১৬শ শতকের মূল্য বিপ্লব – জনসংখ্যা-বাণিজ্য বিনিময় ও ব্যাঙ্কিং

১৬শ শতকের মূল্য বিপ্লব

ষোড়শ শতকে ইউরােপের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটহল মূল্য বিপ্লব (Price revolution)। এই শতকে খাদ্যশস্যের চাহিদা বেড়েছিল, সেই সঙ্গে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছিল প্রায় ছয় গুণ। অন্যান্য ভােগ্যপণ্যের দাম বেড়েছিল, তবে খাদ্য-শস্যের মতাে উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি। ইউরােপের সর্বত্র খাজনা বেড়েছিল, বাণিজ্য শুল্ক বেড়েছিল, সেই সঙ্গে ফাটকাবাজিও বেড়েছিল। সর্বত্র জমির দাম বেড়েছিল, সেই সঙ্গে জমির বাজার গড়ে উঠেছিল। সব দেশে কম বেশি গ্রামীণ মধ্যবিত্তের আবির্ভাব ঘটেছিল। ভূস্বামীরা জমির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির লিজ দিতে শুরু করেন, ভূমি-রাজস্ব আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ রাজস্বদাতার সঙ্গে চুক্তি হয় (farming of revenue), জমির লিজ নিয়ে ফাটকাবাজি শুরু হয়ে যায়। মূল্য বিপ্লবের ফলে পুঁজিপতিরা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে পুঁজি সরিয়ে নিয়ে জমিতে লগ্নি করেন। ইউরােপের সর্বত্র ব্যাঙ্কিং পরিবারগুলি যেমন ওয়েলসার ও ফুগার জমি বন্ধক রেখে ঋণ দিতে থাকে। বণিক, খনির মালিক, বস্ত্র উৎপাদক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমলা সকলে জমি কিনতে থাকে, ছােটো ছােটো বণিক ও কারিগরও জমির মূল্য বুঝেছিল, তারাও জমি কিনতে শুরু করে দেয়।

ইংলন্ডের গ্রামীণ জীবনের ওপর মূল্য বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল। ভূস্বামীরা বেশি খাজনা নিয়ে জমি বন্দোবস্ত করেন, জমি ঘিরে নিয়ে (enclosure) অনেক ভূস্বামী পশম ও মাংসের জন্য ভেড়ার চাষ শুরু করেন। এজন্য গ্রামের ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক কাজ হারিয়েছিল, গ্রামাঞ্চলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। গ্রামের তাঁতি, স্বর্ণবণিক, কসাই, চর্মকার সকলে জমি কিনতে চেয়েছিল। ইংলন্ডের গ্রামের জনগণ রাজা অষ্টম হেনরিকে জানিয়েছিল যে নিম্নবর্গের মানুষ জমি কিনতে থাকায় গ্রামীণ-শান্তি এবং গ্রামীণ-সমাজ বিপন্ন হতে চলেছে। ইংলন্ডে নানা কারণে মূল্য বিপ্লব ঘটেছিল। এলটন জানাচ্ছেন যে সব সময় সর্ব ইউরােপীয় কারণের জন্য মূল্য বিপ্লব ঘটেনি। স্থানীয় কারণে, অজন্মার দরুন এবং যােগাযােগ ও পরিবহণের অভাবে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেত। সমকালীন মানুষ মূল্যবৃদ্ধির জন্য বণিকদের দায়ী করেছিল।

ষােড়শ শতক হল ইউরােপে মূল্য বিপ্লবের যুগ। ১৫০০-১৬২০ খ্রি. মধ্যে এই মূল্য বিপ্লব ঘটেছিল। ১৫৬৮ খ্রি. ফরাসি দার্শনিক জাঁ বোদা (Bodin) মূল্য বিপ্লবের ব্যাখ্যা দেন। বোদার মতে, ষােড়শ শতকে ইউরােপে মূল্য বিপ্লবের কারণ হল অর্থনীতিতে টাকার যােগান বেড়েছিল, উৎপাদন না বাড়িয়ে যদি বাজারে টাকার যােগান বাড়ানাে হয় তাহলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। যােডশ শতকে স্পেন হল এই মূল্য বিপ্লবের কারণ। স্পেন দক্ষিণ আমেরিকা, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল (মেস্কিকো, পেরু, চিলি)। দক্ষিণ আমেরিকার রূপাে স্পেন ইউরােপে আমদানি করেছিল, স্পেন সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। আমেরিকার সােনা ও রূপাে ইউরােপের বাজারে এলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। পঞ্চদশ শতকের ভৌগােলিক আবিষ্কার এবং ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন ষােড়শ শতকের ইউরোপীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল।

বিশ শতকে ই. জে. হ্যামিলটন যােড়শ শতকের মূল্য বিপ্লব তত্ত্ব নিয়ে বিশদ আলােচনা করেছেন। হ্যামিলটন বোঁদার বাড়তি অর্থ সরবরাহ তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ সিপােলা (Cipolla) মূল্য বিপ্লব তত্ত্বটিকে অতিরঞ্জিত বলেছেন। তার মতে যােড়শ শতকের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাকে মূল্য বিপ্লব বলা আদৌ ঠিক নয়। খাদ্যশস্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১.৪ শতাংশ, আধুনিক মাপকাঠিতে একে কিছুতেই বিপ্লব বলা যায় না। অন্যান্য অর্থনীতিবিদরা বিষয়টি আলােচনা করে দেখিয়েছেন যে মূল্যবৃদ্ধির হার এত কম ছিল যে ষোড়শ শতকে মূল্য বিপ্লব হয়েছিল বলা সঙ্গত নয়। এরা দেখিয়েছেন যে ১৫৫০ খ্রি.থেকে ইউরােপে দক্ষিণ আমেরিকার সােনা ও রূপাে বেশি পরিমাণে প্রবেশ করতে থাকে, তার আগে মূল্যবান ধাতুর আমদানি বেশি ছিল না। এর উত্তরে হ্যামিলটন জানিয়েছেন যে পঞ্চদশ শতকে টাইরল, স্যাক্সনি ও বােহেমিয়াতে সােনা ও রূপাের উত্তোলন বেড়েছিল। দক্ষিণ আমেরিকার সােনা ও রূপাে ইউরােপের বাজারে আসার আগে এসব ধাতুর মজুদ ভাণ্ডার গড়ে উঠেছিল। মজুদকারীরা এসব দিয়ে ভােগ্য পণ্য কিনতে শুরু করলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল, দক্ষিণ আমেরিকার মূল্যবান ধাতু মূল্য বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল।

আধুনিককালে কেইন, ব্ৰদেল ও স্পুনার মনে করেন ষোড়শ শতকের আগেই মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল। কিছু লােকের হাতে অতিরিক্ত মুনাফা থেকে পুঁজি গড়ে উঠেছিল, জন নেফ (Nef) এই মতকে সমর্থন করেছেন। মূল্যবৃদ্ধির কারণ হল বিনিয়ােগের সুযোগ বেড়েছিল, সংগঠন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এসেছিল, সস্তা মজুর শােষণ করে পুঁজি গড়ে ওঠেনি। নেফ মনে করেন যে সস্তা মজুরি তত্ত্বটি অনেকটা অতিরঞ্জিত। আবেলের মতাে অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে বাড়তি অর্থের যােগান মূল্য বিপ্লবের আসল কারণ নয়, আসল কারণ হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্য ও ভােগ্য পণ্যের নতুন চাহিদা। যােড়শ শতকে ইউরােপের সব দেশে জনসংখ্যা বেড়েছিল, প্লেগ, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ ছিল না, মৃত্যু হার কমেছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রধানত মূল্য বিপ্লব ঘটেছিল।

সিপােলা জানাচ্ছেন যে দক্ষিণ আমেরিকার মূল্যবান ধাতু বাজারে এলে মূল্যবৃদ্ধির হার অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছিল, ঋণের সরবরাহ বেড়েছিল, ব্যাঙ্কিং কারবার ও লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছিল। পুঁজির সরবরাহ বজায় থাকায় সুদের হার কমেছিল। সিপােলা মনে করেন শিল্প বিপ্লবের আরও অনেক কারণ ছিল। পঞ্চদশ শতকে ইউরােপের রাজারা আর্থিক কারণে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাতেন, এভাবে তারা বাজেটের ঘাটতি মেটাতেন, আয়-ব্যয়ের সমতা আনতেন। ধাতুর অভাব দেখা দিলে তারা অবমূল্যায়ন ঘটাতে বাধ্য হতেন। মুদ্রা-নির্ভর অর্থনীতিতে এভাবে অবমূল্যায়ন ঘটানাের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিত। সরকার আমলাতন্ত্র ও সৈন্যবাহিনীর জন্য বেশি ব্যয় করতে বাধ্য হত। বুর্জোয়ারা মূল্যবৃদ্ধিতে আগ্রহী ছিল, অবমূল্যায়ন হলে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে, শিল্প ও বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি বেশি হলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাতে হত। সিপােলা মনে করেন এসব কারণের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার সােনা রূপাের যােগান এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি যুক্ত করলে মূল্য বিপ্লবের প্রকৃত চিত্রটি পাওয়া যায়।

মূল্য বিপ্লব ইউরােপে খাদ্যশস্য ও ভােগ্য পণ্যের দাম বাড়িয়েছিল, ইউরােপের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর এর গভীর প্রভাব পড়েছিল। মূল্য বিপ্লবের ফলে ভূস্বামীরা লাভবান হন, তাদের খাজনা বেড়েছিল, জমির দাম বেড়েছিল। কৃষির বাণিজ্যিকরণ শুরু হয়েছিল, লাভজনক অর্থকরী কৃষিজ পণ্য উৎপাদন (যেমন—পশম, তুলাে, শণ) বেড়েছিল। পুঁজিবাদী কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়, নিজের ভােগের জন্য নয়, বাজারের চাহিদার দিকে তাকিয়ে লাভের আশায় কৃষিজ পণ্য চাষ শুরু হয়েছিল। বুর্জোয়ারা এই বিপ্লবের ফলে লাভবান হয়েছিল, শিল্প ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে, শিল্প ও বাণিজ্য থেকে পুঁজি গড়ে উঠেছিল। মূল্য বিপ্লব হল শিল্প বিপ্লবের অগ্রদূত, পুঁজির যােগান বেড়েছিল, সুদের হার কমেছিল। মূল্য বিপ্লবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সরকারি কর্মচারী, সাধারণ মানুষ, কৃষক ও শ্রমিক। মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে কৃষক ও শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি, তাদের আয়ের এক বড় অংশ খাদ্যশস্যের জন্য ব্যয় হয়ে যেত। জমির খাজনা বাড়ার জন্য উৎপাদন ব্যয় বেড়েছিল। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অশান্তি ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, জমির চাহিদা থেকে অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিল।

মূল্য বিপ্লবের তাৎপর্য

ষােড়শ শতকের মূল্য বিপ্লবের দুটি দিক হল একশাে বছরে দ্রব্য মূল্য খুব বেড়েছিল (revolutionary rise in prices), আমেরিকা থেকে প্রচুর সােনা ও রূপা ইউরােপে এলে এই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল। ফার্নান্দ ব্ৰদেল ষোড়শ শতকের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যে বিখ্যাত ইতিহাস লিখেছেন তাতে তিনি এই মূল্য বিপ্লবের তীব্রতা ও স্থায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন (violence and length of this revolution)। জাঁ বোদা থেকে হ্যামিলটন সকলে এই মূল্য বিপ্লবের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই এই ধারণার পেছনে সত্য আছে, প্রশ্ন উঠেছে কতখানি সত্য আছে এই ধারণার পেছনে। পারেন্তি (Parenti) নির্মিত ফ্লোরেন্সের মূল্যসূচক এবং নিজের এবং আলিয়াতির (Aleati) লম্বার্ড তথ্য থেকে সিপােলা দেখিয়েছেন যে এই অঞ্চলে পঞ্চাশ বছরে (১৫৫২-১৬০০ খ্রি.) মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল ১০০ শতাংশ, বছরে ২ শতাংশ বৃদ্ধি মােটেই বেশি বলে গণ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় দিকটি হল মূল্যবৃদ্ধির হার।

সিপােলা মূল্যসূচকের যে সারণি তৈরি করেছেন তাতে দেখা যায় এই পঞ্চাশ বছরে শুধু মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি, মাঝে মাঝে পণ্যের দাম কমে গেছে। ১৫৫২-৬০ খ্রি.-এর মধ্যে ৫.২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, আবার (১৫৬০-৬৫ খ্রি.)-এর মধ্যে ১.২ শতাংশ মূল্য কমেছে। ঊনিশ শতকের ইংলন্ডে মূল্য স্তরের স্থিতিশীলতার সময়ে মূল্য সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। সিপােলা মনে করেন যে ষোড়শ শতকের মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ হল যখন মূল্য সূচক নামছে তখনাে জিনিসের দাম তেমন কমেনি (the rise in prices in the 16th century was due to the fact they did not fall during period of decrease.)। আসল কথা হল বৃদ্ধির সময়ে পণ্যের দাম বেড়ে যায় অনেকখানি, হ্রাসের সময় ধীর গতিতে মূল্যস্তর নামে, এজন্য এই পর্বের শেষে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে যায় অনেকখানি। এখানে আমেরিকার সােনা ও রূপাের ভূমিকা ছিল। মন্দার সময়ে তা পণ্যের দাম একটি সীমানার মধ্যে ধরে রেখেছিল, উন্নয়ন পর্বে এই বাড়তি অর্থের যােগান উৎসাহ প্রদানকারী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সােনা ও রূপাে কখনাে উৎসাহ দেয়, আবার কখনাে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেয়, বিনিয়ােগের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।

ইতালির অর্থনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সিপােলা আমেরিকার সােনা ও রূপার যােগানকে ইউরােপের মূল্যবৃদ্ধির একমাত্র কারণ হিসেবে মেনে নিতে চাননি। মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চ পর্বে (১৫৫২-৬০ খ্রি.) ইতালিতে আমেরিকার সােনা ও রূপাে বেশি আসেনি। ষােড়শ শতকের প্রথমার্ধের যুদ্ধ বিগ্রহ ইতালিকে বিধ্বস্ত করেছিল, ইতালির লােকেরা দেশের পুনর্গঠনের কাজে বিপুল অর্থ বিনিয়ােগ করেছিল, এর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। পুরনাে তত্ত্বের সংশােধন করে সিপােলা জানাচ্ছেন যে পুনর্গঠনের জন্য বিনিয়ােগ জিনিসের দাম বাড়িয়েছিল, আমেরিকার সােনা ও রূপাে এজন্য দায়ী ছিল না। ১৫৭০ খ্রি. থেকে ইতালিসহ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে স্পেনের অর্থ সরবরাহ বেড়েছিল, অথচ ঐ সময় থেকে পণ্যমূল্যের দাম কমেছিল। আমেরিকার সােনা ও রূপাে এই হ্রাসের প্রবণতা খানিকটা কমিয়েছিল, বন্ধ করতে পারেনি। সিপােলা জানিয়েছেন যে শুধু সােনার সরবরাহ দিয়ে মূল্য বিপ্লব তত্ত্ব পুরােপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না, মানুষের আকাঙ্খা, প্রয়ােজন, অগ্রাধিকার ইত্যাদির কথাও মনে রাখা দরকার।

জা বোঁদা, কান্টিলাে (Cantillon) ও অ্যাডাম স্মিথ মুদ্রা সরবরাহ তত্ত্ব (quantity theory of money) ব্যাখ্যা করেছেন। উৎপাদন না বাড়িয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ালে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। সিপােলা এই তত্ত্বকে আক্রমণ করেছেন, তার বক্তব্যের মধ্যে যুক্তি আছে। আলেকজান্ডার শেবার (Chabert) মনে করেন মুদ্রা সরবরাহ তত্ত্ব আজকের জটিল পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রয়ােগ করা সম্ভব না হলেও ষোড়শ শতকের ক্ষেত্রে তা সম্ভব। সিপােলা ইতালির অভিজ্ঞতার আলােকে সরবরাহ তত্ত্বকে নস্যাৎ করেছেন। মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল ৩-৫.২ শতাংশ, বৃদ্ধি পর্বের স্থায়িত্ব হল আট বছর (১৫৫২-৬০ খ্রি.)। একে মূল্য বিপ্লব বলা ঠিক নয়, জিনিসের মূল্য হ্রাসের প্রবণতা আমেরিকার সােনা থামিয়ে দিয়েছিল। সিপােলা ইতালির অর্থনৈতিক কাজকর্ম, পুনর্গঠন ইত্যাদিকে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন।

আলেকজান্ডার শেবার সিপােলার যুক্তির বিরােধিতা করেছেন, তার মতে, ৫ বা ৩ শতাংশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মােটেই কম নয়। উল্লেখ করা প্রয়ােজন এর পশ্চাতে ছিল মূল্যস্তরের ভয়ঙ্কর স্থিতিশীলতা (great stability), ষোড়শ শতকের গােড়ার দিকে এক ধরনের গতিহীনতা ছিল। এই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয়ভাগের মূল্যবৃদ্ধিকে ঐতিহাসিকরা মূল্য বিপ্লব বলেছেন। শেবার জানাচ্ছেন যে মূল্যবৃদ্ধি ছিল যথেষ্ট বড়াে ঘটনা, একে বাতিল করা যায় না, তুচ্ছ করা যায় না। ফ্রান্স ও স্পেনের সঙ্গে তুলনায় ইতালির ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি (১৫৫০-১৬০০ খ্রি.) অকিঞ্চিৎকর। মনে হলেও তা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রা সরবরাহ তত্ত্ব এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। স্পেন ফ্রান্স, হল্যান্ড ও ইংলন্ডের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে তার সম্পদ ছড়িয়ে দিয়েছিল, এই দেশগুলি বিশেষভাবে উপকৃত হয়। ইতালির আইবেরীয় উপদ্বীপের সঙ্গে তেমন বাণিজ্য ছিল না। ১৫৭০ খ্রি. থেকে ইতালিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছিল, এর বেশিরভাগ এসেছিল অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় থেকে। পরিসংখ্যানের অভাবে ইতালির মূল্যসূচকের হ্রাস-বৃদ্ধি ও সােনা-রূপাের বর্ধিত সরবরাহের প্রভাবের তুলনামূলক আলােচনা করা সম্ভব নয়। এনিয়ে এখনাে গবেষণা চলছে।

সিপােলা ইতালির অর্থনৈতিক কাজকর্মের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির কারণ লক্ষ্য করেছেন। মুদ্রা সরবরাহ তত্ত্বের একটি দিক হল উৎপাদন বাড়লে বাড়তি মুদ্রার সরবরাহ মূল্যস্তরের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ষােড়শ শতকে শুধু মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি, অর্থনেতিক কাজকর্ম বেড়েছিল, এই দুটি বিষয় হল পরস্পরের পরিপূরক। অনুন্নত অর্থনীতিতে বাড়তি অর্থের যােগান বাড়তি ক্রয় ক্ষমতা সৃষ্টি করে, অর্থনেতিক সম্প্রসারণের সহায়ক হয়। উৎপাদন ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হলে বাড়তি মুদ্রার সরবরাহ মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় না। অনুন্নত দেশে যেখানে উৎপাদন কম বা স্থির সেখানে মুদ্রার বাড়তি সরবরাহ আজো মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। সােনা ও রূপাের সরবরাহ বেড়ে গেলে গতিহীন উৎপাদন ব্যবস্থায় মূল্যস্তর উর্ধ্বগতি লাভ করে। অপরদিকে উৎপাদন যদি ক্রমাগত বেড়ে চলে বাড়তি অর্থের যােগান মূল্যবৃদ্ধি নাও ঘটাতে পারে, এরকম অর্থনেতিক অবস্থায় মুদ্রার মূল্য বাড়ে, মূল্যস্তর নেমে যায়।

ষোড়শ শতকের ইউরােপে উৎপাদন ছিল গতিহীন, সেজন্য সেখানে বাড়তি মুদ্রার সরবহার মূল্য বিপ্লব ঘটিয়েছিল। সিপােলা ইতালির অর্থনৈতিক কাজকর্ম বৃদ্ধিকে মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, শেবার তা মানেননি। উৎপাদন ব্যবস্থায় গতিশীলতা আসেনি, জনগণ তাদের সঞ্চয় পুনর্গঠনের কাজে ব্যয় করেছিল, এজন্য মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল। ইতালিতে আমেরিকার সােনা ও রূপাে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু উৎপাদন বাড়েনি, এজন্য মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল। উৎপাদন বাড়লে টাকার যােগান বাড়া সত্ত্বেও জিনিসের দাম কমতে থাকে। ১৫৫০ খ্রি.-এর পর ইতালিতে জনসংখ্যা বেড়েছিল, পণ্য ও মুদ্রার চাহিদা দুইই বেড়েছিল। ১৫৫০ খ্রি. নাগাদ চাহিদা অনুযায়ী মুদ্রার সরবরাহ না বাড়ায় জিনিসের দাম বেড়েছিল। ১৫৭০ খ্রি. ইতালিতে প্রচুর সােনা ও রূপাে এসেছিল, জিনিসের দাম কমেছিল, এতে মুদ্রা সরবরাহ তত্ত্বের কোনাে ক্ষতি হয় না। সরবরাহ তত্ত্ব একটি স্থিতিশীল উৎপাদন ব্যবস্থায় কার্যকরী থাকে, এই তত্ত্বকে সহজে নস্যাৎ করা যায় না।

অনেকে এই তত্ত্বকে স্বাভাবিক ও যান্ত্রিক বলে থাকেন (automatic, mechanical), ষোড়শ শতকে অর্থনৈতিক পরিকাঠামাে এরকম ছিল। এই তত্ত্ব মানুষ ও তার প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করে না, মূল্যস্তরের ওঠা-নামার সঙ্গে উৎপাদন ও পরিষেবার যােগ অতি ঘনিষ্ঠ। মানুষ, অর্থ ও অর্থের ব্যবহার থেকে অর্থনৈতিক গতিশীলতার সৃষ্টি হয়।

১৬শ ও ১৭শ শতকের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণ

প্রাক্-আধুনিক পর্বে ইউরােপের সামগ্রিক জীবন ছিল গ্রামীণ, উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল প্রাকশিল্প বিপ্লব যুগের, সর্বত্র ছিল নিঃসঙ্গ গ্রাম্য জীবনের উপস্থিতি। একটি বড়াে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হল উত্তর ইতালির পাে-উপত্যকা, সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হল নেদারল্যান্ড। তুলনামূলকভাবে রাশিয়া ও ইউক্রেন ছিল সবচেয়ে জনবিরল অঞ্চল, আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হলে চোখে পড়ত শুধু গ্রাম, শহর প্রায় ছিল না বললেই চলে। ইউরােপের জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ গ্রামে বাস করত, গ্রামে বাস করলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর এদের প্রভাব ছিল। শহরের মানুষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে নেতৃত্ব দিত। করের নথিপত্র, মিলিটারি সেন্সাস, চার্চের জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহের হিসেব থেকে ষােড়শ ও সপ্তদশ শতকের জন্য বুদ্ধি ও নগরায়ণের পরিচয় পাওয়া যায়। সমকালীন পর্যবেক্ষকরা এ সম্পর্কে কিছু তথ্য রেখে গেছেন। উলরিচ ভন হাটেন (Ulrich Von Hutten), সেবাস্টিয়ান ফ্রাঙ্ক (Seba Franck), জা বোঁদা (Jean Bodin) ও স্যার জন হকিন্সের লেখায় ষোড়শ শতকের জনসংখা বৃদ্ধির কথা আছে।

১৪৫০ খ্রি. থেকে ইউরােপের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তবে ইউরােপের সর্বত্র, সব দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে সমতা ছিল না। উত্তর ইউরােপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৫০০-১৬০০ খ্রি. মধ্যে এই দেশগুলিতে (সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক) জনসংখ্যা বেড়েছিল ৬৬ শতাংশ, ইংলন্ড ও নেদারল্যান্ডে বেড়েছিল ৫০ শতাংশ। মধ্য ইউরােপ, স্পেন ও ইতালিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল অপেক্ষাকৃত কম, মাত্র ৩৩ শতাংশ। ফ্রান্সে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে কম, মাত্র ১২.৫ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পর্ব যা ১৪৫০ খ্রি. শুরু হয়েছিল তা ষােড়শ শতকের আশির দশকে এসে শেষ হয়ে যায়। এই সময়ের পর থেকে সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় ইউরােপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেমে গিয়েছিল, কোনাে কোনাে স্থানে কমেছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে জনসংখ্যা হ্রাসের একটি প্রধান কারণ হল প্লেগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড ও গুটি বসন্তের মহামারী। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডে জনসংখ্যা হ্রাসের কারণ হল যুদ্ধ, ভালােয়া-হ্যাপস্বার্গ দ্বন্দ্ব, ধর্মযুদ্ধ এবং নেদারল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধে বহু লােক প্রাণ হারিয়েছিল। সপ্তদশ শতকের গােড়ার দিকে ইউরােপের সর্বত্র জনসংখ্যা হ্রাসের প্রবণতা দেখা দিয়েছিল, কোথাও জনসংখ্যা স্থিতিশীল ছিল, কোথাও হ্রাস পেয়েছিল। দক্ষিণ ইউরােপে এই জনসংখ্যার ঘাটতি মেটাতে দুশাে বছর লেগেছিল।

ঐতিহাসিকদের ধারণা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে হ্রাস-বৃদ্ধি সত্বেও ইউরােপের জনসংখ্যা বেড়েছিল প্রায় দেড়গুণ। এই সময়ে গ্রামের মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে গিয়ে ভীড় করেছিল। প্রশাসনিক কেন্দ্র, সামরিক শিবির, শিল্প-বাণিজ্যকেন্দ্র, বন্দর, শিক্ষাকেন্দ্র ও ধর্মস্থান শহরের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ষোড়শ শতকে সেভিল ও আন্টওয়ার্প ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বড়াে ঘাঁটি, এদের লােকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল দুগুণ। ১৪৫০-১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিঁয়াের জনসংখ্যা বেড়েছিল চারগুণ, রুয়েনের তিনগুণ, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপে মাত্র কয়েকটি শহর ছিল যাদের লােকসংখ্যা এক লাখ বা তার ওপর। শহরগুলি হল কনস্ট্যান্টিনােপল, ভেনিস, মিলান, নেপলস্ ও প্যারিস। ১৬০০ খ্রি. নাগাদ কমপক্ষে নয়টি শহরে—আন্টওয়ার্প, সেভিল, রােম, লিসবন, পালার্মো, মেসিনা, মিলান, ভেনিস ও আমস্টারডামে এক লক্ষের বেশি লােক বাস করত। নেপলস, প্যারিস ও লন্ডনে লােকসংখ্যা দু’লক্ষ অতিক্রম করেছিল, ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই তিন শহরের লােকসংখ্যা পাঁচ লক্ষ অতিক্রম করেছিল।

বড়াে শহরের পাশাপাশি অনেক মাঝারি ও ছােটো শহর গড়ে উঠেছিল। চতুর্দশ শতকের প্লেগের মড়কের সময় বহু শহর পরিত্যক্ত হয়েছিল, এসব শহর পুনর্গঠনের ব্যবস্থা হয়। গ্রামে ও শহরে নতুন করে শহর গড়ে তােলা হয়, শক্ত পাথরের দেওয়াল দিয়ে শহরগুলিকে সুরক্ষা ব্যবস্থা হয়েছিল। এসব শহরের নাগরিকদের জন্য ছিল আলাে, বাতাস, রাস্তা, বাজার, চার্চ ও টাউন হল। বণিক ও যাজকদের উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের ফলে শহরের লােকসংখ্যা বেড়েছিল। ষােড়শ শতকে মৃত্যুর হার খুব বেশি ছিল, দজন শিশুর মধ্যে একজন দশ বছর পেরােনাের আগেই মারা যেত। গ্রামের মানুষ এসে শহরের ঘাটতি মেটাত। ষোড়শ শতকে জনসংখ্যা কেন বেড়েছিল নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। অনুমান করা হয় রাজকীয় হানাহানি ও সামন্ততান্ত্রিক লড়াই বন্ধ ছিল, প্রকৃতিও খানিকটা উদার হয়েছিল, মহামারীর প্রকোপ কমেছিল, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছিল।

১৫০০-১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংলন্ডের লােকসংখ্যা ৩.৫ মিলিয়ন থেকে বেড়ে হয়েছিল ৫ মিলিয়ন। সাম্রাজ্যের লােকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২০ মিলিয়নে। সম্ভবত সমগ্র ইউরােপে জনসংখ্যা কম বেশি বেড়েছিল। নরওয়ের লােকসংখ্যা বেড়েছিল ৪৬ শতাংশ, লুক্সেমবার্গের ৩৯ শতাংশ, নেদারল্যান্ডে গ্রামীণ জনসংখ্যা বেড়েছিল ৫৮ শতাংশ, শহরের ৪৭.১ শতাংশ। নগরায়ণ হল এই পর্বের এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে, এর সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ যুক্ত হয়ে পরিবর্তনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। ষােড়শ ও সপ্তদশ শতকের ইউরােপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের জন্য নানা আর্থ-সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়েছিল। প্রাক্-শিল্প বিপ্লব যুগের উৎপাদন ব্যবস্থায় রাতারাতি পরিবর্তন ঘটিয়ে অধিক ভােগ্য পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি, বাড়তি চাহিদার চাপ পড়েছিল ভােগ্য পণ্য সরবরাহের ওপর, এজন্য জিনিসের দাম বেড়েছিল। জাঁ বোঁদা মনে করেন আমেরিকার সােনা-রূপাের যােগান এজন্য দায়ী ছিল, আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মনে করেন ইউরােপের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হল এর একটি কারণ।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে ইউরােপে জমির চাহিদা বেড়েছিল, পতিত, অনাবাদী জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। ইংলন্ডের ভূস্বামীরা কৃষকের ওপর উচ্চহারে খাজনা বসিয়েছিলেন, জমি ঘিরে নিয়ে অল্প শ্রমিক দিয়ে মেষপালন শুরু করেছিলেন। এই পশম ও মাংস ইউরােপের বাজারে বিক্রি করা হত। শ্রমিকের সরবরাহ বেড়েছিল কিন্তু সেই অনুপাতে কৃষি ও শিল্পের পরিবর্তন ঘটানাে সম্ভব হয়নি। শুধু হল্যান্ডে উন্নত চাষ, জলসেচ ও সার দিয়ে শস্য উৎপাদন ও বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছিল। সব দেশে খাদ্যের চাহিদা বেড়েছিল, এজন্য অনেক দেশে খাদ্য নিয়ে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক কৃষক জমি হারিয়েছিল, অনেকে বেকার হয়ে শহরে গিয়ে ভবঘুরের জীবন অথবা দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। উৎসাহী সরকারগুলি বিদেশে উপনিবেশ স্থাপন করে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সমাধানের কথা ভেবেছিল।

ইউরােপে নগরায়ণের সঙ্গে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের বাসস্থান, জল, আলাে ও শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, এরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করতে শুরু করে দেয়। উচ্চবর্গের মানুষের বিরুদ্ধে শ্রমিক ও কারিগরদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। ধনী ব্যক্তিরা বিশাল বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করে বাস করত, সুদৃশ্য, মূল্যবান ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজের উপরতলা আলােকিত হলেও নিচের তলায় অন্ধকার জমেছিল। বােহেমিয়ায় জন হাসের বিদ্রোহ, ইংলন্ডে ললার্ডি আন্দোলন এবং জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে এদের দুঃখ-দুর্দশার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে ইউরােপের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেড়েছিল, ইউরােপের দেশগুলিতে মুদ্রা-নির্ভর অর্থনীতির চলন হয়েছিল। নব্য ধনিক সম্প্রদায় ও অভিজাতরা নগর প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হন, রাজা ও অভিজাতদের কাছ থেকে নগরের জন্য এরা কতকগুলি অধিকার কিনে নিয়েছিল। নগরের জন্য পৃথক শাসনতন্ত্র রচিত হয়, সম্রাট ও পােপ উভয়ে তা মেনে নেন। ইতালির রাষ্ট্রগুলি পােপ ও সম্রাটের পক্ষে যােগ দিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, নিজেদের মধ্যে করে এরা দুর্বল হয়ে যায়।

ষােড়শ ও সপ্তদশ শতকের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কতকগুলি কুফল ছিল। গ্রামে জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে, শহরে জনসংখ্যার অসম্ভব ভিড় বাড়ে। শুধু সপ্তদশ শতকে ইংলন্ডে শহরবাসীর সংখ্যা দুগুণ হয়েছিল। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ আর যাই থাকুক না কেন কেন্দ্রিয় রাজশক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সামন্ত প্রভুদের হানাহানির অবসান হল এর একটি প্রধান কারণ। পশ্চিম ইউরােপের প্রায় সর্বত্র জল ও স্থল পথে নিরাপত্তা এসেছিল, এর ফলে এই অঞ্চলের কৃষিতে আঞ্চলিক বিশেষায়ন (local specialisation) শুরু হয়েছিল, সামগ্রিকভাবে উৎপাদন বেড়েছিল। আঞ্চলিক কারণে ইউরােপের কোনাে অঞ্চলে শস্য উৎপাদন ব্যহত হলে উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে শস্য পাঠানাের সুবিধা হয়েছিল। ইউরােপে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নতি হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের দ্রুত উন্নতির কারণ।

ইউরােপের বাণিজ্য ও বাণিজ্য সংগঠন

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরােপের বাণিজ্য ও বাণিজ্য সংগঠনের অনেকগুলি ধরন লক্ষ্য করা যায়। বাণিজ্য সংগঠনগুলির লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যিক মূলধন বাঁচানাে, বাড়িয়ে যাওয়া, ঝুঁকি কমানাে এবং দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা। ইউরােপের সবচেয়ে পুরনাে ও সরল বাণিজ্যিক সংগঠন হল ব্যক্তি কেন্দ্রিক বাণিজ্য। বণিক নিজের পণ্য নিয়ে বিদেশে যেত, পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত হত, বণিকের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হত যদি তার সঙ্গে দুই বা ততােধিক বণিক যােগ দিত। একজন পণ্য নিয়ে বিদেশে যেত, অন্যজন দেশে থেকে বাণিজ্য পরিচালনা করত। যে বিদেশে যেত সে হত বণিকের বেতনভুক ফ্যাক্টর। যদি বিদেশে কর্মরত বণিক লাভ-লােকসানের অংশীদার হত তাহলে স্থাপিত হত একটি ট্রেডিং কোম্পানি বা পার্টনারশিপ। অনেক সময় কমিশন দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করা যেত, দুই দেশের বণিক একে অন্যের কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। এতে বাণিজ্যিক কাজকর্মের ব্যয় কম হত, স্থানীয় বাজারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানাে যেত। পার্টনারশিপের সুবিধা হল এতে ঝুঁকি কমে যেত, উত্তর ও পশ্চিম ইউরােপের পরিবহণ বাণিজ্যে এই ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়েছিল।

১৫০০ খ্রি. নাগাদ যারা হল্যান্ডের পরিবহণ জাহাজগুলি চালাত তারা এগুলির মালিক ছিল না, মালিকানার শেয়ার কিনেছিলেন বণিক ও জাহাজ মালিকেরা। এরা জাহাজের ক্যাপ্টেনদের বেতন দিয়ে নিযুক্ত করতেন। জাহাজের মালিকানা, নৌ-বাণিজ্য এবং জাহাজ ভাড়ার ব্যবসা একই বণিকগােষ্ঠি ও পার্টনারশিপের হাতে চলে এসেছিল। এই জাহাজ মালিকদের আবার দুটি গােষ্ঠি ছিল। একদল ছিল নিষ্ক্রিয় মালিক, তারা শুধু শেয়ার কিনে সন্তুষ্ট থাকত, সক্রিয় গােষ্ঠি জাহাজ পরিচালনা, মাশুল নির্ধারণ ইত্যাদি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকত। জাহাজের শেয়ারের ব্যবসা সপ্তদশ শতকের শেষপর্যন্ত চলেছিল, এই সময় নৌ-বীমা চালু হয়েছিল। জাহাজ মালিকদের পার্টনারশিপ জাহাজ পরিবহণের উপর একচেটিয়া আধিপত্য সমাপন করেছিল, সপ্তদশ শতকের হল্যান্ডে এটি ছিল জাহাজ ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য।

শুধু বণিকরা নন, ইউরােপের রাজারা নিজেদের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ফ্যাক্টর নিয়ােগ করতেন। পর্তুগালের রাজারা বিদেশে বাণিজ্য কুঠি পরিচালনার জন্য ফ্যাক্টর নিয়ােগ করেছিলেন। ফ্লান্ডার্স, আফ্রিকা, এশিয়া ও ব্রাজিলে পর্তুগীজ বাণিজ্য সংগঠন ছিল এধরনের, এর মধ্যে মিশ্রণ ঘটেছিল সরকারি ও বেসরকারি স্বার্থের। স্পেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও ইংলন্ড বিদেশে বাণিজ্য পরিচালনার জন্য এধরনের ব্যবস্থা অনুসরণ করেছিল। ইউরােপীয়দের ফ্যাক্টরিগুলি ছিল একাধারে গুদামঘর, বাজার, সামরিক ঘাঁটি ও শুল্কচৌকি। বিদেশে বাণিজ্য করা ছিল বেশ জটিল ব্যাপার। স্থানীয় মুদ্রা, রীতি-নীতি, অস্থির ব্যাংকিং, বাণিজ্যের সময়কাল (trade season) ইউরােপীয় বাণিজ্যের সহায়ক হত না। বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক সুযােগ-সুবিধা সমান ছিল না, জাপান ও চীনে ইউরােপীয় বণিকদের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে যেতে দেওয়া হত না। এশিয়ার উপকূলস্থ দেশগুলি (maritime Asia) এবং আমেরিকায় তারা পণ্য উৎপাদন স্থানে গিয়ে হাজির হত। ইউরােপের দেশগুলিতে ফ্যাক্টরির অধিকার সর্বত্র সমান ছিল না, ইউরােপ ও ইউরােপের বাইরে প্রায় একই ধরনের অবস্থা ছিল। চুক্তি করে কিছু বাড়তি সুযােগ সুবিধা আদায় করা সম্ভব হলেও, যেকোনাে মুহূর্তে সেগুলি বাতিল হতে পারত।

নিরাপত্তা, শাসন, বিচার ও শুল্কের ক্ষেত্রে কিছু অতিরাষ্ট্রিক অধিকার পাওয়া যেত। সরকারের নিযুক্ত কনসাল বণিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তেন। হল্যান্ডের আইনসভা স্টেটস-জেনারেল বণিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছিল। বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনায় ব্যয়ের দিকে ছিল নিরাপত্তা সমস্যা, ইউরােপে যুদ্ধের সময় বাণিজ্যবহর পাহারা দিতে হত। স্পেন ও পর্তুগাল বৈদেশিক বাণিজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিল, এজন্য রাষ্ট্রীয় বিভাগ গঠন করা হয়। পর্তুগালের ছিল কাসা দ্য ইন্ডিয়া, স্পেনের ছিল কাসা দ্য কনট্রাটাসিয়ান। সরকার মূল্যবান ধাতুর ব্যবসা নিজের হাতে রেখে বাকি সব উদ্যোগীদের হাতে ছেড়ে দিত। এই উদ্যোগীরা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল, ইংলন্ড, হল্যান্ড ও ফ্রান্সে বেসরকারি উদ্যোগে বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। এসব দেশের সরকার এদের সাহায্য করতেন, সরকারি চার্টার নিয়ে চাটার্ড কোম্পানি গঠিত হত। এরা হত স্বয়ং শাসিত, কোনাে ভৌগােলিক অঞ্চলে এরা একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পেত। এদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ ছিল—রেগুলেটেড ও জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। রেগুলেটেড কোম্পানি ছিল স্বাধীন বণিকের দল, তবে শৃঙ্খলাবদ্ধ, এদের উদাহরণ হল ইংলন্ডের মার্চেন্ট এডভেঞ্চারার্স (Merchant Adventurers)। ১৫৬৪ খ্রি. এক চার্টারে এদের হল্যান্ড ও হাম্বুর্গের সঙ্গে একচেটিয়া বস্ত্র বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এই কোম্পানির সদস্য সংখ্যা ছিল সাত হাজার দুশাে। আরও একটি উদাহরণ হল বাল্টিক বাণিজ্যে নিযুক্ত ইস্টল্যান্ড কোম্পানি। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি যে নতুনত্ব নিয়ে এসেছিল তা হল স্থায়ী মূলধন, এর আর এক বৈশিষ্ট্য হল নিষ্ক্রিয় শেয়ার হােল্ডার। এরা কোম্পানির বাণিজ্য পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকত না, শুধু লভ্যাংশ পেলে খুশি হত। ১৬০২ খ্রি. স্থাপিত ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হল শেয়ার হােল্ডারদের সংস্থা, ফ্রান্স ও ইংলন্ডে এ ধরনের কোম্পানি স্থাপিত হয়েছিল।

জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলি বিদেশে বাণিজ্য পরিচালনা করত। ইউরােপের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হত, কিন্তু তা সব সময় সফল হত না। ইউরােপীয় বণিকরা বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করত, এরা আবার শিল্প ও কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হত। কোম্পানির সদস্য ও পরিচালক অন্য কোম্পানির সঙ্গে স্বচ্ছন্দে যুক্ত হতে পারত। স্যার এডওয়ার্ড অসবাের্ণ লেভান্ট কোম্পানির গভর্নর ছিলেন, হল্যান্ডের ইস্টল্যান্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় তিনি উদ্যোগ নেন। ইউরােপীয় বাণিজ্য সংগঠনে ব্যক্তি ও পরিবারের বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল (principal unit of enterprise), পরিবার ও ধর্মের বন্ধন বাণিজ্যকে সচল রাখত। স্পেন ও লেভান্ট, আইবেরীয় উপদ্বীপ ও হাম্বুর্গের মধ্যে ইহুদিরা বাণিজ্য পরিচালনা করত। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড ও স্ক্যানডিনেভিয়ার ক্ষেত্রে ক্যালভিন পন্থা বাণিজ্য বন্ধন গড়ে তুলেছিল।

ইউরােপীয় বাণিজ্যের ইতিহাসে দু ধরনের বণিকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, অভিজাত বণিক ও সাধারণ বণিক (commercial aristocracy and ordinary merchant)। ষোড়শ শতক ছিল ফুগারদের যুগ। দক্ষিণ জার্মানির এই অভিজাত বণিকরা ছিল বিশাল মূলধনের মালিক। তামা, মশলা, মদ, লবণ ও ফিটকিরির বাণিজ্যে এরা একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন করেছিল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর তাদের প্রভাব ছিল। এরা ব্যাঙ্কিং-এর কারবার করত, রাষ্ট্রকে ঋণ দিত, স্পেনের হ্যাপ্‌সবার্গ রাজপরিবার ও পােপের ব্যাঙ্কার হিসেবে এরা কাজ করত। জার্মানির খনিজ দ্রব্য উত্তোলনে এরা নতুন প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিল। হল্যান্ডের ট্রিপ পরিবার হল এধরনের আর একটি অভিজাত বণিক পরিবার। এদের লােহা, তামা, অস্ত্র, জাহাজ ও শেয়ারের ব্যবসা ছিল। বিশ্বজুড়ে এই পরিবার ব্যবসা করত, জার্মানি, রাশিয়া, স্ক্যানডিনেভিয়া, লেভান্ট, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এদের বাণিজ্য ছিল। একচেটিয়া বাণিজ্য থেকে এদের প্রচুর লাভ হত, সেই লাভ তারা পুনরায় বাণিজ্যে লগ্নি করত। হল্যান্ডের একচেটিয়া বাণিজ্য অর্থনৈতিক উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। বৃহৎ বণিক পরিবারগুলি জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করত, কোম্পানির বাণিজ্য পণ্য বেচা-কেনায় এরা ছিল মাধ্যম।

অভিজাত বণিকদের জন্য সাধারণ বণিকদের ক্ষতি হয়নি, উত্তর ইউরােপের বাণিজ্য বিস্তারে সাধারণ বণিকদের ভূমিকা ছিল। বিদেশে না গিয়ে বা করপােরেট সংগঠনের সদস্য না হয়েও এরা বাণিজ্য চালাতে পারত, অনেক ক্ষুদ্র বণিক জার্মানির হানস্‌ লীগের (Hanseatic League) সদস্য ছিল। নিয়ন্ত্রিত কোম্পানির তারা সদস্য হতে পারত। সপ্তদশ শতকের হল্যান্ডে বহু ক্ষুদ্র বণিক বাণিজ্যে সক্রিয় ছিল, শস্য, লবণ, হেরিং মাছ, কাঠ ও ইটের ব্যবসায়ে এদের দেখা যেত। তবে অভিজাত ও ক্ষুদ্র বণিকদের মধ্যে স্বার্থ দ্বন্দ্ব ছিল, ক্ষুদ্র বণিকরা মনে করত যে অভিজাত বণিকদের জন্য তাদের জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে টমাস মান ইংলন্ডের বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর যে গ্রন্থ রচনা করেন তাতে বণিকদের গুণাবলীর উল্লেখ আছে। বণিক হবেন হিসেব, মুদ্রা, পরিমাপ, ওজন, শুল্ক, মাসুল, পরিবহণ ও বিদেশি ভাষায় অভিজ্ঞ। ইতালি ও হল্যান্ডের বণিকরা এসব বিষয়ে দক্ষ ছিল। বিভিন্ন দেশে বণিকদের সামাজিক মর্যাদা একরকম ছিল না, হল্যান্ডে বণিকদের সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেওয়া হত, এখানে বাণিজ্য স্বার্থ ছিল অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। ইউরােপে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, রাজারা অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে বণিকদের সাহায্য নিয়েছিলেন, বণিকরা উচ্চ রাজপদ লাভ করেছিল।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ধারণা একরকম ছিল না। হল্যান্ডের অর্থনীতিতে এর বিশেষ ভূমিকা ছিল না, হল্যান্ড হল ব্যতিক্রম। মহাদেশীয় ইউরােপে রাষ্ট্র নিজের স্বার্থে অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করত, রাষ্ট্রের স্বার্থ হল নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের স্বার্থ। রাজারা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ লগ্নি করতেন। ইংলন্ডে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের নাম হল মার্কেন্টাইলিজম Mercantilism), এই তত্ত্বের প্রবক্তারা বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পক্ষে ছিলেন। এজন্য কাঁচামালের রপ্তানি ও শিল্প পণ্য আমদানির ওপর উচ্চহারে শুল্ক ধার্য করা হয়, শিল্প পণ্য রপ্তানি ও কাঁচামাল আমদানিকে ভরতুকি দিয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়। বিদেশি বিলাস দ্রব্য আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ আরােপিত হয়। জাতীয় জাহাজ পরিবহণ নীতি রচিত হয় (Navigation Act), সরকারি ও বেসরকারি স্বার্থের মিলন ঘটানাে হয়। ইংলন্ডের বণিকরা নিজেদের স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থ বলে প্রচার করতেন, রাষ্ট্রকে তারা একটি বৃহৎ করপােরেট অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন, রাষ্ট্র ছিল তাদের স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম। আধুনিক কালের আদিপর্বের শেষ দিকে রাষ্ট্রকে তারা বাণিজ্যের পক্ষে বােঝাস্বরূপ বলে গণ্য করেন, তারা বাণিজ্যের মুক্তি চেয়েছিলেন, নতুন বাণিজ্য সংগঠনের অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল।

চাহিদার উদ্ভব ও চাহিদার উপকরণ

সামন্ততন্ত্র ও শিল্প বিপ্লবের মধ্যবর্তী স্তর হল বাণিজ্যের যুগ। সামন্ততন্ত্রের শেষ পর্বে এর শুরু, শিল্প বিপ্লবের শুরুতে এর শেষ। ইউরােপের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এই বাণিজ্যের যুগ হল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এ যুগে ইউরােপীয় জীবনে নানা পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। সমুদ্র পারে নতুন অঞ্চল আবিষ্কার করে উপনিবেশ গড়ে তোলা হয়, এর প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল, পুরনাে ইউরােপ মানসিক জড়তা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এযুগে নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, নগরের আবির্ভাব ঘটেছিল, নগরকেন্দ্রিক অভিজাত ও বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বুর্জোয়া শ্রেণী স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিয়েছিল, বিনিময়ে কিনে নিয়েছিল নগর ও বাণিজ্যের অধিকার, প্রশাসনিক পদ। এই সময়ে শহর, বন্দর, পােতাশ্রয় গড়ে উঠেছিল, যােগাযােগ ও পরিবহণের উন্নতি হয়েছিল।

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরােপে যে চাহিদা গড়ে উঠেছিল তার পশ্চাতে কতকগুলি আর্থ-সামাজিক ও প্রাকৃতিক কারণ ছিল। কোনাে সামাজিক চাহিদা আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠে না, চাহিদার ওপর ভৌগােলিক অবস্থান ও পরিবেশের প্রভাব পড়ে। উত্তর ও মধ্য ইউরােপ এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের চাহিদার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য ছিল। উত্তর ইউরােপে প্রচণ্ড শীত, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের আবহাওয়া নাতিশীতােষ্ণ, এজন্য চাহিদার ধরনও আলাদা। জলবায়ুর ওপর খাদ্যশস্য ও ভােগ্যপণ্যের উৎপাদন অনেকখানি নির্ভরশীল। কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ুর প্রয়ােজন হয়, সব জমিতে ও জলবায়ুতে তুলাের চাষ হয়না। পশুপালনের জন্য বিশেষ ধরনের জলবায়ুর প্রয়ােজন হয়। ভৌগােলিক পরিবেশ ইমারতি উপকরণের চাহিদা বাড়ায় বা কমায়, কোনাে অঞ্চলের পরিবেশগত কারণের জন্য পাথরের গৃহ নির্মাণ করতে হয়, আবার কোনাে অঞ্চলে কাঠের। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের পরিভােগের ধরনও আলাদা, পেশাগত কারণে পরিভােগের হেরফের হয়, একজন শ্রমিক ও একজন বুদ্ধিজীবীর পরিভােগ একরকম নয়।

আধুনিক ইউরােপের আদিপর্বে চাহিদার ওপর নির্ভর করে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বৈদেশিক বাণিজ্য। খাদ্যশস্য, কাঁচামাল দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাংস ও ফলের বাজার বিস্তৃত হয়েছিল। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন উৎপাদন বাড়ায়, চাহিদার বিস্তার ঘটায়। এই যুগে কৃষি প্রযুক্তিতে তেমন উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটেনি, সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন তেমন বাড়েনি। ইউরােপের অর্থনীতি এই কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল ছিল, কৃষির সঙ্গে ছিল হস্ত ও কুটির শিল্প। কৃষি পণ্যকে ঘিরে চাহিদা আবর্তিত হত; শিল্পের উৎপাদন বাড়ছিল। বয়ন, খনি, ধাতু, মুদ্রণ, ঘড়ি ইত্যাদি ছিল প্রধান শিল্প, এই শিল্পগুলি ছিল পুঁজি নিবিড়, প্রযুক্তিগত উন্নতি তেমন হয়নি। কৃষি ও শিল্পে উন্নতির ফলে জাতীয় আয় বেড়েছিল, মাথা পিছু আয় বেড়েছিল কিনা জানা যায় না। স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদন বেড়েছিল, বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হত। এযুগে বাণিজ্যের বিস্তার শুধু ইউরােপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ইউরােপীয় বাণিজ্য ভূমধ্যসাগরীয় কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হয়ে আটলান্টিকে প্রসারিত হয়েছিল।

বাইরে থেকে চিনি, কফি, চা, মশলা, তুলা, পশম ও কাঠ ইউরােপে আমদানি করা হত। তুলাে, পশম ও কাঠ দিয়ে শিল্পপণ্য উৎপাদন করা হত শহরকেন্দ্রিক অভিজাত শ্রেণীর জন্য। বিদেশ থেকে বিলাস পণ্য আমদানি করা হত, প্রাচ্য দেশ থেকে কার্পাসজাত দ্রব্য, মসলিন, তামাক, সােনা, রূপাে ও হাতির দাঁতের সৌখিন পণ্য ইউরােপের বাজারে আমদানি করা হত। অসঞ্চয়ী মনােভাবের জন্য এসব পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। ইউরােপের দেশগুলিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছিল, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সােনা ও রূপাে ইউরােপের বাজারে এলে মুদ্রার যােগান বেড়ে যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাজাদের অর্থের প্রয়ােজন, উৎপাদনের আঞ্চলিক ঘাটতি ও যােগাযােগের অভাব মূল্য বিপ্লব ঘটিয়েছিল। মূল্য বৃদ্ধি ঘটলেও সব পণ্যের দাম সমান বাড়েনি, খাদ্য শস্যের দাম বেড়েছিল, কিন্তু সেই তুলনায় পােশাকের দাম বাড়েনি। মূল্যের ঊর্ধ্বগতি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল, আমদানি পণ্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমে যায়, দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। মূল্যস্তর মানুষের রুচি নির্ধারণ করে দেয়।

আয় চাহিদার সীমা নির্ধারণ করে দেয়, আয় হল ব্যক্তিগত ও সামাজিক উৎপাদনের স্তর ছিল নিম্নমুখী সেজন্য আয় খুব বেশি হতে পারেনি। উৎপাদনের সীমাবদ্ধতার কারণ হল প্রযুক্তির অভাব, পুঁজির অভাব এবং বিপণনের অসুবিধা। কুজনেটস (Kuznets) হিসেব করে দেখিয়েছেন যে আড়াইশাে বছরে (১৫০০-১৭৫০ খ্রি.) ইউরােপে উৎপাদন বৃদ্ধির হার হল মাথাপিছু বার্ষিক ২ শতাংশ। আড়াইশাে বছরে সামগ্রিক অগ্রগতি ছিল ৬৫ শতাংশ। এই সময়ে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ০.১৭ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম থাকা জনজীবনে সামান্য উন্নতি ঘটেছে, তবে সর্বত্র তা লক্ষ্যনীয় ছিল না। ইংলন্ড, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডে প্রাক-শিল্প বিপ্লবের পদধ্বনি শােনা গিয়েছিল, পূর্ব, দক্ষিণ ও মধ্য ইউরােপে অগ্রগতির হার ছিল খুব কম, অগ্রগতি হয়নি বললে অত্যুক্তি হয় না। নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার রাজতন্ত্র জাতীয় অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

ষােড়শ শতক থেকে খাদ্য সরবরাহের ওপর জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকে, মানুষ ও জমির অনুপাতে পরিবর্তন ঘটে যায়। কৃষি পণ্যের দাম বাড়ে, কিন্তু কৃষক এর ফলে লাভবান হয়নি কারণ তারও ব্যয় বেড়েছিল। কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানে উন্নতি হয়নি, এরা দারিদ্র্য সীমার শেষ প্রান্তে অবস্থান করত। শিল্প শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি, সীমিত মজুরি নিয়ে শিল্প শ্রমিক সমস্যায় পড়েছিল। ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামের শ্রমিকদের অবস্থা তেমন ভালাে ছিল না, তাদের দরিদ্রদের ত্রাণ আইনের (poor law) উপর নির্ভর করতে হত। তবে ইউরােপের সর্বত্র একই অবস্থা ছিল না। ষােড়শ শতকের গােড়ার দিকে ফ্লাণ্ডার্স অঞ্চলে আয়-ব্যয়ে সমতা ছিল, শেষ দিকে তা নষ্ট হয়ে যায়। সপ্তদশ শতকে ইউরােপের এই মুদ্রা-নির্ভর অর্থনীতি অনেক স্থিতিশীল ছিল। ম্যালথাস পণ্যমূল্যের সঙ্গে তুলনায় মজুরির সুবিধাজনক অবস্থানের কথা বলেছেন।

ইউরােপের বেশিরভাগ মানুষ ছিল কৃষক ও কারিগর। ৫-৭ শতাংশ অভিজাত ও যাজক, ১০-১২ শতাংশ পেশাদার, কারিগর ও শিল্পী, বাকি ৮০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। এই ধরনের কে সমাজে আয় ও চাহিদার সুষম বিস্তার ঘটেনি, চাহিদা ছিল স্বভাবতই উল্লম্বিক (vertical)। গ্রেগরি কিঙের লেখায় (Gregory King) ইংলন্ডের সপ্তদশ শতকের চিত্র পাওয়া যায়। অধিকাংশ মানুষ ছিল তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে, মুষ্টিমেয় মানুষ ছিল সচ্ছল। ফ্রান্সে ৫৫ শতাংশ মানুষ (৫/৯) ছিল দারিদ্র্যের মধ্যে, জার্মানিতে প্রতি হাজারে ২৬০ জন ছিল ভিক্ষুক। ইউরােপীয় মানুষের দারিদ্র্যের একটি কারণ হল অলসতা; পূর্ব ইউরােপে ভূমিদাসত্ব গড়ে উঠেছিল। শহরগুলিতে খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভূমিদাস দিয়ে বাড়তি খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে চলেছিল, সমাজে অর্থনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছিল। মূল্য বিপ্লবের ফলে ধনী লােকেরা আরও ধনী হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুর। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বাড়লে বাজার আরও সঙ্কুচিত হয়। হবসবম, ফিলিস ডীন ও অন্যান্যরা দেখিয়েছেন যে এজন্য মূলধন পুঞ্জিভূত হয়েছে, শিল্প বিপ্লবের মূলধন এই সময় তৈরি হয়েছিল।

বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও হল্যান্ডে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ পঞ্জিভূত হয়েছিল।ইংলন্ডের চিত্রটি একটু অন্য ধরনের, রিফরমেশনের ফলে ইংলন্ডে জেন্ট্রি শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা হয়। সামগ্রিকভাবে ইউরােপে পরিভােগের ৯১ শতাংশ ছিল ব্যক্তিগত, ৪-৫ শতাংশ সরকারি। ১৫০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছিল, জনসংখ্যা প্রায় দুগুণ হয়েছিল, এজন্য চাহিদার বিস্তার ঘটেছিল। তবে ইউরােপের সর্বত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সমান ছিল না, দুর্ভিক্ষ ও প্লেগে বহু লােক মারা যেত, এজন্য চাষাবাদও উৎপাদন ব্যাহত হত। শহরের বিকাশ ইউরােপের জনসংখ্যা বাড়িয়েছিল। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপে মেট্রোপলিটান শহরের সংখ্যা হল দশ—রােম, ভেনিস, মিলান, মাদ্রিদ, লিসবন, ভিয়েনা, সেভিল, পালার্মো, লন্ডন ও প্যারিস। বন্দর, ধর্মস্থান, শিক্ষায়তন, প্রশাসনিক কেন্দ্র রাজধানী ও শিল্পকেন্দ্রকে আশ্রয় করে শহর গড়ে উঠেছিল, পণ্যের চাহিদার সৃষ্টি হয়। লন্ডন শহর খাদ্যশস্যের বাজারে পরিণত হয়, বর্ধিত জনসংখ্যা ও শহরের জন্য উৎপাদন বাড়ানাে হয়, সবজি ও ডেয়ারির উৎপাদন বেড়েছিল। নাগরিক প্রয়ােজনে গড়ে উঠছিল অপেরা, থিয়েটার, উদ্যান ও সৈকতাবাস। সামরিক শিবির ও নৌঘাঁটিকে কেন্দ্র করে শহর গড়ে উঠেছিল। ইউরােপে বিনিময় মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটেছিল। শ্রম ও বিনিময়ের স্থান নিয়েছিল মুদ্রা, মুদ্রার লেনদেন, ব্যাঙ্কিং, বীমা, ও বিল অব এক্সচেঞ্জের চলন হয়েছিল।

বিনিময় ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে বন্টন ব্যবস্থার উন্নতি দেখা যায়। নানা ধরনের বাজার গড়ে ওঠে, ইউরােপের মেলাগুলি ছিল বিপণন কেন্দ্র। আন্টওয়ার্প, শ্যাম্পেন ও জার্মানির মেলাগুলি বাণিজ্যিক লেন-দেনের কেন্দ্র ছিল। লন্ডনে পাইকারি বিক্রয়কেন্দ্র ছিল, নিলামকেন্দ্র ও গুদোমঘর স্থাপিত হয়। দোকানে পসরা সাজিয়ে বিক্রি প্রথার চলন হয়, খুচরাে ক্রেতা এসব দোকানে ভিড় করত। দোকানের বিশেষায়ণ, ফেরিওয়ালার আবির্ভাব চাহিদা ও পরিভােগের সীমাকে প্রসারিত করেছিল। ষােড়শ শতক থেকে ডাক বিভাগের উন্নতি হয়। স্ট্রাসবুর্গ জিটুং এর মতাে বুলেটিন বন্টন ব্যবস্থার সহায়ক হয়েছিল, ইংলন্ডে এ ধরনের সংবাদপত্র ছিল, এরা বাণিজ্যিক খবর ও বিজ্ঞপ্তি প্রচার করত। জল ও স্থলপথে পরিবহণের উন্নতি হয়েছিল, সড়ক পথে হােটেল, পান্থশালা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। ইউরােপে ওজন ও পরিমাপের সর্বজন গ্রাহ্য ব্যবস্থা ছিল না, বিভিন্ন স্থানে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা ছিল। মুদ্রা ব্যবস্থা সর্বত্র চালু হয়নি, এজন্য চাহিদার সম্প্রসারণ ব্যাহত হয়েছিল।

বিভিন্ন যুগে মানুষের রুচি ও ফ্যাশন চাহিদার নিয়ামক হয়। পরচুলা, টুপি, মােজা পরার ফ্যাশন হলে এগুলির চাহিদা বেড়েছিল। প্যারিস নতুন পােশাকের চাহিদা গড়ে তুলতে সাহায্য করত, ফ্যাশন পত্রিকার চলন হয়েছিল। এসব হল ব্যক্তিগত চাহিদার ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ। এই সময়ে রাষ্ট্রের চাহিদাও বেড়েছিল। জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরােধ ছিল। পার্লামেন্ট, আমলাতন্ত্র, সৈন্যবাহিনী, আদালত ইত্যাদি ঘিরে রাষ্ট্রের চাহিদা বেড়েছিল। রাষ্ট্রের ব্যয় বেড়েছিল দশগুণ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ব্যয় কমানাে, সঞ্চয় বাড়ানাে ও পুঁজি বিনিয়ােগের চেষ্টা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লাভের দিকে নজর দেওয়া হয়। মার্কেন্টাইল অর্থনীতি চাহিদার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস শুরু হলে ব্যয় বেড়েছিল, চাহিদা বেড়েছিল। লাইসেন্স, পেটেন্ট ও গিল্ড ব্যবস্থার মাধ্যমে ইউরােপ উৎপাদন, বিতরণ ও পরিভােগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল। ধর্মীয় নীতি অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করত।

বিনিময় ও ব্যাঙ্কিং

মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ইউরােপে বিনিময় ও ব্যাঙ্কিং-এর বেশি দরকার পড়তে না কারণ অর্থনীতি ছিল স্বয়ম্ভর, বাজার ও বিনিময়ের তেমন চলন ছিল না। এই ধরনের আঞ্চলিক স্বয়ংসম্পূর্ণ বিনিময়হীন অর্থনীতিকে অর্থনীতিবিদরা স্বাভাবিক অর্থনীতি বলে উল্লেখ করেছেন (natural economy)। ত্রয়ােদশ শতক থেকে ইউরােপীয় বাণিজ্যের বিস্তার শুরু হলে ব্যাঙ্কিং ও বিনিময়ের অর্থনীতি গড়ে উঠতে থাকে। ক্রুসেডের পর ইউরােপে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। কৃষিতে উদ্বৃত্ত শস্য উৎপাদিত হলে বাজার গড়ে উঠেছিল। ইউরােপে শুধু দূর পাল্লার বাণিজ্য গড়ে ওঠেনি, ইউরােপীয় বণিকরা পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও প্রাচ্যদেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছিল। প্রাচ্য থেকে মশলা, সৌখিন দ্রব্য, রেশম ও সুতিবস্ত্র ইউরােপে আমদানি করা হত। এই সব বাণিজ্যের জন্য ঋণ ও হুণ্ডির দরকার হত। এই সব কাজকর্মে বেশকিছু ব্যক্তি ও পরিবার দক্ষতা অর্জন করেছিল। ক্যাথলিক চার্চ সুদের কারবার পছন্দ করত না। সেক্সপিয়ার নাটকে ইহুদিদের সুদের কারবারী হিসেবে দেখানাে হয়েছে। ইহুদিরা ছাড়া, ইউরােপের কিছু মঠ ও আশ্রম এবং কয়েকটি মুসলিম সম্প্রদায় ঋণ ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল।

মধ্যযুগের বণিক, ঋণ ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কিং কারবারী আধুনিক যুগের আদি পর্বের ইউরােপে বর হয়ে বসেছিল। এরা বণিক, রাজা ও সাধারণ মানুষকে সুদে টাকা ধার দিত, বিল অব একচেঞ্জের মাধ্যমে বেচা-কেনা বাড়িয়েছিল। ব্যাঙ্কাররা শুধু বণিকদের নয়, শিল্পোদ্যোগীদের মূলধন সরবরাহ করত, ফাটকাবাজ ও রাজসভার অভিজাতরাও এদের কাছ থেকে ঋণ নিত। বিনিময়ের নতুন মাধ্যম হল টাকা। মুদ্রা অর্থনীতির প্রসার ঘটলে ব্যাঙ্কিং ও বিনিময় ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটে। ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে আন্টওয়ার্পে পৃথিবীর প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়। ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয় লন্ডন রয়্যাল এক্সচেঞ্জ। এই এক্সচেঞ্জগুলি ব্যাঙ্কের অনেক কাজ করত, এদের প্রদত্ত বিলকে বণিকরা সম্মান করত, এর ভিত্তিতে বেচা-কেনা হত। নিঃসন্দেহে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছিল। মধ্যযুগের সামন্ত শাসকরা কৃষিজ পণ্য বিক্রির জন্য বাজার গঠন করেন। এগুলি পণ্য বিনিময় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে, কৃষক সামন্ত প্রভুকে উৎপন্ন শস্যে কর দেওয়া বন্ধ করে নগদ অর্থে রাজস্ব দিতে শুরু করেছিল। সামন্ত প্রভু তার উপরওয়ালাকে নগদে রাজস্ব দিতে শুরু করেছিলেন। নগদ অর্থের লেন-দেন বাড়লে ব্যাঙ্কিং কারবার বেড়েছিল। রাজারা যুদ্ধের সময় এদের কাছ থেকে ঋণ নিতেন। ইংলন্ডের রাজা দ্বিতীয় ও তৃতীয় এডওয়ার্ড ফ্লোরেন্সের বণিকদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। ইংলন্ডের বণিকদের ওপর ফ্লোরেন্সের বণিকদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল।

ইউরােপের রাষ্ট্র ও সমাজে ঋণের চাহিদা বেড়েছিল। স্পেন, ফ্রান্স ও ইংলন্ডের মতাে জাতীয় রাষ্ট্রের ঋণের প্রয়ােজন হত, অস্ট্রিয়া ও তুরস্কের সাম্রাজ্যের বহু অর্থের প্রয়ােজন হত। রাজা ও সম্রাটরা ব্যাঙ্কারদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করতেন। প্রশাসন, সৈন্যবাহিনী, যুদ্ধ ইত্যাদির জন্য রাজাদের ঋণ না নিলে চলত না। ইউরােপের রাজারা নানা কারণে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন, বিশাল বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করে রাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধির প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন। এই পর্বে যুদ্ধ একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল, নতুন অস্ত্রশস্ত্র, নৌবহর নির্মাণের প্রতিযােগিতা চলেছিল। অনেক রাজা ভাড়াটে সৈন্য রেখেছিলেন, তাদের নিয়মিতভাবে বেতন দানের জন্য ব্যাঙ্কারদের ওপর নির্ভর করতে হত। স্পেন ও পর্তুগাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল। এই সব সাম্রাজ্য ছিল দূর বিস্তৃত, একাধিক মহাদেশ জুড়ে তাদের সাম্রাজ্য গঠিত হয়। সাম্রাজ্যের এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র টাকা পাঠানাের দরকার হত। স্পেনের ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করত জার্মানির ফুগার (Fugger) পরিবার, পােপ ও ফ্রান্সের ব্যাঙ্কার ছিল ফ্লোরেন্সের মেদিচি (Medici) পরিবার। শুধু রাজস্ব সংগ্রহ ও আমানত রাখার কাজ এরা করত না, স্পেন ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় বাজেটের ওপর এদের প্রভাব ছিল। রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয়ের বিভিন্ন দিক এরা নির্দিষ্ট করে দিত। প্রাক-আধুনিক যুগে বাণিজ্যিক লেন-দেন, স্টক এক্সেচেঞ্জ, ডাবল এন্ট্রি বুক, লেজার, হােল্ডিং কোম্পানি, বীমা, প্রিমিয়াম প্রভৃতি ধারণাগুলি পরিণত রূপ লাভ করেছিল। আধুনিক ব্যাঙ্কিং-এর গােড়াপত্তনে ফ্লোরেন্সের ব্যাঙ্কারদের বিশিষ্ট অবদান। রাজা, রাজসভার অভিজাত, মিউনিসিপ্যালিটি ও সাধারণ মানুষকে এরা ঋণ দিত।

চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ইউরােপের ব্যাঙ্কিং জগতে প্রাধান্য ছিল ফ্লোরেন্সের ব্যাঙ্কিং পরিবারগুলির। ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ব্যাঙ্কিং পরিবারগুলি হল মেদিচি, স্ট্রোজ্জি, বার্দি, ফ্রেসকোবল্ডি ও পেরুজ্জি। এরা ব্যাঙ্কিং কারবারের নিয়ম-রীতি তৈরি করে দেন, ব্যাঙ্কিং নতুন পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ফ্লোরেন্সের ব্যাঙ্কিং পরিবারগুলির মধ্যে মেদিচি নিঃসন্দেহে বিখ্যাত ছিল। এই পরিবার থেকে একজন পােপ হয়েছিলেন, দুই কন্যা ফ্রান্সের রানী হন। পারিবারিক ও ধর্মীয় কারণে পােপ ও ফরাসি রাজ পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষ অবধি তারা পােপের ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করে। ইতালির রেনেশাঁসের তারাই ছিল সবচেয়ে বড়াে পৃষ্ঠপােষক। ষােড়শ শতকে ইউরো ব্যাঙ্কিং কারবার ইতালি থেকে দক্ষিণ জার্মানিতে চলে যায়। ফুগার ও ওয়েলসাররা (Welser) ছিল বড়াে ব্যাঙ্কিং পরিবার, এরা নানা ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিল আবার বণিক ও রাজাদের ঋণ সরবরাহ করত। ভৌগােলিক আবিষ্কারের জন্য যে অর্থের প্রয়ােজন হত তার সরবরাহ আসত এদের কাছ থেকে। সপ্তদশ শতকে ব্যাঙ্কিং ও বিনিময় একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ক অব আমস্টারডাম স্থাপিত হয়, ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ক অব হামবুর্গ। গৌরবময় বিপ্লবের পর ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ক অব ইংলন্ড গড়ে ওঠে। ব্যক্তিগত ব্যাঙ্কিং-এর দিন শেষ হয়েছিল, শুরু হয়েছিল জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাঙ্কিং ও বিনিময়ের যাত্রা।

পঞ্চদশ শতকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ভেনিসের বাণিজ্য প্রসারিত হলে ইউরােপের ব্যাঙ্কিং ও বিনিময় ব্যবস্থায় ভেনিসের প্রাধান্য স্থাপিত হয়। ভেনিসের অধীনে ছিল বহু জাহাজ (galley), এসব জাহাজে পণ্য বােঝাই করে বিদেশে পাঠানাে হত। বণিকদের ঋণ সরবরাহ করত রিয়ালটোর অর্থ ব্যবসায়ীরা। ভেনিসের শুধু বাণিজ্যবহর ছিল না, ছিল একচেটিয়া বাণিজ্যের মানসিকতা, এবং সব নাগরিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। ভেনিসের ঋণের কারবারীরা সুদের হার নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, এক ধরনের স্টক এক্সচেঞ্জ গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্যপণ্য বীমা করার ব্যবস্থা ছিল. প্রিমিয়াম নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ভেনিসে বণিকরা অংশীদারী বাণিজ্য সংস্থা গঠন করে ঋণ নিত। তবে ভেনিসের বাণিজ্যমুখীনতা সত্ত্বেও একটা অসুবিধা ছিল, ব্যাঙ্কিং ও ঋণদান ব্যবস্থা খুব সংগঠিত ছিল না। ভেনিস ঋণ সরবরাহ ব্যবস্থাটিকে সুগঠিত রূপ দিতে পারেনি। ষোড়শ শতকে ভেনিসে কয়েকটি ব্যাঙ্কিং পরিবার গড়ে উঠেছিল, এরা বণিকদের বাণিজ্য ঋণ সরবরাহ করত। ভেনিসের ব্যাঙ্কিং পরিবারগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল টাইপােলাে, পিসানি ও প্রিউলি। লেভান্ট বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিলে এই ব্যাঙ্কিং পরিবারগুলি দুরাবস্থার মধ্যে পড়েছিল। এযুগে ফ্লোরেন্স ফরাসি রাজতন্ত্রের সহায়তা নিয়ে লিঁওতে (Lyons) একটি ঋণ সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। মেদিচি পরিবার এখানে দুটি ব্যাঙ্ক স্থাপন করেছিল। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে মেদিচি পরিবার বাণিজ্যিক ঋণ সরবরাহ করার চেয়ে রাজাদের অগ্রিম দানের ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল। পঞ্চদশ শতকে ইউরােপের ব্যাঙ্কিং কারবারে চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটেছিল। ইউরােপের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য নতুন ধরনের ঋণ সংস্থার প্রয়ােজন হয়েছিল। স্বল্প মেয়াদ বড়াে ঋণের দরকার হয়েছিল। যারা ঝুঁকি নিয়ে ভৌগােলিক আবিষ্কার ও উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ঋণ দেবেন এমন ফাটকাবাজ ঋণ সরবরাহ সংস্থার প্রয়ােজন দেখা দেয়। প্রসারমান ইউরােপের কাছে পুরনাে ব্যাঙ্কিং প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল। ষােড়শ শতকে আগ্রাসী সম্প্রসারণশীল ইউরােপের ব্যাঙ্কার হল দক্ষিণ জার্মানির ঋণ ব্যবসায়ীরা।

ষােড়শ শতকের ইউরােপে শিল্প ও বাণিজ্যের বড়াে ঘাঁটি হল আন্টওয়ার্প। এখানে ব্যাঙ্কিং ও বিনিময়ের বড়াে কেন্দ্র গড়ে ওঠে, এগুলির পরিচালক ছিল দক্ষিণ জার্মানির ওয়েলসার, ফুগার, হকস্টেটার ও ইমহােপ পরিবার। আন্টওয়ার্পে ব্যাঙ্কিং কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল মধ্য ইতালির টাসকেনির চিগি, ডুক্কি ও বনভিসি পরিবার। মেদিচিরা এখানে ব্যাঙ্কিং কারবার শুরু করেনি কারণ এখানে স্পেনের প্রাধান্য ছিল আর স্পেন ছিল ফ্রান্সের শত্রু। মেদিচিরা ফ্রান্সের ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করত। ষােড়শ শতকে ইউরােপের শিল্প ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছিল, বলা যায় এই সময় থেকে ইউরােপ বিশ্ব অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়। আন্টওয়ার্প থেকে পূর্ব ও পশ্চিমে ইউরােপের বাণিজ্য পরিচালিত হত। আন্টওয়ার্পের স্টক এক্সেচেঞ্জ ইংলন্ডের পশম বাণিজ্য, এশিয়া ও অমেরিকা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। দক্ষিণ জার্মানির পুঁজি এখানকার ঋণের বাজারকে চাঙ্গা করে রেখেছিল। আন্টওয়ার্প আরও একটি অর্থনৈতিক লেন-দেনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ফ্লান্ডার্স অঞ্চলে যেসব মেলা বসত সেখানে আন্টওয়ার্প বিল বিক্রি করত। মিউনিসিপ্যালিটি ও রাজসভার ব্যাঙ্কার হিসেবেও আন্টওয়ার্প কাজ করত। এই অঞ্চলের সব রাজাদের ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করা ছাড়াও আন্টওয়ার্প স্পেনের ব্যাঙ্কার হিসেবেও কাজ করত। অভিজাতরা এদের বিল নিয়ে আর্থিক সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হত। ইংলন্ডের রাজা ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি এদের কাছ থেকে ঋণ নিত। পর্তুগালের রাজার হয়ে আন্টওয়ার্পের স্টক এক্সচেঞ্জ কাজ করত, ভৌগােলিক আবিষ্কারের জন্য এরা শেয়ার বিক্রি করে অর্থসংগ্রহ করে দিত। আন্টওয়ার্প ব্যাঙ্কিং ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে কিছু নতুন নিয়ম-রীতি প্রবর্তন করেছিল। স্পেনের রাজপরিবারের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের জন্য ফুগার পরিবারের পতন ঘটেছিল। ইংলন্ড আন্টওয়ার্পের ওপর আর ভরসা রাখতে পারেনি, ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ড নিজের স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেছিল।

আন্টওয়ার্পের পতনের পর ইউরােপের ব্যাঙ্কিং জগতে জেনােয়ার লোকদের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। জেনােয়ার ব্যাঙ্কাররা সেভিল থেকে অমেরিকা পর্যন্ত যে বাণিজ্য চলত তার মূলধন জোগাত। ইউরােপের বাইরে এশীয় বাণিজ্যে পর্তুগিজদের প্রাধান্য ছিল, তারা নিজেদের মূলধন নিজেরা সংগ্রহ করত। জেনােয়ার বণিকদের পুঁজি ছিল, ছিল জাহাজ, এগুলি নিয়ে তারা ব্যাঙ্কিং-এর কাজ করত। স্পেনের ব্যাঙ্কার হিসেবে তারা কাজ করেছিল। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে জেনােয়া ইউরােপের পুঁজি ব্যবসা থেকে সরে এলে ডাচরা শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিল। আমস্টারডামে ব্যাঙ্ক স্থাপিত হলে (১৬০৯) ইউরােপের নতুন পুঁজি সরবরাহ কেন্দ্র হল এই শহর, স্টক এক্সচেঞ্জও গড়ে উঠেছিল। রাষ্ট্র, ব্যাক্তি, রাজসভা ও বণিকদের ঋণ সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল আমস্টারডাম। হল্যান্ড, জার্মানি ও ইংলন্ডের বাণিজ্যিক পুঁজি সরবরাহ করত আমস্টারডাম। অষ্টাদশ শতকে এই ব্যাঙ্ক ২৫০ মিলিয়ন ফ্লোরিন ঋণ সরবরাহ করেছিল। রাজাদের ঋণ দিয়ে আমস্টারডাম ব্যাঙ্ক বিপদ ডেকে এনেছিল। অষ্টাদশ শতকে আমস্টারডাম ছাড়াও লন্ডন, প্যারিস ও জেনেভাতে ব্যাঙ্কিং ও বিনিময়ের কারবার জোরদার হয়ে উঠেছিল। ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত আমস্টারডাম কেন্দ্রিক ব্যাঙ্কিং ও বিমিময় ব্যবস্থা চালু ছিল।

আন্টওয়ার্প বন্দরের উত্থান ও পতন

আন্টওয়ার্প বন্দরটি ছিল প্রথমে বারগান্ডির অধীনস্থ নেদারল্যান্ডে, পরে এই অঞ্চল অস্ট্রিয়া ও স্পেনের হ্যাপসবার্গ রাজবংশের অধীনে স্থাপিত হয়। রেনেশাঁস ইউরােপে এটি ছিল সবচেয়ে বড়াে বাণিজ্য কেন্দ্র (বর্তমানে এই বন্দর-শহর বেলজিয়ামে)। আন্টওয়ার্পকে বলা হয়েছে বিশ্বের একটি ফুল (one of the flowers of the world)। এর পর আর কোনাে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি যার হাতে ছিল বিশ্বের সব প্রধান দেশের বাণিজ্য। আন্টাওয়ার্প ছিল একটি বন্দর, বাণিজ্য কেন্দ্র, পুঁজি সরবরাহ কেন্দ্র এবং শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্র। ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই বন্দর-শহরের উত্থান শুরু হয়। পর্তুগালের রাজার বাণিজ্য প্রতিনিধি এটিকে মশলা বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত করলে এর দ্রুত উত্থান চলতে থাকে। ষোড়শ শতকের প্রথম ছয় দশক হল এর উত্থানের স্বর্ণযুগ। আন্টওয়ার্পের মাধ্যমে পর্তুগালের মশলা ইউরােপের দেশগুলিতে সরবহার করা হত। পর্তুগালের ঔপনিবেশিক বাণিজ্য ছিল রাজার একচেটিয়া, রাজকীয় প্রতিনিধি এই পণ্য ইউরােপের দেশগুলিতে সরবরাহ করত। পর্তুগাল আন্টওয়ার্প বন্দরে তার মশলা ও অন্যান্য পণ্য পাঠিয়েছিল ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে। ঠিক দুবছর পর পর্তুগাল এখানে এক হাজার টন মশলা রপ্তানি করেছিল। পর্তুগাল এখান থেকে কিনত খাদ্যশস্য, তামা, ধাতবদ্রব্য, বস্ত্র ও রুপাে। এগুলি সে আফ্রিকা ও দূরপ্রাচ্যে পাঠিয়ে মশলা সংগ্রহ করত। পর্তুগাল ছাড়াও আরও দুটি বণিকগােষ্ঠি দক্ষিণ জার্মানির বণিক সংস্থা ও ইংলন্ডের বস্ত্র ব্যবসায়ীরা আন্টওয়ার্প বন্দরে বাণিজ্যের জন্য এসেছিল। সে যুগে মশলা বাণিজ্যে খুব ঝুঁকি ছিল, দূর দেশ থেকে এই পণ্যসংগ্রহ করতে হত, তবে এই বাণিজ্যে লাভ হত প্রচুর।

বহুকাল ধরে নেদারল্যান্ড ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। গােটা অঞ্চল ছিল এক সময় অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র। ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলের ব্রুজ ছিল একটি বড় বাণিজ্য কেন্দ্র, পঞ্চদশ শতকে আন্টওয়ার্প একে অতিক্রম করে যায়। আবার সপ্তদশ শতকে এসে আমস্টারডাম আন্টওয়ার্পকে অতিক্রম করেছিল। অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতন হল ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এর অবক্ষয়ের কারণ। চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে আন্টওয়ার্পের সম্ভাবনার সূত্রপাত, ইংরেজ বণিকরা এই বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্য করতে শুরু করেছিল। বারগান্ডির রাজবংশের নেতৃত্বে এই বন্দর শহর খ্যাতিলাভ করেছিল। হেনরি পিরেন ষোড়শ শতকে আন্টওয়ার্পের সাফল্যের চারটি কারণ দেখিয়েছেন। কারণগুলি হল সমুদ্র থেকে বন্দর পর্যন্ত জলের গভীরতা, এখানকার পােতাশ্রয়গুলির সুব্যবস্থা, ইংরেজ বস্ত্রবণিকদের আগমন, সেই সঙ্গে ছিল ধনী জার্মানদের এখানে বাণিজ্য করার ইচ্ছা। সর্বোপরি, এই বন্দর ছিল অত্যন্ত উদার, অনতিবিলম্বে বন্দর কর্তৃপক্ষ সব বাণিজ্য সমস্যার সমাধান করে দিত। একটি বড়াে বন্দরের জন্য সবচেয়ে প্রয়ােজন হল সহজগম্যতা। আন্টওয়ার্পের উত্থানের সময় এর জলের গভীরতা ও নাব্যতা বেড়েছিল যা এর উত্থানের জন্য অনেকখানি দায়ী ছিল। প্রত্যেক বছর ২০০-৩০০ জাহাজ এই বন্দরে বাণিজ্য করতে আসত। আন্টওয়ার্প বন্দরের অন্য সুবিধা ছিল, ইউরােপের প্রধান স্থলপথগুলির কেন্দ্রস্থলে ছিল এই বন্দর।

আন্টওয়ার্প বন্দরে জার্মানদের বড়াে ধরনের বাণিজ্য ছিল। হান্‌স বণিক ও দক্ষিণ জার্মানির বণিকরা তাদের প্রধান পণ্য বস্ত্র ও ধাতব দ্রব্য নিয়ে এখানে বাণিজ্য করতে এসেছিল। ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে এসব পণ্যের খুব চাহিদা ছিল। জার্মানির বিখ্যাত বাণিজ্য সংস্থা ফুগার, হকস্টেটার, ওয়েলসার ও টুসের এখানে বস্ত্র ও ধাতব দ্রব্যের এক গড়ে তুলেছিল। ইতালীয় বণিকরা এখানে নিয়ে আসত সূক্ষ্ম বস্ত্র ও প্রাচ্যের মশলা। শুধু এজন্য নয়, তাদের বাণিজ্যিক ও আর্থিক অভিজ্ঞতার জন্য এই বন্দরে তাদের কদর ছিল। আন্টওয়ার্প বন্দরের প্রথমদিককার সব ব্যাঙ্কার ছিল ইতালির লােক। তবে আন্টওয়ার্প বাণিজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি দখল করেছিল ইংরেজ বস্ত্র বণিকরা। আন্টওয়ার্প বন্দরে তিনটি প্রধান বাণিজ্য পণ্য হল জার্মানির ধাতু ও ধাতবদ্রব্য, ইংলন্ডের বস্ত্র এবং পর্তুগালের মশলা। ইউরােপের বিভিন্ন জাতি এই বন্দরে বাণিজ্য করতে আসত কারণ এখানকার বন্দর কর্তৃপক্ষ ছিল উদার ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। চারটি কারণে এখানকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সমৃদ্ধি লক্ষ করা যায়। এই চারটি কারণ হল এখানকার বাণিজ্য পদ্ধতি, বাণিজ্যের পরিবেশ, দুটি বাণিজ্য মেলার জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত এবং নেদারল্যান্ড সরকারের নীতি। ইউরােপের সর্বত্র একই ধরনের বাণিজ্য পদ্ধতির চলন ছিল। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাণিজ্যের পরিমাণ ও জটিলতা বেড়েছিল, সেই সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবস্থারও উন্নতি হয়। যেসব দেশ আন্টওয়ার্প বন্দরে বাণিজ্য করতে এসেছিল কর্তৃপক্ষ তাদের উদারভাবে বাণিজ্যিক সুযােগ-সুবিধা দেয়। স্থানীয় বন্দর কর্তৃপক্ষ ইংরেজ বণিকদের সবচেয়ে সুবিধাজনক শর্তে বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিল। আন্টওয়ার্প বন্দরে বছরে দুবার মেলা বসত, সেই সময় – বাণিজ্যিক লেনদেন বেড়ে যেত। আন্টওয়ার্পের উত্থানের পেছনে আরাে একটি কারণ হল হ্যাপসবার্গ রাজংবশের পৃষ্ঠপােষকতা। সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান এবং পঞ্চম চার্লস দুজনেই এই বাণিজ্য কেন্দ্রটিকে সযত্নে রক্ষা করেন, উন্নতির ব্যবস্থা করে দেন। এই বন্দর রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভােগ করত। হ্যাপসবার্গ শাসকরা একে সমর্থন করত কারণ আর্থিক সংকটের সময় এখান থেকে সাহায্য আসত। এই বন্দর সাম্রাজ্যের নীতি মেনে চলত। সম্রাটের প্রতি অনুগত ছিল।

ইতালির বুদ্ধিজীবী গুইসিয়ারডিনি মনে করেন ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই বন্দর ছিল সাফল্যের শীর্ষে। এখানে প্রায় ষোলাে মিলিয়ন সােনার ক্রাউনের বাণিজ্য হত। এর মধ্যে পাঁচ মিলিয়ন ছিল ইংরেজ বণিকদের বস্ত্র বাণিজ্য, প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এর পরে ছিল ইতালীয় বণিকদের পণ্য যার মধ্যে সূক্ষ্ম বস্ত্র ছিল প্রধান, এর মূল্য হল তিন মিলিয়ন। বাল্টিক অঞ্চলের গম বাণিজ্য ছিল প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন, জার্মান মদের ব্যবসা ছিল ১.৫ মালিয়ন। ফরাসি মদ ও পর্তুগিজ মশলা বাণিজ্য ছিল এক মিলিয়ন করে। এসবের সঙ্গে ছিল স্পেনের রপ্তানি পণ্য মদ ও পশম, জার্মানির বস্ত্র, ফরাসি পাস্টেল, ইংলন্ডের পশম এবং ফরাসি লবণ। এসব পণ্য নিয়ে আন্টওয়ার্প বন্দরের তালিকা সম্পূর্ণ হয়। প্রতি বছর বন্দর থেকে এক লক্ষ ষাট হাজার পাউন্ড পণ্য রপ্তানি করা হত। এই বন্দর নেদারল্যান্ডের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৭০-৮০% শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। এই বন্দর-শহরের আমদানি বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত হত। সাধারণভাবে বলা যায় এ যুগে আন্টওয়ার্প ছিল ইউরােপীয় বাণিজ্যের একটি প্রধান ঘাঁটি। এই বন্দর-শহরের আরও বৈশিষ্ট্য ছিল। বহু পণ্য এই বন্দরের মাধ্যমে দেশের বাজারে চলে যেত। এই বন্দর নিজেই ছিল একটি প্রধান শিল্পকেন্দ্র। উত্তর ইউপের সবচেয়ে ঘনবসতি অঞ্চলে ছিল এই বন্দর-শহরের অবস্থান। মধ্য ষােড়শ শতকে শহরে বাস করত প্রায় এক লক্ষ লােক। তাছাড়া বহু লােক বাণিজ্যের জন্য প্রতিদিন এখানে আসত, নাবিক ও পর্যটকদেরও আনাগােনা ছিল। এখানকার নাগরিকদেরও প্রয়ােজন হত খাদ্য, মাছ ও জ্বালানি। আন্টওয়ার্প বন্দরে মৎস্য সংরক্ষণ, চিনি তৈরি, সাবান তৈরির শিল্প ছিল। আন্টওয়ার্প বন্দরে প্রচুর রপ্তানিযােগ্য বস্তু আসত, অনেক বস্ত্র এখানে এসে নতুন রূপ পেত, এই শিল্পও এখানে গড়ে উঠেছিল। ইউরােপে এসময় যুদ্ধবিগ্রহ চলেছিল, সেজন্য অস্ত্রশস্ত্রের চাহিদা বেড়েছিল। আটওয়ার্প শিল্পে তৈরি হত আসবাবপত্র, মেঝে ও দেওয়াল শােভন পণ্য, চিত্রকলা, অলংকার, কাচের পাত্র, বই, কাগজ, মানচিত্র এবং বাদ্যযন্ত্র। বস্ত্র শিল্পের জন্য বন্দর আমদানি করত ফিটকিরি (alum) এবং রঙ। আন্টওয়ার্প বন্দরে এসব পণ্যের ক্রেতা ছিল স্পেন ও পর্তুগাল।

আন্টওয়ার্প বন্দরের আমদানি-রপ্তানি পণ্য ও লেনদেনের কাজ পরিচালনা করত বিদেশিরা – ইংরেজ, জার্মান, পর্তুগিজ ও স্পেনীয়রা। লেন-দেনের ব্যাপারে স্থানীয় লােকজনের ভূমিকা ছিল অধীনস্থের। বিদেশিরা এখানে উপনিবেশ বানিয়ে প্রায় স্থায়ীভাবে বসবাস করত। বিদেশি এরাসমাস সেজ ও গিলিস লুফটম্যান আন্টওয়ার্প বন্দরের ভাগ্য নির্মাণে বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল। এখানে পণ্য ক্রয় বা বিক্রয়ের জন্য নগদ টাকার প্রয়ােজন হত না, বিলের মাধ্যমে পণ্যের ক্রয় ও বিক্রয় চলত, ঋণও পাওয়া যেত। ব্যাঙ্কাররা এই ঋণ সরবরাহ করত। এখানে জার্মান ও ইতালীয় বণিক ও ব্যাঙ্কারদের মধ্যে প্রতিযােগিতা ছিল। এরা এখানকার জমি ও বাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে আগহ দেখাত। এধরনের কারবারে লাভ হত খুব বেশি। এই বন্দর শহরে জুয়ার কারবার ছিল, সম্ভবত সমগ্র ইউরােপে জুয়ার চলন ছিল, আন্টওয়ার্প বন্দরের বণিকরা সাধারণত ঋণের ওপর ১২-১৫% হারে সুদ নিত। চাহিদা অনুযায়ী মূলধনের সরবাহের কোনাে অসুবিধা ছিল না। ইউরােপের রাজারা আন্টওয়ার্পের ব্যাঙ্কারদের কাছ থেকে ঋণ নিত, ইংলন্ডের রাজা অষ্টম হেনরি এবং স্পেনের সম্রাট পঞ্চম চার্লস এখান থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।

১৬শ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে আন্টওয়ার্প বন্দরের অবক্ষয় লক্ষ করা যায়। স্পেন, ফ্রান্স এবং পরে পর্তুগাল দেউলিয়া ঘােষণা করলে এখানকার পুঁজির বাজারে ধস নেমেছিল। এটি ছিল এক বড়াে আঘাত, এ থেকে এই বন্দর আর কখনাে মুক্তি পায়নি। বাণিজ্য জগতে অবিরাম সংকট চলতে থাকে। পর্তুগালের যে কারখানা এই বন্দরে ছিল ১৫৪৯ খ্রিস্টাব্দে তা বন্ধ হয়ে যায়। ইউরােপের দেশগুলি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে সরাসরি মশলা সংগ্রহ করত। পর্তুগালের অর্থের প্রয়ােজন ফুরিয়েছিল, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে মূল্যবান ধাতু এখানে এসে পৌঁছেছিল। দক্ষিণ জার্মানির বণিক ও ব্যাঙ্কার ফুগার সরাসরি তার ধাতব পণ্য পর্তুগালে পাঠিয়ে দেয়, এতে আন্টওয়ার্পের আরাে অবনতি ঘটে। নানা কারণে এই বন্দরে ইংলন্ডের বস্ত্র বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথম কারণ হল এখানে প্রচুর বস্ত্র মজুত ছিল, বস্ত্র বাণিজ্যে মন্দা ছিল। দ্বিতীয় কারণ হল মুল্য বিপ্লব, আর তৃতীয় কারণ হল ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে টাকার অবমূল্যায়ন। এসব কারণে ইংলন্ডের বস্তুবাণিজ্যে অস্থিরতা এসেছিল। ইংলন্ডের বণিকরা অন্যত্র বাণিজ্য কেন্ত্রের সন্ধান করতে থাকে। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় সেনাপতি পারমা বন্দরটি দখল করে নিলে আন্টওয়ার্প বন্দরের বিপর্যয় ঘটে। প্রতিবাদে ওলন্দাজরা এর সামনের নদী শেল্ট অবরােধ করেছিল।

আন্টওয়ার্প বন্দরের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে যায় ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, এর বাণিজ্যস্তম্ভগুলি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তবে এর বাণিজ্য একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। ১৫৬৬, ১৫৭৬ ও ১৫৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক ঘটনাবলি এর ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছিল। বিদেশিরা বন্দর ছেড়ে চলে গেলে স্থানীয়রা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল, অনেকগুলি কোম্পানি স্থাপিত হয়। এসব কোম্পানি বাল্টিক সাগর ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করেছিল। এইসময় থেকে আন্টওয়ার্প আর আন্তর্জাতিক বন্দর নয়, এর পরিচয় নেদারল্যান্ডের জাতীয় বন্দর-শহর হিসেবে। একদা ইউরােপের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল এই বন্দর-শহর, সেই অবস্থা আর ছিল না।

তথ্যঋণ

  • আধুনিক ইউরোপের আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০ – ১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, ৪র্থ সংস্করণ, ২০১৪, পৃ – ১৯১-২১১

2 Trackbacks / Pingbacks

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  2. পশ্চিম ইউরোপে ১৫শ থেকে ১৭শ শতকের মুদ্রণ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও সামরিক বিপ্লব –

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.