোঝা যাচ্ছে যে, আজকের দিনের শিবঠাকুর ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রকৃতই যেন – দেবাদিদেব। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই তিনি বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন মানুষের কাছে আশ্রয়-ভরসার প্রতীক স্বরূপ। তাই তিনি সেই সময় থেকেই সর্বপূজিত ও সর্বপ্রণম্য। তারপর মানব বিবর্তনের ধারা বেয়ে তারও রূপবিবর্তন ঘটতে থাকে। এই মহাকালের পথ পরিক্রমার বিভিন্ন নিদর্শনগুলোই ক্রমে তার বাহন, অঙ্গভূষণ ও পূজা প্রকারণ রূপে দেবাংশী হয়েছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। আদিতে তিনি ছিলেন অমূর্ত বা বিমূর্ত। এরপরে সিন্ধু সভ্যতায় তিনি হলেন মূর্ত ও অমূর্ত। সমগ্র আর্য সভ্যতায় ঋগ্বেদ সংহিতার যুগ থেকে অথর্ববেদ সংহিতার যুগ পর্যন্ত তিনি আবার অমূর্ত, কারণ, আর্যরা মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এরপরে পৌরাণিক যুগে এসে আর্য-অনার্য এই দুই সভ্যতার চূড়ান্ত ধারা সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে আবার তিনি মূর্তিরূপ পরিগ্রহ করলেন; আবার একই সাথে তিনি লিঙ্গ প্রতীকেও পূজিত হতে থাকলেন। সবশেষে আজ তিনি তার লিঙ্গ প্রতীকে এতোটাই জনপ্রিয় যে, তার ফলে তার কায়ারূপ জনমানস থেকে ক্রম-অপস্রিয়মাণ। বর্তমানে শিবঠাকুরের যে মূর্তিরূপ দেখি, তার উৎপত্তি সম্ভবত পৌরাণিক যুগেই সূচিত হয়েছে। সেখানে সিন্ধু সভ্যতার আদি শিবের মূর্তি বহু পরবর্তী অনার্য সভ্যতার মধ্যে ফল্গুধারার মতো প্রাগার্য সভ্যতা থেকে অনুপ্রবেশ করেছিল কিনা তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা তার যে গৌরীপট্ট সমন্বিত লিঙ্গ প্রতীকরূপ দেখি তা মোটেও বেশি প্রাচীন কালের কথা নয়। কারণ প্রাগৈতিহাসিক আত্মা প্রস্তর থেকে শুরু করে পৌরাণিক কাল পর্যন্ত লিঙ্গ প্রতীক বহুবার বহু-সংস্কৃত হলেও আদি পিতার সাথে আদি মাতার সমন্বয় মূর্তি রচনা কখনোই সম্ভব হয়নি। সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনগুলো থেকেও অনুমান করা যায় যে তখনো লিঙ্গ ও মাতৃদেবী (আদি পিতা ও আদি মাতা) আলাদা আলাদা ভাবেই পূজিত হতেন। পৌরাণিক যুগে এসেও লিঙ্গমূর্তিতে গৌরীপট্ট সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। বরং, পণ্ডিতজনদের মতে, এই সময়ে বোধহয় কোনও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে লিঙ্গমূর্তি ক্রমে ক্রমে একান্ত বাস্তবানুগ রূপ নেয়, আবার একই সাথে ক্রমশ তা আকারেও বড় হতে থাকে। এরকম বহু নিদর্শনের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের গুড্ডিমল্লম গ্রামের মনুষ্যপ্রমাণ (খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের) লিঙ্গমূর্তিটি আজও সাড়ম্বরে পূজিত হওয়ার কথা ইতপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। ‘এই সময়কার লিঙ্গমূর্তিগুলো সরাসরি মাটির উপরে খাড়াভাবে প্রোথিত অবস্থায় থাকত। যা ক্রমশ শ্লীলতার সীমারেখা অতিক্রম করতে থাকে। তারপর এই বাস্তবানুগ রূপ খুব সম্ভবত জনরোষেই ধীরে ধীরে পরিশীলিত হয়। যার ফলে পরবর্তীকালের নিদর্শনগুলো বাস্তবানুগতা ছেড়ে বিভিন্ন মাপের নানা ধরনের (লম্বা, ডিম্বাকৃতি, উপবৃত্তাকার, গোলাকার ইত্যাদি) হতে থাকে। আর তা সরাসরি মাটির উপরে খাড়া ভাবে প্রোথিত থাকত। … এইরকম শিবলিঙ্গ আজও বহু জায়গায় (প্রাচীন মন্দিরগুলোতে) পূজিত হচ্ছে। একটু ভালভাবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, সেসব লিঙ্গমূর্তিতে গৌরীপট্ট পরবর্তীকালে বিভিন্ন কায়দায় সংযোজন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় – কাশীর বিশ্বনাথ, কেদারনাথ, মহাকাল, ওংকারেশ্বর, লিঙ্গরাজ, তারকেশ্বর ইত্যাদি। এই উদাহরণগুলো দেখে অনেক প্রাজ্ঞ মানুষ আপত্তি করতে পারেন যে, ওইসব মন্দিরগুলো তো আরও অনেক প্রাচীন কালের নিদর্শন। তা হলে তাদেরকে কি এই যুক্তিতে আনা যায়? কথাটা ঠিকই বিশ্বনাথ, মহাকাল, ওংকারেশ্বর ইত্যাদি মন্দিরগুলো অতি প্রাচীন। কিন্তু ইতিহাস বলে ওই মন্দিরগুলো বহুবার বহুভাবে বিনষ্ট ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; আবার নতুন করে তৈরি হয়েছে।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৫)।
গুপ্তোত্তর কালে শিবলিঙ্গে আদি পিতা ও আদি মাতার সমন্বয় সাধন এবং দার্শনিকতার প্রবেশ : ঐতিহাসিকেরা যদিও গুপ্তযুগকে পৌরাণিক ও হিন্দু সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলেন, কিন্তু এই সময়েও লিঙ্গমূর্তিতে আদিপিতার সাথে আদিমাতার সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়নি। তা সম্ভব হয়েছে গুপ্তোত্তর কালে এসে (খ্রি. ৬ষ্ঠ শতক) কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। আবিষ্কৃত হলো ‘সনালিকা গৌরীপট্ট সমন্বিতম্’ শিবলিঙ্গ। জানা যায়, এর ঠিক কিছুকাল আগে পাঞ্জাবের উদম্বর জনগোষ্ঠী বহুভাবে লিঙ্গমূর্তির রূপ সংস্কারের বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, যার নিদর্শন আজও পাওয়া যায় বলে গবেষকদের অভিমত। ‘তৈরি হল মানুষের দার্শনিকতার সাথে মেলবন্ধন করে যুগোপযোগী ও রুচিসম্মত শিবলিঙ্গ মূর্তি। যাতে বাস্তবানুগতার চেয়ে দার্শনিকতাই বেশি প্রাধান্য লাভ করেছে। আর তাই এই মূর্তি আসমুদ্রহিমাচলে সর্বত্র আদৃত, পূজিত ও প্রণম্য হল – আদি পিতা ও আদি মাতার – শিবশক্তির – বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং-এর দার্শনিক বিমূর্ত প্রকাশরূপে।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৬)। আর এই দার্শনিকতার সাহিত্য নিদর্শনও আমরা দেখতে পাই পরবর্তীকালের শৈব তন্ত্র ও পুরাণ সাহিত্য নিদর্শনগুলোতে। যেমন, বায়বীয় সংহিতায় বলা হয়েছে – “লিঙ্গের বেদীতে মহাদেবীর এবং লিঙ্গেতে মহেশ্বরের অধিষ্ঠান।” (বায়বীয় সংহিতা উত্তরভাগ-২৭/১৩)। প্রাণতোষিণী-ধৃত লিঙ্গপুরাণ বচনেও বলা হয়েছে – “লিঙ্গ-বেদী মহাদেবী ভগবতী-স্বরূপ। আর লিঙ্গ সাক্ষাৎ মহাদেব স্বরূপ। এই লিঙ্গ ও বেদীর পূজাতে শিব ও শক্তি উভয়ের পূজা হয়।” (প্রাণতোষিণী-ধৃত লিঙ্গপুরাণ বচন)। পরবর্তীকালের তান্ত্রিক দৃষ্টিতেও একই তত্ত্ব পাওয়া যায়। যেমন, নিরুত্তর তন্ত্রের ভাষায় – “লিঙ্গরূপে মহাকাল এবং যোনিরূপে কালিকা দেবী অবস্থান করেন।” (নিরুত্তরতন্ত্র-১৪পটল)। নারদপঞ্চরাত্রেও লিঙ্গযোনির নিত্যসম্বন্ধের কথা পাওয়া যায়, যেমন – “যেখানে লিঙ্গ সেখানেই যোনি এবং যেখানে যোনি সেখানেই শিবের অবস্থান।” (নারদপঞ্চরাত্র)। একইভাবে – “মহেশানি, শক্তি-সংযুক্ত না থাকলে শিব নিশ্চিত শব-স্বরূপ হন, এবং শক্তি-যুক্ত হলেই কর্ম-ক্ষম হয়ে উঠেন। অতএব শক্তির সাথে শিব-লিঙ্গের পূজা করবে।” লিঙ্গ যেহেতু পিতৃত্বের এবং যোনি মাতৃত্বের প্রতীক, হয়তো এর থেকেই জগৎ পিতা-মাতার কল্পনা শাস্ত্রকারদের বুদ্ধিতে উদিত হয়েছিল। সে কারণেই নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে – “যোনিতে মাতা এবং লিঙ্গে পিতা, এভাবে উভয়কে মাতৃ-পিতৃজ্ঞানে চিন্তা করবে।” তাই হয়তো পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্যরে অন্নপূর্ণাস্তোত্রে বলা হয়েছে – “দেবী পার্বতী আমার মা, পিতা মহেশ্বর; শিবভক্তরা বান্ধব তাই ত্রিভুবনই স্বদেশ।” (অন্নপূর্ণাস্তোত্র)।
শৈব সম্প্রদায়
কেশীসূক্ত : ইতপূর্বে শৈবদের উপাস্য দেবতা রুদ্র-শিবের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচিত হলেও গোষ্ঠীবদ্ধ শৈব উপাসক সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের বিষয়ে আলোকপাত করা যায়নি। এ চেষ্টার শুরুতেই বলে রাখা আবশ্যক যে, গবেষকরা ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন শৈব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেও তাদের উৎপত্তি নির্ণয়ে প্রধানত নির্ভর করেছেন সাহিত্যগত প্রমাণের উপর। যেহেতু বৈদিক যুগের পূর্বেকার কোনও সাহিত্য এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও আর হবে এমন ভরসা নেই, তাই ঐতিহাসিক কালের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকেই তার অনুসন্ধান শুরু করতে হয়। এক্ষেত্রে ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে ঋগ্বেদের একটি সূক্তের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যা কেশীসূক্ত নামে পরিচিত। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এই সূক্তটি হলো (ঋগ্বেদ-১০/১৩৬) – “কেশীনামক যে দেব, তিনি অগ্নিকে তিনিই জলকে তিনিই দ্যুলোক ও ভূলোককে ধারণ করেন। সমস্ত সংসারকে কেশীই আলোকের দ্বারা দর্শনযোগ্য করেন। এ যে জ্যোতি, এরই নাম কেশী। বাতরশনের বংশীয় মুনিরা পিঙ্গলবর্ণ মলিন বস্ত্র ধারণ করেন, তারা দেবত্ব প্রাপ্ত হয়ে বায়ুর গতির অনুগামী হয়েছেন। তপস্যা-রসের রসিক হয়ে আমরা তাতে উন্মত্তবৎ, আমরা বায়ুর উপর আরোহণ করলাম। হে মনুষ্যগণ, তোমরা কেবল আমাদের শরীর মাত্র দেখতে পাচ্ছ অর্থাৎ আমাদের প্রকৃত আত্মা বায়ুরূপী হয়েছে। যিনি মুনি হন, তিনি আকাশে উড্ডীন হতে পারেন, সকল বস্তু দেখতে পান। যে স্থানে যত দেবতা আছেন, তিনি সকলের প্রিয় বন্ধু, সৎকর্মের জন্যই তিনি জীবিত আছেন। যিনি মুনি হন, তিনি বায়ুপথে ভ্রমণ করবার ঘোটকস্বরূপ, তিনি বায়ুর সহচর, দেবতারা তাকে পেতে ইচ্ছা করেন। পূর্ব ও পশ্চিম এ দুই সমুদ্রে তিনি বাস করেন। কেশীদেব অপ্সরাদের, গন্ধর্বদের এবং হরিণদের বিচরণ স্থানে বিহার করেন। তিনি জ্ঞাতব্য সকল বিষয়ই জানেন ও তিনি অতি চমৎকার, সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ী বন্ধুস্বরূপ। কেশী যখন রুদ্রের সাথে একত্রে জলপান (বিষপান) করেন তখন বায়ু সে জল আলোড়িত করে দেন এবং কঠিন করকাগুলো ভঙ্গ করে দেন।” (ঋগ্বেদ-১০/১৩৬/১-৭ (সমগ্র))। বলাবাহুল্য, এই কেশীসূক্তটি ঋগ্বেদের অন্যতম অর্বাচীন পুরুষসূক্তের মতোই পরবর্তীকালের সংযোজন বলে বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা মনে করেন। এ প্রেক্ষিতে ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য হলো – ‘সূক্তটি পুরুষসূক্তের ন্যায় অপেক্ষাকৃত পরবর্তী স্তরের, এবং এর প্রধান বিষয়বস্তু কেশী ও মুনিগণের বর্ণনা দ্বারা বৈদিক ঋষিরা যে ঠিক কাদের লক্ষ্য করেছেন তা সহজবোধ্য নয়। স্বর্গত অধ্যাপক হারাণচন্দ্র চাকলাদার মহাশয় তার এক অপ্রকাশিত রচনায় (তা আংশিক মুদ্রিত হলেও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি) এই সূক্ত প্রাচ্যদেশবাসী এক ভ্রাম্যমাণ ও তপশ্চর্যানিরত পরিব্রাজক মণ্ডলীর বৈদিক ঋষি কর্তৃক বর্ণনা বলে অনুমান করেছেন। সপ্তসংখ্যক অনুবাক বিশিষ্ট এই সূক্তটির দ্বিতীয় অনুবাকে মুনিগণ এভাবে বর্ণিত হয়েছেন – ‘(প্রায়) দিগম্বর মুনিগণ ধূলিমলিন পিঙ্গলবর্ণ বস্ত্র’ (পরিধান করেন; এই বর্ণনায় কি মুনি কর্তৃক কৌপীন পরিধানের ইঙ্গিত আছে? – মূল পদ এরকম – মুনয়ো বাতরশনাঃ পিশঙ্গা বসতে মলা)।’ প্রথম ও আরও কয়টি অনুবাকে কেশীকে এই মুনিগণের অন্যতম বলা হয়েছে; কেশী (দীর্ঘকেশ বিশিষ্ট), বায়ুর সখা, দেবতাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তপশ্চর্যার দ্বারা উন্মদিত (উন্মত্ত – উন্মদিতাঃ মৌনেয়েন), মুনি (কেশী) পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে বাস বা ভ্রমণ করেন, তিনি বিষপাত্রের দ্বারা যা নত হয় না এরকম দ্রব্যসকলকে ভগ্ন করেন, এই বিষপাত্র তিনি রুদ্রের সাথে পান করেছিলেন (…পিনষ্টি স্ম কুনন্নমা। কেশী বিষস্য পাত্রেণ যদ্রুদেণাপিবৎ সহ)। দীর্ঘকেশ (জটা?) মণ্ডিত প্রায় দিগম্বর ধূলিমলিন পিঙ্গল বস্ত্রাংশ পরিহিত উন্মত্তাপূর্ণ মুনি কি পাশুপত ব্রতধারী রুদ্র-শিব পূজকদের পূর্বপুরুষ? এই অনুমান আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অসঙ্গত কল্পনা নাও হতে পারে। পাশুপত সাধকদের ন্যায় কেশী-মুনিগণেরও তপশ্চর্যারূপ ব্রতসাধনার দ্বারা অতিপ্রাকৃত ঐশী শক্তি অর্জনের কথা এ সূক্তে বলা হয়েছে। সর্বোপরি রুদ্রসহচর কেশী-মুনি রুদ্রের সাথে যে বিষপান করেছিলেন এরও উল্লেখ এ সূক্তে বর্তমান। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৬, ৩৩) ঐতস মুনির উন্মত্ততা ও প্রলাপ ভাষণের যে আর এক দুর্বোধ্য বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাও পাশুপতদের উন্মত্ত আচরণ ও প্রলাপ ভাষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু উক্তরূপ অনুমানের সাপক্ষে এইসব যুক্তি থাকলেও, তা যে সর্বাংশে গৃহীতব্য এ কথা বলা যায় না। কারণ যেকালে এই সূক্ত রচিত হয়েছিল, তখন রুদ্র-শিব দেবতা আর্যগণের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যমূলক পূর্ণ প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারেনি। এতদ্ব্যতীত সূক্তটির কোন অংশেও রুদ্রদেবতার পূজার এমন কি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। এর শেষ চরণে মাত্র একবার রুদ্রের নাম পাওয়া যায়, তাও বিষপাণ প্রসঙ্গে। সায়ন এ বিষ কালকূট বিষ অর্থে গ্রহণ করেন নি, এর ‘জল’ অর্থ গ্রহণ করে প্রখর রশ্মিরূপ অসংখ্য জটাবিশিষ্ট সূর্যদেবতা কর্তৃক জলশোষণের ইঙ্গিত সূক্তটিতে দেখেছেন। সে যা হউক, কেশী সূক্তের প্রকৃত অর্থ এত দুরুহ এবং অনিশ্চিত যে এর একরূপ ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে এর রচনাকালে রুদ্রপূজক গোষ্ঠীর অস্তিত্বের বিষয় নির্বিচারে স্বীকৃত হতে পারে না। তবে এই সূক্তের শেষ চরণে রুদ্র কর্তৃক বিষ (জল?) পানের কথাই যে পৌরাণিক যুগের নীলকণ্ঠ শিব কর্তৃক কালকূট বিষপান কাহিনীর উৎস সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৩-৪৫)।
পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে ও গ্রিক বর্ণনায় শৈবদের ইঙ্গিত : ঋগ্বেদে রুদ্রপূজক গোষ্ঠীর উপরিউল্লিখিত সন্দেহাত্মক উল্লেখের কথা বাদ দিলে, শিবপূজক-শৈবদের অস্তিত্বের প্রথম অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট ইঙ্গিত পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থেই পাওয়া যায় বলে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেন। তার মতে – ‘এর (পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী) চতুর্থ অধ্যায়ের একটি সূত্র (৪, ১, ১১২) ‘শিবাদিভ্যোন’ পরোক্ষভাবে শিবপূজকগণকেই বোঝাচ্ছে বলে মনে হয়। সূত্রের অর্থ এই যে শিবাদি শব্দের পর ‘অন’ প্রত্যয় করে যে পদ নিষ্পন্ন হয় তা দ্বারা শিব ইত্যাদির অপত্যগণকেই বোঝায়। প্রত্যয়ান্ত শৈব শব্দ অপত্যার্থে দেবতার এক ভক্ত পূজকদের কথাই যে বলছে এ অনুমান অসঙ্গত নয়। বহু পরবর্তী কালে রচিত লিঙ্গপুরাণের একটি উক্তি এই অনুমান সমর্থন করে। শিবের লকুলীশাবতারের কথা বলতে গিয়ে, পুরাণকার লকুলীশের প্রধান চারজন ভক্ত শিষ্য, যথা কুশিক, মিত্র, গর্গ এবং কৌরুষ্যকে তার পুত্র বলে বর্ণনা করেছেন। পাণিনি ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে সিন্ধু নদের অপর পারে গান্ধার প্রদেশের সলাতুর নামক একটি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তার সময়ে (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে) ঐ অঞ্চলে শিবের পূজা প্রচলিত ছিল।… পাণিনির সময়ের ন্যূনাধিক এক শতক পরে পাঞ্জাব প্রদেশের এক অংশে যে শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত লোকগণ বাস করতেন, এর প্রমাণ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ সংক্রান্ত সমসাময়িক গ্রীক গ্রন্থাদি হতে কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালের বৈদেশিক গ্রন্থকারদের উদ্ধৃতি হতে জানা যায়। কুইন্টাস কার্টিয়াস, ডিওডোরাস প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণের উদ্ধৃতি প্রমাণ করে যে শিবি (Sibae, Siboi) নামক এক জাতি আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে ঝিলাম ও চিনাব নদীর (তাদের গ্রন্থে এই দুই নদীর নাম – Hydaspes ও Acesines, সংস্কৃত বিতস্তা এবং অসিক্লীর গ্রীক রূপ) সঙ্গমস্থলের নিকট বাস করতেন। বহু পূর্বে পণ্ডিতপ্রবর ল্যাসেন (Christini Lassen) যথার্থ অনুমান করেছিলেন যে গ্রীক গ্রন্থে বর্ণিত শিবি বা শিবয় এবং মহাকাব্য ও পুরাণাদিতে লিখিত ঔশীনর শিবি এরা একই প্রাচীন ভারতীয় জাতিকে বোঝাচ্ছে। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলান্তর্গত অষ্টাদশ সূক্তের সপ্তম অনুবাকে অলিন, পক্থ, ভলানস, বিশানিন প্রভৃতি জাতির সাথে শিব জাতির নাম দেখা যায়।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৫-৪৬)।
শিবি জাতি : মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঋগ্বেদ সূক্তের সংশ্লিষ্ট ঋকের উল্লিখিত জাতিগুলোর নামের স্থানে সায়নাচার্য যেসব বৈশিষ্ট্যসূচক অর্থাবলি ব্যবহার করে তার অর্থ নির্ধারণ করেছেন, তা কৌতুহলজনক বৈকি। সায়ণকৃত বেদটীকার সহায়তায় রমেশচন্দ্র দত্তের তর্জমায় পাঠকের কৌতুহল নিবৃত্তির সুবিধার্থে প্রথম বন্ধনীতে মূল বৈদিক জাতি-নামগুলো আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। উক্ত ঋকটি হলো – “হব্যসমূহের পাচক (পক্থ), ভদ্রমুখ (ভলানস), অপ্রবৃদ্ধ (ভনন্ত-অলিন) ও বিষাণহস্ত (বিষাণিন) মঙ্গলকর (শিব) ব্যক্তিগণ ইন্দ্রের স্তুতি করে। ইন্দ্র সোমপানে মত্ত হয়ে আর্যের গাভীসমূহ হিংসকগণ হতে এনেছেন, স্বয়ং লাভ করেছেন এবং যুদ্ধে মনুষ্যগণকে বধ করেছেন।” (ঋগ্বেদ-৭/১৮/৭)। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন যে এই শিব এবং শিবি এক জাতি। শিবি জাতির যে বর্ণনা উপরে উল্লিখিত গ্রীক গ্রন্থকারেরা দিয়েছেন তা থেকে মনে হয় তারা শিবপূজক গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। শিবিরা বন্যপশুর চর্ম পরিধান করতেন, তারা দণ্ডপাণি ছিলেন, এবং তাদের পশুদেরকে দণ্ডাঙ্ক দ্বারা চিহ্নিত করতেন। এ বর্ণনা শিবভক্তদের যে বিবরণ মহাভাষ্যে পাওয়া যায় তার সাথে আংশিকভাবে মেলে বলে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত। কেননা মহাভাষ্যে উদ্ধৃত শিবপুর বা শৈবপুর নামে এক উদীচ্য গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। বৌদ্ধ মহামায়ূরী গ্রন্থেও শিবপুরের কথা রয়েছে। পাঞ্জাবের এ অঞ্চলের একটি নগর যে গুপ্তযুগেও শিবিপুর বলে পরিচিত ছিল তা বর্তমান সোরকোট নামক স্থানে প্রাপ্ত একটি বৃহৎ ধাতুপাত্রে উৎকীর্ণ ৮৩ গৌপ্তাব্দের একটি লেখ থেকে জানা যায় বলে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন। তিনি আরও বলেন – ‘পাণিনির সূত্র, ‘অয়ঃশূলদণ্ডাজিনাভ্যাং ঠক্ঠঞৌ’ (৫, ২, ৭৬) এর ভাষ্যকালে পতঞ্জলিই প্রথম সুস্পষ্টভাবে শিবভক্তদের উল্লেখ করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে ‘শিবভাগবত’দের নাম করেছেন, এবং বলেছেন যে পাণিনীয় সূত্রানুসারে ‘ঠক্’ ও ‘ঠঞ’ প্রত্যয় দুটি ‘অয়ঃশূল’ ও ‘দণ্ডাজিন’ শব্দদ্বয়ের পরে প্রয়োগ করলে এমন ব্যক্তি বিশেষকে বোঝাইবে যারা লৌহশূল দণ্ড ও অজিন (পশুচর্ম) ইত্যাদি ব্যবহারের দ্বারা স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস পান। পতঞ্জলি আরও বিশদভাবে এরকম ব্যাখ্যা করেছেন যে শিবভাগবতগণই আয়ঃশূলিক অর্থাৎ লৌহত্রিশূলধারী; তিনি দণ্ডাজিনিক কথাটি বোধ হয় বাহুল্যবোধে এ স্থলে ব্যবহার করেন নি, কিন্তু মূলসূত্রে দণ্ডজিন কথাটি থাকা হেতু শিবভাগবতরা যে দণ্ডজিনিকও (দণ্ডধারী ও পশুচর্ম পরিধানকারী) ছিলেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। পশুচর্মে গাত্রাচ্ছাদন, লৌহত্রিশূল ও দণ্ডধারণ প্রভৃতি ক্রিয়া শিবভাগবতেরা তাদের একাত্মিকা শিবভক্তির বাহ্য রূপ বলে বিবেচনা করলেও সকলে যে তাদের এই সব ক্রিয়া ভাল চোখে দেখতেন না এর সাহিত্যগত প্রমাণ বর্তমান। পতঞ্জলি নিজেই এর অনুমোদ করতেন না, কারণ তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে এই জাতীয় শিবভক্তদের দল যে সিদ্ধি শান্ত প্রক্রিয়ার দ্বারা অন্বেষণ করা যায়, তা উগ্র বেগশীল অনুষ্ঠানের সাহায্যে পেতে ইচ্ছা করেন (যো মৃদুনোপায়েনান্বেষ্টব্যানর্থান্ রভসেনান্বিচ্ছতি)। প্রখ্যাত বৈয়াকরণিক অতি অল্প কথায় শিবভাগবতদের বাহ্য ধর্মাচরণের রূপ সম্বন্ধে ইঙ্গিত করে তার প্রতি কটাক্ষ করেছেন।… এই শিবভাগবতগণই কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালে পাশুপত বলে বর্ণিত হয়েছেন; পাশুপতদের ধর্মাচরণ প্রণালী যে কিরূপ উগ্রবেগশীল ছিল তা আলোচনাকালে প্রদর্শিত হবে। পতঞ্জলিপ্রমুখ সামাজিক ব্যক্তিগণ তাদের উগ্র পন্থার বিরোধী ছিলেন, এবং এজন্যই পতঞ্জলির পরবর্তী ভাষ্যকারেরা ‘দণ্ডাজিনিক’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘দাম্ভিক’। সে যাই হউক, মহাভাষ্যোক্ত শিবভাগবতদের বর্ণনার সাথে বৈদেশিক লেখকগণ প্রদত্ত শিবিদের বর্ণনার আশ্চর্য মিল দেখতে পাওয়া যায়।’ – (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৪৭-৪৮)।
পাশুপত সহ বিভিন্ন শৈব সম্প্রদায় ও আচরণ : শৈব-সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশুপত সম্প্রদায়ই প্রাচীনতম হলেও পরবর্তীকালে শৈবপূজক হিসেবে আরও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব শৈব-সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্বে সামান্য প্রভেদ ও আরাধনা পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এই শিবপূজকদের আচার-বিচারে অনেক ক্ষেত্রেই বাহ্যিক অভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্ত তার ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে শিবারাধকদের প্রসঙ্গে বলেন – ‘শৈবেরাও অন্যান্য উপাসকের মতো বিশেষ বিশেষ বীজ মন্ত্রে উপদিষ্ট হন। একাক্ষর মন্ত্র ‘হৌ’। ত্র্যক্ষর মন্ত্র ‘ওঁ জুঁ সঃ’; এর নাম মৃত্যুঞ্জয়াত্মক মন্ত্র। চতুরক্ষর মন্ত্র ‘ঊর্ধ্বফট্’; এর নাম চণ্ড মন্ত্র। পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’। ষড়ক্ষর মন্ত্র ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। অষ্টাক্ষর মন্ত্র ‘হ্রীঁ ওঁ নমঃ শিবায় হ্রীঁ!’ এরকম বিংশত্যক্ষর পর্যন্ত মন্ত্র আছে এবং মন্ত্র-বিশেষে বিশেষ বিশেষ ধ্যান ও পদ্ধতি উক্ত হয়েছে। কৃষ্ণানন্দ-কৃত তন্ত্রসারে ও অপরাপর উপাসনাতন্ত্র-সংগ্রহে সে সমুদায়ের বিস্তারিত বৃত্তান্ত বিনিবেশিত আছে। শিবারাধনায় শরীরে বিভূতি-লেপন ও রুদ্রাক্ষ-ধারণ নিতান্ত আবশ্যক।’ – (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১১)। বিদ্বেন্মোদতরঙ্গিণীতে শৈবদের বেশ-ভূষা সম্পর্কে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় এভাবে – “জটা-যুক্ত, ব্যাঘ্র-চর্ম-পরিধান, বিভূতি-বিভূষিত উজ্জ্বল অঙ্গবিশিষ্ট এবং শরীরের ঊর্ধ্বভাগে রুদ্রাক্ষ-মালায় শোভিত এই শ্রীমান্ পুরুষ আগমন করছেন।” (বিদ্বেন্মোদতরঙ্গিণী)। বিভূতি-লেপন হিসেবে শৈব-সম্প্রদায়ের মধ্যে ভস্ম-লেপনেরই আধিক্য দেখা যায়। তবে অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্যে ‘ভারতবর্ষের দক্ষিণভাগে মাইশোর দেশের মধ্যে মলৈশ্বরবেট্ট নামক পর্বতে একরূপ শ্বেত বর্ণ মৃত্তিকা পাওয়া যায়। সে প্রদেশের শৈবেরা বিভূতির পরিবর্তে সেই মৃত্তিকা ব্যবহার করে থাকেন।’ আর রুদ্রাক্ষ-ধারণ শৈবদের মধ্যে আবশ্যকীয় হিসেবেই বিবেচিত হয়। রুদ্রাক্ষ প্রসঙ্গে যোগসার-এ বলা হয়েছে – “শিখাতে, হস্ত-দ্বয়ে, কণ্ঠে এবং কর্ণ-যুগলে যে মনুষ্য ভক্তিপূর্বক রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন, তিনি শিব-লোক প্রাপ্ত হন।” (যোগসার)। এছাড়া বীরাচারী শাক্ত-সম্প্রদায়ের সুরা সেবনের মতোই শৈবদের বিশেষ করে শৈব-তান্ত্রিকদের সম্বিদা-সেবন ইষ্ট সাধনার একটি অঙ্গ-বিশেষ। সাধকদেরকে তা মন্ত্র-পূত করে ধ্যান ও স্তুতিপূর্বক পুলকিত-চিত্তে পান করতে হয়। শৈব তন্ত্রে বলা হয়েছে – “সম্বিদুল্লাস দ্বারা মহতী কবিতার রচনা হয়, পুরুষদের স্বার্থ দর্শন হয়, ও পাপসমূহ নষ্ট হয়, অতএব তদ্বারা কি না হয়ে থাকে?” (প্রাণতোষিণী)। শৈব-সাধনার আরেকটি অঙ্গ হলো বিজয়া অর্থাৎ গাঁজা। শৈবেরা জল-মিশ্রিত বিজয়া অর্থাৎ সিদ্ধি-পানের ন্যায় বিজয়া ধূম-পানও করে থাকেন। প্রাণতোষিণীতে বলা হয়েছে – “ক্ষ্রৌঁ ক্ষ্রৌঁ ক্ষ্রৌঁ এই মন্ত্র দ্বারা বিজয়া-ধূম শোধন করে পান করবে, মহাদেব, তাতে দোষ নেই।” (প্রাণতোষিণী)। শৈবদের মধ্যে উদাসীন সম্প্রদায়ীই বেশি। তারা সচরাচর প্রায় সন্ন্যাসী ও গোঁসাই বলে উক্ত হয়ে থাকে। বাঙলা-অঞ্চলে বৈষ্ণবদের প্রধান গুরুদের নাম গোঁসাই, কিন্তু ভারতের পশ্চিমোত্তর অঞ্চলে শৈব সন্ন্যাসীদেরকেই গোঁসাই বলা হয়। সেখানে সাধু-লোক বললে যেমন বৈষ্ণব উদাসীন বোঝায়, তেমনি গোঁসাই-লোক বললে শৈব উদাসীন বুঝতে হয়। কোন উদাসীন শৈব কি বৈষ্ণব, তা তিলক দেখলেই অক্লেশে জানতে পারা যায়। অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্যে, – ‘বৈরাগীরা নাসা-মূল হতে কেশ পর্যন্ত ঊর্ধ্বরেখা করেন, আর শৈবেরা ললাটের বাম পাশ থেকে ডান পাশ পর্যন্ত বিভূতি দিয়ে তিনটি রেখা করে থাকেন। প্রথমোক্ত তিলককে ঊর্ধ্বপুণ্ড্র ও শেষোক্ত তিলককে ত্রিপুণ্ড্র বলে।’ – (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১২)।
বাংলায় ও অন্যান্য অঞ্চলে শৈব সম্প্রদায় : বাঙলা অঞ্চলে বিশেষত গৃহস্থদের মধ্যে শিবোপাসক প্রায় দেখাই যায় না। এখানে শক্তি-উপাসকেরই প্রাধান্য। ভারতবর্ষের দক্ষিণ ও পশ্চিম খণ্ডে শিবোপাসনার প্রচলন ছিল এবং আছে। বাঙলা অঞ্চলের গৃহস্থদের মধ্যে পৃথক শিবোপাসক প্রায় না থাকলেও শাক্তেরা শক্তি-পতি শিবের অর্চনা ও শিব-ব্রত পালন করে থাকেন। এটাই তাদের কর্তব্য কর্ম। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে – “অগ্রে শিব-পূজা করে পরে শক্তি পূজা করবে, নতুবা সমুদায় পূজা-দ্রব্য গঙ্গা-জল হলেও মূত্র-সদৃশ হয়। অতএব মহেশানি! অগ্রে শিব-পূজা করবে।” (প্রাণতোষিণী-ধৃত তোড়লতন্ত্রবচন)। অগ্রে শিব-পূজা করার পরামর্শের অর্থ এটাই যে, এরা বস্তুত শিবোপাসক নয়। তারা যে দেবীর উপাসক, সেই দেবীর সাথে শিবের সংযোগ নিবিড় এবং দার্শনিকভাবে অদ্বয় সম্পর্কে সম্পর্কিত। ফলে শিব এখানে অনিবার্যভাবেই উপস্থিত। এজন্যেই বাঙলায় লিঙ্গ প্রতীকে শিবের উপস্থিতিমূলক যত্রতত্র অগুনতি মন্দির বা উপাসনাকেন্দ্র চোখে পড়লেও এগুলো মূলত শক্তি-উপাসনা কেন্দ্রই। এখানে শক্তিই প্রধান, শক্তিমান গৌন কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিভা নিয়ে শক্তির সাথে দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্কে বর্তমান। সে যাক, তন্ত্রের তত্ত্ব-দর্শন প্রসঙ্গে অন্যত্র এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে বাঙলায় শৈবধর্মের প্রাধান্য না থাকলেও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে শিবোপাসকদের বিস্তৃতি প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অক্ষয় কুমার দত্ত বলেন – ‘এদেশীয় লোকের মধ্যে, বিশেষত গৃহস্থেতে, শিবোপাসক প্রায় দৃষ্ট হয় না। দক্ষিণে দ্রাবিড় ও পশ্চিমে রাজস্থান প্রভৃতি অনেক দেশের গৃহস্থেরা শিবের উপাসক। রাজস্থানের অন্তর্গত মেওয়ার প্রদেশের ইতিহাস মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, বহুকাল পূর্বাবধি তাদের রাজবংশীয়েরা শিবের আরাধনায় প্রবৃত্ত ছিলেন। ঐ প্রদেশের মধ্যে স্থানে স্থানে উৎকৃষ্ট শিব-মন্দির ও শিবলিঙ্গ সকল বিদ্যমান আছে। সেখানকার একলিঙ্গ নামক শিবের মন্দিরটি অতি বৃহৎ। তা শ্বেত প্রস্তরে নির্মিত ও নানারূপ চিত্র-কার্যে এরূপ পরিপূর্ণ যে, তার সবিশেষ বর্ণনা করা সুকঠিন। বহুশত বৎসর পূর্বাবধি মেওয়ার অঞ্চলে যে শৈব-ধর্ম প্রবলরূপ প্রচলিত হয়ে আসিয়াছে। পূর্বে এ বিষয়ের বিবরণ করা গিয়েছে। ঐ প্রদেশীয় অনেকানেক নৃপতি ও অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা বহুতর শিব-মন্দির নির্মাণ ও সংস্কার করিয়ে যান। … ভারতবর্ষের দক্ষিণ খণ্ডেও অনেককাল পূর্বে শিবোপাসনার প্রচার ছিল…। এখনও সেখানে গৃহস্থ ও উদাসীন বহু সংখ্যক শৈবের অবস্থিতি আছে। বাঙ্গালী গৃহস্থদের মধ্যে পৃথক শিবোপাসক প্রায় নাই বটে, কিন্তু শাক্তেরা শক্তি-পতি শিবের অর্চনা ও শিব-ব্রত সকল পালন করে থাকেন। এটি তাদের কর্তব্য কর্ম।’ – (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-১২)। অতএব, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রদায়গতভাবে যেসব বিভিন্ন শৈব-উপাসক ছিলো বা আছে, তারা প্রচলিত সমাজ ও জনমনে কিভাবে কতোটা প্রভাবিত করেছে তা বুঝতে হলে তাদের উৎপত্তি ও বিকাশ এবং উপাসক ভেদে তাদের আচার-বিচার ও তত্ত্ব-বিশ্বাস বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান জারি রাখা দরকার। এক্ষেত্রে প্রধান প্রধান কয়েকটি শৈব-সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিচিত হওয়াই বর্তমান আলোচনার জন্য সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
যে কোন ধাতু দিয়ে কি শিব লিঙ্গ বানানো যায়