কখনও একসাথে কয়েকটি কাজ করার চেষ্টা করে দেখেছেন? কেমন লাগে এভাবে কয়েকটা কাজ একসাথে করতে? গোলমাল লাগে? নাকি লাগে না?
একসাথে কয়েকটা কাজ করাকে বলা হয় “মাল্টিটাস্কিং”, আর কাজ করতে গিয়ে যে গোলমাল লাগে, গবেষকগণ তাকে বলছেন “ইন্টারফিয়ারেন্স”। কিন্তু গবেষকগণ হঠাৎ করে এই ব্যাপারগুলোর এরকম নামকরণ করতে গেলেন কেন? এটা নিয়ে কোন কাজ হয়েছে কী? হুম হয়েছে বৈ কি… গত বছরেই এটা নিয়ে একটা পেপার দেখেছিলাম। সেদিন একজনের সাথে কথা হল, বললেন তিনি নাকি সবসময় মাল্টিটাস্কিং করেন, এটা নাকি তার বদ অভ্যাস। আমি বললাম, আরে এখানে বদ অভ্যাসের কিছু নেই, অনেকেই এটা ভালোভাবে করতে পারেন। আর নারীরা এক্ষেত্রে পটু (তিনি নারীই ছিলেন)। এরপর তিনি বিষয়টা নিয়ে লিখতে বলায় আজকের এই লেখাটি. লেখা আরকি…
যাই হোক সেই গবেষণার দিকে ফিরে যাওয়া যাক। সেটায় বলা হচ্ছে, একাধিক কাজ করার ক্ষেত্রে কাজগুলোর মধ্যে যে ইন্টারফিয়ারেন্স তৈরি হয় তা পুরুষের তুলনায় নারীকে কম প্রভাবিত করে। অর্থাৎ একজন নারীর পক্ষে মাল্টিটাস্কিং করা সহজ, কিন্তু পুরুষকে এটা করতে গেলে প্রায়ই হয়তো আটকে যেতে হবে। পেপারটিতে আরও বলা হয়, নারী ও পুরুষের এই বিশেষ আচরণগত পার্থক্যের ক্ষেত্রে হরমোনসমূহ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে।
আমরা জানি, পুরুষের ক্ষেত্রে এস্ট্রোজেন এর মাত্রা অনেক কম থাকে, অন্যদিকে মেনোপোজের পূর্বে নারীর ক্ষেত্রে এই হরমোনটির আধিক্য দেখা যায়। গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষেরা যদি হাঁটতে হাঁটতে কোন কঠিন বাচনিক বা ভার্বাল কাজ করেন, তাহলে ইন্টারফিয়ারেন্সের কারণে তাদের হাঁটার ধরণে পরিবর্তন হয়ে যায়। এদিকে যেসব নারী মেনোপোজে পৌঁছাননি, তাদের বেলায় হাঁটতে হাঁটতে কোন ভার্বাল টাস্ক করার সময় কোন রকম ইন্টারফিয়ারেন্স লক্ষ্য করা যায় নি।
বিজ্ঞানমহলে একটা হাইপোথিসিজ বেশ প্রচলিত ছিল। এটা অনুসারে, মানুষের ডান হাত দোলানোর কাজটি নিয়ন্ত্রণ করে মানব-মস্তিষ্কের বাম অর্ধাংশ বা লেফট হেমিস্ফিয়ার, যদি মস্তিষ্কের এই অংশটিকে অন্য কোন কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে এই কাজটি ডান হাত দোলানোর কাজকে বাঁধা দেবে, কারণ মস্তিষ্কের সেই অঞ্চলের কিছু অংশ এখন আরেকটি কাজ করছে। যাই হোক, এই হাইপোথিসিজটির সত্যতা কতটুকু, তা জানতেই গবেষণাটি করা হয়েছিল। এটি রয়াল সোসাইটি ওপেন সায়েন্স জার্নাল -এ এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। গবেষকগণ অবাক হয়ে দেখলেন, এই বাঁধাটি ষাট বছরের বেশি নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে কাজ করে ঠিকই, কিন্তু ষাট বছরের কম বয়সী নারীদের বেলায় বাঁধাটি কাজ করে না।
স্ট্রুপ টেস্ট (The Stroop test)
আমরা হাঁটার সময় আমাদের হাত কিভাবে নড়াচড়া করছে এই বিষয়ে খুব কমই মনোযোগ দেই। হাঁটা আমাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাবার একটি সরল উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে। হাঁটা আর এর সাথে হাত নাড়ানো হল এক ধরণের সেমি-অটোমেটিক এবং উদ্দেশ্যচালিত (goal directed) আচরণ। কিন্তু আমরা যদি কোন কগনিটিভ বা চিন্তার সাথে সম্পর্ক আছে এমন কাজ করি, তাহলে হাঁটার সাথে আমাদের হাতের দোলানোর সঙ্গতিতে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়।
স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি ফিল্ডের নিউরোসায়েন্টিস্টদের একটি দল একটি প্রোজেক্ট হাতে নেয়। কঠিন কাজগুলো করার সময় হাঁটার ক্ষেত্রে এর কিরকম প্রভাব পড়ে এটাকে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তারা আগ্রহী হয়েছিলেন। আর তারা এও জানতে চান, হাঁটার সময় এই অতিরিক্ত কাজগুলো করার ক্ষেত্রে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া বা সমন্বয় তৈরি করা সম্ভব কিনা।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর মনোযোগ কোন বিষয় থেকে সরিয়ে নিতে যে কাজটি করতে দেয়া হয় তাকে স্ট্রুপ টেস্ট বলা হয়। ১৯৩০ এর দশকে জন রিডলি স্ট্রুপ প্রথম এই টেস্টের প্রস্তাব করেন। এখানে অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি রং এর নাম লিখে দেখানো হয়, (যেমন “Green”), কিন্তু সেই শব্দটি অন্য রং এর কালি দিয়ে লেখা থাকে, (যেমন “Green” শব্দটি ধরুন কালো রং দিয়ে লেখা)। এক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীকে কেবল লেখাগুলোর রং কী সেটাই জিজ্ঞেস করা হয়। কিন্তু তারপরও বেশিরভাগ ব্যক্তিই স্বয়ংক্রীয়ভাবেই শব্দটির রং না বলে, শব্দটিকেই পাঠ করেন। মানে, Green শব্দের রং কী জিজ্ঞেস করা হল, উত্তর হবে কালো, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ বললেন এর রং হচ্ছে সবুজ।
এই কাজ বা টাস্কটি হল একধরণের “ইন্টারফিয়ারেন্স” টাস্ক যেখানে মস্তিষ্ককে একই সাথে আসা একাধিক ও প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ স্টিমুলি বা সংবেদ নিয়ে সফলভাবে সঠিক উত্তরটি দিতে হয়। যেমন উপরের টাস্কটিতে একই সাথে বর্ণের নাম ও লেখা নামের রং এর দুটি প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ সংবেদ মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো হয়েছে। তাই এখান থেকে সঠিক উত্তরটি দেয়া হবে একটি ইন্টারফেয়ারেন্স টাস্ক। এই টাস্কটির সময় যে ব্রেইন নেটওয়ার্ক ও স্ট্রাকচার কাজ করে তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করা হয়েছে, এবং এখান থেকে দেখা গেছে যে এই কাজের জন্য সাধারণত মস্তিষ্কের লেফট হেমিস্ফেয়ার বা বাম অর্ধাংশ জড়িত থাকে।
ট্রেডমিলে স্ট্রুপ টেস্ট
এই গবেষণাটিতে ৮৩ জন স্বাস্থ্যবান পুরুষ ও নারীর ট্রেডমিলে হাঁটার প্যাটার্ন পরিমাপ করা হয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন বয়সের ছিলেন। তাদেরকে ২০ থেকে ৪০, ৪০ থেকে ৬০ এবং ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের দলে ভাগ করা হয়। অংশগ্রহণকারীদেরকে এক মিনিটের জন্য ট্রেডমিলে হাঁটতে দেয়া হয়। হাঁটার সময়ে তারা একটি স্ট্রুপ টাস্ক করতে পারেন, আবার কিছু না করে কেবল স্বাভাবিকভাবে হেঁটেও যেতে পারেন।
বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই হাঁটার সময় সিমেট্রি বা প্রাতিসাম্য মেনে তাদের বাম ও ডান হাত দুলিয়েছিলেন। কিন্তু যখনই যেকোন গ্রুপের পুরুষেরা স্ট্রুপ টেস্টে অংশগ্রহণ করেন, তখন দেখা যায় তাদের হাত দোলানোর গতি নাটকীয়ভাবে কমে যায়। একই বিষয় ৬০ বছরের বেশি বয়সের নারীদের বেলাতেও লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে ৬০ এর কমবয়সী নারীদের ক্ষেত্রে দেখা গেল তাদের হাত দোলানোর সিমেট্রি আগের মতই আছে, লক্ষ্যণীয় কোন পরিবর্তনই ঘটেনি। এক্ষেত্রে একটা জিনিস বলে রাখি, ডান হাত আমাদের মস্তিষ্কের বাম দিক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, আর আগেই বলেছিলাম, আমাদের মস্তিষ্কের বাম অংশই স্ট্রুপ টেস্টের সময় সক্রিয় হয়। পুরুষ এবং বয়স্কা নারীদের বেলায়, স্ট্রুপ টেস্টের ফলে তাদের মস্তিষ্ক এতটাই বেশি কাজ করা শুরু করে যে তাদের ডান হাতের গতি কমে যায়।
হরমোনের প্রভাবের কারণে এটি হতে পারে
পুরুষ ও নারীদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জীববিজ্ঞানগত পার্থক্য থাকলেও, তাদের স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও কার্যকারিতাকে প্রায় একই বলে মনে হয়। আর তাই এক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষের আচরণের পার্থক্যের জন্য তাদের মস্তিষ্কের গঠনের ভিন্নতা দাবী করার আগে বিষয়টি আরও গভীরভাগে ক্ষতিয়ে দেখার প্রয়োজন হয়, যে আসলেই এটি মস্তিষ্কের গঠনের পরিবর্তনের কারণেই হয়েছে নাকি হরমোনজনিত পার্থক্যের জন্য হয়েছে। গবেষকগণও তাই করেছেন।
এই পরীক্ষার ফলাফল দেখে মনে হয়েছে যে, এটা প্রমাণ করছে নারীরা পুরুষের চাইতে মাল্টিটাস্কিং-এ ভাল। কিন্তু এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখা জরুরি যে, দুটো বিশিষ্ট আচরণের ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষের মাঝে এই আচরণগত পার্থক্যটি দেখা গেছে। এদের একটি ছিল ভারবাল ইন্টারফেরেন্স টাস্ক বা বাচনিক ব্যাতিচারী কার্য এবং আরেকটি ছিল হাঁটার সময় হাত দোলানো।
যাই হোক, গবেষকগণ মনে করেন, প্রিমেনোপোজাল নারীদের (মেনোপোজ হয় নি এমন নারী) মধ্যে ইন্টারফেরেন্স রেজিস্টেন্স বা ব্যাতিচার প্রতিরোধী আচরণের জন্য তাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ জড়িত যা স্ট্রুপ টাস্ক এবং হাত দোলানোর ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়। এই অংশটি হল মস্তিষ্কের সামনের দিকের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশ (বাম অংশে)। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হচ্ছে মস্তিষ্কের একটি জটিল অঞ্চল। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় যার উদ্ভব হয়েছে অনেক পরে, কাজেই একে মানবদেহের তুলনামূলকভাবে একটি নতুন অঞ্চল বলা যায়। এটি একই সাথে আমাদের চিন্তাবিষয়ক নিয়ন্ত্রণ বা কগনিটিভ কন্ট্রোল এবং হাঁটার কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত বলে মনে করা হয়।
এবারে আরেকটি নতুন কথায় আসি। অনেক এভিডেন্স আছে যা বলে মস্তিষ্কের এই প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশে এস্ট্রোজেন রিসেপ্টর বা এস্ট্রোজেন গ্রাহকের উপস্থিতি রয়েছে। যখন এখানে এস্ট্রোজেন উপস্থিত থাকে, তখন এই এস্ট্রোজেন রিসেপ্টরের উপস্থিতির ফলে মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক পুনর্গঠিত হয়। আর এর ফলেই প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সম্ভবত তখন আরও ভালভাবে কাজ করা শুরু করে। আর এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে নারীদের শরীরে উচ্চমাত্রার এস্ট্রোজেন থাকে। সুতরাং এটা ইঙ্গিত করছে যে, মাল্টিটাস্কিং নিয়ে নারী ও পুরুষের আচরণের এই পার্থক্যটি তাদের মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও কার্যকারিতার পার্থক্যের জন্য হয় নি, হয়েছে নারী ও পুরুষের হরমোনগত পার্থক্যের জন্য। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নারীদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে যেমন এস্ট্রোজেন রিসেপ্টরের উপস্থিতি আছে বলে মনে করা হয়, একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। তাই পার্থক্য শুধু এখানেই যে, নারীদের দেহে উচ্চমাত্রার এস্ট্রোজেন থাকে।
যাই হোক, এটাই সম্ভবত ব্যাখ্যা করে যে, কেন উচ্চমাত্রায় এস্ট্রোজেন থাকা তরুণ নারীরা অন্তত তাদের মাসিকচক্রের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, তাদের হাত দোলানোকে প্রভাবিত না করেই পুরুষ ও বয়স্কা নারীদের চেয়ে ভালভাবে তাদের মস্তিষ্কের বাম প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে স্ট্রুপ টাস্ক পরিচালনা করতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগো এর ডঃ জিসবার্ট স্টোয়েট আর ইউনিভার্সিটি অফ হার্টফোর্ডশায়ার এর প্রফ. কেইথ লজ মিলে মিলে ২০১৩ সালে বিএমসি সাইকোলজি জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশ করেন যা মাল্টিটাস্কিং বিষয়ক জেন্ডার ডিফারেন্স সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় হাজির করে। জেন্ডার ও মাল্টিটাস্কিং নিয়ে করা পূর্বের গবেষণাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়। চীনের একটি গবেষণায় দেখা যায় মাল্টিটাস্কিং এ নারীরা পুরুষের চাইতে ভাল আবার সুইডেনে আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, যখন মাল্টিটাস্কিং-এ স্থানগত বা স্পেশাল টাস্ক যুক্ত হয় তখন নারীর চেয়ে পুরুষের পারফরমেন্স ভাল থাকে।
এই বিতর্কের অবসানের জন্য ডঃ জিসবার্ট এবং তার একজন সহকর্মী মিলে একটি বিশেষ রকমের মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের আচরণের মধ্যে পার্থক্য বের করার কাজ করেন। এই মাল্টিটাস্কিং-এ খুব দ্রুত একটার পর একটা কাজের পরিবর্তন বা টাস্ক সুইচিং এর ব্যাপার জড়িত থাকে, কিন্তু এগুলোকে একই সাথে করতে হবে এমন নয়। এক্ষেত্রে একজন অফিস ওয়ার্কারের কাজই ধরুন, তাকে বারবার একটার পর আরেকটা কাজে চলে যেতে হয়, তিনি একবার তার ই-মেইল চেক করেন, একবার ফোন কল রিসিভ করেন, তারপর আবার তার অ্যাসাইনমেন্টগুলো করেন, আবার একবার মিটিং-এ যান ও মিটিং থেকে বের হয়ে আসেন। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে বাসায় বাবা মাকে তাদের সন্তানকে দেখাশুনা করতে হয়, আর তার মধ্যেই হঠাৎ করে ফোন কল ধরতে হয়, বা অন্যান্য কাজ করতে হয়। এগুলো একই সাথে যে করতে হয় তেমন না, একটার পর একটা করা যায়।
গবেষকগণ প্রথমে ১২০ জন পুরুষ ও ১২০ জন নারীর মধ্যে একটি কম্পিউটার টেস্ট নেন, সেখানে বিভিন্ন টাস্কের মধ্যে পরিবর্তন বা সুইচ করার ব্যাপারটি জড়িত ছিল৷ এই টাস্কগুলো ছিল মূলত গণনা আর আকার চিহ্নিতকরণের। যখন একবারে একটি কাজই করতে হচ্ছিল তখন নারী ও পুরুষ সমান পারদর্শিতা দেখাচ্ছিলেন৷ কিন্তু যখনই টাস্কগুলোকে মিক্স আপ করে একই সময় একাধিক টাস্ক করার ব্যবস্থা করা হল, তখন একটা পরিস্কার পার্থক্য সামনে চলে আসল৷ এক্ষেত্রে টাস্কগুলো আগের চেয়েও দ্রুত সুইচ করতে হয়। আর তাই নারী ও পুরুষ উভয়েই এর সাথে ভালোভাবে তাল মিলিয়ে উঠতে না পেরে আগের চেয়ে ধীর হয়ে যান, সেই সাথে তারা আগের চাইতে বেশি পরিমাণে ভুলও করতে থাকেন। কিন্তু পুরুষেরা নারীদের থেকে বেশি ধীর হন৷ দেখা যায় এক্ষেত্রে পুরুষেরা সারা প্রদানে ৭৭% বেশি সময় নিচ্ছে, আর নারীরা সময় নিচ্ছে ৬৯ শতাংশ বেশি। মনে হতে পারে এই ৭৭% আর ৬৯% এর পার্থক্যটা কী আর এমন। কিন্তু ডঃ স্টোয়েট বলছেন, এই পার্থক্যটাকে নগন্য বলে মনে হলেও, তারা যখন একসাথে অনেকগুলো কাজ করেন আর অনেক সময় ধরে কাজ করেন, তখন অনেকগুলো কাজ মিলে পার্থক্যটাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়।
গবেষণাটিকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করার জন্য গবেষকগণ আরেকটি টেস্ট করেন। এখানে নারী ও পুরুষ সবাইকে অনেকগুলো টাস্ক সম্পন্ন করার জন্য আট মিনিট সময় দেয়া হয়। এর মধ্যে ম্যাপ দেখে রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করা, সরল গাণিতিক সমস্যা সমাধান, ফোন কলের উত্তর দেয়া, আর মাঠে হারিয়ে যাওয়া চাবি খুঁজে বের করা – এসব ছিল। এতগুলো কাজ মাত্র ৮ মিনিটে শেষ করা অসম্ভব ছিল, আর তাই এর ফলে নারী ও পুরুষ উভয়কেই তাদেরকে দেয়া টাস্কগুলোর মধ্যে প্রায়োরিটাইজ বা কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হবে তা ঠিক করতে হয়, তাদের সময়কে অরগানাইজ করতে হয় আর চাপের মধ্যেও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
হার্টফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফ. কেইথ লজ বলেন, দেখা যায় বিশেষ করে চাবি খোঁজার কাজে নারীরা পুরুষের চেয়ে পরিষ্কারভাবে ভাল পারফরমেন্স দেখাচ্ছে। নিচের চিত্রটিতেই নারী ও পুরুষের চাবি খোঁজার প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে। নারীরা একটি পদ্ধতিগত অনুসন্ধান নকশা অনুসরণ করে, যেমন তারা কনসেন্ট্রিক রেকট্যাঙ্গল বা সমকেন্দ্রিক আয়ত কল্পনা করে তারপর চাবি খোঁজা শুরু করে। আর এটা হারিয়ে যাওয়া কোন কিছু খুঁজে পাবার জন্য একটি উচ্চমাত্রার ফলপ্রসু কৌশল। অন্যদিকে কোন কোন পুরুষ কোন উপায়েই পুরো মাঠটির সবটুকু অঞ্চল খুঁজে দেখেনও নি। প্রফ লজ আরো বলেন, এরকম পার্থক্যের প্রধান কারণটি হচ্ছে নারীরা চাপের মধ্যে বেশি অরগানাইজড থাকে। নারীরা শুরুতেই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে অধিক সময় ব্যয় করে, যেখানে পুরুষেরা কিছুটা ইম্পালসিভনেস দেখায়, এবং খুব দ্রুত কোন কাজে ঢুকে পড়ে। এটা সাজেস্ট করছে যে, কোন চাপের ও জটিল পরিস্থিতিতে নারীরা পুরুষদের থেকে বেশি ভাবনা চিন্তা করে এগোন। আর এই গবেষণা ডঃ স্টোয়েট ও প্রফ. লজ মিলে এই উপসংহারে পৌঁছান যে, মাল্টিটাস্কিং-এ নারীরা পুরুষের থেকে এগিয়ে।
প্রফ. লজ বলেন, এই গবেষণার ফলাফলের সাথে অনেক পুরুষকেই আপত্তি জানাতে দেখা যায়। তারা বলেন, ফলাফলটি নাকি তাদের অভিজ্ঞতার সাথে যায় না, তারা দেখান যে, কত কত বিখ্যাত পাইলট বা অন্যান্য পেশার লোকজন কি সফলতার সাথে কম সময়ের মধ্যে কত কত জটিল টাস্কের সাথে ডিল করত। লজ তাদের বলেন, অবশ্যই অনেক এক্সপার্ট পুরুষ আছেন, আর গবেষকগণ এটা দাবী করছেনও না যে পুরুষেরা মাল্টিটাস্কিং করতে পারেন না, বা কেবল নারীই মাল্টিটাস্কিং করতে পারেন। বরং তারা বলছেন, সময় ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন কাজ সুইচ করার ক্ষেত্রে গড়পড়তায় একজন নারী, একজন পুরুষের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। আর মাল্টিটাস্কিং-এ যে নারী ও পুরুষের আচরণে পার্থক্য পাওয়া যাচ্ছে তা অস্বীকার করার কোন রাস্তাই নেই।
চাইনিজ একাডেমির মনোবিজ্ঞানী ডঃ ডংগিং রেন জানান, তিনি নিজেও এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। আর ডঃ স্টোয়েট ও প্রফ. লজ এর এই গবেষণাটি নিঃসন্দেহে এই বিতর্কটিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তবে ডঃ রেন মনে করেন, নির্দিষ্ট কিছু কাজে পুরুষেরাও এগিয়ে থাকতে পারে। এটা হয়তো কাজগুলোর প্রকৃতি, অর্থাৎ সেগুলো ক্রমান্বয়ে করা হচ্ছে নাকি একসাথে করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করবে। তবে মাল্টিটাস্কিং নিয়ে এই আবিষ্কারের প্রয়োগ বা সম্ভাবনা নিয়ে প্রফ. লজ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “আমাদের সমাজে অফিসে মাল্টিটাস্কিং এর চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। আমাদের উচিৎ প্রতিটি মানুষকে তাদের সামর্থ অনুযায়ী ভূমিকাগুলো গ্রহণে সাহায্য করা… তবে অবশ্যই আমি এটা মনে করি না যে যেখানে দ্রুত টাস্কগুলো সুইচ করতে হয় সেখানে আমাদের কেবল নারীদেরকেই নিয়োগ দেয়া উচিৎ। বরং এক্ষেত্রে নারী পুরুষ বিচার না করে এমপ্লয়ারদেরকে আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকের মাল্টিটাস্কিং এর এবিলিটি পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন, যা ইতিমধ্যেই অনেক ফার্ম শুরু করেছে… কারণ সত্য এই যে মানুষ নিজে নিজেই খুব একটা ভালভাবে নিজেদেরকে বিচার করতে পারে না। গবেষণা দেখায়, পুরুষেরা নিজেদেরকে মাল্টিটাস্কিং-এ তারা যেমন তার তুলনায় বেশি ভাল বলে মনে করে, অন্যদিকে নারীরা মাল্টিটাস্কিং-এ তারা যেমন তার থেকে খারাপ বলে মনে করে।”
কিন্তু কেনই বা নারীরা মাল্টিটাস্কিং-এ পুরুষের থেকে এগিয়ে?
গবেষণায় যে ফলটি পাওয়া যাচ্ছে তার একটি কারণ হতে পারে “লার্নিং এফেক্ট” – যেখানে মানুষ অনুশীলনের দ্বারা দক্ষ মাল্টিটাস্কারে পরিণত হয়। যেহেতু আমাদের সমাজে নারীদেরকে ছোটবেলা থেকেই পুরুষের তুলনায় বেশি মাল্টিটাস্কিং এর কাজ করতে উৎসাহিত করা হয় (যেমন বিভিন্ন ঘরের কাজ করা, বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, ঘরের কাজে বড়দের সাহায্য করা ইত্যাদি) তাই তারা চর্চার মাধ্যমেই পুরুষের চেয়ে ভাল মাল্টিটাস্কারে পরিণত হয়। কিন্তু এটা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভোল্যুশনারি থিওরি বা বিবর্তনগত তত্ত্বও রয়েছে, যেমন একটি হল হান্টার-গ্যাদারার হাইপোথিসিজ বা শিকারি-সংগ্রাহক অনুকল্প।
এই অনুকল্প অনুসারে মানুষ যখন শিকারী সংগ্রাহক যুগে ছিল তখন পুরুষকে মাল্টিটাস্কিং করতে হত না, তাদেরকে সময় দিতে হত শিকারের কাজে, যা নিঃসন্দেহেই একটি একরৈখিক বা লিনিয়ার টাস্ক। শিকারের কাজে বারবার কাজ সুইচিং করলে চলে না, বরং একটি নির্দিষ্ট কাজেই ধৈর্যের সাথে গভীর মনোযোগ দিতে হয়। শিকার করার জন্য যে ধাওয়া করা ও হত্যা করায় পারদর্শিতা দরকার হয় তার জন্য দ্রুত টাস্ক সুইচিং এর দক্ষতা নয়, বরং একই কাজে মনোযোগী থাকার দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এটা না থাকলে আর যাই হোক, এনিমেল প্রোটিন জুটবে না। অন্যদিকে তখন নারীর ভূমিকা ছিল ঘর সামলানো, বাচ্চাকাচ্চা সামলানো, ফলমূল সংগ্রহ, রান্না করা ইত্যাদি। শিকারি সংগ্রাহক যুগে নারীদেরকে কোন একদিকে নিবিষ্ট চিত্তে মনোযোগ রাখলে চলত না, যখন তখন কোন কারণে সন্তানের প্রাণ সংকটের মুখে পড়তে পারে, আবাসস্থলে হিংস্র কোন প্রাণী হানা দিতে পারে। তাই নারীদেরকে সবসময় সব দিকে কান খাড়া রাখতে হত, সব কিছু নিয়েই সজাগ থাকতে হত, যেটা একরকম মাল্টিটাস্কিং এবিলিটি। এখন বিবর্তনের নেচারাল সিলেকশনের কথায় যদি আসি, তাহলে বলুনতো নারী ও পুরুষ কে কোন বৈশিষ্ট্যটি অর্জন করবে? এই হাইপোথিসিজ অনুসারে নারীরা মাল্টিটাস্কিং-এ আর পুরুষেরা লিনিয়ার কাজে বেশি মনোযোগ দেয়ার দক্ষতা অর্জন করবে। কারণ নারীরা যদি মাল্টিটাস্কিং-এ ভাল হয় তাহলে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভাল করে রক্ষা করতে পারছে, আর পুরুষেরা যদি সব দিকে সজাগ না থেকে একটি দিকে মনোযোগ দেয়ার কৌশল রপ্ত করে তাহলে তারা সহজে শিকার ধরার কৌশল রপ্ত করছে যা গোষ্ঠীকে উচ্চমানের প্রোটিনের উৎস্যের সন্ধান দেবে। সুতরাং প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্যই এই বিশেষ প্রাজাতিক সুবিধা নিয়ে মানুষ বিবর্তিত হবে, আর এভাবেই তৈরি হবে নারী ও পুরুষের মধ্যে এই মাল্টিটাস্কিং এর আচরণের পার্থক্য। ডঃ স্টোয়েট যথার্থই বলেছেন, “নারীরা যদি মাল্টিটাস্ক না করতে পারত, তাহলে আমরা (মানুষেরা) আর টিকেই থাকতাম না”।
তবে মাল্টিটাস্কিং নিয়ে আমাদের নিকটতম আত্মীয় এপ বা নরবানরের সাথে আমাদের যে পার্থক্য তা আসলেই চিন্তা করার মত। এদের মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষমতা মানব-নারী বা মানব-পুরুষ সকলের থেকেই অনেক ভাল। এই ব্যাপারটি এটাই নির্দেশ করে যে মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আর ডঃ স্টোয়েট বলছেন, যদি মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষমতা হারিয়েই ফেলে তাহলে নিশ্চই এর মধ্যে কিছু প্রজাতিগত উপকারিতা নিহিত রয়েছে। ডঃ স্টোয়েট বলেন, মানুষের মধ্যে মাল্টিটাস্কিং ক্ষমতা কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আমাদের কাজের মধ্যে ডিসট্রাকশন কমে আসা। আর এই ডিসট্রাকশন কমে যাওয়ার ফলেই মানুষ এমন সব বিষয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে যা এটা না হলে সম্ভব হত না। এই যেমন ধরুন, আগুন জ্বালানো, এটা জ্বালানোর জন্য সেসময় মানুষকে যে ধৈর্য নিয়ে কাজটা করতে হত, নরবানরের মত মাল্টিটাস্কিং এর এবিলিটি থাকলে মানুষ সেটা করতে পারত না…
ডঃ স্টোয়েটের এই কথা থেকে বলতে পারি, মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষমতায় যেমন ভাল দিক আছে, মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষমতা না থাকাতেও কিছু ভাল দিক আছে। বিবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে নারী ও পুরুষ তাদের সেই প্রাচীন ভূমিকা অনুযায়ী বিভিন্ন জেন্ডার রোলের মত আচরণের ক্ষেত্রে এই জেন্ডার ডিফারেন্সকেও গ্রহণ করে নিয়েছে। আর আমরা যদি পার্থক্যগুলোর ভালো দিকগুলো স্বীকার করে নেই, তাহলে হয়তো সমাজের উপকারই হবে। তবে অবশ্যই তা জেন্ডার স্টিরিওটাইপ তৈরি করে নয়, বরং সমতা সৃষ্টির দ্বারাই নারী ও পুরুষ আপনা আপনিই নিজেদের গুণগুলোর প্রকাশ ঘটাতে পারবে।
তথ্যসূত্র:
১। http://rsos.royalsocietypublishing.org/content/4/1/160993#sec-4
২। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/27574966
৩। https://d2l.deakin.edu.au/d2l/eP/presentations/presentation_preview_popup.d2l?presId=67655
৪। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/10859133
৫। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/24862561
৬। http://www.pnas.org/content/112/50/15468
৭। http://journal.frontiersin.org/article/10.3389/fnhum.2014.00078/full
৮। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/16510735
৯। http://www.biomedcentral.com/2050-7283/1/18
১০। http://ieeexplore.ieee.org/xpls/abs_all.jsp?arnumber=5364739&tag=1
১১। http://pss.sagepub.com/content/24/4/514.abstract
১২। http://psytoolkit.gla.ac.uk/basic/taskswitching
Leave a Reply