শঙ্গম যুগ এবং সাতবাহন রাজবংশ

Table of Contents

শঙ্গম যুগ (আনু. খ্রি.পূ. ৫০০ অব্দ – খ্রি. ৩০০ অব্দ)

দক্ষিণ ভারতের, বিশেষত তামিলনাড়ুর ইতিহাসে শঙ্গম যুগ এক অত্যুজ্জ্বল পৰ্বরূপে চিহ্নিত। এই সময় শুধু যে তামিল সাহিত্যেরই অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটল তা নয়, আয় ও স্থানীয় সংস্কৃতির মিলনে এক সমন্বিত সংস্কৃতির অভ্যুদয় হল। উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে ভাবের সেতুবন্ধ রচিত হল। কেবল দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে নয়, ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসেও এই যুগ বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। 

শঙ্গম সাহিত্য

সংজ্ঞা : শঙ্গম সাহিত্য বলতে তামিল সাহিত্যের আদি পর্যায় বা প্রাথমিক স্তর বােঝায়। এই পর্যায়ে বহু সংখ্যক কবিতা আছে। প্রাচীন তামিল কবিরা এসব কবিতা রচনা করেছেন। পরে কবি-গােষ্ঠী বা কবি-পরিষৎ এই কবিতাগুলোকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা অনুমােদন দান করেছে। শঙ্গম কথাটি এসেছে দ্রাবিড় শব্দভাণ্ডার থেকে। গােষ্ঠী, সমাজ, সমিতি বা পরিষৎ অর্থেই এর প্রয়ােগ হয়েছে। এই গােষ্ঠী, সমাজ বা পরিষৎ কবিগণের বা বিদ্বজ্জনের গােষ্ঠী, সমাজ বা পরিষৎ। কবি-গােষ্ঠী, কবি-পরিষৎ বা বিদ্বৎ-সমাজ এই সাহিত্যকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে এই সাহিত্যের নাম শঙ্গম।

প্রথম শঙ্গম : ইরৈয়নার-এর লেখা ‘অহপ্পোরুল’-এর উপর টীকা লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত তামিল ভাষ্যকার নক্কীরর তিন তিনটি শঙ্গম বা কবি-পরিষদের কথা বলেছেন। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রথম শঙ্গম স্থাপিত হয়েছিল প্রাচীন মাদুরাই শহরে। বর্তমানে শহরটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে আছে। এই কবি-পরিষদের সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন মহামুনি অগস্ত্য। তিরিপুরমেরিৎথ বিরিসদৈক্কবুল (শিব), কুনরমেরিন্দ মুরুগবেল (মুরুগ অথবা সুব্রহ্মণ্য) এবং মুরঞ্চিয়ুর মুদিনাগরায়র (আদিশেষ)-এর মতাে দেবতারা এই কবি-সংস্থার সদস্য ছিলেন। সর্বসমেত ৫৪৯ জন সভ্য এই পরিষদের সদস্য ছিলেন। কবি-সমাজ ৪৪৯৯ জন কবির কবিতা অনুমােদন করে। ৮৯ জন পাণ্ড্য রাজা এই শঙ্গমের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। পৃষ্ঠপােষক পাণ্ড্য রাজাদের মধ্যে ৯ জনই কবি ছিলেন। ৪৪০০ বছর এই কবি-পরিষৎ স্থায়ী হয়েছিল। অকত্তিয়ম, পরিপদাল, মৃদুনারৈ, মৃদুকুরুকু ও কলরিআরিয়ৈ এই পর্বের উল্লেখযােগ্য কবিতা সংকলন।

দ্বিতীয় শঙ্গম : দ্বিতীয় কবি-পরিষদের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কপাতপুরম বা অলৈবাই শহরে। বর্তমানে শহরটি সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে আছে। ৩৭০০ বছর স্থায়ী এই সংস্থার মােট ৪৯ জন সভ্য ছিলেন। অগস্ত্য, ইরুয়ুর কুরুঙ্গোলিমােসি ও বেল্লুরকাপিয়ন-এর মতাে ব্যক্তিত্বরা এই সভার সদস্য ছিলেন। ৩৭০০ জন কবির কবিতা এই সভায় অনুমােদিত হয়। ৫৯ জন পাণ্ড্য রাজা এই সভার পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। সমিতির বিশাল গ্রন্থাগারে ৮,১৪৯টি গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, গ্রন্থাগারের সব কটি গ্রন্থ সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে। এ পর্বে রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে অকত্তিয়ম, তােলকাপ্পিয়ম, মাপুরানম ইসৈনুলুক্কম, ভূতপুরানম, কলি, কুরুকু, বোলি এবং ব্যালমালৈ। তােলকাপ্পিয়ম ব্যাকরণ গ্রন্থখানি ছাড়া বাকি সব কটি গ্রন্থই বিনষ্ট হয়ে গেছে।

তৃতীয় শঙ্গম : তৃতীয় শঙ্গম বা কবি-গােষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল উত্তর মাদুরাই শহরে। এই গোষ্ঠীর আয়ুষ্কাল ছিল ১৮৫০ বছর। ৪৯ জন সদস্যবিশিষ্ট এই কবি-পরিষৎ সমসংখ্যক পাণ্ড্য রাজার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছে। তিরুবল্লুবর তার বিখ্যাত কুরল গ্রন্থের শেষের দিকে তৃতীয় শঙ্গমের সদস্যদের নাম উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিলেন নক্কীরর, ইরৈয়নার, কপিলর, পরনর, শীত্তলৈ শাত্তনর এবং পাণ্ড্যরাজ উগ্র। অবশ্য ‘মণিমেকলৈ’ মহাকাব্যের রচয়িতা শীত্তলৈ শাত্তনরকে অনেকেই শঙ্গম যুগের কবি বলে স্বীকার করেন না। ইরৈয়নার এই পর্বে রচিত গ্রন্থসমূহের যে তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে নেদুনথােকৈ, কুরুনথােকৈ, নত্রিনৈ, অইনকুরুনুরু, পদিত্রুপাত্তু, নূত্রৈংবথু, পরিপাদল, কুথু, বরি, পেরিসৈ এবং সিত্রিসৈ। এসব গ্রন্থের বেশির ভাগই আজ অবলুপ্ত, অল্পসংখ্যক কয়েকখানি গ্রন্থ এখনও বর্তমান।

কাল-সীমা ও বিতর্ক : ইরৈয়নার তিনটি শঙ্গম বা কবি-পরিষদের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে যুক্তির চেয়ে কল্পনা বা অন্ধবিশ্বাসই প্রাধান্য পেয়েছে –

  • তার বর্ণনা অনুসারে শঙ্গম যুগ ৯৯৫০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। সাধারণত মনে করা হয়, ৩০০ বা ৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শঙ্গম যুগের সমাপ্তি ঘটেছিল। তাহলে ধরে নিতে হবে, ৯৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শঙ্গম সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। এরূপ সিদ্ধান্ত অবশ্যই অনৈতিহাসিক।
  • দ্বিতীয়ত, শঙ্গম যুগের আয়ুষ্কাল সম্পর্কে বিতর্ক আছে ঠিকই তবু দশ হাজার বছরব্যাপী এক শঙ্গম যুগের কল্পনা যুক্তিহীন, অবাস্তব বলেই মনে হয়।
  • তৃতীয়ত, ইরৈয়নার তিন শঙ্গমের সভ্যরূপে যাদের নামােল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দেবতা। শঙ্গমের সদস্যরূপে দেবতাদের উল্লেখ এ বর্ণনাকে অলৌকিকতা দান করেছে।

ইরৈয়নার-এর বিবরণ সম্পর্কে পণ্ডিত মহলে যতই সংশয় থাকুক না কেন, শঙ্গম সাহিত্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিন্তু সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। শঙ্গম সাহিত্যের সময় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ-মহলে বাগ-বিতণ্ডা আছে। এর প্রকৃত অবয়ব সম্পর্কেও বিতর্কের শেষ নেই। শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার মনে করেন, ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ এই দীর্ঘ হাজার বছর ধরে শঙ্গম সাহিত্যের সংকলনপর্ব অব্যাহত ছিল। পক্ষান্তরে নীলকান্ত শাস্ত্রীর মতাে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক খ্রিস্টীয় ১০০-৩০০ অব্দকে শঙ্গম পর্বরূপে চিহ্নিত করেছেন। শঙ্গম যুগের শুরু ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর সমাপ্তি ২০০ খ্রিস্টাব্দে, এরূপ একটি অভিমতও প্রচলিত আছে। বিষয়টি বিতর্কিত। 

শঙ্গম সাহিত্যের অবয়ব নিয়ে বিতর্ক : বিতর্ক রয়েছে শঙ্গম সাহিত্যের অবয়ব সম্পর্কেও। শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার শঙ্গম সাহিত্যের এক বৃহত্তর অবয়বের কথা বলেছেন। তার মতে শঙ্গম সাহিত্যে রয়েছে তিনটি অঙ্গ। অঙ্গ তিনটি হল পথুপাস্তু বা বর্ণনামূলক দশটি কবিতা, এত্তুথােকৈ বা অষ্ট সংকলন এবং পদিনেলকীলকনক্কু বা অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতা-গ্রন্থ। তিরুবন্দুবর-এর বিখ্যাত গ্রন্থ কুরল এই অষ্টাদশ নীতিমুলক কবিতা-গ্রন্থেরই একটি। মানব-জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও শাশ্বত ভাবনার কথা কুরল গ্রন্থে ধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতাগুলোকে শঙ্গম সাহিত্যের অঙ্গ বলে স্বীকার করেন না। তাদের অভিমত পৎথুপাত্তু ও এত্তুথােকৈ, এই দু’ধরনের কবিতা নিয়েই শঙ্গম সাহিত্য গড়ে উঠেছে।

বর্ণনামূলক কবিতা-দশক :

  • নক্কীরর : বর্ণনামূলক দশটি কবিতার মধ্যে দু’টিই নক্কীররের লেখা। এদের একটি তিরুমূরুকাৎত্রুপ্পদৈ, অন্যটি নেদুনলবাদৈ। প্রথম কবিতাটি দেবতা মুরুগ-এর প্রশস্তি। দেবতা মুরুগ যেসব মন্দিরে পূজিত হন, সেসব দেবালয়ের মনােরম বর্ণনা আছে এ কবিতায়। নক্কীররের দ্বিতীয় কবিতায় বর্ণিত হয়েছে রাজা নেদুঞ্চেলিয়ন ও তার রানির বিরহ-বেদনা। রাজা যুদ্ধক্ষেত্রে, আর নিঃসঙ্গ রানি রাজপ্রাসাদে। রাজা ও রানির মনােবেদনা মর্মস্পর্শী ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে এ কবিতায়।
  • উরুত্তিরঙ্গয়ণ্ণনার : শঙ্গম যুগের আর একজন কবি দু’টি বর্ণনামূলক কবিতা লিখেছেন। তিনি উরুত্তিরঙ্গয়ণ্ণনার। তার লেখা এক কবিতা ‘পেরুম্পানাৎত্রুপদৈ’। এই কবিতাটি ৫০০ স্তবকের। কাঞ্চীপুরম শহরের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে এ কবিতায়। এই প্রখ্যাত কবির লেখা আর একখানি কবিতা ‘পট্টিনপ্পালৈ’। এটি প্রেমের কবিতা। শােনা যায়, এই কবিতাটি রচনা করে তিনি রাজা করিকালের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ পুরস্কার পান। কবিতার নায়কের মনে দ্বন্দ্ব জেগেছে। নায়ক একদিকে দয়িতার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছেন। অন্যদিকে তার কাছে যুদ্ধে যােগদানের আহ্বান এসেছে। আবেগের কাছে কর্তব্যের ডাক হার মানল। নায়ক শেষ অবধি দয়িতার সান্নিধ্যই বেছে নিলেন। প্রাচীন চোল রাজধানী পুহার-এর এক অনুপম বর্ণনা আছে এ কবিতায়।
  • মরুথনার : মরুথনার রচনা করেছেন ‘মদুরৈককাঞ্চি’ নামে এক বর্ণনামূলক কবিতা। এ কবিতায় রাজা নেদুঞ্চেলিয়নের রাজত্বের সপ্রশংস বর্ণনা আছে, প্রাচীন তামিল সমাজ-জীবনের নানা তথ্যের পরিবেশনা আছে।
  • কন্নিআর : ‘পােরুনরাত্রুপ্পদৈ’ কবিতাখানি কন্নিআর-এর লেখা। এ কবিতায় কবিদের দারিদ্র-জর্জরিত জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে।
  • নথ্‌থথনার : নথ্‌থথনার রচনা করেছেন ‘সিরুপানলুপ্পদৈ’ কবিতা। সমকালীন সমাজের খুঁটিনাটি তথ্য আছে এই কবিতায়। রাজা নল্লিঅ কোদন-এর বিবিধ চারিত্রিক গুণাবলি এই কবিতায় প্রশংসিত হয়েছে। আসলে কবি এখানে একজন আদর্শ নরপতির চিত্র একেছেন।
  • নপ্পুথনার : নপ্পুথনার-এর রচনা ‘মুল্লৈপ্পা’ ১০০ স্তবকের এক কবিতা। এই কবিতায় বর্ণিত হয়েছে এক রানির তার প্রবাসী স্বামীর সান্নিধ্য লাভের তীব্র আকুলতা। রানি উদগ্রীব হয়ে আছেন, অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, কখন তার স্বামী ফিরে আসবেন, এই ভাবনায়। অবশেষে তার উৎকণ্ঠা দূর হল। রানি দূর থেকে তার স্বামীর বাদ্যধ্বনি শুনতে পেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বামী তার দৃষ্টির মধ্যে এসে পড়বেন।
  • কপিলর : কপিলর-এর রচনা ‘কুরিঞ্চিপ্পাত্তু’। এক পার্বত্য সর্দার ও এক সুন্দরী রমণীর প্রণয় এ কবিতার বিষয়বস্তু। তাদের বিবাহের পথে বাধা ছিল বিস্তর। ধীরে ধীরে সব সমস্যার সমাধান হল। তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
  • কৌসিকনার : কৌসিকনার-এর লেখা ‘মলৈপদুকদাম’ ছ’শাে স্তবকের এক কবিতা। প্রকৃতির অনুপম বর্ণনা আছে এই কবিতায়। নৃত্যকলা সম্পর্কেও সুন্দর মন্তব্য আছে এতে। 

বর্ণনামূলক এই দশটি কবিতার সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। কবিরা প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ আকণ্ঠ পান করেছেন, মনুষ্যহৃদয়ের গহন করে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। প্রকৃতির বর্ণনায় ও হৃদয়বৃত্তির বিশ্লেষণে তারা অসামান্য পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। করিকাল চোল ও নেদুঞ্চেলিয়ন-এর উদ্দেশ্যে এই দশটির দু’টি করে কবিতা উৎসর্গিত হয়েছে। অধ্যাপক শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার মনে করেন, কবিতাগুলো খ্রিস্টীয় ২য় শতকে রচিত হয়েছিল।

অষ্ট সংকলন : অষ্ট সংকলনের এক একটিতে আছে কয়েকটি করে ছােটো গীতি-কবিতা। প্রথম সংকলনটির নাম ‘নত্রিনৈ’। এতে আছে চারশােটি ছােটো গীতিকবিতা। দ্বিতীয় সংকলনটির নাম ‘কুরুনথােকৈ’। প্রায় দু’শাে জন কবির লেখা প্রেম পর্যায়ের চারশাে কবিতা এই সংকলনে স্থান পেয়েছে। ‘ঐনকুরুনূরু’ এই পর্যায়ের তৃতীয় সংকলন। ৫ জন কবির ৫০০টি প্রণয়মূলক কবিতার সংকলন এটি। মিলন, বিচ্ছেদ, প্রতীক্ষা, বিলাপ ও অভিমান – প্রেমের এই পাঁচটি রূপকে আশ্রয় করেই কবিতাগুলো রচিত হয়েছে। চতুর্থ সংকলন ‘পদিত্রুপাত্তু’। আদিতে এটি ছিল দশ স্তবকের দশটি কবিতার সংকলন। কিন্তু বর্তমানে প্রথম ও সর্বশেষ কবিতাটি আর পাওয়া যায় না। মুখ্যত, চের রাজাদের শেীর্য-বীর্য ও চারিত্রিক গুণাবলি অবলম্বন করে কবিতাগুলো রচিত হলেও এদের সামাজিক গুরুত্ব কম নয়। বিনােদন, মৃতদেহ সৎকার ও নারীদের কেশচর্চার মতাে সামাজিক বিষয়ের অবতারণা আছে এই কবিতাগুলোতে। এই সংকলনে যেসব রাজাদের উল্লেখ আছে তারা খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হয়তাে তখনই কবিতাগুলো রচিত হয়েছিল। পরনর, কপিলর, পলৈ, কৌথম্নার, কাক্কৈ পাদিনৈআর এই পর্বের কয়েকজন খ্যাতনামা কবি। এদের মধ্যে কাক্কৈ পাদিনৈআর ছিলেন মহিলা কবি। পঞ্চম গীতি সংকলন “পরিপাদল”। প্রথম দিকে সংকলনটিতে সর্বসমেত ৭০টি কবিতা ছিল কিন্তু এখন মাত্র ২৪টি কবিতা অবশিষ্ট আছে। সংকলন ‘কলিথােকৈ’। ১৫০টি প্রেম পর্যায়ের কবিতার সংকলন এটি। কপিলর ও তারও চারজন কবি এই কবিতাগুলো রচনা করেছেন। সপ্তম সংকলন ‘অহনানূরু’ এটির আর এক নাম ‘নেদুনথােকৈ’। এতে আছে ৪০০টি প্রণয়মূলক কবিতা। পরনর ও মামূলনার এই সংকলনের বেশির ভাগ কবিতা রচনা করেছেন। এই পর্যায়ের সর্বশেষ সংকলনটির নাম ‘পুরনানূরু’। ১৫০ জন কবির ৪০০টি কবিতা এই সংকলনে স্থান পেয়েছে। কপিলর, অবৈব, কোবর-কিলার, পেরুনথলৈ শাত্তনার, পেরুম-সিত্তিরনার এবং উরৈয়ুর এনিচেরি মুদমােসিয়ার এই সংকলনের খ্যাতনামা কবি। এই কবিতাগুলোতে একদিকে যেমন উন্নতমানের সাহিত্য কীর্তির অভিব্যক্তি ঘটেছে, অন্যদিকে তেমনি প্রাচীন তামিল সমাজের চালচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।

অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতাগ্রন্থ : অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতাগ্রন্থের প্রথমটির নাম ‘নালদিয়ার’। এটি একটি সংকলন বিশেষ। জৈন কবিদের লেখা ৪০০টি চতুস্পদী কবিতার সংকলন এটি। তবে এই পর্যায়ের সবকটি কবিতাই যে উন্নতমানের তা বােধ হয় না। দ্বিতীয়টিও একটি কবিতা-সংকলন। এর নাম ‘নানমনিক্কদৈকৈ’। এতে আছে কবি নাগনার-এর লেখা ১০০টি চতুষ্পদী কবিতা। পরবর্তী চারটি কবিতাগ্রন্থ হল “কারনারপথু’, ‘কলবলি নারপথু’, ‘ইনিঅবৈ নারপথু’ ও ‘ইন্ন নারপথু’। এদের সামগ্রিকভাবে ‘না নারপথু’ও বলে। প্রথম কবিতাটিতে জনৈকা প্রােষিতভর্তৃকার বিরহ-বেদনা অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘কলবলি নারপথু’তে এক চেররাজ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী চোল নৃপতির সংঘর্ষ বর্ণিত হয়েছে। অনেকে বলেন, তখনকার দিনের প্রখ্যাত বৈষ্ণব-সাধ্বী পৌইকৈ আড়বার এই কবিতাটি রচনা করেছেন। পরবর্তী চারটি কবিতাগ্রন্থ একত্রে ‘এনথিনৈ’ নামে পরিচিত। এই পর্যায়ের কবিতাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে নর-নারীর হৃদয়াবেগ ও তাদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন।

তিরুবল্লুবর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কুরল’ এই পর্যায়ের একাদশ কবিতাগ্রন্থ। ব্রহ্মার অবতাররূপে কল্পিত তিরুবল্লুবর তামিল সাহিত্য-গগনের এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। মানবজীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা ও শাশ্বত আদর্শের অভিব্যক্তি ঘটেছে তার এই অমর কবিতাগ্রন্থে। রাজনীতি, নীতিকথা, প্রেম, দাম্পত্যজীবন, নাগরিকত্ব, আইন-আদালত সব কিছুই সুনিপুণভাবে এই গ্রন্থে বিশ্লেষিত হয়েছে। বাচনভঙ্গির সৌন্দর্য, সারল্য, স্বকীয়তা ও পরিমিতিবােধ কবিতাগুলোকে মনােহারিত্ব দান করেছে। তামিলভাষীদের গৃহে গৃহে আজও এই কাব্যখানি সাগ্রহে পঠিত হয়। কাব্যখানি ১১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। আবার প্রতিটি অধ্যায়ে আছে দশটি করে দু’চরণের কবিতা। এই পর্যায়ের বাকি কবিতাগুলো হল ‘তিরিকদুকম’, ‘আচারকোবৈ’, ‘পলমােলি’, ‘সিরুপঞ্চমূলম’, মুদুমােলিক কাঞ্চি’, ‘ইন্নিনৈ’ এবং ‘এলাদি’। এসব কবিতায় মানবিক গুণের বিকাশ ও অনুশীলনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

শঙ্গম সাহিত্যের সর্বজনীনতা : উপরের আলােচনা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, অসমিয়া, বাংলা, হিন্দি প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার জন্মের বহু পূর্বে তামিলনাড়ুতে এক সমুন্নত সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাক ও আদি খ্রিস্টীয় পর্বের সে সাহিত্যে শুধু ঠাকুর-দেবতা বা রাজা-মহারাজদের কথা বলা হয়নি, সমাজের সর্বস্তরের লোকেদের কথা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিরহ বেদনা ও ঘর বাঁধার স্বপ্নের কথাও বলা হয়েছে। এই সাহিত্য সৃষ্টির মহাযজ্ঞে যেসব কবি সামিল হয়েছিলেন তারা তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন, তাদের পেশা ছিল ভিন্ন, ধর্মমতও ছিল ভিন্ন। শঙ্গম সাহিত্য সর্ব অর্থেই সর্বজনীন সাহিত্য হয়ে উঠেছে। এই উদার, সর্বজনীন বাতাবরণের সঙ্গে পদ লালিত্যের মণিকাঞ্চন যােগ শঙ্গম সাহিত্যকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

রাজনৈতিক জীবন

শঙ্গম সাহিত্যে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক জীবনের একটি ছবি পাওয়া যায়। এ ছবি পূর্ণাঙ্গ নয়, অসম্পূর্ণ। শঙ্গম সাহিত্যে রাজাদের নামােল্লেখ আছে, রাজাদের বংশ পরিচয়ও দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাজাদের বা রাজবংশের ইতিহাসের কোনও ধারাবাহিক বর্ণনা নেই। যে বিবরণ আছে তা সংক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া বাকি রাজাদের সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা রাজাদের বীরত্ব, দানশীলতা ও যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রশস্তিবাচক মন্তব্য। পরবর্তী যুগের তামিল সাহিত্যে বা ১১শ-১২শ শতকের লেখমালায় এই পর্বের রাজনৈতিক জীবনের কিছু বর্ণনা আছে কিন্তু তা মূলত কল্পনাশ্রিত।

শঙ্গম সাহিত্যে যেসব রাজাদের উল্লেখ আছে বংশপরিচিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় – চের, পাণ্ড্য চোল। আবার চের, পাণ্ড্য ও চোল রাজারা সকলেই যে তাদের নিজ নিজ বংশের একই শাখাযুক্ত ছিলেন তা নয়, তারা বিভিন্ন শাখার সদস্য ছিলেন।

চের রাজবংশ 

উদয়ঞ্জেরাল : শঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত চের রাজাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রাচীন তার নাম উদয়ঞ্জেরাল। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে তিনি কৌরব ও পাণ্ডব সৈন্যদের ভূরিভােজে আপ্যায়িত করেছিলেন বলে শঙ্গম সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এসব উক্তি তাৎপর্যহীন। সাধারণত মনে করা হয়, খ্রিস্টীয় ২য় শতকের মধ্যভাগে তিনি কেরল ও সংলগ্ন তামিল ভূখণ্ডে অবস্থিত চের অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।

নেদুঞ্জেরল : উদয়ঞ্জেরালের পরবর্তী চেরনৃপতি ইমৈয়বরমবন নেদুঞ্জেরল আদন। এই দুই রাজার মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল বা তারা আদৌ একই শাখাভুক্ত ছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত কিছু জানা যায় না। শঙ্গম যুগের বিভিন্ন কবিতায় নেদুঞ্জেরল এক বিখ্যাত রাজারূপে বর্ণিত হয়েছেন। তিনি যবনদের যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের বন্দি করে রাজধানীতে নিয়ে আসেন এবং পরে প্রচুর উপঢৌকনের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দান করেন। নেদুঞ্জেরলের হাতে পরাজিত যবনেরা সম্ভবত গ্রিস বা আরবদেশীয় বণিক ছিলেন। তাদের রোমক হওয়াও বিচিত্র নয়। তিনি সমুদ্র নিকটবর্তী কদম্ব অঞ্চল অধিকার করেন। কদম্ব সম্ভবত কর্ণাটকের বনবাসির সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। কোনও কোনও কবিতায় তাকে আসমুদ্র হিমাচলের অধীশ্বররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনা অতিশয়ােক্তিমূলক। রাজত্বের শেষের দিকে তিনি জনৈক চোলরাজের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে তিনি এ চোলরাজ উভয়েই মৃত্যুবরণ করেন। শােনা যায়, চেররাজের দুই রানি স্বামীর প্রজ্বলিত চিতাকুতে আত্মাহুতি দিয়ে সতীধর্ম পালন করেন। নেদুঞ্জেরলের প্রতিদ্বন্দ্বী চোলরাজের পরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

শেনগুটুবন : নেদুঞ্জেরল আদনের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র পর পর রাজত্ব করেন। শেষােক্ত নরপতি শঙ্গম সাহিত্যে শেনগুটুবন নামে পরিচিত। তিনি আনুমানিক ১৮০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। অস্ত্রবিদ্যায় তার অসামান্য দক্ষতা ছিল, হস্তী ও অশ্ব চালনায় তার উল্লেখযােগ্য নৈপুণ্য ছিল। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন। মােহূর-এর রাজাকে তিনি পদানত করেন, কোঙ্গু অঞ্চলে অবস্থিত কোডূকূর দুর্গ তিনি অধিকার করেন। তিনি সম্ভবত একটি নৌবাহিনীও গঠন করেন। শুধু সামরিক ক্ষেত্রে নয়, সাংস্কৃতিক জগতেও তিনি সুনাম অর্জন করেন। বহু জ্ঞানী গুণিজন তার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছেন, সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি পরনর তার অনুগ্রহভাজন ছিলেন। তিনি দেবী পত্তিনির পূজা প্রবর্তন করেন। কথিত আছে, দেবীর মূর্তি নির্মাণের জন্য তিনি উত্তর ভারত থেকে পাথর সংগ্রহ করেছিলেন।

রাজধানী : বনজি ছিল চেররাজ্যের রাজধানী। তবে শহরটির সঠিক অবস্থান জানা যায় না। অনেকে। বলেন, তিরুচিরাপল্লীর নিকটস্থ বর্তমান করূর প্রাচীন বনজির স্মৃতি বহন করছে। আবার কারাের মতে শহরটি কোচিনের নিকট তিরুবনজিকুলমে অবস্থিত ছিল। হয়তাে প্রথম মতই ঠিক।

শেল্বক্কডুঙ্গো : নেদুঞ্জেরল আদন ও তার বংশধরদের রাজত্বকালে আর একটি চের শাখা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই শাখার অন্তত তিনজন রাজার কথা জানা যায় – অন্দুবন, তার পুত্র শেল্বক্কডুঙ্গো বালি আদন ও পৌত্র তগডূরএরিন্দ পেরুঞ্চেরল ইরুমপােরৈ। এই চেররাজ্য কাবেরী অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। শেল্বক্কডুঙ্গো এই শাখার শ্রেষ্ঠ নরপতি। কবি কপিলর তার বহু কবিতায় এই রাজার প্রচুর বৈদিক যাগযজ্ঞ, দানশীলতা ও যুদ্ধজয়ের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। বিষ্ণুভক্ত এই নৃপতি ২৫ বছর রাজত্ব করেন। তিনি অপর চের রাজ্যের অধিপতি ইমৈয়বরমবন নেদুঞ্চেরল আদনের ভায়রাভাই ছিলেন। 

তগডূরএরিন্দ : শেল্বক্কডুঙ্গোর মৃত্যুর পর তার পুত্র তগডূরএরিন্দ পেরুঞ্জেরল ইরুমপােরৈ আনুমানিক ১৯০ খ্রিস্টাব্দে পিতৃসিংহাসনে আরােহণ করেন। অরিশিল কিলার এবং মােশি কিরন-এর মতাে দু’জন খ্যাতনামা কবি তার অনুগ্রহভাজন ছিলেন। তিনি কলুবুল নামে এক উপজাতীয় দলপতিকে পরাজিত করে তার প্রশাসনিক কেন্দ্র কামুর অধিকার করেন। কামুরের অবস্থান জানা যায় না। তগড়ুর দুর্গ বিজয় তার রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। চোল ও পাণ্ড্য রাজারা তগড়ুর দুর্গের অধিপতি অদিগমানকে সাহায্য করেন। তৎসত্ত্বেও অদিগমান যুদ্ধে পরাজিত হন এবং চেররাজের বশ্যতা স্বীকার করেন। এই রাজা ১৭ বছর রাজত্ব করেন।

পেরুঞ্জেরল ও ইরুমপােরৈ : আরও দু’জন চেররাজের কথা শােনা যায়। এদের একজন পেরুঞ্জেরল আদন, অন্যজন কণৈক্কাল ইরুমপােরৈ। প্রথমােক্ত জন প্রখ্যাত চোলরাজ করিকালের সমকালবর্তী, অপর জন উত্তর পর্বের। পূর্বোক্ত চেররাজদের সঙ্গে এই দুই রাজার কী সম্পর্ক ছিল বা এদের দুজনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কই-বা কী ছিল, সে সম্পর্কে শঙ্গম সাহিত্য সম্পূর্ণ নীরব। পেরুঞ্জেরল আদন বেণ্ণির যুদ্ধে করিকালের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে পিঠে আঘাত পেয়ে ক্ষোভে ও অপমানে প্রায়ােপবেশনে মৃত্যুবরণ করেন। কণৈক্কাল ইরুমপােরৈ চোলরাজ শেঙ্গণান-এর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন কিন্তু তিনি পরাজিত ও বন্দি হন। শেষে কবিবন্ধু পােয়গৈয়ার-এর সহায়তায় চোল কারাগার থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করেন।

চোল রাজবংশ 

শঙ্গম সাহিত্যে চোল রাজাদের কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে। পরাক্রম, ব্রাহ্মণ্যধর্মানুরাগ, বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান, দানশীলতা, বিদ্যোৎসাহশীলতা প্রভৃতি গুণের জন্য চোল রাজারা শঙ্গম সাহিত্যে প্রশংসিত হয়েছেন। 

ইলঞ্জেটচেন্নি : একজন চোলনৃপতি ইলঞ্জেটচেন্নি। কবি পরনর ও পেরুঙ্গুনরূর কিলার তার সুশাসনের প্রশংসা করেছেন। অনুমান করা হয়, ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন। 

করিকাল : ইলঞ্জেটচেন্নির পুত্র করিকাল। শঙ্গম যুগের শ্রেষ্ঠ রাজা এই করিকাল। সমকালীন যুগে তার সম্পর্কে বহু কবিতা রচিত হয়েছে। পরবর্তী তামিল সাহিত্য ও লেখমালায় তার সম্পর্কে সত্য মিথ্যা নানা কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে। কেন তার নাম করিকাল তা নিয়ে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক আছে। অগ্নিদগ্ধ যার পা তিনি করিকাল, এই অর্থে অনেকে করিকাল শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন। আবার কলির যিনি কাল অর্থাৎ যম তিনিও করিকাল। আবার করি বলতে হস্তীও বােঝায়। এই অর্থে, শত্রুপক্ষীয় হস্তীদের যিনি মৃত্যুস্বরূপ, তিনিও করিকাল।

প্রথম জীবনে করিকালকে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। পিতৃসিংহাসনের উপর তার ন্যায্য অধিকার ছিল কিন্তু শত্রুরা তাকে বন্দি করেন। করিকাল নিজ বুদ্ধিবলে মুক্তি লাভ করেন এবং শত্রুদের পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করেন। ঘটনাকাল আনুমানিক ১৯০ খ্রিস্টাব্দ। করিকালের সিংহাসন উদ্ধারের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনি পট্টিনপ্পালৈ কবিতায় বর্ণিত হয়েছে। 

বেণ্ণির যুদ্ধে বিজয়লাভ করিকালের রাজত্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। বেন্নির বর্তমান নাম কোবিল বেন্নি। স্থানটি তঞ্জাবুর শহরের ২৫ কি. মি. পূর্বে অবস্থিত। এখানে করিকালের সঙ্গে পাণ্ড্য ও চের রাজার সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়। এই যুদ্ধে করিকালের প্রতিপক্ষ চেরনৃপতি পেরুঞ্জেরল আদন পিঠে আঘাত পান। যুদ্ধে পিঠে আঘাত পাওয়ার চেয়ে লজ্জাকর ঘটনা সৈনিকের আর কিছুই নেই। সৈনিক পলায়মান হলে তবেই শত্রুপক্ষের অস্ত্র তার পিঠে আঘাত হানে। অর্থাৎ, বেগতিক দেখে পেরুঞ্জেরল আদন যখন যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করেন তখনই চোলপক্ষের অস্ত্র এসে তার পৃষ্ঠদেশ বিদ্ধ করে। এ ঘটনায় চেররাজ মর্মাহত হন এবং আমৃত্যু অনশনে জীবন ত্যাগ করেন। পাণ্ড্য ও চের নরপতিদের বিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক আকাশে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্করূপে আবির্ভূত হলেন চোল নৃপতি করিকাল। 

বাহৈপ্পরন্দলৈর যুদ্ধে জয়লাভ করিকালের রাজত্বের আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এই যুদ্ধে ৯ জন ক্ষুদ্র নরপতি বা উপজাতীয় দলপতি চোলরাজের নিকট পরাজয় বরণ করেন। এই যুদ্ধের কারণ বা শত্রু রাজাদের পরিচিতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। 

কবি উরুত্তিরঙ্গণ্ণনার রচিত পটিনপ্পালৈ কবিতায় করিকালের রাজ্যজয়ের এক মনােজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এই কবিতায় বলা হয়েছে, করিকাল এয়িনরদের পরাজিত করেন, ওলিয়রদের ক্ষমতা খর্ব করেন, অরুবালরদের দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেন, উদীচ্য দেশবাসীদের গৌরব হরণ করেন। এয়িনর গােষ্ঠী দক্ষিণ আর্কট জেলার তিনদিবনম ও উত্তর বিল্লুপুরম তালুক এবং চিপ লেপুট জেলার মাদুরান্তকম তালুকের শাসনকর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ওলিয়রদের সঠিক পরিচয় অজ্ঞাত। অনেকের মতে তারা আধুনিক রমানাথপুরম জেলার শাসনকর্তা ছিলেন। অধ্যাপক তেরলুণ্ডুর বেঙ্কটরাম মহালিঙ্গম তাদের কলভ্র বলে সনাক্ত করেছেন (Kalichipuram In Early South Indian History (Madras, 1969), পৃষ্ঠা ১২-৪)। কলভ্ররা সম্ভবত মাদুরাই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। অরুবালররা সম্ভবত কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। যাদের উদীচ্যদেশবাসী বলা হয়েছে তারা হয়তাে নেল্লোর ও গুন্টুর জেলার পল্লব রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন (অধ্যাপক হালিঙ্গম এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন (তদেব, পৃষ্ঠা ১৫))। সন্দেহ নেই, তামিলনাড়ুর এক বিস্তীর্ণ ভুখণ্ড এবং অন্ধ্রপ্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল করিকালের অধিকারভুক্ত ছিল। দক্ষিণ ভারতে পূর্বে কখনও এত বড় রাজ্যের উদ্ভব হয়নি। 

তােণ্ডৈমান ইলন্দিরৈয়ন : করিকালের সমকালীন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তােণ্ডৈমান ইলন্দিরৈয়ন। তিনি উরুত্তিরঙ্গণ্ণার রচিত “পেরুম্পানাৎক্রপদৈ” কবিতায় কাঞ্চীর অধিপতিরূপে বর্ণিত হয়েছেন। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, সমকালীন চোল, চের ও পাণ্ড্য রাজারা তার তুলনায় হীনপ্রভ ছিলেন। তিনি একজন যশস্বী কবিও ছিলেন। শঙ্গম সাহিত্য-সংকলনে তার কয়েকটি কবিতা স্থান পেয়েছে। শঙ্গম সাহিত্যে ইলন্দিরৈয়নের বংশ-পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, করিকালের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধেও কোনও মন্তব্য নেই। ফলে কাঞ্চীর রাজনৈতিক সত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাঞ্চী কি করিকালের রাজ্যভুক্ত ছিল না তােণ্ডৈমান ইলন্দিরৈয়নের অধীনে এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাজ্য রূপে গড়ে উঠেছিল? ঐতিহাসিকেরা এ বিষয়ে বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন। শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার মনে করেন, ইলন্দিরৈয়ন করিকালের পৌত্র ছিলেন এবং করিকাল কাঞ্চী অধিকার করে পৌত্রকে বিজিত অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। নীলকান্ত শাস্ত্রীর মতে ইন্দিরৈয়ন কাঞ্চীর স্বাধীন রাজা ছিলেন এবং করিকালের রাজ্য কাঞ্চীর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ছিল। তেরলুর বেঙ্কটরাম মহালিঙ্গমের অভিমত, কাঞ্চী করিকালের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত তাে ছিলই, উপরন্তু চোলরাজ্য কাঞ্চীর সীমানা ছাড়িয়ে আরও উত্তরে প্রসারিত ছিল। কিন্তু শঙ্গম সাহিত্যে ইলন্দিরৈয়নের যে পরিচয় বেদেয়া হয়েছে তাতে তাকে কাঞ্চীর এক চোল স্বাধীন রাজা বলে বােধ হয়। আবার এ কথা সত্য, কাঞ্চীর উত্তরেও করিকাল রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। কাঞ্চী যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ যার চারদিক ঘিরে ছিল করিকালের রাজ্য। হয়তাে ইলন্দিরৈয়ন করিকালের কোনও কন্যা বা সহােদরাকে বিবাহ করেছিলেন বলেই নিরুপদ্রবে কাঞ্চীতে রাজত্ব করেন। 

করিকাল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, বহুদিন পূর্বে কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন (R C Majumdar (Ed.): The Age of Imperial Unity (Bombay, 1960). পৃ. ২৩১)। বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে করিকাল বিজয়ী হয়েছিলেন এবং ১২ হাজার শ্রীলঙ্কীয়কে বন্দি করে স্বদেশে নিয়ে আসেন। লক্ষ করবার বিষয়, শঙ্গম সাহিত্যে চোলরাজের সপক্ষে এ ধরনের কোনও উত্তি নেই। তবু যদি এ অভিমত গ্রাহ্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে ১৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে গজবাহুর মৃত্যুর পরই করিকাল শ্রীলঙ্কা আক্রমণ করেন।

করিকাল একদিকে যেমন নতুন নতুন অঞ্চল জয় করে চোলরাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেন, অন্যদিকে তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে, নতুন নতুন জনপদ সৃষ্টি করে এবং চাষ-আবাদের ব্যবস্থা করে রাজ্যের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেন। পট্টিনপ্পালৈ কবিতায় তৎকালীন কাবেরীপট্টিনম ও সংলগ্ন অঞ্চলের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ছবি অঙ্কিত আছে। অনেক বনভূমিকে তিনি কৃষি ক্ষেত্রে পরিণত করেছেন, বহু অরণ্যাঞ্চলে তিনি নতুন বসতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। শঙ্গম সাহিত্যে তার এক নতুন শহর প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। শহরটিতে একটি দুর্গ স্থাপিত হয়, উঁচু প্রাকার দিয়ে শহরটিকে ঘেরা হয়, শহরে প্রবেশ ও বহির্গমনের জন্য কয়েকটি সুদৃশ্য তােরণও নির্মিত হয়। অনেকেই এই শহরটিকে কাবেরীপূমপট্টিনম বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার অনেকের মতে এই শহরটি কাবেরীপুমপট্টিনম নয়, তােণ্ডৈমণ্ডলমের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত অন্য কোনও এক শহর। কৃষিকার্যে গতি সঞ্চারের জন্য এ সময় বহু কৃপ ও পুষ্করিণী খনন করা হয়। বিচারকার্যে অংশগ্রহণকালে তিনি নিরপেক্ষতার নীতি আনুসরণ করতেন। তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মানুরাগী ছিলেন। বহু যাগযজ্ঞের আয়ােজন করেন তিনি। তামিল সাহিত্যের তিনি পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। শঙ্গম সাহিত্যে তার যে ছবি আঁকা হয়েছে তা সত্য বলে বুঝতে হবে ভােগৈশ্বর্যময় জীবনযাত্রার প্রতি তার আগ্রহ কম ছিল না।

পরবর্তিকালে করিকালকে কেন্দ্র করে প্রচুর কাহিনি রচিত হয়। এসব কাহিনি অতিরঞ্জিত। ‘শিলপ্পদিকারম’ এবং ১১শ-১২শ শতকের বহু গ্রন্থে ও লেখমালায় এ ধরনের কাহিনি সন্নিবেশিত হয়েছে। এসব কাহিনিতে বলা হয়েছে করিকাল আসমুদ্রহিমাচল জয় করেছিলেন, বন্যা প্রতিরােধকল্পে অনুগত নৃপতিদের সহায়তায় কাবেরী নদীর বদ্বীপের মুখে অনেক জলাধার নির্মাণ করেছিলেন। করিকাল সারা ভারত জয় করেছিলেন, এ দাবি অবশ্যই অতিরঞ্জিত। বদ্বীপের মুখে কাবেরী নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বিশাল বিশাল জলাধার নির্মাণের ইতিহাস অনেক প্রাচীন সন্দেহ নেই। এর ফলে বন্যাকে যেমন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তেমনি জলাধারে সঞ্চিত জল বহু সংখ্যক খাল ও শাখা খালের মাধ্যমে কৃষি-জমিতে পাঠিয়ে কৃষিজ ফলন বাড়ানাে যায়। করিকাল এরূপ বৃহৎ সেচপ্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

কিল্লি বল্বন, শেঙ্গণান ও ওয়মান নল্লিয়ক্‌কোডন : শঙ্গম সাহিত্যে করিকালােত্তর পর্বের কয়েকজন চোল রাজার কথাও বলা হয়েছে। এদের একজন কুরাপ্পল্লিত্তুঞ্চিয় পেরুন্দিকুমা বল্বন। তিনি কিল্লি বল্বন নামেও পরিচিত। বীরত্ব, দানশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা প্রভৃতি বিভিন্ন গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তার চরিত্রে। চেরদের রাজধানী বনজি তিনি জয় করেছিলেন বলে জানা যায়। নলঙ্গিল্লি এবং নেডুঙ্গিল্লি এই পর্বের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজকুমার। তারা উভয়েই চেয়েছিলেন সিংহাসনের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন।  শঙ্গম যুগের একেবারে শেষের দিকের এক চোলরাজ শেঙ্গণান। চেরনৃপতি কনৈক্‌কাল ইরুমপােরৈকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি করেন। চের রাজা শেষে নিজেকে মুক্ত করেন। যুদ্ধের স্থান সম্পর্কে বিতর্ক আছে। একটি কবিতায় স্থানটির নাম পাের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর একটি কবিতায় স্থানটিকে কলুমলম বলা হয়েছে। স্থান দুটির সঠিক অবস্থান জানা যায় না। শঙ্গম সাহিত্যে আর একজন চোল রাজার উল্লেখ আছে। তার নাম ওয়মান নল্লিয়ক্‌কোডন। দক্ষিণ আর্কট জেলায় তিনি রাজত্ব করতেন। তার রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষ পাদ।

পাণ্ড্য রাজবংশ

শঙ্গম সাহিত্যে কয়েকজন পাণ্ড্য রাজার কার্যকলাপও বর্ণিত হয়েছে। এদেরই একজন মুদুকুভুমি পেরুবলুদি। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের একটি লেখেও তার কথা বলা হয়েছে। তিনি পরমেশ্বর অভিধা ধারণ করেছিলেন। তার আর একটি অভিধা ‘পল্যাগশালৈ’। বহুসংখ্যক যজ্ঞ-মণ্ডপের প্রতিষ্ঠিতা যিনি তারই নাম ‘পল্যাগশালৈ’। এতে তার ব্রাহ্মণ্যধর্মানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। শঙ্গম সাহিত্যে তার যুদ্ধ বিজয়ের উল্লেখ আছে। মুদুকুড়ুমি পেরুবলুদির এক উত্তরপুরুষ তলৈয়ালঙ্গানত্তুচ্চেরুবেন নেডুঞ্জেলিয়ন। এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পাণ্ড্য রাজা তিনি। আনুমানিক ২১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন। তখন তিনি একজন তরুণ মাত্র। তার সিংহাসনে আরােহণের অল্পদিনের মধ্যে এক শক্তিশালী শত্রুজোট পাণ্ড্যরাজ আক্রমণ করে। এই জোটে চের, চোল, তিতিয়ন, এলিনি, এরুমৈয়ূরন, ইরুঙ্গোবেল্মান ও পােরুনন – এই সাতজন রাজা যােগদান করেন। শত্রু রাজারা ভেবেছিলেন, অনভিজ্ঞ পাণ্ড্য নৃপতি বিনা যুদ্ধে তাদের বশ্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু পাণ্ড্যরাজ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন এবং আক্রমণকারীদের পশ্চাদ্ধাবন করে চোলরাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তলৈয়ালঙ্গানম-এর যুদ্ধে নেডুঞ্জেলিয়ন শত্রু বাহিনীকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। প্রাচীন তলৈয়ালঙ্গানমের বর্তমান নাম তলৈয়ালমকাডু। স্থানটি তঞ্জাবুর জেলার তিরুবালুর শহরের ১২.৮ কি. মি. উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে নেডুঞ্জেলিয়ন শুধু পিতৃসিংহাসনই নিষ্কণ্টক করলেন না, তিনি তামিল অঞ্চলেও নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। পরবর্তিকালে দুটি অঞ্চল জয় করে তিনি নিজ রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেন। বিজিত অঞ্চল দু’টি হল মুত্তূরূকূররম ও কূররম। বিদ্যোৎসাহী রাজারূপেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নিজে একজন কবি ছিলেন। মাঙ্গুডি কিলার ও নক্‌কীররের মতাে সে কালের বিখ্যাত কবিরা তার সম্পর্কে প্রশস্তি রচনা করেছেন। মাদুরাই ছিল তার রাজধানী। শঙ্গম সাহিত্যে এই শহরের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাস্তা-ঘাট ও জন-সমাবেশের মনােরম বর্ণনা আছে। আর একজন পাণ্ড্যরাজ ইলবন্দিগৈপ্পল্লিত্তুঞ্জিয় নন্মরন। কবি নক্কীরর-এর সমকালীন তিনি। তিনি বহু বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। কৌণ্ডিন্য গােত্রীয় ব্রাহ্মণ বিণ্ণন্দায়ন তার পুরােহিত ছিলেন।

প্রশাসন-ব্যবস্থা 

রাজতান্ত্রিক প্রশাসন : শঙ্গমযুগে রাজতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। অরট্ট বা গণশাসনের প্রচ্ছন্ন উল্লেখমাত্র নেই শঙ্গম সাহিত্যে। রাজপদ ছিল পুরুষানুক্রমিক। পিতার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদ লাভ করতেন। কখনও কখনও সিংহাসনের উপর অধিকার নিয়ে রাজপুত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিত।

রাজা : প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রাজা। তিনি রাজপুরুষদের নিয়ােগ করেন, সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন, প্রজাদের নিকট হতে রাজস্ব আদায় করেন, বিচারকার্যে মুখ্য বিচারকের ভূমিকা পালন করেন। এই পরিস্থিতিতে রাজতন্ত্র সাধারণত স্বৈরাচারের রূপ নেয়। তখনকার দিনে রাজাদের মধ্যে অনেকেই স্বৈরাচারী ছিলেন। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের পথে বাধা যে একদম ছিল না তা নয়। প্রথমত, প্রভাবশালী মন্ত্রী, বন্ধু ও কবিরা রাজকার্যে রাজাকে পরামর্শ দিতেন। রাজা তাদের উপদেশ সহসা অগ্রাহ্য করতেন না। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ প্রশাসনে সভা নামে এক প্রতিষ্ঠানের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। এখানে শুধু যে গ্রামের বিচারকার্য সম্পন্ন হত তা নয়, গ্রামের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলােচিত হত। এর উপর ছিল দেশাচারের প্রভাব। দেশাচারের বিরুদ্ধাচরণ করা কোনও রাজার পক্ষে সহজ ব্যাপার ছিল না। দেশাচার রাজাকে সৎ, জিতেন্দ্রিয়, প্রজানুরঞ্জক ও নিরপেক্ষ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শঙ্গম যুগের কবিরা তাদের কবিতায় বার বার এই দেশাচারের কথাই ব্যক্ত করেছেন। কবিরা বলেছেন, রাজা প্রজাদের অভাব-অভিযােগ শুনবেন, অভিযােগের প্রতিকার করবেন, তাদের পুত্রস্নেহে পালন করবেন।

যুদ্ধবিগ্রহ : তখনকার দিনে রাজায় রাজায় প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। নানা কারণে যুদ্ধ হত । প্রতিবেশী রাজ্যের গবাদি পশু অপহরণ সে সময়ের এক নিয়মিত ঘটনা ছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি রাজ্যের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ বেধে যেত। কখনও কখনও কোনও রাজা অন্য রাজ্যের রাজকন্যার পাণিগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। কন্যার পিতা বা অভিভাবক এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে দুই রাজার মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিত। তৃতীয়ত, রাজ্যলিপ্সা ছিল শক্তিমান রাজার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রতিবেশী রাজাদের পরাজিত করে নিজেদের বিজিগীষু নরপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করার আদর্শে তারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। সাত সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাকে পরাজিত করে তাদের মুকুটে তৈরি মালা নিজ গলায় ধারণ করেছেন, রাজাদের এ ধরনের চিত্র শঙ্গম সাহিত্যে অঙ্কিত আছে।

সেনাবাহিনী : রাজশক্তির মূল উৎস যে সৈন্যবাহিনী তা পেশাদার সেনাদের নিয়ে গঠিত ছিল। সৈন্যবাহিনীর চারটি বিভাগ – রথারােহী, গজারােহী, অশ্বারােহী ও পদাতিক। রথ টানত ঘােড়ায় ও বলদে। তরবারি, তির, ধনুক, ব্যাঘ্রচর্ম নির্মিত বর্ম, বর্শা ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হত। শঙ্গম সাহিত্যে এক ধরনের উৎক্ষেপণ অস্ত্রের উল্লেখ আছে। তাকে তােমরম বলা হয়েছে।

শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান : সাধারণত প্রশাসনের স্বার্থে রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশ বা বিভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি বিভাগ আবার কয়েকটি উপবিভাগে বিভক্ত হয়। এক একটি বিভাগ ও উপবিভাগের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির রাজপুরুষেরা নিযুক্ত হন। শঙ্গম সাহিত্যে এ ধরনের কোনও তথ্য নেই। কিন্তু রাস্তা-ঘাট তথা জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রশাসনের তৎপরতার উল্লেখ আছে এ সাহিত্যে।

সভা বা মনরম : সভা বা মনরম ছিল সে যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ সংস্থা। এই সভা বসত নির্দিষ্ট এক বৃক্ষতলে। এই সভায় যেমন খেলাধুলা ও অবসর বিনােদনের ব্যবস্থা ছিল তেমনি গ্রাম সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিও আলােচিত হত। মূলত সামাজিক সংস্থা হলেও গ্রামসভার রাজনৈতিক গুরুত্ব কম ছিল না। উরৈয়ূর-এর চোল সভা ন্যায়বিচারের জন্য সে সময় বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছিল। পরবর্তিকালে পরাক্রান্ত পল্লব ও চোল রাজাদের আমলে তামিলনাড়ুতে যে উন্নত স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার বীজ এই পর্বেই বপন করা হয়।

সমাজ-জীবন

বহুজাতিক সমাজ : বহু জাতির লােক নিয়ে তখনকার দিনের তামিল সমাজ গঠিত ছিল। কিরাতরা এমনই এক জাতি। তাদের সে রকম শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না। কুড়ে ঘরে তারা বাস করতেন। হিংস্র কুকুর তাদের ঘর পাহারা দিত। পশুশিকার তাদের প্রধান উপজীবিকা হলেও যুদ্ধবৃত্তিও তারা গ্রহণ করতেন। তাদের ঘরে প্রচুর পরিমাণে তির, ধনুক, বর্শা ও অন্যান্য অস্ত্র মজুত থাকত। গােয়ালারা ভেড়া, গরু ও মহিষের দুধের ব্যবসা করতেন। গােয়ালাদের স্ত্রী কন্যারা বাজারে বা গ্রামবাসীদের বাড়িতে বাড়িতে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রি করতেন। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সৈন্যবাহিনীতে যােগ দিত। আজীবন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থেকে জীবনসায়াহ্নে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেছেন এমন সৈনিকের কথাও শঙ্গম সাহিত্যে বলা হয়েছে। দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। বেশির ভাগ দাস-দাসী ছিলেন বিজিত অঞ্চলের অধিবাসী। ব্রাহ্মণেরা বেদশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। শাস্ত্র অধ্যয়নে ও যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানেই তাদের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হত। ব্রাহ্মণীরা দেবতা ও অতিথিদের উদ্দেশ্যে সুস্বাদু খাবার তৈরি করতেন। ব্রাহ্মণদের বাড়ির সামনে একটি বাছুর বাঁধা থাকত। ঘরে থাকত দেবতাদের মূর্তি। ব্রাহ্মণেরা পায়রা পুষতেন। মাংস ও মদে তাদের অনীহা ছিল না। বন্দর ও সমুদ্র উপকূলে ছিল মৎস্যজীবীদের ভিড়। মাছ ধরতে তারা সমুদ্রে যেতেন। মাছের হাড়ের পুজো করতেন তারা। ভ্রমণশীল গায়কের দল স্থান থেকে স্থানান্তরে গান গেয়ে বেড়াত। তাদের মেয়েরা গানের তালে তালে নাচতেন। কখনও কখনও নৃত্য-গীত পরিবেশনের জন্য রাজদরবারে তাদের ডাক পড়ত। তখনকার দিনের কবিরা সংখ্যায় বেশ ভারী ছিলেন। তাদের মধ্যে ভাগ্যবান যারা তারা রাজাদের স্নেহধন্য ছিলেন কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ছিলেন দরিদ্র ও বঞ্চিত। একজন কবি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সামান্য একটি উপহারের জন্য তাকে বহুক্ষণ রাজদরবারে অপেক্ষা করতে হয়েছে। রাজার বন্ধু ছিলেন, রাজাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করেছেন এমন কবিদের কথাও শঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত আছে। সে সময় তামিলনাড়ুতে, বিশেষত তােণ্ডি, মুশিরি ও পুহারের মতাে বন্দরগুলোতে বহুসংখ্যক যবন ও ম্লেচ্ছদের বাস ছিল। সন্দেহ নেই, এরা ছিলেন মূলত গ্রিস, ইতালি ও আরব দেশাগত বণিক। তারা তামিল জানতেন না, অঙ্গভঙ্গির দ্বারা মনােভাব ব্যক্ত করতেন। তাদের রাজপ্রাসাদে রক্ষার কাজে বা রাতে রাস্তা-ঘাট প্রহরার কাজে নিয়ােগ করা হত। তারা সর্বদা সশস্ত্র থাকতেন।  

সমন্বিত সংস্কৃতি : শঙ্গম সাহিত্যে তামিলনাড়ুর সাংস্কৃতিক জীবনের যে ছবি প্রতিফলিত হয়েছে তা এক সমন্বিত সাংস্কৃতিক জীবনের ছবি। এ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দু’টি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির মিলনে। এদের একটি স্থানীয় তামিল সংস্কৃতি, অন্যটি উদীচ্য বা আর্য সংস্কৃতি। শঙ্গম যুগের কবিরা আর্যদের ধর্মবিশ্বাস, দর্শন, পৌরাণিক কাহিনি, রামায়ণ-মহাভারতের কথা, নীতিবােধ ও আচার-বিচারের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন এবং তারা তাদের কবিতায় সে পরিচয়ের অজস্র নিদর্শন রেখে গেছেন। তারা তামিল রাজাদের সঙ্গে কুরু-পাণ্ডবদের সম্পর্ক কল্পনা করেছেন, আর্য ধারণালালিত ঋণত্রয়ের কথা বলেছেন, পাণ্ডুতনয়দের হাতে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের পরাভবের উল্লেখ করেছেন, অক্রূরের বীরত্বের প্রশস্তি গেয়েছেন, অর্জুনের খাণ্ডববন দাহের কথা বলেছেন, মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের রন্ধনপটুত্ব, সাধ্বী অরুন্ধতী, চির শান্তির দেশ উত্তর কুরু, বিষ্ণুর নাভিপদ্ম হতে ব্রহ্মার আবির্ভাব, প্রতি প্রত্যুষে সূত, মাগধ ও বৈতালিকদের রাজবন্দনা, গৃহস্বামীর অতিথিকে প্রত্যুদগমন, কোনও প্রসঙ্গই শঙ্গম সাহিত্যে অনূক্ত রাখেননি। এ সময় বহু সংস্কৃত শব্দ অবিকৃতরূপে তামিল শব্দভাণ্ডারে অনুপ্রবিষ্ট হয়, সংস্কৃত শব্দের অনুকরণে বহু নতুন নতুন তামিল শব্দ তৈরি হতে থাকে। একটি উদাহরণ দেয়া যায়। পাদরক্ষা একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ পাদুকা। সংস্কৃত পারক্ষার অনুকরণে তামিল কবিরা এ পর্বে একটি নতুন শব্দ তৈরি করলেন। শব্দটি অভি-পুদৈ অরণম। তবে আর্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে শুধু যে তামিল সংস্কৃতিই সমৃদ্ধ হল তা নয়, আর্য সংস্কৃতিরও পরিপুষ্টি ঘটল।

নারী : শঙ্গম যুগের মহিলারা গৃহবন্দি ছিলেন না। গ্রামসভায় তারা নিয়মিত উপস্থিত হতেন, বিভিন্ন আমােদ-প্রমােদে অংশগ্রহণ করতেন। এ পর্বের কবিতায় গৃহবধূদের আলােকবর্তিকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে অনেকেই লেখাপড়া জানতেন। কেউ কেউ কবি বলে খ্যাতিলাভও করেছিলেন। সে যুগের এমনই এক মহিলা-কবি ঔবৈয়ার। তগড়ুর-এর অধিপতি আদিগমান তাকে দূত নিযুক্ত করে তােণ্ডৈমানের (ইলন্দিরৈয়ন?) দরবারে পাঠান। এ যুগের আর একজন মহিলা কবি বেল্লিবীদিয়ার। অনেক মহিলা নৃত্য ও গীতকে পেশারূপে গ্রহণ করেছিলেন। নর্তকীদের সঙ্গে গৃহস্বামীদের অশুভ ঘনিষ্ঠতা গৃহবধূদের ঘুম কেড়ে নিত। শঙ্গমােত্তর পর্বের রচনা মণিমেকলৈ কাব্যে গণিকাদের উল্লেখ আছে। তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হত। দরবারি নৃত্য, লঘু নৃত্য, গান, বাঁশি ও বীণা বাদন, চিত্রাঙ্কন, সুগন্ধ প্রস্তুতি, ফুলের কাজ ও আরও অনেক বিষয় তাদের আয়ত্ত করতে হত। সালঙ্করা, লাস্যময়ী মহিলাদের রাজসভায় যাতায়াত ছিল। অতিথি-অভ্যাগতদের তারা মদ পরিবেশন করতেন। যুদ্ধে বন্দি মহিলাদের ক্রীতদাসীর জীবন যাপন করতে হত। মহিলাদের অনেকেই স্বামীর মৃত্যুতে স্বামীর প্রজ্বলিত চিতাকুণ্ডে আত্মাহুতি দিয়ে সতীধর্ম পালন করতেন। কিন্তু সন্তানসম্ভবা মহিলাদের এ কাজে নিরস্ত করা হত। যেসব মহিলা সহমরণে যেতেন তাদের কঠোর বৈধব্যজীবন যাপন করতে হত। তারা মস্তক মুণ্ডন করতেন, অলংকার পরিহার করতেন, নামমাত্র আহারে জীবন নির্বাহ করতেন।

বিবাহ : বিবাহাদি সম্পর্কে শঙ্গম সাহিত্যে যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তা অতি সংক্ষিপ্ত। মনে হয়, বিবাহের পূর্বে আত্মীয়স্বজনদের ভূরিভােজে আপ্যায়িত করা হত। স্বামী ও সন্তান বর্তমান এরূপ চারজন মহিলার একটি দল কন্যাকে স্নান করাত। মণ্ডপে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হত। এই উপলক্ষে গান-বাজনার আসর বসত। দেবতাদেরও পূজা দেয়া হত। শঙ্গমােত্তর পর্বের রচনা তােলকাপ্পিয়ম ও কলবিয়ল গ্রন্থ দু’টি থেকে জানা যায়, সাধারণত অভিভাবকেরাই পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করতেন। তবে কখনও কখনও তাদের বিনা অনুমতিতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হত। সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে যে আট প্রকার বিবাহের বিধান আছে তারও উল্লেখ আছে এই দু’টি গ্রন্থে। বয়সে ছােটো বরের সঙ্গে বয়স্কা কন্যার বিবাহ এবং গােষ্ঠী বা জাতির বাইরে বিবাহের কথাও বলা হয়েছে গ্রন্থ দু’টিতে। কিন্তু এ ছবি শঙ্গম যুগের ক্ষেত্রে কতটা প্রযােজ্য বলা কঠিন।

লােকাচার : শঙ্গম সাহিত্যে তখনকার দিনের লােকাচার সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। তখন লােকদের জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রচণ্ড বিশ্বাস ছিল। ফলে জ্যোতিষীদের উপার্জন বেশ ভালােই ছিল বলা চলে। মেয়েদের চুল অবিন্যস্ত রাখা অশুভ বলে বিবেচিত হত। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য ছেলে-মেয়েদের হাতে কবচ পরিয়ে দেয়া হত। যাতে দৈত্য-দানব কোনও ক্ষতি করতে না পারে, যাতে বৃষ্টিপাত হয়, যাতে মনস্কামনা সিদ্ধ হয়, তার জন্য বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হত। লােকদের বিশ্বাস ছিল বটগাছে দেবতারা বাস করেন, তাদের প্রতীতি ছিল সাপেরা ভক্ষণ করে বলে চন্দ্র ও সূর্যের গ্রহণ হয়। তারা মনে করতেন মােরগ ডাকলে বুঝতে হবে বাড়িতে অতিথি আসছেন বা প্রবাসী স্বামী তার নিঃসঙ্গ বধূর গৃহে প্রত্যাবর্তন করছেন। সম্ভবত প্রতি গৃহে মােরগ পােষা হত। দরিদ্রদের মাঝে মাঝে পঙক্তি ভােজনে আপ্যায়িত করা হত।

মৃতদেহ-সৎকার : মৃতদেহ-সৎকার সম্পর্কে শঙ্গম সাহিত্যে অল্প-বিস্তর তথ্য আছে। মৃতদেহ সাধারণত দাহ করা হত। আবার কখনও কখনও শবাধারে ভরে, কখনওবা বিনা আধারে, মৃতদেহ সমাহিত করা হত। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কিছু আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল।

অর্থনেতিক জীবন

শঙ্গম সাহিত্যে তামিলনাড়ুর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিত্র আঁকা হয়েছে। সমৃদ্ধি ঘটেছিল কৃষিতে, শিল্পে ও বাণিজ্যে।

কৃষি ও শিল্প : কৃষিজ ফসলের মধ্যে ধানই ছিল প্রধান। কাবেরী নদীর বদ্বীপে প্রচুর ধান উৎপন্ন হত। বাঁশ, ইক্ষু, হলুদ এবং কাঠালও প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। প্রচুর পরিমাণে মধু উৎপন্ন হত। এ সময় কূপ, পুষ্করিণী ও জলাধার নির্মাণ করে বহু জমিকে কৃষির আওতায় আনা হয়। এর ফলে ফলন বৃদ্ধি পায়। উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ রাজাকে রাজস্ব দিতে হত। তবে সেই অংশ মােট উৎপাদনের কত ভাগ তার কোনও ইঙ্গিত নেই। মাছ ও মাংস সহজলভ্য ছিল। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। ধনী মালিকেরা নিজেরা চাষ-আবাদের কাজ করতেন না, শ্রমিকদের নিয়ােগ করতেন। দরিদ্র ভূস্বামীরা নিজেরাই খেতের কাজ করতেন। মেয়েরা তাদের সহযােগিতা করতেন। এ সময় কার্পাস ও রেশম শিল্পে অগ্রগতি দেখা যায়। বিভিন্ন রঙের ও নকশার সুদৃশ্য কার্পাস ও রেশমি বস্ত্র তৈরি হতে থাকে। অভিজাত রােমক পরিবারে এসব বস্ত্রের বিস্তর চাহিদা ছিল। সােনা, রূপা ও বিভিন্ন মণি-রত্ন দিয়ে নানা প্রকার অলংকার তৈরি হত।

অন্তর্বাণিজ্য : অন্তর্বাণিজ্যে তৎপরতা লক্ষিত হয়। সার্থবাহদের দল শকটে পণ্য সাজিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে পণ্যাদি বিক্রি করত। সার্থবাহদের সঙ্গে কখনও কখনও তাদের পরিবারের লােকজনও থাকতেন। স্থান থেকে স্থানান্তরে চলাচল কালে পণ্যের উপর শুল্ক বসানাে হত। স্থানে স্থানে শুল্ক বিভাগের কর্মচারীরা মােতায়েন থাকতেন। শুল্ক আদায়ের ভার তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। রাস্তা-ঘাটের সুরক্ষার জন্য দিবা-রাত্র প্রহরার ব্যবস্থা ছিল। পট্টিনপ্পালৈ গ্রন্থে এ যুগের বণিকদের প্রশংসা করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা প্রতারক নন, তারা সৎ ব্যবসায়ী, অল্প লাভেই তাদের তুষ্টি, তারা ন্যায়বান, সত্যবাদী, ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ রক্ষায় তারা যত্নবান। জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয় হত নগদে, কখনওবা দ্রব্যের বিনিময়ে। তখন ধানের বিনিময়ে মাছ পাওয়া যেত, ইক্ষুর পরিবর্তে হরিণ পাওয়া যেত, মধু ও বৃক্ষমূল দিয়ে মাছের তেল ও তাড়ি কেনা যেত।

বহির্বাণিজ্য : এ সময় তামিলনাড়ু তথা দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে রােমক সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শঙ্গম সাহিত্যের সাক্ষ্য, ‘পেরিপ্লাস তাফ দি এরিথ্রিয়ান সি’র বর্ণনা, টলেমির বিবরণ এবং প্রত্নাবশেষ এই বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে প্রভূত আলােকপাত করে। শঙ্গম পর্বে পশ্চিম উপকূলে কয়েকটি বন্দর গড়ে উঠেছিল। পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলোর মধ্যে নৌরা (ক্যান্নানাের), তিনডিস (পােন্নানি), মুজিরিস বা মুচিরিপত্তনম (ক্র্যাঙ্গানােরের নিকটবর্তী) ও নেলকিণ্ডা (কোট্টায়মের নিকটবর্তী) উল্লেখযােগ্য ছিল। পুহার (কাবেরীপট্টিনম), পােডুকা (পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেডু), মামল্লপুরম, সােপাৎমা (চেন্নাই?) ও কোরকৈ পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ছিল। কাবেরীপট্টিনমই সম্ভবত টলেমি উল্লিখিত খাবেরিস। সমকালীন সাহিত্যে কোমারি নামে আর একটি বন্দরের উল্লেখ আছে। এর অবস্থান ছিল সর্বদক্ষিণে। তীর্থস্থানরূপেও স্থানটির খ্যাতি ছিল। বর্তমান কন্যাকুমারী শহরটিই প্রাচীন কোমারি। রােমক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্যসামগ্রী বহন করে বড় বড় জাহাজ এই বন্দরগুলোতে এসে ভিড়ত। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল মুদ্রা, সূক্ষ্ম বস্ত্র, ক্ষৌম বস্ত্র, কাচ, তামা, টিন, শিলা, পােখরাজ, প্রবাল, মােমছাল, হরিতাল, মদ ও ঘােড়া। যেসব জিনিস বিদেশে রপ্তানি করা হত তাদের মধ্যে ছিল গােলমরিচ, মুক্তা, গজদন্ত, রেশমি বস্ত্র, মলম, মূল্যবান পাথর, নীলকান্ত মণি, কচ্ছপের খােল ও তেজপাতা। মিশরীয় নাবিক হিপ্পালাস ৪৫ খ্রিস্টাব্দে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহপথ আবিষ্কার করায় পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বহির্বাণিজ্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এখন থেকে বড় বড় জাহাজগুলো মৌসুমি বায়ুর সহায়তায় আরব সাগর আড়াআড়ি পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ ভারতের বন্দরগুলোতে আসতে থাকে। পূর্বে জাহাজগুলো গমনাগমন করত উপকূল ধরে, নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই বেশি লাগত, উপরন্তু বিপদেরও আশঙ্কা ছিল। পেরিপ্লাস গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, ছােটো, মাঝারি ও বড়, পূর্ব উপকূলে এই তিন প্রকার জলযান বা জাহাজের ব্যবহার ছিল। ছােটো জলযানগুলো বদ্বীপ ও নিকটস্থ উপকূল অঞ্চলে যাতায়াত করত। সাংগারা নামে মাঝারি মাপের জাহাজগুলো গাছের বড় গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হত। বড় জাহাজগুলোকে কোলান্দিয়া বলা হত। জলযানগুলো তামিলনাড়ুর বন্দর হতে গাঙ্গেয় ভূভাগ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অভিমুখে যাত্রা করত।

রােমক মুদ্রা ও তার গুরুত্ব : তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর রােমক স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোর মধ্যে যেমন সম্রাট অগাস্টাসের (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৭ – খ্রিস্টাব্দ ১৪), তেমনি টাইবেরিয়াস (খ্রিস্টাব্দ ১৪-৩৭) এবং নিরাের (খ্রিস্টাব্দ ৫৪-৬৮) মুদ্রাও আছে। রােমক সাম্রাজ্যের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্য উপলক্ষে এই রােমক মুদ্রাগুলো বুলিয়নরূপে ভারতে আমদানি হয়। মুদ্রার বিশ্লেষণে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের চতুর্থ পাদ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত সময়ে রােম-ভারত বাণিজ্যে যে ব্যাপকতা দেখা দিয়েছিল খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতকে তাতে মন্দা নেমে আসে। এই বাণিজ্য উপলক্ষে দক্ষিণ ভারতে কয়েকটি রােমক বসতি স্থাপিত হয়। পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেডুতে এরূপ একটি স্থায়ী রােমক বসতি গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত মুজিরিস বন্দরেও আর একটি রােমক বসতি স্থাপিত হয়। বলা বাহুল্য, এই বহির্বাণিজ্যে ভারতই বেশি লাভবান হয়েছিল।

ধর্মীয় জীবন

বৈদিক ধর্মের প্রভাব : শঙ্গম যুগে তামিলনাড়ুতে বৈদিক ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। রাজা মহারাজরা প্রায়ই ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন। যজ্ঞানুষ্ঠানে পশুবলি দেয়া হত। শাস্ত্রজ্ঞান ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য ব্রাহ্মণেরা সমাজে সম্মানিত ছিলেন। বৈদিক ধর্মের তুলনায় তামিলনাড়ুতে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের তেমন প্রসার ছিল না। বৌদ্ধ ও জৈনদের সঙ্গে বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের মাঝে মাঝে বিরােধ বেধে যেত।

বিভিন্ন দেব-দেবী : জনপ্রিয়তায় সুব্রহ্মণ্য (মুরুগন) ছিলেন দেবতাদের শীর্ষে। এই দেবতা শঙ্গম সাহিত্যে বার বার উল্লিখিত হয়েছেন, বার বার বর্ণিত হয়েছে তার অসুর নিধনের কথা, তার বীরত্বের কথা। সুব্রহ্মণ্যের পূজায় ভক্তরা বিভাের হয়ে নৃত্য করতেন। তাদের মধ্যে ভাবােন্মাদনা দেখা যেত। বিষ্ণুপূজারও বিশদ বর্ণনা আছে শঙ্গম সাহিত্যে। তুলসীপত্র সহযােগে, ঘণ্টাধ্বনির মধ্য দিয়ে এ পূজা সম্পন্ন হত। দেবতার প্রসন্ন দৃষ্টি লাভের জন্য ভক্তরা মন্দিরে উপবাস করতেন। স্ত্রীলােকেরা সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরে পুজো দিতেন। সুব্রহ্মণ্য ও বিষ্ণু ছাড়া শিব, বলরাম, কৃষ্ণ ও অর্ধনারীশ্বরেরও পুজো হত। প্রতি বছর পহারে ইন্দ্রোৎসব অনুষ্ঠিত হত। মণিমেকলৈ কাব্যে সরস্বতীর মন্দিরের উল্লেখ আছে, কঠোরপন্থী শৈব কাপালিকদেরও উল্লেখ আছে। তখনকার দিনের পূজা-অর্চনায় নৃত্য-গীতের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। তপশ্চর্যাকে সম্রমের চোখে দেখা হত। ত্রিদণ্ডী তাপসদের উল্লেখ আছে শঙ্গম সাহিত্যে।

জীবন-দর্শন : লােকদের পুনর্জন্মে বিশ্বাস ছিল। পূর্ব জীবনের কর্মফল পরজন্মে বর্তায়, এ ধারণাও তাদের ছিল। মানুষের জীবনে দৈব শক্তির এক বিরাট প্রভাব আছে, এ বিশ্বাসও তাদের ছিল। শঙ্গম যুগের প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে ভােগবাদের আদর্শ প্রচারিত হয়েছে। তবে এ যুগের শেষের দিকের কবিতাগুলোতে দুঃখবাদ ধ্বনিত হয়েছে। জীবন, যৌবন, ধন, মান সবই ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুতেই জীবনের পরিসমাপ্তি। সম্ভোগ নয়, কামনা-বাসনা পরিহারের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। ধর্মশাস্ত্রকার মনুর সেই বিখ্যাত উক্তিই যেন এখানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : প্রবৃত্তিরেষঃ সর্বভূতানাং নিবৃত্তিপ্ত মহাফলা।

সাতবাহন রাজবংশ (খ্রি.পূ. ২য় শতকের শেষ – খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শুরু)

বংশ ও জাতি পরিচয়, আদি নিবাস ও প্রথম রাজ্য স্থাপন

ওড়িশায় যখন চেদি রাজবংশের পত্তন ঘটছিল তখন মহারাষ্ট্রে (মতান্তরে অন্ধ্রপ্রদেশে) এক নতুন রাজবংশের অভ্যুদয় হয়। ক্ষুদ্র এক অঞ্চলের অধিপতিরূপে আত্মপ্রকাশ করে ধীরে ধীরে এই বংশের রাজারা পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের এক শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হন। প্রায় তিন শতাব্দী কাল এই রাজবংশ পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসে এই রাজবংশ সাতবাহন বা শাতবাহন নামে প্রসিদ্ধ।

বংশের নামকরণ : কেন এই বংশের নাম সাতবাহন তার সঠিক উত্তর আজও মেলেনি। কিছু কিছু উত্তর অবশ্যই এসেছে কিন্তু তা আনুমানিক বৈ তাে নয়। সাতবাহন পদটি মুণ্ডা ‘সাদম’ এবং ‘হপন’ হতে নিষ্পন্ন বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ‘সাদম’-এর অর্থ ঘােড়া, ‘হপন’-এর অর্থ পুত্র। তারা মনে করেন, অশ্বমেধ যজ্ঞ যিনি অনুষ্ঠান করেছেন তার পুত্র এই অর্থে সাতবাহন। আবার কেউ কেউ বলেন, অশােকের অনুশাসনে যাদের সত্যপুত্র বলা হয়েছে তারাই সাতবাহন। দেববাচক তামিলপদ ‘শাওন’ হতে সাতবাহন বা শাতবাহন উদ্ভূত, এরূপ মতও প্রচলিত। আবার অনেকে সাতবাহন কথাটি সূর্যের সপ্তবাহন অভিধা হতে এসেছে বলে মনে করেন। সাত ঘােড়ার রথে চড়ে সূর্যদেব ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমা করছেন এ কাহিনি সুপরিচিত। হয়তােবা সাতবাহন রাজারা নিজেদের সূর্য বা ইক্ষ্বাকুবংশীয় বলে মনে করতেন। আবার বিষ্ণুর সপ্তবাহন নাম হতে বংশের নাম সাতবাহন হয়েছে, এমন অভিমতও আছে।

জাতি-পরিচয় : সাতবাহন রাজাদের জাতি-পরিচয় সম্পর্কেও ঐতিহাসিক মহলে বাগ বিতণ্ডা আছে। অনেকে সূর্যের প্রতিশব্দরূপে সাতবাহন পদের ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ধারণা সাতবাহনরা জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। এই বংশের এক রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণিকে রাজমাতা বলার নাসিক প্রশস্তিতে ‘এক-ব্রাহ্মণ’ এবং ‘ক্ষত্রিয়-দর্প-মান-মর্দন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে সাতবাহনরা ব্রাহ্মণ ছিলেন এরকম একটি মতও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এক ‘ব্রাহ্মণ’ এবং ‘ক্ষত্রিয়’ পদ দুটির ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে অন্ধ্ররা ‘দস্যু’ বলে ধিকৃত হয়েছেন। মনু সংহিতায় তাদের নিচ জাতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরাণে সিমুককে ‘বৃষল’ অর্থাৎ পতিত বা বর্ণচত বা শূদ্র আখ্যা দেয়া হয়েছে। সালিবাহন বা সাতবাহন রাজাদের ধমনীতে যে ব্রাহ্মণ ও নাগ রক্ত প্রবাহিত ছিল তা ‘দ্বাত্রিংশৎপুত্তলিকা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে। সম্ভবত সাতবাহনরা অনার্য গােষ্ঠীর লােক ছিলেন কিন্তু পরে নিজেদের ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেন। তবে অন্ধ্রদের সম্পর্কে ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থাদিতে যেসব মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় রক্ষণশীল সমাজ সাতবাহনদের ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে স্বীকার করেনি।

সাতকর্ণি বা শাতকর্ণি পদের অর্থ : সাতবাহন রাজাদের অনেকেই সাতকর্ণি বা শাতকণি পদবি গ্রহণ করেছেন। ‘সাতটি তীর’, ‘সূর্যের সাত রশ্মি’, সাত বা শতেক কান আছে যার ইত্যাদি অর্থে পদটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যুক্তি নয়, কল্পনাই যেন ব্যাখ্যাগুলোকে আশ্রয় করে আছে। সংস্কৃত ‘শত’ থেকে ‘শাত’ কথাটি এসেছে 

আদি নিবাস অন্ধ্রে : পুরাণাদি গ্রন্থে সাতবাহন রাজাদের অন্ধ্র, অন্ধ্রজাতীয় এবং অন্ধ্রভৃত্য আখ্যা দেয়া হয়েছে। এ থেকে অনেকে অনুমান করেন সাতবাহনরা অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। আবার অনেকের ধারণা সাতবাহনরা অন্ধ্রজাতীয় ছিলেন কিন্তু অন্ধপ্রদেশের অধিবাসী নন। তারা মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব যুগে অন্ধ্ররা বিন্ধ্যের দক্ষিণে বিদর্ভ বা বেরারের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাস করতেন, অন্ধ্রে তারা বসতি স্থাপন করেন আরও কিছুকাল পর, খ্রিস্টীয় ২য় শতকে। আবার কেউ কেউ মনে করেন সাতবাহনদের অন্ধ্রপ্রদেশ বা অন্ধ্রজাতি কোনওটির সঙ্গেই সংযােগ ছিল না, পুরাণ সংকলনের সময় তারা অন্ধ্রপ্রদেশে রাজত্ব করায় ভুলক্রমে তাদের অন্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। এই মত যারা পােষণ করেন তারা অন্ধ্রভৃত্য পদটিকে অন্ধ্রদের ভৃত্য অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে সাতবাহন রাজারা কন্নড় ভাষাভাষী ছিলেন, কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায় তাদের আদি বাসস্থান ছিল। তবে সাতবাহনরা জাতিতে যে অন্ধ্র ছিলেন তা বােধহয় স্বীকার করাই ভালাে। পুরাণে তাদের শুধু অন্ধ্রভৃত্যই বলা হয়নি, অন্ধ্র ও অন্ধ্রজাতীয় বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। অন্ধ্রভৃত্য কথাটি সম্ভবত যে অন্ধ্ররা ভৃত্য ছিলেন এই অর্থেই কর্মধারয় সমাসরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয় সাতবাহনরা প্রথম দিকে কাণ্ব বা অন্য কোনও রাজবংশের প্রতি অনুগত ছিলেন। অনেকে তাদের মৌর্যদের অধীনস্থ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন আর সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্যে সময়ের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। অন্ধ্রজাতি প্রাক্-খ্রিস্টীয় যুগে বিন্ধ্যাঞ্চলে বসবাস করতেন, এ মত সমর্থনযােগ্য নয়। অনেক পূর্বে এ অঞ্চলে হয়তাে তাদের বাস ছিল। অশােকের লেখমালায় অন্ধ্রকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গােদাবরী-কৃষ্ণা বিধৌত বা তেলুগু ভাষাভাষী অঞ্চলে অশােকের কয়েকখানি অনুশাসনও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশেই সাতবাহন রাজাদের আদি বাসভূমি ছিল বলে মনে হয়।

সর্বপ্রথম রাজ্য স্থাপন মহারাষ্ট্রে : 

  • অন্ধ্র? : অন্ধ্রপ্রদেশ সাতবাহন রাজাদের আদি বাসভূমি হলেও এই অঞ্চলেই তারা সর্বপ্রথম রাজ্য স্থাপন করেছিলেন এমনটি মনে হয় না। আর. জি, ভাণ্ডারকর ও ভিনসেন্ট স্মিথের মতাে পণ্ডিতেরা কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশেই সাতবাহন রাজারা প্রথমে রাজত্ব করেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। প্রথম জনের মতে সাতবাহন রাজ্যের রাজধানী ছিল ধরণিকোট, দ্বিতীয় জনের মতে শ্রীকাকুলম। এসব মতের সমর্থনে বিশেষ কোনও যুক্তি নেই।
  • মহারাষ্ট্র? : অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতী গ্রামে সাতবাহন যুগের কয়েকখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখসমূহে যেসব রাজাদের নাম উল্লিখিত আছে তাদের কেউই সাতবাহন যুগের আদি পর্বে আবির্ভূত হননি। পক্ষান্তরে সাতবাহন রাজত্বের প্রথম পর্বের কয়েকখানি লেখ মহারাষ্ট্রে পাওয়া গেছে। এই বংশের আদি রাজা সিমুকের পুত্রবধু নাগনিকা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নানাঘাট গিরিপথের গায়ে একখানি লেখ উৎকীর্ণ করেছিলেন। সিমুকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণের লেখ নাসিকে পাওয়া গেছে। নাসিকে রাজা শক্তিশ্রীর একখানি লেখেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। শক্তিশ্রী সম্ভবত রানি নাগনিকার পুত্র ছিলেন। সাতবাহন আমলের প্রথম দিকে উৎকীর্ণ কিছু মুদ্রাও মহারাষ্ট্রে আবিষ্কৃত হয়েছে। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাথীগুম্ফা লেখে সাতবাহন রাজ্যটিকে কলিঙ্গের পশ্চিমে অবস্থিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। জৈন গ্রন্থাদি থেকে জানা যায় প্রতিষ্ঠান শহরটি প্রথম থেকেই সাতবাহন রাজ্যের রাজধানী ছিল। ঔরঙ্গাবাদ জেলার বর্তমান পৈঠান প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের স্মৃতি বহন করছে। এর থেকে অনুমান করা যায় সাতবাহন রাজ্যটি প্রথমে মহারাষ্ট্রেই গড়ে উঠেছিল।
  • প্রথমে অন্ধ্র, পরে মহারাষ্ট্র? : অজয়মিত্র শাস্ত্রী মনে করেন সাতবাহন রাজারা প্রথমে অন্ধ্রপ্রদেশেই রাজত্ব করতেন কিন্তু পরে তারা মাহারাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তার করেন (A M Shastri. Early History Of The Deccan: Problems And Perspectives (Delhi, 1987), পৃ. ১১-১২)। স্বমতের সমর্থনে তিনি কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করেছেন – প্রথমত, অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার কোটলিঙ্গলে সিমুক, প্রথম সাতকর্ণি ও সাতবাহনের কয়েকটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া এ রাজ্যের মেডক জেলার কোণ্ডাপুর ও কুর্ণল জেলার শাতনিকোটে যথাক্রমে সাতবাহন ও শক্তিকুমারের একটি করে মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। দ্বিতীয়ত, অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাপ্ত দু’খানি লেখে সাতবাহনদের নামে আহার ও রাষ্ট্র নামে দু’টি প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ, কুর্ণল জেলায় শাতনিকোট নামে একটি স্থানের নামকরণ ও সাতবাহন রাজাদের রৌপ্যমুদ্রায় দ্রাবিড় ভাষার ব্যবহার নির্দেশ করছে সাতবাহন রাজারা অন্ধ্রপ্রদেশেই রাজত্ব শুরু করেন।
  • মহারাষ্ট্রে হওয়াই গ্রহণীয় বলে মনে হচ্ছে : অন্ধ্রপ্রদেশে আদি সাতবাহন রাজ্যের অবস্থিতির সপক্ষে উত্থাপিত যুক্তিগুলো যে সুপ্রতিষ্ঠিত তা বােধ হয় না। বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলে সিমুক প্রমুখ আদি সাতবাহন রাজাদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। কিন্তু মুদ্রা কখনও এককভাবে কোনও রাজার রাজনৈতিক অধিকার বা তার রাজ্যের বিস্তৃতির সঠিক প্রমাণ নয়। তখনকার দিনে তীর্থযাত্রী ও বণিক-সম্প্রদায় মুদ্রা সঙ্গে নিয়ে স্থান হতে স্থানন্তিরে যাতায়াত করতেন। এভাবেই হয়তো আদি সাতবাহন রাজাদের কিছু মুদ্রা আন্ধ্রপ্রদেশে এসেছিল। মনে করা হচ্ছে, শাতনিকোট নামটি সাতবাহন-কোট্ট হতে এসেছে। এ ধারণা প্রমাণসিদ্ধ নয়। অন্ধ্রপ্রদেশে সাতবাহনের নামে একটি আহার ও রাষ্ট্রের অবস্থান সে অঞ্চলে আদি সাতবাহন রাজ্যের অবস্থিতির কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নয়। সাতবাহন রাজারা দ্রাবিড় ভাষাভাষী ছিলেন বলেই হয়তাে তাদের মুদ্রায় কখনও কখনও দ্রাবিড় ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। এ কথা ভুললে চলবে না, আদি সাতবাহন নরপতিদের প্রায় সব কটি লেখ মহারাষ্ট্রেই আবিষ্কৃত হয়েছে, অন্ধ্রপ্রদেশে সেরূপ একখানি লেখেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। মহারাষ্ট্রে সাতবাহন রাজত্বের শুরু, অন্ধ্রপ্রদেশে নয়, এ অভিমতই বর্তমানে গ্রহণীয় বলে মনে হয়।

প্রতিষ্ঠাকাল

পুরাণ মতে খ্রি.পূ. ৩য় শতক : সাতবাহন রাজারা ঠিক কতদিন রাজত্ব করেছিলেন, তাদের রাজত্বের শুরুই বা কখন হয়েছিল সে সম্পর্কে পণ্ডিতরা সহমত নন। অনেকে মনে করেন মৌর্য সম্রাট অশােকের মৃত্যুর অল্পকাল পরই অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের শেষ ভাগে এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। এ মতের সমর্থনে যে যুক্তি নেই তা নয়। কোনও কোনও পুরাণে বলা হয়েছে সাতবাহনরা ৪৫৬ বা ৪ ৬০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ২২৫ অব্দ নাগাদ সাতবাহন শাসনের যে অবসান ঘটেছিল তা প্রায় সুনিশ্চিত। পুরাণের উক্তি সঠিক হলে বুঝতে হবে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের শেষপর্বেই সাতবাহন রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। 

পুরাণ নিয়ে সন্দেহ : কিন্তু পুরাণােক্ত তথ্যটির সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কোনও কোনও পুরাণে সাতবাহনরা ৪৫৬ বা ৪৬০ বছর রাজত্ব করেছিলেন বলে বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এমন পুরাণও আছে যেখানে সাতবাহন রাজারা তিন শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। সাতবাহন রাজাদের সংখ্যা সম্পর্কেও বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। কোনও কোনও পুরাণে ত্রিশজন রাজার কথা বলা হয়েছে। উনিশজনের নামােল্লেখ আছে এমন পুরাণও আছে। এই ধরনের পরস্পর বিরােধী পৌরাণিক তথ্যের উপর নির্ভর করে সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকাল নির্ধারণ করা যায় না। সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক কাগরাজ সুশর্মাকে পরাজিত করেছিলেন একথা প্রায় সব পুরাণে বলা হয়েছে। মৌর্য, শুঙ্গ বা কাণ্ব রাজারা যে যথাক্রমে ১৩৭, ১১২ ও ৪৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন সে সম্পর্কেও সব কটি পুরাণ মােটামুটি একমত। এই যুক্তিতে ৩২৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ মৌর্যরাজ্য প্রতিষ্ঠার ২৯৪ বছর পর অর্থাৎ ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলা চলে।

লেখ ও উৎখনন থেকে অনুমান : সাতবাহন রাজত্বের একেবারে গােড়ার দিকে নানাঘাট, নাসিক ও সাটীতে কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ হয়েছিল। এই লেখগুলো নিঃসন্দেহে হেলিওডােরাসের বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখের পরবর্তী। হেলিওডােরাসের লেখখানি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের শেষভাগে উৎকীর্ণ হয়েছিল। ফলে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলা চলে। মহারাষ্টের আহম্মদনগর জেলার নেভাসায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাহায্যে শান্তারাম বালচন্দ্র দেও (H. D, Sankalia (Ed.), From History to Pre-lis/ory at Nvasa (Poona, 1960), পৃ. ১৬২) সাতবাহন রাজত্বের সূচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-২য় শতকে ধার্য করেছেন। নেভাসায় উৎখননের ফলে যে কয়েকটি জনবসতি-পর্ব আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের চতুর্থ ও পঞ্চম পর্ব দু’টির কালসীমা যথাক্রমে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথমার্ধ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রারম্ভ ও খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর সূচনা হতে ২য় – ৩য় শতক। চতুর্থ পর্বের ভূমিসংস্তরে সাতকর্ণি ও সাতবাহন নামে যে দু’জন সাতবাহন রাজার মুদ্রা পাওয়া গেছে তারা সকলেই আদি পর্বের। পঞ্চম পর্বে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি ও যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির মতাে উত্তরকালীন দু’জন সাতবাহন নৃপতির মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। নেভাসায় চতুর্থ জনবসতি পর্বের যে কালসীমা নির্দিষ্ট হয়েছে তারই ভিত্তিতে সাতবাহন রাজবংশের অভ্যুদয় খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-২য় শতকে নির্ধারিত হয়েছে।

নেভাসার উৎখনন নিয়ে বিতর্ক : কিন্তু যে পদ্ধতিতে নেভাসায় আদি-ঐতিহাসিক পর্বগুলোর সময়রেখা নির্ণীত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত, ত্রুটিপূর্ণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যেসব উপাদানের উপর নির্ভর করে এই পর্ব সমূহের কালক্ৰম চিহ্নিত হয়েছে তাদের একটি হল সাতবাহন মুদ্রা। অর্থাৎ মূলত সাতবাহন মুদ্রার সম্ভাব্য তারিখের ভিত্তিতেই নেভাসার জনবসতি-পর্বগুলোর সময়সীমা নির্দিষ্ট হয়েছে যে মুদ্রার তারিখ সম্পর্কে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে সে মুদ্রা ভূ-সংস্তর তথা পর্বের কালক্ৰম ধার্যের দিকচিহ্নরূপে বিবেচিত হতে পারে না। তাছাড়া যে যুক্তির ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত খাড়া করা হয়। সেই সিদ্ধান্তকেই আবার সেই একই যুক্তির প্রমাণরূপে উপস্থাপন করা অর্থহীন হয়ে পড়ে। নেভাসায় নির্বাহিত উৎখনন হতে প্রাপ্ত আর একটি তথ্য সাতবাহন রাজত্বের এই প্রাচীনত্বের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। রাজা সাতবাহনের সবকটি মুদ্রাই আবিষ্কৃত হয়েছে চতুর্থ পর্বের উচ্চতম ভূ-সংস্তরে। এই স্তর খ্রিস্টীয় ১ম শতকের অতি নিকটবর্তী। 

খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্যান্য তথ্য : খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষার্ধে সাতবাহন পর্বের শুরু, এ অভিমতের সপক্ষে পুরাণদি ছাড়া আরও কিছু তথ্য আছে –

  • প্রথমত, অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্ণল জেলার শাতনিকোটে শক্তিকুমারের নামাঙ্কিত একটি মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে (Indian Araliaeology (1977-78); A Review, পৃ. ৩-১১)। এ শক্তিকুমার সাতবাহন রাজবশের চতুর্থ নরপতি। মুদ্রাটি যে ভূমি-সংস্তরে আবিষ্কৃত হয়েছে তা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের সমকালীন।
  • দ্বিতীয়ত, কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্রে যজ্ঞসেন এবং মাধবসেনকে দ্বিখণ্ডিত বিদর্ভের দু’জন রাজরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা ছিলেন শুঙ্গরাজ পুষ্যমিত্রের (আনুমানিক ১৮৭-৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অনুগত। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথম পর্বে সাতবাহন রাজত্ব শুরু হলে সে সময় বিদর্ভে সাতবাহন রাজারা রাজত্ব করতেন, যজ্ঞসেন ও মাধবসেন নন।
  • তৃতীয়ত, সাতবাহন রাজাদের মুদ্রায় রাজার নাম ও অভিধার উল্লেখ আছে। গ্রিক মুদ্রার প্রভাবেই ভারতীয় মুদ্রায় এ রীতির প্রচলন হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের পূর্বে এমনটি ঘটা সম্ভব ছিল না।

রাজবৃত্তান্ত 

রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক

সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক বা শ্রীমুখ। কোনও কোনও পুরাণে তাকে কাপ্তদের ভৃত্য বলা হয়েছে। মনে হয় কাণ্বদের অধীনে এক রাজকর্মচারিরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কিন্তু কালক্রমে সম্ভবত মহারাষ্ট্রে তিনি এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সিমুক শুঙ্গ এবং কাণ্বদের নির্মূল করে পৃথিবী জয় করেন বলে পুরাণে বলা হয়েছে। অনেকের ধারণা তিনি শুঙ্গ এবং কাদের কাছ থেকে বিদিশা অঞ্চল অধিকার করেন। মগধ বা উত্তর ভারতের অন্য কোনও অঞ্চল যে তার রাজ্যভুক্ত ছিল না, তা নিশ্চিতরূপে বলা যায়। জৈন গ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, শেষ জীবনে সিমুক স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় পরিণামে তাকে সিংহাসন ও প্রাণ দুই-ই হারাতে হয়। জৈন বিবরণ কতখানি বস্তুনিষ্ঠ তা বলা কঠিন। পৌরাণিক তথ্য অনুসারে সিমুক ২৩ বছর রাজ্য শাসন করেন। ছিমুকের নামাঙ্কিত কতিপয় মুদ্রা অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার কোটলিঙ্গলে আবিষ্কৃত হয়েছে (Numismatic Digesi. Vol. II. Part 1, পৃ. ১০)। ছিমুক নিঃসন্দেহে সিমুক। সিমুকের পর রাজা হন তার অনুজ কৃষ্ণ। তার রাজত্বকালে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের বসবাসের জন্য নাসিকে একটি গুহা খনন করা হয়। পৌরাণিক মতে তিনি ১৮ বছর রাজত্ব করেন।

প্রথম সাতকর্ণি

পিতা : সাতবাহন বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম সাতকর্ণি। পুরাণে তাকে কৃষ্ণের পুত্র বলা হয়েছে। নানাঘাট গিরিপথের গায়ে সাতবাহন রাজপরিবারের অনেক সদস্যেরই মূর্তি খােদিত আছে। প্রতিটি মূর্তির শীর্ষদেশে পরিচয়জ্ঞাপক লেখও আছে। বর্তমানে এই মূর্তি ও লেখগুলোর সিংহভাগই বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাহলেও প্রথম ও দ্বিতীয় মূর্তি যে যথাক্রমে সিমুক এবং প্রথম সাতকর্ণির সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কৃষ্ণ প্রথম সাতকর্ণির পিতা হলে তার মূর্তি অবশ্যই সিমুক ও প্রথম সাতকর্ণির মূর্তির মাঝখানে খােদিত থাকত। তা না থাকায় অনেকে মনে করেন, কৃষ্ণ নন, সিমুকই সাতকর্ণির পিতা।

প্রথম সাতকর্ণির প্রতিপত্তি ও রাজ্যবিস্তার : প্রথম সাতকর্ণির রাজত্বকালে সাতবাহন রাজবংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। প্রভাবশালী মহারঠি পরিবারের কন্যা নায়নিকা বা নাগনিকাকে বিবাহ করে তিনি আপন শক্তি বৃদ্ধি করেন। তার আমলের একখানি লেখ সাচীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে সাতবাহন রাজ্যের বিস্তারের সপক্ষে এটি একটি জোরালাে প্রমাণ। সাত নামাঙ্কিত মালবশ্রেণির কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। অনেকের মতে এই সাত প্রথম সাতকর্ণি। ফলে মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ উত্তর মহারাষ্ট্র যে তার রাজ্যভুক্ত ছিল মুদ্রার তথ্যে তার সমর্থন পাওয়া যায়। নানাঘাট গিরিপথের গায়ে মহিষী নাগনিকার একখাটি লেখ খােদিত আছে। ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থখানি একজন অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিক ৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন। এই গ্রন্থে সােপারা এবং কল্যাণ নামে থানা জেলার দু’টি বাণিজ্যকেন্দ্রকে বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস-এর রাজ্যভুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। স্যারাগেনাস কথাটি সম্ভবত সাতকর্ণি পদের গ্রিক অপভ্রংশ। বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস সম্ভবত প্রথম সাতকর্ণি। আবার অনেকে মনে করেন এই বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস প্রথম সাতকর্ণি নন, তার এক উত্তরসূরি। লেখে প্রথম সাতকর্ণিকে ‘দক্ষিণাপথপতি’ ও ‘অপ্রতিহতচক্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনার মধ্যে হয়তাে অতিশয়ােক্তি আছে। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের বৃহদংশের তিনি অধিপতি ছিলেন, সমগ্র দক্ষিণ ভারতের নয়। 

কলিঙ্গরাজ খারবেলের সাথে যুদ্ধ : প্রথম সাতকর্ণির সময় পূর্ব উপকূলবর্তী কলিঙ্গ রাজ্যটি পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। চেদিবংশীয় খারবেল তখন কলিঙ্গের অধিপতি। তিনি তার হাথীগুম্ফা লেখে দাবি করেছেন, সাতকর্ণির কথা না ভেবে তিনি পশ্চিম দিকে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠান এবং কৃষ্ণা তীরবর্তী অসিকনগর জয় করেন। হাথীগুম্ফা লেখে যে সাতকর্ণির কথা বলা হয়েছে তিনি সম্ভবত প্রথম সাতকর্ণি। সাতকর্ণির সঙ্গে খারবেলের ঠিক কী সম্পর্ক ছিল হাথীগুম্ফা লেখে তার কোনও স্পষ্ট আভাস নেই। ফলে খারবেলের উক্তির প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। এ সম্পর্কে তিনটি সম্ভাবনার কথা মনে হয় :

  • এক. মিত্র প্রথম সাতকর্ণির রাজ্যের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে খারবেল অসিকনগর জয় করেছিলেন;
  • দুই. সাতবাহন রাজার হাত থেকে কলিঙ্গরাজ অসিকনগর অধিকার করেন; 
  • তিন, খারবেল সাতকর্ণির প্রকৃত সামর্থ অনুধাবন করতে পারেননি, ফলে প্রতিপক্ষের নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি অসিকনগর অভিমুখে অগ্রসর হন।

নানাঘাট লেখে বলা হয়েছে প্রথম সাতকর্ণি একটি রাজসূয় ও দুটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাছাড়া তিনি আরও অনেক যাগযজ্ঞের আয়ােজন করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ দু’টির মধ্যে প্রথমটি সম্ভবত তার সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পর এবং দ্বিতীয়টি রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খারবেলকে তিনি যদি সত্যই পরাজিত করে থাকেন তাহলে হয়তাে সেই বিজয় উপলক্ষে তিনি একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়ােজন করেন। 

দুর্দিনের আবির্ভাব

মনে হয়, প্রথম সাতকর্ণির মৃত্যুকালে তার দুই পুত্র বেদী ও শক্তিশ্রী নাবালক ছিলেন। ফলে তার বিধবা পত্নী নাগনিকা প্রথমে বেদশ্রী এবং পরে বেদশ্রীর মৃত্যুতে শক্তিশ্রীর অভিভাবিকারূপে রাজ্য শাসন করেন। এই সময় থেকে প্রায় শতাব্দী কাল পর্যন্ত সাতবাহন রাজ্যের ইতিহাস অনেকটাই তমসাচ্ছন্ন। পুরাণে শক্তিশ্রীর নাম নেই, সাতকর্ণির উত্তরাধিকারী রূপে সেখানে পূর্ণোৎসঙ্গের উল্লেখ আছে। পুরাণে এর পর দ্বিতীয় সাতকর্ণির নাম করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এই দ্বিতীয় সাতকর্ণি সাঁচী এবং হাথীগুম্ফা লেখের সাতকর্ণি। বলা বাহুল্য, এ মত অনেকে স্বীকার করেন না।

দ্বিতীয় সাতকর্ণির পর যারা ক্রমান্বয়ে সাতবাহন সিংহাসনে আরােহণ করেন পুরাণে তাদের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই রাজাদের প্রকৃত নাম এবং সংখ্যা নিয়ে পরাণে পুরাণে মতভেদ। আর তারা সকলেই অতি সাধারণ মানের রাজা ছিলেন, তাদের না ছিল যােগ্যতা, না ছিল সদিচ্ছা। তাদের দুর্বলতার সুযােগে পরাক্রান্ত শকরা সাতবাহন রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের অধিকারভুক্ত করেন। 

‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থখানি থেকে জানা যায়, সােপারা এবং কল্যাণ বন্দর দুটি পূর্বে সাতবাহন রাজাদের অধীন ছিল কিন্তু পরে তা স্যান্ডারেস-এর হস্তগত হয়। খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মাঝামাঝি সময় এই রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে। স্যান্ডারেস সম্ভবত একজন শক শাসক ছিলেন।

কোঙ্কণ উপকূলসহ মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই শক আধিপত্য বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। শক রাজা নহপানের (খ্রিস্টাব্দ ১০০-২৪) বেশ কিছু মুদ্রা এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। নহপানের জামাতা ঋষভদত্তের কয়েকখানি লেখ পুণা জেলার নাসিক ও কার্লেতে পাওয়া গেছে। মনে হয়, অধিকৃত মহারাষ্ট্রের শাসনভার নহপান জামাতার হাতে তুলে দেন। সাতবাহন রাজারা এই সময় মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। সেখানেও নহপানের পূর্বেই ক্ষত্রপ ভূমক শক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। 

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি

সিংহাসনে আরোহন : নহপানের ক্ষত্রপপদে অভিষিক্ত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি সাতবাহন সিংহাসনে আরােহণ করেন। আনুমানিক ১০৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৩০ অব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন বলে অনেকে মনে করেন। ইতিহাসে গৌতমীপুত্র সর্বশ্রেষ্ঠ সাতবাহনরাজরূপে স্বীকৃত।

শকরাজ নহপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : যে সাফল্যের জন্য তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি সেই সাফল্য এসেছিল তার রাজত্বের শেষ পর্বে। তার রাজত্বের প্রথম সতেরাে বছর তাকে শক্তি সঞ্চয়ের কাজে ব্যয় করতে হয়। নহপান ও তার জামাতা ঋষভদত্ত সাতবাহন ভূখণ্ডের এক বিস্তীর্ণ অংশ অধিকার করে আছেন। অধিকৃত ভূখণ্ড হতে শকদের উচ্ছেদ করা সহজসাধ্য ছিল না। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল পরিপূর্ণ প্রস্তুতির। সে কাজ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে সাফল্যের বাতায়ন খুলে যায়। তার রাজত্বের অষ্টাদশ বছর থেকে বিজয়লক্ষ্মী তার প্রতি প্রসন্ন হন। ওই বছরে উৎকীর্ণ তার নাসিক লেখ থেকে জানা যায়, ক্ষহরাতগণের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি সসৈন্যে কিছুকাল নাসিক জেলার বেনাকটক গ্রামে অবস্থান করেন। তখন ত্রিরশ্মি পর্বতবাসী সন্ন্যাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি একখণ্ড জমিও প্রদান করেন। জমিখানি পূর্বে ঋষভদত্তের অধিকারভুক্ত ছিল। ওই একই বছরে উৎকীর্ণ তার কার্লা লেখ থেকে জানা যায়, তিনি বলুরকগুহাবাসী সন্ন্যাসীদের মামাল আহারের অন্তর্ভুক্ত করজক গ্রাম দান করেন। এই গ্রামটিও পূর্বে ঋষভদত্তের অধীনস্থ ছিল। নাসিক ও কালার লেখ দুখানি গৌতমীপুত্রের সাফল্যের দু’টি সুনিশ্চিত প্রমাণ। এই লেখ দু’টি হতে জানা যায়, গৌতমীপুত্র তার রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে অর্থাৎ আনুমানিক ১২৪ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্র হতে নহপানদের উচ্ছেদ করেন। গৌতমীপুত্র যে নহপানকে যুদ্ধে পরাজিত করেন তা নাসিক জেলার জোগলথেম্বি গামে পাওয়া মুদ্রার সাক্ষ্যেও প্রমাণিত। এই গ্রামে সর্বসমেত ১৩২৫০টি রূপার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোর এক তৃতীয়াংশ নহপানের। বাকি মুদ্রাও নহপানের কিন্তু সেগুলো গৌতমীপুত্র কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত। মহারাষ্ট্রের ক্ষহরাত অধিকারভুক্ত অঞ্চলে নহপানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। সে অঞ্চলে নিজের অধিকার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পুরােনাে মুদ্রায় নিজের নাম এবং প্রতীক অঙ্কিত করে গৌতমীপুত্র সেগুলো পুনরায় প্রচার করেন। পুত্র গৌতমীপুত্র ক্ষহরাত বংশ নিধন করেছেন বলে রাজমাতা গৌতমী বলশ্রী নাসিক প্রশক্তিতে দাবি করেছেন। গৌতমীপুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নহপান সম্ভবত নিহত হন।

শক, যবন ও পহ্লবদের সংহার : নহপানের বিরুদ্ধে জয়লাভ গৌতমীপুত্রের একমাত্র কৃতিত্ব নয়। তিনি শক, যবন ও পহ্লবদের সংহার করেছেন বলে নাসিক প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে (সক-পহলব-যবন-নিসুদনস)। ক্ষহরাতরাই শক। যে গ্রিক ও পহ্লবগণকে গৌতমীপুত্র পরাজিত করেন তারা সম্ভবত নহপানের বেতনভুক সৈন্য ছিলেন। নাসিক প্রশস্তিতে ঋষিক (কৃষ্ণা তীরবর্তী), অশ্মক (মহারাষ্ট্রের গােদাবরী-তীরবর্তী অঞ্চল বা অন্ধ্রপ্রদেশের বােধন অঞ্চল), মূলক (ঔরঙ্গাবাদ জেলা), সুরাষ্ট্র, কুকুর (গুজরাতে অবস্থিত), অপরান্ত (উত্তর কোঙ্কণ), অনূপ (নর্মদা তীরবর্তী মান্ধাতা বা মহেশ্বর অঞ্চল), বিদর্ভ (পূর্ব মহারাষ্ট্র), আকর (মধ্য মধ্যপ্রদেশ) এবং অবন্তি (দক্ষিণ-পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থান) অঞ্চল গৌতমীপুত্রের রাজ্যভুক্ত বলা হয়েছে। অপরান্ত, অনূপ, সুরাষ্ট্র, কুকুর, আকর ও অবন্তি পূর্বে নহপানের অধীনস্থ ছিল। উত্তরে গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশ হতে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং পূর্বে বিদর্ভ থেকে পশ্চিমে কোঙ্কণ উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগের অধিপতি হলেন গৌতমীপুত্র। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এত বড় রাজ্য এর আগে কখনও গড়ে ওঠেনি।

নাসিক প্রশস্তি : নাসিক প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রের রাজ্যকে অবশ্য আরও বর্ধিত আকারে দেখানাে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তার যুদ্ধের অশ্ববাহিনী তিন সমুদ্রের জল পান করেছিল। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরকে নিয়েই তিন সমুদ্র। নাসিক প্রশস্তিতে আরও বলা হয়েছে, বিন্ধ্য, পারিযাত্র, মলয়, মহেন্দ্র, চকোর প্রভৃতি পর্বত গৌতমীপুত্রের রাজ্যমধ্যে অবস্থিত ছিল। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দক্ষিণ ভাগের নাম মলয় পর্বত। পূর্বঘাট পবর্তমালার মহানদী ও গােদাবরী নদীর মধ্যবর্তী অংশ মহেন্দ্র। চকোর পর্বতের অবস্থান ছিল সম্ভবত পূর্বঘাট পর্বতমালার দক্ষিণাংশে। নাসিক প্রশস্তির বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করেন ওড়িশা এবং অন্ধপ্রদেশ গৌতমীপুত্রের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এ ধারণা যথার্থ নয়; প্রশস্তিকার নিঃসন্দেহে গৌতমীপুত্রের কার্যকলাপের এক অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছেন।

শকরাজ চষ্টনের নিকট পরাজয় : গৌতমীপুত্রের এই সাফল্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। জীবনের একেবারে পড়ন্তবেলায় তিনি মহাক্ষত্রপ চষ্টনের নিকট পরাজিত হন। প্রতিষ্ঠান শহরটি শ্রীপুলুমাবি এবং উজ্জয়িনী চষ্টনের রাজধানী বলে গ্রিক লেখক টলেমি তার ভূগােল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় চষ্টনের বাজত্বকালে কার্দমকরা সাতবাহন-অধিকারভুক্ত অবন্তি অধিকার করেন। রুদ্রদামার জুনাগড় লেখে দাবি করা হয়েছে, শুধু অবন্তি নয়, আকর, অনুপ, অপরান্ত, সুরাষ্ট্র এবং আনর্তও (গুজরাতের দ্বারকা অঞ্চল) কার্দমকরা অধিকার করেন। এসব অঞ্চল এক সময় গৌতমীপুত্রের শাসনাধীন ছিল। সম্ভবত গৌতমীপুত্রকে পরাজিত করে চষ্টন এসব অঞ্চলে আপন প্রভুত্ব বিস্তার করেন। জুনাগড় লেখে এসব অঞ্চল জয়ের কৃতিত্ব যদিও রুদ্রদামার উপর অরােপিত হয়েছে, তবু মনে হয় চষ্টনের আমলেই এসব ঘটনা ঘটেছিল। রুদ্রদামা সম্ভবত তা পিতামহ চষ্টনকে গৌতমীপুত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় সহযােগিতা করেছিলেন। 

শকরাজ রুদ্রদামার সাথে সম্পর্ক : জুনাগড় লেখে সাতকর্ণির সঙ্গে রুদ্রদামার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উল্লেখ আছে (জুনাগড় লেগের সাতকর্ণি যে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি তা র‍্যাপসন স্বীকার করেন না। তার মতে এই সাতকর্ণি বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবি (Catalogue of the Coins of The Andhra Dynasty, The Western ksatrapas, The Traikutaka Dynasty And The Bodhi Dynasty, পৃ. ৫১))। কানহেরি লেখ থেকে জানা যায়, বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণি এক মহাক্ষত্রপের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। এই মহাক্ষত্রপ সম্ভবত রুদ্রদামা। বাশিষ্ঠীপুত্র গৌতমীপুত্রেরই এক সন্তান ছিলেন। সম্ভবত আত্মরক্ষার তাগিদে গৌতমীপুত্র নিজ সন্তানের সঙ্গে রুদ্রদামার কন্যার বিবাহ দেন।

স্বাস্থ্যজনিত কারণে রাজ্য পরিচালনায় অপারগতা : তার রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে গৌতমীপুত্র স্বাস্থ্যজনিত কারণে রাজ্য পরিচালনায় অপারগ হয়ে পড়েছিলেন, এরূপ সম্ভাবনার ইঙ্গিত মেলে তার রাজত্বের চতুর্বিংশতি বছরে উৎকীর্ণ নাসিক গুহালেখে এই লেখে রাজমাতা গৌতমী বলশ্রীকে ‘জীবসূতা’ (যার পুত্র জীবিত) বলা হয়েছে। গােবর্ধনের অমাত্যকে রাজমাতা তার পুত্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আশ্বস্ত করছেন, এ ধরনের কথাও এই লেখে বলা হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, পুত্রের অসুস্থতার কারণে গৌতমী বলশ্রী সাময়িকভাবে রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে ধারণ করেছিলেন। এই অসুস্থতাই সম্ভবত শেষ পর্যন্ত গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে তথ্য এত অপ্রতুল যে এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত করা যায় না।

পণ্ডিতমহলে ভ্রান্ত ধারণা : গৌতমীপুত্র সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে –

  • বিক্রমাবিদ্য : অনেকের মতে এই গৌতমীপুত্রই কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য। কিন্তু এ মত নিতান্তই অমূলক। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী উজ্জয়িনী, কিন্তু সাতবাহনদের রাজধানী প্রতিষ্ঠান। বিক্রমাব্দের প্রতিষ্ঠাতারূপে বিক্রমাদিত্যের খ্যাতি। পক্ষান্তরে গৌতমীপুত্র বা তার কোনও উত্তরপুরুষ কোনও অব্দ প্রচলন করেননি, তাদের রাজ্যবর্ষের উল্লেখ করেছেন মাত্র। তাছাড়া গৌতমীপুত্রের বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। 
  • নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক : অনেকের বিশ্বাস গৌতমীপুত্র প্রখ্যাত দার্শনিক নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। এ মতও সত্য নয়। শুয়েন চাঙের বর্ণনা হতে জানা যায়, নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক দক্ষিণ কোসলের অধিপতি ছিলেন। গৌতমীপুত্র কখনও দক্ষিণ কোসলে রাজত্ব করেননি। 
  • বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবির সঙ্গে যুগ্মভাবে রাজ্য শাসন : গৌতমীপুত্র তার সন্তান বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবির সঙ্গে যুগ্মভাবে রাজ্য শাসন করেছিলেন, এ মত কেউ কেউ পােষণ করেন। এ মতও সমর্থনযােগ্য নয়। পিতা ও পুত্র যৌথভাবে উৎকীর্ণ করেছেন এমন কোনও লেখ বা মুদ্রার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠান পুলুমাবির রাজধানী ছিল, এ কথা টলেমি স্পষ্ট করেই বলে গেছেন। কিন্তু পুলুমাবির প্রসঙ্গে টলেমি গৌতমীপুত্রের কোনও উল্লেখ করেননি। পিতা ও পুত্র একযােগে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করলে টলেমির উক্তিতে তার সমর্থন পাওয়া যেত।

বাশিষ্ঠীপত্র পুলুমাবি

রাজ্যবিস্তার : গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবি আনুমানিক ১৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে অভিষিক্ত হন। তিনি তিন দশকের কিছু কম সময় রাজত্ব করেছিলেন বলে পুরাণে উল্লেখ আছে। শক-কার্দমকদের কবল হতে পুলুমাবি অধিকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে পারেননি সত্য, কিন্তু তারই রাজত্বকালে সাতবাহন রাজ্য পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার অমরাবতী গ্রামে তার লেখ পাওয়া গেছে। তার নামাঙ্কিত অসংখ্য মুদ্রা করমণ্ডল উপকূল সহ অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত পুলুমাবির রাজত্বকালেই অন্ধপ্রদেশ সাতবাহনদের অধিকারে চলে আসে। কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে রাজ্য বিস্তার পুলুমাবির আর একটি উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব। কর্ণাটকের বোরি জেলায় তার একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজিত অঞ্চল ‘সাতবাহনীয় আহার’ নামে পরিচিত হয়। মহারাষ্ট্র তাে পুলুমাবির রাজ্যভুক্ত ছিলই। নাসিক ও কার্লাতে তিনি বেশ কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ করেন।

রুদ্রদামার কাছে পরাজয় : অনেকে মনে করেন, গৌতমীপুত্র নন, বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবিই রুদ্রদামার হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায় রুদ্রদামা সাতকর্ণি নামে জনৈক রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। পুলুমাবি সাতকর্ণি নাম ধারণ করেছিলেন বলে জানা যায় না।

পরবর্তী সাতবাহন রাজন্যবৃন্দ ও পতন

শিবশ্রী সাতকর্ণি : পুলুমাবির পর রাজা হন তার সহােদর শিবশ্রী সাতকর্ণি (আনু. ১৫৯-১৬৬ খ্রি.)। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতাে তিনিও বাশিষ্ঠীপুত্র নামে পরিচিত ছিলেন। কৃষ্ণা ও গােদাবরী জেলায় তার নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। তার কানহেরি লেখ থেকে জানা যায় তিনি জনৈক মহাক্ষত্রপের এক কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। কানহেরি লেখে সেই মহাক্ষত্রপের সম্পূর্ণ নামের উল্লেখ নেই, আছে তার নামের আদ্যাক্ষর রু-এর উল্লেখ। এই লেখে তিনি কার্দমক বলে বর্ণিত হয়েছেন। এ থেকে মনে হয় সাতবাহনরাজ বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণি মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামার কন্যারই পাণিগ্রহণ করেছিলেন। শ্বশুরের মৃত্যুর পর সাতকর্ণি সম্ভবত শক রাজ্যের কিছু অঞ্চল অধিকার করেন। 

শিবস্কন্দ সাতকর্ণি : তারপর শিবস্কন্দ সাতকর্ণি (আনু. ১৬৬-১৭৪ খ্রি.) সিংহাসনে আরােহণ করেন। পুরাণের শিবস্কন্দ সাতকর্ণি, অমরাবতী লেখের শিবস্কন্দ সাতকর্ণি এবং মুদ্রার স্কন্দ সাতকর্ণি সম্ভবত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি।

যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণি ও শকদের বিরুদ্ধে জয় : শিবস্কন্দের পর যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণি (আনু. ১৭৪-২০৩ খ্রি.) সিংহাসনে আরোহন করেন। যজ্ঞশ্রীর লেখ মহারাষ্ট্রের নাসিক ও কানহেরিতে এবং অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামাঙ্কিত মুদ্রাও পাওয়া গেছে। যজ্ঞশ্রী শুধু দাক্ষিণাত্যের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় প্রান্তে রাজত্ব করেননি, কার্দমকদের নিকট হতে ওজরাতের একাংশও অধিকার করেন। কার্দমকদের বিরুদ্ধে তার সাফল্য মুদ্রার সাক্ষ্যেও পরােক্ষ ভাবে সমর্থিত হয়। তার রূপার মুদ্রা রুদ্রদামার মুদ্রার প্রায় হুবহু অনুকরণ। গুজরাতের যে অঞ্চল হতে যজ্ঞশ্রী কার্দমকদের উচ্ছেদ করেন সেই অঞ্চলে প্রচলনের উদ্দেশ্যেই সাতবাহনরাজ এই মুদ্রা চালু করেন। এই সময় গৃহবিবাদের ফলে কার্দমাক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বিরােধ ছিল জীবদামা এবং প্রথম রুদ্ৰসিংহের মধ্যে। তারা প্রথমে একযােগে কাজ করে পরে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। মহাক্ষত্রপ ঈশ্বরদত্তের অভ্যুত্থানের ফলে কার্দমকরা আরও হীনবল হয়ে পড়েন। কার্দমক শক্তির দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে যজ্ঞশ্রী গুজরাতের একাংশে নিজের অধিকার বিস্তার করেন। যজ্ঞশ্রী সম্ভবত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলও সম্ভবত যজ্ঞশ্রীর রাজ্যভুক্ত ছিল। অনেকে মনে করেন রাজত্বের শেষপর্বে যজ্ঞশ্রী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের ধারণা রাজা ঈশ্বরসেন যজ্ঞশ্রীকে পরাজিত করে উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্রে আভীর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ঈশ্বরসেন খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মধ্যভাগে আবিভূর্ত হয়েছিলেন, ২য় শতকের শেষ-পর্বে নয়।

যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির উত্তরাধিকারী রূপে পুরাণে বিজয়, চন্দ্ৰশ্ৰী বা চণ্ডশ্রী এবং পুলােমা বা পুলুমাবির উল্লেখ আছে। পুরাণের বিজয় এবং মুদ্রার বিজয় সাতকর্ণি সম্ভবত একই ব্যক্তি। চন্দ্র বা চণ্ড সাতকর্ণির একখানি লেখ গােদাবরী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চলে তার নামাঙ্কিত মুদ্রাও পাওয়া গেছে। পুলুমাবির অষ্টম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি লেখ কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে রুদ্র সাতকর্ণির মুদ্রা পাওয়া গেছে। পুরাণে রুদ্র সাতকর্ণির নাম নেই। এই রাজার সমগ্র সাতবাহন রাজ্যের, না তার খণ্ডিত অংশের রাজা ছিলেন, তা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। এই পর্বের একজন রাজা মাঠরীপুত্র শকসেন। তার একখানি লেখা কানহেরিতে আবিষ্কৃত হয়েছে। কৃষ্ণা ও গােদাবরী জেলায় প্রাপ্ত শকসেন বা শকসাত নামাঙ্কিত মুদ্রা সম্ভবত তিনিই উৎকীর্ণ করেন। তার রাজ্যটি আয়তনে বেশ বড়ই ছিল বলে মনে হয়। বাশিষ্ঠীপুত্র চতরপন সাতকর্ণি নামে জনৈক রাজার ত্রয়ােদশ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি লেখ নানাঘাটে পাওয়া গেছে। পূর্ববর্তী রাজগণের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল তা জানা যায় না।

সাতবাহন রাজত্বের অবসান : আনুমানিক ২২৫ খ্রিস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশে সাতবাহন শাসনের অবসান ঘটে। শান্তমূলের নেতৃত্বে সেখানে স্বাধীন ইক্ষ্বাকু রাজ্য গড়ে ওঠে। এই সময় কর্ণাটকেও সাতবাহন আধিপত্যের অবসান হয়। সেখানে মহারঠিদের বিতাড়িত করে প্রথমে মুডানন্দ (মতান্তরে মুলানন্দ) এবং পরে চুটুকুলানন্দ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে মনে করেন চুটুরা অপরান্তও অধিকার করেন। শেষােক্ত মত অবশ্য সকলে স্বীকার করেন না। সাতবাহনরা তখনও মহারাষ্ট্রে এবং সম্ভবত মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশে রাজত্ব করছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরসেন খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মাঝামাঝি সময় মহারাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আভীর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মহারাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও মধ্যপ্রদেশে বাকাটক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী কাল অস্তিত্ব ও প্রভুত্বের লড়াই করে সাতবাহন রাজ্য এভাবে ধসে পড়ল।

প্রশাসন, সমাজব্যবস্থা, কৃষি ও কারিগরি শিল্প

প্রশাসন-ব্যবস্থা

  • রাজা : প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন রাজা। তিনি একাধারে মুখ্য প্রশাসক ও সেনা বাহিনীর অধ্যক্ষ। রাজারা বহুপত্নীক ছিলেন। সে কারণে রাজকুমারেরা অনেক সময় মায়ের নাম গ্রহণ করতেন। গৌতমীপুত্র, বাশিষ্ঠীপুত্রেরা তাই করেছেন। পিতার সিংহাসনে জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই অধিকার ছিল। সাতবাহন রাজারা নিজেদের কখনও দেবতা বা দেবপ্রতিনিধি বলে পরিচয় দেননি। অমরাবতীর ভাস্কর্যে রাজার পদমর্যাদা সম্পর্কে কিছু ধারণা প্রকাশ পেয়েছে। রাজাকে সেখানে প্রায়ই ছত্র ও চামরধারী পরিবৃত দেখা যায়, রাজার আসনও সিংহচিহ্নিত, রাজপদের স্বাতন্ত্র ও মর্যাদা অমরাবতীর ভাস্কর্যে পরিস্ফুট। 
  • জনকল্যাণকর কাজ : জনকল্যাণকর কাজে রাজার ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। প্রজাদের সুখে-দুঃখে গৌতমীপুত্রের সহানুভূতির কথা নাসিক প্রশস্তিতে বলা হয়েছে। পীড়নমূলক কর ধার্য না করা এবং ব্রাহ্মণ ও অন্য সকলের স্বার্থরক্ষায় তার আগ্রহ এই লেখে প্রকাশ পেয়েছে।
  • দু’রকম শাসনব্যবস্থা : সাতবাহন রাজ্যে দু’রকম শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এক অংশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন অনুগত মহারঠি, মহাভােজ এবং কুর পরিবারের লােকেরা। বাকি অংশ ছিল রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন। মহারঠিরা ছিলেন কর্ণাটকের দায়িত্বে, মহাভােজেরা উত্তর কোণের আর কুরেরা কোলাপুর অঞ্চলের। তাদের ভূমিদানের অধিকার ছিল। স্বনামে তারা মুদ্রাও প্রচলন করেছেন। আইনত তারা রাজার অধীনস্থ হলেও কার্যত তারা স্বাধীনই ছিলেন বলা যায়।
  • আহারে বিভক্তি : রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল আবার অনেকগুলো আহারে বিভক্ত ছিল। গােবর্ধন, সােপারা, মামাল, সাতবাহনীয় প্রভৃতি কয়েকটি আহারের উল্লেখ লেখে আছে। আহার শাসনের ভার ছিল অমাত্য পদবির কর্মচারীদের উপর। তাদের উপর রাজার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। আহারস্থিত কোনও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিল না। স্বনামে মুদ্রা চালু করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। সম্ভবত অমাত্যরা এক আহার হতে তান্য আহারে বদলি হতেন। অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে ছিল এক একটি আহার। গ্রামিকের উপর গ্রামের ভার ছিল।। 
  • রাজকর্মচারী : তাছাড়া লেখে রাজামাত্য, মহামাত্র, ভাণ্ডাগারিক, হেরণিক, লেখক, নিবন্ধকার, দূতক প্রভৃতি রাজকর্মচারীদের কথা বলা হয়েছে। রাজার বিশেষ আস্থাভাজন এবং উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন রাজামাত্য। বিশেষ বিশেষ কাজের দায়িত্বে ছিলেন মহামাত্র। ভাণ্ডাগরিকের তার্থ ভাণ্ডারী। রাজকীয় দলিল-দস্তাবেজ রচনার দায়িত্বে ছিলেন লেখক। নিবন্ধকার সম্ভবত ভূমির রেজিষ্ট্রিসংক্রান্ত কাজের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। দুতব হলেন রাজার বার্তাবহ। হেরণিক হলেন কোষাধ্যক্ষ। সাতবাহন লেখে মহাসেনাপতির উল্লেখ আছে। তিনি কখনও লেখকরূপে, কখনওবা জনপদের প্রশাসকরূপে, বর্ণিত হয়েছেন। সমকালীন একখানি লেখে মহাতলবর-এর উল্লেখ আছে। তলবর দ্রাবিড় পদ। এর অর্থ প্রহরী। মহাতলবর সম্ভবত রক্ষা-বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন।

সামাজিক জীবন

  • বর্ণাশ্রম : সেযুগের সমাজ-জীবনের কিছু ছবি ধরা পড়েছে সমকালীন লেখে, সাহিত্যিক উপাদানে এবং ভাস্কর্যে। সমাজে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ব্রাহ্মণরা প্রধানত পুরােহিতের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। যুদ্ধবৃত্তি ক্ষত্রিয়দের উপজীবিকা ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি ছিল বৈশ্যদের উপজীবিকা। শূদ্ররা বিত্তবানদের গৃহে ও খেতে ভূতের কাজ করতেন। স্থানীয় গােষ্ঠীর অনেকে যেমন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর্য সমাজের সঙ্গে মিশে গেলেন তেমনি আবার অনেকে তাদের পৃথক সত্তা বজায় রাখেন। বিভিন্ন পেশাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রেণির বা জাতির উদ্ভব হয়। এই প্রসঙ্গে হলিক বা কৃষক, শ্রেষ্ঠী বা বণিক, গান্ধিক বা সুগন্ধ দ্রব্যাদির প্রস্তুতকারক বা বিক্রেতা, কৌলিক বা তন্তুবায়, তিলপিষক বা ঘানিওয়ালা এবং কর্মকার প্রভৃতি জাতির উল্লেখ করা যায়। 
  • বর্ণাশ্রমের দুর্বল ভিত : সমাজে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা চালু ছিল ঠিকই কিন্তু এর ভিত বেশ দুর্বল ছিল। এর একটি কারণ হল বৌদ্ধধর্মের প্রসার। আর একটি কারণ শক-পহ্লব প্রভৃতি বৈদেশিক জাতির দক্ষিণ ভারতে আগমন। শক মহাত্ৰপ রুদ্রদামার সঙ্গে তাে সাতবাহন রাজপরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। তাছাড়া স্থানীয় গােষ্ঠীর তানেকে আর্য রীতি-নীতি ও বৃত্তি গ্রহণ করে আর্য সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। ফলে বিভিন্ন বর্ণ ও গােষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে যায়। নাসিকের এক লেখে বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতিষ্ঠায় গৌতমীপত্রের আগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নিজেদের ব্রাহ্মণত্বের দাবিতে এবং শক পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সাতবাহনদের সে ঐকান্তিক প্রকাশ পায়নি। 
  • যৌথ পরিবার : যৌথ পরিবার তখনকার সমাজের এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। বাবা-মা, ভাই-বােন, স্ত্রী-পুত্র, নাতি-নাতনিরা সবাই একযােগে দানধ্যান করছেন এরূপ বহু ঘটনার উল্লেখ আছে অমরাবতীর লেখমালায়। পরিবারের সদস্যরা তাদের গুরুত্ব অনুসারে পর্যায়ক্রমে লেখে উল্লিখিত হয়েছেন। অর্থাৎ মায়ের আগে বাবার উল্লেখ আছে, উল্লেখ আছে মেয়ের পূর্বে ছেলের, আর বােনের আগে ভায়ের। সেযুগে সম্ভ্রান্ত ও সাধারণ পরিবারের মেয়েরা যে প্রচুর দানধ্যান করতেন সমকালীন লেখে তার প্রমাণ আছে। নাসিক প্রশস্তি হতে জানা যায় মহিষী নাগনিকা বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন, স্বামীর মৃত্যুতে রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে ধারণ করেছেন। সেযুগে একজন মহিলার বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সমকালীন বৈদিক ভাষ্যকার জৈমিনি স্পষ্ট করে নির্দেশ দিয়েছেন, অশিক্ষিত হওয়ায় মহিলারা যাগযজ্ঞের অধিকারী নন। বৈদিক মন্ত্রের উচ্চারণ মেয়েদের পক্ষে নিষিদ্ধ বলে স্মৃতিকার মনুও বিধান দিয়েছেন। বােঝা যায়, জৈমিনি বা মনুর অনুশাসনা সাতবাহন রাজ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। 
  • বসনভূষণ : অমরাবতী ও কালের ভাস্কর্যে সেযুগের বসনভূষণের পরিচয় মেলে। ভাস্কর্য মূর্তিগুলোর স্বল্পবাস এবং অলংকারের প্রাচুর্য বিশেষভাবে লক্ষ করার মতাে। মূর্তিগুলোর নিম্নাঙ্গ বস্ত্রসজ্জিত কিন্তু ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। পুরুষমূর্তির মাথায় উষ্ণীষ। অলংকারের প্রতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই সমান আগ্রহ। অলংকারের মধ্যে রয়েছে দুল, বালা, ব্রেসলেট, হার এবং অনন্ত। প্রায় সব নারীমূর্তির পায়ে নূপুর।

কৃষি 

  • উৎপাদিত খাদ্য ও শিল্পদ্রব্য : সাধারণ লােকের আয়ের মূল উৎস ছিল কৃষি। লেখমালায় গাে-দান ও ভূমি-দানের অজস্র উল্লেখে জনজীবনে কৃষির গুরুত্বই আভাসিত হয়। মিলিন্দপঞ্চ্‌হো গ্রন্থে অপরান্ত বা কোঙ্কণ উপকূল অঞ্চলের কুমুদভণ্ডিকা ধানের উল্লেখ আছে। এ ধান ছিল মােটা ও সাধারণ মানের। গাথাসপ্তশতীতে ধান, গম, ছােলা, শন, কার্পাস ও ইক্ষুর উল্লেখ আছে। প্লিনির বিবরণী ও পেরিপ্লাস্-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় মালাবার অঞ্চলে গােলমরিচ উৎপন্ন হত। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে যে দারুচিনি, এলাচ প্রভৃতি মশলা প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত পেরিপ্লাস গ্রন্থে তার ইঙ্গিত আছে। করমণ্ডল উপকুলে নারকেল চাষের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তামিলনাড়ুর আরিকমেডুতে আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • কৃষিযন্ত্র : কৃষির কাজে এই পর্বে দু’টি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এদের একটি হল উদকযন্ত্র যার পরােক্ষ উল্লেখ রয়েছে নাসিক হতে পাওয়া একটি লেখে। যন্ত্রটির গঠন ও প্রকৃতি সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য নেই তবু মনে হয় জল সরবরাহের কাজে এটি ব্যবহার করা হত। হালের গাথাসপ্তশতীতে অরহট্টঘটিকা নামে অপর একটি জলযন্ত্রের উল্লেখ আছে। যন্ত্রটি দেখতে চক্রের মতাে, তার গায়ে ঘটিকা বসানাে। চক্রটি বসানাে হত কোনও বৃহৎ কূপে বা জলাশয়ের মধ্যে। চক্রটি ঘুরলে ঘটি জলে ভরে যেত এবং ঘুরন্ত চক্রের সঙ্গে ঘটি নিম্নমুখী হলে সে জল সেচের কাজে ব্যবহার করা যেত। উদকযন্ত্র ও অরহট্টঘটিকার ব্যবহারের ফলে কৃষির উৎপাদন নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পায়। 
  • জমির ব্যক্তিগত মালিকানা : সাতবাহন রাজ্যে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অবশ্য কয়েকটি গ্রাম যে এজমালি সম্পত্তি ছিল তারও প্রমাণ আছে। সাতবাহন লেখে রাজকীয় খেতেরও (রাজকং ক্ষেত্তং) উল্লেখ আছে। রাজা কখনও কখনও তার নিজস্ব জমি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান করতেন, সাতবাহন লেখমালায় এ ধরনের ভূ-দানের প্রচুর উল্লেখ আছে। এসব ক্ষেত্রে গ্রহীতাকে রাজস্বদানের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হত কিন্তু প্রদত্ত জমি কার্যত রাজার মালিকানাধীনই ছিল। জমি কেনাবেচার যেসব তথ্য সাতবাহন লেখে পাওয়া যায় তা সবই ধর্মসম্পর্কিত। এর থেকে কেউ কেউ মনে করেন সেসময় ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও কারণে জমির কেনাবেচা হত না। উল্লেখ নেই শুধু এই কারণে এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। 
  • রাজস্ব : সম্ভবত উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজস্ববাবদ রাজভাণ্ডারে জমা পড়ত। লবণ উৎপাদনে রাষ্ট্র সম্ভবত সরাসরি অংশ গ্রহণ করত না, ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহ দিত। তবে রাষ্ট্র উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট ভাগ কর বা শুল্করূপে গ্রহণ করত। তত্ত্বগতভাবে রাজ্যের যাবতীয় খনি ও খনিজ দ্রব্য ছিল রাজকীয় তথা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি।

বৃত্তি ও কারিগরি শিল্প

  • বিভিন্ন শরণের শিল্প : সমকালীন লেখমালায় এযুগের বিভিন্ন বৃত্তি ও কারিগরি শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা উল্লিখিত হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন উদযান্ত্রিক (জলযন্ত্রনির্মাতা বা কর্মী), কুলরিক (কুম্ভকার), তিলপিষক (ঘানিওয়ালা), কৌলিক (তন্তুবায়), ধন্যিক (ধানের কারবারি), বংশকার (বাশের কারিগর), কাংস্যকার (কাসারি), গন্ধবণিক (গন্ধদ্রব্য-বিক্রেতা), চর্মকার (চর্মশিল্পী), পাষাণিক (প্রস্তর-কারিগর) এবং দন্তকার বা হাতির দাঁতের কারিগর।
  • বস্ত্রশিল্প : কৌলিক বা তন্তুবায়েরা সংখ্যায় বেশ ভারীই ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের মধ্যভাগে অবস্থিত টের ও পৈঠান ছিল বস্ত্রশিল্পের দু’টি প্রধান কেন্দ্র। টেরে উৎখননের ফলে কাপড় রং করার বিশাল পাত্র আবিষ্কত হয়ে পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেড়ুতে উৎখনন চালিয়ে কাপড় রাঙানাের অনুরূপ আঠা আবিয়ে হয়েছে। সাঁচীর একটি লেখে জনৈক দন্তকারের উল্লেখ আছে যিনি সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণির সমসাময়িক ছিলেন। সাঁচীসস্তুপের একটি তােরণ নির্মাণে তিনি অর্থ ব্যয় করেছিলেন।
  • ধাতু, পাথর ও মৃৎশিল্প : সেযুগে অনেকেই ধাতু, পাথর ও মৃৎশিল্পকে জীবিকারূপে গ্রহণ করেছিলেন। সােনা প্রধানত পাওয়া যেত কর্ণাটকের কোলারের খনিগুলোতে। পৈঠান, মাসকি, কোণ্ডাপুর, ভট্রিপ্রােলু, অমরাবতী প্রভৃতি স্থানে পােড়ামাটির সুদৃশ্য মূর্তি, মূল্যবান পাথর, সােনা, তামা, হাতির দাঁতের ও শখের তৈরি বিভিন্ন গহনা, স্ফটিকের জিনিস, ছাঁচ ও মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। পােড়ামাটির মূতিগঠনে শিল্পী যে প্রখর বাস্তবতার পরিচয় দিয়েছেন তা সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মূর্তিগুলোর কেশ বিন্যাসে রয়েছে নয়নমুগ্ধকর বৈচিত্র্য। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটিকে অজণ্টার সেরা চিত্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করা চলে। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সমকালীন স্বর্ণ, মণি ও মৃৎশিল্পের অগ্রগতির সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করছে। 
  • গিল্ড : সাতবাহন লেখমালায় স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও মনে হয় এসব শিল্পী, কারিগর ও ব্যবসায়ীদের নিজস্ব সংগঠন বা ‘গিল্ড’ ছিল। নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যই এই সংগঠন। সাতবাহন লেখে শ্রেণি বা পূগের কথা নেই কিন্তু নিগমের উল্লেখ আছে (A. M. Shastri, Early History of the Deccan : Problem and Perspective. পৃষ্ঠা ১১৮)। দু’খানি লেখে আছে ‘ধান্যকটক-নিগমের’ উল্লেখ। আর একটি লেখে এক নিগমের কথা বলা হয়েছে যার প্রমুখ ছিলেন জনৈক শ্ৰেষ্ঠী। তন্ত্রশাস্ত্র, বেদ, নির্গমন, বাণিজ্য, নগর, বাজার, পথ, পৌরসভা, সংঘ, বণিকসংঘ ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে নিগম শব্দের ব্যবহার আছে। সাতবাহন রাজ্যের এক বিখ্যাত শহর ধান্যকটক। শহরটি বর্তমানে অমরাবতী বা ধরণিকোট নামে পরিচিত। ধান্যকটক-নিগম বলতে সম্ভবত ধান্যকটকের পৌরসভা বােঝানাে হয়েছে। যে নিগমটির কর্ণধার ছিলেন জনৈক শ্রেষ্ঠী সেটি সম্ভবত বাণিজ্যোপজীবী সংগঠন ছিল।

রোম ও পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য

ব্যবসা-বাণিজ্য : ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ নামের গ্রন্থখানি, টলেমি কৃত ‘ভূগােল’ এবং রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া রােমক ও দেশীয় মুদ্রা সেযুগের ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির পরিচয় বহন করে। প্রথম গ্রন্থখানি থেকে জানা যায় সাতবাহন রাজ্যের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল ছিল জনবহুল ও সমৃদ্ধশালী কিন্তু মধ্যাঞ্চল তুলনায় অনগ্রসর ছিল। মরু ও পর্বতসংকুল মধ্যাঞ্চলে বাঘ, হাতি, সাপ প্রভৃতি বিভিন্ন হিংস্র জীবজন্তুর বাস ছিল। এসময় পশ্চিমাঞ্চলে যেসব বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে সােপারা, কল্যাণ, পৈঠান, টগর (বর্তমান টের), জুন্নার, নাসিক ও বৈজয়ন্তী বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। অমরাবতীর লেখসমূহে কেবুরুর, বিজয়পুর, কুদুর প্রভৃতি কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্রের উল্লেখ আছে। টলেমির বিবরণে মাসালিয়া (আধুনিক মসুলিপত্তন) ও ঘণ্টকশালের মতাে পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি সমৃদ্ধশালী বন্দরের উল্লেখ আছে। স্থলপথে ও নদীপথের মাধ্যমে পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় উভয় অঞ্চলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু যে পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল তা নয়, দক্ষিণ ভারতীয় বন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোও পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত ছিল। সাতবাহনদের রাজধানী প্রতিষ্ঠান থেকে একটি পথ টগর, নাসিক, সেতব্য, বনসভয়, উজ্জয়িনী ও সাঁচী হয়ে উত্তরে একেবারে শ্রাবস্তী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পশ্চিম উপকূলের বিখ্যাত বন্দর ভৃগুচ্ছ হতে আর একটি পথ মালব, গাঙ্গেয় উপত্যকা, তক্ষশিলা ও পুষ্কলাবতী হয়ে কাবুল অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় স্থান থেকে স্থানান্তরে গমনাগমন সহজসাধ্য হয়। সমকালীন লেখমালায় দেখা যায় দশপুরের বণিক নাসিকে, বৈজয়ন্তী, ধান্যকোট ও সােপারার পণ্যবিক্রেতা জুন্নারে এবং সােপারার ব্যবসায়ী নানাঘাটে দানধ্যানাদি কাজে অংশগ্রহণ করছেন। এসব ঘটনায় বিভিন্ন শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রমাণিত হয়।

মুদ্রা : সাতবাহন রাজারা সিসা, তামা, রূপা ও মিশ্ৰধাতুতে অনেক মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। তারা। কোনও স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন বলে জানা যায় না। দ্রব্যাদির দৈনন্দিন ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রেই তামা বা সিসার মুদ্রা ব্যবহার করা হত, দুরপাল্লার বাণিজ্যে তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। তবে আন্তর বা দৈনন্দিন বাণিজ্য যে শুধুমাত্র মুদ্রার মাধ্যমেই সম্পন্ন হত তা নয়, পণ্যবিনিময় প্রথাও প্রচলিত ছিল।

রােমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক : সাতবাহন রাজ্যের সঙ্গে রােমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ ভারতে যে সব খাদ্যশস্য ও বিলাসসামগ্রী উৎপন্ন হত রােমের বাজারে তার প্রচণ্ড চাহিদা ছিল। প্রথম প্রথম রােমক বণিকেরা মিশরীয় ও আরবি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যাদি সংগ্রহ করতেন। কিন্তু ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রােমক সম্রাট অকটেভিয়াস অগাস্টাসের মিশর জয়ের পর রােমক বণিকরা সরাসরি ভারতে আসতে শুরু করেন। ভারতীয় বণিকরাও যে সমুদ্র পাড়ি দিতেন না তা নয়। সাঁচীস্তূপের ভাস্কর্যে ভারতীয় বণিকদের সমুদ্রপথে যাতায়াতের কাহিনি রূপায়িত আছে। ঘন্টকশাল ও গুণ্ডুপল্লিতে প্রাপ্ত কয়েকখানি সমকালীন লেখে মহানাবিকের উল্লেখ আছে। মহানাবিক পদটিতে সমুদ্রযাত্রার ইঙ্গিত আছে। ৪৫ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পালাস মৌসুমি বায়ুর প্রবাহপথ আবিষ্কার করে ফেলেন। ফলে প্রাচ্যের সঙ্গে রােমের বাণিজ্যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

পূর্ব আফ্রিকা ও রোমে রপ্তানি পণ্যসমূহ : দক্ষিণ ভারত থেকে যেমন চাল গমের মতাে খাদ্যশস্য পূর্ব আফ্রিকা তথা রােমে রপ্তানি হত তেমনি গােলমরিচ দারুচিনির মতাে মসলাপাতি, চন্দন, সেগুন মেহগনির মতাে দামি কাঠ, কার্পাস রেশমের বস্ত্র, মসলিন, সুতা, দামি আধাদামি পাথর, সুগন্ধি মসলা, গজদন্ত ইত্যাদি শৌখিন দ্রব্যাদিও রপ্তানি হতরােমের বাজারে ভারতীয় দ্রব্যের চাহিদা এতই তীব্র ছিল যে ভারতীয় পণ্য সেখানে একশাে গুণ চড়াদামে বিক্রি হতঅন্যদিকে রােম তথা বিদেশ থেকেও কম জিনিস আমদানি হত নাআমদানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল সুরা, তামা, টিন, সিসা, প্রবাল, পুষ্পরাগ মণি, স্বচ্ছ কাচ, মােমছাল, সুর্মা, স্বর্ণ রৌপ্যমুদ্রা, গায়ক ক্রীতদাসীর দলদক্ষিণ ভারত তথা ভারতের বাজারে ব্যাবিলােন আলেকজান্ড্রিয়ার সূচিশিল্পশােভিত কাপড়ের যথেষ্ট চাহিদা ছিলবলতে দ্বিধা নেই, রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনে লাভের পাল্লাটা ভারতের দিকেই ঝোকানাে ছিল। ২২ খ্রিস্টাব্দে রােমক সম্রাট টাইবেরিয়াস তাে স্পষ্টই অভিযোগ করেছিলেন, বিলাসব্যসনের জোগান দিতে রােমের সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর প্লিনি আক্ষেপের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ভারতীয় পণ্যের পেছনে রােমের বছরে ৫৫০, ০০০, ০০০ সেস্টারসেস পরিমাণ অর্থ বিনষ্ট হচ্ছে। সাতবাহন রাজ্য তথা ভারতের বিভিন্ন স্থানে সােনা ও রূপার অসংখ্য রােমক মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উপলক্ষে বুলিয়নরূপে এই মুদ্রাগুলো আমদানি হয়েছিল। রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে লাভের পাল্লাটা যে ভারতের দিকেই নত ছিল তা এই মুদ্রাগুলোর সাক্ষ্যে সুপ্রমাণিত।

রোমের সাথে বাণিজ্যে ভাটা : মুদ্রার সাক্ষ্যে আর একটি সত্য উদঘাটিত হয়েছেএই মুদ্রাগুলোর বেশির ভাগই ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (রােমক সম্রাট অগাস্টাসের সিংহাসন আরােহণ) হতে ৬৮ খ্রিস্টাব্দের (সম্রাট ২৮ নীরাের মৃত্যু) মধ্যে উৎকীর্ণআবার কিছু মুদ্রা ক্যারাকালা (২১৭ খ্রিস্টাব্দ) ম্যাক্রিনাস (২৩৬ – ৩৮ খ্রিস্টাব্দ)এর সমকালীনএর থেকে বােঝা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষ পাদ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত রােমভারত বাণিজ্যে যে জোয়ার এসেছিল, খ্রিস্টীয় ২য় – ৩য় শতকতাতে ভাটা পড়েস্তিমিত গতিতে হলেও আরও প্রায় দুই শতাব্দী ধরে রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চলেসম্রাট মার্সিয়ান (৪৫০ খ্রিস্টাব্দ), লিও (৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ), এনাস্টেসিয়াস (৪৯১-৫১৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং জাস্টিন (৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) – এর নামাঙ্কিত রােমক মুদ্রাও ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে।

শকদের সাথে সংঘর্ষের ফলে রোমের সাথে বাণিজ্যে অধপতন : শকদের সঙ্গে সাতবাহন রাজাদের সংঘর্ষ ভারতরােম বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুভ হয়নিপেরিপ্লাস্ অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ এবং টলেমির ভূগােলগ্রন্থখানিকে একসঙ্গে পাঠ করলে এই সত্য ধরা পড়েপেরিপ্লাসক্যালিয়েনা নামে কোঙ্কণ উপকূলের এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের উল্লেখ আছেক্যালিয়েনা নিঃসন্দেহে আধুনিক কল্যাণপেরিপ্লাস্এর বর্ণনা থেকে মনে হয় বন্দরটি সাতবাহন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলপেরিপ্লাসের লেখক জানাচ্ছেন জ্যেষ্ঠ স্যারাগেনাস অর্থাৎ সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণির রাজত্বকাল পর্যন্ত ক্যালিয়েনা একটি সমৃদ্ধ বন্দর ছিল, দেশি বিদেশি বণিকদের আনাগােনায় সে স্থান ছিল সতত মুখরকিন্তু স্যান্ডারেস কর্তৃত্ব লাভ করার পর মামবারাস এই বন্দরের উপর নৌ অবরােধ জারি করেনফলে কোনও গ্রিক জাহাজ এই বন্দরে প্রবেশ করতে পারত নাযদিবা কোনও গ্রিক জাহাজ ভুলক্রমে অবরুদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ত, ম্যামবারাসের নৌবাহিনী সেটিকে জোর করে ব্যারিগাজা বা ভৃগুকচ্ছে নিয়ে যেতপেরিপ্লাসের এই বর্ণনা হতে মনে হয় সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে কল্যাণ বন্দরটির ব্যবসাবাণিজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়অনেকেই মনে করেন, যে ম্যামবারাসের আগ্রাসী ভূমিকার ফলে কল্যাণ বন্দরে অরাজকতা নেমে আসে, তিনি শক ক্ষত্ৰপ নহপানতারা আরও মনে করেন, পেরিপ্লাসে বর্ণিত স্যান্ডারেস হলেন সাতবাহনরাজ সুন্দর সাতকর্ণিকিন্তু ধারণা ঠিক নয়স্যান্ডারেস সম্ভবত একজন শক শাসক ছিলেন, আর ম্যামবারাসও নহপান ননপেরিপ্লাস রচিত হওয়ার অন্তত দুই দশক পর নহপানের রাজত্ব শুরু হয়েছিলম্যামবারাস সম্ভবত একজন শক প্রশাসক ছিলেন এবং তিনি খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মধ্যভাগ নাগাদ পশ্চিম ভারতের কিয়দংশে তার শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (স্যান্ডারেস সম্ভবত অপরান্ত অঞ্চলে ম্যামবারাসের প্রতিনিধি ছিলেন)১৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ টলেমি যখন তার ভূগােলগ্রন্থে পশ্চিম ভারতীয় বন্দরগুলোর তালিকা দেন তখন তিনি কল্যাণের কোনও উল্লেখ করেননিঅনুমান করতে দ্বিধা নেই, ততদিনে কল্যাণ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে

শঙ্গম সাহিত্যে ভারত-রােম বহির্বাণিজ্য : শঙ্গম সাহিত্যে ভারতরােম বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছেসেখানে বলা হয়েছে যবন জাহাজগুলো মুচিরিপত্তনম বন্দরে স্বর্ণমুদ্রা ভরে নিয়ে আসত আরপরিবর্তে গােলমরিচ ভর্তি করে দেশে ফিরে যেতশঙ্গম সাহিত্যে যে বন্দরটিকে মুচিরিপত্তনম বলা হয়েছে পেরিপ্লাস্এর লেখক এবং টলেমি তাকেই মুজিরিস আখ্যা দিয়েছেনবন্দরটি আধুনিক ক্র্যাঙ্গানােরের নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে অবস্থিত ছিলমুজিরিসে শুধু যে রােমক জাহাজগুলোর আনাগােনা ছিল তা নয়, এখানে সম্ভবত রােমক বণিকদের একটি স্থায়ী বসতিও গড়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের রচনা ট্যাবুলা বিউটিনজেরিয়ানা গ্রন্থে মুজিরিসে রােমক সম্রাট অগাস্টাসের স্মৃতিতে গড়া এক মন্দিরের উল্লেখ আছেরােমকরা তাদের সম্রাটদের দেবতাজ্ঞানে পূজা করতেনমুজিরিসে রােমকদের স্থায়ী বসতি না থাকলে সেখানে ওই জাতীয় মন্দির গড়ে উঠত না। পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেড়তেও রােমক বণিকদের আর একটি স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতকের রােমক মৃৎপাত্র, পানপাত্র, বাতিদান ও কাঠের পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। আধুনিক আরিকমেডু নিঃসন্দেহে পেরিপ্লাস-এর লেখক ও টলেমি বর্ণিত প্রাচীন পােডুকার স্মৃতি বহন করছে। আরিকমেডুর মতাে আর একটি বিখ্যাত বন্দর কাবেরীপট্টিনম যার উল্লেখ আছে শঙ্গম সাহিত্যে। এই কাবেরীপট্টিনমই টলেমির ভূগােল গ্রন্থে খাবেরােস নামে উল্লিখিত হয়েছে। কাবেরী নদীর মােহনায় অবস্থিত এই বন্দরটি চোল রাজ্যে অবস্থিত ছিল।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য : পশ্চিম দিকে যেমন রােমক সাম্রাজ্যের সঙ্গে, পূর্ব দিকে তেমনি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যগুলোর সঙ্গে এসময় দক্ষিণ ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়পেরিপ্লাস্ টলেমির বিবরণে এই বহির্বাণিজ্যের কিছু ছবি ধরা পড়েছেচিকাকোলের কাছাকাছি এক বড় বন্দরের উল্লেখ আছে গ্রন্থ দুটিতেপণ্যসম্ভার সাজিয়ে জাহাজগুলো এই বন্দর থেকে যাত্রা করে আড়াআড়িভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছতদ্বিতীয় পুলুমাবি যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির অন্যান্য মদ্রার সঙ্গে বিশেষ এক শ্রেণির মুদ্রা করমণ্ডল উপকুলে পাওয়া গেছেএই শ্রেণির মুদ্রায় দুই মাস্তুলযুক্ত জাহাজের ছবি অঙ্কিত রয়েছেমুদ্রাগুলো সাতবাহন যুগের সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপের স্মৃতি বহন করছেদক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সে অঞ্চলে ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিও প্রসার লাভ করে

ধর্মীয় জীবন

বৈদিক যাগযজ্ঞ : সাতবাহন রাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেনতারা ছিলেন বৈদিক যাগযজ্ঞের একান্ত অনুরাগীএকজন সাতবাহনরাজ তাে যজ্ঞশ্রী নামই ধারণ করেছিলেনপ্রথম সাতকর্ণি অশ্বমেধ, রাজসূয়, অগ্ন্যাধেয় প্রভৃতি বিবিধ বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেনযাগযজ্ঞাদি উপলক্ষে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে প্রথম সাতকর্ণির প্রচুর দানধ্যানের কথা নানাঘাট লেখে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। 

পৌরাণিক দেবতারা : সমাজে, বিশেষকরে অভিজাত মহলে, বৈদিক যাগযজ্ঞ যেমন সমাদর লাভ করেছিল তেমনি বাসুদেব এবং পশুপতির মতাে পৌরাণিক দেবতারাও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেননানাঘাট লেখে বাসুদেবের উল্লেখ আছেলক্ষ করবার বিষয়, সেখানে কেবল বাসুদেবের নামেরই উল্লেখ নেই, বাসুদেবের সঙ্গে সংকর্ষণের নাম যুগপৎ উচ্চারিত হয়েছেশুধু তাই নয়, সেখানে বাসুদেবের নামের পূর্বেই সংকর্ষণের নাম উল্লেখ করা হয়েছেসম্ভবত সাতবাহন রাজ্যে সংকর্ষণ বাসুদেবের যৌথ পূজার প্রচলন ছিলএই যৌথ পূজায় সংকর্ষণেরই প্রাধান্য ছিলবাসুদেবের অগ্রজ বলেই হয়তাে সংকর্ষণ বা বলরামের এই প্রাধান্যসমকালীন যুগে রচিত গাথাসপ্তশতীতে কৃষ্ণ সম্পর্কে অনেক কাহিনির অবতারণা আছেগাথাসপ্তশতীতে লক্ষ্মী নারায়ণের উল্লেখ আছেসমকালীন লেখ সাহিত্যে আর যে সকল ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর কথা বলা হয়েছে তাদেরমধ্যে ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য, যম, বরুণ, কুবের এবং গৌরী বিশেষভাবে উল্লেখ্যতখনকার দিনে সাধারণ মানুষদের মধ্যে তীর্থযাত্রা, কূপপুষ্করিণী খনন, বৃক্ষরােপণ ইত্যাদি কাজে যথেষ্ট আগ্রহ দেখা যায়এসব কাজ ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হত। 

জৈনধর্ম : মহারাষ্ট্র অন্ধ্রপ্রদেশের নানা স্থানে প্রাচীন বহু জৈন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছেএদের অনেকগুলোই সাতবাহন আমলেরসাতবাহন রাজ্যে জৈনরা সংখ্যায় নগণ্য ছিলেন না। 

মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার, জন সাধারণের উদ্যোগ : এসময় মহারাষ্ট্র অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেমহারাষ্ট্রের পিটল-খােরা, নাসিক, কার্লে, কানহেরি, জুন্নার, মাহার, কোল, ভাজা কোলাপুর এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ঘণ্টকশাল, জগ্‌গয্যপেটা, অমরাবতী ভট্টিপ্রোলুতে অসংখ্য বৌদ্ধ নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছেদক্ষিণ ভারতের প্রাচীন বৌদ্ধ গুহাগুলোর প্রায় সবকটিই এই পর্বে নির্মিত হয়ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরাগী হয়েও সাতবাহন রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেনবৌদ্ধ শ্ৰমণদের তত্ত্বাবধানের জন্য রাজা কৃষ্ণ নাসিকে একজন মহামাত্র নিযুক্ত করেছিলেনরাজমাতা গৌতমী বলশ্রী ভদ্রযানীয় ভিক্ষুদের অনুকূলে একটি গুহা দান করেছিলেনগৌতমীপুত্র সাতকর্ণি ত্রিবশি পবর্তবাসী ভিক্ষুদের দ্বিশত নিবর্তনের একখণ্ড জমি প্রদান করেন, বলশ্রী গৌতমীপুত্র সমবেত ভাবে একশাে নিবর্তনের জমি তিরশ্নি পর্বতবাসী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করেনদ্বিতীয় পুলুমাবির রাজত্বকালে কালার মহাসংঘিক ভিক্ষুদের ভরণপােষণের জন্য একখানি গ্রাম প্রদত্ত হয় শুধু রাজা বা রাজপরিবারের সদস্যগণ নন, ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি জন সাধারণেরও সজাগ দৃষ্টি ছিল। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের বসবাসের জন্য জনসাধারণের উদ্যোগেও প্রচুর লেণ বা গুহা এবং চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়। ক্রমশ বিহার নির্মাণও শুরু হয়। ভিক্ষু সম্প্রদায়ের খাদ্য ও পরিধানের সংস্থানের জন্য কখনও কখনও জমি বা সমগ্র গ্রাম দান করা হত, তাদের নতুন বস্ত্রও দেয়া হত।

বুদ্ধের পদ, স্তূপ, প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ প্রভৃতির উপাসনা : গাথাসপ্তশতীতে বুদ্ধের পদউপাসনার উল্লেখ আছেবৌদ্ধরা প্রথম দিকে স্তুপ, শূন্য সিংহাসন সহ বােধিবৃক্ষ, বুদ্ধের পাদুকা, ত্রিশূল, ধর্মচক্র এবং বুদ্ধ তার প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ পূজা করতেন কিন্তু মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভগবান বুদ্ধের মূর্তিপূজা শুরু হয়

বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায় : বৌদ্ধধর্মের কিছু কিছু বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ভিক্ষুভিক্ষুণীদের মধ্যে মতবিরােধ পরিণামে বৌদ্ধদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়সাতবাহন রাজ্যে কয়েকটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়উপসম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তা সবিশেষ লক্ষণীয়নাসিক এবং কানহেরি অঞ্চলে ভদ্রযানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়, মহাসংঘিকদের প্রভাব বৃদ্ধি পায় কার্লা সন্নিহিত অঞ্চলে, ধর্মোত্তরীয়দের সােপারায় জুন্নারে, চৈত্যকদের অমরাবতীতে এবং পূর্ব শৈল ও অপর শৈলদের নাগার্জুনীকোণ্ডাতেএদের মধ্যে ধর্মোত্তরীয় এবং ভদ্রযানীয়রা স্থবিরবাদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, অন্যান্যরা ছিলেন মহাসংঘিকদের সঙ্গে সম্পর্কিতপ্রথমােক্তরা ছিলেন রক্ষণশীল, অন্যরা সংস্কারপন্থী বা উদারবাদী কী রক্ষণশীল, কী উদারপন্থী, সকল সম্প্রদায়েরই বৌদ্ধধর্মের কয়েকটি মৌল বিষয় সম্পর্কে মনােভাব মােটামুটি একই ছিলতারা সকলেই চারটি আর্যসত্যে বিশ্বাস করতেন, অষ্টাঙ্গিক-মার্গে তারা আস্থাবান ছিলেন, তারা কর্মকে জন্মান্তরের কারণ বলে মনে করতেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় ধীরে চলার নীতি বা প্রতীত্যসমুৎপাদ প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতেনকিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে মতবিভেদ ছিলস্থবিরবাদীরা মনে করতেন, বুদ্ধ বিরলদৃষ্ট এক মহামানব, তিনি একবারই জন্মেছেন, ভবিষ্যতে আর জন্মাবেন নামহাসংঘিকদের দৃষ্টিতে বুদ্ধ লােকোত্তর, অলৌকিক, সর্ব শক্তিমান এক সত্তা, মানবসাধারণের হিতার্থে তার শাক্য গৌতমের রূপকায় ধারণ, জন্মমৃত্যুর অতীত বুদ্ধ সর্বদাই সমাধিস্থবুদ্ধত্ব অর্জনই মহাসংঘিকদের লক্ষ্য, পক্ষান্তরে অর্হৎত্ব অর্জনকে স্থবিরবাদীরা জীবনের চরম সার্থকতা বলে মনে করেনস্থবিরবাদীদের ধারণা বুদ্ধত্ব অর্জন মানুষের সাধ্যাতীতমহাসংঘিকরা বােধিসত্ত্বের রূপ কল্পনা করেছেনতারা মনে করেন বােধিসত্বের পর্যায় অতিক্রম করলেই বুদ্ধত্ব অর্জন সম্ভব হয়তাছাড়া স্তুপ চৈত্যপূজার উপযােগিতা মহাসংঘিকরাই প্রথম তানুধাবন করেন। 

মহাযান মতের উদ্ভব ও নাগার্জুন : বুদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে মহাসংঘিক সম্প্রদায়ের মনােভাবের সঙ্গে মহাযান বৌদ্ধধর্মের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। অষ্টসাহত্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার মূল গ্রন্থখানি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম শতকে রচিত হয়েছিল। গ্রন্থখানিতে দক্ষিণাপথকে মহাযান বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবস্থল বলা হয়েছে। এই উক্তি সত্য হলে সিদ্ধান্ত করতে হয় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক নাগাদ অন্ধ্র-মহারাষ্ট্র অঞ্চলে মহাযান বৌদ্ধধর্ম অঙ্কুরিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ২য় শতকে নাগার্জুনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মহাযান ধর্মমত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাতবাহনপতি যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির সমকালীন এই বৌদ্ধ আচার্য শূন্যতা তথা মাধ্যমিক দর্শনের প্রবক্তারূপে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। দক্ষিণ ভারতে জীবন শুরু করলেও পরের দিকে তিনি নালন্দায় সংঘের আচার্যপদে বৃত হন। শুয়েন চাঙের বিবরণী হতে জানা যায়, তার জীবনের শেষ দিনগুলো সাতবাহনরাজের আনুকূল্যে দক্ষিণ কোসলে অতিবাহিত হয়েছিল। মধ্যমপন্থাকে নির্দেশ করে বলে নাগার্জুনের মতবাদকে মাধ্যমিক মতবাদ বলা হয়এই মতবাদ অনুসারে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় জ্ঞান তিনই শূন্যকোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেইএই মত অনুসারে জ্ঞেয়রূপ বাহ্য বস্তু মিথ্যা ক্ষণিকযেহেতু জ্ঞেয় বস্তু বা বাহ্য জগতের কোনও অস্তিত্ব নেইসেহেতু জ্ঞাতা বলে কোনও স্থায়ী চেতনার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় নানাগার্জুন দেখিয়েছেন সব কিছুই পরিবর্তনশীল, ক্ষণস্থায়ী অনিত্য, সব কিছুই আপেক্ষিক, সব কিছুই শূন্যে পর্যবসিত

সাহিত্য, স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য

সাহিত্য 

  • কাতন্ত্র ও বৃহৎকথা : ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে সাতবাহন যুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিতএসময়কার লেখা দুখানি গ্রন্থ – কাতন্ত্র বৃহৎকথাপ্রথমখানি সংস্কৃতে লেখা, লেখক সর্ববর্মাদ্বিতীয়খানি পৈশাচী প্রাকৃতে লেখা, রচয়িতা গুণাঢ্যএই গ্রন্থ দুখানির রচনা প্রসঙ্গে সােমদেবের কথাসরিৎসাগরে এক সুন্দর কাহিনির অবতারণা আছেসর্ববর্মা গুণাঢ্য উভয়েই জনৈক সাতবাহন রাজার মন্ত্রী ছিলেনরাজা একদিন জলক্রীড়ার সময় তার পত্নীকে লক্ষ্য করে বার বার জল নিক্ষেপ করতে থাকেনবিরক্ত রাজপত্নী রাজাকে বললেন, মােদকৈঃ পরিতাড়য় মাম্‌অর্থাৎ আমাকে জল ছিটিও নামা এবং উদকৈঃ পদ দুটি যুক্ত হয়ে মােদকৈঃ হয়েছেসংস্কৃত না জানায় মােদকৈঃ সন্ধিবদ্ধ পদটির কদৰ্থ করে রাজা ভাবলেন, পত্নী বুঝি মােদক বা পিঠে চাইছেনপিঠে সংগ্রহ করে রাজা পত্নীর উদ্দেশ্যে তা ছুড়তে থাকেনস্বামীর কাণ্ডকারখানা দেখে রাজপত্নী তাকে উপহাস করেনঅপমানিত রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন সংস্কৃত শিখবেনগুণাঢ্য বললেন, তিনি ছয় বছরে রাজাকে সংস্কৃত শেখাবেনসর্ববর্মা মাত্র ছয় মাস সময় চাইলেনকাতন্ত্র রচনা করে সর্ববর্মা ছয় মাসের মধ্যেই রাজাকে সংস্কৃতজ্ঞ করে তােলেনআর নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করতে গুণাঢ্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বনে চলে গেলেনবনবাসকালেই তিনি বৃহৎকথা রচনা করেনসংস্কৃত ব্যাকরণের উপর লেখা কাতন্ত্র গ্রন্থটি আজও বঙ্গদেশে কাশ্মীরে সমাদৃতবৃহৎকথা গ্রন্থখানি বর্তমানে বিলুপ্তধনপাল, গােবর্ধন এবং সােমদেবের মতাে প্রাচীন সাহিত্যিকরা একবাক্যে বৃহৎ কথার ভূয়সী প্রশংসা করেছেনগােবর্ধন তাে গুণাঢ্যকে ব্যাস বাল্মীকির পরই স্থান দিয়েছেনসর্ববর্মা গুণাঢ্য যার মন্ত্রী সেই সাতবাহন রাজা কে তা জানা যায় না
  • গাথাসপ্তশতী : এযুগের আর একটি উল্লেখযােগ্য সাহিত্যকীর্তি গাথাসপ্তশতীগ্রন্থটি সাতশাে প্রাকৃত কবিতার সংকলন, সম্পাদনা করেছেন রাজা হালকবিতাগুলো শ্লেষ আদিরসে অভিষিক্ত। কবিতাগুলোর কয়েকটি স্বয়ং হালেরই রচনাসুভাষিতের অবিনশ্বর সংকলন বলে বাণভট্ট গাথাসপ্তশতীর অকণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। সমকালীন সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি বিম্বিত হয়েছে এই সংকলনে 
  • লীলাবতী-পরিণয় : এযুগে লেখা আর একখানি কাব্যগ্রন্থ লীলাবতীপরিণয়’হাল লীলাবতীর বিবাহ  কাব্যের উপজীব্য বিষয়প্রাকৃতে লেখা কাব্যের রচয়িতার নাম অজ্ঞাত 
  • লেখসমূহ : সাতবাহন যুগে প্রাকৃত সাহিত্যচর্চার আর একটি নিদর্শন সেযুগের লেখ। লেখাগুলো সবই প্রাকৃত ভাষায় রচিতগৌতমী বলশ্রীর নাসিক প্রশস্তি সুললিত প্রাকৃতে রচিত
  • নাগার্জুনের রচনাসমূহ : শুধু প্রাকৃত নয়, সংস্কৃত সাহিত্য চর্চাতেও এসময় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়। কাতন্ত্রের কথা পূবেই উল্লেখ করা হয়েছেসন্দেহ নেই, এযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকসাহিত্যিক নাগার্জুন। সমসাময়িক সাতবাহন নৃপতির সঙ্গে তার সম্প্রীতির কথা নাগার্জুন সুহৃল্লেখগ্রন্থে ব্যক্ত করে গেছেনবাণভট্টও নাগার্জুন সাতবাহন রাজার বন্ধুত্বের উল্লেখ করেছেনতার সবগুলো গ্ৰন্থই সংস্কৃত ভাষায় রচিতগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রজ্ঞাপারমিতাশাস্ত্র, মূলমাধ্যমিকশাস্ত্র, দ্বাদশনিকায়শাস্ত্র, শূন্যসপ্তথি এবং সুহৃল্লেখবর্তমানে মূল সংস্কৃত গ্রন্থগুলোর আর সন্ধান পাওয়া যায় না কিন্তু তাদের চিনা সংস্করণ আজও সহজলভ্য

স্থাপত্য

বৌদ্ধ স্তুপ : অমরাবতী, ভটিপ্রােলু, জগ্‌গয্যপেটা, ঘণ্টকশাল, নাগার্জুনীকোণ্ডা প্রভৃতি স্থানে যুগে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ স্তুপ নির্মিত হয়কালের প্রভাবে এদের কোনওটিই আজ আর অক্ষত নেইকয়েকটির আবার বেদিকার অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেইতবে পাথরের ফলকে স্তুপের চিত্র থেকে অঞ্চলের স্তুপগুলোর গঠনাকৃতির কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়চিত্রগুলো দেখে মনে হয় শুঙ্গযুগের মতাে এযুগেও ধূপের বেদি, অণ্ড, হমিকা ছত্রএই চারটি অঙ্গ। এখানেও অণ্ড নিঃসন্দেহে প্রধানতম অঙ্গস্তূপের চারদিকে চারটি আয়তক্ষেত্রাকার মঞ্চপ্রতিটি মঞ্চে পাঁচটি করে আর্যকস্তম্ভপ্রতি মঞ্চের দুধারে প্রদক্ষিণা পথে ওঠার সিঁড়িপ্রদক্ষিণা পথ কারুকার্যখচিত পাথরের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরাস্তূপের বেদি এবং অণ্ড অপরূপ কারুকার্যে মণ্ডিত

সাঁচীর বৃহত্তম স্তুপ : ২৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সাঁচীর বৃহত্তম স্তুপটির প্রস্তর বেষ্টনী এবং তার সুদৃশ্য চারটি তােরণ এই পর্বেই নির্মিত হয়প্রস্তর বেষ্টনীর উচ্চতা .মিটারতােরণগুলোর মধ্যে দক্ষিণেরটিই সবচেয়ে পুরােনােপ্রতি তােরণের দুদিকে দুটি চতুষ্কোণ স্তম্ভএক একটি স্তম্ভের শীর্ষদেশে তিনটি করে হাতির মূর্তিহাতিগুলোর পৃষ্ঠদেশে তােরণের উপরের অংশ স্থাপিতউপরের অংশে আছে তিনটি সমান্তরাল ফলক। শীর্ষ ফলকটির উপরে রয়েছে সিংহমূর্তি, দুটি চক্র এবং ত্রিশূল বা বজ্র

চৈত্যগৃহ : পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গা কেটে সাতবাহন যুগে বেশ কয়েকটি চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়এদের মধ্যে ভাজা, নাসিক ও কার্লার চৈত্যগৃহগুলো বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেভাজার চৈত্যগৃহটি আমলে নির্মিত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন

  • ভাজার চৈত্যগৃহ : পুণার নিকটবর্তী ভাজার চৈত্যগৃহটি যেন একটি প্রলম্বিত কক্ষভেতরের দেয়াল ঘেঁষে দুপাশে প্রদক্ষিণা পথ, মধ্যিখানে মূল অংশ আর মূল অংশের একেবারে পেছনের দিকে একটি স্তূপ নিয়েই এই চৈত্যগৃহপ্রায় মিটার উঁচু ২৭টি অষ্টকোণস্তম্ভ প্রদক্ষিণা পথকে মূল অংশ থেকে পৃথক করেছেমূল অংশের ছাদ অর্ধচন্দ্রাকার, বঙ্কিমপ্রদক্ষিণা পথের ছাদ অধিক বাঁকানােচৈত্যগুহের অভ্যন্তরে আলাে প্রবেশের জন্য তােরণে অশ্বক্ষুরাকৃতি গবাক্ষের সংযােজনাএখানে চৈত্যগৃহের নিকট একটি বিহারও নির্মিত হয়েছিল। 
  • নাসিকের চৈত্যগৃহ : নাসিকের চৈত্যগৃহটি ভাজার চৈত্যগৃহের তুলনায় অনেক সুন্দর, উন্নতচৈত্যগৃহটির সম্মুখভাগ অপরূপ কারুকার্যমণ্ডিতভেতরের অষ্টকোণস্তম্ভগুলোও আর সাদামাটা বঙ্কিম নয়, ঋজু অলংকৃতভেতরের স্তুপটির গঠনেও অভিনবত্ব লক্ষণীয়
  • কার্লার চৈত্যগৃহ : এ যুগের স্থাপত্যকীর্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কার্লার আশ্চৰ্য্যসুন্দর চৈত্যগৃহচৈত্যগৃহটি প্রায় ৩৭.৭৯ মিটার দীর্ঘ, ১৪.৩২ মিটার বিস্তৃত ১৩.৭১ মিটার উঁচুঅন্যান্য চৈত্যগৃহের মতাে এটিরও ভেতরের দেয়াল ঘেঁষে প্রদক্ষিণ পথ, মধ্যিখানে মূল অংশ আর মূল অংশের পেছনের দিকে স্তূপপ্রদক্ষিণা পথ আর মূল অংশের মাঝখানে এক এক দিকে ১৫টি করে অলংকৃত স্তম্ভ আর স্তুপের পেছনে ৭টি নিরলংকার স্তম্ভপ্রতি স্তম্ভের মাথায় চতুষ্কোণ বেদি। বেদির উপরে দুটি করে হাতি একটি করে ঘােড়াহাতির পিঠে কোনও মাহুত নেই কিন্তু ঘােড়ার পিঠে আরােহী। চৈত্যগৃহের সামনে একটি বারান্দাবারান্দার সামনে দুটি স্তম্ভের মাথায় চারটি করে সিংহমূর্তিঅপূর্ব কারুকার্যখচিত এই চৈত্যগৃহের তিনটি তােরণপাশের দুটি প্রদক্ষিণা পথের, মাঝখানেরটি মূল অংশের। 

বিহার : নাসিকে পাহাড়ের গা কেটে এযুগে কয়েকটি বিহারও নির্মিত হয়এদের মধ্যে ঋষভদত্ত বিহার গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি বিহার সবিশেষ উল্লেখযােগ্যপ্রতিটি বিহারে রয়েছে একটি করে স্তম্ভবিহীন প্রশস্ত হলঘর, তিনদিকে তিনটি ঘর আর সামনে সস্তম্ভ বারন্দাকার্লাতে পাহাড় কেটে কয়েকটি বিহার নির্মাণ করা হয়এদের কয়েকটি একাধিক তলবিশিষ্টপাহাড়কাটা বহুতল বিহার ভারতে পরবর্তিকালে খুবই জনপ্রিয় হয়বস্তুত, বহুতল বিহার নির্মাণের সূত্রপাত ঘটে এই কার্লাতেই

অজণ্টায় গুহা খোদাই : এ সময় অজণ্টায় ইন্ধ্যাদ্রি নামে এক অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের গা কেটে নবম দশম গুহা দুটি খােদিত হয়গুহা দুটির প্রতিটিতে রয়েছে এক একটি করে লম্বাটে চৈত্যকক্ষতাতে দুদিকে দুসারি স্তম্ভছাদের ভার বহনের কাজে স্তম্ভগুলোর কোনও উপযােগিতা নেইশুধু অলংকরণচৈত্যকক্ষের প্রবেশপথের উপরে একটি গবাক্ষএকে বলে সূর্য গবাক্ষনবম গুহাটির শেষ প্রান্ত অর্ধগােলাকৃতি কিন্তু দশমটির শেষ প্রান্ত চৌকোণাচৈত্যকক্ষের শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি স্তুপস্তুপের সর্বনিম্ন অংশ বর্গাকার বেদিকাএরপর ক্রমান্বয়ে অণ্ড, হমিকা, ছত্রাবলি কলশঅজণ্টায় গুহাস্থাপত্যের কাজ শুরু হয় সাতবাহন রাজাদের আমলেএকাজ সম্পূর্ণ হয় খ্রিস্টীয় ৭ম শতকেঅজণ্টা গুহাস্থাপত্যের প্রারম্ভিক পর্বরূপে সাতবাহন যুগকে চিহ্নিত করা যায়

শিল্পীদের অবিনশ্বর ভাস্কর্যকীর্তি ও অমরাবতী

ভাজা, নাসিক কার্লার চৈত্যগৃহে এবং অমরাবতী, নাগার্জুনীকোণ্ডা প্রভৃতি স্থানের স্তুপে যুগের শিল্পীরা তাদের অবিনশ্বর ভাস্কর্যকীর্তির সাক্ষ্য রেখে গেছেনভাজার চৈত্যগৃহে উৎকীর্ণ দ্বারপাল, সূর্যদেব ঐরাবতের পিঠে উপবিষ্ট ইন্দ্র এবং কার্লার চৈত্যগৃহের দম্পতিমূর্তি সুঠাম দেহগঠনে দৃপ্ত, বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে সমুজ্জ্বলতবে ভাজায় বা কার্লাতে নয়, অমরাবতীর ভাস্কর্যেই যুগের শিল্পসাধনার চরম অভিব্যক্তি ঘটেছেঈষৎ সবুজ চুণাপাথরে খােদিত অমরাবতীর ভাস্কর্যে আছে বিষয়-বৈচিত্র্য। বুদ্ধ ও জাতকের কাহিনি, পরিদৃশ্যমান প্রকৃতি ও চলমান জীবনপ্রবাহ সবই এখানে উপস্থাপিত। তবে ভারহুতের শিল্পে প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতার যে সুর অনুরণিত অমরাবতীতে তা ব্যাহত। এখানে প্রকৃতি গৌণ, মানুষই মুখ্য, পটভূমিরূপেই প্রকৃতির যা সার্থকতা। শিল্পী বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছেন সত্য কিন্তু সংযম, ব্রহ্মচর্য, ত্যাগ ও নির্বাণের মতাে বুদ্ধ প্রচারিত শাশ্বত সত্যের প্রতি তিনি উদাসীন। ধনৈশ্বর্যময়, আনন্দমুখর জীবনের তিনি জয়গান করেছেন। আধ্যাত্মিকতা নয়, ভােগবাদই মূর্ত হয়ে উঠেছে তার শিল্পকর্মে। সম্ভোগ বর্ণনায় শিল্পীর এই অত্যাসক্তির সংগত কারণ আছে বৈকি। একদিকে রােমক সাম্রাজ্য ও অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ফলে এ সময় দক্ষিণ ভারতে অভূতপুর্ব আর্থিক সমদ্ধি ঘটে। অঢেল অর্থাগমের সঙ্গে সঙ্গে বণিক ও অভিজাত মহলে জীবন সম্পর্কে নতুন ধারণা গড়ে ওঠে। এ ধারণা বিলাসব্যসনের ধারণা, ভােগৈশ্বর্যময় জীবনযাপনের ধারণা। বাণিজ্যসমৃদ্ধ নাগর সভ্যতার ছবি প্রতিফলিত হয়েছে শিল্পীর শিল্পকর্মে। বৃক্ষ, লতা, পাখি ও মানবদেহকে পাথরে রূপায়ণে শিল্পী যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। বলিষ্ঠতার সঙ্গে প্রাণশক্তি, গতিশীলতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে অমরাবতীর ভাস্কর্য অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত। উপবিষ্ট, দণ্ডায়মান, অবনত, দোদুল্যমান, নৃত্যরত, গমনশীল প্রভৃতি বিভিন্ন দেহভঙ্গি এবং উত্তেজনা, আনন্দ, অবসাদ, ক্রোধ ইত্যাদি জীবনের নানা মুহুর্ত উৎকীর্ণ নরনারীর মূর্তিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। নারীদেহের রূপায়ণে উচ্চারিত হয়েছে প্রেম, যৌবন ও সুন্দরের জয়গান। আধ্যাত্মিকতা নয়, পরিশীলিত ইন্দ্রিয়পরায়ণতার অভিব্যক্তি দেখা দিয়েছে অমরাবতীর ভাস্কর্যে। বুদ্ধের মূর্তিতেও সে আত্মনিমগ্ন ভাব নেই, পরিবর্তে আভাসিত হয়েছে পরিবেশ সচেতনতা। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের ভাস্কর্যে ধরা পড়েছে শিল্পীর রুচি ও অনুভূতির পরিপূর্ণ বিকাশ। কিন্তু পরবর্তিকালের ভাস্কর্যে সে ছন্দ ব্যাহত হয়েছে, অসংযম ও সুলতায় সে ভাস্কর্য মলিন। সাতবাহন রাজাদের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এসময় শুধু যে দক্ষিণ ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল তাই নয়, এই অঞ্চলের সমাজজীবনে, অর্থনীতিতে, ধর্মে, সাহিত্যে, স্থাপত্যে এবং ভাস্কর্যেও গঠনমুখী, সৃজনধর্মী কর্মকাণ্ডের অভিব্যক্তি দেখা দিল।

গ্রন্থপঞ্জি

শঙ্গম যুগ

  • Mahalingam, T. V. : Kancipuram In Early South Indian History (Madras, 1969),
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960).
  • Sastri, K. A. N (Ed.): A Comprehensive History of India, Vol. II, Part I (Calcutta, 1958); A History of South India (Madras, 1966). 

সাতবাহন রাজবংশ

  • রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থসামাজিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪)
  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৪)
  • Chakraborti, Haripada : Trade And Commerce Of Ancient India (Calcutta, 1966)
  • Chattopadhyaya, S. : Some Early Dynasties of South India (New Delhi, 1994)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960)
  • Narasimha Murthy, A. V. : Coins Of Karnataka (Mysore, 1975)
  • Rama Rao: The Satavahana Coins In The Andhra Pradesh Government Museum, A. PGovernment Series, No. 2 (Hyderabad, 1961)
  • Rapson, E. J.: Catalogue Of The Coins Of The Andhra Dynasty, The Western Ksatrapas, The Traikutaka Dynasty And The Bodhi Dynasty (London, 1908)
  • Raychaudhuri, H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Sarma, I. K. : Coinage Of The Satavahana Empire (Delhi, 1980)
  • Sastri, K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History of India. Vol. II (Calcutta, 1957)
  • Sastri, A. M. (Ed.): Coinage Of The Satavahanas And Coins From Excavations (Nagpur, 1972): Early History of the Deccan : Problems And Perspectives (Delhi1987).
  • Sircar, D. C. : Select Inscriptions Bearing On Indian History And Civilization(Calcutta, 1965),
  • Yazdani, G. (Ed.): The Early History Of The Deccan, Part 1 (London, 1960)

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.