(সম্প্রসারিত হবে)
Table of Contents
আরবদের সিন্ধু বিজয়
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা
তদকালীন ভারতীয় রাজ্যসমূহ
হিমালয়ের স্নেহধন্য এবং আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের আশীর্বাদপুষ্ট এ ভারতবর্ষ প্রাচীন কাল হতে বহু দিগ্বিজয়ী বীর ও পরাক্রমশালী রাজার নেতৃত্ব লাভের সুযােগ পায় এবং ঐক্যবদ্ধ হয় বহুবার। কিন্তু এ ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে কোন ধারাবাহিকতা ছিল না। অধিকাংশ সময়েই রাজনৈতিকভাবে ভারতের খণ্ডিত রূপ লক্ষ করা যায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশােক, চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন প্রভৃতি রাজন্যবর্গের আমল ছাড়া অন্যান্য সময় ভারত সে অখণ্ডতা ধরে রাখতে পারেনি। তবে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে হর্ষবর্ধনের পরবর্তীকালে। এ সময় থেকে মুসলমানদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত আর কোন ঐক্যের প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। ফলে ভারত দীর্ঘস্থায়ীরূপে বিভাজিত হয়ে পড়ে, দুর্বল হয়ে পড়ে ভারতীয় রাজন্যবর্গ। আর তারই সুযােগে আরব ও তুর্কিগণ এ দেশে তাদের অবস্থান করে নেয়ার প্রয়াস পায়। ভারতের এই রাজনৈতিক অবস্থাকে ১৬শ শতকের জার্মানির সাথে তুলনা করা যায়। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো ছিল –
(১) কাশ্মির : কাশ্মিরে এ সময় কর্কট রাজবংশ নামক একটি রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দুর্লভবর্ধন (Durlabha Vardhana)। ৭ম শতকে তিনি এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (৬৩১-৬৩৩) কাশ্মির পরিদর্শনে আসেন। কর্কট রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ললিতাদিত্য। তিনি ৭২৪ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আহণ করেন এবং কালক্রমে পাঞ্জাব, কনৌজ, কুর্দিস্তান, কাবুল প্রভৃতি দখল করেন। এরপর এই বংশে আর কোন শক্তিশালী রাজার আবির্ভাব না ঘটায় কাশ্মির রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ অরাজকতার পর ১৩৩৯ খিস্টাব্দে মুসলমানদের হাতে এর পতন ঘটে।
(২) আফগানিস্তান : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দখলের পর থেকে আফগানিস্তান ভারতের একটি অংশে পরিণত হয়। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যে, ৭ম শতকে জনৈক ক্ষত্রিয় যুবরাজ কাবুল উপত্যকা শাসন করতেন এবং তারই উত্তরাধিকারীগণ ৯ম শতকের শেষ অব্দ পর্যন্ত কাবুলের উপর কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখেন। অতঃপর লালিয়া (Lalliya) নামক জনৈক ব্যক্তি ব্রাহ্মণ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন, যাকে হিন্দুশাহী রাজবংশ নামে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ অভিহিত করেছেন। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে এই রাজবংশের কোন রাজা শাসন করতেন তার নাম জানা যায় না।
(৩) নেপাল : ৭ম শতকের নেপাল ছিল উত্তরে তিব্বত ও দক্ষিণে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী রাষ্ট্র। থাকুরী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা অনুসু বর্মন (Anusu Varman) নিজ কন্যাকে তিব্বতের রাজার সাথে বিবাহ দিলে কালক্রমে নেপাল তিব্বতের প্রভাবাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর কনৌজের বিরুদ্ধে চৈনিক অভিযানকালে নেপাল-তিব্বত চৈনিক বাহিনীকে সহযােগিতা করে। ৮ম শতকের শুরু পর্যন্ত নেপাল সম্পূর্ণরূপে তিব্বতের উপর নির্ভরশীল ছিল। ৭০৩ খ্রিস্টাব্দে নেপাল আবার স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
(৪) আসাম : হর্ষবর্ধনের সময় আসামের রাজা ছিলেন ভাস্করবর্মন (Bhaskar Varman)। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পরও কয়েক বছর তার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই বর্বর নেতা শিলাস্তম্ভের নিকট তিনি পরাজিত হন এবং প্রায় ৩০০ বছরের জন্য আসাম পরাধীন হয়ে পড়ে।
(৫) কনৌজ : হর্ষবর্ধন কনৌজকে তার রাজধানী করায় তখন থেকেই কনৌজের গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর কনৌজের শক্তি ও প্রভাব অব্যাহত ছিল। বর্তমান দিল্লীর ন্যায় কনৌজ ভারতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই অঞ্চলের রাজন্যবর্গের দৃষ্টি থাকত কনৌজের প্রতি। কনৌজ অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারা তদকালীন রাজন্যবর্গের নিকট ভারতবর্ষ অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ করার ন্যায় গৌরবজনক বলে গণ্য হত। কনৌজ দখলের এ প্রতিযােগিতায় বিদেশীদের অংশগ্রহণও দেখা যায়। এমন একটি অভিযান পরিচালিত হয় চীন থেকে। চীনের ওয়াং হিউয়েন সি (Wang Hieun tse) এক অভিযান চালিয়ে কনৌজ দখল করেন। কনৌজরাজ অর্জুনা পরাজিত ও বন্দী হয়ে চীনে নীত হলেন। এখানকার ধন-সম্পদও লুণ্ঠন করে নেন হিউয়েন সি। চৈনিক আক্রমণের পর কনৌজে যেমন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয় তেমনি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজন্যবর্গ কনৌজের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও লিপ্ত হন। তারই একপর্যায়ে প্রতিহার রাজবংশ কনৌজের কর্তৃত্ব লাভ করে। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে যশােবর্মন (Yasovatman) নামক এক রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত বিজেতা ও সফল শাসক। তিনি উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা ও পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে থানেশ্বর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। তিনি সিন্ধুর রাজা দাহিরের সমসাময়িক ছিলেন। কাশ্মিরের ললিতাদিত্যের হাতে তিনি নিহত হন। অতঃপর শুরু হয় আবার সংগ্রাম। এ সময় প্রতিহার রাজ, বাংলার ধর্মপাল ও দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়। একপর্যায় রাষ্ট্রকূটরাজ ও পরবর্তীকালে ধর্মপাল কিছুদিনের জন্য হলেও কনৌজের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। অল্পকালের মধ্যে এ তিন বংশই পতনের দিকে ধাবিত হলে মধ্য ভারত আর শক্তিশালী হবার সুযােগ পায়নি। তবে এরপর প্রতিহাররা আবার ক্ষমতা দখল করে কোন মতে তাদের শাসন অব্যাহত রাখেন। ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ কনৌজ আক্রমণ করলে কনৌজরাজ রাজ্যপাল আত্মসমর্পণ করেন ও প্রচুর ধন-রত্নের বিনিময়ে নিজের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজন্যবর্গ কর্তৃক আক্রান্ত ও নিহত হন। সবশেষে কুতুবউদ্দিন কনৌজ দখল করে দিল্লী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেন।
(৬) সিন্ধু : হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভুক্ত প্রদেশ ছিল সিন্ধু। তা শাসন করত শূদ্র রাজবংশ। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উক্ত রাজবংশের অধীনে সিন্ধু স্বাধীন হয়ে পড়ে। এ বংশের শেষ শাসক ছিলেন শাহরী (Sahri)। তার ব্রাহ্মণ মন্ত্রী চাচা (Chacha) তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে শূদ্র শাসনের অবসান ঘটান এবং এক নতুন মাজবংশের সূচনা করেন। চাচার পুত্র দাহির মুহম্মদ-বিন-কাশিমের সিন্ধু অভিযানের সময় সিন্ধুর রাজা ছিলেন। দাইবুল, নিরুন, যিহওয়াল, ব্রাহ্মণাবাদ, আলাের প্রভৃতি অঞ্চল রাজা দাহিরের অধীন ছিল। তিনি বৌদ্ধ বিদ্বেষী ও অত্যাচারী রাজা ছিলেন বিধায় নিজ রাজ্যের বৌদ্ধ সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন শ্রেণীর পাক তার বিরােধিতা করে মুহম্মদ-বিন-কাশিমের পক্ষাবলম্বন করে। ফলে মুহম্মদ-বিন-কাশিম অতি সহজে রাজা দাহিরকে পরাজিত ও নিহত করে সিন্ধু দখল করেন।
(৭) বাংলা : হর্ষবর্ধনের সমসাময়িককালে বাংলার রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তিনি একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন এবং উত্তর ভারতের রাজনীতিতে যত করে একপর্যায় হর্ষবর্ধনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনকে পরাজিত ও নিহত করেন। এতে হর্ষবর্ধন ক্ষুব্ধ হন এবং সিংহাসনে আরােহণ করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অবশ্য শশাঙ্কের জীবিতাবস্থায় শশাঙ্কের কোনই ক্ষতি করতে সক্ষম হননি। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কিছু এলাকার উপর হর্ষবর্ধনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রায় একশত বছর বাংলায় কোন স্থায়ী শাসকের আবির্ভাব না হওয়ায় এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিশাল অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। অতঃপর ৮ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে গােপাল নামক এক বিজেতার আবির্ভাব ঘটে, যিনি অব্যাহত বিজয়ের দ্বারা অন্যান্য সকল শক্তি ও বিশৃঙ্খলাকারীদেরকে দমন করতে সক্ষম হন। এতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও শান্তিপ্রিয় জনগণ তার পতাকাতলে সমবেত হয় এবং গােপালকে রাজা বলে গ্রহণ করে। তাদের সমর্থনে গােপাল সমগ্র উত্তর বাংলার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। গােপালের পর তার পুত্র ধর্মপাল সিংহাসনে বসেন। তিনি এ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন। তিনি উত্তর ভারতের প্রাণকেন্দ্র কনৌজসহ এক বিশাল এলাকা দখল করেন। ধর্মপালের পর পুত্র দেবপাল রাজা হন। দেবপালের পর যােগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে পাল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেন বংশের অধিকার বিস্তৃত হয়। অবশ্য পূর্ববাংলায় এরপরও কিছু কাল পালদের কর্তৃত্ব ছিল। সেন রাজা বিজয় সেন সমগ্র বাংলার উপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র বল্লাল সেন পিতৃ রাজ্য অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হলেও পরবর্তী রাজা লক্ষণ সেনের সময় সেন রাজ্যের বিপর্যয় ঘটে। এসময় অর্থাৎ ১২০৪ সালে সেনদের হাত থেকে বখতিয়ার খলজী বাংলা কেড়ে নেন।
(৮) দিল্লী ও আজমীর : দিল্লী ও আজমীর ছিল হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যাধীন। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর এ অঞ্চল কনৌজ কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। কনৌজের কর্তৃত্ব নিয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের একপর্যায় রাজপুতনার চৌহান বংশ আজমীর দখল করে নেয়। মধ্য ভারতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় চৌহান বংশের শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক বিলাসদেব প্রতিহার বংশের নিকট থেকে দিল্লী দখল করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ফলে এরপর থেকে দিল্লী ও আজমীর একই শাসনাধীনে আসে। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা পৃথ্বীরাজ ১১৯১ সালে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরীকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেও পরের বছর তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরীর নিকট পরাজিত ও নিহত হন। দিল্লী ও আজমীরসহ অত্র এলাকা ঘুর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। অতঃপর ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিনের নেতৃত্বে দিল্লী সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দিল্লীকেন্দ্রিক স্বাধীন ও স্থায়ী মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়, যা পরবর্তীকালে অখণ্ড ভারতে পরিণত হয়।
দক্ষিণ ভারতের অবস্থাও উত্তর ভারতের ন্যায় বিভাজিত ছিল। দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে চালুক্য রাজ্য, পল্লব রাজ্য, পাণ্ড্য রাজ্য, মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রকূটদের রাজ্য উল্লেখযােগ্য ছিল –
(১) চালুক্য রাজ্য : চালুক্য রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দ্বিতীয় পুলকেশি (Pulakeshi) ছিলেন হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক। তার উত্তরাধিকারীগণ ৭৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। এ সময় কাঞ্চি (Kanchi) তাদের অধিকারভুক্ত হয়।
(২) পল্লব রাজ্য : আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সময় পল্লব রাজ্যের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় নরসিমা বর্মন (Narashima Varman II)। তিনি ৬৯৫ থেকে ৭২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি কাঞ্চির (Kanchi) কৈলাশনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। ৯ম শতকে পল্লবদের পতন ঘটে।
(৩) রাষ্ট্রকুট রাজ্য : দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকট বংশের উত্থান এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। ৭ম শতকের মাঝামাঝি কোন এক সময় রাষ্ট্রকূট বংশের আদি পুরুষ নান্নারাজ জুধাসুরা (Nannaraja Yudhasura) বেরার ইলিসপুরে শাসন করতেন বলে ডঃ আলটেকার (Dr. Altekar) মত প্রকাশ করেন। এ বংশের বিখ্যাত রাজা দান্তিদুর্গের (Dantidurga) নেতৃত্বেই রাষ্ট্রকূট রাজ্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে শুরু করেন। তিনি কাঞ্চি, কলিঙ্গ, কোশল, মালব, চালুক্য ও পল্লবদেরকে পরাজিত করে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ করেন। এ সময়ই আরবরা সিন্ধু অভিযান করে।
উপর্যুক্ত আলােচনা থেকে আরবদের সিন্ধু অভিযানকালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে পরিস্কারভাবে বােঝা যায় যে, এ সময় ভারতে এমন কোন একক শক্তি ছিল না যে আক্রমণকারীদের গতিরােধ করতে সক্ষম হবে। এমনকি, জাতীয় শত্রুকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরােধ করার জন্য একত্রিত হবার মত চেতনাও এই রাষ্ট্রসমূহের ছিল না। উপরন্তু তাদের মধ্যে ছিল পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কোন্দল। তারা বিদেশী শক্তির আক্রমণ সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। বিশেষ করে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের নরপতিরা এক্ষেত্রে অদুরদর্শিতার পরিচয় দেন। ৮ম শতকের সিন্ধু বিজয়ের পর কিছুদিন বিরত থাকলেও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে ১১শ শতকে আবার মুসলিম আক্রমণ প্রবল আকার ধারণ করে। অব্যাহত এ আক্রমণ ভারতীয় অন্তঃসার রাজনৈতিক অবস্থারই সাক্ষ্য বহন করে। কারণ কোন ভারতীয় রাজন্যবর্গত সকল আক্রমণের উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি। তাছাড়া ভারতে অব্যাহতভাবে একক শক্তির অনুপস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল এ সকল আক্রমণকারীকে ভারত আক্রমণে উৎসাহ যােগায়। এ সকল আক্রমণের মধ্য দিয়েই ১২শ শতকে মুসলমানরা একের পর এক ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে নেয় এবং ভারতে দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
প্রশাসনিক, ধর্মীয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
প্রশাসনিক অবস্থা : মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মূলতঃ এ ব্যবস্থাই তখন সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল। অবশ্য বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে স্থানীয় বা রাজ্যের নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক রাজা নিযুক্ত বা সমর্থিত হবার ঘটনাও লক্ষ করা যায়। যেমন বাংলায় পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গােপাল, কাঞ্চির পল্লব বংশীয় নন্দীবর্মন এবং থানেশ্বর ও কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। প্রাচীন ভারতে রাজন্যবর্গ স্বৈরাচারী রাজক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তারা রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বাস করতেন। V.D. Mahajan এ প্রসঙ্গে বলেন, “রাজা এসময় চূড়ান্ত ও অসীম ক্ষমতার চর্চা করতেন এবং শাসনে রাজাদের স্বর্গীয় অধিকারে বিশ্বাস করতেন”। রাজা একাধারে প্রধান সেনাপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধান আইন প্রণেতা ছিলেন। রাজধর্মের আলােকেই সাধারণত রাজকার্য পরিচালিত হয়। V.D. Mahajan-এর মতে, “তিনি (রাজা) স্বৈরাচারী হতে পারতেন না, কেননা তাকে রাজধর্ম অনুসারে শাসন করতে হতো”। শাসনকার্যে পরামর্শ বা মন্ত্রণা দিতেন মন্ত্রীবর্গ। V.D. Mahajan-এর মতে “দুই রকম মন্ত্রী ছিল – মন্ত্রী ও সচিব”। তিনি আরাে বলেন যে, মন্ত্রীদের সংখ্যা কত হবে তা নির্ভর করত প্রয়ােজন ও পরিস্থিতির উপর। এ সময় ভারতে যে ধরণের মন্ত্রীর পরিচয় পাওয়া যায় তা হলাে – সন্ধি বিগ্রহিকা (Sandhi Vigrahika) – যুদ্ধ ও শান্তির মন্ত্রী, সুমন্ত (Sumanta) – পররাষ্ট্র মন্ত্রী। এছাড়া ছিল মহাদণ্ডনায়ক (Mahadandanayak), মহাবলাধিকৃত (Mahabaladhikrita), আমাত্য (Amatya), অক্ষপাটাধিকৃত (Akshapatadhikrita) ইত্যাদি। বাজাকে ধর্ম বিষয়ক পরামর্শ দিতেন পুরােহিত (Purohita) অথবা রাজগুরু (Rajguru) নামক মন্ত্রী। মন্ত্রীদের মর্যাদাগত অবস্থান নির্ভর করত তাদের স্বীয় ক্ষমতা, মেধা ও বিশ্বাসের উপর। অবশ্য রাজার মর্জির উপরও তা অনেকটা নির্ভর করত। সাম্রাজ্য সাধারণত কতকগুলো প্রদেশে বিভক্ত থাকত। প্রদেশও আবার বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিটে বিন্যস্ত থাকত । প্রত্যেক স্তরে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য রাজা নিজে প্রশাসক নিয়ােগ করতেন। তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল রাজস্ব আদায়, শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, দেশের নিরাপত্তা বিষয়ে, বিশেষ করে, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় রাজাকে প্রয়ােজনীয় সাহায্য প্রদান করা ইত্যাদি।
ধর্মীয় অবস্থা : মুসলিম অভিযানের প্রাক্কালে ভারতে ধর্মীয় অবস্থাও আশাব্যঞ্জক ছিল না। গােটা ভারতবর্ষ প্রধানত তিনটি ধর্মে বিভক্ত ছিল। যথা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন। হিন্দু ধর্ম ভারতের আদি ধর্ম। হিন্দু ধর্মের মধ্যেও কোন ঐক্য বা সংহতি ছিল না। হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথার নির্মম কষাঘাতে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ছিল অতিষ্ঠ। তারা সংখ্যাগুরু হয়েও ছিল সমাজে অস্পৃশ্য। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা সকল সুযােগ-সুবিধা ভােগ করত। তাদের ধর্মীয় বাড়াবাড়ি, অন্ধ অনুকরণ, অর্থ শােষণ প্রভৃতির প্রতিবাদেই ভারতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের জন্ম হয়। বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃতি এত ব্যাপক হয় যে, হিন্দু ধর্ম ম্লান হয়ে পড়ে। কিন্তু কালক্রমে আবার হিন্দু ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং বৌদ্ধ ধর্ম বাংলা ও বিহারে আর জৈন ধর্ম দক্ষিণ ভারতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলায় পালদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃতি ঘটে। পাল শ্রেষ্ঠ ধর্মপালের বৌদ্ধ একাডেমী ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠে পরিণত হয়। সেনদের পৃষ্ঠপােষকতায় বৌদ্ধরা বাংলা থেকেও বিতাড়িত হয় এবং এই অঞ্চলে হিন্দুদের পুনরুত্থান ঘটে। মধ্যভারতে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর হিন্দুদের পুনরুত্থান ঘটে। তবে হিন্দুদের মধ্যে শ্রেণীগত বৈষম্য অব্যাহতই ছিল। হিন্দুদের এ অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বৌদ্ধদের সাথে বিরােধ ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন ও একক শক্তি অর্জনের পথে অন্যতম অন্তরায় ছিল, যার সুযােগ নেয় মুসলমানরা।
অর্থনৈতিক অবস্থা : সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও সম্পদে সমৃদ্ধশালী হিসেবে ভারতের সুপরিচিত প্রাচীনকাল হতে মধ্যযুগের শেষপ্রান্তে ইউরােপীয় পরিবাজক মার্কো পােলাের বিবরণে ভারতকে সম্পদের দেশ হিসেবে তা করা হয় এবং তা ইউরােপীয়দেরকে দারুনভাবে আকৃষ্ট করে। এই সম্পদের প্রলােভনেই যুগে যুগে ভারত বিদেশীদের দ্বারা লুষ্ঠিত হয়, অধিকৃত হয়। অনর্থের মূল – এ কথাটি ভারতের ইতিহাসে পরিপূর্ণভাবে প্রযােজ্য। ভারতের সম্পদই ভারতে বহু অনর্থের সৃষ্টি করে। এতদসত্ত্বেও উপমহাদেশে অধিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। কৃষিকাজই ছিল এদের প্রধান পেশা। ভারতের উৎপন্ন শস্য পার্শ্ববর্তী দেশসমূহেও রপ্তানী করা হতাে। অর্থকরী ফসলের মধ্যে পাট, চা ও কার্পাস ছিল অন্যতম। কার্পাস শিল্পের বিকাশ কার্পাস উৎপাদনের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে। কার্পাস বস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানীর জন্য গুজরাট ও বাংলায় প্রসিদ্ধি লাভ করে। এদেশে ধন বৈষম্য ছিল এবং উচ্চ শ্রেণীর ব্যক্তিগণ বিলাস বহুল জীবন যাপন করতেন। তা সত্ত্বেও জনকল্যাণেও তারা সচেষ্ট ছিলেন।
সামাজিক অবস্থা : মুসলমানদের আগমনের প্রাক্কালে ভারতের সমাজ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল। এখানকার হিন্দু সমাজ চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের হাতেই সমাজের সকল ক্ষমতা ও সুযােগ সুবিধা পুঞ্জিভূত ছিল। শূদ্ররা ছিল সমাজে অস্পৃশ্য। সমাজের এই জাতিভেদ প্রথা অত্যন্ত কঠোর ছিল। তবে এ কঠোরতা থাকা সত্ত্বেও সমাজে অসবর্ণ বিবাহ লক্ষ করা যায়। সমাজে নানাবিধ কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। বহু বিবাহ, সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল না। সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। অভিজাত শ্রেণীর মেয়েরাও পুরুষের পাশাপাশি শিক্ষা গ্রহণের সুযােগ পেত। এমনকি, তারা আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণেরও সুযােগ পেত। তবে তা ছিল খুব নগণ্য। সমাজের মানুষ সহজ সরল প্রকৃতির ছিল। তারা সাধারণভাবে জীবন যাপন করত। অধিকাংশই নিরামিষ ভােজী ছিল। এ সময় ভারতীয় সমাজে সামন্ততান্ত্রিকতার বিকাশ ঘটতে থাকে। ভূমির মালিকানা ও সংশ্লিষ্ট এলাকার কর্তৃত্ব কৃষকদের হাত থেকে ভূস্বামীদের হাতে চলে যায়। এ সকল ভূ-স্বামীরা সাধারণত রাজার দ্বারা ভূমিদানের মাধ্যমে ভূমির অধিকার পেতেন। কালক্রমে তারা রাজস্ব দিয়ে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ এলাকায় শাসন কার্য চালাতে চালাতে শাসকে পরিণত হয়ে পড়েন। প্রকৃতপক্ষে এরাই অভিজাত তথা ক্ষত্রিয় শ্রেণীতে পরিণত হন এবং সমাজের নিয়ন্তা হয়ে বসেন।
সাংস্কৃতিক অবস্থা : ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি উন্নত ধরনের ছিল। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। পশ্চিম ভারতের বল্লভী ও বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উদন্তপুর, বিক্রমশীল, বারাণসী প্রভৃতি এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদান রাখে। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। যাদের অবদানে এ যুগের ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে তাদের মধ্যে বানভট্ট, ভবভূতি, রাজশেখর, কালিদাস, আর্যভট্ট, বহ্মগুপ্ত, নাগার্জুন প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। গান্ধার, সাঁচি, অজন্তা, ইলােরা প্রভৃতি স্থানের শিল্পকর্ম সে যুগের উন্নত চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আরবদের সিন্ধু অভিযান
পটভূমি
৮ম শতকের সূচনাপর্বে আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রাজনৈতিকভাবে এটাই ভারত অঞ্চলে মুসলমানদের প্রথম পদচারণা। এর পূর্বে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে তাদের আনাগােনা ছিল। ভারতের প্রভূত ঐশ্বর্য সম্পর্কে তখন থেকেই তারা অবহিত হয় ও বাণিজ্যিকভাবে সে ঐশ্বর্যে অংশিদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। আরবে প্রতিষ্ঠিত মুসলমানরা ৭ম শতকের মাঝামাঝি থেকে দিগ্বিজয়ের মাধ্যমে যে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনােনিবেশ করে তার হাত থেকে সুদূর ভারতবর্ষও রক্ষা পায়নি। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের আমলেই ভারতে অভিযানের প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ অভিযান নৌপথে পরিচালিত হওয়ায় তা ব্যর্থ হয়। পরবর্তী খলিফা ওসমানের শাসনামলে ৬৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল্লাহ-বিন-আমর-এর নেতৃত্বে ভারতের নিকটবর্তী কিরমান ও মেকরানের বিরুদ্ধে সফল অভিযান প্রেরিত হয়। এ সফলতায় উৎসাহিত হয়ে আব্দুল্লাহ আরাে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ভারত আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এ সময় আব্দুল্লাহকে খলিফা জরুরীভাবে রাজধানীতে ডেকে পাঠালে এ অভিযান পরিত্যক্ত হয়। তবে আব্দুল্লাহ রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেও তিনি পরবর্তী অভিযানের পথ প্রশস্ত করে যান, সন্দেহ নেই। সে পথ ধরেই পরবর্তীকালে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালে পূর্বাঞ্চলীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন-ইউসুফের নির্দেশনায় মুহম্মদ বিন-কাসিমের নেতৃত্বে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুতে অভিযান পরিচালিত হয়।
সিন্ধু অভিযানের কারণ
আরবদের সিন্ধু অভিযানের পশ্চাতে বিবিধ কারণ নিহিত ছিল। এ বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। তাদের বর্ণনার মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ উভয় প্রকার কারণ লক্ষ করা যায়।
পরোক্ষ কারণসমূহ –
- (১) অর্থনৈতিক : অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বণিক জাতি আরবীয়রা ইসলামের নবশক্তিতে বলিয়ান হয়ে তাদের ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য সুদীর্ঘকালের পরিচিত ভারতের প্রতি নজর দেয়। অনেকে আবার ঐশ্বর্যশালী ভারতের ধনসম্পদ হস্তগত করার জন্য মরুবাসীরা ভারতে এ অভিযান পরিচালনা করে বলে মনে করেন। সুতরাং রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক কারণই এর পেছনে অধিকতর ক্রিয়াশীল ছিল বলে তাদের ধারণা।
- (২) রাজনৈতিক : কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, সাম্রাজ্যবাদী মুসলিম শাসক শ্রেণীর সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারাবাহিকতায় এ অভিযান প্রেরিত হয়। সূচনালগ্ন হতেই ধর্মভিত্তিক আরবীয় এ রাষ্ট্রটি দ্রুতবেগে চারিদিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ইতােমধ্যে প্রায় সমগ্র উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম এশিয়াসহ প্রায় সমগ্র মধ্য এশিয়া দখল করে তারা ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত এসে পৌঁছে যায়। সুতরাং, তারই ধারাবাহিকতায় ভারতের ন্যায় সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র দখল করে সাম্রাজ্যকে আরাে সম্প্রসারিত করার ইচ্ছা পােষণ করা অস্বাভাবিক নয়।
- (৩) ধর্মীয় : ধর্ম প্রচারও এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল বলে কোন কোন ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন। মূলত আরব কেন্দ্রীক মুসলমানদের রাষ্ট্র ইতামধ্যেই বিশ্বের শক্তিশালী এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে আফ্রিকা ও ইউরােপে একাধিক এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রটি পূর্ব দিকেও তার বিস্তার অব্যাহত রাখে। বিজেতারা ইসলামী শক্তিতে বলীয়ান ছিল এবং নতুন নতুন দেশ জয় করে ইসলাম প্রচার করতে থাকে। সীমান্তের অমুসলিম রাষ্ট্র ভারতেও ইসলাম প্রচার তাদের কাছে আবশ্যক হয়ে পড়ে।
- (৪) প্রতিশোধ স্পৃহা : আরবদের পারস্য অভিযানকালে পারস্যদের দিয়ে সিন্ধুর রাজা দাহির সাহায্য করেন। তার প্রতিশােধ নেয়ার স্পৃহাও এই অভিযানকে ত্বরান্বিত করে।
- (৫) শিয়া বিদ্রোহীদের সিন্ধুত আশ্রয় লাভ : হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের কঠিন মনে কতিপয় শিয়া বিদ্রোহী আরব সিন্ধুর রাজা দাহিরের নিকট আশ্রয় লাভ করায় তাদের প্রত্যার্পণ দাবী করে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ। কিন্তু রাজা দাহির তা প্রত্যাখ্যান করায় হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ক্ষুব্ধ হন এবং রাজা দাহিরকে শাস্তি দেবার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন।
- (৬) হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের উচ্চাকাঙ্ক্ষা : হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের উচ্ছাকাঙ্ক্ষা এ অভিযানের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল। পশ্চিম রণাঙ্গনের বীর সেনানী মূসা ও তারিকের সাফল্যে পূর্বাঞ্চলীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ উৎসাহী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেন। তার রাজ্য বিস্তারের এ উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার ইচ্ছাও এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখে।
- (৭) ভারতে রাজনৈতিক অনৈক্য : ভারতের তদকালীন ক্ষয়িষ্ণু ও অনৈক্যপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থাও মুসলমানদের এ অভিযানকে উৎসাহিত করে। এসময় ভারত যেমন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল তেমনি তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও বিরাজমান ছিল। কোন বিদেশী আক্রমণকারীকে একক বা সম্মিলিতভাবে প্রতিরােধ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। এর পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে এ অভিযান প্রেরিত হয়।
- (৮) সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : পারস্য বিজয়ের ফলশ্রুতিতে মুসলিম সাম্রাজ্য সিন্ধুর রাজা দাহিরের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় তিনি সন্দিহান হয়ে পড়েন। অন্যদিকে রাজা দাহিরের মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকায় মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমান্তও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তাই সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য সীমান্তবর্তী রাজা দাহিরের ধ্বংস সাধন করা মুসলমানদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষ কারণ : উপযুক্ত কারণসমূহ এ অভিযানের পেছনে ক্রিয়াশলী থাকলেও তা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। দীর্ঘদিনের এ কারণসমূহ আরবদেরকে মানসিভাবে প্রস্তুত করে, সন্দেহ নেই। ঠিক তখন এমন একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় যা তাৎক্ষণিকভাবে মুসলমানদেরকে ভারত আক্রমণে বাধ্য করে। এ কারণটিকে ঐতিহাসিকরা প্রত্যক্ষ কারণ বলে অভিহিত করেছেন। সিংহলে ব্যবসা উপলক্ষে অবস্থানরত কয়েকজন আরব বণিকের মৃত্যু হলে সিংহলরাজ মৃত বণিকদের পরিবার-পরিজন ও হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের জন্য কিছু উপঢৌকন ৮টি জাহাজ যােগে বসরায় প্রেরণ করেন। কিন্তু জাহাজগুলো সিন্ধু উপকুলে দেবল বন্দরে পৌঁছলে কিছু সংখ্যক জলদস্যু কর্তৃক তা লুণ্ঠিত ও মৃত বণিকদের পরিবার-পরিজন বন্দি হয়। হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ উক্ত জলদস্যুদের শাস্তি প্রদান এবং লুণ্ঠিত মালামালসহ আটককৃত লােকদের প্রত্যার্পণ দাবী করে রাজা দাহিরের নিকট পত্র লেখেন। কিন্তু দাহির তা করতে অস্বীকার করলে সেগুলো উদ্ধার ও রাজা দাহিরকে সমূচিত শাস্তি দিতে অভিযানের আশু প্রয়ােজন দেখা দেয়। ফলে মুসলিম শাসনকর্তা আর কালবিলম্ব না করে দাহিরের বিরুদ্ধে সমর অভিযান প্রেরণ করেন।
অভিযান
হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির শাসনকর্তা। তিনি দাহিরকে ধ্বংস করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেন এবং সেনাপতি ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু যুদ্ধে ওবায়দুল্লাহ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর তিনি সেনাপতি বুদাইনের নেতৃত্বে আর একটি অভিযান পাঠান। কিন্তু বুদাইনেরও একই পরিণতি হয়। পরপর দুটি অভিযান ব্যর্থ হলেও হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ হতােদ্দম হননি। তিনি নিজ ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা তরুণ ও সাহসী সেনাপতি মুহম্মদ-বিন-কাসিমের উপর তৃতীয় অভিযানের দায়িত্ব অর্পণ করেন। কাসিম বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে দেবল, নিরুন, সিওয়ান, সিসাম প্রভৃতি একের পর এক শহর জয় করে অগ্রসর হন এবং রাওয়ার (Rawar) নামক স্থানে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে রাজা দাহিরের মুখােমুখি হন। ইতােমধ্যে ব্রাহ্মণ নরপতি রাজা দাহিরের হাতে নির্যাতিত জাঠ-মেঠগণ মুহাম্মদ বিন-কাসিমের পক্ষাবলম্বন করে মুসলিম বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে। শুধু তাই নয়, তারা রাজা দাহিরের দুর্বলতাসমূহও মুসলিম সেনাপতিকে অবহিত করে। তা সত্ত্বেও রাজা দাহির বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত ও নিহত হন (২০ জুন, ৭১২ খ্রিস্টাব্দে)। রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তার বিধবা পত্নী রাণীবাঈ এবং পুত্র জয়সিংহ ১৫০০০ সৈন্য নিয়ে আবার প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। কিন্তু টিকতে না পেরে অন্যান্য রমণীদের নিয়ে সম্ভ্রম রক্ষার জন্য রাণীবাঈ আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন। পুত্র জয়সিংহ ব্রাহ্মণবাদে আশ্রয় নেন। এভাবে দাহিরের পতন হয় এবং রাওয়ার দুর্গ সহজেই অধিকৃত হয়।
রাওয়ার অধিকারের পর মুহম্মদ-বিন-কাসিম জয় সিংহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাকে পরাজিত করে ব্রাহ্মণবাদ দখল করেন। সুরজ দেবী ও পরমল দেবী নামক দাহিরের দুই কন্যাকে বন্দী করে তিনি খলিফার নিকট প্রেরণ করেন। এরপর তিনি সিন্ধুর রাজধানী আলাের (Alor) দখল করেন। সিন্ধুর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে মুহম্মদ-বিন-কাসিম মুলতান আক্রমণ করেন। আক্রমণ প্রতিরােধ করতে না পেরে সেখানকার শাসনকর্তা আত্মসমর্পণ করেন। মুহম্মদ আরাে অগ্রসর হয়ে আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় খলিফা তাকে জরুরী ভিত্তিতে রাজধানীতে ডেকে পাঠালে কনৌজ অভিযান পরিত্যক্ত হয়। কথিত আছে, দাহিরের ধৃত কন্যাদ্বয় মুহম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে খলিফার নিকট সম্ভ্রমহানীর মিথ্যা অভিযােগ করলে খলিফা তাকে রাজধানীতে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন। অবশ্য ঐতিহাসিক বালাজুরী ও ইবনে খালদুন এ কাহিনীকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মতে, খলিফা ওয়ালিদের পর এ সময় সুলায়মান খলিফা হলে রাজনৈতিক কারণে তিনি মুহম্মদ-বিন-কাসিমকে কারারুদ্ধ করেন এবং অমানুষিক নির্যাতনের ফলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মুহম্মদ-বিন-কাসিমের মৃত্যুতে এই অঞ্চলে যােগ্য নেতৃত্বের অভাবে মুসলমানদের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তী খলিফাগণ সাম্রাজ্য বিস্তারে তেমন আগ্রহী না হওয়ায় সামরিক তৎপরতাও স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে এ সময় আর কোন অভিযান পরিচালিত হয়নি।
আরবদের সাফল্যের কারণ
মুসলমানদের দীর্ঘ লালিত ভারত বিজয়ের স্বপ্ন মুহম্মদ-বিন-কাসিম পূরণ করেন। এ বিজয় ইসলাম ধর্মে উদ্বুদ্ধ আরবীয় সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ধারাবাহিকতায় হলেও এর সাফল্যের পেছনে স্থানীয় কিছু কারণও নিহিত ছিল। আরবদের এ বিজয়ের সাফল্যের কারণ মূলত দুটি – (১) মুসলিম বাহিনীর দক্ষতা ও (২) ভারতীয়দের দুর্বলতা।
মুসলিম বাহিনীর দক্ষতা :
- মুসলমানদের একের পর এক অঞ্চল জয় : এই যুগটি ছিল মুসলমানদের বিজয়ের যুগ। তখন মুসলমানদের জয়জয়কার অবস্থা। ইসলামী শক্তিতে বলিয়ান মুসলিম বাহিনী এসময় বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বি শক্তিতে পরিণত হয়ে একের পর এক দেশ ও জনপদ পদানত করে এগিয়ে যায়। ইতঃপূর্বে তারা ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ভারতীয়দের মাঝে তখন এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, খুব শীঘই তাদের দেশ আরবীয়দের দখলে চলে যাবে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নিরর্থক। তাই অযথা যুদ্ধের চেয়ে তারা আত্মরক্ষায় মনােযোগী হয়। সুতরাং তখনকার মুসলমানদের সামগ্রিক অবস্থা এ অভিযানকে সফল করতে বাড়তি শক্তি যােগায়।
- আরবীয় বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব : আরবীয় বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব তাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল। আরবদের সুষ্ঠ সংগঠন ও উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে যেমন দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে তেমনি তাদের সকল বিভাগ, বিশেষ করে, সেনাবিভাগ অত্যন্ত শক্তিশালী, উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, ক্ষিপ্র গতিসম্পন সুসংগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিতরূপে গড়ে তোলে। ইসলামের বিধান মােতাবেক যুদ্ধলব্ধ ধন সম্পদ (গণিমাত)-এর এক বিরাট অংশ সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হতাে। এতে সেনাবাহিনী যুদ্ধজয়ে বেশী উৎসাহী ও শক্তি নিয়ােগ করে। তাদের অশ্বারােহী বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণ, শত্রু সম্পর্কে দ্রুত তথ্য সংগ্রহ ও সংবাদ আদান-প্রদান, শত্রু বাহিনীর গতিবিধির উপর নজর রাখা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনন্য ছিল। তখনকার যুগে আরবীয় অশ্বারােহী বাহিনী যেকোন শত্রুর মনে ভীতির সঞ্চার করত।
- উন্নত যুদ্ধোপকরণ : উন্নত যুদ্ধোপকরণও আরবীয়দের সফলতায় অনেকাংশে সহায়তা করে। আরবীয় তরবারির সুতীক্ষ্ম ধার ও ঝলকানিতে প্রতিপক্ষের বুক প্রকম্পিত হয়ে উঠত। এছাড়া অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র ও উন্নত ও যুগােপযােগী ছিল। উপরন্তু আরবীয়দের নৌবহর অত্র এলাকায় তাদের বাড়তি শক্তিস্বরূপ ছিল, যা ভারতীয়দের ছিল না। আরবীয়রা আফ্রিকা ও ইউরােপীয়দের সাথে অনেক যুদ্ধ করায় আফ্রিকা ও ইউরােপীয় যুদ্ধ কৌশলও তারা আয়ত্ব করে।
- মুহম্মদ-বিন-কাসিমের সুদক্ষ সেনাপতিত্ব : ভারতে আরবদের সফলতার মূলে ছিল মুহম্মদ-বিন-কাসিমের সুদক্ষ সেনাপতিত্ব। উন্নত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশাল সেনাবাহিনী থাকলেই যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না, যদি না তার যথােপযুক্ত ব্যবহার হয়। যুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় কৌশল নির্ধারণ ও সে মােতাবেক সেনা বাহিনীকে পরিচালনা করেন সেনাপতি। যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ভর করে সেনাপতির দূরদৃষ্টি, অন্তদৃষ্টি, স্থির মস্তিষ্ক, অভিজ্ঞতা, সমরকুশলতা, তাৎক্ষণিক বুদ্ধি, সাহস প্রভৃতির উপর সকল গুণই মুহম্মদ-বিন-কাসিমের ছিল। তার তেজস্বীতা, বীরত্ব ও ব্যক্তিত্ব যুদ্ধের গতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। উপরন্তু তিনি আরবীয় সাম্রা পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের শাসনকর্তা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের ভ্রাতুস্পুত্র ও উ হওয়ায় তার ছিল বাড়তি মনােবল ও জয়ের চূড়ান্ত স্পৃহা। এ জয়ের জন্য তিনি যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন। তাছাড়া হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ তাকে যুদ্ধ জয়ের জন্য যে পরামর্শ দেন তা তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করেন। ‘History of Muslim civilization in India and Pakistan’ গ্রন্থের প্রণেতা এস.এম. ইকরামের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, হাজ্জাজ-বিন ইউসুফ জামাতা মুহম্মদ-বিন-কাসিমকে যুদ্ধ জয়ের জন্য চারটি পরামর্শ দেন। যেমন- (১) সদ্ব্যবহার, ভদ্রতা, বশীভূত করণের চেষ্টা ও পরাজিতের সাথে মিত্ৰতামূলক আচরণ, (২) দানের মহিমা স্থাপন, (৩) শত্রুদের শত্রুতার কারণ নির্ণয় করে ও তাদের গতিবিধি লক্ষ রেখে দ্রুত ব্যবস্থা অবলম্বন করা ও (৪) সর্বাত্মকভাবে শক্তি প্রয়ােগ করে শত্রু শিবিরকে ধ্বংস করে দেয়া। মুহম্মদ বিন-কাসিম সে মােতাবেক অগ্রসর হন এবং পথিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল দখল করে সেখানকার অধিবাসীদের মিত্রে পরিণত করে তাদেরকে তার পক্ষাবলম্বন করাতে সক্ষম হন। এমনকি, রাজা দাহিরের পক্ষের অনেককে নিজ পক্ষে এনে তার সেনা বাহিনীতে যােগদান করাতে সক্ষম হন। তাই বলা যায়, মুহম্মদ-বিন-কাসিমের ন্যায় উপযুক্ত সেনাপতি আরবদের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল।
ভারতীয়দের দুর্বলতা : আরবীয়দের সাফল্যে ভারতীয়দের দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী ছিল। রাজা দাহিরের দুঃশাসন ও তার প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দাহিরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বহু বৌদ্ধ, হিন্দু, জাঠ, মেঠ প্রভৃতি গােষ্ঠী অনেকদিন ধরেই দাহিরের পতন কামনা করছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের এক বিরাট সংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দু নিজ রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। যুদ্ধ বিগ্রহে অংশগ্রহণ করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কেবল উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাই সৈনিক বৃত্তি গ্রহণ করতে পারত। ফলে এই অধিক সংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সহযােগিতা রাজা দাহির পাননি। বরঞ্চ তারা মুহম্মদ-বিন-কাসিমের আগমনে তাদের মুক্তির পথ খুঁজে পায়। এজন্য মুসলিম বাহিনীকে তারা সর্বাত্মক সহযােগিতা করে। ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব ও কোন্দল নিজেদেরকে কেবল বিভাজনই করেনি, চরমভাবে দুর্বল করে ফেলে। রাজা দাহির মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিরােধে স্বজাতিকে একত্রিত করতে পারেননি। তাছাড়া রাজা দাহিরের ব্যক্তিগত অদক্ষতা, চারিত্রিক দুর্বলতা, প্রাচীন পদ্ধতির সেনাবাহিনী, সামন্তনীতির ব্যর্থতা আরবীয়দের সহায়ক হয়। উপরন্তু, দাহিরের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও অভিজাত দাহিরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। রাজা দাহিরের অর্থনৈতিক দৈন্যতাও তাকে সামরিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্বল করে রাখে। এ সকল কারণে আরবীয়রা অতি সহজেই সিন্ধু ও তার আশেপাশের অনেক এলাকা দখল করে বিজয় পতাকা উড়াতে সক্ষম হয়।
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়। ঐতিহাসিকদের অনেকে এ অভিযানকে নিষ্ফল অভিযান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ অভিযানের পর আরবরা ভারতে কোন স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। অনেকে এ অভিযানকে ফলাফল শূন্য কোন আকস্মিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। লেনপুলের মতে, “আরবরা সিন্ধু জয় করেছিল, কিন্তু এই বিজয় ভারতের ইতিহাসে কেবল একটি এপিসোড ছিল, আর এখানে কোন ফলাফল ছাড়াই এখানে ইসলামের বিজয় হয়েছিল।” কিন্তু অনেকে আবার এ অভিযানকে তাৎপর্যপুর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর ফলাফলগুলো হলো –
(১) রাজনৈতিক ফলাফল : প্রত্যক্ষভাবে আরবদের সিন্ধু অভিযানের তেমন কোন উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক ফলাফল ছিল না। লেনপুলের উপরিউক্ত মন্তব্যে তারই সমর্থন মেলে। কারণ, সিন্ধুতে আরবদের শাসন বেশিদিন স্থায়ী না হওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গণে তার প্রভাব লক্ষ করা যায় না। কেবল রাজা দাহিরের পতন ও মুসলিম প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর তেমন কোন প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখা যায় না। অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে এর রাজনৈতিক ফলাফল তেমন না থাকলেও পরােক্ষ রাজনৈতিক ফলাফলের দিক থেকে এ বিজয়কে নিষ্ফল বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেমন –
- আরবদের সিন্ধু বিজয়ের অব্যবহিত পর হতে প্রায় ৩০০ বছর ধরে সিন্ধুর স্থানীয় মুসলিম শাসকরা স্বাধীনভাবে সিন্ধু ও মুলতান শাসন করেন।
- দ্বিতীয়ত সিন্ধু বিজয়ের ফলে ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে আরব ভীতির সৃষ্টি হয় এবং তারা আত্মরক্ষার নীতি অনুসরণ করেন।
- তৃতীয়ত পরবর্তী মুসলিম বিজেতাগণ এ বিজয় দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়।
(২) সামাজিক ফলাফল : সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরবগণ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসে। অনেক মুসলিম সৈনিক হিন্দু রমনীদের বিবাহ করে। ফলে আর্য ও সেমিটিক জাতির সংমিশ্রণ ঘটে, যা ইন্দো-সেমেটিক জাতিগােষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পায়। তারা ভারতে দীর্ঘদিন যাবৎ ইন্দো সেমেটিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে ভারতীয় সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে, মুলতান, দেবল, নিরুন প্রভৃতি এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাধিক্যতা লাভ করতে থাকে। ফলে এ সকল এলাকায় মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, গড়ে ওঠে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা এবং বিস্তার লাভ করতে থাকে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা। আরবীয় ও ইসলামী রীতিনীতি এ সকল এলাকার হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। পাশাপাশি হিন্দু সমাজের অনেক প্রথা-পদ্ধতিও তারা গ্রহণ করে। ক্রমে উভয়ের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে উঠতে থাকে।
(৩) অর্থনৈতিক ফলাফল : আরবীয়দের সিন্ধু বিজয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক হয়। বণিক জাতি আরবীয়দের ব্যবসায় বাণিজ্য জল ও স্থল উভয় পথেই সম্প্রসারিত হয়। সিন্ধু ও মুলতানে অবস্থান করে তারা আরব ও ভারতের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন রচনা করে। এতে ব্যবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট উভয় অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে থাকে। আরবীয়দের ব্যবসায় বাণিজ্য ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সীমারেখা পেরিয়ে অনতিকালের মধ্যে বঙ্গদেশের উপকূলবর্তী সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামেও সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীতে তা আরাে সম্প্রসারিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। এভাবে আরবীয় বাণিজ্য যেমন মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক বাণিজ্যে রূপ লাভ করে, তেমনি এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সাথে ভারতবর্ষের সামুদ্রিক বাণিজ্যিক সম্পর্কও প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৪) ধর্মীয় ফলাফল : সিন্ধু বিজয়ের ফলে অনেক পীর, কামেল, দরবেশ ভারতবর্ষে এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। এভাবে পৌত্তলিকদের মধ্যে একেশ্বরের বাণী প্রচারিত হতে থাকে এবং মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পরবর্তীকালে মুসলিম অভিযানের সফলতায় অনেক সহায়ক হয়, সন্দেহ নেই। আর এর মূলে ছিল সিন্ধু বিজয়। সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেখানে ইসলামের বীজ বপন করা হয়। তাই শ্রীবাস্তব যথার্থই বলেছেন, “আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতে ইসলামের বীজ বপনের ক্ষেত্র রচিত হয়, যা ভবিষ্যতের আক্রমণকারীদেরকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আক্রমণের উৎসাহ প্রদান করে।”
(৫) সাংস্কৃতিক ফলাফল : সিন্ধু বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এ বিজয়ের ফলে আরব ও ভারতীয়দের মধ্যে এক অপূর্ব সাংস্কৃতিক যােগাযােগ ও লেনদেনের সুযােগ সৃষ্টি হয়। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতিতে এই বিজয়ের ফল খুব গভীর ও সুদূরপ্রসারী ছিল।” ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহু উপাদান আরবীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে এবং পরবর্তীকালে সেগুলাে আরবদের মাধ্যমে ইউরােপে বিস্তার লাভ করে। এরপর থেকে বহু ভারতীয় গ্রন্থ আরবি ভাষায় এবং বহু আরবীয় গ্রন্থ ভারতীয় ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। হিন্দু ধর্ম, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, সঙ্গীত, লােকগীতি, সাহিত্য, স্থাপত্য, চিত্রশিল্প প্রভৃতি জ্ঞান আরবীয়রা নিজ দেশে বিস্তার সাধন করে। আব্বাসীয় খলিফাগণ বহু ভারতীয় মনীষীকে তাদের দরবারে আমন্ত্রণ জানান। আব্বাসীয় আমলে বাগদাদ যে বিশ্বের অন্যতম জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত হয়, তাতে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনন্য অবদান ছিল। এভাবে আরবীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির পরশে সমৃদ্ধশালী হয়। ঐতিহাসিক হ্যাভেলের মতে, “গ্রিস নয়, ভারতই ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমদেরকে দর্শন, গুহ্যধর্মীয় আদর্শ শিখিয়েছে এবং সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রকাশে উৎসাহিত করেছে।” অন্যদিকে ভারতীয়গণও আরবীয়দের নিকট থেকে জ্ঞান বিজ্ঞান, বিশেষ করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে জ্ঞান লাভ করে। আরবীয়দের ধর্মীয় সম্প্রীতি, সাম্য ও সহিষ্ণুতা ভারতীয়দের মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে, বর্ণভেদ প্রথায় নিষ্পেষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। এর ফলেই ভারতে ভক্তিবাদ ও ব্রহ্মসমাজ-এর মত ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠে। আরবীয় ও ভারতীয়দের মিশ্রণ সম্ভব হয় সিন্ধু ও মুলতানে মুসলমানদের দীর্ঘ অবস্থানের প্রেক্ষিতে। সুতরাং দেখা যায় যে, আরবদের সিন্ধু অভিযান কেবল রাজা দাহিরের পতন ও দীর্ঘদিনের আরবীয়দের ভারতে বিস্তারের ইচ্ছা পূরণের মধ্যেই সীমিত না। সিন্ধু অধিকার ভারতে পরােক্ষভাবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে, যার ফলাফল আজও আমরা তথা বিশ্বের সভ্য মানুষ ভােগ করছি।
সিন্ধুতে আরব শাসন ও মুহম্মদ-বিন-কাসিমের উত্তরকালে সিন্ধুর ইতিহাস
বিন-কাসিমের বিজয়ের মাধ্যমে সিন্ধু ও মুলতান আরব সাম্রাজ্যের কপে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পরবর্তী দেড়শত বছর তা খলিফার শাসনাধীন থাকে। এ সময় ভারতীয় এ ভূখণ্ডে আরবীয় শাসন বলবৎ করা হয়। মুহম্মদ-বিন কাসিম প্রথমে দেবল বন্দরে প্রবেশ করেই এই শাসন ব্যবস্থার সূচনা করেন। পনি নিজে যেমন উদার প্রকৃতির লােক ছিলেন, তেমনি ইসলামের উদারনৈতিক সন পদ্ধতি বাস্তবায়নেও প্রয়াসী হন। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের ভূমি বণ্টননীতি অনুসারে সিন্ধু ও মূলতানে আরবীয়দের ভূমি ভােগ দখলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। আরবীয়দেরকে তিনি কেবল সেনাবাহিনীতেই কাজ করার সুযােগ দেন। তিনি বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা স্থানীয় অভিজ্ঞ লােকদের হাতে ছেড়ে দেন। এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মুহম্মদ-বিন কাসিম রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। এছাড়া তিনি স্থানীয় অভিজাত শ্রেণী ও পূর্ববর্তী শাসনামলের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে পূর্বের ন্যায় মর্যাদার আসনে সমাসীন রাখেন এবং তাদের উপর প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন। মুসলিম বিজয়ে ভীত হয়ে সিন্ধুর যে সকল কর্মচারীরা আত্মগােপনে ছিল তিনি তাদেরও খুঁজে বের করেন এবং নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মুহম্মদ-বিন-কাসিমের শাসন ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়কারীরা অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর শিক্ষিত ব্যক্তিরা। ভিন দেশে এসে এভাবে বিধর্মীদের উপর আস্থা স্থাপন করে রাজস্বের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা ইতিহাসে সত্যই বিরল, যা হিন্দুদেরকে মুগ্ধ করে। মুহম্মদ-বিন-কাসিম উদারনৈতিক শাসন ব্যবস্থার দ্বারা সিন্ধুবাসীর মন জয়ের চেষ্টা করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সিন্ধুর অধিবাসীদের মৌলিক-মানবিক চাহিদা মিটাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মুসলিম বিজেতা হয়েও তিনি সিন্ধুবাসীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, এমনকি যুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরসমূহ মেরামত করার অধিকার প্রদান করেন। আর এর জন্য হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের নিকট হতে প্রয়ােজনীয় অনুমতিরও ব্যবস্থা তিনি করেন। তিনি অধিকৃত অঞ্চলের বাসিন্দাদেরকে “আহলে কিতাব” রূপে মনে করে তাদেরকে জিম্মির মাদী দান করেন। অর্থাৎ তারা মুসলমান শাসকের জিম্মায় আছে। সুতরাং তাদের সকল প্রকার নিরাপত্তা ও চাহিদা মেটানাের দায়িত্ব মুসলিম শাসকের।
মুহম্মদ-বিন-কাসিমের রাজস্ব ব্যবস্থাও ছিল উদার। রাজা দাহিরের আমলে অত্যাচারমূলক রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সে সময় ভূমির গুণাগুণ বিচার না করে সকলের উপর এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব নির্ধারিত ছিল এবং তা জোর আদায় করা হতাে। কিন্তু মুহম্মদ-বিন-কাসিম জমি জরিপ করে উর্বরাশক্তির উপর ভিত্তি করে এবং কৃষকের সামর্থের দিকে লক্ষ রেখে এক-চতুর্থাংশ থেকে দুই-পশ্চমাংশ রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপর রাজস্ব আদায়ের ভার দেন এবং নির্ধারিত হারের চেয়ে যাতে অধিক রাজত্ব আদায় করা না হয় ও ন্যায় বিচার লংঘিত না হয় সেজন্য কঠোর নির্দেশ জারী করেন। ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রজারা সুখে শান্তিতে বসবাসের সুযােগ পায়। তিনি ইসলাম স্বীকৃত চার প্রকারের বেশী রাজস্ব আদায় করতেন না। অমুসলমানদের নিকট হতে আদায়যােগ্য জিজিয়া আদায়ের ক্ষেত্রেও তিনি ন্যায় ও সুষ্ঠু নীতি প্রয়ােগ করেন। তিনি তাদেরকে সামর্থ অনুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে জিজিয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন। যেমন- ১ম শ্রেণী ৪৮ দিরহাম, ২য় শ্রেণী ২৪ দিরহাম ও ৩য় শ্রেণী ১২ দিরহাম। তিনি যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে মহানুভবতার আর একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেন। মুহম্মদ-বিন-কাসিম ইসলামিক ব্যবস্থা অনুযায়ী বিচার বিভাগের প্রবর্তন করেন। প্রধান বিচারককে বলা হতাে কাজী-উল-কুজ্জাৎ, আইনের ব্যাখ্যাকারীকে মুফতী এবং রায় ঘােষণাকারীকে মীর আদল বলা হতাে। স্থানীয়ভাবে হিন্দুদের তিনি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা করেন। বিচারের ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণের বৈষম্য ছিল না। এভাবে মুহম্মদ-বিন-কাসিম অল্প সময়ের মধ্যে বিজিত সিন্ধু ও মুলতানে প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তােলেন এবং জনগণকে শান্তির সন্ধান দেন।
মুহম্মদ-বিন-কাসিমের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আরব সাম্রাজ্যের নতুন প্রদেশ সিন্ধু ও মুলতানে যােগ্য শাসকের অভাব লক্ষ করা যায়। এর পরবর্তী শাসনকর্তা নিযুক্ত হন ইয়াজিদ-বিন-মুহাল্লাব এবং তার মৃত্যুর পর হাবীব। তবে তারা দক্ষ শাসক ছিলেন না এবং তাদের সময় কোন উল্লেখযােগ্য ঘটনাও লক্ষ করা যায় না। পরবর্তী শাসকদের মধ্যে আল জুনায়েদ-এর নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তিনি আলাের, ব্রাহ্মণাবাদ, মালব, রাজপুতনা প্রভূত অফ উপর মুসলিম আধিপত্য পুনঃস্থাপন করেন। মুহম্মদ-বিন-কাসিম তা দখল করলেও তার অনুপস্থিতিতে তা আবার হস্তচ্যুত হয়ে যায়। জুনায়েদের দূর্বল শাসকদের আমলে ঐ সকল এলাকা আবার হস্তচ্যুত হয়ে পড়ে। উমাইয়া বংশের পতনের পর আব্বাসীয় শাসন আমলে সিন্ধু ও মুলতানে অস্তিরতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এ সময় শাসনকর্তাদের মধ্যে বিদ্রোহী মনােভাব ও স্বাধীনভাবে শাসন করার প্রবণতার সৃষ্টি হয়। এমনকি, উভয় অঞ্চলের শাসনকর্তাদের মধ্যে আত্মকোন্দল দানা বেঁধে ওঠে। ৯ম শতকের শেষের দিকে সিন্ধু ও মুলতানে স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্ব প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরাে বৃদ্ধি পায়। অচিরেই মুলতান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত ভয়। ১১শ শতকের সূচনাপর্বে গজনীর সুলতান মাহমুদ মুলতান ও সিন্ধু দখল করে নিজ সাম্রাজ্যভূক্ত করেন। ফলে সেই অঞ্চল থেকে আরবীয়দের চির বিদায় ঘটে।
গযনভী (ইয়ামিনী) বংশ
গযনভী বংশের ক্ষমতায় আরোহন, সবুক্তগীন ও সুলতান মাহমুদ
ক্ষমতায় আরোহন : খ্রিস্টীয় ১০ম শতকের শুরু থেকে বাগদাদের খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তুর্কিস্তানের অধিবাসী তথা তুর্কিদের অভ্যুদয় ঘটে। এতদিন আব্বাসীয় খলিফাদের দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করত এই তুর্কিরা। কালক্রমে তারা দুর্বল খলিফাদের উপর প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উচ্চ রাজপদে সমাসীন হয়ে বিশাল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়। ইতােমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তথা খলিফাদের অযােগ্যতার ফলে বিভিন্ন দূরবর্তী প্রদেশসমূহ স্বাধীন হয়ে পড়ে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় পারস্যের সামানিদ বংশ। সামানিদ রাজ মালিকের আমলে আলপ্তগীন প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং খােরাশানের গভর্নর নিযুক্ত হন। এ সময় সামানি বংশের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শুরু হলে তুর্কি নেতা আলপ্তগীন এ সুযােগে গজনীতে এটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে গজনী এক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়। আলপ্তগীনের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইসহাক ও এক বছর পর ইসহাকের মৃত্যু হলে পীরাই গজনীর সিংহাসনে বসেন। কিন্তু পীরাই ছিলেন সম্পূর্ণ অযােগ্য ও অত্যাচারী শাসক। এতে প্রাসাদের সকলের নিকট তিনি অপ্রিয় হয়ে পড়লে আলপ্তগীনের জামাতা ও সেনাপতি সবুক্তগীন পীরাইকে বিতাড়িত করে মসনদ দখল করে গজনীতে এক নতুন রাজবংশের গােড়াপত্তন করেন, যা পরবর্তীকালে গযনভী বা ইয়ামিনী রাজবংশ নামে পরিচিতি পায়।
সবুক্তগীন : সবুক্তগীন ছিলেন জাতিতে তুর্কি। প্রথম জীবনে তিনি আলপ্তগীনের দরবারে ক্রীতদাস হিসেবে আনীত হন। কালক্রমে স্বীয় যােগ্যতা, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার জন্য তিনি উচ্চরাজপদে সমাসীন হন। পর্যায়ক্রমে তিনি আমিরুল ওমরাহ ও সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে আলপ্তগীন নিজ কন্যাকে তার সাথে বিবাহ দেন। আলপ্তগীনের মৃত্যুর পর রাজ্যে যে ক্রান্তিকাল উপনীত হয় তিনি তা দূর করে গজনীর অধিপতি হয়ে বসেন। উচ্চাভিলাসী সবুক্তগীন ক্ষুদ্র গজনী রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজী ছিলেন না। তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি আফগানদের সুসংগঠিত করে শক্তি বৃদ্ধি করেন। অতঃপর তাদের সাহায্যে লামখান ও সিজিস্তান দখল করেন। এরপর তিনি ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তার প্রধান প্রতিবন্ধক ছিলেন পাঞ্জাবের শাহী রাজবংশের রাজা জয়পাল। জয়পাল খুব শক্তিশালী রাজা ছিলেন। সবুক্তগীনের ক্ষমতাসীন হবার পূর্বে গজনীর বিরুদ্ধে তিনি একবার ব্যর্থ অভিযান চালান। সবুক্তগীনের দ্রুত শক্তি বৃদ্ধিতে বিপদ উপলব্ধি করে তিনি ৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় গজনী আক্রমণ করেন। কিন্তু ভারী তুষারপাতের ফলে তিনি সবুক্তগীনের সাথে সন্ধি করে ফিরে আসেন। এরপর ৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সবুক্তগীন এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে জয়পালের রাজ্য আক্রমণ করেন। জয়পাল রাজ্যের এক বিরাট এলাকাসহ প্রচুর ধন-রত্নের বিনিময়ে এক সন্ধি করে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু সবুক্তগীনের প্রত্যাবর্তনের পর তিনি শর্ত পালনে অস্বীকার করেন। অতঃপর ৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে সবুক্তগীন দ্বিতীয়বার জয়পালের রাজ্য আক্রমণ করেন। এ সময় জয়পালকে সাহায্য করার জন্য দিল্লী, আজমীর ও কনৌজের নৃপতিগণ এগিয়ে আসেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবুক্তগীন জয়পালকে পরাজিত করে কাবুল ও তার নিকটবর্তী বিশাল এলাকা দখল করে নেন। এভাবে ভবিষ্যতে ভারতে আক্রমণ পরিচালনার জন্য ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল একটি উপযুক্ত ও শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সবুক্তগীন মারা যান এবং তার পুত্র মাহমুদ সিংহাসনে আরােহণ করেন।
সুলতান মাহমুদ : ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ একজন বিখ্যাত বিজেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি ৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতার উপযুক্ত পুত্র। সিংহাসনে আরােহণের ক্ষেত্রে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভ্রাতা ইসমাইল। তিনি তাকে পরাজিত ও বন্দী করে নিজেকে নিষ্কণ্টক করেন। এরপর তিনি বিদ্রোহী আফগান গােত্র প্রধানদের দমন করেন। এ সময় তার সাথে খোরাশানের সামানিদ সুলতানের বিরােধ দেখা দিলে তিনি সামানিদ রাজ্য দখল করে তা সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন এবং স্বাধীনতা ঘােষণা করে সুলতান উপাধি অহণ করেন। আলপ্তগীন সামানিদ রাজ্যের একাংশ (গজনীতে) স্বাধীন রাষ্ট্রের গাড়াপত্তন করলেও কখনাে স্বাধীনতা ঘােষণা করেননি এবং সুলতান উপাধিও নেননি। সবুক্তগীনও আলপ্তগীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। কিন্তু মাহমুদ সামানিদ রাজ্য দখল করার পর আর কোন কৌশলের আশ্রয় নেয়ার প্রয়ােজন বােধ করেননি। তিনি সুলতান উপাধি গ্রহণ করেই বাগদাদের খলিফা আল কাদির বিল্লাহর নিকট প্রচুর উপঢৌকন পাঠান। এতে খলিফা খুশী হয়ে তাকে সমর্থন করেন এবং ‘ইয়ামিন-উদ-দৌলা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন হতে তার প্রতিষ্ঠিত বংশের নাম হয় ইয়ামিনী রাজবংশ।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য
সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন। তার বারংবার ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে গিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরােধের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ তাকে অর্থলােলুপ ও তস্কর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারও মতে, দস্যু প্রকৃতির মানুষ সুলতান মাহমুদ ভারতের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করার উদ্দেশ্যে এভাবে বারবার অভিযান চালিয়েছেন। জনৈক ঐতিহাসিকদের মতে, “তিনি এলেন, পোড়ালেন, হত্যা করলেন, লুণ্ঠন করলেন, বন্দি করলেন ও চলে গেলেন।” ভারতের ধন-সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রাচীন যুগ থেকে ভারত বহুবার আক্রান্ত হয়, বহুবার লুণ্ঠিত হয়। সুতরাং বিজিত এলাকার ধন-রত্ব হস্তগত করা নতুন কোন ঘটনা নয়। আর এজন্য সুলতান মাহমুদকে লুণ্ঠনকারী বলা ঠিক নয়, এটা সর্বকালেরই প্রচলিত ধারা। অন্যান্য ঐতিহাসিকরা অবশ্য ভিন্নমত পােষণ করেছেন। তাদের অনেকে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য হিসেবে ধর্মীয় কারণ, অনেকে আবার রাজনৈতিক কারণকে চিহ্নিত করেছেন। তার অভিযানের কারণগুলো –
ধর্মীয় উদ্দেশ্য : কোন কোন ঐতিহাসিক সুলতান মাহমুদের এ অভিযানের পেছনে ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করেন। সুলতান মাহমুদের রাজসভার ঐতিহাসিক উতবীর বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে এ সকল ঐতিহাসিকরা ধর্মীয় কারণের উপর জোর দিয়েছেন। তারা মনে করেন, সুলতান মাহমুদ সাম্রাজ্য বিস্তার নয়, অর্থ লুণ্ঠন নয়, কেবল ইসলাম ধর্ম প্রচার ও পৌত্তলিকতা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই ভারতে বারবার অভিযান প্রেরণ করেন। উদাহরণস্বরূপ তারা মাহমুদের নির্বিচারে মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে জানা যায় তিনি কোন হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেননি, তাদেরকে হয়রানীও করেননি। অধ্যাপক মুহম্মদ হাবিবের মতে, “মাহমুদ ধর্মান্ধ ছিলেন না ও তার ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান ধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলনা।” এই মতের সমর্থনে বলা যায় যে, তিনি কেবল হিন্দুশাহীদের বিরুদ্ধেই অভিযান পরিচালনা করেননি, মুলতান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধেও তিনি অভিযান পরিচালনা করেছেন। মধ্যযুগীয় হিসেবে তার মধ্যে হয়তাে ধর্মীয় চেতনার ছাপ কিছুটা ছিল। তবে তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না। ধর্মীয় উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে তিনি এ অভিযান পরিচালনা করেননি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, গজনীতেও প্রচুর সংখ্যক হিন্দু বসবাস করত, তাদের প্রতি তিনি খুবই উদার ছিলেন এবং এমনকি, তাদের জিজিয়া কর থেকেও তিনি অব্যহতি দেন। এ সমস্ত দিক বিচার করলে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের পেছনে ধর্মীয় কারণ গৌণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য : কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই সুলতান মাহমুদ বারবার ভারত অভিযান করেন। সুলতান মাহমুদ যে তার পিতার ন্যায় উচ্চাভিলাষী নরপতি ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং মধ্য এশিয়ায় তার একটি সার্বভৌম সাম্রাজ্য গঠনের অভিপ্রায় অমূলক ছিল না। আর এ সাম্রাজ্যের সংহতি এবং নিরাপত্তার জন্য ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অধিকার করা অপরিহার্য ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তার পিতা সবুক্তগীনের শাসনামল থেকেই তার সাথে পাঞ্জাবের হিন্দুশাহীরাজ জয়পালের বিরােধ শুরু হয়। জয়পাল গজনীর শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন এবং সবুক্তগীনের সময় জয়পাল গজনী আক্রমণ করেন। কিন্তু সে যুদ্ধে জয়পাল পরাজিত হয়ে প্রচুর অর্থের খেসারত দিয়ে সবুক্তগীনের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। এরপর সবুক্তগীন পরপর দু’টি অভিযান চালিয়ে জয়পালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সুলতান মাহমুদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তবে বিষয়টি তখনই নিস্পত্তি হয়ে যায়নি। ৯৯৭ সালে সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর তার পুত্র সুলতান মাহমুদ সিংহাসনে আরােহণের পর তিনি ভারতের দিকে নজর দিলে সে বিরােধ আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যেহেতু যুবরাজ থাকাকালেই মাহমুদ ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা এবং সেখানকার সামরিক বাহিনীর গুণাগুণ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন এবং পূর্ব থেকেই জয়পালের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন সেহেতু জয়পালকে সমুচিত শাস্তি প্রদান এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল দখল করার অভিপ্রায়ে তিনি ভারত অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সুলতান মাহমুদ ১০০০-১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মােট সতের বার ভারতে অভিযান করেন। কিন্তু একমাত্র পাঞ্জাব ছাড়া অন্য কোন ভারতীয় অঞ্চল তিনি স্থায়ীভাবে অধিকার করার চেষ্টা করেননি। কারণ সুলতান মাহমুদের স্থায়ীভাবে ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের বাসনা ছিল না। কারণ ভারতীয় রাজ্যসমূহ স্বীয় কর্তৃত্বে আনলে গজনীর সংহতি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতাে। সুলতানের এ সিদ্ধান্ত তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। এর ফলে গজনীর শক্তি দীর্ঘদিন অটুট ও নিষ্কণ্ঠক ছিল। সুতরাং এ সকল বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, তার অভিযানের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রধান ভূমিকা রাখে।
অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য : কোন কোন ঐতিহাসিকের বিশ্লেষণে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের পেছনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অপেক্ষা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই অন্যতম ছিল বলে মনে হয়। ঐতিহাসিক হাবিব সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, “এটি কোন ধর্মযুদ্ধ ছিল না, বরং গৌরব ও স্বর্ণের লােভেই সংঘটিত পার্থিব যুদ্ধ-বিগ্রহ।” ঐতিহাসিক V. A. Smith ও মন্তব্য করেন যে, “অর্থ লালসা সুলতানকে গ্রাস করেছিল।” এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতের বিরুদ্ধে পরিচালিত তার সতের বার ভারত অভিযানে। তিনি যতবার ভারত আক্রমণ করেন ততবারই অজস্র সােনা, রূপা, হীরা, জহরত, মণি-মাণিক্য নিয়ে স্বদেশে ফিরেন। ঠিক যেমন পারস্য সম্রাট নাদিরশাহ স্ব-ধর্মীয় মুঘলদের কাছ থেকে মূল্যবান ময়ূর সিংহাসন এবং ‘কোহিনুর’ নামক রাজমুকুটের বহু মূল্যবান হীরা অপহরণ করে স্বদেশে নিয়ে যান। মাহমুদের অর্থের প্রয়ােজন ছিল এজন্য যে, তিনি মধ্য এশিয়ায় সার্বভৌম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। এছাড়া তিনি রাজধানী গজনীকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাজধানীতে রূপান্তরিত করার সংকল্প করেন। আর এজন্য তার প্রয়ােজন ছিল প্রচুর অর্থের। ভারতবর্ষে তার বারবার অভিযান এই অর্থ সগ্রহের প্রয়ােজনে পরিচালিত হয়। তবে সুলতান মাহমুদ ভারত থেকে যে বিপুল ধন-সপ স্বদেশে নিয়ে যান তা তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেননি। বরং সে সম্পদ তিনি গজনীতে তার রাজনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করার কাজে এ গজনীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করার জন্য অকাতরে ব্যয় করেন। এ থেকে সুলতান মাহমুদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলাের পরিচয় পাওয়া যায়।
এই আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই মূখ্যভাবে কাজ করে, ধর্মীয় উদ্দেশ্য নয়। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক জাফর যথার্থই বলেছেন, “The real motivation of Muhammad’s Indian invasions were economic-cum political and not religious.”
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান
সিংহাসনে আরােহণ করে সুলতান মাহমুদ নিজ কাকে সুসংহত করেন এবং সীমান্তকে স্থায়ীভাবে সুরক্ষিত করার জন্য সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলাের দিকে দৃষ্টি দেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, এ সকল সাজাগুলাে তার জন্য নিরাপদ নয়, তাই তাদের শক্তি ধ্বংস করা অপরিহার্য ছিল। এ উদ্দেশ্যে তিনি ১০০০ খ্রিস্টাব্দ হতে একের পর এক অভিযান চালান। তিনি ভারতের বিরুদ্ধে কতবার অভিযান চালান তা নিয়ে মত বিরােধ থাকলেও আধুনিক কালের অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত হয়েছেন যে, তিনি সতের বার ভারত অভিযান করেন। তার এ অভিযানসমূহ হলো –
- (১) সুলতান মাহমুদের ভারত অভিমুখে প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় ১০০০ খ্রিস্টাব্দে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। এতে সীমান্তবর্তী কয়েকটি দূর্গ তার দখলে আসে। এতে তার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত অনেকটা নিরাপদ ও সুসংহত হয়।
- (২) সুলতানের দ্বিতীয় অভিযান পরিচালিত হয় ১০০০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব শত্রু পাঞ্জাবের রাজা জয়পালের বিরুদ্ধে। জয়পালের সাথে মাহমুদের পিতারও কয়েকবার যুদ্ধ হয়। জয়পাল এর পূর্বে কয়েকবার পরাজিত হলেও গজনীর বিরুদ্ধে শক্র মনােভাব পরিত্যাগ করতে পারেননি। সুলতান ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে জয়পালকে আক্রমণ করেন এবং পেশােয়ারের নিকট এক যুদ্ধে জয়পালকে পরাজিত ও বন্দী করেন। পরে মুক্তিপণ হিসেবে প্রচুর অর্থ ও রাজ্যের কিয়দংশ ছেড়ে দিয়ে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু জয়পাল পরাজয়ের এ গ্লানি সহ্য করতে না পেরে পুত্র আনন্দ পালের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
- (৩) ঝিলাম নদীর তীরবর্তী ভীরা নগরীর বিরুদ্ধে মাহমুদ ১০০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে তার তৃতীয় অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি রাজা বিজয় রায়কে পরাজিত করে ভীরা ও তারর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল করেন। বিজয় রায় বন্দী হন এবং কারাগারে আত্মহত্যা করেন।
- (৪) ১০০৬ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ মুলতানের শাসনকর্তা আবুল ফতেহ দাউদের বিরদ্ধে অগ্রসর হন। স্বীয় সাম্রাজ্যের স্বার্থে মুলতানকে সাম্রাজ্যভুক্ত করা তার একান্ত জরুরী ছিল। মাহমুদের আগমনে দাউদ ভীত হয়ে পলায়ন করলে অতি সহজে মুলতান অধিকৃত হয়। অবশ্য দাউদ মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করলে বার্ষিক করদানের বিনিময়ে মুলতানের শাসনভার তিনি তার উপর ছেড়ে দেন।
- (৫) আনন্দ পালের পুত্র সুখপাল সুলতান মাহমুদের নিকট থেকে সুবিধা পাবার জন্য ইতঃপূর্বে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মাহমুদের পাঞ্জাব হতে প্রত্যাবর্তনের পরও আনন্দ পাল মাহমুদের প্রতি অনুগত থেকে শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তার পুত্র তা মানতে রাজী ছিলেন না। তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পূর্বের ধর্মে ফিরে যান এবং পাঞ্জাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ফলে ১০০৭ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ তাকে আক্রমণ করে পরাজিত ও বন্দী করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।
- (৬) আনন্দপালের সাথে সুলতান সুসম্পর্ক বজায় রেখে চললেও সুলতানকে ধ্বংস করার জন্য আনন্দপাল গােপনে গােপনে উজ্জয়নী, গােয়ালিয়র, কনৌজ, দিল্লী, আজমীর প্রভৃতি রাজন্যবর্গের সমন্বয়ে একটি ফ্রন্ট গঠন করেন। এ খবর পেয়ে মাহমুদ ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে আনন্দপালকে আক্রমণ করেন। আনন্দপালও ঐ সকল মিত্র দেশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে কাশ্মিরের খােক্কারগণও আনন্দপালের পক্ষে যােগদান করে। উভয় সেনাবাহিনী উন্দের নিকট মুখােমুখি হলে এক ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে সুলতান মাহমুদ জয়লাভ করেন। আনন্দপাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এই বিজয়ের পর প্রচুর ধন-সম্পদ ও যুদ্ধ সামগ্রী সুলতান মাহমুদের হস্তগত হয়।
- (৭) মাহমুদ ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে নগরকোর্ট দূর্গ আক্রমণ করে তা দখল করেন। এবং ৭ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, দুইশত মন সােনা, সাতশত মন স্বর্ণ ও রৌপ্য বাবদ দুই হাজার মন অপরিশােধিত রূপা ও ২০ মন মনি-মুক্তা লাভ করেন বলে ফিরিস্তার বিবরণ হতে জানা যায়।
- (৮) মুলতানের শাসনকর্তার গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় মাহমুদ ১০১০ খ্রিস্টাব্দে তাকে আক্রমণ ও পরাজিত করে মুলতান নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
- (৯) উন্দের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আনন্দপাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন নন্দনাতে রাজধানী স্থাপন করেন। কিছুদিন পর সেখানে তার মৃত্যু হলে তার পুত্র ত্রিলােচনপাল সিংহাসনে আরােহণ করে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। মাহমুদ ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিলােচনপালকে আক্রমণ করে নন্দনা দখল করেন। ত্রিলোচনপাল পালিয়ে গিয়ে কাশ্মিরে আশ্রয় নেন। অতঃপর পিতৃরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে শিবলী পাহাড়ে দূর্গ স্থাপন করে তিনি আবার শক্তি সঞ্চয় করতে তন। এ সময় বুন্দেলখণ্ডের রাজা বিদ্যাধরের সাথে তিনি মিত্ৰতা স্থাপন করেন। মাহমুদ তাকে দমন করার জন্য আবার অভিযান পরিচালনা করেণ। ত্রিলােচনপাল এবার সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। সুলতান মাহমুদ এবার পাঞ্জাবের উপর স্থায়ী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন এবং এজন্য তিনি একজন আমীরকে শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এর অল্প কিছুদিন পর ত্রিলােচনপাল আততায়ীর হাতে নিহত হলে তার পুত্র ভীমপাল পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু তিনিও অল্পকাল পর মারা গেলে পাঞ্জাবের হিন্দু শাহী বংশের যবনিকা ঘটে। ফলে পাঞ্জাবে সুলতানের আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বি থাকল না।
- (১০) সুলতান ১০১৪ সালে থানেশ্বরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তা দখল করে প্রচুর ধন-সম্পদ হস্তগত করেন।
- (১১) সুলতান ১০১৫ সাল হতে ১০২১ সালের মধ্যে কাশ্মিরের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে কাশ্মিরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন।
- (১২) ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ তদকালীন ভারতের প্রাণকেন্দ্র কনৌজের দিকে অগ্রসর হন। কনৌজরাজ ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের আনন্দপালকে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করেন। এ অভিযানকালে সুলতান মাহমুদ প্রথমে বুলান্দশরের শাসক হরদত্তকে আক্রমণ করে পরাজিত করেন। হরদত্ত সদলবলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর মাহমুদ বৃন্দাবন ও মথুরা দখল করে স্বীয় খাদ্য সামগ্রী ও যুদ্ধ সরঞ্জাম বৃদ্ধি করেন। ১৯১৯ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি কনৌজ আক্রমণ করেন। কনৌজের প্রতিহাররাজ রাজ্যপাল মাহমুদকে প্রতিরােধ না করে আত্মসমর্পণ করেন এবং মাহমুদকে ৩০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, ৩৫০টি হস্তি ও ৫৫ হাজার দাস-দাসী উপহার স্বরূপ প্রদান করে। নিজের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখেন।
- (১৩) কনৌজ রাজের এভাবে বশ্যতা স্বীকার করায় পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজন্যবর্গ ক্ষুব্ধ হয়ে কনৌজ আক্রমণ করে রাজ্যপালকে হত্যা করেন। এ সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে সুলতান মাহমুদ ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যপালের হত্যাকারী চান্দেলা রাজ্যের রাজ্য আক্রমণ করেন। চান্দেলারাজ গােন্ডা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাজ্য ছেড়ে পলায়ন করেন এবং সহজেই মাহমুদ তা দখল করেন।
- (১৪) আনন্দপালকে সাহায্যকারী গোয়ালিয়রের বিরুদ্ধে সুলতান ১০১১ খ্রিস্টাব্দে অগ্রসর হলে গােয়ালিয়রের রাজা সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে বার্ষিক কর প্রদানের শর্তে ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখেন।
- (১৫) ১০২৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কালিঞ্জর আক্রমণ করে তাও করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
- (১৬) ভারতবর্ষে সুলতান মাহমুদের জীবনের সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য অভিযান ছিল গুজরাটের কাথিয়াবারের সােমনাথ মন্দিরের বিরুদ্ধে। সােমনাথ মন্দিরের বিপুল ঐশ্বর্যের কথা মাহমুদ পূর্ব থেকেই জানতেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, উক্ত মন্দিরের পুরােহিত প্রচার করেন যে, সােমনাথ মন্দির দখল করা সুলতান মাহমুদের ক্ষমতার বাইরে, কারণ তা ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে বিভিন্ন এলাকার হিন্দুরা নিরাপত্তার জন্য তাদের ধন-রত্ন সােমনাথ মন্দিরে সঞ্চিত করে এবং তা রক্ষার জন্য হাজার হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের সশস্ত্র লােক পাহারা দিতে থাকে। এতে এ মন্দিরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরাে জোরদার হয়। ঈশ্বরের অনুগ্রহ আছে- এ বিশ্বাসে তাদের মনােবলও সুদৃঢ় ছিল। এই প্রচারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ সােমনাথ মন্দিরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। মাহমুদ সােমনাথের দ্বারদেশে এসে উপস্থিত হলে ইতিহাস প্রসিদ্ধ সােমনাথ মন্দির রক্ষার জন্য রাজপুত নৃপতিগণসহ হাজার হাজার মানুষ মাহমুদকে বাধা দেন। হিন্দু বাহিনীর অপূর্ব বীরত্বের কারণে প্রথম অভিযানে মাহমুদ মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু দ্বিতীয় অভিযানে মাহমুদ সফল হন এবং তিনি মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করেন। সুলতান মাহমুদ সােমনাথ থেকে অতুল ধন-সম্পদ লাভ করেন, যা বর্তমানকাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে।
- (১৭) সুলতানের ভারতে সর্বশেষ অভিযান পরিচালিত হয় জাঠদের বিরুদ্ধে। সােমনাথ অভিযানকালে এই জাঠদের দ্বারা মুসলিম সেনারা উৎপীড়িত হয়। মাহমুদ জাঠদেরকে পরাজিত করে অধিকাংশকে হত্যা করেন।
মৃত্যু : দীর্ঘ যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কঠিন পরিশ্রমে সুলতানের শরীর ভেঙ্গে পড়ে এবং ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে ৬০ বছর বয়সে গজনীতে প্রাণত্যাগ করেন। ভারতে সতের বার অভিযান পরিচালনা করে তিনি কিংবদন্তির মহানায়কের স্থান – করেন।
মাহমুদের সাফল্যের কারণ ও ফলাফল
সুলতান মাহমুদ মাত্র ২৬ বছরের মধ্যে সতের বার ভারতে অভিযান চালিয়ে ৩টি অভিযানে জয়লাভ করে বিষ্ময়ের সৃষ্টি করেন। শুধু ভারতেই নয়, মধ্য এশিয়ায়ও তিনি একাধিকবার সফল অভিযান পরিচালনা করেন। ভারতের অভিযানসমূহের অধিকাংশ একক শক্তির বিরুদ্ধে হলেও কোন কোন অভিযানে তাকে সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয়। তিনি পাঞ্জাবের বিখ্যাত হিন্দুশাহী বংশকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন এবং সোমনাথ মন্দির, যা ভারতীয় পুরােহিতদের নিকট ঐশ্বরিক শক্তি সম্পন্ন ছিল, তাও দখল করে পুরােহিতদের মিথ্যা চ্যালেঞ্জের জবাব দেন। তার এ অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয় সাফল্যের কারণসমূহ ঐতিহাসিকরা নির্ণয় করেছেন। সেগুলো হলো –
- (১) সুদক্ষ সেনাপতি : সুলতান মাহমুদ ছিলেন সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক। গােটা ভারতে তার সমকক্ষ কোন সেনাপতি তখন ছিল না। তিনি নিজে যেমন যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, তেমনি সেনাবাহিনীকেও যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেন। তার সেনাবাহিনী ছিল সুশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল, কৌশলী ও দুর্ধর্ষ। সুলতান মাহমুদ নিজেই তার নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু ভারতের সেনাবাহিনী ছিল দুর্বল, অধিকাংশ ছিল অশিক্ষিত ও যুদ্ধবিদ্যা ছিল সেকেলে ধরনের। উপযুক্ত কোন সেনাপতিও তাদের ছিল না। উপরন্তু সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খল ছিল না। তারা সব সময়ই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত থাকত। মুসলিম বাহিনী ছিল ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন অশ্বারােহী বাহিনী নির্ভর। মাহমুদের অশ্বারােহী বাহিনী ক্ষিপ্রতার সাথে আক্রমণ করে আনন্দ পালের হস্তীগুলােকে ক্ষুব্ধ করে তুললে হস্তীর পদতলে নিজ বাহিনীর সদস্যরাই পিষ্ট হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
- (২) ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার অভাব : ভারতীয়দের মধ্যকার অনৈক্যও সুলতান মাহমুদকে সফলতা এনে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ভারতীয়রা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বর্ণভেদ প্রথার দ্বারা যেমন বিভাজিত ছিল, তেমনি রাজনৈতিকভাবে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রীয় সীমানা দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা সর্বশক্তি নিয়ােগ করতে সক্ষম হয়নি।
- (৩) ভারতীয়দের আলস্য : সুজলা সুফলা ভারতবর্ষ ছিল সম্পদে পরিপূর্ণ। এখানে মানুষ অল্প শ্রমে অধিক ফসল ফলাতে সক্ষম হতাে এবং বছরের এককালীন উৎপাদিত ফসল দ্বারা সারা বছর বসে বসে খেতে পারত। ফলে ভারতীয়রা কর্মবিমুখ ও অলস প্রকৃতির ছিল এবং তারা যুদ্ধ-বিগ্রহের চেয়ে সাহিত্য, শিল্পকলার প্রতি বেশী মনােযােগী ছিল। পাশাপাশি মুসলিম বাহিনীর লােকজন ছিল মরু ও পাহাড়ী অঞ্চলের। ফলে তারা ছিল কঠিন পরিশ্রমী এই জীবিকার জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে বা ঝুঁকি নিতে ছিল প্রস্তুত।
- (৪) মুসলমানদের ধর্মীয় উদ্দীপনা : নতুন ধর্ম ইসলামের নবশক্তিতে মুসলমানরা ছিল বলিয়ান। ধর্মের জন্য জেহাদে শামিল হওয়া, মৃত্যু হলে শহীদ হওয়া প্রভৃতি ধর্মীয় উদ্দীপনা মুসলমানদেরকে শক্তি যােগায়। অপরপক্ষে ভারতে এ ধরনের কোন মর্মবাণী অনুপস্থিত ছিল।
এ সকল কারণে সুলতান মাহমুদের অভিযানসমূহ সফল হয় এবং তিনি অপরাজেয় বীরের স্থান লাভ করেন। সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান নিষ্ফল ছিল না। ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি সতের বার ভারত অভিযান করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন –
- (১) রাজনৈতিক : ভারতীয় রাজনীতিতে সুলতান মাহমুদের অভিযানের প্রভাব যথেষ্ট লক্ষ করা যায়। যদিও কোন কোন ঐতিহাসিক এ অভিযান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন প্রভাব রাখেনি বলে মত প্রকাশ করেছেন, কিন্তু তা ঠিক নয়। কারণ, মাহমুদ পাঞ্জাবের উপর স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করে একদিকে যেমন ঐতিহ্যবাহী হিন্দুশাহী বংশের চির অবস্থান ঘটান, তেমনি তিনি কেবল আর গজনীর সুলতান থাকেন নি, পাঞ্জাবের সুলতান হিসেবে তিনি ভারতীয় নৃপতির মর্যাদার আসনও অলংকৃত করেন। সুদীর্ঘ দিনের জন্য পাঞ্জাব মুসলিম রাজ্যাধীন হয়ে পড়ে। তিনি এ অভিযানের মাধ্যমে ভারতের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির উপর চরম আঘাত হেনে নতুন এক বলিষ্ঠ রাজনীতির আগমনের সংকেত দেন। পরবর্তীতে সে পথ পরিক্রমায় ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসনের বিস্তার ঘটে। পাঞ্জাবে মুসলমানদের স্থায়ী অবস্থান এ বিস্তারকে সহজ করে দেয়। এখান থেকে মুসলমানরা ভারতের শাসকদের রাজনৈতিক ও সামরিক ত্রুটিসমূহ লক্ষ কমে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করতে সক্ষম হয়। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, “গযনভিদের পাঞ্জাব দখল ছিল ভারতের অভ্যন্তরে মুসলিম প্রবেশের চাবিকাঠি।”
- (২) অর্থনৈতিক : সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানে একদিকে তার স্বীয় অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত হয়, অন্যদিকে ভারতীয় অর্থনীতি অন্তঃসার শূন্যে পরিণত হয়। ভারতীয় রাজন্যবর্গ এ ধাক্কা আর কখনাে সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে তাদের প্রশাসনিক ও সামরিক শক্তি আরাে দুর্বল হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে গজনী সম্পদের পাহাড়ে পরিণত হয়। মুসলমানদের সামরিক শক্তি আরাে বৃদ্ধি পায়। ভারত থেকে আহরিত এ সম্পদ মাহমুদের মৃত্যুর আরাে অধিককাল পর পর্যন্ত মুসলমানদের শক্তি অক্ষুন্ন রাখতে সহায়ক হয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে অভিযানের মাধ্যমে সম্পদ আহরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, যা মুহম্মদ ঘুরীর অভিযানকালে মুসলিম সেনাদেরকে উৎসাহিত করে।
- (৩) ধর্মীয় : সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে মুসলমানদের বিস্ময়কর আবির্ভাব ও অপরাজেয় অগ্রাভিযান বহু হিন্দুকে ইসলাম ধর্মগ্রহণে উৎসাহিত করে। এমন সময় মুসলমানদের এ আগমন ঘটে যখন জাতিভেদ প্রথার কঠোরতায় ও ধর্মীয় বাড়াবাড়ির প্রেক্ষিতে নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা অতিষ্ঠ ছিল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোন পথ না পেয়ে এ শ্রেণীর মানুষই বহিঃআক্রমণের সময় দেশীয় রাজাদেরকে অসহযােগিতা করে। কালক্রমে তারা ইসলামের উদার মর্মবাণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং এদেশে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাঞ্জাবসহ পশ্চিম ভারতীয় এলাকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেছনে সুলতান মাহমুদের অবদান অনস্বীকার্য। সুলতান মাহমুদ পরাজিত হলে কিংবা পাঞ্জাবে প্রবেশ করতে না পারলে ভারতের ধর্মীয় অবস্থান হয়তাে অন্যরকম হতাে, সন্দেহ নেই।
- (8) সাংস্কৃতিক : সুলতান মাহমুদের অভিযান ভারতীয় সংস্কৃতির উপরও প্রভাব বিস্তার করে। হিন্দু-মুসলমানদের দীর্ঘদিনের সহাবস্থান হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির, বিশেষ করে, তুর্কী ও পারসিক সংস্কৃতির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির মিলন ঘটে। ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি গজনীতে সম্প্রসারিত হয়। হিন্দুরাও ইসলামিক রীতিনীতি সম্পর্কে অবহিত হয়। এতে রাজনৈতিক দূরত্ব না কমলেও মানসিকভাবে পরস্পর পরস্পরের কাছে আসে।
সুলতান মাহমুদের চরিত্র ও কৃতিত্ব
ভারতের ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। অসীম সাহস, রণকৌশল, দুর্দমনীয় তেজস্বিতা, অসাধারণ শৌর্য-বীর্য তাকে শ্রেষ্ঠ নৃপতিত্বের স্থান দান করে। তিনি সামানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র গজনীর অধিপতি থেকে নিজেকে ভারতবর্ষ ও মধ্য এশিয়ার নৃপতির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। তার সাম্রাজ্য পারস্য, খােরাসান, আফগানিস্তান, সিন্ধু ও পাঞ্জাব ব্যাপী বিস্তৃত ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি ভারতের অনেক দেশকে পদানত করে করদ রাজ্যেও পরিণত করেন। তিনি স্বীয় শক্তিতে বলীয়ান হয়েই এই বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ঈশ্বরী প্রসাদ যথার্থই বলেছেন যে, “একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য থেকে একটি বিশাল ও সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য গঠন করা কম বড় কথা নয়।”
বিজেতা হিসেবে : শ্রেষ্ঠ বিজেতা হিসেবে সুলতান মাহমুদের নাম বিশ্বের ইতিহাসে চির ভাস্মর হয়ে আছে। তিনি উত্তরাধিকারানুযায়ী গজনী নামক যে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি লাভ করেন, তা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ছিল না। যদিও তার পিতা স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করেন, প্রকৃতপক্ষে সামানিদ বংশ ছিল তার মালিক। কিন্তু মাহমুদ কেবল স্বাধীনতা ঘােষণা করে স্বাধীন রাজ্যই প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি সামানিদদের উৎখাত করে গােটা সামানি সাম্রাজ্য দখল করেন। এরপর তিনি একে একে খােরাসান, পারস্য, ইরাক, আফগানিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব, মুলতান দখল করেন। তিনি পাঞ্জাবসহ ভারতের অভ্যন্তরে সতের বার অভিযান চালান এবং প্রতিবারই জয়লাভ করেন। তিনিই প্রথম মুসলিম বিজেতা যিনি ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন। তিনি জীবনে কোন যুদ্ধেই পরাজিত হননি। বিজেতা হিসেবে তার এই অভূতপূর্ব সাফল্য শুধু সমসাময়িক বিজেতাদেরকেই নয়, পরবর্তী যে কোন দেশের ও যে কোন যুগের বিজেতাদেরকেই অবাক করে দেয়।
সৈনিক ও সেনাপতি হিসেবে : মাহমুদ ছিলেন আজন্ম সৈনিক। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার অসীম সাহসিকতা ও রণকৌশল প্রতিপক্ষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলত। অনবরত যুদ্ধ করতে তিনি কখনাে ক্লান্তবােধ করতেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে তার মনােবল তাকে সফলতার পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেত। সেনাপিত হিসেবে তিনি সৈনিকদেরকে যে কোন পরিস্থিতিতে সুশৃঙ্খল রাখতে সক্ষম হতেন। তার অসাধারণ সামরিক ও সাংগঠনিক প্রতিভা দ্বারা বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও জাতির সৈনিকদের সুসংগঠিত করে তিনি সেনাবাহিনীকে এশিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বি বাহিনীতে পরিণত করেন। তার যুদ্ধ পরিকল্পনা এত নিখুঁত ও বিজ্ঞান ভিত্তিক ছিল যে, শত্রুপক্ষ তা কল্পনাও করতে পারত না। অন্যদিকে তিনি শত্রপক্ষের দুর্বলতা ও যুদ্ধ কৌশল সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন এবং সে মােতাবেক আক্রমণ চালিয়ে যে কোন শক্তিকে সহজেই ফাঁদে ফেলতে পারতেন।
সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে : গজনী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান মাহমদ। তার পিতা সামানিদ সাম্রাজ্যের অধীন গজনী স্বাধীনভাবে শাসন করলেও তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করেননি কিংবা সুলতান উপাধিও গ্রহণ করেননি। মাহমুদই স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং সামানি বংশকে উৎখাত করে সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন। এভাবে তিনি স্বাধীন গজনী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু গজনীর মত ছােট্ট একটি রাষ্ট্র নিয়ে সন্ত্রষ্ট থাকার পাত্র মাহমুদ ছিলেন না। তিনি গােটা আফগানিস্তান এবং পার্শ্ববর্তী ইরান, খােরাসান, সিন্ধু, মুলতান, পাঞ্জাব প্রভৃতি দখল করে বিশাল গজনী সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। তৎকালীন বাগদাদের খলিফার এত বিশাল সাম্রাজ্য ছিল না। ছােট্ট পাহাড়ী গজনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তা এক বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করা তারই কৃতিত্ব।
রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে : গজনীর ইয়ামিনী রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান মাহমুদ। যদিও পিতা সবুক্তগীন গজনীতে রাজশক্তি অর্জন করেন, কিন্তু তিনি আইনত সামানিদ সুলতানের অধীন ছিলেন। সুলতান মাহমুদই এই বংশের প্রথম পুরুষ, যিনি প্রভু রাজবংশকে উৎখাত করে স্বাধীনা অর্জন করেন এবং সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন। তার স্বাধীনতা ঘােষণা ও সুলতানের উপাধি গ্রহণের মধ্য দিয়েই তার বংশ তথা ইয়ামিনী বংশ রাজবংশে উন্নীত হয়। এই বংশের অধিকাংশ সুলতান অযােগ্যতার পরিচয় দিলেও ১৬ জন সুলতান প্রায় দশ বছর শাসন করে গেছেন। এ বংশের সর্বশেষ সুলতান খশরু মালিক পাঞ্জাবে রাজত্ব করতেন এবং মুহম্মদ ঘুরী ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাকে পরাজিত ও বন্দী করে পাঞ্জাব দখল করলে এ বংশের অবসান হয়।
শাসক হিসেবে : সুলতান মাহমুদ কেবল অপারেজয় বীর ও সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, বিশাল সাম্রাজ্যে তিনি সুশাসন ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন। ভান ছিলেন উদারনৈতিক ও ন্যায় পরায়ণ শাসক। তার দক্ষ শাসন ব্যবস্থার জন্যই সাম্রাজ্যাধীন বিভিন্ন জাতি-গােষ্ঠি, ধর্ম-বর্ণের লােকরা ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করে। তার সাম্রাজ্যে কোন অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা ছিল না বলেই তিনি নিশ্চিন্তে সর্বশক্তি নিয়ে সতের বার ভারতে সফল অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হন। ভারতে এ সকল অভিযানের সময় গজনীতে তার বারংবার অনুপস্থিতি কখনাে কোন সমস্যার সৃষ্টি করেনি। এটা তার সুশাসনের প্রমাণ বহন করে। তার শাসন কাঠামাে যেমন ছিল পারস্য ভিত্তিক তেমনি আইন ছিল শরীয়ত ভিত্তিক। তার শাসন ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল প্রজামঙ্গল। প্রজাদের জান মালের হেফাজত করা ছিল তার প্রধান দায়িত্ব। প্রজারা যে ধর্মের বা জাতির হােক না কেন, তিনি তাদেরকে প্রজা হিসেবেই দেখতেন। ফলে সবাই সমান মর্যাদা ও সুযােগ-সুবিধা পেত। তার আহরিত অগণিত ধন-রত্ন তিনি ব্যক্তিগত ভােগ বিলাসে ব্যয় করেননি। এগুলাে তিনি রাষ্ট্রের কল্যাণে ব্যয় করেন এবং সকল শ্রেণীর প্রজাই তার সমান সুবিধা ভােগ করে সাচ্ছন্দ জীবন যাপন করে। তার সাম্রাজ্যে হিন্দু তথা বিধর্মীরা কখনাে অত্যাচারিত হয়নি। তারা জিজিয়ামুক্ত জীবন যাপন করত এবং স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করত। কাউকে কখনাে জোর পূর্বক তিনি ধর্মান্তরিত করেননি। হিন্দুদের প্রতি তার গভীর আস্থা ছিল। তার সেনাবাহিনীতে অনেক হিন্দু কর্মরত ছিল। ভারতে মন্দির ধ্বংস করায় কোন কোন ঐতিহাসিক তাকে হিন্দু বিদ্বেষী ও অসহিষ্ণু শাসক হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেও আধুনিক ঐতিহাসিকরা তার সাম্রাজ্যে, এমনকি, খােদ গজনীতে হিন্দুদের সুখে-শান্তিতে ও মর্যাদা সহকারে বসবাসের প্রেক্ষিতে ঐ সকল অভিযােগ মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। সুতরাং বলা যায় যে, তিনি সুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে সাম্রাজ্যকে যেমন সমৃদ্ধশালী করেন তেমনি ঐক্যবদ্ধ এক রাষ্ট্রীয় কাঠামােতে পরিণত করেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে : সুলতান মাহমুদ দিগ্বিজয়ী বীর ও সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেন, জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক হিসেবেও তেমনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে বহু কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ, ঐতিহাসিক গজনীকে এশিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেন। বিদ্বান ব্যক্তি যে ধর্মের বা বর্ণের হােক না কেন, মাহমুল নিকট সমাদর পেতেন। চার শতাধিক পণ্ডিত ব্যক্তি তার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে গজনীতে স্বর্ণ যুগের সৃষ্টি করেন বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়। তার চেষ্টায় গজনী শিক্ষা-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ পীঠস্থানে পরিণত হয়। ড. আঃ করিমের মতে “সুলতান মাহমুদ নিজে অশিক্ষিত ছিলেন কিন্তু তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং গুণের আদর করতেন”। সুলতান মাহমুদের রাজসভা যারা অলংকৃত করেছেন তাদের মধ্যে আবু রায়হান আল-বেরুনী, উৎবা, বৈহাকী, আল ফারাবী, ফেরদৌসী, আনসারী, কাকী, মিনুচেহরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। আবু রায়হান আল-বেরুনী ছিলেন একাধারে গণিত শাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ। সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও তার প্রবল বিচরণ ছিল। তার রচিত “কিতাবুল হিন্দ” ও “কানুন-ই-মাসুদী” থেকে ভারতের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। উৎবী ছিলেন ঐতিহাসিক, আল ফারাবী ছিলেন দার্শনিক, বৈহাকী ছিলেন শ্রেষ্ঠ আখ্যান রচয়িতা। বৈহাকীর “তারিখ-ই-সবুক্তগীন” নামক গ্রন্থ পাঠ করে ঐতিহাসিক Lanepool তাকে ‘Oriental pepys’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। আনসারী বা উনসারী ছিলেন মাহমুদের সভাকবি। সুলতান তাকে “মালিক-উস শূয়ারা” উপাধিতে ভূষিত করেন। এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন ফেরদৌসী। সুলতানের পরামর্শে তিনি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “শাহনামা” রচনা করেন। শাহনামা ফেরদৌসী ও সুলতান মাহমুদকে অমর করে রেখেছে। কথিত আছে, শাহনামা রচনার জন্য সুলতান মাহমুদ ফেরদৌসকে ৬০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু লেখা শেষে মাহমুদ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাকে ৬০,০০০ রৌপ্যমুদ্রা দিলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং মাহমুদকে ব্যঙ্গ করে একটি কবিতা রচনা করে গজনী ত্যাগ করেন। এতে মাহমুদের ভুল ভাঙ্গে এবং ৬০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা প্রেরণ করেন। কিন্তু উক্ত মুদ্রা যখন ফেরদৌসীর বাড়িতে পৌঁছে তখন ফেরদৌসীর মৃতদেহ দাফনের জন্য বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সুলতান মাহমুদের রাজত্বকালে তার প্রচেষ্টায় শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি শিক্ষা কার্যক্রমে অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। মূলত ভারত থেকে বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে তিনি যে অগণিত ধনরাজি আহরণ করেন তার এক উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি শিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করেন। তিনি গজনীতে একটি আন্তর্জাতিকমানের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার ও যাদুঘরটি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়টিরই নয়, গজনীরও শ্রীবৃদ্ধি করে। এছাড়াও বহু স্কুল, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তিনি শিক্ষার বিস্তার সাধন করেন। সুলতান মাহমুদের শিল্পকলা ও স্থাপত্যের প্রতিও বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ভবন, সৌধ, মসজিদ নির্মাণ করে গজনীকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন। তার নির্মিত Celestial Bride নামে অভিহিত মসজিদটি নির্মাণ কৌশলের এক অপূর্ব ধারা হিসেবে বিবেচিত হয়। যেকোন পর্যটকের নিকট তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এভাবে মাহমুদ শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনেও নিবেদিত প্রাণ ছিলেন।
ঘুরী বংশ
ঘুরী বংশের ক্ষমতায় আরোহন ও তদকালীন ভারতের রাজনৈতিক পটভূমি
ঘুরী বংশের উত্থান : ঘুরী বংশের উত্থান ভারত তথা এশিয়ার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হিরাত ও গজনীর মধ্যবর্তী ঘুর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এদের উত্থান ঘটে বলেই ইতিহাসে এ রাজবংশ ঘুরী বংশ নামে পরিচিত হয়। এই ঘুরী বংশের মুহম্মদ ঘুরীই ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১০ম শতকে এই অঞ্চলে যখন রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করতে থাকে তখন ঘুর রাজ্য নামে একটি স্বাধীন রাজ্যের বিকাশ ঘটে। সুলতান মাহমুদ ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে তা দখল করে নিলে সাময়িকভাবে এর বিকাশ বাধাগ্রস্থ হলেও তার দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে ঘুরীদের শক্তি আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং গজনীর সুলতানের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এ সময় গজনীর সুলতান বাহরাম ক্ষুব্ধ হয়ে ঘুরীদের উপর আক্রমণ চালায়। এতে ঘুরী বংশের শাহজাদা কুতুবুদ্দিন ও সাইফুদ্দিন নিহত হলে ঘুরীরা এর প্রতিশােধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় এবং ১১৫১ খ্রিস্টাব্দে ঘুরী বংশের অপর এক শাহজাদা আলাউদ্দিন হােসেন গজনী আক্রমণ করে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেন। সুলতান বাহরাম পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এভাবে আলাউদ্দিন হােসেন রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে স্বাধীন ঘুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। গজনীর সর্বশেষ উত্তরাধিকারী খসরুমালিক ঘুরীদের বিরুদ্ধে শেষবারের মত অস্ত্র ধারণ করে ব্যর্থ হয়ে পলায়ন করেন। এভাবে গজনী শাসনের অবসান হয় এবং ঘুর এলাকা শক্তির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। আলাউদ্দিন হােসেনের পর পুত্র সাইফুদ্দিন গজনীর সিংহাসনে বসেন কিন্তু তিনি অল্প কিছুদিন পরই তুর্কিদের হাতে নিহত হন। এরপর আলাউদ্দিনের পুত্র গিয়াসউদ্দিন সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দে নিজ ভ্রাতা মুইজউদ্দিন মােহাম্মদ সামকে “শিহাবউদ্দিন” উপাধি দিয়ে গজনীর শাসক নিয়ােগ করেন। গজনীর শাসনকর্তা হিসেবে শিহাবউদ্দিন যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে ভারত বিজয়ের পরিকল্পনা করেন। তার নেতৃত্বেই ভারতে তৃতীয় পর্যায়ের মুসলিম অভিযান পরিচালিত হয় এবং ভারতে তিনি স্থায়ী মুসলিম শাসন ব্যবস্থার বুনিয়াদ রচনা করেন। শিহাবউদ্দিন ভারতের ইতিহাসে মুহম্মদ ঘুরী নামে প্রসিদ্ধ।
মুহম্মদ ঘুরীর আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা : মুহম্মদ ঘুরীর আক্রমণকালে ভারতে কোন সুস্থ ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল না। সুলতান মাহমুদের আক্রমণের ফলে ভারতে যে বিধ্বস্ত অবস্থার সৃষ্টি হয় ভারতীয়রা তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অখণ্ড ভারত সাম্রাজ্য সৃষ্টি করার মত আর কোন ভারতীয় রাজারও আবির্ভাব ঘটেনি। এ সময় উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাঞ্জাব, মুলতান ও সিন্ধু- এই ৩টি মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। পাঞ্জাবে গজনীর শেষ সুলতান খসরুশাহ, মুলতানে শিয়া মতাবলম্বী কারামাতি বংশ এবং সিন্ধুতে সুমার বংশ শাসন করত। উত্তর ভারতে এ সময় কয়েকটি রাজপুত রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এগুলাে হলাে দিল্লী ও আজমীরের চৌহান রাজবংশ, কনৌজে গহড়বাল রাজবংশ, গুজরাটে বাঘেন রাজবংশ, বুন্দেলখণ্ডে চান্দেলা রাজবংশ। এছাড়া বাংলা ও বিহারে পাল ও সেনবংশের শাসন ছিল। এ সকল রাষ্ট্রের মধ্যে দিল্লী ও আজমীরের চৌহান রাজবংশ শক্তিশালী হলেও এ বংশের সর্বশেষ রাজা পৃথ্বিরাজের সাথে কনৌজের গহড়বালরাজ জয়চন্দ্রের ও বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলা রাজ পারমারদি দেবের বিরােধ ছিল। ফলে তারা মুহম্মদ ঘুরীর আক্রমণকালে পৃথ্বিরাজের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। এ সময় দক্ষিণ ভারতও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। যেমন- চালুক্য, চোল, পাণ্ড্য প্রভৃতি। এ সকল বংশের শাসন দীর্ঘদিন যাবৎ অব্যাহত ছিল। এদের মধ্যে চালুক্য বংশ শক্তিশালী হলেও ১২শ শতকের শেষের দিকে যাদব, কাকতীয় ও হােয়সল- এ তিনটি রাজ্যে তারা বিভক্ত হয়ে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কোন্দলে লিপ্ত হয়। ভারতের এরকম এক বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযােগে মুহম্মদ ঘুরী ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন।
মুহম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণ
কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, ঘুরীর ভারত আক্রমণ ছিল মধ্য এশিয়ায় তার সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যর্থতার ফল। তিনি ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষ দিগ্বিজয়ী বীর। তিনি গজনীর শাসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। তাই তিনি শক্তি সঞ্চয় করে প্রথমেই পার্শ্ববর্তী খােরাসান দখলের চেষ্টা চালান। কিন্তু শক্তিশালী খাওয়ারিজম শাহের হাতে তাকে বারবার পরাজিত হয়ে ফিরে আসতে হয়। মধ্য এশিয়ায় বারবার ব্যর্থতা তাকে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য দিক পরিবর্তন করতে হয় অর্থাৎ পূর্ব দিকে বিজয় অভিযান করে সাম্রাজ্য বিস্তারের সাধ মেটানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। আর এ সময়ের ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাকে ভারতে অভিযান চালাতে উৎসাহিত করে। তাছাড়া পাঞ্জাবে সুলতান মাহমুদের উত্তরাধিকারী খসরু মালিকের অবস্থান ঘুরীর জন্য নিরাপদ ছিল না। সুতরাং খসরু মালিককে দমন করে পাঞ্জাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিজ রাজ্যের জন্য একান্ত প্রয়ােজন ছিল। সবশেষে, এ কথাও বলা যায় যে, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান, তার সহজ জয়, প্রচুর ধন-রত্ন হস্তগত করা প্রভৃতিও ঘুরীকে ভারত আক্রমণে উৎসাহিত করে।
অভিযান : গােলান গিরিপথের মধ্য দিয়ে ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ ঘুরী। সর্বপ্রথম ভারতের দিকে অগ্রসর হন। এ অভিযানটি মুলতানের শিয়া ধর্মাবলম্বী কার্মাথিয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। কার্মাথিয়াদেরকে পরাজিত করে ঘুরী আরাে অগ্রসর হয়ে উঁচু দূর্গটি দখল করেন। তিনি নিজ মনােনীত একজন অনুচরের হাতে মুলতানের ভার অর্পণ করে গজনীতে ফিরে আসেন। ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার ভারত অভিযান করে গুজরাট আক্রমণ করেন। কিন্তু পরাজিত হয়ে কোনক্রমে আত্মরক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন। ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে ঘুরী পেশােয়ার দখল করেন এবং ১১৮১ খ্রিস্টাব্দে শিয়ালকোটে একটি দূর্গ স্থাপন করেন। ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে জম্বুর রাজা বিজয়দেবের সহযােগিতায় তিনি লাহাের আক্রমণ করে অন্যতম শত্রু গজনী বংশের শেষ সুলতান খসরু মালিককে পরাজিত ও বন্দী করে গােটা পাঞ্জাবের উপর নিজ প্রাধান্য বিস্তার করেন। ঘুরী যখন একের পর এক অঞ্চল দখল করে সমগ্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পঞ্চলের উপর প্রাধান্য স্থাপন করেন তখন দিল্লী ও আজমীরের চৌহান বংশীয় রাজা পৃথ্বিরাজও নিকটবর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য দখল করে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বি রাজপুত রাজাদেরকে দমন করতে শক্তি প্রয়ােগ করেন। এক্ষেত্রে বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলারাজকে তিনি পরাজিত করতে সক্ষম হলেও গুজরাট রাজের নিকট তিনি পরাজিত হন। এ সময় পাঞ্জাবের ওপর ঘুরীর আধিপত্য বিস্তৃত হলে পৃথিরাজ ঘুরীর শক্তি খর্ব করার জন্য প্রস্তুত হন। পাশাপাশি পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পৃথ্বিরাজের শক্তিবৃদ্ধিতে ঘুরীও তাকে দমন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন এবং সে লক্ষ্যে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে পৃথ্বিরাজের বিরুদ্ধে তিনি অগ্রসর হন। পৃথ্বিরাজও মুসলিম বাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। এছাড়াও জয়চাঁদ ব্যতীত প্রায় সকল রাজপুত রাজন্যবর্গ পৃথ্বিরাজকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। ফলে পৃথ্বিরাজ বিপুল শক্তি নিয়ে তরাইনের প্রান্তরে যুদ্ধে লিপ্ত হন। অবশেষে যুদ্ধে ঘুরী পরাজিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এ যুদ্ধ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ নামে পরিচিত। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজয় মুহম্মদ ঘুরী মেনে নিতে পারেননি। তিনি এর প্রতিশােধ নেয়ার জন্য আবার প্রস্তুত হন এবং পরের বছর অর্থাৎ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পৃথ্বিরাজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। পৃথ্বিরাজ এবারও এক বিশাল সেনাবাহিনীসহ রাজপূত রাজন্যবর্গের সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। ফলে এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ শোচনীভাবে পরাজিত হন এবং ধৃত হয়ে নিহত হন। অতঃপর ঘুরী দিল্লী ও আজমীর দখল করেন। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার তিনি তার বিশ্বস্ত অনুচর ও সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবকের হাতে অর্পণ করে গজনীতে ফিরে যান। ভারতে ঘুরীদের পরবর্তী অভিযান প্রধানত কুতুবউদ্দিনের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। কুতুবউদ্দিন এরপর একে একে মীরাট, রণথম্ভোর, কোয়েল, হানসী দখল করেন। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঘুরী জয়াচাঁদকে দমন করার উদ্দেশ্যে আবার ভারতে আসেন। চন্দওয়ার যুদ্ধে জয়াদ পরাজিত ও নিহত হলে কনৌজ ঘুরীর অধিকারে আসে। এরপর তিনি আরাে অগ্রসর হয়ে বেনারস দখল করে গজনীতে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় পর্যন্ত কুতুবউদ্দিন প্রভুর সাথেই ছিলেন। ঘুরীর প্রত্যাবর্তনের পর কুতুবউদ্দিন গুজরাট, কালিঞ্জর প্রভৃতি দখল করে উত্তর ভারতের বিশাল অংশ মুসলিম শাসনাধীনে আনেন।
বখতিয়ারের বিহার ও বঙ্গজয় : কুতুবউদ্দিন আইবক যখন উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল একের পর এক পদানত করতে ব্যস্ত তখন বিহার ও বাংলায় ইখতিয়ারউদ্দিন মােহাম্মদ বখতিয়ার খলজী বিস্ময়করভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় বাংলার সেনরাজা লক্ষণ সেনের অবস্থান ছিল নদীয়ায়। বখতিয়ার খলজী জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এক অশ্বারােহী বাহিনী নিয়ে এত দ্রুতবেগে অগ্রসর হন যে মাত্র সতের জন মতান্তরে ১৮ জন অনুসারীর সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। বাকী বিশাল বাহিনী পেছনে ছিল। বখতিয়ার আকস্মিকভাবে লক্ষণ সেনের দরবারের মূল ফটকে অশ্ব বিক্রেতার ভরবেশে উপস্থিত হয়ে দ্বার রক্ষীদের হঠাৎ আক্রমণ করে হত্যা করেন। এ সময় সক্ষণ সেন মধ্যান্ন ভােজে ব্যস্ত ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে নদী পথে বিক্রমপুর এসে আশ্রয় লাভ করেন। ইতােমধ্যে বখতিয়ারের মূলবাহিনীও এসে পড়ে। লক্ষণ সেনের বিশাল বাহিনী যারা শহরে প্রবেশের স্বাভাবিক পথে পাহারারত ছিল, তারা লক্ষণ সেনের প্রাসাদে বখতিয়ারের উপস্থিতি ও লক্ষণ সেনের পলায়নের কথা শুনে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রয়ােজনবােধ না করে সরে পড়ে। এভাবে ভারতে ঘুরীর অভিযান ও তার অনুচরবর্গ কর্তৃক একে একে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারত দখল প্রভৃতির মাধ্যমে ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১২০৩ খ্রিস্টাব্দে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গিয়াসউদ্দিন ঘুরী মারা গেলে মুহম্মদ ঘুরী বিশাল সুর সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরােহণ করেন। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক সংঘর্ষে খাওয়ারিজম শাহের নিকট পরাজিত হন। এ খবর পেয়ে মুলতান ও পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘােষণা করলে তিনি তা দমনের জন্য আবার ভারতের দিকে অগ্রসর হন এবং বিশ্বস্ত শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিনের সহায়তায় একে একে সকল বিদ্রোহ দমন করেন। বিদ্রোহ দমনের পর পাঞ্জাব থেকে গজনীতে প্রত্যাবর্তনের পর খােক্কার বংশীয় এক গুপ্তঘাতকের হাতে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হন।
মুহম্মদ ঘুরীর সাফল্যের কারণ
মুহম্মদ ঘুরী সুলতান মাহমুদের ন্যায় প্রতিটি অভিযানে সফল হতে না পারলেও ভারত বিজয়ে মুসলমানদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেন। ঘুরী ভারতীয় রাজন্যবর্গের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হলেও পরাজয় তাকে হতােদম করতে পারেনি, বরং পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে তিনি আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। তিনি ভারতের প্রধান শক্তিসমূহকে ধ্বংস করেন এবং অন্যান্য শক্তিসমূহকে পদানত করার জন্য উপযুক্ত সেনানায়কের উপর সে দায়িত্ব অর্পণ করেন। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত তিনি ঘুরী সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। মুহম্মদ ঘুরীর এই সাফল্যের কারণসমূহ হলো –
- (১) মুহম্মদ ঘুরীর যুদ্ধনীতি অত্যন্ত উন্নত ছিল। যদিও সে সময় ভারতে হিন্দুদের শক্তিও কম ছিল না এবং মুহম্মদ ঘুরী গুজরাটের যুদ্ধে এবং প্রথম তরাইনের যুদ্ধে হিন্দুদের হাতে পরাজিত হন। কিন্তু দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরী অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যেভাবে বিশাল হিন্দু বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন, তাতে মুহম্মদ ঘুরীর উন্নত ধরনের সেনাপতিত্ব এবং রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। অল্প সংখ্যক রিজার্ভ সৈন্য নিয়ে তিনি শেষ মুহূর্তে দিল্লী এবং আজমীরের চৌহান বংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বিরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন।
- (২) মুহম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণকালে ভারতে অনেকগুলাে স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই রাজ্যগুলাের মধ্যে কোন রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না বললেই চলে। সামন্ত রাজাগণ সর্বদা একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। তাই জাতীয় বিপদের সময় তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আক্রমণকারীদের মােকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। তাদের অনৈক্য ও পারস্পরিক সংঘর্ষই মুহম্মদ ঘুরীকে ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে, সে সময়ে ভারতে রাষ্ট্রীয় ঐক্যকে রক্ষা করার জন্য কোন সার্বভৌম রাজশক্তি ছিল না।
- (৩) মুসলিম সেনাবাহিনীর গঠনপ্রণালী এবং যুদ্ধনীতি ভারতীয় সেনাবাহিনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর ছিল। মুসলমানদের মধ্যে কোন জাতিভেদ প্রথা বা বর্ণবৈষম্য ছিল না। সেনাবাহিনীও গঠিত হত সাহস, বীরত্ব এবং সদ্গুণের ভিত্তিতে। মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রধান শক্তি ছিল তাদের অশ্বারােহী বাহিনী। অশ্বারােহী বাহিনীর সাহায্যে তারা দ্রুতগতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারত। ঐতিহাসিক ড. নিজামীর মতে, “গতি ছিল তুর্কি সেনাবাহিনীর প্রধান হাতিয়ার, সেই যুগ ছিল ঘোড়ার যুগ”। মুসলিম সৈনিকদের ক্ষিপ্রতা তাদের জয়ের প্রধান কারণ ছিল। মােহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর ক্ষিপ্রগতির ফলেই বাংলা ও বিহার বিজিত হয়। অপরপক্ষে, ভারতীয়দের সামরিক পদ্ধতি ছিল যেমন প্রাচীন, তেমনি অকার্যকর। হিন্দুরা চিরাচরিতভাবে হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধ করত। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে মন্থর হস্তীবাহিনী ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন অশ্বারােহী বাহিনীর সঙ্গে সুবিধা করতে পারত না। হিন্দু সেনাবাহিনীতে কর্মদক্ষতারও অভাব ছিল। ফলে তারা সংঘবদ্ধভাবে মুসলিম আক্রমণ প্রতি করতে ব্যর্থ হয়।
- (৪) ভারতে মুসলমানদের সাফল্যের অপর কারণ হলাে মুসলিম শক্তির নবজাগরণ এবং ধর্মীয় উদ্দীপনা। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিতে ইসলাম ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের সাথে তাদের আত্মমর্যাদার প্রশ্নও জড়িত ছিল। শতশত মাইল দূরে যুদ্ধ করতে এসে মুসলমান সৈন্যদের সামনে দুটি পথ খােলা থাকত – জয় অথবা মত্যু, পলায়নের কোন পথ তাদের ছিল না। ফলে তারা মৃত্যুপণ করে যুদ্ধ করত। তারা মনে করত, মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী। সুতরাং এ দুটির যেকোন একটা অর্জন করা ছিল দুর্লভ মর্যাদার অধিকারী হওয়া। অপরপক্ষে, হিন্দুদের মধ্যে অনুরূপ কোন ধর্মীয় আবেগ বা প্রেরণা ছিলনা। সুতরাং ধর্মীয় প্রভাব ও অনুপ্রেরণা ভারতবর্ষে মুসলমানদের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল, তা বলা যায়।
মুহম্মদ ঘুরীর চরিত্র ও কৃতিত্ব
বিশ্বের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুহম্মদ ঘুরীর নাম অন্যতম। ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের মুসলমানদের প্রচেষ্টা সফল করে তিনি ভারত তথা এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম স্থান অধিকার করে আছেন। গজনী ও হিরাতের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র ঘুর রাষ্ট্রটির সিংহাসনে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গিয়াসউদ্দিন আরােহণ করলেও ভাইয়ের অধীনে গজনীর শাসনকর্তা হিসেবে মুহম্মদ ঘুরী একের পর এক ভারতে অভিযান চালিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্র কেবল দখলই করেননি, সেখানে স্থায়ী মুসলিম শাসনও প্রতিষ্ঠা করেন। স্বীয় ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা, সাহসিকতা ও রণনৈপুণ্যতার দ্বারা তিনি সাম্রাজ্যের সুলতান না হয়েও নিজেকে শীর্ষ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেন। তার অসীম ধৈৰ্য্য, অধ্যবসায় তাকে এই উন্নতির চরম শিখরে আরােহণ করতে সাহায্য করে।
সেনাপতি হিসেবে : সেনাপতি হিসেবে মুহম্মদ ঘুরী সুলতান মাহমুদের সমকক্ষ না হলেও রণক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। বিশাল ঘুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও ভারতের স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা তিনি নিজ বাহু বলেই করেন। তিনি নিজের হাতে ও নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং নিজে সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে বিজয় বাসনা সফল করেন। সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ জয়ের অদম্য স্পৃহা তার মাঝে নেশার মত কাজ করত। তাই কোন পরাজয়ই তাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। মধ্য এশিয়ায় বারংবার ব্যর্থতা সত্ত্বেও তিনি গজনীর শাসনকর্তা তথা ঘুর রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। প্রয়ােজনে তিনি দিক পরিবর্তন করেছেন এবং ভারতের দিকে নজর দিয়েছেন। ভারতের গুজরাট ও তরাইনের প্রথম যুদ্ধে তিনি পরাজিত কিন্তু হতােদ্যম হননি। ফলে তরাইনের প্রান্তরে আবার উপস্থিত হন এবং তৎকালীন ভারতের শক্তিশালী পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে এবং দিল্লী ও আজ দখল করে তরাইনের প্রথম যুদ্ধের কেবল প্রতিশােধই নেননি, সেনাপতিতে সার্থকতারও স্বাক্ষর রাখেন। উপরন্তু তিনি দীর্ঘদিনের হিন্দু-মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি স্থায়ী সমাধান দান করেন। তিনি ত্রিশ বছর যাবৎ যুদ্ধ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে ১২০৩ সালে ভ্রাতার মৃত্যুতে তিনি ঘুর সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়েও নিজে যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বিরত থাকেননি, এমনকি, ভারতে তার শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন আইবক থাকা সত্ত্বেও মুলতান ও পাঞ্জাবের বিদ্রোহ দমনে তিনি নিজে আবার ভারতে আসেন এবং কঠোর হস্তে তা দমন করেন। শেষ বয়সে এসেও এমনিভাবে সুদূর মুলতান ও পাঞ্জাবে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা ও বিদ্রোহ দমন করা সেনাপতি হিসেবে তার অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচায়ক।
সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে : ঘুর সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুহম্মদ ঘুরী। ঘুর সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতিকালে ভ্রাতা গিয়াসউদ্দিন সুলতান থাকলেও তিনি এক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই রাখেননি। ঘুরী একাই এ কার্য সম্পন্ন করেন। গজনীর অধীন ক্ষুদ্র পাহাড়ী ঘুর জনপদটি তিনি নিজ প্রচেষ্টায় একের পর এক পার্শ্ববর্তী অঞ্চল আক্রমণ ও দখল করে বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করেন, এমনকি, ভারতও দখল করে ঘুর সাম্রাজ্যের সীমা, মর্যাদা ও গুরুত্ব আরাে বৃদ্ধি করেন। ঘুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ করতে গিয়ে তিনি গজনীর ইয়ামিনী বংশ ও দিল্লী-আজমীরের চৌহান বংশের চির অবসান ঘটান। ভারতে দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা মুহম্মদ ঘুরীকে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অমর করে রেখেছে।
শাসক হিসেবে : মুহম্মদ ঘুরী কেবল বিজেতা ও সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, সুশাসকও ছিলেন। তিনি বিজিত অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও মানুষের জীবন মানের উন্নতির চেষ্টা করেন। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন উদার। তার কোন সন্তান ছিল না, তাই জনগণকেই তিনি সন্তান হিসেবে ভালবাসতেন এবং তাদের সার্বিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করতেন। ভারতে তান অবস্থান করেননি এবং কুতুবউদ্দিনের উপর ভারত শাসনের দায়িত্ব দিয়ে গজনীতে চলে যান। তাই ভারতের শাসন কাঠামো কুতুবউদ্দিনই গড়ে তোলেন।
মানুষ হিসেবে : মানুষ হিসেবে মুহম্মদ ঘুরী ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন খোদাভক্ত, ন্যায়পরায়ণ, দাতা, দয়ালু, বিশ্বাসী, বিনয়ী। সাম্রাজ্যের শীর্ষ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভ্রাতা সুলতান গিয়াসউদ্দিনের প্রতি সর্বাত্মকভাবে অনুগত ছিলেন। তিনি যেমন ভাইয়ের নির্দেশ কখনাে অমান্য করেননি, তেমনি ভাইয়ের নিকট হতেও তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেন। তিনি যেমন বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি একটা বিশ্বাসী অনুচর শ্ৰেণীও গড়ে তুলতে সক্ষম হন। অনুচরবৃন্দই ছিল নিঃসন্তান ঘুরীর উত্তরাধিকারী। তারা বিশ্বস্ততার সাথে ঘুরীর নির্দেশ পালন করেন। ঘুরীর বিরুদ্ধে কোন নির্দয়তা বা নির্মমতার অভিযােগ পাওয়া যায় না। তিনি সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু পরাজিত বা বন্দীদের উপর কখনাে অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন করেননি। তিনি অতি সাধারণভাবে জীবন যাপন করতেন। বিলাসিতা তিনি কখনাে পছন্দ করতেন না। এসকল গুণের জন্য ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন।
তথ্যসূত্র
- V.D. Mahajan, The Sultanate of Delhi
- V.D. Mahajan, Ancient India
- Stanley Lane-Poole, Mediaeval India Under Mohammedan Rule (A.D. 712-1764)
- A. L. Srivastava, The Sultanate of Delhi
- Iswari Prasad, History of Medieval India
- V. A. Smith, Oxford History of India
- ডঃ আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন
- দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : প্রাচীনকাল থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, দিলীপ কুমার সাহা, মোল্লা আমীর হোসেন, সৌরভ প্রকাশনী, ২০১৬, পৃ. ২৫৩-২৯৯
Leave a Reply