৯ম-১০ শতকে ইউরোপে স্যারাসেন-ম্যাগিয়ার-ভাইকিঙ আক্রমণ, ১১শ-১২শ শতকে দক্ষিণ ইতালি-সিসিলিতে নর্মান বিজয় ও নর্মান রাজ্য

Table of Contents

আক্রমণের সময় ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের অবস্থা ও আক্রমণের ভূমিকা

৮১৪ সালে প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সম্রাট শার্লমানের মৃত্যু ও তার অব্যবহিত পরেই চারদিক থেকে সমস্ত খ্রিস্টান জগৎ বিধর্মী ভাইকিঙ, ম্যাগিয়ার ও স্যারাসেন (মুসলিম) আক্রমণকারীদের আক্রমণে জর্জরিত, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিগত চার শতাব্দী ধরে ইউরােপের ‘সভ্য’ দেশগুলিতে সুস্থির, স্বাভাবিক জীবন যাপনের যে প্রয়াস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল এবং খ্রীস্টানদের সামাজিক, অথনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যে একটা স্থায়ী রূপ পরিগ্রহণের চেষ্টা করছিল এই আক্রমণের আঘাতে তা একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ইউরােপের দুর্ভাগ্য ঠিক এই সময়ই ক্যারােলিঞ্জীয় রাজপরিবারে দীর্ঘস্থায়ী ও অন্তর্ঘাতী গৃহযুদ্ধের কারণে এই আক্রমণকারীদের দ্বারা হওয়া নিবিচার হত্যা, নির্বাধ লুণ্ঠন ও ধ্বংসের সামনে ক্ষীণতম প্রতিরােধ গড়াও অসম্ভব হয়ে যায়। শার্লমানের সুদীর্ঘ ও সফল শাসনের পর মনে হয়েছিল পুনর্গঠিত পশ্চিম ইউরােপ সভ্যতার বাঁধানো সড়ক ধরে আরও পূর্বে এগিয়ে যাবে, হয়ত তা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলমান প্রভাবকে প্রতিহত করবে যেমন ৮ম শতাব্দীর মধ্যেই শালমান মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে খ্রীস্টান ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং পীরেণিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশ-স্পনিশ মার্চ স্থাপন করেছিল। লাতিন সভ্যতার সীমানা আরও বিস্তৃত হবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এসব কিছুই হয়নি। সমস্ত খ্রীস্টান জগতের এই ঘাের দুর্দিনে শার্লমানের অযোগ্য বংশধরগণ একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে এবং সম্পত্তি বন্টনে মত্ত হয়ে রইল। টুকরো হয়ে যাওয়া ফ্রাঙ্ক রাজ্যগুলিতে চারিদিক থেকে বাঁপিয়ে পড়ল বিভিন্ন জাতির আক্রমণকারীরা। প্রায় দুশাে বছর ধরে ভাইকিঙ (নর্সমেন বা নর্থমেন), মাগিয়ার (হাঙ্গেরীয়ান.) এবং স্যারাসেনরা (মুসলিম) অবিরাম স্রোতের মতো এসে আপন খুশী অনুযায়ী হত্যা ও ধ্বংসের লীলায় মত্ত ছিল। লুষ্ঠিত ও বিধ্বম্ভ হয় ইউরােপের গ্রাম, জনপদ ও বন্দরগুলো। বিস্তীর্ণ এলাকায় চার্চগুলির প্রায় কোনও চিহ্নই ছিলনা। ৮৪০ থেকে ৯১১ সাল পর্যন্ত প্রায় সত্তর বছর ধরে এই আক্রমণকারীরা ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও হলাণ্ডের বিভিন্ন স্থানে বারবার আক্রমণ করে।

এই দীর্ঘ সময়ে ইউরোপের বহু অঞ্চলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং মনে হয়েছিল সভ্যতা সংস্কৃতির ক্ষীণ দীপশিখাটিকে আর জ্বালিয়ে রাখা যাবে না। অসংখ্য সমসাময়িক বর্ণনায় এইসব শ্বাসরোধকারী, দুর্দম আক্রমণের স্মৃতি বিধৃত হয়েছে আর এগুলির মধ্যেই ধ্বনিত হয়েছে সাধারণ, অসহায় মানুষের আতি ও বিলাপ। আতঙ্কিত কোনও লেখক লিখেছেন ‘ঝলসে উঠলে৷ বিধর্মীদের কঠিন তলোয়ার। সেইন নদীর দুই তীরবর্তী অল সুঠ করতে করতে একশো কুড়িটি ভাইকিঙ জাহাজ অবাধে এগিয়ে গেল পারী পর্যন্ত, বাধা দেওয়ার চেষ্টাও কেউ করে নি।’ কারো বর্ণনায় একই আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছে- ‘স্যারাসেন ঘাতকের দল রােমের নগর প্রাকারের বাইরে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে।’ নগরগুলি জনহীন, গীর্জা ও মঠগুলি সব বিধ্বস্ত হয়েছে বলে বিলাপ করেছেন কেউ কেউ। সারাদেশে বিরাজমান শ্মশানের নিস্তব্ধতায় সন্ত্রস্ত হয়েছে সকলে, রাজশক্তির অন্তর্ধানে, নিরসুশ অরাজকতায় বিক্ষুব্ধ হয়েছেন অনেকে। এই আক্রমণ ধারা স্তিমিত হওয়ার পর, শতাব্দীর নিরাপদ ব্যবধানের আশ্রয়ে থেকে কোনও কোনও লেখক এই আক্রমণকারীদের পৌরুষ, দুর্দম সাহস ইত্যাদির বর্ণনায় অতি-উচ্ছসিত হলেও ৯ম ও ১০ম শতকের পশ্চিম ইউরােপের প্রতিটি মানুষের কাছে এই দুঃসময় মনে হয়েছিল সহনাতীত, অন্তহীন, এবং এর প্রতিকারের কোনও রাস্তাও কেউ খুঁজে পায়নি।

সারাসেন বা মুসলিম আক্রমণ

সারাসেন বা মুসলিম জলদস্যুরা ৯ম শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অবাধ কর্তৃত্ব স্থাপন করে সিসিলি দ্বীপটিকে তাদের একটা ঘাঁটিতে পরিণত করে। অবশ্য এই সারাসেনদের পক্ষে সিসিলি জয় খুব সহজ সাধ্য হয়নি। সুরক্ষিত নগর এবং ভিলা নিয়ে গঠিত এই দ্বীপটি মুসলিম জলদসুদের কাছে বিন৷ বাধায় আত্মসমর্পণ করেনি। সারাসেনরা প্যালার্মো দখল করে ৮৩১ সালে এবং সিসিলির সর্বশেষ উল্লেখযােগ্য নগরী তায়ােরমিনা অধিকার করার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় ৯০২ সাল পর্যন্ত। লুণ্ঠন ও ধ্বংসের পর্ব শেষ হলে বার্বার (Berber) ও উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য উপজাতি সিসিলিতে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১০ম শতকের মধ্যে এভাবেই দ্বীপটিতে বহু নতুন গ্রাম ও জনপদের পত্তন ঘটেছিল। সিসিলির বিজয়ের পর অতি দ্রুত উত্তর আফ্রিকা, ক্রীট, বিলরিক দ্বীপপুঞ্জ ও স্পেনে মুসলিমদের অধিকার বিস্তৃত হয়। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য অর্জিত হওয়ায় প্রভাঁস (Provence) এর ফ্রাক্সিনে (Fraxinet) থেকে দক্ষিণ ইতালির রেগিও ও ব্যরি পর্যন্ত ভূভাগ করায়ত্ত করতে তাদের বিশেষ অসুবিধা হয় নি। অল্পকালের মধ্যেই ফ্রাক্সিনে (Fraxinet) এর ঘাটি থেকে সমস্ত রােণ উপত্যকা এবং পশ্চিম লােম্বার্ডি তারা ইচ্ছেমতো আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে থাকে। আলপাইন গিরিপথের সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্য তাদের উৎপাতে বন্ধ হয়ে যায়। ৮৪৩ সালে রােমের উপকণ্ঠে দেখা যায় হিংস্র এই সারাসেন যোদ্ধাদের। পর পর কয়েকজন পােপ এই বিধর্মী বর্বরদের বাধা দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন; ৮৪৯ সালে পােপ চতুর্থ লিও স্বয়ং তার সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন। সারাসেন কবলিত হলে রােম এবং তৎসহ সমস্ত লাতিন জগতের ভাগ্য কি হতো তা বিতর্কের বিষয়। তবে এটা সুনিশ্চিত যে ভয়ঙ্কর এই দুর্ঘটনা ঘটলে মধ্য যুগের ইতিহাস ভিন্ন পথবাহী হতো। রােমকে রক্ষা করার কৃতিত্ব কিন্তু পশ্চিম ইউরােপের কোনও শক্তির নয়, বাইজানটাইন সম্রাট ‘দীর্ঘ’ চেষ্টার পর, অনেক ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে, দক্ষিণ ইতালী স্যারসেন অধিকার-মুক্ত করে আবার আপন অধিকারে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ৯১৫ সালে গ্যারিগিলিয়ানাে (Garigliano) এবং ৯৭২ সালে ফ্রাক্সিনেতে (Fraxinet) স্যারাসেন জলদস্যুদের ঘাঁটি বিধ্বস্ত হলে তাদের প্রতাপ ক্ষুন্ন হয়। কিন্তু ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত তারা ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে উত্তর পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে পশ্চিম ইউরােপের বাণিজ্য রুদ্ধ করে রেখেছিল। ইউরােপ থেকে স্যারাসেন বিভীষিকা দূর করার কৃতিত্ব জেনােয়া ও পিসার দৃঢ়চিত্ত বণিকদের এবং নর্মাণ শাসকদের প্রাপ্য। এদের চেষ্টাতেই দক্ষিণ ইতালী এবং সিসিলি স্থায়ীভাবে স্যারাসেন কবলমুক্ত হয়।

ইতিহাস কিন্তু স্যারাসেনদের ভীষণ রুদ্র রূপটিকেই শুধু মনে রাখেনি। ১২শ শতকে যে রেনেসাঁ সমস্তু খ্রীস্টান জগৎকে উদ্বেল করেছিল তার উপর আরব সভ্যতার প্রভাব অনস্বীকার্য, এবং এই প্রভাব বিচ্ছুরিত হয়েছিল প্রধানত স্যারাসেন অধিকৃত স্পেন ও সিসিলি থেকে। শুধু ইউরােপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলমান ধ্যানধারণার পরিচয় সাধনের জন্যই নয় প্রাচ্যের মহামূল্যবান সভ্যতার বাহক হিসেবেও স্যারাসেনগণ মধ্যযুগীয় ইতিহাসে স্মরণীয়। গ্রীক মনীষার -কালজয়ী সৃষ্টিসমূহ এবং আরব ও ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত শাস্ত্রের সঙ্গে পশ্চিম ইউরােপের পরিচয় ঘটেছিল তাদেরই মাধ্যমে। খ্রীস্টান জগতের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে স্পেনে, আরব-সঙ্গীতবিদ্যার প্রভাব অনস্বীকার্য। কিঙলেক (Kinglake) ইসলাম ও খ্রীস্টান সভ্যতার যােগসূত্র হিসেবে স্যারাসেন অধিকৃত সিসিলির গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং কুসেডের প্রত্যক্ষ প্রভাবরূপে স্বীকৃত বহু সাংস্কৃতিক উপাদানই যে এখান থেকে সমস্ত ইউরােপে ছড়িয়ে পড়েছিল সে সম্পর্কেও তিনি নিঃসংশয়। পরবর্তীকালে দ্বীপটিতে নর্মান শক্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর তাদের জীবনেই এই সংস্কৃতির সমন্বয় প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। আর নর্মানদের মাধ্যমেই মুসলমান শিক্ষাদীক্ষার বহু বিষয় এবং শাসন সংক্রান্ত চিন্তাধারা জার্মান সাম্রাজ্যেও প্রসারিত হয়। সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক হয়ে ওঠেন এই ভাব সম্মিলনের মূর্ত প্রতীক। ঐতিহাসিক লুকাস (Lucas) এই প্রত্যয়ে সুস্থিত যে মুসলিমদের এই সৃজনশীল ভূমিকা সম্পর্কে যথােপযুক্ত সচেতনতাই ১২শ ও ১৫শ শতকের ইউরােপীয় রেনেসাঁর স্বরূপ উপলব্ধির একটি প্রধান উপায়।

ম্যাগিয়ার বা হাঙ্গেরীয়দের আক্রমণ

স্যারাসেন আক্রমণের ঢেউ মিলিয়ে যেতে না যেতে ৯ম শতাব্দীর শেষার্ধে সুদূর পূর্বাঞ্চল থেকে বেগবান অশ্ববাহিত হয়ে মধ্য ও পশ্চিম ইউরােপের দিকে ম্যাগিয়াররা ( হাঙ্গেরীয়ান) ছুটে এসেছিল  জাতিতে তারা ছিল ফিন্নো-উগ্রিয়ান (Finno-Ugrian)। এশিয়ার বিস্তীর্ণ স্তেপ অঞ্চল থেকে এই যাযাবররা ভীষণতর অন্যান্য দল কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ৮৬২ সালে পূর্ব ফ্রান্সিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে প্রথম হানা দেয় এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বর্তমান হাঙ্গেরীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ৯ম শতকের শেষ থেকে প্রায় ৬০ বছর অসঙ্ঘবদ্ধ, বেসামাল মধ্য ইউরােপে আতঙ্ক ও বিভীষিকার এক অধ্যায় সৃষ্টি করে অশ্বারূঢ় এই ভীষণ দস্যুদল। ইতালির লােম্বার্ডি থেকে অ্যাপুলিয়া, পশ্চিম ফ্রাঙ্ক রাজ্য (ফ্রান্স)-এর সর্বত্র, স্পেনের নিকটবর্তী অঞ্চল এবং সব থেকে বেশি করে নাগালের মধ্যে পাওয়া জার্মানীতে অবাধ লুটতরাজ ও হত্যা চালাতে থাকে। বেগবান এই আক্রমণকারীদের বাধা দেওয়ার মতো কোনও সমবিক ব্যবস্থা ইউরােপীয়দের জানা ছিল না। দুর্গ আক্রমণ করার কৌশল জানা বা সময় না থাকায় ম্যাগিয়াররা পারতপক্ষে দুর্গগুলি এড়িয়ে চলতো। অবশেষে তাদেরই মতো অশ্বারােহী বাহিনী সৃষ্টি করে এবং সুরক্ষিত দুর্গ থেকে তাদের প্রতি-আক্রমণ করে স্যাক্সনীর ডিউক (এবং পরবর্তীকালে রাজা) হেনরী দ্য ফাউলার ম্যাগিয়ারদের দমন করতে চেষ্টা করেন। ৯৩৩ সালে হেনরীর আক্রমণে তারা বিপর্যস্ত হয়, কিন্তু চূড়ান্ত জয় অর্জিত হয় হেনরীর পুত্র প্রথম অটো কর্তৃক আরো দুই দশক পরে, লিচফিল্ডের রণক্ষেত্রে। পুরো তিনদিন ধরে পরাজিত মাগিয়ারদের পশ্চাদ্ধাবন ও হত্যা করা হয়। মধ্য ইউরােপের একটি রক্তাক্ত এবং বীভংস অধ্যায়েরও পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এভাবে। পরাভূত মাগিয়াররা এরপর যে ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করল তারই নাম হাঙ্গেরী।

এর পর মাঝেমাঝে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তে হানা দেওয়ার জন্য কেউ কেউ তাদের মনে রাখলেও, মাগিয়াররা তাদের নতুন বাসভূমিতে উপেক্ষিত হয়েই ছিল যতদিন না তাদের শাসক স্টিফেন (৯৯৭-১০৩৮ খ্রীঃ) (পরে সেন্ট স্টিফেন) পােপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার কর্তৃক খ্রীষ্টধর্মে দক্ষিত হন। এরপর ধীরে ধীরে পূর্ব পুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে তারা কখনো স্বেচ্ছায়, বেশিভাগ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে তারা খ্রীস্টধর্ম অবলম্বন করতে শুরু করে। পূর্ব ইউরােপে লাতিন খ্রীস্টান সভ্যতার প্রসার, নতুন একটি রাজ্যের আবির্ভাব, এবং ম্যাগিয়ার আক্রমণ দমনে জার্মান শাসক অটোর অবিস্মরণীর সাফল্য এবং এই কারণে তার প্রচণ্ড শক্তি বৃদ্ধি ছাড়া ইউরােপের ইতিহাসে অর্ধসভ্য, বিধর্মী ম্যাগিয়ার আক্রমণের অন্য কোনও প্রভাব খুজে পাওয়া শক্ত। মধ্য এশিয়া থেকে আগত, মঙ্গোলিয়ান গােষ্ঠী-উদ্ভূত এই আগন্তুক জাতি ফিন ও বুলগারদের সঙ্গে ইউরােপীয়-পরিবারে কালক্রমে সংযােজিত হয়ে গিয়েছিল।

ভাইকিঙ বা নর্সম্যানদের আক্রমণ

ভাইকিঙ আক্রমণের ভূমিকা ও কারণ

ইউরােপীয়দের অগ্নিপরীক্ষা কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। উত্তর ইউরােপের হিমশীতল, কুয়াশা ঘেরা ও তুষারাবৃত অঞ্চল থেকে বন্যার স্রোতের মতো নেমে আসা ভাইকিঙ (নর্স বা নর্থমেন নামেও তারা পরিচিত) দের আরো ব্যাপক, বিধ্বংসী ও ভয়ঙ্কর আক্রমণ দীর্ঘকাল ধরে দিশাহারা, সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল সমস্ত খ্রীষ্টান জগৎকে। সমস্ত ৯ম এবং ১০ম শতাব্দীর বেশ কিছু অংশ জুড়ে এই জলদস্যুদল বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে লুণ্ঠন, হত্যা ও ধ্বংসের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল।

ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন-স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ার এই সব দেশ থেকে আগত এই বিধর্মী, বর্বর জার্মানদের সমকালীন মানুষ নাম দিয়েছিল ভাইকিঙ (জলদস্যু)। সুতরাং প্রায় চারশো বছর আগে যারা পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রক্তের সম্পর্কে তাদেরই আত্মীয় ছিল এই নবাগত দস্যুদল। এই অর্থে তাদের আক্রমণকে জার্মান জাতিসমূহের মাইগ্রেশন বা অভিপ্রয়াণের অংশ বলে কেউ কেউ মনে করেছেন। কিন্তু পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পক্ষে কালান্তক ‘বর্বর’ আক্রমণের সঙ্গে নবম শতকের ভাইকিঙ অভিযানের মৌলিক পার্থক্যও ছিল একাধিক। ভাইকিঙ অভিযান আদপেই কোনও গােষ্ঠী বা দলের সামগ্রিক অভিপ্রয়ান (Volkerwanderungen) ছিল না। মধ্য ও পশ্চিম ইউরােপের ভয় বিহ্বল মানুষ তাদের অসংখ্য মনে করলেও তারা তিন/চারশাের বেশি ভারী হতো না। সব থেকে বড় যে ভাইকিঙ বাহিনী নবম শতকের ইংল্যান্ড আক্রমণ করেছিল তাতেও এক হাজারের কম ‘দস্যু’ অংশ নিয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি ছিল সামুদ্রিক অভিযান। তাছাড়া পূর্ব পুরুষদের মতো ভাইকিঙরা বাসযােগ্য ভূমির আকর্ষণেই এই দুঃসাহসিক অভিযানগুলো সংগঠিত করেনি। বাণিজ্য, বিশেষ করে দাস ব্যবসা তাদের ভীষণভাবে প্রলুব্ধ করেছিল। লুণ্ঠনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জনও তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল একথা বললে ভুল হবে না। ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত গম্য অগম্য বিভিন্ন অঞ্চলে, তখনকার মানুষের পরিচিত সর্বত্র – উত্তরে ফ্রিসিয়া, বণ্টিক সাগর থেকে দক্ষিণে ইতালী, পূর্বে কিয়েভ, নভগােরড, কনস্টান্টিনোপল, তার দূর উত্তরে আইসল্যাণ্ড, গ্রীণলও, এমন কি আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগে ছিল তাদের অনায়াস বাতায়াত. যথেচ্ছ বিচরণ। প্রচণ্ড বেগবান, বিচিত্র দর্শন জাহাজগুলো নিয়ে তারা সমুদ্রকূলে, নদনদীগুলির তীরবর্তী ভূখণ্ডে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেছিল। সমুদ্রবক্ষে রণতরীর সাহায্যে, পরে ভাগে অবতরণের পর দ্রুতগামী অশ্ববাহিত হয়ে হত, লুণ্ঠন, অগ্নি সংযােগ ও বংসের যে ভয়াবহ লীলায় তারা মত্ত হয়েছিল তার প্রতিরােধের কোনও ব্যবস্থাই দীর্ঘদিন ধরে কেউ করে উঠতে পারেনি। একমাত্র ফ্রিসিয়ানদের যথোপযুক্ত নৌশক্তি ছিল যার দ্বারা হয়তো সমুহবক্ষেই ভাইকিঙ আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে। কিন্তু সম্রাট শার্লমান অনেক আগেই ফ্রিসিয়ানদের দমন করায় সে সম্ভাবনাও লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

ইতিহাসের অনেক ঘটনার মতােই ভাইকিং আক্রমণের হেতু দুর্জ্ঞেয় রয়ে গেছে। সন্দেহ নেই অনুদার, বৈরী প্রকৃতিই তাদের বাধ্য করেছিল জীবিকার জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভর করতে। বীচ ও ওক্‌ বৃক্ষভরা ডেনমার্কের অরণ্যানীতে, বিস্তীর্ণ জলাভূমি, পাথুরে ডাঙা এবং খাড়া পাহাড়ের দেশ সুইডেন ও নরওয়েতে জীনধারণের কঠোরতা ভাইকিংদের দুর্দান্ত, যুদ্ধপ্রিয় একটি জাতিতে পরিণত করেছিল। উন্মুক্ত, ভীষণ সমুদ্রের কোলে থেকেই তারা অকুতোভয়ে, অনায়াসে নিঃসমি সমুদ্রযাত্রায় এবং জাহাজে তৈরীর বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। লাঙল কাধে কৃষকের কৃষিক্ষেত্রে যাওয়ার মতো শাণিত তলোয়ার নিয়ে অন্যের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, লুটপাট করাকে, জলদসুর বৃত্তিকে, তারা অতি স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এই সুদীর্ঘকালব্যাপী অভিযানের পর অভিযান পরিচালনার জন্য যে অমিত লোকবলের প্রয়োজন ছিল জনস্ফীতি বা স্বদেশে অন্নের অনটন-জনিত যুক্তি খাড়া করে তার যথার্থ ব্যাখ্যা করা যায় না।

দুর্জয় সাহস, প্রবল আত্মবিশ্বাস, এবং অবশ্যই, আক্রান্ত দেশগুলির আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধে শোচনীয় ব্যর্থতা ভাইকিঙদের নিরবচ্ছিন্ন এবং বিষ্ময়কর সাফল্যের কারণ। নর্স গাথাগুলিতে বিধৃত হয়ে আছে এক বিচিত্র জীবন-দর্শন যা হয়তো তাদের আরও ভয়ঙ্কর এবং অজেয় করে তুলেছিল। অনিত্য এই জীবন যে একেবারেই নিয়তি-অধীন আর নিয়তি উত্তরসাগরের মতো ক্রুর, মেরু তঞ্চলের আকাশের মতোই ভয়াবহ – এই ছিল তাদের পুরাণ কাহিনীগুলির (সারা নর্ডিক সমাজে যা প্রচলিত ছিল) সারমর্ম। সুতরাং যুদ্ধ, লুণ্ঠন, সুরা, নারী, নৃত্যগীত অর্থাৎ ক্ষণিকের উত্তেজনার খােরাক যা থেকে পাওয়া যায় তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইতো তারা। তাছাড়া তাদের গাথাগুলির শিক্ষা ছিল – কাপুরুষেরাই শত্রুকে এড়িয়ে মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে চায়, কিন্তু শত্রু নিক্ষিপ্ত বল্লম থেকে গা বাঁচাতে পারলেও জরা এসে মানুষকে ভূতলশায়ী করবেই। সুতরাং নিমেষের জন্যও, পথে অথবা প্রান্তরে, অস্ত্র ত্যাগ কোরো না, কেননা কেউই জানে না কখন তা দরকার হবে।” আরও উপদেশ ছিল “কোনও অবস্থাতেই বিক্ষিপ্ত চিত্ত হয়ো না, অভিজ্ঞতা অর্জন করো, যুদ্ধের জন্য নিয়ত প্রস্তুত থাকে। এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে কর্মচঞ্চল এবং উল্লসিত জীবন যাপন করো।” “প্রয়াতদের জীবনের অভিজ্ঞতা ছাড়া আর সবই শেষ হয়ে যায়, গৃহপালিত পশুগুলি নিঃশেষ হয়ে যায়, আত্মীয় স্বজন চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে যায়, এবং আমি জানি, আমারও মৃত্যু আসবেই।” অনুক্ষণ অমােঘ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা, নিঃসীম সমুদ্রে সুদীর্ঘকাল থাকার সময় বিশ্বস্ততা ও সাহচর্যের মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা হয়তো ভাইকিংদের শৌর্যবীর্যের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের অপরাজেয় করে তুলেছিল এবং এটাই হয়তো তাদের নিরবচ্ছিন্ন সাফল্যের মূলসূত্র।

ভাইকিঙ অভিযানের ব্যস্ততম অধ্যায়ে ইউরােপের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম কোনও স্থানই তাদের কাছে অগম্য ছিল না। বিশেষ করে চারটি অঞ্চলে, তাদের কার্যকলাপ বিশেষভাবে স্মরণীয় – (১) পূর্বে রুশ অঞ্চলে, (২) গল অথবা পশ্চিম ফ্রান্সিয়াতে, (৩) ইংলণ্ডে এবং (৪) উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে আইসল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড ও আমেরিকায়।

পূর্বে রুশ অঞ্চলে ভাইকিং ভাইকিঙ কার্যকলাপ

বলা যায় যে সুইডেন থেকে আগত ভাইকিঙ শাখাগুলির (ভারাঙ্গিয়ান নামে পরিচিত) অভিযান রুশ দেশ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ। ৯ম শতাব্দীতে বাল্টিক সাগর থেকে নীপার ও ভোল্গা নদীর মধ্য দিয়ে প্রধানত বাণিজ্যের জন্য তারা ক্যাম্পিয়ান ও কৃষ্ণসাগরে যাতায়াত করেছে, এবং কনস্টান্টিনােপল ও প্রাচ্যের মুসলমান সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে। পথে লুণ্ঠন ছাড়াও বাণিজ্য বৃদ্ধির সদিচ্ছাও ছিল দুবিনীত এই জলদস্যুদের। আরব দেশগুলি এবং বাইজানসিয়ামের অধিবাসীদের কিছু কিছু লেখায় এই সব অবাঞ্ছিত অতিথিদের বর্ণনা আছে। ইবন্ ফালদান (১০ম শতক) লিখেছেন “ভোল্গার তীরে বাণিজ্যরত এই সব রুশ (নর্সমেন) লোকদের দেখেছি। এদের থেকে সুঠাম, বলিষ্ঠ দেহ পুরুষ আমি কখনও দেখিনি। দীর্ঘ খর্জুর বৃক্ষের মতো খাড়া, অগ্নিবর্ণ দেহ এদের। মুহূর্তের জন্যও করচ্যুত হয় না তাদের কুঠার, তরবারি অথবা ছুরিকা। কিন্তু কী ভীষণ নােংরা তারা। খেয়েদেয়ে হাতমুখ ধােওয়ার অভ্যাস তাদের নেই, এমন কি শৌচকার্যেও অনীহা।” এই রুশ ( বা ভ্যারাঙ্গিয়ানরা) কনস্টান্টিনােপলে ব্যবসা এবং লুটপাট দুই-ই করেছে, এবং দলের পিছনে থেকে-যাওয়াদের নিয়েই পূর্ব রােমান সম্রাটের ভ্যারাঙ্গিয়ান রক্ষীবাহিনী গড়ে উঠেছিল। এদেরই একটি শাখা নভগােরডে বসতি স্থাপন করেছিল, কেউ আরও দক্ষিণে নীপার নদীর পথ ধরে গিয়ে পৌঁছেছিল কিয়েভে। কালক্রমে এই নগন্য শহরটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে রাশিয়া যে নাম উত্তর থেকে আসা ভাইকিংদের স্মৃতি বহন করে। কি ভাবে এবং কোন সময়ের মধ্যে রুশ বা ভাইকিঙরা স্থানীয় স্লাভদের সঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছিল এবং গ্রীক-খ্রস্টান ধর্ম ও বাইজানটাইন সভ্যতার প্রভাবে আদিম সত্তা পরিত্যাগ করে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল তা আজও অনুমান ও অনুসন্ধানের স্তরে।

গল অথবা পশ্চিম ফ্রান্সিয়া ও ইংল্যান্ডে ভাইকিঙ কার্যকলাপ

পশ্চিম ইউরােপে ভাইকিঙ আক্রমণের ঝাপটা এসে পড়ে ৮ম শতকের শেষ দিকে এবং গল বা পশ্চিম ফ্রাঙ্ক রাজ্যেই তা ভীষণ রূপ নেয়। ৭৮৭ সালে ইংলণ্ডের দক্ষিণ প্রান্তে এবং ৭৯৩ সালে লিন্ডিসফানে হানা দেয় এই নির্মম জলদস্যু বাহিনী। ৮০০ সালে উৎকণ্ঠিত সম্রাট শার্লমান সেইন ও ল্যয়র নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের রক্ষা-ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত আয়ার্ল্যাণ্ডই ছিল ভাইকিঙ আক্রমণের মূল লক্ষ্য। ৮৩৪ সালের মধ্যেই আয়ারল্যান্ডের অধিকাংশই তাদের কবলিত হয়, লােপ পেয়ে যায় সেখানকার প্রাচীন সভ্যতা, আর এই আয়ার্ল্যাণ্ডের ঘাঁটি থেকেই ব্রিটীশ-দ্বীপপুঞ্জে এবং মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাইকিঙরা অনায়াসে হানা দিতে থাকে।

৯ম শতাব্দীতে গল (ফ্রান্স) তাদের অবিরাম এবং ভয়ঙ্কর আক্রমণে জর্জরিত হতে থাকে। এই দুর্মদ দস্যুরা ৮৩৫ সালে ল্যয়র নদীর মুখে নােরমতিয়ে (Noiriliputier)-র বাণিজ্যকেন্দ্র ও মঠগুলি লুণ্ঠন করে। একের পর এক আক্রান্ত এবং বিধ্বস্ত হয় রুয়েণ (Rouen), রী (Rhe), ইউট্রেক্‌ট, অ্যান্টওয়ার্প এবং নান্তেস। ৮৪৫ সালে সেইন নদীর দুই তীর আতঙ্কিত করে ১২০টি ভাইকিঙ রণতরী পারী পৌঁছায়। এই অঞ্চলে তাদের লুণ্ঠন ও হত্যায় কোনও ক্ষান্তি ছিল না। পথে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে, গীর্জায় যাজকদের, উপাসনার ত নরনারী–কউকেই রেহাই দেয় নি, পরিবারের পর পবিবার নিশ্চিহ্ন করেছে অমানুষিক নির্মমতায়। রাত্রির অন্ধকার না নেমে আসা পর্যন্ত তাদের হত্যা, লুইন ও অগ্নিসংযােগ থামেনি। তারপর লুষ্ঠিত ধনবরে জাহাজ বােঝাই করে, শত শত বন্দী নরনারী নিয়ে নতুন কোনও স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে তারা। পরবর্তী তিরিশ বছর ধরে রাইন, মিউস, শ্যেল্ট, স্যোম, সেইন, মার্ণ প্রভৃতি নদনদীগুলিকে আতঙ্কে শিহরিত করে, তীর-তীব্রগতিতে তারা দুপাশের গ্রামজনপদ ও বন্দরগুলি আক্রমণ করে শ্মশানে পরিণত করে দিয়েছিল। ৮৫৯-৬২ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে এক ভাইকিঙ দস্যুদল মরক্কোর নেকার (Nekur) লুণ্ঠন করে এসেছিল, বেলারিক দ্বীপপুঞ্জ এবং রেসিলনও রেহাই পায় নি। শীতকাল র‍্যোণ উপত্যকায় কাটিয়ে তারা ইতালীর পিসা এবং লুনা ধ্বংস করে। 

৮৬৬ সালে ভাইকিংদের একটি প্রধান শাখা – কোনও কোনও ঐতিহাসিক যাকে ‘ডেনিস গ্রেট আমি’ বলেছেন প্রচণ্ড বিক্রমে ইংল্যান্ড আক্রমণ করে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ইষ্ট অ্যাঙ্গলিয়া, নর্দামব্রিয়া ও মাশিয়া দখল করে নেয়। কিন্তু ৮৭৮ সালের এভিংটনের যুদ্ধে রাজা আলফ্রেডের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ ওয়েষ্ট স্যাক্সনদের কাছে প্রতিহত হয়ে তারা আবার ধাবিত হয় ইউরােপীয় মূল ভূখণ্ডের দিকে। পর পর আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয় ঘেণ্ট, স্যাক্সনীর কোর্টরেই, এবং এলশ্লো। আখেনে তারা অনায়াসে লুঠ করে সম্রাট শার্লমানের প্রাসাদ। সমসাময়িক লেখক এরমেন্টেরিয়াস (Ermentarius of Noirmoutier) সখেদে লিখেছেন “এই সর্বনাশের হাত থেকে পরিত্রাণের কোনও আশাই নেই। প্রতি বছর অবস্থা আরও শােচনীয় হয়ে উঠেছে। ওদের জাহাজের সংখ্যা, মনে হয়, প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে. স্ফীততর হয়ে উঠছে ভাইকিং জলদস্যু বাহিনী। সামনের সমস্ত কিছু বাধাবিপত্তিকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে, অবাধে, দুর্বার গতিতে তারা হত্যা, লুণ্ঠন ও অমানুষিক অত্যাচারের চিহ্ন রেখে যায় পথের দুপাশে। কেউই তাদের প্রতিরােধ করতে পারে না। বােরদো (Bordeaux), তুলুস (Toulouse), তুর (Tours), অলিয়ঁ (Orleans) প্রভৃতি সমৃদ্ধ জনপদ পুড়িয়ে ছারখার করে জনহীন মরুভূমিতে পরিণত করেছে তারা। সমস্ত সেইন নদী জুড়ে তাদের ব্যস্ত আসা যাওয়া আর নদীর দুধারে বিধ্বস্ত, মুণ্ঠিত, অগ্নিদগ্ধ জনপদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।”

ভাইকিঙ সন্ত্রাসের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়, আমিয়াঁ (Amiens), কেঁদে (Cond), এবং লুভেঁ (Louvain)-তে শ্মশানের স্তব্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে ৮৮৫/৮৬ খ্রীষ্টাব্দে তারা অবরােধ করল পারী বা প্যারিস। ভীষণ দর্শন সাতশো জাহাজ আর ভীষণতর ভাইকিঙ দস্যুদলের উপস্থিতিতে পশ্চিম ফ্রান্সিয়ার প্রজাপুঞ্জ ভয়বিহ্বল হয়ে সর্বনাশের প্রতীক্ষা করতে লাগলো। রাজা চার্লস দ্য ফ্যাট ৭০০ পাউণ্ড রুপা আর বার্গাণ্ডি লুণ্ঠনের অনুমতি দিয়ে সাময়িকভাবে তাদের নিবৃত্ত করলেন। ৮৯১ সালে লুব্ধ দস্যুর দল আবার সংহার মূতিতে হানা দিল নেদারল্যাওস্-এ। এবার পূর্ব ফ্রাঙ্ক রাজ্যের আর্নুল্‌ফ-এর হাতে পরাজয় ঘটলো ভাইকিংদের। অবশ্য ইতিমধ্যেই ভাইকিং আক্রমণের প্রচণ্ডতা কমে এসেছিল এবং নিম্ন সেইন উপত্যকায় তাদের অনেকে বসতি স্থাপনও শুরু করেছিল। ৯১১ সালে সরকারীভাবে ‘ডাচি অফ দ্য নর্থমেন’ তাদের নেতা রােল্লোর হাতে তুলে দেওয়া হলো এবং ফ্রান্সের নতুন একটি প্রদেশ ‘নরমাঁদি’ (নরমাণ্ডি) জন্মলাভ করল, যার লোকদের বলা হতো নর্ম্যান। এরা নরমাঁদিতে অবস্থানরত ভাইকিঙ ও ফ্রাঙ্ক জনগোষ্ঠীর মিশ্রণজাত ছিল। ফ্রান্সের পরম সৌভাগ্য যে প্রতিষ্ঠার দেড়শো বছরের মধ্যে নবগঠিত এই প্রদেশ ফরাসী রাজশক্তির সহায়-সম্বলের একটি প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছিল এবং নরমাণ্ডির ‘নর্সমেন’ প্রজাদের সহায়তায় বিজিত হয়েছিল দক্ষিণ ইতালী, সিসিলি, অ্যান্টিয়ােক এবং ইংলণ্ডের বেশ কিছু অংশ।

উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে আইসল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড ও আমেরিকায় ভাইকিঙ কার্যকলাপ

ব্রিটীশ দ্বীপপুঞ্জ থেকে ভাইকিঙরা অকুতােভয়ে অতলস্পর্শী আটল্যান্টিক পাড়ি দেয়। দুঃসাহসিকতা, দৃঢ়তা এবং অজানাকে অবহেলায় জয় করার দৃষ্টান্ত হিসেবে এই পর্বে তাদের কার্যকলাপ বােধহয় সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক। দীর্ঘ পথের সব বিঘ্ন কাটিয়ে ভাইকিংদের মজবুত জাহাজগুলি ফ্যারােয়েস (Faroes) পেীছয় ৮০০ সালের কোনও এক সময়। সেখান থেকে পঞ্চাশ বছর পরে ভাইকিংরা প্রায় অপরিচিত আইসল্যান্ড দ্বীপে অবতরণ করে। প্রকৃতির সর্ববিধ প্রতিকূলতা জয় করে সেখানে ভাইকিঙরা প্রতিষ্ঠা করে তাদের উপনিবেশ। কিন্তু এখানেই আবদ্ধ হয়ে থাকলো না এই শান্ত অভিযাত্রীর দল। আরও দূরে, অজ্ঞাত সমুদ্রপথের সহস্র বিপত্তি হেলায় তুচ্ছ করে, কঠিন হাতে দড়ি বেয়ে এবং শুধু দুঃসাহস ও দুর্মর আশা অবলম্বন করে (কম্পাস তখনও আবিষ্কৃত হয় নি) ৯৮৬ সালে তারা পৌঁছল গ্রীনল্যাণ্ডে। তাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে সাড়াজাগানো অভিযানের ফলে কলম্বাসের অতিপ্রশংসিত আবিষ্কারের প্রায় ৫০০ বছর আগে আনুমানিক ১০০০ সালে পথচিহ্নহীন অজানা সমুদ্রপথে তারা উপনীত হয় উত্তর আমেরিকার কূলে। নর্স গাথায় অভিনন্দিত এই কীতির সমর্থন পাওয়া যায় কানাডায় প্রাপ্ত কিছু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনে এবং অতি পুরােনো কয়েকটি মানচিত্র থেকে, যেখানে তারা নেমেছিল এবং স্বল্পকালের জন্য বাস করেছিল তার নাম দিয়েছিল মালাও ও ভিনল্যাণ্ড। ঐতিহাসিক অ্যালান ব্রাউনের মতে এই জায়গা দুটো ছিল ল্যাব্রেডর ও নিউফাউণ্ডল্যাণ্ড। কিন্তু সংখ্যাল্পতা, স্থানীয় বাসিন্দা (সম্ভবত রেড ইণ্ডিয়ান)-দের প্রচণ্ড শত্রুতা এবং ইউরােপের ঘাঁটিগুলি থেকে তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার ফলে বছর কুড়ির মধ্যেই তারা আমেরিকা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ফিরে এলেও ভাইকিঙরা ভুলে যায় নি অতি দূরের এই দেশটিকে যেখানে তারা ক্ষণিকের অতিথি হয়ে গিয়েছিল। যোগাযোগও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়নি। ঘৃণ্য, অভিশপ্ত এক জলদস্যুদলের নেতা জাণি হার্‌জল্‌ফসন (Bjarni Herjolfsson) এবং লেইফ এরিকসনের (Leif Erikson) যাত্রাপথের ক্ষীণ হয়ে যাওয়া স্মৃতি সম্বল করে এবং পরবর্তী কালের জন ক্যাবট ও ক্রীষ্টোফার কলম্বাসের আবিষ্কৃত পথে ‘নতুন পৃথিবী’র সন্ধান পেয়েছে পুরােনো পৃথিবীর মানুষ।

ভাইকিঙ আক্রমণের ফলে ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের ক্ষতি

অনুমান করা কঠিন নয়, স্যারাসেন, ম্যাগিয়ার এবং ভাইকিউ আক্রমণের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিধা-বিভক্ত ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য। ৮৪৩ সালে ভার্দুনে যখন সম্রাট শার্লমানের বংশধরগণ সাম্রাজ্য ভাগবাটোয়ারায় ব্যস্ত, ভাইকিঙ তাণ্ডব তখন ভীষণতম রূপ নিয়েছে। তাদের নির্মম পীড়নে ফ্রান্স তখন আর্ত, আর জার্মানী সন্ত্রস্ত অশ্ববাহিত ম্যাগিয়ার দস্যুদলের নির্বাধ লুণ্ঠনে। কিন্তু অন্তর্ঘাতী যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় শার্লামেনের অযােগ্য বংশধরেরা এই দুর্দম, নৃশংস, লুণ্ঠনসুব্ধ দস্যুদলের প্রতিরােধের কোনও ব্যবস্থাই গড়ে তুলতে পারেন নি। কোনও উজ্জীবিত ভূমিকায় শাসককুলের কাউকে দেখা যায় নি দেশ ও দশের এই ঘাের দুর্দিনে। তারা যা করেছিলেন বিপদের সময়ে কাপুরুষেরা তাই করে থাকেন – উৎকোচ দিয়ে দস্যুদলকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা অথবা সত্বর সমুদ্রতীরবর্তী এবং নদীকূল সন্নিহিত স্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদ কোনও স্থানে আশ্রয় গ্রহণ। রাজপুরুষদের এই অক্ষত্রিয়জনােচিত দৃষ্টান্ত মঠাধ্যক ও যাজক সম্প্রদায় সাগ্রহে অনুসরণ করেছিলেন কেননা তাদের সম্পত্তির উপরেই দস্যুদলের লোভ হিল বেশি। সেন্ট ক্যর্থবার্ট, সেন্ট এডমণ্ড লায়র নদীর মুখে নােরমতিয়ে (Noirmoutier) এবং ফিলিবার্টের মঠাধ্যক্ষগণ বাধ্য হয়েছিলেন স্থান ত্যাগে। এ ছাড়া ছােট বড় অসংখ্য মঠ এবং চার্চের পলাতক অধ্যক্ষের সংখ্যা নিরুপণ করা যায় নি। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও নিস্তার পান নি অনেকে। পশ্চাদ্ধাবন করে, তাদের যথাসর্বস্ব লুঠ করেছিল আক্রমণকারীরা। পেছনে ফেলে আসা সম্পত্তি তাে সর্বক্ষেত্রে লুণ্ঠিত এবং অগ্নিদদ্ধ হয়েছে। নিরাপদ স্থান বলে তখন হয়তো ইউরােপে কিছু ছিল না।

বিধ্বংসী এই বর্বর আক্রমণের ফলে শস্যক্ষেত্র ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার প্রচণ্ড ক্ষতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ফরাসী ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ। তিনি লিখেছেন যে সুদীর্ঘকালের এই তাণ্ডবলীলায় পশ্চিম ইউরােপে অধিকাংশ কৃষিক্ষেত্ৰই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল। তুলােঁ (Toulon) অঞ্চলে বর্বর দস্যুরা ফিরে যাওয়ার পর কৃষিযােগ্য ভূমিগুলিকে নতুন করে জঞ্জালমুক্ত করতে হয়েছিল, জমির সীমানা বলতে কিছুই ছিল না, এবং, সমসাময়িক এক সনদ থেকে জানা যায় যে, খুশী ও সাধ্যমতো জমি দখলের ঘটনা ঘটেছিল অবিরলভাবে। ভাইকিঙ আক্রমণে জর্জরিত তুরেন (Touraine) অঞ্চলের অবস্থা হয়ে উঠেছিল শােচনীয়। ভূমি রাজস্ব বা করের পুরােনাে হিসেবের কোনও চিহ্ন ছিল না সেখানে। মাতিগনে (Martigny) গ্রামে বহু কৃষক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ভূস্বামীগণও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন তাদের আয়ের একমাত্র উৎস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায়। বিশেষ করে যাজক-অধীন ‘ম্যানর’গুলির অবস্থা হয়ে উঠেছিল অবর্ণনীয়। অনেক ক্ষেত্রে অত্যাচার সহ্যতীত হওয়ায় কৃষকের। উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দস্যুদলের উপর (যেমন ঘটেছিল ল্যয়র ও সেইন নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে)। কিন্তু এ জাতীয় অসঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরােধ কিছুই ক্ষতি করতে পারেনি তাদের। তাৎক্ষণিক এই সব ক্ষতি ছাড়াও অনাবাদী অঞ্চলে, জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি উৎপাদন সম্প্রসারিত করার যে উদ্যোগ আরম্ভ হয়েছিল, বর্বর আক্রমণ স্তিমিত হবার পরেও, কৃষকদের সংখ্যাল্পতার জন্য তা একশো বছরেরও বেশি কাল পিছিয়ে গিয়েছিল।

স্যারাসেন, ম্যাগিয়ার ও ভাইকিঙ আক্রমণের গুরুত্ব, ইউরোপের লাভ ও পরিবর্তন

পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের উদ্ভব

প্রাথমিক এই বিপদ কাটিয়ে ওঠার পর এবং শত্রু দমন করতে গিয়েও কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজশক্তি লাভবান হয়েছিল, হয়তো বা সাফল্যজাত মহিমায় দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। ম্যাগিয়ারদের বিরুদ্ধে হেনরী দ্য ফাউলারের সফল ভূমিকা জার্মানীতে রাজশক্তিকে দৃঢ় করেছিল এবং সেই দস্যুদলের বিরুদ্ধে প্রথম অটোর নিরঙ্কুশ জয় পরােক্ষভাবে সম্ভব করেছিল পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবন। অনুরূপভাবে ডেনদের বিরুদ্ধে রাজা আলফ্রেডের বিস্ময়কর সাফল্য ইংলণ্ডে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের পথ সুগম করে দেয়। ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে নরম্যান্ডির পত্তন এবং খ্রীষ্টান জগতের সীমানার বাইরে স্বল্পজ্ঞাত, রহস্যআচ্ছাদিত পরিবেশে রাশিয়ার জন্ম সমগ্র মহাদেশে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে এনেছিল। ঐতিহাসিক হেনরী পিরেণ গভীরতর এক তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন বিধর্মী বর্বরদের এই তাণ্ডবলীলার মধ্যে। তার মতে স্যারাসেন মুসলমান সভ্যতার সংস্পর্শে আসার ফলেই ধুপদীযুগ থেকে মধ্যযুগে উত্তরণ হয়েছিল ইউরোপের। ‘West’ বলতে যা বােঝায় তার জন্মের মূলে ছিল এ সংযোগ। হেনরী পিরণের অভিমত অতিরঞ্জিত বলে কেউ কেউ মনে করলেও এ তথ্য অনস্বীকার্য যে স্যারাসেন, মাগিয়ার এবং ভাইকিংদের এই সুদীর্ঘকালব্যাপী আক্রমণের সাবিক গুরুত্ব চারশো বছরে আগের ক্ষয়িষ্ণু রােমান সাম্রাজ্যের উপর বর্বর আক্রমণের মতোই। এরই অভিঘাতে কালান্ত হয়েছিল খ্রীস্টান জগতে।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব

ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ লিখেছেন, “অন্তহীন এই সঙ্কটের মধ্যেই জাত হয়েছিল সামন্ততন্ত্র যাকে, একাধিক কারণে, এই বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার ফসল বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।” এ প্রসঙ্গে এ তথ্যও স্মর্তব্য যে বিধর্মী এই দস্যুদলের আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন এবং লক্ষবস্তু ছিল চার্চ ও মঠগুলি। কৃষিপ্রধান জনপদগুলিতে সােনা রুপাে বা মূল্যবান ধাতুর, সংক্ষেপে লুট করার মতো ধনরত্নের প্রাচুর্য ছিল না। সম্পদ বেশীর ভাগই সঞ্চিত ছিল চার্চ ও মঠগুলিতে। এগুলির সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রায় কিছুই ছিল না আর আক্রমণকারীর পক্ষে এগুলিকে খুজে বের করাও শক্ত ছিল না। সুতরাং একের পর এক লুণ্ঠিত, বিধ্বস্ত ও ভস্মীভূত হয়েছিল ইউরােপের খ্যাত অখ্যাত অসংখ্য চার্চ ও মঠ। কারো কারো চোখে বিধর্মী বর্বরদের এই আক্রমণ পবিত্র খ্রীস্টধর্ম ও খ্রীস্টান প্রতিষ্ঠানগুলির উপর নির্মম আঘাত বলেই মনে হয়েছিল। শঙ্কিত যাজক সম্প্রদায় তাই সমস্ত খ্রীষ্টান সমাজের কাছে আবেদন করেছিলেন ভয়ঙ্কর এই বিধর্মী আক্রমণের বিরুদ্ধে খ্রীষ্টানমাত্রকেই ঐক্যবদ্ধ হতে। ‘সীজার ছাড়া ক্রাইস্ট’-এর চলে না, তাই খ্রীস্টধর্মের রক্ষক ও পৃষ্ঠপােষক সম্রাটের অপরিহার্যতা বিষয়ে চার্চ হয়ে উঠেছিল দ্বিধাহীন। ৯ম শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন পােপের নেতৃত্বে তাই শুরু হয়েছিল এমন এক সম্রাটের জন্য অবিরাম অন্বেষণ যিনি সেন্ট পিটারের পবিত্র আসন বিধর্মীর কলুষস্পর্শ থেকে রক্ষা করতে পারবেন। লােথেয়ারের মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজন পােপ পূর্ব ও পশ্চিম ফ্রাঙ্ক রাজ্যের একাধিক শাসককে এই ত্রাতার ভূমিকায় পেতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্যাক্সনীর ডিউক (পরে জার্মানরাজ) হেনরী দ্য ফাউলারের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত শত্রুদমনে সক্ষম এমন কোনও শাসকের দেখা পাওয়া যায় নি। অবশ্য হেনরীও সম্রাট হন নি। তার যােগ্যপুত্র প্রথম অটো ৯৬২ সালে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যকে, তবে তা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে, কোনও পােপকে কৃতার্থ করার জন্য নয়। কিন্তু প্রাক পুনরুজ্জীবনের ঘটনাবলীর উপর পােপদের এই নিরন্তর অন্বেষণ ও প্রচেষ্টার কোনও গুরুত্বই ছিল না একথা নিঃসংশয়ভাবে বলা চলে না।

শার্লমানের অক্ষম, অদূরদর্শী বংশধরদের পক্ষে ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের খণ্ডিত অংশগুলির মধ্যে মধ্য-রাজ্য (Middle Kingdom) এবং পশ্চিম ফ্রাঙ্ক রাজ্যের আয়তন ও ভৌগােলিক অবস্থানের জন্য রাজ্যগুলির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দুর্বহ ছিল। ভাইকিঙদের অবিরাম আক্রমণ, দক্ষিণ থেকে স্যারাসেন এবং পূর্বদিক থেকে অশ্বারূঢ় ম্যাগিয়ার দস্যুদলের অতর্কিত আক্রমণের ফলে কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্বই প্রায় লােপ পেয়ে গিয়েছিল। রাজশক্তির ক্রমবর্ধমান এই অবক্ষয়ে স্থানীয় সামন্তরাই মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। যে কোনও উপায়ে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলাই ছিল সে সময়ে অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু দূরবর্তী, প্রায় সাধারণের নাগালের বাইরে থাকা রাজশক্তি (তা ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট হলেও) দেশ রক্ষায়, আর্ত ত্রাণে, তার প্রাথমিক কর্তব্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে অসহায়, শঙ্কিত মানুষ সেইসব পরাক্রান্ত সামন্তদের উপরই নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিল যাদের নেতৃত্বে অন্তত এই ঘনায়মান সর্বনাশ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক ডেভিস লিখেছেন যে, সন্দেহ নেই এটিই ছিল বিধির বিধান যে সর্বাবস্থায় প্রজাবৃন্দ রাজানুগত থাকবে, কিন্তু চারিদিকে যখন ভাইকিং, স্যারাসেন-মুসলমান এবং হাঙ্গেরীয়ানগণ প্রাণ ও সম্পত্তিনাশে তৎপর তখন সবচেয়ে জরুরী ছিল আঞ্চলিক ভিত্তিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা আর এ জন্যে কোনও শক্তিশালী প্রভুর শরণাপন্ন হওয়া। এর ফলে অতি কঠিন বাস্তব প্রয়ােজনে বৈপ্লবিক একটি পরিবর্তন ঘটে যায় ইউরােপের রাষ্ট্রিক এবং সামাজিক কাঠামােতে। অ্যালান ব্রাউনও মনে করেন এই পরিস্থিতির মধ্যে ফিউড্যালিজম এর না হলেও ফিউডাল সােসাইটির আবির্ভাবের উৎস (বিশেষ করে ফ্রান্সে) খুঁজে পাওয়া যায়। আর ফ্রান্স থেকেই এই নতুন ফিউডাল প্রথা-পদ্ধতি স্বল্পকালের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত খ্রীস্টান জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘ফিউড্যালিজম্’ এবং ‘মধ্যযুগ’ প্রায় সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে এবং খ্রীষ্টধর্ম, ক্যাথলিক চার্চ, গ্রীকো-রােমান সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে জার্মান ঐতিহ্যের মিশ্রনে আধুনিক পশ্চিম ইউরােপের সৃষ্টিতে ‘ফিউড্যালিজম’ এর গুরুত্ব সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নেই। 

খ্রিস্টানজগৎকে নৌবিদ্যা দানের মাধ্যমে তাদেরকে পুনরায় সমুদ্রমুখী করে তোলা

সুদীর্ঘকাল ধরে ‘নর্সমেন’ অভিযান ও বিভিন্ন অঞ্চল এই বিধর্মীদস্যুদলের করায়ত্ত হলেও ইউরােপীয় সমাজে, সাধারণ মানুষের উপর এই ঘটনার বিশেষ কোনও প্রভাব পড়েনি। ভাইকিংদের আচার অনুষ্ঠান, তাদের জীবনযাত্রা পদ্ধতি ফ্রাঙ্ক রাজ্যগুলিতে অপরিচিত ছিল না। শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষার ক্ষেত্রে দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না এই আক্রমণকারীদের। তবে একটি ক্ষেত্রে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল অবিসংবাদিত। নোবিদ্যায়, সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণের দক্ষতায় সমসাময়িক কালে তাদের তুল্য কেউই ছিল না। পূৰ্বাগত জার্মানরা দীর্ঘকাল অনুশীলনের অভাবে সমুদ্রের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। ছোট ছোট পালতোলা, দাড়বাহী, অতি দ্রুতগামী এবং উজ্জ্বলবর্ণ রঞ্জিত জাহাজে বাল্টিক থেকে নীল ভূমধ্যসাগর এবং নিঃসীম আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ভাইকিঙরা একই সঙ্গে দুঃসাহসিকতা এবং নৌবিদ্যা শিখিয়েছিল তাদের প্রতিবেশীদের, আবার সমুদ্রমুখী করে তুলেছিল খ্রীস্টান জগৎকে। (অসলো মিউজিয়ামে একটি ভাইকিঙ জাহাজ রক্ষিত আছে যাকে বলা হতাে ওসবার্গ (Osberg) -লম্বায় ২১ মিটার, চওড়ায় ৫ মিটার, ১৫ টি দাঁড় সম্বলিত। আর এক ধরণের জাহাজকে বলা হতো ‘গােকৃস্টাড (Gokstad)। এর মাস্তুল ১২.৬ মিঃ উঁচু। এগুলি প্রধানত পালের সাহায্যে চালিত হতো এবং ঘণ্টায় দশ মাইল বেগে ছুটতে পারত। ৪০ থেকে ১০০ জন যাত্রী বইবার ক্ষমতা ছিল গােকস্টাডগুলির।)।

বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ভাইকিঙদের অবদান

জেরল্ড হজেট লিখেছেন নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে এবং তার পরবর্তী অধ্যায়ে শুধু ধ্বংসের কাহিনীই নয়, অনাবিষ্কৃত ভূভাগ এবং নতুন বাণিজ্যপথ আবিষ্কারে, ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে ভাইকিঙদের ভূমিকা বিস্ময়কর। ৯ম শতকের শেষার্ধ থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ার বাণিজ্য বিস্তার তাদেরই প্রচেষ্টার ফল। সুইডিশরা (সমসাময়িকদের কাছে ভ্যারাঙ্গিয়ান নামে পরিচিত) রাশিয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণপূর্ব ইউরােপে নতুন বাণিজ্যিক পথ বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল। রিগা উপসাগর থেকে ডুইনা নদীর মধ্য দিয়ে পােলােটস্ক (Polotosk) পর্যন্ত, সেখান থেকে নীপার নদীর তীরে স্মােলেনস্ক এবং কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত পণ্য আমদানী রপ্তানীর পথ তারা চালু করেছিল। কৃষ্ণসাগর তীরস্থ বন্দরগুলি থেকেই বাইজানটাইন বণিকেরা তাদের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ করত। ৮৩৯ সালে ফ্রাঙ্ক সম্রাট লুই দ্য পয়াসের কাছে বাইজান্টাইন সম্রাট প্রেরিত রাজকর্মচারীদের মধ্যে ভাইকিঙদের কয়েকজনের উপস্থিতির কথা জানা যায়। এরা নিজেদের রাস, রােস বা রাশিয়ান বলে পরিচয় দিত। অবশ্য পরে অনাব্যতার জন্য নীপার ত্যাগ করে তারা ভলগা নদী ব্যবহার করত। মধ্য এশিয়া ও দূর প্রাচ্য থেকে আগত বাণিজ্য সম্ভার খাজার (Khazar) ও ইটিল (Itil)দের মাধ্যমে বিনিময়ের কথা জানা যায়। ভাইকিঙরা সাধারণত ফার, কাঠ, মােম এবং ক্রীতদাস বিক্রয় করত। তাদের অনুসৃত পথে প্রাপ্ত আরবীয় রৌপ্যমুদ্রার প্রাচুর্য তাদের বাণিজ্যিক লেনদেনের কথা প্রমাণ করে। ইবন খরদাধ এর লেখাতে ‘রাস’দের ব্যবহৃত পথের বিবরণ মেলে। কখনো কখনাে কাস্পিয়ান সাগর পার হয়ে বাগদাদেও তাদের পণ্য সম্ভার নিয়ে যেত ‘রাস’রা। সাধারণভাবে বলা যায় ইউরােপের এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে নর্সরা উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন সাধন করেছিল। ৭ম এবং ৮ম শতকে ইউরােপের বাণিজ্য প্রধানত ভূমধ্যসাগর কেন্দ্রীক ছিল, ৯ম ও ১০ম শতাব্দীতে তাকে উত্তরাঞ্চলে প্রসারিত করে দেওয়ার কৃতিত্ব ভাইকিঙদের। এই বাণিজ্যিক প্রসার ১০ম শতাব্দীর ইতালীয় ও বাইজানটাইন বন্দরগুলির বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে তুলনীয় নয়, কিন্তু এরই ফলে দক্ষিণ ইউরােপের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলও ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযােগ্য এবং সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করে। এই প্রচেষ্টার ফলেই তিন শতাব্দী পরে ‘হান্‌সি’ এবং কয়েকটি ইতালীয় নগরের নেতৃত্বে মধ্যযুগের ব্যবসাবাণিজ্যের অসাধারণ বিকাশ সম্ভবপর হয়।

উপনিবেশ স্থাপন, ক্রুসেডে সাফল্য অর্জন, নর্মান রাজ্য স্থাপন, ভাষ্কর্য-স্থাপত্যের বিকাশ ও ইউরোপে মুসলিম সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ায় ভাইকিঙ অবদান

‘বর্বর’ হলেও ঔপনিবেশিকের ভূমিকায় নর্সমেনরা ছিল সার্থক। ফ্রান্সে, ইংলণ্ডে, রাশিয়ায় যেখানেই তারা বসতি স্থাপন করেছে সেখানকার লোকজনের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার তারা অবিশ্বাস্য দুততায় আয়ত্ত করে নিয়েছে। পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার অদ্ভুত দক্ষতা দেখিয়েছে দুর্জয় এই ‘আধা-সামুদ্রিক বিধর্মী বর্বররা’। নরমাণ্ডিতে (নরমাঁদি) সুস্থির সামাজিক জীবন আরম্ভ করার একশো বছরের মধ্যেই তারা খ্রিস্টধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিল, আরও পরে পরমোৎসাহে তারা ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেছিল ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উপনীত হয়েছিল, এবং বাইজানটাইন-মুসলমান প্রভাবাধীন দক্ষিণ ইতালী এবং সিসিলিতে এক অভূতপূর্ব দীপ্ত, প্রাণচণ্ডল সভ্যতার পত্তন করেছিল যা ছিল রোমান, নর্ম্যান ও মুসলিম সংস্কৃতির মিলনস্থল, যার ফলে আগমন হয়েছিল ১২শ শতকের রেনেসাঁর। শাসক হিসেবে তারা রেখে গেছে ঈর্ষাযােগ কৃতিত্বের স্বাক্ষর। ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের অনুশীলনেও পিছিয়ে থাকেনি তারা। ঐতিহাসিক হেনরী অ্যাডামস তাদের সাফল্যের এই দিকটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে “তারা যাতে হাত দেয় তা সম্পূর্ণ না করে ক্ষান্ত হয় না।” জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগ সম্পর্কেও এ প্রশংসাবাণী, প্রতিবাদের আশঙ্কা না রেখেই, প্রয়োগ করা যায়।

মধ্যযুগীয় ইউরােপের ইতিহাসে ভাইকিংদের বিশিষ্ট ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আর. ডব্ল্যু. সাউদার্ণ লিখেছেন “যুগের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যথাস্থানে হাজির হওয়ার একটা অলৌকিক ক্ষমতা বা অসাধারণ সৌভাগ্য তাদের ছিল।” ইংলণ্ডে তারা উপনীত হয় এমন একটা সময়ে যখন এই দ্বীপপুঞ্জ লাতিন ইউরােপের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রবাহের দিকে আকর্ষিত বা বিকর্ষিত হবার প্রশ্নে সংশয়াকুল নর্সমেনদের আবির্ভাবের ফলে অন্তত মধ্যযুগের বাকি সময়টুকুর জন্য ইংল্যান্ড মহাদেশীয় ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। লাতিন, গ্রীক ও মুসলমান প্রভাবের সংঘাতে যখন দক্ষিণ ইতালীর ভাগ্য সঙ্কটাপন্ন ঠিক তখনই তাদের উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপের ফলে সেখানে লাতিন সভ্যতারই জয় সূচিত হয়। সংখ্যাতীত চার্চ ধ্বংস করে একদিন তারা পােপতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছিল, কিন্তু সময়ান্তরে, পােপের পরম প্রয়োজনের মুহূর্তে তারা হয়ে ওঠে ধর্মগুরুর অতি বিশ্বস্ত সুহৃদ। সিসিলি থেকে মুসলমানশক্তি অপসৃত করা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য জগতে আরব সভ্যতার নির্যাসটুকু তাদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়েছিল। একদা ভয়ঙ্কর, পরবর্তীকালের এই সুভদ্র খ্রীস্টানদের দক্ষতা অথবা সৌভাগ্য মধ্যযুগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তাদের জড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারই ফলে ইউরোপীয় সভ্যতার বিকাশে তাদের কোনও মৌলিক অবদান না থাকা সত্ত্বেও, এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যাল্পতা নিয়েও, মধ্যযুগের ইতিহাসে নর্সমেন একটা স্থায়ী এবং গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। আর পেছনে যারা রয়ে গিয়েছিল তাদের পিতৃভূমিতে, বিচ্ছিন্নতার মধ্যে, অবহেলিত হয়ে, খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেও যারা তাদের পেগান সত্তা বিসর্জন দিতে পারেনি, তারাই ভাইকিংদের অতীতের বর্ণময়, উদ্দাম জীবনধারার কথা, আশা ও উদ্যমের কাহিনী স্বযত্নে, পরম মমতায় সংরক্ষিত করে রেখেছিল অগণিত নর্স গাথায় (আইসল্যাণ্ডিয় বা প্রাচীন নর্স ভাষায় লিখিত)। ইউরােপের ঘটনাকীর্ণ ইতিহাসে যারা ভিন্নতর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেই সব ভাইকিংদের নয়, মানবসভ্যতা ও সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে বিশিষ্ট এবং মৌলিক অবদানের জন্য ইতিহাস স্মরণ করে রেখেছে অনুজ্জ্বল এবং পিছিয়ে পড়া, পিছনে থেকে যাওয়া স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ার এই মানুষগুলোকে।

নর্মান শাসনাধীন দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলি

নর্মানদের আগমনের পূর্বে দক্ষিণ ইতালীর অবস্থা, বাইজান্টাইন ও মুসলিম শাসন

১১শ শতকের শুরুতে দক্ষিণ ইতালির রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব অনিশ্চয়তা ও জটিলতায় আচ্ছন্ন ছিল। সমস্ত এলাকাটিতে প্রাচীন শাসন ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। বাইজান্টাইন সম্রাট রোম পর্যন্ত ভূভাগের মালিকানা দাবি করলেও দক্ষিণ ইতালির প্রত্যন্ত প্রদেশটুকুতেই তার কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই অসুবিধা সত্ত্বেও কূটনীতি ও অর্থের কুশল প্রয়োগ দ্বারা বাইজান্টাইন সরকার দক্ষিণ ইতালির ছোটো ছোট রাজ্যগুলোর মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষি জীইয়ে রেখে কোনও একজন শাসকের পক্ষে উল্লেখযোগ্য শক্তি সঞ্চয় অসম্ভব করে তুলেছিল। অ্যাপুলিয়া ও ক্যালাব্রিয়াতে বাইজান্টাইন সম্রাটের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। সিসিলিতে তখনও পর্যন্ত সারাসেন বা মুসলিমদের আধিপত্য বজায় থাকলেও গৃহযুদ্ধ মুসলিম শক্তির অবক্ষয়ের একটা প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া অ্যামালফি, নেপল্‌স ও গেইতা স্বাধীন নগররাষ্ট্রের মর্যাদা ভোগ করতো এবং স্যালার্নো, ক্যাপুয়া ও বেনিভেন্তো নামে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীন হলেও কার্যত স্বশাসিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে বাইজান্টাইন সম্রাট বা পবিত্র রোমান সম্রাট বা ফাতেমিদ শাসকদের শক্তির কেন্দ্রভূমি থেকে বহু দূরে থাকায় দক্ষিণ ইতালিতে তাদের কারোর পক্ষেই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন সম্ভব হয়নি, এই সঙ্কীর্ণ ভূখণ্ডটুকু যে কোনও উদ্যমী অকুতোভয় ভাগ্যান্বেষীর সৌভাগ্যেরই লালন-ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারতো।

প্রথম নর্মানদের ইতালীতে আগমন, উইলিয়ম ও দ্রোগো

এই পটভূমিকায় ১০১৬ সাল নাগাদ একদল নর্মান নাইট জেরুজালেম থেকে ফেরার পথে স্যালার্নোতে নামেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদের সামরিক শক্তির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় শাসকদের কেউ কেয় নর্মান নাইটদের সাহায্যপ্রার্থী হন। বিশেষ করে মুসলমান আক্রমণের জন্য ভীত স্যালার্নোর শাসক ও বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী অ্যাপুলিয়ার ডিউক মেলো এই বিষয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। নর্মান নাইটরা এদের প্রত্যাশা পূরণ না করলেও তাদেরই মারফৎ দক্ষিণ ইতালির প্রকৃত রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবর নরমাঁদি বা নরমান্ডিতে পৌঁছয় এবং দলে দলে নাইট পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রেরা, সমাজচ্যুত কিছু মানুষ এবং নরমান্ডির ডিউকের প্রতিপক্ষদের অনেকে ১০৪০ সালের মধ্যেই দক্ষিণ ইতালিতে হাজির হন। অবশ্য এসব ভাড়াটে যোদ্ধারা কিছুকালের মধ্যেই তাদের “প্রভুদের” নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান। যথেচ্ছ লুঠপাটের ঘটনা অবিরলভাবে চলতে থাকে। আবার এদেরই অন্যতম রেইনাল্‌ফ ড্রেগনো (Rainulf Drengot) তার শৌর্যবীর্যের পুরস্কার হিসেবে অ্যাাভারসা (Aversa) কাউন্টি-টি লাভ করেন, এবং সেটি নর্মান ভাড়াটে যােদ্ধাদের একটা কর্মসংস্থান কেন্দ্রে পরিণত হয়। শেষােক্তদের সঙ্গেই দক্ষিণ ইতালীতে এসেছিলেন বহু সন্তানের জনক, দারিদ্র-পীড়িত টানক্রেড দ্য হটিভেল-এর দুই পুত্র উইলিয়ম আয়রণ-আর্ম এবং দ্রোগাে। অত্যলপকালের মধ্যেই এই দুই সহােদরের সমরকুশলতা ও কর্মতৎপরতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কখনও তারা গ্রীকদের হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেন, কখনও বা লোম্বার্ডদের হয়ে গ্রীকদের বিরুদ্ধে। অন্যান্য নর্মান যােদ্ধাদের লুণ্ঠনের লােভ দেখিয়ে এরা প্রায়ই বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল আক্রমণ করতেন। যুদ্ধে পরাজয়, অধীনস্থ যােদ্ধৃ দলে বিক্ষোভ-বিশৃঙ্খলা কিছুই এদের নিরস্ত করতে পারেনি। এদিকে কনস্টান্টিনােপলের রাজদরবারের ষড়যন্ত্র এবং এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন এলাকায় তুর্কী-আক্রমণ বাইজানটাইন শাসকদের প্রায়ই বিব্রত করে রাখায় উইলিয়ম এবং দ্রোগাে ক্রমশ উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করে নিজেদের প্রাধান্য স্থাপনে সক্ষম হন। অ্যাপুলিয়াতে তাদের একটা ঘাঁটিও গড়ে ওঠে।

রবার্ট গুইসকার্ড, রজার ও তাদের শাসন

ইতিমধ্যে উইলিয়ম ও দ্রোগাের বৈমাত্রেয় ভায়েরাও দক্ষিণ ইতালীতে হাজির হয়েছিলেন। এদের অন্যতম রবার্ট গুইসকার্ড (যাকে ক্রিস্টোফার ব্রক “a brigand of genius” আখ্যা দিয়েছেন) প্রায় কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে ওঠেন এবং যথেচ্ছ আক্রমণে বাইজান্টাইন সম্রাটকে সন্ত্রস্ত করে তােলেন। ১০৫৩ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে উইলিয়ম এবং দ্রোগাের মৃত্যুর পর গুইসকার্ডের পক্ষে দক্ষিণ ইতালীতে নর্মানদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে ওঠা অতি সহজ হয়ে যায়। তার পরাক্রমের স্বীকৃতি আসে ১০৫৯ সালে যখন পােপ দ্বিতীয় নিকোলাস তাকে অ্যাপুলিয়া, ক্যালাব্রিয়া এবং সিসিলি ডাচির শাসক হিসেবে মেনে নেন। অবশ্য প্রথমে এটা ছিল নিতান্তই একটা কাগজেকলমের বন্দোবস্ত, কিন্তু ১০৮৫ সালে পােপের দেহাবসানের পর গুইসকার্ডই দক্ষিণ ইতালীর প্রকৃত শাসক হয়ে ওঠেন, সিসিলিতে প্রতিষ্ঠিত হন তারই সহােদর রজার। ক্যাপুয়ার শাসক বা পােপের পক্ষে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা আর সম্ভব ছিল না। পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে, গ্রীক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে গুইসকার্ডের অবিরাম আক্রমণ বাইজানটাইন শাসকের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে দেয়। ১০৭১ সালে তারই হাতে দক্ষিণ ইতালীতে শেষ বাইজানটাইন ঘাঁটির পতন ঘটে।

এদিকে সিসিলিতে রজারও নিশ্চেষ্ট হয়েছিলেন না। ১০৯১ সালের মধ্যেই মুসলিমদের প্রবল প্রতিরােধ সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে সিসিলি থেকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হন। ক্ষাত্রশক্তিতে গুইসকার্ডের মতাে দুদ্ধর্ষ না হলেও রজার ছিলেন সংগঠক ও সুশাসক। সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক ও আইনপ্রণেতা হিসেবে তার খ্যাতি ছিল সুদূ বিস্তৃত এবং ১০৮৫ সালে রাবার্ট গুইসকার্ডের মত্যুর পর সিসিলিই হয়ে ওঠে নর্মানশক্তির প্রধান কেন্দ্র, কেননা তার জ্যেষ্ঠপুত্র রজার বােরসা (১০৮৫-১১১১ খ্রি.) ক্রমশ গুইসকার্ডের অর্জিত কতৃত্ব হারাতে থাকেন। অবশ্য গুইসকার্ডের অপর এক পুত্র বােহেমন্ড প্রথম ক্রুসেডে অতুলনীয় খ্যাতি অর্জন করে অ্যান্টিয়ক জয় করেন এবং ‘প্রিন্স অফ অ্যান্টিয়ােকের’ পদও লাভ করেন। ১১০১ সালে সিসিলির শাসক প্রথম রজারের দেহাবসান হয়, কিন্তু তার আগেই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নর্মান সাম্রাজ্যের উপর তার সংশয়াতীত কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। আর সিসিলিতে তিনি যে রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সংগঠন ও সুশাসনের মানদণ্ডে তা ইংলণ্ডে তার স্বজাতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের থেকে কোনও অংশেই কম ছিল না।

২য় রজার ও ১ম উইলিয়মের শাসন

দক্ষিণ ইতালিতে গুইসকার্ডের বংশধররা অর্জিত কতৃত্বের সদ্ব্যবহার করতে অক্ষম হলেও প্রথম রজারের উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় রজার (১১০৩–১১৫৪ খ্রি.) সিসিলিতে নর্মান শাসনের ভিত্তি দৃঢ়তর করে পরবর্তীকালে ‘দ্য গ্রেট’ অভিধা লাভের যােগ্য হয়ে উঠেছিলেন। ১১২৭ সালে গুইসকার্ডের পৌত্রের মৃত্যু ঘটলে তিনি দক্ষিণ ইতালীর নর্মান শাসনাধীন সমস্ত অঞ্চল নিজ রাজ্যভুক্ত করে নেন। দ্বিতীয় রজার অবশ্য সিসিলির ‘কাউন্ট’ এবং অ্যাপলিয়ার ‘ডিউক’ হিসেবেই তৃপ্ত থাকার মতাে মানুষ ছিলেন না। ১১৩০ সালে পােপ-পদে নির্বাচনে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযােগে তিনি অন্যতম প্রার্থী দ্বিতীয় অ্যানাক্লিটাসের কাছ থেকে ‘রাজা’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেন এবং প্যালর্মোতে সাড়ম্বরে তার রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয়। ১১৩৯ সালে তিনি পােপ-পদের দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ২য় ইনোসেন্টকেও বাধ্য করেছিলেন তাকে রাজা বলে মেনে নিতে। এভাবেই নরমান্ডির এক দুঃস্থ পরিবারের সন্তান খ্রীস্টান জগতের অন্যতম প্রধান শাসকে পরিণত হন।

সিসিলির রূপান্তর শুধু তার শাসকের মর্যাদা বৃদ্ধিতেই শেষ হয়ে যায়নি। এক প্রজন্ম আগেও লুণ্ঠন ও নিপীড়ন যাদের একমাত্র নীতি ছিল, বিত্তের লােভে যে কোনও মানুষের হয়ে অস্ত্রধারণই ছিল যাদের পেশা, সিসিলিতে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে তারা উচ্ছৃঙ্খলতা বা যথেচ্ছাচারের লেশমাত্রও সহ্য করতে রাজী ছিল না। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পুরণের জন্য যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করতে, ভ্যাসালদের বিশ্বস্ত এবং কার্যকর ‘সেবকে’ পরিণত করতে নমানরাজ ছিলেন বদ্ধপরিকর। কিন্তু দক্ষিণ ইতালীতে এই কাজ সহজসাধ্য ছিল না। উইলিয়ম ড্রোগো, এমনকি রবার্ট গুইসকার্ডও সেখানে নিজ কতৃত্ব অধীনস্থদের নিঃসংশয় স্বীকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হননি। তাই দ্বিতীয় রজার ইতালীর দক্ষিণাঞ্চলে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা করলে তার বিরদ্ধে বারবার প্রতিরােধ ঘটতে থাকে, বিক্ষোভ, বিদ্রোহে মথিত হয়ে ওঠে নর্মান অধ্যুষিত এলাকা। শেষ পর্যন্ত সিসিলিতে নর্মান রাজশক্তির অনাক্রমণীয় প্রতিষ্ঠাই রজারকে দক্ষিণ ইতালীতেও নিজ কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করে। সিসিলিতে ভাড়াটে সৈন্যের সাহায্যেই নর্মান রাজশক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এইসব সেনারা কাউণ্টদের বদান্যতা-প্রসূত দান ছাড়া অন্য কিছু দাবী করতে পারতাে না। তাই অতি সহজেই রাজানুগত্য গড়ে উঠেছিল। আর এরই ফলে সিসিলিকে কেন্দ্র করে গােটা খ্রীস্টান জগতে নর্মান রাজশক্তি এক আশ্চর্য মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠে।

সিসিলি রাজ্যের (বা Regno) আবির্ভাব বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য উভয়ের পক্ষেই অস্বস্তিকর, মর্যাদাহানিকর এবং নিজেদের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী বলে প্রতিভাত হয়েছিল। এর শক্তি-সামর্থও ক্রমশ বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পোপতন্ত্র পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নর্মানশক্তিকে ব্যবহারে আগ্রহী হলেও, দক্ষিণের এই সুসংহত রাজ্যটি যে রােমের পক্ষে রাহু-সদৃশ হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে পােপ সচেতন ছিলেন। আর মধ্য ভূমধ্যসাগরেও দ্বিতীয় রজার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কতৃত্ব স্থাপনে দঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। সিসিলিতে তার অধীনে ছিল বহু সুরক্ষিত বন্দর এবং প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টিয়ােকের জজ-এর তত্ত্বাবধানে তার নৌবাহিনীরও যথেষ্ট শক্তিবৃদ্ধি ঘটেছিল। সুতরাং ইতালীর সামুদ্রিক শক্তিতে পরাক্রান্ত অপর দুই নগর-রাষ্ট্র জেনােয়া ও পিসার সঙ্গে সিসিলির সংঘাত ছিল অনিবার্য। ১১৩৪-৫৩ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে দ্বিতীয় রজার ত্রিপােলি থেকে বােন (Bone) পর্যন্ত আফ্রিকার উপকূলভাগ অধিকার করে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যপথের ওপর সিসিলির আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হন। দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় রজার কাফু ও থিবস আক্রমণ করে থিবসের বেশ কিছু সংখ্যক রেশম শিল্পীকে প্যালার্মোতে নিয়ে আসেন। এর পর থেকেই রেশমী বস্ত্র উৎপাদনে সিসিলির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

১১৫৪ সালে সিসিলি-রাজ দ্বিতীয় রজারের সাফল্য-স্নাত জীবনের অবসান হয়। তার মধ্যে প্রেভিটে অরটন যে “unscrupulous political genius” এর অভ্রান্ত নিদর্শন খুজে পেয়েছেন তাই দ্বিতীয় রজারকে পশ্চিম ইউরােপের সব থেকে প্রগতিশীল, স্বশাশিত একটা রাজ্য স্থাপনে সহায়তা করেছিল। যে সমস্ত বিধিবিধানের সাহায্যে নরমান্ডির ডিউক একজন সফল শাসকে পরিণত হয়েছিলেন সিসিলিতেও সেগুলি অনুসৃত হতে দেখা গিয়েছিল। প্রতিটি পরিবারের সক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সাময়িক দায়-দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকায় সিসিলি-রাজকে কখনও সৈন্য-সামন্তের অভাব বোধ করতে হয়নি। আবার সামরিক শক্তির এই প্রাচুর্য যাতে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে পরিণত না হয় সে বিষয়ে রজার যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাছাড়া সিসিলির নর্মান শাসকেরা আরও একটা সৌভাগ্যের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। তারা সিসিলিতে বাইজানটাইন এবং মুসলিম পূর্বসুরীদের আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার একটা কাঠামাে পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রচীন বহু নিয়ম-কানুনের পুনর্জীবন ঘটিয়ে এবং নতুন প্রশাসনিক রীতিনীতির সঙ্গে সেগুলো সমন্বিত করে তারা সহজেই এক সফল প্রশাসনিক ব্যবস্থা পত্তন করতে সক্ষম হন। ১১৪০ সালে অ্যারিবিয়ানাের রাজকীয় পরিষদের মারফৎ রজার দ্য গ্রেট যে আইনাবলীর প্রবর্তন করেন তার মধ্যে নর্মান সামন্ততান্ত্রিক উপাদানগুলোর সঙ্গে বহু গ্রীক ও মুসলমান প্রথা-পদ্ধতির সংমিশ্রণ ঘটতে দেখা গিয়েছিল। তবে এর মূল কাঠামােটা ছিল রােমান আইন দ্বারা প্রভাবিত। ইতিপূর্বে বেশ কিছু সংখ্যক ইতালীয় নগর-রাষ্ট্র রােমান আইনের অনুসরণ করেছিল। কিন্তু মধ্যযুগে ইউরােপীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সিসিলিতেই সর্বপ্রথম রেমান আইন এভাবে সম্মানিত হয়। আর এর দ্বারা এ তথ্যই প্রমাণিত হয় যে সেখানে একটা সুসংগঠিত স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। পশ্চিম ইউরােপে দ্বিতীয় রজার যে সরকার গঠন করেছিলেন তাকে ক্রিস্টোফার বুক “The most mature royal government” আখ্যা দিয়েছেন। দুরত্ব সত্ত্বেও ইংলণ্ডের নর্মানদের সঙ্গে দ্বিতীয় রজার যােগাযােগ বজায় রেখেছিলেন। সিসিলি থেকে আগত নর্মানদের মধ্যে ইংলণ্ডের রাজকর্মচারীদের মধ্যে যারা সুখ্যাত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন টমাস ব্রাউন। ইংলণ্ডেশ্বর দ্বিতীয় হেনরী অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে সিসিলি-রাজের কাছে তার শেখার অনেক কিছুই আছে। দুই রাজ্যের এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে রজারের পৌত্র দ্বিতীয় উইলিয়মের সঙ্গে হেনরীর কন্যার বিবাহ হওয়ায়।

দ্বিতীয় রজারের উত্তরাধিকারী প্রথম উইলিয়মের রাজত্বকালে সিসিলি চারিদিক থেকে আক্রমণে অস্থির হয়ে ওঠে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্ত বাধাবিপত্তি দূর করে তিনি পােপ অ্যাড্রিয়ানকে বাধ্য করেন তাকে স্বীকৃতি দান করতে। তবে ইতিমধ্যে উত্তর আফ্রিকার মূরদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সিসিলি-অধিকৃত স্থানগুলোর সবই বেহাত হয়ে যায়। পরবর্তী শাসক উইলিয়ম দ্য গুডের রাজত্বকালেই অনুষ্ঠিত হয় সম্রাট ফ্রেডারিক বাবারােসার পুত্র হেনরীর (ষষ্ঠ) সঙ্গে সিসিলির ভাবী উত্তরাধিকারিণী কনস্ট্যান্সের বিবাহ, আর এই ঘটনা (১১৮৫ খ্রীঃ) অল্প কিছুকালের মধ্যে সিসিলির ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল।

নর্মান শাসনের লেগেসি

দক্ষিণ ইতালীতে নর্মান রাজ্য সংগঠনের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল; সারা রাজ্যে বিশেষ করে সিসিলিতে, বিজেতাদের সংখ্যাল্পতা এবং রাজ্যটির সাধারণভাবে বিরল-বসতি থেকে যাওয়া। এই কারণে নর্মান রাজারা ভিন্ন স্থান থেকে বন্ধুভাবাপন্ন, বসবাসে আগ্রহীদের এই রাজ্যে আসার আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন, উত্তর ও দক্ষিণের ইতালীয়, গ্রীক ও মুসলিমদের মধ্যে নর্মানরা একটা সমন্বয় সাধনেরও চেষ্টা করে। বাইজানটাইন সম্রাটের মতাে নর্মানরা ঈশ্বর কর্তৃক অভিষিক্ত বলে ঘােষিত হলেও রজার দ্য গ্রেটের মতো আইনজ্ঞ শাসকও তার ১১৪০ সালে প্রবর্তিত ‘Assize of Ariano’তে তার প্রজাদের বহু বিচিত্র প্রাচীন প্রথা-পদ্ধতিগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ফলে নর্মান রাজ্যে জাস্টিনিয়ান কোড ও বাইজানটাইন আইনাবলীর সঙ্গে প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক বিধিবিধানের মিশ্রণ হয়েছিল। আর এই সহিষ্ণুতাই সিসিলিতে পূর্ণ ধমীয় স্বাধীনতার বিকাশও ঘটায়।

নর্মানদের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থার সুসংবদ্ধতা ও সাংগঠনিক দৃঢ়তা ছিল বিস্ময়কর। ‘কিউরিয়া’র লর্ডদের নিয়ে গড়া হয়েছিল ‘প্রিভি কাউন্সিল’। এতে প্রথমে ‘গ্র্যান্ড অ্যাডমিরাল’ মুখ্য ভূমিকা নিতেন, পরে ‘চ্যান্সেলরই’ প্রধানমন্ত্রী বলে গণ্য হতেন। রাজার এই মন্ত্রণা পরিষদ বিচার ও রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়গুলোর তত্ত্বাবধানের জন্য কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত হয়। অর্থদপ্তর পরিচালনা করতেন ‘গ্র্যান্ড চেম্বারলেন’। প্রদেশগুলোতেও বিচার ও রাজস্ব বিষয়ক দপ্তরগুলো পরিচালনা করতেন রাজ-মনােনীত কর্মচারীরা। সামন্ততন্ত্রের প্রভাব মুক্ত, সুবিন্যস্ত এই আমলাতত্র রাজ্যের সর্বত্র রাজশক্তিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছিল। বিভিন্ন ধরনের অ্যাাদ (collectae) ও শুল্ক এবং রেশমের মতাে কয়েকটি পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ে রাজার একচেটিয়া অধিকারের মাধ্যমে রাজকোষে আয় ছিল নিয়মিত এবং উল্লেখযােগ্য।

সিসিলির রাজসভাকে কেন্দ্র করে যে সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তারই মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সুশাসিত ওই দেশের বহু বিচিত্র উপাদান-সম্বলিত বর্ণবহুল জীবনের প্রতিফলন। রাজকীয় আদেশনামাগুলো প্রয়ােজন অনুসারে কখনও লাতিন, কখনও-বা গ্রীক, আবার কখনও কখনও আরবী ভাষায় রচিত হতাে। তবে উত্তর ফ্রান্সে প্রচলিত ভাষাই চালু ছিল রাজ দরবারে। আবার চারুশিল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শৈলী, প্রথা-প্রকরণের একটা সুষম সমন্বয় সাধনের চেষ্টাও লক্ষ্য করা যায়। নর্মান, বাইজানটাইন ও মুসলিম (স্যারাসেন) আঙ্গিকের মিশ্রণ রূপ পেয়েছিল মার্বেল পাথরে গড়া প্যালার্মোর ক্যাপেলা প্যালাটিনাতে, সেফালু ও মনরিয়েল-এর ক্যাথিড্রালে। দ্বীপটিতে অবিরাম আসা-যাওয়া ছিল ভিনদেশী পণ্ডিতের। বহু আরব কবির দ্বারা বন্দিত হয়েছেন একাধিক সিসিলি-রাজ, দ্বিতীয় রজারের রাজসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন সখ্যাত পর্যটক ইদ্রিসি। দরবারের বিভিন্ন রাজকর্মচারীকেও গ্রীক থেকে লাতিন ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদে সফল হতে দেখা গিয়েছিল। সন্দেহ নেই, এই সাফল্যই ১২শ শতকের রেনেসাঁর বিকাশ সহজতর করে দেয়। রাজা দরবারের শােভাবর্ধন করতেন বাইজানটাইন সম্রাটের মতাে বর্ণাঢ্য পোষাকে আচ্ছাদিত হয়ে, তার দেহরক্ষী বাহিনীর একাংশ ছিল খ্রীস্টান নাইটদের নিয়ে গঠিত, অপরাংশ মুসলমান নিগ্রোদের নিয়ে। আর সামন্ত রাজাদের পাঠানাে সেনাবাহিনীতে স্যারাসেন (মুসলিম) তীরন্দাজদের উপস্থিতি অবহেলা করার উপায় ছিল না। বর্ণবহুলতা, বৈচিত্র, এবং বহুর এই মিলে-মিশে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত ছিল দক্ষিণ ইতালী ও সিসিলির নর্মান সংস্কৃতির সবচেয়ে বড়াে বৈশিষ্ট্য।

তথ্যঋণ

  • মধ্যযুগের ইউরোপ, ১ম খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষৎ, কলকাতা, ডিসেম্বর, ১৯৯৪, পৃ. – ৮৭-১০৩
  • মধ্যযুগের ইউরোপ, ২য় খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষৎ, কলকাতা, ডিসেম্বর, ১৯৯৪, পৃ. – ৩২১-২৭

2 Trackbacks / Pingbacks

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও দর্শনের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  2. ক্রুসেড ও মধ্যযুগের সমাজের উপর তার প্রভাব – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.