Table of Contents
এরিজেনা (৮০০-৮৭৭ খ্রি.)
জন স্কোটাস এরিজেনা ছিলেন মধ্যযুগের প্রথম মৌলিক দার্শনিক। ৮১০ খ্রিস্টাব্দে আয়াল্যান্ডে তার জন্ম, এবং সেখানকার স্কুলেই তিনি শিক্ষা লাভ করেন। তার মৃত্যুর তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবে অনেকের মতে ৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে। তার প্রতিষ্ঠিত মঠগুলাে শিক্ষাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। অন্যান্য পণ্ডিতব্যক্তিদের ন্যায় তিনিও প্যারিসে গমন করেন, ফরাসিরাজ চার্লস তাকে রাজকীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। সেখানে তিনি তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিমত্তার জন্য অচিরেই সুখ্যাতি অর্জন করেন। ল্যাটিন ছাড়াও তিনি গ্রিক ও আরবি ভাষা জানতেন। গ্রিক দর্শন ও নব-প্লেটোবাদী দর্শনের সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন। মধ্যযুগের অন্যান্য দার্শনিকের ন্যায় এরিজেনা ধর্মের সবকিছুকে অন্ধভাবে সমর্থন করেন নি, এবং তিনি তার প্রতিটি মতে বিচারশীল মনােবৃত্তির পরিচয় দেন। যদিও তিনি সরকারিভাবে চার্চের অনুশাসনে আস্থাশীল ছিলেন, তবু তিনি এমন সব মতবাদ প্রচার করেন, যেগুলাে ছিল মধ্যযুগীর দর্শনের মর্মবিরােধী। পূর্ব-নিয়ন্ত্রণ (predestination) নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে প্রচলিত গোঁড়া মত সমর্থন না করার ফলে তার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। স্বাধীন ইচ্ছার সমর্থন করে তিনি অন ডিভাইন প্রিডেস্টিনেশন (On Divine Pre-destination) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রমাণের জন্য প্রত্যাদেশের ওপর নির্ভর না করে তিনি নিরপেক্ষ যুক্তির অবতারণা করেন।
এরিজেনার ধর্মতাত্ত্বিক মত নব্যপ্লেটোবাদী ও অগাস্টিনীয় মতের সদৃশ। তার মতে, ঈশ্বর সব সবকিছুর উৎপত্তি, স্থিতি ও সমাপ্তির কারণ। ঈশ্বর থেকে সবকিছুর উদ্ভব, ঈশ্বরেই সবকিছু থাকে এবং ঈশ্বরেই সব ফিরে যাবে। ঈশ্বর শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর অসৃষ্ট স্রষ্টা, অদৃষ্ট সৃজনীশক্তি, তিনি তার মনের পরিকল্পনা বা চিরন্তন আদর্শ (লােগােস) অনুসারে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। লােগােস তার সত্তারই প্রকাশ। সব জাগতিক শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার মূলে ক্রিয়াশীল ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা। স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বর সব জিনিসেই বিরাজমান এবং তিনি সব জিনিসের অস্তিত্বের ভিত্তি। সবকিছু ঈশ্বর থেকে আগত এবং সবকিছু ঐশ্বরিক প্রকৃতিকেই ব্যক্ত করে, ঈশ্বর ও তার সৃষ্টি অভিন্ন। তিনি তার সৃষ্টিতে আছেন, আর তার সৃষ্টিও তার মধ্যেই আছে। জগৎ মানুষের কাছে বিভক্ত ও বহু বলে প্রতীত হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা এমন এক অবিভক্ত জগৎ যেখানে সব বিরােধের সমন্বয় ঘটে।
এ থেকে বােঝা যায় যে, ঈশ্বর জগতে অনুস্যূত (immanent); কিন্তু তিনি আবার জগতের অতিবর্তী (transcendent)। অর্থাৎ, জগতে ঐশ্বরিক সত্তা সম্পূর্ণরূপে উজাড় হয়ে যায় – একথা মানতে এরিজেনা নারাজ। জগতে ঐশ্বরিক সত্তা আংশিকভাবে প্রতিফলিত; জগতের বাইরেও ঈশ্বরের অনন্ত সত্তা পরিব্যাপ্ত। একই আলােকে, একইসঙ্গে বহুলােক। যেমন দেখতে পারে, একই শব্দ বহু লােক যেমন শুনতে পারে, অথচ তাতে আলাে বা শব্দের যেমন হ্রাস হয় না, ঠিক তেমনি সব জীব ঈশ্বরের সত্তার অংশীদার হলেও তাতে ঈশ্বরের কিছু আসে যায় না। তার মতে, ঈশ্বর নিজেকে চারটি পৃথক স্তরে প্রকাশ করেন। প্রথম স্তরে তিনি নিজে অসৃষ্ট হয়েও সৃজনশীল। এ অর্থে তিনি সবকিছুর কেন্দ্র, অন্তঃসার ও সূত্র। তিনি সসীম অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে এবং তাকে আমাদের সীমিত ভাষায় ব্যাখ্যা করা চলে না। তিনি চেতনার এত ঊর্ধ্বে যে, তাকে আত্মসচেতন বলা চলে না, তার আত্মজ্ঞান বলতে কিছু নেই। এর কারণ, চেতনা ও জ্ঞান সসীম পরিস্থিতিতেই অর্থবহ। উদাহরণস্বরূপ, ঈশ্বর যদি নিজেকে জানতেন, তাহলে জ্ঞানের প্রচলিত শর্তাবলির অধীনে তাকে নিজের সম্পর্কে ভাবতে হতাে এবং নিজেকে শ্রেণীবিভক্তও করতে হতাে; কেননা জ্ঞানের জন্য শ্রেণীবিভাগ অপরিহার্য। অথচ ঈশ্বর এক এবং তাকে অনেক ঈশ্বরের মধ্যে একজন বলে শ্রেণীবিভক্ত করা চলে না। দ্বিতীয় স্তরে ঈশ্বর একাধারে সৃষ্ট ও সৃজনশীল। তিনি যদিও সম্পূর্ণরূপে জগতের অতীত, তবুও তিনি অস্তিত্বের অসীম সম্ভাবনার বাহক। আর এই সম্ভাবনা নিরন্তর বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ থেকে সৃষ্টি হয় তৃতীয় স্তরের যেখানে জগতের বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার ব্যক্ত হয় এবং যেখানে ঈশ্বর প্রথমবারের মতাে আত্মসচেতন হন এবং নিজেকে জানেন। এখানে ঈশ্বর নিজে সৃষ্ট অথচ সৃজনশীল নন। দেশ-কালে অবস্থিত যাবতীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বস্তু এই প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। এ থেকে বােঝা যায় যে, সমগ্র বিশ্বরাচর ঐশ্বরিক দ্রব্য থেকে উদ্ভূত। জগৎকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর নিজেকেও সৃষ্টি করেছেন।
তার মতে, অস্তিত্বের সব সম্ভাবনাকে উজাড় করে এবং আত্ম-অভিব্যক্তি সমাপ্ত করে ঈশ্বর সবশেষে নিজের দিকে ফেরেন এবং নিজের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করেন। আবর্তনের শুরুতে তিনি যেমন ছিলেন নিজে অসৃষ্ট অথচ সৃজনশীল প্রকৃতি, ঠিক তেমনি আবর্তনের শেষে এখন তিনি এমন এক স্থিতিশীল প্রকৃতি যা সৃজনশীল নয়, আবার সৃষ্টও নয়। ঈশ্বর থেকেই মানুষের উদ্ভব, ঈশ্বরের কাছে মানুষ ফিরে যাবে এবং বর্ণনাতীত ঐশ্বরিক সত্তার সাথে মানুষ মিশে যাবে। এতেই মানুষের পরিত্রাণ। শুধু মানুষই নয়, সৃষ্টির সকল জীবের সাথেই এটা ঘটে। চিরন্তন ‘লােগােস’-ই বহুকে ‘এক’-এ ফিরিয়ে আনে, মানুষকে ঈশ্বরে ফিরিয়ে নেয়। যিশুই দেশ-কালে ঈশ্বরের প্রকাশ, এবং যিশুর সাহায্যেই সবকিছু ঈশ্বরে ফিরে যায় ও ঈশ্বরের সাথে পুনর্মিলিত হয়।
এরিজেনার মতানুসারে, স্বাধীনতা থেকেই পাপের উৎপত্তি। মানুষ স্বাধীন। ঈশ্বরের দিকে না তাকিয়ে মানুষ নিজের দিকে তাকিয়েছিল বলেই তার পাপের উৎপত্তি, এবং এজন্যই মানুষের পতন। মুক্তি ও পরিত্রাণের জন্য মানুষকে এক উর্ধ্বমুখী পথ অতিক্রম করতে হবে। পতনের ফলে মানুষ রক্তমাংসের যে দেহের অধিকারী হয়, মৃত্যুর ফলেই সে এ দেহ থেকে মুক্ত হতে পারে। গ্রিক ধর্মযাজকদের ন্যায় এরিজেনা বলেন, অশুভের কোনাে পরাতাত্ত্বিক বাস্তবতা নেই । ঈশ্বরে অশুভের কোনাে স্থান নেই। সুতরাং ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে অশুভমুক্ত। অশুভ অসৎ প্রভৃতির কোনাে ভিত্তি নেই। সেন্ট অগাস্টিনের মতের প্রতিধ্বনি করে এরিজেনা বলেন, শুভের অভাবই অশুভ।
বিশ্বাস ও বুদ্ধির বিতর্কে এরিজেনা যে বুদ্ধির সমর্থক, এ কথা আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। এক দিক থেকে তার দার্শনিক মত খ্রিস্টীয় মতবাদকে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করারই প্রচেষ্টা। তার মতে, প্রকৃত প্রত্যাদেশ বিচারবুদ্ধিপরিপন্থী হতে পারে; কেননা প্রত্যাদেশ সত্যের বাহক, আর সত্য স্বভাবতই বুদ্ধিভিত্তিক। দার্শনিক ও ধর্মীয় সত্য এক ও অভিন্ন। বুদ্ধির মাধ্যমে এবং বুদ্ধির পক্ষে গ্রহণযােগ্য ভাষায় ধর্মগ্রন্থকে ব্যাখ্যা করতে হবে। যুক্তিযুক্ত না হলে ধর্মযাজকদের কথাও গ্রহণযােগ্য নয়, হতে পারে না। সত্যের কর্তৃত্বই একমাত্র কর্তৃত্ব; আর ঈশ্বর ও বিশ্বসম্পর্কিত সত্যকে শুধু যুক্তিসম্মত চিন্তার মাধ্যমেই আবিষ্কার করা যায়।
জন স্কোটাস এরিজেনা প্রদত্ত খ্রিস্টীয় মতবাদের এই ব্যাখ্যা কোনােদিনই ব্যাপক সমর্থন পায় নি। পক্ষান্তরে একে দাবিয়ে রাখার সুপরিকল্পিত চেষ্টা অব্যাহত থাকে। কিন্তু তবু প্রকাশ্যে না হলেও চুপিসারে এ মত প্রচলিত ছিল। নানাভাবে বহুবার এর প্রকাশ্য পুনরাবির্ভাব ঘটে। শেষ পর্যন্ত প্রায় চারশ বছর পরে জার্মান মরমিবাদী দার্শনিক মেইস্টার একহার্ট এ মতের জোর সমর্থন করেন।
মরমিবাদ (mysticism)
ভূমিকা
মধ্যযুগের দার্শনিক বিতর্ক ও মতবিরােধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার জন্য তদানীন্তন ধর্মের মরমি আবেদন সম্পর্কে কিছু আলােচনা করা দরকার। প্রেমমিশ্রিত ধ্যান ও স্বজ্ঞা দ্বারা পরমসত্তার সাথে মানুষের প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপনের অভিজ্ঞতাকেই মরমিবাদ (mysticism) বলা হয়। এই অভিজ্ঞতার মাত্রার বিভিন্নতা সত্ত্বেও মরমিবাদীদের সবাই বিশ্বাস করেন যে, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই ঈশ্বরের সাক্ষাৎ জ্ঞানলাভ সম্ভব। মধ্যযুগের ইহুদি ধর্ম ও ইসলামে মরমিবাদ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বস্তুত, মরমিবাদ ছিল অতীন্দ্রিয় ও অতিপ্রাকৃত জগতের বিশ্বাস ও আকর্ষণের প্রতীক। মধ্যযুগের প্রায় সব খ্রিস্টান চিন্তাবিদের মধ্যেই মরমিবাদের প্রভাব বেশ লক্ষণীয়।
মধ্যযুগের মরমিবাদীগণ সংখ্যার মধ্যে মরমি মাধ্যম খুঁজে পান। যেমন : সেন্ট অগাস্টিন বিশ্বাস করতেন যে, সংখ্যার সমন্বয়েই ঈশ্বরের চিন্তা গঠিত। মধ্যযুগে তাই সংখ্যাবিজ্ঞানকেই বিশ্ববিজ্ঞানে পরিণত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বারাে শতকের দিকে আধ্যত্মিক ব্যাপারাদির ওপর প্রতিষ্ঠিত এক সুসংবদ্ধ সংখ্যাতত্ত্ব গড়ে ওঠে। যেমন : বারাে ছিল চার্চের প্রতীক; আর তাই বলা হতাে ধর্ম প্রচারের জন্য যিশুখ্রিস্ট বারাে জন শিষ্য নির্বাচিত করেছিলেন। তিন ও চারের গুণফল বারােকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হতাে। ‘তিন’ ছিল পবিত্র ট্রিনিটি বা ত্রিত্ত্বের প্রতীক এবং আধ্যাত্মিক ব্যাপারাদির তাৎপর্যের বাহক। ‘চার’ চারটি উপাদানের প্রতীক এবং জড়বস্তুর বেলায় প্রযােজ্য। এই সংখ্যাবিজ্ঞান অনুসারে, তিনকে যখন চার দিয়ে গুণ করা হয়, তখন চিৎ ও জড়ের মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়, এবং তা খ্রিস্টের বারােজন নির্বাচিত শিষ্যের-প্রতিনিধিত্বে খ্রিস্টীয় চার্চের প্রত্যাদেশে সুস্পষ্টরূপ গ্রহণ করে। সাত সংখ্যাটিও অনুরূপভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সাত মানুষের প্রতীক। যেহেতু চার ও তিনের যােগফল সাত, সুতরাং মানুষ চিৎ ও জড়ের সমন্বয়ে গঠিত। মধ্যযুগের প্রায় সব বড় বড রচনায় সংখ্যার এই মরমি তাৎপর্যের ব্যাখ্যা ও গুণগান লক্ষ করা যায়।
মরমিবাদের প্রভাবে মধ্যযুগীয় চিন্তায় এক মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। মরমিবাদীদের চিন্তায় ব্যক্তিবাদের বীজ নিহিত ছিল। যাজকীয় কর্তৃপক্ষের মুখে তারা ব্যক্তিমানুষের মর্যাদা ও সম্ভাবনার সমর্থন ও জয়গান করেন। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার স্থলে তারা মানুষের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। মরমিবাদীরা মরমি অভিজ্ঞতার ওপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরােপ করেন, এবং তার ফলে দার্শনিক বিচারবিশ্লেষণের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ্বাসকে তারা জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও হাতিয়ার মনে করতেন বলে তাদের মধ্যে এ ধারণা ক্রমশ বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, জ্ঞানের বাহন হিসেবে বুদ্ধির কার্যকারিতা নিতান্তই গৌণ।
মরমিবাদী চিন্তায় সর্বেশ্বরবাদের বীজ নিহিত ছিল। মরমিবাদীদের অনেকেই চাচের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন ঠিক, কিন্তু তাদের মধ্যে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার দূরত্ব অগ্রাহ্য করা এবং ব্যক্তিকে ঈশ্বরের অংশ হিসেবে গণ্য করার এক বিশেষ প্রবণতা উপস্থিত ছিল। তাই দেখা যায়, মানুষের অন্তরে কী করে ঐশ্বরিক আলােকচ্ছটা উপস্থিত আছে, তা দেখাবার ব্যাপারে তারা বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। গােটা জগৎসংসারকে তারা এক সর্বব্যাপক একত্বের প্রতীক বলে মনে করতেন; আর তা করতেন বলেই তারা ইন্দ্রিয়ের দেয়া পরিবর্তন ও বহুত্বের ধারণাকে বাস্তব বলে গ্রহণ করেন নি।
১২শ শতকে মরমিবাদের যেসব কেন্দ্র গঠিত হয় সেগুলাের মধ্যে সিস্টেরসীয় মঠগুলাে এবং প্যারিসের সেন্ট ভিক্টর মঠটি ছিল অন্যতম। এ দুই কেন্দ্রের একটি অপরটির চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। সিস্টেরসীয় মরমিবাদীদের নেতা ছিলেন সেন্ট বার্নার্ড।
সেন্ট বার্নাড (১০৯১-১১৫৩)
সেন্ট বার্নাড ২৪ বছর বয়সে ক্লেইরভ্যাক্স মাটের কর্তা নিযুক্ত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১২শ শতকের ধর্মীয় চিন্তায় বার্নার্ডের গুরুত্ব এতই বেশি যে, লুথারকে বাদ দিয়ে যেমন ১৬শ শতকের কথা ভাবা যায় না, তেমনি বার্নার্ডকে বাদ দিয়েও ১২শ শতকের কথা ভাবা যায় না। তার চিন্তা ছিল বহুমুখী ব্যক্তিত্বের একটি দিকবিশেষ। একদিকে তিনি দ্বিতীয় ক্রুসেডের প্রস্তুতির নেতৃত্ব দেন, অন্যদিকে আবার তারই অভিযােগের ফলে এবেলার্ডের ধর্মতাত্ত্বিক মত ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হয় এবং এবেলার্ডকে দণ্ড দেয়া হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মপ্রচারের জন্য তিনি ঈশ্বরের একজন প্রেরিতপুরুষ। এ জন্যই তিনি সমকালীন সামাজিক দুর্নীতি অন্যায় অবিচার প্রভৃতি সংশােধন করাকে তার কর্তব্য বলে মনে করতেন।
বার্নার্ড ছিলেন মধ্যযুগীয় মরমিবাদের প্রবর্তক। যুক্তিতর্কের স্থলে হৃদয়াবেগ ও মরমি স্বজ্ঞাকে তিনি ঐশ্বরিক জ্ঞানের সার্থক উপায় বলে মনে করতেন। আর এ জন্যই যুক্তির সাহায্যে ঈশ্বরের জ্ঞান সম্ভব বলে এবেলার্ড যে মত পােষণ করেছিলেন তিনি সে মতের বিরােধিতা করেন। যিশুকে জানাই তার দর্শনের মূল উদ্দেশ্য বলে তিনি ঘােষণা করেন। তিনি বলেন, প্লেটোর দর্শনপাঠ কিংবা এরিস্টটলের সূক্ষ্মতর্কের পর্যালােচনার কথা ধর্ম আমাদের বলে নি। আমাদের আসল কাজ হলাে সত্যের অনুসন্ধান এবং ঐশী জ্ঞান অর্জন। এ জন্যই আমরা মানুষ হিসেবে বেঁচে আছি, এবং এখানেই বাঁচার সার্থকতা। ঐশ্বরিক জ্ঞানের জন্য লজিকের সাহায্য না নিয়ে বার্নার্ড তাকালেন তার নিজ আত্মার দিকে, সংগ্রহ করলেন এমন সুগভীর অভিজ্ঞতা যার সাহায্যে সন্ধান পাওয়া যায় নিগৃঢ় জ্ঞানের।
প্রকৃত জ্ঞানের প্রথম ধাপ বিনয়; কেননা বিনয়ের মাধ্যমেই আমরা আমাদের অসহায় অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে পারি, অন্যের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে শিখি। এ থেকে আবার আমরা আমাদের নিজ পাপকে অপছন্দ করতে এবং সত্য আবিষ্কারের জন্য ধ্যান-অনুধ্যানের সাহায্য নিতে পারি। ধ্যান-অনুধ্যানের শেষ পরিণতি হলাে সমাধিভাব, অর্থাৎ আত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ। দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে সমাধিপ্রাপ্ত আত্মা ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে পারে। বার্নার্ড এখানে সেন্ট অগাস্টিনের মতেরই প্রতিধ্বনি করেছেন। মানুষ শুধু ধ্যান-অনুধ্যান বা স্বজন ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করতে পারে না। এর জন্য প্রয়ােজন ঈশ্বরের কৃপা।
উইলিয়াম অব সেন্ট থিয়েরি (মৃ ১১৪৮)
উইলিয়াম অব সেন্ট থিয়েরি (মৃ ১১৪৮) ছিলেন সেন্ট বার্নার্ডের বন্ধু ও শিষ্য। যুক্তিবাদীদের, বিশেষ করে এবেলার্ডের বিরুদ্ধে যারা অভিযান চালান, তাদের তিনি ছিলেন অন্যতম। সেন্ট বার্নার্ডের কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি এবেলার্ডের ভ্রান্তিসমূহের বিশদ বর্ণনা দেন। তার মতে, স্মৃতির সাহায্যে আত্মা তার স্বর্গীয় উৎপতি কথা জানতে পারে। তার এ মতে প্লেটো ও অগাস্টিনের মতের প্রভাব সুস্পষ্ট। স্মৃতি আবার বুদ্ধি ও ইচ্ছাকে প্রভাবিত করে। এই তিনটি খ্রিস্টীয় ত্রিমূর্তির নির্দেশক স্মৃতি পিতার, বুদ্ধি পুত্রের এবং ইচ্ছা পবিত্ৰাত্মার নির্দেশক। সেন্ট বার্নার্ডের ন্যায় উইলিয়ামও ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভে ঈশ্বরের কৃপার ওপর জোর দেন।
আইসাক অব স্টেলা (১১৪৭-১১৬৯)
সিস্টেরসীয় সম্প্রদায়ের অপর এক চিন্তাবিদ হলেন আইসাক অব স্টেলা (১১৪৭-১১৬৯)। সেন্ট বার্নার্ডের ন্যায় তিনি তার চিন্তাকে বক্তৃতা ও চিঠিপত্রের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন। তিনি দেহ, আত্মা ও ঈশ্বরকে মৌল বাস্তবসত্তা বলে মনে করেন। সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায় তিনি বলেন যে, এক অর্থে আত্মা ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি বিশেষ এবং দেহের ও ঈশ্বরের মধ্যবর্তী হিসেবে এর একটি নিম্নভাগ, একটি মধ্যভাগ ও একটি শীর্ষভাগ আছে। আত্মার নিম্নভাগ কল্পনার সাহায্যে দেখা যায়। আত্মার শীর্ষভাগ বুদ্ধি, আর এই বুদ্ধি ঈশ্বরের সাথে যুক্ত।
হুগাে (১০৯৬-১১৪১)
মরমিবাদের অপর এক কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল সেন্ট ভিক্টর মঠ। ১১০৮ খ্রিস্টাব্দে এই মঠটি উইলিয়াম অব স্যাম্পাে দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে হুগাে (১০৯৬-১১৪১)-এর আবির্ভাবের পূর্বে এর তেমন কোনাে প্রসিদ্ধি ছিল না। হুগাে সেন্ট ভিক্টর মঠের অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রথমে তিনি এবেলার্ডের ছাত্র ছিলেন; কিন্তু পরে তিনি তার গুরুর মতের বিরােধিতা করেন। তার রচনাবলির মধ্যে ‘ডি ড্যাসকালিওন’, ‘ডি মেক্সামেনটিস’ ও ‘সামা সেনটেনসিয়্যারাম’ ছিল প্রধান।
স্কলাস্টিক মত ও বুদ্ধির প্রতি বার্নার্ডের যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস ছিল, হুগাের মধ্যে তা ছিল না। তাই দেখা যায়, মরমি অনুধ্যানের স্তরসমূহ সম্বন্ধে তার মতাবলি ছিল সুসংবদ্ধ এবং ‘ডি সেক্সামেনটিস’ গ্রন্থে তিনি ১৩শ শতকের স্কলাস্টিক চিন্তাপদ্ধতির অগ্রদূত। ‘কজিটেসিও’, ‘মেডিটেসিও’ এবং ‘কনটেমপ্লেসিও’-কে হুগাে অতিপ্রাকৃত সত্তার জ্ঞানের তিনটি স্তর বলে বর্ণনা করেন। তার মতে, প্রত্যেক মরমি সাধক এসব স্তর অতিক্রম করে পরিণামে ঐশ্বরিক স্বজ্ঞা লাভ করে থাকেন। কজিটেসিও বলতে তিনি বুঝেছেন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কোনােকিছু প্রত্যক্ষ করাকে। মেডিটেসিও হলাে প্রকৃতি ও মানবজীবনের প্রচ্ছন্ন অর্থ আবিষ্কার করা, আর কনটেমপ্লেসিও হচ্ছে বাস্তবসত্তার প্রকৃত রূপ জানার অন্তর্দৃষ্টি।
যেকোনাে বিষয় স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল হুগাের। তিনি বিশ্বাসের মধ্যে দুটি পৃথক উপকরণের পার্থক্য দেখান। এদের একটি জ্ঞান এবং অপরটি অনুরাগ। অনুরাগের গুরুত্ব এখানে যে, এর দ্বারা ইচ্ছাশক্তি জাগতিক ব্যাপারাদি থেকে ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত হয়ে থাকে।
রিচার্ড অব সেন্ট ভিক্টর (মৃ. ১১৭৩)
রিচার্ড অব সেন্ট ভিক্টর (মৃ. ১১৭৩) ছিলেন হুগাের পরবর্তী মঠাধ্যক্ষ। তিনিও হুগাের ন্যায় তার মরমি অভিজ্ঞতার এক প্রায়ােগিক ভিত্তি প্রদান করেন। তার ‘ডি ট্রিনিট্যাইট’ শীর্ষক গ্রন্থটি ছিল ১৩শ শতকের স্কলাস্টিক রচনাবলির মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। এ ছাড়া ‘বেনজামিন মেজর’ ও ‘বেনজামিন মাইনর’ তার দুটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ।
সব সত্যকে আবশ্যিক বুদ্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার রিচার্ডের প্রচেষ্টার সাথে আনসেলমের মতের কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত যে, যেসব সত্তার ধর্ম আবশ্যিক (যেমন : ত্রিমূর্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব) তাদের ব্যাখ্যার মূলে শুধু সম্ভাব্য যুক্তিই নয়, আবশ্যিক যুক্তি রয়েছে, যদিও এ যুক্তি কখনাে কখনাে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।” আনসেলমের ন্যায় তিনি ইন্দ্রিয়জগৎ থেকে আবশ্যিক সত্তাবলি আবিষ্কারের চেষ্টা করেন এবং একই যুক্তিবাদিতার পরিচয় দেন। তার দেয়া ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক প্রমাণসমূহ থেকেই এ বিষয়টি লক্ষ করা যায়। ইদ্রিয়গজৎ আমাদের নিয়ত পরিবর্তনশীল বস্তুসমূহের চিত্র প্রদান করে। যেসব জিনিস নিজেরাই সবসময় বদলায় তারা চিরন্তন হতে পারে না। আবার তারা তাদের নিজেদের অস্তিত্বের কারণও হতে পারে না। যার স্বভাব চিরন্তন নয়, তা কখনাে স্বয়ম্ভূ হতে পারে না। সুতরাং এমন একটি চিরন্তন অপরিবর্তনীয় সত্তা অবশ্যই আছে, যে সত্তা থেকে সব সসীম বস্তুর উৎপত্তি। আর সেই চিরন্তন নিত্যসত্তাই ঈশ্বর।
জ্ঞানের বিভিন্ন মাত্রার কথা বলতে গিয়ে রিচার্ড হুগাের অনুসরণ করেন এবং কল্পনা (যার লক্ষ্যবস্তু ইন্দ্রিয়জগৎ) ও বুদ্ধির (যার আলােচ্য বিষয় বুদ্ধিজগৎ) মাধ্যমে অনুধ্যানের (যার লক্ষ্যবস্তু ঈশ্বর) স্তরে পৌঁছান। হুগাের মতের প্রতিধ্বনি করে তিনি অনুধ্যান (contemplation)-কে জ্ঞানের উচ্চতম ধাপ বলে বর্ণনা করেন। তার মতে, ঈশ্বরের স্পষ্ট জ্ঞানলাভের জন্য আত্মাকে নটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। কল্পনা তার বিভিন্ন ধাপে বুদ্ধির সাহায্য লাভ করে; আবার বুদ্ধিও কল্পনার সাহায্য পেয়ে থাকে। এভাবে অগ্রসর হয়ে ব্যক্তি তার অনুধ্যানের উচ্চতম ধাপে সমাধিভাবাপন্ন অবস্থায় নির্মল সত্য আবিষ্কার করে। এ পর্যায়ে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে এবং সবকিছুকে এক এবং এককে সব বলে মনে করে।
সেন্ট ফ্রান্সিস (১১৮১/৮২ – ১২২৬)
রিচার্ড অব সেন্ট ভিক্টরের চেয়েও প্রসিদ্ধ ছিলেন সেন্ট ফ্রান্সিস। তিনি ১১৮২ খ্রিস্টাব্দে আসেনি নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কাপড়ের ব্যবসায়ী। যৌবনে ফ্রান্সিস ছিলেন উচ্চাভিলাষী। ইন্দ্রিয়সুখ ও আমােদপ্রমােদের প্রতি তার অতিশয় আকর্ষণ ছিল। পেরুগিয়ার নাগরিকদের সাথে এক সংঘর্ষের ফলে তাকে এক বছর কারাদণ্ড ভােগ করতে হয়। কিন্তু তাতেও তার উৎসাহ ও আশাবাদ এতটুকু হ্রাস পায়নি। তখনও তিনি সর্বজন সম্মানিত ব্যারন হওয়ার উচ্চাশা পােষণ করতেন। কিন্তু কারাগার থেকে ফিরে আসার পর তিনি রােগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এরপর হঠাৎ তার মনে এক বিরাট আধ্যাত্মিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের দিকেই ইন্দ্রিয়সুখ ও সংসারের প্রতি তার বিতৃষ্ণা শুরু হয়। তখন দুঃখকষ্ট ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সেবায় আত্মনিয়ােগ করার সংকল্প গ্রহণ করেন।
কথিত আছে যে, এক ভােজসভার পর ফ্রান্সিসকে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন দেখে তার বন্ধুবান্ধবরা বিস্মিত হয়েছিলেন; কেননা এ জাতীয় অনুষ্ঠানে সচরাচর তাকে আনন্দ উপভােগ করতে ও নেতৃত্ব দিতেই দেখা যেত। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কেউ একজন এতে নাকি মন্তব্য করেছিলেন, “সম্ভবত ফ্রান্সিস একজন স্ত্রী গ্রহণের কথা ভাবছে।” এক শুনে ফ্রান্সিস নাকি বিরক্তির সাথে চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, “আমি এমন একজন একজন স্ত্রীর কথা ভাবছি, যে হবে তােমরা যা চিন্তা কর তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী, অনেক বেশি ধনী, অনেক বেশি পবিত্র।”
সেন্ট ফ্রান্সিসের প্রামাণিক জীবনীকার বােনাভেনটুরে বলেন, একদা ঘােড়ায় চড়ে পথে চলার সময় ফ্রান্সিসের সাথে হঠাৎ এক কুষ্ঠরােগীর দেখা হয় এবং তিনি তার সাথে আলিঙ্গন করেন। এরপর কুষ্ঠরােগী যখন ভিক্ষার জন্য তার হাত বাড়িয়ে দেয় তিনি প্রথম তাতে চুম্বন করেন এবং পরে টাকা রাখেন। সেন্ট ফ্রান্সিস মনে করতেন যে, সামরিক ও দৈহিক শক্তি আসলে ক্ষণস্থায়ী। দয়া ও করুণা ব্যতিরেকে মানবজীবন অর্থহীন।
অচিরেই ফ্রান্সিসের কাছে বহু শিষ্যের আগমন শুরু হয় এবং তারা ধর্ম প্রচারের এক বিধান তৈরি করে পােপের অনুমতি প্রার্থনা করে। এই বিধান পােপের অনুমােদন লাভ করে। জীবনের শেষের দিকে (মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তার মৃত্যু ঘটে) তার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় এবং তিনি রােগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তখনই একদিন এলভেরনু পর্বতে তিনি এক মরমি অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাতে খ্রিস্টের প্রতি তার বিশ্বাস ও ভক্তি বৃদ্ধি পায়। এই অভিজ্ঞতার ফলে তার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায় যে, স্বর্গের রাজত্ব তার প্রতি উন্মুক্ত হবে। অতীন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা ও দর্শন তার মনে এক নির্ভেজাল প্রশান্তি ও আন্তরিকতার ভাব সৃষ্টি করে। এ জন্যই তার শিষ্যরা তাকে অসাধারণ জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী বলে ভক্তি করত।
১৪শ শতকের মরমিবাদ
মধ্যযুগে অনেক গুহ্যদর্শী ধর্মতাত্ত্বিকদের আবির্ভাব হয়েছিল। তারা ইন্দ্রিয়াতীত পদার্থের অপরােক্ষ অনুভবে বিশ্বাস করতেন। সেন্ট ভিক্টর মঠের গুহ্যবাদী হিউ এবং রিসার্চ ১২শ শতাব্দিতে এবং সেন্ট বােনাভেরে ১৩শ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ঈশ্বরের সঙ্গে সসীম বস্তুর সম্বন্ধ কি, বিশেষত ঈশ্বরের সঙ্গে মানবাত্মার সম্বন্ধ কি, এটাই তাদের প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল।
স্কলাস্টিক দর্শনে যখন নামবাদী ও বাস্তবাদীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল, তখন অনেকের ধর্মচেতনা টমিস্ট ও স্কটিস্ট দার্শনিকদের এই নিরস ও নিষ্ফল আলােচনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানবের পক্ষে যা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়ােজনীয় তার দিকে ফিরেছিল। টমাস-আ-কেম্পিস (১৩৮০-১৪৭১) বলেছিলেন, “গণ ও জাতি দিয়ে আমাদের কাজ কি?… যে গর্বিত দার্শনিক নিজের কথা না ভেবে আকাশের গতির আলােচনা করেন, তার চেয়ে ঈশ্বর সেবক একজন দীন কৃষক শ্রেষ্ঠ।… অনুতাপের সংজ্ঞা কি তা জেনে আমার কি হবে? আমি অনুতাপ অনুভব করতে চাই।” টমাস-আ-কেমপিস রচিত Imitation of Christ (খ্রিস্টের অনুসরণ) জগতে ধর্মসাহিত্যে একখানা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তিনি দার্শনিক আলােচনা বিশেষ করেননি।
জ্যঁ গারসন (১৩৬৩-১৪২৯)
১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে জ্যঁ গারসন প্যারী বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। ধর্ম বিশ্বাস সম্বন্ধে বৃথা কৌতুহল বিষয়ে তার বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে, তদানিন্তন দার্শনিক বাদবিতন্ডার মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা, দম্ভ ও ঈর্ষার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ঈশ্বরের অনুভূতি লাভকে সর্বাপেক্ষা প্রয়ােজনীয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় চেতনার গভীরতার ওপরই মানবের মঙ্গল নির্ভর করে। কিন্তু তিনি দার্শনিক আলােচনার বিরােধী ছিলেন না। ওকামের দর্শন দ্বারা তার দার্শনিক মত বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। তার মতে, বাস্তববাদীগণ তর্কবিদ্যাকে তত্ত্ববিদ্যার সঙ্গে এবং তত্ত্ববিদ্যাকে ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে অভিন্ন করে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। যা বুদ্ধির অতীত তা তারা বুঝতে চেয়েছিলেন এবং ঈশ্বরের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছিলেন। বাস্তববাদের পরিণাম ধর্ম বিরােধিতা।
মেইস্টার একহার্ট (১২৬০-১৩২৮)
মধ্যযুগের স্কলাস্টিক চিন্তার সাথে মরমিবাদের যােগ ছিল খুবই নিকট ও নিবিড়। এ সময়ে এমন অনেক ভাবুক দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে যারা ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির সংযােগকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য বলে মনে করতেন। যে ধর্মতত্ত্বে ঐশ্বরিক সত্তার সাথে যােগাযােগের আশ্বাস ছিল না, সেটিকে তারা নিরর্থক বলে মনে করতেন। ১৪শ শতকের ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাপ্রবাহ এ ধর্মীয় আন্দোলনের পক্ষে খুবই উপযােগী ছিল। ১৪শ শতকে মরমিবাদ দুটি স্বতন্ত্র শাখায় বিভক্ত। এদের একটি ছিল ল্যাটিন এবং অপরটি ছিল জার্মান। ল্যাটিন মরমিবাদ ছিল চার্চের প্রতি অনুগত এবং সেন্ট ভিক্টর ও সেন্ট বােনাভেনটুরে প্রদর্শিত পথের অনুসারী। অন্যদিকে জার্মান মরমিবাদ ছিল চার্চের মত ও শাসনসংক্রান্ত ব্যাপারে অধিকতর স্বাধীন মনােভাবের অধিকারী। পাইরি ডি এইলি (১৩৫০-১৪২৫), জ্যঁ গারসন (১৩৭৩-১৪২৯) প্রমুখ ছিলেন ল্যাটিন মরমিবাদীদের মধ্যে বিখ্যাত। জার্মান মরমিবাদীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন সুসাে (১৩০০-১৩৬৬), টাওলার (১৩০০-১৩৬১) প্রমুখ। তবে এ গােটা আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মেইস্টার একহার্ট (১২৬০-১৩২৭)। তাকে জার্মান মরমিবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে অভিহিত করা যায়। যৌবনেই তিনি ডােমিনিকান সঙ্গে যােগদান করেছিলেন। অতঃপর ১৩০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্যারিস থেকে ধর্মতত্ত্বে ডিগ্রি লাভ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোলােন-এ শিক্ষকতার কাজে নিয়ােজিত ছিলেন।
একহার্ট জার্মানীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ডমিনিকান সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। একহার্টের গ্রন্থাবলিতে যাদের উল্লেখ আছে তাদের মধ্যে বিথিয়াস, অগাস্টিন ও ছদ্ম ডাইওনিসিয়াস বিখ্যাত। একহার্টের চিন্তায় নব্যপ্লেটোবাদের প্রভাব রয়েছে। ডেনিফল তার এক রচনায় একহার্ট সম্বন্ধে বলেন, তিনি যেসব কথা বলেছেন তার অধিকাংশই একুইনাসে পাওয়া যায়। তিনি স্কলাস্টিক দর্শনের বিরােধী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ধর্মচেতনার গভীরতা সম্পাদনের দিকে লােকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। একথা ঠিক যে, একহার্ট বহু জায়গায় একুইনাসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি একই ছিল। বস্তুত অ্যাকুইনাসের মতবাদে যে পরিমাণ রক্ষণশীল মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায়, একহার্টের মতবাদে তা পাওয়া যায় না। তার অনেক উক্তি খ্রিস্টীয় সংঘ কর্তৃক নিন্দনীয় বলে ঘােষিত হয়েছিল। একহার্টের রচনাবলির মধ্যে ‘দি টক্স অব ইনস্ট্রাকশন’ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পরিণত বয়সে তিনি ‘বুক অব ডিভাইন কমফোর্ট’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া ‘এবাউট ডিস্ইন্টারেস্ট’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ তার প্রধান রচনাবলির অন্তর্ভুক্ত।
নব্যপ্লেটোবাদীদের ন্যায় একহার্ট বলেন, ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পূর্ণ বােধের বাইরে। এজন্যই ঈশ্বরের ধারণায় আমরা কোনাে বিশেষ গুণ আরােপ করতে পারিনা। ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বর সম্পর্কিত যেসব শব্দ দিয়ে আমরা তার গুণ আরোপ করার চেষ্টা করি সেগুলো প্রতীক মাত্র, এদের মূলে কোনাে বাস্তবসত্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। ঈশ্বর সম্পূর্ণ নিশ্চল ও নির্লিপ্ত। তাই সৃজনী কর্মকাণ্ডের দ্বারা তার সত্তায় কোনাে পরিবর্তন ঘটে না। ঈশ্বরের স্বভাব অনির্বচনীয় ও অতীন্দ্রিয়। আর এ জন্যই তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না, কেবল খ্রিস্টীয় ত্রিমূর্তি, অর্থাৎ ঈশ্বরপিতা, ঈশ্বরপুত্র ও পবিত্ৰাত্মার মাধ্যমেই তার অভিব্যক্তি ঘটে। চিরন্তন প্রক্রিয়ায় এই ত্রিমূর্তি ঈশ্বরের থেকে নির্গত ও প্রবাহিত হয় এবং পুণরায় সেখানেই ফিরে যায়। নিজের সম্পর্কে চিন্তা করার মাধ্যমেই ঈশ্বর ঈশ্বরত্ব লাভ করেন; আর নিজের সম্পর্কে চিন্তা করার জন্যই তিনি ত্রিমূর্তি ও জগতের প্রয়ােজন অনুভব করেন। ঈশ্বরের পক্ষে তার নিজেকে জানা ও প্রকাশ করা আবশ্যক। ঈশ্বর কেবল শুভই ইচ্ছা করেন।
একহার্ট বলেছিলেন ‘সমস্ত সৃষ্ট বস্তুই বিশুদ্ধ অসত্তা’ (All creatures are pure nothing), অর্থাৎ ঈশ্বর সৃষ্ট বস্তুর আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই, সব ঈশ্বরেরই প্রতিফলন। তার মতে, জগৎ ঈশ্বরে স্থিত। একটি শিল্পকর্ম যেমন সৃজনশীল শিল্পীর মনের মধ্যে থাকে, চিরন্তন প্রত্যয়সমূহও তেমনি ঈশ্বরের মধ্যেই রয়েছে। তার মতে জগৎ একটি চিরন্তন সৃষ্টি। সব বস্তু ঈশ্বরে এবং ঈশ্বর সব বস্তুতে বর্তমান। আমাদের সসীম মনের কাছে জগতের বিভিন্ন বিষয়ে আমরা বহুত্বকে দেখি, বিভিন্ন বস্তুকে আলাদা হিসেবে দেখি। কালবিহীন ও দেশবিহীন অসীম মন সকল বস্তুকে অবলােকন করে তাদের একত্বের মধ্যে, এই মনের কাছে সব কিছুই এক। ঈশ্বর কাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত নন। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। তার কাছে পদার্থমাত্রই চিরন্তন, তার কাছে সবকিছুই ‘এখন’। একহার্ট নব্যপ্লেটোবাদ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এটাই তার ঈশ্বরের একত্বের প্রতি অনুরাগের কারণ। তার মতে, সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে ঈশ্বরের কথা ভাবা যায় না। জীবজগৎ যেমন ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না, তেমনি ঈশ্বরও জীবজগৎকে ছাড়া চলতে পারেনা।
একহার্ট ঈশ্বরের একত্বকে ত্রিমূত্বির উপরে স্থান দিয়েছিলেন এবং সমাধিতে মানবাত্মা এই পরম সত্তায় মিশে যায় বলেছিলেন। তার মতে, ঈশ্বর যথার্থ স্বস্তি পান একমাত্র মানবাত্মায়। এজন্যই ঈশ্বরের জন্য মানবাত্মা আবশ্যক। তিনি বলেন, রুটি যেমন মাসে (Mass) সংস্কৃত হয়ে খ্রিষ্টের দেহে পরিণত হয়, তেমনি ঈশ্বরের সাহায্য লাভ করে মানবাত্মাই ঈশ্বরে পরিণত হয়। ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক খুবই কাছের। তিনি মানবাত্মার স্বরূপ, অথবা স্ফুলিঙ্গ অথবা দূর্গকে (essence, spark, or citadel or soul) অসৃষ্ট বা নিত্য বলেছিলেন। নিত্য হলে তো মানবাত্মা আর আর ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হতে পারেনা, বরং একে ঈশ্বরেরই অংশ বলা যায়। তার মতে, ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই আছেন। ঈশ্বরকে আমাদের ভালােবাসা উচিত এজন্য নয় যে, আমরা পুরস্কারের আশা করি, আমরা স্বর্গের সুখ প্রত্যাশা করি, বরং এজন্য যে, আমরা বিশ্বের একত্ব অনুভব করি। বস্তুত, সব পদার্থই এক, সবই ঈশ্বরের অংশবিশেষ। ঈশ্বরের বাইরে বাস্তবসত্তা বলে কিছু নেই। তার মতে, মানুষ ঐশ্বরিক সত্তার মধ্যে আছে। এ জন্যই ঈশ্বর মানুষের মাধ্যমে তার কার্যাবলি পরিচালনা করে থাকেন। ঈশ্বরে প্রত্যাবর্তন করে মানুষ পুনরায় ঈশ্বরের সাথে মিলিত হয়। ঈশ্বর নিজেও মানবাত্মায় প্রবেশ করেছেন তার ঈশ্বরত্বের সুষ্ঠু অভিব্যক্তির জন্য। টমাস একুইনাস বলেন যে, ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞানলাভের জন্য মানুষকে পরলােকের ওপর নির্ভর করতে হয়। একুইনাসের এ মতের বিরুদ্ধে একহার্ট বলেন, আমরা ইহলােকেই ঐশ্বরিকজ্ঞান বা দিব্যদর্শন লাভ করতে পারি। এ দিব্যজ্ঞান এবং এ একত্বের অনুভূতিই আমাদের অস্তিত্বের শীর্ষবিন্দু; এবং এটিই আমাদের জীবনের পরম প্রাপ্তি।
বিশ্বপ্রক্রিয়া সম্পর্কে এরিজেনা যে মত প্রকাশ করেছিলেন, একহার্টের এই মনে তারই প্রতিধ্বনি শােনা যায়। সব বস্তু ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট এবং এদের সবাই ঈশ্বরে ফিরে যাবে। ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে মানুষ নিজেকেও জানতে পারে না। তবে আমরা ঈশ্বরকে কোনাে বাহ্য কার্যকলাপ কিংবা তীর্থগমনের মাধ্যমে পেতে পারি না। ঈশ্বরকে পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের আত্মার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। মানবাত্মা স্বর্গীয়। আত্মা যে শুধ ঈশ্বরের অনুলিপি তা-ই নয়; আত্মা ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের ধারকও বটে। এজন্যই মানবাত্মার পক্ষে দেশ-কালের বাহ্য জগৎ অতিক্রমের মাধ্যমে সরাসরি ঈশ্বরকে জানা সম্ভব। বহুতু থেকে একত্ব, ভেদ থেকে অভেদের দিকে অগ্রসর হয়ে উচ্চতম ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভ করা যায়। একজন সাধক যখন ঐশ্বরিক জ্ঞানালােকের প্রত্যক্ষ প্রতীতি লাভ করেন, তখন তিনি পৃথিবীর সব বহুত্ব ও বৈপরীত্য ভুলে যান এবং এক অনির্বাচনীয় অনুভূতির অধিকারী হন। এ ঐশ্বরিক জ্ঞানের জন্য মানুষকে ধর্মতত্ত্ব বা প্রত্যাদেশের ওপর নির্ভর করতে হয় না। যে সংযােগ ব্যক্তিকে ঈশ্বরের সাথে নিকট সম্বন্ধে আবদ্ধ করে এবং যার ফলে ব্যক্তি বুঝতে পারে যে ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই আছেন, তাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই মানুষ যথার্থ ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভ করতে পারে।
একহার্টের মতে, ঐশ্বরিকজ্ঞানের জন্য মনের বিশুদ্ধি অত্যাবশ্যক। আত্মাকে সম্বনে কাছে ফিরিয়ে আনাই নৈতিকতা। এর জন্য মানুষকে তার ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিসর্জন দিতে হবে। ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত ধনসম্পদ আপতিক; প্রকৃতপক্ষে এদের কোনাে মূল্য নেই। এদের পরিহারের মাধ্যমেই কেবল উপলব্ধি করা যায় যে, আসলে সকল জীব এক। আমাদের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে হবে। যে ব্যক্তি ধনসম্পদের প্রয়ােজন বােধ করেন না এবং এসব ছাড়াই চলতে পারেন, তিনি যে ব্যক্তি প্রয়োজনের তাগিদে ধন-সম্পদের অধিকারী, তার চেয়ে মহান। যিনি সম্পদের কোনাে প্রয়ােজনই বােধ করেন না এবং সম্পদের অধিকারীও নন, তিনিই সর্বোত্তম ব্যক্তি। দরিদ্রকে খাদ্যদান এবং সন্ন্যাসীদের জন্য আশ্রম ও মঠ নির্মাণের জন্য যদি কেউ ঈশ্বরের নামে কিছু অর্থ দান করেন, তখন তার এ কাজকে আমরা একটি মহৎ কাজ বলে মনে করি। কিন্তু এই ব্যক্তির চেয়েও ঢের বেশি মহৎ সেই ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরের খাতিরে যেকোনাে অর্থ-সম্পদকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। যে ব্যক্তি ঈশ্বরের খাতিরে সবকিছু সানন্দে পরিহার করতে পারেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে স্বর্গরাজ্যের অধিকারী হতে পারেন।
একহার্ট কর্মের খাতিরে কর্ম এবং প্রেমের খাতিরে প্রেম গ্রহণের পরামর্শ দেন। তার মতে, স্বর্গ ও নরক থাকুক আর নাই থাকুক, নিজের মঙ্গলের জন্যই মানুষের জন্য ঈশ্বরের ভালােবাসা দরকার। যথার্থ শুভলাভের প্রেরণা ও প্রচেষ্টাই প্রেম। প্রেম সকল গুণের ভিত্তি; প্রেমই যথার্থ আচরণের উৎস। উপবাস দৈহিক সংযম প্রভৃতি বাহ্য আচরণের মাধ্যমে মােক্ষলাভ সম্ভব নয়। যে মানসিক শক্তি ও উদ্যম কর্মের প্রেরণা যােগায়, তার ওপরই মঙ্গল নির্ভরশীল। তার মতে, সব সদ্গুণ এক, সদ্গুণের কোনাে মাত্রাভেদ নেই। মানুষ যতক্ষণ ঈশ্বরের ইচ্ছাবিরুদ্ধ কাজে নিয়ােজিত, ততক্ষণ তার মনে ঐশ্বরিক প্রেম জাগে না। কোনাে ব্যক্তিকে সবসময় ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতে হয় না। বস্তুত, নৈতিক আচরণবর্জিত নিছক ধ্যান-অনুধ্যান স্বার্থপরতার আকর। কোনাে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দুঃখ-দুর্দশার কথা জানামাত্রই ধ্যানমগ্ন ব্যক্তিকেও ধ্যান পরিহার করে আর্ত মানবতার সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিৎ।
একহার্ট একজন মরমিবাদী। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই তিনি দেশ-কালের বাস্তবতা অস্বীকার করেছেন। তার মতে, গভীর অভিজ্ঞতায় ঈশ্বর ও মানুষের একত্ব অনুভূত হয়। এই অভিজ্ঞতা এমন এক স্তরের নির্দেশক যেখানে মানবাত্মার আলাের সাথে ঐশ্বরিক আলাে মিশে যায়। জ্ঞানের শেষ পর্যায়ে একটি হেঁয়ালির সৃষ্টি হয়। এখানে জ্ঞাতার ব্যক্তিসত্তা ধ্বংস হয়ে যায়, এবং তাতেই সে লাভ করে পুনর্জন্মের এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা।
কোনাে কোনাে দার্শনিক একহার্টকে জার্মান দর্শনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি তার চিন্তায় যেভাবে জার্মান ভাষার ব্যবহার করেন, তা ছিল অত্যন্ত চমৎকার। তার মধ্যে যে তেজ ও দীপ্তি লক্ষ করা যায়, পরবর্তীকালে এটাই মার্টিন লুথারের মধ্যে দেখা যায়। পরবর্তীকালে কোন কোন নাৎসি (Nazi) লেখক একহার্টকে নতুন জার্মান ধর্ম ও দর্শনের পথিকৃৎ বলেছিলেন। চার্চের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বিশ্বস্ত থেকেও একহার্ট চার্চের মৌলিক মতবাদের সমালােচনা করেছিলেন। মানুষ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তার শিক্ষা এরকম : কোনাে বাহ্যিক মধ্যস্থতার সাহায্য না নিয়ে শুধু নিজস্ব প্রচেষ্টা ও অন্তর্দর্শনের মাধ্যমেই ব্যক্তির পক্ষে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব।
একহার্টকে তার দর্শন দেখে তাকে একজন সর্বেশ্বরবাদী (pantheist) বলেই মনে হওয়ার কথা, এজন্য একহার্টের এসব মত ধর্মবিরােধী বলে ঘােষিত হয়েছিল। তবে তিনি একান্তই ইচ্ছাকৃতভাবে আদর্শ জগৎ এবং জীবজগৎ – এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে সর্বেশ্বরবাদ এড়াতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, “সমস্ত সৃষ্ট বস্তুই অসৎ” – এর অর্থ হচ্ছে “সমস্ত সৃষ্টিবস্তুর সত্তাই ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। ঈশ্বর যদি একমুহূর্ত দূরে থাকেন, তা হলে তাদের অস্তিত্বের লােপ হবে।” তিনি তার সর্বেশ্বরবাদ এড়ানোর জন্য বলেন, আমরা যে কালীক জগতে বাস করি তা ঈশ্বরের আদর্শ জগত নয়, বরং তার অনুলিপি বা কপি, এই জগৎ অপূর্ণ, কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু অপূর্ণ নন তাই এই জগৎ ঈশ্বর হতে পারেনা, এই জগৎ তাই ঈশ্বরের সাথে এক নয়, বরং তার দ্বারা সৃষ্ট। তাই ঈশ্বর তার সৃষ্ট এই কালীক ও অপূর্ণ জগতে অবস্থান করলেও তা পূর্ণ ঈশ্বরের সাথে এক নয়, ভিন্ন। তাই এই জগতের অপূর্ণতা ঈশ্বরকে প্রকাশ করেনা। মানবাত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে এক হয়ে যায়, এটা একটা উপমামাত্র। এভাবে তিনি তার দর্শনের সর্বেশ্বরবাদকে এড়ান, আর ফলে তার ওপর ধর্মবিরোধিতার আরোপন থেকেও রক্ষা পান। কিন্তু এই জগৎ ঈশ্বরের অপূর্ণ ছায়া বা মায়া এই ধারণা কখনও সর্বেশ্বরবাদ বা অদ্বৈতবাদের বিরোধী ছিলনা, বরং জগৎ নিয়ে এই চিন্তার ওপর ভিত্তি করেই অদ্বৈতবাদী মত গঠন করা হয়েছে। আর তিনি নিজেই বলেছেন জগৎ হলো পিওর নাথিং, বলেছেন মানবাত্মা সৃষ্ট নয়। এসব মতের সাথে তার পরবর্তীতে দেয়া সর্বেশ্বরবাদবিরোধী মতের সাথে একেবারেই যায়না। তাই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একহার্ট তার ওপর ধর্মবিরোধিতার আরোপনের ভয়েই তার দর্শনকে একরকম অসর্বেশ্বরবাদী চেহারা দেবার জন্য এরকম অসর্বেশ্বরবাদী ও অদ্বৈতবাদ-বিরোধী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
দান্তে (১২৬৫-১৩২১)
মধ্যযুগের অবসানের সময় যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ আরম্ভ হয়, দান্তে ছিলেন তার একজন অগ্রদূত। তার Divine Comedy জগতের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহের অন্যতম। ১৩০২ সালে তার রাজনৈতিক মতের জন্য তিনি ফ্লোরেন্স থেকে নির্বাসিত হন। এরপর তাকে আগুণে পুড়িয়ে মারার আদেশ দেয়া হয়। তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন করে তিনি বহুদিন আত্মগােপন করেছিলেন। অবশেষে রাভেনা নগরে বাসা স্থাপন করেন। এখানে ১৩২১ সালে তার মৃত্যু হয়।
De Monarchia গ্রন্থে দান্তে পােপও পবিত্র রােমান সম্রাট উভয়কে ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ােজিত এবং স্বাধীন বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। Divine Comedy গ্রন্থে তার বহুমুখী জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। তার ভাষাও অপূর্ব সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। এ গ্রন্থে যে আদর্শ প্রেম বর্ণিত হয়েছিল তার উৎস্য ছল বিয়াট্টিস পোর্টিনারী নামে এক মহিলা। বাল্যকালে বিয়াট্টিসের মৃত্যু হয়। তার প্রতি দান্তের যে গভীর প্রেম সৃষ্টি হয়েছিল, মৃত্যুর পূর্বে তিনি তা অনুভব করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর দান্তে বিবাহ করেছিলেন। স্ত্রীর সঙ্গে মৃত্যুর পূর্বে তার দেখা হয়নি।
দান্তের ডিভাইন কমেডিতে শয়তান ত্রিমুখরূপে বর্ণিত হয়েছে। এক মুখে সে খ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাসঘাতক জুডাসকে, অন্য দুই মুখে জুলিয়াস সিজারের প্রতি বিশ্বাসঘাতক ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসকে অবিরল চর্বণ করছে।
অন্যান্য দার্শনিকগণ
রুইস ব্রোত্রক (১২৯৩–১৩৮৯), জন টউলার (মূ. ১৩৬১) এবং হেনরি সুসাে (মূ. ১৩৬৬) অন্য তিন জন খ্যাতনামা গুহ্যদর্শন অনুরাগী ছিলেন। রুইস ব্রোত্রক ক্লন্ডাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। একহার্টের মত তিনিও ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। সুসােও টউলার ডমিনিকান সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। এরা সকলে সাধারণ লােকের ধর্মীয় চেতনার গভীরতা সম্পাদনের চেষ্টা করেছিলেন।
তথ্যসূত্র
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৪৯২-৯৬
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ২৬০-২৮৫
Leave a Reply