সোমবার, নোতরদামে আগুন লাগে। ৮৫০ বছর বয়সী এই ক্যাথিড্রাল যা তার গোথিক স্থাপত্য, তারকাখচিত ইতিহাস এবং ভিক্টর হুগো ক্লাসিক “দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম” এর জন্য বিখ্যাত, তা এখন ৪০০ জন উদ্ধারকর্মীর নয় ঘণ্টার পরিশ্রমের পর আগুন থেকে মুক্ত। কিন্তু এর যে ক্ষতিটা হয়ে গেল, তা ঠিক করতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে।
ভাল খবর হল, একজন মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, ভবনটির ফেসাড (অট্টালিকার সদরের বহির্ভাগ) এবং দুটি প্রধান টাওয়ার অক্ষত রয়ে গেছে, সেই সাথে ক্যাথিড্রালের শিল্পকর্ম এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সুরক্ষিত করা হয়েছে (যাদের মধ্যে সেইন্ট লুই এর কণ্টক মুকুট বা ক্রাউন অফ থর্ন ও ঝিল্লি পোশাক বা টিউনিকও রয়েছে)। খারাপ খবর হল যে, এর ছাদের বিশাল অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, আর ভেঙ্গে গেছে নোটর ডেমের যে প্রতীকী স্পায়ারটি (ভবনটির লম্বা ও চোখা স্ট্রাকচারটি), যা ঊনিশ শতকে হওয়া নোটর ডেমের পুনরুদ্ধার প্রকল্পের সময় যোগ করা হয়েছিল।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য একটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। যদিও কেউ জানে না যে, ঠিক কিভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে, ভবনটির কিছু দুর্বলতা বা ভালনারেবিলিটিস এই অগ্নিকাণ্ড ঘটায় সহায়তা করে থাকতে পারে ও ক্ষয়ক্ষতিকে বাড়িয়ে দিয়ে থাকতে পারে। অবশ্যই, এটি কেবলই অনুমান, আর তদন্ত সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে তার সম্পূর্ণ চিত্র আমরা পাচ্ছি না।
ফায়ার ব্রিগেডের রেকর্ডগুলি নির্দেশ করছে যে, অ্যাটিক (চিলা, চিলে-ছাদ বা চিলে-কোঠা) থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এই অ্যাটিক ক্যাথিড্রালের পাথরের খিলান বা আর্চ এর উপরে অবস্থিত এবং কাঠের কাঠামো এগুলোকে একসাথে ধরে রাখে। অগ্নি নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী কাঠের কাঠামো ভবনের জন্য একটি অন্যতম দুর্বলতা কারণ এর কারণে খুব সহজেই আগুন ধরে যায়, এই ভবনের ক্ষেত্রেও তাই হয়ে থাকবে। এদিকে যুক্তরাজ্যের ডারহাম ক্যাথিড্রালের ডিন অ্যান্ড্রু ট্রেমলেটট নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ভবনটিতে মজুদ থাকা (দাহ্য) ধুলো এবং ধ্বংসাবশেষ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।
এখান থেকে মনে হচ্ছে আগুন খুব দ্রুত এই মধ্যযুগীয় ক্যাথিড্রালের ওক কাঠের কাঠামোকে পুড়িয়ে ফেলে। এই ওক কাঠামোকে “দ্য ফরেস্ট” বলা হয়, কারণ ক্যাথিড্রালটির এই কাঠের কাঠামোটি নির্মাণ করতে অনেক অনেক গাছের দরকার হয়েছিল। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্যাথিড্রালের মুখপাত্র আঁদ্রে ফিনো সাংবাদিকদের জানান, ভবনটি “বিশাল ক্ষতির” সম্মুখীন হয়েছে, ত্রয়োদশ শতকের ওকে কাঠামোটি নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, কাঠামোর কোন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
জন জে কলেজের অগ্নি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গ্লেন কর্পেট নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “একবার আগুন লাগার পর, অগ্নি প্রতিরোধী সুরক্ষাব্যবস্থার অভাব এবং ভবনটির বায়ুময় স্থাপত্য (তার ভাষায় এয়ারি আরকিটেকচার) আগুন নেভানোকে কঠিন করে তোলে। যখন আপনি এইরকম কিছুর মুখোমুখি হন, বেশিরভাগ সময়ই তখন আপনার আর বেশি কিছু করার থাকে না।”
একটি আয়রনি হচ্ছে, উদ্ধারকারীগণ বলছেন, আগুন লাগবার আগে নোতরদাম ক্যাথিড্রালে চলা সংস্কারকার্যই এই অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ হয়ে থাকতে পারে। এই নির্মাণ স্থানে ব্যবহার করা ওয়েল্ডারের মত যন্ত্রপাতি, এবং দাহ্য পদার্থগুলো থেকে এই অগ্নিকাণ্ড শুরু হতে পারে।
Table of Contents
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি
ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক শাখাগুলোর প্রধান এবং আর্ট হিস্টোরি এর প্রফেসর কেভিন ডি. মার্ফি এক সাক্ষাতকারে নোতরদাম ক্যাথিড্রালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বলেছেন। সংক্ষেপে তার কথাগুলো তুলে ধরছি। তিনি বলেন, ক্যাথিড্রালটিতে যে দৃশ্যমান ক্ষয় ক্ষতি দেখা যাচ্ছে তা তুলনামূলকভাবে কম। এটি মূলত যেখানে স্পায়ারটি ছিল তার নিচের পাথরের ভল্টিং ভেঙ্গে পড়ার কারণে হয়েছে। আর দুটো অন্য জায়গায় ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে এটি কেবলই দৃশ্যমান ক্ষতি। ভবনটির ভেতরে গিয়ে এবং ভবনটির স্ট্যাবিলিটি পরীক্ষা করে আসল ব্যাপারটা জানা যাবে। কিন্তু যেটুকু দেখা যাচ্ছে তা থেকে বলা যায় এটা উল্লেখযোগ্য কিছু না। এটা সিরিয়াস অবশ্যই, কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হতে পারত।
আমার মনে হয় অনেক মন্তব্যকারীই বুঝতে পারেন নি, আমরা কখনই আশা করিনি যে ভবনটি পুরোপুরি পুড়ে যাবে, কারণ এর বেশিরভাগই পাথর দিয়ে তৈরি। ক্যাথিড্রালটির নকশা আসলেই এমনভাবে বানানো হয়েছিল যাতে আগুন লাগলে এর ছাদটি পুড়ে যায়, এবং এর নিচের অংশটি নির্ভরযোগ্যভাবে স্থিতিশীলই থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত আগুন নিচে নেমে এসে নেইভ ও প্রধান স্যাঙ্কচুয়ারিতে প্রবেশ করবে না, ততক্ষণ নিচে বেশি ক্ষয় হবার কথা না। প্রধান স্যাঙ্কচুয়ারিতে আগুন গেলে অবশ্যই অনেক ক্ষয়ক্ষতি হত, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে না সেরকম কিছু হয়েছে। আগুন ছাদেই সীমাবদ্ধ ছিল, আর তার কারণ হচ্ছে এটি কাঠামোগতভাবেই একটি বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা। এর নিচের অংশকে বেশি প্রভাবিত না করেই এটি পুড়ে যেতে পারে।
এখন স্থপতি, প্রকৌশলী ও পুনর্নির্মাণ বিশেষজ্ঞরা এর ভেতরে প্রবেশ করে পাথরের কাঠামোগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন, কোথাও দৃশ্যমান ক্ষতি পেলে আরও গভীরভাবে দেখবেন। সেই সাথে ভবনটির পাথরের দেয়াল ও ভল্ট এর স্থিতিশীলতা পরীক্ষা করবেন। তারা নেইভ অংশের উপর ভল্ট এর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারেই বেশি উদ্বিগ্ন হবেন, কারণ ভল্টের কিছু অংশই ভেঙ্গে থাকতে পারে। এছাড়া তারা দেখবেন এখান থেকে ধ্বংসাবশেষগুলো নিচে পড়ে যাবার কারণে কোন ক্ষয়ক্ষতি হল কিনা। এছাড়া আগুনের কারণে আরও বড় কোন কাঠামোগত সমস্যা থাকতে পারে। ক্যাথিড্রালটির বেশিরভাগ স্ট্রাকচারই দাহ্য নয়, যদিও স্যাঙ্কচুয়ারিতে দাহ্য বস্তু রয়েছে। তাই তারা স্যাঙ্কচুয়ারির কোন জায়গা থেকে ধোয়া বের হচ্ছে নাকি তা দেখবেন। তারপর তারা যেসব জায়গা ভেঙ্গে পড়েছে তার আশেপাশের স্ট্রাকচারের ক্ষয়ক্ষতি দেখবেন। আর তারপর স্পায়ার ধ্বসে পড়ার কারনে কোন জায়গার ক্ষতি হল কিনা সেটা দেখবেন।
এখন মনে রাখুন, যা যা পুড়ে গেছে সেখানে অনেক কাঠ ছিল, কিন্তু সেখানে ধাতুও ছিল। ফলে তাতে কিছু ওজনও ছিল। তাই যখন এটা নিচে পড়ে যায়, এর কত অংশ পুড়ে যাওয়া ছাই ছিল (যা কোন ক্ষতি করবে না) দেখতে হবে, কত অংশ সত্যিকারের কাঠ বা ধাতু ছিল (যা নিচে পড়ে আঘাত করে) তা দেখতে হবে, আর এই আঘাত হবার পর কী ঘটল তাও দেখতে হবে। পাথরের উপর কেবল তখনই ক্ষতি হতে পারে যদি তার উপর কোন ভবনের ভেঙ্গে পড়া কোন কিছু বা স্পায়ারের পুড়তে থাকা কাঠ আঘাত করে।
এখন আরেকটি সমস্যা আছে, যা হল জল। ভবনে আগুন লাগার পর প্রচুর পরিমাণে জল সেখানে দেয়া হয়। সেই জল কোথায় যাবে? এটা কি ভল্টের শীর্ষে যাবে? নাকি ভবনের ভেতরে ঢুকে যাবে? তাই যারা ভবনটির ভেতরে পরীক্ষা করার জন্য ঢুকবেন তারা এও পরীক্ষা করবেন যে ক্যাথিড্রালের নিচের অংশে জল প্রবেশ করেছে কিনা। তারা চিত্রকর্ম ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুগুলো সরিয়ে ফেলবেন। কিন্তু আমার মনে হয়না যে তারা সব কিছু সরাতে সক্ষম হবেন। তাই প্রশ্ন হচ্ছে কীরকম বস্তুগুলো জলে সম্পৃক্ত হবে। তাদের মধ্যে সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ থাকবেন যারা এইসব বস্তুগুলো দেখবেন, সেগুলো সরিয়ে দেবেন ও এগুলোর সংরক্ষণ নিয়ে ভাববেন।
আরেকটা জিনিস বলা দরকার। এই ভবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুগুলো হল এর স্টেইনড গ্লাস। যেগুলোকে সরানো সম্ভব না। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বস্তু আছে, কিন্তু সেগুলো এই ভবন ও এর স্টেইনড গ্লাসের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে এগুলোতে কী ক্ষতি হতে পারে? ভাগ্য ভাল আগুন কেবল ছাদেই ছিল, তাই এটা স্টেইনড গ্লাসের লেভেলে আসে নি। যদি নেইভ অংশটা পুড়ে যেত তাহলে তা স্টেইনড গ্লাস এর জন্য বিপজ্জনক হত, যেগুলো সীসার সাথে যুক্ত হয়ে আছে। এই সীসা ও কাঁচ উভয়েই তাপের প্রতি সংবেদনশীল।
ধোয়ার ফলে সৃষ্ট ক্ষতিও হতে পারে, জানায় জলের আঘাতের ফলেও ক্ষতি হতে পারে। এইসব কিছুই বিবেচনা করতে হবে।
স্থাপত্য ও সংস্কারের কিছু ইতিহাস
নোতরদাম ক্যাথিড্রালটির নির্মাণ শুরু হয় ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে, এবং এর কাজ শেষ হয় ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে। নির্মাণকার্য শেষ হবার পর এটি বিভিন্ন সময়ে ধ্বংসের মুখে পড়ে, বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি হয়, আবার বারবার এর পুনর্নির্মাণের কাজও সংঘটিত হয়। এই ক্যাথিড্রালটি নির্মিত হয়েছিল গোথিক স্টাইলে। সেইসময় ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে গোথিক স্থাপত্যকলার একটি অন্যতম আবিষ্কার ছিল “ফ্লাইং বাট্রেস”। ফ্লাইং বাট্রেস আবিষ্কারের আগে ছাদের ভর চলে যেত তাকে ধরে রাখা এবাটমেন্ট ও দেয়ালে, যার জন্য বড় ও উঁচু ভবন নির্মাণ সহ বিভিন্ন সমস্যা হত। ফ্লাইং বাট্রেস আসার ফলে ছাদের এই ভর ভল্টের রিব হয়ে ভবনের মূল কাঠামোর বাইরে নিয়ে আসা হয়, আর কাউন্টার সাপোর্ট এর সিরিজ দিয়ে এই ভরকে গ্রহণ করা হয়। এই ফ্লাইং বাট্রেসের আবিষ্কারের ফলে দেয়ালগুলোকে আরও উঁচু ও সরু করা সম্ভব হয়, জানালাকে আরও বড় করা সম্ভব হয়। স্থাপত্য ও কাঠামোগত প্রকৌশলে ফ্লাইং বাট্রেসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক যার উপর দাঁড়িয়ে আছে গোথিক আর্কিটেকচার, আর নোতরদাম সেই ঐতিহ্যকেই ধারণ করে এসেছে।
রেনেসাঁর সময় গোথিক রীতি সেকেলে হয়ে যায়, তখন নোতরদামের ভেতরের দেয়াল ও পিলারগুলোকে ট্যাপেস্ট্রি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৫৪৮ সালে দাঙ্গাকারী হিউগেনোরা পৌত্তলিকতা ভেবে নোতরদেমের বেশ কিছু ভাষ্কর্যকে ধ্বংস করে। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ লুই এর শাসনামলে নোতরদামকে তখনকার ক্লাসিকাল রূপ দেয়া হয়। ১৪১৩ সালে সেখানে সেইন্ট ক্রিস্টোফারের একটি বিশাল ভাষ্কর্য বসানো হয়েছিল যা ১৭৮৬ সালে ধ্বংস হয়ে যায়। বাতাসের কারণে এর স্পায়ারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যাকে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে সরিয়ে ফেলা হয়।
ফরাসী বিপ্লবের সময় কাল্ট অফ রিজন ও কাল্ট অফ সুপ্রিম বিইং একে গ্রহণ করেছিল। এই সংগঠনগুলো ফ্রান্সের রোমান ক্যাথলিসিজম এর বিরুদ্ধে ছিল। সেইসময় ক্যাথিড্রালের অনেক সম্পদ লুঠ করা হয়। ভবনটির পশ্চিম ফেসাডে থাকা ২৮টি বাইবেলীয় রাজার ভাষ্কর্যকে ফ্রান্সের সম্রাটদের ভাষ্কর্য মনে করে তাদের মাথা কেটে নেয়া হয়েছিল, যেগুলোর অনেকগুলোকেই ১৯৭৭ সালের খননে উদ্ধার করা হয় এবং জাদুঘরে রাখা হয়। সেইসময়ে বড় ঘণ্টাগুলোকে গলিয়ে ফেলা হয়, ভার্জিন মেরি ছাড়া অন্য সব বড় বড় ভাষ্কর্যকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। ক্যাথিড্রালকে তখন অ-ধর্মীয় জিনিসপত্র ও খাদ্যের স্টোরেজ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৮০১ সালে নেপলিয়ান বোনাপার্ট ক্ষমতায় আসলে তিনি এই ক্যাথিড্রালটিকে চার্চকে সমর্পন করেন। ১৮১০ সালে মেরি-লুইস অফ অস্ট্রিয়া এর সাথে তার বিবাহও এই ক্যাথিড্রালেই হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে এই ক্যাথিড্রালটি কার্যকরী থাকলেও এর ভেতরের অর্ধেকই ছিল ধ্বংসীভূত। ভিক্টর হুগো এর দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম উপন্যাসটি ভীষণভাবে বিখ্যাত হলে এটি সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। ১৮৪৪ সালে রাজা ফিলিপ ক্যাথিড্রালটির পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন। জ্যঁ বাতিস্ত আঁতোয়া লেসাস ও ইউজেন ভিওলে লে ডিউক নামে দুজন যুবক স্থপতিকে নিযুক্ত করা হয়। সেই সাথে ভাষ্কর, গ্লাস মেকার অন্যান্য ক্রাফটসম্যানদের বিশাল দল কাজে লেগে যায়। একেবারে আসল সাজসজ্জার নকল করে সব কিছু তৈরি করা হয়, আসল মডেল না থাকলে নতুন নতুন জিনিস তৈরি করে তার অভাব পুরণ করে দেয়া হয়। আসল স্পায়ারটার বদলে আরও সাজানো ও লম্বা স্পায়ার বসিয়ে দেয়া হয়। ভিওলে লে ডিউক এর মত চেহারা দিয়ে সেইন্ট থমাসের একটা ভাস্কর্যও তৈরি করা হয়েছিল। গ্যালেরি ডে শিমেরে যুক্ত করা হয় বিভিন্ন পৌরাণিক প্রাণীর ভাষ্কর্য। ২৫ বছর ধরে এই সংস্কারের কাজ চলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৪ সালে নাৎসিদের হাত থেকে প্যারিসকে স্বাধীন করার সময় এই ক্যাথিড্রালে গুলির আঘাত লেগেছিল। কিছু মধ্যযুগীয় কাঁচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যা আধুনিক এবস্ট্রাক্ট ডিজাইন অনুসারে কাঁচ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। ১৯৬৩ সালে ক্যাথিড্রালটির ৮০০ বছর পূর্তিতে এর ফেসাডকে পরিষ্কার করা হয় ও আসল অফ-হোয়াইট রঙ ফিরিয়ে আনা হয়।
শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে যে বায়ু দুশন বৃদ্ধি পায় তার ফলে ক্যাথিড্রালের বাইরের স্টোন ম্যাসনরি ক্ষয় হয়েছিল, এর পাথরের ক্ষয়ের গতিকে এই দূষণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে বিভিন্ন গারগয়েল ও টারেট পড়ে গিয়েছিল এবং পাথরগুলো বিবর্ণ ও ঢিলা হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে আবার ১০ বছর ধরে চলা সংস্কারের কাজ শুরু হয়, এর বাহিরের অনেক কিছুই প্রতিস্থাপিত হয়, কিন্তু আসল স্থাপত্যটির যাতে কিছু না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। পায়রাদেরকে তাড়ানোর জন্য বৈদ্যুতিক তার লাগানো হয়, ক্যাথিড্রালের পাইপলাইনকে কমিউটারাইজড ও মেকানিকালি আপগ্রেড করা হয়।
২০১৩ সালে এই ভবনের ৮৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এর ঊনবিংশ শতকে নর্দার্ন টাওয়ারে লাগানো চারটি ঘণ্টার সেটকে গলিয়ে নতুন ব্রোঞ্জের ঘণ্টা লাগানো হয়। ক্যাথিড্রালের সপ্তদশ শতকের ঘণ্টার আসল আওয়াজকে পুনরায় তৈরি করার জন্য এটা করা হয়েছিল। তবে এত সংস্কারের পরও ক্যাথিড্রালটিতে ধীরে ধীরে ক্ষয় এর চিহ্ন দেখা যেতে থাকে, এবং তারফলে ২০১০ এর দশকে সরকারকে একটি নতুন পুনর্নির্মাণ এর প্রকল্প গ্রহণ করতে হয় যার জন্য ধার্য করা হয়েছিল ১০০ মিলিয়ন ইউরো। প্যারিসের আর্চবিশপ সরকার ও প্রাইভেট ডোনেশনের মাধ্যমে এই ফান্ডিং এর ব্যবস্থা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। ২০১৮ সালের শেষ থেকে সাম্প্রতিক আগুন লাগার আগ পর্যন্ত এর স্পায়ার সংস্কারের জন্য ৬ মিলিয়ন ইউরো এর একটি প্রকল্পের কাজ চলছিল। এতে এর ছাদের তামা-নির্মিত ভাষ্কর্যগুলো ও অন্যান্য সাজসজ্জার জিনিসকে অস্থায়ীভাবে সরিয়ে ফেলার কাজ হচ্ছিল।
যাই হোক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেছেন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এটির পুনর্নির্মাণ হবে, এবং এটি আগের চেয়েও সুন্দর হবে।
সংস্কার নিয়ে একটি দার্শনিক সমস্যা
এই অগ্নিকাণ্ডের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতিকে পুশিয়ে দিতে প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে এর সংস্কার কার্যের জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার পড়েছে তার তুলনায় অনেক বেশি খরচ হবে। আগুন লাগবার আগের সংস্কার প্রকল্পের ৬ মিলিয়ন ইউরোর কথা বারবার তোলা হচ্ছে। সেটা নোতরদামের মত ভবনের জন্য আসলে কিছুই না।
এখন লোকজন শয়ে শয়ে মিলিয়ন ডলার ডোনেট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, যা সম্ভবত এই অবস্থায় প্রয়োজনীয়। দুঃখের বিষয় হল, কোন ওইতিহাসিক নিদর্শনে এরকম দরকারী ডোনেশনের জন্য এরকম দুর্ঘটনার প্রয়োজন হয়।
কিন্তু এখানে একটি দার্শনিক সমস্যাও তৈরি হয়। এই ভবনটি শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে চলা সংস্কার বা পুনর্নির্মাণের ফল। এর পারফেক্ট উদাহরণটি হল এর স্পায়ারটি। স্পায়ারটিতে এত ক্ষয় দেখা গিয়েছিল যে এটিকে ১৭৮০ এর দশকে সরিয়ে নেয়া হয়। এখন যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা ঊনবিংশ শতকে যুক্ত করা হয়েছে।
সেই ঊনবিংশ শতকের স্পায়ারের প্রতিস্থাপনটিকে যখন নকশা করা হয়েছিল তাতে এর পূর্বের নৃতাত্ত্বিক এবং পদার্থিক সাক্ষ্যপ্রমাণ , আরকাইভাল সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো বিবেচনা করা হয়নি, যেগুলো এখন আমাদের কাছে আছে। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি এখন ঊনবিংশ শতকের পুনর্নির্মাণেই ফিরে যাব, যা ঊনবিংশ শতকে ফ্রান্সের সর্বোত্তম স্থপতিদের অন্যতম ইউজেন ইমানুয়েল ভিওলে লে ডিউক এর স্থাপত্য ছিল? নাকি আমরা একেবারে আসল নোতরদাম ক্যাথিড্রালকে কল্পনা করে একে নির্মাণ করব, ঠিক যেমনটা এটি দেখতে ছিল ১৩৪৫ সালে এর নির্মাণের পর? নাকি স্পায়ারটিকে এখন আমরা আমাদের বর্তমানের স্থাপত্যের ধারণাগুলো মিশিয়ে নির্মাণ করব?
ভবনটিতে যে গ্যালারি অফ কিংগস রয়েছে, সেখানকার ভাষ্কর্যগুলোকে ফরাসী বিপ্লবের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি করা হয়েছিল, আর ঊনবিংশ শতকে সেগুলোকে সংস্কার করা হয়। সেই সময় অনেক লোকই ছিলেন যারা বলেছিলেন, এগুলোকে সংস্কার করা উচিৎ নয়। এগুলো যেরকমটা আছে সেরকম রাখাই প্রয়োজন, যাতে আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের সাক্ষ্যপ্রমাণ, এগুলো ফরাসী বিপ্লবের স্মৃতি ধারণ করে।
সুতরাং ঊনবিংশ শতকেও এই বিষয়ে বিতর্ক ছিল যে, আমরা আমাদের কাল্পনিক পরিপূর্ণতার দিকেই যাবার চেষ্টা করব (যা ভিওলে লে ডিউক এর ধারণা ছিল), নাকি আমরা কেবল ভবনটিকে রক্ষা করার চষ্টা করব? শেষোক্তটি খুবই ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ ধাচের ধ্যানধারণা, যা বলে, ভবনকে রক্ষা করো, একে ধ্বসে পড়ার হাত থেকে বাঁচাও, আর এর যে একটি জটিল ইতিহাস ছিল, তার স্বীকৃতি দাও।
এটাই ভবনগুলো নিয়ে একটি আশ্চর্যজনক বিষয়। এগুলো স্থিতিশীল নয়। তারা জীবন্ত বস্তু, এবং এগুলো তাদের কাঠামোয় অনেক লম্বা ইতিহাস নথিভুক্ত করে রাখে। এটাই একটি ক্যাথিড্রাল নিয়ে অবাক করা বিষয় যা শত শত বছর ধরে টিকে রয়েছে। এতি ইতিহাসের একটা লম্বা সময় দেখেছে, আর তার গল্পগুলো নিজের দেয়াল, ছাদ, মেঝে সহ সব জায়গায় যেন লিখে রেখেছে।
আর এটা কেবল এই ক্যাথিড্রাল নিয়েই নয়, কেবল এই ক্যাথিড্রালেই প্রথম আগুন লাগল না। মধ্যযুগে ক্যাথিড্রাল অফ শার্টসে বিশাল অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিরা ক্যাথিড্রাল অফ রাইমে বোমা বিষ্ফোরণ করেছিল, তাতে তার ছাদ ধ্বংস হয়, আবার তা তৈরি করা হয়। রাউয়েন ক্যাথিড্রালের স্পায়ারটি, যাকে চিত্রকর ক্লদ মনে বিখ্যাত করে দিয়েছিল, সেটা পুড়ে যায়। ১৮২২ সালে সেটাকে পুনর্নির্মাণ করা হয়, আর সেটা করতে ৫০ বছর সময় লেগেছিল। এইসব ভবনের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন ওঠে। এগুলো যদি ধ্বংসের পূর্বে ঠিক আসলটির মত দেখতে না হয় তবে এখন এটাকে কিভাবে নির্মাণ করা উচিৎ?
তথ্যসূত্র
1. https://theculturetrip.com/europe/france/paris/articles/a-brief-history-of-paris-notre-dame/
2. https://www.washingtonpost.com/history/2019/04/15/notre-dame-was-ruins-victor-hugos-novel-about-hunchback-saved-it/
3. https://www.nytimes.com/interactive/2019/04/15/world/europe/paris-notre-dame-fire.html
4. https://www.nytimes.com/interactive/2019/04/15/world/europe/paris-notre-dame-fire.html
5. https://www.washingtonpost.com/world/europe/pariss-notre-cathedral-is-on-fire/2019/04/15/c487906e-5fa1-11e9-bf24-db4b9fb62aa2_story.html?utm_term=.6d676069cab0
6. https://twitter.com/afpfr/status/1117838584394993667
7. http://www.liberation.fr/depeches/2012/12/12/notre-dame-de-paris-joyau-de-l-art-gothique-celebre-ses-850-ans_867048
8. http://traveltips.usatoday.com/notre-dame-cathedral-france-3356.html
9. Laurent, Xavier (2003). Grandeur et misère du patrimoine, d’André Malraux à Jacques Duhamel (1959–1973) (in French). ISBN 9782900791608. OCLC 53974742.
10. https://www.nytimes.com/1992/04/09/world/paris-journal-to-notre-dame-s-rescue-sickly-gargoyles-and-all.html
11. https://www.deseretnews.com/article/624304/Paris-pigeons-to-get-shock-treatment-at-Notre-Dame.html
12. https://www.nytimes.com/1995/04/03/world/paris-journal-notre-dame-s-organ-and-computer-are-no-duet.html
13. https://www.nytimes.com/2011/10/19/world/europe/in-paris-bells-at-notre-dame-will-be-replaced.html
14. https://www.nytimes.com/2017/09/28/world/europe/paris-notre-dame-renovation.html
15. https://www.thetimes.co.uk/article/pariss-crumbling-notre-dame-looks-to-wealthy-foreigners-for-salvation-gpsbkl0ls
16. https://www.vox.com/world/2019/4/16/18410806/notre-dame-fire-restoration-history-q-a
17. https://www.nbcnews.com/news/world/notre-dame-will-rise-again-after-fire-restoration-will-be-n994856
18. https://www.washingtonpost.com/world/2019/04/15/an-iconic-spire-precious-stained-glass-all-that-could-be-lost-notre-dame-blaze/?utm_term=.7de9bd1103af
19. https://www.cnn.com/2019/04/16/business/francois-henri-pinault-bernard-arnault-notre-dame-donation/index.html
20. https://www.washingtonpost.com/nation/2019/04/16/story-behind-towering-notre-dame-spire-year-old-architect-commissioned-build-it/?utm_term=.66a025916f36
21. https://whc.unesco.org/en/list/81
22. http://ee.france.fr/en/discover/cathedral-notre-dame-reims-2
23. https://www.theguardian.com/world/2019/apr/16/notre-dame-fire-is-devastating-but-iconic-cathedral-will-live-on
24. https://www.metmuseum.org/art/collection/search/437124
25. https://www.theguardian.com/world/2019/apr/16/notre-dame-fire-is-devastating-but-iconic-cathedral-will-live-on
Leave a Reply