এশিয়া মাইনোরের ফ্রিজীয় ও লিডীয় সভ্যতা এবং এশিয়া মাইনোর ও ইউরোপে পারসিক আক্রমণ

ফ্রিজিয়া

মাইসিনিয়ান যুগে, ফ্রিজিয়ান নামে একদল লােক এশিয়া মাইনরের উত্তর-পশ্চিম অংশে চলে আসলাে। ইলিয়াডে ট্রয়ের অবরোধ বর্ণনার সময় ট্রয়ের মিত্র হিসেবে ফ্রিজীয় জাতির উল্লেখ আছে, ফলে ধারণা করা যায় সেই সময় এশিয়া মাইনোরে ট্রয় অঞ্চলের পাশে তাদের অস্তিত্ব ছিল। ডােরিয়ান আগ্রাসনের পরবর্তী সময়কালের বিশৃঙ্খল সময়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছিল। ফ্রিজিয়ানরা সম্ভবত সমুদ্র থেকে আসা জনগােষ্ঠী যারা হিট্টাইট সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে, ফ্রিজিয়ানরা এশিয়া মাইনরের পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধেক জুড়ে তারা তাদের রাজত্বের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিল। কিন্তু তারা ঈজিয়ান উপকূলে গ্রিক উপনিবেশিকতার ওপর তারা সেভাবে হস্তক্ষেপ করেনি, তার বদলে গ্রিক সংস্কৃতিই তাদের আকর্ষণ করেছিল, তারা গ্রিকদের সাথে মৈত্রীর বন্ধনেই আবদ্ধ ছিল। তাদের পরবর্তী রাজারা গ্রিক কিংবদন্তীতে প্রবেশ করেছিলেন। গ্রিকরা বলে, গােরডিয়াস নামে এক ফ্রিজিয়ান কৃষক তার গরুরগাড়িতে একটি ঈগল গাঁথা দেখে চমকৃত হয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল এটা তার রাজা হওয়ার জন্য একটি শুভচিহ্ন। নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধ রাজা কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেলেন। আর একটি ওরাকল গােরডিয়াসকেই রাজার উত্তরসূরী হিসেবে দিকনির্দেশ করল। গােরডিয়াস ঈজিয়ান সাগরের তিনশ মাইল ভিতরে গােরডিয়ান নামে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। আর তার উত্তরসূরীদের অধীনে ফ্রিজিয়া উন্নতি করে যেতে লাগল।

শেষ ফ্রিজিয়ান রাজা গ্রিকদের কাছে মাইডাস নামে পরিচিত ছিলেন। এই মাইডাসের সাথে গ্রিক দেবতা ডায়োনিসাসের কাহিনী গ্রিক পুরাণে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। মাইডাস খ্রিস্টপূর্ব ৭৮৮ সাল থেকে ৬৯৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন, আর কাহিনী ‘সােনালী স্পর্শ’-এর কিংবদন্তীতে চিত্রিত ছিল। তিনি স্পর্শেই সবকিছুকে সােনায় পরিণত করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই ক্ষমতা শীঘ্রই তার অনুতাপের বিষয়ে পরিণত হয়, কেননা একে একে তার খাবার, পানীয়, এমনকি নিজের কন্যাও তার স্পর্শে সোনায় পরিণত হয়। এই কিংবদন্তী সঙ্গত মাইডাসের আমলে ফ্রিজিয়ানদের সমৃদ্ধিকেই প্রতিফলিত করে। ফ্রিজিয়ান রাজত্বের পরের শতাব্দীগুলােতে এশিয়া মাইনোরের দক্ষিণ পূর্বে আসিরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু এশিয়া মাইনোরে আসিরীয়দের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল ছিল। অনেকটা শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবেই আসিরীয়রা ফ্রিজিয়াকে ফ্রিজীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়।

যাই হােক, কৃষ্ণসাগর পেরিয়ে উত্তর দিকে সমস্যার উদ্ভব হতে লাগল। আজকে যা ইউক্রেন নামে পরিচিত, সেই সমতলভূমিতে মাইসিনিয়ান যুগে একটি ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী বাস করত যাকে হােমার সিমিরিয়ান (Cimmerian) নামে অভিহিত করেছিলেন। তাদের নাম আজও মানচিত্রে রয়ে গেছে, উপদ্বীপটি আজ ক্রিমিয়া নামে পরিচিত যা তার নামটি প্রাচীন গােত্র থেকে পেয়েছে। সিমেরিয়ানরা মনে হয় তাদের সমতলভূমিতে শান্তিতেই ছিল, কিন্তু মধ্য এশিয়া থেকে আরেকটি জনস্রোত এগিয়ে আসে, যেমনটি কিনা পাঁচ শতাব্দী পূর্বে ডােরিয়ান আগ্রাসনের সময় সংঘটিত হয়েছিল। এই ঘোড়সাওয়ার জনগোষ্ঠীকে গ্রিকরা নাম দেয় সিথিয়ান, এরাও ইন্দো-ইউরোপীয়ই ছিল, তবে ইরানীয় শাখার। এই সিথিয়ানরা পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে ক্রিমিয়ায় পৌঁছল, ফলে সিমিরিয়ানরা সেখান থেকে পালিয়ে গেল। সেই থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষ্ণসাগরের উত্তর সমতলভূমি সিথিয়া নামে পরিচিত ছিল। সিমিরিয়ানরা সিথিয়ানদের নিকট হতে পালিয়ে কৃষ্ণসাগরের আশেপাশে ঢুকে গেল। তারা এশিয়া মাইনর আক্রমণ করে ফ্রিজিয়ান রাজত্ব পুরােপুরি ধ্বংস করে দিল। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী একটি ভয়ানক হারের পরিণতি হিসেবে মাইডাসের আত্মহত্যা এই ঘটনাটিরই প্রতিফলন। (Isaac Asimov, The Greeks : A Great Adventure, Houghton Mifflin Company Boston, p. 81-90)

লিডিয়া

লিডিয়ার উত্থান ও জাইজিস

লিডিয়ার উত্থান : পশ্চিম এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী ছিল লিডীয়রা (Lydian)। তারা পশ্চিম এশিয়া মাইনরে বসবাস করত। ফিলিস্তিনীরা প্যালেস্টাইন আক্রমণের আগে তাদের আবাসভূমি ছিল লাইসিয়া এবং কারিয়া। এই লাইসিয়া এবং কারিয়ার ঠিক উত্তরদিকে লিডীয়রা বসবাস করত। সিমেরিয়ান বহিঃশত্রুদের দিকে ধাবিত হওয়া একটি দলকে লিডিয়ান নামে ডাকা হত, যারা সেখানে ফ্রিজিয়ান কর্তৃত্বের অধীনে ছিল। সম্ভবত তাদের অগ্রসরযাত্রা ফিলিস্তিনীদের অভিবাসন প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী ছিল। একসময় শক্তিশালী ফ্রিজীয় রাজতন্ত্র কর্তৃক লিডীয়রা শাসিত হয়েছিল। হারমােস এবং মিয়ানডার নামক পশ্চিম এশিয়া মাইনরে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত দুটি নদীর উপত্যকায় লিডিয়া রাজ্য অবস্থিত ছিল। হিট্টাইটদের পতনের পর লিডিয়া পশ্চিম দিকে হ্যালিস নদী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। কারিয়ান, ফ্রিজীয় এবং লাইসীয় ছাড়াও কয়েকটি ইন্দো-ইউরােপীয় জনগােষ্ঠীকে নিয়ে লিডীয় জনসংখ্যা পঠিত ছিল। এসব ইন্দো-ইউরােপীয়দের মধ্যে হিট্টাইট এবং উরারতিক গােষ্ঠী ছিল উল্লেখযােগ্য। লিডিয়ার প্রকৃত ইতিহাস শুরু হয় জাইজিস (Gyges) নামক রাজার রাজত্বকালে। প্রথমে তিনি ছিলেন একজন গােত্রীয় প্রধান। এরপর তিনি আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৬৮৩ থেকে ৬৮৭ সালে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তাগত করেন। জাইজিসের নেতৃত্বে লিডীয়রা ফ্রিজীয়দের নিকট থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং জাইজিস দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ঐতিহাসিক হেরােডােটাস কিভাবে জাইজিসের পূর্বসূরী ক্যানডুয়ালেস তার সুন্দরী রাণীকে রক্ষী বাহিনীর অধিনায়ক জাইজিসকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে বাধ্য করেছিলেন সে সম্বন্ধে একটি কাহিনী বিধিবদ্ধ করেছেন। এতে রাণী অত্যন্ত অপমানিত বােধ করেন এবং জাইজিসকে তার স্বামীকে খুন করে তাকে বিবাহ করতে বাধ্য করেন। ইতিপূর্বে ক্যানডুয়ালেস পূর্বদিকে মেসােপটেমিয়া এবং পশ্চিমে গ্রীক জগতের মধ্যে লিডিয়ার অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ করে তােলার প্রচেষ্টা চালান।

জাইজিসের বিদেশ নীতি – আসিরীয়, মিশরীয় ও সিমেরীয়দের সাথে সম্পর্ক : লিডিয়ার প্রতিবেশী দেশ আসিরিয়ার সাথে লিডিয়ার সম্পর্ক ভাল ছিল না। আসিরিয়ার প্রতি লিডীয় নীতি নির্ধারিত হত আত্মসংরক্ষন বা লিডিয়ার অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে। এ সময় ক্রিমিয়া থেকে আগত সিমেরীয়রা (Cimmerians) এবং পারস্যের মেডেস আক্রমণকারীরা লিডিয়া এবং আসিরিয়ার সীমান্তে আগ্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি করে। উল্লেখ্য যে, সিমেরীয়রা পূর্ব এশিয়া মাইনরের লেক ভ্যান অঞ্চলের চারপাশে বসবাস করত। জাইজিস ছিলেন আসিরিয়ার একজন মিত্র, অধীনস্থ নয়। জাইজিস সিমিরিয়ানদের সাথে লম্বা সময়ের যুদ্ধে জড়িত ছিলেন, আর পরবর্তীতে বাইরের সাহায্যের জন্য ঝুঁকেছিলেন। তাই তারা আসিরীয় সাম্রাজ্যের সাহায্য নিয়েছিল। কিন্তু সিমেরীয় এবং মেডেস আক্রমণের তীব্রতা হ্রাস পাবার পর জাইজিস আসিরিয়াকে দুর্বল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আসিরীয়রা যাতে মিশরে আক্রমণ না করে তাই তিনি মিশরের তদকালীন ফারাও সামতিকের কাছে ভাড়াটে সৈন্য পাঠান। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৯ সালে, শেষ শক্তিশালী আসিরীয় রাজা আশুরবানিপাল সিংহাসনে আরােহণ করেন। আসিরিয়ান সাম্রাজ্য ধারাবাহিক বিদ্রোহের কারণে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে হচ্ছিল, আর খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ সালে সাইটিক মিশর অচলাবস্থা নিরসনে সফল হলাে। আশুরবানিপাল সিমেরিয়ান চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। কঠিন একটা যুদ্ধের পর সিমেরিয়ানরা পরাজিত হয় আর তাদের প্রধান শক্তি ভেঙে পড়ে। এরপর থেকে বিচ্ছিন্ন লড়াই চলতে থাকে, আর খ্রিস্টপূর্ব ৬৫২ সালে এগুলোর মধ্যেই একটি যুদ্ধে জাইজেস নিহত হন। সেই সময়ে লিডিয়ান সাম্রাজ্য পুরােদমে প্রতিষ্ঠিত ছিল, আর জাইজিসের উত্তরসূরীরাই ক্ষমতায় থাকলেন। জাইজিসের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী আরদিস আসিরিয়ার শাসক অসূরবনিপালকে নিজের অধিরাজ বা প্রভু হিসেবে মেনে নেন। তবে জাইজিসের সময় তিনি এশিয়া মাইনোরের উপত্যকা বরাবর আয়োনীয় গ্রিক নগর রষ্ট্রগুলোর ওপর যে আক্রমণ শুরু করেন জাইজিসের বংশধরগণ তা অব্যাহত রাখেন। জাইজিসের (৬৮৭-৬৫২ খ্রি.পূ.) পর ক্ষমতায় এলেন তার পুত্র আরদিস (৬৫২-৬০৩ খ্রি.পূ.), তারপর এলেন আরদিসের পুত্র স্যাডিয়াটিজ (৬০৩-৫৯১ খ্রি.পূ.), তারপর এলেন স্যাডিয়াটিজের পুত্র আলিয়াটিজ (Alyattes, ৫৯১-৫৬০ খ্রি.পূ.)। আলিয়াটিজ সিমেরিয়ানদের শেষ প্রতিনিধিদের নিশ্চিহ্ন করে দিলেন, তার রাজত্বকালে এই যাযাবররা ইতিহাস থেকেই হারিয়ে গেল। সিমেরিয়ানদের ব্যবস্থা করার জন্য আলিয়াটিজ হ্যালিস নদীর পশ্চিমে এশিয়া মাইনোরের পুরােটা গ্রাস করে নিতে এগােলেন। উত্তর দিকে প্রবাহিত এই নদীটি এশিয়া মাইনরকে সমান দুইভাগে ভাগ করেছে। লিডিয়ার রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল ঈজিয়ান সাগরের পঞ্চাশ মাইল ভেতরে সারদিসে।

ক্যালডীয় ও মিডীয়দের উত্থান এবং মিডিয়ার সাথে লিডিয়ার যুদ্ধ

ক্যালডীয় ও মিডীয়দের উত্থান : সিমিরিয়ানদের পরাজিত করার জন্য আসিরিয়া যে চেষ্টা করেছিল, তাতে তার শক্তির সবটুকু শেষ হয়ে গিয়েছিল। আসিরিয়ার সবচেয়ে ধনী অংশ ব্যাবিলন এই অবস্থার সুযােগ নিয়ে বিদ্রোহ করে বসে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে এটি বিশাল আর দারুণভাবে সভ্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল, আর উত্তরের আসিরিয়ানদের দ্বারা এটাকে আর কখনােই রাজত্বে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। যদিও এর বিদ্রোহগুলাে রক্তাক্তভাবে দমন করা হয়েছিল। ব্যাপক প্রচেষ্টার পর, আশুরবানিপাল খ্রিস্টপূর্ব ৬৪৮ সালের শেষে একবারের মতাে ব্যাবিলনকে অধীনে নিতে সমর্থ হন। তার জীবিতাবস্থায় তিনি আসিরিয়াকে ঐকব্যবদ্ধ করে রেখেছিলেন, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৬২৫ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তার দুর্বল উত্তরসূরীদের সেই সুযােগ ছিল না। আসিরিয়ানদের বিরুদ্ধে উত্থিত শক্তি ছিল মিডিয়া। এরা হলো আসিরিয়ানদের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী ইন্দো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। তাদের উত্থান ঘটেছিল তাদের স্থানীয় শাসক সাইয়াকসারিজের অধীনে, যিনি কেবলই ক্ষমতায় এসেছিলেন। এদিকে ব্যাবিলনও আরও একবার বিদ্রোহ করে বসল। এবারে ব্যাবিলন চলে এলো ক্যালডিয়ান নামে একটি গোত্রের হাতে। নেতৃত্বে ছিলেন নবোপোলাসার নামে এক ক্যালডিয়ান নেতা। আসিরিয়া উত্তরের সিথিয়ান সৈন্যদের অধীনে চলে যাচ্ছিল, আর মিডিয়া ও ক্যালডিয়ান সমন্বয় ছিল এইক্ষেত্রে শেষ পদক্ষেপ। খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ সালে, নিনেভা দখলকৃত আর পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, আর খ্রিস্টপূর্ব ৬০৫ সালে, আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্নটুকু মুছে গেল, যার কারণে এই নিষ্ঠুর ও কুখ্যাত সাম্রাজ্যটি পৃথিবীর মুখ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল। আশুরবানিপালের মৃত্যুর পর আসিরিয়া এত দ্রুত ভেঙে পড়ল যে, দূরের গ্রিকবাসীদের কাছে তাদের পতনের গুজবেই কেবল কানে এসেছিল। তারা মনে করত আশুরবানিপাল এখনাে রাজা হিসেবে আছেন (অথবা সম্ভবত তার এক ভাইয়ের সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলত)। গ্রিকরা তাকে সারদানাপেলাস নামে চিনত, তাকে এক দুর্বল, বিলাসিতা প্রিয় রাজা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে গ্রিক সাহিত্যে, তারা বলত যখন তার নগর দখল হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি তার নিজের প্রাসাদ পুড়িয়ে দেন ও অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। আসিরিয়ার পতনের পর নবােপােলাসার আর সাইয়াকসারিজ সাম্রাজ্যের ভাগাভাগি ও লুটপাটে অংশ নিলেন। নবােপোলাসার সাম্রাজ্যের প্রধান অংশ – ব্যাবিলনীয়া, সিরিয়া ও ফিনিসিয়া নিয়ে নিলেন। আর সাইয়াকসারিজ উত্তর আর পূর্বের ব্যাপক বিস্তত কিন্তু তুলনামূলক অনুন্নত ভূমি দখলে নিলেন। নবােপােলাসারের ক্যালডিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরই কেবল গ্রিকরা ব্যাবিলন সম্পর্কে জানতে পারল। থেলিস আর পিথাগােরাসের মতাে মানুষরাই সম্ভবত সেই ভূখণ্ড পরিদর্শন করেছিলেন আর জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাবিলনীয়ান শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন। ক্যালডিয়ান’ শব্দটির অর্থ তাই বােঝাত জ্যোতির্বিদ বা জাদুকরকে।

মিডিয়ার সাথে লিডিয়ার যুদ্ধ : ক্যালডিয়ান সাম্রাজ্য তার শীর্ষবিন্দুতে আরােহণ করে নবােপােলাসারের পুত্র নেবুচাদনেজারের সময়, যিনি বাইবেলীয় উচ্চারণ নেবুচাদনেজারেই বেশি সুপরিচিত। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬০৫ সালে সিংহাসনে আরােহণ করেন, আর টানা চল্লিশ বছর শাসন করেন। তিনি তার দুটো কীর্তির কারণে বেশি বিখ্যাত। প্রথমত, তিনি জুডাহদের রাজত্ব ধ্বংস করে ইহুদীদের তাদের ব্যাবিলনীয়ান কারাগারে প্রেরণ করেন। দ্বিতীয়ত, তিনি তার মিডিয়ান রাজকুমারী স্ত্রীকে আমােদিত করার (ব্যাবিলনীয়ার সমতল সমভূমির মাঝে) চেষ্টা করেন, যিনি কিনা তার মাতৃভূমির পাহাড় আর বাগানের জন্য লালায়িত ছিলেন। তাই নেবুচাদনেজার স্ত্রীকে পাহাড়ের একটা আবহ উপহার দেয়ার জন্য শ্রেণিবদ্ধভাবে সাজানাে বাগান তৈরি করলেন , আর এটিই ব্যাবিলনের শূন্যোদান নামে বিখ্যাত। পরবর্তীতে গ্রিকরা একে বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের ভিতর তালিকাবদ্ধ করে। অন্যদিকে মেডেসের উত্থানের ফলে লিডিয়ার জন্য অনেক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। মিডিয়ান সাম্রাজ্যের শাসক সাইয়াকসারিজ আসিরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো দখল করে নিয়ে সতর্কতার সাথে তার শক্তি পশ্চিমদিকে বৃদ্ধি করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সাম্রাজ্য প্রথমে কৃষ্ণসাগর ও পরে হালিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। হেলিস নদীর অপর প্রান্তে ছিল লিডিয়া যেখানে রাজা ছিলেন আলিয়াটিস। এশিয়া মাইনরের ক্ষমতা দখলের জন্য লিডিয়ার এলিয়াটিস ও মিডিয়ার সাইরাকসারিজের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য ছিল, আর এটির প্রচণ্ডতা ছিল কয়েক বছর ধরে। এই উত্তেজনা পরবর্তী প্রজন্মে চলে এলো নিনেভের পতনের পর, যখন মিডিয়ান আর লিডিয়ানরা ইতিহাসের অন্যতম কঠিন একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। তবে মেডেসরা লিডিয়া দখল করতে ব্যর্থ হয়। লিডিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে গ্রিসের ভাড়াটে সৈনিকরা মেডেসদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে এবং এর ফলে উভয় শক্তিই উভয়ের ক্ষমতার পরিমাণ উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ছয় বছর যুদ্ধ চলার পর হ্যালিস নদী পর্যন্ত সীমান্ত অটুট থাকে। সৈন্যরা যখন যুদ্ধ করছিল তখন সূর্যগ্রহণ ঘটলো। থেলিস এই সূর্যগ্রহণেরই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। প্রাচীনকালে, শুধু অল্পকতক জ্যোতির্বিদেরই সূর্যগ্রহণের প্রাকৃতিক কারণ সম্পর্কে কোনাে ধারণা ছিল, আর সাধারণভাবে জনগণের কাছে তা ছিল ঈশ্বরের অসন্তোষের নমুনা এবং ধ্বংসলীলার অন্যতম ভয়ানক চিহ্ন। সূর্যগ্রহণ দ্বারা সৈন্যরা এতই প্রভাবিত ছিল যে সাথে সাথে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়া হলাে। এসময় ক্যালডীয়রাজ নেবুচাদনেজারের মধ্যস্থতায় এ অঞ্চলে শান্তি স্থাপিত হয়। সৈন্যদল ঘরে ফিরে গেল এবং লিডিয়ান আর মিডিয়ানরা আর কখনাে যুদ্ধ করেনি। বর্তমানে জ্যোতির্বিদগণ এই সূর্যগ্রহণের সময়কাল নির্ধারণ করে লিডিয়া ও মিডিয়ার সেই যুদ্ধের সময়কাল নির্ণয় করেছেন। দিনতি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ সালের ২৮ মে। এই যুদ্ধটি ইতিহাসের সর্বপ্রথম ঘটনা যার সঠিক তারিখ নির্ণয় করা হয়েছে। এরপর গ্রিস ও এশিয়া মাইনোরে আসে এক শান্তির প্রজন্মকাল, যেখানে আস্টিয়াজিস (Astyages) ছিলেন মিডিয়ার শাসক, পিসিস্ট্রটাস শাসন করতেন এথেন্স, আর লিডিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন ক্রিসাস (Croesus, ৫৬০-৫৪৬ খ্রি.পূ.)। এসময় গ্রীক ও মেডেসদের মধ্যে যােগাযোেগ অনুষ্ঠিত হয় এবং ভূমধ্যসাগরীয় শক্তি লিডিয়া এবং ভারত মহাসাগররের সীমান্তে অবস্থিত মিডিয়ার মধ্যে প্রাচীন ব্যবিলনীয় রাজার মধ্যস্থতায় শান্তি স্থাপিত হয়। এভাবে পরবর্তীকালে পারস্যের নিকট লিডিয়া এবং মিডিয়া উভয় শক্তি স্বাধীনতা না হারানাে পর্যন্ত এ দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। এই শান্তি চুক্তি সম্পর্কে চার্লস রবিনসন জুনিয়র মন্তব্য করেন যে, ‘The Halys River whose red waters fom a historic landmark of Asia Minor, was chosen as the dividing line between the two states, and the daughter of Alyattes was given in marriage to Aslyages, son of the Median king, Cyaxares” (Robinson Jr., Charles A. Ancient History (New York : Macmillan, 1967, p 111)।

আলিয়াটিসের আগ্রাসন, ক্রিসাসের শান্তিপূর্ণ শাসন ও মুদ্রাব্যবস্থার আবিষ্কার

আলিয়াটিসের আয়োনীয় গ্রিক নগরগুলোতে আক্রমণ : লিডিয়ান রাজধানী পুরাতন ফ্রিজিয়ান রাজধানীর নিকটবর্তী হওয়ায় ব্যাপারটা এটাই বােঝায় যে ফ্রিজিয়ার চেয়ে লিডিয়ার সমুদ্রের প্রতি আগ্রহ বেশি ছিল। জাইজিস গ্রিক শহরগুলাের দিকে আক্রমণাত্মকভাবে ধ্বাবিত হচ্ছিলেন, কিন্তু সিমেরিয়ানদের বাধা তাদের খুব বেশি শক্ত অবস্থান নিতে দেয়নি। আলিয়াটিজ অপেক্ষাকৃত অনেক ভালাে অবস্থানে ছিলেন, আর তাই তিনি পশ্চিমদিকে ধ্বাবিত হলেন। থেলিস মিলেটাস সহ আয়োনীয় নগরগুলোকে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, লিডিয়ান সেনাদলকে প্রতিরােধের একমাত্র উপায় হলাে ‘প্যান-আয়োনিয়ান কাউন্সিল’-এ তাদের একীভূত হওয়া, যা আয়োনীয়দেরকে লিডিয়ানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরক্ষায় পথ দেখাবে। এই পরামর্শের কারণেই থেলিস সাতজন জ্ঞানী মানুষের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু, আয়োনীয় শহরগুলাে থেলিসের পরামর্শ গ্রহণ করেনি, আর তার ফলেই তারা একে একে লিডিয়ান কর্তৃত্বের অধীনে চলে যায়। এই প্রথমবারের মতাে গ্রিক শহরগুলাে গ্রিক ভাষায় “বারবারিয়ানদের” শাসনাধীন হয়ে গেল। আয়োনীয় শহর স্মিরনা আলিয়াটিসের হাতে ধ্বংস হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে এটি লিডিয়ান বন্দরে পরিণত হয়। শুধু মিলেটাসই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এরপর গ্রিক শহরগুলাের অধিরাষ্ট্র হিসেবে লিডিয়া ফ্রিজিয়ানদের মতােই উন্নত আর ধনী হিসেবে বেড়ে উঠল। লিডিয়াই প্রকৃতপক্ষে মুদ্রার উদ্ভাবন করে। সৌভাগ্যক্রমে গ্রিক শহরগুলাের উপর লিডিয়ান নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট কমই ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ সালে আলিয়াটিসের মৃত্যুর পর তার এক সন্তান ক্রিসাস (Croesus, ৫৬০-৫৪৬ খ্রি.পূ.) তার উত্তরাধিকারী হন। উল্লেখ্য যে, মিডিয়ার সর্বশেষ রাজা অ্যাসটিয়াজেস (Astyages) এবং লিডিয়ার শেষ রাজা ক্রিসাস (Croesus) ছিলেন শ্যালক ও ভগ্নীপতি। লিডীয় রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন ক্রিসাস। ঐতিহাসিক বার্নস তার সম্পর্কে লিখেছেন যে, “The Lydians reached the peak of their power and prestige under King Croesus, son of Alyattes” (Barnes, Harry Elmer, A Survey of Western Civilization (New York : Thomas Crowell, 1947, p. 84)।

ক্রিসাসের শান্তিপূর্ণ শাসন ও সমৃদ্ধি : গ্রিকদের প্রতি ক্রিসাসের পূর্ণ সহানুভূতি ছিল, আর চিন্তাভাবনার দিক থেকেও তিনি যথেষ্ট পরিমাণে গ্রিকই ছিলেন। ক্রিসাস তার উদ্যমশীল কর্মকান্ডের জন্য গ্রিকদের কিংবদন্তীতে পরিণত হন। তিনি হ্যালিস নদী থেকে ঈজিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এশিয়া মাইনোর ভূখন্ডকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত গ্রীক নগরীগুলোকে অধীনস্থ মিত্রের পর্যায়ে আনয়ন করেন। কোন কোন নগরী কর্তৃপক্ষকে তিনি উপঢৌকন প্রদান করতে অথবা সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করতে বাধ্য করেন। তবে কোন কোন নগররাষ্ট্রকে তিনি কেবলমাত্র তাদের দুর্গগুলিকে ভেঙ্গে দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। আবার কোন কোন গ্রীক নগরীকে তিনি সরাসরিভাবে সংযােগ করেন। গ্রীক নগর রাষ্ট্রের কোন কোনটিকে তিনি স্বায়ত্তশাসন দিলেও এসব জায়গায় একজন আবাসিক লিডীয় উপদেষ্টা গ্রীকদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতেন। আবার কোন কোন নগররাষ্ট্র লিডীয়দের অনুকুলে শাসন করার জন্য স্থানীয় স্বৈরাচারী শাসক নিয়ােগ দান করা হয়। এসব হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও গ্রীকরা ক্রিসাসকে পছন্দ করত। কারণ ক্রিসাস ছিলেন তাদের মন্দিরগুলির একজন মহান পৃষ্ঠপোষক; বিশেষ করে, ডেলফি, ডােডােনা এবং অরােপাসের জাতীয় মন্দিরগুলিকে ক্রিসাস উদার পৃষ্ঠপােষকতা করেন। ক্রিসাস সবসময় ওরাকলের সাথে পরামর্শ করতেন, বিশেষ করে ডেলফির ওরাকলের সাথে। তিনি ডেলফিতে দামি উপহার পাঠাতেন; গ্রিক শহরগুলাে যা দিতে পারত, তার থেকেও অনেক বেশি পরিমাণে উপহার তিনি ডেলফিতে পাঠিয়েছেন। গ্রিসে তার ধনসম্পদের খ্যাতি এত বেশিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল যে আজকের দিনেও কোনাে ধনশালী ক্ষেত্রে, “ক্রিসাসের মতাে ধনী” কথাটি ব্যবহার করা হয়। দুই শতাব্দী পূর্বের মাইডাসের মতােই মনে করা হত ক্রিসাসের ‘সােনালী স্পর্শ” রয়েছে, আর মাইডাসের মতােই তিনি শান্তিতে তার রাজত্ব শেষ করতে পারেনি। আবারও সমস্যার উদ্ভব হলাে এই সময়ে। গ্রীক কবি, সাহিত্যিক এবং বিজ্ঞানীরাও ক্রিসাসের অভিভাবকত্ব লাভ করেন। থেলিস এবং ঈশপকে তিনি বিবিধভাবে সাহায্য করেন। আবার গ্রীক নেতৃবর্গকেও তিনি বিশেষ সম্মান দেখান। উদাহরণস্বরূপ, এথেন্সবাসী আলকেমিওন এবং থ্রেসের রাজা মিলতিয়াদেসকে তিনি সম্মানিত করেছিলেন। ক্রিসাসের রাজপ্রাসাদে সবসময় গ্রীক অতিথির আগমন ঘটত এবং গ্রীকদের জন্য রাজপ্রাসাদের দরজা সব সময় উন্মুক্ত থাকত। গ্রিক দার্শনিক পিত্তাকাস এবং গ্রীক রাষ্ট্রনীতিক সলােনকে তিনি আপ্যায়ন করেছিলেন। স্ক্রামুজ্জা এবং ম্যাককেন্দরিক লিখেছেন, ‘A well-educated man and an innovator in music, Croesus vigorously carried out Gyges’ policy of making Lydia cultural center. His keen mind reached out for Greek learning while the Greeks on their part tapped eastern culture through Lydia’। (Scramuzza, Vincent M. and Mackendrick, Paul L. The Ancient World (New York : Hoit Rinchart and Winston, 1966, p.108)। ক্রিসাস লিডিয়ায় সুষ্ঠু শাসন কায়েম করেন এবং দেশের সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সংগঠক ও প্রশাসক আবার তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম বড় ধরনের ব্যবসায়ী। তিনি আনাতােলিয়ার খনিজ সম্পদ আহরণ করেন। খুব সম্ভব রাজা জাইজিস পৃথিবীতে প্রথম মুদ্রাঙ্কন করেন। কিন্তু ক্রিসাস এসব সুবর্ণ মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক বিনিময়ের মাধ্যমে পরিণত করেন। মুদ্রার উদ্ভাবন ও প্রচলনের ফলে ব্যবসাবাণিজ্য সহজতর হয় এবং এর পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। তিনি দেশের শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার করেন। লিডিয়ার ভেতর দিয়ে এবং লিডিয়া থেকে পূর্বাঞ্চলে যেসব মালামাল পরিবহন করা হত তার উপর খাজনা ধার্য করা হত। এর ফলে প্রথমবারের মত সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক মাধ্যম ব্যবহার করা হয় যা ইউরােপের বাইরে অবস্থিত ছিল।

লিডীয়দের মুদ্রাব্যবস্থার আবিষ্কার : বিশ্ব সভ্যতায় লিভীয়দের অসাধারণ অবদান ছিল যে তারাই সর্বপ্রথমে মুদ্রা উদ্ভাবন এবং এর তৈরী ও ব্যবহার শুরু করে। আধুনিক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা খৃষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দকে এই সফলতার সময়কালরূপে অভিহিত করেন। খৃষ্টপূর্ব ৮ম শতকেই নিশ্চিতভাবে অঙ্কিত মুদ্রার ব্যবহার চালু হয়। মুদ্রা তৈরীর কাজে সর্বপ্রথম স্বর্ণ ও রৌপ্যের সংমিশ্রণে তৈরী electrum নামক ধাতব ব্যবহার করা হয়। ক্রিসাসের সময় দ্বিধাতুর তৈরী এক প্রকার মুদ্রার উদ্ভাবন করা হয়। এতে রৌপ্য ও স্বর্ণের আনুপাতিক হার ছিল ১.৩২:১। জাইজিসের সময় মুদ্রাঙ্কনের বিষয়ে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এভাবেই মুদ্রাঙ্কন ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। লিডীয় মুদ্রা ছিল শিমের আকৃতি (bean-shaped) সম্পন্ন। একখন্ড ধাতব পদার্থের উপর কামারের নেহাই থেকে ছাপ প্রয়ােগ করা হত। এই মুদ্রা তৈরীর পদ্ধতি সম্পর্কে বার্নস লিখেছেন যে, “The process of manufacture was probably to heat the piece of metal and place it still hot upon an anvil, the surface of which had been striated, to prevent the metal slipping. Punches were then driven into the upper surface of the metal by a blow from a hammer, which reduced the globular mass of hot metal to the shape of a bean.” (Burn, A. R. Money and Monetary Policy in Eariy Times (New York : Knopf, 1927, p 54)। পরবর্তীকালে এথেনীয়রা আরাে উন্নতমানের ধাতব মুদ্রা তৈরী করে।

এশিয়া মাইনোর ও ইউরোপে পারসিক আক্রমণ

সাইরাসের এশিয়া মাইনোর বিজয়

লিডিয়ায় পারস্যরাজ সাইরাসের আক্রমণ : কিন্তু ক্রিসাসের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পারসিকরাজ সাইরাস। মিডিয়ার ৫০০ মাইল দক্ষিণে ফারস নামে একটি অঞ্চল ছিল, যা গ্রিকদের কাছে পরিচিত পারসিস নামে, আজ আমরা একেই পারসিয়া বা পারস্য বলি। ভাষা আর সংস্কৃতিতে পারসিয়ানরা ছিল মিডিসের কাছাকাছি। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে, অথবা তার কাছাকাছি সময়ে, একজন পারসিয়ান গােত্রের নেতার ঘরে এক সন্তানের জন্ম হলাে। তার নাম দেয়া হলাে কুরুশ (অর্থ সূর্য), কিন্তু তিনি আমাদের কাছে সাইরাস (Cyrus) নামে পরিচিত, যা তার নামের গ্রিক সংস্করণের ল্যাটিন উচ্চারণ। পরবর্তীতে কিংবদন্তী তাকে আস্টিয়াজিসের নাতি বানিয়ে দেয়, কিন্তু তা আসলে নাও হতে পারে। সাইরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৮ সালে পারসিয়ায় তার পিতার শাসনের উত্তরাধিকারী হন, আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ সালে তিনি মিডিয়ান রাজার বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের সূচনা করেন। তিনি আস্টিয়াজিসকে পরাভূত করে পারস্য সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হন। এই সাইরাসই এসময় বিশ্ববিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে সাইরাস মিডিয়ার সাথে লিডিয়ার বিবাদের সুযােগ নিতে তৈরি হন।

ক্রিসাসের পরাজয় : চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করতে লিডিয়াও পিছপা ছিল না। ক্রিসাস ভাবলেন শত্রু মিডিয়ার অঞ্চলে শাসকের পরিবর্তনের ফলে পূর্বদিকে তার শক্তি বাড়িয়ে নেয়ার চমৎকার সুযােগ রয়েছে। পারসিকদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য অনুধাবন করার পর ক্রিসাসই সাইরাসকে সর্বপ্রথম আক্রমণ করেন। ক্রিসাস পরিসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। কারণ গ্রীসের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র স্পার্টার সাথে তার সমঝােতা ছিল। এছাড়া ক্যালডীয়া এবং মিশরের সাথেও তার মিত্রতা ছিল। এ সময় তিনি ডেলফির মন্দিরে গিয়ে অ্যাপােলাে দেবতার নিকট ভবিষ্যদ্বাণী প্রার্থনা করেন। তিনি ডেলফির ওরাকলের সাথে পরামর্শ করেছিলেন আর ওরাকল তাকে আশ্বস্ত করল যে, “যদি ক্রিসাস হেলিস অতিক্রম করে, সে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ধ্বংস করবে।” কিন্তু ওরাকল এটা বলেনি যে কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যটি ধ্বংস হতে যাচ্ছে! ক্রিসাসও তাকে তা জিজ্ঞেস করেননি, ধরে নিয়েছিলেন পারস্যের কথাই বলা হচ্ছে। ক্রিসাস হেলিস (Halys) পার হয়ে গেলেন, যেখানে সাইরাসের সাথে এক যুদ্ধে তার মােকাবেলা হলাে। খৃষ্টপূর্ব ৫৪৬ অব্দের এই এ যুদ্ধে ক্রিসাস পরাজিত হন। ক্রিসাস তার মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় মিত্রদের নিকট থেকে সামরিক সাহায্য লাভ করার আগেই সাইরাস হাজার মাইল পথ দ্রুত অতিক্রম করে হ্যালিস নর্দীর সীমান্তে উপনীত হন। ফলাফল চূড়ান্ত হবার আগে ক্রিসাস রাজধানী সার্দিসে সৈন্য সংগ্রহের জন্যে ফিরে গেলে অতর্কিতে তার রাজধানীতে হামলা চালিয়ে সাইরাস লিডীয়ার রাজধানী দখল করে নেন, লিডীয়রা পারসিক বাহিনির উটের গন্ধে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল এমনও জানা যায়। সাইরাস এভাবে একটি পরিপূর্ণ বিজয় লাভ করলেন। তিনি হেলিসের প্রান্তসীমায় লিডিয়ানদের কব্জা করলেন, আর এরপর তিনি সারদিসের (Sardis) দখল নিলেন। এভাবে পারসিকরা লিডিয়া দখল করে এবং ক্রিসাস বন্দী হন। তবে সাইরাস ছিলেন একজন মানবতাবাদী নেতা যিনি ক্রিসাসকে একজন সম্মানিত অতিখির মর্যাদা দেন ও একবাতায়নায় তাকে বসবাস করার অনুমতি দেন। সেখানে খৃষ্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে ক্রিসাসের মৃত্যু হয়। ডেলফির ওরাকল যে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কথা বলেছিল তা ছিল ক্রিসাসের নিজেরই সাম্রাজ্য। আর কোন দিন লিডিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। এটি ওরাকলের দ্ব্যর্থবােধক ঘােষণার সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ, ঘটনা যাই ঘটুক, দ্ব্যর্থতার জন্যই ওরাকল যা বলতো তা সত্য হলো! এই কারণেই এরকম দ্ব্যর্থতাপূর্ণ ঘােষণাকে “ওরাকুলার” বা ডেলফিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

আয়োনীয় গ্রিক নগরগুলোয় সাইরাসের আক্রমণ : লিডিয়ার ধ্বংসের সাথে সাথে উপকূলে আর কোনাে গ্রিক শহরগুলোও হুমকির মুখে পড়ল। এবারও তারা ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হলাে। প্রিয়েনি নামক মিলেটাসের নিকটের একটি শহরের বায়াস অফ প্রিয়েনি (Bias of Priene) নামে একজন আয়োনীয় পলায়নের একটি পন্থা বাতলে দিলেন। তিনি সব গ্রিককেই জাহাজে করে পশ্চিমে সার্দিনিয়ায় পাড়ি জমাতে প্রস্তাব করলেন, যেটি তখন গ্রিক বসতি স্থাপনের জন্য কেবলই উপযুক্ত করা হয়েছে। বায়াসকে পরবর্তীতে সাতজন জ্ঞানী মানুষের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এরা পালিয়ে গেলেও বেশিরভাগ আয়োনীয় গ্রিকরা তাদের জায়গাতেই থেকে গেল, আর একে একে আয়োনীয় নগরগুলোকে সাইরাসের জেনারেলরা কব্জা করতে লাগল। আর এবারও একমাত্র মিলেটাস নগরই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হল। কিন্তু গ্রিক নগরগুলোর সাথে বোঝাপড়া করার আগেই সাইরাস দক্ষিণের দিকে আরও একটি বড় খেলা খেলবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬২ অব্দে নেবুচাদনেজার মারা যান আর ক্যালডীয় সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন দুর্বল রাজারা। এই সাম্রাজ্য ক্রিসাসকে সাহায্য করতে চেয়েছিল কিন্তু তাতে ভাল কিছুই হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ অব্দে সাইরাস সহজেই ক্যালডীয় সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেন। এরপর সাইরাস পূর্বমুখী যাত্রা করে ভারত ও চীনের সীমান্ত-অঞ্চল অব্দি কব্জা করে ফেলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ অব্দে তিনি মারা যান। এভাবে গ্রিক দুনিয়ার একটি অংশ সাইরাসের এই বিশাল ভূখণ্ডের সাম্রাজ্যের একটি অংশ হয়ে গেল, যা গ্রিকদেরকে নিরাপদে বিশাল ভূখণ্ডের এই মহাদেশীয় অংশে ভ্রমণ করা সম্ভব করে দেয়। যে একজন গ্রিক এর সুবিধা নিলেন, তিনি হলেন মিলেটাসের হেকাটিউজ, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের ভেতর দিয়ে মুক্তভাবে ভ্রমণ করেছিলেন এবং ভূগােল আর ইতিহাসের ওপর বই লিখেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এগুলো টিকে নেই। পরবর্তী লেখকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যার কাছে ইতিহাস ছিল দেবতা আর বীরদের কিংবদন্তী থেকেও বেশি কিছু। প্রকৃতপক্ষে, তিনি উপকথা সম্মন্ধে সন্দেহযুক্ত আর সরাসরি নিন্দামূলক মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, যা একজন আয়োনিয়ানের কাছ থেকেই তখন আশা করা যেতো।

প্রথম দারিউসের ইউরোপ আক্রমণ

প্রথম দারিউসের ক্ষমতায় আসা : সাইরাসের মৃত্যুর পরও পারস্যদের দিগ্বিজয় চলতে লাগল। তার পুত্র ক্যাম্বিসেস (Cambyses) অনুধাবন করলেন মিশর তার সঠিক শিকার, কেন না এটিই ছিল পুরনো আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের একটি অংশ যা এখনাে স্বাধীন রয়ে গেছে। মিশর তখন ১৫০ বছর ধরে স্বাধীন ছিল, এবং তার রাজা, গ্রিসের বন্ধু এবং সামােসের পলিক্রেটিসের এক সময়ের মিত্র, আমেসিস, প্রচুর শক্তির সাথে সাইরাসের উত্থান এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি দেখছিলেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ সালে মারা যান, ঠিক যখনই ক্যাম্বিসেস তার আক্রমণ সামলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পারসিয়ান বহিঃআক্রমণ সম্পূর্ণ সফল হলাে আর মিশর পারসিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে গেল। ক্যাম্বিসেস যখন মিশরে ছিলেন, যেভাবেই হােক, দেশে একটি বিদ্রোহ দেখা দিল। ব্যাপারটি দেখার জন্য পেছনে ফিরে আসার পর, ক্যাম্বিসেস খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ সালে মারা যান, সম্ভবত দুর্ঘটনার বা আত্মহত্যার কারণে। পারস্য সাম্রজ্যের এর পরের চার বছর ছিল বিভ্রান্তি ও গৃহযুদ্ধময়। প্রতিষ্ঠার মাত্র এক প্রজন্ম পরেই এই সাম্রাজ্যটি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। পারস্যের রাজকীয় পরিবারের একমাত্র প্রথম দারিউসই সাম্রাজ্যকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। ৫২১ সালে তিনি ক্ষমতা দখল করেন এবং পারস্যের সকল বিদ্রোহকে শক্তি ও দক্ষতার সাথে দমন করেন, বিশেষভাবে তিনি দমন করেন ব্যাবিলনিয়ার বিদ্রোহটি, যা খুব বিপজ্জনক ছিল। তিনি অনুধাবন করলেন, পারস্যের এতদিনকার অবাধ দিগ্বিজয়কে থামিয়ে দেবার এটাই সঠিক সময়, কেননা এবারে এতদিন যাবৎ যেসব অঞ্চলকে জয় করা হয়েছে সেগুলোকেই ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নিতে হবে। আর এই কাজটা সহজ ছিলনা। ১০ মাইলের একটা গ্রিক নগরকে পরিচালনা করা সহজ, কিন্তু পারস্য সাম্রাজ্য ছিল আজকের স্ট্যান্ডার্ডেও অনেক বিশাল, পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২৫০০ মাইল বিস্তৃত। এতে ছিল পর্বত, মরুভূমি, আর ভূমিতে যাতায়াতের একমাত্র উপায় ছিল ঘোড়া বা উট। দারিয়ুস সাম্রাজ্যটিকে বিশটি প্রদেশে ভাগ করেছিলেন, যার প্রত্যেকটির দায়িত্বে ছিলেন একজন শতরাপাভন বা রাজ্যের রক্ষাকর্তা। গ্রিকদের কাছে, এই শব্দটি ছিল সত্রপ, আমাদের কাছেও তাই, আর একেকটি পারস্য প্রদেশ হলাে ‘সত্রপি’। দারিয়ুস সাম্রাজ্যের পূর্বের সড়কসমূহের উন্নয়ন সাধন করেন ও নতুন সড়ক তৈরি করেন, উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখা। লিডীয়রা যে মুদ্রাব্যবস্থা আবিষ্কার করেছিল তিনি সেটাকে গ্রহণ করেন। এসব কারণে তার অধীনে পারস্য সাম্রাজ্যের উন্নতি লাভ করতে থাকে।

প্রথম দারিউসের ঈজিয়ান দ্বীপসহ ও বলকানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল : এভাবে সাম্রাজ্যে শান্তি ফিরে আসার পর দারিয়ুস চিন্তা করলেন, এবারে সাম্রাজ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে নজর দেয়া যাক। সাইরাস এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করেছিলেন, ক্যাম্বিসেস তাতে আফ্রিকার অঞ্চলগুলো যোগ করেছিলেন। দারিয়ুসের জন্য তাই ইউরোপই বাকি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫১২ সালে, দারিয়ুসের নেতৃত্বাধীন পারস্য সেনাদল ইউরোপের প্রণালি পেরিয়ে থ্রেসে অগ্রসর হল। এবারও পারস্যের সেনাবাহিনী সফল, এবং পারস্য সাম্রাজ্যে কৃষ্ণসাগরের পশ্চিম উপকূল থেকে দানিয়ুব নদীর মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত হলাে। এই অভিযানে নতুন গ্রিক অঞ্চলগুলাে পারস্য সাম্রাজ্যে চলে আসে। দারিউসের পূর্বসূরী সাইরাস ইতিপূর্বে লিডিয়া দখল করেন। এই বিজয়ের ফলে পারসিকরা এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলের গ্রীক ভাষাভাষী নগরীগুলোর শাসকে পরিণত হয়। এরপর দারিউস গ্রিসে সমরাভিযান পরিচালনা করে গ্রিসের অংশবিশেষ ও ম্যাসিডােনিয়া পর্যন্ত এলাকাকে নিজের রাজ্যভুক্ত করতে পেরেছিলেন। অর্ধশতাব্দী পূর্বে পিসিস্ট্রটাস থ্রেসিয়ান কেরসােনিসে এথেনিয়ান বাহিনীকে পাঠিয়ে একটি যুদ্ধে যুদ্ধরত স্থানীয়দের সাহায্য করেছিলেন। থ্রেসিয়ান কেরসােনিস (থ্রেসিয়ান উপদ্বীপ) ছিল হেলেসপন্টের ইউরোপীয় পার্শ্বে অবস্থিত ষাট মাইল দীর্ঘ একটি একটি ভূখণ্ড (আধুনিককালে, এটি গালিপােলি উপদ্বীপ নামে পরিচিত)। সেনাবাহিনীর নেতা হিসেবে পিসিস্ট্রটাস তার পুরনাে রাজনৈতিক শত্রু মিলটিয়াডিসকে বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধে এথেন্সবাসীরা জয়ী হয়েছিল, আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৬ সালে মিলটিয়াডিস সেই উপদ্বীপের টাইরান্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যাই হোক, এবারে এই থ্রেসিয়ান কেরনোসিস পারস্যদের অধীনে চলে এলো। এমনকি লেমনস আর ইমব্রোসের মতাে দক্ষিণের ঈজিয়ান দ্বীপও পারস্য সাম্রাজ্যের হয়ে যায়। এভাবে দারিউসের সৈন্যরা প্রোপন্টিস থেকে স্ক্রাইমন নদী পর্যন্ত থ্রেস এবং লেমন্‌স ও ইমব্রোস দ্বীপকে পারসিক প্রদেশে পরিণত করেন। দারিয়ুস ইউরোপে তার অধীনস্ত অঞ্চলগুলোকে শান্তিতে শাসন করবেন এই আশা নিয়েই ফিরে এলেন। আর এটাই হবার কথা ছিল, যদিনা মিলেটাস ও এথেন্স তার শান্তিতে বাধা না দিত। 

শকদের বিরুদ্ধে দারিউসের অভিযান : দারিউস পশ্চিমদিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে মূল ভূখণ্ডের গ্রীকদের প্রতি তার নীতির ভিত্তি কি হবে তিনি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন। আত্মীকরণ (absorption) করা ছিল এক্ষেত্রে একটি সমাধান। কিন্তু তিনি অবহিত ছিলেন যে, এশীয় ভূখণ্ডের গ্রীকরা ভাল যােদ্ধা, নাবিক, সভ্য, পৌরুষপূর্ণ এবং বিত্তবান। আবার গ্রীস আক্রমণ করার পূর্বে তাকে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে হয় যে, গ্রীস পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাতায়াত পথের কোন স্থান শক বা সিথিয়ান জাতি কর্তৃক আক্রান্ত হবে না। এ সময় শকরা দারিউসের রাজ্য আক্রমন করত। আপাতদৃষ্টিতে দারিউস সদ্য প্রতিষ্ঠিত শক সাম্রাজ্যকে আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণ সাগরের উত্তরদিকে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইউরােপীয় দৃষ্টিকোন থেকে এই সাম্রাজ্য ছিল একটি অগ্রবর্তী এলাকা। সম্ভবত ফিরতি যাত্রায় তিনি শকদের মূলভূখণ্ড বিজয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এক্ষত্রে তিনি এই অভিযানের সম্ভাব্য বিপজ্জনক দিক ও অসুবিধাকে ঠিকমত উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হন। যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ৫১২ অব্দে দারিউস বসফরাস প্রণালীর ওপর নৌকা সংযুক্ত করে নির্মিত একটি কৃত্রিম সেতুর ওপর দিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দেন। এর ওপর দিয়ে প্রণালী পার হয়ে তিনি দানিয়ুব এলাকার দিকে চলে যান। অতপর আয়োনীয় অঞ্চলের স্বৈরাচারী শাসকগণ কর্তৃক সরবরাহকৃত একই ধরনের নৌকাযােগে গঠিত সেতুর ওপর দিয়ে তিনি দানিয়ুব অতিক্রম করেন। কিন্তু শকরা দারিউসের বাহিনীকে রণক্ষেত্রে মােকাবেলা করার পরিবর্তে তার বাহিনীকে উপর্যুপরি হয়রানি করতে থাকে। তাছাড়া রসদ ও পানীয়ের নিদারুন অভাব দেখা দেয়। এসব কিছুর ফলে শক ভূখণ্ড জয়লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি ভােলগা অঞ্চলে পর্যন্ত গমন করেন এবং এমনকি দক্ষিণ ইউক্রেন পর্যন্ত তিনি শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্ত্র শকরা ইউক্রেনের গভীর অভ্যন্তরভাগে আত্মগােপন করে এবং দারিউস তাদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন। এই অভিযানের নেতিবাচক এবং ইতিবাচক উভয় দিকই ছিল। ভিনসেন্ট এম স্ক্রামুজ্জা এবং পল এল, ম্যাককেন্ড্রিক এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “নেপোলিয়ন ও হিটলারের মতো তিনি খালি হাতে পশ্চাদপসরণ করেন, কিন্তু দানিউবের মুখ পর্যন্ত তিনি তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন। তার সাম্রাজ্য ছিল সেই সময়ের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ, এটি প্রায় বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বৃহৎ ছিল, এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অংশ নিয়ে এই সাম্রাজ্য গঠিত ছিল।” (Scramuzza et. al. 111)। এভাবে ৩৭ বছরের মধ্যে পারসিকরা নিজেদেরকে একটি শাসিত জনগােষ্ঠির পর্যায় থেকে শাসকের মর্যাদায় উন্নীত করে। তাদের এই সাম্রাজ্যে আনাতােলিয়া, মিশর, মেসােপটেমিয়া, ইরান এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সাম্রাজ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে ম্যাককে. হিল ও বাকলার লিখেছেন যে, ”তারা (পারসিক) একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যার মধ্যে প্রাচীন ও সবচেয়ে সম্মানিত রাজ্যগুলো  ও প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের জনসাধারণও অন্তর্ভূক্ত ছিল, এরকম বিশাল রাজনৈতিক সংগঠনের দ্বারা এই অঞ্চলগুলোর একত্রীকরণ এর আগে কখনও দেখা যায়নি।” (McKay et. al., 59)। তবে সাম্রাজ্য বিস্তৃতির চেয়ে যে নীতির ভিত্তিতে এই সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে তা ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিজিত অসংখ্য জাতিকে একই সরকারের অধীনে অনায়ন করা হয়, যদিও প্রত্যেক জাতির জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা হয়।

পরবর্তীতে গ্রেকো-পারস্যের যুদ্ধ সংঘটিত হয় যার ফলস্বরূ্প খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ অব্দে পারস্য পরাজিত হয় এবং সমস্ত গ্রিস, আয়োনিয়া ও ঈজিয়ান অঞ্চল পারস্যদের হাত থেকে স্বাধীন হয়ে যায়। সে-সম্পর্কে জানতে এখানে যান।

তথ্যসূত্র

  • Isaac Asimov, The Greeks : A Great Adventure, Houghton Mifflin Company Boston, p. 81-95
  • Robinson Jr., Charles A. Ancient History (New York : Macmillan, 1967, p. 111
  • Burn, A. R. Money and Monetary Policy in Eariy Times (New York : Knopf, 1927, p 54)
  • Scramuzza, Vincent M. and Mackendrick, Paul L. The Ancient World (New York : Hoit Rinchart and Winston, 1966, p.108)
  • Barnes, Harry Elmer, A Survey of Western Civilization (New York : Thomas Crowell, 1947, p. 84)

 

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও দর্শনের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.