পাশ্চাত্যে মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

Table of Contents

মধ্যযুগের সংজ্ঞা ও রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য

মধ্যযুগ

সময় ও ঘটনার প্রবাহকে এক একটি স্বতন্ত্র যুগ দিয়ে চিহ্নিত ও বিচ্ছিন্ন করা যায়
না। কিন্তু এই প্রাথমিক অসুবিধা সত্ত্বেও পণ্ডিতেরা আলোচনার স্বার্থে ইতিহাস ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বিকাশকে বিভিন্ন যুগে ভাগ করে থাকেন। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এরকম একটি যুগের উল্লেখ আমরা পাই যার নাম মধ্যযুগ। এছাড়া প্রাচীন ও আধুনিক যূগও আছে। প্রশ্ন হল কোন সময় থেকে কোন সময় পর্যন্ত যুগকে আমরা মধ্যযুগ বলে অভিহিত করব।

সাধারণত ৪০০ সাল থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ বলা হয়। ৪০০ সালের আগে পর্যন্ত ইউরোপে রোমানদের আধিপত্য ছিল। তারপর বাইরের নানা জাতির আক্রমণে এই বিশাল সাম্রাজ্য ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৪০০ সাল পযন্ত চলে রাজনীতিক চিন্তার একটি স্রোত। তবে এই স্রোতের সঙ্গে একাধিক ছোট স্রোত মিলিত হয়েছিল । ১৪০০ সালের পর সংস্কা আন্দোলন, নবজাগরণ ও অন্যান্য কয়েকটি নতুন ভাবধারা জন্মগ্রহণ করে এবং রাজনীতির উপর এদের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে বলে ১৪০০ সালের পরে আমরা নতুন রাজনীতিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করি।

কিন্তু অনেকে আবার এই এক হাজার বছরকে মধ্যযুগ বলে মানতে রাজি নন। একাধিক বিজ্ঞ ব্যন্তি একাদশ থেকে ১৩শ শতাব্দীকালকে বৈশিল্ট্যপূর্ণ মধাষুগ বলে চিহ্নিত করতে চান। হার্নশ (Hearnshaw) ভিন্ন মত পোষণ করে বলেন যে একাদশ শতাব্দীর গ্রেগরীয় (Gregorian) আন্দোলন থেকে প্রোটেস্টান্ট সংস্কার (Protestant Reformation) পর্যন্ত সময় মধ্যযুগের একটি পর্যায়। এই যুগে পোপ ও গির্জার অপ্রতিহত প্রাধান্য দেখা যায়। খ্রিস্টধর্মের নীতি এই যুগে সমগ্র সমাজবাবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে মধ্যযুগের স্বতন্ত্র ভাবধারা লক্ষ্য করা যায় বলে হার্নশ মনে করেন। স্থিত সমাজ ও আর্থ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানা শ্রেণীর লোকের প্রতিবাদের দ্বারা এই যুগ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে দেখা গেল যে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব অনেক কমে গেছে ও তার জায়গায় উপস্থিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয় ও ভৌমিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে। ভৌগলিক স্বাতন্ত্র্যের দ্বারা গঠিত রাষ্ট্র রাজনীতির চিন্তাধারাকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করতে সাহায্য করেছে।

মধ্যযুগের রাজনৈতিক অবস্থা

সুদীর্ঘকাল ধরে রোম ইউরোপের অনেক দেশের রাজনৈতিক ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক ছিল, কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। ইউরোপের যে সমস্ত জাতি নানা রাষ্ট্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল তারা স্থিতিশীল হতে শুরু করে। জাতীয়তার ভিত্তিতে নতুন করে ভৌগলিক সীমানা নির্ধারিত হয়, কিন্তু এই নতুন পরিস্থিতিতে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে দেখা যায় এক ভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক সমস্যা, যা হল প্রশাসন।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এককভাবে কোন রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারেনা, রোমান সাম্রাজের পতনের পর ওন কোন রাষ্ট্র স্বাধীন হয়ে পড়ায় তাদের আভ্যন্তরীন প্রশাসনকে ঘিরে নতুন সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে কোথাও গণতন্ত্র ও কোথাও স্বৈরতন্ত্র স্থাপিত হয়। রোমানরা যতদিন শাসক ছিলেন ততদিন তারা নিজেদের মত শাসন-ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছিল। এর পতনের পর নতুন করে শাসন-ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়জনীয়তা দেখা দেয়।

মধ্যযুগ কি মৃত?

মধ্যযুগকে অনেকে মৃত ও অনুৎপাদনশীল যুগ বলে মনে করেন, মরুভূমির সাথে তুলনা করেন। রোমান সাম্রাজ্য শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দান করে, কিন্তু এই সাম্রাজ্যের পতনের পর সেই অবস্থা আর থাকে না। উন্নত রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শনচিন্তায় ভাটা পড়ে যায়। আইনী কাঠামোর যে বিশাল-প্রাসাদ রোমানরা তৈরি করেছিল তা ভাঙ্গনের মুখে এসে দাঁড়ায়। সমগ্র মধ্যযুগ ধরে, বিশেষ করে পঞ্চদশ শতকের আগ পর্যন্ত এই অবক্ষয় চলতে থাকে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগকে মৃত বলতে অনেকেই রাজি নন, বিশেষ করে হার্নশ মধ্যযুগকে মৃত বলতে চাননি। তিনি বলেন, মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটে, চার্চের আধিপত্য কম ছিল না। জনগণ ও রাজশক্তি চলত চার্চের নির্দেশে। স্বায়ত্তশাসন ও নতুন আর্থব্যবস্থা মধ্যযুগে জয়লাভ করে। সেই সাথে অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে মধ্যযুগ বেশ সজীব ও সমৃদ্ধশালী ছিল। মধ্যযুগের প্রবর্তিত চিন্তাধারা আধুনিক যুগকে প্রভাবিত করে।

মধ্যযুগে রাষ্ট্রচিন্তা ছিল, রাষ্ট্রতত্ত্ব ছিলনা

হার্নশ এর মতে মধ্যযুগের সমাজ সম্পর্কিত তত্ত্বসমূহে ঊষরতা ও অবাস্তবতা দুইই ছিল, একই সঙ্গে ছিল সজীবতা। রাষ্ট্রতত্ত্ব বলতে যা বোঝায় মধ্যযুগে তা ছিল না, কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তা ছিল। হার্নশ এর মতে, রাষ্ট্রতত্ত্ব হল ব্যক্তি বিশেষের স্বকীয় চিন্তা বা মতবাদ, কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তা কোন ব্যক্তিবিশেষের মতবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে না, সামগ্রিক যুগে ব্যপ্ত থাকে, যার আলোকে একটা যুগকে সহজেই নিরীক্ষণ করা যায়। তাই হার্নশ এর মতে মধ্যযুগকে ঊষর বলা যায়না।

রাষ্ট্রচিন্তা সচেতন প্রয়াসলব্দ নয়

রাষ্ট্রচিন্তা হল কয়েক শতক ধরে গড়ে ওঠা রাজনীতি সম্পর্কিত চিন্তা যার পেছনে ব্যক্তি বিশেষের অবদান বলতে কিছু নেই, সমাজের রাজনীতিক সমস্যা সমাধানকল্পে অথবা বিশেষ মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোন পণ্ডিত ব্যক্তি তত্ত্বকথা বিশ্লেষণ করেননি। তাই সুসংহত আকারে মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা পাওয়া যায়না। খ্রিস্টধর্ম, সামন্ততন্ত্র ও অন্যান্য সমসাময়িক ভাবধারার প্রভাব আমরা এই যুগের রাষ্ট্রচিন্তায় প্রত্যক্ষ করি। আবার এদের প্রভাব সর্বত্র সমানভাবে প্রকাশিত হয়নি।

অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক

মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা মানুষের সযত্ন প্রচেষ্টার ফসল ছিল না, ঘটনাবলিকে যুক্তি সহকারে বিশ্লেষণ করা ও তার থেকে সিদ্ধান্ত টানা অথবা রাষ্ট্রচিন্তা বিশ্লেষণের জন্য অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়ার রেওয়াজ মধ্যযুগে ছিল না, অথবা ইতিহাসকে অবলম্বন করে সিদ্ধান্ত টানার প্রথা এই সময়ের বিশ্লেষকগণ করেননি, তাই মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তাকে অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক বলা হয়।

এই সময়ের চিন্তাবিদদের মধ্যে যদি মনীষা বলতে কিছু থাকে তাহলে সেটা মুক্ত ও স্বাধীন ছিলনা। মানুষের বৌদ্ধিক চিন্তাধারা পুরোহিত সম্প্রদায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। চার্চই ছিল যাবতীয় জ্ঞানের রক্ষক ও প্রচারক। প্রায়ই পুরোহিতদেরকে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের উপরে উঠতে দেখা যেত না। তাছাড়া কোন দেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কখনও বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার বাহক ও প্রচারক হয়নি। যেখানে চার্চই ছিল সব কিছু সেখানে চার্চ জনগণকে প্রকৃত জ্ঞান দিয়ে যেতে পারবে ও জ্ঞানের বর্তিকা সাফল্যের সঙ্গে জ্বালিয়ে যাবে তা আশা করা যায়না। গেটেল বলেন, “সংগঠিত চার্চের দ্বারা যে বিশ্বাসের বিকাশ ঘটানো হয় ও প্রচার করা হয় তাই ছিল সকল জ্ঞানের ভিত্তি, এবং এই বিষয়গুলো স্কলাস্টিকবাদের সংকীর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়াতেই বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে, অথবা কোনরকম যৌক্তিক প্রদর্শন ছাড়াই অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্যানমগ্ন অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা গৃহীত হয়।”

বিশ্বজনীনতা

বিশ্বজনীনতা (Universalism) মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রোমান সাম্রাজ্য ভৌগলিক সীমানাকে স্বীকার করেনি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্যকে অস্বীকার করে অখণ্ড সাম্রাজ্য স্থাপন করার কৃতিত্ব রোমান শাসকদের। তাই রাজনৈতিক ব্যাপারে তারাই বিশ্বজনীনতা দেখায়। ধর্মের ব্যাপারে চার্চের ছিল অপ্রতিরোধ্য প্রাধান্য। সকলে রাজনীতির ব্যাপারে সম্রাটের নিকট আর ধর্মের ব্যাপারে চার্চের নিকট শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন করত। এই যুগের প্রবাদ ছিল, সিজারের জিনিস সিজারের, আর পিটারের জিনিস পিটারের।

খ্রিস্টধর্ম ও রাজনীতি

মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্মের সীমাহীন প্রাধান্য ছিল। রোমান শাসকেরা জনগণের উপর যে আধিপত্য স্থাপন করেছিল তা অন্তর্হিত হওয়ায় পুরোটা না হলেও আংশিকভাবে সেই স্থান দখল করে খ্রিস্টধর্ম। বার্কি বলেন, খ্রিস্টধর্ম সাফল্যের সাথে সমাজে ঐক্য আনার কাজটি করে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট যে আনুগত্য দেখাতে হবে বা প্রয়োজন এই জিনিসটা খ্রিস্টধর্ম জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলে। রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে মিলন মধ্যযুগে সাধিত হয়েছিল এবং তার জের সুদীর্ঘকাল ধরে চলেছিল। ঐতিহাসিক জে. বি. মোরাল (J. B. Morall) বলেন, রাজনীতির সাথে ধর্মের সম্পর্কের কারণে অন্যান্য সমাজের রাজনীতি থেকে ইউরোপের রাজনীতি আলাদা হয়ে পড়ে।

চার্চ ও রাষ্ট্র

মধ্যযুগে হিল্ডব্র্যান্ডাইন (Hildebrandine) ও তার অনুগামীরা রাষ্ট্র ও চার্চ সম্পর্কে একটি ধারণা (নীতিও বলা হয়) প্রচার করেন যার সারকথা হল জাস্টিশিয়া (Justitia), যা অনুসারে সমস্ত সমাজে যাজকেরা প্রভাবশালী হয়ে থাকবে, চার্চ বা যাজক সম্প্রদায়কে সমাজের যাবতীয় বন্ধন থেকে মুক্ত করা হবে। পোপের স্থান সবার উপরেহবে ও তার নির্দেশেই সবাই পরিচালিত হবে, এমনকি রাজার যাবতীয় কাজকর্ম বিচার করার ভার ন্যস্ত থাকবে পোপের উপর। জাস্টিশিয়ার আরেকটি বক্তব্য হল রাষ্ট্র হল চার্চের অধীনস্ত একটি সংস্থা। ধর্মীয় নির্দেশে ও অভিভাবকত্বে রাজনীতি অবস্থান করবে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি পোপের স্বীকৃতি লাভ করেনি।

সমান্তরালবাদ

পোপের অধীনে রাষ্ট্র থাকলেও এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়নি। হার্নশ বলেন, “যখন আমরা মধ্যযুগের বিবেচনায় চার্চ ও রাষ্ট্রের কথা বলি, আমাদেরকে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হয় যে আমরা দুটো আলাদা সমাজের কথা বলছি না, বরং একটি একক সমাজের দুটো সরকারের কথা বলছি।” অর্থাৎ রাষ্ট্র ও চার্চ আলাদা মানে দুট সংস্থার জন্য দুরকম পৃথক সমাজ মধ্যযুগে ছিল না। বরং সমাজ ছিল একটা, শাসনব্যবস্থা ছিল আলাদা। তাই একে সমান্তরালবাদ (Parallelism) বলা হয়। এই সমাজকে বলা হত রিপাবলিকা খ্রিশ্চিয়ানা (Republica Christiana)।

এখানে চার্চের নিয়ন্ত্রণ সমাজের উপর প্রসারিত হলেও রাজা অনেক ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর স্বাধীনতা ভোগ করতেন। একটি সমাজের উপর দুটি সংস্থার সমান্তরাল শাসন চলত, তাই একে সমান্তরালবাদ বলা হয়। তবে খ্রিস্টান না হলে রাজনৈতিক সমাজে অচ্ছুৎ হয়ে থাকতে হত। অখ্রিস্টানরা কোন মর্যাদার অধিকারী ছিল না।

দুই তরবারি তত্ত্ব

সমান্তরালবাদ থেকে দুই তরবারি তত্ত্ব (Doctrine of two swords) জন্ম নেয়। ড্যানিং এর মন্তব্যে আমরা পাই, “মধ্যযুগের রাজনীতির সকল তত্ত্বে শুরু হচ্ছে দুটো ক্ষমতার নীতি”। পার্থিব বিষয়ের শাসক ছিলেন রাজা আর অপার্থিব বিষয়ের শাসক ছিলেন পোপ। এটাই হল দুই তরবারি তত্ত্ব। মধ্যযুগের কোন চিন্তক এই দুই তরবারি তত্ত্বকে অবলম্বন ক্করে উভয়ের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার কথা বলেছিলেন, কারণ কেউই কণামাত্র ক্ষমতা ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা চরম হয়ে দেখা গিয়েছিল। ঐক্য ও স্থিতিশীলতা আনার জন্য এই দুই তরবারি তত্ত্বের কথা বলা হয়। কোন কোন চিন্তাবিদ এমন কথাও বলেন যে, রাজা ও পোপের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা, এরা কলহে লিপ্ত হলে ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘন করবেন্ম। কিন্তু ধারণার জগতে দুই তরবারি তত্ত্ব প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও বাস্তবে কার্যকর হয়নি। গেটেল বলেন, “উভয় ক্ষমতারই নিজেদের ক্ষেত্রে শাসন করার কথা ছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে এই দ্বৈত আধিপত্যের তত্ত্বটি বাস্তবে কার্যকর হয়নি।”

সামন্ততন্ত্রের আবির্ভাব

মধ্যযুগে রাজা ও চার্চের মধ্যে বিরোধ যখন তুঙ্গে এবং প্রত্যেকে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত থিক সেইসময় সামন্ততন্ত্রের আবির্ভাব। রাজশক্তি অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় সামন্তপ্রভূরা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের এলাকায় আধিপত্য স্থাপন করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের শাসক বলতে এই সামন্তপ্রভূদেরকে বোঝাত। রাজা ছিলেন নামমাত্র রাজা। ড্যানিং বলেন, “প্রত্যেক স্থানেই সামন্তপ্রভূরা যথেষ্ট সর্বভৌম হয়ে পড়েছিলেন”। মধ্যযুগ ছাড়া অন্য কোন যুগে সামন্তপ্রভূদের এমন ক্ষমতাবিস্তারও সুসংহত হতে দেখা যায়নি। সামন্তপ্রভূদের ক্ষমতার বৃদ্ধি অস্বাভাবিক আকার ধারণ করলে অনেক সময় রাজা ও সামন্তপ্রভূর সঙ্গে বিরোধ পর্যন্ত দেখা যেত।

চার্চের প্রভাব হ্রাস

মধ্যযুগে চার্চের প্রভাব বৃদ্ধি ও হ্রাস দুটোই ঘটেছিল। চার্চের মোহান্ত বা বিশপরা প্রায়ই জনগণকে সৎ অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের পরামর্শ দিতেন একটা সময়ে তারা সরল ও আড়ম্বরহীন জীবন-যাপনই করতেন। কিন্তু পরে জনগণের অকৃপন দানে চার্চের বিষয়-আশয়ের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মোহান্তরা সেই সরল জীবনযাত্রা পরিত্যাগ করে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যান। যাজকদের এই পরিবর্তন দেখে জনগণ শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। চার্চের প্রতি জনগণের যে আনুগত্য ছিল তা লোপ পেতে থাকল, চার্চের প্রভাব আর থাকল না।

সংগঠিত রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি

হার্নশ এর মতে মধ্যযুগে কোন সুসংগঠিত রাষ্ট্র ছিল না। অবশ্য এই যুগের শেষদিকে জাতীয় রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটলেও তার প্রভাব আদৌ ব্যাপক ছিল না। এর অভাবে সামন্তপ্রভূরা নিজ নিজ এলাকায় ক্ষমতার মালিক হয়ে পড়ে ও চার্চও পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। বর্তমানে রাষ্ট্রকে যে সর্বোচ্চ পীড়নমূলক শক্তির আধার হিসেবে দেখা যায় তখনকার দিনে এটি ছিলনা বলে বিশৃঙ্খলা সমাজের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।

সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার একত্র সমাবেশ

মধ্যযুগে কোন সুসংহত রাষ্ট্র ও স্পষ্ট রাষ্ট্রতত্ত্ব না থাকার জন্য সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, নীতিশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব একত্রে সহাবস্থান করত। হার্নশ বলেন, এই বিষয়গুলোর মধ্যে সবসময় পার্থক্য টানা যেত না, সব মিলেমিশে একাকার ছিল। এই বৈশিষ্ট্যের সাথে গ্রিক রাষ্ট্র দর্শন বা দর্শনচিন্তার প্রভূত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের রাষ্ট্র দর্শনের মধ্যে সমস্ত বিষয় একসঙ্গে মিশে একাকার হতে দেখা যায়। বিশেষ করে তাদের আলোচনায় রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য টানা কষ্টসাধ্য।

মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা ও প্রাকৃত আইন

মধ্যযুগে চার্চ যে ভাবধারা ও সংস্কৃতি প্রচার করত তা ছিল প্রাকৃত আইনকেন্দ্রিক। অবশ্য নির্বিকারবাদী দার্শনিকদের কাছ থেকেই চার্চ এই প্রাকৃত আইনের ধারণাটি পেয়েছিল। বিশুদ্ধ প্রাকৃত আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি সমান অধিকার ভোগ করার সুযোগ পাবে ও সমাজে কোন প্রকার বৈষম্য থাকবে না। সরকার ও দাসত্ব দুইই প্রাকৃত আইন বিরোধী। ব্যক্তিগত মালিকানা ও সম্পত্তি প্রাকৃত আইনের স্বীকৃতি লাভ করেনি, কিন্তু চার্চ এই প্রাকৃত আইনকে অনেক শিথিল করে দিয়েছিল।

চার্চের মতে চরম প্রাকৃত আইন সমাজে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা যায়না বলে আপেক্ষিক প্রাকৃত আইন প্রয়োজন। সম্পত্তিকে পাপের ফসল বলে প্রাকৃত আইন বললেও চার্চ এই সিদ্ধান্ত নেয় যে অনেক সময় সীমিত পরিমাণ ব্যক্তিমালিকানা চাহিদা পুরণ করে ও ব্যক্তিকে পাপ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে। এভাবে চার্চ প্রাকৃত আইনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাখ্যা করে।

মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় রাজার স্থান

মধ্যযুগে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্র প্রায় সমার্থক ছিল, মানুষেরা রাষ্ট্রকে রাজতন্ত্র থেকে আলদা ভাবত না, ফলে রাষ্ট্রের প্রতীক ছিল রাজা। কিন্তু এই যুগের মানুষের মনে চার্চ এই ধারণা তৈরি করে দিয়েছিল যে পাপের শাস্তিস্বরূপ ঈশ্বর কাউকে রাজা করে পৃথিবীতে পাঠান। তবে রাজার অন্য কাজও থাকে, যেমন সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সাম্য আনার কাজ। অর্থাৎ মানুষ নিজের দোষে যেসব পাপ কাজ করে তার কুফলগুলো দূর করার দায়িত্ব রাজার। অবশ্য তিনি এই কাজটি করেন ঈশ্বরের নির্দেশে।

চার্চ তত্ত্বে ও বাস্তবক্ষেত্রে রাজার এই দিকটির প্রতি নজর দিত। চার্চ মনে করত রাজাকে ঈশ্বরের নির্দেশে চলতে হবে ও সেই নির্দেশ দেবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে চার্চ। অর্থাৎ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজা ইচ্ছামত কোন কাজ করতে পারেননা, ঈশ্বর হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং তার নির্দেশে সকলকে চলতে হবে।

ঐশ্বরিক অধিকার ও সামাজিক চুক্তি

মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা অনুযায়ী, রাজার ক্ষমতা ঈশ্বরপ্রদত্ত হলেও অবশ্যই রাজতন্ত্রের উপর জনগণের প্রভাব থাকবে। রাজার ক্ষমতায় আরোহন ও ক্ষমতা থেকে চ্যুতি উভয় ক্ষেত্রে জনগণের নিজস্ব বক্তব্য থাকবে। জনগণকে রাজকীয় ক্ষমতার উৎস্য বলে মনে করা হত। হার্নশ বলে, রাজার সঙ্গে জনগণের চুক্তির গোড়াপত্তন হয় মধ্যযুগে ও পরে সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা জন লক তা গ্রহণ করেন।

মধ্যযুগের মুখ্য ধারণা ছিল যে রাজার ক্ষমতা ঈশ্বরপ্রদত্ত হএলো জনগণের স্বার্থ বা কল্যাণবিরোধী কোন কাজ তিনি করতে পারেন না। হার্নশ এর মতে ঐশ্বরিক অধিকার ও সামাজিক মতবাদের মধ্যে মিলন বা সমন্বায়সাধন পরস্পর বিরোধী বলে মনে হলেও এটি কার্যত মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল।

১৪শ ও ১৫শ শতকের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য

আগের শতকগুলোতে চার্চের অপ্রতিহত প্রাধান্য ছিল, কিন্তু এই দুই শতকে সেই প্রাধান্য লক্ষণীয়ভাবে কমে যায়। তবে এটুকুই পর্যাপ্ত নয়। এই দুই শতকে কনসিলিয়ার (Conciliar) আন্দোলন আবির্ভূত হয়। পোপের সার্বভৌমত্বকে নানা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। আগের শতকগুলোতে সমাজ ছিল অনেকটা স্থিতিশীল ও আন্দোলনহীন। চার্চের বিশপ বা মোহান্ত ছাড়া অভিজাত গোষ্ঠীর লোকেরা সমগ্র সমাজের উপর লাঠি ঘোরাত।

কিন্তু এই দুই শতাব্দীতে দেখা গেল সাধারণ মানুষ, স্বাধীন গ্রামবাসী, ভূমিদাস ইত্যাদিরা শ্রেণীবিশেষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর। ক্রীতদাস প্রথা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়। চার্চের অধঃপতনে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয় ও আনুগত্য হারিয়ে ফেলে। এর ফলে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান জনগণের নিকট আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। হার্নশ বলেন, “এটা একই সাথে সেই দিন ছিল রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। চার্চের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল রাষ্ট্রের অর্জন।”

চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ

ভূমিকা

উপরে বর্ণিত মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সংঘর্ষ। মধ্যযুগের সিংহভাগ জুড়ে এই বিরোধ ছিল। আপাতদৃষ্টিতে বিরোধ থাকার কথা না থাকলেও কার্যক্ষেত্রে উভয় সংস্থার একগুঁয়েমি, অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যান্য নানা কারণে বিরোধ দানা বেঁধে ওঠে যা একসময় প্রবল আকার ধারণ করে। রাজা ও পোপ কেউই নিজ নিজ এলাকা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না, ফলে এই বিরোধ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়।

উভয়ই পথভ্রষ্ট

এই যুগে ধর্ম ও রাজনীতি কোনটাই নিজেদের পথে চলেনি, পথভ্রষ্টতা এই বিরোধের অন্যতম কারণ। রাজা ও পোপ কেউই নিজদের পাওনা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না, অধিক পাবার আশা উভয়কে এমনভাবে নেশাগ্রস্ত করে তোলে যে শেষ পর্যন্ত তারা সরাসরি সংঘর্ষে যেতে দ্বিধাবোধ করেননি। যতদিন পোপ ও অন্যান্য পুরোহিত সম্প্রদায় সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন ততদিন তারা জনগণের শ্রদ্ধা পেয়ে আসছিলেন, রাজাও প্রশাসন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে রাজা ও চার্চের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু চার্চ সরল জীবন ছেড়ে বিলাসী হয়ে ওথে ও রাজাও রাজকার্যে অবহেলা শুরু করেন।

চার্চের সম্পদ বৃদ্ধি

মধ্যযুগে রাজশক্তি দুর্বলহবার কারণে অন্যান্য নানা শক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সামন্ততন্ত্র। রাজার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুঠতরাজে সামন্তপ্রভূ ও চার্চের পুরোহিতগণ সকলেই নেপে পড়েছিলেন। কিছুদিন পর সামন্তপ্রভূ ও জমিদারদের সঙ্গে পোপের বা বিশপদের একটা গোপন ও অলিখিত ভাগবাটোয়ারা গড়ে ওঠে। জনসাধারণের দান ও অন্যান্য নানা বে-আইনী উৎস্য থেকে চার্চ বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণ করে ফেলে। প্রয়োজনের তুলনায় আহরণ বেশি হবার ফলে চার্চ আধ্যাত্মিক বিষয়ের সাথে বস্তুগত বিষয়াবলির প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে যায়, তাই তারা তাদের বিপুল সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিবিষ্ট থাকতেন যা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও বাস্তব বিষয়াবলি সম্পর্কিত। পার্থিব ভোগলালসায় পুরোহিত ও মোহান্তরা এত বেশি ব্যস্ত থাকতেন যে তাদেরকে আর ধর্মপ্রাণ বলা যেত না। চার্চের এই বিলাসিতা সাআ দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের ঈর্ষার বস্তু হয়ে ওঠে। সারা দেশ জুড়ে সকলে চার্চের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে, বিশেষ করে শাসক সম্প্রদায় চার্চের তীব্র সমালোচনা করে।

রাজনীতিতে অংশগ্রহণ

প্রারম্ভিক পর্যায়ে রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়াটা হয়তো চার্চের লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু বিষয়ের মোহে পুরোহিতরা নিজেদেরকে সংযুক্ত করে ফেলায় তখন ধর্মকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করা তাদের জীবনের প্রধান উৎস্য হয়ে দাঁড়ায়। সমকালীন ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সম্পত্তি অর্জন ও তাকে সংরক্ষণ করার বাসনাই তাদেরকে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করেছিল। গেটেল বলেন, “চার্চের বর্ধিষ্ণু সম্পত্তি এর কর্মকর্তাদেরকে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজন সৃষ্টি করে। ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়াবলিতে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার আগ্রহ এতই শক্তিশালী ছিল যে চার্চের কর্মকর্তাগণ তা সংবরণ করতে পারেননি।”

পোপ ও বিশপগণ রাজনীতি শুরু করায় রাজা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন ও পুরোহিতদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য অগ্রসর হতে থাকেন। পুরোহিতরাও চুপ করে ছিলেন না। রাজনীতি নিয়ে বেঁধে যায় তুমুল সংঘর্ষ। শুধুমাত্র সম্পদ আহরণের জন্য যাজকগণ রাজনীতি করতেন না, মধ্যযুগে যাজকরা ছিলেন শিক্ষিত ও প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞ। মোট কথা, সমাজের এলিট বলতে একমাত্র যাজক সম্প্রদায়কে বোঝাত। একারণে তারা জমিদারি (fief) শাসনকার্য পরিচালনার দায়দায়িত্বে থাকতেন। রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী যাজকদের প্রশাসনিক ও তৎসহ রাজনীতিতে মাতব্বরী মেনে নিতে পারেননি। ফলে জমিদারি সংক্রান্ত বিষয়ে রাজার নির্দেশ বা আদেশ যাজকরা প্রায়ই অমান্য করতেন।

স্বাধীন হবার বাসনা

যাজক সম্প্রদায় দেখলেন, রাজা বা রাজশক্তির চাইতে জনগণের উপর তাদের প্রভাব অনেক বেশি, অর্থাৎ জনগণ যাজকদের কথা অনুযায়ী বেশি চলে। এই পরিস্থিতিতে চার্চ কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়। পোপ ও অন্যান্য বিশপেরা চার্চকে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। তাছাড়া পোপ ও বিশপরা নিজেদেরকে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক বলে মনে করতেন। রাজশক্তির অধীনে থাকা বা রাজার নির্দেশ মেনে চলাকে তারা অবমাননাকর বলে মনে করতেন। এই মানসিকতা থেকে স্বাধীন হবার ও চার্চকে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার বাসনে জেগে ওঠে।

ভৌগলিক সীমানার মধ্যে থেকে রাজশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোকে রাজা কখনও মেনে নিতে পারেননি।। সেবিন (Sabine) বলেন, “একাদশ শতকের বিতর্ক শুরু হয় আত্মসচেতনতা ও স্বাধীনতার অনুভূতি থেকে যা চার্চম্যানদের চার্চকে স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় পরিণত করার আকাঙ্ক্ষার অংশ ছিল”। নিজের স্বাতন্ত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চার্চ যখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যত হল, তখন কোন দায়িত্ববান ও মর্যাদাসম্পন্ন রাজা তা মিনে নিতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে রাজা তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে অগ্রসর হন।

অভিষেককরণ

অনেকে অভিষেককরণকে রাজশক্তি ও যাজকশক্তির মধ্যে বিরোধের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের রমরমা অবস্থা ছিল। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার দেশের সমস্ত ভূ-সম্পত্তি কতগুলো জমিদারি বা fief-এ বিভক্ত ছিল। প্রত্যেকটা জমিদারির ধর্ম বিষয়ক সমস্ত দায়িত্বভার এক একজন যাজকের উপর ন্যস্ত থাকত। জমিদারির ভারপ্রাপ্ত যাজকেরা যে কেবল ধর্মীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন তা নয়, বিষয় সম্পত্তির তদারকি করার ভারও তাদের উপর ছিল। তাই যাজকদের কেবল ধর্মীয় প্রতিনিধি ভাবলে ভুল হবে।

বলা বাহুল্য যে, বিষয় সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখাই ছিল জমিদারির যাজক প্রতিনিধির অন্যতম কাজ ও এই কাজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জমিদারি ছিল চার্চের সম্পদ আহরণের অন্যতম প্রধান উৎস্য ও যে ব্যক্তি সেই দায়িত্বে থাকতেন তারও গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। জমিদারির প্রতিনিধি নির্বাচন বা অভিষেককরণের (Investiture) কাজটি ন্যস্ত ছিল কেন্দ্রীয় চার্চ প্রতিষ্ঠানের উপর। চার্চ ছাড়া অন্য কোন সংস্থার এই কাজ করার অধিকার ছিল না। ম্যাক্সি বলেন, এসময় রাজা দাবি করলেন, যাজকরা যে সমস্ত কাজ করে সেগুলোক পুরোমাত্রায় ধর্মীয় নয়, সুতরাং যাজক পদে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় যোগ্যতা গৌণ। নিয়োগের জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রীয় অনুমোদন প্রয়োজন। রাষ্ট্রের এই আদেশ বিশপরা শুধু যে মানতে অস্বীকার করতেন তাই নয়, চরম বিরোধিতা করে বসেন।

কর স্থাপন

কর স্থাপনকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে চার্চ ও রাজার মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। সামন্ততান্ত্রিক প্রথায় চার্চের যাজকেরা প্রচুর সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে ও সেই সূত্রে চার্চ নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য জনগণের উপর কর চাপায় ও আদায় করে। যাজকদের এই ক্ষমতা রাজাকে উত্তেজিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল, কারণ একদিকে রাজার ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ, অন্যদকে রাজকোষে ঘাটতি। রাজ্জা দাবি করেন কর স্থাপন রাজার ক্ষমতা।

অনেক সময় চার্চের প্রতিনিধিরা পাপপুন্যের ভয় দেখিয়ে অর্থ বা কর আদায় করতেন। ফলে রাজা জনগণের আনুগত্য লাভে বঞ্চিত হতেন। রাজা এখানে থেমে যাননি। মধ্যযুগে রাজারা অধিকাংশ সময় একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। এর জন্য অর্থের দরকার হত। রাজা চার্চের বিপুল সম্পত্তির উপর কর চাপাবেন বলে মনস্থ করলেন। যাজকেরা বাধা দেয়ার জন্য এগিয়ে এলন। চার্চ বাধা দিল। চার্চের বক্তব্য হল এর সম্পত্তি ধর্মীয় কাজে ব্যয় করা হয় ও রাজা সেই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। যাজকদের অন্য যুক্তি ছিল, চার্চের সম্পত্তি পরিচালনার নির্দেশ ঈশ্বর-প্রদত্ত, ঈশ্বরের ক্ষমতার উপর রাজা হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

বিরোধের কয়েকটি উদাহরণ

রাজার সাথে চার্চের বিরোধ দীর্ঘকাল ধরে চলে, বিশেষ করে ১১শ ও ১২শ শতকে রাজার সঙ্গে যাজক সম্পরদায়ের সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে রাজাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়, কারণ মধ্যযুগের মানুষ কেবল যে ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন ছিল তা নয় কুসংস্কারাচ্ছন্নও ছিল। যাজকরা পরকালের ভয় দেখিয়ে বা পাপপুন্যের কথা বলে জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ ও আনুগত্য আদায় করতেন। এটাই ছিল তখনকার দিনের রীতি। রাজার সঙ্গে চার্চের বিরোধে জনগণ প্রায়ই চার্চের পক্ষ অবলম্বন করতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে পোপগণ ধর্ম থেকেই রাজাকে বহিষ্কার করতেন।

চার্চ ও রাজার মধ্যে বিরোধের ইতিহাসে পোপ প্রথম নিকোলাসের সাথে লোরেনের রাজা (King of Lorraine) লোথেরের (Lothaire) বিরোধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজা লোথের সন্তান জন্ম দিতে না পারায় নিজের স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে প্রেমিকাকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু পোপ প্রথম নিকোলাস্ তাতে বাধা দেন। দীর্ঘদিন ধরে এই বিরোধ চলে। শেষ পর্যন্ত পোপের চাপে পড়ে রাজা তার প্রথমা স্ত্রীকে গ্রহণ করতে বাধ্য হন।

১৩শ শতকে চার্চের শক্তি চরম আকার ধারণ করে। চার্চ জগতের সর্বাধিনায়ক ছিলেন পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট (Innocent III)। তিনি রাজাকে বাধ্য করেছিলেন পোপের অধীনস্ত একজন প্রজা হিসেবে প্রচার করতে। এই সময় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেইন সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে চার্চের প্রভাব ছিল অপ্রতিহত। ১১শ ও ১২শ শতকে যা ছিল রাজা ও চার্চের মধ্যে বিরোধ, ১৩শ শতকে তাকে আর বিরোধ বলা চলে না, বলতে হয় পোপের অপরিসীম ক্ষমতা ও রাজার শর্তহীন আনুগত্য। বিভিন্ন কারণে রাজার ক্ষমতা স্তিমিত হয়ে যায়।

বিরোধের নতুন রূপ

১৪শ শতকে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ১৩শ শতকে রাজশক্তি যতখানি দুর্বল হয়ে পড়েছিল ১৪শ শতকে তা অনেকটা দূর হয়ে যায়। গেটেল বলেন, “রাজারা এসময় নিজেদের রাজকীয় ক্ষমতা শক্তিশালী করেন”। চার্চের সম্পদের অন্যতম উৎস্য ছিল সামন্তপ্রথা। ১৪শ শতকে সামন্ততন্ত্রের প্রভাব অনেকখানি সংকুচিত হয়ে আয়। শাঁসাল উৎস্য শুকিয়ে গিয়েছিল। সামন্ততন্ত্রের প্রভাব ক্ষুণ্ণ হবার সাথে সাথে চার্চের শক্তি কমে যায় ও রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

সর্বোপরি জনসাধারণ যাজক সম্প্রদায়ের আচার-আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ধর্মীয় আচার আচরণের চেয়ে ভোগবিলাসে যাজকদের নিষ্ঠা বেশি ছিল। এই সময়ে জনসাধারণের রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়ে যাওয়ায় তারা ক্রমশ রাজার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ে। সুচতুর রাজা জনগণের এই মানসিকতাকে উপযুক্ত ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। শক্তিশালী রাজা চার্চের ক্ষমতা সংকুচিত করতে দৃষ হস্তে এগিয়ে আসেন, এখন রাজার দিকে পাল্লা ভারি। ১৩শ শতকে রাজাকে পোপের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল, ১৪শ শতকে সে পরিস্থিতি আর নেই।

ম্যাক্সি বলেন, “১৩০০ সালের দিকে জাতীয় রাজতন্ত্রগুলো দৃশ্যপটে চলে সে, ও এর শাসকগণ চার্চের অযাজকীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না”। ১৩০০ সালের আগে বহিষ্করণের ভয় রাজাকে সন্ত্রস্ত করে রাখত। ১৪শ শতাব্দির শক্তিশালী রাজা সেই ভয় কাটিয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে জনগণের সঙ্গে পোপের একটা আপাত বিচ্ছেদ এসে গিয়েছিল।

বিরোধের ফলাফল

চার্চের সঙ্গে রাজার দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের ফলে গোটা মধ্যযুগে কোন সুস্পষ্ট ও সুসংহত রাষ্ট্রতত্ত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া জনসাধারণ নানাপ্রকার শোষণের কবলে পড়েছিল। ধর্মের নামে চার্চের শোষণ, সামন্তপ্রভূদের শোষণ ও সর্বোপরি রাজার শাসন ও শোষণ। তাই মধ্যযুগের ইতিহাসকে দির্ঘ শোষণের ইতিহাস বললে অত্যুক্তি হয়না। আধুনিক যুগে এই শোষণের গতি মন্থর হয়নি, কিন্তু ধর্মের নামে শোষণ ও জনগণকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রাখার প্রবণতা ও প্রচেষ্টা দুইই কমে গিয়েছিল। জনগণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার কোন চেষ্টা চার্চ করেনি। নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেই করেনি কেননা জনগণ শিক্ষার আলোক পেলে সংস্কার মানবে না।

মধ্যযুগে চার্চ সমাজের আরও একটা ক্ষতি করেছিল। সমাজের গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার জন্য নানা রকমের প্রতিষ্ঠানের দরকার। প্রতিষ্ঠানে স্বাধীন স্বাভাবিক বিকাশসাধনের পথে বড় অন্তরায় ছিল চার্চ। দীর্ঘকাল ধরে যেহেতু রাজাকে চার্চের সাথে বিরোধে লিপ্ত হতে হয়েছিল, তিনি প্রগতিমূলক কোন প্রকার চিন্তাভাবনা করার অবকাশ পাননি। তাই মধ্যযুগে সমাজের বিকাশের গতি ছিল অত্যন্ত মন্থর। সামন্তপ্রভূদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দরিদ্র চাষীদের শোষণ করে যতটুকু সম্ভব অর্থ সংগ্রহ করা, কৃষির উন্নতির চিন্তা তাদের মাথায় আসেনি। অর্থাৎ যাজক, রাজা ও সামন্তপ্রভূ কেউই ভাবেননি।

পরিশেষে বলা যায়, সমস্ত মধ্যযুগের ইতিহাস পোপের সমর্থক ও পোপের বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ইতিহাস (ম্যাক্সের মন্তব্য)। আবার এই সংঘর্ষ কেবল ধর্মীয় কারণে সংঘটিত হয়নি। ধর্মই যদি বিরোধের একমাত্র কারণ হত তাহলে মনে হয় বিরোধ এত দীর্ঘস্থায়ী হত না। ইবেনস্টাইন তার Great Political Thinker গ্রন্থে বলেন, “পোপ ও পোপবিরধীদের মধ্যকার সংগ্রাম কেবল ও মূলত ধর্মতত্ত্ব নিয়ে ছিল না, এটি ছিল ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্বের প্রকাশ”। মধ্যযুগে রাজশক্তি ও যাজকশক্তির মধ্যে যে লড়াই শুরু হয় তার পরিসমাপ্তি আজও হয়নি। আসলে সমাজ বিকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে বিভিন্ন সময়ে সমাজের বিভিন্ন প্রভাবশালী শ্রেণী প্রতিষ্ঠা অর্জনের উদ্দেশ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। চার্চকে কেবল একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা ভুল, এটি প্রতিক্রিয়াশীলতার শ্রেণীর প্রতীক মাত্র।

সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা ও উদ্ভব

প্রারম্ভিক মন্তব্য

মধ্যযুগকে কেবল চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখলে হয়না। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সামন্ততন্ত্র। মহাপরাক্রমশালী আচ্ররচের পাশেই এটি গড়ে উঠেছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতন হবারপর অবিচ্ছিন্ন সাম্রাজ্যটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কিন্তু রাজশক্তির দুর্বলতার পুরো সুযোগ নিয়ে সামন্তপ্রভূরা নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য স্থাপন করে ফেলেন ও একেকজন সামন্তপ্রভূ ক্ষুদে “রাজায়”পরিণত হয়ে যান। অনেকে বলেন মধ্যযুগের সমাজ বিকাশের এটি একটি অবধারিত ফসল। মার্ক্সীয় দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে বলা যেতে পারে, সামন্ততন্ত্রের আবির্ভাব স্বেচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার ফসল নয়, সমাজ বিকাশের একটি স্তর। শ্রেণীর আবির্ভাব ও আর্থব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য সামন্ততন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।

সামন্ততন্ত্র

সেবিন বলেন, প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রচিন্তা যেমন নগর-রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা একদিকে চার্চ বনাম রাষ্ট্র, অন্যদিকে সামন্ততন্ত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। মধ্যযুগের রাজনৈতিক ধ্যানধারণা বিশেষ করে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সার্বভৌমত্ব, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে সামন্ততন্ত্র এসে যায়। কিন্তু সুসংবদ্ধভাবে সামন্ততন্ত্রকে ব্যাখ্যা করা সহজ কাজ নয়, অথবা আজ পর্যন্ত এর জন্মের সঠিককাল ইতিহাসবেত্তারা ঠিক করতে পারেননি।

৪৭৬ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত সময়কে পণ্ডিতরা এর বিকাশকাল বলে মনে করেন, যখন সামন্ততন্ত্র ইউরোপের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল, এমনকি মধ্যযুগের আর্থব্যবস্থা অনেকটা সামন্ততন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। বার্কি একে একটি আর্থনীতিক-আইনগত-রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করেছেন। তাছাড়া আধুনিক যুগের ঐতিহ্যের বিকাশ সাধনের উপর মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্রের প্রভাব অনস্বীকার্য।

সামন্ততন্ত্র দ্বারা সেসময় সুস্পষ্ট দুটো ব্যবস্থাকে বোঝানো হত –
১। সামন্তগিরি বা Vassalage – জমিদাররা তাদের ঊর্ধ্বতন শাসক বা প্রভূ বা রাজার কাছে আনুগত্যের  বন্ধনে আবদ্ধ থাকতেন, ঊর্ধ্বতন শাসক বা রাজার সামরিক সাহায্যের প্রয়োজন হলে সামন্ত বা জমিদাররা সেই সাহায্য দিতেন, অর্থাৎ সাহায্যের  বিনিময়ে জমিদারি ভো করার স্বত্ব জমিদাররা পেতেন।
২। ভূমিদাসত্ব বা Serfdom – সাধারণ ব্যক্তি জমির মালিকানা পেত না। জমিদারদের কাছে তারা ক্রীতদাসের মত থাকত, পরিশ্রম কর ও ফরমাস পালন করত।

সামন্ততন্ত্রের এই দুটো অর্থ ছাড়া অন্য একটা অর্থ আছে, জমির মালিকানা ও নিয়মিত খাজনা প্রদানের সঙ্গে সামন্ততন্ত্র ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। সেজন্য কোন কোন সমালোচক সামন্ততন্ত্রকে চুক্তি বলেন, এখানে জমির মালিকরা তাদের অধস্তন ব্যক্তিদের কিছু জমি জায়গা দিতেন ও বিনিময়ে প্রয়োজন হলে সাহায্য পেতেন। সেবা বা সামরিক সাহায্য ছিল প্রধান। এছাড়া জমিদারের ছাপাখানা, কলকারখানা ব্যবহার করার জন্য একটা খাজনা দিতে হত, এটাও চুক্তির মাধ্যমে। এভাবে মধ্যযুগের সামন্তপ্রথা চুক্তির উপর দাঁড়িয়েছিল। গেটেল বলেন, সামন্ততন্ত্র রাজনীতির ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। অর্থাৎ রাজনীতিক উদ্দেশ্যসাধন এর লক্ষ্য ছিল না, এটা ছিল পুরো ব্যক্তিগত।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব

দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। সুস্থিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা একটা কাঠামো গড়ে তোলা কল্পনার বাইরে ছিল। অর্থনীতি বা আর্থব্যবস্থা যে খুব একটা সুস্থ ছিল তা নয়, মোট কথা সমাজের রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক পরিমণ্ডলে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করত। এই ডামাডোলের বাজারে ছোট ছোট রাজনৈতিক একক আবির্ভূত হয়েছিল ও এর শাসকরা একেকটা গণ্ডী তৈরি করে নিজেদের আবদ্ধ করে রেখেছিলেন।

এই যুগে অর্থনীতি ছিল কৃষিকেন্দ্রিক, জীবিকানির্বাহের উপায় ছিল কৃষি। জমি বেশি উর্বর থাকায় সবাই জমির দিকে ঝুঁকে পড়ে। জমির মালিক হওয়া লাভজনক হওয়ায় সমাই জমি দখল করতে আগ্রহী ছিল। আব্র জমির পরিমাণ সীমিত হওয়ায় জমিকে কেন্দ্র করে লেগে যেত নিজেদের মধ্যে নানারকম সংঘর্ষ। এভাবে মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের জম হয়। অর্থাৎ সামন্ততন্ত্র একটা সংগঠনের রূপ নেয়। গোটা সমাজকাঠামো জমির উপর দাঁড়িয়েছিল, এই পরিস্থিতিতে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণী জমির মালিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় সমস্ত জমি বা ভূসম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন।

রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিল খুবই দুর্বল, তারা নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। প্রভাবশালী কোন কোন ভূস্বামী সামরিক বাহিনী পর্যন্ত রাখতেন। বার্কি বলেন, মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের জন্মের পেছনে দুটো উপাদান বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল – (১) রোমান সাম্রাহজ্যের পতনের পর নিরাপত্তার অনুপস্থিতি, (২) কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা।

হার্মন সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের একটা কারণ উল্লেখ করেছেন। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায় ও ছোট ছোট এককের উদ্ভব ঘটে। একটা ঐক্যবদ্ধ প্রশাসন ব্যবস্থার স্থান দখল করে নেয় ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত এককগুলোর প্রশাসন। চার্চের প্রভাব হ্রাস পেলেও রাজ্য শাসন ও অন্যান্য ব্যাপারে রাজার যতখানি পারদর্শিতা থাকার  কথা তা না থাকায় সামন্তপ্রভূদের ক্ষমতা বেড়ে যায়।

সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য

পিতাপুত্র সম্পর্ক

মধ্যযুগের অপরিসীম ধর্মের প্রভাবযুক্ত সমাজে চার্চের পুরোহিতগণ নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রচার করতেন, যাদেরকে ঈশ্বর জনগণকে পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য প্রেরণ করেছেন। খ্রিস্টের একনিষ্ঠ ভক্তরাও তাদেরকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেন, ফলে ঈশ্বর পিতা ও জনগণ তাদের সন্তান এমন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগের শেষের দিকেও ধর্মের প্রভাব পুরো লোপ পায়নি, পিতা-পুত্রের সম্পর্কের জের চলতে থাকে। যেসব সামন্তপ্রভূ ও জমিদার জনগণকে সর্বাধিক নিরাপত্তা ও বিপদে-আপদে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে প্রতেন তারাই পিতার আসনে বসতেন।

কৃষি এই যুগের একমাত্র উপাদান ছিল, তাই কৃষিযোগ্য জমিকে বসানো হয় মায়ের স্থানে। অপার্থিব বিষয় থেকে পার্থিব বিষয়ে সম্পর্কের উত্তরণ ঘটে। ধর্মকে বাদ দিয়ে মানুষ বৈষয়িক চিন্তাধারায় নিজেকে নিযুক্ত করে। কিন্তু অতীতের পিতা-পুত্র বা মাতা-পুত্র সম্পর্কটি রয়েই যায়, বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়না।

অরাজনীতিক

জমিদার, সামন্তপ্রভু, প্রজা বা ক্রীতদাস এদের মধ্যে আর্থনীতিক সম্পর্ক বা লেনদেন ভালভাবেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আর্থনীতিক বা বৈষয়িক সম্পর্ক ছাড়া এদের মধ্যে কোনপ্রকার রাজনীতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। সামন্তপ্রভূদের লক্ষ্য ছিল যেকরেই হোক নিজেদের সম্পত্তিকে রক্ষা করা, একে কেন্দ্র করেই তাদের আর্থনীতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সেখানে কোন আমলাতান্ত্রিক বা প্রশাসনিক বা রাজনীতিক সম্পর্ক স্থান পায়নি। বৈষয়িক প্রয়োজন সবাইকে পরিচালিত করত। কোন মতাদর্শ বা নীতির ভূমিকা ছিল না। ভূমিদাসরা চাষাবাদ করত, অন্যেরা ছোটখাট ব্যবসা-বাণিজ্য বা কুটীর শিল্পে নিযুক্ত থাকত। নিরাপত্তার প্রয়োজনে উভয় উভয়কে সাহায্য করত, কারণ মধ্যযুগে বা এর শেষের দিকে আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার জন্ম হয়নি। আজকাল আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের সেযুগে তেমন ছল না। জমিদার ও তার অধীনস্ত প্রজারা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেন।

অস্থিতিশীল সমাজ

মধ্যযুগে আধুনিককালের মত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোন কর্তৃপক্ষ না থাকায় সমাজের অবস্থা ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। প্রতিটি জমিদার বা সামন্তপ্রভু ছিল স্বাধীন, কেউ আইনকানূন মানতে বাধ্য ছিলেন না। প্রতিটি জমিদার সম্পদ আহরণে, নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণে ও প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত ছিলেন৷ ফলে গোটা সমাজ নিজেদের মধ্যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস নিয়ে যে সমস্ত পণ্ডিত ভাবনাচিন্তা করেন তারা এই পরিস্থিতিকে রাষ্ট্রহীনতা (statelessness) আখ্যা দিয়েছেন। রাজনীতিক কাঠামোর মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন কোন শক্তি না থাকায় বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকত, যা সামন্ততন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেকে বলেন এই কলহের তীব্রতার জন্যই মধ্যযুগে সাবভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে নি। অবশ্য সবাই এ বিষয়ে একমত নন যে রাষ্ট্রব্যবস্থা না থাকায় কলহ দেখা দিত।

স্বৈরাচারী জমিদার

মধ্যযুগে জমিদার ও সামন্তপ্রভুরা ছিলেন রীতিমত ক্ষমতাশালী। তাদের আচার-আচরণ দেখে মনে হত তারা প্রত্যেকে একেকটা রাষ্ট্রের কর্ণধার। নোট ছাপানো থেকে শুরু করে একটা সাবভৌম রাষ্ট্র যা যা কাজ করে সবই জমিদাররা করতেন৷ নিজেদের প্রতিরক্ষা নিজেরাই তৈরী করে ফেলেছিলেন। জমিদাররা নিজেরাই বিচার করতেন। জামদারদের আদেশ বা নিষেধ প্রজারা বা অধস্তন কর্মচারীরা আইনের মর্যাদা দিয়ে মেনে চলত। এককথায় আইন, বিচার ও শাসন সংক্রান্ত -সমন্ত কাজ জমিদাররা নিজেরাই করতেন। তাই বলা যায় তারা স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন।

অবশ্য এই যুগে রাজা যে ছিলেন না তা নয়, কিন্তু তার অস্তিত্ব কেবল কাগজে-কলমে ছিল। কোন রাজা তার কর্তৃত্ব জাহির করতে চাইলে প্রভাবশালী জমিদার চ্যালেঞ্জ করে বসতেন, নতুবা রাজার আদেশ উপেক্ষা করতেন। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের আবির্ভাব তাদের কাছে ছিল অনভিপ্রেত। সেজন্য যেকোন অজুহাতে জমিদাররা রাজার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতেন। অর্থনীতি ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে বৃহৎ রাষ্ট্রীয় এককের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও মধ্যযুগে তার আবির্ভাব দেখা যায়নি। সেবিন বলেন, “এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ছিল এখানেই যে, এই বিশৃঙ্খলার পরিবেশ মধ্যযুগে প্রায়ই নৈরাজ্যের সৃষ্টি করত, এরফলে বৃহৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একক অসম্ভব হয়ে যায়”। সামন্তপ্রভু ও জমিদার-শ্রেণীর ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় কতৃত্বকে এদের স্বার্থের অনুকূলে সীমায়ত করে রাখতে বাধ্য করেছিল। সামন্তপ্রভুরা ছিলেন প্রকৃত ক্ষমতার মালিক। সবার নজর ছিল জমিদার বা সামন্তপ্রভুদের উপর। রাষ্ট্রের প্রতি কারও আনুগত্য দেখা যাত না। জমিদারশ্রেণী ছাড়া পাশাপাশি কেবল চার্চের আধিপত্য মধ্যযুগে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

কৃষিকেন্দ্রিক সামন্ততন্ত্র

ধর্মীয় জগতে পোপ ও আর্থনীতিক জগতে জমিদার ছিলেন স্বৈরাচারী জীবিকা অর্জনের বিকল্প উপায় ছিলনা বললেই চলে, সেজন্য সামন্ততান্ত্রিক যুগে সমাজ পুরোপুরি কৃষিকেন্দ্রিক ছিল। মেইটল্যান্ড (Maitland) বলেন, সামন্ততন্ত্র হল সমাজের এমন একটা অবস্থা যেখানে জনসাধারণের অধিকার ও কর্তব্য জমির ভোগ দখলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বাইরে সামরিক, আর্থিক ও বিচার সংক্রান্ত কোন ধারণা তৈরি হতে পারেনি। জমির ব্যক্তিগত মালিকানাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে এমন কোন আইন বা সামরিক পদ্ধতি সামন্ততান্ত্রিক যুগে প্রচলিত ছিল না। এমনকি গণ-প্রশাসনের ক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্রের অবদান স্পষ্ট ছিল, সামন্তপ্রভুরা পুরুষানুক্রমে গণ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রশাসন বলতে জমির ভোগদখল বোঝানো হত।

রাজারা কদাচিৎ কোন আইন প্রণয়ন করলে তা এমনভাবে করা হত যাতে জমিদারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়। আর জমিদার শ্রেণীর স্বার্থ মানে জল জমির ভোগদখলের স্বার্থ। কৃষিকেন্দ্রিক আর্থব্যবস্থার জন্য সামন্তযুগকে বিকেন্দ্রীকরণের যুগ বলা হয়। জমিদাররা ছিলেন স্বাধীন। কোন কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিল না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজকর্ম পরিচালনা করতেন।

দাসপ্রথা থেকে উন্নত

সামন্ততন্ত্র অতীতের দাসপ্রথা থেকে অনেক উন্নত ছিল। গ্রিস ও রোমে দাস প্রথা সমাজ জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। ক্রীতদাসরা ছিল উৎপাদনের যন্ত্র। তাদের নিজস্ব কোন সত্তা ছিল না। মালিকের সম্পদবৃদ্ধির একমাত্র উপায় ছিল ক্রীতদাস। কিন্তু ভূমিদাস (Serf) ক্রীতদাসের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত জীবনযাত্রা নির্বাহ করত। তারা জমির মালিকানা ভোগ না করতে পারলেও উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর একটা অংশ পেত। ফলে ভূমিদাসরা উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিত। জমিদারকে নানা প্রকার প্রয়োজনে সাহায্যে করার বিনিময়ে ভূমিদাসরা একটা পারিশ্রমিক পেত। অতীতের ক্রীতদাস মালিকের মত সামন্তপ্রভুরা নিষ্ঠুর শোষক ছিলেন না। কিন্তু তাই বলে তারা শোষণ করতেন না এমন কথা বলা যায়না। ভূমিদাসদের শোষণের মাত্রা অনেক কম ছিল।

সামন্ততন্ত্রের পর এলো শিল্পবিপ্লব। ভূমিদাসের পরিবর্তে সমাজে এক নতুন শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটল, শ্রমিক শ্রেণী। মার্ক্স ও এঙ্গেলস ইশতেহারে বলেছেন, মধ্যযুগের সমাজ যেমন জমিদার ও ভূমিদাসে বিভক্ত ছিল শিল্পবিপ্লবোতর যুগের সমাজে তেমনি বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত দেখা যায়।

জটিল ও সংঘর্ষপূর্ণ সমাজ

অনেকে মনে করেন, সামন্তপ্রভুদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ায় সমাজের আকার জটিল ও সংঘর্ষপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। সামন্তপ্রভুদের রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জমির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলা। এর ফলে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ব্যবস্থা জটিল আকার ধারণ করেছিল। স্থিতিশীল আইন-ব্যবস্থা ও প্রশাসন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি। তদুপরি বিভিন্ন সামন্তপ্রভুকে নিজেদের মধ্যে স্বার্থকে ঘিরে বিবাদ করতে দেখা যায়। হার্মন বলেন, “ভূমির ধূলা রক্ত, লোহা ও বিশ্বাসঘাতকতার নীতি দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল”। ১৫শ শতকে নৈরাজ্ ও রক্তলোলুপতা আরও তীব্র আকার ধারন করে।

সামন্ততন্ত্রের তাৎপর্য

জাতীয়তা ও সার্বভৌমত্ব

সামন্ততন্ত্র যথেষ্ট তাৎপর্যমণ্ডিত ছিল। আধুনিক জাতীয়তা (Nationality) ও ভৌমিক (Territorial) সার্বভৌমত্বের জন্ম সামন্ততান্ত্রিক যুগেই। প্রত্যেকটি সামন্তপ্রভু সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে জমিদারী পরিচালনা করতেন। পরে সেটাই জাতীয়তা ও ভৌমিক সার্বভৌমত্বের জন্ম দেয়।

সংবিধানতন্ত্র

অনেক সমালোচক মনে করেন সামন্ততন্ত্র থেকে সংবিধানতন্ত্রের জন্ম। জমিদাররা স্বৈরাচারী হলেও তাদের স্বৈরাচার চরম আকার লাভ করেনি। রাজাকে তারা সবসময় যে অমান্য করে চলতেন তা বহু বিজ্ঞ ব্যক্তি স্বীকার করেন নি। অনেকে বলেন তারা রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে স্বীকার করতেন। তাই রাজার আদেশ অমান্য করার অর্থ ছিল বেআইনি কাজ করা। তাই রাজার অস্তিত্ব, গুরুত্ব ও ক্ষমতা কেউ অস্বীকার করতে পারেননি। অন্যদিকে সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতাও অসীম ছিল না। এক কথায় রাজা ও জমিদার উভয়ের ক্ষমতা পরস্পরের দ্বারা সীমায়িত ছিল। এর থেকে সংবিধানতন্ত্রের সৃষ্টি হয়।  গেটেল বলেন, “সামন্ততন্ত্র একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে চূড়ান্ত আধিপত্যের ধারণাকে প্রতিহত করেছে”।

মধ্য্যযুগের রাজারা আর্থিক সাহায্যের জন্য প্রজাদের, বিশেষ করে জমিদারদের উপর নির্ভর করতেন। রাজারাও অনেক সময় জমিদার বা সামন্তপ্রভুর কষ্ট বা দুর্দশা লাঘব করার জন্য এগিয়ে আসতেন। রাজা ইচ্ছামত কোন কাজ করতে পারতেন না। পরিষদের সাথে পরামর্শ করে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। পরামর্শ দেবার অধিকার পরিষদ বা জনপ্রতিনিধির কাছে এই গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্য ইউরোপের সব স্থানে সমানভাবে দেখা যায়নি। ফ্রান্সে প্রতিক্রিয়াশীল সস্রকার বহাল তবিয়তে রাজত্ব চালাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জনগণ বিপ্লব করতে বাধ্য হয়।

জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব

গেটেল বলেছেন, বিভিন্ন সামন্তপ্রভু ও জমিদারের মদ্যে সবসময় কলহ লেগে থাকত তা ঠিক নয়, অর্থাৎ, সামন্ততান্ত্রিক যুগ চরম নৈরাজ্যের যুগ ছিল না। বরং জমিদারদের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল। যাই হোক, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা সমাজ থেকে যখন আস্তে আস্তে দুরীভূত হচ্ছিল তখন টুকরো টুকরো অংশগুলো একত্রে মিলিত হয়ে জাতীয় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন তৈরি করে। আইনের প্রতি আনুগত্য ও নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান আগেই ছিল। জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠতে খুব বেশি দেরি হয়নি। গেটেল বলেছেন, স্থিতিশীলভাবেই ধারণাটি জন্মায় যে অব্যবহিত সামন্তপ্রভুর প্রতি আনুগত্যের বদলে প্রত্যেক স্বাধীন মানুষই রাজার প্রতি অনুগত, এবং এই নীতি জাতীয় রাষ্ট্রের বিকাশকে দ্রুততর করে।  

শিল্পোন্নত সমাজের পূর্বসূরী

সামন্ততন্ত্রে সমাজ মোটামুটি দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। জমিদার বা সামন্তপ্রভু এবং ভূমিদাস। অন্যান্য শ্রেণী যে ছিল না তা নয়। তবে সমাজে তাদের কোন তাৎপর্য ছিল না। অতীতের তুলনায় ভূমিদাসরা কম শোষিত হলেও সামন্ততন্ত্রে শোষণের মাত্রা যথেষ্ট ছিল। জমিদার ও পুরোহিত সম্প্রদায় একসঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে অত্যাচার চালাতেন এবং ভূমিদাস ও অন্যান্য শোষিত শ্রেণী যাতে বিপ্লবের পথে অগ্রসর না হতে পারে তার জন্য তারা জনগণের মনে বিপ্লব বিরোধী মনোভাব নানা কৌশল অবলম্বন করে তৈরি করেছিলেন। পুরোহিত ও সামন্তপ্রভুরা জানতেন জনগণ রাজনীতি সচেতন হয়ে পড়লে তাদের শোষণের গতি অব্যাহত থাকবে না। ধর্ম, পাপ, পুন্য, আনুগত্য ও ঈশ্বর ইত্যাদি ধারণাগুলো যাজকরা অবিরাম প্রচার চালাতেন। আর এ কাজে সহায়তা করতেন জমিদাররা। সমাজের স্থিতাবস্থা বিঘ্নুইত হোক এটা কারুর কাম্য ছিলনা। মানুষ যাতে প্রগতিমূলক চিন্তাধারা গ্রহণ করতে না পারে তার জন্য তাদেরকে অন্ধ সংস্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন করে রাখা হত। সেজন্য সমস্ত মধ্যযুগের সমাজকে বলা হয় শ্রেণীসমাজ ও এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শোষণ। সামন্ততন্ত্রের পর এসেছিল শিল্পবিপ্লব ও শিল্পোন্নত সমাজেও বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত দুটো শ্রেণীর জন্ম হয়েছিল। মধ্যযুগের শোষণের ঐতিহ্য চলে এসেছিল পরবর্তী যুগে।

দেশপ্রেমের জন্ম

সামন্ততন্ত্রের বিকাশের ফলে দেশপ্রেমের জন্ম হয়েছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। সামন্তপ্রভুরা সব সময় লক্ষ্য রাখতেন যাতে করে তাদের প্রজারা নিরাপত্তাহীন না হয়ে পড়ে ও একজন সামন্তপ্রভুর মৃত্যু হলে তিনি তার উত্তরাধিকারকে এই দায়িত্ব হস্তান্তর করতে যেতেন। সামন্তপ্রভুরা অত্যাচারী হলেও প্রজাদেরকে অন্যের অত্যাচার বা শোষণের মুখে ঠেলে দিতেন না। এই মমত্ববোধ ও ভাবাবেগ সামন্তপ্রভুদেরকে দেশপ্রেমী করে তুলেছিল। হার্মনের মতে, সামন্ত প্রতিজ্ঞা এমনভাবে পারিবারিক সম্পর্ক, সেবা ও আনুগত্যের এমন বন্ধনকে অনুপ্রাণিত করে যা পূর্বে দেখা যাওয়া অন্য যেকোন কিছু থেকে ভিন্ন ছিল।

তথ্যঋণ

  • রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবৃত্ত, প্রাণগোবিন্দ দাস, নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি, ২০১৩, পৃ. ৯৩-১১৩

1 Comment

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.