বিজ্ঞানের অবদানের কারণে আমরা আজ জানি যে চাইল্ড এবিউজ বা শিশু নির্যাতন ব্যক্তির প্রাপ্তবয়স্ক জীবনেও বিভিন্ন খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণা এসম্পর্কে জানাচ্ছে আরও নতুন একটি তথ্য। এই গবেষণাটি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে শিশু নির্যাতনের ফলে ভুক্তভোগীর মস্তিষ্কের কিছু পরিবর্তনকে (লিম্বিক স্কারস) যা তার পরবর্তী জীবনে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশনের মাত্রা ও হার আরও বাড়িয়ে দেয়!
মুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয় এর গবেষকগণ ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ১১০ জনের মস্তিষ্ক স্ক্যান করেছেন এই গবেষণাটির জন্য। এই ১১০ জনই বিষণ্ণতাজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এদের প্রত্যেকেই মেজর ডিপ্রেসিভ এপিসোডের চিকিৎসা গ্রহণ করছিলেন। আবার অন্যদিকে এই রোগীদেরকে দিয়ে ২৫টি প্রশ্নের একটি প্রশ্নোত্তর সমীক্ষা করা হয়। প্রশ্নগুলো ছিল তাদের বিষণ্ণতার মাত্রা এবং ছোটবেলায় তার উপরে হওয়া শিশু নির্যাতন নিয়ে। এই নির্যাতন শারীরিক নির্যাতনও হতে পারে, আবেগীয় নির্যাতনও হতে পারে, আবার যৌন নির্যাতনও হতে পারে। এরপর এই প্রশ্নোত্তর সমীক্ষার ফলাফলের সাথে রোগীদের মস্তিষ্কের স্ক্যান এর মধ্যে তুলনা করা হয়। এই তুলনাটার ফলাফল যা পাওয়া গেল তাই উঠে এসেছে ল্যানসেট সাইকিয়াট্রি (Lancet Psychiatry) জার্নালে।[১]
ফলাফল হিসেবে যা পাওয়া গেল তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, বিষণ্ণতার রোগীদের মধ্যে যারা ছোটবেলায় নির্যাতনের শিকার হন নি, তাদের তুলনায় যারা শিকার হয়েছেন তাদের মস্তিষ্কের ইনসুলার করটেক্স এর আকার ছোট। এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। কারণ এই ইনসুলার করটেক্স আমাদের আবেগীয় নিয়ন্ত্রণ ও আত্ম-সচেতনতার সাথে সম্পর্কিত। তাই গবেষকগণ মনে করেন মস্তিষ্কের এই ইনসুলার করটেক্স এর গঠন যদি পরিবর্তিত হয়ে যায় তাহলে ব্যক্তির বারবার রিলাপ্স করবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে অল্প সময়ের জন্য ভাল অবস্থা কাটাবার পর মানসিক অবস্থা আবার খারাপ হওয়াকেই রিলাপ্স করা বলে।
এই রিলাপ্স করার সাথে সম্পর্ক আছে ক্রনিক ডিপ্রেশনের। দেখা গেল, এই ১১০ জনের মধ্যে ৭৫ জন দুই বছরের মধ্যেই রিলাপ্স করেছেন। এর মধ্যে ৪৮ জনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১বার, ৭ জনের মধ্যে ২ বার এবং ছয় জনের মধ্যে ৩ বার ডিপ্রেসিভ এপিসোড ছিল। বাদবাকি ১৪ জন দুই মাস বা তারও কম সময়ের জন্য রেমিশন পিরিয়ড বা উপশম অবস্থায় ছিলেন। এর মানে হচ্ছে এই ৭৫ জনের প্রত্যেকেই ক্রনিক ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন।
গবেষকগণ বের করলেন, শিশুকালে নির্যাতনের শিকার হওয়ার সাথে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা বিষণ্ণতার একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে। এই গবেষণাটি বলছে শিশু নির্যাতন প্রাপ্তবয়স্কে রিলাপ্স করার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ অব্দি বৃদ্ধি করতে পারে।
গবেষণার প্রধান লেখক জার্মানির মুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিলস ওপেল বলছেন, “আমাদের এই গবেষণাটি এই ধারণাটিকেই আরও শক্তিশালী করল যে ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনের রোগীদের মধ্যে শিশুকালে নির্যাতিতরা যারা নির্যাতিত হন নি তাদের থেকে ভিন্ন।… ছোটবেলায় শিশু নির্যাতনের কারণে নির্যাতিতদের ইনসুলার কর্টেক্স প্রভাবিত হয় যা আবেগীয় সচেতনতার মত বিষয়ের সাথে জড়িত। এই প্রভাবের ফলে সাধারণ চিকিৎসায় এই রোগীদের ক্ষেত্রে তেমন কাজ হয় না, বা রোগীরা সাধারণ চিকিৎসার প্রতি সংবেদী নন। তাই ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও মনোরোগভিত্তিক গবেষণা হওয়া উচিৎ যেখান থেকে এই রোগীদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা ও পরিচর্যার উপায় আবিষ্কার হবে।”[২]
পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে শিশু নির্যাতনের সাথে মস্তিষ্কের গঠনের পরিবর্তনের সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল, সেই সাথে শিশু নির্যাতনের সাথে বিষণ্ণতার ঝুঁকি বৃদ্ধিরও সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এই প্রথমবারের মত শিশু নির্যাতন ও মস্তিষ্কের কোন অংশের গঠনের পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বের করা গেল, যার ফলে তীব্রমাত্রার বিষণ্ণতার সৃষ্টি হয়।
ভাল কথা, এই যে শিশু নির্যাতনের ফলে ভবিষ্যতে মস্তিষ্কের গঠনের পরিবর্তন হওয়ার ব্যাপারটা – আরেক গবেষক ডানোলস্কি এর একটা নামকরণ করেছিলেন তার ২০১১ সালের একটি পেপারে।[৩] সেখানে তিনি ডিপ্রেশনের সাথে পিটিএসডি বা পোস্ট ট্রমেটিক স্ট্রেস ডিজর্ডারের কথাও আনেন, আর দেখান যে শিশু নির্যাতনের ফলে মস্তিষ্কের এমিগডালা ও হিপোক্যাম্পাসের গঠনগত পরিবর্তন হয়। যাই হোক, ইংরেজি শব্দ হিসেবে limbic scar শব্দটা খুব সুন্দর। বাংলায় একে কী বলা যায় সে বিষয়ে কিছু প্রস্তাব রাখতে পারেন।
এই গবেষণাটির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। একটি হল শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো রোগীর নিজেদের কাছ থেকেই শোনা, আর অতীত থেকে স্মরণ করে বলা। আবার এই ১১০ জন রোগীর উপর যে ভিন্ন ভিন্ন রকমের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা নয়। সেটা হলে বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতির প্রভাব নিয়ে মন্তব্য করা যেত। আবার এই গবেষণায় কেবল বিষণ্ণতা নিয়েই কাজ করা হয়েছে, শিশু নির্যাতনের প্রভাবে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় অনেকে যে ট্রমারও শিকার হন তা নিয়ে এই গবেষণায় কিছু নেই। গবেষকগণ স্বীকার করছেন যে এই বিষয়ে আরও অনেক কাজ করার আছে তাদের। কিন্তু তারপরও বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে এই গবেষণার মূল্য অনেক। এর উপর ভিত্তি করেই একদিন হয়তো শিশু নির্যাতনের শিকার হওয়া বিষণ্ণতার রোগীদের জন্য আলাদাভাবে আরও ভাল কোন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হবে।
তথ্যসূত্র:
১। https://www.thelancet.com/journals/lanpsy/article/PIIS2215-0366(19)30044-6/fulltext
২। https://medicalxpress.com/news/2019-03-childhood-trauma-affect-brain-predisposing.html
৩। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/22112927
Leave a Reply