মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা একজন পোলিশ জেনারেলের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। আর সেই কঙ্কালের গঠন নারীর কঙ্কালের মত। আমরা জানি না খাজিমিয়ের্জ পুয়াস্কি (Casimir Pulaski) তার নিজের শরীর সম্পর্কে জানতেন কিনা, কিন্তু মনে হচ্ছে আজ যদি তিনি জীবিত থাকতেন তাহলে তিনি ইন্টারসেক্স বা ট্রান্সম্যান হিসেবে চিহ্নিত হতেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুয়াস্কি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, কিন্তু আজকের দিনে হলে ট্রাম্পের ট্রান্সজেন্ডার নিষেধাজ্ঞা সম্ভবত তাকে এই কাজটি থেকে বিরত রাখত।
পুলস্কি তার পোলিশ সম্ভ্রান্ত পরিবার দ্বারা একটি ছেলে হিসাবে পালিত হয়েছিলেন। রুশ আধিপত্যে থাকা পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তিনি তার সাহস ও সিনিয়র কমান্ডারদের আদেশ প্রত্যাখ্যানের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। পোলিশ বিদ্রোহের পরাজয়ের পর তিনি ফ্রান্সে যান। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবী যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন তার ব্যাপারে প্রস্তাব করেন। যুদ্ধের পর তিনি “যুক্তরাষ্ট্রের অশ্বারোহী দলের পিতা” হিসাবে পরিচিত হন। ১৭৭৭ সালে ব্র্যান্ডিওয়িনের যুদ্ধে তিনি তার অসাধারণ অশ্বারোহী দক্ষতায় জর্জ ওয়াশিংটনকে সম্ভাব্য মৃত্যু বা বন্দিত্বের হাত থেকে উদ্ধার করেন। সেই যুগে নারীদের সৈন্য হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। আর তাই কেউই পুয়াস্কির লিঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তোলে নি।
পুয়াস্কির মৃত্যুর কয়েক দশক পর জর্জিয়ার মন্টেরি স্কয়ারে তাঁর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। যুদ্ধে গ্রেপশটের আঘাতে পুয়াস্কির মৃত্যু হয়। এরপর তার মৃতদেহ যার তত্ত্বাবধানে বহন করা হয় সেও যুদ্ধে মারা যায়। তাই পুয়াস্কির প্রকৃত মৃতদেহ কোথায় ও কিভাবে সমাহিত হয় তা নিয়ে সন্দেহ ছিলই। পুয়াস্কির মৃতদেহ ধারণা করে একটি মৃতদেহকে সেই মন্টেরি স্কয়ারের স্মৃতিস্তম্ভটিতে সমাহিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে স্মৃতিস্তম্ভটির পুনঃস্থাপনের প্রয়োজন হলে তার মৃতদেহ খনন করে তোলা হয় এবং পরীক্ষা করা হয়।
কঙ্কালের উচ্চতা এবং করোটি ও হাতগুলির ক্ষত পুলেস্কির ও যুদ্ধে তার আঘাতের বর্ণনার সাথে মিলে যায়। চোখের নিচে একটি সম্ভাব্য টিউমারও পুয়াস্কির তিনটি সমসাময়িক পোর্ট্রেটগুলির বিবর্ণতার সাথে মিলে যায়। যাইহোক, কঙ্কালের পেলেভিসে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সাধারণত কঙ্কালকে জীববিজ্ঞানগতভাবে নারী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
এই ঘটনাগুলো এক দশক আগে প্রকাশ করা হয়েছিল, কিন্তু এটি পুয়াস্কিরই দেহ কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য এর কোন পারিবারিক ডিএনএ ছিল না। যাই হোক, এখন ডিএনএ প্রযুক্তির অগ্রগতির কল্যাণে পুয়াস্কির নাতির (গ্র্যান্ডনিস) কবর থেকে পাওয়া মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এর সাথে পুয়াস্কির মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ তুলনা করা সম্ভব। যার ফলে এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, দাফনকৃত শরীরটা পুয়াস্কিরই ছিল।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর চার্লস মার্বস শরীরের ফরেনসিক বিশ্লেষণটিতে অবদান রাখেন এবং এএসইউ নিউজকে বলেন: “একটি কঙ্কালের পক্ষে যতটা নারী হওয়া সম্ভব কঙ্কালটি তাই।”
“America’s Hidden Stories: Episode 6 The General Was Female?” নামে একটি স্মিথসোনিয়ান ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সম্প্রতি স্বীকার করতে শুরু করেছে যে, লিঙ্গ দ্বারা লাশ শ্রেণীবদ্ধ করার পুরানো উপায়টি যৌনতা ও লিঙ্গের ক্ষেত্রে মানব বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ। একটি তত্ত্ব বলছে যে, পুয়াস্কির কনজেনিটাল অ্যাড্রেনাল হাইপারপ্ল্যাসিয়া ছিল, যা ইন্টারসেক্স এর একটি প্রকরণ। পুয়াস্কির অভিসিঞ্চনের নোটগুলি নির্দেশ করছে, জন্মের পর থেকেই তার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। আবার এটিও সম্ভব যে, তিনি জৈবিকভাবে নারী ছিলেন, কিন্তু সবসময় নিজেকে একটি ছেলে এবং একজন পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন।
মার্বস বলেন “আমি মনে করি না, তার জীবনে যে কোন সময়ে, তিনি মনে করেন তিনি একজন নারী ছিলেন। আমার মনে হয়, তিনি মনে করতেন যে তিনি একজন পুরুষ ছিলেন এবং তার শরীরে কিছু একটা ভুল ছিল।” মার্বস তার গবেষণাকে “A political hot potato” হিসাবে বর্ণনা করেন এবং বলেন ইতিমধ্যেই তাকে চুপ থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী ছিল, কিন্তু পুয়াস্কির দক্ষতা ও সাহস, ও একই সাথে বিপ্লবী অশ্বারোহী বাহিনীর প্রস্তুত ও প্রশিক্ষণ সেই দেশটিকে অতিরিক্ত কয়েক বছরের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু তিনি যদি আজ জীবিত থাকতেন, তবে সেনাবাহিনীতে তার স্বীকৃতি একটি আইনি ও সামাজিক বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হত।
১২ এপ্রিল, ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কোন ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে পারবেন না, প্রাইভেট হিসেবেও না। ডোনাল্ড ট্রাম্প একবার টুইট করেছিলেন, “…ট্রান্সজেন্ডারদের কারণে সামরিক বাহিনীতে যে প্রচুর চিকিৎসার খরচ হয় ও বিঘ্ন ঘটে তা হতে দেয়া চলবে না।” ট্রাম্প সরকার ট্রান্সজেন্ডারদের নিষেধাজ্ঞার যে সংস্করণটি দেন তাতে মোটামুটিভাবে বলা ছিল, যদি কারও মধ্যে জেন্ডার ডিসফোরিয়া থাকে তবে তাকে মিলিটারিতে নেয়া হবে না, আর যদি কোন ট্রান্সজেন্ডার মিলিটারিতে প্রবেশ করতে চায় তাকে অন্তত ৩৬ মাস স্ট্যাবল অবস্থায় থাকতে হবে, মানে রূপান্তরিত হবার পর ৩৬ মাসের মধ্যে মিলিটারিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। যাই হোক, বেশিরভাগ ট্রান্সজেন্ডার ও ট্রান্সসেক্সুয়ালই এই নিষেধাজ্ঞায় মিলিটারি থেকে ছাটাই হয়ে যাবেন।
বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে ট্রাম্প এই কাজ কোন নীতিমালার প্রেক্ষিতে করেন নি, পুরোটাই রাজনীতির খেলা। কেবল ডেমোক্র্যাটদেরকে পরাজিত করার বাসনা থেকেই এটা করা হয়েছে, মাঝখান থেকে ট্রান্সজেন্ডাররা কোপানলে পতিত হল। ট্রান্সজেন্ডারদের জেন্ডার রিএসাইনমেন্ট এর জন্য মিলিটারি থেকে দেয়া খরচ অত বেশি কখনই হয়না, মিলিটারিদের জন্য যে খরচ করা হয় তার তুলনায় এটা নগণ্য। কানাডা, ইজরাইল, ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে ট্রান্সজেন্ডাররা আছে, তাদের চিকিৎসা খরচ নিয়ে কখনও কিছু বলতে শোনা গেল না, এক যুক্তরাষ্ট্রেরই সেটা নিয়ে প্রবলেম!
২০১৬ সালে RAND corporation নামে একটি প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনীতে ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেটায় কয়েকটা বিষয় উঠে এসেছে। সংক্ষেপে এখানে বলছি:
(ক) যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ লক্ষ সেনার মধ্যে ট্রান্সজেন্ডারের সংখ্যা ২৪৫০ জন মাত্র, আর এদের মধ্যে খুব কমই জেন্ডার এফার্মিং কেয়ার চায়, দেখা গেছে প্রতি বছর মাত্র ২৯ থেকে ১২৯ জন ট্রাঞ্জিশন সম্পর্কিত কেয়ার চায়।
(খ) এইরকম কেয়ার বা চিকিৎসার ফলে সেনাবাহিনীর রেডিনেস এ কোন প্রভাবই পড়ে না বলতে গেলে। দেখা গেছে সেনাবাহিনীর মোট শ্রমঘণ্টার ০.০০১৫% এরও কম খরচ হয় ট্রান্সজেন্ডারদের এরকম চিকিৎসা বা কেয়ারের জন্য। এদিকে ২০১৫ সালে প্রায় ৫০,০০০ জন সক্রিয় সামরিক কর্মচারীকে বিভিন্ন আইনগত, চিকিৎসা সংক্রান্ত ও প্রশাসনিক কারণে ডিপ্লয় করা যায় না। এই সংখ্যাটা সেনাবাহিনীর সক্রিয় অংশের প্রায় ১৪%। এরকম শৎকরা হারের নিষ্ক্রিয়তাকে ধরে নিয়েই বিবেচনা করতে হয়। ট্রান্সজেন্ডার সামরিক কর্মীদের সংখ্যা তো এর তুলনায় অনেক অনেক কম।
(গ) এদিকে রূপান্তর সম্পর্কিত চিকিৎসার খরচও মিলিটারির জন্য অনেক কম। সামরিক বাহিনীর এক্টিভ কম্পোনেন্ট এর চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের জন্য যে পরিমাণ খরচ হয়, ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সেই খরচ মাত্র ০.০৪% থেকে ০.১৩% বৃদ্ধি পায়।
এই প্রতিবেদন থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে ট্রান্সজেন্ডার ও ট্রান্সসেক্সুয়ালদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা অন্য কোন সুবিধার জন্য আসেনি, বরং এসেছে ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি বিদ্বেষ থেকে। এই নিষেধাজ্ঞা সমাজে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্সজেন্ডারদের অবস্থানকে আরও খাটো করে ফেলল। তাদেরকে বলল যে তারা সমাজের অন্যদের মত নয়, অন্যেরা সমাজে যেরকম সুযোগ সুবিধা পায়, তারা সেই সুযোগ সুবিধা পাবে না। পুয়াস্কাদেরকে এভাবেই লড়াই করতে হয়। অষ্টাদশ শতকের পুয়াস্কাকে লড়তে হয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে। এই একবিংশ শতকে এসে পুয়াস্কাদেরকে লড়তে হচ্ছে বরং যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করবার জন্য। যাই হোক, হাউজে ট্রাম্পের এই মতের বিরুদ্ধে একটি নন-বাইন্ডিং রেজোল্যুশন পাশ হয়েছে, দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়।
তথ্যসূত্র:
1. http://www.poles.org/L_Kaz/E_Kaz.html
2. https://asunow.asu.edu/20190405-discoveries-asu-bioarchaeologist-uncovers-200-year-old-mystery
3. https://www.smithsonianchannel.com/shows/americas-hidden-stories/the-general-was-female/1005729/3469173
4. https://asunow.asu.edu/20190405-discoveries-asu-bioarchaeologist-uncovers-200-year-old-mystery
5. http://www.rand.org/pubs/research_reports/RR1530.html
6. https://www.vox.com/identities/2017/7/26/16034366/trump-transgender-military-ban
7. https://www.nydailynews.com/news/national/ny-trump-military-ban-transgender-20190327-nukbdzpmdrgplcaeqzrp5s3ahq-story.html
Leave a Reply