(আব্বাসীয় খিলাফতের পতন নিয়ে আলোচনা করতে হলে আগে এই সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যে বিভিন্ন রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল তাদের ইতিহাস আলোচনা করতে হবে। এখানে সেটাই করা হচ্ছে। সেই সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের নিয়ন্ত্রণ কোন সময় সামরিক শাসনের অধীনে যায়, কোন সময়ে ক্রীতদাস বিদ্রোহীদের অধীনে যায়, আবার একটা বড় সময় জুড়ে বুওয়াহিদ ও সেলজুকদের নিয়ন্ত্রণে পতিত হয়। ধারাবাহিকভাবে সেই ইতিহাসের আলোচনাও প্রয়োজন। এখানে পূর্ব (পারস্য, ট্রান্সক্সিয়ানা, আফগানিস্তান) ও পশ্চিম (লেভান্ত, মিশর, মাগরেব, আনাতোলিয়া) উভয় অঞ্চলের ইতিহাস একত্রে রাখা হয়েছে।)
Table of Contents
কর্দোভার আমিরাত (৭৫৬ – ৯২৯ খ্রি., স্পেইন)
আব্বাসীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পরে উমাইয়া বংশের বিশিষ্ট বংশধর যুবক আবদ-আল-রাহমান নতুন রাজ্য আগ্রাসনের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে যে ব্যাপক গণহত্যা ঘটেছিল তার দায় এড়ানাের জন্য দূরবর্তী স্পেনের কর্ডোভায় পালিয়ে গেলেন। এক বছর পরে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে এক শক্তিশালী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। আর এভাবেই আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের শৈশবাবস্থাতেই প্রথম প্রদেশটি চিরকালের জন্য তাদের হাতছাড়া হয়। শীঘ্রই অন্য প্রদেশগুলোও একই পথ অনুসরণ করে।
বিস্তারিত অন্যত্র
ইদ্রিসি রাজবংশ (৭৮৮ – ৯৭৪ খ্রি., মরক্কো)
আল-হাসানের মহান পৌত্র ইদ্রিস ইবন-আবদুল্লা ৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে আল-মদীনায় বার বার ঘটে যাওয়া আলী অনুগামীদের অনেকগুলো বিদ্রোহের একটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল এবং তিনি মরক্কোতে (আল-মাগরিব) পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি তার নামাঙ্কিত একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই রাজত্ব প্রায় দুশাে বছর টিকেছিল (৭৮৮-৯৭৪ খ্রি.)। এর প্রধান রাজধানী ছিল ফাস (ফেজ)। আর এই ইদ্রিসীয়রাই ছিল মুসলিমদের ইতিহাসে প্রথম শিয়াপন্থী রাজবংশ। বার্বারদের কাছ থেকে তারা তাদের শক্তি সংগ্রহ করেছিল। এই বার্বাররা ছিল সুন্নি, তারা সর্বদা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানাের ব্যাপারে প্রস্তুত থাকত। মিশরের ফাতিমীয় ও স্পেনের উমাইয়াদের সাঁড়াশি আক্রমণে তাদের রাজবংশ শেষ পর্যন্ত কর্ডোভার খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকাম (৯৬১-৭৬ খ্রি.)-এর এক জেনারেলের প্রবল আঘাতে ভেঙে পড়ে।
আগলাবীয় রাজবংশ (৮০০ – ৯০৯ খ্রি., ইফ্রিকিয়া)
শিয়া গােষ্ঠীভুক্ত ইদ্রিসীয়রা যেমন উত্তর আফ্রিকার পশ্চিমাংশে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল, তেমনি সুন্নি গােষ্ঠীভুক্ত আগলাবীয়রাও পূর্বদিকে একই উদ্দেশ্যে অনুরূপ চেষ্টা চালাচ্ছিল। ইফরিকিয়া (আফ্রিকা মাইনর, অর্থাৎ মূলত তিউনিসিয়া) নামে পরিচিত অঞ্চলটির জন্য ৮০০ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহিম ইন আল-আগলাবকে গভর্নররূপে নিযুক্ত করেছিলেন হারুন আল রশীদ। একজন স্বাধীন সার্বভৌম শাসক হিসেবে ইবন-আল-আগলাব (৮০০-৮১১ খ্রি.) তার রাজত্ব চালিয়েছিলেন। তার নিয়ােগের পর আর কোন আব্বাসীয় খলিফা মিশরের পশ্চিম সীমানার বাইরে কর্তৃত্ব প্রয়ােগের কোন চেষ্টা করেনি। আমির উপাধি পেয়েই আগলাবীয়রা নিজেদের সন্তুষ্ট রেখেছিলেন, কিন্তু তারা প্রায় কখনই তাদের মুদ্রার ওপর সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক কর্তৃপক্ষের প্রতীক রূপে খলিফার নাম মুদ্রিত করতেন না বললেই চলে। তাদের রাজধানী আল কায়রাওয়ান, কার্থেজের আইনসম্মত উত্তরাধিকারী। তারা তাদের শতাব্দীব্যাপী শাসনকালে (৮০০-৯০৯ খ্রি.) ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যবর্তী অঞ্চলটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ইব্রাহিমের উত্তরসূরিদের অনেকেই তার মতাে উদ্যোগী ও কর্মতৎপর ছিলেন। তাই এই রাজবংশটি এশিয়া ও ইউরােপের দীর্ঘ সংঘর্ষের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। তাদের সুসজ্জিত নৌবহর নিয়ে তারা ইতালি, ফ্রান্স, কর্সিকা ও সার্ডিনিয়ার উপকূলে অভিযান চালিয়েছিলেন। তাদেরই একজন প্রথম জিয়াদাত-আল্লাহ্ (৮১৭-৩৮ খ্রি.) ৮২৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইন সিসিলিতে সেনা-অভিযান চালান। তার আগে সেখানে অনেকবার জলদস্যুর আক্রমণ চলেছিল। এই অভিযান ও পরবর্তী আরও কয়েকটি অভিযানের ফলে ৯০২ খ্রিস্টাব্দে এই দ্বীপটি সম্পূর্ণ পরাভূত হয় ও আক্রমণকারীদের দখলে আসে। মূল ভূখণ্ড, বিশেষত ইতালি অভিযানের ক্ষেত্রে সিসিলি একটি সুবিধাজনক ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। সিসিলি ছাড়াও মাল্টা ও সার্ডিনিয়া দখল করা হল। এই দখলের নায়ক ছিল জলদস্যুরা এবং এর সুদূর রােম পর্যন্ত মাঝে মাঝেই তাদের অভিযান চালাত। ক্রীটের মুসলিম জলদস্যুরা বার বার এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোতে আক্রমণ চালাত এবং ১০ম শতাব্দীর মাঝামাঝি তারা গ্রিসের উপকূলে তাদের অভিযান সংগঠিত করল। পরবর্তীকালে এথেন্সে আবিষ্কৃত তিনটি কুফিক শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ১০ম শতাব্দীর গােড়ার দিক পর্যন্ত সেখানে আরবদের উপনিবেশ ছিল।
প্রাচ্যের বিখ্যাত মসজিদগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে এখনও দণ্ডায়মান আল-কায়রাওয়ানের বিরাট মসজিদটি তৈরির কাজ জিয়াদাত-আল্লার আমলেই শুরু হয়েছিল এবং দ্বিতীয় ইব্রাহিম (৮৭৪-৯০২ খ্রি.)-এর শাসনকালে সেই কাজ শেষ হয়। আল-কায়রাওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা উকবার পুরানাে প্রাসাদটি যেখানে তাবস্থিত সেখানেই এই মসজিদটি তৈরি হয়েছিল। তার উত্তরসূরিদের মধ্যে একজন কার্থেজের ধ্বংসস্তুপের মার্বেল পাথর নির্মিত স্তম্ভ দিয়ে উকবার মসজিদটি অলঙ্কৃত করেছিলেন। পুনরায় আগলাবীয় কাঠামােয় তা ব্যবহৃত হয়েছিল। এই মসজিদের বর্গাকার মিনারগুলো উমাইয়া আমলের প্রথম দিককার স্থাপত্য শিল্পের একটি নিদর্শন এবং আফ্রিকার বুকে একে সবচেয়ে পুরানাে বলে আখ্যা দেওয়া যায়। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকাতে পরবর্তীকালে এই স্থাপত্যরীতিই চালু হয়। পারস্যের ও মিশরের পলকা ও রুচিশীল স্থাপত্যরীতি কখনই তাকে স্থানচ্যুত করতে পারেনি। উল্লিখিত অন্যান্য স্থাপত্যরীতিতে ইট ব্যবহৃত হলেও সিরিয়ার স্থাপত্যবিদরা পাথর ব্যবহার করতেন। সম্ভবত এই মসজিদের জন্যই পশ্চিমি মুসলিমদের কাছে মক্কা, আল-মদীনা ও জেরুজালেমের পর আল কায়রাওয়ান চতুর্থ পবিত্র শহর এবং স্বর্গে যাবার প্রবেশদ্বারের একটি বলে গণ্য হয়।
আগলাবীয়দের শাসনকালেই বাহ্যিক দিক থেকে ল্যাটিনভাষী ও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ইফ্রিকিয়া, আরবী-ভাষী ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশে পরিণত হয়। ল্যাটিন উত্তর আফ্রিকার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। আর কখনও তার উত্থান ঘটেনি। অথচ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সহ সেন্ট অগস্টাইন তারই ফসল। কিন্তু ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবার পর তার আর পুনরুজ্জীবন ঘটেনি। অন্য যেকোন অঞ্চলের তুলনায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া অনেকটাই সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল। মুসলিমদের অস্ত্র ব্যবহারই তার কারণ। তবে বশ্যতা স্বীকার না করা বার্বার উপজাতি পরবর্তীকালে মুসলিমদের বিরােধিতা করেছিল এবং এই বিরােধিতা শেষ পর্যন্ত বিভেদকামী ও প্রচলিত ধর্মমতবিরােধী মুসলিম সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনের আকার ধারণ করেছিল।
আগলাবীয় বংশের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন তৃতীয় জিয়াদাত-আল্লাহ্ (৯০৩-০৯ খ্রি.)। তার রাজ্যের দিকে ফাতিমিরা এগিয়ে আসার আগেই কোন প্রতিরােধ গড়ে না তুলেই ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পালিয়ে যান। ফাতিমিরা ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে আগলাবীয়দের হঠিয়ে উত্তর আফ্রিকায় এবং ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মিশর ও দক্ষিণ সিরিয়ায় ইখশিদিদদের পরাস্ত করে ক্ষমতা দখল করেছিল। তাদের সম্পর্কে পরবর্তী কোন অধ্যায়ে আলােচনা করা হবে। কিন্তু ইখশিদিদদের সম্পর্কে কিছু বলার আগে তুলুনীয় রাজবংশের সম্পর্কে আলোচনা করে নিতে হবে।
তাহিরিদ রাজবংশ (৮২১ – ৮৭৩ খ্রি., খোরাসান)
বাগদাদের পূর্বদিকে আপাত অর্থে প্রায় স্বাধীন রাজ্য প্রথম তৈরি করেছিলেন আল মামুনের একদা বিশ্বস্ত জেনারেল তাহির ইবনে-আল-হুসাইন। তিনি ছিলেন খোরাসানের অধিবাসী। আল আমীনের বিরুদ্ধে তার প্রভুর সেনাদলকে সাফল্যের সাথে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিজয় অর্জন করেছিলেন। কথিত আছে যে, এই যুদ্ধে একচক্ষু বিশিষ্ট তাহির এত নিপুনভাবে দুহাতে তরবারি চালনা করেছিলেন যে, আল মামুন তার নাম দিয়েছিলেন যু-আল-ইয়ামিনাইন, অর্থাৎ সব্যসাচী। আর এক কবি তার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন “একচক্ষুহীন অতিরিক্ত একটি ডানহাতবিশিষ্ট” যোদ্ধা। এক পারসীয় ক্রীতদাসের বংশধর তাহিরকে ৮২০ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের পূর্বদিকের সমস্ত জমির মালিকানা দান করে আল-মামুন পুরস্কৃত করেছিলেন। এছাড়াও তিনি তাকে খোরাসানে তার ক্ষমতার মধ্যমণি করেছিলেন। এই ঘটনার দুবছর পর ঠিক তার মৃত্যুর আগে রাজধানী মারওয়াতে শুক্রবারের প্রার্থনায় তাহির খলিফার নাম উল্লেখ করেননি। বাস্তবে খলিফার সামন্তপ্রজা হলেও তাহিরের উত্তরসুরিরা তাদের রাজত্বের সীমানা প্রায় ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। পরে তাদের শাসনকেন্দ্রটি তারা নাইসাবুরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানে তারা ৮৭২ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন, তারপর তাদের পরাজিত করে সাফ্ফারীয়রা ক্ষমতায় আসেন।
সাফ্ফারীয় রাজবংশ (৮৬১ – ১০০৩ খ্রি., সিস্তান সহ ইরানের বিশাল অংশ)
সিজিস্তানে (বা সিস্তান) উদ্ভুত সাফফারীয় রাজবংশ পারস্যে ৪১ বছর (৮৬৭-৯০৮ খ্রি.) রাজত্ব করেছিল। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক ইয়াকুব ইবনে আল লাইস আল সাফ্ফার (৮৬৭-৭৮ খ্রি.)। পেশায় আল-সাফ্ফার (তাম্রকার) ছিলেন এক তাম্রকার, কিন্তু বৃত্তিতে ছিলেন এক দস্যু। আইনের চোখে নিষিদ্ধ একটি গোষ্ঠীর দলপতিরূপে তার বীরত্বপূর্ণ ও কুশলী আচরণ সিজিস্তানে যিনি খলিফার গভর্নর ছিলেন তার সস্নেহ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ফলে গভর্নর তাকে তার সেনাদলের নেতৃত্বে বসিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে আল-সাফ্ফার তার উপকারীর উত্তরসুরী হয়েছিলেন এবং গোটা পারস্য ও ভারতের সীমান্ত এলাকাগুলোকে তার রাজত্বের সাথে যুক্ত করেছিলেন। এমনকি বাগদাদে আল-মুতামিদের খলিফা সাম্রাজ্যও তার রাজ্যজয়ের অভিযানে সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পরে সামানীয় রাজবংশ ক্ষমতাসীন হয় এবং সাফ্ফারীয় রাজত্বের এক বিরাট অংশ তাদের দখলে আসে।
রাজরক্ষী বাহিনী, সামাররার নৈরাজ্য (৮৬১ – ৮৭০ খ্রি.) ও জাঞ্জ বিদ্রোহ (৮৬৯ – ৮৮৩ খ্রি.)
যখন আব্বাসীয় ঈগলের ডানা দুটি উভয় প্রান্তে বাঁধা ছিল, ঠিক সেই সময় পারস্যের তুর্কিদের হাতে ধরা একটি ছুরি তার হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানতে উদ্যত হয়েছিল। শিয়াপন্থী পারসীয় বুওয়াইহিদ এবং তারপরে সুন্নিপন্থী তুর্কি সেলজুকদের আমলে খলিফার হাতে রাজধানী ছাড়া আর কোন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। রাজধানীতে তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছিল। একটি বিশাল রাজ রক্ষীবাহিনীর উদ্ভব ও তারপরে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ কেন্দ্রীয় শাসনের ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছিল এবং পরিণতিতে রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পথ প্রশস্ত হয়। হারুনের এক তুর্কি ক্রীতদাসীর গর্ভজাত সন্তান এবং অষ্টম আব্বাসি খলিফা আল-মুতাসিম (৮৩৩-৪২ খ্রি.) প্রথম তার নিজের জন্য ট্রান্সঅক্সিয়ানার তুর্কিদের নিয়ে একটি দেহরক্ষী বাহিনী গড়ে তােলেন। এই বাহিনীতে দেহরক্ষীর সংখ্যা ছিল চার হাজার। খোরাসানের যে সৈন্যদের সাহায্যে আব্বাসীয়রা তাদের খলিফা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, তাদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য তারা তুর্কিদের নিয়ে দেহরক্ষী বাহিনী গড়ে তুলেছিল। কিন্তু প্রতি বছরে তুর্কি সৈন্য নিয়ােগ করার ফলে তা খলিফা সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার পক্ষে আরও বড় বিপদ হয়ে উঠেছিল। আর এভাবেই তাল-মানসুরের শান্তির নগরী পরিণত হয়েছিল বিক্ষোভ-কবলিত অশান্ত নগরীতে। খলিফার সেনাবাহিনীর উদ্ধত ও অত্যাচারী আচরণের বিরুদ্ধে বাগদাদে স্থানীয় মানুষের বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়ে খলিফা ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে তার শাসনকেন্দ্রটিকে টাইগ্রিস নদীর ৬০ মাইল উজানে অবস্থিত সামাররাতে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আদতে অ্যাসিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও খলিফা জায়গাটির নাম দেন সুররা মান রাআ (যে দেখে সেই খুশি হয়)। পরিবর্তিত এই নামের মধ্য দিয়ে এই জায়গাটি আব্বাসীয় মুদ্রার টাকশালের নগর বলে পরিচিতি লাভ করেছিল। অবশ্য সেই সময়ে কৌতুক করে বলা হত যে, নতুন নামের অর্থ হল “যে এটিকে দেখে (সেখানে তুর্কিরা স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে বলে) সে-ই সন্তুষ্ট হয় (কারণ তাদের হাত থেকে বাগদাদ মুক্ত হয়েছে)”। মূলত আল-মুতাসিম ও তার পুত্র আল-মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭-৬১ খ্রি.) সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণ করে সামারারাকে সাজিয়েছিলেন। ৫৬ বছর ধরে এটি তাদের রাজধানী ছিল (৮৩৬-৯২ খ্রি.) এবং এই দীর্ঘ সময়ে আটজন খলিফা তাদের রাজত্ব চালিয়েছিলেন। এই শহরটির ধ্বংসাবশেষ আব্বাসীয় আমলের বিদ্যমান স্মৃতিসৌধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মনােরম।
সামাররার আব্বাসি খলিফাদের বংশবৃত্তান্ত –
(৮) আল-মুতাসিম (৮৩৩-৪২ খ্রি.)
(৯) ৮ এর পুত্র আল-ওয়াসিক (৮৪২-৪৭ খ্রি.)
(১০) ৮ এর পুত্র আল-মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭-৬১ খ্রি.)
(১১) ১০ এর পুত্র আল-মুন্তাসির (৮৬১-৬২ খ্রি.)
(১২) ৮ এর পুত্র মুহাম্মদের পুত্র আল-মুস্তাইন (৮৬২-৬৬ খ্রি.)
(১৩) ১০ এর পুত্র আল-মুতাজ (৮৬৬-৬৯ খ্রি.)
(১৪) ৯ এর পুত্র আল-মুহতাদি (৮৬৯-৭০ খ্রি.)
(১৫) ১০ এর পুত্র আল-মুতামিদ (৮৭০-৯২ খ্রি.)
রােমের প্রিটোরিয়ান সেনাবাহিনী ও তুর্কির জানিসারিদের মতাে এই তুর্কি সেনাবাহিনীও খলিফা সাম্রাজ্যে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তবে তুর্কি সেনায় পূর্ণ এই সেনাবাহিনীর উদয় খলিফা সাম্রাজ্যের পতনেরও সূচনা করেছিল। খলিফা তার নুতন রাজধানীতে তার সেনাদলের হাতে প্রায় বন্দীদশায় দিন কাটাতেন। তার পুত্রের প্ররােচনায় সেনারা ৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আল-মুতাওয়াকিলকে হত্যা করে। আর এটাই ছিল এই ধরনের প্রথম হত্যাকাণ্ড। এরপর বেশ কয়েকটি এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পরিণতিতেই ইতিমধ্যে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া আব্বাসীয় রাজত্ব অতি দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়। অবক্ষয়ের যুগে আল-মুতাওয়াক্কিল ছিলেন প্রথম খলিফা। তারপর থেকেই প্রধানত তুর্কি সেনাদের ইচ্ছানুযায়ী খলিফা নির্বাচিত হত এবং ক্ষমতাচ্যুত হত। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্রীতদাস জেনারেলদের নেতৃত্বে তুর্কি সেনারা ক্ষমতা করায়ত্ত করার জন্য চেষ্টা চালাত। এই ক্রীতদাসদের ওপর প্রভাব ছিল বলে রাজদরবারের মহিলারা তাদের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতেন এবং তার ফলে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পেত। দুর্বল ও দোদুল্যমান আল-মুস্তাইনকে (৮৬২-৬৬ খ্রি.) তার সৈন্যরা ঘেরাও করেছিল ও সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। তারপর তাদেরই পরামর্শে তিনি বাগদাদে পালিয়ে যান এবং তার ক্রীতদাসী মা দু’জন তুর্কি জেনারেলের সঙ্গে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছিলেন। তার উত্তরসূরি আল-মুতাজ (৮৬৬-৬৯ খ্রি.)-এর মা তার খলিফা-ছেলের প্রাণ বাঁচানাের জন্য প্রয়ােজনীয় ৫০,০০০ দিনার দিতে অস্বীকার করেছিলেন। যদিও মাটির নিচে একটি ঘরে তিনি প্রচুর পরিমান মণি-মাণিক্যের সঙ্গে ১,০০০,০০০ দিনার লুকিয়ে রেখেছিলেন। দুশাে বছর ধরে টুকরাে টুকরাে প্রদেশ বিভক্ত হয়ে যাওয়া খলিফা সাম্রাজ্য ক্ষমতাহীন শাসকদের সিংহাসনে আরােহণ ও মৃত্যুর হিমশীতল কবরে অবতরণের এক বিভ্রান্তিকর ছবি তুলে ধরে। যে সমস্ত রাজ্যে একজন স্বাধীন গভর্নর দৃঢ় মূর্তিতে ক্ষমতার দণ্ড ধরেছিলেন, একমাত্র সেই সমস্ত রাজ্যেই শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় ছিল।
এই সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও রক্তাক্ত ঘটনাগুলোর অন্যতম হল জাঞ্জ ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ। এরা ছিল পূর্ব আফ্রিকার থেকে আগত কৃষ্ণাঙ্গ। ইউফ্রেটিসের নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত সােনার খনিতে কাজ করত। এদের নেতা (সাহিব আল-জাঞ্জ) ছিলেন আলি ইবন মুহাম্মাদ এবং তিনি নিজে আরব বংশজাত বলে ভান করতেন। রাজধানীর বিক্ষুব্ধ অবস্থা এবং বিক্ষব্ধ ও দুর্দশাগ্রস্ত খনিশ্রমিকদের বিদ্রোহের সুযােগ নিয়ে ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেকে একজন ‘আলীপন্থী‘ বলে দাবি করে ঘােষণা করলেন যে দিব্যদৃষ্টি ও জ্যোতিষবিদ্যার সাহায্যে তাদের দুরবস্থা মােচনের জন্যই তার আবির্ভাব হয়েছে। এই নতুন মুক্তিদূতের পতাকার নিচে একের পর এক ক্রীতদাসের দল সমবেত হতে থাকলে আরবদের মূল সংবাদদাতা আল-তাবারী তাকে ‘দুবৃর্ত্ত’ ও ‘আল্লাহর শত্রু” বলে আখ্যা দিলেন। এই বিস্ময়কর বিদ্রোহ দমনের জন্য একের পর এক সেনাদল পাঠানাে হতে লাগল। কিন্তু একাধিক খালের দ্বারা বিচ্ছিন্ন এবং পরিচিত ও অনুকূল জলাভূমিতে থাকার দরুণ কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের পরাজিত করল এবং তাদের নেতার নতুন আদর্শ খারিজী তত্ত্ব অনুযায়ী নির্মমভাবে সমস্ত বন্দী ও যুদ্ধ করেনি এমন মানুষদেরও তরবারির আঘাতে হত্যা করল। আল-মুতামিদ (৮৭০-৯২ খ্রি.)-এর রাজত্বের ১৪ বছর (৮৭০-৮৩ খ্রি.) ধরে ক্রীতদাসের এই বিদ্রোহ চলেছিল। কত মানুষ মারা গিয়েছিল তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও সংখ্যাটা ৫ লক্ষেরও বেশিই হবে। এক একটি যুদ্ধের পর নিহত মুসলিমদের সংখ্যা এত বেশি হত যে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ছিন্ন মাথাগুলো জড়াে করে খালের সাহায্যে আল-বাসরায় পাঠিয়ে দিত। যাতে সেখানে তাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবেরা তাদের সনাক্ত করতে পারে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে আল-বাসরা, ওয়াসিত, আল-আহওয়াজ এবং আল-উবুল্লা মানুষহীন জনপদে পরিণত হয়েছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত খলিফার ভাই আল-মুয়াফাক ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি, ততক্ষণ এই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়নি। তাদের নেতার নির্মিত আল-মুখতারা দুর্গটি ৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনি আত্মহত্যা করেন। এইভাবেই পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে লিখিত সবচেয়ে রক্তাক্ত ও ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহের একটি সমাপ্তি ঘটে। আর ওই যুদ্ধের সময়েই ইবন-তুলুনের শাসনাধীন খলিফা সাম্রাজ্য থেকে প্রথম দিককার অন্যতম সুন্দর শহর মিশর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তুলুনীয় রাজবংশ (৮৬৮ – ৯০৫ খ্রি., মিশর, সিরিয়া)
মিশর ও সিরিয়ায় স্বল্পায়ু তুলুনীয় রাজবংশের (৮৬৮-৯০৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আহমদ ইবন-তুলুন। তার বাবা ছিলেন ফরগনার একজন তুর্কি। বোখারার সামানীয় শাসক ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে ছিলেন আল-মামুনের কাছে। ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে আহমদ মিশরে গভর্নরের লেফটেন্যান্ট রূপে সেখানে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি নিজেকে স্বাধীন বলে ঘােষণা করেন। জাঞ্জ বিদ্রোহীরা যখন টাকার জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকে, তখন খলিফা আল-মুতামিদ (৮৭০-৯২ খ্রি.) টাকা চেয়েও মিশরের লেফটেন্যান্টের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাননি। এই ঘটনাটি মিশরের ইতিহাসে দিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এর মধ্য দিয়ে নীল নদের উপত্যকায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং গােটা মধ্যযুগ জুড়ে এই সার্বভৌম রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব বজায় ছিল। তখন থেকেই মিশরের বিপুল পরিমান রাজস্ব আংশিকভাবে বাগদাদ ও এখানকার ক্ষমতাসীন গভর্নরের মধ্যে ভাগ হত। এই গভর্নররা ছিল মূলত কর-প্রদানকারী ক্যক। ফলে দেশের টাকা দেশেই থাকত এবং শাসকদের গৌরব বৃদ্ধির জন্য তা ব্যয় করা হত। ইবনে-তুলুনের সময় পর্যন্ত অন্তত একশাে জন গভর্নরের প্রত্যেকে গড়ে ২.০৮৩ বছর করে রাজত্ব চালিয়েছে এবং প্রত্যেকেই তার আগের জনের পথ অনুসরণ করে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়েছে। তুলুনীয় বংশের শাসনে মিশর লাভবান হয়েছে এবং সমৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করেছে।
আহমাদ ইবন-তুলুন (৮৬৮-৮৪ খ্রি.) তার নতুন রাষ্ট্রের জন্য একটি সুদৃঢ় সামরিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য তিনি ১ কোটি সৈন্যের একটি শক্তিশালী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতেন। এই সামরিক বাহিনীর মূল অংশটি তুর্কি ও কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের নিয়ে গড়া। তার সৈন্যবাহিনী, ক্রীতদাস ও প্রজাদের কাছ থেকে তিনি ব্যক্তিগত আনুগত্যের শপথ আদায় করতেন। ৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে যখন সিরিয়ার গভর্নর মারা গেলেন তখন আহমদ বিশেষ কোন বাধার সম্মুখীন না হয়েই প্রতিবেশী দেশটি দখল করলেন। টলেমির যুগের পর থেকে এই পথ মিশর একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হল এবং ফারাও শাসনের দিনগুলো থেকে এই প্রথম মিশর সিরিয়াকে শাসন করতে শুরু করল। সিরিয়ার ওপর তার কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য আহমাদ আককাতে (একরে) একটি নৌ-ঘাঁটি গড়ে তুললেন। পরবর্তী বহু শতাব্দী ধরে নীলনদের উপত্যকার ক্ষমতাসীন শাসকেরা সিরিয়াকে শাসন করেছিল।
জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম : দেশের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কৃষিতে, সেচব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারে তুলুনীয় শাসকেরা যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। কায়রাের কাছে আল-রাওযা দ্বীপে আহমদ নাইলােমিটারের উন্নতি সাধন করেছিলেন। মেমফিসের পুরানাে পরিমাপক যন্ত্রটির উন্নতি ঘটিয়ে এক উমাইয়া গভর্নর নাইলােমিটার যন্ত্রটি প্রথম তৈরি করেন। আরবরা মিশর জয় করার পর তুলুনীয় রাজবংশের আমলেই মুসলিম ধর্মাবলম্বী মিশর সর্বপ্রথম শিল্পসংস্কৃতির কেন্দ্র ও জমকালাে রাজদরবারের প্রতীক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। রাজধানী আল-ফুস্তাতের নতুন অঞ্চল আল-কাতায়ী (প্রশাসনিক বিভাগ) সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করে সাজিয়ে তােলা হয়। ৬০০০০ দিনার ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালটি (বিমারিস্তান) ছিল এই প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলোর অন্যতম। আহমদ এটি তৈরি করিয়েছিলেন। এখানকার যে মসজিদটিতে এখনও আহমদ ই-তুলুনের নামটি লেখা আছে সেটি ইসলামী দুনিয়ার প্রধান প্রধান ধর্মীয় স্মৃতিসৌধগুলোর অন্যতম। মিশরের সবচেয়ে পুরানাে এই মসজিদটির মিনারে সামাররার স্থাপত্যরীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই সামাররাতেই আহমদ তার যৌবনের দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। ১,২০,০০০ দিনার ব্যয়ে নির্মিত এই মসজিদটি ইটের খিলান ও সূচালাে ধনুকাকৃতি খিলান ব্যবহারের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। কাঠের তৈরি চওড়া ছাদের ঠিক নিচেই গােটা বাড়িটির ভিতরে চারদিকে কাঠের তৈরি স্তম্ভের মাথাল ও কার্নিসের মধ্যবর্তী অংশে সুন্দর সুন্দর কুফিক চিত্রসহযােগে কুরআনের ১/১৭ ভাগ খােদাই করা আছে।
আহমদের বিলাসী পুত্র ও উত্তরসূরি খুমারাওয়াইহ্-এর (৮৮৪-৯৫ খ্রি.) প্রাসাদে একটি ‘সােনার হলঘর’ ছিল। এই হলঘরের সােনায় মােড়া দেওয়ালগুলো বিশেষ বিশেষ পটভূমির মধ্যে প্রায় প্রােথিত তার নিজের এবং তার স্ত্রী ও গায়িকাদের মূর্তি দিয়ে সাজানাে ছিল। সবচেয়ে সেরা ইসলামীক প্রাসাদগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। সােনার মুকুট-পরা খুমারাওয়াইহ্ ও তার স্ত্রীদের মূর্তিগুলো স্বর্ণমুকুট পরিহিত, পূর্ণাবয়ব ও কাঠের ওপর খােদাই করা। ইসলামী দুনিয়ার শিল্প সংস্কৃতিতে এরূপ জীবিত মানুষদের প্রতিমূর্তি তৈরি প্রায় বিরল ঘটনা বললেই চলে। তার প্রাসাদটি ছিল একটি সুন্দর বাগানের মধ্যে। সেখানে ফুলের গাছের বেডগুলো করা হয়েছিল আরবী শব্দের আকারে। এছাড়া সােনার গিল্টি করা জলাশয়ের চারপাশেও লাগানাে হয়েছিল অপূর্ব সব গাছ। একটি পক্ষীশালা ও একটি চিড়িয়াখানা ছিল প্রাসাদটির উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রাসাদটির মুখ্য বৈশিষ্ট্য ছিল একটি পারদের পুকুর আর এর হাওয়া দিয়ে ফোলানোে চামড়ার তাকিয়া রেশমি দড়ি দিয়ে রুপাের স্তম্ভের সঙ্গে বাঁধা থাকত। এর উপর শুয়ে রাজা দুলতে দুলতে নিদ্রাহীনতা থেকে মুক্ত হতেন এবং গভীর ঘুমে ডুবে যেতেন। পরবর্তীকালে ওই স্থানে পারদের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আগে খুমারাওয়াই তার মেয়ে কাতার-আল-নাদার (শিশিরবিন্দু)-র সঙ্গে খলিফা আল-মুতাযিদের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়েতে তিনি যৌতুক বাবদ ১০ লক্ষ দিরহাম, এক হাজার সােনার পিণ্ড, ও অন্যান্য এমন সব মূল্যবান বস্ত্র দিয়েছিলেন যা এর আগে কখনও দেওয়া হয়নি। তার এই অমিতব্যয়িতা ও বিলাসিতার জন্য রক্ষণশীলেরা তাকে অধার্মিক আখ্যা দিয়েছিল। দাবি করা হয় যে, তিনি নাকি একবারে ৪ বোতল মিশরিয় মদ পান করতে পারতেন। মৃত্যুর পর তার দেহ যখন কবর দেওয়া হচ্ছিল, তখন তার লাগােয়া তার বাবার সমাধিস্থলের কাছে দাঁড়িয়ে পবিত্র কুরআন পাঠের জন্য নিযুক্ত সাত ব্যক্তি পাঠ করছিলেন, “আপনারা তাকে ধরুন এবং নরকের আগুনের মাঝখানে তাকে টেনে নিয়ে যান।”
খলিফা সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র অনিয়ন্ত্রিত ও অসংলগ্ন তুর্কি উপাদানের মধ্যে তুলুনীয় রাজবংশ ছিল রাজনৈতিক সঙঘবদ্ধতার একটি প্রারম্ভিক প্রকাশমাত্র। তারপরেই অন্যান্য ও আরও গুরুত্বপূর্ণ তুর্কি রাজবংশের আবির্ভাব ঘটল। খলিফা সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপরে অনেকগুলো রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতারূপে আহমদ ইবনে-তুলুনের ভূমিকা ছিল এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে গেল বা বাগদাদের খলিফার ওপর নামেমাত্র নির্ভরশীল হয়ে রইল। অনুগত সেনা ও ক্রীতদাসদের সাহায্যে কীভাবে একটি মাথাভারী ও বিশালাকার খলিফা সাম্রাজ্যের বিনিময়ে সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করা যায়, আহমদকে তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু যে সমস্ত দেশে তারা শাসন চালিয়েছিল, সেই সমস্ত দেশে তুলুনীয়, ইখশিদিদি ও অন্যান্য রাজবংশের কোন জাতিগত ভিত্তি না থাকায় তাদের শাসন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। তাদের জাতিভুক্ত মানুষের শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সমর্থকদলের অভাবই ছিল তাদের দুর্বলতার মূল কারণ। শাসকেরা ছিল প্রকৃতপক্ষে আগ্রাসনকারী, বিভিন্ন বিদেশি জাতিভুক্ত মানুষদের নিয়ে তারা সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল এবং তাদের মধ্য থেকেই দেহরক্ষীদের নিযুক্ত করেছিল। তুলনাহীন ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ও তার প্রভাবেই কেবলমাত্র এই ধরনের শাসনব্যবস্থা বজায় রাখা যায়। আর যে মুহূর্তে শাসকের দৃঢ়মুষ্ঠি আলগা হয়ে পড়ে বা অন্যের হাতে হস্তান্তরিত হয়, তখনই সেই শাসনব্যবস্থায় ভাঙন ধরে। সুতরাং ইবনে-তুলুন প্রতিষ্ঠিত রাজ্য যে তার পুত্র ও চতুর্থ উত্তরসূরি শাইবা (৯০৪-৯০৫) এর আমলে আব্বাসীয়দের দখলে চলে গেল, তাতে বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই।
তুলুনীয় রাজবংশের শাসকগণ :
(১) আহমাদ ইবনে তুলুন (৮৬৮-৮৪ খ্রি.)
(২) ১ এর পুত্র খুমারাওয়াইহ্ (৮৮৪-৯৫ খ্রি.)
(৩) ২ এর পুত্র জয়েস (৮৮৪-৯৫ খ্রি.)
(৪) ২ এর আরেক পুত্র হারুন (৮৯৬-৯০৪ খ্রি.)
(৫) ১ এর আরেক পুত্র শাইবান (৯০৪-০৫ খ্রি.)
হামদানীয় রাজবংশ (৮৯০ – ১০০৪ খ্রি., আলেপ্পো)
উত্তর দিকে শিয়াপন্থী হামদানীয় বংশ ছিল মিশরের ইখশিদীয় রাজবংশের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। হামদানিরা প্রথমে উত্তর মেসােপটেমিয়ায় তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের রাজধানী ছিল আল-মাওসিল (৯২৯-৯১ খ্রি.)। তাগলিব উপজাতির হামদান ইবন হামদুনের বংশধর ছিল হামদানিরা। ৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তারা উত্তর সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হয় এবং সঈফ-আল-দাওলার (রাজবংশের তরবারি) নেতৃত্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইখশিদীয় লেফটেন্যান্টের কাছ থেকে আলেপ্পো (হালাব) ও হিম্স ছিনিয়ে নেয়। উমাইয়া শাসনে তাদের অতীত গৌরবের কথা সিরিয়ার মানুষ কখনও ভুলতে পারেনি। আর আব্বাসীয় রাজত্বে সিরিয়া অসন্তোষ ও বিদ্রোহের উত্তপ্ত ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। আলেপ্পোর সঈফ-আল-দাওলা (৯৪৪-৬৭ খ্রি.) উত্তর-সিরিয়ায় একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটি ১০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকেছিল। তাদের দ্বিতীয় উত্তরসূরি সাঈদ-আল-দাওলা (৯৯১-১০০১ খ্রি.) মিশরের ফাতিমিয়দের এক সামন্ত প্রজায় পরিণত হয়েছিলেন। বাইজানটাইন ও ফাতিমিয়দের প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে হামদানিদরা সেই বছরে শেযযাক্তদের আনুগত্য স্বীকার করে।
সাহিত্য বিকাশের যুগ : শিক্ষার প্রতি উদার পৃষ্ঠপােষকতার জন্যই আরবদের ইতিহাসে সঈফ-আল-দাওলার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। শুধু তাই নয়, ইসলামের খ্রিস্টধর্মাবলম্বী শত্রুদের বিরুদ্ধে অন্যান্য মুসলিমরা যে দৃঢ়তার সঙ্গে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজে উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণের জন্যও তার নাম লেখা থাকবে। এই হামদানীয় নিজে ছিলেন একজন কবি; তার সময়ের সাহিত্যগােষ্ঠী আল-রশীদ ও আল-মামুনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই গােষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক ও সঙ্গীতজ্ঞ আল-ফারাবি। তার দৈনন্দিন প্রয়ােজন মেটানাের জন্য রাজকোষ থেকে তাকে ৪ দিরহাম পেনসন দেওয়া হত। এই গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আল-ইসবাহানি, ইবন মুবাতা (৯৮৪ খ্রি.) ও আল-মুতানাক্কি (৯১৫-৬৫ খ্রি.)। আল-ইসবাহানি ছিলেন সাহিত্য ও সঙ্গীতের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক। তিনি তার বিশালাকার ‘আগানি’-র নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি তার পৃষ্ঠপােষককে উপহার দিয়েছিলেন এবং বিনিময়ে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার পেয়েছিলেন। বিশিষ্ট বাগ্মী ও রাজদরবারের ধর্মপ্রচারক ইবন-নুবাদার ছন্দোবদ্ধ গদ্যে রুচিপূর্ণ উপদেশাবলি শুনে শ্রোতাদের মনে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ শুরু করার প্রবল ইচ্ছা জেগে উঠত। আর রাজকবি আল-মুতানারি কঠিন কঠিন শব্দালঙ্কার, কাব্যময় অলঙ্কার ও অকল্পনীয় রূপকে উপমাগুলো বর্তমানেও তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। প্রথম দিককার একজন সমালােচক তার কবিতাকে ‘উৎকর্যের সর্বোচ্চ মান’ বলে উল্লেখ করেছেন। আল-মুতানাব্বি (দৈববার্তা ঘােষণাকারী ধর্ম প্রচারকের দাবিদার) ছিলেন আল-কুফার এক জলবাহকের সন্তান। যৌবনকালে তিনি সিরিয়াবাসী বেদুইনদের মধ্যে দৈববার্তা প্রচার করতেন বলে তার ওই রকম নাম হয়েছিল। আলেপ্পোতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কবি ছিলেন সঈফ-আল-দাওলার কাজিন (পিতৃব্যের পুত্র) আবু-ফিরাস-আল-হামদানি। হামদানীয় পৃষ্ঠপােষকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর আল-মুতানাব্বি পৃষ্ঠপােষকতার প্রার্থী হয়েছিলেন ইখশিদীয় বংশের রাজা কাফুর-এর কাছে। তার কাছ থেকে পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করলেও পরে তার সম্পর্কে কবির মােহভঙ্গ হয়েছিল।
উত্তর সিরিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী নবজাগরণের বিলম্বিত ফল হিসাবে ‘কবিদের দার্শনিক ও দার্শনিকদের কবি’ রূপে আবু-আল-আলা আল-মাআররি (৯৭৩-১০৫৭ খ্রি.)-র আবির্ভাব ঘটে। ও ইসলামী দুনিয়ার রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও সামাজিক অবক্ষয়ের যুগের সন্দেহপ্রবণ এবং নৈরাশ্যবাদী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছিল তার রচনায়। তানুখ-এর বংশধর আবু-আল-আলার জন্ম ও মৃত্যু হয় মাআররাত আল-নুমান নামে একটি স্থানে এবং সেই জায়গাটির নাম অনুযায়ীই তার ওই পদবি হয়েছিল। তার সহস্রতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার সমাধিস্থলটির পুনর্গঠন করা হয়। চার বছর বয়সে তিনি গুটিবসন্ত রােগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং পরে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। আবার এরই পরিণতিতে তিনি অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী হয়ে ওঠেন। ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে আবু-আল-আলা বাগদাদে যান, যেখানে ১ বছর ৭ মাস কাটান এবং সেখানেই তিনি ইখওয়ান আল-সাফা এবং অন্যান্য ভারতীয় বংশজাত দার্শনিকদের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বাড়ি ফিরে আসার পথে তিনি নিরামিষাশী হয়ে যান এবং নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেন। তার পরের দিককার রচনা বিশেষত লুজুমিয়াত ও রিসালাত আল-গুফরান (ক্ষমা সম্পর্কিত প্রবন্ধ) থেকে জানা যায় যে, যুক্তির ভিত্তিতে তিনি তার জীবন পরিচালনা করতেন এবং নৈরাশ্যবাদী সন্দেহপ্রবণতাকে তিনি তার দর্শন বলে গ্রহণ করেছিলেন। দাবি করা হয় যে, তার রচিত রিসালা-র দ্বারাই দান্তে তার ডিভাইন কমেডি রচনার ক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার চতুষ্পদী শ্লোকগুলো আংশিকভাবে ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। সিরিয়ার এই কবি ও পারস্যের কবি উমার আল-খইয়ামের মধ্যে বার বার তুলনা টানা হয়। উমার খইয়াম তার মৃত্যুর ৬০ বছর পরে মারা যান এবং তিনিও তার এই পূর্বসূরির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। (উমর খইয়ামের রুবাইয়াতও চার লাইনের পঙক্তি যাতে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ ছন্দ পারসীয় রচনারীতি অবলম্বনে গঠিত)। আল-মুতানাব্বি ও আল-মাআররির পরই আরবের কবিতার মহান যুগ শেষ হয়ে যায়। তারপর থেকে আর কোন আরব কবিই স্থানীয়ভাবে খ্যাতিলাভ করা ছাড়া তেমন কোন প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি।
রোমানদের দেশ আক্রমণ : উত্তর সিরিয়ায় নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার পর হামদানীয় রাজবংশের তরবারিটি অর্থাৎ এই বংশের প্রতিনিধি ৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে থেকে শুরু করে প্রতি বছর এশিয়া মাইনরে আক্রমণ চালাতে লাগলেন। এর ২০ বছর পর তার মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত এমন কোন বছর যায়নি যে বছরে তিনি গ্রিকদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি। শেষ পর্যন্ত সঈফের প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করে। তিনি মারআশ ও কয়েকটি সীমান্তবর্তী শহর দখল করেন। কিন্তু ভবিষ্যতের দুই সম্রাট নাইসফোরাস ফোকাস ও জন টিমিসেসের অসাধারণ নেতৃত্বে বাইজান্টিয়ামের সৌভাগ্য ফিরে আসে। ৯৬১ খ্রিস্টাব্দে নাইসফোরাস শুধুমাত্র দুর্গটি বাদ দিয়ে রাজধানী আলেপ্পো দখল করেন। ১০,০০০ যুবক ও সমস্ত বন্দীদের হত্যা করেন এবং সঈফ-আল-দাওলার প্রাসাদটি ধ্বংস করে দেন। কিন্তু এর আট বা নদিন পরেই তিনি অবসর নেন। তিনি সম্রাট হবার পর (৯৬৩-৬৯ খ্রি.) তার সৈন্যরা আরবদের কাছ থেকে সাইপ্রাস ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং সিলিসিয়া দখল করে ছিল। আর এইভাবেই সিরিয়া যাবার রাস্তা প্রশস্ত হয়ে যায়। তার রাজত্বের শেষ বছরে তার সৈন্যদল, দীর্ঘদিন ধরে উধ্বর্তন যাজক, সাধু ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের শহর এবং বাইজান্টিয়ামের ধর্মসভা বলে পরিচিত অ্যান্টিয়ক শহরটি দখল করে নেয়। ৯৬৯ খ্রি. থেকে ১০৮৪ খ্রি. পর্যন্ত শহরটি বাইজান্টাইনদের দখলেই ছিল। অ্যান্টিয়ােক দখলের পরই নাইসফোরাসের জেনারেল আলেপ্পোতে প্রবেশ করে এবং সঈফের পুত্র ও উত্তরসূরি সাআদ আল-দাওলার (৯৬৭-৯১ খ্রি.) কাছ থেকে একটি অবমাননাকর চুক্তি জোর করে আদায় করে নেয়। সম্রাট জন টিমিসেস (৯৬৯-৭৬ খ্রি.) সিলিসিয়া ও উত্তর সিরিয়ায় তার বিজয়কে দীর্ঘস্থায়ী ও সুদৃঢ় করার নীতি গ্রহণ করেন এবং জেরুজালেমকে মুক্ত করার জন্য তার চূড়ান্ত অভিযান শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি অ্যান্টিয়ােক থেকে যথার্থই একটি ক্রুসেড শুরু করেন দামাস্কাসে পৌছান, কিন্তু প্যালেস্টাইনের খুব ভিতরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। তার রাজত্বের প্রথমদিকে হামদানিদের কাজিন (পিতৃব্যপুত্র) ও নাসিবিনের অধিবাসী অবাধ্য বানু-হাবিব ১২,০০০ মুসলিমকে সঙ্গে নিয়ে চড়া করের প্রতিবাদে দেশ ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং বাইজান্টাইনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুসলিম দেশ আক্রমণে অংশ নেন। টিমিসেসের উত্তরসূরী ছিলেন দ্বিতীয় বেসিল। উত্তর আফ্রিকার আরবরা তাকে কিছু অসুবিধার মধ্যে ফেলেছিল। এই আরবরা তখন সিসিলি ও কিছু ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ শাসন করতাে। শেষ পর্যন্ত মিশরের ফাতিমিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সিরিয়াকে রক্ষা করার জন্য বেসিলকে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। কিন্তু ১১শ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি ফাতিমীয় রাজবংশের আল-হাকিমের সাথে একটি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং তারপর আর কোন গুরুতর সংঘর্ষ ঘটেনি। নাইসফোরাস ও টিমিসেসের মতো দ্বিতীয় বেসিলের প্রচেষ্টায় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমানা ইউফ্রেতিস ও উত্তর সিরিয়ার প্রাণকেন্দ্র পর্যন্ত প্রসারিত হয়। কিন্তু তার জন্য মূল্যস্বরূপ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে হয়েছিল। তবুও একথা সত্য যে তাদের আমলেই প্রাচ্যের মুসলিমদের সাথে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সামানীয় রাজবংশ (৯০০ – ৯৯৯ খ্রি, খোরাসান, ট্রান্সক্সিয়ানা, আফগানিস্তান)
ট্রান্সঅক্সিয়ানা ও পারস্যের (৮৭৪-৯৯৯ খ্রি.) সামানীয় বংশের মানুষেরা ছিলেন বলখ-এর এক মহান জরাথুস্ট্রবাদী সামান-এর বংশধর। সামানীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামান-এর এক পৌত্র নাসর আহমাদ (৮৭৪-৯২ খ্রি.)। কিন্তু নাসরের ভাই ইসমাইল (৮৯২-৯০৭ খ্রি.) এই রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিনিই সাফ্ফারিয় রাজবংশের কাছ থেকে খোরাসান ছিনিয়ে নেন। সামানীয়রা ছিল মূলত তাহিরিদ রাজবংশের অধীন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত উপ-গভর্নর। কিন্তু এদের চতুর্থ বংশধর দ্বিতীয় নসর ইবন-আহমদের (৯১৩-৪৩ খ্রি.) নেতৃত্বে সামানীয়রা তাদের রাজত্বের সীমানা ট্রান্সঅক্সিয়ানা ও খোরাসান থেকে বাড়িয়ে সিজিস্তান (বর্তমান সিস্তান প্রদেশ), কেরমান, এস্তারাবাদ (বর্তমান গোরগান, গোলেস্তান প্রদেশ), আর-রায়ি (বর্তমান রেই, তেহরান প্রদেশ) ও তাবারিস্তান (বর্তমান মাজান্দারান প্রদেশ) পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিল। বাইরের দিক থেকে তাদের আব্বাসীয় রাজবংশের অনুগত বলে মনে হলেও বাস্তবে তারা ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। বাগদাদের খলিফার চোখে এরা ছিল আমির (গভর্নর) বা আমিল (কর আদায়কারী), কিন্তু নিজেদের শাসনাধীন এলাকার মধ্যে এদের কর্তৃত্ব ছিল নিরঙ্কুশ।
সামানীয় রাজবংশের আমলেই ট্রান্সক্সিয়ানা পুরােপুরি মুসলিম শাসনের বশ্যতা স্বীকার করে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে তাদের রাজধানী বোখারা ও প্রধান শহর সমরখন্দ গৌরবের দিক থেকে বাগদাদকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সামানীয় রাজবংশের আমলে আরবী ও পারসী মনীষাকে সযত্নে রক্ষা করা ও বিকাশ ঘটানাে হয়েছিল। এই রাজবংশের দ্বিতীয় শাসকের এক ভাইপাে এবং সিজিস্তানের অধিবাসী ও সামানীয় রাজপুত্র আবু-সালিহ মানসুর ইবন ইসহাকের নামেই আল-মানসুরি নামক চিকিৎসাবিদ্যার ওপর লেখা তার বইটি উৎসর্গ করেছিলেন সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থাকার আল-রাযী। তার পৃষ্ঠপােষকের সম্মানেই তিনি একাজটি করেছিলেন। আবার সামানীয় শাসক দ্বিতীয় নুহ (৯৭৬-৯৭ খ্রি.) এর নির্দেশেই বোখারায় বসবাসকারী ও ২০ বছরেরও কম বয়সের কিশাের ইবনে-সিনাকে সমৃদ্ধ রাজকীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশ করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এই গ্রন্থাগারে পড়াশােনা করেই তিনি অপরিমেয় জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। আর এই যুগেই আধুনিক পারসীয় সাহিত্যের উদ্ভব হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, ফিরদৌসী (৯১৪-১০২০ খ্রি.) এই সময়েই তার প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন। আবার এই সময়েই প্রথম মানসুরের (৯৬১-৭৬ খ্রি.) উজির বালআমি, আল-তাবারীর লেখা ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছিলেন। এভাবে উদ্ভূত পারসী ভাষার সর্বাধিক প্রাচীন গদ্য এখনও বিদ্যমান। মুসলিম বিজয়ের পর থেকেই পারসীয়রা তাদের সাহিত্য রচনায় আরবী ভাষা ব্যবহার করতেন, কিন্তু এই লেখকদের মাধ্যমেই পারস্যের গৌরবময় মুসলিম সাহিত্যের অগ্রগতির সূচনা হয়।
ইরানের সুশিক্ষিত রাজবংশগুলোর মধ্যে সামানীয়রা ছিল অন্যতম। কিন্তু ওই যুগে যে সমস্ত উপাদানগুলো অন্য রাজবংশগুলোর ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছিল, তারাও সেগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। অশান্ত সামরিক অভিজাতবস্ত্র ও পরনির্ভরশীল রাজতন্ত্রের স্বাভাবিক সমস্যাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আর একটি নতুন বিপদ, উত্তর দিকে তুর্কি যাযাবরদের থেকে উদ্ভূত সমস্যা। এমন কি যে সমস্ত তুর্কি ক্রীতদাসদের দিয়ে সামানীয়রা তাদের রাজদরবার পূর্ণ করেছিল, রাজ্যের শাসনক্ষমতা ক্রমশ তাদের হাতেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। অক্সাসের দক্ষিণ দিকে সামানীয় রাজবংশের শাসনাধীন অঞ্চল ৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে গযনবীদের হাতে চলে গিয়েছিল। একজন তুর্কি ক্রীতদাসের নেতৃত্বেই গযনবীরা শাসনক্ষমতা লাভ করেছিল। অক্সাস নদীর উত্তরাঞ্চল দখল করেছিলেন তুর্কিস্তানের তথাকথিত ইলেক (ইলাক) খান। তিনি ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বোখারা দখল করেন ও তার সাত বছর পরে পতনােন্মুখ সামানীয় রাজবংশের ওপর শেষ আঘাত হেনে তাদের শাসনের ইতি টানেন। শেষবারে মতাে না হলেও এই প্রথম মধ্য এশিয়ার তুর্কিরা ইসলামী দুনিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের অগ্রভাগে নিজেদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। চতুর্থ মুসলিম শতাব্দীতে ইসলামী দুনিয়ার সীমান্ত এলাকাগুলোতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ইরান ও তুরস্কের শাসকদের লড়াই আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির পটভূমি হিসাবে কাজ করেছিল। এরপর থেকে বাগদাদের খলিফার অধিকাংশ ক্ষমতা করায়ত্ত করা, বা বাস্তবে বসফোরাসের ওপরে বাগদাদে তাদের নিজস্ব অটোমান সাম্রাজ্য স্থাপন করার আগ পর্যন্ত তারা বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমাগত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিল।
ফাতিমীয় রাজবংশ (৯০৯ – ১১৭১ খ্রি., মিশর ও উত্তর আফ্রিকা)
অন্যত্র আলোচিত
ইখশিদীয় রাজবংশ (৯৩৫ – ৯৬৯ খ্রি., মিশর)
মিশর ও সিরিয়ায় স্বল্পমেয়াদী আব্বাসীয় শাসনের পর ফরগনা থেকে উদ্ভূত ইখশিদীয় (৯৩৫-৬৯ খ্রি.) নামে আর একটি তুর্কি রাজবংশ আল-ফুস্তাত-এ স্থাপিত হয়। এই ও রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে-তুগ্জ (৯৩৫-৪৬ খ্রি.) মিশরের বিশৃঙ্খল অবস্থার সামাল দেন এবং খলিফা আল রাযীর কাছ থেকে ৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইরানের পুরানাে রাজ-উপাধি ‘ইখশিদ’ গ্রহণ করেন। পরবর্তী দু’বছরে তুলুনীয়দের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আল-ইখশিদ তার আধা-স্বাধীন রাজ্যের সঙ্গে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনকে যুক্ত করেন। পরবর্তী কালে মক্কা ও আল-মদীনাও তার রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলে আল-হিজাজ নামে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী একটি বিতর্কিত অঞ্চলের ভাগ্য কয়েক শতাব্দীর জন্য মিশরের ভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
এক কৃষ্ণাঙ্গ হারেম-প্রহরী : মুহাম্মাদ আল-ইখশিদের পর উত্তরসূরি হয়েছিল তার দুই পুত্র, কিন্তু তারা কেবল নামেই শাসন করতেন। বাস্তবে সমস্ত সরকারি ক্ষমতা ভােগ করত আবু-আল-মিশ্ক কাফুর (কস্তুরীর সুগন্ধযুক্ত কর্পূর) নামে এক যােগ্য আবিসিনীয় হারেম-প্রহরী। প্রায় ৮ পাউণ্ড দাম দিয়ে এক তেল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আল-ইখশিদ তাকে কিনেছিলেন। কিন্তু ৯৬৬ খ্রি. থেকে ৯৬৮ খ্রি. পর্যন্ত কাফুরই একমাত্র শাসক ছিলেন। হামদানীয় নামে উত্তর প্রান্তে উদ্ভূত এক নতুন রাজবংশের ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি মিশর ও সিরিয়াকে সাফল্যের সঙ্গে রক্ষা করেন। কাফুরের প্রতিপক্ষ সঈফ-আল-দাওলা আল-হামদানির প্রশস্তিকারী ও তার সময়কার শ্রেষ্ঠতম কবি আল-মুতানাব্বি রচিত কবিতার মাধ্যমে কাফুরের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। অবশ্য এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, প্রথমদিকে কবিতায় তার প্রশংসা করা হলেও পরে এর মধ্য দিয়ে তাকে যথেষ্ট বিদ্রুপ করা হয়েছিল। অতি নগণ্য জীবন থেকে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস যেভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার শিখরে উঠেছিলেন, ইসলামী ইতিহাসে তা প্রথম হলেও শেষ ঘটনা নয়। অন্যান্য রাজবংশের মতাে ইখশিদীয় রাজবংশও বিশেষ করে তাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রজাদের আনুগত্য লাভের জন্য রাজকোষের অর্থের ব্যাপক অপচয় করতেন। মুহাম্মাদের রান্নাঘরে প্রতিদিন একশাে ছাগল, একশােটি ভেড়া, আড়াইশাে হাঁস, পাঁচশাে মুরগি, এক হাজার পায়রা, একশাে জার মিষ্টি লাগত। যখন কাব্যের ভাষায় কাফুরকে জানানাে হয়েছিল যে, তার সাফল্যে উল্লসিত হওয়ায় মিশরে ভূমিকম্প ঘটে তখন সে গর্বিত আবিসিনীয় সেই ভাবী ভূকম্পবিদকে ১০০০ দিনার পুরস্কার দিয়েছিলেন। এছাড়া তাদের আমলে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইখশিদীয়দের কোন অবদান ছিল না, কিন্তু জনকল্যাণের কোন কাজে তারা অবহেলা করেননি। এই বংশের ঐ শেষ প্রতিনিধি ১১ বছরের বালক আবু-আল-ফাওয়ারিস আহমদ ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট ফাতিমিয় জেনারেল জাওহারের কাছে পরাজিত হলে ইখশিদীয় রাজত্বের অবসান ঘটে।
ইখশিদীয় রাজবংশের শাসকগণ :
(১) তুগ্জ এর পুত্র মুহাম্মাদ আল ইখশিদ (৯৩৫-৪৬ খ্রি.)
(২) ১ এর পুত্র আবু আল কাশিম উনুযুর (৯৪৬-৬০ খ্রি.)
(৩) ১ এর আরেক পুত্র আলী (৯৬০-৬৬ খ্রি.)
(৪) ১ এর আরেক পুত্র আবু আল মিসক কাফুর (৯৬৬-৬৮ খ্রি.)
(৫) ৩ এর পুত্র আহমদ (৯৬৮-৬৯ খ্রি.)
আমির আল-উমারার ক্ষমতায় আরােহণ ও সামরিক শাসনের অধীনে খিলাফত (৯৩৬ – ৪৬ খ্রি.)
প্রায় ৫০ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে সামাররা তাদের রাজধানী হিসেবে থাকার পর আল-মুতাযিদের (৮৯২-৯০২) আমলে বাগদাদ আবার রাজধানীতে পরিণত হয়। এর ফলে গাটা দৃশ্যপটটি পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ঘটনাবলি একই ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। প্রকৃত শাসনক্ষমতা খলিফাদের হাত থেকে সেনাবাহিনীর হাতে চলে যেতে থাকে। এই সময়েই আবদুল্লা ইবনে আল-মুতাজের আবির্ভাব ঘটে। তার দ্বিতীয় কাজিন ভাই (পিতৃব্যপুত্র) আল-মুকতাদিরের সঙ্গে খলিফার পদ দখলের লড়াইয়ে জয়লাভ করে তিনি আল-মুর্তাজা নামে মাত্র একদিনের জন্য (১৭ ডিসেম্বর, ৯০৮ খ্রি.) খলিফার আসনে বসেছিলেন। তারপরই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে হত্যা করা হয়। একদিনের এই খলিফা রাজনীতিকের থেকেও বেশি মাত্রায় একজন কবি ও রসসাহিত্যিক ছিলেন। আল-ফিহ্রিস্ত ও ইবন-খালিকানে উল্লিখিত তার রচনাগুলোর অধিকাংশেরই আর কোন অস্তিত্ব নেই। আল-মুকতাদিরের ২৪ বছরের রাজত্বে (৯০৮-৩২ খ্রি.) ১৩ জন উজিরের উত্থান-পতন ঘটেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছিল। বিভ্রান্তি বাড়ানাের জন্যই খলিফার তুর্কি মা নিয়মিত রাজ্য প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতেন। ইবনে-মুকলা ছিলেন এই সমস্ত উজিরদের একজন। তিনি ছিলেন আরবী হস্তাক্ষর বিদ্যার একজন প্রতিষ্ঠাতা। আর একজন উজির ছিলেন আলী-ইবনে-ঈসা। দুর্নীতি ও অত্যাচারে পূর্ণ নির্মম ও নিষ্ঠুর এক রাজত্বে তিনি তার চরিত্রের সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছিলেন। আলীর দুটি উজিরতন্ত্র পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে তিনি অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রাজকোষকে স্ফীত করে তুলেছিলেন। শুধু তাই নয়, রাজ্য পরিচালনায় তিনি দক্ষতার যে নজির সৃষ্টি করেছিলেন তার কোন সমকক্ষও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। আল-মুকতাদির যখন খলিফা ছিলেন, সেই সময়ে উত্তর আফ্রিকায় ফাতিমীয় বংশের উবাইদুল্লাহ (৯০৯ খ্রি.) এবং স্পেনে উমাইয়া বংশের তৃতীয় আবদ-আল-রাহমান (৯২৯) খলিফার পদ ও প্রতীক ধারণ করেছিলেন। এর ফলে একই সময়ে তিনজন স্বীকৃত ও প্রতিদ্বন্দী খলিফার অবস্থান মুসলিম দুনিয়ায় এক অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। দুর্বল ও অক্ষম আল-মুকতাদির রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার দেহরক্ষী দলের প্রধান মুনিস আল-মুজাফ্ফরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মুনিস আল-মুজাফ্ফর ছিলেন হারেমের প্রহরী এবং খলিফা তাকে আমির আল-উমারা (সর্বাধিনায়ক) বলে একটি নতুন উপাধি দান করেছিলেন। মুনিস শীঘ্রই আসল শাসকে পরিণত হলেন। তিনি আল-মুকতাদিরকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন এবং তার জায়গায় সৎভাই আল-কাহিরকে নিয়োগ করলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিজের পদে পুনরায় ক্ষমতাসীন হবার পর আল-মুকতাদিরের দেহ থেকে তার মাথা কেটে বার্বার সেনারা তাদের নেতা মুনিসের কাছে পৌঁছালেন। আল-কাহিরও (৯৩২-৩৪ খ্রি.) তার পূর্বসুরিদের তুলনায় এমন কিছু বেশি সাফল্য লাভ করতে পারেননি। দ্বিতীয়বার ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তাকে অন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং যখন তাকে শেষবার দেখা গিয়েছিল তখন তিনি বাগদাদের রাস্তায় ভিক্ষা করছিলেন। আমির আল-উমারার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার দুই উত্তরসুরি আল-মুত্তাকি (৯৪০-৪৪ খ্রি.) ও আল-মুস্তাকফি (৯৪৪-৪৬ খ্রি.) একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অন্ধকারের জগতে প্রবেশ করেন। এক সময়ে বাগদাদে এমন তিনজন মানুষকে দেখা যেত যারা ইসলামী দুনিয়ার সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিলেন, পরে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, তাদেরকে অন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভর করেই তাদের দিন কাটত। আল রাযীর (৯৩৪-৪০ খ্রি.) আমলে আমি আল-উমারা শুক্রবারের ভাষণে খলিফার সঙ্গে নিজের নামও যুক্ত করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে একে নতুন পদ্ধতি বলে আখ্যা দেয়া যেতে পারে। ওই যুগে অল্প যে কজন খলিফা ক্ষমতাচ্যুত হননি, আল রাযী ছিলেন তাদের অন্যতম। কিন্তু তাকেও শেষ পর্যন্ত সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। আরবের ইতিহাস রচয়িতারা তাকে ‘শেষ প্রকৃত খলিফা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আসলে এর দ্বারা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনিই ছিলেন শেষ ব্যক্তি যিনি শুক্রবারের প্রার্থনা এবং রাজ্য প্রশাসনের বেশ কিছু বিষয় পরিচালনা করতেন। তিনিই শেষ ব্যক্তি যার কবিতা সযত্নে রক্ষা করা হয়েছিল। তার সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতা ও মর্যাদা অন্তর্হিত হয়েছিল। আর ততদিনে একটি বড় সৈন্যদলের প্রধান অধ্যক্ষ আমির আল উমারা মুসলিম রাজ্যের প্রকৃত শাসকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
সামরিক শাসনের অধীন বাগদাদের খলিফাগণ –
- (১৬) আল মুতাযিদ (৮৯২-৯০২ খ্রি.)
- (১৭) ১৬ এর পুত্র আল মুকতাফি (৯০২-৯০৮ খ্রি.)
- (১৮) ১৬ এর পুত্র আল মুকতাদির (৯০৮-৩২ খ্রি.)
- (১৯) ১৬ এর পুত্র আল কাহির (৯৩২-৩৪ খ্রি.)
- (২০) ১৮ এর পুত্র আল রাযি (৯৩৪-৪০ খ্রি.)
- (২১) ১৮ এর পুত্র আল মুত্তাকি (৯৪০-৪৪ খ্রি.)
- (২২) ১৭ এর পুত্র আল মুস্তাকফি (৯৪৪-৪৬ খ্রি.)
বুয়াইহিদ রাজবংশ (৯৩৪ – ১০৬২ খ্রি., ইরাক, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইরান) ও এর দ্বারা খিলাফতের নিয়ন্ত্রণ (৯৪৫ – ১০৬২ খ্রি.)
৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে খলিফা আল-মুস্তাকফি (৯৪৪-৪৬ খ্রি.) বাগদাদে বিজয়ী আহমদ ইবনে বুওয়াইহ্কে সংবর্ধনা জানালেন এবং তাকে সম্মানসূচক মুয়িজ আল দাওলা (যে রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করে) উপাধিতে ভূষিত করে তার আমির আল-উমারা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। আর এরই সঙ্গে সঙ্গে আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে আরও বেশি অন্ধকার যুগের সূচনা হলো। আহমদের বাবা আবু-সুজা বুওয়াইহ্ অন্যান্য অধিকাংশ রাজপদাধিকারীদের মতো রাজবংশের মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রাচীন সাসানীয় রাজাদের বংশধর বলে দাবি করেছিলেন। তিনি কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ তীরবর্তী পার্বত্য অঞ্চলের ডেলামাইট উচ্চভূমির অধিবাসীদের নিয়ে গর্বিত এক যোদ্ধা গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন। এরা বেশ কিছুদিন সামানীয় রাজবংশের কাজে সাহায্য করেছিল। তিনজন পুত্র সহ আহমদ প্রথমে ইসবাহান (ইসফাহান), তারপর শীরাজ (ফার্স প্রদেশে), এবং তার পরবর্তী দুবছরে আল আহওয়াজ (বর্তমান খুজিস্তান) ও কেরমান প্রদেশ দখল করেন। শীরাজ নতুন রাজবংশের রাজধানীতে পরিণত হয়। বাগদাদে (৯৪৫ খ্রি.) আহমদের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তুর্কি সেনারা পালিয়ে যায়, কিন্তু তার নতুন মনিব শিয়াপন্থী পারসীয়দের অভিভাবকত্বেও খলিফার অবস্থার কোন উন্নতি ঘটেনি। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ছিলেন একজন আমি আল-উমারা, তবুও খুতবাতে খলিফার সঙ্গে তারো নামের উল্লেখ রাখার জন্য মুইজ আল দাওলা জোরের সাথে দাবি করেছিলেন। এমনকি মুদ্রার ওপরেও তার নাম খোদাই করেছিলেন।
৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হতভাগ্য আল-মুস্তাকফিকে অন্ধ করে দেয়া হলো এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুতও করা হলো। এই ঘটনার নায়ক মুইজ আল দাওলা নতুন খলিফা হিসেবে আল-মুতিকে (৯৪৬-৭৪ খ্রি.) নিয়োগ করলেন। এতদিনে শিয়াদের অনুষ্ঠানগুলো তাদের যথার্থ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হলো। বিশেষ করে আল হুসাইনের মৃত্যুবর্ষে (মহররমের দশম দিন) জনসাধারণের শোকপ্রকাশ ও গাদির আল-খুমে তার উত্তরসুরিরূপে আলীর নিয়োগ সংক্রান্ত মুহাম্মাদের ঘোষণার দিনে আনন্দোচ্ছ্বাসের প্রকাশও স্বীকৃতি পেল। আর অন্যদিকে আব্বাসীয় খিলাফতও তার চরম অবমাননার যুগে প্রবেশ করল। সেইসঙ্গে বিশ্বাসীদের নেতা বা আমির উল মুমিনীন সর্বাধিনায়ক বা আমীর আল-উমারাহ্ এর হাতে নিছক পুতুলে পরিণত হয়েছিল। কখনও কখনও দবি করা হলেও ইসলামী দুনিয়ার ইতিহাসে বুওয়াইহিদরাই প্রথম সুলতান উপাধি গ্রহণ করেনি। সে যুগের মুদ্রা থেকে জানা যায় যে, মুইজ আল দাওলা, ইমাদ আল দাওলা (রাজ্যের প্রতিপালক) ও রুকন আল দাওলা (রাজ্যের স্তম্ভ) ইত্যাদি সম্মানসূচক উপাধির সঙ্গে আমির বা মালিক শব্দটি যুক্ত করেই তারা নিজেদের সন্তুষ্ট রাখত। উপর্যুক্ত তিনটি সম্মানসূচক খেতাব দিয়ে যথাক্রমে বুওয়াইহ্ এর তিন পুত্রকে সম্মানিত করেছিলেন খলিফা। এরপর একই ধরণের জমকালো খেতাব বা উপাধি গ্রহণ করাটা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুইজের বুওয়াইহি বংশের বেশ কয়েকজন উত্তরসুরি বংশের বেশ কয়েকজন উত্তরসুরি আমির আল উমারা খেতাবও গ্রহণ করেছিলেন, যদিও এটা একটা সম্মানসূচক খেতাব ছাড়া আর কিছুই না।
শতাব্দী বা তার কাছাকাছি সময় ধরে (৯৪৫-১০৫৫ খ্রি.) বুওয়াইহিদ রাজবংশের আধিপত্যের যুগে এবং তাদের ইচ্ছামত খলিফা নিয়োগ করত ও তাদের পদচ্যুত করত। ফারসে অবস্থিত বুওয়াইহিদ রাজ্যের রাজধানী শীরাজে বসে শাসকেরা আল-ইরাকে একটি প্রদেশ হিসেবে শাসন করত। বাগদাদে তারা বহু সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ চালু করেছিল। এদের যৌথ নাম ছিল দার আল মামলাকা (রাজ্যের আবাস)। বাগদাদ তখন আর মুসলিম দুনিয়ার প্রাণকেন্দ্র ছিলনা, কারণ শীরাজ, কায়রো্, কর্ডোভা তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে ভাগ করে নিয়েছিল।
আযুদ-আল-দাওলা : রুকনের পুত্র আযুদ-আল-দাওলার (রাষ্ট্রের সহায়ক হাত, ৯৪৯-৮৩ খ্রি.) শাসনকালেই বুওয়াইহিদ রাজবংশ তাদের সাফল্যের চূড়ায় উঠেছিল। আযুদ শুধু মহত্তম বুওয়াইহিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত শাসক। আল-ইরাকে ও পারস্যে বুয়াইহিদ শাসকদের অধীনে গড়ে ওঠা বহু ছােট ছােট রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি যে বড় রাজ্য গড়েছিলেন তা আয়তনে প্রায় একটি সাম্রাজ্যের সমান ছিল। আযুদ-আল-দাওলা বিয়ে করেছিলেন খলিফা আল-তাইয়ের মেয়েকে। খলিফা অবশ্য তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এই আশায় যে, তাহলে খিলাফতের একজন উত্তরসূরি পাওয়া যাবে। ইসলামী দুনিয়ায় আযুদই প্রথম শাসক যিনি শাহানশাহ উপাধ গ্রহণ করেছিলেন। শীরাজে তার রাজদরবার থাকলেও তিনি বাগদাদ শহরটিকে সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন, মজে-যাওয়া খালগুলোকে সংস্কার করেছিলেন এবং অন্যান্য বহু শহরে মসজিদ, হাসপাতাল এবং রাজভবন গড়েছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও আযুদের কোষাধ্যক্ষ মিসকাওয়াইহ-এর লেখা থেকে ওই সমস্ত তথ্য জানতে পারা যায়। তার পরহিতকর উদ্যোগের জন্য আযুদ তার রাজকোষ থেকে টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। আলীর অনুমান করা সমাধির ওপর নির্মিত পবিত্র স্থানটি (মাশহাদ) ছিল তার উদ্যোগে তৈরি হওয়া একটি আকর্ষণীয় বাড়ি। কিন্তু আল-বিমারিস্তান আল-আযুদি নামে পরিচিত বাগদাদের বিখ্যাত হাসপাতালটি ছিল সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য। ১০০,০০০ দিনার ব্যয় করে তিনি ৯৭৮-৭৯ খ্রিস্টাব্দে এই বাড়িটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। হাসপাতালে ২৪ জন চিকিৎসক ছিলেন এবং তারা চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাদানের শিক্ষকমণ্ডলী হিসাবেও কাজ করতেন। আল-মুতানাব্বির মতাে কবিরাও আযুদের গৌরব নিয়ে গান রচনা করেছিলেন। বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ আবু-আলী আল-ফারিসি তার জন্য কিতাব আল ইজআহ (ব্যাখ্যামূলক বই) লিখেছিলেন। তিনি ও অন্যান্য লেখকেরা তাদের রচনাবলি তার নামে উৎসর্গ করেছিলেন। শান্তি লাভের কলাকৌশলের চর্চা করতে গিয়ে আযুদ তার খ্রিস্টান উজির নাসর ই-হারুনের মতাে একজন দক্ষ সহযােগীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। খলিফার সম্মতি নিয়ে ইন-হারুন গির্জা ও মঠ তৈরি ও তাদের সংস্কার সাধন করেছিলেন।
সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চায় পৃষ্ঠপােষকতা দানের যে পূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন আযুদ আল-দাওলা, তার পুত্র শারাফ আল-দাওলা (৯৯৮৩-৮৯) তা অনুসরণ করে চলেছিলেন। তার মৃত্যুর এক বছর আগে আল-মামুনের অনুকরণের শারাফ একটি বিখ্যাত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করিয়েছিলেন। আযুদের আর এক ছেলে ও দ্বিতীয় উত্তরসূরি বাহা-আল-দাওলা (৯৮৯-১০১২ খ্রি.) ৯৯১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-তাইকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন এবং তার প্রচুর ধনসম্পদ হস্তগত করেছিলেন। তার রাজদরবারের সাবুর ই-আরদাশির নামে একজন সুশিক্ষিত পারসীয় উজির ছিলেন। ৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে সাবুর একটি শিক্ষায়তন গড়ে তুলেছিলেন বাগদাদে এবং এই শিক্ষায়তনে ১০০০০ বইয়ের একটি গ্রন্থাগার ছিল। ওই শহরে ছাত্রাবস্থায় যখন পড়াশােনা করতেন তখন সিরিয়ার কবি আল-মাআররি গ্রন্থাগারটি ব্যবহার করতেন। মনে রাখা দরকার যে, বুওয়াইহিদ রাজত্বে ইখওয়ান আল-সাফার যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু রাজা নিজেই তখন অবক্ষয়ের সম্মুখীন, বাহা, শারাফ ও তাদের তৃতীয় ভাই সামসাম-আল দাওলার মধ্যেকার বংশাতীত ও পারিবারিক ঝগড়া তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যেও সংক্রামিত হল। সর্বোপরি শিয়া ভাবাদর্শের প্রতি বুওয়াইহিদদের আনুগত্য সুন্নি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী বাগদাদে প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং তারই পরিণতিতে রাজবংশের পতন হল। সেলজুক বংশের তুঘরিল বেগ ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রবেশ করলেন এবং বুওয়াইহিদ শাসনের অবসান ঘটালেন। আল-ইরাকে বুওয়াইহিদ বংশের শেষ প্রতিনিধি আল-মালিক আল-রহীম (দয়াল রাজা, ১০৪৮-৫৫ খ্রি.) বন্দীদশায় তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন।
বুওয়াইহিদ একাধিপত্যের আমলে (৯৪৫-১০৫৫ খ্রি.) আব্বাসীয় খলিফাগণ (বুওয়াইহিদ আমলের বাইরের খলিফাদের শাসনকালের তারিখ দেয়া হয়নি) –
- (১৬) আল-মুতাযিদ
- (১৭) ১৬ এর পুত্র আল-মুকতাফি
- (১৮) ১৬ এর পুত্র আল-মুকতাদির
- (১৯) ১৬ এর পুত্র আল-কাহির
- (২০) ১৮ এর পুত্র আল-রাযী
- (২১) ১৮ এর পুত্র আল-মুত্তাকি
- (২২) ১৭ এর পুত্র আল-মুস্তাকফি
- (২৩) ১৮ এর পুত্র আল-মুতি (৯৪৬-৭৪)
- (২৪) ২৩ এর পুত্র আল-তায়ী (৯৭৪-৯১)
- (২৫) ২১ এর পুত্র আল-কাদির (৯৯১-১০৩১)
- (২৬) ২৫ এর পুত্র আল-কাইম (১০৩১-৭৫)
গযনবী রাজবংশ (৯৭৭ – ১১৮৬ খ্রি, ট্রান্সক্সিয়ানা, আফগানিস্তান, উত্তর-পশ্চিম ভারত, ইরানের কিছু অংশ)
তুর্কি ক্রীতদাসদের মধ্যে জনৈক আলপতিগিনকে সামানীয়রা তাদের রাজ-প্রশাসনের উঁচু পদে বসিয়েছিলেন। একজন সাধারণ দেহরক্ষী হিসেবে তার জীবন শুরু হয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই তিনি দেহরক্ষী বাহিনীর নেতা হন। তারপর ৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি খোরাসানের গভর্নর পদে উন্নীত হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ক্ষমতাহীন নতুন সামানীয় রাজার আনুগত্য হারান। এবং তাকে রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের দেশীয় শাসকদের পরাস্ত করে তিনি গজনী দখল করেন এবং সেখানে একটি স্বাধীন অঞ্চল গড়ে তােলেন। পরবর্তীকালে এটাই আফগানিস্তান (৯৬২-১১৮৬ খ্রি.) ও পাঞ্জাবের গযনবী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। অবশ্য আলপতিগিনের জামাই ও এক ক্রীতদাস সুবুক্তিগিনকেই (৯৭৬-৯৭ খ্রি.) গযনবী রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। পরবর্তীকালে যে ১৬ জন গযনবী তার উত্তরসূরি হয়েছিলেন তারা সকলেই ছিলেন তার পর্যায়ক্রমিক বংশধর। ভারতের পেশােয়ার ও পারস্যের খোরাসানকে অন্তর্ভুক্ত করে তিনি তার রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেন। অবশ্য উল্লেখ করা দরকার যে, সামানীয় রাজবংশের অধীনে থেকেই তিনি প্রথম খোরাসান জয় করেছিলেন।
গজনীর মাহমুদ : সুবুক্তিগিনের পুত্র মাহমুদ (৯৯৯-১০৩০ খ্রি.) ছিলেন এই রাজবংশের সবচেয়ে সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব। তার রাজধানী গজনী একটি উঁচু মালভূমির ওপরে অবস্থিত ছিল। সেখান থেকে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল দেখা যেত, কাবুলের উপত্যকার মধ্য দিয়ে সহজেই সেখানে প্রবেশ করা যেত। তার রাজধানীর এই সুবিধাজনক অবস্থান বেশ কয়েকটি পূর্বমুখী অভিযান চালাতে তাকে সাহায্য করেছিল। ১০০১ ও ১০২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন এবং এর মধ্যে দিয়ে রাজধানী লাহাের-সহ পাঞ্জাব, মুলতান ও সিন্ধু প্রদেশের অংশবিশেষ দখল করেছিলেন। এর ফলে পাঞ্জাবে স্থায়ীভাবে মুসলিম প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমস্ত অভিযানের মধ্য দিয়ে হিন্দু মন্দির থেকে মাহমুদ প্রচুর পরিমানে ধনসম্পদ লুঠ করেছিলেন এবং তার সমসাময়িক মুসলিম রাজাদের মধ্যে মূর্তিভঙ্গকারী ও প্রতিমা পূজাবিরােধী রক্ষণশীল ইসলাম ধর্মের চ্যাম্পিয়ন রূপে এক ঈর্ষণীয় মর্যাদা লাভ করেছিলেন। ইসলাম ধর্মে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘােষণা করেছিলেন। এই কারণে ১০০১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাকে আল-গাযী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। মুসলিম ইতিহাসে তিনি সর্বপ্রথম এই উপাধি লাভ করেছিলেন।
মাহমুদ তার রাজত্বের পশ্চিম সীমানাও সম্প্রসারিত করেছিলেন। সেই সময়ে খলিফা পদটি ছিল শিয়াপন্থী বুওয়াইহিদদের নিয়ন্ত্রণে। মাহমুদ তাদের কাছ থেকে ইসবাহান (ইসপাহান) ও আল-রায়ি (রেই, তেহরান) সহ পারসীয় ইরাক কেড়ে নেন। সুন্নিপন্থী মাহমুদ তার আগ্রাসনের সময় থেকেই খলিফা আল কাদিরের (৯১১-১০৩১ খ্রি.) সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছিলেন। তার কাছ থেকেই মাহমুদ ইয়ামিন-আল-দাওলা (রাজ্যের ডান হাত) উপাধি পেয়েছিলেন। নিজেদের দিক থেকে তিনি এবং তার পরবর্তী কয়েকজন উত্তরসূরি তাদের মুদ্রায় আমির (গভর্নর) বা সায়্যিদ (প্রধান) উপাধি গ্রহণ করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। যদিও মুসলিমদের মধ্যে মাহমুদই প্রথম সুলতান উপাধি নিয়েছিলেন। সেই সময়কার মুদ্রালিপি থেকে জানা যায় যে, সেলজুক শাসকেরাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম এই উপাধিটি ব্যবহার করতেন। পূর্বে উত্তর ভারত এবং পশ্চিমে পারসীয় ইরাক ছাড়াও গােটা খোরাসান, রাজধানী বলখ-সহ তুখারিস্তান, উত্তরে ট্রান্সঅক্সিয়ানার কিছু অংশ ও দক্ষিণে সিজিস্তান (সিস্তান) তার রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুন্দর সুন্দর বাড়ি দিয়ে তিনি তার রাজধানীটিকে সাজিয়েছিলেন। একটি বিরাট শিক্ষায়তন তৈরি করেছিলেন এবং তার অতি দানশীল রাজদরবারটিকে কবি ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রধান আশ্রয়ে পরিণত করেছিলেন। আরব ঐতিহাসিক আল-উতবি (১০৩৬ খ্রি.), বিজ্ঞান ও ইতিহাসের বিশিষ্ট লেখক আল-বিরুনী, বিখ্যাত পারসীয় কবি ফিরদৌসী ছিলেন তার সাহিত্যসভার উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে এশিয়া, আমেরিকা ও ইউরােপে এই কবির সহস্রতম জন্মবর্ষ পালিত হয়েছিল। ফিরদৌসী তার বিখ্যাত মহাকাব্য ‘শাহনামা’ উৎসর্গ করেছিলেন মাহমুদকে। কিন্তু এই মহাকাব্যের ৬০,০০০ কবিতার চরণ রচনা করে তিনি ৬০,০০০ দিনারের পরিবর্তে পেয়েছিলেন মাত্র ৬০,০০০ দিরহাম। এর জন্য কবি তার পৃষ্ঠপােষককে কঠোর বিদ্রপ করেছিলেন এবং প্রাণ রক্ষা করতে শেষপর্যন্ত তাকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল।
ইসলামী দুনিয়ায় চুড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইরানের শাসকদের সঙ্গে তুর্কি শাসকদের যে লড়াই চলছিল, গযনবী রাজবংশের উত্থানের মধ্য দিয়ে সেই লড়াইয়ে তুর্কিদের প্রথম বিজয় সূচিত হয়েছিল। তবুও সামানীয় বা সাফ্ফারীয় রাজত্বের তুলনায় গযনবীদের শাসনে মৌলিক কোন পার্থক্য ছিল না। অস্ত্রের জোরেই এই রাজত্ব টিকে ছিল এবং যে মুহূর্তে শাসকের দৃঢ়মুষ্ঠি আলগা হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই সেই রাজত্বের পতন ঘটেছিল। মাহমুদের মৃত্যুর পর সেই একই ঘটনা ঘটেছিল। এভাবেই পূর্বের রাজ্যগুলো পার্বত্য উচ্চভূমিতে অবস্থিত রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং তারই পরিণতিতে ভারতবর্যে অগণিত স্বাধীন মুসলিম রাজবংশের আবির্ভাব ঘটেছিল। উত্তরে তুর্কিস্তানের খানেরা এবং পশ্চিমে পারস্যের সেলজুকরা টুকরো টুকরাে করে দিয়েছিল গযনবী রাজত্ব। আর মধ্যভাগে আফগানিস্তানের ঘুরীরা শেষ আঘাত হেনেছিল এবং ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে লাহােরে শেষ গযনবী রাজ্য তারা ধ্বংস করে দিয়েছিল।
গযনভি সাম্রাজ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান
ঘুরি সাম্রাজ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান
সেলজুক রাজবংশ (১০২৯ – ১১৯৪ খ্রি. আনাতোলিয়া, লেভান্ত, ইরান, ট্রান্সক্সিয়ানা, আফগানিস্তান) ও এদের দ্বারা খিলাফতের নিয়ন্ত্রণ (১০৫৫ – ১১১৮ খ্রি.)
সেলজুক তুর্কিদের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে ইসলাম ও খলিফা সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি নতুন ও উল্লেখযােগ্য যুগের সূচনা ঘটল। ১১শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পূর্বদিক থেকে তাদের আবির্ভাবের পর খলিফার হাতে ক্ষমতা বলতে আর কিছুই ছিল না এবং তার সাম্রাজ্য প্রায় পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। স্পেনে উমাইয়ারা এবং মিশর ও উত্তর আফ্রিকায় শিয়াপন্থী ফাতিমিয়রা তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করল। বাগদাদ থেকে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার কোন আশাই আর রইল না। উত্তর সিরিয়া ও উচ্চ মেসােপটেমিয়া চলে গেল অশান্ত আরব যােদ্ধাদের হাতে, তাদের কেউ কেউ আবার রাজবংশ স্থাপন করতে সফল হয়েছিল। পারস্য, ট্রান্সঅক্সিয়ানা এবং পূর্ব ও দক্ষিণের দেশগুলো বুওয়াইহিদ ও গযনবীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেল অথবা কোথাও কোথাও ছােট ছােট রাজবংশ ক্ষমতা দখল করল এবং সুযােগ পেলেই অন্যকে গলা টিপে মারার সুযােগের অপেক্ষায় রইল। সুন্নি ও শিয়াদের সংঘর্ষই হয়ে উঠল দৈনন্দিন ঘটনা। ইসলামধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবার মতাে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হল।
এরকম ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অবস্থার মধ্যে সেলজুক নামে এক সেনাপতি ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিজাতির ওঘুজ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। তুর্কিস্তানের কিরগিজ সমভূমির এই যাযাবর শ্রেণীভুক্ত লােকেরা বোখারাতে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে এবং আন্তরিকভাবেই সুন্নি ভাবাদর্শকে গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে অথচ নিশিচতভাবে সেলজুক এবং পরে তার পুত্ররা ইলেক খান ও সামানিদদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অগ্রসর হতে থাকে। সেলজুকের পৌত্র তুঘরিল ও তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে খোরাসান অভিমান করেন। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে দুই ভাই গযনবীদের কাছ থেকে মার্ভ ও নাইসাবুর ছিনিয়ে নেয়। এর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বলখ, এস্তারাবাদ (বর্তমান গোরগান), তাবারিস্তান (বর্তমান মাজান্দারান), খাওয়ারিজম (বর্তমান খোরাস্মিয়া), হামদান, আল-রায়ি (বর্তমান রেই, তেহরান) ও ইসবাহান (ইসফাহান) তাদের দখলে আসে। তাদের সামনে বুওয়াইহিদদের প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়ে। তার দুর্ধর্ষ তুর্কি উপজাতীয় সেনাদের সঙ্গে নিয়ে তুঘরিল বেগ ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর বাগদাদ অবরােধ করেন। বুওয়াইহিদ রাজবংশের শেষ প্রতিনিধির শাসনাধীন বাগদাদের সামরিক গভর্নর ও তুর্কি জেনারেল আল-বাসাসিরি রাজধানী ত্যাগ করেন এবং খলিফা আল-কায়িম (১০৩১-১০৭৫ খ্রি.) অক্রমণকারী সেলজুকদেরকে মুক্তিদাতা রূপে গ্রহণ করেন।
তুঘরিলের ক্ষমতায় আরােহণ : এক বছর পরে তুঘরিল বাগদাদে ফিরে এলেন এবং বিরাট অনুষ্ঠান করে তাকে সংবর্ধনা জানানাে হল। ঢিলে লম্বা কোট পরে এবং হাতে পয়গম্বরের দণ্ড ধরে খলিফা পর্দার পিছনে একটি প্ল্যাটফর্মের ওপরে বসেছিলেন; বিজয়ী রাজা এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পর্দাটি তুলে ধরা হল। সংযুক্ত আর একটি প্ল্যাটফর্মে তুঘরিল বসলেন এবং এক দোভাষীর মাধ্যমে খলিফার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। বিজয়ী রাজাকে সাম্রাজ্যের শাসক করা হল এবং পূর্ব ও পশ্চিমের রাজা হিসাবে তাকে স্বাগত জানানাে হল। আল-সুলতান (শাসনক্ষমতার অধিকারী, সুলতান) হল তার আনুষ্ঠানিক উপাধি। এক নতুন ও আরও সদাশয় অভিভাবকের অধীনে চলে গেল খলিফা সাম্রাজ্য। তুঘরিল তখন উত্তর দিকে এক অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। তার সাময়িক অনুপস্থিতির সুযােগে স্বেচ্ছায় ফাতিমিয় স্বার্থের পক্ষে প্রচারকারী আলবাসাসিরি ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে তার দাইলমীয় ও অন্যান্য সেনাদের নেতৃত্বে ফিরে এলেন ও রাজধানী পুনরায় দখল করলেন। এই সময় কায়রাের প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতিমিয় আল-মুস্তানসির (১০৩৫-৯৪)-এর পক্ষে তার ও আন্যান্য আব্বাসীয়দের সমস্ত অধিকার খারিজ করে একটি দলিলে খলিফা স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলেন। আল-কায়িমের পাগড়ি খেলাফতির স্মারক, মহানবীর জুব্বা এবং অন্যান্য পবিত্র স্মারক-সহ তার রাজপ্রাসাদের একটি জানালা জয়ের স্মৃতিচিহ্ন রূপে কায়রােতে পাঠানাে হল। ফিরে আসার পর তুঘরিল পুনরায় তার নিজের পদে আল-কায়িমকে বসালেন এবং বিদ্রোহ করার জন্য আল-বাসাসিরিকে তার জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হল। (১০৬০ খ্রি.)। দাইলমীয় সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হল এবং বুওয়াইহিদ বংশ চিরকালের মতাে ক্ষমতা হারাল। তুঘরিল (১০৩৭-৬৩ খ্রি.) তার ভাইপাে ও উত্তরসূরি আলপ আরসলান (১০৬৩-৭২ খ্রি.) ও ভাইপাের ছেলে মালিকশাহের (১০৭২-৯২ খ্রি.) রাজত্বকালকেই মুসলিম ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যে সেলজুক কর্তৃত্বের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অধ্যায় বলা যেতে পারে। সেলজুক শাসকেরা সমস্ত দিকে তাদের বিজয় অভিযানকে সম্প্রসারিত করে চলল যতক্ষণ পর্যন্ত না পশ্চিম এশিয়া একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম রাজ্যে পরিণত হল এবং মুসলিম সেনাবাহিনীর হৃত গৌরব পুনরুজ্জীবিত হল। মধ্য এশিয়ার এই নতুন জাতি বিশ্বে ইসলাম ধর্মের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম ধর্মের সংগ্রামে তাদের সর্বস্ব দিতে উদ্যত হল। এই সমস্ত বার্বার “নাস্তিকেরা” ইসলাম ধর্মের অনুগামীদের ওপর চরম অত্যাচার চালিয়েছিল আবার একই সময়ে বিজিতদের ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং সেই ধর্মীয় আদর্শের একনিষ্ঠ সমর্থকেও পরিণত হয়েছিল। তবে ওই ধর্মের বৈচিত্র্যময় ইতিহাসে এটি তেমন কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এদের জ্ঞাতি ১৩শ শতাব্দীর মােঙ্গলেরা ও ১৪শ শতাব্দীর প্রথম দিককার অটোমান তুর্কিরাও একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল। ইসলামী রাজনৈতিক আদর্শের অন্ধকারতম অধ্যায়েই ইসলাম ধর্মীয় আদর্শ তার সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিজয়গুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি অর্জন করেছিল।
আলপ আরসলান : তার রাজত্বের দ্বিতীয় বছরেই আলপ আরসলান (বীরসিংহ) খ্রিস্টান আর্মেনিয়ান রাজধানী ও পরবর্তীকালের একটি বাইজান্টাইন প্রদেশ আনি দখল করেছিলেন। শীঘ্রই বাইজান্টাইনের চিরশত্রুদের সঙ্গে তার বিরােধ শুরু হয়ে গেল। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনিয়ার লেকভ্যানের উত্তরে ম্যানজিকার্ট (মালাজকির্ড, মালাসজির্ড)-এর চূড়ান্ত যুদ্ধে আলপ জয়লাভ করলেন এবং সম্রাট রােমানাস ডায়ােজিনিসকে বন্দী করলেন। সেলজুক যাযাবর উপজাতিরাই প্রথম মুসলিম হিসেবে রােমানদের দেশে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তারা এখন এশিয়া মাইনরের মালভূমি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করল। আর তখন থেকেই ওই অঞ্চলটি দার আল-ইসলামের (ইসলামের পবিত্র আবাস) অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠল। এই সেলজুক যাযাবররাই এশিয়া মাইনরকে তুর্কি প্রভাবাধীন অঞ্চলে পরিণত করার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। আলপের জ্ঞাতিভাই সুলাইমান ইনকুতলুমিশ পরে এই অঞ্চলটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তিনি রূম-এ সেলজুকদের সুলতানি স্থাপন করেন (১০৭৭ খ্রি.)। দূরবর্তী নিসিয়া (নিকিয়া, তুর্কিভাষায় ইজনিক)-কে প্রথমে রাজধানী করা হয় এবং প্রথম ক্রুসেডের ক্রুসেডাররা এই শহর থেকেই সুলাইমানের পুত্র ও উত্তরসূরি কিলিজ আরসলানকে বিতাড়িত করেন। ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দের পর এশিয়া মাইনরে সবচেয়ে ধনী সমৃদ্ধ ও সুন্দর বাইজান্টাইন শহর আইকোনিয়াম (কুনিয়া, কোনিয়ে) ওই দেশে সেলজুক রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। ইতিমধ্যে আলপের পুত্র তুতুশ কর্তৃক ১০৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সিরিয়ার সেলজুক রাজবংশ (১০৯৪-১১১৭ খ্রি.) প্রথম ক্রুসেডের যােদ্ধাদের অগ্রগতি রােধ করার জন্য নিজেদের ভূমিকা পালন করছিল। ১০৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আলপের দখলে ছিল আলেপ্পো। সেখানেই তিনি ফাতিমিয়দের অগ্রগতি রােধ করেন এবং তাদের হাত থেকে মক্কা ও আল-মদীনা পুনরুদ্ধার করেন।
সাফল্যের শীর্ষে সেলজুক রাজবংশ : সেলজুক রাজবংশের প্রথম দু’জন সুলতান বাগদাদে বাস করতেন না, কিন্তু সেখানকার একজন স্থানীয় সামরিক প্রশাসকের মাধ্যমে তারা তাদের শাসনক্ষমতা চালাতেন। আলপ কখনও খলিফার রাজধানী বাগদাদ দেখতে যাননি বা দেখেননি। ইস্ফাহান ছিল তার শাসনক্ষমতার কেন্দ্র; তার পূর্বসূরির শাসনক্ষমতার কেন্দ্র ছিল মার্ভ ও আল-রায়ি। ১০৯১ খ্রিস্টাব্দের শীতকাল পর্যন্ত অর্থাৎ মালিকশাহের রাজত্বের ধ্বংসের কিছুকাল আগে পর্যন্ত সেলজুক রাজবংশের শাসনকেন্দ্র আব্বাসীয় খলিফার রাজধানী বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়নি। খলিফা একজন পুতুল শাসকে পরিণত হয়েছিলেন এবং তিনি সুলতানের ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হতেন। শুধু তাই নয়, বিদেশী শক্তি তাকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে রেখেছিল এবং তার উচ্চপদের সমস্ত রাজকীয় অধিকার ও সুযােগ-সুবিধা দিয়ে এই পুতুল শাসককে রাজকীয় সজ্জায় সাজিয়ে রেখেছিল। শুক্রবারের প্রার্থনায় খলিফার নামের সঙ্গে সুলতানের নামও উচ্চারিত হত। ১০৮৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মুকতাদি (১০৭৫-৯৪ খ্রি.) সুলতান মালিকশাহের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন এবং এবং যখন তার একটি ছেলের জন্ম হল তখন মালিকশাহ্ তার নাতির হাতে খলিফা সাম্রাজ্য ও সুলতানি সিংহাসন তুলে দেবার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়ে যায়।
মালিকশাহ্র (১০৭২-৯২ খ্রি.) আমলেই সেলজুক রাজবংশ তাদের সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায়। দৈর্ঘ্যে তার রাজত্ব তুর্কিস্তানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত শহর কাশগড় থেকে জেরুজালেম ও প্রস্থে কনস্ট্যান্টিনােপল থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তুত হয়। যে মাঝিরা তাকে অক্সাস নদী পার করে দিয়েছিল, ভাড়া দেবার জন্য তিনি অ্যান্টিয়োকে তাদের প্রতিনিধির নামে ড্রাফট পাঠিয়েছিলেন। একটি বিস্তৃত সাম্রাজ্যের শাসকের চেয়েও মালিকশাহ্ ছিলেন আরও কিছু বেশি। তিনি রাস্তা ও মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, প্রাচীরের সংস্কার করেছিলেন, খাল খনন করেছিলেন এবং মক্কা পর্যন্ত তীর্থযাত্রার রাস্তায় অসংখ্য পান্থশালা তৈরি করেছিলেন। তার জীবনীকারের লেখা থেকে জানা যায় যে, তার আমলে ওই বিরাট সাম্রাজ্যের সমস্ত রাস্তাই ছিল নিরাপদ এমনকী ট্রান্সঅক্সিয়ানা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাই মরুযাত্রী, এমনকী একজন বা দু’জনের পক্ষেও কোনরকম বিশেষ নিরাপত্তা ছাড়াই চলাচলের পক্ষে সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। এই সময়ে বাগদাদে ময়লা জল নিষ্কাশন ও আবর্জনা দূর করার জন্য পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ইবন-আল-আসীরের জন্য খলিফা আল-মুকতাদিকে কৃতিত্ব দান করলেও এই সমস্ত কাজ শুরু করেছিলেন সেলজুক সুলতান। টাইগ্রিসের তীরে অবস্থিত সাধারণ স্নানাগারের নােংরা জল অপসারণের জন্য ভূগর্ভস্থ খানা-নির্মাণ এবং মাছ পরিষ্কার ও সংরক্ষণের জন্য বিশেষ জায়গার ব্যবস্থা করা এইসব পদক্ষেপের মধ্যেই পড়ে। ইবনে খাল্লিকানের লেখায় উল্লিখিত ছােট একটি সত্য কাহিনী মালিকশাহ্র চরিত্র সম্পর্কে আমাদের জানতে সাহায্য করে। তুস-এর একটি মসজিদ দেখে সুলতান তার সঙ্গী উজির নিজাম-আল-মুলককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, মসজিদে ঢুকে কিসের জন্য তিনি প্রার্থনা করলেন। তখন সেই উজির উত্তর দিলেন, যে-ভাইয়ের সঙ্গে সুলতানের যুদ্ধ চলছিল তাতে সুলতানের জয় কামনা করে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলেন। মালিকশাহ্ বললেন, “আমার দিক থেকে বলতে পারি যে, এরজন্য আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিনি। মুসলিমদের শাসন করার পক্ষে যে উপযুক্ত এবং প্রজার স্বার্থের দিক থেকে যে আরও বেশি উপকারী, তাকে জেতানাের জন্যই আমি আল্লাহর কাছে কামনা করছিলাম।”
নিজাম-আল-মুলক : আলপ আরসলান ও মালিকশাহের প্রশাসনে যে ব্যক্তি প্রধান পরিচালকের কাজ করতেন তিনি হলেন তাদের পারসীয় উজির নিজাম-আল-মুলক (রাজ্যের সংগঠন)। তাকে ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অলঙ্কার বলে আখ্যা দেওয়া যায়। ইবনে খাল্লিকানের লেখা যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয় তা হলে আমরা দেখব যে “মালিকশাহ্র রাজত্বকাল-সহ মােট কুড়ি বছর ধরে নিজাম-আল-মূলক তার নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। আর সুলতান কেবলমাত্র সিংহাসনে বসে থাকতেন বা শিকারের পিছনে ধাওয়া করাটা উপভোগ করতেন।” তার পিতা ও পিতামহের মতাে শিক্ষাদীক্ষাহীন ও সম্ভবত নিরক্ষর হলেও নিজাম-আল মুলকের পরামর্শ অনুযায়ী মালিকশাহ্ তার নবনির্মিত মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ১০৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতির্বিদদের একটি সম্মেলন ডেকেছিলেন এবং পারসীয় ক্যালেণ্ডারের সংজ্ঞা করতে তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর ফলে তৈরি হয়েছিল জালালি ক্যালেণ্ডার (তারিখ)। মালিকশাহ্র ইচ্ছানুযায়ী এই ক্যালেন্ডার তৈরি হয়েছিল বলে তার পুরাে নাম জালাল-আল-দিন (ধর্মের মহত্ত্ব) আবু-আল-ফাহ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এক আধুনিক গবেষকের মতে, এই ক্যালেণ্ডারটি “আমাদের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভুল।” নিজাম-আল-মুলক নিজে ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান ও শিক্ষিত মানুষ। তার কলম থেকে আমরা ‘সিয়াসাত-নামাহ’ নামে রাজ্য পরিচালনা সংক্রান্ত অন্যতম উল্লেখযােগ্য গবেষণামূলক পুস্তিকা পাওয়া গেছে। মালিকশাহ্র পরামর্শ অনুযায়ী একটি প্রতিযােগিতার ফল হিসেবে তিনি এই গবেষণা সন্দৰ্ভটি রচনা করেছিলেন। ভাল রাষ্ট্র প্রশাসনের চরিত্র কেমন হবে সে ব্যাপারে কূটনীতিবিদদের মতামত লিখিত আকারে পেশ করার জন্য সুলতান তাদের অনুরােধ জানিয়েছিলেন। এই সময়ে পারসী ভাষায় রচিত অন্যান্য উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিখ্যাত পর্যটক ও ইসমাঈলি মতের প্রচারক নাসির-ই-খুসরু (১০৭৪ খ্রি.) এবং বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ ও কবি উমার আল-খইয়াম (১১২৩-২৪ খ্রি.)-এর রচনাগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। উমার ক্যালেণ্ডারের সংস্কারের কাজে অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনি নিজামের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিলেন। ইসলামী দুনিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথম সুসংগঠিত শিক্ষায়তন স্থাপনই পারসীয় উজিরের গৌরবের মূল কারণ বলে গণ্য হয়। বাগদাদে ১০৬৫-৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত তার নিজামীয়া বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। একসময় আল-গাজ্জালী এই শিক্ষায়তনের একজন শিক্ষকের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন।
সেলজুক রাজ্যের বিভাজন : ইসমাঈলি গুপ্তঘাতক বা হাসানসিনরা প্রথমদিকে যে কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিককে হত্যা করেছিল, প্রবীণ নিজাম ছিলেন তাদের তান্যতম। ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেলজুক বংশের প্রথম তিনজন রাজার শাসনকালে যে গৌরবময় অধ্যায় শুরু হয়েছিল তার অবসান ঘটে। সংক্ষিপ্ত অথচ গৌরবময় এই অধ্যায়ে তিনজন সুলতান সেই সমস্ত দূরবর্তী রাজ্যগুলোর অধিকাংশকেই ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন যেগুলো একদা ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেছিল। কিন্তু বাগদাদ ও ইসলামের এই গৌরবময় অধ্যায়ের মেয়াদ ভারতের গ্রীষ্মকালের মতােই সংক্ষিপ্ত। মালিকশাহ্র মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও পরবর্তী অন্যান্য দ্বন্দ্ব-বিসম্বাদের পরিণতিতে কেন্দ্রীভূত সেলজুক রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার ফলে সেলজুক রাজবংশের পতন ঘটে। সংগঠনের রূপ ও অভ্যাসের দিক থেকে যাযাবর শ্রেণীর বৈশিষ্ট্যযুক্ত মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা সেলজুক সাম্রাজ্যকে পতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের প্রয়ােজন ছিল। নিজাম-আল-মুলক ১০৮৭ খ্রিস্টাব্দে সামরিক জায়গিরদার প্রথা নিয়মিত করেছিলেন, এবং তার ফলে অনুদানের ব্যাপারটি বংশগত বিষয় হয়েই রইল। পরিণতিতে অনেকগুলো আধা-স্বাধীন রাজ্যের আবির্ভাব ঘটল। এই বিশাল রাজত্বের বিভিন্ন অংশে ছােট ছােট অঞ্চলগুলো বাস্তবে স্বাধীনতা অর্জন করল। অন্যদিকে, পারস্যের মহান সেলজুকরা ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি তাদের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখল। পরিবারের প্রধান উপবিভাগগুলোর তান্যতম ছিল পারসীয় ইরাক (১১১৭-৯৪ খ্রি.)। অটোমান তুর্কিরা ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের পর আল রূমের আইকোনিয়ামে সেলজুকদের পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করল। এই অটোমান তুর্কিরাই ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের শেষ বড় প্রতিনিধি। ওঘুজ উপজাতি থেকেই এদের উদ্ভব, সেলজুকরাও এদেরই বংশধর। দূরবর্তী ভিয়েনা সহ ইউরােপের বিভিন্ন অংশে অনুপ্রবেশ এবং আরবদের খলিফা সাম্রাজ্যের মতাে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপনের পর অটোমান তুর্কিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এশিয়া মাইনর বা আনাতােলিয়া পর্যন্তই তাদের কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ রেখেছিল।
ইসলাম ধর্মে সেলজুক ও অটোমান তুর্কিদের একটি স্থায়ী অবদান ছিল এর মধ্যে রহস্যময়তার সঞ্চার করা। তুর্কিদের দেশে বিভিন্ন মুসলিম ফকির গােষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। তারা এশিয়া মাইনরের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও ধর্মগত বিষয়ে বিচ্ছিন্ন খ্রিস্টানদের ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে প্রথম দিককার উত্তর এশিয়ার জাদুভিত্তিক চিকিৎসক-পুরােহিতদের আদর্শের সমন্বয়ে গঠিত। ভাবনা-ধারণা লালন-পালন করত। মুসলিম আরবেরা ফুতুওয়া নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে তাদের বীরত্বের প্রকাশ ঘটাত। এই সংগঠনটির তুর্কিদের মধ্যে একটি নতুনরূপ বা আখি-এর আকার ধারণ করেছিল। মূলগতভাবে এই আখি সংগঠনগুলো অর্থনৈতিক গিল্ড হতে পারত। কিন্তু এগুলো হয়ে উঠেছিল ধর্মশালা এবং এশিয়া মাইনরে ঘুরে বেড়ানাের সময়ে এই আখি ধর্মশালাগুলোতেই ইবন বতুতার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। | এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় দুটি মাথাওলা ঈগলের ছবিযুক্ত প্রতীকের চিন্তা সর্বপ্রথম কোনােও এক প্রাচীন সুমেরীয় পুরােহিতের মস্তিষ্ক থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। তারপরই ব্যাববিলনের অধিবাসী ও হিটাইটল্যাণ্ডে (এশিয়া মাইনর) স্থায়ী বসবাসকারী সেলজুক তুর্কিরা তিন হাজার বছর পরে আবার এই প্রতীক ধারণ করে। সেলজুকদের কাছ থেকে এটি প্রথমে বাইজান্টিয়াম এবং পরে অস্ট্রিয়া, প্রশিয়া ও রাশিয়ার অধিবাসীরা ব্যবহার করতে শুরু করে।
ক্রুসেড সম্পর্কে অমনােযােগী বাগদাদ : ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে আল-কামিমের রাজত্বকাল থেকে খলিফা সাম্রাজ্যের ওপর সেলজুকদের প্রাধান্যের সূচনা হয়। তাদের এই প্রাধান্য ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে আল-নাসির-এর শাসনকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এই অধ্যায়ের বিরাট অংশ জুড়ে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে ক্রুসেডাররা ক্লান্তিকর প্রবল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সেলজুক বা আব্বাসীয়রা কেউই এই দূরবর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেনি। মুসলিম দুনিয়ার মূল কেন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে মুসলিম সম্প্রদায় এই ক্রুসেডগুলোকে তুচ্ছ বা গুরুত্বহীন ব্যাপার বলে মনে করেছিল। জেরুজালেমের পতনের পর (১০৯৯ খ্রি.) আগ্রাসনকারী খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ে সাহায্যের আবেদন নিয়ে একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল যখন বাগদাদে গিয়েছিল, তখন তারা আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করলেও কোন সাহায্য করেনি। খলিফা আল মুস্তাজহির (১০৯৪-১১১৮ খ্রি.) ওই প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে দেন সুলতান বারকি-ইয়ারকের (১০৯৪-১১০৪ খ্রি.) কাছে। এই বারকি-ইয়ারুক ছিলেন মালিকশাহ্র দ্বিতীয় উত্তরসূরি ও মাতাল ছেলে। এর আমলেই সুলতানি সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। তাই তার সঙ্গে কথা বলে প্রতিনিধি দলের কোন লাভ হয়নি। ক্রুসেডারদের দ্বারা অবরুদ্ধ ত্রিপােলি থেকে ১১০৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আবেদন আসে। এই অবরুদ্ধ শহরটির প্রধানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সাহায্যের আবেদন নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আগের বারের মতাে এবারের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। তিন বছর পরে ফ্রান্স যখন আলেপ্পোর ব্যবসায়ীদের কাছে মাল পৌঁছে দেবার কাজে নিযুক্ত মিশরের কয়েকটি জলযান আটক করে, তখন আলেপ্পোর এক প্রতিনিধি দলের জরুরি অনুরােধে সাড়া দিয়ে আল মুস্তাজহির কিছুটা তৎপর হয়ে ওঠেন এবং হাতে গোনা এক দল সেনা পাঠান যারা অবশ্যই কিছুই করতে পারেনি। আলেপ্পোর এই প্রতিনিধি দলই মসজিদের প্রচারবেদী ধ্বংস করেছিল এবং সুলতান যে মসজিদের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতেন সেখানকার প্রার্থনারীতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিল। খ্রিস্টান-ইসলাম সম্পর্কের ইতিহাসে যখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় নাটক চলেছিল, তখন সেলজুক সুলতান ও ধর্মবিশ্বাসীদের নেতা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন।
পরবর্তীকালে খলিফা আল-মুকতাফির (১১৩৬-৬০ খ্রি.) শাসনকালে ক্রুসেডাররা যখন মারাত্মক আক্রমণ চালাল, পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মুসলিম নেতা জাঙ্গি সাহায্যের জন্য বাগদাদের কাছে জরুরি আবেদন জানালেন। জনতার দাবিতে সাড়া দিয়ে সেখানে কয়েক হাজার সেনা পাঠানাে হল। ইতিমধ্যে জাঙ্গির যােদ্ধা পুত্র নুর-আল-দীন এবং বিখ্যাত সালাহ-আল-দীন (সালাদিন) শুধু খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেই নয়, এমনকি মিশরের অনৈক্যপ্রিয় ফাতিমিয়দের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে তাদের অস্ত্র ধরলেন। ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে সালাহ-আল-দীনের হাতে ফাতিমিয় রাজবংশের পতন ঘটল এবং একজন একনিষ্ঠ সুন্নি হিসেবে তিনি মিশর ও সিরিয়ার খুতবাতে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাদির নাম অন্তর্ভুক্ত করলেন। এর দ্বারা এই সমস্ত দেশগুলোতে আরও একবার আব্বাসীয় খলিফার প্রাধান্য স্বীকৃতি পেল। সালাহ-আল-দীন হিট্টিন-এর চূড়ান্ত যুদ্ধের পর (১১৮৭ খ্রি.) আল-মুস্তাদির উত্তরসূরি আল-নাসিরের কাছে বেশ কিছু ফ্রাঙ্কিশ (জার্মান জাতির শাখাবিশেষ যারা পঞ্চম শতাব্দীতে গল বা আধুনিক ফ্রান্স জয় করেছিল) বন্দী ও লুঠ করা মালের একটি অংশ পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে সােনায় আচ্ছাদিত একটি ব্রোঞ্জের ক্রুশ ছিল এবং কথিত আছে যে, এর মধ্যে নাকি আসল ক্রুশের কিছুটা কাঠ মেশানাে ছিল। খলিফা এই ক্রুশটিকে বাগদাদে মাটির তলায় পুঁতে দিয়েছিলেন।
সেলজুক আমলে খলিফাগণ –
- (২৬) আল-কাইম (১০৩১-৭৫ খ্রি.)
- (২৭) ২৬ এর পৌত্র (মুহাম্মাদের পুত্র) আল মুকতাদি (১০৭৫-৯৪ খ্রি.)
- (২৮) ২৭ এর পুত্র আল মুস্তাজহির (১০৯৪-১১১৮ খ্রি.)
- (২৯) ২৮ এর পুত্র আল মুস্তারশিদ (১১১৮-৩৫ খ্রি.)
- (৩০) ২৯ এর পুত্র আল রশীদ (১১৩৫-৩৬ খ্রি.)
- (৩১) ২৮ এর পুত্র আল মুকতাফি (১১৩৬-৬০ খ্রি.)
- (৩২) ৩১ এর পুত্র আল মুসতানজিদ (১১৬০-৭০ খ্রি.)
- (৩৩) ৩২ এর পুত্র আল মুসতাযি (১১৭০ – ৮০ খ্রি.)
- (৩৪) ৩৩ এর পুত্র আল নাসির (১১৮০ – ১২২৫ খ্রি.)
সেলজুক সাম্রাজ্য ও সালতানাত অফ রুম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান।
খওয়ারিজমের শাহরা (১০৭৭ – ১২৩১ খ্রি.)
আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ১১৮০ থেকে ১২২৫ সাল পর্যন্ত আল-নাসিরের রাজত্বকালকেই দীর্ঘতম আখ্যা দেওয়া যায়। তার পূর্বসূরির মতাে তিনিও খলিফা সাম্রাজ্য পুনরুজ্জীবিত করার একটা শেষ ও মৃদু চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেলজুক রাজপুত্রদের মধ্যে সীমাহীন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বীর সালাহ-আল-দীন কর্তৃক আব্বাসীয় খলিফা সাম্রাজ্যের নতুন স্বীকৃতি আল-নাসিরকে একটা সুযােগ এনে দিয়েছিল। বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি করে তিনি রাজধানীর ওপর তার নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় এক ধরনের শপথাবদ্ধ ভ্রাতৃত্ববােধের সংগঠন ফুতুওয়াহ, এক ধরনের বীরত্বপূর্ণ নাইটহুড বিকশিত হয়েছিল এবং তিনি এই সংগঠনের সংস্কার করেছিলেন। আলী ও নামজাদা লােকেরা, বিশেষত পয়গম্বরের জামাতার বংশধরদের মধ্যে এই সংগঠনের উৎস নিহিত। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সদস্যদের (ফিতিয়ান) অন্তর্ভুক্ত করা হত এবং তারা এই অনুষ্ঠানে বিশেষ ধরনের পােশাক পরে হাজির থাকত। ইয়াজিদ ইবন-মু’আবিয়া দুনিয়ায় প্রথম ফাতা আল-আরব অর্থাৎ আরবদের নাইট উপাধি লাভ করেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে তার কোন প্রয়ােগগত গুরুত্ব ছিল না।
আল-নাসিরের এই প্রচেষ্টাকে নিভন্ত দীপের কম্পমান শিখার সঙ্গে তুলনা করা যায়। তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভুল হয়েছিল যখন তিনি খাওয়ারিজমের শাসক তাকাশ (১১৭২-১২০০ খ্রি.) এবং খওয়ারিজম শাহদের তুর্কি রাজবংশের সদস্যদের পারসীয় ইরাকের সেলজুকদের আক্রমণে প্ররােচিত করেছিলেন। এই সেলজুকরাই পারস্যের পরে বাগদাদ শাসন করেছিল। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে তাকাশের ও সেলজুক সুলতান তুঘরিলের (১১৭৭-৯৪ খ্রি.) যুদ্ধ হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তুঘরিল পরাজিত হন। তার সঙ্গে সঙ্গেই আল-ইরাক ও কুর্দিস্তানে সেলজুক শাসনের অবসান ঘটে। আল নাসির আশা করেছিলেন যে, বিজয়ী শাহ জয় করা অঞ্চলগুলো তার হাতে তুলে দেবেন, কিন্তু তাকাশের পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেলজুক প্রথার অনুকরণে সুলতান হিসাবে তার নাম খােদাই করা মুদ্রা তিনি চালু করলেন এবং বাগদাদের প্রাচীন ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে খলিফাকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সার্বভৌম ক্ষমতা দেবার প্রস্তাব করলেন। তার উদ্যমী পুত্র আলা-আল-দীন মুহাম্মাদের আমলেও (১২০০-১২২০ খ্রি.) এই বিতর্ক চলতে থাকল। পারস্যের অধিকাংশ এলাকা (১২১০) এবং বোখারা ও সমরখন্দকে নিজের অধীনে এনে ও গজনী (১২১৪ খ্রি.) দখল করে এই খওয়ারিজম শাহ আব্বাসীয় খলিফা সাম্রাজ্যের অবসান ঘটানাের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার পরিবর্তে তিনি সেখানে জনৈক আলীপন্থীকে বসানাের পরিকল্পনা করেছিলেন। আতঙ্কিত আল-নাসির ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে বিধর্মী মােঙ্গল তাতারদের সাহসী দলনেতা ও দূরবর্তী পূর্বদিকের উদীয়মান সূর্যের প্রতীক চেঙ্গিস খানের (১১৫৫-১২২৭ খ্রি.) সাহায্য চেয়েছিলেন। এই দুঃসাহসী ষাট হাজার তাতার ও তাদের এগিয়ে চলার সমস্ত পথ জুড়ে বশ্যতাধীন মানুষদের নিয়ে বর্ধিত সেনাদের আক্রমণের সামনে পড়ে আলা-আল-দীনের পালানাে ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। কাস্পিয়ান সাগরের এক দ্বীপে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং ১২২০ খ্রিস্টাব্দে হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় মারা যান।
চেঙ্গিস খানের আবির্ভাব (১২০৬ – ১২২৭ খ্রি.)
দ্রুতগামী ঘােড়ায় চড়ে ও বিস্ময়কর ধনুকে সজ্জিত হয়ে মােঙ্গলরা ইতিমধ্যে যেখানেই গিয়েছিল সেখানেই ব্যাপক অত্যাচার ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। তাদের আক্রমণের মুখে পড়ে প্রাচ্যের ইসলামী দুনিয়ার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যে সমস্ত জায়গায় আগে রাজকীয় প্রাসাদ ও গ্রন্থাগার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এখন জনশূন্য মরুভূমি বা বিকালে রস পড়ে রইল। আর এই বিধ্বস্ত স্থানগুলোতে বয়ে চলল রক্তস্রোত। হেরাতের ১,০০,০০০ জনগণের মধ্যে বেঁচে রইলেন মাত্র ৪০,০০০। ধর্মানুরাগ ও বিদ্যার্জনের জন্য সুবিখ্যাত মসজিদগুলো মােঙ্গলদের ঘােড়ার আস্তাবল রূপে ব্যবহৃত হতে লাগল। সমরখন্দ ও বলখের অধিকাংশ অধিবাসীদের হয় হত্যা করা হল বা বন্দী করা হল। খওয়ারিজম পরিণত হল ধ্বংসস্থূপে। পরবর্তীকালে প্রচলিত একটি কাহিনীতে বলা হয়েছিল যে, বোখারা দখলের পর (১২২০ খ্রি.) চেঙ্গিস (গেঙ্গিস) ঘােষণা করেছিলেন যে, “মানুষের পাপের জন্য শাস্তি দিতে ঈশ্বর তাকে (চিঙ্গিজকে) পাঠিয়েছেন।” সেই সময়ের একজন বিশেষজ্ঞ ইবন-আল-আসীর এই ধ্বংসলীলার বর্ণনায় কেঁপে উঠেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তার জন্ম না হলেই বােধহয় ভাল হত। এমনকী এক শতাব্দী পরে ইবনে বতুতা যখন বোখারা, সমরখন্দ, বলখ ও অন্যান্য ট্রান্সঅক্সিয়ানার শহরে গিয়েছিলেন, তখনও তার বেশিরভাগ অংশই ছিল ধ্বংসস্তুপে ভরা। তার পরেই এসেছিল বাগদাদের পালা।
এইভাবেই ইসলামী দুনিয়াকে বিধ্বস্ত করে বিশাল সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন এই দুঃসাহসী মােঙ্গল যােদ্ধা। তার নেতৃত্বাধীন সেনাদল ১৩শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চীন থেকে অ্যাড্রিয়াটিক পর্যন্ত প্রতিটি রাজ্যের ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছিল। রাশিয়া আংশিকভাবে দখল করেছিল মােঙ্গলরা, আর মধ্য ইউরােপের দূরবর্তী পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত তারা দখল করে নিয়েছিল। ১২৪১ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিসের পুত্র ও তার উত্তরসূরির মৃত্যু ঘটায় এই মােঙ্গল যোদ্ধাদের আক্রমণের হাত থেকে পশ্চিম ইউরােপ রক্ষা পেয়েছিল।
খলিফা আল-নাসিরকে তার শাসনকালের বাকী বছরগুলো সতর্কতার সঙ্গে কাটাতে হয়েছিল। তার পুত্র আল-যাহির (১২২৫-২৬ খ্রি.) ও পৌত্র আল-মুস্তাসিরেরও (১২২৬-৪২ খ্রি.) একই অবস্থা হয়েছিল। একবার এই মোঙ্গলরা প্রায় সামাররা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। সমকালীন ইতিহাসে এদের তাতারও বলা হয়। এর ফলে আত্মরক্ষার জন্য বাগদাদের আতঙ্কিত অধিবাসীদের মধ্যে ঠেলাঠেলি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনকার মতাে বিপদ কেটে গেল। এটা ছিল চরম আঘাতের পূর্বে ক্ষণিকের শাস্তি।
মোঙ্গল সাম্রাজ্য ও চেঙ্গিস খান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে এখানে যান
বাগদাদে হালাকু খানের শাসন (১২৫৬ – ৬৫ খ্রি.)
১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান এক বিরাট সেনাদল সঙ্গে নিয়ে মােঙ্গলিয়া ত্যাগ করেন এবং অ্যাসাসিন ও খলিফা সাম্রাজ্য ধ্বংসের উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চলেন। শুরু হয় মােঙ্গল উপজাতিদের দ্বিতীয় আক্রমণ। খওয়ারিজম শাহদের বিরাট সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপর যে সমস্ত ছােট ছােট রাজ্য গড়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছিল, মােঙ্গলদের আক্রমণের সামনে সেগুলো খড়কুটোর মতাে উড়ে যায়। ইসমাঈলি অ্যাসাসিনদের বিরুদ্ধে তার অভিযানের যােগ দেবার জন্য হালাকু আমন্ত্রণ জানান খলিফা আল-মুসতাসিমকে (১২৪ ২-৫৮ খ্রি.)। কিন্তু এই আবেদনে খলিফা কোন সাড়া দেননি। ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে হালাকুর সেনারা কোনরকম অসুবিধা ছাড়াই আলামুতের মূল ঘাঁটিসহ অ্যাসাসিনদের বেশির ভাগ শক্ত ঘাঁটিই দখল করে নিল। ফলে তাদের সেই ভয়ঙ্কর অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা ধুলােয় মিশে গেল। এমনকী শিশুদেরও হত্যা করা হয়েছিল। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে খলিফা যখন খোরাসানের রাজপথ দিয়ে কৌশলে সরে যাবার চেষ্টা করছিলেন সেই মুহূর্তে বিজয়ী আগ্রাসনকারীরা আত্মসমর্পণের দাবি জানিয়ে খলিফাকে একটি চরমপত্র পাঠান এবং শহরের বাইরের প্রাচীর ভেঙে দিতে বলেন। খলিফা যে উত্তরটি পাঠান তা ছিল এড়িয়ে যাবার একটি ছলমাত্র। ফলে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে হালাকুর সেনারা রাজধানীর বাইরের প্রাচীরটি ভেঙে ফেলার জন্য কার্যকর আক্রমণ চালায়। খুব শীঘ্রই একটি স্তম্ভের গায়ে ফাটল ধরে। উজির ই-আল-আলকামি নেস্টোরিয়ান ক্যাথলিকদের মাধ্যমে সন্ধির চুক্তি নিয়ে আলােচনার জন্য হালাকুর কাছে আসেন। হালাকুর একজন খ্রিস্টান স্ত্রী ছিলেন। তিনি সন্ধির শর্তাবলি জানতে এলেন। কিন্তু হালাকু তাদের অভ্যর্থনা করতে অস্বীকার করেন। যারা ‘শান্তির নগরী’-তে প্রবেশ করেছিল বা আব্বাসীয় খলিফা আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল তাদের পরিণতির কথা উল্লেখ করে হুঁশিয়ারি দেবার চেষ্টাও কার্যকর হয়নি। হালাকুকে বলা হয়েছিল যে, “খলিফাকে যদি হত্যা করা হয় তা হলে গােটা বিশ্বজগতে নৈরাজ্য দেখা দেবে, সূর্য মুখ লুকোবে, বৃষ্টি হওয়া থেমে যাবে এবং গাছপালা আর জন্মাবে না।” জ্যোতিষীদের পরামর্শ নেওয়ার ফলে হালাকু এ সম্পর্কে অনেক বেশি কিছু জানতেন। তাই তিনি তার সেনাদের নিয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি শহরে প্রবেশ করলেন এবং হতভাগ্য খলিফা তার তিনশাে কর্মচারী ও কাযীসহ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠালেন। দশ দিন পরে তাদের সকলকেই হত্যা করা হল। সারা শহর জুড়ে চলল লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযােগ; খলিফার পরিবার সহ শহরের অধিকাংশ মানুষের আর কোন অস্তিত্বই রইল না। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোর মারাত্মক দুর্গন্ধ হালাকুকে কয়েকদিনের জন্য শহর থেকে সরে যেতে বাধ্য করল। সম্ভবত বাগদাদে তিনি বাস করার কথা ভেবেছিলেন, তাই অন্যান্য শহরের মতাে বাগদাদে অত ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলেনি। এখানকার নেস্টোরিয়ান যাজকবর্গ বিশেষ আনুকূল্য লাভ করল। কয়েকটি স্কুল ও মসজিদ এই ধ্বংসলীলার হাত থেকে ছাড় পেয়েছিল অথবা সেগুলোকে পুনরায় তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাসে এই প্রথম, মুসলিম দুনিয়ায় কোন খলিফা রইলেন না শুক্রবারের প্রার্থনার সময় যার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
১২৬০ খ্রিস্টাব্দে হালাকু উত্তর সিরিয়ার দিকে তার অভিযান সংগঠিত করলেন। এখানে আলেপ্পো ছাড়াও হামাহ ও হারিম দখল করলেন এবং সেখানকার প্রায় ৫০,০০০ মানুষকে হত্যা করলেন। দামাস্কাস দখলের উদ্দেশ্যে একজন জেনারেলকে পাঠানাের পর পরিস্থিতির চাপে তার ভাই গ্রেট খানের মৃত্যুর পর তিনি পারস্যে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। সিরিয়া দখলের পর যে সেনাবাহিনী পিছনে পড়ে রইল, মিশরিয় মামলুক কুতুজ-এর বিখ্যাত জেনারেল বেবারের সঙ্গে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে নাজারেথের কাছে (গােলিয়াথ-এর ঝরনা) আইন জালুত-এর যুদ্ধ করতে গিয়ে মোঙ্গলরা পরাজিত হলো। মামলুকরা আবার সিরিয়া দখল করে নিল, এবং এর ফলে নিশ্চিতভাবেই পশ্চিম দিকে মােঙ্গলদের অগ্রগতি রুদ্ধ হল। পরে হালাকু ফিরে এসেছিলেন এবং সিরিয়া জয় করার উদ্দেশ্যে ফ্রাঙ্কদের সঙ্গে মৈত্রী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
আমু দরিয়া থেকে সিরিয়ার সীমান্ত এবং ককেশাস পর্বতমালা থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত—পারস্যের মােঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে হালাকুই প্রথম ইল-খান উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। সপ্তম উত্তরসূরি গাজান মাহমুদ (১২৯৫-১৩০৪ খ্রি.) পর্যন্ত প্রত্যেকেই এই উপাধি নেন। গাজান মাহমুদের শাসনকালেই ইসলামধর্ম তার শিয়াবাদী ঝোক সহ রাজধর্মের স্বীকৃতি লাভ করে। ইল-খানদের বা হালাকুদের আমলে বাগদাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এবং এটি আল-ইরাক আল-আরাবি নামের একটি প্রদেশের রাজধানীতে পরিণত হয়। মহান ইল-খান নামে পরিচিত হালাকু খান তার প্রজাদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবকেই পছন্দ করতেন। শান্তির সময়ে তিনি লবণ হ্রদ আর্মিয়ার পূর্বদিকে অবস্থিত মারাগাতে থাকতে পছন্দ করেন। এখানেই তিনি বিখ্যাত গ্রন্থাগার ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রসহ অনেক অট্টালিকা তৈরি করেছিলেন। ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে প্রাণ ত্যাগ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। মােঙ্গলদের প্রথা অনুযায়ী তার সঙ্গে সুন্দরী যুবতীদের কবর দেওয়া হয়। পূর্বতন শাসক সেলজুকদের মতাে তিনি ও তার উত্তরসূরিরা পারস্যের অধিবাসীদের প্রশাসনিক দক্ষতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং প্রয়ােজনমতাে ব্যবহারও করেছিলেন। ওই সময়ের দুই বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল-জুওয়াইনি (১২৮৩ খ্রি.) ও রশীদ-আল-দীন (১৩১৮ খ্রি.) তাদের রাজসভা অলঙ্কৃত করেছিলেন। পারস্যে ইল-খানদের ৭৫ বছরের রাজত্বকালে সাহিত্যের চরম উন্নতি ঘটেছিল।
পূর্বদিকে বন্য মােঙ্গল ও পশ্চিমে ক্রুসেডের বর্মসজ্জিত নাইটদের প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে ১৩শ শতাব্দীর প্রথমভাগে মনে হয়েছিল যে, ইসলাম ধর্ম বুঝি চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হবে। কিন্তু ওই একই শতাব্দীর শেষভাগে পরিস্থিতির অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল। ইতিমধ্যেই শেষ ক্রুসেডারকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ইল-খানদের অনেকেই খ্রিস্টধর্ম নিয়ে অনুরাগীর ভান করেছে। কিন্তু তাদেরই সপ্তম বংশধর শেষ পর্যন্ত ইসলামকে রাজধর্ম বলে স্বীকৃতি দিল। মুহাম্মাদের মতে বিশ্বাসীদের পক্ষে এটি একটি উজ্জ্বল বিজয়। সেলজুকদের ক্ষেত্রে ঠিক অনুরূপ ঘটেছিল। যেখানে মুসলিমদের অস্ত্রশস্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল সেখানে তাদের ধর্মাদর্শ জয়লাভ করেছিল। ইসলামী সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য হালাকুর নির্মম আক্রমণের পর মাত্র অর্ধ-শতাব্দীরও কম সময়ে তারই প্রপৌত্র গাজান একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হিসাবে ওই একই সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের জন্য অনেক সময় ও উদ্যম ব্যয় করেছিলেন।
বাগদাদের শেষ খলিফারা –
- (৩৪) আল-নাসির (১১৮০ – ১২২৫ খ্রি.)
- (৩৫) ৩৪ এর পুত্র আল যাহির (১২২৫-২৫ খ্রি.)
- (৩৬) ৩৫ এর পুত্র আল মুসতানসির (১২২৬ – ৪২ খ্রি.)
- (৩৭) ৩৬ এর পুত্র আল মুস্তাসিম (১২৪২ – ৫৮ খ্রি.)
হালাকু খান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান
মামলুকদের অধীনে পরবর্তী খলিফারা ও অটোমান উত্তরাধিকার
ইসলাম ধর্মের সামরিক খ্যাতির সংরক্ষণ এবং নতুন ও বিরাট এলাকা জুড়ে তার বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেবার কাজ মােঙ্গলরা করেনি। তাদের জ্ঞাতিভাই ও আরবের এই ধর্মের শেষ চ্যাম্পিয়ন অটোমান তুর্কিরা এই কাজ করেছিলেন। সুলাইমানের শাসনকালে (১৫২০-৬৬ খ্রি.) তাদের রাজত্ব টাইগ্রিসের তীরে অবস্থিত বাগদাদ থেকে দানিয়ুবের তীরে অবস্থিত বুদাপেস্ট গত এবং নীল নদীর প্রথম জলপ্রপাতের কাছে অবস্থিত আসওয়ান থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে সুলাইমানের পিতা সুলতান সেলিম যখন উত্তর সিরিয়ার মামলুক সেনাদলকে ধ্বংস করেন, সেখান থেকে তারই সঙ্গে-আসা বন্দীদের মধ্যে একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি নিজেকে আল-মুতাওয়াক্কিল বলে পরিচয় দিয়ে আব্বাসীয় খলিফাদের আদর্শ প্রচার করে চলেছিল। এই আব্বাসীয় খলিফারা সেখানে প্রায় ২৫০ বছর ধরে মামলুক সুলতানের পুতুল হিসাবে রাজত্ব চালাচ্ছিল। বাগদাদের ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময় পালিয়ে-আসা আল-মুস্তাসিমের এক পিতৃব্য ১২৬১ খ্রিস্টাব্দে এই আদর্শ প্রচারের কাজ শুরু করেছিলেন এবং চতুর্থ মামলুক শাসক বাইবার্স (১২৬০-১২৭৭) তাকে আল-মুস্তানসির নাম দিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে কায়রাের খলিফা পদে বসিয়েছিলেন। আল-মুস্তানসির যখন বাইবার্সের পক্ষে বাগদাদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তখন শত্রুপক্ষের হঠাৎ আক্রমণে তিনি মারা যান। তারপরই আব্বাসীয় বংশের আর একজন বংশধরও মারা যান। ১২৬২ খ্রিস্টাব্দে একই ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একেও খলিফা পদে নিয়ােগ করা হয়েছিল। সুলতান সেলিম খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলকে সঙ্গে করে কনস্টান্টিনােপলে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে কায়রাে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে সেখানেই তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মিশরের আব্বাসী খিলাফতের পতন ঘটে। যদিও অনেক লেখকই বলেছেন যে, শেষ আব্বাসীয় শাসক যাবতীয় সুবিধা ও অধিকারসহ তার ‘খলিফা’ খেতাবটি বিজয়ী উসমানীয় তুর্কি বা তার উত্তরাধিকারীদের নিকট কনস্ট্যান্টিনােপলে সমর্পণ করেছিলেন, তবুও সমসাময়িক কোন সূত্রে তার সমর্থন পাওয়া যায় না।
আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের কারণ
১ম ইসলামী শতাব্দীতে যে বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে আরব মরুভূমির এই সন্তানেরা সভ্য দুনিয়ার বেশিরভাগ অংশ জয় করে নিয়েছিল, ৩য় শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ৪র্থ শতাব্দীর মধ্যভাগের মধ্যে তাদের বংশধরদের একচেটিয়া প্রাধান্যের দ্রুত অবক্ষয়কেই একমাত্র তার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ৮২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অন্য যেকোন জীবিত মানুষের তুলনায় বাগদাদের খলিফার হাতে পৃথিবীর অধিকাংশ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। আবার ৯২০ খ্রিস্টাব্দে তার উত্তরসূরির ক্ষমতা এতই কমে গেল যে, রাজধানীতেও তার বিন্দুমাত্র প্রভাব অনুভব করা যেত না। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী শহরটিই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হল। আর এরই সঙ্গে আরবদের প্রাধান্য চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে গেল এবং প্রকৃত খিলাফতেরও অবসান ঘটল। যে সমস্ত বাহ্যিক কারণগুলো এই ধ্বংসের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল, তার মধ্যে মােঙ্গল বা তাতারদের অত্যাচারই বাস্তবে খিলাফতের অবসান ঘটানাের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ছােট-খাটো রাজবংশ কিন্তু পতনের মূল কারণ ছিল না, ছিল রােগের লক্ষণমাত্র। পাশ্চাত্যের রােম সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে এর খানিকটা তুলনা চলে। খিলাফত যখন প্রায় মৃত্যুশয্যায় তখনই অন্যরা তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, সাম্রাজ্যের অংশবিশেষকে নিজেদের অধিকারভুক্ত করতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু খিলাফতের অবলুপ্তির ক্ষেত্রে বাহ্যিক কারণের চেয়ে আভ্যন্তরীণ কারণগুলো ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের বেশিরভাগ জয়গুলোই ছিল নামে মাত্র। ওই সমস্ত দ্রুত ও অসম্পূ,র্ণ বিজয়গুলোর মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণ ও বিভাজনের সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল। প্রশাসনও স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতার পরিপুরক ছিল না। শােষণ ও আতিমাত্রায় কর আদায় করাই ছিল স্বীকৃত নীতি; ব্যতিক্রম নয়, বরং এটাই ছিল সাধারণ নিয়ম। আরবীয় ও অ-আরবীয়, মুসলিম ও নয়া মুসলিম, মুসলিম ও যিম্মীদের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখাটা ছিল স্পষ্ট। আরবীয় মানুষদের মধ্যেও উত্তর ও দক্ষিণকে কেন্দ্র করে পুরানাে বিভেদকামী মানসিকতা তখনও বজায় ছিল। ইরানীয় বা পারসিক, তুরানীয় বা তুর্কি বা হেমিটিক বা বার্বাররা কেউ সেমিটিক আরবদের সঙ্গে মিলেমিশে কখনও একটি অখণ্ড সত্তায় পরিণত হতে পারেনি। এই ধরনের পৃথক সত্তাগুলোকে কোন সচেতনতাই ঐক্যের সূত্রে বাঁধতে পারেনি। ইরানের অধিবাসীরা সর্বদাই তাদের প্রাচীন জাতীয় গৌরবের ব্যাপারে সচেতন ছিল এবং কখনই তারা নিজেদেরকে নতুন রাজত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। যেকোন সাম্প্রদায়িকতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে বার্বাররা অস্পষ্টভাবে তাদের উপজাতীয় মানসিকতা এবং স্বাতন্ত্রের প্রকাশ ঘটাত। সিরিয়ার আধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই একজন সুফিয়ানির আভ্যুত্থানের অপেক্ষায় ছিল, যে তাদের ‘আব্বাসীয় শাসনের জোয়াল’ থেকে মুক্ত করবে। বহির্মুখী ধর্মীয় শক্তিগুলো রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিগুলো থেকে কোন অংশেই কম কার্যকর ছিল না, বরং তারা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল এবং শিয়া, কারামাতিয়া, ইসমাঈলিয়া, অ্যাসাসিন ও অনুরূপ সম্প্রদায় সৃষ্টি করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই গােষ্ঠীগুলোই ছিল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চেয়ে আরও কিছু বেশি। কারামাতিয়া ওই নতুন সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্তে হঠাৎ প্রবল আক্রমণ করল এবং খুব শীঘ্রই ফাতিমিয়রা পশ্চিম প্রান্তটি দখল করে নিল। খলিফা সাম্রাজ্য যেভাবে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে উপকূলবর্তী অঞ্চলকে যুক্ত করে একটি স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, ইসলামধর্ম সেভাবে তার অনুগামীদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি অখণ্ড সত্তায় পরিণত করতে সক্ষম হয়নি।
তাছাড়া আব্বাসীয় সাম্রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্য প্রয়ােজনীয় সামাজিক ও নৈতিক শক্তিও উপস্থিত ছিল। বহু শতাব্দী ব্যাপী তাদের শাসনকালে বিজয়ী আরব জাতির সাথে বিজিত জাতিসমূহের মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ফলে পূর্বেকার আরবদের যুদ্ধাংদেহী মনোভাব হ্রাস পেতে থাকে, তারাও সভ্য সমাজের সাথে মিশে পূর্বের আদর্শিক জীবনের চেয়ে তুলনামূলক বাস্তবিক এবং বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, এতে আরবদের অদম্য মানসিক শক্তি ও নৈতিক শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে অনেকের মতামত। অগণিত খােজা পুরুষদের সাহায্যে গড়ে ওঠা বড় বড় হারেম, নারীত্ব ও পুরুষত্বের অধঃপতনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি সেই ছেলে মেয়ে ও ক্রীতদাস (গিলম্যান), অসংখ্য উপপত্নী এবং অসংখ্য সৎ-ভাই ও সৎ-বােনের উপস্থিতি এবং তাদের পারস্পরিক হিংসা ও ষড়যন্ত্র, বিলাসবহুল জীবন এবং মদ ও গানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব – এই সমস্তও একই ধরনের অন্যান্য উপাদান পারিবারিক জীবনের প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং তার ফলে ধারাবাহিকভাবে দুর্বল উত্তরসূরির সৃষ্টি হয়েছিল বলে অনেকে মত দেন। উত্তরাধিকারের অধিকার নিয়ে অন্তহীন দ্বন্দ্বের কোন মীমাংসা হয়নি। বরং এই দ্বন্দ্বই দুর্বল উত্তরসূরিদের আরও দুর্বল করে দিয়েছিল। এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক কারণগুলোকেও অবহেলা করা চলে না। নতুন কর আদায় এবং শাসকশ্রেণীর সুবিধার্থে প্রাদেশিক সরকারগুলো কৃষি ও শিল্পকে নিরুৎসাহিত করল। একদিকে যেমন শাসকেরা ধনী হতে লাগল, তারই সঙ্গে সমানুপাতিক হারে সাধারণ মানুষ গরিব হতে লাগল। রাজ্যের মধ্যেও খণ্ড খণ্ড রাজ্য গড়ে উঠেছিল, এবং তার শাসকরা প্রজাদের সর্বস্ব হরণ করে নিয়েছিল। বারবার রক্তাক্ত সংঘর্ষে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটায় জনসংখ্যা কমতে লাগল এবং তার ফলে কৃষিযােগ্য বহু জমি পতিত অবস্থায় পড়ে রইল। নির্দিষ্ট সময়ের পর নিম্ন মেসােপটেমিয়াতে জনজীবন বিপর্যস্ত হল এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে দুর্ভিক্ষ সাধারণ মানুষের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিল। প্লেগ, গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য জ্বর মহামারী আকারে দেখা দিল এবং মধ্যযুগের মানুষ এর সামনে শক্তিহীন অক্ষম অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। মহামারীর আক্রমণে বিরাট এলাকা জুড়ে বহু সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটল। জয়ের পর প্রথম চার শতাব্দীতে প্রায় ৪০ টি বড় ধরনের মহামারীর প্রাদুর্ভাবের ঘটনা আরবীয় বর্ষপঞ্জিতে লেখা আছে। জাতীয় অর্থনীতির আবক্ষয় খুব স্বাভাবিকভাবেই বুদ্ধিবৃত্তি ও সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনার বিকাশের পথ অবরুদ্ধ করল।
তথ্যসূত্র
- Philip K. Hitti, History of the Arabs, Macmillan Company, 1937
- Stanley Lane-Poole, The Mohammedan Dynasties, Frederick Ungar, 1965
মানচিত্রভিত্তিক ভিডিও
আব্বাসিদদের ইতিহাস
ইসলামের ইতিহাস
ইসলামের ইতিহাস (২)
খিলাফতের ইতিহাস
পৃথিবীর ইতিহাস
আফ্রিকার ইতিহাস
ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার ইতিহাস
Leave a Reply