(বৃদ্ধি পাবে)
Table of Contents
ক্রুসেড
ক্রুসেডের অর্থ ও তার পরিবর্তন
অতি-সরলীকৃত ব্যাখ্যায় ক্রুসেডের অর্থ হল বিধর্মীদের হাত থেকে জেরুসালেম উদ্ধারের অভিযান (“The Crusades were religious wars for the capture and defence of Jerusalem”- Margaret Deansly)। কিন্তু তারপরও ক্রুসেড নিছক ধর্মযুদ্ধ ছিল না। দুই শতাব্দীব্যাপী এবং সমস্ত খ্রীস্টান-জগৎ উত্তাল-করা এই ক্রুসেড নামক অভিযান গুলির মধ্যে মধ্যযুগীয় ইউরােপের বহু রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিকাশের প্রতিফলন ঘটেছিল। শুরুতে অবশ্যই প্রচণ্ড একটি ধর্মীয় প্রয়োজন থেকে এই অভিযানগুলোর সংগঠন হয়, কিন্তু ক্রমশ ধর্মের উত্তাপ ও উন্মাদনা শীতল হয়ে যায় আর ধর্মবহিভূত বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রবলতর হয়ে সমস্ত আন্দোলনের চরিত্রকে রূপান্তরিত করে দেয়।
ক্রুসেডের পেছনে ধর্মীয় উন্মাদনা
১০৯৫ সালে ক্লেরমন্ট (ক্লেরমঁ) কাউন্সিল (council of Clermont) এ পােপ দ্বিতীয় আরবানের অতি-প্রসিদ্ধ ভাষণ লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে অবিশ্বাস্য এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু পশ্চিম ইউরােপের আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব জগৎ যদি আগে থেকে অশান্ত না হয়ে থাকতো তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষের এই উন্মাদনা কঠিন ও প্রায় অসম্ভব এক কর্মোদ্যোগে পরিণত হতে পারতো না। ইউরােপে ১১শ শতক বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে ধর্মীয় উন্মাদনার জন্য। এই সময়ে সুসংস্কৃত এবং শক্তিশালী চার্চ গােটা মহাদেশের নৈতিক জীবনের ও সমাজের সকল শ্রেণীর আশা-আকাঙ্ক্ষার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করে। সহজাত পাপ থেকে আত্মশুদ্ধির উপায় দুটি – আত্মনিবেদন করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শরণাগত হওয়া এবং যিশু খ্রিস্টের স্মৃতি-বিজড়িত দূর-দুর্গম দেশে তীর্থ যাত্রা। চার্চ মানুষকে এই দুই দিকে পরিচালিত করার চেষ্টায় অক্লান্ত হয়ে উঠেছিল।
চার্চের ক্ষমতাসম্পর্কে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধের প্রেরণা দান
কিন্তু এর থেকেও বড় পরিবর্তন এসেছিল চার্চের চরিত্রে। আধ্যাত্মিকতার শান্ত, স্নিগ্ধ পথ ছেড়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য চার্চ শক্তি প্রয়ােগেও বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল, খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরু পোপের কাছে যিশুর প্রেম, মৈত্রী ও অমর বাণীর পরিবর্তে অস্ত্র প্রয়োগ ও শাস্তি দানের কথাই বেশি শােনা যেতো। ক্লুনির আশ্রমও এ জাতীয় মনোভাবের সম্প্রসারণে তৎপর হয়ে উঠেছিল। রোমের অধীন সকল ধর্ম-প্রতিষ্ঠানকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তারা যেন সশস্ত্রবাহিনীর সংগঠনে এবং শান্তিভঙ্গকারীদের শাস্তি-বিধানে সচেষ্ট থাকে। নিজে নিরস্ত্র হয়েও লিজ (Liege)-এর বিশপ ভ্যাসন (Vason) তার নগর ও নগরের অন্তর্ভুক্ত চার্চের সম্পত্তি রক্ষার জন্য রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহারে অকুতােভয়ে এগিয়ে এসেছিলেন।
এ সম্পর্কে বিশেষ করে পােপ সপ্তম গ্রেগরির (১০৭৩-৮৫) চিন্তাধারা ও আদর্শের মধ্যে চার্চ এবং তার সময়ের চেহারা প্রতিবিম্বিত হতে দেখা যায়। সপ্তম গ্রেগরীর মুখে প্রায়ই তার পূর্বসূরী গ্রেগরী দ্য গ্রেট ব্যবহৃত এই উক্তিটি শােনা যেত – ‘রক্তপাত থেকে নিজের তলােয়ার যে নিবৃত্ত রাখে সে অভিশাপ পাওয়ার যােগ্য।’ ১১শ শতকে চার্চের সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে তার সংগ্রামী মনােভাব প্রচণ্ড হয়ে উঠেছিল। বহু গীর্জার প্রার্থনা-সভায় যুদ্ধ-বিজয়ের কামনা ধ্বনিত হতে শুরু করেছিল, শাণিত তরবারিকে পবিত্র অস্ত্ররূপে চিহ্নিত করার ঘটনাও হয়ে উঠেছিল অবিরল। সমস্ত খ্রিস্টান জগতে পােপের পার্থিব শক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, বাইজানটাইন সাম্রাজ্য এবং দক্ষিণ ইতালীর নরম্যান শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য চার্চ আর শুধু যিশুর প্রেম-ধর্মের উপর নির্ভর করতে রাজি ছিল না, প্রার্থনা ও উপাসনার সঙ্গে তাই মিশে গিয়েছিল যুদ্ধের ভেরী-ঘােষণা। ১০৪৯ সালের মার্চে হাজার হাজার অনুচর পরিবেষ্টিত হয়ে পােপ নবম লিওর উত্তর ইতালী পরিক্রমা, ক্যানােসার কাউন্টেস ম্যাটিল্ডার সামরিক সাহায্যপুষ্ট সপ্তম গ্রেগরীর বিক্রম প্রদর্শন – এসব চার্চের পরিবর্তিত চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। সেন্ট বেনিডিক্টের শিষ্য, মন্টি ক্যাসিনো মঠের অশ্রমিক অ্যামাটাস (Amatus) এবং আলফানাস (Alphanus) (যিনি পরবর্তীকালে আর্চ বিশপ পদে উন্নীত হয়েছিলেন) আরব, বাইজানটাইন এবং নরম্যান শক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত খ্রিস্টান জগতকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিলেন বারবার। ‘প্রেরিত শিষ্য’ পিটারের আগ্নেয় তলােয়ার বিধর্মীর বিরুদ্ধে ঝলসে উঠুক – এই ইচ্ছা সপ্তম গ্রেগরীর মতো অন্যান্য অসংখ্য যাজকেরও হৃদয়-বাসনা হয়ে উঠেছিল। ১১শ শতকের চার্চ কেবলমাত্র শান্তির ললিত বাণীর উৎস ছিল না, সে কালের যে কোনও হিংস্র যােদ্ধার মতো তার মধ্যেও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল রণােন্মত্ততা।
যোদ্ধৃ সম্প্রদায়ের ওপর চার্চের প্রভাব
সুকঠিন এই দায়িত্ব পালনের স্বপ্ন বিশেষভাবে আলােড়িত করেছিল সেই সব খ্রিস্টানুরাগীদের যারা একই সঙ্গে যিশু এবং ক্ষাত্রশক্তির উপাসক ছিলেন। মার্টিন স্কট (Martin Scot) ইউরোপের সামন্ত-শ্রেণীর এই বিশেষ প্রবণতার মধ্যে সমস্ত ক্রুসেড আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সূত্র বিধৃত আছে বলে মনে করেন। যােদ্ধৃ সম্প্রদায়কে প্রচণ্ড শৌর্যের এই মন্ত্রে চার্চই দীক্ষিত করেছিল। সমরাঙ্গণে রণ-নির্ঘোষের সঙ্গে সেন্ট জন, সেন্ট পিটার এবং বেনিডিক্ট-এর নামোচ্চারণ, সৈন্যবাহিনীর পতাকায় ধর্মীয় প্রতীকের যথেচ্ছ ব্যবহার, রোমান চার্চ ঘোষিত যে কোনও সংগ্রামে অংশ নেবার জন্য অসংখ্য যােদ্ধার আগ্রহ এবং চার্চ ও মঠের সম্পত্তি রক্ষায় ইউরােপের যে কোনও প্রান্তে সামরিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা ইত্যাদি ছােট বড় ঘটনা প্রমাণ করে যে সেসময় ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কিরকম অগ্নিগর্ভ হয়ে গিয়েছিল। নাইটদের শুধু আর ঊর্ধ্বতন প্রভুর প্রতিই কর্তব্য সাধন করতে দেখা যেত না, শতশত যুদ্ধপ্রিয় নাইট চার্চের সেবায় আত্মনিয়ােগ করে “খ্রিস্টের সেনানী” বা “সেন্ট পিটারের সশস্ত্র সৈন্য” এর মত বিশেষণে ভূষিত হচ্ছিল।
ক্রুসেডের অব্যবহিত পূর্বে সমস্ত পশ্চিম ইউরােপের ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ সম্প্রদায়ের কর্মসূচীর দিকে চার্চ যে কেমন উদার দাক্ষিণ্যের হাত প্রসারিত করে দিয়েছিল তার অসংখ্য প্রমাণ আছে সুত্রির বোনিজো (Bonizo of Sutri) লিখিত ‘Book of Christian Life’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ১১শ শতকের মধ্যভাগ থেকেই সমস্ত ইউরােপ যেন এক সমরাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। চার্চের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যোদ্ধার বৃত্তি পবিত্র রূপে অভিষিক্ত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ফ্রান্স ও সন্নিহিত অঞ্চলে এই সময় যােদ্ধৃ শ্রেণীর মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং তৎপরতা ইউরোপের সামাজিক বিবর্তনের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।’ রবার্ট গুইসকার্ড (Robert Guiscard, nicknamed ‘the Cunning’) এবং তার পরিবেষ্টনীর সমরনায়ক রজার (Roger), ট্যানক্রেড (Tancred) এবং বােহিমও (Bohemond) ছিলেন যুগের প্রতিভূ।
আইবেরীয় উপদ্বীপে আরবদের বিরুদ্ধে স্পেনরাজের যুদ্ধ ঘােষণা, প্রভাঁস ও আঁকুতা (Acquitaine) এর ডিউকদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, সেন্ট পিটারের নামাঙ্কিত পতাকা সহ নর্মান্ডির ডিউক উইলিয়ামের ইংল্যান্ড বিজয়, গ্রেগরীর শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য পােপ দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডার কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে মিলানের রাস্তায় খ্যাতনামা সমরনায়ক এর্লেমবল্ড (Erlembald) এর মৃত্যুবরণ, পােপের লোম্বার্ডি অভিযান এবং ট্যাস্কানী ও লােরেনের শাসকদের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে এ তথ্যই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল যে আঞ্চলিক, সামন্ততান্ত্রিক সংঘর্ষ পরিহার করে বৃহত্তর কোনও আদর্শের প্রেরণায় চার্চের নেতৃত্বে ইউরােপের শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে সচেষ্ট হয়েছে। নতুন সেই আদর্শ হয়তো খ্রিস্টীয়-ইউরােপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের স্বপ্নকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল।
আগে জেরুসালেমের প্রতি আগ্রহী না হবার কারণ
রূপান্তরিত চার্চ এবং সামন্ত শ্রেণীর সমর অভিলাষ – এই দুই অনুঘটকের সঙ্গে সম্মিলিত হয়েছিল আরও দুটি নতুন ঘটনার প্রতিক্রিয়া – নিকট প্রাচ্যে বাইজানটাইন শক্তিকে গ্রাসোদ্যত নতুন এক তুর্কিশক্তির আবির্ভাব এবং ইউরোপের নবজাত নগরগুলোর সংঘাতিক বাণিজ্য প্রসারের জন্য তীব্র আগ্রহ। ৬৩৮ সালে জেরুসালেম মুসলমানদের হাতে চলে গিয়েছিল অথচ তা পুনরুদ্ধারের জন্য খ্রিস্টান শক্তিগুলো ১১শ শতকের একেবারে শেষ দশকের আগে কেন চেষ্টা করে নি – সেই প্রশ্নের উত্তর ইউরোপের এবং নিকট প্রাচ্যের ঐ সময়ের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এতকাল রােমান চার্চ আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্য সুদূর প্যালেস্টাইন সম্পর্কে উদাসীন থাকতে বাধ্য হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু তার থেকেও বড় কারণ বাইজানটাইন শাসকগণ প্যালেস্টাইনে লাতিন শক্তিগুলির হস্তক্ষেপের বিরােধিতা করে আসছিলেন। ৬৫০ থেকে ১০৫০ সাল পর্যন্ত বাইজানটাইন এবং মুসলমান শক্তিগুলির মধ্যে যে সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উভয়পক্ষই তা মেনে নিয়েছিল। উপরন্তু পূর্ব রােমান সম্রাটগণ ফ্রাঙ্ক, স্যাক্সন বা অপর জার্মান গােষ্ঠীভুক্ত জাতিগুলোকে সন্দেহ ও শত্রুতার চোখেই দেখতেন।
তুর্কি আক্রমণের ফলে ১১শ শতকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা ও তার প্রতিক্রিয়ায় ক্রুসেড
কিন্তু ১১শ শতকের শেষার্ধে বহু শতাব্দীর পুরোনো আন্তজাতিক সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন হয়। ১০৭১ সালে ক্রোয়াট, সার্ব এবং সিসিলির নরম্যানদের হাতে পরাজয়ের গ্লানি মুছে যাবার আগেই মেঞ্জিকার্ট (Menzikert) এর যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সেলজুক (Seljuk) তুর্কীদের হাতে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের বিপর্যয় ঘটে। সমস্ত আনাতোলিয়া সেলজুকদের হস্তগত হয়ে যায়। সম্রাট ১ম আলেক্সিয়াস কম্নিনাস (Alexios I Komnenos, রা. ১০৮১-১১১৮ খ্রি.) আসন্ন সর্বনাশ থেকে আত্মরক্ষার জন্য পােপের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালেন। সপ্তম গ্রেগরী সমবেদনা জানালেন, প্রতিশ্রুতি দিলেন সাহায্যের কিন্তু ইনভেস্টিচ্যর দ্বন্দ্বের জন্য তার পক্ষে বিশেষ কিছু করা সম্ভবপর হলাে না। গ্রেগরীর উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় আরবানের ওপরই (১০৯১) বাইজান্টাইন সম্রাটকে সাহায্য পাঠানাের দায়িত্ব এসে পড়ে। সম্রাট আলেক্সিয়াস অনুমান করেছিলেন যে পােপ হয়তো কিছু সংখ্যক ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়ে তার কর্তব্য শেষ করবেন। কিন্তু সাহায্য এলো অকল্পিত রূপ নিয়ে। ১০৯৬ সালে পােপ কর্তৃক সংগঠিত বিপুল এক অভিযান পূর্ব দিকে যাত্রা করল। অশাতিরিক্ত, ভয়াবহ এই সাহায্য পৌঁছালে পূর্ব রােমান সম্রাটের কাছে এবং ইতিহাসে সংযােজিত হলো একটি নতুন শব্দ – ক্রুসেড।
ক্রুসেডে ইতালীয় বণিকদের বাণিজ্যিক স্বার্থ
বিপন্ন বাইজান্টাইন সম্রাটের জন্য পােপ যে সাহায্য পাঠিয়েছিলেন তার দায়িত্বভরের অনেকটাই গ্রহণ করে ইতালীর বাণিজ্য-সমৃদ্ধ নগরগুলো, আর তারা এটা অবশ্যই ধর্মীয় প্রেরণায় করেনি, স্থূল বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্যই করেছিল। পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরােপের দক্ষিণাংশের অনেকটাই মুসলমান শক্তির অধীনে চলে যায়। স্পেন, ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলো, মিশর, উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য একসময়কার রােমান শাসনাধীন অঞ্চল, সিরিয়া এবং এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুসলমান শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইউরােপের ব্যবসাবাণিজ্য প্রায় পুরােপুরি খ্রিস্টানদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়। ৯ম শতাব্দীতে ক্যারােলিঞ্জীয় শক্তির অবক্ষয় এবং বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতা মুসলমানদের বাণিজ্যিক প্রসারের আরও সুবিধা করে দেয়। ভূমধ্যসাগর প্রকৃত অর্থেই একটি মুসলমান হ্রদে পরিণত হয়। ১১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নরমানগণ মুসলমানদের হাত থেকে সিসিলি জয় করলে এবং মুসলমান কবলিত স্পেন খ্রীস্টান শক্তি দ্বারা পুনরধিকৃত হলে পশ্চিম ভুমধ্যসাগর এবার ইতালীয় বণিকদের অধীন হয়। এই সময়েই কর্সিকা, সার্ডিনিয়া ও সিসিলিতে নৌঘাঁটি ও বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন শুরু হয়। ১০১৬ সালে জেনােয়া ও পিসার সম্মিলিত অভিযানের মাধ্যমে সার্ডিনিয়া মুসলিমদের থেকে খ্রিস্টানদের হাতে আসে, আর ১০৮৭ সালে ইতালীয় বণিকদের অভিযান সুদূর আফ্রিকায় পৌঁছায় এবং উত্তর আফ্রিকার টিউনিসও খ্রিস্টানদের অধিকারে আসে।
অন্তর্দেশীয় ও বহির্বাণিজ্যে ইতালীয় বণিকেরা ইতিমধ্যেই উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল। এখন অধিকতর বাণিজ্যিক সফলতার জন্য পূর্ব-ভূমধ্যসাগরকেও তারা মুসলমান অধিকার মুক্ত করতে এবং সমৃদ্ধ প্রাচ্য দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠে। নৌবলে বলিয়ান পিসা, জেনােয়া, ভেনিস, অ্যামালফির উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে পােপ-সংগঠিত অভিযানের লক্ষ্য এক হয়ে যায়। বাণিজ্যিক স্বার্থ ও ধর্মীয় উন্মাদনা – একে অন্যের পরিপূরক হয়ে যায়। ক্রুসেডের সংগঠকদের কাছে এই তথ্য খুব স্পষ্ট ছিল যে দূরদেশে যেকোনও বিশাল অভিযান পাঠাতে গেলে উপযুক্ত বন্দর, নৌবহর এবং সমুদ্রযাত্রায় অভিজ্ঞ নাবিকের সহায়তা অপরিহার্য। পােপ দ্বিতীয় আরবান তাই বিধর্মীদের বিরুদ্ধে তাদের সক্রিয় সাহায্যের জন্য জেনােয়ার শাসকবর্গের কাছে ব্যক্তিগত আবেদন পাঠিয়েছিলেন। ধনাকাঙ্ক্ষী ও সফল বণিক সম্প্রদায়ের কাছে এই আহ্বান সুবর্ণ সুযােগ বলেই বিবেচিত হয়েছিল এবং পোপের ডাকে সব রকমের সাড়া দিতে তাদের দেরিও হয়নি। এভাবেই খ্রিস্টের স্মৃতি-জড়িত পূণ্যভূমি উদ্ধারের স্বপ্ন ও রণােন্মত্ত যোদ্ধৃ-সম্প্রদায়ের অদম্য সমর-পিপাসার সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে মিশে গিয়েছিল ব্যবসায়িক লেনদেনের অতি জটিল পরিকল্পনা। ক্রুসেডে এভাবে ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ এবং ক্ষমতালিপ্সা একীভূত হয়ে গিয়েছিল।
সামন্ততান্ত্রিক প্রথানুযায়ী কেবল জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা সম্পত্তি লাভ করায় অন্যদের ক্রুসেডে যোগদান
যে-কোনও সামুদ্রিক-আন্তর্মহাদেশীয় বিস্তারের সঙ্গে সমাজে জনসংখ্যা-বৃদ্ধিজনিত এবং উত্তরাধিকার-সম্পর্কিত সমস্যা জড়িত থাকে। ক্রুসেডের ক্ষেত্রেও সেগুলো ছিল। পশ্চিম ইউরোপের অধিকংশ অঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক ভূসম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেতে ‘জ্যেষ্ঠত্ব’ একমাত্র আইন অনুমােদিত শর্ত হিসেবে গৃহীত হওয়ায় কনিষ্ঠ পুত্রদের পারিবারিক সম্পত্তি লাভের আশা ত্যাগ করে অন্যত্র ভাগ্য-অম্বেষণে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। ক্রুসেড সংগঠিত হওয়ার ফলে দূরদেশে গিয়ে তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের এক সুবর্ণ সুযােগ পেয়েছিল। অনিশ্চিত এই সৌভাগ্য-অন্বেষণ ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হলেও তাদের এই সান্ত্বনাটুকু ছিল যে তাদের জন্য চার্চের আশীর্বাদ ও ঈশ্বরের করুণা সঞ্চিত থাকবে। জেরুসালেমের বল্ডুইন বা অ্যান্টিয়োকের বোহেমন্ডের মতো প্রথম ক্রুসেডের বহু নায়কই পারিবারিক সম্পত্তি লাভের আশা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। নতুন দেশে ভাগ্যান্বেষণ এদেরকে ক্রুসেডের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
তীর্থযাত্রার ভূমিকা
এ তথ্য অবশ্যই তর্কাতীত যে ক্রুসেড সংগঠনে এমন অসংখ্য মানুষের অবদান ছিল যারা ক্ষুদ্র কোনও স্বার্থ, স্থূল কোনও বাসনার বশবর্তী না হয়ে বিশুদ্ধ ধর্মের আবেগেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ১০ম শতকের মাঝমাঝি সময় থেকেই পশ্চিম ইউরােপের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য তীর্থযাত্রী জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে থাকে। অ্যাকুঁতার হিউ নামক এক অভিজাত পাপ-স্থলনের জন্য পুণ্যতীর্থে গিয়েছিলেন, যাত্রা করেছিলেন অ্যাঞ্জুর কাউন্ট নৰ্মান্ডির (নরমাঁদি) ডিউক প্রথম রবার্ট (১০০৭-৩৫)। তাদের পরিক্রমার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এমন কিছু পুণ্যাত্মার জেরুসালেমে যাত্রা যাদের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন অভিজাত সম্প্রদায়। ১০২৬ সালে এমনই এক দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন স্যাঁ ভান্স (St Vannes)-এর অ্যাবট রিচার্ড। অবিরল প্রার্থনাসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে এরা খ্রিস্টের জন্মস্থান ও তার বিচার এবং ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার স্থানগুলো পরিক্রমন করেন। ভান্সের মতো হাঙ্গেরীর এক সন্ন্যাসী জেরার্ড ও সাইরাকিউস-এর সিমিয়ণ (Simeon) কিছু পূর্বে জেরুসালেমে গিয়েছিলেন। এই সব তীর্থযাত্রীদের অভিজ্ঞতা পশ্চিম ইউরোপের বহু ধার্মিককেই খ্রিস্টানদের পবিত্রতম স্থানগুলোর জন্য উদ্বেলিত করে। তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া এই নতুন আবেগও তাদেরকে খ্রিস্টানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান জেরুজালেম জয়ের জন্য প্ররোচিত করতে থাকে, যা ক্রুসেডের উত্থানে অবদান রাখে।
পূর্ব ইউরোপীয়দের যুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
ক্রুসেডের অব্যবহিত পূর্বে পূর্ব ইউরােপের খ্রিস্টান অধিবাসীদের অবস্থা বিশেষ ঈর্ষাযোগ্য ছিল না। বাইজানসিয়াম ও পশ্চিম ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের কবলিত করার চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল, ফলে তাদের মধ্যে দ্বিমুখী একটা মনােভাবের সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিল পশ্চিম স্লাভ, চেক, ক্রোয়াট, স্লোভাক খ্রিস্টানরা। এরা তুর্কী আক্রমণ এবং পশ্চিমাগত অভিযানের পরও বাইজনসিয়াম-বল্কান অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে যে সমৃদ্ধ ও বলিষ্ঠ সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল তাকে পুষ্ট করার কাজে ক্ষান্তি দেয়নি। আর বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের প্রজারা পশ্চিমের অবাঞ্ছিত অভিযাত্রীদের সম্পর্কে কোনদিনই প্রসন্ন ছিল না। পুণ্যভূমি উদ্ধারের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। পূর্ব-রােমান চার্চের চোখে কোনও যুদ্ধই ধর্মযুদ্ধ বলে প্রতিভাত হয় নি। তাদের চোখে শাণিত অসিবল্লম নয়, বরং আধ্যাত্মিকতাই প্রকৃত খ্রিস্টানের সংগ্রামের অস্ত্র। যিশুর দেখানো করুণা ও ভালবাসাই সর্ববিধ অভাব-অভিযােগ দূর করার একমাত্র পথ বলে তারা মনে করতেন। এমনকি মূল-ধর্ম-প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুগত নয় এমন বহু ধর্মীয় সংস্থাও ছিল হিংসা ও রক্তপাতের বিরুদ্ধে।
তুর্কিদের দ্বারা খ্রিস্টানদের উপর সহিংসতা
এশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমির পরিবর্তনও এই সময় প্রথম ক্রুসেডের সংগঠন সহজতর করে দেয়। মুসলমান শাসকেরা সাধারণত খ্রিস্টধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন। ৯ম শতকে পেত্রিয়ার্ক থিওডােসিয়াস লিখেছিলেন, মুসলমান শাসকেরা ন্যায়পরায়ণ এবং আমাদের উপর কোনও অন্যায় বা অবিচার করেন না। কিন্তু দুর্ধর্ষ তুঘ্রিল বে (Tughril Bey) এর নেতৃত্বে অসহিষ্ণু ও নৃশংস সেলজুক তুর্কিদের আবির্ভাবে মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দের দিনের অবসান ঘটল। ১১শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তারা আব্বাসিদ বংশীয়দের হাত থেকে মুসলমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেয়। আরব শাসকদের ন্যায়পরায়ণতা এই অসভ্য তুর্কীদের কাছে আশা করা ছিল বৃথা। অল্পকালের মধ্যে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের ওপর তাদের অত্যাচারও দুঃসহ হয়ে উঠল। এর ফলে পোপ প্যালেস্টাইনে হস্তক্ষেপ করার একটি সুস্পষ্ট একটি অজুহাতও পেয়ে গেলেন। ঐ অঞ্চলের ঘটনাস্রোত ভিন্ন পথে বাঁক নেয়ায় এই অজুহাত পরম সুযােগে রূপান্তরিত হলো।
পোপ আরবানের ভাষণ
১০৭১ সালে মেঞ্জিকার্টের (Manzikert) যুদ্ধে বিধ্বস্ত, বৃহত্তর এবং আরও ভয়ানক তুর্কি আক্রমণের ভয়ে ভীত পূর্ব রােমের সম্রাট আলেক্সিয়াস কম্নিনাস (Alexius Comnenus) পিয়াসেন্জায় পােপ দ্বিতীয় আরবান কর্তৃক আহূত ধর্মসম্মেলনে পশ্চিমের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে জরুরী বার্তা পাঠালেন। সম্রাটের আসন্ন বিপদের মধ্যে পােপ আরবান তার সযত্ন-লালিত পরিকল্পনার রূপ দেয়ার সুযােগ পেলেন। পিয়াসেন্জাতে উপস্থিত ছিলেন বহু অভিজাত সামন্ত; বিশেষ করে দক্ষিণ ফ্রান্সের সমর-নায়কগণ যারা ক্লুনি এবং স্পেনের মঠগুলোর সঙ্গে যােগাযােগ রেখে চলতেন। নিকট প্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহে উত্তেজিত এই সব সমর-নায়কদের পরামর্শে ওভারেন (Auvergne) অন্তর্গত (ক্লেরমঁ) ক্লেরমন্টে ১০৯৫ সালে এক হেমন্তের দিনে বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রকাশ্য অধিবেশন আহূত হয়। সেই সমুদ্র-সদৃশ, বিক্ষুব্ধ ও উত্তাল জনসভায় পােপ দ্বিতীয় আরবান ইতিহাসের অতি-সফল এবং তাৎক্ষণিক ফলপ্রসূ একটি ভাষণ দান করেন।
আরবানের ভাষণে অভিপ্রেত, অনভিপ্রেত সব বিষয়েরই উল্লেখ ছিল। ফ্রাঙ্কদের শৌর্যবীর্যের প্রশংসা, পূর্বাঞ্চলের সহধর্মীদের অবিলম্বে সাহায্য করার প্রয়ােজনীয়তা, বিধর্মী তুর্কীদের ভয়ঙ্কর বিস্তার, খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের ওপর তাদের অবর্ণনীয় অত্যাচার এবং মুসলমানদের দ্বারা জেরুসালেম-এর পবিত্র স্থান কলুষিত করার অসংখ্য ঘটনা সবিস্তারে বণিত হয়েছিল পােপের বক্তৃতায়। শ্রোতাদের তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে অন্তবিরােধ এবং আত্মকলহে মগ্ন থাকার সময় সেটা নয়। তাদের তিনি এ আশ্বাসও দিলেন যে জেরুসালেম-উদ্ধারে অংশ নিলে সর্ব প্রকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা হবে। তাছাড়া খ্রিস্টান মাত্রই এ পুণ্য কাজে ব্রতী হােক এটা স্বয়ং ঈশ্বরের অভিপ্রায়। উপরন্তু শ্রোতাদের সামনে তিনি তুলে ধরলেন প্রাচ্যের প্রাচুর্যের ছবি – সেখানে মানুষ যা চায় তা সবই অফুরন্ত, সহজলভ্য, ইহলােকের সব চাওয়ার তৃপ্তি সেখানে, সেখানেই আছে পরলোকের শাস্তির সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি। তিনি সংসার, সমাজের সব বাধন ছিড়ে তিনি সকলকে খ্রিস্টের আত্মত্যাগ ও দুঃখ বরণের প্রতীক – ক্রস তুলে নিতে আহ্বান জানান, এতে স্বয়ং যিশু তাদের সাথে থাকবে বলে তিনি তাদের নির্ভয়ে এ ধর্মযুদ্ধের সৈনিক হতে উদ্দীপিত করেন। পােপের এই আবেগময় এবং সুচতুর ভাষণ অপরিসীম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে উত্তাল হয়ে ওঠে শ্রোতৃ জনতা, তারা সকলেই ধর্মযুদ্ধে যােগদানের জন্য প্রবল বেগে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
জনতার ক্রুসেড (১০৯৬ খ্রি.) অযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ও সমস্যা, পিপলস ক্রুসেডের পরাজয়
শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও যাজকদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে দ্বিতীয় আরবান উত্তেজিত, উন্মাদ গণসমুদ্রের জোয়ার সংযত করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু এ কাজ তার সাধ্যাতীত ছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রথম ক্রুসেডে যোদ্ধাদের চেয়ে অযোদ্ধাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। ক্লেরমন্টের পর অন্যান্য স্থানেও আরবান ক্রুসেডের জন্য বক্তৃতা দেন। সর্বত্রই একই দৃশ্য দেখা গেল, একই সমস্যা সামনে এলো। প্রচারের ফলে অপ্রয়োজনীয়, সহস্র সহস্র মানুষকে সঘবদ্ধ করা, সেনাবাহিনীতে সংগঠিত করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যারা প্রথমে এগিয়ে এসেছিলেন তারা বেশির ভাগই সমাজের নিচু স্তরের, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বিহীন ধর্মান্ধ মানুষ। উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র, সাংগঠনিক দক্ষতা, আরব্ধ কর্তব্য, লক্ষ্যস্থল, পথ অথবা বাস্তব সুবিধা সম্পর্কে তাদের কিছুই জানা ছিল না। বিশ্বাসকেই একমাত্র পাথেয় করে প্রথম অভিযানের সেনানীরা এগােতে চেয়েছিলেন। পিছিয়েও এসেছিলেন অনেকে।
ক্রমশ খ্যাতনাম সমরনায়কের সাড়া দিতে শুরু করলেন। তুলোর (Toulouse) (ফ্রান্সে) কাউট রেমন্ড, নরমান্ডির (বর্তমান ফ্রান্সে) ডিউক রবার্ট, লোরেনের (Lorraine, বর্তমান ফ্রান্সে অবস্থি) শাসক গডফ্রে, ফরাসী রাজ-ভ্রাতা হিউ দ্য গ্রেট, ফ্ল্যান্ডার্সের (ফ্লাঁদর বা Flanders, বর্তমান বেলজিয়ামে অবস্থিত) কাউন্ট রবার্ট, ব্লর (Blois, ফ্রান্স) এর ধনাঢ্য শাসক স্টিফেন, দক্ষিণ ইতালীর দুজন নর্মান রাজপুত্র – বোহেমন্ড এবং টানক্রেড (Bohemond and Tancred) – এরাও ক্রুশ তুলে নেন। দূর সমুদ্রের অজানা দ্বীপেও অহ্বান পৌঁছেছিল, সমুদ্র পার হয়েও বহু মানুষ এসেছিলেন অভূতপূর্ব এই অভিযানের অংশীদার হবার জন্য। অভিযাত্রীদের সংগঠন এবং যাত্রাপথের সমস্যা সমাধানের জন্য কালক্ষেপ করতে লাগলেন পোপ আরবান। অবশেষে ঠিক হয় ১০৯৬ সালের গ্রীষ্মের পরপরই পুণ্যভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে।
অভিযাত্রীরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে সন্ন্যাসী পিটার (Peter the Hermit) এবং ওয়াল্টার দ্য পেনিলেস (Walter the Pennifess) এর নেতৃত্বে জার্মানীর মধ্য দিয়ে, হাঙ্গেরী এবং বুলগেরিয়া পার হয়ে ১০৯৬ সালের জুনের শেষের দিকে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে। সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে অসংখ্য ক্ষুধার্ত, ধর্মোন্মত্ত এবং উদ্ধৃঙ্খল জনতার আবির্ভাবে সম্রাট আলেক্সিয়াস ভীত হয়ে ওঠেন। অভিযাত্রীগণ পথে বেলগ্রেড নগরের যে ক্ষতিসাধন করেছিল তার সংবাদ তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। অবাঞ্ছিত এই অতিথিদের খাদ্য সরবরাহ করা হলো এবং নিজ সামরিক বাহিনীর সাহায্যে তাদের বসফোরাস অতিক্রম করে ১লা আগষ্টের মধ্যেই এশিয়া মাইনরে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থাও সম্পন্ন হলো। ইতিমধ্যে মৃত্যু, ব্যাধি এবং স্বেচ্ছায় দলত্যাগ ক্রুসেডারদের সংখ্যা উল্লেখযােগ্যরূপে কমিয়ে দিয়েছিল। পিটার মূল সৈন্যবাহিনীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং সম্রাট আলেক্সিয়াসও যথােপযুক্ত সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু উন্মত্ত-অধীর খ্রিস্টান বাহিনী আর ধৈর্য ধরতে রাজি ছিল না। নাইকিয়ার (Nicaea, বর্তমান তুরস্কের উত্তর দিকে, ইস্তাম্বুল বা তদকালীন কনস্টান্টিনোপলের অদূরে) দিকে সেলজুক তুর্কীদের অধীনস্থ অঞ্চলের উদ্দেশ্যে তারা ধাবিত হয়। পথে ঐ অঞ্চলের খ্রিস্টান অধিবাসীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার এবং প্রচণ্ড লুণ্ঠনে মত্ত হওয়ায় সেখানকার খ্রিস্টানরা প্রথম থেকেই তাদের “উদ্ধারকারী” এই ক্রুসেডারদের সম্পর্কে অত্যন্ত বিরূপ হয়ে গিয়েছিল। তুর্কীরাও নিশ্চেষ্ট ছিল না। সুশৃঙ্খল, শক্তিশালী এক তুর্কীবাহিনী সাইভিটটের (Civetot) সমরাঙ্গনে এই ‘ক্রসবাহী যোদ্ধা’ নামধারী জনতাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। পুণ্যভূমিতে পোঁছবার আগেই প্রায় কুড়ি হাজার ধর্মোন্মাদ, লুণ্ঠন-লুব্ধ খ্রিস্টানের জীবনাবসান হলো। জনগণের ক্রুসেডের এই করুণ ইতিহাসের প্রায় একমাত্র সাক্ষী হয়ে জীবিত রইলেন পিটার দ্য হারমিট।
পরবর্তীতে সমরনায়কদের ক্রুসেড বা ১ম ক্রুসেড (১০৯৬-৯৯ খ্রি.)
এই অনুপযোগী অযোদ্ধা জনতার গণবাহিনীর পেছনেই আসছিল যথাযথ ভাবে সংগঠিত, অতি শক্তিশালী ক্রসবাহী যােদ্ধাবাহিনী। এই প্রথম ক্রুসেড ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এক সামরিক অভিযান। এজন্য কৃতিত্ব প্রায় সবটাই চার্চের। পােপের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি অ্যাডহিমার (Adhemar) এই বিশাল সৈন্যবাহিনীর উপর তার ব্যক্তিত্বের, সামরিক জ্ঞানের এবং সংগঠন প্রতিভার ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার একটি বিশেষ সুবিধাও ছিল। তা হল, প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ইউরােপের কোনও রাজা তার কর্তব্য-সাধনে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য এই বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ক্রুসেডাররা কনসটান্টিনােপলে পৌঁছে ত্রিমুখী আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়। যারা উত্তরপূর্ব দিক থেকে এসেছিল তারা গণবাহিনীর মতােই নিম্ন-লােরেনের শাসক (Low of Lorraine) গডফ্রের নেতৃত্বে স্থলপথ ধরে যাত্রা শুরু করে। এই গডফ্রে ছিলেন তার নিজের দেশের একজন ব্যর্থ শাসক। তিনি চতুর্থ হেনরীকে সমর্থন করেছিলেন বলে চার্চ থাকে কটাক্ষ করে। ল্যাতিন ইউরোপে তার আশা করার মত আর কিছুই ছিল না। তাই নিজের স্ত্রী ও পুত্রদের নিয়ে তিনি আর ইউরোপে ফিরে না আসার সংকল্প নিয়েই ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিলেন। হাঙ্গেরীর মধ্য দিয়ে যাত্রা করে ১০৯৬ সালের ডিসেম্বরের শেষে গডফ্রের বাহিনী বাইজানসিয়ামের সীমান্ত অতিক্রম করল।
ইতিমধ্যে ভাবমাঁদোয়ার (Vermandois, বর্তমান ফ্রান্সে) হিউ এর নেতৃত্বে এক ফরাসী যােদ্ধৃবাহিনী ইতালী পার হয়ে নরম্যানদের বন্দর বারী থেকে পূর্ব অভিমুখে জলপথে যাত্রা করেছিল (বারী (Bari) বর্তমান ইতালীর আপুলিয়া অঞ্চলে অবস্থিত, এটি বাইজান্টাইনদের দখলে ছিল, ১০৬৮-৭১ এর বারী অবরোধের মাধ্যমে নরম্যানরা বারী বন্দর দখল করে নেয়।)। প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঝড়ে তাদের প্রভুত ক্ষতি হলেও জীবিতরা গডফ্রের আগেই বাইজানসিয়ামে পৌঁছতে সক্ষম হয়। মন্দভাগ্য এই ফরাসী অভিযাত্রীগণ মধ্যযুগের ইউরােপের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ের সূচনা করে গিয়েছিলেন। সিসিলির নরম্যানরা এতােদিন পর্যন্ত তাদের পুরােণে শত্রু বাইজানটাইন সম্রাটের ত্রাণের ব্যাপারে উদাসীন ছিল, কিন্তু ফরাসী যােদ্ধাদের উপস্থিতি তাদেরও উদ্দীপিত করেছিল ক্রুশেডে অংশ নিতে। নরম্যানরা তদকালীন ফ্রান্সের নরমান্ডিতে বসবাসরত জাতি যাদের পূর্বপুরুষ ছিল স্কান্ডিনেভিয়া থেকে আসা ভাইকিং। ফরাসীদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নরমাঁদির ডিউক রবার্ট, ফ্লাঁদর ও ব্লয় এর কাউন্টগণ এবং কিছু ইংরেজ অভিযাত্রী ১০৯৭ এর এপ্রিল-মে মাসে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে যান। এই দুই বাহিনী ছাড়াও তুলুস্-এর কাউন্ট দ্বিতীয় রেমণ্ডের অধিনায়কত্বে তৃতীয় এক বাহিনী (এডহিমর যার সহযাত্রী হয়েছিলেন) অ্যাড্রিয়াটিক স্পর্শ করে স্থলপথে ড্যামেসিয়ান উপকূল ধরে অতি সঙ্কটাকীর্ণ পথে বাইজানসিয়াম পৌঁছয়।
অবিলম্বে তুর্কীদের আক্রমণ করা ছিল সম্রাট আলেক্সিয়াসের উদ্দেশ্য কেননা শত্রুকে শক্তি সঞ্চয় করতে দেওয়া হবে নিবুদ্ধিতা, আরও বেশি নির্বুদ্ধিতা হবে লুব্ধ-আগন্তুক ক্রুসেডারদেরকে বেশিদিন বাইজানসিয়ামের অতুল ঐশ্বর্যের কাছাকাছি থাকতে দেওয়া। তিনটি ভিন্ন পথ দিয়ে সমাগত সৈন্যবাহিনীকে বসফোরাস পার করিয়ে দিতে পারলেই তার অভিষ্ট সিদ্ধ হতো। ক্রুসেডারদের কাছে তিনি স্মরণীয় কোনও সামরিক বিজয় আশা করেননি। সীমান্তে তুর্কীদের হানা বন্ধ করে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য।
১০৯৯ সালে জেরুসালেমের পতন থেকে পরবর্তী দুশো বছরের ঘটনাবলীতে ক্রুসেডারদের সামরিক দক্ষতার, শৌর্যবীর্যের এবং আত্মত্যাগের অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশ্য কতকগুলি সুবিধাও তারা পেয়েছিলেন । নবজাত সেলজুক সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রিক সংহতি অর্জিত না হওয়ায় খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ তারা গড়ে তুলতে পারে নি। সিরিয়া নিয়ে আরব ও তুর্কীদের রেষারেষি অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেছিল এবং সন্নিহিত অঞ্চলের বহু ছোটখাট দলনেতা বিনা যুদ্ধেই খ্রীস্টান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেরী করে নি।
১০৯৭ সালে ক্রুসেডারগণ নিসিয়া বা নাইকিয়া অবরােধ করেন। নগরটির পতন যখন আসন্ন এবং খ্রীস্টান বাহিনী লুণ্ঠনের জন্য অধীর, তথনই জানা গেল নগর কর্তৃপক্ষ, লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সম্রাট আলেক্সিয়াসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। অপ্রসন্ন এবং সন্দিগ্ধ খ্রীস্টানদের অর্থ দ্বারা বশীভূত করার চেষ্টা করেন বাইজান্টাইন সম্রাট। নাইকিয়ার পতনের পর ক্রুসেডার বাহিনী স্থলপথে অ্যান্টিওকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও সম্রাট আলেক্সিয়াস পশ্চিম এশিয়া মাইনরে তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য পেছনে রয়ে যান। আক্রমণ অব্যর্থ করার জন্য ক্রুসেডারগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে এগোতে থাকেন। এই সুযােগে ৪ঠা জুলাই ডােরিলিয়াম-এর (Dorylaeum) কাছে মুসলমান সেনাবাহিনী ক্রুসেডারদের আক্রমণ করে, কিন্তু আক্রান্তরা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হবার আগেই দ্বিতীয় ক্রুসেডার বাহিনী উপস্থিত হয়ে শুধু সাহস ও পরাক্রমের সাহায্যে তুর্কীদের পরাজিত করে। অ্যান্টিওকের পথও উন্মুক্ত হয়ে যায় ক্রুসেডারদের সামনে। কিন্তু তারা এশিয়া মাইনের দক্ষিণ উপকূলে পৌঁছলে নতুন এক সমস্যা দেখা দেয়। এই অঞ্চল ছিল আর্মেনিয়ান এবং অন্যান্য খ্রীস্টান-সম্প্রদায়-অধ্যুষিত। তারা নির্দিষ্ট কোনও শক্তির শাসনাধীনে না থাকায় ক্রুসেডার সমরনায়কের বিভিন্ন জনপদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। ফলে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়, বাইজানটাইন সম্রাটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংঘর্ষ আসন্ন হয়ে ওঠে এবং লক্ষ্য ভুলে উপলক্ষ্য নিয়ে এই হানাহানির মধ্যেই যথার্থ ক্রুসেডারগণ জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য অধীর হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এডেসাতে (Edessa) আর্মেনীয়দের দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে সমরনায়ক গডফ্রের ভ্রাতা বল্ডুইনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কারো ভাগ্য-সুপ্রসন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এডেসার অবস্থিতি ছিল সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কেননা এখান থেকে পূর্বাঞ্চলের মধ্য দিয়ে মুসলমান শক্তির সাহায্য প্রেরণের সব পথই রুদ্ধ করে দেওয়া যেতো। ১০৯৮ সালে ক্রুসেডারগণ অ্যান্টিয়ােক পৌঁছান। প্রায় সমস্ত সিরিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করত এই নগরটি। কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে অ্যান্টিয়ােক অবরােধ করার মতো সৈন্য ও রসদ কিছুই ছিলনা ক্রুসেডারদের। শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের অতিব্যবহৃত, নিন্দনীয় সেই পন্থা গ্রহণ করলেন ক্রুসেডাররা। বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যে পতন ঘটানো হলে অ্যান্টিওকের।
বিজয়গর্বে আত্মহারা ক্রুসেডারগণ যুদ্ধক্ষেত্রের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি না করে অত্যাবশ্যকীয় রক্ষণব্যবস্থা গড়ে তােলেননি, ফলে খারবােগা (Kerbogha) নামক এক সেনানায়কের নেতৃত্বে তুর্কীরা অ্যান্টিওকে খ্রিস্টানদের অবরোধ করল। প্রচণ্ড খাদ্যাভাব এবং পিটার দ্য হারমিট, ব্লয়ের স্টিফেন প্রভৃতির কাপুরুষোচিত উপায়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা ও সম্রাট আলেক্সিয়াসের বিশ্বাসঘাতকতা ক্রুসেডারদেরকে সঙ্গীন করে তুলল। বিশেষ করে বাইজান্টাইন সম্রাটের এই আচরণের পরে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে ক্রুসেডারদের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে। অবরুদ্ধ সৈনিকদের সাহস ফিরিয়ে আনে জনৈক পিটার বার্থোলোমিও (Petar Bartholomew) কর্তৃক সপ্নাদিষ্ট ‘এক দিব্যাস্ত্র’ লাভের ঘটনা। হতাশা এবং অবসাদ জয় করে ক্রুসেডারগণ প্রবল বিক্রমে তুর্কীদের আক্রমণ ও বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হন। এর পর লক্ষ লক্ষ ধর্মাত্মার স্বপ্নে-দেখা পুণ্যভূমি জেরুসালেমের পথরোধ করে দাঁড়াবার মতো কোনও মুসলমান শক্তি ঐ অঞ্চলে ছিলনা। ১০৯৯ সালে ৭ই জুন নগ্ন পদে রণভেরীর নিনাদের মধ্যে ক্রুসেডারগণ জেরুজালেমের প্রাকাবের চারিদিকে প্রদক্ষিণ শুরু করে। খ্রীস্টানদের অতুলনীয় শৌর্য, অসামান্য দৃঢ়তার কাছে তীর্থভূমি জেরুসালেমের তুর্কী রক্ষীরা পরাস্ত হয়। ১৫ই জুলাই খ্রীষ্টের লীলাভূমি খ্রীস্টভক্তদের করায়ত্ত হয়। কিন্তু বীরত্ব, আত্ম ত্যাগ, অনমনীয় ইচ্ছাশক্তির সাফল্যের এই অসাধারণ ইতিহাস কলঙ্কিত হতেও দেরী হলো না। এখানেও পুনরানুষ্ঠিত হলো নৃশংসতার এক কলঙ্কিত অধ্যায়। নিরীহ, নিরপরাধের শোণিতে তীর্থশ্রেষ্ঠ জেরুসালেমের উষরভূমি সিক্ত হয়ে উঠল, বিধর্মী নারী, শিশু, বৃদ্ধের রক্তে স্নাত হয়ে খ্রীদের সৈনিকরা এক বিষন্ন সন্ধ্যায় ‘হােলি সিপলক্যর’-এ পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে কৃতজ্ঞতার অঞ্জলি দিতে গেলেন, আবেগাপ্লুত স্বরে ক্রুসেডারগণ তার আশীৰ্বাদ চাইলেন। ঘরে ঘরে ভালবাসার-বন্ধন-ডাের ছিন্ন করে, বিধ্বস্ত পল্লীর ভস্মস্তূপে বিজয় ধ্বজা তুলে তীর্থভূমি জেরুজালেমের আকাশে উপাসনার মন্ত্র ছড়িয়ে দিয়ে শেষ হলো বহুকালের বহু মানুষের সাধনার সিদ্ধি-প্রথম ক্রুসেড।
‘লাতিন রাজ্য’ হিসেবে জেরুজালেমের ইতিবৃত্ত
ক্রুসেডারগণ জেরুজালেম অধিকার করার পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হচ্ছে জেরুজালেমকে রোমের মতো চার্চের একটি সম্পত্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করা হবে নাকি একটি সাধারণ রাজারূপেই তাকে গড়ে তােলা হবে। প্যালেস্টাইনে উপস্থিত যাজকেরা প্রথম সম্ভাবনাটিকে সফল করতে চাইলেও খ্রীস্টানদের চূড়ান্ত জয়ের কিছু আগে পােপের প্রতিনিধির দেহাবসান তাদের সাফল্যের পথরােধ করে দাড়ায়। শেষ পর্যন্ত বহু প্রকাশ্য এবং গােপন আলােচনা, কূটনীতির জটিল খেলার পর সিদ্ধান্ত হলো লােরেনের গড়ফ্রে হবেন এই নবগঠিত রাজ্যের প্রধান। তার সরকারী উপাধি হবে ‘হোলিসিপলকার’ এর রক্ষক। কিন্তু পরের বছরেই তার মৃত্যু হওয়ায় নেতা নির্বাচনের সমস্যা আবার মাথা তুলে দাঁড়াল। জেরুজালেমে সদ্য-অভিষিক্ত পেটিয়ার্ক বেহিমন্ডকে (Bohemond) এই পদে বরণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইতিমধ্যে মুসলমানদের হাতে তিনি বন্দী হওয়ায় সদ্যোজাত জেরুজালেম রাজ্যে চার্চের প্রাধান্য স্থাপনের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যায়। ইতিমধ্যে গডফ্রে-গোষ্ঠী তার ভ্রাত৷ এডেসার বল্ডুইনকে সমর্থন করেন। কিন্তু ক্ষমতা পেয়েই বল্ডুইন রাজা উপাধি ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দাবী করেন আর পেট্রিয়ার্কও তা মেনে নিতে বাধ্য হন। জেরুজালেমরাজের কাছ থেকে নিখাদ সামন্ততান্ত্রিক শর্তাধীনে এডেসা ও ত্রিপােলীর কাউন্টি, অ্যান্টিওক প্রিন্সিপ্যালিটি এবং ছোটখাট যে সমস্ত ফিফে (fief) জেরুজালেম-রাজ্য বিভক্ত হয়েছিল – সেগুলির বন্দোবস্ত করা হয়। বলা বাহুল্য জেরুজালেম সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজ্য হওয়ায় সেখানে কোনও রাজকীয় ঐতিহ্য গড়ে ওঠে নি। রাজা ছিলেন ঊর্ধ্বতম সামন্তপ্রভু এবং রাজ্যের প্রকৃত শাসনভার ন্যস্ত ছিল সামন্ত প্রভুদের নিয়ে গঠিত পরিষদের (High Court) ওপর। রাজা মনােনয়নের ক্ষমতা এরই হাতে ছিল এবং এই পরিষদের অসম্মতিতে রাজার কোনও কিছু করার অধিকার ছিল না। বিষয়আশয় নিয়ে সমস্ত জটিলতার মীমাংসা হতো এখানে, ঊর্ধ্বতম আইনপরিষদ রূপে নবগঠিত রাজ্যটি নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার ছিল একমাত্র এই সংস্থার। ইউরােপে অন্যত্র যেমন এখানেও তেমনি, প্রত্যেক ব্যারণ স্বীয় ভূসম্পত্তির মধ্যে সর্বেসর্বা ছিলেন। রাজার প্রতি কর্তব্যপালন তাদের অবশ্যই করতে হতো, কিন্তু সে কর্তব্যের রীতিপ্রকৃতি নির্ধারিত করে দিত ‘পরিষদ’। সুতরাং জেরুজালেম রাজ্যে রাজকর্তৃত্বের বাস্তব-ভিত্তি রচিত হতে পারে নি; পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম যুগে যে সমস্ত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তারই পুনরাবির্ভাব ঘটেছিল পূণ্যভূমিতে। তাছাড়া প্রধান অঙ্গ-রাজ্যগুলির-সিরিয়া, অ্যান্টিওক, ত্রিপােলি এবং এডেসার সঙ্গে জেরুজালেমের সম্পর্ক সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। এই অঞ্চলের শাসকেরা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং বিনতি স্বীকার করলেও, নাবালক শাসকের অভিভাবককের অধিকার প্রয়ােগ করা ছাড়া জেরুজালেমরাজ এদের আভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না।
জেরুজালেম রাজ্যে প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো বিধিবদ্ধ করা হয় ১৩শ শতকের প্রথম দিকে (Assizes of Jerusalem)। অবশ্য এই সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা ছাড়া কুসেডারগণ সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনের নৈতিক এবং বিচারবিভাগীয় প্রথাপদ্ধতির বিশেষ কোনও পরিবর্তন করেন নি। স্থানীয় কর্মচারীদের হাতেই ছিল নগরগুলির পরিচালনার দায়িত্ব, কেবল চার্চ এবং ইতালীয় বণিকদের স্বার্থ-সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা হয়েছিল। সমস্ত জেরুজালেম রাজ্য লাতিন চার্চের কর্তৃত্বাধীনে আনার সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিওক এবং জেরুজালেমে দুজন পেট্রিয়ার্ক নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং এই সঙ্গেই আটটি আর্চবিশপরিক, ষোলােটি বিশপরিক এবং বেশ কয়েকটি মঠস্থাপনের উদ্যোগও করা হয়।
নবগঠিত অতি শীর্ণাকৃতি, পাহাড় এবং উষরভূমির এই রাজ্যটির অস্তিত্ব নির্ভর করতো মেসােপােটেমিয়া এবং মিশরের সঙ্গে জেরুজালেমের পেছনের দিকের ছােটখাট মুসলমান রাজ্যগুলির সম্ভাব্য সম্মিলিত-আক্রমণ প্রতিরােধ ক্ষমতার ওপর। খ্রীস্টানদের অবস্থাও বিশেষ ঈর্ষাযােগ্য ছিল না, কারণ জেরুজালেম বিজিত হবার পরে অধিকাংশ ক্রুসেডার স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন। শত্ৰুবেষ্টিত-জেরুজালেম-রাজ স্বাভাবিক কারণেই সামন্তবর্গের ওপর নির্ভর না করে একটি স্থায়ী সৈন্যবাহিনী গঠনে মনােনিবেশ করেছিলেন, তবে তার সামরিক শক্তির প্রধান স্তম্ভ ছিল রাজ্যের দুর্ভেদ্য দুর্গগুলি এবং টেম্পলার, হসপিটালার প্রভৃতি নবজাত সামরিক সংস্থাগুলি, যাদের সৃষ্টির পেছনে ছিল শিভ্যলরী এবং মঠজীবনবাদের আদর্শ।
সেলজুক তুর্কীগণ পূণ্যভূমি দখলের আগেই অ্যামল্ফির বণিকগণ তীর্থযাত্রীদের পরিচর্যা ও সেবা শুশ্রুষার জন্য জেরুজালেমে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান – Hospital প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রুসেডারগণ জেরুজালেম অধিকার করার পর ‘Templar’ সংগঠনের আদর্শে এই সেবা-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সেবকদের উপর পূণ্যভূমির তীর্থস্থানগুলি রক্ষার দায়িত্বও অর্পি হয়। এরা পরিচিত হন ‘নাইটস অফ দ্য হসপিটাল অফ সেন্ট জন অফ জেরুসালেম’, সংক্ষেপে ‘হসপিটালারস’ রূপে। এদের উর্দি ছিল শ্বেত ক্রস শােভিত কাল পােষাক। হসপিটালার, টেম্পলার এবং টিউটনিক – এই তিনটি সংগঠনের সদস্যদের মঠবাসী সন্ন্যাসীদের মতোই শপথ গ্রহণ করতে হতো, ধর্ম-রক্ষার জন্য যুদ্ধকে তারা ব্রত হিসেবেই গ্রহণ করতেন। সাধারণত তিন শ্রেণীর সদস্য থাকতেন এই সামরিক সংগঠনগুলিতে – নাইটস্ (যােদ্ধা), চ্যাপলেন এবং ‘সার্ভিং ব্রাদার্স’। কেবলমাত্র অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্তগণই নাইট পদবাচ্য হতে পারতেন। চ্যাপলেন ও সার্ভিঙ ব্রাদার্সদের নেওয়া হতো অনভিজাত কিন্তু স্বাধীন-শ্রেণীভুক্তদের মধ্য থেকে। এরা নাইটদের স্কোয়্যার (Squire) হিসেবে অথবা সেবা প্রতিষ্ঠানে পরিচালক রূপে কাজ করতেন। হসপিটালার, টেম্পলার এবং টিউটনিক নাইটদের সংগঠন শুধুমাত্র জেরুজালেমেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পশ্চিম ইউরােপের বন্দরগুলিকে প্রবেশনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও সমগ্র খ্রীস্টান জগতে এই সংস্থাগুলির সদস্যগণ সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ক্রমশ ধনী, ধর্মভীরু মানুষের অকৃপণ দানে এই নাইটগণ অনাস্বাদিত সমৃদ্ধির স্বাদ পেতে আরম্ভ করেন। বিশাল ভূসম্পত্তি লাভ, বাণিজ্য-লক্ষীর আশীর্বাদ অর্জনও বাকি থাকে না।
সামগ্রিকভাবে প্রথম ক্রুসেডের সাফল্য এবং জেরুজালেম রাজ্যের অস্তিত্ব অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল ইতালীর নগরগুলির নৌবহরের তৎপরতা এবং সহায়তার ওপর। ক্রুসেডারদের খাদ্যরসদ সরবরাহে যেমন তারা অপরিহার্য ছিল তেমনি মুসলমান নৌবাহিনীকে অকর্মণ্য করে রাখায় তাদের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযােগ্য। ইতালীর ইতালীয় নৌশক্তির এই অর্ণবপােতগুলি এই সদ্যোজাত, সমস্যাপীড়িত, অনুর্বর রাজ্যটিতে অবিশ্রান্তভাবে ইউরােপ থেকে খাদ্য, রসদ এবং তীর্থযাত্রী পৌঁছে না দিলে প্রথম বল্ডুইনের পক্ষে উপকূলবর্তী মুসলমান জনপদগুলি দখল করা সম্ভব হতাে না, জেরুসালেম রাজ্যের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। জেনােয়ার নৌবাহিনীর সাহায্যে বিজিত হয়েছিল সিজারিয়া (Caesarea, ১১০১) একর (Acre) (১১০৪) এবং ত্রিপােলি (১১০৯)। ভেনিসও নিশ্চেষ্ট ছিল না। ভেনিসের উদ্যোগই বৈরুত (Beyrouth), সিডন (Sidon) এবং টায়ার (Tyre) জয়ের মূল উৎস্য ছিল। আর পিসা দখল করেছিল লাওডিসিয়া। এই সাহায্যের বিনিময়ে ইতালীর নগরগুলি লুষ্ঠিত দ্রব্যের এক-তৃতীয়াংশ ছাড়াও প্রত্যেক বিজিত স্থানে তাদের বাণিজ্যঘাঁটি স্থাপনের অধিকার অর্জন করেছিল।
১১৮৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত জেরুসালেম রাজ্য খ্রীস্টানদের হাতে ছিল এবং এর অস্তিত্বের কারণ তাদের দক্ষতা নয়, বরং মুসলমান শক্তির অনৈক্য। অবশ্যই জেরুসালেম রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ইতিহাসও গ্রীক এবং মুসলমান শক্তিগুলির সঙ্গে ষড়যন্ত্র, আত্মঘাতী সংঘর্ষ, ইতালীর বিভিন্ন নগরগুলির সঙ্গে সামরিক বাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সংকীর্ণতা ও অর্থলিপ্সার কাহিনীতে ভরপুর। জেরুজালেম রাজ্যের ভৌগােলিক অবস্থানই ছিল এর সবচেয়ে বড় শত্রু। উত্তরে এডেসা থেকে প্যালেস্টাইনের দক্ষিণতম প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো মাইল দীর্ঘ হলেও অতি সঙ্কীর্ণ, কোথাও কোথাও মাত্র ৫০ মাইল ছিল এর প্রস্থ। সমুদ্র এবং মরুপ্রান্তরের মধ্যবর্তী মুসলমান অধ্যুষিত জনপদগুলিও অধিকার করতে সক্ষম হয়নি খ্রীস্টানরা। মাঝে মাঝেই রয়ে গিয়েছিল মুসলমান অধিকৃত দুর্গগুলি এবং উত্তর ও দক্ষিণের মুসলমান শক্তিগুলির মধ্যে যােগাযােগ কোনও দিনই বিচ্ছিন্ন হয়নি। সুতরাং দ্রুতগামী অশ্বারােহী বাহিনীর পক্ষে একদিনেই খ্রীস্টানদের যে কোনও ঘাঁটি আক্ৰমণ সহজ ছিল মুসলমানদের পক্ষে। কিন্তু বিপজ্জনক, প্রায় শত্ৰুবেষ্টিত অবস্থিতি, এবং নিজেদের ক্রমবর্ধমান অনৈক্য সত্ত্বেও এ রাজ্যের কর্তৃপক্ষ পূর্ব সীমান্তে হানা দেওয়া বন্ধ করে নি এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত মুসলমান শক্তিগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ১১৪৪ সালে মসুল-শাসকের সেনাধ্যক্ষ ইদাদ উদ্দীন জাঙ্গি (Zangi) এডেস প্রদেশ খ্রীস্টান-হস্তচ্যুত করতে সক্ষম হন। মুসলমান শক্তির এই নতুন উদ্যোগ আবার খ্রিস্টানদের মধ্যে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করে এবং এরই ফলে সংগঠিত হয় দ্বিতীয় ক্রুসেড। কিন্তু মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস ও শক্তি সঞ্চয় অব্যাহত থাকায় একে একে খ্রীস্টান জনপদগুলি আবার তাদের হাতে চলে যেতে শুরু করে। ১১৫৪ সালে দামাস্কাস মুসলমান বাহিনী কর্তৃক বিজিত হয়। তিরিশ বছর পরে ‘প্রাচ্যের রাজার রাজা’ (King of all Oriental Kings) সালাদীন বা সালাউদ্দিন সমস্ত সিরিয়া এবং মেসােপােটেমিয়া খ্রীস্টান প্রভাব মুক্ত করেন। ১১৪৮ সালে জেরুজালেম রাজ্যের পতন ছিল অতি স্বাভাবিক এবং প্রায় অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। শতাব্দী শেষ হবার আগে টায়ার, ত্রিপােলি এবং অ্যান্টিয়ােক এবং কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ঘাঁটি ও উপনিবেশ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে খ্রীস্টান শক্তি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
দ্বিতীয় ক্রুসেড (১১৪৭-৫০ খ্রি.)
১১৪৪ সালে এডেসার পতনের সংবাদ পৌঁছল সন্ত্রস্ত, কিছুটা স্তিমিত ইউরোপীয়দের কাছে। ইতিমধ্যে ক্লেয়ারভােক্সের সেন্ট বানার্ড চার্চে নতুন প্রাণ-প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। তার কর্মসূচী বর্ধিতকায় হলো জারুজালেম রাজ্যের এই ভীষণ বিপদের সম্ভাবনায়। পােপের অনুরোধে অক্লান্ত কর্মী বার্নার্ড নিজেকে নিয়োজিত করলেন নতুন ক্রুসেডার দল সংগঠনে। প্রথম ক্রুসেডে অর্জিত জয়কে স্থায়ী ও সুনিশ্চিত করার জন্য দ্বিতীয় ক্রুসেড পাঠাবার কাজে তৎপর হলো খ্রিস্টান জগৎ। ১১শ শতকের শেষ দশকের অবিস্মরণীয় উদ্দীপনা এবং সর্বপ্লাবী উন্মাদনা এবার ছিল স্মৃতিমাত্র, কিন্তু যে সাড়া পাওয়া গিয়েছিল তাও উল্লেখযোগ্য ছিল। বিশেষ করে স্মরণীয় ছিল সম্রাট তৃতীয় কনরাড এবং ফরাসীরাজ সপ্তম লুই-এর সক্রিয় অংশগ্রহণ। আলাদাভাবে দুই বাহিনী জার্মান এবং ফরাসীরা ১১৪৭ সালে স্বতন্ত্র পথে যাত্রা করে। কিন্তু এশিয়া মাইনরে দুর্গম পথ অতিক্রম করার সময় বিক্ষিপ্ত কিন্তু অতর্কিত মুসলমান আক্রমণে কনরাডের বাহিনী প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়; ফরাসীদের ভাগ্যেও জোটে অমর্যাদাকর পরাজয়। হতাবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে কনরাড এবং লুই জেরুসালেম পৌঁছে দামাস্কস অধিকার করতে পারলে মুসলমানদের মধ্যে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে এই চিন্তায় তারা সম্মিলিত আক্রমণে নগরটি দখল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু দামাস্কাস অবরােধ ব্যর্থ হলো। পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে বিরক্ত, মােহমুক্ত কনরাড এবং লুই স্বদেশে ফিরে এলেন। এই ঘটনা কুসেড সম্পর্কে ইউরোপীয়দের এক প্রজন্মব্যাপী ঔদাসীন্যের সূচনা করে।
দ্বিতীয় ক্রুসেডের ব্যর্থতা মুসলমান শক্তির সঙ্ঘবদ্ধতাই প্রমাণিত করে। মসুলের ইমাদ উদ্দীন জেঙ্গির পুত্র নুরেদ্দিন বা নুর উদ্দিন (Nureddin) দামাস্কাস দখল করেছিলেন, সালাউদ্দিনের বিজয় যাত্রাও অব্যাহত ছিল। মিশর জয় করে তিনি উত্তরে তার আধিপত্য প্রসারিত করে দিয়েছিলেন, ফলে খ্রীস্টান-শাসিত অঞ্চল মুসলমান শক্তি দ্বারা পরিবৃত হয়ে পড়েছিল। প্রতিরােধ করার যেটুকু শক্তি তাদের অবশিষ্ট ছিল তাও তারা নষ্ট করেছিলেন অন্তদ্বন্দ্বে এবং পরস্পর বিরােধী নীতি অনুসরণ করে। তা ছাড়া দীর্ঘকাল প্রাচ্যে বসবাস করায় খ্রীস্টানদের মুসলমান বিদ্বেষও অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল। মুসলমান শক্তির বিরদ্ধে ত্রিপােলির কাউন্ট রেমন্ড চূড়ান্ত অপদার্থতার নিদর্শন রেখেছিলেন। সালাউদ্দিন সম্পর্কে তার তােষণনীতি তাকে অন্যান্য সমরনেতার চোখে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল এবং ত্রিপােলিতে সৃষ্টি হয়েছিল অস্বস্তিকর এক রাজনৈতিক অস্থিরতা। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যচ্যুত খ্রীস্টান বাহিনী হাট্টিনে (Hattin) মুসলমান সৈন্যদের আক্রমণ করে পরাজিত হয়। খ্রীস্টান নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই বন্দী হন, খ্রীস্টান সামরিক ঘাঁটিগুলির একের পর এক আত্মসমর্পণের পালা শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত ১১৪৭ সালের ৩রা অক্টোবরে সালাদীন বা সালাউদ্দিনের হাতে প্রতিরােধ ক্ষমতাহীন জেরুজালেমেরও পতন ঘটে। পুণ্যভূমিতে ৮৮ বছর স্থায়ী খ্রীস্টান-অধিকারের চিহ্নটুকুও মুছে যায়।
সালাদীন বা সালাউদ্দিনের পুর্ণ নাম হল আল মালিক আল নাসির সালাদীন ইউসুফ ইবন আইয়ুব (জন্ম ১১৩৮ খ্রি.)। ক্রুসেডের কাহিনীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যরূপে জড়িত এই মুসলমান সারনেতার পিতা আইয়ুব ছিলেন দাস্কাসের শাসক নূরউদ্দীনের অধীনস্থ অন্যতম প্রদেশপাল। তরুণ বয়সেই চারিত্র মাধুর্যে, রাজনৈতিক জ্ঞানে এবং সমরকুশলতায় সুখ্যাত হয়ে ওঠেন সালাদীন। সর্বপ্রকার আসক্তি-হীনতা এবং অতি সহজ-সরল জীবনযাত্রার জন্যও এই পানধামিক সরনেতা সমসাময়িকদের কাছে পর বিস্ময় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। ১১৭৭ সালে মিশরের উপর ফ্রাঙ্ক বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি যে সামরিক সাফল্য অর্জন করেন তাই তাকে পরবতীকালে (১১৭৫) কুসেডারদের হাত থেকে সিরিয়া রক্ষায় অনুপ্রাণিত করে। জয় গৌরবে স্নাত সালাদীন এর পর মিশর শাসক রূপে সিংহাসনে আরোহন করেন। এভাবেই পত্তন হয় ‘আইযুবিদ’ বংশের। ছয় বছর পরে তার সংগঠিত সমরাভিযান সমগ্র মেসোপোটেমিয়ায় আইয়ুবিদ বংশের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। তার রাজ্যের নতুন রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হয় দামাস্কাস। পণ্ডিত শিক্ষানুরাগী এবং সুশাসক রূপে সালাদীনের খ্যাতি ছিল দূর-বিস্তৃত। বৈরী খ্রীস্টান জগতেও তার অনুরাগী ও গুণগ্রাহীর সংখ্যা কম ছিল না।
যাই হোক, জেরুজালেমের এই অসহায় আত্মসমর্পণে সমস্ত খ্রীস্টান জগৎ শিহরিত হয়ে উঠেছিল। হতাশা এবং গ্লানি আচ্ছন্ন করেছিল সর্ব দেশের খ্রীস্টভক্তদের। ধর্মগুরু পােপ ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন রাজ্যে রাজ্যে বিরােধ মিটিয়ে ফেলতে, এবং সফলও হয়েছিলেন বহুল পরিমাণে। ইংলণ্ডের দ্বিতীয় হেনরী এবং তার পুত্র রিচার্ড, ফরাসীরাজ ফিলিপ অগাষ্টাস এবং জার্মান শাসক সম্রাট ফ্রেডারিক বার্বারােসা পরম শ্রদ্ধায় ক্রস তুলে নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না যে সালাউদ্দিনের মতো কুশলী এবং দুর্ধর্ষ সমর-নায়কের সম্মুখীন হতে গেলে প্রচণ্ড, ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী এক সমরােদ্যোগ প্রয়ােজন। সে কারণে ইংলণ্ডে অর্থ সংগ্রহের জন্য ‘সালাদীন-কর’ প্রবর্তন করা হয়েছিল। ১২শ শতকের শেষের দিকে উদ্যোগ ও আয়োজন-সমৃদ্ধ তৃতীয় ক্রুসেডের যথােপযুক্ত পটভূমি রচিত হয়।
তৃতীয় ক্রুসেড (১১৮৯-৯২ খ্রি.)
তৃতীয় ক্রুসেডের প্রস্তুতি ছিল নিচ্ছিদ্র, পরিকল্পনা নিখুঁত এবং আর্থিক সংগতি ঈর্ষনীয়। অদ্বিতীয় সামরিক নেতা সিংহ-হৃদয় রিচার্ড বা রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট, অসাধারণ কূটনীতিজ্ঞ ফরাসী-রাজ ফিলিপ অগাস্টাস, দক্ষ রাজনীতিজ্ঞ এবং সমবুকুশল সম্রাট প্রথম ফ্রেডারিকের অংশগ্রহণে এই ক্রুসেড স্মরণীয়। কিন্তু ভাগ্য ছিল বিরূপ। পােপকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ফরাসীরাজ এবং ইংলণ্ডেশ্বর পরস্পরের সঙ্গে বিরােধে মত্ত হলেন; সম্রাট ফ্রেডারিক বার্বারেসা পুণ্যভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন, কিন্তু এশিয়া মাইনর পৌঁছে অপঘাতে মৃত্যু হলো তার। সম্রাটের শােকাবহ মৃত্যু তার অনুচরদের হৃদয়ে ধর্মযুদ্ধের উত্তাপ নির্বাপিত করে দিয়েছিল। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় হেনরীর মৃত্যু হওয়ায় রিচার্ড এবং ফিলিপ অগাস্টাস সমুদ্রপথে পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করেন। পথে যুদ্ধপ্রিয় রিচার্ড অনাবশ্যক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে শক্তিক্ষয় করতে লাগলেন, আর ফরাসীরাজ ছিলেন ক্রুসেডের আদর্শে আস্থাহীন। উভয়ের মতানৈক্য প্রকট হয়ে উঠল সিসিলিতে পৌঁছে। বিরক্ত ফিলিপ একাই জেরুজালেম অভিমুখে যাত্রা করলেন আর রিচার্ড বাইজানটাইন সম্রাটের এক আত্মীয়-শাসিত সাইপ্রাস দ্বীপটি দখল করে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের সম্পর্ক তিক্ততর করে তুললেন। এপর রিচার্ড মনোনিবেশ করেছিলেন একর (Acre) অবরােধে। প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরটি অধিকারের উপর খ্রিস্টানদের অন্যান্য হৃত-রাজ্য পুনরুদ্ধার নির্ভরশীল ছিল। অবশ্য সালাউদ্দিন নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। কিন্তু খ্রীস্টানরা যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী হওয়ায় তিনি একরকে অবরোধমুক্ত করতে পারলেন না। খ্রীস্টান শিবিরে পারস্পরিক বিদ্বেষ সত্ত্বেও দীর্ঘ একুশ মাস পরে ১২ই জুলাই, ১১৯১ সালে ক্রুসেডারদের কঠিন প্রতিজ্ঞার কাছে পরাজিত হলো একর। সৃজন-ধর্মী সাহিত্যে তৃতীয় ক্রুসেড উল্লিখিত হয়েছে বহুভাবে, আর রিচার্ড অভিনন্দিত হয়েছেন ১২শ শতকের সর্বােত্তম নাইট রূপে। কিন্তু শৌর্যবীর্যের প্রতীক হলেও প্রায় ২৭০০ একরবাদীকে ‘বন্দীমুক্তিপণ দেওয়া হয়নি’ – এই অজুহাতে হত্যা করতে দ্বিধা হয়নি রিচার্ডের। ইংরেজ সমর-নায়কের এই নৃশংসতা, সালাউদ্দিন কর্তৃক ১১৮৭ সালে জেরুসালেম দখলের পর খ্রীস্টান বন্দীদের মুক্তিদানের পরিপ্রেক্ষিতে, আরও অক্ষমার্হ বলে মনে হয়। আর রিচার্ডের একর বিজয়ও বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। এরপর হতোদ্যম ফিলিপ অগাস্টাস স্বদেশে ফিরে যান, রিচার্ড ছােটবড় কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করলেও জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে প্রবৃত্ত হননি। রিচার্ড নিজে জয়ের মালা পড়লেও তৃতীয় ক্রুসেড অসফল অভিযানই রয়ে গেল। ১১৯২ সালে তার সঙ্গে সালাউদ্দিনের যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয় তার শর্তানুযায়ী খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা জেরুজালেমে অবাধে ধর্মচর্চা করতে পারবেন এবং খ্রীস্টানদের হৃতাবশিষ্ট রাজ্য ‘মুক্ত’ থাকবে বলে স্থিরীকৃত হয়।
যুদ্ধান্তে স্থলপথে স্বদেশে ফেরার সময় রিচার্ড তার পুরােনো শত্রু অস্ট্রিয়ার ডিউক কর্তৃক বন্দী হন। পরে তার অপর এক ব্যক্তিগত শত্রু সম্রাট ষষ্ঠ হেনরীর হাতে তাকে সমর্পণ করা হয়। নিজ রাজ্যের বার্ষিক আয়ের প্রায় তিনগুণ অর্থ মুক্তিপণ হিসেবে দিতে রাজী হওয়ায় ষষ্ঠ হেনরী তাকে ছেড়ে দেন। এই ঘটনা স্পষ্টতর করে তুলেছিল এই তথ্য যে ক্রুসেডের আদর্শ ইউরােপে আর সম্মানিত হচ্ছে না, মহামহিম পােপও ব্যর্থ হয়েছেন তার প্রভাব প্রতিপত্তিকে কার্যকরী করে তুলতে। ক্রুসেডে অংশ নিলে সর্বপ্রকার দায়-দায়িত্ব পালন থেকে এবং সর্বাবস্থায় পােপ তাকে রক্ষা করেন বলে অলিখিত যে বিধান গড়ে উঠেছিল রিচার্ডের বিড়ম্বনা প্রমাণ করল যে তা অক্লেশে অগ্রাহ্য করা যায়। জাতিতে জাতিতে দীর্ঘকালের যে শত্রুতা চলে আসছিল তৃতীয় ক্রুসেড তাও বন্ধ করতে পারে নি, আর ক্রুসেড উপলক্ষ্য করে পােপ যে বিভিন্ন রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ঘটনা-প্রবাহে হস্তক্ষেপ করতেন এবং খ্রীস্টান রাজ্যগুলির সংঘর্ষের সুযােগে স্বীয় প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করতেন তাও ব্যাহত হয়েছিল। ঐক্যবদ্ধ, অভীষ্ট-সাধনে দৃঢ় সঙ্কল্প খ্রিস্টান জগতের ওপর পোপের অনাক্রমনীয় যে প্রতিষ্ঠা অর্জিত হয়েছিল ১২শ শতকের শেষে তার আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা।
চতুর্থ ক্রুসেড (১২০২-০৪ খ্রি.)
তৃতীয় শেডের ব্যর্থতা প্রাচ্য অভিযানে ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে নিরুৎসাহ করলেও চার্চ এই পরাজয়কে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে পারেনি। ১২শ শতকে শেষে প্রাচ্যের অবস্থারও বিশেষ হেরফের ঘটেনি। ১১৯৭ সালে সালাউদ্দিনের মৃত্যুর পর মিশর এবং সিরিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেন তার ভাই। উপকূলের সঙ্কীর্ণ একটি অংশে খ্রিস্টানদের আধিপত্যও অক্ষুন্ন থাকে। এই সময়েই পশ্চিম ইউরােপে অ্যাঞ্জেভিন ফিফগুলির ভাগ্য নিরূপণ করার জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সুদীর্ঘকালের বিরোধ প্রকাশ যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। আর সম্রাট ষষ্ঠ হেনরী জার্মান ভূখণ্ড, ইতালী, আরলেস এবং সিসিলিতে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হলেও তার মৃত্যুর পর গুয়েল্ফ ও হােয়েনস্টফেন বংশের শত্রুতা তীব্র হয়ে ওঠে। ইউরােপের প্রধান দুটি রাজবংশ আপন প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার এই উন্মত্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মত্ত হয়ে ওঠায় এবং তাদের প্রতিপত্তিশালী প্রজারা স্থানীয় রাজনীতিতে নিমগ্ন হওয়ায় পুণ্যভূমি উদ্ধারের আকুলতা শাসকগােষ্ঠীর কাউকে আর আবেগ-মথিত করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে আবির্ভাব হয় অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী পােপ তৃতীয় ইনােসেন্টের। জেরুজালেম উদ্ধারকে তৃতীয় ইনােসেন্ট সমস্ত লাতিন খ্রীস্টান জগতের উপর আপন প্রভূত্ব বিস্তারের একটি সোপান হিসেবেই ভাবতেন এবং ইউরােপের প্রথম সারির নৃপতিবৃন্দ পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত থাকায় তিনি ক্রুসেড আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে পােপের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার সুযোগ পেয়ে গেলেন। ১২০১ সালে তারই প্রচেষ্টায় ফ্লাঁদর (ফ্লান্ডার্স) এবং শ্যাম্পেনের কয়েকজন পরাক্রান্ত ফরাসী সামন্তপ্রভু এবং ইতালীয় মার্কুইস ক্রুসেড সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজী হলেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য জিওফ্রে দ্য ভিলেহারডুইন চতুর্থ ক্রুসেড সম্পর্কে একটি চিত্তাকর্ষক বিবরণ রেখে গেছেন। পূর্ববর্তী অভিযাত্রীদের স্থলপথে যাত্রার তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন থাকায় সংগঠকগণ এবার সমুদ্রপথে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরিবহনের জন্য তারা ইতালীর নগরগুলির শরণাপন্ন হলে কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে ভেনিস এই দায়িত্ব পালনে রাজী হলাে। প্রতি অশ্বারােহীর জন্য ৪ মার্ক এবং পদাতিকের জন্য ২ মার্কের বিনিময়ে ভেনিসীয়গণ সামুদ্রিক পোত এবং রসদ সরবরাহে রাজী হন। কিন্তু সৈন্য সংখ্যা এবং আর্থিক সামর্থ্য সম্পর্কে কোনও পক্ষের সঠিক তথ্য জানা না থাকায় কার্যক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয় এবং শর্তগুলির পুনরালোচনা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ভেনিসীয়গণ প্রথম থেকেই অভিযানটির ভাগ্য বিপর্যয় নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারে উদগ্রীব ছিলেন। অড্রিয়াটিক তীরে জারা (Zaira) বন্দরটি অধিকার করতে তাদের সাহায্য করলে ভেনিসীয়রা ক্রুসেডারদের ঋণ মকুব করতে রাজী হলেন। প্রসিদ্ধ এই বন্দরটি কিন্তু মুসলমান-অধিকৃত ছিল না। চতুর্থ ক্রুসেড শুরুর কিছু আগে হাঙ্গেরীর রাজা এই নগরটি অধিকার করেছিলেন। ভেনিসের এই প্রস্তাবে রাজী হওয়া ছাড়া অভিযাত্রীদের গত্যন্তর ছিল না যদিও পুণ্যভূমি উদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর সেনাবাহিনীর কাছে এই তথ্য গোপন রাখা হলো। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অভিযাত্রীগণ জারা পৌঁছলেন। কিন্তু নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীর কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলে তাদের অধিকাংশই জারা অবরোধে অংশ নিতে অস্বীকার করল। অভিযানের লক্ষ্য পরিবর্তনে তৃতীয় ইনােসেন্ট ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুসেডারদের অপর একটি খ্রিস্টান রাজ্য আক্রমণ করতে নিষেধ করলেন। পোপের দণ্ড মাথায় নিয়ে পোপেরই আশীর্বাদধন্য ক্রুসেডারগণ ১২০২ সালে পাঁচদিন অবরােধের পর জারা অধিকার করল।
ভিল্লেহারডুইন লিখেছেন ভেনিসীয় কর্তৃপক্ষ এবং ক্রুসেডের নেতাদের ষড়যন্ত্র এখানেই শেষ হলো না। অগণিত সৈন্যদের কাছে এই তথ্য গোপন রাখা হলো যে মিশর বা পুণ্যভূমি জেরুজালেম নয়, বাইজানসিয়ামই হবে তাদের অভিযানের লক্ষ্য। অবশ্য মুখরক্ষার জন্য তাদের বলা হলো যে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হলে জেরুজালেম উদ্ধার সহজতর হবে। মন্টফেরাটের মার্কুইসের প্রস্তাব অনুসারে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের গৃহবিবাদের সুযোগ গ্রহণ করা হলো। প্রিন্স অ্যালেক্সিইয়স তার সিংহনচ্যুত পিতাকে সিংহাসন ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করার বিনিময়ে ক্রুসেডার নেতাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন। চুক্তির শর্তানুসারে হৃত-সাম্রাজ্য উদ্ধারে সফল হলে তিনি গ্রীক চার্টের উপর পােপের কর্তৃত্ব স্থাপনে সম্মতি জানালেন এবং মিশর জয়ের জন্য অভিযাত্রীদের অর্থ, রসদ ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতেও স্বীকৃত হলেন। তাছাড়াও তিনি যাবজ্জীবন প্যালেস্টাইনে পাঁচশত নাইট মোতায়েন রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোয় বিচার করলে এই শর্তগুলো ক্রুসেডারদের অধিকাংশের কাছেই লোভনীয় বলে বিবেচিত হলো। কিন্তু তাদের মধেয় যারা অবিমিশ্র ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এসেছিলেন তারা এই জাতীয় লেনদেনে খুশী না হয়ে সরাসরি প্যালেস্টাইন অভিমুখে যাত্রা করেন। পূর্ববর্তী ক্রুসেডগুলোর সময় বাইজান্টাইন সম্রাটের অসহযোগিতার এবং বিরোধিতার কথা কথা ক্রুসেডারগণ বিস্মৃত হননি। সুতরাং এবার বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সক্রিয় সহযোগিতার সম্ভাবনায় নেতৃবৃন্দ উৎফুল্ল হলেন। ভেনিসের বণিকগোষ্ঠীর কাছেও এই প্রস্তাব অতি লোভনীয় বলে বিবেচিত হলো কারণ প্রস্তাবিত ব্যবস্থা কার্যকর হলে বাইজান্সিয়ামের ব্যাবসাবাণিজ্য তাদের হাতের মুঠোয় আনা সম্ভব হবে।
ক্রুসেডারগণ দ্বিধাবিভক্ত, সংহতিহীন কনস্টান্টিনােপলে পৌঁছে প্রায় বিনা বাধায় নগরটি দখল করলেন। আলেক্সিয়স এবং তার পিতাকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলেও দেখা গেল তাদের সদ্যোলব্ধ-কর্তৃত্ব প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের পক্ষে যথেষ্ট নয়। প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে না পারায় অভিযাত্রীদের সঙ্গে শাসকদের সম্পর্কে আবার ভাঙন ধরল। শেষ পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ ক্রুসেডারগণ কন্যান্টিনােপল নিজেদের অধিকারে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুনরাবৃত্ত হলো সেই অবাধ লুণ্ঠন, ধ্বংস এবং অগ্নিসংযােগের ইতিহাস। খ্রিস্ট-ভক্তদের দ্বারা বিধ্বস্ত নগরের মঝে লুণ্ঠনের ক্ষত সর্বাঙ্গে ধারণ করে রইল শতশত পুণ্যাত্মার-স্মৃতিজড়িত-সেন্ট সােফিয়ার চার্চ। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে পােপ তৃতীয় ইনােসেন্ট বারবার নিষেধ করেছিলেন ক্রুসেডারগণ যেন কনস্টান্টিনােপল না আক্রমণ করেন। নানাবিধ অপকর্ম ও অন্যায় আচরণের জন্য তিনি ভেনিসীয়দের সমাজচ্যুত বলে ঘােষণাও করেছিলেন। কিন্তু অক্ষমার্হ এই কাজ সাধিত হবার পর তার সুর পাল্টে গিয়েছিল এবং ক্রুসেডারদের উদ্দেশ্যে তার এই বাণী এলো যে তারা যেন অন্তত এক বছর কনস্টান্টিনােপলে থেকে তাদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতাসুব্ধ ধর্মগুরুর চোখে কনস্টান্টিনােপলে ক্রুসেডারদের ঘাঁটিস্থাপন এবং অর্থোডক্স বা গ্রীক চার্চের সঙ্গে মতানৈক্যের অবসানের সম্ভাবনা অতি বাঞ্ছনীয় বলে মনে হয়েছিল।
কনস্টান্টিনােপল বিজেতাগণ পূর্ব সাম্রাজ্যের জন্য নতুন একজন সম্রাট নিযুক্ত করলেন যিনি পূর্বতন সাম্রাজ্যের এক চতুর্থাংশের অধীশ্বর হলেন, বাকি অংশ ভেনিস এবং অভিযাত্রীদের নায়কদের মধ্যে বণ্টিত হলাে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতারণার মধ্য দিয়ে লাতিন-শক্তি-অধীন যে কনস্টান্টিনােপল সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হলে তা ছিল জন্ম-রুগ্ন। গ্রীকগণের পক্ষে এশিয়া মাইনর এবং আড্রিয়াটিক উপকূলে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা অনায়াসেই সম্ভবপর হয়। বুলগেরীয়রা কনস্টান্টিনােপল-এর উত্তরাঞ্চল অধিকার করে নেয়। অর্ধশতকের সামান্য কিছু বেশি সময় ছিল নতুন সাম্রাজ্যের আয়ু ১২৬১ সালে গ্রীক রাজ্যগুলির অন্যতম নগর কনস্টান্টিনােপল দখল করে নিলেও পুনতে সাম্রাজ্য তার অতীতের গৌরব এবং প্রতিষ্ঠা ফিরে পায় নি। তার শক্তি হ্রাস পরিণামে খ্রিস্টান স্বার্থ ক্ষুন্নই করেছিল। দুর্বল এই রাষ্ট্র মুসলমান শক্তির সম্প্রসারণে বাধা দেওয়ার ভূমিকা আর কখনােই নিতে পারে নি। এই ঘটনার পর পশ্চিম ইউরােপ, বিশেষ করে রোমান চার্চ সম্পর্কে পূর্ব ইউরােপের খ্রীস্টানদের বিরাগ এবং বিদ্বেষেরও অবধি ছিল না। আর প্রথমে ক্রুসেডারদের অভাবিত সালে উল্লসিত হলেও তৃতীয় ইনোসেন্টের এ কথা বুঝতে দেরী হয়নি যে উপলক্ষের লােভনয় আকর্ষণে ক্রুসেডারদের কাছে লক্ষ্য হয়েছে অবহেলিত। চতুর্থ ক্রুসেড প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি নিষ্ফল অভিযান মাত্র। কনস্টান্টিনোপল থেকে জেরুজালেমের মধ্যকার পথ তাদের কাছে অনতিক্রম্যই রয়ে গেল। ১২১৫ সালে ল্যাটেরান কাউন্সিল (Lateran Council) ইনােসেন্ট কর্তৃক পবিত্র সমাধিস্তম্ভ (Holy Sepulchre) পুনরুদ্ধারের স্পর্ধিত প্রতিজ্ঞার মধ্যেই প্রকৃত পক্ষে স্বীকৃত হয়েছে চতুর্থ ক্রুসেডের গ্লানিময় ব্যর্থতা।
বালকদের ক্রুসেড বা শিশুদের ক্রুসেড (১২১২ খ্রি.)
১৩শ শতকের শুরুতে মহামান্য পােপের প্রতিনিধিবৃন্দ যখন পশ্চিম ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বিধর্মীর বিরুদ্ধে হিংসা ও দ্বেষের বাণী প্রচার করছেন, সকলকে আহ্বান করছেন অস্ত্র ধারণের জন্য, তখন মানুষের ত্রাণের জন্য যিশুর আলোকসামান্য দুঃখ-বরণের প্রতীক ক্রস নতুনতর প্রেরণা সঞ্চার করেছিল বেশ কিছু মানুষের হদয়ে। হিংসার পরিবর্তে ভালবাসা ও প্রীতির সাহায্যে অভীষ্ট লাভের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে মহিলা ও কিশাের সদ। ১২১২ সালে ক্রুসেডের ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ এবং অবিস্মরণীর এক অধ্যায়ের সূচনা হলো বালকদের পুণ্যভূমি উদ্ধারের অভিযানের মধ্য দিয়ে। অজানা থেকে গেছে এই তথ্য যে এইসব কিশােরদের কাছে এই মহাসত্য কেউ উঘাটিত করেছিল কিনা যে একমাত্র নিষ্পাপ হৃদয়ের অধিকারীগণই সক্ষম হবে বীর স্মৃতি-আলােকিত পুণ্যভূমি উদ্ধার করতে। অস্পষ্ট এই অলৌকিক কাহিনী থেকে জানা যায় যে ১২১২ সালে নিকোলাস নামক এক জার্মান কিশোর এই কথা প্রচার করতে শুরু করে যে সে ঈশ্বরাদিষ্ট হয়েছে তীর্থভূমিতে বালকদের এক অভিযান পরিচালনার জন্য। সরকারী কর্তৃপক্ষ এবং যাজকদের ভ্রূকুটি সত্ত্বেও রাইন-উপত্যকায় অসংখ্য কিশাের-হৃদয়ে অভাবিত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল নিকোলাসের পরিকল্পনা। অভিভাবকদের শত বাধা উপেক্ষা করে সহ সহস্র বালক (এবং বালকের পােশাকে বালিকা) নিকোলাসকে অনুসরণ করে কলােন থেকে রাইন উপত্যকা পার হয়ে অতিক্রম করল তুষারাচ্ছাদিত আল্পস। দুর্গম পথে অনাহারে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মৃত্যু হলো অসংখ্য বালকবরের, তাদের সামান্য খাদ্য, পাথেয়, পােশাকও লুণ্ঠন করল তস্কররা। ইতালীর জেনােয়াতে এই অভিনব যোদ্ধারা পৌঁছলে বহু বালিকাকে জোর করে গণিকালয়ে অথবা গৃহপরিচারিকার কাজে নিযুক্ত করেন বিভিন্ন নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা; ব্রিন্দিসির বিশপ আপ্রাণ চেষ্টা করেন যাতে এই বাহিনী সমুদ্র পার হতে না পারে। অবশ্য পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট কিশােরকিশােরীর এই নির্ভীক অভিযানে মুগ্ধ হন। তিনি তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন এবং ক্রুসেডারদের শপথ-পালনের দায় থেকে মুক্তি দেন। এদের অনেকে জার্মানীতে ফিরতে অক্ষম হয়, অল্প কিছু সংখ্যক বালক ভগ্ন হৃদয়ে, শ্রান্ত শরীরে স্বদেশ অভিমুখে যাত্রা করে।
ঠিক এই সময়েই ফ্রান্সের ভাঁদোম (Vendome) গ্রামে বারো বছরের স্টিফেন নামক এক অপাপবিদ্ধ কৃষক বালক ফরাসী-রাজ ফিলিপ আগস্টাসের সমীপে নিবেদন করে যে সে যীশুর আদেশ পেয়েছে বালক ক্রুসেডার নিয়ে পুণ্যভূমি উদ্ধারের জন্য। বিভ্রান্ত, বিব্রত রাজা পারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের সঙ্গে আলােচনা করে তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার নিষেধ সত্ত্বেও অসংখ্য বালক স্টিফেনের আবেদনে সাড়া দিয়ে, জার্মান বালকবাহিনীর মতোই দুর্গম পথ অতিক্রম করে মার্সেই বন্দরে পৌঁছয়। সেখানেও প্রতারক, লোভী বণিকের অভাব ছিল না। সাতটি জাহাজে তাদের তুলে সমুদ্রযাত্রা করে বণিকেরা। দুটি জাহাজ সার্ডিনিয়ার কাছে বিধ্বস্ত হয়, বাকিগুলি এই নিপাপ, অকুতোভয় বালকদের টিউনিসিয়া ও মিশরে পৌঁছে দেয় ক্রীতদাস হিশেবে বিক্রীত হবার জন্য। বালকদের এই ক্রুসেড দুটি শুধু মাত্র অভিনব এবং বেদনাবিধুর কাহিনীই নয়, এই অবিশ্বাস্য আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে এই সময়কার সহজ সরল মানুষের অতৃপ্তি, বিবেক দংশনের, হিংসার পথ থেকে সরে আসার বাসনাই প্রকাশিত হয়েছে। হৃদয়হীন, কূটনীতির মূর্ত প্রতীক রূপে বণিত পেপ তৃতীয় ইনােসেন্টও অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে ঐ উন্মাদ বালকেরা লজ্জা দিয়েছে তাকে। এই বিস্ময়কর ঘটনাপুর্তির পর শোকাহত, অনুতপ্ত মানুষ স্টিফেনের অভিযানের সঙ্গে বহু অলৌকিক কাহিনীও যুক্ত করে দিয়েছিল। লােকের মুখে মুখে ফিরত এই কাহিনী যে বনের পশুপাখি, জলের মাছ এবং অজস্র, অসংখ্য প্রজাপতি সঙ্গ নিয়েছিল পাপবিদ্ধদের এই অবিস্মরণীয় অভিযানে। ক্ষমতা লিপ্সা নয়, বাণিজ্য বিস্তার নয়, ধর্মের নামে উন্মত্ততাও নয়, স্বর্গীয় এক আবেগ-পরিচালিত বালক-বাহিনীর এই ক্রুসেড দুটি তথাকথিত মহামান্যদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং আদর্শের সঙ্কীর্ণতা লােকচক্ষুর সামনে তুলে ধরেছিল।
পঞ্চম ক্রুসেড (১২১৭-২১ খ্রি.), ষষ্ঠ ক্রুসেড (১২২৮-২৯ খ্রি.) ও ব্যারনদের ক্রুসেড (১২৩৯ খ্রি.)
পােপ তৃতীয় ইনােসেন্ট এর আবেদনের ফলে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযােগ নেওয়ার বাসনায় ১২১৭ সালে হাঙ্গেরীর শাসক অ্যানড্রুর নেতৃত্বে প্রধানত জার্মানী, অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরীর অধিবাসীদের দ্বারা সংগঠিত পঞ্চম ক্রুসেড প্যালোইন অভিমুখে যাত্রা করে। এই খ্রীস্টান বাহিনী অনায়াসে নীল নদের তীরে বিখ্যাত মিশরীয় বন্দর দ্যামিয়েট্টা (Damietta) অধিকার করে। মিশর এবং সিরিয়ার সুলতান মালিক আল কামিল (Malik-al-Kamil) এই অতি প্রয়োজনীয় বন্দরটির বদলে ক্রুসেডারদের মুক্তি, জেরুজালেমের বেশিরভাগ অংশ এবং পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন (The true cross) ক্রুসেডারদের হাতে সমর্পন করতে রাজি হন। কিন্তু অতি লােভ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে আবার ক্রুসেডারদের সাফল্যের অন্তরায় হলো। শেষ পর্যন্ত মিশরীয় বাহিনীর ওপর অবিবেচনাপ্রসূত এক আক্রমণের ফলে ক্রুসেডাররা বাহিনী দ্যামিয়েট্টাও হারালো। ঘটনাস্রোতের এই আমূল পরিবর্তনের জন্য অভিযাত্রীরা দায়ী করেছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিককে। প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তরুণ সম্রাট জরুরী আভ্যন্তরীন প্রয়োজনে ক্রুসেডে অংশ নিতে পারেননি। একারণে পোপের চরম দণ্ডও তার উপর নেমে আসে। পোপ তাকে চার্চচ্যুত করেন।
পোপের শাস্তিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ১২২৮ সালে একক প্রচেষ্টায় সসৈন্যে জেরুজালেমে এসে উপস্থিত হন, তার এই ক্রুসেড ৬ষ্ঠ ক্রুসেড নামে পরিচিত। ‘বিধর্মী নিধন’ তার লক্ষ্য ছিলনা। আরবীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুণগ্রাহী ‘অধার্মিক’ এই সম্রাট নবনিযুক্ত সুলতান ফকরুদ্দীনকে আলাপ-আলোচনায় মুগ্ধ করে ১২২৯ সালে তার সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদন করেন। এর ফলে মুসলমানদের কাছে-পবিত্র স্থানটুকু বাদ দিয়ে (Dome of the Rock) সমস্ত জেরুসালেম, একর, জাফা, সিডন, নাজারেথ এবং বেথলিহেম সম্রাটকে অর্পণ করেন সুলতান! দশ বছর দশ মাসের জন্য উভয় পক্ষে শান্তি অক্ষুন্ন রাখতেও তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। সুদীর্ঘকালের হিংস্র হানাহানি যে অভীষ্ট পূর্ণ করতে পারেনি সমাজচ্যুত এক সম্রাটের প্রজ্ঞা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা অক্লেশে তা অর্জন করল।
স্বীয় ধর্মান্ধতায় অটল পােপ নবম গ্রেগরী কিন্তু এ চুক্তিকে খ্রিস্টান জগতের প্রতি ‘অবমাননাকর’ বলে ধিক্কার দিলেন এবং ফ্রেডারিকের প্রত্যাবর্তনের পর প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান সম্প্রদায় নিকট-প্রাচ্যের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে অংশ নিয়ে অতি অল্পকালের মধ্যেই ফ্রেডারিকের কীর্তি ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। ১২৩৯ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে পোপ নবম গ্রেগরি নতুন ক্রুসেড ডাকে, যা ব্যারনদের ক্রুসেড নামে পরিচিত। এই ক্রুসেডে ক্রুসেডাররা বিজয়ী হয় ও জেরুজালেমে অনেক স্থানকে যুক্ত করে। কিন্তু এই কৃতিত্ব বেশি দিন ছিলনা। মিশরের আইয়ুবিদ সাম্রাজ্য এবার খোয়ারেজমীয় সাম্রাজ্যের সাথে মৈত্রী করে ও দুইয়ে মিলে জেরুজালেম দখল করে খ্রিস্টানদের উপর গণহত্যা সংঘটিত করে। এভাবে ১২৪৪ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে জেরুসালেম আবার মুসলিমদের করতলগত হয়।
সপ্তম ক্রুসেড (১২৪৮-৫৪ খ্রি.), অষ্টম ক্রুসেড (১২৭০ খ্রি.) ও এডোয়ার্ডের ক্রুসেড (১২৭১-৭২ খ্রি.)
এর অল্প কিছুকাল পরেই ফরাসীরাজ সেন্ট-লুই (নবম লুই) বিশুদ্ধ ধর্মীয় প্রেরণায় ক্রস তুলে নেন এবং সংগঠিত হয় সপ্তম ক্রুসেড। তখনও জেরুজালেম উদ্ধারের ক্ষীণ একটি আশা ছিল। মিশরের দুর্বলতার সুযােগে দ্যামিয়েট্টা খীস্টানগণ আবার জয় করে নেন, কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা এবং পথ নির্বাচনে সাংঘাতিক ভুল করার জন্য সেন্ট লুই এর বাহিনী মানসৌরার (Mansourah) যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু সঙ্কটে অটল, ভাগ্য বিপর্যয়ে অবিচলিত সেন্ট লুই প্যালেস্টাইন অভিমুখে যাত্রা বন্ধ করলেন না। খ্রীস্টান অধিকৃত এলাকার রক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে, শীর্ণ জেরুসালেম রাজ্যের জন্য কিছু স্থান জয় করলেন, কিন্তু পুণ্যভূমি-অধিকার স্বপ্নই থেকে গেল তার কাছে।
অষ্টম ক্রুসেড আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে মােঙ্গল-আক্রমণ নিকট প্রাচ্যের মুসলমানদের সঙ্ঘবদ্ধ করে দিয়েছিল, আর এই কারণেই খ্রীস্টানদের পক্ষে জেরুজালেম উদ্ধারের আশাও ক্ষীণতর হয়ে গিয়েছিল। অদম্য ধার্মিক সেন্ট লুই আবার এসেছিলেন ১২৭০ সালে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্ন সফল করার জন্য। কিন্তু সামরিক জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য টিউনিসের উপর ক্রুসেডাররা অবিবেচনাপ্রসূত এক আক্রমণ করেছিল এবং বিপর্যস্ত হয়েছিল। মর্মাহত, ব্যর্থ এবং অসুস্থ ফরাসীরাজ দূর বিদেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, পরাজিত ফরাসী বাহিনীও শূন্যহাতে স্বদেশে ফিরে গেল।
এর পরেও ইংলণ্ডের প্রিন্স এডােয়ার্ড প্যালেস্টাইন অভিমুখে এক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু নিকট প্রাচ্যে খ্রীস্টান শাননের শেষ চিহ্নটুকুর অবলুপ্তির দিন সামান্য কিছু পিছিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি এডােয়ার্ড। ১২৯১ সালে বিলীন হয়ে গিয়েছিল জেরুজালেমের এর লতিন রাজ্য।
৭ম ক্রুসেডের সময় থেকেই ইউরোপ নিকট প্রাচ্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছিল। ৮ম ক্রুসেডের নিরুত্তেজ, নিষ্প্রভ পরিবেশ সকলের চোখেই ধরা পড়েছিল। জয়নভিলের (Joinville) ধর্মাত্মা শাসক সাগ্রহে অংশ নিয়েছিলেন ষষ্ঠ ক্রুসেডে। কিন্তু পুণ্যভূমি উদ্ধারের প্রচেষ্টা যে অগৌরব এবং ব্যর্থতার মধ্যে অবসিত হবে তা বুঝতে দেরী হয়নি তার। সেজন্য তার ঊর্ধ্বতন প্রভু নবম লুইকে তিনি জানিয়েছিলেন যে স্বদেশে রাজকার্য অবহেলা করে এ জাতীয় মরীচিকার পিছনে ছােটা পাপ। ৮ম ক্রুশেডই ছিল ইউরােপের অন্তিম ক্রুসেড। কোনও কোনও পােপ ১২৯১ সালের পরেও প্রথম দিকের ক্রুসেডগুলি পােপতন্ত্রকে যে অভূতপূর্ব প্রতিষ্ঠা এবং অনাস্বাদিত পরাক্রমের অধিকারী করেছিল তার কথা স্মরণ করে পুণ্যভূমি উদ্ধারের জন্য নিষ্প্রাণ আহ্বান মাঝে মাঝেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু পােপের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ইউরােপের সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার আদর্শ নিঃশেষে পরিত্যাগ করেছিল নব নব সমস্যামগ্ন, নতুন-প্রশ্নাকুল-চতুর্দশ শতকের-ইউরােপ।
মধ্যযুগের সমাজের ওপর ক্রুসেডের প্রভাব
ক্রুসেডারদের নৃসংশতা ও মুসলমানদের ঘৃণা
অভাবিত সমারােহ ও বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে ক্রুসেডের আরম্ভ, অবসান বিষন্ন ব্যর্থতায়। বিধর্মী মুসলমান কবলিত পুণ্যভূমি জেরুসালেম উদ্ধারের যে সংকল্প ইউরােপের অসংখ্য ক্রসবাহী যােদ্ধাদের দীর্ঘকাল উদ্দীপিত এবং আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করেছিল তা সিদ্ধ হয়নি। দুশো বছরের সংগ্রামের পর, ছোট বড় আটটি সামরিক অভিযান এবং কুড়ি লক্ষ মানুষের আত্মদান সত্ত্বেও জেরুসালেম দুর্ধর্ষ মামলুকদের হাতেই রয়ে গেল, ক্রমশ বিরল হলো খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের মানব-পুত্রের পবিত্র স্মৃতিজড়িত প্যালেস্টাইন উদ্দেশ্যে যাত্রা, ক্ষীণায়ু জেরুজালেমের লাতিন রাজ্যের অধ্যায় শেষ হবার আগেই খ্রিস্টানদের মন থেকে মুছে গিয়েছিল। ক্ষতি আরও হয়েছিল। দীর্ঘকাল সংঘর্ষের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যপ্রাচের একদা সহিষ্ণু মুসলমান শক্তিগুলোর কাছে খ্রিস্টান মাত্রই বিদ্বেষ ও শত্রুতার পাত্র হয়ে উঠেছিল। অসাধারণ ত্যাগ, অপরিসীম উৎসাহ এবং মৃত্যুর মুখােমুখি হবার কঠিন প্রতিজ্ঞার মতো দুর্লভ গণের সঙ্গে ক্রুসেডারদের মধ্যে দেখা গেছে সহিংশতা ও অকারণ ধ্বংসের উন্মত্ততা। প্রথম ক্রুসেডে জেরুজালেম উদ্ধারের সময় ক্রুসেডারদের রক্তলোলুপতার অবধি ছিল না। ইউরোপীয় তথ্যানুযায়ী ১০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল, কিন্তু আরবদের মতে নারী ও শিশুসহ নিহতের সংখ্যা ছিল ১,০০,০০০। ভয়াবহ এই হত্যার প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল সাংঘাতিক। লাতিন ইউরােপকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল মুসলমানরা। ফ্রাঙ্করা (এই নামেই ক্রুসেডারদের জানতো তারা) খ্রীস্টান কুত্তা রূপে বর্ণিত হয়েছিল। সমসাময়িক আরব-কবি মােসাফের আল্লা ওয়ারদিস (Mosaffer Allah Werdis) এর রচনার ছত্রে ছত্রে তিক্ততা ও যন্ত্রনা ঝরে পড়েছে। ওয়ারদিসের মতো বহু আরব লেখক খ্রীস্টানদের প্রতিরােধ করার জন্য মুসলমান হৃদয়ে কঠিন প্রতিজ্ঞার আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করেছিলেন। ১১৯১ সালে তৃতীয় ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডারদের ক্ষুদ্রতা ও সঙ্কীর্ণতার এক নগ্ন অধ্যায় উন্মােচিত হলো। সালাউদ্দিনের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা অতি মন্থর মনে হওয়ায় ধৈর্যচ্যুত ক্রুসেডার নেতা রিচার্ড দ্য লায়ন হার্ট (Richard Cocur de Lion) দু হাজারেরও বেশি বন্দী মুসলমানকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। সােনার লােভে নিহতদের ছিন্নভিন্ন করে ঘাটাঘাটি শুরু করছিল ক্রুসেডাররা। সােনা পাবার আশায় কবর না দিয়ে দাহ করা হলো মৃতদেহগুলি। এই সমস্ত ঘৃণ্য ঘটনায় শিহরিত হয়ে উঠেছিল সমস্ত মুসলমান জগৎ। এরপর থেকে পশ্চিম ইউরােপ সম্পর্কে তাদের আর কোনও মােহ ছিল না।
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ক্ষতি
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ওপর ক্রুসেডের প্রতিক্রিয়াও উল্লেখ করার মতো। চতুর্থ ক্রুসেডের ফলেই ১২০৪ সালে কনস্টান্টিনােপল বিজয় সম্ভবপর হয়েছিল এবং সেই বিজয়ের সঙ্গে জড়িত আছে শেভার কর্তৃক সুপ্রাচীন নগরীটির অসংখ্য শিল্প-সামগ্রী এবং জ্ঞান-চর্চার বহু অমূল্য সম্পদ লুণ্ঠন ও ধ্বংসের এক নিন্দনীয় অধ্যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ভিলেহারডুইনের কাছ থেকে জানা যায় যে লুণ্ঠিত সােনা, রূপা, মূল্যবান রত্ন এবং রেশমী বস্ত্রাদির কোনও পরিমাপ করা দুঃসাধ্য ছিল। ক্রুসেডই সৃষ্টি করেছিল পূর্ব এবং পশ্চিম খ্রীস্টান জগতের মধ্যে অনতিক্রম্য এক ব্যবধান। সে ব্যবধান অবিশ্বাসের, ক্রোধের এবং ঘৃণার। এই অভিযানের সূত্রে প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার যে সব বন্দর ইতালীর বণিকেরা করায়ত্ত করেছিল সেগুলিও ঘটনাচক্রে তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষতি, জনমনে বিদেশী ও ইউরোপে বিধর্মী-বিদ্বেষের সূচনা, ইউরোপে অবস্থানরত বিধর্মী ও ধর্মচ্যুতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্রুসেডের ডাক
সর্বজন-অভিনন্দিত এবং গৃহীত একটি মহৎ আদর্শে সংখ্যাতীত খ্রীস্টানকে অনুপ্রাণিত করে গোটা মহাদেশকে সৌভ্রাতৃত্ব এবং ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করার যে চেষ্টা করেছিলেন কয়েক জন পােপ এবং পুণ্যাত্মা যাজক তাও অতি দ্রুত বিলীন হয়ে গেল আঞ্চলিক সংঘাতের আবর্তে, জাতিতে জাতিতে চিরকালের পুরোনো সেই শক্তি-দ্বন্দ্বে। পবিত্র রােমান সম্রাট এবং মহামান্য পােপের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার দুর্ঘটনা তো শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই। দূরদেশে, অচেনা পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী কোনও অভিযান সার্থকভাবে পরিচালনার কোনও যোগ্যতা যে ক্রুসেডারদের নেই – এই নির্মম সত্য উদ্ঘাটিত হলো সকলের কাছে। পরিণামে ইউরােপের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের দুই রােমান সম্রাটের মহিমায় লাগল ব্যর্থতার গ্লানি। পবিত্র রােমান সম্রাটের হৃতবিশিষ্ট শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল নব-মর্যাদায় অভিষিক্ত পােপের সঙ্গে অতি দীর্ঘ সংঘর্ষে এবং বাইজান্টাইন সম্রাট ১২৬১ সালে নতুন প্রতিপত্তি অর্জনের সুযােগ পেলেও ফিরে পান নি তার আগেকার প্রতিষ্ঠা। ক্রুসেডের জন্য যােদ্ধা সংগ্রহের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল পােপের প্রতিনিধিদের ওপর। এই উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে সময় এবং রাজনৈতিক প্রচারের এক দুই ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। জনচিত্তে উত্তেজনা জাগানাের জন্য মিথ্যা, অর্ধ-সত্য, খ্রিস্টানদের উপর বিধর্মীদের অকথ্য অত্যাচারের নানা মনগড়া কাহিনী তারা নির্বিচারে পরিবেশন করতে থাকেন। স্থানকাল-পাত্র ভেদ না করে এই জাতীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করার ফলে ইউরোপের বহুস্থানে ইহুদী নিধন, বিদেশীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ইত্যাদি নিন্দনীয় কাজ হতে থাকে। বিদেশীমাত্রই শত্রু এবং বিধর্মী – এমন একটা মনােভাব সৃষ্টি করার জন্য পােপের প্রচার-যন্ত্রই দায়ী ছিল। বিশেষ করে মেন্ডিকার্ট সম্প্রদায় ক্রুসেডের জন্য পরমোৎসাহে এই ধরনের প্রচার অভিযান চালিয়েছিলেন এবং ১২শ শতকের মধ্যভাগে দেখা গেল ক্রুসেড আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ও লক্ষ্য পরিবর্তিত হতে আরম্ভ করে।
১৩শ শতাব্দীতে শুধুমাত্র পূণ্যভূমি উদ্ধারের জন্য ক্রুসেড পরিচালনা বন্ধ হয়ে গেল, শুরু হলো স্বদেশী-শত্রু-নিধন পর্ব। স্পেনের মুর এবং অন্যান্য বিধর্মীদের উৎখাত করার জন্য অভিযান, ১১৭৪ সালে পূর্ব জার্মানীর স্লাভদের ধ্বংস করার জন্য ওয়েনডিস (Wendish) ক্রুসেড, ১২০৯ সালে অ্যালবিজেনসিয়ান ক্রুসেড (Albigensian Crusade) এবং উত্তর জার্মানীর স্টেডিঙ্গার কৃষকদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সশস্ত্র অভিযান প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ধর্মীয় প্রেরণা এবং জেরুসালেম উদ্ধারের সংকল্পই শুধু ক্রুসেডের পেছনে নেই। রাজনৈতিক-স্বার্থসিদ্ধ করার বাসনাও উদ্যোক্তাদের তৎপর করেছে। ক্রুসেডের উদ্দেশ্য ও আদর্শকে বিকৃত করার এই প্রচেষ্টায় মধ্যযুগের অবশিষ্ট দিনগুলিতে মত্ত হয়ে রইল রােমান চার্চ। ১৩শ শতকের প্রথমার্ধে একের পর এক পােপ আরম্ভ করলেন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য বা পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের হোয়েনস্টফেন রাজবংশকে ধ্বংস করার ক্রুসেড। হীন চক্রান্ত, শক্তির লালসা এবং আত্মহননের মধ্যে হারিয়ে গেল জেরুজালেম উদ্ধারের স্বপ্ন। পােপের এই দৃষ্টান্ত সাগ্রহে অনুসৃত হতে লাগল সর্বত্র। ব্যক্তিগত এবং দেশ ও দশের যে কোনও শত্রুকে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে ধ্বংস করার নামই হয়ে গেল ক্রুসেড। এই প্রবণতা ইউরােপে সজীব হয়ে রইল বহুদিন। ১৬শ শতকেও ‘বিপথগামী’ টিউডর-ইংলণ্ডকে রােমান ক্যাথলিক চার্চের ছত্রছায়ায় ফিরিয়ে আনার চক্রান্তকে ক্রুসেড ভেবে নেওয়ার মতো মানুষের অভাব হয়নি। এই সব কারণেই হয়তো ঐতিহাসিক হেনরী পিরেণ নির্দ্বিধায় লিখেছিলেন যে ইতালীয় বাণিজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি বিধান ছাড়া ক্রুসেডের স্থায়ী কোনও সাফল্য খুঁজে পাওয়া না। আধুনিক ইউরােপের সৃষ্টি-প্রসঙ্গে ক্রুসেডের অধ্যায় অনুল্লেখিত থাকলেও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না কিছুই। ইংরেজ লেখক উইলসনও সখেদে ঘােষণা করেছেন ‘কুসেডগুলি মধ্যযুগের ধর্মান্ধতা এবং নির্বুদ্ধিতার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়।’
রোমান চার্চের মর্যাদার উন্নতি ও অবনতি
কিন্তু মহৎ আয়োজনের পরম শোকাবহ পরিণতি, অথবা ধর্মের-নামাবলী গায়ে কয়েক সহস্র লুণ্ঠন-লুব্ধ ক্রুসেডারের ক্ষণিক সাফল্য এবং অনিবার্য ব্যর্থতার কাহিনী মাত্র – এই সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে সমগ্র ক্রুসেডগুলোকে উপেক্ষা করা অনুচিত এবং অযৌক্তিক। শুধুমাত্র ক্রুসেডারদের দীনতা ও ক্ষুদ্রতার তালিকাবৃদ্ধির কাজে তৎপর হয়ে যারা এই অভূতপূর্ব প্রচেষ্টাকে উপহাস ও উপেক্ষা করেছেন তাদের দ্বারা ইতিহাসের ভারসাম্য রক্ষিত হয় নি। মধ্যযুগের ইউরােপের জীবনের সর্বস্তরে ক্রুসেডের প্রভাব পড়েছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন এসেছিল, কখনো-বা গােপনে, গভীরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রূপান্তর ঘটিয়েছিল দুই শতাব্দী স্থায়ী এই ধর্মযুদ্ধ।
ক্রুসেডের ফলে অন্তত প্রারম্ভিক শত বৎসরে, নতুন মর্যাদা এবং প্রতিপত্তিতে মহিমান্বিত হয়ে উঠেছিল রােমান চার্চ। সম্রাট থেকে ক্ষুদ্র সামন্ত, কুবের-প্রতিম ধনী বণিক থেকে দীন কৃষক – সমাজের বিভিন্ন স্তরের অসংখ্য মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, বিপুল বৈসাদৃশ্য ও বৈচিত্র্যকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সর্বপ্লাবী এক ভাবাবেগে, একটি স্থির লক্ষ্যে এমন বিশাল অভিযান পরিচালনা করে তুলনারহিত এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন পােপ। ধর্মীয় প্রেরণায় সকলেই হয়তো উদ্দীপ্ত হননি, কিন্তু তাতে সারা খ্রিস্টান জগতে পোপের অবিসংবাদিত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কোনও অসুবিধা হয়নি। অভিযানের প্রাক্কালে দেখা যায় যে ক্রুসেডে যোগদানেচ্ছুদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে এবং আর্থসংগ্রহের বাসনায় পােপের পরিভ্রমণরত-প্রতিনিধিবৃন্দ বিভিন্ন দেশের সরকারী কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে দ্বিধা করেন নি। অন্তত বেশ কিছু কালের জন্য পােপই হয়ে উঠেছিলেন লোকনায়ক। পুণ্যভূমি উদ্ধারে পােপের তৎপরতা ছিল অবিচলিত; কিন্তু অন্যান্য রাজপুরুষদের ক্ষেত্রে তা মাঝে মাঝেই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে সংঘবদ্ধ মুসলমান প্রতিরোধ যখন ক্রুসেডের সাফল্য অনিশ্চিত করে তােলে তখনও পােপের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। কোনও সম্রাট বা রাজা নয়, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে পােপই হয়ে উঠেছিলেন গােটা খ্রিস্টান সমাজের একমাত্র নেতা। নতুন যে সমস্ত প্যাট্রিয়ার্ক এবং সামরিক সংস্থাগুলির (the Templars, the Hospitallers, the Teutonic Knights প্রভৃতি) সৃষ্টি হয়েছিল তা সবই ছিল পােপের নিয়ন্ত্রণাধীনে। ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করার অঙ্গীকার থেকে মুক্তি দেবার (অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে) অধিকার একমাত্র পােপেরই ছিল। আর যে সব বিশপ প্যালেস্টাইনের পথে যা করছিলেন। (তাদের অধিকাংশেরই আর স্বদেশে ফেরা হয় নি) তারা নিজ নিজ এলাকাভুক্ত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন পােপের হাতে। ধর্মগুরুর আর্থিক লাভ আরও নানা উপায়ে হয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদের বিরতি ও ঈর্ষা উৎপাদন করে ক্রুসেড উপলক্ষে এবং অন্যান্য অজুহাতে নানাবিধ কর তিনি তাদের প্রজাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। রাজকোষের ক্ষতি সাধন করে, দেশের অন্যান্য জরুরী প্রয়োজনে যে অর্থ নিয়োজিত হলে প্রজাদের কল্যাণ সাধিত হতে পারতো, এখন থেকে তা পােপের অর্থাগার স্ফীততর করতে লাগল। শুধু তাই নয়, ক্রুসেডের উদ্দেশ্যে সংগৃহীত অর্থ পােপের ইচ্ছা মতো অন্যান্য কাজে ব্যয় করার ঘটনাও ঘটতে শুরু করল। Indulgence বা পাপমুক্তির ছাড়পত্রের অবাধ বিক্রয়ের ফলে চার্চের ব্যবসাদারী মনোভাব সকলের কাছে নগ্নভাবে প্রকাশিত হতে দেরী হয়নি। রাজন্যবর্গও পােপ এবং যাযককুলের পথ অনুসরণ করতে কুণ্ঠিত হননি। ধর্মযুদ্ধের এই নায়ক মানুষের ধর্মোন্মাদনার সুযােগে নিজ শক্তিবৃদ্ধি এবং স্বার্থসিদ্ধ করার কোনও সুযােগই ছাড়েননি। অবশ্য ১১শ শতকের অন্তিমলগ্নে পােপের প্রতিপত্তি এবং মর্যাদা তুঙ্গে উঠলেও, ব্যর্থতার গ্লানি তাকে স্পর্শ করতে খুব বেশি বিলম্ব করেনি। পােপের খ্যাতির মধ্যাহ্ন-সূর্য অতি দ্রুত অস্তাচলের দিকে ঢলে পড়েছিল। দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময়েই খ্রিস্টান শক্তিগুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব, স্বার্থান্ধতা কুৎসিত চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তাদের এবং সামগ্রিকভাবে কুসেডের বিফলতার মধ্যে এ তথ্যই ঘােষিত হলো যে সর্বশক্তিমান পােপও সমগ্র মহাদেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অপারগ। চতুর্থ ক্রুসেডের ঘটনাবলী পােপের আসন্ন অধঃপতনের ইঙ্গিত বহন করে আনল। মধ্যযুগের সবচেয়ে শক্তিশালী পােপ রূপে স্বীকৃত তৃতীয় ইনােসেন্ট নিজ উদ্যোগে প্রেরিত অভিযানের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হলেন। ১১৫৩ সালে ক্রুসেডের প্রেরণার প্রধান উৎস সেন্ট বার্নার্ড পরলােক গমন করলেন। মহৎ আন্দোলনের এই শােকাবহ পরিণতিতে ক্লিষ্ট, বিধ্বস্ত, আত্মসমালোচনায়-মুখর এই ধর্মপ্রাণ যাজক একটি পুস্তিকার (De Considerational) মাধ্যমে পােপের নবলব্ধ এই অগাধ ক্ষমতার সদ্ব্যবহারের জন্য করুণ আবেদন জানিয়েছিলেন। ব্যর্থতার, ক্ষুদ্রতার ছায়া যে ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে পােপের মহিমাকে গ্রাস করতে উদ্যত ইহলােক ত্যাগ করার আগে বিষন্নচিত্তে সেন্ট বার্নার্ড তা লক্ষ্য করেছিলেন।
খ্রিস্টধর্মে পরিবর্তন, অস্ত্রের বদলে প্রেমের প্রকাশ ও রোমান চার্চ বিরোধিতা
মধ্যযুগে সমাজের অভিজাতবর্গ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নির্ভর করতেন কেবলমাত্র অস্ত্রের উপর। খ্রিস্টভক্তরূপে পরিচিতরাও ঈশ্বরের রাজ্য (Kingdom of God) প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কোনও উপায় বা পথের কথা ভাবতে পারেন নি। কিন্তু কুসেডের অভিঘাতে ১২শ শতাব্দী থেকেই মােহমুক্ত ইউরােপের এক আধ্যাত্মিক জাগরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেন্ট ফ্রান্সিস এবং অন্যান্য খ্রীষ্ট ভক্তের চেষ্টায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তনের সূচনা এই সময় থেকেই। খ্রীস্টধর্মের প্রতীক ‘ক্রস’ নতুনতর ব্যঞ্জনা নিয়ে আবির্ভূত হয়। বহু খ্রীস্টানের কাছে এই প্রতীক শক্তির রূঢ় আস্ফালনের বদলে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রেমের সীমাহীন শক্তির কথা। শতাধিক বছরের নিষ্ঠুর হত্যা, বিপর্যয় ও ব্যর্থতার পর সাধারণ মানুষের হৃদয়ে ক্রসের আদর্শ ভিন্নতর প্রেরণার সঞ্চার করেছিল। উন্মত্ত শক্তি প্রয়ােগ, সুবিশাল সামরিক অভিযান যে উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে নি, ভালবাসায়, প্রীতির প্রকাশে যে অর্জিত হতে পারে ১২১২ সালে এই দৃঢ় বিশ্বাস উদ্দীপিত করেছিল বালক ক্রুসেডারদেরকে। তথাকথিত মহামান্যদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সকলের কাছে প্রমাণ করে দিয়েছিল রক্ত-লিপ্ত ক্রুসেডের ইতিহাস। সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ অনেক সময়ে তাই অলৌকিকতার আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। এই বিশ্বাসের ফলে সৃষ্ট হয়েছিল সেন্ট ফ্রান্সিস এবং সেন্ট জোয়ান অফ আর্কের অলৌকিক জীবননেতিহাস। ১২৫১ এবং ১৩২০ সালে প্যাস্টোরেল্লি (Pastorelli) আন্দোলন প্রমাণ করে দিয়েছিল কতো সহজে সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে প্রদীপ্ত করা যায়। অলিয়াঁর (Orleans) অপাপবিদ্ধা কুমারী জোয়ানকে বিচারকগণ প্রশ্ন করেছিলেন অসংখ্য প্রজাপতি যে মেঘস্থায় সৃষ্টি করে, তিনি তারই আড়ালে থেকে যুদ্ধরত ছিলেন কিনা। মধ্যযুগে মানুষ বিশ্বাস করত প্রজাপতিদের হালকা পাখার উপরই নাকি আত্মা বিচরণ করে। তাই স্টিফেন এবং অ্যাসিসির তরুণ সন্ত ফ্রান্সিসের পরিমণ্ডলে অসংখ্য প্রজাপতির কল্পনা করে নিয়েছে বিশ্বাসী খ্রিস্টান মাত্রই। রূঢ় বাস্তব প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ সাধারণ সরল মানুষকে যখন ক্রুসেডের ব্যর্থতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল তখন অলৌকিকতার বার্তাবাহী প্রজাপতির প্রতীকের ব্যবহার অতিপ্রাকৃতের জন্য মানুষের আকুতির কথাই ঘোষণা করে। ১২শ শতকের মধ্যভাগে সামরিক অভিযান এবং ধর্মের নামে রক্তপাতের বিরুদ্ধে বারবার সাধারণ মানুষের বিরূপতা প্রকাশিত হয়েছে। শতাব্দী শেষ হবার আগেই পােপকে তাই একক প্রচেষ্টায় ক্রুসেড পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব বহন করতে হয়েছে। পােপের এই ভূমিকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পশ্চিম ইউরোপের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও স্বাভাবিক ভাবেই পরিস্ফুট হয়েছিল।
ক্রুসেড উপলক্ষে সমস্ত খ্রীস্টান জগতের সুদীর্ঘকালব্যাপী বিপুল প্রচেষ্টার মর্মান্তিক পরিণতি, বিশেষ করে তাকে বিপথগামী করার অভিসন্ধি, ইউরােপের বহু অঞ্চলে তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। তীক্ষ্ণ সমালোচনা, নিন্দা ও ঘৃণার যে উত্তাপ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালী এবং জার্মানীতে সঞ্চারিত হয়েছিল তার ফলে বহু সাধারণ মানুষের মন চার্চ-বিরোধী হয়ে গিয়েছিল। ফরাসীরাজ পুণ্যাত্মা নবম লুই স্বয়ং ধর্মের প্রেরণায় ক্রুসেড পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু তার শোচনীয় পরিণতি ক্রুসেডের আদর্শ এবং ফরাসী শিভ্যালরীর গরিমা ম্লান করে দিয়েছিল। প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন রাজমাতা ব্লাঁশ (Blache) অবশ্য ধর্মোন্মাদ পুত্রকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। পুত্রের অনুপস্থিতিকালে পোপ চতুর্থ ইনােসেন্ট কর্তৃক হোয়েনস্টফেন বংশীয় সম্রাট চতুর্থ কনরাডের বিরুদ্ধে ক্রুসেডেরও বিরোধী ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে সেন্ট লুইও অবশ্য সমাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের বিরুদ্ধে পােপ-ঘোষিত ধর্মযুদ্ধে যোগদানের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই সময় থেকেই ক্রুসেড শব্দটি সহজ সরল মানুষের মনে বিরূপতার সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে। জার্মানীর রিজেনবার্গে (Regensburg) ক্রুসেডে যোগদানেচ্ছুদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। পোপের প্রতিনিধি ক্রুসেডার সংগ্রহ করতে এলে পাসাউ-এর (Pass) ক্যাথিড্রাল-কর্তৃপক্ষ তার বিরোধিতা করেন। ফ্রান্সেও এ সময়ে গড়ে ওঠে প্রতিধর্মযুদ্ধের (Counter Crusade) আন্দোলন। পোপের নেতৃত্বে আস্থাহীন, ‘Master from Plungary’ রূপে সম্মানিত জ্যাকব দীনদরিদ্র মানুষের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন জেরুজালেমে তার সহযাত্রী হবার জন্য। দক্ষিণ ফ্রান্সে বহু কবির রচনা ক্রুসেডারগণ নির্বোধ, পাপী এবং উন্মাদরূপে ধিক্কৃত হন। ১২শ ও ১৩শ শতকে এই জনসমর্থিত আন্দোলন রোমান চার্চের সর্ববিধ প্রচেষ্টার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে শান্তি, মৈত্রী এবং ভালবাসার প্রসারে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থন পাওয়া যায় ফ্রান্সিসকান (Franciscan) অধ্যাত্মবাদীদের চিন্তা ও আচরণের মধ্যে। ইংল্যান্ডে জন ওয়াইক্লিফ ও লােলার্ড সম্প্রদায়, এবং বাপ্টিস্ট ও কোয়েকারগণও অনুরূপ প্রেরণায় আন্দোলিত হয়েছিলেন।
তাছাড়া ক্রুসেড উপলক্ষ্য করে সমস্ত খ্রিস্টান জগতের দীর্ঘকালব্যাপী বিপুল এর পরিণতি, বিশেষ করে চার্চের নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে বিপথগামী করার অভিসন্ধি ১২শ ও ১৩শ শতকে সমস্ত খ্রিস্টান জগতে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করেছিল। ইংলণ্ড, ফ্রান্স, ইতালী এবং জার্মানীতে নিন্দা, ঘৃণা ও নির্মম সমালোচনার যে উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছিল তার ফলে চার্চ-বিরােধী এক দৃষ্টিভঙ্গী মানুষের মনে সহজেই গড়ে উঠেছিল। ফ্রান্সে পূণ্যাত্মা নবম লুই বিশুদ্ধ ধর্মীয় প্রেরণায় যে ক্রুসেড পরিচালনা করেছিলেন তার মর্মান্তিক ব্যর্থতা একই সঙ্গে ক্রুসেডের আদর্শ এবং ফরাসী শিভালরীর গরিমাকে ম্লান করে দেয়। রোজেনবার্গ, পাসাউ প্রভৃতি স্থানের বিচ্ছিন্ন কিন্তু অভাবনীয় কিছু ঘটনায় যাজক, সন্ন্যাসী ও নাইট সম্প্রদায়ের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরােধিতার প্রতিফলন ঘটেছিল। দক্ষিণ ফ্রান্সের বহু কবির রচনায় ধর্মযােদ্ধারা নির্বোধ, পাপী এবং উন্মাদ বলে ধিক্কৃত হয়েছিলেন। গুইলেম ফিগুয়েরা (Guillem Figueira) ঘৃণাভরে ঘােষণা করেছিলেন যে মহামান্য পােপ বিধর্মী সারাসেনদের স্পর্শ করতে পারেননি, কিন্তু অসংখ্য খ্রিস্টান গ্রীক ও লাতিন নিধনে পশ্চাদপদ হননি। আলবিজেনসিয়ান (albigensian) ধর্মদ্রোহীদের উৎখাত করার বহু পূর্বেও দক্ষিণ ফ্রান্সে এ জাতীয় সমালোচনার অস্ফূট গুঞ্জন শােনা যেতো। এই সময়েই ক্যাথার (Cathar) এবং সমগােত্রীয় অন্যান্য বিক্ষুব্ধবাদীরা শান্তি ও করুণার ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এদের মূল বক্তব্য ছিল খ্রিস্টানদের কোনও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশ নেওয়া উচিত নয়। ১২শ ও ১৩শ শতকের জনসমর্থিত এই আন্দোলনগুলো রোমান চার্চের সর্ববিধ প্রচেষ্টার প্রতি উদাসীন থেকে প্রেম ও মৈত্রীর প্রসারে আত্মনিয়ােগ করেছিল। বিখ্যাত কানন (Canon) আইনজ্ঞ হসটিয়েনলিস ক্রুসেডের স্বপক্ষে যে যুক্তিজাল বিস্তার করেছিলেন শক্তিমদোন্মত্ত পােপতন্ত্র তা আপন পার্থিবশক্তির প্রসারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অন্তরের কথা রূপ নিয়েছিল ফরাসী কবি রুতবায়ফের (Rutebuef) লেখাতে। ব্যঙ্গ-কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত এই কবি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘স্ত্রীপুত্র ছেড়ে, প্রিয় বস্তুগুলি পরিত্যাগ করে দূর বিদেশে রণজয়ী হয়ে আমার কি লাভ? আমি তাে জেরুজালেমের বদলে পারীতে বসেই ঈশ্বরের আরাধনা করতে পারি। ১৩শ শতকে সত্তরের দশকের মধ্যেই ক্রুসেডের চরিত্র এবং উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ইউরোপের ভাবজগতে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তার থেকে জন্ম নিয়েছিল ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ।
সা্মন্ততন্ত্রের অবক্ষয় এবং নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনধারায় পরিবর্তন
সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি শিথিল করে দিয়ে ক্রুসেড ইউরােপ খুব বড় রকমের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধন করেছিল। অনুচর সমেত ক্রুসেডে যােগদানের জন্য অর্থ সংগ্রহে অতিউৎসাহী ভূস্বামীরা দলে দলে তাদের ভূসম্পত্তি, বিশেষ-অধিকার ইত্যাদি বিভিন্ন কমিউনগুলির কাছে, এমন কি সার্ফ সম্প্রদায়ের কাছে বিক্রয় করতে, অথবা বন্ধক রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইউরােপের সর্বত্র, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং জার্মানীতে বিশাল বিশাল ভূসম্পত্তি এভাবে হস্তান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন ভূস্বামী শ্রেণী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, তাদের জমিজমা, সম্পত্তি কিনে মাথা তুলে দাঁড়াল নতুন এক শ্রেণী। তা ছাড়া অসংখ্য ভ্যাসাল (Vassal) তাদের প্রভুদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করার ফলে কৃষিকার্যের জন্য লােকজনের তীব্র ঘাটতি দেখা গেল। এর ফলে লাভ হয়েছিল সার্ফ বা ভূমিদাসদের। বন্ধন-দশা ঘুচে তাদের অধিকাংশই স্বাধীন দিনমজুরের স্তরে উন্নীত হয়ে যায়। সামন্ততন্ত্রের আঁটসাট কাঠামো শিথিল হয়ে যাওয়ার অপর একটা কারণ এই, যে মন সুপ্রাচীন বিধি বিধান, আজীবন আনুগত্য স্বীকারের শপথ ও অনুষ্ঠান এই ব্যবস্থার ভিত্তি স্বরূপ ছিল সেগুলিও ক্রুসেডের উন্মাদনার জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল। মুখ্যভূম্যধিকারীর সঙ্গে উপসামন্ত এবং ভিলান ও সার্ফের যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল ক্রুসেডের শেষে তাদের পূর্ণ পুনর্প্রতিষ্ঠার আর সম্ভাবনা ছিল না। আর ক্রুসেডার বেশি সংগৃহীত হয়েছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, নর্মান শাসনাধীন ইতালী প্রভৃতি দেশ থেকে যেখানে সামন্ততন্ত্র সব থেকে দৃঢ় ও ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ক্রুসেডের সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াও স্বাভাবিক কারণে এইসব অঞ্চলেই ছিল প্রবলতর।
এ ছাড়া ইউরােপের নাগরিক এবং গ্রামীণ জীবন-ধারায় আরো একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছিল ক্রুসেড। এই অভিযানে অংশ নেওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় বহু ভূস্বামী তাদের নিজ নিজ কর্তৃত্বাধীন এলাকার নগর বন্দর ইত্যাদির উপর বিশেষ অধিকার মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তরীকরণে রাজী হন। ফলে স্বাধিকারপ্রাপ্ত নগরের সংখ্যা অকস্মাৎ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। ক্রুসেডে যোগদানের জন্য অসংখ্য সার্ফ বা ভূমিদাস অনায়াসে মুক্তি অর্জন করেছিল। আর ঐ সময় বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ধিষ্ণু নগরগুলিতে দ্রুত-গড়ে-ওঠা কুটীর-শিল্পে অংশ নেবার সুযােগও তাদের ম্যানর ছেড়ে দিতে প্রলুব্ধ করে। এরফলে ১১শ শতক শেষ হবার আগেই ইউরােপের নগর ও গ্রামাঞ্চলের চেহারা দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। ইউরােপের সমাজ-জীবনেও শুভ রূপান্তর এনেছিল ক্রুসেড। বহুক্ষেত্রে গৃহকর্তার সুদীর্ঘ অনুপস্থিতিতে গৃহকত্রী স্বামীর ভূসম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আত্মনিয়ােগ করতে বাধ্য হন। নতুন দায়িত্ব, বহুক্ষেত্রে সমাজে তাদের বৃহত্তর মর্যাদার অধিকারিণী করে দিয়েছিল। আর সুখের কথা ক্রুসেডের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে নারী জাতির প্রতি এই নতুন সসম্ভ্রম দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে যায় নি।
রাজশক্তির শক্তি বৃদ্ধি ও জাতীয়তাবোধের বিকাশ
আবার, সামন্ত শ্রেণীর দুর্গতি, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে, রাজশক্তিকে সবল করে দিয়েছিল। ‘Over mighty subjects’দের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে রেহাই পেয়ে দেশ শাসনের ব্যাপারে রাজার শক্তি বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় ছত্রভঙ্গ-হয়ে-যাওয়া-সামন্ত শ্রেণীর হাত থেকে শাসন ক্ষমতা রাজার হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে এই সময় থেকেই। সামন্ত শ্রেণীর অবক্ষয়ে রাজশক্তির অর্থনৈতিক বনিয়াদও দৃঢ় হতে আরম্ভ করে। ক্রুসেডে অংশগ্রহণকারী বহু ভূস্বামীর আর স্বদেশে ফেরা হয়নি, অনেকক্ষেত্রে তাদের উত্তরাধিকারীদেরও হদিশ মেলে নি, ফলে সে সমস্ত সম্পত্তি রাজার অধিকারে চলে গিয়েছিল। তাছাড়া এই সুযােগ ফ্রান্সে ফিলিপ অগাস্টাস এবং ইংলণ্ডে দ্বিতীয় হেনরী ১১৮৮ সালে প্রজাদের উপরে ‘সালাদীন টাইদ’ নামে এক কর-ভার চাপিয়ে দেন। মধ্যযুগে প্রত্যক্ষ কর প্রবর্তনের এটাই বােধহয় প্রথম দৃষ্টান্ত। এ জাতীয় কর আদায়ে ইংলণ্ডেশ্বর তৃতীয় হেনরী এবং নরওয়ের রাজা চতুর্থ হ্যাকনও বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। এই সব কিছুর অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হিসেবে পূর্বোক্ত রাষ্ট্রগুলিতে সুসংহত কেন্দ্রীয় শক্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততন্ত্র দুর্বল হতে থাকে। রাজশক্তি অন্য এক উপায়েও লাভবান হয়েছিল। ক্রুসেডে অংশ নিতে ইউরােপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়েছিল। তাদের ভাষা আচার ব্যবহারে কিছুই মিল ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই একের সঙ্গে অপরের বিপুল পার্থক্য দৃঢ়তর করেছিল তাদের স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়তা। জাতিগুলির মধ্যে ভেদাভেদ জ্ঞানের অস্তিত্ব মেনে নিয়েই দ্বিতীয় ক্রুসেডে ফরাসী ও জার্মান ক্রুসেডারদের স্বতন্ত্রভাবে প্রাচ্য অভিমুখে পরিচালনা করা হয়। একই দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে একাত্মতার (সঙ্কটাকীর্ণ বিদেশের বৈরী পরিবেশ যা তীক্ষ্ণতর করেছিল) মধ্যে হয়তো ভবিষ্যতের জাতীয়তাবোধের একটা উপাদানের আভাস মেলে। এই ঐক্য সর্বত্র রাজশক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এক রাজচ্ছত্রতলে সমবেত হয়ে অনির্দেশের পথে যাত্রা মানুষের মনে রাজার প্রতি এক নতুন ও অভূতপূর্ব আনুগত্যের সঞ্চার করেছিল।
বাণিজ্যের প্রসার ও ভোগ্য পণ্যের আমদানি
১১শ শতকে ইউরােপের, বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলির, ব্যবসা বাণিজ্যের অভূতপূর্ব প্রসার যে ক্রুসেডের জন্যই সম্ভব হয়েছিল তা আজ সর্বজনবিদিত। ক্রুসেডারগণ পুণ্যভূমি-জেরুজালেম খ্রিস্টান অধিকারে রাখতে অক্ষম হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু অভিযানের অনুষঙ্গ হিশেবে ভূমধ্যসাগরে শুধু মুসলমান আধিপত্যেরই অবসান হয়নি, ঐ অঞ্চল থেকে বাইজানটাইন প্রভাবও লুপ্ত হয়ে গেল। ভেনিস, জেনােয়া, পিসা, আমাল্ফি, মার্সেই, বার্সেলােনা প্রভৃতি প্রসিদ্ধ বন্দরগুলি মুসলমান অধিকৃত প্রাচ্য দেশগুলির সঙ্গে, বসফোরাস ও কৃষ্ণসাগর উপকূলবর্ত এলাকায় ক্রুসেডের আগে থেকেই উল্লেখযােগ্য বাণিজ্যিক-সম্বন্ধ স্থাপন করেছিল। কিন্তু ক্রুসেডের ফলে এই বাণিজ্যের যে প্রসার ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল তা বিস্ময়কর। বন্দরগুলোর প্রয়ােজন অনুসারে অন্তর্দেশেও বহু সমৃদ্ধ নগরের পত্তন হয়েছিল। বহু জার্মান, ফরাসী ও ফ্লেমিশ নগরের জন্মকাহিনীর শুরু এখান থেকেই। ভেনিসের উদ্যোগে কনস্টান্টিনােপল বিজয় ছাড়াও, ধর্মযােদ্ধা ও রসদসম্ভার এবং তীর্থযাত্রীদের প্যালেস্টাইনে পৌঁছে দেয়ার জন্য যথােপযুক্ত পরিবহণ-ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও প্রাচ্যের লােভনীয় পণ্যাদি প্রচুর পরিমাণে আমদানীর ব্যাপারে ইউরােপীয় বণিককুলে দেখা গিয়েছিল এক অভূতপূর্ব ব্যস্ততা এবং কর্মকুশলতা। প্রয়ােজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো বেশিসংখ্যক এবং আরাে বড় বড় জাহাজ তৈরী শুরু হলো। উত্তরের দেশগুলিও, বিশেষ করে ইংল্যান্ড পিছিয়ে রইল না। ইতালী ও স্যারাসেন (মুসলিম) নৌবিদ্যার কাছে ইউরােপীয় নাবিকদের অনেক ঋণ আছে। অনেকের অনুমান কম্পাস ও এস্ট্রোলেবের ব্যবহার স্যারাসেন বা মুসলিমদের কাছ থেকেই শিখেছিল ক্রুসেডারগণ। যাইহোক, অকূল সমুদ্র-পথকে বাণিজ্যের প্রয়ােজনে এমনিভাবে নিরন্তর ব্যবহার শেষ দেখা গিয়েছিল রােমান সাম্রাজ্যের গৌরব ও সমৃদ্ধির দিনগুলোতে। তারপর দীর্ঘদিন সমুদ্র ছিল অবহেলিত। ক্রুসেডের ফলেই আবার প্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে সমুদ্রপথে ইউরােপের যােগাযােগ স্থাপিত হলো। প্রাচ্যের বহু বাণিজ্য-সম্ভার পরমাদৃত ছিল ইউরােপের ধনী পরিবারগুলোতে। এখন থেকে লােভনীয় সে সব বস্তু ইউরােপের বাজারে থরে থরে দেখা যেতে লাগল। কার্পাস ও রেশমী বস্ত্রাদি, চিনি, সুরা, কম্বল, মশলা, কাঁচ ও মাটির পাত্র, ওষুধ, সুগন্ধি, বিভিন্ন প্রকারের রঙ ও তেল, খেজুর, অপরিচিত নানা জাতের শস্যের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হলো ইউরােপের ছোটবড় ব্যবসা কেন্দ্রগুলিতে। বাণিজ্য অভাবনীয় সমৃদ্ধি এনে দিল ইউরােপকে। প্রাচ্য দেশগুলিতেও ইউরােপীয় পণ্যের জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে বহুল পরিমাণে রপ্তানী হতো কারু ও কুটির-শিল্পজাত পণ্যাদি। বাইজানসিয়াম ও মুসলমান-অধিকৃত দেশগুলি মারফৎ উন্নততর ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা তৈরী হলো ইউরোপে। লেনদেন ব্যবস্থার ব্যবহারিক দিকগুলি এভাবেই স্পষ্ট আকার নিয়েছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং এই সময় থেকে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলনও শুরু হলো বাণিজ্যের সুবিধার জন্য। সিসিলিতে প্রচলিত ডুকাট (ducat), ফ্লোরেন্স-এর ফ্লোরিন (florin) এবং ভেনিসের সেকুইন (Sequin) ছড়িয়ে পড়ল দেশদেশান্তরে। আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্যের এই প্রচণ্ড বৃদ্ধির ফলে এবং নতুন নতুন নগর ও বন্দরের উৎপত্তি ও শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শুভ আবির্ভাব হলো ইউরােপীয় সমাজে। ক্রুসেড যখন শুরু হয় ইউরোপ তখন ছিল কৃষিপ্রধান, সামন্ততন্ত্র তুঙ্গে। আর ধর্মোন্মাদনার সঙ্গে ‘জার্মান বর্বরতা’ মিশে গিয়েই তৈরী হয়েছিল ক্রুসেডের প্রেরণা ও পরিবেশ। ক্রুসেডের অবসানের পর দেখা গেল ইউরোপের চেহারা ও চরিত্রের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। মহাদেশে ক্ষুদ্র শিল্প এবং বাণিজ্যের বিস্ময়কর প্রসার যা ঘটিয়ে দিয়েছে তাকে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব বললে হয়তো অতিশয়ােক্তি হয় না। এই বাণিজ্য-প্রসূত বিপুল সমৃদ্ধিই ইউরােপীয় রেনেসাঁর অধ্যায়ে শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের অকল্পিত ব্যয়ভার বহন করতে সাহায্য করেছিল ইতালী, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের নাগরিকদের।
ইউরােপীয়দের (বিশেষ করে ধনী পরিবারগুলিতে) দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব এসে পড়ে প্রাচ্যের বর্ণবহুল জীবনযাত্রার। মুসলমান দেশগুলিতে ক্রুসেডাররা এমন এক সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছিল যার মান ছিল অনেক উন্নত, বৈভবে মনােমুগ্ধকর এবং বৈচিত্র্যে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ফলে ইউরােপীয়দের গৃহে বিলাস-ব্যসনের নিত্য নতুন উপকরণের আমদানী হতে শুরু করল, অনাস্বাদিত এক সৌষ্ঠবের সঞ্চার হলো তাদের গৃহস্থালীতে। ভোগ্য-পণ্যের তালিকাও ক্রমশ স্ফীততর হতে শুরু করল।
ভৌগলিক বিষয় সহ অন্যান্য জ্ঞানবৃদ্ধি এবং সাহিত্য ও সঙ্গীতের বিকাশ, ইউরোপীয় চেতনায় পরিবর্তন
তীর্থভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের এই অভিযান ইউরােপের মানসিক দিগন্তেরও উল্লেখযােগ্য বিস্তার ঘটিয়েছিল। ক্রুসেডের ফলে ইউরোপীয়দের ভৌগােলিক জ্ঞানবৃদ্ধি সর্বজন-স্বীকৃত একটি তথ্য কনস্টান্টিনােপলের আরও পূর্বে যে বিশাল অখ্রীস্টান, বৈরী জগৎ ছিল সে সম্পর্কে ইউরোপীয়দের সুনিশ্চিতভাবে সচেতন করে দিয়েছিল এই অভিযানগুলি। প্রথম ক্রুসেডের আগে পর্যন্ত এই ভূভাগ সম্পর্কে বিশেষ ঔৎসুক্য তাদের মনে ছিল না। ১০৯৫ খ্রীষ্টাব্দে ক্লেরমঁ (Clemont) কাউন্সিলে পােপ আরবানের বক্তৃতায় খ্রীস্টানদের এই অজ্ঞান তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। তিরিশ বছর পর ইংরেজ ঐতিহাসিক ম্যালমেসূবেরীর উইলিয়ম পােপ আরবনের ভাষণের এই ইঙ্গিতটুকুর ব্যাখ্যা করেন। এশিয়া ও আফ্রিকার বিপুল অখ্রিস্টান জনসংখ্যা খ্রীস্টান জগতের অস্তিত্বের পক্ষে যে কী ভয়ানক তা তার লেখায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। উইলিয়ম আক্ষেপ করেছিলেন মিথ্যেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে ‘পৃথিবীর তিনভাগের একভাগ খ্রিস্টান ইউরােপ, শক্তি সামর্থ্যে বাকি দুই অংশের সমতুল্য’। পৃথিবীর বাস্তব চেহারা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়াও ইউরােপীয়দের প্রত্যক্ষ ফল লাভ কম হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য সামুদ্রিক অভিযানের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, এশিয়া এবং আফ্রিকার বহু দেশ সম্পর্কে ইউরােপের মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃততর হয়ে ওঠে। তৈরী হয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সন্তোষজনক মানচিত্র। আর অসংখ্য তীর্থযাত্রীদের পরিক্রমার ইতিহাস, পর্যটকদের সুদূর মঙ্গোলীয় খানের দেশ পর্যন্ত এমন বৃত্তান্ত (১৩শ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রখ্যাত মার্কো পােলোর অবিস্মরণীয় ভ্রমণ কাহিনী স্মর্তব্য) মুগ্ধ ও বিস্ময়-বিহ্বল করেছিল ইউরোপের জনচিত্ত।
প্রায় দুশো বছর ধরে অগণিত মানুষের এই প্রাচ্য দেশগুলিতে যাওয়া-আসার ফলে অঞ্চলিক সকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়েছিল খ্রীস্টান জগৎ। এই মানসিক প্রসারের ফলে, অদেখা অচেনাকে জানার ফলে সৃজনশীল হয়েছিল ইউরােপের মনীষা, নানা স্বাদে, বিচিত্র রূপে ও রসে ঐশ্বর্যশালী হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য জগতের সাহিত্য ও সংস্কৃতি। তা ছাড়া প্রাচুর্য ও বৈভব তৈরী করে দিয়েছিল জ্ঞানচর্চার অনাস্বাদিত এক অনুকূল পরিবেশ। ক্রুসেডারদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে, তাদের বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গকে কেন্দ্র করে রচিত হতে হল বহু উল্লেখযোগ্য কাহিনী, কবিতা এবং ইতিহাস। ক্রুসেডের প্রেরণাজাত গীতিকবিতা অননুভূত এক সুষমার সন্ধান দিয়েছিল সে যুগের ইউরোপীয়দের। অনুবাদে-অধরা এই কবিতাগুলি গীর্জার গম্ভীর গম্ভীর ঘন্টাধ্বনির মতো পূত অনুরণনের মধ্য দিয়ে অসংখ্য অতিসাধারণ মানুষকে আদর্শের জন্য সর্বস্ব ত্যাগের কথা মনে করিয়ে দিত। এ কবিতাগুচ্ছে বিধৃত হয়ে আছে এমন বহু মানুষের জীবনকাহিনী যারা পুণভূমি থেকে তীর্থ-দর্শনের তৃপ্তি নিয়ে ফিরে এসেছিল অথবা এমন আরও অনেকের কথা যারা স্বদেশপ্রবর্তনে বাধ্য হয়েছিল জেরুজালেম উদ্ধারে ব্যর্থতার বেদনা বহন করে। বেশ কিছু জার্মান কবির রচনায় (যেমন হাইনরিখ হন্ মোরাঞ্জেন বা Heinrich Von Morungen, ফ্রেডরিক ফন হাউসেন বা Frederick Von Hausen, এবং ওয়ালথার ফন দ্যু ভোগেলওয়াইদ বা Walther Von du Vogelweide) ক্রুসেডে অংশগ্রহণকারী এমন বেশ কিছু নাইটের চিত্তের বিচিত্র অনুভূতি, স্বপ্ন ও ব্যর্থতা, স্বদেশ ও প্রিয়-বিচ্ছেদে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের বেদনা অনবদ্য রূপ পেয়েছে। মানুষের নিভৃত ভাবনার এমন অসংকোচ উন্মোচন, হৃদয়ের আর্তি ও আকুতির এমনি অন্তরঙ্গ প্রকাশ আগে সাহিত্যে সেভাবে কখনও দেখা যায়নি। Minnesang নামক গীতিকবিতাগুলিতে আঞ্চলিক ভাষায় সহজিয়া ভাবের প্রকাশ দেখা যায়। ক্রুসেড মানুষের মনে ভয় ও ভাবনার, স্বপ্ন ও সাধনার যে অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল তার থেকেই বহু Minnesinger তাদের গীতিকবিতার বিষয়বস্তু খুঁজে পেয়েছিলেন। এছাড়া ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ও ক্রুসেডের ঘটনাবলী থেকে উপাদান সংগ্রহ করে রচিত হয়েছিল ভিলহারদুইঁ (Villhardouin) এবং জয়নভিলের গ্রন্থ। জেরুজালেম ও রােমানিয়ার অ্যাসাইজগুলোও (assize) ফিউডালিজম বা সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে বহু নতুন তথ্য সরবরাহ করছে। রম্যরচনারও অভাব হয়নি। শিভ্যলরীকেন্দ্রিক অপরূপ কাব্যকাহিনীগুলিও নবীনতর রূপে দেখা দিয়েছিল এই সময়ে। আলেকজান্ডার, সোলেমনের কীর্তিও নবকলেবরে আবির্ভূত হলো ইউরােপীয় সাহিত্যের অঙ্গনে। আর সব থেকে বিস্ময়কর যে প্রাপ্তি তা হলো ক্রুসেডের পর থেকেই প্রাচ্যের মধুর বিরহমিলন গাথাগুলি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যে বিধৃত হতে শুরু করেছিল। ধর্মগ্রন্থও উপেক্ষিত হয়নি। ১১৪১ সালে লাতিন ভাষায় কোরান অনুদিত হয়। ১২শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পারীতে আরবীয় ও আর্মেনীয় ভাষা শিক্ষাদানের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অচেনা, অদেখা প্রাচ্যের দেশগুলিতে দেখা মেলে অনেকে প্রাণীর যাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ইউরােপীয়দের কোনও ধারণাই ছিল না। প্রাণীবিদ্যার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বহুস্থানে প্রতিষ্ঠিত হলো চিড়িয়াখানা। তাছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমানদের পারদশিতা মুগ্ধ করেছিল ক্রুসেডারদেরকে। এই সূত্র ধরে পরবর্তীকালে বহু মুসলমান চিকিৎসক আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ইউরােপের বহু দেশে। মঁপেল্লিয়ারে (Montpellier) এদের সাদর অভ্যর্থনা তো সমকালীন সমাজে রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছিল।
কিন্তু শুধু ব্যবসায়িক লেনদেনের মধ্যে নয়, তরী নিয়ে নিত্য নতুন দেশে যাবার তীব্র বাসনাতেও নয়, পুরােনো এবং পরিণত এক সভ্যতার সঙ্গে দৃশ্য-অদৃশ্য অসংখ্য পথে ইউরোপের পরিচয় নিবিড়তর করার মধ্যেই নিহিত আছে ক্রুসেডের গুরুত্ব। বিদেশী সংস্কৃতির প্রাণভাণ্ডার থেকে বহু বিচিত্র উপকরণ গৃহপ্রত্যাগত ক্রুসেডারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রায় সমগ্র মহাদেশে। আর তা কোনও একটি অঞ্চলে বা বিশেষ একটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বলেই ইউরােপের সজীব, সুস্থ ও সচেতন মনীষা সামগ্রিকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। ক্রুসেডের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম এবং বীক্ষণশীলতার উন্মেষ। শুধু দিন যাপনের গ্লানি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জীবনে ‘সীজার ও ক্রাইস্ট’ এর স্থান ও মর্যাদা নিয়ে দ্বন্দ্ব, নবলব্ধ শক্তির আস্ফালনে মত্ত নগরগুলির সঙ্গে রাজশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা – এইসব পুরোনো ঘটনা ও সমস্যায় অভ্যস্ত ইউরােপের প্রায়-বদ্ধ জীবনে নতুন ঢেউ এসে অঘাত করতে শুরু করল, ক্রমশ আলোড়িত, উন্মথিত হয়ে উঠল ইউরােপীয় চেতনা। এই আত্মপ্রসারণের উদ্বোধনের মধ্যে, সংঘাত ও সমন্বয়ের মধ্যেই ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট শুনতে পেয়েছেন রোনেসাঁর আবির্ভাবের পদধ্বনি।
প্রাচ্যে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
ইউরােপ থেকে বহু দূরে, সমুদ্র পারে, সিরিয়ার সূর্যকর-স্নাত প্রদেশে ফ্রাঙ্ক-ক্রুসেডার স্থাপিত জনপদগুলি সহিষ্ণুতা ও প্রীতির উদার বন্ধনের, মুসলমান সমাজের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক আশ্চর্য সুন্দর আদর্শ তুলে ধরেছিল। সম্প্রীতির সে স্নিগ্ধ-বন্ধন দুশো বছরেও শিথিল হয়নি। মধ্যযুগীয় স্পেনে মুসলমান, ইহুদী এবং খ্রীস্টানদের শান্তি ও মৈত্রীর মধ্যে বাস করার মতােই এই আদর্শ ইউরােপের ভাবজগতের বিকাশের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পার্শ্ববর্তী মুসলমান রাজ্যের অভিজাতবর্গের সঙ্গে খ্রীস্টানদের মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠতেও দেরী হয় নি। বিধর্মীদের উষ্ণ আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় পশ্চিমাগত খ্রীস্টানদের মুগ্ধতাও লুকানো থাকে নি। “Noble infidel” এর এই প্রত্যক্ষ পরিচয় ইউরােপেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। ‘Greatest of the courtly epic poets’ রূপে পরিচিত কবি উলফ্রেন ফন্ এশ্চেনব্যাককে ‘পরকে আপন করার-মতে-হৃদয়ের এই প্রসার’ মুগ্ধ করেছিল। জেরুসালেম উদ্ধারের অভিযানে যারা অংশ নিয়েছিলেন তারাও সানন্দ-বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছিলেন সিরিয় খ্রীস্টানগণ মুসলমান রাজ্যগুলিতে কী সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে কর্মরত হয়ে আছেন।
জার্মান কবি ফ্রীডাঙ্ক (Freidank) ঘােষণা করেছিলেন একরে (Acre) বসবাসকারী খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টানদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাবার মতো শক্তি কোনও ক্রুসেডারদের নেই। শার্ত্রের (Chartres) এক ফরাসী কবি ফুলশেরের (Fulcher) রচনাতেও সম-প্রকৃতির অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিল। নিকট প্রাচ্যে স্থাপিত ফ্রাঙ্ক রাজ্যদ্বয়ে (জেরুজালেম রাজ্য (১০৯৯-১১৮৫) এবং একর (Acre) (১১৪৯-১২৯১)) পশ্চিমা নাইটরা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এবং অল্পায়াসে আঞ্চলিক রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার আয়ত্ত করে নিতে পেরেছিলেন এবং প্রতিবেশী মুসলমান অভিজাতদের সঙ্গে তাদের গড়ে উঠেছিল প্রীতি ও মৈত্রীর এক পরম সুন্দর সম্পর্ক। উপহার বিনিময়, উভয় সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং, বিস্ময়ের কথা, সংগ্রামকালে প্রদর্শিত শৌর্যবীর্যের জন্য একে অপরের সুখ্যাতি-এমনই এক পরিবেশ রচনা করেছিল যার মধ্যে খ্রীষ্ট ও মহম্মদের ভক্তরা অক্লেশে, পরম নিশ্চিন্তার মধ্যে বসবাস করতে পারতেন। ১৩শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জনৈক রিকলদাস দ্য মন্তি ক্লাসিয়াস (Richoldus de Monte Cracious) মসজিদে অভ্যর্থিত হয়ে মুসলমানদের নামাজ পড়ার উষ্ণ আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিধর্মীদের আতিথেয়তা ও মহানুভবতা পশ্চিমাগত খ্রীস্টানগণকে প্রশংসামুখর করে দিয়েছিল বার বার। ‘Noble infidel’দের এই প্রত্যক্ষ ও নিবিড় পরিচয় পশ্চিম জগতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরকে নিকট বন্ধু করার এই মন্ত্র, হৃদয়ের এই প্রসারতা শুধু সুখ্যাত জার্মান কবি উল্ফ্রাম ফন্ এস্চেনব্যাক (Wolfram Von Eschenbagh – ‘greatest of the courtly epic poets) কেই স্পর্শ এবং অভিভূত করেনি, পরবর্তীকালে বহু কবি ও মনীষীর প্রেরণারও কারণ হয়েছে। অলিভেরাস স্কলাস্টিকাস (Oliverus Scholasticus) স্বয়ং জানিয়েছেন যে সুলতান আল মালিক বাল কামিল কি ভাবে এক পরাজিত ফ্রাঙ্ক বাহিনীকে খাদ্য পানীয় ও আশ্রয় দান করে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন। লুবেকের আর্নল্ড নামক এক লেখক কল্পিত এক মুসলমান চরিত্রের মুখে এই কথাগুলি বসিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমাদের ধর্মবিশ্বাস স্বতন্ত্র কিন্তু আমরা তো সেই এক স্রষ্টা-পিতার সন্তান। ধমীয়-সম্প্রদায় রূপে না হলেও, ভাই হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমরা কি পাশাপাশি বাস করতে পারবো না?’ এ ছাড়া ক্রুসেডে যারা অংশ নিয়েছিলেন, ‘ঘৃণ্য বিধর্মীর’ কবল থেকে যারা পুণভূমি উদ্ধারের বাসনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন তারাও লক্ষ্য না করে পারেননি যে সিরিয় খ্রীস্টানগণ মুসলমান রাজ্যগুলিতে করণিক, দোভাষী, কর্মচারী রূপে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে কাজ করতে কোনও অসুবিধাই বােধ করতেন না। কোনও কোনও স্থান ছিল উভয় সম্প্রদায়েরই তীর্থক্ষেত্র। একরে একটি মসজিদকে গীর্জায় রূপান্তরিত করে, গীর্জার একাংশ আবার মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার ‘Oxen’s Well’-এ মুসলমানদের জন্য একটি প্রসিদ্ধ মসজিদ গড়ে তােলা হলেও সেখানে খ্রিস্টানদের ভক্তি নিবেদনের জন্য একটি প্রার্থনা-বেদীও সংরক্ষিত করার কথা জানা যায়। দামাস্কাসে সৈদানাজার (Saidanaja) মত ভার্জিন মেরীর উদ্দেশ্যে হৃদয়ের অঞ্জলি দেবার জন্য খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মুসলমানদেরও যাওয়া আসার বিরাম ছিলনা। উত্তর আফ্রিকার ধর্মযুদ্ধের ঘনঘটা সত্ত্বেও বহুস্থানে খ্রিস্টান মঠ ও গীর্জায় ধর্মানুশীলন স্বাভাবিকভাবেই পরিচালিত হতো। যুদ্ধের সময় ধৃত এবং দাসরূপে বিক্রীত হবার জন্য আনীত মুসলমান বালক-বালিকাদের পরিত্রাণে তৎপর খ্রীস্টান যাজকের দেখা পাওয়া মােটেই কঠিন ছিলনা ১২শ শতকের উত্তর আফ্রিকায়।
সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক পোপ কর্তৃক সমাজচ্যুত হওয়ার পর আপন উদ্যোগে যে ক্রুসেড পরিচালনা করেছিলেন এবং জেরুজালেমকে যেভাবে খ্রিস্টান, মুসলমান এবং ইহুদী – এই তিন ধর্মের তীর্থস্থান রূপে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তা সহৃদয় মুসলমান মাত্রেরই হৃদয় স্পর্শ করেছিল। ১২২৯ সালে জেরুজালেমের রাজা রূপে সুলতান আল মালিক আল কামিলের (Al Malik al Kamil) সঙ্গে চুক্তি করে তিনি জেরুজালেমের পূত স্থানগুলি খ্রীস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন – খ্রীস্টান অধিকারে থাকলো পবিত্র সমাধি (Holy Sepulchre) এবং মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত রইলাে ওমরের মসজিদ। সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক যেমন মুসলমান সভ্যতা-সংস্কৃতির পরম অনুরাগী ছিলেন, তেমনি মিশরের সুলতান প্রেরিত রাষ্ট্রদূত আমীর ফকরুদ্দীনও পাশ্চাত্য সভ্যতার গুণ-কীর্তন করেছেন পরম আন্তরিকতার সঙ্গে। ক্রুসেড আরম্ভ হবার পর থেকে যে সমস্ত ফ্রাঙ্ক ব্যারন ও বিশপ আরবী ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন তাদের মধ্যে টায়ারের উইলিয়ম (William of Tyre) টোরনের হামফ্রে (Humphrey of Toron), সিডনের রোনাল্ডে (Rainald of sidon) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘টেম্পলার’ সম্প্রদায়ভুক্ত নাইটগণ মুসলমান অভিজাতদের কাছে বিশেষ সম্মানের পাত্র ছিলেন এবং উভয় সম্প্রদায়ের নিবিড় ব্যক্তিগত পরিচয় হয়তো কালে দীর্ঘস্থায়ী সখ্যতার সঞ্চার করতে পারতো। এইভাবে দেখা যায় ক্রুসেড চলাকালীন এবং তা সাঙ্গ হবার পরেও রােমান চার্চ এবং পােপ যখন হিংসায় উন্মত্ত হয়ে সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে মানুষের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করছেন, ঘৃণা এবং বিদ্বেষে বিষাক্ত করে তুলছেন পাশ্চাত্য জগতের পরিবেশ, তখন নিকট প্রাচ্যের বহু অঞ্চলে সহাবস্থান ও পরমতসহিষ্ণুতা, প্রীতি ও মৈত্রীর এক পরম সুন্দর আবহাওয়া রচিত হয়েছে। ধর্মের নামে হানাহানি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর মানব সভ্যতার মহৎ একটি উত্তরাধিকার হিসেবে থেকে গিয়েছিল এই মনােভাব এবং নিকট ভবিষ্যতে এরই প্রভাব গিয়ে পড়েছিল খ্রিস্টান জগতের বিভিন্ন রাজ্যে।
তথ্যঋণ
- মধ্যযুগের ইউরোপ, ১ম খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষৎ, কলকাতা, ডিসেম্বর, ১৯৯৪, পৃ. – ৩০১-৪৫
Leave a Reply