Table of Contents
নব্যপিথাগোরীয়বাদ
নব্যপিথাগোরীয়বাদের উদ্ভবের ক্ষেত্র ও বুদ্ধি-প্রজ্ঞার চেয়ে সজ্ঞা-অনুভূতিতে গুরুত্বারোপ
সুস্পষ্ট দার্শনিক আন্দোলন হিসেবে পিথাগােরীয়বাদ বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকের পর এর বিলােপ ঘটে । এভাবে প্রায় দেড়শ বছর পর্যন্ত অবলুপ্ত থাকার পর খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের দিকে পিথাগােরীয়বাদ পুনরায় একটি প্রভাবশালী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের মধ্যেই তা পুনরায় দার্শনিকভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। এই নব্যপিথাগোরীয়বাদের প্রেরণার উৎস ছিল আদি পিথাগােরীয়বাদ। তবে প্লেটোবাদ ও সমকলীন স্টোয়িকবাদ থেকেও তা যথেষ্ট প্রেরণালাভ করেছিল। দার্শনিক মত হিসেবে পিথাগােরীয়বাদের এই পুনরুজ্জীবন আলেকজান্দ্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। সেখান থেকে তা রােমের দিকে বিস্তারলাভ করে। প্রথমদিকের নব্যপিথাগোরীয়দের মধ্যে এপােলােনিয়াস ও মডারেটাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে প্রাচ্যদেশসমূহ থেকে রােমে যেসব ধর্মমত প্রবেশ করতে থাকে, পরবর্তী চারশ বছরের মধ্যে সেগুলাে সারা রােমান সাম্রাজ্যে বিস্তারলাভ করে। অর্ফিক পিথাগােরীয় ধর্মমতের পুনরুজ্জীবন ছিল তারই এক বিশেষ প্রকাশ। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রাচীন রােমের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল এক রূঢ়, ব্যবহারিত মানসিকতার ওপর। এ জন্যই তা ধর্মপ্রাণদের সন্তুষ্ট করতে পারে নি। রােমান ধর্মে মুক্তির কোন ফলশ্রুতি ছিল না। দুঃখ-ক্লেশের অবসান এবং আত্মার অমরতের আশাও তাতে ছিল অনুপস্থিত। অশুভের বিরুদ্ধে শুভের সংগ্রামের পক্ষে তা কোনাে প্রেরণা যােগাতে পারেনি। স্রষ্টার সঙ্গে মানবাত্মার নিকট যােগাযােগের সম্ভাবনাসূচক ইঙ্গিতও তাতে ছিল না। এসব কারণে রােমান ধর্ম ক্রমশই অনুসারীদের আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং রােমান সাম্রাজ্যের অধীনেই এই ধর্মের প্রতি মানুষ ক্রমবর্ধমানভাবে অনীহা প্রদর্শন করতে থাকে। প্রচলিত ধর্মমতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার এবং ধর্মবিরোধী শক্তিসমূহকে অবদমিত করার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অব্যাহত চেষ্টা সত্ত্বেও কোনাে ফল হয় নি। বিরােধী প্রাচ্য মতসমূহকে কোনােমতেই দমিয়ে রাখা সম্ভব হলাে না। কেননা মুক্তি, অমরত্ব, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সরাসরি যােগাযােগ, অশুভের বিরুদ্ধে শুভের গামে সহায়তা প্রভৃতি যা প্রাচীন ধর্ম দিতে পারে নি, নতুন বিরােধী মতগুলােতে প্রত্যেকটিরই প্রতিশ্রুতি ছিল। তাছাড়া ধর্মমতগুলােকে উপস্থাপিত করা হয়েছিল চিত্তাকর্ষকভাবে। ফলে সাধারণ মানুষ অতি সহজেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠে।
এসব ধর্মীয় আন্দোলনের প্রভাবে যে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি, তার যে এক বিশেষ ধর্মতাত্ত্বিক ও মরমি রূপ থাকবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আবার বিচার-বিশ্লেষণের একতরফা আত্যন্তিক প্রয়ােগের ফলে সংশয়বাদ ও স্টোয়িকবাদে বুদ্ধির কার্যকারিতা সম্পর্কে যে নৈরাশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল নতুন দার্শনিক মতাবলম্বীদের মধ্যেও তার প্রভাব দেখা যায়। পারমার্থিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা বিচার-বিশ্লেষণের চেয়ে অনুভূতি বা স্বজ্ঞাকেই অধিকতর ফলপ্রসূ বলে গ্রহণ করেন। তবে এ কথাও বলে রাখা ভালাে যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বজ্ঞার সমর্থন করা সত্ত্বেও নতুন মতের সমর্থকেরা যুক্তিবিচারের বিরােধী ছিলেন না। প্রজ্ঞার সমর্থনের ভিত্তিতে তারা এমন এক সূক্ষ্ম অধিবিদ্যার পত্তন করেছিলেন, যার অভীষ্ট লক্ষ ছিল পরমসত্তা। যুক্তিবুদ্ধি যখন তার সীমিত শক্তিতে কতিপয় জটিল তত্ত্বীয় সমস্যা সমাধানে অপারগ বলে বিবেচিত হয়, তখনই শুধু পরমসত্তাকে জানার প্রচেষ্টায় বিচার-বিশ্লেষণের স্থলে অনুভূতির, প্রজ্ঞার স্থলে স্বজ্ঞার সাহায্য নেয়া হয়। এ পর্যায়ে জ্ঞাতা মরমি অভিজ্ঞতার সাহায্যে পরমসত্তার এমন এক অপরােক্ষ প্রতীতি লাভ করে যাকে জ্ঞান না বলে অনুভূতি বলাই সঙ্গত।
ধর্ম প্রভাবিত অন্যান্য দর্শনের মতো-পিথাগােরীয়গণ তাদের নেতাদের দৈব শক্তিসম্পন্ন শিক্ষক বলে শ্রদ্ধা এবং পিথাগােরাসকে সত্য ও জ্ঞানালােকের উৎস বলে বিশ্বাস করতেন। বস্তুত, পিথাগােরাসকে কেন্দ্র করে যেসব উপকথা ও ঐন্দ্রজালিক শক্তির অবতারণা করা হয় এবং পিথাগােরাসকে যেসব কারণে ঈশ্বরের অবতারের মর্যাদা দেয়া হয়, নব্যপিথাগোরীয়বাদেই এসবের সূত্রপাত। নব্যপিথাগোরীয়গণ তাদের অনুপ্রেরণার জন্য পিথাগােরাসের ওপর যতটুকু নির্ভর করেছেন, প্রায় ততটুকুই নিভর করেছেন প্লেটোর ওপর। বস্তুত, নব্যপিথাগোরীয়বাদ প্লেটোর পুনরুজ্জীবনস্বরূপ। যেমন, প্লুটার্কের চিন্তায় প্লেটোর প্রভাব এত বেশি ছিল যে, আমরা তাকে পিথাগােরীয়দের চেয়ে প্লেটোর দ্বারাই বেশি অনুপ্রাণিত এবং নব্যপ্লেটোবাদের বিস্তারের পেছনে এক বড় অনুপ্রেরণা বলে মনে করতে পারি। অধিকন্তু, তিনি ছিলেন প্রথম দার্শনিক যিনি অনুধ্যানমূলক দর্শনের পুনরুজ্জীবনের এক বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেন এবং এর তিন উপকরণের একত্ববিধান করেন। নব্যপিথাগােরীয়বাদের যেসব সাধারণ বৈশিষ্ট্যের এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেগুলাের প্রায় সবগুলােই তার বেলায় প্রযােজ্য।
নব্যপিথাগোরীয়বাদে বিশ্বতত্ত্ব, আত্মা, নীতি ও দেবতা নিয়ে চিন্তাধারা এবং অন্যান্য দর্শনের প্রভাব
এসব নতুন দার্শনিক ভাবধারার পেছনে বিভিন্ন মতের প্রভাব থাকার ফলে তাদের স্বভাব ছিল মিশ্র, মৌলিক নয়। আর তাদের সিদ্ধান্তসমূহও ছিল ভিন্নধর্মী। যেমন, নব্যপিথাগােরীয়বাদে প্লেটো, এরিস্টটল ও স্টোয়িকবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যামান। প্রাচীন পিথারােগীয়গণ একত্ব ও বহুত্ব, যুগ্ম ও অযুগ্ম, সীমিত ও অসীমের মধ্যে যে পার্থক্য করেছিলেন এবং শুভ ও স্বর্গীয়কে উপরােক্ত বিরুদ্ধনীতিদ্বয়ের একটি এবং অশুভ ও জাগতিককে অপরটির নামান্তর বলে দেখাবার যে চেষ্টা করেছিলেন, নব্যপিথাগোরীয়গণ তা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের স্বভাব ও জীবজগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ে তাদের মধ্যে বেশ মতভেদ ছিল। স্টোয়িকদের অনুসরণ করে তাদের কেউ কেউ ঈশ্বরকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মা বা প্লেটোর বিশ্বাত্মা বলে কল্পনা করেছিলেন। অন্যেরা আবার ঈশ্বরকে জগৎ থেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন এবং অনেকটা এরিস্টটলের মতো কিংবা ‘টাইমীয়ুস’ গ্রন্থে প্লেটোর মতো জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছিলেন। অন্য কেউ কেউ আবার ঈশ্বরকে একটি মােনাড বলে কল্পনা করেন। তাদের মতে, একত্ব ও বহুত্ব, যুগ্ম ও অযুগ্ম, রূপ ও উপাদান – এ সবই মােনাড থেকে উৎপন্ন। একে নিছক বিচারবুদ্ধির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা চলে না। জগতের পরিচালক হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর একদিকে যেমন রূপ ও উপাদানের সংযােগ-বিধান করেন, অন্যদিকে একত্ব ও দ্বিত্বের সৃষ্টি করেন।
প্লেটো ও স্টোয়িকদের মতো নব্যপিথাগোরীয়গণ নক্ষত্ররাজিকে দেবতা বলে মনে করতেন। তারা জগৎকে সুন্দর ও পূর্ণ বলে মনে করতেন। আবার এরিস্টটলের মতো তারা জগৎকে নিত্য এবং মানবজাতিকে অনাদি বলে মনে করতেন। আত্মার স্বরূপ বিষয়ক তাদের মতের সঙ্গে প্লেটোর মতের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। প্লেটোর মতো তারাও মনে করতেন যে, আত্মার তিনটি অংশ রয়েছে। আত্মাকে তারা অমর ও অবিনশ্বর বলে মনে করতেন। তারা আত্মার প্রাক-জন্ম অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু পুনর্জন্মের ব্যাপারে নীরব ছিলেন। নব্যপিথাগোরীয়দের জ্ঞানতত্ত্বে প্লেটোর মতের প্রতিধ্বনি শােনা যায়। যেমন, প্লেটোর মতো তারা মনে করেন যে, সংবেদন থেকে অভিমতে এবং অভিমত থেকে বােধে (understanding) এবং বােধ থেকে বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার পর্যায়ে পৌঁছার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞানলাভ করা যায়। আবার প্লেটোর মতােই তারা ইন্দ্রিয়-জগৎকে প্রাজ্ঞিক জগতের অপূর্ণ রূপ বলে মনে করতেন। জগৎ কি কোনাে এক বিশেষ সময়ের সৃষ্টি (যেমন প্লেটো তার ‘টাইমীয়ুস’ গ্রন্থে বলেছিলেন) নাকি তা অসৃষ্ট ও অনন্ত (যেমন : এরিস্টটল বলেছিলেন), এটি বিতর্কিত বিষয় ছিল না।
নৈতিক আচরণের ভিত্তি হিসেবে নব্যপিথাগোরীয়গণ এক বিস্তৃত নৈতিক মতবাদ রচনা করেন। তবে প্লেটো ও এরিস্টটলের নৈতিক মতের বাইরে তারা নতুন কিছুই সংযােজন করেন নি। অনেকটা প্লেটোর মতােই তারা তাদের নৈতিক মতকে অর্ফিকদের কাছ থেকে পাওয়া এবং জগৎবিরােধী মানবমুক্তি মতবাদ দ্বারা পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করেন। সংসার ও রক্তমাংসের দেহকে তারা আত্মার শত্রু বলে মনে করতেন। তাদের মতে, ইন্দিয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা যখন তার স্বর্গীয় আদি নিবাসে প্রত্যাবর্তন করে, তখনই আসে মুক্তি। তাদের মতে, জীবন পরিশুদ্ধির জন্য দৈহিক আমােদ-প্রমােদ ও ভােগবিলাস বর্জন করা দরকার। তবে প্রাচীন পিথাগােরীয়দের মতাে তারা মাংসভক্ষণ ও মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন নি। তারা চিরকৌমার্য সমর্থন করতেন না। তাদের মতে, জৈবিক প্রয়ােজনের জন্য নয়, স্রেফ বংশবৃদ্ধির খাতিরেই যৌনক্রিয়া অনুমােদনীয়।
প্লুটার্ক (৪৮-১২০/২৫ খ্রি.)
বিখ্যাত চরিতাবলির রচয়িতা হিসেবে প্লুটার্কের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি আনুমানিক ৪৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসদেশের চেরােনিয়া নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এথেন্সে প্রথম গণিতশাস্ত্রে এবং পরে দর্শনে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি রােম সফর করেন। সেখানে তিনি ল্যাটিন ভাষা শেখেন এবং রােমান সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি হন। রােমে অবস্থানকালে তিনি বেশকিছু ভাষণদান করেন। এর ফলে চারদিকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১২০-১২৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনাে এক সময় তার মৃত্যু ঘটে। তিনি ছিলেন বহু গ্রন্থের প্রণেতা। সৌভাগ্যবশত পঞ্চাশটি জীবনচরিত ছাড়াও তার প্রায় তিরাশিটি পূর্ণাঙ্গ রচনা এবং আরাে চব্বিশটি রচনার অংশবিশেষ আজো সংরক্ষিত আছে। দর্শনে তার ব্যুৎপত্তি ছিল ব্যাপক ও অগাধ। এপিকিউরীয়দের তিনি অবজ্ঞার চোখে দেখতেন এবং স্টোয়িকদের অনেক কথা অপছন্দ করতেন। তিনি প্লেটো, এরিস্টটল ও পিথাগােরীয় দর্শনের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিলেন।
প্লুটার্কের মতে, একমাত্র ঈশ্বরই যথার্থ অস্তিত্বের অধিকারী। ঈশ্বর স্বয়ংসৃষ্ট, স্বচালিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিশুদ্ধ ও অবিভাজ্য একত্ব। ঈশ্বর মঙ্গলময় এবং তার মধ্যে ঈর্ষার কোনাে স্থান নেই। তিনি প্রজ্ঞাময় এবং সব জিনিসের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তবে এসব গুণ দ্বারা ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমরা শুধু জানতে পারি যে তিনি আছেন; কিন্তু আসলে তিনি যে কী, তা আমরা জানতে পারি না; কেননা তার অধিষ্ঠান ইন্দ্রিয়জগতের বহু ঊর্ধ্বে, মানুষের সীমিত বুদ্ধির ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঈশ্বরের মতো এত উচ্চ ও পবিত্র সত্তাকে জগতের অশুভ ও অপূর্ণতার জন্য দায়ী করা চলে না। পাপ ও শাস্তি, প্রতিকূল প্রাকৃতিক কার্যকলাপ এবং ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা ও সর্বশক্তিমত্তার মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য স্টোয়িকরা যে চেষ্টা করেছিলেন, প্লুটার্ক তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, ঐশ্বরিক সত্তা থেকে স্বতন্ত্র কোনাে জড়ীয় নীতি বা শক্তির সাহায্যে জাগতিক অপূর্ণতাকে ব্যাখ্যা করা চলে না; কেননা জড় অনেকটা কুমােরের হাতের কাদার মতাে। জড় থেকে নয়, বরং জড়ের যখন যে রূপ দেয়া হয়, সেটি থেকেই মঙ্গল অমঙ্গলের উৎপত্তি। অর্থাৎ অমঙ্গলের স্বরূপ ব্যাখ্যায় প্লুটার্ক ঈশ্বরের অতিরিক্ত একটি ২য় তত্ত্বের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। প্লেটো তার ‘লজ’ গ্রন্থে যা বলেছেন, তারই অনুকরণে প্লুটার্ক বলেন, জড় ছাড়াও অশুভ জগদাত্মা বলে একটি পৃথক সত্তা রয়েছে। স্বভাবগতভাবেই এই অশুভ জগদাত্মা ঈশ্বরবিরােধী এবং জগতের যাবতীয় অন্যায়-অশুভের ভিত্তি।
এও সম্ভব যে, অশুভ জগদাত্মা বিষয়ক মতবাদে প্লুটার্ক শুধু প্লেটোর ‘লজ’ গ্রন্থের যুক্তি দ্বারাই নয়, আহুরা মাজদা (শুভ শক্তি) ও আহরিমান (অশুভ শক্তি) নামে বিপরীত শক্তি নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত আছে বলে যে পারস্যদেশীয় মত প্রচলিত ছিল, মত দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। জগৎ অসৃষ্ট ও নিত্য বলে এরিস্টটল যে মতপোষণ করেছিলেন, প্লুটার্ক তা প্রত্যাখ্যান করেন। অনেকটা প্লেটোর মতের প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন, জগতের একটা সুনির্দিষ্ট শুরু রয়েছে এবং ঈশ্বরই একে কোনাে একসময় সৃষ্টি করেছেন। তবে এই সৃষ্টিকর্ম প্রত্যক্ষ নয়। নিজে সরাসরি সৃষ্টি না করে শুভ জগদাত্মার সাহায্যে ঈশ্বর জগৎসৃষ্টি করেছেন। শুভ ও অশুভ জগদাত্মা ছাড়াও আরাে কিছু শুভ ও অশুভ সত্তা রয়েছে। নক্ষত্ররাজি পরিচালনার জন্য কিছু দেবতা রয়েছেন, এবং তাদের অধঃস্থন এমন আরাে কিছু দেবদূত রয়েছেন যারা ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী। তাদের মাধ্যমেই ঈশ্বর ও ঈশ্বরের পরবর্তী দেবতাগণ জগতের নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন এবং তাদেরকেই পাপীদের শাস্তি ও পুণ্যাত্মাদের পুরস্কারপ্রদানের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এসব ডেমন বা দেবতাদের কেউ কেউ মানুষের মতােই স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী, এবং মানুষের মতােই তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে আবার ভালাে মানুষের পক্ষে দেবত্বলাভ সম্ভব। মানবাত্মা শুভ ও অশুভ জগদাত্মা থেকে যথাক্রমে শুভ ও অশুভ শক্তি পেয়ে থাকে। এসব শক্তি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মানবাত্মার নিজের। অশুভ জগদাত্মা থেকে আসে ইন্দ্রিয় ও দৈহিক কামনা বাসনা ইত্যাদি; আর শুভ জগদাত্মা থেকে আসে উচ্চতর প্রজ্ঞা, যা মানুষের মধ্যে দেবতাস্বরূপ। প্লেটোর মতো প্লুটার্কও নিম্নতন আত্মাকে বীর্য (spirit) ও অন্ন (appetition) – এ দু’ভাগে বিভক্ত করেন। মৃত্যুতে আত্মার প্রজ্ঞাংশ দেবদূতের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয় এবং অনন্তকাল ধরে তাদের সঙ্গেই অবস্থান করে, কিংবা পূর্বজন্মের অশুভ কর্মের ফলে পুনরায় মানবদেহে প্রবিষ্ট হয়। দুষ্ট লােকের আত্মা পরবর্তী জন্মে ইতরপ্রাণীর রূপ নিতে পারে। প্লুটার্ক আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন।
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর প্লুটার্ক যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করেন। স্বাধীন ইচ্ছা অস্বীকার করার জন্য তিনি এপিকিউরীয়দের তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি স্টোয়িকদের নিয়ন্ত্রণবাদের বিরােধী ছিলেন। বিশেষ করে, তিনি ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তার সঙ্গে অশুভ অস্তিত্বের সমন্বয়বিধানের সমালােচনা করেন। প্লুটার্ক মনে করতেন যে, মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী; সুতরাং মানুষের যাবতীয় দুঃখ-ক্লেশের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। নিম্নতন প্রবৃত্তির চাপে মানুষ যা করার ইচ্ছা অনুভব করে, উচ্চতর প্রজ্ঞার সাহায্যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষের রয়েছে। যারা এই ক্ষমতার ব্যবহার করেন তারাই পুণ্যাত্মা, আর যারা তা না করে দৈহিক শক্তির চাপে কুকর্মে লিপ্ত হয়, তারাই পাপী। প্লুটার্ক তার নৈতিক মতবাদে এরিস্টটলের অনুসারী ছিলেন। তার মতাবলি এরিস্টটলের ‘নিকোম্যাকীয় এথিকস’ থেকে প্রাপ্ত । তিনি এপিকিউরীয়দের স্বাধীন ইচ্ছা অস্বীকৃতির যেমন বিরােধিতা করেন, তেমনি একমাত্র সুখই শুভ বলে তাদের মতের বিরােধী ছিলেন। আবার সুখ বাহ্যশুভ, এবং মানুষের আনন্দের সঙ্গে দৈহিক কার্যকলাপের কোনাে সম্পর্ক নেই বলে স্টোয়িকদের ধারণাও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে এসব জিনিস আমাদের জন্য অনাবশ্যক নয়; সুতরাং এদের উপেক্ষা করে যথার্থ আনন্দ পাওয়া যেতে পারে না। শুভ ও উন্নত জীবনের পক্ষে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা আবেগ অনুভূতি ইত্যাদি প্রয়ােজনীয়; কেননা এগুলােও মানবপ্রকৃতির আবশ্যিক উপাদান।
এরিস্টটলের সুরে সুর মিলিয়ে প্লুটার্ক বলেন, মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব। সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেক বিরত থেকে নয়, বরং এসব কাজে অংশগ্রহণ করেই মানুষ তার যথার্থ কর্মক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে। মানুষের মহৎ কাজ বা পেশার মধ্যে রাজনীতি অন্যতম। কর্তৃত্বের অধিকার যাদের দেয়া হয় তাদের দায়িত্বও অনেক। নিঃস্বার্থভাবে ও কায়মনােবাক্যে সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাওয়া তাদের কর্তব্য। প্লুটার্কের মতে, বিভিন্ন প্রকার সরকারের মধ্যে রাজতন্ত্রই সর্বোত্তম। তবে রাজার পক্ষে ঈশ্বরের সেবক ও প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা উচিত। নিছক শুভকর্মে নয়, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতায়ই মানুষের প্রকৃত শান্তি ও মুক্তি নিহিত। এই ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বা ঐশ্বরিক জ্ঞানের ওপর নাস্তিকতার প্রভাব নিতান্তই ধ্বংসাত্মক, নাস্তিকতা মানবপ্রকৃতির আধ্যাত্মিক দিকটিকে দেউলিয়া করে দেয়। তার মতে, নাস্তিকতার মতো কুসংস্কারের প্রভাবও ক্ষতিকর। প্লুটার্কের মতে, প্রচলিত ধর্মতত্ত্বে বর্ণিত গল্প ও উপাখ্যানসমূহে ঈশ্বর ও দেবদেবীদের সম্পর্কে বহু কুসংস্কার বিদ্যমান। এমনিতে বহু-ঈশ্বরবাদের সঙ্গে প্লুটার্কের কোনাে বিবাদ নেই। তার মতে, প্রকৃত অর্থে ঈশ্বর এক। তিনি সব মানুষ ও সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা। তবে তিনি নিজেকে নানাভাবে ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন দেবদেবী ঈশ্বরেরই অভিব্যক্তি। জুপিটার, এপােলাে প্রভৃতি দেবতা একই ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম, এবং একই ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ। প্রচলিত ধর্মে বর্ণিত অতিপ্রাকৃত দৈববাণী ও সত্যকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমরা যখন ঘুমে বিভাের থাকি তখন আমাদের আত্মা দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে স্বর্গীয় জগৎ থেকে দৈববাণী পেতে পারে। জাগ্রত জীবনেও কৃত্রিম উপায়ে দেহ থেকে মুক্ত হয়ে আত্মার পক্ষে দৈববাণী পাওয়া সম্ভব। আর এই অবস্থায় ডেলফি ও অন্যান্য দৈববাণীপীঠের অধিষ্ঠাতা এক একজন ‘ডেমন’ তার নির্বাচিত পুরােহিতের মুখ দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন।
পরবর্তী নব্যপিথাগোরীয় দর্শন
প্লুটার্কের পরবর্তী বিখ্যাত দার্শনিক টাইর-এর ম্যাক্সিমাস (খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষ দিক)। তিনি ২য় খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধে দর্শন প্রচার করেন। সাধারণ রূপরেখার দিক থেকে তার মতের সঙ্গে প্লুটার্কের মতের খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। তবে এরিস্টটল যে বিশুদ্ধ প্রজ্ঞাকে দৈব সত্তার নির্যাস বলে বর্ণনা করেছিলেন, তিনি সেটিকে ঈশ্বর বলে বর্ণনা করেন। প্লুটার্কের মতো তিনি কোনাে অশুভ বিশ্বাত্মার অবতারণা করেন নি। তার মতে, জড়ই বিশ্বের অশুভ ও অপূর্ণতার কারণ। প্রজ্ঞার বিধান অমান্য করে নিছক প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করা থেকেই পাপের সৃষ্টি। আত্মা স্বর্গীয় সত্তার স্ফুলিঙ্গবিশেষ। ক্ষণিকের জন্য দেহের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলেও সৎকার্যের ফলে পরিণামে আত্মা তার তার আদি স্বর্গীয় নিবাসে ফিরে যেতে পারে। ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী বেশকিছু দেবদেবী রয়েছেন। তারা মানুষের স্বর্গীয় অভিভাবক ও ঈশ্বরের সেবকের ভূমিকা পালন করে থাকেন।
ম্যাক্সিমাসের সময়ের অপর এক দার্শনিক এপুলেইয়াস (১২৪-১৭০ খ্রি.)। তিনি ‘মেটামরফসেস’ বা ‘সােনালী গর্দভ’-এর গল্পের জন্য বিখ্যাত। অধিবিদ্যায় তিনি ম্যাক্সিমাসের মতের সমর্থন করেন এবং এ মতের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেন। ঈশ্বর ও জড়ের মাঝখানে তিনি শুধু দেবদেবীদেরই নয়, প্লেটোর প্রত্যয়সমূহ ও প্রজ্ঞাকেও সন্নিবেশিত করেন। তার মতে, দেহের পিঞ্জর ও জগতের শৃঙ্খল থেকে আত্মার মুক্তিতেই প্রকৃত পরিত্রাণ নিহিত। প্লুটার্কের পরবর্তী অপর এক দার্শনিক হলেন আলবিনাস (১৫০ খ্রি.)। ঈশ্বর ও জগতের মধ্যবর্তী দেবদেবীদের স্বীকৃতি আলবিনাসেও দেখা যায়। তিনি দেবদেবীদের সঙ্গে বিশ্বাত্মা ও প্লেটোনিক প্রত্যয়সমূহকে সংযােজিত করেন। তার মতে, বিশ্বসৃষ্টি ঈশ্বরের নয় অধঃস্থন দেবদেবীদের কাজ। ঈশ্বর জড়জগৎ থেকে বহুদূরে থাকেন; সুতরাং তিনি জড়জগতের কোনাে কাজের সঙ্গেই সরাসরি জড়িত নন। প্লুটার্কের মতের বিরােধিতা করে এবং এরিস্টটলের মতের সমর্থনে আলবিনাস বলেন, কোনাে বিশেষ সময়ে জগৎ সৃষ্ট হয় নি, জগৎ অনাদি ও অনন্ত। প্লুটার্কের অন্য এক উত্তরসূরি আটিকাস (১৭৫ খ্রি.)। জগৎ এক বিশেষ সময়ে সৃষ্ট বলে তিনি মত পােষণ করেন। ম্যাক্সিমাস ও এপুলেইয়াস তাদের চিন্তায় যে বিশ্বাসকে বর্জন করেছিলেন, আটিকাস সে বিশ্বাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
নিউমেনিয়াস (খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষ ভাগ)
দার্শনিক আপামেয়ার নিউমেনিয়াসের দার্শনিক চিন্তায় এক নতুন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। তার রচনা চুরি করে নিজের বলে প্রচার করার দায়ে প্লোটিনাসকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। নিউমেনিয়াস ইচ্ছাকৃতভাবে নব্যপিথাগােরীয়বাদ ও নব্যপ্লেটোবাদের সমসাময়িক ভাষ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে তাদের আদি উৎসসমূহ থেকে অনুপ্রেরণালাভ করেন। কিন্তু তিনি দেখতে পান যে, প্লেটো ও পিথাগােরাস, এরা উভয়েই অতীতের জ্ঞানের সাধক ও চিন্তাবিদদের শিক্ষার ভাষ্যকার ছিলেন। মোজেসের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল প্রগাঢ়, এবং প্লেটোকে তিনি এই পয়গম্বরের যমজ সহােদর বলে মনে করতেন। কথিত আছে যে, যীশুর শিক্ষার প্রতিও তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তবে তার সঙ্গে তার সমসাময়িক পিথাগােরীয়-প্লেটোবাদী সিলাস-এর পার্থক্য ছিল। সিলাস ছিলেন স্টোয়িক নিয়ন্ত্ৰণবাদ ও প্রকৃতিবাদ দ্বারা প্রভাবিত, এবং তিনি খ্রিস্টধর্মকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং প্লেটোর মতের এক অভাবনীয় অধঃপতিত সংস্করণ বলে নিন্দা করেন।
নিউমােনিয়াসের দার্শনিক মত প্লুটার্কের মতের চেয়েও বেশি দ্বৈতবাদী ছিল। তিনি ঈশ্বরকে এরিস্টটলের প্রজ্ঞা, পিথাগােরীয়দের মােনাড এবং প্লেটোর শুভের ধারণার সমার্থক বলে মনে করেন। তার মতে, ঈশ্বর এতই উচ্চস্থানীয় এবং এতই দূরবর্তী যে, জগতের সঙ্গে তার কোনাে সম্পর্কই থাকতে পারে না। জগতের কার্যকলাপে ঈশ্বরের কোনাে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই, এবং জগৎসৃষ্টিতেও ঈশ্বরের কোনাে হাত নেই। জগতের সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ এক অধঃস্থ ২য় ঈশ্বরের কাজ। জগৎকে বলা চলে ৩য় ঈশ্বর । অর্থাৎ নিউমােনিয়াসের মতে, ঈশ্বরের সংখ্যা এক নয়, তিন। এরা হলেন : এক, পরমেশ্বর; দুই তারই সৃষ্ট সৃজনী ঈশ্বর; এবং তিন, সৃষ্ট জগৎ, ২য় ও ৩য় ঈশ্বরের স্বভাব দ্বৈত প্রকৃতির। বিশুদ্ধ স্পিরিট বা প্রজ্ঞা থেকে উদ্ভূত হলেও জড়ের সঙ্গে ২য় ঈশ্বরের সংযােগ রয়েছে। এই ২য় ঈশ্বরই হলেন জগতের অন্তর্নিহিত শুভ আত্মা। ৩য় ঈশ্বর স্বর্গীয় আত্মা ও জড়ের সংমিশ্রণ। তবে স্বর্গীয় আত্মার বিরােধী এক অশুভ শক্তি দ্বারা জড় পরিচালিত, এবং এ শক্তিই জগতের সব অপূর্ণতার জন্য দায়ী। সুতরাং তিনজন ঈশ্বরের সঙ্গে একজন ডেভিল বা অশুভ সত্তাকে যুক্ত করা আবশ্যক। মানুষ একাধারে আধ্যাত্মিক ও দেহধারী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাহীন বলে উভয় প্রকার (শুভ ও অশুভ) জগদাত্মার সঙ্গেই তার সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের সংগ্রাম অবিরাম চলছে, এবং এ নিয়েই তার নৈতিক জীবন গঠিত। তবে নিউমেনিয়াস তার নৈতিক মতের কঠোরতার সমর্থক নন। তিনি মনে করেন দৈহিক কার্যকলাপকে যেকোনাে অবস্থায়ই অশুভ বলা চলে না। প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত না হয়ে অযৌক্তিক ও অশুভ বিশ্বাত্মার শিকার হলেই কেবল তারা অশুভ। তবে এক উচ্চতর অবস্থা থেকেই আত্মার প্রজ্ঞাংশ দেহে প্রবিষ্ট হয়েছে। দেহের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে উচ্চতর স্বর্গীয় আদিআত্মায় প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই আত্মার মুক্তি বা পরিত্রাণ নিহিত। বিদেহী অবস্থা থেকে কয়েকবার দেহপ্রাপ্ত হওয়ার মাধমে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত হয়েই মানুষ চূড়ান্ত মুক্তিলাভ করতে পারে। প্রজ্ঞার বিধান অনুসারে কাজ করা এবং ঈশ্বরের সঙ্গে যােগাযােগ রাখাই আমাদের বর্তমান জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
হার্মিসীয় রচনা
এ প্রসঙ্গে হার্মিসীয় রচনাবলির উল্লেখ করা প্রয়ােজন। অবশ্য এ রচনাবলি ৩য় শতকের শেষার্ধের, এবং প্লোটিনাসেরও পরবর্তী সময়ের। এগুলাের মধ্যে যে ভাবার্থ পাওয়া যায়, তাতে পূর্ববর্তী সময়ের চিন্তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়, এবং আমরা এতক্ষণ যে ভাবধারা নিয়ে আলােচনা হলো, তার সঙ্গেও এর কিছুটা মিল দেখা যায়। মহান হার্মিস দেবতা তার শিষ্যদের যেসব উপদেশ দেন, এ রচনাবলি সেগুলাের লিপিবদ্ধ রূপ বলে মনে করা হয়। এসব রচনার মূলে কে বা কারা ছিলেন সঠিকভাবে জানা যায় না। এসব রচনায় কোনাে মৌলিক মতবাদ নেই। হার্মিসীয়গণ ঈশ্বরকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসেন, যেখানে তিনি অনেকটা মরমিভাবাপন্ন হয়ে যান। কিন্তত তার মধ্যে প্রজ্ঞা ও ইচ্ছা আরােপ করে থাকেন। সূর্য থেকে যেভাবে আলাের আগমন, ঠিক তেমনি ঈশ্বর থেকে প্রজ্ঞার আগমন। এই প্রজ্ঞা থেকেই আত্মার উৎপত্তি। আত্মা ও জড়ের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রয়ােজন। বায়ু ও শ্বাসপ্রশ্বাসই এই মধ্যস্থতা করে থাকে। সে একটি নিষ্ক্রিয় ও আকারহীন শক্তি; কিন্তু তা স্বর্গীয় সত্তা দ্বারা এত সুন্দরভাবে গঠিত যে তাকে ২য় ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরের পুত্র বলা চলে। এপ্রসঙ্গে জগৎকে উপেক্ষা ও তুচ্ছজ্ঞান করার জন্য খ্রিস্টানদের সমালােচনা করা হয়। ঈশ্বর জগতের ঊর্ধ্বে, সুতরাং তিনি জগতের স্রষ্টা নন – যারা এ মত পােষণ করেন তাদেরও সমালােচনা করা হয়। অপূর্ণতা ও অশুভের ব্যাখ্যায় তাদের মধ্যে এক অসঙ্গতিপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষণীয়। তাদের মতে, সব অশুভ-অমঙ্গলের মূলে রয়েছে জড়। আধ্যাত্মিক ও জড়ের, ঐন্দ্ৰিয়িক ও স্বর্গীয় সত্তার মধ্যে কোনাে সংযােগ সম্ভব নয়। মানুষের আত্মা ও প্রজ্ঞার উৎপত্তি স্বর্গীয় সূত্র থেকে, এবং পুণ্যকাজ অনুষ্ঠানের ফলে পরিণামে তারা তাদের আদিনিবাসে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন। হার্মিসীয়দের নৈতিক মতে কিছুটা অসংগতি লক্ষণীয়। একদিকে তারা আমাদের বাহ্যজগৎ ও ইন্দ্রিয় থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে ঈশ্বরের সঙ্গে অপরােক্ষ যােগাযােগ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, অন্যদিকে আবার বলেছেন যে, আমরা যে জগতে বাস করছি তাকে ঘৃণা ও উপেক্ষা করা অনুচিত। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের এই উপদেশ দিচ্ছেন যে, প্রতিষ্ঠিত ধর্মের চর্চা এবং দেবদেবীদের মূর্তির উপাসনা করা মানুষের কর্তব্য।
তথ্যসূত্র
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড : থেলিস থেকে হিউম, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদারস, ২০১৪
Leave a Reply