বিশিষ্ট বাঙ্গালী

(সম্প্রসারিত হবে)

রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮–১৯৮০)

(লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মৃত্তিকা সহিতা কর্তৃক রচিত, বণিকবার্তা প্রকাশনীর “কালপুরুষ : উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলা” গ্রন্থে প্রকাশিত)

ইতিহাসচর্চা ছিল তার কাছে সাধনার মতাে। গভীর নিষ্ঠা ও অভিনিবেশসহকারে তিনি বিনির্মাণ করেছেন প্রাচীন বাংলা ও ভারতের অমূল্য ঐতিহাসিক চিত্র। তিনি ইতিহাসের একজন সার্থক শিক্ষকও বটে। আজীবন জ্ঞান বিতরণ করেছেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা প্রশাসক হিসেবেও স্পর্শ করেছেন সাফল্যের শীর্ষবিন্দু। অনন্যসাধারণ কৃতবিদ্য এ মানুষটি ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার। জন্ম ১৮৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খন্দরপাড়ায়। পিতা হলধর মজুমদার ও মাতা বিধুমুখী। পদ্মার কুলবর্তী এলাকায় তার বেড়ে ওঠা, তাই নদীমাতৃক বাংলার জল-হাওয়াতেই তার মানসগঠন। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল ছেলেবেলার নিত্যসঙ্গী। এক সাক্ষাৎকারে বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, অল্প বৃষ্টিতেই মাঠ-ঘাট তলিয়ে যেত সব। এঘর-ওঘর যাতায়াতে কলাগাছ বা তালগাছের ভেলাই ছিল সম্বল। তারও ব্যবস্থা না হলে সাঁতার দেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তবে এসব কিছুই তার মেধা বিকাশের অন্তরায় হতে পারেনি। গ্রামেই শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। সে যুগে তালপাতার ওপর লেখার চল থাকলেও অধ্যাপক মজুমদার জানান, সহজপ্রাপ্যতার জন্য তারা স্কুলে কলাপাতার ওপর বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করে লিখতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখিত পাঠ্যপুস্তক তারা পড়তেন। ক্লাসে একজনও মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল না, সে কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।

এর পর উচ্চশিক্ষার্থে ব্রতী হন এবং সেখানেও মেধার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯০৯ সালে তিনি ইতিহাস বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক লাভ করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। দুই বছর পর একই প্রতিষ্ঠান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর পর তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন এবং অনেক দূর অগ্রসর হন। কিন্তু চূড়ান্ত ইন্টারভিউ এর দিন স্ত্রী আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার আর পরীক্ষা দিতে যাওয়া হয়নি। পথ পরিবর্তন করে চলে এলেন শিক্ষা ও গবেষণায়। মােড় ঘুরে গেল জীবনের আর বিশ্ব পেল একজন অসামান্য ঐতিহাসিক, ধীমান গবেষককে।

গবেষক হিসেবে তার যাত্রা শুরু আরেক বাঙালি দিকপাল মনীষী মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তত্ত্বাবধানে। এ সময় অন্ধ্র-কুষাণ কাল নামক যে অভিসন্দর্ভ তিনি রচনা করেন, তা তাকে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিতে ভূষিত করে। সময়টা ছিল ১৯১২ সাল। তার বয়স তখন ২৪ বছর। পরের বছর ১৯১৩ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে যােগদানের মাধ্যমে তার দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সূত্রপাত। ১৯১৪ সালের জুলাইয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পড়াতেন তিনি। এখানে তার ছাত্র হিসেবে অন্যদের মধ্যে ছিলেন স্বনামখ্যাত লেখক শ্রীনীরদ সি চৌধুরী। তরুণ বয়সেই গবেষক হিসেবে অধ্যাপক মজুমদারের খ্যাতি যে ছড়িয়ে পড়েছিল, শ্ৰীচৌধুরীর লেখায় তার সাক্ষ্য মেলে। তার লেখা The Autobiography of an Unknown Indian গ্রন্থে শ্ৰীচৌধুরী অধ্যাপক মজুমদারের শিক্ষকতার উচ্চ প্রশংসা করে এর। বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লেখেন, His [R C Majumdar] lectures gave me the sense of watching the process of the writing of ancient Indian history, and not merely the experience of reading it.” অধ্যাপক মজুমদার চাকরি বদল করে ঢাকায় চলে যাওয়ায় তারা যে মর্মাহত হন, সে কথাও উল্লেখ করেন। এ বইটি অধ্যাপক মজুমদারের হাতে আসে বহু বছর পর। এক স্মৃতিকথায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ছাত্রের কাছ থেকে এমন শ্রদ্ধা ও প্রশংসা শিক্ষকমাত্রেরই পরম আরাধ্য।

১৯২১ সালে পূর্ববঙ্গে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। সত্যেন বসু, নলিনী বসু, মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরাে নামজাদা পণ্ডিতরা যােগ দেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। রমেশচন্দ্র মজুমদারও যুক্ত হন তাদের সঙ্গে। যােগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পদে। বিভাগের একমাত্র অধ্যাপক হওয়ায় তিনি এ বিভাগের সভাপতির পদও অলঙ্কৃত করেন। ঢাকায় দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে একের পর এক সাফল্যজনক কীর্তি রেখে যান তিনি। বিভাগীয় পাঠক্রমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তারই পরামর্শে এ ক্লাসের পাঠক্রমে অত্যাধুনিক কাল অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাছাড়া এমএ মৌখিক পরীক্ষার সময় প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ছাত্রদের প্রাচীন ভারতীয় লিপি ও মুদ্রা দেখিয়ে জ্ঞানের নির্ধারণের নিয়ম চালু করেন তিনি। বিশেষত পরীক্ষার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে আদর্শ, মান ও সততার সুউচ্চ মানদণ্ড স্থির করেছিল, তা তিনি বারবার স্মরণ করেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, সে সময় শিক্ষকরা মেধার ভিত্তিতে নিয়ােগপ্রাপ্ত হতেন এবং ছাত্ররা তাদের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসার সঙ্গে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করত। একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়, একবার গান্ধীবাদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে একদল ছাত্র সিদ্ধান্ত নিল, সব জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে সরস্বতী পজার অঞ্জলি দেবে ও একত্রে আহার করবে। আরেক দল ছাত্র এতে তীব্র আপত্তি জানায় এবং অধ্যাপক মজুমদারের কার্যালয়ে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। অধ্যাপক মজুমদার শান্তভাবে তাদের বক্তব্য শােনেন এবং বলেন যে, সব ছাত্র যদি একত্রে পূজা উদ্যাপন করতে না পারে, তাহলে শিক্ষকরাও এতে যােগ দেবেন না। তার অনমনীয় দৃঢ়তায় পিছু হটে বিক্ষোভরত ছাত্ররা, কথা দেয় শিক্ষকের সম্মান রক্ষার। ছাত্রের ওপর এমনই প্রভাব বিস্তার করতেন সেকালের শিক্ষকরা। বিভাগের একাডেমিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ইতিহাস বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিতই শিক্ষা সফরে বেরােতেন তিনি। ১০-১২ বার তাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন তিনি। এ সময় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এক গভীর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠত, যা তিনি আজীবন পরম তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করেছেন।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগ দেয়ার কিছুকাল পর কলা অনুষদের ডিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অধ্যাপক মজুমদার সেখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বও তিনি পালন করেন। ছাত্র-শিক্ষকের স্নেহের সম্পর্কের নিদর্শন মেলে এক ঘটনায়। অধ্যাপক মজুমদার লিখছেন, একদিন ক্লাস নিচ্ছি, এমন সময় ভাইস চ্যান্সেলরের এক স্লিপ এল, ‘তুমি এখনই বাড়ি যাও; লাঞ্চ সেরে ফেরার পথে আমি এই মাত্র দেখে আসছি যে, একদল ছেলে তােমার বাড়ি ঘিরেছে।’ তখনই ক্লাস বন্ধ করে আমি তাড়াতাড়ি হেঁটে বাড়ি গেলাম। তখন বেলা দুটো-আড়াইটা হবে। গিয়ে দেখি, হলের ৬০-৭০ জন ছাত্র দাড়িয়ে আছে। সেটা দোলযাত্রার দিন, তারা খেলতে শহরে গিয়েছিল, অনেক দেরিতে ফিরেছিল। ফিরে দেখে খাবার নেই। সুতরাং এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই শুনে আমার স্ত্রী বলেছেন, তােমরা স্নান সেরে এসাে, খাবারের ব্যবস্থা করছি। এরই মধ্যে তিনি দুজন ছেলেকে আমার গাড়িতে নবাবপুর থেকে মিঠাই কিনে আনতে পাঠিয়েছেন। অল্পক্ষণের মধ্যে মিঠাই এসে গেল। ছেলেরা সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে খুশিমনে বাড়ি চলে গেল।

ভাইস চ্যান্সেলর সবটা শুনে ছাত্রদের আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করলে মজুমদারের স্পষ্ট জবাব, ‘সব ব্যাপারে অত খুঁটিনাটি নিয়ম মেনে চলা যায় না। আর এমন ব্যাপারে টাকা খরচও কিছু অপব্যয় নয়।’ শিক্ষকের মধ্যে পরস্পর পরিচয় ও নিবিড় বন্ধনের স্থান ছিল তার কাছে সর্বাগ্রে। ১৯৩৬ সালে অধ্যাপক মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকায় মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। কর্মজীবনে বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছে। এও তার জীবনের এক উল্লেখযােগ্য প্রাপ্তি, যা তিনি খুবই গুরুতের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ চট্টোপাধ্যায়, সরােজিনী নাইডু, স্যার যদুনাথ সরকার প্রমুখ ব্যক্তিত্ব।

১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইন্দোলজি কলেজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকেন এবং এর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫০ সালে অধ্যাপক মজুমদার ‘International Commission for a History of the Scientific and Cultural Development of Mankind’-এর সদস্য ও সহসভাপতি নির্বাচিত হন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, এ সিরিজের প্রথম গ্রন্থটিতে পশ্চিমা পণ্ডিতদের দ্বারা লিখিত ভ্রান্ত তথ্য ছিল। অধ্যাপক মজুমদার দায়িত্ব নিয়ে বিশেষ টীকা যােগ করে সংশােধিত আকারে তা প্রকাশ করেন।

১৯৫৫ সালে অধ্যাপক মজুমদার নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দোলজি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যােগ দেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগাে ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ অঞ্চলের সারস্বতসাধনার অন্যতম কেন্দ্র এশিয়াটিক সােসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ উভয়েরই সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি যথাক্রমে ১৯৬৬-৬৮ ও ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত। এছাড়া ১৯৬৭-৬৮ সালে কিছুদিনের জন্য তিনি কলকাতার ‘শেরিফ (Sheriff)’-এর পদেও সম্মানের সঙ্গে আসীন ছিলেন।

এসবের পাশাপাশি তার গবেষকসত্তাটিকে কখনাে অবহেলা করেননি তিনি। গােড়া থেকেই গভীর নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সঙ্গে উচ্চমানের গবেষণা করেছেন ও সেগুলাে প্রকাশ করেছেন প্রসিদ্ধ জার্নালে ও পুস্তকাকারে। এশিয়াটিক সােসাইটির জার্নালে তার প্রথম গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ হয় ১৯১৪ সালে। এর কিছুদিন পর তিনি স্যার আশুতােষের উদ্যোগে সোসাইটির কাউন্সিলের সভ্য হন। তিনিই এর অন্যতম কনিষ্ঠ সভ্য ছিলেন। এশিয়াটিক সােসাইটির জার্নাল ছাড়াও Journal of Indian History, Indian Historical Quarterly, Journal of the Bihar and Orissa Research Society-তে একাধিক প্রবন্ধ লেখেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ রমেশচন্দ্র মজুমদারের Corporate Life in Ancient India শীর্ষক পিএইচডি অভিসন্দর্ভ।

ঢাকায় যাওয়ার পর উপাচার্য ফিলিপ হার্টগ অধ্যাপক মজুমদারকে অনুরােধ করে বলেন, তার ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন একটি উৎকৃষ্ট গবেষণাকেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং তার জন্য তিনি যেন গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নেন। এ সূত্রেই ১৯২৪ সালে Early History of Bengal নামক পুস্তিকাটি রচিত ও প্রকাশ হয়। হার্টগ স্বয়ং এর প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে Outline of Ancient Indian History (পরিমার্জিত নাম Ancient India) প্রকাশ হয়। অদ্যাবধি পাঠকসমাজে বইটি বিপুলভাবে সমাদৃত। এ সময় বাংলার বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসের প্রতিও তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সুষ্ঠুভাবে গবেষণা সম্পাদনের লক্ষ্যে তিনি ফরাসি ও ডাচ ভাষা শেখেন এবং ভিয়েতনাম অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপর Champa, Ancient Indian Colonies in the Far East (1927) গ্রন্থটি রচনা করেন। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে আরাে লেখেন। Suvarnadvipa, Ancient Indian Colonies in the Far East, Kambuja Desa Or An Ancient Hindu Colony In Cambodia, Hidu Colonies in the Far East.

তিন খণ্ডে বাংলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস The History of Bengal-এর পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ অধ্যাপক মজুমদারের জীবনের এক মূল্যবান কীর্তি। এর মধ্যে প্রাচীনকালের ওপর লেখা প্রথম খণ্ডটি তিনি নিজে সম্পাদনা করেন, যা ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশ হয়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনের এ প্রয়াস বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সমাদৃত হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড সম্পাদনার ভার পান স্যার যদুনাথ সরকার।

অধ্যাপক মজুমদারের আরেকটি বিশেষ কীর্তি ভারতীয় বিদ্যাভবন সিরিজের History and Culture of the Indian People. ১১ খণ্ডে রচিত এ প্রকল্পে ৭৫ জন বিদ্বজ্জন কাজ করেন। তা হলেও সিরিজের সিংহভাগ লেখা অধ্যাপক মজুমদার নিজেই লিখেছিলেন। এমনকি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির চাপে তাকে মধ্য ও আধুনিককালের ইতিহাসও রচনা করতে হয়েছে। প্রচুর পরিশ্রম করে ২৮৩টি প্লেট, ২০টি মানচিত্রসংবলিত প্রায় নয় হাজার পৃষ্ঠার এ সিরিজটি সম্পন্ন করতে হয়েছে।

‘স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস’ নামক ভারত সরকারের একটি প্রকল্পে অধ্যাপক মজুমদার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তবে এটি নিয়ে ভারতীয় সরকারের সঙ্গে তার তীব্র দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। এ দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে তিনি The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857 (one volume, 1957) এবং History of Freedom Movement in India (three volumes, 1962-63) নামক চারটি বৃহদাকার গ্রন্থ রচনায় মনােনিবেশ করেন। এইচসি রায়চৌধুরী ও কালীকিংকর দত্তের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত Advanced History of India গ্রন্থটি ১৯৬০ সালে প্রকাশ হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস বিষয়ে রচিত স্নাতক পর্যায়ের নির্ভরযােগ্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ছাত্রমহলে এটি দীর্ঘদিন ধরে বিপুল সমাদৃত। তার সারা জীবনের কর্মসাধনার জন্য তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একাধিক পুরস্কার লাভ করেন। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের ৯২ বছরের দীর্ঘ কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ দিনটি ছিল ১৯৮০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি।

মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬)

(লেখাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের প্রেসিডেন্ট ও অধ্যাপক মোঃ শরিফ উদ্দিনের, বণিকবার্তা প্রকাশনীর “কালপুরুষ : উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলা” গ্রন্থে প্রকাশিত)

আলােকিত বিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬) বিজ্ঞানের ইতিহাসে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। একজন বিজ্ঞানী, শিক্ষক, বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সফল প্রতিষ্ঠাতা, জনপ্রতিনিধি, চিন্তাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক— এ ধরনের বহু অভিধায় তাকে পরিচিত করিয়ে দেয়া যায়। বহুগুণের সমন্বয় একজন মানুষের ভেতরে কীভাবে ঘটতে পারে, তার সবচেয়ে কাছের উদাহরণ মেঘনাদ সাহা। তিনি এ ঢাকার সন্তান, এ দেশের আলাে-বাতাসেই বেড়ে উঠেছেন। অবিভক্ত ভারতের ঢাকার শহরতলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম এ পথপ্রদর্শক, দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে তার সে অবদানের কথা। তিনি পৃথিবীর সামনে ‘আনয়নের সমীকরণ’ রহস্য উন্মােচন করে কার্যত পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানীদের সামনে ঘাের তৈরি করেন।

দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মেঘনাদ সাহা তার সমকালের অন্যতম। একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। পরবর্তীতে যার অনন্য গুণ আর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছেন পৃথিবীখ্যাত, নােবেল পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানীরাও। তৎকালীন বিজ্ঞানের গতিধারার সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞানচর্চার একটি অপূর্ব সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের জয়জয়কার ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা নেয়ার জন্য তাকে কল্পনাতীত সংগ্রাম করতে হয়েছে, প্রাথমিক পাঠ শেষ হওয়ার পর তার মুদিদোকানি পিতা সন্তানের জন্য এর বেশি পড়াশােনায় আগ্রহ দেখাননি। শেষ পর্যন্ত শিক্ষকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তার শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা পায়। এভাবে শেষ পর্যন্ত মেঘনাদ সাহাই তার সমকালের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনন্য উচ্চতায় আরােহণ করেন, নােবেল কমিতিতে অন্তত চারবার পেয়েছেন মনােনয়ন। সারা জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য ফেলােশিপ ও সম্মাননা।

দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানাের হাতেখড়ি তার হাত ধরেই। ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সােসাইটি প্রভৃতি বিশ্বমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান তার নেতৃত্বেই আলােয় আসতে পেরেছে। শুধু প্রবল আগ্রহ আর ইচ্ছাশক্তির জোরে গণিতের ছাত্র হয়েও শিখরে পৌঁছেছেন পদার্থবিদ্যায়; যার প্রমাণ মেলে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যখন তার লেখা ‘টেক্সট বুক অব হিট’ বইটি আবশ্যক মনে করে পড়েন। রাজনীতিসচেতন এ বিজ্ঞানী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভারতের লােকসভার সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। উপমহাদেশে প্রথম বিগ ব্যাং, পারমাণবিক তত্ত্বের পরীক্ষণ সহজ করা যন্ত্র সাইক্লোট্রনের প্রতিষ্ঠাও হয়েছে তার হাতে।

নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় সমগ্র ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক ৪ টাকা বৃত্তিলাভ মেঘনাদের বড় হওয়ার মনােবল বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ছেলেবেলাতেই। এন্ট্রান্স ও উচ্চ মাধ্যমিকে পূর্ববঙ্গে প্রথম হওয়া ছিল তারই ধারাবাহিকতা। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় কলেজ ম্যাগাজিনে হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ হয় তার। কথিত আছে, ভীষণ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জন্মেছিলেন বলে ঠাকুরমা তার নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ, পরে স্কুলে ভর্তি হলে নাম হয় মেঘনাদ। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে গণিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে বিএসসি পাস করেন মেঘনাদ। প্রেসিডেন্সিতে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখ ছিলেন তার সরাসরি শিক্ষক। বিএসসি পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখলেও নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু, বাঘা যতীন প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল ধর্মীয় শ্ৰেণীবৈষম্যে বিরক্ত মেঘনাদের। বয়সে সুভাস চন্দ্র বসুর চেয়ে তিন বছরের বড় ছিলেন মেঘনাদ। ১৯১৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে এমএসসি পাস করেও টিউশনি ছিল তার উপার্জনের একমাত্র উপায়, কারণ মেঘনাদের সঙ্গে বিপ্লবীদের যােগাযােগ রয়েছে বলে সরকারের কাছে রিপাের্ট ছিল। কলকাতায় বিজ্ঞান কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স না হয়েও বছর না পেরুতেই যােগ দেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। পড়াতে পড়াতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের ভালােবাসায় পড়ে যান মেঘনাদ সাহা।

ক্যারিয়ার

কলকাতার ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্সের গণিত বিভাগে তিনি ১৯১৬ সালে প্রভাষক হিসেবে যােগদানের মধ্য দিয়ে প্রথাগত শিক্ষকতা জীবনে প্রবেশ করেন। প্রায় একই সময়ে একই কলেজে তার সহপাঠী সত্যেন্দ্রনাথ বসুও শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন। কিছুদিনের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা দুজনই গণিত বিভাগ ছেড়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যােগ দেন। তখন যদিও ওই কলেজটির কোনাে সমৃদ্ধ গবেষণাগার ছিল না, তবু শিক্ষকতার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা গবেষণায় আগ্রহ দেখান।

১৯১৭ সালে তিনি সিলেক্টিভ রেডিয়েশন প্রেসার বিষয়ে একটি দীর্ঘ আর্টিকেল রচনা করেন এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান-বিষয়ক জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠান। কিছুদিন পর তার গবেষণার একটি সংক্ষিপ্ত নােট জার্নালটিতে ছাপা হয়। ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি তার গবেষণার (Harvard Classification of Stellar Spectra) জন্য প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২০ সালে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ওপর তার চারটি গবেষণা প্রবন্ধ ফিলােসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়। মূলত তিনি তার এসব গবেষণাপত্রে Thermal lonization তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর তিনি তার এ গবেষণার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Griffith Prize লাভ করেন।

প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে তিনি অধিকতর গবেষণার উদ্দেশ্যে দুই বছরের জন্য ইউরােপে পাড়ি জমান, আলফ্রেড ফুলারের সঙ্গে কয়েক মাস কাজ করার পর তিনি বার্লিনে যান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়াল্টার নার্নেস্টের গবেষণাগারে গবেষণা অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করার জন্য। এর পর দেশে ফিরে ১৯২৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করেন এবং পরবর্তী ১৫ বছর সেখানেই কাটান। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি অসংখ্য পুরস্কারের জন্য মনােনীত হন এবং ১৯২৫ সালে তাকে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে মনােনীত করা হয়। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। এ সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের এমএসসি সিলেবাসে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যুক্ত করেন। সেখানে পরমাণুবিদ্যার ওপর স্নাতকোত্তর-পরবর্তী একটি কোর্স চালু করেন। একজন মহান বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি বহু প্রতিষ্ঠানের পত্তন করেছেন। তিনি কলকাতায় ১৯৩৫ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসােসিয়েশন, ১৯৫০ সালে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। এবং তিনিই মূলত দামােদর ভ্যালি প্রজেক্টের প্রকৃত ডিজাইনার।

চিন্তাবিদ ও সমাজসংস্কারক

একজন বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিসচেতন নাগরিক হিসেবে তিন ম্যাগাজিন পত্রিকা প্রকাশের গুরুত্ব অনুভব করেন। যেখানে বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সমাজ, অর্থনীতি, পরিবেশসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞজনদের লেখা প্রকাশ হবে। এভাবে বন্ধু এবং সহকর্মীদের সহায়তা তিনি সায়েন্স এবং কালচার নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সমাজের শিক্ষিত মানুষকে সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষার সংকট ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সচেতন করা এবং সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করা। তিনি তার অনেক প্রবন্ধে দেখানাের চেষ্টা করেছেন একই সমস্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ কীভাবে সমাধান করেছে। যেহেতু তার সময়ের যােগাযােগের মাধ্যমগুলাে আজকের তুলনায় দুর্বল ছিল, সে সময়ও তিনি তার ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় এবং অন্যান্য প্রবন্ধে অভূতপূর্ব চমক দেখান। যেমন ধরা যাক, হাইড্রোলিক গবেষণাগার, ভারতের সেচ পদ্ধতির গবেষণা, দামােদর ভ্যালির পরিকল্পনা, ভারতের বহুমুখী নদী প্রকল্পের উন্নয়ন, জনগণের জন্য বিদ্যুতায়ন, তেল এবং অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয় জ্বালানি নীতি ইত্যাদি।

ক্যালেন্ডার পুনর্গঠন ছিল তার জীবনের অন্যতম একটি বড় অবদান, তাকে ১৯৫২ সালে ক্যালেন্ডার পুনর্গঠন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। এ সময় তিনি কঠোর পরিশ্রম করে ভারতের বিভিন্ন অংশের অন্তত ৩০টি ক্যালেন্ডার এবং পৃথিবীর ক্যালেন্ডারগুলাে অধ্যয়ন করেন। মেঘনাদ সাহার বিভিন্ন লেখা, তার বক্তৃতা এবং গবেষণা, ক্যালেন্ডার পুনর্গঠনে ভূমিকা, স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন কমিশনের নেতৃত্ব দেয়া এসবই এ বিজ্ঞানীকে একজন মহান সমাজ সংস্কারকের সারিতে স্থান দেয়।

মেঘনাদ সাহা তার সারা জীবনের চিন্তা-গবেষণায় দেখিয়ে গেছেন যে, কীভাবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষা, বস্ত্র, ক্ষুধা এবং প্রযুক্তির অপ্রতুলতার সংকট কাটিয়ে উঠতে হয়। কীভাবে বিজ্ঞানের সুফল ঘরে তুলতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বিশেষভাবে বাঙালির এ পরম ঘনিষ্ঠজনের অবদান আজো উপমহাদেশের মানুষকে আলাে দিয়ে চলেছে, করছে আলােকিত।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪)

(লেখাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্‌ হাসান নকীব এর লেখা, বণিকবার্তা প্রকাশনীর “কালপুরুষ : উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলা” গ্রন্থে প্রকাশিত)

দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বয়স ১৪ বিলিয়ন বছরের কাছাকাছি। পদার্থবিজ্ঞানীরা এ মহাবিশ্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কণা, শক্তি, তরঙ্গ— এ শব্দত্রয়ের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তবে মনে রাখা ভালাে, কণা, শক্তি, তরঙ্গ— এ শব্দগুলাের দৈনন্দিন জীবনে যে অর্থ, তা কিন্তু সবসময় পদার্থবিজ্ঞানের ধ্যানধারণার সঙ্গে মেলে না। পদার্থবিজ্ঞানে কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (wave-particle duality) আছে, আছে ক্ষেত্রতত্ত্বে (field theory) শক্তিকণা আর বস্তুকণার ভেতরকার রূপান্তর, যা অহরহ ঘটে চলে। এ জগৎ যেন এক ছায়াজগৎ, যেখানে রূপান্তর ও সতত পরিবর্তনই মুখ্য, ‘আসল’ চেহারা নিয়ে কেউ যেন ধরা দিতে চায় না। হয়তাে আসল চেহারার ধারণাটিই নকল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ ছায়াজগতের বাসিন্দারা সদাপরিবর্তনশীল হওয়া সত্ত্বেও কিছু নিয়মনীতির বাঁধনে দৃঢ়বদ্ধ। শক্তি, কণা বা তরঙ্গ যে চেহারাতেই প্রতিভাত হােক না কেন, শেষ বিচারে মহাবিশ্বের সব মৌলিক উপাদানকে দুই ভাগে ভাগ করা চলে বােসন আর ফার্মিয়ন। এর কোনাে ব্যতিক্রম নেই। এ বােসন নামটি এসেছে বিখ্যাত বাঙালি পদার্থবিদ অধ্যাপক সত্যেন বােসের নামানুসারে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অভিধানে বােসন শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গুটিকয়েক শব্দের অন্যতম। বছরখানেক আগে হিগস্ বােসন নিয়ে মাতামাতি আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি।

অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ (সত্যেন) বসু ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষা ও পারিবারিক জীবন নিয়ে বেশ লেখালিখি হয়েছে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ও মা আমােদিনী বসুর সাত সন্তানের ভেতর সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম। দুই পুরুষ ধরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এ পরিবারটিতে একই সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বিলেতি সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। সত্যেন বসু ১৯০৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশােনা শুরু করেন। শৈশব থেকেই প্রতিভাবান সত্যেন বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে এসে সহপাঠী হিসেবে পান সাহাকে। মেঘনাদ সাহা কালক্রমে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বসু ও সাহার ভেতর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং তারা একত্রে বেশকিছু প্রকল্প নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান।

সত্যেন বসু ১৯১৩ সালে বিএসসি ও ১৯১৫ সালে এমএসসি সমাপ্ত করেন। উভয় পরীক্ষায়ই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। দ্বিতীয় স্থান ছিল মেঘনাদ সাহার। সে যুগেও চাকরি পাওয়া সহজ ছিল না। বসু ও সাহা দুজনকেই একটি বছর বেকার থাকতে হয়। এ দুঃসময়ে আশীর্বাদ হিসেবে উদয় হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি। তিনি রত্ন চিনতে ভুল করেননি। ১৯১৬ সালে বসু ও সাহা উভয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক ১২৫ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন।

বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এক দারুণ সময়। প্ল্যাঙ্ক, বাের, আইনস্টাইন তাদের যুগান্তকারী সব আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়েছেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা তার শিকড় বিস্তার করছে। বােলৎসম্যান আর গিবস পরিসংখ্যানিক বলবিদ্যাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। বিজ্ঞান জগজ্জুড়ে এক অতুলনীয় রােমাঞ্চ। এ পটভূমিতে বসু ও সাহা ছাত্রদের কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও আপেক্ষিক তত্ত্ব পড়াতে শুরু করেন। 

১৯২১-এ সত্যেন বসু সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার (সহযােগী অধ্যাপক সমতুল্য) পদের জন্য আবেদন করেন এবং যােগদানের সুযােগ পান। বেতন মাসিক ৪০০ টাকা। বসুর ওপর দায়িত্ব বর্তায় তড়িৎগতিবিদ্যা ও তাপগতিবিদ্যা বিষয় দুটির। তাপগতিবিদ্যা পড়াতে গিয়েই বসু প্ল্যাঙ্কের বিকিরণতত্ত্বে অন্তর্গত এক অসংলগ্নতা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্ল্যাঙ্কের যুগান্তকারী বিকিরণতত্ত্বে শােষিত ও বিকিরিত আলােকে বিচ্ছিন্ন শক্তিকণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে শক্তি ঘনত্বের জন্য রাশিমালায় একটি প্রাক-গুণিতক (pre-factor) নিণয় করা হয়েছে আলােকরশ্মিকে নিরবচ্ছিন্ন তরঙ্গ কল্পনা করে। এ অসঙ্গতি সম্পর্কে আইনস্টাইনসহ আরাে কিছু বিখ্যাত পদার্থবিদ সচেতন ছিলেন। তবে এ ত্রুটি দূর করার কোনাে উপায়ই তারা খুঁজে পাননি। সত্যেন আলােককণাগুলােকে (ফোটন) সমরূপ (indistinguishable) বিবেচনা করে সমাহারতত্ত্বের (combinatorics) একটি চমৎকার প্রয়ােগ করেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল প্রাক-গুণিতকটি নিরূপণে দশা-স্থানের (phase-space) একটি ক্ষুদ্রতম আয়তনের ধারণা। সত্যেন বসু বললেন, এ ক্ষুদ্রতম হচ্ছে h3, যেখানে h হচ্ছে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। অধ্যাপক বসুর এ ধারণা উদ্দীপ্ত ভাবনার (inspired thinking) একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। সংক্ষেপে বলা যায়, বসু প্ল্যাঙ্কের বিকিরণতত্ত্বের এমন একটি বিকল্প প্রতিপাদন পেশ করেন যা অন্তর্নিহিত অসংলগ্নতা থেকে মুক্ত। বসুর এ আবিষ্কার কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিকসের সূচনা।

বসু তার কাজটি বিলেতের ফিলােসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করেন ১৯২৪ সালের প্রথম দিকে। পত্রিকার সম্পাদক প্রায় ছয় মাস পর প্রকাশনার অনুপযুক্ত বলে তা ফেরত পাঠান। সত্যেন বসু হতােদ্যম হননি। তিনি আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে অনুরােধ জানালেন। প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সাইটশ্রিফট ফুর ফিজিকে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে। প্রবন্ধের তাৎপর্য বুঝতে আইনস্টাইনের বেগ পেতে হয়নি । তিনি অকপটে স্বীকার করলেন, প্রবন্ধটি পদার্থবিজ্ঞানে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। জার্মান ভাষায় অনূদিত প্রবন্ধটি বসু ও আইনস্টাইনের যৌথ নামে দ্রুত ১৯২৪ সালেই প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির শিরােনামের ইংরেজি অনুবাদ Planck’s Law and Light-Quantum Hypothesis. বিজ্ঞানজগৎ এক নতুন পরিসংখ্যানের সঙ্গে পরিচিত হয়, যা আজ বসু-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিকস নামে বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে অবশ্যপাঠ্য। এ পরিসংখ্যান যেসব কণা মেনে চলে তাদের বােসন বলা হয়। যত দিন বিজ্ঞান আছে, তত দিন বােসন নামটির ভেতরে সত্যেন্দ্রনাথ বসু অমর হয়ে থাকবেন। এর পর ১৯২৬ সালে দুই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ফার্মি ও ডিরাক আরেকটি কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকসের ধারণা প্রকাশ করেন, যা ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিকস নামে পরিচিত। এ পরিসংখ্যান ফার্মিয়নদের জন্য প্রযােজ্য। ফার্মিয়নরা পাউলির বর্জননীতি মেনে চলে, অন্যদিকে বােসনরা বর্জননীতির তােয়াক্কা করে না।

সত্যেন বসুর এ আবিষ্কার বিশ্বমানচিত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশিষ্ট আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। বােসের এ আবিষ্কার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার বললে ভুল হবে না। বােসের এ আবিষ্কারের পথ ধরেই বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবনের (Bose-Einstein condensation) ধারণা পাওয়া যায়। ধারণা থেকে ল্যাবরেটরিতে বাস্তবতায় রূপ নিতে বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবনের সময় লাগে প্রায় ৭০ বছর। আবিষ্কারকারীরা নােবেল পুরস্কার লাভ করেন।

প্রকৃতপক্ষে বসুর এ আবিষ্কারের পূর্ণ তাৎপর্য তখনকার পদার্থবিজ্ঞানীরা পুরােটা অনুধাবন করতে পারেননি। এমনকি আইনস্টাইন নিজেও নন। প্লাঙ্কের সূত্রের প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে বসু প্রাক-গুণিতক নির্ণয় করতে গিয়ে প্রথমে যা পান, তা ঈপ্সিত মানের অর্ধেক। বসুকে এ মানটির সঙ্গে দুই গুণ করতে হয়। এ দুইয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বসু ফোটনের স্পিনের ধারণা সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু স্পিনের ধারণা আইনস্টাইন পছন্দ করেননি। তিনি পােলারাইজেশনকে ভিত্তি করে দুই সংখ্যাটিকে সামনে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ফোটনের স্পিন আছে এবং বসু সঠিক পথেই ছিলেন। ফোটনের স্পিনের মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা বসুর হাতছাড়া হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বসু দুঃখ করে বলেছেন, ‘বুড়ো কেটে দিল, একটা পার্টিক্যালের আবার পােলারাইজেশন কি রে?।’ আইনস্টাইনের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাবােধ থেকেই বসু এ ব্যাপারে কখনাে উচ্চবাচ্য করেননি। আজীবন আইনস্টাইন বসুর কাছে ছিলেন পরম আরাধ্য।’

১৯২৪ সালের আবিষ্কার সত্যেন বসুর জন্য প্রথিবী উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯২৫ সালে ইউরােপ ভ্রমণের সুযােগ আসে। তিনি ফ্রান্সে মাদাম কুরির গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। ডি-ব্ৰগলির গবেষণাগারেও কাজ করার সুযােগ পান। সংস্পর্শে আসেন ল্যাঞ্জেভাঁর মতাে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের। কিছু সময় জার্মানিতে কাইজার ভিলহেলম ইনস্টিটিউটে কাজ করেন এক্স-রে নিয়ে। ঢাকায় ফিরে তিনি নিজ বিভাগে একটি এক্স-রে ক্রিস্টালােগ্রাফি ল্যাবরেটরি গড়ে তােলেন।

অধ্যাপক সত্যেন বসু পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখায় কাজ করেছেন । প্রথম দিকে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে কাজ করেছেন চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে কাজ করেছেন কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান নিয়ে। এছাড়া কাজ করেছেন গাণিতিক পদার্থবিদ্যা ও একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিকসে তার অবদানই তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

সত্যেন বসুর বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন দিক অল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনার উল্লেখ করে এ লেখার ইতি টানব। ১৯৪৫ সালে অধ্যাপক বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কলকাতায় ফিরে যান। সেখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতের বিভিন্ন আইআইটিতে অধ্যাপক বসু সিলেকশন বাের্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। যােগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যাপারে তিনি আপসহীন ছিলেন। একবার একটি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জনৈক প্রার্থীর নিয়ােগের জন্য সর্বশক্তি প্রয়ােগ করেন। সত্যেন বসুকে টলানাে যায়নি। বরং সত্যেন বসু এমন ব্যবস্থ নিয়েছিলেন যে, ভারতে আইআইটিগুলােয় নিয়ােগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সংশ্লিষ্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় ঘটনা অনেক সময় আগের। ১৯২৬ সালে সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক বিভাগের জন্য আবেদন করেন। এক্সপার্ট হিসেবে ছিলেন নােবেল বিজয়ী আর্নল্ড সমারফেল্ড। সমারফেন্ডের বিবেচনায় প্রথম পছন্দ হিসেবে সত্যেন বসু স্থান পাননি! অথচ আজকাল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােয় অতি সহজেই সবাই অধ্যাপক হচ্ছেন। যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় একটি বড় ধরনের অধঃপতন ঘটে গেছে।

অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ৮০ বছর বয়সে কলতায় পরলােকগমন করেন। সত্যেন বসু বাঙালি বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস।

মাস্টারদা সূর্য সেন (১৮৯৪-১৯৩৪)

(লেখাটি লেখক, রাজনীতিক, বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন এর লেখা, বণিকবার্তা প্রকাশনীর “কালপুরুষ : ঔপনিবেশিক বাংলা” গ্রন্থে প্রকাশিত)

স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে লেখা এই গানটি যখন গাওয়া হয়, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।’ তখন মনে হয় এ গান লেখা হয়েছিল সূর্য সেনদের মতো বিপ্লবীদের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। কবি নজরুল লিখেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এই অভিযান সেনাদলের তূর্য বাদকের আমি একজন।’ লিখেছিলেন নজরুল, কিন্তু মনে হয় সূর্য সেনও এই সেনাদলের একজন। কিংবা কলকাতা পুলিশের প্রধান চার্লস টেগারট অবসর নিয়ে ইংল্যান্ড চলে যাওয়ার সময় তেহরান বিমানঘাঁটিতে যখন বলেছিলেন, Chittagong is the mastermind of all Bengal revolutionary activities, তখন প্রথমেই যে নামটি মনে পড়ে তাঁর নাম সূর্য সেন।

পরাধীন ভারতে চট্টগ্রাম সশস্ত্র অভ্যুত্থান, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগীর নাম।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটেছিল। সূর্য সেন ছিলেন সেই অভ্যুত্থানের অবিসংবাদী নেতা। ব্রিটিশ অস্ত্রাগার দখল করে সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের এক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। পরাধীন ভারতে প্রথম নিজস্ব সরকার গঠনের ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ :

প্রিয় বিপ্লবী সৈনিকবৃন্দ,

ভারতের বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব আজ ভারতীয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাহিনীর উপর ন্যস্ত। ভারতবাসীর অন্তরের বাসনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ করবার জন্য আমরা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম বৈপ্লবিক কর্ম সম্পন্ন করার গৌরব অর্জন করেছি।

শত্রুর সেনাবাহিনী পরাস্ত। অত্যাচারী বিদেশী সরকারের অস্তিত্ব লুপ্ত। জাতীয় পতাকা আজ উচ্চে উড্ডীয়মান, জীবন ও রক্তের বিনিময়ে একে সর্বতোভাবে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।

ভারতীয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাহিনীর চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি আমি সূর্য সেন, এতদ্বারা ঘোষণা করছি, চট্টগ্রাম শাখার গণপ্রজাতন্ত্রী বাহিনীর বর্তমান পরিষদই সাময়িক বিপ্লবী সরকারে পরিণত হয়ে নিম্নলিখিত জরুরি কাজ সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে,

১। আজকের জয় সুনিশ্চিত করবার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

২। ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকে আরো ব্যাপক এবং তীব্র করে তুলতে হবে।

৩। অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দমন করতে হবে।

৪। সমাজদ্রোহী ও লুণ্ঠনকারীদের শাসনে রাখতে হবে।

৫। এই সাময়িক বিপ্লবী সরকারের পরবর্তী নির্দেশগুলি সম্পন্ন করতে হবে।

আমাদের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার চট্টগ্রামের প্রত্যেক সাচ্চা তরুণ তরুণীর কাছে সম্পূর্ণ বাধ্যতা, আনুগত্য ও সক্রিয় সহযোগিতা আশা ও দাবি রাখে। একথা ঠিক যে, সেদিনের সেই সরকার অল্প সময় স্থায়ী হয়েছিল, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার গুরুত্ব অপরিসীম।

১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে সূর্য কুমার সেনের জন্ম। তাঁর বাবার নাম রাজমনি সেন। ভালো ছাত্র হিসেবে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। পরে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ১৯১৮ সালে।

সূর্য সেনের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়েছে এমন এক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুগসন্ধিক্ষণে, যার প্রভাবে তিনি তাঁর জীবনের লক্ষ্য তিনি নির্ধারণ করেছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত রক্ষা আইন ১৯১৬, রাউলাট আইন ১৯১৯-এর মতো কালাকানুন তৈরি করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছে। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে গণবিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে: জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, হাজার হাজার কর্মীকে কারারুদ্ধ করেছে, কিন্তু আন্দোলন স্তব্ধ হওয়ার পরিবর্তে আরো ব্যাপক ও তীব্র রূপ নিয়েছে। নিপীড়ন যত বেড়েছে, মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলন তত শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮), রাশিয়ায় কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯১৭) সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মনে ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ সময়ে বহরমপুর কলেজে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে বিপ্লবীদের সংযোগ ঘটে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিপ্লববাদী পথে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাই রাজনৈতিক কাজের সুবিধার্থে চট্টগ্রামে ফিরে শিক্ষকতার জীবন বেছে নেন। ছাত্রদেরকে অঙ্ক শেখানোর পাশাপাশি জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে থাকেন। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের বিদ্যার্জন, তোমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণ, তোমাদের ভাবী জীবনের স্বপ্ন ও চিন্তার মধ্যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে একটি কথাকে কি প্রোজ্জ্বল করে রাখতে পারবে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে, ইংরেজের পরাধীনতার পীড়ন থেকে এই দেশকে মুক্ত করাই তোমাদের ব্রত, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য?’ তিনি নিজে তাঁর সারাটি জীবন এই উদ্দেশ্যেই পরিচালিত করেছেন। পিতৃমাতৃসম দাদা-বউদির প্রতিশ্রুতি ও সম্মান রক্ষায় বিয়ে করলেও তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রেখেছিলেন।

১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে ফিরে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলে তিনি যুগান্তর দলকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ব্যক্তিগত হত্যা, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ব্রিটিশকে হত্যা করলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে, কিন্তু ভারতবাসীকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো যাবে না। আবার অহিংস পথে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপ ও সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমেই কেবল স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব। এ কারণে ধৈর্য আর যত্ন নিয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছেন তিনি। ১৯২৩ সালে অর্থ সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রেল কোম্পানির টাকা লুট করার মামলায় গ্রেফতার হন, কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পরে মুক্তি পান। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার সব বিপ্লবী নেতা ও কর্মীদের বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করতে থাকলে সূর্য সেন দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় তিনি গ্রেফতার হন, প্রথমে মেদিনীপুর, তারপর বোম্বাইয়ের রত্নগিরি ও বেলগাঁও জেলে বন্দিজীবন অতিবাহিত করে ১৯২৮ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। দেশের রাজনীতিতে তখন ভীষণ উত্তেজনা। কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সুভাষ চন্দ্র বোসের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি আর গান্ধী নেহরুর Dominion status বা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে তীব্র মতবিরোধ, বিপ্লবী নেতাদের সুভাষ চন্দ্রের প্রতি সমর্থন, ১৯২৯ সালে সাইমন কমিশনবিরোধী তীব্র গণ-আন্দোলন, পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপত রায়কে পুলিশ নির্যাতন করে হত্যা- এসবের ফলে ধূমায়মান অসন্তোষ ব্যাপক সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল। সূর্য সেন তখন চট্টগ্রাম কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। গান্ধীর আহ্বানে কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি লবণ সত্যাগ্রহ বিক্ষোভে রূপ নিতে চলেছে। এমন অবস্থায় ১৯৩০ সালের ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রকাশ্য রাস্তায় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সূর্য সেন স্বাক্ষরিত ইশতেহার ছড়ানো হলো। ‘দেশের দিকে দিকে স্বাধীনতার সূর্য ধ্বনি শোনা যাইতেছে, সর্বত্র আইন অমান্য সংগ্রামের আরম্ভ হইয়াছে। ১৯২১ সালে যেই চট্টগ্রাম ছিল সবার পুরোভাগে, আজ সেই চট্টগ্রাম পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে, ইহা ক্ষোভ ও লজ্জার কথা। … কালবিলম্ব না করিয়া আমরাও ২২ এপ্রিল হইতে আইন অমান্য করিব স্থির করিয়াছি। ইহার জন্য সর্বসাধারণের সহানুভূতি চাই, সত্যাগ্রহী সেনা চাই, লোক ও টাকা চাই।’ এ ইশতেহার ছিল সূর্য সেনের ব্রিটিশ সরকারকে বিভ্রান্ত করার এক কৌশল । দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তিনি ধীরে ধীরে যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহ, অস্ত্রাগার দখলের, তার তারিখ ঠিক করে রেখেছিলেন ১৮ এপ্রিল। চূড়ান্ত গোপনীয়তা, কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে অল্প কিছু কিশোর তরুণকে নিয়ে গঠিত বিপ্লবী বাহিনীর সাহায্যে ঝড়ের গতিতে তাঁরা দখল করেন অস্ত্রাগার। রেল ও টেলিফোন, টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পুলিশ প্রশাসন এই অভিযানের বিন্দ আঁচ করতে না পেরে হতভম্ব হয়ে পড়ে। এই অভিযানের সর্বাধিনায়ক ছিলেন সূর্য সেন। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিপ্লবীরা তাঁদের দায়িত্ব শেষ করে ফিরে এলে পুলিশ অস্ত্রাগারকে হেড কোয়ার্টারস বানিয়ে সেখানে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে অতিরিক্ত সৈন্য এনে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড় যুদ্ধের মাধ্যমে যুব বিদ্রোহের অবসান ঘটায় ব্রিটিশরা । এই বিদ্রোহ আপাত অর্থে ব্যর্থ হলেও স্বাধীনতার স্পৃহাকে আরো তীব্র করে তোলে ভারতবাসীর মধ্যে। পরবর্তীতে একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে অস্থির করে রাখেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল, প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। প্রীতিলতার পূর্বে স্বদেশী সশস্ত্র আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না। নারীদেরকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল সূর্য সেনের প্রথাবিরোধী এক সাহসী পদক্ষেপ। আরো অনেক বিষয় সূর্য সেনকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল, যা আজো যারা মানুষের মুক্তির সংগ্রাম করতে চান, তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর সহযোদ্ধা গণেশ ঘোষের ভাষায়, ‘কখনই তিনি নিজের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ তাঁর সহকর্মী বা অনুবর্তীদের ওপর চাপিয়ে দিতেন না। অন্যের বিরুদ্ধ মতের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করতেন না। প্রতিটি বিরুদ্ধ মতকে অপরিসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে আলোচনা করেছেন, যুক্তির শক্তিতে বিরোধী মনোভাব জয় করেছেন। তাঁর এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি পরিপূর্ণভাবে তাঁর প্রত্যেকটি সহকর্মীর হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন।’ বিধু সেন লেখেন, ‘প্রশস্ত কপাল, শীর্ণকায় অতি সাধারণ এক নিরীহ শিক্ষক, চোখে পড়ার মতো কিছুই নয়। কিন্তু প্রথম দিনের পরিচয়ের পর বারবার অনুভব করেছি তাঁর মধ্যে একটা প্রবল আকর্ষণ, যা দিয়ে তিনি আমাদের অন্তর জয় করেছিলেন। অনুভব করেছি তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শিতা, সংকল্পে অবিচল নিষ্ঠা, বিপ্লবী নিয়মানুবর্তিতা আর জনগণ ও বিপ্লবী কর্মীদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা।’ বনবিহারী দত্ত বলেন, ‘তিনি ছিলেন সাধারণের মধ্যে অতি অসাধারণ। তাঁকে বিপ্লবী মহানায়ক বলতে যতটা গৌরব বোধ করি, আমাদের মাস্টারদা বলতে যেন আরো বেশি গৌরব বোধ করি।’ বিপ্লবী সহযোদ্ধারা কখনই তাঁকে এমন কোনো কাজ করতে দেখেননি বা এমন কোনো আচরণ করতে দেখেননি, যা মাস্টারদার আদর্শের, লক্ষ্যের পরিপন্থী, ন্যায়নীতিবোধ বিচ্যুত। স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিতাড়িত করা, স্বাধীন ভারত গঠন করাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। পরাধীন দেশের জনগণের দুঃখ-বেদনা, অপমান-লাঞ্ছনা তাঁর বুকে বেজেছিল বলেই নিজের জীবনের সর্বস্ব দিয়েই মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পটিয়ার গইরলা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়ি থেকে ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে বন্দি হন সূর্য সেন। এক বছর জেলহাজতে অমানুষিক নির্যাতন শেষে ব্রিটিশ সরকার তাঁর ফাঁসির সময় নির্ধারণ করে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে। মৃত্যুর পর তাঁর দেহটা দেশের মাটিতে সৎকার করাবার সাহস পায়নি ব্রিটিশ সরকার। তাঁর মরদেহ ফেলে দিয়ে আসে গভীর সমুদ্রে। যে দেশের মাটি ও মানুষকে মুক্ত করার জন্য লড়েছিলেন তিনি, সে দেশের মাটিতে ও জনগণের কাছে সূর্য সেনকে রাখতে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। সূর্য সেন আজ নেই। কিন্তু শোষণ লুণ্ঠন আছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। মৃত্যুর আগে সূর্য সেনের শেষ বাণী তাই আজো আমাদের শোষণ লুণ্ঠনবিরোধী আন্দোলনের সামনে এক দিক নিশানার মতো। ফাঁসির আগে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, Ideal and unity is my farewell message What shall I leave behind for you? Only one thing, that is my dream, a golden dream- a dream of free India How auspicious a moment it was, when I first saw it? Throughout my life most passionately and untiringly, I have pursued it like a lunatic. If icy hand of death give you a touch before the goal is reached then give the charge of your further pursuit to your followers, as I do today. Onward, my comrades, onward-never fall back. মাস্টারদা সূর্য সেনের স্বপ্ন ও সাধনার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই।

আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯)

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক নেহাল করিমের লেখা, বণিকবার্তা প্রকাশনীর “কালপুরুষ : উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলা” গ্রন্থে প্রকাশিত)

ড. আহমদ শরীফ সম্পর্কে তার প্রিয় ছাত্র ও সহকর্মী প্রখ্যাত প্রথাবিরােধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “একটি শব্দ ধ্রুবপদের মতাে ফিরে ফিরে তার সম্পর্কে ব্যবহার করেন পরিচিত ও অন্তরঙ্গরা। শব্দটি ছােট কিন্তু তার অর্থ-আয়তন অভিধানের বড় বড় শব্দের থেকে অনেক ব্যাপক। শব্দটি ‘অনন্য’। তারা বলেন, ডক্টর আহমদ শরীফ অনন্য। এমন আর নেই, আর পাওয়া যাবে না পলিমাটির এই ছােট্ট বদ্বীপে। দ্বিতীয় নেই, তৃতীয় নেই, চতুর্থ নেই তার।”  

বাংলাদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে ড. আহমদ শরীফই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সবার কাছে প্রিয় হওয়ার দুর্বলতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী ড. আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের পটিয়ার সুচক্রদন্তী গ্রামে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে ঢাকায় প্রয়াত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ১৯৬৭ সালে পিএইচডি অর্জন করেছিলেন। কলেজে অধ্যাপনার (১৯৪৫-৪৯) মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু। পরে এক বছরের কিছু বেশি সময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সহকারী হিসেবে থাকার পর ১৯৫০-এর শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যােগ দেন। একটানা ৩৪ বছর অধ্যাপনা করে ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানসহ সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, শিক্ষকদের ক্লাবের সভাপতি ও কলা অনুষদের চারবার নির্বাচিত ডিন ছিলেন। সেসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অন্যতম রূপকার ছিলেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাপক পদে ১৯৮৪-৮৬ পর্যন্ত নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার প্রাগ্রসর এবং মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসের বিদগ্ধ পণ্ডিত ড. আহমদ শরীফ একগুচ্ছ অসামান্য তীব্র বৈশিষ্ট্যসংবলিত একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এ কথা আর বলা যায় যে, বাংলাদেশের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে ড. আহমদ শরীফ একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব; যাকে উপেক্ষা করা যায়, তবে কোন অবস্থায়ই তার বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না। নিজস্ব দর্শন-চিন্তা বিশেষত্বের কারণে বােদ্ধা সমাজের কাছে ছিলেন বহুল আলােচিত, সমালােচিত ও বিতর্কিত এবং তার মৃত্যুর পরও এ ধারা বহমান। তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের মতাে একটি অনুন্নত দেশের আর্থসামাজিক কাঠামাের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে লেখাপড়া জানা মানুষের মাঝে না-পড়া, না জানার প্রবণতা গড়ে উঠেছে। তাই কেউ নিজে থেকে কোনাে বইয়ের বা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখার গরজ অনুভব করে না। আবার যেকোনাে মানুষ বা কোনাে বিষয়কে সমাজে পরিচিত করতে প্রচার হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সরকারি পৃষ্ঠপােষকতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে বা বিভিন্ন জাতীয় পর্ষদে কিংবা জাতীয় প্রচার মাধ্যমে আয়ােজিত অনুষ্ঠানগুলােয় ঘুরে-ফিরে যারা সবসময় অংশগ্রহণের সুযােগ পেয়ে থাকেন, তারাই কেবল দেশের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে থাকেন। সরকারি বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রচনাশৈলী যা-ই হােক না কেন, তার গুণগত মান প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে সঠিক মূল্যায়ন শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যতের গবেষকরাই করতে পারবেন। 

বাংলাদেশে ড. আহমদ শরীফের মতাে হাতেগােনা চার থেকে পাঁচজন লিখিয়ে পাওয়া যাবে, যারা কোনাে সময়ই সরকারি বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতার বেড়াজালে নিজেদের জড়াননি। তাই তারা মননশীল লেখক হিসেবে বা তাদের চিন্তাসমৃদ্ধ গ্রন্থগুলাে লেখাপড়া জানা মানুষের কাছে অদ্যাবধি অজ্ঞাত ও অপঠিত থেকে গেছে। তিনি পঞ্চাশের দশক থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেছিলেন এবং তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলমান !!! তার রচিত মৌলিক রচনাসংবলিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪৫, যার মােট পৃষ্ঠা ১৩ হাজার ৮৪৪ অর্থাৎ ছাপাকৃত প্রতি পৃষ্ঠাকে হাতের লেখায় আড়াই করে ধরলে তাতে ৩৪ হাজার ৬১২ পৃষ্ঠা হয়। উল্লেখ্য, এ সংখ্যা শুধু মাত্র রচনার হিসাব এবং সম্পাদিত মৌলিক গবেষণার ওপর গ্রন্থগুলাের সংখ্যা সব মিলিয়ে লাখের অধিক হবে। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, অদ্যাবধি বাংলাদেশে মৌলিক গবেষণার সংখ্যা হিসাবে ড. আহমদ শরীফের চেয়ে বেশি কাজ আর কারাের নেই।

দেশ-কাল-সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথাগত সংস্কার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবসময় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তিসহ সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আস্থা ও আগ্রহ। ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মার্ক্সবাদের যৌগিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান ধারণা, আচার-আচরণে, বক্তব্যে ও লেখনীতে। তার রচিত শতাধিক গ্রন্থের প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত জোরালাে যুক্তি দিয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস ও সংস্কার এবং আন্তরিকভাবে আশা করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার। আগেই উল্লেখ করেছি, পঞ্চাশ থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকামীদের কাছে তার পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। তার রচিত পুস্তকরাশির মধ্যে দু-খণ্ডে রচিত ‘বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য’ তার অসামান্য কীর্তি। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণাকর্ম তাকে ‘কিংবদন্তি পণ্ডিত’-এ পরিণত করেছে। উভয় বঙ্গে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এবং অদ্যাবধি স্থানটি শূন্য রয়ে গেছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে তিনি মধ্যযুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনা করে গেছেন। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য-তত্ত্ব ও যুক্তিসমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন।

জীবিতকালে বেশকিছু পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি-লিট ডিগ্রি পেয়েছিলেন। তার লেখনীর মধ্যে যেমন মানুষের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির কথা রয়েছে, তেমনি তৎকালীন পাকিস্তানের বেড়াজাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতা তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ)-এর সঙ্গেও তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। ১৯৬৩ সালে গঠিত অপূর্ব সংসদের (অস্থায়ী পূর্ব বাংলা সরকার) এবং তৃতীয় চূড়ান্ত ইশতেহার, যা ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’ প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’ গানটির কথা উল্লেখ ছিল। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দেশের সব সংকটময় মুহূর্তে কখনাে এককভাবে কখনাে সম্মিলিতভাবে তা প্রশমনের জন্য জনতার কাতারে যুক্ত হয়েছিলেন। অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ পর্যায়ের উত্তাল দিনগুলােয় অন্য পেশাজীবীদের মতাে লেখক, শিল্পী কর্মীদের প্রতিবাদ সভাগুলােয় তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, কলাকুশলী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিক্ষোভ সমাবেশে সবাইকে তিনি শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। সবাই তার নেতৃত্বে হাত তুলে শপথ নেন : “আমরা পূর্ব বাংলার সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও চালিয়ে যাব। সংগ্রামী জনগণকে আমরা প্রেরণা জোগাব লেখনীর মাধ্যমে, আমায় লেখনী হবে সংগ্রামের সাফল্যের জন্য বুলেট-বেয়নেট, অতীতের সব মতানৈক্য ভুলে জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা এগিয়ে যাব সংগ্রামের সাফল্যের দিকে।’ স্বাধীনতার পর জরুরি অবস্থা ঘােষণার সময় গঠন করেছিলেন মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তৎকালীন একদলীয় রাজনৈতিক দল গঠনের বিরুদ্ধে। ১৯৭৬-এ সামরিক শাসনের ভেতর প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের ‘একুশ’ উদযাপন জাতীয় কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান ও ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করার জন্য ১৯৮১ সালে গঠন করেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরােধী নাগরিক কমিটি। 

উভয় বঙ্গের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধি ও নির্মোহ চিন্তার ধারক ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা শাস্ত্র ও প্রথাবিরােধিতার কারণে ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত করেছিল। কথা ও কর্মে অবিচল, অটল, দৃঢ় মনােভাবের নাস্তিক সব রকমের প্রথা-সংস্কার শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৯৫ সালে লিপিবদ্ধ করা ‘অসিয়তনামা’র মাধ্যমে মরণােত্তর চক্ষু ও দেহ দান করে গেছেন। অসিয়তনামায় উল্লেখ ছিল, চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ-প্রতীক। কাজেই গােটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগানােই তাে বাঞ্ছনীয়। 

 

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.