Table of Contents
শাহজাহান (রা. ১৬২৮-১৬৫৮ খ্রি.)
শাহজাহানের প্রথম জীবন ও সিংহাসনে আরােহণ
সম্রাট জাহাঙ্গীরের চার পুত্রের অন্যতম পুত্র ছিলেন শাহজাহান। শাহজাহানের প্রথম নাম ছিল খুররম। ১৫৯২ খ্রীষ্টাব্দে ১৫ জানুয়ারি মারওয়ারের রাণা উদয় সিংহের কন্যা জগৎ গোঁসাই এর গর্ভে শাহজাহান জন্মগ্রহণ করেন। শাহজাহান সম্রাট আকবর ও পিতা জাহাঙ্গীরের খুব প্রিয় ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই আকবর স্বয়ং তার শিক্ষার ব্যবস্থা করে মুঘল রাজপরিবারে উপযুক্ত একজন সদস্য করে গড়ে তােলেন। ফার্সী ভাষা ও সাহিত্য ছাড়াও তিনি ইতিহাস, ভূগােল এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে যথেষ্ট জ্ঞানলাভ করেন। ১৬১১ খ্রীস্টাব্দে তিনি নূরজাহানের ভাই আসফ খানের কন্যা মমতাজমহলকে বিবাহ করেন। তার সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে জাহাঙ্গীর তাকে বহু যুদ্ধে অধিনায়ক পদে নিযুক্ত করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের জীবিতকালে মেবার, দাক্ষিণাত্য ও কাংড়া অভিযানে তিনি অভাবনীয় সামরিক কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৬১৭ খ্রীস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের আহমদনগরের শক্তিশালী মালিক অম্বরকে পরাজিত করতে সক্ষম হলে জাহাঙ্গীর প্রীত হয়ে তাকে ‘শাহজাহান’ উপাধিতে ভূষিত করেন ও ৩০,০০০ জাত ও ২০,০০০ সওয়ারের মনসবদার নিযুক্ত করেন। শাহজাহানের পূর্বে বা পরে কোন মুঘল শাহজাদা এরূপ বিপুল সম্মানে ভূষিত হননি।
কিন্তু শাহজাহানের এই গৌরবের সুফল বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ নূরজাহানের প্রথম বিবাহজাত কন্যা লাডলী বেগমের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়রের বিবাহ অনুষ্ঠিত হলে শাহজাহানের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। নূরজাহান তার জামাতা শাহরিয়রকে সিংহাসনে বসানাের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়লে ১৬২২ খ্রীস্টাব্দে শাহজাহান বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। ১৬২৫ সালে পিতা ও পুত্রের মধ্যে সদ্ভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও নূরজাহান জামাতা শাহরিয়রকে সিংহাসনে বসানাের চেষ্টা পরিত্যাগ করেননি।
১৬২৭ খ্রীস্টাব্দে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হলে শাহজাহান ও শাহরিয়রের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুকালে শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করছিলেন। এমতাবস্থায় তার শ্বশুর আসফ খান জামাতার কাছে দূত প্রেরণ করে শীঘ্রই তাকে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পাঠান এবং তাকে সিংহাসন লাভের পথ প্রশস্ত রাখার জন্য খসরুর পুত্র দাওয়ার বক্সকেকে সাময়িকভাবে সিংহাসনে স্থাপন করেন। অপরদিকে নূরজাহানের সাহায্যে শাহরিয়র লাহােরে নিজেকে সম্রাট বলে ঘােষণা করেন। আসফ খান আমত্যবর্গের সহায়তায় সসৈন্যে লাহাের অবরােধ করে শাহরিয়রকে পরাজিত ও বন্দী করেন। বন্দী অবস্থায় শাহরিয়রকে অন্ধ করে দেয়া হয়। শাহজাহান আগ্রায় পৌঁছানোর পূর্বে আসফ খানকে তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যার নির্দেশ দেন। আসফ খান জামাতার সিংহাসনের পথ নিষ্কন্টক করার উদ্দেশ্যে একে একে সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন। ১৬২৮ খ্রীস্টাব্দে ২৪ জানুয়ারি শাহজাহান মহাসমারােহে রাজধানীতে প্রবেশ করেন এবং তার পিতার দেয়া ‘শাহজাহান’ উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন। সিংহাসন লাভের সহায়তার জন্য শাহজাহান তার শ্বশুর আসফ খানকে রাজ্যের উজীরের পদে উন্নীত করেন এবং মহাব্বত খানের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করে তাকে আজমীরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। অতঃপর শাহজাহান পঞ্জিকা বা কালগণনার পদ্ধতির পরিবর্তন করেন। এবং সৌরমাসের পরিবর্তে চন্দ্রমাস গণনা পদ্ধতি এবং হিজরী সনের পুনঃপ্রবর্তন করেন। এরপর শাহজাহান ইতােপূর্বে সম্রাটকে সিজদা করার যে প্রথা চালু ছিল তা ইসলাম-বিরােধী মনে করে তা বন্ধ করে দেন এবং তার স্থলে ডান হাত দ্বারা মাটি স্পর্শ ও চুম্বনের রীতি চালু করেন। তিনি কতিপয় শরিয়ত আইনেরও পুনঃপ্রবর্তন করেন। শাহজাহানের এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সাম্রাজ্যের গোড়াপন্থী মুসলমানরা সন্তুষ্ট হন।
বিদ্রোহ দমন ও দুর্ভিক্ষ লাঘবের ব্যবস্থা
সিংহাসনে আরােহণের পর শাহজাহানকে কয়েকটি বিদ্রোহের মােকাবিলা করতে হয় –
(১) বুন্দেলখন্ডের রাজা জুজার সিংহের বিদ্রোহ : বুন্দেলখন্ডের রাজপুত জাতির নেতা জুজার সিংহ ছিলেন বীরসিংহ বুন্দেলার পুত্র। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বীরসিংহ বুন্দেলা যুবরাজ সেলিমের পক্ষ নিয়ে আবুল ফজলকে হত্যা করেছিলেন। বীরসিংহ বুন্দেলার মৃত্যুর পর তার পুত্র জুজার সিংহ বুন্দেলখণ্ডের রাজা হন। শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম বছরেই জুজার সিংহ বিদ্রোহী হন। শাহজাহান জুজার সিংহের বিদ্রোহ দমন করার জন্য মহাব্বত খান, খান-ই-জাহান ও আব্দুল্লাহ খানের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী মুঘল বাহিনী প্রেরণ করেন। মুঘল বাহিনীর সঙ্গে কয়েকদিন যুদ্ধের পর জুজার সিংহ আত্মসমর্পণ করেন। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ জুজার সিংহ সম্রাটকে পনেরো লক্ষ টাকা এবং উপঢৌকন হিসেবে এক হাজার মােহর দিতে স্বীকৃত হন। প্রতিদানে শাহজাহান জুজার সিংহকে জায়গীর প্রদান করেন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে জুজার সিংহ আবার বিদ্রোহী হন। শাহজাহান তার বিদ্রোহ দমনের জন্য পুনরায় সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং যুদ্ধে জুজার সিংহ নিহত হন। বুন্দেলখণ্ড মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
(২) খান-ই-জাহান লােদীর বিদ্রোহ : শাহজাহানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিদ্রোহ সংঘটিত হয় খান-ই-জাহান লােদীর নেতৃত্বে। খান-ই-জাহান লােদী ছিলেন দাক্ষিণাত্যে মুঘল শাসনকর্তা। সৈনিক হিসেবে তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় তিনি অনেক যুদ্ধে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সমাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তিনি নূরজাহানের পক্ষ অবলম্বন করেন। শাহজাহানের সিংহাসন লাভের পর তিনি দাক্ষিণাত্যে সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। এর ফলে সম্রাট শাহজাহান মহাব্বত খানকে খান-ইজাহানের স্থলে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিয়ােগ করে খান-ই-জাহানকে আগ্রায় ডেকে পাঠান। খান-ই-জাহান আগ্রায় এসে ৭/৮ মাস রাজদরবারে অবস্থান করেন। তিনি রাজদরবারের পরিস্থিতি নিজ অনুকূল নয় বিবেচনা করে দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেন এবং আহমদনগরের সুলতান দ্বিতীয় মুর্তজার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। ফলে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ১৬২৯ খ্রীস্টাব্দে শাহজাহান এই বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে স্বয়ং দাক্ষিণাত্যে গমন করেন। খান-ই-জাহান মুঘল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।
(৩) পর্তুগীজ দমন ও হুগলি অধিকার : পর্তুগীজদের দমন ও তাদের বাণিজ্য কুঠি হুগলি অধিকার শাহজাহানের রাজত্বকালে এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ১৭শ শতকের প্রথমদিকে পর্তুগীজ বণিকেরা ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করে এবং আকবর ও জাহাঙ্গীরের অনুমতিক্রমে হুগলতে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। শাহজাহানের রাজত্বের প্রথমদিকে তারা শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হুগলিতে বাণিজ্যকুটির অন্তরালে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। তারা বে-আইনীভাবে নদীর ভেতর দিয়ে যাতায়াতকারী বণিকদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করতে থাকে। এতে সরকারী রাজস্বের যথেষ্ট ক্ষতিসাধিত হয়। উপরন্তু তারা বাংলায় সর্বত্র লুণ্ঠন, দাস-ব্যবসা এবং বলপূর্বক প্রজাবর্গকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতকরণ শুরু করে। এ সময় পর্তুগীজরা মমতাজ মহলের দুজন হারেমের মহিলাকে আটক করে তাদের ওপর চরম নির্যাতন করে। পর্তুগীজদের এসব অপকর্মের জন্য শাহজাহান ক্রমশঃ তাদের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বদ্ধপরিকর হন। তিনি ১৬৩১ খ্রীস্টাব্দে কাশিম খানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন এবং তাকে বাংলা থেকে পর্তুগীজদের বিতাড়নের নির্দেশ দেন। ১৬৩২ খ্রীস্টাব্দে কাশিম খান হুগলি অবরোধ করেন এবং তিন মাস যুদ্ধ চলার পর পর্তুগীজরা মুঘল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার পর্তুগীজ নিহত হয় এবং চার হাজার বন্দী হয়ে আগ্রায় প্রেরিত হয়। অবশ্য ১৬৩৩ খ্রীস্টাব্দে শাহজাহান পুনরায় পর্তুগীজদের হুগলিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অনুমতি দেন।
(৪) গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে দুর্ভিক্ষ (১৬৩০ খ্রীঃ) : শাহজাহানের সিংহাসনে আরােহণের তিন বছর পর ১৬৩০ খ্রীস্টাব্দে গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে এক ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষ এত ভয়াবহ ছিল যে, হাজার হাজার নর-নারীর এতে প্রাণহানি ঘটে। রাজদরবারের ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহােরী এই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “এক টুকরো রুটির বিনিময়ে মানুষ আত্মবিক্রয় করতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু খরিদ্দার ছিল না। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ মানুষের মাংস ভক্ষণ করতে থাকে। এমনকি পিতার কাছে পুত্রের মাংস লােভনীয় ছিল। মৃতদেহের স্তুপের জন্য রাস্তাঘাটে যাতায়াত করা যেত না।” সমকালীন ইংরেজ ব্যবসায়ী ও পর্যটক পিটার মান্ডির (Peter Mundy) বিবরণ থেকেও এই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। এরূপ অবস্থায় শাহজাহান দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের সাহার্যাথ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি দুই রাজ্যের ৭০ লক্ষ টাকার রাজস্ব মওকুফ করেন; দ্বিতীয়ত, দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে লঙ্গরখানা খুলে খাদ্য বিতাড়নের ব্যবস্থা করেন। এবং তৃতীয়ত, জনগণের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে তিনি মনসবদারদের সেবামূলক কাজে আত্মনিয়ােগ করার নির্দেশ দেন। সম্রাটের এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলেও জনগণের দূরাবস্থার সীমা ছিল না।
শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি
দাক্ষিণাত্যে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শাহজাহানের রাজত্বকালে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শাহজাহানের পূর্বে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে আকবর ও জাহাঙ্গীর দাক্ষিণাত্যে অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। আকবর খান্দেশ ও বেরার সাময়িকভাবে দখল করলেও সমগ্র দাক্ষিণাত্যকে তিনি পদানত করতে পারেননি। আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে অগ্রসর হয়েছিলেন কিন্তু আহম্মদনগরের প্রধানমন্ত্রী মালিক অম্বরের প্রতিরােধের কারণে জাহাঙ্গীর শেষ পর্যন্ত আহম্মদনগর জয় করতে ব্যর্থ হন। এসময় দাক্ষিণাত্যের অপর দুই মুসলিম রাজ্য বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা নিজ স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়। ফলে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ অসমাপ্তই থেকে যায়। কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসন আরােহণের সঙ্গে সঙ্গে মুঘলদের দাক্ষিণাত্য নীতি এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। (“With Shahjahan’s accession to the throne commenced a new era of Deccan policy. Fully aware of the strong and weak points of the Deccan states, he was qualified to undertake operations on a large scale.” Iswari Prasad, A Short History of Muslim rule in India, p:391)। শাহজাহান নতুনভাবে দাক্ষিণাত্য নীতি অবলম্বন করেন। অনেক ঐতিহাসিক শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতির পেছনে রাজনৈতিক কারণের সঙ্গে ধর্মীয় কারণকে যুক্ত করেছেন। তাদের মতে, ধর্মীয় কারণে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যসমূহে শিয়াদের আধিপত্য খর্ব এবং শিয়া রাজ্যগুলােকে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করা শাহজাহান কর্তব্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক তেসলিম চৌধুরী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে অভিযান প্রেরণ করেছিলেন এ মতের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “মুঘলদের পারিবারিক ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, তারা ‘শিয়া’ ও ‘সুন্নী’ সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিভেদ করেন নি। কারণ শাহজাহানের পিতামহ আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান ছিলেন ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত। আকবরের শিক্ষক আব্দুল লতিফ ও আবুল ফজলের পিতা শেখ মােবারকও ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। স্বভাবতই বলা যায়, মধ্যযুগের বাতাবরণেও মুঘল রাজপরিবারটি ছিল এক উদার মানসিকতার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। তাই শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতির পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই পিতামহের মত মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।” (মধ্যযুগের ভারত ও মুঘল আমল, পৃঃ ২৬৬)।
(১) আহম্মদনগর বিজয় (১৬৩২) : মুঘল সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে আহম্মদনগরের নিজামশাহী রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। ১৬১৯ খ্রীস্টাব্দে এই রাজ্যের প্রতিভাবান প্রধানমন্ত্রী মালিক অম্বরের মৃত্যু হলে তার পুত্র ফতেহ খান তার স্থলাভিষিক্ত হন। শীঘ্রই নিজামশাহী সুলতান মুর্তজা নিজামের সঙ্গে ফতেহ খানের বিবাদ শুরু হয় এবং তিনি মুঘলদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সুলতানকে হত্যা করে তার নাবালক পুত্র হুসেন শাহকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্যশাসন করতে থাকেন। কিন্তু ফতেহ খান মুঘলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কামনা করেননি। তাই ১৬৩১ সেনাপতি মহাব্বাত খান আহম্মদনগরের দৌলতাবাদ দুর্গ আক্রমণ করলে ফতেহ খান মুঘলদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মুঘলদের প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। কিন্তু মুঘল বাহিনী কর্তৃক দৌলতাবাদ অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে তিনি দশ লক্ষ মুদ্রা উৎকোচের বিনিময়ে দৌলতাবাদ দুর্গ মুঘলদের কাছে সমর্পণ করেন। এভাবে আহম্মদনগর রাজ্যটি মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। নিজামশাহী বংশের শেষ নাবালক সুলতান হুসেন শাহকে বন্দী অবস্থায় কালাতিপাত করতে হয়। শাহজাহান কৃতকার্যের পুরস্কারস্বরূপ বিশ্বাসঘাতক ফতেহ শাহকে মুঘলদের উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করেন।
(২) গােলকুণ্ডা ও বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযান : দাক্ষিণাত্যে আহম্মদনগর মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করার পর শাহজাহান গােলকুণ্ডা ও বিজাপুর রাজ্যের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এ সময় মারাঠা নেতা শিবাজীর পিতা শাহাজী ভোসলে গােলকুণ্ডা ও বিজাপুরের সুলতানের সমর্থনে আহম্মদনগরে পুনরায় নিজামশাহী বংশের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন। এতে শাহজাহান অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং ১৬৩৬ খ্রীস্টাব্দের প্রথমদিকে ৫০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে দাক্ষিণাত্যে গমন করেন। দাক্ষিণাত্যে পৌঁছেই সম্রাট গােলকুণ্ডা ও বিজাপুরের সুলতানকে মুঘলদের আধিপত্য মেনে নিতে এবং শাহাজী ভোসলেকে সাহায্য প্রদানে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেন। গােলকুণ্ডার সুলতান কুতুবশাহ বিশাল মুঘল বাহিনী এবং স্বয়ং সম্রাটের উপস্থিতি দেখে ভীত হয়ে শাহজাহানের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং সম্রাটকে কর প্রদান এবং সম্রাটের নামে মুদ্রা প্রচলন ও খুৎবা পাঠ করতে স্বীকৃত হন।
কিন্তু বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে শাহজাহান ক্ষুব্ধ হয়ে বিজাপুরকে তিন দিক থেকে আক্রমণের নির্দেশ দেন। বিজাপুরের সৈন্যদল বীরত্বের সঙ্গে মুঘল বাহিনীকে বাধা প্রদান করে এবং নানাভাবে মুঘল সৈন্যদের বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ নিষ্ফল মনে করে সুলতান আদিল শাহ এক সন্ধির দ্বারা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায়। এই সন্ধির দ্বারা (১) সুলতান আদিল শাহ মুঘল সম্রাটের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন; (২) সুলতান আহম্মদনগরের বিষয়ে আর কোন হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন; (৩) সুলতান মুঘল সম্রাটকে এককালীন ২০ লক্ষ টাকা নজরাণা হিসেবে দিতে স্বীকৃত হন; (৪) (৪) সুলতান সম্রাট শাহজাহানকে এই প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি শাহাজী ভােসলেকে তার রাজ্যের কোন পদে নিযুক্ত করবেন না এবং সাহায্যও প্রদান করবেন না।
এভাবে চল্লিশ বছর স্থায়ী (১৫৯৫-১৬৩৬ খ্রীঃ) দাক্ষিণাত্যের বিবদমান অবস্থার নিষ্পত্তি ঘটে। সম্রাটের পদমর্যাদা প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকৃত হয়। তার সাম্রাজ্যের সীমানা পরিস্কারভাবে চিহ্নিত হয় এবং প্রাথমিকভাবে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলাের ওপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। (“Thus after forty years of strife (1595-1636) the affairs of the Deccan were at last settled. The position of the emperor was asserted beyond challenge, his boundaries clearly defined and his suzerainty over the southern kingdoms formally established.” – Sir J. N. Sarkar – Advanced History of India, p;469)
দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হিসেবে আওরঙ্গজেব
দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পর শাহাজাহান আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করে ১৬৩৬ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। তখন আওরঙ্গজেবের বয়স ছিল মাত্র আঠারাে বছর। দাক্ষিণাত্য প্রদেশকে খান্দেশ, বেরার, তেলিঙ্গানা ও দৌলতাবাদ এই চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে মুঘল শক্তিকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি সুরাট ও খান্দেশের মধ্যবর্তী অঞ্চল বলগন্দা জেলা অধিকার করেন এবং শিবাজীর পিতা শাহাজী ভােসলেকে সাতটি দুর্গসহ নিজামশাহী রাজপুত্রকে মুঘলদের হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য করেন। ১৬৩৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি আগ্রায় এসে পারস্য রাজপরিবারের শাহনাওয়াজ খানের কন্যা দিলরাস বানুকে বিবাহ করেন। ১৬৪৪ খ্রীস্টাব্দে তার প্রিয় ভগ্নী জাহানারা ভয়ানকভাবে অগ্নিদগ্ধ হলে তিনি তাকে দেখবার জন্য আগ্রায় আসেন। কিন্তু আগ্রায় পৌঁছবার তিন সপ্তাহ পরে প্রতিকূল অবস্থার চাপে তিনি দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তার পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।
আওরঙ্গজেবের পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে আব্দুল হামিদ লাহােরী, কাফী খান প্রমুখ ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, আওরঙ্গজেব কঠোর সংযমী সন্ন্যাস জীবনযাপন করতে মনস্থ করেছিলেন। এতে সম্রাট অসন্তুষ্ট হন এবং তার ইচ্ছা সম্রাট অনুমােদন করেন। তবে আওরঙ্গজেবের পদত্যাগের পেছনে মূল কারণ ছিল আওরঙ্গজেবের প্রতি বড় ভাই দারাশিকোর হিংসা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস ও সন্দেহ। আওরঙ্গজেবের পত্রাবলী থেকেও তার প্রতি দারাশিকোর অবিরত বৈরিতার জানা যায়। মূলতঃ দারাশিকোর প্রতি শাহজাহানের পক্ষপাতিত্বই আওরঙ্গজেবের পদত্যাগের মূল কারণ ছিল। স্বীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য বিরক্ত হয়ে আওরঙ্গজেব সুবাদারের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
কিন্তু আল্পকাল পরেই বড় বােন জাহানারার প্রচেষ্টায় আওরঙ্গজেব ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং ১৬৪৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৬৪৭ খ্রীস্টাব্দে শাহজাহান তাকে মধ্য-এশিয়ার বালখ ও বাদকাশান অভিযানে প্রেরণ করেন। কিন্তু তার মধ্য-এশিয়া অভিযান ব্যর্থ হলে তিনি আগ্রায় ফিরে আসেন। ১৬৫৩ খ্রীস্টাব্দে আওরঙ্গজেবকে পুনরায় দাক্ষিণাত্যের সুবাদার পদে নিযুক্ত করা হয়। দীর্ঘ নয় বছর পর দাক্ষিণাত্যের শাসনভার গ্রহণ করে আওরঙ্গজেব দেখেন যে, অকর্মন্য রাজকর্মচারীদের পরিচালনায় দাক্ষিণাত্যের শাসনব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। আওরঙ্গজেব প্রথমেই দাক্ষিণাত্যে আর্থিক সঙ্কট নিরসনের জন্য রাজস্ব ও কৃষি সংক্রান্ত নানাবিধ সংস্কার গ্রহণ করেন। রাজস্ব বিভাগের সুযােগ্য রাজকর্মচারী দিউয়ান মুর্শিদকুলী খানের সহায়তায় আওরঙ্গজেব রাজস্ব সংস্কার করে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মুর্শিদকুলী খান ভূমি-জরিপ ও রাজস্বনির্ধারণে রাজা টোডরমল প্রবর্তিত ‘জাবতি’ পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন। এই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে রাজস্ব আয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং দাক্ষিণাত্য থেকে সম্রাটের তহবিলে নিয়মিত রাজস্ব প্রেরিত হতে থাকে।
আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে আভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থা সুসংগঠিত করে বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা স্থায়ীভাবে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করবার জন্য কৃতসংকল্প হন। ১৬৩৬ খ্রীস্টাব্দে স্বাক্ষরিত চুক্তি মােতাবেক গােলকুণ্ডার সুলতান আব্দুল্লা কুতুবশাহ মুঘল সম্রাটকে নিয়মিত কর প্রদান বন্ধ করে দিলে আওরঙ্গজেব গােলকুণ্ডার সুলতানের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। ইতােমধ্যে গােলকুণ্ডা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মীরজুমলা সুলতানের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং মুঘলদের সঙ্গে গােপন সখ্যতা গড়ে তােলেন। (মীরজুমলা ছিলেন পারস্যের ইস্পাহান শহরের এক তেল ব্যবসায়ীর পুত্র। সুচতুর ব্যবসায়ী মীরজুমলা নিজ বুদ্ধিকৌশলে গােলকুণ্ডায় অশেষ খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করেন এবং সুলতান আব্দুল্লা কুতুবশাহের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরে মীরজুমলা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে মৈত্রী স্থপন করে গােলকুণ্ডা রাজ্যের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।) গোলকুণ্ডার সুলতানের সঙ্গে মীরজুমলার বিবাদ আওরঙ্গজেবকে গােলকুণ্ডা আক্রমণে বিশেষভাবে প্রলুব্ধ করেছিল। ১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে ১০ জানুয়ারি আওরঙ্গজেব সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে তার পুত্র মহম্মদকে গােলকুন্ডা আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন এবং মহম্মদ গােলকুণ্ডার রাজধানী হায়দ্রাবাদ অধিকার করেন। সুলতান কুতুবশাহ মুঘল আক্রমণের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য শীঘ্রই দারাশিকোর কাছে দূত প্রেরণ করে তার সাহায্য কামনা করেন। দারার প্ররােচনায় সম্রাট শাহজাহান শেষপর্যন্ত আওরঙ্গজেবকে গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে যুদ্ধ স্থগিত করতে নির্দেশ দেন। ফলে দারার প্রভাবে আওরঙ্গজেব গােলকুণ্ডার বিরুদ্ধে নিশ্চিত জয়লাভের গৌরব থেকে বঞ্চিত হন। গােলকুণ্ডার সুলতান যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ মুঘলদের দশ লক্ষ টাকা; রাজ্যের কিয়দংশ ছেড়ে দিতে স্বীকৃত হন এবং আওরঙ্গজেবের পুত্র মহম্মদের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দেন। সুলতান কুতুবশাহের মৃত্যুর পর শাহজাদা মহম্মদ গােলকুণ্ডার সিংহাসন লাভ করবেন – আওরঙ্গজেব গােলকুণ্ডার সুলতানের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি আদায় করেন। সম্রাট শাহজাহান আওরঙ্গজেবের মুখে মীরজুমলার বিভিন্ন গুণের কথা শুনে তাকে রাজধানী আগ্রায় আমন্ত্রণ জানান এবং তাকে গােলকুণ্ডার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
গােলকুণ্ডার পর আওরঙ্গজেব বিজাপুরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন। ১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে বিজাপুরের শক্তিশালী সুলতান আদিল শাহের মৃত্যু হলে তার নাবালক পুত্র দ্বিতীয় আলী আদিল শাহ বিজাপুরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তার সিংহাসনে আরােহণের পর বিজাপুর রাজ্যে গােলযােগ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আওরঙ্গজেব এই বিশৃঙ্খলার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে সম্রাট শাহজাহানের সম্মতি নিয়ে মীরজুমলার সাহায্যে ১৬৫৭ খ্রীস্টাব্দে বিজাপুর আক্রমণ করেন। দীর্ঘ অবরােধের পর আওরঙ্গজেব বিজাপুরের বিদর ও কল্যাণীর দুর্গ দখল করেন। বিজাপুর রাজ্য বিজয় যখন সমাপ্তির পথে ঠিক তখনই দারার প্রভাবে শাহজাহান এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেন এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। শেষপর্যন্ত বিজাপুরের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের এক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে (১) বিজাপুরের সুলতান বিদর, কল্যাণী, পারেন্দা মুঘলদের ছেড়ে দেন; (২) যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ তিনি এক কোটি টাকা মুঘলদের প্রদান করতে স্বীকৃত হন। এভাবে শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতির ওপর যবনিকা পড়ে। এ প্রসঙ্গে স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, ‘Dara’s jealousy was rising in proportion to the success of his younger brother, and he at last persuaded the emperor to put an end to the war.’ (A Brief Survey of Muslim Rule in India, Mohar Ali, p:270)। আওরঙ্গজেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার পর দক্ষিণের শিয়া রাজ্যগুলাে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
শাহজাহানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি
ভারতের নিরাপত্তার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রকৃতি ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখলেও কেবলমাত্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথই বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এই পথ ধরেই প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে বিদেশী বিভিন্ন জাতির ভারতবর্ষে আগমন ঘটেছিল। মুসলিম শাসকেরা সর্বপ্রথম উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তার কথা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সুলতানি আমলে সুলতান বলবন ও সুলতান আলাউদ্দীন খলজী উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সর্বপ্রথম আকবর (রা. ১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে কান্দাহার দখল করেছিলেন এবং সেখানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছিলেন। কান্দাহার শুধুমাত্র সামরিক দিক থেকেই নয়, ভারত ও মধ্যএশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেও কান্দাহারের বিশেষ গুরুত্ব ছিল।
জাহাঙ্গীরের (রা. ১৬০৫-১৬২৭ খ্রি.) রাজত্বকালের শেষের দিকে অর্থাৎ ১৬২৩ খ্রীস্টাব্দে কান্দাহার মুঘলদের হস্তচ্যুত হয়। শাহজাহান সিংহাসনে আরােহণের পর তিনি পুনরায় কান্দাহার উদ্ধার করার ব্যাপারে সচেষ্ট হন। এ সময় পারস্য রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে কান্দাহারের শাসক ছিলেন আলী মর্দান খান। শাহজাহান সর্বপ্রথম আলী মর্দানকে কূটকৌশলে নিজ পক্ষে আনার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। অতঃপর শাহজাহান কান্দাহারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এমতাবস্থায় আলী মর্দান পারস্য রাজের সাহায্য প্রার্থনা করেন কিন্তু পারস্যের শাহ আলী মর্দানকে সন্দেহ করে তাকে কোন সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকেন এবং আলী মর্দানকে বন্দী করার চক্রান্ত করেন। এর ফলে আলী মর্দানের সঙ্গে পারস্যের শাহের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত আলী মর্দান কোন উপায় না দেখে তার নিরাপত্তার জন্য মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং কান্দাহার শাহজাহানের কাছে সমর্পণ করে দিল্লীতে চলে আসেন। মুঘল রাজদরবারে আলী মর্দান সাদর অভিনন্দন লাভ করেন এবং তাকে কাশ্মীর ও কাবুলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
কিন্তু শাহজাহান বেশীদিন কান্দাহার মুঘলদের অধিকারে রাখতে সমর্থ হননি। ১৬৪৮ খ্রীস্টাব্দে পারস্যের দ্বিতীয় শাহ আব্বাস (রা. ১৬৪২-১৬৬৬ খ্রি.) কান্দাহার পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হন এবং তিনি শীতকালে কান্দাহার অবরােধ করেন। কারণ তিনি জানতেন শীতকালে মুঘল সম্রাট কর্তৃক বিরাট সেনাবাহিনী কান্দাহারে প্রেরণ সম্ভব হবে না। যাইহােক, কান্দাহারে মােতায়েনকৃত মুঘল বাহিনী প্রায় দু’মাস অসীম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালান, কিন্তু দিল্লী থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে তারা শেষ পর্যন্ত ১৬৮৯ খ্রীস্টাব্দে পারস্যের শাহের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
কান্দাহারের পতন হলে শাহজাহান নিজের ভুল বুঝতে পারেন। কান্দাহার পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্য ১৬৪৯ খ্রীস্টাব্দে যুবরাজ আওরঙ্গজেব ও প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লাহ খানের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। মুঘল বাহিনী কান্দাহার অবরােধ করেন। কিন্তু দীর্ঘ চার মাস কান্দাহার অবরােধ করার পরও পারসিক গােলন্দাজ বাহিনীর বিপুল বিক্রমের কাছে মুঘল বাহিনীকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। মুঘল বাহিনী কান্দাহার থেকে প্রত্যাবর্তন করে। এরপর সম্রাট শাহজাহান তিন বছর ব্যাপক প্রস্তুতির পর আবার আওরঙ্গজেব ও সাদুল্লা খানের নেতৃত্ব কান্দাহারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযান প্রেরণ করেন। সম্রাট নিজে কাবুলে উপস্থিত থেকে সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি তত্ত্বাবধান করেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মুঘল বাহিনী কান্দাহার দুর্গ অবরােধ করেন। মুঘল বাহিনী দুই মাস কান্দাহার অবরােধ করেও তা দখল করতে ব্যর্থ হয়। পারসিকদের উন্নত গােলন্দাজ বাহিনীর কামানের গর্জনে মুঘল বাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়। এমতাবস্থায় সম্রাট শাহজাহান মুঘল বাহিনীকে কান্দাহার অবরােধ প্রত্যাহার করে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। আওরঙ্গজেব সম্রাটের কাছে কান্দাহার পুনরুদ্ধারের শেষ চেষ্টা করার অনুমতি প্রার্থনা করলে সম্রাট তার প্রার্থনা নামঞ্জুর করেন। এভাবে আওরঙ্গজেবের মত সুদক্ষ সেনানায়ক ভগ্নহৃদয়ে চরম অপমানের বােঝা মাথায় নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। শাহজাহানের দ্বিতীয়বার কান্দাহার অবরােধও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
কান্দাহার বিজয়ে আওরঙ্গজেবের ব্যর্থতায় দারা ভীষণ উল্লসিত হন এবং কান্দাহার বিজয়ের ভার তার ওপর অর্পণ করার জন্য পিতাকে অনুরােধ করেন। দারা ঘােষণা করেন যে, মাত্র সাত দিনের মধ্যে তিনি কান্দাহার জয় সম্পন্ন করবেন। শাহজাহান অন্ধ পিতৃস্নেহে দারাকে তৃতীয় কান্দাহার অভিযানের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন এবং তাকে সবচেয়ে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করেন। এই অভিযানে শাহজাহান দারাকে ৭০,০০০ অশ্বারােহী, ৫,০০০ পদাতিক সৈন্য, ৩,০০০ আহাদীয়, ১০,০০০ গােলন্দাজ, ৬,০০০ পরিখা খননকারী এবং ৫০০ পাথর খােদাইকারী সরবরাহ করেন। সম্রাট এই বাহিনীর সঙ্গে ৬০টি খুব যুদ্ধহস্তী এবং বিস্তর রসদ দান করেন। সম্রাট যুদ্ধ পরিচালনার জন্য দারাকে এক লক্ষ টাকা প্রদান করেন। (আব্দুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, পৃঃ ৩১৩)। মুঘল বাহিনী দীর্ঘ সাত মাস কান্দাহার অবরোধ করে রেখেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। দারার নেতৃত্বে তৃতীয় কান্দাহার অভিযানও চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর শাহজাহান আর কান্দাহার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেননি।
সম্রাট শাহজাহানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি ছিল ব্যর্থতার অন্যতম দৃষ্টান্ত। এই অভিযানের ফলে-
- (১) মুঘল রাজকোষের প্রভূত ক্ষতি হয়। যুদ্ধে বারাে লক্ষ টাকা ব্যয় হয় এবং অজস্র দক্ষ সৈন্য ও সেনাপতির প্রাণনাশ ঘটে;
- (২) এই যুদ্ধের ফলে মুঘল রাজশক্তির ক্ষমতা ও মর্যাদা বিনষ্ট হয় এবং মুঘল সেনাবাহিনীর দুর্বলতা এশিয়াবাসীর কাছে নগ্ন ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে;
- (৩) মুঘল সেনাবাহিনীর দুর্বলতা প্রকাশ পেলে দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তি দুর্বার হয়ে ওঠার সুবর্ণ সুযােগ পায়;
- (৪) শক্তিশালী মুঘল বাহিনীকে তিন তিনবার পরাজিত করার ফলে পারস্য সম্রাটের মনেও তার রাজ্যসীমা সম্প্রসারণ করার লােভ জাগে এবং বহুদিন ধরে মুঘল সম্রাট পারস্য আক্রমণের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। এ কারণেই এরূপ বলা হয়ে থাকে যে, ‘For years afterwards the Persian peril hung like a dark cloud on the western frontier of India.”
শাহজাহানের মধ্য-এশিয়া নীতি
সম্রাট শাহজাহান মধ্য-এশিয়াতেও রাজ্য সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তবে শাহজাহানের মধ্য-এশিয়া নীতি ফলপ্রসূ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে শাহজাহানের মধ্য-এশিয়া নীতি ছিল তার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার প্রতীক। শাহজাহানের মধ্য-এশিয়াতে সাম্রাজ্য বিস্তারের পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল।
- (১) ১৬৩৮ খ্রীস্টাব্দে শাহজাহান কান্দাহারের শাসনকর্তা আলী মর্দানের সহায়তায় কান্দাহার অধিকার করতে সক্ষম হন। কান্দাহার অধিকৃত হলে শাহজাহান রাজ্যবিস্তারের লক্ষ্যে মধ্য-এশিয়া জয়ের ইচ্ছা পােষণ করেন। সামরিক দিক থেকেও মুঘলদের মধ্য-এশিয়া জয়ের প্রয়ােজন ছিল।
- (২) মধ্য-এশিয়ার সমরখন্দ ছিল মুঘলদের পূর্বপুরুষ বিখ্যাত তৈমুর লঙ্গের (রা. ১৩৬৯-১৪০৫ খ্রি.) রাজধানী। সম্রাট বাবর ছিলেন সমরখন্দের অধিবাসী। তিনি সমগ্র জীবন সমরখন্দের কর্তৃত্ব লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীরও বাবরের ন্যায় একই আশা পােষণ করলেও মধ্য-এশিয়া অঞ্চলে মুঘল আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হননি। দাক্ষিণাত্য অভিযানে সাফল্য লাভ করে শাহজাহান তাই তার বিজয়নীতিকে আরও প্রসারিত করা এবং পূর্বপুরুষদের আবাসভূমি মধ্য-এশিয়া জয়ের জন্য বিশেষভাবে তৎপর হয়ে ওঠেন।
- (৩) বর্তমান আফগানিস্তানের উত্তরে অক্সাস নদী এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালার মধ্যখানে বালখ ও বাদাকশান নামক দুটি প্রদেশ ছিল। এই প্রদেশ দুটি শাহজাহানের পূর্বপুরুষদের দখলে ছিল। শাহজাহান এই প্রদেশ দুটি দখল করতে বদ্ধপরিকর হন। কারণ তিনি জানতেন বালখ ও বাদাকশান অধিকৃত হলে মুঘলদের স্বপ্নের সমরখন্দ সহজেই লাভ করা যাবে।
- (৪) মধ্য-এশিয়ার দুর্ধর্ষ-উজবেক জাতি প্রায় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে হামলা চালাতো। শাহজাহান ভারতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে দুর্ধর্ষ পার্বত্য উজবেক জাতির আক্রমণ প্রতিহত করে সে অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান করতে সচেষ্ট হন। সুতরাং শাহজাহানের মধ্য-এশিয়া অভিযানের পেছনে উজবেক জাতির দমন করা তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
শাহজাহান প্রথমে বালখ ও বাদাকশানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এ সময় প্রদেশ দুটি বুখারার রাজা নজর মহম্মদ খানের অধীনে ছিল। নজর মহম্মদ ও তার পুত্র আব্দুল আজিজ উভয়েই ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং তারা কাবুল ও গজনীর উপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করলে শাহজাহান ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু অনতিকাল মধ্যে আব্দুল আজিজ তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন। এমতাবস্থায় নজর মহম্মদ শাহজাহানের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই সুযােগে শাহজাহান পিতা-পুত্রের গৃহবিবাদ মেটাবার নাম করে, অথচ প্রকৃতপক্ষে বালখ ও বাদাকশান জয়ের উদ্দেশ্যে যুবরাজ মুরাদ ও আলী মর্দানের অধীনে ৫০,০০০ অশ্বারােহী এবং ১০,০০০ পদাতিক সৈন্যের এক বিরাট সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। শাহজাহান মুরাদকে নজর মহম্মদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার এবং সহযােগিতা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু মুরাদ নজর মহম্মদ উপেক্ষা করে মুঘল বাহিনীকে বালখ-এর দুর্গে প্রবেশ করার নির্দেশ দেন। মুঘল বাহিনী অতি সহজেই বালখ ও বাদাকশান অধিকার করে। মুরাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে নজর মহম্মদ পারস্যে পালিয়ে যান এবং পারস্যের শাহের সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু তিনি পারস্যের শাহের কাছ থেকে সাহায্য না পেয়ে অবশেষে নিজ রাজ্যে ফিরে আসেন। অন্যদিকে নজর মহম্মদের পুত্র আব্দুল আজিজ ট্রান্স-অক্সিয়ানায় মুঘলদের বিরুদ্ধে উজবেকদের সংঘবদ্ধ করেন। এ সময় মুরাদ বুখারার রাজনৈতিক অবস্থা চিন্তা করে এবং জলবায়ু তার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর বিবেচনা করে পিতার বিনা অনুমতিতেই মুঘল-বাহিনীকে মধ্য-এশিয়ায় রেখে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর শাহজাহান যুবরাজ আওরঙ্গজেব এবং সাদুল্লা খানকে বুখারায় প্রেরণ করেন। সম্রাট নিজেও কাবুলে গমন করেন এবং মধ্য-এশিয়া আক্রমণের প্রস্তুতির তদারক করেন। এ সময় উজবেকরা জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে মুঘল বাহিনীকে প্রায় বিপর্যস্ত করে তোলে। আওরঙ্গজেব কয়েকটি যুদ্ধে উজবেকজদের পরাজিত করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত উজবেকদের প্রচণ্ড বিরােধিতার ফলে মুঘলদের বালখ ও বুখারা দখলে রাখা সম্ভব হয়নি। অবশেষে বহু ক্ষতি স্বীকার করে মুঘল বাহিনীকে স্বদেশে ফিরে আসতে হয়। এভাবে শাহজাহানের পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি অধিকার করার স্বপ্ন ব্যর্থ হয়।
মধ্য-এশিয়ায় শাহজাহানের ব্যর্থতা মুঘলদের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই ক্ষতিসাধন করে। এই ব্যর্থতার ফলে একদিকে যেমন মুঘল রাজশক্তির ক্ষমতা ও মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হয় তেমনি মুঘল রাজশক্তির সামরিক দুর্বলতা এশিয়াবাসীর কাছে প্রকাশ পায়। মুঘলদের সামরিক ব্যর্থতার ফলে ভারতে মারাঠারা মুঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে উৎসাহী হয়। কান্দাহারও মুঘলদের হস্তচ্যুত হয়। এর ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারস্য মুঘলদের চরম প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই অভিযানের ফলে মুঘল রাজকোষেরও প্রভূত ক্ষতি হয়। যুদ্ধে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয় হয়। যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যাও ছিল অধিক। অপরিমিত রাজ্যলিপ্সার মূল্য মুঘল শাসনকে দিতে হয়। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার এদিক লক্ষ্য করে বলেছেন, “Such is the terrible price that aggressive imperialism makes India pay for wars across the North-Western frontier.” (Advanced History of India, p:468)।
সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল
মমতাজ মহল (‘মমতাজ মহল’ অর্থ রাজপ্রাসাদের অলঙ্কার) ছিলেন নূরজাহানের ভাই প্রভাবশালী মুঘল অভিজাত আসফ খানের একমাত্র কন্যা। তার বাল্য নাম ছিল আরজুমন্দ বানু বেগম। অসামান্য সৌন্দর্যের অধিকারিণী মমতাজ ১৫৯৪ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ষােল বছর বয়সে শাহজাদা খুররমের সঙ্গে অনেক ধুমধামের সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। সম্রাট শাহজাহানের আরও অনেক পত্নী ছিল, কিন্তু মমতাজ মহলই শাহজাহানের জীবনে প্রধান মহিষীর স্থান অধিকার করেছিলেন। মমতাজ যেমন স্বামীকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন তেমনি সম্রাটও তাকে অকৃত্রিম ও সুগভীরভাবে ভালবাসতেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন একে-অপরের সুখ-দুঃখ বেদনার সাথী। শাহজাহান মমতাজ মহলের পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করতেন না। তার তীক্ষ্মবুদ্ধি ও রাজনৈতিক পারদর্শিতার জন্য শাহজাহান তাকে ‘মালিকা ই-জামান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মমতাজ মহল ছিলেন সুশিক্ষিত, উদার ও উন্নতমনা চরিত্রের অধিকারী একজন রমনী। গরীব, বিধবা এবং অনাথ বালক বালিকাদের তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা। তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন এবং রােজা রাখতেন। ১৬৩১ খ্রীস্টাব্দের জুন মাসে চতুর্দশ সন্তান প্রসবকালে মমতাজ মহল শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রিয় স্ত্রীর মৃত্যুতে শাহজাহান অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং প্রায় একমাস দরবারে বসেননি। প্রিয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি প্রায় বলতেন, “রাজ্যে আর কোন মাধুর্য নেই, আমার জীবনে আর কোন মােহ নেই।” শাহজাহান তার প্রিয়তম পত্নীর স্মৃতি অমর করে রাখবার জন্য যমুনা নদীর তীরে পৃথিবী বিখ্যাত তাজমহল নির্মাণ করেন। তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি এবং দাম্পত্য প্রেমের এক অবিস্মরণীয় প্রতীকরূপে কেয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের ভাষায়, ‘The emperor fully requited her devotion by building the Taj, which will remain for all time to come the noblest monument of conjugal love and fidelity.’ (A Short History of Mulsim Rule in India, p: 386)
শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব
সম্রাট শাহজাহানের শেষ জীবন চরম দুঃখ দুর্দশা ও অবমাননার মধ্য দিয়ে অতিবহিত হয়েছিল। ১৬৫৭ খ্রীস্টাব্দে বৃদ্ধ সম্রাট অসুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিংহাসন নিয়ে তার পুত্রদের মধ্যে উত্তরাদিকার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব ছিল শাহজাহানের রাজত্বকালের সবচেয়ে অগৌরবময় এবং কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। শাহজাহানের চার পুত্র ও দুই কন্যা জীবিত ছিল। তারা সকলেই মমতাজের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তান ছিলেন। দারা ছিলেন জ্যেষ্ঠ, সুজা দ্বিতীয়, আওরঙ্গজেব তৃতীয় এবং মুরাদ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার দুই কন্যার মধ্যে জাহানারা ছিলেন জ্যেষ্ঠ এবং রওশনআরা ছিলেন কনিষ্ঠ। ভাইদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিরােধে জাহানারা দারার পক্ষে এবং রওশনারা আওরঙ্গজেবের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন।
জােষ্ঠ্যপুত্র দারা ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের সর্বাধিক প্রিয় এবং সম্ভবত শাহজাহান তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। দারা পাঞ্জাব, মুলতান ও এলাহবাদের শাসনকর্তা ছিলেন। তবে তিনি পিতার সঙ্গে আগ্রায় অবস্থান করতেন এবং রাজকার্য পরিচালনায় পিতাকে সাহায্য করতেন। সবসময় পিতার অত্যধিক স্নেহে থাকার ফলে শাসনকার্য, কূটনীতি ও সৈন্য পরিচালনার ব্যাপারে দারা বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভের সুযােগ পাননি। কিন্তু দারা বিদ্বান, বিদ্যোৎসাহী এবং আকবরের ন্যায় ধর্ম বিষয়ে উদার ছিলেন। তিনি মুসলমান সুফী ও হিন্দু বেদান্ত দার্শনিকদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন এবং হিন্দু পণ্ডিতদের সাহায্যে তিনি বেদ ও উপনিষদ ফার্সী ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করেছিলেন। আকবরের ন্যায় তিনিও ছিলেন সকল ধর্মের সারগ্রাহী। ধর্মীয় বিষয়ে দারার উদারতার ফলে গোড়া মুসলমানরা তাকে সুনজরে দেখতেন না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন দাম্ভিক এবং তিনি কারও পরামর্শ বা উপদেশ গ্রহণ করতেন না। এ কারণে রাজদরবারে অভিজাতবর্গের অনেকেই তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন। সুতরাং বলা যায় বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হওয়ার যােগ্যতা দারার ছিল না। দ্বিতীয় পুত্র সুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। তিনি তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন, সাহসী, কুটকৌশলী এবং মেধাবী ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘকাল বাংলায় আরামপ্রদ আবহাওয়ায় কাটিয়ে তিনি অত্যন্ত সুখী ও অলস হয়ে পড়েছিলেন। মদ ও নারী তার জীবনের সর্বনাশ করেছিল। এসব কারণে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি অক্ষম ছিলেন।
তৃতীয় পুত্র দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা আওরঙ্গজেব ছিলেন শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ও সাহসী। তিনি ছিলেন দয়ালু, ধমভীরু, আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ়চরিত্রের অধিকারী। সামরিক দক্ষতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং কূটনীতিতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি ছিলেন একজন গােঁড়া সুন্নী মুসলমান এবং সে কারণে তিনি ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সমর্থন লাভ লাভ করেছিলেন। সিংহাসন লাভের উপযুক্ততা বিচারে শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে আওরঙ্গজেবের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেই হবে। কনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন সাহসী যােদ্ধা। ঐতিহাসিক লেনপুল তার চরিত্র বিশ্লেষণে বলেন, “শাহজাহানের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন একজন তেজস্বী আস্ফালনকারী, সিংহের মত সাহসী, দিনের ন্যায় স্পষ্টভাষী, রাজনীতিতে নির্বোধ, কূটনীতিতে হতাশাগ্রস্ত এবং তরবারী চালনায় সিদ্ধহস্ত।” (“The youngest son of Shah Jahan was a gallant swash-buckler, brave as a lion, frank and open as the day, a fool in politics, despair in statecraft and a firm believer in ruddy steel”- S. Lane people, Medieval India.) মদ ও নারীর প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি থাকায় তিনিও সুজার মত অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলেন।
উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের কারণসমূহ
শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের জন্য প্রধানত যে কারণগুলাে দায়ী ছিল –
- ১। মুসলিম ভারতে সিংহাসন লাভের জন্য সুষ্ঠু কোন উত্তরাধিকার আইন ছিল না। সিংহাসন লাভের জন্য “জোর যার মুল্লুক তার” (survival of the fittest) নীতি অনুসৃত হত। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান সকলেই প্রতিদ্বন্দ্বী নিকট আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সংঘটিত দ্বন্দ্বে বিজয় লাভ করে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। সুতরাং উত্তরাধিকার নীতির অভাবে শাহজাহানের অসুস্থতার সুযােগে তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল এক সাধারণ ব্যাপার।
- ২। শাহজাহান যখন কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হন তখন জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা আগ্রায় পিতার কাছে উপস্থিত ছিলেন এবং সিংহাসনে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি ভাইদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন –
- (১) তিনি রাজধানীতে অবস্থানরত তার ভাইদের ভকিল বা প্রতিনিধিগণকে রাজদরবার তথা সম্রাটের অসুস্থতা সম্পর্কে কোন তথ্য স্ব স্ব প্রভুদের কাছে না পাঠানাের নির্দেশ দেন।
- (২) তিনি রাজধানীর সাথে বাংলা, গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যের পথগুলাে বন্ধ করে দেন যাতে রাজধানীর কোন সংবাদ প্রদেশে পৌঁছতে না পারে।
- (৩) তিনি তার ভাইদের বিশেষ করে আওরঙ্গজেবকে দুর্বল করার লক্ষ্যে ভাইদের অধীনস্থ সকল সুযােগ্য সেনাপতিকে রাজধানীতে ডেকে পাঠান। দারার এসব পদক্ষেপের ফলে তার ভাইদের মনে এ আশঙ্কার জন্ম নেয় যে, শাহজাহানের মৃত্যু হয়েছে। ফলে সকলেই সিংহাসন লাভের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। সুতরাং উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব সংঘটিত হওয়ার পেছনে দারাই মূলতঃ যে দায়ী ছিলেন তা বলা যায়।
- ৩। সিংহাসন নিয়ে পুত্রদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের জন্য শাহজাহানও কম দায়ী ছিলেন না। সুস্থ হওয়ার পর সম্রাট যদি নিজ হাতে শাসনভার গ্রহণ করতেন তাহলে হয়তো পুত্রদের মধ্যে বিবাদ এড়ানাে যেত। তার উচিৎ ছিল মৃত্যু সম্পর্কে গুজব অস্বীকার করে সত্য ঘটনা প্রকাশ করা। (“The war could be prevented or at best postponed if Shah Jahan had reasserted his authority immediately after his recovery from his illness… He ought to have contradicted the rumour of his death and averted the course which events had taken.” – Mohar Ali, A Brief Survey of Muslim Rule in India, P – 272). কিন্তু সম্রাট এসবের পরিবর্তে দারার হাতে শাসনভার ন্যস্ত রেখে এবং তার প্রতি অন্ধ স্নেহ ও অনুরাগ প্রদর্শন করে অন্যান্য পুত্রদের মনে হিংসা ও ঈর্ষার উদ্রেকে সহায়তা করেন।
- ৪। বর্তমানে অনেক গবেষক উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের জন্য আওরঙ্গজেবের প্রতি শাহজাহানের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণকে দায়ী করেন। তাদের মতে, মুসলিম আইনে যখন সিংহাসন লাভের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পুত্রের দাবিকে মেনে নেয়া হয়নি, তখন অযোগ্য দারার প্রতি অযথা পক্ষপাতিত্ব না করে শাহজাহানের উচিৎছিল সিংহাসনের ওপর আওরঙ্গজেবের দাবিকে সমর্থন করা। এটি একদিকে যেমন উত্তরাধিকার মনোনয়নের ক্ষেত্রে সম্রাটের সুবিবেচনার নিদর্শন হয়ে থাকতো, অপরদিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকেও এড়ানো যেতো।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রধান ঘটনাবলী
আওরঙ্গজেব তার ভগ্নী রওশানারার মাধ্যমে রাজধানীর সকল সংবাদই পাচ্ছিলেন। যাই হােক, সর্বপ্রথম বাংলার শাসনকর্তা সুজা বাংলার তদকালীন রাজধানী রাজমহল থেকে নিজেকে সম্রাট বলে ঘােষণা করে বিহার অধিকার করেন এবং আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে দারার পুত্র সুলায়মানশিকো রাজা জয়সিংহের সাহায্যে বাহাদুরপুর নামক স্থানে তাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলে সুজা বাংলায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। এদিকে মুরাদও নিজেকে সম্রাট বলে ঘােষণা করেন। কিন্তু সুচতুর আওরঙ্গজেব তা না করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। আওরঙ্গজেব কূটকৌশলে মুরাদকে নিজ দলভূক্ত করেন এবং তার সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে স্থির করা হয় যে, তারা একযোগে দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন এবং যুদ্ধে জয়ের পর সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেবেন।
ধর্মাটের যুদ্ধ (১৬৫৮): আওরঙ্গজেব ও মুরাদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর উভয়েই রাজধানী আগ্রার দিকে অগ্রসর হন এবং উভয়ের সেনাবাহিনী উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী ধর্মাট নামক স্থানে উপস্থিত হয়। শাহজাহানের আদেশে দারা রাজা যশােবন্ত সিংহ এবং কাশিম খানকে তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ১৬৫৮ খ্রীস্টাব্দের ধর্মাটের রণক্ষেত্রে উভয় সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। কিন্তু উন্নত রণকৌশলের ফলে আওরঙ্গজেব ধর্মাটের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে আওরঙ্গজেবের সামরিক খ্যাতি ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
সামুগড়ের যুদ্ধ (১৬৫৮) : বিজয়ী আওরঙ্গজেব ও মুরাদ এরপর সেনাবাহিনীসহ আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হয়ে আগ্রা থেকে ষাট মাইল দূরে সামুগড় নামক স্থানে উপস্থিত হন। দারা ধর্মাটের যুদ্ধে পরাজয়ের কথা শুনে অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েন। এবার তিনি ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে স্বয়ং আওরঙ্গজেব ও মুরাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। রামসিংহের নেতৃত্বে রাজপুতরাও দারার সঙ্গে যােগ দেন। ১৬৫৮ খ্রীস্টাব্দের ২৯ মে সামুগড় নামক স্থানে উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। কিন্তু এবারও আওরঙ্গজেবের নিপুন রণকৌশলের কাছে দারা পরাজিত হন। সামুগড়ের যুদ্ধেই প্রকৃতপক্ষে দারার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।
দারা কিছু অনুগত সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবে পলায়ন করেন। আওরঙ্গজেব অবিলম্বে আগ্রায় উপস্থিত হয়ে আগ্রা দুর্গ অবরােধ করেন। এরপর তিনি পিতাকে আগ্রার দুর্গে নজরবন্দী করে নিজ হাতে শাসনভার গ্রহণ করেন। সম্রাট পদ গ্রহণ করার পর আওরঙ্গজেব ইতিহাসের পাতা থেকে ভাইদের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেন। তিনি সুকৌশলে দারাকে আটক করে গােয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করে রাখেন। ইতােমধ্যে মুরাদ আওরঙ্গজেবের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন। ১৬৬১ খ্রীস্টাব্দে ৪ ডিসেম্বর গুজরাটের দেওয়ান নকী খানকে হত্যার অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ইতােমধ্যে সুজা পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করে শক্তি বৃদ্ধি করেন। আওরঙ্গজেব সুজার বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। ১৬৫৯ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে উভয়ের মধ্যে খজওয়া নামক স্থানে ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে সুজা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন। অতঃপর সুজা বাংলার ভেতর দিয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে, ১৬৬০ খ্রীস্টাব্দে আরাকান মগ কর্তৃক সুজা নিহত হন।
এদিকে দারা পাঞ্জাব থেকে মুলতান, মুলতান থেকে গুজরাট এবং গুজরাট থেকে রাজপুতনায় পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। এ সময় যােধপুরের রাজা যশােবন্ত সিংহ দারাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দারা সসৈন্যে গমন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যশােবন্ত সিংহ আওরঙ্গজেবের ভয়ে দারাকে সাহায্য দিতে সাহস পাননি। অতঃপর দারা দেওয়াই-এর গিরিপথ অধিকার করার চেষ্টা করলে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধেও তিনি পরাজিত হন এবং আহম্মদাবাদে পলায়ন করেন। কিন্তু এলাহবাদের শাসনকর্তা তাকে শহরে প্রবেশের অনুমতি না দিলে দারা দাদরের বালুচ নেতা মালিক জিওয়ানের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কয়েক বছর পূর্বে জিওয়ান খান দারার সাহায্যে সম্রাটের প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। কিন্তু অকৃতজ্ঞ জিওয়ান অর্থলােভের কারণে দুই কন্যা ও পুত্র সহ দারাকে মুঘলদের হাতে সমর্পণ করেন। বন্দী অবস্থায় দারাকে দিল্লীতে নিয়ে আসা হয় এবং আওরঙ্গজেবের নির্দেশ অনুসারে দারাকে প্রকাশ্য রাজপথে কুৎসিত হাতির পিঠে চড়িয়ে জনসমক্ষে অপমান করা হয়। কিছুকাল কারাভােগের পর ১৬৫৯ খ্রীস্টাব্দে ধর্মদ্রোহিতার অভিযােগে দারাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়। দারার ছিন্নমুণ্ডু আওরঙ্গজেবের কাছে পাঠানাে হয়। আওরঙ্গজেব পুনরায় দারার মৃতদেহকে দিল্লীর রাস্তায় ঘোরাতে আদেশ দেন যাতে জনসাধারণের মনে দারার মৃত্যু সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহ না থাকে। (ডঃ আব্দুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন পৃঃ ৩২৯)। এভাবে উত্তরাধিকারের দাবা খেলায় বুদ্ধির চালে আওরঙ্গজেব বিজয়ী হন এবং ১৬৫৯ খ্রীস্টাব্দের ৫ জুন সিংহাসনে আরােহণ করেন।
আওরঙ্গজেবের সাফল্যের কারণ
আওরঙ্গজেব নানা কারণে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে সাফল্য লাভ করেছিলেন। তার সাফল্যের কারণসমূহ –
- ১। সম্রাট শাহজাহানের দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা আওরঙ্গজেবের সাফল্যের প্রধান কারণ ছিল। সম্রাট অসুস্থ হয়ে পড়লে তার মৃত্যু সংবাদ চারদিকে ছাড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শাহজাহান তার মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ প্রচার বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা নেননি। আরােগ্য লাভের পর শাহজাহান নিজ হাতে ক্ষমতা গ্রহণ করলে পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের উদ্ভব হত না। তিনি যখন দেখলেন মুরাদ ও আওরঙ্গজেব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন তার সসৈন্যে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু সম্রাট কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নিস্ক্রিয় থাকেন। শাহজাহানের অদূরদর্শিতার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
- ২। সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিকেরা আওরঙ্গজেবের সাফল্যের জন্য তার ধর্মপ্রবণতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে মত প্রকাশ করেছেন। তার মতে, আকবরের সময়কাল থেকেই ভারতের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইসলামের গৌরবকে পুনরুদ্ধার করবার জন্য একজন প্রকৃত নেতার অনুসন্ধান করছিলেন। ইসলামের প্রতি আওরঙ্গজেবের অনুরাগ লক্ষ্য করে সুন্নী ও ধর্মভীরু মুসলমানগণ আওরঙ্গজেবকে ইসলামের রক্ষক হিসেবে মনে করে তার পতাকাতলে সমবেত হয় এবং হিন্দুঘেষা দারার বিরুদ্ধে সর্বতােভাবে সমর্থন ও সহযােগিতা করে। প্রকৃতপক্ষে জনসমর্থনই ছিল আওরঙ্গজেবের সাফল্যের প্রধান কারণ।
- ৩। আওরঙ্গজেবের সাফল্যের অপর কারণ ছিল তার ব্যক্তিগত গুণাবলী। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সমর নেতা, সুদক্ষ প্রশাসক এবং সুচতুর কূটনীতিক। যুদ্ধ পরিচালনায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এবং রণক্ষেত্রে ভাইদের মধ্যে কেউই তার সমকক্ষ ছিলেন না। তার খােদা ভক্তি, সততা, সামর্থ এবং সদয় ব্যবহারের কারণে সাম্রাজ্যের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত অনেক কর্মকর্তা ও সেনাপতি তার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। বিপদের সময় তার শত্রুপক্ষের অনেকে তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। এমনকি শাহজাহান ও তার মন্ত্রীরাও আওরঙ্গজেবকে সম্রাটের পুত্রদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা যােগ্য বলে অভিহিত করেছিলেন। (“Some anecdotes have come down to us which prove that. Aurangzib was regarded by the ministers and even by Shah Jahan himself as the ablest of the princes” – J.N. Sarkar, A Brief Survey of Muslim Rule in India. p:284.)। অপরপক্ষে দারা, সুজা ও মুরাদ কেউই সেনাপতিত্বে, রাজনীতিতে এবং কূটনীতিতে আওরঙ্গজেবের সমকক্ষ ছিলেন না। ড. আব্দুল করিম বলেন, “দারা পিতার অত্যধিক ৱেহ ও ভালবাসার কারণে বড় যােদ্ধা এবং রাজনীতিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারেননি। দারা জ্ঞানী ও গুণী হিসেবেই বড় হয়ে ওঠেন।” ঐতিহাসিক লেনপুল দারা সম্পর্কে বলেন, ‘Dara himself was a nervous, sensitive impulsive creature, full of the fine feelings and vivid emotions, never master of himself or of others, and liable to lose his self-control just when cool judgement was necessary. He might have been a poet or transcendental philosopher; he could never have become a ruler of India.’
- ৪। দারার সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলার বড় অভাব ছিল। তার অধীনে রাজপুত ও মুসলিম সৈন্যবাহিনীর মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। রাজপুতদের প্রতি দারার অতিরিক্ত নির্ভরতা মুসলিম সেনাপতিরা সুনজরে দেখেননি। এছাড়া দারার রুক্ষমেজাজ এবং উদ্ধত আচরণ অনেককে তার প্রতি বৈরী করে তুলেছিল। অপরপক্ষে, আওরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী ছিল সুসংঘবদ্ধ। একক নেতৃত্বে পরিচালিত দারার বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনায় তিনি অনেক বেশি কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। দারার সেনাবাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়লে তখনই আওরঙ্গজেব তার বাহিনীকে প্রতিপক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিতেন।
- ৫। পরিশেষে বলা যায়, উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে আওরঙ্গজেবের সাফল্যের প্রধানতম কারণ ছিল তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, “আওরঙ্গজেবের বিজয় ছিল নিস্ক্রিয়তার ওপর তরিৎকর্মতার, জড়তার ওপর নির্ভিকতার, বিশৃঙ্খলা ও অসামঞ্জস্যতার ওপর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার বিজয়।” (“The Victory of Aurangzeb was the victory of action over supineness, of intrepidity over inertia, and of organisation and discipline over confusion and incoherence.” – History of Muslim Rule in India. p:455)।
শাহজাহানের মৃত্যু (১৬৬৬)
শাহজাহানের শেষ জীবন অত্যন্ত দুঃখে অতিবাহিত হয়েছিল। তাকে দীর্ঘ আট বছর নজরবন্দী অবস্থায় আগ্রা দুর্গে কাটাতে হয়। বন্দী অবস্থায় সম্রাটের পাশে ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারা। সম্রাট বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করেও সফল হননি। মানুচি লিখেছেন যে, কারাগারে সম্রাটের এক জোড়া জুতার দরকার হলে তাকে অতি সাধারণ জুতা সরবরাহ করা হয়। তিনি কারাগারে সাধারণ বন্দীর সুযােগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন। যদিও সমসাময়িক অন্যান্য তথ্য থেকে জানা যায়, আওরঙ্গজেব কোন সুযােগসুবিধা থেকে তার পিতাকে বঞ্চিত করেননি। প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের মৃত্যু এবং পর পর তার প্রিয় পুত্রদের মৃত্যুতে শাহজাহান একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে শাহজাহান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৩১ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আওরঙ্গজেব পিতাকে তার মায়ের নামে শ্রেষ্ঠ সৌধ ‘তাজমহলে’ সমাহিত করেন।
শিল্প ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে শাহজাহান
সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালকে ভারতে মুঘল শাসনের ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। কারণ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, নিরাপত্তা, সাহিত্য ও শিল্পকলা সব দিক দিয়ে বাবর প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্য তার শাসনামলে গৌরবের চরম শিখরে উপনীত হয়। তার শাসনামলে মুঘল কোষাগারে রাজস্ব ও বাণিজ্য থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ সঞ্চিত হয়। এরই ফলে শাহজাহানের রাজত্বকাল স্থাপত্য শিল্পের বিকাশে মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসে গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছে। প্রকৃতপক্ষে স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষতার জন্যই ঐতিহাসিকেরা তার রাজত্বকালকে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে তিনি ভারতবর্ষে যেন বিপ্লব এনেছিলেন।
সম্রাট শাহজাহান ছিলেন একজন মহান স্থপতি এবং এজন্য ঐতিহাসিকেরা তাকে ‘The prince of builders’ বলে অভিহিত করেছেন। তার স্থাপত্য শিল্প ভারতীয় ও পারসিক স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল। তবে শাহজাহান তার স্থাপত্য শিল্পে রঙের আতিশয্য ও আড়ম্বরকে অধিক গুরুত্ব দেন। শুধু তাই নয়, স্থাপত্যের ক্ষেত্রে তিনি লালপাথরের পরিবর্তে শ্বেতপাথরের ব্যবহার করে ভারতীয় রীতি থেকে সরে এসেছিলেন। শ্বেতপাথর ছিল সম্রাটের কাছে খুবই প্রিয় এবং তার নির্মিত সকল ইমারতে শ্বেতপাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, শ্বেতপাথরের ব্যবহার ঘটিয়ে শাহজাহান ভারতীয় স্থাপত্য রীতিকে এক অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী করেছিলেন।
শাহজাহানের স্থাপত্য নিদর্শনের বিবরণ –
- ১। দেওয়ান-ই-য়াম ও দেওয়ান-ই-খাস : দিল্লীর লালকেল্লার অভ্যন্তরে নির্মিত ‘দেওয়ান-ই-য়াম’ ও ‘দেওয়ান-ই-খাস’ শাহজাহানের শিল্পকীর্তির অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন। ১৬২৭ খ্রীস্টাব্দে শাহজাহান তার সিংহাসনে আরােহণের বছরেই ‘দেওয়ান-ই-য়াম’ নির্মাণ করেন। দেওয়ান-ই-য়াম এর পেছনেই নির্মিত হয় অনুপম শিল্প-শৈলীসম্পন্ন ‘দেওয়ান-ই-খাস’। ‘দেওয়ান ই-য়াম’ ও ‘দেওয়ান-ই-খাস’ ছিল প্রশস্ত হলঘর এবং এই জাঁকজমকপূর্ণ হলঘর দুটিতে সম্রাট সভাসদদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতেন। ‘দেওয়ান ই-য়াম’-এর থাম ও গম্বুজের আকার এমনভাবে করা হয় যে, সম্রাট আস্তে কথা বললেও সকলে তা শুনতে পেতেন এবং যে কোন স্থান থেকে সম্রাটকে দেখা যেত। ‘দেওয়ান-ই-খাস’ ছিল সম্রাট শাহজাহানের মতে এক অনবদ্য সৃষ্টি। এর ছাদ ছিল রূপার পাতে মােড়া এবং এর তিনদিকে মার্বেল, সােনা ও মণি-মুক্তার অলংকার দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। সম্রাট শাহজাহান ‘দেওয়ান-ই-খাস’-এর অনুপম সৌন্দর্য অক্ষয় করে রাখার উদ্দেশ্যে এখানেই ফার্সী ভাষায় খােদাই করে রেখেছিলেন এই বলে – “দুনিয়ার বুকে যদি স্বর্গ কোথা রহে, শুধু এই খানে, শুধু এই খানে, শুধু এই খানে।” (“If there is a paradise on the face of the earth, it is this, it is this, it is this.” ফারসিতে “আগর ফেরদৌস সেবরুইয়ে জমি আস্ত/হামি আস্ত, হামি আস্ত ও হামি আস্ত”)।
- ২। মতি মসজিদ : মতি মসজিদকে মুঘল স্থাপত্যের এক অনবদ্য শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করা হয়। শাহজাহান অন্তঃপুরিকাদের জন্য আগ্রার প্রাসাদ দুর্গের অভ্যন্তরে শ্বেতপাথরের এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক ফার্গুসন শিল্প- সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বিচার করে মসজিদটিকে- “One of the purest and most elegant buildings of its class to be found anywhere” বলে উল্লেখ করেছেন। এই মসজিদটি নির্মাণ করতে ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। এই মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৪৮ খ্রীস্টাব্দে এবং শেষ হয়। ১৬৬২ খ্রীস্টাব্দে।
- ৩। দিল্লীর জামে মসজিদ : শাহজাহানের নির্মিত অপূর্ব সৌধাবলীর মধ্যে দিল্লীর জামে মসজিদ অন্যতম। এটি ভারতের বৃহত্তম মসজিদগুলাের অন্যতম। এখানে প্রায় এক লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান নামাজ আদায় করতে পারেন।
- ৪। শাহজাহানবাদ : সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৯ খ্রীস্টাব্দে রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করেন এবং নিজের নামে এর নাম রাখেন শাহজাহানবাদ। এটিই বর্তমানে নতুন দিল্লী নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক ফার্গুসনের মতে শাহজাহানবাদে তার রাজপ্রাসাদ শুধু প্রাচ্যে নয়, হয়তো গােটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুরম্য, সবচেয়ে স্থাপত্যভূষণখচিত, সবচেয়ে বিস্ময়ােদ্দীপক।
- ৫। লালকেল্লা দুর্গ : সম্রাট শাহজাহান আগ্রা দুর্গের অনুকরণে দিল্লীর অনতিদূরে ‘লালকেল্লা’ তৈরী করেন। লাল বেলেপাথরের তৈরী সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত এই প্রাসাদের বিশালতা আজও বিশ্বের স্থাপত্যবিদদের কাছে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। অধ্যাপক তেসলিম চৌধুরীর ভাষায়, “এই দুর্গ মুঘল স্বৈরতন্ত্রের নিদর্শন হলেও, বর্তমান ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের গৌরব বহন করে চলেছে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে। দিল্লী আজও ভারতের রাজধানী। তাই অতীতের স্মৃতি ও বর্তমানের রাজনৈতিক মর্যাদার দ্যোতক এই প্রাসাদ দুর্গ।” (মধ্যযুগের ভারত : মুঘল আমল, পৃঃ ২৮৯)।
- ৬। ময়ূর সিংহাসন : ভুবন বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন সম্রাট শাহজাহানের স্থাপত্য-শিল্পের অন্যতম আর এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পারস্যের বিখ্যাত শিল্পী বেবাদল খান দীর্ঘ সাত বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই সিংহাসন নির্মাণ করেন। এটি নির্মাণে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। সিংহাসনের নীচে রত্ন খচিত ময়ুর বাহন হিসেবে সিংহাসনকে পিঠে করে রাখত। সিংহাসনের মাথায় ছিল পৃথিবী বিখ্যাত কোহিনুর হীরা ও রত্নখচিত ছাতা। জোড়া ময়ুরের মধ্যস্থলে মুক্তো দিয়ে তৈরী অকৃত্রিম আঙুরের থােকা ঝুলত এবং মনে হত ময়ুরেরা সেগুলাে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। এ এক অভূতপূর্ব শিল্প সৌন্দর্য। সিংহাসনটি লম্বায় ৩ গজ, প্রস্থে ২ গজ এবং উচ্চতায় ৫ গজ ছিল। ১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে পারস্য সম্রাট নাদির শাহ দিল্লী লুণ্ঠনকালে মহামূল্যবান ময়ূর সিংহাসনটি নিয়ে যান। তারপর এই সিংহাসনটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
- ৭। রঙ মহল : রঙ মহল সম্রাট শাহজাহানের আর এক অনবদ্য সৃষ্টি। এটি ছিল একটি দরবার হল এবং এখানে সম্রাট শাহজাহান পরিবার পরিজন নিয়ে ক্লান্তিকর জীবনের অবসাদ থেকে আনন্দ উপভােগ করতেন। ঐতিহাসিকেরা ‘রঙমহল’কে ‘স্বর্গের কল্পিত নন্দনকাননের থেকেও সুন্দর’ বলে মতপ্রকাশ করেছেন। রঙ মহলের মেঝে ছিল শুভ্র মার্বেলে পরিবৃত এবং ছাদের নীচে সােনার পাত ব্যবহার করা হয়েছিল। এর চারিদিক মনি-মুক্তায় সুসজ্জিত ছিল। রঙ মহলের মধ্যে ছিল একটি জলের ফোয়ারা। সত্তর মাইল দূর থেকে যমুনা নদীতে বাধ দিয়ে ক্যানেলের সাহায্যে এখানে জল সরবরাহ করা হত। জল সরবরাহের ফলে এই সৌধে এক মােহময় স্বর্গীয় সপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এজন্য পার্সি ব্রাউন এটিকে “stream of paradise” বলে অভিহিত করেছেন।
- ৮। তাজমহল : সম্রাট শাহজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কীর্তি হল প্রিয়তমা পত্নী মমতাজ মহলের স্মৃতিসৌধ আগ্রার তাজমহল। শিল্প সৃষ্টির দিক দিয়ে একে বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় বলে মনে করা হয়ে থাকে। এটি শুধুমাত্র মুঘল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রমাণ করে না, বরং যুগ যুগ ধরে দাম্পত্য প্রেমের এক অবিস্মরণীয় প্রতীকরূপে এটি সমাদৃত। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের ভাষায়, “Taj still remains the foremost monument of conjugal love and fidelity in the world.” তাজমহল সম্পর্কে স্যার এডউইন আরনল্ড (Sir Edwin Arnold) লিখেছেন –
“Not architecture,
as all other are,
But the proud passion of an
Emperor’s love.”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন –
“হীরা-মুক্তা মানিক্যের ঘটা
যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা
যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,
শুধু থাক,
একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।’
শাহজাহান – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তাজমহলের গঠন-পরিকল্পনা কে বা কারা করেছিলেন সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। ফাদার মানরিকের মতে, ভেনেসীয় শিল্পী জারােনিমা ভেরােনা তাজমহলের গঠন পরিল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এ মতের সমর্থনে সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ নেই। প্রকৃতপক্ষে, পারস্যের ওস্তাদ ইসা ছিলেন তাজমহলের প্রধান স্থপতি। মূল পরিকল্পনা করেছিলেন শিল্পী ইসফামদিয়ার রুমী। ইউরােপীয় পর্যটক টেভার্ণিয়ারের মতে, তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৩৩ খ্রীস্টাব্দে। এবং সুদীর্ঘ ২২ বছর ধরে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে এই সৌধ নির্মিত হয়। যদিও সমসাময়িক ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহােরীর মতে, এই সৌধ নির্মাণ করতে ১২ বছর সময় লেগেছিল এবং ব্যয় হয়েছিল ৫০ লক্ষ টাকা। তাজমহলের দেয়ালে কোরআনের বাণীগুলাে খােদাই করেন আমানত খান সিরাজী। দূর হতে অক্ষরগুলো দেখলে মনে হয় প্রস্ফুটিত পুষ্পদল। সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত অন্যান্য স্থাপত্য-শিল্প ছিল যথাক্রমে শিশমহল, মুসলমানবুরুজ, নাগিনা মসজিদ ইত্যাদি।
সাহিত্য : আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলের সাহিত্য-চর্চা শাহজাহানের রাজত্বকালেও অব্যাহত ছিল। সম্রাটের পৃষ্ঠপােষকতায় মুঘল রাজদরবার শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। তার রাজসভায় বিদ্বান, শিল্পী ও গুণীর সমাদর ছিল। বিহারীলাল, সুন্দর দাস, চিন্তামণি, জগন্নাথ, কবীন্দ্র আচার্য, সুখ সেন প্রমূখ পণ্ডিত তার দরবার অলকৃত করেছিলেন। যােগ্যতা অনুযায়ী সম্রাট সকলকে পুরস্কৃত করতেন। তার রাজত্বকালে যেসব বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে ‘পাদশানামার’ রচয়িতা আব্দুল হামিদ লাহােরী, ‘শাহজাহাননামার’ লেখক ইনায়েত খান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সমাটের জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশিকো একজন খ্যাতনামা কবি ও দার্শনিক ছিলেন এবং তিনি উপনিষদ, ভগবদগীতা প্রভৃতি গ্রন্থ সংস্কৃত হতে ফার্সিতে অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়া দারাশিকো ‘সিয়র-উল-আউলিয়া’ ও ‘মজম-উল-বাহরাইন’ নামক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
সঙ্গীত : সঙ্গীতের প্রতিও শাহজাহানের প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি নিজে একজন ভাল গায়ক ছিলেন এবং নিজ হাতে সঙ্গীত যন্ত্র বাজাতে পারতেন। তিনি একজন গীতিকারও ছিলেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার উল্লেখ করেন যে, শাহজাহানের রচিত কতকগুলাে হিন্দী সঙ্গীত শ্রবণ করে দরবারের অনেক শ্ৰোতাই তন্ময় হয়ে পড়তেন। তার রাজদরবারে স্বনামধন্য সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে তানসেনের জামাতা লাল খান, মুহম্মদ সালিহ ও জগন্নাথের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য।
চিত্রশিল্প : হুমায়ুনের রাজত্বকালে চিত্রকলার উন্মেষ হয় এবং জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে মুঘল চিত্র-শিল্প গৌরবের চরম শিখরে আরােহণ করে। শাহজাহানের রাজত্বকালেও চিত্র-শিল্পের উন্নতি সাধিত হয়। তবে চিত্রকলার চেয়ে স্থাপত্য-শিল্পের প্রতি সম্রাটের অস্বাভাবিক দুর্বলতা ছিল। ঐতিহাসিক ড. সাকসেনা এ প্রসঙ্গে বলেন, “জাহাঙ্গীরের কৃতিত্ব যেখানে কাগজে, শাহজাহানের কৃতিত্ব সেখানে ইট-সুরকির মধ্যে।” পুত্র দারার এলবাম শাহজাহানের আমলের চিত্রকলার এক অনবদ্য সৃষ্টি। শাহজাহানের সময় বিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন নাদির সমরকন্দি, মীর হাসান, অনুপ চিত্রা ও চিত্রমনি। শাহজাহানের রাজত্বকালে শাহজাহাননামার চিত্রায়ন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রায়ন।
সুতরাং সব দিক দিয়ে বিচার করলে শাহজাহানের রাজত্বকালকে নিঃসন্দেহে মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা যায়। ঐতিহাসিক হান্টার যথার্থই বলেছেন, “The Mughal Empire attained its highest union strength and magnificence under Shah Jahan.”
শাহজাহানের চরিত্র ও কৃতিত্ব
সম্রাট শাহজাহান নিঃসন্দেহে একজন মহান শাসক হিসেবে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ইতিহাসে তার জীবনালেখ্য এক বিচিত্রময় ঘটনায় পরিপূর্ণ। জাঁকজমক, আড়ম্বর ও গৌরবের চরম শিখর হতে হঠাৎ করে তিনি একজন নিঃস্ব, দুস্থ ও দুর্দশাগ্রস্ত বন্দী অবস্থায় উপনীত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থই বলেছেন, “শাহজাহানের জীবন-নাট্য শুরু হয়েছিল অনুপম উজ্জ্বলতা,সুখ-সমৃদ্ধি ও আমােদ-উপভােগের মধ্য দিয়ে কিন্তু তার যবনিকা ঘটে গ্রীক বিয়ােগান্তক নাটকের বেদনা বিধুর পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে।” (“The drama of Shah Jahan’s lite which began amidst scenes of unparalleled brilliance and enjoyment ended like one of the Greek tragedies.” – A Short History of Muslim Rule in India, P: 448)।
ইউরােপীয় ঐতিহাসিকেরা ও পর্যটকরা অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সম্রাটের সমালােচনা করেছেন। এক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন ভিনসেন্ট স্মিথ, বার্ণিয়ে, মানুচি, টমাস রো, টেভারনিয়ার প্রমূখ। তারা সকলে শাহজাহানকে নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও ব্যভিচারী বলে অভিহিত করেছেন। একথা সত্য যে, পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের নির্মমভাবে হত্যা, পর্তুগীজদের প্রতি নির্মম ব্যবহার, হিন্দুধর্মের প্রতি বিরূপ মনােভাব প্রভৃতি নিঃসন্দেহে সম্রাটের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছে। কিন্তু সমসাময়িক যুগের পারিপার্শ্বিকতার দিক দিয়ে বিচার করলে সম্রাটকে বিশেষ দোষী করা যায় না। সে যুগে ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এরূপ ঘটনা বিরল নয়। সর্বোপরি নূরজাহানের অবিশ্রান্ত চক্রান্ত হতে নিজেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সম্রাটকে ঐ সব পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল। তার অবাধ্যতা এবং পিতার নিকট অপরাধের জন্য নূরজাহানের ষড়যন্ত্র কম দায়ী ছিল না। পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে সম্রাটের নির্মম অত্যাচারের জন্য তাদের ভারতীয়দের উপর অত্যাচার, ধর্মান্তরকরণ এবং লুটতরাজ প্রধানতঃ দায়ী ছিল। হিন্দুধর্ম, খৃষ্টান ও শিয়াদের প্রতিও সম্রাটের বিরূপ মনােভাব ছিল। প্রকৃতপক্ষে সমকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট ধর্মীয় ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তবে সম্রাট হিন্দুধর্মের প্রতি বৈরী হলেও তিনি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকার্যে হিন্দুদের নিয়ােগ দান করে উদারতার পরিচয় দেন। তার রাজসভায বহু হিন্দু কবি, দার্শনিক, পণ্ডিত, শিল্পী অলংকৃত করেছিলেন এবং সম্রাটের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন। হিন্দুদের উপর তিনি জিজিয়া কর প্রবর্তন করেননি।
সম্রাট শাহজাহানের চরিত্রে নানাবিধ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন সৎ, ভদ্র এবং তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন শাসক। তার চরিত্রে স্নেহ-মমতারও যথেষ্ট স্থান ছিল। তার পত্নীপ্রেম ইতিহাসে তাকে অমর করে রেখেছে। তার পুত্র বাৎসল্যও ছিল গভীর। অবশ্য এই পুত্রবাৎসল্যই তার শােচনীয় পরিণামের জন্য দায়ী ছিল। বড় মেয়ে জাহানারার গােটা শরীর আগুনে ঝলসে গেলে সম্রাট যারপরনাই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। গরীবদের দুঃখ-কষ্টে সম্রাট বেদনা অনুভব করতেন এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা মােচনে নানাভাবে চেষ্টা করতেন। উদাহরণ স্বরূপ ১৬৩১-৩২ খ্রীস্টাব্দে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষে যখন লক্ষ লক্ষ প্রজার দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না, তখন সম্রাট উদাসীন না থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কষ্ট লাঘবে বিশেষভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
শাহজাহান একজন সুদক্ষ সেনাপতি হিসেবে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, কিন্তু শাহজাহানই সর্বপ্রথম বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা পদানত করে সেখানে মুঘল সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। দাক্ষিণাত্যের আহম্মদনগরও তিনি মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু শাহজাহানের দুর্ভাগ্য তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এবং মধ্য-এশিয়ায় ব্যর্থ হয়েছিলেন।
শাসক হিসেবেও শাহজাহান অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দেন। শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি পিতামহ আকবরের গৃহীত উদার নীতিই অবলম্বন করেছিলেন। তার শাসনামলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিদ্যমান ছিল, রাজস্ব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং প্রজাবর্গ সুখী ও সমৃদ্ধশালী ছিল। দু-একটি ঘটনা ছাড়া তার রাজত্বকালে শান্তি-শৃঙ্খলা কখনই বিঘ্নিত হয়নি এবং বৈদেশিক আক্রমণও সংঘটিত হয়নি। তার রাজত্বকালে কৃষির অভাবনীয় উন্নতি হয় এবং রপ্তানী বাণিজ্যেরও যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। ভারতবর্ষের ঐশ্বর্য তখন বহু বিদেশীর মন আকৃষ্ট করেছিল এবং অনেক পর্যটক ভারত পরিভ্রমণে এসে ভারত সম্পর্কে চমকপ্রদ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
শাহজাহানের রাজত্বকালকে ভারতে মুঘল শাসনের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। রাজত্বকাল ছিল শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজ করায় তার রাজত্বকালে শিল্প ও সাহিত্যে অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। কাব্য, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, নাচ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যা তার পৃষ্ঠপােষকতা ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করেছিল। কিন্তু শাহজাহানের রাজত্বকাল হাত চিরস্মরণীয় হয়ে আছে স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষে। প্রকৃতপক্ষে, স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষতার জন্যই ঐতিহাসিকেরা তার রাজত্বকালকে ভারত-ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। তার স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তার প্রিয়তম পত্নী মমতাজ মহলের স্মৃতিসৌধ আগ্রার তাজমহল। এছাড়া, দিল্লীর দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জামে মসজিদ, মতি মসজিদ শিল্পোৎকর্ষ ও সৌন্দর্যের জন্য আজও পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছে। ময়ূর সিংহাসনও শাহজাহানের সৌন্দর্যজ্ঞান এবং ঐশ্বর্যের উজ্জ্বলতম নিদর্শন।
শাহজাহানের শাসনামলে কিছু নেতিবাচক দিক
সমাট শাহজাহানের রাজত্বকাল বহু দিক থেকে গৌরবােজ্জ্বল ছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু তার শাসনকালে কিছু নেতিবাচক দিকও ছিল। তার রাজত্বকালেই সকাল সামাজ্যের ভবিষ্যৎ বিপর্যয় সুচিত হয়। সম্রাটের মধ্য-এশিয়া নীতি চরমভাবে ব্যর্থ হয়। পর পর তিনবার কান্দাহার অভিযানের ব্যর্থতা একদিকে যেমন বহির্বিশ্বে মুঘলদের সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়, অন্যদিকে মুঘলদের রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুন্ন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। আহম্মদনগরের স্বাধীনতা হরণ এবং বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা রাজ্যের দুর্বলতা মারাঠাদের সাহসী করে তােলে। মারাঠা শক্তির পুনর্জাগরণে পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করে। ভারতে ইংরেজদের মধ্যেও রাজ্যলিপ্সা দেখা দেয়। যুদ্ধাভিযান, শিল্পকলার প্রসার ও সাম্রাজ্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সম্রাট রাজকোষের অর্থ অকাতরে ব্যয় করেছেন। এতে আর্থিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে যা পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হয়ে দাড়ায়। এসব কারণে অনেক ঐতিহাসিক শাহজাহানের রাজত্বকালকে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মাজত্বকালে ফ্রান্স গৌরবের চরম শিখরে অধিষ্ঠিত হয়। আবার তার সময় থেকেই ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পতনের সূচনা হয়।
যাই হোক, শাহজাহানের শাসনামলের নানা ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসে সম্রাট শাহজাহান এক গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছেন। ঐতিহাসিক হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় তার রাজত্বকালের সার্বিক মূল্যায়ন করে যথার্থই বলেছেন, “দোষ-গুণে শাহজাহান উচ্চ মর্যাদার অধিকারী এবং তাঁর রাজত্বকালে বহু গ্লানি সত্ত্বেও স্মরণীয়।” (ভারতবর্ষের ইতিহাস, (মুঘল ও ব্রিটিশ ভারত), পৃঃ ১০৩)।
আওরঙ্গজেব (রা. ১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.)
আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরােহণ
১৬৫৮ খ্রীস্টাব্দে সামুগড়ের যুদ্ধে জয়লাভ করে আওরঙ্গজেব আগ্রা অধিকার করেন এবং পিতাকে গৃহবন্দী করে নিজেকে দিল্লীর সম্রাট বলে ঘােষণা করেন। কিন্তু তখনও তার প্রতিদ্বন্দিদের নির্মূল করা সম্ভব হয়নি বলে তিনি তার অভিষেক অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেন। এরপর আওরঙ্গজেব খাজুয়া ও দেওরাই-এর যুদ্ধে দারাকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে ১৬৫৯ খ্রীস্টাব্দের ৫ জুনে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন এবং দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করে আলমগীর ‘বাদশাহ গাজী’ উপাধি গ্রহণ করেন।
উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের ফলে মুঘল শাসন ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযােগে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক শাসনকর্তাগণ যথেচ্ছভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হয়ে পড়ে এবং জনগণের ওপর অতিরিক্ত কর আরােপ করার ফলে তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যের কোন কোন অংশে অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। আওরঙ্গজেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য কয়েকটি বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত, সম্রাট জনগণের আনুগত্য ও সহানুভূতি অর্জনের লক্ষ্যে তাদের মােট দেয় করের পরিমাণ হ্রাস করেন। তিনি প্রথমে ‘রাহদারী’ (রাজপথ বা ফেরী পার হওয়ার সময় এই কর আদায় করা হত) এবং ‘পাথদারী’ (ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হত) রহিত করে দেন। এছাড়া আওরঙ্গজেব প্রায় ৮০ প্রকার আইনী বা বেআইনী কর বাতিল করেন; দ্বিতীয়ত, কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য তিনি বিশেষ দৃষ্টি দেন; তৃতীয়ত, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি দমনের জন্য তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বদলীর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সম্রাটের এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে জনগণের জীবনযাত্রা সুখকর হয় এবং তারা নানা হয়রানি থেকে রক্ষা পায়।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্মরণীয় সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের শাসনকালকে সমান দুভাগে বিভক্ত করা যায় – রাজত্বের প্রথম ভাগ উত্তর ভারতে অবস্থান (১৬৫৮-১৬৮১ খ্রি.) এবং দ্বিতীয় ভাগে দাক্ষিণাত্যে অবস্থান (১৬৮১-১৭০৭ খ্রি.)। প্রথম ভাগে আওরঙ্গজেবের কার্যাবলী উত্তর ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল। এ সময়কালে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল উত্তর-পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ এবং রাজপুত, শিখ, জাঠ, বুন্দেলা ও সৎনামী বিদ্রোহ। দ্বিতীয় ভাগে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল দাক্ষিণাত্যের সুলতানি রাজ্য বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা বিজয় এবং শিবাজী ও মারাঠাদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ। এ সময় মারাঠা নেতা শিবাজী আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যে বিব্রত করে রাখেন। সম্রাটের দীর্ঘকাল ব্যস্ত থাকার ফলে উত্তর ভারতের শাসনে শৈথিল্য দেখা দেয় এবং বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সূত্রপাত হয়। ফলে সম্রাটের প্রগাড় অধ্যবসায় ও গভীর কর্তব্যনিষ্ঠা সত্ত্বেও তার শাসনকাল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি
আওরঙ্গজেব অত্যন্ত ধার্মিক সম্রাট ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সুন্নী মুসলমান এবং সুন্নী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং আচারকেই তিনি একমাত্র সত্য বলে মনে করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কোরআন ও হাদীসের অনুশাসনগুলাে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। সুতরাং একজন ধর্মপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান সুন্নী মুসলমান হিসেবে রাষ্ট্রীয় জীবনে সুন্নী মতাদর্শকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করা ছিল তার ধর্মনীতির প্রধান লক্ষ্য। ভারতে গােড়া সুন্নী মুসলমানদের মত আওরঙ্গজেবের মনেও এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, আকবরের শাসনকাল হতে ইসলামের পবিত্রতা বিভিন্ন ধর্মের সংস্পর্শে বিকৃত হয়ে পড়েছে। সুতরাং সিংহাসনে আরােহণ করেই সম্রাট ইসলামের পবিত্রতা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য শরিয়তের বিধান অনুযায়ী কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো –
(১) উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে আওরঙ্গজেবের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল সুন্নী মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা। এজন্য তিনি সুন্নীদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ‘নওরােজ’ (নতুন বর্ষ) অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেন।
(২) তিনি আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত দীন-ই-ইলাহী রহিত করেন।
(৩) মুসলিম জ্যোতির্বিদদের দ্বারা তিনি নতুন পঞ্জিকা তৈরী করেন। তিনি সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত সৌর ইলাহী বছর বাতিল করে ইসলামী চন্দ্র মাসের গণনা পুনঃপ্রবর্তন করেন।
(৪) তিনি সাম্রাজ্যে মদ্যপান, ভাঙ সেবন ও জুয়াখেলা নিষিদ্ধ করেন।
(৫) তার রাজত্বের ১১শ বর্ষে তিনি রাজদরবারে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেন এবং সঙ্গীতজ্ঞদের অবসর বৃত্তি দিয়ে বিদায় করেন। সেই সাথে নৃত্য ও চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ করা হয়। হারেম থেকে নারী ও খােজাদের বিতাড়িত করা হয়।
(৬) প্রতিদিন ভােরে সম্রাটকে ঝােলা-বারান্দায় দাড়িয়ে প্রজাদের দর্শন দেওয়ার যে নিয়ম অর্থাৎ ‘ঝারােকা দর্শন’ তিনি বন্ধ করে দেন। এছাড়া, সম্রাটের কপালে চন্দনের ‘রাজটিকা’ দেয়ার প্রথাও তিনি নিষিদ্ধ করেন।
(৭) স্ত্রী লােকদের সুফি সাধকের মাজার জেয়ারত নিষিদ্ধ করা হয়।
(৮) জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য এবং সম্রাটের সকল আদেশ যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য সম্রাট ‘মুহতাসিব’ নামক এক শ্রেণীর কর্মচারী নিয়ােগ করেন।
(৯) তিনি মহররমের মিছিল বন্ধ করেন। হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য তিনি ব্যবস্থা নেন।
(১০) তিনি নতুন অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন এবং বহু পুরাতন মসজিদ সংস্কার সাধন করেন। তিনি মােয়াজ্জিম ও ইমামদের মাসিক বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
(১১) মুসলমানদের পীরদের সমাধিস্থলে বাতি দেওয়া নিষিদ্ধ হয়।
সম্রাটের এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দরবারে অনৈসলামিক কার্যকলাপ যেমন বন্ধ হয়, তেমনি রাজ্যের অনেক মুসলমান মদ্যপান, জুয়াখেলা প্রভৃতি কাজ থেকে বিরত থাকে।
কতিপয় ভারতীয় ঐতিহাসিক বিশেষ করে ঐতিহাসিক শ্রীরামশরণ শৰ্মা তার “Religious policy of Mughal Emperors” গ্রন্থে আওরঙ্গজেবকে একজন ধর্মান্ধ এবং ভারতবর্ষ হতে পৌত্তলিকতা উচ্ছেদ করে দার-উল-হারবকে (অমুসলমানদের আবাসস্থল) দার-উল-ইসলামে (ইসলামের আবাসভূমি) পরিণত করার অভিযােগ এনেছেন। সম্রাটের বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযােগসমূহ ও এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া –
(১) হিন্দু মন্দির ও টোল ধ্বংস – ঐতিহাসিকগণ বলছেন, সম্রাট সত্যই তার শাসনামলে মন্দির ধ্বংসের নির্দেশ দিলে সেই সময়ের পূর্বে ভারতবর্ষে নির্মিত কোন মন্দিরের অস্তিত্ব থাকতো না। সম্রাটের বিভিন্ন ফরমানে (রাজকীয় নির্দেশ) দেখা যায়, তিনি হিন্দুদের প্রতি উদার ও সহিষ্ণু ছিলেন। আওরঙ্গজেব বেনারসের শাসনকর্তার কাছে প্রেরিত ফরমানে নির্দেশ দেন যে, পুরনো মন্দিরগুলো অক্ষত থাকবে, কিন্তু নতুন মন্দির নির্মাণ করা হবেনা। (“Our royal command is that…… no person shall in an unlawful way interfere with “disturb the Brahmans and the other Hindu residents in these places, so that they may, as before, remain in their occupation and continue with peace of mind or offer prayer for the continuance of our God-given Empire.” দ্রষ্টব্য Dr. Mohar Ali, A Bnet Survery of Muslim Rule in India p: 288)। আওরঙ্গজেব অমুসলিমদেরকে তার সাম্রাজ্যে শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতাই প্রদান করেননি, তিনি এক ফরমানে কিছু মেধাবী ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি ও অর্থ সাহায্য করার নির্দেশ দেন। (“We have therefore, granted the same plots of land to Goshian Ram Jivan and his sons as Inam, so that after building dwelling house for the pious Brahmans and the Holy Faqirs in the above mentioned pots, he should remain engaged in the contemplation of God.” দ্রষ্টব্য A Brief Survey of Muslim Rule in India. P. 288)।
আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষভাগে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন (Alexander Hamilton) নামক একজন ইংরেজ ভারতবর্ষে পরিভ্রমণে এসেছিলেন। তিনি সম্রাটের ধর্মীয় নীতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, “ভারতবর্ষের প্রত্যেক মানুষই স্বাধীনভাবে কাজ করছে এবং নিজস্ব উপায়ে আরাধনা করছে” (Every one is free to serve and worship God in his own way)। অতি সম্প্রতি ড. বি.এন. পাণ্ডে তার গবেষণামূলক রচনা “Islam and Indian Culture” গ্রন্থে মত প্রকাশ করেছেন যে, “আওরঙ্গজেব মোটেই হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি অনেক মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য জায়গীর দান করেছেন।” (তেসলিম চৌধুরী, মধ্যযুগের ভারত ও মুঘল আমল, পৃঃ ৩৩৪)। বিভিন্ন লেখকের এসব অভিমত থেকে বলা যায়, ধর্মীয় কারণে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের কোন মন্দির ধ্বংসের আদেশ দেননি। তবে রাজনৈতিক কারণে তিনি বহু পুরনো মন্দির ধ্বংসের আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ সে সময় হিন্দুদের অনেক মন্দির রাজনৈতিক মন্ত্রণাগারে ও অস্ত্রাগারে পরিণত হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ঐতিহাসিক সম্রাটের বিরুদ্ধে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের অভিযােগে অভিযুক্ত করেছেন।
সম্রাটের বিরুদ্ধে হিন্দুদের টোল ধ্বংসের যে অভিযােগ আনা হয়েছে তাও সত্য নয়। ‘মা-আসির ই-আলমগীর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, সম্রাট প্রাদেশিক সব শাসনকর্তাদের অবিশ্বাসীদের (অমুসলিম) সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস এবং তাদের সর্বপ্রকার শিক্ষা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে সম্রাটের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ সমর্থন করেননি।
(২) রাজকার্য হতে হিন্দুদের বহিস্কার – সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযােগ হচ্ছে তিনি বিনা অপরাধে কিছু হিন্দু কর্মচারীকে পদচ্যুত করেছিলেন। একথা সত্য যে গৃহযুদ্ধের অবসানের পর সম্রাট কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কেরানী, দিউয়ান ও রাজস্ব আদায়কারীকে বরখস্ত করেছিলেন এবং তাদের পদে মুসলমানদের নিযুক্তি করেছিলেন। কিন্তু তার রাজত্বকালে সামরিক ও বেসামরিক উভয় বিভাগে হিন্দুরা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যশােবন্ত সিংহ যিনি গৃহযুদ্ধের সময় আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন সেই যশােবন্ত সিংহকে তিনি গৃহযুদ্ধ অবসানের পর শুধু ক্ষমাই করেননি, তাকে পুনরায় পূর্বতম সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত করে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে হিন্দু সেনাপতিরা নেতৃত্বে ছিলেন। ভারতের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আতাহার আলী বলেছেন যে, আওরঙ্গজেবের আমলে রাজপুত মনসবদারদের সংখ্যা হ্রাস পেলেও হিন্দু বিশেষ করে মারাঠা মনসবদারদের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। আধুনিক ঐতিহাসিক ড. সতীশচন্দ্র আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি নতুন করে মূল্যায়ন করে বলেছেন যে, আওরঙ্গজেব কখনই হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না। এবং তিনি যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের শাসক এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন। সুতরাং সম্রাট বিনা অপরাধে হিন্দু-কর্মচারীদের পদচ্যুত করেছিলেন এবং হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন এ কথা বিশ্বাস করা যায় না।
(৩) হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ – সম্রাটের বিরুদ্ধে হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণের যে অভিযােগ আনা হয় তা সত্য নয়। রাজনৈতিক কারণে হয়তো কিছু হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যাপকভাবে যে ঘটেনি, তার প্রধান প্রমাণ এই যে, উত্তর ভারতে মুসলিম শাসন বহুদিন স্থায়ী হলেও সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশী হয়নি, বরং বলা যায়, বাংলার মত যেসব অঞ্চলে দিল্লীর প্রত্যক্ষ শাসন দুর্বল ছিল সেসব অঞ্চলে সামাজিক কারণে ইসলামে দীক্ষিত জনসংখ্যা বেশী হয়েছিল।
(৪) হিন্দুদের ওপর জিজিয়া করের পুনঃপ্রবর্তন – সম্রাটের বিরুদ্ধে অপর অভিযোগ হল তিনি অমুসলিমদের উপর ১৬৭৯ খ্রীস্টাব্দে “জিজিয়া” কর পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে আরও অভিযােগ করা হয় যে, জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তনের মূলে ছিল হিন্দুদের ওপর অধিক চাপ প্রয়ােগ করে ভারতবর্ষে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। কিন্তু এখানে স্মরণ রাখা প্রয়ােজন যে, “জিজিয়া কর কোনরূপ নিন্দনীয় ছিল না এবং ‘জিম্মি’দের ওপর তা অতিরিক্ত ভার-স্বরূপ ছিল না। মুসলমানদের যেমন যাকাত ও ফেতরা দিতে হত, হিন্দুদেরও তেমনি জিজিয়া কর প্রদান করতে হত। এই কর প্রদানের বিনিময়ে হিন্দুরা সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেত এবং সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তা পেত। তবে যারা সামরিক দায়িত্ব পালন করত তারা এই কর থেকে অব্যাহতি পেত। তাছাড়া, ব্রাহ্মণ, বৃদ্ধ, দরিদ্র, স্ত্রীলােক ও অপ্রাপ্তবয়স্কদেরকে এই কর দিতে হত না। সম্রাট আকবর হিন্দুদের মন থেকে ‘হীনতার মনােভাব’ (inferiority complex) দূর করবার জন্য জিজিয়া কর রহিত করেছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবও আকবরের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। সিংহাসনে আরােহণের বাইশ বছর পর্যন্ত তিনি অমুসলিমদের উপর জিজিয়া কর পুনঃস্থাপন করেননি। এর কারণ ছিল প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা। কিন্তু সিংহাসনে আরােহণের পর জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে সম্রাটকে প্রায় ৮০ প্রকারের কর তুলে দিতে হয়। সম্রাটের এ পদক্ষেপে রাষ্ট্রের আয় বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়। তাছাড়া সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ দমন এবং যুদ্ধবিগ্রহের ফলে রাষ্ট্রের ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় সরকারের আয়ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য সম্রাটকে নতুন করে জিজিয়া কর প্রবর্তন করতে হয়। তবে সম্রাটের এ পদক্ষেপ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ক্ষুব্ধ করেছিল সন্দেহ নেই। যাই হােক, সম্রাট আওরঙ্গজেব মূলতঃ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই অমুসলিমদের উপর জিজিয়া কর প্রবর্তন করেছিলেন, ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা হিন্দুদের নির্যাতনের উদ্দেশ্যে নয়, বলে মন্তব্য করেন ঐতিহাসিকগণ।
পরিশেষে বলা যায়, মুঘল সম্রাটদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে অধিক ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষ বিচারে দেখা যায়, সম্রাট রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যেসব নীতি অবলম্বন করেছিলেন, তা কখনই হিন্দু-বিদ্বেষ দ্বারা তাড়িত হয়ে প্রণীত হয়নি। আকবরের শাসনামলে তার উদার ধর্মনীতি অনুসরণের ফলে ইসলাম ধর্মের দৃঢ় বন্ধন অনেকটা শিথিল হয়ে পড়ে। সম্রাট আওরঙ্গজেব ইসলাম ধর্মের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু আইন বলবৎ করেছিলেন। সম্রাট তার শাসনামলে হিন্দুদের ওপর কোন অত্যাচার করেননি, তাদের আচার অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রেও কোন বাধার সৃষ্টি করেননি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সম্রাটের অসহিষ্ণু ধর্মনীতির ফলে হিন্দু পুনর্জাগরণ ও ধর্মীয় চেতনাবােধের সৃষ্টি হয়। তাদের এ অভিমত সমর্থনযােগ্য নয়। কারণ রাজপুত, মারাঠা ও সৎনামীদের বিদ্রোহ ঐতিহাসিক পটভূমির বিচারে অনিবার্য ছিল।
পূর্ব সীমান্তে কোচবিহার, অহোম ও মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
পূর্ববর্তী মুঘল শাসকদের ন্যায় সম্রাট আওরঙ্গজেবও রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনামলেই মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে। আওরঙ্গজেব সর্বপ্রথম ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত দু’টি হিন্দু রাজ্য কোচবিচার ও আহােম (আসাম) রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে বিহার প্রদেশের শাসনকর্তা দাউদ খান আওরঙ্গজেবের নির্দেশে পালামৌ অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং ঐ বছরেই সম্রাট আওরঙ্গজেব মীরজুমলাকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তাকে কোচবিহার ও আসামের নৃপতিদেরকে দমন করার জন্য প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য যে, কোচবিহার ও আসামের হিন্দুরাজারা প্রায়ই মুঘল সীমান্তে হামলা চালিয়ে লুটপাট করত। ১৬৬১ খ্রীস্টাব্দে মীরজুমলা সম্রাটের নির্দেশে কোচবিহার আক্রমণ করেন এবং অতি সহজেই কোচবিহার অধিকার করেন। কোচবিহারের রাজা যুদ্ধ না করেই পলায়ন করেন। এরপর মীরজুমলা আসামের দিকে অগ্রসর হন। বার হাজার অশ্বারােহী, গােলন্দাজ বাহিনী ও নৌবহর নিয়ে মীরজুমলা আক্রমণ চালালে আহােমরাজ প্রতিরােধে অসমর্থ হয়ে রাজধানী পরিত্যাগ করে সপরিবারে পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মুঘল বাহিনী আসামের রাজধানী গড়গাঁও দখল করে এবং প্রভুত ধনরত্ন ও হাতী লুট করে। কিন্তু অচিরেই বর্ষা এসে পড়ার মুঘল সৈন্যরা আসামের জলবায়ু ও নানাপ্রকার রােগে আক্রান্ত হয়ে বিব্রত হয়ে পড়ে। এই সুযােগে আহােমরা মুঘল বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায় এবং রাজধানী গড়গাঁও সহ আসামের সকল স্থানই তারা মুঘল বাহিনীর হাত থেকে পুনরুদ্ধার করে। বর্ষা শেষে মুঘলরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠলে অহোমরাজ জয়ধ্বজ মীরজুমলার সঙ্গে এক সন্ধি স্থাপন করেন। সন্ধির শর্তানুসারে আহােমরাজ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, বার্ষিক কর এবং আসামের দারাং প্রদেশের অর্ধেক মুঘলদের দিতে সম্মত হন। আসামে অবস্থানকালে মীরজুমলা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ঢাকা ফেরার পথে ১৬৬৩ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। মীরজুমলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আহােমরা তাদের হস্তচ্যুত স্থানগুলাে আবার দখল করে নেয়। কোচবিহারও মুঘলদের হস্তচ্যুত হয়।
মীরজুমলার মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তার মাতুল শায়েস্তা খানকে (আসফ খানের পুত্র) দাক্ষিণাত্য থেকে প্রত্যাহার করে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। শায়েস্তা খান দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বাংলায় এসে লক্ষ্য করেন যে, আরাকান রাজ্যের মগ জলদস্যুরা পর্তুগীজদের সহায়তায় পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। শায়েস্তা খান মগদের অত্যাচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে বাংলার নৌশক্তি বৃদ্ধি করেন এবং ১৬৬৫ খ্রীস্টাব্দে মগদের প্রধান ঘাঁটি সন্দীপ অধিকার করেন। ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি আরাকানের রাজাকে পরাস্ত করে চট্টগ্রাম দখল করেন। এই দুটি স্থান অধিকার করার ফলে পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের জনগণ পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি লাভ করে। শায়েস্তা খান কোচবিহারের রাজাকেও মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেন। তার শাসনামলে বাংলার খাদ্য দ্রব্যের দাম দারুন সস্তা ছিল।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ইউসুফজাই ও আফ্রিদি বিদ্রোহ
মুঘলদের কাছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সর্বদাই এক মারাত্মক সমস্যা ছিল। এই অঞ্চলে বসবাস করতাে দুর্ধর্ষ আফগান কিছু উপজাতীয় গােষ্ঠী। তারা মাঝে মাঝে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে লুটতরাজ এবং জনগণের উপর অত্যাচার চালাত। সম্রাট আকবর সর্বপ্রথম উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে শান্তি স্থাপনে প্রয়াসী হয়েছিলেন এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে উপজাতিদিগকে বশীভূত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের শাসনামলে মুঘল বাহিনী কান্দাহার, বলখ ও বদখশান আক্রমণ করলে মুঘল সেনাবাহিনীর ভয়ে তারা কিছুদিন শান্ত থাকে। কিন্তু শাহজাহানের রাজত্বকালের শেষ দিকে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে তারা পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ায় এবং মুঘল সাম্রাজ্যে আক্রমণ শুরু করে। আওরঙ্গজেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে পার্বত্য উপজাতিদের অর্থদান করেবশীভূত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি সফল হননি। সুতরাং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় আওরঙ্গজেব উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ‘অগ্রসর নীতি’ (Forward Policy) অবলম্বন করতে বাধ্য হন।
১৬৬৭ খ্রীস্টাব্দে ইউসুফজাই নামক এক উপজাতি ভাগু নামক এক নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। ভাগু অন্যান্য উপজাতি দলকে সংঘবদ্ধ করে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তােলেন। ফলে আফগান স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্পৃহা প্রবল হয়ে ওঠে। উপজাতি দলগুলাে সিন্ধুনদ অতিক্রম করে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত আটক ও হাজারা জেলা আক্রমণ করে সেখানে লুটতরাজ ও অত্যাচার শুরু করে। আওরঙ্গজেব এই সংবাদ জানতে পেরে পার্বত্য উপজাতির বিরুদ্ধে মুঘল সেনাপতি কামিল খান ও আমীন খানকে প্রেরণ করেন। তারা পার্বত্য জাতির ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে অবশেষে তাদের দমন করতে সমর্থ হন। সম্রাট রাজা যশােবন্ত সিংহকে জামরুদের সামরিক ঘাঁটির অধিনায়ক পদে নিযুক্ত করে ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।
১৬৭২ খ্রীস্টাব্দে আফ্রিদি উপজাতি তাদের নেতা আকমল খানের অধীনে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আকমল খান নিজেকে রাজা বলে ঘােষণা করেন এবং নিজ নামে মুদ্রা জারী করেন। খুব শীঘ্রই মুঘলদের সঙ্গে আকমল খানের যুদ্ধ শুরু হয় এবং আকমল খান আলী মসজিদের যুদ্ধে মুঘল শাসনকর্তা আমীন খানকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে আফ্রিদিরা প্রায় দশ হাজার মুঘল সৈন্যকে বন্দী করে। এই বিজয়ের ফলে আকমল খানের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পায় এবং উপজাতিরা দলে দলে তার পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। আওরঙ্গজেব মুঘল বাহিনীর পরাজয়ে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি আমীন খানের স্থলে মহব্বত খানকে কাবুলের শাসনকর্তা করে পাঠান। কিন্তু মহব্বত খান বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুদের সঙ্গে মিলিত হলে সম্রাট সুজাত খানকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু ১৬৭৪ খ্রীস্টাব্দে সুজাত খান আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। আফ্রিদিদের এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ’খাটাক’ নামক অপর এক উপজাতি তাদের নেতা খুশহাল খানের নেতৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে আফ্রিদিদের সঙ্গে মিলিত হয়। এর ফলে অটোক হতে কান্দাহার পর্যন্ত সম্পূর্ণ পাঠানমুলুক মুঘলদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সম্রাট আওরঙ্গজেব অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে স্বয়ং পেশােয়ারের নিকটবর্তী হাসান আবদালে উপস্থিত হন। সম্রাট একই সঙ্গে কূটনীতি ও সমরনীতি (policy of kick and kisses) এর সাহায্যে বিদ্রোহী আফগান উপজাতিগুলােকে বশীভূত করার চেষ্টা করেন। তিনি বিদ্রোহী উপজাতি সর্দারদের অর্থ, জায়গীর ও মুঘল মনসব দান করে নিজ পক্ষে আনতে সক্ষম হন। কিন্তু খাটন নেতা খুশহাল খান কখনই মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেননি এবং তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার স্বীয় পুত্র বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দেন। এরূপে আওরঙ্গজেব সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
আওঙ্গজেবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি সাময়িকভাবে সফল হলেও মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক হয়েছিল সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, ‘Ruinous as the Afghan’s was to the imperial economy its political effects was ever more harmful.” (History of Aurangzeb)। প্রথমত, এই যুদ্ধের ফলে মুঘল রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতিদের মধ্যে জাতীয় জাগরণ দেখা দেয়ায় ঐ অঞ্চল থেকে মুঘল বাহিনীতে সৈন্য সংগ্রহ অসম্ভব হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিদ্রোহী উপজাতিদের দমনের জন্য আওরঙ্গজেবকে বিপুল সংখ্যক দক্ষ সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে হয়। এই সুযােগে মারাঠা নেতা শিবাজী দাক্ষিণাত্যে নিজ শক্তি অপ্রতিহত করতে সক্ষম হন। এসব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধ মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষতিকরই হয়েছিল।
জাঠ, সৎনামী, বুন্দেলা ও শিখ বিদ্রোহ
আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তার রাজত্বকালে জাঠ, সৎনামী, শিখ, রাজপুত ও মারাঠাগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু উল্লিখিত বিদ্রোহগুলাে সম্রাটের ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা উগ্র ধর্মীয় নীতির ফল নয়, অবস্থা ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহগুলাে সংঘটিত হয়েছিল।
জাঠ বিদ্রোহ – ১৬৬৯ খ্রীস্টাব্দে প্রথমে মথুরার জাঠরা গােকলা নামে এক ভূস্বামীর নেতৃত্বে সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহী জাঠগণ মথুরার শাসক আব্দ-উন-নবীকে হত্যা করে। এতে আওরঙ্গজেব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি তৎক্ষণাৎ জাঠদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য কয়েকজন সেনাপতিকে সৈনসহ প্রেরণ করেন। মুঘল সেনাবাহিনী অতি সহজেই জাঠদের পরাজিত করে তাদের নেতা গােকলাকে হত্যা করে। কিন্তু গােকলার মৃত্যুর পরও জাঠদের বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়নি। পরে জাঠরা রাজারাম নামক অপর এক নেতার অধীনে যুদ্ধ পরিচালনা করে। অবশেষে রাজারামও মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। রাজারামের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুস্পুত্র চুরামন জাঠদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরও জাঠরা মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের অনেক ক্ষতি সাধন করে।
সৎনামী বিদ্রোহ – পাঞ্জাবের বর্তমান পাতিয়ালা এবং মেওয়াট অঞ্চলে সৎনামী নামে এক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস ছিল। তারা পেশায় ছিল কৃষক ও ব্যবসায়ী। একজন মুঘল সৈন্য কর্তৃক জনৈক সৎনামী কৃষক নিহত হলে ১৬৭২ খ্রীস্টাব্দে তারা মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। সৎনামীদের বিদ্রোহ দমন করতে মুঘল বাহিনীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুঘল বাহিনী তাদের পরাজিত করে ঐ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। (‘সৎনামী’ অর্থ সৃষ্টিকর্তার সৎনামে বিশ্বাসী-ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ শর্ট হিস্টরী অব মুসলিম রুল পৃঃ ৪৮২)।
বুন্দেলা বিদ্রোহ – বুন্দেলাখণ্ডের বুন্দেলা রাজপুতগণ প্রথমে চম্পত রায়ের নেতৃত্বে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। কিন্তু পরে তিনি মুঘলদের হাতে বন্দী হওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা করেন। তার পুত্র ছত্ৰসাল কিছুকাল আওরঙ্গজেবের অধীনে কাজ করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি মারাঠা নেতা শিবাজীর স্বাধীনতা স্পৃহা ও দুঃসাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে বুন্দেলখণ্ড ও মালবে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। ১৬৭১ খ্রীস্টাব্দে তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সফলতা লাভ করেন। তািন মালবে একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
শিখ বিদ্রোহ – পাঞ্জাবের শিখরাও আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির কারণে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। শিখদের আদি গুরু নানক সব ধর্মের মহত্ত্ব ও অন্তর্নিহিত ঐক্যের বাণী প্রচার করেছিলেন। শিখদের চতুর্থ গুরু রামদাস মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে দেখা করলে সম্রাট তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে অমৃতসরে সরােবর এক খন্ড জমি দান করেন এবং ঐ জমিতেই পরে শিখদের বিখ্যাত শিখমন্দির নির্মিত হয়। শিখদের পঞ্চম গুরু অর্জুন সিংহ (১৫৮১-১৬০৬) শিখ সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মধ্যে একতাবােধ জাগিয়ে তােলেন। তিনিই পূর্বগামী গুরুদের বাণী ও অন্যান্য সাধুসন্তদের উপদেশাবলী একত্রিত করে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ “গ্রন্থ সাহিব” সম্পাদনা করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে অর্জুন সিংহ যুবরাজ খসরুকে আশীর্বাদ ও সমর্থন জানালে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর অর্জুন সিংহকে প্রাণদণ্ড দেন। শিখরা তাদের গুরুকে এভাবে হত্যা করায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়। বলা যায়, এই হত্যাকাণ্ড থেকেই মুঘলদের বিরুদ্ধে শিখদের বিদ্রোহভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্জুন সিংহের পর শিখদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন গুরু হরগােবিন্দ সিংহ। তিনি শিখদেরকে একটি সামরিক সম্প্রদায়রূপে গড়ে তােলেন। তার পরবর্তী দু’জন শিখ গুরু উল্লেখযােগ্য কিছু করতে পারেননি। কিন্তু শিখদের নবম গুরু তেজবাহাদুরের নাম ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি আওরঙ্গজেবের শাসনামলে আওরঙ্গজেবের হিন্দু বিরােধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং কাশ্মীরের ব্রাহ্মণদের আইন অমান্য করতে উৎসাহ দান করেন। কথিত আছে, মুঘল সৈন্যরা তেজবাহাদুরকে গ্রেপ্তার করে দিল্লীতে নিয়ে আসে এবং তেজবাহাদুরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে ১৬৭৫ খ্রীস্টাব্দে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। (“তেজবাহাদুর ধর্মত্যাগ অপেক্ষা মৃত্যুবরণই শ্রেয় মনে করেছিলেন। তিনি ‘শির’ দিয়েছিলেন, কিন্তু ‘সর’ দেননি – অর্থাৎ তিনি মস্তক দিয়েছিলেন, ধর্ম দেননি (শির দিয়া সর ন দিয়া)- এডভান্সড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, পৃঃ ৪৯৩)। তেজবাহাদুরের মৃত্যুতে পাঞ্জাবে শিখদের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। তেজবাহাদুরের পর তার পুত্র গুরু গােবিন্দ সিংহ গুরু পদে অধিষ্ঠিত হন। গুরু গােবিন্দ সিংহ ছিলেন শিখদের সর্বশেষ গুরু। তিনি পিতার নৃশংস হত্যার প্রতিশােধ গ্রহণে দৃঢ়সংকল্প হন। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য শিখদের যােদ্ধা জাতি হিসেবে গড়ে তােলেন এবং পৃথক জীবন-শৃঙ্খলার মধ্যে তাদের সংগঠিত করেন। তখন থেকে তরবারি ও কৃপান হয় শিখদের নিত্যসঙ্গী। সকল শিখকে সব সময় ৫টি জিনিস রাখার বিধান দেয়া হয়। সেগুলাে হলাে – কেশ (চুল), কঙ্গী (চিরুনী), কৃপান (তরবারি), কচ (হাঁটু পর্যন্ত চোসা) এবং কর (লােহার বালা)। শিখরা শত্রুদের নিপাত করার শপথ নেয়। গুরু গােবিন্দ সিংহের নেতৃত্বে শিখরা পুনরায় মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। আওরঙ্গজেব শিখদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আশঙ্কিত হয়ে শিখদের দমন করার জন্য মুঘল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। গুরু গােবিন্দ সিংহ পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। তার দুই পুত্রকে বন্দী করে পরে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারী বাহাদুর শাহের আমন্ত্রণে গুরু গােবিন্দ সিংহ দাক্ষিণাত্যে গমন করেছিলেন। সেখানে গােদাবরী নদীর তীরে ১৭০৮ খ্রীস্টাব্দে একজন আফগান কর্তৃক তিনি নিহত হন।
রাজপুত বিদ্রোহ
রাজপুতদের প্রতি আওরঙ্গজেবের নীতি ইতিহাসে এখনও সমালােচনার বিষয় হয়ে আছে। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অভিযােগ করা হয় যে, সম্রাট আকবর উদার নীতি অনুসরণ করে যে দুর্ধর্ষ রাজপুত জাতিকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করে মুগল সাম্রাজ্যের বিস্তার সাধন এবং এর ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিলেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব তার ধর্মান্ধ নীতির দ্বারা বন্ধুভাবাপন্ন রাজপুত জাতিকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান শত্রুতে পরিণত করেন। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব দায়ী ছিলেন না, বরং মুঘলদের প্রতি রাজপুতদের বৈরী মনােভাবের কারণেই সম্রাট তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরােহণের পর দীর্ঘ বিশ বছর তিনি রাজপুতদের প্রতি সম্রাট আকবরের উদার নীতিই গ্রহণ করেছিলেন। মধ্যযুগের ইতিহাসের প্রখ্যাত ভারতীয় গবেষক মহম্মদ আতাহার আলী আওরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, “আওরঙ্গজেবের শাসনের অংশ দু’বছরে ১৪,০০০ ‘জাঠ’ পদ এবং নতুন মনসবের ১৯ শতাংশ রা কর্মচারীদের দেওয়া হয়েছিল অথচ শাহজাহানের রাজত্বকালে রাজপুতদের দখলে ছিল ১০০০ বা তার থেকে বেশী ‘সওয়ার’ মর্যাদার মাত্র ১৬ শতাংশ ‘মনসব’। শাহজাহানের রাজত্বকালে কোন রাজপুত শাসকদের ৭০০০ মনসব দেয়া হয়নি, কিন্তু আওরঙ্গজেবের আমলে জয় সিংহ ৭০০০ মনসব পদে উন্নীত হয়েছিলেন। (তেসলিম চৌধুরি, মধ্যযুগের ভারত (মুঘল আমল), পৃঃ ৩১৮)। শুধু তাই নয়, সারা জীবন রাজপুত নেতা যশোবন্ত সিংহ মুঘলদের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সিংহাসনে আরােহণের পর সম্রাট তাকে ক্ষমা করে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। যশােবন্ত সিংহকেও ৭০০০ পদে উন্নীত করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে রাজপুতদের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের বিরােধের মূল কারণ ছিল রাজপুত সরদারদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্বে আওরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপের ফলেই রাজপুতদের সঙ্গে মুলঘদের প্রকাশ্য সংঘর্ষ শুরু হয়। (শেখর বন্দোপাধ্যয়, অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা, পৃঃ ৪২)।
১৬৭৮ খ্রীস্টাব্দে রাজা যশােবন্ত সিংহ মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আওরঙ্গজেব কর্তৃক খাইবার গিরিপথে জামরুদ দুর্গের ফৌজদার ছিলেন। মৃত্যুর সময়কাল পর্যন্ত তার কোন পুত্র সন্তান ছিল না। যশােবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তার রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং রাজ্যের শাসনের ব্যবস্থা করেন। সম্রাট ৩৬ লক্ষ টাকা উত্তরাধিকার করের বিনিময়ে যশােবন্ত সিংহের ভ্রাতুষ্পুত্র ইন্দর সিংহকে মারওয়ারের রাজা নিযুক্ত করেন। কিন্তু ইন্দর সিংহের মনােনয়নকে রাজপুত সর্দারগণ মেনে নিতে পারেনি। কারণ যশােবন্ত সিংহের পরিবারের সঙ্গে ইন্দর সিংহের পরিবারের বিরােধ ছিল। ইতােমধ্যে যশােবন্ত সিংহের বিধবা পত্নী দুই যমজ সন্তান প্রসব করেন। একটি পুত্র অচিরেই মারা যায় এবং অজিত সিংহ নামে অপর পুত্রটি জীবিত থাকে। যশােবন্ত সিংহের দুই বিধবা স্ত্রীকে পুত্রসহ দিল্লীতে আনা হয়। মারওয়ারের রাজপুত নেতারা সম্রাট আওরঙ্গজেবকে অজিত সিংহকে মারওয়ারের রাজা বলে স্বীকার করে নেওয়ার অনুরােধ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব অজিত সিংহকে মারওয়ারের রাজা বলে স্বীকৃতি দিতে রাজী হন। তবে তিনি রাজপুত সর্দারদের অজিত সিংহকে মুঘল দরবারে তার লালন পালনের জন্য প্রেরণ করার আহ্বান জানান। কিন্তু রাজপুতরা সম্রাটের এই আদেশ সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তাদের মনে এই আশঙ্কা জন্মে যে, সম্রাট হয়তো নাবালক রাজাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার ষড়যন্ত্র করছে। যাইহােক রাজপুতরা সম্রাটের নির্দেশকে তাদের প্রতি চরম অসম্মান বিবেচনা করে সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। এ সময় দুর্গাদাস নামক যশােবন্ত সিংহের এক মন্ত্রী যিনি অজিত সিংহের অভিভাবকের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন তিনি যশােবন্ত সিংহের দুই স্ত্রীকে পুরুষের পােষাকে সজ্জিত করে পুত্র অজিত সিংহ সহ দিল্লী থেকে যােধপুরে পলায়ন করেন। আওরঙ্গজেব এ অবস্থায় তার তিন পুত্রের অধীনে (মুয়াজ্জম, আজম ও আকবর) এক বিরাট সেনাবাহিনী মারওয়ারের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এভাবেই রাজপুতদের সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে রাজপুত বাহিনী মুঘল বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়। আওরঙ্গজেব মারওয়ার রাজ্যকে কয়েকটি অংশে বিভক্ত করে প্রত্যেক অংশে একজন করে মুসলমান ফৌজদার নিযুক্ত করেন।
যশােবন্ত সিংহের স্ত্রী মেবারের রাজকন্যা ছিলেন। তিনি মেবারের রাণা রাজসিংহের কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করেন। রাণা মাওয়ারের ন্যায় মেবার মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হতে পারে এ আশঙ্কায় রাণীর প্রস্তাবে সাড়া দেন এবং অজিত সিংহের পক্ষে অস্ত্রধারণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। আওরঙ্গজেব মেবার রাজ্যের মনােভাব বুঝতে পেরে বিশাল মুঘল বাহিনীসহ মেবার রাজ্য আক্রমণ করেন। রাজসিংহ পলায়ন করে আরাবল্লীর পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নেন। আওরঙ্গজেব তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এবং মেবারের অনেক মন্দির ধ্বংস করেন। অতঃপর সম্রাট শাহজাদা আকবরকে চিতােরের শাসনভার অর্পণ করে আজমীর প্রত্যাবর্তন করেন। ইতােমধ্যে রাজপুতরা মেবারের রাণা রাজসিংহের অধীনে আবার সংঘবদ্ধ হয়ে মেবারের শাসনকর্তা যুবরাজ আকবরের ওপর তীব্র আঘাত হানে এবং মুঘল বাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তােলে, আকবর পরাজিত হন। আওরঙ্গজেব আকবরের পরাজয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে মেবার হতে মারওয়ারে বদলী করেন এবং যুবরাজ আজমকে মেবারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এতে যুবরাজ আকবর অপমানবােধ করে পিতা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে রাজপুতদের সঙ্গে যােগ দেন। এ সময় আওরঙ্গজেব আজমীরে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব কূটকৌশলে রাজপুতদের সঙ্গে যুবরাজ আকবরের বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হন। রাজপুতরা আকবরকে ত্যাগ করলে শাহজাদা ভগ্নহৃদয়ে প্রথমে দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেন এবং পরে পারস্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৭০৪ খ্রীস্টাব্দে পারস্যে তার মৃত্যু হয়।
মেবারের বিরুদ্ধে মুঘলদের যুদ্ধ অনেকদিন ধরে চলে এবং উভয় পক্ষে অংশ সৈন্য হতাহত হয়। এ সময় আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। ফলে শীঘ্রই আওরঙ্গজেবের সঙ্গে রাজপুতদের এক সন্ধি স্থাপিত হয়। এই সন্ধির দ্বারা (১) মুঘলরা মেবার ত্যাগ করে; (২) রাজসিংহের পুত্র জয়সিংহ মেবারের মহারাণা হিসেবে স্বীকৃত হন এবং পাঁচ হাজারী মনসবদার পদে নিযুক্ত হন; (৩) জয়সিংহ জিজিয়া করের পরিবর্তে তার রাজ্যের কয়েকটি পরগনা মুঘলদের হাতে সমর্পণ করেন। ১৬৮১ খ্রীস্টাব্দে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং আর কখনও উত্তর-ভারতে প্রত্যাবর্তন করেননি। রাজপুতরা মুঘলদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করলেও তারা দুর্গাদাসের নেতৃত্বে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত এই যুদ্ধ অবশেষে ১৭০৯ খ্রীস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের পুত্র ও পরবর্তী সম্রাট শাহ আলম বাহাদুর শাহ অজিত সিংহকে মারওয়ারের রাণা বলে স্বীকার করলে মুঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সংগ্রামের অবসান হয়।
রাজপুত নীতির ফলাফল : সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি মুঘল সামাজ্যের পক্ষে শুভ হয় নি। কারণ এই যুদ্ধের ফলে একদিকে যেমন প্রচুর অর্থ ও লোকক্ষয় হয় তেমনি মুঘল সামরিক শক্তিও দুর্বল হয়। মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারে এবং নিরাপত্তা বিধানে যে রাজপুত জাতি বুকের রক্ত দিয়ে অস্ত্রধারণ করেছিল সেই রাজপুতদের বিরুদ্ধে সম্রাট যুদ্ধ ঘােষণা করে তাদের শত্রুতে পরিণত করেন। রাজপুতদের সহযােগিতায় যে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, সেই সাম্রাজ্য তাদের বিরােধিতায় দুর্বল হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে দেখা দেয় বিদ্রোহ। রাজপুতদের সঙ্গে সম্রাটের সুদীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার সুযােগে দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তির উত্থান ঘটে। অনেক ঐতিহাসিক মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য আওরঙ্গজেবের রাজপুত নীতিকে দায়ী করে থাকেন। ঐতিহাসিক ড. আব্দুল করিম আওরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি সম্পর্কে বলেন, “সম্রাট রাজপুতদের প্রতি আরও অধিক সহানুভূতিশীল হইলে হয়তঃ মােগল সাম্রাজ্যের পতন রােধ করা সম্ভব হত।” (ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, পৃঃ ৩৬১)। সুতরাং সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক নয়।
আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
মুঘল ভারতের ইতিহাসে আওরঙ্গজেব কর্তৃক অনুসৃত দাক্ষিণাত্য নীতি একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ধর্মীয় গোঁড়ামিই আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কারণ দাক্ষিণাত্যে বিরাট এলাকা জুড়ে ছিল মারাঠাদের আবাসভূমি। এই অঞ্চলেই গােলকুন্ডা ও বিজাপুর নামক দুটি ‘শিয়াপন্থী’ রাজ্য অবস্থিত ছিল। ঐতিহাসিক ফিরিস্তা বলেন, শিয়াপন্থীরা মসজিদে মূর্তিপূজা এবং গানবাজনা করতাে। আওরঙ্গজেব এদের সহ্য করতে পারতেন না। যাইহােক, শিয়া মুসলমান সুন্নী সম্রাটগণের বিরূপ মনােভাব থাকলেও এ কথা সত্য নয় যে, সম্রাট প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে দাক্ষিণাত্যে বিজয় অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল থেকেই দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানও ঐ একই দাক্ষিণাত্য নীতি অনুসরণ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিকেও তার পূর্বের সম্রাটদের দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতিরই পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে। আওরঙ্গজেব যখন দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা ছিলেন, তখন তিনি গােলকুন্ডা ও বিজাপুর রাজ্য দুটি মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দারাশিকোর প্ররােচনায় এবং পিতার হস্তক্ষেপের ফলে আওরঙ্গজেব তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সক্ষম হননি। সুতরাং বলা যায়, বহু পূর্ব হতেই আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলােকে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড ও গ্যারেট বলেন, “আওরঙ্গজেব ষােড়শ শতাব্দীর আকবরের আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের নীতি তাকে উৎসাহিত করেছিল।” (Edward & Garret, Mughal Rule in India.)। দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের প্রতিও সম্রাটের বিজাতীয় বিদ্বেষ ছিল না। সুতরাং বলা যায়, ধর্মীয় বশবর্তী হয়ে নয়, রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যেই সম্রাট দাক্ষিণাত্য জয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন।
সিংহাসনে আরােহরণের পর আওরঙ্গজেব প্রায় পঁচিশ বছর উত্তর ভারতের রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ফলে দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের প্রতিপত্তি চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। গােলকুন্ডা ও বিজাপুর রাজ্য দুটির ক্রম ক্ষীয়মান শক্তিহ্রাসের সুযােগে শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা শক্তি দাক্ষিণাত্যে প্রবল হয়ে ওঠে। এছাড়া, আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আকবর পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে শিবাজীর পুত্র শম্ভুজীর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আওরঙ্গজেব নিজেই দাক্ষিণাত্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার আশু প্রয়ােজন অনুভব করেন এবং ১৬৮১ খ্রীস্টাব্দে রাজপুতদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে দাক্ষিণাত্যের দিকে যাত্রা করেন। ১৬৮১ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যু পর্যন্ত সম্রাট দাক্ষিণাত্যেই অবস্থান করেন।
আওরঙ্গজেব ও মারাঠা
মহারাষ্ট্রের অধিবাসীরা মারাঠা নামে পরিচিত। ১৭শ শতকের শেষ ভাগে মারাঠা শক্তির উত্থান ভারতের ইতিহাসে এক উল্লেখযােগ্য ও রোমাঞ্চকর ঘটনা। দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের অধীনে মারাঠারা চাকুরীতে নিযুক্ত থেকে সামরিক ও বেসামরিক শাসনকার্যে তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। মারাঠা নেতা সুলতানদের অধীনে জায়গীর ও উচ্চ সম্মান লাভ করেছিলেন। এই মারাঠা জায়গীরদারগণের অন্যতম শাহাজী ভােসলের পুত্রই বিখ্যাত শিবাজী (জন্ম ১৬২৭ খ্রীঃ) ছিলেন মারাঠাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা এবং তিনিই শতধা-বিভক্ত ও বিক্ষিপ্ত মারাঠা জাতিকে জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করে এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত থাকাকালীন আওরঙ্গজেব শিবাজীকে দমন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফলকাম হতে পারেননি। শাহাজানের অসুস্থতার কারণে সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালীন আওরঙ্গজেব উত্তর ভারতে বিব্রত থাকলে সে সযােগে শিবাজী দাক্ষিণাত্যে নিজের শক্তিবৃদ্ধি করতে প্রয়াস পান। সিংহাসনে আরােহণের পর আওরঙ্গজেব আবার দাক্ষিণাত্যের দিকে মনােনিবেশ করেন। তিনি তার মাতুল শায়েস্তা খানকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করে শিবাজীর ক্রমবর্ধমান শক্তিকে দমন করার নির্দেশ দেন। শায়েস্তা খান শিবাজীর কয়েকটি দুর্গ দখল করে পুনরায় ফিরে এসে সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় শিবাজী এক গভীর ষড়যন্ত্র করেন। ১৬৬৩ খ্রীস্টাব্দে এক রাতে শিবাজী অতর্কিত শায়েস্তা খানের শিবির আক্রমণ করে তার এক পুত্রকে হত্যা করেন। আক্রমণে শায়েস্তা খান হাতের এক আঙ্গুল হারিয়ে কোনরকমে পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। ১৬৬৪ খ্রীস্টাব্দে শিবাজী সুরাট দুর্গ লুণ্ঠন করেন। এমতাবস্থায় আওরঙ্গজেব শিবাজীর বিরুদ্ধে যুবরাজ মুয়াজ্জম ও রাজা জয়সিংহকে প্রেরণ করেন। মুঘল বাহিনী শিবাজীর পুরন্দর দূর্গ অবরােধ করে। উপায়ন্তর না দেখে শিবাজী সন্ধির প্রস্তাব করেন। ফলে ১৬৬৫ খ্রীস্টাব্দে জুন মাসে মুঘলদের সঙ্গে শিবাজীর পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্তানুসারে শিবাজী মুঘলদের ২৩ টি দুর্গ ছেড়ে দেন এবং ১২টি দুর্গ নিজ অধিকারে রাখেন। এরপর জয়সিংহের অনুরােধে শিবাজী মুঘল দরবারে আগমন করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব শিবাজীকে দরবারে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বন্দী করেন। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে শিবাজী কৌশলে দরবার থেকে পলায়ন করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হন। ইতােমধ্যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ইউসুফজাই সম্প্রদায় বিদ্রোহ করলে আওরঙ্গজেব বিদ্রোহ দমনে তৎপর হন। সে সুযােগে শিবাজী নিজ রাজ্যে মুঘল অধিকৃত অঞ্চলগুলাে প্রায় সবই পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। ১৬৭৪ খ্রীস্টাব্দে ১৬ জুন শিবাজী রায়গড় দুর্গে স্বীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন এবং ‘ছত্রপতি’ উপাধি গ্রহণ করেন। মুঘল বাহিনী উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অধিক ব্যস্ত থাকার সুযােগে শিবাজী কর্ণাট আক্রমণ করেন এবং জিঞ্জি, ভেল্লোর এবং আরও কয়েকটি দূর্গ দখল করেন। কিন্তু শিবাজীর উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে উঠবার পূর্বেই ১৬৮০ খ্রীস্টাব্দে ৪ এপ্রিল ৫৩ বছর আকস্মিকভাবে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। শিবাজীর মৃত্যুর পর তার পুত্র শম্ভুজী মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৬৮৯ খ্রীস্টাব্দে শম্ভুজী মুঘলদের হাতে ধৃত ও নিহত হন। অল্পকালের মধ্যেই মারাঠা শক্তি আবার শম্ভুজীর ভাই রাজারামের নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ১৭০০ খ্রীস্টাব্দে রাজারাম মৃত্যুবরণ করলে তার শিশু পুত্র তৃতীয় শিবাজী মারাঠা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং তিনি মাতা তারাবাঈয়ের পরিচালনায় মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে থাকেন। ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত মুঘল মারাঠা সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল।
বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা জয়
মারাঠা শক্তি ভিন্ন দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গােলকুণ্ডার বিরুদ্ধেও আওরঙ্গজেব সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। যদিও বিজাপুর ও গােলকুন্ডার বিরুদ্ধে অভিযান সম্রাটের সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই অংশ, তবুও এই দুই রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল যে, শাহজাহানের আমলে স্বাক্ষরিত চুক্তি মােতাবেক রাজ্য দুটি মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক কর নিয়মিত প্রদান করেনি। তাছাড়া এ দুটি রাজ্য কেবলমাত্র মুঘলদের আজন্ম শত্রু মারাঠাদের সঙ্গেই নয়, পারস্যের শিয়া সুলতানদের সঙ্গেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আওরঙ্গজেব ১৬৮৩ খ্রীস্টাব্দে শাহজাদা আজমকে বিজাপুরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। শাহজাদা সােলপুর দখল করতে সমর্থ হলেও বিজাপুরের বিরুদ্ধে তার আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই ঘটনায় সম্রাট আওরঙ্গজেব স্বয়ং ১৬৮৫ খ্রীস্টাব্দে সােলপুরে আসেন এবং মুঘল বাহিনী বিজাপুর অবরােধ করে। বিজাপুরের সেনারা অবরুদ্ধ অবস্থায় খাদ্যাভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে ১৬৮৬ খ্রীস্টাব্দে বিজাপুরের সুলতান সিকান্দার আদিল শাহ মুঘল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় দুই শতাব্দীর অস্তিত্বের পর বিজাপুর রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। বিজাপুরের পর আওরঙ্গজেব গােলকুণ্ডার দিকে দৃষ্টি দেন। গােলকুণ্ডা গােপনে বিজাপুর এবং মারাঠাদের সাহায্য করেছিল। এই অপরাধে সম্রাট স্বয়ং গােলকুন্ডা অবরােধ করেন। দীর্ঘ আট মাস অবরােধের পর ১৬৮৭ খ্রীস্টাব্দে কুতুবশাহী বংশের শেষ সুলতান আবুল হাসান আত্মসমর্পণ করেন। গােলকুন্ডা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এভাবে বিজাপুর ও গােলকুন্ডা রাজ্য মুঘলদের অধীন হওয়ায় দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
দাক্ষিণাত্য নীতির সমালােচনা
ভিনসেট স্মিথ, এলফিনস্টোন প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গােলকুন্ডা রাজ্য দুটি ধ্বংস সাধন করে অবিবেচনার কাজ করেছিলেন। তাদের মতে এই দুটি রাজ্য স্বাধীন থাকলে নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তারা মারাঠা শক্তিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতাে। তারা আরও বলেন, আওরঙ্গজেবের উচিৎ ছিল দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাজ্যগুলাের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে ক্রমবর্ধমান মারাঠা শক্তিকে বিধ্বস্ত করা। কিন্তু আওরঙ্গজেব তা না করে ভুল করেন। ঐতিহাসিকগণের এ চিন্তাধারার পেছনে যুক্তি আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সময় আওরঙ্গজেবের পক্ষে এ ধরনের চিন্তা করা সম্ভব ছিল কিনা তাও ভেবে দেখা দরকার। সম্রাট আকবরের সময় থেকেই দাক্ষিণাত্যের সুলতান শাসিত রাজ্যগুলাের সঙ্গে মুঘলদের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কারণ দাক্ষিণাত্যের শাসকেরা কখনই উত্তর-ভারতের আধিপত্য মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারা একে অপরকে শত্রুজ্ঞান করত। এ কারণে মারাঠারা বিজাতীয় হলেও মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তারা মারাঠাদের সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং মুঘলদের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের বিরােধ সাময়িক ছিল না, এই বিরােধ ছিল চিরস্থায়ী। তাছাড়া, দাক্ষিণাত্যের সুলতানী রাজ্যগুলােয় স্বাধীনতা বজায় থাকলেও তাদের পক্ষে মারাঠা শক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব ছিলনা, কারণ সে সময় মারাঠারা ছিল ঐক্যবদ্ধ ও জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ। সুতরাং বিজাপুর ও গােলকুন্ডা জয় করে আওরঙ্গজেব যে রাজনৈতিক ক্ষীণদৃষ্টির পরিচয় দেন বলে ঐতিহাসিকেরা যে অভিযােগ করেন তা গ্রহণ করা যায় না। বরং বলা যায়, মুঘলদের গােটা ভারতবর্ষ ব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারের যে আকাঙ্ক্ষা সম্রাট আকবরের সময় থেকে উজ্জীবিত হয়েছিল, সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক বিজাপুর ও গােলকুন্ডা অধিকারের মধ্য দিয়ে তাদের সে আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার যথার্থই বলেছেন, “Thus by the end of year 1689, Aurangeb was the unrivalled and paramount of Northern India and the Deccan alike.”
দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল
আপাতদৃষ্টিতে আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি সাফল্য লাভ করলেও মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের বীজ আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির মধ্যে নিহিত ছিল। প্রথমত, দাক্ষিণাত্য মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ায় সাম্রাজ্যের এত বিস্তৃতি ঘটে যে, কোন এক কেন্দ্র থেকে একজনের পক্ষে গােটা সাম্রাজ্যের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, সম্রাটকে সুদূর দাক্ষিণাত্যে সুদীর্ঘকাল অবস্থানের ফলে উত্তর ও মধ্য-ভারতের শাসনব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। চারিদিকে বিদ্রোহ ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় ভূস্বামী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তারা কেন্দ্রীয় শাসন উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। তৃতীয়ত দীর্ঘকালব্যাপী ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে মুঘল রাজকোষ একেবারে শূন্য হয়ে পড়ে। এমনকি অর্থাভাবে সৈনিকদের বেতনও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। স্থানে স্থানে দেখা দেয় বিদ্রোহ। এর ফলে মুঘল কেন্দ্রীয় শাসনের মর্যাদা নষ্ট হয়। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের জন্য কাল হয়। ঐতিহাসিক স্মিথ এ প্রসঙ্গে বলেন, “The Deccan was the grave of his body as well as of his empire.” ফরাসী সম্রাট নেপােলিয়ন স্পেনীয় ক্ষতকে যেমন তার সর্বনাশের কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন তেমনি ‘দাক্ষিণাত্যের ক্ষত’ আওরঙ্গজেবের সর্বনাশের কারণ হয়েছিল।” (“Napoleon I used to say, it was the Spanish ulcer which ruined me. ulcer ruined Aurangzeb.”- Advanced History of India. p:500)।
তবে আওরঙ্গজেবের এই ব্যর্থতা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক ড. নিজামী আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও গৌরবের কথা স্মরণ করে যে মন্তব্য করেছেন তা এখানে প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেন, “ভারতের দাক্ষিণাত্য যদি তার জীবনের ও সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে ‘কারবালা’ বলে পরিগণিত হয়, তাহলে তিনি হােসেনের মর্যাদা দাবী করতে পারেন। কারণ, আওরঙ্গজেবই প্রথম সম্রাট, যিনি উত্তর-ভারতের সুখ-ঐশ্বর্য ত্যাগ করে দাক্ষিণাত্যের বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তির বিরুদ্ধে অক্লান্ত সৈনিক হিসেবে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ছুটেছেন এবং দাক্ষিণাত্যের বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিকে ভারতরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরই সময় যে অখণ্ড ভারতরাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়েছিল তাঁরই উপর ভিত্তি করে আধুনিক ভারতের ‘সৌধ’ নির্মিত হয়েছে। রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্যের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব কম নয়। তাই বলা যায়, ভারত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনৈতিক সংহতির তিনিই প্রথম উদগাতা।” (তেসলিম চৌধুরী, মধ্যযুগের ভারত ও মুঘল আমল, পৃঃ ৩২৬)।
আওরঙ্গজেবের শেষ জীবন ও মৃত্যু
সম্রাট আওরঙ্গজেবের শেষ জীবন মােটেই সুখের হয়নি। সুদীর্ঘকাল দাক্ষিণাত্যে অবস্থান এবং মারাঠা জাতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত থাকার ফলে সম্রাটের দেহ ও মন ভেঙ্গে পড়ে। ১৭০২ খ্রীস্টাব্দে বিদ্রোহী পুত্র আকবর মৃত্যুবরণ করেন। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে পুত্রদের সংঘাতের সূচনা হয়। সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ চিন্তা তার অন্তরকে ভীষণভাবে ব্যথিত তােলে। সাম্রাজ্যের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে তার সন্ত্রস্ত চেতনার কথা, ব্যর্থতার কথা পুত্রদের কাছে লেখা তার লিখিত পত্রাবলী থেকে জানা যায়। তিনি তার পুত্র শাহজাদা আজমকে এক পত্রে লেখেন “আমি একাকী এসেছিলাম, একাকীই প্রত্যাবর্তন করছি। আমি প্রজাদের কোন উপকার করতে পারিনি এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও কোন আশা পােষণ করতে পারছিনা।” আর পুত্র কামবক্সকে তিনি লেখেন, “আমার ত্রুটির ভার আমি নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি….. যাই ঘটুক আমি যাত্রা করলাম।” (তেসলিম চৌধুরী, মধ্যযুগের ভারত ও মুঘল আমল, পৃঃ ৩৩৯)। ভগ্নহৃদয় ও ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম বৃহত্তর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আওরঙ্গজেব ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে ৩ মার্চ নব্বই বছর বয়সে দাক্ষিণাত্যের আহমদনগরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃতদেহ দৌলতাবাদে আনা হয় এবং সেখানে বিখ্যাত মুসলিম সাধক শেখ বুরহান উদ্দীনের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
আওরঙ্গজেবের চরিত্র ও কৃতিত্ব
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে সম্রাট আওরঙ্গজেবের চরিত্র ও নীতি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক, বিদেশী পর্যটক ও ইউরােপীয় লেখক ইংরেজী ভাষায় রচিত বিভিন্ন উপাদানের ওপর নির্ভর করে আওরঙ্গজেবের চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা ফার্সি উপাদানের সাহায্যে আওরঙ্গজেবের চরিত্র ও নীতি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে আওরঙ্গজেবকে একজন শক্তিশালী শাসক হিসেবেই নয়, বরং ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট হিসেবে অভিহিত করেছেন। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি পিতার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিলেন এবং সমস্ত ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বৃদ্ধ পিতার প্রতি তার নিষ্ঠুর ব্যবহার আদৌও যুক্তিসঙ্গত ও সমর্থনযােগ্য নয়। কিন্তু পিতার প্রতি পুত্রের এই ব্যবহারের জন্য শাহজাহানও কম দায়ী ছিলেন না। শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে আওরঙ্গজেব সব দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও শাহজাহান তার জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। তাছাড়া দারার ওপর পক্ষপাতিত্ববশত তিনি বিভিন্ন সময় আওরঙ্গজেবের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন। তার এই আচরণ আওরঙ্গজেবের অনুভুতিকে প্রচণ্ডভাবে আহত করেছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেব কখনই পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি। পিতৃহত্যার উদাহরণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে প্রচুর দেখতে পাওয়া গেলেও আওরঙ্গজেব অন্ততঃপক্ষে পিতৃহন্তা ছিলেন না। তাছাড়া, সে যুগে সিংহাসন লাভের জন্য ভ্রাতৃহত্যাকে দোষণীয় বিবেচনা করা হতোনা। সম্রাট শাহজাহানও তার সিংহাসনকে নিষ্কণ্টক করার জন্য তার প্রতিদ্বন্দ্বী সবাইকে হত্যা করেছিলেন। সে তুলনায় আওরঙ্গজেবের পক্ষে বলা যায় যে, তিনি ভাইদের হত্যা করলেও ভ্রাতুস্পত্রের প্রাণহরণ করেনি।
সমগ্র মধ্যযুগের মুসলমান শাসকদের মধ্যে আওরঙ্গজেবের চরিত্রে এমন কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য ছিল যা সত্যই প্রশংসার দাবী রাখে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আদর্শবাদী পুরুষ। মধ্যযুগের নৈতিক কলুষতা কখনই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। শরিয়তে বিধান মােতাবেক চারজন স্ত্রী তিনি গ্রহণ করেছিলেন। পূর্বপুরুষদের ন্যায় বহু মহিষী নিয়ে প্রমােদ-পরায়ণতা তার ছিল না। পােশাকপরিচ্ছদ ও আহার্যে তার কোন বিলাসিতা ছিল না। মদ্যপান তিনি বর্জন করে চলতেন। তিনি অত্যন্ত অনাড়ম্বর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। রাজকীয় কোষাগারকে তিনি জনগণের সম্পত্তিরূপে গণ্য করতেন এবং নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য রাজকীয় কোষাগার থেকে কিছু গ্রহণ করতেন না। সাধারণ টুপি সেলাই করে এবং কোরআন নকল করে সম্রাট তার খরচ নির্বাহ করতেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন দক্ষ সমরবিদ ও কূটনীতিবিদ। সামরিক বিষয়ে তার অসামান্য নৈপুন্য ছিল। যৌবনে তিনি যেমন সামরিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, বৃদ্ধ বয়সেও তিনি স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সৈন্য পরিচালনা করতেন। একমাত্র কান্দাহার যুদ্ধে তিনি গােলন্দাজ বাহিনীর দুর্বলতার জন্য পরাজয় বরণ করেছিলেন। তার আমলেই সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার কূটনৈতিক চাতুর্য ছিল ম্যাকিয়াভেলার নীতির মত। কূটনীতির বলেই তিনি সকল ভ্রাতাকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেছিলেন। কূটনীতির মাধ্যমেই তিনি রাজপুত নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে উত্তর-ভারতে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসক। রবার্ট উমি (Orme) তাকে ভারতের সর্বাপেক্ষা সুদক্ষ সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন। দাক্ষিণাত্যে শাসন-সংক্রান্ত ব্যাপারে তার সুবাদার হিসেবে তিনিই সর্বপ্রথম রাজা টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থা প্রয়োগ করে সেখানকার অর্থনৈতিক ইতিহাস এক নতুন যুগের সূচনা করেন। রাজ-কর্তব্য সম্পর্কে তার ধারণা ছিল মহান। প্রজাকল্যাণ যে রাজার মহান কর্তব্য, আওরঙ্গজেব কখনই তা বিস্মৃত হননি। এ প্রসঙ্গে তিনি এরূপ মন্তব্য করেছিলেন, “I was sent into the world by providence to live and labor not for myself but for other.” প্রজাকল্যাণের কথা চিন্তা করেই তিনি সিংহাসনে আরােহণের পর ৮০ প্রকার কর তিনি মওকুফ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। বৃদ্ধ বয়সেও রাজকার্যে তার ক্লান্তি ছিল না। ১৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দে গেমিলি ক্যাবেরী নামক একজন ইতালীয় চিকিৎসক ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “সম্রাট ৭০ বছর বয়সে হাসিমুখে চোখে চশমা না লাগিয়ে, নিজের হাতে সব দরখাস্তের ওপর মন্তব্য লিখতেন।” বিচার বিভাগের কাজেও তার ভূমিকা সমসাময়িক বিদেশীরা প্রশংসা করেছেন। সম্রাট ছিলেন ন্যায় বিচারক এবং বিচারের সময় তিনি ধনী-দরিদ্র ও উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ করতেন না।
আওরঙ্গজেব একজন শ্রেষ্ঠ সেনাপতি, প্রজাহিতৈষী শাসকই ছিলেন না, তিনি নিজে ছিলেন একজন বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী শাসক। তিনি ফার্সি ভাষায় যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন এবং হিন্দী ও তুর্কী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। কোরআন তার কণ্ঠস্থ ছিল। তার রচিত প্রায় দু’হাজার পত্রাবলি ইতিহাস সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তারই পৃষ্ঠপােষকতায় বিখ্যাত আইন গ্রন্থ ‘ফতােয়া-ই-আলমগীরী’ রচিত হয়। তার সময় কাফী খান ‘মুনতাখাবুল লুবাব’ নামক ইতিহাস গ্রন্থখানি রচনা করেন। তবে শিল্পকলা, সাহিত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পে তার কোন অনুরাগ ছিল না। এসব চর্চাকে তিনি ইসলামবিরােধী মনে করতেন।
আওরঙ্গজেবের চরিত্রে সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। এর ফলে মন্ত্রীরা স্বাধীনভাবে কোন নীতি নির্ধারণ বা কর্ম সম্পাদন করতে পারতেন না। ফলে তারা স্বাভাবিক উদ্যম হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘকাল যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকার ফলে সেনাবাহিনীর সামরিক দক্ষতাও হ্রাস পায়। শুধু তাই নয়, রাজকোষেরও ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পূর্বেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
মারাঠা শক্তির উত্থান
মারাঠা শক্তির উত্থানের কারণ
১৭শ শতকের শেষার্ধে মারাঠা শক্তির উত্থান মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। মারাঠা জাতির এই উত্থানের প্রধান পুরুষ ছিলেন মারাঠা নেতা শিবাজী। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে মারাঠারা এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছিল। তবে মারাঠা জাতির অভ্যুদ্বয়ের পেছনে ভৌগােলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপাদানও বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
প্রথমত, মহারাষ্ট্রের ভৌগােলিক অবস্থা উত্তর-ভারত হতে সম্পূর্ণরূপে পৃথক ছিল। এলাকাটি চারদিক থেকে প্রাকৃতিক সীমারেখাবেষ্টিত ছিল। উত্তর হতে দক্ষিণে সম্প্রসারিত সম্প্রসারিত সহাদ্রি পর্বতমালা এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্প্রসারিত সাতপুরা ও বিন্ধ্য পর্বতমালা ছাড়াও নর্মদা ও তাপ্তি নদীর স্রোতধারাও দেশটিকে সুবিস্তৃত ও সুগভীর পরিখার মত ঘিরে রেখেছে। মহারাষ্ট্রের পাহাড়িয়া দুর্গগুলােও বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল। মহারাষ্ট্রের জলবায়ুও মারাঠাদের দুর্ধর্ষ করে তােলে। ভূমির অনুর্বরতা ও বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মারাঠারা কঠোর পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু ও সংগ্রামশীল হয়ে ওঠে। দেশ পর্বতসঙ্কুল হওয়ায় তারা গেরিলা যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠে এবং গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমেই তারা বিভিন্ন সময়ে মুঘল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সমর্থ হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, ১৫শ, ১৬শ ও ১৭শ শতকে মহারাষ্ট্রে ভক্তি আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। ভক্তি আন্দোলনের নেতা রামদাস, তুকারাম, একনাথ, বামনপণ্ডিত প্রমুখ প্রচার করেন যে, জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ ঈশ্বরের সন্তান এবং মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। এর ফলে মারাঠা সমাজে সাম্য-ভাবধারা গড়ে ওঠে। মারাঠা ভাষা ও সাহিত্যও মারাঠাদের ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। তুকারাম রচিত ভজন মারাঠা সমাজের সকল শ্রেণী কর্তৃক গীত হতো এবং এগুলাে মারাঠাদের মধ্যে সামাজিক ঐক্যবােধ জাগিয়ে তুলেছিল।
তৃতীয়ত, মারাঠা নেতা শিবাজীর আবির্ভাবের পূর্বেই মারাঠারা সামরিক ও শাসন বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। দাক্ষিণাত্যের গােলকুণ্ডা ও বিজাপুর প্রভৃতি মুসলিম রাজ্যসমূহে মারাঠারা বিভিন্ন বিভাগে উচ্চপদে নিযুক্ত ছিল। আহম্মদনগরের সুলতানের প্রধানমন্ত্রী মালিক অম্বর সর্বপ্রথম মারাঠাদের সামরিক বিভাগে নিযুক্ত করে তাদের সামরিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠবার সুযােগ করে দেন। ড বেণীপ্রসাদের মতে, “Malik Ambar stands at the head of the builders of the Maratha nationality.” মুসলিম সুলতানরা মারাঠাদের সামরিক বিভাগ ছাড়াও রাজস্ব বিভাগেও নিযুক্ত করেছিলেন। অনেক মারাঠা মন্ত্রীপদও লাভ করেছিলেন। এমনকি মুসলিম সুলতানরা মারাঠা বাহিনীও গঠন করেছিলেন। এসবের ফলে মারাঠারা রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায় এবং তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের পথ উন্মুক্ত হয়।
শিবাজীর উত্থান
শিবাজীর প্রাথমিক জীবন : ১৬২৭ খ্রীস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের কাছে শিবনের পার্বত্য দুর্গে শিবাজী জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল শাহাজী ভোঁসলে ও মাতার নাম ছিল জিজাবাঈ। শিবাজীর জন্মের সময় তার পিতা শাহাজী বিজাপুর রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। জিজাবাঈয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল ছিল না। সেজন্য পুত্রের জন্মের পূর্বেই তিনি তুকাবাঈ নামে এক সুন্দরী রমণীকে বিবাহ করে নতুন জায়গীর কর্ণাটকে চলে যান। শিবাজী ও তার মা জিজাবাঈ পুণাতে একজন ব্রাহ্মণ দাদাজী কোণ্ডদেবের তত্ত্বাবধানে বসবাস করতে থাকেন। জিজাবাঈ অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা রমনী ছিলেন। তার প্রভাব শিবাজীর জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। মাতার নিকট থেকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী শুনে বাল্যকাল থেকেই শিবাজীর মনে বীরত্ব ও দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। দাদাজী কোন্ডদেব তাঁকে একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসেবে গড়ে তােলেন। কোণ্ডদেব শিবাজীকে প্রশাসনিক কাজকর্ম, অস্ত্রচালনা ও অশ্বারােহণ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেন। ধীরে ধীরে শিবাজী একজন বীর ও সাহসী যােদ্ধারূপে বেড়ে ওঠেন। ভক্তি আন্দোলনের নেতা রামদাস ও তুকারামও শিবাজীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। বাল্যকাল থেকেই মাওয়ালী নামে পরিচিত অঞ্চলের পরিশ্রমী কৃষকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এই মাওয়ালীদের নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম বিশ্বস্ত সেনাবাহিনী গঠন করেন।
শিবাজীর রাজ্যজয় : ১৬৮৭ খ্রীস্টাব্দে দাদাজী কোণ্ডদেবের মৃত্যু হলে শিবাজী রাজ্যজয়ে মনােনিবেশ করেন। শিবাজীর রাজ্যজয়ের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ঐতিহাসিক রােলিনসন বলেন, “লুটতরাজ বা সম্পদের লােভে শিবাজী রাজ্যজয়ে মনােযােগী হননি, বরং বৈদেশিক আক্রমণ থেকে স্বদেশকে মুক্ত করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য।” ঐতিহাসিক জি.এস. সারদেশাই ও ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন যে, শিবাজীর রাজ্যজয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষব্যাপী হিন্দু রাষ্ট্র গঠন। যাই হােক, শিবাজীর রাজ্যজয়ের পেছনে যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, তিনি দক্ষিণ ভারতে বিজাপুরের সুলতান ও মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।
বিজাপুরের সঙ্গে সংঘর্ষ : শিবাজী সর্বপ্রথম বিজাপুর রাজ্যের বিশৃঙ্খলার সুযােগ নিয়ে ১৬৪৭ খৃষ্টাব্দে বিজাপুরের তােরণা দুর্গটি দখল করেন এবং পরে তােরণার পাঁচ মাইল পূর্বে অবস্থিত রায়গড় দুর্গ অধিকার করেন। এই দুর্গেই শিবাজীর রাজধানী স্থাপিত হয়। এরপর তিনি বড়মতি, ইন্দ্রপুর, পুরন্দর ও কোন্দল প্রভৃতি দুর্গ একে একে জয় করেন। শিবাজীর এসব কার্যকলাপে বিজাপুরের সুলতান ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং শিবাজীকে শিক্ষা দেবার জন্য তার পিতা শাহাজীকে বন্দী করেন। ফলে শিবাজী আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ রাখেন এবং পিতার মুক্তির জন্য দাক্ষিণাত্যের মুঘল সুবাদার শাহজাদা মুরাদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এতে বিজাপুরের সুলতান ভীত হয়ে শাহাজীকে মুক্তি দেন। শীঘ্রই বিজাপুরের সুলতানের সঙ্গে শিবাজীর এক চুক্তি হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী শিবাজী ছয় বছর (১৬৪৯-৫৫) রাজ্যজয় থেকে বিরত থাকেন এবং এই সুযােগে সকলের অগােচরে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন।
১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে বিজাপুরের সুলতান অদিল শাহ মৃত্যুবরণ করলে তার নাবালক পুত্র বিজাপুরের সিংহাসনে আরােহণ করেন। এ সময় দাক্ষিণাত্যের মুঘল সুবাদার ছিলেন আওরঙ্গজেব। তিনি বিজাপুরের সুলতানের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে বিজাপুর আক্রমণ করেন। শিবাজী এ সময় উপলব্ধি করেন যে, দক্ষিণ ভারতে মুঘলদের আধিপত্য বিস্তৃত হলে পরিণামে তারই ক্ষতি হবে। সুতরাং তিনি আহম্মদনগর ও জুন্নার মুঘল অধিকৃত অঞ্চলে আক্রমণ এবং লুটতরাজ শুরু করেন। আওরঙ্গজেব শিবাজীর বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করলে শিবাজী পরাজিত হন। ইতােমধ্যে বিজাপুর মুঘলদের সঙ্গে সন্ধি করলে শিবাজীও মুঘলদের আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হন। হঠাৎ আওরঙ্গজেব শাহজাহানের অসুস্থতার সংবাদ শুনে আগ্রার দিকে যাত্রা করেন এবং উত্তরাধিকার যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলে বেশ কিছুদিন তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে নজর দিতে পারেন নি।
মুঘলদের আক্রমণ থেকে নিস্কৃতি পেয়ে বিজাপুরের সুলতান শিবাজীর শক্তি ধ্বংস করবার মনস্থ করেন। ১৬৫৯ খ্রীস্টাব্দে সুলতান সেনাপতি আফজাল খাঁকে কাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু আফজাল খাঁ শিবাজীর এক ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে নিহত হন। সেনাপতির মৃত্যু সংবাদে বিজাপুরের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অতঃপর শিবাজী কোলাপুর ও দক্ষিণ কোঙ্কন অধিকার করে নেন। বিজাপুরের সুলতান শিবাজীর বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেছিলেন কিন্তু তার সব অভিযান ব্যর্থ হয়। অবশেষে তিনি শিবাজীর সঙ্গে সন্ধি করেন। সুলতান শিবাজীর অধিকৃত অঞ্চলগুলাের ওপর তার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন।
শিবাজী ও আওরঙ্গজেব
এতদিন শিবাজী বিজাপুর রাজ্য আক্রমণ করে সন্তুষ্ট ছিলেন। এবার তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের দিকে দৃষ্টি দেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধে জয়লাভ করে আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরােহণ করেই শিবাজীকে দমন করার জন্য দাক্ষিণাত্যের সুবাদার মাতুল শায়েস্তা খানকে নির্দেশ দেন। ১৬৬০ খ্রীস্টাব্দে শায়েস্তা খান শিবাজীকে যুদ্ধে পরাজিত করে পুণা, চাকন এবং উত্তর-কোঙ্কনের কল্যাণ জেলা অধিকার করেন। শিবাজী আত্মরক্ষার জন্য বিজাপুরের সুলতানের সঙ্গে সমঝােতা করেন। এ সময় শায়েস্তা খান পুণার শিবিরে অবস্থান করছিলেন। ১৬৬৩ খ্রীস্টাব্দে এক রাতে শিবাজী অতর্কিতে শায়েস্তা খানের শিবির আক্রমণ করে তার পুত্র আবুল ফৎ ও প্রায় ৪০ জন রক্ষীকে হত্যা করেন। শায়েস্তা খান তার হাতের একটি আঙ্গুল খুইয়ে কোনরকমে নিজে প্রাণ রক্ষা করে দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করেন। শিবাজী অতঃপর সুরাট বন্দর লুণ্ঠন করে প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন।
শায়েস্তা খানের পরাজয়ে আওরঙ্গজেব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে দাক্ষিণাত্য থেকে সরিয়ে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। শাহজাদা মুয়াজ্জেম দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হন। আওরঙ্গজেব তার বিখ্যাত সেনাপতি জয়সিংহ ও দিলীর খানকে ১৬৬৫ খ্রীস্টাব্দে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। শিবাজী মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্তানুসারে শিবাজী নিজের জন্য ২২টি দুর্গ রেখে ২৩টি দুর্গ মুঘলদের হাতে অর্পণ করেন। উপরন্তু শিবাজী বিজাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘলদের ৫০০০ অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। শিবাজী মুঘল সম্রাটের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন। অতঃপর জয়সিংহ শিবাজীকে আগ্রায় সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আমন্ত্রণ জানান। ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে শিবাজী পুত্র শম্ভজীসহ আওরঙ্গজেবের দরবারে উপস্থিত হন। কিন্তু শিবাজীর উদ্ধত আচরণে আওরঙ্গজেব খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং শিবাজীকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু শিবাজী সুকৌশলে রক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে এক ফলের ঝুড়িতে পরে পলায়ন করে নিজ রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হন।
দাক্ষিণাত্যে ফিরে শিবাজী আওরঙ্গজেবের আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং পুত্রের জন্য চাকুরী প্রার্থনা করেন। শাহজাদা মুয়াজ্জেম এবং যশােবন্ত সিংহের অনুরােধে আওরঙ্গজেব শিবাজীকে রাজা উপাধি দেন এবং পুত্র শম্ভুজীকে ‘পাঁচ হাজারী’ মনসব পদে নিযুক্ত করেন। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও শিবাজী ১৬৭০ খ্রীস্টাব্দে পুনরায় মুঘলদের সাম্রাজ্য আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। তিনি একে একে কোন্দালা, পুরন্দর, সিংহগড় প্রভৃতি দুর্গগুলাে মুঘলদের হাত হতে উদ্ধার করেন। অতঃপর তিনি কোঙ্কনের মুঘল ফৌজদারকে বিতাড়িত করেন। তিনি দ্বিতীয়বার সুরাট বন্দর লুণ্ঠন করে প্রচুর ধনরত্নের মালিক হন। ১৬৭৪ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি দিলীর খান মারাঠাদের হাতে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন। দাক্ষিণাত্যে শিবাজীর এসব সাফল্যের কারণ ছিল এই যে, এ সময় মুঘলগণ উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আফগান উপজাতি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিল। ফলে শিবাজীর বিরুদ্ধে মুঘলরা কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
শিবাজী দীর্ঘদিন ধরে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন এলাকা জয় করে নিজেকে একজন রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে ও আইনের চোখে তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাটের এক প্রজা ও জায়গীরদার মাত্র। তিনি কোন রাজার সমমর্যাদা দাবী করতে পারতেন না। এ অবস্থায় শিবাজী নিজেকে স্বাধীন রাজা বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৭৪ খ্রীস্টাব্দে ৬ জুন মহাসমারােহে রায়গড় দুর্গে শিবাজীর অভিষেকক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি ‘ছত্রপতি’ উপাধি গ্রহণ করেন। এর ফলে শিবাজীর রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এবার শিবাজী সর্বসমক্ষে বিজাপুর-গােলকুণ্ডা সুলতানের সমমর্যাদাভুক্ত হন। কিছুদিন শান্তি অব্যাহত থাকার পর শিবাজী পুনরায় মুঘলদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। তিনি জিঞ্জি, ভেলাের ও মহীশূরের এক বিরাট অংশ দখল করেন। ১৬৮০ সালে তিনি যখন এভাবে নিজ রাজ্যের সীমা বিস্তারে ব্যস্ত সে সময় অকস্মাৎ তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার রাজ্য উত্তরে রামনগর থেকে দক্ষিণে কানাড়া জেলা এবং পূর্বে বাগলানা এবং পশ্চিমে আরবসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
শিবাজীর শাসনব্যবস্থা
মারাঠা জাতির জনক শিবাজী একজন বিখ্যাত সমরনায়কই ছিলেন না, একজন সুদক্ষ শাসক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার শাসনব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক হলেও প্রজাকল্যাণই ছিল তার মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিবিধ সংস্কার প্রবর্তন করেন।
কেন্দ্রীয় প্রশাসন : শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চে ছিলেন স্বয়ং রাজা। তাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য ‘অষ্ট-প্রধান’ বা আটজন মন্ত্রী নিয়ে একটি পরিষদ ছিল। রাজাই মন্ত্রীদের নিয়ােগ করতেন এবং পদচ্যুত করতেন। মন্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা রাজার উপর নির্ভর করতাে। আটজন মন্ত্রীর পদ ছিল – (১) পেশােয়া বা প্রধানমন্ত্রী; (২) আমত্য বা অর্থমন্ত্রী; (৩) মন্ত্রী-যিনি রাজা বা রাষ্ট্রের সকল উল্লেখযােগ্য ঘটনা লিপিবদ্ধ করতেন; (৪) সচিব-যিনি রাজার চিঠিপত্রসহ যাবতীয় যােগাযােগ রক্ষা করতেন; (৫) সেনাপতি-সেনাবাহিনীর প্রধান; (৬) সামন্ত বা বিদেশমন্ত্রী; (৭) পন্ডিতরাও বা ধর্মমন্ত্রী; (৮) ন্যায়াধীশ বা প্রধান বিচারপতি। রাজ্য পরিচালনায় ১৮টি বিভাগ ছিল এবং রাজার নির্দেশ অনুসারে মন্ত্রীরা বিভাগগুলাে পরিচালনা করতেন।
প্রাদেশিক শাসন : শিবাজীর রাজ্য কয়েকটি প্রান্ত বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক প্রদেশ একজন শাসনকর্তা দ্বারা শাসিত হত। রাজা প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের নিযুক্ত করতেন। কেন্দ্রীয় শাসন পদ্ধতি অনুসারে প্রাদেশিক প্রশাসন পরিচালিত হত। এখানেও আটজন কর্মনিৰ্বাহক থাকতেন। প্রদেশগুলাে আবার পরগণায় বিভক্ত ছিল। রাজ্যের ক্ষুদ্রতম প্রশাসনিক একক ছিল গ্রাম। পঞ্চায়েত গ্রাম্য শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।
রাজস্ব ব্যবস্থা : শিবাজী রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থায় রাজা টোডরমল ও মালিক অম্বরের নীতি অনুসরণ করেন। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য তিনি তার সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রান্তে বিভক্ত করেন। প্রান্তগুলাে আবার পরগনা ও তরফে বিভক্ত ছিল। সর্বনিম্ন রাজস্ব বিভাগ ছিল গ্রাম। শিবাজী রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করান এবং প্রথমে উৎপাদিত শস্যের ৩০ শতাংশ এবং পরে ৪০ শতাংশ সরকারি রাজস্ব হিসেবে নির্দিষ্ট করেন। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। কৃষকেরা নগদ অর্থে বা ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব পরিশােধ করতে পারত। দুর্ভিক্ষ বা অজন্মার সময় কৃষকদেরকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হত। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে শিবাজী কঠোর নীতি গ্রহণ করেছিলেন। শিবাজীকে বিরাট সেনাবাহিনী পােষণ করতে হত। এজন্য নিজ রাজ্যের বাইরে থেকে চৌথ ও সরদেশমুখী নামে সামরিক কর আদায় করতেন। যে অঞ্চল থেকে এসব কর আদায় করা হত সে অঞ্চল মারাঠা আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেত। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ এই করকে ‘দস্যুকর’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। শিবাজীর এই কর আদায় জনগণ ভাল চোখে দেখেনি। এই কর আদায়ের ফলে মারাঠাদের সুনাম বাইরে বিনষ্ট হয়।
সামরিক বিভাগ : শিবাজী সামরিক ক্ষেত্রেও সংস্কার সাধন করেন। পূর্বে মারাঠা সেনাবাহিনী অশ্বারােহী সৈন্য দ্বারা গঠিত ছিল। সৈন্যরা অধিকাংশ ছিল কৃষিজীবী। এরা বছরে অর্ধেক সময় কৃষি কাজে নিয়ােজিত থাকত এবং কৃষিকাজ বন্ধ থাকলে সেনাবিভাগে যােগ দিত। ফলে মারাঠাদের স্থায়ী কোন সেনাবাহিনী ছিল না। শিবাজী এই অসুবিধা দূর করে বেতন ও আবাসসহ স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন। তার সেনাবাহিনীতে প্রায় ১ লক্ষ পদাতিক, ৪০,০০০ অশ্বারােহী, ১২০০ হস্তী এবং ১৫০০ উট ছিল। এর বাইরে নিয়মিত একটি গােলন্দাজ বাহিনীও ছিল। তার অশ্বারােহী বাহিনী দু’ধরনের ছিল, যথা-বর্গী ও শিলাদার। বর্গীরা সরকার থেকে নিয়মিত বেতন ও অস্ত্রশস্ত্র পেত। কিন্তু শিলাদারদের যুদ্ধের সময় সরকার থেকে বেতন দেয়া হত, তবে অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের সংগ্রহ করতে হত। শিবাজী স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সৈন্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু সমর বিভাগের কর্তৃত্ব ন্যস্ত ছিল সেনাপতির উপর। সৈন্যদের জায়গীরের পরিবর্তে নগদে বেতন দেয়া হত। শিবাজীর জীবদ্দশায় এ বাহিনী বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় না দিলেও পরবর্তীকালে পর্তুগীজ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ বাহিনী যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেছিল।
বিচার ব্যবস্থা : শিবাজীর বিচার ব্যবস্থা খুব উন্নত ছিল না। তিনি কোন স্থানীয় আদালত প্রতিষ্ঠা করেননি। বিচারের জন্য কোন নির্দিষ্ট আইন কানুন ছিলনা। গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সাধারণত দেওয়ানী মামলার নিষ্পত্তি করা হত। গ্রাম্য প্রধান প্যাটেল ফৌজদারী মামলার বিচার করতেন। দোষীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হত। রাজদরবার ছিল সর্বোচ্চ বিচারালয়।
শিবাজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব
ভারতবর্ষের ইতিহাসে শিবাজী এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তবে চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে পরস্পরবিরােধী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। সমসাময়িক মুসলিম ঐতিহাসিকেরা শিবাজীকে মর্যাদাবান না বলে একজন দস্যু ও লুণ্ঠনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইংরেজ ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ শিবাজীর রাষ্ট্রকে ‘দস্যু রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আবার হিন্দু ঐতিহাসিকেরা শিবাজীকে অতি উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তবে শিবাজীর কৃতিত্বকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে তাকে খাটো করে দেখার কোন উপায় নেই। কারণ সামান্য এক জায়গীরদারের অবহেলিত নিরক্ষর পুত্র নিজ প্রতিভাবলে ভারতে এক স্বাধীন মারাঠা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা কম গৌরবের নয়।
শিবাজীর সর্বাধিক কৃতিত্ব ছিল এই যে, তিনি শতধা বিভক্ত ও বিক্ষিপ্ত মারাঠা জাতিকে জাতীয়তাবােধে ঐক্যবদ্ধ করে এক শক্তিশালী জাতি রূপে গড়ে তুলেছিলেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তার বিখ্যাত ‘Shivaji and his Times’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘Before his rise, the Maratha race was scattered like atoms through many Deccan kingdoms. He welded them into a mighty nation and he achieved this in the teeth of the opposition of four mighty powers like the Mughal Empire, Bijapur, Portuguese India and the Abyssinians of Jinjira.’ তার পূর্বে কোন হিন্দু এরূপ কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি।
একজন বীর যােদ্ধা ও বিজেতা হিসেবেও শিবাজী অসামান্য সফলতা দেখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সমরকুশলী ও কূটনীতিক। তিনি তার সামরিক বাহিনীতে কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা প্রবর্তন করেছিলেন। এর ফলে মারাঠা বাহিনী বার বার শক্তিশালী মুঘল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে শিবাজীর সামরিক সাফল্যের প্রধান কারণ ছিল তার গেরিলা যুদ্ধ নীতি অনুসরণ। মহারাষ্ট্রের ন্যায় পর্বতসঙ্কুল দেশে তার এই নীতি খুবই কার্যকর হয়েছিল।
রাষ্ট্রশাসন ব্যাপারেও শিবাজী সৃজনী-শক্তির পরিচয় দেন। তিনি তার রাজ্যে একটি শক্তিশালী ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন। প্রজাকল্যাণই ছিল তার শাসনব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। তার রাজ্যে হিন্দু মুসলমানের কোন ভেদাভেদ ছিলনা। যোগ্যতার বিচারে তিনি সকলকে দায়িত্ব প্রদান করতেন। যদুনাথ সরকার বলেন, “শিবাজী যে শুধু মারাঠাদের স্রষ্টা ছিলেন এমন নহে, তিনি ছিলেন মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাসম্পন্ন জাতীয় স্রষ্টা।” (“Shivaji was not only the maker of the Maratha nation, but also the greatest constructive genius of medieval India” – V.D. Mahajan, Muslim Rule in India, P: 214)।
শিবাজীর ব্যক্তিগত চরিত্রও আদর্শস্থানীয় ছিল। সমসাময়িক রাজা-বাদশাহদের চরিত্রে যেসব দোষ ছিল, তা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন। হিন্দু ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। কিন্তু পরধর্মবিদ্বেষ তার চরিত্রকে কখনও কলুষিত করেনি। তার কঠোর সমালােচক কাফি খান শিবাজীর পরধর্মসহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন। তিনি মুসলিম পীরদের সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা পােষণ করতেন, পীরদের দরগার ব্যয় তিনি নির্বাহ করতেন। তিনি তার সৈন্যদের কাছে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন মসজিদ, পবিত্র কোরআন এবং মুসলিম মহিলাদের কোনরকম অসম্মান না করেন। সুরাট লুণ্ঠনের সময় তিনি খৃষ্টান পাদ্রীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় হয়তো তাকে শঠতা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিতে হয়েছে, কিন্তু তার জন্য মধ্যযুগীয় পরিস্থিতিই দায়ী ছিল। সুতরাং সব দিক বিচার করলে শিবাজীর চরিত্র ও কৃতিত্বের ঔজ্জ্বল্য সত্যই চমৎকৃত করে।
শিবাজীর উত্তরাধিকারীগণ
শিবাজীর মৃত্যুর পর তার পুত্র শম্ভুজী (১৬৮০-৮৯) মারাঠা সিংহাসনে আরােহণ করেন। শম্ভুজী ছিলেন পিতার অনুপযুক্ত পুত্র। তিনি ছিলেন আরামপ্রিয় ও দুশ্চরিত্র। তিনি মারাঠাদের ঐক্যবদ্ধ করার কোন প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেননি। মুঘলদের শক্তি সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। মুঘলরা বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় তিনি আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি পর্তুগীজ ও জাঞ্জিবারের সিদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করেন। আওরঙ্গজেবের বিদ্রোহী পুত্র যুবরাজ আকবর শম্ভুজীর সাহায্যের প্রত্যাশায় প্রায় ছয় বছর তার দরবারে অবস্থান করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের ভয়ে তিনি তাকে কোন সাহায্য প্রদান করেননি। যুবরাজ শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে পারস্যে পলায়ন করেন। আওরঙ্গজেব বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা জয় সমাপ্ত করে শম্ভুজীর রাজ্য আক্রমণ করেন। মুঘল বাহিনীর হাত থেকে শম্ভুজী আত্মরক্ষা করতে ব্যর্থ হন এবং তিনি অকস্মাৎ মুঘল বাহিনীর হাতে বন্দী হন। ১৬৮৯ খ্রীস্টাব্দে তার প্রাণদণ্ড হয়। বহু দুর্গসহ বিখ্যাত রায়গড় দুর্গ মুঘলদের হস্তগত হয়। তার শিশুপুত্র মুঘলদের হাতে বন্দী হয়। শিবাজীর দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র রাজারাম কোন রকমে পলায়ন করে কর্ণাটক প্রদেশের অন্তর্গত জিঞ্জিতে আশ্রয় নেন।
শম্ভুজীর মত্যুর পর রাজারাম (১৬৮৯-১৭০০) মারাঠাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। জিঞ্জিতে বসেই তিনি মারাঠা বাহিনীকে সংগঠিত করেন। তার নেতৃত্বে অল্পকালের মধ্যেই মারাঠা শক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। মারাঠারা বিভিন্ন স্থানে মুঘল শক্তিকে বিভিন্ন কৌশলে পর্যুদস্ত করে তােলে। আওরঙ্গজেব মারাঠা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবার জন্য তার দুর্ধর্ষ সেনাপতি জুলফিকার খানকে প্রেরণ করেন। ১৬৯১ খৃষ্টাব্দ থেকে মুঘলরা মারাঠাদের জিঞ্জি দুর্গ অবরােধের অষ্টা চালায়। মারাঠারা মুঘল বাহিনীকে প্রচণ্ডভাবে বাধা প্রদান করে। অবশেষে ১৬৯৮ খ্রীস্টাব্দে মুঘল বাহিনী জিঞ্জি দুর্গ অধিকার করতে সমর্থ হয়। রাজারাম পালিয়ে সাতারায় আশ্রয় নেন এবং পুনরায় নতুন করে মারাঠা বাহিনী গঠন করেন। এখানে শক্তি সঞ্চয় করে তিনি খান্দেশ, বেরার ও বলগান প্রভৃতি মুঘল রাজ্য থেকে চৌথ ও সরদেশমুখী কর আদায় করতে থাকেন। ১৬৯৯ খ্রীস্টাব্দে আওরঙ্গজেব স্বয়ং মারাঠাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। তিনি সাতারায় কয়েকটি মারাঠা দুর্গ দখল করেন। ১৭০০ খ্রীস্টাব্দে রাজারামের মৃত্যু হয়।
রাজারামের মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় পুত্র দ্বিতীয় শিবাজী সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং রাজারামের বিধবা স্ত্রী তারাবাঈ (১৭০০-১৭০৭) বালক রাজার অভিভাবিকা নিযুক্ত হন। তারাবাঈ প্রখর বুদ্ধিসম্পন্না ছিলেন। তিনি নতুন করে মারাঠাদের সংঘবদ্ধ করে মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। মারাঠা সেনাবাহিনী বারবার দাক্ষিণাত্যের মুঘল প্রদেশগুলােতে আক্রমণ চালাতে থাকে। দাক্ষিণাত্য ও মধ্য-ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে মারাঠাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওরঙ্গজেব সর্বশক্তি নিয়ােগ করেও মারাঠাদের দমন করতে সমর্থ হননি। ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মারাঠারা ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। মারাঠা শক্তির এই পুনরুত্থান মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করে দেয়।
আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারীগণ এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতন
আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারীগণ
১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সূচিত হয়। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুকালে তার জীবিত তিন পুত্র মুয়াজ্জেম কাবুলের, আজম গুজরাটের এবং কামবক্স দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা ছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই সিংহাসন লাভের জন্য তিন পুত্রের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়। এই সংগ্রামে কাবুলের শাসনকর্তা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মুয়াজ্জেম অপর দুই ভ্রাতাকে পরাজিত ও নিহত করে বাহাদুর শাহ বা প্রথম শাহ আলম উপাধি ধারণ করে ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। বাহাদুর শাহ একজন বিদ্বান, দানশীল ও উদার শাসক ছিলেন। তার রাজত্বকালের উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল পাঞ্জাবের শিখ নেতা বান্দার বিদ্রোহ দমন। তিনি রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর রাজত্ব করার পর বাহাদুর শাহ ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর পুনরায় তার চার পুত্র জাহান্দার শাহ, আজিম উসমান, জাহান শাহ ও রফি উসশানের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বে জাহান্দার শাহ প্রখ্যাত অভিজাত জুলফিকার খানের সাহায্যে অপর তিন ভাইকে হত্যা করে ১৭১২ খ্রীস্টাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু এক বছর রাজত্ব করার পর জাহান্দার শাহ নিজ ভ্রাতা আজিম উসমানের পুত্র ফারুকশিয়ার কর্তৃক নিহত হন। ফারুকশিয়ার ১৭১৩ খ্রীস্টাব্দে নিজেকে সম্রাট করে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। ফারুকশিয়ারের সিংহাসন লাভে সহায়তা করেছিলেন ‘সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়’, যারা হলেন পাটনার সহকারি শাসনকর্তা হুসেন আলী ও এলাহবাদের শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ। সিংহাসনে আরােহণ করে ফারুকশিয়ার সাম্রাজ্যের শাসনভার সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের হাতে ছেড়ে দেন। ফলে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হন। সম্রাট তাদের হাতে পুতুলে পরিণত হন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ সাম্রাজ্যের উজীর এবং সৈয়দ হুসেন আলী সেনাপতি নিযুক্ত হন। শীঘ্রই সম্রাটের কিছু পদক্ষেপে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং অবশেষে ১৭১৯ তারা ফারুকশিয়ারকে হত্যা করেন। ফারুকশিয়ারের মৃত্যুর পর সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় মুঘল রাজবংশের প্রকৃত ভাগ্যবিধাতায় পরিণত হন। সাম্রাজ্যে নিজেদের প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে তারা বাহাদুর শাহের দুই পুত্র রফি-উদ-দরতাৎ ও রফি-উদ-দৌলাকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই এই দুই কিশোর রাজার মৃত্যু হলে জাহান শাহের পুত্র রোহশান আখতার সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের সাহায্যে ‘মুহম্মদ শাহ’ (১৭১৯-৪৮) উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন।
মুহম্মদ শাহ একজন স্বাধীনচেতা সম্রাট ছিলেন। তিনি সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের হাতের পুতুল হয়ে রাজ্য শাসন করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি শেষপর্যন্ত গুপ্তঘাতক দ্বারা সৈয়দ আলীকে হত্যা করেন। এতে সৈয়দ আলীর অপর ভ্রাতা আব্দুল্লাহ বিদ্রোহী হলে তাকেও পরাজিত ও হত্যা করা হয়। এভাবে মুহম্মদ শাহ সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত থেকে মুক্তি পান। সম্রাট দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিজাম-উল-মুলকে সাম্রাজ্যের উজীর পদে নিযুক্ত করেন। নিজাম-উল-মুলক সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের পতনে সম্রাটকে সাহায্য করেছিলেন। যাইহােক, মুহম্মদ শাহের শাসনামলে কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে বিভিন্ন প্রদেশের সুবাদারগণ নিজ নিজ এলাকায় বিদ্রোহ ঘােষণা করে স্বাধীন হয়ে যান। সম্রাটের দুর্বলতা এবং অকর্মন্যতা লক্ষ্য করে নিজাম উল-মুলকও দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান এবং হায়দ্রাবাদে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজ্যই পরবর্তীকালে হায়দ্রাবাদের নিজাম রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে। এভাবে অযােধ্যার শাসনকর্তা সাদাত খান, বাংলার নবাব আলীবর্দী খান স্বাধীন হয়ে যায়। মারাঠারাও রাজ্যের বিভিন্ন অংশে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আগ্রার সন্নিকটে জাঠগণ, পাঞ্জাবের শিখরা এবং আফগান রােহিলাগণও ক্রমে স্বাধীন হয়ে পড়ে। মুঘল সাম্রাজ্যের এই চরম দুর্যোগের সময় পারস্যরাজ নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেন। কাবুল ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশও মুঘল সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়ে যায়।
১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে মুহম্মদ শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র আহমদ শাহ (১৭৪৮-৫৪) দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। আহমদ শাহের পর মুঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন দ্বিতীয় আলমগীর (১৭৫৪-৫৯)। তিনি ছিলেন একজন দুর্বল সম্রাট। তিনি ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী ইমাদ-উল-মুলকের দ্বারা নিহত হন। দ্বিতীয় আলমগীর নিহত হলে তার পুত্র দ্বিতীয় শাহ আলম (১৭৫৯) সিংহাসনে আরােহণ করেন। ১৭৬৪ খ্রীস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে শাহ আলম ইংরেজদের হাতে পরাজিত ও বন্দী হন। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা কর পাওয়ার স্বার্থে বাংলা ও বিহারের দেওয়ানী ইংরেজদের হাতে অর্পণ করেন। দ্বিতীয় শাহ আলমের মৃত্যুর পর তার পুত্র ছিল, (১৮০৬-১৮৩৭) দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। ১৮৩৭ সালে দ্বিতীয় আকবর মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৮৩৭-৫৮) সিংহাসনে নামেমাত্র অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের বিদ্রোহীরা তাকে ভারতের সম্রাট বলে ঘােষণা করেন। মহাবিদ্রোহে যােগদানের অপরাধে অভিযুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার তাকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেন। ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে সেখানে তার মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুঘল রাজবংশের অবসান ঘটে।
বৈদেশিক আক্রমণ
নাদির শাহ (১৭৩৮-৩৯)
নাদির শাহের বাল্য নাম ছিল নাদির কুলী খাঁ। প্রথম জীবনে তিনি দস্যুদলের সর্দার ছিলেন। ভাগ্যের বহু কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি পারস্যের সিংহাসনচ্যুত রাজপরিবারকে আফগানদের কবল থেকে মুক্ত করতে, অর্থাৎ পারস্যকে মুক্ত করতে সাহায্য করেন। পারস্য সম্রাট শাহ তহমাস্প পারস্যের সিংহাসন ফিরে পেলে তিনি তার অধীনে রাজকার্যে নিযুক্ত হন। শাহ তহমাস্প ছিলেন একজন দুর্বল শাসক। তার দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে নাদির কুলী খাঁ অত্যন্ত ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠেন এবং ১৭৩২ খ্রীস্টাব্দে পারস্য সম্রাটকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। অতঃপর ১৭৩৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি ‘নাদির শাহ’ উপাধি ধারণ করে পারস্যে রাজত্ব শুরু করেন।
১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দে নাদির শাহ কান্দাহার আক্রমণ করন এবং এক বছর অবরােধের পর কান্দাহার অধিকার করেন। নাদির শাহ কর্তৃক কান্দাহার অধিকৃত হলে বিদ্রোহী আফগান উপজাতিগুলাে সীমান্ত পার হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাবুলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নাদির শাহ এই ঘটনার প্রতিবাদ করে দিল্লীতে দূত প্রেরণ করেন। কিন্ত দিল্লীর রাজদরবারে এই দূতকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করে তাকে আটক করে রাখা হয়। এতে নাদির শাহ অত্যন্ত ক্রুব্ধ হন এবং ভারত আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৭৩৮ খ্রীস্টাব্দে নাদির শাহ একরকম প্রতিরােধ ছাড়াই আফগানিস্তানে প্রবেশ গজনী ও কাবুল অধিকার করেন। অতঃপর তিনি লাহাের জয় করে দিল্লী অভিমুখে অগ্রসর হন। সে সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন মুহম্মদ শাহ। মুহম্মদ শাহ নাদির শাহের আক্রমণের কোন গুরুত্ব না দিয়ে সভাসদদের নিয়ে আমোদ প্রমোদে মগ্ন ছিলেন। যখন তার চৈতন্যোদয় হলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে নাদির শাহ পানিপথের অনতিদূরে কর্ণালে উপস্থিত হলে মুহম্মদ শাহ তাকে বাধা দেন। কিন্তু মুহম্মদ শাহ পরাজিত হন। কর্ণালের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুহম্মদ শাহ ৫৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে নাদির শাহের সঙ্গে এক সন্ধি করেন। নাদির শাহ মুহম্মদ শাহকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লীতে প্রবেশ করেন। মুহম্মদ শাহ নাদির শাহকে শাহজাহানের সুরম্য প্রাসাদ দেওয়ান-ই-খাসে থাকার ব্যবস্থা করেন। এসময় গুজব রটে যে, নাদির শাহের মৃত্যু হয়েছে। এই মিথ্যা সংবাদের ওপর ভিত্তি করে দিল্লীর অধিবাসীরা কয়েকশাে পারসিক সৈন্য হত্যা করে। এতে ক্রোধান্ধ হয়ে নাদির শাহ তার সেনাবাহিনীকে দিল্লী লুণ্ঠনের আদেশ দেন। নাদির শাহের নির্দেশে পারসিক সেনাদল প্রায় লক্ষাধিক দিলীবাসীকে হত্যা করে এবং বহু গৃহ লুণ্ঠন করে। প্রায় দু’মাস ধরে হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন কার্য চলে। নাদির শাহ দিল্লীর অধিবাসীদের নিকট হতে প্রায় ৩ কোটি টাকা আদায় করেন। অবশেষে সম্রাট মুহম্মদ শাহের অনুরােধে নাদির শাহ নৃশংস হত্যাকাণ্ড স্থগিত করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় নাদির শাহ প্রায় পনের কোটি মুদ্রা, বহু মণি মাণিক্য, ভূবন বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনুর মণি, মূল্যবান পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, দশ হাজার অশ্ব, তিনশত হস্তি ও বহু সংখ্যক উট নিয়ে ভারত ত্যাগ করেন। উপরন্তু মুহম্মদ শাহের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু, কাবুল ও পশ্চিম পাঞ্জাব নাদির শাহকে ছেড়ে দিতে হয়। নাদির শাহের ভারত আক্রমণ পতনােন্মুখ মুঘল সাম্রাজ্যকে চরম আঘাত হেনেছিল।
আহমদ শাহ আবদালী (১৭৪৮-৬৭)
আহমদ শাহ আবদালী পারস্য সম্রাট নাদির শাহের একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন। তার বাল্যজীবন সম্পর্কে সঠিক জানা যায় না। ১৭৪৭ খ্রীস্টাব্দে নাদির শাহ তার এক অনুচরের ছুরিকাঘাতে নিহত হলে আহম্মদ শাহ আবদালী পারস্যের পূর্বাঞ্চল আফগানিস্তানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সিংহাসনে আরােহণ করে তিনি ‘দর-ই-দুরান’ উপাধি ধারণ করেন। তিনি আফগানিস্তানের অধিপতি হিসেবে ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৭৬৮ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত মোট নয়বার ভারত আক্রমণ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর ভারতবর্ষে আফগান প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের অপরিসীম ধনরত্ন লাভ করাই ছিল তার ভারত আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য। তাছাড়া নিজ দেশে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং নিজের মহিমা বৃদ্ধি করার জন্য তার ভারত আক্রমণ প্রয়ােজন ছিল।
১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে আহমদ শাহ আবদালী প্রথম ভারতবর্ষ আক্রমণ। এই অভিযানে তিনি পাঞ্জাব পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু যুবরাজ আহম্মদ শাহের কাছে তিনি পরাজিত হয়ে বিতাড়িত হন। আহম্মদ শাহের রাজত্বকালে তিনি পুনরায় ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন এবং সিন্ধুনদের পশ্চিমাঞ্চল দখল করেন। ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দে তিনি তৃতীয়বার ভারত আক্রমণ করেন এবং পাঞ্জাবের শাসনকর্তা মঙ্গল খানকে পরাজিত করে তাকে পশ্চিম পাঞ্জাব ছেড়ে দিতে বা করেন। চতুর্থ অভিযানে অগ্রসর হয়ে আবদালী দিল্লী, মথুরা লুট করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেন। এ সময় দ্বিতীয় আলমগীর মুঘল সম্রাট ছিলেন। শেষপর্যন্ত সম্রাট আলমগীর পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও সিন্ধুদেশ আবদালীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আবদালী তার পুত্র তৈমুর শাহকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে কাবুলে প্রত্যাবর্তন করেন।
তৈমুর শাহের এক বছরের শাসনকালে পাঞ্জাবে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় জলন্ধরের মুঘল শাসনকর্তা আদিল বেগ পাঞ্জাব থেকে আফগানকে বিতাড়নের জন্য মারাঠাদের সাহায্য গ্রহণ করেন। মারাঠা নেতা রঘুনাথ রাও-এর সাহায্যে আদিল বেগ আফগানদের পাঞ্জাব থেকে বিতাড়ন করতে সক্ষম হন। আহমদ শাহ আবদালী পুত্রের দুর্গতির সংবাদ শুনে খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং প্রতিশােধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে তিনি পুনরায় ভারত আক্রমণ করে পাঞ্জাব অধিকার করেন। এবার তিনি মারাঠা শক্তিকে ধ্বংস করবার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ১৭৬১ খ্রীস্টাব্দে ঐতিহাসিক পানিপথের প্রান্তরে মারাঠাদের সঙ্গে আবদালীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এটি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধে মারাঠারা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে জয়লাভ করে আহমদ শাহ আবদালীর বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ৪০ লক্ষ মুদ্রা কর হিসেবে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে নাদির শাহের মত তাকেও আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়।
আহমদ শাহ আবদালীর ভারত আক্রমণ ছিল মুঘল সাম্রাজ্য ও মারাঠা শক্তির কাছে এক বড় আঘাত। আফগান অধিপতির বার বার ভারত আজ ফলে ধ্বংসপ্রায় মুঘল সাম্রাজ্য প্রায় ধ্বসে পড়ে। তৃতীয় পানিপথের মারাঠাদের পরাজয়ের ফলে মারাঠা শক্তিও সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। এর ফলে ভারতে তাদের সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মারাঠা শক্তি বিধ্বস্ত হলে শিখ জাতির উত্থানের পথ যেমন সহজতর হয় তেমনি ইংজেরদের ভারতে প্রভুত্ব স্থাপনের পথও সুগম হয়। প্রকৃতপক্ষে আহমদ শাহ আবদালীর ভারত আক্রমণই মুঘল সাম্রাজ্যকে শেষ আঘাত হেনেছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লােদীকে পরাজিত করে বাবর ভারতবর্ষে যে মুঘল সাম্রাজ্যের গােড়াপত্তন করেন, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দানের জন্য ইংরেজ শাসক কর্তৃক মুঘল বংশের সর্বশেষ শাসক দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করার সাথে সাথে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এই সুদীর্ঘ তিন শতকের অধিক রাজত্বকালে মুঘলগণ ভারতবর্ষের ইতিহাসকে শুধুমাত্র সমৃদ্ধই করেননি, বরং অক্ষয় ও অবিস্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হঠাৎ করে ঘটেনি, বরং অনেক পর্বেই সাম্রাজ্যের পতনের বীজ বপন হয়েছিল। কিন্তু সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয় এবং পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন দিল্লী ও আগ্রার নিকটবর্তী অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মুঘল সাম্রাজ্যের এই দ্রুত অবক্ষয় কেন হল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরােধ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক ডঃ যদুনাথ সরকার মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য আওরঙ্গজেবের হিন্দু-বিদ্বেষী নীতিকে দায়ী করেছেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মতে, মনসবদারী প্রথার ভাঙ্গন ও জায়গীর সংকট প্রধানত মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংস ডেকে এনেছিল। একই বিশ্ববিদ্যালয়েল অধ্যাপক আতাহার আলী বলেছেন যে, ১৮শ শতকে মুঘল শাসক শ্রেণীর অধঃপতনই মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের অন্যতম কারণ। যাইহােক, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূলে কোন একটি বিশেষ বিষয় ও কোন ব্যক্তি দায়ী ছিলেন না। বিভিন্ন বিষয়গুলাের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিষয়গুলো হলো –
(১) উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর অভাব : মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রকাঠামাে। সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও অস্তিত্ব নির্ভর করতাে সম্রাটের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, বুদ্ধি, কর্মনিষ্ঠা ও সামরিক শক্তির ওপর। কিন্তু দুর্বল শাসকের আবির্ভাব ঘটলেই তাতে সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবার সম্ভাবনা ছিল। বাবর থেকে আওরঙ্গজেব-এই ছয়জন সম্রাট সকলেই শক্তিশালী প্রতিভাসম্পন্ন শাসক ছিলেন। তাদের শাসনামলে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অনেক সংকট থাকা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যের শান্তি ও শৃঙ্খলা অব্যাহত ছিল। আওরঙ্গজেবের পরবর্তী সব মুঘল সম্রাটই ছিলেন অপদার্থ, শাসন পরিচালনায় অনুপযুক্ত, বিলাসী ও চরিত্রহীন। তারা সকলেই মন্ত্রীদের হাতে রাজ্যভার ন্যস্ত করে নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করতেন। তাদের দুর্বলতার সুযােগে অভ্যন্তরীন বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং সে সুযােগে বার বার বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঘটে। কিন্তু বিশাল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা সুনিশ্চিত করে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ করার মত ক্ষমতা, যােগ্যতা ও বিচক্ষণতা তাঁদের একবারেই ছিল না। সুতরাং আওরঙ্গজেবের পরবর্তী সুযােগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
(২) উত্তরাধিকার আইনের অভাব : ভারতের মুঘল রাজবংশের একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিল এই যে, সিংহাসনে উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোন আইন ছিল না। এর ফলে দেখা যায় প্রায় সকল সম্রাটের রাজত্বের শেষে উত্তরাধিকার যুদ্ধ সংঘটিত হত। তখন এক নিয়ম ছিল – তখত য়া তখতা, অর্থাৎ “হয় সিংহাসন লাভ নতুবা কবরে আশ্রয়”। একমাত্র সম্রাট আকবর ছাড়া প্রত্যেকেই জোর যার মুলুক তার নীতির প্রতিফলন ঘটিয়ে সিংহাসন লাভ করেন। এসব সংঘর্ষ মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তিকে হরণ করে। সুতরাং মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য উত্তরাধিকার আইনের অভাব অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয়।
(৩) সাম্রাজ্যের বিশালতা : সাম্রাজ্যের বিশালতা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্য কাবুল থেকে আসাম এবং কাশ্মীর থেকে মহীশূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তৎকালীন যুগের যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় এই বিশাল সাম্রাজ্যকে এক কেন্দ্র থেকে সুষ্ঠুভাবে শাসন করা ছিল অসম্ভব। কোন দূরবর্তী প্রদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিলে তা দমন করা দিল্লী থেকে খুব কঠিন ছিল। আওরঙ্গজেব যখন উওর ভারতে ছিলেন তখন উত্তর-ভারতের শাসনব্যবস্থা সুসংহত ছিল, কিন্তু তিনি যখন বিদ্রোহ দমনে দাক্ষিণাত্যে গমন করে সেখানে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান দপ্তরে পরিণত করেন তখন তার অনুপস্থিতির সুযোগে উত্তর-ভারতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কাজেই বলা যায় যে, মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি অপ্রতিহত ক্ষমতার উৎস না হয়ে বরং দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আওরঙ্গজেবের পর কোন শক্তিশালী সম্রাট না থাকায় মুঘল কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা হেতু সাম্রাজ্যের সংহতি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায়।
(৪) অভিজাত শ্রেণীর নৈতিক অবনতি ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাত : ১৮শ শতকে অভিজাত সম্প্রদায়ের (Nobility) নৈতিক অবনতি ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাত মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের বিশেষ কারণ ছিল। অভিজাত শ্রেণী ছিল মুঘল প্রশাসনের মেরুদণ্ড। ১৬শ ও ১৭শ শতকে মুঘল অভিজাত শ্রেণী মুঘল সাম্রাজ্য সংগঠনে, রক্ষণে এবং পরিচালনায় মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছিলেন। বৈরাম খান, মহাব্বত খান, সাদুল্লা, মীরজুমলা প্রমূখ অভিজাতগণ ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তির উৎস। কিন্তু আওরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটদের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত শ্রেণীরও অধঃপতন ঘটে। তারা ইরানী, তুরানী ও হিন্দুস্থানী-এই তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং সাম্রাজ্যের স্বার্থকে উপেক্ষা করে গােষ্ঠী স্বার্থ রক্ষায় অধিক সচেষ্ট থাকেন। সম্রাটদের নিষ্ক্রিয়তা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভাবহেতু তারা ক্ষমতা লাভের আশায় পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর প্রভাব শুধুমাত্র দরবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই-রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক সব বিভাগেই এর বিরূপ প্রভাব গভীরভাবে অনুভূত হয়। গােষ্ঠী দ্বন্দ্বের ফলে প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ে, রাষ্ট্রের আর্থিক কাঠামাে ধ্বংস হয়, রাজ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং অগণিত দক্ষ সেনা ও সেনানায়কের মৃত্যু হয়। অভিজাতদের মধ্যে অনেকে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করে। (“The entire life of the state political, administrative, military-became utterly corrupt and inefficient…… conditions became anarchical….the party conflicts adversely affected the interests of the state and accelerated the downfall of the empire”. J.N. Sarkar, A Study of 18th Century India. P: 29)।
(৫) জায়গীর-প্রথার সংকট : সাম্রাজ্যের পতনে অপর গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল জায়গীর-প্রথার সংকট। জায়গীর বলতে বােঝাত একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা ভূখন্ড যা মনসবদার বা অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের নগদ বেতনের বিনিময়ে প্রদান করা হতো। এসব জায়গীরের দায়িত্ব যাকে দেয়া হতো তাকে বলা হত জায়গীরদার। জায়গীরদারের কাজ ছিল প্রধানত তার এলাকায় সরকারের প্রাপ্য সংগ্রহ করা এবং সেই আয় থেকে তাদের একটি নির্দিষ্ট সেনাদল মােতায়েন রাখতে হত এবং অন্যান্য খরচ মেটাতে হত। জায়গীর বংশানুক্রমিক ছিল না। সাধারণত নিজ যোগ্যতাবলেই জায়গীর লাভ করতে হত। আসলে জায়গীরদারগণ সাধারণত গ্রাম্য প্রধানের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। জায়গীরদাররা মুঘল প্রশাসনের মূল শক্তি এবং মুঘল রাষ্ট্রের ভিতকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু ১৭শ শতকের শেষভাগ থেকে জায়গীরদারী প্রথার সংকট শুরু হয়। এর কারণ হল জায়গীরের স্বল্পতা এবং সেই সঙ্গে অভিজাতদের সংখ্যা এবং তাদের ব্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি। সম্রাট আকবরের সময় থেকে জায়গীর-প্রথার সংকট শুরু হলেও সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে তা তীব্র আকার ধারণ করে। আওরঙ্গজেব খরচ কমিয়ে নতুন কর ধার্য করেন এবং কৃষির উন্নতির জন্য নির্দেশ জারি করে এই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তার দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে জায়গীরদারী সংকট আরও জটিল হয়ে পড়ে। দাক্ষিণাত্যের অভিজাতদের হাত করার জন্য তিনি মুক্ত হস্তে মনসব বিতরণ করেন। মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তাদের অধীনস্থ ভূখণ্ডের পরিমাণ কমে যায়, ফলে রাজস্ব আয়ও কমতে থাকে। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য জায়গীরদাররা কৃষকদের ওপর নির্যাতন ও শােষণ শুরু করেন। উৎকৃষ্ট জায়গীর লাভের জন্য মনসবদারদের মধ্যে প্রতিযােগিতা শুরু হয়ে যায়। এসবের ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন তীব্র আকার ধারণ করে তেমনি শাসনক্ষেত্রেও অচলাবস্থা দেখা দেয়। সব মিলিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে।
(৬) কৃষক অসন্তোষ : মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল কৃষক শ্রেণীর বিদ্রোহ। মুঘল রাজস্বের মূল উৎস ছিল ভূমি-রাজস্ব। আকবরের শাসনামল থেকেই বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে কৃষকদের ওপর করের বােঝা বৃদ্ধি পায়। সম্রাট শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেবের সময় গৃহযুদ্ধ এবং রাজপুত ও মারাঠাদের সঙ্গে অবিরত যুদ্ধের ফলে রাজকোষ প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সম্রাটদের ভূমি-রাজস্বের ওপর অধিক নির্ভরশীল হতে হয়। ফলে কৃষকদের ওপর করের চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু অভিজাতদের জায়গীরের নিয়ত হস্তান্তরের ফলে কৃষকদের অবস্থা আরও শােচনীয় হয়ে পড়ে। জায়গীরদাররা তাদের জায়গীর থেকে নির্ধারিত রাজস্ব আদায় করতে পারতেন না বলে তারা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে ইজারাদার নামক এক শ্রেণীর লােকের রাজস্ব আদায়ের ভার তুলে দিতেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তারাই ইজারা পেতেন যারা জায়গীরদারকে সবচেয়ে বেশী রাজস্ব আদায় করার প্রতিশ্রুতি দিতেন। ফলে ইজারাদারদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় কৃষকদের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব বেশী রাজস্ব আদায় করা। এই ব্যবস্থায় সরকারের রাজস্ব আয়ের বৃদ্ধি ঘটে ঠিকই, কিন্তু কৃষির উৎপাদন মােটেই বৃদ্ধি পায়নি। ফলে কৃষকের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে। খাজনা প্রদানে অসমর্থ হয়ে অনেক কৃষক জমির চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। কৃষকের অসন্তোষ ক্রমেই বিদ্রোহের রূপ নেয়। বস্তুতঃ গােটা মুঘল আমল জুড়েই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। তবে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কৃষক বিদ্রোহ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। এসব বিদ্রোহ দমন করা মুঘল সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। যাইহােক, এসব কৃষক বিদ্রোহের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং এক ঘােরতর কৃষি-সংকট সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে কৃষির অবনতি ও কৃষক অসন্তোষ মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলেছিল।
(৭) অর্থনৈতিক সংকট : মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক অবক্ষয়। সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়। শাহজাহান স্থাপত্যকর্মে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে রাজকোষ প্রায় শূন্য করে ফেলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় নিরন্তর যুদ্ধ-বিগ্রহ ও প্রজা বিদ্রোহের ফলে রাজকোষের বহু অর্থ ব্যয় হয়। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর শাহজাদাদের মধ্যে উত্তরাধিকারী দ্বন্দ্বের ফলে পূর্ববর্তী সম্রাটদের সঞ্চিত ধনসম্পদ নিঃশেষ হয়ে হয়ে যায়। উপরন্তু মুঘল শাসকগােষ্ঠীর ব্যয়বহুল জীবনযাপন এবং ব্যয়বহুল মুঘল হারেম প্রভৃতি কারণে সাম্রাজ্যে এক দারুন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষা ও জনসাধারণের অগ্রগতির জন্য তখন প্রয়ােজন ছিল কৃষির উন্নতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের সম্প্রসারণ। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নতিতে মুঘল সম্রাটেরা চরম অবহেলা প্রদর্শন করেন। তাই বলা যায়, অবিরত যুদ্ধ-বিগ্রহ, শাসক গােষ্ঠীর বিলাস বহুল জীবনযাপন, কৃষি সংকট এবং ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পে মুঘল সম্রাটদের অবহেলা প্রভৃতি কারণে সাম্রাজ্যে এক মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয় যা মুঘল পতনকে তরান্বিত করে।
(৮) সামরিক ত্রুটি : আধুনিক ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ ও আরভিন মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য মুঘল সামরিক সংগঠনের ত্রুটিকে দায়ী করেছেন। মূলতঃ তারা মুঘল সামরিক সংগঠনের ত্রুটি বলতে মনসবদারী ব্যবস্থার ত্রুটিকে বোঝাতে চেয়েছেন। মনসবদারদের তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী আইন মােতাবেক নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য ও অশ্ব রাখতে হত। কিন্তু তারা জায়গীরের আয় সৈন্য রক্ষার কাজে ব্যয় না করে নিজেদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পেছনে ব্যয় করতেন। যােগ্য অশ্বারােহী সৈন্য না রেখে তারা অনেক সময় অশিক্ষিত আনাড়ী সেনা যােগাড় করে পাঠাতো। এর ফলে সেনাবাহিনীর দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠত। মনসবদারের অধীনে সেনাবাহিনী থাকায় সম্রাট বা সেনাপতির প্রতি তাদের কোন আনুগত্য ছিল না। সৈন্যবাহিনী মনসবদারদের অধীনস্থ থাকায় রাষ্ট্রীয় ঐক্যের স্বার্থে তাদের কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না। তাছাড়া বিভিন্ন স্থান ও বিভিন্ন জাতি থেকে সৈন্য সংগ্রহের নীতি গ্রহণ করায় সেনাবাহিনী অখণ্ড জাতীয় বাহিনীর রূপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। মুঘল সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও আধুনিক ছিল না। তাদের কামানগুলাে ছিল পুরনো এবং এত ভারী যে, একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া ছিল রীতিমত কষ্টসাধ্য। মুঘল বাহিনী ছিল বিশাল ও আড়ম্বরপূর্ণ। যুদ্ধযাত্রার সময় এই বাহিনীর সঙ্গে থাকত মুঘল দরবার, হারেম, ভারী কামান, হস্তি অর্থাৎ সব মিলিয়ে মনে হতো একটি চলমান মেলা। এর ফলে মুঘল বাহিনীর ক্ষিপ্রতা ও গতিবেগ আদৌ ছিল না। ঐতিহাসিক আরভিন যথার্থই বলেছেন, “মুঘলগণ ব্যক্তিগতভাবে বীরত্বের পরিচয় দিলেও মুঘলদের নিয়মানুবর্তিতা ও সংগঠন শক্তির অভাব এবং মুঘল বাহিনীর প্রয়ােজনীয় অতিরিক্ত সাজসজ্জা মুঘলদের অধঃপতনের কারণ হয়েছিল।”
(৯) নৌবাহিনীর অভাব : মুঘলদের শক্তিশালী কোন নৌবহর ছিল না। ঐতিহাসিক স্মিথ সুষ্ঠু নৌশক্তির অভাবকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। মুঘল শাসকেরা স্থল বাহিনীর গঠনে জোর দিয়েছিলেন কিন্তু বিরাট উপকুল ভাগ রক্ষার জন্য যে শক্তিশালী নৌবহর প্রয়ােজন তা তারা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে একমাত্র সম্রাট আকবর নৌ শক্তি গড়ে তুলতে যত্নবান হয়েছিলেন এবং ‘নওয়ারা’ নামে একটি বিভাগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু আকবরের পরবর্তী সম্রাটেরা নৌবাহিনী সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। একমাত্র আওরঙ্গজেবের শাসনকালে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান কিছু যুদ্ধ জাহাজ তৈরী করে মগ ও ফিরিঙ্গীদের শায়েস্তা করেছিলেন। ভারতের নৌশক্তির দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে ইউরােপীয় শক্তিগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় উপকুলে বাণিজ্য ঘাঁটি গড়ে তােলে। এখান থেকে তারা ভারতীয় রাজনীতির দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে ধীরে ধীরে ভারতের অভ্যন্তরে ক্ষমতা বিস্তার এবং তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু মুঘলদের শক্তিশালী নৗবহর থাকলে বিদেশী বণিকগণ কখনই এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হত না।
(১০) বৈদেশিক আক্রমণ : আভ্যন্তরীণ কারণে যখন মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের প্রান্তসীমায় উপনীত সে সময় (১৭৩৯) পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে মুঘল সাম্রাজ্যকে বিধ্বস্ত করেন। নাদির শাহের আক্রমণে প্রায় লক্ষাধিক ভারতবাসী নিহত হন এবং অসংখ্য বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়। মণিমুক্তা সহ প্রায় ১৭ কোটি টাকার সম্পদ ভারতবর্ষ থেকে লুট করে তিনি স্বদেশে ফিরে যান। ভারতবর্ষ থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের বহির্গমনে মুঘলদের অর্থনৈতিক অবক্ষয় চরমভাবে দেখা দেয়। নাদির শাহের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলে মুঘল সম্রাটের মর্যাদাও বিনষ্ট হয় এবং সাম্রাজ্যের চারদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ দেখা দেয়। এই অবস্থায় আফগানিস্তানের শাসক আহমদ শাহ আবদালী ভারত আক্রমণ শুরু করেন। তার ক্রমাগত ভারত আক্রমণে মুঘল সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতের এই চরম অভ্যন্তরীণ সংকটের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে বিদেশহী শক্তিসমূহ। অবশেষে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের প্রতিপক্ষ শক্তিগুলোকে পরাভূত করে সমগ্র ভারতবর্ষের ক্ষমতা অধিকার করে।
(১১) আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি : বিভিন্ন ঐতিহাসিক, বিশেষ করে স্যার যদুনাথ সরকার, শ্রীরামশরণ শর্মা, শ্রীবাস্তব প্রমুখ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে দায়ী করেছেন। এসব ঐতিহাসিকদের মতে, আওরঙ্গজেব তার পূর্বের মুঘল শাসকদের উদার নীতি বর্জন করে হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর স্থাপন এবং হিন্দুদের দেব-মন্দির ধ্বংস করে হিন্দুদের শত্রুতে পরিণত করেন। শুধু তাই নয়, যে রাজপুত জাতি ছিল আকবরের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ, সেই রাজপুত জাতিকে দরবারের উচ্চপদ থেকে বঞ্চিত করে এবং রাজা যশোবন্ত সিংহের বিধবা পত্নী এবং তার শিশুপুত্রকে হস্তগত করার চেষ্টা রাজপুতদেরকে যারপরনাই ক্ষুব্ধ করে তােলে। শিখদের মতে তেজবাহাদুরকে হত্যা করে তিনি শিখজাতিকে মুঘল সাম্রাজ্যের ঘাের শত্রুতে পরিণত করেন। তার ধর্মনীতির ফলেই জাঠ, শিখ, মারাঠা ও রাজপুতদের অভ্যুদয় ঘটে যা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে তরান্বিত করে। তবে অনেক ঐতিহাসিক বলেন আওরঙ্গজেবের মধ্যে পরধর্মবিদ্বেষ ছিলনা, কেননা-
প্রথমত, আওরঙ্গজেব তার রাজত্বের প্রথম বাইশ বছরে গোড়া কোন ধর্মীয় নীতি গ্রহণ করেননি। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার বাইশ বছর পর তিনি হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর স্থাপন করেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন আসে সম্রাট যদি ধর্মান্ধতাবশত এ কাজ করে থাকেন তাহলে দীর্ঘ বাইশ বছর তার অপেক্ষা করার প্রয়ােজন ছিল না। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই সম্রাট হিন্দুদের উপর এই কর আরােপ করেছিলেন। মুসলিমদের কাছ থেকেও যাকাত নামে একটি কর আদায় করা হত। দ্বিতীয়ত, আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কিছু হিন্দু-মন্দির ধ্বংস হয়েছিল তা সত্য। কিন্তু সম্রাটের মন্দির ধ্বংসের পেছনে ধর্মীয় উদ্দেশ্যের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশী ছিল। বিদ্রোহী শক্তিগুলােকে দমন করতে গিয়ে হিন্দুদের কিছু দেবালয় ধ্বংস হয়। তৃতীয়ত, আওরঙ্গজেব দরবারের উচ্চপদ থেকে রাজপুতদের বঞ্চিত করেছিলেন- ঐতিহাসিকদের এ বক্তব্য ঠিক নয়। প্রখ্যাত গবেষক আতাহার আলী বলেছেন, আওরঙ্গজেবের শাসনের প্রথম দু’বছরে ১৪,০০০ জাঠ পদ এবং নতুন মনসবের ১৯ শতাংশ রাজপুতদের দেয়া হয়েছিল। এমনকি সম্রাট রাজপুত রাজা জয়সিংহ ও যশােবন্ত সিংহকে সাত হাজারী মনসব পদে উন্নীত করেছিলেন। যশােবন্ত সিংহের বিধবা স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে হস্তগত করার কারণে রাজপুত জাতি মুঘলদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল বলে সম্রাটের বিরুদ্ধে যে অভিযােগ করা হয় তা ঘটনা বিশ্লেষণে সত্য প্রমাণিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে রাজপুত সর্দারদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে আওরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপের রাজপুতদের সঙ্গে মুঘলদের বৈরীতা শুরু হয়। তবে অনেক ঐতিহ্য রাজপুতদের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া আওরঙ্গজেবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব বলে মন্তব্য করেছেন।
অধুনা ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র তার বিখ্যাত ‘মােগল দরবারে দল ও রাজনীতি’ গ্রন্থে বলেন যে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে দায়ী করা ইতিহাস-সম্মত নয়। প্রথমত, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর ছয় বছরের মধ্যেই জিজিয়া এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে অন্যান্য বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাগুলো পরিত্যক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর রাজপুত নেতাদের বিরুদ্ধে দমনমূলক নীতির অবসান ঘটে। রাজপুতদের পুনরায় উচ্চ মনসব ও জায়গীর দেয়া হয়। তৃতীয়ত, মারাঠা নেতা শাহুকে বন্দীত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয় এবং তাকে স্বরাজ্যে অধিকার দান করা হয়। ১৭১৮ খ্রীস্টাব্দের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যে ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়। চতুর্থত, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর হিন্দু-মন্দির ধ্বংস বা হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তকরণের একটি ঘটনাও ঘটেনি। সুতরাং বলা যায় যে, পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে পরিত্যক্ত করেছিলেন। তবুও মুঘল সাম্রাজ্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তাই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তিনি আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে দায়ী বলে মনে করেন না।
(১২) আওরঙ্গজেব কর্তৃক বিজাপুর ও গোল্পকুণ্ডা দখল : সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আরও অভিযােগ করা হয় যে, তিনি দাক্ষিণাত্যের দুই শিয়া রাজ্য বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা গ্রাস করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে মহাভুল করেন। সম্রাট যদি এই দুটি রাজ্যকে গ্রাস না করতেন তাহলে দাক্ষিণাত্যের উদীয়মান মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে এই দুই শিয়া সুলতানী রাজ্য কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারতো। তিনি মারাঠাদের সঙ্গে ২৫ বছর যুদ্ধ চালিয়েও শেষপর্যন্ত মারাঠা শক্তিকে দমন করতে পারেননি। সুদীর্ঘকাল দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে সাম্রাজ্যের আর্থিক বুনিয়াদ যেমন নষ্ট হয়, তেমনি সম্রাটের দীর্ঘকাল উত্তর-ভারতে অনুপস্থিতির ফলে উত্তর-ভারতে মুঘলদের নিয়ন্ত্রণও শিথিল হয়ে যায়। ফরাসী সম্রাট নেপােলিয়নের জন্য ‘স্পেনীয় ক্ষত’ যেমন দায়ী ছিল, তেমনি দাক্ষিণাত্যের ক্ষত আওরঙ্গজেবের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যের গােলকুণ্ডা ও বিজাপুর মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করার স্বপক্ষে এটাই বলা যায় যে, আওরঙ্গজেব সম্রাট আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি অনুসরণ করেছিলেন মাত্র। এ দুটি রাজ্য দখল করা ছিল তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। এ দুটি রাজ্য স্বাধীন থাকলে মারাঠাদের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবকে সাহায্য করত ঐতিহাসিকদের এ অনুমান সঠিক নাও হতে পারতো। কারণ ইতােপূর্বে রাজ্য দুটি মারাঠাদের সাহায্য করেছিল এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতার প্রমাণ রেখেছে।
তথ্যসূত্র
- দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : ১৫২৬ খ্রী হতে ১৮৫৭ খ্রী পর্যন্ত, দিলীপ কুমার সাহা, ঢাকেশ্বরী লাইব্রেরী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ১৭০-২৪৮
সম্রাট আওরঙ্গজেবের ন্যায়নীতিতে মার্কস যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তা শ্রী বিনয় ঘােষকেও কিঞ্চিৎ স্বীকার করতে হয়েছে। তিনি লিখেছেন,
“বার্নিয়েরের বিশ্লেষণ পাঠ করে কার্লমার্কসের মত মনীষীও মুগ্ধ হয়েছিলেন।” (ভারত জনের ইতিহাস, ৪৮৭ পৃ:)
যার ন্যায়নীতি কালমার্কসও মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি হিন্দুদের প্রতি বিদ্ধেষ রাখতেন ?! ওনাদের সভাসদদের কয়জন মুসলমান এবং কয়জন হিন্দু ছিল বলতে পারবেন ?
সত্য প্রচার করুন।