নেতাজী সুভাষের মুক্তিসংগ্রাম ও আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস

(লেখাটি বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ও সাধুভাষায় রচিত “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস” গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৮ম পর্বের “নেতাজী সুভাষের মুক্তিসংগ্রাম, আজাদ হিন্দ ফৌজের গৌরব কাহিনী” অংশের চলিতরূপ মাত্র, সমস্ত তথ্যসূত্র লেখাটির ভেতরেই রয়েছে।)

ভূমিকা

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তী নায়কে পরিণত হয়েছেন এবং তার কাহিনী আজ ঘরে ঘরে প্রচারিত। তার নেতৃত্বে ভারতের বাইরে আজাদ হিন্দ সরকার গঠন এবং সেই সরকারের পক্ষ থেকে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও আজাদ হিন্দ ফৌজ কর্তৃক হাতে-কলমে সশস্ত্র সংগ্রাম কিংবা ভারত-ব্ৰহ্ম সীমান্ত-অঞ্চলে মুক্তি অভিযান ভারতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। মহাযুদ্ধের শেষে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন একমাত্র গান্ধীজী বা কংগ্রেসের জন্যই সম্ভব হয়নি, সেই স্বাধীনতার মূলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র ও আজাদ হিন্দ ফৌজের দানও অসামান্য। অবশ্য জার্মানী বা জাপানের মত ফ্যাসিস্ট শক্তিবর্গের সহায়তায় ভারতকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার এই দুঃসাহসিক চেষ্টা নিয়ে আজও রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের শেষ হয়নি। তবুও একথা স্বীকার করতেই হবে যে, নেতাজী সুভাষচন্দ্রের অতুলনীয় দেশপ্রেম, তার আশ্চর্য সংগঠনশক্তি এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার তীব্র ঘৃণা, আর অবিশ্বাস্য সাহস, ধৈর্য ও পরিশ্রম তার নেতৃত্বকে এমন এক মহিমান্বিত রূপ দিয়েছে যে, ভারতের জনসাধারণের কাছে আজও তিনি মত্যুহীন নায়কের মত বন্দনীয়। সেই সঙ্গে একথাও উল্লেখ করতে হবে যে, তিনি কখনও জার্মানী বা জাপানের হাতের পতুল ছিলেন না এবং ভারতের স্বাধীনতার বিনিময়ে অক্ষশক্তিবর্গের সঙ্গে কোন প্রকার আপোস-মীমাংসায়ও তিনি রাজী ছিলেন না। যুদ্ধ চলাকালীন তার বিরুদ্ধে ষত কুৎসাই রটনা হয়ে থাকুক না কেন, মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে প্রকাশিত বিভিন্ন পুস্তক, দলিল ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিবৃতি থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি অখণ্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যই সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং বৃটিশ শক্তির বদলে অন্য কোন বৈদেশিক শক্তির নিকট মাথা নত করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি সত্য সত্যই ‘অপোসহীন বিরামহীন’ যোদ্ধা ছিলেন।

জার্মানী গমন ও তৎপরতা

১৯৪১ সালের ১৮ই জানুয়ারী গভীর রাত্রে ( রাত্রি ১টা ১৫মিঃ) সুভাষচন্দ্র তার ভ্রাতুপত্র শ্রীশিশিরকুমার বসুর সহায়তায় এলগিন রোডের বাসগৃহ থেকে গোপনে এবং ছদ্মবেশে কলকাতা ত্যাগ করে পেশোয়ার অভিমুখে রওনা হন এবং সেখান থেকে প্রধানতঃ শ্রী ভগতরাম তলোয়ারের সাহায্যে ও সাহচর্যে প্রকাণ্ড বিপদের ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত দুর্গম পথ অতিক্রমপূর্বক কাবুলে গিয়ে উপস্থিত হন। সেদিনের যুদ্ধরত ভারতের গোয়েন্দাচকের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি যে সাফল্যের সঙ্গে ভারত ত্যাগ করে আফগানিস্তানে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন, সেটাও এক অবিশ্বাস্য কাহিনীর মত। বলাই বাহুল্য যে, তার কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর, সহকর্মী ও বন্ধুর অত্যন্ত সতর্ক উদ্যম এবং সাহসিক চেষ্টার ফলেই এভাবে তার পক্ষে কাবুলে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয়েছিল।

কাবুল থেকে তিনি ইতালীয় রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় আফগানিস্তান পার হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছলেন এবং ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে মস্কো থেকে তিনি জার্মানীতে বা বার্লিনে উপস্থিত হলেন। সেখানে কয়েকজন ভারতীয় দেশপ্রেমিক-যেমন নাম্বিয়ার, গণপুলে, আবিদ হাসান, ডঃ গিরিজা মুখার্জি, প্রমোদ সেনগুপ্ত, ডাঃ সুলতান, এম. ভি. রাও, ডঃ মল্লিক, কান্তরাম প্রভৃতি তার সঙ্গী ও সহায়ক হলেন। সেখানে গঠিত হলো আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ, ২রা নভেম্বর, ১৯৪১, এই সঙ্ঘের প্রথম বৈঠকে তিনটি অবিস্মরণীয় কথার জন্ম হলো – জয়হিন্দ, আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ, আর নেতাজী – যে কথাগুলি পরবর্তীকালের ভারতবর্ষে যেন বৈপ্লবিক আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। আফ্রিকার যুদ্ধে যে সমস্ত ভারতীয় সৈনিক জেনারেল রোমেলের হাতে বন্দী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ১০ হাজার বন্দী সৈন্যকে জার্মানীতে আনা হয়েছিল। সেই বন্দী ভারতীয় সৈন্যদের ভিতর থেকেই সুভাষচন্দ্রের চেষ্টায় প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সংখ্যায় তারা ছিলেন সামান্য ১৫ জন মাত্র। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের অক্লান্ত চেষ্টায় এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে বন্দীদের আগ্রহের জন্য মাত্র এক বছরেই তাদের সংখ্যা দাঁড়ালো সাড়ে তিন হাজারে। কিন্তু অর্থাভাবের জন্য এই সংখ্যা আর বাড়ানো গেল না। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে জার্মান কর্তৃপক্ষের এই মর্মে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল যে, জার্মান সরকার আপাততঃ টাকাটা ঋণ হিসাবে দেবেন এবং পরে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে সমস্ত টাকাটা পরিশোধ করে দেওয়া হবে। (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ (তৃতীয় খণ্ড), নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবতী, পৃষ্ঠা-৩১)।

যদিও ১৯৪১ সালের মার্চ থেকে ১৯৪৩ সালের ফেরুয়ারী মাস পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র জার্মানীতে বা বার্লিনে অবস্থান করেছিলেন, তবু যুদ্ধের পরবর্তীকালে প্রকাশিত দলিলপত্র ও পুস্তকাদিতে দেখা যায় যে, সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে নাৎসী নেতা ও নাৎসী সরকারের তেমন কোন সদ্ভাব ছিল না, বা তেমন কোন আন্তরিক সহায়তাও তিনি জার্মানীর কাছ থেকে পাননি। এর প্রথম কারণ ছিল এই যে, নাৎসী জার্মানীরা অন্য কোন দেশের – বিশেষতঃ ভারতের মত পরাধীন দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতো না। দ্বিতীয়ত সুভাষচন্দ্র কোন ক্রমেই সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করতে সম্মত হননি এবং তার বহু বেতার ভাষণের মধ্যে কোথাও তিনি রাশিয়ার নিন্দা করেননি কিংবা হিটলার কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণ সমর্থনও করেননি। ১৯৪১ সালের মে মাসে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফন রিবেন্ট্রপের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল বটে, কিন্তু সেই সাক্ষাতে জার্মানী কর্তৃক ভারতের স্বাধীনতায় সাহায্য দানের কথা দূরে থাকুক, রিবেন্ট্রপ সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার পর্যন্ত করেননি। হিটলারের সঙ্গেও সুভাষচন্দ্রের মাত্র একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল – ১৯৪২ সালের ২৯শে মে। এই প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, হিটলার তার আত্মজীবনীমূলক পুস্তক মেইন ক্যাম্ফে (Mein Kampf) ভারতবর্ষ সম্পর্কে যে সমস্ত অপমানজনক মন্তব্য করেছিলেন, সুভাষচন্দ্র সেই বিষয়ে হিটলারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, কিন্তু হিটলার সেই সমস্ত কথার জবাব দিতে অস্বীকার করেন। জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরের ভারতীয় শাখার একজন বিশিষ্ট অফিসার ডঃ আলেকজান্ডার ভার্থ এই সাক্ষাৎকারের কথা একটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে মন্তব্য করেছেন যে, হিটলারের কাছ থেকে তার প্রশ্নের কোন জবাব না পেয়ে সুভাষচন্দ্র পুনরায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, যুদ্ধের পর ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কোন গ্যারেন্টি দিয়ে তিনি (হিটলার) কোন ঘোষণা দিতে রাজী আছেন কিনা। এই প্রশ্নের জবাবে হিটলার সোজা বলে দিলেন যে, আগামী ১৫০ বছরের মধ্যেও ভারতবর্ষ স্বাধীনতালাভের যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না।

হিটলারের এই অসম্মানজনক মন্তব্যের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং হিটলার তা নিঃশব্দে শুনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে হিটলার ও জার্মানীর কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র হতাশই হয়েছিলেন বেশী এবং পরে যখন তিনি জাপানে গেলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো মুখে খুব সমর্থন ও সহানুভুতি দেখালেন বটে, কিন্তু কাজের বেলা সুভাষচন্দ্র বৈষয়িক ও সামরিক সাহায্য খুব সামান্যই পেয়েছিলেন। তবুও নেতাজী সুভাষ আজাদ হিন্দ সরকার ও ফৌজের গঠনে যে অসামান্য কৃতিত্ব, সংগঠনশক্তি এবং অবর্ণনীয় সাহস দেখিয়েছিলেন, সেটা সম্পূর্ণরপে তার নিজেরই প্রতিভার গুণে, জাপানীদের কোন সাহায্যের জন্য নয়।

১৯৭৩ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বার্লিনের হ্যামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কীয় গবেষণা বিভাগের প্রধান ডঃ এম. সি. ওয়াইডম্যান কলকাতার এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন যে, সম্প্রতি জার্মানী গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে (জি. ডি. আর.) সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে। সেই গবেষণা থেকে জানা যায় যে, নেতাজী সুভাষচন্দ্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার জন্যই দেশত্যাগপূর্বক সদর জার্মানীতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোন দিনই সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল হতে চাননি। বরং নাৎসী সাম্রাজ্যবাদীরা সম্পূর্ণরূপে তাদের নিজেদের স্বার্থে নেতাজীকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। ডঃ ওয়াইডম্যান আরও প্রকাশ করেন যে, জার্মান সাম্রাজ্যবাদ নেতাজী সুভাষচন্দ্র এবং তার আজাদ হিন্দ ফৌজকে (বার্লিনে গঠিত) সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের সময় ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভারতীয় সৈন্যেরা দৃঢ়তার সঙ্গে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেই ‘অপরাধেই’ জার্মানীতে ভারতীয় সৈন্যদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়েছিল।

হিটলার ও জার্মানী সম্পর্কে মোহমুক্তির পর সুভাষচন্দ্র ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। বার্লিন থেকে তিনি তাকিয়ে দেখলেন সদর প্রাচ্যের দিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে তখন জাপান অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং ব্রহ্মদেশ বা বার্মাসহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বৃটিশ ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত এবং জাপানের করতলগত। সুতরাং যদি জাপানের সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া যায়, তবে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন ব্রহ্মদেশ থেকে তিনি অনায়াসে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চালাতে ও ভারতে প্রবেশ করতে পারবেন, যেটা ৬ হাজার মাইল দূরবর্তী জার্মানী থেকে সম্ভব নয়। বিশেষতঃ তখন স্ট্যালিনগ্রাদ ও ককেশাসের যুদ্ধে জার্মানী ছিল বিপর্যয়ের মুখে।

জাপানে গমন ও আজাদ হিন্দ সরকার গঠন

ঠিক সেই সময় একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ দেখা দিল। মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু তখন জাপানে। ১৯১২ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন তিনি ২৬ বছরের যুবক, তখন দিল্লীতে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড হাডিঞ্জকে হত্যা করার জন্য তিনি বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন এবং তারপর আত্মগোপন করে ১৯১৫ সালে জাপানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং বৃটিশদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য জাপানী নাগরিকত্ব ও একটি জাপানী মহিলার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে এই অগ্রগণ্য নায়ক জাপানে এসেও নিরলস বসে রইলেন না। ভারতের বন্ধন মোচনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি বৃটেনের বিরুদ্ধে “নিউ এশিয়া” নামে একটি সাময়িকপত্র প্রকাশ করলেন এবং ১৯২৪ সালে ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ স্থাপন করলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই লীগ থেকেই ইতিহাস বিখ্যাত আই.এন.এ. বা আজাদ হিন্দফৌজের উদ্ভব হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক এবং সিঙ্গাপুরের পতনের পর জাপানীদের হাতে বন্দী ৫০ হাজার ভারতীয় সৈন্যের মধ্য থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে উঠল। এই সংগঠনের প্রথম কৃতিত্ব বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর। কিন্তু তখন তার স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। সতরাং তিনি অনুভব করলেন যে, ভারতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তির দায়িত্ব গ্রহণের প্রয়োজন। সুতরাং এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি আমন্ত্রণ জানালেন। টোকিওস্থিত জার্মান রাষ্ট্রদূতের মারফৎ বার্লিনস্থিত জাপানী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করলেন। সুভাষচন্দ্র সোৎসাহে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।

৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৩, জার্মানীর কিয়েল বন্দর থেকে সুভাষচন্দ্র সাবমেরিন যোগে যাত্রা করলেন সেই সুন্দর জাপান অভিমুখে, সঙ্গে একমাত্র সহকারী আবিদ হাসান। জার্মানীতে যে সংগঠন তিনি গড়ে তুলেছিলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে সেটা পরিত্যাগ করতে হলো। কারণ, কোন গত্যন্তর ছিল না। পুরো তিন মাস তিনি সাবমেরিনে কাটালেন। এই বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় অজস্র অসুবিধারও সম্মুখীন হয়েছিলেন স্বল্পায়তন এই সাবমেরিনে। পরে আফ্রিকার উপকুলবর্তী মাদাগাস্কার দ্বীপের কাছে তিনি পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী জার্মান সাবমেরিন বদল করে জাপানী সাবমেরিনে আরোহণ করলেন এবং ৬ই মে, ১৯৪৩ তারিখে তিনি সুমাত্রার সাবান বন্দরে পৌঁছলেন এবং সেখান থেকে বিমানযোগে তিনি টোকিওতে উপস্থিত হলেন ১৬ই মে। রূপকথার রাজপুত্রের মত তিনি যেন ভারতীয় স্বাধীনতার রাজকন্যাকে উদ্ধারের জন্য সাত-সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এলেন। আধুনিক ভারতে এই কাহিনীর তুলনা নেই।

ভারতীয় স্বাধীনতার দুই মহান যোদ্ধা রাসবিহারী বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হলো টোকিওর বিখ্যাত ইম্পিয়ীয়েল হোটেলে এবং দুই জনেই ভাবাবেগের দ্বারা উদ্বেলিত হয়েছিলেন, পরামর্শ করলেন তারা আসন্ন কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে। ১০ই জুন এবং ১৪ই জুন সুভাষচন্দ্র দেখা করলেন জেনারেল তেজোর সঙ্গে এবং তোজো আকৃষ্ট হলেন সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিত্বের প্রতি। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং এই প্রতিশ্রুতির কথা তিনি জাপান পার্লামেন্টে ঘোষণাও করলেন। (আমি সুভাষ বলছি (তৃতীয় খণ্ড)—শ্রীশৈলেশ দে, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯)।

৪ঠা জুলাই, ১৯৪৩ তারিখটি এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয়। কারণ ওই দিন সিঙ্গাপুরের এক প্রকাশ্য জনসভায় বিপুল উৎসাহ ও উত্তেজনার মধ্যে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তার এত দিনকার গঠিত ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ এবং আই. এন. এ’র সর্বময় কতৃত্ব তুলে দিলেন সুভাষচন্দ্রের হাতে এবং বক্তৃতার শেষে তিনি ঘোষণা করলেন-‘সুভাষ তারুণ্যের প্রতীক। ভারতবর্ষ বা পথিবীর কোথাও তার নতুন করে পরিচয় দেওয়ার মত কিছু নেই। তার পরিচয় তিনি নিজেই। এখন থেকে তিনিই আমাদের নেতা। আমরা সবাই তার আজ্ঞাবাহী সৈনিক মাত্র।‘ প্রকাশ্য জনসভায় রাসবিহারী বসুর ওটাই ছিল জীবনের শেষ ভাষণ। সুভাষচন্দ্র অভিভূত হলেন এবং রাসবিহারী বসুর প্রতি তিনি তার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রীতি নেবেদন করলেন। আর জন্মভুমির শৃঙ্খল মোচনের জন্য সমস্ত ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেন।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের শীর্ষ সমর নায়ক জে.কে. ভোসলে নেতাজীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন। বলা বাহুল্য যে, সেদিন সিঙ্গাপুরের ভারতীয়-অভারতীয় সমগ্র জনতার পক্ষ থেকে সুভাষচন্দ্র অপূর্ব সংবর্ধনা এবং সমর্থন লাভ করলেন এবং পরদিন ৫ই জুলাই সশস্ত্র বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করলেন। সেদিন থেকে শুরু হলো নতুন ইতিহাস এবং নেতাজীরূপে সুভাষচন্দ্রের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠা। সুভাষচন্দ্র এবং তার সহকর্মীগণ অদম্য উৎসাহে অগ্রসর হলেন পুরাতন সংগঠনের সংস্কার ও নতুন করে গড়ে তোলার জন্য। তিনি আগেই জনমভায় ঘোষণা করেছিলেন যে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য সর্বাগ্রে চাই একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকার বা আজাদ হিন্দ সরকার গঠন এবং এই সরকার একটি স্বাধীন সরকার হিসেবে কাজ করবে। (অস্থায়ী সরকার এজন্য যে, ভবিষ্যতে একমাত্র স্বাধীন ভারতের জনগণই স্থায়ী সরকার গঠনের অধিকারী)।

২১শে অক্টোবর, ১৯৪৩ তারিখে ইতিহাসের আর একটি লাল তারিখ। কেননা, ঐদিন প্রতিষ্ঠিত হলো আজাদ হিন্দ সরকার এবং ভারতের বাইরে সেই প্রথম স্বাধীন ভারত সরকার (অস্থায়ী) গঠিত হলো। এই সরকারকে স্বীকৃতি দিলেন জাপান, জার্মানী ও ইতালী এবং তাদের অনুগত কয়েকটি সরকার। আর সদর আয়র্ল্যাণ্ড থেকে অভিনন্দন বার্তা পাঠালেন স্বনামধন্য বিপ্লবী নেতা ডি. ভ্যালেরা। বলা বাহুল্য যে, এই অভিনন্দন-বার্তায় সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ বাহিনী ও সরকারের সর্বাধিনায়করপে নেতাজী উচ্ছসিত জনতার সম্মুখে এই শপথবাক্য উচ্চারণ করলেন – “ভগবানের নামে ভারতবর্ষ এবং আমার ৩৭ কোটি দেশবাসীর মুক্তির জন্য, আমি সুভাষচন্দ্র বসু এই পবিত্র শপথ করছি যে, আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এই সংগ্রাম চালিয়ে যাব।” (আমি সুভাষ বলছি (তৃতীয় খণ্ড)—শ্রীশৈলেশ দে, পৃ. ১২০)। মেয়েরাও পিছনে পড়ে রইলেন না, তারাও দলে দলে এগিয়ে এলেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নানা দেশ থেকে। গঠিত হলো ঝাঁসীর রানী বাহিনী এবং এই বাহিনীর উদ্বোধন হলো ২২শে অক্টোবর। ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন এই বাহিনীর অধিনেত্রী নিযুক্ত হলেন এবং এই বাহিনীর কথা বিদ্যুৎগতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০০।

কিন্তু কাদের নিয়ে সেদিন আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হয়েছিল? নিম্নে সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম উদ্ধত করা গেল –
সুভাষচন্দ্র বসু – রাষ্ট্রনায়ক, প্রধানমন্ত্রী, সমর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন – নারী সংগঠন।
এস. এ. আয়ার – প্রচার সচিব।
লেঃ কর্নেল এ. সি. চ্যাটার্জি — অর্থ।
সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি — কনেল জে. কে. ভোঁসলে, লেঃ কর্নেল আজিজ মহম্মদ, লেঃ কর্নেল ভগৎ, লেঃ কনেল গুলজারা সিং, লেঃ কর্নেল এম. জেড. কিয়ানী, লেঃ কর্নেল এ. ডি. লোগনাথন, লেঃ কর্নেল ঈশান কাদির এবং লেঃ কর্নেল শাহনওয়াজ খান।
এ. এম. সহায় — সেক্রেটারি (মন্ত্রীর সম-মর্যাদা সহ)।
রাসবিহারী বসু-প্রধান উপদেষ্টা।
উপদেষ্টা-করিম গণি, দেবনাথ দাস, ডি. এম. খাঁ, এ ইয়েলাপা, জে. থিবি, সর্দার ঈশ্বর সিং।
এ. এন. সরকার – আইন বিষয়ক উপদেষ্টা।

সেদিন সিঙ্গাপুরের আকাশ-বাতাস জয়হিন্দ ধ্বনিতে এবং ‘নেতাজী জিন্দাবাদ’, আর ‘চলো দিল্লী’ ‘চলো দিল্লী’ আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠল। (আমি সুভাষ বলছি (তৃতীয় খণ্ড)—শ্রীশৈলেশ দে, পৃ. ১২১-২২)। কিন্তু স্বাধীন সরকার পরিচালনা ও সৈন্যবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থ চাই। সেই অর্থ কে দেবে? কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সুভাষচন্দ্রের আবেদনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ধনী-ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোক কিংবা সমাজের সর্বস্তর থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেল। লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি টাকা সংগৃহীত হলো। এক দেশ থেকেই ২৫ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছিল! আজাদ হিন্দ সরকার তাদের নিজেদের ব্যাঙ্কও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজাদ হিন্দ সরকারের নিজস্ব কোন ভূখণ্ড ছিল না, এজন্য জাপানী গবর্নমেন্ট আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ দুটি নেতাজীর হাতে তুলে দিলেন এবং এই দ্বীপ দুটির নতুন নামকরণ হলো শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপ।

ইঙ্গ-মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধ

২৩শে অক্টোবর, ১৯৪৩ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের আর-একটি লাল তারিখ। ঐ দিন আজাদ হিন্দ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু, রাত্রি বারোটা পাঁচ মিনিটের সময় বেতারযোগে বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত-ব্রহ্ম সীমান্তে আক্রমণাত্মক অভিযান সংগঠিত করার জন্য উদ্যোগ নিল এবং ১৯৪৪ সালের জানুয়ারী মাসে নেতাজী সুভাষ তার সদর দপ্তর সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুনে স্থানান্তরিত করলেন — উদ্দেশ্য ইম্ফলের দিকে আক্রমণ। মোট তিনটি ডিভিশন গঠিত হলো এবং প্রত্যেকটি ডিভিসন আবার তিনটি ব্রিগেডে বিভক্ত হলো এবং কয়েকটি ব্রিগেড জাতীয় নেতাদের নামে চিহ্নিত হলো। প্রথম ডিভিসনের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল এম. জেড. কিয়ানী, দ্বিতীয় ডিভিসনের কর্নেল আজিজ আমেদ (পরে শাহ নওয়াজ খান) এবং তৃতীয় ডিভিসনের এন. এস. ভগৎ (পরে জি. আর. নাগর)। এগুলি ছাড়া অন্যান্য কয়েকটি গ্রুপ এবং মেডিক্যাল ইউনিটও ছিল।

ভারতের অভ্যন্তরে বাহিনীর খবরাখবর সংগ্রহ এবং গোয়েন্দাগিরি ও নাশকতামূলক কার্যের জন্য নেতাজী সুভাষ তার বিশ্বস্ত অনুচর, সহকর্মী ও হিতৈষীদের সঙ্গে কিছুটা গোপন যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন এবং কয়েকটি স্থানে গুপ্ত ঘাঁটি ও শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের সাহায্যে সংবাদের আদান-প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এই বিপজ্জনক কার্য করতে গিয়ে কিছু সংখ্যক দেশপ্রেমিক বৃটিশ-ভারতীয় গোয়েন্দাপুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন এবং গোপন বিচারে ও গুপ্তভাবে তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আবার কেউ কেউ আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করেছিল। নেতাজীর মুক্তি অভিযানে সহায়তা করতে গিয়ে যারা ভারতে নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছিলেন, সেই সমস্ত সাহসী দেশপ্রেমিকদের মধ্যে ডাঃ পবিত্র রায়, শ্রীহরিদাস মিত্র এবং তার স্ত্রী বেলা মিত্রের নাম আজও উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে।

ভারত-ব্ৰহ্ম সীমান্তে অভিযানের আগে সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ সরকারের পক্ষ থেকে জাপানীদের সঙ্গে এই মর্মে একটা চুক্তি করেছিলেন যে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাদের অভিযান হবে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র এবং জাপানীদের যুদ্ধ হবে আলাদা। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ বাহিনীর উপর জাপানীদের কোন কতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ চলবে না এবং ভারত সীমান্তের অভ্যন্তরে যে সমস্ত এলাকা ও জমি আজাদী সৈন্যেরা দখল করে নেবে, সেগুলি থাকবে সম্পূর্ণরুপে আজাদী সরকারের নিয়ন্ত্রণের অধীন এবং যেখানে ভারতের জাতীয় পতাকা উড্ডীন হবে। এই চুক্তির দ্বারাই বোঝা যাবে যে, সুভাষচন্দ্র জাপানীদের কর-ধৃত পুত্তলিকা ছিলেন না এবং তার স্বদেশ প্রেমের মধ্যে কোন প্রকার ভেজাল ছিল না কিংবা তার স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে কোন সন্দেহজনক কলুষ ছিল না। অথচ তার বিরোধী এবং শত্রুপক্ষ তার বিরুদ্ধে তখন নানা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছিলেন। অবশ্য সেই সঙ্গে একথাও সত্য যে, যুদ্ধের সেই ঘোরতর তীব্রতার দিনে সত্য সংবাদ ও প্রকৃত অবস্থা জানারও কোন সুযোগ ছিল না।

কিন্তু এই সমস্ত সত্ত্বেও একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার – সুভাষচন্দ্রের দুর্জয় সাহস, অসাধারণ মনোবল এবং অতুলনীয় দেশপ্রেমই ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের আসল সম্বল। কারণ, কার্যতঃ আজাদী ফৌজের কোন আধুনিকতম সমর সম্ভার ও যান্ত্রিক যুদ্ধের উপযোগী ব্যবস্থা ছিল না। যে বিমান ও ট্যাঙ্ক আধুনিক যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বাহন, তার কিছুই আজাদী ফৌজের ছিল না। এমন কি উপযুক্ত সাজপোশাক এবং খাদ্যদ্রব্যও ছিল না। অপর পক্ষে ভারত-ব্রহ্ম সীমান্ত ছিল অত্যন্ত দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল পাহাড় ও অরণ্যে সমাচ্ছন্ন। সোজা কথায় প্রাকৃতিক বিপ্নগুলিও যেন শত্রুপক্ষের সহায়ক ছিল। তবুও এই অবস্থার মধ্যে আজাদী ফৌজের আক্রমণে (৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪) আরাকান থেকে পাওয়া গেল প্রথম জয়ের খবর। উল্লাসে ফেটে পড়ল দেশপ্রেমিক জাতীয় বাহিনী। ৮ই এপ্রিল কোহিমা দখল হলো, ১৪ই এপ্রিল ময়রাং এবং তারপর বিষেণপুর মুক্ত হলো। ভারতের অভ্যন্তরে ভারতের মাটিতে জাতীয় জয়পতাকা উড্ডীন হলো – আর আওয়াজ উঠল সহস্র কণ্ঠে জয় হিন্দ, চলো দিল্লী এবং নেতাজী জিন্দাবাদ।

কিন্তু তখনও ইম্ফল জয় বাকি এবং ইম্ফলে ইঙ্গ-মার্কিন পক্ষ তাদের প্রচণ্ডতম শক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছিল – আধুনিক সমরসম্ভার থেকে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য পর্যন্ত। তবু বিষ্ময়ের কথা এই যে, আজাদ হিন্দ বাহিনী তিনমাস কাল ইম্ফল অবরোধ করে রেখেছিল এবং অবর্ণনীয় বাধা-বিপত্তি ও শত্রুপক্ষের প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও আজাদী সৈন্যরা ইম্ফলের উপকণ্ঠে পৌঁছেছিল। এখানে জাপানী সৈন্যবাহিনীও ইঙ্গমার্কিন পক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ চালিয়েছিল। কিন্তু, জেনারেল শ্রিমের অধীনে , মিত্রপক্ষের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৬০ হাজার, আর আধুনিক যুদ্ধের মারণাস্ত্র এবং বিমানশক্তির একাধিপত্য। আর আজাদী বাহিনীর না ছিল খাদ্য, রসদ এবং বিমান ও অন্যান্য অস্ত্র কিংবা যানবাহন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ভারত-ব্রহ্ম সীমান্তের এই সমগ্র যুদ্ধটাই মিত্রপক্ষের ইস্তাহারে ও সংবাদে একমাত্র জাপানীদের যুদ্ধ বলে প্রচারিত হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র বা আজাদ হিন্দ ফৌজের নাম ভুলক্রমেও উচ্চারণ করা হয়নি। তবে, যুদ্ধের শেষে চার্চিল তার মহাযুদ্ধের ইতিহাসে একবার মাত্র ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আমির নাম উল্লেখ করেছিলেন। (চার্চিল, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৩৫)। কিন্ত তার ইতিহাসের পঞ্চম খণ্ডে (পৃষ্ঠা ৫০৩) চার্চিল স্বীকার করেছেন যে, সেনানীমণ্ডলীর অধিনায়কেরা জুন মাসে ইম্ফলের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আরও রিজার্ভ সৈন্য, গোলাগুলি এবং সরবরাহ ছাড়া অবস্থা যে সামলানো যাবে না, একথাও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ অধিনায়ক লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের নিকট এক পত্রে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্যলক্ষী মাউন্টব্যাটেনের প্রতিই প্রসন্ন হলেন, জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ইম্ফল ও মিটকিনার বিপদ কেটে গেল এবং “জাপানীদের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনাও দূর হয়ে গেল।”-(মাউন্টব্যাটেনের রিপোর্ট)।

কিন্তু আসলে এই যুদ্ধটা একমাত্র “জাপানীদের ভারত আক্রমণ” ছিল না, ছিল সেই সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত মুক্তির অভিযান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই অভিযান সামরিক দিক দিয়ে ব্যর্থ হলো। কেননা, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আজাদী বাহিনীর আধুনিক যুদ্ধের উপযোগী সমরাস্ত্র, এরোপ্লেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সমরসম্ভার ছিল না। এদিকে হঠাৎ ভীষণ বৃষ্টি ও বর্ষা নেমে গেল। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে এবং অরণ্য ও পাহাড়িয়া নদীবহুল এলাকাগুলিতে এই বর্ষা নিদারুণ বিপদের সৃষ্টি করল। সব যেন ভেসে যাওয়ার জো হলো। সমস্ত সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল এবং মান্দালয় থেকে ইম্ফল পর্যন্ত বহুদূরের এই সাপ্লাই-পথ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ল। “হিকারী কিকান” নামক যে জাপানী সংগঠনের উপর সাপ্লাই যোগানোর দায়িত্ব ছিল, তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলো। খাদ্যবস্তু ছিল না, ঔষধপত্র ছিল না। আহতদের চিকিৎসা করা এক কঠিন সমস্যা ছিল। তার উপর ছিল অসংখ্য পোকামাকড় ও হিংস্র জোঁকের উৎপাত – আহতদের ক্ষতস্থানে এই সমস্ত পোকামাকড়ের কামড় অত্যন্ত মর্মান্তিক অবস্থার সৃষ্টি করল। সুতরাং আজাদী বাহিনীর পশ্চাদপসরণ ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সুতরাং ময়রাং, বিষেণপুর, ইম্ফল ইত্যাদি পরিত্যক্ত হলো। আর আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। এই মুক্তিযুদ্ধে ২৭ হাজার জওয়ান প্রাণ বিসর্জন দিলেন। স্বাধীনতাকামী ভারত সীমান্তের মাটি হাজার হাজার শহীদের রক্তে সিক্ত হলো। আধুনিক ভারতে এক নতুন ইতিহাসের সূচনা হলো।

বর্ষার শেষে নতুন বছরে আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষ থেকে আবার যুদ্ধ যাত্রার প্রস্তাব হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা আর সম্ভব হলো না। কারণ, একটির পর একটি করে দুভাগ্যজনক ঘটনার সমাবেশ হলো। ২১ জানুয়ারী, ১৯৪৫ তারিখে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু; মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। সুতরাং তার সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা থেকে আজাদ হিন্দ সরকার বঞ্চিত হলো। এদিকে রণক্ষেত্রে জাপানীদের ক্রমাগত ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজোপদত্যাগে বাধ্য হলেন (জুলাই, ১৯৪৪) এবং নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন জেনারেল নিয়েকি কইসো (Koiso)। জাপানীদের আওতায় গঠিত এবং ডাঃ বা ম পরিচালিত ‘স্বাধীন’ বার্মা সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের নেতা জেনারেল আউঙ্গ সান বিদ্রোহ করলেন এবং জাপানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেন। অন্যদিকে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীও প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে উত্তর বার্মা পুনরায় দখল করল এবং রেঙ্গুনের দিকে অভিযান করল। জাপানী বাহিনী তখন রেঙ্গুন থেকে পলায়ন করলে আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পূর্ণরূপে একক ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ৩রা মে, ১৯৪৫ তারিখে রেঙ্গুন মিত্রশক্তির দখলে চলে গেল। সুতরাং এই অবস্থায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর আর যুদ্ধ চালাবার সুযোগ রইল না। কারণ, সেই যুদ্ধ চালাবার অর্থ ছিল নিশ্চিত ধ্বংস। অতএব ২৪শে এপ্রিল নেতাজী সুভাষচন্দ্রকেও ব্রহ্মদেশ ত্যাগ করতে হলো। তার ইচ্ছা ছিল চীন বা রাশিয়া থেকে ভারতের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করা। কিন্তু জাপানীরা এই বিষয়ে কোন সহায়তা দিতে রাজী ছিল না। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে কলকাতায় আগত দুইজন জাপানী জেনারেল লেঃ জেনারেল ইসোদা এবং লেঃ জেনারেল ফুজিওয়ারা, যারা নেতাজীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন, তারা এক সাংবাদিক বৈঠকে নেতাজীর উপরোক্ত সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। (২৪-১-১৯৭৫ তারিখের কলকাতার হিশোন স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত)।

কিন্তু ব্রহ্মদেশ ত্যাগ করার আগে ঝাঁসীর রানী বাহিনীর মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে নেতাজীর একনিষ্ঠ সহকর্মী দেবনাথ দাসের নেতৃত্বে ব্যাংককে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর অনেক বিশিষ্ট সেনাপতি ও সেনানী রেঙ্গুন বিজয়ী বৃটিশদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র সহকর্মীদের অনুরোধে রেঙ্গুন থেকে মৌলমিন এবং সেখান থেকে ব্যাংককে চলে যেতে বাধ্য হলেন। সেখান থেকে তিনি গেলেন সিঙ্গাপুর এবং ১৬ই আগষ্ট বিমানযোগে সিঙ্গাপুর ত্যাগ করার আগে তিনি মেজর জেনারেল কিয়ানীকে তার অনুপস্থিতিতে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিনিধি নিযুক্ত করে গেলেন। কিন্তু তার আগেই তিনি জাপানের পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তের কথা শুনেছিলেন।

বর্মা দেশ ত্যাগ করার আগে নেতাজী তার সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক বিদায়-বাণীতে বলেন – “আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপতি ও সৈনিকেরা, ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আজ আমি বার্মা ছেড়ে যাচ্ছি। এখানে থাকলো তোমাদের সংগ্রাম ক্ষেত্রের অম্লান বীরত্বগাথা, যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারী মাসে এবং আজও যা নিঃশেষ হয়নি, ইম্ফল ও বার্মার রণাঙ্গনে আমরা মুক্তিসংগ্রামের প্রথম পর্বে পরাজিত হয়েছি, কিন্তু সে পরাজয় কেবলমাত্র প্রথম পর্বের পরাজয়, শেষ নয়। … আগামী দিনের নতুন ভারতবর্ষ জন্ম নেবে স্বাধীনতার দেব-দেউলে, পাশবদ্ধ জীবন নয়; তোমাদের আজকের এই বিস্ফারিত আত্মদান তাদের জন্ম সম্ভব করে তুলবে, স্মরণ করিয়ে দেবে তাদের কানে এই পরম তথ্য তোমরাই তাদের পূর্বসুরী।… আমারই মত এ-কথা বিশ্বাস করো যে, নব উষার পূর্বক্ষণ চিরদিনই থাকে দুর্গম আঁধারে ঢাকা। আর একটি কথাও বিশ্বাস করো যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে এবং হবে অচিরেই।” (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, পৃষ্ঠা ১৭৯-৮০)।

সুভাষচন্দ্রের এই ভবিষ্যৎবাণী দুই বছরের মধ্যেই (১৯৪৭ সালে) ফলে গিয়েছিল। কিন্তু বর্মা দেশের পতনের পর নেতাজীর পক্ষে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করাও আর নিরাপদ ছিল না। অতএব তার মন্ত্রিসভার অনুরোধে ও চাপে পড়ে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে চলে গেলেন সায়গনে এবং সেখান থেকে দালাত ও তুরান হয়ে ১৮ই আগষ্ট অপরাহ্নে তিনি পৌঁছলেন ফরমোজা দ্বীপের তাইহোকু বিমানবন্দরে-সঙ্গে একমাত্র কর্নেল হবিবুর রহমান।

তারপরের ইতিহাস সর্বজন বিদিত এবং বিতর্কিত। তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে নেতাজী ও হবিবুর রহমান যে বিমানে চড়ে যাত্রা করেছিলেন সেটি হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে ও প্লেনটিতে আগুন ধরে যায় এবং প্লেনের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ফলে নেতাজীর পোশাকে আগুন লাগে এবং তিনি গুরুতররপে আহত হন, তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নেওয়া হয় বটে, কিন্তু সেই রাতেই তার জীবনান্ত ঘটে। পাঁচ দিন পর ২৩শে আগস্ট সেই খবর জাপান থেকে সরকারীভাবে প্রচার করা হলো রেডিও যোগে। কিন্তু সেদিন থেকে আজ বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মত্যু নিয়ে বহু বিতর্ক, আন্দোলন ও আলোড়ন ঘটে গিয়েছে। কেননা, রাজনৈতিক মহলের এবং জনগণের মধ্যে অনেকের নিকট সুভাষচন্দ্রের মত্যু এখনও রহস্যাবৃত। তারা বিশ্বাস করেন না যে, সুভাষচন্দ্রের মত্যু হয়েছে। তাদের ধারণা সুভাষচন্দ্র কোথাও আত্মগোপন করে আছেন। এমন কি ভারত সরকার কর্তৃক একাধিক তদন্ত কমিশন গঠন এবং তার মৃত্যু সম্পর্কে বিস্তৃত অনুসন্ধানের পরেও জনচিত্র থেকে সংশয় ও সন্দেহ দূর হয়নি। পাঞ্জাব হাইকোটের ভুতপূর্ব প্রধান বিচারপতি জি. ডি. খোসলাকে নিয়ে যে একক তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল, চার বছর ধরে সেই কমিশন বিস্তৃত অনুসন্ধানের পর ১৯৭৪ সালের ১লা জুলাই ভারত সরকারের নিকট এই মর্মে রিপোর্ট দিয়েছে যে, ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মত্যু হয়েছে। কিন্ত কমিশনের এই সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করলেও জনগণের মধ্যে অনেকেই এই সিদ্ধান্ত নিঃসংশয়চিত্তে গ্রহণ করেনি। অবশ্য জাতীয় জনচিত্তে নেতাজী সুভাষচন্দ্র চিরদিনই অমর থাকবেন।

নেতাজীর সংগ্রামের মূল্যায়ন

নেতাজী সুভাষচন্দ্র ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে এ পর্যন্ত অজস্র আলোচনা হয়েছে। এই সমস্ত আলোচনার মধ্যে বোধ হয় বিদেশীদের দ্বারা নেতাজীর সংগ্রামের মুল্যায়নের গুরত্ব সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে কলকাতার নেতাজী ভবনে যে আন্তজাতিক আলোচনা-চক্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল, শ্রীযুক্ত শিশিরকুমার বসু কর্তৃক সম্পাদিত একটি গ্রন্থে সেই আলোচনার বিবরণী প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশে ও বিদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন এবং এই আলোচনার সারমর্ম থেকে জানা যায় যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বন্ধন থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য সুভাষচন্দ্রের দুর্জয় সংকল্প এবং দুঃসাহসিক সংগ্রাম ও অভুতপূর্ব ধৈর্য এবং কষ্ট স্বীকারের কোন তুলনা ছিল না। তিনি কোনমতেই নাৎসী, জার্মানী ও জাপানের বশংবদ ছিলেন না, ছিলেন স্বাধীনচেতা। কিন্তু, বৃটিশ পরাধীনতার পাশ ছিন্ন করার জন্য যতটুকু সাহায্য ও সহযোগিতা না নিলে কার্যোদ্ধার সম্ভব নয়, বাস্তব প্রয়োজনের খাতিরে ততটুকু নিতে তিনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সেই সাহায্য বা সহযোগিতাও আত্মসম্মানের বিনিময়ে নয়।

এই সম্পর্কে নাৎসী জার্মানীর পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রাক্তন অফিসার Dr. Alexander Werth (ইনি ‘রাশিয়া এ্যাট ওয়ার’ নামক রুশজার্মান সংগ্রামের সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাস লেখক আলেকজাণ্ডার ভার্থ নন। ইনি পশ্চিম জার্মানীর রাজধানী বনের অধিবাসী ছিলেন) একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে এই চিত্তাকর্ষক মন্তব্য করেছেন, “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তিবর্গের সঙ্গে নেতাজীর সহযোগিতার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে আমরা নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি – Regardless of the fact that he was operating in Axis countries in 1941-1945 Subhas Chandra Bose remained an uncompromising fighter for Indian Independence, made a very significant contribution to Indian independence and what is more – he continued to be a planner and builder of the free India of his dreams. The Axis Powers lost the war. But Subhas Ch. Bose won the victory of India over Britain and his ideas of national reconstruction will win many more victories in the days to come.” (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, পৃষ্ঠা ২৫৬)। (অর্থাৎ, “১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসু যদিও অক্ষশক্তিবর্গের দেশে কার্যকলাপ চালাচ্ছিলেন, তবুও তিনি বরাবরই ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতার একজন আপোসহীন সংগ্রামী। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে তিনি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছেন এবং তার চেয়েও গুরত্বপূর্ণ কথা এই যে, তিনি তার স্বপ্নের স্বাধীন ভারতকে গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা ও নির্মাণকার্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অক্ষশক্তিবর্গ যুদ্ধে হেরে গেল বটে, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু ভারতে বৃটেনের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেন। আগামী দিনের ভারতের জাতীয় পুনর্গঠনে তার চিন্তাধারা আরও অনেকবার জয়লাভ করবে”।)

একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুভাষচন্দ্র কখনও রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানীর আক্রমণকে সমর্থন করেননি। বরং ভারত ত্যাগের পর তিনি প্রথম আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়াতেই গিয়েছিলেন সোভিয়েত সাহায্যলাভের আশায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না হওয়ায় তিনি বার্লিনে গেলেন। কিন্তু বার্লিনেও হিটলারী নেতাদের আচরণে ও মনোভাবে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারিলেন না। বরং হিটলার কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের জন্য তিনি একেবারে হতাশ হয়ে পড়লেন। এই বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলান হউনার (Milan Hauner) মন্তব্য করেছেন, “The outbreak of war between Germany and Russia shocked Bose profoundly. He felt that at one stroke his plans were falling to pieces.’ (অর্থাৎ “জার্মানী ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়াতে বসু গভীরভাবে আঘাত পেলেন। তিনি অনুভব করলেন যেন একটি আঘাতে তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে”।) (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, পৃষ্ঠা ২৮০)।

প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া আক্রান্ত হওয়ার ফলেই তিনি জার্মানী ছেড়ে সুদূরপ্রাচ্যে জাপানে যাওয়ার সংকল্প করেছিলেন-“যদিও চীন-জাপান যুদ্ধে সুভাষচন্দ্র চীনের প্রতিই বেশী সহানুভুতি সম্পন্ন ছিলেন।“ (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, পণ্ঠা ২৫৫)। জাপান থেকে রাসবিহারী বসুর আহ্বান ও সুভাষচন্দ্রের উপর স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাবার ভার অর্পণ ইতিহাস-বিদিত-ঘটনা। কিন্ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাটিতে পদার্পন করেই তিনি অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকার গঠন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন কেন? কারণ সুভাষচন্দ্র বলতেন – ‘ইতিহাস থেকে শিখেছি যে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য গোড়াতেই চাই একটি জাতীয় বাহিনী ও জাতীয় সরকার”। (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী পণ্ঠা ৩৫১)। এজন্যই প্রথমে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত এবং সঙ্গে সঙ্গেই আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে জাপানী পররাষ্ট্র দপ্তরের এশীয় ব্যুরোতে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে যে দলিল তৈরী হয়েছিল, তাতে জাপান ও নেতাজীর মধ্যে সম্পর্কের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই দলিলে সুভাষের অজস্র প্রশংসা করা হয়েছে এবং ভারত-ব্ৰহ্ম সীমান্ত অঞ্চলের যুদ্ধে শত্রুর বিমান আক্রমণের মুখে নেতাজী কিরূপ অবিচলিত ছিলেন এবং খোলা জায়গায় অবস্থান করে আশ্চর্য সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, হাজার বিঘ্ন বিপদ সত্ত্বেও নেতাজীর সংগ্রামের ইচ্ছা বিন্দুমাত্র কমেনি। সারা জীবন তিনি তার প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে অতি তিক্ত সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন। (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী পণ্ঠা ৩৯৭)।

আলোচ্য জাপানী দলিলে উদ্ধৃত অংশগুলির মধ্যে উপসংহারে গান্ধী ও নেহরুর মতামত ছিল – ‘Making an assessment of Bose’s Work Gandhi said the Bose achieved in a few years what others would have taken several decades to achieve. In Gandhi’s opinion the use of arms was regrettable, but Bose’s achievements and contributions to Indian Independence movement was boundless. Nehru once said that I.N.A. under Bose’s command believed the past judgement of Britishers that Indians did not have military leaders of high standard. Though I.N.A. was poor in equipment compared to the British it fought gloriously and defeated the white armies.” (অর্থাৎ, ‘সুভাষচন্দ্র বসুর কার্যকলাপের পর্যালোচনা করে গান্ধী বলেছিলেন যে, অন্যের পক্ষে যে কাজ করতে কয়েক যুগ লেগে যেতো, বসু তা কয়েক বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করেছিলেন। গান্ধীর মতে অস্ত্রের ব্যবহার দুঃখজনক ছিল বটে, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সুভাষের কীতি ও অবদান সীমাহীন ছিল। “নেহরু একদা বলেছিলেন যে, বৃটিশরা আগে মনে করতো ভারতীয়েরা উৎকৃষ্ট সামরিক নেতা হতে পারে না। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর অধীনে আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই সেই ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। যদিও বৃটিশদের তুলনায় আই. এন. এ.’র সামরিক সাজসজ্জা খুব সামান্যই ছিল, তবু তারা গৌরবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং শ্বেতাঙ্গ সৈন্যদিগকে হারিয়ে দিয়েছিলেন”।) (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী পণ্ঠা ৪২০-২১)।

১৯৪৪ সালের শেষ দিনে সুভাষেরও জীবনব্রতের বা অভিযানের শেষ পর্যায় চিহ্নিত হলো। বৃটিশ সৈন্যেরা আকিয়াবে অবতরণ ও দখল করে নিল। শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রকে পিছনে হঠে ব্রহ্মদেশ ত্যাগ করে যেতে হলো। তিনি রাশিয়ায় আশ্রয় লাভের জন্য মাঞ্চুরিয়ায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্ত জাপানী সামরিক কর্তৃপক্ষ সম্মত হলেন না। টোকিওর রুশ রাষ্ট্রদূতও নেতাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হলেন না। জাপানী ভাষ্য অনুসারে ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ তারিখে তাইপে বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র আহত ও তার সারা দেহে আগুন ধরে গিয়েছিল। কিন্তু সারা দেহে আগন সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র অবিচলিত ছিলেন। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে নেতাজী বলেছিলেন ‘একমাত্র দুঃখ ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না’। (নেতাজী সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-(তৃতীয় খণ্ড) নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী পণ্ঠা ৪১৬)।

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.