আমেরিকায় ঔপনিবেশিক আমল

ভূমিকা

ঔপনিবেশিকরা তাদের প্রাথমিক পর্যায়ে একই সঙ্গে দু’টি সরকারের অধীনে বাস করতাে। একটা তাদের স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। অপরটি ব্রিটিশ সম্রাটের শাসন। মাতৃভূমি থেকে তিন হাজার মাইল দূরে নতুন একটি ভূখণ্ডে, তারা যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নতুন এক জীবনযাত্রা প্রণালী গড়ে তুলবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। তবু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভালাে-মন্দ, সুখ-দুঃখের সঙ্গে তারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছিল – তা থেকে গা বাঁচিয়ে চলার কোন উপায় তাদের ছিল না। ঘটনাপ্রবাহ তখন বিশ্বে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টায় ব্রিটেন আর ফ্রান্সের মধ্যে প্রচণ্ড এক শক্তিপরীক্ষায দানা বেঁধে উঠেছে।

প্রাদেশিক সমাজ

আমেরিকা আর ব্রিটেনের মধ্যে সুস্পষ্ট একটা পার্থক্য ছিল এই যে, ইউরোপের বহু অংশ (বিশেষ কোরে জার্মানী এ আয়াল্যাণ্ড থেকে) এবং আফ্রিকা থেকে লােকজন এসে আমেরিকায় বসতি স্থাপন করে। এদের স্বতন্ত্র জাতীয়তা এবং লক্ষ্যের বৈসাদৃশ্যের দরুন এরা আলাদা কায়দায় জমি বণ্টন করে এবং এক এক জায়গায় এক একভাবে তাকে কাজে লাগায়। সবারই কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল, কৃষি জমির মালিকানায় নিরঙ্কুশ অধিকার। এই অধিকার অর্জনের পথে অবশ্য তাদের প্রতিদ্বন্দিতা করতে হয়, এসব জমির প্রকৃত মালিক, বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী প্রস্তরযুগীয় ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের সঙ্গে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এরা হটে যেতে বাধ্য হলেও ঔপনিবেশিকদের জীবনধারার বিন্যাসে তাদের অবদান ছিল যথেষ্ট। ঔপনিবেশিক আমেরিকার শ্রমিকদের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের শ্রমিকদের একটা লক্ষ্যণীয় পার্থক্য ছিল এই যে, এখানকার শ্রমিকদের অনেকেই ছিল দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় এবং সাময়িক ভাবে, কিন্তু বেশীর ভাগই স্থায়ীভাবে।

ঔপনিবেশিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা অংশ, সম্ভবতঃ ১৫ শতাংশ, কৃষির দ্বারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করত। অন্যদের মধ্যে বেশীর ভাগই মাছ, পশুলােম, কাঠ ইত্যাদি উৎপাদন করে সরাসরি বিক্রি করত কিংবা বিদেশে চালান দিত। তাদের সুস্পষ্ট আমেরিকান মার্কা সামাজিক জীবন ছিল গ্রামীণ, পরিবারকেন্দ্রীক এবং “প্রাদেশিক”। এক একটা পরিবার সাধারণত নিজেরাই নিজেদের অন্ন, বস্ত্র এবং গৃহের সংস্থান করত। বাসিন্দাদের প্রায় সবাই ছিল ধর্মপরায়ণ, যদিও মতবাদের দিক দিয়ে বিভিন্নতা ছিল প্রচুর এবং ক্যাথলিকবাদের রক্ষণশীল ধর্মতত্ত্ব থেকে শুরু করে কোয়েকারদের প্রগতিশীল চিন্তাধারা পর্যন্ত কোনটারই সেখানে অভাব ছিল না। আমেরিকান ধর্মীয় জীবনধারা সাধারণভাবে ‘সহিষ্ণুতার” পথে এগিয়ে চলে কারণ মতবাদের এই ছড়াছড়ির দরুন একা কোনটার পক্ষেই শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করা এবং অপরকে তার অনুসারী হতে বাধ্য করা সম্ভব ছিল না। বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন সত্ত্বেও এর জনগণের সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভাবধারা অক্ষুণ্ণ থাকে। ঔপনিবেশিক আমেরিকার আইনকানুনও প্রণীত হয় ইংল্যান্ডে প্রচলিত আইন-কানুনের ভিত্তিতে। বন্য ভূখণ্ডের রুক্ষ পরিবেশে সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রবণতা সত্ত্বেও শিল্পকলা, সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উচ্চ মান বজায় রাখার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা হত এবং সে প্রয়াস প্রায়ই সাফল্যমণ্ডিত হত।

প্রত্যেকটি উপনিবেশের শাসনকর্তা ছিলেন একজন গভর্নর এবং প্রত্যেকের জন্যেই কোন-না-কোন রকমের একটা প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদের ব্যবস্থা ছিল। গভর্নরদের মধ্যে আটজনের নিয়ােগকর্তা ছিলেন রাজা স্বয়ং, মালিকরা নিয়ােগ করতেন দু’জনকে এবং দু’জন স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত হতেন। মালিক-কর্তৃক নিযুক্ত পেনসিলভ্যানিয়ার গভর্নর, ডেলাওয়ারের শাসন দায়িত্ব পালন করতেন। প্রত্যেকটি প্রতিনিধি পরিষদের অন্তত একটি সভা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হত। স্থানীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা চালাতে গিয়ে এবং তার দ্বারা স্বায়ত্তশাসনের উপযােগী করে নিজেদের গড়ে তােলার অবকাশে রাজপুরুষদের সঙ্গে এসব পরিষদে কোন-না-কোন কারণে বিবাদ লেগেই থাকত। এগুলােকে “গণতান্ত্রিক” বলা যাবে না, কারণ অবাধ ভােটাধিকারের কথা তখনও পর্যন্ত কেউ শােনেনি এবং বৈষয়িক ও ধর্মগত যােগ্যতার অভাবে অনেকে ভােট প্রদান কিংবা নির্বাচিত হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হত। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তুলনায় এগুলােকে অনেক বেশী প্রতিনিধিত্বমূলক বলা যেতে পারে। সরকারী আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ কর আদায়ের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকার দরুন গভর্নর কিংবা অন্যান্য রাজপরিষদের সঙ্গে বিরােধে এটাই ছিল এসব পরিষদের প্রধান হাতিয়ার। কর এবং বাজেট সম্পর্কে একমত হতে না পারলে প্রশাসনের পক্ষে শাসনকাজ পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়তাে। এই কলহপরায়ণতাকে অবশ্য জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রাথমিক আন্দোলন বলে গণ্য করা ঠিক হবে না। ১৭৭৫ খৃস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতার কোন প্রশ্নই কখনাে ওঠেনি।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি

উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির অধিকাংশেরই পত্তন হয় ইংরেজ ইতিহাসের স্টুয়ার্ট যুগে। এ সময় স্টুয়ার্ট বংশের চারজন রাজা সিংহাসনে আরােহণ করেন। প্রথম দু’জন-প্রথম জেমস এবং প্রথম চার্লস, উপনিবেশগুলোর ওপর সামান্যই প্রভাব খাটাতেন এবং বেশীর ভাগ সময় তাদের নিজেদের সুবিধেমতাে গড়ে ওঠার সুযােগ দেন। ১৬৪২ থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ, “কমনওয়েলথ” এবং অলিভার ক্রমওয়েল কর্তৃক “প্রােটেক্টরেট” স্থাপন – এসবের দরুন স্টুয়ার্টদের রাজত্বের সাময়িক অবসান ঘটে। ঔপনিবেশিকরা এসব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে পড়তে দেয়নি এবং তারা তাদের স্বাধীন বিকাশ অব্যাহত রাখে। দ্বিতীয় চার্লসের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তাদের ওপর ইংল্যান্ডের কিছুটা বেশী নজর পড়তে শুরু করে। নিউ ইয়র্কের জমিদার ডিউক অব ইয়র্ক যখন দ্বিতীয় জেমস নাম নিয়ে সিংহাসনে আরােহণ করলেন তখন একজন ক্যাথলিক হিসেবে তার জনপ্রিয়তার যে অভাব ছিল সেটা আরও জোরদার হল এই ভীতির দ্বারা যে, রাজা হিসেবে তিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হতে অভিলাষী। ফলে ১৬৮৮ খৃস্টাব্দে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে বিতাড়িত করা হয়। তার বিতাড়নে, আমেরিকায় আনন্দের ধুম পড়ে যায় কারণ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে তিনি ‘ডােমিনিয়ন অব নিউ ইংল্যাণ্ডের’ ভেতরে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। এর দ্বারা বস্টনকে রাজধানী বানিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় সকল উপনিবেশকে জোর করে একতাবদ্ধ করা হয় এবং এটা সাফল্যমণ্ডিত হলে সম্ভবত উপনিবেশগুলােতে স্থানীয় স্বত্তশাসনের সমাধি রচিত হত। আমেরিকানরা এই এতাে আগে থেকেই তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠেছিল। যে সাম্রাজ্যে তারা বাস করত, সেটা সুবিন্যস্তভাবে গড়ে ওঠেনি এবং কখনােই তা সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে পরিকল্পিত হয়নি। স্থানীয় ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তাদের যতদিন পর্যন্ত ছিল, ততদিন ঔপনিবেশিকরা দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অধীনে বাস করতে আপত্তি করেনি।

১৮শ শতাব্দীর ৬০ দশক পর্যন্ত রাজকীয় সরকার উপনিবেশগুলােতে স্থানীয় প্রশাসনের কাজকর্মে সামান্যই হস্তক্ষেপ করে। সরকারের দায়িত্ব ছিল প্রধানত উপনিবেশগুলোতে প্রবর্তিত আইন-কানুনের বৈধতা যাচাই এবং ঔপনিবেশিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানী গ্রহণ করা। অন্যথায় সামগ্রিকভাবে গোটা সাম্রাজ্যের বৃহত্তর সমস্যাবলীর দিকেই তার মনােযোগ সীমাবদ্ধ থাকতাে। এসব সমস্যা ছিল প্রধানত অর্থনৈতিক, যার জন্যে বেশ কিছু আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাম্রাজ্যব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ম-কানুন বেঁধে দেয়া হয়। এগুলো সম্মিলিতভাবে যে অর্থনৈতিক তত্ত্বের জন্ম দেয় তার নাম ‘মার্কেন্টাইলিজম’ বা ‘বাণিজাবাদ’। এই মতবাদের মােদ্দা কথা হচ্ছে, ব্যবসাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যেন তার দ্বারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই জাতি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। সেজন্যে দরকার জাহাজ চলাচল, কৃষি ও ব্রিটিশ উৎপাদন শিল্পকে উৎসাহ দান এবং স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার। এছাড়া বাণিজ্যবাদীরা বিদেশী ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীলতা পরিহারেরও চেষ্টা করতাে। ওদিকে আমেরিকান ঔপনিবেশিকদের ক্ষেত্রে এই বাণিজ্যবাদী নীতির যে দিকটা তাদের সবচেয়ে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল বেশ কয়েকটি জাহাজ চলাচল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সেই সব জাহাজের ব্যবহারে উৎসাহ যােগানাে, যেগুলাে সাম্রাজ্যের ভেতরেই তৈরী হয়েছে। এবং সাম্রাজ্যের বাসিন্দারাই যেগুলাের মালিক এবং চালক। কিন্তু একই সঙ্গে, উপনিবেশগুলাের কাঁচামালের জন্যে ব্রিটেনে একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি (এবং ব্রিটিশ উৎপাদকদের জন্যে ঔপনিবেশিক বাজার সৃষ্টি) এবং স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহারকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণমূলক কতকগুলি আইন পাস করে বাণিজ্যবাদী অন্য সব উদ্দেশ্য হাসিলেরও চেষ্টা করা হয়। আমেরিকায় বাণিজ্য সংক্রান্ত এসব আইনের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে তেমন আপত্তি ওঠেনি, তবে কাগজের নােট ব্যবহারের ওপর আরােপিত বাধানিষেধ কিছুটা অসন্তোষের সষ্টি করে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হয়ে দেখা দেয়, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ফরাসী উপনিবেশগুলাের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আরােপিত বাধানিষেধ। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্যে তাদের চোরাচালানের আশ্রয় নিতে হয় (যদিও তার পরিধি, যেমন বলা হয়ে থাকে, ততােটা ব্যাপক ছিল না)।

ইঙ্গ-ফরাসী প্রতিদ্বন্দিতা

১৭শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘােষণার কয়েক বছর আগে পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স চারবার প্রকাশ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়। নিউ ফ্রান্সের সম্প্রসারণের ভাবভঙ্গী দেখে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের মনে এই ধারণা জন্মে যে, তাদের সুপরিকল্পিতভাবে ঘেরাও করে ফেলা হচ্ছে। ফরাসী ব্যবসায়ী এবং ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা এ্যাপােলেশিয়ান পর্বতমালার পশ্চিম দিকের ভূখণ্ডে ব্যবসা পরিচালনা এবং সেখানকার জমির ওপর অধিকার দাবী করতাে এবং তারা প্রত্যেকেই ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানাের চেষ্টা করতাে। ওদিকে ভারতবর্য, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জেও তারা মাতৃভমির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিদ্বন্দিতার সম্মুখীন হত। কাজেই আমেরিকান দৃশ্যপট ছিল দুনিয়া জোড়া একটা সংগ্রামেরই খণ্ডাংশ মাত্র।

উইলিয়াম অব অরেঞ্জ আর চতুর্দশ লুইয়ের মধ্যে যে লড়াই ওয়ার অব দি লীগ অব অগসবার্গ নামে পরিচিত, আমেরিকায় তারই সম্প্রসারিত রূপ হচ্ছে রাজা উইলিয়ামের যুদ্ধ (১৬৪৯-৯৭)। বনাঞ্চলে এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলােতে, বিশেষ করে নিউ ইংল্যান্ডে ইণ্ডিয়ানরা নির্মমভাবে লড়াই চালায়। ঔপনিবেশিকরা অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে এই যুদ্ধ থেকে বিশেষ লাভবান হতে পারেনি। রাণী এ্যানের যুদ্ধ (১৭০১-১৩) ছিল স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের জন্যে সংগ্রামের ঔপনিবেশিক পর্যায়। আমেরিকায় মেক্সিকো উপসাগর থেকে সেন্ট লরেন্স নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সংঘর্ষ বিস্তার লাভ করে। এই লড়াইয়ের শেষে শক্তিশালী ইরােকী ইণ্ডিয়ান উপজাতীয়রা ব্রিটেনের আশ্রিত হিসেবে চিহ্নিত হয়। আকাদিয়া, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড এবং হাডসন বে অঞ্চলও ব্রিটেনের এখতিয়ারভুক্ত বলে মেনে নেয়া হয়। রাজা জর্জের যুদ্ধ (১৭৪৫-৪৮) ইউরােপে যা অস্ট্রিয়ায় উত্তরাধিকারের যুদ্ধ নামে অভিহিত। এটি আমেরিকাতেও সমান রক্তক্ষয়ী রূপ নেয় কিন্তু তা অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। নিউ ইংল্যান্ডের যােদ্ধাদের বিশাল লুইবুর্গ দুর্গ দখল করার গর্ব হতাশায় রূপান্তরিত হল, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন দেখা গেল তা ফরাসীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দু’পক্ষই একে প্রকৃত শান্তির বদলে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি বলে গণ্য করে। উপনিবেশ বিস্তারের প্রতিদ্বন্দিতা সবচেয়ে সঙ্কটজনক রূপ নেয় উত্তর আমেরিকায়। সেখানে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩) ফ্রেঞ্চ-ইণ্ডিয়ান যুদ্ধ নামে পরিচিত ছিল। ইউরােপে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমেরিকায় ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত সবচেয়ে সঙ্গতভাবেই তা উপনিবেশ বিস্তারের মহাযুদ্ধ (দি গ্রেট ওয়ার ফর এমপায়ার) নামে অভিহিত। এই লড়াইয়ের ফলে ফরাসীরা উত্তর আমেরিকা থেকে বিতাড়িত হয়।

উভয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মূলত একই জমির মালিকানা নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হত। ব্রিটিশরা তাদের আশ্রিত, যুদ্ধংদেহী ইরােকী ইণ্ডিয়ানদের মাধ্যমে ওহায়ো উপত্যকা এবং সেন্ট লরেন্স নদীর উজানের ভূখণ্ডের ওপর অধিকার দাবী করে। ওদিকে ফরাসীরা প্রথম আবিষ্কারের যুক্তিতে পশ্চিম নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভ্যানিয়া এবং ভার্জিনিয়ার বেশীর ভাগ এলাকার মালিকানা তাদের বলে দাবী জানায়। বিস্তীর্ণ উর্বর ভূখণ্ড এবং সেই সঙ্গে বিপুল কাঁচা চামড়ার সম্পদ ছিল এই বিবাদের কারণ। যে কোন যুদ্ধে ফরাসীদের একটা সুবিধা ছিল। তাদের সরকার এবং সামরিক কম্যান্ড পরিচালনায় ক্ষমতার ভাগাভাগি ছিল না। পশ্চিম দিকে সব কটি গুরত্বপূর্ণ যােগাযােগ পথে অবস্থিত প্রধান দগলাে ছিল তাদের দখলে। ইণ্ডিয়ানদের বেশীরভাগই ছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু তাদের লােকসংখ্যা ছিল কম, বসতিগুলাে ছিল অনেক দুরে দুরে অবস্থিত এবং বাসিন্দাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল যাযাবর ধরনের, গৃহস্থ পরিবার নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলাে যেসব রাজনৈতিক ইউনিটের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে মতের কোন মিল ছিল না। এদের জোড়াতালি একতাব্দধ রেখেছিলেন একজন রাজা, যিনি বাস করতেন তিন হাজার মাইল দূরে এবং এদের সামরিক ব্যাপারে যার নিয়ন্ত্রণ ছিল শিথিল। এই উপনিবেশগুলাে অভিন্ন কোন লক্ষ্য অর্জনে পরস্পরের সহযােগিতা করেছে এমন কোন নজীর নেই এবং টাকা-কড়ি, লােকলস্কর সরবরাহের জন্যে খােসামােদ করে, মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে এদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে রাজী করাতে হত। সামরিক দিক দিয়ে কেন্দ্রায়ত্ব নিয়ন্ত্রণের এই অভাব ছিল তাদের সবচেয়ে গুরুতর দুর্বলতা, কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের এই অভিজ্ঞতার কোন দাম ছিল না তাই বা কী করে বলা যাবে? রাজকীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আর একটা সম্ভাব্য এটি ছিল এই যে, ব্রিটিশ সামরিক অফিসারদের মধ্যে ঔপনিবেশিক সৈনিকদের প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের মনােভাব পােষণ করার একটা প্রবণতা পরিলক্ষিত হত; যার ফলে আমেরিকানদের যেসব বৈশিষ্ট্য যুদ্ধে খুবই কাজে লাগতে পারতাে, তার পরিপূর্ণ সুযােগ তারা নিতেন না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিপুলে সংখ্যাধিক্য এসব দুর্বলতা পুষিয়ে দেয়। ফরাসী ঔপনিবেশিকদের তুলনায় তাদের সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৫ গুণ বেশী। ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর শক্তি তখন সারা দুনিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। সেটাও ছিল একটা মহামূল্যবান সম্পদ। ফরাসী সমর্থক ইণ্ডিয়ানদের তুলনায় এদের মিত্র ইরােকী ইণ্ডিয়ানরা ছিল বহুগুণে বেশী শক্তিসম্পন্ন। এবং সবশেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বেসামরিক নেতৃত্ব ছিল এক কথায় অতুলনীয়।

নতুন দুনিয়ায় চারটি এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভৌগােলিক অবস্থান মিলিতভাবে সেগুলােকে রণাঙ্গনে পরিণত হতে সহায়তা করে। এগুলি হচ্ছে নিউ ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত, লেক শ্যাম্পলেনের সঙ্গে সংযােগ রক্ষাকারী সরু ভূখণ্ড, ওহায়াে নদীর উৎস এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ। এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা ইউরােপের যে কোন জায়গায় এ যুদ্ধে সূচিত হতে পারতাে। কিন্তু ঘটনামে যুদ্ধের সূচনা হয় ওহায়াে নদীর উজানের ভূখণ্ডে, যখন ভার্জিনিয়ার গভর্নর তার বর্তমানের পিটসবার্গ এলাকা ছেড়ে ফরাসীদে চলে যেতে তাদের হুশিয়ার করে দেবার জন্য আধা সামরিক বাহিনীর একজন সিনিয়র অফিসার জর্জ ওয়াশিংটনকে পাঠান। ফরাসীরা চলে যেতে অস্বীকার করল, একের পর এক ঘটনা পরিস্থিতিকে ক্রমশ ঘােলাটে করে তুললাে, এবং অবশেষে পাশ্ববর্তী জঙ্গলে ছােটখাট দুটি সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে লড়াই বেঁধে উঠলাে। অচিরেই সারা দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়লাে। একমাত্র ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোন জায়গাতেই ব্রিটিশরা সুবিধা করতে পারলাে না। গােড়ার দিকে ব্রিটিশ পরাজয়গালাের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমেরিকায় ব্রাডকের সেনাবাহিনীর নিধনের ঘটনা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। আমেরিকার অন্য সবখানে এবং সেই সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ও ইউরােপেও ব্রিটিশদের শােচনীয় ও  অপমানজনক পরাজয় বরণ করতে হয়।

পরাজয়ের এই নিম্নমুখী স্রোতকে বিজয়ের জোয়ারে রপান্তরিত করার জন্যে অন্য যে কোন কারণের চাইতে অধিকতর গুরত্বপূর্ণ যে কারণটি এককভাবে দায়ী তা হচ্ছে একা একজন মানুষের প্রতিভা। তার নাম উইলিয়াম পিট। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকারে প্রবেশ করার পর তিনি বৈদেশিক সম্পর্ক এবং যুদ্ধ পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের হাতে গ্রহণ করেন। একা একটা লােকের পক্ষে যতটা সম্ভব, এ বিজয়ের কতিত্ব সম্পূর্ণ তার একার। সামরিক পরিচালনা ব্যবস্থাকে একক সংগঠনের অধীনস্থ করার মাধ্যমে দুনিয়া জোড়া রণাঙ্গনে সেনাপতিদের পরিচালনার ভার তিনি নিজের হাতে তুলে নেন। বিংশ শতাব্দীর পাঠক আজও তার নির্দেশাবলীর মধ্যে খুঁজে পান প্রজ্ঞা আর বলিষ্ঠতার ছাপ। তিনি বেছে নেন যােগ্যতাসম্পন্ন এমন সব তরণ সেনাপতিকে, আক্রমণ ঠেকানাের বদলে যাদের জয় করার ক্ষমতা ছিল সুবিদিত। তার এই সব ক্রিয়াকলাপ দায়িত্বশীল অফিসারদের মনােবল বহুলাংশে বর্ধিত করে। তার পরিকল্পনা, তার অনুসৃত নীতি এবং তার মেধাসম্পন্ন সুযােগ্য স্থল ও নৌ-সেনাপতিদের সমাহারের দ্বারা সূচিত হয় অসাধারণ চমকপ্রদ সামরিক জয়ের মিছিল, নেপােলিয়ানের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক ইতিহাসে যার কোন নজীর নেই। এই বিজয়েরই নিশান হয়ে বিশ্বের প্রতিটি কোণায় সগর্বে উড়তে থাকে ব্রিটেনের ইউনিয়ন জ্যাক। ১৭৫৯ সালে জেনারেল উলফ আমেরিকায় কুইবেক অধিকার করেন। তিনি এ যুদ্ধে আহত হয়ে অনতিকাল পরেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিন্তু তার কুইবেক বিজয় কানাডায় ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে, আর উত্তর আমেরিকায় ফরাসি সাম্রাজ্যের সমাধি স্থাপন করে। 

১৭৬৩ সালে প্যারিসের সন্ধি এবং সংশ্লিষ্ট আলাপ-আলােচনায় ব্রিটেনের এই বিজয়কে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ফ্রান্স উত্তর আমেরিকার ভূখণ্ড থেকে বিদায় নেয়। ইংল্যান্ড নিউ ফ্রান্সের কানাডা নিয়ে নেয় আর স্পেইন নিয়ে নেয় নিউ ফ্রান্সের লুইজিয়ানার বেশিরভাগ অংশ। অন্যভাবে বললে মিসিসিপির পূর্বাঞ্চলে তার জমিজমা যা ছিল, তা ব্রিটেনের দখলে চলে যায়, আর ওদিকে মিসিসিপির পশ্চিমাঞ্চল লাভ করে তারই বিপর্যস্ত মিত্র এবং এই লাঞ্ছনায় তার সমভাগী স্পেইন। এই বিজয়ের ফলে ব্রিটিশ সামাজ্য বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়।

তথ্যসূত্র

আমেরিকার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কাফি খান, বাংলাদেশ বুকস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ২৩-৩০

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.