হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যা ও হাইডেগারের (১৮৮৯-১৯৭৬) অস্তিত্ববাদ

Table of Contents

প্রপঞ্চবিদ্যা এবং এডমন্ড হুসার্ল

প্রপঞ্চবিদ্যার ইতিহাস

প্রপঞ্চবিদ্যা বা রূপবিজ্ঞানের বেশ একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ল্যামবার্ট (Lambert) নামে একজন জার্মান দার্শনিক ১৮শ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম তার চিন্তাধারাকে বােঝানাের জন্যে প্রপঞ্চবিদ্যা (Phenomenology) শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। ফেনোমেনন বা অবভাস বলতে ল্যামবার্ট আমাদের অভিজ্ঞতার ভ্রমাত্মক দিকগুলােকে বুঝিয়েছেন এবং সে কারণে তার মতে প্রপঞ্চবিদ্যা হলাে ভ্রম-সম্পৰ্কীয় মতবাদ। ল্যামবার্টের সমসাময়িক কান্ট মাত্র দু’একবার তার দর্শনে প্রপঞ্চবিদ্যা শব্দটি ব্যবহার করেছেন, অবশ্য অন্য এক নতুন ও বৃহত্তর অর্থে। কান্ট আমাদের এ পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালে এক স্বরূপগত সত্তার (noumena বা things-in-themselves) কথা বলেছেন যা তার মতে অজ্ঞেয় ও অজ্ঞাত। সেই স্বরূপগত সত্তাসমূহের বিপরীতে দৃশ্যমান বাহ্যবস্তুসমূহের আলােচনাকে বােঝানের জন্যে কান্ট রূপবিজ্ঞান শব্দটিতে প্রয়ােগ করেছেন। হেগেল তার phenomenology of mind গ্রন্থে প্রপঞ্চবিদ্যা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। পরম সত্তা (Absolute) বা পরমাত্মার (Mind বা Spirit) দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে সেই অভিব্যক্তিকে যা নিম্নস্তরে ইন্দ্রিয়-চেতনা থেকে শুরু করে প্রত্যক্ষণ, বােধ ও চেতনার বিভিন্ন প্রকারের মধ্য দিয়ে উচ্চস্তরে বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকর্ম পর্যন্ত বিস্তারিত নির্দেশ করার জন্যে। অতি সাম্প্রতিককালে প্রপঞ্চবিদ্যার সাথে অনেকের নাম যুক্ত হয়ে আছে; তবে এদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযােগ্য হচ্ছেন এডমুন্ড হুসার্ল (Edmund Husserl, ১৮৫৯-১৯৩৮ খ্রি.) নামে একজন জার্মান-ইহুদি দার্শনিক। হুসার্ল শুধু যে এ দার্শনিক মতবাদের একজন মৌলিক ও অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন তা নয়, তাকেই সাধারণত প্রপঞ্চবিদ্যার প্রবক্তা বলে মনে করা হয়।

সমকালীন দার্শনিক চিন্তায় প্রপঞ্চবিদ্যা বা রূপবিজ্ঞান (Phenomenology) একটি বিশিষ্ট প্রভাবশালী মতবাদ। এডমন্ড হুসার্ল নামক একজন জার্মান দার্শনিক এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। গাইগার, শেলার, পেফান্ডের এবং রাইনাখ প্রমুখ চিন্তাবিদগণ হুসার্লের এই মতবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযােগিতা করেছেন। তবে পরবর্তীতে হাইডেগার এবং সার্ত প্রমুখ দার্শনিকদের হাতে পড়ে এই মতবাদ তার মৌলিক তথা নিজস্ব অবস্থান হারিয়ে অস্তিত্ববাদী দর্শনে বিলীন হয়ে যায়।

এডমন্ড হুসার্লের জন্ম ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। জন্মসূত্রেই তিনি ছিলেন ইহুদী। ইহুদী উত্তরাধিকারের জন্য শেষ জীবনে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। হুসাৰ্ল প্রথম জীবনে গণিতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। গণিত নিয়ে তিনি লেখাপড়া এবং গবেষণা কর্ম সম্পাদনা করেন। ১৮৮১ সালে তিনি গণিতের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর স্বনামধন্য গণিতবিদ কার্ল থিওডর ভাইয়রেস্ট্রাস-এর অধীনে (তার সহকারী হিসেবে) ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু ইতােমধ্যে তার দর্শনের প্রতি অনুরাগ জন্মে। তিনি চলে যান ভিয়েনায়। সেখানে গিয়ে বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রেঞ্জ ব্রেনটানাের অধীনে দর্শন অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে দর্শন অধ্যয়ন করেন। এর পরে, ১৮৮৭ সালে তিনি গ্যায়টিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তারপর তিনি ফ্লাইবুগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করেন। ১৯২১ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। গণিত ও দর্শনের ওপর তিনি বেশ ক’টি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে The Philosophy of Mathemetics, Prolegomena to the Pure Logic, Ideas, ইত্যাদি প্রধান। মূলত বিশুদ্ধ গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বের প্রকৃত ভিত্তি অনুসন্ধান করাই ছিল হুসার্সের প্রধান লক্ষ্য। এজন্য তিনি এক বিশেষ পদ্ধতির অনুমােদন করতে গিয়ে প্রপঞ্চবিদ্যা (Phinomenology) নামক নতুন দার্শনিক তত্ত্বে উপনীত হন।

ব্রেন্টানোর প্রপঞ্চবিদ্যা

হুসার্লকে প্রপঞ্চবিদ্যার প্রবক্তা বলে গণ্য করা হলেও আসলে এ চিন্তাধারাটির গােড়াপত্তন হয় হুসেলের গুরু ব্রেন্টানাের (Franz Brentano) হাতে। ব্রেন্টানাে তার Psychology from an Empirical Point of View নামক গ্রন্থে অভিপ্রায় (intentionality) ধারণাটির উপর ভিত্তি করে বর্ণনামূলক মনােবিজ্ঞানের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন। এর দ্বারা হুসার্ল গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং ব্রেন্টানাের অভিপ্রায় ধারণাটির ব্যাখ্যা ছাড়া রূপবিজ্ঞানের উৎপত্তি হতাে না বলে মন্তব্য করেন। ব্রেন্টানাে অভিজ্ঞতামূলক মনােবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে অন্যান্য অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর মধ্যে মূল পার্থক্য কি এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন। অর্থাৎ, উদাহরণস্বরূপ, ভূতত্ত্ববিদরা ভূত্বক বা পৃথিবীর কঠিনাবরণ সম্পর্কে বা পাখি বিশারদরা পাখি সম্পর্কে যে আলােচনা করেন তার সঙ্গে মনােবিজ্ঞানীদের চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলােচনার মধ্যে পার্থক্য কি? ব্রেন্টানাের মতে মনােবিজ্ঞানীরা যে অবভাসের বর্ণনা দেন তাহলাে ধারণা। ধারণা বলতে তিনি যা ধারণা করা হয় বা কল্পনা করা হয় তাকে বােঝান না, তিনি বােঝান ধারণা বা কল্পনার ক্রিয়াকে যেমন, কোনাে সুর শােনা, রঙিন বস্তুকে দেখা বা সাধারণ ধারণার চিন্তা প্রভৃতি। এখানে লক্ষণীয় যে, এ শােনা দেখা বা চিন্তার ক্রিয়াটি সম্ভব নয় যদি এর বিপরীতে কোনাে বস্তু না থাকে। তাই যা মানসিক (psychical) ক্রিয়া তার বৈশিষ্টই হলাে কোনাে বস্তুকে নির্দেশ করা। এখানে অবশ্য একটি মনস্তাত্ত্বিক অবভাস ও অন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক অবভাসের মধ্যে কিভাবে পার্থক্য করা যায় সে প্রশ্নটি এসে যায়। এ পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে অবভাসের সঙ্গে এর বিষয়বস্তুর মধ্যে সম্পর্কের বিভিন্নতার উপর ভিত্তি করে। এবং এ বিভিন্নতা নির্ধারণ করতে হবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা অন্তপ্রত্যক্ষণের মাধ্যমে যার ফলে বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়া যেমন কোনােকিছু সম্পর্কে আশা করা ও কোনােকিছু সম্পর্কে ভীত হওয়ার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব।

মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকর্ম বস্তুকে নির্দেশ করে – ব্রেন্টানাের এ ধারণা দর্শনের ইতিহাসে প্রপঞ্চবিদ্যার বিকাশে নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযােগ্য অবদান। এখানে মনে হতে পারে যে, দৈহিক ক্রিয়ার জন্য বস্তুর অবশ্যই অস্তিত্ব থাকতে হবে, কিন্তু মানসিক ক্রিয়ার জন্য বস্তুর অস্তিত্বশীল হবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ব্রেন্টানে অন্যভাবে দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, মানসিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও বস্তুর অস্তিত্বশীল হবার প্রয়ােজন আছে। আমি একটা বাস্তব দ্বীপের যেমন ধারণা বা আকাক্ষা করতে পারি, ঠিক তেমনি একটা কাল্পনিক দ্বীপেরও ধারণা করতে পারি। আমার কাল্পনিক দ্বীপটি আমার চিন্তা, ধারণা বা আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে আমার কাছে যা এটা ঠিক তাই। এ অর্থে বাস্তবে না হলেও এর একটা অস্তিত্ব রয়েছে। কাজেই বাস্তবে অস্তিত্বশীল না হলেও মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়ার বিষয়বস্তু হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক বস্তুকে কোনাে না কোনােভাবে অস্তিত্বশীল হওয়া অত্যাবশ্যক। কিন্তু প্রশ্ন হলাে আমাদের আরও অনেক মানসিক ক্রিয়াকর্ম রয়েছে, যেমন আমাদের মনের বিভিন্ন অবস্থা (moods) যার কোনাে বস্তু আছে বলে মনে হয় না। কাজেই মানসিক ক্রিয়া বস্তুকে নির্দেশ করে – ব্রেন্টানাের এ মতকে যদি গ্রহণ করতে হয়, তাহলে আমাদের মনের বিভিন্ন অবস্থাকে মানসিক ঘটনা না বলে দৈহিক ঘটনা বলতে হবে। ব্রেন্টানাে এরও ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। তার মতে আমাদের যে কোনাে মানসিক অবভাস বা ক্রিয়ার সম্ভাব্য দুটো বস্তু থাকে – একটি মুখ্য, অন্যটি গৌণ। মুখ্য বস্তুটি হলাে যা ক্রিয়ার বহির্ভূত থাকে, যাকে ক্রিয়া বা অবভাস নির্দেশ করে, যেমন চিন্তার, ভালােবাসার বা আশার বস্তু। আর গৌণ বস্তুটি হলাে স্বয়ং মানসিক অবভাস। সব মানসিক অবভাসের মুখ্য বস্তু থাকে না, কিন্তু গৌণ বস্তু অবশ্যই থাকতে হবে। মনের অবস্থার ক্ষেত্রে এর বস্তু হলাে মনের অবস্থা নিজেই। কারণ মনের অবস্থা যদি নিজের সম্পর্কে সচেতন না হয় বা নিজের প্রতি নির্দেশ না করে তা হলে তা কখনাে চেতনাময় মনের অবস্থা হতে পারে না। ব্রেন্টানাের এ ধারণা অস্তিত্ববাদকে তথা অস্তিত্ববাদী মনােবিজ্ঞানের বিকাশে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ব্রেন্টানাের মতােই তাই সার্তকে বলতে শুনি যে, সব মানসিক ক্রিয়া অনিবার্যভাবে আত্মসচেতনমূলকও। আমরা যখন কোনাে বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করি বা ধারণা করি তা একই সঙ্গে সচেতনাকেও প্রকাশ করে। এদিক বিচারে কোনাে মানসিক ক্রিয়া সচেতনমূলক নয় বলা বিরােধপূর্ণ।

হুসার্লের মনস্তত্ত্ববাদ বিরোধিতা ও ব্রেন্টানোর সাথে তার মতবাদের পার্থক্য

তবে মনে রাখতে হবে যে, ব্রেন্টানাে এবং অস্তিত্ববাদীদের মাঝখানে দাড়িয়ে আছেন হুসার্ল এবং তার প্রভাবই অস্তিত্ববাদীদের উপর সবেচেয়ে বেশি। অবশ্য এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, ব্রেন্টানাের বর্ণনামূলক মনােবিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই উৎপত্তি হয়েছে হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যার চিন্তাধারা। হুসার্লের রূপবিজ্ঞানও বর্ণনামূলক। এর কাজ হলাে প্রত্যক্ষ চেতনার মাধ্যমে অবভাসের বর্ণনা দেওয়া। তবে পর্যবেক্ষণীয় (observable) অবভাসের বর্ণনা দেওয়া প্রপঞ্চবিদ্যার কাজ নয়, কারণ এটি অত্যাবশ্যকভাবে একটি অনভিজ্ঞতামূলক (nonempirical) বিজ্ঞান। অন্যদিকে ব্রেন্টানাের বর্ণনামূলক মনােবিজ্ঞান কিন্তু একটি অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞান। হুসার্ল ব্রেন্টানাের দ্বারা প্রভাবিত হলেও শুরু থেকে দুজনের মধ্যে একটা উল্লেখযােগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। হুসার্ল সুস্পষ্টভাবে দর্শন ও মনােবিজ্ঞানের ভূমিকার মধ্যে একটা পার্থক্য নির্ণয় করতে চেয়েছেন এবং সে উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে দর্শনের তথা যৌক্তিক ও গাণিতিক সত্য বা উক্তির সঙ্গে মনােবৈজ্ঞানিক সত্য বা উক্তিকে অভিন্ন মনে করার সেই মনােবিজ্ঞানবাদ বা মনস্তত্ত্ববাদ (psychologism) নামে পরিচিত মতবাদ আক্রমণ করেন। অবশ্য হুসার্লই মনস্তত্ত্ববাদের বিরােধিতা করার একমাত্র দার্শনিক নন। কান্ট, লােজ্বসে (Lotze), ফ্রেগে (Frege) এবং নব্য কান্টপন্থীরা মনস্তত্ত্ববাদ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং সমালােচনা করেন।

হুসার্লের মনস্তত্ত্ববাদের বিরােধিতা করার কারণ হলাে যৌক্তিক উক্তিসমূহকে মনস্তাত্ত্বিক উক্তিসমূহের সঙ্গে একীভূত করা যায় না, কেননা যৌক্তিক উক্তিগুলাে হলাে অনভিজ্ঞতামূলক আর মনস্তাত্ত্বিক উক্তিগুলাে হলাে অভিজ্ঞতামূলক। মনােবিজ্ঞান বাস্তব ঘটনা (facts) নিয়ে আলােচনা করে বলে এর উক্তিসমূহ অভিজ্ঞতামূলক। অভিজ্ঞতামূলক উক্তিসমূহ অত্যাবশ্যকভাবে সত্য নয়, সম্ভাব্য সত্য মাত্র; বিশেষ বিশেষ ঘটনার উপর ভিত্তি করে গঠিত হবার কারণে এগুলাে আরােহমূলক সাধারণীকরণের (inductive generalization) উপর নির্ভরশীল এবং সে কারণে ভবিষ্যতে আরও পর্যবেক্ষণের দ্বারা এগুলাে ভুল প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু যৌক্তিক উক্তিসমূহ সুনির্দিষ্ট, অত্যাবশ্যকভাবে সত্য এবং কোনাে আরােহমূলক পদ্ধতিতে গঠিত নয় বা আরােহমূলক সাধারণীকরণের উপর ন্যস্ত নয়। এভাবে মনস্তত্ত্ববাদকে খণ্ডন করে হুসার্ল দেখালেন যে, উক্তি দু’রকমের : অভিজ্ঞতামূলক এবং অনভিজ্ঞতামূলক। আর প্রপঞ্চবিদ্যা সংক্রান্ত উক্তিসমূহ হলাে অনভিজ্ঞতামূলক। এবং সে কারণে এ উক্তিসমূহের সত্য-মিথ্যা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভরশীল নয়। তবে প্রপঞ্চবিদ্যা সংক্রান্ত উক্তিসমূহ যদিও অনভিজ্ঞতামূলক বা অভিজ্ঞতাপূর্ব (a priori), কিন্তু বিশ্লেষণাত্মক (analytic) নয়। এগুলাে ফেনোমেনন বা অবভাসের বর্ণনা দেয়, এবং কিভাবে বর্ণনা দেয় অর্থাৎ সঠিকভাবে অবভাসের বর্ণনা করে কিনা তার উপর নির্ভর করে এগুলাের সত্যতা। তবে তার আগে জানতে হবে অবভাস বলতে কী বোঝায়। তবে তারও আগে হুসার্লের দর্শনের একটা রূপরেখা দেয়া যাক।

প্রপঞ্চবিদ্যার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

প্রপঞ্চবিদ্যা হচ্ছে চেতনায় প্রকাশিত অবভাস (phenomena) বা রূপ সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক আলােচনা। হুসার্লের মতে চেতনায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশিত অবভাসের যথার্থ জ্ঞান (সাধারণ বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক) লাভ করতে পারলে বস্তুর প্রকৃত রূপ বা সারসত্তা সম্পর্কে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়। কেননা, বস্তুর অবভাস প্রকাশিত হয়ে গেলে তার সারসত্তা আর গােপন থাকতে পারে না। হুসার্ল চেতনা সম্পর্কে যে আলােচনা করেন তাকে তিনি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক আলােচনা বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, এটি কোন বৌদ্ধিক বা বিচারমূলক আলােচনা নয়। এটি এমন একটি বিশেষ পদ্ধতি-ভিত্তিক আলােচনা যা অনুসরণ করলে চেতনায় প্রকাশিত অবভাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। হুসাৰ্ল প্রপঞ্চবিদ্যাকে সুকঠোর বিজ্ঞান বলেও অভিহিত করেছেন। প্রপঞ্চবিদ্যা চেতনায় প্রকাশিত যে বিশেষ ধরনের অবভাস (phenomena) বা রূপ নিয়ে আলােচনা করে তা কান্টীয় অবভাসের মতাে অবভাস নয়। কান্টের মতে, অবভাস হলাে প্রকৃত বস্তু (thing-in-itself) থেকে উৎপন্ন অবাস্তব একটা কিছু। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা এই অবভাসের জ্ঞান লাভ করে থাকি। অবভাসকে জানা আর প্রকৃত সত্তাকে জানা এক কথা নয়। প্রকৃত সত্তা সর্বদাই অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়। কিন্তু হুসার্লের মতে অবভাস হল বস্তুর প্রকৃত রূপ। অবভাসের সঠিক কাঠামাে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারলে বস্তুর প্রকৃত সারসত্তা সম্পর্কেও জানা হয়ে যায়। মূলত বিশুদ্ধ অবভাসই হল প্রপঞ্চবিদ্যার বিষয়বস্তু। এই বিশুদ্ধ অবভাসের মাধ্যমেই সারসত্তা জানা যায়। আর এই বিশুদ্ধ অবভাস অন্বেষণের জন্যই চেতনাকে বিশ্লেষণ করতে হয়। চেতনায় যে বিশেষ প্রকৃতির অবভাস প্রকাশিত হয় তা স্বজ্ঞা বা ইনটুইশনের মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়। স্বজ্ঞার মাধ্যমেই আমাদের চেতনায় অবভাস উপস্থিত হয়। অবভাস তাই চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা, কামনা-বাসনাসহ সর্বপ্রকার মানসিক ঘটনার পূর্ববর্তী। স্বজ্ঞা হল একটি তাৎক্ষণিক অনুভূতি যা অন্য কোন মানসিক বৃত্তির ওপর নির্ভরশীল নয়।

প্রপঞ্চবিদ্যা ‘আভিমুখ্যতার নীতি’ অনুসরণ করে। একে বস্তুর প্রকৃত স্বরূপের দিকে প্রত্যাবর্তন বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। হুসার্লের মতে, চেতনার ক্রিয়া ও তার বিষয় একান্তভাবেই অভিন্ন। চেতনা মানে কোন বিষয় সম্পর্কে চেতনা, তাই চেতনা সর্বদা কোন বিষয়ের অভিমুখী। চেতনা বিশ্লেষণ করলে তাই কোন না কোন বিষয়ের জ্ঞান অবশ্যই পাওয়া যাবে। চেতনা থাকবে অথচ তার কোন বিষয় থাকবে না, এমনটি সম্ভব নয়। চেতনাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বস্তুর দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকি। প্রপঞ্চবিদ্যা হচ্ছে অভিজ্ঞতার বিজ্ঞান। এটি বিষয় বা বিষয়ীর বিজ্ঞান নয়। মানবঅভিজ্ঞতা (চেতনার মধ্যে প্রাপ্ত) নিয়ে প্রপঞ্চবিদ্যা আলােচনা করে সত্য, কিন্তু অভিজ্ঞতার বিষয় বা বিষয়ী এককভাবে প্রপঞ্চবিদ্যার আলােচ্য বিষয় নয়; বরং প্রপঞ্চবিদ্যা একই সাথে বিষয় ও বিষয়ী উভয়কে তার আলােচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে। চেতনায় প্রকাশিত শুদ্ধ অবভাসের মধ্যে বিষয় ও বিষয়ী একাকার হয়ে থাকে। আর এই অবভাসই হলাে প্রপঞ্চবিদ্যার আলােচনার কেন্দ্র বিন্দু।

প্রপঞ্চবিদ্যা এক বিশেষ ধরনের বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। একে রূপবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বলে অভিহিত করা হয়। এই বিশ্লেষণ নীতি যুক্তিবিদ্যক মনােবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণসহ সর্বপ্রকার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে স্বতন্ত্র। চেতনাকে বিশ্লেষণ করে চেতনায় উদ্ভাসিত অবভাসসমূহের সার্বিক কাঠামাে আবিষ্কারের মাধ্যমে বস্তুর প্রকৃত সারসত্তাকে জানাই এই বিশ্লেষণ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। প্রপঞ্চবিদ্যা হচ্ছে একাধারে একটি পদ্ধতি ও তত্ত্ব। পদ্ধতি হিসেবে প্রপঞ্চবিদ্যা একটি বিশেষ বিশ্লেষণ পদ্ধতি হাজির করে যার মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রপঞ্চবিদ্যা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর তত্ত্ব হিসেবে ইহা প্রকৃত সত্তা বা বস্তুর সারসত্তা সম্পর্কে এক বিশেষ মতবাদ হাজির করে। তাই প্রপঞ্চবিদ্যা একই সাথে একটি বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও দর্শন।

কোন প্রকার পূর্ব-স্বীকৃতির ওপর প্রপঞ্চবিদ্যা নির্ভর করে না। সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় প্রপঞ্চবিদ্যা চেতনাকে বিশ্লেষণ করতে প্রয়াসী। বস্তুর আসল রূপ জানতে হলে আমাদের চেতনায় বস্তুর যে বিশুদ্ধ অবভাস বা রূপ উদ্ভাসিত হয় তাকে জানতে হবে; জানতে হবে তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রে যদি কোন পূর্ব স্বীকৃতি গ্রহণ করা হয় তাহলে বস্তুর প্রকৃত সারসত্তা হয়তাে জানা যাবে না। তার সাথে অন্য কোন ধারণার সংমিশ্রণ ঘটে যেতে পারে। আমরা জানি, প্রত্যেকটি বিজ্ঞান কোন না কোন পূর্বধারণা বা স্বীকার্য সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু প্রপঞ্চবিদ্যা কোন প্রকার পূর্ব-ধারণার ওপর নির্ভর করার পক্ষপাতি নয়। পূর্ব-ধারণা স্বীকার করা দূরের কথা প্রপঞ্চবিদ্যা বস্তুকেই বিশ্লেষণ থেকে বাদ দেয়। রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুযায়ী বস্তুকে বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়। একে ‘রূপ বৈজ্ঞানিক হ্রাস’ (phenomenological reduction) বলা হয়। এই হ্রাস অনুসারে বস্তুর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলােকে বাদ দিয়ে সার্বিক বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃত সারসত্তাকে গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে বিশুদ্ধ চেতনাই কেবল গ্রহণ করা হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে চেতনার বাইরে যা কিছু থাকে তার সবকিছুকেই বাদ দেওয়া হয়। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর হ্রাস প্রক্রিয়ার জন্য রূপ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি একটি বিশেষ আত্মগত পদ্ধতিতে পরিণত হয়।

অবভাস বা রূপ (Phenomena)

দর্শনের ইতিহাসে বিভিন্ন দার্শনিক ‘অবভাস’ শব্দটিকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রপঞ্চবিদ্যার অবভাস প্লেটোনিক অবভাস, কান্টীয় অবভাসহেগেলীয় অবভাস থেকে ভিন্ন। প্লেটো অবভাস বলতে বাস্তব সত্তার (বাস্তব সত্তা হল সার্বিক ধারণা) ছায়া বা প্রতিরূপ বুঝিয়েছেন। প্লেটো আমাদের এ বাস্তব জগৎটাকে তার প্রত্যয় বা ধারণার জগতের প্রতিচ্ছবি বা অবভাস বলে অভিহিত করেছেন। কান্টের মতে, অবভাস হল প্রকৃত বস্তুর (Think-in-itself) নিছক প্রতীয়মান রূপ। এটি প্রকৃত সত্তার বা প্রকৃত বস্তুর ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু প্রকৃত বস্তুর সত্যিকারের প্রতিরূপ নয়। কান্ট স্বরূপগত সত্তা থেকে পার্থক্য করে দেখানাের জন্যে এ দৃশ্যমান জগতের বস্তুসমূহকে অবভাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হেগেল দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে অবভাস হিসেবে পরমসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রপঞ্চবিদ্যায় অবভাস ও সত্তার মধ্যে এ ধরনের চরম বিভক্তকরণকে অথবা একমাত্র অবভাসই বিদ্যমান – এ ধরনের সংকীর্ণ মতকে কোনােটিকেই গ্রহণ করেন না। অবভাস বলতে তারা বােঝাতে চান প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় (immediate experience) যা আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয় তাকেই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলতে প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ কখনাে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে (sensory observation) বোঝনি। অবভাস বলতে তারা কিন্তু বাহ্যবস্তু, চিন্তা, অনুভূতি, সংখ্যা, গল্প-কবিতা প্রভৃতি জগতের অস্তিত্বশীল সত্তার বাইরে অন্য কোনাে শ্রেণী সত্তার কথা বলছেন। তাদের প্রস্তাবিত রূপবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বা বিচার করলে যে কোনাে বস্তুই অবভাস। এ দৃষ্টিকোণটিই রূপবিজ্ঞানী তথা হুসার্লের বিখ্যাত উক্তি “বস্তুর নিজস্ব রূপ অবলােকন করা” (“zu den Sachen” বা “to the things”) এ ধারণার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।

অবভাস হল তাই যা চেতনায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশিত হয়। এজন্য প্রপঞ্চবিদ্যাকে চেতনা সম্পর্কিত বিজ্ঞানও বলা হয়ে থাকে। কেননা চেতনার বিজ্ঞান-ভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই অবভাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হল অবভাস চেতনায় কিভাবে ধরা দেয়? এ প্রশ্নের জবাবে হুসাৰ্ল বলেন একমাত্র স্বজ্ঞার মাধ্যমেই অবভাস চেতনায় উদ্ভাসিত হয়। আর স্বজ্ঞার মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয় বলে এটি হল শুদ্ধ এবং নিশ্চিত বিষয়। অবভাসে যা ধরা পড়ে তাকে নিশ্চিত বলেই ধরে নিতে হবে। প্রপঞ্চবিদ্যায় অবভাস বস্তুর সত্যিকারের রূপ। তাই বস্তুর প্রতিরূপ আর বাস্তবসত্তা মূলত একই রকমের। স্বজ্ঞার মাধ্যমে যদি কোন বিষয়ের অবভাস চেতনায় উদ্ভাসিত হয় তাহলে সেই বিষয়ের বাস্তবসত্তা আর অপ্রকাশিত থাকতে পারে না। আর এই অবভাসকে সঠিকভাবে বুঝতে পারলে সত্তার জ্ঞানার্জন সম্ভব। অবভাস সর্বদাই কোন বিষয়ের অবভাস কিন্তু বিষয়ের অবভাস হিসেবে এটা একান্তভাবে বস্তুগত নয়। আবার চেতনায় উদ্ভাসিত বলা হয়েছে বলে এটি একেবারে আন্তর্গতও নয়। এটি আত্মগত এবং বস্তুগত উভয়ই। বস্তুর আসল সত্তা অবভাসের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় সত্য কিন্তু চেতনার বিশেষ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই এই অবভাসকে সঠিকভাবে বােঝা যায়। আর ঐ অবভাস চেতনায় উদ্ভাসিত হয় স্বজ্ঞার মাধ্যমে। তাই একে একাধারে আত্মগত এবং বস্তুগত বলে প্রপঞ্চবিদ্যা দাবি করে। প্রপঞ্চবিদ্যা যে অবভাসের কথা বলে সেই অবভাস বস্তুর আসল প্রকৃতি তুলে ধরবে। তাই অবভাস সম্পর্কে কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রতি প্রপঞ্চবিদ্যা আকৃষ্ট নয়; প্রপঞ্চবিদ্যার লক্ষ্য হল অবভাসের সার্বিক বৈশিষ্ট্যের ওপর। অবভাসের সার্বিক বৈশিষ্ট্য জানতে পারলেই অবভাসের বিষয়গুলির প্রকৃত রূপ আমরা জানতে পারবাে বলে প্রপঞ্চবিদ্যা বিশ্বাস করে। বাস্তব ঘটনা দ্বারা বস্তুকে জানা যায় না। কোন বিষয়কে জানতে হলে ঐ বিষয়টি আমাদের চেতনার কাছে, স্বজ্ঞার মাধ্যমে, অবভাস রূপে যেভাবে নিজেকে উপস্থিত করে সেই অবভাসের সার্বিক কাঠামাে আবিষ্কার করতে পারলেই প্রকৃত বস্তু বা সারসত্তাকে জানা যাবে। প্রপঞ্চবিদ্যা তাই স্বজ্ঞার দ্বারা চেতনায় উদ্ভাসিত কোন বস্তু বা বিষয়ের অবভাস এর আলােচনা করে থাকে যে অবভাসের সার্বিক কাঠামাে ঐ বস্তু বা বিষয়ের সারসত্তা প্রকাশক।

প্রত্যক্ষবাদ বনাম প্রপঞ্চবিদ্যা ও পূর্ব-ধারণাবিহীন বিজ্ঞান হিসেবে প্রপঞ্চবিদ্যা

হুসার্ল তার প্রপঞ্চবিদ্যাকে বিজ্ঞানভিত্তিক করতে চেয়েছেন, কিন্তু দর্শন বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল – তিনি প্রত্যক্ষবাদীদের (Positivist) এই বিজ্ঞানবাদের বিরােধী ছিলেন। বিজ্ঞানবাদের মতে দার্শনিক যুক্তির ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক উক্তিসমূহ হেতুবাক্য (Premise) হিসেবে এমনভাবে কাজ করে যে দার্শনিক উক্তিগুলাের সত্যতা নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক উক্তিসমূহের সত্যতার উপর। এটা অস্বীকার করে প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ বলতে চান যে, দর্শনের প্রকৃত কাজ বা ভূমিকার প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি না দেবার কারণে এ ধরনের ধারণার উদ্ভব হয়েছে। আসলে দর্শনের যে কাজ তা বিজ্ঞান থেকে স্বাধীন। অবশ্য প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ বিজ্ঞানের বিরুদ্ধাচরণ করতে চাননি কখনাে, বরং প্রপঞ্চবিদ্যাগত পদ্ধতির মাধ্যমে দর্শনকে একটি কঠোরতম বিজ্ঞানে (rigorous science) পরিণত করতে চেয়েছেন। কাজেই দেখা যায়, প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণের উদ্দেশ্য দর্শনকে বিজ্ঞানের অধীন করা নয়, বরং দর্শনকে বিজ্ঞানােচিত করা। এ কাজটি তারা এমনভাবে করতে চান যেন প্রপঞ্চবিদ্যা সব বিজ্ঞানের জন্য ভিত্তি প্রদান করতে পারে, যার ফলে বিজ্ঞান যেসব ধারণা ব্যবহার করে কিন্তু ব্যাখ্যা করে না, প্রপঞ্চবিদ্যার মাধ্যমে সে সব ধারণার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দান করা যায়।

প্রপঞ্চবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা এডমন্ড হুসার্ল বিশুদ্ধ যুক্তিবিজ্ঞান ও গণিতের নতুন ভিত্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক পর্যায়ে সকল প্রকার বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ ভিত্তি অনুসন্ধান করতে প্রয়াসী হন। তিনি চেয়েছিলেন সর্ব প্রকার বিজ্ঞানকে এক চরম নিরপেক্ষ ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে। আর এই চরম নিরপেক্ষ ভিত্তি স্থাপন করতে হলে এমন এক আত্মিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করার প্রয়ােজন যেখানে কোন প্রকার ধার করা ধারণা বা বিশ্বাস থাকবে না। দেকার্ত তার দার্শনিক আলােচনার শুরুতে মন থেকে সর্বপ্রকার ধারণা উপড়ে ফেলার কথা বলেছেন। তিনি এমন কিছুকেই গ্রহণ করতে চাননি যা তার নিজের কাছে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। হুসার্লের ওপর দেকার্তের এই প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। তিনিও মনকে সর্বপ্রকার পূর্ব-স্বীকৃতিমুক্ত রেখে তার দার্শনিক অনুসন্ধান শুরু করতে চান। তিনি চেতনার কাছে উদ্ভাসিত অবভাসকে বিশুদ্ধভাবে অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন। প্রপঞ্চবিদ্যা সর্বপ্রকার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস অনুমান এবং পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে একমাত্র চেতনায় প্রকাশিত বাস্তবতা বা অবভাসের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে। চেতনায় প্রকাশিত স্বজ্ঞাত অবভাসকে একান্তভাবে চিনে নেওয়াই হল প্রপঞ্চবিদ্যার কাজ। অবভাসকে তার সার্বিক কাঠামাে অনুযায়ী চিনে নিতে হবে। আর এই সার্বিক কাঠামাের ভিত্তিতে তাকে চিনতে হলে, একান্তভাবে বিশুদ্ধ অবভাসকে জানতে হলে কোন ভাবেই পূর্ব-ধারণার ওপর ভিত্তি করা যাবে না। কোন প্রকার পূর্ব-অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটলে অবভাসের বিশুদ্ধতা বিনষ্ট হয়ে থাকে। আর বিশুদ্ধভাবে অবভাসকে জানতে, না পারলে বস্তুর প্রকৃত রূপ অবলােকন করা যায় না, চেনা যায় না সারসত্তাকে। এজন্য প্রপঞ্চবিদ্যা সর্বপ্রকার পূর্বধারণা বা প্রাকস্বীকৃতিবিহীনভাবে এর অনুসন্ধান চালাতে প্রয়াসী। এই দিক থেকেও প্রপঞ্চবিদ্যা বিজ্ঞান থেকে ভিন্ন বা স্বাধীন।

প্রপঞ্চবিদ্যা এমন একটি “বিজ্ঞান” যা এক নতুন অভিজ্ঞতামূলক অনুসন্ধানের মাধ্যমে বস্তু বা ঘটনার আসল রূপ অবলােকন করতে চায়। কিন্তু প্রত্যেক বিজ্ঞানের কিছু পূর্ব-স্বীকৃতি থাকে। যেমন পরীক্ষণমূলক প্রকৃতিবিজ্ঞান প্রাকৃতিক নিয়মানুবর্তিতা নীতি, কার্য-কারণ নিয়ম ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল, এগুলাে এ সকল বিজ্ঞানের প্রাকস্বীকৃতি বা পূর্ব ধারণা। যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রেও মধ্যম রহিত নিয়ম, স্ব-বিরােধ নিয়ম ইত্যাদি নিয়মকে পূর্ব-ধারণা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা তাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু করেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, আবহাওয়া অবস্থা, জীবনের সম্ভাবনা প্রভৃতি প্রাকৃতিক নিয়ম ও পূর্ব-ধারণার (Presuppositions) উপর ভিত্তি করে। কিন্তু প্রপঞ্চবিদ্যায় কোনােকিছুকেই পূর্ব থেকে ধারণা করলে চলবে না। প্রপঞ্চবিদ্যা তার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রূপে পূর্ব-ধারণাবিহীনভাবে অগ্রসর হয়। এটা সাধারণভাবে মনে হয় যে, সব উক্তিকেই অন্য কোনাে উক্তি বা উক্তিসমূহের সত্যের উপর ভিত্তি করে সত্য বলে দেখানাে বা প্রমাণ করা সম্ভব নয় – কিছু কিছু উক্তিকে প্রথমে অবশ্যই সত্য বলে ধরে নিতে হবে। প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ এই ধরনের ধারণায় বিশ্বাসী নন। অন্য কোনাে বিশেষ উক্তিসমূহ সত্য হবার কারণেই যে প্রপঞ্চবিদ্যাগত উক্তিসমূহ সত্য তা নয়, এগুলাে সত্য হয় যদি সত্যিকারভাবে অবভাসের ব্যাখ্যা দান করে। প্রপঞ্চবিদগণ কোনাে মতবাদ গঠন করেন না, তাদের কাজ হলাে সংস্কারমুক্ত মনে অবভাসের পরীক্ষা করা এবং সযত্নে ব্যাখ্যাদান করা। তাত্ত্বিক কোনাে লক্ষ্য না থাকায়, বরং অবভাসকে সযত্নে পরীক্ষা করা এবং সযত্নে ব্যাখ্যাদান না হওয়া পর্যন্ত কোনাে অবভাসকে বােধগম্য বলে গ্রহণ না করার যে ব্যবহারিক প্রবণতা তার জন্য প্রপঞ্চবিদ্যা হলাে বর্ণনামূলক ও পূর্বধারণাবিহীন একটি বিজ্ঞান। প্রপঞ্চবিদ্যার কোনাে উক্তিকেই তাহলে উপযুক্ত পরীক্ষণ ছাড়া সত্য বলে গ্রহণ করা যাবে না। এবং প্রপঞ্চবিদ্যার জন্য অপরীক্ষিত সত্যের কোনাে প্রয়ােজন নেই।

রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ যখন অবভাসের পরীক্ষা করা, ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করার কথা বলেন, তারা এর দ্বারা বিশেষ বিশেষ বস্তুর ব্যাখ্যাদানের কথা বােঝান না। প্লেটো, কান্ট, হেগেল প্রমুখ দার্শনিকরা অবভাস বলতে যা বােঝান, প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ সে অর্থে অবভাস শব্দটিকে ব্যবহার করেন না। তারা অবভাস বলতে বুঝিয়েছেন সারসত্তাকে (essence) অর্থাৎ বস্তুর সারসত্তাসমূহকে। বলা যায়, প্লেটো যাকে প্রত্যয় বা ধারণা বলেছেন, প্রপঞ্চবিদ্যার দৃষ্টিতে তাই হলাে অবভাস। এ অবভাস বা সারসত্তাকে বর্ণনা করাই হলাে প্রপঞ্চবিদ্যার কাজ। এবং প্রপঞ্চবিদ্যা সংক্রান্ত উক্তিসমূহ সত্য না মিথ্যা তা নির্ভর করে এ সারসত্তাসমূহের সঠিক ব্যাখ্যাদানের উপর। এ ব্যাখ্যাদান কাজটি প্রপঞ্চবিদ্যা বা রূপবিজ্ঞানের দার্শনিকগণ যেভাবে বা যে স্টাইলে করতে চান তাকে এক কথায় রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলা যায়। প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ প্রপঞ্চবিদ্যাকে একটি মতবাদ বা মতবাদের ধারা হিসেবে নয়, বরং একটি পদ্ধতি হিসেবে উপস্থিত করতে চেয়েছেন। এ পদ্ধতি হবে অত্যাবশ্যকভাবে পূর্বধারণাবিহীন। অবভাস সম্পর্কে এ পদ্ধতিটির দৃষ্টি হবে বিশেষ ঘটনার প্রতি নয়, বরং সাধারণ বা সার্বিক বৈশিষ্ট্যের দিকে, যে বৈশিষ্ট্য বা সারসত্তাসমূহ অবভাসগুলােকে ঠিক যেরকম সেরকমভাবে উপস্থিত করে। সেজন্যেই হুসার্ল বলেন, “বস্তুর নিজস্ব রূপ অবলােকন কর।” বস্তুর আসল রূপ বর্ণনা করা, অন্যকথায়, বস্তুর সার্বিক কাঠামাে জানাই হলাে রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্দেশ্য। এখানে দেকার্তের প্রভাব লক্ষণীয়। প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট ধারণা আবিষ্কার না করা পর্যন্ত দেকার্ত প্রত্যেকটি জিনিসকে সন্দেহ করেছিলেন এবং কোনাে পূর্ব-ধারণা ছাড়া তার দর্শন শুরু করেছিলেন। ঠিক তদ্রুপ, হুসার্লও চেয়েছেন পূর্ব কোনাে বিশ্বাস ও অনুমান ছাড়া অবভাসের সার্বিক কাঠামাে (essential structure of phenomena) আলােচনা বা বর্ণনা করতে।

প্রপঞ্চবিদ্যা একাধারে একটি বিশেষ দার্শনিক পদ্ধতি ও দর্শন। পদ্ধতি হিসেবে প্রপঞ্চবিদ্যা এক বিশেষ বিশ্লেষণী পদ্ধতি এবং তার সাথে বর্ণনামূলক পদ্ধতির দিকনির্দেশনা প্রদান করে। আমরা জানি, বিশুদ্ধ গণিত ও যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে হুসাৰ্ল তার প্রপঞ্চবিদ্যা নামক তত্ত্বে উপনীত হন। তিনি যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তাকে তিনি কঠোর বৈজ্ঞানিক নীতি বলে উল্লেখ করেছেন। তবে হুসাৰ্ল মূলত নতুন এক জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন প্রদান করেছেন এবং সে ক্ষেত্রে নতুন এক পদ্ধতির অনুমােদন করেছেন। হুসার্লের এই নতুন পদ্ধতি হল বিশ্লেষণ পদ্ধতি। তিনি যে বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রদান করেন তা স্বাতন্ত্রের দাবিদার। এছাড়া তিনি যে বর্ণনামূলক পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন তা অন্যান্য বিজ্ঞানের থেকে তেমন পৃথক কোন পদ্ধতি নয়।

তাই হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যায় তিনি যে বিশেষ পদ্ধতিতত্ত্ব অনুমােদন করেছেন তা হল বিশ্লেষণ পদ্ধতি। আমরা জানি, যুক্তিবিদ্যা, মনােবিদ্যাসহ বিভিন্ন পরীক্ষণমূলক প্রকৃতি বিজ্ঞান বিশ্লেষণী পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া সমকালীন দর্শনে বিশ্লেষণী দার্শনিকগণ এক আলােড়ন সৃষ্টিকারী বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রণয়ন করেছে (এই বিশ্লেষণী দার্শনিকগণের মধ্যে আছেন মুর, রাসেল, ভিটগেনস্টাইন, ভিয়েনা সার্কেলের যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীগণ এবং অতি সাম্প্রতিক কালের সাধারণ ভাষা দার্শনিকবৃন্দ)। যুক্তিবিদ্যা সঠিক যুক্তি-পদ্ধতির নিয়ম-কানুন আবিষ্কার করে এবং ভুল যুক্তি থেকে নির্ভুল যুক্তির পার্থক্য দেখায়। এই কাজের জন্য যুক্তিবিদ্যা বিশেষ বিশ্লেষণী পদ্ধতি প্রয়ােগ করে থাকে। যুক্তিবিদ্যা বচন বা আবধারণের বিশ্লেষণ করে, যুক্তির গঠন বিশ্লেষণ করে। মনােবিজ্ঞানের বিশ্লেষণের বিষয় হচ্ছে মানুষের আচরণ; মানুষের আচরণের অভিজ্ঞতামূলক বিশ্লেষণই মনােবিজ্ঞানের কাজ। এর মাধ্যমে মনােবিজ্ঞান মানসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করে থাকে। বিভিন্ন পরীক্ষণমূলক প্রকৃতি বিজ্ঞানও অভিজ্ঞতামূলকভাবে প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়কে অনুসন্ধান করে পরীক্ষণ করে। এই অনুসন্ধান ও পরীক্ষণের ক্ষেত্রে ঐ সকল বিজ্ঞান তাদের বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত করার মাধ্যমে তার বিশ্লেষণ করে এবং একে পরীক্ষণ করে। সমকালীন দর্শনের বিশ্লেষণী দার্শনিকবৃন্দ ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং শব্দ ও ধারণার অর্থ স্পষ্ট করার প্রয়াসী। এটি করতে গিয়ে তারা দর্শনে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ ও ভাষার জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতামূলক ভিত্তি অথবা তার প্রমাণযােগ্যতা যাচাই করে থাকেন।

কিন্তু এসকল বিশ্লেষণ থেকে প্রপঞ্চবিদ্যার বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। প্রপঞ্চবিদ্যা রূপ বা অবভাসকে এবং অবভাসের সার্বিক কাঠামাের ভিত্তিতে বস্তুর প্রকৃত সারসত্তা জানতে চায়। হুসার্লের মতে, এই অবভাস আমাদের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়। তাই চেতনাকে বিশ্লেষণ করাই মনােবিজ্ঞানের কাজ হয়ে পড়ে। এজন্যই প্রপঞ্চবিদ্যা এক বিশেষ বিশ্লেষণী পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় চেতনা দ্বারাই চেতনাকে বিশ্লেষণ করা হয়। অর্থাৎ কোন প্রকার সংবেদন বা বাহ্য অভিজ্ঞতার আশ্রয় নিয়ে বা তার সাথে সঙ্গতি রেখে এই বিশ্লেষণ করা হয় না; বরং প্রপঞ্চবিদ্যায় বস্তুকে বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়; সর্বপ্রকার অভিজ্ঞতাকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। শুধু তাই নয়, আমরা জানি, প্রপঞ্চবিদ্যা একটি পূর্বধারণা বিহীন বিজ্ঞান, কোন প্রকার পূর্বধারণা বা বিশ্বাসকেও চেতনা থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাই রূপবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে শুধুমাত্র চেতনা দ্বারা চেতনাকে বিশ্লেষণ করা হয়।

“বস্তুর নিজস্ব রূপ অবলােকন কর” – একথা বলার অর্থ কিন্তু এ নয় যে, প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ বাস্তববাদী হবার কথা বলেছেন। যে বস্তুসমূহের বর্ণনা দেবার কথা, সেগুলাে অভিজ্ঞতার বিষয় নয়, চেতনার বিষয়। প্রপঞ্চবিদ্যা হলাে চেতনা সম্পর্কীয় বিজ্ঞানভিত্তিক (বিচারমূলক নয়) আলােচনা। বিশ্বাস, ভাবাবেগ ও অনুমানসহ আমাদের চেতনার সবল জীবন্ত অভিজ্ঞতার পরম স্বজ্ঞাত সত্য লাভই এর উদ্দেশ্য। হুসার্লের মতে স্বজ্ঞাই (intution) বস্তুকে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করে। কাজেই যখন বলা হয় যে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় অবভাস আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, এর দ্বারা কিন্তু প্রপঞ্চবিদ্যার দার্শনিকগণ বােঝাতে চান স্বজ্ঞাকে, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে নয়। অন্য কথায় বস্তুর সারসত্তা অর্থাৎ অবভাস আমাদের কাছে জ্ঞাত হয় স্বজ্ঞার দ্বারা, চেতনার দ্বারা। চেতনা সব সময় কোনাে না কোনাে কিছু সম্পর্কে চেতনা, এবং চেতনা যাকে বােঝায় বা যে সম্পর্কে চেতনাময় হয় তা হলাে এর অভিপ্রায় ক্ষেত্র (intentional field)। চেতনার অভিপ্রায় ক্রিয়ায় তাহলে সুস্পষ্টভাবে দুটো জিনিস বিদ্যমান – জ্ঞান-ক্রিয়া (noesis) ও জ্ঞাত বস্তু (noema)। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জন্য এ দুটো হলাে স্বতন্ত্র কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কিত উপাদান। মন তার অভিপ্রেত বস্তুকে জানতে চায়, আর প্রপঞ্চবিদ্যার লক্ষ্য হলাে সেই বস্তুগত অভিপ্রায় ক্রিয়াটি সম্পন্ন করা। বস্তু যখন স্বজ্ঞার মাধ্যমে আমাদের কাছে নিজেকে প্রদর্শিত বা উপস্থাপিত করে, তখনই এর জন্য প্রমাণ বা সত্যানুসন্ধানের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। স্বজ্ঞা অবশ্য বুদ্ধি বা চিন্তামূলক (reflective) বিশ্লেষণের সঙ্গে তুলনীয় নয়। স্বজ্ঞা কোনাে সহজলব্ধ অন্তদৃষ্টি বা গূঢ় কোনাে প্রত্যাদেশ (revelation)-ও নয়, বরং অবভাস। স্বরূপে ঠিক যেরকম সেরকমভাবে দেখা বা দেখতে পারার দৃষ্টি। জার্মান ভাষায় সজ্ঞার সমার্থক শব্দ হলো Anshauung (seeing)। এখানে Anschauung বা দেখা বলতে সাধারণ অর্থে ইন্দ্রিয় বস্তুকে দেখা বােঝায় না, বােঝায় বস্তুর সারসত্তাকে স্বজ্ঞার মাধ্যমে জানা। মনের অভিপ্রায় বস্তুটি তাহলে বিশেষ বিশেষ কোনাে ইন্দ্রিয় বস্তু (empirical object) নয়, বস্তুর সারসত্তাই হলাে মনের লক্ষ্যবস্তু। স্বজ্ঞার মাধ্যমে অভিপ্রেত বস্তুটির আত্মপ্রকাশের ফলে যখনই মনের অভিপ্রায় পরিতৃপ্ত হবে, তখনই সন্দেহাতীত ও অত্যাবশ্যক সত্য অর্জিত হবে।

স্বজ্ঞার মাধ্যমে সারসত্তাকে জানার যে পদ্ধতি এর দ্বারা বৈজ্ঞানিক কোনাে জ্ঞান লাভ হয় কি না বলা মুশকিল। তবে প্রপঞ্চবিদ্যার প্রবণতা হলাে বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া; কিন্তু অস্তিত্ববাদ যদিও বিজ্ঞান বিরােধী নয় তবুও বিজ্ঞানভিত্তিক হতে চায় না। নিশ্চয়তা বা বৈজ্ঞানিক যথার্থই হলাে হুসার্লের লক্ষ্য। পরম নিশ্চয়তা ও প্রণালীবদ্ধ কাঠামাে অস্তিত্ববাদের প্রধান লক্ষ্য নয়। এর আকর্ষণীয় বিষয় হলাে মানব অস্তিত্ব বা মানবসত্তা, চেতনা নয়। তাত্ত্বিক যুক্তি প্রদান অস্তিত্ববাদের চরম লক্ষ্য নয়; এর দৃষ্টি একটা বিশেষ ধরনের জীবনের দিকে যা সাধারণত “যথার্থ অস্তিত্ব” (authentic existence) বলে অভিহিত।

রূপবৈজ্ঞানিক হ্রাস

প্রপঞ্চবিদ্যা যে বিষয়ে বিশেষভাবে আকৃষ্ট তা হলাে অবভাসের অত্যাবশ্যক কাঠামাে বা সার্বিকতা। এর ঝোঁক বাস্তব ঘটনার প্রতি নয়, সার্বিক সত্তার প্রতিবাস্তব ঘটনা সার্বিক সত্তারই অনুলিপি মাত্র। বিশুদ্ধ চেতনার মধ্যে বস্তুর যে অবভাস ধরা পড়ে তার সার্বিক কাঠামাে জানতে পারলেই বস্তুর সারসত্তা জানা যাবে বলে প্রপঞ্চবিদরা মনে করে। এজন্য প্রপঞ্চবিদ্যা বস্তুকে বাদ দিয়ে দৃষ্টি দেয় তার অবভাস বা রূপের দিকে চেতনাকে বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করতে চায় সেই রূপ। প্রতিষ্ঠা করতে চায় ঐ রূপ বা অবভাসের সার্বিক কাঠামাে। একজন প্রপঞ্চবিদের কাছে তাই একটি বিশেষ বস্তু যেমন সাদা বিড়াল, গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলাে সাদাত্ব। এবং তার মতে সাদা বস্তুর মাধ্যমে সাদাত্বই প্রত্যক্ষিত হয়। প্রপঞ্চবিদ্যা তাই আলােচনা ও বিশ্লেষণ থেকে বস্তুকে সাময়িকভাবে বাদ দেয় বা বস্তুকে বন্ধনীর মধ্যে রাখে। এক্ষেত্রে একজন প্রপঞ্চবিদ অবশ্য বাহ্য জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকারও করে না, প্রত্যাখ্যানও করে না। এভাবে “বস্তুকে বন্ধনীর মধ্যে রাখা” (putting things into brackets) অথবা বস্তুকে বিশ্লেষণ থেকে বাদ দেয়াকেই বলা হয়, “রূপবৈজ্ঞানিক হাস” (phenomenological reduction) বা ইপােক (epoche)। এ হ্রাস দু’রকমের – 

  • ১. সত্তাকেন্দ্রিক হ্রাস বা বিশেষ হ্রাস (editic reduction) – যার অর্থ হলাে, বিশেষ বিশেষ ঘটনাকে বাদ দিয়ে শুধু সারসত্তাকে আলােচনা করতে হবে।
  • ২. চেতনাকেন্দ্রিক হাস হ্রাস (transcendent) – যার মতানুসারে বন্ধনীর পদ্ধতি অবলম্বনে শুধু চেতন বা আত্মিকতাকেই গ্রহণ করতে হবে এবং এটিই হবে সব জ্ঞানের উৎস ও দার্শনিক চিন্তার সূত্রপাত।

চেতনাকেন্দ্রিক হ্রাস অনুসারে তাহলে চেতনার বিষয় হিসেবে স্বজ্ঞার মাধ্যমে প্রাপ্ত অবভাস বা রূপের বিশ্লেষণ করতে হবে, যে বিশ্লেষণের পদ্ধতি হবে একান্তভাবেই আত্মিক বা আত্মগত। অন্য কথায়, আত্মিকতাই হবে প্রপঞ্চবিদ্যায় জ্ঞানের ভিত্তি। চেতনার মধ্যে যে সকল অচেতন বিষয় রয়েছে তাকে বিশ্লেষণ থেকে বাদ দিতে হবে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল বিষয় থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে হবে। বাহ্যজগৎ থেকে প্রাপ্ত সকল বিশ্বাস, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। কিছুক্ষণের জন্য এগুলােকে বন্ধনীর মধ্যে আটকে রাখতে হবে (প্রকৃত সারসত্তাকে না জানা পর্যন্ত)। আর সত্তাকেন্দ্রিক হাস অনুসারে চেতনার মধ্যে প্রাপ্ত অবভাসের বিশেষ বিশেষ অংশকে বাদ দিয়ে সার্বিক কাঠামাে আবিষ্কার করতে হবে। অবভাসের সার্বিক কাঠামােকে আবিষ্কার করতে পারলেই সারসত্তাকে জানা হবে। এভাবে প্রপঞ্চবিদ্যা প্রথমে বস্তুজগতের বস্তু ও ঘটনা সম্পর্কিত যে কোন পূর্বধারণা বা অভিজ্ঞতাকে সাময়িকভাবে বাদ দিয়ে বা স্থগিত রেখে তারপর চেতনার মধ্যে স্বজ্ঞার মাধ্যমে উপস্থিত অবভাসের সার্বিক কাঠামাে আবিষ্কারের মাধ্যমে বস্তুর প্রকৃত সারসত্তা জানতে চায়। এভাবেই হুসার্ল তার দর্শনকে এক ধরনের ভাববাদে পরিণত করেন যা অতিবর্তী ভাববাদ (transcendantal idealism) নামে পরিচিত। সর্বপ্রকারের অস্তিত্বকে বন্ধনীর মধ্যে রেখে তিনি যেন এক ধরনের আত্মসর্বস্ববাদের সূচনা করেছেন। যদিও তিনি বাহ্যজগৎকে বিশ্বাস করতেন, তবুও তিনি মনে করতেন যে, এ সম্পর্কে জ্ঞান জ্ঞাতার চেতনার উপরই নির্ভর করে। এবং তিনি যে সারসত্তায় আকৃষ্ট ছিলেন তা বিশেষ কোনাে বস্তুর মতাে অস্তিত্বশীল নয়, বরং তা জানতে হবে জ্ঞাতার চেতনার মাধ্যমে এবং সেভাবেই বাহ্য জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন সম্ভব।

সমীক্ষা

এডমন্ড হুসাৰ্ল প্রপঞ্চবিদ্যার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেও এক্ষেত্রে তার পূর্ববর্তী দু’জন দার্শনিকের যথেষ্ট অবদান রয়েছে; তারা হলেন হুসার্সের শিক্ষক ফ্রেজ ব্রেন্টানাে (১৮৩৮-১৯১৭) এবং এলেক্সিয়াস মেইনং (১৮৫৩-১৯২১)। এছাড়া হুসার্লের রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আধুনিক দর্শনের জনক রেনে দেকার্তের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এসকল প্রভাবের কথা অবশ্য হুসার্ল স্বীকার করে নিয়েছেন।

হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যা সমকালীন দর্শনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যতিক্রমধর্মী মতবাদ। তবে তিনি যেভাবে প্রপঞ্চবিদ্যাকে একটি সুকঠোর ও সুসংবদ্ধ বিজ্ঞান বলে দাবি করেছেন তা সম্পূর্ণভাবে মেনে নেওয়া যায় না। হুসার্লের রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি স্বজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু স্বজ্ঞা একটি বিশেষ আত্মগত অনুভূতি, এর দ্বারা বস্তুগত সত্য আবিষ্কার কিভাবে সম্ভব। হুসার্ল অবশ্য অবভাসের সার্বিক কাঠামাে নির্মাণের মাধ্যমে বস্তুর প্রকৃত সারসত্তা আবিষ্কারের কথা বলেন, কিন্তু যে অবভাস স্বজ্ঞায় উদ্ভাসিত সে অবভাস এক এক জনের কাছে এক এক রকম করে উদ্ভাসিত হতে পারে। তাই সার্বিক কাঠামাে রচনা করলেও তা যে নিশ্চিতভাবে বস্তুগত হবে এমন আশা পোষণ করা যায় না। এছাড়া রূপবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে চেতনাকেন্দ্রিক হ্রাস (transcendental reduction) নামক যে বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে তাও একটি আত্মগত পদ্ধতি এবং তা অতিবর্তী ভাববাদ, এমনকি আত্মসর্বস্ববাদের নামান্তর। 

যাই হােক, হুসাৰ্ল বস্তুর আসল রূপ অবলােকনের যে মানসিকতা পােষণ করেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। হুসার্লের সারসত্তা আবিষ্কারের পদ্ধতি ও তত্ত্বকে পরবর্তীতে হাইডেগার এবং সার্ত প্রমুখ বিশিষ্ট অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ তাদের অস্তিত্ববাদী দর্শন প্রতিষ্ঠার কাজে সুবিধা মতাে (সংস্কার করে) ব্যবহার করেছেন। তারা হুসার্লের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই দেখা যায় অস্তিত্ববাদের মতাে প্রভাবশালী দার্শনিক মতবাদের ওপরও হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যার যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান।

হুর্সেলের প্রপঞ্চবিদ্যা ভিত্তিক সমাজতত্ত্ব

তবে তার প্রবর্তিত প্রপঞ্চবিদ্যা প্রাথমিক থাকার কারণে এটাকে আমাদের এখন মনে হয় যেন বস্তুনিষ্ঠবাদের অনুলিপি মাধ্যম। তবুও দেখা যায় জার্মান সমাজ চিন্তাবিদ আলফ্রেড শুজ (Alfred Schütz, ১৮৯৯-১৯৫৯ খ্রি.) পরবর্তী পর্যায়ে এসে হুসার্লের ধারণাগুলাে সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং এগুলােকে মিথস্ক্রিয়াবাদী বিশ্লেষণে রূপান্তরিত করে। পরবর্তী যুগে মিথস্ক্রিয়াবাদীরা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে তার এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানান। ১৯৩৯ সালে শুজ যখন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন তখন তার জন্য প্রপঞ্চবিদ্যা সম্বন্ধীয় কাজগুলাে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করার সুযােগ আসে। তিনি যখন মার্কিন মিথস্ক্রিয়াবাদীদের সংস্পর্শে আসেন তখন তিনি জার্মান থেকে এগুলােকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করার প্রয়ােজন অনুভব করেন। তবে এই ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতবাদই শুজ যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগেই মােটামুটি বিকাশ লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রে এসে তিনি নতুন যে কাজগুলাে করেন সেগুলাে মৌলিক কিছু না হলেও ইউরােপে আত্মপ্রকাশ করা মৌলিক কিছু মতবাদের বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা ছিল সেগুলাে।

সমকালীন সমাজবিদ্যায় যে এডমান্ড হুসার্লের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এই নিয়ে সন্দেহের কিছু নেই। তবে মনে রাখতে হবে তার এই রূপবিজ্ঞানের ফলপ্রসূ রূপান্তরে যার ভূমিকা সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য তিনি হচ্ছেন আলফ্রেড শুজ। জীবিত থাকলে তিনি হয়তাে হুসার্ল তার কাজকর্মের জন্য যে প্রশংসা পাচ্ছেন তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারতেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে হুসার্লের মতবাদসমূহ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজবিজ্ঞানে ধার এবং প্রয়ােগ করা হয়। এই ধরনের প্রক্রিয়া থেকেই বর্তমান প্রপঞ্চবিদ্যার বিকাশ ঘটে এবং মিথস্ক্রিয়াবাদী মতবাদসমূহও হুসার্লের আবিষ্কৃত প্রপঞ্চবিদ্যা থেকে ব্যাপকভাবে উপস্থিত হয়। হুসার্লের মতবাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – 
(১) তার দার্শনিক পরস্পর বিরােধিতা
(২) বিবেক সম্বন্ধীয় বা সচেতনতা সম্বন্ধীয় মতবাদ 
(৩) নিরপেক্ষ প্রয়ােগবাদের সমালােচনা এবং 
(৪) সমাজবিজ্ঞানের দার্শনিক বিকল্প 
(Husserl’s basic ideas are contained in the following: Phenomenology and the Crisis os western Intioduction (New York: Harper & Row, 1965, originally published 1936))

সব প্রশ্নগুলাের মধ্যে যেগুলাে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলাে হচ্ছে – বাস্তবতা কি, বাস্তবে পৃথিবীর কোন কোন জিনিসটি তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, কিভাবে একটি বিষয় বা বতুর অস্তিত্ব নির্ণয় করা যায়। হুসার্ল ছিলেন মূলত একজন দার্শনিক এবং তার দর্শন জগতের একটি কেন্দ্রিক প্রশ্ন ছিল যা আমাদের জন্য প্রণিধানযােগ্য। হুসার্লের দর্শনের আলােকে এটাই বলা যায় যে, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার আলােকেই মানবজাতি তার বিশ্বকে চিনতে শিখেছে। পৃথিবীতে বাহ্যিক যা কিছু আছে তা মানুষ জানতে শেখে অভ্যন্তরীণ কিছু ক্ষমতার মাধ্যমে। এই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাটি হচ্ছে তার মনােজাগতিক সচেতনতা। অভিজ্ঞতার আলােকেই মানুষ অন্যান্য জনগণ, মূল্যবােধ, প্রথা এবং বসতুগুলাের অস্তিত্ব নির্ধারণ করেন। কারণ মানুষ তার সচেতনতার মাধ্যমেই এই শক্তিগুলাের অস্তিত্ব নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। বাস্তবতার সাথে মানুষের প্রত্যক্ষ কোন যােগাযােগ নয়, প্রত্যক্ষ যােগাযােগের পরিবর্তে মানুষের সাথে বিশ্বের সংস্পর্শটা হচ্ছে পরােক্ষ এবং বিশ্ব ও মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বিষয়টা হচ্ছে মানুষের মন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানব জ্ঞানের জগতে সচেতনতার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন্দ্রীয় বিষয়। তাই একজন মানুষের দার্শনিক চিন্তাধারার প্রথম পদক্ষেপ হবে কিভাবে এই প্রক্রিয়াগুলাে কাজ করে এবং কিভাবে এই প্রক্রিয়া মানব কর্মকাণ্ডের উপর প্রভাব ফেলে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, অভিজ্ঞতাই মানুষের মধ্যে বাহ্যিক বাস্তবতা সম্বন্ধে এক ধরনের ধারণার সৃষ্টি করে এবং এটাই হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সচেতনতা সম্বন্ধীয় প্রক্রিয়া। আর এই সচেতনতা সম্বন্ধীয় প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রপঞ্চবাদের মূল আলােচ্য বিষয়।

হুসার্ল প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাকৃতিক প্রবণতার বিশ্বের কথা বলেন এবং পরবর্তীতে তিনি Lifeworld বা জীবনবিশ্ব সম্বন্ধীয় পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। তবে উভয় ক্ষেত্রে তিনি এই মতবাদের উপর জোর দেন যে, মানুষ এক পূর্ব নির্ধারিত বিশ্বে নিজের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে যা তার মনােজাগতিক জীবনে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করে। এই বিশ্বে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে মানুষ তার অস্তিত্ববােধ নির্ধারণ করে। মানুষ নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য কর্মকাণ্ড এবং অনুপ্রেরণা নিয়ন্ত্রণ করতে এক ধরনের মাপকাঠি তৈরি করে। যে সমস্ত বিষয় সে দেখে তার ভিত্তিতে বা অন্যান্য জনগণ, স্থান, ধ্যান-ধারণা এবং আরাে যা কিছু দেখে তার আলােকে সে এই মাপকাঠি নির্ধারণ করে। এই জীবন দৃশ্য কিংবা প্রাকৃতিক প্রবৃদ্ধির বিশ্বই হচ্ছে মানবজাতির জন্য বাস্তবতা। আমাদের মতে প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি সম্বন্ধীয় হুসার্লের মতবাদ দুইটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আজও মিথস্ক্রিয়াবাদী চিন্তাধারার জগতে তার প্রভাব বজায় রেখেছে –

  • ১. জীবন বিশ্ব হচ্ছে এক ধরনের স্বতঃসিদ্ধ। এটা কোন প্রতিফলনশীল চিন্তাধারার বিষয় নয়। তা সত্ত্বেও বলা যায় এটাই মানুষের কর্মকাণ্ড এবং চিন্তাধারাকে সংগঠিত করে তার স্বরূপ নির্ধারণ করে।
  • ২. মানবজাতি এই পূর্ব নির্ধারিত ধারণা নিয়ে তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে যে তারা সবাই একই জগতের অভিজ্ঞতার আলােকে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে। তবে মানবজাতি তার অভিজ্ঞতাসমূহ নিজস্ব সচেতনতার বাইরে অর্জন করতে পারে না। সরাসরি পূর্ববর্তী কোন ধারণাকে সত্য বলে নিশ্চিত হওয়ার মতাে ক্ষমতাও তাদের খুব একটা বেশি নেই। সঠিক ও সত্য সম্বন্ধে তাদের এই দুর্বলতা সত্ত্বেও অভিন্ন বিশ্ব। সম্বন্ধীয় তাদের অভিজ্ঞতাও পরস্পরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

উপরিউক্ত আলােচনা থেকে এটাই বোঝায় যে, মানবজাতি জীবনবিশ্বে তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে এটাকে পূর্বনির্ধারিত একটি বিষয় হিসেবে এবং এই ধারণার আলােকে সে দলীয় অভিন্ন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় করে। এই বাস্তবতা হুসার্লকে তার মূল সমস্যার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় – মানুষ কিভাবে নিজের জীবন বিশ্ব থেকে বের হয়ে এসে সত্যটাকে উপলব্ধি করতে পারে? মানবজাতির জীবনবিশ্ব সম্পর্কিত কাঠামাে যদি তার সচেতনতা এবং কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করে তাহলে মানব আচরণ এবং প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে বৈষয়িক বিজ্ঞানের সৃষ্টি করা যায়? এই ধরনের প্রশ্নসমূহকে হুসার্ল মনে করেন তাকে প্রকৃতিবাদী বিজ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হুসার্লের পূর্বের একটি মতবাদ ছিল যা বলত, মানব ইন্দ্রিয় এবং সচেতনতার বাইরে এমন এক বাস্তব বিশ্বের অস্তিত্ব বিদ্যমান যা এই দুই বিষয় থেকে স্বতন্ত্র এবং পৃথক। বিজ্ঞানমুখী পদ্ধতির মাধ্যমে এই বাস্তব বিশ্বকে সরাসরি চেনা সম্ভব। যদি তার পারিপার্শ্বিকতার মূল্যায়নে সচেষ্ট থাকে তাহলে তার পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে বুঝে ওঠা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে এবং পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা সম্বন্ধে সে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। হুসার্ল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করেন। মানুষ যদি শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমে সবকিছু জানতে পারতো কিংবা বাস্তব বিশ্ব বা অন্তর্নিহিত জীবনবিশ্ব যদি সচেতনতার গঠন আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে অনেক বাহ্যিক এবং বাস্তব বিশ্বের বৈষয়িক মাপকাঠি প্রবর্তন করা সম্ভব? আমাদের জানামতে একটি মানুষ তার সচেতনতা থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে সেটাই হচ্ছে জীবন বিশ্ব। এই সংজ্ঞার আলােকে যে সমস্যাটির কথা আমাদের বলতে হয় সেটা হচ্ছে কিভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান বৈষয়িকভাবে বহির্বিশ্বের একটি বৈষয়ক মাপকাঠি নির্ধারণ করতে পারে? এই সমস্যা সম্বন্ধে হুসার্ল আমাদের সামনে যে সমাধান তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে মূলত দার্শনিক সমাধান। তিনি সমস্যার সমাধান খুঁজতে Essence of consciousness বা সচেতনতার নির্যাস সম্বন্ধে তার নিজস্ব মতবাদ ব্যক্ত করেন। সামাজিক ঘটনাবলি বুঝে উঠতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে এই ঘটনাবলির প্রক্রিয়া সম্বন্ধীয় সচেতনতাকে বুঝতে হবে। এই ক্ষেত্রে সচেতনতার স্বাধীন বিষয় কিংবা জীবনবিশ্বই সবকিছু নয়, বরঞ্চ সচেতনতার নির্বস্তুক বা বিমূর্ত প্রক্রিয়া হচ্ছে আমাদের দার্শনিক অনুসন্ধানের আলােচ্য বিষয়।

হুসার্ল সমস্যার সমাধানে The radical abstraction of the individual বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের চরম নির্বস্তুকতা বা বিমূর্ততা সম্বন্ধে একটি পরিভাষার সৃষ্টি করে। এই পরিভাষা মূলত আন্তঃব্যক্তিক অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। সমাজবিজ্ঞানীরা যখন বিচার-বিশ্লেষণ করবেন তখন তাদেরকে নিজেদের প্রাকৃতিক প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এবং সচেতনতার প্রক্রিয়ার অধীনে তাকে সবকিছু অবলােকন করার যােগ্যতা অর্জন করতে হবে। হুসার্লের উপর পড়াশুনা করতে গেলে অনেকেই তার Pure mind বা বিশুদ্ধ মনের মুখােমুখি হতে পারেন। বিশুদ্ধ মনকে বুঝে উঠতে হলে একজনের জীবনবিশ্বকে প্রথমে বাতিল বলে মেনে নিতে হবে। হুসার্লের মতে জীবনবিশ্ব সম্বন্ধীয় ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত হলেই একজন ব্যক্তির সচেতনতার মৌলিক এবং নির্বস্তুক বা বিমূর্ত উপাদানগুলাে আবিষ্কার করতে এবং বুঝতে সক্ষম হবে। এই মৌলিক উপাদানগুলাে বুঝে উঠতে পারলে একজন মানুষ তার অন্তদৃষ্টি দিয়ে বাস্তবতার প্রকৃতি অবলােকন করতে পারবে। কারণ পৃথিবীর যা কিছু মানুষ জানে তা দানে প্রধানত সচেতনতার কল্যাণে। তাই জীবন বিশ্ব সম্বন্ধীয় উপাদান থেকে মুক্ত হয়ে একজনকে সচেতনতার নির্বস্তুক প্রকৃতিকে আগে বুঝে উঠতে হবে।

এই পর্যায়ে আমাদের একটু সচেতন হতে হবে যে হুসার্ল কিন্তু তার সচেতনতা সম্বন্ধীয় মতবাদ দ্বারা ম্যাক্স ওয়েবারের Verstehen পদ্ধতির সমর্থন করেন নি। Verstehen দ্বারা একজন পর্যালােচকের সমবেদনামুখী অন্তর্জ্ঞানকে বোঝানাে হয়। এই অন্তর্জ্ঞানকে আমরা আবার অন্তদর্শন বলে আখ্যায়িত করতে পারি । ম্যাক্স ওয়েবারের বিরােধিতা করে তিনি আবার মানুষ পরিস্থিতির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তার গঠনহীন এবং আধ্যাত্মিক অনুসরণের কথাও তিনি বলেন নি। তার মতে, এই ধরনের পদ্ধতিসমূহ শুধুমাত্র জীবন বিশ্ব উপাদান সম্বন্ধীয় কিছু উপাদান সরবরাহ করবে। যা কিনা দৃষ্টবাদের গঠনমুখী মাপকাঠি থেকে খুব একটা সরস কিছু নয়, বরঞ্চ হুসার্লের মূল উদ্দেশ্য ছিল সচেতনতা সম্বন্ধীয় একটি নির্বস্তুক বা বিমূর্ত মতবাদ তৈরি করা যা বাহ্যিক সামাজিক বিশ্ব সম্বন্ধীয় পূর্বনির্ধারিত ধারণাকে বাতিল বলে ঘােষণা করবে। তবে হুসার্লের দার্শনিক ব্যাখ্যা যেহেতু ব্যর্থ হয় নি তাহলে আমাদের একটু অবাধ না হলেই নয়। কারণ তিনি কখনাে তার অভীষ্ট লক্ষ্য সচেতনতা সম্বন্ধীয় নির্বস্তুক কোন স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দিতে পারে নি যা জীবনবিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে বিবেচ্য হবে। তবে এতটুকু কৃতিত্ব তাকে দেওয়া যেতে পারে যে তিনি তার মতবাদের মাধ্যমে সর্বপ্রথম আধুনিক প্রপঞ্চবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেন। এই মতবাদের মাধ্যমে তিনি সম্প্রদায় সম্বন্ধীয় পদ্ধতিগত বিদ্যা এবং আরাে অনেক মতবাদের সৃষ্টিমুখী উপাদান সরবরাহ করেন। এই পর্যায়ে আমরা স্মরণ করতে পারি। ইয়ুর্গেন হেবারমাসের জীবন বিশ্ব সম্বন্ধীয় প্রধান মতবাদকে। সম্প্রদায় পদ্ধতি বিদ্যা এবং বেষ্টিক কাঠামাে সম্বন্ধীয় মতবাদে হুসার্লের মতবাদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তবে এই প্রভাব একটু ভিন্ন রূপ নিয়ে নতুন মতবাদসমূহের তাদের অবস্থানের ঘােষণা দেয়। এই ধরনের রূপান্তরই হচ্ছে মূলত আলফ্রেড শুজের প্রাথমিক কাজগুলাের মূল অবদান। তিনি মূলত হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যাকে এক ধরনের মিথস্ক্রিয়াবাদী মতবাদে রূপান্তরিত করেন।

প্রপঞ্চবিদ্যা ও অস্তিত্ববাদের তুলনা

অস্তিত্ববাদী দর্শন বিশেষ করে হাইডেগার ও সার্তের দর্শন বুঝতে হলে প্রপঞ্চবিদ্যা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়ােজন। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে প্রপঞ্চবিদ্যা ব্যতিরেকে অস্তিত্ববাদের বিকাশ ও প্রসার সম্ভব নয়। হাইডেগার ও সার্তের দর্শনের উপর প্রপঞ্চবিদ্যা বেশ প্রভাব বিস্তার করলেও এটি ছাড়া যে অস্তিত্ববাদ বিকাশ ও প্রসার লাভ করতে পারে, কিয়ের্কেগার্ডনীটশের দর্শনই তার প্রমাণ। প্রপঞ্চবিদ্যা ও অস্তিত্ববাদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে – 
১. প্রপঞ্চবিদ্যা অত্যাবশ্যকভাবে বুদ্ধিভিত্তিক, কিন্তু অস্তিত্ববাদ অবৌদ্ধিক;
২. প্রপঞ্চবিদ্যার বিষয়বস্তুর হলাে চেতনায় উদ্ভাসিত অবভাসের (phenomena) সারসত্তা সম্পর্কে আলােচনা, আর অস্তিত্ববাদের বিষয়বস্তু হলাে মানুষের মূর্ত অস্তিত্ব।

প্রপঞ্চবিদ্যা ও অস্তিত্ববাদ দুই-ই আত্মগত; তবে একটির আত্মিকতা অন্যটির থেকে আলাদা, যেহেতু এদের বিষয়বস্তু ভিন্ন ধরনের। অস্তিত্ববাদ মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আলােচনা করে, আর প্রপঞ্চবিদ্যার সমস্যা হলাে চেতনা। প্রপঞ্চবিদ্যা সব ধরনের অস্তিত্বকে বাদ দিয়ে শুধু সার্বিক কাঠামাে বা সারসত্তা নিয়েই আলােচনা করতে চায়। কিন্তু যেহেতু সারসত্তাকে একমাত্র চেতনার মাধ্যমেই জানা সম্ভব, তাই প্রপঞ্চবিদ্যা পরিশেষে চেতনার বিষয়ের প্রতিই বিশেষভাবে আকৃষ্ট। অবশ্য চেতনা অস্তিত্বেরই একটি অংশ, কিন্তু অস্তিত্ববাদীরা প্রপঞ্চবিদ্যার সে চেতনাকে অগ্রাহ্য করেছেন। প্রপঞ্চবিদ্যার চেতনা চিন্তামূলক (reflective); কিন্তু অস্তিত্ববাদীদের মতে চেতনা চিন্তামূলক নয়, সব সময়ই অভিজ্ঞতামূলক (empirical)। 

হুসার্লের দিক থেকে বিচার করলে মানুষের অস্তিত্ব প্রপঞ্চবিদ্যার আলােচনার বিষয় হতে পারে না, কেননা সার্তের মতানুসারে মানুষের কোনাে সারসত্তা নেই। অথচ প্রপঞ্চবিদ্যা সারসত্তার আলােচনাতেই আকৃষ্ট। অপরদিকে, মানুষের যদি সারসত্তা থাকেও, যেমন কিয়ের্কেগার্ড সে-রকম মনে করেন এবং সে সারসত্তা যদি রূপবৈজ্ঞািনিক আলােচনার মধ্যে আনা হয়, তাহলেও সেখানে সারসত্তা অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ও অসম্পর্কিত থাকবে, যেহেতু রূপবিজ্ঞানের সব ধরনের অস্তিত্বকেই বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়। এটুকু অবশ্য বলা যায় যে, স্বাধীনতা, নির্বাচন, মনস্তাপ প্রভৃতি অনেক অস্তিত্ববিষয়ক ধারণা আছে যেগুলােকে একাধিক মানুষ সম্পর্কে প্রযােজ্য বলে মানুষের অস্তিত্বের সার্বিক কাঠামাে বা সারসত্তা বলা যায়। এবং সে কারণে হয়তাে এগুলােকে প্রপঞ্চবিদ্যার আলােচনার অধীনে আনা যায়। মনে হয় অস্তিত্ববাদীরা ঠিক তাই করতে চেয়েছেন, অবশ্য নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যদিও তারা ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্বের প্রতি প্রধানত আকৃষ্ট, তাদের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে তারা সাধারণ শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের সাধারণ মত একাধিক মানুষের জন্য বৈধ। তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে, প্রপঞ্চবিদ্যা যদি অস্তিত্ব-বিষয়ক ধারণাগুলাে সম্পর্কে আলােচনা করতেও চায়, তা ধারণাগুলাের খাতিরেই করতে চাইবে, কেননা কোন বিশেষ ব্যক্তি-মানুষের সঙ্গে এগুলাে সংযুক্ত তা বিচার করা প্রপঞ্চবিদ্যার কাজ নয়। একজন প্রপঞ্চবিদের কাছে যেমন সাদা জিনিসের চেয়ে সাদাত্বই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি তার কাছে আকর্ষণীয় হবে স্বাধীনতা (সার্বিক অর্থে), ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা বা অস্তিত্ব নয়।

হাইডেগারের উপর হুসার্লের প্রভাব 

প্রপঞ্চবিদ্যা ও অস্তিত্ববাদের মধ্যে মৌল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে অনেকেই হুসার্লের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। হাইডেগার ও সার্ত দু’জনেই ছিলেন হুসার্লের ছাত্র এবং হুসার্লের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। শেষ পর্যন্ত দু’জনেই অবশ্য নিজেদের ইচ্ছানুসারে এবং নিজেদের মতের উপযােগী করে তাদের গুরুর দর্শনকে পরিবর্তন করেছেন। হুসার্লের মতাে তারা প্রপঞ্চবিদ্যাকে স্বতন্ত্র একটি স্বাধীন বিজ্ঞান বলে মনে করেন না; তাদের কাছে প্রপঞ্চবিদ্যা হলাে বীয়িং তথা মানুষের অস্তিত্ব আলােচনার একটি উপযুক্ত মাধ্যম। অস্তিত্ববাদীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যেভাবে হুসার্লের রূপবিজ্ঞানের পরিবর্তন করেছেন, এতে তারা প্রপঞ্চবিদ্যার মূলনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন এবং যে পদ্ধতি তারা প্রয়ােগ করেছেন, তা প্রকৃত রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে মনে হয় না। হাইডেগেরের দর্শনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বীয়িং। এ বীয়িংকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি যে পদ্ধতি প্রয়ােগ করেছেন তা হলাে রূপবৈজ্ঞানিক। কিন্তু তা হুসার্লের পদ্ধতির মতাে নয়। হুসার্লের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তার গুরুর দর্শনকে তিনি পরিবর্তন করেছেন এবং নিজের উপযােগী করে কাজে লাগিয়েছেন। তার পদ্ধতিকে তাই হুসের্লের পদ্ধতির পরিবর্তিত সংস্করণ বলা যেতে পারে।

জ্ঞানের প্রশ্নেও হুসার্ল হাইডেগেরের মধ্যে বিশেষ পাথর্ক্য পরিলক্ষিত হয়। দেকার্তের মতাে হুসার্লেরও লক্ষ ছিল নিশ্চিত জ্ঞান। বুদ্ধি সংক্রান্ত সাধুতা ও নৈতিক মূল্যবােধ আমাদেরকে মানুষ ও বিশ্বজগৎ সম্পর্কে সন্দিহান করে তােলে এবং জ্ঞান হিসেবে গ্রহণযােগ্য না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ববােধই আমাদেরকে এগুলােকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করতে বাধ্য করে। জ্ঞান সম্পর্কে হুসার্ল দুটো বিষয়ের কথা বলেছেন – ১. অস্তিত্বের প্রকার (modes of being) ও ২. অভিজ্ঞতার প্রকার (modes of experiencing)। উদাহরণস্বরূপ, একটি কালাে বাের্ডের কালােত্ব, কাঠিন্য, চতুষ্কোণাকৃতি প্রভৃতি অস্তিত্বের অনেক আকার আছে যেগুলােকে হুসার্লের মতানুসারে কালাে বাের্ডের মৌল আকার বলা যায়। এ মৌল আকারগুলাের অনুরূপ জ্ঞাতার মধ্যেও আছে। অভিজ্ঞতার আকার যেগুলাে ঠিক একইভাবে মৌল এবং অভিজ্ঞতার এ আকারগুলাে দিয়েই বাের্ডের আকারগুলােকে জানা যায়। হুসার্লের মতানুসারে তাহলে এক বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় বস্তুর অস্তিত্বের আকারগুলাের জানার মাধ্যমে, অর্থাৎ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে। হুসার্লের এ মত হাইডেগার অস্বীকার করেন। তার মতে অভিজ্ঞতার মৌল আকার প্রত্যক্ষণ নয়, প্রয়ােগ; প্রয়ােগ বা কাজে লাগানােই একটা বস্তুকে বস্তু বলে নির্ধারণ করে। যেমন একটা টাইপরাইটারকে দেখা যায়, স্পর্শ করা যায় বা এর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণ করা যায়; এটি একটি টাইপরাইটার। টাইপরাইটারের অস্তিত্বের আকারগুলাে তাহলে একমাত্র প্রয়ােজনের মাধ্যমেই জানা যায়।

হুসার্লের অতিবর্তী রূপবৈজ্ঞানিক ভাববাদ (transcendental phenomenological idealism) এক ধরনের আত্মগত ভাববাদ বা আত্মসর্বস্ববাদ বলে অভিযুক্ত। হুসার্ল দেকার্তের জ্ঞান-সম্পৰ্কীয় মতবাদ প্রত্যাখ্যান করলেও তার সংশয় পদ্ধতির অহমবাদকে (subjectivism) গ্রহণ করেছেন এবং এর ফলে তার মত আত্মগত ভাববাদে (subjective idealism) পরিণত হয়েছে। কিন্তু হাইডেগার অহমবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার মতে হুসার্ল ও দেকার্ত দু’জনেই অহম ও বস্তুর (subject-object) মধ্যে পার্থক্যকে গৌণ (derivative) মনে না করে মৌলিক মনে করায় অত্যাবশ্যকভাবে গােলমালের মধ্যে পড়ে গেছেন। এবং এ ভুল ধারণার জন্য তারা “বস্তুগত”, “সর্বজনবিদিত”, “বাহ্য জগতের আত্মা নিরপেক্ষ অস্তিত্বকে একটি সমস্যা বলে মনে করেন। হাইডেগারের মত হুসার্লের মত থেকে আরও ভিন্ন এ কারণে যে, হুসের্লের রূপবৈজ্ঞানিক হ্রাসের বিভিন্ন স্তরের কোন স্থান হাইডেগারের দর্শনে নেই। রূপবৈজ্ঞানিক হ্রাস হুসার্লের দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, অথচ হাইডেগারের দর্শনে তা সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। আরও একটি বড় পার্থক্য হলাে হুসার্ল যেখানে প্রপঞ্চবিদ্যাকে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন বিজ্ঞান বলে মনে করেন, হাইডেগার সেখানে রূপবিজ্ঞানকে গ্রহণ করেছেন বীয়িং পরীক্ষা করে দেখার একটি উপযােগী মাধ্যম হিসেবে।

হাইডেগার প্রপঞ্চবিদ্যাকে ‘অবভাসের বিজ্ঞান বা পঠন’ বলে অভিহিত করেছেন। অবভাস বলতে অবশ্য তিনি কান্টের আভাসকে (appearance) বোঝাননি, বুঝিয়েছেন যা প্রদর্শন করে বা নিজকে প্রকাশ করে, তা নির্দেশ করার উপায়কে। অবভাস কেবলমাত্র আভাস নয়, যদিও অবভাসের সঙ্গে এটি অত্যাবশ্যকভাবে সম্পর্কিত। হাইডেগারের মতে ভূমিকম্প যেমন একটি অবভাস, চেতনাও ঠিক তেমনি একটি অবভাস। অবভাস বলতে তাহলে ইন্দ্রিয়-জ্ঞান থেকে শুরু করে ভয়, সন্ত্রাস, মার্কসবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন জিনিসকেই বুঝায়। মানুষ, মানুষের অস্তিত্বও সে কারণে অবভাস।

হাইডেগারের দর্শনে প্রপঞ্চবিদ্যা তত্ত্ববিদ্যার (ontology) সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। হুসার্ল স্বজ্ঞার ওপর বিশেষ করে জোর দিয়েছেন। স্বজ্ঞাই চেতনা সম্পর্কে আলােচনায় অগ্রসর হবার উপযুক্ত পদ্ধতি। কিন্তু হাইডেগারের মতে সব অবভাস প্রত্যক্ষভাবে স্বজ্ঞার কাছে উন্মােচিত হয় না। বিশেষ বিশেষ অবভাস (ontic phenomena) সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাহলে প্রপঞ্চবিদ্যাকে তত্ত্বমূলক নীতির আশ্রয় নিতে হবে। এভাবে সব বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানের জন্য কোনাে না কোনাে তত্ত্বমূলক নীতিকে পূর্ব থেকে অনুমান করতে হবে। এদিক দিয়ে তাহলে বিশিষ্টতা (ontic) ও তত্ত্ব (ontological) অবিচ্ছেদ্য; অন্য কথায়, “সব তত্ত্ব একমাত্র প্রপঞ্চবিদ্যা হিসেবেই সম্ভব।”

সার্তের রূপবৈজ্ঞানিক অস্তিত্ববাদ 

হাইডেগেরের মতাে সার্তও নিজের সুবিধেমতাে প্রপঞ্চবিদ্যাকে তার দর্শনে প্রয়ােগ করেছেন। প্রপঞ্চবিদ্যাকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক সার্তের চিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছে – ১. অবভাস ও ২. অভিপ্রায় (intentionality)। অবভাস হলাে তা যা আমাদের চেতনার কাছে উন্মােচিত হয় – অবভাস সম্পর্কে হুসার্লের এই সংজ্ঞা সার্ত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু হুসার্ল যেখানে অবভাসের সারসত্তার প্রতি আকৃষ্ট, সার্ত সেখানে সংশ্লিষ্ট ছিলেন অবভাসের বিশেষ ঘটনা নিয়ে এবং চেতনা বলতে তিনি হুসার্লের জ্ঞানাতিরিক্ত অর্থাৎ অতিবর্তী চেতনাকে বোঝাননি, তার মতে চেতনা হলাে অভিজ্ঞতালব্ধ। অবভাসের এই অর্থের উপর ভিত্তি করে তিনি দাবি করেছেন যে, একমাত্র রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বারাই তিনি বলতে সক্ষম হয়েছেন বীয়িং কি? বীয়িং মানে এমন কিছু নয় যা আভাস থেকে নিজেকে গােপন রাখে। বস্তুতপক্ষে আভাসই হলাে বীয়িং। সার্ত বলেন, আমরা যদি আভাসের অন্তরালে বীয়িং বলে কোনাে কিছুতে বিশ্বাস না করি, তাহলে আভাস সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়; এর সারসত্তা আভাসিত হওয়া যা বীয়িং-এর বিরােধী নয়, বরং এর মানদণ্ড; কেননা, কোনাে বস্তুর বীয়িং হলাে যথার্থভাবে যা আভাসিত হয় ঠিক তাই। (Being and Nothingness, পৃ. X/VI)। গুপ্ত সত্তা সম্পর্কিত সব ধারণা বর্জন করে সার্ত বিশ্বাস করলেন শুধু অবভাসকে, কেননা অবভাস হলাে যেভাবে আভাসিত হয়। সত্যিকারভাবে ঠিক তাই। তাই সার্ত বলেন, অবভাস যেরূপ ঠিক সেরূপেই পরীক্ষা করা যায় ও বর্ণনা করা যায়, যেহেতু এটি সম্পূর্ণভাবে নিজের নির্দেশক।

যেহেতু সার্তের কাছে একটি বস্তুর অবভাসই সবকিছু, তাই বাহ্য ও অভ্যন্তর বলে কোনাে দ্বৈতবাদে তিনি বিশ্বাসী নন। তার মতে কোনাে বস্তুর আসল প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন বা গােপন করে রাখে এমন কোনাে বাহ্য (exterior) বলতে কিছু নেই। ঠিক তেমনি নিজকে গুপ্ত অবস্থায় রাখে এবং কোনাে অবস্থাতেই উন্মােচিত হয় না বস্তুর এমন কোনাে অভ্যন্তর (interior)-ও নেই। আভাসসমূহ যেগুলাে বস্তুকে উন্মােচন করে অভ্যন্তরও নয়, বাহ্যও নয়, এগুলাে হলাে সমান। (Being and Nothingness, পৃ. X/V)। সার্ত দুটো উদাহরণের মাধ্যমে তার বক্তব্য বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। শক্তি গুপ্ত বা অজ্ঞাত এমন কিছু নয় যা এর বেগবৃদ্ধি, গতির বিভিন্ন পরিবর্তন প্রভৃতি কার্য থেকে ভিন্ন। শক্তি হলাে এর কার্যের সমষ্টি। ঠিক তেমনি, তড়িৎ-প্রবাহ যার প্রাকৃতিক-রাসায়নিক কার্য একে উন্মােচন করে তা সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়।

সার্ত তার আভাস মতবাদের একই যুক্তিতে অব্যক্ত ক্ষমতা (potency) ও কার্য-সম্পাদন (act) সম্পর্কিত দ্বৈতবাদকেও খণ্ডন করেছেন। তার কাছে কার্যসম্পাদনই সবকিছু; কার্য সম্পাদনের অগােচরে অব্যক্ত ক্ষমতা বলতে কিছু নেই। যেমন, প্রাউস্টের প্রতিভা বলতে তিনি নির্দিষ্ট কোনাে কাজ করার বিশেষ সামর্থ্যকে বোঝান না – যে সামর্থ্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত বা বিকশিত হয়নি। সার্তের মতে প্রাউস্টের প্রতিভা বলতে বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচিত কর্মকে বোঝায় না, কর্ম সম্পাদন করার আত্মগত সামর্থ্যকেও বোঝায় না, বরং বোঝায় প্রাউস্টের সে-কর্মকে – যা একজন ব্যক্তি হিসেবে তাকে উন্মােচন করার সমষ্টি হিসেবে বিবেচিত। (Being and Nothingness, পৃ. X/V)। এখানে সার্ত মানুষের ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতামূলক দিকের কথাই বলেছেন বলে মনে হয়। একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব উন্মােচিত হয় একমাত্র তার কর্মের মাধ্যমে। স্পষ্টভাবে সার্ত মানুষের কোনাে অ-উন্মােচিত বা গুপ্ত মানবিক সত্তায় বিশ্বাসী নন। তার মতে মানুষ নিজেকে যেভাবে গড়ে তােলে, সে ঠিক তাই। প্রত্যেক মানুষ তাই তার নিজের সত্তা গঠনের জন্য দায়ী এবং তার সত্তা হলাে তা; যা তার কর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।

সার্ত সব বস্তুকে আভাস বা অবভাসের অনুক্রমে পরিণত করেছেন। তার মত অবশ্য কান্টের মতের বিরােধী, কেননা কান্টীয় ইন্দ্রিয়াতিরিক্ত সত্তায় (noumenon) তিনি বিশ্বাসী নন। তার মতে আভাস থেকে ভিন্ন কোনাে সত্তা নেই। আভাসই বস্তুর সত্তা। সুতরাং কোনাে অবভাস যখন নিজকে প্রকাশ করে তখন তা নিজের সত্তা ও নিজের অস্তিত্বকেই প্রকাশ করে। এভাবে সার্ত বীয়িং-এর ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করেন যে, তার অবভাসিক মতের মাধ্যমে তিনি বীয়িং এর প্রপঞ্চবিদ্যাগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হুসার্লেরর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এ ব্যাখ্যাকে কিন্তু প্রকৃত অর্থে কখনাে প্রপঞ্চবিদ্যাগত বলা যায় না, কারণ হুসার্লের রীতি, হ্রাস প্রভৃতি কোনাে রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সার্ত গ্রহণ করেননি। রূপবৈজ্ঞানিক হ্রাসের উদ্দেশ্য হলাে বিশেষ কোনাে ঘটনাকে বাদ দিয়ে সত্তার আলােচনা করা। সার্ত এ পদ্ধতিকে অনুপযুক্ত বলে বর্জন করেছেন, যেহেতু এর দ্বারা বীয়িং-এর ব্যাখ্যা দেয়া যায় না, কারণ বীয়িং হলাে সত্তাবিহীন। সার্ত তাই বীয়িং-এর সত্তার বদলে বিশিষ্টতার আলােচনায় হুসার্লের রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে নিজের উপযােগী করে প্রয়ােগ করেছেন। সার্তের রূপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তাই হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যার একটি পরিবর্তিত রূপ।

চেতনা সম্পর্কিত ব্যাখ্যায়ও সার্তের মত হুসার্লের মত থেকে উল্লেখযােগ্যভাবে ভিন্ন। হুসার্লের প্রপঞ্চবিদ্যার প্রধান ধারণাগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে অভিপ্রায়। দেকার্তের ‘আমি’ নিজের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে অভিনিবিষ্ট, নিজের সহজাত ধারণা সম্পর্কে সচেতন; কিন্তু হুসার্লের ‘আমি’ নিজকে ছাড়া অন্য কিছু আকাঙ্ক্ষা (অভিপ্রায়) করে। হুসার্লের মতে সব অভিজ্ঞতাই কোনাে বস্তুর সঙ্গে অত্যাবশ্যকভাবে সম্পর্কিত। অন্যথায়, চেতনা সব সময়ই কোনাে কিছু সম্বন্ধে চেতনা। কিন্তু হুসার্ল কখনাে চেতনার বস্তুর অস্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না; তার আকর্ষণ ছিল চেতনার বাস্তব ঘটনার প্রতি। উদ্দেশ্য ছিল বিশুদ্ধ চেতনার (pure consciousness) প্রকৃত স্বরূপ জানা। হুসার্লের বাহ্যজগতের অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি সত্য, কিন্তু তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এ সত্য অগ্রাহ্য করেছেন চেতনার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার (অর্থাৎ মনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতনতা) প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টিনিবদ্ধ করার জন্য। অস্তিত্বকে এভাবে বন্ধনীর মধ্যে রাখা বা রূপবৈজ্ঞানিক হ্রাসের এ পদ্ধতিকে সার্ত সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

হুসার্লকে অনুসরণ করে সার্ত চেতনা সম্পর্কে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর উপর গুরুত্ব আরােপ করে তার জ্ঞান-সম্বন্ধীয় মত প্রতিষ্ঠা করেন। তাই চেতনা, যে সব সময় কোনাে বস্তু সম্পর্কে চেতনা, যা নিজে চেতনাময় নয় – হুসার্লের এ মত সার্ত পুনরাবৃত্তি করেন। এর দ্বারা সার্ত বুঝাতে চেয়েছেন যে, চেতনার কোনাে বিষয় (content) নেই, চেতনা হলাে সব সময় বাইরের কোনাে বস্তুর নির্দেশ। চেতনার প্রকৃতিই এমন যে এটি সব সময় বাইরের কোনাে অচেতন বস্তুকে বুঝায়। এটি সার্ত তত্ত্ববিষয়ক প্রমাণ বলেছেন। তার ধারণা এ প্রমাণের দ্বারা তিনি অচেতন বস্তু, অর্থাৎ অবভাসের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ অচেতন বস্তুর নাম সার্ত দিয়েছেন আঁ-সােয়া। এ আঁ-সােয়ার ধারণা তার দর্শনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর দ্বারা তিনি তার দর্শনকে ভাববাদ থেকে বাঁচিয়েছেন।

কিন্তু চেতনা কি শুধু অতিবর্তী? অন্তর্বর্তী (immanent) নয়? চেতনা যে অন্তর্বর্তী হতে পারে সার্ত তা অস্বীকার করেন না, অগ্রাহ্য করেন শুধু। তিনি বিশ্বাস করেন যে, চেতনা বাহ্য বস্তুর চেতনা হয়েও নিজের সম্পর্কে চেতনাময় হতে পারে। তখন চেতনা হবে ‘চেতনার চেতনা’ (consciousness of consciousness) (Being and Nothingness, পৃ. X/II)। কোনাে বস্তুকে জানতে গিয়ে চেতনা নিজকেও জানে। টেবিল সম্পর্কে চেতনা টেবিল সম্পর্কে চেতনার চেতনাকেও বোঝায়। এ ধরনের আত্ম চেতনা হলাে চিন্তামূলক, যা সার্তের মতে, দেকার্তের ‘আমি’র সঙ্গে এক ও অভিন্ন। এটি হলাে একজনের আত্ম-চেতনার অবস্থা সম্পর্কে বিশুদ্ধ চিন্তার নির্দেশ। এখানে জ্ঞান বলতে কোনাে বস্তুর চেতনাকে নয়, নিজ সম্পর্কে চেতনাকেই বোঝায়। আমি যদি একটি প্যাকেট গুণে দেখি যে, সেখানে এক ডজন সিগারেট আছে, তাহলে আমার কাজটি হবে অচিন্তামূলক, কারণ আমি শুধু সিগারেট গুনেছি – গোনার কাজ সম্পর্কে সচেতন নই। কিন্তু আমি যদি আমার কাজ সম্পর্কে সচেতন হই, তাহলে আমার কাজটি হবে চিন্তামূলক। এখানে চেতনার বিষয় সিগারেট নয়, সিগারেট গােনার কাজ, অর্থাৎ চেতনা নিজেই চেতনার বিষয়। সার্ত এ চিন্তামূলক চেতনা বা আত্মাকে বন্ধনীর মধ্যে রেখে দিতে চান। তার মতে অভিজ্ঞতামূলক বা অচিন্তামূলক চেতনার গঠনমূলক অংশ হিসেবে চিন্তামূলক চেতনার ধারণা নিষ্প্রয়ােজন ও অনাবশ্যক। বস্তুতপক্ষে মানসিক বা মনােদৈহিক ‘আমি’ বা চেতনা থেকে আলাদা অতিবর্তী কোনাে আত্মার অস্তিত্বের ধারণাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি দেখান যে, যদি অনাবশ্যক অতিবর্তী কোনাে আত্মার অস্তিত্ব থাকে, তাহলে তা চেতনার নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, করবে বিভক্ত এবং খণ্ড খণ্ড যেন একটা ধারালাে ব্লেডের মতাে। এ ধরনের অতিবর্তী আত্মার ধারণা চেতনা মৃত্যুরই নামান্তর। (Jean-Paul Sartre, Transcendence of the Ego, trans, Forrest Williams and Robert Kirkpatrick. New York. 1957. পৃ. ৪০)।

সার্তের মতে একটি মাত্র আত্মাই আছে, যা প্রধানত অচিন্তামূলক, কিন্তু যা চিন্তামূলকও হতে পারে। হুসার্লের অনুসরণের তিনি বলেন যে, চেতনা হলাে সর্বদা কোনাে একটা বস্তু সম্পর্কে চেতনা, অর্থাৎ নিজ থেকে আলাদা অন্য কোনাে একটি বিষয় সম্পর্কে জানা বা চেতনাময় হওয়া। এটা হলাে অচিন্তামূলক চেতনা (prereflective consciousness)। কিন্তু কোনাে বিষয় সম্পর্কে জানা বা চেতনাময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেতনা নিজ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। নিজ সম্পর্কে এ সচেতনতাই হলাে চিন্তামূলক চেতনা (reflective consciousness)। অর্থাৎ চেতনা যখন নিজ সম্পর্কে সচেতন হয়, তখন তা হয় চিন্তামূলক। চেতনা যে চিন্তামূলক হতে পারে সার্ত তা অস্বীকার করেন না; যা তিনি অস্বীকার করেন তা হলাে অচিন্তামূলক বা অভিজ্ঞতামূলক চেতনা থেকে আলাদা চিন্তামূলক চেতনার অস্তিত্ব। আলাদাভাবে চিন্তামূলক চেতনা বলে কোনাে চেতনার অস্তিত্ব নেই, অচিন্তামূলক চেতনা নিজ সম্পর্কে সচেতন হলেই তা চিন্তামূলক চেতনায় পরিণত হয়। কাজেই একমাত্র অচিন্তামূলক চেতনার জন্যই চিন্তামূলক চেতনা সম্ভব, অচিন্তামূলক চেতনাই দেকার্তের ‘আত্মা’ বা ‘আমি’র শর্ত।

হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ

ভূমিকা ও পরিচয়

অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে যে কয়েকজন সরাসরি মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে আলােচনা না করে বীয়িং-এর ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের দর্শন শুরু করেছেন, মার্টিন হাইডেগার (Martin Heidegger, ১৮৮৯-১৯৭৬ খ্রি.) তাদের অন্যতম। অস্তিত্ববাদী দর্শনের বিকাশের যে দার্শনিক যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন সে দার্শনিক হাইডেগার শুধু যে অস্তিত্ববাদীদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন তা নয়, নিজেকে অস্তিত্ববাদী বলে পরিচয় দিতে পর্যন্ত রাজি ছিলেন না। তার দর্শনের প্রধান বিষয় ছিল বীয়িং, মানুষের অস্তিত্ব নয়। তার প্রায় সব লেখায় তিনি জোর দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, দর্শনকে অবশ্যই বীয়িং-এর পুনরাবিষ্কারের মাধ্যমেই আধুনিক মানুষ তার বর্তমান আশঙ্কাজনক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে পারে। আধুনিক দর্শনের ইতিহাস এ প্রশ্নকে অবহেলা করেছে বলে তিনি অভিযােগ করেন এবং দাবি করেন যে, বীয়িং-এর তাৎপর্য বােধগম্য না হওয়া পর্যন্ত দর্শনচিন্তামাত্রই গােলমেলে ও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

হাইডেগার জার্মান নাস্তিক অস্তিত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতা। তার সমসাময়িক সময়ে নিজের দেশসহ অন্যত্রও তিনি যেমন সমাদৃত ছিলেন, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত বিতর্কিত। ১৮৮৯ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ব্ল্যাক ফরেস্টের অন্তর্গত মেকির্ষ (Messkirch) নামক স্থানে দরিদ্র একটি ক্যাথলিক পরিবারে মার্টিন হাইডেগার জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্যাথলিক চার্চের কর্মচারী ছিলেন। হাইডেগার মূলত গ্রামীণ প্রাদেশিক জার্মান হিসাবে তার জীবন কাটিয়েছিলেন, যিনি মাশরুম তুলতে আর গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে আর তাড়াতাড়ি ঘুমাতে ভালােবাসতেন। তিনি টেলিভিশন, প্লেটো, পপ সংগীত, বাজারজাত খাদ্য ঘৃণা করতেন। পারিবারিক দিক থেকেই তারা ছিলেন গােড়া ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী। ছােটবেলা থেকে কঠোর বর্মীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে তিনি লালিত হন। জিমােনেসিয়াম স্কুলে লেখাপড়া শেষ করে তিনি ১৯০৯ সালে ফ্লাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত সেখানে ধর্মতত ও দর্শনের ওপর লেখাপড়া করেন। ১৯১৪ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯১৬ সালে ফ্লাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে তিনি তার শিক্ষক স্বনামধন্য দার্শনিক এডমণ্ড হুসার্লের সহকারী নিযুক্ত হন। তবে দুই বছর পরে তিনি ফ্লাইবার্গ ছেড়ে মারবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। সেখানে সাত বছর চাকুরী করার পর হুসার্লের অবসর গ্রহণের পরে (১৯২৮) তিনি আবার ফাইবার্গে চলে আসেন এবং হুসার্লের স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯২৭ সালে তার বিখ্যাত বই Being and Time প্রকাশিত হবার পর তিনি পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন।

কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করে বসেন যখন মধ্য ত্রিশে (অবশ্য এই ভুল তিনি একা করেননি)। হিটলার সেই সময় যা-কিছু বলেছিলেন তিনি তা বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন নাৎসিরা জার্মানিতে শৃঙ্খলা আর মর্যাদা ফিরিয়ে আনবে। নাৎসী বাহিনীর নেতা হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তিনি তার সমর্থন জানান এবং নাৎসীদের সাথে সর্বদা যােগাযােগ রক্ষা করেন। আর সেই সময়ের মানসিকতার সাথে তাল মিলিয়ে ফ্রিবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইহুদি শিক্ষকদের নিষিদ্ধ ঘােষণা করারও চেষ্টা করেন। সেই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির রেক্টর ছিলেন। বহু দশক ধরে তিনি তার সেই কাণ্ডজ্ঞানহীন পর্বের জন্য অনুশােচনা করেছেন তার নিজের মতাে করে, এবং এর জন্য তাকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছিল। মিত্রবাহিনীর নির্দেশে ১৯৪৫ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ থেকে অপসারিত হন। ১৯৪৫ সালে জার্মানির পরাজয়ের পর তাকে যেকোনাে ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছরের জন্য। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তার পেশাগত জীবন খুব ধীরে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। ১৯৫১ সালে তিনি আবার নিয়ােগ পান এবং ১৯৫৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সময় কাটিয়েছেন জঙ্গলের মধ্যে তার বানানাে ছােট একটি কুটিরে, সভ্যতা থেকে বহুদূরে, ১৯৭৬ সালে তার মৃত্যু অবধি।

মার্টিন হাইডেগার ছিলেন রূপবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এডমন্ড হুসার্সের ছাত্র। তার চিন্তার মধ্যে হুসার্লের প্রভাব লক্ষণীয়। তবে হুসার্লের রূপবিজ্ঞানকে তিনি ইচ্ছামতাে পরিবর্তন করেন। এছাড়া ফ্রেজ ব্রেন্টানাে এবং হেনরি রিকার্টের দ্বারাও তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত ছিলেন। অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে তিনি সােরেন কিয়ার্কেগার্ডের আস্তিক্য অস্তিত্ববাদের বিরােধিতা করেন। তবে অস্তিত্ববাদের মূলমন্ত্র তিনি কিয়ার্কেগার্ড থেকেই গ্রহণ করেন এবং অস্তিত্ববাদী দর্শনের মৌলিক দিকের প্রায় সবগুলিই তিনি ধারণ করেন। হাইডেগারের দর্শনকে বিভিন্ন আলােচক বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। তার সময়ে এবং তার পরবর্তী সময়ে তার ব্যক্তিগত জীবন ও দর্শন নিয়ে অনেক বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়। তিনি নাৎসী বাহিনীর সমর্থক ছিলেন এজন্য অনেকেই তাকে ব্যক্তি হিসেবেই অবজ্ঞা করে তার দর্শনবিমুখ ছিলেন। মার্কসবাদী কমিউনিস্টরাও তাকে কঠোর সমালােচনা করেছেন। এমনকি অনেকে তাকে ‘দর্শনহীন দার্শনিক’ বলেও মন্তব্য করেছেন। এতসব সমালােচনা ও বিরােধিতা সত্ত্বেও হাইডেগারের দর্শনের মূল্য দর্শনের ইতিহাসে অক্ষুন্ন হয়ে আছে। বিশেষ করে অস্তিত্ববাদী দর্শনের ক্ষেত্রে তার দর্শনকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তবে মজার ব্যাপার হল, হাইডেগার নিজেকে অস্তিত্ববাদী হিসেবে পরিচয় দিতে নারাজ ছিলেন । হাইডেগার লিখেছেন প্রচুর। তার লিখিত গ্রন্থের মধ্যে Being and Time, Descourse on Thinking, Kant and the Problem of Metaphysics, The Question of Being, Identity and Defference, Existence and Being, What is Philosophy, এবং The End of Philosophy প্রধান।

হাইডেগার পুরাে পেশাগত জীবনে তিনি চেষ্টা করেছিলেন কীভাবে আরাে বেশি বিবেচনা ও প্রজ্ঞার সাথে আমরা আমাদের জীবন কাটাতে পারি। তিনি আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন যেন কিছু সত্য স্বীকার করার মতাে সাহসী হয়ে উঠতে পারি আমরা, যা আমাদের জীবনকে আরাে সমৃদ্ধ, গভীর আর সুখী করে তুলবে। তিনি মনে করতেন দর্শন কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন নয়, এটি, যেমন করে গ্রিকরা ভাবতেন, একটি আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা, একধরনের চিকিৎসা বা থেরাপি। তিনি শনাক্ত করেছিলেন, আধুনিক মানবতা তার আত্মায় বেশকিছু নতুন অসুখে আক্রান্ত।

মানবতার আত্মার অসুখগুলো

১। আমরা লক্ষ করতে ভুলে গেছি যে আমরা বেঁচে আছি

তাত্ত্বিকভাবে আমরা এটি জানি, অবশ্যই, কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে আমরা সঠিকভাবে আমাদের অস্তিত্বের তীব্র রহস্যময়তাকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হই, যে রহস্যটিকে হাইডেগার বলেছিলেন ‘das Sein’ বা Being’; তার বেশিরভাগ দর্শন মূলত চেষ্টা করেছে। আমাদের জাগিয়ে তুলতে, অন্যথায় আপাতদৃষ্টিতে নীরব, অপরিচিত, অবান্ধব, বসতিশূন্য একটি মহাবিশ্বে ঘূর্ণায়মান একটি গ্রহে বেঁচে থাকার অদ্ভুত বিষয়টির প্রতি সচেতন করে তুলতে। শুধুমাত্র অল্পকিছু অদ্ভুত মুহূর্তে, হয়তাে গভীর রাতে অথবা যখন আমরা অসুস্থ, সারাদিন ধরে একাকী, অথবা প্রকৃতির কাছাকাছি, তখনই হয়তাে আমরা সবকিছু রহস্যময়, এই অদ্ভুত বিষয়টির মুখােমুখি হতে পারি। কেন সবকিছুর অস্তিত্ব আছে যেমন আমরা দেখি, কেন আমরা সেখানে না বরং কেন আমরা এখানে এভাবে, কেন পৃথিবী এমন, কেন ঐ গাছ বা বাড়িটাই বা ঐরকম, এই দুর্লভ মুহূর্তগুলাে অনুভব করার প্রক্রিয়াটি, যা স্বাভাবিক সবকিছুকে আমূল নাড়িয়ে দেয়, সেটিকে বােঝাতে হাইডেগার ব্যবহার করেছিলেন Mystery of Being বা ‘বেঁচে থাকার রহস্যময়তা’ শব্দকে। তার দর্শনের পুরােটাই নিবেদিত ছিল, এই বিমূর্ত, তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটির মূল্যায়ন ও এর প্রতি সঠিক প্রতিক্রিয়া আমরা কীভাবে দেখাতে পারি সেই বিষয়গুলাে নিয়ে।

হাইডেগারের জন্য, আধুনিক পৃথিবী হচ্ছে নারকীয় একটি যন্ত্র যার কাজ হচ্ছে বেঁচে থাকার সেই বিস্ময়কর প্রকৃতির মৌলিকতাটি থেকে আমাদের মনােযােগকে বিক্ষিপ্ত করা। সারাক্ষণই এটি আমাদের প্রায়ােগিক ব্যবহারিক কাজের দিকে টানে, আমাদেরকে নিমজ্জিত করে তথ্য দিয়ে, নীরবতাকে হত্যা করে, আমাদের এটি একা কিছুতেই থাকতে দেয় না, আংশিকভাবে এর কারণ Mystery of Being অনুভব করার সাথে যুক্ত আছে কিছু আতঙ্কিত করার মতাে অভিজ্ঞতার মাত্রা। সেটি করলে আমরা হয়তাে আক্রান্ত হতে পারি উৎকণ্ঠায়, কারণ আমরা সচেতন হই যে সবকিছু যা মনে হয় প্রােথিত, প্রয়ােজনীয়। এ আবশ্যকীয়, সেগুলাে হতে পারে আকস্মিক, অর্থহীন আর সত্যিকারভাবেই উদ্দেশ্যহীন। আমরা হয়তাে নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি কেন আমরা ঐ কাজটির বদলে এই কাজটি করছি, কেন অন্যজন নয়-এর সাথে সম্পর্কে আছি, বা বেঁচে আছি যখন কিনা আমরা খুব সহজেই মরে যেতে পারি। প্রাত্যহিক জীবনের অনেককিছুই পরিকল্পিত এই অদ্ভুত, বিচলিত আর অস্থির করা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলােকে লাগাম দিয়ে রাখার জন্যে। আমরা আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি das Nichts (The Nothing) বা শূন্যতার মুখােমুখি হতে, যার অবস্থান Being বা আমাদের অস্তিত্বেই অন্যপাশে। এই das Nichts বা শূন্যতা রয়েছে সর্বত্র, এটি আমাদের সারাক্ষণ অনুসরণ করে, একসময় এটি আমাদের গ্রাস করবে, কিন্তু হাইডেগার আমাদের জানাতে ভুলে যাননি যে, একটি জীবনকে খুব ভালােভাবে কাটানাে যাবে, যদি কেউ শূন্যতা বা Nothingness আর Being বা অস্তিত্বের সংক্ষিপ্ত রূপটিও বিবেচনায় রাখে। যেমন আমরা সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে হালকা সন্ধ্যার আলাে ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকা দিনের শেষে সূর্যাস্ত দেখার সময় করি।

২। আমরা ভুলে গেছি সব জীবনই সংযুক্ত

আমাদের সংকীর্ণ স্বার্থের প্রিজম দিয়ে আমরা পৃথিবীকে দেখি। আমাদের নিজস্ব চাহিদা সেগুলােকেই রঙিন করে যা যার প্রতি আমরা নজর দিই বা ভাবি। আমরা অন্যদেরকে ও প্রকৃতিকে কোনােকিছু অর্জন করার একটি উপায় হিসাবে ব্যবহার করি। কিন্তু কখনাে কখনাে আমরা আমাদের এই সংকীর্ণ কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি এবং অস্তিত্বের বাকি অংশের সাথে আমাদের যােগাযােগকে আরাে উদার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে পারি। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আমরা ঐ গাছের ডালে বসা লেডি বার্ডটিকে, ওই পাথরটিকে, ওই মেঘটিকে লক্ষ করব, লক্ষ করবো অস্তিত্ববান সবকিছুকে যাদের অস্তিত্বের সাথে আমরা একীভূত হয়ে আছি। হাইডেগারের কাছে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্তিত্বশীলতার অনুভূতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তিনি চেয়েছিলেন যাতে আমরা এর মাধ্যমে আরও গভীর উদারতায় প্রবেশ করতে পারি, আরও বেশি করে বিচ্ছিন্নতা ও স্বার্থপরতাকে অতিক্রম করতে পারি, শূন্যতা বা das Nichts আমাদের গ্রাস করার আগেই আমরা গভীরভাবে অনুভব করতে পারি সেই সংক্ষিপ্ত সময়টিকে।

৩। আমরা ভুলে গেছি কীভাবে স্বাধীন হতে হয় আর নিজেদের জন্য বাঁচতে হয়

বেঁচে থাকার বিষয়টি ভুলে যাওয়াকে হাইডেগার বলেছেন Seinsvergessenheit। অবশ্যই আমরা অনেক কারণেই খুব বেশি স্বাধীন নই। হাইডেগার বলছেন, আমাদের জীবনের শুরুতেই আমাদেরকে এই পৃথিবীতে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে (Thrown into the world)। আমাদের ছুড়ে দেয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট আর সংকীর্ণ সামাজিক পরিবেশে, আমাদের পরিবেষ্টিত করে আছে কঠোর মানসিকতা, প্রাচীন সংস্কার আর প্রায়ােগিক আবশ্যিকতা যার কোনােটাই আমাদের সৃষ্টি নয়। হাইডেগার আমাদের সাহায্য করতে চান এই “Thrownness” এই Geworfenheit থেকে আমাদের নিজেকে মুক্ত করতে, এর নানা বৈশিষ্ট্যগুলােকে বুঝতে। আমাদের উচিত হবে আমাদের মনােজাগতিক, সামাজিক ও পেশাগত সংকীর্ণতাবাদকে ভালাে করে বােঝার চেষ্টা করা আর তারপর আরাে বিশ্বজনীন একটি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে সেটিকে অতিক্রম করা। আর সেটি করতে গিয়ে, আমাদের করতে হবে একটি হাইডেগারীয় যাত্রা, যা হবে কৃত্রিমতা বা Uneigentlichkeit থেকে সত্য বা Eigentlichkeit এর দিকে। এর মধ্য দিয়ে আমরাও সত্যিকারভাবে নিজেদের জন্য বাঁচতে শুরু করব। কিন্তু তারপরও বহু সময়ে, হাইডেগারের দৃষ্টিতে, আমরা খুব খারাপভাবে এই কাজে ব্যর্থ হই। আমরা শুধুমাত্র আত্মসমর্পণ করি একটি সামাজিকভাবে গ্রহণযােগ্য ও উপরিদৃষ্টিতে হালকা জীবনযাত্রার প্রক্রিয়ায়, যাকে তিনি বলেছিলেন they-self (যা our-selves-এর বিপরীত)। আমরা শুধু কথাবার্তা বা গুজব অনুসরণ করি (das Gerede); যা আমরা খবরের কাগজে, টিভি কিংবা বড় কোনাে শহরে (যেখানে থাকতে তিনি ঘৃণা করতেন) থাকলে সারাক্ষণ শুনতে পাই। এই they-self থেকে যা আমাদের বের হয়ে আসতে সাহায্য করে তাহলাে আমাদের আসন্ন মৃত্যুর প্রতি উপযুক্ত পরিমাণে গভীর মনােযােগ। শুধুমাত্র যখন আমরা অনুধাবন করি যে অন্য মানুষরা আমাদের das Nichts থেকে রক্ষা করতে পারবেনা, তখনই সম্ভবত আমরা তাদের জন্য বাঁচা বন্ধ করব। অন্যরা কী ভাবে সেটি নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করা বন্ধ করব, জীবনের সিংহভাগ বিসর্জন দেয়া বন্ধ করব, অন্যদের সন্তুষ্ট করার জন্যে এবং আমাদের শক্তি খরচ বন্ধ করব, সেই মানুষগুলােকে তুষ্ট করার জন্যে যারা আসলেই আমাদের পছন্দ করেন। অস্তিত্বহীনতার শূন্যতা নিয়ে উৎকণ্ঠা যদিও অস্বস্তিকর, তবে তা আমাদের বাঁচাতে পারে। আমাদের এই Sein-Zum-Tode বা Being-toward-death বা বেঁচে থাকা থেকে মৃত্যু সম্বন্ধে আমাদের সচেতনতাই জীবনের পথ। ১৯৬১ সালে এক লেকচারের সময় হাইডেগারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কীভাবে আমরা আমাদের অকৃত্রিমতাকে পুনরুদ্ধার করতে পারি, তিনি খুব সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করছিলেন, ‘সমাধিক্ষেত্রে’ বেশি সময় কাটানাের চেষ্টা করা উচিত আমাদের।

৪। আমরা অন্যদেরকে মানুষ না, বরং বস্তু হিসাবে ভাবি

বেশিরভাগ সময়, গভীর কােনাে অর্থ ছাড়াই, আমরা অন্য মানুষদের জীবন্ত কোনাে অস্তিত্ব বা সত্তা হিসাবে নয় বরং বস্তু হিসাবে বিবেচনা করি (হাইডেগারের শব্দ das Zeug বা যন্ত্র)। আর এই স্বার্থপরতার নিরাময় আছে মহান শিল্পকলায়। আমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসতে, অন্য মানুষ আর জিনিসের স্বাধীন অস্তিত্বকে মূল্যায়ন করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে শুধুমাত্র শিল্পকর্ম। হাইডেগার এই ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে ভ্যান গগের একটি চিত্রকর্ম ব্যবহার করেছিলেন, কৃষকের একজোড়া জুতার তৈলচিত্র। সাধারণত আমরা জুতার প্রতি এত মনােযােগ দিই না, আমাদের ব্যবহার করার একটি উপকরণ মাত্র, যা আমাদের দরকার আছে চলার জন্য। কিন্তু যখন সেটি কোনাে ক্যানভাসে উপস্থাপন করা হয়, আমরা তাদের লক্ষ্য করতে বাধ্য হই। যেন প্রথমবারের মতাে, শুধুমাত্র তাদের খাতিরে। একই বিষয় আমাদের সাথে ঘটতে পারে, যখন আরাে প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট কিছুকে এভাবে উপস্থাপন করতে দেখি মহান শিল্পীদের। শিল্পকলার কল্যাণে আমরা নতুন ধরনের অস্তিত্বের অনুভব (বা তার ভাষায় Sorge) বােধ করি যার অবস্থান আমাদের বাইরে।

বীয়িং কী?

হাইডেগারের মতে সব প্রশ্নের মৌল প্রশ্ন হলাে – বীয়িং কি? এ জগতের বিচিত্র রকমের অসংখ্য জিনিস আছে; এগুলাে অস্তিত্বশীল কেন? এসব জিনিসের পরিবর্তে একেবারে কিছুরই অস্তিত্ব না থাকলে কী হতাে? শূন্যতার পরিবর্তে এসব জিনিস আছে কেন? কিসের জন্য? এ প্রশ্ন হলাে বীয়িং এর প্রশ্ন, দর্শনের মৌল প্রশ্ন। এ প্রশ্নটি হাইডেগেরের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর উত্তর না জানলে জগতের কোনাে কিছুই বােধগম্য হবে না এবং মানুষের জ্ঞান হবে বৃথা ও প্রতারণামূলক। হাইডেগার মনে করেন, প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান মূল প্রশ্নটি বাদ দিয়ে নিজেদের পরিকল্পিত বিষয়ের অর্থ অনুসন্ধানে ব্যস্ত। দেশ, কাল, জীবন, মন, সমাজ প্রভৃতির অর্থ অনুসন্ধান করে লাভ কি, যদি বীয়িং-এর অর্থ অস্পষ্ট ও অবােধগম্য থেকে যায়। কাজেই তত্ত্বের প্রশ্নই হলাে আসল প্রশ্ন। কোনােকিছু সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে বীয়িংকে। তত্ত্বকে ছাড়া বিশিষ্টতাকে জানা সম্ভব নয়। এ কারণে হাইডেগার তার দর্শনে তত্ত্ববিদ্যার উপর এতবেশি জোর দিয়েছেন। বস্তুতপক্ষে তার কাছে দর্শন ও তত্ত্ববিদ্যা এক ও অভিন্ন।

এটা তাহলে স্পষ্ট যে, হাইডেগারের দর্শন মূলত তত্ত্বমূলক। তার আকর্ষণ ছিল বীয়িং-এর তত্ত্বমূলক অর্থ জানা। বীয়িং বলতে তিনি বুঝিয়েছেন অস্তিত্বকে, তবে বিশেষ অর্থে নয়, সামগ্রিক বা সার্বিক অর্থে। এ বীয়িং বা সার্বিক অস্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন বলেই হাইডেগার নিজেকে একজন অস্তিত্ববাদী বলে দাবি করতে চাননি। তবুও মানুষের অস্তিত্বের উপর তিনি এত গুরুত্ব আরােপ করেছেন যে, তাকে অস্তিত্ববাদী না বলার কোনাে উপায় নেই। বীয়িং তার দর্শনের প্রধান বিষয় হলেও, তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এ বিষয়ে অগ্রসর হবার একমাত্র মাধ্যম মানুষের অস্তিত্ব। কেননা, এ জগতের সব বস্তুর মধ্যে মানুষের অস্তিত্ব হলাে স্বতন্ত্র – মানুষই একমাত্র জীব যে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে, বীয়িং সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারে। আমরা যখন বীয়িং সম্পর্কে প্রশ্ন করি, তখনই আমরা প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা এ জগৎ বা এ জগতের কোনাে বস্তু দিয়ে আরম্ভ করতে পারি না, কারণ এর থেকে আমরা কোনাে প্রত্যক্ষ উত্তর পাই না। আমাদেরকে আরম্ভ করতে হবে আমাদের অস্তিত্ব দিয়ে কেননা আমরা হলাম বীয়িং এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আমাদের অস্তিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারি।

তবে মনে রাখতে হবে, বীয়িং জানার জন্যে মানুষের অস্তিত্ব একটি প্রারম্ভিক সূত্র; মৌল প্রশ্নটি জ্ঞান বিষয়ক নয়, তত্ত্ববিষয়ক প্রশ্ন হলাে অস্তিত্ব কী? অন্য কথায় অস্তিত্বকে আমরা কিভাবে জানি তা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলাে বীয়িং অর্থাৎ অস্তিত্ব কী তা জানা। তবে হাইডেগার শুধু অস্তিত্ব কী তা জানতে চান না, অস্তিত্বের অর্থ, উদ্দেশ্য বা গুরুত্ব কী তাও জানতে চান, এবং অস্তিত্বের অর্থ দিয়েই শুরু করতে চান। মানুষের অস্তিত্ব শুধু যে সার্বিক অস্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তা নয়, এ জগতের সব অস্তিত্বশীল জিনিসের মধ্যে মানুষই একমাত্র এ জগতের বৈচিত্র্য বুঝতে পারে, বস্তুর অস্তিত্ব জানতে পারে, নিজের অস্তিত্বকে বুঝতে পারে এবং এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারে।

ডাজায়েন (Dasein) ও যথার্থ অস্তিত্ব 

হাইডেগার তার দর্শনে মানুষের অস্তিত্বকে বোঝানাের জন্য একটি আলাদা শব্দ ব্যবহার করেছেন। শব্দটি হলাে ডাজায়েন যার দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন জগতে অস্তিত্বশীল হওয়া (Being-in the-world)। দেকার্তের মতানুসারে মনের যেমন জড় থেকে আলাদা স্বাধীন অস্তিত্ব আছে, ডাজায়েন কিন্তু এ জগৎ থেকে আলাদা একটা কিছু নয়। ডাজায়েন ও জগতের মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে: তত্ত্বের দিক থেকে অনাত্মা ছাড়া আত্মার কল্পনা করা যায় না – জগৎ ছাড়া ডাজ্যয়েন অচিন্তনীয়। “আমি আছি” মানেই হলাে “আমি এ জগতে আছি।” তবে যে অর্থে গ্লাসের মধ্যে জল থাকে আমার অস্তিত্ব কিন্তু আমি “দেশ বা স্থান অধিকার করে আছি” বলে নয়। আমার অস্তিত্বকে শুধু দেশ বা স্থানের নৈকট্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে চলবে না। জগৎ সম্পর্কে উদ্বেগই (care) আমার অস্তিত্বের আসল কথা। এবং একমাত্র এ আলােকেই জগতের বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে বুঝতে হবে। ডাজায়েন ও জগতের মধ্যে অবিরাম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলছে। অনাত্মা অর্থাৎ জগৎ ছাড়া যেমন আমি অস্তিত্বশীল হতে পারি না, ঠিক তেমনি আমার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া ছাড়া এ জগতের কোনাে অর্থ বা গুরুত্ব থাকে না।

হাইডেগারের মতে মানুষের বড় বৈশিষ্ট্য হলাে তার স্বাতন্ত্র। এ স্বাতন্ত্র কিন্তু মানুষের কোনাে একটা নির্দিষ্ট গুণ নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের একটা অস্ফুট কর্মশক্তি, সম্ভাবনাময় এক বিরাট ক্ষমতা। মানুষের সম্ভাবনাসমূহের মধ্যে দুটোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এ দুটোর অধীনে অন্য সব সম্ভাবনাকেই ব্যাখ্যা করা যায়। এগুলাে হলাে : যথার্থ (authentic) ও অযথার্থ (inauthentic) অস্তিত্বের সম্ভাবনা। হাইডেগার মানুষের পূর্বনির্ধারিত কোনাে সারসত্তায় বিশ্বাস করেন না। তার মতে মানুষের অস্তিত্বই মানুষের সারসত্তা। মানুষের জীবন সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। এ সম্ভাবনা সিদ্ধিতেই তার সারসত্তা নিহিত। তবে এর মানে এ নয় যে, মানুষের জন্য যে-কোনাে কিছুই সম্ভব। প্রত্যেক মানুষেরই সম্ভাব্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনাে না কোনাে দিকে সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমাদের সবারই নির্বাচন করার ক্ষমতা আছে এবং এ জগৎ সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ আমাদেরকে যে ভবিষ্যতের দিকে এক পরিস্থিতি থেকে অন্য এক পরিস্থিতিতে নিয়ে যাচ্ছে এ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি কী করবাে? আমি কী ব্যবহার করবাে? জিনিসগুলাে কি আমার ভালাের জন্য নাকি ক্ষতির জন্য? – এই প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় জগৎ সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ। আমরা নির্বাচন করি বলেই উদ্বেগ আমাদের মনে জাগে, যারা নির্বাচন করে না। তাদের মনে এসব প্রশ্ন জাগে না।

মানুষ যখন নির্বাচন করে, সে শূন্য নির্বাচন করে না – এ জগতেই তাকে নির্বাচন করতে হয়। জগতের জিনিসগুলাে আমাদের কাছে শুধু বাহ্যবস্তু হিসেবে নয়, বরং আমাদের উদ্দেশ্যের উপায় বা যাত্রাপথের প্রতিবন্ধকতা হিসেবেই উপস্থিত হয়। তাছাড়া এ জগতে আমরা একা নই, অন্য লােকের দ্বারা চারদিকে পরিবেষ্টিত। হয়তাে এমন হতে পারে আমরা আমাদের স্বতন্ত্র অস্ফুট কর্মশক্তিকে সাধারণ মানুষের অর্থাৎ জনতার অব্যক্তিক কর্মরাশি থেকে আলাদা করতে সক্ষম নই; আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে-সমাজে বসবাস করি সে সমাজের রীতি নীতি, ধারণা-বিশ্বাস ও সংস্কার মেনে চলি; সর্বসাধারণের জন্য প্রস্তুত কাপড়চোপড় পরিধান করে, জনসাধারণের যাতায়াত ব্যবস্থা ও পার্ক ব্যবহার করে এবং সাধারণ মানুষের জন্য লেখা পত্রিকা পড়ে আমরা সন্তুষ্ট হই; অর্থাৎ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমরা নিজেদেরকে জনতা থেকে আলাদা করতে পারি না। এ ধরনের অস্তিত্বকে হাইডেগার বলেছেন অযথার্থ অস্তিত্ব। এ ধরনের অস্তিত্বেও অবশ্য আমরা ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হই, আমাদের জীবনের সম্ভাবনাগুলােকে বুঝতে পারি; কিন্তু এগুলােকে আমরা অব্যক্তিক, অযথার্থ ও জনতার সম্ভাবনার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলি – নিজের অস্তিত্বকে, সম্ভাবনাগুলােকে জনতা থেকে স্বতন্ত্রভাবে উপলব্ধি করি না। এ ধরনের অস্তিত্ব আসল অস্তিত্ব নয়। কিয়ের্কেগার্ড এ ধরনের অস্তিত্বকে ভােগের স্তর বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ ধরনের জীবন সাধারণ মানুষের জীবন, জনতার জীবন সেখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের প্রকাশ পায় না, জীবন চলে গড্ডালিকা প্রবাহের মতাে।

মানুষের যথার্থ অস্তিত্ব শুরু হয় তখনই, যখনই সে উপলব্ধি করে এবং সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারে যে, সে আসলে কে, তার অস্তিত্ব কী? সে যদি একবার বুঝতে পারে যে, প্রত্যেকটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র, অন্য যে কোনাে মানুষ থেকে আলাদা এবং তার নিজের সম্ভাবনাগুলােকে নিজেকেই পূর্ণ করতে হবে, তখন জগৎ সম্পর্কে তার উদ্বেগ সাধারণ মানুষ যেভাবে কাজ করছে ঠিক সেভাবে কাজ করার বা সমাজে অন্যান্য লােকদের বাঁচার জন্য যা করা প্রয়ােজন তা করার উদ্বেগ না হয়ে হবে তার নিজের প্রকৃত অস্ফুট কর্মশক্তিকে পূর্ণ করা। যথার্থ অস্তিত্বের এ ধারণা, নিজের স্বাতন্ত্রকে উপলব্ধি করার প্রয়ােজনীয়তা কিয়ের্কেগার্ডের গভীর আত্মােপলব্ধি বা আত্মিকতা ধারণার, যাকে কিয়ের্কেগার্ড ধর্মীয় স্তর বলেন, তারই অনুরূপ।

হাইডেগারের মতে আমরা যখন কোনাে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, তখন আমাদের মনে বিশেষ অনুভূতি বা ভাব জাগে। পরিস্থিতির সঙ্গে সংযুক্ত এ মনােভাবের উপর ভিত্তি করেই আমরা আমাদের পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারি। মনােভাবগুলাের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলাে মনস্তাপ। ভীতিও এক ধরনের মনােভাব; তবে মনস্তাপ ও ভীতি এক জিনিস নয়। নির্দিষ্ট কোনাে বস্তুর ভয় থেকে ভীতি উৎপন্ন হয়, আমাদের জীবনের প্রতি হুমকি থেকেই ভীতি জাগে। কিন্তু মনস্তাপের নির্দিষ্ট কোনাে বস্তু নেই – আমাদের যথার্থ অস্তিত্বের সচেতনতা থেকেই মনস্তাপের উৎপত্তি।

হাইডেগার অযথার্থ অস্তিত্বকে পতিত স্তর বলে উল্লেখ করলেও কিয়ের্কেগার্ডের মতাে পাপযুক্ত বলে চিহ্নিত করেননি। এ স্তরে মানুষ জগতের সঙ্গে তার সম্পর্কের সত্যকে অবহেলা করে। জগতের জিনিসগুলাে সত্যিকারভাবে কি তা আংশিকভাবে জানলেও অধিকাংশই সে জানে না; তার কারণ অন্যান্য লােক এগুলােকে যেভাবে দেখে এবং যে বৈশিষ্ট্য আরােপ করে, ঠিক সে দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে এক করে ফেলে। সে সহজভাবে কোনাে মত গঠন করতে পারে না; তার মতামত আংশিকভাবে তার নিজের এবং আংশিকভাবে অন্য লােকের। সে যদি বিশেষ কোনাে জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ও, তাহলে তাে বিশুদ্ধ জ্ঞান-লাভের চেয়ে বেশি তার নিজের কৌতূহলের জন্যই।

এমনও হতে পারে, একজন মানুষ তার সারাটা জীবন এ ধরনের অযথার্থ পরিস্থিতিতে কাটিয়ে দিতে পারে এবং সেখান থেকে সে কখনাে বেরিয়ে আসতে পারে না। তবে জগতের সঙ্গে তার সত্যিকারের সম্পর্ক এবং দায়িত্ব সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গির হয়তাে পরিবর্তন হতে পারে। জগতে যে তার স্বতন্ত্র স্থান আছে তা বুঝতে পারলে সে হয়তাে এ সত্যটুকুও উপলব্ধি করতে পারে যে জগৎকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য সেই একমাত্র দায়ী। সে হয়তাে উপলব্ধি করতে পারে যে, জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন উদ্বেগের, অন্য দিকে তার উদ্বেগ তেমনি এক ভিন্ন ধরনের। অন্যেরা বস্তুর উপর যে গুরুত্বারােপ করে অসংশােধিত অবস্থায় সে ঠিক তাই গ্রহণ করে। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে সে যখন আসল ব্যাপারে জানে, তখন সে বুঝতে পারে যে, সাধারণ লােকজন কখনাে তার জীবনের জন্য গুরুত্বের উৎস হতে পারে না। সে আসলে একাকী এবং তার ইচ্ছানুযায়ী সে বস্তুর উপর যে কোনাে মূল্য আরােপ করতে পারে।

এভাবে যখন মানুষের মনে আত্মােপলব্ধি হয়, ঠিক তখনই তার মনে মনস্তাপ জাগে। এটা নির্দিষ্ট এমন কিছু নয় যা তাকে যন্ত্রণা দেয়, এটি হলাে এ জগতে তার অসমর্থিত, স্বতন্ত্র অবস্থা মাত্র। সে জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দেহ করতে শুরু করে, কেননা সে উপলব্ধি করে যে, সেই এর বাস্তবতার উৎস। এমনকি জগতে তার অবস্থান সম্পর্কে সে সন্ধিহান এবং কোনােকিছুই সে আর ধরে নিতে পারে না। এ ধরনের অবস্থায় নিজেকে রক্ষা করার জন্য তখন সে হয়তাে আরও বেশি করে সাধারণ, দৈনন্দিন বা ব্যবহারিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে। সমর্থন হারাবার ভয়ে সে তখন সম্পূর্ণভাবে সাধারণ মানুষের দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়, গোঁড়ামি, বুর্জোয়া ও স্বাভাবিকতাকে রক্ষা করে এবং তার অযথার্থ লক্ষ্যের দিকে উন্মত্তভাবে ছোটে। অন্যদিকে, জগৎ সম্পর্কে তার উদ্বেগের ব্যাপারটি সে দৃঢ় সংকল্পচিত্তে পরিবর্তন করতে পারে এবং তার একাকিত্ব ও দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানের কথা মনে রেখে যথার্থ অস্তিত্বের দিকে হয়তাে সে দৃঢ়চিত্তে অগ্রসর হতে পারে।

অনস্তিত্ব ও কাল 

হাইডেগার উদ্বেগের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত অনস্তিত্ব (nothing) ও কালের (time) ধারণার মাধ্যমে যথার্থ অস্তিত্ব কি তা বোঝানাের চেষ্টা করেছেন। ‘নাথিং’ শব্দটির দ্বারা হাইডেগার বস্তুত পক্ষে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও মােটামুটিভাবে বলা যায় যে, জগতের অস্তিত্বের ধারণার বিপরীতে অনস্তিত্বের ধারণাকে বোঝানাের জন্য তিনি এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। জগৎ সম্পর্কে চিন্তা করতে গিয়ে যে বিষয়টি অত্যাবশ্যকভাবে আমাদের উপলব্ধি করা উচিত তাহলাে জগতের সব জিনিসই পরস্পর থেকে ভিন্ন এবং বিশেষভাবে ডাজায়েন অর্থাৎ মানুষ থেকে ভিন্ন। জগৎকে আমরা যেভাবে বর্ণনা করি না কেন, আমাদের বর্ণনার মধ্যে একটা নঞর্থক কিছু থেকেই যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, এ জগতের অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনস্তিত্বের কথাও ভাবী – সাধারণ অস্তিত্বের ধারণার সঙ্গে যা অস্তিত্বশীল নয় তার ধারণা একসঙ্গে গ্রথিত।

একটা বিশেষ ক্ষেত্রে এ অনস্তিত্বের ধারণাটি খুবই স্পষ্ট; এবং তাহলাে আমরা মরণশীল। আগে হােক বা পরে হােক, আমরা যে একসময় আর অস্তিত্বশীল থাকবাে না – এই উপলব্ধি এক অকৃত্রিম সত্য। হাইডেগারের মতে অস্তিত্বহীনতার উপলব্ধিই যথার্থ অস্তিত্বের পথে প্রথম পদক্ষেপ; এ সত্যটুকু মেনে নিয়ে মানুষ উপলব্ধি করে যে, সে সম্পূর্ণভাবে একা, জগতের প্রত্যেক বস্তু ও মানুষ তার নিজের, অন্য কেউ তার মৃত্যুর জন্য মরতে পারে না। কাজেই এ অস্তিত্বহীনতাই হলাে শেষ পরিণতি যার দিকে আমরা সবাই অগ্রসর হচ্ছি – অস্তিত্বশীল হওয়া মানেই এর দিকে ধাবিত হওয়া।

চরম সসীমত্বই (radical finitude) হলাে তাহলে ডাজায়েন বা মানুষের অস্তিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এখানে হাইডেগার কান্টের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। কান্ট বহির্জগৎ, আত্মার অমরত্ব ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের সীমাত্ব স্বীকার করেছেন। এ সসীমত্বের ধারণা হাইডেগার অন্যভাবে মানুষের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করেছেন। মানুষের অস্তিত্ব সীমিত বলতে বাহ্যবস্তু যেভাবে আকারগতভাবে সীমিত ঠিক তা বোঝায় না। মানুষ সীমিত মানে হলাে তার অস্তিত্বের মধ্যে অনস্তিত্বের ধারণা রয়েছে। “আমি হই” বললে “আমি নই” বোঝায় যেহেতু “আমার হওয়া” একদিন না হওয়ায় পরিণত হবে – যখন মৃত্যু এসে আমার অস্তিত্ব কেড়ে নিয়ে যাবে। মৃত্যুতেই মানুষের সম্ভাবনাময় জীবনের পরিসমাপ্তি – “আমাকে মরতে হবে” এ ধারণা আমার অস্তিত্বের এক অপরিহার্য সম্ভাবনা।

হাইডেগারের মতে মানুষের সসীমত্বের প্রকাশ ঘটে অনিত্যতা বা ক্ষণস্থায়ীত্বে (temporality)। এ অনিত্যতার ধারণা ছাড়া এ জগৎ সম্পর্কে মানুষের কোনাে উদ্বেগই থাকতাে না। আমরা আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনটি ভিন্ন উপায়ে সচেতন; প্রথমত আমরা আমাদের অতীতের ঘটনা যেমন, আমাদের জন্ম, পিতা-মাতা, শিক্ষা প্রভৃতি সম্পর্কে সচেতন; দ্বিতীয়ত বর্তমান মুহূর্ত অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে আমাদের চোখের সামনে যা আছে তার সম্পর্কে সচেতন এবং তৃতীয়ত আমাদের সম্ভাবনা (যা পূর্ণ করার জন্য বস্তুতপক্ষে আমরা কাজ করি) সম্পর্কে সচেতন। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতাই হাইডেগের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।

জগৎ সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ নির্ভর করে কিছু একটা করতে হবে – এ ধারণার ওপর এবং এ ধারণা ভবিষ্যৎকেই বোঝায়। আমাদের অস্তিত্ব অনিত্য, আমরা সব সময় ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি। সময় হলাে সাধারণত মুহর্তের সমষ্টি, কিন্তু ভবিষ্যৎ শুধু কতকগুলাে মুহূর্তের সমষ্টি নয়, বরং বর্তমানের নির্ধারক এবং যৌক্তিকভাবে বর্তমানের অগ্রগামী – ভবিষ্যৎই নিয়ন্ত্রণ করছে বর্তমানকে এবং ভবিষ্যই পরিণত হচ্ছে বর্তমানে। একজন সাধারণ মানুষ একজন পতিত বা অযথার্থ অস্তিত্বের মানুষ; যদি সে কখনাে কাল সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, শুধু বর্তমানকে নিয়েই সে মগ্ন থাকে; অতীত তার কছে আকর্ষণীয় নয়, এবং ভবিষ্যৎ হলাে শুধু তা যা শিগগিরই ঘটবে বা বর্তমানে পরিণত হবে। কিন্তু একজন যথার্থ অস্তিত্বশীল মানুষের কাছে বর্তমান হলাে অতীত ও ভবিষ্যতের সমন্বয়, কেননা সে জানে সে কি ছিল। কি হবার জন্য সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; এবং এখানেই তার দৃষ্টিনিবদ্ধ। এ আত্মজ্ঞানকেই হাইডেগার বলেছেন বিবেক। এ বিবেকের দ্বারাই মানুষ তার চরম লক্ষ্য, মৃত্যুর দিকে পরিচালিত হয়। কাল সম্পর্কে আমাদের সচেতনতার কারণ হলাে আমরা জানি যে, আমাদেরকে মরতে হবে। মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের এ সচেতনতা ছাড়া কালাের কোনাে মানবিক গুরুত্ব থাকতাে না। ঠিকভাবে বলতে গেলে মানুষ কালের মধ্যে নয়, বরং কালই মানুষের মধ্যে অবস্থান করছে। কাল তাে বস্তু নয় যে মানুষের মূল্যায়ন ছাড়া এর কোনাে অস্তিত্ব থাকবে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ধারণা মানুষের অস্তিত্বের স্বরূপ থেকেই বেরিয়ে আসে। অতীত হলাে যা নেই, ভবিষ্যৎ হলাে যা এখনাে ঘটেনি এবং বর্তমান হলাে “এখানে – এখন” – অনিত্যতার এ তিন মুহূর্তের আলােকেই মানুষের অস্তিত্বকে বুঝতে হবে।

ঐতিহাসিক (historicity) ও অতিবর্তিতা (transcendence) 

হাইডেগারের দর্শনের একটি অন্যতম উল্লেখযােগ্য ধারণা হলাে ইতিহাস সম্পর্কে তার ধারণা। এ ধারণাটি তার অনিত্যতার ধারণার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত যে মানুষের অনিত্য স্বভাব থেকে তার ঐতিহাসিক স্বভাবকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করা সম্ভব নয়। আমরা জানি, হাইডেগেরের মতানুসারে জন্মগ্রহণ করা মুহূর্ত থেকে মানুষ অত্যাবশ্যকভাবে ভবিষ্যতের দিকে, তার শেষ পরিণতি মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়। সে যদি যথার্থভাবে অস্তিত্বশীল হয় তাহলে সে এ বিষয়ে সচেতন হয় যে, সে তার অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যস্থলে, যদিও অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের দ্বারাই সে বেশি নিয়ন্ত্রিত। এটুকু প্রত্যেক মানুষের জন্য সত্য। তবে এও সত্য যে বীয়িং এর সাধারণ অস্তিত্বের (যা আলােচনা করা হাইডেগারের দর্শনের প্রধান লক্ষ্য) একটা নির্দিষ্ট ইতিহাস আছে যেমন আছে প্রত্যেকটি মানুষের। কিন্তু সাধারণ অস্তিত্বের ইতিহাস জানতে হলে আরম্ভ করতে হবে মানুষের ইতিহাস দিয়ে। মানুষের উদ্বেগ ছাড়া কোনাে ইতিহাসই সম্ভব নয়, কেননা মানুষ ছাড়া আর অন্য কেউ অতীতকে কাজে লাগাতে সক্ষম নয়।

যা কিছু বাস্তব বা যার ইতিহাস আছে তার সবকিছুই মানুষ কর্তৃক প্রকাশিত। মানুষ অতীতকে বোঝে, বর্তমানে প্রয়ােগ করে এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে এবং এভাবে ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাস আবিষ্কৃত হয়। এটা অবশ্য এ নয় যে, ইতিহাস মানুষকে শিক্ষা দেয় বা এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। এর অর্থ হলাে অতীত সত্যিকারভাবে কী ঘটেছে তা ভালােভাবে বুঝে ভবিষ্যতের জন্য নিজের চিন্তাধারায় তা প্রয়ােগ করা। এ যে প্রতি মুহূর্তে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হওয়া, মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হওয়া – যেখানে ভবিষ্যৎ হচ্ছে বর্তমান, বর্তমান হয়ে যাচ্ছে অতীত, আবার অতীত ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমানে, ভবিষ্যতের জন্য এটি হলাে মানুষের অস্তিত্বের আসল রূপ। এ ধারণাটিই হাইডেগারের দর্শনে অতিবর্তিতা নামে পরিচিত। অতিবর্তিতা বলতে বোঝায় অতিক্রম করা নিজের বাইরে চলে যাওয়া এবং এটি সংঘটিত হয়। তিনটি জিনিসকে দিয়ে – ১. ঘটনা (অতিক্রম করার কাজ), ২. কর্তা (যে অতিক্রম করে), এবং ৩. বস্তু (যাকে লক্ষ্য করে এবং যার বাইরে অতিক্রম করা হয়)।

মানুষের অস্তিত্ব হলাে এক সম্ভাবনার কর্মক্ষেত্র যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত নির্বাচন করছে, এক সম্ভাবনা থেকে অন্য সম্ভাবনায় ছুটছে এবং তার অতিক্রম করার কাজ চলতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃত্যুতে এসে পরিণতি লাভ করে। মৃত্যুতেই ঘটে মানুষের সম্ভাবনার পরিসমাপ্তি যার প্রতি লক্ষ করেই মানুষ অগ্রসর হয় কিন্তু যার বাইরে অতিক্রম করার আর কিছুই নেই। যদিও অতিবর্তিতার এ ব্যাখ্যা হুসার্লের অভিপ্রায় ধারণার মতােই মনে হয় – যে ধারণানুযায়ী সব চেতনাই অচেতন সম্পর্কে চেতনা – হাইডেগারের মতে কিন্তু অতিবর্তিতা অভিপ্রায়ের ধারণা থেকে উদ্ভূত নয়, বরং অভিপ্রায় এবং এর বিভিন্ন অংশ যেমন ইন্দ্রিয়জ, কল্পনা প্রভৃতি এ অতিবর্তিতার মধ্যেই নিহিত। অতিবর্তিতা জ্ঞান বিষয়ক সত্য নয়, তাত্ত্বিক সত্য এ অর্থে যে, এটি জানার বা আচরণ করার একটা বিশেষ পন্থা নয়, বরং সব জানা ও আচরণ করার মূল ভিত্তি।

অতিবর্তিতার প্রথম আবির্ভাব ঘটে ডাজায়েনের মাধ্যমে, যা ছাড়া এটি অচিন্তনীয়। মানুষ যখন নিজের বাইরে, নিজের বীয়িং-এর দিকে, ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হয়, তার জন্য স্বাধীন হওয়া অত্যাবশ্যক। হাইডেগারের মতে তাই স্বাধীনতা থেকে অতিবর্তিতা অবিচ্ছেদ্য। যে পরিকল্পনার দ্বারা ডাজায়েন নিজের স্বাধীনতাকে প্রকাশ করে অথবা যার দ্বারা এটি নিজেই নিজের স্বাধীনতা, তা শুধু একটা ইচ্ছার কাজ নয় বরং নিজের বীয়িং-এর ভিত্তি; সম্ভাবনা হিসেবে নিজের স্বাধীন পরিকল্পনার মধ্যেই জন্ম নেয় স্বাধীনতা। তবে স্বাধীনতা জগতের সঙ্গে গ্রথিত যা বিশেষ কোনাে অস্তিত্বের বাইরে অতিক্রমণকে প্রবর্তিত করতে সহায়ক।

কিন্তু এ জগতের অস্তিত্বই আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, অসীম সম্ভাবনা সৃষ্টি করার ক্ষমতা স্বাধীনতার নেই। মানুষের অস্তিত্বই সীমিত, কেননা যা এখনাে ঘটেনি তার সঙ্গে এটি অপরিহার্যভাবে সংযুক্ত। মানুষ তার স্ব-পরিকল্পনার দ্বারা সীমিত, কারণ সে যে বীয়িং-এর দিকে ধাবিত হচ্ছে সে বীয়িং সম্ভাবনাময় মাত্র, এখনাে অস্তিত্বশীল নয়। অনিত্যতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে ডাজায়েন কখনাে তার নিজের ভবিষ্যৎ বা অতীতের সঙ্গে এক হতে পারে না। যে কাজের দ্বারা ডাজায়েন নিজের জগৎ সৃষ্টি করে সে জগতেই সে সীমিত, কেননা সে জগতেই তাকে অস্তিত্বশীল হতে হয়। সুতরাং এ অর্থে তার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয় সেভাবে যেভাবে সে নিজে অর্থারােপ করা জিনিসের দ্বারা সীমিত হয়। তার নিজের সম্ভাবনাগুলাের পরিকল্পনায় ডাজায়েন এভাবে অনুভব করে যে, সে অন্যান্য বস্তুর মধ্যেই আছে এবং এসব বস্তুর সীমাবদ্ধতা থেকে উদ্ভূত মনােভাব বা ভাবাবেগের দ্বারা সে প্রভাবিত।

তথ্যসূত্র

  • সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শনের রূপরেখা, মোঃ শওকত হোসেন, তিথি পাবলিকেশন, ২০১৫, ঢাকা, পৃ. ২২৪-২৩১, ২৫৫-২৫৭
  • অস্তিত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা : দর্শনে ও সাহিত্যে, নীরুকুমার চাকমা, অবসর প্রকাশ, ২০২০, ঢাকা, পৃ ৮৮-১০৮
  • দর্শনের সহজ পাঠ, কাজী মাহবুব হাসান, দিব্যপ্রকাশ, ২০১৮, পৃ. ৩৬৭-৭২
  • আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সমাজচিন্তা, ড. মোঃ আহসান হাবিব, গ্রন্থ কুটির, ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ৩৭৭-৮১

2 Trackbacks / Pingbacks

  1. কাঠামোবাদ ও উত্তরকাঠামোবাদ – বিবর্তনপথ
  2. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.