উত্তরাধুনিক শিল্প ও পপ-আর্টের ইতিহাস

পোস্টমডার্ন শিল্প

উত্তরাধুনিকতাবাদ বা পােস্ট-মডার্নিজম কথাটি অনেক বছর থেকে শিল্প, সাহিত্যের আলােচনায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এর দ্বারা প্রথমত, সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ইতিহাসের একটি সময় পর্বকে চিহ্নিত করা হয়। দ্বিতীয়ত, শব্দটি সেই বিষয়ের ক্ষেত্রে কিছু গুণগত বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা করে। উভয় ক্ষেত্রেই শব্দটির সর্বজনীন প্রয়ােগ প্রায় অসম্ভব, অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্যের কোনাে একটি ক্ষেত্রে পােস্ট-মডার্নিজমের সূচনাপর্ব এবং শনাক্ত করার মতাে বৈশিষ্ট্য বলে যা নির্ধারণ করা যায়, অন্য ক্ষেত্রে তা না হয়ে পৃথক ব্যাখ্যা দাবি করে। পোস্ট-মডার্নিজমের এটা নতুন কোনাে সমস্যা বা ব্যাপার নয়, মডার্নিজমের প্রসঙ্গেও একই জটিলতা দেখা গিয়েছে। তবে শিল্পকলার ক্ষেত্রে মডার্নিজমের সংজ্ঞা এবং সূচনাকাল যেভাবে মতানৈক্যের ভিত্তিতে একাধিক উপায়ে দেওয়া হয়েছে পােস্ট-মডার্নিজমের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। বরং দেখা যায় শিল্পে পোস্ট-মডার্নিজমের ব্যাখ্যায় সাহিত্যের (দর্শনেরও) তত্ত্বই প্রয়ােগ করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পােস্ট-মডার্নিজম শব্দটি ব্যবহার না করে বিভিন্ন শিল্পধারা এবং আন্দোলনের উল্লেখেই শিল্প ইতিহাসের পরিবর্তনশীল একটি পর্ব হিসেবে আলােচিত হতে দেখা যায়, যার ফলে পােস্ট-মডার্নিজমের প্রয়ােগ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে, এমনকি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও পােস্ট-মডার্ন কথাটি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে শিল্পকলায় এর ব্যাখ্যা দেয়া এবং আলােচনা করা প্রয়ােজন। কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে পােস্ট-মডার্নিজম কথাটির ব্যবহারের কারণেই নয়, তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যগুলি শিল্পকলার ক্ষেত্রে চিহ্নিত করার জন্যও শিল্পে পোস্টমডার্নিজম নিয়ে বিশেষ আলোচনা দরকার। অবশ্য সময়কাল নির্ধারণের আগে নতুন বৈশিষ্ট্যগুলাে শনাক্ত করা প্রয়ােজন। এর অনুষঙ্গ হিসেবে আসে শিল্পকলায় কবে থেকে নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে তার নিরূপণ। এটা না জানলে শিল্পকলায় পােস্ট-মডার্নিজমের সময়কাল নির্ধারণ কঠিন হয়ে যায়। তাই পােস্টমডার্নিজমের সময়কাল ও বৈশিষ্ট্য একই সঙ্গে আলােচনায় আনতেই হয়।

মডার্নিজম-এর ধারাবাহিকতায় প্রাপ্ত বাস্তবতা অথবা চরম দৃষ্টিতে তার সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমেই পােস্ট-মডার্নিজমের সূত্রপাত। তাই পােস্ট-মডার্নিজমের আলােচনায় অবধারিতভাবেই মডার্নিজম এসে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই মডার্নিজমকে রেফারেন্স হিসেবে না নিয়ে উপায় নেই। অন্যদিকে মডার্নিজম বললে আভাঁ-গার্দের প্রসঙ্গও চলে আসে, কারণ ২০শ শতকের প্রথম তিন দশকে মডার্নিজম ও আভাঁ-গার্দ উভয়েরই প্রবল ভূমিকা ছিল, যে কারণে আলােচনায় দুটি বিষয় একসঙ্গে চলে আসে। মডার্নিজম এবং আভাঁ-গার্দকে মনে করা হয়েছে সমার্থক হিসেবে। আমেরিকান শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক তাত্ত্বিকরা এভাবেই দুটো বিষয়কে দেখেছেন, যদিও ইউরােপের বিশ্লেষকরা দুটির মধ্যে পার্থক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। তারা এই বিষয়েও ঐকমত্যে এসেছেন যে এই দুটির মধ্যে ওভারল্যাপ বা উপরিপাতন রয়েছে। আভা-গার্দ দ্বারা তারা বুঝিয়েছেন অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ অথবা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যা ছিল মডার্নিজমের মধ্যে নতুন। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট হয়েছে ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় ষাটের দশকে আমেরিকায় বিভিন্ন প্রতিবাদ-আন্দোলনের ভিত্তিতে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তার নাম দেওয়া হয় কাউন্টার-কালচার, যার সঙ্গে ট্র্যাডিশনাল কালচারের কোনাে সম্পর্ক নেই। কাউন্টার-কালচারের এই ধারণা আভাগার্দের সঙ্গে মিলে যায়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাউন্টার-কালচার দিয়ে যার যাত্রা শুরু সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন ধারণ করে ২০শ শতকের প্রথম তিন দশকের শিল্প ও সাহিত্যে, আভা-গার্দ-এর আন্দোলন ও কর্মসূচির নানা অনুষঙ্গ যার মধ্যে ছিল। ডাডাইজম, ফিউচারইজম, স্যুররিয়ালিজম ইত্যাদি এই সব শিল্প আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে নতুন মাত্রা যােগ করে পপ আর্ট, অপ আর্ট ও অন্যান্য নব্য আভা-গার্দ শিল্পধারা। এই সবই ছিল নব্য আভা-গার্দ যা ইউরােপে নয়, আমেরিকায় দেখা দিয়েছে। তফাত ছিল এই যে, তিরিশের দশকের আভা-গার্দ-এর মতাে ষাটের দশকের আভা-গার্দ অতীতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল না, ছিল নতুন সৃষ্টির তাগিদ। এই নতুন শিল্পধারাগুলাে যেহেতু ইতিবাচক সেজন্য এর মাধ্যমেই শিল্পে পােস্ট-মডার্নিজমের যাত্রা শুরু হয় বলে মনে করা হয়েছে।

বিশ শতকের প্রথম তিন দশকের আভা-গার্দ আন্দোলন ও কর্মসূচি নেতিবাচক এবং বিদ্রোহসূচক হওয়ায় আভা-গার্দ বলে কোনাে আন্দোলন পােস্ট-মডার্নিজম-এর আওতায় সরাসরি আসে না। সেজন্য বিমূর্ত প্রকাশবাদের পর আবির্ভুত কিছু শিল্পধারা, যেমন পপ আর্ট, অপ আর্ট ইত্যাদিকে আভা-গার্দ অভিধা দেয়া হয়নিয, যদিও তাদের সঙ্গে নিকট অতীতের শিল্পধারার পার্থক্য ছিল অনেক। অতীতের অতিরিক্ত হিসেবেই পপ আর্ট, অপ আর্ট ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের উদ্ভব ঘটেছিল পােস্ট-মডার্নিজম-এর পর্বে। মডার্নিজম-এ যেমন গুরুত্ব পেয়েছে সমগ্রতা তার স্থানে পােস্ট-মডার্নিজমে প্রাধান্য পেয়েছে খণ্ডাংশের চর্চা। মডার্নিজম-এ কেন্দ্রে ছিল তার নিজস্ব কর্মসূচি, পােস্ট-মডার্নিজম-এ রয়েছে নিজস্ব কর্মসূচির অতিরিক্ত হিসেবে ভবিষ্যতের জন্য ছক তৈরি। আভা-গার্দ অতীতকে (ট্র্যাডিশন) খারিজ করেই সন্তুষ্ট, নিজের কর্মসূচি বাস্তবায়নে খুব মনােযােগী নয়। মডার্নিজম-এ হাই আর্ট প্রাধান্য পেয়েছে, আর পােস্ট-মডার্নিজম-এ পপ কালচার। মডার্নিজম এককের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, পোস্ট-মডার্নিজম বহুত্বের ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে। তিরিশের দশকের আভা-গার্দ নতুন সৃষ্টি সম্বন্ধে নীরব, তার প্রধান সুর বিদ্রোহের, অতীতের বিরােধিতা যেখানে প্রধান চালিকা শক্তি। ষাটের দশকে কাউন্টার কালচারের আবির্ভাবের সময় মনে হয়েছিল যেন ২০শ শতকের প্রথম দশকের আভা-গার্দ কর্মসূচি ফিরে আসবে। কিন্তু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অতীতমুখীনতার জন্য তা হয়নি। আভা-গার্দ নয়, পোস্ট-মডার্ন তার স্থান অধিকার কত নিল। যেমন ষাটের দশকে ডাডা এবং স্যুরলিয়াজমের পুনরাবর্তন অবধারিত মনে হলে তা হয়নি। এর পরিবর্তে পপ আর্ট, হ্যাপেনিংস, কনসেপচুয়াল, পারফরমেন্স আর্ট ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে। পিটার বার্জার বলেছেন, আভা-গার্দ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বুর্জোয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের ভিতে ধস এনে তার রূপান্তর বা বিপরীতে নতুন শিল্পের প্রতিষ্ঠা (পিটার বার্জার, ১৯৮৪)। ইউরােপে হাই আর্ট বুর্জোয়া সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় সেখানে তার বিরুদ্ধে আভা-গার্দ অনুসারীদের বিদ্রোহ বিশ্বাসযােগ্য মনে হয়েছে। কিন্তু আমেরিকায় হাই আর্টের সেই ভূমিকা না থাকায় আভা-গার্দের পুনরাৰ্বিভাব সম্ভব হয়নি। সেই জন্য আমেরিকায় মডার্নিজম-এর অতিরিক্ত হিসেবে নতুন কর্মসূচি নিয়ে পােস্টমডার্নিজমের আবির্ভাব অবধারিত হয়েছে।

শিল্পে পােস্ট-মডার্নিজম প্রসঙ্গে আভা-গার্দের আলােচনা করা হলাে এই জন্য যে আমেরিকাতেই পােস্ট-মডার্নিজমের সূচনা আর অনেকে একে আভা-গার্দ আন্দোলন মনে করেছে। কেন আভা-গার্দ-এর পুরাতন, এমনকি সাম্প্রতিক ব্যাখ্যায় এই নতুন পর্বকে চিহ্নিত করা যায় না, তা বলা না হলে বিভ্রান্তি থেকে যেতে পারে। ইউরােপে ২০শ শতকের তিন দশকে যে আভা-গার্দ আন্দোলন (ডাডা, স্যুররিয়ালিজম ইত্যাদি) তেমন কিছু আন্দোলন আমেরিকায় না থাকার জন্য ষাটের দশকে সেখানে যে শিল্প আন্দোলন তাকে আভা-গার্দ-এর পুনরাবির্ভাব না বলে পােস্ট-মডার্নিজম বলাই সংগত মনে করেছেন অনেকে। তবে ইউরােপের আভা-গার্দ-এর মতাে আমেরিকান পােস্টমডার্নিজম-এর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের (মিউজিয়াম, কনসার্ট, আর্ট অ্যাকশন, ইত্যাদি) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না হলেও তার প্রতিক্রিয়ায় নতুন কর্মসূচির সূচনা হয়েছে। নিরীক্ষাধর্মিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-বিরােধিতার ভিত্তিতে ইউরােপীয় আভা-গার্দ (বিশ শতকের তিন দশক) আর আমেরিকার পােস্ট-মডার্নিজম-এর মধ্যে মিল থাকলেও তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন, ইতিবাচক বনাম নেতিবাচক, যার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও পােস্ট-মডার্নিজমকে আভা-গার্দ-এর পরিণতি হিসেবেই দেখা যেতে পারে, তাদের মধ্যে ন্যূনতম মিলের ভিত্তিতে।

২০শ শতকের ষাট দশক পর্যন্ত শিল্পে বিমূর্ত প্রকাশবাদ এবং সাহিত্যে নিউ ক্রিটিসিজমের সমালােচনাতত্ত্ব সাহিত্যের মূল্যায়নে কাঠামাে ও শৃঙ্খলা হিসেবে কাজ করেছে। এই দুই প্রভাবের ও কৃতিত্বের বাইরে এসে নতুন সৃষ্টি করা ছিল পােস্ট-মডার্নিজমের উদ্দেশ্য, যার উদ্যোগ নেওয়া হয় আমেরিকায় আভা-গার্দ আন্দোলনের মাধ্যমে। সাহিত্যের তুলনায় মডার্নিজমের অতিরিক্ত কিছু কাজ করার দৃষ্টান্ত দেখা যায় শিল্পের ক্ষেত্রে ষাটের দশকে, যখন লন্ডন হয়ে নিউ ইয়র্কে এসে থিতু হয় পপ আর্ট। পঞ্চাশের 

দশকের মাঝামাঝি যাত্রা শুরু করে পপ আর্ট, নিও-ডাডা এবং কাইনেটিক আর্ট। এই সবই ছিল নতুন শিল্প মাধ্যম যার সঙ্গে বিমূর্ত প্রকাশবাদের মিল ছিল শুধু এই জায়গায় যে এগুলো বাস্তবের প্রতিফলনে বেশি করে সৃজনশীলতার সাহায্য নিয়েছে। অনেক শিল্পী এই সব নতুন কাজ নিয়ে উপস্থিত হয় বলে মিডিয়া এবং মিউজিয়াম বা গ্যালারি সেসব প্রত্যাখ্যান বা উপেক্ষা করতে পারেনি। যে মিডিয়া পপ আর্টের প্রধান প্রচার মাধ্যম ছিল সেটাই তার দ্রুতগতিতে জনপ্রিয়তা লাভের প্রধান কারণ। মডার্নিজমের হাই আর্টের শেষ পর্বে বিমূর্ত প্রকাশবাদের পর যেসব শিল্পধারা তার স্থানে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেগুলোর পৃথক নামকরণ হয়। কিন্তু মডার্নিজমের অতিরিক্ত (বিপরীতে না বলার কারণে) বলেই এই সব শিল্পধারার সমন্বিত নামকরণ অনায়াসে পােস্ট-মডার্নিজম করা যায়। আর যেহেতু এই সব নতুন শিল্পধারার সূচনা পঞ্চাশের মাঝামাঝি হলেও পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে ষাটের দশকের আমেরিকায় সেজন্য শিল্পে পােস্ট-মডার্নিজমের সময়কাল ষাটের দশক থেকেই ধরা যায়। তুলনায় সাহিত্যে এর আবির্ভাব হয়েছে আরাে এক দশক পর।

পোস্ট-মডার্নিজম শিল্প বলতে যেসব শিল্পধারাকে বােঝানাে হয় সেসব শুরুতেই এই নাম গ্রহণ করেনি, ঠিক যেমন মডার্নিজম কিংবা তার আগের শিল্পধারাগুলােও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা করেনি। সাধারণত একই বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেকের শিল্পচর্চা যখন অগ্রসর হবার পর পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা অথবা সমালােচকরা সেসবের গ্রহণযােগ্য নামকরণ করেছেন। তবে ডাডাইজম আর স্যুররিয়ালিজম ছিল এর ব্যতিক্রম। এই দুটি এবং তাদের মতাে অন্যধারার প্রবক্তারা একটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রেডি করেছিলেন, আর তার ভিত্তিতেই এই ধারার অন্তর্ভুক্ত শিল্পীরা শিল্পচর্চা করেছে। তবে এই সব পূর্বপরিকল্পিত আন্দোলন সাহিত্য দিয়েই শুরু হয়েছে, আর পরবর্তী সময়ে তা প্রযােজ্য হয়েছে শিল্পের ক্ষেত্রে। এও দেখা গিয়েছে সরবে এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে একটি ধারার শিল্প অগ্রসর হলেও সেগুলো যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, তার কোনাে নিশ্চয়তা ছিলনা। শিল্পের ইতিহাস বলে যে, কোনাে ধারাই স্থায়ী নয়, বিভিন্ন সময়ের পরিধিতে সক্রিয় থাকার পর সব আন্দোলন এবং ধারাই অতীতের বিষয় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনাে ধারাই সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় না, নতুন ধারার সঙ্গে প্রত্যক্ষে না হলেও পরােক্ষভাবে তা মিশে থাকে। আবার এও হয় যে নতুনের পাশাপাশি গৌণ ধারা হয়ে চলতে থাকে পুরনো শিল্পধারা। যেমন, ১৯৬০-এর দশকে পপ আর্ট দিয়ে পােস্ট-মডার্নিজমের যাত্রা শুরু হলেও তারপরও বিমূর্ত প্রকাশবাদের ধারায় ছবি আঁকা অব্যাহত থেকেছে, মূলধারায় না হলেও।

পােস্ট-মডার্নিজম যেসব শিল্পধারা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে সেসবের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, এমনকি রাজনৈতিক কারণ কাজ করেছে, ভবিষ্যতেও তাই করবে। শিল্প স্বয়ম্ভূ কিছু নয়, যদিও মাঝে মাঝে এমন দাবি করা হয়েছে। সব শিল্পই সমকালের সৃষ্টি এবং সমকালের বিভিন্ন শক্তি (ফ্যাক্টর) তার পেছনে কাজ করে। কিন্তু তার পেছনে অবধারিতভাবে কম বেশি অতীত ও নিকট অতীতের প্রভাব থাকে। পোস্ট-মডার্নিজমের প্রথমদিকের শিল্পধারার মধ্যে পপ আর্ট, কাইনেটিক আর্ট ইত্যাদির আবির্ভাব হয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন মাধ্যমের আবির্ভাবে। পারফরমেন্স আর্টের সঙ্গে অবশ্য সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্য-প্রতিবাদ জানানাের বিষয় জড়িত। ফাঙ্ক আর্টের সঙ্গেও সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। মডার্নিজম কিংবা পূর্ববর্তী শিল্পধারাগুলির তুলনায় পােস্ট-মডার্নিজম পর্বে এসে বিভিন্ন শিল্পধারা বিভিন্ন নন্দনতাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক প্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে আগের তুলনায় বেশি মাত্রায়। এর একটা কারণ শিল্প সম্বন্ধে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি, আর একটা কারণ হলো এবারে শিল্প আর হাই আর্টে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পপ কালচার শিল্পের অংশ হয়ে যাওয়ায় তার আরও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ হওয়া। এতে শিল্পের অবমূল্যায়ন হয়েছে কি না, বিশুদ্ধ শিল্পসৃষ্টি সম্ভব হয়েছে কি না, এসব প্রশ্ন উঠেছে। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকবে, আর এটাই স্বাভাবিক। শিল্পের জন্য শিল্পনীতি থেকে বেরিয়ে আসার অর্থই হলাে শিল্পকে বিতর্কিত হতে দেওয়া; শুধু নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও তাকে মূল্যায়নের মুখােমুখি হতে দেওয়া, এটাই বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রবণতা। মূর্ত অথবা অর্ধ-বিমূর্ত, যেভাবেই হােক, শিল্প যদি বাস্তবের প্রতিফলন হয়ে থাকে তাহলে পরিবর্তনশীল বাস্তবকে অস্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব না। তেমন করা হলে সেই শিল্পই বিশ্বাসযােগ্যতা হারায়। বাস্তব বদলে গেলে তার প্রতিফলনে পন্থা ও পদ্ধতির পরিবর্তনও আসতে বাধ্য। শুধু পোস্টমডার্ন শিল্পের ক্ষেত্রে নয়, পূর্ববর্তী সকল শিল্পধারার ক্ষেত্রেই কথাটি খাটে।

দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন সরাসরি শিল্প সম্বন্ধে কিছু বলেননি কিন্তু ভাষা সম্বন্ধে তার দার্শনিক চিন্তা ও তত্ত্বের সঙ্গে রিপ্রেজেন্টেশন অথবা এক্সপ্রেশনের সম্পর্ক রয়েছে। তাই পােস্ট-মডার্নিজম আর্টের তাত্ত্বিক/দার্শনিক আলােচনায় তার প্রসঙ্গ এসে যায়। তিনি ভাষা সম্বন্ধে তার প্রাথমিক ধারণা সংশােধন করে বলেছেন যে, ভাষাকে মিউজিয়ামে প্রদর্শিত/সংরক্ষিত বিষয় হিসেবে না দেখে শিথিলভাবে নিয়ন্ত্রিত, নিয়ত পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতা হিসেবেই দেখা সমীচীন। এই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত জীবনে যেমন অর্জিত হয় প্রতিদিন, বাইরের পরিবেশের সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যমেও একইভাবে ব্যক্তির জীবনে দেখা যায়। ভাষা সম্পর্কিত এই অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্ন নয়, খণ্ডে খণ্ডে বিভক্তও নয়। টাঙানাে ছবির মতাে তার দিকে তাকিয়ে কোনাে বস্তুর চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া রূপ দেখার মতাে বিষয়ও নয়। ছবির সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন ভাষা হলাে এমন ছবি, যা ধারণা করার প্রতিমুহূর্তে বর্ণনা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়ােজন পড়ে। ভিটগেনস্টাইন ভাষা সম্পর্কে তার শেষ পর্বের চিন্তায় পূর্ববর্তী নির্দিষ্টতার বিপরীতে যাত্রা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভাষার মাধ্যমে বাস্তবকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য যে ধারণা ছিল তা যেন ফ্রেমে বাঁধা একটি ছবির মতাে, যে ছবির কাছে বাঁধা পড়েছিলাম আমরা। তিনি বলেছেন, তিনি ও তার প্রজন্মের দার্শনিকরা ফ্রেমে বাঁধা ছবির মাধ্যমে বাস্তবকে দেখতে পান। 

১৯৫১ সালে তার মৃত্যুর পর তার একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, রিপ্রেজেন্টেশন নির্ধারিত রেফারেন্স আর বিশুদ্ধ গঠনের (স্ট্রাকচারের) মিথস্ক্রিয়ার বিষয় নয়, বিশুদ্ধ কাঠামাে/স্ট্রাকচারের অধীনে আছে স্থির, অনড় নিয়মকানুন, তার পরিবর্তে রিপ্রেজেন্টেশনকে (ভাষার মাধ্যম) বিবেচনা করা হয় নিরবচ্ছিন্ন সচল এক প্রক্রিয়া হিসেবে। প্রায় একই সময়ে ১৯৫০-এর নিউ ইয়র্কের কয়েকজন শিল্পী- অ্যালান ক্যাপেল, রবার্ট রসচেনবার্গ প্রমুখ শিল্পকে নির্দিষ্ট, বিশুদ্ধ, খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার সমষ্টি মনে না করে জীবন ও শিল্পের মধ্যে সব রকমের মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনার ভিত্তিতে দেখে সে সম্বন্ধে বক্তব্য রেখেছেন। দার্শনিক চিন্তায় এভাবে পােস্ট-মডার্নিজম পৃথক ধারনা হিসেবে দেখা দেয়।

ষাটের দশক থেকে ‘পােস্ট-মডার্নিজম’ কথাটির ওপর বেশ কয়েকটি পরতের অর্থ সংযােজিত হয়েছে যার জন্য কেউ কেউ এই পর্বকে সুদৃঢ় সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করার বিপক্ষে মত রেখেছেন। যেমন, আন্দ্রিয়াস হুইসেন তাঁর ‘আফটার দ্য গ্রেট ডিভাইড’ (১৯৮৬) বইতে জোর দিয়ে বলেছেন, শিল্পের ক্ষেত্রে পােস্ট-মডার্নিজমের সূচনা হয়েছে পপ আর্ট থেকে। পপ আর্টের জনপ্রিয়তার পেছনে তিনি শনাক্ত করেছেন ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের প্রতি একাত্মতা ঘােষণা, প্রগতিশীল রাজনীতির পক্ষে জনমত সৃষ্টি, শিল্পকর্ম তৈরির জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন (যেমন, সিল্কস্ক্রিনে ছবি ছাপানাে), ক্ষুদ্র আকারের গ্যালারিতে ছবি প্রদর্শনের সুযােগ, শিল্পকে একই সঙ্গে সমকালীন ভােক্তাকেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রকাশ এবং তার সমালােচনা হিসেবে দেখা, গজদন্ত মিনার থেকে শিল্পকে উদ্ধার করে সর্বসাধারণের সামনে উপস্থাপন, ফ্যান্টাসি এবং স্বতঃস্ফূর্ততার স্বীকৃতি, উজ্জ্বল রঙের প্রতি গুরুত্ব আরােপ, দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ হওয়া, বস্তু এবং ইমেজের প্রতিফলনের মাধ্যমে বাস্তবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, বুর্জোয়া সমাজের হাই আর্টকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসা, দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা, এসথেটিক এবং নন-এসথেটিকের মধ্যবর্তী পার্থক্য ঘুচিয়ে বাস্তব ও শিল্পকে অভিন্ন করে তােলা, অসুন্দরসহ সুন্দরের সহাবস্থানে আস্থাজ্ঞাপন, এই সব ঘটনা বা কারণকে। এই সব প্রবনতা, দৃষ্টিভঙ্গী এবং রীতি-পদ্ধতি পােস্ট মডার্ন শিল্পের সংজ্ঞা গঠন করে।

থিওডর অ্যাডর্নো অবশ্য হাই আর্ট থেকে পপ আর্টের বিবর্তনে শিল্পের অবমূল্যায়নই দেখেছেন এবং এর জন্য বাজার অর্থনীতিকে দায়ী করেছেন। বেশ ব্যঙ্গাত্মকভাবে তিনি এই প্রবণতা ও প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে একে অভিহিত করেছেন ‘কালচার ইন্ডাস্ট্রি’ বলে। ওয়াল্টার বেনিয়ামিনও তার ‘আর্ট ইন দ্য এজ অফ মেকানিকাল রিপ্রােডাকশন’ (১৯৩৬) প্রবন্ধে পুঁজিবাদে শিল্পের বিপন্ন হওয়ার বিষয়ে যে আলােচনা করেছেন তার সঙ্গে অ্যাডর্নোর মতের মিল রয়েছে যদিও অ্যাডর্নো কোনাে মতাদর্শগতভাবে তার বক্তব্য রাখেননি এবং ওয়াল্টার বেনিয়ামিন আর্টের সহজলভ্যতায় রাজনৈতিক প্রচারের ইতিবাচক দিক দেখতে পেয়েছেন। অপরদিকে, হার্বাট মারকুজা বিষয়টি দেখেছেন বামপন্থি রাজনীতি ও আদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে। তার মতে পপ আর্টের ফলে শিল্প বুর্জোয়া সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জীবনঘনিষ্ঠ হতে পেরেছে। তিনি মনে করেন শিল্পের সৌন্দর্য মায়ার ওপর নির্ভর না করে বাস্তব ও জীবনযাপনের আনন্দকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে পপ আর্টের আবির্ভাবে। ‘দ্য অ্যাফারমেটিভ ক্যারেক্টার অব কালচার’ (১৯৬৩) বইতে তিনি বলেছেন, শিল্পকে অলীকের নয়, বাস্তবের প্রতিফলন করতে হবে। ষাটের দশকে জার্মানি, ফ্রান্স ও আমেরিকায় ছাত্রদের আন্দোলন যেন মারকুজার ভিশন অনুযায়ী সংস্কৃতির রূপান্তরের সূচনা করেছে এবং জীবনযাপনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

শিল্পে পপ আর্ট দিয়ে পােস্ট-মডার্নিজমের শুরু, আন্দ্রিয়াস হুইসেনের এই কথা মেনে নেওয়া যায়। কেননা, এর সঙ্গে আগের বিমূর্ত প্রকাশবাদ, সুপার রিয়েলিজম ইত্যাদি শিল্পধারার বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এর পর সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অন্য যেসব শিল্পধারা পােস্ট-মডার্নিজমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেসবের মধ্যেও মডার্নিজম বা আগের পর্বের শিল্পের সাদৃশ্য নেই, বরং পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। বিজ্ঞান (অপটিকাল সায়েন্স) ও প্রযুক্তির (স্ক্রিন পেইন্টিং টেকনিক, টেলিভিশন) ব্যবহার এই সব শিল্পকে মডার্নিজম ও তার আগের সব শিল্পধারা থেকে দূরে নিয়ে এসেছে। পােস্ট-মডার্ন শিল্পে আগের শিল্পধারার ব্যবহার হয়েছে আংশিক ও অসম্পূর্ণভাবে এবং বর্তমানের অনুষঙ্গ হিসেবে। আগের শিল্পধারার চর্চা পােস্ট-মডার্ন পর্বেও হয়েছে। কিন্তু তা থেকেছে বিচ্ছিন্ন ও গৌণ ধারা হয়ে এবং কোনাে গােষ্ঠীর নয়, ব্যক্তির উদ্যোগ হিসেবে।

পপ আর্ট

পোস্ট-মডার্ন শিল্পের প্রথমেই আলোচনায় আসবে পপ-আর্ট। পপ আর্টের আবির্ভাবের ঘটেছিল দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে, বিশেষ করে পশ্চিমের উন্নত দেশে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রেক্ষিতে। ১৯৫০-এর দশকে এর সূচনা হলেও ১৯৬০-এর দশকের সামাজিক আন্দোলনের ফলেই পপ আর্টের দ্রুতগতিতে বিকাশ ঘটে। ফ্যাশন থেকে মিউজিক সব ক্ষেত্রেই এই দশকে সৃজনশীলতার জোয়ার শুরু হয়। এই সময়েই সুইংগিং লন্ডন বা ফুর্তিবাজ লন্ডনের সূত্রপাত। যুদ্ধকালীন নিত্যব্যবহার্য পণ্যের অভাব দূর হয়ে জীবনযাত্রার মানে যে উন্নতি ঘটে তার ভিত্তিতেই পপ আর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই ছিল এর লক্ষ্য ছিল, যারা বিভিন্ন শিল্পকর্মের (সংগীত, পােশাক) ভােক্তা হিসেবে একটি নতুন পরিবর্তনের চালিকাশক্তির ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তাদের এই ভােগ্যপণ্যকেন্দ্রিক জীবনযাপনে সহায়তা করেছে বাজার অর্থনীতি এবং পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এই সময়ে বাজারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ধনী, মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এতদিন দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতাে যে পার্থক্য ছিল তাতে ধস নামে। এই নতুন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জনপ্রিয় সব দৃশ্যকল্প (ইমেজ) এমন ওতপ্রােতভাবে মিশে যায় যে সেইসব বস্তু বা ইমেজই হয়ে যায় শিল্প। যেমন, সাবানের বাক্স, স্যুপের ফটোগ্রাফ ইত্যাদি। পপ আর্ট দৈনন্দিনের পরিচিত ও ব্যবহার্য অথবা ফেলে দেওয়া এই সব বস্তু বা ইমেজ ব্যবহার করে সৃষ্টি করেছে শিল্প এবং জনসাধারণের কাছে সেই শিল্প পৌঁছে দিয়েছে সুলভে। এভাবে সাধারণ ও নিত্যব্যবহার্য বস্তু ইমেজকে শিল্প হিসেবে পরিবেশনায় বেশ চমক ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, সব শ্রেণির মানুষই এই প্রথম শিল্পকে দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ হিসেবে দেখতে পেয়েছে। নিত্যব্যবহার্য বস্তু ও ইমেজের মধ্যে তাদের ব্যবহারিক মূল্যের ঊর্ধ্বেও যে শিল্পগুণ রয়েছে, পপ আর্টের মাধ্যমে সেই উপলব্ধি হয়েছে সকল শ্রেণির মানুষের। এই প্রথম শিল্পকর্ম সবার কাছে পরিচিত এক অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে দেখা দেয় যার জন্য পপ আর্টকে বলা যায় সংস্কৃতির গণতন্ত্রায়ণে বিশাল এক পদক্ষেপ। থিওডর অ্যাডর্নো মেশিনে তৈরি বিপুল সংখ্যায় এই সব শিল্পকর্ম ‘কিচ বা জগাখিচুড়ি’ বললেও জনসাধারণ সেসব গ্রহণ করেছে। ছােট গ্যালারি থেকে যাত্রা শুরু করে পপ আর্ট একসময় বড় মিউজিয়াম এবং গ্যালারিতেও প্রদর্শিত হয়েছে।

ইংল্যান্ডেই পপ আর্টের যাত্রা শুরু যদিও তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে আমেরিকার শিল্পীদের হাতে। ইংল্যান্ডের পপ শিল্পী রিচার্ড হ্যামিলটন পপ আর্টের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তার উল্লেখ করা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি যুদ্ধোত্তর ইউরােপের দেশগুলির সমাজে যে আনন্দ উত্তেজনাময় জীবনযাপন শুরু হয় তার সঙ্গে এই নতুন শিল্পের সম্পর্ক শনাক্ত করার পর সংজ্ঞা দেওয়ার মতাে করে বলেছেন, “জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য পণ্য, যা ব্যাপকহারে মেশিনে প্রস্তুত; ক্ষণস্থায়ী নিত্যব্যবহার্য পণ্য যা ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়; সুলভে প্রাপ্য; কৌশলপূর্ণ; যৌন আবেদনমূলক; ঝলমলেভাবে আকর্ষণীয়; কর্পোরেট বাণিজ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যময় ইত্যাদি।” হ্যামিলটন তার দেওয়া পপ আর্টের এই বিখ্যাত সংজ্ঞায় মূলত স্টাইল এবং গ্ল্যামারের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সেইসঙ্গে উল্লেখ করেছেন ভােক্তার পরিচিত ইমেজারি সৃষ্টির প্রক্রিয়ার কথা। শিল্প ইতিহাসের পূর্বতন অভিজ্ঞতা ও বয়ান মনে রেখে তিনি তার ব্যাখ্যায় পপ আন্দোলনকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মাত্রা দিতে চেয়েছেন, যা এর আগের অনেক শিল্পধারার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল বলে তিনি মনে করেছেন।

ফাইন আর্ট এবং পপুলার কালচারের মধ্যে যে বিভেদ বা ভেদরেখা দেখা যায় পপ আর্ট তা দূর করতে চেয়েছে। এই উদ্দেশ্যে পপ শিল্পীরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যেসব উল্লেখযােগ্য ইমেজ দেখা গিয়েছে সিনেমায়, ফ্যাশন জগতে, ভােগ্যপণ্যের বিপণিবিতানে, কমিকসহ বইপত্রে, ফটোগ্রাফিতে ও বিজ্ঞাপনে সেসব উদার ও মুক্তভাবে ব্যবহার করেছে। ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডে শিল্পী, স্থপতি এবং লেখকদের এক গােষ্ঠী মাঝে মাঝে ইনস্টিটিউট অব কনটেম্পোরারি আর্টের ভবনে বসে শিল্পের ওপর সাম্প্রতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে আলােচনা শুরু করে। এই গােষ্ঠীর সদস্যরা তাদের এই অনানুষ্ঠানিক গােষ্ঠীর নামকরণ করেছিলেন ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট গ্রুপ’। এই গােষ্ঠীর সভায় যে আলােচনা হতাে তার ভিত্তিতেই তারা গণসংস্কৃতির (ম্যাস কালচার) প্রতি আগ্রহ প্রকাশ এবং মতামত তৈরি করেন। এর থেকেই যাত্রা শুরু হয় পপ আটের, শিল্প-ঐতিহাসিকরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন। দ্য ইনডিপেনডেন্ট গ্রুপ ১৯৫৫ সালে ভেঙে যায়। কিন্তু তার আগেই এই গােষ্ঠীর এক সদস্য শিল্প-সমালােচক লরেন্স এলােওয়ে ‘পপ আর্ট’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করে পরবর্তী সময়ে এর বহুল ব্যবহারের পথ সুগম করে দেন।

ব্রিটিশ শিল্পী রিচার্ড হ্যামিলটনকে (১৯২২-২০১১) মনে করা হয় পপ আর্টের পথিকৃৎ। তিনি কোলাজধর্মী শিল্প তৈরি করলেও বিজ্ঞাপনের জন্য কাজ করেছেন। তার যে কোলাজধর্মী কাজে প্রথম পপ আর্টের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার শিরােনাম বেশ দীর্ঘ – “Just what is it that makes today’s homes so different, so appealing?” (১৯৫৬)। স্থপতি ও লেখক থিও ক্রসবি ১৯৫৬ সালে লন্ডনের হােয়াইট চ্যাপেলে এক শিল্প প্রদর্শনীর আয়ােজন করেন। প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হয় ‘দিস ইজ টুমরাে’। আধুনিক জীবনযাপনের শৈলীকে বিষয় করে এই প্রদর্শনীতে রাখা হয় এমন সব শিল্পকর্ম এবং ইনস্টলেশন যেখানে শিল্পী ও স্থপতির যৌথ অংশগ্রহণ ছিল। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে এবং পােস্টারে যে ইমেজ ছাপানাে হয় সেটি ছিল হ্যামিলটনের উপরিউক্ত কোলাজ শিল্পকর্ম। একেই মনে করা হয় প্রথম পূর্ণাঙ্গ পপ আর্ট। ছবির শিরােনামটি তিনি গ্রহণ করেন একটি আমেরিকান ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন দেখে। ছবিতে যেসব বস্তু বা ইমেজ স্থান পেয়েছে সেসবই ছিল পপুলার কালচারের শ্রেণিভুক্ত অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনযাপন শৈলীর সঙ্গে সম্পর্কিত। পপুলার কালচারের এই সব নিদর্শন থেকেই পপ আর্টের সূত্রপাত। ছবিতে কার্ডবাের্ড কাট-আউটে একজন পুরুষ ও একটি নারীকে দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ কর্মরত অবস্থায় দেখানাে হয়েছে (খেলাধুলা, প্রসাধন)। সেইসঙ্গে রয়েছে গার্হস্থ্য জীবনে ব্যবহৃত নানা যন্ত্র, প্যাকেজিংয়ের বাক্স, টেলিভিশন, বিজ্ঞাপনের গ্রাফিক্স, দেওয়ালের পােস্টারে কমিকসের ছবি, ফটোগ্রাফ, টেপ রেকর্ডার এবং গৃহসজ্জার অন্যান্য সরঞ্জাম। দোতলার যে অংশ দেখা যায় সেখানে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘দ্য জাজ সিংগার’-এর দৃশ্য রয়েছে। একটি ছবির মাধ্যমে হ্যামিলটন নিপুণভাবে পপ আর্টের সব উপকরণ, বিষয় ও ইমেজ তুলে ধরেছেন। একে বলা যায় পপ আর্টের ভিস্যুয়াল ম্যানিফেস্টো।

রিচার্ড হ্যামিলটন ছাড়া ব্রিটিশ যেসব শিল্পী পপ আর্টের জন্মলগ্নে জড়িত ছিলেন এবং সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে এডওয়ার্ডো পাওলােজ্জি (Eduardo Paolozzi, ১৯২৪-২০০৫) এবং অ্যালেন জোনসের (Allen Jones, ১৯৩৭-) নাম উল্লেখযােগ্য। অ্যালেন জোনস বিজ্ঞাপনের ভঙ্গিতে যৌন আবেদনময় নারীর ছবি এঁকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি এমন বিষয় বা বস্তু শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করেন যা এর আগে অ্যাকাডেমিক বা আনুষ্ঠানিক শিল্পের জগতে স্বীকৃতি পায়নি। এই সব ইমেজ বা বস্তুর ছবি উজ্জ্বল রঙের এবং আনকোরা হওয়ায় সহজেই দর্শকের মনােযােগ আকর্ষণ করে। এদের শিল্পগুলোর মধ্যে এডোয়ার্ডো পাওলোজ্জির I was a Rich Man’s Plaything (১৯৪৭), এবং অ্যালেন জোনসের কাট-এ-ওয়ে (১৯৭৬) এর কথা বলা যেতে পারে। ইংরেজ শিল্পী পিটার ব্লেকের (Peter Blake, ১৯৩২-) পপ আর্টে স্মৃতিমেদুরতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বিখ্যাত মুষ্টিযােদ্ধার ছবি এঁকে এবং সেখানে লিখিত শব্দ ব্যবহার করে পপ আর্টের বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি লুই ক্যারলের বিখ্যাত শিশুসাহিত্য ‘থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’ বইয়ের ইলাস্ট্রেশন তৈরি করেছেন এই স্মৃতিকাতরতা থেকেই। ব্রিটিশ শিল্পীদের মধ্যে ডেভিড হকনির (David Hockney, ১৯৩৭-) সেই সময়ের শিল্পকর্ম ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। তার প্রথমদিকের ছবিতে জনপ্রিয় ইমেজগুলি গ্রাফিটির মতাে এঁকে তিনি সবার দষ্টি আকর্ষণ করেন। তার এই সব ছবিতে পেইন্টিংয়ের ওপর ব্যঙ্গাত্মক বিষয়ও স্থান পেয়েছে। তিনিও পিটার ব্লেকের মতাে বইয়ের অলংকরণ করেন। এর জন্য তিনি নির্বাচন করেন জনপ্রিয় রূপকথার বই ‘গ্রিমস ফেয়ারি টেলস’। তার পপ আর্টগুলোর মধ্যে “এ বিগার স্প্ল্যাশ” (১৯৬৭) উল্লেখযোগ্য। রিচার্ড স্মিথ (Richard Smith, ১৯৩১-২০১৬) ছিলেন সময়ের বিটিশ শিল্পীদের মধ্যে ব্যতিক্রমী। তিনি নিউ ইয়র্কে বসবাস ও ছবি আঁকা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে পপ শিল্প থেকে সরে গিয়ে তিনি বড় আকারের কালার ফিল্ড ছবি আঁকেন বিমূর্ত প্রকাশধারার অনুসরণে।

১৯৬০-এর দশকের শুরুতে আমেরিকার পপ শিল্পীদের হাতে পপ আর্ট নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়। নতুন শ্রেণির পপ আর্টে দেখা যায় নতুন প্রযুক্তি ও মেশিনে প্রস্তুত বহুসংখ্যক পণ্যের নিদর্শনসমূহ। এই সময় থেকে আমেরিকায় পপ আর্টের চর্চা এক ব্যাপক আন্দোলনের আকার গ্রহণ করে। প্রিন্ট মিডিয়ার ইমেজারি ব্রিটিশ ও ইউরােপীয় শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করলেও আমেরিকান শিল্পীদের কাছে এই বিষয় খুব সাধারণ ও বৈশিষ্ট্যহীন বলে মনে হয়েছে। ব্রিটিশ কিংবা ইউরােপীয় শিল্পীদের ক্ষেত্রে যা হয়নি, আমেরিকার পপ শিল্পীরা প্রথম থেকেই পপ আর্ট বিষয়ে দ্ব্যর্থবােধকতা ও জটিলতার মুখােমুখি হয়ে কাজ শুরু করে। ইউরােপ, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের পপ শিল্পীরা যেখানে বাস্তবে দেখা বিজ্ঞাপন, পঠিত কমিকস এবং বইপত্র, দৈনন্দিন জীবনে দেখা পােস্টার, সেলিব্রেটি ফিগারের প্রতিকৃতি এবং নিত্যব্যবহার্য পণ্য হুবহু ব্যবহার করে ছবি এঁকেছেন, আমেরিকার পপ শিল্পীরা এই সব উপকরণকে প্রসেস করেছেন নিজেদের কল্পনা অনুযায়ী, যেমন দেখতে পেয়েছেন সেইভাবে শিল্পকর্মে উপস্থাপিত করেননি। অনেকটা মার্শেল দুশাম্পের (১৮৮৭-১৯৬৮) মতাে হলেও পপ আর্টে ট্র্যাডিশনাল অর্থে নন-আর্ট অবজেক্ট হুবহু আদিরূপে ছবিতে স্থান পায়নি, পেয়েছে রূপান্তরের মাধ্যমে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা গিয়েছে অ্যান্ডি ওয়ারহলের (Andy Warhol, ১৯২৮-৮৭) পপ আর্টে।

শিল্পী হওয়ার আগে ওয়ারহল নিউ ইয়র্কের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন তৈরির কেন্দ্র ম্যাডিসন স্কয়ারে ‘গ্ল্যামার’ নামে এক পত্রিকায় কাজ করতেন। ১৯৬০-এর প্রথমদিকে শিল্পী, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ভাস্কর হিসেবে আবির্ভূত হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। অচিরেই তিনি পপ আর্ট গােষ্ঠীর নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করে পপ লাইফ স্টাইলের প্রধান প্রবক্তা হয়ে যান। তিনি যখন বলেন, প্রত্যেকেই ১৫ মিনিটের জন্য বিখ্যাত হয়ে যাবে, সেই উক্তিতে পপ আর্টের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার বক্তব্য প্রকাশ পায়। তার ছবির বিষয় ছিল পরিচিত বিখ্যাত ব্যক্তির প্রতিকৃতি অথবা নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্য। প্রথম শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জ্যাকুলিন কেনেডিএলিজাবেথ টেইলার, মেরিলিন মনরাে, মাও সে তুংয়ের প্রতিকৃতি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল ক্যাম্পবেল স্যুপের ক্যান, ব্রিলো সাবানের হার্ডবাের্ড কার্টন, কোকাকোলার বােতল ইত্যাদি। এই সব বিষয় পেইন্টিংয়ে রূপান্তরের জন্য তিনি তার উদ্ভাবিত সিল্ক স্ক্রিন প্রিন্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করেন যার সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল গণমাধ্যমে একই ব্যক্তি বা দৃশ্যের পৌনঃপুনিক রিপ্রােডাকশনের। যে স্টুডিওতে তার নির্দেশনায় কারিগররা পরিচিত সেলিব্রেটি ব্যক্তিত্ব বা নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বহুসংখ্যক ছবি তৈরি করেছে তিনি তার নাম দেন ‘ফ্যাক্টরি’। এ থেকে বােঝা যায় যে পপ আর্টকে তিনি এক মজার বিষয় বলে বিবেচনা করেছিলেন। ওপর থেকে নিচে এবং পাশাপাশি মেরিলিন মনরাের কিংবা মাও সে তুং-এর ছবি সিল্ক স্ক্রিনে ছাপিয়ে এবং বহু সংখ্যায় কপি করে তিনি এই সব সুলভে বাজারে বিক্রি করার জন্য দেন। একইভাবে তিনি ক্যাম্পবেল অ্যাপের ক্যান অথবা ব্রিল্লোর বাক্সের ছবি তৈরি করেছেন। গণসংস্কৃতি নিয়ে এ যাবৎ যত তত্ত্ব তৈরি হয়েছে তিনি সেসব উল্টে দিয়েছিলেন তার শিল্পকর্মের মাধ্যমে। ইউরােপ কিংবা ইংল্যান্ডের পপ শিল্পীদের হাতে এমন হয়নি। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের লেখা ‘আর্ট ইন দ্য পিরিয়ড অব মেকানিকাল রিপ্রােডাকশন’-এ যেভাবে পরিচিত বিষয়ের পৌনঃপুনিক সৃষ্টিকে তিনি শিল্পের জন্য ক্ষতিকর মনে করেছেন ওয়ারহল যেন তারই উত্তরে দুর্বিনীতভাবে তার পপ আর্ট তৈরি করেছেন। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন শিল্পের এই পৌনঃপুনিক সৃষ্টিতে শিল্পের গুণ ব্যাহত হয় না। ওয়ারহল বলিষ্ঠভাবে বলেছেন যে, তিনি যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের পক্ষে এবং নিজেই সেই উৎপাদনের একটি মেশিন। তিনি বলেন, ‘সবই যদি দেখতে একরকম হতাে তাহলে দারুণ বলা যেত।’ ভাসা ভাসা আপাতসদৃশ অতিসাধারণের মধ্যে তিনি শিল্পগুণ দেখতে পেয়েছিলেন। বেশ গর্ব করেই তিনি বলেছিলেন, আমার তৈরি ছবি, ফিল্ম অথবা আমাকে দেখলে মনে না হয়ে পারে না যে ভেতরে কিছু নেই, সবই ভাসা ভাসা। আসলেই তাই। ছবির বিষয় তার সরাসরি উপস্থাপনে, অন্তর্নিহিত কোনাে অর্থে নয়। সিল্ক স্ক্রিন পদ্ধতি তৈরি তার একই বিষয়ে একাধিক কপির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন যে, আপাতদৃষ্টিতে আবেগহীন এবং নৈর্ব্যক্তিক মনে হলেও প্রতিটি ছবিতেই সমকালীন মিডিয়া-অধ্যুষিত সংস্কৃতির পরিচিতি রয়েছে। তার ছবিতে নায়ালিজম (Nihilism) এবং মৃত্যুর প্রতীক রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তার এ দাবির পেছনে খুব একটা গ্রহণযােগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। দার্শনিকতার পক্ষে তার এই দাবি যৌক্তিক কি না সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায় ওয়ারহল সমকালীন কনজুমার সােস্যাইটি ও ম্যাস কালচারের ব্যাপকতা প্রসঙ্গে যে বক্তব্য রেখেছেন সেখানে সমকালীন জীবনের প্রতিফলন ছিল। যেহেতু সিল্ক স্ক্রিনে রূপান্তরিত হয়ে একই বিষয় একাধিক সংখ্যায় ক্রেতার জন্য লভ্য হয়েছে সেইজন্য শিল্পকে কল্পনা প্রয়ােগের উদাহরণ হিসেবে যেমন দেখা যায় একই সঙ্গে তার ব্যবহারিক দিকের প্রতিও যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ওয়ারহল পপ আর্টকে যতটা এবং যেভাবে জনসমক্ষে নিয়ে এসে পরিচিত করান তার আগে তেমন কেউ করেননি। তিনিই পপ আর্টের সম্রাট। পপ সংস্কৃতির মূল্যায়নে তিনি যখন বলেছিলেন, সব ব্যক্তিই এবং বস্তুই পনেরাে মিনিটের জন্য বিখ্যাত হবে, সেই উক্তি অবশ্যই প্রতীকী অর্থে। পপ আর্ট যে ক্ষণস্থায়ী সমকালীন জীবনের অভিজ্ঞতার মতােই, এ কথাই বলতে চেয়েছেন তিনি।

অ্যান্ডি ওয়ারহল তার পপ আর্টে গাড়ি দুর্ঘটনা, চিত্রজগতের বিখ্যাত চরিত্র, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং স্যুপের ক্যান বা সাবানের বাক্স সিল্ক স্ক্রিনে পৌনঃপুনিকভাবে ছাপিয়ে যে ছবি তৈরি করেন তার উৎস দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় যেমন, সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের সচিত্র হেডলাইন কিংবা বিজ্ঞাপন। তার ইমেজসমূহে দেখা যায় বিজ্ঞাপনের সাময়িক অস্তিত্বের প্রকাশ অথবা হেডলাইন নিউজের অস্থায়ী আভাস। নির্মাণ আসরের মতাে ওয়ারহল খাদ্যের প্যাকেজ, স্যুপের ক্যান এবং ব্রিলো সাবানের কার্টন তৈরি করেছেন রঙিন কাঠে। সেসব তিনি সাজিয়েছেন ঠিক যেভাবে সুপার মার্কেটে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য দেখা যায়। বাস্তবে এই সব বস্তুর এবং মানুষের ছবির অনুকৃতির যে বৈপরীত্য তার মাধ্যমে শিল্পগুণ সৃষ্টি হয়েছে বলে ওয়ারহল দাবি করেন। এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি দর্শকের প্রতিটি শিল্পকর্ম সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া যে শিল্পীর নিখুঁত হিসাব বা আনমানের সমান্তরাল, তার উল্লেখ করেছেন। শিল্পকর্মে প্রচলিত যে কাহিনি বয়ান তা ওয়ারহলের ছবিতে নেই। এর উদ্দেশ্য হলাে বােরডম বা একঘেয়েমিজনিত ক্লান্তির মুখােমখি করে দেয়া। ফলে ছবির বিষয় নিষ্ক্রিয় বা অকেজো হয়ে যায় যান্ত্রিক উপস্থাপনার কঠোর শৃঙ্খলায়। যে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তার ছবি আঁকা তার জন্য দর্শকের মনে কোনাে আবেগের সৃষ্টি হয় না অথবা শনাক্তকরণের প্রয়ােজনও পড়ে না। শূন্যতাবােধ এবং নিস্পৃহভাব সত্ত্বেও ওয়ারহল পরিচিত মিথ ও প্যারেবলের আওতায় কাজ করেছেন। তাকে আধুনিক ঐতিহাসিক চিত্রকর বলে আখ্যায়িত করেছেন স্যাম হান্টার ও জন জ্যাকোবাস (১৯৮০)। এই বর্ণনার যুক্তি হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন ওয়ারহলের ছবিতে প্রধান ইমেজগুলোর নাগরিক সংস্কৃতির মিডিয়াভিত্তিক ঘটনার বর্ণনা। যেহেতু ওয়ারহল ক্যানভাসের সারফেসে তার ফিল্মের বিকল্প একটি পদ্ধতির সাহায্যে ছবি এঁকেছেন সেজন্য বিক্ষিপ্ত ও অপরিকল্পিতভাবে (অনেকটা সিনেমা ভেরিতের মতাে) তৈরি ছবির দৃশ্যকল্প দেখে মনে হয় বিক্ষিপ্ত, পৃথক ও স্বেচ্ছাচারী মুহূর্তের প্রকাশ, কোনাে দৃশ্যমান ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা নয়। পপ আর্ট তৈরি করতে গিয়ে তিনি যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন তাই হয়ে গিয়েছে ছবির বিষয়। যেমন, ফটো-কেমিকাল সিল্ক স্ক্রিন পদ্ধতি ইমেজের মাধ্যমে সমঝােতা আনে হাফটোন ডট ব্যাবহার করে। হাতে আঁকা পেইন্টিংয়ে যেসব ঐতিহাসিক এবং আনুষ্ঠানিক ইঙ্গিত থাকে সেগুলাে সম্পূর্ণ বর্জন করে বাণিজ্যিক পুনরুৎপাদনের ওপর নির্ভরশীলতা তার ছবির বিষয়কে নস্টালজিক ক্লিশেতে পরিণত করেছে, এ কথা বলেছেন অনেক শিল্প-সমালােচক।

১৯৬২ সালে আমেরিকান পপ আর্ট শিল্পী হিসাবে নাটকীয়ভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হন রয় লিখটেনস্টাইন (Roy Lichtenstein, ১৯২৩-৯৭), ক্লস ওল্ডেনবার্গ  (Claes Oldenburg, ১৯২৯-), জেমস রােজেনকুইস্ট (James Rosenquist, ১৯৩৩-২০১৭), অ্যান্ডি ওয়ারহল, টম ওয়েজেনম্যান (Tom Wesselmann, ১৯৩১-২০০৪) এবং রবার্ট ইন্ডিয়ানা (Robert Indiana ১৯২৮-২০১৮) একক শিল্প প্রদর্শনীর মাধ্যমে। ইংল্যান্ডে যার সূচনা, আমেরিকায় এসে সেই ‘আভাঁ-গার্দ’ শিল্প একটি আন্দোলন ও শক্তিশালী শিল্পমাধ্যমে পরিণত হয়। এর জন্য দর্শকদের যত না কৃতিত্ব তার চেয়ে বেশি ছিল মিডিয়ার ভূমিকা। মিডিয়ার বিষয় যেমন সংবাদ, রাজনৈতিক ও অন্যান্য পেশার সেলিব্রেটি, বাণিজ্যিক পণ্যের বিজ্ঞাপন এবং কমিকস, এই সব পপ আর্টে ব্যবহৃত হওয়ায় মিডিয়া এই নতুন শিল্পধারাকে সহজেই এবং সানন্দে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু ১৯৬২ সালের নভেম্বরে যখন নিউ ইয়র্কের সিডনি জেনিস গ্যালারি পপ আর্টিস্টদের ছবি ‘নিউ রিয়েলিস্ট’ শিরােনামে প্রদর্শন করে সেই সময়ে প্রবীণ অনেক শিল্পী, সমালােচক নতুন শিল্পধারায় উপকরণকে রূপান্তরিত না করেই অবিকৃতভাবে ফর্ম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এর মধ্যে শিল্পের গুণ দেখতে পাননি। সংবাদপত্রে ছাপা কমিকস্ট্রিপ (রয় লিখটেনস্টাইন), বিলবাের্ডের বিজ্ঞাপন (রােজেনকুইস্ট) বাণিজ্যিক ভােগ্যপণ্যের. সেলিব্রেটিদের ইমেজ পৌনঃপুনিকভাবে তৈরি (ওয়ারহল) কিংবা খাদ্যদ্রব্যের ভাস্কর্য (ওল্ডেনবার্গ) শিল্প হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে রক্ষণশীল শিল্পীমহলে বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। রবার্ট ইন্ডিয়ানার রাস্তার সাইনবাের্ড নিয়ে আঁকা ছবিতে নান্দনিকতার কিছু লক্ষণ দেখেতে পেলেও সমালােচকরা তার ছবিতে ছাপার মেকানিকাল টাইপফেস ও রাস্তার সাইন ব্যবহারের জন্য অন্য পপ আর্ট শিল্পীদের সঙ্গে কোনাে পার্থক্য দেখতে পায়নি। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের শিল্পী এবং দর্শকদের কাছে পপ আর্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কেননা এর মধ্যে তারা দেখতে পায় দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। বিমূর্ত প্রকাশবাদে এই সম্পর্ক ছিল না যার জন্য পপ আর্টকে বিমূর্ত প্রকাশবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ ও জবাব হিসেবে দেখা হয়েছে।

জেমস রােজেনকুইস্ট নিউ ইয়র্কে টাইমস স্কয়ারে বিলবাের্ডে বিজ্ঞাপন শিল্পী হিসেবে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা ব্যবহার করে তৈরি করেন তার পপ আর্ট। তার ‘ফ্লেমিঙ্গো ক্যাপসুল’ ছবিতে সমকালীন বিমূর্তধারার ছবির আভাস যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে স্যুররিয়েলিস্টদের ভিন্ন বাস্তবতার বিভ্রান্তিকর ইমেজও দেখা যায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত বিলবাের্ডে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ইমেজগুলাে কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আর ডে-গ্লো পেইন্ট ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা তার ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এই সব ছবির মধ্যে বিলবাের্ড ছবির লক্ষণ যেমন রয়েছে, ভবিষ্যতের শিল্পরূপ ফটোরিয়েলিজমের আভাসও দেখা যায়। এই সব ইমেজের মধ্যে যে ব্যবহার্য বস্তুর বা ভােগ্যপণ্যের জন্য আমেরিকার মানুষের আকর্ষণ ও কৌতূহল তা প্রকাশ পেয়েছে। রুচিহীনভাবে উপস্থাপিত হলেও তার এই সময়ের পপ আর্টে আমেরিকার সমাজে ভােগবাদ ও জাগতিক উন্নতির জন্য আকাক্ষার পরিচয় দেখে অনেকে আকৃষ্ট হয়েছে। তার এবং অন্যান্য পপ শিল্পীদের শিল্পকর্মে সমকালীন জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে যে দৈনন্দিন জীবনযাপন, তার প্রতিফলন অন্য কোনাে শিল্পকর্মে এমন জোরালােভাবে করা হয়নি। জেমস রােজেনকুইস্ট বিলবাের্ডভিত্তিক পপ আর্ট সাধারণ দর্শকের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের হৃদয়ে এবং শেষ পর্যন্ত শিল্পীমহলে স্থান করে নিয়েছেন।

রয় লিখটেনস্টাইনের পপ আর্ট হিসাবে কমিক স্ট্রিপ ব্যবহার করে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন। ইউরােপিয়ান শিল্পীদের মতাে কমিক স্ট্রিপ মৌলিক আকারে অবিকৃত না রেখে তিনি সেসব বড় করে দেখিয়েছেন এবং রং ব্যবহার করেছেন নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী। বিশেষ করে তিনি ছবিতে ডট ব্যবহার করে সেসব শুধু বড়াে আকারে দেখাননি, বিশেষ প্রেক্ষিতও সৃষ্টি করেছেন। ডট ব্যবহার করে তিনি ছবিতে কমিক স্ট্রিপের সম্পূরক বিন্যাস তৈরি করেছেন, এ কথা বলা যায়। এর ফলে তার ছবিতে মাধ্যম এবং পদ্ধতিই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হয়েছে। যুদ্ধে বিমান আক্রমণে মৃত্যু ও ধ্বংসের দৃশ্য দেখিয়ে তিনি যুদ্ধ সম্পর্কে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন করেছেন। এই দিক দিয়ে তার কমিক স্ট্রিপে পপ আর্টের সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। তার প্রথম পর্বের ছবিতে পুরােনাে আমলের কমিক ব্যবহার করে তিনি কমিকের তাৎক্ষণিকতা থেকে সরে এসে স্থায়ী অভিজ্ঞতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে ভাব কমিক খুব সাধারণ। খুব সাধারণ ও বালখিল্য মনে হলেও এর মধ্যে গভীরতার ব্যঞ্জনা রয়েছে। মেকানিকাল পদ্ধতিতে ছবি তৈরি এবং সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করলেও লিখটেনস্টাইনের ছবিতে শিল্পগুণ, বিশেষ করে স্টাইলের প্রতি মনােযােগ দেখা যায়। তার নতুন পপ আর্টে শিল্পগুণ ও স্টাইলের প্রতি এই মনােযােগের পরিচয় পাওয়া যায় ‘আটিস্টস স্টুডিও : দ্য ডান্স’ (১৯৭৪) ছবিতে। এখানে মাতিসের ছবির সঙ্গে কমিক স্ট্রিপের সামঞ্জস্যবিধান করা হয়েছে। তিনি তার ছবির অনুকরণমূলক ও রৈখিক আলােড়নের সঙ্গে মাতিসের ছবিতে যে রেখাভিত্তিক স্টাইল তার মিশ্রণ ঘটাতে চেয়েছেন। তিনি প্রায়ই হাই আর্টের শৈলীর সঙ্গে বৈপরীত্য স্পষ্ট করে পপ কালচারের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর এই নিরীক্ষাধর্মিতার জন্য তার ছবি হয়েছে নিরন্তর পরিবর্তনশীল এক উদ্ভাবন।

ছাত্রজীবনে টম ওয়েজেনম্যান কার্টুনের ছবি এঁকেছেন। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের ছবিতে নারীদেহের ছবি আঁকেন। তিনি সিনসিনাটি আর্ট একাডেমি এবং নিউ ইয়র্কের কুপার ইউনিয়নে কার্টুন আঁকা শেখেন। ১৯৬০ সাল থেকে ওয়েজেনম্যান শুরু করেন তাঁর ‘গ্রেট আমেরিকান ন্যুড’ সিরিজের ছবি আঁকা। আমেরিকান পতাকার লাল নীল এবং সাদা রঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তার ছবিতে। যৌনানুভূতিসূচক বিষয়ের উপস্থাপন করেছেন তিনি। এর পর তিনি আরাে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করেন। এই পর্বে মাতিসের ‘ওডেলিস্ক উইদ রেইসড আর্ম’ (১৯২৩) ছবি মডেল হিসেবে ব্যবহার করে এয়ার ব্রাশের সাহায্যে মাতিসের মতাে কাট-আউট কালার ফর্ম নিয়ে আসেন তাঁর ছবিতে, যা “সানসেট ন্যুড উইদ মাতিস ওডেলিস্ক” (২০০৩) নামে পরিচিত। তাঁর ছবিতে নারী দেহের অংশ এবং কোলাজ ব্যবহার স্যুররিয়ালিজমের দৃশ্যকল্প নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত মনে হয়। এর দ্বারা আমেরিকান পপ আর্টে বিষয়ের অবাস্তব ও কাল্পনিক উপস্থাপন যে প্রাধান্য পেয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ক্লস ওল্ডেনবার্গ পপ আর্টের ধারায় ভাস্কর্য নির্মাণ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অন্যান্য পপ আর্ট শিল্পীর মতাে তার ভাস্কর্যেও খাদ্য এবং নিত্যব্যবহার্য বস্তুর ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বস্তু যেমন দেখায় তার ভাস্কর্যে তার অনুকরণ না হয়ে সৃজনশীলতার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, তার বিখ্যাত ‘জায়ান্ট হ্যামবার্গার’ (১৯৬২) ভাস্কর্যে নৌকার পালের কাপড় রঙিন করে রুটি হিসেবে দেখানাে হয়েছে। এই শিল্পকর্মে মাংসের গােলাকার অংশ প্লাস্টিকে তৈরি এবং রুটি এবং মাংসের ভেতর রাখা হয়েছে ফোম। আকারে ওল্ডেনবার্গের হ্যামবার্গার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বড় এবং ব্যবহারের জন্য স্পর্শ করলে তা নড়েচড়ে ওঠে বলে মনে হয়। ওল্ডেনবার্গের জায়ান্ট হ্যামবার্গার ভাস্কর্যের প্রচলিত সংজ্ঞায় পড়ে না। এই ধরনের কাজে সারফেস ভলিউমের দ্যোতক তা বেশ বােঝা যায়। যা শিল্প নয় বলে মনে হয় তাকেই শিল্প হিসেবে পরিচয় করানাের মাধ্যমে ওল্ডেনবার্গ শিল্পের সীমানা প্রসারিত করেছেন। বিমূর্ত প্রকাশবাদের জনবিচ্ছিন্নতার স্থানে ওল্ডেনবার্গ শিল্পকে সাধারণ মানুষের আসার তাগিদ অনুভব করেছেন, যেমন করেছেন অন্য পপ আর্ট শিল্পীরা। ওল্ডেনবার তার ব্যতিক্রমী ভাস্কর্যের জন্য ‘মাস্টার অব সফট কালচার’ নামে খ্যাত হন।

পপ আর্ট ইউরােপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন গ্যালারি ও মিউজিয়াম আয়ােজিত প্রদর্শনীর মাধ্যমে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই প্রসঙ্গে মিডিয়ার ইতিবাচক সহযােগিতামূলক ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক থেকে একসময় পশ্চিমে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থানান্তরিত হয় পপ আর্টের প্রধান কর্মস্থল। এখানে নত প্রজন্ম, উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সম্পদশালী মধ্যবিত্ত নতুন ধারার শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপােষকতায় এগিয়ে আসে স্বেচ্ছায়। পপ আর্ট কিনে গৃহসজ্জা হয়ে দাঁড়ায় এ শ্রেণির মানুষের জীবনযাপনের ফ্যাশন। তাদের মুক্ত জীবনযাপনের সঙ্গে পপ আর্টের সামঞ্জস্যময়তা খুঁজে পায় তারা। পপ শিল্পের বিষয় যেমন, কমিক স্ট্রিপ, ভােগ্যপণ্য, সেলিব্রেটিদের প্রতিকৃতি, বিজ্ঞাপন অথবা পর্নোগ্রাফি, ব্রাত্যজনের শিল্প, সাবার্বিয়ার জীবন, আমেরিকান ইতিহাসের মিথ, বিশেষ করে আমেরিকান ড্রিম সম্পর্কে কল্পনায় মেশানাে ধারণা, পপ আর্টের এই সব বিষয়ের মধ্যে থাকায় তার সঙ্গে দর্শকদের সম্পর্ক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে। নিউ ইয়র্কের তুলনায় ক্যালিফোর্নিয়ায় এটা হয় আরাে বেশি সেখানকার মুক্ত জীবনধারার জন্য। এই অর্থে পপ আর্ট ছিল নতুন প্রজন্মের এবং উঠতি সফল শ্রেণির নিজেদের আর্ট।

পপ শিল্পীরা তাদের কাজের মাধ্যমে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিল্পকর্ম তৈরি করে এই শ্রেণির কাছে খুব সহজেই প্রিয় হয়ে যায়। এই সঙ্গে বদলে যায় তাদের সামাজিক ভূমিকাও। একাকী বিচ্ছিন্নভাবে অথবা শুধু শিল্পীদের সাহচর্যে কাজ না করে তারা বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। তাদের সেলিব্রেটি স্ট্যাটাসের জন্য তারা সমাজে সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃতি পায়, বাজারে তাদের ছবি যেমন বিক্রিই হােক না কেন। শ্রেণি হিসেবে শিল্পীদের মর্যাদা এই সময় বৃদ্ধি পায় বলে অ্যামি ডেম্পসে উল্লেখ করেছেন (অ্যামি ডেম্পসে, ২০১৮)। তাদের নিয়ে মিডিয়ায় তাে বটেই। সামাজিক চক্রেও বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং তারা সেলিব্রেটির মর্যাদা পেয়ে যায়। পপ আর্টের জোয়ারের সময় শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী শিল্প আন্দোলনের ওপর এর প্রভাব থেকে যায়। অপ আর্ট, কনসেপচুয়াল আর্ট, পারফরমেন্স আর্ট, সুপার রিয়েলিজম – এই সব ধারা পপ আর্ট থেকে ধারণা ও শৈলী গ্রহণ করে।

পপ আর্টের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে সেই সময় ‘হ্যাপেনিং’ নামে এক জীবন্ত শিল্পরূপের সূচনা হয়, যা শিল্পের ভুবনে নতুন এক মাত্রা যােগ করে। জিম ডাইনের (Jim Dine, ১৯৩৫-) মতাে শিল্পী, এখন যাকে পারফরমেন্স আর্ট বলা হয়, সেই ধরনের পাবলিক অনুষ্ঠানে শিল্পীর অংশগ্রহণে অঙ্গভঙ্গি দ্বারা বক্তব্য প্রকাশ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তার এক শিল্পকর্মে দৰ্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ি এবং আহত যাত্রীদের দেখানাে হলে তা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ক্লস ওল্ডেনবার্গ ‘স্টোর ডেজ’ নামের এক গুদামঘরে ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে পপ আর্ট বিক্রি করে এই শিল্পকর্ম যে দৈনন্দিন নিত্যব্যবহার্য অন্য তার মতাে, সেই বিষয়টি তুলে ধরেন। পারফরমেন্স আর্টের মাধ্যমে পপ আর্ট আরাে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির চেষ্টা করে। রসচেনবার্গ তার পেইন্টিংয়ে নিত্যব্যবহার্য বস্তুর অংশ অন্তর্ভুক্ত করেন এই উদ্দেশ্য নিয়ে। তার একটি কাজে দেখা যায় মৃত ছাগলের পেটে কাপড় ভরিয়ে দিয়ে প্রদর্শন। কিংবা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা একটি বিছানা তার নতুন শিল্পকর্মের নিদর্শন হয়। এ ধরনের কাজ পরে অবশ্য পারফরমেন্স না বলে ইনস্টলেশন শিল্প বলে পরিচিত হয়েছে। জিম ডাইন ও জ্যাসপার জোনস (Jasper Johns, ১৯৩০-) তাদের কাজের উপকরণ ছবিতে যুক্ত করে নতুনত্ব সৃষ্টি করেন। ব্ল্যাক মাউন্টেন কলেজের আভাঁ-গার্দ সংগীত সুরকার জন কেজ-এর সঙ্গে সহযােগিতা করে রসচেনবার্গ দর্শকদের মনােযােগ আকর্ষণ করেন। এইভাবে হ্যাপেনিং বা পারফরমেন্স আর্ট পপ আর্টের অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। পারফরমেন্স আর্ট পােস্ট-মডার্নিজমের সূচনা করেনি, এসেছে পপ আর্টের অব্যবহিত পরে। পপ আর্টই বিমূর্ত প্রকাশবাদের সমাপ্তি ঘােষণা করে মডার্নিজমের ওপর পর্দা টেনে দেয়; শুরু হয় পােস্ট-মডার্নিজমের বিচিত্র ও ঘটনাবহুল যাত্রা। এর পাশাপাশি অবশ্য আগের শিল্পধারাও অব্যাহত থাকে, যদিও সীমিত সময়।

তথ্যসূত্র

  • শিল্পকলার নান্দনিকতা, হাসনাত আবদুল হাই, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ৪২৮-৪৩
  • Pop Art: A Critical History, Steven Henry Madoff
  • Pop Art, L. R. Lippard
  • What is Painting?, Julian Bell

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.