Table of Contents
আয়োনীয় দর্শনের হাত ধরে প্রাচীন পাশ্চাত্য দর্শনের উদ্ভব
প্রাচীন এক সভ্যতার লীলা লালনভূমি হল গ্রিস। এই সভ্যতাকে যারা বিশ্বনিন্দিত করেছিলেন তারা হলেন কতিপয় দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। ও গ্রিসেই ইউরোপীয় দর্শনের জন্ম। প্রাচীনকালে গ্রিকদের চারটি প্রধান জাতির মধ্যে আয়োনীয় জাতি এশিয়া মাইনোরে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। উপনিবেশের ১২টি শহরের মধ্যে একটি ছিল মিলেটাস। আয়োনীয় অধিবাসী নাগরিকদের প্রায় সবাই নাবিকের জীবনযাপন করতো এবং তাদের জীবিকা উপার্জনের উপায় ছিল ব্যাবসা-বাণিজ্য। বাণিজ্য উপলক্ষে তারা বহু দূর-দূরান্তরে সমুদ্রযাত্রা করতো। এভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৭ম শতকে তারা বহু দেশকে যখন অনেকটা জেনে যায়, এই জানাজানির ভেতর দিয়ে তাদের নামানুসারে সমগ্র দেশের নাম রাখলো গ্রিস।
কেবল বাণিজ্য নয়, শিল্পকলায়ও গ্রিকরা খুব পারদর্শি ও কৌশলি ছিল। গ্রিক কারিগরদের হস্তনির্মিত শিল্প সামগ্রীর চাহিদা বহির্জগতেও বেশ ছিল। গ্রিকবাসীগণ অন্যান্য দেশে খালি বাণিজ্যই করতো না, তারা ভবেরও বিনিময় করতেন। ‘কার্লাগুহায়’ অঙ্কিত শিল্প নিদর্শন ও বিভিন্ন বৌদ্ধমঠের গায়ে খোদিত ভাষ্কর্য শিল্পের উপর গ্রিক ভাষ্কর্য রীতির স্বার্থক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এগুলোকে গান্ধার শিল্প বলা হয়। এই গ্রিকদের কেউ কেউ আবার সৃষ্টির মূলতত্ত্বকে জানার জন্য চিন্তাভাবনা করেন। এই চিন্তা ভাবনা করতে গিয়েই গ্রিক দর্শনের সবচেয়ে পুরনো শাখা আয়োনীয় সম্প্রদায়ের থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, অ্যানাক্সিমিনিস প্রমুখ দার্শনিকগণের আবির্ভাব ঘটে। আয়োনীয় দার্শনিকগণ প্রধাণত সৃষ্টির মূলতত্ত্বকে জানার জন্য উৎসুক ছিলেন। তাদের দার্শনিক চিন্তার মূল উপজীব্যই ছিল সৃষ্টির উৎস কোথায়, এই প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজে পাওয়া। আয়োনীয় দার্শনিকগ, আকাশচারী কল্পনায় বিশ্বাসী ছিলেননা। অ্যানাক্সিমেন্ডারকে আমরা দেখি ঐ সময়ের জ্ঞাত জগতের একটি নকশা প্রস্তুত করতে যা বহুদিন ধরে বণিকদের পথ প্রদর্শনের কাজ করেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, তারা দার্শনিক ব্যবহার বা বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের জন্য জীবনবিমুখ ছিলেন না, বরং জীবন ঘনিষ্ঠ চিন্তাভাবনাকেই বিশ্লেষণ করে দেখতে চেয়েছিলেন। এই সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের এক শতাব্দীর পূর্বেই আমরা উপনিষদের দার্শনিকদের প্রশ্ন করতে দেখি, বিশ্বের মূল উপাদান কী, যে এককে জানলে সবকিছুই জ্ঞাত হওয়া যায় সেটি কী। এই মূলতত্ত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কেউ অগ্নিকে, কেউ বায়ুকে, কেউ আকাশকে, আর কেউ ব্রহ্মকে। আয়োনীয় দার্শনিক থেলিসের (৬২৪-৫৪৭ খ্রি.) মতে জলই আদি উপাদান। অ্যানাক্সিমেন্ডার (৬১১-৫৪৬ খ্রি.) বলেন, বস্তুর মূল উপাদান নির্দিষ্ট কোন কিছু নয়। এর কোন আকার নেই।
এই প্রাচীন আয়োনীয় দার্শনিকদের মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এদের কেউ প্রশ্ন করেননি যে বিশ্বকে কে সৃষ্টি করেছেন। তাদের প্রশ্ন ছিল কিভাবে বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। ভারতেও তাদের সমকালীন চার্বাক ও বুদ্ধও সৃষ্টিকর্তা, বিধাতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসু ছিলেন না। আয়োনীয় দার্শনিকগণ জীবনকে এত তুচ্ছ মনে করতেন না যে তার জন্য পৃথক একটা চেতন চালকশক্তির পেওয়োজন হবে। মেঘগর্জন, বহমান নদী, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, দোলায়িত বৃক্ষ, স্পন্দিত পৃথিব, প্রাণের স্ফূরণকেই প্রমাণ করে। এর জন্য তারা কোন স্রষ্টা বা অন্তর্যামীকে জানার প্রয়োজন তারা বোধ করেননি। বস্তুজ্ঞানই তাদের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয়েছিল। (রাহুল সংকৃত্যায়ন, দর্শন-দিগ্দর্শন, প্রথমখণ্ড, সম্পাদক, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা, চিরায়ত প্রকাশ, ১১৯৬)। এই আয়োনীয় দার্শনিকদেরহাতেই পাশ্চাত্য দর্শন বিকশিত হবার যাত্রা শুরু হয়।
গ্রীক দর্শনের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন মত
গ্রীক দর্শনের উদ্ভব ব্যাবিলন ও মিশরে নয় : রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন গ্রীক দর্শনের পেছনে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রভাবের কথা বলেন। গ্রীক বণিকরা বাণিজ্যের মাধ্যমে অত্যন্ত প্রাচীন ও সম্মানীয় কৃষ্টির সাথে পরিচিত হয়। তারপর এই সুপ্রাচীন সভ্যতা থেকে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতিশাস্ত্র, প্রকৃতিবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষা গ্রহণ করে মেধাবী হন। এই ভাববিনিময়ের ফলে হয়েছিল গ্রীক দর্শনের সবচেয়ে পুরনো শাখা আয়োনীয় সম্প্রদায়ের (থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, অ্যানাক্সিমিনিস) আবির্ভাব। তাই গ্রীক দর্শনের উৎপত্তিকে ব্যবলনীয় ও মিশরীয় সভ্যতা প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। তবে এই মত পরিত্যাক্ত হয়েছে। বার্নেট এই প্রসঙ্গে বলেন, গ্রীকদেরকে এখানে যাদের কাছে ঋণী বলা হচ্ছে, আসলে তাদের কোন দর্শনই ছিল না। তাই গ্রীকদের কাছে এদের থেকে গ্রহণ করার মত কিছু ছিলই না। কেউ কেউ বলেন গ্রীকরা তাদের গণিত মিশর ও জ্যোতির্বিজ্ঞান ব্যাবিলন থেকে লাভ করেছে, কিন্তু বার্নেট, কপলস্টোন প্রমুখ এই জাতীয় অভিমত নাকছ করে দেন। বার্নেট বলেন, গ্রীকরা গণিতের জন্য মিশরের কাছে ঋণী হলে, পিথাগোরাস ও তার অনুগামীদের সমতল জ্যামিতির মৌলিক নিয়মগুলো প্রমাণ করার দরকার হত না। আর ব্যাবিলনীয়দের যদি সৌরমণ্ডল সম্পর্কে জ্ঞান থাকত তাহলে গ্রীকরা পৃথিবীর যথার্থ আকার ও চন্দ্র-সূর্য-গ্রহণের ব্যাখ্যার জন্য তৎপর হত না। কপলস্টোন বলেন, মিশরীয়রা যে জ্যামিতির বিকাশসাধন করে তা বিজ্ঞানসম্মত ছিল না, গ্রীকরাই বিজ্ঞানসম্মত জ্যামিতির বিকাশ ঘটান। আর ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদ্যা ছিল মূলত জ্যোতিষবিদ্যা বা এস্ট্রোলজি। গ্রীকরাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা শুরু করে।
প্রাচ্যের সৃষ্টিতত্ত্বগুলো গ্রীক দর্শনের উৎস্য নয় : অনেকে বলেন, প্রাচ্যদেশের সৃষ্টিতত্ত্ব বা কসমোগনিগুলো গ্রীক দর্শনের উৎস্য। তবে বার্নেট বলছেন, সৃষ্টিতত্ত্বগুলো গ্রীক দর্শনের উৎপত্তির উৎস্য হিসেবে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। গ্রীকদের মধ্যেই থেলিসের পূর্বে অনেক সৃষ্টিতত্ত্ব ছিল যেগুলো মিশর ও ব্যাবিলনের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকেও প্রাচীন হতে পারে। যেসব জাতি সভ্যতা তৈরি করতে পারেনি, অনুন্নত তাদেরও সৃষ্টিতত্ত্ব থাকতে পারে। এসবের সাথে দর্শনের কোন সম্পর্ক নেই। যেখানে বিচারবুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা থাকে না সেখানে দর্শনও থাকে না। এই বিচারবুদ্ধিভিত্তিক বিজ্ঞান গ্রীকদেরই সৃষ্টি।
ভারতীয় উপমহাদেশের চিন্তাধারার প্রভাব? : ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম, পৌরাণিক সাহিত্য, লোকায়ত দর্শন, জৈনদর্শন, বৌদ্ধদর্শন, বেদান্তদর্শন প্রভৃতির কোন কোন মতবাদের সাথে গ্রীক ধর্ম, সাহিত্য ও কোন কোন দার্শনিক মতবাদের যথেষ্ট মিল থাকায় অনেকে গ্রীক দর্শনে ভারতীয় উপমহাদেশের চিন্তাধারায় প্রভাবের কথা বলেন। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতীয় চিন্তাধারা গ্রীকদের অগ্রগামী ছিল। প্রাচীনকালের আর্য চিন্তাবিদদের একেশ্বরবাদ ও দেবতাবাদ, লোকায়েতদের জড়বাদ বা উপাদানবাদ, জৈনদের জীববাদ, পরমাণুবাদ, বৌদ্ধদের জন্মান্তরবাদ, অবভাসবাদ, ক্ষণিকবাদ, নীতিবাদ ও ন্যায়তত্ত্ব ও ঔপনিষদদের দার্শনিক মতবাদগুলোর সাথে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের অনেক সামঞ্জস্য রয়েছে। ম্যাক্সমূলার, ওয়েবার প্রমুখ এই কথা বলেন। ফরাসী দার্শনিক ফুঁজে বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের দর্শন অবলম্বন করে গ্রীক দর্শনের বিকাশ লাভ ঘটে। পিথাগোরাস সম্প্রদায় ও প্ললেটোর দর্শনে জন্মান্তরবাদ আছে। বিশেষ করে থেলিস, অ্যানাক্সিমিনিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, এম্পিডোকলেস, হেরাক্লিটাস, জেনোফেনিস, পারমেনাইডিস, প্লেটো প্রমুখ দার্শনিকদের সাথে ভারতীয় অভিমতের মিল আছে। এজন্য কেউ কেউ একথা বলেন যে, ভারতীয় দর্শন থেকে গ্রীক দর্শনের উৎপত্তি। তবে দুটি দেশের মধ্যে কোন কোন মতবাদের সাদৃশ্য দেখে বলা যায় না যে, এক দেশ অপর দেশের কাছ থেকে এসব মতবাদ গ্রহণ করেছে। কপলস্টোন বলেন, মানুষের বুদ্ধি সদৃশ অভিজ্ঞতাকে সদৃশভাবে ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে সমর্থ, সেটা গ্রীক বা ভারতীয় যার বুদ্ধিই হোক না কেন।
গ্রীক দর্শনের উদ্ভব গ্রীসে : উপরের কারণগুলোর জন্য অনেকে সিদ্ধান্ত নেন যে গ্রীক দর্শনের উদ্ভব গ্রীসেই হয়েছিল। গ্রীক দর্শনের শুরু কখন তা জানা যায়, এর প্রারম্ভিক দিকের প্রতি সচেতন দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় যে এই দার্শনিক চিন্তা মৌলিক ও এর উপর অন্য দর্শনের প্রভাব পড়েনি। গ্রীক দর্শনের প্রারম্ভটা এতই সরল যে, এই সামান্য দার্শনিক চিন্তার অধিকারী গ্রিকরা হতে পারেনা তা ভাবা যায়না। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গ্রীক দর্শনের শুরু। বস্তুজগতের মূলতত্ত্বের স্বরূপ কী, এই প্রশ্নের আলোচনাকে নিয়েই গ্রীক দর্শনের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে বাহ্য প্রকৃতি থেকে গ্রীক দর্শনের দৃষ্টি পড়ে মানুষের উপর।
সত্তা সম্পর্কিত সমস্যা গ্রীক দর্শনে প্রাধান্য লাভ করে : বার্নেট বলেন, সামগ্রিকভাবে দর্শনের দিকে তাকালে দেখা যায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রীক দর্শনে প্রাধান্য লাভ করেছে সত্তা বা রিয়ালিটি সম্পর্কিত সমস্যা। সত্তা কী, এই প্রশ্ন প্লেটো ও এরিস্টোটল যেমন করেছেন, তেমনি থেলিসও করেছেন। থেলিসের উত্তর যেমনই হোক না কেন, তিনি যখন এই প্রশ্ন করেন তখন থেকেই তার দার্শনিক চিন্তার পরিচয় লাভ করা যায়। আর সেই সময়টাই ছিল পাশ্চাত্য দর্শনের সূচনা।
গ্রীক দর্শনের ভৌগলিক পরিসর ও যুগবিভাগ
তবে এই উৎপত্তি বর্তমান গ্রীসে নয়। প্রাচীনকালে গ্রীকরা তাদের মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে এগিরেনের দ্বীপগুলোতে, সিসিলি, দক্ষিণ ইতালি, এশিয়া মাইনোরের সমুদ্রোপকূল সন্নিহিত স্থানগুলোতে ও অন্যান্য সমৃদ্ধ উপনিবেশে বসবাস করার জন্য গিয়েছিলেন। এসব ব্যক্তিদের কেউ কেউ দার্শনিক ছিলেন, তাদের দর্শনও গ্রীক দর্শনের অন্তর্গত। গ্রীক দর্শনের প্রথম যুগের দর্শন আসলে বর্তমান গ্রীস এর বাইরের গ্রীক উপনিবেশগুলোতে বাস করা গ্রীকদের দর্শন চিন্তাই। প্রাচীন গ্রিক দর্শনকে যুগ অনুসারে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় –
১। গ্রীক দর্শনের প্রাচীন যুগ (৬০০ – ৪৩০ খ্রি.পূ.) : একে প্রাক-সক্রেটিস বা প্রিসক্রেটিক যুগও বলা হয়। এখানেই গ্রীক দর্শনের জন্ম। এই যুগকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয় –
(ক) প্রাক-সোফিস্ট বা প্রিসোফিস্টিক যুগ : এই দর্শন নিসর্গবাদী বা প্রকৃতিবাদী। দার্শনিকগণ বাহ্য প্রকৃতি সম্পর্কিত পরস্পর নির্ভরশীল দুটো প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন। এগুলো হল –
(১) মৌলিক দ্রব্য কি যার দ্বারা সব বস্তু গঠিত হয়
(২) এই গঠন প্রক্রিয়ার স্বরূপ কী যার দ্বারা মৌলিক বস্তুগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে পরিণত হয়
উল্লেখযোগ্য দার্শনিকগণ হলেন থেলিস, পিথাগোরাস, পারমিনাইডিস, জেনো, হেরাক্লিটাস, অ্যানাক্সাগোরাস প্রমুখ।
(খ) সোফিস্ট বা সোফিস্টিক যুগ : সোফিস্টরা গ্রীসের কুটতার্কিক পণ্ডিত বলে খ্যাত ছিলেন। এসব দার্শনিকদের দর্শন প্রাচীন যুগের দর্শন থেকে স্বতন্ত্র। প্রাচীন যুগের বাহ্য প্রকৃতির আলোচনা ত্যাগ করে এরা মানুষের সমস্যা, মানুষের জ্ঞান, আচরণ প্রভৃতির আলোচনায় মনোনিবেশ করেন। মানব জীবনের ব্যবহারিক সমস্যার আলোচনায় এরা আগ্রহী ছিলেন। এই যুগের বৈশিষ্ট্য –
- (১) তাত্ত্বিকজ্ঞানের সাথে ব্যবহারিক প্রয়োজনের মিশ্রণ। খুব সম্ভবত ব্যবহারিক প্রয়োজনের কথা ভেবেই থেলিসের নৌচালনা সংক্রান্ত জ্যোতির্বিদ্যার উৎপত্তি।
- (২) দর্শন ও বিজ্ঞানের পরিপূর্ণ সংমিশ্রণ। তখন পর্যন্ত মননমূলক ও অভিজ্ঞতামূলক গবেষণার মধ্যে কোন পার্থক্য করা হত না। তাই জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, ভেষজবিজ্ঞান সহ সব প্রাকৃতিক বিজ্ঞান দর্শনের অন্তর্ভূক্ত ছিল।
- (৩) অনেকটা তত্ত্ববিদ্যামূলক বা অন্টোলজিকাল, কারণ বিষয়বস্তুর মূলতত্ত্বের অনুসন্ধানই এর অন্যতম কাজ ছিল।
- (৪) মূলত অদ্বৈতবাদী বা মনিস্টিক, কারণ এই যুগের দারশনিকগণ একটি মাত্র তত্ত্ব বা ঘটনার সাহায্য নেন।
- (৫) এই দর্শনকে সজীব বস্তুবাদ বা hylozoism অথবা সর্বাত্মাবাদ বা panpsychism বলা যায়। এনাক্সাগোরাস ছাড়া অন্যদের মধ্যে জড়বাদী মনোভাব দেখা যায়, এদের জড় ও মনের পার্থক্য করতে দেখা যায় না যা পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে দেখা যায়। প্রাচীনকালে গ্রীকরা বহুঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল, তার আমনে করত সমুদ্র, পর্বত, নদী, বৃক্ষ, সূর্য কোন না কোন দেবতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেজন্য সমুদ্র দেবতা, সূর্য দেবতা প্রভৃতি দেব দেবীর কথা কল্পনা করা হয়। আবার দর্শনের দিক দিয়ে তারা মনে করতেন সব জড়তে প্রাণ আছে, এমনকি পাথরেও। তাই এদের দর্শনকে সজীব জড়বাদী দর্শন বলা হয়। এই যুগের দার্শনিকরা প্রাণের দ্বারা অধ্যুষিত নয় এমন প্রকৃতির কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। জেলার বলেন, এটা কেবল প্রিসক্রেটিকদের ক্ষেত্রেই সত্য নয়। স্টোয়িক, এপিকিউরিয়াস দর্শন অনুগামীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় মনোবিজ্ঞান ছিল পদার্থবিজ্ঞান ও ধর্মবিজ্ঞানের অঙ্গীভূত।
- (৬) এই দর্শন নির্বিচারবাদী বা ডগমেটিক, কারণ জ্ঞানের সম্ভাবনা, শর্ত, সীমা ও বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা না করেই এ যুগের দর্শন নির্বিকারে স্বীকার করে নেয় যে, মানব মনের জগৎ সম্পর্কীয় সমস্যার সমাধানের ক্ষমতা আছে। জ্ঞানের সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনা না করে দার্শনিকগণ জগতের উৎপত্তি সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
- (৭) এদের দর্শনকে প্রাকৃতিক দর্শন বা নেচারাল ফিলোসফি বলা যায়, কারণ এরা প্রথমে মূলতত্ত্বের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে, তারপর এ তত্ত্ব কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সেই সাথে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের নির্ভরযোগ্যতা কতখানি ও চিন্তার সাথে এর সম্পর্ক কী সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জেলারের মতে এই যুগেই জ্ঞান সম্পর্কিত মতবাদ অর্থাৎ জ্ঞানতত্ত্ব বা এপিস্টেমোলজির সূচনা হয়।
- (৮) জড় ও মন, দেহ ও আত্মা, ঈশ্বর ও জগৎ এদের মধ্যে প্রভেদ পিথাগোরাসের দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা স্থান পেয়েছে, তার অনুগামীরাই প্রথম নীতিবিদ্যা ও সমাজবিদ্যাকে দর্শনে আনেন, পরে ডিমোক্রিটাস ও সোফিস্টদের ক্ষেত্রে এরকম আলোচনা গুরুত্ব পায়।
- (৯) সোফিস্ট দর্শনে সংশয়বাদের সূচনা হয়, প্রকৃতি থেকে তারা নজর সরিয়ে মানুষকে দর্শনের বিষয়বস্তু বানায়। তারা শিক্ষা সম্পর্কীয় মতবাদেরও সূচনা করে। কিন্তু বস্তুগত জ্ঞানের অস্তিত্ব অস্বীকার করার জন্য ও প্রচলিত নৈতিক বিজ্ঞানের প্রতি সমর্থন না দেয়ার জন্য তারা গ্রীকদের প্রকৃতির মধ্যে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ নিহিত রয়েছে তাকে আরও উসকে দিয়ে সক্রেটিক দর্শনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া শুরু করে।
২। সক্রেটিস দর্শনের যুগ বা সক্রেটিক যুগ (৪৩০ – ৩২২ খ্রি.পূ.) : সোফিস্ট আন্দোলনই এই যুগের সূচনা করে। বাহ্য প্রকৃতির আলোচনা পরিত্যাগ করে সক্রেটিস আত্মজ্ঞানের আলোচনায় প্রবেশ করেন। সোফিস্ট দর্শনে মানুষের আলোচনা স্থান পেয়েছিল, সক্রেটিসের দৃষ্টিতে দর্শনের প্রধান আলচ্য হল জীবনের যথাযথ আচরণ। মানব আচরণের প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য সক্রেটিস বস্তুগতজ্ঞানের সন্ধানে নিয়োজিত হন। এই যুগের বিস্তৃতি এরিস্টোটলের সময়কাল পর্যন্ত। প্লেটো ও এরিস্টোটলের যুগ গ্রীক দর্শনের চরম উৎকর্ষের যুগ। দর্শনের এমন কোন সমস্যা নেই যা এই যুগে আলোচিত হয়নি। জগৎ, জীবন, ঈশ্বরসহ যা কিছু আজ দর্শনের আওতাভূক্ত বলে বিবেচিত হয় প্রায় সবকিছুই এই যুগের দর্শনে আলোচিত হয়েছে।
৩। এরিস্টোটল পরবর্তী দর্শনের যুগ বা পোস্ট-এরিস্টোটলিয়ান যুগ (৩২২ খ্রি.পূ. – ৫২৯ খ্রি.) : এথেন্স, আলেকজান্দ্রিয়া ও রোম ছিল এই দর্শনের কেন্দ্রস্থল। এই যুগে আলচনার দুটি ধারা দেখা যায় – (ক) নৈতিক ও (খ) ধর্মীয়। স্টোয়িক ও এপিকিউরিয়ান দর্শন চরিত্র ও নীতির উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে ও তাদের দর্শনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল মানুষের জীবনে পরম শুভ কী তা জানা। জেনো স্টোয়িক দর্শন ও এপিকিউরিয়াস এপিকিউরিয়ান দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। ৬ষ্ট শতকে নব্যপ্লেটোনিকবাদ বা নিওপ্লেটোনিজমের আবির্ভাবের সাথে সাথে গ্রীক দর্শনের, অর্থাৎ পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাচীন যুগের সূচনা ঘটে। ৫২৯ সালে সম্রাট জাস্টিনিয়ান এথেন্সের গ্রীক দর্শনের আলোচনার কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেন। এর ফলে নিওপ্লেটোনিক দর্শনেরও অবসান ঘটে। মানুষ দর্শনচর্চা ভুলতে শুরু করে। তখন থেকে ইউরোপে সাতশত বছরব্যাপী অন্ধকার যুগের সূচনা।
গ্রীক সমাজের প্রথম যুগের বৈশিষ্ট্য ও দর্শনে এর প্রভাব
স্বাধীন ও সুসংবদ্ধ দার্শনিক চিন্তা শুরু হবার আগে গ্রীকদের মধ্যে পৌরাণিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের প্রচলন খুবই ব্যাপক ও প্রবল ছিল। গ্রীক দর্শনের প্রথম যুগে গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তায় তাদের পূর্বসূরিদের পৌরাণিক ও ধর্মীয় প্রভাব সুস্পষ্ট ছিল। গ্রিক দার্শনিকরাই ছিলেন ইউরােপীয় চিন্তাধারার প্রবর্তক। স্বাধীন সুসংবদ্ধ দার্শনিক চিন্তা শুরু হওয়ার আগে গ্রিকদের মধ্যে পৌরাণিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের প্রচলন ছিল ব্যাপক। গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তায় তাদের পূর্বসূরিদের পৌরাণিক ও ধর্মীয় প্রভাব সুস্পষ্ট। যুক্তিবাদী গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তায় এমন অনেক ধারণা দেখা যায় যেগুলাে তাদের পূর্ববর্তী পৌরাণিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ফলশ্রুতি। এ প্রবণতা গ্রিক দর্শনের শুরুতে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। থেলিস, যাকে প্রথম ইউরোপীয় দার্শনিক ও বস্তুবাদী দার্শনিক বলা হয়, যিনি প্রথম জগৎ ব্যাখ্যায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তার ব্যবহার করেন তার চিন্তাতেও পৌরাণিক প্রভাব দেখা যায় যখন তিনি বলেন, সব বস্তুতেই প্রাণ বা চেতনা রয়েছে। গ্রীক দার্শনিকদের জগৎ ও ব্যাখ্যাকে বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসিদ্ধ বলা গেলেও আদের মধ্যে পুরাণের কিছু প্রভাব ছিল, যা গ্রীক দর্শনের আদি পর্বে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
তবে পরবর্তী দার্শনিকরাও এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন না। এরিস্টটলের মতাে একজন যুক্তিবাদীর মতবাদেও এমন কিছু ধারণা লক্ষ করা যায় যাদের রীতিমতাে পীড়াদায়ক বলা চলে। যেমন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, চন্দ্র সূর্য প্রভৃতি জ্যোতিষ্ক নিষ্প্রাণ নয়, জ্যান্ত প্রাণীবিশেষ। অবশ্য সভ্যতার আদিপর্বে পৌরাণিক কাহিনী এবং রূপক-উপমাই ছিল সার্বিক ও গভীর সত্য প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন। তাই প্লেটোর মতাে একজন পরিপক্ক দার্শনিককেও অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের অভিব্যক্তির বাহন হিসেবে পুরাণকে যুক্তিসঙ্গত বলে ব্যবহার করতে দেখা যায়। যাই হােক, দার্শনিক ও পৌরাণিক চিন্তার মাঝখানে সুনির্দিষ্ট ভেদরেখা টানা প্রায় অসম্ভব, আর তাই যেকোনাে আলােচনায় পুরাণ ও উপমার ব্যবহার কমবেশি থাকবেই। এটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন এই রূপক বা উপমা ইত্যাদির প্রভাবে থেকেও দাবি করা হয় অতীতের যাবতীয় অপূর্ণতা ও অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রভাব থেকে আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রত্যয় ও বিশ্বাস যখন যুক্তির আবরণে লুকিয়ে থেকে যুক্তির আবেদন সৃষ্টি করতে চায়, তখনই বিপদ। আর এ বিপদ থেকে মুক্ত থাকা সহজ ব্যাপার নয়। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পুরাণের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রবণতা সব চিন্তাবিদদের মধ্যেই কমবেশি দেখা যায়। তবে আদি গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে তা এত বেশি উপস্থিত যে, গ্রীক দর্শনকে ভালভাবে বুঝতে হলে তাতে পুরাণ ও ধর্মের প্রভাব কতটুকু ছিল তা নিয়ে আলোচনা করাও আবশ্যক হয়ে পড়ে। গ্রীক দর্শনের সাথে গ্রীকদের বিশ্বাসের সম্পর্ক খুব নিকট ও নিবির। গ্রীক ধর্মের দুটো প্রধান দিক দুটো –
(১) হোমার ও হেসিয়ডের অলিম্পিক দেবতাদের ধারণা – হোমার ও হেসিয়ড ছিলেন গ্রীকদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণার মূল উৎস্য। তবে গ্রীকরা তাদের স্বর্গীয় প্রত্যাদিষ্ট দেবতা বলে মনে অরত না, আর তাদের নির্দেশ ও উপদেশাবলিকেও অকার্যকর বলে গ্রহণ করতো না। দেবতাদের সম্পর্কে গ্রীকদের ধারণা ছিল অদ্ভূত। দেবতাদের তারা জগতের স্রষ্টা, কিংবা এর গতিপ্রকৃতির পরিচালক বলে বিশ্বাস করত না। মানুষ ও দেবগণ একই উৎস্য থেকে উদ্ভূত বলেই তারা মনে করত। কবি পিন্ডারের মতে, মানুষ ও দেবগণ একই মায়ের সন্তান, একই ঐতিহ্যের অংশীদার ও একই আদিম পরিবারের সদস্য। দেবগণ মানুষেরই মত আবেগ, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছার সাথে পরিচিত। তারা কাম-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি রিপু সম্পন্ন। মানুষের সাথে তাদের সক্রিয় সম্পর্ক বিরাজমান। দেব-দেবীরা স্রষ্টা নন, অন্যান্য সত্তার ন্যায় তারাও জগতের সৃষ্টিধারার ফলশ্রুতি। তাদের একটি পারিবারিক অনুক্রম ছিল ও বিশ্ব পরিবর্তনের সাথে তাদের বংশেরও বৃদ্ধি ও বিবর্তন ঘটে। দেবতাদের সাথে মানুষের পার্থক্য এখানে ছিল যে, তারা মানুষের মত নশ্বর নন, বরং স্বচ্ছন্দ ও চিরস্থায়ী জীবনের অধিকারী। স্বয়ং প্রকৃতিই তাদের মৃত্যুহীন জীবনের সৌভাগ্য দান করে। মানুষের পক্ষে এধরণের জীবনের অধিকারী হওয়া অসম্ভব। এই আশা করাও তাদের পক্ষে অশোভন।
(২) গূঢ় ধর্মমতসমূহ যেগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল এলিউসিনীয় ও অর্ফিক ধর্মীয় মত – এই দিকটি প্রাধান্য লাভ করে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকের দিকে এলিউসিনীয় ধর্মমতের প্রসার ঘটে। সব অনুসারীর জন্য অমরত্বের আশ্বাস, বিস্তারিত দীক্ষামূলক আচার-অনুষ্ঠান, গোপন শপথ ও মরমি মনোভাব ছিল এই ধর্মের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক। এখানে নৈতিক আদর্শের চেয়ে ধর্মীয়-আচার-অনুষ্ঠানাদির উপরেই জোর দেয়া হত। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ সহ ধর্মের বিভিন্ন নির্দেশ পালন করাকেই প্রত্যেকের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করা হত। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতি নৈতিক অনুশীলন ও সংস্কার সাধনের চেয়ে মৌলিক আনুগত্যের দাবিই বেশি ছিল। অর্ফিক ধর্মমত এলিউসিনীয় মতের থেকে আলাদা ছিল। প্রথম দিকে এর আচার অনুষ্ঠানাদি ছিল বেশ কঠোর, ও মানুষ বলি দেয়ার প্রথাও তখন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অন্তর্ভূক্ত ছিল। অর্ফিক মতে, দেবতাদের পূর্ণতার অধিকারী হওয়া ও পরিণামে স্বর্গীয় শক্তির সাথে মিলিত হওয়াই মানুষের লক্ষ্য। তাদের মতে এটি সম্ভব জন্মান্তরবাদের সুদীর্ঘ অনুক্রমের মাধ্যমে। এই লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসেবে অর্ফিকবাদ কিছু কঠোর নিয়ম অনুশীলন করার নির্দেশ প্রদান করে। এই ধর্মে দেহকে মনে করা হত অশুভের উৎস্য। তবে এই মতের সাথে প্রচলিত গ্রীক মতের বিরোধ ছিল। প্রচলিত মত অনুসারে মানুষের দেহই শুভ ও পূর্ণতার উৎস্য। সাধারণ মানুষের কাছে হোমারের ধর্মের (যেখানে দেবতাদের মানুষ রূপে বর্ণনা করা হয়) চেয়ে এইসব গূঢ় ধর্মের আবেদন ছিল অনেক বেশি। অমরতার প্রতিশ্রুতি ও জীবন সম্পর্কে আবেগাত্মক চেতনা প্রভৃতি কারণেই সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
(গ্রেকো-রোমান সংস্কৃতির গূঢ় বা রহস্যবাদী ধর্মসমূহ সম্পর্কে জানতে পড়ুন “প্রাচীন গ্রেকো-রোমান রহস্যবাদী ধর্মসমূহ” লেখাটি)
গ্রিসে ধর্মের একটি সামাজিক ভূমিকা ছিল। প্রত্যেকটি নগররাষ্ট্রের নিজ পৃষ্ঠপােষক দেবতা ছিল। যেমন : এথেন্সের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত চিন এথেনা দেবতার। ধর্মীয় উৎসবাদি ছিল গণউদ্যাপনের উপলক্ষ বিশেষ। শিল্পকলা যুদ্ধবিগ্রহ রাজনীতি প্রভৃতি গ্রিক জীবনের প্রায় সব দিকের ওপর ধর্মের প্রভাব ছিল অপরিমেয়। অন্যান্য জাতির মত গ্রীকরাও ভবিষ্যৎ কথন বা ডিভিনেশনে বিশ্বাসী ছিল। ইন্দ্রজালের চর্চা সেদিনের গ্রীসে ছিল বহুল প্রচলিত, ও ইন্দ্রজালিক বা জাদুকরদের কাছে বহু শিষ্যের সমাগম হত। এথেনীয় জীবনে দৈবের কি বিপুল প্রভাব ছিল তা এরিস্টোফ্যানিসের নাটকগুলো, বিশেষ অরে দ্য বার্ডস পড়লে বোঝা যায়। গ্রীকরা ডেলফি নগরের অরাকলকে পরম সত্যের উৎস্য বলে মনে করত। জ্যোতিষশাস্ত্রের তখন ব্যাপক প্রচলন ছিল। জ্যোতিষদের পরামর্শ অনুসারে সামরিক অভিযান পরিচালিত হত। এসব কুসংস্কারের প্রতিবাদ উরার দায়ে দার্শনিকদের কেউ কেউ অভিযুক্তও হয়েছিল। এভাবে গ্রীসে সহজবুদ্ধি ও শিক্ষিত মানুষের ধর্মের মধ্যে একটা ফাঁক তৈরি হয়। ধর্ম সম্পর্কে সহজ বুদ্ধি ও শিক্ষিত মানুষের ধারণা ছিল নিতান্তই অপরিপক্ষ। ভীতি প্রণোদিত হয়েই তারা অলৌকিক ঘটনাবলিতে বিশ্বাস করতো ও বিভিন্ন কুসংস্কারের শিকার হত। অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী দার্শনিকরা সাধারণ মানুষের কল্পিত দেবতাদের অস্তিত্ব নির্বিচারে মেনে নিতে পারেননি। রূপক উপমার সাহায্যে তারা এসব দেবতার যে ব্যাখা ও সমীক্ষা করতেন তাতে সংশয়বাদের ইঙ্গিত থাকত। এথেনীয় সভ্যতার শীর্ষ সময়, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকেই বিশেষ করে এই মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে। জগতের মৌল স্বভাব আবিষ্কারের যে বুদ্ধিসম্মত ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা গ্রিক চিন্তায় দেখা যায়, তার নজির সম্ভবত আর কোথাও নেই। জগতের স্বরূপ ও গঠনপ্রকৃতি, জীবনের অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে ধ্যান-অনুধ্যান করতে গিয়ে গ্রিকরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তার ফলেই তারা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ডেমােক্রিটাস, প্লেটো ও এরিস্টটল প্রমুখ দার্শনিক অস্তিত্বের বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে অন্যান্য যেসব মৌল প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা চালান, সেসব প্রশ্নের আবেদন শুধু নৈতিক আদর্শ ও মানদণ্ড নির্ণয়েই নয়, মানুষের জ্ঞানের সমন্বয়বিধানের ব্যাপারেও প্রযােজ্য ছিল।
গ্রিকরা ছিল ইহলৌকিক মনােভাবাপন্ন এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের স্বাধীন চর্চায় উৎসাহী। পারলৌকিকতাব প্রতি তাদের তেমন কোনাে পক্ষপাতিত্ব ছিল না, এবং তারা অতীন্দ্রিয় ব্যাপারাদির চেয়ে পার্থিব তথ্য ও ঘটনাবলির প্রতিই আকৃষ্ট ছিল বেশি। এক কথায়, গ্রিকরা ছিল প্রকৃতিবাদী। তারা প্রকৃতিকে সজীব বলে মনে করত এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলিকে মানুষের অনুভূতি ও ইচ্ছা-উদ্দেশ্যের আলােকে বিচার করত। তারা প্রকৃতি থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলে ভাবত না, বরং প্রকৃতির সাথে একাত্মবােধ করত। আর প্রকৃতির সাথে এ ধরনের একাত্মবােধ করত বলেই তারা ধর্মীয় অভিজ্ঞতার জন্য নিজেদের অন্তরের দিকে না তাকিয়ে বহিপ্রকৃতির দিকে তাকাতাে। প্রাচীন গ্রিক ধর্মও ছিল বহির্মুখী। মানুষের অন্তর্জগৎ সম্পর্কে তারা বড় একটা ভাবত না। সংসারবিমুখ ঐশী মনােভাব তাদের মধ্যে প্রবল ছিল না। তবে বৈরাগ্যবাদের অনুসারী যে গ্রিসে আদৌ ছিল না তা নয়। গূঢ় ধর্মগুলাের আওতায় বৈরাগ্যবাদ ক্রমশ প্রবল হয়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক পর্যন্ত প্রকৃতিবাদী মনােভাব প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু হেলেনিক যুগের পেলােপােনেসীয় যুদ্ধের (খ্রি.পূ. ৪৩১ – ৪০৪ অব্দ) পর থেকে ক্রমশ গ্রিকদের মধ্যে পারলৌকিক ও মরমি মনােভাব শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। দেহ ও মন এবং প্রকৃতি ও মানুষের গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বতন গ্রিক বিশ্বাসের ওপর তখন থেকেই সন্দেহ পােষণ শুরু হয় এবং দার্শনিকদের মধ্যে দৈহিক আবেদন ও আত্মার মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে বিতণ্ডা বৃদ্ধি পায়। গ্রিকরা বহুদেবদেবীতে বিশ্বাসী ছিল। প্রায় সবদিক দিয়েই গ্রিক দেবগণ প্রাচীন বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। যেমন, ইহুদিদের কাছে জেহােভা ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক এমন এক রুদ্র দেবতা, যার কাছে প্রত্যেককে মাথা নত করতে হতাে। অন্যকোনাে দেব-দেবীর উপাসনা করলে তিনি শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। অন্যদিকে নৈতিকতার ব্যাপারে গ্রিক দেবতারা মাথা ঘামাতেন না; বরং তারা নিজেরাই প্রকাশ্যে অনৈতিকতার চর্চা করতেন বলে বিশ্বাস করা হতাে। মিথ্যা শপথ, যুদ্ধবিগ্রহ, ব্যভিচার প্রভৃতি অনৈতিক কার্যকলাপ ছিল গ্রিক দেবতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
আধুনিক ধর্মীয় জীবনে যে পরিমাণ অন্তর্মুখিনতা বা আধ্যাত্মিকতা লক্ষণীয়, গ্রিকদের মধ্যে তা ততটুকু ছিল না। গ্রিকদের কাছে দেবতা ও মানুষের সম্পর্ক ছিল অনেকটা যান্ত্রিক । বলি-উপাসনার মাধ্যমে দেবতাদের সন্তুষ্ট করা গেলেই জীবনে সাফল্য ও উন্নতিলাভ করা যায় বলে তারা বিশ্বাস করত। ধর্মকে নেয়া হতে একটি আনুষ্ঠনিকতার ব্যাপার হিসেবে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সাথে নৈতিক পরিশুদ্ধির কোনাে সম্পর্ক ছিল না। আধ্যাত্মিক অনুশীলন বা ঐশী প্রেমের ওপর কোনাে গুরুত্ব দেয়া হতাে না। আদি পাপের ধারণা তাদের মধ্যে ছিল না; এবং কোলে ধর্মীয় গূঢ়ৈষা (complex) দ্বারাও তারা পীড়িত হতাে না। ভয়-ভীতিমুক্ত খােলা মনের অধিকারী ছিল বলেই তারা আজকের দিনের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চিন্ত ও সুখী। ছিল। জীবনকে দুঃখের আগার ও পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতিপর্ব বলে মনে করার যে নির্দেশ প্রধান প্রধান ধর্মগুলােতে রয়েছে, গ্রিকরা এর সাথে পরিচিত ছিল না। রক্ষণশীল গ্রিক ঐতিহ্যে পরলােকের ধারণা মােটেও মনােজ্ঞ ছিল না। মৃত্যুর পরও ব্যক্তি বেঁচে থাকে বলে বিশ্বাস করা হতাে ঠিক; কিন্তু তাদের কাছে মরণােত্তর জীবন ছিল স্মৃতি ও বুদ্ধিবিবর্জিত একটি অস্পষ্ট ছায়াময় আলােকচ্ছটার মতাে।
তবে জীবন সম্পর্কে গ্রিকদের সবাই আশাবাদী ছিলেন, এমন কথা বলা চলে না। কোনাে কোনাে চিন্তাবিদের রচনায় নৈরাশ্যবাদী মনােভাব প্রকাশ পায়। যেমন, জীবনের নানারকম অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতার কথা ভেবে থিওগনিস মন্তব্য করেন, “জন্মগ্রহণ না করা, জ্বলন্ত সূর্যের উদয় কখনাে প্রত্যক্ষ না করাই সবচেয়ে ভালাে হতাে।” অশুভের সমস্যা, পুণ্যাত্মাদের দুঃখ-কষ্ট ও পরাজয়-পরাভব, অথচ অসৎ ও অন্যায়কারীদের উন্নতি ও বিজয় প্রভৃতি দ্বারা পীড়িত হয়েই তিনি এ দুঃখবাদী উক্তি করেন। সফোক্লিসের চিন্তায়ও একই নৈরাশ্যবাদের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। “পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ না করাই সবচেয়ে সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ, জন্মের মধ্যেই অনিবার্য মৃত্যুর সঙ্কেত নিহিত। যৌবনের পরিসমাপ্তির মানেই হলাে সুখের অবসান ও দুঃখ-কষ্টের সূচনা। আর এ দুঃখ-কষ্টের চাপেই মানুষ ক্রমশ হিংসা-বিদ্বেষ ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়। আবার নৈতিক সংগ্রামের তাৎপর্য বিষয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি বলেন, “এটি একটি অদ্ভুত ব্যাপার যে, দুষ্টপ্রকৃতির মা-বাবার ছেলে-মেয়েরা উত্তরােত্তর উন্নতিলাভ করে, অথচ ভ্রান্ত বংশজাত সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ প্রায়শই দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়ে থাকে। এমন অবস্থায় দেবতাদের উচিত ছিল পুণ্যাত্মাদের পুরস্কারের এবং পাপিষ্ঠদের শাস্তিবিধান করা। তা হলে দুষ্ট লােকেরা কোনােদিনই উন্নতির আশা করতে পারত। সফোক্লিস অবশ্য আশা করেন যে, পরিণামে পুণ্যের জয় হবে। তবে অশুভ সংক্রান্ত তার উত্থাপিত প্রশ্নাবলি, সে দিনের গ্রিকদের অনেকেরই মনে যে পীড়াদায়ক সংশয় ছিল, তারই পরিচায়ক। শুধু নৈতিক সংগ্রামের অর্থ ও তাৎপর্যের ব্যাপারেই নয়, বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় কুসংস্কার ও দুর্নীতি অনেক গ্রিক চিন্তাবিদকে নৈরাশ্যবাদের দিকে পরিচালিত করে।
গ্রিকরা অদৃষ্টবাদে (fatalism) বিশ্বাসী ছিল। জীবনের তিক্ত বেদনাদায়ক অনুভূতি ছিল সেই অদৃষ্টবাদের অঙ্গ। দেবতা মানুষ নির্বিশেষে সবাই ছিল অদৃষ্ট দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এমনকি জিউস নিজেও অদৃষ্টের বিধানকে লঘন বা উপেক্ষা করতে পারেন নি। নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করার অধিকার মানুষ বা দেবতাদের কারােরই ছিল না। মানুষের ন্যায় দেবতাদেরও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে এবং সহদেবতাদের সুযােগ-সুবিধায় হস্তক্ষেপ করলে তাদেরও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে বলে বিশ্বাস করা হতাে। অদৃষ্টবাদের এ ধারণায় অবশ্য কোনাে নিশ্চল জীবনবােধের সমর্থন ছিল না। এ মতের অন্তর্নিহিত অর্থ এই যে, বিশ্বব্যবস্থায় মানুষ দেবতা নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সমাজ ন্যায়নীতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রধান প্রধান গ্রিক দার্শনিকদের মতবাদে এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন, প্লেটো ও এরিস্টটলের দার্শনিক মত আলােচনার সময় আমরা লক্ষ করব যে, অনিয়ম ও বিশৃখলাকে তারা নিন্দা করেন এবং ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি সুষ্ঠু সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন।
সুবৰ্ণ মধ্যকের (golden mean) ওপর গুরুত্ব আরােপ ছিল গ্রিক সংস্কৃতির এক প্রধান লক্ষণ। শিল্পকলা ও নৈতিকতার মধ্যে নিবিড় সম্পর্কনির্দেশ ছিল এ মতের উদ্দেশ্য। যথার্থ শুভ ও সুখী জীবন বলতে গ্রিকরা বুঝত সৌষ্ঠব ও শৃঙখলাপূর্ণ জীবনকে। তথাকথিত নৈতিক পূর্ণতার চেয়ে উচ্চতর মানসিকতার অনুশীলন ও বিকাশকেই তারা মানুষের পক্ষে অধিকতর কাম্য বলে মনে করত। মানুষের সীমিত শক্তি সম্পর্কে তারা সচেতন ছিল; কিন্তু তাই বলে মানুষকে অসহায় ও দেবতাদের অনুগ্রহের পাত্র হিসেবে উপস্থাপিত করে এমন কোনাে নৈতিক মনােভাবের সাথে অধিকাংশ গ্রিকরাই পরিচিত ছিল না। যেমন, যথার্থ মহাপুরুষ বলতে এরিস্টটল বুঝতেন এমন ব্যক্তিকে যিনি তার মহৎ কার্যাবলি ও উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন। নিজের গুণাবলি সম্পর্কে অতিশয় বিনয়ী হওয়াকে এরিস্টটল অনাবশ্যক কপটতা বলে মনে করতেন। তবে এরিস্টটলের নৈতিক মতের চেয়ে স্বতন্ত্র অপর একটি সংস্কারও গ্রিক চিন্তায় লক্ষণীয়। জীবন সম্পর্কে প্লেটোর মনােভাব এ সংস্কারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্মে বৈরাগ্যবাদের যে প্রসার দেখা যায়, প্লেটোর মতের সাথে এর অদ্ভুত মিল রয়েছে। প্লেটো ন্যায় ও শুভের অনপেক্ষ (absolute) মর্যাদায় বিশ্বাসী ছিলেন। এক গালে চড়ের প্রত্যুত্তরে অন্য গাল পেতে দাও – অনেকটা এরকম ছিল ন্যায় সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা। আর এজন্যই বীরােচিত মনােভাবের সমর্থক নীটশে (১৮৪৪১৯০০) প্লেটোকে অবক্ষয়ের প্রতিনিধি বলে নিন্দা করেন।
ব্যায়াম ও ক্রীড়ানুষ্ঠানবিষয়ক গ্রিক আদর্শের কথা আজও মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এ আদর্শই মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সম্মিলন ঘটায়। অলিম্পিক ক্রীড়া এ মনােভাবেরই দৃষ্টান্ত। এসব ক্রীড়ানুষ্ঠানে বিজয়ীরা এমন পুরস্কারলাভ করত যার জন্য তারা প্রায় সবকিছুই উৎসর্গ করতে রাজি ছিল। গ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় দেহের আবেদনকে উপেক্ষা করা হতাে না। প্লেটো ও এরিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকেরা দৈহিক প্রশিক্ষণের বিস্তারিত রূপরেখা প্রদান করেন। শুধু দৈহিক উৎকর্ষলাভই নয়, নাগরিকদের নৈতিক জীবনকে উন্নত করাও ছিল গ্রিক ক্রীড়া-ব্যায়ামের উদ্দেশ্য। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের মধ্যেই ব্যক্তি তার নিজ সত্তাকে খুঁজে পেতে পারে – এই ছিল গ্রিকদের জীবনাদর্শের এক প্রধান দিক। বিশেষ করে এথেন্সে এ ধারণা বহুল প্রচলিত ছিল। আর এ জন্যই সেখানকার লােকদের মধ্যে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের এক বিপুল উৎসাহ ও প্রেরণা লক্ষ করা যায়। বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন, কিংবা শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার ধারণাকে গ্রিকরা অস্বাভাবিক ও অবাঞ্ছিত বলে মনে করত বলা বাহুল্য। মধ্যযুগীয় জীবনাদর্শের সাথে গ্রিক জীবনের এখানেই মূল প্রভেদ। গ্রিকদের একতার মূল উৎস ও প্রেরণা ছিল তাদের নগররাষ্ট্র। অপরপক্ষে, চার্চের পরিচালনায় নিজ মুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই ছিল মধ্যযুগীয় জীবনের লক্ষ্য। গ্রীক শিক্ষাব্যবস্থায় দেহের আবেদনকে উপেক্ষা করা হত না। প্লেটো, এরিস্টোটল প্রমুখ দার্শনিকেরা দৈহিক প্রশিক্ষণের এক বিস্তারিত রূপরেখা দিয়েছিলেন। প্রাচীন গ্রীক দর্শনের যুগে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় নারী সমাজ পুরুষের সমকক্ষতার দাবি করতে পারেনি। ঘর সংসারের দেখাশোনা ও ক্রীতদাসদ্র তত্ত্বাবধানই ছিল তাদের সময় কাটাবার মূল উপায়। এজন্য গ্রীক সাহিত্যে রোমান্টিক প্রেমের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে বন্ধুত্বের অথা বেশি শোনা যায়।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় গ্রীক দর্শনের মূল সমস্যা ছিল তাদের দার্শনিক আলোচনায় ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় প্রভাব। ধর্মকে নিয়ে দার্শনিকরা বেশি চিন্তাভাবনা বা গবেষণা করেছিলেন। পরবর্তীকালের দর্শনে ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও তা প্রাচীন গ্রীসের মত ততটা প্রবল ছিল না। যেমন পিথাগোরীয় সম্প্রদায়, সক্রেটিস, প্লেটো ও পরবর্তীকালের নব্য-প্লেটোবাদী ও নব্য-পিথাগোরীয় দার্শনিক আন্দোলন অর্ফিক ধর্মমত দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল। তবে প্রাচীন যুগের দ্বিতীয় পর্বে বা শেষ পর্বে দার্শনিকদের দর্শন আলোচনায় ধর্মীয় প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেয়ে সেখানে বিজ্ঞান স্থান করে নেয়। (রাহুল সাংকৃত্যায়ন ও দর্শন-দিগদর্শন, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২)। এই পর্বের দার্শনিকদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানের অভাবিত অগ্রগতির বর্তমান পরিবেশে গ্রিক মনীষার গুরুত্ব উপলব্ধি করা সহজ ব্যাপার নয়। যন্ত্র আজ বিপুল শক্তির অধিকারী। অতর্কিতে তা যদি ফ্রাংকেস্টাইন দৈত্যে পরিণত হয়ে যায়, তাতেও বিস্মিত হবার কারণ থাকবে না। প্রাচীন গ্রিসে যন্ত্রের এত প্রতিপত্তি ছিল না; আর তা নয় বলেই গ্রিকরা সুযােগ পেয়েছিল সুনির্মল অনুধ্যানমূলক চিন্তার, সুকুমারবৃত্তি অনুশীলনের মাধ্যমে জীবনকে উপভােগ্য করার অবস্থা সৃষ্টির, জগৎ ও জীবনকে বােঝার চেষ্টা করার । প্রয়ােজনবাদী মনােভাব বলতে আমরা আজ যা বুঝি, গ্রিকদের তা ছিল না। তাই দেখা যায় জগৎ ও জীবনবিষয়ক যেসব মৌল প্রশ্ন নিয়ে তারা ভাবতেন, প্রায়ােগিক অভিজ্ঞতার নিরিখে তাদের সত্যাসত্য প্রতিপাদনের ধার তারা বড় একটা ধারতেন না।
গ্রীক দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ
সুদূর অতীতের যে পরিবেশে দার্শনিক চিন্তার সূত্রপাত আজকের দিনের তুলনায় তা ছিল নিতান্তই অপরিপক্ক ও অনগ্রসর। সেদিনের চিন্তার বিচার বিশ্লেষণের চেয়ে কল্পনা ও স্বজ্ঞা–এর স্থান ছিল প্রধান। এ দিক থেকে সেদিনের স্বাভাবিক সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করা যায় না কোন মতেই। কেননা এ থেকে সূচীত হয়েছে পরবর্তীকালের উন্নত চিন্তা, পরিচালিত হয়েছে সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক অভিযান। গ্রীক দর্শনের উদ্ভব ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে। গ্রীক দার্শনিকগণ ছিলেন পার্বত্য উপদ্বীপ অঞ্চলের অধিবাসী। প্রাচীন গ্রীক দর্শনের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন থেলিস। তিনি ছিলেন বস্তুবাদী। মানুষ যখন উৎপাদন বিমুখ অতি প্রাকৃত ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা আচ্ছন্ন তখন সেখানে প্রয়ােজন ছিল মুক্ত চিন্তার। ঠিক তখনি গ্রীক চিন্তাবিদগণ সমাজ প্রগতির পথে সহায়ক ও বাস্তব জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিন্তাধারার উদ্ভাবন করেন।
গ্রীক দর্শনের বিষয়বস্তু
বিশ্ব এবং সৃষ্টিকর্তা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নই ছিল গ্রীক দর্শনের প্রধান বিষয়বস্তু। মুলত এ প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই গ্রীক দর্শন গড়ে উঠতে থাকে। গ্রীক দর্শনকে মূলত তিনটি পর্বে বিভক্ত করা যেতে পারে।
- (ক) আদি যুগ (৬২৪-৪২০ খ্রি: পূ:) : বহুত দর্শনের উদয় কালকে আমরা আদি যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। গ্রীক দার্শনিক থেলিস থেকে অ্যানাক্সিমিনিস পর্যন্ত এ যুগ সীমিত। বাহ্য জগতের মূল রহস্য সন্ধানে এ দার্শনিকগণ ভিন্ন মত পােষণ করতেন।
- (খ) মধ্য যুগ (সক্রেটিস-এরিস্টোটল – ৪২০-৩২০ খ্রি.পূ.) : এ যুগের সময় সীমা সক্রেটিস থেকে অ্যারিস্টটলের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শন চর্চার ফলে এ যুগের দর্শন চরম উৎকর্ষতা লাভ করে।
- (গ) অন্ত:যুগ : এ যুগে দর্শন চর্চা তেমন উৎকর্ষতা লাভ করেনি। এ সময়ের দার্শনিকদের চিন্তা–ভাবনা ছিল জাতীয়ভিত্তিক।
গ্রীক দর্শনের বৈশিষ্ট্যগুলাে নিম্নে আলােচনা করা হলাে –
- ১. বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আবিষ্কার : গ্রীক দর্শন থেকে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনার সূত্রপাত ঘটে। থেলিস তঁার মূলসত্তা পানির ব্যাখ্যা দানের সময় কোন রূপ গল্পের আশ্রয় নেননি বরং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তার ব্যাখ্যা দানের চেষ্টা করেছেন। গ্রীক দর্শনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দানের চেষ্টা এটাই প্রথম।
- ২. দর্শন ও বিজ্ঞানের সংমিশ্রণ : গ্রীক দর্শনে বিজ্ঞান ও দর্শনের পরিপূর্ণ সংমিশ্রণ করা যায়। কেননা তখন পর্যন্ত মননশীলতা ও অভিজ্ঞতামূলক কোন গবেষণার মধ্যে পার্থক্য করা হতাে না। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত শাস্ত্র অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এমনকি ভেষজ বিজ্ঞান তখনও দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- ৩. বিশ্বতাত্ত্বিক : গ্রীক দর্শনে দেখা যায় যে, এ যুগের দার্শনিকদের আলােচনার মূল বিষয় ছিল আদি সত্তার স্বরূপ জানা, যা থেকে বস্তুর উদ্ভব। দার্শনিকগণ বায়ু, পানি, অগ্নি, সংখ্যা প্রভৃতিকে জগতের আদি সত্তা হিসেবে নিরূপণ করেছেন। এভাবে দেখা যায় প্রাচীন দর্শন ক্রমাগত বিশ্বতাত্ত্বিক হয়ে পড়েছে।
- ৪. ভিত্তি স্বরূপ : গ্রীক দর্শন হচ্ছে বর্তমান দর্শনের ভিত্তি স্বরূপ। কেননা সভ্যতার প্রাথমিক স্তরকে বাদ দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া যায় না।
- ৫. সজীব জড়বাদ : গ্রীক দার্শনিকগণ মনে করতেন যে, যাবতীয় জড় পদার্থে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। অ্যানাসেগােরাস ভিন্ন প্রাক–সক্রেটিস যুগের অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে এ মনােভাব লক্ষ করা যায়। সুতরাং এ কারণে তাকে সজীব জড়বাদী দর্শন হিসেবে অভিহিত করা যায়।
- ৬. অবরােহমূলক চিন্তা : গ্রীক দর্শনের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে। অবরােহমূলক চিন্তা প্রণালী। সক্রেটিসের সার্বিক ধারণা দর্শনের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। আধুনিক সব ভাববাদের বীজ এখানেই লুক্কায়িত ছিল।
- ৭. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তা : স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিজ্ঞের মত বাস্তব মূল্য নির্ধারণ করাই দার্শনিকের কাজ। গ্রীক দর্শনে এ মহান নীতিটির প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হয়।
- ৮, বিচার বিযুক্তবাদী : চিন্তার বিযুক্তবাদীতা গ্রীক দর্শনের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। জ্ঞানের বৈধতা, শর্ত, সীমা সম্ভাবনা ইত্যাদি সম্পর্কে কোন আলােচনা না করে গ্রীক দর্শন স্বীকার করে নেয় যে, মানুষের মনে জগত বিষয়ক সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা আছে সুতরাং গ্রীক দর্শন বিচার–বিযুক্তবাদী।
- ৯. প্রাকৃতিক : গ্রীক দর্শন প্রকতি ও বহির্জগত নিয়ে আলােচনা করে। প্রতি স্বরূপত কি এবং এতে মানুষের ভূমিকা কতখানি এসব সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রীক দর্শন প্রাকৃতিক দর্শন নামেও পরিচিত।
- ১০. পরমাণুবাদী : গ্রীক দর্শনে পরমাণুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। এক জাতীয় বস্তু নিয়ে গঠিত পরমাণু হচ্ছে বস্তুর মূল উপাদান। গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তা ধারায় এ মতবাদের প্রতিফলন দেখতে পাই। বর্তমান বিজ্ঞানের উন্নতির মূলে পরমাণুবাদীদের দান অপরিমেয়।
- ১১. তত্ত্ববিদ্যামূলক : এ যুগের দর্শন ছিল তত্ত্ববিদ্যামূলক। যেহেতু বিষয়বস্তু মূল তত্ত্বের অনুসন্ধানই তার অন্যতম কাজ।
- ১২. ধর্মীয় মনােভাব : গ্রীক দর্শনের চিন্তায় তাদের পূর্বসূরীদের পৌরাণিক ও ধর্মীয় প্রভাব সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান ছিল। গ্রীক দর্শনের সাথে তৎকালীন ধর্মের সম্পর্ক ছিল নিবিড়।
- ১৩. অদৃষ্টবাদী : গ্রীকগণ অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। জীবনের তিক্তময় ও বেদনাদায়ক অনুভূতি ছিল সেই অদৃষ্টবাদের ভিত্তি। দেবতা মানুষ নির্বিশেষে সবাই। ছিল অদৃষ্টবাদ দ্বারা পরিচালিত।
- ১৪. বস্তুবাদী : গ্রীক দার্শনিকগণ বস্তুবাদী চিন্তা ধারার অধিকারী ছিলেন। এ জগতের আদিম সত্তার সমস্যা সমাধান বিষয়ক আলােচনায় আমরা তা লক্ষ করি।
উপসংহার ও উপরােক্ত বৈশিষ্ট্যগুলাের পর্যালােচনার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, গ্রীক দর্শনে চিন্তা ও গবেষণার মূল লক্ষ ছিল সত্যিকার জ্ঞান লাভ। গ্রীক দার্শনিকগণ তাদের দর্শন আলােচনায় জড় রীতি-নীতির সমালােচনা ও নতুন চিন্তা ধারার প্রচারের মাধ্যমে এর পুরানাে বিশ্বাস জড় সংস্কারকে বাদ দিয়ে স্বকীয় চিন্তা রাজ্যে তাদের নিজের মতবাদ ও মনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তারা সৃজনশীল মন প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক প্রভাব ও মননশীলতার জনে। ব্যতিক্রমধর্মী গ্রীক চিন্তাবিদদের মানসিকতা জগত ও জীবন সম্পর্কে এক উদারবােধ প্রবৃত্তি ও জিজ্ঞাসু প্রবণতার মাধ্যমে প্রভাবান্বিত, এদিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দার্শনিকগণ মত প্রকাশ করেন যে, গ্রীক দর্শনকে ভিত্তি করেই আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে আছে।
গ্রীক দর্শনের মধ্যাহ্ন
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দ আয়ােনীয় বা গ্রীক দর্শনের সুবর্ণ যুগ। এর কিছু পূর্বেই জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস মৌখিক উপদেশ বিতরণ করে তরুণ সমাজের হৃদয় জয় করেছেন। তার অসমাপ্ত কাজ তার সুযােগ্য শিষ্য প্লেটো এবং তস্য শিষ্য অ্যারিস্টটল সম্পন্ন করেন। এই যুগের দর্শনকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা – সক্রেটিস এবং প্লেটো গুরুশিষ্যের যথার্থবাদ বা যুক্তিবাদ এবং অ্যারিস্টটলের প্রয়ােগবাদ ও বস্তুবাদ।
তথ্যঋণ
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৩-১২, ১২৭-৩০
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ড. আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৩২-৩৮
Leave a Reply