Table of Contents
মধ্যযুগে বিজ্ঞান ও স্কলাস্টিসিজম
মধ্যযুগ থেকে বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতরা মানব অস্তিত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছিলেন। মহাবিশ্ব সম্পর্কে তার অনন্ত কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। পিথাগােরাসের গণিত, ইউক্লিডের জ্যামিতি, প্লেটোর বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসা, আর্কিমিডিসের ইঞ্জিনিয়ারিং সূত্র, টলেমির জ্যোতির্বিদ্যা, গালেনের চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে বিজ্ঞানের জগৎ তৈরি হয়েছিল। অ্যারিস্টটল, গালেন ও টলেমির চিন্তা-ভাবনাকে ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে মেলানাে হয়। এরই নাম হয় স্কলাস্টিসিজম (Scholasticism)। রােমান ক্যাথলিক চার্চ ও রাষ্ট্র এই বিজ্ঞান চর্চাকে সমর্থন করেছিল। রাষ্ট্র ও ধর্মচর্চার সঙ্গে বিজ্ঞান চর্চার বিরােধ ছিল না। মধ্যযুগে ধরে নেওয়া হত বিজ্ঞান চর্চা শুধু জ্ঞানের জন্য, এর কোনাে ব্যবহারিক দিক নেই। এজন্য বিজ্ঞানের সূত্রগুলো শুধু ছাত্রদের জানানাে হত, অজানা দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলে জ্ঞানের বিস্তার ঘটানাের চেষ্টা হত (book learning and disputation)।
মধ্যযুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান ছিল অবশ্যই সীমিত, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্ম হয়নি। পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের তত্ত্ব বা পদ্ধতি অন্য বিভাগে মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কৌশল গােপন করে রাখা হত, প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটানাের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে আদান প্রদান ছিল না। এ যুগে বিজ্ঞানীরা শিল্পী ও কারিগরদের নানাভাবে সহায়তা দিতেন। শল্য চিকিৎসকদের কাছ থেকে শিল্পীরা শারীর-সংস্থান জেনে নিতেন। আবার চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখে শারীর-সংস্থান শিখে নিতেন। মন্টপিলিয়ের, পাদুয়া ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যা বিশেষভাবে শেখানাে হত। এখানে শব ব্যবচ্ছেদ করে চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতি ঘটানাের চেষ্টা হয়। এ যুগে কম্পাস ও এস্ট্রোল্যাব আবিষ্কৃত হয়েছিল, গণিতের অধ্যাপকরা নৌ-পরিবহণের যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিকোলাস ওরসমে (Nicholas Oresme) হলেন এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ জ্যামিতিবিদ।
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সঙ্গে তিনটি সমস্যা জড়িত ছিল –
- (১) যদি সব প্রাকৃতিক কারণে ঘটে, ঈশ্বরের যদি কোনাে ভূমিকা না থাকে তবে মানুষের অবস্থান কীভাবে নির্ধারিত হবে।
- (২) প্রাকৃতিক কার্যকারণ সম্পর্ক কীভাবে নির্ধারিত হবে, এর প্রভাব কি হবে।
- (৩) বিজ্ঞানের বিশ্বজনীন ভাষা কি হবে, আবর্তন গতিতত্ত্ব ইত্যাদি কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে।
মধ্যযুগে ধরে নেওয়া হত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও মানুষের অবস্থান সব কিছু ঈশ্বরের নিয়মের অধীন। ঈশ্বরের অভিপ্রায় দিয়ে জাগতিক সব রহস্য ব্যাখ্যা করা হত। অ্যারিস্টটলের যুক্তি-বিজ্ঞান ১২শ শতকে আবিষ্কৃত হয়, আরব পণ্ডিতরা তা ইউরােপে পৌঁছে দেন। ১৫শ শতক পর্যন্ত অ্যারিস্টটল যুগিয়েছিলেন বিশ্বজনীন বিজ্ঞানের ভাষা। রেনেসাঁ যুগে আবিষ্কৃত হল নতুন জগৎ, নতুন মানুষ ও নতুন দেশ, ইউরােপ নতুন আবিষ্কৃত অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করেছিল। ইউরােপে নতুন শিক্ষার আলােকে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনন পাল্টেছিল। অ্যারিস্টটলের যুক্তি-বিজ্ঞান দিয়ে সব কিছুর যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না। রেনেসাঁ যুগ থেকেই অ্যারিস্টটলের যুক্তি-বিজ্ঞানকে সরিয়ে দিয়ে স্থান গ্রহণ করলাে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নির্ভর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। এই সময় বিজ্ঞানের নতুন নিজস্ব ভাষার অনুসন্ধান চলেছিল। ইউরােপের পণ্ডিতরা মনে করলেন বিজ্ঞানের বিশ্বজনীন ভাষা হতে পারে অংকশাস্ত্র। নতুন যুগে বিজ্ঞান হল শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞান, বিজ্ঞান সম্পর্কে নতুন ধারণার জন্ম হল।
১৪শ-১৫শ শতকে রেনেসাঁ যুগে বিজ্ঞান
আধুনিককালে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা মানব সভ্যতার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। রেনেসাঁ মানুষের মনন ও চিন্তার জগৎকে আলােড়িত করেছে, মানুষ, পৃথিবী, ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন চিন্তার জন্ম দিয়েছে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এর অবদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে রেনেসাঁ কি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল, রেনেসাঁর মানুষ কি বিজ্ঞান বিমুখ ছিল? মানবতাবাদীরা কি বিজ্ঞানচর্চার বিরােধিতা করেছিলেন? রেনেসাঁর ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন যে ১৪শ ও ১৫শ শতকে রেনেসাঁর সুবর্ণ যুগে বিজ্ঞান অবহেলিত ছিল না। বরং পূর্ববর্তী যুগের সঙ্গে তুলনায় এ যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ছিল দ্রুততর (pace of scientific enquiry became a little quicker)। এর কারণ হল এ যুগে মানুষের চিন্তার মুক্তি ঘটেছিল। মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছিল, ক্লাসিকাল যুগ থেকে বিজ্ঞানের যে ঐতিহ্য চলে আসছিল রেনেসাঁর যুগের বিজ্ঞানীরা তার বিচার বিশ্লেষণ করে সংশােধন করে নেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জঁ বুরিদা (Jean Buridan) অ্যারিস্টটলের গতিতত্ত্ব সংশােধন করে ‘ইমপেটাস তত্ত্ব’ (impetus theory) খাড়া করেন। জার্মান আলবার্ট বুরিদার গতিতত্ত্বের ওপর আরও অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন।
রেনেসাঁ যুগে স্বতন্ত্রভাবে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী ছিল না। সায়েনসিয়া (Scientia) বলতে বােঝাত সমগ্র জ্ঞানভাণ্ডার অথবা জ্ঞানের অংশ বিশেষ। ক্লাসিকাল যুগে প্রাকৃতিক জগৎকে বােঝার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। জ্ঞানের এই বিশেষ বিভাগকে বলা হত প্রাকৃতিক দর্শন (Natural Philosophy), প্রাকৃতিক দর্শনের মধ্যে ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, অপরসায়ন (alchemy), ম্যাজিক, গণিত, জ্যামিতি, শারীরবিদ্যা ইত্যাদি। এ যুগে মানবতাবাদীরা প্রাচীন বিদ্যা এবং প্রাচীন পুঁথির পুনরুদ্ধারে মন দেন, বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়। আর্কিমিডিসের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। রেনেসাঁ যুগে কমপক্ষে তিন হাজার বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, এ সবের ফলে বিজ্ঞানচর্চা প্রসারিত হয়। মধ্যযুগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপকরা প্রাকৃতিক দর্শন পড়াতেন কিন্তু সেখানে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা এবং নতুন তত্ত্বকে প্রমাণের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। ছাত্ররা প্রাকৃতিক দর্শন সম্পর্কে যে মডেল ছিল বা বিভিন্ন বিভাগে যে জ্ঞানভাণ্ডার সঞ্চিত হয়েছিল তা আয়ত্ত করত। মৌল অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল না।
ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন যে রেনেসাঁ যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সামাজিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মানুষের কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল পুরাবস্তু, পশু, পাখি, উদ্ভিদ, প্রকৃতির খেয়ালি সৃষ্টি (freaks) সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। দার্শনিক রচনাগুলো ছিল উচ্চস্তরের এবং সমালােচনামূলক। মানুষের সাধারণ জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, অনুভূতি ইত্যাদি বেশ প্রখর হয়ে উঠেছিল। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ফসিল দেখে অনুমান করেছিলেন যে সে অঞ্চলে একসময় সমুদ্র ছিল। তবে কৌতূহল, সমালােচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, সাধারণ জ্ঞান প্রথাগত বিশ্ববীক্ষার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। জ্যোতির্বিদরা গ্রহনক্ষত্রের আবর্তন লক্ষ্য করেছেন, ব্যাখ্যা করেননি। কোপারনিকাস ও পরে গ্যালিলিওই প্রথম সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের কথা বলেছিলেন। গতিতত্ত্ব বা মানুষের ওপর গ্রহের প্রভাব নিয়ে বিতর্ক চলেছিল। এ যুগের মানুষ জ্যোতিষে বিশ্বাস করত, রাজা থেকে সাধারণ মানুষ সকলে জ্যোতিষের সাহায্য নিত। ব্যতিক্রম হলেন রেনেসাঁ পর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী পিকোদেল্লামিরানদোলা। তিনি আবহাওয়া সংক্রান্ত। তথ্য সংগ্রহ করে জ্যোতিষ শাস্ত্রের অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। পিকোর সমসাময়িক ফিসিনাে ও পন্টানাে বংশ, শিক্ষা ও পরিবেশের প্রভাব স্বীকার করেও গ্রহের প্রভাব নস্যাৎ করেননি। অপরসায়নবিদরাও গ্রহের প্রভাব স্বীকার করেন।
জি সারটোন (Sarton) জানাচ্ছেন যে রেনেসাঁ যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটেছিল। জীবনের ওপর বিজ্ঞানের ভূমিকা ছিল। ভৌগােলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে পর্তুগাল ও স্পেন উদ্যোগ নিয়েছিল। বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতির ক্ষেত্রে বিরাট উন্নতি ঘটেছিল। দশমিক পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়েছিল, ১৫৮৫ সালে স্টেভিন (Stevin) এই পদ্ধতির প্রচলন করেন। পােপ ত্রয়ােদশ গ্রেগরি পুরনাে ক্যালেন্ডার বাতিল করে নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। এ পর্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা হলেন সাইমন স্টেভিনাস (Stevinus), দেল্লাপার্তা (Della Parta) ও জিওদেসি (Geodesy)। এ যুগে যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রযুক্তির দিকে সকলে নজর দিয়েছিল। মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার হল রেনেসাঁর এক শ্রেষ্ঠ অবদান। চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে খােদাই আঙ্গিকের চলন হয়, ছবি সংক্রান্ত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গাছপালা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে বােটানিক্যাল গার্ডেনস গড়ে তােলা হয়। এ যুগের নাম করা উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হলেন লিওন হার্ড ফুক্স। আদ্রে ভেসালিয়াস শারীর তত্ত্বের ওপর ফ্যাব্রিকা (Fabrica) নামে গ্রন্থ লেখেন। প্যারাসেলসাস (Paracelsus), ফ্রাকাসতেরাে (pracastoro) ও আমব্রয়েস পেয়ার (Ambroise Pare) হলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী। এরা ছিলেন যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড, ইতালি ও ফ্রান্সের লােক। ফ্রাকাসতেরাে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে গবেষণা করেন, আধুনিক জীবাণু তত্ত্বের তিনি সন্ধান দেন। পেয়ার ছিলেন শল্য চিকিৎসক, যুদ্ধে যােগ দিয়ে তিনি শল্য চিকিৎসার অনেক নতুন দিক আবিষ্কার করেন। ডাইনি বিদ্যা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা ছিল। ওলন্দাজ ওয়েয়ার (Weyer) জানিয়েছিলেন যে নানারকম অসুখ থেকে শারীরিক বিকৃতি আসে, এতে ডাইনির কোনাে ভূমিকা নেই।
রেনেসাঁ যুগে মুদ্রণ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে যায়। বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, বিজ্ঞান সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গালেনের (Galen) শারীরবিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মহাবিশ্ব, গতিতত্ত্ব, জ্যামিতি ও অন্যান্য বিষয়ের ওপরও বই বেরিয়েছিল। ধাতুবিদ্যা, জাহাজ নির্মাণ ও কারিগরি শিল্পে বিজ্ঞানের প্রয়ােগ ঘটেছিল।নতুন আবিষ্কারের জন্য পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল না। যুক্তি বিজ্ঞান পদার্থ ও শরীর বিজ্ঞানের উন্নতির ক্ষেত্রে বড়াে ভূমিকা নিয়েছিল। গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কার খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। লিওনার্দোর মতাে বিজ্ঞানী-শিল্পী স্থান, দূরত্ব ও আলাের ব্যবহার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে পরীক্ষামূলক গবেষণা হল সব সত্যের উৎস (experiment, the source of all certainty)। শব ব্যবচ্ছেদ করে তিনি শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন লক্ষ্য করেছিলেন। তবে সকলের লিওনার্দোর মতাে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী বা পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল। সমকালীন মারিনিও (Marineo) গণিত, সংখ্যা, পরিমাপ, কারণ, গতিতত্ত্বের সঙ্গে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান ও প্রভাব পর্যবেক্ষণ করতে বলেছেন। এ যুগে বিজ্ঞানের অবস্থান অনেকটা অনিশ্চিত, সাধারণ জ্ঞান ও প্রথাগত বিশ্ববীক্ষার (cosmology) মধ্যস্থলে হল এর অবস্থান।
মুদ্রণযন্ত্র এবং সামরিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে যেমন প্রাচ্যজগৎ পাশ্চাত্যকে প্রভাবিত করেছিল, বিজ্ঞান-সাধনার ক্ষেত্রে প্রায় অনুরূপ প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়। শূন্যের আবিষ্কার, ব্রহ্মসিদ্ধান্তে পৃথিবী ও সৌরজগৎ সম্বন্ধে বিশিষ্ট ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্যভট্টের বৈপ্লবিক আবিষ্কার (কোপারনিকাস-গ্যালিলিওর পূর্বে) এবং চৈনিক বিজ্ঞানীর ভাবনাচিন্তা পাশ্চাত্য দুনিয়াকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এক্ষেত্রে আরব বণিকরা পণ্যের আদানপ্রদানের মতাে বৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তার আদানপ্রদানে এবং বিশেষত প্রাচ্যের বাণী পাশ্চাত্যে পৌছে দিতে সহায়তা করেছিলেন। ইউজিন এফ. রাইস (Eugene F. Rice) তার The Foundations of Early Modem Europe গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “…The breakthrough to such a science, so different and so much successful than the sciences of the ancient Greek, the medieval Arabs, the Indians and the Chinese…” অর্থাৎ এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সমাধানসমূহ প্রাচীন গ্রিক, মধ্যযুগীয় আরব, ভারতীয় ও চৈনিক বিজ্ঞানের তুলনায় সম্পূর্ণরূপে পৃথক ও সাফল্যমণ্ডিত ছিল। অনেকেই এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, পাশ্চাত্যের বাহুবল এবং পশুশক্তি (সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি) প্রাচ্যকে অধীনতা ও অনগ্রসরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখেছিল। কিন্তু এর বিরুদ্ধেও এটা বলা যায় যে, ১৮শ শতকের পূর্বে প্রাচ্যে পাশ্চাত্যের প্রভাব দেখা যায়নি, তারপরও ১৪শ থেকে ১৮শ শতকের মধ্যে পাশ্চাত্যে যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হয়েছিল একই সময়ে প্রাচ্যে সেরকম কিছুই দেখা যায়নি। আবার শুধু প্রাচ্যই যে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানমনস্কতাকে প্রভাবিত করেছিল এটাও মনে করার কোনাে কারণ নেই। প্রাচ্য ছাড়াও আধুনিক ইউরােপ অনেকটাই ঋণী ছিল ইউরোপেরই মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর কাছে। এমনকি প্রাচীন গ্রিসও আলাে পর্বের বিজ্ঞান সাধনাকে প্রভাবিত করেছিল। একদিকে যেমন পিথাগােরাস এর ইউক্লিডের মতাে গ্রিক গণিতবিদগণ জ্যামিতি চর্চাকে প্রভাবিত করেছিলেন, অন দিকে তেমনি হিপােক্রিট আধুনিক ওষধিশাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। (হিপােক্রিটসকে খুব সংগত কারণে ‘Father of Medicine’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে)। ঠিক অনুরূপভাবে টলেমির চিন্তাভাবনা এবং আর্কিমিডিসের সূত্র জ্যোতির্বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যাচর্চাকে সমৃদ্ধতর করতে সাহায্য করেছিল।
রেনেসাঁ যুগে কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর মতাে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন, লিওনার্দোর মতাে প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী ও শিল্পী ছিলেন। ক্লাসিকাল যুগ থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব, জল, বাতাস, গতি ইত্যাদি সম্পর্কে যেসব ধারণা চলে আসছিল তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল না। এর একটি কারণ হল মানবতাবাদী শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা নির্ভর গবেষণায় আগ্রহ দেখায়নি। মানবতাবাদীরা সমাজ ও মানুষ নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন, এসব কারণে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছিল, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বাধা ছিল জ্যোতিষ, অপরসায়ন ও চার্চ নির্ভর প্রথাগত বিশ্ববীক্ষা এসব। বাধা অতিক্রম করে রেনেসাঁ যুগে বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছিল টারটাগলিয়া (Tartaglia), স্টেভিনাস ও ফুকদের হাত ধরে। তারা হয়তাে বাস্তব অভিজ্ঞতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে কার্যকারণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। কিন্তু যুক্তি ও বুদ্ধির মুক্তি, রেনেসাঁ কৌতূহল ও প্রখর সাধারণ জ্ঞান বিজ্ঞানের জয়যাত্রার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। এ পর্বে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের অবদান কম ছিল না।
১৬শ-১৭শ শতকের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের স্বরূপ
বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হল এই প্রথাগত বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্তি। রেনেসাঁ মানুষকে নতুন নতুন প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল, যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছিল। যুক্তির আলোক পুরনাে গতানুগতিক বিজ্ঞান চিন্তায় ভাঙন ধরিয়েছিল। এর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত হল সামন্ত ব্যবস্থায় ভাঙন, উৎপাদন ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্থান নিতে থাকে উৎপাদন-নির্ভর, মুদ্রা-নির্ভর, মুনাফা-নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যার নাম হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও গাণিতিক ব্যাখ্যা। অর্থনৈতিক পরিবর্তন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দরকার হয়। বিজ্ঞানের উন্নতি হল বলে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ঘটেনি, অর্থনীতির প্রয়ােজনে নতুন বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল (it was the demands of economic progress that brought about the growth of scientific enquiry)। নৌ-পরিবহণ, উপনিবেশ স্থাপন, বাণিজ্য, যুদ্ধ, জাহাজ নির্মাণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটেছিল। ১৬শ শতকে যেমন যুদ্ধ বেড়েছিল তেমনি উপনিবেশ স্থাপনের কাজ চলেছিল। আমেরিকায় ইউরােপীয়রা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল, প্রাচ্যের জলপথ আবিষ্কৃত হয়। উপনিবেশ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে ইউরােপের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছিল। নৌ-পরিবহণের জন্য উন্নতমানের জাহাজ তৈরি করা হয়, মানচিত্র ও নৌপরিবহণের যন্ত্রপাতি যেমন কম্পাস, এ্যাস্ট্রোল্যাব ইত্যাদির প্রয়ােজন হয়। পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, নৌ-বিদ্যা শিক্ষা দানের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। গ্রহনক্ষত্রের গতিপথ, আবর্তন ইত্যাদি নিয়ে নতুন কৌতূহল তৈরি হয়েছিল।
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্যতম অবদান ছিল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি। এক অর্থে এই অগ্রগতিকে ‘বৈপ্লবিক’ আখ্যা দেওয়া অনুচিত হবেনা, কারণ আলােচ্য পর্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারসমূহ প্রকৃতি ও ভৌত জগৎ সম্বন্ধে মানুষের প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এর বৈপ্লবিক রূপান্তরের সহায়তা করেছিল। কোপারনিকাস পূর্ববর্তী ইউরােপে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং প্রকৃতিলােক সংক্রান্ত ধারণা প্রধানত অ্যারিস্টটলীয় বলবিদ্যা, টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং খ্রিস্টীয় ধর্মশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এই ধারণায় নিশ্চল পৃথিবীর অবস্থান ছিল ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত এবং সমস্ত সৃষ্টির মূলে ছিলেন ঈশ্বর। সমস্ত প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপ বা বিপর্যয়ের যথাযথ বা যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা সেই বিজ্ঞান দিতে পারেনি। আকাশে উল্কা বা অন্য কোনাে মহাজাগতিক পদার্থের আকস্মিক আবির্ভাব অথবা জলস্ফীতি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা বা ফসলহানি অথবা জরা, বার্ধক্য, মৃত্যুর যথার্থ কারণ কী তার উত্তর সেই বিজ্ঞানের জানা ছিল না। কিন্তু ১৬শ ও ১৭শ শতকের নব্য-বিজ্ঞানচর্চা প্রকৃতি ও জীবনােক সম্বন্ধীয় বহু প্রচলিত ধ্যানধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে চিন্তার জগতে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। সৌরজগৎ গ্রহ-নক্ষত্র, শরীর-বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, স্থল ও জলপথের আবিষ্কার। ও দিকনির্ণয় সংক্রান্ত যন্ত্র আবিষ্কার প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই যুগের গবেষণা নবদিগন্ত উন্মােচনে সহায়তা করেছিল। গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, নিউটন প্রভূতি ছিলেন এই সময়ের বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকে এরা এদের মৌলিক চিন্তাভাবনা, অনুসন্ধিৎসা এবং অন্তদৃষ্টির স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বলাবাহুল্য, এইসব আধুনিক মানুষের আবির্ভাবের ক্ষেত্রে রেনেসাঁ ও নব্যমানবতাবাদের অবদান ছিল বিশাল। সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা হল রেনেসাঁসের প্রভাব শিল্প-সাহিত্যের দর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বাস্তব হল এই যে নবজাগরণ এবং নব্যমানবতাবাদ যে নতুন ও আধুনিক মানুষের জন্ম দিয়েছিল তারা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন।
সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার। কিন্তু ১৬শ ও ১৭শ শতকে নতুন বৈজ্ঞানিক সূত্র বা প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়নি, বিপ্লব ঘটেছিল বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষেত্রে, মননের ক্ষেত্রে, মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছিল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও পৃথিবীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নতুন ধারণার উদ্ভব হয়েছিল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের অবস্থান নিয়ে কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হল দৃষ্টিভঙ্গি, ধারণা এবং বৈজ্ঞানিক দর্শনের বিপ্লব। বৈজ্ঞানিক মনন তৈরি হয়েছিল, অনুসন্ধিৎসু মন গড়ে উঠেছিল। এই পর্বে অনুসন্ধিৎসু মানুষ প্রাকৃতিক জগতের নতুন সংজ্ঞা খুঁজেছিল, প্রাকৃতিক যেসব ঘটনা ঘটে তার কারণ ও চরিত্র জানার প্রয়াস চালিয়েছিল। পৃথিবীর আবর্তন স্বাভাবিক কারণে ঘটে না ঈশ্বরের ইচ্ছায় কাজ করে তা জানার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। বন্যার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা হয়, ঋতুচক্রের আবর্তনের পেছনে যে বৈজ্ঞানিক কারণ আছে তা খুঁজে বার করার চেষ্টা হয়। পৃথিবীর আবর্তন এবং ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবীর অবস্থান বােঝার চেষ্টা করেছিলেন বৈজ্ঞানিকরা। ১৬শ ও ১৭শ শতকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রের পরিবর্তনের চেয়ে এই বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জে. ডি. বার্নাল বলে চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন হল বৈজ্ঞানিক বিপ্লব। এটি খ্রিস্টান যাজকদের গড়ে তােলা কল্পবিজ্ঞানের অট্টালিকায় প্রচণ্ডভাবে ভাঙন ধরেছিল। ১৬শ ও ১৭শ শতক নিয়ে এল এক নতুন বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা- প্রণালী। মধ্যযুগের মুসলিম ও খ্রিস্টান যাজকরা গ্রিকদের কাছ থেকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যে ছকটি পেয়েছিলেন তা ছিল সীমিত, অনেকটা কাল্পনিক ও ধর্ম-নির্ভর। নতুন বিজ্ঞান এর যে প্রকৃতিগত ব্যাখ্যা দিয়েছিল তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অ্যারিস্টটলে ক্রমােচ্চস্তরে বিন্যস্ত মহাবিশ্বের স্থান নিয়েছিল নিউটনের মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। নতুন বিজ্ঞান ছিল একই সঙ্গে ধ্বংসাত্মক ও গঠনমূলক, পুরনাে ধ্যান-ধারণাকে ধ্বংস করে বিজ্ঞান নতুন করে বিশ্ববীক্ষার সুচনা করেছিল। মানুষের পুরনাে ধ্যান-ধারণা, মহাবিশ্বে তার অবস্থান এবং ঈশ্বর সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা অবশ্যই ধাক্কা খেয়েছিল। পুরনাে সমাজ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করে নতুন যুগের বিজ্ঞানীরা স্বতন্ত্র ধরনের চিন্তা-পদ্ধতি গড়ে তুললেও প্রাচীন ঐতিহ্যকে তারা একেবারে নস্যাৎ করেননি। কোপারনিকাস ও হার্ভের মতাে বিজ্ঞানীরা প্রাচীনদের অস্বীকার করেননি। আর্কিমিডিস ও প্লেটোর বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনাকে তারা গ্রহণ করে এগিয়ে যান। প্রাচীনদের অনুসৃত পদ্ধতি অনসুরণ করে আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান চিন্তায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেন।
জে. ডি.বার্নাল জানিয়েছেন যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হল নতুন উদ্যোগী বুর্জোয়া শ্রেণীর দান। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে পণ্যের চাহিদা বেড়েছিল, প্রযুক্তি-কৌশলের উন্নতি হয়েছিল। ধাতু নিষ্কাশন, যুদ্ধ, নৌ-পরিবহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের ফলে নতুন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। ১৭শ শতক শেষ হবার আগেই কয়েক জন বিজ্ঞানী মিলে বলবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূল সমস্যাগুলোর সমাধান করতে সক্ষম হন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্যার সমাধানে তারা পরীক্ষামূলক ও গাণিতিক পদ্ধতির প্রয়ােগ করেন। বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকটির ওপর জোর পড়েছিল। এক্ষেত্রে এই ১৬শ-১৭শ শতকেই আমরা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক দিয়ে তিনরকম বৈপ্লবিক ব্যাপার লক্ষ্য করি। প্রথমত, আমরা দেখি সেই সময় বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোর সাথে সাথে প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নতি সাধিত হচ্ছে। খনি নিষ্কাশন বিদ্যা, ধাতু বিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যায় উন্নতি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত আমরা দেখি, বিজ্ঞানীদের মধ্যে অধ্যাপক ছাড়াও অন্যান্য ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে মানুষ প্রবেশ করছে। ১৬শ ও ১৭শ শতকের বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুধু অধ্যাপকরা ছিলেন না, সব ধরনের মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে ছিল ধাতু বিশারদ, ইঞ্জিনিয়ার, রসায়নবিদ, ঘড়ির মিস্ত্রি ও যন্ত্র নির্মাণের কারিগর, অভিজাত, বুর্জোয়া, ডাক্তার ও যাজকরাও ছিলেন। তৃতীয়ত আমরা দেখি, বিজ্ঞানীরা কারিগরদের পেশা ও যন্ত্রপাতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করে দিয়েছেন। অনেক সময় কারিগরি ও শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা থেকেই বৈজ্ঞানিক আলোচনার নতুন ক্ষেত্রের সৃষ্টি হচ্ছে। সে যুগে দৈনন্দিন জীবনে যেসব সমস্যা দেখা দেয় তার সমাধান খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার সম্ভব হয়। জার্মানির অ্যাগ্রিকোলা খনি শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে ভূতত্ত্বের গােড়াপত্তন করেন। পূর্বে বিজ্ঞানীরা ছিলেন বেশিরভাগ উচ্চবর্গের আর কারিগররা ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ, কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সময় অভিজাত ও অনভিজাতদের মধ্যে বিভেদ এই সময় কমে এলো। বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হল নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। আগে ধরে নেওয়া হত মহাবিশ্ব হল অপরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনীয়। মহাবিশ্বের সঙ্গে মানুষের আপসমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। নতুন বিজ্ঞান প্রকৃতির শাশ্বত বিধিনিয়মকে মেনে নিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। বস্তুজগৎ নিয়ে যে নতুন আগ্রহ তৈরি হয়েছিল এই নতুন দৃষ্টি হল তার পরিণতি। প্রকৃতি নিয়ে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একই সাথে কারিগর ও বিজ্ঞানীরা বিপ্লব সাধন করেছিলেন।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের যুগে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের সম্পর্ক
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলে অপরসায়ন ও যাদু বিদ্যা জনগণের আস্থা হারিয়েছিল। তবে ১৬শ শতকে ইংল্যান্ডের সাহিত্যে অতিপ্রাকৃত ঘটনার উল্লেখ দেখা যায়। শেক্সপিয়ার ও মারলাের নাটকে পরী, দৈত্যদানব ইত্যাদির উল্লেখ আছে। অনেক লােক জ্যোতিষীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি সত্বেও মানুষ সম্পূর্ণভাবে কুসংস্কার মুক্ত হতে পারেনি। প্রাচীনপন্থীরা যেমন কর্নেলিয়াস এগ্রিপ্পা নতুন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের বিরােধিতা করেছিলেন। চার্চ এই বিজ্ঞানকে গ্রহণ করেনি।
এযুগের বিজ্ঞানচর্চা যে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিল এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই। আলােচ্য পর্বে মানুষের অনুসন্ধিৎসা এবং সমালােচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও বিজ্ঞানসাধনা প্রথাগত বিশ্ববীক্ষার ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে সবসময় উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। এযুগে জ্যোতির্বিদরা গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন লক্ষ করেছিলেন, কিন্তু সবসময় তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। অবশ্য কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও পরবর্তীকালে সৌরজগৎ ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা বলেছিলেন। আর একটি সীমাবদ্ধতা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের এক অংশের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস প্রায় অক্ষুন্ন ছিল। এদের চোখে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র প্রায় সমার্থক ছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ব্যতিক্রম ছিলেন রেনেসাঁ পর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী পিকোদেল্লা মিরানদোলা। তিনি আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব সংগ্রহ করে জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তার কয়েকজন সমসাময়িক বিশিষ্ট পণ্ডিত, ফিসিনাে ও পন্টানাে বংশ, শিক্ষা ও পরিবেশের প্রভাব পুরােপুরি অস্বীকার না করেও গ্রহের তথাকথিত প্রভাবকে অগ্রাহ্য করেননি। অপরসায়নবিদরাও গ্রহের প্রভাব কিছুটা মেনে নিয়েছিলেন। এ যুগের বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকদের একাংশ গবেষণা ও ধর্মাচরণকে অভিন্ন বলে মনে করতেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গতি-প্রকৃতির পশ্চাতে তারা ঐশ্বরিক মহিমা লক্ষ করেছিলেন। স্বয়ং নিউটন ‘প্রিন্সিপিয়াতে’ লিখেছিলেন, “সূর্য, গ্রহ এবং ধূমকেতু নিয়ে অসীম সুন্দর জগৎ গড়ে উঠেছে, তা পরিচালিত হচ্ছে অসম্ভব মেধাবী ও ক্ষমতাসম্পন্ন এক সত্তার আদেশে।” রবার্ট বয়েলের বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে প্রােটেস্ট্যান্ট মতবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রধানত এইসব কারণে এই যুগের ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ কতদূর ‘বৈপ্লবিক’ ছিল সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকেই যায়। অবশ্য, এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পরে আলােচ্য পর্বের বৈজ্ঞানিক চেতনা তথা চিন্তাধারা যে সামগ্রিক বিচারে ‘বৈপ্লবিক’ ছিল, সেটা অনস্বীকার্য।
আলােচ্য পর্বের বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই খ্রিস্টধর্মের প্রভাবকে পুরােপরি অস্বীকার করতে পারেননি। স্বয়ং নিউটন ছিলেন আস্তিক। ১৭শ শতকের বহু বিজ্ঞানসাধক বিশ্বাস করতেন যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে পারে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে রােমান ক্যাথলিকদের তুলনায় প্রােটেস্ট্যান্টরাই ঈশ্বর ও তার সৃষ্ট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সম্পর্কের নতুন তত্ত্বে অধিকতর আস্থাশীল ছিলেন। রােমান ক্যাথলিকরা কখনােই দেকার্তের মতাে পণ্ডিতকে মেনে নিতে পারেননি, কারণ দেকার্তের মতাদর্শ অ্যারিস্টটল দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং এই দর্শন ছিল রােমান ক্যাথলিক মতবাদের অন্যতম ভিত্তি স্কলাস্টিক তত্ত্বের প্রেরণা। এবিষয়ে Robin Briggs তার ‘Embattled Faiths : Religion and Natural Philosophy in the 17 Century’ নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন: “Religion and science were not distinct entities in the seventeenth century, nor were widely seen as being in direct conflict”। অর্থাৎ ১৭শ শতকে ধর্ম ও বিজ্ঞানের কোনাে পৃথক সত্তা ছিল না এবং এরা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষেও অবতীর্ণ হয়নি। তিনি আরও বলেছেন যে সেই যুগে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানচর্চার পশ্চাতে ঐশ্বরিক (বা স্বর্গীয়) অভিপ্রায় লক্ষ করা যায়। বহু ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আলােচ্য পর্বে বুদ্ধিজীবীরা ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ সম্পন্ন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। অন্যদিকে যাজক সম্প্রদায় সর্বক্ষেত্রে এবং দলমত গােষ্ঠী নির্বিশেষে নব্য বিজ্ঞানের বিরােধী ছিলেন এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই। ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বহুক্ষেত্রে সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত হত, পরস্পরের অগ্রগতিকে এরা অবরুদ্ধ না করে সমর্থন করত। উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রােটেস্ট্যান্ট ও রােমান ক্যাথলিক চিন্তাধারার মধ্যে সাদৃশ্যও লক্ষ করা যায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে পরীক্ষিত সত্য এবং ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যার মধ্যে কখনও কখনও তীব্র বিতর্কের উদ্ভব হত কিন্তু সতর্ক বিশ্লেষণে লক্ষ করা যায় যে এর প্রকৃতি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং উভয়ের মধ্যে মতপার্থক্যের সীমারেখাও ছিল অস্পষ্ট।
রজার লকিয়ারও মনে করেন যে আলােচ্য পর্বের বৈজ্ঞানিকগণ অধার্মিক ছিলেন না, তারা মনে করতেন যে তাদের গবেষণার ফলে ঈশ্বর সম্বন্ধে এক নব্য সচেতনতার উদ্ভব হচ্ছে। কিন্তু তিনি মনে করেন যে প্রচলিত ধ্যানধারণার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় আবেগের তীব্রতাও কমে আসতে থাকে। অবশ্য, আলােচ্য পর্বে ধর্মীয় অনুদারতা পুরােপুরি অন্তর্হিত হয়নি, অ্যানের রাজত্বকালে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টোরি নেতৃত্ব কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ধর্মের প্রতি সেই যুগের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল হয় উদাসীন নয়তাে কিছুটা সন্দেহবাদী। ১৮শ শতকের ইংল্যান্ডের সমাজের উপর মহলে একপ্রকার Deism জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস কিন্তু প্রত্যাদেশে (revelation) অবিশ্বাস ছিল এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বরকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চালিকা শক্তির (prime mover) মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ইহলৌকিক দৈনন্দিন জীবনে তার তেমন উল্লেখযােগ্য কোনাে ভূমিকা ছিল না। সব মিলিয়ে বলা যায়, নব্যবিজ্ঞান কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাত হানলেও সর্বক্ষেত্রে তা খ্রিস্টধর্ম বিরােধী বা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না।
১৬শ-১৭শ শতকে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি
এই সময়ে নতুন বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তােলেন ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬ খ্রি.)। তিনি বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত উন্নতির দিকে মন দিয়েছিলেন। নােভাম ওরগানাম (Novum Organum) গ্রন্থে তিনি পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের কথা বলেন। ব্রিটেনে রয়াল সােসাইটি প্রতিষ্ঠার তিনি ছিলেন অন্যতম প্রস্তাবক (১৬৬২ খ্রি.)। ফ্রান্সে চতুর্দশ লুই ‘রয়াল একাডেমি’ গঠন করেন, ইউরােপের অন্যান্য দেশে এ ধরনের বিজ্ঞান চর্চাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, পর্তুগালে ছিল সমুদ্র গবেষণাকেন্দ্র, ডেনমার্কে জ্যোতির্বিজ্ঞান কেন্দ্র। রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রি.) ডিসকোর্স অন মেথড (Discourse on Method) গ্রন্থে নতুন বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভাবনা অনুমান করেছিলেন। তিনি হলেন বিজ্ঞান। গবেষণা পদ্ধতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
রেনেসাঁ থেকে ১৭শ শতকের শেষ অবধি বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটে চলেছিল। মাঝখানে ছিল ধর্মযুদ্ধের পর্ব। প্রথম পর্বে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন মহাবিশ্বের ধারণাটিকে বাতিল করে দেন। নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি.) নতুন করে ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব আলােচনা করেন। তিনি অ্যারিস্টটল ও টলেমির মহাবিশ্বের ধারণা বাতিল করে সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা প্রচার করেন। পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা বাতিল করে তিনি সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব তত্ত্ব প্রচার করেন। কোপারনিকাস টলেমির আলমাজেস্ট (AImagest) গ্রন্থের ত্রুটি-বিচ্যুতি তিনি দেখিয়ে দেন। তিনি লিখছেন, “আমরা বস্তু নিচয়ের যে গতি দেখি তা দর্শকের নিজের গতির জন্য হতে পারে, অথবা যে বস্তুকে দেখছি তার গতির জন্য হতে পারে, অথবা বস্তু ও দর্শক উভয়ের গতির জন্য হতে পারে। পৃথিবীর যদি কোনাে গতি থাকে, তবে পৃথিবীর বাইরে অবস্থিত প্রত্যেক বস্তুতেই সেই গতি প্রতিভাত হবে, অবশ্য বিপরীত দিকে ঘুরন্ত পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে মহাবিশ্বকে দেখা যায়, পৃথিবী অন্যান্য গ্রহের মতাে একটি গ্রহ।” তিনি দেখান, প্রতি ২৪ ঘন্টায় পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এই বিষয়ে তার বিখ্যাত গ্রন্থ হল অন দ্য রেভােলুশন অব দ্য সিলেসিয়াল স্ফিয়ারস। রাইনহােল্ড, জন ফিল্ড, রবার্ট রেকর্ড ও টমাস ডিগস্ কোপারনিকাসের তত্ব প্রচার করেন।
জিত্তরদিনাে ব্রুনাে কোপারনিকাসের তত্ত্ব প্রচার করে ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। কোপারনিকাসের এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দেন জোহান কেপলার ও গ্যালিলিও। এ পর্বের একজন শ্রেষ্ঠ জোতির্বিজ্ঞানী হলেন টাইকো ব্রাহে (Tycho Brahe)। ডেনমার্কের এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য একটি গবেষণাগার বানিয়েছিলেন। জোহান কেপলার আবর্তন তত্ত্বকে আরও প্রসারিত করেন। গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২ খ্রি.) হলেন পদার্থ বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার। তিনি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। তিনি ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, বিজ্ঞানের দুই নতুন শাখা স্ট্যাটিকস (Statics) এবং ডাইনামিকসের (Dynamics) তিনি গােড়া পত্তন করেন। তিনি দুখানি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন, এগুলোর নাম হল ডায়ালগস অন টু নিউ সায়েন্সেস (Dialogues on Two New Sciences) এবং ডায়ালগ কনসানিং দ্য টু চিফ সিস্টেমস অব দ্য ওয়ার্ল্ড (Dialogue concerning the Two Chief systems of the World)। গ্যালিলিও বিজ্ঞানের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য প্রয়াস চালিয়েছিলেন। গ্যালিলিও ও কেপলার ছিলেন প্রতিভাবান অংকশাস্ত্রবিদ, ভিয়েটা ছিলেন অ্যালজেবরা ও ত্রিকোণমিতির স্রস্টা। সাইমন স্টেভিন দশমিক পদ্ধতির প্রবর্তন করলেন। পরবর্তীকালের বিজ্ঞান শাখা হাইড্রোস্ট্যাটিসটিকসের (Hydrostatistics) জন্ম হল। স্টেভিন আধুনিক হাইড্রোলিকসের (Hydraulics) প্রতিষ্ঠা করেন। লিওনার্দো ও গ্যালিলিও বিজ্ঞান সম্মত ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার সূচনা করেছিলেন। উইলিয়াম গিলবার্ট ম্যগনেটিক ফিল্ড তত্ত্বের সূচনা করেছিলেন, হার্টম্যান ও রবার্ট নরম্যান তার দ্বারা প্রভাবিত হন। যাজকদের ধারণার বিরােধী মতবাদ প্রচারের জন্য গ্যালিলিওকে শেষ জীবনে বন্দি জীবনযাপন করতে হয়। তিনি টলেমি ও কোপারনিকাসের বিশ্ববীক্ষার তুলনা করে কোপারনিকাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের তিনি হলেন আবিষ্কারক। ছায়াপথ, যুগ্ম নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকা, সৌরকলঙ্ক ইত্যাদিও হল তার আবিষ্কার। গতি, ত্বরণ ও বল সম্বন্ধীয় যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো নতুন বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছিল।
১৬শ-১৭শ শতকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি সুনির্দিষ্ট পর্ব লক্ষ করা যায়। কোপারনিকাসের On the Revolutions of the Celestial Spheres (1543) থেকে যে বিজ্ঞানচর্চার সূচনা হয়েছিল, নিউটনের Principia (1687)-তে তার পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষ করা যায়। আলােচ্য পর্বে যে বিশিষ্ট গবেষণার পদ্ধতি বা method উদ্ভাবিত হয়েছিল তা তিনটি অংশকে আত্মস্থ করেছিল। যথা তর্কশাস্ত্রীয় (logical), পরীক্ষামূলক (experimental) এবং গাণিতিক (mathematical)। ১৪শ ও ১৫শ শতকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে এই তিনটি পদ্ধতি পৃথকভাবে অনুসৃত হয়েছিল। ১৬শ শতকের প্রথমদিকে তিনটি পদ্ধতি ধীরে ধীরে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই সমন্বয়সাধন এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতা প্রকৃতির ওপর মানুষের অতুলনীয়-অভাবনীয় জ্ঞান ও দখলের ভিত্তিস্থাপন করেছিল। এই পদ্ধতিগুলোকে যারা প্রাথমিক ও তর্কশাস্ত্রসম্মত রূপ দিয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন প্যারিস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লজিক এবং দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক। এছাড়া, এদের একাংশ তাদের মনন ও ভাবনাচিন্তার উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন (রেনেসাঁর আলােকে) বােলােনা এবং পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র থাকাকালীন।
এই যুগে রসায়ন শাস্ত্রের প্রভূত উন্নতি হয়, আর রসায়ন শাস্ত্রের সঙ্গে চিকিৎসা বিদ্যার উন্নতি হয়েছিল। হােহেনহাইম প্যারাসেলসাস (Hohenheim Paracelsus) ছিলেন রেনেসাঁ যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানী, তিনি গালেন ও আবিসিনার তত্ত্বের সমালােচনা করেন। ভ্যান হেলমন্ট ও অ্যান্ড্রিয়াস ভেসালিয়াস শারীর বিজ্ঞানের সূচনা করেছিলেন।আন্ড্রিয়া ভেসালিয়াস ১৫৪৩ সালে দ্য ফ্যাব্রিকা (De fabrica) লিখে চিকিৎসা বিদ্যায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেন। গ্যালেন ও অ্যারিস্টটলের স্থান নেন ভেসালিয়াস। ইংরেজ উইলিয়াম হারভে (১৫৭৮-১৬৫৭ খ্রি.) শরীরে রক্ত চলাচল বিদ্যার সূত্রপাত করেন। গ্রহের আবর্তনের মতো রক্ত সঞ্চালন ছিল আর একটি বড়াে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে নতুন ধ্যান ধারণায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়। ১৭শ শতকে এসে বিজ্ঞান ক্রমাগত উন্নতি করে চলেছিল, বিজ্ঞান সভাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। বয়েল, হুক ও হাইগেন্স গণিত ও বলবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞান চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যান। নিউটনের ম্যাথম্যাটিক্যাল প্রিন্সিপলস্ আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। অ্যারিস্টটলের ‘পরম উদ্দেশ্যের’ তত্ত্ব বাতিল হয়ে যায়, বলবিজ্ঞান সম্মত কারণ দিয়ে সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা শুরু হয়। নতুন বৈজ্ঞানিক দর্শনের জন্ম হল। স্বয়ংস্বতন্ত্র কণাসমূহ যথেচ্ছভাবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটায় এবং এই ব্যাপারটিকে পরিচালিত করে প্রাকৃতিক নিয়মাবলীর অদৃশ্য এক নিয়ন্ত্রণ। প্রকৃতিকে জানলে মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে পারবে এমন ধারণা গড়ে উঠেছিল। শুধু বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান সাধনা নয়, বিজ্ঞানকে মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির কাজে লাগানাে সম্ভব বলে ধরে নেওয়া হয়।
রবার্ট বয়েল (১৬২৭-৯১ খ্রি.) স্টীম নিয়ে গবেষণা করেন, রুপার্ট হুক সম্প্রসারণ তত্ত্ব (Elasticity) নিয়ে গবেষণা করে হুকস্ ল (Hooke’s law) আবিস্কার করেন। জন ডী (Dee) ছিলেন একজন ভূগােলবিদ। ১৭শ শতকের শেষ দিকে শ্রেষ্ঠবিজ্ঞানী হলেন আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭ খ্রি.)। প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিসিয়া (Principia Mathematicia) গ্রন্থে তিনি মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি শুধু মধ্যাকর্ষণ আবিস্কার করেননি, বিজ্ঞানের অনুসন্ধান পদ্ধতির তিনি হলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিহল অংকশাস্ত্র। নিউটনের যুক্তিবাদী বিজ্ঞান শুধু বিজ্ঞানের রহস্য উদঘাটন করেনি, ১৮শ শতকের সমাজ বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত করেছিল, তার যুক্তিবাদ মানুষের স্বাভাবিক অধিকারের ধারণাকে প্রসারিত করেছিল। নতুন বিজ্ঞানের মৌল বৈশিষ্ট্য হল জ্ঞানকে মূল পর্যন্ত গিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। শুধু যুক্তি দিয়ে প্রকৃতির সব রহস্য উদঘাটন করা যায় না। নতুন বিজ্ঞান মানুষকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল, মানুষের সংকীর্ণ প্রেক্ষিত থেকে বিজ্ঞান মুক্তি পেয়েছিল। গ্যালিলিও ও দেকার্ত বিজ্ঞানের উপযােগিতার কথা ভেবেছিলেন। বিজ্ঞান কোনাে বিমূর্ত জ্ঞান সাধানা ছিল না, সমাজ যে বিজ্ঞান থেকে লাভবান হয় সেই ধারণা গড়ে উঠেছিল। পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও গণিতিক পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নতি বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মােচন করেছিল। বৈজ্ঞানিক বিপ্লব আধুনিকতার প্রসারে সহায়ক হয়।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব
নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) ও কোপারনিকান বিপ্লবের স্বরূপ
নিকোলাস কোপারনিকাস হলেন ১৬শ শতকের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের স্রষ্টা। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক নিকোলাস কোপারনিকাস ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে পােল্যান্ডের টোরান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইতালির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়া শেখেন। ১৮ বছর বয়সে ক্র্যাকো বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৪৯১-৯৪) পড়ার সময় তিনি সেইযুগের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট রুগেস্কির সংস্পর্শে আসেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতঃপর জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান ও চিন্তা। চিকিৎসা, আইন ও জোতির্বিদ্যায় তিনি বিশেষ পাঠ নিলেও জোতির্বিজ্ঞান ছিল তার প্রিয় বিষয়। এই পর্বে, অর্থাৎ ১৪৯৭-১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইতালির বােলােনা ও পাদুয়াতেও পড়াশুনা করেছিলেন। অবশ্য এর পাশাপাশি তিনি। চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং কিছুকাল চিকিৎসকের পেশায় নিযুক্ত থাকেন। আরও পরবর্তীকালে রােম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক রূপে তিনি প্রকৃত ও সার্থক কর্মজীবন শুরু করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে তিনি জীবন কাটিয়েছিলেন।
অ্যারিস্টটল যে মহাবিশ্বের ধারণা তৈরি করেছিলেন তাতে পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র হিসেবে দেখানাে হয়, মানুষের গৌরব বাড়ে। এই মহাবিশ্বে ঈশ্বর, মানুষ, দেবদূত, গাছপালা প্রাণী সকলের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সৃষ্টির উৎপত্তি তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইউরােপের মানুষ এভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ধরে নেওয়া হয় এসব সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী এবং মহাবিশ্ব এভাবে অনন্তকাল টিকে আছে। এই ধারণার বিরােধী ধারণাও তৈরি হয়েছিল। টলেমি অ্যারিস্টোটলীয় প্রাকৃতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই তার ভূকেন্দ্রিক ধারণাটি (Ptolemaic geocentric system) দাঁড় করান। কোপারনিকাসের বহু আগে সিসেরাে ও হিকিটাস বলেছিলেন যে পৃথিবী তার কক্ষপথে অবর্তিত হয়। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটারকাস বলেছিলেন যে পথিবী সূর্যের চারপাশে ঘােরে। সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা নতুন নয়, রেনেসাঁ বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার নয়। এই ধারণাটি গৃহীত হয়নি কারণ বিজ্ঞানীরা প্রমাণসহ একে উপস্থাপন করতে পারেননি। একটি বিকল্প ধারণারূপে এটি বরাবরই বিদ্যমান ছিল। ধারণাটা মেনে নেওয়া শক্ত ছিল কারণ পৃথিবী যে ঘুরছে না, আর সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররা যে ঘুরছে এটা তাে স্পষ্ট দেখা যায়। রেনেসাঁর যুগ থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানের আলােচনায় টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। এই ধারণাটির পরিবর্তন ঘটানাের জন্য প্রয়ােজন ছিল মনােবল ও বিজ্ঞানের। আর এই কাজটি করলেন কোপারনিকাস। তার মনােবল ছিল অদম্য আর প্রেরণা পেয়েছিলেন রেনেসাঁ মানবতাবাদ থেকে। তিনিই সর্বপ্রথম ঘােষণা করেন যে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলো নির্দিষ্ট সময়ে প্রদক্ষিণ করছে। তিনি টলেমির ভূকেন্দ্রিক মতবাদের বিরুদ্ধে তার সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ নিয়ে On the Revolutions of the Celestial Spheres গ্রন্থটি রচনা করলেন (মূল লাতিন গ্রন্থটির নাম “Nicolai Copernici torinensis de revolutionibus orbium coelestium Librivi’)। টলেমির আলমাজেস্টের (AImagest) ত্রুটি-বিচ্যুতি তিনি দেখিয়ে দেন। তিনি লিখছেন, “আমরা বস্তু নিচয়ের যে গতি দেখি তা দর্শকের নিজের গতির জন্য হতে পারে, অথবা যে বস্তুকে দেখছি তার গতির জন্য হতে পারে, অথবা বস্তু ও দর্শক উভয়ের গতির জন্য হতে পারে। পৃথিবীর যদি কোনাে গতি থাকে, তবে পৃথিবীর বাইরে অবস্থিত প্রত্যেক বস্তুতেই সেই গতি প্রতিভাত হবে, অবশ্য বিপরীত দিকে ঘুরন্ত পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে মহাবিশ্বকে দেখা যায়, পৃথিবী অন্যান্য গ্রহের মতাে একটি গ্রহ।” এই গ্রন্থে তারা দেখিয়েছিলেন গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীটাকে নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। পৃথিবী নিজেও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। তিনি আরও দেখালেন, যে এই ধারণাটি স্বীকার করে নিলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তার বৈপ্লবিক ধারণার যুক্তিগুলো ছিল দার্শনিক ও নন্দনতাত্ত্বিক। গ্রহগুলোর কক্ষপথ নিয়ে তিনি যুক্তিসম্মত আলােচনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে এক প্রাচীন ধারণাকে তিনি নতুন রূপ দেন। সৌরমণ্ডলে সূর্য রাজার ন্যায় বিরাজ করছেন। পৃথিবীতে কেন্দ্রিভূত রাজাই সেইরকম স্বমহিমায় বিরাজমান।
১৫১০ থেকে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার On the Revolutions of the Celestial Spheres গ্রন্থটির আদি গ্রন্থ একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ছিল Commentoriolus। এটি ছিল তার যাবতীয় গবেষণার সংক্ষিপ্তসার। চার্চ তার গ্রন্থগুলোকে নিষিদ্ধ করে। জীবনের অন্তিম মুহূর্তেই ১৫৪০ সালের দিকে তিনি তার গ্রন্থটির কাজ সমাপ্ত ও প্রকাশ করেন। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলােকগমন করেন, সেই বছরেই তার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। একটি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ একদিকে সেইযুগে যেমন কিছু স্বল্পসংখ্যক মানুষ আলােকিত হয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এদের বিরূপ সমালােচনা তাকে এতটুকু বিচলিত করেনি। কোপারনিকাসের যুগান্তকারী আবিষ্কার এই চিরাচরিত চার্চ সমর্থিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। এটাই ছিল কোপারনিকাসের বিরুদ্ধে চার্চের ক্ষোভের মূল কারণ। ১৬১৬ সালে চার্চ কোপার্নিকাসের গ্রন্থটিকে ব্যান করে।
আর্থার বেরি (A. Berry, A Short History of Astronomy) মনে করেন যে সমগ্র জ্যোতির্বিজ্ঞান সাহিত্যে Revolutions -এর তুলনা একমাত্র টলেমির Almagest এবং নিউটনের Principia-র সঙ্গে করা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞান ক্ষেত্রে কোপারনিকাস রচিত এই গ্রন্থের প্রকাশ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি যথার্থই ‘বিপ্লব’ ছিল। এই বিপ্লবের কেন্দ্রীয় ধারণা—আপাতদৃষ্টিতে গ্রহনক্ষত্র জ্যোতিষ্কের যে গতি আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো তাদের প্রকৃত গতি নয়। গতিশীল পৃথিবীর উপর বসে থাকা পর্যবেক্ষকের গতির জন্যই গ্রহ নক্ষত্রকে গতিশীল মনে হয়। অর্থাৎ জ্যোতিষ্কের যে গতি আমরা পর্যবেক্ষণ করি সেটি তাদের প্রকৃত গতি নয়, আপেক্ষিক গতি। এক্ষেত্রে কোপারনিকাস ভার্জিলের একটি পংক্তিকে উপমা হিসাবে উদ্ধৃত করে সমগ্র বিষয়টি আরাে প্রাঞ্জল করেছেন, “Provehimur Portu, terraeque urbesque recedunt” (বঙ্গানুবাদ – “আমরা বন্দর ছেড়ে পাড়ি দিলাম, দেশ ও নগর দূরে সরে যেতে লাগল”)। শুধু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হিসাবেই সূর্য কেন্দ্রীয় মতবাদ যুগান্তকারী ছিল এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই। ১৫শ-১৬শ শতকের মানসে এই ঘটনা এক নিদারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। এযাবৎকাল মানুষের এই ধারণা প্রায় বদ্ধমূল ছিল যে তার একান্ত প্রিয় ও সাধের আবাসস্থল এই পৃথিবীই ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র। একমাত্র তার জন্য একদিন সৃষ্ট হয়েছিল এই পৃথিবী চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্ররা ; তার সুবিধার জন্যই গ্রহদের আবর্তন ও কক্ষ পরিক্রমণ; তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ ও ভবিষ্যতের সঙ্গে এইসব জ্যোতিষ্কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ঐ নিশ্চল নক্ষত্রলােকে চিরশান্তির স্বর্গ বিবদমান, একদিন সেখানেই তার স্থান হবে।
কোপারনিকাসের জ্যোতিষ এই বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছিল। পৃথিবী এখন আর বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নয়, অন্যান্য ছন্নছাড়া গ্রহদের মতাে সেও তার সমগ্র সৃষ্টি নিয়ে মহাশূন্যে অবিরত ঘুরপাক খাচ্ছে আর হয়রান হচ্ছে। নক্ষত্রলােকও আগের মতাে আর নিকটে নেই, মহাশূন্যে অকল্পনীয়-অবিশ্বাস্য দূরত্বে নাকি তার অবস্থান! কোপারনিকাসের কিছুকাল পরে ব্রুনাে জানালেন মহাশূন্য অনন্ত এবং আদি-অন্তহীন এবং এতে একাধিক ব্ৰহ্মাণ্ডলােক বিরাজমান। এই পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ হঠাৎ নিজেকে অতি ক্ষুদ্র ও অসহায় মনে করল। এক অতি ক্ষুদ্র, ভ্রাম্যমাণ গ্রহের নগণ্য অধিবাসী হিসাবে তার সৃষ্টিকে বিধাতার এক বিরাট প্রহসন বলে মনে হয়েছিল। এই অবস্থায় রােমান ক্যাথলিক চার্চ যে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠবে এবং নব্য বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার কণ্ঠরােধ করতে উদ্যত হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
পৃথিবীর গতি কল্পনা করে গ্রহগুলোর আপাতগতির জটিল ব্যাখ্যায় কোপারনিকাস যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করলেও এক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল আংশিক। সৌরজগতের চাবিকাঠি হাতে পেয়েও শেষপর্যন্ত তিনি এর রহস্যের দুয়ার সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করতে পারেননি। আমরা এখন জেনেছি এর জন্য শুধু প্রয়ােজন ছিল বৃত্তের পরিবর্তে উপবৃত্ত পথে গ্রহগুলোর পরিক্রমা কল্পনা করা। এই সামান্য অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংশােধনের অভাবে পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্যের সঙ্গে তাত্ত্বিক গণনার ফল মেলাবার অধিকাংশ চেষ্টা তার একপ্রকার পণ্ডশ্রম হয়েছিল। কেপলার এই পরিবর্তন সাধন করেছিলেন ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে। দুর্ভাগ্যবশত পিথাগােরীয় ও অ্যারিস্টটলীয় ধারণায় আচ্ছন্ন কোপারনিকাস ভাবতে পারেননি যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও একান্ত স্বাভাবিক বৃত্ত ছাড়া আর কোনাে জ্যামিতিক রেখাপথে জ্যোতিষ্কদের মতাে স্বর্গীয় বস্তুদের আকাশ পরিক্রমা সম্ভব। সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে টলেমির সেই পুরাতন কৌশল উৎকেন্দ্রীয় বৃত্ত ও পরিবৃত্তের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছিল। তিনি সূর্যকে গ্রহদের কক্ষের ঠিক কেন্দ্রস্থলে না বসিয়ে কিছুটা দূরে বসিয়েছিলেন এবং কয়েকটি গ্রহের উপর একটি করে পরিবৃত্ত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তার সান্ত্বনা ছিল এইটুকু যে টলেমি যেখান ৭৯টি বৃত্ত ব্যবহার করেছিলেন সেখানে তার ৩৪টি বেশি বৃত্তের প্রয়ােজন হয়নি। উপরােক্ত গবেষণা ব্যতীত কোপারনিকাস ঋতু পরিবর্তন, গ্রহ, উপগ্রহ ও চন্দ্র সম্বন্ধে বহু আলােচনা করেছিলেন এবং অধিকাংশ বিষয়েই তার প্রস্তাবিত সমাধান ও ব্যাখ্যা প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের সিদ্ধান্ত অপেক্ষা উন্নততর হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোপারনিকাস পর্যবেক্ষণের উপর খুব বেশি গুরুত্ব আরােপ করেনি। ‘অ্যালমাজেস্টে’ প্রদত্ত তথ্য ও তালিকাই ছিল তার রচনার প্রধান উপাদান। এই তথ্য যে নির্ভুল নয়, তা নির্ণয়ের জন্য নতুন করে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক সারসরঞ্জামের সংস্কার তথা উন্নতিসাধন যে একান্তভাবে প্রয়ােজন কোপারনিকাস সেবিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না।
কোপারনিকাসের স্বকীয়তা সম্বন্ধে পণ্ডিতদের একাংশ প্রশ্ন করেছেন। টলেমির অ্যালমাজেস্টের কাছে তার ঋণ অনস্বীকার্য। তার আগে গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর একাংশ অনুরূপ কিছু চিন্তাভাবনা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে পিথাগােরীয় ফিলােলাউস, অ্যারিস্টার্কাস অফ সামােয় প্রভৃতির উল্লেখ করা যায়। গুপ্তযুগে আর্যভট্ট ব্রহ্মসিদ্ধান্তে পাবার আহ্নিক গতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু মত ব্যক্ত করা এক জিনিস ও সমাধানের দ্বারা তার শ্রেষ্ঠত্ব ও অভ্রান্ততা প্রমাণ করা আর এক জিনিস। সূর্যকেন্দ্রিক পরিকল্পনার প্রথম উল্লেখ হয়তাে সুপ্রাচীন কিন্তু এই পরিকল্পনা অনুযায়ী নানা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক ঘটনা, গ্রহের গতি, ক্রান্তিবিন্দুর অয়ন-চলন, ঋতু পরিবর্তন প্রভৃতি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা করতে ইতিপূর্বে আর কোনো ইউরােপীয় বিজ্ঞানী সক্ষম হননি। এটাই কোপারনিকাসের কৃতিত্ব ও স্বকীয়তা।
অবশ্য Revolutions প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর বৈপ্লবিক সম্ভাবনার বিষয়টি সবাই তেমনভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। গ্রন্থের জটিল গাণিতিক আলােচনার আড়ালে কোপারনিকাসের মূল বক্তব্য কিছুটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিছুকাল পরে ওসিয়ান্দার ইচ্ছাকৃতভাবে মূল গ্রন্থের আংশিক পরিবর্তন করায় অনেকের মনে হয়েছিল পৃথিবীর সূর্য পরিক্রমা নিছক একটি গাণিতিক পরিকল্পনা, বাস্তব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক নেই। অবশ্য কিছু সংখ্যক বৈজ্ঞানিক কোপারনিকাসের মতবাদের অভিনবত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম যুগে রাইনহােল্ড, টমাস ডিগ, জন ফিল্ড প্রভৃতি এই মতবাদ প্রচারে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। টাইকো ব্রাহে নিজে কোপারনিকাসের তত্ত্বের বিরােধী হলেও ‘নােভা’ বা নতুন নক্ষত্রের আবিষ্কার করে সনাতন জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করেছিলেন। সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের দার্শনিক গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন জিওরদানাে ব্রুনাে। গ্যালিলিওর দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কোপারনিকাসের সিদ্ধান্তকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল।
অন্যদিকে সেই যুগের বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকদের একাংশ কোপারনিকাসের মতবাদের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছিলেন। ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কোপারনিকাসের তত্ত্বের বিরুদ্ধে লেখার জন্য কসিমাে দ্য মেদিচি নামক একজন গবেষককে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছিল। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় ঐ বছরেই নিউটন ঐ কেন্ত্রিজেই অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে কোপারনিকাসবিরােধী অপর এক প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানীর কথা বলা যায়। ইনি ছিলেন পারি মান মন্দিরের অধ্যক্ষ ক্যাসিনি (১৬২৫-১৭১২)। অবশ্য, উনবিংশ শতকের সূচনায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে রােমান ক্যাথলিক চার্চ প্রথম সরকারিভাবে ঘােষণা করে যে অতঃপর কোপারনিকাসের তত্ত্ব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি ব্যাখ্যা হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হবে। যাইহােক, কিছু সীমাবদ্ধতা ও বিরুদ্ধ সমালােচনা সত্ত্বেও কোপারনিকান বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
কোপারনিকাসের তত্ব গৃহীত হয়নি। কোপারনিকাসের প্রায় দেড়শ বছর পরে তার তত্ত্ব সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞানী মহলে সমাদর লাভ করে। রাইনহােল্ড, জন ফিল্ড, রবার্ট রেকর্ড ও টমাস ডিগস্ কোপারনিকাসের তত্ব প্রচার করেন। কোপারনিকাসের পর জিওরদিনো ব্রুনাে এই তত্ত্বকে প্রচার করেন। এজন্য তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। কোপারনিকাসের এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দেন জোহান কেপলার ও গ্যালিলিও। ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে ও জোহান কেপলার এই ধারার আরও অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন। কেপলার অর্ধবৃত্তাকার ডিম্বাকৃতি কক্ষ পথের কথা বলেন। গ্যালিলিও গ্যালিলি বলবিদ্যা ও গতিতত্ত্বের সাহায্য নিয়ে এই তত্ত্বকে আরও বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। গ্যালিলিও দূরবীণ বানিয়ে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থাকে আরও ভালােভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযােগ পেয়েছিলেন। কোপারনিকাসের তত্ত্ব পণ্ডিতমহলে স্বীকৃতিলাভ করেছিল। যাজকদের ধারণার বিরােধী মতবাদ প্রচারের জন্য গ্যালিলিওকে শেষ জীবনে বন্দি জীবনযাপন করতে হয়। তিনি টলেমি ও কোপারনিকাসের বিশ্ববীক্ষার তুলনা করে কোপারনিকাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের তিনি হলেন আবিষ্কারক। ছায়াপথ, যুগ্ম নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকা, সৌরকলঙ্ক ইত্যাদিও হল তার আবিষ্কার। গতি, ত্বরণ ও বল সম্বন্ধীয় যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো নতুন বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছিল।
গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২)
আধুনিক বিজ্ঞানের জনক। এই যুগের অপর এক বিশিষ্ট মহাকাশবিজ্ঞানী গ্যালিলিও ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালির পিসা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। কিন্তু কোপারনিকাসের মতাে তিনিও গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি যথেষ্ট আকর্ষণ অনুভব করতেন। একবার সেকালের প্রসিদ্ধ গণিতবিদ ইউক্লিডের বক্তৃতা শুনে গণিতের প্রতি অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন। ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখানে থাকাকালীন তিনি নানা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার সাহায্যে ‘দোলকের সূত্র’ এবং পতনশীল বস্তুর সূত্র আবিষ্কার করেন। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ The Starry Messenger প্রকাশ করেন।
তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন একটি অত্যন্ত উন্নতমানের টেলিস্কোপ যার সাহায্যে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন সূর্যকলঙ্ক, বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ, শুক্র ও মঙ্গলের কলা এবং শনির বলয়। বলাবাহুল্য তিনি ছিলেন কোপারনিকাসের সুযােগ্য ভাবশিষ্য এবং তার তত্ত্বের একজন দৃঢ় সমর্থক। বলাবাহুল্য, তথাকথিত অলঙ্ঘনীয় ধর্মাদর্শের বিরােধিতার অপরাধে তার বিচার হয়েছিল। স্বয়ং পােপ তাকে ডেকে পাঠিয়ে অপমান করেছিলেন। দুঃসহনীয় মানসিক চাপ ও নিপীড়নের সম্মুখে নতিস্বীকার করে তিনি তার উপলব্ধ সত্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ব্যাথিত-হৃদয় মানুষটি অতঃপর গ্রামবাসী হন। গ্রামে থাকাকালীন তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে এই ক্ষণজন্মা মহাবিজ্ঞানী শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রসিদ্ধ লেখক ব্রুস্টার মনে করেন যে প্রায় একই সময়ে টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১), জোহান কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) এবং গ্যালিলিও মতাে তিনজন অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর গবেষণায় যুক্ত হওয়ার মতাে ঘটনা বাস্তবিকই আশ্চর্য ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয়টি ব্রুস্টার তার Martyrs of Science গ্রন্থে পর্যালােচনা করেছেন। সুনিপুণ হস্তে নির্মিত উচ্চমানের যন্ত্রপাতির। সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে টাইকো ৫৪ বছর বয়সে প্রাগে বসে যে অসংখ্য তথ্য সং গ্রহ করেছিলেন, তার দ্বারা উত্তরকালে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি রচিত হয়েছিল, এই তথ্যের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের ফলেই গ্রহ-পরিক্রমা সংক্রান্ত নীতি ও নিয়মাবলী আবিষ্কার করেছিলেন কেপলার (এক্ষেত্রে তার গাণিতিক ব্যাখ্যা ও প্রয়ােগ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য)। প্রায় সমসাময়িক পর্বে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে নতুন জ্যোতিষ্কের আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অক্ষয় অবদান রেখেছিলেন গ্যালিলিও।
গ্যালিলিও সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দ্বারা তিনি একদিকে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে যেমন সুদৃঢ় ভিত্তির। উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, অন্যদিকে তার বলবিদ্যা বিষয়ক গবেষণা থেকে জন্মলাভ করেছিল আধুনিক বলবিদ্যা ও পদার্থ বিজ্ঞান। বস্তুর গতি ও স্থিতির যথার্থ কারণ ও নিয়ম আবিষ্কার করে এবং এই বিষয়ে প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন ও প্রায় নির্বিচারে স্বীকৃত অ্যারিস্টটলীয় মতাদর্শ ও শিক্ষাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছিলেন। তার গবেষণায় নিউটনের যুগান্তকারী আবিষ্কারসমূহ সুনিশ্চিত হয়েছিল। গ্যালিলিও ও নিউটনের পদার্থবিদ্যার প্রয়ােগেই কোপারনিকাসের মস্তিষ্কপ্রসূত বৈজ্ঞানিক বিপ্লব শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছিল। | গ্যালিলিওই সর্বপ্রথম আধুনিক বিজ্ঞানী। যে পরীক্ষার কথা রজার বেকন ত্রয়ােদশ শতাব্দীর অনুকূল বৌদ্ধিক বাতাবরণে (কিছুটা অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, রেনেসাঁসের সূচনায় ফ্লোরেন্সর বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন বিশিষ্ট মানুষ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যে আদর্শের কথা উদাত্ত স্বরে ঘােষণা করেছিলেন, হার্ভে, গিলবার্ট প্রমুখ বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় যে আদর্শ ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল সেটাই পরিপূর্ণ ও প্রায় সর্বাঙ্গসুন্দর রূপে মূর্ত হয়ে উঠেছিল গ্যালিলিওর বৈজ্ঞানিক গবেষণায়।
এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে উদ্দেশ্যবিহীন পরীক্ষার দ্বারা বৈজ্ঞানিক সত্যের আবিষ্কার সম্ভব নয়, পরীক্ষার প্রাপ্ত তথ্যের গাণিতিক বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা স্থাপন করে তবেই প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। অত্যাশ্চর্য ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও একাগ্রতার অভাবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে দীর্ঘদিন যাবত অনুসরণ করার মতাে ধৈর্য্যের অভাবে লিওনার্দো তার প্রায় কোনাে গবেষণাকেই সম্পূর্ণ করতে পারেননি। পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব সম্যকরূপে উপলব্ধি না করতে পারায় এবং তথ্যের উন্নতি সাধনে তেমনভাবে সফল না হওয়ায় কোপারনিকাস তার যুগান্তকারী পরিকল্পনাকে নানাভাবে জটিল ও দষিত করে তুলেছিলেন। তার নিজস্ব গবেষণা যে বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করেছিল তা তিনি নিজেও ভালাে বুঝতে পারেননি। টাইকোর পর্যবেক্ষণ অবশ্য উদ্দেশ্যবিহীন ছিল না কিন্তু গাণিতিক জ্ঞানের অভাবে মূল জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধানে তার কোনাে উল্লেখযােগ্য অবদান ছিল না। তাত্ত্বিক জ্ঞানে কেপলার গ্যালিলিওর থেকেও অগ্রগামী ছিলেন কিন্তু টাইকোর গ্রহ ও নক্ষত্র তালিকা ব্যবহারের সুযােগ না পেলে কেপলারের অতুলনীয় গাণিতিক দক্ষতাও বােধহয় শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হত।
এই প্রসঙ্গে আরাে বলা যায়—লিওনার্দো ছাড়া টাইকো, কেপলার, কোপারনিকাস বা ভেসালিয়াস কেউ সম্পূর্ণরূপে মধ্যযুগীয় বৌদ্ধিক সংস্কারমুক্ত ছিলেন না। এই সংস্কারের পিছুটান তারা মাঝেমাঝেই কমবেশি অনুভব করেছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন গ্যালিলিও। অ্যারিস্টটলীয় ও টলেমীয় মতবাদের অসারতা যেদিন থেকে তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন, সেদিন থেকে সনাতন পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতিষের সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরতরে বিচ্ছিন্ন হল। জীর্ণ বস্ত্রের মতাে ঐ দুজনার ভাবধানা তিনি চিরতরে পরিত্যাগ করলেন। এমনকি পাণ্ডিত্য প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে লাতিন ভাষাকেও পরিত্যাগ করতেও তিনি দ্বিধাবােধ করেননি। তার বদলে তিনি পেত্রার্কের আদর্শে বেছে নিয়েছিলেন মাতৃভাষাকে। সহজ, সরল, অলংকার বর্জিত ভাষায় লেখা গ্যালিলিওর বৈজ্ঞানিক রচনা আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সমতুল্য।
এত স্বল্প পরিসরে গ্যালিলিওর বিশাল বৈজ্ঞানিক প্রতিভা ও আবিষ্কারের বিস্তারিত আলােচনা সম্ভব নয়। এখানে একটি সংক্ষিপ্তসার পরিবেশিত হল। প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি তিন বৎসরের জন্য পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। ইতিপূর্বেই ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিওর প্রথম মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল উদ্স্থিতীয় তুলাদণ্ড’ (hydrostatic balance)। পিসায় থাকাকালীন তার নত সমতলের (inclined plane) উপর গড়িয়ে পড়ার সময় বস্তুর গতিবেগ প্রভৃতি সংক্রান্ত গবেষণা অ্যারিস্টটলের গতানুগতিক সিদ্ধান্তের উপর চরম আঘাত হেনেছিল। দুর্ভাগ্যবশত রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন গ্যালিলিও তিন বছরের চুক্তিপত্রের মেয়াদ ফুরানাের আগেই পিসা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুকাল পরে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করেন। এটাই ছিল তার অধ্যাপনা ও গবেষণা জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। নতুন নক্ষত্র বিষয়ক গবেষণা, দূরবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়ােগ ও তার সাহায্যে চন্দ্রপৃষ্ঠের অসমতা পর্যবেক্ষণ, বহু নতুন নক্ষত্র ও নীহারিকার আবিষ্কার, ছায়াপথের স্বরূপ নির্ণয়, বৃহস্পতির উপগ্রহদের আবিষ্কার, শনির বলয় সংক গবেষণা—এসব পাদুয়ায় থাকাকালীন (১৫৯২-১৬১০) সম্ভব হয়েছিল।
গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে পােপতান্ত্রিক রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া ও তার করুণ পরিণতি কথা ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। ঐতিহাসিকদের অনেকেই মনে করেন পাদুয়া, ছেড়ে চলে যাওয়া তার মারাত্মক ভুল হয়েছিল। তিনি প্রায় জেনেশুনেই ভেনিসীয় সাধারণতন্ত্র ছেড়ে তাস্কেনি গিয়েছিলেন, যে তাস্কেনি ছিল স্বয়ং পােপের খাস তালুকের অন্তর্ভুক্ত। তার Dialogues on the Ptolemic and Copernican System প্রকাশ করেই তিনি রােমান ক্যাথলিক চার্চের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত, ইনকুইজিশন প্রদত্ত দৈহিক নির্যাতন ও ব্রুনাের পরিণতির কথা চিন্তা করে সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধ বিজ্ঞান সাধক শহিদের মর্যাদা অর্জন করতে চাননি। শােনা যায়, মার্জনা ভিক্ষা করা সত্ত্বেও তিনি নাকি প্রায় নীরবে স্বগতােক্তি করে বলেছিলেন “E pur Si mouve” (তবুও তা ঘুরছে)। হয়তাে এটা নিছক জনশ্রুতি বা গল্প। কিন্তু সেই নিদারুণ বিপর্যয় ও বিড়ম্বনার মুহূর্তে হয়তাে সেটাই ছিল তার অন্তরের কথা। (সাম্প্রতিককালে অবশ্য ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ গ্যালিলিওর প্রতি অবিচার ও অন্যায় নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে)।
জিওরদানাে ব্রুনাে (১৫৪৮-১৬০০)
আলােচ্য পর্বের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদদের মধ্যে অন্তত একজন বিদ্রোহী রূপে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ইনি ছিলেন জিওরদানাে ব্রুনাে। কোপারনিকাসের তত্ত্বকে সমর্থন এবং বিশ্ববিদ্যালয় তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারের অপরাধে চার্চ একে গ্রেপ্তার করেছিল। Inquisition বা ধর্মীয় আদালতে বিচারের (বিচারের প্রহসন) পর ইনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। অবর্ণনীয় শারীরিক এবং মানসিক উৎপীড়ন সত্ত্বেও নবজাগরণ প্রসূত আত্মমর্যাদাবােধ ও যুক্তিবাদের দ্বারা চালিত ব্রুনাে কিন্তু দোষ স্বীকার করেননি। অতঃপর এই নির্ভীক বিজ্ঞানীকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। সমকালীন শিক্ষিত সমাজ এই নৃশংসতায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। ব্রুনাের এই শহিদের মর্যাদাবরণ একেবারে ব্যর্থ হয়নি। এর পরবর্তীকালে কোপারনিকাসের তত্ত্ব আরও প্রসারিত হয়েছিল এবং অভাবনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন। করেছিল। ব্রুনাে অন্তত পরােক্ষভাবে Reformation আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিলেন।
জোহান কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)
এই যুগের আর একটি বিশিষ্ট জার্মান বিজ্ঞানী জোহান কেপলার ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির ওয়াইল শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। সেখানে থাকাকালীন প্রােটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বীদের সঙ্গে বিরােধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তৎকালীন বােহেমিয়ার রাজধানী প্রাগ শহরে চলে যেতে বাধ্য হন। তিনি শুধু কোপারনিকাসের অনুগামী ছিলেন না, তিনি তার তত্ত্ব আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি গ্রহগুলোর আবর্তন সম্পর্কে আরও তিনটি নতুন সূত্র প্রকাশ করেছিলেন। তার একটি সূত্রে প্রথম প্রকাশ পায় যে গ্রহগুলো সূর্যকে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তন করে। মহাবিজ্ঞানী নিউটন পরবর্তীকালে কেপলারের সূত্রের সাহায্যে বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেন। জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়া তার গবেষণার অন্যতম বিষয় ছিল আলােক-বিজ্ঞান এবং গণিত। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হারমােনিকস্ মুন্ডি প্রকাশিত হয়।
ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬)
ইংল্যান্ডে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ ছিলেন ফ্রান্সিস বেকন। তিনি অবশ্য প্রকৃত অর্থে বৈজ্ঞানিক ছিলেন না। তার সমকালীন বা পূর্ববর্তী যুগের ইউরােপীয় মহাদেশে যে সমস্ত যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছিল, তার সম্বন্ধেও তিনি খুব সম্ভবত তেমন ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তার প্রধান পরিচিতি ও খ্যাতি একজন সাহিত্যিক, দার্শনিক ও আইনজ্ঞ হিসাবে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বৈজ্ঞানিক গবেষণার উজ্জ্বল সম্ভাবনার প্রতি সমকালীন ও আগামী প্রজন্মের মানসে উদ্দীপনা সৃষ্টির কৃতিত্ব তিনি দাবি করতে পারেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান সাধনার পক্ষে একজন বড়াে মাপের প্রচারক। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য একটি ‘অ্যাকাডেমি’ বা শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার কথা তিনি বলেছিলেন। যদিও তার যুগে অনুরূপ কোনাে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি কিন্তু পরবর্তীকালে তার প্রচারের অনুপ্রেরণায় প্রসিদ্ধ রয়াল সােসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্টুয়ার্ট বংশীয় নৃপতি দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে (১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে)। তিনি ছিলেন এই গবেষণা কেন্দ্রের আত্মিক প্রতিষ্ঠাতা।
এছাড়া, বিজ্ঞান সাধনার পক্ষে একটি অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টি ছিল তার অন্যতম কৃতিত্ব। ইউরােপের বহু দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পক্ষে উপযুক্ত স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ ছিল না। বিশেষত প্রতিধর্মসংস্কারের (counter reformation) যুগে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ভ্রুকুটি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অলঙ্ঘনীয় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করত যার নিদারুণ প্রতিক্রিয়া অনুভব করেছিলেন ব্রুনাে ও গ্যালিলিওর মতাে বাশষ্ট বিজ্ঞান-সাধকগণ। কিন্তু রজার বেকনের উচ্চপদ ও সুখ্যাতি বহু অনুসন্ধিৎসু মানুষকে তার পৃষ্ঠপােষকতা গ্রহণ ও ছত্রছায়ায় অবস্থান করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তার ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণা-সংক্রান্ত পরিকল্পনার পরিচয় তার ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ডি অগমেন্টিস সাইন্টিয়ারাম (De Augmentis Scientiarum) গ্রন্থে পাওয়া যায়।
স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)
স্যার আইজাক নিউটনের কথা না বললে এই আলােচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী কেপলারের প্রভাবে বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে অধ্যয়নের সময় কেপলারের গতিসূত্র পড়ে তার মনে হয়েছিল যে সূর্য ও গ্রহের মধ্যে অবশ্যই কোনাে আকর্ষণ বল কাজ করে। ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাকে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিয়ােগ করা হয়। এই বিশিষ্ট ইংরেজ বিজ্ঞানীর অন্যান্য যুগান্তকারী আবিষ্কারের মধ্যে। অন্যতম ছিল আলােকের গতি সম্পর্কে নতুন তত্ত্ব কণাবাদ, ক্যালকুলাস, বীজগণিতের একটি নতুন সূত্র এবং Law of Motion বা গতির সূত্র। ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার বিখ্যাত Principia গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি ছিলেন রয়্যাল সােসাইটির উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক।
মধ্যযুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান ছিল অত্যন্ত সীমিত। তখনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্ম হয়নি। পদার্থবিদ্যা বা রসায়ন তত্ত্ব বা পদ্ধতি মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহারের সুযােগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে আদানপ্রদান বা ভাব বিনিময় ছিল না। কিন্তু বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ও প্রসারে সবচেয়ে বড়াে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল রােমান ক্যাথলিক চার্চ। চার্চের মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং কুসংস্কারে পরিপূর্ণ মনোভাব বিজ্ঞানচর্চাকে নিরুৎসাহিত ও ব্যাহত করেছিল। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে প্রসার কোপারনিকাস, গ্যালিলিও এবং অন্যান্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা তাদের মৌলিক ও বৈপ্লবিক চিন্তাধারা প্রকাশ করে কীভাবে যাজক সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইতালীয় চিত্রকর ও যন্ত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (১৪৫২-১৫১৯) কথাও বলতে হয়। এর অসংখ্য স্কেচ্ সংবলিত যে সমস্ত নােটবুক পাওয়া গেছে (এবং যেগুলো আজও সযত্নে সংরক্ষিত) তাতে তার মানবদেহ, অসংখ্য যন্ত্রপাতি প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার এ বিষয়ে জ্ঞানাদর্শনের প্রচেষ্টা আমাদের আজও বিমুগ্ধ করে। দ্য ভিঞ্চি ছাড়া আরও কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধক এই পর্বের বিজ্ঞান সাধনাকে সমৃদ্ধতর করেছিলেন, যথা—এগ্রিকোলা (স্যাক্সনির চিকিৎসাবিজ্ঞানী, ১৪৯৪-১৫৫৫), উইলিয়াম হার্ভে (ইংরেজ চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের আবিষ্কারক ১৫৭৮-১৬৫৭), ফ্রান্সিস বেকন (ইংল্যান্ডের লর্ড চ্যান্সেলর এবং একাধারে আইনজ্ঞ, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ) এবং রেনে দেকার্তে (দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সমালােচনামূলক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভাবক এবং Discourse on Method-এর রচয়িতা ১৫৯৬-১৬৫০)।
আলােচ্য পর্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও চিন্তাভাবনা ইউরােপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বলাবাহুল্য এদের চিন্তাভাবনার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু ইউরােপ নয় সমগ্র বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এযুগের বিজ্ঞানচর্চা। মধ্যযুগীয় কুসংস্কার এবং অন্ধকার থেকে মননের এই মুক্তির মূলে ছিল রেনেসাঁস এবং রেনেসাঁস প্রসূত নব্যমানবতাবাদ।
জীবনবিজ্ঞান ও রসায়নের অগ্রগতি
১৫৫৯ থেকে ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জীবনবিজ্ঞান ও রসায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি ঘটেনি। আলােচ্য পর্বে পদার্থবিদ্যা বা গণিত শাস্ত্রের মতাে বিজ্ঞানের এই দুটি শাখায় কোনাে যুগান্তকারী বা বৈপ্লবিক আবিষ্কার সংঘটিত হয়নি। এইযুগে জীবনবিজ্ঞান ও রসায়ন ছিল যথাক্রমে চিকিৎসাচর্চা এবং ঔষধিবিজ্ঞান ও ধাতুবিদ্যার উপেক্ষিত সহায়ক। এই দুটি বিজ্ঞান তখনও পর্যন্ত কোনাে যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি, মান বা উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
অবশ্য জীববিদ্যার কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে, বিশেষত শবব্যবচ্ছেদ এবং শারীরস্থান বিষয়ক, শারীরবৃত্ত এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযােগ্য গবেষণা হয়েছিল। ইতালিতে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট গবেষক ও অধ্যাপকবৃন্দ গ্যালেনের চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু শিক্ষা ও ধ্যান-ধারণাকে প্রায় ১৫০০ বছর পর সংশােধন ও সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে (অর্থাৎ যে বছর কোপারনিকাস তার বৈপ্লবিক তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন) পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্ড্রেয়াস ভেসালিয়াস (১৫১৪-১৫৬৪) নামক একজন বিশিষ্ট ফ্লেমিস শারীরবিজ্ঞানী মানবদেহের বিষয়ে এমন একটি উল্লেখযােগ্য গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, যা আগামী দিনে এ বিষয়ে বহু নবদিগন্ত উন্মােচিত করেছিল। গ্যালেনের তুলনায় তিনি অনেক বেশি শবব্যবচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এতে সংশােধিত হয়েছিল গ্যালেনের বহু সিদ্ধান্ত। ভেসালিয়াসের গবেষণাপত্রে সুনিপুণ হাতে অঙ্কিত মানবদেহর অস্থি ও পেশিগুলোর শৈল্পিক উৎকর্ষ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঐ পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত ইংরেজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভের (১৫৭৮-১৬৫৭) একটি গবেষণা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতে হার্ভে প্রথম মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের বিষয়ে আলােকপাত করেছিলেন। তার গবেষণাও গ্যালেনের কিছু ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করেছিল। ইতিপূর্বে মনে করা হত যে শিরার রক্তে আছে নীলের ছোঁয়া আর ধমনির রক্ত উজ্জ্বল লাল। রক্ত দুইটি ধারায় (অর্থ শিরা ও ধমনিতে) পৃথকভাবে প্রবাহিত হয়। গ্যালেনের সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করে। হার্ভে এই যথার্থ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে হৃদপিণ্ড অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ধমনিগুলোতে রক্ত সঞ্চালিত করে, অতঃপর রক্ত শিরায় প্রবাহিত হয়ে পুনরায় হৃদপিণ্ডে সঞ্চালিত হয়ে ফিরে আসে। কোপারনিকাস যেমন সূর্যের উপাসক ছিলেন, ঠিক তেমন হার্ভে ছিলেন হৃদ্যন্ত্রের উপাসক। অবশ্য হার্ভের এই আবিষ্কার সমকালীন অন্যান্য চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের তেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি।
উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বহু নতুন আবিষ্কার সম্ভব হয়েছিল। ১৫৪০-এর দশকে মােট আবিষ্কৃত বৃক্ষ এবং লতা-গুল্মের প্রজাতির সংখ্যা ছিল ৫০০, ১৬৮০র দশকে এর সংখ্যা ১৮,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই যুগেই একজন প্রসিদ্ধ ওলন্দাজ বিজ্ঞানী অ্যান্টন ফন লিউয়েনহক (Anton von Leeuwenhock, 1632-1723) সর্বপ্রথম একপ্রকার অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে, তার মধ্যে দিয়ে এমন সব এককোষী জীব প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যা খালি চোখে দেখা অসম্ভব ছিল। তিনি অবশ্য এটা বােঝেননি। ঐসব প্রাণীদের একাংশ রােগজীবাণুর ধারক ও বাহক। এই বিষয়টি বৈজ্ঞানিকরা ঊনবিংশ শতকের আগে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেননি।
জীবনবিজ্ঞানের মতাে রসায়নের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি হয়নি, যদিও এই যুগে রয়াসনবিজ্ঞানীর অভাব ছিল না। এদের একাংশ ছিলেন ধাতুবিজ্ঞানী, যারা ধাতু পরীক্ষা এবং গুণাগুণ বিচার করতেন, একাংশ ছিলেন ভেষজবিজ্ঞানী যারা নানাপ্রকার মিশ্রণের দ্বারা ঔষধ তৈরি করতেন, আর ছিলেন অপরসায়নবিদগণ (alchemists) যারা ধাতু রূপান্তরের (transmute) কাজে নিজেদের নিয়ােজিত রেখেছিলেন (আরও পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতকে তাদের এই প্রয়াস, অপপ্রয়াসও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছিল)। এদের সঙ্গে যােগদান করেছিলেন দার্শনিকদের একাংশ যারা অণু-পরমাণু নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। সেই যুগের চিকিৎসকরা সিফিলিসের মতাে মারাত্মক যৌন ব্যাধির চিকিৎসার উদ্দেশ্যে প্রথমে রােগীদের পারদ এবং antimony সেবন করিয়ে তাদের পরিশুদ্ধ করতে চেষ্টা করতেন। আধুনিক রসায়নবিদদের মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ বিষয়ক ধারণা তখনকার বৈজ্ঞানিকরা অনুধাবন করতে পারেননি। রয়াল সােসাইটির প্রথম যুগের সদস্যদের মধ্যে রবার্ট বয়েলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তার প্রকৃতি সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা ও গবেষণা ইংল্যান্ড ও ইউরােপের বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলীয় ধ্যানধারণার মূল্যোৎপাদন করে নিদারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। সুইজারল্যান্ড, ইতালি ও ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষালাভের পর গৃহযুদ্ধের যুগে তিনি ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৬৫৬-১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দের পর্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি রয়াল সােসাইটির অপর এক বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক রবার্ট হুকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বায়ু অন্তর্গমন ও বহির্গমনের যন্ত্র Air pump সৃষ্টি করেছিলেন। বায়ুর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন যে দহন, শ্বসন ও শব্দ প্রেরণের জন্য বায়ু অপরিহার্য। তার এই গবেষণা-প্রসূত তত্ত্ব ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল (রয়াল সােসাইটি রিপাের্টে এটি প্রকাশিত হলেছিল ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে)। এর ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বয়েলের সূত্র’বা Boyle’s law) এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোনাে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট ভরের যে-কোনাে গ্যাসের আয়তন তার চাপের সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতিক। এছাড়া, ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে The Sceptical Chemist পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা পত্রে তিনি মেটল কণিকা সংক্রান্ত ধারণা (Concept of Primary particles) ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেই পত্রে তিনি দেখিয়েছিলেন যে এগুলোর সংযুক্তির ফলে সূক্ষ্ম কণিকার (Corpuscle) সৃষ্টি হয়। এই নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা অ্যারিস্টটলীয় উপাদানের দ্বারা অর্থাৎ মাটি, বায়ু, অগ্নি ও জলের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। মৌল কণিকার গতি ও সংগঠনের দ্বারাই এর ব্যাখ্যা সম্ভব। এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী রসায়ন বিদ্যার জনকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। বয়েল একদিকে অ্যারিস্টটলের মৌল মৌলিক পদার্থ সংক্রান্ত (মাটি, জল, বায়ু ও অগ্নি) ধারণাকে বর্জন করেছিলেন কিন্তু পদার্থের গঠন সম্বন্ধে কোনাে বিকল্প গ্রহণযােগ্য তত্ত্ব তিনি। খাড়া করতে পারেননি। রাসায়নিক বিপ্লবের জন্য আমাদের ১৮শ শতাব্দীর অন্তিম পর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই যুগেই বিশিষ্ট ফরাসি বৈজ্ঞানিক লাভইশিয়ার (Lavoisier) অম্লজান (oxygen) আবিষ্কার করেছিলেন। এছাড়া তার অন্যতম কৃতিত্ব ছিল সর্বপ্রথম রাসায়নিক মৌলিক পদার্থের তালিকা তৈরি করা।
বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি
বিজ্ঞান একাডেমির পটভূমি
১৭শ শতাব্দীর আগে প্রাচীন ও মধ্যযুগে মানুষ বিজ্ঞানসভা গড়ে তােলার কথা চিন্তা করেছিল। প্লেটোর আকাদেমিতে, অ্যারিস্টটলের লাইসিয়ামে এবং আলেকজান্দ্রিয়ার সংগ্রহশালায় এই ভাবনা অস্পষ্ট অভিব্যক্তি লক্ষ করা গিয়েছিল। মধ্যযুগের ইসলামি ও খ্রিস্টান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিজ্ঞানসভার একপ্রকার অপরিণত রূপ মনে করা যায়। কিন্তু ১৭শ শতাব্দীতে চিন্তাশীল মানুষ এই সিদ্ধান্তে আসে যে ঐ ধরনের বিজ্ঞানসভাগুলো তেমন যুগােপযােগী নয়। গড়ে তুলতে হবে নতুন সংগঠন ও সভা যা ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যে অগ্রগতি হয়েছে, তার সঙ্গে যা সাযুজ্য রক্ষা করতে পারবে। এই চিন্তার ফলশ্রুতি ১৭শ শতকের ইউরােপের একাধিক বিজ্ঞানসভার আত্মপ্রকাশ। এর পেছনে ফ্রান্সিস বেকন ও অন্যান্য মনীষীদের তাত্ত্বিক অনুপ্রেরণা তাে ছিলই। কিন্তু এর চেয়ে বড়াে কারণ ছিল বিজ্ঞান-উৎসাহী মানুষদের স্বতঃস্ফুর্ত আদানপ্রদান ও মেলামেশাকে একটা আনুষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা। যাইহােক, এই সভাগুলো গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞান মানব-সংস্কৃতির এক স্বীকৃত অঙ্গ রূপে চিরস্থায়ী আসন দখল করল।
বেকন ছাড়া অন্য যে চিন্তাশীল ব্যক্তি বিজ্ঞানসভা গঠনের ভাবগত ও তাত্ত্বিক পটভূমি রচনা করেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন মােরাভিয়ার চার্চের শেষ বিশপ জন আমােস কমেনিয়াস (১৫৯২-১৬৯০)। দীর্ঘজীবী এই মানুষটি মনে করতেন বিজ্ঞান মানুষের সার্বিক শিক্ষার এক অপরিহার্য অঙ্গ। এই সার্বিক শিক্ষা সংগঠনের কাজে তিনি প্রায় আজীবন নিজেকে নিয়ােজিত রেখেছিলেন। তার পরিকল্পিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল Panosophic College। যেখানে পরীক্ষা-নির্ভর নব্য দর্শনের চচা ও পঠন-পাঠন হবে। দুর্ভাগ্যবশত ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ চলাকালীন এই যাজক পণ্ডিত বােহেমিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে অত্যন্ত অস্থির জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। অবশ্য তার সার্থক শিক্ষাপ্রণালীর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় বহু উদারনৈতিক দেশের সরকার তাকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যাইহােক, পার্লামেন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শেষপর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডে উপস্থিত হন। নানাপ্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে তিনি তার পরিকল্পনামাফিক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারলেও, রয়াল সােসাইটি গঠনকে কিছুটা প্রভাবিত করেছিলেন। রােমের Accademia dei Lincei (১৬০০-১৬৩০) এবং ফ্লোরেন্সে ‘Cimento’ (১৬৫১-১৬৬৭) ইউরােপের প্রথম গঠিত বিজ্ঞানসভা। ইউরােপে অন্যত্র বিজ্ঞানসভা এই দুটির প্রভাবেই গড়ে উঠেছিল। দুর্ভাগ্যবশত ইতালির এই দুটি সভা শেষপর্যন্ত অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি। এর মূলে ছিল সেখানকার বিজ্ঞান-বিরােধী শক্তিগুলোর অপ্রতিহত প্রভাব।
ইউরােপের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিগুলোতে বিজ্ঞানচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। রেনেসাঁ থেকে একটি ধারণা গড়ে উঠতে থাকে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান পড়ানাে হলেও এগুলো বিজ্ঞান গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার আসল কেন্দ্র হতে পারে না। মুদ্রণ বিপ্লবের পর বিজ্ঞানচর্চার দ্রুত বিস্তার ঘটে, বিজ্ঞান সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, উচ্চস্তরের মানুষজন মনে করেন বিজ্ঞানচর্চার প্রকৃষ্টক্ষেত্র হতে পারে বিজ্ঞান সমিতিগুলো। এসব সমিতিতে বিজ্ঞানীরা মিলিত হয়ে বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের চিন্তা-ভাবনার বিনিময় করতে পারেন। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আসল কারণ হল সামাজিক চাহিদা। সমাজ নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির দাবি করেছিল। জল নিষ্কাশন, জলশক্তি, নৌপরিবহন, মেকানিকস ও জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে নতুন চাহিদা তৈরি হয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের যুগে শুধু পণ্ডিত বিজ্ঞানীরা নন, মেকানিক ও কারিগররাও পরীক্ষামূলক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হত। এরাও বিজ্ঞান সমিতি বা অ্যাকাডেমি স্থাপিত হলে তার সঙ্গে যুক্ত হন। ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি স্থাপিত হয়। এগুলো স্থাপিত হয়েছিল ১৬শ ও ১৭শ শতকে। বৈজ্ঞানিক আলােচনা ও পরীক্ষার জন্য এগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। ইউরােপের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের উপযােগিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়, বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গড়ে ওঠে। ১৭শ শতকের ইউরােপে আনুষ্ঠানিকভাবে কতকগুলো বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি স্থাপিত হয়। এ সব অ্যাকাডেমি স্থাপনে বিশিষ্ট অবদান রাখেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতরা – এমােস রুমেনিয়াস, জনরে, অংকশাস্ত্রবিদ ওয়ালিচ, রবার্ট বয়েল, স্যার উইলিয়াম পেট্টি এবং ক্রিস্টোফার রেন।
১৭শ শতকের শেষার্ধ ছিল আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠার পথের একটি চূড়ান্ত পর্ব। এর মানসিক ভিত্তি রচিত হয়েছিল পূর্ববর্তী একশাে বছরে ধ্রুপদী ও সামন্ততান্ত্রিক যুগের তাত্ত্বিক মূলােৎপাটনের মাধ্যমে। বিজ্ঞানের পরবর্তী অগ্রগতি ও সংহতি সাধনের পথটি প্রধানত এই কারণেই প্রশস্ততর হয়ে উঠেছিল। এই সময়ে ইউরােপীয় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। ইউরােপীয় বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির বিকাশে ও আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই দুটি দেশের অবদান অনস্বীকার্য। তুলনামূলক বিচারে ইংল্যান্ডের অবদান ছিল আরও বেশি, কারণ সে দেশে গৃহযুদ্ধ ও গৌরবময় বিপ্লবের ফলে প্রচলিত ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছিল। এই যুগে শিল্পোৎপাদন ও বহির্দেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নব দিগন্ত উন্মােচিত হয়েছিল। এটাই ছিল যান্ত্রিক উদ্ভাবনের চাহিদা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ – যে চাহিদা বিজ্ঞান চর্চার পক্ষে একটি অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল। ইংল্যান্ডে রয়াল অ্যাকাডেমি স্থাপিত হয় ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে। তার আগে বিজ্ঞানীরা গ্রেসাম কলেজে মিলিত হয়ে তাদের বিজ্ঞানচর্চা ও চিন্তা-ভাবনার বিনিময় করতেন। ইংল্যান্ডের সব উদীয়মান বিজ্ঞানী এখানে মিলিত হয়ে আলােচনায় যােগ দিতেন। একটি গােষ্ঠি প্রতি সপ্তাহে অক্সফোর্ডে মিলিত হয়ে বিজ্ঞানের সমস্যা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আলােচনায় লিপ্ত হত। এসব প্রয়াসের ফল হল রয়াল অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠা। রাজা দ্বিতীয় চার্লস (রা. ১৬৬০-১৬৮৫ খ্রি.) একটি রাজকীয় আদেশ জারি করে এটি স্থাপন করেন। উল্লেখ্য রাজা রয়াল অ্যাকাডেমি স্থাপন করলেও তিনি এর আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। অ্যাকাডেমির সদস্যদের চাঁদা এবং ধনীদের অর্থানুকূল্যে এই প্রতিষ্ঠান চলত। ১৬৬৫ থেকে রয়াল সােসাইটি ‘ফিলজফিক্যাল ট্রানজাকসনস’ নামে জার্নাল প্রকাশ করতে থাকে। টমাস স্প্র্যাট তার রয়াল সােসাইটির ইতিহাসে এসব তথ্য সরবরাহ করেছেন।
ফ্রান্সের পরিস্থিতি ছিল কিছুটা ভিন্ন, কারণ সেখানে তখনও বিপ্লব ঘটেনি। সেখানে তখনও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র-কেন্দ্রিক রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা ও সামন্ততন্ত্রের মূলােৎপাটন সম্ভব হয়নি। কিন্তু ফ্রান্স তখনও ইউরােপীয় মহাদেশের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দেশ এবং তার আর্থিক সমৃদ্ধিও ছিল বিপুল। তাই এই সমৃদ্ধির প্রভাবেই একটা আপসরফা সম্ভব হল। কিছু করে ছাড়, বিশেষ ভাতা ও ভার্সাই প্রাসাদের ঐশ্বর্যের বিনিময়ে অভিজাত শ্রেণি নিজেদের ক্ষমতা অন্তত কিছুটা ছাড়তে রাজি হয়েছিল। রাজা আগের মতাে শাসনযন্ত্রের কেন্দ্রেই রইলেন কিন্তু বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদাধিকারী হলেন উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি। এদের মধ্য থেকেই উদ্ভূত হয়েছিলেন বৈজ্ঞানিকদের একাংশ। এই প্রবণতা মােটামুটিভাবে চতুর্দশ লুইয়ের (রা. ১৬৪৩-১৭১৫ খ্রি.) রাজত্বকালে লক্ষ করা যায়। কোলবার্ট (Colbert, কা. ১৬৬১-৮৩ খ্রি.) তখন প্রশাসনের মধ্যমণি। এই পর্বেই ফরাসি বিজ্ঞানচর্চার সূচনা হয় ও ফরাসিরা বিজ্ঞান একাডেমি গড়ে তোলে। পশ্চিম ইউরােপের অন্যান্য দেশেও এ ধরণের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি গঠিত হয়। কিন্তু তুলনামূলক বিচারে ইউরােপের বিজ্ঞান মঞ্চে এই দেশগুলোর (বিশেষত হল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া এবং পূর্ব ইউরােপীয় দেশগুলো) ভূমিকা ছিল অপেক্ষাকৃত গৌণ। সামরিক বিচারে এদের একাংশ শক্তিশালী হলেও আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার পরিপ্রেক্ষিতে এই পর্বে বিজ্ঞানের জগতে এর অবদান ছিল খুব সামান্য। বিখ্যাত জার্মান গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক লিবনিজ জার্মানিতে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানে জার্মানির বিজ্ঞানীরা মিলিত হয়ে আলাপ-আলােচনা চালাতেন। ১৮শ শতকে দ্বিতীয় ফ্রেডারিক (রা. ১৭৪০-১৭৮৬ খ্রি.) বার্লিন অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স গঠন করেন। এদের আলোচনার বিষয় ছিল ভৌতবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান ও প্রকৃতির রহস্য, এরা দর্শন, ধর্ম ও অধিবিদ্যাকে নার বাইরে রাখেন। সমগ্র ইউরােপে এটি ছিল বিজ্ঞানচর্চার সাধারণ রীতি। ইতালির বোলগনা ছিল বিজ্ঞানচর্চার একটি বড়াে কেন্দ্র। এখানে একটি সায়েন্স অ্যাকাডেমি ছিল। সেখানে মিলিত হতেন বিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিদ, রসায়নশাস্ত্রবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। অস্বীকার করা যায় না ইউরােপের এসব বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি বিজ্ঞানচর্চার সম্প্রসারণে এবং বিজ্ঞানমুখী মানসিকতা গঠনে সহায়ক হয়। ডেনমার্কের ট্রাইকো ব্রাহে সেখানে একটি উন্নত মানের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণাগার গড়ে তােলেন। সে যুগের বিজ্ঞানীদের অনেকেই জােতির্বিজ্ঞানকে গবেষণার একটি প্রধান ক্ষেত্র বলে গ্রহণ করেন। বিজ্ঞানের বিখ্যাত ঐতিহাসিক জে ডি বার্নাল বলেছেন যে সামাজিক চাহিদা থেকে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘটনা ঘটে। সমাজ চেয়েছিল নতুন প্রযুক্তি, নতুন যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌল গবেষণা যাতে সামাজিক মানুষের উন্নতি হয়। বিজ্ঞান সম্পর্কে নতুন দৃষ্টি, বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, এবং অজানাকে জানার কৌতূহল বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি গঠনের পেছনে ছিল চালিকা শক্তি।
ইংল্যান্ডে রয়াল সোসাইটি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠা
ইউরােপে প্রােটেস্ট্যান্ট আন্দোলন শুরু হলে বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতি ঘটে, পিউরিটানরা শিক্ষার পাঠক্রমের পরিবর্তন দাবি করেছিল। নতুন যুগের বিজ্ঞানীদের কাছে অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞান জগৎ বা বিজ্ঞান চিন্তা আর যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি। ইউরােপের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের নতুন পাঠ্যবিষয় হল জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, এবং প্রাণিবিজ্ঞান। পুরনাে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজ মৌল বিজ্ঞান বিষয় ও প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের ওপর জোর দিয়েছিল। ড. চার্লস ওয়েবস্টার তার গ্রন্থের (Dr. Charles Webster, The Great Instauration, Science, Medicine and Reform, 1626-60 (1975).) আলােচনায় দেখিয়েছেন কীভাবে অক্সফোর্ড এবং কেম্ব্রিজ গৃহযুদ্ধের যুগের বিশৃঙ্খলার প্রভাব কাটিয়ে উঠে পুনরায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা শুরু করেছিল। কেম্ব্রিজ প্রধানত জন রের (John Ray) প্রভাব চর্চা হত উচ্চতর জীবনবিজ্ঞান, অন্যদিকে অক্সফোর্ড ছিল ভৌত বিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র। প্রথাগত শিক্ষার পরিধির বাইরে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (এবং লন্ডনে) একাধিক বিজ্ঞানসভা বা ক্লাব গড়ে উঠতে থাকে ১৬৫০-এর দশকে। এখানে নব্য বিজ্ঞান সংক্রান্ত ধ্যানধারণা আলােচনা পর্যালােচনা ও প্রচার করা হত। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেছিল Oxford Experimental Philosophy Club। সাধারণত Wadham College-এর Warden জন উইলকিন্সের (John Wilkins) গৃহে এর ঘরােয়া বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হত। অন্যান্য সভার অনুরূপ ঘরােয়া বা আনুষ্ঠানিক বৈঠক অক্সফোর্ড অন্যত্র, কেম্ব্রিজে এবং লন্ডনেও অনুষ্ঠিত হত।
দুর্ভাগ্যবশত প্রথম যুগের এই বিজ্ঞানসভাগুলোর কোনাে ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে রয়াল সােসাইটি গঠনকে এগুলো কীভাবে প্রভাবিত করেছিল তাও সঠিক বলা যায় না। প্রত্যক্ষ না হলেও পরােক্ষভাবে এই সভাগুলো রয়াল সােসাইটি গঠনকে প্রভাবিত করেছিল। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বৈজ্ঞানিকদের একটি ছােটো (কিন্তু প্রভাবশালী) গােষ্ঠী গ্রেশাম কলেজে (Gresham College) মিলিত হয়ে রয়াল সােসাইটি গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্থির হয় সেখানে জন উইলকিন্সের সভাপতিত্বে নিয়মিত সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হবে। উইলকিন্সের সহযােগী ছিলেন গণিতজ্ঞ ড. ওয়ালিস ও জার্মানি থেকে আগত শরণার্থী ড. থিওডর হাক। এই ড. হাকই প্রথম সাপ্তাহিক বৈঠক বসানাের প্রস্তাব দেন। এছাড়া কয়েকজন চিকিৎসকও এই গােষ্ঠীতে যােগদান করেছিলেন। লন্ডনে প্রাথমিক কয়েকটি অধিবেশন বসার পর এরা ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অক্সফোর্ডে নিয়মিত বসতে থাকেন। অক্সফোর্ডে যােগদানকারী নব্য বিজ্ঞানীদের দলটি আরও শক্তি অর্জন করে তিনজন প্রতিভাশালী তরুণের যােগদানে। এরা ছিলেন রবার্ট বয়েল, স্যার উইলিয়াম পেটি এবং ড. ক্রিস্টোফার রেন। এদের চেয়ে কিছুটা নিম্নপদস্থ হিসাবে যােগদান করেছিলেন রবার্ট হুক – রয়াল সােসাইটিকে সফল করে তােলার পেছনে যার অবদান ছিল সর্বাধিক। অবশেষে ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডরাজ দ্বিতীয় চার্লসের (রা. ১৬৬০-১৬৮৫ খ্রি.) কাছ থেকে এই সভ্য অনুমােদন সংক্রান্ত রাজকীয় সনদ (Royal Charter) লাভ করে।
এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, Royal Charter অর্জন করা সত্ত্বেও প্রথম যুগে সােসাইটির গবেষণা বা ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কোনো সরকারি অর্থ অনুমােদন করা হয়নি। শােনা যায় দ্বিতীয় চার্লস স্বয়ং নাকি কোনােদিন রয়াল সােসাইটি পরিদর্শনে যাননি। Restoration ইংল্যান্ডের নব উদীয়মান সম্পদশালী শ্রেণি এই সভার পৃষ্ঠপােষকতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বণিক, মাঝারি জমিদার এবং চিকিৎসক, আইনজীবী ও অন্যান্য স্ব-নির্ভর পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ। প্রগতিশীল যাজকদের একাংশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেননি। প্রয়ােজনে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল বিজ্ঞানীরা অন্য বিজ্ঞানীদের নিয়ােগ করতেন। রবার্ট বয়েল এক দরিদ্র সহকারী যাজকের পুত্র হুককে নিয়ােগ করেছিলেন। অন্যত্র হল্যান্ডের জুলিকেমের জমিদার ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স নিয়ােগ করেছিলেন মধ্য ফ্রান্সের ব্লোআ শহরের দনি পাপ্যাকে। এই আলােচনা থেকে বৈজ্ঞানিক চেতনার প্রসারের বিষয়টি মােটামুটি অনুধাবন করা যায়। সেই যুগে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রভাব অনুভূত হয়েছিল শৌখিন বিলাসী ও ধনী মানুষের মধ্যে যারা (হয়তাে অস্পষ্টভাবে) বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপযােগিতা উপলব্ধি করে এর আর্থিক পৃষ্ঠপােষকতায় এগিয়ে এসেছিলেন। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানসভাগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। রয়াল সােসাইটির সাময়িকপত্র বা Journal of Philosophical Transaction ১৬৬৫ থেকে হেনরি ওল্ডেনবার্গের (Henry Oldenburg) সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণাপত্র প্রকাশ করা ছাড়া এই সাময়িকপত্র উপরােক্ত সম্পদশালী শ্রেণিসমূহের পৃষ্ঠপােষকতা প্রার্থনা করত। এরা সবাই যে নিউটন, বয়েল, হুক ও অন্যদের গবেষণার মর্মার্থ যথাযথভাবে অনুধাবন করতেন তা নয় কিন্তু ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে সােসাইটির সভ্য হিসাবে পৃষ্ঠপােষকতার বিষয়ে এরা কার্পণ্য করেননি।
বিজ্ঞান সমিতি গঠনের প্রভাব অনুভূত হয়েছিল ফ্রান্সে। সেখানে প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘Academic Royale des Sciences’ (১৬৬৬) সেখানকার বিজ্ঞানীরা ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই অ্যাজঁ-প্রভঁস-এ (Aix-en Provence) পিয়েরেক্স (Pieresc) নামক একজন ধনী আইনজীবীর গৃহে মিলিত হতেন। সেখানে উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট পণ্ডিত ছিলেন গ্যাসঁদি (Gassendi)। ইনি পরমাণুতত্ত্বের পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। ফরাসি বিজ্ঞানচর্চার প্রকৃত কেন্দ্র ছিল যাজক এবং অত পত্রলেখক মের্সেনের (Mersenne) গৃহ। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের ঘরােয়া অনুষ্ঠান এর গৃহেই অনুষ্ঠিত হত। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইনি পরলােক গমন করলে মঁৎমর (Montmor) নামক আর এক আইনজীবীর বাড়িতে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এইসব ঘরােয়া অধিবেশন থেকেই ফরাসি বিজ্ঞান আকাদেমি গড়ে ওঠে। এই সময় চতুর্দশ লুইয়ের প্রধানমন্ত্রী কোলবার্ট ফরাসি অর্থনীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শিল্প ও বাণিজ্য বিকাশের ওপর জোর দেন। তারই উদ্যোগে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমিক অফ দ্য সায়েন্সেস স্থাপিত হয়। অন্যরা যারা ফ্রান্সে বিজ্ঞান মনস্কতার প্রসারে বিশিষ্ট ভূমিকা নেন মার্সেন রেনাদো ও মন্টমাের তাদের মধ্যে অন্যতম। এরা বিজ্ঞানীদের নিজেদের গৃহে আহ্বান করে বিজ্ঞান নিয়ে আলােচনায় উৎসাহ দিতেন। এখানে উল্লেখ্য ইংল্যান্ডে যেমন বিজ্ঞানের উন্নতির সহায়ক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল ফ্রান্সে তেমনটি হয়নি। কার্ডিনাল ম্যাজারিন ফ্রান্সের প্রথম যুগের বিজ্ঞান সাধকদের নানাভাবে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। এই যুগে আর এক বিজ্ঞান উৎসাহী ফরাসি ছিলেন রেনােদো (Renaudot)। রাজধানী প্যারিস নগরীতে এর প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রের লাগােয়া একটি ঘরে ইনি বৈজ্ঞানিক আলােচনার জন্য একটি বক্তৃতা কক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খােলেন একটি পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং একটি চাকুরি এজেন্সি যা গােটা প্রাতিষ্ঠানটির খরচ জোগাত। কার্ডিনাল মাজারিন (Mazarin) ছিলেন তার পৃষ্ঠপােষক। ফ্রান্সে বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ ইংল্যান্ডের মতাে অনুকূল ছিল না। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর রেনােদোর শত্রুদের তৎপরতায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ বয়ে যায়। এইভাবে ফ্রান্সে জনবােধ্য বিজ্ঞান প্রচারের পরিসমাপ্তি ঘটে। এর পুনঃপ্রচারের জন্য ফ্রান্সকে শতাধিক বৎসর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিজ্ঞানসভার কার্যক্রম ও কার্যকারিতা
প্রথম যুগে লন্ডন ও প্যারিসের বিজ্ঞানসভায় দার্শনিক তত্ত্বের আলােচনার চেয়ে সেইযুগের প্রকৌশলগত সমস্যার চর্চার উপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করা হত। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পাম্পিং , জলবিজ্ঞান (hydraulics), নৌচলন ও কামান সজ্জা। নৌচালন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিন্তাভাবনা ও সমাধানের প্রচেষ্টা বিজ্ঞানের প্রধান দুটি ক্ষেত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যথা বলবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান। এদের একত্রিত করেই নিউটনের অসামান্য তাত্ত্বিক সংশ্লেষণ সম্ভব হয়েছিল। ব্যবহারিক দিক থেকে অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ ফল পাওয়া গিয়েছিল পাম্প বিষয়ক চর্চা থেকে। এই চর্চা থেকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল শূন্যাবস্থা (vacuum) এবং পরবর্তীকালে গ্যাস সংক্রান্ত নিয়মাবলি। এরফলেই উদ্ভব ঘটেছিল বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের। পরবর্তী শতকে রসায়নে গ্যাস বলবিজ্ঞান (Pneumatics) যে বিপ্লব এসেছিল, তার সূচনাও এখানেই হয়েছিল। রয়াল সােসাইটির প্রথম যুগের অন্যতম সদস্য, আগামীদিনে রচেস্টারের বিশপ এবং রয়াল সােসাইটির ইতিবৃত্তকার টমাস স্প্যাট সেইসময় সম্বন্ধে তার ধারণা এইভাবে লিখেছিলেন, ‘…তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল খােলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার মুক্তি উপভােগ করা এবং সেই ভয়ঙ্কর যুগের উন্মত্ততায় না মেতে নিরিবিলিতে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনা করা। যাইহােক পরে এরা (এবং ফরাসি বিজ্ঞানীরাও) অনুভব করেছিলেন যে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান না থাকলে কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। দরকার আরও অর্থ ও স্বীকৃতির।
৮টি দেশের বিজ্ঞানসভা স্থাপনের প্রক্রিয়া দুটি দেশের অর্থনীতির চরিত্র অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছিল। ফরাসি সরকার ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত; সুতরাং দেশের বিজ্ঞান আকাদেমি যে সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সরকারই যে তার ব্যয়ভার বহন করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কোলবার্ট জাতীয় উৎপাদন শিল্পস্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিলেন প্রধানত এই কারণে ইতিপূর্বে মাজারিন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও চারুশিল্পের আকাদেমির পাশাপাশি একটি বিজ্ঞান আকাদেমি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার কোনাে আপত্তি ছিল না। এছাড়া সেই যুগে ফ্রান্সে রাজগৌরব অক্ষুন্ন রাখা বা বৃদ্ধি করার জন্য চারুকলা শিল্পচচা ও জাকজমকপূর্ণ আড়ম্বরের উপরেও যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করা হত। কলবেয়ার যেসব উৎপাদন শিল্পের পৃষ্ঠপােষকতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সাভ্র-এর মৃৎশিল্প, লিঁয়র রেশমবয়ন শিল্প এবং প্যারিসের গাের্লা পর্দা চিত্রণ শিল্প (tapestry)। এগুলোর প্রত্যেকটিকেই ফরাসি নৌবহরের জন্য জাহাজ নির্মাণের মতােই সমান গুরুত্ব দেওয়া হত।
ইংল্যান্ডের পরিস্থিতি যে ভিন্ন ছিল তা ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। রয়াল সােসাইটি সরকারি সাহায্যের চেয়ে বেসরকারি অনুদানের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। অবশ্য প্রথম যুগে সেটা জোগাড় করাও কষ্টকর ছিল। প্রথমদিকে সদস্যপিছু সাপ্তাহিক চাঁদা এক শিলিং জোগাড় করার কাজটি বেশ কঠিন ছিল। ঐ টাকা থেকে সম্পাদক ও ভবন-অধ্যক্ষের (Curator) পারিশ্রমিক জোগাতেও বেশ অসুবিধা হত। বলা হয়েছিল সােসাইটির কার্যকলাপে অংশগ্রহণকারী সদস্যগণ দর্শন ও গণিতে সুপণ্ডিত হবেন এবং সােসাইটির প্রতি অধিবেশন অত্যন্ত উচ্চমানের তিনটি বা চারটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার আয়ােজন করবেন কিন্তু সােসাইটি যতদিন না উপযুক্ত তহবিল গড়ে তুলতে পারছে, ততদিন তারা কোনাে পারিশ্রমিক আশা করবেন না।
ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স এই দুটি দেশের সরকার বিজ্ঞান সভাগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে চিন্তাভাবনার মধ্যে সুষমতা এল এবং অত্যন্ত বিতর্কিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে চলা সম্ভব হয়েছিল। ফ্রান্সে রােমান ক্যাথলিক চার্চ অ্যারিস্টটলবাদের উপর গুরুত্বদানের বিষয়টি কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রত্যাহার করে নিয়ে দেকার্ত প্রস্তাবিত আপসরফাকে স্বীকার করে নিল। ইংল্যান্ডেও বিজ্ঞান সাধকরা গৃহযুদ্ধের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিতর্ক থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে হুক রয়াল সােসাইটির সংবিধানের যে খসড়া প্রস্তাবটি লেখেন তাতে বলা হয়েছিল, “..রয়াল সােসাইটির কাজ হল পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ সম্বন্ধে জ্ঞান বাড়ানাে, যাবতীয় ব্যবহারিক প্রয়ােগ কৌশল, উৎপাদন পদ্ধতি, যন্ত্রপ্রক্রিয়া, এনজিন এবং উদ্ভাবনের উন্নতি ঘটানাে। ঈশ্বর, অধিবিদ্যা রাজনীতি…নিয়ে মাথা ঘামানো তার কাজ নয়।”
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স উভয় দেশেই বিজ্ঞানসভার সংগঠিত প্রক্রিয়াটি তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে দুটি দেশেরই সভার সাংগঠক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে, ১৮শ শতকে এগুলো পুনত্বজ্জীবিত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আলােচ্য পর্বে এই দুটি সভার প্রতিষ্ঠা সমাজে যে সঠিক সমর্থন ও ব্যাপক আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, সেই সময় বিজ্ঞান উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী, কৌতূহলজনক এবং সম্ভবত লাভজনক বলে বিবেচিত হচ্ছিল। সামগ্রিক বিচারে বিজ্ঞানচর্চা লাভজনক ছিল কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। নববিজ্ঞান চর্চার মাত্র একটি ক্ষেত্র – জ্যোতির্বিজ্ঞান ও নৌপরিবহন প্রকৃত অর্থে মানুষের কাজে লেগেছিল। কিন্তু এই বিষয় সংক্রান্ত গবেষণা পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় জলের গভীরতা কতটা হলে জাহাজ ভাসমান হবে (draught) তা হিসাব করে বার করেছিলেন স্যার অ্যান্টনি ডিন। কিন্তু এই হিসাব নির্ণয় করা হয়েছিল জাহাজ জলে না ভাসিয়েই। এতে জাহাজ নির্মাণের বাস্তব প্রক্রিয়ায় কোনাে প্রভাব দেখা যায়নি। আদি রয়াল সােসাইটি তার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির খুব সামান্যই পূরণ করতে পেরেছিল। তাই বিজ্ঞান ক্ষেত্রের বাইরের বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিলেন তা একেবারে অমূলক নয়। এই ব্যঙ্গবিদ্রুপ সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে জোনাথন সুইফ্টের ‘গালিভার্স ট্র্যাভেল্স-এ’। পরিশেষে অবশ্য ফলাফল একেবারে ভিন্ন হয়েছিল। নানাবিধ পেশার প্রতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীর স্বাভাবিক অন্তর্দৃষ্টিকে জাগিয়ে তুলে রয়াল সােসাইটি সনাতন প্রয়ােগ কৌশল ও উৎপাদনের একটা যুক্তিসম্মত মূল্যায়ন ও পুনর্গঠনের ভিত্তি রচনা করেছিল। পরবর্তী শতাব্দীতে এই ভিত্তির উপরেই গড়ে উঠেছিল শিল্পবিপ্লবের কাঠামাে। বস্তুত যে বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে শিল্পবিপ্লবের প্রধান আবিষ্কার আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা উদ্ভূত হয়েছিল রয়াল সােসাইটি ও অন্যান্য বিজ্ঞানসভার চিন্তাভাবনা ও পর্যালােচনার ফলশ্রুতি হিসাবে। অন্যান্য বিজ্ঞানী গােষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ছিল ফ্লোরেন্সর Academia del Cimento এবং ফ্রান্সের বিজ্ঞান আকাদেমি।
আদি বিজ্ঞানসভাগুলো গড়ে ওঠার ফলে বিজ্ঞান হয়ে উঠেছিল এক প্রতিষ্ঠান। আইন বা চিকিৎসা শাস্ত্রের মতাে এই নবগঠিত প্রতিষ্ঠানটিও নিজস্ব অভিজ্ঞান চিহ্নে ও ভাবগাম্ভীর্যে মণ্ডিত হয়েছিল। অবশ্য আইন বা চিকিৎসাশাস্ত্রের মতােই এই সভাগুলো জাকজমক ও অত্যধিক পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে থাকে। অবশ্য সভার অন্তর্ভুক্ত বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক ও বাস্তব জীবনের বহু বিষয় নিয়েও মাথা ঘামাতেন ও চর্চা করতেন। এগুলোর মধ্যে গ্রহনক্ষত্রের দূরত্ব যেমনি ছিল, তেমনি ছিল রঙ ছাপানাের কৌশল, লন্ডন ও শহরতলীর সাপ্তাহিক মৃত্যু তালিকা এবং লঙ্কা-জলের কীটাণুর মতাে বিষয়।
নবগঠিত এই বিজ্ঞানের প্রথম ইশতেহার রূপে ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে লিখিত হয়েছিল History of Royal Society এর লেখক ছিলেন বিশপ স্প্র্যাট। একে নিছক ইতিহাস গ্রন্থ না বলে পরীক্ষাভিত্তিক দর্শনের এক কর্মসূচি ও পক্ষ সমর্থন আখ্যা দেওয়া যায়। এই গ্রন্থে রয়াল সােসাইটিতে সকল দেশের ও সমাজের সর্বস্তরের যে কোনাে পেশায় নিযুক্ত মানুষের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করেছিলেন স্প্র্যাট। স্প্র্যাট রয়াল সােসাইটির যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা ও সােসাইটি ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে আলােচনা শেষ করেছিলেন সভ্যদের বক্তৃতার ধরনের বিষয়ে মন্তব্য করে। তিনি লিখেছিলেন, ‘ ..সােসাইটি তার সভ্যদের সুবােধ্য, নিরলংকার ও স্বাভাবিক ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করেছে…।” যাইহােক, ১৭শ শতকের অন্তিম পর্বে ইংরাজি গদ্য হয়ে উঠেছিল সহজ, সরল অথচ প্রাঞ্জল। প্রায় একশাে বছর পরে স্যামুয়েল জনসন স্প্র্যাট সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “নিতান্তই অনিত্য ও অচিরস্থায়ী বিষয় নিয়ে লিখিত হওয়া সত্ত্বেও এই বইটির মূল্য যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায়নি, তার কারণ হচ্ছে ভাবের নির্বাচন ও ভাষার সৌকর্য।”
নারী ও জাদুবিদ্যা
একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থার পরিকল্পনা করতে গিয়ে ফরাসি রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাবিদ জাঁ বোদোঁ (Jean Bodin) তার Six Books of the Republic (1576) গ্রন্থে আফ্রিকাবাসী নিগ্রো ও আমেরিকার আদি বাসিন্দা Indian-দের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য পর্তুগিজ ও স্পেনীয়দের নিন্দা করেছিলেন। বোদোঁর দৃষ্টিতে দাসপ্রথা শুধু অমানবিক ও নিষ্ঠুর নয়, এর ফলে সামাজিক সুস্থিতি ও শৃঙ্খলা বিপন্ন হতে পারে কারণ এর বিরুদ্ধে দাস বিদ্রোহের একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। নিপীড়িত ও শােষিত দাস চিরকাল নীরবে যাবতীয় অত্যাচার মেনে নেবে এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সােচ্চার হলেও বােদোঁ কিন্তু পুরুষের সামাজিক আধিপত্যকে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। নারীর সমানাধিকার অর্জনের প্রবণতা সর্বক্ষেত্রেই নিন্দনীয় এবং বিপজ্জনক, কারণ পুরুষ সবসময় বিজ্ঞ ও যুক্তিসম্মত এবং নারী নির্বোধ ভাবাবেগতাড়িত। সমাজব্যবস্থার একক হিসাবে পরিবার এর পরিবারভুক্ত মাতা ও স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বােদাঁ অস্বীকার করেননি কিন্তু এই পাশাপাশি নারী ও সন্তান-সন্ততীদের উপর পুরুষের কর্তৃত্বকে তিনি মুক্ত কণ্ঠে সমর্থন করেছিলেন। বােদোঁ একদিকে নারীজাতির শারীরিক নিপীড়ন মেনে নিতে পারেননি কিন্তু তিনি এটাও বলেছিলেন যে প্রয়ােজনবােধে পুরুষ নারীকে তার পারিবারিক ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য তিরস্কার করতে পারে। বিশেষত নারীজাতির (এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের) মদ্যপানের মতাে অনাচারের তিনি তীব্র নিন্দা করেছিলেন। মদ্যপ নারী উস্তৃঙ্খল ও ব্যভিচারী এবং এর ফলে সমগ্র পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিপন্ন হতে পারে সামাজিক সুস্থিতি ও শৃঙ্খলা।
বােদাঁর দৃষ্টিতে নারীর সামাজিক-পারিবারিক অবস্থানের মধ্যে বিশেষ অভিনবত্ব ছিল না। এতে চিরাচরিত ধ্যানধারণার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়, যে ধ্যানধারণায় নারীপুরুষের সঙ্গিনী (এর বাইরে তার কোনাে পৃথক সত্তা নেই) সে সবসময় দুর্বল এবং তাকে যথাস্থানে রাখা উচিত, অর্থাৎ পুরুষের অধীনে। মহাকবি শেক্সপিয়ারের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রায় অনুরূপ ছিল। কিন্তু বােদার জীবদ্দশাতেই নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ করা যায় এবং এর ফলে তারা মাঝে মাঝেই কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হত।
১৬শ শতকের অন্তিম পর্বে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধান এবং রানিরূপে প্রথম এলিজাবেথ ও মেরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ফ্রান্সের রানিমাতা এবং সিংহাসনের পশ্চাতে শক্তি রূপে ক্যাথরিন দ্য মেদিচির। অবশ্য রাজনৈতিক জীবনে নারীর এই প্রাধান্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৬০৩-১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের পর্বে ইউরােপের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে যারা আবির্ভূত হয়েছিলেন, যথা – ফ্রান্সে রানিমাতা মারি দ্য মেদিসি, ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় মেরি ও অ্যান, সুইডেনে ক্রিশ্চিনা এরা কেউ প্রথমােক্ত তিনজনের মতাে সুদক্ষ ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন না। আলােচ্য পর্বে পিউরিটান বিপ্লবের যুগে যে লেভেলাররা গণতন্ত্রের সপক্ষে জোরালাে সওয়াল করেছিলেন, তারা নারীর ভােটাধিকারের বিষয়ে নীরব ছিলেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা ছিল অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। ১৬শ শতকে ইউরােপে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে চাষবাস অথবা তাত বােনার কাজে সহযােগী হওয়ার চেয়ে গৃহকর্মে বেশি সময় ব্যয় করত। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির কাজ অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ ও জটিল হয়ে উঠতে থাকে। এইসব কাজে বাড়ির মেয়েরা ছাড়াও পরিচারিকাদের অনেক বেশি সংখ্যায় নিয়ােগ করা হতে থাকে।
আলােচ্য পর্বে নারীর ধর্মীয় জীবনেও কিছু উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। রিফরমেশন এবং প্রােটেস্ট্যান্ট মতবাদের উদ্ভদের সঙ্গে সঙ্গে, প্রতিবাদী ধর্মমত ও প্রতিষ্ঠানে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে নারী গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। তারা যাতে মূল বাইবেল পাঠে সক্ষম হতে পারে, সেইজন্য তাদের অনেকে সাক্ষরতা অর্জন করে। সাধারণভাবে প্রােটেস্ট্যান্ট চার্চগুলো পুরুষের তুলনায় নারীজাতিকে বেশি সংখ্যায় আকৃষ্ট করেছিল। ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী প্যারিসের রাস্তায় যেসব হিউগেনােরা বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণের অপরাধে কারারুদ্ধ হয়েছিল, তাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছিল নারী। ১৫৫০-এর দশকে ইংল্যান্ড যে ২৮২ জন প্রােটেস্ট্যান্টদের অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ জন ছিলেন নারী। ১৭শ শতকের ইংল্যান্ডে যেসব প্রতিবাদী এবং বৈপ্লবিক গােষ্ঠী আবির্ভূত হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোয়েকাররা (The Quakers) নারীর সমানাধিকারের ব্যাপারে সােচ্চার হয়েছিল। সক্রিয় কোয়েকারদের মধ্যে নারীর সংখ্যা নেহাত উপেক্ষণীয় ছিল না। .
কিন্তু মুখ্য (এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ) প্রােটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় বা গােষ্ঠীগুলো, যথা লুথারপন্থী, ক্যালভিনপন্থী এবং অ্যাংলিকানগণ ধর্ম আন্দোলনে নারীর ভূমিকাকে সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখত। এদের চোখে প্রােটেস্ট্যান্ট নারীর প্রধান ভূমিকা ছিল কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী এবং মার। চার্চে তারা অবশ্যই নীরবতা পালন করবে। তাদের কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে পরে বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে তারা সে বিষয়ে আলােচনা করবে। অন্যদিকে সাধারণভাবে আরও বেশি রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও রােমান ক্যাথলিকবাদ সন্ন্যাসিনীদের অধিকতর দায়িত্বপূর্ণ ধর্মীয় কার্যকলাপ সম্পাদনের অধিকার প্রদান করেছিল। ধর্মযাজকদের মতাে তাদেরও ব্রহ্মচর্য পালনের অধিকার ছিল, বিশিষ্ট পুরুষ সন্তদের জীবনাদর্শ তারাও অনুসরণ করতে পারতেন, মা মেরির আরাধনার অধিকার তাদের ছিল (প্রােটেস্ট্যান্টরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। প্রােটেস্ট্যান্ট মেয়েরা শুধু পিতারূপে ঈশ্বর ও সন্তানরূপে খ্রিস্টের আরাধনা করতে পারত)। সমকালীন একটি বিবরণীতে জেনিভার একটি ক্যাথলিক মঠের সন্ন্যাসিনী সিস্টার জাঁ আমাদের জানাচ্ছেন যে একদিন জনৈক ভূতপূর্ব প্রােটেস্ট্যান্ট সাধ্বী তার মঠে এসে তাকে এবং অন্যান্য সিস্টারদের মঠ ছেড়ে পালাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এভাবে পালিয়ে গেলেই তাদের পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব হবে। কয়েকজন সুদর্শন পাণিপ্রার্থীর সন্ধানও তিনি দিয়েছিলেন। এই ঘৃণ্য প্রস্তাব শােনার পর মঠের সন্ন্যাসিনী সেই প্রােটেস্ট্যান্ট সাধ্বীর গায়ে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ঐ তথাকথিত পবিত্র প্রােটেস্ট্যান্ট বিবাহ বন্ধন আসলে পুরােনাে সাংসারিক দাসত্বের বন্ধন এবং স্ত্রীলােকের উপর পুরুষের আধিপত্যের স্বীকৃতি।
উপরােক্ত আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক পটভূমিতে আমাদের আলোয় পর্বের জাদুবিদ্যার বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত। এখানে অবশ্য জাদুবিদ্যা বলতে মূলত witchcraft hysteria বা ডাইনি সংক্রান্ত কুসংস্কার এবং ডাইনি নিধন সম্পর্কিত গণ-উন্মাদনা বােঝানাে হয়েছে। বলাবাহুল্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর শিকার হত নারীজাতি কারণ বিশেষ কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সমকালীন সমাজে স্ত্রীলােকের স্থান তেমন সম্মানের ছিল না। ১৫৬০ থেকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই শতবর্ষব্যাপী সময়কালে ডাইনি-নিধনের মতাে নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথাটি একটি চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছিল। ডাইনি সংক্রান্ত ভ্রান্ত বিশ্বাসটি অবশ্য ইউরােপে নতুন কোনাে বিষয় ছিল না, মধ্যযুগেও এর প্রচলন দেখা যায়। কিন্তু বিষয়টি তখনও তেমন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌছােয়নি। সেই যুগে গ্রামেগঞ্জে এবং শহরেও কিছু জাদুঘর ছিল। অত্যন্ত ধূর্ত এই মানুষগুলো অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করত এবং ঝাড়ফুক, ভূতপ্রেত তাড়ানাে এবং ডাইনিদের শাসনে এরা দক্ষ ছিল। ১৬শ শতকের প্রথমার্ধে লুথার, ক্যালভিন এবং স্পেনীয় ও ইতালীয় ইনকুইজিশানে বিচারকমণ্ডলী তথাকথিত অলৌকিক জাদুবিদ্যার (Black Magic) এবং দৈত্য-দানাের উপাসকদের তীব্র নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু এই যুগেও ডাইনি শিকারের ঘটনা মােটের উপর বিরল ছিল। কিন্তু ১৫৬০-এর দশক থেকে এই ধরনের ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সমসাময়িক সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে witch trial এবং hunting কতগুলো ঘটনা আলােচ্য পর্বে ঘটেছিল তা বলা সম্ভব নয়। এই বিষয়ে প্রাপ্ত উপাদানসমূহ পাঠ এবং বিশ্লেষণ করলে মনে হয় আলােচ্য পর্বে (১৫৬০-১৬৬০) এই ধরনের বিচারের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। ইউরােপীয় মহাদেশে স্পেন থেকে পােল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ডাইনি-নিধন চলত ব্যাপকভাবে এবং এ ব্যাপারে শুধু ক্যাথলিক নয় প্রােটেস্ট্যান্টরাও পিছিয়ে ছিল না। ১৫৬১ থেকে ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানিতে ৩২২৯টি ডাইনি বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ভদ্ নামক সুইস ক্যান্টনে ১৫৯১-১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের পর্বে এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩৩৭১। এই এলাকাগুলোতে গণআদালতে তথাকথিত ডাইনি অপরাধে ব্যাপকভাবে মেয়েদের উপর নির্মম শারীরিক অত্যাচার নিপীড়ন চলত এবং তারপর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করা হত। ইংল্যান্ডের পরিস্থিতি ইউরােপীয় মহাদেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম অমানবিক ছিল। সেখানে ডাইনিদের বিচার হত পৃথকভাবে (গণআদালতে নয়), তাদের উপর সাধারণত দৈহিক অত্যাচার করা হত না। মৃত্যুদণ্ডাদেশের ঘটনাও বিরল ছিল।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারের নামে প্রহসনের ক্ষেত্রে যারা নিপীড়িত হত, তারা ছিল স্ত্রীলােক। William Monter-এর Witchcraft in France and Switzerland নামক গ্রন্থে প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে কাস্তিলে শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশ ছিল নারী, অন্যান্য স্থানের পরিসংখ্যান – জেনিভা ৭১ শতাংশ, ভেনিস ৭৮ শতাংশ, ফিনল্যান্ড ৭৮ শতাংশ, জার্মানি ৮২ শতাংশ এবং ইংল্যান্ড ৯২ শতাংশ। ১৬শ শতকের অন্তিম পর্বে ডাইনি-নিধন এত ব্যাপক হয়ে উঠেছিল কেন? কেনই বা এক্ষেত্রে প্রধানত মেয়েদের বেছে নেওয়া হত? এইসব প্রশ্নের কোনাে সঠিক উত্তর দেওয়া যায় না। এই নিধন যজ্ঞের পেছনে একটি সম্ভাব্য কারণ ছিল ১৬শ শতাব্দীর তীব্র ধর্মীয় অনুভূতি ও ভাবাবেগের পুনর্জাগরণ। প্রােটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক উভয় সম্প্রদায় মানবজাতির পাপপুণ্যের তত্ত্বে গভীরভাবে বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত মানব জাতির কার্যকলাপের উপর পিশাচ বা শয়তানের প্রভাবের তত্ত্বে। ক্যাথলিকরা মনে করত যে প্রােটেস্ট্যান্টদের যাবতীয় কার্যকলাপ শয়তানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রােটেস্ট্যান্টরাও ক্যাথলিকদের প্রায় অনুরূপ দৃষ্টিতে দেখত। অপকর্মরত মানুষ চুক্তিবদ্ধ হত শয়তান বা পিশাচের সঙ্গে। এই অশুভ প্রবণতার মূলােৎপাটনের জন্য ধর্মীয় বােধসম্পন্ন মানুষের সজাগ থাকা একান্ত প্রয়ােজন এবং চরম শাস্তি প্রদানে তাদের কখনােই দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। এই প্রসঙ্গে আরও বলা যায় যে সেই যুগে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, দারিদ্র্য এবং অপরাধ প্রবণতার বিরুদ্ধে কোনাে সামাজিক প্রতিষেধক ছিল না। ১৬শ শতকের বিজ্ঞান আবহাওয়ার পূর্বাভাস বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। অধিকাংশ ব্যাধির লক্ষণগুলো সঠিক বােঝা যেত না এবং রােগের প্রতিকারেও বিজ্ঞান অক্ষম ছিল। প্রধানত এই কারণেই ব্যক্তিগত ভাগ্য বিপর্যয় বা অসুখবিসুখ এবং মহামারির জন্য মানুষ অতিপ্রাকৃত অলৌকিক শক্তিকেই দায়ী করত। ডাইনিরূপী নারী ছিল সেই শক্তির প্রতীক। তাকে নিশ্চিহ্ন করা ধর্মীয় চেতনাসম্পন্ন মানুষ পবিত্র কর্তব্য বলেই মনে করত।
ডাইনি-নিধনের পেছনে আরও একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। এই ধরনের বিচার সংক্রান্ত কিছু নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এক্ষেত্রে বাদী এবং বিবাদী উভয়পক্ষই পরস্পরের পরিচিত হত এবং এক্ষেত্রে স্থানীয় বিবাদের একটা ভূমিকা থাকত। অনেক সময় ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে ঝগড়া-ঝাটির সূত্রপাত হত। ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডের মতাে দেশে ভিক্ষুরা গৃহস্থের কাছে ভিক্ষা না পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে ডাইনিবৃত্তির অভিযােগ আনত। কিন্তু ইংল্যান্ডে ভিখারিদেরই স্থানীয় রােগব্যাধির জন্য দায়ী করে তাদের ডাইনি সাজিয়ে বিচার করা হত। Witchcraft-এর মূলে দারিদ্র্য, অনগ্রসরতা এবং ক্ষুধার যে একটা ভূমিকা ছিল সেটা অস্বীকার করা যায় না। শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল বলেই প্রধানত ডাইনি হিসাবে মেয়েদেরই বেছে নেওয়া হত। সেকালের মানুষের এইরকম ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা ছিল যে ডাইনি-নারী শয়তান বা পিশাচ পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হয়ে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। জনমানসে ডাইনির যে ছবি আঁকা হয়েছিল সেটি ছিল একটি বৃদ্ধা, শতছিন্ন পােশাক পরিহিতা, কুৎসিত দর্শন নারীর। সে ছিল দারিদ্র্যের প্রতিমূর্তি। ১৬শ শতকের মানুষ দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যর্থ হয়ে দারিদ্র্যের শিকার অসহায়, দুর্বল বৃদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার সঙ্গে কিন্তু অমানবিক প্রথা বেছে নিয়েছিল।
তথ্যসূত্র
- আধুনিক ইউরোপের বিবর্তন : মধ্য পঞ্চদশ থেকে মধ্য অষ্টাদশ শতক, বাসবেন্দ্র বসু, মিত্রম, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ৭০-১০০
- আধুনিক ইউরোপ আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০-১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, কে পি বাগচি এন্ড কোম্পানি, ২০১২, পৃ. ৭৭-৮১, ২৪৯-২৫৫
Leave a Reply