প্রাথমিক মধ্যযুগে বাংলার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবস্থা

(পরিবর্তিত ও সম্প্রসারিত হবে)

Table of Contents

মুদ্রা ব্যবস্থা

ভূমিকা

রাষ্ট্রগঠনের অল্পবিস্তর সার্থক প্রয়াস ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের অল্পবিস্তর বিস্তার ছাড়া সাধারণত মুদ্রা-প্রচলনের প্রয়োজন হয় না, অন্তত ভারতবর্ষের ইতিহাসে তেমন প্রমাণ নেই, তা শীলমোহর মুদ্রিত (Punch-marked) মুদ্ৰাই হোক আর তঙ্কশালার ঢালাই করা (cast) মুদ্রাই হোক। শুধু স্থানীয় হাটবাজারের কেনা-বেচার ব্যাপারেই নয়, বহির্বাণিজ্যের ব্যাপারেও দ্রব্য-বিনিময়ে (exchange by barter) ব্যাবসা-বাণিজ্য চালানো যায়, ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। তবে, যে সমাজে ব্যাবসা-বাণিজ্যিক ব্যাপারে রাষ্ট্রের বা বণিক গোষ্ঠীর (guild) অধিকার স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত, অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের দিক থেকে যে-সমাজ অর্থনৈতিক ব্যাপারে যত বেশি সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত, সে-সমাজে মুদ্রার প্রচলন তত বেশি।

প্রত্নসাক্ষ্যই হোক বা লিপি বা প্রাচীনগ্রন্থ-সাক্ষ্যই হোক, মুদ্রা প্রচলনের যত প্রমাণ প্রাচীন বাংলায় পাওয়া যাচ্ছে, তা হয় উত্তরবঙ্গ (বগুড়া, দিনাজপুর) থেকে না হয় নিম্নগাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গ থেকে। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই, ইতিহাসের সূচনা থেকেই বাংলার ভাগ্য নির্ণীত হয়েছে মধ্য-গাঙ্গেয় উত্তর-ভারতের ইতিহাস দ্বারা, সেখানকার ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত, অবস্থার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি বাংলায় এসে ঢেউ তুলেছে এবং তার ফলে এ দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। মুদ্রা-প্রসঙ্গে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ে এবং তার অনেক পরেও মধ্য-গাঙ্গেয় ভারতের জীবন-প্রবাহের পূর্বদিকে যাত্রার পথ ছিল প্রধানত দুটি –

  • পাটলিপুত্রে গঙ্গা পার হয়ে উত্তর-বিহারের চম্পা থেকে সোজা উত্তরবঙ্গের ভেতর দিয়ে ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্বতীরবর্তী কামরূপ পর্যন্ত, এই পথের ওপর মহাস্থান ও কোটিবর্ষ (বাণগড়) পড়ে।
  • রাজমহলে গঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় ঢুকে নদীর দুই তীর ধরে ধরে একবারে সাগর মোহনা পর্যন্ত। এই পথের শেষ প্রান্তে, সাগরতীরে তাম্রলিপ্ত, গঙ্গাবিন্দর, চন্দ্ৰকেতুগড় পড়ে।

দুটি পথই প্রাচীন ব্যাবসা-বাণিজ্যের পথ, উত্তর-ভারতীয় সংস্কৃতির পূর্বাভিযানের পথ। মৌর্যবংশ প্রতিষ্ঠার আগেও এই পথ-দুটির অস্তিত্ব ছিল, লোকজনের আসা-যাওয়া, ব্যাবসা-বাণিজ্যও চলত পথ দুটি ধরে। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে তার আভাস-ইঙ্গিত একেবারে অপ্রতুল নয়। কিন্তু খ্ৰীষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের আগে এসব অঞ্চলে মুদ্রার প্রচলন ছিল তা মনে হয়না, তখন এই অঞ্চলগুলোতে মুদ্রার প্রচলনের প্রয়োজন ছিল বলেও মনে হয়না। এর প্রধান কারণ বোধহয়, তার আগে ভারতের পূর্বাঞ্চলে রাষ্ট্র গঠনের কোনও সার্থক প্রয়াস দেখা দেয়নি। সে প্রয়াসের প্রথম ইঙ্গিত, গ্ৰীক ঐতিহাসিককুল-কথিত Prasioi ও Gangaridae রাষ্ট্র দুটি। দ্বিতীয় ইঙ্গিত, বাংলায় মৌর্যরাষ্ট্রের বা অন্তত মৌর্য রাষ্ট্ৰীয় প্রভাবের সক্রিয় অনুপ্রবেশ। এই ব্যাখ্যাতি যুক্তিসিদ্ধ হলে স্বীকার করতে হয়, শীলমোহরিত মুদ্রা বা তঙ্কশালা-নিৰ্গত ঢালাই মুদ্ৰাই হোক, গণ্ডক বা কাকনিক মুদ্ৰাই হোক, অথবা ক্যালটিস স্বর্ণমুদ্ৰাই হোক, প্রাচীনতম বঙ্গের কোনও মুদ্ৰাই মোটামুটি খ্ৰীষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের আগে নয়, এবং সে মুদ্রা মধ্য-গাঙ্গেয় উত্তর-ভারতের প্রতিধ্বনি মাত্র।

মৌর্য ও গুপ্ত আমলের মুদ্রা

মৌর্য আমলের পর থেকে শুরু করে গুপ্তপর্ব সূচনার আগ পর্যন্ত, এই দীর্ঘকালের মধ্যে প্রাচীন বঙ্গে কী ধরনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল তা জানার কোনও উপায় নেই। তবে দেশের নানা জায়গায় প্রচুর কুষাণ মুদ্রা পাওয়া গেছে। মনে হয় কুষাণ আমলে, এবং হয়তো তার পরেও উত্তর-ভারতের সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্যের সূত্রে এইসব মুদ্রা কিছু কিছু এই অঞ্চলেও প্রচলিত হয়েছিল। উত্তর-ভারতের অন্যান্য মুদ্রাও এই সময়ে অল্পবিস্তর প্রচলিত হয়েছিল এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। সন্দেহ নেই যে, ব্যাবসা-বাণিজ্য সূত্রেই তা হয়েছিল। কিন্তু কুষাণ মুদ্রাই হোক বা উত্তর-ভারতীয় অন্যান্য মুদ্রাই হোক, এই সব মুদ্রার সঙ্গে স্থানীয় কেনাবেচার জন্য প্রচলিত পূর্বতন কড়ি, গণ্ডক, কাকনিক, শীলমােহরিত ও তঙ্কশালা-নিৰ্গত প্রভৃতি মুদ্রার সম্বন্ধ কী ছিল এবং স্থানীয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গেই বা কী সম্বন্ধ ছিল এ-সম্বন্ধে কিছু বলার কোনও উপায়ই আজও আমরা জানিনা।

কুমিল্লার ময়নামতিতে প্রাপ্ত মুদ্রাভাণ্ডার নিয়ে প্রকাশিত বিবরণ থেকে মনে হয়, মুদ্রগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়ে স্বৰ্ণমুদ্রগুলো যার সঙ্গে গুপ্তোত্তর বাংলায় প্রচলিত এর চেয়েকৃত পাতলা ওজনের ‘নকল’ স্বর্ণমুদ্রার কোনও পার্থক্য নেই বললেই চলে; এ-ধরনের মুদ্রা ৭ম শতকের শেষ পর্যন্তও প্রচলিত ছিল। এই মুদ্রাগুলোর একদিকের বামপাশে দণ্ডায়মান একটি নারীমূর্তি, আর একদিকে একটি উপবিষ্ট অথবা দণ্ডায়মান নরমূর্তি, খুব সম্ভব, যথাক্রমে রাজা ও রানীর, অথবা রাজা ও শ্ৰী বা লক্ষ্মীর। অনেকগুলো মুদ্রার একদিকে, গুপ্তমুদ্রার অনুকরণে, দণ্ডায়মান মূর্তির বাম হাতের নীচে ছোট এক লাইন একটি লেখ। এই লেখগুলোর পাঠোদ্ধার এখনও হয় নি, তবে একটি মুদ্রায় যে “বলভট’ বলে একটি ব্যক্তিনাম লেখা আছে, সে-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই – আর একটিতে যা লেখা আছে তা পড়া হয়েছে “ভঙ্গল মৃগাঙ্কস্য’ বলে; পড়েছেন ময়নামতীর বিবরণ লেখক এফ. এ. খান, প্রধানত দেববংশীয় রাজাদের শীলমোহর ও তাম্রশাসনোৎকীর্ণ “শ্ৰীভঙ্গল মৃগাঙ্ক”-লাঞ্ছনটি অনুসরণ করে। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, এই পাঠ যথার্থ নয়, শুদ্ধ পাঠ হওয়া উচিত ‘অভিনব মৃগাঙ্কস্য’, যেহেতু দেববংশীয় রাজা ভবদেবের শীলমোহর ও তাম্রশাসনে যা লেখা আছে তার পাঠ “শ্ৰীঅভিনব মৃগাঙ্ক”। যাই হোক, সন্দেহ নেই, দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় এই ‘নিকল, গুপ্তোত্তর স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়েছিল দেববংশের রাজত্বের আমলে, ৮ম শতকে।

গণ্ডক ও ক্যালটিস

বিনিময়ের জন্য মুদ্রার ব্যবহার অর্থনৈতিক সভ্যতার দ্যোতক। খ্রিস্টীয় শতকের আগে থেকেই বাংলায় মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়। মহাস্থানের শিলাখণ্ডের লিপিটিতে গণ্ডক নামে একপ্রকার মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়, যা সোনা না রূপার, বলার কোনও উপায় নাই। তবে বহু পূৰ্ববতী কালের ‘গণ্ডা” গণনা রীতির সঙ্গে যে এই গণ্ডক মুদ্রার একটা শব্দতাত্ত্বিক সম্বন্ধ ছিল এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। এই গণ্ডক মুদ্রার চেহারা যে কিরূপ ছিল তাও আমরা কিছু জানি না। কেউ কেউ মনে করেন, মহাস্থান লিপিতে ‘কাকনিক’ নামে আর একপ্রকার মুদ্রারও উল্লেখ আছে। এই মুদ্রারও রূপ, মূল্য বা ওজন সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না। গণ্ডকের সঙ্গে এর সম্বন্ধ যে কী ছিল তাও বলা যায় না।

পেরিপ্লাস-গ্রন্থে খবর পাওয়া যায় গঙ্গা-বন্দরে ক্যালিটিস (Calitis) নামে একপ্রকার স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল যা খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের কথা। কেউ কেউ মনে করেন, Calitis সংস্কৃত ‘কলিত’ অর্থাৎ সংখ্যাঙ্কিত শব্দেরই রূপান্তর। পেরিপ্লাস-গ্রন্থের সম্পাদক মনে করেন Calitis এবং দক্ষিণ-ভারতের Kalais, একই মুদ্রা। ভিনসেন্ট স্মিথ তো বলেন, Kalais নামেও বাংলায় একপ্রকার মুদ্রার প্রচলন ছিল। কনকলাল বড়ুয়া মনে করেন, আসামের ‘কলিত বণিকেরা একপ্রকার স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করিত, তার নাম ছিল Kallis। বোধহয় এরও আগে এক ধরনের নানা চিহ্নাঙ্কিত (punch marked) রৌপ্য ও তাম্র-মুদ্রার বিস্তৃত প্রচলন ছিল বাংলায়।

চব্বিশ পরগনার নানা প্রত্নস্থানে, রাজশাহীর ফেটুগ্ৰাম, মৈমনসিংহের ভৈরববাজার, মেদিনীপুরের তমলুক এবং ঢাকার উয়াড়ী প্রভৃতি স্থানে এই ধরনের সীসা, রৌপ্য ও তাম্র-মুদ্রা প্রচুর আবিষ্কৃত হয়েছে; এদের সঙ্গে ভারতবর্ষের নানাস্থানে প্রাপ্ত এই জাতীয় মুদ্রার নিকট আত্মীয়তা সহজেই ধরা পড়ে। সেহেতু, সর্বভারতীয় সাধারণ অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে বাংলার একটা যোগাযোগ ছিল এই অনুমান হয়তো নিতান্ত মিথ্যা নাও হতে পারে।

মুদ্রা-বিনিময়-নির্ভর অর্থনৈতিক জীবনকে সভ্যতার অন্যতম দ্যোতক বলে মনে করা হয়। বাংলায় প্রাচীনতম ধাতুর (তামা) মুদ্রা পাওয়া গেছে। প্রত্নোৎখনন বা প্রত্নানুসন্ধানের ফলে, উত্তরবঙ্গের মহাস্থান (বগুড়া জেলা) ও বাণগড়ে (দিনাজপুর জেলা), আর পাওয়া গেছে নিম্নগাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের তমলুক (মেদিনীপুর) ও চন্দ্ৰকেতুগড়ে (২৪ পরগনা)। উভয় অঞ্চলেই শীলমোহর-মুদ্রিত এবং ঢালাই করা, দু’রকমের মুদ্রাই পাওয়া গেছে। প্রত্নখননের সংস্তরের (stratification) সর্বত্র খুব সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত নয়, তবু মোটামুটি বলা চলে, ঢালাই-মুদ্রা থেকে শীলমোহরিত মুদ্রা প্রাচীনতর এবং এই মুদ্রার প্রচলন বহুদিন অব্যাহত ছিল। গাঙ্গেয় উত্তরভারতে যে-সব জায়গায় এই দুই জাতীয় মুদ্রাই পাওয়া গেছে, সে-সব জায়গায়, যেমন, হস্তিনাপুরে, দিল্লীর পুরানো কেল্লায়, কৌশাম্বীতে, উজ্জয়িনীতে, এই দুই মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। (একমাত্র প্রমাণ, প্রত্ন-সংস্তরের সাক্ষ্য) মোটামুটি খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে। প্রাচীন বাংলায় তা হয়েছিল বলে মনে হয় না। বস্তুত প্রত্নসংস্তরের সাক্ষ্য থেকে এই দুই জাতীয় মুদ্রারই প্রচলন শুরু খ্ৰীষ্টপূর্ব মোটামুটি ৩২৫-৩০০-র আগে হয়েছিল বলে অনুমান করবার কোনও কারণ নেই। অন্যতর সাক্ষ্যের ইঙ্গিতও একই। মহাস্থানে মৌর্য-ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা যে ভগ্নাংশ-লিপিটি পাওয়া গেছে তাতে দুই মূল্যের দুটি মুদ্রার উল্লেখ আছে, একটি গণ্ডক, আর একটি কাকনিক (= অর্থশাস্ত্রোক্ত কাকনিকা)। এই মুদ্রা দুটির স্বরূপ কী ছিল জানবার উপায় নেই। এ দুটি কি ধাতুমুদ্রা না। আর কিছু, তা-ও নিশ্চয় করে বলার উপায় নেই। শুধু এইটুকু আমাদের জানা আছে, বাংলায় কিছুদিন আগেও প্রচলিত ছিল চার কড়িতে এক গণ্ডা, আর কৌটিল্য ও অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে বলা যায়, এক কাকনিক ছিল বিশ কড়ির সমান মূল্য। এই একান্ত ঐতিহ্যবাহিত, পরম্পরাগত আর্যগণনা থেকে হয়তো বলা যায়, প্রাচীন বাংলায় কড়িই ছিল নিম্নতম দ্রব্যমূল্যমান, এবং সেই মান দ্বারাই নির্ণীত হতো উচ্চতর মুদ্রামান। আমার নিজের ধারণা, গণ্ডক ছিল শীলমোহরিত নিম্নতম মুদ্রা, আর কাকনিক ছিল ঢালাই করা তাঙ্কশালার মুদ্রা। অনুমান করা চলে, মৌর্য আমল থেকে শুরু করে বেশ-কিছুকাল এই দুই মুদ্রারই প্রচলন ছিল বাংলায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর তৃতীয়পদে অজ্ঞাতনামা গ্ৰীক গ্রন্থকারের লেখা Periplus গ্রন্থে বলা হয়েছে, দক্ষিণতম বঙ্গের গঙ্গা (Ganga) বন্দরে সমসাময়িক কালে Caltis নামে এক সুবৰ্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল। এই উক্তির ঐতিহাসিক যাথার্থ কতটুকু, বলা কঠিন। বাংলায় এই সময়ে সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন ব্যাখ্যা করা একটু মুশকিল। তবে, এমন হতে পারে, কেউ কেউ তা বলেওছেন, এই Calitis। কুষাণ সম্রাটদের প্রচলিত সুবর্ণমুদ্রা। কুষাণেরা যে এই সময় বারাণসী পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, এবং তাদের আধিপত্যের প্রভাব যে পূর্বভারতেও বিস্তৃতিলাভ করেছিল, এ-সম্বন্ধে অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণও বিদ্যমান।

ময়নামতিতে পাওয়া মুদ্রা

আর-এক পর্যায়ের মুদ্রা ময়নামতীতে পাওয়া গেছে, অধিকাংশই রৌপ্যমুদ্রা, সংখ্যায়। সুপ্রচুর ওজনে খুব হালকা, এবং বোধ হয় একাধিক মূল্যমানের। যত মুদ্রা পাওয়া গেছে সবই প্রকৃতিতে এতই একই রকমের যে এর ভেতর কোনও ক্রমবিবর্তন-বিবর্ধন নেই বললেই চলে, অর্থাৎ কালের কোনও চিহ্ন যেন এগুলোর ওপর মুদ্রিত নেই। এই মুদ্রগুলোর একদিকে আছে একটি বিন্দুবলয়চক্ৰ, তার ভেতরে একটি রেখাচক্ৰ; আর বাঁ দিক ঘেষে আছে একটি উপবিষ্ট বৃষমূর্তি। অন্য দিকে আছে দুটি বৃত্ত, বাইরে রেখাবৃত্ত, ভেতরে বিন্দুবৃত্ত। এফ. এ. খান এই রেখা ও বিন্দুবৃত্ত-অলংকৃত লাঞ্ছনটিকে ত্রিরত্ন কেন বলেছেন, বোঝা দুষ্কর। কতকগুলো মুদ্রার একদিকে একটি ছোট লেখ আছে; লেখটিকে কেউ কেউ পড়েছেন ‘পটিকোৰ্য বলে, কেউ কেউ পড়েছেন ‘পট্টিকের বলে। আবার অন্য কতকগুলো মুদ্রায় যে লেখাটি আছে সেটিকে “হরিকেল বলে পড়া চলে। বুঝতে কষ্ট হয় না, মুদ্রগুলো যথাক্রমে পট্টিকের ও হরিকেলের তঙ্কশালায় মুদ্রিত ও সেখান থেকে নিৰ্গত হয়েছিল। কতগুলো মুদ্রার উল্টেপিঠে “ধর্মবিজয়’, কতগুলোর উল্টেপিঠে “ললিতকরঃ’ বলে ছোট একটি লেখ আছে; ধর্মবিজয় ও ললিতকর বোধ হয় ব্যক্তিনাম বা উপাধি, হয় স্থানীয় শাসনকর্তার বা তাঙ্কশালার অধিকর্তার। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই রৌপ্যমুদ্রগুলো প্রায় সবই দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালের (দশম-একাদশ শতাব্দী)। পট্টিকের ও হরিকেল দুইই এদের রাজ্যভুক্ত ছিল। মুদ্রাগুলোতে যে লেখ আছে তার অক্ষর সাক্ষ্য আমার এ-ধারণার প্রতিকূল নয়। কিন্তু আমার এই ধারণার অন্য কারণও আছে। এ-তথ্য সুবিদিত যে, আরাকানে এক চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের রাজত্ব খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী কি তারও আগে থেকে শুরু করে অন্তত একাদশ শতাব্দীর মধ্যপাদ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। সেই সময় পাগান-রাজ আনাউরহথা (১০৪৪-১০৭৭) উত্তর আরাকান জয় ও অধিকার করেন, যার ফলে র্তার রাজ্যের পশ্চিম সীমা পট্টিকের পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই চন্দ্রবংশীয় রাজাদের শঙ্খ, বৃষ, অংকুশ, চামর, শ্ৰীবৎসচিহ্ন প্রভৃতি লাঞ্ছিত এবং রেখা ও বিন্দুচক্রালংকৃত প্রচুর রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। এই মুদ্রগুলোর মধ্যে যেগুলো প্রাচীনতর। সেগুলোর সঙ্গে প্রাচীন ফুনান, দ্বারবতী, এবং প্রাচীন পুত্ব ও মোন রাজাদের অন্যান্য রাজধানীতে প্রাপ্ত মুদ্রার আত্মীয়তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু যে মুদ্রগুলো পরবতী কালের (সেগুলো সংখ্যায় কিছু কম নয়), সেগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা লালমাই-ময়নামতীতে পাওয়া রৌপ্যমুদ্রগুলোর সঙ্গে; বৃষ লাঞ্ছন এবং রেখা ও বিন্দুচক্রালংকার প্রায় একই রকমের। আরাকানের চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের রাজধানী প্রাচীন বৈশালীতে প্রাপ্ত বহু বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য প্রতিমার সঙ্গে ময়নামতীর সাম্প্রতিক উৎখনন থেকে প্রাপ্ত প্রতিমার অনেকগুলোর সঙ্গে আশ্চর্য মিল; উভয়ক্ষেত্রেই শৈলসাক্ষ্যের ইঙ্গিতে প্রতিমাগুলোর তারিখ মোটামুটি দশম শতাব্দী।

কিন্তু মুদ্রায় সামাজিক ধনের রূপ প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে লালমাই-ময়নামতীতে পাওয়া রৌপ্যমুদ্রগুলোর রূপা ধাতুটি এল কোথা থেকে।- গুপ্তোত্তর ‘নকল’ ও হালকা ওজনের, খাদ মেশানো সুবর্ণমুদ্রার সোনা নিয়ে বড় কিছু প্রশ্ন নেই; শশাঙ্কের আমল থেকে তো এই প্রকৃতির স্বর্ণমুদ্রাই বাংলা দেশে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত। এই সোনা প্রাচীনতর, ওজনে ভারী, প্রায় নিখাদ স্বর্ণমুদ্রা থেকে অথবা সোনার তাল গলিয়ে পাওয়া সোনা। কিন্তু প্রাচীন বাংলায় রূপা এত সহজলভ্য ছিল না। এই প্রসঙ্গে মূল গ্রন্থমধ্যেই বলা হয়েছে, কিছু বিস্তৃতভাবেই গুপ্ত আমলে এবং পরে পাল আমলে রৌপ্যমুদ্রা প্রচলনের কথা। সেই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করেছিলাম। বৈগ্রাম-পট্টোলী কথিত রূপক মুদ্রার কথা, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য-সম্বন্ধের কথা, রৌপ্যের অপ্রতুলতার কথা, এবং শেষ পর্যন্ত রৌপ্যমুদ্রার একান্ত অনস্তিত্বের কথা। পাল আমলে যে কিছুটা চেষ্টা হয়েছিল রৌপ্যমুদ্রার পুনঃপ্রচলনের এবং সে চেষ্টা যে সার্থক হয়নি, সে কথাও বলেছিলাম। আজও এ কথা সত্য। কিন্তু এতে বিস্মিত হবার কারণ নেই। রৌপ্য বিদেশাগত; যে কারণেই হোক, দেশে রূপার আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং রৌপ্যমুদ্রাও অপ্রচলিত হয়ে যায়; পাল আমলের রৌপ্যমুদ্রা তো অত্যন্ত নিকৃষ্ট পর্যায়ের। সে রূপা পূর্বতন রৌপ্যমুদ্রা থেকে পাওয়া। আমার ধারণা, গুপ্তপর্বেই রূপার অপ্রতুলতা ঘটতে শুরু হয়; বস্তুত (প্রথম) কুমারগুপ্তের পর রৌপ্যমুদ্রার আর উল্লেখও নেই। বৈদেশিক বাণিজ্যে যে সব ভারতীয় তথা বাঙালী বণিকেরা লিপ্ত হতেন তারা দ্রব্য বিনিময়ে সোনা ছাড়া, সুবর্ণমুদ্রা ছাড়া আর কোনও ধাতু বা ধাতুমুদ্রা নিতে চাইতেন না; দ্বিতীয় শতাব্দীর প্লিনি এবং নবম-একাদশ শতাব্দীর আরব বণিকদের সাক্ষ্য থেকে ভারতীয় বণিকদের এই অপরূপ স্বর্ণপ্ৰিয়তার অল্পবিস্তর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুতরাং রূপা দুর্লভ বস্তু হবে, আপেক্ষিকতায় সোনার চেয়ে রূপার দাম হবে বেশি, এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। তাহলে লালমাই-ময়নামতীতে প্রাপ্ত সুপ্রচুর রৌপ্যমুদ্রার, যত হালকা ওজনেরই হোক, রূপা এল কোথা থেকে? আমার উত্তর সংক্ষিপ্ত এ রূপা এসেছে আরাকান থেকে, বৰ্মা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজাত রূপা। আরাকানের সঙ্গে ময়নামতীর ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্বন্ধ ছিল, এ-অনুমানের যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান, এবং সেই বাণিজ্যাশ্রয়েই প্রাচীন আরাকানে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির বিস্তার। লালমাই-ময়নামতীর পট্টিকের নগর ও রাজ্য সেই বাণিজ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির উৎস এবং তা অন্তত সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই।

কুষাণ ও গুপ্ত আমলের স্বর্ণমুদ্রা

কুষাণ আমলের দু-চারটি স্বর্ণমুদ্রাও বাংলায় পাওয়া গেছে। বাংলায় কখনও কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না; কাজেই অনুমান হয়, বুকুতুবপদেশে বা অন্য কোনও উপায়ে কিছু কিছু কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা বাংলায় এসে উত্তর-বঙ্গ গুপ্ত-সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল এ তথ্য সুবিদিত। সেই আমলে গুপ্ত মুদ্রারীতি বাংলায় বহুল প্রচলিত ছিল। এই মুদ্রা ছিল প্রধানতম স্বর্ণ ও রৌপ্যের; স্বন্দগুপ্তের আমলে গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার ওজন ছিল ১৪২ মাষের কাছাকাছি, এবং রৌপ্যমুদ্রার ওজন একটি রৌপ্য কাৰ্যাপণের প্রায় সমান অর্থাৎ ৩৬ মাষ। পূর্ববর্তী সম্রাটদের কালে স্বর্ণমুদ্রা ওজনে আরও কম ছিল।

যাই হোক, গুপ্ত আমলে এই দুই মুদ্রাই যে বাংলায় প্রচলিত ছিল তার লিপি-প্রমাণ প্রচুর; বিনিময়-মুদ্রা হিসাবে এই মুদ্রাই ব্যবহৃত হত। পঞ্চম থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলীগুলোতে ভূমির মূল্য দেওয়া হয়েছে (স্বর্ণ) দিনারে (denarious aureus)। প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রাই যে ছিল দিনার, তা এতেই প্রমাণিত হয়। রৌপ্যমুদ্রার নাম ছিল রূপক। দৃষ্টান্তস্বরূপ বৈগ্রাম পট্টোলীর উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই লিপি থেকেই প্রমাণ হয় যে, আটটি রূপক মুদ্রা অর্ধ-দিনারের সমান, অর্থাৎ ষোলোটিতে এক দিনার।

রৌপ্যমুদ্রার অপ্রতুলতা ও স্বর্ণমুদ্রার মান কমে যাওয়া

গুপ্তযুগে প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে (ধনাইদহ, দামোদরপুর ও বৈগ্রাম পট্টোলীর কালে) এক স্বর্ণ দিনারের ওজন ছিল ১১৭-৮ হতে ১২৭-৩ মাষ পরিমাণ, এবং এক রূপকের ওজন ছিল ২২.৮ হতে ৩৬.২ মাষ পরিমাণ। এখান থেকে সোনার সঙ্গে রূপার আপেক্ষিক সম্বন্ধের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাতে মনে হয়, রূপার আপেক্ষিক মূল্য সোনার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার সন্দেহ নেই, কিন্তু এর কারণ বর্তমানে যে ঐতিহাসিক উপাদান আমাদের হাতে আছে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। হতে পারে, দেশে রৌপ্যের অপ্রতুলতাই এর কারণ, অথবা কোনও-না-কোনও কারণে দেশে রৌপ্যের আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অথবা পট্টোলীগুলোর মধ্যে আমরা যে স্বর্ণ দিনারের উল্লেখ দেখি তার যথার্থ স্বর্ণমূল্য (intrinsic value) অনেক কম ছিল, অর্থাৎ সুবর্ণমুদ্রার স্বর্ণগত অবনতি ঘটেছিল (debasement)।

দেখা যায়, গুপ্ত আমলের অব্যবহিত পরেই বাংলায় যখন স্ব স্ব প্রধান ছোট ছোট রাজবংশের স্বতন্ত্র আধিপত্য চলছে তখন রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন একবারে নেই, অথচ স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন অব্যাহত, এবং এই স্বর্ণমুদ্রার যথার্থ মূল স্বর্ণমূল্য থেকে অনেক কম; এটি অবনত (debased) স্বর্ণমুদ্রা, যদিও ওজনে তা কমেনি। বাংলার বহু স্থানে কিছু কিছু গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। তার কিছু সাধারণ সরকারী গ্রন্থশালায় রক্ষিত, কিন্তু ব্যক্তিগত সংগ্রহে যা আছে তার সংখ্যাও কম নয়।

  • ১৭৮৩ খ্ৰীষ্টাব্দে কালীঘাটে প্রায় ২০০ (গুপ্ত?) সুবর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছিল। কিন্তু তার অধিকাংশই গলিয়ে ফেলা হয়েছিল।
  • গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে যশোহরের মহম্মদপুরে, হুগলিতে ও হুগলি জেলার মহানাদে।
  • গুপ্ত রৌপ্য ও তাম্র-মুদ্রা পাওয়া গেছে যশোহরের মহম্মদপুরে, বর্ধমান জেলার কাটোয়ায়।
  • ‘নকল গুপ্তমুদ্রা পাওয়া গেছে ওপরোক্ত মহম্মদপুরে, ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায়, ঢাকা জেলার সাভার গ্রামে এবং রংপুরে।
  • বাংলার নানা জায়গায় শশাঙ্ক, জয় নাগ, সমাচার দেব এবং অন্যান্য রাজার নামাঙ্কিত এই ধরনের কিছু কিছু সুবর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়, রৌপ্যমুদ্রা একেবারেই নেই।

কড়ির ব্যবহার

আশ্চর্যের বিষয় এই গুপ্ত আমলেও, যখন স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা বহুল প্রচলিত, তখনও মুদ্রার নিম্নতম মান কিন্তু কড়ি।

  • ৪র্থ শতকে ফা হিয়েন বলছেন, লোকে ক্রয়বিক্রয়ে কড়িই ব্যবহার করত, এবং নিম্নতম মান কড়ি একেবারে ১৯শ শতক পর্যন্ত কোনও দিনই ব্যবহারের বাইরে চলে যায়নি।
  • চর্যাপদ (১০ম-১১শ শতকগুলোতে) দেখা যায়, কবাডি (কড়ি) এবং বোডির (বুড়ি) ব্যবহার।
  • মিনহাজ উদ্দীন তুরস্কাভিযানের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, অভিযাত্রী তুরষ্কেরা বাংলার কোথাও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন দেখতে পাননি; সাধারণ ক্রয়-বিক্রয়ে লোকে কড়িই ব্যবহার করত।
  • এমন-কি রাজাও যখন কাউকে কিছু দান করতেন, কড়ি দিয়েই করতেন; লক্ষ্মণসেনের নিম্নতম দান ছিল এক লক্ষ কড়ি।
  • ১৩শ শতকেও কড়ির প্রচলনের সাক্ষ্য অন্য জায়গায়ও পাওয়া যায়।
  • ১৫শ শতকে মা-হুয়ান একই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এবং বিদেশী পর্যটকদের সাক্ষ্যও একই প্রকার।
  • এমন-কি, ১৭৫০ খ্ৰীষ্টাব্দে ইংরেজ বণিকেরাও দেখেছেন, কলকাতা শহরে কর আদায় হত কড়ি দিয়ে। বাজারে অনেক ক্ৰয়-বিক্রয়ও কড়ির সাহায্যেই হত।

পালযুগে মুদ্রার মানের অবনতি

যাই হোক, মাৎস্যন্যায় পর্বের শেষে পাল রাজারা যখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হলেন এবং শান্তি ও সুশাসন ফরে এলো তখন আবার দেশে রৌপ্যমুদ্রার (এবং সঙ্গে সঙ্গে তাম্রমুদ্রার) প্রচলন যেন ফিরে এলো। কিন্তু স্বর্ণমুদ্রা আর ফিরল না। স্বর্ণমুদ্রার ক্রমশ অবনতি ঘটতে ঘটতে শেষে যেন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেল। বস্তুত, পাল রাজা ও সেন রাজাদের আমলের একটি স্বর্ণমুদ্রাও বাংলায় কোথাও আবিষ্কৃত হয় নি, কিংবা সমসাময়িক সাহিত্যে কোথাও তার কোনও উল্লেখও নেই। ৭ম শতকের পর থেকেই স্বর্ণ-দিনার বা যে-কোনও প্রকার স্বর্ণমুদ্রা একেবারে অনুপস্থিত। এসময়কার আবিষ্কৃত রৌপ্যমুদ্রা ও তাম্রমুদ্রার নমুনা –

  • বাংলা ও বিহারের কোথাও কোথাও “শ্ৰী বিগ্রহ” নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে; কোথাও কোথাও ঐ নামাঙ্কিত বা কোনও নামাঙ্কন ছাড়া পালযুগীয় তাম্রমুদ্রাও পাওয়া গেছে (যেমন, পাহাড়পুরে)।
  • “শ্ৰী বিগ্রহ” নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রাগুলো পালরাজ প্রথম বিগ্রহপালের সময়কার ও নিকৃষ্ট তাম্রমুদ্রগুলো দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিগ্রহপালের আমলেরও হতে পারে, এমন-কি সমসাময়িক বা পরবর্তী “অন্য কোনও রাজারও হতে পারে। ঐ নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা সাধারণত দ্রাহ্ম (drachm) নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
  • ধর্মপালের মহাবোধি লিপিতে দ্রাহ্ম নামক একপ্রকার মুদ্রার উল্লেখ আছে; এই উল্লেখই পাল আমলে দ্রাহ্মী মুদ্রার প্রচলনের প্রমাণ।
  • উক্ত রাজার রাজত্বের ষোলো বছরে কেশর নামক এক ব্যক্তি তিন হাজার দ্রাহ্ম মুদ্রা খরচ করে (ত্রিতয়েন সহস্ৰেণ দ্রাহ্মাণাং খানিতা) একটি পুকুর খনন করেছিলেন।

স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন তো ছিলই না, এবং আবিষ্কৃত মুদ্রগুলো থেকে মনে হয়, রৌপ্যমুদ্রারও যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল। যে অবনতি গুপ্ত-পরবর্তী যুগে দেখা গিয়াছিল, পাল রাজারাও সেই অবনতি ঠেকাতে পারেননি; এমনকি আবিষ্কৃত তাম্রমুদ্রাগুলোও মূল মূল্য বা আকৃতি বা শিল্পীরূপের দিক থেকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট। ভাস্করাচার্যের (১০৩৬ শক = ১১১৪ খ্ৰী) লীলাবতী-গ্রন্থে একটি আর্য আছে; কুড়ি কড়া বা কড়িতে এক কাকিনী, চার কাকিনীতে এক পণ, ষোলো পণে এক দ্রাহ্ম (রৌপ্যমুদ্রা), ষোলো দ্রহ্মে এক নিষ্ক। অমরকোষের মতে এক নিষ্ক এক দিনারের সমান, অর্থাৎ ষোলো দ্রহ্মে এক দিনার অর্থাৎ ষোলো দ্রাহ্ম – ষোলো রূপক। দ্রাহ্ম যে রৌপ্যমুদ্রা তা হলে এ সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ থাকল না। কিন্তু রৌপ্যমুদ্রা হলে কী হবে, পাল রৌপ্যমুদ্রা যা পাওয়া গেছে তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের; মূল মূল্য (intrinsic value) এবং বাহ্যরূপ উভয় দিক থেকেই নিকৃষ্ট।

সেন আমলে মুদ্রাব্যবস্থার অবনতি

সেন আমলে কিন্তু তাও নাই। স্বর্ণমুদ্রা তো দূরের কথা, রৌপ্যমুদ্রাও একেবারে অন্তর্হিত। বস্তুত, ধাতুমুদ্রা প্রচলনের একটা চেষ্টা পাল আমলে যদিও বা ছিল, সেন আমলে তাও দেখা যায় না। এই আমলে দেখা যায়, ঊর্ধ্বতম মুদ্রামান পুরাণ বা কপর্দক পুরাণ। এই পুরাণ বা কপর্দক পুরাণের একটিও বাংলায় কোথাও আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। সেজন্যই এই মুদ্রার রূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অনুমান ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কেউ কেউ বলেন, যে পুরাণ মুদ্রার আকার ছিল কপর্দক বা কড়ির মত, সেই মুদ্রাই কপর্দক পুরাণ। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর মহাশয় এমনটাই মনে করেন এবং বলেন কপৰ্দক পুরাণ রৌপ্যমুদ্রা। এমনটা মনে করার কারণ এই যে, পুরাণ ৩২ রতি বা ৫৮ মাষ পরিমাণের সুবিদিত রৌপ্যমুদ্রা বলে নানা গ্রন্থে কথিত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, প্রায় প্রত্যেকটি লিপিতেই শত শত পুরাণ-মুদ্রার উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত বাংলায় একটিও পুরাণ-মুদ্রা পাওয়া গেল না কেন? এবং অন্যদিকে, মিনহাজই বা কেন বলছেন, তুর্কিরা রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন দেখেনি, হাটবাজারে কড়িরই প্রচলন ছিল? এমনকি রাজার দানমুদ্রাও ছিল কড়ি! এ রহস্যের অর্থ কি এই যে, কপর্দক পুরাণ বা পুরাণ বলে যথার্থত কোনও ধাতু-মুদ্রার অস্তিত্বই সেন আমলে ছিল না, আন্তর্দেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যে মুদ্রার উর্ধ্বতম ও নিম্নতম উভয় মানই ছিল কড়ি? অথবা, কপর্দক-পুরাণ ছিল একটা কাল্পনিক রৌপ্যমুদ্রা মান, এবং এক নির্দিষ্ট সংখ্যক কড়ির মূল্য ছিল সেই রৌপ্যমানের সমান? বহির্বাণিজ্য এবং পরদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্যই কি এইরূপ মান নির্ধারণের প্রয়োজন ছিল? বোধ হয় তাই। সুরেন্দ্ৰকিশোর চক্রবর্তী নানা অনুমানসিদ্ধ প্রমাণের সাহায্যে এই ধরনের ইঙ্গিতই করছেন, বলছেন, “…Payments were made in cowries and a certain number of them came to be equated to the silver coin, the purana, thus linking up all exchange transactions ultimately to silver, just as at present, the silver coin is linked up to gold at a certain ratio.”

মুদ্রার অবনতির ব্যাখ্যা ও ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ

গুপ্তযুগের পর অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৭ম শতক থেকেই মুদ্রার, বিশেষভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার, এমন অবনতি ঘটল কেন, এই প্রশ্ন অর্থনীতিবিদ এবং ঐতিহাসিক উভয়ের সামনেই উপস্থিত করা যেতে পারে। প্রথমাবস্থায় স্বর্ণমুদ্রার অবনতি ঘটল, কিছুদিন গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার নকলও চলল এবং তারপর একেবারে অন্তৰ্হিত হয়ে গেল! রৌপ্যমুদ্রা ৭ম শতকেই একবার অন্তহিঁত হয়ে গিয়েছিল, তবে পাল আমলে আবার তার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা দেখা যায়, কিন্তু সে চেষ্টা সার্থক হয়নি। সেন আমলে তা আর তা দেখাই গেল না, এমন-কি তাম্রমুদ্রাও নয়। গুপ্ত আমলে স্পষ্টত স্বর্ণই ছিল অর্থমান নির্দেশক, পাল আমলে রৌপ্য; সেন আমলেও রৌপ্য ছিল বলা হচ্ছে যদিও সেই রৌপ্য দৃশ্যত অনুপস্থিত। নিম্নতম মান কড়ি সব সময়ই ছিল, এবং ছোটখাটো কেনাবেচায় ব্যবহারও হত, কিন্তু অর্থমান নির্ণীত হত সোনা বা রূপায়। সেন আমলে কড়িই মনে হচ্ছে সর্বেসর্ব। মুদ্রার এই ক্রমাবনতি কি দেশের সাধারণ আর্থিক দুৰ্গতির দিকে ইঙ্গিত করে? না, রাষ্ট্রের স্বর্ণের ও রৌপ্যের গচ্ছিত মূলধনের স্বল্পতার দিকে ইঙ্গিত করে? মুদ্রার প্রচলন কি কমে গিয়েছিল? স্বর্ণমুদ্রার অবনতি এবং বিলুপ্তি হয়তো Gresham Law দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়; রৌপ্যমুদ্রার অবনতিও কি সেই কারণে? যে ব্যাবসা-বাণিজ্যের ওপর, বিশেষ করিয়া বহির্বাণিজ্যের ওপর, প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধি নির্ভর করত, তার অবনতি ঘটিয়াছিল কি? সোনা ও রূপার অভাব ঘটেছিল কি? রাজকোষে সমস্ত সোনা ও রূপা সঞ্চিত হচ্ছিল কি?

সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আজও হয়তো সম্ভব নয়। তবে কিছু কিছু তথ্য ও তথ্যগত অনুমান উল্লেখ করা যেতে পারে। গুপ্ত রাজাদের আমলের পর থেকেই, এমন-কি শশাঙ্কের আমলেই, বাংলার রাষ্ট্ৰীয় অবস্থায় গুরুতর চাঞ্চল্য দেখা গিয়েছিল। প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ চলছিল। তারপর তো প্রায় সুদীর্ঘ এক শতাব্দীরও ওপর দুরন্ত মাৎস্যন্যায়ের অপ্ৰতিহত রাজত্ব চলেছে; অন্তর্বাণিজ্য-বহির্বাণিজ্য দুইই খুবই বিচলিত হয়েছিল সন্দেহ নেই, এবং সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিও খানিকটা শিথিল হয়েছিল। এই অবস্থায় স্বর্ণমুদ্রার অবনতি ঘটা অস্বাভাবিক নয়, নকল মুদ্রা চলাও অস্বাভাবিক নয়। আর, রৌপ্যমুদ্রার অবনতিও একই কারণে হয়ে থাকতে পারে। রূপা বাংলার কোথাও পাওয়া যায় না; এও হতে পারে যে, বিদেশ থেকে রূপার আমদানি কোনও কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পালসাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সুবিস্তৃত হবার পরও স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ঘটল না কেন, রৌপ্যমুদ্রাই বা সগৌরবে ও যথার্থ মূল্যে প্রতিষ্ঠিত হল না কেন, এই প্রশ্ন সন্দেহের সৃষ্টি করে বৈকি। পালরাজাদের আদান-প্ৰদান ও যোগাযোগ ছিল উত্তর-ভারত জুড়ে এবং হয়তো দক্ষিণ-ভারতেও; সমসাময়িক কালে অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনও ছিল অল্পবিস্তর। আনুমানিক ১১শ শতকে জনৈক বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণ কামরূপের রাজা জয়পালের কাছ থেকে (হোন্নাম শতানি নবী) নয়শো স্বর্ণমুদ্রা দান গ্রহণ করেছিলেন, সিলিমপুর লিপিতে এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অথচ, বাংলায় তখন স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন একেবারে নেই, পরেও নেই। পাল ও সেন-বংশের মত সমৃদ্ধ ও সচেতন রাজবংশ স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনে প্ৰয়াসী হলেন না কেন? বৈদেশিক বাণিজ্যের মধ্যে কি এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে?

খ্রীষ্টীয় ৮ম শতকের প্রারম্ভেই আরব মুসলমানেরা সিন্ধুদেশ অধিকার করে। এদের পূর্বমুখী অভিযান আগেই আরম্ভ হয়েছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমমুখী অভিযানও চলছিল। দেখতে দেখতে তারা একদিকে স্পেন ও অন্যদিকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত নিজেদের রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব এবং চীনদেশ পর্যন্ত বাণিজ্যপ্ৰভুত্ব বিস্তার করে। ভূমধ্যসাগর থেকে আরম্ভ করে ভারত-মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপগুলো পর্যন্ত যে সামুদ্রিক বাণিজ্য ছিল একসময় রোম ও মিশর-দেশীয় বণিকদের করতলগত, সেই সুবিস্তৃত বাণিজ্য-ভার চলে যায় আরব বণিকদের হাতে। অবশ্য একদিনে তা হয়নি। ৭ম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই বিবর্তনের সূত্রপাত এবং ১২শ-১৩শ শতকে এসে চরম পরিণতি। সংক্ষেপে একথা বলা যায়, এই সুবৃহৎ বাণিজ্যে উত্তর-ভারতীয়দের যে অংশ ছিল তা ক্রমশ খর্ব হতে আরম্ভ করে। প্রথম পশ্চিম-ভারতের বন্দরগুলো চলে যায় আরবদেশীয় বণিকদের হাতে, এবং পরে পূর্ব-ভারতের। দক্ষিণ-ভারতীয় পল্লব, চোল ও অন্য ২/১ টি রাজ্য প্রায় ১৪শ শতক পর্যন্ত সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছিল, কিন্তু পরে তাও চলে যায়। মুঘল আমলে তো প্রায় সমস্ত ভারতীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যটাই আরব ও পারস্যদেশীয় বণিকদের হাতে ছিল; সেই বাণিজ্য নিয়েই তো পরে পর্তুগীজ-ওলন্দাজ-দিনেমার-ফরাসী-ইংরেজদের মধ্যে কাড়াকড়ি মারামারি।

বাংলার পূর্বের সামুদ্রিক বাণিজ্য ও তাম্রলিপ্তি

সামুদ্রিক বাণিজ্য থেকে প্রাচীন বাংলায় প্রচুর অর্থাগম হত। গঙ্গাবিন্দর ও তাম্রলিপ্তি থেকে জাহাজ বোঝাই হয়ে মাল বিদেশে রপ্তানি হত, এবং তার বদলে দেশে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা আমদানি হত। এই স্বর্ণ রোমক দিনার এবং রৌপ্য রোমক দ্রাহ্ম হওয়াই সম্ভব। খ্ৰীষ্টপূর্ব শতক থেকেই এই সমৃদ্ধির সূচনা দেখা গিয়েছিল এবং সমানে চলছিল প্রায় খ্রিস্টীয় ৭ম শতক পর্যন্ত। কিন্তু তারপরেই এই সমৃদ্ধ বাণিজ্যস্রোতে যেন ভাটা পড়ে যায়, ভারতীয় দ্রব্যসম্ভারের কাছে পশ্চিমের সুবিস্তৃত হাট বন্ধ হয়ে যায়। যখন আবার সেই হাট খুলল তখন বাণিজ্যকর্তৃত্ব চলে গেছে আরব বণিকদের হাতে এবং সেই হাটেরও চেহারা বদলে গেছে। পশ্চিমের বাজারে যেসব জিনিসের চাহিদা ছিল তাও অনেক কমে গেছে। অন্তত এই সুসমৃদ্ধ বাণিজ্যে বাংলার যে অংশ ছিল তা যে খর্ব হয়ে গেছে, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই।

বাংলার প্রধান বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি; সেই তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যসমৃদ্ধির কথা সকলের মুখে মুখে, পুঁথির পাতায় পাতায়। ৭ম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙ ও ইৎসিঙ তাম্রলিপ্তির সমৃদ্ধির বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সামুদ্রিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে বা কোনও হিসাবেই তাম্রলিপ্তির উল্লেখ ৮ম শতকের পর আর পাওয়া যায়না। নদীর ওপরে ছিল তাম্রলিপ্তির অবস্থিতি পলি পড়ে পড়ে সেই নদীটির মুখ বন্ধ হয়ে যায় অথবা নদীটি খাত পরিবর্তন করে। তাম্রলিপ্তির সৌভাগ্য-সূর্য অস্তমিত হয়, এবং আশ্চর্য এই, ৮ম থেকে ১৫শ শতক পর্যন্ত বাংলায় আর কোথাও সামুদ্রিক বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। ১৪শ শতকে দেখা যায়, সরস্বতী-তীরবর্তী সপ্তগ্রাম তাম্রলিপ্তির স্থান অধিকার করছে এবং পূর্ব-দক্ষিণতম বাংলায় নতুন দুটি বন্দর বেঙ্গলী ও চট্টগ্রাম গড়ে উঠছে। সত্যই এই সুদীর্ঘ ছয়-সাত শত বছর সামুদ্রিক বাণিজ্যে বাংলার বিশেষ কোনও স্থান নেই। এবং সেই সেজন্য বাইরে থেকে সোনারূপার আমদানিও কম।

বাংলার বাণিজ্যিক অবস্থার অবনতি

ভারতের অন্তর্বাণিজ্যে বাংলার অংশ নিঃসন্দেহে আছে; বাংলা বিদেশে ও ভারতবর্ষে তার বস্ত্ৰসম্ভার, চিনি, গুড়, লবণ, নারিকেল, পান, সুপারি ইত্যাদি রপ্তানি করছে প্রচুর, কিন্তু তার নিজস্ব কোনও সামুদ্রিক বন্দর নেই; যেটুকু তার অংশ তা শুধু আন্তর্দেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যে। সেই সূত্রে সোনারূপার দাম সে পাচ্ছে কি না বলা কঠিন, পেলেও বোধহয় তা আগেকার মতো আর লাভজনক নয়, সুপ্রচুরও নয়। স্বর্ণ-দ্বারা অর্থমান নির্ণয় করার মত ইচ্ছা বা অবস্থা পরবর্তী পাল বা সেন রাষ্ট্রের আর নেই তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। অথবা, যেহেতু বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্য তাদের আর নেই, তাই স্বর্ণমানের প্রয়োজনও নেই। অথচ ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে দেখছি, সাধারণ গৃহস্থও ভূমি কেনাবেচা করছেন স্বর্ণমুদ্রার সাহায্যে। সেন আমলের শেষ পর্যন্ত অন্তত স্বীকারত রৌপ্যই হয়তো অর্থমান-নিৰ্ণক, কিন্তু তারপরও পাল আমলে রৌপ্যমুদ্রার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, সেন আমলে মৃত। ভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে আদানপ্রদানের জন্যই হয়তো রৌপ্যমান বজায় রাখার প্রয়োজন হয়েছিল। মুদ্রার অবস্থা যাই হোক, এ তথ্য অনস্বীকার্য যে, ৮ম শতক ও তার পর থেকেই ভারতীয় সামুদ্রিক বহির্বাণিজ্যে বাংলার আর কোনও বিশেষ স্থান ছিল না, এবং অন্তর্বাণিজ্যে অল্পবিস্তর আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও বণিককুল ও ব্যবসায়ীদের সমাজে ও রাষ্ট্রে সে প্রভাব ও প্রতিপত্তি আর থাকে নি। ৮ম শতক থেকে দেখা যায় বঙ্গীয় সমাজ ক্রমশ কৃষিনির্ভর হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে, এবং কৃষকেরাই সমাজদৃষ্টির সামনে এসে পড়েছে, সঙ্গে এও দেখা যায়, বণিক ও ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিপত্তি হ্রাস পেয়েছে। রাষ্ট্রের অধিষ্ঠানাধিকরণগুলোতে শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, কুলিক ও ব্যাপারী প্রভৃতিদের যে আধিপত্য পঞ্চম, ষষ্ঠ ও ৭ম শতকে দেখা যায় ৮ম শতকে ও তারপর আর তা নেই।

বহির্বাণিজ্যের দ্বারাই কেবল মুদ্রার অবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায়না

কিন্তু স্বর্ণমুদ্রার অনস্তিত্ব এবং রৌপ্যমুদ্রার অবনতি ও অনস্তিত্ব শুধু বহির্বাণিজ্যের অবনতি ও বিলুপ্তি দ্বারা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পাল ও সেন আমলে খুব যে নেমে গেছিল তা মনে হয় না। এই দুই আমলের লিপিগুলো এবং সমসাময়িক সাহিত্য রামচরিত, পবনদূত, গীতগোবিন্দের মত কাব্য, সদুক্তিকর্ণামৃতের মত সংলকন-গ্রন্থে উদ্ধৃত সমসাময়িক বাঙালী কবিদের রচনা পাঠ করলে, নানা বিচিত্ৰ অলংকারশোভিত মূর্তিগুলো দেখলে, অসংখ্য সুদৃশ্য সুউচ্চ মন্দির-রচনার কথা স্মরণ করলে, যাগযজ্ঞে পূজানুষ্ঠানে রাজারাজড়া এবং অন্যান্য সমৃদ্ধ লোকদের দানধ্যানের কথা স্মরণ করলে মনে হয় না লোকের, অন্তত সমাজের উচ্চতর আর্থিক শ্রেণীগুলোর, ধনসমৃদ্ধির কিছু অভাব ছিল। মণিমুক্তাখচিত সোনারূপার অলংকারের যেসব পরিচয় লিপিগুলোতে, সমসাময়িক সাহিত্যে এবং শিল্পে পড়া ও দেখা যায় তাতে তো মনে হয় সোনারূপাও দেশে যথেষ্ট ছিল। তারপরও এই দুই রাজবংশ স্বর্ণমুদ্রা, এমনকি সেনরাজারা রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করলেন না। আন্তর্ভারতীয় বাণিজ্য এবং অন্যান্য ব্যাপারে কিসের সাহায্যে নিষ্পন্ন হত? ভিনদেশীরা তো নিশ্চয়ই কড়ি গ্রহণ করতেন না। রাষ্ট্রকে বিনিময়ে সোনা ও রূপা নিশ্চই দিতে হত। সেন আমলে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা কিছুই তো ছিল না; তবে কি বিনিময় ব্যাপারটা সােনা বা রূপার তালের সাহায্যে নিষ্পন্ন হত? রাজকোষে যে অর্থ সঞ্চয় হত তাও কি সোনা ও রূপার তাল? আন্তর্ভারতীয় বাণিজ্য, ভিনদেশীর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন প্রভৃতি কি রাষ্ট্রের মারফতে বা মধ্যবর্তিতায় নিষ্পন্ন হত? মুদ্রা-সংক্রান্ত এসব অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর ঐতিহাসিক গবেষণার বর্তমান অবস্থায় একরূপ অসম্ভব বললেই চলে।

শ্রেণী বিণ্যাস

ভূমিকা

বিভিন্ন শ্রেণী

প্রাচীন বাংলার সমাজ যেমন বিভিন্ন বর্ণে তেমনই বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সামাজিক ধনের উৎপাদন ও বণ্টনানুযায়ী সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব ও স্তরভেদ দেখা দেয়। যে-সমাজের উৎপাদিত ধনের ওপর সকলের সমান অধিকার, ব্যক্তিগত ধনাধিকার যে-সমাজে স্বীকৃত নয়, সেই সমাজে শ্রেণী-বিন্যাসের প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু, প্রাচীন বাংলার সমাজে ব্যক্তিগত ধনাধিকার যেমন আজকের মতোই স্বীকৃত হত— সমগ্ৰ ভারতবর্ষেই হত, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও হত— তেমনই অস্বীকৃত হত উৎপাদিত ধনের ওপর সকলের সমান অধিকার। বস্তুত, বহু প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষের অধ্যাত্মচিন্তায় অন্নের ওপর সকলের সমানাধিকার, অর্থাৎ সকলেরই খেঁয়ে বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকৃত হলেও, বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে সামাজিক ধনের ওপর সকলের সমানাধিকার কখনও স্বীকৃত হয়নি। বিংশ শতকের আগে মঠ-মন্দির- বিহার-সংঘারাম ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এই স্বীকৃতি ছিল না। কৌম সমাজের ধনসাম্য-ব্যবস্থার কথা বাদ দিলে, ঐতিহাসিক পর্বে ব্যক্তিগত ধনাধিকারবাদ স্বীকৃতির ওপরই ছিল প্রাচীন সমাজের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ধন উৎপাদন যারা করতেন তারাই যে উৎপাদিত ধন ভোগ করতে পারতেন তা নয়।

ধনোৎপাদনের উপায়

সামাজিক ধন কারা বেশি ভোগ করতেন, কারা কম করতেন, কারা কায়ক্লেশে জীবনধারণ করতেন, কিংবা উৎপাদিত ধন একেবারেই ভোগ করার সুযোগ পেতেন না, তা নির্ভর করত উৎপাদিত ধনের বণ্টন ব্যবস্থার ওপর। এই বণ্টন কারা করতেন? প্রাচীন বাংলায় ধনোৎপাদনের ছিল তিন উপায়— কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য। কৃষি ও ব্যাবসা-বাণিজ্যই এই তিন উপায়ের মধ্যে ধনাগমের প্রধান দুই উপায় ছিল বলে মনে হয়। কৃষি ভূমিনির্ভর; ভূমির ব্যক্তিগত অধিকার এবং ব্যক্তিগত অধিকারের ওপর রাষ্ট্রের অধিকার প্রাচীন বাংলায় স্বীকৃত ছিল। কাজেই, কৃষিদ্রব্য ক্ষেত্রকর বা কার্যকরা উৎপাদন করলেও বণ্টন ব্যবস্থাটা ছিল ভূম্যধিকারী এবং রাষ্ট্রের হাতে। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বণিকদের হাতে, শিল্প ছিল শিল্পীদের হাতে; এই দুই উপায়ে উৎপাদিত অর্থের বণ্টন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ এদের হাতে না থাকলেও— খানিকটা তো রাষ্ট্রের হাতে ছিলই- অধিকাংশ এদেরই করায়ত্ত ছিল। ধনোৎপাদনের তিন উপায় অবলম্বন করে স্বভাবতই বাংলায় তিনটি শ্রেণী গড়ে উঠবে, এটি কিছু আশ্চর্য নয়; এবং উৎপাদিত ও বণ্টিত ধনের তারতম্যানুযায়ী প্রত্যেক শ্রেণীতে নানা স্তর থাকবে তাও আশ্চর্য নয়।

বর্ণপ্রথার সাথে সম্পর্ক

কিন্তু, সমাজে এমন বহু লোক বাস করে যারা ধন উৎপাদন করে না, বণ্টনের অধিকারও যাদের নেই। ধন উৎপাদন ও বণ্টন ছাড়াও সমাজের অনেক কর্তব্য আছে যা সমাজের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় এবং কল্যাণকর। এসব কর্তব্যের তালিকা সুদীর্ঘ; রদের একপ্রান্তে যেমন মিলবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মকর্ম, শিল্পকলা, ভাষা-সাহিত্য, এক কথায় সমাজের মানস-জীবনের নায়কদের, শিক্ষা ও ধর্মজীবীদের, তেমনই অন্যপ্রান্তে পাওয়া যাইবে সমাজের অঙ্গ-নিৰ্গত আবর্জনা-পরিষ্কারক রাজক-চণ্ডাল-বাউড়ী-পোদ-বাগদী ইত্যাদিদের। এখানেই এসে পড়ে সমাজের বর্ণ-বিন্যাসের কথা, এবং শ্রেণী-বিন্যাসের সঙ্গে তা জড়িয়ে যায়। বস্তুত, ভারতীয় সমাজে বর্ণ ও শ্রেণী অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, একটিকে আর একটি থেকে পৃথক করে দেখার উপায় নেই; বাংলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৃত্তি বা জীবিকা বর্ণনির্ভর, এবং বর্ণ জন্মনির্ভর। বিশেষ বর্ণের কেউ নির্ধারিত বৃত্তির সীমা অতিক্রম করত না এমন নয়, কিন্তু তা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম; অধিকাংশ লোক নিজ নিজ বৃত্তিসীমা রক্ষা করেই চলতেন। ব্রাহ্মণ থেকে আরম্ভ করে অস্ত্যজ চণ্ডাল পর্যন্ত অগণিত স্তরের অগণিত বৃত্তি এবং বৃত্তি অনুযায়ী যেমন বর্ণের সামাজিক মর্যাদা, তেমনই বর্ণনুযায়ী বৃত্তির নির্দেশ। বৃত্তি বা জীবিকা যেখানে বর্ণ অনুযায়ী সেখানে বর্ণ ও শ্রেণী একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে, এটি বিচিত্র কিছু নয়, এবং শ্রেণীর মর্যাদাও সেই সমাজে বর্ণ ও বৃত্তি অনুযায়ী হবে তাও বিচিত্র নয়। উৎপাদিত ধন উৎপাদক ও বণ্টকেরা তো ভোগ করতই, বিশেষভাবে করত উৎপাদন ও বণ্টন যারা নিয়ন্ত্ৰণ করত তারা, যারা তাদের সহায়ক ও সমর্থক ছিল তারা, এবং সমাজের অন্যান্য বিচিত্র কর্তব্যে যারা নিয়োজিত ছিল তারাও। সমানাধিকারবাদের স্বীকৃতি যখন ছিল না, তখন সকলে সমভাবে সামাজিক ধন ভোগ করতে পারত না, তাও স্বাভাবিক। তার ওপর এই বণ্টন আবার নিয়মিত হত বর্ণ ও বৃত্তির মর্যাদানুযায়ী; কাজেই, ধনোৎপাদনের প্রধান তিন উপায়ানুযায়ী তিনটি শ্রেণী ছাড়া আরও অনেক অর্থনৈতিক শ্রেণী থাকবে তা অস্বাভাবিক নয়।

শ্রেণীর বিবর্তন

সব শ্রেণী-উপশ্রেণী একসঙ্গে গড়ে উঠেছিল এমন মনে করার কারণ নেই; সমাজের গঠন-বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, সমাজকর্মের জটিলতা ও কর্মবিভাগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণী-উপশ্রেণীর সংখ্যা বেড়েছে, এটাই যুক্তিসঙ্গত অনুমান। তবে, এই অনুমান অনেকটা নিঃসংশয়ে করা চলে যে, খ্ৰীষ্টপূর্ব শতকগুলোতেই ধনাগমের পূর্বোক্ত তিন প্রধান উপায় অবলম্বন করে তিনটি প্রধান শ্রেণী প্রাচীন বাংলায় গড়ে উঠেছিল। সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই, কিন্তু ষষ্ঠ-পঞ্চম-চতুর্থ খ্ৰীষ্টপূর্ব শতকগুলোতে প্রতিবেশী অঙ্গ-মগধের সাক্ষ্য যদি আংশিকভাবেও পুণ্ড্র-রাঢ়-সুহ্ম-বঙ্গ সম্বন্ধে প্রযোজ্য হয়, এবং এই সব জনপদের কৃষি-শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি সম্বন্ধে যদি সমসাময়িক সাক্ষ্য প্রমাণিক হয়, তাহলে এই অনুমান অস্বীকার করা যায় না। তবে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকেই এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়; তার আগে সবটাই অনুমান। পঞ্চম শতক-পরবর্তী বাংলার লিপিমালা পূর্বোক্ত অনুমান সমর্থন করে এবং সদ্যকথিত তিনটি ও অন্যান্য শ্রেণীগুলো যে তার আগেই তাদের বিশেষ বিশেষ বৃত্তি নিয়ে কোথাও অস্পষ্ট, কোথাও সুস্পষ্ট সীমারেখায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার কিছু কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যায়।

বিভিন্ন উপাদান

প্রধাণ উপাদান

শ্ৰেণী-বিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের প্রধান উপকরণ ভূমিদান-বিক্রয়ের পট্টোলী, এবং সমর্থক ও আনুষঙ্গিক উপকরণ–পাল ও সেন আমল— সমসাময়িক সাহিত্য, বিশেষভাবে বৌদ্ধ, চর্যাগীতি, বৃহদ্ধৰ্মপুরাণ, ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ ও বাংলার স্মৃতিগ্রন্থগুলো।

মৌর্য আমলের মহাস্থান শিলাখণ্ড লিপি, শুশুনিয়া লিপি

মহাস্থান শিলাখণ্ড লিপি বা চন্দ্ৰবৰ্মার শুশুনিয়া লিপি আমাদের বিশেষ কোনও কাজে লাগছে না। যদি অনুমান করা যায় যে, মৌর্যকালে বাংলা বা তার কিছু অংশ মৌর্য সম্রাটদের করতলগত ছিল এবং মৌর্যশাসন-পদ্ধতি এ দেশেও প্রচলিত ছিল, তাহলে ধরে নিতে হয় যে, মৌর্যরাষ্ট্রে আমরা যেসব রাজপুরুষদের পরিচয় অশোকের লিপিমালা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মেগাস্থিনিসের ইণ্ডিকা-গ্রন্থ থেকে পাই, সেসব রাজপুরুষেরা এদেশেও বিদ্যমান ছিল, এবং মৌর্য প্রাদেশিক-শাসনের যন্ত্র পুদনগলের (পুণ্ড্রনগরের) মহামাত্যের নির্দেশে বাংলায়ও পরিচালিত হত। কিন্তু তবুও এই অনুমান বা প্রমাণ থেকে আমরা একমাত্র রাজপুরুষশ্রেণী বা সরকারি চাকুরিজীবী ছাড়া আর কোনও শ্রেণীর খবর পেলাম না।

মৌর্য পরবর্তী যুগ, উত্তরভারতের লিপি যেমন শুদ্রকের মৃচ্ছক, সীচীর শিলালিপি

পরবর্তী যুগেও কিছুটা তাই; উত্তর-ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সমসাময়িক লিপিগুলোর বেশিরভাগই তো রাজরাজড়ার বংশপরিচয় ও যুদ্ধ-জয়বিজয়ের এবং অন্যান্য কীর্তিকলাপের বিবরণ। এসব লিপিতেও রাজপুরুষশ্রেণী ছাড়া আর কারও খবর খুব একটা নেই। সমসাময়িক সংস্কৃত-সাহিত্যে, যেমন শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকে, ভাসের দুয়েকটি নাটকে, কালিদাসের শকুন্তলায় পরোক্ষভাবে সমাজের অন্যান্য বৃত্তি ও শ্রেণীর খবরাখবর কিছু কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু তাও অত্যন্ত অস্পষ্ট। শুঙ্গ আমলের ভরহুত স্তুপের বেষ্টনীতে কিংবা কিছু পরবর্তী কালের সীচীর শিলালিপিগুলোতে ও মথুরায় প্রাপ্ত কোনও কোনও লিপিতে, কোনও কোনও প্রাচীন মুদ্রায়ও এই ধরনের পরোক্ষ কিছু কিছু খবর আছে; শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীশ্রেণীর আভাস তাতে আছে। বস্তুত, একমাত্র জাতক-গ্ৰন্থ ছাড়া আর কোনও উপাদানের ভিতরই প্রাচীন ভারতের শ্রেণী-বিন্যাসের সুস্পষ্ট চেহারা খুঁজে পাওয়া যায় না। পঞ্চম শতক পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। তবে, অনুমান করে একটা অস্পষ্ট চেহারা এঁকে নেয়া যায়। কিন্তু সেই চেষ্টা করে লাভ নেই।

বাংলার ভূমিদান পট্টোলী ও এতে উল্লিখিত শ্রেণীসমূহ

৫ম থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত বাংলা সংক্রান্ত পট্টোলীগুলোর সবই ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিল। এই পট্টোলীগুলোর মধ্যে আমরা শ্রেণী-সংবাদ যে খুব বেশি পাওয়া যায়না, তবে দুটি শ্রেণী বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠছে, একথা সহজেই বলা যায়, একটি রাজপুরুষ শ্রেণী, আর একটি বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী। তাছাড়া, মহত্তরাঃ, ব্ৰাহ্মণাঃ, কুটুম্বিনঃ, ব্যবহারিণঃ প্রভৃতি, এবং সাধারণভাবে “অক্ষুদ্র প্রকৃতি’ অর্থাৎ গণ্যমান্য জনসাধারণের কথাও পাওয়া যায়। ব্ৰাহ্মণদের বৃত্তি কী ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। মহত্তর (মহতর=মাহাতো = মাতব্বর লোক, অর্থাৎ সম্পন্ন গৃহস্থ), কুটুম্ব (অর্থাৎ গ্রামবাসী সাধারণ গৃহস্থ) এবং ‘অক্ষুদ্র প্রকৃতি’ জনসাধারণ কিংবা যে সমস্ত সদব্যবহারী’ কোনও বিশেষ প্রয়োজনে নিজেদের মতামত দেয়ার জন্য স্থানীয় অধিকরণের (তথা রাষ্ট্রের) সাহায্যের জন্য তাদের ডাকা হতো, তাদেরপেশা কী ছিল, তারা কোন শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত ছিলেন, এ-সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনও আভাস এই লিপিগুলোতে পাওয়া না গেলেও অনুমান করা খুব কঠিন নয়। ভূমি দান-বিক্রয় উপলক্ষে যাদের সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে, যাদের এই দান-বিক্রয় বিজ্ঞাপিত করা প্রয়োজন হচ্ছে, তাদের মধ্যে শ্রেণী হিসাবে কোনও শ্রেণীর উল্লেখ নেই, তবে যারা এই ব্যাপারে প্রধান তাদের মধ্যে রাজপুরুষশ্রেণী এবং বণিক-ব্যবসায়ীশ্রেণীর লোকেদেরই নিঃসংশয় উল্লেখ দেখা যায়। অন্য যাদের উল্লেখ আছে, তারা কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণীপর্যায়ভুক্ত বলে উল্লিখিত হয়নি, কিন্তু উল্লেখের রীতি দেখে মনে হয়, শ্রেণীর ইঙ্গিত বর্তমান। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে রাখা দরকার যে, রাজপুরুষদের উল্লেখ তাদের অধিকৃত পদমর্যাদার জন্যই। সুস্পষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত করে তাদেরকে উল্লেখ করা হচ্ছে না; তেমন উল্লেখের প্রয়োজনও হয়নি।

৮ম থেকে ১৩শ অব্দের ভূমিদান দলিল

৮ম শতক থেকে ১৩শ শতক পর্যন্ত লিপিগুলোর স্বরূপ একটু ভিন্ন প্রকারের, এগুলোর সবই ভূমিদানের দলিল। ৫ম থেকে ৭ম শতকের দলিলগুলোতে ভূমি কিভাবে বিক্ৰী হচ্ছে, এবং পরে কিভাবে দান করা হচ্ছে, তার ক্রমের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। ৮ম শতকের পরের দলিলগুলোতে ভূমি ক্ৰয়ের যে ক্রম তা আমাদের দৃষ্টির বাইরে; আমরা শুধু দেখি, রাজা ভূমি দান করছেন, এবং সেই ভূমিদানের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। এই বিজ্ঞাপন যাদের কাছে করা হচ্ছে, তাদের উপলক্ষ করে সমসাময়িক প্রায় সমস্ত শ্রেণীর লোকেদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। যাদেরকে বিজ্ঞাপিত করার কোনও প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় না, তাদেরও জানানো হচ্ছে, যেমন যে গ্রামে ভূমিদান করা হচ্ছে, সেই গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের সমস্ত শ্রেণীর লোকদের নিশ্চয়ই জানানো প্রয়োজন, সেই গ্রাম যে বীথী বা মণ্ডল বা বিষয় বা ভুক্তিতে অবস্থিত তার রাজপুরুষদের জানানো প্রয়োজন, কিন্তু রাজনক, রাজপুত্র, রাজমাতা, সেনাপতি ইত্যাদি সকল রাজপুরুষদের জানাবার কোনও প্রয়োজন বাস্তবক্ষেত্রে আছে বলে তো মনে হয় না। কিংবা মালব, খস, কুণ, কর্ণাট, লাট ইত্যাদি ভিনদেশাগত বেতনভোগী সৈন্যদের বিজ্ঞাপিত করার কারণও কিছু বোঝা যায় না। ৫ম থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত লিপিগুলোতে এই ধরনের সর্বশ্রেণীর, সকল বৃত্তিধারী লোকের উল্লেখ নেই; সেখানে যে বিষয়ে অথবা মণ্ডলে ভূমি দানবিক্রয় করা হচ্ছে, সেই বিষয়ের বা মণ্ডলের রাজপুরুষ, বণিক ও ব্যবসায়ী, মহত্তর, ব্ৰাহ্মণ, কুটুম্ব ইত্যাদির বাহিরে আর কারও উল্লেখ করা হচ্ছে না।

উপাদান বিশ্লেষণ

বিভিন্ন উপাদান

  • বলা বাহুল্য, পঞ্চম শতকের পূর্বে উপাদান বিশ্লেষণের বিষয়ে স্থির করে কিছু বলার উপায় নেই। প্রথম কুমারগুপ্তের ধনাইদহ (৪৩২-৩৩ খ্রী) লিপিতে দেখা যায়, ভূমি-বিক্রয়ের ব্যাপারটি বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে গ্রামের কুটুম্ব, অর্থাৎ অন্যান্য গৃহস্থদের, ব্রাহ্মণদের এবং মহত্তর অর্থাৎ প্রধান প্রধান ব্যক্তিদের; বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন একজন রাজপুরুষ।
  • এই সম্রাটের ১নং দামোদরপুর-লিপিতে (৪৪৩-৪৪ খ্ৰী) রাজপুরুষ হচ্ছেন কোটিবর্ষ বিষয়ের বিষয়পতি কুমারামাত্য বেত্ৰিবৰ্মা এবং ভূমি-রিক্রয় ব্যাপারে তার সহায়ক ও পরামর্শদাতা হচ্ছেন। নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম সার্থিবাহ, প্রথম কুলিক এবং প্রথম বা জ্যেষ্ঠ কায়স্থ। এরা সকলেই অবশ্য রাজপুরুষ নন, প্রথম কায়স্থ খুব সম্ভব। একজন রাজপুরুষ; বাকি তিনজনের দুই জন বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এবং একজন শিল্পীশ্রেণীর প্রতিনিধি। কয়েকজন পুস্তপালের উল্লেখ আছে, এরাও রাজপুরুষ।
  • বৈগ্রাম পট্টোলী (৪৪৭-৪৮ খ্রী) মতে কুমারামাত্য কুলবৃদ্ধি ছিলেন পঞ্চনগরী বিষয়ের বিষয়পতি; কিন্তু এক্ষেত্রে তার সহায়ক নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম সার্থিবাহ, প্রথম কুলিক অথবা প্রথম কায়স্থের সাক্ষাৎ পাচ্ছি না; পরিবর্তে ভূমি-বিক্রয়ের ব্যাপারটি যেখানে জানানো হচ্ছে, সেখানে বিষয়াধিকরণকেও জানাবার ইঙ্গিত আছে। অন্যান্য সমসাময়িক লিপি থেকে আমরা জানি যে, পূর্বোল্লিখিত নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম সাৰ্থবাহ, প্রথম কুলিক এবং প্রথম বা জ্যেষ্ঠ কায়স্থ, এরাই বিষয়াধিকরণ গঠন করতেন। এদের ছাড়া বিক্ৰীত ভূমিসম্পূক্ত দুই গ্রামের কুটুম্ব, ব্ৰাহ্মণ ও সংব্যবহারীদিগকেও বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এই সংব্যবহারীরা বিষয়, মণ্ডল বা গ্রামের রাজপ্রতিনিধির সহায়ক, কিন্তু রাজপুরুষ ঠিক নন। কোনও বিশেষ কারণে বা উপলক্ষে প্রয়োজন হলে এরা আহুত হন এবং স্থানীয় রাজপ্রতিনিধিকে সাহায্য করেন।
  • ২নং দামোদরপুর-লিপির সাক্ষ্য (৪৪৭-৪৮ খ্ৰী) প্রথম কুমারগুপ্তের ১নং দামোদরপুর-লিপিরই অনুরূপ। পাহাড়পুর পট্টোলীতেও (৪৭৮-৭৯ খ্রী) আয়ুক্তক ও পুস্তপালের উল্লেখ পাওয়া যায়, অধিষ্ঠানাধিকরণের উল্লেখও আছে এবং ভূমি মেপে সীমা ঠিক করে দিতে বলা হয়েছে গ্রামের ব্রাহ্মণ, মহত্তর ও কুটুম্বদেরকে। ৩নং ও ৪নং দামোদরপুর-লিপির (৪৮২-৮৩ খ্ৰী দ্বিতীয়টির তারিখ অজ্ঞাত) সাক্ষ্যও এরকমই।
  • বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর-লিপিতে (৫০৭-৮ খ্ৰী) পঞ্চাধিকরণোপরিক, পুরপালো পরিক, সন্ধিবিগ্ৰহাধিকরণ, কায়স্থ ইত্যাদি রাজপুরুষদের উল্লেখ দেখা যায়; অন্য কোনও শ্রেণীর লোকেদের উল্লেখ নেই। দত্ত ভূমি কোনও ব্যক্তিবিশেষ ক্রয় করে পরে দান করছেন কিনা, সে-খবর উল্লিখিত অন্যান্য লিপিগুলোতে যেমন আছে, এই লিপিটিতে তেমন নেই; শুধু আছে, জনৈক মহারাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত শাসন-নির্দিষ্ট ভূমি দান করছেন।
  • পরবর্তী শতকে ত্রিপুরায় প্রাপ্ত লোকনাথের পট্টোলীও ঠিক গুণাইঘর-লিপিরই অনুরূপ। ঠিক এই ক্রমটি দেখা যায় পাল ও সেন-যুগের লিপিগুলোতে। গুপ্তযুগের লিপিগুলো একটু অন্যরকম; সেখানে কোনও ব্যক্তিবিশেষ রাজসরকারের নিকট থেকে ভূমি কিনে দান করছেন এবং সেক্ষেত্রে রাজসরকারের অর্থলাভ এবং পুণ্যলাভ দুইই হচ্ছে (বৈগ্রাম-লিপি ও পাহাড়পুর-লিপি দ্রষ্টব্য; “…অর্থেপচয়ো ধৰ্ম্মষড়ভাগাপ্যায়নঞ্চ ভবতি”– পাহাড়পুর-লিপি)।
  • পাল ও সেন যুগে দানটা কিন্তু করছেন রাজা স্বয়ং, কোনও ব্যক্তিবিশেষের অনুরোধে (ধর্মপালের খালিমপুর-লিপি এবং দামোদর দেবের চট্টগ্রাম-পট্টোলী = দ্রষ্টব্য)। যাই হোক, গুণাইঘর-লিপি এবং ৭ম শতকের লোকনাথের লিপি, এদের উভয়েরই ধারাটা যেন পরবর্তী পাল ও সেন আমলের; গুপ্ত আমলের অন্যান্য লিপি-নির্দিষ্টরা যেন নয়।
  • গোপচন্দ্রের মল্লসরুল-লিপি সম্বন্ধেও মোটামুটি একই কথা বলা যেতে পারে। যাই হোক, গুপ্ত আমলের লিপিগুলোতে আবার ফিরে যাওয়া যাক। দামোদরপুরের ৫নং লিপি বক্ষ্যমাণ বিষয়ের সাক্ষ্য ব্যাপারে এই-স্থানে প্রাপ্ত অন্যান্য লিপির মত।
  • ফরিদপুরের ধর্মাদিত্য গোপচন্দ্র ও সমাচারদেব প্রভৃতির তাম্রপট্টোলীর সাক্ষ্য একটু অন্য প্রকার। ধর্মাদিত্যের ১নং শাসনে ভূমি-ক্রয়েচ্ছা জ্ঞাপন করা হচ্ছে বিষয়-মহত্তরদেরকে, অর্থাৎ বিষয়ের প্রধান প্রধান লোকেদের এবং অন্যান্য সাধারণ লোকেদের গ্রামীয় ভূমির দান-বিক্রয়ের খবর দেওয়া হল। ধর্মাদিত্যের ২নং লিপিতে নতুন খবর কিছু নেই।
  • গোপচন্দ্রের লিপিতে বিজ্ঞাপিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রধানব্যাপারিণঃ অর্থাৎ স্থানীয় প্রধান ব্যাপারীদের উল্লেখ আছে। সমাচারদেবের ঘুঘরাহাটি পট্টোলীতে নূতন খবর কিছু নেই। জয়নাগের বপ্যঘোষবাট পট্টোলীতেও তাই। লোকনাথের ত্রিপুরা-লিপিতে রাজপুরুষদের ছাড়া বিজ্ঞাপিত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘সপ্রধান-ব্যবহারিজনপদান’ অর্থাৎ স্থানীয় প্রধান ব্যবহারী ও জনপদদের নাম করা হচ্ছে। ৮ম শতকের খড়গবংশীয় দেবখড়েগর আস্রফপুর-পট্টোলীতে বিষয়পতিদের সঙ্গে সঙ্গে কুটুম্ব-গৃহস্থদেরকেও বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে।

ব্যাখ্যা

এই বিশ্লেষণ থেকে এক শ্রেণীর লোক পাওয়া যাচ্ছে যারা রাজপুরুষ বা রাজপ্রতিনিধি। কিন্তু লক্ষ করার বিষয় এই যে, কোথাও তাদের রাজপুরুষ বা রাজপ্রতিনিধি বলা হচ্ছে না, এবং সেভাবে বিশেষ কোনও একটি শ্রেণীভুক্তও করা হচ্ছে না। আর এক ধরনের লোকের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে যাদেরকে বিশেষ প্রয়োজনে ডেকে আনা হলে রাষ্ট্রব্যাপারে রাজপুরুষদের সাহায্য করে থাকেন, এদেরকে কোথাও ব্যবহারিণঃ, কোথাও সংব্যবহারিণঃ, বিষয়ব্যবহারিণঃ, প্রধান-ব্যবহারিণঃ ইত্যাদি বলা হয়েছে। এদের পেশা কী ছিল, তা আমরা জানি না; তবে এটাই অনুমেয় যে, নানা বৃত্তির প্রধান প্রধান লোকেদেরই আহ্বান করা হত; বিষয় বা অধিষ্ঠান-অধিকরণের সভ্য, নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম সাৰ্থবাহ, প্রথম কুলিক, এরাও সেই হিসেবে সংব্যবহারী এবং কোনও কোনও পট্টোলীতে তাদেরকেও এই আখ্যাতেই উল্লেখ করা হয়েছে।

মহত্তর অর্থাৎ প্রধান প্রধান সম্পন্ন গৃহস্থ, কুটুম্ব অর্থাৎ সাধারণ গৃহস্থ, (তারা বিষয়েরই হোন বা গ্রামেরই হোন বা জনপদেরই হোন), অক্ষুদ্র প্রকৃতি বা শুধু প্রকৃতি অর্থাৎ প্রধান প্রধান অধিবাসী অথবা সাধারণ অধিবাসী প্রভৃতি যাদের উল্লেখ পাচ্ছি, তাদের কার কী বৃত্তি ছিল অনুমানের উপায় থাকলেও সুনির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই বা তারা কে কোন শ্রেণীর লোক, তাও জানা যায় না। তবে, রাজপুত্র ও রাজপ্রতিনিধি ছাড়া এমন কজন ব্যক্তির খবর পাওয়া যায় যাদের বৃত্তি সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই, যেমন নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম সার্থিবাহ ও প্রথম কুলিক। যে-ভাবে এদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এরা যে এক-একটি বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর প্রতিভূ তা বোঝা যাচ্ছে, এবং তা সমর্থিত হচ্ছে গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলীতে ‘প্রধান-ব্যাপরিণঃ’ বা প্রধান প্রধান ব্যবসায়ীদের উল্লেখ দ্বারা। রাজপুরুষ ও এই বণিক-ব্যবসায়ী-শিল্পীশ্রেণী ছাড়া আর একটি শ্রেণীর পরোক্ষ উল্লেখও আছে; সেটি ব্রাহ্মণদের। এদের পেশা কী ছিল, তাও সহজেই অনুমেয়; পূজা, ধর্মকর্ম ইত্যাদির জন্যই তো তারা ভূমিদান গ্রহণ করছেন। অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনাও এদের অন্যতম পেশা ছিল। অবশ্য, এদের মধ্যে অনেকে রাজপুরুষের পেশা কিংবা অন্যান্য পেশাও গ্রহণ করতেন, লিপিগুলোতে তার প্রমাণও আছে, কিন্তু তা ব্যতিক্রম মাত্র; সাধারণভাবে এসব পেশা তাদের ছিল না। এবং সবসময়ই লিপিগুলোতে তাদেরকে পৃথকভাবে বর্ণবদ্ধ শ্রেণী হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে।

৮ম শতক থেকে শুরু করে ১৩শ শতক পর্যন্ত লিপিগুলোর দিকে যাওয়া যাক। ধর্মপালের খালিমপুর-শাসনে নরপতি ধর্মপাল দুইটি গ্রাম দান করছেন। দানের প্রার্থনা জানাচ্ছেন মহাসামন্তাধিপতি শ্ৰীনারায়ণ বৰ্মা; দানের কারণ হচ্ছে নারায়ণ বর্মীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নারায়ণবিগ্রহের পূজা এবং বিগ্রহের পূজারী লাট (গুজরাট) দেশীয় ব্ৰাহ্মণদের এবং মন্দির-ভৃত্যদের ব্যবহার। যাইহোক, এই দান এভাবে বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে – “এযু চতুৰ্ম্ম গ্রামেষু সমুপগতান সর্বানের রাজ-রাজনক – রাজপুত্র – রাজামাত্য – সেনাপতি – বিষয়পতি – ভোগপতি – ষষ্ঠাধিকৃত – দণ্ডশক্তি – দণ্ডপশিক – চৌরোদ্ধরণিক – দৌঃসাধসাধনিক – দূতখেলে – সমাগামিকা – ভিত্বরমাণ – হস্তাশ্ব – গোমহিষাজবিকাধ্যক্ষ’ – নাকাধ্যক্ষ – বলাধ্যক্ষ – তরিক – শৌল্কিক – গৌল্মিক – তদাযুক্তক – বিনিয়ুক্তকাদি রাজপাদোপজীবিনোহন্যাংশ্চাকীর্ত্তিতান্‌ চাটভাটজাতীয়ান্‌ যথাকলোধ্যাসিনো জ্যেষ্ঠকায়স্থ-মহামহত্তর – দাশগ্রামিকান্দি-বিষয়ব্যবহারিণঃ সকরুণান প্রতিবাসিনঃ ক্ষেত্ৰকারাংশ্চ ব্রাহ্মণ্যমাননাপূর্বকং যথাৰ্থং মািনয়তি বোধয়তি সমাজ্ঞাপয়তি চ।” এই সূত্রটি খালিমপুর-লিপিতে প্রথম পাওয়া যায়। ১৩শ শতক পর্যন্ত ভূমিদানের যত পট্টোলী আছে, তার প্রায় সবকটিতেই এই ধরনের একটি সূত্র উল্লেখ করা আছে; প্রভেদের মধ্যে দেখা যায়, কোথাও রাজপুরুষদের তালিকাটি সংক্ষিপ্ত, কোথাও বিস্তৃত। এই বিস্তৃততর তালিকার আর উল্লেখ করে লাভ নেই; তবে একটু আধটু নতুন সংযোজন কোথাও কোথাও আছে, সেগুলো কাজে লাগার সম্ভাবনা আছে। কাজেই, যেখানে এধরনের নতুন সংযোজন পাওয়া যাবে, তাদের উল্লেখ করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দেবপালের মুঙ্গেরী-লিপিতে রাজ্যপাদোপজীবীদের (এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, স্বাপদপদ্মোপজীবীনঃ) তালিকায় চাটভাটজাতীয় সেবকদের সঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে-“গৌড়-মালব – খস-হূণ – কুলিক-কর্ণাট – লাট-চাটভাট – সেবকদৌন – অন্যাংশ্চকীর্তিতান”; এবং প্রতিবাসী ও ব্রাহ্মণোত্তরদের সঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে — “মহত্তর-কুটুম্বি -পুরোগমেদানপ্রকচণ্ডালপর্যন্তান”। নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপিতেও ঠিক এধরনের উল্লেখ আছে। বস্তুত, পালরাজাদের সমস্ত লিপিই এরকম। শুধু গৌড়-মালব-খস-তুণ প্রভৃতিদের সঙ্গে কোথাও কোথাও চোড়দেরও (মদনপালের মনহলি-লিপি দ্রষ্টব্য) উল্লেখ আছে। চাটভাটদের জায়গায় চট্টভট্ট অথবা চাটভটদের উল্লেখ পাওয়া যায়; বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে “ক্ষেত্রকরণ”-এর পরিবর্তে পাওয়া যায় “কর্ষকান্‌”। কিন্তু ১০ম শতকের কম্বোজরাজ নয়পালদেবের ইর্‌দা-পট্টোলীতে বিজ্ঞাপিত ব্যক্তিদের নামের তালিকা একটু অন্যরূপ। এখানে উল্লেখ পাচ্ছি, স্থানীয় “সকরণান ব্যবহারিণঃ”দের (কেরানিকুল সহ অন্যান্য রাষ্ট্রসহায়কদের), কৃষক ও কুটুম্বদিগকে এবং ব্ৰাহ্মণদের। অন্যত্র যেমন, এখানেও তাই; ব্রাহ্মণদের যে বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে ঠিক তা নয়, তাদের সম্মান জ্ঞাপনের পর (মাননাপূর্বকং) অন্যদের বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। আর, রাজমহিষী, যুবরাজ, মন্ত্রী, পুরোহিত, ঋত্বিক, প্রদেষ্টবৰ্গ, সকল শাসনাধ্যক্ষ, করণ (বা কেরানি), সেনাপতি, সৈনিক সংঘমুখ্য, দূতবর্গ, গৃঢ়পুরুষবর্গ, মন্ত্রপালবৰ্গ এবং অন্যান্য রাজকর্মচারীদের বলা হচ্ছে এই দান মান্য করার জন্য।

সেনরাজাদের এবং সমসাময়িক অন্যান্য রাজবংশের লিপিগুলো সম্বন্ধে বলার বিশেষ কিছু নেই; বক্ষ্যমাণ বিষয়ে তাদের সাক্ষ্য পাল-লিপিগুলোরই অনুরূপ। তবে পাল ও সমসাময়িক অন্য রাজাদের লিপিতে যেখানে পাচ্ছি প্রতিবাসীদের কথা, পরবর্তী লিপিগুলোতে ঠিক সেখানেই আছে জনপদবাসীদের (জনপদান কিংবা জনপদান) কথা। কিন্তু, একটি বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাল ও সমসাময়িক অনেকগুলো লিপিতে দেখা যায়, বিজ্ঞাপিত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষেত্রকর ইত্যাদির পরেই নিম্নস্তরের যে অগণিত লোক তাদেরকে সব একসঙ্গে গেঁথে দিয়ে বলা হচ্ছে, “মেদান্ত্ৰচণ্ডালপর্যন্তান” অথবা “আচণ্ডালান”, অর্থাৎ, নিম্নতর স্তরের চণ্ডাল পর্যন্ত; অর্থাৎ বর্ণ-বিন্যাস অধ্যায়ে স্লেচ্ছ ও অন্ত্যজ পর্যায়ে যতগুলো উপবর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায় তারা সকলেই ঐ “মেদান্ধিচণ্ডাল” পদের মধ্যেই উক্ত হয়েছে। পরবতী লিপিগুলোতে, অর্থাৎ কম্বোজ-বর্মণ-সেন আমলের লিপিগুলোতে কিন্তু এই পদটি কোথাও নেই; চণ্ডাল পর্যন্ত নিম্নতম শ্রেণী ও বর্ণের অন্যান্য লোকেরা একেবারে অনুল্লিখিত। পালযুগের পরে সেন-আমলে রাষ্ট্রের ও সমাজের উচ্চস্তরের, অর্থাৎ, এক কথায় উৎপাদন ও বণ্টন কর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন বদলে গিয়েছিল। এই অনুমান অস্বীকার করা কঠিন।

সমসাময়িক সাহিত্য

বৌদ্ধ চর্যাগীতিতে কয়েকটি আদিবাসী কোম ও উপবর্ণ এবং তাদের বৃত্তির ইঙ্গিত আছে; সেন আমলের দুই-একটি লিপিতেও আছে। সমসাময়িক বঙ্গীয় স্মৃতি ও পুরাণে এরা অন্তজ বা ম্লেচ্ছ পর্যায়ভুক্ত, এবং শুধু বর্ণ হিসেবেই নয়, অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসেবেও এরা সমাজের নিম্নতম শ্রেণীর লোক; এদের অনুসৃত পেশাতেই তা পরিষ্কার। মেদ, অন্ধ ও চণ্ডালদের মতো কোল, পুলিন্দ, পুককস, শবর, বরুড় (বাউড়ী?), চর্মকার, ঘট্টজীবী, ডোলাবাহী (দুলিয়া, দুলে) ব্যাধ, হাড়ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগাতীত (বাগদী?), ইত্যাদি সকলেই সমাজের শ্রমিক-সেবক, আজিকার দিনের ভাষায় দিনমজুর, এবং আজিকের মতই ভূমিহীন প্রজা।

এদের অব্যবহিত ওপরের স্তরেই আর-একটি শ্রেণীর আভাস ধরতে পারা যায়; এরা বিভিন্ন উপবর্ণে বিভক্ত, প্রত্যেকের পৃথক পৃথক পেশা ও উপজীবিকা। কিন্তু লক্ষণীয় এই যে, এরা প্রায় সকলেই বৃহদ্ধৰ্মপুরাণের মধ্যম-সংকর এবং ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের অসৎশুদ্র পর্যায়ভুক্ত। এদের মধ্যে শিল্পজীবীও আছেন, কৃষিজীবীও আছেন, এমন-কি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও নেই, এমন নয়; শিল্পজীবী, যেমন তক্ষণ, সূত্ৰধার, চিত্রকার, অট্টালিকাকার, কোটক ইত্যাদি; কৃষিজীবী, যেমন রাজক, আভীর (বিদেশী কোম), নট, পৌণ্ডক (পোদ্য?), কৌয়ালী, মাংসচ্ছেদ ইত্যাদি; ব্যবসায়ী, যেমন তৈলকার, শৌণ্ডিক (শুড়ি), ধীবর-জালিক ইত্যাদি। নিজ নিজ পেশাই এদের জীবিকা সন্দেহ নেই, কিন্তু জীবিকার জন্য এরা কমবেশি আংশিকভাবে কৃষিনির্ভরও ছিলেন, এরূপ অনুমান অত্যন্ত স্বাভাবিক। এদের পেশাগুলোর প্রত্যেকটিই সামাজিক কর্তব্য; সেই কর্তব্যের বিনিময়ে এরা ভূমির ওপর অথবা ভূমিলব্ধ দ্রব্যাদির ওপর আংশিক অধিকার ভোগ করতেন, এই অনুমানও স্বাভাবিক। এরাই এর চেয়েকৃত আধুনিক কালের অস্থায়ী প্ৰজা, ভাগচাষী ইত্যাদি। উন্নত সমাজাধিকার বা উৎপাদন ও বণ্টন-কর্তৃত্ব যে এদের নাই তা বর্ণ-বিন্যাসের স্তর থেকেও কিছুটা অনুমান করা যায়। এদেরই অব্যবহিত ওপরের স্তরে ক্ষুদ্র ভূম্যধিকারী, ভূমিস্বত্ববান কৃষক বা ক্ষেত্রকর, শিল্পী, ব্যবসায়ী, করণ-কায়স্থ বৈদ্যক-গোপ -যুদ্ধ-চারণ প্রভৃতি পেশার বিভিন্ন লোক নিয়ে একটি বৃহৎ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের পরিচয়ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণতালিকার মধ্যে ধরতে পারা কঠিন নয়। তাছাড়া, শিক্ষাদীক্ষা-ধৰ্মকর্মবৃত্তিধারী ব্ৰাহ্মণ ও বৌদ্ধ যতি সম্প্রদায় তো ছিলেনই।

বিভিন্ন স্তরের শ্রেণীসমূহ

রাজপাদোপজীবী শ্রেণী

৫ম থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত লিপিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন রাজপুরুষদের উল্লেখ আছে। মহারাজাধিরাজের অধীনে রাজা, রাজক, রাজনক-রাজন্যক, সামন্ত-মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক-মহামাণ্ডলিক, এসব নিয়ে যে অনন্ত সামন্তচক্র তারাও রাজপদোপজীবী। রাজা-রাজনক-রাজপুত্র থেকে শুরু করে তরিক-শোন্ধিক -গৌলিক প্রভৃতি নিম্নস্তরের রাজকর্মচারী পর্যন্ত সবার উল্লেখই শুধু নয়, তাদের সকলকে একত্রে একমালায় গেঁথে বলা হচ্ছে “রাজ্যপাদোপজীবীনঃ”, এবং সুদীর্ঘ তালিকায়ও যখন সমস্ত রাজপুরুষের নাম শেষ হয়নি, তখন তার পরই বলা হয়েছে “অধ্যক্ষপ্রচারোক্তানিহকীর্তিতান”, অর্থাৎ আর যাদের কথা এখানে কীর্তিত বা উল্লিখিত হয়নি। কিন্তু তাদের নাম (অর্থশাস্ত্ৰ জাতীয় গ্রন্থের) অধ্যক্ষ পরিচ্ছেদে উল্লেখ আছে। এইযে সমস্ত রাজপুরুষকে একসঙ্গে গেঁথে একটি সীমিত শ্রেণীতে উল্লেখ করা, তা পাল আমলেই যেন প্রথম শুরু হল; অথচ আগেও রাজপুরুষ, রাজপাদোপজীবীরা ছিলেন না, তা নয়। বোধ হয়, এভাবে উল্লেখের কারণ আছে।

মোটামুটি ৭ম শতকের সূচনা থেকে গৌড় স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় সত্তা লাভ করে; বঙ্গ এই সত্তার পরিচয় পেয়েছিল। ৬ষ্ঠ শতকের তৃতীয় পাদ থেকে যাই হোক, ৭ম শতকেই সর্বপ্রথম বাংলা নিজস্ব রাষ্ট্র লাভ করল, নিজস্ব শাসনতন্ত্র গড়ে তুলল। গৌড় ও কর্ণসুবর্ণাধীপ শশাঙ্ককে আশ্রয় করেই তার সূচনা দেখা গেল, কিন্তু তা স্বল্পকালের জন্য মাত্র। কারণ, তার পরই অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সমস্ত দেশ জুড়ে রাষ্ট্ৰীয় আবর্ত, মাৎস্যন্যায়ের উৎপীড়ন। এই মাৎস্যন্যায় পর্বের পর পাল রাষ্ট্র ও পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা আবার আত্মসম্বিৎ ফিরে পেল, নিজের রাষ্ট্র ও রাজ্য লাভ করল, রাষ্ট্ৰীয় স্বাজাত্য ফিরে পেল, এবং পেল পূর্ণতর বৃহত্তর রূপে। মর্যাদায় ও আয়তনে, শক্তিতে ও ঐক্যবোধে বাংলা নিজের এই পূর্ণতর বৃহত্তর রূপ আগে কখনও দেখেনি। বোধ হয়, এই কারণেই রাষ্ট্র ও রাজপাদোপজীবীদের শুধু সবিস্তার উল্লেখই নয়, শাসনযন্ত্রের যারা পরিচালক ও সেবক, তারা নতুন এক মর্যাদার অধিকারী হলেন, এবং তাদেরকে একত্রে গেথে স্বসীমায় সুনির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর নামকরণ করাটাও সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। যাইহোক, সোজাসুজি রাজপাদোপজীবী অর্থাৎ সরকারী চাকুরেদের একটা সুস্পষ্ট শ্রেণীর খবর এই প্রথম পাওয়া গেল।

ভূম্যধিকারির শ্রেণীস্তর

রাজপাদোপজীবী সকলেই আবার একই অর্থনৈতিক স্তরভুক্ত ছিলেন না। তাদের মধ্যে সকলের ওপরে ছিলেন রাণক, রাজনক, সামন্ত, মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক, মহামাণ্ডলিক ইত্যাদি সামন্ত প্রভুরা; স্ব স্ব নির্দিষ্ট জনপদে তাদের প্রভুত্ব মহারাজাধিরাজ এর থেকে কিছু কম ছিল না। সর্বপ্রধান ভূস্বামী মহাসামন্ত-মহামাণ্ডলিকেরা; তাদের নিচেই সামন্ত-মাণ্ডলিকেরা-সামন্তসৌধের দ্বিতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে মহামহত্তরেরা—বৃহৎভূস্বামীর দল; চতুর্থ স্তরে মহত্তর ইত্যাদি, অর্থাৎ ক্ষুদ্র ভূস্বামীর দল এবং তার পর ধাপে ধাপে নেমে কুটুম্ব অর্থাৎ সাধারণ গৃহস্থ বা ভূমিবানপ্রজা, ভাগীপ্ৰজা, ভূমিবিহীন প্রজা ইত্যাদি। সামন্ত, মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক, মহামাণ্ডলিক— এরা সকলেই সাক্ষাৎভাবে রাজপাদোপজীবী; কিন্তু মহত্তর, মহামহত্তর। কুটুম্ব প্রভৃতিরা রাজপাদোপজীবী নহেন, রাজসেবক মাত্র। রাষ্ট্রের প্রয়োজন ডাকা হলে এরা রাজপুরুষদের সাহায্য করতেন, এমন প্রমাণ পঞ্চম শতক থেকে শুরু করে প্ৰায় সব লিপিতেই পাওয়া যায়।

রাজসেবক শ্রেণী

পূর্বোক্ত রাজপাদোপজীবী শ্রেণীর বাইরে আর-একটি শ্ৰেণীর খবর পাওয়া যায়। ৮ম শতকের পূর্বের লিপিগুলোতে এই শ্রেণীর লোকেদের খবর পাওয়া যায়। এরা রাজসরকারে চাকরি করতেন কিনা ঠিক বলা যায় না, তবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ডাকা হলে রাজপুরুষদের সাহায্য করতেন, তা বোঝা যায়।

পাল ও সেন আমলের লিপিগুলোতেও এদের উল্লেখ আছে, কিন্তু এখানে এরা উল্লিখিত হচ্ছেন রাষ্ট্রসেবক রূপে। এরা হচ্ছেন, জ্যেষ্ঠ কায়স্থ, মহত্তর, মহামহত্তর, দাশগ্রামিক, করণ, বিষয়-ব্যবহারী ইত্যাদি। কোনও কোনও লিপিতে মহত্তর, মহামহত্তর ইত্যাদি স্থানীয় ব্যক্তিদের এই শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু চাটভাট ইত্যাদি অন্যান্য নিম্নস্তরের রাজকর্মচারীরা সর্বদাই সেবকাদি অর্থাৎ (রাজ)-সেবকরূপে উল্লিখিত হয়েছেন।

৮ম শতকের পূর্বের লিপিগুলোর জ্যেষ্ঠ কায়স্থ বা প্রথম কায়স্থ তো রাজপুরুষ বলেই মনে হয়; যে পাঁচজন মিলে স্থানীয় অধিকরণ গঠন করেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। পরবর্তীকালে রাজপুরুষ না হলেও তিনিও যে একজন রাজসেবক, তাতে আর সন্দেহ কী? এই (রাজ)-সেবকদের মধ্যে গৌড়মালব-খস-তৃণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট-চোড় ইত্যাদি জাতীয় ব্যক্তিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা কারা? এটুকু বোঝা যাচ্ছে, এরাও কোনও উপায়ে রাষ্ট্রের সেবা করতেন। যে-ভাবে এদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, মনে হয়, এসব ভিনপ্রদেশী লোকেরা বেতনভুক সৈন্যরূপে রাষ্ট্রের সেবা করতেন।

পুরোহিতরূপে লাট বা গুজরাটদেশীয় ব্ৰাহ্মণদের উল্লেখ খালিমপুর-লিপিতেই আছে। কিন্তু ঐ দেশীয় সৈন্যরাও এদেশে রাজসৈনিকররূপে ছিলেন বলে মনে হয়। বিভিন্ন সময়ে অন্য প্রদেশ থেকে যেসব যুদ্ধাভিযান বাংলায় এসেছে, যেমন কর্ণাটীদের, তাদের কিছু কিছু সৈন্য এদেশে থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। অবশ্য, অন্যান্য পেশা অবলম্বন করেও যে তারা আসেননি তাও বলা যায় না। তবে, যেভাবেই হোক, এদেশে তারা যে পেশা গ্রহণ করেছিলেন, তা রাজসেবকের পেশা। অবশ্য, সমাজের সঙ্গে এদের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ছিল বলে মনে হয়না।

যাই হোক, রাজপদোপজীবী শ্রেণীরই আনুষঙ্গিক বা ছায়ারূপে পাওয়া যায় রাজসেবকশ্রেণী। এই দুই শ্রেণীর সমস্ত লোকেরাই এক স্তরের ছিলেন না, পদমর্যাদা এবং বেতনমর্যাদাও এক ছিল না। উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন স্তরের বিত্ত ও মর্যাদার লোক এই উভয় শ্রেণীর মধ্যেই ছিল; কিন্তু যে স্তরেই হোক, এদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রাষ্ট্রের সঙ্গেই যে একান্তভাবে জড়িত ছিল, তা স্বীকার করতে কল্পনার আশ্রয় নেবার প্রয়োজন নেই।

আমলাতন্ত্রের শ্রেণীস্তর

রাজ্যপাদোপজীবী শ্রেণীর বিভিন্ন স্তরগুলো ধরতে পারা কঠিন নয়। সামন্ত, মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক, মহামাণ্ডলিকদের নিচের স্তরেই পাওয়া যায় ওপরিক বা ভুক্তিপতি, বিষয়পতি, মণ্ডলপতি, অমাতা, সান্ধিবিগ্রহিক, মন্ত্রী, মহামন্ত্রী, ধর্মাধ্যক্ষ, দণ্ডনায়ক, মহাদণ্ডনায়ক, দৌঃসাধসাধনিক, দৃত, দূতক, পুরোহিত, শান্ত্যাগরিক, রাজপণ্ডিত, কুমারামোত্য, মহাপ্ৰতীহার, রাজামাতা, রাজস্থানীয় ইত্যাদি। সুবৃহৎ আমলাতন্ত্রে এরাই সবচেয়ে ওপরের স্তর এবং এদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, অর্থাৎ শ্রেণীস্বাৰ্থ একদিকে যেমন রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত, তেমনই অন্যদিকে ক্ষুদ্র বৃহৎ ভূস্বামীদের সঙ্গে।

এই ওপরতম স্তরের নিচেই একটি মধ্যবিত্ত, মধ্যক্ষমতাধিকারী রাজকর্মচারীর স্তর; এই স্তরে বোধ হয় অগ্রহারিক, ঔদ্রঙ্গিক, আবস্থিক, চৌরোদ্ধািরণিক, বলাধ্যক্ষ, নাবাধ্যক্ষ, দাণ্ডিক, দণ্ডপাশিক, দণ্ডশক্তি, দশাপরাধিক, গ্রামপতি, জ্যেষ্ঠকায়স্থ, খণ্ডরক্ষ, খোল, কোট্টাপাল, ক্ষেত্রপ, প্ৰমাতৃ, প্রান্তপাল, ষষ্ঠাধিকৃত ইত্যাদি। এদের নিম্নবর্তী স্তরে শৌল্বিক, গৌল্মিক, গ্রামপতি, হট্টপটি, লেখক, শিরোরক্ষিক, শান্তকিক, বাসাগরিক, পিলুপতি ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে এই সব রাজপুরুষদের ক্ষমতা ও মর্যাদার তারতম্য হত। সর্বনিম্ন স্তরও একটি নিশ্চই ছিল; এই স্তরে স্থান হয়েছিল ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্রসেবকদলের, এবং এই দলে কুণ-মালব –খস-লাট -কর্ণাট-চোড় ইত্যাদি বেতনভুক সৈন্যরা ছিলেন, ক্ষুদ্র করণ বা কেরানিরা ছিলেন, চাটভাটেরা ছিলেন এবং ছিলেন আরও অনেকে।

মহত্তর, মহামহত্তর, কুটুম্ব, প্রতিবাসী, জনপদবাসী ইত্যাদির অধিকাংশই যে বিভিন্ন স্তরে ভূম্যধিকারী ছিলেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার অবসর কম। শাসনাবলীতে উল্লিখিত রাজপাদোপজীবী, ক্ষেত্রকর, ব্ৰাহ্মণ এবং নিম্নস্তরের চণ্ডাল পর্যন্ত লোকেদের বাদ দিলে যারা বাকি থাকেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশ ভূমিসম্পদে এবং অল্পসংখ্যক ব্যক্তিগত গুণে ও চরিত্রে সমাজে মান্য ও সম্পন্ন হয়েছিলেন; তারাই মহামহত্তর ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত হয়েছেন এরকম মনে করলে অন্যায় হয় না। কুটুম্ব, প্রতিবাসী, জনপদবাসী— এরা সাধারণভাবে স্বল্পভূমিসম্পন্ন গৃহস্থ; কৃষি, গৃহ-শিল্প ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাবসা এদের পেশা ও জীবিকা। কৃষি এদের পেশা বললাম বটে, কিন্তু এরা নিজেরা নিজেদের হাতে চাষের কাজ করতেন বলে মনে করা যায়না। যদিও ভূমির মালিক পৃথকভাবে উল্লিখিত হয়েছেন। ৮ম শতকের দেবখড়েগর আম্রফপুর-লিপির একটি স্থানে দেখা যায়, ভূমি ভোগ করছেন একজন, কিন্তু চাষ করছে অন্য লোকেরা—“শ্ৰীশৰ্বান্তরেণ ভুজ্যমানকঃ মহত্তরশিখরাদিভিঃ কৃষ্যমাণকঃ” (এখানে মহত্তর একজন ব্যক্তির নাম)। এই ব্যবস্থা শুধু এখন নয়, প্রাচীন কালে এবং মধ্যযুগেও প্রচলিত ছিল। বস্তুত, যিনি ভূমির মালিক, তার পক্ষে নিজের হাতেই সমস্ত ভূমি রাখা এবং নিজেরাই চাষ করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। জমি নানা শর্তে বিলি বন্দােবস্তু করতেই হত।

সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত বিশ্বরূপসেনের এক লিপিতে হল্যায়ুধ শৰ্মা নামক জনৈক আবল্লিক মহাপণ্ডিত ব্ৰাহ্মণ একা নিজের ভোগের জন্য নিজের গ্রামের আশেপাশে তিন-চারিটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে ৩৩৬ই উন্মান ভূমি রাজার নিকট হতে দানম্বরূপ পেয়েছিলেন; এই ভূমির বার্ষিক আয় ছিল ৫০০ কপর্দক পুরাণ। এই ৩৩৬৪ উন্মানের মধ্যে অধিকাংশ ছিল নালভূমি অর্থাৎ চাষের ক্ষেত্র। ইহা তো সহজেই অনুমেয় যে, এই সমগ্ৰ ভূমি হলায়ুধ শৰ্মর সমগ্র পরিবার পরিজনবৰ্গ নিয়েও নিজেদের চাষ করা সম্ভব ছিল না, এবং হলায়ুধ শৰ্মা ক্ষেত্ৰকল্প বলে উল্লিখিতও হতে পারেন না। তাকে জমি নিম্নপ্রজাদের মধ্যে বিলি বন্দোবস্ত করে দিতেই হত। এই নিম্নপ্রজাদের মধ্যে যারা নিজেরা চাষবাস করেন, তারাই ক্ষেত্রকর। এখানে এই ধরনের একটি অনুমান যদি করা যায় যে, সমাজের মধ্যে ভূমি-সম্পদে ও শিল্প-বাণিজ্যে সম্পদে সমৃদ্ধ নানা স্তরের একটি শ্রেণীও ছিল এবং এই শ্রেণীরই প্রতিনিধি হচ্ছেন মহত্তর, মহামহত্তর, কুটুম্ব ইত্যাদি ব্যক্তিরা, তাহলে ঐতিহাসিক তথ্যের বিরোধী বোধ হয় কিছু বলা যায় না, বরং যে প্রমাণ আছে, তার মধ্যে তার ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন, এ-কথা স্বীকার করতে হয়।

ধর্ম ও জ্ঞানজীবী শ্রেণী

ব্ৰাহ্মণেরা বর্ণ হিসেবে যেমন, শ্রেণী হিসেবেও তেমনই পৃথক শ্রেণী। দান-ধ্যান-ক্রিয়াকর্ম যাকিছু করা হচ্ছে, তাদের সম্মাননা করার পর। ভূমিদান এরাই লাভ করছেন, এদের মধ্যে কেউ কেউ রাজপদোপজীবী শ্রেণীতে উল্লিখিত হয়েছেন; মন্ত্রী, এমনকি, সেনাপতি, সামন্ত, মহাসামন্ত, আবস্থিক, ধর্মধ্যক্ষ ইত্যাদিও হয়েছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। সাধারণ নিয়মে তারা পুরোহিত, ঋত্বিক, ধৰ্মজ্ঞ, নীতিপাঠক, শাস্ত্যাগারিক, শান্তিবারিক, রাজপণ্ডিত, ধৰ্মজ্ঞ, স্মৃতি ও ব্যবহারশাস্ত্ৰাদির লেখক, প্রশস্তিকার, কাব্য, সাহিত্য ইত্যাদির রচয়িতা।

এদের উল্লেখ পাল ও সেন আমলের লিপিগুলোতে, সমসাময়িক সাহিত্যে বারবার পাওয়া যায়। এই ব্ৰাহ্মণ-শাসিত ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ছাড়া পাল আমলের শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রাধান্য কম ছিল না। ব্ৰাহ্মণরা যেমন শ্রেণী হিসেবে সমাজের ধর্ম, শিক্ষা, নীতি ও ব্যবহারের ধারক ও নিয়ামক ছিলেন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মসংঘগুলোও ঠিক তেমনই সমাজের কতকাংশের ধর্ম, শিক্ষা ও নীতির ধারক ও নিয়ামক ছিল, এবং তাদের পোষণের জন্যও রাজা ও অন্যান্য সমর্থ ব্যক্তিরা ভূমি ইত্যাদি দান করতেন; ভূমিদান, অর্থদান ইত্যাদি গ্রহণ করে তারা প্রচুর ভূমি ও অর্থ-সম্পদের অধিকারী হতেন, তার প্রমাণের অভাব নেই। এই বৌদ্ধ-জৈন স্থবির ও সংঘ-সভ্যদের এবং ব্ৰাহ্মণদের নিয়ে প্রাচীন বাংলার বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-ধর্মজীবী শ্রেণী।

কৃষক বা ক্ষেত্রকর শ্রেণী

৮ম শতক থেকে শুরু করে যতগুলো লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকটিতেই ক্ষেত্রকরদের বা কৃষক-কর্ষকদের উল্লেখ আছে। অথচ আশ্চর্য এই ৮ম শতকের আগে প্রায় কোনও লিপিতেই এদের উল্লেখ নেই, যদিও উভয় যুগের লিপিগুলো ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয় ও দানেরই পট্টোলী। এ তর্ক করা চলবে না যে, ক্ষেত্রকর বা কৃষক পূর্ববর্তী যুগে ছিল না, পরবর্তী যুগে হঠাৎ দেখা দিল। খিল অথবা ক্ষেত্রভূমি দান ক্রয়-বিক্রয় যখন হচ্ছে, চাষের জন্যই হচ্ছে। আর, ভূমি দান বিক্রয় যদি মহত্তর, কুটুম্ব, শিল্পী, ব্যবসায়ী, রাজপুরুষ, সাধারণ ও অসাধারণ (প্রকৃতয়ঃ এবং অক্ষুদ্র-প্রকৃতয়ঃ) লোক, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি সকলকে বিজ্ঞাপিত করা যায়, তাহলে ভূমিব্যাপারে যার স্বাৰ্থ সবার চেয়ে বেশি, সেই কর্ষকের উল্লেখ নেই কেন? আর, ৮ম শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী লিপিগুলোতে তাদের উল্লেখ আছে কেন? তর্ক তোলা যায়, পূর্ববর্তী যুগের লিপিগুলোতে কৃষকদের অনুল্লেখের কথা যা বলছি, তা সত্য নয়; কারণ তারা হয়তো ঐ গ্রামবাসী কুটুম্ব, গৃহস্থ, প্রকৃতয়ঃ অর্থাৎ সাধারণ লোক, এদের মধ্যেই তাদের উল্লেখ আছে। এর উত্তর হচ্ছে, তাহলে এসব কুটুম্ব প্রতিবাসী, জনপদবাসী জনসাধারণের কথা তো ৮ম শতক-পরবর্তী লিপিগুলোতেও আছে, তারপরও আলাদাভাবে ক্ষেত্রকরদের, কৃষকদের উল্লেখ আছে কেন? আমার কিন্তু মনে হয়, পঞ্চম থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত লিপিগুলোতে কৃষকদের অনুল্লেখ এবং পরবতী লিপিগুলোতে প্রায় আবশ্যিক উল্লেখ একেবারে আকস্মিক বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এর একটি কারণ আছে এবং এই কারণের মধ্যে প্রাচীন বাংলার সমাজ-বিন্যাসের ইতিহাসের একটু ইঙ্গিত আছে।

লোকসংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক সমাজে ভূমির চাহিদা ক্রমশ বাড়ছিল, সমাজের মধ্যে ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্র করে ভূমি কেন্দ্রীকৃত হবার দিকে একটা ঝোঁক একটু একটু করে দেখা দিচ্ছিল। সামাজিক ধনোৎপাদনের ভারকেন্দ্রটি ক্রমশ যেন ভূমির ওপরেই এসে পড়েছিল; পাল ও বিশেষ করে সেন আমলের লিপিগুলো তন্ন তন্ন করে পড়লে একথাই মনের মধ্যে জুড়ে বসতে চায়। কোন ভূমির উৎপন্ন দ্রব্য কী, ভূমির দাম কত, বার্ষিক আয় কত, ইত্যাদি সংবাদ খুঁটিনাটি সহ সবিস্তারে যেভাবে দেয়া হচ্ছে, তাতে সমাজের কৃষিনির্ভরতার ছবিটাই যেন দৃষ্টি ও বুদ্ধি অধিকার করে বসে। তাছাড়া, জনসংখ্যা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন ভূমি আবাদ, জঙ্গল কেটে গ্রাম বসানোর ও চাষের জন্য জমি বের করার চেষ্টাও চোখে পড়ে। বস্তুত, তেমন প্রমাণও দুয়েকটি আছে; উদাহরণস্বরূপ ৭ম শতকের লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীতে এই ক্রমবর্ধমান কৃষিনির্ভরতার প্রতিচ্ছবি সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে ফুটে উঠবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এবং পাল ও সেন-আমলের লিপিগুলোতে তাই হয়েছে। ৭ম শতক পর্যন্ত লিপিগুলোতে বর্ণিত ও উল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে পৃথক ও সুনির্দিষ্টভাবে কৃষক বা ক্ষেত্রকর বলে যে কারও উল্লেখ নেই তার কারণ এই নয় যে, তখন কৃষক ছিল না, কৃষিকর্ম হত না; তার যথার্থ ঐতিহাসিক কারণ, সমাজ তখন একান্তভাবে কৃষিনির্ভর হয়ে ওঠেনি, এবং কৃষক বা ক্ষেত্রকর সমাজের মধ্যে থাকলেও তারা তখনও একটা বিশেষ অথবা উল্লেখযোগ্য শ্রেণী হিসেবে গড়ে ওঠেনি।

সারমর্ম

যাইহোক, এপর্যন্ত শ্রেণীবিন্যাসের যে তথ্য পাওয়া গেল তার ভিত্তিতে বলা যায়, রাজপাদোপজীবীরা একটি সুসংবদ্ধ, সুস্পষ্ট সীমারেখায় নির্দিষ্ট একটি শ্রেণী এবং তাদেরই আনুষঙ্গিক ছায়ারূপে আছে (রাজ)-সেবক শ্রেণী। এরা রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালক ও সহায়ক। এদের মধ্যে আবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তর বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। বিদ্যা-বুদ্ধি -জ্ঞান-ধৰ্মজীবীরা আর-একটি শ্রেণী; এরা সাধারণভাবে জ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির ধারক ও নিয়ামক। এদের মধ্যে ব্ৰাহ্মণদের সংখ্যাই অধিক; বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের সংঘগুরু এবং যতিরাও আছেন, সিদ্ধাচার্যরা আছেন এবং স্বল্পসংখ্যক কারণ-কায়স্থ, বৈদ্য এবং উত্তম-সংকর বা সৎশূদ্র পর্যায়ের কিছু কিছু লোকও আছেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি ধোয়ী তন্তুবায় ছিলেন এবং সমসাময়িক অন্য আর একজন কবি, জনৈক পাপীপ, জাতে ছিলেন কেবাট্ট বা কৈবর্ত। ব্ৰহ্মদেয় অথবা ধর্মদেয় ভূমি, দক্ষিণালব্ধ ধন ও সাময়িক পুরস্কার হল এই শ্রেণীর প্রধান আর্থিক নির্ভর। ভূম্যধিকারীর একটি শ্রেণীও অল্পবিস্তর সুস্পষ্ট এবং এই শ্রেণীও বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। সর্বোপরি স্তরে সামন্ত শ্রেণী এবং নীচে স্তরে স্তরে মহত্তর, মহামহত্তর ইত্যাদি ভূমিসম্পৃক্ত অভিজাত শ্রেণী থেকে শুরু করে একেবারে কুটুম্ব ও প্রধান প্রধান গৃহস্থ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূস্বামীর স্তর। এরা, বিশেষভাবে নিম্নতর স্তরের ভূস্বামীরাই শাসনোক্ত ‘অক্ষুদ্র প্রকৃতয়ঃ’। চতুর্থ একটি শ্রেণী হচ্ছে ক্ষেত্রকর বা কৃষকদের নিয়ে। দেশের ধনোৎপাদনের অন্যতম উপায় এদের হাতে; কিন্তু বণ্টন ব্যাপারে এদের কোনও হাত নেই; এরা অধিকাংশই স্বল্পমাত্র ভূমির অধিকারী অথবা ভাগচাষী ও ভূমিহীন চাষী। পাল ও সেন লিপিতে পঞ্চম একটি শ্রেণীর উল্লেখ আছে; এই শ্রেণীর লোকেরা সমাজের শ্রমিক-সেবক, অধিকাংশই ভূমি-বঞ্চিত, রাষ্ট্ৰীয়-সামাজিক অধিকার বঞ্চিত। এই শ্রেণী তথাকথিত অন্ত্যজ ও স্লেচ্ছাবর্ণের ও আদিবাসী কোমের নানা বৃত্তিধারী লোকদের নিয়ে গঠিত। লিপিগুলোতে বিশদভাবে এদের কথা বলা হয়নি, এবং যেটুকু বলা হয়েছে তাও পালপর্বের লিপিমালাতেই। ৮ম শতকের আগে এদের উল্লেখ নেই; পালপর্বের পরেও এদের উল্লেখ নেই। পালপর্বেও এদের সবাইকে নিয়ে নিম্নতম পেশা ও স্তরের নাম পর্যন্ত করে এক নিঃশ্বাসে বলে দেয়া হয়েছে, “মেদাস্ত্ৰচণ্ডালপর্যন্তান”— একেবারে চণ্ডাল পর্যন্ত। কিন্তু পাল ও সেন-আমলের সমসাময়িক সাহিত্যে— কাব্যে, পুরাণে, স্মৃতিগ্রন্থে— এদের বর্ণ ও বৃত্তিমর্যাদা সম্বন্ধে বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়। লিপি প্রমাণদ্বারাও সমসাময়িক সাহিত্যের সাক্ষ্য সমর্থিত হয়। রাজক ও নাপিতরাও সমাজশ্রমিক, সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার কর্ষক বা ক্ষেত্ৰকারও বটে। জনৈক রাজক সিরাপা ও নাপিত গোবিন্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্ৰীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবের লিপিতে। মেদ, অন্ধ, চণ্ডাল ছাড়া আরও দুয়েকটি অস্ত্যজ ও স্লেচ্ছ পর্যায়ের, অর্থাৎ নিম্নতম অর্থনৈতিক স্তরের লোকদের খবর সমসাময়িক লিপিতে পাওয়া যায়, যেমন পুলিন্দ, শবর ইত্যাদি। চর্যাপদে যে ডোম, ডোম্বী বা ডোিমনী, শবর-শবরী, কাপালিক ইত্যাদির কথা বার বার পাওয়া যায় তারাও এই শ্রেণীর। একটি পদে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ডোন্ধীর কুঁড়িয়া (কুঁড়ে ঘর) নগরের বাইরে; এখনও তো তারা গ্রাম ও নগরের বাইরেই থাকে। বাঁশের চাংগাড়ী ও বাঁশের তাত তৈরী করা তখন যেমন ছিল এদের কাজ, এখনও তাই। শিল্পীশ্রেণীর মধ্যে তন্তুবায় সম্প্রদায়ের খবরও চর্যাগীতিতে পাওয়া যায়; সিদ্ধাচার্য তন্ত্রীপাদ সিদ্ধিপূর্বজীবনে এই সম্প্রদায়ের লোক এবং তাঁতিগুরু ছিলেন বলেই মনে হয়।

শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী

কিন্তু ৮ম শতক থেকে শুরু করে এই যে বিভিন্ন শ্রেণীর সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তার মধ্যে শিল্পী, বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর উল্লেখ কোথায়? এই সময়ের ভূমি দান-বিক্রয়ের একটি পট্টোলীতেও ভুল করেও বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর কোনও ব্যক্তির উল্লেখ নেই; এটা আশ্চর্য নয় কি? ৮ম শতক-পূর্ববর্তী লিপিগুলোও ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় অধিকরণ উপলক্ষেই যে শুধু নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম সার্থিবাহ ও প্রথম কুলিকের নাম করা হচ্ছে, তাই নয়, কোনও কোনও লিপিতে “প্রধানব্যাপারিণঃ’ বা প্রধান ব্যবসায়ীদেরও উল্লেখ করা হচ্ছে, অন্যান্য শ্রেণীর ব্যক্তিদের সঙ্গে বণিক ও ব্যবসায়ীদেরও বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। রাষ্ট্র-ব্যাপারেও তাদের বেশ কিছু আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ৮ম শতকের পর এমন কি হল, যার ফলে পরবর্তী লিপিগুলোতে এই শ্রেণীটির কোনো উল্লেখ রইল না? ভূমিদানের ব্যাপারে শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপিত করারও কোনও প্রয়োজন হয়নি, এই তর্ক উঠিতে পারে।

এ যুক্তি হয়তো কিছুটা সত্য, কিন্তু প্রয়োজন কি একেবারেই নেই? যে-গ্রামে ভূমিদান করা হচ্ছে, সে-গ্রামের সকল শ্রেণী ও সকল স্তরের লোক, এমন কি চণ্ডাল পর্যন্ত সকলের উল্লেখ করা হচ্ছে, অথচ শ্রেণী হিসাবে শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ীদের কোনও উল্লেখই হচ্ছে না। এতগুলো নাম ও তৎসম্পৃক্ত ভূমিদানের উল্লেখ আমরা পাচ্ছি, অথচ তার মধ্যে একটি গ্রামেও শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোক কি ছিলেন না? আর যেখানে রাজসেবকদের উল্লেখ করা হচ্ছে, সেখানেও তো নগরশ্ৰেষ্ঠী বা সার্থবহ বা কুলিক ইত্যাদির কারও উল্লেখ পাচ্ছি না। অথচ, ৭ম শতক পর্যন্ত তারাই তো স্থানীয় অধিকরণের প্রধান সহায়ক, তারা এবং ব্যাপারীরাই স্থানীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সংব্যবহারী। অথচ এদের কোনো উল্লেখ নেই।

এই অনুল্লেখ আকস্মিক নয়। ৮ম শতকের পরে শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী ছিলেন না, এইরূপ অনুমান মুর্খতা মাত্র। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, খালিমপুর লিপির “প্ৰত্যাপণে মানপৈঃ”— দোকানে দোকানে মানপদের দ্বারা ধর্মপালের যশ কীর্তনের কথা, তারনাথ কথিত শিল্পী ধীমান ও বীটপালের কথা, শিল্পী মহীধর, শিল্পী শশিদেব, শিল্পী কর্ণভদ্র, শিল্পী তথাগতসর, সূত্ৰধার বিষ্ণুভদ্র এবং আরও অগণিত শিল্পী যারা পাল লিপিমালা ও অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ করেছিলেন তাদের কথা; বণিক বুদ্ধমিত্র ও বণিক লোকদত্তের কথা। মহারাজাধিরাজ মহীপালের রাজত্বের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ রােজ্যাঙ্কে বিলকিন্দক (ত্রিপুরা জেলার বিলকান্দি) গ্রামবাসী শেষোক্ত দুই বণিক একটি নারায়ণ ও একটি গণেশমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শুধু পাল আমলেই তো নয়; সেন আমলেও শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীদের অপ্রাচুর্য ছিল না। শিল্পীদের তো গোষ্ঠীই ছিল এবং বিজয়সেনের আমলে জনৈক রাণিক শিল্পীগোষ্ঠীর অধিনায়ক ছিলেন। পূর্বোক্ত ভাটেরা গ্রামের গোবিন্দকেশবের লিপিতে এক কাংস্যকার (কঁসারী) এবং দন্তকারের (হাতির দাতের কাজ যাহারা করেন) খবর পাওয়া যাচ্ছে। বল্লালচরিতে বণিক ও বিশেষভাবে সুবর্ণবণিকদের উল্লেখ তো সুস্পষ্ট। আর বৃহদ্ধর্ম ও ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণ দুটিতে তো শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর অগণিত উপবর্ণের তালিকা পাওয়া যাচ্ছে। শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখ করা যায়, তন্তুবায়-কুবিন্দক, কর্মকার, কুম্ভকার, কংসকার, শঙ্খকার, তক্ষণ-সূত্ৰধার, স্বর্ণকার, চিত্রকার, অট্টালিকাকার, কোটক ইত্যাদি। বণিক-ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা পাচ্ছি, তৈলিক, তৌলিক, মোদক, তাম্বলী, গন্ধৰ্ব্বণিক, সুবর্ণবণিক, তৈলকর, ধীবর ইত্যাদির।

শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী সমাজে তাহলে নিশ্চয়ই ছিলেন; কিন্তু ৮ম শতকের পূর্বে শ্রেণী হিসেবে তাদের যে প্রাধান্য রাষ্ট্রে ও সমাজে ছিল, সেই প্রাধান্য ও আধিপত্য ৭ম শতকের পর থেকেই কমে গিয়েছিল। বণিক ও ব্যবসায়ী পেশাধারী যেসব বর্ণের তালিকা ওপরোক্ত দুই পুরাণ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, লক্ষণীয় এই যে, এরা সবাই ক্ষুদ্র বণিক ও ব্যবসায়ী স্থানীয় দেশান্তর্গত ব্যাবসা-বাণিজ্যেই যেন এদের স্থান। প্রাচীনতর কালের, অর্থাৎ পঞ্চম ও ৬ষ্ঠ শতকের এবং হয়তো তারও আগেকার কালের শ্রেষ্ঠী ও সার্থবাহরা কোথায় গেলেন? এদের উল্লেখ সমসাময়িক সাহিত্যে বা লিপিতে নেই কেন?

ঠিক এই সময় থেকেই অর্থাৎ মোটামুটি ৮ম শতক থেকেই প্রাচীন বাংলার সমাজ কৃষিনির্ভর হয়ে পড়তে আরম্ভ করে, এবং ক্ষেত্রকর-কর্ষকেরাও বিশেষ একটি শ্রেণীরূপে গড়ে ওঠেন, এবং সেভাবেই সমাজে স্বীকৃত হন। ৮ম শতকের আগে তাদের সুনির্দিষ্ট শ্রেণী হিসাবে গড়ে উঠবার কোনও প্রমাণ নাই। শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর পক্ষে হল ঠিক তার বিপরীত। পঞ্চম থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত দেখি— বোধহয় খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক থেকেই – বিশেষভাবে শ্রেণী হিসাবে তাদের উল্লেখ না থাকলেও রাষ্ট্র ও সমাজে এরাই ছিলেন প্রধান, তাদেরই আধিপত্য ছিল অন্যান্য শ্রেণীর লোকদের চাইতে বেশি। এর একমাত্র কারণ, তদানীন্তর বাঙালী সমাজ প্রধানত শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য নির্ভর। এই তিন উপায়েই ধনোৎপাদনের প্রধান তিন পথ, এবং সামাজিক ধন বণ্টনও অনেকাংশে নির্ভর করত এদের ওপর। কৃষিও তখন ধনোৎপাদনের অন্যতম উপায় বটে, কিন্তু প্রধান উপায় শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য। ৮ম শতক থেকে সমাজ অধিকতর কৃষিনির্ভর, এবং উত্তরোত্তর এই নির্ভরতা বেড়েই গিয়েছে, শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য ধনোৎপাদনের প্রধান ও প্রথম উপায় আর থাকেনি, এবং সেজন্যই রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের প্রাধান্যও আর থাকেনি। ব্যক্তি হিসাবে কারও কাহারও মর্যাদা স্বীকৃতি হলেও শ্রেণী হিসাবে ৭ম শতক-পূর্ব মর্যাদা আর তারা ফিরে পাননি। লক্ষণীয় যে, অনেক শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোক বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে মধ্যম-সংকর বা অসৎশদ্র পর্যায়ভুক্ত; যারা উত্তম-সংকর বা সৎশুদ্র পর্যায়ভুক্ত তাদেরও মর্যাদা কারণ-কায়স্থ, বৈদ্য-অম্বষ্ঠ, গোপ, নাপিত প্রভৃতির নিচে। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের সাক্ষ্যে দেখছি, শিল্পী, স্বর্ণকার, সূত্ৰধার ও চিত্রকার এবং কোনও কোনও বণিক সম্প্রদায়কে মধ্যম সংকর পর্যায়ে স্থান দেয়া হয়েছে। বল্লালচরিতের সাক্ষ্য প্রামাণিক হলে স্বীকার করতে হয়, বণিক ও বিশেষভাবে সুবৰ্ণ বণিকদের তিনি সমাজে পতিত করে দিয়েছিলেন। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র ও সমাজে এদের প্রাধান্য থাকলে, ধনোৎপাদন ও বণ্টন ব্যাপারে। এদের আধিপত্য থাকলে এরূপ স্থান নির্দেশ বা অবনতিকরণ কিছুতেই সম্ভব হত না।

সদ্যোক্ত মন্তব্য ঐতিহাসিক অনুমান সন্দেহ নেই, তবু যুক্তিটি যদি ঐতিহাসিক মর্যাদার বিরোধী না হয় এবং ধনসম্বল অধ্যায়ে সামাজিক ধনের বিবর্তনের ইঙ্গিত, মুদ্রার ইঙ্গিত, ভূমি-বিন্যাস এর বিষয়গুলো যদি সত্য হয়, তাহলে এই অনুমানও ঐতিহাসিক সত্যের দাবি রাখে। তবে এই অনুমানের সপক্ষে সমসাময়িক যুগের (দ্বাদশ শতক) একটি কবির একটি শ্লোক আমি উদ্ধার করা যায়। এই শ্লোক ঐতিহাসিক দলিলের মূল্য ও মর্যাদা দাবি করে না। সত্য কিন্তু এই শ্লোকটিতে ওপরোক্ত সামাজিক বিবর্তনের অর্থাৎ বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অবনতি এবং কৃষক-ক্ষেত্রকর সম্প্রদায়ের উন্নতির ইঙ্গিত অত্যন্ত সুস্পষ্ট। গোবর্ধন আচার্য ছিলেন লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি; তারই রচনা এই পদটি। প্রাচীনকালে শ্রেষ্ঠীরা শক্ৰধ্বজোত্থান পূজা (ইন্দ্রের ধ্বজার পূজা) উৎসব করতেন; দ্বাদশ শতকেও উৎসবটি হত কিন্তু তখন শ্রেষ্ঠীরা আর ছিলেন না।
তে শ্রেষ্ঠানঃ রূ সম্প্রতি শক্ৰধ্বজ যৈঃ কৃতস্তবোচ্ছায়াঃ।
ঈষাং বা মেঢ়িং বাধূনাতনাস্ত্ৰাং বিধিৎসন্তি ৷।
হে শক্ৰধ্বজ! যে শ্রেষ্ঠীরা (একদিন) তোমাকে উন্নত করে গিয়েছিলেন, সম্প্রতি সেই শ্রেষ্ঠীরা কোথায়! ইদানীংকালে লোকেরা তোমাকে (লাঙ্গলের) ঈষ অথবা মেঢ়ি (গরু বাধিবার গোজ) করতে চাচ্ছে।
এই একটি শ্লোকে ব্যাবসা-বাণিজ্যের অবনতিতে এবং একান্ত কৃষিনির্ভরতায় বাঙালী সমাজের আক্ষেপ গোবর্ধন আচার্যের কণ্ঠে যেন বাণীমূর্তি লাভ করেছে। একটু প্রচ্ছন্ন শ্লেষও কি নেই!

সার সংক্ষেপ

৫ম শতকের পুর্বে

সুপ্রাচীন বাংলার শ্রেণী-বিন্যাস সম্বন্ধে পঞ্চম শতকের আগে উপাদানের অভাবে কিছু বলা কঠিন। তবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰ, জাতকের গল্প, মিলিন্দপঞহ, পেরিপ্লাস-গ্রন্থ, টলেমির বিবরণ, কথাসরিৎসাগরের গল্প, বাৎস্যায়নের কামসূত্র, মহাভারতের গল্প, গ্ৰীক ঐতিহাসিকদের বিবরণ, এবং সমসাময়িক সাহিত্যে প্রাচীন বাংলার শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধির যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে মনে হয়, শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ীদের একাধিক সুসমৃদ্ধ সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক শ্রেণী দেশে বিদ্যমান ছিল, এবং রাষ্ট্রে ও সমাজে তাদের প্রভাব এবং আধিপত্যও ছিল যথেষ্ট। ধনোৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় এই শ্রেণীগুলোর প্রভুত্ব সহজেই অনুমেয়। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে গৌড়, বঙ্গ, পুণ্ডে যে নাগর-সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় তা যে সদাগরী ধনতন্ত্রেরই সৃষ্টি এ-সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশের সুযোগ নেই। ধর্ম ও অধ্যাপনাজীবী একটি শ্রেণীর আভাসও পাওয়া যায়, এবং এই শ্রেণী জৈন এবং বৌদ্ধ যতি ও ব্রাহ্মণদের নিয়ে গঠিত। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের ব্ৰাহ্মণদেকে অর্জুন অনেক ধনরত্ন উপহার দিয়েছিলেন, এ-তথ্য মহাভারতেই উল্লিখিত আছে (১৷৷২১৬)। বাৎস্যায়নও গৌড়-বঙ্গের ব্রাহ্মণদের কথা বলেছেন (৬।৩৮,৪১); সদাগরী ধনতন্ত্রপুষ্ট নাগর-সভ্যতা তাদেরও স্পর্শ করেছিল।

বাংলায় স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তখন ছিল না। কিন্তু কৌম সমাজযন্ত্রের কথা ছেড়ে দিলেও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের রাষ্ট্রযন্ত্র তো একটা ছিলই; মহাস্থানশিলাখণ্ড-লিপিই তার প্রমাণ। সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে কেন্দ্ৰ করে যত ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণই হউক, রাজপদোপজীবীদের একটি শ্রেণীও গড়ে উঠেছিল, এই অনুমান অসঙ্গত নয়। এদেরই অভিজাত প্রতিনিধি হচ্ছেন গলদন— বাংলায় মৌর্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধি অর্থাৎ মহামাত্র। সর্বনিম্ন শ্রেণীস্তরের একটু আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে এই স্তরে ছিল ক্ৰীতদাসেরা। বাৎস্যায়ন এই ক্রীতদাসদের কথা বলেছেন (৬৩৮)। পৃথিবীর সর্বত্রই সদাগরী ধনতন্ত্রের সঙ্গে ক্রীতদাস প্রথা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত; বাংলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হিন্দু আমলের শেষ পর্যন্ত এই প্রথা বাংলায় প্রচলিত ছিল, জীমূতবাহন তার দায়ভাগ গ্রন্থে সেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। বাংলার দাস ক্রয়-বিক্রয়ের প্রথা অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকেও প্রচলিত ছিল, তার প্রমাণস্বরূপ পট্ৰিকৃত দলিলপত্র আজও বাংলার সর্বত্র পাওয়া যায়। ক্রমপ্রসারমান আর্য-ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রান্তসীমায় যে-সমস্ত আদিবাসী কোম স্থান পাচ্ছিলেন তারাও অর্থনৈতিক শ্রেণীসমূহের নিম্নস্তরেই নিবদ্ধ হচ্ছিলেন, এ-অনুমানও খুব অসঙ্গত নয়।

৫ম-৭ম শতক পর্ব

পঞ্চম শতকের গোড়া থেকেই প্রায় ৮ম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শ্রেণীবিন্যাসগত সামাজিক চেহারাটা সুস্পষ্ট ধরতে পারা অনেক সহজ। এই পর্বে বাঙালী সমাজ প্রধানত শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য নির্ভর; অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসাবে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীর উল্লেখ না থাকলেও সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের প্রাধান্য পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কৃষক, ক্ষেত্রকর, কৃষিকর্ম, সবই সমাজে রয়েছে, কৃষিকর্মের বলে সমাজে ধনোৎপাদনও হচ্ছে, কিন্তু যেহেতু সমাজ প্রথমত ও প্রধানত শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য নির্ভর, এবং ভূমি সম্পদ ও কৃষিকৰ্ম সামাজিক ধনের স্বল্প অংশ মাত্র, সেহেতু কৃষকরা তখনও সুসমৃদ্ধ-সুসম্বন্ধ শ্রেণী হিসাবে গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি, এবং সেইভাবে রাষ্ট্রে ও সমাজে স্বীকৃতিলাভও করতে পারেনি। কিন্তু ৬ষ্ঠ শতকেই সামন্ত প্রথা স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠালাভ করছে, ভূমির চাহিদা বাড়তে আরম্ভ করেছে; বোঝা যাচ্ছে, সমাজ ভূমিসম্পদকেই যেন প্রধান সম্পদ বলে মেনে নেয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ৭ম শতকের শেষার্ধ ও ৮ম শতকের প্রথমার্ধপ্রায় জুড়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আবর্ত এবং পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের দ্রুত অগ্রগতির স্রোতে এই বিবর্তন যেন সম্পূর্ণ হল; শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য যেন ধনোৎপাদনের প্রথম ও প্রধান উপায় আর রইল না। এর কারণ একাধিক, যাইহোক, এই পর্বে অভিজাত ও অনভিজাত রাজপুরুষ, সংব্যবহারী ও রাজসেবকদের দেখা যাচ্ছে; কিন্তু স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তখনও গড়ে ওঠেনি বলে রাজকর্মচারী বা রাজসেবকদের সুনির্দিষ্ট শ্ৰেণী তখনও গড়ে ওঠেনি; তার সূচনামাত্র দেখা যাচ্ছে। জৈন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির ধারক ও নিয়ামক বুদ্ধি-বিদ্যা-জ্ঞান-ধৰ্মজীবী শ্রেণীর পরিচয় এই যুগে সুস্পষ্ট। তাদের মর্যাদা ও সম্মাননা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, এবং তারা যে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিপাল্য সেই দাবিও স্বীকৃত হয়েছে। নিম্নতর শ্রেণীস্তরের লোকেরা তো নিশ্চয়ই ছিলেন; কিন্তু তারা সমাজের প্রধান শ্রেণীগুলোর বাইরে। অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসাবে তারা গড়ে ওঠেননি, সেই হিসেবে তাদের কোনো মূল্য স্বীকৃতও হয়নি; উল্লেখও তাই নেই।

৮ম হতে ১৩শ শতক পর্ব

অষ্টম হতে ১৩শ শতক পর্যন্ত অর্থাৎ আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত বাঙালী সমাজ প্রধানত ও প্রথমত কৃষিনির্ভর। সামন্ত প্রথা সুপ্রতিষ্ঠিত, ভূমিই সমাজের প্রধান সম্পদ এবং সেই ভূমির অধিকারের বিচিত্র ক্রমসংকুচীয়মান স্তর নিয়েই এই যুগের সমাজ। এর একপ্রান্তে জনপদজোড়া ভূমির অধিকার নিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপে দণ্ডায়মান মুষ্টিমেয় মহামাণ্ডলিক-মহাসামন্তরা; অন্যদিকে লেশমাত্র ভূমিবিহীন অসংখ্য প্রজার দল; মধ্যস্থলে ভূমিস্বত্বাধিকারের নানা স্তর। এই বিচিত্র স্তরই প্রধানত শ্রেণীনির্দেশের দ্যোতক। এটিই এই যুগের প্রথম ও প্রধান সামাজিক বৈশিষ্ট্য। যেহেতু সমাজ প্রধানত ভূমিনির্ভর তাই এই পর্বে কৃষক-ক্ষেত্রকর শ্রেণীও সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নিয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। একই কারণে গ্রাম্য সমাজে ভূমিসম্পদসমৃদ্ধ একটি ভূম্যধিকারী, এবং আর একটি কৃষিসম্পদসমৃদ্ধ গ্রাম্য কুটুম্ব, গৃহস্থ, ভদ্র শ্রেণীও গড়ে উঠেছে।

এদের ঠিক পৃথক একটি শ্রেণী বলা হয়তো উচিত নয়, বরং একই শ্রেণীর বিভিন্ন স্তর বললেই যথাৰ্থ বলা হয়। শিল্পী, বণিক এবং ব্যবসায়ীরাও সমাজে আছেন; শিল্পকর্ম, ব্যাবসা-বাণিজ্যও চলছে। কিন্তু ভূমিনির্ভর, কৃষিনির্ভর সমাজে শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য ধনোৎপাদনের অন্যতম উপায় মাত্র, প্রধান উপায় আর নয়। সেজন্য শ্রেণী হিসাবে এই শ্রেণীদের অস্তিত্বের খবর নেই, রাষ্ট্রে এবং সমাজে তাদের প্রাধান্যও আর নেই। স্বতন্ত্র স্বাধীন স্বসীমাবদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে ওঠার ফলে রাজপাদোপজীবী বলে একটি বিশেষ সুস্পষ্ট শ্রেণী এই পর্বে গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যেও আবার বিভিন্ন স্তর; একপ্রান্তে ওপরিক, রাজস্থানীয়, মহাসেনাপতি, মহাধৰ্মাধ্যক্ষ, মহামন্ত্রী ইত্যাদি; অন্যপ্রান্তে তরিক, শৌন্ধিক, গৌলিক, চাটভাট, ক্ষুদ্র করণ, বেতনভুক সৈন্য, প্রহরী ইত্যাদি। যাইহোক, রাজপদোপজীবী শ্রেণীরই আনুষঙ্গিক ছায়ারূপে রাষ্ট্ৰসেবক শ্রেণীর আভাসও সুস্পষ্ট। এদের মধ্যে ভূমিসম্পদ-নির্ভর শ্রেণীস্তর সমূহের লোকেদের দর্শনও মিলছে। বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-ধৰ্মজীবী শ্রেণীও সুস্পষ্ট; এই শ্রেণীতেও বিভিন্ন স্তর। একপ্রান্তে তিন্তিড়িপত্র ও শাকান্নভুক বিনয়নম্র ব্রাহ্মণ পুরোহিত বা পণ্ডিত; অন্যপ্রান্তে প্রভূত অর্থসমৃদ্ধ রাজপণ্ডিত বা পুরোহিত, পৌরোহিত্য ও অধ্যাপনার ছদ্মবেশে সমৃদ্ধ ভূম্যধিকারী। ভূমিহীন সমাজ শ্রমিকশ্রেণীও সুস্পষ্ট; এরা অধিকাংশ অস্ত্যজ বা ম্লেচ্ছ বর্ণবদ্ধ, স্বল্পসংখ্যক মধ্যম-সংকর বা অসৎশুদ্র পর্যায়ের নিম্নস্তরে। পালপর্বে চণ্ডাল পর্যন্ত সমাজের নিম্নতম শ্রমিক শ্রেণীস্তর সমাজদৃষ্টির সামনে উপস্থিত; কিন্তু সেন-আমলে ব্রাহ্মণ্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অত্যুচ্চারণের ফলে, সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দৃষ্টির আচ্ছন্নতার ফলে তাদেরকে সমাজদৃষ্টির বাহিরে রেখে দেয়া হয়েছে। বৌদ্ধ মহাযান-বজ্ৰযান —মন্ত্রযান-সহজযানে ডোম-ডোন্ধী, শবর-শবরীদেরও স্বীকৃতি ছিল; চর্যাগীতিই তার প্রমাণ। ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতিতে তা ছিল না, কাজেই সেন-আমলে সমাজ-শ্রমিক শ্রেণীর এই অবজ্ঞা কিছু অস্বাভাবিক নয়।

ভূমি-বিণ্যাস

ভূমিদান এবং ক্রয়-বিক্রয়ের রীতি

ভূমিকা

ভূমি- ব্যবস্থাসম্পর্কিত যে-সব পট্টোলী প্রাচীন বাংলায় এপর্যন্ত পাওয়া গেছে, সেগুলোকে মোটামুটি দুভাগে ভাগ করা যায় – খ্ৰীষ্টোত্তর পঞ্চম থেকে ৮ম শতক পর্যন্ত লিপিগুলো সমস্ত ভূমিদান-বিক্রয় সম্পর্কিত, এই লিপিগুলোতে ভূমিদান-বিক্রয় রীতির ক্রমও কম বেশি বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার ফলে ভূমি-সম্পর্কিত দায় ও অধিকার, ভূমির প্রকারভেদ ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক প্রকার সংবাদ এই লিপিগুলোতে পাওয়া যায়। রাজার দ্বারা ব্ৰাহ্মণকে কিংবা দেবতার উদ্দেশে ভূমি-দান লিপি বা দলিল প্রাচীন ভারতে অজ্ঞাত নয়; কিন্তু প্ৰাচীন বাংলার এই পর্বের লিপিগুলো ঠিক এই জাতীয় ব্ৰহ্মদেয় বা দেবোত্তর ভূমি-দানের পট্ট বা দলিল নয়। এই শাসনগুলো একটু বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রাচীন বাংলার ভূমি-ব্যবস্থা সম্বন্ধে এমন সব সংবাদ পাওয়া যায় যা সাধারণত প্রাচীন ভারতের ভূমিদান-সম্পর্কিত শাসনগুলোতে বেশি দেখা যায় না।

৫ম থেকে ৮ম শতকের লিপি

প্রথমেই দেখা যাচ্ছে, ভূমি-ক্রয়েচ্ছু যিনি তিনি স্থানীয় রাজসরকারের কাছে আবেদন বিজ্ঞাপিত করছেন। ক্রয়েচ্ছু একজনও হতে পারেন, একজনের বেশিও হতে পারেন, এবং একাধিক ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি একই সঙ্গে ক্ৰয়ের ইচ্ছা বিজ্ঞাপিত করতে পারেন। যেমন বৈগ্রাম তাম্রপট্টোলীতে দেখা যায় একই সঙ্গে দুই ভাই, ভোয়িল ও ভাস্কর, একত্র রাজ্যসরকারের ভূমি-ক্রয়ের আবেদন জানাচ্ছেন। পাহাড়পুর পট্টোলীতে দেখা যায়, ব্ৰাহ্মণ নাথশৰ্মা ও তার স্ত্রী রামী একই সঙ্গে আবেদন উপস্থিত করছেন। ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা সাধারণ গৃহস্থও হতে পারেন, অথবা রাজসরকারের কর্মচারী বা তৎসম্পর্কিত ব্যক্তি বা অধিকরণের সভ্যও হতে পারেন। ধনাইদহ তাম্রপট্টোলীতে দেখা যাচ্ছে ভূমি-ক্রেতা হচ্ছেন একজন আয়ুক্তক বা রাজকর্মচারী; ৪নং দামোদরপুর তাম্রশাসনে উল্লিখিত নগরশ্রেষ্ঠী রিভুপাল স্থানীয় অধিষ্ঠানাধিকরণের একজন সভ্য; বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর পট্টোলীতে আবেদন-কর্তা হচ্ছেন মহারাজ রুদ্রদত্ত, যিনি মহারাজ বৈন্যগুপ্তের পদদাস, তবে রুদ্রদত্ত মূল্য দিয়ে ভূমি ক্রয় করেছিলেন, না বিনামূল্যেই তা লাভ করেছিলেন, স্পষ্ট করে শাসনে বলা হয়নি; ধর্মদিতে্যুর ১নং পট্টোলীতে ভূমি-ক্রেতার নাম বাটভোগ, যিনি ছিলেন সাধনিক, এবং এই উপাধি থেকে মনে হয় তিনি রাজকর্মচারী ছিলেন; গোপচন্দ্রের পট্টোলীতে ভূমি-ক্রেতা হচ্ছেন বৎসপাল যিনি ছিলেন বারকমণ্ডলের বিষয়-ব্যাপারের কর্তা, রাষ্ট্রের বিনিযুক্তক (বারিক বিষয়-ব্যাপারায় বিনিযুক্তক বৎসপাল স্বামিনা), অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র-সম্পর্কিত ব্যক্তি; ত্রিপুরা জেলায় প্ৰাপ্ত লোকনাথের পট্টোলীতেও ব্ৰাহ্মণ মহাসামন্ত প্ৰদোষশর্মণ এই জাতীয় জনৈক রাষ্ট্রযন্ত্র-সম্পর্কিত ব্যক্তি, কিন্তু তিনি মূল্য দিয়া ভূমি লাভ করেছিলেন কিনা তা শাসনে সুস্পষ্ট উল্লিখ করা হয়নি। রাজসরকল্প বলতে সাধারণত যে অধিষ্ঠান বা বিষয়ে প্রস্তাবিত ভূমির অবস্থিতি সেই অধিষ্ঠানের আয়ুক্তক ও অধিষ্ঠানাধিকরণ, অথবা বিষয়ের বিষয়পতি ও বিষয়াধিকরণ এবং স্থানীয় প্রধান প্রধান লোকদের বোঝায়। দুই-একটি পট্টোলীতে মাঝে মাঝে এর অল্পবিস্তর ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যায়না, তবে তা খুব উল্লেখযোগ্য নয়, একারণে যে, সর্বত্রই ভূমির প্রকৃত অধিকারীর পক্ষে স্থানীয় প্রতিনিধিদের বিজ্ঞাপিত করাটাই ছিল সাধারণ নিয়ম। রাজসরকারের উল্লেখ-প্রসঙ্গে তদানীন্তন রাজার এবং ভুক্তিপতি বা ওপরিকের নামও উল্লেখ করার রীতি প্রচলিত ছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শাসনের এই অংশে লিপির তারিখও দেওয়া হয়েছে।

এই সাধারণ বিজ্ঞপ্তির পরেই দেখা যায়, ভূমি-ক্রয়ের বিশেষ উদ্দেশ্যটি কী, তা আবেদন-কর্তা সাধারণত প্রথম পুরুষেই বিজ্ঞাপিত করছেন, এবং তিনি যে, ক্ষেত্র, খিল, অথবা বাস্তুভূমির স্থানীয় প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মূল্য দিতে প্রস্তুত আছেন, তাও বলছেন। দেখা যাচ্ছে, সর্বত্রই ভুমি-ক্রয়ের প্রেরণা ক্রীত-ভূমি দেবীকার্য বা ধর্মাচরণোদেশে দানের ইচ্ছা।

তৃতীয় পর্বে পুস্তপাল বা দলিল-রক্ষকের বিবৃতি। ভূমি-ক্রয়েছু ব্যক্তির আবেদন রাজসরকারে পৌঁছলেই রাজসরকার তা পুস্তপাল বা পুস্তপালদের দপ্তরে পাঠাচ্ছেন; পুস্তপাল বা পুস্তপালেরা প্রস্তাবিত ভূমি আর কারও ভোগ্য কিনা, আর কারও অধিকারে আছে কি না, অন্য কেউ সেই ভূমি ক্রয়ের ইচ্ছা জানিয়েছে কিনা, ভূমির মূল্য যথাযথ নির্ধারিত হয়েছে কিনা, রাজসরকারের কোনও স্বার্থ তাতে আছে কিনা ইত্যাদি জ্ঞাতব্য তথ্য নির্ণয় করছেন তার বা তাদের দপ্তরে রক্ষিত কাগজপত্র, শাসন ইত্যাদির সাহায্যে, এবং কোনও প্রকার আপত্তি না থাকলে প্রস্তাবিত ভূমি বিক্রয়ের সম্মতি জানাচ্ছন। যে কয়েকটি শাসনের খবর জানা যায় তার প্রত্যেকটিতে পুস্তপাল-দপ্তরের সম্মতিই বিজ্ঞাপিত হয়েছে; এই কারণে অনুমান করা স্বাভাবিক যে, ব্যাপারটা নেহাৎই কার্যক্রমাগত। কিন্তু বোধহয়, এই অনুমান সর্বত্র সংগত নয়। ৫নং দামোদরপুর পট্টোলীতে বিষয়পতির সঙ্গে পুস্তপালের একটু বিরোধের (বিষয়পতিনা কশ্চিদ্বিরোধঃ) ইঙ্গিত যেন আছে। কী নিয়ে বিরোধ বেধেছিল তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি; তবে অনুমান হয় যে, বিষয়পতির পক্ষ হতে কোনও আপত্তি ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মহারাজাধিরাজের কাছে গিয়ে বিষয়পতির আপত্তি টেকেনি।

চতুর্থ পর্বে রাষ্ট্রের অনুমতি। যথানির্ধারিত মূল্য গ্রহণের পর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্থানীয় রাজসরকার ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ভূমি বিক্রয়ের অনুমতি দিচ্ছেন, এবং প্রস্তাবিত ভূমি যে গ্রামে অবস্থিত সেই গ্রামের প্রধান প্রধান ব্যক্তি ও ব্রাহ্মণ-কুটুম্বদের ও রাজপুরুষদের সামনে অনুযায়ী ভূমির মাপজোখ করে বিক্ৰীত ভূমি ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিদিগকে হস্তান্তরিত করে দিচ্ছেন। কী শর্তে তা দিচ্ছেন, তাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে প্রায় সর্বত্রই এই শর্ত অক্ষয়নীবীধর্মানুযায়ী।

পঞ্চম পর্বে ক্রেতার বা বিক্রেতার পক্ষ থেকে ক্ৰীত বা বিক্ৰীত ভূমি-দানের বিবৃতি। এই পর্বে ক্রেতা অথবা বিক্রেতা কাকে বা কাদের কী উদ্দেশ্যে, কোন শর্তে ক্ৰীত ভূমি দান করছেন তা বলা হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ক্রেতার পক্ষ থেকে বিক্রেতাও তা করছেন।

ষষ্ঠ অথবা সর্বশেষ পর্বে এই জাতীয় দত্তভূমি রক্ষণাপহরণের পাপপুণ্যের বিবৃতি দেয়া হচ্ছে এবং শাস্ত্রোক্ত শ্লোকে তা সমাপ্ত হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই পর্বে শাসনের তারিখ উল্লিখিত আছে। স্থানীয় রাজসরকারের শীলমোহরদ্বারা এসব পট্টোলী নিয়মানুযায়ী পট্টীকৃত আধুনিক ভাষায় রেজিস্ট্রি করা হত।

সমস্ত তাম্রশাসনেই যে সব কটি পর্বের উল্লেখ একই ভাবে আছে, তা নয়। কোনও কোনও তাম্রপাট্ট সব কটি পর্বের বিস্তৃত উল্লেখ নেই, কোনও পর্বের আভাসমাত্র আছে, আবার কোথাও কোথাও একেবারে বাদও দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, কোনও কোনও ক্ষেত্রে জমিত মাপজোখ ও সীমানির্দেশ রাজসরকার থেকে না করে গ্রামপ্রধানদের তা করার আদেশ দেয়া হয়েছে, যেমন পাহাড়পুর পট্টোলীতে। এরূপ অল্পস্বল্প ব্যতিক্রম কোথাও কোথাও থাকা সত্ত্বেও মোটামুটি পট্টোলীগুলো একই ধরনের।

কিন্তু এই পঞ্চম হতে ৮ম শতক পর্যায়ে একেবারে অন্য ধরনের ভূমি-দানের পট্টোলীও যে নেই তা বলা চলে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর পট্টোলী (৬ষ্ঠ শতক), জয়নাগের বপ্লঘোষবাট পট্টলী (৭ম শতক), লোকনাথের ত্রিপুরা পট্টোলী (৭ম শতক), এবং দেবখড়গের আম্রফপুরের দুটি পট্টোলীর (৮ম শতক) উল্লেখ করা যেতে পারে। এদের প্রত্যেকটিই ভূমি-দানের শাসন, দত্তভূমি ক্রয়ের কোনও উল্লেখই এদের মধ্যে নেই; কাজেই পূর্বোক্ত শাসনগুলোর ক্রমের সঙ্গে এই পট্টোলীগুলোর তুলনা করা চলে না। বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর তাম্রপট্টোলীতে মহারাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত স্বয়ং কিছু ভূমি দান করছেন মহাযানী সম্প্রদায়ের অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘকে; লোকনাথের ত্রিপুরা পট্টোলীতে রাজকর্মচারী ব্ৰাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশৰ্মণ এক অনন্তনারায়ণের মন্দির নির্মাণ ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং তার দৈনন্দিন ব্যয়নির্বাহের জন্য মহারাজ লোকনাথের কাছে কিছু ভূমি প্রার্থনা করছেন, এবং রাজা সেই ভূমিদান করছেন। জয়নাগের বিপ্লঘোষবাট পট্টোলী ও দেবখড়গের আস্রফপুর পট্টোলী দুটিতে ভূমিদানের অনুরোধ বা প্রার্থনা কেউ জানাচ্ছেন, এমন উল্লেখও নেই; রাজা নিজেই যথাক্রমে ভট্ট ব্ৰহ্মবীর স্বামী ও কোনও বৌদ্ধসংঘকে ভূমিদান করছেন, এটুকুই শুধু জানা যায়। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের নিধনপুর লিপিতে আর একটি প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাচ্ছে। ভাস্করবর্মার জনৈক উর্ধ্বতন পুরুষ রাজা ভূতিবৰ্মণ একবার কয়েকজন ব্রাহ্মণকে প্রচুর ভূমিদান করে দানকর্ম রাজসরকারে পট্টীকৃত করে তাম্রপট্টগুলো ব্রাহ্মণদের হাতে অৰ্পণ করেছিলেন। পরে কোনও সময়ে অগ্নিদাহে সেই তাম্রপট্টগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে ভূমির ভোগাধিকার নিয়ে পাছে কোনও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, বোধহয় এই আশঙ্কাতেই সেই ব্ৰাহ্মণদের বংশধরেরা ভাস্করবর্মণের কাছ থেকে পুরাতন দানক্রিয়া নতুন করে পট্টীকৃত করে নেন। ভাস্করবর্মণানুমোদিত তাম্রপট্টই বর্তমানে নিধনপুর পট্টোলী বলে খ্যাত; কিন্তু মূলত এই ব্রহ্মদেয় ভূমি রাজা ভূতিবৰ্মার দান।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আগে যে দানবিক্রয়-সম্পর্কিত পট্টোলীগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো সদ্যোক্ত পট্টোলীগুলো থেকে ভিন্ন। পূর্বোক্ত পট্টোলীগুলো প্রথমত ভূমি-ক্রয়বিক্রয়ের শাসন এবং দ্বিতীয়ত ভূমি-দানের শাসনও বটে। সদ্যোক্ত পট্টোলীগুলো শুধুই ভূমি দানের শাসন। ভূমি-ক্রয়ের শাসন কাকে বলে বাৰ্হস্পত্য ধর্মশাস্ত্ৰে তারই কেবল উল্লেখ আছে। বৃহস্পতি বলেন, ন্যায্য মূল্য দিয়ে কোনও ব্যক্তি যখন কোনও বাস্তু, ক্ষেত্র অথবা অন্য কোনও প্রকার ভূমি-ক্রয় করেন এবং মূল্যের উল্লেখসমেত ক্রয়কার্যের একটি শাসন লিপিবদ্ধ করে নেন, তখনই সে শাসনকে বলা হয় ভূমি-ক্ৰয়ের শাসন। পূর্বোক্ত লিপিগুলো যে বৃহস্পতি-কথিত ভূমি-ক্রয়ের শাসন এ সম্বন্ধে তাহলে কোনও সন্দেহ নেই। জার্মান পণ্ডিত য়লি (Jolly) মনে করেন, বৃহস্পতি খ্ৰীষ্টাত্তর ৬ষ্ঠ অথবা ৭ম শতকের লোক; যদি তা হয় তাহলে বৃহস্পতি পূর্বোক্ত পট্টোলীগুলোর প্রায় সমসাময়িক। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বাস্তু ও বাস্তু-বিক্রয় অধ্যায়ে সর্বপ্রকার ভূমি, ঘরবাড়ি, উদ্যান, পুষ্করিণী, হ্রদ, ক্ষেত্র ইত্যাদি বিক্রয়ের ক্রম ও রীতির উল্লেখ আছে; এই অধ্যায় থেকে আমরা জানতে পারি, এই ধরনের ক্রয়-বিক্রয় কুটুম্ব, প্রতিবাসী এবং সম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনে হওয়া উচিত, এবং যিনি সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে ভূমি ডেকে নিয়ে কিনতে রাজি হবেন তার কাছেই প্রস্তাবিত ভূমি বিক্রয় করতে হবে। ভূমির মূল্যের ওপর ক্রেতাকে রাজ সরকারে একটা করাও দিতে হবে, এ কথাও কৌটিল্য বলছেন। মূল্যের ওপর কোনও প্রকার করের উল্লেখ আমাদের লিপিগুলোতে নেই; এর কারণ সহজেই অনুমেয়। ক্রীত ভূমিমখণ্ডগুলো প্রায় সমস্তই ধর্মাচরণোদেশে দানের জন্য, এবং সেহেতুই তা করারহিত। তবে, ভূমি-বিক্রয়ের ব্যাপারটা যে কুটুম্ব, প্রতিবাসী এবং সম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনেই নিষ্পন্ন হত। তার উল্লেখ প্রায় প্রত্যেক লিপিতেই পাওয়া যায়। কিছুটা পূর্বোক্ত শাসনানুরূপ ভূমি-বিক্রয়ের অন্তত একটি পাথুরে প্রমাণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। এই লিপিটি নাসিকের একটি বৌদ্ধ-গুহার প্রাচীরে উৎকীর্ণ, এবং এর তারিখ খ্ৰীষ্টাত্তর দ্বিতীয় শতকের প্রথমার্ধ। এতে উল্লেখ আছে যে, ক্ষত্রপ নহপানের জামাতা, দীনীকপুত্র উষবদান্ত জনৈক ব্ৰাহ্মণের কাছ থেকে ৪,০০০ কার্ষপণ মুদ্রায় কিছু ক্ষেত্রভূমি ক্রয় করিয়াছিলেন, তা গুহাবাসী ভিক্ষুসংঘকে দান করেছিলেন। উষবদাত ভূমি ক্ৰয় করেছিলেন জনৈক গৃহস্থের কাছ থেকে, রাজা বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নয়, কাজেই সে ক্ষেত্রে যে সুবিস্তৃত ক্রমের উল্লেখ প্রাচীন বাংলার পূর্বোক্ত লিপিগুলোতে আছে তারও কোনও প্রয়োজনই হয়নি। আমাদের লিপিগুলোতে কিন্তু সাধারণভাবে একটি দৃষ্টান্তও পাওয়া যাচ্ছে না যেখানে কোনও গৃহস্থ কোনও ভূমি বিক্রয় করছেন; সর্বত্রই যে ভূমি বিক্রীত হচ্ছে, তা রাজা বা রাষ্ট্রকর্তৃকই হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন আসে, প্রাচীন বাংলার সুদীর্ঘ কালের মধ্যে কোনও গৃহস্থই কি ভূমি বিক্রয় করেন নি? সে অধিকার কি তার ছিল না? যদি করে থাকেন, যদি সে-অধিকার থেকে থাকে, তাহলে তা কী উপায়ে বিধিবদ্ধ হত? সে বিক্রয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কিরকম ছিল? কৌটিল্যের ইঙ্গিতানুযায়ী ভূমির মূল্যের ওপর রাজাকে বা রাষ্ট্রকে কিছু প্রণামী দিতে হত কিনা। রাষ্ট্র রাজস্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত? এসব অত্যন্ত সংগত ও স্বাভাবিক প্রশ্নের কোনও উত্তর পাবার সূত্রও লিপিগুলোতে আবিষ্কার করা যায় না।

৮ম থেকে ১৩শ শতকের লিপি

প্রথমেই বলা যায়, যতগুলো শাসনের সংবাদ জানা যায়, তার সাব-কটিই ভূমি-দানের শাসন, ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয়ের শাসন একটিও নয়। এই পর্বের শাসনগুলোকে সেজন্য পূর্বোক্ত গুণাইঘর, বিপ্লঘোষবাট, লোকনাথ বা আম্রফপুর লিপিগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যদিও পাল ও সেন আমলের লিপিগুলো অনেকটা দীর্ঘায়িত। অন্য কারণেও এই পর্বের কোনও কোনও শাসনের সঙ্গে গুণাইঘর লিপি অথবা লোকনাথের লিপিটির কিছুটা তুলনা করা চলে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধর্মপালের খালিমপুর লিপিটির উল্লেখ করা যেতে পারে। মহাসামন্তাধিপতি শ্ৰীনারায়ণ বৰ্মা একটি নারায়ণ-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; সেই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পূজার দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি যুবরাজ ত্ৰিভূবনপালকে দিয়া রাজার কাছে চারটি গ্রাম প্রার্থনা করেছিলেন, এবং প্রার্থনানুযায়ী রাজা তা দান করেছিলেন। এই ধরনের দৃষ্টান্ত আরও দু-একটি উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ শাসনে এ রকম প্রার্থনা বা অনুরোধের কোনও উল্লেখ নেই। রাজা যেন স্বেচ্ছায় ভূমি দান করছেন, এরকম ধারণা জন্মায়। অথবা, এমনও হতে পারে, অনুরোধ বা প্রার্থনা করা হয়েছিল, কিন্তু তা আর বাহুল্য অনুমানে উল্লিখিত হয়নি। এধরনের লিপিগুলোর সঙ্গে বিপ্লঘোষবাট ও আস্রফপুর লিপি দুটির তুলনা করা যেতে পারে। পাল-আমলে দেখা যায়, কোথাও কোথাও ভূমি দান করা হচ্ছে কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে, যদিও ব্যক্তিগতভাবে ব্ৰাহ্মণকে ভূমি-দানের দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। কিন্তু, সেন-আমলে প্রায় সব দানই ব্যক্তিগত দান, এবং সেন-রাজাদের যে কয়টি ভূমি-দানের সংবাদ শাসনে পাওয়া যায় তার সাব-কয়টিই দান-গ্ৰহীতা হচ্ছেন। ব্ৰাহ্মণ এবং দানের উপলক্ষ হচ্ছে কোনও ধর্মানুষ্ঠানের আচরণ। এই ধরনের দান কিছুটা ব্ৰাহ্মণ-দক্ষিণা জাতীয়, এবং এসব ক্ষেত্রে ভূমি-দান গ্রহণের কোনও অনুরোধ-জ্ঞাপনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। মনে হয়, যে-সব ক্ষেত্রে কোনও ধর্ম-প্রতিষ্ঠানের জন্য ভূমি প্রয়োজন হয়েছে, সেখানেই প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা রাজাকে ভূমি দানের অনুরোধ জানিয়েছেন, এবং রাজাও সেই অনুরোধ রক্ষা করেছেন; গুণাইঘর, লোকনাথ ও খালিমপুর লিপির সাক্ষ্য এই অনুমানের দিকেই ইঙ্গিত করে। আর, যেখানে রাজা অথবা রাষ্ট্র নিজেই প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা, অথবা যেখানে পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত কোনও আয়তনের প্রয়োজন রাজা নিজেই অনুভব করেছেন, অথবা রাষ্ট্র-কর্মচারীর বা জনপদ-প্রধানদের মুখ থেকে শুনেছেন, সেখানে রাজা নিজেই স্বেচ্ছায় ভূমি দান করেছেন, কোনও অনুরোধের এর চেয়ে বা অবসর সেখানে নেই। শেষোক্ত ক্ষেত্রে আমার এই অনুমানের সাক্ষ্য ৮ম শতকের আস্রফপুর লিপি দুটিতে আছে। এর সাক্ষ্য এই যে, রাজা দেবখড়গ নিজেই আচার্য সংঘমিত্রের বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রচুর ভূমি দান করছিলেন, কোনও অনুরোধের উল্লেখ সেখানে নেই। শ্ৰীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবদেবের লিপির সাক্ষ্যও একই প্রকারের।

এই পর্বের লিপিগুলোতে দেখা যায়, ভূমিদান করিছেন সর্বত্রই রাজা স্বয়ং, কিন্তু সপ্তম-৮ম শতকের আগেকার লিপিগুলোতে দেখা যায়, ধর্মপ্রতিষ্ঠানের ব্যয়নির্বাহের জন্য ভূমিদান গৃহস্থ ব্যক্তিরাই করছেন, এবং দানের পূর্বে সেই ভূমি মূল্য দিয়ে রাজার কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন। দু-চার ক্ষেত্রে রাজাও ভূমিদান করছেন, কিন্তু তাও ক্রেতার পক্ষ থেকেই; তিনি শুধু দানকার্যের পুণ্যের যষ্ঠভাগ (ধৰ্মষড়ভাগং) লাভ করছেন। এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, আগেকার পর্বে অর্থাৎ ৭ম শতকের পূর্বে ধৰ্ম-প্রতিষ্ঠানের যত ভূমিদানি তা অধিকাংশ গৃহস্থ ব্যক্তিরাই করছেন কেন, আর উত্তরপর্বে ভূমিদানি শুধু রাজাই করছেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কি এই যে, ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব আগে ব্যক্তিগতভাবে পুরজনপদবাসী গৃহস্থরাই করতেন, এবং পরে ক্রমশ সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাজাই গ্রহণ করেছিলেন? ব্যক্তিগতভাবে ব্রাহ্মণদের যে-সব ভূমিদান করা হত, সে-সব দান সম্বন্ধে এ ধরনের কোনও প্রশ্নের বা উত্তরের অবকাশ নেই। এরকম ব্যক্তিগত দানের পরিচয় ঘাঘরাহাটি এবং বিপ্লঘোষবাট পট্টোলী দুটিতে পাওয়া যায়। পাল ও সেন আমলের লিপিতে এই পরিচয় প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়।

গুপ্ত আমল থেকে আরম্ভ করে সমস্ত ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলীতেই দেখা যায় পুস্তপাল (record-keeper) নামক জনৈক রাজপুরুষের উল্লেখ। কেন্দ্রীয় ভুক্তি-সরকারে যেমন, আহার এবং মণ্ডল-অধিষ্ঠানেও তেমনই পুস্তপাল-নামীয় একজন রাজপুরুষ নিযুক্ত থাকাই যেন রীতি ছিল। পট্টোলীগুলো একটু অভিনিবেশে পাঠ করলেই মনে হয়, ভূমি-সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্রের দপ্তরের মালিকই ছিলেন তিনি, এবং তার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য ছিল তার অধীন সমস্ত ভূমির সীমা, স্বত্ব, অধিকার বিভাগ, অর্থাৎ জরিপ সম্বন্ধীয় সমস্ত সংবাদ ও হিসাব সংগ্রহ করা এবং তা প্রস্তুত রাখা। খুবই সম্ভব, এসব সংবাদ লিপিবদ্ধ থাকত তালপাতায় বা ঐ জাতীয় কোনও বস্তুর ওপর; আজ আর সেসব দপ্তর উদ্ধারের কোনও উপায় নেই। জমি যখন দান-বিক্রয় করা হত এবং রাজসরকারে পট্টীকৃত বা রেজেস্ট্রি করা হত, কেবল তখনই প্রয়োজন হত তাম্রশাসনের; তারই দুই-চারটি ইতস্তত পাওয়া গেছে। পাল আমলে না হোক, অন্তত সেন রাজাদের আমলে কোনও না কোনও প্রকার পুঙ্খানুপুঙ্খ জমি-জরিপের বন্দোবস্ত ছিল এবং সমস্ত জমির সীমা, স্বত্ব, অধিকার, শস্যোৎপত্তির গড়পড়তা পরিমাণ, কর বা খাজনা ইত্যাদির পরিপূর্ণ সংবাদ পুস্তপালের দপ্তরে মজুত থাকত, এ অনুমান প্রায় ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করা যেতে পারে। শুধু যে দত্ত ভূমি সম্বন্ধেই এই জরিপ করা হত তা মনে হয় না; রাজ্যের সমস্ত বাস্তু, ক্ষেত্র ও খিল এবং অন্যান্য ভূমিও এই ধরনের জরিপের অন্তৰ্গত ছিল, এই অনুমানও সহজেই করা যায়। সেন আমলের পট্টোলীগুলোতে জমি-সংক্রান্ত সংবাদ এমন সুসংবদ্ধ, সুনির্দিষ্ট ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেওয়া হয়েছে যে, এধরনের জরিপের সম্ভাব্য অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করা কঠিন।

ভূমির চাহিদা

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূমির চাহিদা বাড়ে, বিশেষভাবে কৃষিপ্রধান দেশে, যা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু না থাকলেও এই অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন বাংলায়ও জনসংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূমির চাহিদা বাড়ছিল। যে সময় থেকে লিপি-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৫ম শতক থেকে এর কিছু কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। পাহাড়পুর-লিপিতে দেখা যায়, জনৈক ব্ৰাহ্মণ, নাথশৰ্মা ও তার স্ত্রী রামী ১ কুল্যবাপ ও ৪ দ্রোণবাপ ভূমি কিনে দান করছেন বট-গোহালীর একটি জৈন বিহারে, সেই বিহারের পূজাৰ্চনাদির ব্যয় নির্বাহের জন্য। এই অনুমান খুব স্বাভাবিক যে, সেই বিহারের নিকটবর্তী ভূমিই এই ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা উপযোগী হত, আর নিকটবতী ভূমি যদি একান্তই পাওয়া সম্ভব না হত, তাহলে সমগ্র পরিমাণ ভূমি একই জায়গায় একই ভূখণ্ডে পেলে ভালো হত। নাথশৰ্মা তা সংগ্ৰহ করে উঠতে পারেননি; তাকে ১ কুল্যবাপ ৪ দ্ৰোণ ভূমি সংগ্ৰহ করতে হয়েছিল। পাশাপাশি চারটি গ্রাম থেকে; পৃষ্ঠিমপোষক, গোষাটপুঞ্জক এবং নিত্বগোহালী গ্ৰাম তিনটি থেকে যথাক্রমে ৪, ৪ এবং ২: দ্রোণ এবং বটগোহালী গ্রাম থেকে ১২ দ্রোণ বাস্তুভূমি। এই অনুমান অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে পড়ে যে, ভূমির চাহিদা এত বেশি হয়েছিল যে, একটি গ্রামে একসঙ্গে ১ কুল্যবাপ ৪ দ্ৰোণ ভূমি সংগ্রহ করার সুযোগ এই দম্পতি পাননি। বৈগ্রাম-পট্টোলীতে দেখা যাচ্ছে, দুই ভাই ভোয়িল এবং ভাস্কর একই ধর্মপ্রতিষ্ঠানে কিছু ভূমি দান করলেন; তাও দুই জনে সংগ্ৰহ করলেন দুই গ্রামে, এক গ্রামে ভোয়িল কিনলেন ৩ কুল্যবাপ খিলভূমি, আর-এক গ্রামে ভাস্কর কিনলেন ১ দ্রোণবাপ বাস্তুভূমি। (প্রশ্ন হচ্ছে একই পিতার দুই পুত্র পৃথকভাবে পৃথক পৃথক গ্রামে ভূমি কিনলেন কেন বিশেষত দানের পাত্র এবং উদ্দেশ্য যেখানে এক? একান্নবর্তী পরিবারের আদর্শে কোথাও ফাটল ধরেছিল কি?) গুণাইঘর লিপিতেও দেখা যায়, ১১ পাটক ক্রয়যোগ্য খিলভূমি যদিও একই গ্রামে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তা একসঙ্গে এক ভূখণ্ডে পাওয়া যাচ্ছে না, যাচ্ছে পাঁচটি পৃথক ভূখণ্ডে। ৫ নং দামোদরপুর পট্টোলীদ্বারা যে ৫ কুল্যবাপ ভূমি বিক্ৰীত হচ্ছে তাও চারটি বিভিন্ন গ্রামে। আস্রফপুর পট্টোলীদ্বারা সঙ্ঘমিত্রের বিহারে যে ভূমি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে দেখা যায়, প্রথম দফার ৯ পাটক দ্রোণ ভূমি ৭টি পাড়া বা গ্রামে, দ্বিতীয় দফার ৬ পাটক ১০ দ্ৰোণ ভূমি ৮টি পাড়া বা গ্রামে। এসব সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে সহজেই জনসাধারণের মধ্যে ভূমির চাহিদার পরিমাণ অনুমান করা যায়। প্রতিষ্ঠিত গ্রাম ও জনপদগুলোতে প্রায় সমগ্র পরিমাণ ভূমিতেই জনপদবাসীদের বসতি এবং চাষবাস ইত্যাদি ছিল, কাজেই কোনও গ্রামেই একসঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ ভূমি সহজলভ্য ছিল না, এই অনুমান অসংগত নয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যানুযায়ী বন, অরণ্য ইত্যাদি কেটে নতুন গ্রাম ও বসতির পত্তন করাও যে প্রয়োজন হচ্ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ত্রিপুরা জেলার লোকনাথের পট্টোলীতে।

পরবর্তী কালেও এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রমাণ দুর্লভ নয়। ধূল্লা পট্টোলী দ্বারা রাজা শ্ৰীচন্দ্র ১৯ হল ৬ দ্রাণ ভূমি দান করেছিলেন শান্তিবারিক ব্যাসগঙ্গশৰ্মাকে, কিন্তু এই ভূমিও সংগ্ৰহ করতে হয়েছিল পাঁচটি গ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম পট্টোলী দ্বারা রাজা দামোদারদেব মাত্ৰ পাঁচ দ্রোণ ভূমি দান করেছিলেন, তাও দুই গ্রামে। ভাটরালিপিদ্ধারা ভট্টপাটকের শিবমন্দিরের সেবার জন্য যে ২৯৬টি বাড়ি এবং ৩৭৫ হল ভূমি দেওয়া হচ্ছে, তা ২৮টি বিভিন্ন গ্রামে বিস্তৃত। সাহিত্য-পরিষদ-পট্টোলীদ্বারা রাজা বিশ্বরূপসেন জনৈক আবল্লিক পণ্ডিত হলায়ুধ শৰ্মাকে ৩৩৬২ উন্মানভূমি দান করেছিলেন ছয়টি বিভিন্ন গ্রামে, ১১টি পৃথক পৃথক ভূখণ্ডে। বিশ্বরূপসেনের এই পট্টোলীটির সাক্ষ্য অন্যদিক থেকেও খুব উল্লেখযোগ্য।

দানসংগ্রহ দ্বারা কোনও কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠান প্রচুর ভূমির অধিকারী হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত দু-একটি আমাদের লিপিগুলোতে পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষ নিজের জন্য, হয় ক্রয় করে নাহয় দান গ্রহণ করে অথবা উভয় উপায়েই, নিজের প্রয়োজনাধিক ভূমি সংগ্ৰহ করে ভূমির বড় মালিক হয়ে বসেছেন, এমন অন্তত একটি দৃষ্টান্ত বিশ্বরূপসেনের এই লিপিটি থেকে পাওয়া যাচ্ছে। আরও আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে যে, এই ভূম্যধিকারীটি হচ্ছেন একজন ব্রাহ্মণপণ্ডিত, সাধারণত আমরা যাদের সর্বপ্রকারে নির্লোভ এবং বিত্তহীন বলে মনে করি। এই আবল্লিক পণ্ডিতটি কিভাবে ভূমি সংগ্ৰহ করেছিলেন, তার একটু পরিচয় নেয়া যেতে পারে, এবং এই পরিচয়ের মধ্যে ভূমি সংগ্রহের ইচ্ছা সমাজের মধ্যে কিভাবে রূপ নিচ্ছিল, তার একটু আভাসও পাওয়া যেতে পারে।
১. রামসিদ্ধি পাটকে দুইটি ভূখণ্ড, ৬৬টি উদান পরিমাণ, আয় ১০০ (পুরাণ) উত্তরায়ণ সংক্রান্তি উপলক্ষে রাজার দান।
২. বিজয়তিলক গ্রামে ২৫ উদান, আয় ৬০ (পুরাণ)।
৩. আজিকুল পাটকে ১৬৫ উদান, আয় ১৪০ (পুরাণ)। হলায়ুধ নিজে এই ভূখণ্ড কিনেছিলেন।
৪. দেউলহন্তী গ্রামে ২৫ উদান, আয় ৫০ (পুরাণ)।
২, ৩ ও ৪ নং ভূমি হলায়ুধ চন্দ্রগ্রহণ উপলক্ষে রানীমাতার কাছ থেকে দান গ্রহণ করেছিলেন।
৫. দেউলহন্তী গ্রামে আরও দুইটি ভূখণ্ড, পরিমাণ ১০ উদান, আয় ২৫ (পুরাণ)। হলায়ুধ আগে তা কিনেছিলেন, পরে কুমার সূর্যসেনের কাছ থেকে দান গ্রহণ করেছিলেন, কুমারের জন্মদিন উপলক্ষে।
৬. দেউলহস্তী গ্রামেই আরও দুটি ভূখণ্ড, পরিমাণ ৭ উদান, আয় ২৫ (পুরাণ)। হলায়ুধ আগে তা কিনেছিলেন, পরে সান্ধিবিগ্রহিক নাঞীসিংহের কাছ থেকে দান গ্ৰহণ করেছিলেন।
৭. ঘাঘরাকাট্টি পাটকে ১২.৭৫ উদান ভূমি, আয় ৫০ (পুরাণ)। হলায়ুধ বাজপণ্ডিত মহেশ্বরের কাছ থেকে তা কিনেছিলেন।
৮. পাতিলাদিবীক গ্রামে ২৪ উদান, আয় ৫০ (পুরাণ)। উত্থানদ্বাদশী তিথি উপলক্ষে কুমার পুরুষোত্তম সেনের দান।
সর্বসুদ্ধ এই ৩৩৬.৫ উন্মান ভূমির বার্ষিক আয় ছিল ৫০০ শত (পুরাণ); তখনকার দিনে এই অর্থের পরিমাণ কম নয়। ব্রাহ্মণপণ্ডিত হলায়ুধ শৰ্মা বিভিন্ন গ্রামে বিস্তৃত সমগ্র পরিমাণ এই ভূমি রাজার কাছ থেকে ব্ৰহ্মত্র দানস্বরূপ গ্রহণ করে ভূম্যধিকারী হয়ে বসেছিলেন; রাষ্ট্রকে তার কোনও করই দিতে হত না, অথচ তার প্রজাদের কাছ থেকে সমস্ত করই তিনি পেতেন। পাল ও সেন বংশীয় রাজারা ও অন্যান্য ছোটখাটো রাজবংশের রাজারা অনেক সময়ই অনেক ব্ৰাহ্মণকে যে গ্রামকে-গ্রাম দান করেছেন, তার দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি পাওয়া যায়। প্রয়োজনাধিক ভূমির অধিকারী হওয়ার ইচ্ছা, ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্ৰ করে ভূমির স্বত্বাধিকার কেন্দ্রীকৃত হওয়ার ঝোক সমাজের মধ্যে কী ভাবে বাড়ছিল, এসব সাক্ষ্যপ্রমাণের মধ্যে তার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।

ভূমির ক্রমবর্ধমান চাহিদার ইঙ্গিত কতকটা ভূমির সূক্ষ্ম সীমা-নির্দেশের মধ্যেও পাওয়া যায়। প্রত্যেকেই প্ৰত্যেকের ভূমির সীমা ও পরিমাণ সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন রাষ্ট্রও এ সম্বন্ধে কম সচেতন ছিল না। ভূমি দান-বিক্রয়কালে অন্য কারও ভূমিস্বার্থ যাতে আহত না হয়, এ-সম্বন্ধে প্রজার ও রাষ্ট্রের দৃষ্টি খুবই সজাগ ছিল। তাছাড়া, প্রত্যেকটি লিপিতেই ভূমি সীমা এত সূক্ষ্মভাবে ও সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে যে, পড়লেই মনে হয়, সূচ্যগ্ৰ ভূমিও কেউ সহজে ছেড়ে দিতে রাজি হতেন না। কালের অগ্রগতির সঙ্গে এই চেতনাও বুদ্ধি পাচ্ছিল বলে মনে হয়। ৮ম শতক এর পূর্বের লিপিগুলোতে এই সীমা-বিবৃতি খুব বিস্তৃত নয়; কিন্তু পরবর্তী লিপিগুলোতে ক্রমশ এই বিবৃতি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবার দিকে ঝোঁক অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

তাছাড়া ভূমির পরিমাপের বর্ধমান সূক্ষ্মতাও ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিকে ইঙ্গিত করে। ৮ম শতকের আগের লিপিগুলোতে ভূমি-পরিমাপের নিম্নতম ক্রয় হচ্ছে আঢবাপ বা আঢ়কবাপ, কিন্তু সেন আমলের লিপিগুলোতে দেখা যায়, নিম্নতম ক্রম আঢ়বাপ থেকে উন্মান, উন্মান থেকে কাকিণী পর্যন্ত নেমেছে। ভূমির চাহিদা যতই বাড়ছিল, লোকেরা সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মী ভগ্নাংশ সম্বন্ধেও ক্রমশ সজাগ হয়ে উঠছিল, এই অনুমানই স্বাভাবিক।

পাল ও সেন যুগের সামাজিক ইঙ্গিত

পালায়নের পরিনির্বাণ (আঃ ১১২০-১১৬২ খ্রি.)

রামপালের চারপুত্রের মধ্যে দুই পুত্র, বিত্তপাল ও রাজ্যপালের সিংহাসন আরোহণের সৌভাগ্যলাভ ঘটেনি। অন্য দুই পুত্র, কুমারপাল ও মদনপালের মধ্যে কুমারপাল (আঃ ১১২৬-২৮) রাজা হন; তার পর কুমারপাল-পুত্র তৃতীয় গোপাল (আঃ ১১২৮-৪৩) এবং গোপালের পর রামপালের অন্যতম পুত্র মদনপাল (আঃ ১১৪৩-৬১) রাজা হয়েছিলেন। রামচরিত-কাব্যপাঠে মনে হয়, সিংহাসনারোহণের এই ক্ৰম সম্বন্ধে একটা রহস্য কোথাও ছিল। রামচরিত রামপালকে নিয়েই রচনা, কিন্তু বস্তুত মদনপালের রাজত্ব পর্যন্ত কাব্যটি বিস্তারিত, অথচ রামপালের পর কুমারপাল এবং গোপাল সম্বন্ধে এই কাব্যে প্রায় কিছু বলা হয়নি বললেই চলে। মদনপালে পৌঁছে সন্ধ্যাকর যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছিলেন। কোনও বংশগত বা পারিবারিক গোলমালের কল্পনা একেবারে অলীক নাও হতে পারে।

যাই হোক, এই তিন জনের রাজত্বকালেই চারশো বছরের সযত্নলালিত, বাঙালীর গৌরব পাল-রাজ্য ও রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একেবারে ভেঙ্গে পড়ে যায়। ধর্মপাল-দেবপাল যে-সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, মহীপাল যাকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাচিয়েছিলেন, রামপাল যাকে শেষবারের জন্য আত্মপ্রতায় এবং প্রতিষ্ঠা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ আর তাকে রক্ষা করিতে পারলেন না। ঘরে এবং বাইরে স্থানীয় আত্মসচেতন, একান্ত ব্যক্তিক রাষ্ট্রবুদ্ধি উৎকট হয়ে দেখা দিল; একে ব্যাহত করার মত শক্তি ও বুদ্ধি নিয়ে কোনও মহীপাল বা রামপাল আর সিংহাসন আরোহণ করেননি।

কুমারপালের নিজের প্রিয় সেনাপতি বৈদ্যদেব কামরূপে এক বিদ্রোহ দমন করে নিজেই এক স্বতন্ত্র স্বাধীন নরপতিরূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে নিলেন। পূর্ববঙ্গে ভোজ্যবর্মার নেতৃত্বে বর্মণরা স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হল। দক্ষিণ থেকে কলিঙ্গের গঙ্গবংশীয় রাজারা আরম্য (= বর্তমান আরামবাগ) দুর্গ জয় করে মেদিনীপুরের (মিধুনীপুর) ভেতর দিয়ে গঙ্গাতীর পর্যন্ত ঠেলে চলে এলেন। কুমারপালের রাজত্বকালে সেনাপতি বৈদ্যদেব বোধ হয় সাফল্যের সঙ্গে এই আক্রমাণ কিছুটা ব্যাহত করেছিলেন এবং মদনপালও বোধ হয় একবার কলিঙ্গ পর্যন্ত বিজয়াভিযান করে থাকবেন। কিন্তু, কিছু দিনের মধ্যেই পাল ও গঙ্গদের সংগ্রামের এবং দক্ষিণের কল্যাণ-চালুক্যদের আক্রমণের সুযোগ নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে কর্ণাটাগত সেন-রাজবংশ মস্তক উত্তোলন করল। এই সেন-রাজবংশ ইতিপূর্বেই পূর্ববঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিল! এবার তারা একেবারে গৌড়ের হৃদয়দেশ আক্রমণ করল। কালিন্দী-নদীর তীরে, বোধ হয় মদনপালের রাজধানীর নিকটেই, এক তুমুল যুদ্ধ হল। এই যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত, কারণ রামচরিতে যেমন মদনপালের জয় দাবি করা হয়েছে, তেমনই দেওপাড়া-লিপিতে সেন-রাজ বিজয়সেনের পক্ষ থেকেও জয়ের দাবি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গাহড়িকাল-রাজারাও এই সময় বাংলায় আবার নতুন করে সমারাভিযানে উদ্যত হলেন। ১১২৪ খ্ৰীষ্টাব্দের আগেই পাটনা অঞ্চল তাদের অধিকারে চলে গেল; ১১৪৬ খ্ৰীষ্টাব্দের আগে গেল মুদগগিরি বা মুঙ্গের অঞ্চল। মদনপালের রাজত্বের আট বছর পর্যন্ত বরেন্দ্রীর অন্তত কিয়দংশ তার অধিকারে ছিল বলে লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। এটুকু ছাড়া বাংলার আর কোনও অংশই তার অধিকারে ছিল বলে মনে হয় না; তবে বিহারের মধ্যে ও পূর্বাঞ্চল তখনও পাল-রাজ্যভুক্ত ছিল। মদনপালের মৃত্যুর পর দশ বছরের মধ্যে তাও আর রইল না এবং পাল-রাজ্যের শেষচিহ্নও বিলুপ্ত হয়ে গেল। মদনপালই পালবংশের শেষ রাজা। তবে, তার পরও গোবিন্দচন্দ্র (আঃ ১১৫৫—১১৬২ খ্রি.) নামে একজন পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বরের নামে পাওয়া যায়। লিপি-প্ৰমাণ থেকে মনে হয়, গয়া জেলাই ছিল তার রাজ্যকেন্দ্ৰ; গৌড়রাজ্যের কিছু অংশও হয়তো এক সময় তার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।

সামন্ততন্ত্র

পাল আমলে সামন্ততন্ত্র আরও দৃঢ়প্রতিষ্ঠ ও দৃঢ়সংবদ্ধ হয়। সুবিস্তৃত সাম্রাজ্যের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সামন্তদের সংখ্যাও ছিল অনেক। অনুমান করা কঠিন নয়, এদের অনেকেই বিজিত রাজ্য ও রাষ্ট্রের প্রভু ছিলেন; বিজিত হবার পর মহাসামন্ত-সামন্তরূপে স্বীকৃত হয়েছিলেন। মহারাজাধিরাজ সম্রাটের সঙ্গে এদের সম্বন্ধের স্বরূপ নিৰ্ণয় করা কঠিন; তবে, খালিমপুর লিপি পাঠে মনে হয়, বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাল সম্রাটেরা সময় সময় মহতী রাজকীয় সভা আহ্বান করতেন এবং তখন এই সব মহারাজা-মহাসামন্ত থেকে শুরু করে সাধারণ সামন্ত ও মাণ্ডলিক পর্যন্ত সকলেই সেই সভায় উপস্থিত হয়ে মহারাজাধিরাজ সম্রাটকে বিনীত প্ৰণতি জ্ঞাপন করে নিজেদের অধীনতার স্বীকৃতি জানাতেন। পাল ও চন্দ্র লিপিমালায় রাজপুরুষদের যে ক্ষুদ্র বৃহৎ তালিকার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, তাতে রাজন, রাজনক, রাজন্যক, রাণক, সামন্ত, মহাসামন্ত প্রভৃতি ঔপধিক রাজপাদোপজীবীদের সাক্ষাৎ মেলে। এরা সকলেই যে নানা স্তরের সামন্ত নরপতি, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম বা ধর্মপালের খালিমপুর-লিপিতে জনৈক মহাসামন্তাধিপতি শ্ৰীনারায়ণবর্মার খবর পাওয়া যায়; তিনি কোন জনপদের মহাসামন্তাধিপতি তা জানা যাচ্ছে না। এই লিপিতেই উত্তরাপথের যে সব নরপতিদের কনৌজের রাজদরবারে এসে রাজরাজেশ্বরের সেবার্থ সমবেত হবার ইঙ্গিত আছে, ভোজ-মৎস্য-মন্দ্র-কুরু- যদু-যবন-অবস্তি-গন্ধাের- কীর-পঞ্চাল প্রভৃতি মিত্র রাজন্যবর্গের যে উল্লেখ আছে তারাও এক হিসাবে সামন্তরাজা, সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে যারা পালরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তারাও ‘অনন্ত সামস্তচক্ৰ’। আবার রামপাল যাদের সহায়তায় পিতৃরাজ্য বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করেছিলেন তাদেরও সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে “সামন্ত’ আখ্যায়ই পরিচয় দিয়েছেন, অথচ তারা সকলেই স্ব স্ব জনপদে প্রায় স্বাধীন নরপতি। অপর-মন্দারের অধিপতি লক্ষ্মীশূর নিজেও ছিলেন সামন্ত এবং “আটবিক সামন্ত-চক্র-চুড়ামণি”। রামপালের মাতুল রাষ্ট্রকূট মহনের দুই পুত্র, মহামাণ্ডলিক কাহ্নরদেব এবং সুবৰ্ণদেবও রামপালের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। তার পর, পালরাষ্ট্রের দুদিনে যারা বিদ্রোহপরায়ণ হয়ে সেই রাষ্ট্রকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন, তারাও সামন্ত। এক বর্মণরাজ রামপালের শরণাগত হয়েছিলেন এবং এটি অসম্ভব নয় যে, বর্মণ বংশ সামন্ত-বংশ রূপেই বাংলায় প্রতিষ্ঠালাভ করেন এবং পরে স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। কামরূপের বিদ্রোহী নরপতি তিঙ্গ্যদেবও পালরাষ্ট্রের সামন্তই ছিলেন।

পালযুগের সামাজিক ইঙ্গিত

ভূমিকা

বাংলার ইতিহাসে পালবংশের আধিপত্যের চারিশত বৎসর নানাদিক থেকে গভীর ও ব্যাপক অর্থ বহন করে। বর্তমান বাংলার ও বাঙালী জাতির গোড়াপত্তন হয়েছে এই যুগে; এই যুগই প্রথম বৃহত্তর সামাজিক সমীকরণ ও সমন্বয়ের যুগ। এই চারশো বৎসরের সামাজিক ইঙ্গিতগুলো সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হল:

রাষ্ট্রীয় আদর্শ

খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক হতে আরম্ভ করে প্রায় খ্ৰীষ্টপরবর্তী ষষ্ঠ-৭ম শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় আদর্শ সর্বভারতীয় একরাষ্ট্রত্ব, সমস্ত ভারতের একচ্ছত্ৰাধিপত্য; মাঝে মাঝে এই আদর্শ হতে বিচূতি ঘটেছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু যখন তা হয়েছে, তখনই ভারতবর্ষকে রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে বিদেশীর নিকট অনেক লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে এবং প্রচুর মূল্য দিয়ে আবার সেই পুরাতন আদর্শকেই মেনে নিতে হয়েছে। মৌর্য ও গুপ্তরাজবংশ এই আদর্শের প্রতীক।

৭ম শতকেও এই আদর্শ সক্রিয়, কিন্তু তখন সীমা সংকীর্ণতর হয়ে গেছে সর্বভারত থেকে সকল-উত্তরাপথে সেই আদর্শ নেমে এসেছে; ‘সকলোত্তরপথনাথ হওয়াই এই যুগের সর্বোচ্চ রাষ্ট্ৰীয় স্বীকৃতি। ৮ম শতকেও এই আদর্শকে কেন্দ্ৰ করে প্ৰতীহার ও পালবংশের সংগ্রাম অক্ষুন্ন এবং তাকে ব্যর্থ করার চেষ্টায় দক্ষিণের রাষ্ট্রকূটবংশ সদা জাগ্রত। অন্যদিকে ধীরে ধীরে অন্য একটি রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ গড়ে উঠছিল; এই আদর্শের অস্তিত্ব যে ছিল না তা নয়, তবে সৰ্ব্বভারতীয় আদর্শের মত এতটা সক্রিয় কখনো ছিল না। এই আদর্শ স্থানীয় ও প্রাদেশিক আত্মকর্তৃত্বের আদর্শ। গুপ্ত-সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমশ এই আদর্শ মাথা তুলতে আরম্ভ করে; কিন্তু ধর্মপাল-দেবপাল, বৎসরাজ-নাগভট্টের সময়েও উত্তরাপথস্বামীত্বের আদর্শ একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। কিন্তু তার পর থেকেই স্থানীয় ও প্রাদেশিক আত্মকর্তৃত্বের আদর্শের জয়জয়কার। এই সময় থেকেই যেন ভারতবর্যের বিভিন্ন দেশখণ্ডের অর্থ-সংস্থান, ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্ৰ করে এক একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং এই রাষ্ট্রগুলো নিজেদের প্রাদেশিক আত্মিকর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। সংস্কৃত্তির ক্ষেত্রেও দেখা যায়, মোটামুটি ৮ম শতক বা তার কিছু পর থেকে এক একটি বৃহত্তর জনপদ রাষ্ট্রকে কেন্দ্ৰ করে মূলগত এক কিন্তু এক একটি বিশিষ্ট লিপি বা অক্ষর রীতি, ভাষা এবং শিল্পদর্শ গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে এবং দ্বাদশ-১৩শ শতকের মধ্যে তাদের এক একটি প্রাদেশিক বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়ে গেছে। বস্তুত, ভারতবর্ষের, বিশেষত উত্তর-ভারতের, মহারাষ্ট্র ও উড়িষ্যার প্রত্যেকটি প্রাদেশিক লিপি ও ভাষার ভ্রূণ ও জন্মাবস্থা মোটামুটি এই চারশো বৎসরের মধ্যে। বাংলা লিপি ও ভাষার গোড়া খুঁজতে হলে এই চারশো বছরের মধ্যেই খুঁজতে হবে। বাংলার ভৌগোলিক সত্ত্বও এই যুগেই গড়ে উঠেছে। ভারতের অন্যান্য লিপি, ভাষা ও প্রাদেশিক ভৌগোলিক সত্ত্বা সম্বন্ধেও একই উক্তি প্রযোজ্য।

জাতীয় স্বাতন্ত্র্য

এই লিপি, ভাষা, ভৌগোলিক সত্ত্বা ও রাষ্ট্রীয় আদর্শকে আশ্রয় করে এক একটি স্থানীয় সত্ত্বও গড়িয়া ওঠে এই যুগে। বঙ্গ-বিহারে এই রাষ্ট্ৰীয় সত্ত্বার সূচনা ৭ম শতকেই দেখা দিয়েছিল এবং তার প্রতীক ছিলেন শশাঙ্ক। কিন্তু পরবর্তী একশো বছরের মৎস্যন্যায়ে এই রাষ্ট্রীয় সত্ত্বাই আহত হয়েছিল সকলের চেয়ে বেশি। পাল-রাজারা আবার তা জাগিয়ে তুললেন; বাঙালী নিজস্ব স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র লাভ করল এবং চারশো বছর ধরে তা ভোগ করল। শুধু তাই নয়, ধর্মপাল-দেবপাল-মহীপালের সাম্রাজ্য বিস্তারের কৃপায় এই রাষ্ট্র একটা আন্তর্ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বাদও কিছুদিনের জন্য পেয়েছিল। অধিকন্তু, এই পালরাজাদের এবং পালরাষ্ট্রের পোষকতা ও আনুকূল্যে, নালন্দা-বিক্রমশীলা-ওদন্তপুরী-সারনাথের বৌদ্ধ সংঘ ও মহাবিহারগুলোকে আশ্রয় করে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধজগতেও বাংলা ও বাঙালীর রাষ্ট্র একটি গৌরবময় স্থান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এই সকলের সম্মিলিত ফলে বাংলায় এই যুগেই, অর্থাৎ এই প্রায় চারশো বছর ধরে একটা সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। এটিই বাঙালীর স্বদেশ ও স্বজাতবোধের মূলে এবং এটিই বাঙালীর একজাতীয়ত্বের ভিত্তি। পাল-যুগের এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দান।

সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সমন্বয়

এই দানের মূলে পালরাজাদের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হয়। পালরাজারা ছিলেন বাঙালী, বরেন্দ্রী তাদের পিতৃভূমি। বংশ-প্রতিষ্ঠায়ও এরা পুরাপুরি বাঙালী; পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য-সমাজের বংশাভিজাত্যের দাবি এদের নেই। রামচরিতে ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি করা হয়েছে বা ক্ষত্রিয় রাজবংশের সঙ্গে তাদের বিবাহাদি হত, এজন্য তাদের ক্ষত্ৰিয় মনে করা কঠিন। রাজা মাত্ৰেই তো ক্ষত্রিয়, বিশেষত পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য সংস্কৃতি প্রবর্তনের পর। আর, রাজরাজড়ার বৈবাহিক সম্বন্ধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো রাষ্ট্রীয় কারণেই হয়ে থাকে; তাদের কোনও বর্ণ নেই! আবুল ফজল যে এদের কায়স্থ বলছেন তার মূলেও কোনও বস্তুভিত্তি আছে কিনা সন্দেহ; তবে তারা উচ্চতর তিন বর্ণের কেউ নন। এই সংস্কার লোকস্মৃতিতে ষোড়শ শতকেও বিদ্যমান ছিল বলে মনে হয়। তারনাথ এবং মঞ্জশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকারই বোধ হয় যথার্থ ঐতিহাসিক ইঙ্গিতটি রেখেছেন। তারনাথ বলছেন, জনৈক বৃক্ষদেবতার ঔরসে ক্ষত্ৰিয়াণীর গর্ভে গোপালের জন্ম। কাহিনীটি টোটেম-স্মৃতি জড়িত বলে সন্দেহ করলে অন্যায় বা অনৈতিহাসিক কিছু করা হয় না।

পৌরাণিক-ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি-বহির্ভূত, আর্যসমাজ-বহির্ভূত সমাজের সংস্কার এই গল্পের মধ্যে বিদ্যমান। গোপাল এই সমাজ, সংস্কার ও সংস্কৃতির লোক। বোধ হয় এই জন্যই মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকার পালরাজাদের বলছেন “দাসজীবিনঃ”। অথচ এই পালরাজারা ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম, স্মৃতি, সংস্কার ও সংস্কৃতির ধারক ও পোষক, চার বর্ণের রক্ষক ও সংস্থাপক; লিপিগুলোতে তার প্রমাণ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। ধর্মে এরা বৌদ্ধ, পরম সুগত; এরা মহাযানী বৌদ্ধসংঘ ও সম্প্রদায়ের পরম অনুরাগী পোষক; অথচ বৈদিক ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধৰ্মও এদের আনুকূল্য ও পোষকতা লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, একাধিক পালরাজা ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পূজা এবং যাগযজ্ঞে নিজেরা অংশগ্রহণ করেছেন, পৌরোহিত্য-সিঞ্চিত শান্তিবারি নিজেদের মস্তকে ধারণ করেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মে ব্ৰাহ্মণের নিয়োজিত হতেন, মন্ত্রী এবং সেনাপতিও হতেন, আবার কৈবর্তরাও স্থান পেতেন না, এমন নয়। এভাবে পালবংশকেও কেন্দ্র ও আশ্রয় করে বাংলায় প্রথম সামাজিক সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল; একদিনে নয়, চারশো বছর ধরেই তা চলেছিল।

ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর স্মৃতি ও আচার, আর্য ও আর্যেতর সংস্কার ও সংস্কৃতি, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য পুরাণ, পূজা, শিক্ষা ও আদর্শ, দেবদেবী সমস্তই পালবংশকে কেন্দ্র ও আশ্ৰয় করে পরস্পরে আদান-প্ৰদান করেছে এবং এক মিলন সমন্বয় সূত্রে গ্রন্থিত হয়ে একটি বৃহৎ সামাজিক সমন্বয় গড়ে তুলেছে। গুপ্ত—আমল থেকে আরম্ভ করে আর্য জৈন ও বৌদ্ধধর্মের ওপর যে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোত বাংলার বুকের ওপর দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছিল, এবং মোটামুটি ৭ম শতকে যে সাংস্কৃতিক সংঘর্যের সৃষ্টি করেছিল—শশাঙ্ক তারই প্রতীক—সেই স্রোত ও সংঘর্ষ সমন্বিত হল। এই চারশো বছর ধরে পাল-রাজাদের বৃহৎ ছত্ৰছায়ায়। এই আর্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বাইরে যে বৃহৎ আর্যেতর সংস্কার ও সংস্কৃতি দেশের অধিকাংশ অংশ জুড়ে বিরাজ করছিল তাও অন্তত কিছুটা যে পাল-রাজচ্ছত্রের আশ্রয় লাভ করেছিল, তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়পুরের অসংখ্য পোড়ামাটির ফলকগুলোতে এবং সমসাময়িক ধর্মমত ও সম্প্রদায়গুলোতে।

বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্মেই এই সময়ই আর্যেতর দেবদেবী, আচার ও সংস্কার ধীরে ধীরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং কিছু কিছু স্বীকৃতিও লাভ করে। এই যুগের দেবদেবীর মূর্তিতত্ত্ব তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ এবং এই প্রমাণ অনস্বীকার্য। এই সুবৃহৎ সমন্বয় অবশ্যই সংগঠিত হয়েছিল আর্য ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও সংস্কৃতির আদর্শানুযায়ী; পাল-রাজারাও তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ভূমি-ব্যবস্থা, উত্তরাধিকার, চতুর্বর্ণের স্বীকৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের স্বীকৃতি এবং প্রচলন শুধু নয়, সেই ভাষায় কাব্যময় সাহিত্য রচনা এই সমস্তই সেই আদর্শের নিঃসন্দিগ্ধ পরিচয় বহন করে। এই আর্য বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আশ্রয় করেই বাংলা উত্তরোত্তর উত্তর ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান ধারার সঙ্গে আত্মীয়তায় যুক্ত হয়। এই সচেতন যোগ সাধন শুরু হয়েছিল গুপ্ত—আমলেই, কিন্তু পর্ণরূপ গ্ৰহণ করল পাল-আমলে; এবং বাংলায় তা এক বৃহত্তর সমন্বয়ের আশ্রয় হল, আর্যেতর এবং মহাযান-বজ্রযান-তন্ত্রযান-বৌদ্ধধর্মের সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তায় যুক্ত হয়ে এই সমন্বিত এবং সমীকৃত সংস্কৃতিই বাঙালীর সংস্কৃতির ভিত্তি, এবং এটাও পাল-আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠদান। সমন্বয় এবং সমীকরণের এই রূপ ও প্রকৃতি ভারতের অন্যত্র আর কোথাও দেখা যায় না।

সামন্ততন্ত্র

কিন্তু জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং সমন্বয় ও সমীকরণ পালযুগের রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। স্থানীয় প্রাদেশিক আত্মকর্তৃত্বের রাষ্ট্রীয় আদর্শও দেখা যায়। এই আদর্শ শুধু যে বৃহত্তর রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিল তা নয়, সাম্রাজ্যিক গুপ্ত-আমলের পর থেকে আন্তরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও এই আদর্শ ক্রমশ কার্যকরী হল। এখান থেকেই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব, এবং মোটামুটি যষ্ঠ শতক থেকে বাংলাও মহারাজাধিরাজের বৃহত্তর রাজ্যের মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত-নায়ক ও সামন্ত-রাজার রাজ্য ও রাষ্ট্রের বিস্তার শুরু হয়। নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে এরা প্রায় স্বাধীন নরপতির মতই ব্যবহার করতেন; শুধু মৌখিকত মহারাজাধিরাজকে মেনে চলতেন মাত্র। পাল-আমলে এই সামন্ত প্ৰথা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বাংলায়ও পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছিল। বস্তুত, পালরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভিত্তিই এই সামন্ততন্ত্র এবং এই সমস্তুতন্ত্রই পাল-রাষ্ট্রের শক্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতাও। বিজিত রাষ্ট্রসমূহকে মৌর্য বা গুপ্ত রাষ্ট্রের মতো এই আমলে আর কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হতনা; বস্তুত, তারা স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রই থাকত, পাল-রাষ্ট্রের সর্বাধিপত্য স্বীকার করত মাত্র। কিন্তু এই কেন্দ্রীয় অন্তরাষ্ট্রেও যে অসংখ্য সামন্ত নরপতি ও নায়ক ছিলেন, পাল-লিপিমালা ও রামচরিতই তার প্রমাণ। উভয় ক্ষেত্রেই স্থানীয় আত্মকর্তৃত্বের আদৰ্শই জয়ী হয়েছে, এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ও রাজবংশ যখন দুর্বল হত তখন উভয়ই মস্তকোত্তালন করত। দেবপালের মৃত্যুর পর বিজিত রাষ্ট্রসমূহ স্থানীয় আত্মকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেই পালসাম্রাজ্য ভেঙ্গে দিয়েছিল; মহীপাল সেই সাম্রাজ্যের কতকাংশ জোড়া লাগিয়েছিলেন, কিন্তু বেশিদিন তা স্থায়ী হয় নি। বিজিত ও অবিজিত রাষ্ট্র এবং অন্তরাষ্ট্রের সামন্তবর্গ মহীপালের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। আর, দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিলেন তারা তো অন্তরাষ্ট্রেরই অনন্ত-সামন্তচক্র। আবার, রামপাল যখন বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করে পাল-রাজ্যের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে এনেছিলেন তখনও তার প্রধান সহায়ক ছিলেন এই সামন্তবর্গ। আবার এরাই রামপালের মৃত্যুর পর পালরাজ্য ও রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করে তাদের বিলুপ্তির পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন। সামন্ত-মহাসামন্ত, মণ্ডলিক-মহামাগুলোক, মণ্ডলেশ্বর-মহামণ্ডলেশ্বর এরা সকলেই ক্ষুদ্র বৃহৎ সামন্ত, এবং অনেক রাজা-মহারাজা ও সামন্ত; এদের সাক্ষাৎ পাল-লিপিগুলোতে বরাবর পাওয়া যায়। রাজন, রাণক, রাজনক, রাজনাক এরা সকলেই সামন্ত।

আর সামন্ততন্ত্র যখন ছিল তখন সামন্ততান্ত্রিক বীরধর্ম এবং সেই ধর্মোদ্ভূত বীরগাঁথাও প্রচলিত নিশ্চই ছিল। এই বীরধর্মের কতকটা পরিচয় পাওয়া যায় দেবপালের সমস্ত বলবৰ্মার (নালন্দা-লিপি) চরিত্রে, রামচরিতে রামপালের সমস্তদের আচরণ, ভীম-সহায়ক হারির আচরণে। আর বীরগাথার পরিচয় পাওয়া যায় ধৰ্মপাল-সম্বন্ধীয় গাথায় (খালিমপুর-লিপি), উত্তরবঙ্গের মহীপালের গানে, যোগীপাল ভোগীপালের গীতে। সুতরাং (পরবর্তী কালের ভাট-ব্রাহ্মণেরা) যে বীরগাথা গেয়ে বেড়াতেন তার অন্তত একটি প্রমাণ পাওয়া যায় মহামাণ্ডলিক ঈশ্বরঘোষের লিপিটিতে। ঈশ্বর ঘোষের বংশের প্রতিষ্ঠাতা ধূর্তঘোয্যের পুত্র বালিঘোষ যুদ্ধব্যবসায়ী ছিলেন; তার পুত্ৰ ধবলঘোষের বীরত্ব ও গৌরব গাথায় গীত হত। কিন্তু এই বীর্যধর্ম বা স্বামীধর্ম সম্বন্ধে সবচেয়ে সুন্দর সংবাদ পাওয়া যায় বোধ হয় তৃতীয় গোপালের নিমদীঘি বা মাণ্ডা শাসনে। এই লিপিটির পাঠ নিঃসন্দিগ্ধ নয়। নলিনীকাপ্ত ভট্টশালী মহাশয়ের পাঠ গ্রহণযোগ্য কিনা, এই বিষয়ে সন্দেহ পোষণের যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। এই পাঠ অনুযায়ী মিজং নামে গোপালের এক সামন্ত বলছিলেন,

‘শ্ৰীমদ গোপালদেব স্বেচ্ছায় শরীর ত্যাগ করে স্বৰ্গত হয়েছেন এবং তার পদধূলি মিজং নামে প্রথিত আমি (হায়!) এখনও বেঁচে আছি। পিতৃ আজ্ঞায় (রাজার প্রতি) প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অসীম কৃতজ্ঞাসম্পন্ন ঐড়দেব সেনশত্রুকে একশোটি তীক্ষ্ণ তীর দিয়ে ধ্বংস করে আটজন সহচরসহ রাজার সাথে স্বর্গে গিয়েছেন। যুদ্ধদ্বারা নিজের (জীবিতাবস্থা) অতিক্রম করে চন্দ্ৰকিরণের মতো আমল যশ অর্জনপূর্বক শুভদেবানন্দন (ঐড়দেব) দেবতাগণের মতো ত্ৰিদশ সুন্দরীগণের দৃষ্টি নিয়ে খেলা করছেন। তার (ঐড়দেবের) গীতবাদ্যপ্রিয়, ধর্মধর অমৎসর, গলবস্ত্ৰ, দানশূর সুসংযত বেশ বৈমাত্ৰেয় ভ্ৰাতা শ্ৰীমান ভাবিক যজ্ঞাদি ধর্মকার্য (শ্রাদ্ধ?) সম্পাদন করেন। শরশিল্য দ্বারা নিহত বহু প্ৰাণীকে (সৈন্যকে) যে স্থানে দগ্ধ করা হয়েছিল, সেই স্থানে ভাবকাদাসকৃত এই কীর্তি (মন্দির?) বিরাজ করছে।…’

এটি সামন্ততান্ত্রিক স্বামীধৰ্ম, বীরধর্ম পালনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঐড়দেব ও মিজং দুইটি নামই অসংস্কৃত, অনার্য; দুজনই প্রাচীন বাংলার স্বামীধর্ম ও বীরধর্মের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তাছাড়া, সামন্ততান্ত্রিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সতীদাহ প্রথাও পাল-ভীমামলের শেষ দিকে এবং সেন আমলে প্রসার লাভ করেছিল বলে মনে হয়। বৃহদ্ধৰ্মপুরাণ গ্রন্থে (২।৮।৩-১০) মৃত স্বামীর সঙ্গে পুড়ে মরবার জন্য সমাজ-নায়কেরা দ্বিজ নারীদের পুণ্যলোভে প্রলুব্ধ করেছেন। এর চেয়ে বীরত্ব নাকি তাদের আর কিছু নাই; সহমরণে গেলে নাকি এক পূর্ণ মন্বন্তর স্বামীসঙ্গসুখ ভোগ করা যায়; বাংলা এভাবে একাদশ-দ্বাদশ শতকেই সামন্ততন্ত্রের সব কটি লক্ষণ ফুটিয়ে তুলেছিল।

আমলাতন্ত্র

সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমন প্রসারিত হয়েছিল, তেমনই প্রসারিত হয়েছিল আমলা বা কর্মচারীতন্ত্র। বস্তুত, পাল-যুগের লিপিমালায় রাজকর্মচারীদের যে সুদীর্ঘ তালিকা দেখা যায় তা থেকে এই তথ্য সুস্পষ্ট যে, এই যুগে রাষ্ট্রের বৃহদ্বাহু সমাজের সর্বাঙ্ক ব্যাপী বিস্তৃত। বিভিন্ন রাষ্ট্রকর্মের বিচিত্র বিভাগে বিচিত্র কর্মচারী রাষ্ট্রের প্রধান কেন্দ্ৰ থেকে শুরু করে একেবারে গ্রামের হাট খেয়াঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ৷ লৌকিক প্রায় সমস্ত ব্যাপারই রাষ্ট্রশাসনের গাণ্ডীর অন্তর্ভুক্ত, এমন কি পারলৌকিক ধর্মাচরণ পর্যন্ত। লিপিগুলোতে এই সব বিক্রিত বিভাগের বিচিত্র কর্মচারীর সুদীর্ঘ তালিকা দেয়ার পরও যখন তা শেষ হয় নি তখন “অন্যাংশ্চকীর্তিতান” বলে বাকি সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটা বৃহৎ আমলাতন্ত্র যে পাল-যুগে গড়ে উঠেছিল এই সব সাক্ষ্যই তার প্রমাণ। প্রধান প্রধান কর্মচারী, যেমন মন্ত্রী, সেনাপতি ইত্যাদির হাতে ক্ষমতাও প্রচুর কেন্দ্রীকৃত হত। অত্যন্ত স্বাভাবিক উপায়েই। এই সব কর্মচারীরাও কখনো কখনো সুযোগ পেলে রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতিকূল আচরণ করতেন না, এমন নয়। দিব্য একজন উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন বলে মনে হয়; আর, বৈদ্যদেব কুমারপালের সেনাপতি ছিলেন।

সমাজের কৃষি-নির্ভরতা

এই সামন্ততন্ত্র ও আমলাতন্ত্র অকারণে গড়ে ওঠেনি। এই আমলে বাংলার সামুদ্রিক বাণিজ্যের খবর একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। তাম্রলিপ্তি মৃত; নতুন কোনো বন্দর গড়ে উঠছে বলে খবর নাই। বিহার-বাংলার সঙ্গে সুমাত্রা-যবদ্বীপ-ব্ৰহ্মদেশ ইত্যাদি পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপগুলোর যোগাযোগ অব্যাহত; নালন্দায় প্রাপ্ত শৈলেন্দ্ৰবংশীয় বালপুত্রদেবের লিপিই তার অন্যতম প্রমাণ। এসব দ্বীপ ও দেশগুলোর ইতিহাসেও এই যোগাযোগের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়, কিন্তু একটি প্রমাণও ব্যাবসা-বাণিজ্যিক যোগাযোগের দিকে ইঙ্গিত করে বলে মনে হয় না, সবই যেন ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধীয়। তবে আন্তঃদেশীয় ব্যাবসা-বাণিজ্য অব্যাহত; লিপিগুলোতে বণিক-ব্যবসায়ী ইত্যাদির সংবাদ অপ্রতুল নয়। নানাপ্রকার কারু এবং চারুশিল্পের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে এবং শিল্পীদের গোষ্ঠী যে ছিল তার অন্তত একটি প্রমাণ আছে। জনৈক শিল্পীগোষ্ঠী-চুড়ামণি তো একজন সামন্ত বা উচ্চ রাজপদও (রাণক) লাভ করেছিলেন। কিন্তু তরপরও মনে হয় রাষ্ট্রে বা সমাজে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীর প্রাধান্য খুব ছিল না। তাছাড়া, বর্ণ ব্ৰাহ্মণ্য-সমাজে তারা উচ্চস্থান অধিকার করতেন বলে মনে হয় না। রৌপ্যমুদ্রা প্রচলনের খবর যা পাওয়া যাচ্ছে, স্বর্ণমুদ্রা একেবারেই নেই। এই সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি রাষ্ট্রে ও সমাজে খুব ছিল না। অথচ অন্যদিকে সমাজে ভূমি ও কৃষিনির্ভরতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ প্রচুর। ব্ৰাহ্মণ সম্প্রদায়, রাজপাদোপজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী (মহত্তর, কুটুম্ব প্রভৃতি) ইত্যাদি সকলেই ভূমিনির্ভর। তাছাড়া, ক্ষেত্রকর, কৃষক, কর্ষকেরা বারবার লিপিগুলোতে উল্লিখিত হচ্ছেন দেখে এই অনুমান করা যায় যে, সমাজে তাদের স্বীকৃতি বেড়েছে। প্রধানত ভূমি-নির্ভর সমাজে সামস্ততান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক। ভূমিই যে-সমাজে জীবিকার প্রধান উপায় এবং ভূমির ওপর ব্যক্তিগত ভোগাধিকার যেখানে স্বীকৃত, সেখানে সামন্ততান্ত্রিক ভূম্যধিকারগত সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, তা কিছু আশ্চর্য নয়।

এই একান্ত ভূমি-নির্ভরতার ছবি পাল-যুগের রাজকর্মচারীদের তালিকাটি দেখলেও চোখে পড়ে। আশ্চর্য এই সুদীর্ঘ তালিকাটির মধ্যে নাকাধ্যক্ষ (নৌকাধ্যক্ষ-নাবাধ্যক্ষ), শোন্ধিক (যিনি শুল্ক আদায় করেন) এবং তরিক (পারাপার-কর্তা) ছাড়া আর একটি পদও ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এবং এই তিনটি পদও যে একান্তই ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত তাও বলা যায় না। অন্যদিকে সামরিক ও শাসনসংক্রান্ত কর্মচারী ছাড়া অধিকাংশ রাজপদ ভূমি ও কৃষিসম্পর্কিত।

সেনযুগের সামাজিক ইঙ্গিত

ভূমিকা

সেন-রাজবংশ বাঙালী ছিলেন না, দক্ষিণের কর্ণাট থেকে বাংলায় এসে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে পাল-যুগসৃষ্ট বাংলা ও বাঙালীজাতির আধিপত্য লাভ করেছিলেন। লক্ষণীয় এই যে, এই যুগে আর একটি রাজবংশ পূর্ববঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিল; এই বর্মণ রাজবংশও সম্ভবত অবাঙালী, কলিঙ্গ থেকে আসা। পাল-বংশ মুখ্যত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, সেনা-বংশ গোড়া ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী। আর, যে চন্দ্ররাজবংশকে অধিকারচ্যুত করে বর্মণ-বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারও পালরাজাদের মত পরম সুগত অর্থাৎ বৌদ্ধ, আর বর্মণেরা এবং মেঘনা-অঞ্চলের দেব-বংশের রাজারা সেনদের মতই গোড়া ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও ব্ৰাহ্মণ্য সংস্কারাশ্রয়ী। এই দুই তথ্যের মধ্যে এই যুগের সামাজিক ইঙ্গিত অনেকাংশ নিহিত; এদের ঐতিহাসিক ব্যঞ্জনা অবহেলার বস্তু নয়।

রাষ্ট্রীয় আদর্শ, সংকীর্ণ সামাজিক দৃষ্টি , আমলাতন্ত্রের বিস্তৃতি, রাষ্ট্রযন্ত্রে পৌরোহিত্যের প্রভাব

সুদীর্ঘ পালযুগের রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ এই যুগে অপরিবর্তিত ও নতুন কোনও রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ এই যুগে গড়ে ওঠেনি, রাষ্ট্রযন্ত্রেরও কোনও পরিবর্তন হয় নি। স্থানীয় স্বাতন্ত্র্য ও আত্মকর্তৃত্বের আদর্শ সমভাবে বিদ্যমান। সুপ্রতিষ্ঠিত ও ক্রমাগ্রসরমান বৈদেশিক মুসলমানশক্তির নিরস্তর করাঘাতেও রাষ্ট্রীয় আদর্শের কোনও পরিবর্তন হয়নি; সামগ্রিক ভারতীয় ঐক্যবোধ ও আদর্শ, বৃহত্তর রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ কিছু গড়ে ওঠেনি। সামস্ততন্ত্র সমভাবে সক্রিয়। উত্তরারোত্তর ভূমির চাহিদা বাড়ছে, পুরোহিত-ব্ৰাহ্মণেরাও ভূমিসংগ্রহে তৎপর হয়ে উঠেছেন, সমাজ ক্রমশ ভূমিনির্ভর, কৃষিনির্ভর হয়ে উঠছে। অথচ, রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ক্ষেত্রকর বা কৃষক সম্প্রদায় অবজ্ঞাত, রাজকীয়-ভূমিসংক্রান্ত দলিলপত্রে তারা ভুলেও উল্লিখিত হচ্ছেন না। সমাজের নিম্নতম স্তরের লোকদেরও কোনও উল্লেখ দেখা যায় না। অথচ, পালযুগের লিপিমালায় সর্বত্রই কৃষক-কর্ষক-ক্ষেত্রকরদের উল্লেখ তো আছেই, চণ্ডালদের পর্যন্ত উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, সমাজের কোনও স্তরই তখন রাষ্ট্রের দৃষ্টির বহির্ভূত ছিল না। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, সেন-যুগে রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের আধিপত্যের বিস্তার, অর্থাৎ, রাজ্যপরিধিও পাল-সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি; তাও সংকীর্ণই বলা যায়,

যদিও লক্ষ্মণসেন প্রায় মহীপালের রাজ্যসীমা উদ্ধার করেছিলেন, তবে স্বল্পকালের জন্য মাত্র। অথচ, অন্যদিকে ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল রাজ ও সামন্তবংশেরই রাষ্ট্ৰীয় আমলাতন্ত্র ক্রমবর্ধমান। নতুন নতুন রাজকর্মচারীদের নাম এই যুগে প্রথম শোনা যাচ্ছে; সঙ্গে সঙ্গে ক্রমসংকুচীয়মান নতুন নতুন রাজ্যবিভাগ— খণ্ডল, চতুরক, আবৃত্তি, পাটক ইত্যাদি। ছোট ছোট রাজপদ যেমন বেড়েছে তেমনই বেড়েছে “মহা”-পদের সংখ্যা— মহামন্ত্রী, মহাপুরোহিত, মহাসান্ধিবিগ্রহিক, মহাপিলুপতি, মহাগণস্থ, মহাধৰ্মধ্যক্ষ, ইত্যাদি— “মহা”-পদের আর শেষ নেই। কম্বোজরাজ নয়পালের ইর্দা পট্টোলীতে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র বিভাগের নামও শোনা যায়; কারণ অর্থাৎ কেরানী মণ্ডলসহ “অধ্যক্ষবৰ্গ”, সেনাপতিসহ “সৈনিকসংঘমুখ্য”, দূতসহ “গূঢ়পুরুষ”-বৰ্গ, এবং আরও অনেক কিছু। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একদিকে রাষ্ট্রের সমাজদৃষ্টি যত সংকীর্ণ হচ্ছে, পরিধি যত সংকীর্ণ হচ্ছে, আমলাতন্ত্রের বিস্তার হচ্ছে তত বেশী, রাজ্যপাদোপজীবীর সংখ্যা তত বাড়ছে, চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তত বিস্তৃত হচ্ছে। দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর তালিকা দিয়েও তখন এদের শেষ করা যাচ্ছে না। তখন বলা হচ্ছে, এর পর অন্যান্য অনুল্লিখিত রাজকর্মচারী যারা থাকলেন তাদের নাম অর্থশাস্ত্ৰ-গ্রন্থের অধ্যক্ষ-প্রচার অধ্যায়ে লিখিত আছে। এখান থেকে বোঝা যায় আমলাতন্ত্র কতটা সংখ্যায় ও অধিকার-বৃদ্ধিতে স্ফীত ও অতিমাত্রায় সচেতন হয়েছিল।

শুধু তাই নয়, রাজার সর্বময় কর্তৃত্বও বেড়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় আড়ম্বরও। এই যুগেই দেখিতেছি, তার নূতন নূতন উপাধি গ্রহণের আতিশয্য। স্মলযুগের রাজকীয় বিজ্ঞপ্তিতে রানীর উল্লেখ দেখা যায় না; কিন্তু এখন দেখিতেছি। রাজ্ঞী-মহিষীরাও উল্লিখিত হতেছেন। রাজপরিবারের আভিজাত্য ও দরবারী জৌলুস ও বাড়িতেছে, এমন অনুমান করা বোধ হয়। অন্যায় নয়! বৰ্মণ, কম্বোজ ও সেনা-বংশ সকলেই তো বিদেশাগত; মাতৃপ্রধান অথবা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্মৃতি তারা বহন করিয়া আনিয়াছিলেন, এমনও হতে পারে! এইখানেই শেষ নয়; পুরোহিত, মহাপুরোহিত, শাস্ত্যাগরিক, শাস্ত্যাগোরাধিকৃত, শান্তিবারিক, মহাতন্ত্রাধিকৃত প্রভৃতি নূতন নূতন রাজপুরুষ (ইহারা সকলেই ধর্মীচরণ-ধর্মানুষ্ঠান সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত) রাজসভা জাকাইয়া বসিয়া আছেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ রাজপণ্ডিতও আছেন; তিনিও এই যুগে অন্যতম রাজকর্মচারী। আমলাতন্ত্রের এই সুদীর্ঘ ও সর্বব্যাপী বাহু এবং সর্বময় প্রভুত্ব জনসাধারণ কী দৃষ্টিতে দেখিত তা জানার কোনও উপায় নাই।

শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের স্থান

ভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকেও রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টি-সংকীর্ণতার সমর্থন পাওয়া যায়। পূর্বতর যুগের মতো পালযুগের রাষ্ট্রে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীর প্রাধান্য ছিল না, এ-কথা সত্য; কিন্তু সমাজে তাদের একটা স্থান ছিল, স্বীকৃতি ছিল। সেন-আমলে দেখা যাচ্ছে, শিল্পী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকেরা সমাজের নিম্নস্তরে নেমে গেছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এ সম্পর্কে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই দুই গ্রন্থে বর্ণ-বিন্যাসের যে-ছবি পাওয়া যায়, যদি তা সেন-আমলের সমাজ-বিন্যাসের কিছু ইঙ্গিতও বহন করে তাহলে স্বীকার করতেই হয়, অনেক শিল্পী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সংশুদ্ৰ বলেও গণ্য হতেন না; বর্ণ-বিন্যাসের নিম্নতর স্তরে তাহদের স্থান ছিল।

বৌদ্ধধর্মে রাজানুগ্রহের অভাব

বর্মণ ও সেন বংশের প্রত্যেকটি লিপিতেই অধিকমাত্রায় ব্ৰাহ্মণ্য স্মৃতি, সংস্কার ও পূজাৰ্চনা দেখা যায় যেগুলো বিভিন্ন তিথি উপলক্ষে তীর্থস্নান, উপবাস, বিভিন্ন রকমের বৈদিক ও পৌরাণিক যাগযজ্ঞ ইত্যাদির বিবরণ। এসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেবল ব্রাহ্মণদেরকেই ভূমিদান করা হত। কোন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বা বৌদ্ধ বিহার বা সংঘ এই যুগে কোনও রকম রাজানুগ্রহ লাভ করছেন এর কোন প্রমাণ এই যুগে নেই।

বাংলায় প্রাপ্ত বৌদ্ধমূর্তির বেশিরভাগ অষ্টম থেকে ১১শ শতকের, অল্প কয়েকটি মূর্তিই দ্বাদশ-১৩শ শতকের। পট্টিকেরা রাজ্যের এক রণবঙ্কমল্ল হারিকালদেবী ছাড়া এই যুগে আর কোনও বৌদ্ধ নরপতির খোঁজ পাওয়া কঠিন। মধুসেন পরমসুগত সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি সেন-বংশের রাজা কিনা নিশ্চিত করে বলা কঠিন, আর, এধরনের ২/১টি দৃষ্টান্তের সাহায্যে রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ ধরাও যায়না। বর্মণ ও সেনা-বংশীয় রাজারা কেউ শৈব, কেউ বৈষ্ণব, কেউ সৌর, কিন্তু প্রত্যেকেরই আশ্রয় পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও সংস্কার, এবং তারা প্রত্যেকেই এই স্মৃতি ও সংস্কার প্রচার ও বিস্তারে সদা উৎসুক। রাজপরিবারের লোকদেরও এ-সম্বন্ধে আগ্রহের সীমা নেই। বৌদ্ধধর্ম এই সময় বিলীন হয়ে গিয়েছিল, সংঘ-বিহার ইত্যাদি ছিল কিন্তু রাষ্ট্রের কোনও অনুগ্রহই সেদিকে বর্ষিত হয়নি।

বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিরোধিতা

বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি বিরোধিতাও এই যুগে শুরু হয়ে থাকতে পারে, যার পেছনে রাষ্ট্রের সমর্থন ছিল। বৰ্মণরাজ জাতবর্মীর রাজত্বকালেই সম্ভবত বর্মণ-রাষ্ট্রের বঙ্গাল সৈন্যদল সোমপুরের বৌদ্ধ মহাবিহারের অন্তত একাংশ পুড়িয়ে দিয়েছিল; নালন্দার একটি লিপিতে এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতির উল্লেখ আছে। এই আক্রমণ শুধু কৈবর্তনায়ক দিব্যর বিরুদ্ধেই নয়, বৌদ্ধধর্মেরও বিরুদ্ধে।

ভট্ট-ভবদেব ছিলেন রাজা হরিবর্মর সন্ধিবিগ্রহিক; তার পিতামহ আদিদেব বঙ্গরাজের সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন; এই পরিবারের রাষ্ট্ৰীয় প্রভাব সহজেই অনুমেয়। তার ওপর ভবদেব নিজে ছিলেন সমসাময়িক কাল এবং সংস্কৃতির একজন প্রধান নায়ক, কুমারিলভট্টের মীমাংসা-বিষয়ক তন্ত্রবার্তিক গ্রন্থের টীকাকার, হোরাশাস্ত্ৰ, মীমাংসা-সিদ্ধান্ত-তন্ত্র-গণিত এবং ফলসংহিতা বিষয়ক গ্রন্থসমূহের রচয়িতা, কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি বা দশকর্মপদ্ধতি, প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ প্রভৃতি স্মৃতি বিষয়ক গ্রন্থের লেখক এবং ব্রহ্মবিদ্যাবিদ পণ্ডিত। এই ভবদেব-ভট্ট ‘অগস্ত্যের মতো বৌদ্ধরূপ সমুদ্রকে গণ্ডযে পান করেছিলেন এবং তিনি পাষণ্ডবৈতপ্তিকদের যুক্তিতর্কখণ্ডনে দক্ষ ছিলেন বলে তার প্রশস্তিলিপিতে দাবি করা হয়েছে। পাষণ্ডবৈতণ্ডিকেরা যে বৌদ্ধ নৈয়ায়িক এসম্বন্ধে সন্দেহ নেই। তাই দেখা যাচ্ছে, এই যুগের ব্রাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি, বৌদ্ধ দর্শন ও সংস্কৃতির বিরোধী।

ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যের বিকাশ

বর্মণ বংশের রাষ্ট্র ভবদেব যেমন সামাজিক আদর্শের প্রতিনিধি সেন-রাষ্ট্রে তেমনই হলায়ুধ। এই হলায়ুধও ভবদেবেরই মতো ব্রাহ্মণকুলতিলক, এবং তেমনই প্রথমে রাজপণ্ডিত, তারপর লক্ষ্মণসেনের মহামাতা, এবং সর্বশেষ লক্ষ্মণসেনেরই ধর্মধিকারী বা ধর্মধ্যক্ষ। তার পিতা ধনঞ্জয়ও ছিলেন রাজকীয় ধর্মাধ্যক্ষ। এই পরিবারেরও রাষ্ট্রীয় প্রভাব অনস্বীকার্য হলায়ুধের দুই ভাই ঈশান এবং পশুপতি যথাক্রমে আহ্নিক এবং শ্ৰাদ্ধ সম্বন্ধে দুটি পদ্ধতি রচনা করেছিলেন। পশুপতি একটি পাকযজ্ঞ-গ্রন্থেরও রচয়িতা। আর, হল্যায়ুধ নিজে তো ব্রাহ্মণসর্বস্ব, মীমাংসাসৰ্বস্ব, বৈষ্ণবসর্বস্ব শৈব সর্বস্ব এবং পণ্ডিতসর্বস্ব প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। সুস্পষ্ট বিরোধিতার ইঙ্গিত ভবদেব ছাড়া আর কারও জীবনে পাওয়া যায় না, কিন্তু এ-কথা সত্য যে, এ-যুগের রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ একান্তই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি আশ্রয়ী। দুটি মাত্র দৃষ্টান্ত আহরণ করা হইল কিন্তু বস্তুত, বাংলায় আজও যে স্মৃতিশাসনে শাসিত, যে বর্ণ-বিন্যাসে বিন্যস্ত সেই স্মৃতি ও বর্ণ-বিন্যাস দুইই এই সেন-বৰ্মণ যুগের সৃষ্টি। বল্লালসেনের গুরু অনিরুদ্ধ থেকে শুরু করে জিতেন্দ্ৰিয়, বালক, ভবদেব, হল্যায়ুধ এবং বোধ হয় জীমূতবাহন, এরা প্রত্যেকেই সেন-বর্মণ আমলের লোক, এবং হারলতাপিতৃদায়িতা থেকে শুরু করে ব্যবহারমাত্রিকা-দায়ভাগ-কালবিবেক পর্যন্ত সমস্ত স্মৃতি, ব্যবহার ও মীমাংসা গ্রন্থ এই যুগের রচনা। এই স্মৃতি-ব্যবহার-মীমাংসাই শূলপাণিরঘুনন্দনের দ্বারা পরিবর্ধিত ও পরিশোধিত হয়ে আজও বাংলার সমাজ শাসন করছে।

এই ধর্ম ও সাংস্কৃতিক আদর্শের পেছনে রাষ্ট্রের সক্রিয় পোষকতা ও সমর্থন না থাকলে একশো-দেড়শো বছরের মধ্যে এদের এমন সমৃদ্ধ রূপ কিছুতেই দেখা যেত না। পোষকতা ও সমর্থন যে ছিল তার প্রমাণ বল্লালসেন ও লক্ষ্মণসেন স্বয়ং। বল্লাল স্বয়ং আচারসাগর, প্রতিষ্ঠাসাগর, দানসাগর এবং আংশিকত অদ্ভুতসাগর এই চারটি স্মৃতি বিষয়ক গ্রন্থের রচয়িতা। দানসাগর তিনি লিখেছিলেন তার গুরু অনিরুদ্ধের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে। অসম্পূর্ণ অদ্ভুতসাগর সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন লক্ষ্মণসেন স্বয়ং, এবং তার পিতার নির্দেশেই।

পুরোহিতদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি

এই যুগের সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রেই প্রথম দেখা যাচ্ছে, পুরোহিত-মহাপুরোহিত, শান্ত্যাগরিক-শাস্তবারিক, তন্ত্ৰাধিকৃত প্রভৃতির রাজকর্মচারী বলে গণ্য হচ্ছেন। রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য, ব্ৰাহ্মণধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং রাষ্ট্র ও রাজবংশ এই সংস্কৃতি বিস্তারে সচেষ্ট। সমাজ নিয়ন্ত্রণ রাজার কর্তব্য বলে ভারতবর্ষে বরাবরই স্বীকৃত হয়েছে; পাল-রাজারাও বর্ণাশ্রম রক্ষণ ও পালন করেছেন; কিন্তু সেন-আমলে রাষ্ট্র ও রাজবংশ যেভাবে দেশের সকলের দৈনন্দিন জীবনের ছোট-খাট ক্রিয়াকর্তব্য থেকে শুরু করে সমস্ত ধর্ম ও সমাজগত আচার ও আচরণ, পদ্ধতি ও অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্ৰণ করতে চেষ্টা করেছিল, এমন সজ্ঞান সচেতন এবং সর্বব্যাপী কর্তৃত্বমূলক চেষ্টা বাংলায় এর আগে বা পরে আর কখনো হয়নি। এই যুগের সর্বপ্রধান চেষ্টাই যেন একান্ত পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য স্মৃতি-সংস্কৃতির আদর্শনুযায়ী বাংলার সমাজকে একেবারে নতুন করে ঢেলে সাজানো, নতুন করে গড়া। সেই চেষ্টার পেছনে রাষ্ট্র ও রাজবংশের পরিপূর্ণ সক্রিয় সমৰ্থন রয়েছে, উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীর লোকেরাও তার পোষক ও সমর্থক।

সামাজিক স্তরায়ণে ব্রাহ্মণ্য-আধিপত্য

এই যুগের লিপিমালা এবং ধর্মশাস্ত্ৰ-গ্রন্থগুলোও এই ইঙ্গিত দেয়। কুলজী গ্রন্থমালার সাক্ষ্য, বাংলার কৌলীন্য প্রথার সাক্ষ্য ঐতিহাসিক, প্রামাণিক ও বিশ্বাসযোগ্য না হতে পারে, কিন্তু, লোকস্মৃতি ও লোকেতিহাসের কিছুমাত্র ঐতিহাসিক মূল্য থেকে থাকলে স্বীকার করতে হয়, শ্যামলবৰ্মা এবং বল্লালসেনের সঙ্গেই বাংলার প্রচলিত বর্ণ-বিন্যাস ও সামাজিক স্তরবিভাগের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। লোকস্মৃতির নিচে সাধারণত কোথাও একটা কিছু সত্য গোপন থাকে, বৰ্মণ ও সেন-বংশের সামাজিক আদর্শ সম্বন্ধে যে অকাট্য নিঃসংশয় প্রমাণ সুবিদিত, লোকস্মৃতি এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধাচরণ করছে না। আনন্দভট্টের বল্লালচরিত-গ্ৰন্থ খুব প্রামাণিক না হতে পারে কিন্তু এর সামাজিক ইঙ্গিত একেবারে হয়তো মিথ্যা নয়। এখানে বল্লালসেন বণিকদের ওপর অত্যাচার করছেন এবং সুবর্ণবণিকদের পতিত করে দিয়েছেন, আর কৈবর্ত, মালাকার, কুম্ভকার ও কর্মকারদের সৎশুদ্রস্তরে উন্নীত করেছিলেন যে বৰ্ণনা আছে, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু সেন রাষ্ট্র ও রাজবংশের আমলে এভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তর নির্ণয় এবং কোন স্তরে কোন সম্প্রদায়ের স্থান ইত্যাদি নির্দেশ করা হচ্ছিল, তা অস্বীকার করা যায় না, হয়তো তার পেছনে রাষ্ট্রের বা রাজকীয় নির্দেশও কিছু মাত্রায় ছিল।

প্রভাবাধীন অঞ্চল

এই ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল বরেন্দ্রী ও রাঢ়দেশ, এবং পরবর্তীকালে বিক্রমপুর অঞ্চল। কিন্তু বিক্রমপুর বৌদ্ধ সাধনা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্ৰস্থল থাকায়।সেখানে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতাপ রাঢ়-বরেন্দ্রীর মতো এতটা প্রবল হয়ে উঠতে পারেনি। আর ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ সাধনার প্রভাব বহুদিন পর্যন্ত প্রবল ছিল। এ-সম্বন্ধে লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। বোধ হয়, এইজন্যই মৈমনসিংহ-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম-শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে আজও ব্রাহ্মণ্য স্মৃতির শাসন এর চেয়েকৃত শিথিল।

সেন ও বর্মণ উভয় বংশ‍ই দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছে। এই তথ্য সুবিদিত যে, অন্ধ্র-সাতবাহন আমল থেকেই দক্ষিণ ভারত ব্রাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির খুব বড় কেন্দ্র। পল্লব, চোল, চালুক্য, ইত্যাদি সকল রাজবংশই এই ধর্ম ও সংস্কৃতির পোষক, ধারক ও সমর্থক। বস্তুত, উত্তর-ভারতের থেকে দক্ষিণ-ভারত এই বিষয়ে বেশি গোড়া ও পরিবর্তন-বিবর্তন বিমুখ। শুধু আজই এরকম নয়, প্রাচীনকালেও তাই ছিল। কলিঙ্গ-কর্ণাট থেকে বর্মণ ও সেনেরা সেই আদর্শ নিয়েই বাংলায় এসেছিলেন, এবং রাষ্ট্রের বিপুল ও সক্রিয় সমর্থন এবং রাজবংশের মর্যাদার বলে সহায়তায় সেই আদর্শ এবং তদনুযায়ী স্মৃতি ও ব্যবহার শাসন বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছিলেন। তাদের এই চেষ্টা সফল হয়েছিল। বাধা-বিরোধিতা তখনও হয়েছিল, পরেও হয়েছে। বাঙালী সমাজ পদ্ধতি ও শাসন বাংলার সর্বত্র সমভাবে স্বীকৃত ছিল না, এখনও নেই; কিন্তু কোনও বাধাই যথেষ্ট কার্যকরী হয়নি। আজ পর্যন্ত উচ্চতর বর্ণ ও সমাজ সেই যুগেরই স্মৃতি ও ব্যবহার-শাসন মেনে চলছে, নিম্নতর বর্ণেরও তাই আদর্শ ও মাপকাঠি।

পালযুগের সাংস্কৃতিক সমন্বয়

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবর্তন সমসাময়িক বাংলার পক্ষে সার্থক ও কল্যাণকর হয়েছিল কিনা। পাল-যুগের সামাজিক আদর্শ ছিল বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণ। ইতিহাসের চক্রাবর্তে বৈদিক ও পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের যে স্রোত বাংলায় প্রবাহিত হচ্ছিল সেই স্রোতকে ব্রাহ্মণেতর ধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মেরই কাঠামো ও আদর্শনুযায়ী একটি বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয় গড়ে তোলাই ছিল পাল-চন্দ্র পর্বের সাধনা। সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজবংশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ তাই ছিল। গুপ্ত-আমল থেকে শুরু করে ব্ৰাহ্মণ্যধম ও সংস্কৃতির প্রভাব বাংলায় সুস্পষ্ট এবং ক্রমবর্ধমান; তখন থেকেই না হউক, অন্তত সপ্তম-৮ম শতক থেকে ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতিই বলবত্তর; কখনো তা অস্বীকৃত হয়নি। বৌদ্ধ খড়্গ বা পাল বা চন্দ্র রাজারাও তা করেননি, বরং তারা সেই আদর্শই মেনে নিয়েছেন, ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করেছেন, পুরোহিত অৰ্চিত শান্তিবারি মস্তকে গ্রহণ করেছেন, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মন্দির স্থাপন করেছেন, চতুৰ্বর্ণ সমাজ রক্ষা ও পালন করেছেন, রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ পাঠ শুনেছেন। শুধু তাই নয়, পাল-যুগে ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ দেবদেবীদের মধ্যেও একটা বৃহৎ সমন্বয়-স্বাঙ্গীকরণ-ক্রিয়া চলছিল; বৌদ্ধ ও শৈব তন্ত্রধর্ম ও চিন্তা বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের একটি বৃহৎ সমন্বয় সূত্রে গাঁথা ছিল; বৌদ্ধরা অসংখ্য ব্ৰাহ্মণ্য দেবদেবীকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন; আর্যেতর, ব্রাহ্মণেতর সংস্কৃতির দেবদেবীদের পংক্তিভূক্ত করছিলেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণেরাও বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণেতর, আর্যেতর দেবদেবীদের কিছু কিছু মেনে নিচ্ছিলেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই সমন্বয়স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়া সমভাবে চলছিল। বর্ণ-বিন্যাস ও সামাজিক স্তরভেদের ব্যাপারেও তা দেখা যায়।

সেন আমলে ধর্মীয় সমন্বয়হীনতা ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য

পাল-আমলে চণ্ডাল পর্যন্ত সকল শ্রেণী ও বর্ণের লোকেরাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিভূত; সেন-আমলে শুধু উচ্চতর বর্ণের লোকেরাই রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আছেন। এমন কি রাষ্ট্রযন্ত্রেও ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের প্রাধান্য। পাল-রাজারা চার বর্ণের সমাজ রক্ষা ও ধারণ করেছেন, কিন্তু সেন ও বর্মণ রাজারা ইচ্ছামত এবং স্মৃতি-নিৰ্দেশমত চার বর্ণের বিভিন্ন স্তর ঢেলে সাজিয়েছেন। বস্তুত, পাল আমলের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণের আদর্শ এযুগে যেন একেবারে পরিত্যক্ত হয়েছিল; সেই আদর্শের স্থানে সবলে ও সোৎসাহে তারা এক নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আদর্শ স্মৃতি-শাসিত বৈদিক ও পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির আদর্শ, সর্বপ্রকার যুগোপযোগী সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণ-বিরোধী আদর্শ।

কঠোর সামাজিক স্তরভেদ ও অস্পৃশ্যতা

কুলজী-গ্ৰন্থগুলো, লোকস্মৃতির যদি কিছু মাত্র মূল্যও থাকে, বল্লাল-চরিত গ্রন্থোক্ত-কাহিনীর পেছনে যদি কোনও সত্য থাকে, তাহলে স্বীকার করিতে হয়, সেন ও বর্মণ আমলে পালযুগ গঠিত বাংলার সমাজ ও বাঙালী জাতিকে খণ্ড খণ্ড করে ভেঙ্গে নতুন করিয়া গড়া হয়েছিল। এই গড়ার মূলে কোনও সমন্বয় বা স্বাঙ্গীকরণের আদর্শ সক্রিয় ছিল না। বর্ণ-বিন্যাসের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, সমাজ বিভিন্ন স্তরে স্তরে বিভক্ত; প্রত্যেকটি স্তর সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত; এক স্তরের সঙ্গে অন্য স্তরের মিলন ও আদান-প্রদানের বাধা প্রায় দুর্লঙ্ঘ্য, অন্যতিক্রম্য। মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ যেখানে মিলন ও আদান-প্ৰদান হচ্ছে সেখানে স্মৃতি-শাসনের ব্যতিক্রম হচ্ছে, এবং এই ব্যতিক্রমগুলোও সুনির্দিষ্ট নিয়মে নিয়মিত।

বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণ-বিন্যাস ও তার যুক্তি, এই যুগের অসংখ্য স্মৃতি-গ্ৰস্থাদির বিবরণ ও যুক্তি পাঠ করলে সমাজের এই স্তরভেদ কিছুতেই অস্বীকার করার উপায় থাকে না। সর্বোচ্চ বৰ্ণ-ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যদি বা উত্তর সংকর বা সৎশুদ্রদের খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে আদান-প্রদানের পথ খানিকটা উন্মুক্ত ছিল, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজদের সঙ্গে একেবারেই ছিল না। এক স্তরের সঙ্গে আর এক স্তরের, কিংবা একই স্তরের মধ্যে এক শাখার সঙ্গে আর এক শাখার বৈবাহিক আদান-প্ৰদান একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। এক একটি স্তরের মধ্যেও আবার নানা ক্ষুদ্র বৃহৎ উপস্তর; এবং সেখানেও বিভিন্ন বিচিত্র উপস্তরের মধ্যে বিচিত্র বাধা-নিষেধের প্রাচীর। এ সব সাক্ষ্য কুলজী গ্রন্থমালা বা বল্লালচরিতের নয়, এই যুগেরই স্মৃতি-গ্ৰন্থগুলোর, লিপিমালার এবং এই যুগেরই প্রতিফলন যেসব গ্রন্থে পড়েছে অর্থাৎ বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সাক্ষ্য এবং তা অস্বীকার করা কঠিন। শেষোক্ত পুরাণ দুটোয় দেখা যাবে, ব্ৰাহ্মণদের মধ্যেই বিভিন্ন স্তর। এ-যুক্তি স্বীকার্য যে, সেন-বর্মণ আমলে এসব স্তরভেদ ও বিভিন্ন স্তর-উপস্তরের মধ্যে বিধি-নিষেধের প্রাচীর পরবর্তীকালের মতো সুনির্দিষ্ট, এত কঠোর হয়তো হয়ে ওঠেনি; কিন্তু রাষ্ট্র ও উচ্চতর বর্ণগুলোর সামাজিক আদর্শ তাই ছিল এবং সেই আদৰ্শই তারা সবলে প্রচার করতে শুরু করেছিলেন, যার প্রমাণ সেন-বৰ্মণ যুগের লিপিমালা এবং স্মৃতিগ্রন্থমালা। সমাজের এই স্তরভেদ এবং স্তরে স্তরে আদান-প্রদানের বিচিত্র বিধিনিষেধ নবগঠিত বাংলার সমাজ ও বাঙালী জাতিকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেয়।

কঠোর শ্রেণী-ব্যবধান

বর্ণ-বিন্যাসের ক্ষেত্রে যেমন শ্রেণী-বিন্যাসের ক্ষেত্রেও তাই। কৃষক-ক্ষেত্রকর থেকে শুরু করে অন্ত্যজ চণ্ডাল পর্যন্ত লোকেরা রাষ্ট্রের দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত ছিল না; আর, ব্রাহ্মণেরা রাষ্ট্রে ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করছিলেন, ধর্মানুষ্ঠানের কর্তারা যে ক্রমশ রাজপাদাপোজীবী হচ্ছিলেন। ভবদেব-ভট্টের মত একজন পণ্ডিত ও রাষ্ট্রনায়ক ব্ৰাহ্মণদের কৃষিকার্য সমর্থন করেছেন; লিপিমালায় প্রমাণ পাওয়া যায়, ব্রাহ্মণেরা রাষ্ট্রকার্যে, সামরিক ও অন্যান্য ব্যাপারে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত আছেন, অথচ ভবদেবই ব্ৰাহ্মণদের পক্ষে অন্য প্রায় সকল বৃত্তিই নিষিদ্ধ বলছেন, এমন কি অব্রাহ্মণকে শিক্ষাদান, এবং অব্রাহ্মণ্যের যাগযজ্ঞ-পূজা-অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য পর্যন্ত। এখান থেকে শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদের সৃষ্টি, ভেদবুদ্ধি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্ৰাহ্মণদের পক্ষে চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা, চিত্রবিদ্যার চর্চাও নিষিদ্ধ ছিল; যারা তা করতেন তারা ‘পতিত’ হয়েছিলেন। অথচ জ্যোতিবির্দার চর্চাও নিষিদ্ধ ছিল; দেবল ব্রাহ্মণরা এইজন্যই পতিত হয়েছিলেন। অথচ ভবদেব-ভট্ট, বল্লালসেন প্রভৃতির স্বয়ং এবং আরও অনেক সমসাময়িক প্রধান প্রধান পণ্ডিত-ব্রাহ্মণ, জ্যোতিষ, ফলসংহিতা, হোরাশাস্ত্ৰ ইত্যাদির চর্চা করতেন। তারা তাতে পতিত হননি। ব্রাহ্মণেতর বর্ণের পৌরোহিত্য যারা করতেন তারা ঐ সব নিম্ন বর্ণের বর্ণভুক্ত হতেন, শ্রেণী ভেদবুদ্ধির প্রমাণ দেয়। এসব সাক্ষ্যের সবই সমসাময়িক। এদিকে বল্লাল-চরিতের সাক্ষ্য প্রামাণিক হলে বলতে হয় বল্লালের রাষ্ট্র কোনও না কোনও কারণে বণিকদের সমর্থন হারিয়েছিল, যার ফলে সমাজে সুবর্ণবণিকেরা পতিত হয়েছিল।

সেক-শুভোদয়ার একটি গল্পে দেখছি, লক্ষ্মণসেনের এক শ্যালক, রানী বল্লভার এক ভ্রাতা কুমারদত্ত, এক বণিক-বধুর ওপর পাশবিক অত্যাচার করতে গিয়েছিল। বণিকবধু মাধবী যে শেষপর্যন্ত রাজসভায় সুবিচার পেয়েছিলেন শুধু তেজস্বী ব্রাহ্মণ সভাকবি ও পণ্ডিত গোবর্ধন আচার্যের জন্য। নইলে রাজসভায় মন্ত্রী, রাজমহিষী ও স্বয়ং রাজার যে আচরণ এই গল্পের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে তা সেন-রাজসভার পক্ষে খুব প্রশংসনীয় নয়। বল্লালসেন যে মালাকার, কর্মকার, কুম্ভকার এবং কৈবর্তদের উন্নীত করেছিলেন, এখানেও শ্রেণীগত ভেদবুদ্ধির প্রমাণ সুস্পষ্ট। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও দেখা যায়, অনেকগুলো সমৃদ্ধ ও অর্থশালী শিল্পী ও বণিক সম্প্রদায় মধ্যম সংকর ও অসৎশুদ্ৰ পর্যায়ভুক্ত এবং স্বর্ণকার ও সুবর্ণবণিকদের স্থান এই পর্যায়ে।

বৌদ্ধ ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোকেরা যে সেন-রাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না, তার ইঙ্গিত তারনাথের বিবরণীতেও খানিকটা পাওয়া যাচ্ছে। তাদের দোষও দেয়া যায় না কারণ সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্র তাদের প্রতি শ্রদ্ধিত ও সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল না, আর রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শও বৌদ্ধস্বার্থ বিরোধী ছিল। বৰ্ণভেদবুদ্ধি এবং এই শ্রেণীভেদবুদ্ধি একত্রে জড়িত হয়ে নবগঠিত বাংলাকে, সেন-রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সামন্ততন্ত্র এবং অস্বাভাবিকরূপে স্ফীত আমলাতন্ত্র-বিন্যস্ত সেন-বৰ্মণরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় আদর্শে ভেদবুদ্ধির দুর্বলতা, স্থানীয় আত্ম-কর্তৃত্বের দুর্বলতা তো ছিলই, তার ওপর বর্ণ ও শ্রেণীগত এই ভেদবুদ্ধি, সমোজাদর্শগত ভেদবুদ্ধি বৈদেশিক আক্রমণকে প্রশ্ৰয় দিয়েছে, তা সহজ করে দিয়েছে। বিহার-ধ্বংসের কথা শুনেই নবদ্বীপের প্রায় সমস্ত লোক ভয়ে আতঙ্কে পালিয়ে গিয়েছিল, রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গ লক্ষ্মণসেনকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, রাজ-জ্যোতিষীরা লক্ষ্মণসেনকে বিভ্ৰান্ত করেছিলেন। সমসাময়িক সামাজিক আদর্শ ও বিন্যাসের দিক থেকে দেখলে মিনহাজ-উদ-দীনের এই সব উক্তি একেবারে মিথ্যা বলে মনে হয় না। মিনহাজের কথায় বণিকেরাও নিজেদের কর্তব্য ফেলে দিয়ে পালিয়েছিলেন। এসব সর্বব্যাপী ভেদবুদ্ধির আচ্ছন্নতার মধ্যে লক্ষ্মণসেনের বা তার পুত্রদের ব্যক্তিগত শৌর্যবীর্য বা সৈন্যদলের প্রতিরোধ তেমন কার্যকরী হবার কথা না।

যৌনতা ও দেবদাসী

আর্যেতর ধর্মের আচারানুষ্ঠান ও তন্ত্রধর্মের বিকৃতি এসময় বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্ম ও সমাজকেই স্পর্শ করেছিল, এবং উভয় ধর্মেরই আচারানুষ্ঠানকে বিভিন্ন রকম যৌনাতিশয্যে ভরে তুলেছিল। বোধ হয়, তারই ফলে সমাজে, বিশেষভাবে উচ্চ বর্ণ ও শ্রেণীগুলোতে নানান প্রকারের কাম ও যৌনবিলাস দেখা দিয়েছিল। সেন-বর্মণ যুগের স্মৃতি ও কাব্যগ্রন্থগুলো, লিপিমালা ও ধর্মানুষ্ঠানের বিবরণগুলো পাঠ করলে এসম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ থাকে না। বস্তুত, যৌন আচার-ব্যবহারে কোনোরকম শীলতা জ্ঞান এই সমাজে ছিল বলে মনে হয় না। নাগর-সমাজে প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য দাসী রাখা নিয়মের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। জীমূতবাহন এবং টীকাকার মহেশ্বরের সাক্ষ্য এ-সম্বন্ধে প্রামাণিক বলে স্বীকার করা যেতে পারে। আর, সেন-আমলেই বোধ হয় দেবদাসী প্রথা বাংলায় বিস্তৃতি লাভ করে। বাংলায় এই প্রথা কল্যাণকর হয়নি। এই প্রথা ক্রমশ যৌনাতিশয্যের দ্যোতক হয়ে উঠেছিল এবং রাজরাজড়া থেকে শুরু করে উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীর সমৃদ্ধ লোকেরা এই প্রথার আশ্রয়ে তাদের কাম-বাসনার চরিতার্থতা খুঁজে পেয়েছিলেন, এ-সম্বন্ধেও সন্দেহ করার কারণ নেই।

বিজয়সেন ও ভট্ট ভবদেবী দুজনই তাদের প্রতিষ্ঠিত ধর্মমন্দিরে শত শত দেবদাসী উৎসর্গ করার গৌরব দাবি করেছেন। সুহ্মদেশে আর এক সেনরাজ (বোধ হয়, লক্ষ্মণসেন) প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে দেবদাসীর (বার-ব্লামা) উল্লেখ ধোয়ী কবির পবনদূত কাব্যে পাওয়া যায়। সন্ধ্যাকরনদীর রামচরিতেও দেববারবনিতার উল্লেখ সুস্পষ্ট। হয়তো পালযুগেই এই প্রথা প্রবর্তিত হয়েছিল; রাজতরঙ্গিণী-গ্রন্থে কমলা-নর্তকীর কাহিনী প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেন আমলে এর বিস্তৃতি ও সমসাময়িক কবিকণ্ঠে এসব বাররামা-বারবনিতাদের উচ্ছ্বাসময় নির্লজ্জ স্তুতিগান অনস্বীকার্য। ধোয়ী এবং ভবদেব-প্রশস্তির কবি এই বারবনিতাদের ওপর কবিকল্পনার অজস্ৰ মধুময় বাণী বর্ষণ করেছেন। সেন-বৰ্মণরা বোধ হয় দক্ষিণ-দেশ থেকে এই দেবদাসী প্রথার প্রবাহ নতুন করে বাংলায় নিয়ে এছিলেন। সমসাময়িক বাংলার নাগর-সমাজের যুবক যুবতীদের যে কামলীলার বিবরণ ধোয়ী কবির পবনদূতে পাওয়া যায় তাও খুব প্রশংসনীয় নয়, অথচ কবি তাকে সাধারণসমাজ জীবনের অঙ্গ বলেই বর্ণনা করে গেছেন।

বাৎস্যায়ন তার কামসূত্রে গৌড়-বঙ্গের রাজান্তঃপুরে কামচাতুর্যলীলার এবং নির্লজ্জ কামক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন (তৃতীয়-৪র্থ শতক), এবং বৃহস্পতিও বলেছেন যে, প্রাচ্যদেশের দ্বিজবর্ণের মেয়েরা যৌনব্যাপারে দুর্নীতিপরায়ণ। কিন্তু সমাজ তখনকার সেই সওদাগরী ধনতন্ত্র এবং সুগঠিত কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্রের আমলে এত দুর্বল ছিল না, ভেদবুদ্ধি এত প্রবল ছিল না, এবং এই সব দুনীতি দ্বিজবৰ্ণ, রাজান্তঃপুর এবং অভিজাতশ্রেণী অতিক্রম করে সমাজের সকল স্তরে বিস্তৃত হয়ে পড়েনি। পাল-আমলের শেষের দিক থেকেই তা দেখা দিল এবং সেন আমলে সমগ্র সমাজদেহকে তা কলুষিত করে দিল। ব্ৰাহ্মণ শূদ্র নারীকে বিয়ে করতে পারত না, কিন্তু শূদ্র নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্বন্ধে তার বিশেষ কোনও বাধা ছিল না; নামমাত্র শাস্তিতেই সে-অপরাধ কেটে যেত, এটাই সমসাময়িক বাংলার স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান।

বিলাস ও আড়ম্বরাতিশয্যও এই সময় নাগরি সমাজকে গ্রাস করেছিল। সন্ধ্যাকর নন্দী রামাবতী এবং ধোয়ী কবি বিজয়পুরের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে এ-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকে না। এই যুগের প্রস্তরশিল্পেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পল্লবিত বাক্য, ভাবোচ্ছাসবিলাসময় কল্পনা, আড়ম্বরময় অতিশয়োক্তি, অলংকার প্রাচুর্য এবং লাস্যবিলাসময়, শৃঙ্গাররসাবিষ্ট দৃষ্টি এই যুগেরই সাহিত্য ও শিল্পের বৈশিষ্ট্য। সদ্যোক্ত যৌনাতিশয্য ও কামবিলাস জনসাধারণের ধর্মানুষ্ঠানগুলোকেও স্পর্শ করেছিল। শারদীয়া দুৰ্গাপূজার সময় দশমী তিথিতে শারদোৎসব নামে একটি নৃত্যগীতোৎসব প্রচলিত ছিল। গ্রামে নগরে এই উৎসবে নরনারীর দল কর্দমলিপ্ত এবং বৃক্ষপত্ৰমাত্র পরিহিত ও অর্ধ উলঙ্গ হয়ে নানাপ্রকার যৌনক্রিয়াগত অঙ্গভঙ্গি করে এবং তদ্বিষয়ক গান গেয়ে উন্মত্ত নৃত্যে মাতত; তা না করলে নাকি দেবী ভগবতী ক্রুদ্ধা হতেন, সমসাময়িক কালবিবেক-গ্ৰন্থ এবং প্রায় সমসাময়িক বা কিছু পরবর্তী কালিকাপুরাণে তা উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে এই সম্বন্ধে একটু বিধিনিষেধের বর্ণনা আছে, কিন্তু তা শক্তি-উপাসক বা উপাসিকার পক্ষে প্রযোজ্য নয়। তারা এরকম করলে নাকি দেবীর সুখ উৎপাদিত হত। বসন্তে হোলক (হোলী) এবং চৈত্র মাসে কাম-মহোৎসবে প্রায় অনুরূপ অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। কালবিবেক-গ্রন্থে বলা হয়েছে, কামমহোৎসবে নানা রকম যৌন অঙ্গভঙ্গি এবং জুগুন্সিতোক্তি করে নৃত্যগীত করলে কামদেবতা প্রীত হন, এবং তার ফলে ধনপুত্রে লক্ষ্মীলাভ হয়।

সেন-রাজসভায় কবি ও পণ্ডিতদের খুব সমাদর ছিল। বিজয়বল্লাল-লক্ষ্মণ-কেশবের রাজসভা অনেক কবিরাই অলংকৃত করতেন; আর বল্লাল-লক্ষ্মণ এবং তার একপুত্র নিজেরাও কবি ও পণ্ডিত ছিলেন। বস্তুত, সেন-আমল বাংলার সংস্কৃত সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। এক্ষেত্রেও সেন-রাজাদের সামাজিক আদর্শ সক্রিয়, কিন্তু এই সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যও সমসাময়িক ঐশ্বৰ্য্য-বিলাস এবং কামবাসনার আতিশয্য দ্বারা স্পষ্ট। জয়দেব বলছেন, ত্রুটিবিহীন শৃংগার কাব্য রচনায় গোবর্ধন কবির তুলনা ছিল না। আর্যা সপ্তশতীই তার সাক্ষ্য। আর জয়দেবের গীতগোবিন্দও এক হিসেবে শৃংগার কাব্যই; কামবাসনার কাব্যোচ্ছাসময় কল্পনাই এই কাব্যের বৈশিষ্ট্য। ষোড়শ শতকে সন্ত কবি নাভাজী দাস তার ভক্তমাল গ্রন্থে এই কাব্যকে বলেছেন কোকশাস্ত্র (কামশাস্ত্র) এবং শৃংগার রসের আধার। বস্তুত, এই যুগের সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য এবং কবিতাগুলো ঐশ্বৰ্যবিলাসে এবং যৌনকামবাসনায় মন্দির এবং মধুর। রাজসভায় বসে রাজা ও পত্রমিত্রসভাসদ সকলে এসব মদির-মধুর কাব্য উপভোগ করতেন। এই পরিবেশ ও আবেষ্টনীর সঙ্গে দেববারবনিতা ও দেবদাসীদের যে উচ্ছ্বাসময় স্তব সমসাময়িক কবিরা করেছেন তার কোথাও কোনো অমিল নেই।

এই মন্দিরমাধুর্য এবং বিলাসলালসাময় ভাবকল্পনা রাজসভার বাহিরেও বিস্তার লাভ করার কথা, বৃহত্তর সমাজদেহের নাড়ীতে প্রবেশ করার কথা। এই প্রসঙ্গে সভাকবি উমাপতিধরের ম্লেচ্ছ রাজার সাধুবাদ সম্বন্ধে একটি শ্লোকে তার সামাজিক ইঙ্গিত, এবং সেক-শুভোদয়া কথিত কুমারদত্ত মাধবী কাহিনীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেন-রাজসভার চরিত্র ও আবহাওয়া তা থেকেও কিছুটা বোঝা যায়। সেক-শুভোদয়ায় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছে যে, লক্ষ্মণসেনের রাজসভার অন্যতম অলংকার, কবি, স্মার্ত পণ্ডিত, বাল্যে রাজপণ্ডিত, যৌবনে মহামন্ত্রী এবং প্রৌঢ়াবস্থায় মহার্ধর্মাধ্যক্ষ, রাজার সর্বোত্তম আবাল্য সুহৃদ হলায়ুধ মিশ্র শেখ জালাল উদ-দীন তব্রিজির খুব পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিলেন। এ-তথ্য যদি সত্য হয়, সেক-শুভোদয়ার সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয় তাহলে স্বীকার করতে হয়, সেনরাষ্ট্র ও সেন রাজসভার চরিত্র বলে কিছু ছিল না। সভাকবি উমাপতিধর এবং মহার্ধর্মাধ্যক্ষ হলায়ুধ মিশ্র এই চরিত্রহীনতার দুটি দৃষ্টান্ত মাত্র। পৃথিবীর সর্বত্রই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধোগতির এই একই চিত্র–প্রাচীন গ্রীসে, রোমে, অষ্টাদশ শতকের প্যারিসে, অষ্টাদশ শতকের কৃষ্ণনগরে, ১৯শ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতায়। সেই চিত্ৰ সামাজিক দুর্নীতির, চারিত্রিক অবনতির, মেরুদণ্ডবিহীন ব্যক্তিত্বের, কামপরায়ণ বিলাসলীলার, শৃংগাররসাবিষ্ট, অলংকারবহুল, মদির-মধুর শিল্প ও সাহিত্যের, তরল রুচি ও দেহগত বিলাসের, অতিমাত্রায় ভেদ বৈষম্যের, ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত বিশ্বাসঘাতকতার। একাদশ-দ্বাদশ শতকের রামাবতী, বিজয়পুর, নবদ্বীপেও সেই একই ছবি দেখা যায়।

বখতিয়ারের পক্ষে বৌদ্ধ চর ও সেন-রাজাদের উদাসীনতা

বখতিয়ারের বিহার-লুণ্ঠনের মিনহাজ-কথিত কাহিনীর সম্বন্ধে বৌদ্ধ লামা তারনাথ কিছু বর্ণনা রেখে গেছেন। তারনাথের বর্ণনা জনশ্রুতিনির্ভর; কাজেই তার সব উক্তি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবু এই বর্ণনার মধ্যে সামাজিক তথ্যের খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। তারনাথ বলছেন, চন্দ্ৰবংশীয় (?) লবসেনের বংশধরেরা (তারনাথ কর্ণাটাগত ব্ৰহ্মক্ষত্ৰিয় সেন-বংশের খবর নিশ্চই জানতেন না) আশি বছর রাজত্ব করেছিলেন। মগধে এই সময় তীৰ্থিক (ব্রাহ্মণ্য) ধর্ম ক্রমশ বিস্তার লাভ করছিল, এবং তাজিক (ইসলাম) ধর্মবিশ্বাসী অনেক লোকের উদয় হচ্ছিল। এর পর গঙ্গা-যমুনার মধ্যস্থিত অস্তর্বেদিতে তুরস্কারাজ “চন্দ্র” (মূল তুরস্ক-নামের তিব্বতী অনুবাদ হওয়া বিচিত্র নয়; তিব্বতী পণ্ডিতেরা নামও অনুবাদ করিতেন) আবির্ভূত হন। তিনি অনেক সংবাদবাহী ভিক্ষুকদের মধ্যবর্তিতায় বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুরস্ক রাজাদের নিজের দলভুক্ত করে মগধ লুণ্ঠন করতে থাকেন এবং অনেক বৌদ্ধ আচার্যকে হত্যা করে, ওদন্তপুরী ও বিক্রমশিলা বিহার ধ্বংস করেন। এসব ও অন্যান্য বৌদ্ধবিহারের অনেক পণ্ডিত নানাদিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, এবং তার ফলে মগধে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তারনাথের বিবরণী থেকে মনে হয়, একদল বৌদ্ধ ভিক্ষু মুহম্মদ বখত্-ইয়ারের গুপ্তচরের কাজ করেছিলেন, এবং বাংলার সঙ্গে তার যোগাযোগের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। মিনহাজ ও তারনাথের বিবরণ একত্রে মিলিয়ে দেখলে মনে হয়, বিহার-বাংলারই একদল লোক বিভীষণ-বাহিনীর কাজ করেছিল। মগধে তখন পরিপূর্ণ নৈরাজ্য, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অবস্থাটা যে অচিরেই কী হবে তা সকলেই বুঝতে পারছিল। তা না হলে, বিক্রমশীলা-বিহারের প্রধান মন্ত্রাচার্য রত্নরক্ষিত যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, দুই বছর মধ্যেই তাজিকেরা মগধের দুটি বিহার ধ্বংস করবে, এই ভবিষ্যৎদ্বাণীর কোনও অর্থই হয় না। মিনহাজ ও লক্ষণসেনের রাজজ্যোতিষীদের মুখে যে-ভবিষ্যদ্বাণীর ইঙ্গিত দিয়েছেন তার অর্থও এই যে, সকলেই অবস্থাটা জানত, এবং তুরুস্ক জাতীয় মুসলমান শত্ৰুরাই যে আক্রমণ-কর্তা, তা জানত। অথচ, প্রতিরোধের ব্যবস্থা তেমন কিছু গ্রহণ করা হয়নি।

সাহাব-উদ-দীন ঘোরী দুবার পরাজিত হয়ে তৃতীয় বারের চেষ্টায় পঞ্জাব অধিকার করেছিলেন, এবং তাও রাজমহিষীর বিশ্বাসঘাতকায়। পরেও হিন্দুরাষ্ট্রশক্তিপুঞ্জ মুসলমান শক্তির বিরুদ্ধে কোনও সামগ্রিক প্রতিরোধ রচনা করিতে পারেননি। গজনীর মামুদের সফল আক্রমণের পর থেকে উত্তর-ভারতের অনেক স্থানেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলমান বসতি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। গাহড়বাল রাজ্যেও বোধহয় এধরনের ছোট ছোট তুরুস্ক কেন্দ্ৰ ছিল। জয়চন্দ্রের পিতামহ গাহড়বাল-রাজ গোবিন্দচন্দ্রের লিপিতে তুরুস্কদণ্ড নামে একপ্রকার করের উল্লেখ আছে; এই সব কর বোধ হয় আদায় করা হইত গাহড়বাল রােজ্যান্তৰ্গত তুরুস্ক-বাসিন্দাদের নিকট থেকে। মুহম্মদ বখত্‌ ইয়ারের আক্রমণের আগেই উত্তর-ভারতের বিহার পর্যন্ত যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুরুস্ক-কেন্দ্র কিছু কিছু গড়ে উঠেছিল তারনাথের বিবরণ থেকেও তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কি এই সব তুরুস্ক কেন্দ্রের সঙ্গেই বখত্-ইয়ারের যোগসাধন করে দিয়েছিলেন? উত্তর-পূর্ব ভারতের এই উচ্ছঙ্খল অবস্থা লক্ষ্মণসেন ও তার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গের জেনে থাকার কথা, কিন্তু প্ৰতিকারের অর্থাৎ সামাজিক ও রাষ্ট্ৰীয় এই নিম্নগামী প্রবাহকে রোধ করার মত সাহস ও শক্তি, বুদ্ধি ও চরিত্র, দৃষ্টি ও ব্যক্তিত্ব, ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি কারও ছিল না, না সেন-রাজসভায়, না বৃহত্তর সমাজে। সকলেই যেন অনিবার্য গড্ডলিকা প্রবাহে গা’ ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

একদিকে উত্তর-ভারতের অধিকাংশ যখন মুসলমানদের করতলগত, উত্তর-গাঙ্গেয় ভারতে, অর্থাৎ বর্তমান যুক্তপ্রদেশ [উত্তর প্রদেশ] ও বিহারে যখন রাষ্ট্ৰীয় অবস্থা প্রায় নৈরাজ্য বললেই চলে, তখন বাংলার রাষ্ট্র ও সমাজ ভেদবুদ্ধিদ্বারা আচ্ছন্ন, স্তরে উপস্তরে দুর্লঙ্ঘ্য সীমায় বিভক্ত; রাজসভা চরিত্র ও আত্মশক্তিহীন; ধর্ম ও সমাজ বিলাসালালসায় ও যৌনাতিশয্যে পীড়িত; শিল্প ও সাহিত্য বস্তুসম্বন্ধবিচ্যুত ভাবকল্পনার জগতে পল্লবিত বাক্য, উচ্ছাসময় অত্যুক্তি, আলংকারিক আতিশয্য এবং দেহগত লীলাবিলাসে ভারগ্রস্ত ও মন্দির; জনসাধারণের দেহ,মন বৌদ্ধ বজ্ৰযান-সহজযান প্রভৃতির এবং তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য-ডাকিনী-যোগিনীদের অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড তুকতাকে পঙ্গু; উচ্চতর বর্ণসমাজ ব্রাহ্মণ্য পুরোহিততন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বে আড়ষ্ট। রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক অধোগতির চিত্র সম্পূৰ্ণ; উভয় চরিত্রে ও আত্মশক্তিতে দুর্বল ও দৈন্যপীড়িত। এই দুর্বল ও দৈন্যপীড়িত রাষ্ট্র ও সমাজ ভেঙ্গে পড়বে, এবং সমাজ-প্রকৃতির নিয়মে পরবর্তীকালে শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী দেশ তার মূল্য দিয়ে যাবে, এটা কিছু বিচিত্র নয়। বখত্-ইয়ারের নবদ্বীপ-জয় এবং একশো বছরের মধ্যে সমগ্ৰ বাংলা জুড়ে মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা কিছু আকস্মিক ঘটনা নয়, ভাগ্যের পরিহাসও নয়, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতির অনিবার্য পরিণাম। মুসলমান অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পূর্বের ভারতীয় বুদ্ধি ও সংস্কৃতির অবস্থার কথা বলতে গিয়া প্রসিদ্ধ উর্দুভাষী মুসলমান কবি হালি বলেছেন : “ইধর হিন্দ মে হরক্তরক অন্ধেরা।/কি থা গিয়ান গুণক লড়াইয়াসে ডরা৷” বাস্তবিকই হিন্দুস্থানে তখন চারদিকে অন্ধকার!

সেই সময়কার বর্ণবিন্যাস সম্পর্কে জানতে দেখুন – বাংলার বর্ণবিন্যাস নিবন্ধটি।

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.