(নীহাররঞ্জন রায় এর “বাঙ্গালীর ইতিহাস:আদিপর্ব” গ্রন্থের “বর্ণ বিন্যাস” অধ্যায়ের চলিতরূপ)
Table of Contents
ভূমিকা
বর্ণাশ্রম প্রথার জন্মের ইতিহাস আলোচনা না করেও বলা যেতে পারে, বর্ণবিন্যাস ভারতীয় সমাজ-বিন্যাসের ভিত্তি। খাওয়া-দাওয়া এবং বিবাহ ব্যাপারের বিধিনিষেধের উপর ভিত্তি করে আর্যপূর্ব ভারতবর্ষের যে সমাজব্যবস্থার পত্তন ছিল তাকে পিতৃপ্রধান আর্যসমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঢেলে সাজিয়ে নুতন করে গড়েছিল। এই নতুন করে গড়ার পেছনে একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুক্তি কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। যে যুগে বাংলার ইতিহাসের সূচনা সেযুগে বর্ণাশ্রম আদর্শ গড়ে উঠেছে, ভারতীয় সমাজের উচ্চতর এবং অধিকতর প্রভাবশালী শ্রেণীগুলোতে তা স্বীকৃত হয়েছে, এবং ধীরে ধীরে তা পূর্ব ও দক্ষিণ ভাবতবর্ষে বিস্তৃত হয়েছে। বর্ণাশ্রমের এই সামাজিক আদর্শের বিস্তারের কথাই এক হিসেবে ভাবতবর্ষে আর্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিস্তা্রের ইতিহাস, কারণ ঐ আদর্শের ভেতরেই ঐতিহাসিক যুগের ভারতবর্ষের সংস্কার ও সংস্কৃতির সকল অর্থ নিহিত। বর্ণাশ্রমই আর্যসমাজের ভিত্তি, শুধু ব্রাহ্মণ্য সমাজেরই নয়, জৈন এবং বৌদ্ধ সমাজেরও। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যপূর্ব ও অনার্য সংস্কার এবং সংস্কৃতি এই বর্ণাশ্রমের কাঠামো এবং আদর্শের মধ্যেই সমন্বিত ও সমীকৃত হয়েছে। বস্তুত, বর্ণাশ্রমগত সমাজ-বিন্যাস এক হিসেবে যেমন ভারত-ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্টা, তেমনই অন্য দিকে এমন সর্বব্যাপী এমন সবগ্রাসী এবং গভীর অর্থবহ সমাজব্যবস্থাও পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। প্রাচীন বাংলার সমাজবিন্যাসের কথা বলতে গিয়ে সেজন্য বর্ণবিন্যাসের কথা বলতেই হয়।
বর্ণাশ্রম প্রথা ও অভ্যাস যুক্তিপদ্ধতিবদ্ধ করেছিলেন প্রাচীন ধৰ্মসূত্র ও স্মৃতিগ্রন্থের লেখকেরা। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চতুর্বর্ণের কাঠামোর মধ্যে তারা সমস্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন। এই চতুর্বর্ণ প্রথা অলীক উপন্যাস, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। কারণ ভারতবর্ষে এই চতুৰ্বর্ণের বাহিরে অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোম ছিল, প্রত্যেক বর্ণ, জন ও কোমের ভেতর আবার ছিল অসংখ্য স্তর-উপস্তর। ধর্মসূত্র ও স্মৃতিকারেরা নানা অভিনব অবাস্তব উপায়ে এসব বিচিত্র বর্ণ, জন ও কোমের স্তর-উপস্তর ইত্যাদি ব্যাখ্যা করতে এবং সবকিছুকেই আদি চতুৰ্বর্ণের কাঠামোর যুক্তিপদ্ধতিতে বাঁধতে চেষ্টা করেছেন। সেই মনু-যাজ্ঞবল্ক্যের সময় থেকে আরম্ভ করে ১৫শ-১৬শ শতকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই চেষ্টার কখনও বিরাম হয়নি। একথা অবশ্যস্বীকার্য যে স্মৃতিকারদের রচনার মধ্যে সমসামযিক বাস্তব সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন আছে, সেই অবস্থার ব্যাখ্যার একটা চেষ্টা আছে; কিন্তু যে যুক্তিপদ্ধতির আশ্রয়ে তা করা হয়েছে অর্থাং চতুর্বর্ণ-বহির্ভূত অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোমের নরনারীর সঙ্গে চতুর্বৰ্ণাকৃত নরনারীর যৌনমিলনের ফলে সমাজের যে বিচিত্র বর্ণ ও উপরর্ণের, বিচিত্ৰ সংকর বর্ণের সৃষ্টি করা হয়েছে, তা একান্তই অনৈতিহাসিক এবং তাই অলীক। তারপরও স্বীকার করতেই হয় আর্যব্রাহ্মণ্য ভারতীয় সমাজ আজও এই যুক্তিপদ্ধতিতে বিশ্বাসী, এবং সুদূর প্রাচীন কাল হতে আদি চতুর্বর্ণের যে কাঠামো ও যুক্তিপদ্ধতি অনুযায়ী বর্ণব্যাখ্যা হয়ে এসেছে সেই ব্যাখ্যা প্রয়োগ করে হিন্দুসমাজ আজও বিচিত্র বর্ণ, উপবর্ণ ও সংকর বর্ণের সামাজিক স্থান নির্ণয় করে থাকে। বাংলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি, আজও হচ্ছেনা।
এসব বিচিত্র বর্ণ, উপবর্ণ, সংকর বর্ণ সকল কালে ও ভারতবর্ষের সকল স্থানে এক প্রকারের ছিল না, এখনও নয়; সকল স্মৃতিশাস্ত্রে সেজন্য এক প্রকারের বিবরণও পাওয়া যায় না। প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থগুলোর একটিও বাংলায় রচিত নয়; কাজেই বাংলার বর্ণবিন্যাসগত সামাজিক অবস্থার পরিচয়ও তাতে পাওয়া যায় না, আশা করাও অযৌক্তিক এবং অনৈতিহাসিক। বস্তুত, ১১শ শতকের আগে বাংলায় বাংলার সামাজিক প্রতিফলন নিয়ে একটিও স্মৃতিগ্রন্থ বা এমন কোনও গ্রন্থ রচিত হয়নি যার ভেতর সমসাময়িক কালের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছুমাত্র পওয়া যেতে পারে। বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বীকার করলে বলতেই হয়, এই সময় থেকেই বাঙালী স্মৃতি ও পুরাণকারের সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে বাংলার সমাজব্যবস্থাকে প্রাচীনতর ব্রাহ্মণ্য স্মৃতির আদর্শ ও যুক্তিপদ্ধতি অনুযায়ী ভারতীয় বর্ণবিন্যাসের কাঠামোর মধ্যে বাঁধার চেষ্টা আরম্ভ করে। কিন্তু এই সজ্ঞান সচেতন চেষ্টার আগেই, বহুদিন থেকেই, আর্যপ্রবাহ বাংলায় প্রবাহিত হতে আরম্ভ করে; এবং আর্যধর্ম ও সংস্কৃতির স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণাশ্রমের যুক্তি এবং আদর্শও স্বীকৃতি লাভ করে। সেজন্য প্রাচীন বাংলার বর্ণবিন্যাসের কথা বলতে হলে বাংলার আর্যীকরণের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই তা আরম্ভ করতে হয়।
বাংলার বর্ণ-বিন্যাস ইতিহাসের উৎস্য
ভূমিকা
আর্যীকরণের তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্বের ইতিহাস নানা সাহিত্যগত উপাদানের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে হয়। সে উপাদান রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, মনু-বৌধায়ন প্রভৃতি স্মৃতি ও সূত্রকারদের গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থগুলোতেও এ সঙ্গন্ধে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে এবং বাংলার অন্যত্র গুপ্তাধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আর্যীকরণ তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের সূত্রপাত। এই সময় থেকে আবম্ভ করে একেবারে ১৩শ শতকের শেষ পর্যন্ত বর্ণবিন্যাস-ইতিহাসেব প্রচু্র উপাদান বাংলার অসংখ্য লিপিমালায় বিদ্যমান। বস্তৃত, সন-তারিখযুক্ত এই লিপিগুলোর মত বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরযোগ্য যথার্থ বাস্তব উপাদান আর কিছু হতেই পারে না; এগুলোর ওপর নির্ভর করেই বাংলার বর্ণবিন্যাসের ইতিহাস রচনা করা যেতে পারে, এবং সেটা করাই সবচেয়ে নিরাপদ।
তবে, সেন-বর্মণ আমলে বাংলায় প্রচুর স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। সেগুলো কখন কোন রাজার আমলে ও পোষকতায় কে রচনা করেছিলেন তা সুনির্ধারিত ও সুবিদিত। সমস্ত স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ কালের হাত এড়িয়ে আমাদের কালে এসে পৌঁছয়নি; অনেক গ্রন্থ হারিয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু যা পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে ভবদেব ভট্টের ও জীমূতবাহনের কয়েকটি গ্রন্থই প্রধান। এসব স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক বলে স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই।
স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ ছাড়া অন্তত দুইটি অর্বাচীন পুরাণ-গ্রন্থ বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, গোপালভট্ট-আনন্দভট্টকৃত বল্লালচরিত, এবং বাংলার কুলজী গ্রন্থমালায় হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর একটিকেও সমসামযিক সাক্ষ্য বলে স্বীকার করা যায় না। সেজন্য ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এরা কতটি নির্ভরযোগ্য সেই বিচার আগেই একটু সংক্ষিপ্ত ভাবে করে নেয়া প্রযোজন।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে কিছু কিছু বিচারালোচনা হয়েছে। (বৃহদ্ধর্মপুরাণ, Bib. Ind. edn; বঙ্গবাসী মুদ্রাযন্ত্র প্রকাশিত একটি সংস্করণও বিদ্যমান। উত্তরখণ্ডের ১৩শ ও ১৪শ অধ্যায়ে এবং অন্ত খণ্ডের ইতস্তত বর্ণসংবাদ বিক্ষিপ্ত। প্রথমভাগে ব্রহ্মখণ্ডের দশম অধ্যায়ের ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৭ শ্লোকে বর্ণবিন্যাস-সংবাদ নিবদ্ধ, ভারতবর্ষ মাসিকপত্র, ১৩৩৬-৩৭, ২য় খণ্ড, ৬৭৩ পৃ., ১৩৩৭ ৩৮, ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃ.। History of Bengal, I., D. U. : pp. 5’7-574, Paul, P. C., Early History of Bengal Vol. II, 59-61.) প্রথমোক্ত পুরাণটিতে পদ্মা ও যমুনা নদীর উল্লেখ, গঙ্গার তীর্থমহিমার সবিশেষ উল্লেখ, ব্রাহ্মণের মাছমাংস খাওয়ার বিধান (যা ভারতবর্ষের আর কোথাও বিশেষ নেই) ব্রাহ্মণেতর সমস্ত শূদ্রবর্ণের ছত্রিশটি উপ ও সংকর বর্ণে বিভাগ (বাংলার থাকথিত ‘ছত্রিশ জাত’ যা ভারতবর্ষে আর কোথাও দেখা যায় না) ইত্যাদি দেখে মনে হয় এই পুরাণটির লেখক বাঙালী না হলেও বাংলার সঙ্গে তার সবিশেষ পরিচয় ছিল। ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণের পৃথক অনুল্লেখ, ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ পর্যায়ে শূদ্রদের দুই ভাগ, ব্রাহ্মণদের পরেই অম্বষ্ঠ (বৈদ্য) এবং করণ (কায়স্থ)দের স্থান নির্ণয়, শংখকার (শাঁখারী), মোদক (ময়রা), তন্তুবায়, দাস (চাষী), কর্মকার, সুবর্ণবণিক ইত্যাদি উপ ও সংকর বর্ণের উল্লেখ প্রভৃতিও এই অনুমানের সমর্থক। বাংলার বাইরে অন্য কোথাও এই ধরনের বর্ণব্যবস্থা এবং এসব সংকর বর্ণ দেখা যায় না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা বলা চলে; বস্তুত, বৃহদ্ধর্মপুবাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণব্যবস্থার চিত্র প্রায় এক এবং অভিন্ন, এবং তা যে বাংলা সম্বন্ধেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য তাওও অস্বীকার করা যায় না। এই দুই গ্রন্থের রচনাকাল নির্ণয় করা কঠিন; তবে এই কাল ১২শ শতকের আগে নয় এবং ১৪শ শতকের পরে নয় বলে অনুমিত হয়েছে। যদি তা হয় তাহলে বলা যায়, এই দুই পুরাণে বাংলার হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবির একটা মোটামুটি কাঠামো পাওয়া যাচ্ছে।
বল্লালচরিত
বল্লালচরিত নামে দুটি গ্রন্থ প্রচলিত। একটির গ্রন্থকার আনন্দভট্ট; নবদ্বীপের রাজা বুদ্ধিমন্ত খাঁর আদেশে তার গ্রন্থটি রচিত হয়। রচনাকাল ১৫১০ খ্ৰীষ্টাব্দ।(Vallala-Charita, ed. Haraprasad Sastri, Asiatic Society of Bengal. 1904.)। আনন্দভট্টের পিতা দাক্ষিণাত্যগত ব্রাহ্মণ, নাম অনন্তভট্ট। আর একটি গ্রন্থ পূর্বখণ্ড, উত্তরখণ্ড ও পবিশিষ্ট এই তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডের রচয়িতার নাম গোপালভট্ট, গোপালভট্ট নাকি বল্লালসেনের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন, এবং বল্লালের আদেশানুসারে ১৩০০ শকে নাকি গ্রন্থটি রচিত হয়। তৃতীয় খণ্ড রাজার ক্ৰোধোৎপাদনের ভয়ে গোপালভট্ট নিজে লিখে যেতে পারেননি; দুশো বছর পর ১৫০০ শকে আনন্দভট্ট তা রচনা করেন।(Vallala-Charita, ed. by Harischandra Kaviratna, 1889.)। দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে নানা কুলজীবিবরণ, বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তিকথা ইত্যাদি আছেই, তাছাড়া প্রথম গ্রন্থে বল্লাল কর্তৃক বণিকদের ওপর অত্যাচার, সুবর্ণবণিকদের সমাজে ‘পতিত’ করা এবং কৈবর্ত প্রভৃতি বর্ণের লোকদের উন্নীত করা প্রভৃতি যেসব কাহিনী বর্ণিত আছে তারও পুনঃবিবৃতি আছে। দ্বিতীয় গ্রন্থে বল্লালের যে তারিখ দেওয়া হয়েছে তা বল্লালের যথার্থ কাল নয়; কাজেই গোপালভট্ট বল্লালের সমসাময়িক ছিলেন একথাও সত্য নয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই গ্রন্থটিকে বলেছিলেন ‘জাল’; আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা সম্পাদিত প্রথম গ্রন্থটিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘জাল’।(Intro. to the English trans. of the Vallalacharita by Haraprasad Sastri, pp. v.-vi.; Ep. Ind. XV, p. 281; যতীন্দ্রমোহন রায়, ঢাকা)।
বল্লালচরিতের কাহিনীটি হলো – “সেনরাজ্যে বল্লভানন্দ নামে একজন মস্তবড় ধনী বণিক ছিলেন। উদন্তপুরীর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য বল্লালসেন বল্লভানন্দের কাছ থেকে একবার এক কোটি নিষ্ক ধার করেন। বারবার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর বল্লাল আর একবার শেষ চেষ্টা করার জন্য প্রস্তুত হন, এবং বল্লভানন্দের কাছ থেকে আরও দেড় কোটি সুবর্ণ (মুদ্রা) ধার চেয়ে পাঠান। বল্লভানন্দ সুবর্ণ পাঠাতে রাজি হন, কিন্তু তৎপরিবর্তে হরিকেলির রাজস্ব দাবি করেন। বল্লাল এতে ক্রুদ্ধ হয়ে অনেক বণিকের ধনরত্ব কেড়ে নেন এবং নানাভাবে তাদের ওপর অত্যাচার করেন। এরপর আবার সৎশূদ্রদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসে আহার করতে তাদের আপত্তি আছে বলে বণিকেরা রাজপ্রাসাদে এক আহারের আমন্ত্রণ অস্বীকার করে। এই প্রসঙ্গেই বল্লাল শুনতে পান যে বণিকদের নেতা বল্লভানন্দ পালরাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছেন, এবং মগধের রাজা তার জামাতা। বল্লাল অতিমাত্রায় ক্রুদ্ধ হয়ে সুবর্ণবণিকদের শূদ্রের স্তরে নামিয়ে দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে এই বিধানও দিয়ে দিলেন যে, তাদের পূজা অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করলে ও তাদের কাছ হতে দান গ্রহণ করলে কিংবা তাদের শিক্ষাদান করলে ব্রাহ্মণেরাও ‘পতিত’ হবেন। বণিকের তখন প্রতিশোধ নেবার জন্য দ্বিগুণ ত্রিগুণ মূল্য দিয়ে সমস্ত দাসভৃত্যদের হাত করে ফেলল। উচ্চবর্ণের লোকেরা বিপদে পড়ে গেলো। বল্লাল তখন বাধ্য হয়ে কৈবর্তদেরকে জলচল সমাজে উন্নীত করে দিলেন, তাদের নেতা মহেশকে মহামাগুলোক পদে উন্নীত করলেন। মালাকার, কুম্ভকার এবং কর্মকার, এরাও সৎশূদ্র পর্যায়ে উন্নীত হল। সূবর্ণবণিকদের পৈতা পরা নিষিদ্ধ হয়ে গেল; অনেক বণিক দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বল্লাল উচ্চতর বর্ণের মধ্যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখে অনেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কে শুদ্ধিযজ্ঞের বিধান দিলেন। ব্যবসায়ী নিম্নশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব একেবারে ঘুচে গেল, তারা ব্রাহ্মণ-সমাজ থেকে ‘পতিত’ হলেন।“
কাহিনীটির ঐতিহাসিক যথার্থতা স্বীকার করা কঠিন; কিন্তু একে একেবারে অলীক কল্পনাগত উপন্যাস বলে উড়িয়ে দেয়া আরও কঠিন। গ্রন্থদুটিকেও ‘জাল’ বলে মনে করিবার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান নেই। সেনবংশ ‘ব্রহ্মক্ষত্ৰ’ বংশ; বল্লাল সেন কলিঙ্গরাজ চোড়গঙ্গের বন্ধু ছিলেন (সমসাময়িক তারা ছিলেনই); বল্লালের সময়ে কীকটমগধ পালবংশের করায়ত্ত ছিল এবং তার আমলেই পালবংশের অবসান হয়েছিল; বল্লাল মিথিলায় সমরাভিযান প্রেরণ করেছিলেন – বল্লালচরিতের এসব তথ্য অন্যান্য স্বতন্ত্র সুবিদিত নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। এসব কারণ দেখিয়ে কোনও কোনও ঐতিহাসিক যথার্থই বলেছেন, বল্লালচরিত ‘জাল’ গ্রন্থ নয়, এবং এর কাহিনী একেবারে ঔপন্যাসিকও নয়। তাদের মতে ১৬শ-১৭শ শতকে প্রচলিত লোক-কাহিনীর ওপর নির্ভর করে বল্লালচরিত এবং এই জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থ রচিত হয়েছিল; কেউ কেউ এও মনে করেন যে “The Vallala charità contains the distorted echo of an internal disruption caused by the partisans of the Pāla dynasty which proved an important factor in the collapse of the Sena rule in Bengal.” এই মত সর্বথা নির্ভরযোগ্য।(H B (D.V.), I, pp. 239-4)। তবে, এই কাহিনীকে যতটা বিকৃত প্রতিধ্বনি বলে মনে করা হয় সেরকমটা নাও হতে পারে। আমরা জানি কৈবর্তরা পালরাষ্ট্রের প্রতি খুব প্রসন্ন ছিলেন না, একবার তারা বিদ্রোহী হয়ে এক পালরাজাকে হত্যা করে বরেন্দ্র বহুদিন তাদের করায়ত্তে রাখিয়াছিলেন। কাজেই সেই কৈবর্তদের প্রসন্ন করা এবং তাদের হাতে রাখিতে চেষ্টা করা বল্লালের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষত মগধের পালদের সঙ্গে শত্রুতা যখন তাদের ছিলই। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে সেন-রাষ্ট্রেব সামাজিক আদর্শের, স্মৃতি ও পুরাণ গ্রন্থাদিতে সমসাময়িক সমাজ-বিন্যাসের যে পরিচয় আমরা পাই তাতে স্পষ্টই মনে হয় সমাজে বণিকদের স্থান খুব মর্যাদাপুর্ণ ছিল না। বৃহদ্ধর্মপুরাণে তাঁতী, গন্ধবণিক, কর্মকার, তৌলিক, (সুপারি ব্যবসায়ী), কুমার, শাঁখারী, কাঁসারী, বারজীবী (বারুই), মোদক, মালাকার সকলকে উত্তম সংকর পর্যায়ে গণ্য করা হয়েছে, অথচ স্বর্ণকার-সুবর্ণবণিকেরা ধীবর-রজকের সঙ্গে জল-অচল মধ্যম সংকর পর্যায়ে। এর তো কোনও যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বল্লালচরিতে এ সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে একটা যুক্তি আছে; রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক কারণে এরকম হওয়া খুব বিচিত্র নয়। একে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। সেন-বর্মণ আমলে এরকম পর্যায় নির্ণয় যে হয়েছে স্মৃতিগ্রন্থগুলোই তার সাক্ষ্য। লোকস্মৃতি এক্ষেত্রে একেবারে মিথ্যাচরণ করেছে, এমন মনে হচ্ছে না। বল্লালচরিত-কাহিনী একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হলেও এর মূলে যে একটি ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে, তার আভাস পাওয়া যায়।
কুলজীগ্রন্থমালা
বল্লালচরিতের ঐতিহাসিক ভিত্তি কিছুটা স্বীকার করা গেলেও কুলজী গ্রন্থের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করা অত্যন্ত কঠিন। বাংলায় কুলজী গ্রন্থমালা সুপরিচিত, সুআলোচিত। ব্রাহ্মণ-কুলজীগ্রন্থমালায় ধ্রুবানন্দ মিশ্রের মহাবংশাবলী বা মিশ্র গ্রন্থ, নুলো পঞ্চাননের গোষ্ঠকথা, বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম, ধনঞ্জয়ের কুলপ্রদীপ, মেলপনায় গণনা, বারেন্দ্র কুলপঞ্জিকা, কুলার্ণব, হরিমিশ্রের কারিক, এডু মিশ্রের কাবিকা, মহেশের নির্দোষ কুলপঞ্জিকা এবং সর্বানন্দ মিশ্রের কুলতত্বার্ণব প্রভৃতি গ্রন্থ সমধিক প্রসিদ্ধ। ধ্রুবানন্দের মহাবংশাবলী ১৫শ শতকের রচনা বলে অনুমিত; মুলে পঞ্চানন এবং বাচস্পতি মিশ্রের গ্রন্থের কাল ১৬শ-১৭শ শতক হতে পারে। বাকি কুলজীগ্রন্থ সমস্তই অর্বাচীন। বস্তুত, কোন কুলজী গ্রন্থেরই রচনাকাল ১৫শ শতকের আগে নয়; অধিকাংশ কুলজীগ্রন্থ এখনও পাণ্ডুলিপি আকারেই পড়ে আছে, এবং নানা উদ্দেশ্যে নানা জনে এগুলোর পাঠ অদলবদলও করেছেন, এমন প্রমাণও পাওয়া গিযাছে। বৈদ্য-কুলজী গ্রন্থের মধ্যে রামকান্তের কবিকণ্ঠহার এবং ভরত মল্লিকের চন্দ্র প্রভা সমধিক খ্যাত; এগুলোর রচনাকাল যথাক্রমে ১৬৫৩ ও ১৬৭৩ খ্ৰীষ্টাব্দ। কায়স্থ এবং অন্যান্য বর্ণেরও কুলজী ইতিহাস পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো কিছুতেই ১৭শ-১৮শ শতকের আগেকার রচনা বলে মনে করা যায় না। ১৯শ শতকের শেষপাদ হতে আরম্ভ করে একান্ত আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলার অনেক পণ্ডিত এসব পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত কুলজীগ্রন্থ অবলম্বন করে বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করেছেন, এবং এখনও অনেক কৌলীন্য মর্যাদাগর্বিত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বংশ এসব কুলজীগ্রন্থের সাক্ষ্যের ওপরই নিজেদের বংশমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। বস্তুত, বাংলার কৌলীন্যপ্রথা একমাত্র এই কুলশাস্ত্র বা কুলজী গ্রন্থমালার সাক্ষ্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত।
একান্ত সাম্প্রতিক কালে উচ্চশ্রেণীর সামাজিক মর্যাদা যে ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তাকে আঘাত করা অত্যন্ত কঠিন। নানা কারণেই ঐতিহাসিকের এসব কুলজীগ্রন্থমালার সাক্ষ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতিতে আলোচনার বিষয়ীভূত করেননি, যদিও অনেকে তাদের সন্দেহ ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেননি। এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য প্রথম বিচার করেন রমাপ্রসাদ চন্দ।(Chanda, R. P., Indo-Aryan Races, Chap. V.)। খুব সাম্প্রতিককালে রমেশচন্দ্র মজুমদার এসব কুলজীগ্রন্থের বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিচার করেছেন; তার সুদীর্ঘ বিচারালোচনার যুক্তিবত্তা অবশ্যস্বীকার্য।(ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৬, কার্তিক—ফাল্গুন, HB (D U.), pp. 623-34)।
প্রথমত, ১৬শ ও ১৭শ শতকে যখন কুলশাস্ত্রগুলো প্রথম রচিত হতে আরম্ভ করে তখন মুসলমান-পূর্ব যুগের বাংলার সামাজিক বা রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙালীর জ্ঞান ও ধারণা খুব অস্পষ্ট ছিল। (Majumdar, R. C., “An Indigenous History of Bongal,” ln Proc, of the Ind, Hist. Records Commission, XVI, 59 ff.)। কোন ও কোন ও পারিবারিক ইতিহাসের অস্তিত্ব হয়ত ছিল, কিন্তু আজ সেগুলোর সত্যাসত্য নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব। এসব বংশাবলী এবং প্রচলিত অস্পষ্ট রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে, অর্ধসত্য অর্ধকল্পনার নানা কাহিনীতে সমৃদ্ধ করে এই কুলশাস্ত্রগুলো রচনা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এসব গ্রন্থোক্ত কাহিনী ও বিবরণ বংশমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে পড়ে নানা উদ্দেশ্যে নানাভাবে পাঠ-বিকৃতি লাভ করে এবং নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও কাহিনীদ্বারা সমৃদ্ধতর হয়। কাজেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসেবে এগুলোর ওপর নির্ভর করা কঠিন। ১৫শ-১৬শ শতকে, প্রায় ২০০-২৫০ বছর মুসলমানাধিপত্যের পর বর্ণহিন্দুসমাজ নিজের ঘর নতুন করে গোছাতে আরম্ভ করে, রঘুনন্দন তখনই নতুন স্মৃতিগ্রস্থাদি রচনা করে নতুন সমাজনির্দেশ দান করেন; চারদিকে নতুন আত্মসচেতনার আভাস সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। কুলশাস্ত্রগুলোর রচনাও তখনই আরম্ভ হয়, এবং প্রচলিত ধর্ম ও সমাজব্যবস্থাকে প্রাচীনতর কালের স্মৃতিশাসনের সঙ্গে যুক্ত করে তার একটা সুসঙ্গত ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা ও পণ্ডিতদের মধ্যে উদগ্র হয়ে দেখা দেয়। সেন-বর্মণ আমলই স্মৃতিরচনা ও স্মৃতিশাসনের প্রথম সুবর্ণযুগ; কাজেই কুলশাস্ত্রকারেরা সেই যুগের সঙ্গে নিজেদের ব্যবস্থা-ইতিহাস যুক্ত করবেন তাও কিছু আশ্চর্য নয়!
দ্বিতীয়ত, কুলশাস্ত্রকাহিনীর কেন্দ্রে বসে আছেন রাজা আদিশূর। আদিশূর কর্তৃক কোলাঞ্চ-কনৌজ (অন্যমতে, কাশী) থেকে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনার সঙ্গেই ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ ও অন্যান্য কয়েকটি বর্ণ-ওপরর্ণের কুলজী কাহিনী এবং কৌলীন্য প্রথার ইতিহাস জড়িত। কৌলীন্যপ্রথার বিবর্তনের সঙ্গে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের নামও জড়িত হয়ে আছে, এবং রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলজীর সঙ্গে আদিশূরের পৌত্র ক্ষিতিশূরের এবং ক্ষিতিশূরের পুত্র ধরাশূরের; বৈদিক-ব্রাহ্মণ কুলকাহিনীর সঙ্গে বৰ্মণরাজ ও শ্যামবৰ্মণ এবং হরিবর্মণের নামও জড়িত। ১১শ শতকে দক্ষিণবাঢ়ে এক শূববংশ রাজত্ব করতেন, এবং রণশূর নামে অন্তত একজন রাজার নাম আমরা জানি। আদিশূর, ক্ষিতিশূর এবং ধরাশূরের নাম আজও ইতিহাসে অজ্ঞাত। সেন ও বর্মণ রাজবংশদ্বয় খুবই পরিচিত, কিন্তু আদিশূরই বাংলায় প্রথম ব্রাহ্মণ আনলেন, তার আগে ব্রাহ্মণ ছিল না, বেদের চর্চা ছিল না, কুলজী গ্রন্থগুলোর এই তথ্য একান্তই অনৈতিহাসিক, অথচ এরই ওপর সমস্ত কুলজী কাহিনী নির্ভরশীল। ৫ম শতক থেকে আরম্ভ করে বাংলায় ব্রাহ্মণের কিছু অভাব ছিল না, বেদ-বেদাঙ্গচর্চাও যথেষ্টই ছিল; ৮ম শতকের আগেই বাংলার সর্বত্র অসংখ্য বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের বসবাস হয়েছিল আর ৮ম থেকে আরম্ভ করে ১২শ শতক পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য ব্রাহ্মণ যেমন বাংলায় এসে বসবাস আরম্ভ করেছিলেন, তেমনই বাংলার ব্রাহ্মণ-কায়স্থেরা বাংলার বাইরে গিয়েও বিচিত্র সম্মাননা লাভ করেছিলেন। বঙ্গজ ব্রাহ্মণদের কোনও কাহিনী কুলশাস্ত্রগুলোতে নেই, অথচ (পূর্ব)বঙ্গেও অনেক ব্রাহ্মণ গিয়ে বসবাস করেছিলেন, এসম্বন্ধে লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র এবং সম্ভবত বৈদিক ও গ্রহবিপ্র ব্রাহ্মণদের অস্তিত্বের খবর অন্যতর স্বতন্ত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকেও পাওয়া যায়। রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র একান্তই ভৌগোলিক সংজ্ঞা; বৈদিক ব্রাহ্মণদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আদিশূর-পূর্ব লিপিপ্রমাণ বিদ্যমান; আর গ্রহবিপ্রেরা তো শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বলেই মনে হয়। এগুলোর সম্পর্কে কুলজীর ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিহাসিক। বৈদ্য ও কায়স্থদের ভৌগোলিক বিভাগ সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের নাম অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত, অথচ এই দুই রাজার আমলে যেসব স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, এগুলোর নিজেদের যেসব লিপি আছে তার একটিতেও এই প্রথা সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিতমাত্রও নেই, উল্লেখ তো দুরের কথা; তা ছাড়া, এই যুগের ভবদেব ভট্ট, হলায়ুধ, অনিরুদ্ধ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং অসংখ্য অপ্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণের যেসব উল্লেখ সমসাময়িক গ্রন্থাদি ও লিপিমালায় পাওয়া যায় তাদের একজনকেও ভুলেও কুলীন কেউ বলেননি। বল্লাল ও লক্ষ্মণের নাম কৌলীন্যপ্রথা উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত থাকিলে তার নিজের কেউ তার উল্লেখ করলেন না, সমসাময়িক গ্রন্থ ও লিপিমালায় তার উল্লেখ পাওয়া গেল না, এটা খুবই আশ্চর্য বলতে হবে। আদিশূরকাহিনী এবং কৌলীন্যপ্রথার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের গাঞী বিভাগও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। গাঞীর উদ্ভব গ্রাম হতে; যে গ্রামে যে-ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করতেন তিনি সেই গ্রামের নামানুযায়ী গাঞী পরিচয় গ্রহণ করতেন। বন্দ্য, ভট্ট, চট্ট প্রভৃতি গ্রামের নামের সঙ্গে উপাধ্যায় বা আচার্য জড়িত হয়ে বন্দ্যোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পদবীর সৃষ্টি। বস্তুতঃ বন্দ্য, ভট্ট, চট্ট ব্রাহ্মণদের এসব গ্রামনামায় পরিচয় অষ্টম শতক-পূর্ব লিপিগুলোতেই দেখা যাচ্ছে। কাজেই এসব গাঞী পর্যায়-পরিচয় স্বাভাবিক ভৌগোলিক কারণেই উদ্ভূত হয়েছিল এবং তার সূচনা ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই দেখা গিয়াছিল – আদিশূরকাহিনী বা কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে উহাকে যুক্ত করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। বৈদ্য এবং কোনও কোনও ব্ৰাহ্মণ কুলজীতে আদিশূর এবং বল্লালসেনকে বলা হয়েছে বৈদ্য। এই তথ্য একান্তই অনৈতিহাসিক। সেনেরা নিঃসন্দেহে ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়; এরা এবং সম্ভবত শূরেরাও অবাঙালী। কাজেই বাঙালী বৈদ্য সংকরবর্ণের সঙ্গে এগুলোকে যুক্ত করিবার কোন কারণ নেই।
কুলজী গ্রন্থগুলোতে নানা প্রকার গালগল্প ও বিচিত্র অসংগতি তো আছেই। সাম্প্রতিক পণ্ডিতেরা তা সমস্তই অঙ্গুলি নির্দেশে দেখিয়ে দিয়েছেন। এসব কারণে কুলশাস্ত্রের সাক্ষ্য ঐতিহাসিক আলোচনায় নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না। তবে এগুলোর ভেতর দিয়ে লোকস্মৃতির একটি ঐতিহাসিক ইঙ্গিত প্রত্যক্ষ করা যায়, এবং সে-ইঙ্গিত অস্বীকার করা কঠিন। ১৫শ-১৬শ-১৭শ শতকে যে বর্ণ, উপবর্ণ সমাজব্যবস্থা, যে-স্মৃতিশাসন বাংলায় প্রচলিত ছিল তার একটা প্রাচীনতর ইতিহাস ছিল, এবং লোকস্মৃতি সেই ইতিহাসকে যুক্ত করেছিল শূর, সেন ও বর্মণ রাজবংশগুলোর সঙ্গে পাল, চন্দ্র বা অন্য কোনও রাজবংশের সঙ্গে নয়, তা লক্ষণীয়। আমরা নি:সংশয়ে জানি সেন ও বর্মণ বংশদ্বয় অবাঙালী; শূরবংশও সম্ভবত অবাঙালী; এও আমরা জানি সেন এবং বর্মণ রাষ্ট্র ও রাজবংশ দুটির ছত্রছায়ায়ই এবং তাদের আমলেই বাংলায় ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহাব-শাসন, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুশাসন সমস্ত পরিবেশ ও বাতাবরণ, সমস্ত খুঁটিনাটি সংস্কার নিয়ে সর্বব্যাপী প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুলজীগ্রন্থগুলোর ইঙ্গিতও তাই। এই হিসেবে লোকস্মৃতি মিথ্যাচরণ করেছে বলে মনে হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও বংশের প্রাচীনতর ইতিহাস ১৫শ-১৬শ শতকে বিদ্যমান ছিল বলে মনে হয়, এবং কুলজী গ্রন্থাদিতে তা ব্যবহৃতও হয়েছে। এরকম কয়েকটি বংশের সাক্ষ্য স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বারা সমর্থনও করা যায়।(History of Bengal, (D. U.), pp. 630 31, footnotes.)। কুলজীগ্রন্থে রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক ও গ্রহবিপ্র, ব্রাহ্মণদের এই চার পর্যায়ের বিভাগ ও স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বার সমর্থিত। কুলশাস্ত্রগ্রন্থমালায় ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন শাখার বিচিত্র গাঞীর বিভাগের অন্তত কযেকটি গাঞীর নাম লিপিমালায় এবং সমসাময়িক স্মৃতিসাহিত্য গ্রন্থে পাওয়া যায়। (History of Bengal, pp. 635-37 and footnotes)। এইসব কারণে মনে হয়, কুলজীগ্রন্থমালার পেছনে একটা অস্পষ্ট লোকস্মৃতি বিদ্যমান ছিল, এবং এই লোকস্মৃতি একেবারে পুরোপুরি মিথ্যাচার নয়। তবে, কুলশাস্ত্রগুলোর ঐতিহাসিক ইঙ্গিতটুকু সামান্যই।
চর্যাগীতি
এসব ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থাদি ছাড়া আর একটি উপাদানের উল্লেখ করতে হয়; এই উপাদান সহজিয়াতন্ত্রের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি গ্রন্থ, চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চযাঁগীতি। এই গ্রন্থ বিভিন্ন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কর্তৃক গুহ্য তান্ত্রিক সাধনা সম্বন্ধীয় সন্ধাভাষায় রচিত কয়েকটি (৫০টি) পদের সমষ্টি। পদগুলো প্রাচীনতম বাংলা ভাষার নিদর্শন; এগুলোর তিব্বতী ভাষারূপও কিছুদিন হলো পাওয়া গিয়েছে। যাই হোক, এগুলোর রচনার কাল ১০ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যে বলে বহুদিন পণ্ডিতসমাজে স্বীকৃত হয়েছে। এই পদগুলোর যত গুহ্য অর্থই থাকুক, কিছু কিছু সমাজসংবাদও এগুলোর মধ্যে ধরা পড়েছে, এবং বিশেষভাবে ধরে পড়েছে ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি তথাকথিত অন্ত্যজ পর্যায়ের বর্ণসংবাদ। সমসাময়িক সাক্ষ্য হিসেবে এগুলোর মূল্য অস্বীকার করা যায় না।(বৌদ্ধ গান ও দোহা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সং, বঙ্গীয় সাহিত পরিষৎ, Md. Sahidullah Buddhist Mystic Songs; Bagchi, P. C., Materials for a Critical Edition of the Caryapadas; চযাঁপদ, মণীন্দ্রমোহন বসু সং, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।)
আর্যীকরণের সূচনা : বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্ব
ভূমিকা
বাঙালীর ইতিহাসের যে অস্পষ্ট ঊষাকালের কথা আমরা জানি তা থেকে বোঝা যায়, আর্যীকরণের সূচনার আগে এই দেশ অষ্ট্রিক ও দ্রাবিডভাষাভাষী—অষ্ট্রিক ভাষাভাষীই অধিকসংখ্যক,— খুব স্বল্পসংখ্যক অন্যান্য ভাষাভাষী, কৃষি ও শিকারিজীবি, গৃহ ও অরণ্যচারী, অসংখ্য কোমে বিভক্ত লোকদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। সাম্প্রতিক নৃতাত্বিক গবেষণায় এই তথ্য উদঘাটিত হয়েছে যে এসব অসংখ্য বিচিত্র কোমদের ভেতর বিবাহ ও আহার-বিহারগত সম ও আচারগত নানাপ্রকার বিধিনিষেধ বিদ্যমান ছিল; এবং এসব বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করে বিচিত্র কোমগুলির পরস্পবের ভেতর যৌন ও আহারবিহার সম্বন্ধগত বিভেদ-প্রাচীরেরও অন্ত ছিল না।(Census Report of India, 1931., vol. I, part I, Section on Caste)
পরবর্তী আর্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসেব মূল অনেকাংশে এসব যৌন ও আহার-বিহার সঙ্গন্ধগত বিধিনিষেধকে আশ্রয় করেছে, তা প্রায় অনস্বীকার্য; তবে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি গুণ ও কর্মকে ভিত্তি করে তাদের চিন্তা ও আদর্শানুযায়ী এসব বিধিনিষেধকে ক্রমে ক্রমে কালানুযায়ী প্রয়োজনে যুক্তি ও পদ্ধতিতে প্রথাশাসনগত করে গড়েছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজ ও নৃতাত্বিক গবেষণাব নির্ধারণানুযায়ী বিচার করলে ভারতীয় বর্ণবিন্যাস আর্যপূর্ব ও আর্য্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির সম্মিলিত প্রকাশ। অবশ্যই এই মিলন একদিনে হয়নি; বহু শতাব্দীর নানা বিরোধ, নানা সংগ্রাম, বিচিত্র মিলন ও আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে এই সমন্বয় সম্ভব হয়েছে। এই সমন্বয়-কাহিনীই এক হিসেবে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির এবং কতকাংশে ভারতীয় মুসলমান সংস্কৃতিরও ইতিহাস। যাই হোক, বাংলায় এই বিরোধ-মিলনসমন্বয়েব সূচনা কিভাবে হয়েছিল তার কিছু কিছু আভাস প্রাচীন আর্য ব্রাহ্মণ্য ও আর্য-বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এসব গ্রন্থের সাক্ষ্য এক পক্ষীয়, এবং তাতে পক্ষপাত দোষ নেই এমনও বলা চলে না; আর্যপূর্ব জাতি ও কোমদের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দেবার মত কোনও অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত নেই। তাছাড়া, বাংলা উত্তর-ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ; আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির স্পর্শ ও প্রভাব এদেশকে আক্রমণ করেছে সকলের পরে, তখন তা উত্তর-ভারতের আর প্রায় সবত্রই বিজয়ী, সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিমান। অন্যদিকে, তখন সমগ্র বাংলায় আর্যপূর্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিসম্পন্ন বিচিত্র কোমদের বাস; তারাও কম শক্তিমান নয়। তাদের নিজস্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিবোধ গভীর ও ব্যাপক। কাজেই এদেশে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিজয়াভিযান বিনা বিরোধ ও বিনা সংঘর্ষে সম্পন্ন হয়নি। বহু শতাব্দী ধরে এই বিরোধ-সংঘর্ষ চলেছিল, এটি যেমন স্বভাবতই অনুমান করা যায়, তেমনিই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারাও তা সমর্থিত। লিপি প্রমাণ থেকে মনে হয়, গুপ্ত আমলে আর্য-ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাস, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এদেশে সম্যক স্বীকৃত হয়নি। তারপরও ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের নিম্নস্তরে ও তার বাইরে সংস্কার ও সংস্কৃতির সংঘর্ষ বহুদিন চলেছিল; সেন-বর্মণ আমলে (১১শ-১২শ শতকে) বর্ণসমাজের উচ্চস্তরে আর্যপূর্ব লোক সংস্কৃতির পরাভব প্রায় সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙালী সমাজের অন্তঃপুরে এবং একান্ত নিম্নস্তরে এই সংস্কার ও সংস্কৃতির প্রভাব আজও একেবারে বিলুপ্ত হয়নি – ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের আদেশ সেখানে শিথিল দৈনন্দিন জীবনে, ধর্মে, লোকাচারে, ব্যবহারিক আদর্শে, ভাবনা-কল্পনায় আজও সেখানে আর্যপূর্ব সমাজের বিচিত্র স্মৃতি ও অভ্যাস সুস্পষ্ট। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে শিল্পে, ধর্মে বতর্মান বাঙালীর ধ্যানে মননে আচারে ব্যবহারে এখনও সেই স্মৃতি বহমান।
বৈদিক ধর্মগ্রন্থসমূহ
ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থের “বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা’ এই পদে কেউ কেউ বঙ্গ, মগধ, চের এবং পাণ্ড্য কোমের উল্লেখ আছে বলে মনে করেন; এসব কোমকে বলা হয়েছে ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষী-বিশেষাঃ’, এবং এরা যে আর্য-সংস্কৃতির বহির্ভূত তাও ইঙ্গিত করা হয়েছে।(ঐতরেয় আরণ্যক ২.১.১) এই পদটির পাঠ ও ব্যাখ্যা এভাবে হতে পারে কিনা এ সম্বন্ধে মতভেদের অবসর বিদ্যমান। কিন্তু ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পুণ্ড্র, প্রভৃতি জনপদের লোকদের যে ‘দস্যু’ বলা হয়েছে এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোন কারণ নেই। এই দুটি ছাড়া আর কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থেই প্রাচীন বাংলার কোনও কোমের উল্লেখ নেই। বোঝা যাচ্ছে, সেই সুপ্রাচীন কালে আর্যভাষীরা তখন পর্যন্ত বাংলার সঙ্গে পরিচিতই হননি; পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থাদি রচনার সময় তরা পুণ্ড্র, বঙ্গ, ইত্যাদি কোমের নাম শুনছেন মাত্র।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণের একটি গল্প এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ঋষি বিশ্বামিত্র একটি ব্রাহ্মণ বালককে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করেন – দেবতার প্রীত্যর্থে যজ্ঞে বালকটিকে আহুতি দেয়ার আয়োজন হয়েছিল, সেখান থেকে বিশ্বামিত্র তাকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। যাই হোক, পিতার এই পোষ্যপুত্র গ্রহণ বিশ্বামিত্রের পঞ্চাশটি পুত্রের সমর্থন লাভ করেনি। ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র পুত্রদের অভিসম্পাত দেন যে তাদের সন্তানেরা যে উত্তরাধিকার লাভ করবে তা একেবারে পৃথিবীর প্রান্ততম সীমায় (বিকল্পে : তাদের বংশধরেরা একেবারে সব নিম্ন বর্ণ প্রাপ্ত হইবেন)। এরাই ‘দস্যু’ আখ্যাত অন্ধ্র, পুণ্ড্র, শবর, পুলিন্দ, এবং মুতিব কোমের জন্মদাতা।(ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৭৷১৩-১৮)
মহাভারত ও বৌধায়নের ধর্মসূত্র
এই গল্পের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মহাভারতের এবং কতিপয় পুরাণের একটা গল্পেও পাওয়া যায়।(মহাভারত, সভাপর্ব, ৫২৷১৭; বায়ু পুরাণ, ৯৯৷১১৷৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮৷৭৭…) অন্যত্র ভীমের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বাংলার সমুদ্রতীরবাসী কোমগুলিকে বলা হয়েছে ‘ম্লেচ্ছ’; ভাগবত পুরাণে কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুক্কস, আভীর, যবন, থস এবং সূহ্ম কোমের লোকদের বলা হয়েছে ‘পাপ’।(মহাভারত, ২।৩০; ভাগবতপুরাণ, ২৪।৪।১৮)
বৌধায়নেব ধৰ্মসূত্রে আবট্ট (পাঞ্জাব), পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ) সৌবীর (দক্ষিণ পঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ), বঙ্গ (পূর্ব বাংলা), কলিঙ্গ (উড়িষ্যা) প্রভৃতি কোমের লোকদের অবস্থিতি নির্দেশ করা হয়েছে আর্যবহির্ভূত দেশের প্রত্যন্ততম সীমায়; এদের বলা হয়েছে “সংকীর্ণ যৌনয়ঃ” এবং এসব দেশ একেবারে আর্য-সংস্কৃতির বাইরে, এসব জনপদে কেউ স্বল্প কালের প্রবাসে গেলেও ফিরে এসে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত।(বোধায়ন, ১।১।২৫-৩১) স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, বৌধায়নের কালে বাংলার সঙ্গে পরিচয় যদিও বা হয়েছে, যাতায়াতও হয়ত কিছু কিছু শুরু হয়েছে, কিন্তু তখনও আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কারের দৃষ্টিতে এসব অঞ্চলের লোকেরা ঘৃণিত এবং অবজ্ঞাত। বিভিন্ন পৌরাণিক গল্পে, যেমন রামায়ণে রঘুর দিগ্বিজয়, মহাভারতে কর্ণ, কৃষ্ণ ও ভীমের দিগ্বিজয়েও এর ইঙ্গিত আছে।
জৈন আচারঙ্গসূত্র ও বৌদ্ধ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প
এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রাচীন আর্য জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতেও কিছু কিছু দেখা যায়। আচাবঙ্গ = আয়ারঙ্গ সূত্রের একটি গল্পে পথহীন রাঢ়দেশে মহাবীর এবং তার শিষ্যদের লাঞ্ছনা ও উৎপীড়নের যে-বর্ণনা আছে, বজ্রভূমিতে যে অখাদ্য কুখাদ্য ভক্ষণের ইঙ্গিত আছে তাতে এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা সুম্পষ্ট।(আচারঙ্গ সূত্র ১।৮।৩)
বৌদ্ধ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-গন্থে গৌড়, পুণ্ড্র, সমতট ও হরিকেলের লোকদের ভাষাকে বলা হয়েছে ‘অসুর’ ভাষা। এসব বিচিত্র উল্লেখ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, এরা এমন একটি সুদীর্ঘকালের স্মৃতি-ঐতিহ্য বহন করে যেকালে আর্য ভাষাভাষী এবং আর্যসংস্কৃতির ধারক ও বাহক উত্তর ও মধ্যভারতের লোকে বা পূর্বতম ভারতের বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সূহ্ম প্রভৃতি কোমদের সঙ্গে পরিচিত ছিল না, যে-কালে এসব কোমদের ভাষা ছিল ভিন্নতর, আচার-ব্যবহার অন্যতর। এই অন্যতর জাতি, অন্যতর আচার-ব্যবহার, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং অন্যতর ভাষাভাষী লোকদের সেজন্যই বিজেতা, উন্নত ও পরাক্রান্ততর জাতিসুলভ দর্পিত উন্নাসিকতায় বলা হয়েছে, ‘দস্যু’, ‘ম্রেচ্ছ’, ‘পাপ’, ‘অসুর’ ইত্যাদি।
কিন্তু এই দর্পিত উন্নাসিকতা বহুকাল স্থায়ী হয়নি। নানা বিরোধ সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে এসব দস্যু, ম্লেচ্ছ, অসুর, পাপ কোমের লোকদেব সঙ্গে আর্যভাষাভাষী লোকদের মেলামেশা হচ্ছিল। এসব বিরোধ সংঘর্ষের কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত নানা পৌরাণিক গল্পে—রামায়ণে রঘুর দিগ্বিজয়, মহাভারতে কর্ণ, কৃষ্ণ ও ভীমের দিগ্বিজয়, আচারঙ্গসূত্রে মহাবীরের রাঢ়দেশে জৈনধৰ্ম প্রচার, ইতাদি প্রসঙ্গে।
মিলন
এদের মধ্য দিয়েই আর্য ও আর্যপূর্ব সংস্কৃতির মিলনপথ প্রশস্ত হচ্ছিল এবং আর্যপূর্ব সংস্কৃতির ‘ম্লেচ্ছ’ ও ‘দস্যু’রা আর্যসমাজে স্বীকৃতি লাভ করছিল। এই স্বীকৃতি লাভ ও আর্যসমাজে অন্তর্ভূক্তির দুটি দৃষ্টান্ত আহরণ করা যেতে পারে। রামায়ণে দেখা যাচ্ছে,(রামায়ণ, ২।১০।৩৬-৩৭) মৎস্য-কাশী-কোশল কোমেব সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ-অঙ্গ-মগধ কোমের রাজবংশগুলো অযোধ্যা রাজবংশের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হচ্ছেন। এর চেয়ও আর একটি অর্থবহ গল্প আছে বায়ু ও মৎস্যপুরাণে, মহাভারতে। এই গল্পে অসুররাজ বলির স্ত্রীর গর্ভে বৃদ্ধ অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমসের পাঁচটি পুত্র উৎপাদনের কথা বর্ণিত আছে; এই পাঁচপুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সূহ্ম; এদের নাম থেকেই পাঁচ পাঁচটি কৌম জনপদের নামের উদ্ভব।(মহাভারত, সভাপর্ব ৫২৷১৭; বায়ুপুরাণ ৯৯৷১১।৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।৭৭…)
প্রাথমিক পরাভব ও যোগাযোগের পর বাংলার এসব দস্যু ও ম্লেচ্ছ কোমগুলো ধীরে ধীরে আর্যসমাজ ব্যবস্থায় কথঞ্চিৎ স্বীকৃতি ও স্থান লাভ করতে অরম্ভ করল। এই স্বীকৃতি ও স্থানলাভ যে একদিনে ঘটেনি, তা সহজেই অনুমেয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একদিকে বিরোধ ও সংঘর্ষ অন্যদিকে স্বীকৃতি ও অন্তর্ভূক্তি চলেছিল— কখনও ধীর শান্ত, কখনও দ্রুত কঠোর প্রবাহে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। রাষ্ট্ৰীয় ও অর্থনৈতিক পরাভব ঘটেছিল আগে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরাভব ঘটেছিল ক্রমে ক্রমে, অনেক পরে, এ সম্বন্ধেও সন্দেহের অবসর কম। মানবধর্মশাস্ত্রে আর্যাবর্তের সীমা দেয়া হচ্ছে পশ্চিম সমূদ্র থেকে পূর্ব সমূদ্রতীর পর্যন্ত, অর্থাং প্রাচীন বাংলার অন্ততঃ কিয়দংশ আর্যাবর্তের অন্তর্গত, এই যেন ইঙ্গিত।(মানবধর্মশাস্ত্র) মনু পুণ্ড্র, কোমের লোকদের বলছেন ‘ব্রাত্য’ বা পতিত ক্ষত্রিয়, এবং তাদের পংক্তিভুক্ত করছেন দ্রাবিড়, শক, চীন প্রভৃতি বৈদেশিক জাতিদের সঙ্গে। মভাভারতের সভাপর্বে (৫২।১৭) বঙ্গ ও পুণ্ড্রদের যথার্থ ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে; জৈন প্রজ্ঞাপনা গ্রন্থেও বঙ্গ এবং রাঢ় কোম দুটোকে আর্য কোম বলা হয়েছে।(lnd. Ant. p. 375) শুধু তাই নয়, মহাভারতেই দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন বাংলার কোনও কোনও স্থান তীর্থ বলে স্বীকৃত ও পরিগণিত হচ্ছে, যেমন পুণ্ড্রভূমিতে করতোয়াতীর, সূহ্মদেশের ভাগীরথী সাগর-সঙ্গম।(বনপর্ব ৮৫।২-৪, ১।২১৬, কামসূত্র, ৬।৩৮, ৪১) অর্জুন অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের তীর্থস্থানসমূহ পরিভ্রমণকালে ব্রাহ্মণদেরকে নানা প্রকারে উপহৃত করেছিলেন; বাৎস্যায়ন তার কামসূত্রে (৩য়-৪র্থ শতক) গৌড়-বঙ্গের ব্রাহ্মণদের উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ বাংলা এবং বাঙালীর আর্যীকরণ ক্রমশঃ অগ্রসর হচ্ছে, এটাই এইসব পুরাণকথার ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতের সমর্থন পাওয়া যায় মভাভারত ও পুরাণগুলোতে। বায়ু ও মংস্যপুরাণে, মহাভারতে বঙ্গ, সূহ্ম, পুণ্ড্রদের ক্ষত্ৰিয়ই বলা হয়েছে, এমন কি শবর, পুলিন্দ এবং কিরাতদেরও। (মহাভারত, ১।১০৪, ২।৫১, ১৪।২৯, বিষ্ণুপুরাণ, ৪।৮।১; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।১।৪, মনুস্মৃতি, ১০।৪৪।)
কোনও কোনও বংশ যে ব্রাহ্মণ পর্যায়েও স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল, ঋষি দীর্ঘতমসের গল্পটি তার কিছুটা প্রমাণ বহন করে। অধিকাংশ বিজিত লোকই স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল শূদ্রবর্ণ পর্যায়ে, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। মনু বলছেন, পৌণ্ড্রক ও কিরাতেরা ক্ষত্রিয় ছিল, কিন্তু বহুদিন তার ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংস্পর্শে না আসায় তারা ব্রাহ্মণ্য পুজাচার প্রভৃতি পরিত্যাগ করেছিল, এবং তাই তাদের শূদ্র পর্যায়ে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। (মনুস্মৃতি, ১০।৪৪) অন্যান্য কোমদের ক্ষেত্রেও বোধ হয় এমনই হয়ে থাকবে। মনু কৈবর্তদদের বলেছেন সংকর বর্ণ, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ তাদের বলছে “অব্রহ্মণ্য,” অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজ বহির্ভূত। কিন্তু একদিকে স্বীকৃতি অন্তর্ভূক্তি এবং আর একদিকে উন্নীত অবনীতকরণ যাহাই চলতে থাকুক না কেন, এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আর্য বর্ণবিন্যাসও বাংলায় ক্রমশঃ তার মূল প্রতিষ্ঠিত করছিল। শুধু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরাই যে আর্য সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা বাংলায় বহন করে এনেছিল তাই নয়, জৈন ও বৌদ্ধধমাবলম্বীরাও এ-সম্বন্ধে সমান কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন। তারা বেদবিরোধী ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু আর্য সমাজ-ব্যবস্থা বিরোধী ছিলেন না, এবং বর্ণব্যবস্থাও একেবারে অস্বীকার করেননি।(Rhys Davids, Buddhist India.)
মৌর্য যুগে আর্যীকরণ
মৌর্য ও শুঙ্গাধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে এবং তাকে আশ্রয় করে আর্য সংস্কৃতি সমাজব্যবস্থা ক্রমশঃ বাংলায় অধিকতর প্রসার লাভ করেছিল সন্দেহ নেই, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রের আদিপত্যকালে। কিন্তু, মহাস্থান লিপির গলদন পুরাদস্তুর বাংলা নাম বলেই মনে হচ্ছে; প্রাকৃত গলদনকে সংস্কৃত গলদন বললেও তার দেশজ রূপ অপরিবর্তিতই থেকে যায়। লিপিটির ভাষা প্রাকৃত; মৌর্য আমলের সবলিপির ভাষাই তাই; কিন্তু বঙ্গে যে আর্য সামাজিক আদর্শ গৃহীত ও স্বীকৃত হচ্ছিল তাই সুস্পষ্ট। বোধ হয় এই সময় থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, ধৰ্ম প্রচার, রাষ্ট্রধর্ম প্রভৃতিকে আশ্রয় করে অধিকতর সংখ্যায় উত্তর ভারতীয় আর্যভাষীরা বাংলায় এসে বসবাস আরম্ভ করতে থাকে। কিন্তু আর্য, বৌদ্ধ, জৈন এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা গুপ্তকালের আগে হয়েছিল বলে মনে হয় না, এবং আর্য বৰ্ণব্যবস্থা ও বাংলায় বোধ হয় তার আগে দানা বেঁধে গড়ে ওঠেনি।
বাংলার অধিকাংশ জনপদ গুপ্তসাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী সমাজ উত্তরভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থান অন্তর্ভূক্ত হতে শুরু করে। এই যুগের লিপিমালাই তার নিঃসংশয় সাক্ষ্য বহন করছে। লিপিগুলো বিশ্লেষণ করলে অনেকগুলো তথ্য জানা যায়।
গুপ্ত পর্বের বর্ণ বিন্যাস
ভূমিকা
প্রথমেই সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে অগণিত ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানের। ১ নং দামোদরপুর লিপিতে (খ্ৰীষ্টাব্দ ৪৪৩-৪৪) জনৈক কর্পটিকনামীয় ব্রাহ্মণ অগ্নিহোত্র যজ্ঞকাৰ্য সম্পাদনের জন্য ভূমিক্রয় প্রার্থনা করছেন; ২ নং পট্টোলি দ্বা্রা (৪৪৮-৪৯) পঞ্চ মহাযজ্ঞেব জন্য আর এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দেয়া হচ্ছে; ধনেইদহ পট্টোলির (৪৩২-৩৩) বলে কটকনিবাসী এক ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ কিছু ভূমি লাভ করছেন; ৩ নং দামোদরপুর পট্টোলিতে (৪৮২-৮৩) পাচ্ছি নাভক নামে এক ব্যক্তি কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বসাবার জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করছেন; ৪ নং দামোদরপুর লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, নগরশ্রেষ্ঠ রিভূপাল হিমালয়ের পাদদেশে ডোঙ্গাগ্রামে কোকামুখস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী এবং নামলিঙ্গের পূজা ও সেবার জন্য ভূমিক্রয় করছেন; বৈগ্রাম পট্টোলির (৪৪৭-৪৮) সংবাদ, ভোয়িল এবং ভাস্কর নামে দুই ভাই গোবিন্দস্বামীর নিত্য পূজার জন্য ভূমি ক্রয় করছেন; ৫ নং দামোদর পট্টোলিতে (৫৪৩-৪৪) দেখছি শ্বেতবরাহস্বামীর মন্দির সংস্কারের জন্য ভূমি ক্রয় করছেন অযোধ্যাবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব। এ সমস্ত লিপিই পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত ভূমি সম্বন্ধীয়। এই অনুমান নিঃসংশয় যে ৫ম শতকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্ম স্বীকৃতি লাভ করেছে, এই ধর্মের দেবদেবীরা পূজিত হচ্ছেন, ব্রাহ্মণদের বসবাস বিস্তৃত হচ্ছে, অব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করছেন, তাদেরকে এনে বসবাস করাচ্ছেন, এবং অযোধ্যাবাসী ভিন-প্রদেশী এসেও এইদেশে মন্দির সংস্কার করাবার জন্য ভূমি ক্রয় করছেন। যেসব ব্রাহ্মণেরা আসছেন তাদের মধ্যে বেদবিদ ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণও আছেন। উত্তরবঙ্গের সংবাদ বোধ হয় আরও পাওয়া যায় কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের নিধনপুর লিপিতে। লিপিটি ৭ম শতকের, পট্টোলি কর্ণসুবর্ণ জয়স্কান্ধাবার থেকে নির্গত; দত্তভূমি চন্দ্রপুরি বিষয়ের ময়ূরশান্মলাগ্রহার ক্ষেত্র, এবং এই ভূমিদানকার্য ভাস্করের চার পুরুষ পূর্বে বুদ্ধপ্রপিতামহ ভূতিবর্মণদ্বারা (আনুমানিক ৬ষ্ঠ শতকের প্রথম পাদ) প্রথম সম্পাদিত হয়েছিল। চন্দ্রপুরি বিষয় বা ময়ূরশাল্মল অগ্রহার কোথায় তা আজও নিঃসংশয়ে নির্ণীত হয়নি; তবে উত্তরবঙ্গের পূর্বতন সীমায় (রংপুর জেলায়) কিংবা একেবারে শ্রীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড (লিপির আবিষ্কার স্থান) অঞ্চল, এ দুয়ের এক জায়গায় হওয়াই সম্ভব, যদিও রংপুর অঞ্চল হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। যাই হোক, এই লিপিতে দেখা যাচ্ছে ময়ূরশাল্মল অগ্রহারে ভূতিবর্মণ ভিন্ন ভিন্ন বেদের ৫৬টি বিভিন্ন গোত্রীয় অন্তত ২০৫ জন ‘বৈদিক’ বা ‘সাম্প্রদায়িক’ ব্রাহ্মণের বসতি করিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণের সকলেই বাজসনেয়ী, ছান্দোগ্য, বাহ্বৃচ্য, চারক্য এবং তৈত্তিরীয়, এই পাঁচটি বেদ-পরিচয়ের অন্তর্গত, তবে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী-পরিচয়ের সংখ্যাই অধিক। চারক্য এবং তৈত্তিরীয়েরাও যজুর্বেদীয়; বাহ্বৃচ্য ঋগ্বেদীয়; ছান্দোগ্য সামবেদীয়। এদের অধিকাংশের পদবী স্বামী। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, ৬ষ্ঠ শতকের গোড়াতেই উত্তরপূর্ব-বাংলায় (ভিন্ন মতে, শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে) পুরাদস্তুর ব্রাহ্মণ-সমাজ গড়ে ওঠেছে। পূর্বোক্ত অন্যান্য লিপির সাক্ষ্যও তাই। ভূমি দান-বিক্রয় যেসব গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নিষ্পন্ন হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেক ব্রাহ্মণের দর্শন মিলছে; এদের নামপদবী শর্মণ এবং স্বামী দুইই পাওয়া যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের খবর পাওয়া যাচ্ছে বিজয়সেনের মল্লসারুল লিপি (৬ষ্ঠ শতক) এবং জয়নাগের বপ্যঘোষবাট লিপিতে (৭ম শতক)। শেষোক্ত লিপিটিদ্বারা মহাপ্রতীহার সূৰ্যসেন বপ্যঘোষবাটনামক একটি গ্রাম ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী নামে এক ব্ৰাক্ষণকে দান করছেন, এই লিপিতেই খবর পাওয়া যাচ্ছে কুককুট গ্রামের ব্রাহ্মণদেব ভট্ট উন্মীলন স্বামী এবং প্রবলি স্বামী নামে আরও দুইটি ব্রাহ্মণের দেখা এখানেও মিলছে। এক্ষেত্রেও নাম-পদবী স্বামী। মল্লাসারুল লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, দৈনিক পঞ্চ মহাযজ্ঞ নিম্পন্নের জন্য মহারাজ বিজয়সেন বৎসস্বামীনামক জনৈক ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমি দান করছেন। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে রাঢ় রাষ্ট্রেও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা যষ্ঠ-৭ম শতকেই স্বীকৃত ও প্রসারিত হয়েছে। এই তথ্যের প্রমাণ আর ও পাওয়া যায় সদ্য আবিষ্কৃত শশাঙ্কের মেদিনীপুর লিপি দুটিতে। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে দণ্ডভূক্তিদেশে ও যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা স্বীকৃত হয়েছিল তা সিদ্ধান্ত করা যায় এগুলোর সাক্ষ্যে।
মধ্য ও পূর্ব বঙ্গেও এই যুগে অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীত হচ্ছেন লৌহিত্য তীরবাসী জনৈক কান্বগোত্রীয় ব্রাহ্মণ, ভট্টগোমীদত্ত স্বামী। যে-মণ্ডলে (বারকমণ্ডলে; ফরিদপুর জেলায়) দত্ত ভূমির অবস্থিতি তার শাসনকর্তাও ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, তার নাম বৎসপাল স্বামী। এই বংশের আর এক রাজা ধর্মাদিত্যের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীতা হচ্ছেন ব্রাহ্মণ চন্দ্রস্বামী, আর একটির জনৈক বসুদেব স্বামী। শেষোক্ত পট্টোলিতে গর্গস্বামী নামে আর এক ব্রাহ্মণের ভূমিরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। তখনও বারকমণ্ডলের শাসনকতা একজন ব্ৰাহ্মণ, নাম গোপালস্বামী। ধর্মাদিত্যের প্রথম পট্টোলিটিতে গ্রামবাসিদের মধ্যেও দুজন ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে বলে মনে হয় একজনের নাম বৃহচ্চট, আর একজনের কুলস্বামী। মহারাজ সমাচার দেবের ঘুগ্রাহাটি লিপির দত্তভূমির দানগ্রহীতা ও একজন ব্রাহ্মণ, নাম সুপ্রতীক স্বামী এবং দান-গ্রহণের উদ্দেশ্য বলিচরুসত্ৰ প্রবর্তন। যষ্ঠ শতকের ফরিদপুর ছেড়ে ৭ম শতকের ত্রিপুরার লোকনাথ লিপির সাক্ষ্য ও একই প্রকার; এখানে ও দেখছি জনৈক ব্রাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশর্মণ অনন্তনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ২১১ জন চাতুবির্দ্য ব্রাহ্মণের বসতি করাবার জন্য পশুসংকুল বনপ্রদেশে ভূমিদান গ্রহণ করছেন। গ্রামকুটম্বি অর্থাং গৃহস্থদের মধ্যে শর্মা ও স্বামী পদবীযুক্ত অনেক নাম পাচ্ছি, যথা মঘশর্মা, হরিশর্মা, রুষ্টশর্মা, অহিশর্মা, গুপ্তশর্মা, ক্রমশর্মা, শুক্রশর্মা, কৈবর্তশর্মা, হিমশর্মা, লক্ষ্মণশর্মা, নাথশর্মা, অলাতস্বামী, ব্রহ্মস্বামী, মহাসেনভট্টস্বামী, বামনস্বামী, ধনস্বামী, জীবস্বামী, ইত্যাদি।
শুধু যে ব্রাহ্মণেরাই ভূমিদান লাভ করছেন তাই নয়; জৈন ও বৌদ্ধ আচার্যরা এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও অনুরূপ ভূমিদান লাভ করেছেন। ৫ম শতকে উত্তরবঙ্গে পাহাড়পুর অঞ্চলে প্রাপ্ত একটি লিপিতে দেখছি (৪৭৮-৭৯ খ্ৰী) জনৈক ব্রাহ্মণ নাথশর্মা এবং তার স্ত্রী রামী এক জৈন আচার্য গুহনন্দির বিহারে দানের জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করছেন। ৬ষ্ঠ শতকে (গুনেইঘর লিপি, ৫০৭-৮ খ্রী) ত্রিপুরা জেলায় জনৈক মহাযানাচার্য শান্তিদেব প্রতিষ্ঠিত আর্য অবলোকিতেশ্বরের আশ্রম বিহারের মহাযানিক অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘের জন্য মহারাজ রুদ্রদত্ত কিছু ভূমি দান করছেন। এই লিপিটিতেও একজন ব্রাহ্মণ কুমারামাত্য বেরজ্জ স্বামীর সংবাদ পাচ্ছি। ৭ম-৮ম শতকে ঢাকা জেলার আস্রফপুর অঞ্চলে দেখছি জনৈক বৌদ্ধ আচার্য বন্দ্য সংঘমিত্র তার বিহার ইত্যাদির জন্য স্বয়ং রাজার কাছ থেকে প্রচু্র ভূমিদান লাভ করছেন।
ব্রাহ্মণদের পদবী ও গাঞি (?) পরিচয়
উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ হতে দেখা যাচ্ছে শর্মণ ও স্বামী পদবী ছাড়া ব্রাহ্মণদের বোধ হয় অন্য পদবী-পরিচয়ও ছিল। যেমন, বৃহচ্চট নামে চট্ট, ভট্ট গোমিদত্ত স্বামী, ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী, ভট্ট উন্মীলন স্বামী, ভট্ট বামন স্বামী, মহাসেন ভট্ট স্বামী, এবং শ্রীনেত্ৰ ভট (ভট্ট) প্রভৃতি নামে ভট্ট, এবং বন্দ্য জ্ঞানমতি ও বন্দ্য সংঘমিত্র নামে বন্দ্য। বৃহচ্চট্টের চট্ট নামের অংশমাত্র বলে মনে হচ্ছে না। ব্রহ্মবীর, উন্মীলন, বামন এবং মহাসেন যে ব্রাহ্মণ তা তাদের স্বামী পদবীতেই পরিশগকার; কিন্তু তার পরেও যখন তাদের নামের পূর্বে অথবা মধ্যে ভট্ট ব্যবহৃত হচ্ছে তখন ভট্ট যেন তাদের “গাঞি” পরিচয় বলেই মনে হচ্ছে। পরবর্তী কালের ভাট অর্থ এই ক্ষেত্রে গ্রহণেযাগ্য বলে মনে হয় না। শ্রীনেত্র ভট স্পষ্টই শ্রীনেত্র ভট্ট এবং এক্ষেত্রে ভট্ট ব্যবহৃত হয়েছে নামের পরে। বন্দ্য পূজনীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে, অন্ততঃ আচার্য বন্দ্য সংঘ মিত্রের ক্ষেত্রে; কিন্তু বন্দ্য জ্ঞানমতির ক্ষেত্রেও কি তাই? এক্ষেত্রেও বন্দ্য “গাঞি” পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। চট্ট, ভট্ট এবং বন্দ্য, এই কটিই যে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অসংখ্য “গাঞি” পরিচয়ের মধ্যে তিনটি, এ তথ্য পববর্তী স্মৃতি ও কুলজী গ্রন্থে জানা যায়। ৬ষ্ঠ-৭ম শতকেই এই “গাঞি” পরিচয়ের রীতি প্রচলিত হয়েছিল, তা অসম্ভব এবং অনৈতিহাসিক নাও হতে পারে।
ব্রাহ্মণদের শর্মণ-শর্মা পদবী-পরিচয় বাংলায় আজও সুপ্রচলিত। কিন্তু স্বামী পদবী-পরিচয় মধ্যযুগের সূচনা থেকেই অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছে। নিধনপুর লিপি্র সাক্ষ্য ও শ্ৰীহট্ট অঞ্চলের লোকস্মৃতি হতে মনে হয়, ঐ লিপির দুই শতাধিক স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা বৈদিক (পরবর্তী কালে, সাম্প্রদায়িক) ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত ছিলেন। অনুমান হয়, এরা সকলেই বাংলার বাইরে থেকে – পশ্চিম বা দক্ষিণ হতে এসেছিলেন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তো এখনও ব্রাহ্মণোদের স্বামী পদবী সুপ্রচলিত। প্রাচীন কালেও তাই ছিল। উত্তর-ভারতেও যে তা ছিল তার প্রমাণ গুপ্তযুগের শিলামালায়ই পাওয়া যায়। পরবর্তী কালের কুলজী-গ্রন্থে বৈদিক ব্রাহ্মণদের দুটি শাখার পরিচয় পাওয়া যায় – পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য। এসব স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ হওয়া অসম্ভব নয়। ধনেইদহ পট্টোলির দানগ্রহীতা বরাহস্বামী ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ, এবং তিনি এসেছিলেন উড়িষ্যান্তর্গত কটক অঞ্চল হতে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলির দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণটির নাম গোমিদত্ত স্বামী। তিনি কান্বগোত্রীয় এবং লৌহিত্য-তীরবাসী। লৌহিত্য-তীরবর্তী কামরূপের ব্রাহ্মণেরা তো আজও নিজেদের পাশ্চাত্য বৈদিক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। অবশ্য, স্বামী পদবীর ওপর নির্ভর করে এসম্বন্ধে নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত কিছু করা চলে না। বাইরে থেকে ব্রাহ্মণেরা যে বাংলায় আসছেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অযোধ্যবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব স্বয়ং।
এসব ব্রাহ্মণদের ছাড়া ৫ম হতে ৮ম শতক পর্যন্ত লিপিগুলোতে রাজকর্মকারচী, গ্রামবাসী গৃহস্থ, প্রধান প্রধান লোক, নগরবাসী, শ্ৰেষ্ঠী, সার্থবাহ এবং অন্যান্য লোকের নাম-পরিচয়ও পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকটি নামের উল্লেখ করা যেতে পারে; যথা, চিরাতদত্ত, বেত্রবর্মণ, ধৃতিপাল, বন্ধুমিত্র, ধৃতিমিত্র, শাম্বপাল, রিশিদত্ত (লক্ষণীয় এই যে, নামটির বানান ঋষিদত্ত উচিত ছিল; সংস্কৃত রীতিপদ্ধতি তখনও অভ্যস্ত হয়নি বলে মনে করা চলে), জয়নন্দি, বিভুদত্ত, গুহনন্দি, দিবাকরনন্দি, ধৃতিবিষ্ণু, বিবোচন, রামদাস, হরিদাস, শশিনন্দী, দেবকীর্তি, ক্ষেমদত্ত, গোষ্ঠক, বর্গপাল, পিঙ্গল, সুংকুক, বিষ্ণুভদ্র, খাসক, রামক, গোপাল, শ্ৰীভদ্র, সোমপাল, রাম, পত্রদাস, স্থায়ণপাল, কপিল, জয়দত্ত, শণ্ডক, রিভূপাল, কুলবৃদ্ধি, ভোয়িল, ভাস্কর, নবনন্দী, জয়নন্দী, ভটনন্দী, শিবনন্দী, দুর্গাদত্ত, হিমদত্ত, অর্কদাস, রুদ্রদত্ত, ভীম, ভামহ, বৎসভোজিক, নরদত্ত, বরদত্ত, বস্পিয়ক, আদিত্যবন্ধু, জোলারি, নগিজোদক, বুদুক, কলক, সূর্য, মহীপাল, খন্দবিদুর্গ, গবিক, মণিভদ্র, যজ্ঞপাত, নাদভদক, গণেশ্বর, জিতসেন, রিভূপাল, স্থাণুদত্ত, মতিদন্ত, বিপ্ৰপাল, স্কন্দপাল, জীবদত্ত, পবিক্রক, দামুক, বংসকুণ্ড, শুচিপালিত, বিহিতঘোষ, শূরদত্ত, প্রিয়দত্ত, জনার্দন, কুণ্ড, কবণিক, নবনাগ, কেশব, ইটিত, কুলচন্দ্র, গরুড়, আলূক, অনাচার, ভাশৈত্য, শুভদেব, ঘোষচন্দ্র, অনমিত্র, গুণচন্দ্র, কলসখ, দুর্লভ, সত্যচন্দ্র, প্রভূচন্দ্র, রুদ্রদাস, অর্জুন-বপ্প (সোজাসুজি অর্জুনের বাপের সংস্কৃত রূপ, এই ধরনের ডাক-নাম আজও বাংলার পাড়াগাঁয়ে প্রচলিত), কুণ্ডলিপ্ত, নাগদেব, নয়সেন, সোমঘোষ, জন্মভূতি, সূর্যসেন, লক্ষ্মীনাথ, শ্রীমিত্রাবলি, বর্ণটিয়োক, শর্বান্তর, শিখর, পুরদাস, শক্ৰক, উপাসক, স্বস্তিমোক, সুলদ্ধ, রাজদাস, দুর্গগট ইত্যাদি।
এই নামগুলো বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি তথ্য লক্ষ্যগোচর হয় –
- প্রথমত, অধিকাংশ নামের রূপ সংস্কৃত; কতকগুলো নামের দেশজ রূপ হতে সংস্কৃতীকরণ হয়েছে, যেমন বস্পিযক, খন্দবিদুৰ্গ গরিক, অর্জুন-বপ্প, বর্ণটিয়োক, দুর্গ্ গট ইত্যাদি; আর কতকগুলোর নামরূপ দেশজই থেকে গিয়েছে, যেমন, জোলারি, নগিজোদক, কলক, নাদভদক, দামুক, আলূক, কলসখ, ইটিত, সুং’কুক, খাসক ইত্যাদি। ‘অক্’ বা ‘ওক্’ প্রত্যয় জুড়ে দিয়ে দেশজ বা ভাষা শব্দের নামকে সংস্কৃত ক-কারান্ত পদ রূপে দেখাইবার যে রীতি আমরা পরবর্তী কালে বাংলায় প্রচলিত দেখিতে পাই (যেমন “সদুক্তিকর্ণামৃত” গ্রন্থে গৌড় বঙ্গের কবিদের নাম-পরিচয়ে, এবং অন্যত্র) তাও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, যথা, খাসক, রামক, বম্পিযক, বর্ণটিযোক, নগিজোদক, নাদভদক, স্বস্তিয়োক ইত্যাদি।
- দ্বিতীযত, ব্যক্তিগত নামে জনসাধারণ সাধারণত কোনও পদবী ব্যবহার করতো না, শুধু পূর্ব নামেই (forename) পরিচিত হতো (তেমন নামে সংখ্যাই অধিক), যেমন, পিঙ্গল, গোপাল, শ্রীভদ্র, রাম, কপিল, বিরোচন, দেবকীৰ্তি, গোষ্ঠক, শণ্ডক, ভোয়িল, ভাস্কর, ভামহ, বুদ্ধক, সূর্য, পরিক্রক, করণিক, কেশব, গরুড়, অনাচার, ভাশৈত্য, দুর্লভ, শবান্তর, শিখর, শক্রুক, উপাসক, সুলব্ধ, গরুড় ইত্যাদি।
- তৃতীয়ত, এই নামগুলোর মধ্যে কতকগুলো অন্ত্যনামের (Surname) পবিচয় পাওয়া যাচ্ছে যেগুলো এখনও বাংলায় নাম-পদবী হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন, দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দি-নন্দী, বর্মণ, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুণ্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, এমন কি দাম (দা), ভূতি, বিষ্ণ, যশ, শিব, রুদ্র ইত্যাদি। অধিংকাংশ ক্ষেত্রেই যে এগুলো অন্ত্যনাম এসম্বন্ধে সন্দেহ করা চলে না, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে নামেরই অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, এই অনুমানও হয়তো করা চলে।
- চতুর্থত, এসব অন্ত্যনাম আজকাল যেমন বর্ণজ্ঞাপক, ৫ম-৮ম শতকে তেমন ছিল না, তবে ব্রাহ্মণেতর বর্ণের লোকেরাই এই অন্ত্যনামগুলো ব্যবহার করতেন; ব্রাহ্মণের শুধু শর্মণ বা স্বামী পদবী এবং ভট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি “গাঞি” পরিচয় গ্রহণ করতেন, এরকম অনুমান বোধ হয় করা যায়। বাংলায় ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য তথাকথিত ‘ভদ্র’ জাতের মধ্যে (বৃহদ্বর্ম পুরাণোক্ত উত্তম সংকর ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত সৎশূদ্র জাতের মধ্যে) চন্দ্র, গুপ্ত, নাগ, দাস, আদিত্য, নন্দী, মিত্র, শীল, ধর, কর, দত্ত, রক্ষিত, ভদ্র, দেব, পালিত প্রভৃতি নামাংশ বা পদবীর ব্যবহার এই সময় হতে আরম্ভ হয়ে হিন্দু আমলের শেষেও যে চলছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় “সদুক্তিকর্ণামৃত”-গ্রন্থের গৌড়বঙ্গীয় কবিদের নামের মধ্যে।(সদুক্তিকর্ণামৃত, সংকলয়িতা, শ্রীধরদাস (১২০৬) Ed by Ramavatara Sarma and Haradatta Sarma. Lahore. 1936. শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, “সদুক্তিকর্ণামৃত” বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ, ১৩৫০)। একথা সত্য বাংলার বাইরে, বিশেষভাবে গুজরাত-কাথিয়াবাড় অঞ্চলে প্রাচীন কালে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে দত্ত, নাগ, মিত্র, ঘোষ, এবং বর্মণ ইত্যাদি অন্তনামের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু বাংলায় এই লিপিগুলোতে এসব অন্ত্যনাম যেসব ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে, তাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলে মনে হচ্ছে না, ব্রাহ্মণেরা যেন সর্বত্রই শর্মণ বা স্বামী এই অন্ত্যনামে পরিচিত হচ্ছেন, অথবা ভট্ট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি উপ বা অন্ত্য নামে।
লিপিগুলোতে অনেক ব্যক্তিনামের উল্লেখ যেমন আছে, তেমনই আছে অনেক স্থান নামের উল্লেখ। এই নাম গুলো বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, কতকগুলো নামের রূপ পুরাপুরি সংস্কৃত, যেমন, পুণ্ড্রবর্ধন, কোটীবস, পঞ্চনগরী, নব্যাবকাশিকা, সূবর্ণবীথি, ঔদম্বুরিক (বিষয়), চণ্ডগ্রাম, কর্মান্তবাসক, শিলাকুণ্ড, পলাশবৃন্দক, স্বচ্ছন্দ পাটক ইত্যাদি। কতকগুলো নামের দেশজরূপ হতে সংস্কৃতীকরণ হয়েছে, যেমন, বারিগ্রাম, পৃষ্ঠম-পোট্টক, গোষাটপুঞ্জক, খাড়(টা)পার, ত্রিবৃতা, ত্রিঘট্টিক, বোল্লবায়িকা ইত্যাদি। আবার, কতকগুলোর নাম এখনও দেশজ রূপেই থেকে গিয়েছে, যেমন, কুট্কুট্, নাগিরট্ট, ডোঙ্গা (গ্রাম), কণমোটিকা ইত্যাদি। মনে হয়, ব্যক্তি-নামের ক্ষেত্রে যেমন স্থাননামের ক্ষেত্রেও তেমনই, আর্যীকরণ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
কায়স্থ-করণ
উপরোক্ত অন্ত্যনামগুলো যাদের ব্যক্তিনামের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে তারা কোন বর্ণ বা উপবর্ণের তা স্থির করার কোনও উপায় নেই। এই যুগের লিপিগুলোতে কায়স্থ নামে পরিচিত এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর সংবাদ পাওয়া যায়, যেমন, প্রথম কায়স্থ শাম্বপাল, স্কন্দপাল, বিপ্রপাল, করণ-কায়স্থ নবদত্ত, কায়স্থ প্রভুচন্দ্র, রুদ্রদাস, দেবদত্ত, কৃষ্ণদাস, জ্যেষ্ঠকায়স্থ নয়সেন, ইত্যাদি। এরা যে রাজকর্মচারী এসম্বন্ধে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। কায়স্থ বলতে মূলত কোনও বর্ণ বা উপবর্ণ বোঝাতো না, কোষাকার বৈজয়ন্তী (একদশ শতক) কায়স্থ অর্থে বলছেন লেখক, এবং কায়স্থ ও করণ সমর্থক এও বলছেন।(“কায়স্থঃস্যার্ল্লিপিকয়ঃ করণোক্ষর জীবনঃ লেখকোক্ষর চূঞ্চুশ্চ”)। ক্ষীরস্বামী কৃত অমরকোষের টীকায়ও করণ বলতে কায়স্থদের মতই একশ্রেণীর রাজকর্মচারীকে বোঝান হয়েছে। গাহডবালরাজ গোবিন্দচন্দ্রের দুইটি পট্টোলিক লেখক জলহণ একটিতে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন কায়স্থ বলে, আর একটিতে তিনি “করণিকোদ্গতো”।(Ep. Ind IV, p. 14o, VIII, p. I53) চান্দেল্লরাজ ভোজবর্মণের অজয়গড় লিপিতেও করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলে ধরা হয়েছে।(Ep. Ind. I, p. 330) কায়স্থরা যে রাজকর্মচারী তা প্রাচীন বিষ্ণু ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিদ্বারাও সমর্থিত।(Kane, History of Dharmasasta) বিষ্ণুস্মৃতিমতে তারা রাজকীয় দলিল-পত্রাদির লেখক ছিলেন; যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির টীকাকার বলেন কায়স্থরা ছিলেন লেখক ও হিসাবরক্ষক। এখনও তো বিহার অঞ্চলে হিসাব রাখার লিখনপদ্ধতির যে বিশিষ্ট ধরণ তাকে বলা হয় “কাইথী” লিপি। করণ শব্দও লেখক ও হিসাবরক্ষক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; সমস্ত পববর্তী সাক্ষ্যের ইঙ্গিতই এরকম, দু’এক ক্ষেত্রে মাত্র করণ ও কায়স্থ দুইটি শব্দ পৃথক পৃথক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন ৮৭০ খ্রীস্টাব্দের গুরম্হ তাম্র পট্টোলিতে।(Bhandan kar, List of Inscriptions….no. 34)। বৃহদ্ধর্মপুরাণে কিন্তু করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলা হয়েছে। উত্তর বিহারে করণ সম্প্রদায় এখনও কায়স্থদেরই একটি শাখা বলে পরিগণিত, উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থরা আজও নিজেদের করণ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। মেদিনীপুর, উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের করণরা চিত্রগুপ্তকেই তাদের আদিপুরুষ বলে মনে করেন, বাঙালী কায়স্থরাও তো তাই করেন। প্রাচীন কালে যাই হোক, পরবর্তী কালে অর্থাং খ্রীস্টীয় ৯ম-১০ম শতক নাগাদ বাংলায় করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলিনেই বিবেচিত হতো; ভারতের অন্যত্র ও হতো। বাংলায় করণেরা ক্রমে কায়স্থ নামের মধ্যেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, আমরা যে-যুগের আলোচনা করছি সেই যুগে বাংলার লিপিগুলোতে কায়স্থ শব্দের ব্যবহার যেমন পাচ্ছি, তেমনই পাচ্ছি করণ শব্দের ও প্রাচীন গ্রীক ও পারসিক দলিলপত্রে কাইথিঅয়, ক্ষযতিয় নামে এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর সংবাদ পাওয়া যায়; তারা ও লেখক ও হিসাবরক্ষক। এই কাইথিঅয়–ক্ষয়তিয়-র সঙ্গে আমাদের কায়স্থ শব্দের একটা যোগাযোগ থাকা কিছু অসম্ভব নয়। এ তথ্য নিঃসংশয় বলে মনে করা যেতে পাবে যে এই যুগের লিপিগুলোতে কায়স্থ কোন ও বর্ণ বা উপবর্ণজ্ঞাপক শব্দ নয়, বরং জীবনবৃত্তিবাচক শব্দ, অর্থাং কায়স্থর এই যুগে এখনও বর্ণ বা উপবর্ণ বলে গড়ে ওঠেনি। এই যুগের অন্তত দুইটি লিপিতে করণদের উল্লেখ পাচ্ছি। গুণাইঘর পট্টোলির লেখক সন্ধিবিগ্ৰহাপিক মানদত্ত ছিলেন করণ-কায়স্থ, এবং ত্রিপুরার লোকনাথ পট্টোলির মহারাজ লোকনাথও নিজের পরিচয় দিচ্ছেন করণ বলে। কারণ-কায়স্থ বলে নবদত্তের আত্মপরিচয় লক্ষ্যণীয়, করণ এবং কায়স্থ একেবাবে সমার্থক একথা স্পষ্ট না হলে ও উভয়েব মধ্যে যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগ বিদ্যমান তা এই ধরণের উল্লেখের মধ্যে যেন সুস্পষ্ট। লোকনাথের করণ-পরিচয় ও অন্য দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। তার মাতামহ কেশবকে বলা হয়েছে, ‘পারশর’; পিতামহ ‘দ্বিজবর’, প্রপিতামহ ‘দ্বিজসত্তমা’, এবং বুদ্ধপ্রপিতামহ মুনি ভরদ্বাজের বংশধর। ‘পরাশর কেশব’ কথার অর্থ তো এই যে কেশবের ব্রাহ্মণ পিতা একজন শূদ্রাণীকে বিবাহ করেছিলেন। অথচ, কেশব ছিলেন রাজার সৈন্যাধ্যক্ষ, এবং সমসাময়িক রাষ্ট্রে ও সমাজে তিনি যথেষ্ট মান্যও ছিলেন। ব্রাহ্মণ বর ও শূদ্র কন্যার বিবাহ বোধ হয় তথন ও সমাজে নিন্দনীয় ছিল না, পরবর্তী কালেও নিন্দনীয় না হোক অপ্রচলিত যে ছিল না তা তো স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট এবং জীমূতবাহনের রচনা থেকেই জানা যায়। লোকনাথের নিজের করণ-পরিচয়ের কারণ বলা বড় কঠিন। বোঝা যাচ্ছে, লোকনাথের পিতা একজন পারশর-দুহিতাকে বিবাহ করেছিলেন; এই জন্যই কি লোকনাথ বর্ণসমাজে নীচে নেমে গিয়েছিলেন, নাকি তার পিতাও ছিলেন করণ? এক্ষেত্রে করণ বর্ণ না বৃত্তিবাচক শব্দ তাও কিছুই নিশ্চয় করে বলা যাচ্ছে না। যাই হোক, এইটকু বোঝা গেল, করণ বা কায়স্থ এখন ও নিঃসন্দেহে বর্ণ বা উপবর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না, এই দুই শব্দেরই ব্যবহার মোটামুটি বৃত্তিবাচক, তবে বৃত্তি ক্রমশ বর্ণে বিধিবদ্ধ হইবার দিকে ঝুঁকছে।
ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য
উপরে আলোচিত ও বিশ্লেষিত নামগুলোর মধ্যে আর কোন কোন বর্ণ বা উপবর্ণ আত্মগোপন করে আছে তা বলার উপায় নেই; অন্তত বিশেষ ভাবে কোনও বর্ণ বা উপবর্ণ উল্লিখিত হচ্ছে না। বর্মণ অন্ত্যনাম কোন ও কোন ও ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে, যেমন বেত্রবর্মণ সিংহবৰ্মণ, চন্দ্রবর্মণ ইত্যাদি। এই যুগে বর্মণান্ত নাম উত্তর-ভারতের অন্যত্র ক্ষত্রিয়ত্ব জ্ঞাপক; কিন্তু বেত্রবর্মণ, চন্দ্রবর্মণ ক্ষত্রিয় কিনা বলা কঠিন, অন্তত তেমন দাবি কেউ করছেন না। রাজ-রাজন্যরা তো সাধারণত ক্ষত্রিয়ত্বের দাবি করে থাকেন, কিন্তু সমসাময়িক বাংলার রাজরাজন্যদের পক্ষ হতে ও তেমন দাবি কেউই জানায়নি। পরবর্তী পাল রাজাদের ক্ষত্রিয়ত্বের দাবিও নিঃসংশয় নয়, কেবল বিদেশাগত কোনও কোন ও বাজবংশ এই দাবি করেছেন। বস্তুত বাংলার স্মৃতি-পুরাণে ঐতিহ্যে ক্ষত্রিয় বর্ণের সবিশেষ দাবি কারও যেন নেই! নগরশ্রেষ্ঠ, সার্থবাহ, ব্যাপারী-ব্যবসায়ীর উল্লেখ এযুগে প্রচুর; কিন্তু তাদের পক্ষ হতেও বৈশ্যত্বের দাবি কেউ করছেন – তা সমসাময়িক কালে দেখা যায়না, পরবর্তী কালেও নয়। বাংলার স্মৃতি-পুরাণ-ঐতিহ্যে বিশিষ্ট পৃথক বর্ণ হিসেবে বৈশ্যবর্ণের স্বীকৃতি নেই। বল্লালচরিতে বণিক-সুবর্ণবণিকদের বৈশ্যত্বের দাবি করা হয়েছে; কিন্তু এ সাক্ষ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। অন্যত্র কোথাও কাহারও সে দাবি নেই, স্মৃতি গ্রন্থাদিতে নেই, বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পর্যন্ত নেই। বস্তুত বাংলায় কোনও কালেই ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সুনির্দিষ্ট বর্ণহিসেবে গঠিত ও স্বীকৃত হয়েছিল বলেই মনে হয় না; অন্তত তার সপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোনও প্রমাণ নেই। এর কারণ কি বলা কঠিন। বহুদিন আগে রামপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বলেছিলেন, (Chanda, Indo-Aryan Races) বাংলার আর্যীকরণ ঋগ্বেদীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী হয়নি, সেজন্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য-শূদ্র লইয়া যে চাতুবৰ্ণ-সমাজ, বাংলায় তার প্রচলন নেই। বাংলার বর্ণসমাজ অ্যাল্পীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী গঠিত, এবং অ্যালপীয় আর্য ভাষীরা ঋগ্বেদীয় আর্যভাষী হতে পৃথক। চন্দ মহাশয়ের এই মত যদি সত্য হয় তা হলে এর মধ্যে বাংলার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের প্রায়ানুপস্থিতির কারণ নিহিত থাকা অসম্ভব নয়। বাংলার বর্ণবিন্যাস ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রবর্ণ ও অন্তজ-ম্লেচ্ছদের লইয়া গঠিত; করণ-কায়স্থ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য এবং অন্যান্য সংকর বর্ণ সমস্তই শূদ্র-পর্যায়ে; সর্বনিম্নে অন্ত্যজ বর্ণের লোকেরা। ১২শ ১৩শ শতকের এই বর্ণবিন্যাস ৫ম-৮ম শতকে খুব সুস্পষ্টভাবে দেখা না দিলেও তার মোটামুটি কাঠামো এই যুগেই গড়ে উঠেছিল, এই অনুমান করা চলে। কারণ, এই যুগের লিপিগুলোতে তিনটি দ্বিজবর্ণের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণদেরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ধরা পড়ছে; আর যারা, তারা এবং অন্যান্যে বিচিত্র জীবন-বৃত্তি অবলম্বন করে শূদ্রান্তর্গত বিভিন্ন উপবর্ণ গড়ে উঠছে মাত্র; ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণের কোন ইঙ্গিত-আভাস কিছুই নেই।
পাল যুগ : বর্ণ বিন্যাসের তৃতীয় পর্ব
ভূমিকা
বর্ণ হিসেবে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের ইঙ্গিত আভাস পরবর্তী পাল আমলেও দেখা যাচ্ছে না। একমাত্র “রামচরিত” গ্রন্থের টীকাকার পাল-বংশকে ক্ষত্রিয়-বংশ বলে দাবি করেছেন।(রামচরিত, ১।১৭ শ্লোকের টীকা দ্রষ্টব্য)। কিন্তু এই ক্ষত্রিয় কি বর্ণ অর্থে ক্ষত্রিয়? রাজা-রাজন্য মাত্রই তো ক্ষত্ৰিয়; সমসাময়িক কালে সব রাজবংশই তো ক্ষত্ৰিয় বলে নিজেদের দাবি করেছে, এবং একে অন্যের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে। রাজা-রাজন্যের বিবাহ-ব্যাপারে কোন ও বর্ণগত বাধা-নিষেধ কোন ও কালেই ছিল না। তারানাথ তো বলছেন গোপাল ক্ষত্রিয়াণীর গর্ভে জনৈক বৃক্ষদেবতার পুত্র(Taranath’s Geschichte der Buddhismus. — p. 202); এ-গল্প নিঃসন্দেহে টটেম-স্মৃতিবহ! আবুল ফজল বলেন পাল রাজারা কায়স্থ(Ain-i-Akbari. Trs. Blochmann & Jarret, II, p. 145); মঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থ তাদের সোজাসুজি বলেছে দাসজীবী (Manjusrimulakalpa, ed. Jayaswal. v. p. 883)। পালেরা বৌদ্ধ ছিলেন, এবং মনে রাখা দরকার তারানাথ এবং মঞ্জশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার দুইজনই বৌদ্ধ। পালেরা যে বর্ণহিসেবে দ্বিজশ্রেণীর কেউ ছিলেন না, তারানাথ, আবুল ফজল এবং শেষোক্ত গ্রন্থের লেখক সকলের ইঙ্গিতই যেন সেই দিকে। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বর্ণের নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উল্লেখ আর কোথাও দেখছি না। তবে রাজা, রাণক, রাজন্যক প্রভৃতিরা ক্ষত্ৰিয় বলে নিজেদের পরিচয় দিতেন, এমন অনুমান অসম্ভব নয়, কিন্তু বর্ণ হিসেবে তারা যথার্থই ক্ষত্রিয় ছিলেন কিনা সন্দেহ। ক্ষত্রিয়-পরিবারে বিবাহ অনেক রাজাই করেছেন, কিন্তু শুধু তাই ক্ষত্ৰিয়ত্ব জ্ঞাপক হতে পারে না।
করণ-কায়স্থ
করণ-কায়স্থদের অস্তিত্বের প্রমাণ অনেক পাওয়া যাচ্ছে। রামচরিতের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা ছিলেন “করণানামাগ্ৰণী”,অর্থাৎ করণ কুলের শ্রেষ্ঠ(রামচরিত, কবিপ্রশস্তি, ৩নং শ্লোক); তিনি ছিলেন পালরাষ্ট্রের সন্ধিবিগ্রহিক। শব্দপ্রদীপ নামে একটি চিকিৎসা গ্রন্থের লেখক আত্মপরিচয় দিচ্ছেন “করণান্বয়”, অর্থাৎ করণ-বংশজাত বলে; তিনি নিজে রাজবৈদ্য ছিলেন, তার পিতা ও প্রপিতামহ যথাক্রমে পালরাজ রামপাল ও বঙ্গালরাজ গোবিন্দ চন্দ্রের রাজবৈদ্য ছিলেন।(Eggeling, Cat. of Sans, Mss. In the Library of the India Office, London. 1887. v. p. 974)। ন্যায়কন্দলী- গ্রন্থের লেখক শ্ৰীধরের (৯৯১ খ্রী) পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাণ্ডুদাস, তার পরিচয় দেয়া হয়েছে ‘কায়স্থ কুলতিলক’ বলে(সুকুমার সেন, বাঙ্গলা সহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড; JASB. 1912, p. 34I)। পাণ্ডুদাসের বাড়ী বাংলায় বলেই মনে হচ্ছে, যদিও এসম্বন্ধে নিঃসংশয় প্রমাণ নেই। তিব্বতী গ্রন্থ পাগ্-সাম-জোন্-জা (Pag-Sam-Jon-Zang) পাল-সম্রাট ধর্মপালের এক কায়স্থ রাজকর্মচারীর উল্লেখ করছেন, তার নাম দঙ্গদাস(Ed.S. C. Das, lnt o. p. iii;)। জড্ঢ নামে গৌড়দেশবাসী এক করণিক খাজুরাহোর একটি লিপির (৯৫৪) লেখক(Eр, Ind. 1. р. 122)। যুক্ত প্রদেশের পিলিভিট্ জেলায় প্রাপ্ত দেবল প্রশস্তির (৯৯২) লেখক তক্ষাদিত্যও ছিলেন একজন গৌড়দেশবাসী করণিক(Ep. Ind, I, p, 81)। চাহমান রাজ রায়পালের নাডোল লিপির লেখক ছিলেন (১১৪১) ঠকুর পেথড নামে জনৈক গৌড়ান্বয় কায়স্থ(Ep. Ind. XI, p. 4), বীসলদেবের দিল্লী-শিবালিক স্তম্ভলিপির (১১৬৩) লেখক শ্রীপতিও ছিলেন একজন গৌড়ান্বয় কায়স্থ(lnd. Ant. XIX, p. 2 18)। সমসাময়িক উত্তর ও পশ্চিম ভারতে করণ-কায়স্থেরা পৃথক স্বতন্ত্র বর্ণ বা বংশ বলে গণ্য হতো, এসম্বন্ধে অনেক লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। রাষ্ট্রকূট অমোঘবর্ষের একটি লিপিতে (৯ম শতক) বলভ-কায়স্থ বংশের উল্লেখ, ১১৮৩ বা ১১৯৩ খৃষ্টাব্দের একটি লিপিতে কায়স্থ বংশের উল্লেখ(Ep. Ind. XVIII, p 25 I, P oc. A. S. B. 1880, p 78), প্রভূতি হতে মনে হয় ৯ম-১০ম-১১শ শতকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সর্বত্রই কায়স্থরা বর্ণহিসেবে গড়ে উঠেছিল। বাস্তু হতে উদ্ভূত এই অর্থে বাস্তব্য কায়স্থের উল্লেখ ও একাধিক লিপিতে পাওয়া যাচ্ছে; ১১শ শতকের আগে এই বাস্তব্য কায়স্থেরা কালঞ্জর নামক স্থানে বাস করতো, এই তথ্যও এই লিপিগুলো হতে জানা যাচ্ছে। বুদ্ধ গয়ায় প্রাপ্ত এই আমলের একটি লিপিতে(Ep Ind, J, p 332) পরিষ্কার বলা হয়েছে যে বাস্তব্য কায়স্থেরা করণবৃত্তি অনুসরণ করতো; এবং তাহদের বর্ণ বা উপবর্ণকে যেমন বলা হয়েছে কায়স্থ তেমনই বলা হয়েছে করণ, অর্থাং করণ এবং কায়স্থ যে বর্ণহিসেবে সমর্থিক ও অভিন্ন তাই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ৯ম-১০ম শতক নাগাদ বাংলায়ও করণ-কায়স্থেরা বর্ণহিসেবে গড়ে উঠেছিল, এই সঙ্গন্ধে অন্তত একটি লিপিপ্ৰমাণ বিদ্যমান। শাকম্ভরীর চাহমানাধিপ দুলৰ্ভরাজের কিনসরিযা লিপির (৯৯৯) লেখক ছিলেন গৌড়দেশবাসী মহাদেব, মহাদেবের পরিচয় দেয়া হয়েছে “গৌড়কায়স্থবংশ” বলে (Ep. Ind. XI 1. p. 61)।
কায়স্থদের বর্ণগত উদ্ভব সম্বন্ধে লিপিমালায় এবং অর্বাচীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে নানা প্রকাল কাহিনী প্রচলিত দেখা যায়। বেদব্যাস স্মৃতিমতে কায়স্থরা শূদ্রপপর্যায়ভূক্ত(Kane, History of the Dharmasastras, p. 76)। উদয়সুন্দরী কথা-গ্রন্থের লেখক কবি সোঢ্ঢল (১১শ শতক) কায়স্থবংশীয় ছিলেন(উদয়সুন্দরীকথা, Gaekwad Or. Ser. p. 11), তার যে বংশপরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যায় কায়স্থরা ক্ষত্ৰিয় বর্ণান্তর্গত বলে দাবি করতেন। ১০৪৯ খ্রীস্টাব্দের কলচুরীরাজ কর্ণের জনৈক কায়স্থ মন্ত্রীর একটি লিপিতে কায়স্থদের বলা হয়েছে ‘দ্বিজ’ (৩৪: শ্লোক), অন্য স্থানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে তারা ছিলেন শূদ্র (Ep lnd. XXlV, p. 101)। ব্ৰাহ্মণেরাও যে করণবৃত্তি গ্রহণ করতেন তার একাধিক লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। ভাস্করবমর্ণের নিধনপুর লিপি-কথিত জনৈক ব্রাহ্মণ জনাৰ্দন স্বাধী ছিলেন ন্যায়-করণিক। এই লিপিতে জনৈক কায়স্থ দুন্ধুনাথেরও উল্লেখ আছে(কামরূপশাসনাবলী, পু ৪৩)। উদয়পুরের ধোড়লিপিতে (১১৭১) এক করণিক ব্রাহ্মণের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় (Bhandarkar, List of Insciptions no. 350)। করণিক শব্দ এইসব ক্ষেত্রে যে বৃত্তিবাচক সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই; তবে, সাম্প্রতিক কালে কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, বাংলার কায়স্থরা নাগর ব্রাহ্মণদের বংশধর, এবং এইসব নাগর ব্রাহ্মণ পঞ্জাবের নগরকোট, গুজরাট-কাথিয়াবাড়ের আনন্দপুর (অন্য নাম নগর) প্রভৃতি অঞ্চল হতে এসেছিলেন (Ind. Ant., LXI, p. 48, I. H. Q. VI, p. 60)। এই মত সকলে স্বীকার করেন না; এসম্বন্ধে একাধিক বিরুদ্ধ-যুক্তি যে আছে, সত্যই তো ই অস্বীকার করা যায়নি (H.B. (D. U.), p. 589)। বিদেশ হতে নানাশ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা বাংলায় এসে বসবাস করেছেন, তার প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান; কিন্তু পৃথক পৃথক বর্ণস্তর গড়ে তুলিবার মতন এত অধিক সংখ্যায় তারা কখনও এসেছিলেন, এমন প্রমাণ নেই।
বৈদ্য-অম্বষ্ঠ
পাল আমলের সুদীর্ঘ চারিশত বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষের অন্যত্র বৈদ্যবংশ ও পৃথক উপবর্ণ হিসেবে গড়ে ওঠেছে। প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে বর্ণহিসেবে বৈদ্যের উল্লেখ নেই, অর্বাচীন স্মৃতি-গ্রন্থে চিকিৎসাবৃত্তিধাবী লোকদের বলা হয়েছে বৈদ্যক। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বৈদ্য ও অম্বষ্ঠ সমার্থক বলে ধরা হয়েছে, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অম্বষ্ঠ ও বৈদ্য দুই পৃথক উপবর্ণ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার সহবাসে উৎপন্ন অম্বষ্ঠ সংকব বর্ণের উল্লেখ একাধিক স্মৃতি ও ধর্মসূত্র গ্রন্থে পাওয়া যায়। বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত অম্বষ্ঠ-বৈদ্যের অভিন্নতা পরবর্তী কালে বাংলায় স্বীকৃত হয়েছিল; চন্দ্রপ্রভা-গ্রন্থ এবং ভট্টিটীকার বৈদ্য লেখক ভরত মল্লিক (১৭শ শতক) অম্বষ্ঠ এবং বৈদ্য বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন (চন্দ্রপ্রভা, কলিকাতা)। কিন্তু বাংলার বাইরে সর্বত্র এই অভিন্নতা স্বীকৃত নয়; বর্তমান বিহার এবং যুক্তপ্রদেশের কোনও কোনও কায়স্থ সম্প্রদায় নিজেদের অম্বষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন; এবং অন্ততঃ একটি অর্বাচীন সংহিতায় (সূত-সংহিতা) অম্বষ্ট ও মাহিষ্যদের অভিন্ন বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যাই হোক, দক্ষিণতম ভারতে ৮ম শতকেই বৈদ্য ওপরর্ণের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। জনৈক পাণ্ড্যরাজার তিনটি লিপিতে(Ep. Ind. XVII, 291-3o9; VIII, 317-38 1, Ind. Ant., 1893, 57 pp.)। কয়েকজন বৈদ্য সামন্তের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, এবং এরা প্রত্যেকেই সমসাময়িক রাষ্ট্র ও সমাজে সম্ভ্রান্ত ও পরাক্রান্ত বলে গণিত হতেন, তা বোঝা যাচ্ছে। এগুলোর একজনের পরিচয় দেয়া হয়েছে বৈদ্য এবং “বৈদ্যকশিখামণি” বলে; তিনি একজন প্রখ্যাত সেনানায়ক এবং রাজার অন্যতম উত্তরমন্ত্রী ছিলেন। আর একজনের জন্মের ফলে বঙ্গলণ্ডৈব (পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার?) বৈদ্যকুল উজ্জ্বল হয়েছিল; তিনি ছিলেন গীতবাদ্যে সুনিপুণ। আরও এক জনের পরিচয় বৈদ্যক হিসেবে; তিনি ছিলেন একাধারে কবি, বক্তা এবং শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত। এই লিপিগুলোর বৈদ্যকুল, ‘বৈদ্য’ ‘বৈদ্যক’ শব্দগুলো ভিষক্বৃত্তিবাচক বলে মনে হচ্ছে না, এবং বৈদ্যকুল বলতে যেন কোনো উপবর্ণই বোঝাচ্ছে। বাংলার সমসামধিক কোনো লিপি বা গ্রন্থে এই অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে বৈদ্যক, বা বৈদ্যকবংশ বা বৈদ্যক কুলের কোনো উল্লেখ নেই। বস্তুত, তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তী পাল ও সেন-বর্মণযুগে, ১১শ শতকের পাল লিপিতে ১২শ শতকে শ্রীহট্টজেলায় রাজা ঈশানদেবের ভাটেরা লিপিতে। ঈশানদেবের অন্যতম পট্টনিক বা মন্ত্রী বনমালী কর ছিলেন “বৈদ্যবংশ প্রদীপ” (Proc. A. S. B. 188o, 141 pp. Ep. lnd. XIX, 277 pp.)। পূর্ববতী পাল-চন্দ্রযুগে বরং দেখেছি শব্দপ্রদীপ গ্রন্থের লেখক, তার পিতা এবং প্রপিতামহ যাবা সকলেই ছিলেন রাজবৈদ্য বা চিকিৎসক তাদের আত্মপবিচয় ‘করণ’ বলে সেজন্য মনে হয়, ১১শ-১২শ শতকের আগে, অন্ততঃ বাংলায়, বৃত্তিবাচক বৈদ্য-বৈদ্যক শব্দ বর্ণ বা উপবর্ণ-বাচক বৈদ্য শব্দে বিবর্তিত হয়নি অর্থাং বৈদ্যবৃত্তিধারীরা বৈদ্য-ওপরর্ণে গঠিত ও সীমিত হইয় ওঠেননি। কিন্তু, পূর্বোক্ত পাণ্ড্যরাজার একটি লিপিতে যে বঙ্গলণ্ডৈর বৈদ্যকুলের কথা বলা হয়েছে, এই বঙ্গলণ্ডৈ কোথায়? এই বঙ্গলণ্ডৈর সঙ্গে কি বঙ্গ-বঙ্গালজনের বা বঙ্গাল-দেশের কোনও সম্বন্ধ আছে? নিহাররঞ্জন রায় এর মতে আছে। তার মতে এই বৈদ্যকুল বঙ্গ বা বঙ্গালদেশ (দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গ) থেকে দক্ষিণ প্রবাসে গিয়ে থাকতে পারে। বাংলায় বৈদ্যকুল এখনও বিদ্যমান; দক্ষিণতম ভারতে কিন্তু নেই, মধ্যযুগেও ছিল বলে কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া পূর্বোক্ত তিনটি লিপিই একটি রাজার রাজত্বের, এবং যে তিনটি বৈদ্য-প্রধানের উল্লেখ করা হয়েছে তারা যেন একই পরিবারভুক্ত। এইসব কারণে মনে হয়, বৈদ্যকুলের এই পরিবারটি বঙ্গ বা বঙ্গালদেশ হতে দক্ষিণ ভারতে গিয়ে হয়ত বসতি স্থাপন করেছিলেন। বঙ্গলণ্ডৈ হয়ত পাণ্ড্যদেশে বঙ্গ-বঙ্গাল দেশবাসীর একটি উপনিবেশ, অথবা একেবারে মূল বঙ্গ-বঙ্গালভূমি। যদি এই অনুমান সত্য হয় তা হলে স্বীকার করতে হয়, ৮ম শতকেই বাংলায় বৈদ্য উপবর্ণ গড়ে উঠেছিল।
কৈবর্ত
পাল আমলে কৈবর্তদের প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। বরেন্দ্রীর কৈবর্তনায়ক দিব্য বা দিব্বোক পালরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সামন্ত কর্মচারী ছিলেন বলে মনে হয়; অনন্তসামন্তচক্রের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পালরাষ্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহপরায়ণ হয়ে রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন, এবং বরেন্দ্রী কেড়ে নিয়ে সেখানে কৈবর্তাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। বরেন্দ্র কিছুদিনের জন্য দিব্য, রুদোক ও ভীম পর পর এই তিন কৈবর্ত রাজার অধীনতা স্বীকার করেছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় সমসাময়িক উত্তরবঙ্গ-সমাজে কৈবর্তদের সামাজিক প্রভাব ও আধিপত্য, জনবল ও পরাক্রম যথেষ্টই ছিল। বিষ্ণুপুরাণে কৈবর্তদের বলা হয়েছে অব্রহ্মণ্য, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও সংস্কৃতি বহির্ভূত।(৪।২৪।৮)। মনুস্মৃতিতে নিষাদ-পিতা এবং আয়োগব মাতা থেকে জাত সন্তানকে বলা হয়েছে মার্গব বা দাস; এগুলোরই অন্য নাম কৈবর্ত।(১০।৩৪) মনু বলছেন, এগুলোর উপজীবিকা নৌকার মাঝিগিরি। এই দুটি প্রাচীন সাক্ষ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কৈবর্তরা কোনও আর্যপূর্ব কোম বা গোষ্ঠী ছিল, এবং তারা ক্রমে আর্য-সমাজের নিম্নস্তরে স্থানলাভ করছিল। বৌদ্ধ জাতকের গল্পেও মৎস্যজীবিদের বলা হয়েছে কেবত্ত = কেবর্ত।(Rhys Davids, Buddhist India; Fick, Social Organisation.) আজ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের কৈবর্তরা নৌকাজীবী মৎস্যজীবী। ১২শ শতকে বাঙালী স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট সমাজে কৈবর্তদের স্থান নিদেশ করছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে, রজক, চর্মকার, নট, বরুড়, মেদ এবং ভিল্লদের সঙ্গে (প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ, ১১৮ পৃ); এবং স্মরণ রাখা প্রযোজন ভবদেব রাঢ়দেশের লোক। অমরকোষেও দেখছি, দাস ও ধীবরদের বলা হচ্ছে কৈবর্ত। মনুস্মৃতি এবং বৌদ্ধজাতকের সাক্ষ্য একত্রে যোগ করলেই অমকোষের সাক্ষ্যের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। ১২শ শতকের গোড়ায় ভবদেব ভট্টের সাক্ষ্যও প্রামাণিক। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, ঐ সময়ে ও কৈবর্তদের সঙ্গে মাহিষ্যদের যোগাযোগের কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নেই; এবং মাহিষ্য বলে কৈবর্তদের পরিচয়ের কোনও দাবিও নেই, স্বীকৃতিও নেই। পরবর্তী পর্বে সেই দাবি এবং স্বীকৃতির স্বরূপ ও পরিচয় পাওয়া যাবে; কিন্তু এই পর্বে নয়। কৈবর্তদের জীবিকাবৃত্তি যাই হোক, পালরাষ্ট্রের উদার সামাজিক আদর্শ কৈবর্তদের রাষ্ট্ৰীয় ক্ষমতালাভ ও সঞ্চয়ের পথে কোন ও বাধার সৃষ্টি করেনি, করলে দিব্য এত পরাক্রান্ত হয়ে উঠিতে পারতেন না। সন্ধ্যাকর নন্দী পালরাষ্ট্রের প্রসাদভোজী, রামপালের কীর্তিকথার কবি, তিনি দিব্যকে দস্যু বলেছেন, উপধিব্রতী বলেছেন, কুংসিত কৈবর্ত নৃপ বলেছেন, তার বিদ্রোহকে অলীক ধর্ম বিপ্লব বলেছেন, এই ডমর উপপ্লবকে ‘ভবস্য আপদম’ বলে বর্ণনা করেছেন – শত্রু এবং শত্রুবিদ্রোহকে পক্ষপাতী লোক তা বলেই থাকে, কিন্তু কোথাও তার বা তার শ্রেণীর বৃত্তি বা সামাজিক স্থান সম্বন্ধে কোন ও ইঙ্গিত তিনি দেননি। মনে হয়, সমাজে তাদের বৃত্তি বা স্থান কোনটাই নিন্দনীয় ছিল না। কৈবর্তরা যে মাহিষ্য, এ-ইঙ্গিতও সন্ধ্যাকর কোথাও দিচ্ছেন না। ১১শ-১২শ শতকে ও কৈবর্তরা বাংলায় কেবট্ট বলে পরিচিত হতেন এবং তাদের মধ্যে অন্ততঃ কেউ কেউ সংস্কৃতচর্চা করতেন, কাব্যও রচনা করতেন, এবং ব্রাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির ভক্ত অনুরাগী ছিলেন। ‘সদুক্তি কর্ণামৃত” নামক কাব্যসংকলন গ্রন্থে (১২০৬) কেবট্টপপীপ অর্থাং কেওট বা কৈবর্ত কবি পপীপ রচিত গঙ্গাস্তবের একটি পদ আছে। পদটি বিনয়-মধুর, সুন্দর!
বর্ণসমাজের নিম্নস্তর
পালরাজাদের অধিকাংশ লিপিতে সাময়িক বর্ণসমাজের নিম্নতমস্তরের কিছু পরোক্ষ সংবাদ পাওয়া যায়। লিপিগুলোর যে অংশে ভূমি দানের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হচ্ছে সেখানে বাজপাদোপজীবী বা রাজকর্মচারীদের সুদীর্ঘ তালিকার পরেই উল্লেখ করা হচ্ছে ব্রাহ্মণদের, তার পরে প্রতিবাসী ও ক্ষেত্রকর বা কৃষকদের, এবং কুটুম্ব অর্থাং স্থানীয় ধান প্রধান গৃহস্থ লোকদের। লক্ষণীয় যে ক্ষত্ৰিয়বৈশ্যাদের কোনও উল্লেখ নেই; এগুলোর পরই অন্যান্য যেসব স্তরের লোক তাদের সকলকে একত্র করে গাঁথিয়া উল্লেখ করা হচ্ছে মেদ, অন্ধ্র ও চণ্ডালদের। চণ্ডালরাই যে সমাজের নিম্নতম স্তব তাতে লিপির এই অংশটুকু উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে – “প্রতিবাসিনশ্চ ব্রাহ্মণোত্তরান্ মহত্তরকুটম্বিপুরোগমেদান্ ধ্ৰুকচণ্ডালপয্যন্তান্”। ভবদেব ভট্টের স্মৃতিশাসনে চণ্ডাল অন্তজ পর্যায়ের, চণ্ডাল ও অন্ত্যজ এই দুইই সমার্থক। মেদরাও ভবদেবের মতে অন্ত্যজ পর্যায়ের। মেদ ও চণ্ডালদের সঙ্গে অন্ধ্রদের উল্লেখ হতে মনে হয়, এদেরও স্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল বাঙালী সমাজের নিম্নতম স্তরে। কিন্তু, কেন এরকম হয়েছিল, বোঝা কঠিন। বেতনভূক সৈন্য হিসেবে মালব খস কুলিক, হূণ, কর্ণাট, লাট প্রভৃতি বিদেশী ও ভিনপ্রদেশী অনেক লোক পালবাষ্ট্রেব সৈন্যদলে ভর্তি হয়েছিল; এই তালিকায় অন্ধ্রদের দেখা পাওয় যায় না। এরা স্বভাবতঃ জীবিকার্জনের জন্য নিজের দেশ ছেড়ে বাংলায় এসে এদেশের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন, এবং সামাজিক দৃষ্টিতে হেয় বা নীচ এমন কোনও কাজ করে জীবিকানির্বাহ করতেন।
এদের ছাড়া “চযাঁগীতি” বা “চযাঁচর্যবিনিশ্চয়” গ্রন্থে আরও কয়েকটি তথাকথিত নীচ জাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে, যথা ডোম বা ডোম্ব, চণ্ডাল, শবর ও কাপালি। ডোমপত্নী অর্থাং ডোমনী বা ডোম্বি ও কাপালি বা কাপালিক সম্বন্ধে কাহ্নুপাদের একটি পদের কিয়দংশ উদ্ধার করা যেতে পারে। (চযাঁপদ ১০ নং)।
নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহেরি কুড়িআ (কুঁড়েঘর)।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্মণ নাড়িআা (নেড়ে ব্রাহ্মণ)।।
আলো (ওলো) ডোম্বি তোত্র সম করিব ম সঙ্গ।
নিঘিন (নিঘৃণ — ঘৃণা নেই যার) কাহ্ন কাপালি জোই (যোগী) লাংগ (উলঙ্গ)।।…
তান্তি (তাঁত) বিকণঅ ডোম্বি অরবনা চাংগেড়া (বাশের চাঙ্গাড়ি)।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়-পেড়া ॥
ডোমেরা যে সাধারণতঃ নগরের বাইরে কুঁড়ে বাঁধিয়া বাস করতো, বাঁশের তাঁত ও চাঙাড়ি তৈরি করে বিক্রয় করতো, এবং ব্রাহ্মণস্পর্শ যে তাদের নিষিদ্ধ ছিল, এই পদে তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে! ডোম পুরুষ ও নারী নৃত্যগীতে সুপটু ছিল। কপালী বা কাপালি(ক)রাও নিম্নস্তরের লোক বলে গণ্য হতো; এই পদে তার ও ইঙ্গিত বিদ্যমান। ভবদেব ভট্ট চণ্ডাল ও পুক্কশদের সঙ্গে কাপালিকদেরও অন্ত্যজ পর্যায়ভুক্ত করেছেন। কাপালিকরা ছিল লজ্জাঘৃণাবিরহিত, গলায় পরিত হাড়ের মালা, দেহগাত্র থাকিত প্রায় উলঙ্গ। শবরেরা বাস করতো পাহাড়ে জঙ্গলে, ময়ূরের পাখ্ ছিল তাদের পরিধেয়, গলায় গুঞ্জা বীচির মালা, কর্ণে বজ্রকুণ্ডল। (চযাঁপদ ২৮ নং)।
উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী॥…
একেলী শবরী এ বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডলবজ্রধারী!
তিঅ ধাউ খাট পাড়িলা সবরো মহাসুখে সেজি ছাইলী।
সবোর ভূজঙ্গ নৈরামণি দাবী পেহ্মরাতি পোতাইলী।।
শবর-শবরীদের গানের একটা বিশিষ্ট ধরণ ছিল; সেই ধরণ শবরী রাগ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কয়েকটি চযাঁগীতি যে এই শবরী রাগে গীত হতো সে-প্রমাণ এই গ্রন্থেই পাওয়া যাচ্ছে। এই চৰ্যাগীতিটির মধ্যেই আমরা বজ্রযান বৌদ্ধদেবতা পর্ণশবরীর রূপাভাস পাচ্ছি, এ-তথ্যের ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট। একাধিক চযাঁগীতির ইঙ্গিতে মনে হয় ডোম্ব ও চণ্ডাল অভিন্ন (১৮ ও ৪৭ সংখ্যক পদ) কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ডোম ও চণ্ডাল উঠাই অন্ত্যজ অস্পৃশ্য পর্যায়ভুক্ত, কিন্তু পৃথক পৃথকভাবে উল্লিখিত। চযাঁপদের সাক্ষ্য হতে এই ধারণা করা যায় যে সমাজের উচ্চতর শ্রেণী ও বর্ণের দৃষ্টিতে এগুলোর যৌনাদর্শ ও অভ্যাস শিথিল ছিল। পরবর্তী পর্বে দেখা যাবে, এই শৈথিল্য উচ্চশ্রেণীর ধর্মকর্মকেও স্পর্শ করেছিল। পাহাড়পুরের ধ্বংসস্তুপের পোড়ামাটির ফলকগুলোতে বাঙালীসমাজের নিম্নস্তরের এইসব গোষ্ঠী ও কোমদের দৈহিক গঠনাকুতি ও দৈনন্দিন আহারবিহার বসনব্যসনের কতকটা পরিচয় পাওয়া যায়। বৃক্ষপত্রের পরিধান, গলায় গুঞ্জাবীচির মালা, এবং পাতা ও ফুলের নানা অলঙ্কার দেখিলে শবরী মেযেদের চিনিয়া লইতে দেরী হয় না।
ব্রাহ্মণ
পাল-চন্দ্র-কম্বোজ পর্বের ব্রাহ্মণেতর অন্যান্য বর্ণ উপবর্ণ সম্বন্ধে যেসব সংবাদ পাওয়া যায় তা একত্রে গাঁথিয়া মোটামুটি একটা চিত্র দাঁড় করাবার চেষ্টা করা গেল। দেখা যাচ্ছে এযুগের রাষ্ট্রদৃষ্টি বর্ণসমাজের নিম্নতম স্তর চণ্ডাল পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য বর্ণসমাজের মাপকাঠি ব্রাহ্মণ স্বয়ং এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও ধর্ম। সমাজে এদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির বিস্তার ও গভীরতার দিকে তাকালে বর্ণসমাজের ছবি স্পষ্টতর ধরতে পারা যায়। এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার তারতম্য এবং বিশিষ্টতা অনেকাংশে কোন বিশেষ ধর্ম ও ধর্মগত সংস্কার ও সমাজব্যবস্থার প্রসারতার দ্যোতক।
৫ম-৬ষ্ঠ-৭ম শতকে ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি প্রসার আগেই লক্ষ্য করা হয়েছে। সমাজে ব্রাহ্মণ্য বর্ণব্যবস্থাও সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ প্রসারিত হচ্ছিল। যুয়ান্-চোয়াঙ, ও মঞ্জুশ্ৰীমূল-কল্পের গ্রন্থকার শশাঙ্ককে বলেছেন বৌদ্ধবিদ্বেষী। সত্যই শশাঙ্ক তা ছিলেন কিনা সে-বিচার এখানে অবান্তর। এই দুই সাক্ষ্যের একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি নদীয়া বঙ্গসমাজের কুলজী গ্রন্থেও আছে, এবং সেই সঙ্গে আছে শশাঙ্ক কর্তৃক সরযূনদীর তীর হতে বারো জন ব্রাহ্মণ আনয়নের গল্প। শশাঙ্ক এক উৎকট ব্যাধিদ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন; ব্যাধিমুক্তির উদ্দেশ্যে গৃহযজ্ঞ করার জন্যই এই ব্রাহ্মণদের আগমন। রাজানুরোধে এই ব্রাহ্মণেরা গৌড়ে বসবাস আরম্ভ করেন এবং গৃহবিপ্র নামে পরিচিত হন; পরে তাদের বংশধরেরা রাঢ়েবঙ্গে ও বিস্তৃত হয়ে পড়েন এবং নিজ নিজ গাঞী নামে পরিচিত হন। বাংলার বের হতে ব্রাহ্মণ্যগমনের যে ঐতিহ্য কুলজী গ্রন্থে বিধৃত তার সূচনা দেখছি শশাঙ্কের সঙ্গে জড়িত। কুলজীগ্রন্থের অন্য অনেক গল্পের মত এই গল্পও হয়তো বিশ্বাস্য নয়, কিন্তু এই ঐতিহ্য-ইঙ্গিত সৰ্বথা মিথ্যা নাও হতে পারে। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার বলছেন, শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণের পক্ষে ব্রাহ্মণ্যপ্রীতি কিছু অস্বাভাবিক নয়, এবং বহুযুগস্মৃত শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষ কাহিনীর মূলে এতটুকু সত্যও নেই, একথাই বা কি করে বলা যায়। সমসাময়িক কাল যে প্রাগ্রসরমান ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও সংস্কৃতিরই কাল তা তো নানাদিক হতে সুস্পষ্ট। আগেই তা উল্লেখ করেছি। যুয়ান্ চোয়াঙ্, ইৎসিঙ্, সেংচি প্রভৃতি চীন ধৰ্ম পরিব্রাজকেরা যেসব বিবরণী রেখে গিয়েছেন তা থেকে অনুমান করা যায় বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থাও বেশ সমুদ্ধই ছিল, কিন্তু তারপরও এ তথ্য অনস্বীকার্য যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থা তার চেয়েও অনেক বেশী সমুদ্ধতর ছিল। বাংলার সর্বত্র ব্রাহ্মণ দেবপূজকের সংখ্যা সৌগতদের সংখ্যাপেক্ষ অনেক বেশি ছিল, এতথ্য যুয়ান্-চোয়াঙই রেখে গিয়েছেন। পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের তথা বৰ্ণব্যবস্থার প্রসার বেড়েই চলিয়াছিল, এ সম্বন্ধে দেবদেবীর মূর্তি-প্রমাণই যথেষ্ট। জৈন ধর্ম ও সংস্কার তো ধীরে ধীরে বিলীন হয়েই যেতেছিল। আর, বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কারও ব্রাহ্মণ্য সমাজাদর্শকে ধীরে ধীরে স্বীকার করে লইতে ছিল, পাল-চন্দ্র-কঙ্গোজ রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শের দিকে তাকাইলেই তা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। যুয়ান্-চোয়াঙ কামরূপ প্রসঙ্গে বলছেন, কামরূপের অধিবাসিরা দেবপূজক ছিল, বৌদ্ধধর্মে তারা বিশ্বাস করতো না; দেবমন্দিব ছিল শত শত, এবং বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের লোকসংখ্যা ছিল অগণিত। মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি বৌদ্ধ ছিল তারা ধর্মানুষ্ঠান করতো গোপনে। এই তো ৭ম শতক কামরূপের অবস্থা; বাংলায়ও তার স্পর্শ লাগে নেই, কে বলবে? মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার স্পষ্টই বলছেন, মাৎস্যন্যায়ের পর গোপালের অভ্যুদয় কালে সমুদ্রতীর পর্যন্ত স্থান তীৰ্থিকদের (ব্রাহ্মণ?) দ্বারা অধ্যুষিত ছিল; বৌদ্ধমঠগুলো জীর্ণ হয়ে পড়িতেছিল, লোকে এগুলোরই ইটকাঠ কুড়িয়ে নিয়ে ঘরবাড়ী তৈরি করছিল। ছোটবড় ভূস্বামীরাও তখন অনেকে ব্রাহ্মণ। গোপাল নিজেও ব্রাহ্মণানুরক্ত, এবং বৌদ্ধ গ্রন্থকার সেজন্য গোপালের ওপর একটু কটাক্ষপাতও করেছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের ক্রমবর্দ্ধমান প্রসার ও প্রভাব সম্বন্ধে কোন ও সন্দেহই আর করা যায় না।
পালরাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ
পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগের সমসাময়িক অবস্থাটা দেখা যেতে পারে। এ তথ্য সুবিদিত যে পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের তার পরম পৃষ্ঠপোষক, ওদন্তপুরী, সোমপুর এবং বিক্রমশীল মহাবিহারের তারা প্রতিষ্ঠাতা, নালন্দা মহাবিহারের তারা ধারক ও পোষক; বজ্রাসনের বিপুল করুণা পরিচালিত দলবল পাল রাষ্ট্রের রক্ষক। বাংলায় যত বৌদ্ধ মূর্তি ও মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে তা প্রায় সমস্তই এই যুগের; যত অসংখ্য বিহারের উল্লেখ পাচ্ছি নানা জায়গায় জগদ্দল বিক্রমপু্রী-ফুল্লহরি-পট্টিকেরক-দেবীকোটপণ্ডিত-ত্ৰৈকূটক-পণ্ডিতসন্নগর – এই সমস্ত বিহারও এই যুগের; দেশ-বিদেশ-প্রখ্যাত যে বৌদ্ধ পণ্ডিতাচার্যদের উল্লেখ পাচ্ছি তারাও এই যুগের। চন্দ্রবংশও বৌদ্ধ; জিন (বুদ্ধ), ধর্ম ও সংঘের স্বস্তি উচ্চারণ করে চন্দ্রবংশীয় লিপিগুলোর সূচনা; এগুলোর রাজ্য হরিকেল তো বৌদ্ধতান্ত্রিক পীঠগুলোর অন্যতম পীঠ। ভিন্ন-প্রদেশাগত কম্বোজ রাজবংশ ও বৌদ্ধ, পরমসুগত।
অথচ এদের প্রত্যেকেরই সমাজাদর্শ একান্তই ব্রাহ্মণ্য সংস্কারানুসারী, ব্রাহ্মণ্যাদর্শানুযায়ী। এই যুগের লিপিগুলো তো প্রায় সবই ভূমিদান সম্পর্কিত; এবং প্রায় সর্বত্রই ভূমিদান লাভ করছেন ব্রাহ্মণেরা, এবং সর্বাগ্রে ব্রাহ্মণদের সম্মাননা না করে কোন দানকার্যই সম্পন্ন হচ্ছে না। তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি রাষ্ট্রের ও সমাজের সর্বত্র। “হরিচরিত” নামক গ্রন্থের লেখক চতুর্ভূজ বলছেন, তার পূর্বপুরুষের বরেন্দ্রভূমির করঞ্জগ্রাম ধৰ্মপালের কাছ থেকে দানস্বরূপ লাভ করে ছিলেন। এই গ্রামের ব্রাহ্মণেরা বেদবিদ্যাবিদ এবং স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ ছিলে।(Sastri, H. P.–Cat of Mss. Nepal. 1, 134 p; হরপ্রসাদ সংবৰ্দ্ধন লেখমালা, ২য় খণ্ড, ২০৮ পৃ; যতীন্দ্র মোহন রায়—ঢাকার ইতিহাস, ২য় খণ্ড, ১০৭ পৃ)। এই ধর্মপাল প্রসিদ্ধ পাল-নরপতি হওয়াই সম্ভব, যদিও কেউ কেউ মনে করেন ইনি রাজেন্দ্রচোল-পরাজিত ধৰ্মপাল। বৌদ্ধ নরপতি শূরপাল (প্রথম বিগ্রহপাল) মন্ত্রী কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া অনেকবার শ্রদ্ধাসলিলাপ্লুতহৃদয়ে নতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করেছিলেন। বাদল প্রস্তরলিপিতে শাণ্ডিল্যগোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ মন্ত্ৰীর শৈব প্রশস্তি উৎকীর্ণ আছে; এই বংশের তিনপুরুষ বংশপরম্পরায় পালবাষ্ট্রের মন্ত্রীত্ব করেছিলেন। দর্ভপাণিপুত্র মন্ত্রী কেদারমিশ্র সঙ্গন্ধে এই লিপিতে আরও বলা তইয়াছে, “তার [হোমকুণ্ডোত্থিত] অবক্ৰভাবে বিরাজিত সুপুষ্ট হোমাগ্নিশিখাকে চুম্বন করে দিকচক্রবাল যেন সন্নিহিত হয়ে পড়িত।” তা ছাড়া তিনি চতুৰ্বিদ্যা-পয়োনিপি পান করেছিলেন (অর্থাৎ চারি বেদবিদ ছিলেন)। কেদারমিশ্রের পুত্র মন্ত্রী গুরবমিশ্রের “বাগ্বৈভবের কথা, আগমে ব্যুৎপত্তির কথা, নীতিতে পরম নিষ্ঠার কথা… জ্যোতিষে অধিকারের কথা এবং বেদার্থচিন্তাপরায়ণ অসীম তেজসম্পন্ন তদীয় বংশের কথা ধর্মাবতার ব্যক্ত করে গিয়েছেন।” পরমসুগত প্রথম মহীপাল বিষুবসংক্রান্তির শুভতিথিতে গঙ্গাস্নান করে এক ভট্ট ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করেছিলেন। তৃতীয় বিগ্ৰহপালও আমগাছি লিপিদ্বারা এক ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করেছিলেন।
মদনপালেব মহনলি লিপিতে বলা হয়েছে, শ্রীবটেশ্বর স্বামীশর্মা বেদব্যাসপ্রোক্ত মহাভারত পাঠ করায় মদনপালের পট্টমহাদেবী চিত্রমতিকা ভগবান বৃদ্ধভট্টারককে উদ্দেশ্য করে অনুশাসন দ্বারা বটেশ্বরকে নিষ্কর গ্রাম দান করেছেন। বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপিতে দেখছি, বরেন্দ্রীর অন্তর্গত ভাবগ্রামে ভরত নামক ব্রাহ্মণ প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন; “তার যুধিষ্ঠির নামক বিপ্র (কুল) তিলক পণ্ডিতাগ্রগণ্য পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি শাস্ত্রজ্ঞানপরিশুদ্ধবুদ্ধি এবং শ্রেত্রিয়ত্বের সমুজ্জ্বল যশোনিধি ছিলেন।” যুধিষ্ঠিরের পুত্র ছিলেন দ্বিজাধীশ-পূজ্য শ্রীধর। তীর্থভ্রমণে, বেদাধ্যয়নে, দানাধ্যাপনায়, যজ্ঞানুষ্ঠানে, ব্রতাচরণে, সবশ্রোত্রীয়শ্রেষ্ট শ্রীধর প্রাতঃ, নক্ত, অযাচিত এবং ওপরসন (নামক বিবিধ কৃচ্ছ্রসাধন) করে মহাদেবকে প্রসন্ন করেছিলেন, এবং কর্মকাণ্ড জ্ঞানকাণ্ডবিং পণ্ডিতগণের অগ্রগণ্য, সর্বাকার-তপোনিধি এবং শ্রৌতস্মার্তশাস্ত্রের গুপ্তার্থবিৎ বাগীশ বলে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। পবিত্র ব্রাহ্মণবংশোদ্ভব কুমারপাল-মন্ত্রী বৈদ্যদেব বৈশাখে বিষুবসংক্রান্তি একাদশী তিথিতে ধর্মাধিকার পদাভিষিক্ত শ্ৰী গোনন্দন পণ্ডিতের অনুরোধে এই ব্রাহ্মণ শ্রীধরকে শাসনদ্বারা ভূমিদান করেছিলেন। কিন্তু আর দৃষ্টান্ত উল্লেখের প্রয়োজননি; লিপিগুলোতে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী এবং মন্দির ইত্যাদির যেসব উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় তারও আর বিবরণ দিতেছি না। বস্তুত, পালযুগেব লিপিমালা পাঠ করলেই এ তথ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এইসব লিপির রচনা আগাগোড়া ব্রাহ্মণ্য পুরাণ, রামায়ণ মহাভারতের গল্প, ভাবকল্পনা, এবং উপমালঙ্কার দ্বারা আচ্ছন্ন – এগুলোর ভাবাকাশ একান্তই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের আকাশ। তা ছাড়া বৌদ্ধ পালরাষ্ট্র যে ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও বর্ণব্যবস্থা পুরোপুরি স্বীকার করতো তার অন্ততঃ দুটি উল্লেখ পাল-লিপিতেই আছে। দেবপালদেবের মুঙ্গের লিপিতে ধর্মপাল সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ধর্মপাল “শাস্ত্রার্থের অতুবর্তী শাসনকৌশলে (শাস্ত্রশাসন হতে) বিচলিত (ব্রাহ্মণ্যদি) বর্ণসমূহকে স্ব স্ব শাস্ত্রনিদিষ্ট ধর্মে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন”। এই শাস্ত্র যে ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র এই সম্বন্ধে তো কোন সন্দেহই থাকতে পারে না। স্ব স্ব ধর্মে প্রতিস্থাপিত কবিবার অর্থও নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসে প্রত্যেক বর্ণের যথানিদিষ্ট স্থানে ও সীমায় বিন্যস্ত করা। মাৎস্যন্যায়ের পরে নতুন করে শাস্ত্রশাসনানুযায়ী বিভিন্ন বর্ণগুলোকে সুবিন্যস্ত কবার প্রয়োজন বোধ হয় সমাজে দেখা দিয়েছিল৷ আমগাছি লিপিতেও দেখছি তৃতীয় বিগ্রহপালকে “চাতুবর্ণ্য-সমাশ্রয়” বর্ণাশ্রমের আশ্রয়স্থল বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
চন্দ্র ও কম্বোজ রাজ্যের সামাজিক আদর্শ
ভূমিকা
পালরাষ্ট্র সম্বন্ধে যা বলা হলো, চন্দ্র ও কম্বেজি রাষ্ট্র সম্বন্ধেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। বৌদ্ধ রাজা শ্ৰীচন্দ্র যথারীতি পবিত্র বারি স্পর্শ করে কোটিহোমকর্তা শাণ্ডিল্যগোত্রীয় ত্রিঋষিপ্রবর শান্তিবারিক ব্রাহ্মণ পীতবাস গুপ্ত শর্মাকে ভূমিদান করছেন, আর একবার এই রাজাই হোমচতুষ্টয়ক্রিয়াকালে অদ্ভূত-শান্তি নামক মঙ্গলানুষ্ঠানের পুরোহিত কাণ্বশাখীয় বার্দ্ধকৌশিকগোত্রীয় ত্রিঋষিপ্রবর শান্তিবারিক ব্রাহ্মণ ব্যাসগঙ্গশর্মাকে ভূমিদান করছেন – উভয় ক্ষেত্রেই দানকার্যটি হচ্ছে বুদ্ধভটারকের নামে এবং ধর্মচক্রদ্বারা শাসনথানা পট্টীকৃত করে। কঙ্গোজরাজ পরমসুগত নয়পালদের একটি গ্রাম দান করছেন ভট্টাদিবাকর শর্মার প্রপৌত্র, উপাধ্যায় প্রভাকর শর্মার পৌত্র এবং উপাধ্যায় অনুকূল মিশ্রের পুত্র, ভট্টপুত্র পণ্ডিত অশ্বত্থ শর্মাকে; এবং এই দানকার্যের যারা সাক্ষী তাদের মধ্যে পুরোহিত, ঋত্বিক এবং ধর্মজ্ঞ অন্যতম। এই দুই রাষ্ট্রেই ঋত্বিক, ধর্মজ্ঞ, পুরোহিত, শান্তিবারিক ইত্যাদি ব্রাহ্মণেরা রাজপুরুষ, এই তথ্য ও লক্ষণীয়।
বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য আদর্শ
বস্তুতঃ, ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কিছু নেই। পূর্ব পর্ব যুগে যাই হোক, এই যুগে সমাজব্যবস্থা ব্যাপারে বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণে কিছু পার্থক্য ছিল না। সামাজিক ব্যাপারে বৌদ্ধেরা ও মনুর শাসন মেনে চলতেন, ঠিক আজও বৌদ্ধধর্মানুসারী ব্রহ্ম ও শ্যামদেশ সামাজিক শাসনানুশাসনের ক্ষেত্রে যেমন কতকটা ব্রাহ্মণ্য শাসনব্যবস্থা মেনে চলে। তারানাথের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস এবং অন্যান্য তিব্বতী বৌদ্ধগ্রন্থের সাক্ষ্য থেকেও অনুমান হয়, বর্ণাশ্রমী হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে কোন সামাজিক পার্থক্যই ছিল না। যারা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতেন, বিহারে সংঘারামে বাস করতেন, তাদের ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রম-শাসন প্রযোজ্য ছিল না, থাকিবার কোন ও প্রযোজনও ছিল না। কিন্তু যার উপাসক মাত্র ছিলেন, গৃহী বৌদ্ধ ছিলেন তারা সাংসারিক ক্রিয়াকর্মে প্রচলিত বর্ণ-শাসন মেনেই চলতেন। বৌদ্ধপণ্ডিতে ব্রাহ্মণপণ্ডিতে ধর্ম ও সামাজিক মতামত লষ্টয়া দ্বন্দ্ব-কোলাহলের প্রমাণ কিছু কিছু আছে, কিন্তু বৌদ্ধরা পৃথক সমাজ সৃষ্টি করেছিলেন এমন কোনও প্রমাণ নেই। বরং সমসাময়িক কাল সম্বন্ধে তারানাথ এবং অন্যান্য বৌদ্ধ আচাৰ্যর যা বলছেন, তাতে মনে হয়, পালযুগের মহাযানী বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ তন্ত্রধর্মের কুক্ষিগত হয়ে পড়িতেছিল, এবং ধর্মাদর্শ ও ধর্মানুষ্ঠান, পূজা প্রকরণ প্রভৃতি ব্যাপারে নতুন নতুন মত ও পথের উদ্ভব ঘটছিল। তন্ত্রধর্মের স্পর্শে ব্রাহ্মণ্যধর্মেরও অনুরূপ বিবর্তন ঘটছিল, এবং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভেদ কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঘুচে যাচ্ছিল।
সমাজের গতি ও প্রকৃতি
ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাস পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, এবং বর্ণাশ্রম রক্ষণ ও পালনের দায়িত্ব এই যুগের বৌদ্ধরাষ্ট্রও স্বীকার করতো, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ সত্যই নেই। কিন্তু বর্ণবিন্যাস এবং প্রত্যেক বর্ণের সীমা পরবর্তী কালে যতটা দৃঢ়, অনমনীয় এবং নানা বিধিনিষেধের সূত্রে শক্ত ও সুনির্দিষ্ট রূপে বাঁধা পড়েছিল, এই যুগে তা হয়নি। তার প্রধান কারণ, বাংলা তখনও পর্যন্ত তার নিজস্ব স্মৃতিশাসন গড়ে তোলেনি; বস্তুত, স্মৃতিশাস্ত্র রচনার সূত্রপাতই তখনও হয়নি। দ্বিতীয়তঃ, এই যুগের সবকটি রাষ্ট্র এবং রাজবংশই বৌদ্ধধমাবলম্বী এবং বৌদ্ধ সংস্কারাশ্রয়ী; এরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং ব্রাহ্মণ্য-সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও পালক হলেও হিন্দুরাষ্ট্ৰীয় আদর্শে রাজার অন্যতম কর্তব্যই প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ধারণ ও পালন – উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাসন এদের নিকট একান্ত হয়ে উঠিতে পারেনি। তৃতীয়তঃ, পালবাজবংশ উচ্চবর্ণোদ্ভব নয়; বর্ণ-হিসেবে এগুলোর ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি “রামচরিত” ছাড়া আর কোথাও নেই, এবং তা রামপালের পিতা সম্বন্ধে। গোপাল বা ধর্মপাল বা দেবপাল সম্বন্ধে এ দাবি কেউ করেনি; দশ-বার পুরুষ রাজত্ব করার পর একজন রাজা ও তার বংশ ক্ষত্ৰিয় বলে পরিগণিত হবেন – তা কিছু আশ্চর্য নয়। যাই হোক, পালবংশ উচ্চবর্ণোদ্ভভ ছিলেন না বলেই বোধ হয় তারা বর্ণশাসনের স্মৃতি-সুলভ সুদৃঢ় আচার-বিচার বা স্তরউপস্তরভেদ সম্বন্ধে খুব নিষ্ঠাপরায়ণও ছিলেন না। চতুর্থতঃ, বঙালী সমাজের অধিকাংশ লোকই তখনও বর্ণাশ্রম বহির্ভূত, অল্প সংখ্যক উচ্চশ্রেণীর লোকেরাষ্ট বর্ণাশ্রমের অন্তর্গত ছিল, যদি ও তার সীমা ক্রমশই প্রসারিত হয়ে চলছিল। কিন্তু ক্ৰমবৰ্দ্ধমান সীমার মধ্যে যারা এসে অন্তর্ভূক্ত হচ্ছিল তারা সকলেই আর্যপূর্ব কোম-সমাজের ও সেই সমাজগত সংস্কার ও সংস্কৃতির লোক। ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থা, সংস্কার ও সংস্কৃতি তারা মেনে নিচ্ছিল অর্থনৈতিক আধিপত্যের চাপে পড়ে। ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের সূত্রের মধ্যে তাদের গেঁথে নেয়া খুব সহজ হয়নি; অন্তত পাল ও চন্দ্ররাষ্ট্র সচেতন ও সক্রিয়ভাবে সেদিকে চেষ্টা কিছু করেছিল বলে তো মনে হয় না, প্রমাণও কিছু নেই। রাষ্ট্রীয় চাপ সেদিকে কিছু ছিল না; রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টিও এবিষয়ে উদার ছিল। আমার এই শেষোক্ত অনুমানের সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কিছু নেই, তবে সমসময়িক রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় সমাজব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি যা হওয়া সম্ভব ও স্বাভাবিক তাই অনুমানের রূপে ও আকারে ব্যক্ত করিলাম। হিন্দুধর্ম ও সমাজের স্বাঙ্গীকরণক্রিয় আজও যে যুক্তিপদ্ধতি অনুসারে চলছে বিভিন্ন আর্যপূর্ব গোষ্ঠী ও কোম গুলোতে, সেই যুক্তিপদ্ধতিই এই অল্পমানের সাক্ষ্য ও সমর্থক। তাছাড়া, এই অনুমানের পেছনে রহিয়াছে, পরবর্তী যুগের বিশেষভাবে সেন-বর্মণ আমলের বাংলার বর্ণ ও সমাজ-বিন্যাসের ইতিহাস এবং বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য।
সেন-বর্মণ যুগ : বর্ণ বিন্যাসের চতুর্থ পর্ব
ভূমিকা
পাল-চন্দ্ররাষ্ট্রে ও তাদের কালে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসেব আদর্শ ছিল উদার ও নমনীয়; কম্বোজ সেন-বৰ্মণ আমলে সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের সক্রিয় সচেতন চেষ্টার ফলে সেই আদর্শ হলো সুদৃঢ়, অনমনীয় ও সুনিদিষ্ট। যে বর্ণ-বিন্যস্ত সমাজব্যবস্থা আজও বাংলায় প্রচলিত ও স্বীকৃত তার ভিত্তি স্থাপিত হলো এই যুগে দেড় শতাব্দীর মধ্যে। বাংলার সমাজ ব্যবস্থার এই বিবর্তন প্রায় হাজার বছরের বাংলাকে ভেঙ্গে নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছে। কি করে এই আমূল সংস্কার, এত বড় পরিবর্তন সাধিত হলো তা একে একে দেখা যেতে পারে।
কম্বোজ-রাজবংশকে অবলম্বন করেই এই বিবর্তনের সূচনা অনুসরণ করা যেতে পারে। এই পার্বত্য কোমটি বোধ হয় বাংলায় আসার পর আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি আশ্রয় করে। প্রথম রাজা রাজ্যপাল ছিলেন ‘পরমসুগত’ অর্থাৎ বৌদ্ধ; কিন্তু তার পুত্র নারায়ণপাল হলেন বাসুদেবের ভক্ত। নারায়ণপালের ছোট ভাই সম্রাট নয়পাল একবার নবমী দিবসে পূজাস্নান করে শঙ্কর ভট্টারকের (শিবের) নামে জনৈক ব্রাহ্মণকে বর্ধমানভুক্তিতে কিছু ভূমি দান করেন। বৌদ্ধ রাজার বংশধরদের ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় সমাজচক্র কোন দিকে ঘুরছে। পালবংশের শেষের দিকেও একই চিহ্ন সুস্পষ্ট। শেষ অধ্যায়ে পালরাষ্ট্রও এই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সমাজশাসনের স্পর্শে এসেছিল। পালবংশ ও পালরাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করে, সেনবংশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো; চন্দ্রবংশকে বিলুপ্ত করে হলো বর্মনবংশের প্রতিষ্ঠা। যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র বিলুপ্ত হলো তারা উভয়ইে বাঙালী ও বৌদ্ধ, এবং যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র নতুন প্রতিষ্ঠিত হলো তারা উভয়েই ভিন প্রদেশাগত। উভয়েই অত্যন্ত নৈতিক ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি আশ্রয়ী। বাঙালীর সামাজিক ইতিহাসের দিক হতে এই দু’টি তথ্যই অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক অর্থবহ।
সেন-রাজবংশ কর্ণাটাগত; তারা আগে ছিলেন ব্রাহ্মণ, পরে যোদ্ধবৃত্তি গ্রহণ করে হলেন ক্ষত্রিয়, এবং পরিচয় হলো ব্রহ্মক্ষত্র রূপে। বর্মণ-বংশ কলিঙ্গাগত বলে অনুমিত, অন্তত ভিন্ন প্রদেশী এবং দক্ষিণাগত, সন্দেহ নেই; এবং বর্ণহিসেবে ক্ষত্রিয়। দক্ষিণদেশ সাতবাহন এবং তৎপরবর্তী সালঙ্কায়ন, বৃহৎফলায়ন, আনন্দ, পল্লব, কদম্ব প্রভৃতি রাজবংশের সময় থেকেই নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের কেন্দ্র, যাগযজ্ঞহোম প্রভৃতি নানাপ্রকার ব্রাহ্মণ্য পূজানুষ্ঠানে গভীর বিশ্বাসী, এবং প্রচলিত বর্ণাশ্রমের উৎসাহী প্রতিপালক। দক্ষিণদেশের এই নিষ্ঠাপূৰ্ণ ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার নিয়ে সেন ও বর্মণ রাজবংশ বাংলায় এসে সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। দেখতে দেখতে বাংলা যাগযজ্ঞহোমক্রিয়ার ধূমে ছেয়ে গেল, নদ-নদীর ঘাটগুলো বিচিত্র পুণ্যস্নানার্থীর মন্ত্রগুঞ্জরণে মুখরিত হয়ে উঠিল, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা, বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠান দ্রুত প্রসারিত হলো। সহজ স্বাভাবিক বিবর্তনের ধারায় এই দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়নি; পেছনে ছিল রাষ্ট্রের ও রাজবংশের সক্রিয় উৎসাহ, অমোঘ ও সচেতন নির্দেশ। এই যুগের লিপিমালা, অসংখ্য পুরাণ, স্মৃতি, ব্যবহার ও জ্যোতিষগ্রন্থ ইত্যাদিই তার প্রমাণ।
ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের সূচনা
লিপি প্রমাণগুলোই আগে উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্মণ-বংশ পরম বিষ্ণুভক্ত। এই রাজবংশের যে বংশাবলী ভোজবর্মণের বেলার লিপিতে পাওয়া যাচ্ছে তার গোড়াতেই ঋষি অত্রি হতে আরম্ভ করে পৌরাণিক নামের ছড়াছড়ি, এগুলোরই বংশে নাকি বৰ্মণ পরিবারের অভ্যুদয়। রাজা জাতবর্মণ অনেক দেশ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দিব্যকেও পর্যুদস্ত করেছিলেন বলে দাবি করেছেন। এই দিব্য যে বরেন্দ্রীর কৈবর্ত নায়ক দিব্য তা স্বীকৃত হয়েছে। দিব্যর সৈন্য আক্রমণকালে জাতবর্মণকে নিশ্চয়ই উত্তরবঙ্গে অভিযান করতে হয়েছিল। এই অভিযানের একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি বোধ হয় নালন্দার একটি লিপিতে পাওয়া যায়। সোমপুরের বৌদ্ধ মহাবিহার জাতবর্মণের সৈন্যরা পুড়াইয়া দিয়েছিল বলে মনে হয়। “সোমপুরের একটি বৌদ্ধ ভিক্ষুর গৃহ যখন বঙ্গাল-সৈন্যরা পুড়িয়ে দিচ্ছিল, ভিক্ষুটি তখন বুদ্ধের চরণকমল আশ্রয় করে পড়েছিলেন; সেখানে সেই অবস্থাতেই তিনি স্বৰ্গত হলেন।” বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি বর্মণ-রাষ্ট্রের মনোভাব কিরূপ ছিল এই ঘটনা হতে তার কিছু পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। শুধুমাত্র এই ঘটনাটি থেকেই এতটা অনুমান নিশ্চয়ই করা যেতো না; কিন্তু যুগ-মনোভাবটাই ছিল এরকম। এই বৰ্মণ রাষ্ট্রেরই অন্যতম মন্ত্রী স্মার্ত ভট্ট ভবদেব অগস্ত্যের মত বৌদ্ধ-সমুদ্রকে গ্রাস করেছিলেন, এবং পাষণ্ডবৈতণ্ডিকদের (বৌদ্ধদের নিশ্চয়ই, নাথপন্থীরাও বটে) যুক্তিতর্ক খণ্ডনে অতিশয় দক্ষ ছিলেন বলে গর্ব অনুভব করেছেন। সেই রাষ্ট্রের সৈন্যরা যুদ্ধব্যপদেশে বৌদ্ধবিহারও ধ্বংস করিবে ইহা কিছু বিচিত্র নয়! জাতবর্মণের পরবর্তী রাজা সামলবর্মণের কুলজীগ্রন্থের রাজা শ্যামলবর্মণ; স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই শ্যামলবর্মণের নামের সঙ্গেই এবং অন্যমতে তারই পূর্ববর্তী রাজা হরিবর্মণের সঙ্গে কান্যকুব্জাগত বৈদিক ব্রাহ্মণদের শকুনসত্র যজ্ঞের কিংবদন্তী জড়িত। সামলবর্মণের পুত্র ভোজবর্মণ সাবর্ণ গোত্রীয়, ভৃগু-চ্যবন-আপ্লুবান-ঔব-জমদগ্নি প্রবর, বাজসনেয় চরণ এবং যজুৰ্বেদীয় কাণ্বশাখ, শান্ত্যাগারাধ্যক্ষ ব্রাহ্মণ রামদেবশর্মাকে পৌণ্ড্র ভুক্তিতে কিছু ভূমিদান করেছিলেন। রামদেব শর্মার পূর্বপুরুষ মধ্যদেশ হতে এসে উত্তর-রাঢ়ের সিদ্ধলগ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সিদ্ধলগ্রামে সাবর্ণ গোত্রীয় ব্রাহ্মণদের বসতির কথা বর্মণ-রাজ হরিবর্মণ-দেবের মন্ত্রী ভট্ট ভবদেবের লিপিতেও দেখা যাচ্ছে। এই লিপিতে সমসাময়িক কালের ভাবাদশ, সমাজ ও শিক্ষাদর্শ, বর্ণ-ব্যবস্থা ইত্যাদি সংক্রাস্ত অনেক খবর পাওয়া যায়। ভবদেবের মাতা সাঙ্গোক ছিলেন জনৈক বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণের কন্যা। এই সময়ে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের “গাঞী”-পরিচয় বিভাগ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্টরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিযাছে, এ সম্বন্ধে আর তা হলে কোনও সন্দেহই রইল না। ভবদেব সমসাময়িক কালের বাঙালী চিন্তানায়কদের অন্ততম; তিনি ব্রহ্মবিদ্যাবিদ্, সিদ্ধান্ত-তন্ত্র-গণিত-ফলসংহিতায় সুপণ্ডিত, হোরা শাস্ত্রের একটি গ্রন্থের লেখক, কুমারিলভট্টের মীমাংসা গ্রন্থের টীকাকার, স্মৃতিগ্রন্থের প্রখ্যাত লেখক, অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, আগমশাস্ত্র এবং অস্ত্রবেদেও তনি সুপণ্ডিত। রাঢ়দেশে তিনি একটি নারায়ণ মন্দির স্থাপন করে তাতে নারায়ণ, অনন্ত এবং নৃসিংহের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুমারিলভট্টের তন্ত্রবাতিক নামক মীমাংসা গ্রন্থের ভবদেবকৃত তৌতাতিতমত-তিলক নামক টীকাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ আজও বর্তমান। তার কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি বা দশকর্মপদ্ধতি ও প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ নামক দুইটি স্মৃতিগ্রন্থ আজ ও প্রচলিত। পরবর্তী বাঙালী স্মৃতি ও মীমাংসা লেখকের ভবদেবের উক্তি ও বিচার বারবার আলোচনা করেছেন। বাঙালীর দৈনন্দিন ক্রিয়াকম, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু, শ্ৰাদ্ধ বিভিন্ন বর্ণের বিচিত্র স্তর উপস্তর বিভাগের সীমা উপসীমা, প্রত্যেকের পারস্পরিক আহার বিহার, বিবাহ ব্যাপারে নানা বিধি নিষেধ, এক কথায় সর্বপ্রকার সমাজকর্মের রীতিপদ্ধতি নিয়মবিধি সুনিদিষ্ট সূত্রে গ্রথিত হয়ে সমাজশাসনের একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক, পুরোহিত-তান্ত্রিক নির্দেশ এই সর্বপ্রথম দেখা দিল। ভবদেবভট্ট পালযুগের শেষ আমলের লোক; এই সময় থেকেই এই একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সমাজশাসনের সূচনা এবং ভবদেব ভট্টই তার আদি গুরু। বর্মণরাষ্ট্রকে অবলম্বন করেই এই ব্রাহ্মণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বাংলায় প্রসারিত হতে আরম্ভ করলো। ভূমি প্রস্তুত হয়েই ছিল; রাষ্ট্রের সহায়তা এবং সক্রিয় সমর্থন পেয়ে সেই ভূমিতে এই শাসন প্রতিষ্ঠালাভ করতে বিলম্ব হলো না। এই শাসনের প্রথম কেন্দ্রস্থল হলো একদিকে রাঢ়দেশ, আর একদিকে বিক্রমপুর।
বর্মণরাষ্ট্রে যার সুচনা সেনবাষ্ট্রে তার প্রতিষ্ঠা। ব্রাহ্মণ্য সমাজ এই সময় থেকেই আত্মসংরক্ষণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও দৃঢ়কম হয়ে উঠিল। এই সংরক্ষণী মনোবৃত্তির একটা কারণ অনুমান করা কঠিন নয়। আগে দেখেছি, ভবদেব ভট্ট বৌদ্ধদের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না; এগুলোর ও পাষণ্ডবৈতণ্ডিকদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ-তন্ত্রের সংরক্ষণী মনোবৃত্তি ভবদেবভট্টের রচনাতেই সুস্পষ্ট। সেন আমলে এই মনোবৃত্তি তীব্রতর হয়ে দেখা দিল। পাল আমলে বৌদ্ধ দেবদেবীব কিছু কিছু ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের সঙ্গে মিশে যেতেছিলেন, এবং শেষোক্ত দেবদেবীরাও বৌদ্ধ ও শৈবতন্ত্রে স্থান পাচ্ছিলেন। বৌদ্ধসাধনমালায় ব্রাহ্মণ্য মহাকাল ও গণপতির স্থান, বৌদ্ধতন্ত্রে ব্রাহ্মণ্য লিঙ্গ এবং শৈব দেবদেবীদের স্থানলাভ এই যুগেই ঘটিয়াছিল। তা ছাড়া, বৌদ্ধ-তান্ত্রিক বজ্রযান, মন্ত্রযান, কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদির আচারানুষ্ঠান, সাধনপদ্ধতি, সাধনাদশ প্রভৃতি ক্রমশঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাধনপদ্ধতি ও পূজানুষ্ঠান প্রভৃতিকে স্পর্শ করছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিভূদের কাছে তা ভাল লাগবার কথা নয়, বিশেষতঃ ভিন্নপ্রদেশাগত বর্মণ ও সেনারাষ্ট্রের প্রভূদের কাছে। বাংলার তন্ত্রধর্মের সমাজ-প্রকৃতি সম্বন্ধে তাদের জ্ঞানও খুব সুস্পষ্ট থাকিবার কথা নয়। যে-ভাবেই হোক, সেন আমলের ব্রাহ্মণ্য সমাজ এখানেই হয়ত ভবিষ্যৎ বিপদের সম্ভাবনা, এবং সমসাময়িককালের ব্রাহ্মণ্যসমাজের সামাজিক নেতৃত্ব-হীনতার কারণ খুঁজে পেয়ে থাকবেন।
স্মৃতি ও ব্যবহার শাসনের বিস্তার
যাই হোক, ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র রচনাকে আশ্রয় করেই ব্রাহ্মণ্যসমাজের এই সংরক্ষণী মনোবৃত্তি আত্মপ্রকাশ করলো। আদি ধর্মশাস্ত্র লেখক জিতেন্দ্রিয় ও বালকের কোনও রচনা আজ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নেই; কিন্তু শুভাশুভকাল, প্রায়শ্চিত্ত, ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে এই দুজনেরই মতামত আলোচনা করেছেন জীমূতবাহন, শূলপাণি, রঘুনন্দন প্রভৃতি পরবর্তী বাঙালী স্মার্ত ও ধর্মশাস্ত্র লেখকেরা। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ পারিভদ্রীয় গাঞী মহামহোপাধ্যায় জীমূতবাহনও এই যুগেরই লোক, এবং তিনি সুবিখ্যাত ব্যবহার মাত্রিকা, দায়ভাগ এবং কালবিবেক গ্রন্থের রচয়িতা। কুলজীগ্রন্থের মতে পারিহাল শাণ্ডিল্য গোত্রীয় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অন্যতম গাঞী। জীমূতবাহনের পরেই নাম করতে হয় বল্লালসেনের গুরু, হারলতা এবং পিতৃ-দয়িতা গ্রন্থদ্বয়ের রচয়িতা অনিরুদ্ধভট্টের। তিনি শুধু মহামহোপাধ্যায় রাজগুরু ছিলেন না, সেনরাষ্ট্রের ধর্মাধ্যক্ষও ছিলেন। অনিরুদ্ধের বসতি ছিল বরেন্দ্রীর অন্তর্গত চম্পাহিটি গ্রামে, এবং তিনি চম্পাহিটি মহামহোপাধ্যায় আখ্যায় পরিচিত ছিলেন। কুলজীগ্রন্থের মতে চম্পটি শাণ্ডিল্য গোত্রীয় বারেন্দ্র গাঞীদের অন্যতম গাঞী। অনিরুদ্ধশিষ্য রাজা বল্লালসেন স্বয়ং একাধিক স্মৃতিগ্রন্থের লেখক। তদ্রচিত আচারসাগর ও প্রতিষ্ঠাসাগর আজও অনাবিষ্কৃত; কিন্তু দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর বিদ্যমান। দানসাগর তিনি রচনা করেছিলেন গুরু অনিরুদ্ধের আদেশে; অসম্পূর্ণ অদ্ভুতসাগর পিতার আদেশে সম্পূর্ণ করেছিলেন পুত্র লক্ষ্মণসেন। ছান্দোগ্য মন্ত্রভাষ্য রচয়িতা গুণবিষ্ণুও এই যুগের লোক। কিন্তু এসব স্মৃতি-ব্যবহার-ধর্মশাস্ত্র রচয়িতাদের মধ্যে সব প্রধান হচ্ছেন ধর্মাধ্যক্ষ ধনঞ্জয়ের পুত্র, লক্ষ্মণসেনের মহাধর্মাধ্যক্ষ হলায়ূধ। হলায়ূধের এক ভাই ঈশান আহ্নিকপদ্ধতি সম্বন্ধে একটি গ্রন্থ এবং অপর ভ্রাতা পশুপতি দুইটি গ্রন্থ রচনা করেন, একটি শ্রাদ্ধপদ্ধতি এবং অন্য একটি পাকযন্ত্র সম্বন্ধে। হলায়ূধ স্বয়ং সুবিখ্যাত ব্রাহ্মণ সর্বস্ব, মীমাংসা সর্বস্ব, বৈষ্ণব সর্বস্ব, শৈব সর্বস্ব এবং পণ্ডিত সর্বস্ব প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। কিন্তু আর নামোল্লেখের প্রয়োজননি। এক কথায় বলা যেতে পারে, যে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহার শাসন পরবর্তীকালে শূলপাণি-রঘুনন্দন কর্তৃক আলোচিত ও বিধিবদ্ধ হয়ে আজও বাংলায় প্রচলিত তার সূচনা এই যুগে— বর্মণ ও সেনরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়। এই যুগে রচিত স্মৃতি-ব্যবহার গ্রন্থগুলোতে ব্রাহ্মণসমাজের সংরক্ষণী মনোবৃত্তি সুস্পষ্ট। দন্তধাবন, আচমন, স্নান, সন্ধ্যা, তর্পণ, আহ্নিক, যাগযজ্ঞ, হোম, পূজানুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্মের শুভাশুভকালবিচার, অশৌচ, আচার, প্রায়শ্চিত্ত, বিচিত্র অপরাধ ও তার শাস্তি, কৃচ্ছ্র, তপস্যা, গর্ভধান-পুংসবন হতে আরম্ভ করে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত সমস্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কার, উত্তরাধিকার, স্ত্রীধন, সম্পত্তি-বিভাগ, আহার বিহারের বিচিত্র বিধিনিষেধ, বিচিত্র দানের বিবৃতি, দান-কর্মের বিচিত্ৰতর বিধিনিষেধ, তিথিনক্ষত্রের ইঙ্গিত বিচার, দৈবিক, বায়ুবিক ও পার্থিব বিচিত্র উৎপাত, লক্ষ্মণাদির শুভাশুভ নির্ণয়, বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রপাঠের নিয়ম ও কাল—এক কথায় দ্বিজবর্ণের জীবনশাসনের কোনও নির্দেশই এইসব গ্রন্থ হতে বাদ পড়ে নেই। সমাজের বিচিত্র স্তর ও উপস্তরের, বিচিত্ৰতর বর্ণ ও উপবর্ণের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয়, বিশেষভাবে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাহদের সম্বন্ধের অসংখ্য বিধি নিষেধও এইসব স্মৃতিকর্তাদের আলোচনার বিষয়। শুধু তাই নয়, এগুলোর নির্দেশ অমোঘ ও সুনির্দিষ্ট। এই যুগের স্মৃতি-শাসনই পরবর্তী বাংলার ব্রাহ্মণতন্ত্রের ভিত্তি।
ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সেনরাষ্ট্র
রাষ্ট্রে এই একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন সুস্পষ্ট। তা না হইবারও কারণ নেই, কারণ ভবদেবের বংশ, হলায়ূধের বংশ, অনিরুদ্ধ এরা তো সকলেই রাষ্ট্রেরই সৃষ্টি এবং সে রাষ্ট্রের নায়ক হরিবর্মণ, সামল (শ্যামল) বর্মণ, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন। শেষোক্ত দুইজন তো নিজেরাই ভাবাদর্শে সমাজাদর্শে অনিরুদ্ধ-হলায়ূধের সমগোত্রীয, নিজেরাই স্মৃতিশাসনের রচয়িতা। তা ছাড়া, শান্ত্যাগারিক, শান্ত্যাগারিধিকৃত, শান্তিবারিক, পুরোহিত, মহাপুরোহিত, ব্রাহ্মণ-রাজপণ্ডিত, এরা রাজপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন এই যুগেই—কম্বোজ-বর্মণ-সেন রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রে এদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ছে, এরা রাষ্ট্রের অজস্র কৃপালাভ করছেন, নানা উপলক্ষ্যে অপরিমিত ভূমিদান এরাই লাভ করছেন। কাজেই রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন দেখা যাবে, তা বিচিত্র নয়।
বিজয়সেন ও বল্লালসেন উভয়েই ছিলেন পরম মাহেশ্বর অর্থাৎ শৈব; লক্ষ্মণসেন কিন্তু পরম বৈষ্ণব এবং পরম নারসিংহ (অর্থাৎ বৈষ্ণব); লক্ষ্মণসেনের দুই পুত্র বিশ্বরূপ ও কেশব উভয়েই সৌর অর্থাৎ সূর্যভক্ত। সেন-বংশের আদিপুরুষ সামন্তসেন শেষ বয়সে গঙ্গাতীরস্থ আশ্রমে বানপ্রস্থে কাটাইয়া ছিলেন; এইসব আশ্রম-তপোবন ঋষিসন্ন্যাসী দ্বারা অধ্যুষিত এবং যজ্ঞাগ্নিসেবিতঘৃতধূমের সুগন্ধে পরিপূরিত থাকতো; সেখানে মৃগশিশুরা তপোবন-নারীদের স্তন্যদুগ্ধ পান করতো এবং শুকপাখীরা সমস্ত বেদ আবৃত্তি করতো! কবিকল্পনা সন্দেহ নেই, কিন্তু বস্তুসম্পর্কবিহীন কবি-কল্পনাও রাষ্ট্রের সমাজাদর্শকেই ব্যক্ত করছে এবং প্রাচীন তপোবনাদর্শের দিকে সমাজের মনকে প্রলুব্ধ করার, সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, সে-বিষয়েও সন্দেহ নেই। সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের ওপর এত রূপ বর্ষণ করেছিলেন এবং সেই কৃপায় তারা এত ধনের অধিকারী হয়েছিলেন যে, তাদের পত্নীদিগকে নাগরিক রমণীরা মুক্তা, মরকত, মণি, রৌপ্য, রত্ন এবং কাঞ্চনের সঙ্গে কার্পাস বীজ, শাকপত্র, অলাবুপুষ্প, দাড়িম্ববীচি এবং কুষ্মাণ্ডলতপুষ্পের পার্থক্য শিক্ষা দিত। যজ্ঞকার্যে বিজয়সেনের কখনও কোনও ক্লান্তি ছিল না। একবার তার মহিষী মহাদেবী বিলাসদেবী চন্দ্র গ্রহণের সময়ে কনক-তুলাপুরুষ অনুষ্ঠানের হোমকার্যের দক্ষিণাস্বরূপ রত্নাকর দেবশর্মার প্রপৌত্র, রহস্কর দেবশর্মার পৌত্র, ভাস্কর দেবশর্মার পুত্র, মধ্যদেশাগত, বৎসগোত্রীয়, ভাগব-চ্যবনআপ্লুবান-ঔর্ব-জামদগ্ন্য প্রবর, ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন শাখার ষড়ঙ্গধ্যায়ী ব্রাহ্মণ উদয়কর দেবশর্মাকে কিছু ভূমিদান করেছিলেন। বল্লালসেনের নৈহাটিলিপি আরম্ভ হয়েছে অৰ্দ্ধনারীশ্বরকে বন্দনা করে; তার মাতা বিলাসদেবী একবার সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে গঙ্গাতীরে হেমাশ্বমহাদান অনুষ্ঠানের দক্ষিণাস্বরূপ ভরদ্বাজ গোত্রীয়, ভরদ্বাজআঙ্গিরস-বার্হস্পত্য প্রবর, সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী ব্রাহ্মণ শ্রীওবাসুদেবশর্মাকে ভূমিদান করেছিলেন। বল্লালসেন এই লিপি দ্বারা এই দান অনুমোদিত ও পট্টিকুত করেন। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া লিপির ভূমিদানগ্রহীতা হচ্ছেন কৌশিক গোত্রীয়, বিশ্বামিত্র-বন্ধুল-কৌশিক প্রবর, যজুর্বেদীয় কান্বশাখাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রঘুদেব শর্মণ। লক্ষ্মণসেন যে অসংখ্য ব্রাহ্মণকে ধান্যশস্যপ্রসূ উপবনসমৃদ্ধ বহু গ্রামদান করেছিলেন তাও এই লিপিতে উল্লিখিত আছে। এই রাজার গোবিন্দপুর পট্টোলির ভূমিদান গ্রহীতাও একজন ব্রাহ্মণ, উপাধ্যায় ব্যাসদেব শর্মণ—বৎসগোত্রীয় এবং সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী। এই ভূমিদানকার্য প্রথম করা হয়েছিল লক্ষ্মণসেনের অভিষেক উপলক্ষে। সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী, ভরদ্বাজ গোত্রীয় আর এক ব্রাহ্মণ ঈশ্বরদেবশর্মণও কিছু ভূমিদান লাভ করেছিলেন রাজা কর্তৃক হেমাশ্বরথমহাদান যজ্ঞাতুষ্ঠানে আচার্যক্রিয়ার দক্ষিণাস্বরূপ। এই ভূমির সীমানির্দেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পূর্বদিকে বৌদ্ধ বিহারদেবতার এক আঢ়বাপ নিষ্কর ভূমির পূর্ব সীমা আলি (বৌদ্ধবিহারী দেবতা নিকরদেয়ম্ মালভূম্যাটাবাপ-পূর্বালিঃ)। সেন বংশের লিপিমালার মধ্যে এই একটি মাত্র স্থানে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ পাওয়া গেল; বরেন্দ্রীতে তা হলে ১২শ শতকের শেষপাদেও বৌদ্ধধৰ্ম্মের প্রকাশ্য অস্তিত্ব ছিল। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর লিপি সর্বত্র সুম্পষ্ট ও সুপাঠ্য নয়; মনে হয় রাজা তার মূল অভিষেকের সময় ঐন্দ্ৰীমহাশান্তি যজ্ঞানুষ্ঠান উপলক্ষে কৌশিকগোত্রীয়, অথর্ববেদীয় পৈপ্পলাদশাখাধ্যায়ী শান্ত্যাগারিক ব্রাহ্মণ গোবিন্দ দেবশর্মণকে যে ভূমিদান করেছিলেন তাই এই শাসন দ্বারা অনুমোদিত ও পট্টিকৃত করা হয়েছে। আর একবার এই রাজাই সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে জনৈক কুবের নামীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমিদান করেছিলেন। এই রাজার সুন্দরবন লিপিতেও কয়েকজন শান্ত্যাগারিক ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের খবর পাওয়া যায়, যথা, প্রভাস, রামদেব, বিষ্ণুপাণি গড়োলী, কেশব গড়োলি এবং কৃষ্ণধর দেবশর্মা; এরা প্রত্যেকেই শান্ত্যাগারিক। শেষোক্তটি গার্গগোত্রীয় এবং ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়নশাখাধ্যায়ী। লক্ষ্মণসেনের পুত্র কেশবসেন ধান্য শস্যক্ষেত্র ও অট্টালিকা পূর্ণ বহু প্রসিদ্ধ গ্রাম ব্রাহ্মণদের দান করেছিলেন। তদনুষ্ঠিত যজ্ঞাগ্নির ধূম চারিদিকে এমন বিকীর্ণ হতো যেন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যাইত। তিনি একবার তার জন্মদিনে দীর্ঘজীবন কামনা করে একটি গ্রাম বাৎস্যাগোত্রীয় নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ ঈশ্বরদেবশর্মণকে দান করেছিলেন। লক্ষ্মণসেনের আর এক পুত্র বিশ্বরূপসেন শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফললাভের আকাঙ্ক্ষায় বাৎস্যগোত্রীয় নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ বিশ্বরূপ দেবশমর্শকে কিছু ভূমিদান করেছিলেন। এই রাজারই অন্য আর একটি লিপিতে দেখছি হলায়ূধ নামে বাৎস্যগোত্রীয় যজুর্বেদীয়, কান্বশাখাধ্যায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ আবল্লিক পণ্ডিত রাজপরিবারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীদের কাছ থেকে প্রচুর ভূমিদান লাভ করছেন— উত্তরায়ণ-সংক্রান্তি, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থানদ্বাদশীতিথি, জন্মতিথি ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে।
ত্রিপুরা-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেববংশের লিপিগুলোতেও অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এই রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী এবং বিষ্ণুভক্ত। এই বংশের অন্যতম রাজা দামোদর একবার জনৈক যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ পৃথ্বীধরশর্মণকে কিছু ভূমিদান করেছিলেন। বোধ হয়, এই বংশেরই আর একজন রাজা, অরিরাজ দনুজমাধব শ্ৰীদশরথদেবের (= কুলজী গ্রন্থের দনুজমাধব = মুসলমান ঐতিহাসিকদের সোনারগাঁর রাজা, দনুজ রায়) আদাবাড়ী লিপি দ্বারা যে সমস্ত ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করা হয়েছে তাদের গাঞী পরিচয় আছে; যথা, সন্ধ্যাকর, শ্রীমাক্রি (দিণ্ডী গাঞী), শ্রীশক্র, শ্রীসুগন্ধ (পালি গাঞী), শ্ৰীসোম (সিউ গাঞী), শ্ৰীবাদ্য (পালি গাঞী) শ্ৰীপণ্ডিত (মাসচটক গাঞী), শ্ৰীমাণ্ডী (মূল গাঞী), শ্রীরাম (দিণ্ডী গাঞী), শ্ৰীলেঘু (সেহন্দায়ী গাঞী), শ্ৰীদক্ষ (পুতি গাঞী), শ্ৰীভট্ট (সেউ-গাঞী,), শ্রীবালি (মহান্তিযাড়া গাঞী), শ্ৰীবাসুদেব (করঞ্জ গ্রামী), এবং শ্রীমিকো (মাসচড়ক গাঞী), ইত্যাদি। গাঞীপ্রথার প্রচলন ভবদেবভট্টের কালেই আমরা দেখেছি; বোধ হয় তারও বহু পূর্বে গুপ্ত আমলেই এই প্রথা প্রবর্তিত হয়ে থাকবে (গুপ্ত আমলের লিপিগুলোতে ভট্ট, বন্দ, চট্ট, প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য পদবী-পরিচয গাঞী-পরিচয় হওয়াই সম্ভব)। ১৩শ শতকে এই প্রথা একেবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। আদাবাড়ী লিপির গাঞী তালিকায় রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র উভয গাঞী পরিচয়ই মিলছে।
বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি ব্রাহ্মণ-তন্ত্রের ব্যবহার
এই সুবিস্তৃত লিপি-সংবাদ হতে কযেকটি তথ্য সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রথমত, বিভিন্ন বাষ্ট্রের ও রাজবংশের সুদীর্ঘ দানতালিকায় বৌদ্ধধৰ্ম্ম ও সংঘে একটি দানের উল্লেখও নেই। অথচ বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব তখনও ছিল, লক্ষ্মণসেনের তর্পণদীঘি লিপিতেই তার প্রমাণ আমরা দেখেছি। তা ছাড়া রণবঙ্কমল্ল হরিকাল দেবের (১২২০) পট্টিকেরা লিপিও তার অন্যতম সাক্ষ্য; এই লিপিতে হরিকাল কর্তৃক পট্টিকেরা নগরের এক বৌদ্ধবিহারে একখণ্ড ভূমিদানের উল্লেখ আছে। এই লিপিতেই দুর্গোত্তারা নামক বৌদ্ধ দেবীমূর্তির এবং সহজধর্মেরও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।(IH Q. lX, 282 pp.)। আরও প্রমাণ আছে। পঞ্চরক্ষা নামক মহাযানগ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপির পুষ্পিকা অংশে(Sastri H. P.-Cat of Mss. Nepal, I, 117 p, Mss. No, 4078)। “পরমেশ্বর পরমসৌগত-পরমমহারাজাধিরাজ শ্ৰীমন্ গৌড়েশ্বর-মধুসেন-দেবপাদানাং বিজয়রাজ্যে” উল্লেখ হতে জানা যায় ১২১১ শকে (= ১২৮৯) মধুসেন নামক একজন বৌদ্ধ রাজা গৌড়ে রাজত্ব করছিলেন। বর্মণরাষ্ট্রেও বৌদ্ধ মহাযান মতের অস্তিত্ব ছিল। “লঘু কালচক্র” নামক মহাযান গ্রন্থের “বিমলপ্রভা” নামীয় টীকার একটি পুঁথি লেখা হয়েছিল হরিবর্মদেবের ৩৯ রাজ্যাঙ্কে, এবং ৪৬ রাজ্যাঙ্কে অর্থাৎ সাত বছর পর, “পূর্বোত্তর দিশাভাগে বেংগদ্যাস্তথা কূলে” গৌরী নামে একটি (বৌদ্ধ?) মহিলা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছিলেন গ্রন্থটি নিয়মিত বাচনের জন্য।(Sastri, H. P.–Cat. of Mss. Nepal)। এই বেংগ নদী, মনে হয়, যশোর কি ফরিদপুর জেলার কোনও নদী। এই অঞ্চলেই ১৫শ শতকেও বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায় ১৪৯২ সংবতের (= ১৪৩৬) মহাযান মতের বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিচযাঁবতারের একটি অতুলিপি হতে। (এই অনুলিপিটি প্রস্তুত করেছিলেন সোহিথতরী গ্রামনিবাসী কুটুম্বিক উচ্চমহত্তম শ্ৰীমাধবমিত্রের পুত্ৰ মহত্তম স্ত্রীরামদেবের স্বার্থ-পরার্থের জন্য “সদ্বৌদ্ধ করণ কায়স্থ ঠকুর” শ্ৰীঅমিতাভ। কোন এক সময়ে পুঁথিখানা গুণকীর্তি “ভিক্ষুপাদানাং” অধিকারে ছিল। (Sastri, H. P.–Cat. of Mss. Nepal)।)। পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের আমলে বৌদ্ধ রাজবংশের যে ঔদার্য ছিল সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের সে ঔদার্যের এতটুকু চিহ্ন কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কান্তিদেবের পিতা বৌদ্ধ ধনদত্ত একজন পরম শিবভক্ত রাজকুমারীকে বিবাহ করেছিলেন এবং নিজের সুভাষিত-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে ব্যুৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে গবর্ণনুভব করেছিলেন। তার পুত্ৰ কান্তিদেব নিজে বৌদ্ধ হয়েও তার রাজকীয় শীলমোহরে বৌদ্ধ পিতা ও শৈব মাতা উভয়ের ধর্মের সমন্বিত রূপ উদ্ভাবন করেছিলেন। এই ধরণের বহু দৃষ্টান্ত আগেও উল্লেখ করেছি। কিন্তু রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শের সেই উদারতার যুগ আর ছিল না। সেন-বর্মণদের আমলে এই ঔদার্যের এতটুকু দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। দ্বিতীয়তঃ, সেন-বর্মণ-দেব রাষ্ট্র ও রাজবংশ বাংলার অতীত সামাজিক বিবর্তনের ধারা, বিশেষভাবে, গৌরবময় পাল-চন্দ্র যুগের ধারা, গতি প্রকৃতি ও আদর্শ একেবারে অস্বীকার করে বৈদিক ও পৌরাণিক যুগ বাংলায় পুনঃপ্রবর্তন করতে চাহিয়া ছিলেন। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-কালিদাস-ভবভূতি যে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য আদর্শের কথা বলেছেন সেই ব্রাহ্মণ্য আদর্শ সমাজ-জীবনে সঞ্চার করার প্রয়াস লিপিগুলোতে এবং সমসাময়িক সাহিত্যে সুস্পষ্ট।
এই যুগের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিনিধি হলায়ূধ সন্দেহ নেই। তার “ব্রাহ্মণ সর্বস্বের” গোড়াতেই আত্মপ্রশস্তিমূলক কয়েকটি শ্লোক আছে, তার একটি এই :–
পাত্ৰং দারুময়ং ক্কচিদ্ বিজয়তে ক্কচিৎ ভাজনং
কুত্রাপ্যস্তি দুকূলমিন্দুধবলং কুত্রাপি কৃষ্ণাজিনম্।
ধূপঃ ক্বাপি বষট্কৃতাহুতিকৃতো ধূমঃ পরঃ ক্বাপ্যভূদ্
অগ্নে কর্মফলং চ তস্য যুগপজ্জাগতি ষন্মন্দিরে।।
[ হলযুধের নিজের গৃহে ] কোথায়ও কাঠের [ যজ্ঞ ] পাত্র [ ছড়াইয়া আছে ], কোথাও বা স্বর্ণপাত্র [ ইতাদি)। কোথাও ইন্দূধবল দুকুলবস্ত্র; কোথাও কৃষ্ণমৃগচৰ্ম্ম। কোথাও ধূপের [গন্ধময় ধূম] কোথাও বষট্কার ধ্বনিময় আহুতির ধূম। [ এইভাবে তার গৃহে ] অগ্নির এবং [তার নিজের ] কর্মফল যুগপৎ জাগ্রত।
ইহাই ব্রাহ্মণ্য সেন-রাষ্ট্রের ভাবপরিমণ্ডল। হলায়ূধ-গৃহের ভাবকল্পনেই সমসামরিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ভাবকল্পনা।
কনক-তুলাপুরুষ মহাদান, ঐন্দ্ৰীমহাশাস্তি, হেমাশ্বমহাদান, হেমাশ্বরথদান প্রভৃতি যাগযজ্ঞ; সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থান দ্বাদশীতিথি, উত্তরায়ণ সংক্রান্তি প্রভৃতি উপলক্ষে স্নান, তৰ্পণ, পূজানুষ্ঠান; শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফলাকাঙ্ক্ষা; বিভিন্ন বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণের পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ; গোত্র, প্রবর, গাঞী প্রভৃতির বিশদ বিস্তৃত পরিচয়োল্লেখ; দুর্বাতৃণ জলসিক্ত করে দানকার্য সমাপন; নীতিপাঠক শান্ত্যাগারিক, প্রভৃতি ব্রাহ্মণদের ওপর রাষ্ট্রের কৃপাবৰ্ষণ ইত্যাদির সামাজিক ইঙ্গিত অত্যন্ত সুস্পষ্ট—সে ইঙ্গিত পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য আদশের প্রচলন এবং পাল-চন্দ্র যুগের সমন্বয় ও সমীকরণাদশের বিলোপ। বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন ধর্মণদশের সহজ স্বাভাবিক বিবর্তিত সমন্বয় নয়, ঔদার্যময় বিন্যাস নয়, এক বর্ণ, এক ধর্ম ও সমাজাদশের একাধিপত্যই সেন-বৰ্মণ যুগের একতম কামনা ও আদর্শ। সে বর্ণ ব্রাহ্মণ বর্ণ। সে ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। এবং সে সমাজাদর্শ পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের আদর্শ। এই কালের স্মৃতি-ব্যবহার-মীমাংসা গ্রন্থে আগেই দেখেছি ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য আদর্শের জয়জয়কার; লিপিমালায়ও তাই দেখিলাম। সেই আদর্শই হলো সমাজব্যবস্থার মাপকাঠি। রাষ্ট্রের শীর্ষে যারা আসীন সেই রাজার, এবং রাষ্ট্রের যারা প্রধানতম সমর্থক সেই ব্রাহ্মণের দুইয়ে মিলিয়া এই আদর্শ ও মাপকাঠি গড়ে তুললেন—পরস্পরের সহযোগীতায়, পোষকতায় ও সমর্থনে, এবং মূর্তিতে, মন্দিরে, রাজকীয় লিপিমালায়, স্মৃতি, ব্যবহার ও ধর্মশাস্ত্রে, সর্বথা সর্ব উপায়ে এই আদর্শ ও মাপকাঠি সবলে সোৎসাহে প্রচার করলেন। পেছনে যেখানে রাষ্ট্রের সমর্থন সেখানে এই প্রচার কার্য ও ঈপ্সিত সমাজব্যবস্থার দ্রুত প্রচলন সার্থক হবে, তা কিছু বিচিত্র নয়।
পরিণতি – (ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মণেতর বর্ণবিন্যাস ইত্যাদি)
পরিণতি
ভিন্-প্রদেশী বর্মণ ও সেনাধিপত্য সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই (তখন পাল পর্বের শেষ অধ্যায়) বাংলার ইতিহাস-চক্র সম্পূর্ণ আবর্তিত হয়ে গেল। বৈদিক, আর্য ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি বাংলায় গুপ্ত আমল থেকেই সবেগে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিনশত সাড়েতিনশত বছর ধরে এই প্রবাহ চলেছে। বৌদ্ধ খড়গ-পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের কালেও তা ব্যাহত হয়নি; বরং আমরা দেখেছি সামাজিক আদর্শ ও অনুশাসনের ক্ষেত্রে এইসব রাষ্ট্র ও রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য আদর্শ ও অনুশাসনকেই মেনে চলিত, কারণ সেই আদর্শ ও অনুশাসনই ছিল বৃহত্তর জনসাধারণের, অন্ততঃ উচ্চতর স্তর সমূহের লোকদের আদর্শ ও অনুশাসন। কিন্তু, বৌদ্ধ বলেই হোক বা অন্য সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণেই হোক, পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ ও অনুশাসনের একটা ওদার্য ছিল – তার দৃষ্টান্ত সত্য সত্যই অফুরন্ত – ব্রাহ্মণ্য সামাজিক আদর্শকেই একটা বৃহত্তর সমন্বিত ও সমীকৃত আদর্শের রূপ দেবার সজাগ চেষ্টা ছিল; অন্যতর সামাজিক যুক্তিপদ্ধতি ও আদর্শকে অস্বীকার করার কোনও চেষ্টা ছিল না, কোনও সংরক্ষণী মনোবৃত্তি সক্রিয় ছিল না। (Ep. Ind. XIII 292 p.; Insc of Bengal, 24, 67, 157, pp: গৌড়লেখমালা, ২৬-২৭, ৯৭ পৃ; Ep. Ind. XXII, 15P P; XV, 293 p, ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৪, ১ম খণ্ড, ২৬৪ পৃ)। সেন-বর্মণ আমলে কিন্তু তাই হলো; সমাজ ব্যবস্থায় কোনও ঔদার্য, অন্যতর আদর্শ ও ব্যবস্থার কোনও স্বীকৃতিই আর রইল না; ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এবং তদনুযায়ী সমাজ ও বর্ণ ব্যবস্থা একান্ত হয়ে উঠিল; তারই সবর্ণময় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো – রাষ্ট্রের ইচ্ছায় ও নির্দেশে।
ফল যা ফলিবার সঙ্গে সঙ্গেই ফলিল। বর্ণবিন্যাসের ক্ষেত্রে তার পরিপূর্ণ রূপ দেখছি সমসাময়িক স্মৃতি গ্রন্থাদিতে, বৃহদ্ধর্ম পুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে, সমসাময়িক লিপিমালায় এবং কিছু কিছু পরবর্তী কুলজী গ্রন্থমালায়।
ব্রাহ্মণ
ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বর্ণব্যবস্থার চূড়ায় থাকবেন স্বয়ং ব্রাহ্মণেরা তা তো খুবই স্বাভাবিক। নানা গোত্র, প্রবর ও বিভিন্ন বৈদিক শাখানুষ্ঠায়ী ব্রাহ্মণের যে ৫ম-৬ষ্ঠ-৭ম শতকেই উত্তর ভারত তেকে বাংলায় এসে বসবাস আরম্ভ করেছিলো। “মধ্যদেশ-বিনির্গত” ব্রাহ্মণদের সংখ্যা ৮ম শতক হতে ক্রমশঃ বেড়ে যেতে আরম্ভ করলো; ক্রোড়ঞ্চি-ক্রোড়ঞ্জ (= কোলাঞ্চ), তর্কারি (যুক্তপ্রদেশের শ্রাবস্তী অন্তর্গত), মৎস্যাবাস কুন্তীর, চন্দবার (এটোয়া জেলার বতর্মান চান্দোয়ার), হস্তিপদ, মুক্তাবাস্তু এমন কি সুদূর লাট (গুজরাত) দেশ হতে ব্রাহ্মণ পরিবারদের বাংলায় এসে বসবাসের দৃষ্টান্ত এ যুগের লিপিগুলোতে সমানেই পাওয়া যাচ্ছে। এরা এদেশে এসে পূর্বাগত ব্রাহ্মণদের এবং তাদের অগণিত বংশধরদের সঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছিলো, এরকম অনুমানই স্বাভাবিক।
গাঞী বিভাগ
কুলজীগ্রন্থের আদিশূর-কাহিনীর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে বর্ণকাহিনী রচনার প্রয়োজননি; লিপিমালা ও সমসাময়িক স্মৃতিগ্রন্থাদির সাক্ষ্যই যথেষ্ট। ৫ম-৬ষ্ঠ-৭ম শতকেই দেখছি ভট্ট, চট্ট, বন্দ্য ইত্যাদি গ্রামের নামে পরিচয় দিবার একটি রীতি ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে; নিঃসংশয়ে বলার উপায় নেই, কিন্তু মনে হয় গাঞী পরিচয় রীতির তখন থেকেই প্রচলন আরম্ভ হয়েছে, কিন্তু তখনও বিধিবদ্ধ, প্রথাবদ্ধ হয়নি। ১২শ ১৩শ শতকে কিন্তু এই রীতি একেবারে সুনির্দিষ্ট সীমায় প্রথাবদ্ধ নিয়মবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ভবদেব ভট্টের মাতা বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ কন্যা; “টাকাসর্বস্ব” গ্রন্থের রচয়িতা আর্তিহরপুত্র সর্বানন্দ (১১৫৯-৬০) বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ (Insc. of Bengal, III, p. 37; Ed, Trivandrum, Sans. Ser. 4. Vols; also see JRAS., 1927, p. 472.)। ভবদেব স্বয়ং এবং শান্ত্যাগরাধিকৃত ব্রাহ্মণ রামদেবশৰ্ম্মা উভয়েই সাবর্ণগোত্রীয় এবং সিদ্ধল গ্রামীয়;( Insc. of Bengal, III, p. 36 and 24 respectively.) বল্লালগুরু অনিরুদ্ধভট্ট চম্পাহিটী বা চম্পহট্টীয় মহামহোপাধ্যায়,( JASB., 1912, 343 p.) মদনপালের মনহলি লিপির দানগ্রহীতা বটেশ্বরও চম্পহট্টীয়;(গৌড়লেখমালা, ১৫৪ পৃ) জীমূতবাহন আত্মপরিচয় দিয়েছেন পারিভদ্রীয় বলে।(কালবিবেক গ্রন্থের পুম্পিকা; কালবিবেক, Bib, Ind. Intro. vii p), দশরথদেবের আদাবাড়ী লিপিতে দিণ্ডী, পালি বা পালী, সেউ, মাসচটক বা মাসচড়ক, মূল, সেহন্দায়ী, পুতি, মহান্তিয়াড়া এবং করঞ্জ প্রভৃতি গাঞী পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। হলায়ূধের মাতৃপরিচয় গোচ্ছাষণ্ডী গ্রামীয়রূপে,(ব্রাহ্মণসর্বস্ব; Ind. Culture, I, 505 p.) লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি শ্ৰীনিবাসের মহিন্তাপনীবংশ পরিচয়ও গাঞী পরিচয়।(অদ্ভূতসাগর, Ind. Ant., 1922, 47 p.)। বরেন্দ্রীর তটক, মৎস্যাবাস; রাঢ়ার ভূরিশ্রেষ্ঠী, পূর্বগ্রাম, তালবাটী, কাঞ্জিবিল্লী এবং বাংলার অন্যান্য অনেক গ্রামের (যথা, ভট্টশালী, শকটী, রত্নামালী, তৈলপাটী, হিজ্ জলবন, চতুর্থ খণ্ড, বাপডলা) ব্রাহ্মণদের উল্লেখ সমসাময়িক লিপি ও গ্রন্থাদিতে পাওয়া যাচ্ছে।(সদুক্তিকর্ণামৃত, Ed. by Ramavatara Sarma & Haradatta Sarma, Intro 44, 47, 58, 71, 81)। সংকলয়িতা শ্রীধর দাসের “সদুক্তিকর্ণামৃত” (১২০৬) গ্রন্থেও দেখছি বাঙালী ব্রাহ্মণদের নামের সঙ্গে—বর্তমান ক্ষেত্রে নামের পূর্বে—গ্রামের নাম অর্থাং গাঞী পরিচয় ব্যবহারের রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, যথা, ভট্টশালীয় পীতাম্বর, তৈলপাটীয় গাঙ্গোক, কেশরকোলীয় নাথোক, বন্দিঘটীয় সর্বানন্দ, ইত্যাদি।(Ed. Ind. XV. 3o1 p, ন্যায়কন্দলী, Jour Andhra Hist. Sec 1V, 158-62; Ind. Off Cat. I, Part one, No. 450; D.U. Mss, no.)। এইসব গাঞী পরিচয় অল্পবিস্তর পরিবর্তিতরূপে কুলজীগ্রন্থমালার রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পঞ্চগোত্রে বিভক্ত ১৫৬টা গাঞী পরিচয়ের মধ্যেই পাওয়া যায়। কালক্রমে এই গাঞী পরিচয়প্রথা বিস্তৃত হয়েছে, বিধিবদ্ধ হয়েছে এবং সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত হয়েছে; এই সীমিত, বিধিবদ্ধ প্রথারই অস্পষ্ট পরিচয় আমরা পাচ্ছি কুলজীগ্রন্থমায়।
ভৌগোলিক বিভাগ
কিন্তু গাঞী বিভাগ অপেক্ষা ও সামাজিক দিক হতে গভীর অর্থবহ বিভাগ ব্রাহ্মণদের ভৌগোলিক বিভাগ। এক্ষেত্রেও কুলজী গ্রন্থের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে লাভ নেই; কারণ রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক ও অন্যান্য শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের উদ্ভব সম্বন্ধে এইসব গ্রন্থে যে বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে তা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু হলায়ূধের “ব্রাহ্মণসর্বস্ব” প্রামাণ্যগ্রন্থ, এবং তার রচনাকালও সুনির্দিষ্ট। এই গ্রন্থে হলায়ূধ দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের যথার্থ বেদবিদ ছিলেন না; ব্রাহ্মণদের বেদচর্চার সমধিক প্রসিদ্ধি ছিল, তার মতে, উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশ সমূহে।(ব্রাহ্মণসরস্ব, বারাণসী সং, সংবৎ ১৯৩৫। তেজেশচন্দ্র বিদ্যানন সম্পাদিভ কলিকা, সং, বাং ১৩৩১)। যাই হোক, হলায়ুধের সাক্ষ্য হতে দেখছি, ১২শ শতকেই জনপদ বিভাগানুযায়ী ব্রাহ্মণদের রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে; এবং লিপিসাক্ষ্য হতে জানা যায়, এসব ব্রাহ্মণের রাঢ় ও বরেন্দ্রীর বাইরে পূর্ব বঙ্গেও বসতি স্থাপন করছেন। বরেন্দ্রীর তটক গ্রামীয় একজন ব্রাহ্মণ বিক্রমপুরে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন, অন্ততঃ একটি দৃষ্টান্ত আমরা জানি কুলজী গ্রন্থমালায় দেখা যায় কায়স্থ, বৈদ্য, বারুই প্রভৃতি অব্রাহ্মণ উপবর্ণদের ভেতরও রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র এবং বঙ্গজ প্রভৃতি ভৌগোলিক বিভাগ প্রচলিত হয়েছিল, কিন্তু এসম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু নেই।
বৈদিক ব্রাহ্মণ
রাঢ়ীয় এবং বারেন্দ্র বিভাগ ছাড়া ব্রাহ্মণদের আর একটি শ্রেণী বৈদিক বোধ হয় এই যুগেই উদ্ভূত হয়েছিল। কুলজী গ্রন্থমালায় এসম্বন্ধে দুইটি কাহিনী আছে; একটি কাহিনী মতে, বাংলায় যথার্থ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ না থাকায় এবং যজ্ঞাগ্নি যথানিয়মে বক্ষিত না হওয়ায় রাজা শ্যামলবর্মণ (বোধ হয় বর্মণরাজ সামল বর্মণ) কান্যকুব্জ (কোনও কোনও গ্রন্থমতে, বারাণসী) হতে ১০০১ শকাব্দে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন। অপর কাহিনী মতে সরস্বতী নদীতীরস্থ বৈদিক ব্রাহ্মণেরা যবনাক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে বাংলায় পালিয়ে আসেন, এবং বর্মণরাজ হরিবর্মণের পোষকতায় ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায় বসবাস আরম্ভ করেন। উত্তর ভারত হতে আগত এইসব বৈদিক ব্রাহ্মণেরাই পাশ্চাত্য বৈদিক নামে খ্যাত। বৈদিক ব্রাহ্মণদের আর এক শাখা আসেন উৎকল ও দ্রাবিড হতে; এরা দাক্ষিণাত্য বৈদিক নামে খ্যাত। এই কুলজী কাহিনীর মূল বোধ হয় হলাপের ব্রাহ্মণসৰ্ব্বস্ব গ্রন্থে পাওয়া যাচ্ছে। এই গ্রন্থ-রচনার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে হলায়ূধ বলছেন, রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠ করতো না এবং সেই হেতু বৈদিক যাগযজ্ঞানুষ্ঠানের রীতিপদ্ধতিও জানিত না; যথার্থ বেদজ্ঞান তার সময়ে উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশেই প্রচলিত ছিল। বাংলার ব্রাহ্মণেরা নিজেদের বেদজ্ঞ বলে দাবি করলেও যথার্থত বেদচর্চার প্রচলন বোধ হয় সত্যই তাদের মধ্যে ছিল না। হলায়ূধের আগে বল্লালগুরু অনিরুদ্ধ ভট্ট ও তার “পিতৃদয়িতা” গ্রন্থে বাংলায় বেদ চর্চার অবহেলা দেখে দুঃখ করেছেন।(পিতৃদয়িত, ৮ পৃ)। যাই হোক, পাশ্চাত্য বলতে হলায়ূধ এক্ষেত্রে উত্তর ভারতকেই বোঝাচ্ছেন, সন্দেহ নেই। বাংলায় উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশাগত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের বসবাস তখন করছিলেন কি না এ সম্বন্ধে হলায়ূধ কোনও কথা বলেননি; তবু, সামলবর্মণ ও হরিবর্মণের সঙ্গে কুলজী কাহিনীর সম্বন্ধ, তাদের মোটামুটি তারিখ, অনিরুদ্ধ ভট্ট এবং হলায়ূধ কথিত রাঢ়ে-বরেন্দ্রীতে বেদচর্চার অভাব এবং সঙ্গে সঙ্গে উৎকল ও পশ্চিম দেশসমূহে বেদজ্ঞানের প্রসার, পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য এই দুই শাখায় বৈদিক ব্রাহ্মণের শ্রেণীবিভাগ, এইসব দেখে মনে হয় সেন-বর্মণ আমলেই বাংলায় বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের উদ্ভব দেখা দিয়েছিল।
এসব শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ ছাড়াও আরও দুই তিন শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের সংবাদ এই যুগেই পাওয়া যাচ্ছে। গয়াজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে প্রাপ্ত একটি লিপিতে (১০৫৯ শক = ১১৩৭) দেখছি, শাকদ্বীপগত মগব্রাহ্মণপরিবার সম্ভূত জনৈক ব্রাহ্মণ গঙ্গাধর জয়পাণি নাম গৌড়রাষ্ট্রের একজন কর্মচারীর কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন।(Ep. Ind. II, 330 p.) এই লিপি এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণ গ্রন্থের সাক্ষ্য হতে দেবল বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের পরিচয় জানা যায়। শেষোক্ত গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হচ্ছে, দেবল ব্রাহ্মণেরা শাকদ্বীপ হতে এসেছিলেন, এবং সেই হেতু তারা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত হয়েছেন। বল্লালসেনের “দানসাগর” গ্রন্থে সারস্বত নামে আর এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কুলজী গ্রন্থের মতে এরা এসেছিলেন সরস্বতীনদীর তীর হতে অন্ধ্ররাজ শূদ্রকের আহবানে। শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের উদ্ভব সম্বন্ধে কুলজী গ্রন্থে কিন্তু অন্য কাহিনী দেখা যাচ্ছে; এই কাহিনী মতে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের পূর্ব পুরুষরা গ্রহবিপ্র নামে পরিচিত ছিলেন, এবং এরা বাংলায় প্রথম এসেছিলেন গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে, শশাঙ্কেরই আহ্বানে তার রোগমুক্তির উদ্দেশে গ্রহযজ্ঞ করার জন্য। বৃহদ্ধর্মপুরাণে দেখছি দেবল অর্থাৎ শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ পিতা এবং বৈশ্যমাতার সন্তানরা গ্রহবিপ্র বা গণক নামে পরিচিত হচ্ছেন। যাই হোক ব্রহ্মবৈবর্ত পুবাণ গ্রন্থে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গণক বা গ্রহবিপ্রর (এবং সম্ভবতঃ, দেবল-শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণরাও) ব্রাহ্মণ সমাজে সম্মানিত ছিলেন না; গণক-গ্রহবিপ্ররা তো ‘পতিত’ বলেই গণ্য হতেন, এবং সেই পাতিত্যের কারণ বৈদিক ধর্মে তাদের অবজ্ঞা, জ্যোতিষ ও নক্ষত্রবিদ্যায় অতিরিক্ত আসক্তি এবং জ্যোতির্গণনা করে দক্ষিণা গ্রহণ। এই গণক বা গ্রহবিপ্রদেরই একটি শাখা অগ্ৰদানী ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত ছিলেন, এরাও ‘পতিত’ বলে গণ্য হতেন, কারণ তারাই সর্ব প্রথম শূদ্রদের কাছ থেকে এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দান গ্রহণ করেছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই ভট্ট ব্রাহ্মণ নামে আর এক নিম্ন বা পতিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণের খবর পাওয়া যাচ্ছে; সূত পিতা এবং বৈশ্য মাতার সন্তানরাই ভট্ট ব্রাহ্মণ, এবং অন্যলোকের যশোগান করাই এদের উপজীবিকা, এ-সংবাদও এই গ্রন্থে পাওয়া যাচ্ছে। এরা নিঃসন্দেহে বর্তমান কালের ভাট ব্রাহ্মণ। এখানেও পতিত ব্রাহ্মণদের তালিকা শেষ হচ্ছে না। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে দেখছি শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণেরা উত্তম সঙ্কর পর্যায়ের ২০ বিশটি উপবর্ণ ছাড়া (এরা সকলেই শূদ্র) আর কারোর পূজানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে পারতেন না; মধ্যম ও অধর্ম সঙ্কর বা অন্ত্যজ পর্যায়ের কাহারও পৌরোহিত্য করলে তিনি ‘পতিত’ হয়ে যজমানের বর্ণ বা উপবর্ণ প্রাপ্ত হতেন। মধ্যযুগের ও বর্তমান কালের ‘বর্ণ ব্রাহ্মণ’দের উৎপত্তি এভাবেই হয়েছে। স্মার্ত ভবদেব ভট্ট বলছেন, এসব ব্রাহ্মণদের স্পৃষ্ট খাদ্য যথার্থ ব্রাহ্মণদের খাওয়া নিষেধ, খেলে যে অপরাধ হয় তার প্রায়াশ্চিত্ত স্বরূপ কৃচ্ছ্রসাধনের বিধানও তিনি দিয়েছেন। এই বিধিনিষেধ ক্রমশঃ কঠোরতর হয়ে মধ্যযুগেই দেখা গেল, পতিত বৰ্ণব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে বৈবাহিক আদান প্রদান দূরে থাক্ তাদের স্পৃষ্ট জলও যথার্থ ব্রাহ্মণের পান করতেন না। তা ছাড়া কতকগুলো বৃত্তি ছিল ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ; ভবদেব ভট্ট তার এক সুদীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন। ব্রাহ্মণদের তো প্রধান বৃত্তিই ছিল ধর্ম কর্মানুষ্ঠান এবং অন্যের ধর্মানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য, শাস্ত্রাধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা। অধিকাংশ ব্রাহ্মণই তা করতেন, সন্দেহ নেই। তাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক রাজা ও রাষ্ট্র, ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের কৃপা লাভ করে দান ও দক্ষিণাস্বরূপ প্রচুর অর্থ ও ভূমির অধিকারী হতেন, এমন প্রমাণেরও অভাব নেই। আবার অনেক ব্রাহ্মণ ছোটবড় রাজকর্মও করতেন; ব্রাহ্মণ রাজবংশের খবরও পাওয়া যায়। পাল আমলে দর্ভপাণি কেদারমিশ্রের বংশ, বৈদ্যদেবের বংশ, বর্মণরাষ্ট্রে ভবদেবভট্টের বংশ, সেনরাষ্ট্রে হলায়ূধের বংশ একদিকে যেমন উচ্চতম রাজপদ অধিকার করতেন, তেমনই আর একদিকে শাস্ত্রজ্ঞানে, বৈদিক যাগযজ্ঞ আচারানুষ্ঠানে, পাণ্ডিত্যে ও বিদ্যাবত্তায় সমাজেও তাদের স্থান ছিল খুব সম্মানিত। ব্রাহ্মণেরা যুদ্ধে নায়কত্ব করতেন, যোদ্ধৃ ব্যবসায়ে লিপ্ত হতেন এমন প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পূর্বোক্ত ভবদেবের তালিকায় দেখছি, অনেক নিষিদ্ধবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণদের পক্ষে শূদ্রবর্ণের অধ্যাপনার, তাদের পূজানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য, চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা, চিত্র ও অন্যান্য বিভিন্ন শিল্পবিদ্যার চর্চা প্রভৃতি বৃত্তিও নিষিদ্ধ ছিল; করলে পতিত হতে হতো। অথচ কৃষিবৃত্তি নিষিদ্ধ ছিল না; যুদ্ধবৃত্তিতে আপত্তি ছিল না; মন্ত্রী, সন্ধিবিগ্রহিক, ধর্মাধ্যক্ষ বা সেনাধ্যক্ষ হলে কেউ পতিত হতো না! অথচ বর্ণবিশেষের অধ্যাপনা বা পৌরোহিত্য নিষিদ্ধ ছিল।
ব্রহ্মণেতর বর্ণবিন্যাস
বৃহদ্বর্মপুরাণে দেখা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ ছাড়া বাঙলাদেশে আর যত বর্ণ আছে, সমস্তই সংকর, চতুর্বর্ণের যথেচ্ছ পারস্পরিক যৌনমিলনে উৎপর্ন মিশ্রবর্ণ, এবং তারা সকলেই শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণদ্বয়ের উল্লেখই এই গ্রন্থে নেই। ব্রাহ্মণেরা এই সমস্ত শূদ্র সংকর উপবর্ণগুলোকে তিনশ্রেণীতে বিভক্ত করে প্রত্যেকটি উপবর্ণের স্থান ও বৃত্তি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। এই বর্ণ ও বৃত্তিসমূহের বিবরণ দিতে দিয়ে বৃহদ্বর্মপুরাণ বেণ রাজা সম্বন্ধে যে-গল্পের অবতারণা করেছেন কিংবা উত্তম, মধ্যম ও সংকর এই তিন পর্যায়-বিভাগের যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার উল্লেখ বা আলোচনা অবান্তর। কারণ, স্মৃতিগ্রন্থের বর্ণ-উপবর্ণ ব্যাখ্যার সঙ্গে বাস্তব ইতিহাসের যোগ আবিষ্কার কথা বড় কঠিন। যাই হোক, এই গ্রন্থ তিন পর্যায়ে ৩৬ টি উপবর্ণ বা জাতের কথা বলছে, যদিও তালিকাভুক্ত করছে ৪১টি জাত। বাঙলাদেশের জাত সংখ্যা বলতে আজও আমরা বলি ছত্রিশ জাত। ৩৬টিই বোধ হয় ছিল আদি সংখ্যা, পরে আরও ৫টি উপবর্ণ এই তালিকায় ঢুকে পড়ে থাকবে।
উত্তম-সংকর পর্যায়ের ২০টি উপবর্ণ – ১. করণ (এরা লেখক ও পুস্তককর্মদক্ষ এবং সৎশুদ্র বলে পরিগণিত), ২. অম্বষ্ঠ (এদের বৃত্তি চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদচর্চা, সেইজন্যে এরা বৈদ্য বলে পরিচিত। ঔষধ প্রস্তুত করতে হয় বলে এদের বৃত্তি বৈশ্যের, কিন্তু ধর্মকর্মানুষ্ঠানের ব্যাপারে এরা শুদ্র বলেই গণিত।) ৩. উগ্র (এদের বৃত্তি ক্ষত্রিয়ের, যুদ্ধবিদ্যাই ধর্ম), ৪. মাগধ (হিংসামূলক যুদ্ধব্যবসায়ে অনিচ্ছুক হওয়ায় এগুলোর বৃত্তি নির্দিষ্ট হয়েছিল সূত বা চারণের এবং সংবাদবাহীর।), ৫. তন্ত্রবায় (তাঁতী), ৬. গান্ধিক বনিক (গন্ধদ্রব্য বিক্রয় যে-বণিকের বৃত্তি; বর্তমানে গন্ধবনিক), ৭. নাপিত, ৮. গোপ (লেখক), ৯. কর্মকার (কামার), ১০. তৈলিক বা তৌলিক (গুবাক-ব্যবসায়ী), ১১. কুম্ভকার (কুমোর), ১২. কাংসকার (কাঁসারী), ১৩. শাঙ্খিক বা শঙ্খকার (শাঁখারী), ১৪. দাস (কৃষিকার্য এদের বৃত্তি, অর্থাৎ চাষী), ১৫. বারজীবী (বারুই) (পানের বরজ ও পান উৎপাদন করা উঁহাদের বৃত্তি), ১৬. মোদক (ময়রা), ১৭. মালাকার, ১৮. সূত (বৃত্তি উল্লিখিত নেই, কিন্তু অনুমান হয় এরা চারণ-গায়ক), ১৯. রাজপুত্র (বৃত্তি অনুল্লিখিত; রাজপুত?), ২০. তাম্বলী (তামলী) (পানবিক্রেতা)।
মধ্যম-সংকর পর্যায়ে ১২টি উপবর্ণ – ২১. তক্ষণ (খোদাইকর), ২২. রজক (ধোপা), ২৩. স্বর্ণকার (সোনার অলংকার ইত্যাদি প্রস্তুতকারক), ২৪. সুবর্ণবনিক (সোনা ব্যবসায়ী), ২৫. আভীর (আহীর) (গোয়ালা, গোরক্ষক), ২৬. তৈলকার (তেলী), ২৭. ধীবর (মৎস্যব্যবসায়ী), ২৮. শৌণ্ডিক (শুঁড়ি), ২৯. নট (যারা নাচ, খেলা ও বাজি দেখায়), ৩০. শাবাক, শাবক, শারক, শাবার(?) (এরা কি বৌদ্ধ শ্রাবকদের বংশধর?), ৩১. শেখর(?), ৩২. জালিক (জেলে, জালিয়া)।
অধম-সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ে ৯টি উপবর্ণ; এরা সকলেই বর্ণাশ্রম-বহির্ভূত। অর্থাৎ, এরা অস্পৃশ্য এবং ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থার মধ্যে এদের কাহারও কোনও স্থাননি – ৩৩. মলেগ্রহী (বঙ্গবাসী, সং: মলেগৃহি), ৩৪. কুড়ব(?), ৩৫. চণ্ডাল (চাঁড়াল), ৩৬. বরুড় (বাউড়ী?), ৩৭. তক্ষ (তক্ষণকার?), ৩৮. চর্মকার (চামার), ৩৯. ঘট্টজীবী (পাঠান্তর ঘণ্টজীবী– খেয়াঘাটের রক্ষক, খেয়াপারাপারের মাঝি? বর্তমান, পাটনী?), ৪০. ডোলাবাহী – ডুলি-বেহারা, বর্তমানে দুলিয়া বা দুলে (?), ৪১. মল্ল (বর্তমানে মালো ?)।
ম্লেচ্ছ পর্যায় – এই ৪১টি জাত ছাড়া ম্লেচ্ছ পর্যায়ে আরও কয়েকটি দেশি ও ভিন্প্রদেশি আদিবাসি কোমের নাম পাওয়া যায়; স্থানীয় বর্ণ-ব্যবস্থার এদেরও কোনও স্থান ছিল না, যথা, পুক্কশ, পুলিন্দ, খস, থর, কম্বোজ, যবন, সুহ্ম, শবর ইত্যাদি।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও অনুরূপ বর্ণ-বিন্যাসের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ (উচ্চ ও নিম্ন) এই দুই পর্যায়ে শূদ্রবর্ণের বিভাগের আভাস বৃহদ্বর্মপুরাণেই পাওয়া গিয়েছে; করণদের বলা হয়েছে ‘সৎশূদ্র’। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সমস্ত সংকর বা মিশ্র উপবর্ণগুলোকে সৎ ও অসৎ শূদ্র এই দুই পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। সৎশূদ্র পর্যায়ে যাদের গণ্য করা হয়েছে তাদের নিম্নলিখিতভাবে তালিকাগত করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রেও সর্বত্র পৃথক সূচীনির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না। এই অধ্যায়ে আহৃত অধিকাংশ সংবাদ এই গ্রন্থের প্রথম অর্থাৎ ব্রহ্মখণ্ডের ১০ম পরিচ্ছেদে পাওয়া যাবে; ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৯ শ্লোক বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। ২/৪টি তথ্য অন্যত্র বিক্ষিপ্তও যে নেই তা নয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মিশ্রবর্ণেরও সম্পূর্ণ তালিকা এক্ষেত্রে উদ্ধার করা হয়নি, করে লাভো নেই; কারণ, এই পুরাণেই বলছে, মিশ্রবর্ণ অসংখ্য, কে তার সমস্ত নাম উল্লেখ ও গণনা করতে পারে (১।১০।১২২)? সৎশূদ্রদের তালিকাও যে সম্পূর্ণ নয়, তার আভাসও এই গ্রন্থেই আছে (১।১০।১৮)।
লক্ষণীয় যে, এই পুরাণ বৈদ্য ও অম্বষ্ঠদের পৃথক উপবর্ণ বলে উল্লেখ করছে, এবং উভয় উপবর্ণের যে উৎপত্তি-কাহিনী দিচ্ছে, তাও পৃথক।
সৎশূদ্র – ১. করণ, ২. অম্বষ্ঠ (দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান), ৩. বৈদ্য (জনৈক ব্রাহ্মণীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারের ঔরসে জাত সন্তান; বৃত্তি চিকিৎসা), ৪. গোপ, ৫. নাপিত, ৬. ভিল্ল (এরা আদিবাসী কোম; কি করে সৎশদ্র পর্যায়ে পরিগণিত হলেন, বলা কঠিন), ৭. মোদক, ৮. কুবর (?), ৯. তাম্বুলী (তাম্লী), ১০. স্বর্ণকার ও অন্যান্য বনিক (এরা পরে ব্রাহ্মণের অভিশাপে, ‘পতিত’ হয়ে ‘অসৎশূদ্র’ পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলেন; স্বর্ণকারদের অপরাধ ছিল সোনাচুরি), ১১. মালাকার, ১২. কর্মকার, ১৩. শঙ্খকার, ১৪. কুবিন্দক (তন্তুবায়), ১৫. কুম্ভকার, ১৬. কাংসকার, ১৭. সূত্রধার, ১৮. চিত্রকার (পটুয়া), ১৯. স্বর্ণকার, সূত্রধর ও চিত্রকর কর্তব্যপালনে অবহেলা করায় অপরাধে ব্রাহ্মণের অভিশাপে ‘পতিত’ হয়ে অসৎশুদ্র পর্যায়ে গণ্য হয়েছিলেন। স্বর্ণকারও ‘পতিত’ হয়েছিলেন, এ কথা আগেই বলা হয়েছে।
অসৎশূদ্র – পতিত বা অসৎশূদ্র পর্যায়ে যাদের গণনা করা হতো তাদের তালিকাগত করলে এরকম দাঁড়ায়: স্বর্ণকার [সুবর্ণ] বনিক, সূত্রধার (বৃহদ্বর্মপুরাণের তক্ষণ), চিত্রকার, ২০. অট্টালিকাকার, ২১. কোটক (ঘরবাড়ি তৈরীর মিস্ত্রী), ২২. তীবর, ২৩. তৈলকার, ২৪. লেট, ২৫. মল্ল, ২৬. চর্মকার, ২৭. শুঁড়ি, ২৮. পৌণ্ড্রক (পোদ?), ২৯. মাংসচ্ছেদ (কসাই), ৩০. রাজপুত্র (পরবর্তী কালের রাউত?), ৩১. কৈবর্ত (কলিযুগের ধীবর), ৩২. রজক
৩৩. কৌয়ালী, ৩৪. গঙ্গাপুত্র (লেট-তীবরের বর্ণ-সংকর সন্তান), ৩৫. যুঙ্গি (যুগী?), ৩৬. আগরী (বৃহদ্বর্ম্পুরাণের উগ্র ? বর্তমানে আগুরী)।
অসৎশূদ্রেরও নিম্ন পর্যায়ে, অর্থাৎ অন্তজ-অস্পৃশ্য পর্যায়ে যাদের গণনা করা হয় তাদের তালিকাগত করলে এরকম দাঁড়ায় – ব্যাধ, ভড় (?), কাপালী, কোল (আদিবাসী কোম), কোঞ্চ (কোচ, আদিবাসী কোম), হড্ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী), শরাক, ব্যালগ্রাহী (ব্রহ্মদ্বর্ম্পুরাণের মলেগ্রাহী?), চণ্ডাল ইত্যাদি।
এই দুইটি বর্ণবিভাগের তালিকা তুলনা করলে দেখা যায় প্রথমোল্লিখিত গ্রন্থের সংকর পর্যায় এবং দ্বিতীয় গ্রন্থের সৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু মগধ, গন্ধবণিক, তৌলিক বা তৈলিক, দাস, বারজীবি, এবং সূত দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হতে বাদ পড়েছে; পরিবর্তে পাচ্ছি ভিল্ল ও কুবর এই দুইটি উপবর্ণের উল্লেখ, এবং বৈদ্যদের উল্লেখ। তাছাড়া, প্রথম গ্রন্থের উত্তম সংকর বর্ণের রাজপুত্র দ্বিতীয় গ্রন্থের অসৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু ব্রহ্মদ্বর্মপুরাণের আভীর, নট, শাবাক (শ্রাবক?), শেখর ও জানিল দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হতে বাদ পড়েছে; পরিবর্তে পাচ্ছি অট্টালিকাকার, কোটক, লেট মল্ল, চর্মকার, পৌণ্ড্রক, মাংশচ্ছেদ, কৈবর্ত, গঙ্গাপুত্র, যুঙ্গি, আগরী এবং কৌয়ালী। এদের মধ্যে মল্ল ও চর্মকার বৃহদ্বর্মপুরাণের অধর সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ের। বৃহদ্বর্মপুরাণে ধীবর ও জালিক, মৎস্য-ব্যবসাগত এই দুইটি উপবর্ণের খবর পাচ্ছি; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাচ্ছি কেবল কৈবর্তদের। কৈবর্তদের উদ্ভব সম্বন্ধে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে: কৈবর্ত ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান; কিন্তু কলিযুগে তীবরদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে এরা ধীবর নামে পরিচিত হন এবং ধীবর বৃত্তি গ্রহণ করেন। ভবদেব ভট্টের মতে কৈবর্তরা অন্ত্যজ পর্যায়ের। ভবদেবের অন্ত্যজ পর্যায়ের তালিকা উপরোক্ত দুই পুরাণের তালিকার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে: রজক, চর্মকার,নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ এবং ভিল্ল। ভবদেবের মতে চণ্ডাল ও অন্ত্যজ সমার্থক। চণ্ডাল, পুক্কশ, কাপালিক, নট, নর্তক, তক্ষণ (বৃহদ্বর্মপুরাণোক্ত মধ্যম সংকর পর্যায়ের তক্ষ?), চর্মকার, সুবর্ণকার, শৌণ্ডিক, রজক এবং কৈবর্ত প্রভৃতি নিম্নতম উপবর্ণের এবং পতিত ব্রাহ্মণদের স্পৃষ্ট খাদ্য ব্রাহ্মণদের অভক্ষ্য বলে ভবদেব ভট্ট বিধান দিয়েছেন, এবং খেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, তাও বলেছেন।
দেখা যাচ্ছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উল্লিখিত তিনটি সাক্ষ্যে অল্পবিস্তর বিভিন্নতা থাকিলেও বর্ণ-উপবর্ণের স্তর-উপস্তর বিভাগ সম্বন্ধে এদের তিনজনেরই সাক্ষ্য মোটামুটি একই প্রকার। এই চিত্রই সেন-বর্মণদের আমলের বাঙলাদেশের বর্ণ-বিন্যাসের মোটামুটি চিত্র।
করণ-কায়স্থ – প্রথমেই দেখছি করণ ও অম্বষ্ঠদের স্থান। করণরা কিন্তু কায়স্থ বলে অভিহিত হচ্ছেন না; এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বৈদ্যদের স্পষ্টতই অম্বষ্ঠ হতে পৃথক বলে গণ্য করা হয়েছে। করণদের সম্বন্ধে পাল-পর্বেই আলোচনা করা হয়েছে, এবং করণ ও কায়স্থরা যে বর্ণহিসেবে এক এবং অভিন্ন তাও ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই অভিন্নতা পাল পর্বেই স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিল; বৃহদর্মপুরাণে বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কেন যে সে ইঙ্গিত নেই তা বলা কঠিন। হতে পারে, ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের তখনও তা সম্পূর্ণ স্বীকৃত হয়ে ওঠে নেই।
অম্বষ্ঠ বৈদ্য – বৃহদ্বর্মপুরাণে বর্ণহিসেবে বৈদ্যদেরও উল্লেখ নেই, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আছে; কিন্তু সেখানেও বৈদ্য ও অম্বষ্ঠ দুই পৃথক উপবর্ণ এবং উভয়ের উদ্ভব-ব্যাখ্যাও বিভিন্ন। এই গ্রন্থের মতে দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সঙ্গমে অম্বষ্ঠদের উদ্ভব; কিন্তু বৈদ্যদের উদ্ভব সূর্যতনয় অশ্বিনীকুমার এবং জনৈকা ব্রাহ্মণীর আকস্মিক সঙ্গমে। বৈদ্য ও অম্বষ্ঠরা যে এক এবং অভিন্ন এই দাবি ১৭শ শতকে ভরতমল্লিকের আগে কেউ কহিতেছেন না; ইনিই সর্বপ্রথম নিজে বৈদ্য এবং অম্বষ্ঠ বলে আত্মপরিচয় দিচ্ছেন। তবে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের উল্লেখ হতে বোঝা যায়, ১২শ-১৩শ শতকে বৈদ্যরা উপবর্ণ হিসেবে বিদ্যমান, এবং বৃহদ্বর্মপুরাণ ও সদ্যোক্ত পুরাণটির সাক্ষ্য একত্র করলে এও বোঝা যায় যে, অম্বষ্ঠ ও বৈদ্য উভয়েই সাধারণত একই বৃত্তি অনুসারী ছিলেন। বোধ হয়, এক এবং অভিন্ন এই চিকিৎসাবৃত্তিই পরবর্তীকালে এই দুই উপবর্ণকে এক এবং অভিন্ন উপবর্ণে বিবর্তিত করেছিল, যেমন করেছিল করণ ও কায়স্থদের।
কৈবর্ত-মাহিষ্য – পাল-পর্বে কৈবর্ত-মাহিষ্য প্রসঙ্গে বলেছি, তখন পর্যন্ত কৈবর্তদের সঙ্গে মাহিষ্যদের যোগাযোগের কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নেই এবং মাহিষ্য বলে কৈবর্তদের পরিচয়ের কোনও দাবিও নেই স্বীকৃতিও নেই। সেন-বর্মণ-দেব পর্বেও তেমন দাবী কেউ উপস্থিত করছেন না; এই যুগের কোনও পুরাণ বা স্মৃতিগ্রন্থেও তেমন উল্লেখ নেই। বস্তুত, মাহিষ্য নামে কোন উপবর্ণের নামই নেই। কৈবর্তদের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সংকলয়িতা বলছেন, ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্যমাতার সঙ্গমে কৈবর্তদের উদ্ভব। লক্ষণীয় এই যে, গৌতম ও যাজ্ঞবল্ক্য তাদের প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে মাহিষ্যদের উদ্ভব সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যাই দিচ্ছেন; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা কোথায় পেলেন, বলা কঠিন; কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থ কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখায় নেই, সমসাময়িক বৃহদ্বর্মপুরাণ বা কোনও স্মৃতিগ্রন্থেও নেই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যা যদি বা পাচ্ছি মাহিষ্য-ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কিন্তু কলিযুগে এদের বৃত্তি নির্দেশ দেখছি ধীবরের, মাহিষ্যের নয়। সুতরাং মনে হয়, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যার মধ্যেই কোনও গোলমাল রয়ে গিয়েছে। ১২শ শতকে ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে। বৃহদ্বর্মপুরাণ ধীবর ও মৎস্যব্যবসায়ী অন্য একটি জাতের অর্থাৎ জালিকদের স্থান নির্দেশ করছেন মধ্যম সংকর পর্যায়ে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ধীবর ও কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করছেন অসৎশূদ্র পর্যায়ে; এবং এদের প্রত্যেকেরই ইঙ্গিত এই যে, এরা মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী নন। তবে, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সংকলয়িতা এদের উদ্ভব-ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, এই জাতীয় ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করেই পরবর্তীকালে কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের এক ও অভিন্ন বলে দাবী সমাজে প্রচলিত ও স্বীকৃত হয়। যাই হোক, বর্তমানকালে পূর্ববঙ্গের হালিক দাস এবং পরাশর দাস এবং হুগলী-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের চাষী কৈবর্তরা নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আবার পূর্ববঙ্গে (ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, মৈমনসিংহ, ঢাকা অঞ্চলে) মৎস্যজীবী ধীবর ও জালিকরা কৈবর্ত বলে পরিচিত। বোঝা যাচ্ছে, কালক্রমে কৈবর্তদের মধ্যে দুইটি বিভাগ রচিত হয়, একটি প্রাচীন কালের ন্যায় মৎস্যজীবীই থাকিয়া যায় (যেমন পূর্ববঙ্গে আজও), আর একটি কৃষি (হালিক) বৃত্তি গ্রহণ করে মাহিষ্যদের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন বলে পরিগণিত হয়। বল্লালচরিতে যে বলা হয়েছে, রাজা বল্লালসেন কৈবর্ত (এবং মালাকার, কুম্ভবকার ও কর্মকার)-দিগকে সমাজে উন্নীত করেছিলেন, তার সঙ্গে কৈবর্তদের এক শ্রেণীর বৃত্তি পরিবর্তনের (চাষি-হালিক হওয়ার) এবং মাহিষ্যদের সঙ্গে অভিন্নতা দাবীর যোগ থাকা অসম্ভব নয়।
ব্ৰাহ্মণদের সঙ্গে অন্যান্য বর্ণের সম্বন্ধ
ব্রাহ্মণদের সঙ্গে অন্যান্য বর্ণ-উপবর্ণের সম্বন্ধ ও যোগাযোগ সম্বন্ধে কয়েকটি তথ্যের সংবাদ লওয়া যেতে পারে। প্রথমেই আহার-বিহার নিয়ে বিধি-নিষেধের কথা বলা যাক। ভবদেব ভট্টের প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ এ-সম্বন্ধে প্রমাণিক ও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সমস্ত বিধিনিষেধের উল্লেখের প্রয়োজননি; দুই-চারটি নমুনাস্বরূপ উল্লেখই যথেষ্ট।
রাজক, কর্মকার, নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ, ভিল্লী, চণ্ডাল, পুক্কশ, কাপালিক, নর্তক, তক্ষণ, সুবৰ্ণকার, শৌণ্ডিক এবং পতিত ও নিষিদ্ধ বৃত্তিজীবী ব্ৰাহ্মণদের দ্বারা স্পষ্ট বা পক্ক খাদ্য ব্রাহ্মণদের পক্ষে ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল; এই নিষেধ অমান্য করলে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হতো। শূদ্ৰপক্ক অন্ন ভক্ষণও নিষিদ্ধ ছিল; নিষেধ অমান্য করলে পূর্ণ কৃচ্ছ্র-প্ৰায়শ্চিত্তের বিধান ছিল; প্রাচীন স্মৃতিকারদের এই বিধান ভবদেবও মেনে নিয়েছেন, তবে টীকা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়পক্ক অন্নগ্ৰহণ করলে কৃচ্ছ্র-প্রায়শ্চিত্তের অর্ধেক পালন করলেই চলিবে; আর বৈশ্যপক্ক অন্ন গ্রহণ করলে তিন-চতুর্থাংশ। ক্ষত্রিয় যদি শূদ্ৰপক্ক অন্ন গ্রহণ করে তাকে পূর্ণ কৃচ্ছ্র-প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হবে, কিন্তু বৈশ্যপক অন্নগ্রহণ করলে অর্ধেক প্রায়শ্চিত্ত করলেই চলিবে; বৈশ্য শূদ্ৰপক্ক অন্নগ্ৰহণ করলেও অর্ধেক প্রায়শ্চিত্তেই চলতে পারে। শূদ্রহস্তে তৈলপক্ক ভর্জিত (শস্য) দ্রব্য, পায়স কিংবা আপৎকালে শূদ্ৰপক্ক দ্রব্য ইত্যাদি ভোজন করতে ব্ৰাহ্মণের কোনও বাধা নেই; শেষোক্ত অবস্থায় মনস্তাপপ্রকাশরূপ প্ৰায়শ্চিত্ত করলেই দোষ কেটে যায়। ভবদেবের সময়ে দ্বিজবর্ণের মধ্যে বাঙলাদেশে এইসব বিধি-নিষেধ কিছু স্বীকৃত ছিল, কিছু নতুন গড়ে উঠছিলো বলে মনে হচ্ছে। শূদ্রের পাত্রে রক্ষিত অথবা শূদ্রদত্ত জলপানও ব্রাহ্মণদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল, অবশ্য স্বল্প প্রায়শ্চিত্তেই সে দোষ কেটে যেতো; তবে ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র কেউই চণ্ডাল ও অন্তজস্পৃষ্ট বা তাদের পাত্রে রক্ষিত জল পান করতে পারতেন না, করলে পুরোপুরি প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। নট ও নর্তকদের সম্বন্ধে ভবদেবের বিধি-নিষেধ দেখিয়া মনে হয়, উচ্চতর বর্ণসমাজে এরা সম্মানিত ছিলেন না। বৃহদ্ধৰ্মপুরাণে নটেরা অধম সংকর পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু সমসাময়িক অন্য প্রমাণ হতে মনে হয়, যারা নট-নৰ্তকের বৃত্তি অনুসরণ করতেন সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠা কম ছিল না। নট গাঙ্গো বা গাঙ্গোক-রচিত কয়েকটি শ্লোক সুপ্রসিদ্ধ সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। “পদ্মাবতীচরণচারণ-চক্রবর্তী” জয়দেবের পত্নী প্রাকবিবাহ জীবনে দেবদাসী-নটী ছিলেন, এরকম জনশ্রুতি আছে। জয়দেব নিজেও সংগীতপারঙ্গম ছিলেন; সেকশুভোদয়া গ্রন্থে এই সম্বন্ধে একটি গল্পও আছে।
অন্ত্যজ জাতেরা বোধ হয় এখনকার মতো তখনও অস্পৃশ্য বলে পরিণগতি হতেন। ডোম্ব-ডোম্বীরা যে ব্রাহ্মণদের অস্পৃশ্য ছিলেন তার একটু পরোক্ষ প্রমাণ চযাঁগীতে পাওয়া যায় (১০ নং গীত)। ভবদেবের প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ-গ্রন্থের সংসর্গ প্রকরণাধ্যায়ে অস্পৃশ্য-স্পর্শদোষ সম্বন্ধে নাতিবিস্তর আলোচনা দেখেও মনে হয় স্পর্শবিচার সম্বন্ধে নানাপ্রকার বিধি-নিষেধ সমাজে দানা বেঁধে উঠছিলো।
বিবাহ-ব্যাপারেও অনুরূপ বিধি-নিষেধ যে গড়ে উঠছিলো। তার পরিচয়ও সুস্পষ্ট। পালপর্বে এই প্রসঙ্গে রাজা লোকনাথের পিতৃ ও মাতৃবংশের পরিচয়ে দেখা গিয়েছে, উচ্চবর্ণ পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণ নারীর বিবাহ, ব্রাহ্মণ বর ও শূদ্রকন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না। সবর্ণে বিবাহই সাধারণ নিয়ম ছিল, এই অনুমান সহজেই করা যায়। কিন্তু সেনা-বর্মণ-দেবী আমলেও চতুৰ্বর্ণের মধ্যে, উচ্চবর্ণ বর ও নিম্নবর্ণ কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ হয়নি, এমন-কি শূদ্রকন্যার ব্যাপারেও নহে; ভবদেব ও জীমূতবাহন উভয়ের সাক্ষ্য থেকেই তা জানা যায়। ব্ৰাহ্মণের বিদগ্ধা শূদ্র স্ত্রীর কথা ভবদেব উল্লেখ করেছেন; জীমূতবাহন ব্রাহ্মণের শূদ্র স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের উত্তরাধিকারগত রীতিনিয়মের কথা বলেছেন; যজ্ঞ ও ধর্মানুষ্ঠান ব্যাপারে সমাবর্ণ স্ত্রী বিদ্যমান না থাকিলে অব্যবহিত নিম্নবর্তী বর্ণের স্ত্রী হলেও চলতে পারে, এরকম বিধানও দিয়েছেন। এইসব উল্লেখ হতে মনে হয়, শূদ্ৰবৰ্ণ পর্যন্ত ব্ৰাহ্মণ পুরুষের যে কোনও নিম্নবর্ণে বিবাহ সমাজে আজকের মতো একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে যায়নি। অবশ্য কোনও পুরুষই উচ্চবর্ণে বিবাহ করতে পারতেন না। তবে, দ্বিজবর্ণের পক্ষে শূদ্রবর্ণে বিবাহ সমাজে নিন্দনীয় হয়ে আসছিল, এও অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, এই প্রথা যে নিন্দনীয় এ-সম্বন্ধে মনু ও বিষ্ণুস্মৃতির মত উল্লেখ করে জীমূতবাহন বলছেন, শঙ্খস্মৃতি দ্বিজবর্ণের ক্ষত্ৰিয়া ও বৈশ্য স্ত্রীর কথাই বলেছেন, শূদ্র স্ত্রীর কথা উল্লেখই করেননি। যজ্ঞ ও ধর্মানুষ্ঠানে স্ত্রীর অধিকার সম্বন্ধে জীমূতবাহনের যে-মত একটু আগে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে জীমূতবাহন মনুর মত সমর্থনা করে বলছেন, সবর্ণ স্ত্রীই এই অধিকারের অধিকারী, তবে সবৰ্ণ স্ত্রী বিদ্যমান না থাকিলে ক্ষত্ৰিয়া স্ত্রী যজ্ঞভাগী হতে পারেন, কিন্তু বৈশ্য বা শূদ্র নারী ব্ৰাহ্মণের বিবাহিত হলেও তিনি তা থেকে পারেন না, অর্থাৎ যথার্থ স্ত্রীত্বের অধিকারী তিনি হতে পারেন না। এই টিপ্পনী থেকে স্বভাবতই এই অনুমান করা যায় যে, ব্রাহ্মণ বৈশ্যানী এমন-কি শূদ্রাণীও বিবাহ করতে পারতেন, করতেনও, কিন্তু তারা সর্বদা স্ত্রী অধিকার লাভ করতেন না। এই অনুমানের প্রমাণ জীমূতবাহনই অন্যত্র দিচ্ছেন; বলছেন, ব্ৰাহ্মণ শুদ্রাণীর গর্ভে সন্তানের জন্মদান করলে তাতে নৈতিক কোনও অপরাধ হয় না; স্বল্প সংসৰ্গদোষ তাকে স্পর্শ করে মাত্র, এবং নামমাত্র প্রায়শ্চিত্ত করলেই সে অপরাধ কেটে যায়। শূদ্রাণীর সঙ্গে বিবাহ যে সমাজে ক্রমে নিন্দনীয় হয়ে আসছিল। তা জীমূতবাহনের সাক্ষ্য হতে বোঝা যাচ্ছে; বিভিন্ন বর্ণের স্ত্রীদের মর্যাদা সম্বন্ধেও যে পার্থক্য করা হচ্ছিল তাও পরিষ্কার, বিশেষত শূদ্র বিবাহিতা পত্নী সম্বন্ধে। বর্ণাশ্রম-বহির্ভূত যেসব জাত ছিল তাদের সঙ্গে বিবাহ-সম্বন্ধের কোনও প্রশ্ন বিবেচনার মধ্যেই আসেনি, অর্থাৎ তা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল, এমন-কি শূদ্রের পক্ষেও।
দ্বিজবৰ্ণ (এবং বোধ হয় উচ্চ জাতের শূদ্রবর্ণের মধ্যেও) সপিণ্ড, সগোত্র এবং সমানপ্রবারের বিবাহই সাধারণত প্রচলিত ছিল; ভবদেব ভট্টের সম্বন্ধ-বিবেক গ্রন্থে তার ওপর বেশ জোরই দেয়া হয়েছে। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য এবং প্রজাপত্য বিবাহে কন্যা বরের মায়ের দিক হতে ৫ম পুরুষের মধ্যে কিংবা পিতার দিক হতে ৭ম পুরুষের মধ্যে হলে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বার এবং কন্যা সগোত্র কিংবা সপ্রবারের হলেও বিবাহ হতে পারতো না। আসুর, গান্ধৰ্ব, রাক্ষস এবং পৈশাচ বিবাহে কন্যা বরের মায়ের দিক থেকে তিন পুরুষ, কিংবা পিতার দিক হতে ৫ম পুরুষের বাইরে হলে বিবাহ হতে পারতো, কিন্তু তারা সমাজে শূদ্র পর্যায়ে পতিত বলে গণ্য হতেন।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ হতে বোঝা যায়, এইসব বর্ণগত বিধি-নিষেধ সাধারণত ব্ৰাহ্মণের সম্বন্ধেই সবিশেষ প্রযোজ্য ছিল এবং তাও ব্রাহ্মণের সঙ্গে নিম্নতর এবং বিশেষ ভাবে নিম্নতম বর্ণের আহার-বিহার-বিবাহ ব্যাপারে যোগাযোগ সম্বন্ধে। কালক্রমে এইসব বিধি-নিষেধই সামাজিক আভিজাত্যের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় এবং বৃহত্তর সমাজে বিস্তৃত হয়ে অন্যান্য বর্ণ ও জাতের মধ্যেও স্বীকৃতি লাভ করে। শেষ পর্বে এসে যে-অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তা তো সাম্প্রতিককালে বাঙালী হিন্দুসমাজে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। যাই হোক, সমসাময়িক স্মৃতিগ্রন্থে সেনা-বর্মণ-দেবী আমলের বর্ণগত বিধি-নিষেধের যে-চিত্র দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তাতে স্পষ্টই দেখা যায়, এই সময়ই ব্ৰাহ্মণেরা বৃহত্তর সমাজের অন্যান্য বর্ণ ও জাত হতে প্রায় পৃথক ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। এক প্রান্তে মুষ্টিমেয় ব্ৰাহ্মণ সম্প্রদায়, অন্য প্রান্তে স্বাঙ্গীকৃত ও স্বাঙ্গাক্রিয়মান, স্পর্শচ্যুত, অধিকারলেশহীন। অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়, আর মধ্যস্থলে বৃহৎ শূদ্ৰ সম্প্রদায়। প্রত্যেকের মধ্যে দৃঢ় ও দুরতিক্রম্য প্রাচীর। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ও নানা ভৌগোলিক এবং অন্যান্য বিভেদ-প্রাচীরে বিভক্ত, আহার-বিহার-বিবাহ ব্যাপারে নানা বিধি-নিষেধের সূত্রে দৃঢ় করে বাধা; যোগাযোগের বাধাও বিচিত্র। বৃহৎ শূদ্র সম্প্রদায়ও নানা জাতে নানা স্তরে বিভক্ত, এবং প্রত্যেক স্তর দৃঢ় ও দুর্লঙ্ঘ্য সীমায় সীমিত। অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ পর্যায় তো একান্তই রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টির বাইরে।
ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণের উল্লেখ ভবদেব ভট্ট, জীমূতবাহন ও অন্যান্য স্মৃতিকারেরা বারবার করেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তা একান্তই ঐতিহ্য-সংস্কারগত উল্লেখ বলে মনে হয়—উত্তর-ভারতীয় প্রাচীনতর স্মৃতিকথিত বর্ণ-বিন্যাসের প্রথাগত অনুকরণ। পূর্বতন কালে অথবা বাঙলার আদি স্মৃতিগ্রন্থগুলোর সমসাময়িক কালে এই অঞ্চলে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের উপস্থিতির কোনও নিঃসংশয় সাক্ষ্য আজও আমরা জানি না।
প্রাচীন বাঙলায় বর্ণ-বিন্যাসের পরিণতির কথা বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের History of Bengali Vol. I-গ্রন্থে একটি উক্তি করা হয়েছে; উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য – “An important factor in the evolution of this final stage is the growing fiction that almost all non-Brahmanas were Sudras. The origin of this fiction is perhaps to be traced to the extended significance given to the term Sudra in the Puranas, where it denotes not only the members of the fourth caste, but also those members of the three higher castes who accepted any of the heretical religions or were influenced by Tantric rites. The predominance of Buddhism and Tantric Saktism in Bengal as compared with other parts of India, since the eighth century A. D. perhaps explains why all the notable castes in Bengal were degraded in the Brihad-dharma Puranas and other texts as Sudras and the story of Vena and Pritha might be mere echo of a large scale re-conversion of the Buddhists and Tantric elements of the population into the orthodox Brahmanical fold.” (p. 578).
বর্ণ, শ্রেণী ও কোম
উপরোক্ত উভয়পুরাণের মতেই করণ-কায়স্থ এবং বৈদ্য-অম্বষ্ঠদের পরেই গোপ, নাপিত, মালাকার, কুম্ভকার, কম কাব, শংখকার, কংসকার, তন্তুবায়-কুবিন্দক, মোদক এবং তাম্বলীদের স্থান। গন্ধবণিক, তৈলিক, তৌলক (সুপারী-ব্যবসায়ী), দাস (চাষী), এবং বারজীবি (বারুই), এদেরও সদ্যোক্ত জাতগুলোর সমপর্যায়ে গণ্য করা হতো। এগুলোর মধ্যে কৃষিজীবি দাস ও বারজীবি, এবং শিল্প জীবি কুম্ভকার, কর্মকার, শংখকার, কংসকার ও তন্তুবায় ছাড়া আর কাহাকেকও ধনোৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করা যায় না। গোপ, নাপিত, মালাকার, এরা সমাজ-সেবক মাত্র। মোদক, তাম্বুলী (তাম্লী) তৈলিক-তৌলিক এবং গন্ধবণিকেরা ব্যবসায়ী শ্রেণী, এবং সেই হেতু অর্থোৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করা যেতে পারে; তবে এদের মধ্যে মোদক বা ময়রার ব্যবসায় বিস্তৃত বা যথাযথভাবে ধনোৎপাদক ছিল, এমন বলা যায় না। গুবাক, পান এবং গন্ধদ্রব্যের ব্যবসায় সুবিস্তৃত ছিল। কারণ ও অম্বষ্ঠদের বৃত্তিও ধনোৎপাদক বৃত্তি নয়। করণরা সোজাসুজি কেরাণী, পুস্তপাল, হিসাবরক্ষক, দপ্তর-কর্মচারী; অম্বষ্ঠ-বৈদ্যরা চিকিৎসক। উভয়ই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সাক্ষ্য হতে স্পষ্টই মনে হয়, স্বর্ণকার ও অন্যান্য বণিকেরা—সুবর্ণবণিকেরা হয়ত এগুলোর অন্তর্গত ছিলেন –আগে উত্তম সংকর বা সংশূদ্র পর্যায়েই গণ্য হতেন, কিন্তু বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনাকালে তারা ‘পতিত’ হয়ে গিয়েছেন। ১২শ শতকে ভবদেব ভট্টও সুবর্ণকারদের নিম্নজাত পর্যায়ে ফেলিয়াছেন। বল্লালচরিতে যে বলা হয়েছে বল্লালসেন কোনও কোনও বণিক, বিশেষ ভাবে সুবর্ণবণিকদের সমাজে ‘পতিত’ করে দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের এই ইঙ্গিতের যোগ থাকা অসম্ভব নয়। অন্ততঃ এইটুকু স্থম্পষ্ট যে, কোনও না কোনও কারণে অর্থোৎপাদক শিল্পী ও বণিক সম্প্রদায়ের কোনও কোনও অংশ সমাজে ‘পতিত’ হয়েছিল, তা রাষ্ট্রের নিদেশে বা অন্ত যে কোনও কারণেই হোক।
আশ্চর্য এই যে, সমাজের ধনোৎপাদক অনেক শিল্পী, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের লোকেরাই সংশূদ্র বা উত্তম সংকর বলে গণিত হননি। এগুলোর মধ্যে স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, তৈলকার, চিত্রকার, স্বত্ৰধার, শোণ্ডিক বা শুড়ি, তক্ষণ, ধীবর-জালিক-কৈবর্ত অট্টালিকাকার, কোটক প্রভৃতি জগতের নাম করতেই হয়; এরা সকলেই মধ্যম সংকর বা অসৎশূদ্র পর্যায়ের। যুঙ্গি-যুগীরা এবং চর্মকারেরাও অর্থোৎপাদক শিল্পী শ্রেণীর অন্ততম; এরাও অসংশূদ্র বা মধ্যম সংকর। নট সেবক মাত্র, ভবদেব ভট্টের মতে নট নর্তক। চর্মকার, শুড়ি, রজক, এরা সকলেই নিম্নজাতের লোক। এরা প্রয়োজনীয় সামাজিক স্তর সন্দেহ নেই, কিন্তু শোণ্ডিক ও চর্মকার ছাড়া অন্য দুইটিকে ঠিক অর্থনৈতিক স্তরের লোক বলা যায় কিনা সন্দেহ। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে চর্মকারেরা একেবারে অন্ত্যজ পর্যায়ে পরিগণিত —তাদের বৃত্তির জন্য সন্দেহ নেই। অসংশূদ্র পর্যায়ভুক্ত মল্ল (= মালো, মাঝি?) এবং রজক প্রয়োজনীয় সমাজ-শ্রমিক। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে মল্ল অন্ত্যজ পর্যায়ভুক্ত।
সমাজ-শ্রমিকেরা কিন্তু প্রায় অধিকাংশই অন্ত্যজ বা ম্লেচ্ছ পর্যায়ে— বর্ণাশ্রমের বাইরে তাদের স্থান। চণ্ডাল, বরুড় (বাউড়ী), ঘট্টজীবি (পাটনী?), ডোলাবাহী (দুলিয়া, দুলে), মল্ল (মালো?), হড্ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী?)—এরা সকলেই তো সমাজের একান্ত প্রয়োজনীয় শ্রমিক-সেবক, অথচ এগুলোর স্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে। অন্ত্যজ পর্যায়ের আর একটি বর্ণের খবর দিচ্ছেন বন্দ্যঘটীয় আর্তিহর পুত্র সর্বানন্দ (১১৬০)। এরা বেদে বা বাদিয়ে; বাদিয়েরা সাপখেলা দেখিয়ে বেড়াইত (ভিক্ষার্থং সর্পধারিণি বাদিয়ে ইতি খ্যাতে) ৷ চর্যাগীতিগুলো থেকে ডোম, চণ্ডাল, শবর প্রভৃতি নিম্ন অন্ত্যজ বর্ণ ও কৌমের নরনারীর বৃত্তির একটা মোটামুটি ধারণা করা যায় – বাঁশের তাঁত ও চাঙারি বোন, কাঠ কাটা, নৌকার মাঝিগিরি করা, নৌকা ও সাঁকো তৈরী করা, কাঠ কাটা, মদ তৈরী করা, জুয়া খেলা, তুলা ধোনা, হাতী পোষা, পশু শীকার, নৃত্যগীত ইত্যাদি ছিল এদের বৃত্তি। এসব বস্তু আশ্রয় করেই বৌদ্ধ সহজ-সাধকদের গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে।
শ্রীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত একটি লিপিতে সৎ ও অসৎ শূদ্র উভয় পর্যায়েরই কয়েকজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ মিলছে। কয়েকটি অজ্ঞাতনামা গোপ, জনৈক কংসকার গোবিন্দ, নাপিত গোবিন্দ, এবং দন্তকার রাজবিগা – এরা সংশূদ্র পর্যায়ের সন্দেহ নেই, কিন্তু রজক সিরুপা অসৎশুদ্র পর্যায়েব; নাবিক দ্যোজে কোন পর্যায়ের বলা যাচ্ছে না।
মনে রাখা দরকার, বর্ণ ও শ্রেণীর পরস্পর সম্বন্ধের যেটুকু পরিচয় পাওয়া গেল তা একান্তই আদিপর্বের শেষ অধ্যায়ের। পূর্ববর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে এ-পরিচয় খুব সুস্পষ্ট নয়। তবু, প্রাচীনতর স্মৃতি ও অর্থশাস্ত্রগুলোতে বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধের একটা চিত্র মোটামুটি ধরিতে পারা যায়, এবং অনুমান করা সহজ যে, অন্ততঃ গুপ্ত আমল হতে আরম্ভ করে বাংলায়ও অনুরূপ সম্বন্ধ প্রবর্তিত হয়েছিল। সেখানেও দেখা যায়, অনেকগুলো অর্থোৎপাদক শ্রেণী—তাদের মধ্যে স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, তৈলকার, গন্ধবণিক ইত্যাদিরা ও আছেন – বর্ণ হিসেবে সমাজে এরা উচ্চস্থান অধিকার করেনি, বরং কতকটা অবজ্ঞাতই। আর, সমাজ-শ্ৰমিক যারা তারা তো বরাবরই নিম্নবর্ণস্তরে, কেউ কেউ একেবারে অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য পর্যায়ে। তবে, সমাজ যতদিন পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধান ছিল, অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যই ছিল সামাজিক ধনোৎপাদনের প্রধান উপায় ততদিন পর্যন্ত বর্ণস্তর হিসেবে না হোক, অন্ততঃ রাষ্ট্রে এবং সেই হেতু সামাজিক মর্যাদায় বণিক-ব্যবসায়ীদের বেশ প্রতিষ্ঠাও ছিল। কিন্তু ৭ম-৮ম শতক হতে বাঙালী সমাজ প্রধানতঃ কৃষি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহশিল্পনির্ভর হয়ে পড়িতে আরম্ভ করে, এবং তখন থেকেই অর্থোংপাদক ও শ্রমিক শ্রেণীগুলো ক্রমশঃ সামাজিক মর্যাদাও হারাতে আরম্ভ করে। হাতের কাজই ছিল যাদের জীবিকার উপায় তারা স্পষ্টতই সমাজের নিম্নতর ও নিম্নতম বর্ণস্তরে; অথচ বুদ্ধিজীবী ও মসীজীবী যারা তারাই উপরের বর্ণস্তর অধিকার করে আছেন এমন কি, কৃষিজীবি দাস-সম্প্রদায়ও অনেক ক্ষেত্রে বণিক-ব্যবসায়ী এবং অতি প্রয়োজনীয় সমাজ-শ্রমিক সম্প্রদায় গুলোর উপরের বর্ণস্তরে অধিষ্ঠিত। মধ্য ও উত্তর ভারতে বর্ণস্তরের দৃঢ় ও অনমনীঘ সংবদ্ধতা এবং সমাজের অর্থোৎপাদক ও শ্রমিক শ্রেণীঃস্তরগুলো সম্বন্ধে একটা অবজ্ঞা খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয়চতুর্থ শতক থেকেই দেখা দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর পারস্পরিক সম্বন্ধের বিরোধও ক্রমশঃ তীব্রতর হচ্ছিল। বাংলায়, মনে হয়, মোটামুটিভাবে পাল আমল পর্যন্ত এই বিরোধ খুব তীব্র হয়ে দেখা দেয়নি; পাল আমলের শেষের দিকে, বিশেষ ভাবে সেন-বর্মণ-আমলে উত্তর ও মধ্যভারতের বর্ণ ও শ্রেণীগত সামাজিক আদর্শ, অর্থাৎ এই দুয়ের সুস্পষ্ট বিরোধ রূপ ধরে ফুটে উঠলো।
উল্লিখিত তালিকাগুলোতে এবং সমসাময়িক লিপি ও স্মৃতিগ্রন্থে কতকগুলো আদিবাসি আরণ্য ও পার্বত্য কোমের এবং বিদেশি বা ভিন-প্রদেশি কোমের নাম পাওয়া যাচ্ছে; যথা ভিল্ল, মেদ, আভীর, কোল, পৌণ্ডক (পোদ), পুলিন্দ, পুক্কশ, খস, খর, কম্বোজ, যবন, সুহ্ম, শবর, অন্ধ ইত্যাদি। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে ভিল্লদের সৎশুদ্র পর্যায়ে কী করে গণ্য করা হয়েছিল বলা কঠিন; ভবদেব এদের মেদদের সঙ্গে বিন্যস্ত করেছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে। পৌণ্ড্রকরা অসৎশূদ্র পর্যায়ে পরিগণিত হয়েছিলেন; বাকী সমস্ত কোমই হয় অন্ত্যজ, না হয় ম্লেচ্ছ পর্যায়ে। কোলেরা পুরাণোক্ত কোল্ল সন্দেহ নেই। পুরাণোক্ত কোল্ল-ভিল্লের দর্শন তা হলে এখানেও পাওয়া যাচ্ছে। পুলিন্দরাও প্রাচীন কোম এবং এদের উল্লেখ বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতেও পাওয়া যাচ্ছে। খসদের উল্লেখ পালদের লিপিতেই পাওয়া যাচ্ছে, গৌড়-মালব কুলিক-হূণ- কর্ণাট-লাট প্রভৃতি বেতনভুক্ সৈন্যদের সঙ্গে। খর, পুক্কশ, এরাও পুরাণোক্ত আদিবাসি কোম। আভীররা বিদেশাগত প্রাচীন কোম এবং ভারতেতিহাসে সুবিদিত। বৃহদ্ধৰ্মপুরাণ মতে উঁহারা মধ্যম সংকর পর্যায়ভুক্ত। আর কোনও বিদেশি কোমের পক্ষে কিন্তু এতটা সৌভাগ্য ঘটে নেই। কম্বোজরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সুপরিচিত কোম হতে পারে অথবা আসাম-ব্ৰহ্ম সীমান্তের বা ভোট অঞ্চলের পার্বত্য কোমও হতে পারে; শেষোক্ত কোম হওয়াই অধিকতর সম্ভব। এক কম্বোজ রাজবংশ বাংলায় কিছুকাল রাজত্বও করেছিলেন। অনেকের ধারণা যাদের কোচ বলা হয় তারা এই কম্বোজদেরই বংশধর। যবনরা বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে মুসলমান। অন্ধ্রদের কথা তো পালপর্বে নিম্নতম স্তরের জাতগুলোর আলোচনা প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে। সুহ্মরা বাঙলার প্রাচীনতম আদিবাসী কোমগুলোর অন্যতম। শবরীরাও তাই। এদের কথাও পালপর্বে বলা হয়েছে; বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতে পুলিন্দদের সঙ্গে এগুলোরও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। শবর-নারীদের মতো পুলিন্দ নারীরাও গুঞ্জাবীচির মালা পরতে খুব ভালোবাসতো; নৈহাটি লিপিতে এ-কথার ইঙ্গিত আছে। যাই হোক, উপরোক্ত বিশেষণ হতে বোঝা যাচ্ছে, হিন্দু বর্ণ-সমাজে ধীরে ধীরে যে স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়া চলছিল। তার ফলে কোনও কোনও আদি বাঙালী কোম এবং বিদেশী কোম বৰ্ণাশ্রমের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল, যেমন পৌণ্ডক এবং আভীররা এবং ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের সাক্ষ্য সত্য হলে, ভিল্লারাও; কোনও কোনও আদিবাসী কোম বৰ্ণাশ্রমের বাইরে অন্ত্যজ পর্যায়ে স্থান পেয়েছিলো, যেমন মেদ, ভিল্ল, কোল প্রভৃতি; আবার কেউ কেউ, একেবারে ম্লেচ্ছ পর্যায়ে পুক্কশ, খস, খর, কম্বোজ, যবনদের সঙ্গে, যেমন সুহ্ম, শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি। অনুমান করা কঠিন নয়, ব্যাধ, হড্ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী ?), চণ্ডাল, মল্ল, ডোলাবাহী (দুলিয়া, দুলে), ঘট্টজীবী (পাটনী?), বরুড় (বাউরী) প্রভৃতিরাও আদিবাসি কোম। হিন্দু সমাজের সামাজিক স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়ার যুক্তিপদ্ধতিতে এরাও ক্রমশ সমাজের নিম্নতম স্তরে স্থান পেয়েছিলো। পাল আমলের লিপিগুলোতে “মেদান্ধ্রচণ্ডালপর্যন্তান” পদাংশ হতে মনে হয় এই স্বাঙ্গীকরণ পালযুগেই সুপরিণতি লাভ করে গিয়েছিল। সেন-আমলে সামাজিক নিম্নতম স্তর তো রাষ্ট্রের দৃষ্টির অন্তর্ভুক্তই ছিল না, অন্তত রাজকীয় দলিলপত্রে এগুলোর কোনও উল্লেখ নেই।
বর্ণ ও রাষ্ট্র
বিভিন্ন পর্বে বর্ণ-বিন্যাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণের সম্বন্ধের কথা না বলে বর্ণ-বিন্যাস প্রসঙ্গ শেষ করা উচিত হবে না। বাংলা গুপ্তাধিপত্যের আগে এই সম্বন্ধের কোনও কথাই বলার উপায় নেই; তথ্যই অনুপস্থিত। গুপ্তাধিকারের কালে ভুক্তির রাষ্ট্রযন্ত্রে অথবা বিষয়াধিকরণে কিংবা স্থানীয় অন্য রাষ্ট্রাধিকরণের কর্তৃপক্ষদের মধ্যে যাদের নামের তালিকা পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ প্রায় নেই বললেই চলে। ভুক্তিপতি বা উপরিকদের মধ্যে যাদের দেখা মিলছে তারা কেউ চিরাতদত্ত, কেউ ব্রহ্মদত্ত, কেউ জয়দত্ত, কেউ রুদ্রদত্ত, কেউ কুলবৃদ্ধি ইত্যাদি; এদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলে মনে হয় না। বিষয়াপতিরা বা তৎস্থানীয়রা কেউ বেত্ৰিবৰ্মণ, কেউ স্বয়ম্ভুদেব, কেউ শণ্ডক; এগুলোর মধ্যে বেত্ৰিবৰ্মণ ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি করতে পারেন; স্বয়ম্ভুদেব সম্বন্ধে কিছু বলা কঠিন, ব্ৰাহ্মণ হলে থেকেও বা পারেন; শশুক যে অব্রাহ্মণ এ-অনুমান সহজেই করা যায়। তারপরেই নিঃসন্দেহে যারা রাজকর্মচারী তারা হচ্ছেন পুস্তপাল এবং জ্যেষ্ঠ বা প্রথম কায়স্থ। এদের কাহারও নাম শাম্বপাল, কাহারও কাহারও নাম দিবাকরানন্দী, পত্ৰদাস, দুর্গাদত্ত, অর্কদাস, করণ-কায়স্থ নরদত্ত, স্কন্দপাল ইত্যাদি। এসব নামও ব্ৰাহ্মণেতর বর্ণের, সন্দেহ করার কারণ নেই। অন্তত একজন করণ-কায়স্থ নরদত্ত যে সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন, সে-পরিচয় পাওয়া যায়। কুমারামাত্যদের মধ্যে একটি নাম পাওয়া যায়। বেরজাস্বামী; তিনি ব্ৰাহ্মণ ছিলেন বলে কতকটা নিঃসংশয়ে বলা যায়। পুস্তপাল ও জ্যেষ্ঠ বা প্রথম কায়স্থদের সঙ্গে যারা স্থানীয় অধিকরণের রাষ্ট্ৰকার্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন তারা হচ্ছেন নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম সার্থবাহ এবং প্রথম কুলিক; এদের নামের তালিকায় পাওয়া যায় ধূতিপাল, বন্ধুমিত্র, রিভুপাল, স্থাণুদত্ত, মতিদত্ত ইত্যাদি ব্যক্তিকে; এদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলা যায় না। বস্তুত, এইসব নামাংশ বা পদবী পরবর্তী কালের ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়েতর অন্য ‘ভদ্র’বর্ণের।
৬ষ্ঠ-৭ম শতকে (পূর্ব) বঙ্গেও এই একই অবস্থা দেখা যায়। শুধু সুবর্ণবীথি অন্তর্গত বারকমণ্ডলের বিষয়াধিনিযুক্তক ব্যক্তিদের মধ্যে দুবার দুজনের নাম পাওয়া যায়, গোপালস্বামী ও বৎসপালস্বামী। এই দুজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, সন্দেহ নেই। জ্যেষ্ঠ কায়স্থ পুস্তপাল ইত্যাদির নামের মধ্যে পাওয়া যায় বিনয়সেন, নয়ভূতি, বিজয়সেন, পুরদাস ইত্যাদিকে; এরা অব্রাহ্মণ, তাতেও সন্দেহ নেই।
অর্থাৎ, ৭ম শতক পর্যন্তও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের কোনও প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে না; বরং পরবর্তীকালে যারা কারণ-কায়স্থ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য ইত্যাদি সংকর শূদ্ৰবৰ্ণ বলে গণ্য হয়েছেন তাদের প্রাধান্যই দেখা যায়। বেশি, বিশেষভাবে করণ-কায়স্থদের। শ্রেণী হিসেবে শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর প্রাধান্যও যথেষ্ট দেখা যাচ্ছে; বর্ণ হিসেবে এরা বৈশ্যবর্ণ বলে গণিত হতেন কিনা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। বৈশ্য বলে কোথাও এদের দাবি সমসাময়িক কালে বা পরবর্তীকালেও কোথাও দেখা যায় না, এইটুকুই মাত্র বলা যায়। অনুমান হয়, পরবর্তীকালে যেসব শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী শূদ্র উত্তম ও মধ্যম সংকর বর্ণ পর্যায়ভুক্ত বলে পাওয়া যায়, তারাই এই যুগে শ্রেষ্ঠী, সার্থিবাহ, কুলিক ইত্যাদির বৃত্তি অনুসরণ করতেন। বোঝা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ্য বৰ্ণব্যবস্থা বিস্তৃতি লাভ করলেও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণেরা এখনও প্রাধান্য লাভ করতে পারেননি; তারা সম্ভবত এখনও নিজেদের বর্ণনুযায়ী বৃত্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। অন্যান্য বর্ণের লোকেদের সম্পর্কে মোটামুটি বলা যায় যে, তারাও নিজেদের নির্দিষ্ট বৃত্তিসীমা অতিক্রম করেননি। রাষ্ট্রে করণ-কায়স্থদের প্রতিপত্তি বৃত্তিগত স্বাভাবিক কারণেই; শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তির কারণ অর্থনৈতিক। শেষোক্ত কারণের ব্যাখ্যা অন্যান্য প্রসঙ্গে একাধিকবার করেছি।
কিন্তু, ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও বর্ণ-ব্যবস্থার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, রাষ্ট্রের সক্রিয় পোষকতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ক্রমশ ব্রাহ্মণের প্রতিপত্তিশীল হয়ে উঠিতে আরম্ভ করেন; ভূমিদান অর্থদান ইত্যাদি কৃপালাভের ফলে অনেক ব্ৰাহ্মণ ক্রমশ ব্যক্তিগতভাবে ধনসম্পদের অধিকারীও হতে থাকেন। এই সামাজিক প্রতিপত্তি রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হতে বিলম্ব হয়নি। কারণ-কায়স্থেরাও রাজসরকারের চাকুরি করে রাষ্ট্রের কৃপালাভে বঞ্চিত হয়নি; গ্রামে, বিষয়াধিকরণে, ভুক্তির রাষ্ট্রকেন্দ্রে সর্বত্র যারা মহত্তর, কুটুম্ব ইত্যাদি বলে গণ্য হচ্ছেন, রাজকার্যে সহায়তার জন্য যারা আহুত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে করণ-কায়স্থ এবং অন্যান্য ‘ভদ্র’ বর্ণের লোকই সংখ্যায়। বেশি বলে মনে হচ্ছে। প্রচুর ভূমির অধিকারী রূপে, শিল্প-ব্যবসায়ে অর্জিত ধনবলে, সমাজের সংস্কার, সংস্কৃতি ও বর্ণ-ব্যবস্থার নায়করূপে যেসব বর্ণ সমাজে প্রতিপত্তিশীল হয়ে উঠছেন তারা রাষ্ট্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হবেন, তা বিচিত্র নয়। রাষ্ট্রেরও স্বার্থে হলো সেই সব প্রতিপত্তিশীল বর্ণ বা বর্ণসমূহকে সমর্থকরূপে নিজের সঙ্গে যুক্ত রাখা।
সাধারণতঃ অধিকাংশ লোকই নিজেদের বর্ণবৃত্তি অনুশীলন করতেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই সত্য, কিন্তু ব্যক্তিগত রুচি, প্রভাব-প্রতিপত্তি কামনা, অর্থনৈতিক প্রেরণা ইত্যাদির ফলে প্রত্যেক বর্ণেরই কিছু কিছু লোক বৃত্তি পরিবর্তন করতো, তাও সত্য। স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতে যে নির্দেশই থাকুক বাস্তবজীবনে দৃঢ়বদ্ধ রীতিনিয়ম সর্বদা অনুসৃত যে হতো না তার প্রমাণ অসংখ্য লিপি ও সমসাময়িক গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। পাল-চন্দ্র এবং সেনা-বর্মণ আমলে যথেষ্ট ব্ৰাহ্মণ রাজা, সামন্ত, মন্ত্রী, ধর্মাধ্যক্ষ, সৈন্য-সেনাপতি, রাজকর্মচারী, কৃষিজীবী ইত্যাদির বৃত্তি অবলম্বন করছেন; অম্বষ্ঠ বৈদ্যেরা মন্ত্রী হচ্ছেন; দাসজীবীরা রাজকর্মচারী, সভাকবি ইত্যাদি হচ্ছেন, করণ-কায়স্থেরা সৈনিকবৃত্তি, চিকিৎসাবৃত্তি ইত্যাদি অনুসরণ করছেন; কৈবৰ্তরা রাজকর্মচারী ও রাজ্যশাসক হচ্ছেন; এ ধরনের দৃষ্টান্ত ৮ম হতে ১৩শ শতক পর্যন্ত অনবরতই পাওয়া যাচ্ছে।
পাল রাষ্ট্রযন্ত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাষ্ট্র ও সমাজপদ্ধতির পূর্বোক্ত রীতিক্রম সুস্পষ্ট ও সক্রিয়। প্রথমেই দেখা যায়, রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের প্রভাব ও আধিপত্য বেড়েছে। দ্বিজশ্রেষ্ঠ শ্ৰীদর্ভপাণি, পৌত্র কেদারমিশ্র ও প্রপৌত্র গুরবমিশ্র রাজা ধৰ্মপালের সময় হতে আরম্ভ করে পর পর চারজন পালসম্রাটের অধীনে পালরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কত করেছিলেন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন বেদবিদ পরমশাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিত এবং সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যবিশারদ ও রাজনীতিকুশল। আর একটি ব্রাহ্মণ বংশের শাস্ত্রবিদশ্রেষ্ঠ যোগদেব, পুত্র তত্ত্ববোধভূ বোধিদেব এবং তৎপুত্র বৈদ্যদেব এই তিনজন যথাক্রমে তৃতীয় বিগ্রহপাল, রামপাল এবং কুমারপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই পরিবারও পাণ্ডিত্যে, শাস্ত্ৰজ্ঞানে, এক কথায় ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতিতে যেমন কুশলী ছিলেন তেমনই ছিলেন রাজনীতি ও রণনীতিতে। নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপির দূতক ভট্ট গুরব ব্রাহ্মণ ছিলেন, সন্দেহ নেই। প্রথম মহীপালের বাণগড়-লিপির দূতক ছিলেন ভট্ট শ্ৰীবামন মন্ত্রী, ইনিও অন্যতম প্রধান রাজপুরুষ সন্দেহ নেই। এই রাজার রাজগুরু ছিলেন শ্ৰীবামরাশি; ইনি বোধ হয় একজন শৈব সন্ন্যাসী ছিলেন। বৌদ্ধরাজার লিপি “ওঁ নমো বুদ্ধায়” বলে আরম্ভ হয়েছে, কিন্তু প্রথম দুই শ্লোকেই বলা হচ্ছে, “সরসীসদৃশ বারাণসী ধামে, চরণাবনত-নৃপতি-মস্তকাবস্থিত কেশপাশ সংস্পর্শে শৈবালাকীর্ণরূপে প্ৰতিভাত শ্ৰীবামরাশি নামক গুরুদেবের পাদপদ্মের আরাধনা করে, গৌড়াধিপ মহীপাল [যাদিগের দ্বারা] ঈশান-চিত্ৰঘণ্টাদি শতকীর্তিরত্ন নির্মাণ করিয়েছিলেন”। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন “চিত্রাঘণ্টেশী” নবদুর্গার একতম রূপ; কাজেই, ঈশান চিত্ৰঘণ্টাদি অর্থে নবদুর্গার বিভিন্ন রূপ সূচিত হয়ে থাকা অসম্ভব নয়। শ্ৰীবামরাশি নামটিও যেন শৈব বা শাক্ত লক্ষণের সূচক।
একটি ক্ষত্ৰিয়বর্ণ প্রধান রাজপুরুষের নাম বোধ হয় পাওয়া যাচ্ছে। ধর্মপালের খালিমপুরলিপিতে; ইনি মহাসামন্তাধিপতি নারায়ণবর্মা। এই সামন্ত নরপতিটি যেন অবাঙালী বলেই মনে হচ্ছে। কিছু কিছু বণিকের নাম পাওয়া যায়, যেমন বণিক লোকদত্ত, বণিক বুদ্ধমিত্র; নামাংশ বা পদবী দেখিয়া মনে হয়, এরা পরবর্তীকালের ‘ভদ্র’, সংকরবর্ণীয়, বৃত্তি অবশ্যই বৈশ্যের; কিন্তু রাষ্ট্রে বর্ণ হিসেবে বা শ্রেণী হিসেবে এগুলোর কোনও প্রাধান্য নেই। কারণ কায়স্থদের প্রভাব ব্রাহ্মণদের প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও খুব কম ছিল না। রামচরিত-রচিয়তা সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন করণদের মধ্যে অগ্রণী এবং রামপালের কালে পালরাষ্ট্রের সান্ধিবিগ্রহিক। আর এক করণ-শ্রেষ্ঠ শব্দপ্রদীপ গ্রন্থের রচয়িতা; তিনি স্বয়ং, তার পিতা ও পিতামহ সকলেই ছিলেন রাজবৈদ্য; দুইজন পাল-রাজসভার, একজন চন্দ্র-রাজসভার। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে ধর্মাধিকার-পদাভিষিক্ত জনৈক শ্ৰীগোনন্দন এবং মদনপালের মনহলি-লিপিতে সান্ধিবিগ্রহিক দূতক জনৈক ভীমদেবের সংবাদ পাওয়া যায়; এরাও করণ-কায়স্থকুলসম্ভূত বলে মনে হচ্ছে। কৈবর্ত দিব্য বিদ্রোহী হইবার আগে পাল রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান রাজপুরুষ বা সামন্ত ছিলেন, সে কথা তো আগেই একাধিকবার বলা হয়েছে। সামন্ত নরপতিদের মধ্যেও করণ-কায়স্থদের দর্শন মিলছে। ত্রিপুরা পট্টেলীর মহারাজা লোকনাথ নিজেই ছিলেন করণ। কিন্তু করণদের প্রভাব পাল রাষ্ট্রের যতই থাকুক, ঠিক আগেকার পর্বের মতো আর নেই। ৫ম হতে ৭ম শতকের রাষ্ট্রে সর্বত্রই যেন ছিল করণ-কায়স্থদের প্রভাব, অন্তত নামাংশ বা পদবী হতে তাই মনে হয়। পাল-চন্দ্ৰ পর্বে ঠিক ততটা প্রভাব নেই; পরিবর্তে ব্ৰাহ্মণ প্রভাব বর্ধমান।
কম্বোজ-সেনা-বর্মণ পর্বের রাষ্ট্রে এই ব্ৰাহ্মণ প্রভাব ক্রমশ বেড়েই গিয়েছে। ভবদেব ভট্ট ও হলায়ূধের বংশ এর উদাহরণ। একাধিক পুরুষ ব্যাপি সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রে এ দুই পরিবারের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। তাছাড়া, অনিরুদ্ধ ভট্টের মতো ব্ৰাহ্মণ রাজগুরুদের প্রভাবও কিছু কম ছিল না। অধিকন্তু, প্রভৃতিরও প্রভাব এই পর্বের রাষ্ট্রগুলোতে সুপ্রচুর, এবং এরা সকলেই ব্ৰাহ্মণ। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য প্রভাবের পরিচয় বিশেষভাবে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না; বরং বল্লাল-চরিত, বৃহদ্ধর্ম ও ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণের বর্ণতালিকা হতে মনে হয়, শিল্পী ও ব্যবসায়ী শ্রেণীভুক্ত অনেক বর্ণ রাষ্ট্রের অকৃপাদৃষ্টি লাভ করে সমাজে নেমে গিয়েছিল। বণিক-ব্যবসায়ীদের প্রতি সেন-রাষ্ট্র বোধ হয় খুব প্রসন্ন ছিল না। একমাত্র বিজয়সেনের দেবপাড়া-লিপিতে পাওয়া যায় বারেন্দ্র-শিল্পগোষ্ঠীচূড়ামণি শূলপাণিকে পাওয়া যায় বণিক সামন্তরূপে। বৈদ্যদের প্রভাব-পরিচয়ের অন্তত একটি দৃষ্টান্ত আমাদের জানা আছে; বৈদ্যবংশ-প্ৰদীপ বনমালীকর রাজা ঈশান দেবের পট্টনিক বা মন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু সংবাদটি বঙ্গের পূর্বতম অঞ্চল শ্ৰীহট্ট হতে পাওয়া যাচ্ছে যেখানে আজও বৈদ্য-কায়ন্থে বৰ্ণ-পার্থক্য খুব সুস্পষ্ট নয়। একই অঞ্চলে দেখা যায়, দাস-কৃষিজীবীরা রাজকর্মচারী এবং সভাকবিও হতেন। কিন্তু ব্ৰাহ্মণদের পরেই রাষ্ট্রে যাদের প্রভাব সক্রিয় ছিল তারা কারণ-কায়স্থ; এগুলোর প্রভাব হিন্দু আমলে কখনও একেবারে ক্ষুন্ন হয়েছিল বলে মনে হয় না; কারণ-কায়স্থদের বর্ণগত বৃত্তিই বোধ হয় তার কারণ। সেন-রাজসভার কবিদের মধ্যে অন্তত একজন করণ-কায়স্থ উপবর্ণের লোক ছিলেন বলে মনে হয়; তিনি উমাপতিধর। মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধচিন্তামণি-গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক হলে স্বীকার করতে হয়, উমাপতি লক্ষ্মণসেনের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন। সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের সংকলয়িতা কবি শ্ৰীধরদাসও বোধ হয় কারণ-কায়স্থ ছিলেন; শ্ৰীধর নিজে ছিলেন মহামাণ্ডলিক, তার পিতা বটুদাস ছিলেন মহাসামন্তচূড়ামণি। বিজয়সেনের বারাকপুর-লিপির দূত শালাড্ডনাগ, বল্লালসেনের সান্ধিবিগ্রহিক হরিঘোষ, লক্ষ্মণসেনের মহাসান্ধিবিগ্রহিক নারায়ণদত্ত, এই রাজারই অন্যতম প্রধান রাজকর্মচারী শঙ্করধর, বিশ্বরূপসেনের সান্ধিবিগ্রহিক নাঞী সিংহ এবং কোপিবিষ্ণু, ইত্যাদি সকলকেই করণ-কায়স্থ বলেই মনে হচ্ছে। লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি ধোয়ী কিন্তু ছিলেন তন্তুবায়; তন্তুবায়-কুবিন্দকেরা উত্তম-সংকর বা সৎশুদ্র পর্যায়ের লোক, একথা স্মরণীয়।
রাষ্ট্রে বিভিন্ন বর্ণের প্রভাবের মোটামুটি যে-পরিচয় পাওয়া গেল তা থেকে অনুমান হয়, ব্ৰাহ্মণ ও করণ-কায়স্থদের প্রভাব-প্রতিপত্তিই সকলের চেয়ে বেশি ছিল। কারণ-কায়স্থদের প্রভাবের কারণ সহজেই অনুমেয়; ভূমির মাপ-প্রমাপ, হিসাবপত্র রক্ষণাবেক্ষণ, পুস্তপালের কাজকর্ম, দপ্তর ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ, লেখকের কাজ প্রভৃতি ছিল এগুলোর বৃত্তি। স্বভাবতই, তারা রাষ্ট্রে এই বৃত্তিপালনের যতটা সুযোগ পাইতেন অন্যত্র তা সম্ভব হতো না। কাজেই এক্ষেত্রে বর্ণ ও শ্রেণী প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্ৰাহ্মণদের ক্ষেত্রে তা বলা যায় না; এরা বৃত্তিসীমা অতিক্ৰম করেই মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ, ধর্মধ্যক্ষ, সান্ধিবিগ্রহিক ইত্যাদি পদ অধিকার করতেন। রাজগুরু, রাজপণ্ডিত, পুরোহিত, শান্ত্যাগারিক ইত্যাদিরা অবশ্যই নিজেদের বৃত্তিসীমা রক্ষা করে চলতেন, বলা যেতে পারে। কোন সামাজিক রীতিক্রমানুযায়ী ব্ৰাহ্মণের রাষ্ট্রে প্রভুত্ব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। বৈশ্যাবৃত্তিধারী বর্ণ-উপবর্ণ সম্বন্ধে বলা যায়, যতদিন শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের অবস্থা উন্নত ছিল, ধনোৎপাদনের প্রধান উপায় ছিল শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য, ততদিন রাষ্ট্রেও তঁহাদের প্রভাব অনস্বীকার্য ছিল, কিন্তু একাধিক প্রসঙ্গে দেখাইতে চেষ্টা করেছি, ৭ম শতকের পরে ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রেও বৈশ্যবৃত্তিধারী লোকেদের প্রভাব কমে যেতে থাকে। পাল-রাষ্ট্রেই তার চিহ্ন সুস্পষ্ট। বল্লাল-চরিতের ইঙ্গিত সত্য হলে সেন-রাষ্ট্র র্তাহাদের প্রতি সক্রিয়ভাবে অপ্রসন্নই ছিল। তাছাড়া, বৃহদ্ধর্ম-ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণও সে-ইঙ্গিত সমর্থন করে। রাষ্ট্রে এগুলোর প্রভাব থাকিলে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে এরা এতটা অবজ্ঞাত, অবহেলিত হতে পারতেন না।
যাই হোক, এ তথ্য সুস্পষ্ট যে, ব্ৰাহ্মণ ও করণ-কায়স্থদের প্রভাবই রাষ্ট্রে সর্বাপেক্ষা বেশি কার্যকরী ছিল। অম্বষ্ঠ-বৈদ্যদের প্রভাবও হয়তো সময়ে সময়ে কিছু কিছু ছিল; কিন্তু সর্বত্র সমভাবে ছিল এবং খুব সক্রিয় ছিল এমন মনে হয় না। বৈশ্যাবৃত্তিধারী বর্ণের লোকেরা রাষ্ট্রে ৮ম শতক পর্যন্ত প্রভাবশালীই ছিলেন, কিন্তু পরে তাদের প্রভাব কমে যায় এবং তাদের কোনও কোনও সম্প্রদায় সংশুদ্রি পর্যায় থেকেও পতিত হয়ে পড়ে। কৈবর্তদের একটি সম্প্রদায় কিছুদিন রাষ্ট্রে খুব প্রভাবশালীই ছিলেন, এবং পরেও সে-প্রভাব খুব সম্ভব অক্ষুন্ন রেখেছিল। আর কোনও বর্ণের কোনও প্রভাব রাষ্ট্রে ছিল বলে মনে হয় না।
উপসংহার
যে বিচিত্ৰ বৰ্ণভেদ-বিন্যাসের কথা এতক্ষণ বলা হলো, ৫ম শতকের পর থেকেই এই ভেদ-বিন্যাস ক্রমশ বিস্তৃত হতে আরম্ভ করে এবং সেন-বৰ্মণ পর্বে তা দৃঢ় ও অনমনীয় হয়ে সমাজকে স্তরে-উপস্তরে বিভক্ত করে সমগ্র সমাজ-বিন্যাস গড়ে তোলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে এমন মানুষ, এমন সাধক ছিলেন যারা মানুষে মানুষে এই ভেদ-সংঘাত অস্বীকার করে তার উর্ধ্বে উঠিতে পেরেছিলেন। জাতিভেদ, বৰ্ণভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর তাদের উদার সমদৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করতে পারে নেই। সমস্ত জাত বৰ্ণ ভেদ করে, তাকে অতিক্রম করে মানুষের মানব-মহিমা ঘোষণাই ছিল তাদের অধ্যাত্মচিন্তা ও জীবন-সাধনার আদর্শ। এই আদর্শ সব চেয়ে বেশি প্রচার করেছেন ভাগবতধর্মী এবং সহজযানী সাধকেরা। সমাজে তাদের আদর্শ কতটা অনুসৃত হয়েছিল বলা কঠিন, খুব যে হয়েছিল, এমন প্রমাণ নেই, কিন্তু সে আদর্শ যে অধ্যাত্মচিন্তায় এবং কিছু কিছু লোকের জীবন-সাধনার কাজে লাগিয়েছিল, সে-সম্বন্ধে সন্দেহ করা যায় না। অন্তত বিশেষ বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীতে জাতিভেদ বর্ণভেদের কোনও বালাই-ই ছিল না, একথা মানতেই হয়। ভাগবত তো খুব জোরের সঙ্গেই বলেছেন, ভগবানের কাছে সকলেরই সমান অধিকার, এমন-কি কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুক্কশ, আভীর, সুহ্ম, যবন, খসদেরও। প্রাচীন বাঙলায় এ-কথাটা খুব ভালো করে জোরের সঙ্গে বলেছেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা এবং ভবিষ্যপুরাণের ব্ৰহ্মপর্ব যদি বাংলায় রচিত হয়ে থাকে তা হলে ঐ ভাবের ভাবুকেরাও। বজ্রসূচিকোপনিষৎ নামে একটি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল বোধ হয় বাংলায়ই, এবং মনে হয় এই উপনিষদটি বজ্রযানী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের রচনা। গ্রন্থটি ৯৭৩-৯৮১ খ্ৰীষ্ট তারিখে চীনা ভাষায় অনুদিত হয়। এই গ্রন্থেও প্রচণ্ড যুক্তিতর্কে জাতিভেদের যুক্তি খণ্ডন করা হয়েছে।
সরহপাদের দোহাকোষের প্রথমেই বলা হয়েছে, ব্ৰাহ্মণ [সহজধর্মের] রহস্য জানে না। সংস্কৃত টীকাকার বলছেন, দ্বিজবর্ণের সংস্কার পালনেই যদি জাতি হয় তবে সংস্কার পালন তো সকলেরই হতে পারে, তাতে জাতি সিদ্ধ হয় না— তস্মাৎ না সিধ্যতি জাতিঃ। দোহাকোষের টীকার অন্যত্র আছে, শূদ্র বা ব্ৰাহ্মণ বলে বিশেষ কিছু জাতি নেই, সমস্ত লোক একই জাতিতে নিবদ্ধ, ইহাই সহজ ভাব— তয়া ন শূদ্রং ব্রাহ্মণাদি জাতি বিশেষং ভবতি সিদ্ধং। সর্বে লোকা একজাতি নিবদ্ধাশ্চ সহজমেবিতি ভাবঃ ৷ ভবিষ্যপুরাণের ব্ৰহ্মপর্বে জাতিভেদের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ যুক্তি দেয়া হয়েছে এবং সর্বশেষে বলা হয়েছে, চার বর্ণই যখন এক পিতার সন্তান তখন সকলেরই একই জাতি; সব মানুষের পিতা যখন এক তখন এক পিতার সন্তানদের মধ্যে জাতিভেদ থাকতেই পারে না। বজ্রসূচিকোপনিষদেও খুব জোরের সঙ্গে বর্ণ-ব্রাহ্মণত্বের দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের বেশির ভাগ সম্বন্ধই তো শবর-শবরী, ডোম-ডোমিনী, চণ্ডাল-চণ্ডালিনীদের সঙ্গে।
কিন্তু, এই উদার সমাদৃষ্টি ও অধ্যাত্ম-ভাবনা সামাজিকভাবে সমাজে গৃহীত হয়নি, ব্যক্তিগত অধ্যাত্ম ও ধর্মসাধনার ক্ষেত্রেই যেন সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যক্তিজীবনে এই উদার আদর্শের ধ্যান ও স্পর্শ অনেক মানুষকে জীবনসাধনায় অগ্রসর করেছে, প্রাচীন বাঙলায় এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। পাল-যুগে বৌদ্ধ সহজধর্মের উদার আদর্শ কিছুটা সামাজিক জীবনেও সক্রিয় ছিল, কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক আচার, বিচার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং সমাজ-বিন্যাসে এই উদার মানবাদর্শের স্বীকৃতি বিশেষ ছিল বলে মনে হয় না।
অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। নিয়মিত পড়ব এই কলাম ও লেখা।