Table of Contents
অষ্টম হেনরীর সিংহাসনারােহণ
ল্যাঙ্কাস্টার ও ইয়র্ক বংশের মিলন; মন্ত্রী এম্পসন ও ডাডলির মৃত্যুদণ্ড; ক্যাথরিনের সাথে বিবাহ: রাজা সপ্তম হেনরীর (১৪৮৫-১৫০৯) মৃত্যুর পর তার আঠারো বছর বয়স্ক পুত্র হেনরী ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে রাজা অষ্টম হেনরী উপাধি গ্রহণ করে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার সিংহাসনারােহণের ফলে দুই বিবদমান গােলাপ দলের (ল্যাঙ্কাস্টার ও ইয়র্ক বংশের) যথার্থ মিলন ঘটে। কারণ, তার মাতা এলিজাবেথ ছিলেন ইয়র্ক বংশীয় রাজকন্যা এবং পিতা সপ্তম হেনরী মাতৃকুলের দিক দিয়ে ল্যাঙ্কাস্টার বংশীয় ছিলেন। রাজা হয়েই জনসাধারণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য অষ্টম হেনরী তার পিতা সপ্তম হেনরীর বিশ্বস্ত অমাত্য এম্পসন ও ডাডলিকে অন্যায় উৎপীড়নের দ্বারা অর্থ সংগ্রহের অভিযােগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন এবং তার পরলােকগত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিধবা পত্নী স্পেনরাজ দুহিতা ক্যাথারিনকে বিবাহ করেন।
অষ্টম হেনরীর সুদীর্ঘ রাজত্বকালকে ১৫০৯–১৫২৯ খ্রি., ১৫২৯—১৫৪০ খ্রি. এবং ১৫৪০-১৫৪৭ খ্রি. – এই তিন অংশে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম অংশে হেনরীর দৃষ্টি মুখ্যত পররাষ্ট্র বিষয়ে নিবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় অংশে হেনরী রােমের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ তথা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের কাজে নিয়ােজিত ছিলেন। তৃতীয় বা শেষ অংশে তিনি পুনরায় পররাষ্ট্র বিষয়ে মনােনিবেশ করেন।
অষ্টম হেনরীর পররাষ্ট্র নীতি
বহির্দেশে গৌরব ও প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা : সিংহাসনে আরােহণ করে অষ্টম হেনরী সর্বাগ্রে পররাষ্ট্র বিষয়ে সর্বাধিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ১৫০৯ থেকে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত তার রাজত্বকাল প্রধানত বৈদেশিক কার্যাবলিতে নিয়ােজিত ছিল। তার সিংহাসনারােহণকালে ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা আর ছিল না; টিউডর বংশ ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সমগ্র দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলবৎ ছিল এবং নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছিল। পিতা সপ্তম হেনরীর সঞ্চিত বিপুল অর্থভাণ্ডারের মালিক অষ্টম হেনরী। সুতরাং রাজা হয়েই অষ্টম হেনরীর ন্যায় ঐশ্বর্যশালী ও উদ্যমশীল নৃপতির পক্ষে প্রথমেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বীয় গৌরব ও প্রভাব বিস্তার করতে পররাষ্ট্র বিষয়ে মনােনিবেশ করা একান্ত স্বাভাবিক ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল ইউরােপের রাজনীতি ক্ষেত্রে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করা এবং তার পিতার ফরাসি-বিরােধী নীতি অধিকতর সক্রিয় ও বলিষ্ঠ পদ্ধতিতে অনুসরণ করে চলা।
পবিত্র সংঘে যোগদান : পরিস্থিতিও তার অনুকূলে ছিল। কারণ, সপ্তম হেনরীর রাজত্বকাল থেকেই ইতালির ওপর অধিকার বিস্তারের জন্য স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। এই যুদ্ধে ফ্রান্সকে পরাজিত করার জন্য স্পেনের কাছে ইংল্যান্ডের সহযােগিতা লাভ বিশেষ কাম্য ছিল। আগে থেকেই ফরাসি বাহিনী ইতালির একাংশ অধিকার করে সেখানে অবস্থান করছিল। ফরাসিদের ইতালি থেকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে পােপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (১৫০৩-১৫১৩), পবিত্র রোমান সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ন (রোমান ও জার্মানদের রাজা ১৪৮৬-১৫১৯, পবিত্র রোমান সম্রাট ১৫০৮-১৫১৯), এবং স্পেনরাজ ফার্দিনান্দ (এরাগন ১৪৭৯-১৫১৬, ক্যাস্টাইল ও লিও ১৪৭৫-১৫০৪) ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে ‘পবিত্র সংঘ’ (Holy League) নামে একটি মৈত্রী জোট গঠন করেন। এরপরও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নিশ্চিত হতে না পেরে স্পেনরাজ ফার্দিনান্দ তার জামাতা অষ্টম হেনরীকে পবিত্র সংঘে যােগদানের আমন্ত্রণ জানান। শ্বশুরের আহ্বানে হেনরী আগ্রহ সহকারে পবিত্র সংঘে যােগদান করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েন, কারণ –
- প্রথমত, অষ্টম হেনরী প্রথম থেকেই ইউরােপীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন।
- দ্বিতীয়ত, তিনি ফ্রান্সের কাছ থেকে হৃত ইংরেজ গ্যাসকনি প্রদেশ পুনরুদ্ধার করার আশা পােষণ করতেন।
- তৃতীয়ত, ইংল্যান্ডের জনগণও ইংল্যান্ডের পূর্ব গৌরব পুনরুদ্ধার করতে আগ্রহী ছিল।
গিনিগিটের যুদ্ধ : ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি হৃত গ্যাসকনি প্রদেশ পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। অভিযানটি সুপরিকল্পিত ও সুসজ্জিত না হওয়ায় ব্যর্থ হয়। ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে হেনরী স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করে উত্তর ফ্রান্স আক্রমণ করে থেরােইন ও টুর্নাই নামক শহর দুটো দখল করেন এবং ফরাসি বাহিনীকে গিনিগেটের যুদ্ধে পরাজিত করেন। গিনিগেটের যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর ফরাসি নাইটগণ খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধের পাট চুকিয়ে ফেলতে চেষ্টা করেন। এজন্য এ যুদ্ধকে ‘ব্যাটল অব পারস্’ (Battle of Spurs) বা তাড়াহুড়ার যুদ্ধ নামেও অভিহিত করা হয়েছে।
থমাস উল্সীর উত্থান : এ যুদ্ধেই ইংল্যান্ডের শেষ ও শ্রেষ্ঠ যাজক রাজনীতিক এবং প্রথম কূটনীতিক থমাস উল্সীর উত্থান ঘটেছিল। এই প্রসঙ্গে থমাস উল্সী প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। থমাস উল্সী ইংল্যান্ডের ধর্মীয় রাজনীতিবিদগণের মধ্যে সর্বশেষ এবং শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ইপউইচের একজন ধনী ব্যবসায়ীর পুত্র ছিলেন। ১৪৭১ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম হয়। অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজ হতে মাত্র পনেরাে বছর বয়সে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করে তিনি ‘বয় ব্যাচেলর’ (Boy Bachelor) নামে পরিচিত হন। অতঃপর তিনি গির্জায় যােগদান করেন এবং শীঘ্রই উইনচেস্টারের প্রভাবশালী বিশপ রিচার্ড ফক্সের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফক্স তাকে রাজনীতিতে দীক্ষা দেন এবং রাজা সপ্তম হেনরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সপ্তম হেনরীর মৃত্যুর পূর্বেই উল্সী ‘রয়াল আমােনার’ (Royal Almoner) ও লিঙ্কনের ‘ডিন’ পদে নিযুক্ত হন। অষ্টম হেনরীর রাজত্বকালে উল্সীর দ্রুত পদোন্নতি হয়। ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি যুদ্ধকালে এই যুবক পুরােহিত সামরিক সরবরাহ বিভাগে এবং জটিল রাজনীতির কাজে বিশেষ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে অষ্টম হেনরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফলে অতি সত্ত্বর তার পদোন্নতি হয় ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে টুর্নাইয়ের পতনের পর তিনি ঐ শহরের বিশপের পদে নিযুক্ত হন। ক্রমান্বয়ে তিনি লিঙ্কনের বিশপ (১৫১৩ খ্রি.), ইয়র্কের আর্চবিশপ (১৫১৪ খ্রি.) এবং লর্ড চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন (১৫১৫ খ্রি.)। পরবর্তী দুই-এক বছরের মধ্যেই পােপ দশম লিও তাকে ‘কার্ডিনাল’ (Cardinal—পােপ-মন্ত্রিসভার সদস্য) এবং পােপের ইংল্যান্ডীয় প্রতিনিধি (Legate) নিযুক্ত করেন। কালক্রমে তিনি উইনচেস্টার, বাথ, ডারহাম ও সেন্ট আলবান মঠের বিশপের পদ লাভ করেন। এরূপে উল্সী ইংল্যান্ডের একজন প্রজার পক্ষে সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হন। তিনি পােপ হবার আকাঙ্ক্ষাও পােষণ করতেন। উল্সী অষ্টম হেনরীর প্রধান উপদেষ্টারূপে ১৫১৪ হতে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ এই ১৫ বছর যাবৎ তিনি ইংল্যান্ডের বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনা করে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন এবং ইংল্যান্ডকে ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদার আসন দান করেন।
থমাস উল্সীর বিভিন্ন কাজ, অবদান ও শক্তি সাম্য নীতি : রাজশক্তি বৃদ্ধি করাই উল্সীর স্বরাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য ছিল। তিনি মনে করতেন যে শাসনব্যবস্থায় ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা এবং জনগণের মঙ্গলের জন্য রাজার হাতে ব্যাপক ক্ষমতা থাকা দরকার। এ কারণে তিনি পার্লামেন্ট আহ্বানের পক্ষপাতী ছিলেন না এবং প্রিভি কাউন্সিলের মাধ্যমে রাজ্যশাসন করা পছন্দ করতেন। ১৫১৪ থেকে ১৫২৯ সালে তার ক্ষমতাসীনকালে কেবল ১৫২৩ সালে মাত্র একটি পার্লামেন্ট আহ্বান করা হয়। পার্লামেন্টের সহায়তা ছাড়াই তিনি রাজার জন্য প্রচুর অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। এজন্য তিনি বাধ্যতামূলক ঋণ (Forced Loan) অথবা বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ (Amicable Loan) গ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রকার স্বেচ্ছাচারী কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এজন্য অবিলম্বে তিনি এম্পসন ও ডাডলির মত জনসাধারণের অপ্রীতিভাজন হন। কিন্তু তাদের বিরক্তিকে তিনি আদৌ গ্রাহ্য করতেন না। তার বিরােধীদের তিনি স্টার চেম্বার আদালতের সাহায্যে শাস্তি প্রদান করতেন। উল্সী রেনেসাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চার্চ সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি অবশ্য মার্টিন লুথারের মতবাদ সমর্থন করতেন না। তার বদলে তিনি গির্জার অভ্যন্তরীণ সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি চার্চের অধঃপতিত অবস্থার জন্য পুরােহিত সম্প্রদায়ের সুশিক্ষার অভাব এবং নিম্নমানের চার্চের জীবনযাত্রাকে দায়ী মনে করতেন। তাই তিনি ধর্মযাজকদের সুশিক্ষিত, পরিশ্রমী ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এরূপে তিনি চার্চের সংস্কার সাধন করার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি কয়েকটি ক্ষুদ্র ও দুর্নীতিপরায়ণ মঠের উচ্ছেদ সাধন করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এবং তার দ্বারা অক্সফোর্ডে একটি কলেজ এবং ইপউইচে একটি বিদ্যালয় (Grammer School) স্থাপন করেন। তবে স্বরাষ্ট্র বিষয় অপেক্ষা পররাষ্ট্র বিষয়ের প্রতি উল্সী অধিকতর উৎসাহী ছিলেন। তার রাজার মত তিনিও মুখ্যত আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় বড় খেলায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী ছিলেন। অষ্টম হেনরীর বৈদেশিক নীতির কৃতিত্ব মূলত তারই প্রাপ্য। তিনিই প্রথম ইংরেজ রাজনীতিবিদ, যিনি ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের জন্য বিশিষ্ট স্থান অধিকার করতে সক্ষম হন এবং ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতিতে ‘শক্তিসাম্য’ (Balance of Power) নামে এক নতুন নীতির প্রবর্তন করেন। এ নীতির উদ্দেশ্য ছিল ইউরােপীয় কোন শক্তিকে অত্যধিক শক্তিশালী হতে না দেয়া এবং কোন পক্ষ দুর্বল হলে তার পক্ষে যােগদান করে প্রবল প্রতিপক্ষের শক্তি খর্ব করা।
ফ্লডেন এর যুদ্ধ; পবিত্র সংঘ ত্যাগ; ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ডের সাথে মৈত্রী : যাই হোক, হেনরী যখন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তখন স্কটল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জেমসের (১৪৮৮-১৫১৩) ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন। কিন্তু ফ্লডেনের যুদ্ধে (১৫১৩ খ্রি.) জেমস শােচনীয়রূপে পরাজিত ও নিহত হন। এর অল্পকাল পরেই হেনরী পবিত্র সংঘ ত্যাগ করেন। এই প্রসঙ্গে তদকালীন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডের গুরুত্বের ব্যাপারটা একটু আলোচনা করে নিতে হবে, তা নাহলে সেই সময় হেনরী ও উল্সীর বৈদেশিক নীতিসমূহের গুরুত্ব কতখানি তা বোঝা যাবেনা। এ সময় ইউরােপীয় রাজনীতির প্রধান রঙ্গমঞ্চ ছিল ইতালি। সেখানে ইংল্যান্ডের কোন স্থান ছিল না। তখন পর্যন্ত পােপাধিষ্ঠান ও খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যের দৃষ্টিতে ইংল্যান্ডের স্থান ছিল অতি নগণ্য। এ জন্য উল্সী ইতালিতে কেন্দ্রীভূত ইউরােপীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে ইংল্যান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আসন অধিকার করতে মনস্থ করেন এবং যেরূপ দক্ষতার সাথে তিনি একপক্ষকে অন্য পক্ষের সমকক্ষতায় আনয়ন করেন, তাতে ইউরােপে ইংল্যান্ডের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ সময় ফ্রান্স ও স্পেন ঘােরতর বিবাদে লিপ্ত ছিল। এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির কোনটিই যেন অধিকতর শক্তিশালী হতে না পারে এটাই ছিল উল্সীর নীতি। আর তাই উল্সীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন সূচিত হয়। উল্সীর ক্ষমতালাভের পূর্বে ইংল্যান্ডের নীতি ছিল গিনিতে হারানাে স্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা এবং প্রাচীন শত্রু ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কিন্তু উল্সীর রাজনৈতিক মঞ্চে অবতরণের ফলে এক নতুন কর্ণধারের আবির্ভাব ঘটে এবং পররাষ্ট্র নীতিতে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক নতুন গতির সৃষ্টি হয়। হেনরী বুঝতে পারেন যে, তার পবিত্র সংঘের মিত্ররা তাকে শুধু নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করছেন। কার্যত তিনি তাদের কাছ থেকে বিশেষ কোন সাহায্য পাননি। এছাড়া উল্সী ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন কারণ, ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী ছিল ইউরােপে শক্তিসাম্য বজায় রাখার উপায়; আর এতে ইংল্যান্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি ছিল অবশ্যম্ভাবী। তাই হেনরী উল্সীর পরামর্শে ফ্রান্সকে চিরশত্রু হিসেবে গণ্য করার নীতি পরিহার করে তাকে বন্ধু রাষ্ট্রে পরিণত করতে মনস্থ করেন। এ উদ্দেশে তিনি হেনরীকে ‘পবিত্র সংঘ’ পরিত্যাগ করার পরামর্শ দেন। উল্সীর এ নীতি হেনরী পছন্দ করেন এবং সে অনুযায়ী তিনি পবিত্র সংঘ ত্যাগ করে ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ডের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন। তারপর ফরাসিরাজ দ্বাদশ লুইয়ের (১৪৯৮-১৫১৫) পত্নীবিয়ােগ হলে হেনরী উল্সীর পরামর্শে তার আঠারো বছর বয়স্কা ভগিনী মেরীকে ৫২ বছর বয়স্ক লুইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় করার ব্যবস্থা করেন। এরূপে ইংল্যান্ডকে ফ্রান্সের সাথে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করে উল্সী ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এ অভিনব মৈত্রীর ফলে পরবর্তীকালে স্পেনের সঙ্গে প্রতিযােগিতার মধ্য দিয়েই ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা আমেরিকায় বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাই উল্সী ইংরেজদের জাতীয় প্রগতির নিয়ামকদের মধ্যে অমর আসন লাভ করেছেন।
এরূপে ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতিতে একটা উল্লেখযােগ্য পরিবর্তনের সূচনা হলাে, ফ্রান্সের সঙ্গে প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত বৈরী মনােভাবের পরিবর্তে বন্ধুত্ব স্থাপিত হল। এই অভিনব মৈত্রীর ফলে পবিত্র সংঘের শক্তি সংযত হয়ে পড়ে। ফ্রান্সের বন্ধুত্বের পক্ষে উল্সীর ‘পবিত্র সংঘ’ বর্জনের ফলে ইংল্যান্ড ইউরােপীয় বৃহৎ শক্তিগুলাের সাগ্রহ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বৃহৎ শক্তিগুলাে এটা বুঝতে পারে যে, ব্যালেন্সের কোন একদিকে দাঁড়ালে ইংল্যান্ডের ভারই চূড়ান্ত হবে। উল্সী যতদূর সম্ভব উন্মুক্ত দৃষ্টি রেখে ইংল্যান্ডের এ মর্যাদা রক্ষা করার চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ফ্রান্স ইংল্যান্ডের চিরশত্রু নয় এবং স্পেনও চিরকালের বন্ধু নয়। তাই উভয় পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে একটিকে অন্যের সমকক্ষতায় আনাই ছিল তার নীতি। তিনি চূড়ান্ত বা স্থায়ীরূপে কোন পক্ষ অবলম্বন করার বিরােধী ছিলেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করলেই এর সত্যতা সহজেই প্রমাণিত হয়। ফ্রান্সের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর এক বছরের মধ্যে ফরাসি রাজ দ্বাদশ লুইয়ের মৃত্যু হয় (১৫১৫ খ্রি.)। তার মৃত্যুতে প্রথম ফ্রান্সিস ফ্রান্সের সিংহাসনে আরােহণ করেন। পরের বছর ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দও পরলােক গমন করেন এবং তার পৌত্র পঞ্চম চার্লস স্পেনের সিংহাসনের অধিকারী হন। স্পেনরাজ ফার্দিনান্দের মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র পঞ্চম চার্লস স্পেন, সিসিলি, নেদারল্যান্ড, বার্গান্ডি এবং আমেরিকার পেরু, মেক্সিকো প্রভৃতি রাজ্যসহ এক বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী হলে স্পেনের শক্তি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ইউরােপের শক্তিসাম্য বিঘ্নিত হবার উপক্রম হয়। উল্সী তখন ফ্রান্সের সঙ্গে পুনরায় মৈত্রী স্থাপন করে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করেন এবং হেনরীর অপ্রাপ্ত বয়স্কা কন্যা মেরীর সঙ্গে ডফিনের (ফরাসি রাজপুত্র) বিয়ে দেবার অঙ্গীকার করে ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় করার চেষ্টা করেন। ফ্রান্সিস ও চার্লস উভয়েই তেজস্বী ও পরিপূর্ণ যুবক ছিলেন। কাজেই তাদের সিংহাসনারােহণের পর স্পেন ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়। এছাড়া তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একটি ‘বিশ্ব শান্তি চুক্তি’ (Universal Peace) সম্পাদনের কার্য পরিচালনা করেন (১৫১৬ খ্রি.)। পােপ সম্রাট ম্যাক্সি মিলিয়ন, ফরাসিরাজ প্রথম ফ্রান্সিস, স্পেনরাজ পঞ্চম চার্লস, স্কটরাজ পঞ্চম জেমসের পক্ষ থেকে রাজমাতা মার্গারেট এবং অষ্টম হেনরী নিজে উল্সীর প্রস্তাবিত এ আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন ও যােগদান করেন। এভাবে উল্সী ইংল্যান্ডকে ইউরােপের প্রধান সালিশ (Supreme Arbiter) রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটাই ইংল্যান্ডের প্রথম নেতৃত্ব।
১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়নও ইহলােক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে জার্মান বা পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটের পদ শূন্য হলে পঞ্চম চার্লস ও প্রথম ফ্রান্সিস উভয়েই উক্ত পদের জন্য প্রার্থী হন। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর পঞ্চম চার্লস সম্রাট পদে নির্বাচিত হন। ফলে তিনি প্রায় সমগ্র পশ্চিম ইউরােপের অধিপতি হন এবং ফ্রান্স ও স্পেনের দ্বন্দ্ব এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে গুরুতর আকার ধারণ করে। উভয় পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকে। হেনরীর সাহায্য উভয়েরই কাম্য ছিল কেননা এই অবস্থায় হেনরী যার পক্ষ নেবেন মোটামুটি তার বিজয়ই চূড়ান্ত হয়ে যায়। তাই উভয় পক্ষই ইংল্যান্ডের বন্ধুত্ব অর্জন করার জন্য সচেষ্ট হয়, উভয়েই হেনরীকে দলে টানার চেষ্টা করতে লাগলেন। এ অধ্যায়টি হেনরীর সঙ্গে ফ্রান্সিস ও চার্লসের পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু হেনরী কিছুকাল কোন পক্ষেই যােগদান না করে উল্সীর পরামর্শে কূটনীতির বলে লাভবান হতে চেয়েছিলেন। তাই এই দ্বন্দ্ব গুরুতর আকার ধারণ করলে, হেনরী কিছুকাল নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেন। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে ক্যালাইসের কাছে ফ্রান্সিসের সাথে হেনরীর একটি বৈঠক হয়। এতে জাকজমক এত বেশি হয়েছিল যে, সম্মেলন ক্ষেত্র ‘স্বর্ণবস্ত্রের ক্ষেত্র’ (Field of the cloth of gold) নামে অভিহিত হয়েছে। কিন্তু এতে বিশেষ কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি; কারণ অল্পকাল পরেই হেনরী চার্লসের সঙ্গে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হন। স্পেইন বা তদকালীন হলি রোমান এম্পেরর চার্লসের সাথে ইংল্যান্ডের বেশ কিছু স্বার্থ ও প্রভাব জড়িত ছিল। চার্লস ছিলেন হেনরীর শ্যালিকা-পুত্র, অর্থাৎ হেনরীর স্ত্রী বা তদকালীন ইংল্যান্ডের রানী ক্যাথরিন ছিলেন স্পেনীয়, তার উপর তাই স্পেনীয় প্রভবা ছিল। সেই সাথে নেদারল্যান্ডকে তখন বাণিজ্যিক দিক ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধশালী অঞ্চল, আর চার্লস হলি রোমান এম্পেরর হওয়ায় এই নেদারল্যান্ড এখন তার নিয়ন্ত্রণে, তাই চার্লসের প্রতি হেনরীর বাণিজ্যস্বার্থও ছিল। তার উপর হেনরীর বিদেশ নীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব যার তিনি হলেন উল্সী। এই উল্সীর ছিল চার্লসের প্রতি তার ব্যক্তিগত স্বার্থ। তার মধ্যে ছিল পােপ হওয়ার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। চার্লসের সাহায্যেই তিনি রােমে প্রভাব বিস্তার করে পােপ হবার স্বপ্ন দেখতেন।
এসব কারণে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হলে হেনরী অবশেষে চার্লসের পক্ষাবলম্বন করেন। এই যুদ্ধ ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরােপের কয়েকটি স্থানে সংঘটিত হয়। হেনরী পুনরায় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি দুবার ফ্রান্স আক্রমণ করেন, কিন্তু এতে ক্ষতি ভিন্ন লাভ হয়নি। হেনরী চার্লসের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাননি; স্কটল্যান্ডের সাথে পুনরায় বিবাদ আরম্ভ হয়; এবং সর্বোপরি তার অর্থাভাব দেখা দেয়। সুতরাং যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ কয়েক বছর চলার পর ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সিস পাভিয়ার যুদ্ধে চার্লসের হাতে শােচনীয়রূপে পরাজিত ও বন্দী হন। ফ্রান্সিসের পরাজয়ে স্পেনের শক্তি বৃদ্ধি হয়, চার্লস সমগ্র ইউরােপে প্রাধান্য বিস্তার করবেন বলে আশঙ্কা দেখা দেয়। অর্থাৎ শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হবার উপক্রম। এটা উল্সী কিংবা অষ্টম হেনরী কারও কাম্য ছিল না। তাই হেনরী শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্য এবং চার্লসের স্বার্থপরতায় বিরক্ত হয়ে উল্সীর পরামর্শে ফ্রান্সের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন, পরিবর্তে হেনরী ফ্রান্সিসের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ লাভ করেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সিস বন্দিদশা হতে মুক্ত হবার পর পুনরায় স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে হেনরী উক্ত সন্ধি অনুযায়ী ফ্রান্সের পক্ষ অবলম্বন করেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার প্রয়ােজন দেখা দেয়ায় হেনরী ১৫২৯ হতে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরবর্তী এগার বছরের জন্য আন্তঃমহাদেশীয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবশ্য এর মধ্যে তিনি সমগ্রকে ব্রিটিশ দ্বিপপূঞ্জকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে হেনরী ওয়েলসকে ১৫টি কাউন্টিতে বিভক্ত করে সেখানে ইংলিশ আইন-কানুন প্রবর্তন করেন। সেই বছরই তিনি আয়ারল্যান্ডে প্রাধান্য স্থাপন করে ‘আয়ারল্যান্ডের রাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন।
হেনরীর রাজত্বকালের এই প্রথম পর্বে উলসীর পররাষ্ট্রীয় কার্যসমূহ বিবেচনা করলে আমরা দেখি, তিনি যেভাবে ইউরােপীয় রাজনীতির জটিল সূত্রে দক্ষতার সাথে ইংল্যান্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন, তার পূর্বে কোন ইংরেজ রাজনীতিবিদ তার মত দক্ষতার সাথে বৃহৎ শক্তিগুলাের সঙ্গে কূটনৈতিক মােকাবেলা করতে সক্ষম হননি। যে ইংল্যান্ড ইউরােপীয় রাজাদের দৃষ্টিতে একটি শক্তি হিসেবে আদৌ গণ্য হতাে না, উল্সীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতার বলে সে ইংল্যান্ড ইউরােপ মহাদেশে একটা বিশিষ্ট আসন লাভ করতে সক্ষম হয়। এ কারণে তার সম্বন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে যে, “উল্সীই ইংল্যান্ডকে ইউরােপীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে একটি শ্রেষ্ঠ আসন দানকারী প্রথম রাজনীতিবিদ।” (Wolsey was the first statesman to raise England to a great place in European politics)।
যাই হোক, রাজত্বের শেষভাগে (১৫৪০-৪৭ খ্রি.) হেনরী পুনরায় পররাষ্ট্র বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার অবকাশ লাভ করেন। এ সময় হেনরী ও চার্লসের মধ্যে পুনরায় বন্ধুত্ব স্থাপিত হয় এবং স্কটল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হয়। স্কটল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জেমস্ ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন। ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু অষ্টম হেনরী তাকে সলওয়েমসের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। এ পরাজয়ের অল্পকাল পরেই পঞ্চম জেমস শিশু কন্যা মেরীকে উত্তরাধিকারী রেখে পরলােকগমন করেন। পঞ্চম জেমসের মৃত্যুর পর অষ্টম হেনরী স্কটল্যান্ডকে ইংল্যান্ডের পক্ষে আনার উদ্দেশ্যে তার পুত্র এডওয়ার্ডের সঙ্গে স্কট-রানী মেরীর বিবাহের চেষ্টা করেন। তার এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি ক্রুদ্ধ ও ধৈর্যহারা হয়ে স্কটল্যান্ড আক্রমণ করেন। কিন্তু এর দ্বারা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি; বরং এর ফলে স্কটল্যান্ডে ইংলিশ প্রভাব যেটুকু ছিল তাও বিনষ্ট হয় এবং স্কটল্যান্ড ফ্রান্সের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আংশিকভাবে ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের স্কটিশ আক্রমণের পরিণামে এবং আংশিকভাবে চার্লসের অনুরােধে হেনরী ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিন বছর এ যুদ্ধ চলার পর ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে এর অবসান হয়। এই যুদ্ধের ফলে বুলাে বন্দর ইংল্যান্ডের অধিকারে আসে। এটাই হেনরীর ব্যয়বহুল বৈদেশিক অভিযানসমূহের একমাত্র বস্তুগত লাভ। কিন্তু এটিও ইংল্যান্ড বেশিকাল ধরে রাখতে পারেনি। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ফ্রান্স তা পুনরুদ্ধার করে নেয়। ইতােমধ্যে ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধাবসানের এক বছর পরেই অষ্টম হেনরী ইহলােক ত্যাগ করেন (১৫৪৭ খ্রি.)।
অষ্টম হেনরীর বৈদেশিক অভিযানসমূহের দ্বারা যদিও ইংল্যান্ডের বস্তুগত বিশেষ কোন লাভ তথা রাজ্য সম্প্রসারিত হয়নি, তবুও তার পররাষ্ট্রনীতি ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযােগ্য। কারণ, তা ছিল অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ এবং বলিষ্ঠ। হেনরী তার সাহসিকতাপূর্ণ নীতির দ্বারা ইউরােপের রাজনীতি ক্ষেত্রে স্বীয় প্রভাব ও গৌরব বিস্তার করতে এবং সেই সঙ্গে ইংল্যান্ডের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বলিষ্ঠ নীতির জন্যই ইউরােপীয় রাজন্যবর্গ ইংল্যান্ডের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া হেনরী তার মন্ত্রী উল্সীর পরামর্শক্রমে শক্তি সাম্য নীতি গ্রহণ করে ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছেন।
অষ্টম হেনরী ও ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলন
ভূমিকা
উল্সীর সহযােগিতায় হেনরী যখন পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের গৌরব বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন, সে সময় ইউরােপে যুগান্তকারী ধর্মসংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অষ্টম হেনরীর রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধর্মসংস্কার আন্দোলন। ১৫২৯-১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অষ্টম হেনরী মুখ্যত এ কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে আরম্ভ হয়ে এ আন্দোলনের ঢেউ ক্রমান্বয়ে ইংল্যান্ডের তটে এসে আঘাত করে এবং বেশ কিছুসংখ্যক লােককে প্রভাবিত করে। এমনি সময়ে পােপের সাথে অষ্টম হেনরীর ব্যক্তিগত কারণে বিবাদ বেধে যায়। ফলে, ইংল্যান্ডেও সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। অষ্টম হেনরীর রাজত্বকালে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের গতিকে চারটি অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে – (১) পােপ তথা রােমের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ; (২) মঠ উচ্ছেদ; (৩) ক্র্যানমারের অধীনে তত্ত্বীয় বা নীতিগত পরিবর্তন এবং (৪) অষ্টম হেনরীর প্রবর্তিত ছয় দফা বিধি বা ব্যবস্থা।
১. রােমের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ (Breach with Rome)
রােমের সাথে ইংল্যান্ডীয় চার্চের সম্পর্কচ্ছেদ অষ্টম হেনরীর রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের এটাই প্রথম পদক্ষেপ। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণগুলােকে প্রকৃত এবং প্রত্যক্ষ বা আশু এ দুই অংশে ভাগ করা যায়।
প্রকৃত কারণ
গত তিন শতাব্দী যাবৎ পােপের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্যান্য ইউরােপীয় দেশের মত ইংল্যান্ডেও গণ-অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল। এটাই পােপের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্কচ্ছেদের অন্তর্নিহিত কারণ। উচ্চ শ্রেণীর যাজকদের ধনরত্নের প্রাচুর্য ও বিলাসিতা, মঠবাসী সন্ন্যাসীদের লােভ ও অলসতা, চার্চের কুসংস্কারপূর্ণ শিক্ষা এবং সর্বোপরি, পােপের অপ্রতিহত ক্ষমতা এবং এর অপব্যবহার প্রভৃতি কারণে পােপ ও চার্চের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। তৃতীয় এওয়ার্ডের আমল থেকেই ইংরেজরা ইংলিশ চার্চ ও ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে পােপের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করে আসছিল। প্রিমুনার ও প্রােভাইজার আইন দুটি থেকে বােঝা যায় যে, ইংল্যান্ড পােপকে অর্থ প্রদান করতে কিংবা তার কাছে মামলার আপীল প্রেরণ করতে অনেক দিন থেকে অনিচ্ছুক ছিল। অতঃপর রেনেসাঁর প্রভাবে পােপ ও চার্চের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। রেনেসাঁর ফলে মধ্যযুগের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের স্থান অধিকার করে যুক্তিবাদ। জনসাধারণ সকল ব্যাপারই যুক্তিতর্ক দ্বারা বিচার করে সত্যাসত্য নির্ণয় করতে আরম্ভ করে এবং বুঝতে পারে যে, অনেক ক্ষেত্রেই তারা যাজকগণকর্তৃক প্রতারিত হয়েছে। ফলে চার্চ ও পােপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং সংস্কারের অনুকূলে জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। রেনেসাঁ সৃষ্ট পণ্ডিত ইরাসমাস ও স্যার থমাস মোর যথাক্রমে তাদের গ্রন্থ ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ ও ‘ইউটোপিয়ার’ মাধ্যমে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের অনুকূলে পথ প্রশস্ত করেন। এছাড়া রােমান ক্যাথলিক যাজকদের মধ্যেও কয়েকজন ব্যক্তি চার্চের দুর্নীতি ও কুসংস্কার দূর করে এটিকে নতুনভাবে গড়ে তুলবার প্রয়াসী ছিলেন। এদের আন্দোলনের ফলে জনসাধারণের মধ্যে পােপের প্রতি বিদ্বেষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমনি সময়ে জার্মানির উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক এবং প্রােটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের প্রবর্তক মার্টিন লুথার ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম পােপ ও রােমান ক্যাথলিক মতবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে জার্মানিতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। লুথারের মতবাদ দ্রুত গতিতে সমগ্র ইউরােপে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইংল্যান্ডের লােককেও বিশেষত উন্নত পূর্বাঞ্চলীয় কাউন্টিসমূহের এবং লন্ডনের জনগণকে প্রভাবিত করে। এরূপে ইংল্যান্ডে পােপ ও চার্চের বিরুদ্ধে অসন্তোষ রেনেসাঁ ও লুথারের মতবাদের পর তীব্রতর হয়ে ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
আশু কারণ
রেনেসাঁ ও লুথারীয় মতবাদের প্রভাবে ইংল্যান্ড যখন ব্যাপক সুদূরপ্রসারী সংস্কারের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে রানী ক্যাথারিনের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রশ্নে পােপের সাথে অষ্টম হেনরীর বিরােধ সৃষ্টি হয়। এটাই রােমের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিন্ন হবার আশু কারণ ছিল। ক্যাথারিনের সাথে দীর্ঘকাল ঘর করে অষ্টম হেনরী ক্রমে তার ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন। পুত্রহীনা ক্যাথারিন ছিলেন অকাল বার্ধক্যপীড়িত। তার সন্তানদের মধ্যে একমাত্র কন্যা মেরী ছাড়া আর কেউ জীবিত ছিল না। হেনরী সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে পুত্রের জন্যে লালায়িত ছিলেন এবং সেজন্য আবার বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এ ছাড়া ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে হেনরী স্পেনের সাথে মৈত্রীবন্ধন ছিন্ন করলে স্পেনরাজ দুহিতা ক্যাথারিনের সাথে তার মতান্তর হয়। এতে পত্নীর ওপর হেনরীর বিতৃষ্ণা আরাে বেড়ে যায়। সর্বোপরি, হেনরী অ্যানবােলিন নামে জনৈকা সুন্দরী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টীয় ধর্মমতে প্রথমা পত্নী ক্যাথারিনকে আইনত ত্যাগ করার পূর্বে এ বিয়ে সম্ভব ছিল না। এ সকল কারণে অষ্টম হেনরী ক্যাথারিনকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেজন্য অজুহাতের অভাব হলাে না। তিনি যুক্তি দেখালেন যে, ক্যাথারিন তার চেয়ে পাঁচ বছরেরও অধিক বয়স্কা; ক্যাথারিন পূর্বে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধূ ছিলেন বলে তার সাথে বিবাহ ধর্মের চোখে অগ্রাহ্য এবং সেহেতু অভিশপ্ত ছিল। অভিশপ্ত বিবাহ বলেই ক্যাথারিন হেনরীকে কোন পুত্র সন্তান দান করতে পারেননি। এ সকল যুক্তি দেখিয়ে হেনরী ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে পােপের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এরূপ সম্মতি দান ও প্রত্যাহার করার প্রথা সেকালে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে পােপ সমস্যায় পড়লেন। কারণ, একদিকে ক্যাথারিন সম্রাট পঞ্চম চার্লসের মাতৃম্বসা বা মাসি; অন্যদিকে চার্লস অষ্টম হেনরীর মতই একজন দুর্ধর্ষ রাজা। এ কারণে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ সমর্থন করতে সাহসী হলেন না; অথচ হেনরীকে অসন্তুষ্ট করতেও দ্বিধাবােধ করতে লাগলেন। সুতরাং বৃথা সময় হরণ করার উদ্দেশ্যে তিনি তার ইংল্যান্ডস্থ প্রতিনিধি ও হেনরীর উপদেষ্টা থমাস উল্সী এবং ক্যাম্পাগ্জিয়াে নামে একজন ইতালির কার্ডিনালকে ইংল্যান্ডেই উক্ত অভিযােগের বিচার করতে আদেশ দেন। কিন্তু তারা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই পােপ ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে নিজ হাতে বিচারকার্য গ্রহণ করেন এবং হেনরী বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি আদায় করতে ব্যর্থ হন। এটাই ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের তথা পােপের সাথে ইংল্যান্ডীয় চার্চের সম্পর্কচ্ছেদের প্রত্যক্ষ কারণ।
এই পরিস্থিতিতে উলসীর সাথে কী ঘটল তা একটু বলা দরকার। পােপের অনুমতি আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্রুদ্ধ হেনরী এর জন্য উল্সীকেই দায়ী করে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিকভাবে তাকে চ্যান্সেলর পদ হতে অপসারিত করেন। এভাবে যে উল্সী পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতায় ইউরোপে ইংল্যান্ডকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদায় আসীন করেছিলেন, হেনরীর মাত্র একটি অঙ্গুলি-হেলনে সেই উল্সীর অকস্মাৎ পতন ঘটল। উল্সীর পতনের পর চ্যান্সেলর পদ গ্রহণ করেন স্যার থমাস মোর। ইনিও হেনরীর ক্রোধের শিকার হয়েছিলেন, তার কথা পরে আলোচনা হবে। পদচ্যুতির পর উল্সী ইয়র্কে গিয়েই আর্চবিশপরূপে বাস করেছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি অল্পকালের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়ায় হেনরী ঈর্ষান্বিত হয়ে মিথ্যা রাজদ্রোহের অভিযােগে তাকে গ্রেফতার করে লন্ডনে আনার আদেশ দেন। বন্দিরূপে লন্ডনে আসার সময় পথিমধ্যে উল্সী পীড়িত হয়ে পড়েন এবং লিস্টারের একটি মঠে আশ্রয় নেন। অনতিকাল পরেই তার মৃত্যু হয় (১৫৩০ খ্রি)। মৃত্যুকালে তিনি বলেন, “এখানে আমি মরতে এসেছি। একাগ্রতার সঙ্গে আমি এতকাল রাজসেবা করেছি, যদি তার অর্ধেকও ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে নিয়ােজিত করতাম তা হলে এ বৃদ্ধ বয়সে তিনি আমায় ত্যাগ করতেন না।” এভাবে মাত্র ৪২ বছর বয়সে এ অসাধারণ প্রতিভাময় জীবনের অবসান ঘটে।
যাইহোক, এরপর হেনরী আর্চবিশপ ক্র্যানমারের পরামর্শে বিবাহ বিচ্ছেদ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার জন্যে ইউরােপীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অনুরােধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিভিন্ন মত প্রকাশ করে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে হেনরী ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ওপর থেকে পােপের কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে স্বীয় অভিলাষ পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এ উদ্দেশে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘রিফরমেশন পার্লামেন্ট’ (The Reformation Parliament) নামে অভিহিত একটি পার্লামেন্ট আহ্বান করেন। এi পার্লামেন্ট ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। পার্লামেন্টের সদস্যগণ পূর্ণমাত্রায় পােপবিরােধী ছিলেন। সুতরাং এর সাথে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের বা পােপের সাথে ইংল্যান্ডীয় চার্চের বিচ্ছিন্নকরণের কাজ শুরু হয়ে যায়।
রিফরমেশন পার্লামেন্টের কার্যাবলি (পােপের সাথে ইংল্যান্ডীয় চার্চের সম্পর্ক ছিন্ন করার উদ্দেশে গৃহীত ব্যবস্থাবলি)
অষ্টম হেনরী পােপবিরােধী মনােভাবাপন্ন রিফরমেশন পার্লামেন্টের সাহায্যে নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে অতি সহজেই ইংল্যান্ডের ওপর থেকে পােপের কর্তৃত্ব বিলােপ করতে সক্ষম হন। প্রথমত, যাজক সম্প্রদায়কে রাজার নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার উদ্দেশ্যে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনে চার্চের কতগুলাে লাভজনক আয় রহিত করা হয়। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে উল্সীকে পােপের প্রতিনিধিরূপে স্বীকার করার অভিযােগে যাজকবর্গকে প্রাচীন ‘অ্যাক্ট অব প্রিমুনার’ অনুসারে অভিযুক্ত করে বিচারাধীনে আনা হয় এবং তাদের অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এর পর যাজকদের ‘সাবমিশন অব ক্লার্জি’ (Sub-mission of Clergy) নামক একটি দলিলে দস্তখত করতে বাধ্য করা হয়। এর দ্বারা রাজার অনুমােদন ছাড়া চার্চ কর্তৃপক্ষের চার্চ-সংক্রান্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রহিত করা হয়।
এরূপে যাজকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পর হেনরী ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টের তৃতীয় অধিবেশনে ‘অ্যাক্ট অব এ্যানেট্স’ (Act of Annates) পাস করে পােপের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ শুরু করেন। এর দ্বারা ‘এ্যানেটস’ ও ‘পিটার পেনস্’ নামক কর পােপের কাছে প্রেরণ নিষিদ্ধ করা হয় এবং তার বদলে ঐ সকল করের যাবতীয় অর্থ রাজার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাক্ট অব অ্যাপীল’ (Act of Appeal) প্রণয়ন করে ইংল্যান্ডের ধর্মাধিষ্ঠান হতে যাজকদের বিচার-সংক্রান্ত আপীল পােপের দরবারে প্রেরণ নিষিদ্ধ করা হয় এবং উক্ত ক্ষমতা ইংল্যান্ডের যাজকসভার ‘আপার হাউস’-এর ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ আইনের বলে আর্চবিশপ ক্র্যানমার চার্চ বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিবাহ বিচ্ছেদ মামলার বিচার করে হেনরী ও ক্যাথারিনের বিবাহ প্রথম থেকেই অবৈধ ছিল বলে ঘােষণা করেন। অষ্টম হেনরী আগেই গােপনে অ্যানবােলিনকে বিবাহ করেছেন। এখন ক্র্যানমারের রায় ঘােষণার পর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রানী বলে অভিষিক্ত করা হয়।
১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টের পঞ্চম অধিবেশনে হেনরী একটি উত্তরাধিকার আইন (Act of Succession) পাস করে ক্যাথারিন কন্যা মেরীকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন এবং অ্যানবােলিনের সন্তানকে উত্তরাধিকার দান করেন। এরপর অষ্টম হেনরী পার্লামেন্টের ষষ্ঠ অধিবেশনে (১৫৩৪ খ্রি.) বিখ্যাত ‘অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসী’ (Act of Supremacy) আইনটি প্রণয়ন করেন। এর দ্বারা রাজাকে ইংল্যান্ডের চার্চের সর্বময় প্রভু বা কর্তা (Supreme Head) ঘােষণা করা হয়। যারা ‘অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসী’ মানতে অস্বীকার করেন তাদের রাজদ্রোহের অভিযােগে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। স্যার থমাস মোর এই আইন মেনে নিতে অস্বীকার করলে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। এই প্রসঙ্গে স্যার থমাস মোর সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। স্যার থমাস মোর সপ্তম হেনরীর মন্ত্রী কার্ডিনাল মর্টনের গৃহে প্রতিপালিত হয়েছেন। মর্টন তাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেখানে অধ্যয়নকালে স্যার থমাস মোর রেনেসাঁর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমন্সসভার স্পীকার নির্বাচিত হন এবং উল্সীর পতনের পর চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন। স্যার থমাস মোর ছিলেন যুগের একজন প্রসিদ্ধ চিন্তানায়ক। তিনি ইউটোপিয়া (Utopia) বা ‘সব পেয়েছির দেশ’ নামক একখানি গ্রন্থ রচনা করে কালজয়ী খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার এ বিখ্যাত গ্রন্থে তিনি এক আদর্শ সাধারণতন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন এবং ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুপারিশ করেছেন। থমাস মোর ক্যাথারিনের সাথে হেনরীর বিবাহ বিচ্ছেদের বিরােধী ছিলেন। তাই শীঘ্রই তিনি হেনরীর বিরাগভাজন হন। কিছুকাল পরে ‘অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসী’ অনুসারে রাজাকে ইংল্যান্ডের চার্চের প্রধান হিসেবে স্বীকার করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করার অপরাধে হেনরী তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। যখন তিনি দণ্ড গ্রহণের জন্য যুপমঞ্চে আরােহণ করেন, তখন মঞ্চ সােপান তার পদভারে অল্প অল্প দুলছিল। এ সময় তিনি হাসতে হাসতে স্বভাবসিদ্ধ সরল পরিহাসের সুরে বন্দিশালার অধ্যক্ষের দিকে চেয়ে বলেন, “আমাকে নির্বিঘ্নে ওপরে পৌছিয়ে দিন, নেমে আসার সময় আমি একাই আসতে পারব।” যাই হোক, এভাবে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের প্রথম পর্যায় – রােমের সাথে ইংল্যান্ডের চার্চের সম্পর্কচ্ছেদ এবং চার্চের ওপরে পােপের বদলে রাজার কর্তৃত্ব স্থাপন সম্পন্ন হয়।
রােমের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্কচ্ছেদ অথবা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল
রােমের সাথে ইংল্যান্ডীয় চার্চের বিচ্ছেদ (অথবা ধর্মসংস্কার আন্দোলন) ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলদায়ক ঘটনা। এর ফলে :
- (১) বৈদেশিক প্রভুত্বের অবসান : ইংল্যান্ডের চার্চের ওপর থেকে বৈদেশিক প্রভুত্বের অবসান হয়। ইতােপূর্বে ইংল্যান্ডীয় চার্চের শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে পােপ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত। ইংল্যান্ড থেকে সর্বদাই পােপের দরবারে রিপাের্ট, আপীল ও কর প্রেরণ করতে হতাে। অনুরূপভাবে পােপের দরবার থেকে আদেশ, কমিশন এবং এমনকি রাজনীতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত ইংল্যান্ডে প্রেরিত হতাে। রাজার বিবাহেও পােপের অনুমতির প্রয়ােজন হতাে। পােপ ও তার ধর্মাধিষ্ঠানের ওপর ইংল্যান্ডীয় গির্জার এবং জনজীবনের এমন নির্ভরশীলতা ধর্মসংস্কার বা পােপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ফলে লােপ পায়।
- (২) স্বাধীন জাতীয় চার্চের প্রতিষ্ঠা : ইংল্যান্ডীয় চার্চের ওপর থেকে বৈদেশিক প্রভুত্বের অবসান হওয়ায় ইংল্যান্ড ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জন করে। ইংল্যান্ডীয় চার্চ এখন থেকে একটি স্বাধীন জাতীয় চার্চে পরিণত হয়।
- (৩) রাষ্ট্র কর্তৃক চার্চের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ : চার্চের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের অধীনে আসে এবং তার দ্বারা চার্চের ওপর রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগে চার্চ রাষ্ট্রের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী স্বাধীন সংস্থা এবং ‘রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র’ (A state within a state) হিসেবে অবস্থান করত। রােমের সাথে বিচ্ছিন্ন হবার ফলে চার্চের সে মর্যাদা আর থাকল না। তা এখন রাষ্ট্রীয় সরকারের একটি বিভাগের পর্যায়ে অবনমিত হলাে।
- (৪) রাজক্ষমতা বৃদ্ধি : রাজার ক্ষমতা বিভিন্নভাবে অনেক বেড়ে যায়। চার্চের ওপর কর্তৃত্ব পােপের পরিবর্তে রাজার হাতে যাওয়ায় এবং চার্চের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে রাজার অধীনে আনায় অষ্টম হেনরী পূর্ববর্তী রাজাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধর্মীয় আদালত কর্তৃক ধার্য জরিমানা এবং এ্যানেট্স্ ও পিটারপেন্স্ প্রভৃতি করসমূহ রাজকোষাগারে স্থানান্তরিত হওয়ায় রাজার আর্থিক ক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পায়। ফলে, রাজতন্ত্রের বুনিয়াদ সুদৃঢ় হয়।
- (৫) পার্লামেন্টের অধিকার ও মর্যাদা বৃদ্ধি : পার্লামেন্টের অধিকার, মর্যাদা ও কার্যক্রম এলাকা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে বেড়ে যায়। যেহেতু পার্লামেন্টের মাধ্যমেই হেনরী পােপের কর্তৃত্ব বিনষ্ট করে তার জায়গায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেহেতু ভবিষ্যতের জন্য পার্লামেন্টীয় অধিকারের সপক্ষে এ নজির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, দেশের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করতে হলে পার্লামেন্টের অনুমােদন অপরিহার্য। পার্লামেন্টের কার্যক্রম এলাকা এবং মর্যাদাও এর ফলে বেড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া পােপের সাথে বিচ্ছেদজনিত কার্যাবলি পার্লামেন্টের গঠন প্রণালীকেও প্রভাবিত করেছিল।
- (৬) জাতীয়তাবাদের বিকাশ : পরিশেষে, পােপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ তথা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে ইংল্যান্ডে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। জার্মানি ছাড়া ইউরােপের অধিকাংশ দেশই ছিল ক্যাথলিক, আর ইংল্যান্ড ছিল প্রােটেস্টান্ট দেশ। এ অবস্থায়ই ইংল্যান্ডের মধ্যে দৃঢ় জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি করেছিল। অধিকন্তু, রােমের সাথে সম্পর্কচ্যুতির ফলে স্পেন ইংল্যান্ডের ঘােরতর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডকে বৈদেশিক বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য ইংরেজগণ জাতীয় ঐক্যের বিশেষ প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে। এই প্রয়ােজনই ইংল্যান্ডের তীব্র জাতীয়তাবােধের বিকাশ ঘটিয়েছিল।
২. মঠ উচ্ছেদ
মঠ উচ্ছেদের কারণ ও প্রক্রিয়া
ইংল্যান্ডীয় গির্জার ওপর থেকে পােপের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত করার পর অষ্টম হেনরী সন্ন্যাসীদের মঠগুলাের উচ্ছেদ সাধনে মনােনিবেশ করেন। তিনটি কারণে হেনরী মঠগুলাে উচ্ছেদ করেন। প্রথমত, মঠবাসী সন্ন্যাসীরা ইংল্যান্ডে পােপের কর্তৃত্বের বিশেষ সমর্থক ছিলেন বলে মঠগুলাে পােপের ক্ষমতার অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। কাজেই যতদিন মঠগুলাে বিদ্যমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত যত আইনই পাস করা হউক না কেন পােপ তার মঠবাসী অনুচরদের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের বিপুল সংখ্যক জনগণের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন, এ আশঙ্কা করে হেনরী ইংল্যান্ড হতে পােপের কর্তৃত্ব সমূলে বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে মঠগুলাের উচ্ছেদ সাধন করার সিদ্ধান্ত নেন। দ্বিতীয়ত, মঠগুলাের বিপুল সম্পদ দেখে সম্ভবত তার লােভ হয় এবং সেগুলাে বাজেয়াপ্ত করে রাজকোষ পূর্ণ করার বাসনা জন্মে। তৃতীয়ত, এ সময় কতগুলাে মঠে নানাপ্রকার দুর্নীতি প্রবেশ করেছিল এবং সন্ন্যাসীরা অলস ও পাপপূর্ণ জীবনযাপন করত। এ কারণে মঠগুলাের বিরুদ্ধে জনগণের একাংশ কর্তৃক অনেকবার অভিযােগ উত্থাপিত হয়েছিল। বিশেষত ওয়াইক্লিফ এবং অক্সফোর্ডের সংস্কারকগণ মঠের দুর্নীতির কঠোর সমালােচনা করেছিলেন। দুর্নীতির কারণেই ইতােপূর্বে থমাস উল্সীও কয়েকটি ক্ষুদ্র মঠের উচ্ছেদ সাধন করেছিলেন।
মঠ উচ্ছেদের ব্যাপারে হেনরীর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন থমাস ক্রমওয়েল। এই ক্রমওয়েল ছিলেন একজন কর্মকারের পুত্র। তার কর্মজীবন খুব বৈচিত্র্যময় ছিল, প্রথমে তিনি ইতালিতে ছিলেন সৈনিক, তারপর অ্যান্টওয়ার্পে হলেন কেরানি, তারপর পুটনীতে ব্যবসায়ী এবং এরপর ইংল্যান্ডে এসে হলেন উকিল। স্যার থমাস মোরের পতনের পর এই থমাস ক্রমওয়েলই অষ্টম হেনরীর প্রধান উপদেষ্টার পদ লাভ করেন। ক্রমওয়েল হেনরীর পোপবিরােধী নীতি কার্যকর করার প্রধান হাতিয়ার ছিলেন। তার কর্মক্ষমতায় সন্তুষ্ট হয়ে হেনরী তাকে ধর্মীয় কাজ পরিচালনা করার জন্য ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ভাইকার জেনারেল’ (Vicar ceneral) পদে এবং মঠগুলাে পরিদর্শন ও সেগুলাে সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা প্রদান করেন। মঠগুলাের উচ্ছেদ সাধন করে ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অগ্রগতি সাধন করেন। এছাড়া তিনি হেনরীর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল পার্লামেন্টকে অনুগত করে রাজশক্তি বৃদ্ধি করা। তিনি রাজ্যের সর্বক্ষেত্রে গুপ্তচর নিযুক্ত করে তাদের মাধ্যমে রাজার নীতির সমালােচক রাজ বিরােধীদের সন্ধান নিতেন এবং নিষ্ঠুরভাবে তাদের দমন করতেন। ফলে হেনরীর অধীনে স্বৈরতন্ত্র চরম আকার ধারণ করেছিল। সুতরাং ক্রমওয়েল ছিলেন হেনরীর পক্ষে কাজের লােক। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই ক্রমওয়েলকেও থমাস মোর ও উল্সীর মত হেনরীর ক্রোধের শিকার হয়েই মরতে হয়েছিল। সেই কাহিনী পরে হবে।
থমাস ক্রমওয়েল ক্ষমতা পেয়ে সন্ন্যাসীদের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ান এবং সন্ন্যাসী দমনের হাতুড়ি হিসাবে পরিগণিত হন। তিনি মঠগুলাের অবস্থা পরিদর্শন করার জন্যে একটি কমিশন নিয়ােগ করেন। কমিশন মঠগুলাে সম্পর্কে প্রতিকূল রিপাের্ট প্রদান করে। বস্তুত ক্রমওয়েলের ইচ্ছা কি ছিল এবং তিনি কি ধরনের রিপাের্ট কামনা করতেন কমিশন তা ভালরূপেই জানত। এ কারণে কমিশনের রিপাের্ট কিছু অতিরঞ্জিত ছিল। এ রিপাের্টের বলে হেনরী ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টের একটি আইন দ্বারা যে সমস্ত মঠের বার্ষিক আয় ছিল দু’শত পাউন্ডের নিচে এরূপ ৩৭৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মঠ বাতিল করেন। পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে (১৫৩৭-৩৯ খ্রি.) হেনরী বৃহৎ মঠগুলােও গ্রাস করেন। এ সকল মঠ উচ্ছেদের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। প্রথমত কিছু সংখ্যক মঠাধ্যক্ষ ও মঠাধিকারিণীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের মঠগুলাে আপােষে রাজার হাতে সমর্পণ করতে বলা হয়। তাদের বলা হয় যে তারা আপােষে তা করতে সম্মত হলে তাদের সাথে সদয় ও উদার ব্যবহার করা হবে, না হলে তারা রাজকোপানলে পড়বেন। এতে কিছু সংখ্যক মঠাধ্যক্ষ বশ্যতা স্বীকার করলে অবশিষ্টগণের ওপর ক্রমাগত অধিক চাপ প্রয়ােগ এবং প্রয়ােজনবােধে ভীতি প্রদর্শন করে তাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়। গ্ল্যালটেনবার্গ, রিডিং ও কোলচেস্টারের মঠাধ্যক্ষগণ তাদের মঠ সমর্পণ করতে অস্বীকার করলে তাদের মামলায় জড়িত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন পার্লামেন্টের দ্বারা এ সকল ব্যবস্থা অনুমােদন করানাে হয়। এরূপে অষ্টম হেনরী ক্রমওয়েলের সাহায্যে মঠগুলাের উচ্ছেদ সাধন করেন।
মঠের সমস্ত সম্পত্তি প্রধানত রাজসরকারে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু হেনরী মঠ সম্পত্তির সামান্য অংশ খাসে রেখে বাকি সমস্তই বিভিন্ন রূপে হস্তান্তর করেন। কিছু অংশ নতুন ধর্মীয় এলাকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন, কিছু অংশ বিদ্যালয় স্থাপন এবং কিছু অংশ উপকূল অঞ্চলের প্রতিরক্ষার্থে দুর্গ ও নৌবহর ব্যবস্থা নির্মাণের কাজে বরাদ্দ করা হয়। কিছু অংশ হেনরী তার মন্ত্রী ও সভাসদগণকে দান করেন, কিন্তু অধিকাংশই স্বল্প মূল্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে বিক্রয় করেন। ইংল্যান্ডের অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার (চার হাজার একর) এ সম্পত্তি ক্রয় করেছিলেন। এরূপে ইংল্যান্ডে ‘কান্ট্রি জেন্টেলমেন’ (Country Gentlemen) নামে এক শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল।
মঠ উচ্ছেদের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া
মঠগুলাের উচ্ছেদ ইংল্যান্ডের জনগণের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল –
সামাজিক : সামাজিক ক্ষেত্রে মঠগুলাে অতীতে জনসাধারণের কাছে বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর ছিল। যেসব ব্যক্তি জাগতিক অন্যায়-অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ধার্মিকের জীবন যাপন করতে ইচ্ছুক হতাে তারা মঠগুলােতে আশ্রয় গ্রহণ করে শান্তিলাভ করত এবং নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিন্তে ঈশ্বরের উপাসনা করতে সক্ষম হতাে। পর্যটকদের জন্যও মঠগুলাে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। এ ছাড়া মঠগুলাে সাধারণ লােকের জন্য শিক্ষার কেন্দ্রও ছিল। মঠের বিদ্যালয়সমূহে অনেক ছেলেমেয়ে পড়ালেখার সুযােগ সুবিধা ভােগ করত। সর্বোপরি, মঠের আয় থেকে অনেক গরিব ও দুঃস্থ ব্যক্তি নানারকম সাহায্য লাভ করত এবং অসহায় পীড়িত ব্যক্তিগণ বিনা পয়সায় চিকিৎসা ও সেবা পেত। সুতরাং মঠগুলাে উঠিয়ে দেয়ার ফলে অনেক দরিদ্র ব্যক্তি জীবনধারণের অবলম্বন হারায়; অনেকে ভিক্ষুকে পিরণত হয় এবং বেকার ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এরূপে সৃষ্ট ভিক্ষাবৃত্তি ও বেকারত্ব ইংলান্ডের সামাজিক জীবনে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। এ ছাড়া মঠসম্পত্তি ভােগকারী প্রজারাও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মঠাধ্যক্ষরা ছিলেন উদার ভূস্বামী। তারা ভূমিকর বা অন্যান্য প্রাপ্যের জন্য প্রজাদের ওপর কোন রকম পীড়ন দরিদ্রদের দুর্দশা এবং বা অত্যাচার করতেন না। কিন্তু মঠ সম্পত্তির নতুন মালিকগণ প্রজাদের মঙ্গলামঙ্গলের কোন তােয়াক্কা না করে নিজেদের স্বার্থই বেশি করে দেখতেন। তারা অধিক আয়ের জন্য যথেচ্ছ কর বৃদ্ধি, সাধারণ ভূমিগুলাে দখল, আবাদী ভূমিকে চারণ ভূমিতে পরিণত করতেন। ফলে প্রজাদের অশেষ দুর্গতি হয়।
ধর্মীয় : মঠ উচ্ছেদের ফলে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলন অধিক জোরদার হয়। মঠের ভূসম্পত্তি ক্রয় করে যারা নতুন জমিদার হয়েছিল, তারা সকলেই সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক হতে বাধ্য হয়। কারণ তারা জানতেন যে, ইংল্যান্ডে পােপের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে মঠগুলােও পূনর্গঠিত হবে এবং সেই সাথে তাদেরও তাদের নবলব্ধ সম্পত্তি ফেরত দিতে হবে। সুতরাং সম্পত্তি হারাবার ভয়ে তারা সংস্কার আন্দোলকে দৃঢ় সমর্থন দিতে থাকেন। এরূপে মঠ উচ্ছেদের ফলে পােপের বিরুদ্ধে একদল শক্তিশালী সমর্থকের সৃষ্টি হয় এবং তদ্বারা ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শক্তিশালী হয়।
রাজনৈতিক : মঠ উচ্ছেদ রাজশক্তিকে আরও সুদৃঢ় করে। মঠ উচ্ছেদের পরে মঠের অধিকাংশ সম্পত্তির মালিক হন অনেক নতুন ব্যক্তি। মঠ সম্পত্তির এ নতুন মালিকদের মধ্য থেকে রাজার প্রতি অনুগত একদল নতুন অমাত্য বা অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভব হয়, অর্থাৎ বলতে গেলে এভাবে মঠ বিলোপনের মাধ্যমে হেনরী মঠের সম্পত্তি বিক্রয় করে রাজার প্রতি অনুগত এই নতুন অমাত্যের সৃষ্টি করলেন। স্বভাবতই তারা রাজার বিশ্বস্ত সমর্থক দলে পরিণত হন। তারা তাদের নবলব্ধ সম্পত্তির জন্য রাজার ওপর পুরাপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং নিজেদের আধিপত্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সব সময় রাজাকেই সমর্থন করতেন। ফলে, রাজশক্তি পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া মঠগুলাে উচ্ছেদ করায় লর্ডসভারও অনেক পরিবর্তন হয়। পূর্বে লর্ডসভার মঠাধ্যক্ষগণের বিশেষ প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল। কিন্তু মঠ বিনাশের ফলে মঠাধ্যক্ষগণ লর্ডসভায় তাদের আসন হারালে তাদের স্থলে নতুন অযাজক সদস্য নিযুক্ত হন। ফলে, লর্ডসভায় সাধারণ পিয়ারদের সংখ্যা বেড়ে যায়। এসকল সদস্যের অনেকেই রাজার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন বলে লর্ডসভায় বিশপদের প্রাধান্য বিলুপ্ত হয়ে রাজার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এভাবে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে লর্ডসভার গঠনের বিশেষ পরিবর্তন হওয়ায় লর্ডসভার ওপর বাজার-কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়।
মঠ উচ্ছেদের প্রতিক্রিয়া : ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম হেনরী ক্ষুদ্র মঠগুলাের উচ্ছেদ সাধন করলে ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। লিঙ্কনশায়ার এবং ইয়র্কশায়ারে মঠের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। এ দুটি স্থানে মঠপক্ষীয়গণ মঠ উচ্ছেদের প্রতিবাদে বিদ্রোহ করে। ইয়র্কশায়ারে বিদ্রোহের নেতা ছিলেন রবার্ট আস্কে নামক এক তরুণ আইনজীবী। এ বিদ্রোহ ইতিহাসে তীর্থ যাত্রা (Pilgrimage of Grace) নামে অভিহিত হয়েছে। বিদ্রোহীরা থমাস ক্রমওয়েলের অপসারণসহ মঠের ভূসম্পত্তিও প্রত্যর্পণের দাবি জানায়। কিন্তু হেনরী কঠোর হাতে এ বিদ্রোহ দমন করেন এবং বিদ্রোহের প্রধান নেতৃবর্গকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এরপর হেনরী উক্ত অঞ্চলে ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রােধ এবং রাজকীয় কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশে ইয়র্কে কাউন্সিল অব দি নর্থ নামে প্রিভি কাউন্সিলের একটি শাখা গঠন করেন।
৩. নীতিগত বা তত্ত্বীয় পরিবর্তন
থমাস ক্রমওয়েলের সহায়তায় অষ্টম হেনরী যখন মঠগুলাের উচ্ছেদ সাধন করছিলেন, তখন আর্চবিশপ ক্র্যানমারের প্রভাবে ধর্মসংস্কার আন্দোলন কিছুটা (প্রােটেস্টান্ট মতের অনুকূলে) তত্ত্বীয় পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হয়। ক্র্যানমার ক্রমে প্রােটেস্টান্ট মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাই তার প্রচেষ্টায় এ পথে কিছু অগ্রগতি সাধিত হয়। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশপের বই (Bishop’s Book) নামে একখানা ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থখানা প্রােটেস্টান্ট মতবাদের কিছু অনুকূলে ছিল। এরপর ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে টিনডেলের বাইবেলের অনুকরণে ইংরেজি ভাষায় বাইবেলের এক নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং এটি ইংল্যান্ডের প্রত্যেক চার্চে প্রার্থনা পুস্তকরূপে ব্যবহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়। বইখানি সহজবােধ্য ছিল; এটি পাঠ করে জনসাধারণ ক্রমে খ্রিস্টধর্মের প্রকৃত মর্ম অনুধাবন করতে পারে। ফলে পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে প্রােটেস্টান্ট ধর্মমত এবং সংস্কার আন্দোলন জনপ্রিয় ও জোরদার হয়েছিল।
৪. অষ্টম হেনরীর প্রবর্তিত ছয়দফা বিধি বা ব্যবস্থা
ক্র্যানমারের প্রভাবে তত্ত্বীয় বা নীতিগত পরিবর্তনের দিকে ইংল্যান্ডীয় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের যে মন্থর অগ্রগতি হয়েছিল তা শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, পােপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেও অষ্টম হেনরী মার্টিন লুথারের প্রােটেস্টান্ট ধর্মমত গ্রহণের বিরােধী ছিলেন এবং দেশে যাতে প্রােটেস্টান্ট ধর্মমতের প্রসার ঘটতে না পারে সে জন্য তিনি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টকে দিয়ে ‘ছয়দফা বিধি’ (Statute of Six Articles) নামে একটি আইন প্রণয়ন করে তার মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চের কয়েকটি মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। উক্ত ছয়টি বিধি হলাে- (১) ট্র্যান্সাবস্ট্যানশিয়েশন (Transubstantiation) বা লর্ডস সাপারের (Lords Supper) রুটি ও মদ খ্রিস্টের স্বাভাবিক দেহ ও রক্তে রূপান্তরে বিশ্বাস, (২) যাজকদের চির কৌমার্য, (৩) ধর্মযাজকের কাছে গােপনে পাপ স্বীকার, (৪) ‘প্রাইভেট ম্যাসেস’ (Private masses) বা ব্যক্তিগত খ্রিস্টের ভােজের উৎসব, (৫) পবিত্রতা রক্ষার চিরন্তন পথ এবং (৬) সাধারণের জন্য শুধু এক দ্রব্যে (মদ ভিন্ন রুটি দ্বারা) কমিউনিয়ন বা খ্রিস্টীয় ভােজের উৎসব পালন (Communion in one kind)। এ ছয়দফা বিধি বা এর যে কোন একটি বিধি অমান্য করার অপরাধে দণ্ডের বিধানও সংযুক্ত করা হয়। প্রথমটি অমান্য করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য যে কোনটি ভঙ্গ করার জন কারাদণ্ড ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করা হয়। এরূপে অষ্টম হেনরী ইংলিশ চার্চে পুরাতন ধর্মনীতিই বজায় রাখেন। যারা তার এ ধর্মনীতি মানতে অস্বীকার তাদের অনেকেরই প্রাণদণ্ড হয়। সুতরাং অষ্টম হেনরীর এ ছয়দফা আইন হতে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মে কোন তত্ত্বীয় বা নীতিগত পরিবর্তন আনয়ন করা (অর্থাৎ ইংল্যান্ডে প্রােটেস্টান্ট ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করা) তার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না। তার আন্দোলন মূলত ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। তিনি রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। সুতরাং ছয়দফা আইন প্রবর্তনের পর অষ্টম হেনরীর রাজত্বকালে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের আর কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি।
ইংল্যান্ডীয় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য
ইংল্যান্ডীয় চার্চের সংস্কার মূলত রাজনৈতিক আন্দোলনেরই অংশবিশেষ।
(১) মূলত রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ ও রাজার ব্যক্তিগত কারণ থেকে এর সূচনা : সংস্কার আন্দোলনের উৎপত্তি রূপ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইংল্যান্ডে এ আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়নি। রাজার ব্যক্তিগত কারণ থেকেই এর উৎপত্তি হয়েছিল। অষ্টম হেনরী ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রথম থেকেই এর প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যখন পােপের বিরুদ্ধাচরণ করেন তখন কোন ধর্মীয় সংস্কারের চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সংস্কার আন্দোলন চালাননি। তিনি এটি চালিয়েছেন এ কারণে যে, পােপ তার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনের পথে অন্তরায় হয়েছিলেন। অর্থাৎ পােপ ক্যাথারিনের সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদে অনুমতি প্রদান করেননি বলেই হেনরী পােপের বিরুদ্ধাচরণ করেন। তার ব্যক্তিগত এই একটি প্রশ্নই হেনরীকে পােপ বিরােধী কার্যকলাপে তথা ধর্মসংস্কারক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
(২) চার্চের ওপরে রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : হেনরী এ আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে মুখ্যত পােপের কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে চেয়েছেন। তার লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডীয় চার্চের ওপর থেকে পােপের আধিপত্য বিনষ্ট করে তার বদলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং ইংল্যান্ডের চার্চকে একটি স্বাধীন জাতীয় চার্চে পরিণত করা। এ উদ্দেশ্য সাধন করেই তিনি ক্ষান্ত হয়েছিলেন।
(৩) পুরনো আচার অনুষ্ঠান অপরিবর্তিত : অষ্টম হেনরী পােপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেও চার্চের পুরাতন ধর্মনীতি বা আচার-অনুষ্ঠানের কোন পরিবর্তন করেননি। তার অধীনে ইংল্যান্ডের চার্চ পােপ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও নীতিগতভাবে ক্যাথলিক চার্চ হিসেবেই পরিচালিত হয়। হেনরী প্রােটেস্টান্ট মতবাদের অনুকূলে চার্চের ধর্মনীতির কোনরূপ সংস্কার সাধন করেননি। বরং দেশে যাতে প্রােটেস্টান্ট ধর্মমতের প্রসার ঘটতে না পারে সে জন্য তিনি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ছয়দফা বিধি’ (Statute of Six Articles) পাস করে ট্রান্সবস্ট্যানশিয়েশন, যাজকদের চিরকৌমার্য, ধর্মযাজকদের কাছে পাপ স্বীকার, প্রাইভেট ম্যাসেস, পবিত্রতা রক্ষার চিরন্তন শপথ এবং সাধারণের জন্য একদ্রব্যে কমিউনিয়ন পালন প্রভৃতি ক্যাথলিক মতবাদ ফের চালু করেন। এ বিধিগুলাে থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, প্রােটেস্টান্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা কিংবা ধর্মে নীতিগত কোন পরিবর্তন আনয়ন করা অষ্টম হেনরীর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না। সুতরাং হেনরীর আন্দোলন মূলত ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। তিনি রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। সুতরাং অধ্যাপক মুইর যথার্থই বলেছেন যে অষ্টম হেনরী কর্তৃক সূচিত ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার আন্দোলন মূলত রাজনৈতিক আন্দোলন।
(৪) পোপের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধাচরণ : জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ ইংল্যান্ডের জনসাধারণ বিদেশে অবস্থিত ক্যাথলিক পােপের কর্তৃত্ব বা হস্তক্ষেপ পছন্দ করত না। তারা তাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুদূরে অবস্থানরত এবং ভিন্ন ভাবধারা পােষণকারী পােপের কর্তৃত্বের অবসান কিছুকাল পূর্ব হতেই মনে মনে কামনা করেছিল। এদিক দিয়ে বিচার করলেও ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলন অনেকখানি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল।
(৫) ইংল্যান্ডে রাজার নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু : ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এ যে, ইংল্যান্ডে এটি জাতীয় আন্দোলন ছিল না। অপর দেশীয় সংস্কার আন্দোলনের সাথে এখানেই ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পার্থক্য। অন্যদেশে চার্চ সংস্কার ছিল জাতীয় আন্দোলন, কিন্তু ইংল্যান্ডে রাজার প্রয়ােজনে এবং আদেশে উক্ত সংস্কার সাধিত হয়েছিল। অর্থাৎ ইংল্যান্ডে সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব ও সৃষ্টি যুগপৎ দুটো কাজই রাজা অষ্টম হেনরী ব্যক্তিগতভাবে আরম্ভ করেছিলেন – জনসাধারণ এর উদ্যোক্তা ছিল না। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, ইংল্যান্ডে জনমত রাজার অনুকূলে ছিল।
সুতরাং সকল দিক বিচার করে আমরা বলতে পারি যে, ইংল্যান্ডে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন মুখ্যত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই হেনরীকর্তৃক এ আন্দোলন পরিচালনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
অষ্টম হেনরীর ধর্মীয় নীতির পর্যালােচনা ও এই নীতির সাফল্যের কারণ
অষ্টম হেনরী বাল্যকাল থেকে ক্যাথলিক ধর্মমতে প্রতিপালিত ও শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পিতার দ্বিতীয় পুত্র হিসেবে তার ভ্রাতার জীবদ্দশায় তাকে ভবিষ্যতে ইয়র্কের আর্চবিশপ পদে অধিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে যাজকত্বের শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। ধর্ম ব্যাপারে হেনরী মার্টিন লুথারের মতবাদের সমর্থক ছিলেন না। পক্ষান্তরে তিনি মার্টিন লুথারের মতবাদের বিরুদ্ধে ‘দি ডিফেন্স অব দি সেভেন স্যাক্ৰামেন্টস’ (The Defence of the Seven Sacraments) নামে একখানি পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন। এ জন্য পােপ তাকে ‘ধর্মরক্ষক’ (Defender of the Faith) উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। কিন্তু হেনরী কালক্রমে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে পােপের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। রানী ক্যাথারিনকে পরিত্যাগ করার জন্য পােপের অনুমতি লাভে ব্যর্থ হওয়ায় হেনরী ক্রুদ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডের চার্চকে রােম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইংল্যান্ডের ওপর থেকে পােপের কর্তৃত্ব বিনষ্ট করতে সঙ্কল্পবদ্ধ হন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে রিফরমেশন পার্লামেন্ট আহ্বান করেন। দীর্ঘ সাত বছর কাল (১৫২৯-৩৬ খ্রি.) স্থায়ী উক্ত পার্লামেন্টের সাহায্যে তিনি ‘অ্যাক্ট অব এ্যানেটস’, ‘অ্যাক্ট অব অ্যাপীল’, ‘অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসী’ প্রভৃতি আইন পাস করে ইংল্যান্ডের গীর্জার ওপর থেকে পােপের কর্তৃত্ব বিলােপ করে সে জায়গায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর তিনি ১৫৩৬ হতে ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পােপ সমর্থক সন্ন্যাসীদের মঠগুলাে উচ্ছেদ করেন।
হেনরীর এ সমস্ত ব্যবস্থার মূলে কোন ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি রােমান গীর্জার ধর্মনীতি ও আচার অনুষ্ঠান অপছন্দ করে পােপের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হননি। তার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনের পথে পােপ অন্তরায় সৃষ্টি করেছিলেন বলেই এবং তার মত স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতাপ্রিয় রাজার পক্ষে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পােপের কতৃত্ব স্বীকার করা কাম্য ছিল না। তাই তিনি পােপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। তার প্রবর্তিত ব্যবস্থাগুলাে লক্ষ্য করলেই তার উদ্দেশ্য, সংস্কারের প্রকৃতি ও তার ধর্মীয় নীতি স্পষ্টরূপে বােঝা যায় তিনি ক্যাথলিক ধর্মনীতি ও আচার অনুষ্ঠানের কোন পরিবর্তন করেননি। ল্যাটিন মাস ইত্যাদি অপরিবর্তিত ছিল। | এটাও লক্ষণীয় যে, হেনরী কোন নতুন গির্জা প্রতিষ্ঠিত করেননি। সত্য যে ইংল্যান্ডের গির্জা তখন থেকে রােমের অধীন ছিল না বরং নতুন কর্তৃত্বাধীনে আনীত হয়েছিল। কিন্তু গির্জার ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, বিশপ ও পুরােহিত যথারীতি পূর্বের মতই ছিল। অর্থাৎ হেনরীর অধীনে ইংল্যান্ডীয় গির্জা রােম থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও ক্যাথলিক গির্জা হিসাবেই পরিচয় প্রদান করত। অন্যান্য দেশের মত এটি প্রােটেস্টান্ট নাম গ্রহণ করেনি। রােমের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেও হেনরীর ধর্মমতের পরিবর্তন হয়নি। তিনি আগের মত ক্যাথলিক ধর্মমতেই বিশ্বাসী ছিলেন। তবে পরিবর্তন এটুকু হয়েছিল যে, তিনি আর পােপভক্ত ক্যাথলিক ছিলেন না। Catholicism minus the Pope অর্থাৎ পােপকে বাদ দিয়ে ক্যাথলিক ধর্ম প্রােটেস্টান্ট বিরােধী বজায় রাখা – এটাই ছিল হেনরীর ধর্মমত। তিনি প্রােটেস্টান্ট ধর্মমত আদৌ গ্রহণ করেননি; পক্ষান্তরে, এর বিরুদ্ধে ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে একটি ছয়দফা বিধি (Statute of Six Articles) প্রবর্তন করে ক্যাথলিক চার্চের অনেক রীতিনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তার এ আইন স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, তিনি ইংল্যান্ডে প্রােটেস্টান্ট ধর্মমত প্রচার ও প্রসারের বিরােধী ছিলেন। তাই বলা যায় অষ্টম হেনরীর ধর্মীয় নীতি পােপপন্থী ও প্রােটেস্টান্টপন্থী কোনটাই ছিল না। তিনি ক্যাথলিকপন্থীই ছিলেন কিন্তু পােপকে বাদ দিয়ে। এরূপে তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। প্রাচীন ও নতুন মতবাদের মাঝামাঝি তার এ নিজস্ব মতবাদকেই তিনি সর্বাধিক প্রাধান্য দিতেন। ফলে প্রােটেস্টান্ট ও রােমান ক্যাথলিক উভয় সম্প্রদায়ের লােক তার হাতে নির্যাতিত হয়েছিল। পোপের সমর্থনকারীরা যেমন তার হাতে প্রাণ হারাতো, তেমনই তার ছয়দফা বিধি বিরােধী প্রােটেস্টান্ট মতাবলম্বীরাও অব্যাহতি পেত না। পরিশেষে ধর্ম ব্যাপারে অষ্টম হেনরীর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডের ওপর থেকে পােপের কর্তৃত্ব বিলােপ করে তদস্থলে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং তার মাধ্যমে পােপের স্থলে স্বীয় একনায়কত্ব শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা। তার সমস্ত সংস্কারের মূলে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই নিহিত ছিল; নীতিগত পরিবর্তন তথা ধর্ম সংস্কারের কোন আন্তরিক পরিকল্পনা তার ছিল না। এ কারণেই তার কতগুলাে ব্যবস্থা রিফরমেশনের অনুকূলে (অবশ্য ক্র্যানমারের প্রভাবে) হলেও, অন্যগুলাে এর ঘাের বিরােধী ছিল।
অষ্টম হেনরীর ধর্মীয় নীতির সাফল্যের মূলে নিহিত ছিল রেনেসাঁর প্রভাব, নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার বিকাশ এবং লুথারীয় মতবাদ প্রচারের ফলে ইংল্যান্ডের জনসাধারনের মধ্যে জাগ্রত হওয়া চার্চকে সংশােধিত এবং রােমের প্রভাবমুক্ত করতে উৎসাহ। পোপ ও রাজার বিবাদের সময় টিনডেলের বাইবেল এবং ওয়াইক্লিফ, লুথার প্রভৃতি সংস্কার প্রবন্ধাদি অবিরত প্রকাশিত ও সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল। কিছু বাধা অবশ্য হেনরীর স দেখা দিয়েছিল; যথা- মঠপক্ষীয়গণ একটি ক্ষুদ্র বিদ্রোহ করে; আয়ারল্যান্ড সাধ্যমত রাজাকে বাধা দেয়; ফ্লান্ডার্সের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট হয় দেখে ব্যবসায়ীগণও অসন্তুষ্ট হয়। কিন্তু জনমতের অধিকাংশই হেনরীর সপক্ষে থাকায় হেনরী সহজে এ সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হন। ফিসার, স্যার থমাস মোর প্রমুখ ধর্মপ্রাণ প্রাচীনপন্থী ব্যক্তি হেনরীর আদেশে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। হেনরীকে বহিষ্কৃত ঘােষণা করে পােপ হেনরীর প্রচেষ্টায় সাধ্যমত বাধা দিয়েছিলেন, কিন্তু হেনরী ফ্রান্সের ফ্রান্সিসের সাথে সন্ধি করায়, পােপের দক্ষিণ হস্ত সম্রাট চার্লস হেনরীর বিরােধিতা করতে পারেননি। বিশেষত চার্লস তখন তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। সুতরাং হেনরীকে বাহির বা ভেতর থেকে বিশেষ কোন বাধা পেতে হয়নি। হেনরীর সাফল্যের অন্যতম কারণ এ ছিল যে, তিনি সাধারণের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর হস্তক্ষেপ করেননি। ইংল্যান্ডের অধিকাংশ লােক পােপবিরােধী হওয়া সত্ত্বেও তখন পর্যন্ত প্রােটেস্টান্ট মনােভাবাপন্ন হয়ে ওঠেনি। তারা ক্যাথলিক ধর্মমতেই বিশ্বাসী ছিল। হেনরীও তাদের এ বিশ্বাসের ওপর হস্তক্ষেপ করেননি। এ সকল কারণে দ্বিতীয় হেনরীর শাসনকালে চার্চের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করায় যেরূপ প্রতিবাদ উঠেছিল, অষ্টম হেনরীর ক্ষেত্রে তা হয়নি।
অষ্টম হেনরীর স্বরাষ্ট্র নীতি
ব্রিটেনে কল্যাণকর স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তন করাই অষ্টম হেনরীর স্বরাষ্ট্র নীতির মূল লক্ষ্য ছিল। পিতা সপ্তম হেনরীর প্রদত্ত পরিপূর্ণ রাজকোষ এবং স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা তার হাতে অমােঘ যন্ত্রের ন্যায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। হেনরী পার্লামেন্টকে বিশেষ অনুগত সংস্থায় পরিণত করেছিলেন। পার্লামেন্ট ছিল তার হাতের যন্ত্র। তার যে আইন অনুমোদন করানোর প্রয়োজন হতো পার্লামেন্ট তাই অনুমোদন করত। আর এর কারণ ছিল এই যে, তার আমলের পার্লামেন্ট ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লােকদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। উক্ত সম্প্রদায়ের উত্থান ও পতন টিউডর রাজবংশের (অষ্টম হেনরী যে রাজবংশের রাজা) সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল। সুতরাং তারা নিজেদের স্বার্থেই রাজাকে সমর্থন করতে বাধ্য ছিল। দ্বিতীয়ত, বড় বড় মঠ উচ্ছেদ করার ফলে এবং মিথ্যা রাজদ্রোহের অভিযােগে বহু ধর্মযাজকের প্রাণনাশ ঘটায় পার্লামেন্টের লর্ডসভার ৩৬টি ধর্মাধ্যক্ষের পদ শূন্য হয়। হেনরী সে সকল পদে সাধারণ অভিজাত সদস্য নিয়ােগ করেন। রাজার এ সকল মনােনীত সদস্যগণ পার্লামেন্টে গিয়ে সব বিষয়ে রাজারই অনুগত হয়ে চলতেন। তৃতীয়ত, হেনরী কমন্সসভায় নিজের দলকে শক্তিশালী করার জন্য কয়েকটি উপনগর সৃষ্টি করে সে সকল স্থান থেকে নিজেই কিংবা নিজের দলের কোন লর্ডের মারফত পার্লামেন্টের সদস্য নিয়ােগ করতেন। সুতরাং পার্লামেন্ট ছিল অতিশয় রাজভক্ত। এটি রাজার স্বেচ্ছাচারী কার্যাবলিকে সমর্থন ও পালন করত। হেনরীও স্বীয় স্বার্থের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে পার্লামেন্টকে তার ক্রীড়নক যন্ত্রে পরিণত করেন এবং তার দ্বারা রাজশক্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি অবশ্য পার্লামেন্টের বিধিসঙ্গত অধিকারকে কখনও অগ্রাহ্য করেননি। তার নীতি ছিল পার্লামেন্টকে কৌশলে সন্তুষ্ট রেখে তার অভীষ্ট সাধনের যন্ত্রে পরিণত করা । পিতা সপ্তম হেনরীর মত অষ্টম হেনরীও বিভিন্ন উপায়ে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাজতন্ত্রের ভিত্তি অর্থবল বৃদ্ধি করেন। তিনি ইংল্যান্ডীয় গির্জা থেকে পােপের আয় এবং মঠ সম্পত্তি করায়ত্ত করে বিপুল অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। এছাড়া, তিনি বাধ্যতামূলক ঋণ (Forced Loan) ও প্রীতি উপহার বা নজরানা (Benevolence) আদায় করে এবং মুদ্রামানের পরিবর্তন করে অনেক অর্থ সংগ্রহ করেন।
অত্যন্ত ক্ষমতাপ্রিয় ও শক্তিশালী ছিলেন বলে হেনরীর কার্যপদ্ধতি স্বভাবতই স্বেচ্ছাচারমূলক ছিল। তার কার্য বা নীতির বিরুদ্ধাচারীকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে তিনি কুণ্ঠাবােধ করতেন না। যারা তার বিরুদ্ধাচরণ বা সমালােচনা বিরােধী মতাবলম্বীদের করত বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ড ছিল তাদের চরম পরিণতি। এ উদ্দেশ্যে প্রতি হেনরীর নীতি তিনি ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে একটি রাজদ্রোহিতার আইন পাস করেন। এ আইন এবং ছয়দফা আইনের কবলে পড়ে বহু গণ্যমান্য ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। তার এরূপ নিধন যজ্ঞের প্রধান মুখপাত্র বা সহায় ছিলেন থমাস ক্রমওয়েল। ক্রমওয়েল স্বৈরতন্ত্রকেই একমাত্র উপযুক্ত শাসনব্যবস্থা বলে মনে করতেন। এরূপে অষ্টম হেনরীর রাজত্বকালে টিউডর স্বৈরতন্ত্র চরম পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী হলেও হেনরী সযত্নে কুখ্যাতি এড়িয়ে চলতেন। এ জন্য তিনি তার স্বেচ্ছাচারী কার্যাবলির সমস্ত দায়িত্ব মন্ত্রীদের কাঁধে চাপিয়ে দিতেন এবং যখন তাদের হেনরী ও তার মন্ত্রিগণ প্রয়ােজন শেষ হতাে, তখন তাদের বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্ততবােধ করতেন না। তার অতি বিশ্বস্ত ও অনুগত সেবক থমাস উল্সী ও থমাস ক্রমওয়েলকে তিনি প্রয়ােজন শেষে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বিসর্জন দেন।
হেনরী ইংল্যান্ডের চার্চকে স্বাধীন জাতীয় চার্চে পরিণত করেন এবং বিভিন্ন দেশহিতকর কার্য সম্পাদন করে নিজেকে জাতীয় স্বার্থের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । তিনি জাহাজ নির্মাণ কাজে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন এবং তার দ্বারাই ব্রিটিশ নৌ বাহিনীর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। তিনি যুদ্ধ-জাহাজের নির্মাণ-কৌশলের উন্নতি বিধান করে সেগুলােকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র বহনের উপযােগী করেছিলেন। তার উদ্ভাবিত উন্নত যুদ্ধ-জাহাজের জন্যই পরবর্তীকালে স্পেনীয় আর্মাডাকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল। এ সমস্ত দেশহিতকর কার্য ছাড়াও হেনরী মঠ সম্পত্তির কিছু অংশ দিয়ে জনহিতকর প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন। হেনরী ঐক্যবদ্ধ গ্রেট ব্রিটেন কল্পনা করতেন এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জকে মিলিত করার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন। তার শাসনকালে ওয়েলস সম্পূর্ণরূপে ইংলিশ পার্লামেন্টের অধীন হয়। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে হেনরী ওয়েলসকে ১৫টি কাউন্টিতে বিভক্ত করে সেখানে ইংলিশ আইন-কানুন প্রবর্তন করেন। সেই বছরই তিনি আয়ারল্যান্ডে প্রাধান্য স্থাপন করে ‘আয়ারল্যান্ডের রাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন। সুতরাং অষ্টম হেনরী একজন পরিপূর্ণ স্বেচ্ছাচারী রাজা হলেও তার স্বরাষ্ট্র নীতি দেশের পক্ষে কল্যাণকর ছিল। তার স্বরাষ্ট্র নীতির সাফল্যের পশ্চাতে এই কারণ ছিল যে, তখনও জনগণের অন্তর হতে গােলাপ যুদ্ধের বিভীষিকা কাটেনি বলে তারা শক্তিশালী শাসক চেয়েছিল। তিনিও অসাধারণ শক্তিশালী ছিলেন। সর্বোপরি হেনরী নিজের ও দেশের কাম্য সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ও সচেতন ছিলেন। তাই তার পেছনে জাতীয় সমর্থন ছিল এবং তার নীতি সফল হয়েছিল।
অষ্টম হেনরীর বৈবাহিক জীবন, উত্তরাধিকার ব্যবস্থা ও মৃত্যু
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আর্থারের বিধবা পত্নী ক্যাথারিন ছিলেন অষ্টম হেনরীর প্রথমা পত্নী; তার একমাত্র সন্তান মেরী। ১৫৩৩ হতে ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হেনরী দ্বিতীয় পত্নী অ্যানবােলিনের সাথে বিবাহিত জীবনযাপন করেন। তারই কন্যা এলিজাবেথ। অ্যানবােলিনের ঔদ্ধত্যে ক্রুদ্ধ হয়ে হেনরী তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে পরদিন জেন সেমোউর নামে এক মহিলাকে বিবাহ করেন। জেন সেমোউরের গর্ভে ১৫৩৭ সালে এডওয়ার্ড নামে এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। পুত্রের জন্মের অল্পকাল পরেই মাতার মৃত্যু হয়। থমাস ক্রমওয়েলের পরামর্শে তখন হেনরী ১৫৪০ সালে অ্যান অব ক্লিভস্ নামে পরিচিতা এক জার্মান রাজকুমারীকে বিবাহ করেন। এ অ্যানের রূপহীনতায় বিরক্ত হয়ে হেনরী তার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। ক্রমওয়েল হেনরীকে সাধ্যমত সব বিষয়ে সাহায্য করতেন। কিন্তু হেনরী কার্যোদ্ধার হবার পর কারও সম্মান রেখে চলতেন না। সুতরাং অনেকের মত তাকেও দুর্ভাগ্যের কবলে পড়তে হয়। অ্যানের রূপহীনতার জন্য এ বিবাহ মনােমত না হওয়ায় হেনরী তাকে (ক্রমওয়েলকে) রাজার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে অভিযুক্ত করে সেই ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এভাবে যার মাধ্যমে হেনরী তার বৈবাহিক জীবনকে কণ্টকমুক্ত করতে ধর্মীয় সংস্কার আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাকেই তিনি তার বৈবাহিক জীবনের নতুন আরেক সমস্যার কারণে “হত্যা” করলেন। হেনরীর পরবর্তী পত্নী ক্যাথারিন হাওয়ার্ড। অল্পকালের মধ্যে হেনরী তাকেও অবিশ্বস্ততার অভিযােগে প্রাণদন্ডে দণ্ডিত করেন। তারপর হেনরী ক্যাথারিন পার নামে আর একজন মহিলাকে বিবাহ করেন। তিনিই হেনরীর সর্বশেষ ষষ্ঠ পত্নী। এ পত্নী হেনরীর মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন।
১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘উত্তরাধিকার আইন’ (Act of Succession) দ্বারা স্থির হয়েছিল যে, হেনরীর মৃত্যুর পর অ্যানবােলিনের সন্তান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে হেনরী পার্লামেন্টের অনুমােদনক্রমে একটি উইল সম্পাদন করেন। তাতে স্থির হয় যে, তার মৃত্যুর পর তার পুত্র এডওয়ার্ড রাজা হবেন; এডওয়ার্ড নিঃসন্তান হলে ক্যাথারিনের কন্যা মেরী এবং তারপর অ্যানবোলিনের কন্যা এলিজাবেথ সিংহাসনের অধিকারিণী হবেন; এ তিনজনের কারও সন্তানাদি না হলে হেনরীর কনিষ্ঠা ভগিনী মেরীর সন্তানগণ সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করবেন। ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অষ্টম হেনরী শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তার চিরবিদায়ের সময় আসন্ন। তা বুঝতে পেরে তিনি আর্চবিশপ ক্র্যানমারকে ডেকে পাঠান এবং তার হাতে হাত রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অষ্টম হেনরীর চরিত্র ও কৃতিত্ব
টিউডর বংশের দ্বিতীয় রাজা অষ্টম হেনরী দৈহিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে শক্তিশালী ছিলেন। তার দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্য বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল। তিনি আর এ দীর্ঘ দেহের অধিকারী ছিলেন এবং সকল পুরুষােচিত এবং মানবিক গুণাবলিতেও ভূষিত ছিলেন। তিনি নিজে বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এবং প্রতিভাবান লােকদের সাহচর্য পছন্দ করতেন। তিনি বিদ্বান ছিলেন, একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ এবং ধর্মতত্ত্বে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি ধর্মানুরাগীও ছিলেন এবং নিয়মিতভাবে গির্জার প্রার্থনায় যােগদান করতেন। শিকার ও টেনিস খেলাতেও তার সমান উৎসাহ ছিল। তিনি জাঁকজমক আমােদ-প্রমােদ ভালোবাসতেন, কিন্তু সে জন্য কর্তব্যকর্মে কখনও অবহেলা প্রদর্শন করতেন না। তার একটি বিশেষ গুণ ছিল এই যে, তিনি সহজেই উপযুক্ত লােক বাছাই করে তাদের সথাযথভাবে কাজে লাগাতে এবং তাদের দ্বারা কার্যোদ্ধার করতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তার কিছু দোষ ছিল, যেমন তিনি অহঙ্কারী ও অত্যন্ত ক্ষমতাপ্রিয় ছিলেন। স্বার্থপরতা ছিল তার চরিত্রের প্রধান দোষ। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিনি বিশ্বস্ত ও অনুগত ব্যক্তিদেরও অপসারিত করতে তিনি দ্বিধাবােধ করতেন না। তার আমলে টিউডর স্বৈরতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। কিন্তু তাসত্ত্বেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। কারণ, তিনি যেমন তেজস্বী, প্রভুত্বকামী ও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন, তেমনি একজন পরিপূর্ণ ইংরেজও ছিলেন। তিনি তার সাহসিকতাপূর্ণ ও বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি এবং বিভিন্ন দেশহিতকর ও জাতিগঠনমূলক কার্যের দ্বারা এবং সর্বোপরি ইংল্যান্ডের চার্চকে স্বাধীন জাতীয় চার্চে পরিণত করে ইংলিশ জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ ও বাস্তবায়িত করেছিলেন। ইংরেজ জাতির স্বভাব, মনােভাব এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল ও সচেতন ছিলেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করে স্বার্থ সিদ্ধ করেন। এ কারণে এবং তার জাঁকজমকপূর্ণ জীবন এবং সরল, উদার ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য তিনি আজীবন জনপ্রিয় ছিলেন। তার যুগান্তকারী কার্যসমূহের দ্বারা তিনি তার রাজত্বকালকে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে সংযােজিত করেছেন। তার রাজত্বকাল শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ ছিল।
টিউডর রাজাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও দুর্ধর্ষ রাজা ছিলেন অষ্টম হেনরী। তার হাতে টিউডর স্বৈরতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। তিনি এরূপ শক্তিশালী ও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন যে, লােকে বলত, “হেনরী রাজা, পরিপূর্ণ রাজা এবং রাজা ছাড়া আর কিছুই নন।” তার ইচ্ছাই ছিল আইন। মন্ত্রিমণ্ডলী ও পার্লামেন্ট তার ইচ্ছানুসারেই কাজ করত। তার নীতি বা কাজের বিরুদ্ধাচারীকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে তিনি কুণ্ঠাবােধ করতেন না। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী হলেও, অষ্টম হেনরী ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একজন কৃতী শাসক হিসেবে পরিচিত। কারণ, তিনি ছিলেন জাতীয় অর্থের রক্ষক। ইংল্যান্ডের চার্চকে রােমের চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তিনি একে স্বাধীন জাতীয় চার্চে পরিণত করেন এবং তার মাধ্যমে ইংরেজ জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই বাস্তবায়িত করেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় এবং অক্ষয়-কীর্তি। পিতা সপ্তম হেনরীর ন্যায় অষ্টম হেনরীও বিভিন্ন উপায়ে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাজতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেন। পার্লামেন্টের বিধিসঙ্গত অধিকারকে অগ্রাহ্য করে তিনি এটাকে সুকৌশলে অনুগত সংস্থায় পরিণত করেন। বাজেয়াপ্তকৃত মঠ সম্পত্তির দ্বারা তিনি অনেক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং উপকূল অঞ্চলের প্রতিরক্ষার জন্য দুর্গ ও নৌবহর নির্মাণ করেন। তিনি জাহাজ নির্মাণ কার্যে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন এবং তার দ্বারাই ব্রিটিশ নৌবহরের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। তিনি ইংল্যান্ডের নৌবহরেরও যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন এবং তার দ্বারাই ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ভিত্তি স্থাপিত হয়। তিনি যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ কৌশলের উন্নতি বিধান করে সেগুলােকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র বহনের উপযােগী করেন।
তিনি ঐক্যবদ্ধ গ্রেট ব্রিটেনেরও কল্পনা করতেন। এ লক্ষ্যে তিনি ওয়েলসকে সম্পূর্ণরূপে ইংলিশ পার্লামেন্টের অধীনে আনয়ন করেন এবং আয়ারল্যান্ডে প্রাধান্য স্থাপন করে ‘আয়ারল্যান্ডের রাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন। বৈদেশিক ক্ষেত্রেও অষ্টম হেনরী বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির দ্বারা ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের প্রভাব ও গৌরব বিস্তার করতে সক্ষম হন। তার বলিষ্ঠ নীতির জন্যই ইউরােপীয় রাজারা ইংল্যান্ডের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার মন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টা থমাস উল্সীর উদ্ভাবিত শক্তিসাম্য নীতির যথাযথ প্রয়ােগ দ্বারা তিনি ইংল্যান্ডকে ইউরােপীয় রাজনীতির নিয়ন্তাস্বরূপ করে তুলেছিলেন। ইতােপূর্বে আর কখনও ইউরােপের রাজনীতিতে ইংল্যান্ড এরূপ মর্যাদার অধিকারী হতে পারেনি। এ সকল গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনের জন্য অষ্টম হেনরী ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম কৃতী শাসক ও জনপ্রিয় রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
তথ্যসূত্র
- আধুনিক ইংল্যান্ডের ইতিহাস (১৪৮৫ থেকে ১৯৩৬ খ্রিঃ পর্যন্ত), তানজিমুল ইসলাম, বুক চয়েস, ঢাকা, ২০১৮, পৃ. ৫০-৮১
Leave a Reply