খবরটা একটু পুরনো হয়ে গেছে, কিন্তু এর গুরুত্বের কারণেই এতদিন পর লিখছি। খবরটা Lora DiCarlo নামে একটি কোম্পানি থেকে আবিষ্কার করা “Osé personal massager” নামক একটি নারী-কেন্দ্রিক সেক্স টয় বা যৌন খেলনা নিয়ে। এই সেক্স-টয়টি মানুষের মুখ, জিহ্বা, আঙ্গুল এর অনুভূতিকে অনুকরণ করতে পারে, যা আগে কোন সেক্সটয় করে দেখাতে পারেনি। যন্ত্রটির আবিষ্কর্তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই নারী। কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স শো (CES) এর রোবটিক্স ক্যাটাগরিতে এওয়ার্ড এর জন্য একে বাছাইও করা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল, এই আবিষ্কারটিকে এওয়ার্ড প্রদান থেকে বাতিল করা হয়, এবং কনফারেন্সটিতে যন্ত্রটিকে ডিসপ্লে করা থেকেও ব্যান করা হয়। CES এর এই আচরণ নিয়ে লিঙ্গবাদ (sexism) ও লিঙ্গবৈষম্য এর অভিযোগ আসে, যা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়।
লোরা ডিকারলো তাদের ওয়েবসাইটে এই ব্যাপারটি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন “We Won a CES Robotics Innovation Award. Then they took it back.” শিরোনামে। সেখানে এই প্রোডাক্টটিকে উল্লেখ করা হয় “হস্ত-বিহীন ব্লেন্ডেড অরগাজম এর জন্য ডিজাইন করা একমাত্র প্রোডাক্ট” হিসেবে। ব্লেন্ডেড অরগাজম কী জিনিস, সেটা একটু ব্যাখ্যা করছি। নারীর অরগাজম মূলত দুরকমের। ক্লিটোরাল অরগাজম আর জি স্পট অরগাজম। ক্লিটোরাল অরগাজমের জন্য ক্লিটোরিস বা ভগাঙ্কুরে স্টিমুলেশনের প্রয়োজন হয়, আর জি স্পট অরগাজমের জন্য ভাজাইনাল ওয়ালে বিশেষভাবে স্টিমুলেশন দরকার হয়। আর এই দুইরকম অরগাজম একসাথে পাওয়া গেলে তাকে বলে ব্লেন্ডেড অরগাজম, বাংলা করলে দাঁড়ায় “মিশ্রিত রাগমোচন”।
পূর্বে জি স্পটকে স্টিমুলেট করার জন্য জি স্পট ভাইব্রেটর আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু ব্লেন্ডেড অরগাজম দিতে পারে এরকম যন্ত্র এটাই প্রথম। এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এডভান্সড মাইক্রো-রোবটিক্স। আর এটা এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে যেকেউ নিজেদের পছন্দ মত করে একে এডজাস্ট করে নিতে পারে। কোম্পানির ওয়েবসাইটটির কথা অনুসারে, “একজন বাস্তব সঙ্গীর মত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা দিতে পারার জন্যই” একে তৈরি করা হয়েছে। এসব বিবেচনা করে বলা যায়, এটি নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। যন্ত্রটিতে এরকম ফিচার আছে বলেই বিচারকমণ্ডলি একে রোবটিক্স এন্ড ড্রোন প্রোডাক্ট ক্যাটাগরিতে সিইএস ২০১৯ ইনোভেশন এওয়ার্ড এর জন্য বাছাই করেছিল।
লোরা ডিকার্লো এর ফাউন্ডার ও সিইও লোরা হ্যাডক এই অর্জনকে বলেছিলেন, “feather in our collective cap”। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেখা গেল, কয়েকদিন পরেই তাদের টুপি থেকে পালকটি কেড়ে নেয়া হয়েছে। এক মাস পরেই কোম্পানিটিকে কনজিউমার টেকনোলজি এসোসিয়েশন (CTA) এর পরিচালকগণ (যারা CES পরিচালনা করেন) জানান এই প্রোডাক্টটিকে CES 2019 এ দেখানো হবে না, আর তাদের এওয়ার্ডকে বাতিল করা হয়েছে!
কিন্তু কেন? CTA এর ভাষায়: “যেসব আবিষ্কারকে CTA অনৈতিক, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ, অবজ্ঞাপূর্ণ বা CTA এর ভাবমূর্তির বিরোধী বলে মনে করবে, সেগুলোকে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়”। CTA এর এই আচরণকে আপনাদের অরগানাইজারদের অতিশালীনতা বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে যে এইসব ক্ষেত্রে এরা শুধু একটু শালীনতার চর্চা করছে মাত্র, এখানে লিঙ্গবৈষম্য, লিঙ্গবাদের কী আছে? তাহলে একটু দেখা যাক পূর্বের বছরগুলোকে এরা কোন কোন আবিষ্কারগুলোকে “অনৈতিক”, “অশ্লীল” ও “কুরুচীপূর্ণ” বলে মনে করেন নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালে CES-এ সোলানা নামে একটি সেক্স ডল দেখানো হয়েছিল। একজন বাস্তব মানব নারীর সাথে সেটার এতটাই মিল ছিল যে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এরপর ২০১৮ সালে CES এ দেখানো হল একটি পোল ড্যান্সিং হিউম্যানয়েড। এই হিউম্যানয়েডকে একটি “নারী টারমিনেটর” এর সাথে তুলনা করলে খুব একটা ভুল হয় না। ২০১৬ সালে CES এ আনা হয়েছিল ভারচুয়াল রিয়ালিটি পর্নোগ্রাফি। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন। CES তখন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম পর্নোগ্রাফি প্রোডাকশন কোম্পানি Naughty America কে ভারচুয়াল রিয়ালিটি পর্নোগ্রাফি বা ভি আর পর্ন দেখানোর জন্য নিমন্ত্রণ করেছিল। পুরুষদেরকে এই পর্নোগ্রাফি দেখার জন্য একটি বিশেষ কক্ষ বরাদ্দ করা হয়, যেখানে তারা Samsung Gear VR headset এর সাহায্যে নটি আমেরিকা এর পর্নকে উপভোগ করতে পারবেন। mashable.com এর একজন লেখক সেই পর্ন উপভোগ করে কিছু কথা লিখেছিলেন। তিনি তার এই VR Porn দেখার যে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন তার কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি:
“আমি স্যামসাং গিয়ার ভিআর হেডসেটটি মাথায় লাগালাম, আর ভিআর পর্ন ভিডিও অন করলাম। এরপরই পর্দা থেকে নটি আমেরিকার টাইটেলটি অদৃশ্য হয়ে গেল আর আমিও নিজেকে একটি বেডরুমে আবিষ্কার করলাম। আমার সামনে একজন নারী পর্নস্টার হাঁটু গেড়ে বসেছিল এবং প্রলোভনসঙ্কুলভাবে “নোংরা” কথা বলছিল। আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার শরীর কোন পেশিবহুল যুবকের আকার ধারণ করেছে, যে আমি নই। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই, কার শরীর এটা? এটা কি আমি? হ্যাঁ, এখন আমিই এই শরীর।
সেই পর্নস্টার তার এক নারী বন্ধুকে নিয়ে আসল। এরপর আমি দেখলাম তারা দুজনেই নগ্ন হয়ে গেছে, আর সেই ভিআর ব্যক্তিটির সাথে, মানে আমার সাথে তারা ওরাল সেক্সে অংশগ্রহণ করেছে। সেই পার্টিটি একটি থ্রিসামে পরিণত হয়েছিল।
আমি তখনও যথেষ্ট সচেতন। আমি জানি, আমার সামনে যে দুজন পর্নস্টার আছে তারা আসলে আমার সামনে নেই। কিন্তু এই দুজন নারী যত বেশি করে তাদের স্তন আমার মুখের উপর নাড়াচ্ছিল, যত বেশি তারা তাদের নিতম্ব আমার শরীরের সাথে ঘর্ষণ করছিল, তত বেশি করে যেন আমি সেই ভিআর পর্ন ব্যক্তিটিতে ঢুকে যেতে থাকি, আর পর্নস্টারদের “দক্ষতাকে” বাস্তবে অনুভব করতে থাকি।”
ম্যাশেবলের লেখকের বর্ণনা আরও অনেক বড় ছিল, তিনি সেই পর্ন এর পর আরও নতুন নতুন পর্নে ঢুকেছিলেন আর সেই অভিজ্ঞতারগুলোরও বর্ণনা করেছিলেন। সেইসব অভিজ্ঞতার কথা না হয় অন্য দিনের জন্য তোলা থাক, কিন্তু আপাতত আমার মূল পয়েন্ট হচ্ছে, CES এগুলোকে “অনৈতিক”, “অশ্লীল”, “কুরুচিপূর্ণ”, “অবজ্ঞাপূর্ণ” কিছুই ভাবেনি, যেমনটা ভেবেছে নারীদের জন্য আবিষ্কৃত Osé personal massager নামক সেক্স-টয়টিকে। উল্লেখ্য, সেই ২০১৬ সালের পর থেকে প্রতিবারই CES এই ভিআর পর্ন দেখানোর ব্যবস্থা রাখে। এটা এখন তাদের রেগুলার ফিচার হয়ে গেছে, এবারও সেটা ছিল।
লোরা হ্যাডক লিখেছেন, “পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে CTA এর পুরুষের যৌনতা নিয়ে, পুরুষের সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন রকম যৌন প্রদর্শন নিয়ে কোন সমস্যা নেই। অন্যান্য সেক্সটয়কে CES এ সবসময়ই দেখানো হয়েছে, এবং এদের অনেকগুলো পুরস্কারও পেয়েছে। কিন্তু Osé, একটি প্রোডাক্ট যা নারীদের জন্য তৈরি, যা নারীকে ক্ষমতায়িত করে, তা তাদের কাছে ভিন্ন একটি বিষয়, এবং তাদের কাছে সমস্যার।”
এটা বলে রাখা ভাল, ভাইব্রেটর আগেও CES এ দেখানো হয়েছে। ২০১৬ সালে OhMiBod এর একটি মডেল দেখানো হয়। এছাড়া গত বছরে দেখানো হয় ARTGASM। অথচ CTA থেকে Osé সম্পর্কে একটি আপডেটেড স্টেটমেন্ট এসেছে যেখানে লেখা হয়েছে, “Osé তাদের কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে না, তাই এটাকে বাদ দেয়া হয়েছে।” Buzzfeed বলছে, Osé-কে “রোবট ও ড্রোন” প্রোডাক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি কেননা “এটি একটি এডাল্ট প্রোডাক্ট”। অথচ সেক্সবট একটি এডাল্ট প্রোডাক্ট হলেও এটি একটি রোবট, আর Osé-তে উচ্চস্তরের মাইক্রোরোবটিক্স ব্যবহার করা হয়েছে।
CES এর বেশ কিছু আচরণ পূর্বেও বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। যথেষ্ট নারীদের জন্য প্রোডাক্টের অভাবের ব্যাপারটি তো আছেই, সেই সাথে আছে বিভিন্ন প্রোডাক্ট এর বিজ্ঞাপনের জন্য আকর্ষণীয় নারীকে রিক্রুট করা যাদেরকে “বুথ বেব” বলা হয়।
আমরা সাম্প্রতিক সময়ে একটি নতুন সেক্সুয়াল রেভোল্যুশন বা যৌন বিপ্লব দেখছি, যাকে প্রযুক্তি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। মানুষেরই সন্তুষ্টির জন্য নতুন নতুন সেক্সবট, সেক্সটয়, ভিআর পর্ন তৈরি করা হচ্ছে যা যৌনতাকে দিচ্ছে একটি নতুন মাত্রা। এগুলোর কারণে একসময় ট্রেডিশনাল পর্নোগ্রাফি, সেক্স ট্রাফিকিং, প্রস্টিটিউশন সবই অনেকাংশেই কমে যাবে, বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যখন বিভিন্ন প্রযুক্তির মূল্যায়নের ব্যাপারটা সামনে আসছে তখন মনে হচ্ছে এখানেও নারী ও পুরুষের যৌনতা, সন্তুষ্টি ও উপভোগকে সমান গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এটার জন্যেও হয়তো নারীদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের যৌনতা, নিজেদের সন্তুষ্টি নিয়ে তাদেরকে ভাবতে হবে। একই সাথে STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত) ফিল্ডে নারীকে আরও বেশি প্রবেশ করতে হবে ও সেখানে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিতে হবে। আর তখন নারী-কেন্দ্রিক আবিষ্কারগুলোকে অবমূল্যায়িত করা হবে না, এওয়ার্ড দেবার জন্য বাছাই করার পরে তা বাতিল করা হবে না।
তথ্যসূত্র
1. https://loradicarlo.com/pages/cesgenderbias
2. https://www.ibtimes.co.uk/ces-2018-solana-sex-robot-looks-absolutely-horrifying-without-her-skin-1654796
3. https://www.iflscience.com/technology/androids-take-up-exotic-dancing-in-vegas-of-course/
4. https://mashable.com/2016/01/08/naughty-america-vr-porn-experience/?europe=true
5. https://mashable.com/video/boat-life-london-family/
6. http://www.gizmodo.co.uk/2019/01/ces-2019-ar-porn-is-a-thing-now/
7. https://mashable.com/2016/01/05/ohmibod-lovelife-krush/
8. https://www.engadget.com/2018/01/11/artgasm-orgasm-art/
9. https://www.buzzfeednews.com/article/katienotopoulos/ces-sex-toy-ose-innovation-award-disqualified
10. https://www.usatoday.com/story/tech/news/2018/01/12/ces-booth-babes-less-obvious-but-theyre-not-gone/1029060001/
11. https://www.theverge.com/2018/1/4/16849620/ces-2018-sexism-female-ceo-diversity-cta-all-male-lineup
Leave a Reply