Table of Contents
ভূমিকা
ভারতীয় দর্শন বলতে আমরা এমন এক আধ্যাত্মিক দর্শনের জগতকে বুঝে থাকি যেখানে প্রায় সবগুলো দর্শনই বিপুলভাবে আধ্যাত্মবাদে পরিপূর্ণ। এই সর্বগ্রাসী আধাত্মবাদের বিপরীতে কেবল একটি মাত্র দর্শন যে তার বস্তুতান্ত্রিক জড়বাদী ধারায় একক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্র ধরে সেই প্রাচীনকাল থেকেই নিজের অবস্থানটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে তা হলো চার্বাক দর্শন (carvaka philosophy)।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির প্লাবনে ভেজা মাটিতে পাশাপাশি দাঁড়ানো এই মতবাদের বহমান অক্ষুণ্নতা স্বমহিমায় এতোটাই উজ্জ্বল যে, ভারতীয় দার্শনিকরা তাদের নিজ নিজ মতবাদকে সাজাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সম্ভাব্য আপত্তি অনুমান করে আগেভাগেই যুক্তি তর্কের সাহায্যে সেই আপত্তি খণ্ডনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। দু’পক্ষের দ্বন্দ্বময় যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির যুযুধান স্রোতের বিপুল আয়োজনে ভারতীয় দর্শনের জগতটা তড়তড় করে এক সমৃদ্ধ অবস্থানে এগিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে চার্বাক পক্ষের নিজেদের অবস্থানের জায়গাটা ঢাকা পড়ে গেছে এক রহস্যজনক অন্ধকারে। চার্বাকদের নিজস্ব রচনা সম্ভারগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিলুপ্ত এখন। তা কি যথোচিত সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, না কি ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষের দুরভিসন্ধিমূলক অভিপ্রায়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে আমাদের জানার উপায় নেই। তবে বস্তুতই এ মতবাদ যে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখে তা অপরপক্ষের সমরায়োজনের প্রস্তুতি থেকেই আমাদেরকে অনুমান করতে হয়। এই বিরুদ্ধপক্ষ কর্তৃক চার্বাক মতবাদকে ঠেকানো ও খণ্ডনের বিচিত্র প্রয়াস হিসেবে সেই দ্বন্দ্বপ্রসূত বিরোধী রচনাগুলোই চার্বাক মতবাদ জানার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য মহামূল্যবান উৎস হয়ে আছে আজো।
বিরুদ্ধপক্ষের নিজেদের অনুকুল দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপস্থাপিত দর্শন-তত্ত্ব ও সাহিত্যে প্রতিপক্ষের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ও মূলানুগ মতবাদ জানার প্রচেষ্টা কতোটা সন্দেহমুক্ত ও নির্ভরযোগ্য হবে তার আশঙ্কা প্রশ্নাতীত নয় যদিও, কিন্তু চার্বাকদের নিজস্ব সৃষ্টিসম্ভারের একান্তই অনুপস্থিতিতে এ ছাড়া আমাদের উপায়ও নেই। তাদের দর্শনসম্বন্ধীয় ধারণার জন্য অন্যের রচনার উপর এই নির্ভরতার কারণেই হয়তো চার্বাক মতের সুপ্রাচীন শক্তিটা অবিকৃতভাবে আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে না কখনোই। তবে যুক্তিশীল কল্পনা অবারিত করলে তা অনুমান করা মোটেও দুঃসাধ্য হবে না বলে বিশ্বাস। এই অনুমান যথাযথ করার নিমিত্তে ভারতীয় দর্শনের প্রাথমিক পরিচিতি ও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য জেনে রাখা আবশ্যক।
ভারতীয় দর্শন-সূত্র
দর্শনের সংজ্ঞা ও ফিলোসফি ও দর্শনের ব্যুৎপত্তিগত পার্থক্য
যদিও ‘Philosophy’ শব্দটিই ভারতবর্ষে দর্শন নামে পরিচিত, তবু এই Philosophy এবং দর্শন- শব্দ দুটি ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে সমার্থবোধক নয় এবং এদের উৎসও এক নয়। Philosophy শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হলো জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ (Love of wisdom), আর ভারতীয় দর্শনের বিষয় বা উদ্দেশ্য হলো সত্য বা তত্ত্বোপলব্ধি। ‘দর্শন’ কথাটার সাধারণ অর্থ হলো দেখা বা প্রত্যক্ষ করা। কিন্তু যে-কোন প্রকার দেখাকেই ‘দর্শন’ নামে অভিহিত করা যায় না। ভারতীয় মতে ‘দর্শন’ বলতে বোঝায় আত্মদর্শন, অর্থাৎ আত্মাকে দেখা বা জানা। এর অর্থ আত্মাকে উপলব্ধি করা। অতএব, দর্শন হলো সত্য বা তত্ত্বকে দেখা এবং তার স্বরূপ উপলব্ধি করা অর্থাৎ সত্যের সাক্ষাৎ উপলব্ধি। আর যিনি সত্য বা তত্ত্বকে জীবনে উপলব্ধি করেছেন তিনিই সত্যদ্রষ্টা বা তত্ত্বজ্ঞানী দার্শনিক। এই হলো ভারতীয় দর্শনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
যদিও জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা শুধুমাত্র দর্শনেরই আলোচ্য বিষয় নয়, মানব-সভ্যতার বিভিন্ন স্তরে বিজ্ঞান জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সঙ্গে দার্শনিক ব্যাখ্যার একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানশাস্ত্র কোন এক বিশেষ শ্রেণীর জাগতিক ঘটনার বা ঘটনাসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দর্শনের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর। দর্শনের জিজ্ঞাসা হলো হলো মানুষের স্বরূপের জিজ্ঞাসা, মানব জীবনের পরম লক্ষ্যের জিজ্ঞাসা, জগৎ-সৃষ্টির আদি রহস্যের জিজ্ঞাসা। মানুষ দেহ-ইন্দ্রিয়াদির সমষ্টিমাত্র কিনা কিংবা দৃশ্যমান জগৎ যথার্থই সত্য কিনা, দর্শন সে প্রশ্ন তুলেছে। যেহেতু মানুষ নিজেই তার নিজের সৃষ্টি-রহস্যের ব্যাখ্যা চেয়েছে, ফলে মানুষের ক্রিয়ার সঙ্গে সচেতনতা ও মননশীলতা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাই সে নিজেকেই প্রশ্ন করে- ‘আমি কে?’ এই ‘আমি’র জিজ্ঞাসা বিজ্ঞানের মধ্যে পাওয়ার কথা নয়। চার্বাক ছাড়া অন্যান্য দর্শন এই জিজ্ঞাসার নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে পরিদৃশ্যমান দেহ, ইন্দ্রিয় ও জাগতিক বস্তুর উর্ধ্বে অতীন্দ্রিয় কোন পরম সত্তার উপলব্ধির কথা ঘোষণা করেছে। এই উপলব্ধি কেবলই অলৌকিকতার ব্যাপার নয়, এই উপলব্ধি সাধনালব্ধ হলেও তা বিচার ও মনননির্ভর।
ভারতীয় মুনি-ঋষিরা জগৎ ও জীবনের যে সত্যকে তাদের কথিত সাধনায় উপলব্ধি করেছেন তাকে তারা সেভাবেই ব্যক্ত করেছেন বলে মনে করা হয়। মুনি-ঋষিদের এই তথাকথিত সাধনালব্ধ উপলব্ধির উপর নির্ভর করে সৃষ্ট হয়েছে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়। বলা হয়ে থাকে, এ সকল সম্প্রদায় একই পরম সত্যের বিভিন্ন দিক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভাসিত করেছেন। তাই ভারতীয় দর্শন হলো জগৎ ও জীবনের পরম ও চরম উপলব্ধি। তবে সত্য উপলব্ধির দার্শনিক প্রপঞ্চে ভারতীয় দর্শন-চিন্তার ক্রমবিকাশে প্রধানত দুটি পরস্পর বিপরীত ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি হলো আস্তিক ধারা, অন্যটি নাস্তিকপন্থি। বর্তমান প্রচলিত অর্থে যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাদেরকে আস্তিক এবং যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না তাদেরকে নাস্তিক বলা হলেও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে আস্তিক ও নাস্তিক শব্দদুটি বর্তমান অর্থে নয়, বরং এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
আস্তিক্য বনাম নাস্তিক্য
- পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ (৬০০-৪০০ খ্রি.পূ.) : আস্তিক ও নাস্তিক প্রসঙ্গে এক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’র সংশ্লিষ্ট ব্যাকরণসূত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। পাণিনির প্রাচীনত্ব নিয়ে দ্বিমত না-থাকলেও তার আনুমানিক সময়কাল ধরা হয় খ্রীস্টপূর্ব ৬০০-৪০০ এর মধ্যে। পাণিনি তার ব্যাকরণসূত্রে ‘অস্তি নাস্তি দ্বিষ্টং মতিঃ’-এর মাধ্যমে দুটি বিপরীত মত-গোষ্ঠির উদ্ধৃতি টেনেছেন। এই সূত্রানুসারে ‘দ্বিষ্টং পরলোকো অস্তি’ অর্থাৎ পরলোক আছে এরূপ বুদ্ধি বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আস্তিক এবং ‘দ্বিষ্টং পরলোকো নাস্তি’ অর্থাৎ পরলোক নাই এরূপ বুদ্ধি বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নাস্তিক বলা হয়েছে।
- পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ (১৫০ খ্রি.পূ.) : পাণিনি সূত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ব্যাকরণকার পতঞ্জলি (অন্যুন খ্রীস্টপূর্ব ১৫০) তার ‘মহাভাষ্য’ গ্রন্থে ‘আস্তিক’ ও ‘নাস্তিক’ শব্দের সংজ্ঞা সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করেছেন। পতঞ্জলির মতে ‘অস্তি’ বা ‘আছে’ এই ধারণার বশবর্তী লোকেরা আস্তিক এবং এর বিপরীত ‘ন অস্তি’ এই ধারণায় প্রভাবিত লোকেরা নাস্তিক পদের দ্বারা অভিধেয় (মহাভাষ্য ৪/৪/১)। অর্থাৎ আস্তিকেরা যে বিশেষ বস্তু বা ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করেন, সেগুলিকে স্বীকৃতি না-দেয়ার জন্য নাস্তিকেরা স্বতন্ত্র এক গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
- মহাভারত (খ্রি.পূ. ৪র্থ শতক – খ্রি. ৪র্থ শতক) : পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্যে’ এসবের বিস্তৃত বিবরণ না থাকলেও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে নাস্তিক শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আরো কিছু আভাস পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে মহাভারত থেকে উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মহাভারতের বিভিন্ন স্থানে (১২/১২/৫, ১২/২৬৯/৬৭, ১২/২৭০/৬৭) নাস্তিকদের দ্বারা অস্বীকৃত বিভিন্ন ধারণার সঙ্গে বৈদিক সমর্থনকে যুক্ত করার প্রয়াস দেখা যায়। যেমন-
- “সম্ভব হলেও যারা কর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস অবলম্বন করে, আপনি তাদেরকে বেদবাক্য পরিত্যাগী অত্যন্ত নাস্তিক বলে অবগত হোন।” (মহাভারত : ১২/১২/৫)
- “ভরতনন্দন, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সমস্ত কর্মের মধ্যে বেদোক্ত কর্ম পরিত্যাগ করে দেবযানে স্বর্গে যেতে পারেন না। বিশেষত বেদবিশ্বাসী লোকেরা এই গৃহস্থাশ্রমকে সমস্ত আশ্রমের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে থাকেন।” (মহাভারত : ১২/১২/৬)
- “নরনাথ, যে সব ব্রাহ্মণ বেদজ্ঞানসম্পন্ন, আপনি তাদেরকে জেনে রাখুন। যারা ন্যায়ার্জিত ধর্ম উত্তম যজ্ঞে বিতরণ করেছেন, তারাই বেদজ্ঞঅন-সম্পন্ন।” (মহাভারত :১২/১২/৭)। এবং “বেদের উপরে অবজ্ঞা করা এক প্রকার নাস্তিকতা।” (মহাভারত : ১২/২৬৯/৬৭) ইত্যাদি।
- মনুস্মৃতি (২০০ খ্রি.পূ. – ২০০ খ্রি.) : এছাড়া প্রাচীন গ্রন্থ মনুস্মৃতিও প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।
- সেখানে স্পষ্ট দেখা যায়, মনুর মতে বেদনিন্দুকেরাই ‘নাস্তিক’ আখ্যায় অভিহিত হওয়ার যোগ্য – “যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ-তর্ককে অবলম্বন ক’রে ধর্মের মূলস্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতির) প্রাধান্য অস্বীকার করে (বা অনাদর করে), সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে- তাকে সকল কর্তব্য কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা (অর্থাৎ অপাংক্তেয় ক’রে রাখা)। কারণ, সেই ব্যক্তি বেদের নিন্দাকারী, অতএব নাস্তিক।” (মনুসংহিতা)
- বেদবিরোধী নাস্তিকদের কার্যকলাপে বৈদিক ঐতিহ্যের ধারক বাহক মনুর সমর্থন না থাকাই যে স্বাভাবিক তা মনুসংহিতার বিভিন্ন স্থানে নাস্তিকদের নির্দ্বিধ নিন্দা করার মধ্যেই পরিস্ফুট হয়। যেমন- “যে রাজা শাস্ত্রবিধি ও শিষ্টাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মব্যবস্থা রক্ষা করেন না, কিন্তু নাস্তিক এবং অযথা অন্যায় অর্থদণ্ডাদির দ্বারা যিনি প্রজাবর্গের ধন হরণ করেন, যিনি প্রজাগণকে রক্ষা করেন না, অথচ যিনি সেই প্রজাদের দ্রব্য সমূহের অত্তা অর্থাৎ ভোগকারী, এইরকম রাজা নরকে পতিত হয়েছেন বলে বুঝতে হবে।” (মনুসংহিতা – ৮/৩০৯)।
- উল্লেখ্য, মনুসংহিতার টীকাকার মেধাতিথি উপরিউক্ত শ্লোকে উল্লিখিত ‘নাস্তিক’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – ‘পরলোক বলে কিছু নেই, যাগ-দান-হোম এগুলিও কিছু নয়- এইরকম কথা যিনি বলেন এবং এই বিশ্বাসে যিনি চলেন তিনি নাস্তিক।’ (মনুসংহিতা)
অতএব, দেখা যাচ্ছে, বৈদিক ঐতিহ্যের প্রভাবপুষ্ট সকলের কাছে ‘নাস্তিক’ সংজ্ঞাটি আসলে বৈদিক প্রাধান্যের বিরোধীদের অর্থেই ব্যবহার্য। ভারতীয় দর্শনগুলিকে ‘আস্তিক’ ও ‘নাস্তিক’ এই দুটি সুনির্দিষ্ট বিভাগে চিহ্নিত করার মূলেও রয়েছে এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রেরণা। অর্থাৎ যারা বেদের সিদ্ধান্ত প্রমাণরূপে গ্রহণ করেন তাদেরকে আস্তিক এবং যারা বেদের সিদ্ধান্তকে অভ্রান্তরূপে গ্রহণ করেন না তাদেরকে নাস্তিক সম্প্রদায় বলা হয়। তাই বৌদ্ধ ও জৈনগণ পরলোক স্বীকার করলেও বেদনিন্দা করে নাস্তিক আখ্যায় অভিহিত হয়েছে। আর চার্বাকরা বেদ ও পরলোক উভয়ই অস্বীকার করে একেবারে নাস্তিক শিরোমণি আখ্যায় ভূষিত হয়েছে। তাই হয়তো মাধবাচার্য্য (১৪শ শতক) তার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেন- ‘নাস্তিকশিরোমণিনা চার্বাকেণ’। অপরদিকে বেদ এবং উপনিষদানুসারী ষড়দর্শন যথা- সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত হলো সম্পূর্ণই বেদবিহিত আস্তিক দর্শন।
আবার ৮ম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী তার ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে ‘আস্তিকবাদিনাম্’ বা আস্তিকবাদ হিসেবে যখন বৌদ্ধ ও জৈন মতের উল্লেখ করেন, তখন এটাই প্রতীয়মান হয় যে আস্তিক সংজ্ঞাটা এখানে পরিবর্তিত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে টীকাকার সোমতিলক সূরীর মতে উক্ত গ্রন্থের অন্তর্গত এই ‘আস্তিকবাদিনাম্’ পদটির অর্থ হচ্ছে – ‘পরলোকগতিপুণ্যপাপাস্তিক্যবাদিনাম্’, অর্থাৎ আস্তিকবাদী বলতে তাদেরকেই বোঝায় যাদের পরলোক, পুণ্য, পাপ ইত্যাদিতে আস্থা আছে। হরিভদ্র সূরীর এই পরিবর্তিত অর্থেও দেখা যাচ্ছে চার্বাকরা নাস্তিকগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একইভাবে ৮ম শতকেরই বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থে পরলোকের অস্তিত্ব অস্বীকার করার কারণে লোকায়ত মতকে ‘পরানাস্তিকতা’ আখ্যায় অভিহিত করা হয়েছে। এখানে চার্বাক মতেরই অন্যতম প্রাচীন নাম লোকায়ত দর্শন।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, প্রাচীন ভারতীয় দর্শন জগতের অপরাপর সবগুলো দর্শনেই চার্বাক মতকে যার যার মতো করে নিজেদের বিপরীত অবস্থানে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও বেদের প্রাধান্যকে স্বীকার না করার জন্য ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির সমর্থকগোষ্ঠি জৈন ও বৌদ্ধ মতকে আস্তিক্যের মর্যাদা দিতে চাননি, তবু ভারতের ঐতিহ্যগত সাধারণ মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের সাপেক্ষে বৌদ্ধ ও জৈনরা যে স্বাভাবিকভাবে নাস্তিক্য প্রভাবের বাইরে, তারই ইঙ্গিত হয়তো এটা। তা থেকে একটা বিষয়ে একমত হওয়া যায় যে, ‘নাস্তিক’ সংজ্ঞার মধ্যে প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের ইঙ্গিতই লুকিয়ে আছে। আর এই বিদ্রোহী মনোভাবের মূর্ত প্রতীক আসলে চার্বাকই। কেননা এই নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গিটাকে যদি জড়বাদী ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলেই এ পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে যায় আমাদের কাছে। প্রাচীন ভারতীয় অপরাপর সমস্ত ভাববাদী দর্শনের বিপরীতে একমাত্র জড়বাদী দর্শনই হলো চার্বাক দর্শন। মূলত এজন্যেই মাধবাচার্য তার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকদেরকে ‘নাস্তিকশিরোমণি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
চার্বাক দর্শনের মূল কথাগুলো হচ্ছে- প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ; পৃথিবী (মাটি), জল, তেজ (আগুন) ও বায়ু- এই চারটি হচ্ছে তত্ত্ব; অর্থ ও কাম- দু’টি পুরুষার্থ; জীবনে ভোগ ত্যাজ্য নয় গ্রাহ্য। ভূতচতুষ্টয় হতে চৈতন্যের উৎপত্তি, পুনর্জন্ম বা পরলোক নেই, মৃত্যুই মোক্ষ। ভূতচতুষ্টয়ের মিলনে উৎপন্ন চৈতন্যবিশিষ্ট এই দেহ হতে বিচ্ছিন্ন পৃথক জীব নেই; ঈশ্বর বা আত্মা বলেও কিছু নেই। অগ্নিহোত্র, ত্রয়ী বেদ, ত্রিদণ্ড ও ভস্মগুণ্ঠন হচ্ছে প্রজ্ঞাপৌরুষহীন ব্যক্তিগণের জীবিকামাত্র। ত্রয়ী ধূর্তগণের প্রলাপ ও বেদের বিধানের মধ্যে কোন তফাৎ নেই, উভয়ই বঞ্চনামূলক ও মিথ্যা। দণ্ডনীতিই একমাত্র বিদ্যা, বার্তা (কৃষি ইত্যাদি অর্থনীতিসংক্রান্ত বিদ্যা) দণ্ডনীতির অন্তর্ভুক্ত। সত্যান্বেষণে প্রয়োজন অনুভব ও বুদ্ধিকে পথপ্রদর্শক করা, ইত্যাদি।
চার্বাকমতের প্রাক-পটভূমি
ভারতীয় দর্শনের বিকাশ ও বস্তুবাদী পটভূমি
চার্বাক-দর্শন ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন এবং একমাত্র বস্তুবাদী বা জড়বাদী দর্শন। কিন্তু বস্তুবাদের একমাত্র প্রতিনিধি হয়েও ভারতবর্ষের দর্শনসভায় চার্বাক সিদ্ধান্ত ‘বস্তুবাদী’ আখ্যার পরিবর্তে ‘নাস্তিক’ সংজ্ঞার মাধ্যমেই অধিকতর পরিচিত। এতেই বোঝা যায় যে, মূলধারার সবগুলি দর্শনের রোষানলের মধ্যে থেকেই চার্বাকদেরকে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, চার্বাকদের নীতি প্রধানত নেতিবাচক। ভারতীয় দর্শননীতির বিধানসভায় এরা অবতীর্ণ হয়েছেন বিরোধীপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার ‘Lokayata’ (লোকায়ত) গ্রন্থে বলেন– ‘they have a few doctrines to defend but a lot to assail.’ বস্তুবাদী মতকে সাধারণভাবে আশ্রয় করলেও চার্বাকপন্থীরা বস্তুবাদের খুঁটিনাটিকে তাদের উপজীব্য করেননি। তাদের মতে, ভারতীয় ঐতিহ্যের যে মূল ধারা ভারতের অধ্যাত্মচিন্তার বিভিন্ন খাতে প্রবহমান, তার অগ্রগতির পথে প্রতিপক্ষরূপে দাঁড়াতেই এরা নানাভাবে সচেষ্ট হয়েছেন। চার্বাক দর্শনের যে অংশ আমাদের জ্ঞানের গোচরীভূত তার মধ্যে এই প্রচেষ্টারই সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখা যায়। তাই চার্বাক-মত সম্বন্ধে ধারণার প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের দর্শনচিন্তার মূলগত ভাবধারা সম্পর্কেও সাধারণ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা এই ভাবধারার বিরোধিতার মধ্য দিয়েই চার্বাকীয় চিন্তার অগ্রগতি বলে মনে করা হয়। এবং চার্বাকেতর ভারতের অন্যান্য দার্শনিক-গোষ্ঠি সেই সাধারণ ভাবের দ্বারাই অনুপ্রাণিত। আর ভারতীয় দর্শনচিন্তার মূলগত ভাব সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের যেতে হবে এর উৎসমুখে – উপনিষদীয় বৈদিক চিন্তাধারার মধ্যে। তবে চার্বাকরা কেন ওই অধ্যাত্ম-ভাবধারার বিপক্ষে এমন বস্তুবাদী লোকায়তিক অবস্থান নিয়েছিলেন তার সামাজিক তাৎপর্যটা অনুধাবন করা না গেলে এই দর্শনের মূল-স্পন্দনটাই আলোচনার বাইরে থেকে যাবে।
চার্বাকমতের প্রাক্-পটভূমি
চার্বাক দর্শনের আরেকটি প্রসিদ্ধ নাম হলো লোকায়ত দর্শন। এই নামকরণের পিছনে নিশ্চয়ই কোন সুগভীর সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। দার্শনিক তাৎপর্যের দিক থেকে এই দর্শনকে বলা হয় ভূতচৈতন্যবাদ, কখনো কখনো দেহাত্মবাদও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই নাম দুটির পিছনে যে সে যুগের এক বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। বিরোধীপক্ষের দেয়া লোকায়ত নামের তাৎপর্যের মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে এই দর্শনটির অন্তর্গত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়টি। একথা স্বীকার করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সামাজিক বিন্যাসে বস্তুত উচ্চবর্ণের শ্রেণীস্বার্থকে আঘাত করেছিলো বলেই ‘লোকায়ত’ নামটির কিছু কুৎসিত অপব্যাখ্যা অনেকদিন ধরে প্রচলিত। বলা হয়ে থাকে, চার্বাক দর্শন হলো – “যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।/ ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।” (চার্বাক-ষষ্ঠি), অর্থাৎ, “যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?” তার মানে – ‘খাও দাও ফুর্তি করো, জীবের জীবন আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না’ – এজাতীয় স্থূল ভোগবিলাসবাদী জান্তব দর্শনই চার্বাক দর্শন। তাই সংসার-ভোগাসক্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে এ দর্শন সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এজন্যেই এর নাম হলো ‘লোকায়ত’ দর্শন।
এই ভিত্তিতে ‘বিষ্ণুপুরাণ’-এ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে মায়ামোহের কাহিনীরও সৃষ্টি করা হয়েছে তা আর কিছুই নয় – “অসুররা বৈদিক ধর্মানুসারে কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলো। দেবতারা প্রমাদ গুনলেন। তাহলে অসুররাই স্বর্গ ভোগ করবে। আমাদের কী উপায় হবে? তাই দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু বললেন, ভয় নেই। আমি ব্যবস্থা করছি। বিষ্ণু তার শরীর থেকে মায়ামোহ সৃষ্টি করলেন। বললেন, হে মায়ামোহ! তুমি অসুরদের প্রলুব্ধ করো যাতে তারা বৈদিক ধর্মানুসারী তপস্যার পথ পরিত্যাগ করে ঐহিক ভোগসুখে মত্ত হয়ে পড়ে। মায়ামোহ তপস্যারত অসুরদের কাছে বেদ-বিরোধী পরলোক-বিরোধী ঐহিকভোগবিলাসবাদী বিপরীত দর্শনের মর্ম ব্যাখ্যা করলো। অসুররা মায়ামোহের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে তপস্যার পথ পরিত্যাগ করে ভোগবিলাসের পিছনে ছুটলো। তাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটলো। তখন দেবতারা অনায়াসে অসুরদের পরাস্ত করলেন। তাদের স্বর্গরাজ্য নিষ্কণ্টক হলো। (বিষ্ণুপুরাণ, অংশ-৩, অধ্যায়-১৭-১৮)। আর অধিকতর প্রচলিত কাহিনীটি হলো– স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরদের নৈতিক অধঃপতন ঘটিয়ে দুর্বল করার জন্য ভোগবাদী দর্শন সৃষ্টি করে শিষ্য চার্বাকের মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন। সাংসারিক সুখভোগকামী অজ্ঞ সাধারণ মানুষ এতে নিজের কামনা-বাসনা-লালসা চরিতার্থ করার পিছনে দার্শনিক যুক্তির সমর্থন পাওয়ায় সহজেই এই দর্শন গ্রহণ করে। তাই এর নাম হলো ‘লোকায়ত’ দর্শন।
কিন্তু এসব তো পৌরাণিক কাহিনী-কথা। তার বাইরে চার্বাক-দর্শনের সুদূরপ্রসারী সামজিক তাৎপর্যের চমৎকার দার্শনিক ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় জৈন-দার্শনিক মণিভদ্রসূরির রচনায়। প্রসিদ্ধ জৈন-দার্শনিক হরিভদ্রসূরি’র বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’-এ যেসব আলোচ্য দার্শনিক প্রস্থান ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে সেগুলি হলো– বৌদ্ধ, ন্যায়, সাংখ্য, জৈন, বৈশেষিক, জৈমিনীয় অর্থাৎ মীমাংসা। কিন্তু সবশেষে চার্বাকদর্শনও রয়েছে সংক্ষিপ্তাকারে। তাতে দর্শনের প্রস্থান সংখ্যা দাঁড়ায় আসলে সাতটি। তাই তার গ্রন্থের নাম হিসেবে ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ নামটি কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিকর বটে। হয়তো হরিভদ্রসূরি চার্বাকদর্শনের ওপর খুব একটা গুরুত্ব দিতে চানটি বলে শেষে পরিশিষ্টাকারে সামান্য কিছু বলেছেন। কিন্তু এই গ্রন্থের টীকাকার মণিভদ্রসূরি চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্য বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে এই দর্শনের যথেষ্ট গুরুত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলো – হরিভদ্রসূরি (৬০০ খ্রিস্টাব্দ) তার গ্রন্থের কোথাও বেদান্তদর্শনের নামমাত্র উল্লেখ করেননি। তবে কি তিনি বেদান্তদর্শনকে দর্শন বলেই গ্রাহ্য করেননি! হয়তো তিনি শঙ্করাচার্যের (৮০০ খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তী হলে অদ্বৈতবাদকে নিশ্চয়ই আমল দিতেন। সে যাক, মণিভদ্রসূরির ব্যাখ্যার উল্লেখযোগ্য বক্তব্যটুকু হলো – “যারা অস্পৃষ্ট, অনাস্বাদিত, অনাঘ্রাত, অশ্রুত, অদৃষ্ট, স্বর্গমোক্ষপ্রভৃতি সুখপিপাসায় চিত্ত সমর্পণ করে, দুঃসাধ্য তপস্যাদি জনিত ক্লেশ স্বীকার করে জীবন ক্ষয় করে তাদের এ ধরনের জীবনযাপন হল মহামূর্খতার দুঃসাহস মাত্র। আরো একটা কথা– কী আছে কী নেই প্রত্যক্ষকেই তার একমাত্র নিরিখ বলে মেনে নিলে জগৎটাকে আর অস্বীকার করা যায় না (তাহলে জগতের অন্তর্গত আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ সমাজব্যবস্থাকেও বাস্তব বলে স্বীকার করতে হয়)। তখন বঞ্চিত দরিদ্রও মনে করবে– দেশের স্বর্ণভাণ্ডারে আমারও অধিকার আছে। (এ অধিকার কায়েম করে) তখন সেও অনায়াসে নিজের দারিদ্র্যকে পদদলিত করবে। দাসও মনে প্রাণে স্বাধীনতা অবলম্বন করে দাসত্ব করতে অস্বীকার করবে। কেউ আর নিজের অনভিপ্রেত জীবনযাত্রার দৈন্য মেনে নেবে না। এভাবে সমাজে সেব্য-সেবক সম্বন্ধ বা ধনি-দরিদ্র সম্বন্ধ সম্বলিত শ্রেণীভেদ আর থাকবে না। তখন সংসারের বর্তমান সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত হবে। তাই প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ এই হল চার্বাকের সুস্থির সিদ্ধান্ত।… তাই ধর্মের ভেকধারী পরবঞ্চনাপ্রবণ ধূর্তের দল অনুমান, শাস্ত্রবাক্য প্রভৃতিকে প্রমাণ বলে প্রচার করছে; এসব প্রমাণের দ্বারা পাপপুণ্য, স্বর্গনরক প্রভৃতি অলীক কল্পনাকে সত্য বলে নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে; মূঢ় বিভ্রান্ত ইতর জনসাধারণের মধ্যে ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছে।” (ষড়দর্শনসমুচ্চয়-এর মণিভদ্র কৃত টীকা ৮১ শ্লোক, হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় কৃত তর্জমা, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৪)। এর সারমর্ম হলো – চার্বাক প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। কিন্তু কেন? কারণ, একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলে মেনে নিলে প্রত্যক্ষের অযোগ্য পরলোক, জন্মান্তর, অবিনশ্বর আত্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল ও অদৃষ্টজনিত ইহলোকের দুঃখভোগ, পুণ্যকর্মের দ্বারা বা ঈশ্বরোপাসনার দ্বারা স্বর্গলাভ বা মুক্তি – এ সমস্ত অন্ধ মূঢ় বিশ্বাস আর দুঃখ লাঞ্ছনার জন্য উচ্চবর্ণের কূটবুদ্ধি ও শ্রেণীস্বার্থকলুষিত ধর্মীয় সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করবে। তারা মানুষের বাঁচার অধিকারের দাবিতে বিদ্রোহ করবে। এই হলো চার্বাককর্তৃক প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণরূপে স্বীকার করার সামাজিক তাৎপর্য।
চার্বাকদর্শনের এই সুগভীর সামাজিক তাৎপর্য মনে রাখলে ‘লোকায়ত’ কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে কষ্ট হবে না। তবে প্রসঙ্গত এটা মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই যে, জৈন দার্শনিকরা বুঝি চার্বাকের প্রতি প্রসন্নই ছিলেন। সেব্য-সেবক ধনী-দরিদ্র ভেদশূন্য সমাজব্যবস্থার প্রতি তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ বা সহানুভূতি ছিলো এরকম কোন বিশেষ নজির পাওয়া যায় না। বরং ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ের পরবর্তী শ্লোক ও তার টীকা থেকে শুরু করে গ্রন্থের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত কদর্থিত চার্বাকদর্শনের বিকৃত প্রচলিত ব্যাখ্যারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে– আত্মা নেই, পরলোক নেই, জন্ম-জন্মান্তর নেই, জীবের জীবন এ জন্মেই শুরু এবং মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হবে, আর ফিরে আসবে না। অতএব পিবত-খাদত-মোদত– অর্থাৎ সবাই মিলে পান করো, খাও দাও ফুর্তি করো– এই হলো চার্বাকদর্শনের শেষ কথা। উল্লেখ্য, এ-প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জৈনধর্মে বা জৈনদর্শনে যদিও ঈশ্বর বা বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করা হয়নি, কিন্তু পারলৌকিক মুক্তি স্বীকার করা হয়েছে। সাধনার দ্বারা জন্ম-জন্মান্তরের কর্মফল বন্ধন ছিন্ন হলে কর্মক্লেশ-ভারহীন আত্মা শেষ জন্মের পর নিতান্ত হাল্কা হয়ে মহাশূন্যে অন্তহীন উর্ধ্বে পাড়ি জমাবে। কোথায় পৌঁছাবে কেউ জানে না। এর নামই মুক্তি। হয়তো চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবন করে জৈন দার্শনিকরাও বিব্রত ছিলেন।
চার্বাকদের দুর্নাম হলো চার্বাক বেদদ্রোহী, অতএব সমাজদ্রোহী, অতএব সনাতন বৈদিক সমাজের ক্ষমার অযোগ্য বিদ্রোহী দার্শনিক। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো, চার্বাক বেদের কোন অংশকে প্রধানত আক্রমণ করেছেন? তারা ‘আক্রমণ করেছেন বেদের কর্মকাণ্ডকে যেখানে বিপুল আড়ম্বরপূর্ণ সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া-কণ্টকিত যজ্ঞগুলির বিস্তৃত বর্ণনা করা হয়েছে। এই যজ্ঞগুলির পৌরোহিত্যের ভার দেওয়া হয়েছে ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা দ্বারা সুরক্ষিত এবং ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ধনরাশির দ্বারা পরিপুষ্ট দক্ষিণার দাক্ষিণ্যে নিরাশঙ্ক নিরাপদ ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের ওপর। অসাধারণ সাহিত্যিক উৎকর্ষে সমুজ্জ্বল, উদার ভাবৈশ্বর্যে সমৃদ্ধ ঋক্-সংহিতা ও অন্যান্য সংহিতার মন্ত্রগুলিকে চার্বাক আক্রমণ করেননি। বৈদিক যাগযজ্ঞের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়েছে মূলত এবং প্রধানত যজুর্বেদ-এর তৈত্তিরীয় সংহিতায়।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৫)। যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞে বলিদানের জন্য আনীত অশ্বকে করুণাময় বৈদিক ঋষি সান্ত্বনাবাক্য শোনাচ্ছেন – “হে অশ্ব, তুমি এই ভেবে দুঃখ করো না যে বলিপ্রদত্ত তুমি সত্যিই মরে যাচ্ছো বা লোকে তোমাকে হিংসা করছে। তুমি অতি সহজ ও উত্তম পথে সুকৃত ব্যক্তিদের কাম্য দেবতাদের নিকট স্বর্গলোকে চলে যাবে। এমনকি তুমি স্বর্গে ইন্দ্রত্ব প্রাপ্ত হবে। ইন্দ্রের হরিনামক অশ্বদ্বয় এবং মরুৎগণের পৃষতীনামক বলবান ঘোড়া তোমার রথ টেনে নিয়ে যাবে। এই হীন জান্তব জীবনে তুমি ভারবাহী গর্দভের মতো প্রভুর ভার পৃষ্ঠে বহন করে চলেছো। কিন্তু স্বর্গে বলশালী স্বর্গীয় অশ্ব তোমাকে বহন করে চলবে। (কৃষ্ণযজুর্বেদ-৪/৬/৯/১০, শুক্লযজুর্বেদ-২৫/৪৪, ঋগ্বেদ-১/১৬২/২০, বাজসনেয়ী বা শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতা-২৩/১৬, সায়ণ ও মহীধর ভাষ্য)। এই বিচিত্র আর্যদৃষ্টির মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে না পেরেই চার্বাকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, আহা, অত সহজেই যদি স্বর্গে যাওয়া যায় তবে আর অবোধ পশুটাকে বলি দিচ্ছেন কেন? পশুর বদলে ঋষিবর নিজের বৃদ্ধ পিতাকেই কেন এই সহজ পথে স্বর্গে পাঠাবেন না? “জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে নিহত পশুর যদি স্বর্গলাভ হয়, তবে যজ্ঞকারী যজমান কেন তার পিতাকে হত্যা করে না?” (চার্বাকষষ্ঠি-৫০)।
বেদবাদীদের প্রতি এ যে নির্মম বিদ্রূপ। তাই বেদভক্তদের কাছে এটি ‘কুরুচিপূর্ণ উপহাস’ সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বিদ্রূপ সত্যদ্রষ্টা ঋষি ও তার মহিমা-কীর্তনীয়ার পক্ষে হজম না করে উপায় কী? সুতরাং তাদের পক্ষেও চার্বাককে বেসামাল গালিগালাজ দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারপরও কেউ কেউ এর একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন এভাবে– বেদে যাকে বলি দেবার বিধান নির্দিষ্ট রয়েছে তাকে বলি দিলেই সে স্বর্গে যাবে। বৃদ্ধ পিতাকে বলি দেবার কোনো নৈতিক বিধান নেই। তাই বলিপ্রদত্ত পিতা স্বর্গে যেতে পারবেন না। অতএব এটি বেদের মাধ্যমে বিধাতার উদারতারই নিদর্শন। উদারতা তো বটেই। কেননা গীতায় স্বয়ং ভগবানই বলেছেন – “যারা পণ্ডিত অর্থাৎ বেদোজ্জ্বল-বুদ্ধিসম্পন্ন, তারা বিদ্যাবিনয়-সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর, চণ্ডাল সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখেন।” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৫/১৮)। এই সমদৃষ্টির নমুনা বেদ থেকেই পাওয়া যেতে পারে। ঋগ্বেদের সেই বিখ্যাত পুরুষ-সূক্ত স্মর্তব্য, যে সূক্তে বৈদিক সংহিতার শেষের যুুগে উচ্চ-নীচ বর্ণবিশিষ্ট শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এই সূক্তে বিধাতার পা থেকে শূদ্রের উদ্ভবের কথা বলা হয়েছে – “পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র ব্যাপ্ত করে দশ অঙ্গুলি পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে অবস্থিত থাকেন। (ঋক্-১০/৯০/১)।। এর (বিধাতা-পুরুষের) মুখ ব্রাহ্মণ হলো, দু বাহু রাজন্য হলো, যা উরু ছিলো তা বৈশ্য হলো, দু চরণ হতে শূদ্র হলো। (ঋক্-১০/৯০/১২)।।” যদি সহস্রশীর্ষ সহস্রপাদ সহস্রচক্ষু বিরাট বিধাতাপুরুষকে সমাজের সকল মানুষের সমন্বিত রূপের প্রতীকী কল্পনা বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে সূক্তটির তাৎপর্য দাঁড়াবে – ‘সমাজের শ্রমজীবী ইতর জনসাধারণ, যারা শারীরিক শ্রমের দ্বারা উচ্চবর্গীয় মুরুব্বি মানুষের ভোগের উপকরণ তৈরি করছে, সমাজের ধনসম্পদ সৃষ্টি করছে, অথচ যে ধনসম্পদে তাদের কোনো অধিকার নেই, সমাজের ভারবাহী সেই মানুষরূপী পশুদলের জন্য স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে সমাজের সকলের নীচে। এ বক্তব্যের পূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের আবার তৈত্তিরীয় সংহিতা-র শরণাপন্ন হতে হবে।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৬)। ‘তৈত্তিরীয়-সংহিতা’র ঋষির এই তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যটি হলো – “…শূদ্র ও অশ্ব বিধাতার পা থেকে জন্মেছে। সুতরাং অশ্ব যেমন ব্রাহ্মণাদি উচ্চ ত্রিবর্ণের ভার বহন করে, তাদের আদেশ পালন করে, শূদ্রও তেমনি ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের আজ্ঞাবহ দাসরূপে বিচরণ করবে। অর্থাৎ এরা সম্পূর্ণভাবে উচ্চবর্ণের অধীন। উচ্চবর্ণের সেবা করাই এদের একমাত্র ধর্ম। এজন্যই শূদ্রের বৈদিক ক্রিয়াকলাপে কোনো অধিকার নেই।” (কৃষ্ণযজুর্বেদ-সংহিতা-৭/১/১, হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়-কৃত মন্ত্র ও সায়ণ-ভাষ্যের তর্জমা)।
হিন্দু দার্শনিক ও ধর্মশাস্ত্রকাররা যে বেদকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখেননি তথা বেদের কোন্ অংশ পূর্ব যুগে রচিত আর কোন্ অংশ পরবর্তী যুগে রচিত এ সমস্যা নিয়ে তারা মাথা ঘামাননি তা বোঝা যায় তাদের মতে সমগ্র বৈদিক সাহিত্যই ঈশ্বরের বাণী অথবা অনাদি অপৌরুষেয় বাণী হিসেবে সকল বিধানই তর্কাতীতভাবে মেনে নেয়ার অভ্যস্ততা থেকে। তাই বেদবাণী অনুসরণ করেই ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানভাজন মনুসংহিতায় শূদ্রদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী নৃশংস বিধানসমূহ রচিত হয়েছে। চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবনে বেদসম্মত সমাজসংগঠনে ব্রাহ্মণ্যবাদী গ্রন্থ মনুসংহিতার অন্তর্গত দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলেই কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী লোকায়তিক চার্বাক-মত উত্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো তা বুঝতে সহায়ক হবে।
ভারতীয় সাহিত্যে চার্বাক
চার্বাক সাহিত্য
চার্বাক দর্শন সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় অন্তরায় হচ্ছে চার্বাকদের নিজস্ব রচনাসম্ভার বা সাহিত্য সৃষ্টির কোন নমুনা আমাদের বর্তমান জ্ঞানজগতের আয়ত্তে না-থাকা। সেগুলো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। ফলে সম্পূর্ণতই অন্যের রচনার উপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে চার্বাক দর্শন সম্পর্কিত আমাদের ধারণার উৎস প্রধানত চার্বাক-বিরোধী তথা চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চার্বাকী মতবাদের সমালোচনা- যেখানে চার্বাক সর্বদাই পূর্বপক্ষ হিসেবে উপস্থাপিত। হয়তো চার্বাকী বক্তব্যের কেবল সেই অংশগুলিই অন্যের মারফৎ প্রচারিত হয়েছে যেগুলির বিরোধিতা বা খণ্ডনের নিমিত্তে অপরপক্ষ নিজ সিদ্ধান্ত স্থাপন করতে যুক্তি-বাণ মোকাবেলায় সক্ষম ছিলেন। ভারতীয় দর্শনের সব ক’টি বিভাগেই চার্বাক মত এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে এখান থেকে আমরা হয়তো চার্বাকী দৃষ্টিভঙ্গিটা অনুমান করতে সক্ষম হই বটে, কিন্তু চার্বাক দর্শনের অবিকৃত পূর্ণাঙ্গ স্বরূপটা দৃশ্যের অন্তরালেই থেকে যায়।
ভারতীয় দর্শনমতের যে গ্রন্থগুলিতে কঠোর সমালোচনার সূত্র ধরে চার্বাক মতের অন্তর্ভুক্তি দেখা যায় তার মধ্যে ৯ম শতকের ন্যায়-দার্শনিক জয়ন্ত ভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’, ৮ম শতকের দুই বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা’, ৮ম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সুরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’, ৭ম শতকের অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ ও ব্রহ্মসূত্রের (৩/৩/৫৩-৫৪) শাঙ্করভাষ্য, ১৪শ শতকের অদ্বৈত বেদান্তবাদী মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘সর্বমতসংগ্রহ’, ১৪শ শতকের বিদ্যারণ্যমুনির ‘বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ’, ১২শ শতকের শ্রীহর্ষের ‘নৈষধচরিত’ (সপ্তদশ সর্গ) প্রভৃতি গ্রন্থেও চার্বাক সিদ্ধান্তের কিছু বর্ণনা রয়েছে। এসব গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের যে বিশিষ্ট রূপের প্রকাশ, সেই রূপেরই প্রতিফলন দেখা যায় ভারতীয় সাহিত্যের অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে চার্বাক মতের বর্ণনায়। কোথাও ‘লোকায়ত’, কোথাও বা ‘বার্হস্পত্য’ সংজ্ঞায় পরিচিত, অনেক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট কোন নামের স্বাক্ষর বহন না করেও বর্ণনাগুলি চার্বাকী মতের প্রতিফলন বহন করে। এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও কৃষ্ণ মিশ্র রচিত একাদশ শতাব্দির ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নামক রূপক নাটকে সৃষ্ট চার্বাক চরিত্রের মাধ্যমেও চার্বাক মত সম্বন্ধে কিছুটা পরিচিত হওয়া যায়। ভারতীয় দর্শন জগতে এই বিশেষ মতবাদ ‘চার্বাক’ সংজ্ঞার মাধ্যমে সুপরিচিত এবং চার্বাক দর্শন হিসেবে তা পরিজ্ঞাত।
তবে একটি মাত্র গ্রন্থ পাওয়া যায় যেটাতে চার্বাক মতের সিদ্ধান্ত বিচার উত্তরপক্ষ রূপে করা হয়েছে, তা হলো জয়রাশি ভট্ট (সম্ভাব্য ৭০০ খ্রী.) রচিত ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’। ১৯৪০ সালে বইটি মুদ্রিত আকারে প্রথম প্রকাশ করা হলে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের তৈরি হয়। কেননা অন্যত্র সবখানেই চার্বাক দর্শনের যে ছবি আমরা দেখতে পাই, এ গ্রন্থে তার অন্যরূপ প্রতিফলন দেখা যায়। সমগ্র চার্বাক দর্শনের অংশমাত্রের পরিচায়ক হিসেবে ধারণা করা হয় বইটি হয়তো চার্বাকের কোন বিশেষ এক শাখার সিদ্ধান্ত, যাদেরকে কেউ কেউ বৈতণ্ডিক চার্বাক নামে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি আদৌ চার্বাকী মতবাদী নয় বরং সর্বপ্রমাণবিরোধী সংশয়বাদের নিদর্শক গ্রন্থ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কারণ, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো, প্রমাণমাত্রেরই খণ্ডন। ভারতীয় প্রতিটা দর্শনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তগুলিকে প্রমাণের নিমিত্তে নিজস্ব যুক্তির অনুকূলে ন্যায় বা তর্কশাস্ত্রীয় চর্চাটাকে খুবই গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এবং এসব যুক্তিশাস্ত্রে প্রমাণের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রপঞ্চের আমদানি ঘটালেও প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষকে অতীব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ন্যায়দর্শনেই প্রমাণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা রয়েছে বলে ন্যায়দর্শন নামান্তরে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবেই প্রসিদ্ধ। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ- অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। অন্যদিকে দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে দাবি করেন যে, লোকায়ত বা চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অথচ জয়রাশি ভট্ট প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ বলে আসলে কোনো প্রমাণই হতে পারে না। অর্থাৎ এক তূণে তিনি সকল তত্ত্ব বা দর্শনকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বইটির নাম ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ এর অর্থ হচ্ছে সোজা বাংলায়- সিংহের মতো দর্পে তত্ত্বমাত্রকে- অর্থাৎ সবরকম দার্শনিক মতকে- উপপ্লব বা উৎখাত করে দেবার দাবি।
দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ-বাদী, সর্বপ্রমাণ-বিরোধী নয়। সর্বপ্রমাণ-বিরোধী হিসেবে যারা ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ তারা আসলে চরম ভাববাদী, মোটেও বস্তুবাদী নন। এই চরম ভাববাদী দর্শনগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ দুটো হলো বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (১৭৫ খ্রীস্টাব্দ) শূন্যবাদ এবং অদ্বৈত-বেদান্তী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রীস্টাব্দ) মায়াবাদ। এদিক থেকে দেখলে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-এর জয়রাশির অবস্থান আসলে বস্তুবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণযুক্ত অদ্বৈত-বেদান্ত ও বৌদ্ধ-শূন্যবাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে থাকার কথা। তাই জয়রাশি ভট্টের উদ্দেশ্য নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে অস্পষ্টতা ব্যাপক। এ প্রেক্ষিতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য – “মনে রাখা দরকার, বইটির অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু থেকে সম্পাদকরা এটিকে প্রসিদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে দাবি করেননি। করা সম্ভবও নয়। শুরুতেই গ্রন্থকার বলছেন, সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধি আছে যে মাটি, জল, আগুন, বাতাস- এগুলিই মূল সত্য। কিন্তু দার্শনিক বিচারের ধোপে তাও টেকে না ! তার মানে প্রসিদ্ধ চার্বাক মত বর্জন থেকেই বই-এর শুরু। গ্রন্থশেষে জয়রাশি আস্ফালন করে বলেছেন, স্বয়ং দেবগুরু বা বৃহস্পতির মাথাতেও যা আসেনি তা এই পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের বইতে ব্যাখ্যা করা হলো। বৃহস্পতি-মতের কোনো প্রকৃত সমর্থকের পক্ষে এমন আস্ফালন সহজবোধ্য নয়, কেননা গুরুমারা বিদ্যের স্থান আর যেখানেই থাকুক না কেন, অন্তত ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে থাকতে পারে না। বরং, প্রতিটি দার্শনিক মতের প্রকৃত প্রবক্তারা পরের যুগে কোনো নতুন কথা বলার সময়ও যেন-তেন-প্রকারেণ কথাটা সম্প্রদায়-প্রবর্তকের প্রকৃত অভিপ্রায় বলেই প্রচার করতে চান। পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে প্রচলিত রকমারি গালিগালাজের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের পাষণ্ড আখ্যা দিয়ে সন্তোষ লাভ করলেও, ব্রাহ্মণ-বৌদ্ধ উভয়ের পক্ষেই চার্বাককে সমস্বরে পাষণ্ডশিরোমণি হিসাবেই দেখবার কথা।” তাহলে বইটিতে চার্বাক-প্রবণতার পরিচয় শুরুতেও নেই, শেষেও নেই। আরো বড় কথা হলো, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য-বিষয়ের মধ্যেও নয়। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ অবশ্যই সহজপাঠ্য বই নয়; যুক্তিতর্ক-কণ্টকিত রীতিমতো কঠিন বই। তবুও সাধ্যমতো সহজ করে এবং সংক্ষেপে তার সারমর্ম বলে রাখা দরকার। জয়রাশি কী করে দেখাতে চান যে কোনো রকম দার্শনিক মতই স্বীকারযোগ্য নয়? সংক্ষেপে তার বক্তব্য এই : যে-কোনো দার্শনিক মত বা তত্ত্ব হোক না কেন, স্বীকারযোগ্য হতে গেলে তার পক্ষে তো প্রমাণ থাকা দরকার। অথচ বিচার করলে বোঝা যায় যে, কোনো রকম তথাকথিত প্রমাণেরই প্রামাণ্য- বা প্রমাণ করার যোগ্যতা থাকতে পারে না। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ, অনুমান, প্রভৃতির প্রমাণ হিসেবে প্রসিদ্ধি আছে। কিন্তু জয়রাশি দেখাতে চান, সে-প্রসিদ্ধি আসলে অলীক, কেননা নামে প্রমাণ হলেও এগুলি সবই আসলে অসার; কোনোটিকেই প্রমাণ বলা যায় না। আর প্রমাণ বলেই যদি কিছু না থাকে তাহলে কোনো রকম দার্শনিক মত বা তত্ত্ব স্বীকার করার কারণও থাকতে পারে না। অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’- সিংহদর্পে সর্বতত্ত্বের উপপ্লব বা উৎখাত।’ (সূত্র : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-২৯)। অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থটিকে চার্বাক মতের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা তা প্রয়োজনীয় পর্যালোচনার দাবি রাখে হয়তো।
এছাড়া কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’র মতো কিছু প্রাচীন গ্রন্থে এবং প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত কিছু লোকগাথায় চার্বাক মতের বিশেষ বিশেষ দিক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই চার্বাকমতের একটা পুনর্গঠিত রূপের ধারণা পেতে আমাদেরকে মূলত যেসব সাহিত্য-উপাদানের উপর নির্ভর করে আগাতে হয়, তা হলো- (১) প্রামাণিক বিবেচনায় প্রাচীন গ্রন্থাবলি, (২) সম্ভাব্য প্রামাণিক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত কিছু লোকগাথা, এবং (৩) প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের চার্বাক বিরোধী পক্ষের রচনায় পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাক বা লোকায়ত বর্ণনাগুলি- যেখানে পরমত খণ্ডনের প্রথা অনুযায়ী প্রথমে পূর্বপক্ষ হিসেবে সে মতটা আসলে কী তা ব্যাখ্যা করে পূর্বপক্ষের সমর্থনে সম্ভাব্য সব যুক্তি দিয়ে তা যথাসম্ভব স্থাপন করে নেয়া হয়, যাতে পরবর্তীতে তা উত্তরপক্ষের যুক্তিবিস্তারে খণ্ডন করা হলে কেউ যেন ওটার সমর্থনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
উল্লেখ্য, চার্বাকদের নিজস্ব রচনা বিষয়ক কোন বিশ্বস্ত দলিল প্রামাণ্য হিসেবে সুনির্দিষ্ট না থাকায় বিভিন্ন উপাদান নির্ভর অনুমানগুলোও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে দেখা যায়। ফলে বিভিন্ন বিদ্বান ও দার্শনিকদের মধ্যেও চার্বাক নিয়ে মতান্তরের অন্ত নেই। আর এতোসব মতান্তরের কারণেই হয়তো চার্বাক দর্শন নিয়ে কোন কালেই কৌতুহলি গবেষকদেরও আগ্রহের কমতি দেখা যায়নি। রহস্যময় বিচিত্র বিভ্রমের তুঙ্গে থেকে সেই প্রাচীন কাল থেকে আজতক মুক্তচিন্তক ভাবুকদের জন্য চার্বাক দর্শন এক অনন্য সাধারণ দর্শন হিসেবে দার্শনিক চিন্তা জগতে ক্রমাগত ঢেউ তুলে যাচ্ছে। এই ঢেউগুলো তো এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহু প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজার এক দীর্ঘ ধারাক্রম। আর এই একই ধারায় এগিয়ে যেতে যেতে আমাদেরকেও জেনে নিতে হয় চার্বাক সংশ্লিষ্ট বেশ কতকগুলো বিষয়ে আপাত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ও এর রূপরেখাসমূহ।
চার্বাক নামের উৎস
ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে বস্তুবাদী দর্শনটির নজির যত প্রাচীনই হোক-না কেন, এ মতবাদের চার্বাক নামকরণ সে তুলনায় অর্বাচীন। ৮ম-৯ম শতকের আগে দর্শন সাহিত্যে এ নামের কোন উল্লেখযোগ্য নিদর্শন চোখে পড়ে না। প্রাচীনেরা এ মতটিকে প্রধানত লোকায়ত নামেই উল্লেখ করেছেন। ওই ৮ম-৯ম শতক থেকেই বস্তুবাদী অর্থে লোকায়ত বা চার্বাক মতের সমালোচনায় বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায় বিভিন্ন মতের দার্শনিকগণকে। এদের মধ্যে নবম শতকের ন্যায় দার্শনিক জয়ন্ত ভট্ট প্রধানতম। অন্যরা হলেন ৮ম শতকের বৌদ্ধ আচার্যদ্বয় শান্তরক্ষিত ও কমলশীল এবং জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী।
লোকায়ত নামে চার্বাক মতের প্রাচীনতম অন্তর্ভুক্তির নিদর্শন হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য হলেও বস্তুবাদ অর্থে চার্বাক শব্দের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা’ গ্রন্থে, যা কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’ নামে খ্যাত। কমলশীলের এই বিশাল গ্রন্থ মূলত তার গুরু শান্তরক্ষিত রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা। শান্তরক্ষিত ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খণ্ডন করে স্বীয় মত স্থাপন করার লক্ষ্যে প্রচলিত দার্শনিক মতগুলো খণ্ডন করে স্বীয় বৌদ্ধ মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কিন্তু ওখানেও লোকায়ত হিসেবে বস্তুবাদী মতের সমালোচনা থাকলেও চার্বাক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’য় এই বস্তুবাদ সুস্পষ্টভাবেই চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি চার্বাকমতের প্রবক্তা হিসেবে পুরন্দর নামে জনৈক পূর্ববর্তী দার্শনিকের নামও উল্লেখ করেছেন। চার্বাকী সাধারণ ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে এই পুরন্দর লৌকিক অনুমানকে প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যদিও অলৌকিক কোন ধারণাকে এই অনুমানের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে তার অসম্মতির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পুরন্দর রচিত কোন গ্রন্থের কথা আদৌ জানা যায় না।
চার্বাক মতের প্রধানতম সমালোচক ৯ম শতকের ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত প্রতিনিধি জয়ন্ত ভট্ট। জয়ন্ত ভট্টের পাণ্ডিত্য যেমন প্রগাঢ়, যুক্তি ও বিচার যেমন প্রখর, তেমনি তার আশ্চর্য লেখার কায়দা বা রচনা কৌশলের বন্যায় যেন বিপক্ষমতকে একেবারে ভাসিয়ে নেবার মতো। স্বীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি তার রচিত ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে অন্যতম বিপক্ষ মত খণ্ডনে চরম বস্তুবাদী মত বোঝাতে সুস্পষ্টভাবে চার্বাক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এবং তার সঙ্গে রকমারি বিশেষণ যোগ করে মতটি নিয়ে তিনি হাসি-তামাশা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতেও পিছপা হননি। কোথাও তিনি চার্বাককে হাবাগোবা অর্থে ‘বরাক’ বলে উল্লেখ করেছেন ‘চার্বাকাস্তু বরাকাঃ’ উদ্ধৃতি দিয়ে, কোথাও বা চার্বাককে তুখোড় প্রতারক অর্থে ‘ধূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। আবার কোথাও ‘সুশিতিতরাঃ’ বিশেষণও ব্যবহার করেছেন। জয়ন্ত ভট্টের এরকম বিচিত্র বিশেষণ ব্যবহার থেকে ঐতিহাসিকেরা চার্বাকদের বিভিন্ন প্রাচীন গোষ্ঠির উপস্থিতির অনুমানও করে থাকেন। তবে একাধিক গোষ্ঠি থাকলেও জয়ন্ত ভট্টের লেখায় চার্বাক শব্দ চরম বস্তুবাদেরই নিদর্শক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
খ্রীস্টিয় ৮ম শতকে রচিত জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ নামকরণেই বোঝা যায় সেকালের ছটি প্রখ্যাত দার্শনিক মতের বিচারমূলক পর্যালোচনা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে জৈন মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণই এর উদ্দেশ্য। সেকালের প্রখ্যাত ছটি দার্শনিক মতের অন্যতম ছিলো বস্তুবাদী লোকায়ত মত। হরিভদ্র কোথাও চার্বাক শব্দটি উল্লেখ না-করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে চার্বাক এবং লোকায়ত অভিন্ন। এই ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের বিশদ ব্যাখ্যা হিসেবে আনুমানিক ১৪শ-১৫শ শতকের প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক গুণরত্ন রচনা করেন বিখ্যাত ‘তর্করহস্যদীপিকা’ টীকাগ্রন্থটি। এটারও উদ্দেশ্য ছিলো অন্যান্য দার্শনিক মত আরো বিশদভাবে বিচার করে জৈন মতই সবচাইতে সেরা এরূপ সিদ্ধান্ত করা। এই অন্যান্য মতের অন্যতম চরম বস্তুবাদেরও বিস্তৃত বিচার করা হয় এ গ্রন্থে এবং গুণরত্নের রচনায় এই বস্তুবাদ চার্বাক নামেই অভিহিত হয়েছে। একইভাবে বেদব্যস বা বাদরায়ন রচিত ‘ব্রহ্মসূত্র’-র প্রখ্যাত ভাষ্যকার রামানুজ একাদশ শতকে তার রচিত ভাষ্যগ্রন্থে বস্তুবাদী দর্শনকে চার্বাক নামেই অভিহিত করেছেন।
তবে বিভিন্ন দার্শনিক মতের পর্যালোচনা হিসেবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থটি হলো ১৪শ শতকের অদ্বৈত বৈদান্তিক দর্শনকার সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। অদ্বৈত বেদান্তই যে শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মত- এটি প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যেই সেকালে প্রচলিত আরো পনেরোটি দার্শনিক মত বিচারমূলকভাবে খণ্ডন করার বিস্তৃত প্রয়াস এই গ্রন্থ। এ লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রথম যে মতটি খণ্ডন করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন তা হলো বস্তুবাদী দর্শন। এবং মাধবাচার্য তাকে চার্বাক নামেই উল্লেখ করেছেন। এজন্যেই তার গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘চার্বাক-দর্শনম’।
চার্বাক বলতে যে এক প্রখর বস্তুবাদী দর্শনই বোঝায়- এ ধারণাই হয়তো পরবর্তীকালের ভারতীয় সাহিত্যে খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করে। এমন কি দার্শনিক সাহিত্য পেরিয়ে এই ধারণার প্রভাব যে নাট্যসাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে তার প্রমাণ ১১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষ্ণমিশ্র রচিত রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’। এ নাটকের বস্তুবাদী দর্শনের প্রতীক চরিত্রটির নাম ‘চার্বাক’।
চার্বাক নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। ‘নয়তে চার্বী লোকায়তে’ এই কাশিকাবৃত্তিতে জানা যায় যে, লোকায়ত শাস্ত্রে চার্বী নামক আচার্য পদার্থের ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, বৃহষ্পতির শিষ্য চার্বাক নামে কোন একজন প্রাচীন ঋষি এই দর্শনের সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করেছেন। আবার কারো মতে চারু হচ্ছে বৃহষ্পতির নাম। তার উপদেশরূপ বাক্যকে অনুসরণ করায় চার্বাক নাম হয়েছে। এছাড়াও চার্বাক নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে চার্বাক শব্দটির আরো দু’রকম মানে দাঁড় করাবার চেষ্টাও চোখে পড়ে। যেমন, প্রথমতঃ কারো মতে ‘চর্ব’ (অর্থাৎ চর্বণ) ধাতু থেকে চার্বাক শব্দটি নিষ্পন্ন। এই দর্শনে মূল মন্ত্র হচ্ছে ‘খাও, পান করো ও আনন্দ করো’, খাওয়া-পান করাকে অত্যধিক জোর দেওয়ায় এই দর্শনকে চার্বাক নামে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয়তঃ কারো মতে ‘চারু বাক্’ থেকে চার্বাক। ‘চারু (সুন্দর, মিষ্ট) বাক্ (বচন, বাক্য) যার’ এই বিগ্রহে বহুব্রীহি সমাসে ‘চার্বাক’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। কেননা অদৃষ্ট অপেক্ষা দৃষ্ট সুখের জন্য বা দৃষ্ট দুঃখের নিবৃত্তির জন্য প্রাণিকূল সাধারণত প্রবৃত্ত হয়। স্বর্গসুখ প্রাপ্তির জন্য খুব কম ব্যক্তিই যজ্ঞাদি কর্মে প্রবৃত্ত হয়। তেমনি নরকদুঃখ ভয়ে খুব কম লোকই পাপকর্ম থেকে নিবৃত্ত হয়। সেকারণে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কারো কথা শুনে যা অনায়াসে চারুরূপে (=মধুরভাবে) গৃহীত হয় তা হচ্ছে লোকায়ত চার্বাক। প্রতিপক্ষের কটাক্ষ বা বিদ্রূপ থেকেই এই মানে তৈরির প্রবণতা লক্ষ্যণীয় বলে কারো কারো ধারণা। কেননা ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম অনুসারে কোনটাই টেকে না বলে পণ্ডিতদের অভিমত।
খ্রীস্টিয় ৭ম বা তার পরবর্তীকালে ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনে প্রখর জড়বাদী মতবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ‘চার্বাক’ শব্দটি সুপরিচিতি লাভ করলেও প্রাচীন সাহিত্যে এ শব্দটি একেবারেই নিরব। বিশিষ্ট চিন্তাধারাকে স্বনামে পরিচিত করার উপযোগী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোন চার্বাকের অস্তিত্বের সমর্থনে কোন তথ্যের একান্তই অভাব বলে চার্বাক নামটির উৎস নিয়ে একটা অনুন্মোচিত রহস্যের জট থেকেই যায়। তবে প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজধর্মানুশাসন প্রসঙ্গে চার্বাক নামে এক রাক্ষসের উপাখ্যান আছে (মহাভারত : ১২/৩৮/২২-৩৬)। “সাক্ষ্য, শিখী এবং ত্রিদণ্ডী’ ব্রাহ্মণরূপী এ রাক্ষস চার্বাক ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পরম শত্রু”। দুর্যোধনের সখা এবং প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যমতের তীব্র সমালোচক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। মহাভারতকে আমরা বর্তমানে যে আকারে পাই তার রচনাকালের পূর্ব সীমা খ্রীস্টপূর্ব ৪র্থ এবং শেষ সীমা খ্রীস্টিয় ৪র্থ শতক বলে সাধারণত ধরে নেয়া হয়। আর মহাভারতের এই অংশের রচনাকাল আনুমানিক খ্রীস্টিয় ৪র্থ শতক। চার্বাক দর্শনের ইতিহাস বা চার্বাকের উৎস খুঁজতে গিয়ে আগ্রহী গবেষকদের দৃষ্টি মহাভারতের এই উপাখ্যানের দিকেই আকৃষ্ট হয় স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু এখানে জড়বাদ বা নাস্তিক্যবাদ সম্বন্ধে কোন কথা নেই। বরং যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় এই চার্বাকের স্বল্পস্থায়ী উপস্থিতি রাজা যুধিষ্ঠিরকে অপমান করতেই ব্যয়িত হয়েছে, যার পরিণামে সভায় ক্রমাগত ব্রাহ্মণদের রোষাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে তার জীবনাবসান ঘটে। মহাভারতের উপাখ্যানটি এরকম- “পাণ্ডবগণের পুরপ্রবেশকালে হাজার হাজার পুরবাসী-প্রজা দর্শনাকাঙ্ক্ষী হয়ে তথায় আগমন করতে লাগল। …ঐ সময় সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুর্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণ পূর্বক অবস্থান করছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হলে তাহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না-করেই নির্ভীকচিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্বিতবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন পূর্বক বলল – “চার্বাক বলল- ‘পাণ্ডুনন্দন, এই ব্রাহ্মণেরা সকলে আমার উপরে বাক্য স্থাপিত করে বলছেন, (আমার মুখে বলছেন)- ‘আপনি জ্ঞাতিহত্যাকারী ঘৃণিত রাজা; সুতরাং আপনাকে ধিক্। কুন্তীনন্দন, এভাবে জ্ঞাতি ক্ষয় করে এবং গুরুজনদিগকে বধ করিয়ে আপনার রাজ্যদ্বারা কি হবে। আপনার এখন মৃত্যুই ভাল- জীবন নয়’। তখন ব্রাহ্মণেরা সকলেই সেই দুষ্ট রাক্ষসের এই প্রকার বাক্য শুনে এবং তার পূর্বোক্ত বাক্যে আক্রান্ত হয়ে ব্যথিত হলেন ও আক্রোশ প্রকাশ করতে লাগলেন। তার পর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলে ও সেই রাজা যুধিষ্ঠির লজ্জিত ও বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে কিছুকাল নীরব থাকলেন। তারপরে যুধিষ্ঠির বললেন, ‘ব্রাহ্মণগণ, আমি অবনত হয়ে, আপনাদের প্রসন্নতা প্রার্থনা করছি। আপনারা আমার উপরে প্রসন্ন হোন’। আমার মৃত্যু অতিনিকটবর্তী; সুতরাং আমার উপরে ধিক্কার দেওয়া আপনাদের উচিত নয়’। তদনন্তর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলেই একযোগে বললেন- ‘রাজা, এই ব্রাহ্মণটা আমাদের কেউই নয়। আপনি জীবন ধারণ করুন, আপনার রাজলক্ষ্মীও চিরস্থায়িনী হোক। তার পর বেদবিদ্বান্ ও তপোবলে নির্মলচিত্ত সেই মহাত্মা ব্রাহ্মণেরা জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা চার্বাককে চিনতে পারলেন। ব্রাহ্মণেরা বললেন- ‘মহারাজ, দুর্য্যোধনের সখা চার্বাকনামক এই রাক্ষস পরিব্রাজকরূপে দুর্য্যোধনেরই হিতসাধন করার ইচ্ছা করছে। ধর্মাত্মা, আমরা এরূপ কথা বলিনি। অতএব আপনার এইরূপ নিন্দার ভয় তিরোহিত হোক এবং ভ্রাতৃগণের সহিত আপনার মঙ্গল হোক। তার পর সেই পবিত্র ব্রাহ্মণেরা সকলে ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে, ভর্ৎসনা করতে থেকে, হুঙ্কারদ্বারা সেই পাপাত্মা রাক্ষসটাকে মেরে ফেললেন। তখন ইন্দ্রের বজ্রদগ্ধ অঙ্কুরযুক্ত বৃক্ষের ন্যায় সেই রাক্ষসটা বেদবাদী ব্রাহ্মণগণের তেজে দগ্ধ হয়ে পতিত হল। তারপরে সেই ব্রাহ্মণেরা বিশেষ সম্মানিত হয়ে, যুধিষ্ঠিরের অভিনন্দন করে, যথাস্থানে প্রস্থান করলেন এবং যুধিষ্ঠিরও সুহৃজ্জনের সহিত আনন্দিত হলেন।” (মহাভারত : ১২/৩৮/২৬-৩৭)
এমন এক দুরাত্মা পাপী রাক্ষসের নামের সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনটিকে জুড়ে দিলে সাধারণ পাঠকের মনে দর্শনটির প্রতি সহজেই আতঙ্ক ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত হবার কথা। এ কারণেই এই জড়বাদী দর্শনটিকে চার্বাক নামে উল্লেখ করার প্রথা গড়ে উঠেছিলো কিনা তা বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবনার বিষয় হতেই পারে। তবে চার্বাককে ব্রাহ্মণদের ক্রোধের বলি করে উপাখ্যানটি এই ব্রাহ্মণবেশী দুর্যোধনসখার মধ্যে ব্রাহ্মণবিরোধী এক মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। আর এ ইঙ্গিতটাকে স্পষ্টতর করে তোলে মহাভারতেরই অন্তর্গত অন্য এক উপাখ্যান, যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মার প্রসাদপুষ্ট অপর এক চার্বাকের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় উপাগত এই চার্বাকের অভিন্নতা প্রদর্শন করেন। (মহাভারত: ১২/৩৯/৩-১১) । উপাখ্যানটি এরকম- “কৃষ্ণ বললেন- ‘মাননীয় রাজা, এই জগতে ব্রাহ্মণেরা সর্বদাই আমার পূজনীয়। কারণ, এরা পৃথিবীচারী দেবতাস্বরূপ এবং এদের বাক্যই বিষ, আবার প্রসন্নতা উৎপাদন করাও সহজ। মহাবাহু রাজা, পূর্বকালে সত্যযুগে এই রাক্ষস চার্বাক বদরিকাশ্রমে বহু-বৎসর যাবৎ তপস্যা করেছিল। ভরতনন্দন, তারপর ব্রহ্মা এসে বর নেবার জন্য বার বার অনুরোধ করলে, চার্বাক সমস্ত প্রাণী হইতেই নিজের অভয় বর প্রার্থনা করেছিল। তখন অপমানিত ব্রাহ্মণ ভিন্ন অপর সমস্ত প্রাণী হইতেই সর্বোত্তম অভয় বর তাকে ব্রহ্মা দান করেছিলেন। তারপরে অসাধারণ বিক্রমশালী, নিষ্ঠুর কার্য্যকারী, মহাবল ও পাপাত্মা চার্বাক ব্রহ্মার নিকট সেই বর লাভ করে, দেবগণকে সন্তপ্ত করতে লাগল। তার পর একদা দেবতারা সেই চার্বাক রাক্ষসের প্রভাবে নিপীড়িত হয়ে, ব্রহ্মার নিকটে যাইয়া, চার্বাকের বধের জন্য এই কথাই বললেন। ভরতনন্দন, তদনন্তর ব্রহ্মা দেবগণকে বললেন- ‘যাতে অচিরকালমধ্যে চার্বাক নিহত হয়, সে বিষয়ে আমি উপায় করেছি। মনুষ্যলোকে দুর্য্যোধননামে এক রাজা জন্মিবেন এবং তিনি চার্বাকের সখা হবেন। কালক্রমে এই চার্বাক সেই দুর্য্যোধনের সৌহার্দ্দসূত্রে আবদ্ধ হয়ে, ব্রাহ্মণগণের অবমাননা করবে। তখন বাক্শক্তিসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা চার্বাকের অবজ্ঞায় ক্রুদ্ধ হয়ে, ব্রহ্মতেজেই পাপাত্মাকে দগ্ধ করবেন; তাহাতেই চার্বাক বিনষ্ট হবে’। ভরতশ্রেষ্ঠ রাজপ্রধান, সেই চার্বাক রাক্ষসই এই ব্রাহ্মণের তেজে বিনষ্ট হয়ে শয়ন করেছে। অতএব আপনি ব্রহ্মহত্যা হয়েছে বলিয়া অনুতাপ করবেন না।’ যুধিষ্ঠিরের সভায় সমাগত চার্বাকের বিনাশের মূলে কার্যকর ব্রহ্মার অভিশাপ এবং ব্রাহ্মণদের বিরোধিতার মাধ্যমে অভিশাপটিকে ফলপ্রসূ করার দায়িত্ব স্বয়ং চার্বাকেরই। উপাখ্যানের সাহায্যে এই সিদ্ধান্তকে দৃষ্টিপটে তুলে ধরার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট।
চার্বাক নামে কোন ব্যক্তির কাহিনী মহাভারতের অন্যত্র বা অন্য কোন গ্রন্থেও আর দেখা যায় না। মহাভারতে চার্বাক নামের এই রাক্ষসের সামান্য উল্লেখ থেকে চার্বাক মতবাদের এরকম নামকরণের পক্ষে সুনিশ্চিত কোন যুক্তি বা সাক্ষ্য আদৌ আছে কিনা জানা নেই। তবে এটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে চার্বাক এখানে বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী দর্শনের এক মূর্ত রূপ। তাই বিরোধী প্রখর জড়বাদী মতের প্রতি বৈদিক সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের তীব্র বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ এমন চার্বাক নামকরণের মধ্যে দিয়ে ঘটে যাওয়া অসম্ভব নাও হতে পারে।
চার্বাক ও বৃহস্পতি
চার্বাক দর্শন সম্পর্কে যেটুকু নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে এই মতবাদের সূচনার কাল বা ‘চার্বাক’ নামের সঙ্গে এর সংযুক্তির কাহিনী কিছুই সঠিকভাবে নির্ণয় করা এখনো সম্ভব নয়। তাছাড়া এই চিন্তাধারা চার্বাক দর্শন নামে পরিচিতি লাভ করলেও চার্বাক নামে কোন ব্যক্তিকে এর প্রবর্তক বলে স্বীকার করার কোন প্রমাণও এযাবৎ পাওয়া যায়নি। তবে ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ প্রভৃতি গ্রন্থে এই মতবাদের আদি প্রচারক হিসেবে বৃহস্পতির নাম উল্লেখ করা আছে। ব্যক্তিরূপী চার্বাক এসব গ্রন্থে স্বীকৃতি পেলেও তা উদ্ধৃত হয়েছে বৃহস্পতিশিষ্য হিসেবে। যেমন ১৪শ শতকের মাধবাচার্য তার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘চার্বাক-দর্শনম’-এর শুরুর দিকে বলছেন- ‘বৃহস্পতির মতানুসারী নাস্তিক শিরোমণি চার্বাক কর্তৃক তিনি দূরোৎসারিত- দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অর্থাৎ তাদের মতে ঈশ্বর নামক কোন পদার্থ নাই।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ, পৃষ্ঠা ০২)। আর কৃষ্ণমিশ্র রচিত ১১শ শতকের রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ বলা হচ্ছে – ‘বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন’। (প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৪)। অন্যদিকে অষ্টম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা হিসেবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে রচিত আরেক জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় ‘যদুবাচ বাচস্পতিঃ’ অর্থাৎ ‘বাচস্পতি যা বলেন’ উল্লেখ করে বাচস্পতি বা বৃহস্পতির উক্তি হিসেবে তিনটি সূত্র উদ্ধৃত করেন। সেগুলো হচ্ছে- ‘পৃথিবী (মাটি), জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব।’ ‘এর (তত্ত্ব চতুষ্টয়) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।’ (বৃহস্পতি সূত্র)।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, সম্ভাব্য ৮ম শতকের প্রথমদিকে রচিত জয়রাশি ভট্টের ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে রচয়িতার নাম উল্লেখ না করে এই তিনটি সূত্রই উদ্ধৃত হয়েছে বস্তুবাদী নিদর্শন হিসেবে। আবার বৌদ্ধ পণ্ডিত কমলশীলের (৮ম শতক) ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় লোকায়তসূত্র হিসেবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্রেরই উদ্ধতি রয়েছে। যদিও সূত্র দুটি কমলশীলের উদ্ধৃতিতে সামান্য পরিবর্তিত আকারে দেখা যায়, যেমন- ‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি তেভ্যশ্চৈতন্যম্’ এবং ‘তৎসমুদায়ে’। এতে অবশ্য ভাবগত অর্থে শ্লোকগুলির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য হয় না। যেমন বাংলা তর্জমায় সূত্র দুটির সমন্বিত অর্থ দাঁড়ায়- ‘পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটি তত্ত্বের সমন্বয়ে চৈতন্যের জন্ম ও অভিব্যক্তি হয়।’ অন্যদিকে উল্লেখিত প্রথম সূত্রটি (অথাতস্তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ)-কে জয়ন্ত ভট্টের (নবম শতক) ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে চার্বাক দর্শনের আদি সূত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। (ন্যায়মঞ্জরী ১, পৃঃ-৫৯)। অথচ সংকলিত বার্হস্পত্যসূত্রে এই সূত্রটির অন্তর্ভুক্তিই পাওয়া যায় না কোথাও। এসব দেখেশুনে মনে হয় যে চার্বাক গ্রন্থকাররা প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুকরণে এই আদি সূত্রে অন্তর্ভুক্ত তত্ত্বের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, যদিও প্রত্যেকেরই ধারণায় তাদের নিজ নিজ ব্যাখ্যাটি প্রকৃত সূত্রকারেরই অনুমোদন-সাপেক্ষ। সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে বিভিন্ন দার্শনিক গ্রন্থের ভাষ্যকারদের রচনায় এরকম প্রচুর সূত্রের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এগুলির প্রচারক কখনও চার্বাক, কখনও লোকায়ত, আবার কখনও বা বার্হস্পত্য বিশেষণে বিশেষিত হয়েছে।
সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায়ও এরকম কিছু শ্লোকের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। মাধবাচার্যের মতে এগুলি চার্বাক সিদ্ধান্তের প্রবর্তক বৃহস্পতির উক্তি – ‘অর্থ ও কামই পুরুষার্থ’, ‘পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু- এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব’, ‘কিণ্ব বা বৃক্ষবিশেষ হতে মদশক্তির ন্যায় চৈতন্য জন্মে’, ‘বেদত্রয়ী ধূর্তের প্রলাপমাত্র’, ‘অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ কর্মের প্রয়োজন জীবিকামাত্র, অন্য কিছু নয়’, ‘লোকপ্রসিদ্ধ রাজাই পরমেশ্বর’, ‘দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ’। এসব শ্লোকেরই অনুরূপ কিছু শ্লোক ভারতীয় সাহিত্যের বিভিন্ন পাতায় ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে, কোথাও বা চার্বাক দর্শনের সাথে যুক্ত হয়ে, কোথাও অন্যভাবে দেখা যায়। শ্লোকগুলির রচয়িতা প্রকৃতই বৃহস্পতি নামে কোন ব্যক্তি কিনা তা বলা কঠিন। তবে যথার্থ ইতিহাসের পর্যায়ে ফেলা না গেলেও চার্বাক মতবাদের সাথে বৃহস্পতির নামে যোগ বহন করে ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে কয়েকটি উপাখ্যান প্রচলিত আছে।
দেবতাদের গুরুর নাম বৃহস্পতি। কথিত চার্বাক আচার্য বৃহস্পতির প্রকৃত পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তিনি যে ক্রমে এই দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে একাত্মতা লাভ করেছেন তা ওই উপাখ্যানগুলোর কাহিনী থেকে প্রতীয়মান হয়। ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকে চার্বাক মতের প্রচারক বৃহস্পতি যে এই দেবগুরুর সঙ্গে অভিন্ন এবং বাচস্পতি আখ্যায় অভিহিত, তা ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখানো হয়েছে। বাচস্পতি শব্দের অর্থ বাক্যের অধিপতি এবং দেবগুরু বৃহস্পতি সাধারণত এই নামের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে বৃহদারণ্যক উপনিষদ স্মর্তব্য – “প্রাণের আর-এক নাম বৃহস্পতি। বাক্যকে বলে বৃহতী। যেহেতু তিনি বাক্যের গতি, তাই বৃহস্পতি।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)। প্রচলিত বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে ধারণা এই চার্বাক মতবাদের মাধ্যমে প্রচারিত, দেবতাদের গুরুর সঙ্গে সে ধারণার মিল বা সংগতি খুঁজে পাওয়া কঠিন বৈকি। তাই হয়তো এ ক্ষেত্রে উভয়ের যোগের সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে কিছু কল্পনার মাধ্যমে। আর এই কল্পনা বিভ্রান্তি বা মায়ামোহের রূপ নিয়ে বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণে (৩/১৭/১৪-২৬) বলা হয়েছে, অসুরদের মোহগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই মায়ামোহ তাদের মধ্যে এই মারাত্মক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। মায়ামোহের ওই উপদেশগল্পে বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে নর্মদা নদীর তীরে কিছু দৈত্য শ্রুতিপ্রতিপাদিত পথে একাগ্র অন্তঃকরণে তপস্যা করছিলো। তাতে ভীত দেবগণ নারায়ণের শরণাপন্ন হন। তারপর নারায়ণ তাদেরকে সেমত অবস্থায় দেখে তাদের মনোব্যাথা দুর করার জন্য নিজ শরীর হতে মায়ামোহ নামে একজন পুরুষকে উৎপন্ন করে ‘এই ব্যক্তি আপনাদের কার্য সম্পাদন করবে’ বললেন। মায়ামোহ নিজের নাম অনুসারে নিজ প্রবৃত্তি প্রদর্শন করে নিজ মায়ায় দৈত্যদের মোহিত করে সন্মার্গ হতে ভ্রষ্ট করেছিলো। বৃহস্পতির প্রণীত সূত্রানুসারে মায়ামোহ উপদেশ শুনাতে শুনাতে তাদের মনে বিশ্বাস জন্মিয়ে তপস্যা হতে নিবৃত্ত করেছিলো। নাস্তিক মতের প্রচার করে মায়ামোহ যে উপদেশ দিয়েছিলো তা অনেক প্রকার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সর্বসাধারণ। যেমন যজ্ঞাদি কর্ম ধর্ম নয়, একথা স্বীকার করতে হয়। কেননা সেখানে পশু সকল হত্যা করা হয়। আর অহিংসা হচ্ছে পরম ধর্ম। বেদ হচ্ছে ধূর্ত ব্যক্তিদের প্রলাপ। এরই মোহে পড়ে অসুরেরা বৈদিক জ্ঞানকে উপহাস করতে শিখলেন; অতএব তাদের দারুণ অধঃপতন ঘটলো। সেই অবকাশে দেবতারা শক্তি সঞ্চয় করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন এবং সহজেই অসুরদের পরাজিত করলেন। এই মায়ামোহ যে মূলত দেবগুরু বৃহস্পতি তা স্পষ্ট হয় সম্ভাব্য বুদ্ধ-পরবর্তী কালে সৃষ্ট মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের (৭,৮,৯) অন্তর্ভুক্ত অনুরূপ একটি পৌরাণিক উপাখ্যানের মধ্যে। এই উপাখ্যান অনুযায়ী- দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরগুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে ইন্দ্রের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই অসুরদের মধ্যে এই মারাত্মক অবিদ্যা-মূলক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। সেই অবিদ্যার প্রভাবেই অসুরেরা অধর্মকে ধর্ম এবং ধর্মকে অধর্ম মনে করতে শুরু করে।
বেদ বিরোধী এই মতাদর্শ যে আসলে চার্বাক দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা বৃহস্পতির বচন হিসেবেই বিভিন্ন স্থানে পরিদৃষ্ট হয়। এই উপাখ্যানের মাধ্যমে দেবগুরু বৃহস্পতির কুল রক্ষা করা গেলো বটে, তবে একই সাথে এই চার্বাক মতকে অমঙ্গলের প্রতীক অসুর মত হিসেবেও প্রচার করার প্রয়াসও দেখতে পাই আমরা। এই অসুর বলতে যাদেরকেই বোঝাক না কেন, তাদের সংস্কৃতি যে বেদবিরোধী ছিলো এ নিয়ে সন্দেহ নেই। ফলে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরা তাদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখেই দেখার চেষ্টা করেছিলেন। বৈদিক সংস্কৃতিতে এই অসুর মত যে একান্তই পরিত্যাজ্য সে সম্পর্কে যথোপযুক্ত প্রচারণার লক্ষ্যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- “হে পার্থ, এই জগতে দেবস্বভাব ও অসুরস্বভাব- এই দুই প্রকার মানুষ সৃষ্ট হয়েছে। দেবস্বভাবসম্পন্ন মানুষের কথা বিস্তৃতভাবে বলেছি। এখন অসুরস্বভাববিশিষ্ট মানুষের কথা আমার নিকট শ্রবণ কর। অসুরস্বভাব ব্যক্তিগণ ধর্মবিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অধর্মবিষয় হতে নিবৃত্ত হতে জানে না; তাদের শৌচ নাই, সদাচার নাই এবং সত্যও নাই। আসুরভাববিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বলে, এই জগৎ সত্যশূন্য; ইহা ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাহীন। ইহার কর্মফলদাতা ঈশ্বর নাই এবং কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই ইহা উৎপন্ন; ইহার উৎপত্তির অদৃষ্ট ধর্মাধর্মাদি অন্য কারণ নাই। এই লোকায়তিক মত আশ্রয়পূর্বক পারলৌকিক-সাধনচ্যুত ক্রূরকর্মা, অনিষ্টকারী ও অল্পবুদ্ধি আসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণ জগতের বিনাশের জন্য জন্মগ্রহণ করে।” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – ১৬/৬-৯)
উল্লেখ্য, বেদের সারাংশকে উপনিষদ এবং ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’কে উপনিষদের সার বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ হচ্ছে মহাভারতের (আনুমানিক ৪০০খ্রীস্টপূর্ব-৪০০খ্রীস্টাব্দ) ভীষ্মপর্বের এক বিশিষ্ট অংশও। তাই গীতায় এ অসুর-মত বিষয়ক আরো শ্লোক উদ্ধৃত থাকলেও উল্লেখকৃত শ্লোক-ক’টি থেকেই কথিত অসুর মত সম্পর্কে একটা আপাত ধারণা তৈরি হয়ে যায়। বর্ণিত শ্লোক অনুযায়ী এই মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার পাশাপাশি তথাকথিত ঈশ্বর প্রদত্ত কর্মফল তথা এতদসংশ্লিষ্ট জন্মান্তরবাদও অসার বলে ঘোষিত হয়েছে। অসুর মতের সৃষ্টিতত্ত্বে এই জগৎ যে স্ত্রী-পুরুষের মিলনজাত ও কামোদ্ভূত এবং এর পেছনে অদৃষ্ট নামের কোন ধর্ম-অধর্ম পাপ-পুণ্য বা স্বর্গ-নরক ও আত্মা এসব অলৌকিক অবাস্তব কোন কারণ নেই তাও এই শ্লোক থেকে ধারণা করতে পারি আমরা। এবং এ শ্লোক থেকে আরেকটি যে কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পেয়ে যাই তা হলো, গীতায় এই অসুর মতকে লোকায়তিক মত হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি। ফলে চার্বাক মতের আদি উৎস খুঁজতে গিয়ে বৃহস্পতির সম্পর্কসূত্রে শেষপর্যন্ত পৌঁছে যাই লোকায়ত মত নামের এক প্রাচীন ধারণার কাছাকাছি। তবে কি চার্বাক দর্শনের আদি রূপটি লুকিয়ে আছে প্রাচীন লোকায়ত মতের গভীরে কোথাও? নিশ্চয়ই তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। কিন্তু সে পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি-আকর্ষণ করা যেতে পারে।
চার্বাক মত ও বামাচার
লোকায়ত-মত পর্যালোচনার আগে চার্বাক-বৃহস্পতি-লোকায়তের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় বর্ণিত উদ্ধৃতাংশটি প্রণিধানযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে – “অনন্তর লোকায়ত। প্রথমে নাস্তিকদের কথা। কাপালিক :- ভস্ম আচ্ছাদিত যোগীগণ এবং অন্ত্যজ ব্রাহ্মণাদি কেহ কেহ নাস্তিক। তাহারা জীবগণের পুণ্য পাপ প্রভৃতির বিচার করে না। তাহারা জগতকে চতুর্ভূতাত্মক বলিয়া মনে করে। চার্বাক প্রভৃতি মতাবলম্বীদিগের কেহ কেহ আকাশকে পঞ্চম ভূত রূপে ধরিয়া জগতকে পঞ্চভূতাত্মক বলিয়া থাকে। তাহাদের মতে চৈতন্য মদশক্তির ন্যায় আবির্ভূত হয়। জীবগণ জলবুদবুদ্ তুল্য। পুরুষ চৈতন্যবিশিষ্ট শরীরমাত্র। তাহারা মদ্যপান ও মাংস ভোজন করিয়া থাকে এবং মাতা প্রভৃতি অগম্য নারী প্রভৃতিতেও গমন করিয়া থাকে। প্রতি বৎসর কোনো একদিনে সকলে একত্র হইয়া যথাভিপ্রেত স্ত্রীগণের সহিত রমন করিয়া থাকে। কাম ব্যতীত ধর্ম নাই। এই জন্যই চার্বাকদিগকে লোকায়ত বলা হইয়া থাকে। পরোক্ষ বস্তুসমূহ হইতে জাত গলাধঃকরণ ও চর্বণ হেতুই চার্বাক বলা হইয়া থাকে। …নির্বিচারে সাধারণ লোকের ন্যায় আচরণ করে বলিয়াই তাহাদিগকে লোকায়ত বা লোকায়তিকও বলা হইয়া থাকে। তাহাদের মত বৃহস্পতি প্রণীত বলিয়াই তাহাদের বার্হস্পত্যও বলে।” উদ্ধৃতিটিতে প্রাচীন তান্ত্রিক মত বামাচারের সাথে চার্বাক মতকে মিশিয়ে ফেলে তথ্য বিচ্যুতি ঘটানোর প্রবণতা অনুমান করা অস্বাভাবিক হবে না। তবে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক ধ্যানধারণায় প্রকৃতিস্বরূপা নারীযোনির আদিম জাদুবিশ্বাস সংশ্লিষ্ট প্রাচীন তান্ত্রিক আচারের সাথে চার্বাকী লোকায়ত মতাদর্শকে এক করে দেখানোর অন্যতম কারণ হয়তো উভয়ই বেদবহির্ভূত লোকায়তিক চিন্তা-চেতনা থেকে উদ্ভূত বলেই। কিন্তু এই তন্ত্র-সাধনার সাথে চার্বাক মতের সরাসরি পার্থক্যটাই হলো তান্ত্রিক আচার সুস্পষ্টভাবেই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যনিষ্ট কিন্তু দেহাচারী স্বতন্ত্র সাধন-পদ্ধতি, অন্যদিকে চার্বাক মতাদর্শ সম্পূর্ণই দেহাত্মবাদী বস্তুতান্ত্রিক দর্শন। যার সাথে আধ্যাত্মিকতার কোনই সম্পর্ক নেই। তাই আধুনিক রুচি ও নীতিবোধের কাছে পঞ্চমকারপূর্ণ অর্থহীন তান্ত্রিক সাধনার বীভৎসতায় এর আদি-তাৎপর্য না খুঁজে কেবল লোকায়তিক আচারের দোহাই দিয়ে নির্দিষ্ট দর্শনদৃষ্টির সাথে মিশিয়ে ফেলাটা যথাযথ উপস্থাপন নয় বলেই মনে হয়। বিষয়টির কিঞ্চিৎ অনুধাবনের নিমিত্তে প্রাচীন তন্ত্র-সাধনার গূঢ়তত্ত্ব উদ্ঘাটন না-হলেও রহস্য-চিহ্নায়ক তন্ত্র-নির্দেশনার কিছু উদ্ধৃতি টানা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে প্রাচীন ‘কুলার্ণব-তন্ত্র’-এ (সূত্র: লোকায়ত দর্শন / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) বলা হচ্ছে – “মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন- এই পাঁচটি বস্তুর নামের আদিতে ‘ম’ অক্ষরটি থাকায় ইহাদের সংক্ষিপ্ত নাম মকার। এই পঞ্চমকার দেবতাদিগের জন্যও প্রীতিকারক। পঞ্চমকার তন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। পঞ্চমকার ব্যতীত তান্ত্রিকের কোনো কার্যেই অধিকার নাই। পঞ্চমকার দেবতাদিগেরও দুর্লভ ; মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চমকার দ্বারা জগদম্বিকাকে পূজা করিতে হয়। পঞ্চমকার ব্যতীত চণ্ডিমন্ত্র কেমন করিয়া জপ হইতে পারে?” যদিও তান্ত্রিক রিচ্যুয়াল বা আধ্যাত্মিক তন্ত্রবিশ্বাস মতে বলা হয়ে থাকে, পঞ্চমকারের তাৎপর্য অতি গূঢ়, সাধারণের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়, তবু একই প্রাকৃত উৎস থেকে উদ্ভূত এই আদিম তান্ত্রিক বিশ্বাস আর বার্হস্পত্য মতাদর্শের মধ্যে যে মাত্রাগত পার্থক্য তা বোধ করি বুঝতে অসুবিধা হয় না। তন্ত্রসাধনায় যত গূঢ় রহস্যই থাকুক না কেন, এটা যে কামপ্রধান আচারই তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। যেমন – “কামবীজ (কীং) এবং মায়াবীজ (হ্রীং) দ্বারা কামবীজকে পুটিত করিলে, তাহা সর্বকাম ফলপ্রদ কামেশ্বর মন্ত্র হয়। (কীং হ্রীং কীং হ্রীং কীং)”। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৩৫)। “পার্বতী বলিলেন- হে মহাদেব ! যে জন মন্ত্রার্থ মন্ত্রচৈতন্য এবং যোনিমূদ্রা জানে না, শতকোটি যপের দ্বারাও তাহার বিদ্যা (ইষ্টমন্ত্র) সিদ্ধ হয় না। আপনি পূর্বে এইরূপ যে সূচনা করিয়াছিলেন, হে শঙ্কর ! এই তত্ত্ব কৃপাপূর্বক বলুন।” (সরস্বতীতন্ত্র : ১/১-২)।
তবে চার্বাকরা বেদকে প্রামাণিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তন্ত্রসাধকদের ধ্যান-ধারণায় ব্রাহ্মণ্যবাদী বিশ্বাসের ছাপ পুরোদমেই বিদ্যমান দেখা যায়। যেমন – “কালিকামন্ত্র স্মরণমাত্রই সাধক জীবন্মুক্তি লাভ করে এবং একবার মাত্র উচ্চারিত হইলে অযুত অশ্বমেধযজ্ঞ সম্পাদনের ফল লাভ হয়।” (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৪৯)। এই যাগযজ্ঞ বা বৈদিক বিশ্বাসের সাথে অবাধ কামাচারের মণি-কাঞ্চণ যোগের বৈধ সংকলকের ভূমিকায় তান্ত্রিকদের কালিকামন্ত্রের কার্যকর শক্তি যে কী বিপুল, তা তন্ত্রসাধনায় কুমারীতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলের ‘কুলাচার-কথন’ উপাখ্যানের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায় – “দেবী কহিলেন- হে দেবদেব মহাদেব। আপনি জগৎ প্রলয়কারক। হে প্রভু ! কুলাচারবিধি-নির্দ্দিষ্ট মদ্যাদি পঞ্চমকার অধর্ম অর্থাৎ পাপ সৃষ্টির কারণ। সুতরাং তৎসমুদয় কিরূপে মন্ত্রসিদ্ধি-প্রদায়ক হইতে পারে প্রকাশ করিয়া আপনি আমার সন্দেহ দূর করুন। ভৈরব কহিলেন- দেবেশি ! তুমি অতি উত্তম প্রশ্ন করিয়াছ। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতেছি, শ্রবণ কর। পুরাকালে মুনিগণ কামমোহিত চিত্তে রম্য দারুবনে নিয়ত মদ্যপান এবং পরস্ত্রী ধর্ষণকার্য্যে ব্যাপৃত ছিল। মুনিগণের এই সকল অন্যায় কার্য্য দর্শন করিয়া, বিষ্ণু আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হন। তখন বিষ্ণু আমাকে বলিতে লাগিলেন, হে দেবদেব মহাদেব ! আপনি সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের কর্তা। হে প্রভো ! দারুবনে কামমোহিত মদ্যপায়ী পাপাত্মা দিগম্বর ও পানমত্ত মুনিগণ পরস্ত্রী ধর্ষণ করিতেছে। ইহাদের কি গতি হইবে। হে প্রিয়ে ! তৎকালে বিষ্ণুর এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, কালিকা-নামক যে মহামন্ত্র এবং অনিরুদ্ধ যাহার সরস্বতী, যাহা মন্ত্রসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ- এই সকল মুনিগণ সেই মহামন্ত্র জপ করে। সেই কালিকা গায়ত্রী জপ করিয়া ইহারা সকলেই শ্রেষ্ঠ মুক্তি লাভ করিবে। কালিকাদেবীর প্রভাবে দেবতারাও বিমোহিত হইয়া থাকেন। কালিকাদেবীর প্রভাবে পরশুরাম ভ্রুণহত্যা ও মাতৃবধ পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। কালিকাদেবীর প্রভাবে দত্তাত্রেয় এবং ত্রিপুর সুরাপানের পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। আমি রুদ্রও স্বয়ং ব্রহ্মহত্যা বা ব্রহ্মার শিরচ্ছেদরূপ পাতক হইতে কালিকাদেবীর প্রভাবেই মুক্তিলাভ করিয়াছিলাম। সুরপতি ইন্দ্রও কালিকাদেবীর প্রভাবে গুরুপত্নী গৌতমীতে ধর্ষণজনিত পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন এবং ব্রহ্মাও কন্যাধর্ষণহেতু পাপ হইতে, বশিষ্ঠ চাণ্ডালীগমন পাপ হইতে এবং রামচন্দ্র রাবণবধজনিত পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন।” (কুমারীতন্ত্র : ৬/১-১১) এবং কালিকামন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কিভাবে কুলাচার পালন করতে হবে তারও বর্ণনা রয়েছে কুমারীতন্ত্রে – “ব্রাহ্মণ তাম্রপাত্রস্থিত মধুকেই মদ্যরূপে কল্পনা করিবে। নটী, কাপালিকা, বেশ্যা, রজকী, নাপিতাঙ্গনা, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা এবং মালাকার কন্যা- ইহারা নবকন্যা বা গ্রহণীয়া কুলযুবতী বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। এই সকল কুলযুবতী মধ্যে অন্যতমা কুলযুবতী গ্রহণ করিয়া তাহার শক্তিমণ্ডলে কালিকা দেবীর পূজা করিবে। তৎপর কুলযুবতীর মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে।” (কুমারীতন্ত্র : ৬/২১-২৩)
বামাচারী তান্ত্রিক সাধনায় দেহজ কামের সাথে আধ্যাত্মিকতা মেশানো এই প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই শুদ্ধ বৈদিক আচার বা সামাজিক রুচি ও সদাচারের পরিপন্থী ছিলো। তাই হয়তো ব্রহ্মবাদীরা একে কদাচারের তুল্য হিসেবে বিবেচনা করতে কার্পণ্য করেননি। অন্যদিকে স্রেফ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত চার্বাক মতাদর্শকেও এই ব্রহ্মবাদীরা নিন্দনীয় দেহজ কামনা-বাসনার দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে গেছে সবসময়ই। ফলে এ দুটোকে এক করে দেখানোর প্রবণতা বোধ করি অস্বাভাবিক নয়। তার উপর এই বামাচারী তান্ত্রিক সাধনার নিমিত্তে যখন অতি সম্মান ও জ্ঞানীর আসনে বৃহষ্পতির নাম উদ্ধৃত হয়, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। কেননা বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এই তান্ত্রিক সাধনায় উক্ত হয়েছে, তা রীতিমতো লোমহর্ষক – “যে ব্যক্তি বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হইতে ইচ্ছা করে সে ব্যক্তি এই সাধনাপ্রভাবে বৃহস্পতিতুল্য জ্ঞানবান হইয়া থাকে, এতদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। প্রত্যহ সুন্দরী যৌবনোন্মতা কুলযুবতী আনয়নপূর্বক প্রথমে কুলাগার অভিমন্ত্রিত করিবে। তৎপর মন্ত্রজ্ঞ সাধাক অষ্টোত্তর শতবার কালিকামন্ত্র জপ করিয়া ঐ কুলস্ত্রীর সহিত মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। এইরূপে কুলস্ত্রীর সহিত রতিক্রিয়া সম্পন্ন করিলে সাধক পূর্ণফল লাভ করিয়া থাকে। রতিকালে কুলযুবতীর মুখে মুখ প্রদান করিয়া এক-সহস্র সংখ্যক মানস জপ করিবে। যে ব্যক্তি এইরূপে কার্য্য করে সে সর্বসিদ্ধিদাতা হইয়া থাকে। এতদ্বিষয়ে বিচার বিতর্ক অনাবশ্যক। সর্বপ্রকার সাধন পদ্ধতির মধ্যে কুলাচারমতে সাধনই সর্বশ্রেষ্ঠ। সুতরাং সর্বপ্রযত্নে অত্যন্ত একাগ্রতার সহিত কুলাচার পদ্ধতিতে সাধন করিবে।” (কুমারীতন্ত্র : ৫/১৯-২৩)। বৃহস্পতির তুল্য জ্ঞানী হওয়ার এই দেহাচারী তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতির নমুনা থেকে প্রতীয়মান হয়, পরবর্তীকালের ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক দর্শনের আদিতে বৃহস্পতির নামেই এই দর্শনটিকে হয়তো নিচু ভোগবাদী মতাদর্শ হিসেবে প্রচারের প্রবণতা কার্যকর ছিলো। এবং তা হয়তো সফলও হয়েছিলো।
উল্লেখ্য, সহজ কথায় তান্ত্রিক মতের মূল চেতনা হলো- ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাই আছে দেহভাণ্ডে।’ তান্ত্রিক সাধনার এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুরণন আমরা নির্বাণতন্ত্রে দেখতে পাই এভাবে – “হে দেবাধীশ্বরি, পরমেশ্বরি, মহাব্রহ্মাণ্ড মধ্যে যাহা যে প্রকারে রহিয়াছে বৃহদ্ ব্রহ্মাণ্ড মধ্যেও সেই সকল সেইভাবে রহিয়াছে। সেইরূপ দেহমধ্যে চতুর্দ্দশ ভূবন বর্তমান। সৃষ্টিপ্রকার ব্রহ্মাণ্ডে কোন ভেদ নাই ইহা সুনিশ্চয়রূপে জানিবে।” (নির্বাণতন্ত্র : ১০/১৯-২০)। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ সংস্করণ এই দেহভাণ্ডকে উপলক্ষ করে সাধনমার্গের মাধ্যমেই ব্রহ্মাণ্ডের যে সাধনা বিস্তার তান্ত্রিক বিশ্বাস-সম্মত, এর সাথে ইন্দ্রিয়াতীত কোন সত্তায় অবিশ্বাসী ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক মতের বিরাট দার্শনিক প্রভেদ বর্তমান। তবু হয়তো তাদের মধ্যকার অন্তর্গত সাদৃশ্য কেবল এখানেই যে, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় উভয়ের লক্ষ্যই দেহপ্রত্যক্ষতা। ভাববাদী বা ব্রহ্মবাদীদের দৃষ্টিতে একটি অনাচারী, অন্যটি বেদবিদ্বেষী। ফলে প্রতিপক্ষ কর্তৃক বিরুদ্ধতার সমান্তরাল অবস্থানে উভয় মত হয়তো তাদের কাছে একই রেখায় মিশে গেছে একসময়। আর তাই প্রাচীন জড়বাদী লোকায়ত দর্শনের প্রতি অন্যান্য মতাবলম্বীদের দিক থেকে গুণরত্নের উপরিউক্ত বক্তব্যটি হয়তো এই সাধারণ প্রবণতারই লক্ষণ। চার্বাক মতের আদিরূপ সন্ধানে এই লক্ষণ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে রাখা আবশ্যক যে, জৈন দার্শনিক গুণরত্ন চার্বাক-বৃহস্পতি-লোকায়তের সাথে তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতিকে মিশিয়ে দিলেও আধুনিককালের অতি-প্রসিদ্ধ বিদ্বান-গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কিন্তু এই লোকায়তের সাথে বৌদ্ধ-তান্ত্রিকদের একাত্ম করে উত্তরকালের সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধ-সহজযান হিসেবে উল্লেখ করে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের ফল বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি তার ‘বৌদ্ধধর্ম’ গ্রন্থে বলেছেন যে, নামান্তরের আড়ালে লোকায়তিক সম্প্রদায় আজো আমাদের দেশে টিকে রয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি সহজিয়া-সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তাহলে প্রশ্ন, সহজিয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়? কোত্থেকেই বা এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হলো? হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন, এই সহজিয়া সম্প্রদায় বা সহজযান আসলে হলো বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের ফল – ‘যে পঞ্চকামোপভোগ নিবারণের জন্য বুদ্ধদেব প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলেন, যে চরিত্র-বিশুদ্ধি বৌদ্ধধর্মের প্রাণ, যে চরিত্রবিশুদ্ধির জন্য হীনযান হইতেও মহাযানের মহত্ত্ব, যে চরিত্র বিশুদ্ধির জন্য আর্যদেব ‘চরিত্র বিশুদ্ধি প্রকরণ’ নামে গ্রন্থই রচনা করিয়া গিয়াছেন, সহজযান সেই চরিত্রবিশুদ্ধি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া দিল। বৌদ্ধধর্ম সহজ করিতে গিয়া, সহজযানীরা যে মত প্রচার করিলেন তাহাতে ব্যভিচারের স্রোত ভয়ানক বাড়িয়া উঠিল। ক্রমে বৌদ্ধধর্ম নেড়ানেড়ীর দলে গিয়া দাঁড়াইল। সহজযানীরা সন্ধ্যাভাষায় গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন। সন্ধ্যাভাষার অর্থ আলো-আঁধারী ভাষা। কানে শুনিবামাত্র একরকম অর্থ বোধ হয়, কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলে তাহার গূঢ় অর্থ অতি ভয়ানক। তাহারা দেহতত্ত্বের গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন।… যে বোধিচিত্ত মহাযানমতে নির্বাণ পাইবার আশায় ক্রমেই আপনার উন্নতি করিতেছিলেন, দেহতত্ত্বের মধ্যে আসিয়া তাহার যে কী দশা হইল তাহা আর লিখিয়া জানাইব না। জানাইতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৩)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বৌদ্ধধর্মের এই ভয়াবহ অধঃপতনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরো বলছেন – ‘বৌদ্ধধর্মে অনেকদিন হইতেই ঘুণ ধরিয়াছিল। বুদ্ধদেব নিজে যেদিন স্ত্রীলোকদিগকে দীক্ষা দিয়া ভিক্ষুণী করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন- সেইদিন হইতেই তাহাকে সঙ্ঘের বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য অনেক কঠোর নিয়ম করিতে হইয়াছিল। তিনি ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের এক বিহারে থাকিতে দিতেন না। কিন্তু তাহার মৃত্যুর পাঁচ ছয় শত বৎসর পর হইতে ভিক্ষুরা ক্রমে বিবাহ করিতে লাগিল- ক্রমে একদল গৃহস্থ ভিক্ষু হইল। এইখান হইতেই ঘুণ ধরা আরম্ভ হইল।… ভিক্ষুর ছেলে- সে একেবারেই ভিক্ষু হইত।… আমাদের দেশে যেমন ‘জাত বৈষ্ণব’ বলিয়া একটা জাতি হইয়াছে- সেকালেও তেমনি ‘জাত ভিক্ষু’ বলিয়া একটা জাতির মত হইয়াছিল। উহাদের যত দলপুষ্টি হইতে লাগিল, আসল ভিক্ষুদের অবস্থা তত হীন হইতে লাগিল। গৃহস্থ ভিক্ষুরা কারিগরি করিয়া জীবন নির্বাহ করিত- ভিক্ষাও করিত- কেন বা রাজমজুর হইত, কেন বা স্যাকরা হইত, কেন বা ছুতার হইত- অথচ ভিক্ষাও করিত, ধর্মও করিত, পুজাপাঠও করিত। বৌদ্ধধর্মের পৌরহিত্যটা ক্রমে নামিয়া আসিয়া কারিগরদের হাতে পড়িল।… লেখাপড়া, বিদ্যাবুদ্ধির নামগন্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধদের মধ্যে লোপ পাইল।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৯)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহামহোপাধ্যয়ের এই অনুমান যদি নির্ভুল হয় তাহলে এ-থেকে ঠিক কী সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব? ওই তথাকথিত অধঃপতনের স্বরূপটিকে বিশ্লেষণ করে দেবীপ্রসাদ বলছেন – ‘ওই ‘অধঃপতিত’ বৌদ্ধধর্মের রূপটিকে বিশ্লেষণ করে কি তার মধ্যে শুধুমাত্র স্থূলবুদ্ধি, নির্বুদ্ধি এবং নিরক্ষরতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে? না, এমন কিছু কিছু নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে যার সঙ্গে ইতিপূর্বেই আমাদের পরিচয় ঘটেছে? যদি প্রথম সম্ভাবনাটি ঠিক হয় তাহলে মানতে হবে, প্রাকৃতজনের সংস্পর্শে এসে বৌদ্ধধর্মের মহত্তর ও বৃহত্তর আদর্শগুলির স্থূল-ব্যাখ্যা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু যদি দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ঠিক হয়- যদি দেখা যায় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং জাত-আলাদা কিন্তু সুনির্দিষ্ট কতকগুলি আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান এই তথাকথিত অধঃপাতে-যাওয়া বৌদ্ধধর্মের প্রাণবস্তু হয়ে দাঁড়ালো- তাহলে স্বীকার করতে হবে, সমাজের নিচের মহলের মানুষদের উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এসে পড়া সত্ত্বেও তাদের চিন্তাচেতনায় এই বৌদ্ধধর্ম কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অর্থাৎ, সমাজের নিচের মহলের ওই মানুষদের বিশ্বাসাদির উপর যদিও কৃত্রিমভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রলেপ এসে পড়লো তবুও তারা আসলে তাদের আদিম বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান নিয়েই মেতে রইলো। এই সম্ভাবনা অনুসারে সহজিয়া-সম্প্রদায়কে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে মনে না করে কৃত্রিম বৌদ্ধপ্রভাবের পরিচায়ক মনে করাই সঙ্গত হবে।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪৬০)
বস্তুত এটাই যৌক্তিক যে, সহজিয়া সম্প্রদায়ের উপর বৌদ্ধতত্ত্বের ওই প্রলেপটাই কৃত্রিম এবং অর্বাচীন। তাই একে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের পরিচায়ক না বলে বরং আদিম জাদুবিশ্বাসের কৃত্রিম বৌদ্ধসংস্করণ মনে করাই ন্যায়সঙ্গত। এবং এই প্রভেদটা এইজন্যই তাৎপর্যপূর্ণ যে, দেবীপ্রসাদের মতে, কেননা, বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের পরিচায়ক হিসেবে গ্রহণ করলে এ-সম্প্রদায়ের মূল কথাগুলিকে বোঝবার সময় বৌদ্ধধর্মের মৌলিক তত্ত্বের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে হবে এবং দেখতে হবে একদা-মহৎ কতকগুলি ধ্যানধারণা কীভাবে অশিক্ষিত ও মূর্খ মানুষদের চেতনায় স্থূল ও বিকৃত অর্থে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ-পরিভাষায় কৃত্রিমভাবে সজ্জিত এক আদিম বিশ্বাসের পরিচায়ক বলে গ্রহণ করলে এই সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ওই বৌদ্ধ-পরিভাষাগুলিই অপ্রাসঙ্গিক বলে স্বীকৃত হবে এবং সে-ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের স্বরূপ উপলব্ধির উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র পদ্ধতি গ্রহণ করবার প্রয়োজন হবে।
এখানে স্মর্তব্য যে, সিন্ধু-ধর্ম প্রসঙ্গে কৃষিকেন্দ্রিক উর্বরতামূলক আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানে শক্তি-উপাসনার যে সুপ্রাচীন উপাদানগুলির পরিচয় পেয়েছি তার সাথে সহজিয়া-সম্প্রদায়ের মূল তত্ত্বগুলির বিচার করলেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, সমাজ-বিকাশের পিছনদিককার পর্যায়ে আটকে পড়ে থাকা মানুষদের মধ্যেই সেই বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের স্পষ্টতর স্বাক্ষর রয়েছে। তাছাড়া শাস্ত্রী মহাশয়ের রচনাতেও এমন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন (বৌদ্ধধর্ম ১০৬), বৌদ্ধধর্ম কোথায় গেল? উত্তরে তিনিই বলছেন, প্রধানত মুসলমান আক্রমণের দরুনই বাংলা থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। উড়িষ্যার জঙ্গলে, চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে আজো ওই (অধঃপতিত) বৌদ্ধধর্মের জীবন্ত নিদর্শন পাওয়া যায়। এই অঞ্চলগুলি যে প্রধানতই দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষদের অঞ্চল সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে দেবীপ্রসাদ প্রশ্ন রাখেন, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে-সব ধ্যানধারণাকে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে অনুমান করছেন সেগুলি টিকে থাকবার মতো স্বাভাবিক জমি কেন এই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের মানুষদের মধ্যেই পেলো? এইদিক থেকেও, ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের সঙ্গে এ-জাতীয় ধ্যানধারণার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক অনুমান করা সঙ্গত নয় কি?
এ-প্রেক্ষিতে আরো বলা বাহুল্য হবে না যে, ওই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে গবেষক অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, এ-জাতীয় সম্প্রদায় একটি নয়, বহু। পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে নানান নামের অন্তরালে মূলত ওই একই সম্প্রদায়কে টিকে থাকতে দেখা যায় : কর্তাভজা, বাউল, বৈষ্ণব এবং আরো অনেক নাম। এবং শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এই জাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে তত্ত্বগত সাদৃশ্যের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী-২/৩২৫)- ‘সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া-সাধনা- সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত।’
আর নৃতাত্ত্বিক যুক্তি অনুসারে এই জাতীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াই স্বাভাবিক বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। কেননা, উক্ত ধ্যানধারণার উৎসে যদি কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানই বর্তমান থাকে এবং যদি বাংলার কৃষকদের উৎপাদন-পদ্ধতিতে খুব বড়ো রকমের মৌলিক উন্নতি দেখা না দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের নানান দলের চেতনায় উক্ত ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব নানান নামে প্রতিভাত হওয়াই সম্ভব এবং স্বাভাবিক।
যদিও অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন নিজেও এই সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধধর্মেরই স্মারক বলে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, তবুও তাকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, আধুনিক বিদ্বানদের এই সিদ্ধান্তটি সহজিয়াদের নিজেদের কাছেই অজ্ঞাত – ‘The Sahajias would by no means confess that they were Buddhists, nor refer to any Buddhist texts whick would make it far easier to trace the doctrines to their genuine origin…. It is the duty of a historian and scholar to thrash out grains from the chaff and find out the true Buddhist elements in their views and practices.’ অর্থাৎ : সহজিয়ারা কিছুতেই স্বীকার করবে না যে তারা আসলে বৌদ্ধ। তারা কোনো বৌদ্ধ গ্রন্থেরও উল্লেখ করবে না- তাহলে তাদের মতের প্রকৃত উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হতো।… ঐতিহাসিক ও বিদ্বানের কর্তব্য হলো, ধানকুটে চাল বের করবার মতো করেই সহজিয়াদের মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠান থেকে প্রকৃত বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিকে খুঁজে বের করা।’ (তর্জমা- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৬৩)
ধান কুটে চাল বের করার দৃষ্টান্তটি জুতসই বলা চলে। কেবল কোনটি চাল আর কোনটি তুষ- এখানেই বিভেদ। দেবীপ্রসাদ বলেন, ওই বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিই তুষের মতো- সহজিয়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে এই তুষই বাদ দিতে হবে। বাদ দিলে কী পড়ে থাকে? কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান। আর এর সূত্রের মাথাটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সেই সুপ্রাচীন সিন্ধু-যুগের উর্বরতাকেন্দ্রিক আদিম জাদু-বিশ্বাসের মধ্যেই হয়তো। তাহলে আমাদের আলোচ্য লোকায়তিক দর্শনের সাথে ওই সহজিয়া-সম্প্রদায়গুলির সাদৃশ্য কোথায়? মৌলিক তত্ত্বের দিক থেকে হয়তো বা লোকায়তিকদের সঙ্গে এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের কোনভাবে সাদৃশ্য রয়েছে যা গভীর পর্যবেক্ষণের দাবী রাখে। তবে মোটাদাগে অন্তত একটা সাদৃশ্য খুবই দৃশ্যমান যে, সনাতন বেদপন্থীরা মূলত উভয় সম্প্রদায়কেই ঘৃণার চোখে দেখেছেন। আর তার ফলেই তাদের মধ্যে এই দুটিকে এক করে দেখা কিংবা উপস্থাপনের উৎসাহ ব্যাপক বলে মনে হয়। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠা উচিৎ যে, তথাকথিত অধঃপাত নির্ণয়ে বেদপন্থীদের এই উৎসাহ আসলে কতোটা প্রাসঙ্গিক? কেননা লোকায়তিক বা সহজিয়াদের ওই বামাচার বা কামাচার যদি তাদের কাছে অবৈদিক ও অধঃপাত হিসেবেই বিবেচিত হয় তাহলে বৈদিক সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত বামাচার বা কামাচার-সদৃশ উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্যগুলিকে বেদপন্থীরা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
বৈদিক সাহিত্যে বামাচার
বৈদিক সাহিত্যে বেদ-ত্রয়ীর অন্যতম যজুর্বেদের নিদর্শন দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। শুক্ল-যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী-সংহিতার ২৩/২১ থেকে ২৩/৩১ বেদমন্ত্রগুলিতে কিছু দৃশ্য ও সংলাপের বর্ণনা রয়েছে। কিসের সংলাপ? মৈথুনের। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই মৈথুন-দৃশ্যে ও মৈথুন-সংলাপে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তারা কেউই আজকালকার লম্পটের মতো লোক নন। বরং এরা হচ্ছেন পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিক- অধ্বয্যু, ব্রহ্মা, উদ্গাতা প্রমুখ।
- তার মধ্যে ২৩/২২-২৩ : অধ্বয্যু কুমারীকে অভিমেথন করছেন- দুটি মন্ত্রে অধ্বয্যু ও কুমারীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ।
- ২৩/২৪-২৫ : ব্রহ্মা মহিষীকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে ব্রহ্মা ও মহিষীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ।
- ২৩/২৬-২৭ : উদ্গাথা কুমারী বাবাতাকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে অনুরূপ সংলাপ। ইত্যাদি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বলা আবশ্যক, হরফ প্রকাশনী কলকাতা থেকে প্রকাশিত শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার অনুবাদক ২৩/২০ মন্ত্রের পর আগেভাগেই টীকায় বলেছেন – ‘এখান থেকে ৩১ কণ্ডিকা পর্যন্ত মহীধর ভাষ্যে অশ্লীল অর্থ করা হয়েছে। আধ্যাত্মিক পবিত্র বৈদিক মন্ত্রে এ অশ্লীল অর্থ কেন, তা আমাদের বোধগম্য হয় না। ভাষ্যকার কারণ বলেছেন অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্বের সংস্কারের জন্য তা করা হয়েছে। যাজ্ঞিক অর্থ সম্বন্ধে আমাদের বলবার কিছু নেই, তবে মন্ত্রসকলের অন্য অর্থও সম্ভব। আমরা এখানে ভাষ্য অনুযায়ী সাধারণ একটা অর্থ দিয়েছি।’
- অর্থসহ শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার আলোচ্য অংশটুকু (শুক্লযজুর্বেদ-২৩/২১-৩০) হলো –
- “হে বর্ষণকারী অশ্ব, তুমি বীর্য ধারণ কর, যা রমণীগণের জীবন ও ভোজন স্বরূপ। ২১/১।।
- ক্ষুদ্র পক্ষীর মত কুমারী হলে হলে শব্দ করে যাচ্ছে। ২২/১।।
- হে অধ্বর্যুগণ, পক্ষীর মত তোমাদের মুখই শব্দ করছে, আমাদের প্রতি এরূপ বলো না। ২৩/১।।
- তোমার মাতা ও পিতা কাষ্ঠময় মঞ্চকের অগ্রভাগ রোহন করেছিলেন। ২৪/১।।
- তোমার মাতা ও পিতা পূর্বে মঞ্চকের আগে ক্রীড়া করেছিল। তোমার মুখ যেন আরও বলতে চায়, হে ব্রাহ্মণ, আর বহু কথা বলো না। ২৫/১।।
- পর্বতে ভারবাহী ব্যক্তি যেমন পর্বতের উপর ভার রেখে উপরে উঠে, সেরূপ একে উপরে তোল। ঠান্ডা বাতাসে কৃষক যেমন ধান ঝেরে ধান্যপাত্র উপরে রাখে, সেরূপ একে উপরে রাখ। ২৬/১।।
- পর্বতে ভারবাহী ব্যক্তি যেমন পর্বতের উপর ভার রেখে উপরে উঠে, সেরূপ হে নর, উদ্গাতাকে উর্ধ্বে রাখ। শীতল বায়ুতে কম্পমান লোকের মত একে কাঁপাও। ২৭/১।।
- জলপূর্ণ গাভীর খুরে মৎস্য যেমন কাঁপে, সেরূপে হ্রস্ব ও স্থূল শিশ্ন যোনি প্রাপ্ত হয়ে কাঁপে। ২৮/১।।
- যখন দেবগণ ক্রীড়া করে, তখন চোখে দেখা প্রত্যক্ষের মত নারীর উরু দেখা যায়। ২৯/১।।
- হরিণ ক্ষেত্রস্থ ধান্য ভক্ষণ করলে ক্ষেত্রপতি যেমন সুখী হয় না, সেরূপ শূদ্রা স্ত্রী বৈশ্যগামিনী হলে তার পতি সুখী হয় না। ৩০/১।।”
বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যায় জোর করে এই সাধারণ অর্থ আরোপ থেকে বৈদিক-ভাষায় অনভিজ্ঞ সাধারণ পাঠক এতে কতটুকু কী বুঝবেন জানি না। বোঝার সুবিধার্থে মন্ত্রগুলির প্রকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা-ভাষ্য জরুরি বৈকি। তাই আলোচনার প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বোঝবার সুবিধার্থে শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার ২৩/২৬-২৭ মন্ত্র দুটির অর্থের সঙ্গে উবটভাষ্যও উদ্ধৃত করেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়, যেমন-
- ২৩/২৬ : এই স্ত্রীকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। পর্বতে যেমন করিয়া ভার উত্তোলন করে। অনন্তর ইহার মধ্যদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক। বায়ুতে শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবটভাষ্য : উদ্গাতা বাবাতাকে অভিমেথন করিলেন। কোনো পুরুষকে বলিলেন, এই বাবাতাকে উর্ধ্বে তুলিয়া উষ্প্রিত করো। কেমন করিয়া? পর্বতে ভারবস্তুকে মধ্যস্থানে ধরিয়া যেমন ভাবে উত্তোলন করা হয় তেমনি ইহাকে মধ্যে ধরিয়া উত্তোলন করো। অনন্তর যাহাতে এই বাবাতার যোনিপ্রদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় সেইভাবে ইহাকে ধরো। যেমন কৃষক বায়ুতে ধান্য শুদ্ধ করিতে করিতে গ্রহণ করে ও বপন করে… - ২৩/২৭ : ঊর্ধ্বে এই পুরুষকে তুলিয়া ধরো। যেমন করিয়া পর্বতে ভারবস্তুকে উত্তোলন করা হয়। অনন্তর ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক। শীতল বায়ুতে যব শস্য শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবটভাষ্য : প্রত্যুত্তরে বাবাতা উদ্গাতাকে বলিল, তোমা কর্তৃকও এই রকমই করা হউক। এই পুরুষকে, অর্থাৎ উদ্গাতাকে, উর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। এইখানে স্ত্রীলোক পুরুষের ন্যায় আচরণ করিতেছে। পর্বতে যেমন করিয়া ভার তোলে। অনন্তর এইরূপ ক্রিয়মান ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক, অর্থাৎ মৈথুন চলিতে থাকুক। অনন্তর ইহাকে চাপিয়া ধরো। যেমন কৃষক শীতল বায়ুতে যব শুদ্ধ করিতে করিতে ঝটিতে গ্রহণ এবং বপন করে…
সাধারণ পাঠক নিশ্চয়ই এই দুটি বেদমন্ত্রের আভাসিত অর্থ যাচাইয়ের মাধ্যমে পূর্ব-উদ্ধৃত অন্য মন্ত্রগুলির অন্তর্গত বিশেষ অর্থও অনুধাবনে সমর্থ হবেন আশা করি। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মৈথুন-সংলাপের মধ্যে ক্ষেত্রে বীজ বপনের দৃষ্টান্তের ব্যবহার। তার মানে বামাচারের সঙ্গে বার্তা-বিদ্যার সংযোগ শুধুমাত্র কাপালিক-লোকায়তিক সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয়, খোদ বৈদিক ঐতিহ্যেও একই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেদপন্থীদের জন্য এখানে সমস্যা হলো রচনাটি খোদ বৈদিক ঋষিদেরই। ‘অবশ্যই, পরের যুগের বেদপন্থীরা এই মন্ত্রগুলি নিয়ে খুবই বিপদে পড়েছেন। তার কারণ, তাদের উত্তরযুগের রুচির সঙ্গে এগুলি কিছুতেই খাপ খায় না। তাই পরের যুগে এমনকি বিধান দেওয়া হয়েছে, এই বৈদিক মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করবার জন্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত-বিধানের মূলে নিশ্চয়ই পাপ-বোধ। অথচ, পুরাকালে বৈদিক ঋষিরা যদি সত্যিই একে পাপাচরণ মনে করতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার জন্য পাঁচ-পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিককে নিয়োগ করতে চাইতেন না। তাই তাদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই যে একটি বৈদিক যজ্ঞ-বিশেষ সে-বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহেরই অবকাশ নেই। বস্তুত, বেদের ছাত্রমাত্রই জানেন এই মন্ত্রগুলির সঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞের কী রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৫)
কিন্তু প্রশ্ন হলো, মৈথুনের সঙ্গে বৈদিক যজ্ঞের কী সম্পর্ক? বিষয়টা নিশ্চয়ই কৌতুহলজনক। তবে যজ্ঞ মানে যাই হোক না কেন, অনেক জায়গায় দেখা যায় প্রাচীনেরা মৈথুনকেও সরাসরি যজ্ঞের মতোই মনে করেছিলেন –
- বৃহদারণ্যক উপনিষদের শেষের দিকে তার প্রমাণ পাওয়া যায় – “যাবতীয় ভূতের রস এই পৃথিবী। জল পৃথিবীর রস। ওষধি লতা-পাতা জলের রস। ফুল ওষধির রস। ফল ফুলের রস। ফলের সার পুরুষ। রেতঃ বা জীববীজ পুরুষের রস বা নির্যাস। এইভাবে ক্রমানুসারে পুরুষদেহে এলো সৃষ্টির বীজ- বীর্য। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি সেই জীববীজকে দেখে চিন্তিত হলেন- এর উপযুক্ত আধার (পাত্র) কোথায়? অনেক ভেবে তিনি এর পাত্ররূপে সৃষ্টি করলেন নারীকে, স্ত্রীকে। সৃষ্টি করে, তিনি তাকে নিচে রেখে তার অধোদেশে মিলিত হয়ে মৈথুনকর্মের উপাসনা করেছিলেন। সেই কারণে, আজও পুরুষ স্ত্রীকে নিচে রেখেই তার অধোদেশে মৈথুনের উপাসনা করে আসছে। প্রজাপতি তার সোমলতা পেষার পাষাণদণ্ড বা নোড়ার মতো সুকঠিন জননেন্দ্রিয় বা পুরুষাঙ্গ দিয়ে সেই স্ত্রী সংসর্গ করে তাকে গর্ভবতী করেছিলেন। তার (স্ত্রীলোকটির) উপস্থ অর্থাৎ নিম্নাঙ্গ বা নিতম্ব হলো যজ্ঞের বেদী, তার লোমরাজি কুশ বা যজ্ঞ-তৃণ, তার চর্মাবরণ আশ্রয় বা অধিযবন (=সোমরস নিষ্কাশনের যন্ত্র), তার মধ্যস্থল প্রদীপ্ত অগ্নি, মুষ্কদ্বয় অর্থাৎ দুদিকের দুটি স্থূল মাংসপিণ্ড হোমকুণ্ডের দুদিকের দুই ফলক বা পাথরের আড়াল। বাজপেয় যজ্ঞ যারা করে তারা যে সুফল পায়, স্ত্রীর নিম্নাঙ্গকে যারা এইভাবে দেখে, তারাও সেই সুফল পায়। এটি জেনে যে ‘অধোপহাস’ অর্থাৎ মৈথুন কর্ম করে, সে স্ত্রী দ্বারা নিজে শক্তিমান হয়। আর যে এ তত্ত্ব না জেনে মৈথুন করে সে তার সুকৃতি স্ত্রীকে দেয়।” (বৃহদারণ্যক-৬/৪/১-৩)
- এ-রকম প্রকট বামাচারী চিন্তা কিন্তু উপনিষদে মাত্র একবারই উঁকি দেয়নি, ছান্দোগ্য উপনিষদেও দেখা যায় ছান্দোগ্যের ঋষি বলছেন- “হে গৌতম, স্ত্রীলোকই হলো যজ্ঞীয় অগ্নি। তার উপস্থই হলো সমিধ। ওই আহ্বানই হলো ধূম। যোনিই হলো অগ্নিশিখা। প্রবেশ-ক্রিয়াই হলো অঙ্গার। রতিসম্ভোগই হলো বিস্ফুলিঙ্গ। দেবতারা এই অগ্নিতে রেত বা শুক্র আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সম্ভব হয়।”(ছান্দোগ্য – ৫/৮/১-২)।
- এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদেও হুবহু এ-কথারই প্রতিধ্বনি দেখা যায় – “গৌতম, যোষা অর্থাৎ স্ত্রী যজ্ঞের অগ্নি। তার উপস্থদেশ হলো সেই অগ্নির সমিধ বা ইন্ধন। (উপস্থদেশের) লোমরাজি হলো সেই ইন্ধনের ধোঁয়া। যোনিদেশ হলো সেই অগ্নির শিখা। মৈথুন হলো অঙ্গার। আর শীৎকারাদি যে ক্ষণিক পুলক শিহরণ, তা হচ্ছে সেই যজ্ঞাগ্নির স্ফুলিঙ্গ। এই যজ্ঞাগ্নিতে দেবতারা সেই রেতঃ বা জীববীজ আহুতি দেন। তা থেকে উৎপন্ন হয় পুরুষ (প্রজাতি)। যতদিন প্রাণ থাকে, সেই সন্তান বেঁচে থাকে। তারপর মারা যায়।” (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৩)।।
অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপনিষদের অতি প্রসিদ্ধ ঋষিরাই মৈথুন-ক্রিয়াকে খোলাখুলিভাবেই যজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন। এবং কথায় কথায় সোমযাগ থেকে উপমা নেয়ার চেষ্টাটাও লক্ষ্য করবার মতো বলে দেবীপ্রসাদ তার লোকায়ত দর্শন গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। আমাদের আধুনিক রুচিতে এ-সব কথাবার্তা যতোই কদর্য লাগুক না কেন (যেমন আধুনিককালের স্বামী লোকেশ্বরানন্দও তার উপনিষদ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের ৫/৮/১-২ শ্রুতির বাংলা তর্জমা প্রায় গোটাটাই ফাঁকা রেখে এড়িয়ে গেছেন), উপনিষদের ঋষিরা এই তত্ত্বটির প্রতিই যে কতোখানি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন তার পরিচয় পাওয়া যায় নানান দিক থেকে। যেমন বৃহদারণ্যকের ঋষি এই তত্ত্ব বলবার পরই তিনজন প্রাচীন জ্ঞানীর নজির দেখিয়ে বলেছেন, বিদ্বান উদ্দালক আরুণি, বিদ্বান নাক মৌদ্গল্য ও বিদ্বান কুমারহারিত- এই তিনজনই নাকি এই তত্ত্ব জানতেন এবং সেই মর্মে উপদেশ দিয়েছেন। এবং এই তত্ত্বের অসাধারণ গুরুত্ব বিবেচনায় বৃহদারণ্যকের ঋষি আরো এগিয়ে উপদেশ প্রদান করতে করতে বলছেন – “(বাজপেয় যজ্ঞানুষ্ঠানের মতোই এই অধোপহাস অর্থাৎ মৈথুনকর্ম জেনে) বিদ্বান উদ্দালক আরুণি, মুদ্গল-তনয় নাক ঋষি, কুমারহারিত বলেছিলেন- নামেমাত্র ব্রাহ্মণ, এমন অনেকে আছে যারা এই বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞান না জেনে স্ত্রীসংসর্গ এবং মৈথুনকর্ম করার ফলে বিকলেন্দ্রিয় হয়ে এবং সুকৃতি হারিয়ে মারা যায়। জাগ্রত কিংবা ঘুমন্ত, যে কোন অবস্থাতেই তাদের অনেক-অনেক বীর্যস্খলন ঘটে।.. যদি কেউ জলে স্খলিত বীর্য হয়ে নিজের ছায়া দেখে তবে সে নিজের মঙ্গলের জন্য এই মন্ত্রে প্রার্থনা জানাবে-‘ময়ি তেজ…সুকৃতম্’ অর্থাৎ আমার তেজ, ইন্দ্রিয়শক্তি, যশ, ধন, সৌভাগ্য দেবতারা আমায় দান করুন। যে নারী মলোদ্বাসা অর্থাৎ ঋতুকালীন মলিন-বসন পরিত্যাগ করেছে সে নারীদের মধ্যে শ্রীযুক্তা বা লক্ষ্মীস্বরূপা। অতএব মলোদ্বাসা সেই সৌভাগ্যবতী নারীতে গর্ভাধান করার জন্য পুরুষ তাকে আমন্ত্রণ জানাবে, আহ্বান করবে। যদি সেই নারী পুরুষকে কাম দিতে রাজী না হয়, তবে প্রথমে উপহার সামগ্রি দিয়ে তাকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করবে। যদি তাতেও সে সাড়া না দেয় তবে সেই স্ত্রীকে হাত বা লাঠি দিয়ে প্রহার করে অভিভূত করে বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ তে…আদদ’ অর্থাৎ আমার ইন্দ্রিয়শক্তিরূপ যশ দিয়ে আমি তোমার যশ কেড়ে নিচ্ছি। এই বলে তাতে উপগত হবে। তখন সেই নারী বশে আসতে বাধ্য হবে। আর আহ্বান-মাত্রেই যদি সে স্ত্রী পুরুষের কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য নিজেকে দান করতে চায়, বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ…আদধাম’- অর্থাৎ, আমার ইন্দ্রিয়রূপ যশ দিয়ে তোমাকে যশস্বী করছি। এতে নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যশস্বী হয়, সুখী হয়। পুরুষ যদি নারীটিকে কামনাপরায়ণা করে তুলতে চায়, তবে সে স্ত্রী-অঙ্গে নিজের অর্থ অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ সংযোগ করে, মুখে মুখ রেখে বা মুখচুম্বন করে স্ত্রীর উপস্থ অর্থাৎ নিতম্ব ছুঁয়ে এই মন্ত্র জপ করবে-‘অঙ্গাদঙ্গাৎ…ময়ীতি’- অর্থাৎ, হে রেতঃ, তুমি উৎপন্ন হয়েছো আমার প্রতিটি অঙ্গ হতে, তোমার জন্ম আমার হৃদয়ে। তুমি আমার সর্বাঙ্গের রস। বাণবিদ্ধা হরিণীর-মতো তুমি এই নারীকে বিদ্ধ করো। রসসিক্তা করে একে আনন্দে অধীরা করে তোলো।” (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৪-৯)।
বলাই বাহুল্য, আজকের দিনে এ-ধরনের উপদেশ দিতে গেলে ঋষির গৌরব পাবার বদলে কপালে কী ঘটবে। কিন্তু বৃহদারণ্যক উপনিষদের ঋষি মেয়েদের লাঠি-পিটে, কিলচড় লাগিয়ে কামভাব চরিতার্থ করতে দিতে বাধ্য করবার উপদেশ দিয়েও নাজেহাল হয়েছিলেন বলে কোথাও লেখা নেই। বরং তার রচিত গ্রন্থকে প্রাচীনেরা জ্ঞানের আকর বলেই মনে করেছেন। আর তাতেই প্রমাণ হয় মৈথুন ও কাম সম্বন্ধে আজকের দিনের ধারণার সঙ্গে সেকালের মানুষদের ধারণার একেবারে আকাশ-পাতাল তফাত। এবং এ-বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যখন দেখা যায় মহাভারতের যুগে এসেই এ-বিষয়ে পুরনো কালের ধ্যানধারণার সঙ্গে নতুন কালের ধ্যনধারণাগুলি আর মিল খাচ্ছে না। যেমন, মহাভারতের আদিপর্বের ১১৬ অধ্যায়ে বর্ণিত হচ্ছে (মহাভারত-আদিপর্ব-১১৬/৩-২১) – “তার পর, ধর্মজ্ঞ মহাত্মা ঋষিরা যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, আমি সেই প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব তোমার নিকট বলিব; শ্রবণ কর। চারুহাসিনি, পূর্বকালে সকল স্ত্রীলোকই অনবরুদ্ধ ছিল এবং তাহারা ইচ্ছা অনুসারে বিহার করিয়া বেড়াইত এবং স্বাধীন ছিল। সুন্দরি, তাহারা বিবাহের পর হইতে পতিকে ছাড়িয়া ইচ্ছানুসারে অন্য পুরুষের সহিত বিচরণ করিত; তাহাতে তাহাদের অধর্ম হইত না। কেন না, তাহাই প্রাণিগণের চিরন্তন স্বভাব। মনুষ্যভিন্ন প্রাণীরা আসক্তি ও বিদ্বেষশূন্য হইয়া এখনও সেই প্রাচীন ধর্মেরই অনুসরণ করিয়া থাকে। মহর্ষিরাও প্রত্যক্ষ দেখিয়াছেন বলিয়া এই ব্যবহারের আদর করেন এবং উত্তর কুরুদেশে এখনও এই ব্যবহার আদৃত হইয়া থাকে; আর, এই আচার স্ত্রীলোকদিগের প্রতি অনুগ্রহসূচক এবং চিরকালই চলিয়া আসিতেছে। সুন্দরি, অধিক কাল হয় নাই; যে কারণে যিনি এই দেশে এই নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি বিস্তরক্রমে আমার নিকট শ্রবণ কর। আমাদের শুনা আছে- উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন; শ্বেতকেতু নামে তাহার এক পুত্র ছিলেন, তিনিও মুনি ছিলেন। পদ্মনয়নে, সেই শ্বেতকেতু যে কারণে ক্রোধবশতঃ এই ন্যায়সঙ্গত নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি আমার নিকট শোন। একদা এক ব্রাহ্মণ সেই উদ্দালকের সমক্ষে শ্বেতকেতুর মাতার হস্ত ধারণ করিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেন যে, ‘চল, আমরা যাই’। তাহার পর, বলপূর্বকই যেন মাতাকে সেইভাবে লইয়া চলিয়াছে- ইহা দেখিয়া শ্বেতকেতু অসহিষ্ণুতাবশতঃ ক্রোধ প্রকাশ করিলেন। কিন্তু তখন পিতা উদ্দালক, পুত্র শ্বেতকেতুকে ক্রোধকম্পিত দেখিয়া বলিলেন- ‘বৎস! তুমি ক্রোধ করিও না; ইহাই স্ত্রীলোকদিগের চিরাচরিত নিত্যধর্ম। জগতে সকল বর্ণের স্ত্রীলোকেরাই অনবরুদ্ধ; সুতরাং গরুগুলি যেমন স্বেচ্ছাচারিণী, মনুষ্যরমণীরাও তেমন আপন আপন বর্ণে স্বেচ্ছাচারিণীই হইয়া থাকে। তবে তাহারা কখনও রন্ধনাদি গৃহকার্য্যে অনবধানতা করিত না, কিংবা ঋতুকালে ভর্তাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করিত না’। ঋষিপুত্র শ্বেতকেতু সে প্রাচীন আচার সহ্য করিলেন না; কিন্তু জগতে সকল স্ত্রী-পুরুষের জন্যই এই নিয়ম স্থাপন করিলেন। কুন্তি, আমাদের শুনা আছে যে, তদবধি এই নিয়ম কেবল মনুষ্যসমাজেই চলিয়াছে; কিন্তু অন্য প্রাণীর মধ্যে নহে। ‘আজ হইতে যে রমণী পতিকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করিবে, তাহার ভ্রূণহত্যা তুল্য ঘোরতর দুঃখজনক পাপ হইবে। আবার, কন্যাকালে ব্রহ্মচারিণী এবং বিবাহের পর পতিব্রতা- এহেন ভার্য্যাকে পরিত্যাগ করিয়া যে পুরুষ অন্য স্ত্রীর সংসর্গ করিবে, তাহারও এই পাপই হইবে। আর, যে রমণী ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করিবার জন্য পতির আদেশ পাইয়াও সে আদেশ পালন করিবে না, তাহারও এইরূপ পাপই হইবে’। কুন্তি, পূর্বকালে উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু তপোবলে এই ধর্মসঙ্গত নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন।”
যৌনজীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা যে একটি বিশেষ যুগেই বদলেছে- আগে একরকম ছিলো, পরে অন্যরকম হলো- উদ্ধৃত শ্বেতকেতুর কাহিনীটাই এ-কথার স্পষ্ট প্রমাণ হতে পারে। যদিও সেই যুগ বলতে ঠিক কোন যুগ,- কোন যুগ থেকে কামজীবন সম্বন্ধে আধুনিক ধ্যানধারণার শুরু,- এ-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র। কিন্তু সেকালের ধারণাটা ঠিক কী রকম বা কীরকম ধারণার বশবর্তী হলে বৈদিক ঋষিদের পক্ষে কামজীবনকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক মনে করা সম্ভবপর? এর-জবাবে দেবীপ্রসাদ বলেন, ‘এ-প্রশ্নের পুরো জবাবটা অবশ্যই শুধুমাত্র বৈদিক সাহিত্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।… কিন্তু, যেটা খুবই বিস্ময়ের কথা, এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্য আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করে না। উপনিষদ এবং বিশেষ করে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির কাছ থেকেই প্রশ্নটার অন্তত আংশিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৯)। কী উত্তর? এ-প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ হিসেবে ছান্দোগ্য-উপনিষদের বামদেব্য-ব্রতের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বামদেব্য’ নামটা এখানে উল্লেখযোগ্য। কেননা তার মতে, বৈদিক সাহিত্যেও যে বামাচারের স্মারক রয়েছে তার একটি স্পষ্ট নিদর্শন ওই নামেই মধ্যেই পরিদৃষ্ট হয়। এই বামদেব্য-ব্রত সম্পর্কে ছান্দোগ্য উপনিষদে (ছান্দোগ্য-২/১৩) বলা হয়েছে – “মৈথুনে লিপ্ত হওয়ার আগে যে পুরুষ স্ত্রীলোককে আহ্বান করে সেই হলো পঞ্চবিধ সামের প্রথম সাম ‘হিঙ্কার’। স্ত্রীর মনোরঞ্জন করা বা তাকে সন্তুষ্ট করা হলো দ্বিতীয় সাম ‘প্রস্তাব’। স্ত্রীর সঙ্গে শয্যায় শয়ন হলো ‘উদ্গীথ’। সঙ্গমের প্রাক-মুহূর্তে স্ত্রীর অভিমুখ হয়ে শয়ন করা ‘প্রতিহার’। মিথুন-অবস্থায় থাকা হলো ‘নিধন’। আবার চরিতার্থতাও ‘নিধন’। এই বামদেব্য নামক সাম মিথুনে প্রতিষ্ঠিত। যে এইভাবে বামদেব্য সামকে মিথুনে প্রতিষ্ঠিত বলে জানে সে নিয়ত মিথুনে মিলিত হয়। (তার) প্রত্যেক মিথুন থেকেই প্রজার (সন্তানের) উৎপত্তি হয়। সে পূর্ণজীবী হয়। সন্তান, পশু ও কীর্তিতে মহান হয়। কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না- এই-ই ব্রত।” (ছান্দোগ্য-২/১৩/১-২)। মিথুন থেকে কী কী পাওয়া যাবে? তালিকা হলো – সন্তান পাওয়া যাবে, পূর্ণ জীবন পাওয়া যাবে, পশু পাওয়া যাবে, মহান কীর্তির নামডাক পাওয়া যাবে। এখানে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি হলো, উপনিষদের ঋষি মৈথুনকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনেরই উপায় মনে করছেন না, সেই সঙ্গেই ধন-উৎপাদনের উপায় বলেও বর্ণনা করছেন। উপনিষদের যুগেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকখানিই পশুপালনমূলক বলে আমরা জানি, তাই ধন-উৎপাদন বলতে প্রধানতই পশুবৃদ্ধি। আর এই ধারণার দরুনই মিথুনকে এতোটা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে যে, উপনিষদের ঋষি মিথুনের বিভিন্ন স্তরকে যজ্ঞের হিঙ্কার, প্রস্তাব, উদ্গীথ, প্রতিহার প্রভৃতি পঞ্চবিধ সামগানের সঙ্গে এক বলে বর্ণনা করছেন। শুধু তাই নয়, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’- কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না, এই-ই ব্রত।
তাহলে, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাচীনদের মনে মিথুন সম্বন্ধে ধারণাটা ঠিক একালের আমাদের মতো নয়। আমাদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? উত্তর হলো, সন্তান। কিন্তু প্রাচীন ঋষিদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? শুধু সন্তান নয়, ধনসম্পদও। আমাদের ধারণায় সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে ধনসম্পদ উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাদের ধারণায়, ধনসম্পদ উৎপাদন ও সন্তান উৎপাদন- দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক বড়ো গভীর। কিন্তু কোন্ ধারণা সঠিক এ-নিয়ে কি তর্ক তোলার আদৌ দরকার আছে? এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলেন – ‘এখন, আমাদের ধারণাটা ঠিক না তাদের ধারণাটা ঠিক, এ-নিয়ে তর্ক তোলবার দরকার নেই। অবশ্যই, এ-বিষয়ে আমাদের ধারণা তাদের চেয়ে অনেক স্পষ্ট, অনেক নির্ভুল। তার তুলনায়, তাদের ধারণাটার প্রায় পরেরো আনাই কল্পনা। কিন্তু যেটা আসলে ঢের বড়ো কথা, তাদের যুগে তাদের মনে এই রকমের একটা কল্পনা সত্যিই ছিলো, ছিলো ওই রকমের একটা ভুল ধারণা। তাই তাদের লেখা পুঁথিপত্র আমরা যদি বুঝতে চাই তাহলে আমাদের একালের ধ্যান-ধারণাগুলিকে তাদের লেখার উপর আরোপ করে বসলে প্রকাণ্ড ভুল হবে- ঠিক কী ভেবে তারা কী লিখেছিলেন সে-কথা আমরা বুঝতেই পারবো না।’ (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১১০)। দেবীপ্রসাদ আরো বলেন (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১১১), ‘তাদের মনে যে সত্যিই ওই রকমের একটা ধারণা ছিলো এ-কথার প্রমাণ শুধুই উপনিষদ নয়, ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিও। বরং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে এই কথা এতোবার এবং এতো স্পষ্টভাবে তারা লিখে রেখেছেন যে সেদিকে চোখ না পড়াটাই বিস্ময়কর। স্থানসংকুলানের খাতিরে আমরা এখানে মাত্র একটি নমুনার উল্লেখ করতে পারবো; উৎসাহী পাঠক…অন্যান্য বহু দৃষ্টান্তের উল্লেখ পাবেন। আমাদের এই দৃষ্টান্তটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের প্রথম পঞ্চিকা প্রথম অধ্যায় থেকে সংগৃহিত, তর্জমা শ্রদ্ধেয় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ/৬-৭) : ‘যে যজমান আপনাকে অপ্রতিষ্ঠিত মনে করে সে ঘৃতপক্ক চরু নির্বাপন করিবে। (অপ্রতিষ্ঠিত অর্থে, পুত্রাদিরহিত ও গবাদিরহিত)। হে বৎস, যে এইরূপ প্রতিষ্ঠারহিত সে ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত (শ্লাঘ্য) হয় না। (ঘৃতচরুর দ্বারা সেই অপ্রতিষ্ঠার পরিহার হয়)। তাহাতে (সেই ঘৃতপক্ক চরুতে) যে ঘৃত আছে তাহা স্ত্রীর পয়ঃ (শোনিতস্বরূপ) আর যে তণ্ডুল আছে তাহা পুরুষের (রেতঃ স্বরূপ); সেই ঘৃততন্ডুল মিথুন সদৃশ; সেই জন্য এই মিথুনদ্বারাই (ঘৃততন্ডুলময় চরুপ্রদানদ্বারা) ইহাকে (যজমানকে) সন্ততিদ্বারা ও পশুদ্বারা বর্ধিত করা হয়। (সেই হেতু এই চরু) প্রতিষ্ঠারই হেতু।’ এখানেও সেই একই ধারণার প্রতিচ্ছবি- মিথুন থেকে শুধুই যে সন্তান পাওয়া যাবে তাই নয়, পশু অর্থাৎ ধনসম্পদও। তার মানে, সে-যুগের যারা জ্ঞানী তাদের ধারণায় ধনউৎপাদন আর প্রজনন এমন কিছু আলাদা ব্যাপার নয়। মিথুন থেকে শুধু সন্তান পাবার আশা নয়, পশুদ্বারা বর্ধিত হবার আশাও। আর এই বিশ্বাস যদি অটুট হয় তাহলে তারা স্বভাবতই উপদেশ দেবেন : ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’, কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না- এই-ই ব্রত। এখানে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। এই ব্রাহ্মণমন্ত্রে ঋষি-কর্তৃক মিথুন-সদৃশ ঘৃততণ্ডুলের মধ্যে স্ত্রীর স্বরূপে যে ঘৃতের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে এদিকে বেদপন্থী পণ্ডিত-দার্শনিকদের শ্যেন-দৃষ্টি যে-কোনো অদৃশ্য কারণে পিছলে গেলেও লোকায়ত চার্বাক-মতগোষ্ঠির নামে প্রচলিত প্রবাদ- ‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো সুখেই বাঁচো, প্রয়োজন হলে ঋণ করেও ঘি খাও- উদ্ধৃত করে ভোগবাদিতার পরাকাষ্ঠায় নিন্দামুখর হয়ে তারা লোকায়তিকদের উপর সম্মিলিতভাবে হামলে পড়তে কোন দ্বিধাবোধ করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, আধুনিক কালের বেদপন্থী পণ্ডিতেরা বেদ-উপনিষদে এ-ধরনের লেখা আছে দেখে কী-ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেন? হয়তো বা এ-কারণে বিলক্ষণ বিরক্তিবোধ করতে পারেন। কেননা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ও জাতিগোষ্ঠির মধ্যে আদিম বিশ্বাসজনিত কামাচার বা বামাচারের স্বাক্ষর দেখে যেভাবে তারা আধুনিক রুচি-বিগর্হিত অধঃপাতের নমুনা আবিষ্কার করেন, যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে বেদ-উপনিষদের রচয়িতাদের মধ্যে অত্যন্ত স্থূল আর কদর্য মনোবৃত্তি কল্পনা না করে উপায় থাকে কি? কিন্তু তাই বা কী করে বলা যায়? হাজার হোক, তারা ছিলেন সত্যদ্রষ্টা ঋষি। ফলে আধুনিক বেদপন্থী পণ্ডিতদের পক্ষে হয়তো একমাত্র উপায় হলো ঋষিদের এই জাতীয় কথাবার্তাগুলিকে চেপে যাওয়া। এই প্রবণতার নমুনা খুঁজলে তার কমতি হবে না বলেই মনে হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ পণ্ডিতজনেরা তাদের কথিত অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মে বামাচারের কদর্যতা প্রকাশ করতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করতে হয় বললেও অন্যদিকে বৈদিক সাহিত্যে প্রকটিত বামাচারের জ্বলজ্যান্ত স্মারকগুলি নিয়ে কোথাও কিছু বলেছেন কিনা জানা নেই। আর খুব একটা গুরুত্ববহ না হলেও অতি-সাম্প্রতিক একটা ভিন্নধরনের উদাহরণ এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে হয়। যেমন, ইতঃপূর্বে আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদের ত্রয়োদশ খণ্ডে বর্ণিত বামদেব্য-ব্রতের (ছান্দোগ্য-২/১৩/১-২) শ্রুতিদ্বয় প্রয়োজনীয় তর্জমাসহ উদ্ধৃত করেছি। কিন্তু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ কৃত ‘উপনিষদ’ দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের শঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যায় মূল সংস্কৃতে বামাদেব্য ব্রতের এই শ্রুতিদুটির উল্লেখ থাকলেও তার বাংলা তর্জমা দেয়া হয়েছে এভাবে – ‘উপরোক্ত মন্ত্র দুটির অন্তনির্হিত অর্থ হল, জাগতিক বলতে আমাদের কিছুই নেই। আমাদের সবকিছুই আধ্যাত্মিক, এমনকি দৈহিক অভিজ্ঞতাগুলিও।’- (উপনিষদ দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮২)
বাস্তবে কি তাই? প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের বক্তব্যগুলিকে এভাবে চেপে যাওয়া বা ভণিতার মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়ার পদ্ধতিটাই যে ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, দেবীপ্রসাদের মতে, প্রাচীনেরা কী ভেবে কী লিখেছেন তা ঠিকমতো বুঝতে হলে সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার যে প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন- তাই একালের ধ্যানধারণাগুলি তাদের মধ্যে কল্পনা করাটাই অসঙ্গত ও যুক্তিহীন। বৈদিক সাহিত্যের মূল গ্রন্থাবলি অনেকটা দুষ্প্রাপ্য হলেও তবুও এখনো বিরল নয়, বহাল তবিয়তে বর্তমান আছে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, প্রাচীন জড়বাদী চার্বাক-মতের নিজস্ব গ্রন্থাবলির বিলুপ্তিজনিত কারণে তাদের বিবৃতি ও বক্তব্য খুঁজে পেতে আমাদেরকে যখন বিরোধীপক্ষের গ্রন্থের উপরই নির্ভর করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে চার্বাক-মত নির্ধারণে সুনিশ্চিতভাবেই অদ্ভূত এক জটিলতার সম্মুখীন হতেই হয়, কোনটা তাদের প্রকৃত মত কিংবা কোনটা বিরোধীপক্ষের বিকৃত-উপস্থাপনের ভণিতা তা নির্ধারণের অসহায়তা। সে যাক, আমাদের মনোযোগের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো একই জড়বাদী দর্শনের বিভিন্ন নামকরণের প্রবনতা পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ চার্বাকই বার্হস্পত্য এবং বার্হস্পত্যই যে লোকায়ত, এ বিষয়টি ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবসময়ই একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়েই উপস্থাপিত হয়ে এসেছে। ফলে সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন থেকেই লোকায়ত মতের গভীরে চার্বাক দর্শনের আদি রূপটিকে খুঁজে দেখা যৌক্তিকভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে চার্বাক দর্শনের মূল স্পন্দনটুকু। তবে লোকায়তিক আলোচনায় প্রবেশের আগে বৃহস্পতির সূত্র তথা বার্হস্পত্য-দর্শনের সাথে আরেকটু নিবিড় পরিচয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়।
বার্হস্পত্য, চার্বাক-মতের আদিরূপ
চার্বাকী জড়বাদী চিন্তাধারার উপর কেবলি এক দেহাত্মবাদী ভোগলিপ্সু দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে এই মতটি যে ঘৃণ্য অসুর মত তা প্রমাণ ও প্রচারে ব্যস্ত হওয়ার নিদর্শন শুধু ভিন্নমতাবলম্বী দার্শনিকদের মধ্যেই নয়, বরং এর প্রবনতা-উৎস ঢের পেছনে সেই উপনিষদ যুগ থেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। প্রাচীন ছান্দোগ্য-উপনিষদের (৭০০ খ্রিস্টপূর্ব) ‘প্রজাপতি ও ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদ’ উপাখ্যানে এই নমুনা অস্পষ্ট নয়। উপাখ্যানটি এরকম – “প্রজাপতি এক সময় বলেছিলেন যে, পাপ-জরা-মৃত্যু-শোক-আহারেচ্ছা-পিপাসা রহিত যে আত্মা সত্যকাম, সত্যসঙ্কল্প তাকেই অন্বেষণ করতে হবে, বিশেষভাবে জানতে হবে। যে তাকে অনুসন্ধান করে জানতে পারে তার কাছে কোন লোক (জগৎ) যেমন অপ্রাপ্য থাকে না, তেমনি কোন কামনাই অপূর্ণ থাকে না। দেব ও অসুরগণ উভয়েই লোকপরম্পরায় এই উপদেশের কথা শুনলেন। দুপক্ষই নিজেদের মধ্যে বসে আলোচনা করলেন, ‘যে আত্মাকে অনুসন্ধান করলে সর্বলোক ও সর্বকাম্যবস্তু লাভ করা যায়, আমরা সেই আত্মাকে অনুসন্ধান করবো’। (এ উদ্দেশ্যে) দেবগণের মধ্যে দেবরাজ ইন্দ্র এবং অসুরগণের মধ্যে অসুররাজ বিরোচন (প্রজাপতির) অভিমুখে গমন করলেন। তারা পরস্পরকে না জানিয়ে সমিৎপাণি অর্থাৎ সমিধ হাতে শিষ্য হয়ে প্রজাপতির সমীপে উপস্থিত হলেন। তারা সেখানে দুজনেই বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য নিয়ে রইলেন। তারপর একদিন প্রজাপতি তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী ইচ্ছা করে তোমরা এখানে এমনভাবে রইলে ?’ তারা বললেন, ‘ভগবানের বাক্য বলে বিদিত যে- যে-আত্মা পাপরহিত, জরারহিত, শোকরহিত, অশনেচ্ছারহিত, যিনি সত্যকাম ও সত্যসঙ্কল্প- তাকেই অন্বেষণ করতে হবে, তাকেই বিশেষরূপে জানতে হবে। যিনি এ আত্মাকে অনুসন্ধান করে জানেন, তিনি সর্বলোক ও সমুদয় কাম্যবস্তু লাভ করেন। সেই আত্মাকে জানার ইচ্ছা নিয়েই আমরা এখানে আপনার কাছে রয়েছি।’ প্রজাপতি তাদের প্রার্থনা শুনে বললেন- ‘চক্ষুতে যে পুরুষ দৃষ্ট হয়, ইনিই আত্মা।’ তিনি আরো বললেন- ‘ইনিই অমৃত অভয় এবং ইনিই ব্রহ্ম।’ প্রজাপতির এই উপদেশের মর্মার্থ ধরতে না পেরে তারা জিজ্ঞাসা করলেন- হে ভগবন্, এই যে পুরুষ জলে দৃষ্ট হয়, আর এই যে পুরুষ দর্পণে দৃষ্ট হয়, এই পুরুষ কে? প্রজাপতি বললেন- ‘এই সমুদয়েই আত্মা পরিদৃষ্ট হন।’ প্রজাপতি বললেন- ‘জলপূর্ণ পাত্রে আপনাকে (দেখো), দেখে আত্মার বিষয়ে যা বুঝবে না, তা আমাকে বোলো।’ তারা জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদেরকে দেখলেন। এরপর প্রজাপতি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী দেখলে ?’ তারা বললেন- হে ভগবন্ ! আমরা সমগ্র আত্মা- লোম ও নখ পর্যন্ত এর প্রতিরূপ দর্শন করলাম। প্রজাপতি তাদেরকে বললেন- ‘(এবার) সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে, সুবসন পরিধান করে, পরিষ্কৃত হয়ে জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদের দর্শন করো।’ তারা সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে সুবসন পরিধান করে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদের দর্শন করলেন। প্রজাপতি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী দেখলে ?’ তারা বললেন- ‘হে ভগবন ! এই আমরা যেমন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত এবং পরিষ্কৃত, তেমনি জলের মধ্যেও এই দু’জন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত ও পরিষ্কৃত।’ প্রজাপতি বললেন- ‘ইনিই আত্মা; ইনিই অমৃত ও অভয় এবং ইনিই ব্রহ্ম।’ (এই জ্ঞান নিয়ে) এরপর দু’জন শান্ত হৃদয়ে ফিরে গেলেন। তাদেরকে (চলে যেতে) দেখে প্রজাপতি মনে মনে বললেন- ‘(এরা) আত্মাকে উপলব্ধি না করেই, আত্মাকে অবগত না হয়েই চলে গেলো। এদের মধ্যে যে এটাকে উপনিষৎ (অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞান) বলে গ্রহণ করবে- দেবতা হোক বা অসুরই হোক- সে বিনাশপ্রাপ্ত হবে।’ বিরোচন শান্ত হৃদয়ে অসুরদের নিকট গেলেন এবং তাদেরকে এই উপনিষৎ শিক্ষা দিলেন- ‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করবে এবং দেহেরই পরিচর্যা করবে। দেহকে মহীয়ান করলে এবং দেহের পরিচর্যা করলেই ইহলোক ও পরলোক- এই উভয় লোকই লাভ করা যায়।’ এইজন্য আজও দানহীন, শ্রদ্ধাহীন, যজ্ঞহীন ব্যক্তিকে অসুর বলা হয়। এটাই অসুরগণের উপনিষৎ। তারা গন্ধমাল্যাদি এবং বসন ও অলঙ্কার দ্বারা মৃতব্যক্তির দেহকে সজ্জিত করে এবং মনে করে এর দ্বারা পরলোক জয় করবে।” (ছান্দোগ্য-উপনিষদ ৮/৭/১-৪, ৮/৮/১-৫)। এই দীর্ঘ উপাখ্যানের এখানেই শেষ নয়। এরপর, অসুরদের প্রতিনিধি বিরোচন ওইভাবে দেহকেই আত্মা বলে জেনে সন্তুষ্ট হলেও দেবতাদের প্রতিনিধি ইন্দ্রের কাছে এই দেহাত্মবোধ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি প্রজাপতির কাছে প্রত্যাবর্তন করেন এবং দেহাত্মবোধের ভ্রম উত্তীর্ণ হয়ে তার ক্রমশ সচ্চিদানন্দ আত্মাকে উপলব্ধি করার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়া একে একে বর্ণিত হয়েছে।
দেহাতিরিক্ত এই আত্মার ধারণাই মূলত ভারতীয় আস্তিক দর্শনগুলোর মূল বিবেচ্য বিষয়। অন্যদিকে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনে ইন্দ্রিয়াতিরিক্ত কোন সত্তা স্বীকৃত নয়, যা চার্বাক দর্শনের মূল কথা। উল্লেখিত উপাখ্যানে ব্রহ্মার বদান্যতায় অসুর মতের যে দেহাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারিত হয়েছে, তাতে বৈদিক সংস্কৃতির বিপরীত ধারণাটাই অসুর মতের মাধ্যমে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে করে অনুমিত হয় যে, প্রাচীন উপনিষদ যুগের শুরুতে কিংবা তারও আগে থেকেই ভারতীয় সমাজে চার্বাক মতের জড়বাদী চিন্তাধারার উদ্ভব হয়ে গেছে। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই লোকসমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো বা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো বলেই হয়তো প্রাচীন উপনিষদে একে প্রতিরোধের নিমিত্তে বিভিন্ন উপাখ্যানেরও সৃষ্টি হয়েছে। আবার প্রাচীন উপনিষদে দেহাত্মবাদ বিরোধী আধ্যাত্মবাদী ধারণা ও মতামতের মধ্যেও পরবর্তী যুগের পরিণত চার্বাকী দেহাত্মবাদের প্রাথমিক রূপের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ঐতরেয় উপনিষদে (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৫০০) বলা হয়েছে – “সেই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত (মাটি, বায়ু, আকাশ, জল, অগ্নি বা তেজ)। ইনিই ক্ষুদ্র কীটাণুকীট, উভচর থেকে সব কিছুর উৎপত্তিস্থল- বীজ। অণ্ডজ (পাখি ইত্যাদি), উদ্ভিজ্জ (গাছপালা প্রভৃতি) থেকে শুরু করে ঘোড়া, গরু, মানুষ, হাতি- যত প্রাণী, এমনকি স্থাবর-জঙ্গমের মধ্যেও ইনিই হলেন সেই প্রাণ। প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সেই প্রজ্ঞাই হল সব কিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সব কিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। তিনিই সেই আত্মা।” (ঐতরেয় উপনিষদ – ৩/৩)।
উপনিষদীয় এই আধ্যাত্ম ধারণার বিরোধী চার্বাক মতের দেহাত্মবাদ সংশ্লিষ্ট দার্শনিক সূত্রে আমরা দেখি – “পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। এর সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।” (বার্হস্পত্য-সূত্র)। এখানে আত্মার অস্তিত্ব তো নেই-ই, এমনকি আকাশ নামের কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যহীন ভূত বা তত্ত্বও স্বীকৃত হয়নি। এই দেহাত্মবাদী চার্বাক চেতনার উৎসকাল জানার কোন প্রামাণ্য তথ্য আমাদের হাতে না থাকলেও এটা কল্পনা করতে বাধা নেই যে, উপরিউক্ত উপনিষদীয় ধারণার প্রেক্ষাপটেও যদি বিরোধী দেহাত্মবাদী মত সৃষ্ট হয়ে থাকে তাহলেও উপনিষদ যুগেই চার্বাক ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছিলো।
একইভাবে বৃহদারণ্যক উপনিষদের (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০) একটি অনুচ্ছেদে আত্মতত্ত্ব বিশ্লেষণে মরণোত্তর চৈতন্যের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি দেখা যায় – “(মৈত্রেয়ীকে) যাজ্ঞবল্ক্য বললেন- একটা নুনের ডেলা জলে পড়ে গেলে ডেলাটাকে তুলে আনতে পারবে না। জলের সঙ্গে সে মিশে একাকার হয়ে যাবে। জলটাই নোনতা হয়ে যাবে। যেখান থেকেই চুমুক দাও, সেই মিশে-যাওয়া নুনের স্বাদটুকু ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। আমাদের সেই মহান বস্তুটিও তেমনি অনন্ত, অপার, বিজ্ঞানময়। ব্রহ্মাণ্ডের স্থাবর থেকে শুরু করে দেবতা, মানুষ যত জঙ্গম দেখি সবই অভিব্যক্ত হয়েছে ঐ মহান আত্মা থেকে। এক এক রূপ, এক এক নাম। যখন এদের সংজ্ঞা লোপ পায়, পরমায়ু শেষে মৃত্যু আসে, তখন সবই গিয়ে মিশে যায় তার সঙ্গে। সেই মহান আত্মাই হল তত্ত্ব।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ – ২/৪/১২)। অন্যান্য উপনিষদের বিভিন্ন স্থানেও আত্মতত্ত্ব ব্যাখ্যায় এই জলের সাথে মিশে থাকা লবণের দৃষ্টান্ত উক্ত হতে দেখা যায় (যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদ: ঋষি উদ্দালক-শ্বেতকেতু উপাখ্যান ২/৪/১২, ৬/১৩/১-২ ইত্যাদি)। ভূতাত্মক দেহ থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি এবং দেহনাশের সমকালীন চৈতন্যের বিনাশসম্বন্ধীয় যে ধারণা চার্বাক মতে অঙ্গীভূত তার প্রতিচ্ছবি এই উপনিষদীয় অনুচ্ছেদে লক্ষ্যণীয়। এই উপনিষদীয় ধারণা থেকে আত্মাটাকে বাদ দিলেই চার্বাকীয় দেহাত্মবাদী রূপটি স্পষ্ট হয়ে যায়।
তবে কঠোপনিষদের (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-৪০০) নচিকেতা-যমরাজ উপাখ্যানের এক পর্যায়ে পরলোকগামী আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী সম্প্রদায় বিশেষের উল্লেখ (কঠোপনিষদ: ১/১/২০) আমাদেরকে ভিন্ন বা আদিরূপে চার্বাক মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ সেই উপনিষদীয় যুগেই চার্বাক দর্শনের আদিরূপের অস্তিত্বে আধ্যাত্মবাদ বিরোধী বস্তুবাদী ধারণার উপস্থিতির সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না। আলোচ্য এই দীর্ঘ নচিকেতা-যমরাজ উপাখ্যানটির উদ্দিষ্ট অংশটুকুতে আমরা দেখি – ঋষি গৌতম রাজশ্রবস যজ্ঞদানকালে একবার রেগেমেগে কথায় কথায় পুত্র নচিকেতাকে যমকে দান করলে পিতৃবাক্য পালনে নচিকেতা যমালয়ে গিয়ে উপস্থিত হন। পরবর্তীতে নচিকেতার গুণে সন্তুষ্ট যমরাজ নচিকেতাকে তিনটি বর দিতে চাইলেন। তৃতীয় বর চাইতে গিয়ে নচিকেতা বললেন – “মানুষ মাত্রেই মরণশীল। জন্মালে মরতেই হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর কী? কেউ বলেন আত্মা আছে। কেউ বলেন বাজে কথা, আত্মা থাকে না। যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে ততদিনই আত্মা থাকে, কাজ করে। মরে প্রেত হয়ে গেলে নাকি আত্মারও আর কিছু করার থাকে না। এ-নিয়ে আমাদের মধ্যে দারুণ সংশয় আছে। এ-ব্যাপারে কোনটা ঠিক, মৃত্যুর অধিপতি আপনি যেমন জানেন, আর কেউ তেমন জানেন না। এর রহস্য জানতে আমার খুব ইচ্ছে। আপনি যখন স্বেচ্ছায় আমাকে বর দিতে চেয়েছেন, তখন এটাই আমার তৃতীয় প্রার্থনা। পরলোকের রহস্য আমায় বলুন। নচিকেতার বর প্রার্থনা শুনে যমরাজ চমকে উঠলেন। ভাবতেও পারেননি যে ঐটুকু ছেলে নচিকেতা তাকে এমন একটা প্রশ্ন করে বসতে পারেন। এ যে দারুণ গোপন ব্যাপার। পরলোকের এই রহস্য যদি কোন মানুষ জানতে পারে, তাহলে আর তো সে তার আওতার মধ্যে থাকবে না। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন – “তোমার এই প্রশ্নের জবাব দেয়া বড়ই কঠিন। সহজে বোঝানো যায় না, বোঝাও যায় না। দেবতারাও এখনো এ-নিয়ে সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছেন, মানুষ তো কোন্ ছার। তুমি ও-বিষয়ে জানার জন্য আমাকে অনুরোধ কোরো না। অন্য বর চাও। নচিকেতা বললেন – (সে কি কথা যমরাজ!) পরলোকের এমনি রহস্য যে বোঝানোও যায় না, বোঝাও যায় না ? আবার দেবতারাও সঠিক জানেন না ! মহারাজ, যদি তাই হয়, তাহলে, এই বর ছাড়া আমার আর অন্য বর নেই। বিশেষ করে আপনার মত ধর্মরাজের অনুগ্রহ যখন পেয়েছি, তখন এই রহস্য ছাড়া আমি আর অন্য কিছু জানতে চাই না। কেননা, আত্মতত্ত্বই হল পরমপুরুষার্থ- সবরকমের বন্ধনমুক্তির একমাত্র উপায়।” (কঠোপনিষদ – ১/১/২০-২২)। অতঃপর উপাখ্যানটি পরলোক, আত্মা ইত্যাদি আধ্যাত্মিক ধারণার জটিল থেকে জটিলতর বুননের দিকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু সেই উপনিষদের যুগেই যে ইন্দ্রিয়াতীত আত্মা বা পরলোকের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক প্রতিষ্ঠিত ছিলো তা নিয়ে হয়তো সন্দেহ থাকে না। এবং চার্বাক মতের আদিরূপে এসব ভাববাদী চেতনায় অবিশ্বাসী বস্তুবাদীদের উপস্থিতিও বেশ জোরেশোরে ছিলো বলে প্রতীতী হয়।
ভারতীয় দর্শন সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই জড়বাদী চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন নামেই অভিহিত করা হয় এবং তাকেই বার্হস্পত্য মত হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আর বার্হস্পত্য মত মানে বৃহস্পতির মত বা বৃহস্পতি-প্রণীত মত। পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে বৃহস্পতি দেবগুরু বা দেবতাদের আচার্য। কিন্তু স্বয়ং দেবগুরু-প্রণীত মত হওয়ায় বৈদিক সংস্কৃতির বাহকদের কাছে দর্শনটি খুবই মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কথা থাকলেও তা না-হয়ে যে ঠিক উল্টোটিই হয়েছে, এর কারণ তার জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিই। এবং এই জড়বাদী মত কী করে দেবগুরুর উদ্ধৃতিতে প্রচারিত হলো, এটাই ভারতীয় দর্শনে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ রহস্য। অবশ্য পৌরাণিক উপাখ্যানেই এই রহস্যের জবাবও দেয়া হয়েছে বেশ কৌশলে। মৈত্রায়নী উপনিষদের উপাখ্যান অনুসারে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা হেরে গেলে দেবগুরু বৃহস্পতি ফন্দি করে অসুর গুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে অসুরদের মধ্যে গিয়ে এই বেদবিরোধী বস্তুবাদী দর্শনের প্রচার করেন। এবং এই ভ্রান্ত ও ঘৃণ্য মতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অসুরেরা এমন অধঃপাতে গেলো যে সেই সুযোগে তাদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে দেবতারা হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এই উপাখ্যানের মাধ্যমে একটা প্রতারণামূলক নাস্তিক্যবাদী শাস্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে বৃহস্পতিকে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে। সাথে হয়তো এটাও শিক্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এই শাস্ত্র অসুরদের নাশের জন্যেই সৃষ্ট, তাই এটা অনুসরণ করলে অনুসরণকারীর জন্য অধঃপাত অনিবার্য।
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবে আমাদেরকে পুনরায় স্মরণ করতে হয় যে, উপনিষদ হলো বেদের অন্তিম অংশ। সংহিতা বা মন্ত্রের মাধ্যমে যে বৈদিক যুগের প্রারম্ভ এবং বৈদিক ‘ব্রাহ্মণে’ যার পূর্ণ বিকাশ, সেই বৈদিক যুগের পরিসমাপ্তি এই উপনিষদের যুগে। কিন্তু এই যুগের পরিধিকে কোন বিশেষ সীমারেখায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের কালকে ইতিহাসের এক বিশেষ সীমা হিসেবে চিহ্নিত করে এর সাপেক্ষে ‘ছান্দোগ্য’, ‘বৃহদারণ্যক’ প্রভৃতি কয়েকটি প্রধান উপনিষদের রচনাকালকে বহু প্রাচীন এবং বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বলে মনে করা হলেও ‘মৈত্রায়ণীয়’ এবং অন্যান্য বহু উপনিষদ বুদ্ধোত্তর বলে অনেকেরই ধারণা। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার ‘দর্শন-দিগদর্শন’ গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য উপনিষদগুলির ক্রমিক সৃষ্টিকাল নির্ণয় করেছেন এভাবে –
- (১) প্রাচীনতম উপনিষদ (৭০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) ঈশ, (খ) ছান্দোগ্য, (গ) বৃহদারণ্যক।
- (২) দ্বিতীয় যুগের উপনিষদ (৬০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) ঐতরেয়, (খ) তৈত্তিরীয়।
- (৩) তৃতীয় যুগের উপনিষদ (৫০০-৪০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) প্রশ্ন, (খ) কেন, (গ) কঠ, (ঘ) মুণ্ডক, (ঙ) মাণ্ডুক্য।
- (৪) চতুর্থ যুগের উপনিষদ (২০০-১০০ খ্রিস্টপূর্ব)- (ক) কৌষীতকি, (খ) মৈত্রী বা মৈত্রায়ণীয়, (গ) শ্বেতাশ্বতর।
সেক্ষেত্রে এই মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের উপাখ্যান কল্পনা যে দেবগুরুর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের এক কৌশলী প্রয়াস হিসেবেই করা হয়ে থাকতে পারে এই সন্দেহ অযৌক্তিক হবে না। অর্থাৎ এই পৌরাণিক কাহিনী সৃষ্টির আগেই চার্বাক বা লোকায়ত মত ভারতীয় সমাজে ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিলো। তাছাড়া বৈদিক সংস্কৃতির ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বুদ্ধমতেরও সূচনা হয়েছিলো বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
এছাড়াও বুদ্ধের প্রায় সমকালবর্তী ও বয়োজ্যেষ্ঠ দার্শনিক অজিত কেশকম্বলীর (৫২৩ খ্রিস্টপূর্ব) উক্তিতেও চার্বাকী চিন্তার প্রতিচ্ছবি রয়েছে। বৌদ্ধ ত্রিপিটকের কয়েক জায়গায় যেমন দীঘনিকায় (১/২), মজ্ঝিমণিকায় (২/১/১০, ২/৬/৬) অজিত কেশকম্বলীর দার্শনিক মতের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে এভাবে – ‘দান-ধ্যান …যজ্ঞ নেই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল বিপাক নয়। ইহলোক-পরলোক নয়, মাতা-পিতা-দেবতা নেই। সত্যলোকে পৌঁছে যাওয়া এমন কোন সত্যারূঢ় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি স্বয়ং ইহলোক-পরলোককে জ্ঞাত হয়ে মানুষকে বোঝাতে পারেন। মনুষ্য চতুর্ভূতের সৃষ্টি। মৃত্যুর পর (দৈহিক) পৃথিবী পৃথিবীতেই বিলীন হয়। …অনল অনলে …জল জলে …বায়ু বায়ুতেই লয় প্রাপ্ত হয়। ইন্দ্রিয় আকাশে গমন করে। মৃত ব্যক্তিকে খাটে করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। চিতায় অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হয়; তারপর অস্থিসমূহ ক্রমশ ক্ষুদ্র ও ধূসরবর্ণ হয়ে আসে, অবশেষে চিতাভস্ম ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। দান করার পরামর্শ মূর্খের উপদেশ, যিনি আস্তিক্যবাদের কথা বলেন তিনি তুচ্ছ ও মিথ্যা কথা বলেন। মূর্খ-বিদ্বান সকলেই বিনষ্ট হয়, বিচ্ছিন্ন হয়, মৃত্যুর পর আর কিছু থাকে না।’ (পৃষ্ঠা-৭৪, দর্শন-দিগদর্শন ২য় খণ্ড / রাহুল সাংকৃত্যায়ন)। বৈদিক যজ্ঞ ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের বিশেষ সুবিধাভোগের বিরোধিতা এবং বেদবিহিত শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের সমালোচনার মাধ্যমে কেশকম্বলী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা অজিত কেশকম্বলীর উপরিউক্ত চিন্তাধারা চার্বাক দর্শনের সঙ্গে একই আসনে নিজের স্থান করে নিয়েছে বলা যায়। এখানে – ‘চার্বাকের মত অজিতও মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। আর পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, কর্মফল ইত্যাদি ধারণাও অস্বীকার করেন। জাগতিক বস্তুনিচয়ের উপাদান হিসাবে পঞ্চ মহাভূতের পরিবর্তে চার মহাভূতের স্বীকৃতিতে ভারতীয় সাধারণ ধারণার যে ব্যতিক্রম চার্বাক মতবাদে পরিস্ফুট, অজিতের মধ্যে আমরা তার সূচনা লক্ষ্য করি। …অজানিত ভবিষ্যতে সুখের আশায় জীবনের প্রতিদিনের সাধারণ আনন্দের প্রতি যারা উদাসীন- তাদের আদর্শবাদী চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত হল এই সম্প্রদায়ের মনোভাব। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে চার্বাকদের সঙ্গে কেশকম্বলীদের অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।’ (পৃষ্ঠা-১৬, চার্বাক দর্শন / লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
এরকম নাস্তিক্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নমুনা রামায়ণেও বিরল নয়। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (রামায়ণ: ২/১০৮) ব্রাহ্মণ জাবালির উক্তির মধ্যে এই মতাদর্শীয় যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে পরবর্তীকালের ‘চার্বাক’ নামযুক্ত দর্শনের রূপ সুস্পষ্টভাবেই পরিস্ফুট হয়েছে। ‘পিতার মৃত্যুর পর ভরত বনবাসী রামকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করে পিতৃসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার জন্য অনুরোধ জানালে পিতৃসত্য পালনে কৃতসংকল্প রাম তার সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এবং অরণ্যজীবনের কঠোরতা বরণের সমর্থনে অভিমত জ্ঞাপন করেন। রামকে কৃচ্ছ্রসাধনের দৃঢ় সংকল্প থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণ জাবালি উপদেশাত্মক এক বিবৃতি দেন এবং রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত নাস্তিকবাদ এই প্রচেষ্টারই সাক্ষ্য বহন করে। জাবালি বলেন যে, পারলৌকিক ধর্মের মোহে বৈষয়িক সুখকে বিসর্জন দেওয়ার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। এর ফলে বর্তমান জীবন দুঃখময় হয়, কিন্তু পরিণামে দেহত্যাগের পর সুখের কোন সম্ভাবনা থাকে না। কারণ ফলভোক্তার দেহাতিরিক্ত কোন পৃথক সত্তা নেই। অন্ন প্রভৃতি ভোজ্য বস্তুর সাহায্যে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য যে ভোগ সম্ভব, শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমরা সেটাকেই কেবল নষ্ট করি, নতুন কোন ফল পাই না। জাবালি বলেন যে, মৃত্যুর পর প্রাণীর কোন অস্তিত্ব থাকে না। কাজেই মৃতের উদ্দেশ্যে আমরা যে ভোজনের আয়োজন করি তা নিরর্থক হয়। আপাতঃ রমণীয় হলেও জাবালির উপদেশকে রাম প্রতিপালনের অযোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন এবং এর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে নিজ সঙ্কল্প পরিত্যাগ করেননি।’ (পৃষ্ঠা-১১, চার্বাক দর্শন / লতিকা চট্টোপাধ্যায়)
উল্লেখ্য, বর্তমানে মহাভারতকে যে আকারে পাওয়া যায় তার রচনাকালের পূর্বসীমা খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ এবং শেষ সীমা খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক বলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষের দিকেই রামায়ণ রচনা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। অর্থাৎ রামায়ণ এবং মহাভারতের পূর্ণ রূপায়ণের বহু পূর্বেই ভারতীয় দর্শনের জগতে ‘চার্বাক’ নাম বিশিষ্ট না হলেও এই মতের আবির্ভাব সূচিত হয়েছিলো বলেই প্রতীয়মান হয়। এবং এই মত যে প্রকৃতই তৎকালীন লোকসমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো, প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে এর উপস্থিতি এই সাক্ষ্যই দেয়। হতে পারে এই মতকে অসার বা প্রয়োগযোগ্যতাহীন প্রতিপন্ন করার প্রয়োজনেই তৎকালীন সাহিত্য-আয়োজনে এর উপস্থাপন করা হয়েছিলো, তবু ইতিহাসের নিরীখে এই উপস্থিতির গুরুত্ব কোনভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে রাখা দরকার যে, ‘অবশ্যই মহাভারত একজনের রচনা নয়। অধুনালভ্য মহাভারতের সংস্করণটি নানা কবির হাত ঘুরে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তাই মহাভারতের সর্বত্র হুবহু একই মতাদর্শের পরিচায়ক হবার কথা নয়।’ (পৃষ্ঠা-২২, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। অতএব মহাভারতে নাস্তিক্য বা লোকায়ত বস্তুবাদী মতের আভাস যেমন বিরল নয়, তেমনি বস্তুবাদ-বিদ্বেষের নজির দেখানোও কঠিন নয়।
মহাভারতের বনপর্বে (মহাভারত: ৩/৩০-৩১) দেখা যায়, দ্যুত ক্রীড়ায় পরাজিত পঞ্চপাণ্ডব যখন বন থেকে বনান্তরে ঘুরে অশেষ দুর্দশায় কালাতিপাত করছিলেন, সে সময় যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশ্যে দ্রৌপদী বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যের অনুকুলে নানা ধরনের যুক্তি দেখিয়ে যে বক্তব্য রাখেন তাতে ‘নাস্তিক্য’ মতের আভাসই পরিলতি হয়। নিজ শক্তিতে বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করে নেবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করার যে প্রয়াস দ্রৌপদীর বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায়, তা যে তৎকালীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতিতে প্রচলিত অদৃষ্ট, প্রাক্তন বা পূর্বজন্মের কর্মের সংস্কার ইত্যাদি ধারণার পরিপন্থি ছিলো বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা সনাতন ধর্মের এই সংস্কারে পূর্ণ প্রভাবিত মানুষ গভীরতম দুঃখেও বিচলিত না হয়ে নিজের দুর্দশাকে অতীতেরই স্বকৃত কর্মফল হিসেবে বিচার করে তা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত থাকেন। ঈশ্বরের ন্যায়বিচার এবং ধর্ম ও শাস্ত্রবিহিত ক্রিয়ানুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে আধ্যাত্মিক মতের মোক্ষকে চরম লক্ষ্য স্থির করে তারই প্রস্তুতি হিসেবে প্রাত্যহিক জীবনের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করেন এই শ্রেণীর লোকেরা। ফলে ধর্মকে একান্তভাবে অবলম্বন করেও যে ঐহিক উন্নতি লাভে যুধিষ্ঠির অসমর্থ, ধর্মকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র নিজ শক্তিতে কর্মের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দুর্যোধন তা অর্জন করেছেন বলে দ্রৌপদীর অভিমত। এখানে দ্রৌপদীর উল্লেখিত ‘কর্ম’ প্রচলিত সনাধন ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দেয়। মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদীর উল্লিখিত দীর্ঘ বক্তব্যের কিছু নমুনা, যেমন – “পার্থ, আমি কোন প্রকারেই ধর্মকে অবজ্ঞা বা নিন্দা করি নাই এবং কেনই বা লোকনিয়ন্তা ঈশ্বরের প্রতি অবজ্ঞা করিব।… তবে, ভরতশ্রেষ্ঠ, জঙ্গম প্রাণিগণের মধ্যে মনুষ্যেরাই বিশেষ বিশেষ কর্মদ্বারা পরলোকে এবং ইহলোকে স্থিতিলাভ করিবার ইচ্ছা করে। ভরতনন্দন, জগতের সকল প্রাণীই কর্মের উদ্যম করিতে জানে এবং আপন প্রত্যক্ষে ও লোকপ্রত্যক্ষে সেই কর্মের ফল ভোগ করে।… জগতে যদি প্রাণীরা কর্ম না করিত, তবে সমস্ত প্রাণীই উৎসন্ন হইয়া যাইত এবং কর্ম যদি নিষ্ফল হইত, তাহা হইলে প্রাণীরা বৃদ্ধি পাইত না।… যে লোক কেবল দৈবকেই আশ্রয় করিয়া থাকে এবং যে লোক ‘অতর্কিত ভাবেই সকল সিদ্ধ হয়’ এই কথা বলে, তাহারা উভয়েই অধম; আর যে লোক দৈবসহকারে কর্ম করিবার ইচ্ছা করে, সে-ই প্রশংসনীয়।… পার্থ, মানুষ দেবতার আরাধনা দ্বারা যে কিছু ধর্ম লাভ করে, তাহাকেই দৈব বলা হয়। মানুষ জনসাধারণের প্রত্যক্ষে আপন কর্ম দ্বারা যে ফল লাভ করে, তাহাকে পৌরুষ বলা হয়।… বীর, প্রাণিগণ প্রথমে মনে মনে কর্তব্য বিষয় নিশ্চয় করিয়া, পরে চেষ্টা দ্বারা বুদ্ধিপূর্বক সেই কার্য্য আরম্ভ করে; সুতরাং তাহাদের দেহ নিমিত্ত কারণ। পুরুষশ্রেষ্ঠ, কর্মগুলির সংখ্যা করা যায় না; (তবে ইহা বলা যায় যে,) গৃহনগরপ্রভৃতি সমস্ত কার্য্যসিদ্ধির প্রতিই পুরুষের দেহ-হেতু।… মানুষ যদি কর্মফলের প্রতি কারণ না হইত, তবে কেহই যাগ ও কূপ-নির্মাণপ্রভৃতি কর্মের ফল পাইত না এবং কেহ কাহারও শিষ্য বা গুরু হইত না।… নাস্তিকেরা বলে- ‘সকল কার্য্যই স্বভাবতঃ সিদ্ধ হয়’, আস্তিকেরা বলেন- ‘সকল কার্য্যই দৈববশতঃ সিদ্ধ হয়’ এবং প্রাকৃত লোকেরা বলে- ‘সকল কার্য্যই মানুষের চেষ্টায় সিদ্ধ হয়’। এইভাবে ত্রিবিধ লোক ত্রিবিধ কারণ নিরূপণ করে।… অতএব ইষ্ট বা অনিষ্ট সমস্ত ফলের প্রতিই ঈশ্বর, প্রারব্ধ কর্ম এবং পুরুষকার- এই তিনটিই কারণ; ইহা যাহারা পর্যালোচনা করিয়াও বোঝে না, তাহারা ইতর লোকের ন্যায় একেবারে অনভিজ্ঞ।… কৃষক লাঙ্গলদ্বারা ভূমি কর্ষণ করিয়া বীজ বপন করে এবং তাহার পরে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কেন না, তখন ফলের কারণ হয়- মেঘ।… অতএব ভরতনন্দন, আপনিও পুরুষকার করুন; তাহাতে ফল না হইলেও আপনি যেন নিজের অবমাননা করেন না। কারণ, ফলসিদ্ধিবিষয়ে (ঈশ্বরের ইচ্ছা ও প্রাক্তন কর্মস্বরূপ) আরও দুইটি কারণ আছে।… কার্য্য আরম্ভ করিলে পর তাহার অঙ্গহানি হইলে, অল্প ফলও হয়, একেবারে ফল নাও হয়; কিন্তু কার্য্য আরম্ভ না করিলে, কোথাও ফল বা কর্তার উৎকর্ষ, কোনটাই দেখা যায় না।… পুরুষ কখনো নিজের প্রতি নিজে অবজ্ঞা করিবে না। কারণ, সেরূপ লোকের ভাল সম্পত্তি হয় না। ভরতনন্দন, আমি এই নিয়মে লোকের কার্য্যসিদ্ধির কথা এবং দেশ ও অবস্থার বিভাগ অনুসারে কার্য্যসিদ্ধির উপায়ের কথা বলিলাম। ভরতশ্রেষ্ঠ, পূর্বে আমার পিতা কোন পণ্ডিত ব্রাহ্মণকে বাস করাইয়াছিলেন; তিনিই এই সমস্ত নীতি আমার পিতার নিকট বলিয়াছিলেন। এবং সেই ব্রাহ্মণই এই বৃহস্পতিপ্রোক্ত নীতি পূর্বে আমার ভ্রাতৃগণকে শুনাইয়াছিলেন; আবার আমি আমার ভ্রাতাদের নিকট তখন ইহা শুনিয়াছিলাম।” বনপর্ব-১২৮/১,৫,৬,১১,১৩,১৭,২৫,২৬,৩০,৩২,৩৮,৪৭,৫০,৫২,৫৮-৬১)
ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও দ্রৌপদীর অভিযোগ পরিলক্ষিত হয়। যুধিষ্ঠিরকে বিপদ এবং দুর্যোধনকে সম্পদ প্রদান করার মধ্যে যে পক্ষপাতিত্বের প্রকাশ তার জন্য দ্রৌপদী ঈশ্বরকে দোষারোপ করেন। কর্মফলবাদের নীতি অনুসারে স্বকৃত কর্মের ফল প্রত্যেককেই ভোগ করতে হয়। এই নীতি স্বীকৃতি পেলে ঈশ্বরও তার কৃতকর্মের জন্য পাপে লিপ্ত হতে এবং সে অনুযায়ী ফল ভোগ করতে বাধ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যে স্বকৃত পাপের ফল ভোগের ব্যাপারে অব্যাহতি লাভ করেন তার মূলে ঈশ্বরের শক্তি ও প্রতাপ কার্যকরী। অর্থাৎ দ্রৌপদী তার বক্তব্যে এটাই পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন যে, নিজ শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তিযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই কেবল জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ সম্ভব। ধর্ম, কর্মফল বা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে নয়। যেমন, মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদীর কিছু আক্ষেপ – “এই জগতে ধর্ম, কোমলতা, ক্ষমা, সরলতা কিংবা দয়া দ্বারা কেউ কখনও সম্পদ লাভ করতে পারে না।… ভরতনন্দন, আপনার ভ্রাতারা তখন বা এখন বা কোন সময়েই ধর্মের চেয়ে কোন বস্তুকেই প্রিয়তর বলে জানেননি; জীবনের চেয়েও ধর্মকেই বেশি প্রিয় বলে জানেন।… আমি গুরুজনদের কাছে শুনেছি যে, রাজা ধর্মকে রক্ষা করলে, ধর্মও রাজাকে রক্ষা করেন; কিন্তু আমি মনে করি সে ধর্ম নিজেকে রক্ষা করেন না।… জগতের সব প্রাণীই ঈশ্বরময় এবং ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করে রয়েছে; তাই সূত্রগ্রথিত মণির মতো, নাসিকাবদ্ধ বৃষের মতো এবং তীরচ্যুত ও স্রোতের মধ্যে পতিত বৃক্ষের মতো প্রাণিরা বিধাতার আদেশেরই অনুসরণ করে; কিন্তু স্বাধীন হয়ে কোন সময়েই চলতে পারে না। নিজের সুখ-দুঃখবিধানে অসমর্থ মূঢ় প্রাণীরা ঈশ্বরপ্রেরিত হয়ে স্বর্গে বা নরকে যায়।… মহারাজ, ঈশ্বর এই মায়ার প্রভাবকে যেমন করেছেন, তা দেখুন। যিনি নিজের মায়ায় মোহিত করে প্রাণিগণ দ্বারাই প্রাণিগণকে বধ করছেন।… সচ্চরিত্র ও লজ্জাশীল সজ্জনদিগকে দুঃখিত দেখে এবং অসজ্জনদিগকে সুখী দেখে আমি চিন্তায় যেন বিহ্বল হচ্ছি। পার্থ, আপনার এই বিপদ এবং দুর্য্যােধনের সম্পদ দেখে আমি বিধাতাকেই নিন্দা করছি। কারণ, যিনি বিপরীতভাবে পর্য্যালোচনা করছেন। হায়, দুর্য্যােধন ধর্মশাস্ত্র অতিক্রম করে ধর্ম নষ্ট করেছে এবং সে ক্রূরস্বভাব ও লুব্ধপ্রকতি; তথাপি বিধাতা তাকে সম্পত্তি দান করে কি ফল পাচ্ছেন! যদি প্রাক্তন কর্ম কর্তারই অনুসরণ করে, অন্যের অনুসরণ না করে; তাহলে নিশ্চয়ই সেই পাপকর্মে ঈশ্বরও লিপ্ত হচ্ছেন। তারপর, যদি এটা বলা যায় যে, প্রাক্তন কর্ম কর্তার অনুসরণ করে না, তবে বলতে হবে যে, তার কারণ একমাত্র বল। এমন হলে, দুর্বল লোকদের জন্যই আমার শোক হচ্ছে।” (বনপর্ব – ৩,৫,৮,২৬-২৮,৩২,৩৯-৪৩)। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে ঈশ্বরে সরাসরি অস্বীকৃতি না থাকলেও দ্রৌপদী বর্ণিত এই নাস্তিক্য মত যে আমাদের পরিচিত বার্হস্পত্য বা চার্বাক মতের মূল নীতিগুলিরই অনুগামী, তা অস্পষ্ট নয়।
আবার মহাভারতের শান্তিপর্বে সাংখ্যাচার্য পঞ্চশিখকে নিজ মতবাদ প্রচারের সময় সমসাময়িক যে সব মতগোষ্ঠীর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো সেবিষয়ক উপাখ্যানও দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে ‘চার্বাক’ বিশেষণের প্রয়োগ না হলেও চার্বাক মতের অনুরূপ মতেরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে (মহাভারত: ১২/২১৮/২২-৩২)। যেমন – “পঞ্চশিখ প্রথমে জন্মের দোষ বলিয়া পরে কর্মের দোষ বলিলেন এবং কর্মের দোষ বলিয়া লৌকিক সমস্ত কার্য্যরেই দোষ বলিলেন। মানুষ মীমাংসকের মত অনুসরণ করিয়া যে মুক্তির জন্য নিষ্কামভাবে ধর্মানুষ্ঠান করে; সে মুক্তিলাভ করায় বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, তত্ত্বজ্ঞান ভিন্ন কেবল ধর্মে মুক্তি হয় না। আর মানুষ যে পুত্রাদি ফললাভের জন্য কাম্যকর্ম করে, তাহাও মোহ-প্রযুক্ত। কেন না, কাম্যকর্মের ফল বিনশ্বর, অস্থির ও অনিশ্চিত। নাস্তিকেরা বলেন- দেহই আত্মা, দেহ ভিন্ন আত্মা নাই। কারণ, দেহেরই বিনাশ দেখা যায়, প্রত্যক্ষ করা যায় এবং মানুষেরাই তাহা প্রত্যক্ষ করে; অতএব শাস্ত্র অনুসারে দেহ ভিন্ন আত্মা আছে-এইরূপ বলিতে থাকিয়া আস্তিকগণ পরাজিতই হয়। আত্মার মৃত্যুর মূর্তি নাই; সুতরাং সেই মৃত্যুকে দেখা যায় না। সে যাহা হউক, ছেদভেদাদিজনিত কষ্ট, জরা, রোগ ও বিনাশ এইগুলি দেহেরই ধর্ম; সুতরাং দেহই আত্মা, অতএব আস্তিকগণ দেহভিন্ন আত্মা আছে বলিয়া যে মনে করে, তাহাদের সে মত সমীচীন নহে। তারপর তোমরা (আস্তিকেরা) যদি বল যে, জগতে যাহা দেখা যায় না, এরূপ বস্তুও আছে; যেমন অঙ্কুর দেখা যায় না, অথচ তাহা বীজে আছে। সে বিষয়ে আমাদের (নাস্তিকদের) বক্তব্য এই যে, স্তুতিপাঠকেরা যেমন রাজাকে অজর ও অমর মনে করিয়াই যেন তাহার সেইরূপ বর্ণনা করে; তোমরাও (আস্তিকেরাও) তেমন আত্মাকে অজর ও অমর মনে করিয়া সেইরূপ বলিয়া থাক। বাস্তবিকপক্ষে রাজার ন্যায় আত্মারও জরা এবং মৃত্যু আছে। আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ে দৃঢ়তর প্রমাণ না থাকিলে এবং আত্মা আছে কি নাই- এইরূপ সন্দেহ চলিতে লাগিলে, মানুষ কি অবলম্বন করিয়া সাংসারিক কার্য্য করিবে; তাহা আপনার (নাস্তিকের) বলা উচিত। প্রত্যক্ষই অনুমান ও আগমের মূল; সুতরাং প্রত্যক্ষকর্তৃক বাধিত হইলে অনুমান ও আগম কিছুই নহে (ইহা নাস্তিকের উক্তি)। এই অনুমানদ্বারা যেখানে যেখানে সাধ্যের সিদ্ধি হইল বলিয়া তুমি মনে কর, সেইখানে সেইখানে তাহা করিবে না; কারণ, আমাদের নাস্তিকদের মতে অনুমান প্রমাণ নহে এবং দেহভিন্ন অন্য জীবাত্মা নাই। বটবৃক্ষের ক্ষুদ্র বীজে যেমন প্রথমে তাহার পত্র, শাখা ও প্রশাখাপ্রভৃতি সূক্ষ্মভাবে থাকে, পরে প্রকাশ পায়; তেমন পুরুষের শুক্রে প্রথমে মনপ্রভৃতি সূক্ষ্মভাবে থাকে, পরে প্রকাশ পায়। ভুক্তঘৃত পরিপাক পাইলে তাহা হইতে যেমন শুক্র জন্মে, তেমন পিতার শুক্র পরিণত হইলে তাহা হইতে পুত্র ও কন্যার শুক্র ও শোণিত জন্মিয়া থাকে। চন্দনবাসিত কাষ্ঠ হইতে যেমন সৌরভ উৎপন্ন হয়, তেমন স্ত্রীশোণিতসংযুক্ত পুরুষের শুক্র হইতে রক্তপ্রভৃতি উৎপন্ন হয়। পর্য্যুষিত তণ্ডুল-প্রভৃতি বহুদ্রব্যনির্মিত মদ্যে যেমন মাদকতাশক্তি জন্মে; তেমন ক্ষিতি, জল, তেজ ও বায়ু- এই চারিটি দ্রব্যনির্মিত দেহে চৈতন্য জন্মে। যেমন জড় মন হইতে অজড় স্মৃতি উৎপন্ন হয়, তেমন জড়দেহ হইতে অজড় চৈতন্য উৎপন্ন হইয়া থাকে। জড় অয়স্কান্তমণি যেমন লৌহকে সঞ্চারিত করে, তেমন জড় দেহ ও ইন্দ্রিয়গণকে সঞ্চালিত করে। শীতল সূর্য্যকান্তমণি যেমন সূর্য্যরশ্মিসংযোগে অগ্নি আবিষ্কার করে, তেমন শীতল শুক্র ও রসরক্তসংযোগে জঠরানল আবিষ্কার করে। আর জলোৎপন্ন বড়বানল যেমন জলই ভক্ষণ করে, তেমন শুক্র হইতে উৎপন্ন দেহ শুক্র ধারণ করে। (আস্তিকের বক্তব্য) চৈতন্য দেহের ধর্ম হইলে দেহ প্রাণশূন্য হইয়া পড়িলে চৈতন্য থাকে না কেন? গুরুতর রোগ জন্মিলে চৈতন্য রক্ষার জন্য নাস্তিকেরাও দেবতাপ্রভৃতির নিকট প্রার্থনা করে কেন? এইগুলিই আমাদের আস্তিকদের মতে চৈতন্য যে দেহ হইতে ভিন্ন এবং জীবাত্মা তাহার পক্ষে প্রমাণ; আর ইহাই নিশ্চয়। (শান্তি-২১৫/৩১)।। নাস্তিক! আপনি যে যুক্তিগুলি দেখাইয়াছেন, তাহা কি সম্ভবপর হয়? কখনই না। কারণ, জগতে যে কিছু মূর্তিমান্ পদার্থ আছে, তাহা হইতে অমূর্ত পদার্থের উৎপত্তি হয় না। কেন না, মূর্তিমান্ পদার্থের সহিত অমূর্ত পদার্থের সাদৃশ্য থাকে না।”
তবে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’র সাক্ষ্যে বার্হস্পত্য সম্পর্কে চমৎকার প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রথম অধিকরণ বিনয়াধিকারিকম্ এর বিদ্যাসমুদ্দেশ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যা ও তাদের সম্মন্ধে পূর্ববর্তী শ্রদ্ধেয় আচার্যগণের মতভঙ্গি উদ্ধৃত করতে গিয়ে কৌটিল্য বলেন – “কৌটিল্যের মতে, বিদ্যা চার প্রকারের, যথা- আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্-যজুঃ-সামবেদাত্মক বেদ-বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)। মানব সম্প্রদায় অর্থাৎ মনু-শিষ্যগণ বলেন- ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতি- বিদ্যা এই তিনপ্রকার। কারণ, আন্বীক্ষিকী (বা হেতুবিদ্যা) ত্রয়ীর অর্থবিচার করে বলে সেটি ত্রয়ীবিশেষ-মাত্র অর্থাৎ ত্রয়ীরই অন্তর্ভুক্ত। বৃহস্পতির শিষ্যগণের (বার্হস্পত্যগণের) মতে, বার্তা ও দণ্ডনীতি – এই দুই প্রকারের বিদ্যা ; কারণ, ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদের অর্থাৎ বার্তা ও দণ্ডনীতির অনুষ্ঠান বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে সংবরণের অর্থাৎ আচ্ছাদনের কাজ করে মাত্র (লোকতন্ত্রজ্ঞ হলেও ত্রয়ীজ্ঞান না থাকলে নাস্তিক বলে লোকসমাজে যে নিন্দিত হতে হয়, তার থেকে রক্ষার উপায়মাত্র হওয়ায় ত্রয়ীর স্বতন্ত্র বিদ্যাত্ব স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই)। ঔশনস (উশনা-পুত্র শুক্রাচার্যের শিষ্য) গণের মতে, দণ্ডনীতি বা অর্থশাস্ত্রই একমাত্র বিদ্যা, কারণ দণ্ডনীতিতেই অন্যান্য সমস্ত বিদ্যার আরম্ভ (অর্থাৎ কর্মনীতিপদ্ধতি এবং যোগক্ষেম) প্রতিষ্ঠিত আছে। কিন্তু কৌটিল্যের মতে, (প্রথম উক্ত) চারটিই বিদ্যা। (এই চারটিকে বিদ্যা বলবার কারণ-) এই চারটির দ্বারাই ধর্মসংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার এবং অর্থ বা জাগতিক সকল প্রয়োজনবস্তু জানা যায় ; এবং এদের দ্বারা জানা যায় বলেই এদের ‘বিদ্যাত্ব’ সার্থক হয়েছে। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্ – ১/২/১)। এবং এই বিদ্যাগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কৌটিল্য আবার বলেন – “সাংখ্যদর্শন, যোগদর্শন ও লোকায়ত – এই তিনটি শাস্ত্রই উক্ত আন্বীক্ষিকী-বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত। এই আন্বীক্ষিকীর দ্বারা এবং সূক্ষ্ম অন্বীক্ষার সাহায্যে ধর্ম এবং অধর্মের বিষয় ত্রয়ীতে প্রতিপাদিত হয় ; অর্থ এবং অনর্থ প্রতিপাদিত হয় বার্তা-নামক বিদ্যায় ; এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় (good policy and bad policy) প্রতিপাদিত হয়। এই তিন বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য-ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে। আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।” (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্ – ১/২/২)।
উল্লেখ্য, আন্বীক্ষিকীর অন্তর্ভুক্ত বিদ্যা হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত যে যোগদর্শনের উল্লেখ রয়েছে, পণ্ডিতদের মতে সেটা আসলে পতঞ্জলির (২৫০ খ্রিস্টাব্দ) যোগদর্শন নয়, মূলত ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে প্রাচীন যোগ বোঝানো হয়েছে। কেননা, পণ্ডিত ফণিভূষণ তর্কবাগীশ এবং কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রী উভয়েই মূল্যবান সাক্ষ্য ও যুক্তি প্রদর্শন করে নিশ্চিত করেছেন যে, পরবর্তীকালে যে-দার্শনিক মতকে আমরা ন্যায়-বৈশেষিক নামে সনাক্ত করতে অভ্যস্ত, প্রাচীন কালে তাকেই ‘যোগ’ নামে অভিহিত করার প্রথা ছিলো। কৌটিল্যর রচনাতেও যোগ শব্দ এই প্রাচীন অর্থেই ব্যবহৃত। এখানে কৌটিল্যের মতে বিদ্যা চারটি হলেও উল্লেখিত শ্লোক অনুযায়ী কৌটিল্যবর্ণিত বার্হস্পত্যদের মতে বিদ্যার সংখ্যা দুই- দণ্ডনীতি এবং বার্তা। বেদ অথবা আন্বীক্ষিকীকে বার্হস্পত্যরা বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। তারা বেদকে ‘লোকযাত্রাবিদ্’ বা লৌকিক ব্যবহারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ‘সংবরণ’ বা পোশাক বলে অভিহিত করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, বার্হস্পত্যদের অভিমত অনুসারে সে সময়ে বেদজ্ঞ বলে যারা নিজেদের প্রচার করতেন তাদের প্রকৃত স্বরূপ সব সময়ই বেদজ্ঞানের আবরণে গোপন থাকতো। তা থেকে অনুমিত হয় যে, ‘অর্থশাস্ত্রে’র সময়কালে অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব 4র্থ শতকেই বার্হস্পত্য মতবাদ বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
তবে এখানে যে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি নজর এড়িয়ে যাওয়া সঙ্গত হবে না, তা হলো, কৌটিল্য বর্ণিত যে আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে লোকায়তের পরিচিতি, সেই আন্বীক্ষিকীকে কৌটিল্য সর্ব ধর্মের আশ্রয় বলে বর্ণনা করলেও বার্হস্পত্যরা এই আন্বীক্ষিকীকে বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত করেন নি। এখানে আন্বীক্ষিকী মানে অনুমান-মূলক দর্শন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তবে কি প্রাচীন লোকায়ত শাস্ত্র আর পরবর্তীকালের চার্বাক দৃষ্টিভঙ্গির লোকায়ত মত এক নয় বা পরস্পর বিপরীত? হতেও পারে। কেননা পরবর্তীকালের ‘চার্বাক’ নামে বিশেষিত লোকায়তিক দর্শনের পরিধি থেকে ধর্ম সম্পূর্ণ বহিষ্কৃত হওয়ার কারণেই হয়তো এই বৈপরিত্য সৃষ্টি হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে দর্শনমতের বিবর্তন অসম্ভব কিছু নয়।
তাই কৌটিল্যের এই বার্হস্পত্য মত বর্ণনার সাপেক্ষে পরবর্তীকালের সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের সাযুজ্য বিশ্লেষণ করতে ১১শ শতকের কৃষ্ণমিশ্র রচিত ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকটিকে গুরুত্বপূর্ণ নমুনা-উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই রূপক নাটকে বর্ণিত চার্বাক সিদ্ধান্তে বলা হচ্ছে – “দণ্ডনীতিই একমাত্র বিদ্যা। বার্তা দণ্ডনীতির অন্তর্ভুক্ত এবং ত্রয়ী বা বেদ ধূর্তদের প্রলাপ।” (প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৫)। আবার ৮ম শতকের প্রখ্যাত অদ্বৈত-বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্য লোকায়ত প্রসঙ্গে তার ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন – “(লোকায়তরা) কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, দণ্ডনীতি ইত্যাদি দৃষ্ট উপায়ের মাধ্যমে জাগতিক বস্তু উপভোগের পরামর্শ দেন।” (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ – ২/১৫)। অতএব, ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-চার্বাক বা ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-লোকায়তের আদি রূপ হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত বর্ণিত বার্হস্পত্যের অনুমান করা খুব অসঙ্গত হবে না বলেই মনে হয়। তারপরও প্রশ্ন থাকে, চার্বাক তথা বার্হস্পত্য দর্শনের প্রকৃত উৎস কোথায়?
বার্হস্পত্য-সূত্র
ভারতীয় দর্শন বা প্রাচীন সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বৃহস্পতি-সূত্র নাম দিয়ে যে সূত্রগুলি ব্যবহার করা হয় তার স্পষ্ট উৎস আমাদের কাছে অজ্ঞাত এখনো। অথচ ভারতীয় দার্শনিক প্রথা বা ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতিটা দর্শনেরই একেকটি সূত্রগ্রন্থ থাকলেও যে সূত্রগুলির উপর ভিত্তি করে চার্বাক দর্শন নামে একটা প্রতিপত্তিশালী শক্ত দর্শন দাঁড়িয়ে আছে, ভারতীয় দর্শন-রীতিতে তারও একটা সূত্রগ্রন্থ থাকার কথা ছিলো, যার প্রণেতা হয়তো বৃহস্পতি নামের কেউ। কিন্তু সেরূপ গ্রন্থ আদৌ ছিলো কি ছিলো না, তা নিয়েও দার্শনিক মহলে যথেষ্ট বিতর্ক রয়ে গেছে। তবে অন্যতম পরোক্ষ উৎস হিসেবে ১৪শ শতকের বেদান্ত দার্শনিক সায়ণমাধবাচার্যের যে বিখ্যাত গ্রন্থটির বিস্তৃত পূর্বপক্ষ বয়ান থেকে চার্বাক দর্শনের বিশিষ্ট রূপটিকে অনুমান করা সহজসাধ্য হয়ে ওঠে, সেই ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থেও মাধবাচার্য প্রধানত চার্বাক-ষষ্ঠিকে অবলম্বন করেই চার্বাক-দর্শন সংকলন করেছেন। প্রায়ক্ষেত্রেই তিনি চার্বাক-ষষ্ঠির বচনকেই প্রমাণরূপে প্রদর্শন করেছেন, কোথাও বার্হস্পত্য-সূত্রের উল্লেখ করেন নি। এতে করে পণ্ডিতদের ধারণা, তিনি অন্যান্য কোন কোন গ্রন্থে বার্হস্পত্য-সূত্র দেখে থাকলেও সম্পূর্ণ বার্হস্পত্য সূত্র দেখেন নি অর্থাৎ বার্হস্পত্য-সূত্র নামের কোন গ্রন্থের খোঁজ তিনি পান নি। এবং গ্রন্থশেষে তিনি ‘তদেতৎ সর্বং বৃহস্পতিনাপ্যুক্তং’ বলে চার্বাকষষ্ঠির শ্লোকাকার বচনগুলির উল্লেখ করেছেন। বৃহস্পতি সূত্রাকারে চার্বাকমত বললেও শ্লোকাকারে বলেন নি। তবে চার্বাক-ষষ্ঠি যে বৃহস্পতির সূত্র অবলম্বনে রচিত, এ ব্যাপারে পণ্ডিতেরা মোটামুটি নিঃসন্দেহই বলা যায়। এবং নানান প্রাচীন গ্রন্থে ভারতীয় দর্শনের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অনুসরণে সৃষ্ট এরূপ কোন কোন সূত্রের উল্লেখ থেকে অনুমান হয়, বার্হস্পত্য-সূত্র অতি প্রাচীন। (সূত্র: চার্বাক-দর্শনম্ /শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী)।
চার্বাক বা বার্হস্পত্য দর্শনসংশ্লিষ্ট কোন সূত্রগ্রন্থের অস্তিত্ব এখনো অজ্ঞাত হলেও অতীতে কোন এককালে এরকম সূত্রগ্রন্থ থাকার সম্ভাব্যতাকে অস্বীকারও করা যায় না। কেননা প্রখ্যাত ব্যাকরণকার পাণিনির (আনুমানিক ৬০০-৪০০ খ্রীস্টপূর্ব) কালজয়ী ব্যাকরণসূত্র ‘অষ্টাধ্যায়ী’র ভাষ্যকার পতঞ্জলির (আনুমানিক অন্যুন ১৫০ খ্রীস্টপূর্ব) ‘মহাভাষ্যে’ ‘ভাগুরি’ নামে লোকায়তের এক ‘বর্তিকা’ বা ভাষ্যের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে- ‘বর্ণিকা ভাগুরী লোকায়তস্য, বর্তিকা ভাগুরী লোকায়তস্য’ (মহাভাষ্য: ৭/৩/১)। অর্থাৎ ভাগুরী লোকায়তের বর্ণিকা বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ। মূলগ্রন্থ ছাড়া কোন ভাষ্যগ্রন্থের অস্তিত্ব অনুমান কঠিন বলেই মহাভাষ্যের সাক্ষ্য অনুযায়ী লোকায়তের কোন গ্রন্থ ও তার ভাষ্য ছিলো বলেই অনুমান করা হয়। এছাড়া বৌদ্ধদের লেখা সংস্কৃত গ্রন্থ (অনুমান সম্রাট অশোকের কিছুটা পরবর্তীকালের) ‘দিব্যাবদানে’ও লোকায়ত শাস্ত্রের মূল গ্রন্থের উপর লেখা ভাষ্য ও প্রবচনের উল্লেখ রয়েছে- ‘লোকায়তং ভাষ্যপ্রবচনম্’ (দিব্যাবদান, পৃষ্ঠা ৬৩০) উদ্ধৃতিতে।
জীবনের দীর্ঘকাল ব্যাপী চার্বাক বা লোকায়ত নিয়ে একনিষ্ঠভাবে অনুসন্ধান ও আলোচনায় রত থাকা প্রখ্যাত ভারতীয় সংস্কৃতিবিদ পণ্ডিত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী তার ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থের শেষে ‘বার্হস্পত্যসূত্রম্’ শিরোনামে একটি পরিশিষ্ট সংযোজন করেছেন। বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাকমত বর্ণনায় চার্বাকদের নিজস্ব উক্তি হিসেবে যে-সব উদ্ধৃতি পাওয়া যায় তারই সংকলন এটি। তার তালিকায় মোট ৫৪ টি ‘সূত্র’ বর্তমান। শাস্ত্রী মহাশয়ের ভাষায়- ‘…বৃহস্পতি, চার্বাক, লোকায়ত, পুরন্দর, কম্বলাশ্বতর- এই কয়জন দার্শনিকের অর্ধশতাধিক সূত্র এবং যে গ্রন্থ হইতে যেরূপ অবস্থায় সংগৃহীত হইয়াছে তা প্রদত্ত হইল।’ দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় কর্তৃক এভাবে বিভিন্নজনের সূত্রগুলিকে ‘বার্হস্পত্যসূত্রম’ নামে পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্তির কারণ তার ধারণা – বৃহস্পতি ব্যক্তিবিশেষের নাম নয় ; ব্যাস, শঙ্করাচার্য ইত্যাদি উপাধির মত বৃহস্পতিকেও উপাধিবিশেষ বলা চলে। চার্বাক মতের প্রচারে যারা সহায়তা করেছেন এই উপাধি তারাই লাভ করেছেন। এবং তার মতে- ‘সুদূর অতীতে কোনও সময়ে এই বৃহস্পতিগণ মিলিত হয়ে বার্হস্পত্য মত প্রবর্তন… …করেন।’ কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয়ের এই ধারণা বা সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে যথোপযুক্ত প্রমাণের অভাব থাকায় তা সমর্থনযোগ্য নয় বলেই গবেষকরা মনে করেন। এছাড়া তার প্রদত্ত তালিকায় চার্বাকদের নামে প্রচলিত নানান প্রামাণিক লোকগাথাও অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই কোন কোন গবেষকদের মধ্য থেকে এরকম প্রশ্নও উত্থিত হয়েছে যে – পারিভাষিক অর্থে লোকগাথাকেও ‘সূত্র’ আখ্যা দেয়া সঙ্গত কিনা। তবে চার্বাকালোচনা করতে হলে কোনভাবেই তার পরিশিষ্টটিকে উপেক্ষা করার উপায় নেই বলেই মনে হয়।
অন্যদিকে বিখ্যাত ইতিহাস গবেষক এফ. ডব্লু. টমাস (F. W. Thomas) ‘বৃহস্পতি-সূত্র’ নামে একটি পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন বলে জানা যায় এবং ১৯২১ সালে অনুবাদসহ তার মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কিন্তু গ্রন্থটি প্রকৃত চার্বাক মতের পরিচায়ক হতে পারে না বলে পণ্ডিতদের অভিমত। কেননা আরেক প্রখ্যাত গবেষক ‘তুচ্চি’ (Twcci) গ্রন্থটির ওপর মন্তব্য করেছেন যে, এই বই ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবে ভরপুর। গ্রন্থটি থেকে হয়তো বড়জোর চার্বাক-সংক্রান্ত সামান্য খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত আভাস পাওয়া যেতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। চন্দ্রকীর্তির ‘প্রজ্ঞাশাস্ত্র’ এবং আর্যদেবের ‘শাস্ত্রাশাস্ত্র’ গ্রন্থে প্রকৃত বার্হস্পত্য-সূত্র উদ্ধৃত হয়েছে বলে তুচ্চি উল্লেখ করেন। তাই বিভিন্ন দার্শনিকের চার্বাক-বর্ণনায় উদ্ধৃত বৃহস্পতি-সূত্রগুলি বা চার্বাকদের নিজস্ব উক্তি হিসেবে বাক্যগুলির প্রকৃত উৎস জানবার সুযোগ না থাকলেও উদ্ধৃতিগুলি উড়িয়ে দেবার মতো নয়। অনেকসময় চার্বাকমত পুনর্গঠনে এগুলি বিশেষ মূল্যবান উপাদান হতে পারে।’ (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। তবে যেভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন, চার্বাকমতের সেসকল সূত্র কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলেও ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের বিভিন্ন প্রামাণিক গ্রন্থের অনুশীলনে পুনঃসঙ্ঘটিত এসব সূত্র পরবর্তীকালে বার্হস্পত্য-সূত্র নামে সংকলিত হয়েছে। শ্রীমৎ-সায়ণমাধব-কৃত ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থ অবলম্বনে শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী রচিত ‘চার্বাক-দর্শনম্’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে সংস্কৃতভাষায় এরকম একশটি বার্হস্পত্য-সূত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। উপস্থাপিত এই সংকলিত বার্হস্পত্য-সূত্রগুলির বাংলা অনুবাদ নিচে উপস্থাপন করা হবে।
ইতোপূর্বেও সূত্রের লক্ষণে বলা হয়েছে, অল্প অক্ষরযুক্ত, সন্দেহমুক্ত, সারযুক্ত, সর্বত্র প্রয়োগযোগ্য এবং নির্দোষ নিয়মকেই সূত্র বলে। সূত্র হলো সংক্ষিপ্ত বাক্যের নম্র উপচার। ছোট ছোট অর্থপূর্ণ বচনের সাহায্যে এরকম কিছু সূত্রের আবরণে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাকে সযত্নে গেঁথে রাখা হতো। স্বল্পতম অক্ষরবিশিষ্ট এরকম কিছু সংখ্যক সূত্রের মাধ্যমে দর্শন-চিন্তার প্রথম আত্মপ্রকাশই ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত ধারা এবং ভারতীয় দর্শনের অধিকাংশ শাখারই আদি রচনা এই জাতীয় কিছু সূত্রের সমষ্টি বলে মনে করা হয়। সূত্রগুলোয় অক্ষরসংখ্যা নিয়মনের দিকে খুব জোর দেয়া হয়েছে, ফলে সংক্ষিপ্ততম অবয়বে ব্যাপকতম অর্থব্যঞ্জনার প্রবণতা প্রত্যেক সূত্রে দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে। কেননা সূত্রগুলির মর্মার্থের পেছনে যে ব্যাপক তথ্য ও যুক্তির শাস্ত্রীয় আধার সুপ্ত থাকে সেগুলির বিশ্লেষণ ছাড়া বস্তুত সূত্রগুলির ব্যাখ্যা সমার্থক হয় না। তারপরও ব্যাখ্যাকারের নিজস্ব চিন্তা ও মতের সাপেক্ষে ব্যাখ্যাগুলির বক্তব্য-চেহারাও পরিবর্তিত হয়ে যায়। আর তাই যে-কোন তর্জমার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট সূত্রের একান্ত আক্ষরিক তর্জমা বলতে গেলে অসম্ভবই প্রায়। সেই সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই বার্হস্পত্য-সূত্রগুলোর তর্জমাগুলো এখানে দেয়া হলো। বৃহস্পতি প্রণিত বার্হস্পত্য সূত্র –
লোকায়ত-মতে তত্ত্বাদির বিচার
- ১। পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব।
- ২। এর (পদার্থ বা তত্ত্ব চতুষ্টয়) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।
- ৩। (দেহের আকারে পরিণত ভূত-চতুষ্টয় হতে) চৈতন্যের জন্ম ও অভিব্যক্তি হয়।
- ৪। কিণ্ব বা বৃক্ষবিশেষ হতে যেরূপ মদশক্তি জন্মে।
- ৫। শরীর ও ইন্দ্রিয়ের সংঘাতের মাধ্যমে দেহে চেতনার জন্ম হয়।
ধর্মশাস্ত্রের সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফলের অভাব বিচার
- ৬। (প্রত্যক্ষের অগোচরে অতীন্দ্রিয় সত্তা নেই বলে) ধর্ম কর্ম অনুষ্ঠেয় নহে।
- ৭। এ-রকম অদৃষ্ট ব্যাখ্যাত ফল ইহজন্মে পাওয়া যায় না।
- ৮। ধর্মশাস্ত্র-বর্ণিত যজ্ঞাদি বা পারলৌকিক বিষয়াদি সাধিত হলেও ফল হবে কিনা) সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
- ৯। মূর্খ ভিন্ন কোন্ ব্যক্তি হস্তগত দ্রব্যকে পরগত করে?
- ১০। আগামীকাল ময়ূর লাভের আশার অপেক্ষা আজকের প্রাপ্ত কপোত মন্দের মধ্যে ভালো।
- ১১। সংশয়সঙ্কুল শত স্বর্ণমুদ্রা লাভ অপেক্ষা নিঃসন্দেহ এক কার্ষাপণ লাভও মন্দের ভালো।
- ১২। (প্রতিক্ষণে শরীরের অনিত্যতাকে উপলব্ধির জন্য) শরীরে চিতা-ভস্মধারণ করা অর্থহীন কাজ।
- ১৩। পারলৌকিক ফলপ্রাপ্তির আশায়) যাগ-যজ্ঞ অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠেয় নহে, বেদ পাঠও নিষ্ফল।
- ১৪। (অর্থহীন অপচয় করে কাল্পনিক ফললাভের আশায়) তীর্থযাত্রা করণীয় নয়।
- ১৫। অগ্নিহোত্র-সন্ধ্যা-জপ ইত্যাদি অনুষ্ঠান করা সর্ব অর্থেই অর্থহীন অপ্রয়োজনীয়।
- ১৬। বস্তুত স্বীয় দোষ ঢাকবার অভিপ্রায়ে বেদ-পাঠের কথা বলা হয়।
- ১৭। (পারলৌকিক স্বর্গপ্রাপ্তির কামনায়) অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করা নির্বুদ্ধিতা।
- ১৮। সুরাপান রমণী-সম্ভোগ সুখার্থেই করণীয়।
- ১৯। সুরাপান উপভোগ-স্পৃহার জন্ম দেয়।
- ২০। নিজের কামনা পূরণার্থে রমণীয় সুখ উপভোগ্য।
শৃঙ্গারবেশ ইত্যাদির কর্তব্য বিচার
- ২১। (নিজেকে উপভোগ্য করতে) শৃঙ্গার বেশ করণীয়।
- ২২। পণ-পূর্বক অক্ষ বা দ্যুতক্রীড়া ক্ষতির কারণ হয়।
- ২৩। তাই কখনো এতে আসক্ত হওয়া উচিৎ নয়।
- ২৪। আসব পান করণীয়।
- ২৫। (ভোগ-সামর্থ্যের প্রয়োজনে) মাংস ভোজন দোষণীয় নয়।
- ২৬। সামর্থ অনুযায়ী সুখ উপভোগ করা উচিৎ।
- ২৭। (মনোমুগ্ধতার জন্য) দিব্য প্রমদার দর্শন উচিৎ।
- ২৮। (সৌকর্য্যের প্রয়োজনে) নেত্রাঞ্জন গ্রহন করা উচিৎ।
- ২৯। (নিজেকে আকর্ষণীয় করার প্রয়োজনে) দর্পণে মুখাদির দর্শন করণীয়।
- ৩০। (সুখকর তৃপ্তির জন্য) তাম্বুল চর্বণ করা যেতে পারে।
- ৩১। কর্পূর চন্দন ও অগুরু অনুলেপন করণীয়।
বেদের অপ্রামাণ্য বিচার
- ৩২। পাথর ভাসতে থাকার মতোই যজ্ঞের ফল বিষয়ে বেদের সত্যতা প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ অসম্ভব।
- ৩৩। বেদানুগ ভাবনা শূন্যগর্ভ।
- ৩৪। কেননা শাস্ত্রে প্রচুর বিরোধ দৃষ্ট হয়।
- ৩৫। (শাস্ত্রে যেসব পারলৌকিক ফলপ্রাপ্তির কথা আছে) সে-সব নিষ্ফল।
- ৩৬। শাস্ত্র-কথিত অনর্থক বাক্যের অর্থ করতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা।
- ৩৭। বেদের পরস্পরবিরোধী বাক্যই একটি আরেকটিকে মিথ্যা প্রমাণ করে।
- ৩৮। বেদবাক্যের একটির সাথে অন্যটির সাযুজ্য নেই।
- ৩৯। (বেদোক্ত শূদ্র ইত্যাদি অশূচি বর্ণের দোষ) স্ত্রীলোকের অপরাধ হিসেবে পুত্রে সঞ্চারিত হতে দেখা যায়।
- ৪০। বেদে বিধিবাক্যের নামে যেসব স্তুতি রয়েছে তাতে চিরায়ত সামান্যের-কল্পনা নিরর্থক।
- ৪১। শাস্ত্র ব্যতীত ধর্মে কোনো প্রমাণ নেই- এই অর্থে বেদ অপ্রামাণ্য।
- ৪২। শাস্ত্র-বাক্য লৌকিক নিয়ম বহির্ভূত।
- ৪৩। বেদ মনুষ্য-রচিত, তাই তা নিত্য সত্য হতে পারে না।
- ৪৪। বেদের অবিদ্যমান বচন থেকে যে জ্ঞান হয় তার কোনো বাস্তব রূপায়ন নেই।
- ৪৫। ফলপ্রাপ্তির কামনায় বেদে অচেতন পদার্থের স্তুতি রয়েছে বলে বেদের অযথার্থতা প্রতীত হয়।
- ৪৬। বেদবাক্যে পরস্পর অর্থ-বিরোধ দৃষ্ট হয়, যা একটি আরেকটিকে খণ্ডন করে।
- ৪৭। স্বাধ্যায়রূপ প্রণব-ধ্বনি কোন বচন বা বাক্য হতে পারে না, এবং স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় ইষ্টদেবতার সন্দর্শন ঘটে এমন ধারণা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
- ৪৮। বেদোক্ত প্রত্যক্ষ উপলব্ধিহীন অর্থবিচার গ্রহণীয় নয়।
- ৪৯। শাস্ত্রে এক মন্ত্রের সাথে অন্য মন্ত্রের অর্থগত সাযুজ্যহীনতা রয়েছে।
- ৫০। ধর্মের পারলৌকিক কল্পনার সাথে ব্যাপ্তি-স্মরণ সম্ভব নয় বলে তা অপ্রামাণ্য।
- ৫১। দেশান্তরে বা কালান্তরে সাধ্যের সাথে হেতুর ব্যাপ্তি সর্বকালীন নয়।
- ৫২। (কোনো ইন্দ্রিয়াতীত সর্বজ্ঞ সত্তা হও বললেই হয়ে যায়) এমন কৃত-বাক্য গ্রহণীয় নয়।
- ৫৩। (শ্রুতিবাক্য সর্বত্র অবিকৃত অভিন্ন হওয়ার কথা হলেও) স্থানবিশেষে ভিন্নরূপে প্রদর্শিত হয়।
- ৫৪। একই শব্দ একাধিক ব্যক্তি উচ্চারণ করলে, একাধিক বার সেই শব্দ উচ্চারিত হতে পারে। শব্দকর্তার সংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধি হেতু শব্দেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। (এভবে বেদের নিত্যত্ব বিষয়ে প্রতিবাদ উপস্থাপন করা হয়)।
- ৫৫। জগতের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রোক্ত প্রকৃতি-বিকৃতি ইত্যাদি সমর্থনযোগ্য নয়।
- ৫৬। শ্রুতি বা বেদবাক্য থেকে কোনো কার্যকর নিত্যজ্ঞান সম্ভব নয়।
- ৫৭। আপ্তবাক্যে শব্দ-নিত্যতা প্রমাণিত নয়।
- ৫৮। এতে (বেদে) অনৃত দোষ বা মিথ্যে কথা, ব্যাঘাত দোষ বা পরস্পর বিরুদ্ধ কথা এবং পুনরুক্ত দোষ পূর্ণ।
- ৫৯। (বেদের কর্তা) ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর ত্রয়ী।
- ৬০। লোকায়তিকরা বলেন, ধর্মশাস্ত্রে পিণ্ডদান প্রেত্যকর্ম ইত্যাদির সমর্থনে অযথা অতিকথন ভণ্ডদের উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত মাত্র।
- ৬১। আস্তিকগণ অশন বা জীবিকার জন্য ধর্ম প্রচার করেন।
- ৬২। ধর্মের নামে বেদশাস্ত্রে হিংসাত্মক বাক্য পাঠ করানো হয়।
- ৬৩। (বেদ) নিন্দাবাক্যে ভরপুর।
- ৬৪। (ধর্মশাস্ত্রোক্ত) মহেশ্বর জাগতিক কামনা পূরণে অসমর্থ।
পুরুষার্থ বিচার
- ৬৫। (যা কামনা করা হয় তাই কাম এবং) একমাত্র কামই পুরুষার্থ।
- ৬৬। ধর্ম ও মোক্ষ কোন প্রয়োজনই সিদ্ধ করতে পারে না বলে কামনা পূরণের জন্য শরীরই মুখ্য।
- ৬৭। পুরুষার্থ রূপে কামে আসক্ত হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
- ৬৮। শরীরের স্থিতিহেতু বলে কামগুলি আহারের সধর্মা- আহারের সমানগুণযুক্ত।
- ৬৯। দ্বারে ভিক্ষুক এসে দাঁড়াতে পারে বলে উনুনে হাঁড়ি চড়াবে না, এরকম করে না কেউ। কিংবা ভিক্ষুক আছে বলে যব বপন করবে না, এটাও সুবুদ্ধির পরিচয় নয়।
প্রমাণ বিচার
- ৭০। কেবল প্রত্যক্ষই প্রমাণ।
- ৭১। অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নয়।
- ৭২। সাদৃশ্যজ্ঞান অনুমাননির্ভর। পূর্বশ্রুত সাদৃশ্য-জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞাতপূর্ব পদার্থকে প্রত্যক্ষ করে যে উপমিতি জ্ঞান হয় তাকে বলে উপমান। প্রমাণ হিসেবে উপমান অসিদ্ধ।
- ৭৩। শব্দ বা আপ্তবাক্য অনুমাননির্ভর বলে তা অজ্ঞাত অনুপলব্ধ বিষয়ের জ্ঞান হতে পারে না।
- ৭৪। শব্দ বা আপ্তবাক্য প্রমাণ নয়।
ঈশ্বরের অনস্তিত্ব বিচার
- ৭৫। ঈশ্বর অসিদ্ধ বা তার কোন অস্তিত্ব নেই।
- ৭৬। প্রমাণের অভাবেই তার (ঈশ্বর) অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় না।
- ৭৭। যদি ঈশ্বরে প্রমাণ থাকতো তবে ঈশ্বরে সিদ্ধি হতো, কিন্তু ঈশ্বরে প্রমাণ নেই বলে স্বোপার্জিত কর্মই অনুগুণ ফল প্রদান করে।
- ৭৮। শুক্র-শোণিত সম্ভূত এই মানুষের সৃষ্টি পিতা-মাতার মিলনহেতুই সম্ভব।
- ৭৯। প্রত্যক্ষের অগোচরে সর্বজ্ঞ সর্বাধিকারী কিছুর অস্তিত্ব নেই।
- ৮০। শশক বা খরগোশের শিং-এর মতোই (অতীন্দ্রিয় বস্তু অবাস্তব)
- ৮১। (অতীন্দ্রিয় কিছু নেই বলে) মুক্ত বা বদ্ধ আত্মা বলে কোনো সত্তা সিদ্ধ নয়।
- ৮২। লোকের প্রয়োজনে অধিষ্ঠিত (রাজাই) ক্ষমতা শীর্ষে থাকার সুবাদে দুর্জনকে শাস্তি প্রদান করেন, সুজনকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেন।
- ৮৩। ভুবন প্রসিদ্ধ অতিক্ষমতার অধিকারী (রাজাই) লৌকিক ঈশ্বর।
- ৮৪। (যিনি পালক, রক্ষক, পরিচালক রূপে প্রজার অন্তরে আসন লাভ করেন) এই অমিত ক্ষমতার অধিকারীই রাজা।
- ৮৫। (কার্যসিদ্ধির প্রয়োজনে দেশ, কাল, পাত্র অনুযায়ী বিবিধ রূপ ধারণে সক্ষম) লোকপ্রসিদ্ধ রাজাই পরমেশ্বর।
পরলোকের অনস্তিত্ব বিচার
- ৮৬। পরলোক বলে কিছু নেই।
- ৮৭। অদৃষ্ট বলে যদি কিছু থাকতো, তবে তা কোন না কোনভাবে দৃষ্ট হতো, দৃষ্ট না হয়ে অদৃষ্ট হতো না।
- ৮৮। অতএব অদৃষ্ট নাই।
- ৮৯। যেহেতু পরলোক নাই, তাই পরলোকগামী আত্মা বা পরলোকীও নাই।
- ৯০। জাতিস্মরণ বা পূর্বজন্মের স্মৃতি অসিদ্ধ বা অসম্ভব। মৃতের কোন স্মৃতি ধারণ অসম্ভব।
আত্মস্বরূপের বিচার
- ৯১। শরীরই আত্মা।
- ৯২। চৈতন্যবিশিষ্ট কায়া বা দেহই পুরুষ বা আত্মা।
- ৯৩। (পৌরাণিকী অনুসারে রাহু বলতে যেহেতু মস্তক-সর্বস্ব শরীরই বোঝায়) ’আমার দেহ’ বললেও তা ’রাহুর মস্তক’ এর মতো অভেদ উপাচার বিশেষ, অর্থাৎ কথার কথা।
- ৯৪। যে পুরুষ ইন্দ্রিয়ের গোচর, সেই পুরুষই আছে, অন্য পুরুষ নাই।
- ৯৫। শরীর ভিন্ন ইহলোক পরলোক বলে কিছু নেই, শরীরের নাশ হলে চৈতন্যেরও অবলুপ্তি হয়।
মোক্ষ বিচার
- ৯৬। দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ।
- ৯৭। শরীর ভিন্ন মুক্ত বা বদ্ধ আত্মা বলে কিছু নেই।
- ৯৮। (যুক্তি প্রতিষ্ঠিত বলে) তর্ক অপ্রতিষ্ঠ নয়।
- ৯৯। সর্বদা লোকায়তিকই একমাত্র শাস্ত্র।
- ১০০। আচার্য বৃহস্পতি কর্তৃক বর্ণনা সমাপ্ত হলো।
চার্বাক ও লোকায়ত
যা চার্বাক তাই লোকায়ত – এটি বিভিন্ন গ্রন্থেই বিভিন্ন দার্শনিকের বয়ানে উঠে এসেছে –
- ৮ম শতকের বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিত তার ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থে স্বমত-সমর্থনে তথা বিপক্ষমত খণ্ডনে যে বিস্তৃত আয়োজন করেছিলেন, সেখানে তৎকালীন প্রচলিত বস্তুবাদী মতবাদকে তার খণ্ডনের প্রয়োজন ছিলো এবং সে ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। এই খণ্ডনের প্রয়োজনে পূর্ব-পক্ষ হিসেবে স্থাপিত বস্তুবাদী মতকে তিনি ‘লোকায়াত’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।
- আবার একই শতকের বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীল তার গুরু শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ নামের যে বিশাল ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন, সেখানেও বস্তুবাদী মত খণ্ডনে ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু কমলশীল এখানে গুরু শান্তরক্ষিতের আখ্যায়িত ‘লোকায়ত’ মতকে ‘চার্বাক’ মত হিসেবে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ এই দুই বৌদ্ধ আচার্যের দার্শনিক সিদ্ধান্তে লোকায়ত ও চার্বাক ভিন্ন ভিন্ন নামে আসলে একই অভিন্ন মতবাদ ও সম্প্রদায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে।
- একইভাবে ৮ম শতকের আরেক জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী তার স্বমত জৈনমতের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণে রচিত ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে সেকালের যে ছটি প্রখ্যাত দার্শনিক মতের বিচারমূলক পর্যালোচনা করেছেন, সেখানে বস্তুবাদী মতটিকে ‘লোকায়ত’ মত হিসেবেই উপস্থাপন করেন। অথচ এই ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের বিশদ ব্যাখ্যা হিসেবে আনুমানিক ১৪শ-১৫শ শতকের প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক গুণরত্নের রচিত ‘তর্করহস্যদীপিকা’ নামের টীকাগ্রন্থে ওই একই বস্তুবাদী মত চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। অবশ্য চার্বাক ও লোকায়ত যে একই মতের ভিন্ন ভিন্ন নাম, গুণরত্ন তা বলতেও দ্বিধা করেননি – “তার নাম চার্বাক, লোকায়ত ইত্যাদি।”
- বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ মহর্ষি বেদব্যাস বা বাদরায়ন রচিত ‘ব্রহ্মসূত্রে’র প্রখ্যাত ভাষ্যকার বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বেদান্ত দার্শনিক রামানুজ ১১শ শতকে রচিত তার ভাষ্যগ্রন্থে বস্তুবাদী দর্শনকে ‘চার্বাক’ নামে অভিহিত করলেও এর বহু আগেই ৭ম শতকের আরেক প্রখ্যাত ভাষ্যকার অদ্বৈত-বেদান্তবাদী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের প্রসিদ্ধতম গ্রন্থ ‘বেদান্তভাষ্য’র কোথাও চার্বাক শব্দটি চোখে পড়ে না। বস্তুবাদী মতটিকে শঙ্করাচার্য একাধিকবার ‘লোকায়ত’ নামেই উল্লেখ করেছেন।
- আসলে চার্বাকমতেরই পূর্বকৃত নামান্তর যে লোকায়ত, এটারই উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪শ শতকের আরেক বেদান্ত দার্শনিক মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে – “ওই চার্বাকদর্শনেরই অপর এক জুৎসই বা সার্থক নাম হলো লোকায়ত।”
- লোকায়ত নামটিকে মাধবাচার্য কথিত অপর এক ‘অণ্বর্থম্’ বা জুৎসই উল্লেখের মধ্যে চার্বাকদর্শনের প্রতি তার অপছন্দ-প্রসূত কটাক্ষের আভাস রয়েছে বলে মনে হয়। এরই প্রতিধ্বনি শোনা যায় লোকায়ত নামের ব্যাখ্যায় জৈন দার্শনিক গুণরত্নের উক্তিতেও- “সহজ কথায় বিচারবিহীন সাধারণ মানুষ এই মত অনুসারে আচরণ করে বলেই লোকায়ত বা লোকায়তিক শব্দের ব্যবহার।” (তর্করহস্যদীপিকা)।
গুণরত্নের এই ব্যাখ্যা থেকে প্রতীয়মান হয়, এই বস্তুবাদী মতানুযায়ী কোন বাছবিচার ছাড়া সাধারণ মানুষের আচরণ অনুচর্চিত হয় বলে এটা লোকায়ত অর্থাৎ জনসাধারণের দর্শন। আর সাধারণ মানুষের বস্তুবাদী আচরণ নিশ্চয়ই আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের কাছে সম্মানজনক বিবেচিত হয়নি। ফলে এসব দার্শনিকের পক্ষ থেকে এরকম কম-বেশি কটাক্ষ বর্ষণ ভারতীয় দার্শনিক আচার হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে হয়তো। এবং লোকায়তবাদীদের পক্ষ থেকেও যখন ফের পাল্টা কটাক্ষ বর্ষিত হতে শুরু করে, তখনই শুরু হয় যুক্তিতর্কের এক অন্যরকম দার্শনিক বিতর্ক। তাই চার্বাক মতের উৎসগ্রন্থের অনুপস্থিতিতে বিষয়ানুগ আলোচনায় এসব উষ্ণতা এড়িয়ে চার্বাক মত পুনর্গঠনের সুযোগ আপাতদৃষ্টিতে নেই বলেই মনে হয়।
এই দার্শনিক কটাক্ষের মধ্য দিয়েই যে লোকায়ত মতগুলি ভারতীয় আধ্যাত্ম দর্শনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে চার্বাক মতের প্রতিনিধি হয়ে নিজের সদম্ভ অস্তিত্ব ঘোষণা করে নিরন্তর যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, সেগুলি আসলে প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সমাজে একরকম দার্শনিক ছড়া হিসেবে চালু ছিলো। এগুলি কার রচনা তা জানা নেই কিংবা বিদগ্ধ কোন গ্রন্থের অংশও নয় এগুলি। তবুও লোকমুখে মুখে চলে এসেছে বলে একে বলা হয় লোকগাথা। এই লোকগাথার পেছনে দীর্ঘকালের রেশ থাকলে অনেক সময় তা প্রামাণিক লোকগাথা হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়ে যায়। চার্বাকের নামে প্রচলিত এরকম কিছু প্রামাণিক লোকগাথার উপস্থিতি দেখা যায় প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্য গ্রন্থগুলিতে, তাও আবার প্রতিপক্ষ দার্শনিকদের দর্শনযুক্তির পূর্বপক্ষ হয়ে। এরকম একটি লোকগাথা হলো – “যতদিন বেঁচে আছ ততদিন সুখভোগ করে নাও। মরণ থেকে কারুরই রেহাই নেই। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?” (সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)।
মাধবাচার্য তার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে এই লোকগাথাটি উদ্ধৃত করে এরপর মন্তব্য করেছেন – “এই লোকগাথার অনুবর্তন করে, নীতিশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র অনুসারে অর্থ ও কামকে পুরুষার্থ মনে করে, পারলৌকিক স্বর্গ, দেবতা, পাপ ও পুণ্য প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ পদার্থ অগ্রাহ্য করে চার্বাকমতের অনুবর্তন করতে দেখা যায়। এজন্যে চার্বাক মতের অপর একটি সার্থক নাম লোকায়ত। প্রায় সমস্ত লোকে এই মতটি পরিব্যাপ্ত বলে তা লোকায়ত মত নামে প্রসিদ্ধ।” (সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)। মাধবাচার্যের এই মন্তব্য থেকে আমাদের অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, চার্বাক মত আর লোকায়ত মত একই, যা সাধারণ জনমনে খুবই জনপ্রিয়। এবং তার চেয়েও বড় কথা হলো, দর্শনটি ঐকান্তিক অর্থেই ইহলোকসর্বস্ব। এই মতে পরকাল পরলোক প্রভৃতির কোন স্থান নেই। দৃশ্যমান এ পৃথিবী বাস্তব সত্য। মূলত এটিই এ দর্শনের প্রাণকথা। প্রত্যক্ষসিদ্ধ এই বাস্তবতাকে কোন ইন্দ্রিয়াতীত কল্পনার আধ্যাত্মিক যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যে দুরুহ তা চার্বাকমতের ঘোর বিরোধী হয়েও মাধবাচার্য হয়তো অনুধাবন করেছিলেন ঠিকই। তাই শুরুতেই বলে রেখেছেন – “চার্বাকের চেষ্টিত বা প্রচারিত এই মতবাদ দুশ্ছেদ্য।” (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।
উপরিউক্ত লোকগাথাটি ছাড়াও মাধবাচার্য তার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাক বা লোকায়তিকদের নামের সঙ্গে সম্পর্কিত এরকম বেশ কিছু প্রামাণিক বা প্রসিদ্ধ লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এই লোকগাথাগুলির অন্তর্গত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি চার্বাক মতেরই প্রতিধ্বনি। তবে এগুলোর লোকায়তিক কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্যের মূল কথাটা হচ্ছে- কিছু ধূর্ত মানুষ লোক-ঠকিয়ে উপার্জন করবার উদ্দেশ্যে রকমারি ধর্মকর্ম ও ক্রিয়াকাণ্ডের বিধান দিয়ে থাকেন এবং এসব যে নেহায়েতই লোক-ঠকানো ব্যাপার, প্রত্যক্ষ-প্রমাণ থেকেই তা সহজে বোঝা যায়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ উদ্ধৃত লোকগাথাগুলির বাংলা তর্জমা বিবৃত করা হলো। সর্বদর্শনসংগ্রহে লোকায়তিক চার্বাকপক্ষ প্রকরণ –
- (লোকায়ত মতে) মাটি, জল, আগুন, বাতাস- শুধুমাত্র এই চার রকম ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার রকম ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়।
- যেমন কিণ্ব প্রভৃতি বস্তুগুলি থেকেই উৎপন্ন হয় মদশক্তি। ‘আমি মোটা’, ‘আমি রোগা’- এ জাতীয় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আসলে বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্কই বর্তমান।
- ‘মোটা’ প্রভৃতি শব্দ দেহেরই বিশেষণ বলে স্বতন্ত্র কোনো আত্মার কথা অবান্তর। ‘আমার দেহ’ জাতীয় কথা নেহাতই কথার কথা- যাকে বলে উপচার।
- স্বর্গ বলে কিছু নেই, অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা বলেও নয়। বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্মও নেহাতই নিষ্ফল।
- যাদের না-আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মুরোদ তাদের জীবিকা হিসাবেই বিধাতা যেন সৃষ্টি করেছেন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, তিন বেদ, সন্ন্যাসীদের ত্রিদণ্ড, গায়ে ভস্মলেপন প্রভৃতি ব্যবস্থা।
- জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সরাসরি স্বর্গেই যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের পিতাকে হত্যা করে না? (অর্থাৎ, স্বর্গে যাবার অমন সোজা সড়ক থাকতেও যজমান কেন নিজের পিতাকে তা থেকে বঞ্চিত করে?
- কেউ মারা যাবার পর শ্রাদ্ধকর্ম যদি তার তৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে তো প্রদীপ নিভে যাবার পরেও তেল ঢেলে তার শিখা প্রদীপ্ত করা যেত।
- যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিণ্ড) কল্পনা করা বৃথা, কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তর গমন করলে ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলেই তো তার পাথেয়-ব্যবস্থা সম্পন্ন হতো। (অর্থাৎ গ্রামান্তরগামীর পক্ষে তো তাহলে পাথেয় হিসেবে চাল-চিঁড়ে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার হতো না।)
- যিনি স্বর্গে গেছেন তার উদ্দেশ্যে দান নেহাতই বৃথা, কেননা তাহলে যিনি প্রাসাদের উপরে উঠে গেছেন তার উদ্দেশ্যে (মাটিতে বসে) দান করলেও তো তার তৃপ্তি হবার কথা।
- যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?
- জীব যদি এই দেহ ছেড়ে পরলোকে যায়, তাহলে বন্ধুবান্ধবদের টানে সে আবার ফিরে আসে না কেন?
- ব্রাহ্মণদের জীবিকা হিসেবেই মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে (শ্রাদ্ধাদি) প্রেতকার্য বিহিত হয়েছে। তাছাড়া এসবের আর কোনো উপযোগিতা নেই।
- যারা তিন বেদ রচনা করেছেন তারা নেহাতই ভণ্ড, ধূর্ত ও চোর (নিশাচর)। জর্ফরীতুর্ফরী (প্রভৃতি অর্থহীন বেদমন্ত্র) ধূর্ত পণ্ডিতদের বাক্যমাত্র।
- আর তারাই বিধান দিয়েছেন, অশ্বমেধ-যজ্ঞে যজমান-পত্নী অশ্বের শিশ্ন গ্রহণ করবে। তেমনি চোরেরাই (নিশাচর) মাংস খাবার মতলবে (যজ্ঞে পশুবলির) বিধান দিয়েছেন।
- এরকম আরো বহু রমণীয় চার্বাক লোকগাথা রয়েছে। সায়ণ মাধবাচার্য বিরচিত সর্বদর্শনসংগ্রহ নামক গ্রন্থের চার্বাকদর্শন নামক প্রকরণ সমাপ্ত হলো।
লোকমুখে প্রচারিত এই লোকগাথাগুলিতে দর্শনের জটিল বিভ্রম নেই ঠিকই, কিন্তু তাদের নিজস্ব বাস্তবসম্মত দর্শনের ঔজ্জ্বল্যটুকু বিকিরিত হয়েছে ঠিকই। আর তা হলো ইন্দ্রিয়গোচর ইহলৌকিক দর্শন। যাকে আমরা বস্তুবাদী চার্বাক দর্শন বলি। এটাই প্রাকৃতজনের বা জনগণের দর্শন অর্থাৎ লোকায়ত দর্শন। এই ইন্দ্রিয়গোচরতাই যে লোকায়ত, তা নিরূপন করতে গিয়ে জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী তার ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’-এ বলেন – “যতটুকু নিছক ইন্দ্রিয়গোচর সেটুকুকেই বলে ‘লোক’।” আর এই ‘লোক’ই যাদের কাছে একমাত্র সত্য তারাই লোকায়তিক। ফলে লোকায়তিক মতে প্রত্যক্ষগোচর পদার্থই একমাত্র সত্য। কিন্তু লোকায়তিকদের মধ্যে শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ-গোচর পদার্থকে সত্য বলে স্বীকার করার কারণ কী? এর সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় ভাষ্যকার মণিভদ্র’র উক্তিতে – “লোকায়তিকদের মতে প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা ধর্মপ্রবঞ্চনার প্রতিষেধক, কেননা অনুমান, আগম (শাস্ত্র) প্রভৃতির নজির দেখিয়ে পরবঞ্চনপ্রবণ ধর্মছদ্মধূর্তেরা সাধারণ মানুষের মনে স্বর্গাদিপ্রাপ্তি সংক্রান্ত অন্ধ মোহের সঞ্চার করে, এই কারণেই প্রত্যক্ষ ছাড়া অন্য প্রমাণ স্বীকার করা সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাপদ নয়।” (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১৬/ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। এর মানে দাঁড়ালো, আধ্যাত্মবাদী দর্শনের পেছনে লোকবঞ্চনার এক আয়োজন সক্রিয়। চার্বাক বিরোধী হয়েও মণিভদ্রের এই চমৎকার ব্যাখ্যাটি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, তিনি একাধারে একজন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী দার্শনিকও। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বরূপটিও তার উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং মণিভদ্রের এই ব্যাখ্যা স্বীকার্য হলে এটাও মানতে হবে যে, সেকালের লোকায়তিকেরাও দার্শনিক মতকে একেবারে নির্ভেজাল তত্ত্বজিজ্ঞাসার পরিচায়ক বলে মেনে নেননি। দার্শনিক মতের সঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির এরকম যোগাযোগ তাদের চেতনারও অগোচর ছিলো না। উপরে উদ্ধৃত লোকাগাথাগুলিই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
দেহাতিরিক্ত আত্মা অস্বীকার করাটাই চরম জড়বাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর পরলোকগামী আত্মা বলে যদি কিছু না-থাকে তাহলে পরলোকের কল্পনাও অবান্তর। এ অর্থে জড়বাদ বা বস্তুবাদ মানেই ইহলোক-সর্বস্ব দর্শন। ফলে আত্মবাদী বা আধ্যাত্মবাদীদের পক্ষে অবশ্যই এই দর্শনকে অপছন্দ করার পাশাপাশি এরকম দর্শনের প্রতি সহজাতভাবে আকৃষ্ট জনসাধারণকেও ভালো চোখে দেখার কথা নয়। কেননা, দেহাতিরিক্ত আত্মাকেই চৈতন্যের মূল বা উৎস হিসেবে প্রচার করে আধ্যাত্মবাদীরা যে ইন্দ্রিয়াতীত সত্তা ও পারলৌকিক জগতের কল্পনা বিস্তার করেছেন, তা দিয়ে মূলত পূর্বজন্মের কর্মফল হিসেবে প্রাকৃত জনগোষ্ঠির বর্তমান জন্ম ও ক্রিয়াকাণ্ডকে বেঁধে ফেলে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। এটা যে চতুর লোকবঞ্চনা তা লোকায়তিকদের সাধারণ দৃষ্টিতেই ধরা পড়েছে এবং ইন্দ্রিয়াতীত কোন অস্তিত্বে সরাসরি অস্বীকারের মধ্য দিয়েই তা প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে। তাই লোকায়তিকদের মতে চৈতন্য যে আসলে দেহেরই গুণ বা দেহধর্ম, তা কট্টর ব্রহ্মবাদী বৈদান্তিক দার্শনিক শঙ্করাচার্য’র কটাক্ষপূর্ণ উক্তি থেকেও বোঝা যায় – ‘ইতর জনগণ বা প্রাকৃতজন এবং লোকায়তিকেরা চৈতন্যবিশিষ্ট দেহমাত্রকে আত্মা বলে মনে করে।’
জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা লোকায়তিকদের প্রত্যক্ষ যুক্তি সংবলিত প্রচলিত লোকগাথাগুলিকে বস্তুবাদী দর্শনের অন্যতম প্রতিভূ হিসেবে পূর্বপক্ষ বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক সাহিত্যে আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের পক্ষ থেকে যুক্তি খণ্ডনের প্রয়াস প্রত্যক্ষ করলেই এ ধারণা জোরালো হয়ে ওঠে যে, লোকায়ত ও চার্বাক আসলে একই মতের একাধিক নাম ছাড়া কিছু নয়। ৭ম-৮ম শতকের শঙ্করাচার্যও তার ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে লোকায়ত মতের প্রতিভূ হিসেবে বেশ কিছু লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেগুলিরও তর্জমাগুলো দেয়া হলো (সংগ্রহ সূত্র: সায়ন মাধবীয় সর্বদর্শনসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড)- চার্বাকদর্শন / অমিত ভট্টাচার্য / সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা) –
- লোকায়ত মতে চারটি ভূতকেই তত্ত্ব বলা হয়। উক্ত চারটি ভূত হলো যথাক্রমে পৃথিবী, জল, তেজ এবং বায়ু। অপর কোন ভূত এই মতে স্বীকৃত নয়।
- যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে থাকে- এমন কথা অদৃষ্টবাদিগণও বলেন না।
- লোকায়তিকেরা বলেন, যদি অদৃষ্ট কোথাও দেখে থাকো, তবে সেই দৃষ্ট বস্তুকে অদৃষ্ট কেন বলো? আবার শশশৃঙ্গাদির ন্যায় নিত্যই যা অদৃষ্ট, তা কিভাবে সৎ হতে পারে?
- অপরবাদিগণ কর্তৃক সুখদুঃখরূপ হেতুর দ্বারা ধর্ম ও অধর্মের অনুমান করা অযৌক্তিক। স্বভাববশতই মানুষ সুখ এবং দুঃখ পেয়ে থাকে। এই বিষয়ে ধর্ম ও অধর্ম নামক কারণান্তরের অপেক্ষা নেই।
- ময়ূরদের কে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করে দেয়? কোকিলদেরই বা কে কূজন করায়? বস্তুত স্বভাব ব্যতীত এক্ষেত্রে অন্য কোন কারণ নেই।
- আমি স্থূল, তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ ইত্যাদি বাক্যে স্থূল প্রভৃতি বিশেষণের দ্বারা দেহই বিশেষিত হয়ে থাকে। দেহ থেকে ভিন্ন অন্য কোন আত্মা নামক পদার্থ ঐ বিশেষণের বিশেষ্য হয় না।
- জড় ভূতের বিকাররূপ শরীরাদিতে যে চৈতন্য দৃষ্ট হয়, তা পান, সুপারি এবং চূণ সংযোগে রক্তিমার ন্যায়- সংযোগজন্য।
- ইহলোক থেকে পৃথক স্বর্গ অথবা নরক নামক কোন স্থান নেই। মূর্খ এবং প্রতারকেরাই শিবলোকাদির কল্পনা করে থাকে।
- শোভন অন্নভোজন, ষোড়শী যুবতীর সঙ্গ, সূক্ষ্ম বস্ত্র এবং সুগন্ধ মাল্য চন্দনাদির উপভোগই স্বর্গানুভব।
- শত্রুর অস্ত্র অথবা ব্যাধি প্রভৃতির উপদ্রবই নরকানুভব। মরণই মুক্তি এবং সেই মরণ হলো প্রাণবায়ুর চিরতরে বহির্গমন।
- সুতরাং সেই মুক্তির জন্য বিদ্বানদের কৃচ্ছ্রসাধন করা উচিত নয়। মূর্খ লোকেরাই উপবাসাদি তপস্যার দ্বারা শুষ্ক হয়।
- যারা বুদ্ধিমান অথচ স্বয়ং দুর্বল (নিজেদের স্ত্রী রক্ষায় অক্ষম) তারাই পাতিব্রত্য প্রভৃতির নিয়ম করেছে। ক্ষুধায় জর্জরিত দরিদ্র লোকেরাই সুবর্ণদান, ভূমিদান এবং শোভন নিমন্ত্রণ ভোজনের ব্যবস্থা কল্পনা করছে।
- পথিকেরাই কেবল দেবালয়, জলসত্র, কূপ, পান্থনিবাসের প্রশংসা করে থাকে, অন্যেরা নয়।
- অগ্নিহোত্র, তিন বেদ, ত্রিদণ্ডধারণ (সন্ন্যাস), ভস্মানুলেপন প্রভৃতি বুদ্ধি ও পৌরুষহীন মানুষের জীবিকার্জনের উপায় বলে বৃহস্পতি মনে করেন।
- অতএব বুদ্ধিমান সর্বদা কৃষিকর্ম, গোপালন, বাণিজ্য এবং দণ্ডনীতি প্রভৃতি দৃষ্ট উপায় দ্বারা এই পৃথিবীতেই ভোগ অনুভব করেন।
- আচার্য শঙ্কর বিরচিত সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহনামক গ্রন্থের লোকায়তিকপক্ষ নামক দ্বিতীয় প্রকরণ সমাপ্ত হলো।
মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ ও শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’-এ উদ্ধৃত লোকগাথাগুলিতে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন, লোকগাথাগুলিকে প্রতিপক্ষ আধ্যাত্মবাদী দার্শনিক কর্তৃক যুক্তি খণ্ডনের নিমিত্তে পূর্বপক্ষ হিসেবে তাদের সাহিত্যে স্থাপন করা হয়েছে। এই লোকগাথাগুলির মূল কথা প্রধানতই নেতিবাচক এবং প্রধান ঝোঁক পরমত খণ্ডন। অর্থাৎ আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা তাদের দার্শনিক সিদ্ধান্তে যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন তার অনেক কথাই এসব লোকগাথায় নস্যাৎ করার আয়োজন করা হয়েছে বলে মনে হয়। এতে স্বমত প্রতিষ্ঠায় যুক্তিজাল বিস্তারের কোন আয়োজন চোখে পড়ে না। এবং এগুলোর প্রধান হাতিয়ার হলো কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য অর্থাৎ বাস্তব জীবনের প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও হাসি-তামাশার ব্যবহার।
এছাড়া, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মহর্ষি বাৎস্যায়ন তার অতি প্রসিদ্ধ ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে লোকায়তিক মতের বর্ণনায় প্রাসঙ্গিক যে সূত্রগুলি উদ্ধৃত করেছেন সেগুলি সংকলিত বার্হস্পত্য-সূত্রেও রয়েছে। বাৎস্যায়ন ‘কামসূত্রে’র ‘সাধারণাধিকরণম্’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ত্রিবর্গপ্রতিপত্তিঃ’-তে লোকায়তিক বর্ণনায় বলছেন (কামসূত্র-১/২/২১-২৪) –
- ২১। ‘ধর্মাচরণ করার প্রয়োজন নেই;- কারণ তার ফল ইহজন্মে পাওয়া যায় না এবং যজ্ঞাদি সাধিত হলেও ফল হবে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহও আছে’।
- ২২। ‘মূর্খ ভিন্ন কোন্ ব্যক্তি হস্তগত দ্রব্যকে পরগত করে?’
- ২৩। ‘আগামী কল্যকার ময়ূর লাভের চেয়ে আজকের পারাবত লাভ মন্দের মধ্যে ভাল’।
- ২৪। ‘সংশয়সঙ্কুল হেমশত লাভের চেয়ে নিঃসন্দেহে এক কার্যাপণ লাভও মন্দের ভাল।- একই কথা লোকায়তিক নাস্তিকেরা বলে থাকে।’
এই বাৎস্যায়ন এবং ভারতীয় দর্শন-সাহিত্যের প্রখ্যাত ন্যায়-ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন একই ব্যক্তি কিনা তা নির্ণয়সাপেক্ষ। তবে আস্তিক মতাদর্শি হিসেবে লোকায়তিক নাস্তিক মতের বিরোধিতা তিনি করবেন এতে আর আশ্চর্যের কী! কিন্তু এই নাস্তিক-মতের বিরোধিতা করলেও প্রাচীন ভারতীয় দর্শন তথা ধর্মশাস্ত্রে স্বীকৃত মানবজীবনের অন্যতম পুরুষার্থ হিসেবে জাগতিক ‘কাম’কে গুরুত্ব দিয়েই তিনি স্বতন্ত্র কামশাস্ত্র হিসেবে ‘কামসূত্র’ প্রণয়নেও দ্বিধা করেননি। এবং বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে ধর্মাচরণজনিত লোকাচার আখ্যায়িত করে তিনি হয়তোবা শাস্ত্র নির্দেশনা মোতাবেক কামচর্চাকেও ধর্মাচরণেরই অঙ্গ বলে প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন। কেননা ঠিক পরের শ্লোকেই তিনি বলছেন – ‘শাস্ত্রের উপর আশঙ্কাপ্রকাশ করতে পারা যায় না, অভিচার ও শান্তিকপৌষ্টিকাদির ফল কখনও কখনও দেখতে পাওয়া যায়, লোকের শুভাশুভ প্রদর্শনার্থই যেন বুদ্ধিপূর্বক নক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য্য-গ্রহচক্রের প্রবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়, লোকযাত্রা বর্ণাশ্রমাচার-ঘটিত এবং ভবিষ্যৎ শস্যলাভার্থ বীজ হস্তগত হলেও ভূমিতে বপন করা হয় দেখতে পাওয়া যায়।- এই হেতু ধর্মাচরণ করবে। এই কথা বাৎস্যায়ন বলেন।’ (কামসূত্র-১/২/২৫)।
সে যাক, কিন্তু লোকগাথাগুলিতে যুক্তিজাল বিস্তারের আয়োজন নেই বলেই এজাতীয় খণ্ডনপদ্ধতি যুক্তিহীন বা দার্শনিক মর্যাদার দিক থেকে অবান্তর ভাবারও কারণ নেই। কেননা প্রচলিত অর্থে বিচার-বিশ্লেষণের আয়োজন না থাকলেও এই প্রাণশক্তিপূর্ণ লোকগাথাগুলি কোনভাবেই যুক্তিশূন্য নয়। আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হিসেবে প্রকাশিত হলেও এগুলির ভিত্তি-ভূমিতে কোন যুক্তির পরিচয় না-থাকলে প্রতিটা বিপক্ষ দর্শন-সাহিত্যে এদের খণ্ডনে ব্যাপক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন হতো না। অতএব কেবলই পরমত খণ্ডন-লিপ্ত লোকগাথা হলেও দার্শনিক বিচার-পদ্ধতিতে এর অন্তর্নিহিত যুক্তির মধ্যেই স্বীয় মতের পরিচয় নিহিত রয়েছে। সেগুলি সংশ্লেষণের মধ্য দিয়েই লোকায়ত চার্বাক দর্শনের মূল সিদ্ধান্ত এবং এর রূপরেখা তৈরি ও পুনর্গঠন করাও অসম্ভব নয় বলেই বিদ্বানেরা মনে করেন। কিন্তু এই লোকগাথাপ্রসূত লোকায়ত মতের সাথে খ্রীস্টপূর্ব ৪র্থ শতকের প্রাচীন গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্য বর্ণিত আদি লোকায়ত ধারণার যে দ্বন্দ্বমূলক ভিন্নতা সূচিত হয়ে আছে, তার ব্যাপারে কোন যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত না-আসা পর্যন্ত বিষয়টা রহস্যময় প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়।
চার্বাক-ষষ্ঠি
বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে চার্বাকের নামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচলিত লোকগাথা বা লোকগাথার আদলে সংগৃহিত শ্লোক সংকলন হচেছ ‘চার্বাক-ষষ্ঠি’। পণ্ডিতদের মতে চার্বাকষষ্ঠি হলো বার্হস্পত্য-সূত্রের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। প্রাচীন দর্শন গ্রন্থের রচয়িতারা চার্বাক মত উপস্থাপন করতে গিয়ে এই শ্লোকগুলিরও আশ্রয় নিয়েছেন ব্যাপকভাবে। ষষ্ঠি অর্থ ষাট। চার্বাকষষ্ঠিতে চার্বাকের নামে প্রচলিত প্রামাণিক লোকগাথাগুলি ষাটটি লোকায়ত শ্লোকে সংকলিত হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে চার্বাক-ষষ্ঠি। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এই মূল চার্বাক-ষষ্ঠি বাংলা তর্জমাসহ উপস্থাপন করা হলো। (সংগ্রহ সূত্র: সায়ন মাধবীয় সর্বদর্শনসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড)- চার্বাকদর্শন / অমিত ভট্টাচার্য / সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা।)
- ১। পাথর ভাসতে থাকার মতো যজ্ঞের ফল বিষয়ে বেদের সত্যতাও অসম্ভব। ওহে বুদ্ধিমানেরা! সে সম্বন্ধে তোমাদের কী এমন বিশ্বাস যে কামের পথ অবরুদ্ধ করেছ?
- ২। কোন এক বোধিসত্ত্ব বেদের মর্ম উদ্ঘাটনের জন্য জন্মেছিলেন। যেহেতু সত্তা নামক হেতুর সাহায্যে তিনি জগতকে ক্ষণিক বলেছিলেন।
- ৩। (বৃহস্পতি বলেন-) হোম, বেদবিহিত কার্যকলাপ, পাশুপত ব্রত ও ভস্ম তিলক হলো প্রজ্ঞাশক্তিহীন ব্যক্তিদের জীবিকা।
- ৪। যেহেতু পিতামাতার দুই বংশের একে একে শুদ্ধতা হলে শুদ্ধি হয় এবং একইভাবে অনন্ত বংশভেদ তাই দোষবশত নির্দোষ জন্ম কোথায় আছে?
- ৫। কামিনীগোষ্ঠীর সংসর্গে কে না পাপে আক্রান্ত হয়? হায়, মোহবশে এই জগতে কাম্য ফলের অভাব সত্ত্বেও (ব্রতপার্বণে) খায় না, স্নান করে।
- ৬। কামান্ধ ভাবের পার্থক্য না থাকলেও যারা ঈর্ষাবশত মেয়েদের আটকে রাখে আর পুরুষদের নিবৃত্ত করে না, কুলের মর্যাদার বিষয়ে দাম্ভিক সেই লোকেদের ধিক্ ।
- ৭। পরস্ত্রী থেকে যে নিবৃত্ত থাকা- সেটা হলো দম্ভ। বজ্রপাণি ইন্দ্র অহল্যার সঙ্গে কামক্রীড়ায় তৎপর হয়ে স্বয়ং তা উপেক্ষা করেছেন।
- ৮। ওহে ব্রাহ্মণের দল! তোমরা এমন, যাদের পতি চাঁদের গুরুপত্নী সম্ভোগে অত্যন্ত আগ্রহ। অতএব গুরুপত্নী সম্ভোগে যে পাপ তার কল্পনা ত্যাগ কর।
- ৯। পাপ থেকে মৃতের তাপ, পুণ্য থেকে আনন্দ- এই হচ্ছে বেদ। দ্রুত প্রত্যক্ষ হচ্ছে এর বিপরীত ভাব। অতএব সবল ও দুর্বল কোনটা তোমরাই বল।
- ১০। অন্যদেহ লাভ করা বিষয়ে সন্দেহ সত্ত্বেও যদি পাপ বর্জনীয় হয়, তবে ওহে বেদপাঠকের দল, হিংসাদোষের সন্দেহ থাকায় যজ্ঞ ছেড়ে দাও।
- ১১। ত্রিবেদজ্ঞ পণ্ডিত তোমাদের আরাধ্য ব্যাসদেবও বলেছেন- কামার্ত রমণীর হস্তধারণ যুক্তিযুক্ত।
- ১২। সুকৃতি বিষয়ে তোমাদের শ্রদ্ধা কেন, স্ত্রী সম্ভোগে তা নেই কেন? পুরুষের সেই কাজ করা উচিত যার শেষে আনন্দ বা সুখ বাড়ে।
- ১৩। জোর করে পাপ কর, সে-সব তোমাদের না-করা হিসেবে থাকবে। মনুই তো বলেছেন- বলপূর্বক সব কিছু করে ফেলা তো না-করা দোষ।
- ১৪। ওহে সম্প্রদায়ভুক্তগণ! নিজেদের শাস্ত্রের এই অর্থ বিষয়েও সন্দিগ্ধ থেকো না। যা যা চাও স্বচ্ছন্দে সেই সেই আনন্দ ভোগ কর।
- ১৫। বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্রের অর্থবোধের বিষয়ে মহাজ্ঞানীদের মধ্যে কোথায় ঐকমত্য রয়েছে? ব্যাখ্যা বুদ্ধিবলের উপর নির্ভরশীল। সুখের অভিমুখী ব্যাখ্যা উপেক্ষণীয় নয়।
- ১৬। যে দেহে আছি বলে জ্ঞান হচ্ছে, তা পুড়িয়ে ফেললে পাপে তোমাদের কী হবে? অন্য কিছু যার সাক্ষী, সেই আত্মাতে ফল হলে আত্মা হওয়ার সুবাদে অন্য কোথাও কি তা হতে পারে না?
- ১৭। মৃত ব্যক্তি পূর্বজন্মগুলি স্মরণ করে, মৃত ব্যক্তিতে কর্মফলের পরম্পরা বর্তায়, অন্যদের খাওয়ার ফলে মৃতের তৃপ্তি হয়- এধরনের বজ্জাতি-পূর্ণ কথায় লাভ নেই।
- ১৮। বেদ অতিমাত্রায় ধূর্ত। আশ্চর্য! যে লোক ‘আমি আছি’ এইভাবে দেহকে জানে, ‘এটি তুমি নও’ এইভাবে তাকে তা ছাড়তে ও অন্য কিছুকে ধরতে প্রেরণা যোগায়।
- ১৯। উভয়পক্ষে সন্দেহের মধ্যে একটি অবশ্যই হবে। তার মধ্যে ঈপ্সিত বস্তুর প্রাপ্তি হলে ধূর্তেরা নিজেদের মন্ত্র প্রভৃতিকে তার কারণ বলে, অন্যথা হলে সেগুলোর অঙ্গহানি উল্লেখ করে।
- ২০। ওহে ভীরু! সকলের পাপের ফলে অন্তহীন তাপে বেদে প্রতিপাদিত যে একমাত্র আত্মা ডুবে যাচ্ছে, তোমার পাপে তার কী ভারবৃদ্ধি হবে?
- ২১। বৃন্ত হতে সংগৃহীত পুষ্পে তোমার কী প্রয়োজন? কারণ কেবল সেখানে তাতে ফল ধরে। যদি পাথরের মাথাতেই তা রাখবার উপযুক্ত হয় তবে তা নিজের মাথায় রাখ।
- ২২। স্ত্রীলোকের সম্বন্ধে ঘৃণাসূচক কথাগুলোকে তৃণের ন্যায় পরিহার কর। তুমিও সেইরকম হওয়ায় দীর্ঘকাল তোমার লোকঠকানো কেন?
- ২৩। ওহে মূর্খের দল! ব্রহ্মা প্রভৃতিও যা লঙ্ঘন করেননি, কামদেবের সেই আজ্ঞা পালন কর। বেদও দেবতার আজ্ঞা। সে বিষয়ে বেশি সম্মান কেন?
- ২৪। যদি বেদের অংশবিশেষকেও প্রলাপোক্তি বলেই মেনে থাক, তবে কোন্ দুর্ভাগ্যবশে দুঃখকর বিধানগুলোকে তেমন স্বীকার করছ না?
- ২৫। ওহে মীমাংসায় পরিপক্ক বুদ্ধিমানের দল! তোমরা বেদকে শ্রদ্ধা কর। আবার পরাস্ত হয়ে হাড়িকাঠে বাঁধা হাতি দান করতে বলছে- এমন বেদকে নিজেরাই প্রক্ষিপ্ত বল।
- ২৬। কে জানে পরলোকে (সুখ) আছে কি-না- এইভাবে যে বেদ বলেছে, তাকে প্রমাণ ধরে নিয়ে পরলোক সম্বন্ধে লোকে কীভাবে বিশ্বাস করবে?
- ২৭। ধর্ম অর্জন ও অধর্ম বর্জন করতে পারা যায় না। কৌশলে রাষ্ট্রের দণ্ড আদায়ের প্রয়োজনে সে সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মনু বৃথাই পণ্ডিতদের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন।
- ২৮। ব্যাসদেবের কথায় সে বিষয়ে আস্থা হয়েছে- এইভাবে নিশ্চয় তোমরা যুক্তিবাদী বটে! তোমরা মাছেরও উপদেশের পাত্র। তোমাদের সঙ্গে, এমনকি মাছেদের সঙ্গে, কে কথা বলবে?
- ২৯। ঐ ব্যাস পাণ্ডবদের চাটুকারিতায় পটু কবি ও পণ্ডিত। তারা নিন্দা করতে থাকলে সে নিন্দা করেনি কি? তারা প্রশংসা করতে থাকলে সে প্রশংসা করেনি কি?
- ৩০। ঐ ব্যাস ভ্রাতৃবধূর প্রতি নাকি কামবশে আসক্ত হয় নি। তখন দাসীর সঙ্গে সে যে রত ছিল, তাতেও কি মা আদেশ করেছিলেন?
- ৩১। দেবতা ও ব্রাহ্মণদের লেখা বইগুলো যাদের কাছে তাঁদের সমাদর সম্বন্ধে পথনির্দেশ, তারা গোরুকে প্রণাম জানিয়ে তার থেকেও কি নিজেদের স্পষ্টভাবে ছোট করে নি?
- ৩২। যাদের মন শান্ত, তারা যজ্ঞে উন্মুখ হয়ে মরেও সেই স্বর্গলাভ করতে চায় যেখানে সারবস্তু হল হরিণনয়না অপ্সরা। তারা ঠিকভাবেই কামুকতা ছাড়েনি।
- ৩৩। ওহে প্রকৃষ্ট অজ্ঞের দল! শান্তি আবার কী? প্রেয়সীর প্রীতি উৎপাদনের জন্য পরিশ্রম কর। ভস্মীভূত জীবের পুনরাগমন কীভাবে হবে?
- ৩৪। ‘অপবর্গে তৃতীয়া’ এইভাবে যিনি বলছেন, সেই পাণিনি মুনিরও অভিপ্রায় হল- স্ত্রী ও পুরুষ এই দুই ব্যক্তির (অথবা ধর্ম ও অর্থ এই দুই বিষয়ের) কামে আসক্ত থাকা উচিত। (পাণিনি সূত্রের প্রকৃত অর্থ- ফলপ্রাপ্তি বোঝালে ব্যাপ্তি অর্থে তৃতীয়া বিভক্তি হয়। বিকৃত অর্থ করা হচ্ছে- মোক্ষ বিষয়ে তৃতীয় অর্থাৎ স্ত্রী পুরুষ ভিন্ন নপুংসক নিযুক্ত থাকবে অথবা মোক্ষের বিষয়ে তৃতীয় পুরুষার্থ অর্থাৎ কামই উপযোগী।
- ৩৫। উর্ধ্বলোকে যাওয়ার জন্যে (গঙ্গায়) ডুব দিয়ে লোকেরা- সামনে যুদ্ধ করতে গিয়ে পিছিয়ে যায়, এমন ভেড়ার সদৃশ্য লাভ করে।
- ৩৬। এই পাপে তীর্যক প্রাণী হবে- ইত্যাদি কী বিভীষিকা! নিজের সুখের উপকরণে ঢোঁড়া সাপও রাজার মতো সুখী।
- ৩৭। নিহত হয়ে যদি কেউ স্বর্গে খেলা করে, তবে দৈত্যদের শত্রু বিষ্ণুর হাতে সেইভাবেই নিহত হয়ে সেই দৈত্যগুলো সেখানেও তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করুক।
- ৩৮। সংসারদশায় নিজে ও ব্রহ্ম আছে, কিন্তু মুক্তিতে কেবল ব্রহ্ম- এই হলো বেদবাদীদের নিজের উচ্ছেদ নামক মুক্তি সম্পর্কে উক্তির বাহাদুরি।
- ৩৯। চেতনদের পাষাণত্ব প্রাপ্তি নামক মুক্তির জন্য যে শাস্ত্র রচনা করেছে, সেই গোতমকে বিচার করে যেভাবে জানছ, সে ঠিক তাই করবে।
- ৪০। হরি, হর প্রভৃতির পত্নীরা নিরন্তর তাঁদের সম্বন্ধে মনোনিবেশ করেও কেন মুক্ত নয়? কেন তারা কামের কারাগারে থাকে?
- ৪১। যদি কৃপালু, সত্যবাক্, সর্বজ্ঞ কোন দেবতা থেকে থাকেন, তবে কেবল বাক্য ব্যয় করে আমাদের মতো প্রার্থীদের কৃতার্থ করেন না কেন?
- ৪২। অন্যেরা কারণবশত আমাদের শত্রু হয়। সংসারীদের আপন কর্মজনিত দুঃখও ঘটতে প্রবর্তনা দিয়ে ঈশ্বর অকারণে আমাদের শত্রু হয়ে পড়বেন।
- ৪৩। যেহেতু যুক্তির অপ্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে সাদৃশ্য আছে, সেহেতু পরস্পরের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এমন কোন্ মতগুলি সৎপ্রতিপক্ষ নামক দোষে দুষ্ট হয়ে প্রামাণ্যহীন হবে না?
- ৪৪। যে ক্রোধী তপস্বীরা অপরকে ক্রোধের অভাব বিষয়ে শিক্ষা দেয়, তারা নির্ধন হওয়ায় ধনের জন্যই ধাতুবিষয়ক কথার উপদেশ দেয়।
- ৪৫। তোমরা কেন ধন দাও? এই হরিপ্রিয়া লক্ষ্মী, যে দাতা নয় তার উপর সন্তুষ্ট। মূর্খ বলি সব ধন দান করে বন্ধন লাভ করেছিল।
- ৪৬। এইসব লোক ধনীকে দোহন করে, মনে মনে তার অপকারও করে। লোভের চাঞ্চল্য ত্যাগ করে যদি কেউ উদাসীন থাকে, তো দু’একজন।
- ৪৭। অচৌর্য বা চুরি না করা দৈন্যের আয়ু বাড়ায়। না খাওয়া (উপবাস) হল জঠরকে বঞ্চনা করা। সুখের একমাত্র অঙ্কুর যে স্বেচ্ছাচার- তাই অবলম্বন কর।
- ৪৮। (চার্বাক মতানুসারে-) পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারিটিই ভূত। কিণ্ব বা বৃক্ষবিশেষের নির্যাস ইত্যাদির বিকার বা পরিণাম থেকে মদশক্তির ন্যায় উক্ত চারিটি ভূত থেকেই দেহে চৈতন্য জন্মে।
- ৪৯। আমি স্থূল, কৃশ- ইত্যাদি রূপে আত্মা ও দেহের সামানাধিকরণ্য হয়। দেহই স্থূল বা কৃশ হয় বলে দেহই আত্মা শব্দের বাচ্য। দেহ ভিন্ন অন্য কোন আত্মা নেই। ‘আমার দেহ’ এরূপ প্রয়োগ ঔপচারিক বা গৌণ।
- ৫০। জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে নিহত পশুর যদি স্বর্গলাভ হয়, তবে যজ্ঞকারী যজমান কেন তার পিতাকে হত্যা করে না?
- ৫১। শ্রাদ্ধ যদি মৃত ব্যক্তিদের তৃপ্তির কারণ হয় তবে এই পৃথিবীতে পর্যটনকারী মানুষের পথের সম্বল ভোজ্য দ্রব্যাদির প্রদান ব্যর্থ।
- ৫২। নির্বাপিত প্রদীপে তেল ঢাললে তার শিখা প্রদীপ্ত হওয়া উচিত। গৃহস্থ ঘরে বসে শ্রাদ্ধ করলেই পথে ভ্রাম্যমাণ ব্যক্তির অবারিত তৃপ্তি হোক।
- ৫৩। স্বর্গস্থিত পিতৃগণ যদি দানের দ্বারা তৃপ্তি লাভ করেন, তবে প্রাসাদের উপরে বসবাসকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে এই গৃহে কেন দান করছেন না?
- ৫৪। আত্মা যদি দেহ হতে মুক্ত হয়ে পরলোকে গমন করে তবে পুনরায় বন্ধুস্নেহে ব্যাকুল হয়ে কেন প্রত্যাবর্তন করে না?
- ৫৫। যতদিন বাঁচবে, ততদিন সুখে বাঁচবে। ঋণ করে হলেও ঘৃত পান করবে। ভস্মীভূত দেহের পুনরাগমন কোনভাবেই হতে পারে না।
- ৫৬। নিজ স্ত্রী এবং পরস্ত্রী নির্বিশেষে যথেচ্ছ বিহার করবে। নিজের হিতসাধনে গুরুশিষ্য প্রণালী ত্যাগ করবে।
- ৫৭। অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্বের শিশ্ন পত্নীগ্রাহ্য বলে ভণ্ডরা প্রচার করেছেন। অন্যান্য পর-ব্যবহৃতসামগ্রী গ্রহণের কথাও ভণ্ডরা বলেছে। মাংস ভক্ষণের কথাও নিশাচরেরা বলেছে।
- ৫৮। স্ত্রীলোকের আলিঙ্গনাদিজন্য সুখই হল পুরুষার্থ। কণ্টকাদিজন্য দুঃখই হল নরক। লোকপ্রসিদ্ধ রাজা হলেন পরমেশ্বর। অন্য কোন ঈশ্বর নেই।
- ৫৯। পুরুষের বিষয়ভোগজন্য সুখ যেহেতু দুঃখ মিশ্রিত সেহেতু তাকে পরিত্যাগ করতে হবে- এটা নেহাৎই মূর্খের বিচার। এমন হিতার্থী কে আছেন- যিনি তুষকণাযুক্ত বলে পরিষ্কার উত্তম তণ্ডুলপূর্ণ ধান্য পরিত্যাগ করেন?
- ৬০। অভিধেয়, তাৎপর্য পর্যালোচনা করে বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণ কর্তৃক সংক্ষেপে লোকায়তদের মত বিবৃত হল।
লোকায়ত ও আন্বীক্ষিকী
ইতঃপূর্বেই আমরা দেখেছি যে, লোকায়তকে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে’র অনুমোদিত বিদ্যাচতুষ্টয়ের অন্যতম আন্বীক্ষিকী’র অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন – ‘সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত – এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকী -বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।’ (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
কৌটিল্যের এই বিদ্যাচতুষ্টয় হলো – ‘আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্ -যজুঃ -সামবেদাত্মক বেদ -বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।’ (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।
‘অর্থশাস্ত্রে’র বর্ণনা অনুসারে আন্বীক্ষিকী যে বিদ্যাগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে তাও বোঝা যায় কৌটিল্যের উদ্ধৃতিতে – ‘এই আন্বীক্ষিকীর দ্বারা এবং সূক্ষ্ম অন্বীক্ষার সাহায্যে ধর্ম এবং অধর্মের বিষয় ত্রয়ীতে প্রতিপাদিত হয়; অর্থ এবং অনর্থ প্রতিপাদিত হয় বার্তা -নামক বিদ্যায় ; এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় (good policy and bad policy) প্রতিপাদিত হয়। এই তিন বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য -ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে।’ (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
সহজ কথায় একমাত্র এই আন্বীক্ষিকী বিদ্যার সহায়তার ভিত্তিতেই অপর বিদ্যাগুলি সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। এই অপর বিদ্যাগুলির মধ্যে বেদও অন্তর্ভুক্ত। তাই কৌটিল্যের মতে আন্বীক্ষিকী সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ – ‘আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর -) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক -) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।’ (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অন্যদিকে জড়বাদী বার্হস্পত্যরা তাঁদের মতাদর্শে এই আন্বীক্ষিকীকে যে বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত করেননি তাও কৌটিল্যর উদ্ধৃতি থেকেই জানা যায় – ‘বৃহস্পতির শিষ্যগণের (বার্হস্পত্যগণের) মতে, বার্তা ও দণ্ডনীতি – এই দুই প্রকারের বিদ্যা ; কারণ, ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদের অর্থাৎ বার্তা ও দণ্ডনীতির অনুষ্ঠান বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে সংবরণের অর্থাৎ আচ্ছাদনের কাজ করে মাত্র (লোকতন্ত্রজ্ঞ হলেও ত্রয়ীজ্ঞান না থাকলে নাস্তিক বলে লোকসমাজে যে নিন্দিত হতে হয়, তার থেকে রক্ষার উপায়মাত্র হওয়ায় ত্রয়ীর স্বতন্ত্র বিদ্যাত্ব স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই)।’ (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।
কৌটিল্য বর্ণিত এসব উদ্ধৃতি থেকেই স্পষ্টত বোঝা যায় যে, আন্বীক্ষিকী বৈদিক সংস্কৃতির পরিপন্থী ছিলো না কখনোই, বরং বেদের পরিপূরক শাস্ত্র হিসেবেই তা পরিগণিত হতো। ফলে জড়বাদী বার্হস্পত্যরা এটাকে বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। তবে তৎকালীন চিন্তাজগতে আন্বীক্ষিকীর যে যথেষ্ট সম্মান ছিলো, কৌটিল্যের বর্ণনাভঙ্গিতে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
অর্থশাস্ত্রে সাংখ্য, (ন্যায় -বৈশেষিক অর্থে) যোগ এবং লোকায়ত এই তিনটি শাস্ত্রকে আন্বীক্ষিকীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ভারতীয় চিন্তাজগতে উপনিষদীয় চিন্তাধারা -প্রভাবিত সাংখ্য ও যোগ নামের এই সুপরিচিত দর্শন দুটি যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সমর্থনপুষ্ট, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু দর্শন জগতে এ দুটি শাস্ত্র মতের উৎস ও বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাস জানা থাকলেও লোকায়তের সেরকম কোন পরিচিতি সূত্র, ভাষ্য বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবু শাস্ত্র হিসেবে লোকায়তও যে সমসাময়িক সাংখ্য ও যোগের সমান সমানই ছিলো, ‘অর্থশাস্ত্রে’র বিবরণী থেকে তা ধারণা করা যায়। আর কৌটিল্য বর্ণিত বার্হস্পত্য মতে বিদ্যার ক্ষেত্রে আন্বীক্ষিকীকে প্রবেশাধিকার না দেয়ায় অর্থশান্ত্রোক্ত লোকায়ত যে তৎকালীন বার্হস্পত্য থেকে পৃথক ছিলো তাও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ফলে এটা সহজেই অনুমেয়, পরবর্তী যুগের জড়বাদী নাস্তিকধর্মী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে প্রাচীন এই লোকায়ত শাস্ত্র অভিন্ন ছিলো না। বরং ‘লোকায়ত’ সংজ্ঞার দ্বারা বিশেষিত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী চার্বাক মতবাদ দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে প্রাচীন লোকায়ত শাস্ত্রের বিপরীত। তাহলে বিভিন্ন যুগের বিপরীতমুখি এই শাস্ত্র দুটির সাধারণ একটি সংজ্ঞায় অভিহিত হওয়ার মূলে কী কারণ থাকতে পারে? এর কারণ হিসেবে পণ্ডিতেরা উভয়ের অন্তনির্হিত সাদৃশ্য বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে প্রভাবটিকে কার্যকর যোগসূত্র হিসেবে ধারণা করেন, তা হলো হেতুবিদ্যা। তাই বিষয়টি কিঞ্চিৎ পর্যালোচনার দাবি রাখে।
লোকায়ত শাস্ত্র নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মত দেখা যায়। পালি সাহিত্য বিষয়ে সুপণ্ডিত রিস ডেভিডস (Rhys Davids) এ ব্যাপারে ‘লোকায়ত’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের উপরই নির্ভর করতে চেয়েছেন। এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থটি হচ্ছে – ‘লোকেষু আয়তো লোকায়তঃ’। অর্থাৎ জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত বলেই নাম লোকায়ত। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতেও – ‘লোকায়ত মত লোকে আয়ত অর্থাৎ ছড়াইয়া পড়িয়াছে বলিয়াই ওই নাম পাইয়াছে।’ এ ব্যাপারে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মন্তব্য হলো – ‘জনসাধারণের মধ্যে যার পরিচয় পাওয়া যায়’। এ প্রসঙ্গে তিনি বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দিব্যাবদান’ -এর নজির দেখিয়েছেন, যেখানে লোকায়ত শব্দ এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থেই ব্যবহৃত। তাছাড়া – ‘লোকায়ত’ শব্দের এই অর্থের অনুসরণে রিস ডেভিডস লোকায়তকে সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন বিষয়ের অবলম্বনে রূপায়িত শাস্ত্র হিসেবে নির্দেশ করেন এবং এই বিশেষ শাস্ত্রটি তাঁর মতে ব্রাহ্মণ্য বিদ্যারই একটি শাখা। …এ ব্যাপারে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন, ‘লোকায়ত’ সংজ্ঞায় তর্ক বা যুক্তিভিত্তিক এক বিশেষ শাস্ত্রকে বোঝায়, যার উল্লেখ বৌদ্ধ সাহিত্যের বহু স্থানে আছে। পালি গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে প্রাপ্ত লোকায়তসম্বন্ধীয় মন্তব্য থেকে দাশগুপ্ত মহাশয় সিদ্ধান্ত করেন যে ‘লোকায়ত’ শাস্ত্রের আশ্রয় এক বিশেষ ধরনের তর্ক, যে তর্কের উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষকে যে -কোন উপায়ে নিরস্ত করা, আত্মপক্ষ উপস্থাপনা নয়। এই জাতীয় তর্কের পারিভাষিক নাম ‘বিতণ্ডা’ এবং পালি লেখক বুদ্ধ ঘোষ লোকায়তকে বিতণ্ডাত্মক শাস্ত্র হিসাবে বর্ণনা করেছেন। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা -২৪ /লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
উল্লেখ্য, ‘বিতণ্ডা’ শব্দটির পারিভাষিক অর্থ যে খুব ভালো কিছু নয় তা উপরের উদ্ধৃতি থেকেই প্রতীয়মান হয়। ন্যায়সূত্রে বিতণ্ডা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে – প্রতিপক্ষস্থাপনাহীন জল্পকে বিতণ্ডা বলে। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৪)।
একটি বিষয় বুঝতে গিয়ে এখানে ফের নতুন একটি পারিভাষিক শব্দ ‘জল্প’ -এর উপস্থিতির কারণে আরেকটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে হয়তো। ন্যায়শাস্ত্রে দার্শনিক বিতর্ক সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সমধর্মী কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পারিভাষিক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেমন – বাদ, জল্প, বিতণ্ডা ইত্যাদি। উল্লেখিত এই তিনটি পদ বা শব্দই সমধর্মী অর্থাৎ তর্কসংশ্লিষ্ট। আর ভিন্নতা হচ্ছে যুক্তির উপস্থিতি -অনুপস্থিতি এবং বিপক্ষমত খণ্ডন ও স্বমত প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হওয়া -না -হওয়ার তারতম্যের মধ্যে। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া জরুরি।
ন্যায়শাস্ত্রে কোন বিষয় নিয়ে সাধারণভাবে কিছু বলার নাম ‘বাদ’। এই বলার ব্যাপারে বক্তব্যটির বিষয়বস্তুতে বিভিন্ন ধর্মের আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে এবং ধর্মগুলি পরস্পরবিরুদ্ধ হলে বাদী (বক্তা) স্বভাবতঃই একটিকে সমর্থন এবং অপরটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। ন্যায়ের ভাষায় একই বিষয়ে পরস্পর বিপরীত ধর্মের একটিকে পক্ষ এবং অপরটিকে প্রতিপক্ষ বলে। এই পক্ষ এবং প্রতিপক্ষের মধ্যে একটির সাধন বা স্থাপনা এবং অপরটির উপালম্ভ বা প্রত্যাখ্যান বাদের আবশ্যিক অঙ্গ। সহজ কথায় প্রমাণ ও তর্কের দ্বারা তত্ত্বনির্ণয়ের উদ্দেশ্যে আলোচনাকেই বাদ বলে।
এই পক্ষ এবং প্রতিপক্ষযুক্ত বিষয় জল্পেরও অঙ্গ, তবে কেবল সাধারণ আলোচনা জল্পের প্রতিপাদ্য নয়। জল্প প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে – জল্পের প্রধান উদ্দেশ্য অপরের প্রতিষিদ্ধ স্বপক্ষের স্থাপনা। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৩)।
সহজ কথায়, কোন তত্ত্বনির্ণয়ের প্রতি লক্ষ্য না রেখে কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য যে নিছক বাক্যুদ্ধ চলে, তাকেই বলা হয় জল্প। জল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আত্মপক্ষ সমর্থন। জল্পে প্রবৃত্ত ব্যক্তির মধ্যে বিজিগীষা বা প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার এক মনোভাব থাকে, যে মনোভাব বাদে অদৃশ্য। যে বিজিগীষু মনোভাব জল্পের পটভূমি রচনা করে, জল্পের বিশেষ রূপ বিতণ্ডাতে তারই চরম প্রকাশ ঘটে কেবল অপরপক্ষের দূষণকে কেন্দ্র করে। বৈতণ্ডিকের কাজ শুধুই অপরপক্ষের সমালোচনা। এই সমালোচনাতেই বৈতণ্ডিক তাঁর সমগ্র প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করেন এবং পক্ষদ্বয়ের মধ্যে অপরপক্ষের প্রতিপক্ষ যে স্বপক্ষ, সেই স্বপক্ষের মতামত সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। সোজা কথায়, বিতণ্ডা হলো একপ্রকার যুক্তিহীন তর্ক, যেখানে কোন পক্ষই নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করে কেবল অপরের মত খণ্ডন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে।
অতএব পালি লেখক বুদ্ধ ঘোষ লোকায়তকে যে বিতণ্ডাত্মক শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন, সেটুকু বিবেচনায় নিলে অনুমিত হয়, বিতণ্ডাত্মক শাস্ত্র হিসেবে বর্ণিত প্রাচীন লোকায়তের মধ্যে অপরের সমালোচনার প্রবণতাই মূখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন এই লোকায়ত শাস্ত্রে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সম্মতি বা অনুমোদনের নিদর্শন দেখে ধারণা করা বিচিত্র নয় যে বৌদ্ধরাই এক্ষেত্রে লোকায়তের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বৌদ্ধদের সমালোচনার মাধ্যমেই এই লোকায়ত শাস্ত্র বিতণ্ডাত্মক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। কেননা, কৌটিল্যের সমকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মুখে প্রকাশিত বৌদ্ধবিদ্বেষ নিশ্চয়ই কোন গোপন বিষয় ছিলো না। প্রাচীন রামায়ণেও এ নজির বিরল নয়। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব সম্বন্ধে কিছু বক্রোক্তি রামায়ণে দেখা যায় – ‘যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধস্তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি’। (রামায়ণ: ২/১০৯/৩৪)।
তাছাড়া রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (রামায়ণ: ২/১০৮) বনবাসী রামকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের দৃঢ় সংকল্প থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণ জাবালি যে উপদেশাত্মক বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা ছিলো বৌদ্ধ নাস্তিকবাদের সমগোত্রীয়। জাবালির উপদেশকে রাম প্রতিপালনের অযোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন।
মূলত যে ধরনের তর্ককে কেন্দ্র করে বিতণ্ডার প্রচলন, সে ধরনের তর্কের নিদর্শন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রচুর দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে – ‘হেতুবিদ্যা’ নামে প্রাচীন ভারতে প্রচলিত যে বিশেষ বিদ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা সাধারণত তর্ককেন্দ্রিক এবং প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করার প্রয়াসেই এর ব্যবহার দেখা যেতো। প্রাচীন লোকায়ত শাস্ত্রের উপর এই হেতুবাদের প্রভাব খুব বেশি। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে বৌদ্ধদের সমালোচনায় তৎপর হেতুবাদমূলক লোকায়ত প্রাচীন যুগে কেবলমাত্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরই বিরাগের পাত্র ছিল ; অপরপক্ষে ব্রাহ্মণরা বিদ্যার এক বিশেষ শাখা হিসাবে এই শাস্ত্রের অনুশীলনে রত ছিলেন। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা -২৫/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
এই হেতুবিদ্যা বা তর্কশাস্ত্রের উল্লেখ ‘অর্থশাস্ত্রে’র অন্তর্গত আন্বীক্ষিকীর আলোচনায়ও দেখতে পাই আমরা। কৌটিল্য যখন বলেন – ‘এই তিন (ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি) বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য হেতু বা যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে।’ – (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
এখানে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কৌটিল্য তাঁর আলোচনায় অপর বিদ্যাগুলির গুণাগুণ, বলাবল ইত্যাদি বিচারের ব্যাপারে এই হেতুকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে বর্ণনা করেছেন (হেতুভিরন্বীক্ষমাণাঃ)। প্রাচীন ভারতে ‘হেতু’ শব্দ সাধারণত তর্ক অর্থে ব্যবহৃত হতো এবং তর্ককেন্দ্রিক বিদ্যাবিশেষকে ‘হেতুবিদ্যা’ নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণ প্রতিহত করে নিজ মতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট উপায়ে তর্ক প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা প্রাচীন ভারতে ভালোভাবেই অনুভূত হয়েছিলো, যার ফলে একটি বিশেষ শাস্ত্র হিসেবে ভারতের চিন্তাজগতে হেতুবিদ্যার আত্মপ্রকাশ। এর নজির হিসেবে মহাভারতের শান্তিপর্বে হেতুবাদের উল্লেখ দেখা যায় (মহাভারত : ১২/১৯/২৩ -২৪, ১২/১৮০/৪৮) । যেমন – ‘‘মৃত্যুর পরে আর জীব থাকে না’ এইরূপ মতবাদী, যুক্তিতর্কাবলম্বী হেতুবাদী, উক্ত মতে দৃঢ়বিশ্বাসী, প্রাচীন কতকগুলি পণ্ডিত লোকও উক্ত সিদ্ধান্তের বহুদূরে অবস্থান করিয়া গিয়াছেন।’ (মহাভারত : ১২/১৯/২৩)। তা’র পর, উক্ত নাস্তিকমত মিথ্যা বলিয়া তাহার অবজ্ঞাকারী, বহুশাস্ত্রজ্ঞ এবং গার্হস্থ্যের প্রাধান্যবাদী অনেক লোকই জনসভায় বক্তৃতা দিতে থাকিয়া সমগ্র পৃথিবী বিচরণ করেন। (মহাভারত : ১২/১৯/২৪)।
মহাভারতের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, হেতুবাদী পণ্ডিতেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে জনসভায় নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতেন। আবার মহাভারতের অশ্বমেধপর্বে (মহাভারত: ১৪/৮৫/২৭) তর্কযুদ্ধে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী কিছু হেতুবাদীর উল্লেখ থেকে হেতু বা তর্কের সাহায্যে প্রতিদ্বন্দ্বীর মতকে খণ্ডন করে স্বমতের প্রতিষ্ঠাই যে হেতুবাদী এই বাগ্মীদের উপজীব্য তা বোঝা যায়। ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্যের বর্ণনায় এই হেতু বা তর্কবিদ্যারই অঙ্গ হিসেবে আন্বীক্ষিকীর পরিচিতির প্রকাশ। কৌটিল্যের সমকালীন হেতুবিদ্যা আন্বীক্ষিকী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অবিরোধী ছিলো এবং আন্বীক্ষিকীর অন্যতম লোকায়ত শাস্ত্র ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির দ্বারা অনুমোদিত বিদ্যার এক শাখা হিসেবেই পরিগণিত হতো। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা -২৬/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
প্রাথমিক পর্যায়ে বেদের অবিরোধী হিসেবে আবির্ভূত হলেও এই হেতুশাস্ত্র ক্রমে বৈদিক প্রামাণ্যের বিচারকেও তার অস্ত্রপরীক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত করে বসলো। ফলে – বৈদিক প্রভাবের অপপ্রয়োগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ এবং ক্রিয়াকলাপে ক্রমশঃ বহু লোকের বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। ফলে যুক্তির মাধ্যমে বৈদিক সব ধারণাকে যাচাই করে দেখার প্রচেষ্টার সূচনা হয়। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হেতুবাদই হল এই প্রচেষ্টার মাধ্যম। এই বেদবিরোধী নাস্তিকদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে কালক্রমে হেতুবাদের প্রতি সনাতনপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্যণীয়। হেতুবাদের সংজ্ঞাতেও এর পরিণামে সাহচর্যজনিত কিছু পরিবর্তন হওয়া বিচিত্র নয়, ফলে পরবর্তী যুগের ‘আন্বীক্ষিকী’ শব্দও ভিন্ন সংজ্ঞার দ্বারা চিহ্নিত। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা -২৬/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
এই ভিন্ন সংজ্ঞাটা কী? অন্বীক্ষা শব্দের অর্থ ‘পরবর্তী জ্ঞান’। অনু (অর্থাৎ পরবর্তী) + ঈক্ষা (বা জ্ঞান)। অনুমান শব্দটির অর্থও হুবহু একই : অনু (পরবর্তী) + মান (জ্ঞান)। অতএব ‘অন্বীক্ষা’ ও ‘অনুমান’ একই কথা, ভারতীয় পরিভাষায় যাকে বলে পর্যায়শব্দ। কিন্তু ‘পরবর্তী জ্ঞান’ বললে… প্রশ্ন… কিসের পরবর্তী ? ভারতীয় ঐহিত্য অনুসারে ‘প্রত্যক্ষর পরবর্তী’। …ঐতিহ্য অনুসারে ‘অনুমান’ জ্ঞান প্রত্যক্ষজ্ঞানের অনুগামী – পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। প্রথমে কোনো প্রত্যক্ষ -জ্ঞান এবং তারই অনুসরণ করে অনুমান -জ্ঞান।… তাহলে, ‘আন্বীক্ষিকী’র শব্দার্থ হলো ‘অনুমানবিদ্যা’ – আজকাল চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ‘লজিক’। অবশ্য, কৌটিল্য এখানে বিশুদ্ধ অনুমানবিদ্যা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেননি ; তাঁর মতে ‘আন্বীক্ষিকী’ শুধু অনুমানবিদ্যা ছাড়াও অনুমান -মূলক দার্শনিক মতও। (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা -৫৯/ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)।
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজে স্বীয় স্থান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য উত্তর যুগের আন্বীক্ষিকী তর্ক বা অনুমান শব্দকে নিজস্ব সংজ্ঞায় ‘হেতু’ শব্দের স্থলাভিষিক্ত করেছে। তাই হয়তো অমরকোষে আন্বীক্ষিকীকে তর্কশাস্ত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে – ‘আন্বীক্ষিকী দণ্ডনীতিস্তর্কবিদ্যার্থশাস্ত্রয়োঃ (অমরকোষ, পৃষ্ঠা -১৩)। আর ন্যায়ভাষ্যকার বাৎসায়নের মতে, শ্রুতি বা বেদের অবিরোধী অন্বীক্ষা বা অনুমান আন্বীক্ষিকীর প্রধান কাজ – ‘প্রত্যাগমাশ্রিতমনুমানং সা অন্বীক্ষা…’। (ন্যায়ভাষ্য: ১/১/১)। অপরপক্ষে হেতুবাদকে যাঁরা অবলম্বন করে থাকেন সেই হৈতুকরা সনাতনপন্থীদের নিন্দার পাত্র হলেন। যেমন মনুসংহিতায় এই হেতুবাদে অনুরক্ত নাস্তিক ব্রাহ্মণদের নিন্দা করে বলা হয়েছে – যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ -তর্ককে অবলম্বন করে ধর্মের মূলস্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতির) প্রাধান্য অস্বীকার করে (বা অনাদর করে), সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে – তাকে সকল কর্তব্য কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা (অর্থাৎ অপাংক্তেয় করে রাখা)। কারণ, সেই ব্যক্তি বেদের নিন্দাকারী, অতএব নাস্তিক। (মনুসংহিতা: ২/১১)।
আবার মনুশাস্ত্রের অন্যত্র এই হৈতুকরা বাক্যালাপেরও অযোগ্য বলে বর্ণিত হয়েছে – পাষণ্ডী অর্থাৎ বেদপথবিরুদ্ধব্রতধারী (যথা, বৌদ্ধভিক্ষু -ক্ষপণকাদি), বিকর্মস্থ (অর্থাৎ প্রতিষিদ্ধবৃত্তিজীবী, যারা আপৎকাল ছাড়াও অন্য বর্ণের জীবিকা গ্রহণ করে, যথা, ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি বা ক্ষত্রিয় হয়ে ব্রাহ্মণের বৃত্তি অবলম্বন করে যারা জীবিকার্জন করে), বৈড়ালব্রতিক (বিড়ালতপস্বী, অথবা দাম্ভিক, যারা কেবল লোককে আকৃষ্ট করার জন্যই অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ করে, কিন্তু ধর্মবুদ্ধিতে এই সব যজ্ঞ করে না), শঠ (বেদে শ্রদ্ধারহিত), হৈতুক (বেদবিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ) এবং বকবৃত্তিধারী (প্রবঞ্চক ও কপটবিনয়ী -দ্বিজ) – এই সব ব্যক্তি যদি অতিথি -যোগ্য কালেও উপস্থিত হয়, তাহলে বাক্যের দ্বারাও তাদের সম্ভাষণ করবে না। (মনুসংহিতা: ৪/৩০)।
উল্লেখ্য, মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথির মতে হৈতুক অর্থ হচ্ছে – নাস্তিক অর্থাৎ যারা এই রকম দৃঢ়নিশ্চয় করে যে, পরলোক নেই, দানেরও কোনও ফল নেই, হোম করারও কোনও ফল নেই, তারাই হৈতুক। আবার মনুসংহিতার অপর ভাষ্যকার কুল্লুক ভট্টের মতে হৈতুক হলো – হৈতুক হচ্ছে বেদবিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ।
মহাভারতেরও বিভিন্ন স্থানে হেতুবাদরত পণ্ডিতদের নিন্দা দেখা যায় (মহাভারত: ১২/১৯/২৩ -২৪) – ‘মৃত্যুর পরে আর জীব থাকে না’ এইরূপ মতবাদী, যুক্তিতর্কাবলম্বী, উক্ত মতে দৃঢ়বিশ্বাসী, প্রাচীন কতকগুলি পণ্ডিত লোকও উক্ত সিদ্ধান্তের বহুদূরে অবস্থান করিয়া গিয়াছেন। তারপর, উক্ত নাস্তিকমত মিথ্যা বলিয়া তাহার অবজ্ঞাকারী, বহুশাস্ত্রজ্ঞ এবং গার্হস্থ্যের প্রাধান্যবাদী অনেক লোকই জনসভার বক্তৃতা দিতে থাকিয়া সমগ্র পৃথিবী বিচরণ করেন।’
তাই অনুমান করা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, কালের অগ্রগতির সঙ্গে হেতুবাদের একটি শাখা আন্বীক্ষিকীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেদবিরোধী নাস্তিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বৌদ্ধদের সমালোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে তর্কের অস্ত্রকে বেদের বিরোধিতার ক্ষেত্রেও প্রসারিত করে স্বতন্ত্রভাবেই হেতুবাদী তর্কশাস্ত্রে রূপান্তরিত হলো। অন্যদিকে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ এবং পরবর্তীযুগের ন্যায়ভাষ্যে বর্ণিত বিশ্লেষণমূলক শাস্ত্র হিসেবে আন্বীক্ষিকীর মূল শাখাটি বৈদিক বচনকে যুক্তির সমর্থন দিয়ে বেদসমর্থকদের শাস্ত্র হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে।
ওই হেতুবাদী তর্কশাস্ত্রই পরবর্তীকালের লোকায়ত হিসেবে আখ্যায়িত, যা বেদসমর্থকদের কাছে নিন্দাযোগ্য হিসেবে প্রচার পেয়েছে। যেমন, এরই সমসাময়িক নমুনা হিসেবে রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (রামায়ণ: ২/১০৮) দেখা যায়, রামের ভাই ভরত রামচন্দ্র সকাশে এলে তাঁকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে রাম বললেন- হে বৎস, আশা করি তুমি লোকায়তিক ব্রাহ্মণদের সেবা করছো না। (রামায়ণ: ২/১০৮)। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু, এবং পাণ্ডিত্যের অভিমান নিয়ে আস্ফালন করলেও আসলে বালকের মতো মূর্খ। প্রধান প্রধান ধর্মশাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও যুক্তিতর্কমূলক দুর্বুদ্ধির দোহাই দিয়ে অর্থহীন কথা প্রচার করে। (রামায়ণ: ২/১০০/৩৮-৯)।
অপরপক্ষে মনুসংহিতায় নৃপতিদের আন্বীক্ষিকী চর্চার বৈদিক সমর্থন হিসেবে মনু বলছেন- রাজা ত্রিবেদবেত্তা দ্বিজাতিদের কাছ থেকে ঋগ্-যজুঃ-সাম এই বেদত্রয় আয়ত্ত করবেন। পরম্পরাগত দণ্ডনীতি অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র- যা চিরকাল বিদ্যমান আছে এমন রাজনীতিশাস্ত্র- রাজনীতিবিদ ব্যক্তিদের কাছে অধ্যয়ন করবেন। আন্বীক্ষিকী বা তর্কশাস্ত্র এবং আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা এবং বার্তা অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যপশুপালনাদি জ্ঞান সেই সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের কাছে শিক্ষা করবেন। (মনুসংহিতা: ৭/৪৩)।
তবে আন্বীক্ষিকীর সঙ্গে হেতুবাদের সম্পূর্ন বিচ্ছেদের কাল সময়ের কোন নির্দিষ্ট গণ্ডিতে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কেননা হেতুবাদ যখন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরাগভাজন, তখনও কোন কোন ক্ষেত্রে হেতুবাদের সঙ্গে আন্বীক্ষিকীর ঘনিষ্টতার ছাপ সাধারণের চিত্তে অবিচল। যার ফলে আন্বীক্ষিকীও ব্রাহ্মণ্য সমাজে কোন কোন ক্ষেত্রে সমালোচিত হয়েছে। যেমন রামায়ণের (রামায়ণ: ২/১০০/৩৬-৩৯) এই বর্ণনায় দেখা যায়, হেতুবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েও লোকায়ত আন্বীক্ষিকী সংজ্ঞার সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখেছে। আবার মহাভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা নিন্দিত হচ্ছে।
এ প্রেক্ষিতে মহাভারতের শান্তিপর্বে (মহাভারত: ১২/১৭৪/৫-৫৪) ব্রাহ্মণ্যবাদ কর্তৃক হেতুবাদী আন্বীক্ষিকীর নিন্দামূলক ‘ইন্দ্র ও কাশ্যপ সংবাদ’ উপাখ্যানটি সংক্ষেপে এরকম- একবার এক ব্রতচারী তপস্বী দরিদ্র ব্রাহ্মণ কাশ্যপ কোন এক ধনসম্পদশালী বৈশ্যের রথের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাগে দুঃখে অপমানে আত্মহত্যায় উদ্যোগী হলে তাঁকে নিবারণ করতে এসময় শৃগালরূপী ইন্দ্র সামনে এলেন এবং বলতে লাগলেন- ‘জগতে অন্যান্য সকল প্রাণীই মনুষ্যযোনি কামনা করে, আবার মনুষ্যমধ্যেও ব্রাহ্মণত্বেরই সকলে প্রশংসা করিয়া থাকে। (১২/১৭৪/৮) কাশ্যপ ! তুমি সেই মনুষ্য ও ব্রাহ্মণ এবং তাহাতে আবার বেদবিৎ হইয়াছ। অতএব অতিদুর্লভ এই সকল পাইয়া কেবল দারিদ্র্যদোষে মরিবার ইচ্ছা করিতে পার না। (১২/১৭৪/৯) …তোমার যেমন ধনের স্পৃহা চলিতেছে, আমাদেরও তেমন হস্তশালী প্রাণিগণের স্পৃহা আছে। এই জগতে হস্তলাভ অপেক্ষা অধিক কোন লাভ নাই। (১২/১৭৪/১২)। এরপর শৃগালরূপী ইন্দ্র হস্তহীন প্রাণীদের কষ্টকর দুঃসহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলছেন যে, আরো নিকৃষ্ট যোনিতে জন্মাবার ভয়ে এই শৃগাল-জীবন থেকে আত্মহত্যার মতো ঘোরতর পাপও করা যাচ্ছে না। সেইসব নিকৃষ্ট যোনিতে জন্মাবার কষ্ট আরো বহু ব্যাপক। হস্তযুক্ত আর হস্তহীন প্রাণীর সুবিধা-অসুবিধা এবং বিভিন্ন জন্মে কে কী পাপে কোন যোনিতে কিভাবে জন্ম নেয় ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনার পর তিনি তাঁর বর্তমান শৃগালযোনিতে জন্ম নেবার কারণস্বরূপ পূর্বজন্মের কৃত পাপের উল্লেখ করতে গিয়ে বলছেন (১২/১৭৪/৪৭-৫১) – আমি পূর্বজন্মে হেতুবাদী, বেদনিন্দক ও নিরর্থক তর্কবিদ্যায় অনুরক্ত একটা কুৎসিত পণ্ডিত ছিলাম। তৎকালে আমি কেবল যে এক এক জনের নিকট সেই হেতুযুক্ত বাক্য বলিতাম তাহা নহে, বহু সভাতেও তাহাই বলিতাম এবং বেদের উপরে গালি দিতাম ও বেদ-বাক্যসম্বন্ধে বিচারে পণ্ডিতগণকে পরাজয় করিতাম। তারপর আমি সেই জন্মে নাস্তিক ছিলাম, বেদ ও স্মৃতিপ্রভৃতির সিদ্ধান্তের উপরে আশঙ্কা করিতাম; সুতরাং তখন আমি পণ্ডিতাভিমানী একটা মূর্খই ছিলাম। ব্রাহ্মণ ! তাহারই এই ফল হইয়াছে যে, আমি এই জন্মে শৃগাল হইয়াছি। হায় ! এই শৃগালরূপী আমি আর কি বহুকাল পরে কখনও মানুষ হইতে পারিব ?। এবং সেই জন্মে সর্ব্বদা সন্তুষ্ট, কর্ত্তব্য কার্য্যে মনোযোগী, যজ্ঞ, দান ও তপস্যায় ব্যাপৃত, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা ও বর্জনীয়ের বর্জ্জয়িতা হইতে পারিব কি ?।
মহাভারতের এই উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে হেতুবাদী ব্রাহ্মণদেরকে বেদনিন্দুক ও তর্কবিদ্যায় অনুরক্ত নাস্তিক হিসেবে অবজ্ঞার পাশাপাশি এই মতাদর্শে কেউ অনুরক্ত হলে মহাপাপের ফল হিসেবে পরবর্তী জন্মের ভয়ঙ্করতা তুলে ধরে বেদপরিপন্থি না হবার উপদেশ প্রচার করার ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাব স্পষ্ট। আর ব্রহ্মবাদীদের এই বিরোধিতা থেকে আরেকটি বিষয়ও হয়তো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সেই মহাভারতের যুগে বা তারও আগে থেকেই এই যুক্তিপ্রবণ হেতুবাদী নাস্তিক মতটি তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হিসেবে তৎকালীন লোকসমাজে যথেষ্ট জনপ্রিয়ও ছিলো।
অন্যদিকে আবার ব্রাহ্মণ্য সমাজে সাধারণভাবে নিন্দনীয় হৈতুকদেরও স্থানবিশেষে সম্মানের স্বীকৃতি দেখা যায় মনুসংহিতায়, যেখানে অনাম্নাত বিষয়ের মীমাংসার জন্য দশাবরা পরিষৎ গঠনের বিধানে সেই পরিষদের দশ জনের মিলিত সদস্যগোষ্ঠিতে হৈতুকও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে- ঋগ্বেদ প্রভৃতি তিন বেদে অভিজ্ঞ তিনজন, হেতুক অর্থাৎ অনুমানাদি-নিপুণ একজন, তর্কী অর্থাৎ ঊহ-অপোহকুশল একজন (মীমাংসক), বেদাঙ্গ-নিরুক্তশাস্ত্র-জ্ঞাতা একজন, মানবাদিধর্মশাস্ত্রজ্ঞ একজন এবং প্রথম তিনটি আশ্রমের তিন ব্যক্তি (অর্থাৎ ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ এবং বানপ্রস্থ) এইরকম অন্যূন দশজনকে নিয়ে দশাবরা পরিষৎ গঠিত হবে। (মনুসংহিতা: ১২/১১১)।
তবে সম্মানের স্বীকৃতি পাওয়া এ হৈতুক যে বেদ-সমালোচক নয় বরং বেদ বা শ্রুতিকে প্রমাণ গণ্য করা হেতুবিদ, তা বোঝা যায় মনুর অন্য শ্লোকে- ‘ব্রহ্মচর্যাদি ধর্মযুক্ত হয়ে যাঁরা ‘সপরিবৃংহণ বেদ’ অর্থাৎ বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ইতিহাস ও পুরাণাদির দ্বারা পরিপুষ্ট বেদশাস্ত্র বিধিপূর্বক আয়ত্ত করেছেন সেই ব্রাহ্মণকে শিষ্ট বলে বুঝতে হবে; শ্রুতিই তাঁদের নিকট প্রত্যক্ষস্বরূপ এবং হেতুস্বরূপ অর্থাৎ অনুমানাদি অন্যান্য প্রমাণস্বরূপ।’ (মনুসংহিতা: ১২/১০৯)।
ধারণা করা হয়, প্রাচীন লোকায়ত এবং চার্বাক দর্শনের মধ্যে মিলনের সেতু রচিত হয়েছে এই হেতু বা তর্কাশ্রয়ী যুক্তির সাহায্যে। নাস্তিক যে গোষ্ঠি হেতুবাদের আশ্রয় নিয়ে বেদের প্রামাণ্য প্রতি পদে যাচাই করতে আগ্রহী ছিলো, লোকায়ত ক্রমে তার সঙ্গে যুক্ত হলো। তাই প্রাচীন লোকায়তের হেতু বা যুক্তিভিত্তিক তর্কের উত্তরাধিকারই সঞ্চারিত হতে দেখা যায় পরবর্তী লোকায়ত বা চার্বাক সিদ্ধান্তে। প্রাচীন লোকায়তের অনুসরণে যুক্তিতর্কের জাল বিস্তার করে বিপক্ষের ত্রুটির অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে। এই বিপক্ষ এখানে শুধু বৌদ্ধ নয়, জৈন এবং আধ্যাত্ম দর্শনের প্রতিটি শাখা। সম্মতিতর্কপ্রকরণের ব্যাখ্যাকার অভয়দেব সূরী তাই উদ্ধৃত করেন- ‘চার্বাক শাস্ত্রকার বৃহস্পতির সকল উক্তিই পর্যনুযোগপর অর্থাৎ পরমত দূষণের জন্য প্রশ্নাত্মক।’ মূলত এই তর্কে অনুরক্তির পরিচয় পরবর্তী লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের মধ্যে ভালোভাবেই পাওয়া যায়। এ কারণে মনুশান্ত্রেও এই বেদবিরোধী তর্কমূলক শাস্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা উচ্চারিত হয়- ‘বেদবাহ্য অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ যে সব স্মৃতি আছে এবং যে সব শাস্ত্র কুদৃষ্টিমূলক অর্থাৎ অসৎ-তর্কযুক্ত মতবাদসমূহ যে শাস্ত্রে আছে, সেগুলি শেষ পর্যন্ত একেবারে প্রেত্য বা নিষ্ফল অর্থাৎ বৃথা বা অকিঞ্চিৎকর বলে প্রতিভাত হয় এবং সেগুলি তমোনিষ্ঠ বলে স্মৃত হয়ে থাকে।’ (মনুসংহিতা: ১২/৯৫)। যে ব্যক্তি বেদোক্ত-ধর্মোপদেশসমূহ বেদশাস্ত্রের অবিরোধী অর্থাৎ অনুকূল তর্কের সাহায্যে অনুসন্ধান করেন অর্থাৎ নিরূপণ করতে চেষ্টা করেন, তিনিই বেদের ধর্ম অর্থাৎ বেদের অর্থ অবগত হন; এর বিপরীত স্বভাব ব্যক্তি বেদার্থধর্ম বোঝে না। (মনুসংহিতা: ১২/১০৬)।
তবে যে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না-করে থাকে না তা হলো, বৈদিক সংস্কৃতির সমুদ্রমন্থনে যে দ্বিজ বা ব্রাহ্মণ ব্যক্তিসম্প্রদায় অমৃতের অধিকারী হয়েছেন, নাস্তিকতা বন্টনেও তারাই হয়তো অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে- মনুকথিত নাস্তিক দ্বিজ, রামায়ণের ব্রাহ্মণ জাবালি অথবা মহাভারতের ব্রাহ্মণবেশি চার্বাকের উপাখ্যানের মাধ্যমে তার আভাস পাওয়া যায়। আর দেবগুরু বৃহস্পতিকে নাস্তিকবাদের গুরু বলে বর্ণনা করার মধ্যেও এর কিছু ইঙ্গিত মেলে। ব্রাহ্মণ্যধর্মী লোকায়তের নাস্তিক মতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সমর্থনেও হয়ত এই সব কাহিনী কোন তথ্য সরবরাহ করতে পারে। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৩০/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।
অতএব, বার্হস্পত্য, লোকায়ত ও চার্বাক এই জড়বাদী তিনটি মতাদর্শের পরবর্তী রূপ অভিন্নাকার হলেও পণ্ডিতদের ধারণায় প্রাচীনকালের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক পরিক্রমায় প্রতিটা মতেরই কোন অন্তর্গত ভিন্নতাকে সময়ের প্রেক্ষাপটে আদিরূপের সাপেক্ষে অস্বীকার করা যাবে না। তাই কেউ কেউ এই প্রাচীন দর্শনকে চার্বাকপন্থী, লোকায়ত এবং বার্হস্পত্য বা বৃহস্পতিশিষ্য হিসেবে তিনটি শ্রেণীতে ভাগও করেছেন। তবে সেরকমের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমাণ না থাকায় ‘নাস্তিক’ সংজ্ঞার বৃহৎ পরিধিতে এগুলোকে আর পৃথক গোষ্ঠি ভাবা সমীচীন হবে না বলেই মনে হয়। তবে প্রাচীন সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের মূলগত দৃষ্টিতে কিছু শ্রেণীগত ভেদ চোখে পড়ে ঠিকই, যা নিয়ে কিছুটা হলেও আলোচনার অবকাশ থেকে যায়।
Leave a Reply