দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্ব (১৭৪৬-৬৩ খ্রী.)

ভূমিকা

দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্ব ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধের ঘটনাবলীতে চমকপ্রদ কিছু নেই সত্য, কিন্তু ভারতে ইংরেজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটিই ছিল সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। এই দ্বন্দের ফলেই শেষপর্যন্ত ভারতে ফরাসী শক্তির পতন হয় এবং ইংরেজ শক্তি বিজয়ী হয়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়-এই সংগ্রাম নিশ্চিতভাবে স্থির করে দিয়েছিল যে ফরাসীরা নয়, ইংরেজরাই ভারতবর্ষে প্রভুত্ব করতে চলেছে। (“This struggle……. decided once for all that the English and not the French were to become masters of India.”- History of the Freedom Movement in India, Vol-1)।

ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের প্রাক্কালে ভারত

১৮শ শতকের মধ্যভাগে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয় হয়ে পড়ে। ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়। দুর্বল উত্তরাধিকারীদের কারণে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে মুঘল কর্তৃত্ব শিথিল হতে থাকে। অল্পকালের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্য অনেকগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ সকল রাজ্যের রাজারা সর্বদাই পরস্পর কলহে লিপ্ত ছিলেন। ১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে পারস্যের সম্রাট নাদির শাহের (১৭৩৬-১৭৪৭) ভারত আক্রমণে মুঘল সাম্রাজ্যর দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে দাক্ষিণাত্যের মুঘল সুবাদার নিজাম-উল-মুলক প্রথম আসফ ঝা (১৭২৪-১৭৪৮) স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং হায়দ্রাবাদে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মারাঠাগণ প্রথম বাজীরাও (১৭২০-১৭৪০) এর নেতৃত্বে নিজামের প্রভুত্বকে অস্বীকার করে এর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। মারাঠা আক্রমণের চাপে এবং বার্ধক্যের ভারে নিজাম ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েন। তার মৃত্যুর পর দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি কোন দিকে মােড় নেবে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ সময় দাক্ষিণাত্যে মহীশূর, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর, ত্রিচিনাপল্লী, মাদুরা ও তাঞ্জোর প্রভৃতি প্রধান হিন্দু রাজ্য ছিল। এসব রাজ্যগুলাের মধ্যে না ছিল কোন ঐক্য, না ছিল নিজ পায়ে দাঁড়ানাের মত কোন ক্ষমতা। এদিকে হায়দ্রাবাদ এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চৌথ আদায়ের উদ্দেশ্যে মারাঠাদের আক্রমণ দাক্ষিণাত্যের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তােলে। এ সময় দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের অধীনে কর্ণাটক নামে একটি প্রদেশ ছিল। এর রাজধানী ছিল আর্কট। কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলী খান (১৭৩৪-১৭৪০) হায়দ্রাবাদের নিজামের অধীন হলেও নিজামের বার্ধক্য ও দুর্বলতা তাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তােলে। তিনি নিজামের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য চালাতে থাকেন। 

সুতরাং দেখা যায়, ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের প্রাক্কালে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল খুবই জটিল। ভারতীয় শক্তিগুলোর অবিরাম কলহই ইউরােপীয় বণিক সংঘগুলােকে দেশীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়। প্রথমে হয়ত তাদের বাধ্য হয়েই অরাজক ভারতবর্ষে নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু পরে সে অরাজকতার সুযােগে তারা সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করতে থাকে। ভারতবর্ষের তদকালীন কলহপূর্ণ অবস্থার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে ইংরেজ ও ফরাসী শক্তি। তারা দক্ষিণ ভারতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। উভয় জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিযােগিতা শেষপর্যন্ত সাম্রাজ্য স্থাপনের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। দাক্ষিণাত্যে দেশীয় রাজন্যবর্গের অবিরাম কলহে পণ্ডিচেরীর ফরাসি গভর্নর জোসেফ ফ্রাঁসোয়া ডুপ্লে (Joseph François Dupleix, ১৭৪২-১৭৫৪) ভারতবর্ষে ইংরেজ প্রতিপত্তি বিনষ্ট করে ফরাসি সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দেশীয় কলহে পক্ষাবলম্বন করতে আরম্ভ করেন। অনুরূপভাবে ইংরেজদের অন্তরেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখা দেয় এবং তারা নিজেদের স্বার্থ বিপন্ন বােধ করে পাল্টা ব্যবস্থাস্বরূপ প্রতিপক্ষে যােগদান করে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮ খ্রীঃ)

এবারে এই সময়ে দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত নিয়ে বলা যাক। ১৭৪০ এর দশকে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক অঞ্চলের পরিস্থিতি ছিল খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে মারাঠারা কর্ণাটক আক্রমণ করে কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলীকে হত্যা করে। এর ফলে কর্ণাটকের সিংহাসনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায় হায়দ্রাবাদের নিজাম স্বয়ং কর্ণাটকে এসে তার এক বিশ্বাসভাজন আনােয়ারউদ্দীনকে নবাব পদে অধিষ্ঠিত করেন (১৭৪৩)। এতে সংকটের নিরসন হয়নি। কারণ কর্ণাটকের পূর্বতন নবাব দোস্ত আলীর জামাতা চাঁদ সাহেব আনােয়ারউদ্দীনের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতায় লিপ্ত হন। কর্ণাটক অঞ্চলের রাজনৈতিক এই অনিশ্চয়তা ইংরেজ ও ফরাসী উভয় কোম্পানীকে ঐ অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনে প্রলুব্ধ করে।

ইতােমধ্যে ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে ইউরােপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব (War of Austrian Succession) শুরু হয়, আর ইংল্যান্ড তাতে যোগ দেয় ১৭৪৪ সালে। এই যুদ্ধে ইংরেজ ও ফরাসীরা পরস্পরবিরােধী পক্ষ অবলম্বন করে। এই যুদ্ধের প্রভাব ভারতেও পড়ে। ১৭৪৬ সালের গােড়ার দিকে ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে খােলাখুলি শত্রুতা শুরু হয়। এ সময় বার্নেটের নেতৃত্বে ইংরেজ নৌবহর কতকগুলাে ফরাসী জাহাজ অধিকার করে। পন্ডিচেরীর ফরাসী গভর্নর ডুপ্লে তৎক্ষণাৎ মরিশাসের ফরাসী গভর্নর লা বুর্দনের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন পাঠান। লা বুৰ্দন আটটি শক্তিশালী জাহাজ নিয়ে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে করমণ্ডল উপকূলে উপস্থিত হলে ইংরেজ নৌসেনাপতি পেইটন লা বুর্দনকে কোন বাধা না দিয়ে বাংলার দিকে পালিয়ে যান। এই সুযোেগ ডুপ্লে ইংরেজদের শক্ত ঘাঁটি মাদ্রাজ দখল করে নেন। অতঃপর লা বুৰ্দন মরিশাসে ফিরে যান। এরপর ডুপ্লে পন্ডিচেরীর দক্ষিণে ইংরেজ ঘাঁটি সেন্ট ডেভিড আক্রমণ করেন। কিন্তু ইংরেজরা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। এভাবে দক্ষিণ ভারতে ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের প্রথম পর্যায়ে ডুপ্লের নেতৃত্বে ফরাসীরা সফল হয়।

এপ্রসঙ্গে ডুপ্লের সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেই। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে যােশেফ ডুপ্লে-একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। ফরাসী কোম্পানী কর্তৃক ভারতে প্রেরিত ফরাসীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দক্ষ কূটনীতিবিদ এবং অপূর্ব রাজনৈতিক প্রতিভাসম্পন্ন একজন শাসক। তার স্বদেশপ্রেম ছিল প্রশংসনীয়। স্বীয় দেশের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করাই ছিল তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। জোসেফ ডুপ্লে ১৭৩১ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম কলকাতার সন্নিকটে চন্দননগরে ফরাসী শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে ভারতে আসেন। দীর্ঘ দশ বছর কৃতিত্বের সঙ্গে চন্দননগরের শাসনকার্য পরিচালনার পর ফরাসী কোম্পানী তাকে ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের পন্ডিচেরীর গভর্নর নিযুক্ত করেন। পন্ডিচেরীর শাসনভার গ্রহণের পর তিনি অনুধাবন করেন যে, দেশীয় শাসকবর্গের মর্জির উপর নির্ভর করে চললে কখনই ফরাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্য উৎকর্ষ লাভে সম্ভব হবে না। তাছাড়া তিনি ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করে এদেশে ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন যে, ইউরােপীয় পদ্ধতিতে এবং ইউরােপীয় সেনাধ্যক্ষের পরিচালনায় ভারতীয় সেনাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুশিক্ষিত করে তুলতে পারলে তারা সহজে ভারতীয় রাজাদের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে। এ লক্ষ্যে তিনি অচিরেই ইউরােপীয় পদ্ধতিতে কিছুসংখ্যক ভারতীয় সেনাকে সুশিক্ষিত করে তােলেন। 

যাই হোক, দক্ষিণ ভারতে যখন ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখন কর্ণাটকের নবাব দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকেননি। নবাব আনােয়ারউদ্দীন তার অনুমতি ছাড়াই রাজ্যে যুদ্ধ শুরু করায় ইংরেজ ও ফরাসীদের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। সুচতুর ডুপ্লে নবাবের মনােভাব বুঝতে পেরে তাকে আশ্বাস দেন যে, ফরাসীরা ইংরেজদের অধিক থেকে মাদ্রাজ দখল করে তার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু ডুপ্লে তার প্রতিশ্রুতি পালন করেননি। এতে নবাব আনােয়ারউদ্দীন ক্ষুব্ধ হয়ে ফরাসীদের বিরুদ্ধে এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এদিকে ডুপ্লে এতদিনে ভারতীয় সৈন্যদেরকে ইউরোপীয় রনকৌশলে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। এদের সাহায্যেই ১৭৪৬ খ্রীস্টাব্দে সেন্ট টোম-এর যুদ্ধে কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীনের বিশাল সেনাবাহিনীকে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। প্রথমত, কর্ণাটকের যুদ্ধ ছিল ভারতে প্রথম যুদ্ধ যে যুদ্ধে কোন ইউরােপীয় শক্তি দেশীয় শক্তিকে সুনিশ্চিতভাবে পরাজিত করে। অল্প সংখ্যক কিছু ফরাসী সৈন্যের হাতে নবাব আনোয়ারউদ্দীনের বিশাল বাহিনীর পরাজয়ে ভারতীয় শক্তির দুর্বলতা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এদেশের রাজাদের সামরিক শক্তি যে কতটা দুর্বল তা এর পূর্বে বিদেশী বণিকদের কাছে এত স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। ঐতিহাসিক পার্সিভাল স্পীয়ারের মতে, “এর পরই ডুপ্লের দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের সাহসী প্রচেষ্টা শুরু হয়।” (“There followed Dupleix’s bold bid for South Indian Empire”- The Oxford of Modera India.)।

এই অপ্রত্যাশিত সফলতার পর ডুপ্লে ভারতে একটি ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনে অধিকতর উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন ভারতে ফরাসী প্রাধান্য স্থাপনের পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ইংরেজ শক্তি। এজন্য তিনি ইংরেজদেরকে বিতাড়িত করে পর্যায়ক্রমে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে দমন করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধে ডুপ্লের এই সাফল্যের ফলে ভারতীয়দের চোখে ডুপ্লের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এর পাল্টা হিসেবে ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা ফরাসীদের পণ্ডিচেরী আক্রমণ করলে ডুপ্লের কাছে পরাজয় বরণ করে। এই অবস্থায় ভারতে খবর পৌঁছায় যে, আয়-লা-শ্যাপলের চুক্তিতে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটেছে (১৭৪৮)। ফলে ইউরােপে যুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসী যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা মাদ্রাজ ফিরে পায়, বিনিময়ে আমেরিকায় তারা ফরাসিদের কাছ থেকে যে নোভাস্কোটিয়ার লুইসবার্গ দুর্গ দখল করেছিল তা ফিরিয়ে দেয়। এই যুদ্ধে আপাততদৃষ্টিতে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু দুটো জিনিস এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল –

  • (১) ভারতীয় সেনাবাহিনী ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর তুলনায় অনেক দুর্বল, ইউরোপীয় রনকৌশলে প্রশিক্ষিত অল্পসংখ্যক সেনা নিয়েই বিশাল সংখ্যক ভারতীয় সেনাকে পরাজিত করা সম্ভব, এটাই সেই সময় ফরাসী ও ইংরেজদেরকে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনে উৎসাহিত করে, এবং
  • (২) এই যুদ্ধে নৌশক্তির গুরুত্ব থেকে স্পষ্ট হয় যে নৌযুদ্ধে যারা অধিকতর পারদর্শিতা অর্জন করতে পারবে তারাই হবে ভবিষ্যতে ভারতের অধীশ্বর। 

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৮-৫৫ খ্রীঃ)

প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ ইংরেজ ও ফরাসী উভয় শক্তিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করে। তাঞ্জোরের ক্ষুদ্র রাজ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ইংরেজরা সেখানে হস্তক্ষেপ করে এবং ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দে দেবীকোট্টাই অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে হায়দ্রাবাদের নিজাম আসফ ঝা মারা যান। তার মৃত্যুর পর হায়দ্রাবাদের নিজামের পদ গ্রহণ করেন তার দ্বিতীয় পুত্র নাসির জং। কিন্তু এ সময় নাসির জং-এর ভাগ্নে মুজাফফর জং হায়দ্রাবাদের সিংহাসনের দাবী উত্থাপন এবং ঘােষণা করেন যে, তিনি মুঘল সম্রাট কর্তৃক দাক্ষিণাত্যের সুবাদার পদে নিযুক্ত হয়েছেন। ফলে হায়দ্রাবাদের সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে।

অপরদিকে কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীন তার সিংহাসন সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। কারণ কর্ণাটকের প্রাক্তন নবাব দোস্ত আলীর জামাতা চাঁদ সাহেব কর্ণাটকের নবাব পদ লাভে আগ্রহী ছিলেন। শীঘ্রই উভয়ের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ডুপ্লে এই সুযােগে দাক্ষিণাত্যে প্রভাব বিস্তারের আশায় চাঁদ সাহেব এবং মুজাফফর জং-এর পক্ষ সমর্থন করেন এবং তাদের সঙ্গে একটি গােপন চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। ফলে দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দের ৩ আগস্ট মুজাফফর জং, চাঁদ সাহেব এবং ফরাসী বাহিনী সম্মিলিতভাবে ভেলােরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত অম্বুরের যুদ্ধে কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীনকে পরাজিত করে হত্যা করে। এই যুদ্ধের পর আনােয়ারউদ্দীনের পুত্র মুহম্মদ আলী ত্রিচিনাপলিতে পলায়ন করেন এবং সেখানে ইংরেজদের আশ্রয় লাভ করেন। 

১৭৫০ খ্রীস্টাব্দে হায়দ্রবাদের নিজাম নাসির জং ফরাসী বাহিনীর হাতে নিহত হন। নাসির জং নিহত হলে ডুপ্লের প্রচেষ্টায় মুজাফফর জং হায়দ্রাবাদের নিজাম পদে অধিষ্ঠিত হন। কৃতজ্ঞ নিজাম ডুপ্লেকে কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে অবস্থিত যাবতীয় অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত করেন। ফলে নিজামের দরবারে ফরাসী প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এভাবে ডুপ্লে চাঁদ সাহেবকে কর্ণাটকের সিংহাসনে এবং মুজাফফর জংকে হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন এবং সমরকুশলী হিসেবে স্বীয় প্রতিভার পরিচয় দেন। ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে আততায়ীর হাতে মুজাফফর জং মারা যান। তার মৃত্যুর পর ফরাসীরা মুজাফফর জং-এর তৃতীয় পুত্র সালবৎ জংকে হায়দ্রাবাদের নিজাম পদে অধিষ্ঠিত করেন। এ সময় চাঁদ সাহেব ফরাসী বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজ সমর্থনকারী মুহম্মদ আলীকে ত্রিচিনাপলিতে অবরােধ করেন। মুহম্মদ আলীকে সাহায্য করার জন্য একটি ইংরেজ বাহিনী ত্রিচিনাপলীতে হাজির হয়। শুরু হয় ত্রিচিনাপলী শহর দখলের জন্য দীর্ঘ ইঙ্গ-ফরাসী সংঘর্ষ। কিন্তু এ সময় দাক্ষিণাত্যে রবার্ট ক্লাইভ নামক একজন ইংরেজ বীরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি মাদ্রাজ কুঠির জনৈক অসামরিক কর্মচারী ছিলেন, যিনি ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। 

সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে ক্লাইভ সামরিক ক্ষেত্রে তার প্রতিভা স্ফুরণের এক অপূর্ব সুযােগ পান। ক্লাইভ এ সময় (১৭৫১ খ্রীস্টাব্দেই) তড়িৎবেগে কর্ণাটকের রাজধানী আর্কট দখল করে নেন। ফলে ফরাসী বাহিনী ত্রিচিনাপলী দখলের ব্যাপারে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করতে পারল না। অতঃপর ক্লাইভ ত্রিচিনাপলী অবরোধ করে ফরাসী সেনাপতি জেকিস ল-কে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এভাবে ত্রিচিনাপলী দখলে ব্যর্থ ফরাসী বাহিনী শেষপর্যন্ত ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইংরেজরা চাঁদ সাহেবকে বন্দী করে হত্যা করে। ইংরেজদের সাহায্যে মুহম্মদ আলী কর্ণাটকের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ডুপ্লে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতেও ফরাসী গভর্নর ডুপ্লে পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। এক বছরেরও অধিককাল ধরে তিনি ইংরেজ সাফল্যকে প্রতিহত করার জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি ডুপ্লের সহায়ক ছিল না। ফ্রান্সের সরকার ক্রমশ তার উপর বিরক্ত হয়ে উঠছিল। সরকার তাকে ভুল বুঝে ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য থেকে অপসারণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়। ফলে তাকে স্বদেশে ফিরে যেতে হয়। ডুপ্লের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে ফরাসী প্রভাব ও ফরাসী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ডুপ্লের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর গডেহু পন্ডিচেরীর গভর্নর নিযুক্ত হয়ে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তারই উদ্যোগে ১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ফরাসী ও ইংরেজদের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে উভয় কোম্পানী ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে। ফরাসী কোম্পানীর আঞ্চলিক অধিকার বজায় থাকে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারতে দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ভারতে ফরাসী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ডুপ্লের স্বপ্ন সফল হয়নি সত্য, কিন্তু ভারতের তার নীতি ছিল অভ্রান্ত। ডুপ্লের নীতি অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনে সফল হয়। প্রকৃতপক্ষে ডুপ্লের ব্যর্থতার জন্য তার ব্যক্তিগত ত্রুটি এবং সামরিক ভুল যে কিয়দাংশ দায়ী ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তবে তার ব্যর্থতার জন্য ফরাসী কর্তৃপক্ষও কম দায়ী ছিল না। ফরাসী সরকার তার পরিকল্পনা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন এবং তাকে সাহায্য না করে দেশে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে ডুপ্লে একজন ব্যর্থ নায়ক। কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও তার স্বদেশ প্রীতি ও ফরাসী স্বার্থরক্ষার জন্য তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ সবাইকে মুগ্ধ করে। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা ডুপ্লের কৃতিত্বকে সব সময় খাটো করে দেখেন। কিন্তু অনেক ইংরেজ ঐতিহাসিকও তার মহত্ত্ব ও অবদান অস্বীকার করতে পারেননি। P.E. Roberts ডুপ্লে সম্পর্কে বলেন, “In spite of his final failure, Duplex is a striking and brilliant figure in Indian history. For even if we give up the old uncritical estimate, we need not deny his real claims to greatness. His political conceptions were daring and imaginative. He raised the prestige of France in the East for some years to an amazing height, he won a reputation among Indian princes and leaders that has never been surpassed, and he aroused a dread in the English Contemporaries……” (History of British India, P: 118-19)

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধও ভারতের ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। প্রথমত, এই যুদ্ধের ফলে কর্ণাটকে ফরাসী প্রাধান্যের অবসান ঘটে। দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধের ফলে ইংরেজদের ক্ষমতা ও মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। তৃতীয়ত, এই যুদ্ধ এটিই প্রমাণ করল যে, বিদেশীরা ভারতীয় শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং ভারতীয় শাসকশ্রেণী তাদের অস্তিত্বের জন্য ইউরােপীয়দের উপর অসহায়ভাবে নির্ভরশীল। কর্ণাটকের মুহম্মদ আলী ইংরেজদের এবং হায়দ্রাবাদের সালবৎ জং সম্পূর্ণরূপে ফরাসীদের অধীনস্তে পরিণত হয়।

তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩ খ্রীঃ)

১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও শান্তিচুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইংরেজ ও ফরাসী কোন পক্ষই পারস্পরিক বিরােধিতা ত্যাগ করেনি। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে ইউরােপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩) শুরু হলে ভারতে পুনরায় ইংরেজ ও ফরাসীগণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, ভারতে ইঙ্গফরাসী দ্বন্দ্ব আবার নবজীবন লাভ করে। কিন্তু এবার বাংলা ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের প্রধান ক্ষেত্র। বাংলায় ইংরেজ ও ফরাসিরা দুর্গ সুরক্ষিত করতে থাকলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তাদেরকে দুর্গ তৈরি করতে নিষেধ করেন। ফরাসিরা নবাবের আদেশ মানলেও ইংরেজরা অগ্রাহ্য করে। ফলে নবাব ১৭৫৬ সালে ইংরেজদের নিকট থেকে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গটি দখল করেন। কিন্তু ক্লাইভ ও ওয়াটসন সেটি পুনরুদ্ধার করেন। এরপর ক্লাইভ সপ্তবর্ষের যুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতে ফরাসীদের শক্তি ধ্বংস করার জন্য চন্দননগর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদেরকে তার রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু নবাবের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ক্লাইভ ও ওয়াটসন ২৩ মার্চ ফরাসী বাণিজ্য কুঠি চন্দননগর আক্রমণ করেন এবং দখল করেন। চন্দননগর আক্রমণ করলে নবাব ফরাসীদের কোন সাহায্য না করে ভুল করেন। চন্দননগরের পতনের পর সিরাজের পতনও আসন্ন হয়ে পড়ে। চন্দননগর পতনের ফলে বাংলায় ফরাসী শক্তি দুর্বল হয়ে গেলে ইংরেজদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সংঘর্ষে নবাব ফরাসীদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে পলাসীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ক্লাইভ বাংলায় ইংরেজ প্রভুত্ব স্থাপন করেন। ইংরেজরা বাংলায় প্রভূত্ব স্থাপন করলে তা তৃতীয় কর্ণাটিক যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়কে নিশ্চিত করে দেয়। কারণ বাংলা থেকে ইংরেজরা যখন খুশী অর্থ ও সৈন্য মাদ্রাজে প্রেরণ করতে পারত, এর সামরিক গুরুত্ব ছিল প্রচুর।

১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে ফরাসী কর্তৃপক্ষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য কাউন্ট লালিকে (Count Lally) পন্ডিচেরীর গভর্নর করে ভারতে পাঠান। ভারতে ফরাসী কোম্পানীকে শক্তিশালী করবার অভিপ্রায়ে এ সময় ফরাসী সরকার এক বিশাল বাহিনীও ভারতে প্রেরণ করেন। ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দের ২রা জুন ফরাসীরা ইংরেজদের কাছ থেকে সেন্ট ডেভিড দুর্গ দখল করে নেয়। এরপর ফরাসী সেনাপতি বুসি হায়দ্রাবাদের “উত্তর সরকারের অন্তর্গত” বিশাখাপত্তম সহ চারটি ইংরেজ ঘাটি দখল করেন। এরপর লালি মাদ্রাজ আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি সমগ্র ফরাসী বাহিনীকে একত্রিত করেন এবং বুসীকে হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরে আসতে নির্দেশ দেন। এটি ছিল গভর্ণর লালির একটি ভুল সিদ্ধান্ত। হায়দ্রাবাদ থেকে লালির প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা বাংলা থেকে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই রাজমাহেন্দ্ৰী, মসলিপট্টম প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে নেয়। ইংরেজ কোম্পানী হায়দ্রাবাদের নিজাম সালবৎ জং-এর সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন। এর ফলে দাক্ষিণাত্যে ফরাসী প্রভাব হ্রাস পায়। ফরাসীরা ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে মাদ্রাজ অবরােধ করলে মাদ্রাজের ইংরেজ শাসনকর্তা পিগট ও সেনাপতি লরেন্স যুগ্মভাবে ফরাসীদের বাধা দেয়। ইতােমধ্যে একটি ব্রিটিশ নৌবহর মাদ্রাজে এসে পৌঁছলে লালি মাদ্রাজের অবরােধ তুলে নিতে বাধ্য হন। ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে ২২ জানুয়ারি ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ ‘বন্দিবাসের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। বন্দিবাসের এই যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি স্যার আয়ারকুটের কাছে ফরাসী বাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের তিন মাসের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যের অধিকাংশ অঞ্চল ফরাসীদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ইংরেজ বাহিনী পন্ডিচেরী অবরোধ করে লালিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যের অপর দু’টি ফরাসী ঘাঁটি মাহে এবং জিঞ্জি ইংরেজ শক্তির হস্তগত হয়। এভাবে ভারতে ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনের সব স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। ভারতে উপিনবেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই শেষ হাসি হাসে। ১৭৬৩ খ্রীস্টাব্দে প্যারিস শান্তি চুক্তি দ্বারা সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটলে ভারতীয় উপমহাদেশেও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চুক্তিতে ফ্রান্স ইংরেজদেরকে চন্দননগর, মাহে, পণ্ডিচেরী, কারিকল ও জিজ্ঞি – এই পাঁচটি স্থান ফিরে পেলেও ফরাসি অধিকৃত কোনাে স্থানে দুর্গ বা সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করা হবে না – এই শর্ত ফ্রান্সকে দিতে হয়েছিল।

ফরাসীদের বিফলতার কারণ

বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ইউরােপীয় জাতিসমূহের মধ্যে ভারতে সর্বশেষ আগমন ঘটে ফরাসীদের। ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্য স্থাপন এবং দেশীয় নৃপতিদের সহায়তায় ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনের দ্বন্দ্বে ফরাসীরা প্রতিপক্ষ ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়। ফরাসীদের এই পরাজয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ দায়ী ছিল –

  • (১) তীক্ষ্ম কূটনৈতিক বুদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সত্ত্বেও ভারতে ফরাসী গভর্নর ডুপ্লের সামরিক ক্ষেত্রে কিছু ভ্রান্ত পদক্ষেপ ফরাসীদের পরাজয়ের কাছ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের সময় কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীন অম্বুরের যুদ্ধে নিহত হলে তার পুত্র মুহম্মদ আলী ত্রিচিনাপলীতে আশ্রয় নেন। যুদ্ধের পরেই যদি ডুপ্লে মুহম্মদ আলীকে ত্রিচিনাপলী দুর্গে আঘাত হানতেন তবে হয়ত ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতি ভিন্নভাবে প্রবাহিত হত। ডুপ্লের বিলম্বের সুযােগে ইংরেজ শক্তি ত্রিচিনাপলীতে মুহম্মদ আলীর রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। ডুপ্লেও তৎক্ষণাৎ জেনারেল ল নামে এক সেনাধ্যক্ষের অধীনে একটি ফরাসী বাহিনী ত্রিচিনাপলীতে পাঠায়। কিন্তু ফরাসী বাহিনী ত্রিচিনাপলী দখল করতে ব্যর্থ হয়।
  • (২) ডুপ্লে দাক্ষিণাত্যে ফরাসী বাহিনীকে বিভক্ত করে রেখেছিলেন। তিনি হায়দ্রাবাদে সেনাধ্যক্ষ বুসীর অধীনে ফরাসী সেনাদলের একাংশ স্থাপন করে অবশিষ্ট সেনাদল দ্বারা তিনি ত্রিচিনাপলী অবরােধ করেন। এর ফলে ফরাসী সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডডওয়েল বলেন, “একটির পরিবর্তে দু’টি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা করতে গিয়ে তিনি বােকামী করেছেন।”
  • (৩) ঐতিহাসিকেরা ভারতে ক্ষমতা দখলের লড়াইতে ফরাসী শক্তির বিপর্যয়ের জন্য ফরাসী সেনাপতি কাউন্ট লালিকে দায়ী করেছেন। তৃতীয় কণাটকের যুদ্ধের সময় হায়দ্রাবাদ থেকে বুসীকে সরিয়ে আনা ছিল তার এক মারাত্মক ভুল। বুসীকে অপসারণের ফলে হায়দ্রাবাদে ফরাসী প্রতিপত্তি বিনষ্ট হয়। তাছাড়া লালির কর্কশ মেজাজ ও সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ফরাসী শিবিরে অনৈক্যের সৃষ্টি করে। ফরাসীরা অন্তর্দ্বন্দ্বে তাদের শক্তি ক্ষয় করায় ইংরেজদের জয়লাভের পথ সুগম হয়।
  • (৪) ফরাসী কোম্পানীর কাঠামােগত দুর্বলতা তাদের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছিল সম্পূর্ণভাবে ফরাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে কোম্পানী স্বাধীনভাবে কোন নীতি নির্ধারণে সক্ষম ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই ফরাসী সরকারের সিদ্ধান্তের উপর তাদের নির্ভর করতে হত।
  • (৫) ডুপ্লের নীতির অপর ত্রুটি ছিল তিনি ফরাসী কোম্পানীর আর্থিক সমৃদ্ধি উপেক্ষা করে সামরিক আদর্শ গ্রহণ করেন। এর ফলে কোম্পানীর আর্থিক স্বচ্ছলতা বিনষ্ট হয় এবং মুনাফার পরিবর্তে কোম্পানী ফরাসী সরকারের কাছে বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসী সরকারের কাছ থেকে প্রয়ােজনীয় অর্থ সাহায্য না পাওয়ায় ডুপ্নে তার বিশাল পরিকল্পনা কার্যকর করতে ব্যর্থ হন।
  • (৬) ভারতে ফরাসী কোম্পানীর দুর্দিনে ফরাসী সরকার কর্তৃক ডুপ্লেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ ছিল একটি মারাত্মক ভুল। ডুপ্লেকে পদচ্যুত করে তদস্থলে ফরাসী সরকার গডেহুকে নিযুক্ত করলে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে বিজিত অঞ্চলগুলাে ইংরেজদের ছেড়ে দেন। এর ফলে ফরাসী কোম্পানীর মৃত্যুঘন্টা বেজে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে ডুপ্লের প্রত্যাবর্তনের ফলে ভারতে ফরাসী প্রভুত্বের অবসান ঘটে।
  • (৭) ফরাসীদের কোন নৌশক্তি ছিল না। উপযুক্ত নৌবহরের অভাবে তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের ইংজেরদের হাতে ফরাসী বন্দর পন্ডিচেরীর পতন হয়েছিল। ফরাসীদের ভারত মহাসাগরের মরিশাসে একটি নৌ-ঘাঁটি ছিল সত্য, কিন্তু করমণ্ডল উপকূল হতে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় প্রয়ােজনের সময় ফরাসীরা সেখান থেকে তেমন সামরিক সাহায্য লাভ করতে পারেনি। অপরপক্ষে, ইংরেজরা উন্নত নৌশক্তির বলেই ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
  • (৮) ফরাসীরা দেশীয় রাজন্যবর্গের অনিশ্চিত সাহায্যের উপর নির্ভরশীল থেকে মারাত্মক ভুল করেছিল। মহীশূরের হায়দার আলী ফরাসীদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করলেও নিজ রাজ্যে অভ্যন্তরীণ গােলযােগের কারণে ফরাসী শিবির থেকে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু ইংরেজগণ সামরিক সাহায্যের জন্য দেশীয় নৃপতিদের উপর মােটেই নির্ভরশীল ছিল না।
  • (৯) ফরাসী সরকার ভারত অপেক্ষা আমেরিকা ও ইউরােপে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধকে অধিক গুরুত্ব দেন। কারণ ভারতে ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনার কথা ডুপ্লে কোম্পানীর উর্ধ্বতম কর্তৃপক্ষকে সুস্পষ্টভাবে জানাননি। কোম্পানীর স্বার্থরক্ষা ছিল ফরাসী সরকারের কাছে গৌন বিষয়।
  • (১০) ফ্রান্স স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হত। ফ্রান্সে তৃতীয় শ্রেণী বা সাধারণ জনমতের কোন মূল্য ছিলনা। অপরপক্ষে, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভারতে কোম্পানীর স্বার্থ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ছিল। স্যার আলফ্রেড লয়েল মন্তব্য করেছেন, “ফরাসীরাজ পঞ্চদশ লুইয়ের ভ্রান্ত বৈদেশিক নীতি, ইউরোপের যুদ্ধকে ফরাসী সরকারের অধিক গুরুত্বদান এবং পঞ্চদশ লুইয়ের উপপত্নী ও অযােগ্য মন্ত্রীদের কুমন্ত্রণার ফলেই ভারতে ফরাসীদের পরাজয় ঘটে।”

উপসংহারে বলা যায়, ডুপ্লের সামরিক পরিকল্পনায় ত্রুটি, লালীর গোয়ার্তুমি, ফরাসী নৌসেনাপতিদের অপদার্থতা, ফরাসী সরকারের উপর কোম্পানির নির্ভরশীলতা, ভারত বিষয়ে ফরাসী সরকারের ঔদাসীন্য ও অসহযােগিতা এবং সর্বক্ষেত্রে ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্বের ফলে ভারতবর্ষে ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

ইংরেজদের সফলতার কারণ

ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্য স্থাপন এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে ইংরেজরা শেষপর্যন্ত ফরাসীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। ইংরেজদের এই জয়লাভের পেছনে নানাবিধ কারণ ছিল –

  • (১) ইংরেজ কোম্পানী ছিল একটি প্রাইভেট কোম্পানী। ১৬০০ খ্রীস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে সনদ লাভ করে এই কোম্পানী সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই ভারতে আগমন করে। ভারতে তাদের প্রথম ও প্রধান পেশা যে ব্যবসা তা ইংরেজ জাতি কখনই বিস্মৃত হয়নি। কোম্পানীর কর্মচারীরা ভালভাবেই জানতেন যে, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই কোম্পানীর স্থায়িত্ব সম্ভব। অন্যথায় পতন অনিবার্য। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কারণেই ইংরেজ কোম্পানী দিনে দিনে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। তারা রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং সরকারকে মােটা টাকা ধার দিত।
  • (২) ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল তাদের নৌবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব। সমুদ্রে ইংরেজরা একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর ফলে ভারতে যে কোন জরুরী পরিস্থিতিতে ইংরেজ নৌবহর সাহায্য প্রেরণ করতে পারত। সমুদ্রপথে তাদের বাধা দেওয়ার মত কোন শক্তি তখন ছিল না। জলপথে ইংরেজদের প্রাধান্যের কারণেই ডুপ্লের মত নায়কের পরাজয় অনিবার্য ছিল।
  • (৩) ভারতবর্ষে ইংরেজদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যথা-কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজ্যে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। শত্রু কর্তৃক একটি ঘাঁটির কিংবা একই সঙ্গে দু’টি ঘাঁটির পতন ঘটলে অন্যটি ইংরেজদের অধীনে থাকত। কিন্তু ফরাসীদের একমাত্র পন্ডিচেরীতে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। পন্ডিচেরীর পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ফরাসী শক্তিরও পতন ঘটে।
  • (৪) দাক্ষিণাত্যে ইংরেজদের সাফল্য লাভের ক্ষেত্রটি তৈরী হয় ১৭৫৭ সালে বাংলায় পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজরা সমৃদ্ধশালী বাংলায় তাদের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। বাংলা থেকে ইংরেজরা যখন খুশী অর্থ ও সৈন্য মাদ্রাজে প্রেরণ করতে পারত। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যথার্থই বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধই প্রকৃতপক্ষে ভারতে ফরাসীদের ভাগ্য নির্ধারিত করে দিয়েছিল। “The battle of plassey may be truely said to have decided the fate of the French in India.”।
  • (৫) ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের অপর কারণ হল সে সময় ইংরেজ বাহিনীতে রবার্ট ক্লাইভ, সান্ডার্স, আয়ারকুট প্রভৃতি সুদক্ষ সেনানায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল। ফরাসী সেনানায়ক ডুপ্লে, বুসী ও লালি নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান ছিলেন। কিন্তু তারা কেউই ইংরেজ সেনানায়কদের সমকক্ষ ছিলেন না।

উপসংহারে বলা যায়, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি, শক্তিশালী নৌবহর, সমৃদ্ধশালী বাংলায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠা, কোম্পানীর উন্নয়নে সম্মিলিত প্রয়াস, ইংরেজদের সামরিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা, এবং ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতি ও আনুকূল্য ইংরেজদের সফলতার মূলে বিদ্যমান ছিল।

তথ্যসূত্র

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : ১৫২৬ খ্রী হতে ১৮৫৭ খ্রী পর্যন্ত, দিলীপ কুমার সাহা, ঢাকেশ্বরী লাইব্রেরী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ২৮৮-৯৯

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.