Table of Contents
ভূমিকা
মধ্যযুগের ইউরোপের সৃষ্টিরহস্য রোমান এবং জার্মান ক্লাসিক্যাল ও বারবারিয়ান সংস্কৃতির বহুবিচিত্র উপাদানের স্বার্থক মিলনের মধ্যেই নিহিত আছে। অবশ্য এই মিলে মিশে যাওয়ার কাহিনীর মধ্যে কখনো অন্তর্লীন, কখনো বা প্রবলতর সক্রিয় ছিল খ্রিস্টধর্ম, যার বিস্তার রোমান সাম্রাজ্যের তারই ফলশ্রুতি। ইউরোপের ইতিহাসের এই অধ্যায়েই মহাদেশের পশ্চিম ও পূর্বভাগ এর মধ্যকার ব্যবধান বড় হতে থাকে। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য কে সম্রাট কনস্টানটাইন স্থাপিত রাজধানী কনস্টান্টিনোপল কে ঘিরে আপন বিশিষ্ট ইতিহাস রচনায় এবং থাকতে দেখা যায়। বৈরি পারসিক, আরব, তুর্কি ও ল্যাতিন জাতিগুলি কর্তৃক পরিবেষ্ঠিত হয়েও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য প্রতিবেশী স্লাভদের কাছে ইউরোপীয় সভ্যতার বাণী পৌঁছে দিয়েছে, প্রায় ১০ শতাব্দি ধরে হেলেনিক ও রোমান সভ্যতার অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদগুলো রক্ষা করেছে, এবং শেষ পর্যন্ত খন্ড বিখন্ড হয়ে জীবনীশক্তি হারিয়ে তুর্কীদের দ্বারা বিজিত হয়েছে।
কিন্তু পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ এই সহস্র বছরের মধ্যে পূর্ব রোমান বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ণ রূপান্তরের ফলে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহকরূপে স্বীকৃতি পাবার উপায় তার ছিলনা, সে গৌরবের একমাত্র দাবীদার হয়ে উঠেছিল লাতিন ইউরোপ। আর একই ধর্মের অনুসারী হলেও তাত্ত্বিক ও আনুষ্ঠানিক উভয় বিষয়ে ইউরোপের ২ ধর্মের বৈসাদৃশ্য হয়ে উঠেছিল অনতিক্রম্য। মধ্যযুগের আদি, মধ্য ও অন্ত্যপর্বে রোমান এবং গ্রিক অর্থোডক্স চার্চকে একে অন্যের পরিপূরক নয়, বরং প্রতিযোগী হিসেবে কর্মরত দেখা গিয়েছিল। তাছাড়া সপ্তম ও অষ্টম শতকে মুসলমান শক্তির অত্যাশ্চর্য বিস্তারের অভিঘাতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের জীবনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যায়। একই মহাদেশে অবস্থিত হলেও পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের ব্যবধান হয়ে ওঠে দুস্তর।
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের সূত্রপাত
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বিশালত্বের চেয়ে তার অন্তর্নিহিত ঐক্যই সর্বশ্রেণীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বহুকাল ধরে। ভূমধ্যসাগরে সুদীর্ঘ উপকূল ভাগ আশ্রয় করে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তার সংহতি ছিল বিস্ময়কর। শুধু সুশাসন, কেবলমাত্র সতর্ক, কুশলী এবং যথোপযুক্ত সামরিক শক্তিই তাকে এ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেনি, রোমান আইনের সর্বপ্লাবী প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা এই ঐক্য ও সংহতিকে সম্ভব করেছিল। তাছাড়া ধর্মের ক্ষেত্রে রোমের ‘সর্বেশ্বরবাদ’ অগণিত বিজিত জাতিগুলির উপাস্য দেবদেবীকে পুজ্য করে নেয়ার প্রবণতাও সাম্রাজ্যিক ঐক্য রক্ষায় নিঃসন্দেহে সহায়তা করেছিল। ‘প্যাক্স রোমানার’ (Pax Romana) প্রতি অনায়াস আনুগত্য এই বিশাল সাম্রাজ্যের কোথাও বিচলিত হয়নি দীর্ঘকাল।
রোমান সাম্রাজ্যের এই সংহতির উপর প্রথম আঘাত আসে সম্রাট কনস্টানটাইন কর্তৃক খ্রিস্টধর্ম কে সরকারিভাবে গ্রহণ করার পর। শুধু একেশ্বরবাদই নয়, একমাত্র তাদের ধর্মেই বিকৃত আছে পরম সত্য – খ্রিস্টানদের এই বিশ্বাস বহু ধর্মাবলম্বী রোমান প্রজাপুঞ্জের সামনে এক নতুন এবং কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করে। তাছাড়া বাইজানসিয়ামে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের পর থেকে ধীরে ধীরে ভুমধ্যসাগরের উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে থাকে এবং রোমের অর্থনীতিতে শুরু হয়ে যায় প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া। রোমান সাম্রাজ্যের সংহতিতে নতুন করে ফাটল ধরে যখন পঞ্চম শতক থেকে উত্তর ইউরোপের ‘বর্বর’ জাতিগুলো বিভিন্ন শাখায় ভিন্ন ভিন্ন পথে সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ শুরু করে (Volkerwanderung)। সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ইতিহাস বিমথিত হয়ে ওঠে আক্রমণের ফলে। অবশ্য অনায়াসে না হলেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ খ্রিস্টধর্মের প্রসার ও বিধর্মী বর্বর আক্রমণ জাতীয় সমস্যার সমাধান করে সমন্বয়ের পথে, দেয়ানেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সপ্তম শতকে ইসলামিক শক্তির বিপুল বিস্ফোরণের। কিন্তু সপ্তম শতকে ও ঐস্লামিক শক্তির বিপুল বিস্ফোরণের আঘাত তাকে আপন শরীরে ধারণ করতে হয়েছিল বহুকাল।
‘বর্বর’ আক্রমণ
রোমান ও জার্মানদের পুরনো সম্পর্ক
৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের সম্রাট রোমুলাসের উপর বর্বরদের আক্রমণ ও তার সিংহাসনচ্যুতির মধ্যে কোন আকস্মিকতা ছিলনা। রোমান সাম্রাজ্যে জার্মানদের অনুপ্রবেশ আরম্ভ হয়েছিল বহু আগ থেকে। এমনকি খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে ঐতিহাসিক ট্যাসিটাস রোমান সাম্রাজ্য সীমান্তে বিধর্মী বর্বরদের উৎপাতের কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে রোমান ও জার্মানদের পারস্পরিক পরিচয় ছিল বেশ পুরনো। উভয় পক্ষের মধ্যে বড় রকমের সংঘর্ষ হলে বেশ কিছু সংখ্যক জার্মানকে বন্দিরূপে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যেত। এদের উপর রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। আর বন্দীদের পিতৃভূমির সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্যগুলি অপরিচিত থাকতো না রোমান নাগরিকদের কাছে।
রোমান সংস্কৃতির স্বাদ লাভের আকাঙ্ক্ষা
পঞ্চম শতাব্দী বহু আগে থেকেই ক্রুর প্রকৃতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইউরোপের দক্ষিণাংশে জার্মান জাতি বিভিন্ন শাখা উপশাখাগুলির বিপুল সংখ্যায় অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছিল। আত্মরক্ষার তাগিদ ছাড়া তাদের সামনে ছিল রোমানদের উন্নততর মানের জীবনযাত্রার দুর্নিবার আকর্ষণ। রোমান সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করার পরিবর্তে তার স্বাদ লাভ করা বা তার অংশীদার হওয়া ছিল প্রায় সব শ্রেণীর বর্বর দলগুলির নিশ্চিত লক্ষ্য। আর দীর্ঘদিনের পূর্ব পরিচয়ের ফলে বিজিত স্থানগুলিতে তাদের বসতি স্থাপনও সহজতর হয়ে যায়। যে দাস শ্রমের উপর রোমান রাষ্ট্রসমাজ নির্ভরশীল ছিল সেই দাসেরা সংগৃহীত হত রোমান রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রধানত স্থানগুলি থেকে। এরা রোমান পরিবারের মধ্যে স্থান পাওয়ায় অরোমান বর্বরদের রীতিনীতি সম্পর্কে রোমান নাগরিকদের প্রায় কিছুই অজানা ছিল না।
ফেদেরাতি ও রোমান-জার্মান আদান-প্রদান
তবে পারস্পরিক পরিচয় গড়ে তোলার ব্যাপারে রোমান সেনাবাহিনীতে ‘foederati’ হিসেবে জার্মানদের বিপুল সংখ্যায় নিয়োগেই হয়তো সবচেয়ে কার্যকর হয়ে উঠেছিল। কখনো কখনো নতুন বর্বর আক্রমণ প্রতিরোধের সহজ উপায় রূপে বর্বরদের একটা গোটা সম্প্রদায়কে সীমান্তে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হতো। রোমান সামরিক ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য ‘foederati’ ব্যবহৃত হলেও মাঝে মাঝে সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বর্বর সেনানায়কদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের ঘটনা অবিরল ছিলনা। এইভাবে বিভিন্ন সূত্রে পঞ্চম শতকের বেশ কিছুকাল আগে থেকে পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজে রোমান ও জার্মান উপাদানের মিলনের যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল তা ক্রমশ গভীরতর হতে থাকে।
দেয়া-নেয়া প্রক্রিয়া যে কতদূর পরিব্যপ্ত হয়ে গিয়েছিল তা কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ স্পষ্ট হবে। চতুর্থ শতকের শেষার্ধে ও পঞ্চম শতকের প্রারম্ভে স্টিলিকো (Stilicho) নামক যে সেনাধ্যক্ষ রোমান সাম্রাজ্যের ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি জাতিতে ছিলেন ভ্যান্ডাল। আর সম্রাট রোমুলাসকে সিংহাসনচ্যুত করে যে সেনানায়ক ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেন সেই অডোভেকারও ছিলেন বর্বরজাতি উদ্ভূত। আবার ইতালিতে অডোভেকারের প্রাধান্য লুপ্ত করে যে অস্ট্রোগথ সেনানায়ক রাজা থিওডোরিক আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তিনি রোমান সংস্কৃতির পরম অনুরাগী ছিলেন। থিওডোরিক বাইজানটাইন সম্রাটের প্রতিভূ রূপে এই নবগঠিত রাজ্য শাসন করতে থাকেন। এই প্রসঙ্গে সমসাময়িক কালের প্রখ্যাত দুই মনীষী ক্যাসিওডোরস (Cassiodorus) এবং বোয়েথিয়াসের (Boethius) নাম স্মরণযোগ্য। এরা বিধর্মী বর্বরদের অধীনে থেকেও ধ্রুপদী সংস্কৃতির অনুশীলনের ছিলেন। বোয়েথিয়াস তার অনুবাদকর্ম ও ভাষ্যরচনা এর মাধ্যমে প্রাচীনকালের জ্ঞানচর্চার অমূল্য ফসল গুলি সংরক্ষণ করেছিলেন আর ‘On the Consolation of Philosophy’ নামক একটি মৌলিক রচনা মধ্যে তার প্রতিভার সুস্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়।
হুনদের আক্রমণ
দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে বর্বরদের রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশের অপর একটি কারণ হলো তাদের উপর ভয়ঙ্কর হুনদের আক্রমণ। যে সমস্ত জার্মান তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল (প্রধানত অস্ট্রোগথ ও ভিসিগথ) তারা মধ্য এশিয়া থেকে ধাবমান হুনদের দ্বারা (প্রচণ্ড গতিতে ও বিপুল সংখ্যায় হুনদের এই পশ্চিমে এগিয়ে যাওয়াকে ফার্ডিন্যান্ড লট “ethnic cyclone” রূপে বর্ণনা করেছেন) বিতাড়িত হয়ে চতুর্থ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
রোমান সাম্রাজ্যের পতন
বিতাড়িত এইরকম এক বর্বর দলের হাতেই (ভিসিগথ) ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে আদ্রিয়ানোপলে রোমান সেনাবাহিনীর প্রথম উল্লেখযোগ্য পরাজয় ঘটে। অপর এক ভিসিগথ নেতা অ্যালারিকের নেতৃত্বে রোম আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয় ৪১০ খ্রিস্টাব্দে। এর দুই দশকের মধ্যেই ভ্যান্ডালগণ উত্তর আফ্রিকার রোমান প্রদেশগুলি দখল করে নেয়, পরিণামে সেখান থেকে রোমান সাম্রাজ্যে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ভিন্নতর পথে পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে অ্যাঙ্গেল, স্যাক্সন ও জুটগণ ব্রিটেন অধিকার করে (অবশ্য এই ঘটনার বহু আগেই সেখানে রোমান শাসনের অবসান হয়ে গিয়েছিল), আর ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে বর্বর দলনায়ক অডোভেকার শেষ রোমান সম্রাট কে সিংহাসন থেকে অপসারিত করে রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটান। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ হবার আগেই অস্ত্রগথগণ ইতালিতে; ফ্রাঙ্ক, বার্গান্ডিয়ান ও ভিসিগথগণ গলদেশে; ভিসিগথদের একটি শাখা আইবেরীয় উপদ্বীপে; ভ্যান্ডালগণ উত্তর আফ্রিকায় এবং অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন ও জুটগণ ব্রিটেনে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে নেয়।
সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
ধর্মীয় পার্থক্য ও ধর্মান্তরকরণ
অগণিত নবাগত এই বর্বরদের সঙ্গে খৃষ্টানদের ধর্মীয় পার্থক্য, রীতিনীতি শুধু উল্লেখযোগ্য ছিল না তা উভয়ের মিলনের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে ভ্যান্ডালগণ প্রথমে চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিল, গথগণও ‘আরিয়ান’ মতবাদ ছাড়তে চায়নি। কিন্তু কালে এই ধর্মের ক্ষেত্রেই খ্রিস্টান ও প্যাগানদের মিলন সম্পূর্ণ হতে দেখা যায়।
অগণিত পেগানদের সম্মুখীন হয়ে কোথাও কোথাও তাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে খ্রিস্টান চার্চ তাদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা সমীচীন মনে করেনি। চার্চ বিধর্মী বর্বরদের খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে তাদের মানসিক প্রবণতা দিকে সযত্ন দৃষ্টি দেখে। তাছাড়া তাদের নেতাদের (যেমন ক্লোভিস) প্রথমেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে সক্ষম হওয়ায় অন্যান্যদের বশে আনা সহজতর হয়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে খ্রিষ্টধর্মের অতুলনীয় মহিমা স্থাপনের জন্য তার অলৌকিকত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন সেন্ট বোনিফেসের মতো ধর্মীয় আচার্যগণ। এ বিষয়ে পোপ গ্রেগরি দ্য গ্রেটের মধ্যে অসামান্য বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। সদ্য দীক্ষিতদের খ্রিস্টান চার্চ এর প্রতি অনুগত রাখার জন্য তাদের বহু প্রাচীন ও জনপ্রিয় আচার-অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার অনুমতি দেন আচার্য গ্রেগরি। তাছাড়া প্রাথমিক পর্বে বর্বরদের মধ্য থেকে কিছু শিক্ষিত ও সচেতন মানুষকে দীক্ষা দিয়ে তাদের মধ্য থেকেই পুরোহিত মনোনয়নের ব্যবস্থা চালু হয়। এরাই পরবর্তীকালে বিশপের পদ গ্রহণ করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখেন। পঞ্চম শতকের একজন ফ্রাঙ্ক আরবোঘাস্ট (Arboghast) শার্ত্রের বিশপ পদে নিযুক্ত হন এবং অ্যাংলো-স্যাক্সনদের মধ্য থেকে বহু প্রচারক জার্মানিতে বিধর্মীদের ধর্মান্তরিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আধ্যাত্মিক জীবনের রোমান ও জার্মানদের পরস্পরের কাছে আসার পথ এভাবেই রচিত হয়েছিল আর নবদীক্ষিত বহু বর্বর শাসককে প্রবল উৎসাহে বিজিত জাতিগুলোকে খ্রিস্টান চার্চের শরণাগত হতে বাধ্য করতেও দেখা গিয়েছিল।
সাংস্কৃতিক মিলন
তাছাড়া বর্বর সমরনায়কদের সঙ্গে রোমান সৈন্যাধক্ষের পারস্পরিক পরিচয় ও বিভিন্ন রণাঙ্গনে একই পক্ষে যুদ্ধ বিগ্রহ পরিচালনার কাজে রত হওয়ার ফলে এক নিবিড় নৈকট্যবোধের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীকালে বর্বর সেনানায়কদের পক্ষে এক সামরিক অভিজাত সম্প্রদায় গঠনও সম্ভবপর হয়। বিভিন্ন দেশের রাজসভাগুলিতেও এদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করতে দেখা গিয়েছিল। এরা রোমান পদ্ধতি পরিহার করে জার্মান প্রথা অনুযায়ী ব্যক্তিগত নাম (বংশগত বা গোষ্ঠীগত নয়) ব্যবহার শুরু করে। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রায় সমস্ত গলদেশে এই প্রথা চালু হয়ে যায়। আর মিশ্র বিবাহের ফলে একই পরিবারে লাতিন ও জার্মান নামের অস্তিত্বও লক্ষ্য করা যায়।
দাসপ্রথার বিলুপ্তি
বর্বর আক্রমণের প্রারম্ভিক অভিঘাত ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রোমান ও বর্বরদের সামাজিক বিন্যাস এর মধ্যে মৌলিক কতগুলি সাদৃশ্য ছিল। উভয়ের সমাজেই উপরের স্তরে বিশেষ সুবিধাভোগী এবং প্রভাবশালী ভূস্বামীদের এবং নিচের স্তরে দাস শ্রেণীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। রোমান সমাজে নিপীড়িত দাস শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ ছিল এবং মাঝে মাঝে তা বিদ্রোহের রূপও নিত। কিন্তু বর্বরদের কখনো বিদ্রোহী দাসেদের ত্রাতার ভূমিকায় দেখা যায়নি। অবশ্য খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে সাধারণভাবে দাসপ্রথা খেতে আরম্ভ করে, কেননা কোন খৃষ্টান কে দাসে পরিণত করা ছিল নিষিদ্ধ। ওই কারণেই হয়তো দশম শতাব্দীর মধ্যেই পশ্চিম ইউরোপে দাসপ্রথা পায় অবলুপ্ত হয়ে যায়।
গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তন ও সামন্ততন্ত্রের বিকাশ
আগন্তুক বর্বর অধিকৃত এলাকায় গ্রামীণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও প্রায় অপরিবর্তিত থেকে যায়। ছোট ছোট ক্ষেত-খামারের মালিকানার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি তবে বিশালাকারের ভূসম্পত্তির হাতবদল হয়েছিল কোথাও কোথাও। আর এই জাতীয় ভুসম্পত্তিগুলি ছিল দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্তা। এই ধরনের কৃষিক্ষেত গুলি আকারে ১০০ থেকে কয়েক হাজার একর ছিল, এগুলোকে ছোট ছোট ক্ষেতখামারে বিভক্ত করে শর্তসাপেক্ষে কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো এবং কৃতজ্ঞতা বংশানুক্রমিক ভাবে ভোগ করার অধিকার লাভ করতেন। এছাড়া ছিল ভূস্বামীর ভরণপোষণের জন্য নিজস্ব জমি, খাস জমি, অনাবাদি জমি ও অরণ্য। জমির মালিককে রাজস্ব দান ছাড়াও দায়বদ্ধ কৃষকদের ভূস্বামীদের জমিতে বেগারখাটা ছিল বাধ্যতামূলক, খামারের জন্য যন্ত্রপাতি এবং ঘরে বোনা কাপড়ও তাদেরকে সরবরাহ করতে হতো। ভূ-সম্পত্তিগুলি একারণেই স্বনির্ভর হতে পেরেছিল এবং এইসব সম্পত্তির বেশকিছু অংশ পরাক্রান্ত বর্বর সমর নায়কদের অধীনে এসে গিয়েছিলো। এইভাবে কালক্রমে তারাও অনায়াসে প্রাচীন অভিজাত শ্রেণীভূক্ত হয়ে যায়।
আইনগত পরিবর্তন
রোমান রাষ্ট্রের সবচেয়ে স্থায়ী ও মূল্যবান সৃষ্টি নিঃসন্দেহে তার সুবদ্ধ ও বিশদ আইনাবলি। আর সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত রীতিনীতিগুলিকেই বিভিন্ন বর্বর গোষ্ঠীগুলির আইনের মর্যাদা দিতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপনের পর সেই সব স্থানে প্রচলিত ও সমন্বিত রোমান আইনগুলিকে তারা সাগ্রহে গ্রহণ করেছিল। ভিসিগথ শাসক আলরিক এবং বার্গান্ডির রাজা গান্ডোবাডের মত কোন কোন জার্মান শাসক রোমান আইনের সময়ানুগ পরিমার্জনা ও সম্প্রসারণ করে সুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। একই সঙ্গে কোথাও কোথাও বর্বরদের রীতিনীতি, লোকাচারগুলিকে সুশৃঙ্খল সুবিন্যাস্ত করে আইনের রূপ দেয়ার চেষ্টাও চলছিল। বলা বাহুল্য, এই কাজে ব্রতীগণ রোমান আইনের প্রভাব অগ্রাহ্য করতে পারেননি, ফলে কিছুকালের মধ্যেই বিশেষ করে দক্ষিণ ফ্রান্স ও ইতালিতে প্রাচীন জার্মান রীতিনীতিগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত আইন-কানুনের মধ্যে বর্বরদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর রীতিনীতির ছাপ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।
নগরসমূহের পরিবর্তন ও বাণিজ্যের সংকট
গ্রাম্য জীবন যাপনে অভ্যস্ত বর্বর জাতিগুলির আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্যের প্রাচীন নগরগুলির ক্রমাবনতি ছিল একটি অনিবার্য পরিণাম। শাশ্বত নগরী রোম এবং কনস্টান্টিনোপলও অস্ট্রোগথদের দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাছাড়া অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকোচন ও আঞ্চলিক শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের ফলে সুখ্যাত জনপদ, বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির গুরুত্ব অতি দ্রুত হ্রাস পেয়ে যায়। কালজীর্ব জনপদগুলির সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত নগরগুলির সংখ্যা যুক্ত হওয়ায় পশ্চিম ইউরোপে উল্লেখযোগ্য নগরের সংখ্যা অত্যন্ত কমে যায়। পশ্চিম ইউরোপের ভূচিত্রের এই উল্লেখযোগ্য রূপান্তর স্থায়ী হয় প্রায় একাদশ শতক পর্যন্ত।
ভাষা
অবশ্য এই বিঘ্ন সৃষ্টি করলেও পশ্চিম ইউরোপের জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বর্বর আক্রমণের সৃজনধর্মী প্রভাব খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। রোমান জার্মান সমন্বয়ের একটি স্পষ্ট প্রকাশ দেখা যায় মধ্যযুগে লাতিনের রূপান্তরের মধ্যে। পঞ্চম শতকের মধ্যেই বহিরাগত ভিন্নভাষীদের প্রভাবে লাতিনের শব্দভাণ্ডারে, উচ্চারণে, বাক্যবিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। কথ্য এবং সাহিত্য ও সরকারি কাজে ব্যবহৃত ল্যাতিনের মধ্যে মিল ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হওয়ায় সাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য অতি সতর্কতার লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অবশ্য সংখ্যাতীত বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশে কথ্য ল্যাতিনের চারিত্রিক পরিবর্তন সত্ত্বেও তা বর্বরদের ব্যবহৃত ভাষাগুলির তুলনায় নমনীয় ও সমৃদ্ধতর ছিল এবং ভাষা সম্পর্কে বর্বরদের কোনো উগ্র অহমিকা না থাকায় কথ্য ল্যাতিন শিক্ষায় তাদের আগ্রহের কোনো অভাব দেখা যায়নি। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিভিন্ন প্রভাবের স্পর্শে কথ্য ল্যাতিনও ক্রমশ জনপ্রিয় ও ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে। ফলে লাতিনের আদি ও অকৃত্রিম রূপটি মুষ্টিমেয় শিক্ষিত যাজকের মধ্যেই তার শীর্ণ অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল; ক্যারোলিঞ্জীয় রেনেসাঁসের আগে তার প্রসার ঘটেনি।
উপসংহার
এইভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে, পশ্চিম ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বর্বরদের সঙ্গে প্রাক্তন রোমান সাম্রাজ্যের প্রজাপুঞ্জের মিলন ও সমন্বয় ঘটতে থাকে কয়েক শতক ধরে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নবাগতদের অধিগত হওয়ায় তাদের রীতিনীতি, গোষ্ঠী বা সাম্প্রদায়িক বিধানের বহু অংশ বিজিতদের গ্রহণ করা ছাড়া উপায় ছিল না, আর বিজয়ীদের পক্ষেও সম্ভব ছিল না রোমান সভ্যতা সংস্কৃতির দূরবিস্তৃত প্রভাব অস্বীকার করা। বর্বর জাতিগুলির শিল্পভাবনা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত শিল্পশৈলীর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এই সময় থেকেই আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। আবার সনাতনরূপে না হলেও খ্রিস্টধর্মই তাদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে। রোমান জার্মানির এই মিলেমিশে যাওয়ার প্রক্রিয়াতে লেনদেনের মাত্রা নির্ধারণ সহজসাধ্য নয়। আর এই সময়ে রোমান সমাজও স্থানু ছিল না, পরিবর্তনের স্রোতে সেও চঞ্চল হয়ে ওঠায় নতুনকে, অপরিচিতকে নিঃশেষে আত্মসাৎ করা তার পক্ষে সহজতর হয়।
মুসলিমদের আক্রমণ ও সেসময় জার্মান শাসকদের অবস্থা
জার্মানদের বসতি স্থাপনের বিন্যাসে পরিবর্তন
মধ্যযুগের ইউরোপের নির্মিতিকে প্রাচীন ও নবীনের অবদান এই কারণেই আলাদা করে চিহ্নিত করা দুরূহ। অবশ্য পশ্চিম ইউরোপে জার্মানদের এই বসতি স্থাপনের বিন্যাসে বহু পরিবর্তন দেখা দেয় ভাইকিং, ম্যাগিয়ার এবং আরো আগে আরবদের প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে। এদের মধ্যে মুসলমানগন শুধু যে আইবেরীয় উপদ্বীপ খ্রিস্টানদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তাই নয়, তাদের আক্রমণে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যও সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। মুসলমান সাম্রাজ্যও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে লাতিন খ্রিস্টান জগতের প্রতিবেশীরূপে মধ্যযুগের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত করতে শুরু করে।
আক্রমণের কারণ
৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মলাভ করে মক্কার অধিবাসী মোহাম্মদ মধ্যবয়সে যে ধর্ম প্রচার শুরু করেন ইসলাম ধর্মরূপে মানব ইতিহাসের উপর তার প্রভাব সুচিরস্থায়ী হয়েছে। খ্রিস্টানদের মতো একেশ্বরবাদী হলেও মুসলমানগন মোহাম্মদের মধ্যে দেবত্ব আরোপ করতে নিমরাজি, যাজক ও অযাজকদের মধ্যে কোন পার্থক্যতেও তারা বিশ্বাসী নন। তাছাড়া চার্চ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে কোন সীমারেখা তারা স্থাপন করেননি। একমাত্র মহম্মদই প্রতিটি মুসলমানের কাছে প্রফেট রূপে শ্রদ্ধার্ঘ্য পেয়ে এসেছেন এবং পরবর্তীকালে তার বংশধরগণই খলিফারূপে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা হিসেবে বিবেচিত হতেন। শুধু ধর্ম প্রচারই নয়, মোহাম্মদ ও কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে বিধর্মীমাত্রের বিরুদ্ধেই ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদে অংশ নেয়া প্রতিটি মুসলমানের পক্ষে আবশ্যিক। ধর্মের এই উন্মাদনাই নবদীক্ষিত মুসলমানদের অসামান্য বিস্তারের মূল কারণ।
মুসলিমদের বিস্তার
মোহাম্মদের দেহাবসানের (৬৩২ খ্রি.) পর থেকেই আরব দেশের সীমানা অতিক্রম করে তাদের অপ্রতিরোধ্য অভিযান শুরু হয়। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বাইজানটাইন সাম্রাজ্য গুপ্ত সিরিয়াল প্যালেস্টাইন জয় করে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে সমস্ত পারস্য সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠেন মোহাম্মদের অনুগামীগণ। পারস্য সাম্রাজ্য থেকে অভিযান করে মুসলমান সেনাবাহিনী ৭১২ খ্রিস্টাব্দে বোখারা ও সঞ্চয় করে আরো পূর্বে ভারতবর্ষে অভিমুখে অগ্রসর হয়। ইতিমধ্যে দক্ষিণ মিশর (৬৪০ খ্রি.) অধিকার করে তারাই অষ্টম শতকের গোড়ার দিকে আফ্রিকার সমস্ত উত্তর উপকূলভাগ দখল করে নেয় এবং ৭১১ থেকে ৭২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আইবেরীয় উপদ্বীপেও তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
এইভাবে তারুণ্য-তেজোদীপ্ত মুসলমান শক্তি তখন ল্যাটিন খ্রিস্টান জগতের সম্মুখীন হয় তখন তা সবে বর্বর আক্রমণজাত অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা অবসানে সুস্থির জীবনযাত্রা শুরু করেছে। দক্ষিণ গলে অবশ্য মুসলমানদের বিজয় অভিযান প্রত্যাহত হয় ফ্রাঙ্ক শাসক চার্লস মার্টেলের চেষ্টায়। পশ্চিম ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বাংশ অধিকার করে মুসলমানদের সন্তুষ্ট থাকতে হলেও তাদের নৌশক্তির অপ্রতিহত প্রতাপে সমস্ত ভূমধ্যসাগর একটি “মুসলমান হ্রদে” পরিণত হয়। কনস্টান্টিনোপল অধিকারে তারা দুবার (৬৭৩ এবং ৭১৭ খ্রি.) ব্যর্থ হলেও সিসিলিকে বাইজানটাইন শাসনমুক্ত করতে তাদের বেগ পেতে হয়নি। সিসিলি থেকে ইতালির অভ্যন্তরে, এমনকি রোমেও তাদের হানা দিতে দেখা গিয়েছিল।
তড়িৎ গতিতে মুসলমানদের এই বিশাল ও প্রাণবন্ত সাম্রাজ্য স্থাপন শুধু বিস্ময়কর ছিলনা, সমকালীন সভ্যতাগুলির উপর তার প্রভাব ছিল গভীর ও দূরবিস্তৃত। তাছাড়া এই তথ্যও স্মর্তব্য যে, এই অতুলনীয় সামরিক বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল সমসাময়িককালে দুই প্রধান শক্তিশালী সাম্রাজ্য- বাইজান্টাইন ও পারস্যকে পরাভূত করে। মুসলমানদের এই সুবিশাল সাম্রাজ্যে সেকালের সমৃদ্ধতম জনপ্রিয় প্রায় সবই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
প্রায় সমসাময়িককালে জার্মান জাতিগুলোর দ্বারা রোমান সাম্রাজ্যের উপর আধিপত্য স্থাপন এবং মুসলমান শক্তির অভাবনীয় বিস্তৃতির তুলনামূলক আলোচনায় এই তথ্য স্পষ্ট হয়ে যায় যে ‘বর্বরগণ’ পশ্চিম ইউরোপ আক্রমণ করার আগে থেকেই রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং সামরিক সাফল্যের পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম ও ল্যাটিন ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে তাদের পৃথক সত্তা বিসর্জন দিয়েছিল। মুসলমানগন কিন্তু খ্রিস্টান জগতের যে সমস্ত অঞ্চল অধিকার করেছিল সেখানে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি (গ্রিক সভ্যতার দানে সমৃদ্ধ) অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ওইসব দেশে ঐস্লামিক সভ্যতার দীপ্তি ও অনন্যতা অম্লান ছিল বহু শতাব্দী ধরে এবং মুসলমান শাসনের প্রবল প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভবপর হয়নি লাতিন ইউরোপের পক্ষে।
জার্মান রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা
লাতিন ইউরোপের উপর মুসলমান সভ্যতার প্রচণ্ড প্রভাব আলোচনা ও বিশ্লেষণ এর আগে অষ্টম শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে কিছু পূর্ব জ্ঞান দরকার। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর যে সমস্ত রোমানো-জার্মান রাষ্ট্র গঠিত হয় সেগুলি প্রায় সবই ছিল ক্ষীণায়ু। উত্তর আফ্রিকার ভ্যান্ডাল শক্তি, ইতালিতে অস্ট্রোগথদের রাজ্য, স্পেনে ভিসিগথদের কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আল্পস এর উত্তরে আড্রিয়াটিক ও দানিয়ুবের মধ্যবর্তী অঞ্চলে আলিমান (Aleman) ও ব্যাভেরিয়ানদের শক্তি অবশ্য দৃঢ়তর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইলিরিয়া চলে যায় স্লাভদের হাতে, প্যানোনিয়া আভারদের। দুর্ধর্ষ লোম্বার্ডগণ উত্তর ইতালিতে আপনাদের সুপ্রতিষ্ঠিত করলেও মধ্যযুগের ইতিহাসে তারা ফ্রাঙ্কদের মত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হয়নি।
৫২৬ খ্রিস্টাব্দে থিওডোরিকের মৃত্যুর পর রোম বা রাভেন্যা, মিলান বা পেভিয়া, তুলুস বা আর্লেস পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের কেন্দ্ররূপে বিবেচিত হত না; সেই স্থান অধিকার করে নিয়েছিল সেইন (Seine) ও মিউস (Meuse) নদীর উপত্যকা। উত্তর থেকে এসে এই অঞ্চলেই ফ্রাঙ্করা আপনাদের প্রতিষ্ঠিত করে। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত, বিধর্মী ফ্রাঙ্কদের সম্প্রসারণের মধ্যে নাটকীয়তা ছিল না, রাইনল্যান্ড থেকে তারা ধীর ও নিশ্চিত পদক্ষেপে গলদেশে আপনাদের প্রভুত্ব স্থাপনে সক্ষম হয়। পরবর্তীকালে ল্যয়র ও রাইন নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সঙ্গে যুক্ত হয়ে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রায় সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। নবম শতকের শেষে ফ্রাঙ্ক শাসনের অবসান হলেও এখানে তারা শক্তির যে ভিত্তি রচনা করেছিল তা রোমান সাম্রাজ্য এবং কাপেতীয় (Capetian) রাজতন্ত্রের আত্মবিকাশের পক্ষে পরম সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়। মধ্যযুগের ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এই অঞ্চল বিবেচিত হতো এবং এখানেই মেরোভিঞ্জীয় শাসকগণ ৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করে, তারপর শুরু হয় ক্যারোলিঞ্জীয়দের অধ্যায়।
রোমান সংস্কৃতির প্রবাহমানতা বিষয়ে হেনরী পিরেন
হেনরী পিরেন
সাধারণভাবে খ্রিস্টান জগৎ ও ঐস্লামিক সাম্রাজ্যের সম্পর্ক, বিশেষ করে ক্যারোলিঞ্জীয় ফ্রাঙ্ক রাজ্যের বিকাশের উপর আরবদের সম্প্রসারণের প্রগাঢ় প্রভাবের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সুবিখ্যাত বেলজিয়ান ঐতিহাসিক হেনরী পিরেনের (আঁরি পিরেন) মতামত প্রণিধানযোগ্য। ‘Medieval Cities’ নামক গ্রন্থে পিরেনের মতবাদ প্রথম পরিবেশিত হয়। তারপর ১৯৩৯ সালে ‘Muhammad and Charlemagne’ নামক রচনাটিতে তার সিদ্ধান্ত, তথ্য ও পরিসংখ্যান দ্বারা সমৃদ্ধতর হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ইউরোপীয় পণ্ডিত সমাজকে বিস্মিত ও উচ্চকিত করেছিল।
ইউরোপে ভূমধ্যসাগরীয় নির্ভরশীলতা
হেনরী পিরেন এ বিষয়ে নিঃসংশয় যে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ঐক্য, অর্থনৈতিক বিকাশ, শাসনব্যবস্থা – এমনকি তার অস্তিত্বও নির্ভর করত ভূমধ্যসাগরের উপর। সঙ্গে সঙ্গে তার সমুদ্র নির্ভরতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কনস্টান্টিনোপলে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের ফলে রোমের গুরুত্ব সর্ববিষয়ে হ্রাস পেলেও তার বাণিজ্য এবং সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের সম্পর্কের নিবিড়তাও শ্লথ হয়না। এমনকি উত্তর ইউরোপ থেকে নেমে আসা বর্বরদের অবিশ্রান্ত ধারায় আক্রমণের ফলে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের আয়তন সংকুচিত হলেও তার রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়নি এবং আক্রমণের প্রচন্ড অভিঘাত সত্বেও রোমান সভ্যতা-সংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষত থাকে, শুধু বৃদ্ধি পায় ভূমধ্য সাগরের উপর নির্ভরতা। কনস্টান্টিনোপল, এডেসা, অ্যান্টিওক থেকে মূল্যবান বস্ত্রসম্ভার, সিরিয়া থেকে নানা প্রকার মসলা, তেল, সুরা, মিশর থেকে প্যাপিরাস, স্পেন ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গম ইত্যাদি খাদ্যশস্য আমদানিও অব্যাহত থাকে।
৪র্থ শতকে রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত অতিক্রম করে গথ, ভ্যান্ডাল, সুয়েভি, ফ্রাঙ্ক প্রভৃতি উপজাতিগুলির রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ ও বসতি স্থাপনের পেছনে লুণ্ঠনই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। এই সমৃদ্ধ, উষ্ণ ও উর্বর অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস, রোমান শাসনের সংখ্যাতীত সুফলগুলি ভোগ করাও ছিল তাদের অভিপ্রায়। ৫ম শতকের মধ্যে রোমান সাম্রাজ্যের যে সকল স্থান তারা দখল করে সেগুলি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদের মধ্যে সর্বশেষ আগত ফ্রাঙ্করাই ছিল ব্যতিক্রম। কিন্তু মেরোভিঞ্জীয় ফ্রাঙ্কগণও যে ভূমধ্যসাগরীয় ভূমধ্যসাগরের উপকূল স্পর্শ করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তা ক্লভিস এর প্রভেন্স জয়ের স্বপ্ন দেখার দ্বারা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া সম্রাট জাস্টিনিয়ান কর্তৃক ইতালিতে অস্ট্রোগথদের শক্তি বিনষ্ট হলে ক্লভিস তার সুযোগ গ্রহণ করতেও দ্বিধা করেননি।
রোমান সংস্কৃতির প্রবহমানতা
এইভাবে দেখা যায় রোমান সাম্রাজ্য খন্ড বিখন্ড হয়ে বর্বর জাতি গঠিত হলেও ভুমধ্যসাগরের অপরিহার্যতা কারো কাছে অজ্ঞাত ছিল না। উপরন্তু রোমান সাম্রাজ্যের ধর্ম, ভাষা, আইন ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিজয়ী জার্মানদের দ্বারা গৃহীত হয়ে রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। রোমান প্রজাপুজের জীবনে ‘বর্বর’দের রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠানের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু তাদের সামরিক জয়ের ফলে জার্মান সংস্কৃতির রোমান সভ্যতাসংস্কৃতির স্থলাভিষিক্ত হবার মত কোন ঘটনা ৫ম শতকে ঘটেনি। ৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট রোমুলাসের সিংহাসনচ্যুতি ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি সত্বেও পশ্চিম ইউরোপের জীবনযাত্রা পরিচিত ও পূর্ব অনুসৃত পথেই চলতে থাকে। হেনরী পিরেন রোমুলাস অগাস্টুলাস এর সিংহাসন চ্যুতির কাল থেকে ফ্রাঙ্ক শাসক শার্লমানের আবির্ভাব পর্যন্ত এই ভূমধ্যসাগর-কেন্দ্রিক ইতিহাসের মধ্যে কোন ছেদ দেখতে পাননি।
৬ষ্ঠ শতকে বাইজানটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান (৫২৭-৬৫ খ্রি.) কর্তৃক উত্তর আফ্রিকার উপকূলভাগ, ইতালী ও স্পেন পুনরুদ্ধারের ফলে ভূমধ্যসাগর আবার ‘রোমান হ্রদে’ পরিণত হয় কিছুকালের জন্য। উত্তর ইতালী লোম্বার্ডদের দ্বারা অধিকৃত হলেও (৫৬৮ খ্রি.) এবং স্পেনে ভিসিগথরা বাইজানসিয়ামের অধীনতা পাশ ছিন্ন করতে সক্ষম হলেও দক্ষিণ ইতালী, সিসিলি এবং উত্তর আফ্রিকার উপকূলভাগের আধিপত্য দীর্ঘদিন অক্ষুণ্ণ থাকে, আর ভূমধ্যসাগর কে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়দের জীবনযাত্রার প্রবাহ অবিঘ্নিত থাকার সৌভাগ্য হয়।
রাষ্ট্রীয় জীবনের এই ধারাবাহিকতা অটুট থাকা ছাড়াও পিরেন এই অধ্যায় রোমান সংস্কৃতির নিরবিচ্ছিন্ন প্রবহমানতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বোয়েথিয়াস (৪৮০-৫২৫), ক্যাসিওডোরাস (৪৭৭-৫৬২), সেন্ট বেনিডিক্ট (৪৮০-৫৩৪), গ্রেগরী দ্য গ্রেট (৫৯০-৬০৪) এবং সেভিলের ইসিডোরাস (৫৭০-৬৩৬) এর ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চার উজ্জ্বল অধ্যায় বর্বর আক্রমণপ্রসূত অনিশ্চয়তার মধ্যেও সম্ভব হয়েছিল। চার্চের প্রেরণায় জীবনে নতুন মাত্রা সংযোগের সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুপদী সংস্কৃতির অনুশীলন এই সময়েওব্যাহত দেখা যায়। বলা বাহুল্য এই শুভ প্রচেষ্টার প্রাণ-কেন্দ্র ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। ইতালী থেকেই সেন্ট অগাস্টাইন ব্রিটেনের অ্যাংলো-স্যাক্সনদের কাছে খ্রিস্টের বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন, মার্সেই থেকে ধর্ম-প্রচারকগণ আয়ারল্যান্ডে উপনীত হন এবং বেলজিয়ামের ধর্মজীবন যাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছিল সেই দুজন – সেইন্ট আমান্দ (St Amand) ও সেইন্ট রেমাদ (St Remade) ছিল অ্যাকুঁতার (Acquitaine) অধিবাসী।
বর্বর আক্রমণের ব্যাপকতা ও প্রচণ্ডতা নিশ্চিতভাবেই পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক জগতের শ্রী ও সমৃদ্ধি হ্রাস করেছিল। কিন্তু হেনরী পিরেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিমরাজি যে জার্মান আক্রমণের আর্থই হল কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রতিষ্ঠা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অপমৃত্যু। নাগরিক জীবনের প্রতি বর্বরদের বিরাগের তত্ত্ব পিরেনের মতে অলীক উপকথা, রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী কোনও কোনও নগরের প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন নিশ্চই হয়েছিল কিন্তু এ দুর্বিপাক সত্ত্বেও বেশিরভাগ নগরের সজীব অস্তিত্ব বজায় ছিল। ফ্রান্স, ইতালি এমনকি রাইন ও দানিউব নদী তীরবর্তী পরবর্তীকালের বহু প্রসিদ্ধ নগর যে এই যুগের নগরগুলির ভিত্তির উপরই পুনঃপ্রতিশঠিত হয়েছিল তা সন্দেহাতীত। বর্বর আক্রমণের ফলে এইসহ জনপদের পৌর চরিত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এমনকি গল ও স্পেনের স্বায়ত্বশাসন পরিচালনার জন্য ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের অস্তিত্ব পরবর্তীকালে অক্ষুণ্ণ ছিল। প্রতিটি নগরেই গড়ে উঠেছিল সন্নিহিত গ্রাম্য অঞ্চলে উৎপন্ন সর্বপ্রকার পণ্যাদির জন্য বাজার, সম্ভ্রান্ত ভূস্বামীদের শীতকালীন আবাস ও ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী নগরগুলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র। তুর এর গ্রেগরীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে তার কালের গলদেশের পারী, মার্সেই, অর্লিয়, ভার্দুন, ক্লেরমঁ, বোর্দো প্রভৃতি নগরগুলি ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য প্রখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
পিরেন অবশ্য স্বীকার করেন রোমান আমলের মত মেরোভিঞ্জীয় গলও ছিল প্রধানত কৃষিনির্ভর। কিন্তু এই কারণেই সে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির কথা মেনে নিতে তিনি অনিচ্ছুক। এই সময়েই বাজারের তোলা, বন্দর, রাজপথ, সেতু ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য শুল্ক প্রবর্তনের কথা সুবিদিত। সুতরাং পঞ্চল থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের, বিশেষ করে বর্বর অধ্যুষিত পশ্চিম ইউরোপ ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেন অব্যাহত ছিল। স্পেন ও গলের (মার্সেই বন্দর, তুরের গ্রেগরীর (Gregory of Tours) বিবরণ অনুযায়ী, ছিল এ বিষয়ে অগ্রগণ্য) বন্দরগুলি থেকে সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন স্থানের পণ্যসম্ভার আমদানী-রপ্তানীর উপর জার্মান আক্রমণের প্রভাব ছিল নিতান্তই সাময়িক।
মেরোভিঞ্জীয়দের মুদ্রা ব্যবস্থাও একারণে রোমান বা রোমান-বাইজান্টাইন প্রথানুগ ছিল। সলিডাস, ট্রিয়েন (Trien) এবং দিনারিয়াস প্রভৃতি স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রায় সম্রাটের প্রতিকৃতি ও ভিক্টোরিয়া অগস্টি এই কথাগুলো সংকীর্ণ থাকতো। বাইজানসিয়ামের মুদ্রায় বিজয় বা ভিক্ট্রীর প্রতীকের পরিবর্তে ক্রুশ ব্যবহার শুরু হলে ফ্রাঙ্কমুদ্রাতেও তা অনুসৃত হয়। গলের মূল্যব্যবস্থার সঙ্গে বাইজান্টাইন মুদ্রার আকৃতি ও মানগত এই সাদৃশ্য উভয় দেশের মধ্যে সুনিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুনিশ্চিত প্রমাণ।
মুসলিম আক্রমণ মধ্যযুগ আনে – হেনরী পিরেন ও সমালোচনা
ইসলামী আক্রমণ ও ভূমধ্যসাগরীয় অর্থনীতির ধ্বংসপ্রাপ্তি
কিন্তু হেনরী পিরেন ঘোষণা করেছেন ৪র্থ/৫ম শতকের ‘বিধর্মী বর্বর’ আক্রমণে পশ্চিম ইউরোপের ভূমধ্যসাগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়নি, সপ্তম শতকে ইসলামী শক্তির অসামান্য বিস্তারে তা বিপর্যস্ত হয়ে যায়। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে চীনসাগর থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত ভূভাগে মুসলমান সাম্রাজ্য স্থাপিত হয় অপ্রতিহত গতিতে। সপ্তম শতকের প্রথমার্ধের মধ্যেই পারস্য সাম্রাজ্য আরব সেনাবাহিনীর হস্তগত হয়, সিরিয়া (৬৩৪-৩৫), মিশর (৬৪১-৪২) এবং উত্তর আফ্রিকা (৬৯৮) বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যচ্যুত হয় এবং স্পেনে আরবগণ উপনীত হন ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। ৭১৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল এর নগর প্রাকারের সামনে এবং পশ্চিমে ফ্রাঙ্ক শাসক চার্লস মার্টেলের সেনাবাহিনীর কাছে (তুর (Tours) ৭৩২ খ্রি.) প্রতিহত হবার আগে আরবদের বিজয় অভিযান স্তব্ধ হয়নি।
ইসলামের আত্মপ্রসারণের শক্তি নির্বাপিত হলেও ইতিমধ্যেই এই অভূতপূর্ব সামরিক সাফল্য মানবেতিহাসের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দিয়েছিল। ইউরোপের ইতিহাসে ধ্রুপদী অধ্যায়ও শেষ হয়ে গিয়েছিল এই আক্রমণের আঘাতে। উত্তরাগত বর্বরদের আক্রমণে যে ভূমধ্যসাগর-কেন্দ্রিক সভ্যতার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি, মুসলমানদের এই অকস্মাৎ ও অভূতপূর্ব সাফল্যে তার অবসান অনিবার্য হয়ে উথল। মুসলমান অধিকৃত স্থানগুলোতে খ্রিস্টের পরিবর্তে মহম্মদের ধর্ম প্রবর্তিত হল, রোমান আইনের স্থালাভিষিক্ত হল মুসলমান আইনকানুন, গ্রিক ও লাতিনের স্থান অধিকার করল আরবী। সুদীর্ঘকাল রোমান প্রভাবাধীন থাকার পর ভূমধ্যসাগর ‘মুসলমান হ্রদে’ পরিণত হল এবং ভূখণ্ডবেষ্টিত এই সাগরকে কেন্দ্র করে ইউরোপের দুই প্রান্তের যে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল তার সমাপ্তি ঘটতেও দেরি হয়নি।
এতদিন ফিনিশীয়, গ্রিক ও রোমানদের সহায়তায় পশ্চিম ইউরোপের মানুষ প্রাচ্যের সঙ্গে যে সম্পর্ক (প্রধানত বাণিজ্যিক) বজায় রেখেছিল তা সম্ভব করেছিল ভূমধ্যসাগর। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের উপকূলভাগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরবদের হস্তগত হওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিম-ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দু ভূমধ্যসাগর থেকে সরে গিয়ে স্থিত হল উত্তর-ইউরোপে, রোমের স্থান নিল আখেন এবং যে ফ্রাঙ্করা এতদিন লাতিন ইউরোপের জীবনযাত্রায় অতি অনুজ্জ্বল একটি ভূমিকা পালন করছিল তারা ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে আসার সুযোগ লাভ করল।
ইসলামের বিজয় এভাবেই ক্যারোলিঞ্জীয় ফ্রাঙ্কদের পশ্চিম ইউরোপের ভাগ্যবিধাতা হতে সাহায্য করেছিল এবং এই মহাদেশের অর্ধাংশে বহু শতাব্দীর পুরোনো যে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এতদিন রোমান-অরোমানদের সমভাবে ধারণ করেছিল তাকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়ে পশ্চিম-ইউরোপের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে দিয়েছিল। হেনরী পিরেনের ঘোষণা -এভাবেই ঘটেছিল ধ্রুপদী যুগের অবসান ও মধ্যযুগের আরম্ভ।
ক্যারোলিঞ্জীয় শাসকদের দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে মনোযোগ স্থাপন
মেরোভিঞ্জীয় আমলে পিরেন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ভূমধ্যসাগর তার পূর্বপরিচিত ভূমিকাতেই সক্রীয় ছিল। প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও সমাজজীবনে তার বিপুল প্রভাব কিছুই হ্রাস পায়নি। কিন্তু অষ্টম শতক থেকে সে ভূমিকার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটায় ক্যারোলিঞ্জীয় শাসনাধীন ইউরোপের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন ভিন্ন পথ গ্রহণ করে। ফ্রাঙ্ক নৃপতি শার্লমান কর্তৃক রোমান সম্রাট ও অগস্টাস অভিধা গ্রহণের ঘটনা থেকে (৮০০ খ্রি.) মনে হতে পারে যে তিনি রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যবিরোধী কাজ করেছিলেন। তার সাম্রাজ্য একটি রোমান প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হতে পারে শুধু এই কারণে যে তার সকল কর্মের মূল্ প্রেরণা চার্চও ছিল রোমান। অবশ্য এই চার্চের সেবায় তিনি যে শক্তি নিয়োগ করেছিলেন তার উৎস্য ছিল প্রধানত ইউরোপের উত্তরাঞ্চল। ইতালী, স্পেন বা অ্যাকুতাঁর মানুষকে নিয়ে শার্লমানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উপদেষ্টামণ্ডলী গঠিত হয়নি, তাতে স্থান পেয়েছিলেন অ্যাংলো-স্যাক্সনগণ (সেইন্ট বোনিফেস, আলকুইন) ও এইনহার্ডের মত সোয়াবিয়ার মানুষ। ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সম্পর্ক-রহিত ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের পরিচালনায় দক্ষিণ ইউরোপের মানুষের প্রায় কোনও ভূমিকাই ছিল না। আর এর সম্প্রসারণও ঘটেছিল পুর্বদিকে এলব ও বোহেমিয়ার পার্বত্য অঞ্চল অভিমুখে। ইতালীতে লোম্বার্ডরাজ্য জয় বা স্পেনে অভিযানের পেছনে শার্লমানের ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে কোন যোগাযোগ স্থাপনের অভিপ্রায় পিরেন বিশ্বাস করতে রাজি নন। তার মতে ফ্রাঙ্ক সম্রাট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হয়ে ও পোপের সুহৃদ হিসেবে ইতালীর দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন, আর স্পেনে মুসলমান শক্তির বিরুদ্ধাচরণই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। শার্লমানের চিন্তায়, লক্ষ্যে বা সাম্রাজ্যিক পরিকল্পনায় ভূমধ্যসাগরের কোনও স্থানই ছিলনা।
ক্যারোলিঞ্জীয় আমলে কৃষি-নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি
অর্থনীতির ক্ষেত্রে ফ্রাঙ্কদের এই দুই শাসকগোষ্ঠী- মেরোভিঞ্জীয় ও ক্যারোলিঞ্জীয়দের মৌলিক পার্থক্যের কথা হেনরী পিরেন অত্যন্ত স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। মেরোভিঞ্জীয় আমলেও গল ছিল সমুদ্রনির্ভর দেশ এবং এই কারণেই ব্যবসাবাণিজ্য গলের অর্থনৈতিক জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছিল। শার্লমানের সাম্রাজ্য প্রধানত একটি সমুদ্র-সংস্পর্শরহিত ভূখণ্ডকে আশ্রয় করে উঠতে বাধ্য হওয়ায় বহির্জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কৃষিই হয়ে উঠেছিল তার একমাত্র অবলম্বন। পিরেন অবশ্য স্বীকার করেছেন গলের এই চারিত্রিক পরিবর্তনের বা সংক্রমণের কাল নির্দেশ দুরূহ। এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র মার্সেই এর গৌরবের দিন অকস্মাৎ অবসিত হয়নি।
ক্যারোলিঞ্জীয় আমলে বাণিজ্য পরিস্থিতির অবনতি, প্যাপিরাস-মশলা পণ্যাদির আমদানি রদ
তবে সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভূমধ্যসাগরে মুসলমান শক্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তার বাণিজ্যিক তৎপরতাও কমতে থাকে। সিরিয়ার পর মিশর মুসলমানদের দ্বারা অধিকৃত হলে গলদেশে প্যাপিরাসের আমদানীও বন্ধ হয়ে যায়। ৬৭৭ খ্রিস্টাব্দের পর সরকারী দপ্তরে প্যাপিরাসের ব্যবহারেরও অবসান হয়। প্রাচ্য থেকে মশলা আমদানী আরও কিছুকাল অব্যাহত থাকলেও অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই মার্সেই প্রায় স্তব্ধ ও পরিত্যক্ত একটি বন্দরে পরিণত হয়। সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে গলের যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হলে সমস্ত ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্য অর্থনীতির দিক দিয়ে দারুণ পিছিয়ে পড়ে।
ইতিমধ্যে বেলারিক দ্বীপপুঞ্জ, কর্সিকা, সার্ডিনিয়া এবং সিসিলি মুসলমান সাম্রাজ্যভূক্ত হয়। উত্তর আফ্রিকায় টিউনিস (৬৯৮-৭০৩), মেহদিয়া ও কায়রো (৯৭৩) বন্দর স্থাপিত হলে ভূমধ্যসাগরের উপর নির্ভরশীল সামরিক, বাণিজ্যিক – সর্বপ্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা তাদের হাতের মুঠোয় চলে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতির উপর এইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়ঙ্কর রকমের বিরূপ।
বাজার থেকে শুধু প্যাপিরাস, প্রাচ্যের মশলা ও মূল্যবান বস্ত্রসম্ভারই অন্তর্হিত হল না, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বিনিময়-মাধ্যম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনও সেখানে স্থগিত থাকে। ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যে শুধু রৌপ্যমুদ্রা চালু হয় এবং সমস্ত পশ্চিম ইউরোপ গ্রামীন অর্থনীতির বৈভবহীনতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পূর্বের বাণিজ্যিক তৎপরতার স্থান গ্রহণ করে আঞ্চলিক ভিত্তিতে অল্প কয়েকটি ভোগ্য পণ্যের লেনদেন।
ক্যারোলিঞ্জিয় নৌশক্তির অনুপযুক্ততা
সমগ্র ভূমধ্যসাগরে আরবদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিরোধে ক্যারোলিঞ্জীয় নৌশক্তির চূড়ান্ত অনুপযুক্ততার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল নবম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত স্যারাসেন ও নর্সমেন জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করায় তাদের অক্ষমতার মধ্য দিয়ে। রাইন, মিউস, শ্যেল্ট, সেইন, গরোনে ও রোন উপত্যকা এদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও উপযুক্ত নৌবাহিনী বা বন্দর না থাকায় শাসকবর্গ এই দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়ঙ্কর উপদ্রব বন্ধ করতে পারেননি। বৈদেশিক বাণিজ্য গড়ে তোলায় ক্যারোলিঞ্জীয়দের অক্ষমতার অভ্রান্ত প্রমাণ এইসব ঘটনার মধ্যেই নিহিত আছে বলে পিরেন মত প্রকাশ করেন।
নবম শতকের কোনও উল্লেখযোগ্য দলিলপত্র বা ক্যাপিটুলারিগুলিতে তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের কথা বিধৃত হয়ে নেই। একমাত্র গলের উত্তরাংশে কোয়েনটোভিক (Quentovic) এবং ড্যুয়রস্টেড (Duurstede) বন্দর ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কের সঙ্গে আমদানি রপ্তানী বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপে কর্মরত ছিল এবং এই বন্দরদ্বয়ের জন্যই ফ্রিজিয়ানরা রাইন, শ্যেল্ট ও মিউস নদীর মধ্য দিয়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে পেরেছিল। এছাড়া বিভিন্ন নদীপথে অত্যাবশ্যক পণ্যাদি (খাদ্যদ্রব্য, লবণ ও মদ) এবং নিষিদ্ধ পণ্য-ক্রীতদাস আনানেয়ার কথা জানা যায়। ক্যারোলিঞ্জীয় আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের এই শীর্ণ, সঙ্কুচিত অবস্থার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে হেনরী পিরেন লিখেছেন এইক্সে (Aix) সম্রাট শার্লমানের প্রাসাদের সন্নিকটে যে ব্যবসায়ীদের দেখা যেত বা সাঁ রেকোয়ার (St Requier) এর অ্যাবির কাছে যারা পণ্য-সামগ্রী বিক্রয় করত তাদের বণিক-শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য করা যায়না।
ক্যারোলিঞ্জীয় আমলে মুদ্রাব্যবস্থার সংকট
বাজার থেকে শুধু প্যাপিরাস, প্রাচ্যের মশলা ও মূল্যবান বস্ত্রসম্ভারই অন্তর্হিত হল না, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বিনিময়-মাধ্যম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনও সেখানে স্থগিত থাকে। ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যে শুধু রৌপ্যমুদ্রা চালু হয় এবং সমস্ত পশ্চিম ইউরোপ গ্রামীন অর্থনীতির বৈভবহীনতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পূর্বের বাণিজ্যিক তৎপরতার স্থান গ্রহণ করে আঞ্চলিক ভিত্তিতে অল্প কয়েকটি ভোগ্য পণ্যের লেনদেন।
ক্যারোলিঞ্জিয় আমলে অর্থনৈতিক অধোগতির প্রকাশ ওই সময়ের মুদ্রাব্যবস্থায় দেখা যায়। পেপিন দ্য শর্ট ও শার্লমানের মুদ্রা সংস্কারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল স্বর্ণমুদ্রর বদলে রৌপ্যমুদ্রা চালু করা। রোমান আমল থেকে প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা সলিডাস (Solidas) সরকারী স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয় এবং ২ গ্রাম রৌপ্যম্যদ্রা Deier (আধুনিক কালের মূল্যমান অনুসারে ৮.৫ সেন্ট, যেখানে মেরোভিঞ্জীয় স্বর্ণমুদ্রা সলিডাসের মূল্যমান ৩) প্রধান মুদ্রারূপে প্রচলিত হয়। পিরেনের মতে ফ্রাঙ্ক সাম্রাহ্যে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন বাতিল হয়ে যাওয়ার একটি কারণই ছিল, তা হল গল দেশে সোনার ঘাটতি। আর এই মূল্যবান ধাতুটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায় ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে প্রাচ্য দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবার ফলে।
শার্লমানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আদিম
পিরেনের মতে শার্লমানের কৃতিত্বের সবটাই সামরিক শক্তি ও চার্চের সহযোগিতার দ্বারা অর্জিত হয়েছিল। বাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধিজাত কোনও সুফলের প্রভাব ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যে দেখা যায়নি। তাই পিরেনের মতে শার্লমানের সময়কার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল আদিম। রোমান আমলের যে পোলট্যাক্স (মাথাপিচু ধার্য কর) মেরোভিঞ্জীয়গণ চালু রেখেছিলেন, ৯ম শতকে তাও বাতিল হয়। প্রকৃতপক্ষে রাজার খাস-জমিজাত আয়, পদানত জাতিগুলির কর ও যুদ্ধলব্ধ ধনরত্নাদিই ছিল শার্লমানের রাজকোষে অর্থাগমের প্রধান উৎস্য। এ সময়ে পণ্যদ্রব্যের উপর শুল্কের পরিমাণ অনুল্লেখ্য। আর্থিক সংগতির অয়াবেই ক্যারোলিঞ্জীয় শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত ভূস্বামীদের সহযোগিতায় ও বাইজান্টাইন সম্রাট বা খলিফাদের মত সুবিন্যস্ত ও নানাবিধ কর, শুল্ক ইত্যাদির দ্বারা রাজকোষ পূর্ণ করার কোনও সম্ভাবনাই এই সময়ে ছিল না। ফলে অভিজাত ভূস্বামীগণ রাজশক্তির অংশ গ্রাস করার সুযোগ পেতেন। পরবর্তীকালে এদের অত্যধিক শক্তিবৃদ্ধিই ক্যারোলিঞ্জীয়দের পতন তরান্বিত করে।
কৃষিনির্ভর সমুদ্রসম্পর্ক ছাড়া এই সাম্রাহজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার চূড়ান্ত ব্যর্থতা তার অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে রেখেছিল। যতদিন পশ্চিম ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্য সজীব ছিল ও নাগরিক জীবন ছিল সচল ততদিন খাস জমিজাত উৎপন্ন দ্রব্যের উদ্ভৃত্ত অংশের বিক্রয়ের জন্য বাজারও ছিল। কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জনপদে নাগরিক ও বণিকশ্রেণীর সংখ্যাও হ্রাস পেতে শুরু করে। ফ্রাঙ্ক রাজ্যের মত অন্যান্য বর্বর জাতি পদানত অঞ্চলেও প্রয়োজনাতিরিক্ত উৎপাদনে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট সকলেই। পন্য-বিনিময়ের পরিবর্তে কেবলমাত্র ব্যবহারের জন্য উৎপাদনই এই সময়ের অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। পিরেন এজাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থার নামকরণ করেছেন Closed domestic economy – The economy of no markets.
কিন্তু ক্যারোলিঞ্জীয় শাসকগণ স্বেচ্ছায় এ অর্থনীতি গ্রহণ করেননি, তা ছিল ভূমধ্যসাগরে মুসলমান শক্তির একাধিপত্যের অনিবার্য ফল। মেরোভিঞ্জীয় আমলেও প্রাচ্যের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু ইসলামের অপ্রতিহত বিস্তারের ফলে তা অকস্মাৎ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে শুধুমাত্র উত্তর ইউরোপের শক্তি সম্বল নিয়েই শার্লমানকে তার সাম্রাজ্য গঠন করতে হয়। এই কারণে দীনতার সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের জীবনে নেমে আসে এক অবাঞ্ছনীয় বদ্ধতা। সংস্কৃতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে মুষ্টিমেয় যাজকের মধ্যে, লাতিনের স্থান অধিকার করে আঞ্চলিক ভাষাগুলি। এর অর্থই হল সেক্যুলার রাষ্ট্রের অপমৃত্যু, যাজক সম্প্রদায়ের প্রাধান্য স্থাপন এবং সামন্ততন্ত্রের আবির্ভাব – পিরেনের মতে যা ছিল “inexorable consequence of economic regression”. এভাবে দেখা যায় মধ্যযুগের বিখ্যাত সম্রাট শার্লমানের সাম্রাজ্যিক আদর্শ, তার শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতির প্রকৃতি, সংক্ষেপে তার শাসনকালের যুগ চরিত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে ভূমধ্যসাগরে আরবদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপনের প্রতিক্রিয়া।
পিরেনের মত নিয়ে মন্তব্য
মধ্যযুগের সূচনাপর্বে পিরেনের এই বিশ্লেষণ ও তার অভিমত নিঃসন্দেহে অভিনব ও আকর্ষণীয়। এই কাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ভাবনাচিন্তা ও আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা নতুনপথে চালিত হয়েছে পিরেনের জন্যই। এই বেলজিয়ান ঐতিহাসিকই মধ্যযুগের ইতিহাসকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা শাসনতান্ত্রিক বিকাশের আলোচনার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন যুগ থেকে ইউরোপের মধ্যযুগে উত্তরণের ইতিহাস রচনা করেছেন। সমসাময়িক কালের প্রচণ্ড শক্তি – ইসলামের অভূতপূর্ব সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন ল্যাতিন ইউরোপের ইতিহাস।
পিরেনের মতবাদ দুটি স্পষ্টভাগে বিভক্ত। প্রথমে তিনি মেরোভিঞ্জীয় যুগে ধ্রুপদী ঐতিহ্যে যা একান্তভাবে ভূমধ্যসাগরের ধান – প্রবাহমানতার কথা বলেছেন এবং তারপর ক্যারোলিঞ্জীয় যুগে পশ্চিম ইউরোপের মৌলিক পরিবর্তনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ভূমধ্যসাগর আরবদের করায়ত্ত হওয়াকেই পিরেন এই পরিবর্তনের একমাত্র হেতুরূপে বর্ণনা করায় পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকগণ ঐ সময়ে ভূমধ্যসাগরীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতির বিশ্লেষণে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মেরোভিঞ্জীয় আমলে হেনরী পিরেনের মতানুযায়ী প্রাচ্যের দেশগুলির সাথে অবাধ বাণিজ্য গলের অর্থনৈতিক ভিত্তি এতই সুদৃঢ় করে রেখেছিল যে ধ্রুপদীযুগের বর্ণবহুল, সমৃদ্ধ নাগরিক সভ্যতার ধারাবাহিকতা এসময়ে বিঘ্নিত হয়নি।
পিরেনের সমালোচনা
ভূমধ্যসাগরে আরবদের প্রাধান্য স্থাপনে বাধ্য করেনি
কিন্তু পিরেন পরিবেসিত মেরোভিঞ্জীয় গলের সমৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক সাফল্যের তত্ব তথ্যনির্ভর নয়। প্রাচ্য দেশগুলির সঙ্গে গলের ব্যবসাবাণিজ্য কখনই এমন স্তরে পৌঁছয়নি যে তাকে সমাজের প্রধান ভিত্তিরূপে গ্রহণ করা যায়। দ্বিতীয়ত আরবগণ ভূমধ্যসাগরের পথে প্রাচ্যের পণ্য-সম্ভার পশ্চিম ইউরোপে রপ্তানী বন্ধ করতে সক্ষম হলেও স্থলপথে তা প্রায় অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা পিরেনের মনে জাগেনি। ক্যারোলিঞ্জীয় যুগে কৃষি উৎপাদন নিঃসন্দেহে ব্যবসা বাণিজ্যের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই কারণেই ফ্রাঙ্ক রাজ্যে বাণিজ্যের অনুপস্থিতি প্রমাণিত হয়না। লেভান্ট অঞ্চলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাহত হলেও স্পেনে ও ইতালীর বন্দরগুলির সহায়তায় প্রাচ্যের প্রয়োজনীয় বাণিজ্যসম্ভার আমদানী করা হত এই সময়কার গলদেশে। তাছাড়া বাল্টিক সাগর ও রুশ দেশের মধ্য দিয়েও প্রাচ্যের এবং বাইজানসিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগের একটা পথ ছিল। প্রধানত স্থলশক্তি ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন এভাবেই পরিচালিত হত। সুতরাং ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভূমধ্যসাগুরে আরবদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপন ক্যারোলিঞ্জীয়দের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে তাদের শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদনে নিযুক্ত থাকতে বাধ্য করেছিল এই সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়।
ভূমধ্যসাগরে ইসলামের অধিকার প্রতিষ্ঠা অনায়াস ছিল না
তা ছাড়াও হেনরী পিরেন ভূমধ্যসাগর আরব সামরিক শক্তির যে অনায়াস এবং সম্পূর্ণ সাফল্যের (পরিণামে যা পশ্চিম ইউরোপের বৈদেশিক বাণিজ্য ধ্বংস করেছিল) চিত্র এঁকেছেন তাও অনৈতিহাসিক। পিরেনের মত অনুসারে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আরবদের প্রাধান্য অপ্রতিহত হয়ে যায় এবং সিসিলির উপর তারা চরম আঘাত হানে ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু আমারি (Amari) নামে ইতালীয় ঐতিহাসিক এই বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে আরব আক্রমণের নেতা ও কাল সম্পর্কে মুসলমান পণ্ডিত মহলেই মতদ্বৈততা আছে। অনেকের দৃঢ় ধারণা ঐ ঘটনার কাল ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ। ৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইন নৌবাহিনী বিধ্বস্ত করলেও আরবগণ এই বিজয়ের স্থায়ী রূপ দিতে অগ্রসর হননি। ফলে বাইজান্টাইন শাসকবৃন্দ সিসিলি ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের সামরিক গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে এবং পূর্ণমাত্রায় সচেতন হবার সুযোগ পান। গ্রিক নৌবাহিনী ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে মিশরে আরবদের আক্রমন করে এবং ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে বার্কা (Barka) অধিকারে সমর্থ হয়। অপরপক্ষে কার্থেজ অধিকারে আরবদের প্রাথমিক ব্যর্থতা স্মরণীয়। কার্থেজ তাদের হস্তগত হয় ৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে এবং জিব্রাল্টার প্রণালী বা স্পেন তখনও ছিল অনধিকৃত। সুতরাং ৭০০ খ্রিস্টাব্দের আগে ভূমধ্যসাগর পশ্চিম ইউরোপের কাছে রুদ্ধ করে দেয়ার প্রশ্ন অবান্তর।
৭৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্পেন বিজিত হলেও দামস্কাসে উম্মিয়াদ খলিফা অপসারিত হন। ইতিমধ্যে গ্রিক নৌবাহিনী দুবার মিশর আক্রমণ করে এবং ৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে একটি আরব নৌবাহিনীকে সাইপ্রাসের কাছে ধ্বংসও করে দেয়। তাছাড়া আব্বাসিদদের রাজধানী বাগদাদ সমুদ্র উপকূল থেকে বহুদূরে (প্রায় ৭০০ মাইল) অবস্থিত হওয়ায় তাদের পক্ষে শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনে মনোযোগী হওয়াও কঠিন ছিল। আর স্পেনও প্রতিদ্বন্দ্বী উম্মিয়াদদের হাতে চলে যায় এবং উত্তর আফ্রিকায় আব্বাসিদদের অধিকার অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। এর পর থেকে খলিফার সাহায্য ও সম্বল ছাড়াই অর্ধস্বাধীন ও স্বাধীন প্রাদেশিক শাসকবৃন্দের উপর নিজ নিজ দায়িত্বে ও উদ্যোগে ভূমধ্যসাগরে নতুন অভিযান সংগঠনের ভার এসে পড়ে। সিসিলি, বারবার প্রচেষ্টার পর, আরবগণ কর্তৃক বিজিত হয় ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে, সার্ডিনিয়া ৭১০ খিস্টাব্দে ও কর্সিকা ৭১৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু শার্লমান কর্সিকা পুনরুদ্ধার করেন ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে এবং সার্ডিনিয়ার উপর আরব কর্তৃত্ব কোনও সময়েই নিরঙ্কুশ হতে পারেনি। সুতরাং এই দ্বীপগুলো থেকেও পশ্চিম ইউরোপের সংযাত্রিক বাণিজ্যের উপর আঘাত হানার সম্ভাবনা ছিল কম। তাছাড়া ৬৭৪-৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সাইজিকাসে আরব নৌঘাঁটি স্থাপিত হলেও সেখান থেকে পশ্চিম ইউরোপ ও বাইজানসিয়ামের মধ্যে বাণিজ্য তাদের দ্বারা বিঘ্নিত হবার কোনও প্রমাণ নেই। উপরন্তু সমুদ্রপথে যোগাযোগ সঙ্কটাপন্ন হলে ইউরোপীয় বণিকগণ যে বিকল্প স্থলপথ (কৃষ্ণসাগরতীরস্থ ট্রেবিজোনা – Trebizona বন্দর হয়ে) ব্যবহার করতে পারতেন সে সম্ভাবনাও হেনরী পিরেনের মনে আসেনি। সুতরাং ভূমধ্যসাগরে অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরবদের অনায়াস সাফল্য ও তাদের আধিপত্যের প্রকৃতি সম্ভন্ধে পিরেন পরিবেশিত তথ্য আতিশয্যদুষ্ট।
বিধর্মীদের সাথে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া আরবনীতি ছিল না
এই প্রসঙ্গে আরও একটি মৌল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যদি এই বেলজিয়ান ঐতিহাসিক মত অনুযায়ী প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বাণিজ্যিক সম্পর্কচ্যুতির কথা মেনে নেয়া যায়। আরবদের নীতিই কি ছিল বিধর্মীর সংগে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া? এবং তা ঠিক কোন সময়ে ও কি কারণে হয়েছিল তার সদুত্তর হেনরী পিরেন দেননি। মহম্মদের উপদেশসমূহের মধ্যে, কোরানে বা খলিফাদের অনুশাসনের মধ্যে খ্রিস্টানদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে দেয়ার কোনও নির্দেশ নেই। বরং যে সমস্ত খ্রিস্টান্ন বণিক তাদের নব বিজিত রাজ্যগুলিতে উপস্থিত হতেন তারা মুসলমান শাসকবর্গের কাছে সবসময় পক্ষপাতহীন ব্যবহারই পেয়েছেন। বহু ক্ষেত্রে বিজিত খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনত অক্ষুণ্ণ থেকেছে; কর্মরত কর্মচারীদের অপসারিত করা হয়নি, ভাষাও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অবশ্য এ তথ্য সংশয়াতীত যে কর্ডোভার উম্মিয়াদ শাসক ও ক্যারোলিঞ্জীয়দের মধ্যে সীমান্তের প্রশ্নে সংঘর্ষ হয়েছে, শার্লমান ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে অভিযান পাঠিয়েছেন স্পেনে এবং সংঘর্ষের পর ৮০২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের সীমানা এব্রো থেকে বার্সিলোনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু ফ্রাঙ্কসম্রাট ও আব্বাসিদদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মৈত্রীর এবং তা দৃঢ়তর হয়েছিল স্পেনের উম্মিয়াদ রাজবংশ ও বাইজান্টাইন সম্রাট উভয়ের অমিত্র বিবেচিত হওয়ায়। ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্য থেকে রাষ্ট্রদূত নিয়মিত উপস্থিত হয়েছেন বাগদাদে-আব্বাসিদ রাজসভায় এবং খ্রিস্টানদের জন্য পুণ্যভূমিতে একটি পাঠাগার নির্মাণে অনুমতি দিতেও আব্বাসিদ শাসক কার্পণ্য করেন নি। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রাচ্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ অকস্মাৎ এবং সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অবিশ্বাস্য মনে হয়।
বাণিজ্যিক অবনতির কারণ ল্যাতিন খ্রিস্টীয় ও বাইজানসিয়ামের সম্পর্কছেদ
ঐতিহাসিক আর. এস. লোপেজ (R. S. Lopez) পশ্চিম ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্কোচনের জন্য দায়ী করেছেন বাইজানসিয়ামের সঙ্গে ল্যাতিন খ্রিস্টান জগতের সম্পর্কছেদকে, আর এই ঘটনা ইসলামের দিগ্বিজয়ের সমসাময়িক নয় বা উভয়ের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্কও অতি ক্ষীণ। লোপেজ অবশ্য পশ্চিম ইউরোপেরসংস্কৃতির উপর ইসলামের অভ্যুদয়ের প্রভাব সম্পর্কে পিরেনের মত আংশিকভাবে সমর্থন করেছেন। রোমান সাম্রাজ্যের যে সমস্ত স্থানে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে ধ্রুপদী সংস্কৃতি বিলীন হয়ে গেছে । বিজেতাদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি ক্রমশ বিজিতেরা গ্রহণ করেছে। স্পেন বা সিসিলিতে ‘আরব-রোমানেস্ক’ (Arab-Romanesque) জাতীয় সমন্বয়প্রসূত কোনও স্থাপত্য-শিল্পের উদ্ভব হয়নি, আবার রোমান সাম্রার্জোর অনুসরণে কোনও আরব সাম্রাজ্যিক ঐতিহ্যও গড়ে ওঠেনি। উভয় সংস্কৃতির মিলনের ফলে যা গড়ে উঠেছে ত৷ সম্পূর্ণ নতুন এবং তা গ্রীসীয়-রোমান-পারসিক-সেমেটিক প্রভাবের সম্মিলনের ফল।
পণ্যাদির আমদানী বন্ধ হয়নি
ভূমিকা
অবশ্য হেনরী পিরেনের বক্তব্যে সাংস্কৃতিক প্রভাব ‘বিকীরণ, গ্রহণ ও বর্জনের চেয়ে আরব বিজয়ের ফলে পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের বিবয়ই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। কিন্তু ঐতিহাসিক এম. সাব্বে (M. Sabbe) এ বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, পশ্চিম ইউরোপে ষে সমস্ত মূল্যবান পণ্যের আমদানী বন্ধ হয়ে যাওয়াকে পিরেন ভূমধ্যসাগরায় বাণিজ্য ইউরোপীয় বণিকদের হস্তচ্যুত হয়ে যাওয়ার অভ্রান্ত প্রমাণ হিসেবে দাখিল করেছেন তা তথ্যনির্ভর নয়। আর এফ. এল. গানশফ (F. L. Ganshof) এর বিবরণে অষ্টম থেকে দশম শতক পর্যন্ত প্রভেন্সের বাণিজ্যিক তৎপরতা যেভাবে আলোচিত হয়েছে তার সঙ্গে পিরেনের সিদ্ধান্তের সাদৃশ্য প্রায় নেই।
হেনরী পিরেনের মতে ৬৫০ খ্রীস্টাব্দের পরে পাশ্চিম ইউরোপের বাজার থেকে প্রাচ্যের প্যাপিরাস, মশলা ও মূল্যবান বস্ত্রাদি ভোগ্যপণ্যও অদৃশ্য হতে থাকে, স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনও ফ্রাঙ্করাজ্যে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে এই পণ্যগুলোর দুষ্প্রাপ্যতার জন্য ভূমধ্যসাগরে আরব আধিপত্য স্থাপনকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা যায় না। প্যাপিরাস তৈরী হতো কেবলমাত্র মিশরে এবং এই দেশ আরবদের দ্বারা ৬৩৯-৪১ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে অধিকৃত হবার পরেও ৬১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং গলের সরকারী দপ্তর দ্বারা প্যাপিরাসের ব্যবহারের সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্যাপিরাস
কর্বি (Corbie) মঠের সন্ন্যাসীগণ ৭১৬ খ্রিস্টাব্দেও বেশকিছু পরিমাণ প্যাপিরাস সংগ্রহ করেছিলেন নিজেদের ব্যবহারের জন্য। লাতিন ইউরোপে এই মূল্যবান পণ্যটির দুর্লভ হয়ে যাওয়ার কারণ অন্যত্র নিহত ছিল। সরকারী দলিলপত্রে জালিয়াতির সম্ভাবনা রোধের জন্য মিশরে টলেমিদের শাসনকাল থেকেই প্যাপিরাস তৈরী ও তার রপ্তানীর উপর নানাবিধ সরকারী নিয়ন্ত্রণ ছিল। পরবতীঁকালে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে বাইজানটাইন শাসকগণও এ সম্পর্কে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করোছলেন। আরবগণও মিশর অধিকার করে এই দুর্লভ পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনেন। তাদের বিধিনিষেধ মেনে নিয়েই বাইজানটাইন সম্রাট প্যাপিরাসের ব্যবহার অব্যাহত রাখেন (নবম শতকে বাইজানটাইন সম্রাটের প্যাপিরাসের উপর লেখ্য একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক নর্মান এইচ. রেনেস)। এইসময়ে লোম্বার্ডর সরকারী কার্যালয়েও প্যাপিরাসের ব্যবহারের পরোক্ষ প্রমাণের অভাব নেই । তবে আবদুল মালিকের নির্দেশনামার ফলে ইতালীর মত গলদেশেও এই প্রয়োজনীয় পণ্যটি দুর্লভ হয়ে ওঠে। কিন্তু ইবনে হকাল (Ibn Haukal) এর একটি লেখা থেকে অনুমান করা হয় সিসিলিতে ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্যাপিরাস তৈরী হত, এবং পোপের দপ্তর ১০ম ও ১১শ শতকে সেখান থেকেই তা সংগ্রহ করতো।
এ বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ সাধারণভাবে একমত যে মিশরে আরব আধিপত্য স্থাপনের পর অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত সরকারী কাজে পশ্চিম ইউরোপীয়গণ প্যাপিরাসের বদলে পার্চমেণ্ট ব্যবহার শুরু করেন। তাছাড়া অষ্টম শতকের শেষের দিকে বাগদাদেও চৈনিক পদ্ধতিতে কাগজ তৈরী আরম্ভ হয় এবং তার ফলে মিশরে প্যাপিরাসের উৎপাদনও হাস পেতে থাকে। সুতরাং ভূমধ্যসাগর ‘মুসলমান হুদে’ পরিণত হওয়ার তাৎক্ষাণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে পশ্চিম ইউরোপে প্যাপিরাসের রপ্তানী বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে এ তথ্য সন্দেহাতীত যে গলে প্যাপিরাসের ব্যবহার ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। কিন্তু এর কারণ লেখার উপকরণ হিসেবে সহজলভ্য ও সুলভ পার্চমেন্টের ব্যবহার এবং মুদ্রার মূল্যহ্রাসজনিত অসুবিধার ফলে প্যাপিরাস আমদানী অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠার মধ্যে নিহিত আছে।
ভেনিস ও স্কান্ডিনেভীয় বণিক
প্যাপিরাস ছাড়াও খ্রীস্টান জগতের বাজারগুলিতে প্রাচ্যের অন্যান্য মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভার সপ্তম শতকের শেষার্ধে অদৃশ্য হয়ে যায়নি। প্রভেন্সের বাণিজ্যিক তৎপরতার কথা বাদ দিলেও গলের সন্নিহিত দেশগুলিতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আরব শান্তির প্রতিষ্ঠার কোনও প্রতিক্রিয়ার সূচনা হয়নি। ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ভেনিসিয়া বণিকদের পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্রে ভেলভেট, রেশমীবস্ত্র ও টায়ারের রক্তবর্ণ মহার্ঘ পোষাক বিক্রয় করতে দেখা গিয়েছিল। নবম শতকের শুরুতে আলেকজান্দ্রিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে Doge যে আদেশনামা জারি করেন তা সম্রাট ৫ম লিও (৮১৩-২০) দ্বারা সমর্থিত হয়। ভেনিসের রপ্তানী বাণিজেোর অন্তর্ভূক্ত ছিল অস্ত্রশস্ত্র, জাহাজ তৈরীর উপযুক্ত কাঠ এবং ক্রীতদাস, আর তার আমদানীজাত পণ্যের মধ্যে ছিল প্রাচ্যের মশলা প্যাপিরাস ও বিচিত্র এবং মহার্ঘ রেশমীবস্ত্র। মুসলমানদের শক্তি বিস্তার প্রতিরোধের থেকে তাদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যেই বেশী আগ্রহী ছিলেন ভেনিস, নেপলস, অ্যামালফি, স্যালারনো এবং গেইতার বণিক সম্প্রদায়। তাছাড়া উত্তরের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো এবং বাল্টিক তীরবর্তী অঞ্চলগুলোও রুশদেশের নদীপথে পারস্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগ রক্ষা করে আসছিল। আরব বণিকেরা এইসব দেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মধু, ক্ষার, মোম, বার্চ বৃক্ষের ছাল, মাছ, চামড়া এবং ক্রীতদাস কিনত। বিনিময়ে নানাবিধ মণিমুক্তা, আয়না, মনোহারী দ্রব্যাদি বিক্রয় করত। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত মুদ্রার সঞ্চয় স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে প্রাপ্ত মুসলমানদের কবর, ব্রিমেনের অ্যাডাম (Adam of Bremen) এবং সেন্ট আনস্গর (St. Ansgar) সম্পর্কে রিমবার্টের একটি বিবরণ থেকে উত্তর ইউরোপ এবং প্রাচ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের বিষয় জানা যায়। আর এ তথ্য সংশয়াতীত যে চতুষ্পার্শ্বের বাণিজ্যরত দেশগু’লর পণ্যসম্ভার গলেও বিক্রয়ের জন্য আনা হত।
মশলা ও মূল্যবান বস্ত্রাদি
পিরেন ঘোষণ৷ করেছেন যে ৬৫৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে গলদেশে “মশলা” ও মূল্যবান বস্ত্রাদি আমদানী বন্ধ হয়ে গিয়োছিল, কিন্তু আলকুইনের লেখার একটি অংশ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সম্রাট শার্লমানের সময়েও মশলা পাওয়া যেত যাদিও পণ্যটি ইতিমধ্যেই মহার্ঘে (মহামূল্যবান) পরিণত হয়োছিল। এইনহার্ডের একটি ব্রচনায় বহু মূল্যবান রেশমী বস্ত্রাচ্ছাদিত সন্তদের স্মৃতিচিহ্ন রেশমীকুশনের উপর স্থাপনের উল্লেখ আছে। ৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে নর্সমেন দস্যুদল কর্তৃক প্যারী অবরোধের বিবরণ দেবার সময় আ্যাবো (Abbo) প্রাচ্যদেশজাত বিলাস-ব্যসনের দ্রব্যাদিভোগে অভ্যস্ত, ক্ষাত্রতেজহীন অভিজাতদের নিন্দায় মুখর হয়েছেন। সেন্ট গল মঠের আবাসিক এক সন্ন্যাসীর থেকেও প্রমাণিত হয় যে প্রাচ্যদেশ থেকে মনোহর পণ্যসম্ভারের আমদানীর কোনও ঘাটতি ছিল না এ সময়ে। আ্যাবট আ্যাডালহার্টের একটি দলিলে পশ্চিম ইউরোপে লভ্য মশলার একটি তালিকা আছে।
ক্যারোলিঞ্জীয় গলদেশও যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ব্যবস৷ বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তার অভ্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যায় ৮০৫ খ্রীস্টাব্দে শার্লমানের একটি অনুশাসনের মধ্য থেকে। লুই দ্য পায়াসও মার্সেই এর বিশপকে ঐ বন্দরের শুল্ক সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তৃতীয় চার্লস এর একটি অনুশাসনে দানিয়ুব তীরবর্তী বন্দর প্যাসাউ এর বণিকদের শুল্ক প্রদানের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানা যায়। ৮৪০ থীস্টাব্দে লোথার ভেনিসের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করোছলেন এবং ঐতিহাসিক সাব্বে (Sabbe) ৮৪৫ খ্রীস্টাব্দে জীবিত ও কর্মরত বন এর এক বণিকের উল্লেখ করেছেন যার কর্মসূচী মেরোভিঞ্জীয় যুগের বণিকদের কর্মসূচীর সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়। এই ঐতিহাসিক নবম শতকে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের এমন বহু বণিকের বিবরণ সংগ্রহ করেছেন ধাদের নিজ নিজ বাণিজ্যতরী বিচিত্র পণ্যসম্ভারে পূর্ণ করে দূরদেশে বাণিজ্য করতে দেখা যেত, এবং যারা পণ্য-মূল্যের উত্থানপতন সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলেন। সুতরাং প্রমাণ ও দৃষ্টান্তের তালিকা বর্ধিততর না করে এ সিদ্ধান্তে পৌছানো বোধহয় অসমীচীন হবে না যে নবম শতকে গলের সঙ্গে প্রাচের বাণিজ্যিক সম্পর্কচ্যুতির মতো কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। মধ্যযুগে, বর্তমানকালের মতো, অর্থনৈতিক অবরোধের পদ্ধতিও গড়েনি, সুতরাং পশ্চিম ইউরোপে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিষিদ্ধ করে আরব শাসকদের দ্বারা খ্রিস্টানদের কোনও শাস্তিবিধানের সন্তাবনাও স্বীকার করা যায় না।
মুদ্রাব্যবস্থার পরিবর্তন ভিন্ন কারণ
৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পর যে সমস্ত বস্তু, পিরেণের মতে, পশ্চিম ইউরোপে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে স্বর্ণমুদ্রাও অন্তর্ভূক্ত ছিল। কোন রাজ্যে মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন সেই দেশের শাসকের সার্বভৌম ক্ষমতার অন্তর্গত। মুদ্রাপ্রচলনের সময় আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তার মূল্যমান অক্ষুণ্ণ রাখা, মুদ্রা জাল হওয়ার সম্ভাবনা রোধ করাও শাসকের কর্তব্য কেননা মুদ্রাই পণ্য বিনিময়ের সবচেয়ে সুবিধাজনক মাধ্যম। মধ্যযুগে এই অধিকার ‘regale’ রূপে বর্ণিত হতো এবং রোমান রাষ্ট্র প্রবর্তিত মুদ্রাব্যবস্থাকে সরকারী আয়ের উৎস সিসেবে কখনোই ব্যবহার করেন নি। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর ‘ববর জাতিগুলির বিভিন্ন রাজ্য প্রতিষ্ঠার ফলে মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কিত সমস্যাটি জটিল হয়ে ওঠে।
বাইজানটাইন সম্রাটের মুদ্রানীতি অনুসারে ‘বর্বর’ শাসকবৃন্দ তাদের নিজস্ব প্রতীকসহ রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা প্রচলনের অধিকারী হলেও স্বর্ণমুদ্রা সম্রাটের প্রতিকৃতি ও নামসহ চালু রাখাই ছিল বৈধ। ভান্ডাল ও অস্ট্রোগথগণ এই বিধান বহুদিন পর্যন্ত ভঙ্গ করেনি আর ভিসিগথ এবং লোস্বার্ডদের রাজ্যে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয় অনেক পরে। মেরোভিঞ্জীয় শাসক প্রথম থিওবার্ট (Theobert I) কিছু স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করলে বাইজান্টাইন সম্রাট অসন্তুষ্ট হন। অবশ্য এর পর বহুকাল কোনও মেরোভিঞ্জীয় শাসকই স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন নি। স্বর্ণমুদ্রা সম্পর্কে এই বিশেষ অধিকার কনস্টান্টিনোপল শুধু তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তির জন্যই ভোগ করেনি, অপরিচিতদর্শন মুদ্রাগ্রহণে জনসাধারণের আপত্তিও এর একটা কারণ। তাছাড়া বর্বর অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে পণ্য বিনিময়ের পরিমাণ এত অল্প ছিল যে স্বর্ণমুদ্রার প্রয়োজন প্রায় অনুভূত হত না।
কিন্তু মুদ্রা প্রস্তুত ও প্রচলন সম্পর্কে ‘বর্বর’ শাসকদের ‘বিশেষ-অধিকার-সচেতনতা’ ছিল তা বলা যায়না। এ বিষয়ে তারা রোমান আইন অনুসারেই আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু মেরোভিঞ্জীয় গল ছিল এই বিষয়ে ব্যতিক্রম। সেখানে রাজার মুদ্রা প্রস্তুত ও প্রচলন সম্পর্কিত বিশেষ অধিকার প্রবর্তিত না হওয়ায় বাক্তিবিশেষের উদ্যোগে প্রস্তুতকারকের স্বাক্ষর-সম্বলিত মুদ্রার প্রচলন হয়োছল । ‘এ কারণে অল্পসংখ্যক রাজ-প্রতিকৃতি-লাঞ্ছিত’ স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া প্রচুর সংখ্যায় রৌপ্যমুদ্রা সেখানে দেখা যেতো। মুদ্রা সম্পর্কে এই প্রথা গলদেশে আরব আক্রমণের বহু আগেই চালু হয় এবং পিরেন-কথিত ব্যবসা বাণিজ্যের অন্তর্ধানের সঙ্গে এর কোনও প্রতাক্ষ সম্পর্ক ছিল না। মহম্মদের আবির্ভাবের বহু বছর পূর্বে এবং মেরোভিঞ্জীয়দের দুর্বলতা প্রকট হবার আগেই গলে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তুলনায় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন কমে যায়।
ক্যারোলিঞ্জীয়দের শাসন আরম্ভ হবার পর পিপিন দ্য শর্ট মুদ্রা বিষয়ে রাজকীয় অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে যথেচ্ছ এবং বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা প্রচলনের বিরোধী ছিলেন। এই ক্ষেত্রে সমতা প্রাতিষ্ঠার একটি উপায়ই তার জানা ছিল এবং তা সম্রাটের প্রতিকৃতি-সম্বলিত স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন বন্ধ করে দেওয়া। শার্লমান এবং লুই দ্য প্রায়াসের শাসনকালে রাজশক্তি যখন অপ্রতিহত তখন আবার কিছুকালের জন্য তা চালু হয়েছিল যদিও তাদের শাসনের অবসানে মুদ্রাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার আবির্ভাব ঘটতে দেরি হয় নি।
কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে স্বর্ণমুদ্রার স্বল্পতা যে আরবশক্তির বিস্তারের অনিবার্য ফল নয় তা প্রমাণিত হয় স্পেনের দৃষ্টান্ত দ্বারা। ভিসিগথদের পরাভূত করে স্পেনে আরব আধকার প্রতিষ্ঠার সময় সে দেশে স্বর্ণমুদ্রা চালু ছিল। কিন্তু কর্ডোভার প্রথম স্বাধীন শাসক প্রথম আব্দল রহমান (পিপিন দ্য শর্টের সমসাময়িক) স্বর্ণমুদ্রা প্রস্তুত, প্রচলন ও মুদ্রায় স্ব-নাম অঙ্কন থেকে বিরত হন কারণ তখনও আইনত মুসলমান সাম্রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের আধিকারী ছিলেন একমাত্র খলিফা। এর বহু পরে বাগদাদের খলিফা তুর্কী সেনানায়কের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হলে কর্ডোভার শাসক তৃতীয় আব্দল রহমান (৯১২-৬১) স্বয়ং খলিফা উপাধি গ্রহণ করেন এবং স্পেনে নিয়মিত স্বর্ণ-মুদ্রাঙ্কন ও প্রচলন আরম্ভ হয়। সুতরাং প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্পেনে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ফ্রাঙ্ক শাসক পিপিন দ্য শর্টকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনাও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ক্যারোলিঞ্জীয় রাজ্যে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার বর্জন করে রৌপ্যমুদ্রা চালু করার মধ্যে হেনরী পিরেণ “money economy” থেকে “natural economy” তে আগমনের স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন। কিন্তু রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহার দ্বারা যদি তাই সূচিত হয় তবে আধুনিক কালের বহু রাষ্ট্র (মেক্সিকো, চীন ও কয়েকটি আরবরাষ্ট্র) সম্পর্কেও এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ক্যারোলিঞ্জীয় শাসকগণ নিয়ন্ত্রিত, সঠিক মানের ও খাঁটি রৌপ্যমুদ্রা চালু করে মুদ্রাবাবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রের সচেতনতার প্রমাণই রেখেছিলেন।
মন্তব্য
হেনরী পিরেনের অভিমতের অভিনবত্ব ও তার ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপ্তির নিত্য-প্রতিষ্ঠা, কিন্তু মধ্যযুগের খ্রীস্টান জগতের উপরে ইসলামের প্রভাব সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত বলে নয়, গবেষকদের এ কালের অর্থনোতিক ও সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ করে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করার প্রেরণা হিসেবেই অধিকতর মূল্যবান। ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে পশ্চিম ইউরোপে রোমান এতিহ্যের প্রবহমানতা বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ তার সঙ্গে একমত। বর্বর আক্রমণের ফলে অকস্মাৎ সে ঐতিহ্যের নিঃশেষে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথাও কেউ আর বিশ্বাস করেন না। কিন্তু অষ্টম শতকেব্র মধ্যে মুসলমান শক্তির দৃপ্ত ও প্রায় নির্বাধ প্রসারণ ও ভূমধ্যসাগরের উপর অধিকার হারানোর ফলে প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কচ্যুত হয়ে পশ্চিম ইউরোপের সহসা ভিন্ন পথবাহী হওয়া এবং বিচ্ছিন্নতা ও বৈভবহীনতার মধ্যে আবদ্ধ, বর্ণহীন জীবন যাপনে বাধ্য হওয়ার তথ্য সমর্থনযোগ্য নয়। আর এইসব ঘটনার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে মধাযুগীর ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু বাণিজ্য-সফল ও রোমান ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দাক্ষণাঞ্চল থেকে জার্মান-প্রভাবিত উত্তরাঞ্চলে স্থিত হওয়া সম্পর্কে তার ধারণা আজ শুধু কৌতুহল-উদ্দীপক। নতুন এক শাসকগোষ্ঠী ক্যারোলিঞ্জীয় ফ্রাঙ্কদের অধীনে পশ্চিম ইউরোপে কেবলমাত্র কৃষিনির্ভর ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজের যে চিত্র এই বেলজিয়ান ঐতিহাসিক এঁকেছেন তা নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত। বাণিজ্যলক্ষ্মীর আশীর্বাদবঞ্চিত ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের যে পরাগতি, সীমাবদ্ধতা ও অপ্রাচুর্যের কথা তিনি দ্বিধাহীন স্বরে বলেছেন তা সত্য হলে সম্ভব হত না সম্রাট শার্লমান কর্তৃক সুবিশাল একটি সাম্রাজ্যের সংহতিরক্ষা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের মধ্যে স্থগিত থাকত পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রীয় বিকাশ ও অসম্ভব হত ক্যারোলিঞ্জীয় যুগের রেনেসাঁস, যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও যার উৎকর্ষ ও বহুমুখীনতা সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ নেই।
তথ্যঋণ
- মধ্যযুগের ইউরোপ – ১ম খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, ৩য় সংস্করণ, ডিসেম্বর, ১৯৯৪, পৃ – ১-২৭
Leave a Reply