(সম্প্রসারিত হবে)
Table of Contents
উপযােগবাদ: প্রেক্ষাপট, সংজ্ঞা ও উদ্ভব
১৯শ শতকের রাষ্ট্রচিন্তা : পিউরিটান বিপ্লব, গৌরবােজ্জ্বল বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব ও আমেরিকার বিপ্লবের সম্মিলিত প্রভাব সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রচিন্তার উপর পড়ে এবং ব্রিটিশ রাষ্ট্রচিন্তা এই প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে নি। ফলে উনিশ শতকের ব্রিটিশ রাষ্ট্রচিন্তা বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বহুমখী চিন্তাগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য আনাও মুস্কিল। একদিকে জন স্টুয়ার্ট মিল-এর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও উদারনীতিবাদ অন্যদিকে গ্রীণ-এর ভাববাদ ও উদারনীতিবাদের সংশােধনকে পাশাপাশি দেখি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও ভাববাদের মধ্যে মিলন কোন ক্ষেত্রে সম্ভব নয় যদিও এরা কেউ ব্যক্তিকে উপেক্ষা করতে চায় না। উনিশ শতকের শেষ কোঠায় ফেবীয় সমাজবাদের আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রনীতির প্রায়ােগিক ক্ষেত্রে আমরা দেখি রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন না করে কিভাবে একে গণতন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করানাে যায় তার প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। পার্লামেন্টের ক্ষমতা ব্রিটেনে উত্তরােত্তর বেড়েছে এবং নানা সংস্কার সাধনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকীকরণ করা হয়েছে। পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন নানা প্রকার রাষ্ট্রচিন্তার জটিল আবর্তে উনিশ শতকে আরেকটি চিন্তার আবির্ভাব ঘটে এবং এটি হল উপযােগবাদ বা হিতবাদ। এই মতবাদের মুখ্য প্রবক্তা বেন্থাম। ব্রিটেনের মাটিতে হবস, লক, বেকন প্রমুখ অনেক দিকপাল চিন্তকের জন্ম হলেও কেউ অনুগামী বা শিষ্য তৈরী করে যেতে পারেন নি যা বেন্থাম করে গেছেন।
উপযােগবাদ : উপযােগবাদকে রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্য সম্পর্কিত কোন তত্ব বলে মনে করা ভূল। রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলােচনা এসে গেলেও উদ্দেশ্য কিন্তু তা নয়। এই মতবাদের মুখ্য প্রবক্তা বেন্থাম একে নীতিসম্পকীয় তত্ত্ব বলে মনে করতেন। মানুষের আচরণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে উপযােগবাদ আলােচনা করে হিতবাদের সারকথা হল মানুষ যুক্তিবাদী ও সামাজিক বিষয়সমূহে সে সচেতন। যে বস্তু বা আচরণ বা নীতি বা সরকারের কোন সিদ্ধান্ত তাকে বেদনা বা যন্ত্রণা দেয় বা দিতে পারে বলে সে মনে করে তাকে সে এড়িয়ে যায় এবং যা তাকে আনন্দ দেয় বা দিতে পারে তাকে সে গ্রহণ করে। সুতরাং সুখপ্রদানকারী কাজ বা সিদ্ধান্তসমূহকে সে ভাল ও বিপরীত কাজকে সে খারাপ নামে অভিহিত করে। হিতবাদ একটি নৈতিকতত্ত্ব এই কারণে যে দুঃখ বা যন্ত্রণাদানকারী কোন বিষয় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোন ব্যক্তিকে বাধ্য করা নীতিবিরুদ্ধে কাজ।
উপযোগবাদের প্রবক্তা : আমরা বেন্থামকে উপযােগবাদের প্রধান বক্তা হিসেবে জানি। কিন্তু রাষ্ট্র চিন্তার ইতিহাস বা বিকাশ নিয়ে যারা আলােচনা করেন তারা বলেন, বেন্থাম-এর আগে হিউম এ বিষয় নিয়ে আলােচনা করে গেছেন যদিও তিনি সরাসরি উপযােগবাদ বা হিতবাদ কথা তিনি ব্যবহার করেন নি। বহু পণ্ডিত ব্যক্তি হিউমকে হিতবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করেন। জেমস মিল ও জন স্টুয়ার্ট মিল হলেন হিতবাদের অন্য দুই প্রবক্তা। স্মরণ রাখা প্রয়ােজন যে হিউমকে উপযােগবাদের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দেওয়া হলেও বেন্থাম একে তাত্ত্বিক কাঠামাের মধ্যে বন্দী করে রাখেন নি যা হিউম করেছিলেন। এটিকে তিনি একটি আন্দোলনের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন। আর জন স্টুয়ার্ট মিল বেন্থাম ও জেমস মিল-এর হিতবাদকে সংশােধন করেছিলেন। বেন্থামকে এই মতবাদের আসল ব্যাখ্যাকারের আসনে বসানাে হলেও তিনি কিন্তু উপযােগবাদ বা হিতবাদ কথা ব্যবহার করেন নি, করেছেন জে. এস. মিল।
হিতবাদের বৈশিষ্ট্য : সংক্ষেপে হিতবাদের দু’একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। উপযােগবাদ নীতি সম্পর্কিত একটি তত্ত্ব। ব্রিটেনে নীতিবিদ্যার সুত্রপাত থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত যে বিকাশ সাধিত হয়েছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এর উন্নতি বিধান করা হয়েছে। ব্যক্তির নীতিবােধ, মূল্যবােধ ও যুক্তিবােধকে সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়াই হিতবাদের উদ্দেশ্য। হিতবাদ একটি আন্দোলনও বটে। বেন্থামের লক্ষ্য ছিল সরকারী ক্রিয়াকর্ম ও সিদ্ধান্তকে সুখ ও আনন্দ প্রদানের ক্ষমতা অনুযায়ী বিচার করা। উপযােগবাদ মানুষকে একটিমাত্র স্বার্থ, দৃষ্টিভঙ্গী বা উৎসাহের প্রতীক বলে মনে করে না। পরস্পর বিরােধী জটিল দৃষ্টিভঙ্গী বা স্বার্থ তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তার কতকগুলি নিজস্ব উদ্দেশ্য বা আকাঙ্ক্ষা যেগুলিকে বাস্তবায়িত করার জন্য সে খুবই সচেষ্ট। উপযােগবাদ অনুযায়ী মানুষ আদর্শের চেয়ে বাস্তবকে বেশি পরিমাণে অনুসরণ করতে চায়। বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকটি বিষয় সে যাচাই করে নিতে আগ্রহী। ব্যক্তির সুখানুসন্ধনকে উদ্দীপিত করা ও মােট সুখের পরিমাণ বাড়িয়ে তােলা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। উপযােগবাদ মানুষকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন একক বলে মনে করে না। সমাজের অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
নতুন পরমবাদের সূচনা : ম্যাক্সে বলেন (পৃঃ ৪৫৬) ইতিহাসের দৃষ্টিতে বিচার করলে বলতে হয় হিতবাদের জন্ম গ্রীস দেশে। এপিকিউরাস-এর সুখভােগবাদ (Hedonism) থেকে হিতবাদের জন্ম। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরমভাববাদ (absolute idealism) বেশ প্রভাব বিস্তার করে। পরমভাববাদকে বাতিল করে নতুন পরমবাদের স্থানে পরম অভিজ্ঞতাবাদ বা প্রত্যক্ষবাদ (empiricism) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেন্থাম ও তার অনুগামীরা তৎপর হয়ে ওঠেন। পরমভাববাদে ব্যক্তির কোন স্বতন্ত্র স্থান বা মর্যাদা ছিল না। ভাববাদ বা আদর্শ সমস্ত সমাজ তথা মানুষকে পরিচালিত করবে এবং ব্যক্তি সেই পরমভাবের নির্দেশে কাজ করে যাবে। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ও যুক্তির স্থান সেখানে থাকবে না। বেন্থাম তা মানতে রাজি হন নি। পরম অধিকার (absolute rights) পরম সার্বভৌমত্ব ও পরম ন্যায়বিচার বলতে যা কিছু বলা হয় সেগুলি নিষ্ফল ও অনুর্বর। এই অষ্টাদশ শতকী পরমবাদকে দূরে সরিয়ে রেখে পরম উপযােগবাদকে গ্রহণ করার কথা বলা হয়। (উপযোগবাদের নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, যারা পরম অধিকার, পরম সার্বভৌমত্ব এবং পরম ন্যায়বিচারের মত ধারণাকে বন্ধ্যাত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তারা মনে করতেন মানবজীবনে কেবল একটা বিষয়ই পরম হতে পারে, তা হল পরম উপযোগিতা। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী নীতিকে কোন কল্পনাময় বিষয়ের ভিত্তিতে ভাল ও খারাপ মূল্যায়ন করা উচিৎ নয়, যা মানবাধিকার ও মানুষের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে খামখেয়ালি অনুমান দান করে, এর চেয়ে বরং ভাল ও খারাপ নির্ণয় করা উচিৎ আরও স্থির বা স্থায়ী মানের উপর ভিত্তি করে, যা হল মানব জীবনের উপযোগিতা। – Maxey, P. 456)।
নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ও জমিদার শ্রেণীর সঙ্গে বিরোধ : রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলির নির্মাণ এবং এদের ক্রিয়াকলাপের পেছনে নানা উপাদান সক্রিয়ভাবে কাজ করে যায়। তবে সবরকম উপাদানের মতে আর্থনীতিক উপাদানের কথা সবার আগে উল্লেখ করতে হয়। শিল্প বিপ্লবকে সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে আমরা, ১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীর রাজনীতিক চিন্তার প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারব না। এর শাখা প্রশাখা কিভাবে চতুর্দিকে শ্রেণীর সঙ্গে বিরােধ বিস্তার লাভ করেছিল তা জানা একান্ত আবশ্যক। এই বিপ্লবের ১০০ বছরের মধ্যেই ব্রিটেন ইউরােপের এক মহাশিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মালিক শ্রেণী ছাড়া ব্রিটেনে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে আরেক শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছিল। এই শ্রেণীকে অনেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলেন। আধুনিক অর্থে মধ্যবিত্ত নয়। অনেকটা সম্পদশালী শ্রেণী। এই শ্রেণী বিপুল সম্পত্তি, অর্থের মালিক হয়েছিল। স্বাভাবিক কারণে শ্রেণীর লােকেরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত। কিন্তু ব্রিটেন থেকে জমিদার শ্রেণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। সেসময় একটা পার্লামেন্ট ছিল। কিন্তু জমিদাররা নানা কৌশলে পার্লামেন্টকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। তাছাড়া সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার চালু না হওয়ায় নতুন শ্রেণী পার্লামেন্টে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাতে পারে নি। যাই হােক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী চেষ্টা করতে ত্রুটি করে নি এবং এই কারণে জমিদার শ্রেণীর সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
শিল্প শ্রেণীর আগ্রাসী নীতি : সুসংগঠিত না হবার জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী সামন্তপ্রভু ও জমিদারদের সঙ্গে প্রথম দিকে লড়াই করে জয়লাভ করতে পারে নি। কিন্তু এই শ্রেণীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণী নানাবিধ উপায়ে জমিদারদের ক্ষমতাচ্যুত করার তালে ছিল। শিল্প বিকাশ দুততর হবার ফলে ব্রিটেনে শিল্প শ্রেণী (industrial class) নামে আরেক শ্রেণী সৃষ্টি হয়। এই শ্রেণী উৎপাদনের উপায়সমূহ ও উৎপাদন সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। একই সঙ্গে ব্যাঙ্কব্যবস্থা ও মহাজনী পুঁজি এই শ্রেণীর হাতে চলে যায়। এই শ্রেণী অনেকটা আগ্রাসী মনােভাবাপন্ন ছিল। রাজনীতিক ক্ষমতা জমিদারদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে তারা বদ্ধপরিকর হয়। বাণিজ্যিক ও আর্থনীতিক স্বার্থে এটির প্রয়ােজনীয়তা ছিল। কিন্তু বিদ্যাবিষয়ক ক্ষেত্রে শিল্প শ্রেণীর কোন ঘাঁটি ছিল না। নতুন তত্ত্বকথা বা বিদ্যাবিষয়ক চিন্তাধারা শিল্প শ্রেণীর লােকেরা প্রচারের সুযােগ পায়নি। (তাদের টাকা আর শক্তি ছিল। তাদের একটি সমন্বিত এবং প্ররোচনামূলক তত্ত্ব এবং মুখপাত্রের অভাব ছিল এটিকে ব্যবহার করার জন্য।) শিল্প শ্রেণীর প্রত্যয় জন্মাল যাবতীয় কাজকর্মকে তত্ত্বকথার আড়ালে ঢাকা দিতে হবে। লক-ঘােষিত প্রাকৃত অধিকার এই শ্রেণীর নিকট তেমন জুৎসই মনে হয় নি। তাছাড়া ফরাসী বিপ্লবে প্রাকৃত অধিকারগুলি একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল (হার্মন, পৃঃ ৩৬৪)। সর্বোপরি প্রাকৃত অধিকারের সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদের কোন সম্পর্ক নেই। যুক্তিবাদের চেয়ে অভিজ্ঞতাবাদের উপর নজর সবার। অভিজ্ঞতার নিরিখে যা বিচার করা যায় তাকেই মেনে নিতে হবে। স্যাবাইন বলেছেন – “সর্বত্র শিল্প শ্রেণী ১৯ শতকে উদারনৈতিক রাজনৈতিক সংস্কারের নেতৃত্ব গঠন করে… একইভাবে জমিদার শ্রেণীর প্রভাব তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছিল।” ( P. 671 ) |
উপযোগবাদের জন্ম : প্রভাবশালী শিল্প শ্রেণী ব্যক্তিস্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে উদারনীতিবাদের প্রতি সমর্থন জানাল, যে উদারনীতিবাদের প্রবক্তা হলেন বেন্থাম। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য বিধান যে আইন বা সিদ্ধান্ত করতে পারবে তাকেই মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ, উপযােগ হবে যে কোন বিষয়ের গ্রহণ বা বর্জনের নির্ধারক। উপযােগিতা যদি পর্যাপ্ত না হয় তাহলে নাগরিক তা বর্জন করতে পারবে। এই উপযােগিতার মাপকাঠিতে সমাজের যাবতীয় বিষয় বিচার করতে হবে। ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যালরাই উপযােগনীতিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে গেছেন। ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যালদের নেতা হলেন বেন্থাম। স্যাবাইন বলেন যে উদারনীতিবাদের প্রারম্ভিক পর্যায়ে এর বৌদ্ধিক কাঠামােটি এই র্যাডিক্যালরা তৈরী করেন এবং মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বেন্থাম। ফিলজফিল্যাল র্যাডিক্যালরা উপযােগনীতিকে মূলধন করে আইনী, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক সংস্কারের কথা বলে গেছেন।
হব্স্, হিউম ও বেন্থাম : আধুনিক যুগে টমাস হবসকে উপযােগবাদের একজন অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে তিনি উপযােগবাদ কথাটা ব্যবহার করেন নি বা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেন নি। হব্স্-কথিত উপযােগবাদের সারকথা হল নৈতিকতা বা নীতিবােধের সম্যক বিকাশ সাধনের নিমিত্ত মানুষ প্রকৃতির রাজ্য ছেড়ে পুরসমাজ গঠন করেছিল তা ঠিক নয়। নিজের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার তাগিদে সে এমন একটা সংগঠনের গােড়াপত্তন করেছিল। অর্থাৎ, নিছক উপযােগ বা ব্যক্তিগত স্বার্থই সমাজ গঠনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল বলে হব্স্ মনে করতেন। মানুষ যুক্তিবাদী বা সচেতন বলে সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলে তা ঠিক নয়। এই সমস্ত নিয়মকানুনের প্রতি আনুগত্য দেখায় এই কারণে যে তার স্বার্থ রক্ষিত হবে। নাগরিকের নিরাপত্তা ও স্বার্থবিধান করাই রাষ্ট্রের কাজ এবং এটাই তার অস্তিত্বের হেতু। কিন্তু হব্স্ মনে করতেন যে রাষ্ট্র বা সার্বভৌম শক্তির হাতে চরম ক্ষমতা তুলে দিলে ব্যক্তির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে। উপযােগবাদীরা হবস-এর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি। এইখানে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। হবস-এর চেয়ে হিউম উপযােগবাদের মূল বক্তব্যটি সংক্ষেপে বিবৃত করে গেছেন। আবেগ বা প্রবণতাই মানুষের কাজকর্মের উপাদান হিসেবে কাজ করে। সে যন্ত্রণাকে এড়িয়ে আনন্দকে পেতে চায়। সব মানুষ আনন্দ ও যন্ত্রণা সমানভাবে উপলব্ধি করে তা নয়। তবে আনন্দ পাবার প্রবণতা সবার মধ্যে বিরাজমান।
বেন্থাম: জীবনী ও রচনা
বেন্থামের পরিচয়
ভূমিকা
বেন্থাম উপযোগিতাবাদের প্রতিষ্ঠাতা, অথবা দার্শনিক মৌলবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তার মতবাদটি যে খুব প্রভাবশালী ছিল তা “বেন্থামিজম” শব্দটি দেখেই বোঝা যায়, কেননা দার্শনিকের নামের উপর ভিত্তি করে ইংল্যান্ডে খুব কম মতবাদেরই নামকরণ করা হয়েছে। -Ebenstein
শিল্প বিপ্লব শুরু হবার ১২ বছর ও মার্কস-এঙ্গেলস-এর ম্যানিফেস্টো প্রকাশিত হবার ১০০ বছর আগে ১৭৪৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি লন্ডন শহরে জেরেমি বেন্থাম জন্মগ্রহণ করেন। বেন্থাম ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এবং এই বাস্তববুদ্ধিতা অনেক সময় মাত্রা ছাড়িয়ে যেত বলে তাঁকে লােকে খামখেয়ালি বলে অভিহিত করত। একেবারে শিশুকালে বেন্থাম লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভাল ছিলেন। এবং পরে বিদ্যার্জনের প্রতি তার আগ্রহ বদ্ধি পায়। তিন বছর বয়সে লাতিন ও ইংরেজীতে লেখা ইতিহাসের বইপত্তর পড়ে ফেলেছিলেন। ছয় বছর বয়সে তিনি লাতিন ভাষায় লিখতে পারতেন ও ভলতেয়ার পড়তেন। সাত বছর বয়সেই লাতিন ভাষায় কবিতা লিখতেন। পনের বছর বয়সে তিনি ডিগ্রীলাভ করেন এবং বাবার ইচ্ছানুসারে আইন পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইন ব্যবসা তিনি করেন নি। ব্ল্যাকস্টোন ছিলেন বেন্থামের সমসাময়িক বিখ্যাত আইনবিদ। তার বক্তৃতা শুনে তিনি কোন উৎসাহ পান নি। এই কারণে আইনবিদের পেশা ছেড়ে তিনি পড়াশােনায় নিজেকে নিযুক্ত করেন এবং পরবর্তী প্রজন্মগুলি একজন শীর্ষস্থানীয় চিন্তককে লাভ করে।
রচনা
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের বছরে অর্থাৎ ১৭৭৬ সালে বেন্থাম-এর বিখ্যাত রচনা Fragment of Government প্রকাশিত হয়। ব্ল্যাকস্টোন বিখ্যাত আইনবিদ হলেও অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিলেন। রক্ষণশীল দৃষ্টি দিয়ে তিনি আইনের ব্যাখ্যা করতেন। বেন্থামের এই পদ্ধতি মনঃপুত হয় নি। তিনি ব্ল্যাকস্টোনকে তীব্র ভাষায় Fragment of Government বইতে সমালােচনা করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে বেন্থাম এই গ্রন্থ রচনা করেন বলে তদানীন্তন পণ্ডিত ব্যক্তি ও আইনবিদরা তাঁর কথার উপর কোন প্রকার গুরত্ব আরােপ করেন নি। যাই হােক, এই বই তাকে খ্যাতি অর্জন করতে বিশেষ সাহায্য করে। ১৭৮৫ সালে বেন্থাম রাশিয়ায় যান এবং সেখানে আড়াই বছর থেকে Defence of Usury নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন যার মধ্যে সুদের বিনিময়ে অর্থ ধার দেওয়ার নীতির প্রতি তিনি সমর্থন জানান। পরে এই বইকে অবলম্বন করে তিনি অবাধ বাণিজ্য নীরি (laissez faire ) উপর Manual of Political Economy নামে অন্য এক বই লেখেন। এর পর বেন্থাম রাজনীতিতে প্রবেশের উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টের সদস্য লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং পড়াশনা ও লেখা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করা স্থির করেন। গৌরবময় বিপ্লবের ১০০ বছর পরে বেন্থামের বিখ্যাত রচনা Introduction to the Principles of Morals of and Legislation প্রকাশিত হয়। এ দিকে ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লব শুর হয়ে যায় এবং তার সঙ্গে বিপ্লবীদের যােগাযােগ ঘটে। তার ইচ্ছা ছিল উপযােগবাদের নীতিগুলি বিপ্লবীরা বাস্তবে রূপায়িত করবে। কিন্তু এই পারে তিনি ব্যর্থ হন। যাই হােক, শেষােক্ত বই তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়।
বেন্থাম এবং ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যাল
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বেন্থাম যে উপযােগবাদের প্রবর্তন করেছিলেন তাকে আমূল সংস্কারবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এই সংস্কারবাদের পেছনে দার্শনিক যুক্তি নিহিত থাকলেও স্যাবাইন বলেন বেন্থাম বা তার অনুগামীরা কেউই পুরাদস্তুর দার্শনিক ছিলেন না। যাই হােক ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যাল বলা হয় এই কারণে যে তিনি রাজনীতি ও আইনী বিষয়গুলির সংস্কার সাধনে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। আইন ও প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কার সাধনের ব্যাপারে তিনি তার নিজের দেশের ও ইউরােপের অন্যান্য দেশের সরকারকে প্রায়ই পরামর্শ দিতেন। ফরাসী বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই তিনি ফরাসী সরকারকে আইন ও প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে নানা পরামর্শ দেন। কিন্তু সরকার সেই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন। উনিশ শতকের প্রথম কয়েক বছর তিনি আইনের সংস্কারের জন্য এককভাবে লড়াই লিয়ে যান। ১৮০৮ সাল নাগাদ জেমস মিল তার সাথী হন এবং তিনি বেন্থামকে বুঝিয়ে বলেন যে ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা উদার না হলে আইনের সংস্কার সম্ভব নয়। বেন্থামের ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যালিজম কেবল আইনের সংস্কারের মধ্যে বন্দী ছিল না, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রসারলাভ করেছিল। কঠোর নীতির হাত থেকে ব্যবসাবাণিজ্যকে তিনি মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। অতীতে জমিদার শ্রেণী রাজনীতি ও অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরপে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। এই একচেটিয়া ক্ষমতার বিলােপসাধনের নিমিত্ত তিনি উদারনীবািদের প্রবর্তন করে গেছেন।
উপযােগবাদ সম্পর্কে বেন্থামের বক্তব্য
ভূমিকা
উপযােগবাদের জনকের মর্যাদা বেন্থামকে দিতে আপত্তি থাকলেও তাকে এর সব শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকারের মর্যাদা দিতে কারাের আপত্তি নেই। মানুষ সুখ ও স্বাচ্ছন্দের চিন্তাধারার দ্বারা পরিচালিত। যে কোন সরকারকে এ কথাটা মনে রেখে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে বলে তিনি ফতােয়া জারি করলেন। সরকার যদি নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য বিধান ও আনন্দ বর্ধন করতে পারে তাহলেই সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হবে। কিন্তু তাই বলে সরকার ইচ্ছামত ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। Principles of Morals and Legislation বই-এর শুরুতে তিনি বলেছেন যে প্রকৃতি মানবজাতিকে দু’টি সার্বভৌম প্রভুর অধীনে স্থাপন করেছে – বেদনা ও আনন্দ। এই বেদনা ও আনন্দ মানুষের কাজকর্ম আচরণ ও কথাবাতা ইত্যাদি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রিত করে। অর্থাৎ, বেদনা ও আনন্দকে বাদ দিয়ে কোন ব্যক্তি কিছুই করতে পারে না। আনন্দ ও বেদনা কি এবং এর উৎস কোথায় তা কেবল ব্যক্তি সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে পারে।
সমাজ একটি কল্পিত বস্তু
উপরের আলােচনা থেকে সহজে অনুমান করা যায় যে বেন্থাম একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন হতে পারে কেন। তার মতে সমাজ একটি কল্পিত বস্তু। যে কোন সমাজের আসল প্রাণ হল ব্যক্তি যারা এর সদস্য। সুতরাং আমরা যখন সমাজের স্বার্থের কথা বলি তখন এর সদস্যদের স্বার্থকে বােঝাই। ব্যক্তিস্বার্থ উপেক্ষা করে সমাজ নামক একটি কল্পিত বস্তুর স্বার্থের কথা একদম ভাবা যায় না, উচিতও নয়। ব্যক্তি তার নিজ প্রয়ােজনেই সমাজ গড়ে তুলেছে। ব্যক্তির সুখ দুঃখ, বেদনা আনন্দকে যথাযথ বিবেচনার মধ্যে না এনে কেবল কল্পিত ধারণার পেছনে দৌঁড়লে সমাজের কল্যাণ হতে পারে না বলে তার প্রত্যয় জন্মেছিল। বেন্থামের সারকথা হল – “ব্যক্তির স্বার্থ কি তা না বুঝে সম্প্রদায়ের স্বার্থের কথা বলা বৃথা।” সমাজকে কল্পিত বস্তুর স্তরে স্থাপন করে বেন্থাম ব্যক্তিকে সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে গেছেন যা ভাববাদীরা করেন নি। ভাববাদীদের কাছে আগে সমগ্র পরে অংশ। সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তিকে মিলে যেতে হবে। সকলের সুখে ব্যক্তির সুখ।\
উপযােগ কী?
Principles of Morals and Legislation গ্রন্থে বেন্থাম উপযােগ কাকে বলে তা বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে – “উপযােগের নীতি হল সেই নীতি যেখানে প্রদত্ত সত্তার আনন্দের বৃদ্ধি ও হ্রাসের উপর ভিত্তি করে তার প্রতিটি কর্মের কাজকে সমর্থন বা অসমর্থন করা হয়।” বেন্থাম উপযােগকে একটি বস্তুর ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে একটি বস্তুর উপযােগিতা বা উপযােগ আছে বলে মনে করা হবে যদি সেই বহু উপকার, সুযােগ, আনন্দ, কল্যাণ বা সুখ সুনিশ্চিত করতে পারে ও একই সঙ্গে কষ্ট যন্ত্রণা বেদনা এবং অপকার থেকে ব্যক্তিকে রেহাই দিতে পারে।
উপযোগ হল সব কিছুর নিয়ামক
বেন্থামের রাষ্ট্রতত্ত্বের একেবারে সারকথা হল এই উপযােগবাদ। উপযোগ ব্যক্তি ও সমাজের একমাত্র নিয়ামক। সরকার আইন প্রণয়নকালে লক্ষ্য রাখবে যে এই আইন জনগণের কোন প্রকার উপকারে আসবে কিনা ও সুখসমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারবে কিনা। সেই পদ্ধতিকে সর্বোৎকৃষ্ট বলা হবে যে পদ্ধতি সর্বাপেক্ষা বেশি পরিমাণ সুখ উৎপাদনে সক্ষম। প্রত্যেকে আনন্দ পেতে চায় বলে সরকারের উচিত এ কাজে বাধা না দেওয়া, বরং সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে। বেন্থাম এক জায়গায় বলেছেন – “A measure of government may be said to be conformable to or dictated by the principle of utility.” আইন ব সিদ্ধান্তের উপযােগিতা থাকলেই তার প্রতি আনুগত্য দেখাবার প্রশ্ন ওঠে। তিনি বলেছেন উপযােগ সষ্টিকারী আইন নাগরিক পালন করে চলবে অথবা তাদেরকে বলা যেতে পারে যে পালন করা উচিত। বেন্থাম আরও বলেছেন যে উপযােগের প্রশ্ন আছে বলে উচিত, ঠিক ও ভুল ইত্যাদি কথাগুলাে অর্থবহ।
আইনপ্রণেতার ভূমিকা
সুখ ও আনন্দ চাইলেই পাওয়া যায় না। বাস্তবে অর্জন করার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। তিনি মনে করতেন সুখােৎপাদনে সরকারের একটা ইতিবাচক ভূমিকা অবশ্যই আছে। এবং এ ব্যাপারে আইনপ্রণেতার ভূমিকাকে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। একমাত্র আইনপ্রণেতারাই আইনের মাধ্যমে সুখ ও আনন্দকে জনগণের কাছে পৌছে দিতে পারে। তার মতে – “আইনপ্রণেতাকের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে প্রতিটি ব্যক্তির সুখ।” বেন্থাম বলেছেন যে আনন্দ ও বেদনা অত্যন্ত জটিল বিষয়। সম্পদ, সুনাম, পরােপকার, কল্পনা, দয়া ইত্যাদি আনন্দের উৎস। দারিদ্র্য, শত্রুতা, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, দুর্নাম ইত্যাদি বেদনার কারণ। আইনপ্রণেতা এই বিষয়গুলো যথাযথ নজর বেখে আইন প্রণয়নে ব্রতী হবেন।
বেন্থাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী
হার্মনের মতে বেন্থামের উপযােগবাদ তত্ত্বটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আবরণে আবৃত। (It should be understood that Bentham’s theory here is individualistic rather than communitarian. Harmon, p. 373)। আগেই বলা হয়েছে যে উপযােগবাদ বিশ্লেষণে তিনি ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছেন। সমগ্র সমাজের কথা বলেন নি। তিনি সর্বপ্রথম ব্যক্তির সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনাকে রাষ্ট্রনীতির একমাত্র নিয়ামক বলে ঘােষণা করলেন। তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাধারাকে হার্মন সাম্যদর্শনবাদ বলে অভিহিত করেছেন (পৃ: ৩৭২)। কারণ কোন বস্তু থেকে সুখ এবং কোন বস্তু থেকে নিরানন্দ আসবে তা কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলবে, তার হয়ে অন্য কেউ সিন্ধান্ত নিতে পারবে না। ব্যক্তির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং এটি বাতিল করার কোন প্রশ্ন ওঠে না। সরকার বা আইনপ্রণেতা কোন একজন ব্যক্তিকে অধিক মর্যাদা বা গুরত্ব দেবে এবং অন্যকে উপেক্ষা করবে তা হতে পারে না। এই কারণে বলা হয়েছে—Each counts for one and only one. ব্যক্তির বিচারবুদ্ধিকে বেন্থাম যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। রুশাে বলেছেন যে গণঅভীপ্সা স্থির করার সময় প্রত্যেকটি ব্যক্তি আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে এবং একজন অন্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না।
ব্যক্তিস্বার্থ ও সমষ্টিস্বার্থের মধ্যে সমন্বয়
বেন্থাম যদিও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ছিলেন তবুও এমন কথা বলা যায় না যে তিনি সমাজে সামগ্রিক স্বার্থকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছিলেন। উভয়ের মধ্যে যে বিরােধ থাকতে পারে সে বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। ব্যক্তিস্বার্থ ও সমষ্টি উভয় প্রকার স্বার্থের মধ্যে বিরােধের মাত্রা কমিয়ে ফেলার জন্য নেন্থাম পথ বাতলে দিয়ে গেছেন। উপযুক্ত শিক্ষা পেলে ও সমাজ সম্পর্কে নাগরিক সচেতন হলে ব্যক্তি নিজের সুখ ও আনন্দের সঙ্গে সমাজের সুখ ও আনন্দকে যুক্ত করে নেয়। অর্থাৎ, উভয়ের মধ্যে একটা চলনসই ও কল্যাণজনক সময় গড়ে তােলে। শিক্ষিত মানুষ একেবারে স্বার্থপর হয় না। তা যদি হত সমাজ অচল হয়ে পড়ত। তার মতে গণমুখী শিক্ষাই ব্যক্তিস্বার্থ ও সামগ্রিক স্বার্থের মধ্যে একটি কার্মিক সেতুবন্ধন রচনা করে। তাই এই জাতীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার প্রয়ােজন। এইজন্য তিনি নানাপ্রকার প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার কথা বলেছেন যাদের মাধ্যমে নাগরিকগণ নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান করতে পারবে।
প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার
সমাজের সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক নাগরিকের সর্বাপেক্ষা বেশি পরিমাণ সহ আনন্দের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকেতিনি সহায়ক বলে মনে করতেন। গণতন্ত্রে জনগণ বাধাহীনভাবে নিজ নিজ মত প্রকাশ করতে পারে। সুতরাং কোন আইন উপযােগ সষ্টিকারী কিনা তা জনগণ বিনা বাধায় প্রকাশ করতে পারে। উপযােগে বিঘ্নসৃষ্টিকারী হলে জনগণ প্রতিবাদ জানাতে পারবে। তবে যদি কোন শাসনব্যবস্থা স্বাধীন মত প্রকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে তাহলে তাকেও উপযোগবাদের পক্ষে অনুকূল বলা যাবে। বেন্থাম সরকারের প্রকৃতি সম্পকে উৎসাহী ছিলেন না, আইন সম্পর্কে তার উৎসাহ ছিল।
উপযােগবাদের তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য
ভূমিকা
প্রসঙ্গত বেন্থাম-এর উপযােগবাদ তত্ত্বে প্রাকৃত বা স্বাভাবিক অধিকারের কোন স্থান নেই। তিনি প্রাকৃত অধিকার তত্ত্বকে আধিবিদ্যক (metaphysical) বলে অভিহিত করেছেন। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণা অথবা ফ্রান্সের মানুষের অধিকার ঘােষণা প্রাকৃত অধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও কার্যক্ষেত্রে এরা নাগরিকের বিশেষ কিছু উপহার করতে পারে নি। জনগণের অভাব দূর করা এই দুই ঘােষণাপত্রের পক্ষে সম্ভব হয় নি। এমন কি আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণার পরে একজন নিগ্রোও মুক্তি পায় নি। তিনি বলেছেন একমাত্র আইন নাগরিককে অধিকার দিতে পারে এবং এই আইনের ভিত্তি হবে উপযােগ। উপযােগের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইন থেকেই মানুষ সুখবাচ্ছন্দ্য পেতে পারে। ব্যক্তিত্ব বিকাশও সম্ভব।
বেন্থামের সুখকলন
বেন্থাম উপযােগবাদের যে তাত্ত্বিক কাঠামাে প্রস্তুত করে গেছেন তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল আনন্দ ও বেদনাকে পরিমাপ করা যায়। পরিমাপযােগ্য বলেই ব্যক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। দুঃখ ও আনন্দের এই পরিমাপযোগ্যতাকে সুখকলন (felicific calculus) বলা হয়েছে। মানুষ যুক্তিবাদী বলে আইন বা সরকারী সিদ্ধান্ত থেকে কতটুকু আনন্দ সে পেল তার হিসেবনিকেশ সে করে এবং সুখানুসন্ধানের কাজে সে সদাই ব্যপৃত থাকে। সুখের গুণগত উৎকর্ষও সে বিচার করতে চায়। সুখের একটা পবিত্র দিক আছে যা সবচেয়ে বেশি কাম্য। যে কোন সুখ মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। বেন্থাম সুখের পরিমাপযােগ্যতা থেকে আরও কয়েকটি অনুমান টেনেছেন যাদের উল্লেখ করা যেতে পারে। সুখ স্থিতিশীল বা অস্থিতিশীল দুইই হতে পারে। এই কারণে যে কোন বিবেচক ব্যক্তি স্থিতিশীল আনন্দের পেছনে অগ্রসর হয়। সুখ নিশ্চিত এবং অনিশ্চিত হতে পারে। কোন ব্যক্তি অনিশ্চিত সুখ চায়না যদি নিশ্চিত সুখ তার নাগালের মধ্যে থাকে। আনন্দের পরিমাপযােগ্যতা বিষয়টিকে বেন্থাম কেবল ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেন নি। আনন্দকে পরিমাপ করার পর কিভাবে জনগণ সর্বাধিক আনন্দলাভ করতে পারে তা আইনপ্রণেতা দেখবেন।
উপযোগ দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্ট
বেন্থামের উপযােগ তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে ওয়েপার বলেছেন যে এটি বস্তুগত প্রতিপন্নযােগ্য, দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্ট (পৃ: ১৩)। Federalist-এর লেখক বলেছেন যে ন্যয়বিচার হল সরকারের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, যেকোন সরকারের প্রধান কাজ হবে ন্যায়বিচারকে বাস্তবায়িত করা। বেন্থাম প্রশ্ন তুলেছেন – সুখ কি অপরাধ করল? সুখ কি তা যে কোন ব্যক্তি জানে। কারণ আনন্দ ও নিরানন্দের মধ্যে সে সহজে পার্থক্য টানতে পারে। সুতরাং যে কোন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত সুখার্জনে নাগরিককে যথাসাধ্য সাহায্য করা। কিন্তু ন্যায়বিচার নিয়ে বিরােধ দেখা দিতে পারে এবং এটি অনেক স্থলে মনােগত ব্যাপার। অতএব সুখানুসন্ধানে সরকার সচেষ্ট হলে সমাজের যতখানি কল্যাণ সাধিত হতে পারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করকে তা হবে না।
বাস্তবে প্রয়োগ সম্ভব
বেন্থাম উপযােগ তত্ত্বকে কল্পিত ধারণা বলে মনে করেন নি। একে বাস্তবে প্রয়ােগ করা যেতে পারে। সুখ বা আনন্দ পরিমাপযােগ্য বলে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। শিল্প বিপ্লবের পরে ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তন এসেছিল তার পুনর্বিন্যাসের জন্য তিনি সংস্কারের সুপারিশ করেছিলেন এবং এই সংস্কার হবে উপযােগিতাকে ভিত্তি করে। একটি অতিপরিচিত উদাহরণের সাহায্যে বেন্থাম তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তি উচ্ছেদ করা হবে কিনা তা নিয়ে যদি একটা বির্তকের সূচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে শেষ পর্যন্ত কোন কার্যকর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বস্তির নানাপ্রকার কুফলের চিত্র ও বস্তি উচ্ছেদের সফলগুলি যদি পাশাপাশি রাখা যায় তাহলে এবিষয়ে আর কোন বিতর্ক থাকতে পারে না, এবং যে কোন একটা সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়া যাবে। উপযােগবাদকে বেন্থাম বলেন, একটা বাস্তব বর্জিত ধারণার পর্যায়ে নামিয়ে এনে বর্জন করে ফেলা যুক্তিযুক্ত নয়।
উপযোগবাদ সর্বজনীন
মানুষ পরোপকারী ও পরমতসহিষ্ণু। তার আরও অনেক গুণ আছে। দোষও প্রচুর। কিন্তু একটা বিষয় সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রতিটি ব্যক্তি বেদনা এড়িয়ে যেতে ও আনন্দ পেতে চায়। এ ব্যাপারে কোনপ্রকার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় না। তাই সুখ বা আনন্দ সুনিশ্চিতকরণ যদি সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কাজকর্মের নীতি হয় তাহলে এটি হবে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কোন মানুষ বেচ্ছায় যন্ত্রণাকে নিতে চায় না। বেন্থাম বলেছেন যে সুখ অন্বেষণ ও যন্ত্রণা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া মানুষ আরও অনেক অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু এগুলি সাময়িক।
উপযোগবাদের সমালােচনা
আনন্দের পরিমাণ সহজ নয়
বেন্থামের উপযােগবাদ তত্ত্ব সমালােচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। ম্যাক্সে বলেছেন যে তার উপযােগবাদ তীব্র সমালােচিত হয়েছে। প্রথমেই আমরা জিজ্ঞেস করব আনন্দ, সুখ ও যন্ত্রণা ইত্যাদি মনােগত ধারণাগুলিকে (যদিও বেন্থাম এদেরকে বস্তুগত বলেছেন) কিভাবে আঙ্কিক উপায়ে পরিমাপ করা যাবে? সুখার্জন নানাপ্রকার জটিল পদ্ধতির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয় এবং প্রকৃত আনন্দ সম্পর্কে কোন বস্তুগত ধারণা তৈরী করা যায় না। তাছাড়া সুখ বা যন্ত্রণা পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশের পরিবর্তন হলে সুখ সম্পর্কিত ধারণা বদলে যায়। সুতরাং আঙ্কিক নিয়মে সুখ বা যন্ত্রণা কেমন করে পরিমাপ করা যাবে তা বােধগম্য নয়।
সুখ ও যন্ত্রণা ছাড়া আরও অনেক অনুভূতি ব্যক্তিকে পরিচালিত করে
প্রতিটি ব্যক্তি সুখ পেতে ও যন্ত্রণা এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু তাই বলে তাকে একগুচ্ছ সুখ বা আনন্দের প্রতীক বলে মনে করা খুবই অন্যায়। এই ধরনের সাধারণীকরণ করে বেন্থাম মানুষকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেছেন। অনেক সময় মানুষ আদর্শ বা নীতির জন্য লড়াই করে এবং তা করতে গিয়ে সে অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করে থাকে। সুতরাং মানুষ যন্ত্রণাকে এড়িয়ে থাকতে চায় কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। জাতীয় মুক্তি আন্দোলন অথবা বিপ্লবের জন্য যারা লড়াই করে তারা আনন্দ হয়তো পায় কিন্তু দুঃখ কম পায় না। দুঃখকে এড়িয়ে যেতে চাইলে পথিবীতে কোন মহৎ কাজ আজ পর্যন্ত সম্পাদিত হত না। মানুষ বুদ্ধিমান বলে হিসেবী। কিন্তু, হিসেবনিকেশের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে সে সমাজে সব সময় চলে না। অভ্যাস, পরিবেশ এবং ভাল লাগা ইত্যাদি নানা কারণে সে কাজ করে। ধুমপান ক্ষতিকর ও যন্ত্রণাদায়ক জেনেও মানুষ ধূমপান করে এবং এটা অভ্যাসবশত।
বেন্থামীয় দর্শন অপর্যাপ্ত
ম্যাক্সে বলেছেন যে বেন্থামীয় দর্শনের দুর্বলতম দিকটি হল মানুষের মনস্তত্ত্বের যে ছবিটি তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন সেটি অপর্যাপ্ত। কারণ মনস্তত্ত্বের পুরো ছবি আমরা পাই না। তাছাড়া কিভাবে সমগ্র সমাজের ও ব্যক্তির সন্তুষ্টির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যাবে তাও তিনি বলেন নি। ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের গভীরে প্রবেশ করার যােগ্যতা তার ছিল না। কোন বিষয় সম্পকে ভাসাভাসা আলােচনা করলে শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বেশ কষ্টকর। ম্যাক্সে আরও বলেছেন যে বেন্থামকে অনুসরণ করে অগ্রসর হলে আমরা উপযােগ সম্পকে ভুল সিদ্ধান্তে উপস্থিত হতে পারি এবং সে ক্ষেত্রে উপযােগকেন্দ্রিক সমস্ত বিষয় বানচাল হয়ে যাবে। তিনি স্বীকার করেছেন যে মানুষ স্বার্থপর। তবে শিক্ষা বিস্তার করে তাকে পরার্থপর করে গড়ে তোলে যেতে পারে। আমরা তার এই মতের সঙ্গে একমত নই। কারণ মানুষ শিক্ষিত হলে পরার্থপর হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।
অবাস্তব ও হাস্যকর
হর্মিন বলেছেন (পৃ: ৩৭৩) যে তার সুখকলন ( felicific calculus) অবাস্তব ও হাস্যকর। বেদনা ও আনন্দের একটা শ্রেণীবিভাগ তিনি করে গেছেন। কিন্তু এর বাইরে আরও অসংখ্য প্রকার আনন্দ ও যন্ত্রণা আছে যার কথা তিনি বলেন নি। হয়তাে তিনি জানতেন না। প্রতিটি ব্যক্তির আনন্দকে এক যােগ করে আনন্দের সর্বোচ্চীকরণ করা কিভাবে সম্ভব এবং একটি সরকার কেমন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন করবে তাও জানা যায় নি। সুবিধা ও অসুবিধার বিষয়টি গণতান্ত্রিক সরকার সক্রিয় বিচারবিবেচনা মধ্যে আনলেও স্বৈরতন্ত্রে এর স্থান নেই এবং বেন্থাম যখন Principles of Morals and Legislation লেখেন তখন (অর্থাৎ ১৭৮৯) ব্রিটেনে স্বৈরতন্ত্র পুরােমাত্রার না থাকলেও আজকের দিনের মত গণতন্ত্র ছিল না। বেন্থামের এই গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পরে ইউটোপীয় সমাজবাদী রবার্ট ওয়েন শ্রমিক শ্রেণীর কল্যাণের জন্য পার্লামেন্টকে অনুরােধ করেছিলেন আইন তৈরী করতে এবং বলা বাহুল্য তিনি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বেন্থামকে যদিও বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিভূ বলে কেউ কেউ বলেন তাহলেও জনগণের প্রতি তার যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। তার নীতি বা দর্শন অনুযায়ী তদানীন্তন সরকারকে তিনি পরিচালিত করতে পারেন নি।
বেন্থামের রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা
সীমাহীন উদ্দেশ্য বিশিষ্ট একটি সংস্থা হল রাষ্ট্র
হিতবাদীদের ধারণার রাষ্ট্র ও অন্যান্য ধারণার রাষ্ট্রের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে তা বেন্থাম-বিশ্লেষিত রাষ্ট্রের স্বরূপের দিকে তাকালে সহজে বোঝা যায়। বেন্থাম ও অন্যান্য উপযােগবাদিগণের রাষ্ট্র-সম্পকিত ধারণা বিশ্লেষণ করে ওয়েপার বলেছেন (পৃ: ৯৪), কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন হল রাষ্ট্র যার উদ্দেশ্যে হল নাগরিকদের সুখ বা আনন্দ উদ্দীপিত ও সংরক্ষিত করা। প্লেটো, অ্যারিস্টটল বা রুশাের মত সৎ এবং মহৎ জীবন সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য – এই অস্পষ্ট ও অবাস্তব ধারণা বেন্থামকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করে নি। তিনি মনে করতেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সর্বাধিক সুখ সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য এবং ব্যক্তিত্ব বা মহত্বের বিকাশের পথে রাষ্ট্র আদপে অগ্রসর হবে না। সুখ বা আনন্দ অর্জনকে রাষ্ট্রের একটি অত্যাবশ্যক কাজ হিসেবে বর্ণনা করে বেন্থাম এর উদ্দেশ্যকে সীমাহীন করে গেছেন বলে ওয়েপার মনে করেন। (The utilitarian explanation of the state is a complete explanation in terms of an unlimited end.) আনন্দবধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্বের পর্যায়ভুক্ত করলে এর উদ্দেশ্য যে সীমাহীন হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ সুখ নিজেই সীমাহীন।
রাষ্ট্র একটি আইন প্রণয়নকারী সংস্থা
বেন্থাম ও তার অনুগামীরা মনে করতেন যে রাষ্ট্র হল একটি আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। কিছু সংখ্যক ব্যক্তি একত্র মিলিত হয়েছে আনন্দ বা সুখকে উপভােগ করার জন্য এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্র আইন রচনা করে ব্যক্তিকে সাহায্য করবে। রাষ্ট্রের এই আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন বাধ্যতামূলক এই শর্তে যে আইন সুখানসন্ধানকে বিঘ্নিত করবে না। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুখার্জনকে বেন্থাম সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলে মনে করতেন এই কারণে যে প্রচলিত রীতিনীতি বা আচার-অনুষ্ঠান বা প্রথা অনন্দ বর্ধনের পক্ষে পর্যাপ্ত নয় এবং বৌদ্ধিক প্রবণতাকে খর্ব করে উদ্দেশ্য সাধনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। সমষ্টি ও ব্যষ্টির বাথের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সমাজের মােট সুখ বা আনন্দকে বাড়িয়ে তুলতে কেবল রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইন সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গে বেন্থাম সাবধান করে দিয়ে বলেছেন যে, যে সমস্ত আচরণ বা প্রতিক্রিয়া সমাজের ক্ষতি করতে পারে রাষ্ট্রের আইন সেগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করবে এবং অন্য কোন বিষয়ে সহজে হস্তক্ষেপ করবে না।
বেন্থামের রাষ্ট্র সার্বভৌম
বেন্থাম আইনকে সার্বভৌম শক্তির নির্দেশ বলেছেন। সার্বভৌমের নির্দেশ লঙ্ঘিত হলে তাকে আর তাকে সাবভৌম বলা যাবে না। এই কারণে তিনি রাষ্ট্রকে সার্বভৌম শক্তিসম্পন্ন বলেছেন। তার সার্বভৌম রাষ্ট্র কেবল আইনের উৎস নয়, জনগণের সমস্ত অধিকারের উৎসও বটে। তিনি প্রাকৃত অধিকারের তত্ত্ব অস্বীকার করে বলেছেন যে এগুলি ননসেন্স ও বাস্তবে অপ্রয়োগযােগ্য। একমাত্র সার্বভৌম শক্তি যে আইন প্রণয়ন করে সেগুলিকে কার্যকর করা যায়।
বেন্থামের রাষ্ট্র ব্যক্তির ট্রাস্টি ও গণতান্ত্রিক
জীবনের প্রথম দিকে বেন্থাম টোরী ছিলেন এবং পরে বেশ গণতান্ত্রিক মনােভাবাপন্ন হয়ে পড়েন। যে কোন কারণেই হােক তার মনে এই প্রত্যয় জমেছিল যে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের স্বার্থ বা কুমতলব যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ বিঘ্নিত করতে না পারে সে দিকে রাষ্ট্রের নজর দেওয়া আবশ্যক এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সফল করে তুলতে হলে এর গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মে সমাজের সবাইকে সামিল হতে হবে। প্রত্যেকটি নাগরিক কেবল সুখ বা আনন্দ সম্পর্কে সচেতন হলে চলবে না, প্রতিকূল অবস্থায় এটি যাতে বানচাল হয়ে না যায় সে দিকে নজর দেওয়া রাষ্ট্রের কতব্য। তিনি বলেছেন সমস্ত ব্যক্তি এগিয়ে আসবে। বেন্থামের রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে, তাই বলে তিনি কোন দিন ভাবেন নি যে প্রাকৃত সাম্য (natural equality) সমাজে প্রতিষ্ঠিত হােক। আসল ব্যাপার হল অত্যধিক, অসাম্য সর্বাধিক সুখার্জনে বাধা সৃষ্টি করে।
বেন্থামের রাষ্ট্র নেতিবাচক
ওয়েপার লিখেছেন – “যদিও তার নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে পারে যতক্ষণ না তা আনন্দ বৃদ্ধি করবে বা ব্যথা কমাবে, যদিও তিনি নিজে একটি অসমালোচনামূলক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ থেকে অসমালোচনামূলক সমষ্টিবাদে পৌঁছেছিলেন, তবুও তার রাষ্ট্র মৌলিকভাবে নেতিবাচক।” কেন বেন্থামের রাষ্ট্রকে নেতিবাচক বলা হয়েছে সে সম্পর্কে দু’এক কথা বলা যেতে পারে। তার রাষ্ট্র নাগরিকের নৈতিক বিকাশ সাধনে কোন প্রকার ভূমিকা পালন করবে না। একমাত্র কাজ হল তার সুখার্জনে সাহায্য করে যাওয়া। রাষ্ট্র ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু তাকে বদলে দিতে পারেনা বা সে চেষ্টা করতে রাষ্ট্র রাজি নয়। ব্যক্তি চরিত্রের উন্নতিবিধান করাও রাষ্ট্রের উদ্দেস নয়। এহেন রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে নেতিমূলক ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। “রাষ্ট্র নাগরিকদেরকে পরিবর্তন করেনা, নাগরিকই রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করে।”
রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা
বেন্থামের রাষ্ট্র স্বাধীনতার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে গতানুগতিক উদারনীতিবাদীদের রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন। স্নাধীনতাকে সর্বোচ্চীকরণ করা তার রাষ্ট্রের কাজ নয়। সুখার্জন হল রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ওয়েপার বলেন – “সুখই পরম বিষয়, এবং স্বাধীনতাকে এই পরমের প্রতি আত্মসমর্পন করতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নয়, বরং সর্বোচ্চ সুখ।” বেন্থাম বলেছেন সার্বভৌম শক্তি যে আইন প্রণয়ন করবে তা যদি স্বাধীনতার পরিপন্থী হয় কিন্তু সুখার্জনে বিশেষভাবে সাহায্য করে তাহলে সেই আইনকে জনগণ বিনা বাধায় মেনে নেবে। রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অনুিগত্যের প্রশ্নও আসে সুখার্জনে এর ভূমিকা থেকে, স্বাধীনতা রক্ষণাবেক্ষণ থেকে নয়।
সীমিত ও ফলপ্রদ সরকার
অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বেন্থাম নাগরিককে সর্বাধিক স্বাধীনতা দেওয়ার কথা এইজন্য বলে গেছেন যে এর ফলে তারা সুখ ও উপযােগকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করতে সক্ষম হবে। নাগরিক প্রতি পদক্ষেপে রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাধা পেলে কাজ করতে উৎসাহ বােধ করবে না এবং সুখান্বেষণে সরকারী বিধিনিষেধগুলি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, সরকারী হস্তক্ষেপকে তিন সুখান্বেষণের অনুকূল বলে কোনদিন ভাবতে পারেন নি। উপযােগের নীতিকে স্বীকার করে নিলে সরকারী ক্ষমতার সঙ্কোচনের নীতিকে মেনে নিতেই হবে। আগেই বলা হয়েছে যে সরকারের কাজ হল জনগণকে সবচেয়ে বেশি সুখ দেওয়া এবং এইজন্য যত কম বিধিবিধান সরকার প্রয়ােগ করে ততই মঙ্গল। সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত গণ্ডীর মধ্যে রাখার কথা বেন্থাম বলেছেন অন্য এক কারণে। তিনি চাইতেন যে একটা গণতান্ত্রিক সরকার কর্মক্ষম ও দায়িত্ব পালনে সক্ষম হােক। এটি উপযােগবাদের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে প্রয়ােজন। তিনি মনে করতেন যে সরকারের উপর অত্যধিক কাজ ও দায়িত্বের ভাব অর্পন করলে অনেক কাজ ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। কারণ তার সামর্থ্যের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। কর্মক্ষমতার (efficiency) কথা বিচার করেই দায়িত্বের ভার লঘু করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি বেন্থামের রাষ্ট্র—a limited state to erasure efficient government. দক্ষ ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীর দ্বারা সরকার পরিচালনার কথা বলে গেছেন। একমাত্র কারণ সরকারকে সুদক্ষ ও জনগণের সুখার্জনের বিষয়ে প্রয়ােজনমুখী করে তােলা। তার রাষ্ট্রতত্ত্বের বিশ্লেষকগণ বলেন যে তিনি Fragment on Government বইতে এ বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। একটি সুদক্ষ সরকার যে কোন রাষ্ট্রের পক্ষে একটি মূল্যবান সম্পদ। বেন্থামের রাষ্ট্রসম্পকিত আলােচনার মধ্যে আমরা আরাে পাই যে একজন দক্ষ আইনপ্রণেতার উপর আইন প্রণয়নের দায়িত্ব থাকবে। হার্মন লিখেছেন, “দক্ষতা ও স্বাধীনতা এই দুয়ের মধ্যে বিরােধ উপস্থিত হলে বেন্থাম দক্ষ সরকারের প্রতি সমর্থন জানাতেন।” কারণ তার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে সর্বাধিক সুখকে বাস্তবায়িত করতে হলে দক্ষ সরকার অপরিহার্য। সরকারকে সুদক্ষ করে তােলার জন্য বেন্থাম প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার সুপারিশ করে গেছেন। সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হলে এবং দায়িত্বশীল থাকলে দুর্নীতি ও অপদার্থতা বাসা বাঁধতে পারবে না বলে তিনি মনে করতেন। কর্মদক্ষতা বদ্ধির জন্য তিনি ক্ষমতা বিভাজন নীতির উপর আদৌ জোর দেন নি। স্বায়ত্তশাসন স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে সম্ভাব্য বিরােধের অবসান ঘটিয়ে সরকারকে গণপ্রয়ােজনমুখী করে তোলাকে তিনি সমর্থন করতেন।
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বেন্থামের স্থান
অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতির জনক
বেন্থাম হিতবাদ বা উপযােগবাদের জনক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে তিনি উপযােগবাদের প্রথম প্রবক্তা নন। পরােক্ষভাবে হলেও তাঁর আগে হবস, লক ও হিউম উপযােগবাদ সম্বন্ধে আলােচনা করে গেছেন। এরও আগে পঞ্চম, শতাব্দীতে গ্রীস দেশে সফিষ্টরা (Sophists) উপযােগবাদ নিয়ে কিছু আলোচনা করেছিলেন। বেন্থামের পদ্ধতির কৃতিত্ব হ’ল তিনি আইন ও সরকারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতামূলক ও সমালোচনাত্মক পদ্ধতি প্রয়ােগ করার সুপারিশ করেছেন, অর্থাৎ আইন ও সরকারের কাজকর্মের বিশ্লেষণ বা পর্যালােচনার জন্য এই দুই পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে আমরা লক্ষ্য করছি যে গবেষণা ও অনুসন্ধান ( research and investigation) সরকারের চতুর্থ শাখায় পরিণত হয়েছে। আইন প্রণয়ন ও আইনের বাস্তব রূপায়ণেই সরকারের দায়-দায়িত্বের পরিসমাপ্তি হয় না। প্রতিটি নীতি ও কাজের ফলাফল কি হচ্ছে তা যে কোন সরকারকে জানতে হয়। অর্থাৎ, জন প্রশাসনের এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে কোন প্রগতিশীল সরকার নিজ কাজকর্মের মূল্যায়নের নিমিত্ত অনুসন্ধানকে সরকারী প্রশাসনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করেন। (“সরকার সাধারণ মাত্রার দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে নাক গলানো বন্ধ করে দিয়েছে, এটি বরং নিজেকে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখায় নিজেকে সীমাবদ্ধ করেছে, এটির এখন বিশেষ করে জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং সমাজ কল্যাণের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। বেন্থাম প্রথম আধুনিক লেখক যিনি জননীতির সমস্যার উপর অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেন।” – Ebenstein, p. 514)
প্রতিটি ব্যক্তিকে তিনি স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছিলেন
ওয়েপার বলেন প্রতিটি পুরুষ ও নারীকে বেন্থাম, স্বতন্ত্র মর্যাদা দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। সমাজে তিনি কাউকে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্ট ভাবতেন না। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন সমাজের স্বার্থ বলতে কি বােঝায়? তার উত্তর হল – বিভিন্ন সদস্যের সম্মিলিত স্বার্থই সমাজের স্বার্থ। রাষ্ট্রের অস্থিত্ব ব্যক্তির কল্যাণের জন্য, ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য নয়। সেইজন্য তাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বলা হয়। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তিনি অবাধ বাণিজ্য নীতির সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাই বলে তাঁকে গোঁড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বলা চলে না। প্রয়ােজনবােধে তিনি সরকারী হস্তক্ষেপকে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত ছিলেন।
আইনের ক্ষেত্রে বেন্থামের অবদান
আইনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি বলেছেন যে বিচারকের উচিত বিভিন্ন অপরাধীকে শ্রেণীবিভাগ করে প্রত্যেক অপরাধীর জন্য স্বতন্ত্র শাস্তি বিধান করা। শাস্তির মাত্রা এমন হবে যে অপরাধী দ্বিতীয়বার অপরাধ করার কোনপ্রকার উৎসাহ পাবে না। বেন্থাম আইনের বিভিন্ন দিক ও তার কার্যকারিতার বিস্তারিত ও বাস্তবানুগ আলােচনা করে গেছেন। পরবর্তীকালের বহু আইনজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তি বেন্থামকে অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে অনুসরণ করেছেন। স্যাবাইন বলেন, “আইনি প্রক্রিয়া এবং বিচার বিভাগীয় সংগঠনের তত্ত্বে… বেন্থাম তার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারণা বিকশিত করেন এবং নিশ্চিতভাবে এখানে তিনি উদারনৈতিক ঐতিহ্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন।” (Sabine, p. 683)
বেন্থাম অতীত চিন্তার মূলে আঘাত দিয়েছিলেন
অতীতের সমস্ত রক্ষণশীল চিন্তাধারাকে এক মতবাদ নাড়া দিয়েছিল যার প্রবক্তা ছিলেন বেন্থাম। বেন্থাম তীক্ষ যুক্তির সাহায্যে প্রাকৃত অধিকার, চুক্তিমুলক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার ও ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বসমূহকে সরাসরি অস্বীকার করে বসলেন। তিনি ঘােষণা করলেন যে সরকার যদি জনগণের স্বাচ্ছন্দ্যবিধানে ব্যর্থ হয় তাহলে তার শাসন করার কোন অধিকার নেই এবং সরকারী শাসন যদি জনগণের কাছে কোন উপযােগ সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে তারা আনুগত্য দেখাতে বাধ্য নয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে অথবা ভগবান প্রেরিত প্রতিনিধি বলে কতৃপক্ষের কাছে আনুগত্য দেখাতে হবে এমন কোন কথা নেই। (“বেন্থাম তার মতবাদের বৃহৎ অংশ জুড়ে লিখেছেন যে সরকারকে অবশ্যই নিজেকে সমর্থন করতে হবে এবং এইভাবে মানবজাতির প্রতি তার সরাসরি এবং তাৎক্ষণিক সেবায় তার উপাধি খুঁজে বের করতে হবে।” – Maxey, p. 468)।
বিদেশে বেন্থামের প্রভাব
গেটেল বলেছেন যে ইংলণ্ডের বাইরে কোন কোন দেশে বেন্থামের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। ফরাসী বিপ্লবের ব্যাপারে তিনি সক্রিয়ভাবে উৎসাহী ছিলেন। আইন সম্পর্কীয় লেখাগুলো ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। ফরাসী আইনসভার পদ্ধতির খসড়া বেন্থাম তৈরী করে দিয়েছিলেন। ফরাসী সরকার তাঁর বহু প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। রাশিয়া, স্পেন ও পর্তুগালে তাঁর মতবাদ স্বীকৃতি পেয়েছিল। ইউরােপের বহু দেশের আইন সংস্কারের কাজে সাহায্য করেছিলেন।
ফেবীয় সমাজবাদের পূর্বসুরী
ইবেনস্টাইন বলেছেন যে উনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে (বিশেষ করে ১৮৮৪ সালে) ইংলণ্ডে ফেবীয় সমাজবাদের জন্ম হয়। ফেবীয় সমাজবাদীদের মূল বক্তব্যের সঙ্গে
বেন্থামের বক্তব্যের বেশ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় –
১। ফেবীয়পন্থীরা বলতেন কল্পনার চেয়ে তথ্য বা ঘটনাই বড়।
২। সামাজিক নিয়ম ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
৩। মানুষকে কেবল যুক্তি দিয়ে বােঝানো যেতে পারে, শঠতা দিয়ে নয়।
বলা বাহুল্য, একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এগুলাে বেন্থাম-এর বক্তব্য।
সমালোচনা
ওয়েপার বলেন যে বেন্থাম একজন প্রথম সারির দার্শনিক ছিলেন না। তিনি উপযােগ নীতিগুলােকে সম্যকরূপে উপলদ্ধি না করে কেবল গলাধঃকরণ করেছিলেন। রাষ্ট্র দর্শনের কোন বৈপ্লবিক চিন্তাধারা পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যেতে পারেন নি। জ্ঞান তত্ত্ব তিনি লক ও হিউম-এর কাছ থেকে, আনন্দ ও যন্ত্রণার নীতি হেলভেটিয়াস-এর (Helvetius) কাছ থেকে, উপযােগ নীতি হবস ও লক থেকে ধার নিয়েছিলেন। এর থেকে বােঝা যায় যে তার রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে কোন মৌলিকত্ব নেই। বক্তব্য বিভ্রান্তি ও পরস্পরবিরােধী উক্তিতে ভরা। বিভ্রান্তি সম্বন্ধে তিনি পুরােপুরি সচেতন ছিলেন এবং তা দূর করার জন্য তিনি বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণ পুরাে অনুমানভিত্তিক। ফলে বিভ্রান্তি বিশৃঙ্খলায় রুপান্তরিত হয়েছে। (Wayper, p. 99)
বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার সমর্থক
কোন কোন সমালােচক বেন্থামকে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার সমর্থক বলে মনে করেন। কারণ, যে সমস্ত মানুষ প্রাত্যহিক জীবনযন্ত্রণায় জর্জরিত নয় এবং স্বচ্ছল জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে অধিক মাত্রায় অভ্যস্ত একমাত্র তারাই সুখানুসন্ধানে ও যন্ত্রণা এড়াবার কাজে নিজেদেরকে সদাই ব্যাপৃত রাখতে পারে। উদয়াস্ত পরিশ্রমে যারা জীবিকা অর্জন করে তারা বেন্থামের মত সুখ বা আনন্দ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে না। যন্ত্রণা এবং দুঃখ তাদের জীবনের চিরসাথী। হবস ও লকের মত বেন্থাম বুর্জোয়া ব্যবস্থার সমর্থক। তার সময়ে শিল্প বিপ্লবের ফলে যে নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্যেই তিনি রাষ্ট্রিক হস্তক্ষেপকে ন্যুনতম স্তরে নামিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। সরাসরি কথাগুলো বেন্থাম বলেন নি। তবে তিনি উপযােগ নীতিকে শিখণ্ডীরপে ব্যবহার করেছেন। যদিও প্রতিটি ব্যক্তি এই নীতির ব্যবহার করতে পারে তবুও আমরা জানি সবার সাধ্য নেই এর সাহায্য নেওয়া। বেন্থাম সম্পত্তির অধিকারের পক্ষে জোর ওকালতি করে গেছেন। না করে উপায় ছিল না। কারণ শিল্প বিপ্লবের ফলে সবেমাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তি সম্পত্তি ভােগদখল করতে শুরু করেছিল। তিনি ছিলেন তাদের প্রতীক। তদুপরি বেন্থাম নিজে বিপুল সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। এ-অবস্থায় সম্পত্তির অধিকারের বিরােধিতা করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।
কেন বেন্থামকে বুর্জোয়া চিন্তক বলা হয়
কেন বেন্থামকে বুর্জোয়া চিন্তক বলা হয় সে সম্পর্কে আরও দু’এক কথা বলা যেতে পারে। তিনি নিরাপত্তার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তবে বলা প্রয়ােজন যে এই নিরাপত্তা কিন্তু সার্বিক নয়, কেবল সম্পত্তির বিদ্যমান বণ্টন-ব্যবস্থা। সম্পত্তির মালিকরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে তার তীক্ষ্ণ নজর ছিল। তিনি সাম্য প্রতিষ্ঠাকে অবাস্তব বলে ভাবতেন। তবে অসাম্য হ্রাস করা যেতে পারে। নিঃস্বতা ও সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে তিনি আপােসহীন সংগ্রামের কথা বলেন নি। বেন্থাম অ্যাডাম স্মিথের অবাধ বাণিজ্য নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক। কেউ কেউ বলেন যে তিনি সুবিধাভােগী শ্রেণীর আয়ের খানিকটা নিয়ে সম্পত্তিহীনদের দেয়ার কথা বলেছেন। এটা কি তাঁর সমাজতান্ত্রিক মনােভাব? মস্কো থেকে প্রকাশিত রাজনীতিক মতবাদ-এর লেখকগণ বলেন (পৃ: ৪৯ ) একে তাঁর সমাজবাদ বলা যায় না। তিনি ছিলেন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের একেবারে সনাতনপহী পক্ষপাতী। রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের আর্থনীতিক ক্রিয়াকলাপে আদৌ হস্তক্ষেপ করবে না। উপরি-উক্ত লেখকগণ বলেছেন তাঁর রাজনৈতিক মতবাদের ভারকেন্দ্র হ’ল আনুষ্ঠানিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানাদির উন্নয়ন, তাতে ঘুণাক্ষরে সম্পত্তির সামাজীকরণের কথা নেই।
পূর্বকালীন ও সংশােধিত উদারনীতিবাদ
উদারনীতিবাদের দুটি পর্যায়
স্যাবাইন উদারনীতিবাদের বিকাশকে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়টি বেন্থাম ও জেমস মিল-এর রাষ্ট্রদর্শনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের আবির্ভাব ঘটে জন স্টুয়ার্ট মিল-এর সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে স্যাবাইন অমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে উদারনীতিবাদের এই স্তরীয় উদারনীতিবাদের বিভাজন কঠোরভাবে অনুসরণ করা যায় না অথবা এমন কথা বলা চলে না যার দু’টি স্তর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। তবুও উদারনীতিবাদের বিকাশের জন্য এই স্তরীয় বিভাজন আমাদের স্মরণ রাখা কর্তব্য। বেন্থাম ও জেমস মিল সামন্ত প্রভুদের আধিপত্য থেকে পার্লামেন্ট ও প্রশাসনকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। সামন্ত শ্রেণীর হাত থেকে শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা চলে যায়। যাই হােক, আইন প্রণয়ন ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকারের পরিধিকে বিস্তৃত করার কথা এরা বলেন। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নির্মোক বেন্থাম বা জেমস মিল খুলে ফেলতে পারেন নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে আমরা দেখি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনেকখানি উপেক্ষিত।
পূর্বকালীন উদারনীতিবাদের রাষ্ট্রতত্ত্ব : বেন্থাম
বেন্থাম ও জেমস মিলের রাজনীতি সম্পর্কিত ধারণা বিশ্লেষণ করলে আমরা জানতে পারি যে এরা কেউই চান নি যে সরকার দুর্বল ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ুক। বিশেষ করে বেন্থামকে রাষ্ট্র-সম্পর্কিত ধারণায় আমরা দেখেছি যে তিনি একটি দক্ষ সরকার গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের কথা বেন্থাম বলেছেন। সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন পার্লামেন্ট দক্ষ সরকারের প্রতিশ্রুতি বহন করে। কিন্তু এই পার্লামেন্ট যাতে স্বৈরাচারী অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত না হয় তার জন্য তিনি আলােকপ্রাপ্ত জনমতের প্রাধান্যের কথা বলেছেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে জনগণের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকা উচিত। সর্বজনীন ভোটাধিকারের প্রবর্তন করতে তিনি চেয়েছিলেন। (বেন্থাম চূড়ান্ত রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করতেন, এবং মনে করতেন জনগণকেও তা ধারণ করা উচিত, কারণ তাহলেই সরকারের স্বার্থের সাথে জনস্বার্থ এক হবে। এই জনস্বার্থকে কার্যকরী করার জন্য তিনি সার্বজনীন ভোটাধিকারে বিশ্বাস করতেন। – Sabine, P. 695)। বেন্থাম পালামেন্টের মেয়াদ কমিয়ে এক বছর করতে চেয়েছিলেন এই কারণে যে এটা করা হলে জনগণের নিকট এর দায়দায়িত্ব অনেকখানি বেড়ে যাবে। মােট কথা, বেন্থামের উদারনীতিবাদের সারকথা হ’ল সরকার হবে দক্ষ ও কর্মোদ্যমী এবং তা জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকবে। সরকারের কাজকর্মের উপর সাংবিধানিক বিধিনিষেধ জারী করার ব্যবস্থা থাকবে। এই হ’ল তাঁর উদারনীতিবাদের সারকথা।
জেমস মিল ও পূর্বকালীন উদারনীতিবাদ
জেমস মিল-এর উদারনীতিবাদ বেন্থামের উদারনীতিবাদ থেকে আলাদা নয়। উনিশ শতকের শ্রেণী শাসনের বিরুদ্ধে মিল জোর গলায় যুদ্ধ ঘােষণা করেন। ওয়েস্টমিনিস্টার রিভ্যু নামক পত্রিকায় ১৮২৪ সালে জেমস মিল বলেন যে জমিদার শ্রেণীর রাজনীতিক আধিপত্যের অবসান ঘটানো আবশ্যক। কমন্স সভা মাত্র দু’শ পরিবারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংসদীয় গণতন্ত্রের এটি আসল চেহারী নয়। জনগণের মতামত ব্রিটিশ কমন্স সভায় সুচারুরূপে প্রতিফলিত হবার সুযােগ পায় না। সরকারের ক্ষমতা সীমিত হোক বলে জেমস মিল মনে করতেন। কিন্তু ক্ষমতাকে বিভাজিত করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। একমাত্র জনগণের সচেতন মতামতই সরকারকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারে। এই কারণে তিনি শিল্প বিপ্লব জাত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে ভােটাধিকারের ব্যাপ্তির সুপারিশ করেন। বেন্থাম প্রবর্তিত উপযােগবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন জেমস মিল। তিনি মনে করতেন যে সর্বজনীন ভােটাধিকারের বিস্তৃতি প্রয়ােজন এই কারণে যে প্রতিটি ব্যক্তি যুক্তিবাদী ও নিজ স্বার্থ রক্ষায় পারঙ্গম। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তিত হলে ব্যক্তির রাজনীতিক সচেতনতা বাড়বে ও কল্যাণ অঙ্গনের পথ প্রশস্ত হয়ে উঠবে। এই মন্তব্য করতে গিয়ে স্যাবাইন বলেন – “In short he succeeded…in combining rather pessimistic estimate of human nature with some remnant of that sublime faith in reason.” পরে জেমস মিল-এর পুত্র জন স্টুয়ার্ট মিল আত্মজীবনীতে বলেছেন যে মানুষের মনের উপর যুক্তির অপরিসীম প্রভাবের সম্পর্কে তাঁর বাবার প্রগাঢ় আস্থা ছিল ।
পূর্বকালীন উদারনীতিবাদের অবদান
স্যাবাইন পূর্বকালীন (early) উদারনীতিবাদকে একটি বৌদ্ধিক (intellectual) শক্তি বলে অভিহিত করেছেন। ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যালদের উদারনীতিবাদ পুরনাে আমলের অকেজো রাজনীতিক মতবাদকে বিসর্জন দিয়ে নতুন যুগের উপযােগী একটি সজীব মতবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যালদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় নি। পার্লামেন্টের সংস্কার, বাণিজ্য ও শিল্পের উপর বিধিনিষেধ কমানো, বিচারিক কাঠামাের পুনর্বিন্যাস ইত্যাদি পূর্বকালীন উদারনীতিবাদী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল। ১৮৩২ সালের পার্লামেন্টীয় সংস্কার বেন্থাম-প্রদত্ত সংস্কার-সুপারিশের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। তার পরে এক এক করে অনেক সংস্কার করা হয়েছে। বেন্থামই এসবের সূত্রপাত করে যান। সংস্কার আন্দোলনকে উদ্দীপিত করেন জেমস মিল। প্রশাসনিক সংস্কার এবং আনুষঙ্গিক বিষয় পূর্বকালীন উদারনীতিবাদী আন্দোলনের ফসল। আরক্ষা বাহিনী ও জনস্বাস্থ্যের প্রতি ব্রিটিশ সরকার উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নজর দিতে আরম্ভ করে।
পূর্বতন উদারনীতিবাদের সমালোচনা
পূর্বতন উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযােগ হ’ল এটি প্রতিষ্ঠানের গুরত্ব বা প্রয়ােজনীয়তার সম্যক উপলব্ধি করতে পারে নি, কেবল মানুষের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের উপর জোর দিয়ে গেছে। পূর্বতন উদারনীবিদের দার্শনিক চিন্তাধারা অদৌ স্পষ্ট নয়। অভিজ্ঞতামূলক হবার প্রচেষ্টা এই উদারনীতিবাদের নীতিবাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেলেও তথ্য বা ঘটনা দিয়ে সিদ্ধান্তকে বিচার করতে পারে নি। ফলে পূর্বকালীন উদারনীতিবাদ দার্শনিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যালিজমকে স্যাবাইন একটি অস্থায়ী (ad hoc) দর্শন বলে অভিহিত করেছেন। শিল্প বিপ্লবের ফলে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল তার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবার জন্যই ফিলজফিক্যাল র্যাডিক্যালরা বিশেষ ভাবে তৎপর ছিলেন। যদিও এরা সমগ্র সমাজের স্বার্থের কথা সােচ্চারে প্রচার করে গেছেন। সামাজিক কল্যাণ সম্পর্কে এদের কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রতি অপরিসীম আকর্ষণ এদের সম্পর্কে অনেককে সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছিল। সরকার সম্পর্কে পূর্বতন উদারনীতিবাদীগণের ধারণা সম্পূর্ণ নেতিবাচক, বিশেষ করে সমাজের বৃহৎ অংশ যখন মনে করত যে সরকারের উচিত অধিক পরিমাণে রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করা। কারণ শিল্প বিপ্লব সমাজের সম্পদ বৃদ্ধি ঘটালেও যে সমস্ত সমস্যা তৈরী করেছিল সেগুলির সমাধান শিল্প মালিক ও সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত ছিল। স্যাবাইনের মন্তব্যের উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গ শেষ করা যেতে পারে। “রাজনৈতিক বিবর্তনের দীর্ঘ দৃষ্টিভঙ্গিতে দার্শনিক আমূল সংস্কারবাদ (Philosophical Radicalism) উন্নয়নের দিকে নিজেকে প্রক্ষেপণ করার পরিবর্তে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাষায়।” (G. H. Sabine, A History of Political Theory, P. 699)।
সংশোধিত বা আধুনিকীকৃত উদারনীতিবাদের জন্ম
ফিলজফিক্যালদের (বেন্থাম ও জেমস মিল) হাতে যে উদারনীতিবাদের জন্ম নিয়েছিল উনিশ শতকের শেষ পাদে এসে দেখা গেল তা বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। শিল্পের সম্প্রসারণ বল্গাহীনভাবে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সম্পদের সুষম বণ্টন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। বরং এ দুটির অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল যে সাধারণ মানুষ ও কট্টর উদারনীতিবাদিগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। ১৮৪১ সালে ব্রিটেনের কয়লাখনি শিল্পে শ্রমিকদের অবস্থা অনুসন্ধানের নিমিত্ত একটি কমিশন গঠিত হয়। অনুসন্ধানের ফল সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তােলে। কয়লাখনিতে শিশু ও মহিলাদের ব্যাপক হারে কাজে লাগানাে হত অপেক্ষাকৃত অল্প মজুরিতে। মালিকরা নিষ্ঠুরভাবে শােষণ চালাত। কাজের সময়ের কোন হিসেব ছিল না। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ মালিক পক্ষ অনুভব করে নি। শিল্প বিপ্লব জাত সম্পদের দুর্গের দরজা তত্ত্বগতভাবে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে খোলা থাকলেও বাস্তবে বুর্জোয়া শ্রেণীর অপ্রতিহত প্রাধান্য হেতু সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারে নি। এই প্রসঙ্গে আমরা সি. বি. ম্যাকফার্সন-এর মন্তব্য উল্লেখ করতে পারি। তিনি বলেছেন, “শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা এতটাই অমানবিক হয়ে উঠছিল যে সংবেদনশীল উদারপন্থীরা এটাকে নৈতিকভাবে যৌক্তিক বা অর্থনৈতিকভাবে অনিবার্য বলে মেনে নিতে পারেনি।” (The Life and Times of Liberal Democracy, p. 44)। উনিশ শতকের শ্রমিক শ্রেণীর দুরবস্থার চিত্র এঙ্গেলস আরও সুন্দরভাবে এঁকে গেছেন। উনিশ শতকের এগােবার সাথে সাথে উদারপন্থী চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে থাকে। কট্টর উদারনীতিবাদীরা পর্যন্ত রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার কথা স্বীকার করেন। এমন কি কেউ কেউ বলতে আরম্ভ করেন যে পারম্পরীয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পরিত্যক্ত হয়েছে এবং সেই শুন্যস্থানে এসেছে আধুনিকীকৃত (modernized) বা সংশােধিত উদারনীতিবাদ। আবার কেউ কেউ বলেন সমষ্টিবাদ।
কিভাবে এল?
শিল্প বিপ্লবের পরে ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা আস্তে আস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেলে। রাজনীতি এদের হাতে পুতুলে পরিণত হয়। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যায় যে সমাজ থেকে, বুর্জোয়া শ্রেণী যেন ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দুরবস্থার জন্য রাজনীতি সচেতন মানুষের একটা অংশ বুর্জোয়া শ্রেণীকে দায়ী করছে। স্বার্থের প্রয়ােজনে বুজোয়া শ্রেণী সমাজের সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। যে উদারনীতিবাদ এবং আইন চলে আসছিল বুর্জোয়ারা তাদের সংশােধন সাধনে তৎপর হয়ে উঠল। বুর্জোয়ারা তাদের সমর্থিত রাজনীতিক দলের উদ্দেশ্য ও তাত্ত্বিক কাঠামাে পরিবর্তনের কথা ভাবল। (“ফলশ্রুতিতে উদারনীতিবাদকে যদি তার জনগণকে হারাতে না হয়, তাহলে তাকে তার আইনকে সংশোধন করতে হবে, এবং প্রকৃতপক্ষে উদারনীতিবাদ এটাই করেছে। একটি দল হিসেবে এটিকে তার নীতি সংশোধন করতে হয়, কিন্তু সেই সাথে সামাজিক চিন্তার একটি উপাদান হিসেবে তার অবস্থানকে বজায় রাখার জন্যেও এটিকে তার তত্ত্বকে সংশোধন করতে হয়।” – G. H. Sabine, A History of Political Theory, p. 704)
উদারনীতিবাদের পরিবর্তন সাধন করতে হলে রাষ্ট্রতত্ত্ব আইন ও সর্বোপরি রাষ্ট্রের কাজকর্ম এবং উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কে ধ্যানধারণা বদলে ফেলা দরকার। বুর্জোয়ারা ভাবল জনমানসে বুর্জোয়া শ্রেণী সপর্কে একটি উচ্চমানের চিন্তা তৈরী করে দিতে হবে। জনগণকে দেখাতে হবে বুর্জোয়া শ্রেণী এমন একটি রাষ্ট্রতত্ত্বের সমর্থক ও প্রচারক যার উদ্দেশ্য সমাজের সার্বিক কল্যাণ বিধান করা। সাবাইন লিখেছেন, “উদারনৈতিক তত্ত্বের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ সংশোধনের জন্য রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও কার্যাবলী, স্বাধীনতার প্রকৃতি এবং স্বাধীনতা ও আইনি চাপের মধ্যে সম্পর্ক পুনরায় পরীক্ষা করা প্রয়োজন।” সমাজের পরিবেশ বদলে যাওয়ায় গােটা উদারনীতিবাদটার পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়ল। ব্যক্তির সঙ্গে পারিপারিক অবস্থার সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন দেখা দিল। অতীতে বেন্থাম ও জেমস মিল আনন্দ বর্ধন, যন্ত্রণা বর্জন ও উপযােগিতাকে অবলম্বন করে যে রাষ্ট্রতত্ত্ব তৈরী করে গিয়েছিলেন তার সংশােধন আশু বলে দেখা দিল। সমাজের একটা উল্লেখযােগ্য অংশ ভাবতে শুরু করল, যন্ত্রণা, আনন্দ ও উপযােগিতা রাষ্ট্রনীতির একমাত্র উপাদান বলে বিবেচিত হতে পারে না। এই দর্শন চিন্তার যাঁরা প্রবর্তক ও প্রচারক তারাও ধীরে ধীরে জনগণের শ্রদ্ধা হারাতে লাগলেন।
সংশোধনের দ্বিমুখী ধারা
স্যাবাইন মনে করেন উদারনীতিবাদের সংশােধন বা আধুনিকীকরণ দুটি ধারা বেয়ে অগ্রসর হয়। একটি ধারার নেতৃত্ব দেন জন স্টুয়ার্ট মিল ও হার্বাট স্পেন্সার। অন্য ধারার নেতৃত্ব দেন টমাস হিল গ্রীণ ও অন্যান্য অক্সফোর্ড ভাববাদিগণ। তবে উদারনীতিবাদের সংশােধন ব্যাপারে টমাস হিল গ্রীণ-এর অবদান সবচেয়ে বেশি। পণ্ডিতগণ মনে করেন পারিপারিক পরিস্থিতি এমন অবস্থায় উপস্থিত হয়েছিল যে মিল ও স্পেন্সার উদারনীতিবাদের সংশােধনের প্রয়ােজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করেন। তবে এই দুইজন উদারপন্থীর বৌদ্ধিক প্রকাশ সম্পূর্ণরূপে একরকম নয়। স্পেন্সার জৈবিক বিবর্তন ও সমাজ দর্শনের পরিবর্তনের মধ্যে সামঞ্জস্য আনার কথা বলেন। প্রাকৃত বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানের সম্পর্কের বিষয়টিও স্পেন্সার উল্লেখ করেছেন। উপযােগবাদের সংশােধন করে মিল উদারনীতিবাদের মধ্যে পরিবর্তন আনেন। যেটুকু সংশােধন বাকি ছিল অক্সফোর্ড ভাববাদীরা বিশেষ করে গ্রীন এসে তা সম্পূর্ণ করেন। যে অভিজ্ঞতামূলক ঐতিহ্য ইঙ্গ-মার্কিন দার্শনিকরা তৈরী করেছিলেন তার অবসান ঘটে গ্রীনের হাতে।
জন স্টুয়ার্ট মিল : প্রেক্ষাপট, জীবনী ও রচনা
ভূমিকা
প্রেক্ষাপট
মিলের দর্শনের গুরুত্ব ছিল সিস্টেম থেকে তার প্রস্থান যা তার সংশোধনগুলো সহ এখনও সমর্থিত হয়, যা উপযোগবাদী ঐতিহ্যের নির্মাণ করেছে। – Sabine
প্রত্যেক দার্শনিক বা চিন্তকের চিন্তাধারার উপর সমকালীন ঘটনাবলীর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় এবং জন স্টুয়ার্ট মিল এদিক থেকে আদৌ ব্যতিক্রম নন। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার উপর শিল্প বিপ্লব ও শিল্পবাদ (industrialism) যে সমস্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল সেগুলির সুস্পষ্ট ছাপ আমরা মিল-এর রচনায় দেখতে পাই। বেন্থাম ও জেমস মিল শিল্প বিপ্লব জাত সমস্যাগুলি সম্পর্কে অবহিত থাকলেও এদের স্বরূপ নির্ধারণ বা সংজ্ঞার্থ নির্ণয় কোনটাই যথার্থভাবে সম্পন্ন করতে পারেন নি। এমন কি বেন্থাম প্রদত্ত হিতবাদ সমস্যা সমাধানে সক্ষম ছিলেন না। অ্যাডাম স্মিথ ঘােষিত অবাধ বাণিজ্য নীতি ও পুর্ণাঙ্গ প্রতিযােগিতা রাষ্ট্রব্যবস্থার আর্থনীতিক রােগ শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান দুর্দশা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে যে ব্যর্থ তা প্রমাণ করেছিল। সরকার কর্তৃক আরােপিত বিধিনিষেধের প্রয়ােজনীয়তা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে। এই কারণে উদারপন্থী চিন্তাধারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে উপেক্ষা করে সমষ্টিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু সমষ্টিবাদও ত্রুটিমুক্ত ছিল না। জেমস মিল ও বেন্থাম সর্বজনীন ভােটাধিকারের কথা বলেন এবং ভােটাধিকারের পরিধি সংস্কারের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। অত্যল্পকাল পরে দেখা গেল সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য সংখ্যালঘিষ্ঠকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। স্বাধীনতা প্রয়ােজন। তাই বলে কতৃত্বের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। মানবতাবাদের বিজয় নিশান সবার আগে তুলে ধরতে হবে। কিন্তু শিল্পবিকাশের গতিকে মন্থর করে দিলে চলবে না। কর্তৃত্ব ও ব্যক্তি স্বাধীনতা উভয়ের মধ্যে সফল সাযুজ্য বিধান একান্ত প্রয়ােজন। কারণ কোনটাকে অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি, এই জটিল ঘূর্ণাবর্তে জন স্টুয়ার্ট মিল আবির্ভূত হন।
জীবন ও পরিবার
১৮০৬ সালে জন স্টুয়ার্ট মিল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জেমস মিল ছিলেন হিতবাদী বেন্থাম-এর গোঁড়া শিষ্য। পুত্রলাভে তিনি যত না উৎফুল্ল হয়েছিলেন। তার চেয়ে বেশি উৎফুল্ল হয়েছিলেন এই ভেবে যে পুত্রকে তিনি নিজ ভাবধারা ও মতাদর্শে গড়ে তুলবেন এবং এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি একেবারে ছােটবেলা থেকেই পুত্রকে নানা বিষয়ে শিক্ষাদান করতে থাকেন। তাছাড়া জেমস মিল পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন যে মস্তিষ্কের মধ্যে কতরকম সংবাদ ঠেসে ঢুকিয়ে দেয়া যায়। তিন বছর বয়সে মিল গ্রীক ভাষা শেখেন ও সাত বছর বয়সে লাতিন ভাষাও আয়ত্ত করে ফেলেন। এই বয়সে তিনি প্লেটোর দর্শনচিন্তার সঙ্গে পরিচিত হন। আট বছর বয়সে তিনি গ্রীক ও লাতিন সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বয়েস যখন তের তখন অ্যাডাম স্মিথ ও রিকার্ডোর রাজনীতিক অর্থবিদ্যায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। অঙ্কশাস্ত্র, রসায়ন বিদ্যা ও অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি পরিচিত হন এবং আস্তে আস্তে এই সমস্ত বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে থাকেন। এগার বছর বয়সে জেমস মিল-এর ব্রিটিশ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া সকলনে সাহায্য করেন। ষোল বছর বয়সে আনুষ্ঠানিক পড়াশােনার পাট চুকিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে যােগ দেন। ১৮৫৬ সালে তিনি কেম্পানীর মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিকের পদে উন্নীত হন। কিন্তু কোম্পানীর সঙ্গে মতবিরােধ হয় ১৮৫৮ সালে পদত্যাগ করেন। ১৮৬৫ সালে ওয়েস্টমিনিস্টারের ভােটারগণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তাকে অনুরােধ করেন এবং তিনি রাজি হন। নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর ধারণা হ’ল যে প্রার্থী অর্থ ব্যয় ও প্রচার কোনটাই করবেন না। অল্প ব্যবধানে তিনি জয়ী হন। তিন বছর পরে ১৮৬৮ সালে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ১৮৭৩ সালে মিল পরলােকগমন করেন। ছােটবেলায় কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে জীবন অতিবাহিত হয়েছিল বলে তিনি মনের সুকুমারবৃত্তিগুলােকে বিকশিত করার সুযোগ পাননি। হেরিয়েট টেলর নামী বিদুষী মহিলাকে তিনি বিয়ে করেন।
মিলের রচনা
ইট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর চাকরী থেকে ইস্তফা দেবার আগে মিল Logic ও Principles of Political Economy নামে দু’খানা বই প্রকাশ করেন। মিল-এর রাষ্ট্রদর্শনের ব্যাখ্যাকারগণ এই দুইখানি বইকে তাঁর চিন্তাধারার প্রকৃত প্রতিফলন বলে মনে করেন না। জেমস মিল-এর প্রভাবে থাকার দরুন তাঁর চিন্তাধারা স্বাধীনভাবে বিকশিত হবার কোন সুযােগ পায় নি। পলিটিক্যাল ইকনমির পরবর্তী সংস্করণগুলিতে দেখা গেছে যে তিনি বেন্থামীয় অবাধ বাণিজ্য নীতি থেকে দুরে সরে এসেছেন। শেষ জীবনে তিনি সমাজবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। পলিটিক্যাল ইকনমি ছাড়া তিনি Utilitarianism, Autobio graphy, Liberty and Representative Government ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে তাঁর বৌদ্ধিক উৎসাহ কোন একটিমাত্র বিষয়ের উপর নিবম ছিল না। তাঁর Logic দর্শনশাস্ট্রের একটি প্রধান গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। আত্মজীবনী বইখানা পড়লে তার মনের অবস্থা ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। লিবার্টি ও রিপ্রেজেনটেটিভ গভর্ণমেন্ট বই দুখানা রাজনীতি বিষয়ক এবং আজও এরা অনবদ্য। আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন যে শিল্প সমাজে নাগরিকের স্বাধীনতার স্বরূপ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে তিনি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। ইবেনস্টাইন বলেন (পঃ ৫৩১), মিল-এর অন লিবাটি গ্রন্থখানি মিল্টন-এর Areopagitica গ্রহের সমমর্যাদাসম্পন্ন। ইংরেজী ও অন্যান্য ভাষায় এই গ্রহের সমতুল্য কোন গ্রন্থ আজ পর্যন্ত রচিত হয় নি বলে ইবেনষ্টাইন মনে করেন। মিল মনে করতেন স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটে স্বায়ত্তশাসনের আবির্ভাবের ফলে। মিল-এর অন লিবার্টি, রিপ্রেজেনটেটিভ, গভরমেন্ট ও অটোবায়ােগ্রাফিকে বিচ্ছিন্ন বলে ভাবা ঠিক নয়। এরা তাঁর সময় রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে জড়িত।
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সম্পর্কে মিল
স্বাধীনতা ও স্বৈরতন্ত্রের প্রকারভেদ
রিপ্রেজেনটেটিভ গভর্নমেন্ট বইতে মিল নাগরিকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করেছেন। অন লিবার্টি বই এর প্রধান বক্তব্য বিষয় হল শিল্প সমাজের নাগরিকের স্বাধীনতা কেমনভাবে সংকটের মধ্যে পড়ে এবং কিভাবে তার স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষিত করা যায়। মিল বলেছেন যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার বিকাশলাভের ফলে নাগরিক সরকারের স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে নিজেকে অনেকখানি রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু অন্য এক প্রকার সঙ্কট তাকে গ্রাস করতে উদ্যত। সমাজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে পড়ে নাগরিকের স্বাধীনতা সকটাপন্ন। সমাজের নানাপ্রকার বিধিনিষেধ ও নিয়মকানুন নাগরিকের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে এবং নিষ্কৃতি পাবার কোন উপায় থাকে না। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত সংখ্যালঘিষ্ঠকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে চলতে হয় এবং মিল ওকে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র নাম দিয়েছেন। অন লিবার্টি গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে আন্দোলন, প্রতিবাদ বা অন্য কোন গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারী স্বৈরতন্ত্রের বিরােধিতা করা সহজ হলেও সামাজিক স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করা সহজ নয়। সমাজিক বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করে এবং দৃষ্টিভঙ্গি মানসিকতা ও চরিত্রের উপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে ব্যক্তিত্বের স্বচ্ছন্দ বিকাশকে ব্যাহত করে তােলে। অনতিবিলম্বে ব্যক্তি ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে যায়। সামাজিক আচার নিষ্ঠাকে জে. এস. মিল পীড়নমুলক বলেছেন। মিল-এর আমলে সামাজিক নিষ্ঠা এত বেশি এবং এদের প্রতিক্রিয়া এত প্রবল ছিল যে তিনি এগুলিকে সামাজিক স্বৈরতন্ত্র বলতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যক্তিকে পুরাে স্বাধীনতা দিতে হলে এগুলোর অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণের শিথিলীভবন অপরিহার্য।
মিলের মতে স্বাধীনতা কী?
১৮৫৯ সালে মিল-এর অন লিবার্টি নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই বইতে স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে এবং অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিচারবিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেছেন যে স্বাধীনতাকে কেবল সুখানসন ও যন্ত্রণা এড়াবার একটা কৌশল বলে মনে করা অযৌক্তিক। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সম্প্রসারণের জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। ব্যক্তিসত্তাকে সমৃদ্ধশালী করতেও স্বাধীনতা বিশেষভাবে সাহায্য করে বলে মিল মনে করতেন। ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধন না হলে সমাজের কল্যাণে অথবা তার নিজের সুখ ও সমৃদ্ধির সুনিশ্চিতকরণে সে কোন প্রকার সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারবে না। অতএব স্বাধীনতাকে মিল একদিকে যেমন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রী দৃষ্টিতে দেখছেন তেমনি সমাজের সার্বিক কল্যাণের কথাটাও বিচারবিবেচনার মধ্যে এনেছেন। সমালােচকগণ মনে করেন যে জে. এস. মিল স্বাধীনতা তত্ত্বটি ব্যাখ্যাকালে গ্রীক দর্শনের কথা মনে রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে গ্রীক দর্শনের সারকথা হ’ল ব্যক্তিত্বের পুর্ণাঙ্গ বিকাশ। প্রখ্যাত সমালােচক ইবেনষ্টাইন-এর মন্তব্যে আমরা পাই – “স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে, মিলের মনে একটি বিস্তৃত লক্ষ্য ছিল, যা হচ্ছে আত্মউন্নয়নের গ্রীক আদর্শ। প্রত্যেক মানুষেরই তার অভিজ্ঞতাগুলোকে নিজের মত ব্যাখ্যা করার ও ব্যবহার করার সুবিধা রয়েছে, আর তার এই বিকল্পসমূহের মধ্য থেকে নির্বাচন করার মধ্য দিয়েই তার নীতি-নৈতিকতা গঠিত হয়।” (P. 533)। সমাজের ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করে সিদ্ধান্ত টানতে হলে এবং নানা বিকল্পের ভেতর থেকে একটাকে বেছে নিতে হলে স্বাধীনতা অপরিহার্য। প্রথা, আচারব্যবহার ও রীতিনীতি যদি ব্যক্তির আচরণকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রাখে তাহলে সে কোন ব্যাপারে সঠিক মত প্রকাশ করতে পারবে না।
সামাজিক সমরূপতা এবং মিল
শিল্প বিপ্লবের পরে ব্রিটেনে একটি শিল্প সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যার আসল রূপ হল সমস্ত বিষয়ে সমরূপতা (uniformity)। কুটীর শিল্প থেকে বৃহদায়তন শিল্পব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটার ফলে শিল্পক্ষেত্রে সমরূপতা দেখা দিল এবং সমাজের সকল স্তরে এর ব্যাপ্তি ঘটল। এই সমরূপতা মিল-এর মনকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে এই কারণে যে প্রতিটি নাগরিক একইভাবে আচরণ করে, একই বিষয় পড়ে, একই কথা শােনে ও একইভাবে মতপ্রকাশ করে। মিল মনে করতেন যে এই চরম সমরূপতা ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থী। কিন্তু শিল্প বিপ্লব যে সমাজ তৈরী করেছে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে স্বাধীনতা সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করা এবং এর পুনর্মূল্যায়ন বিশেষভাবে প্রয়ােজন।
মতের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
চিন্তা ও বিচারবুধি অনুযায়ী মত পােষণ করা ও সেই মত বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে জনগণের মধ্যে প্রচার করার সর্বাধিক স্বাধীনতার পক্ষে মিল মতপ্রকাশ করে গেছেন। অন লিবাটি গ্রন্থে মিল বলেছেন যে বিজ্ঞান নীতিবিদ্যা বা ধর্মবোধ সম্পর্কে যে কোন প্রকার মত মনের মধ্যে পােষণ ও জনসমক্ষে প্রচার করার চরম স্বাধীনতা নাগরিককে দেয়া একান্ত প্রয়ােজন। ব্যক্তিত্ব বিকাশের পক্ষে অনুকূল যে কোন আচরণ করার স্বাধীনতা ব্যক্তি পাবে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবার স্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। যে সমাজে এই স্বাধীনতাগুলি যথাযথ মর্যাদা ও বিকাশের সুযােগ পায় না সেই সমাজকে তিনি স্বাধীন সমাজ বলেন নি। সরকার যতই ভাল বা দক্ষ হােক না কেন চরম ও শর্তহীন স্বাধীনতা না থাকলে তাকে স্বাধীন সমাজ বলা উচিত নয়। উপরিউক্ত স্বাধীনতাগলোর চরম রূপ মিল দেখতে চেয়েছিলেন। এই স্বাধীনতার উপর বিশেষ তাৎপর্য আরােপ করে মিল স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণাটিকে অত্যন্ত উন্নতমানের ও কালজয়ী করে গেছেন। ম্যাক্সে বলেন মিল-এর এই ধারণা তাকে মিল্টন, স্পিনোজা, ভলতেয়ার, রুশাে, পাইন ও জেফার্সন প্রমুখের পর্যায়ভুক্ত করেছে।
মিল নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা চান নি
মিল যেভাবে শর্তহীন ও চরম স্বাধীনতার পক্ষে জোর ওকালতি করে গেছেন তার থেকে মনে হতে পারে যে তিনি নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা চাইতেন। কিন্তু তার রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাখ্যাকারগণ বলেন যে এ ব্যাপারে তিনি কিছু পরিমাণ স্ববিরােধের শিকার হয়েছিলেন। তিনি নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা চান নি। সকলের প্রয়োজনে সমাজ স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে। কোন ব্যক্তির আচরণ বা কাজকর্ম যদি অন্যের অনিষ্ট সাধনে উদ্যত হয় তাহলে সমাজের কর্তৃত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত তারা ক্ষতিসাধনকারী ব্যক্তির আচরণ ন্যায়সঙ্গতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মিল বলেছেন—”মানুষকে একক বা দলগতভাবে কেবল একটা ক্ষেত্রেই তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে, তা হল আত্ম-রক্ষা। এটাই একটি মাত্র উদ্দেশ্য যার জন্য একটি সভ্য সম্প্রদায়ে ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ন্যায্যভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে, তা হল তাকে অন্যদেরকে ক্ষতি করতে দেয়া যাবে না।” মিল বলতে চেয়েছেন, যে কোন সভ্য সমাজের প্রধান লক্ষ্য হ’ল এর নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং এটি একজন বা একাধিক নাগরিকের আচরণের ফলে বিঘ্নিত হলে রাষ্ট্র সেক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গতভাবে হস্তক্ষেপ করবে। একজন ব্যক্তির কল্যাণ যথেষ্ট নয়। তার এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তিনি নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা চান নি। আমরা মিলকে একজন বাস্তববাদী বলেই জানি। চরম বাধীনতা যে সমাজের পক্ষে আদৌ কাম্য নয় তা তার বুঝতে বাকি ছিল না। যে কোন ব্যক্তিকে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের কথা ভাবতে হবে আর তা ভাবতে গিয়ে নিজের স্বাধীনতা যদি কিছু পরিমাণে ক্ষয় হয় তাহলে ব্যক্তিকে সেই ক্ষতি স্বীকার করতেই হবে। এইখানে মিল-এর স্বাধীনতা তত্ত্ব কট্টর উদারপন্থীদের স্বাধীনতা তত্ত্ব থেকে আলাদা। মিল সমাজকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ও সুখানুসন্ধানে ব্যাপৃত ব্যক্তিগণের সমন্বয় বলে মনে করেন নি।
সর্বত্র বিধিনিষেধ আরোপ চলবে না
বিধিনিষেধ আরােপ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকলেও সেই ক্ষমতা রাষ্ট্র যথেষ্টজাত প্রয়ােগ করতে পারবে না। আগেই বলা হয়েছে যে চিন্তা করা, মত প্রকাশ করা বা জোটবদ্ধ হবার স্বাধীনতা থেকে রাষ্ট্র নাগরিককে বঞ্চিত করতে পারে না। ধর্মাচরণের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর মিলকে সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করতে দেখা যায়। তার বিশ্লেষণের এক জায়গায় আমরা পা – “যদি একজন ছাড়া অন্য সকল মানুষের মত এক হয়, আর কেবল আরেকজন তাদের বিরোধী মত পোষণ করে, সেক্ষেত্রে সেই মানুষকে অন্যান্য সব মানুষেরা নিশ্চুপ করিয়ে দিতে পারে না, তা ন্যায্য নয়। যদি তাই হয় তাহলে সেই একজন যদি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তাহলে তিনি নিজের বিপরীত মতের জন্য সমস্ত মানব জাতিকেই নিশ্চুপ করিয়ে দিতে পারেন।” সমগ্র মানবজাতির মতের বিরােধিতা করার অধিকার একজন নাগরিকের আছে এবং রাষ্ট্র সেই অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারে না। এই চরম মত পােষণ করার কারণ উল্লেখ করতে মিল ভােললন নি। এমন হতে পারে যে মতকে খর্ব করা হ’ল সেই মত ঠিক এবং মানবজাতি একটা সঠিক মত থেকে বঞ্চিত থেকে গেল। মিল অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন যে নানাপ্রকার মতের অবাধ সহাবস্থান থেকে আসল সত্যটি উঘাটিত হয়। এই কারণে মিল কোন মতের সঙ্কোচনের বিরদ্ধে মত প্রকাশ করে গেছেন। আত্মসম্পর্কীয় কাজে বা আচরণে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনুচিত মিল-এর এই ধারণা মিল-উত্তর রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক ধ্রুপদী ধারণার মর্যাদা লাভ করে। কেন তিনি স্বাধীনতার উপর নিষেধ আরােপের বিরােধী ছিলেন সেটি অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে সত্য বলে আমরা যাকে ঘােষণা করি তা চূড়ান্ত, শাশ্বত ও মিশ্রিত নয়। আজ যা সত্য বলে কথিত আগামী দিনে তা মিথ্যায় পর্যবসিত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সত্যের দোহাই দিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করাকে মিল একেবারে মেনে নিতে পারেন নি। সত্যের সন্ধান করতে গেলে এক সীমাহীন পথ পরিক্রমা করতে হয়। এইজন্য যে কোন সভ্য সমাজে অবাধ তর্কের অবকাশ থাকা একান্ত প্রয়ােজন।
অন্যান্য স্বাধীনতা সম্পর্কে মিল
বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে মিল যত বেশি সচেতন ছিলেন অন্য নানা প্রকার স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি তত বেশি সচেতন ছিলেন না। অন্যান্য স্বাধীনতা সম্পর্কে আমরা তাকে অনেক বেশি বিধাগ্রস্ত ও অস্পষ্ট হতে দেখি। যেমন জুয়াখেলা, মদ্যপান করে মাতলামি করা ও যৌন অপরাধে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে নাগরিক স্বাধীনতা ভােগ করবে কিনা তা তিনি নিশ্চিত করে বলে যান নি। তিনি বলেছেন যে নাগরিকের এই সমস্ত কাজ পুলিশ যদি নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে সেটা ঠিক হবে না। পরক্ষণেই তিনি বলেছেন যে এগুলির অশুভ প্রতিক্রিয়া সমাজের উপর পড়লে পুলিশ প্রতিরােধ করবে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মিল নাগরিকের স্বাধীনতা-উদ্ভূত কাজকর্মকে গতানুগতিকভাবে আত্মসম্পর্কিত ও পরসম্পর্কিত ভাগে ভাগ করে একটা সমাধান সূত্র বের করতে চেয়েছেন যা শেষ পর্যন্ত কোন সমাধান বলে সমালােচকগণ কর্তৃক বিবেচিত হয় নি।
মিল ও গণতন্ত্র
মিল ছিলেন গণতন্ত্রের একজন একনিষ্ঠ পুজারী। তার রিপ্রেজেনটেটিভ গভর্ণমেন্ট বইখানা এ ব্যাপারে এক অনবদ্য সৃষ্টি। পূর্বতন উদারনীতিবাদের সংশােধনের স্রোতের বিপরীত দিকে তিনি যাত্রা করতে চান নি। শিল্প বিপ্লব জাত সমস্যাবলীর সমাধানকল্পে যে সমস্ত সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল তার মধ্যে ভােটাধিকারের সংশােধন অন্যতম। মিল অত্যন্ত জোরের সঙ্গে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, নারীর ভােটাধিকার ইত্যাদির কথা বলেন। গণতন্ত্র বলতে তিনি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বােঝাতে চেয়েছেন। তবে এই গণতন্ত্রকে সফল করে তুলতে ও ব্যক্তিত্ব স্ফুরণের পক্ষে সহায়ক করতে হলে সংস্কার প্রয়ােজন এবং তাই তিনি নারীর ভােটাধিকারের কথা বলেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রকে ত্রুটিমুক্ত করতে হলে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করা দরকার। গণতন্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ ও রাজনীতি সচেতন নয় এমন মানুষের হাতে সরকার গড়ে তােলার দায়িত্ব অর্পণ করলে তা কখনও কল্যাণজনক হতে পারে না। আইনসভা দেশ শাসন করবে। কিন্তু সদস্যরা যাতে যথাযথ যােগ্য হয় সে দিকে নজর দেওয়া প্রয়ােজন এবং তা করতে হলে ভােটদাতারা অবশ্যই যােগ্য হবে। মিল প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের নানা দিক নিয়ে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা দেখলে বােঝা যায় যে তিনি গণতন্ত্র সম্পর্কে বিশেষভারে উৎসাহী ছিলেন এবং এর উন্নতিবিধানের জন্য গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতেন। এর বিপদ সম্পর্কেও তিনি অবহিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত ও রাজনীতি অসচেতন। এই অজ্ঞতার সুযোেগ নিয়ে তাদেরকে শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত করলে অবিচার করা হবে। জোর করে সাধারণ মানুষকে প্রশাসন থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে তারা ক্ৰমশ নিরৎসাহী হয়ে পড়বে। গণতন্ত্রের জন্য এবং এর স্বার্থে তাদেরকে উপযােগী করে ভােলাই হবে সরকারের প্রধান কাজ। মিল আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন যাতে স্বৈরাচারে পরিণত না হয় সে দিকে আমাদের সবাইকে নজর দিতে হবে। এই প্রবণতা রােধ করার জন্য মিল দুটি রাজনীতিক দল ছাড়া একটি তৃতীয় রাজনীতিক দল গড়ার পরামর্শ দিয়েছেন যে দল দুটি প্রধান দলকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেবে। তিনি আরও বলেছেন গণতন্ত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠ সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত হলে গণতন্ত্র শ্রীবৃদ্ধিশালী হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারিতা আর দেখা দেবে না।
সরকার ও রাষ্ট্র সম্পর্কে জে. এস. মিল
প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকে মিল সবচেয়ে বেশি কাম্য সরকার বললেও ভাল সরকারের উপাদান ও গুণ সম্পর্কে তিনি আলােচনা করেছেন। জনসাধারণ যদি বুদ্ধিমান ও গুণসম্পন্ন হয় তাহলে সরকার ভাল হবে। সরকারের কাজ হল জনগণের মধ্যে সদাচার, নীতি ও আদর্শববাধ জাগিয়ে ভােলা। অসৎ ও নীতিবর্জিত জনগণ কখনও ভাল সরকার তৈরী করতে পারে না। আবার ভাল সরকার নীতিবােধ ও আদর্শ থেকে লোক সমাজকে বঞ্চিত করতে পারে না। মিল-এর ভাল সরকারের বর্ণনা প্লেটো ও অ্যারিস্টটল-এর আদর্শ রাষ্ট্রের সমরূপ না হলেও বলা যেতে পারে দুই গ্রীক দার্শনিক জনগণের সদাচার, নীতি ও আদর্শবােধের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং এই গুণগুলি উদ্দীপনের ব্যাপারে সরকারের যে একটি ইতিবাচক ভূমিকা আছে তাও তারা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলে গেছেন। এই প্রসঙ্গ শেষ করার আগে আমরা বলতে পারি যে মিল-এর নিকট গণতন্ত্র ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার সমার্থক এবং নানাবিধ উপায়ে এই সরকারের ত্রুটিগুলি দূর করে ফেললে এটি ভাল সরকারে পরিণত হবে। মিল গণতন্ত্রের বিকল্প কিছু ভাবেন নি।
বহুমুখী প্রতিভা
মিল-এর প্রতিভা বহুমখী। তার Autobiography-এর ভূমিকায় ল্যাস্কি লিখেছেন, “মিল সিস্টেমকে রচনা করেন নি। তিনি তার পিতা বা বেন্থামের মত না হয়ে বরং খুব দ্রুত সিস্টেমের চাহিদার মেটাতে সেই অনুযায়ী নতুন ধারণাগুলো প্রদান করেছিলেন।” এই কারণে তার রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে সব সময় সঙ্গতি দেখতে পাওয়া যায় না। দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের কোন শাখাই তার আলোচনা থেকে বাদ পড়ে নি। Cambridge History of English Literature বলে যে এক প্রজন্মের অধিককাল ধরে সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার প্রভাব ছিল অপরিসীম।
ত্রুটি
মিল আদৌ সমালােচনার উধে নন। স্বাধীনতা সম্পর্কে তার চিন্তাধারা কেউ মেনে নিতে পারেন নি। তিনি এ ব্যাপারে ছিলেন চরমপন্থী। সমগ্র মানবজাতির বিরুদ্ধে নিজের মতকে জয়ী করতে চাওয়ার ব্যাপারে কোন বাস্তব বুদ্ধি নেই বলে সমালােচকগণ মনে করেন। অধিকার সম্পর্কে তার কোন সুসংহত ধারণা ছিল না। সমগ্র সমাজ সম্পর্কে মিল কোন স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতেন বলে মনে হয় না। বার্কার বলেছেন—”মিল ছিলেন ফাঁকা স্বাধীনতার দেবদূত এবং একজন বিমূর্ত ব্যক্তি। তার অধিকারের কোন সুস্পষ্ট দর্শন ছিল না যার মাধ্যমে স্বাধীনতার ধারণা একটি সুদৃঢ় অর্থ লাভ করে। সমগ্র সমাজ সম্পর্কে তার কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না।” জীবনের শেষ দিকে মিল সমাজবাদী চিন্তাধারা পােষণ করতেন। কিন্তু এটিকে তিনি পূর্ণাঙ্গ রুপ দিতে পারেন নি। ফলে তার কাছে সমাজ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে পরিণত হয়েছে।
মিল ও উপযোগবাদ
পরিবর্তনের সূচনা
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে জেমস মিল জন স্টুয়ার্ট মিলকে ছােটবেলা থেকেই একজন বিশ্বজোড়া পণ্ডিত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য তিনি জনকে শিশুকাল থেকেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। এর ফলে জন স্টুয়ার্ট মিল এর স্বাধীন চিন্তাধারা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হতে বসেছিল। পরিবর্তনের সুচনা তিনি তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন যে জেমস মিল-এর প্রভাবে পড়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। ১৮৩৬ সালে জেমস মিল মারা যাবার পর তিনি সব কিছু নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন। মানসিক সঙ্কটের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলেরিজ পড়ে। তার জীবনে কার্লাইল এর লেখার প্রভাব কিছ পড়েছিল (বার্কি, পৃঃ ১৮২)। ১৮৩৮ ও ১৮৪০ সালে মিল London and Westminister Review-তে কয়েকটা প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ জেমস মিল-এর প্রভাব থেকে মুক্ত হবার সূচনা করে। সুতরাং যদিও জন স্টুয়ার্ট মিল বেন্থাম ও জেমস মিল-এর ঐতিহ্যের মধ্যে গড়ে উঠেছিলেন তবুও শেষ পর্যন্ত তিনি স্বাধীন ভাবে তার মতবাদ প্রচার করেন। চিন্তাধারার স্বাধীনতা আমরা তার উপযােগবাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। মিল-এর উপযােগবাদ বেন্থাম ও জেমস মিল থেকে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র না হলেও বহু ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে।
মিল বেন্থামের উপযোগবাদ গ্রহণ করেছিলেন
জন স্টুয়ার্ট মিল বেন্থামের উপযােগরাদ, আপাতঃদৃষ্টিতে পুরােমাত্রায় গ্রহণ করেছিলেন (সাবাইন, পৃঃ ৭০৭ )। বিশেষ করে তার সর্বাধিক সুখতত্ত্বকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। উপযােগবাদ গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে, উপযােগ বা সর্বাধিক সুখতত্ত্ব অনুযায়ী যে কাজ সুখ উৎপাদনে সক্ষম তাকে সঠিক কাজ বলে মনে করা হয়। তিনি আরও বলেছেন যে সুখের অপর নাম আনন্দ, অথবা যন্ত্রণার অনুপস্থিতি। বেন্থাম-এর মত মিল মনে করতেন যে সুখানুসন্ধান করা এবং একে এক বা একাধিক স্তরে উন্নীত করা ব্যক্তিমাত্রের লক্ষ্য। সবাই যদি নিজ নিজ কল্যাণে রত থাকে, তাহলে তার মাধ্যমে সমাজের সর্বাধিক মঙ্গল সাধিত হতে পারে।
মিল বেন্থামকে পুরোপুরি মেনে নেননি
মিল-এর সঙ্গে বেন্থাম-এর সাদৃশ্য থাকলেও পার্থক্য যথেষ্ট ছিল। বেন্থাম আনন্দের কোন শ্রেণীবিভাগ করেন নি। তিনি পুশপিন ও কবিতাকে একই পর্যায়ে ফেলেছিলেন যদি উভয় থেকে আনন্দ পাওয়া যায়। মিল বেন্থাম-এর এই মত মেনে নিতে পারেন নি। মিল-এর হাতে আমরা বিভিন্ন প্রকার আনন্দের শ্রেণীবিভাগ দেখতে পাই। কোন জিনিসের বেশি, কোন জিনিসের কম আনন্দ দেবার ক্ষমতা আছে। আবার কোন আনন্দ স্থায়ী, কোনটা অস্থায়ী হতে পারে। অর্থাৎ, স্থায়িত্বের বিচারে সব আনন্দ সমান হবে এমন কোন কথা নেই। মিল নিজেই স্বীকার করেছেন যে মানুষ কোন কোন সুখকে বেশি পরিমাণে পেতে চায়। আবার কোন কোন আনন্দকে অধিকতর মুল্যবান বলে মনে করে। (এটা স্বীকার করা উপযোগিতার নীতির সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে যে, কোন কোন রকম সুখ অন্যগুলোর থেকে অধিক পরিমাণে আকাঙ্খিত।) (মিলের ইউটিলিটারিয়ানিজম)।
নানাপ্রকার আনন্দ কেবল গুণগত দিক থেকে পৃথক তা নয়, পরিমাণের বিচারে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় এক্ষেত্রেও মিল নিজেকে বেন্থাম-এর তত্ত্ব থেকে সরিয়ে এনেছেন। বিভিন্ন বস্তু বা কম বা আচরণ থেকে সমান অনন্দ পাওয়া যায় না বলে মিল মনে করতেন। তিনি বলেছেন যে শুকর হয়ে আনন্দ লাভ করার চেয়ে মানুষ হয়ে নিরানন্দ লাভ করা অনেক শ্রেয়। বোকার আনন্দ এবং সক্রেটিস-এর নিরানন্দ দুটো কখনও এক জিনিস নয়। সক্রেটিস-এর পর্যায়ে উঠে নিরানন্দ হয়ে থাকা অনেক বেশি কাম্য। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মিল সমস্ত প্রকার আনন্দকে এক পর্যায়ে ফেলেন নি। আবার অনেক নিরানন্দ আনন্দের চেয়ে অধিক কাম্য। সমস্ত জিনিসের সমান আনন্দ দেবার ক্ষমতা নেই। এইভাবে মিল বেন্থামের হিতবাদ বা উপযােগবাদের সংশােধন করেছেন। বেন্থাম সব আনন্দকে সমান করতে চেয়েছিলেন। স্যাবাইন বলেছেন যে সেটা একটা vulgar nonsense ছাড়া কিছু নয়। মিল বরং উপযােগবাদকে নতুন আঙ্গিকে বিচার করে তাকে বাস্তবানুগ করে তুলেছেন। কিন্তু একে আনন্দবাদ বা প্রেমােবাদ (hedonism) বলা চলে না।
মানুষ কেবল নিজের সুখ চায় না
বেন্থাম বলেছেন যে মানুষ যন্ত্রণার হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে আনন্দ পেতে চায়। এবং এর পরিমাণ বাড়িয়ে তােলার দিকে ব্যক্তির আগ্রহ সর্বদা সক্রিয় অবস্থায় থাকে। বেন্থাম-এর ব্যক্তি নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে নিজের সুখ অর্জনে ব্যস্ত থাকে। অর্থাৎ, সে আত্মকেন্দ্রিক। নিজের সুখটা পুরাে মাত্রায় অর্জিত হয়ে গেলে সমাজের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে ব্যক্তি মনে করে। মানুষ আত্মসুখে ব্যস্ত ও অহংবাদী (egoist) মিল তা মেনে নিতে পারেন নি। একথা সত্য যে প্রতিটি ব্যক্তি নিজের সুখ চায়। কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য যে অন্যের সুখ বা সুবিধাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে নিজের সুখ কব্জার মধ্যে আনতে আগ্রহী নয়। মিল মনে করতেন যে কিছু কিছু মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা থাকলেও সবার তা নেই এবং এইজন্য সমাজে জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম হচ্ছে। মােট কথা, মিল মানুষকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসুখে বিভাের বলে ভাবেন নি। ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিকতাকে তিনি যেমন অস্বীকার করেন নি তেমনি তার পরার্থপরতাকে স্বীকার করেছেন।
উপযোগের ভিত্তি নৈতিকতা
বেন্থামের সঙ্গে মিল-এর অন্য এক জায়গায় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বেন্থাম উপযােগকে রাজনীতির চত্বরে উপস্থিত করেছিলেন। একটুকরাে আইন গ্রহণযােগ্য হবে কি হবে না তা পুরাে নির্ভর করে সেই আইনের উপযােগিতা কতটুকু। উপযােগহীন আইনের গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে কোনরকম গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। মিল বেন্থাম-এর এই মতবাদ গ্রহণ করেন নি। মিল-এর কাছে উপযােগের ভিত্তি হল নৈতিকতা। মানুষ নিজের সুখ বা কল্যাণ আদৌ চায় না একথা মিল একবারও বলেন নি। নিজের সুখের পাশাপাশি সে অন্যের কল্যাণও চায়। মিল-এর কাছে এটাই হ’ল নৈতিকতা। নীতিবােধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে ব্যক্তি কাজ করে। নিছক জড়বাদী সুখ বা আনন্দের মােহে মানুষ সব সময় পরিচালিত হয় না। অর্থাৎ, মিল বলতে চেয়েছেন যে মানুষের নৈতিকতা বােধ সক্রিয় ভাবে কাজ করে। নীতি ও আদর্শ বােধের বিচারে সে গ্রহণ ও বর্জন পদ্ধতি অবলম্বন করে। সুখ প্রদানের ক্ষমতা বা অক্ষমতা তার কাছে একমাত্র বিচার্য বিষয় নয়। উপযযাগিতার বিচারে কোন আইনের গ্রহণযােগ্যতা তার কাছে নাও থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে সে আইনের প্রতি আনুগত্য দেখাবে না তা হতে পারে না। ব্যক্তি যদি দেখে যে একই আইন থেকে অন্যান্য ব্যক্তিরা উপযােগ পেতে পারে তাহলে সে আইন মেনে চলবে।
মিলের উপযোগ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নয়
উপরিউক্ত আলােচনা থেকে অন্য এক সিদ্ধান্ত অতি সহজে টানা যেতে পারে। মিল-এর উপযােগবাদ বা হিতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নয়। মিল উপযােগ তত্ত্বকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গণ্ডী থেকে বের করে নিয়ে সমাজের বহৎ পরিমণ্ডলের মধ্যে উপস্থাপিত করেছেন। মিল-এর হাতে ব্যক্তি অনেকখানি পরার্থপর হয়ে গিয়েছে। নিজ কল্যাণের চেয়ে সে অন্যের কল্যাণ অধিকতর উৎসাহ সহকারে বিচারবিবেচনা করে। মিল যদিও রাষ্ট্রের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতী তবুও সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের প্রয়োজনে রাষ্ট্র ব্যক্তির কাজকর্ম ও অর্থ বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। বার্কার যথার্থই বলেছেন- “তার হাতে উপযোগিতাবাদ কম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হতে শুরু করে, এবং আরো বেশি করে একটি সমাজতান্ত্রিক গুণ গ্রহণ করে। সামাজিক উপযোগিতাই এখানে লক্ষ্য। এজন্য তিনি মনে করেন, এর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা ব্যক্তির সর্বোচ্চ কর্তব্য হতে পারে। সম্পদের বন্টন নিয়ন্ত্রণের বৃহৎ দায়িত্ব রাষ্ট্রকে হস্তান্তর করা আবশ্যক হতে পারে।” (Barker-Political Thought in England, p. 12)।
বেন্থামের সমন্বয়-সাধন মিল গ্রহণ করেন নি
বেন্থাম স্বীকার করেছিলেন যে ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সমাজের স্বার্থের বিরােধ থাকা খুবই স্বাভাবিক। উভয় প্রকার স্বার্থের মধ্যে বিরােধ যাতে দেখা দিতে না পারে তার জন্য বেন্থাম উপযােগের অনুমােদন বা মঞ্জরি (sanctions of utility) পদ্ধতির প্রস্তাব করেছিলেন। বেন্থামের মতে কোন উপযােগের পেছনে যদি ধমীয়, রাজনীতিক ও নৈতিক অনুমােদন থাকে তাহলে সেই উপযােগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মিল বলেছেন যে ধর্মীয়, নৈতিক বা রাজনীতিক অনুমােদন কেবল বাহ্যিক, সহজাত নয়। মানুষ যদি স্বেচ্ছায় বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজের কল্যাণ না করতে চায়, তাকে জোর করে বা ধর্মের দোহাই দিয়ে কল্যাণজনক কাজ করানো যায় না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে মিল মানুষের নৈতিকতা ও যুক্তিবাদিতায় বিশেষভাবে আস্থাশীল ছিলেন। মানুষের যুক্তিবাদিতাকে বেন্থাম অস্বীকার না করলেও বাহ্যিক অনুমােদন বা মঞ্জুরিকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন এই কারণে যে ব্যক্তির সহজাত যুক্তিবাদিতা সব সময় কার্যকর নাও হতে পারে।
মিল নৈতিক রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন
বেন্থাম ও বেন্থামপন্থীরা সেই রাষ্ট্র ও সমাজকে সুখী সমাজ ও সুখী রাষ্ট্র বলে মনে করতেন যে সমাজ বা রাষ্ট্র সর্বাধিক সংখ্যক জনগণের সর্বাধিক কল্যাণসাধন করতে পারে। সুখের মাপকাঠি হ’ল উপকার পাওয়া। রাষ্ট্র যদি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যক্তির উপকার করতে সক্ষম হয়, তখন সেই রাষ্ট্রকে নিশ্চয় সুখী রাষ্ট্র বলা যাবে। মিল বেন্থামের এই বক্তব্য মেনে নিতে পারেন নি। তিনি সুখী রাষ্ট্রের কথা না বলে নৈতিক রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। ব্যক্তি স্ব-মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে ও পর্যাপ্ত স্বাধীনতা পেলেই সুখী হতে পারবে। নিছক সুবিধা বা অসুবিধা দিয়ে তার আনন্দ বা সুখ বিচার করতে যাওয়া ঠিক নয়। নীতিজ্ঞান সম্পন্ন স্বাধীন নাগরিককে নিয়েই নৈতিক সমাজ। ব্যক্তি সব সময় পার্থিব সুখের আশায় টৈটুম্বুর নাও থাকওে পারে। মিল তার On Liberty বই-এর এক জায়গায় বলেছেন যে ব্যক্তির মানসিক ও নৈতিক সমন্নয়নের মধ্যেই রাষ্ট্রের উৎকর্ষ নিহিত আছে।
সরকারের লক্ষ্য ব্যক্তির উন্নতিসাধন
বেন্থাম মনে করতেন একমাত্র উদারনীতিক সরকার ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ উপযােগ ও সুবিধা তৈরী করতে পারে। সুতরাং সেদিক থেকে এই সরকার যােগ্য ও দক্ষ। মিল বলেছেন যে সরকারের দক্ষতা বা অদক্ষতা উপযােগ সৃষ্টির দ্বারা বিচার করতে যাওয়া ঠিক নয়। ব্যক্তিত্বের পরিস্ফুটন যাতে সম্ভব হয় সেদিকে নজর দেওয়াই সরকারের প্রধান কাজ। মিল মনে করতেন এ ব্যাপারে একমাত্র উদারনীতিক সরকারে তা সম্ভব। চিন্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তিত্ব বিকাশের অন্যতম উপাদান। এগুলাে উদারনীতিক সরকারে পাওয়া সম্ভব। সেইজন্য প্রগতি ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। “দক্ষতার কারণেই একটি জনপ্রিয় সরকারকে তিনি সমর্থন করেননি। এটি সবসময় দক্ষ থাকে সেই বিষয়ে তার গভীর সন্দেহ ছিল আর উদারপন্থী সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রসমূহ সবসময় উপকারের পথে যৌক্তিকভাবে ব্যবহৃত হবে… এটি উচ্চ মানের নৈতিক চরিত্র তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করবে… এই বিষয়ে তার পিতার যে আস্থা ছিল তিনি তা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিলেন।” (Sabine, p. 709)।
মিল কি উপযোগবাদী ছিলেন?
হার্মন প্রশ্ন তুলেছেন – মিলের স্বাধীনতা সম্পর্কিত যুক্তিগুলো আসলেই উপযোগবাদী কিনা। হার্মন বলেছেন যে মিল অন্তত তাই দাবি করেন। আবার আর্নেস্ট বার্কার বলেছেন- “তাকে অবশ্যই মহান উপযোগবাদীদের মধ্যে সর্বশেষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে”। (Barker-Political Thought in England, p. 70)। উপযােগ তত্ত্বকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তিনি বেন্থামের উপযোগবাদকে এমনভাবে সংশোধন করেছেন যে বেন্থামীয় উপযােগবাদ থেকে অনেকখানি সরে গিয়েছে। যেমন বেন্থাম উপযােগকে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের একমাত্র কারণ হিসেবে বলেছেন। কিন্তু জন স্টুয়ার্ট মিল উপযোগের চেয়ে নৈতিকতাকে আনুগত্যের উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বেন্থামের উপযােগ ও মিলের নৈতিকতা এক জিনিস নয়। বেন্থামের মতে সর্বাধিক উপযােগ আদায় করে নেওয়া নাগরিকের চরম লক্ষ্য। মিল-এর নিকট মর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন নাগরিক হওয়া ব্যক্তির লক্ষ্য। ওয়েপার বলেন (পঃ ১১১) এটা হ’ল উপযােগবাদের অস্বীকৃতি। ওয়েপার আরও বলেন যে মিল মনে করতেন যে তিনি বেন্থামের উপযােগবাদের পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে উপযােগবাদকে সমর্থন করেছেন। আসলে মিল-এর হাতে উপযােগবাদ ধংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। মিল রাষ্ট্রের নেতিবাচক দিকটার উপর বিশেষ নজর দেন নি। “মিল বেন্থামবাদে যা যা পরিবর্তন সাধন করেছিলেন তা দেখে মিলের মনে হতে পারে যে তিনি উপযোগবাদকে সমর্থন করছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি একে ধ্বংস করছিলেন… তবে তার একটা পরিবর্তন বেন্থামবাদের থেকেও অধিক পরিমাণে উপযোগবাদী ছিল। তার রচনায় রাষ্ট্রের নেতিবাচক চরিত্র ব্যাপকভাবে অন্তর্হিত হয়েছে।” (Wayper, p. 116)। মিল মনে করতেন রাষ্ট্রের উপযােগিতা বিচার করা হবে রাষ্ট্র ব্যক্তিকে কতখানি নীতিজ্ঞানসম্পন্ন করতে পেরেছে। এটাকে যদি উপযােগবাদ বলা যেতে পারে, মিল নিশ্চয় উপযােগবাদী।
উপসংহার
প্রশ্ন হতে পারে কেন মিল বেন্থাম কর্তৃক বিশ্লেষিত ও প্রচারিত উপযােগবাদ পুরােপরি মেনে নেন নি। ম্যাক্সে মনে করেন, বেন্থাম ও জেমস মিল যে বৌদ্ধিক ধারা ও ঐতিহ্য তৈরী করে গিয়েছিলেন তাকে তিনি ভালবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তার মন ছিল উন্মুক্ত। চারপাশের সমাজ ও তার হাল হকিকত দেখে তিনি স্থির করেছিলেন যে বেন্থামের উপযােগবাদ চলমান সমাজের সমস্যা সমাধানে সক্ষম নয়। তাই তিনি এর সংশােধনে ব্রতী হয়েছিলেন।
মিল কি সমাজবাদী ছিলেন?
সমাজবাদী বলা হয়
মিলকে কেন আদর্শ হিতবাদী বলা যায় না তার অন্যতম কারণ হ’ল তার সমাজবাদী চিন্তাধারা। মিল বলেছেন যে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বুদ্ধিগত ও শক্তিগত পার্থক্য আছে। সুতরাং সকলে সমানভাবে সুখ বা আনন্দ পেতে পারে না। মােট আনন্দের পরিমাণের মধ্যে পার্থক্য থেকেই যাবে। এই পার্থক্য নিয়ে ব্যক্তি যাত্রা শুরু করলে শেষ পর্যন্ত সেটা আর কোনদিন বিলুপ্ত হবে না। তিনি মনে করতেন এই বৈষম্যমূলক পরিবেশের অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। মিল যে সমাধানের কথা বলেছেন তা সাম্প্রতিক সমালােচকরা সমাজবাদ বলতে চেয়েছেন। (উদাহরণস্বরুপ আমরা ওয়েপার ও বার্কির নাম উল্লেখ করতে পারি।)
সম্পদের পুঞ্জীভবন
মিল আক্ষেপের সুরে বলেছেন (Political Economy বইতে) জমি, শিল্প প্রভৃতি সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির হস্তে পুঞ্জীভূত। সমাজের বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ এর থেকে কোন উপকার পাচ্ছে না। অথবা যা পাচ্ছে তা তাদের প্রয়ােজনের তুলনায় নগণ্য। সমাজকে এই অবিচারের হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য তিনি সমাজবাদের উপর বিশেষভাবে সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে যে সমস্ত বাধা আছে রাষ্ট্র তা দূর করুক এটাই মিলের কাম্য ছিল। বেন্থাম সম্পত্তিকে পবিত্র বলে মনে করতেন। মিল তা স্বীকার করেন নি। সম্পত্তি বা জমির পুঞ্জীভবন মিলের কাছে অন্যায় বলে মনে হয়েছে। সমাজবাদীদের মত মিল শিক্ষাকে গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত বলে মনে করতেন। তাই তিনি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে জোর ওকালতি করে গেছেন। শিশু শ্রমিক ব্যবস্থার অবলুপ্তির জন্য মিল আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন।
মিল এর পরিকল্পনা
আত্মজীবনীতে (Autobiography, 1873) মিল সমাজবাদের কতকগুলাে মূল নীতির উল্লেখ করেছেন। বার্কি একে নিয়ন্ত্রিত বা সীমাবদ্ধ সমাজবাদ (qualified socialism) বলেছেন। আত্মজীবনীতে মিলকে তার স্ত্রীর দেখা যায়। মিল দম্পত্তি কল্পনা করেছেন যে ভবিষ্যতে এমন একটা সময় আসবে যখন সমাজে অলস বলতে কেউ থাকবে না। সমস্ত কাঁচামালের অভিন্ন মালিকানার সঙ্গে আসবে ব্যক্তিস্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ। সমাজের যাবতীয় সযােগসুবিধার অংশীদার হবে সবাই। এর বাস্তব রূপায়ণের জন্য শ্রমিক ও মালিক উভয়ের মনের পরিবর্তন আবশ্যক। তবে মনে হয় না এই পরিবর্তন অতি সত্বর আসবে—এই ছিল মিল দম্পত্তির আশঙ্কা। মিল-এর সমাজবাদী বক্তব্য ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় যে রাষ্ট্রকে আরও উপযােগী করে তােলার জন্য তিনি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে বক্তব্য পেশ করেছেন। বেন্থাম বুর্জোয়া মানসিকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন নি। সুখদুঃখের হিসেবনিকেশ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তি করবে। সবার পক্ষে সম্ভব নয়। মিল রাষ্ট্রকে সবার পক্ষে উপযােগী করে তােলার কথা বলেছেন।
মিলের রাষ্ট্রচিন্তার মুল্যায়ন
নতুন উদারনীতিবাদের প্রবক্তা
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বেন্থামের উপযােগতত্ত্ব শিল্পােন্নত ব্রিটেনের যাবতীয় রাজনীতিক চাহিদা মেটাতে পারে নি। শিল্পােন্নয়নের ফলে সম্পদ বৃদ্ধি ঘটলেও সেই অনুপাতে শ্রমিক শ্রেণীর আর্থিক উন্নতি হয় নি। এছাড়া শ্রমিক এবং সমাজের অন্যান্য স্বল্পবিত্ত মানুষের নানারকম অসুবিধা বাড়তে থাকায় উদারনীতিক রাষ্ট্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিরা নতুন রাজনীতিক তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। নতুন তত্ত্ব জন্ম নিল এবং সাবাইন একে আধুনিকীকৃত উদারনীতিবাদ (modernized liberalism) বলে অভিহিত করেছেন। জন স্টুয়ার্ট মিল এই আধুনিকীকৃত উদারনীতিবাদের প্রবক্তা। জেমস মিল মনে করেছিলেন যে প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার সংস্কার সাধন হলে, ভােটাধিকারকে ব্যাপক করলে ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে রাজনীতিক স্বাধীনতার বহু জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ১৮৫৯ সালে জন স্টুয়ার্ট মিল দেখতে পেলেন সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে বহু রকম সংস্কার কার্যকর করার পরেও রাজনীতিক সংগঠনের গণ্ডীর মধ্যে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয় নি। স্যাবাইন বলেছেন’— “মিল তাই চিহ্নিত করেছিলেন যাকে পুরনো উদারনীতিবাদ কখনও দেখেনি, আর সেটা ছিল একটি উদার সরকারের পেছনে অবশ্যই উদার সমাজ থাকতে হবে।” (Sabine, p. 710)।
একটি পরিশীলিত মন
বার্কার বলেছেন মিল ছিলেন… “ঊনিশ শতকের সবচেয়ে সূক্ষ্ম চিন্তাবিদ ও সবচেয়ে উদারমনা লোকেদের মধ্যে একজন।” (Barker-Political Thought in England, p. 3)। মিল স্বাধীনতাকে বাহ্যিক আচরণের জগৎ থেকে আধ্যাত্মিক জগতে নিয়ে গেছেন। তার মতে স্বাধীনতার কাজ হ’ল নৈতিকতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ। মিল মানুষকে কেবল একটি পরিশীলিত সুখানুসন্ধানে রত একটা যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করেন নি। তার কতকগুলাে নীতি, আদর্শ ও অধ্যাত্মচিন্তা আছে। স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের নিমিত্ত সে রাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে তুলেছে ও তার সদস্যপদ নিয়েছে। মিল বেন্থামের গণতন্ত্রকে আধ্যাত্মিকতার আবরণে আবৃত করেছেন। প্রতিনিধিত্বমুলক সরকার স্বার্থরক্ষার একটা নিছক যন্ত্র নয়। মন ও আত্মার উন্নতি বিধানের একটা উপায়ও বটে। সুখ সুনিশ্চিতকরণে সাফল্যের মধ্যে মিল গণতান্ত্রিক সরকারের কৃতিত্ব দেখতে পান না। ব্যক্তিত্ব ও নৈতিকতা বিকাশেই এর কৃতিত্ব এবং দক্ষতা। তিনি মনে করতেন গণতান্ত্রিক সরকারে মন ও আত্মার সম্যক উন্নতি সহজ। এখানেই আমরা মিল-এর একটা পরিশীলিত, মনের সুন্দর পরিচয় লাভ করি। বেন্থামের মত মিল ব্যক্তিকে এতখানি স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক বলে ভাবেন নি।
সমসাময়িক নীতির উপর মিলের প্রভাব
মিল-এর রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে বেশ অসঙ্গতি দেখা যায়। কিন্তু এই অসঙ্গতি সত্ত্বেও সমসাময়িক নীতির উপর তার প্রভাব অনস্বীকার্য। জনৈক সমালােচক বলেছেন, “তিনি তার নিজের সময়ের দেবদূত ছিলেন।” (Bowle-Politics and the Opinion in the 19th century, p. 196)। প্রতিনিধি ব্যবস্থার আইনকানুন ও পদ্ধতি বিষয়ে তিনি যে সমস্ত প্রস্তাব দিয়েছিলেন তদানীন্তন সরকার সেগুলো বাস্তবে কার্যকর করতে আগ্রহী ছিল। শিক্ষা সম্পর্কে মিল-এর মতামত ব্রিটিশ সরকার বহুলাংশে মেনে নিয়েছিল। তার রাষ্ট্রদর্শনের জনৈক ব্যাখ্যাকার বলেছেন— “তিনি যে উদারনৈতিক শিক্ষার মূল্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা শিক্ষার আধুনিক পদ্ধতিতে স্বীকৃতি লাভ করে।” (Sobhanlal Mookerjea, p. 263)। সমালােচকরা বলেন একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি সমকালীন রাষ্ট্রের কাজকর্মকে প্রভাবিত করেছিলেন।
মিলের মানবতাবোধ ছিল
মিল বাধীনতা, উপযােগবাদ বা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের কেবল একজন প্রবক্তা ছিলেন না বেন্থামের উপযােগতত্ত্ব অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ, নীরস ও বৌদ্ধিক (scholastic, frigid and intellectual) হলেও এর মানবতা বােধ ছিল না। অপর পক্ষে মিলের উপযােগবাদ মানবতা বােধে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। উপযােগবাদকে তিনি অনুভূতি দিয়ে বিচার করেছেন। ব্যক্তির চিন্তা, ভাবাবেগ ও অনুভূতির প্রতি তার দৃষ্টি ছিল। এগুলাে তিনি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করতেন। বাস্তব বর্জিত চিন্তার স্থান মিলের মধ্যে নেই (বার্কি, পৃঃ ১৮৬)।
মিল উত্তর দর্শনচিন্তার উপর প্রভাব
পরবর্তীকালের দর্শনচিন্তার উপর মিলের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। ইংরেজী দর্শনশাস্ত্রে (English Philosophy) মিল একটা বিশেষ উল্লেখযােগ্য নাম। বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর দর্শনশাস্ত্রের ব্যাখ্যা মিলকে বাদ দিয়ে করা যায় না। আবার ঊনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর কয়েক দশকের রাষ্ট্রদর্শনের ধারা তার রাষ্ট্রদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। Representative Government এবং On Liberty বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পাঠ্য বইএর মর্যাদা লাভ করেছে। আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে মিল-এর লেখা বই পড়ে থাকেন। ফেবীয় সমাজবাদের মূল বক্তব্য মিলের রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় বলে সমালােচকরা বলেন। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ব্যক্তিদের উপর তার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। “নিঃসন্দেহভাবেই মিলের প্রত্যক্ষ উত্তরসুরীদেরকে মডারেট সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের মধ্যে পাওয়া যাবে, বিশেষ করে তার চিন্তাধারা ব্রিটেইনের ফেবিয়ান সমাজের সাথে সম্পর্কিত; পরবর্তিতে ফেবিয়ান সমাজের বিশ্বাস ও নীতিসমূহকে যে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে আরও বিকশিত করা হয় তার মূল নিহিত ছিল মিলের সমাজবাদেই।” (Berki, p. 187)।
মিল এবং কল্যাণরাষ্ট্র
অনেকে বলেন আধুনিক কালের কল্যাণ-রাষ্ট্রের ধারণা মিলের রাষ্ট্রদর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। সমাজের সার্বিক এবং দ্রুত বিকাশের জন্য জনসংখ্যা সীমিত করার প্রয়ােজনীয়তা মিল উপলব্ধি করেছিলেন। রাষ্ট্রের উচিত জন্মশাসন পদ্ধতি (birth control measures) প্রয়ােগ করা। সমবায় সমিতি গঠন, জনকল্যাণের নিমিত্ত সরকারী হস্তক্ষেপ প্রভৃতির কথা আমরা মিলের মধ্যে পাই। এগুলাে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সমাজবাদ ও পুঁজিবাদ উভয়ের দোষ সম্পর্কে মিল অবহিত ছিলেন বলে কোনটাকেই তিনি চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে পারেন নি। উভয় মতবাদের সুবিধাগুলাে নিয়ে তিনি সামাজিক-পুঁজিবাদ (socio-capitalism) গঠন করতে চেয়েছিলেন। কল্যাণ-রাষ্ট্র সামাজিক পুঁজিবাদের বহনীতি গ্রহণ করেছে। “আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো সামাজিক পুঁজিবাদের একরকম পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছে যাকে মিশ্র অর্থনীতি (mixed economy) বলা হয়।” (Sobhanlal Mookerjea, p. 268)।
তথ্যসূত্র
- রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবৃত্ত, প্রাণগোবিন্দ দাস, নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, জুলাই ২০১৩, পৃ. ৩৮২-৪২১
- Political Thought: From Plato to the Present, Harmon, M. Judd, McGraw Hill (January 1, 1964)
- Political philosophies, Chester C Maxey, The Macmillan Company (January 1, 1938)
- A history of political theory, George Holland Sabine, Holt, Rinehart and Winston; 3rd edition (January 1, 1961)
- Political thought, C. L. Wayper, English Universities Press, Ltd.; 1st Edition. (January 1, 1954)
- Great Political Thinkers: From Plato to the Present, Alan O. Ebenstein
Leave a Reply