প্লাস্টিক দূষণ: এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রধান ফোকাস- পর্ব ২

গত ৫ জুন পরিবেশ দিবস উপলক্ষে এই এই সিরিজের প্রথম পর্বটি লিখেছিলাম। সিরিজের বিষয়বস্তু হিসেবে প্লাস্টিককেই চিহ্নিত করি কারণ প্লাস্টিক দূষনই ছিল এই পরিবেশ দিবসের প্রধান ফোকাস। এরই ধারাবাহিকতায় এখন দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে হাজির হচ্ছি। যাই হোক, গত গত পর্বের লেখাটায় আমার শেষ কথাটি ছিল “গবেষণা এও বলছে যে, যদি এর প্রতিকারের জন্য কিছুই না করা হয়, বা এখন যা চলছে তেমনি যদি চলতে থাকে, তাহলে সামনের ১০ বছরের মধ্যে মহাসাগরে প্লাস্টিকের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে, আর ২০৫০ সালে এই প্লাস্টিকের ভর সকল সামুদ্রিক মাছের ভরের চেয়ে বেশি হবে। তখন মহাসাগরের পরিবেশের কী অবস্থা ঘটবে, আশা করি বুঝতেই পারছেন।” এবার এই দুটি বিষয় দিয়েই পর্বটি শুরু করছি… 

 

২০২৫ সালে মহাসাগরে প্লাস্টিক দূষণ হবে আজকের দূষণের মাত্রার  তিন গুণ!

যুক্তরাজ্যের অফিস ফর সায়েন্সে “Foresight Future of the Sea” শিরোনামে একটি নতুন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে মহাসাগরগুলোর স্বাস্থ্যের অবস্থা তুলে ধরা হয়, সেই সাথে দেখানোর চেষ্টা করা হয় যে এটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে যুক্তরাজ্যের ভূমিকাকে কিরকম প্রভাবিত করবে। রিপোর্টটির মূল কথা এই যে, বর্তমানে সারা বিশ্বের মহাসাগরে ৫.২৫ ট্রিলিয়নেরও বেশি প্লাস্টিকের টুকরা আছে আর এই হারেই প্লাস্টিক সেখানে বাড়তে থাকবে এই বিবেচনায়, ২০২৫ সালে মহাসাগরে প্লাস্টিকের পরিমাণ তিনগুণ হবে।

এই রিপোর্টিতে এটাও উঠে আসে যে, মহাসাগরের বর্তমানে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তা জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আসতে পারে। এছাড়া ১৯৭০ সাল থেকে ২০১২ সালের প্লাস্টিক দূষণের কারণে ইতিমধ্যেই সামুদ্রিক মেরুদণ্ডী প্রানীদের সংখ্যা ৪৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই রিপোর্টটির একজন লেখক ইয়ান বয়েড বিবিসিতে বলেছেন, “The ocean is out of sight, out of mind”। অর্থাৎ মহাসাগরকে আমরা দেখি না, তাই এটা নিয়ে আমরা ভাবিও না। একই সুরে কথা বলেছেন এর আরেকজন লেখক ইউকে ন্যাশনাল ওশিনোগ্রাফি সেন্টারের প্রফেসর এডওয়ার্ড হিল। তিনি বলেন, “আমরা স্পেসের বিভিন্ন মিশনের জন্য প্রচুর অর্থ ইনভেস্ট করি, কিন্তু সেখানে কেউই থাকে না। অথচ মহাসাগরের সিবেড প্রাণের সঞ্চারে পরিপূর্ণ, আমরা সেখানে তেমন ইনভেস্টই করছি না। আমাদের “প্লানেট ওশিন” নিয়েও মিশন হাতে নিতে হবে।”

প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সচেতন হবার সময় এখনই। কারণ এভাবে চলতে থাকলে মাত্র ৭ বছর পর কী ক্ষতিটা হবে তা এই রিপোর্টটাই বলে দিচ্ছে। রিপোর্টটির প্রাইমারি রিকমেন্ডেশনের একটি হচ্ছে নতুন বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক তৈরি করে এবং জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করে প্লাস্টিক দূষণকে কমিয়ে আনা। আর এটা শুধু যুক্তরাজ্য না, সকল রাষ্ট্রের জন্যই প্রযোজ্য। যাই হোক, এই এতটা কষ্ট করে বানানো রিপোর্ট এর ফলাফল খুব একটা ভাল ছিল না। এই রিপোর্ট পাবলিকেশনের পর তা নিয়ে ইউকে সরকার একটা অফিশিয়াল প্রেস রিলিজ ডাকে, আর সেখানে বিশ্বের প্লাস্টিক পল্যুশন নিয়ে তেমন কিছু তো বলাই হয়নি, বরং বলা হয়েছে, “যুক্তরাজ্য সমুদ্র থেকে আরও কি কি মহান সুযোগ সুবিধা (“great opportunities”) লাভ করতে পারে, সেখানেই তারা নজর রাখবে।” (তথ্যসূত্রে প্রেস রিলিজটির লিংক দেয়া হয়েছে) প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সরকারী মহলের এরকম অনীহা নতুন নয়। এরকম ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়, এই পর্বেই এর প্রমাণ পাবেন।

মহাসাগরে প্লাস্টিক দূষণ আউট অফ সাইট বলে আউট অফ মাইন্ড হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্লাস্টিক দূষণের পরিণতি যে কেবল মহাসাগরেই ঘটছে তা নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেই এর ফল আমরা ভোগ করছি। কিছুদিন আগেই স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়েছে চাঞ্চল্যকর আরেকটি রিপোর্ট। সেটা বলছে, বোতলজাত জলের ৯৩ শতাংশতেই নাকি মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কী জিনিস তা গত পর্বে আলোচনা করেছিলাম, দেখা যাচ্ছে মানুষ এখন দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পানীয় জলের সাথে পলিপ্রোপিলিন, নাইলন আর পলিএথিলিন টেরেফথ্যালেটও গ্রহণ করছে। তাই শুধু সামুদ্রিক পাখি আর মাছকেই এই পল্যুশন এফেক্ট করে, তা নয়। এফেক্ট করছে মানুষকেও। তাই এটা বোধ হয় আর খুব বেশি দিন আউট অফ সাইট এন্ড আউট অফ মাইন্ড থাকবে না। যাই হোক, এই বিশেষ রিপোর্ট নিয়ে একটু পরেই বিস্তারিত লিখছি।

 

২০৫০ সালে মহাসাগরে প্লাস্টিক ছাড়িয়ে যাবে মাছের ভরকেও, দরকার প্লাস্টিক রিসাইকলিং, রিইউজিং ও প্লাস্টিক প্রোডাকশনের নতুন পদ্ধতি

এবার আরেকটি রিপোর্টে যাচ্ছি। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি প্লাস্টিক রিসাইকলিং-এ দ্রুত পরিবর্তন না আসে, তাহলে ২০৫০ সালে মহাসাগরে প্লাস্টিকের ভর মাছের ভরের চেয়েও বেশি হয়ে যাবে। হ্যাঁ, এটা বলছে বর্তমান অবস্থাই চলতে থাকবে, এরকম ক্ষেত্রে ২০২৫ সালে মহাসাগরে প্রতি তিন টন মাছের জন্য এক টন প্লাস্টিক পাওয়া যাবে, আর ২০৫০ সালে মাছের ভরের চাইতেও প্লাস্টিকের ভরই বেশি হয়ে যাবে! এলেন ম্যাকআরথার ফাউন্ডেশন থেকে এই রিপোর্টটিই ২০১৬ সালে প্রকাশ করা হয়, আর একে লাঞ্চ করা হয় ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে।

ইকোনমিক ফোরামে প্রকাশিত রিপোর্ট যেহেতু, তাই এখানে প্লাস্টিক পল্যুশন বিষয়ক অর্থনীতিই বেশি ফুটে উঠেছে। এই বিষয়েই আলোচনা করা যাক। রিপোর্টটি বলছে, প্রতি বছর ৯৫ শতাংশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং এর ইকোনমি শুধু মাত্র একবার ব্যবহারের পরেই হারিয়ে যায়, যার মূল্য হবে ৮০ থেকে ১২০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। মাত্র ৫ শতাংশ প্লাস্টিককে রিসাইকল করে আবার ব্যবহারের উপযোগী করে ফিরিয়ে আনা হয়। ৯৫ শতাংশ হারানো প্লাস্টিক এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ চলে ল্যান্ডফিলে যেখানে প্লাস্টিককে মাটি চাপা দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রতি বছর মোট যে প্লাস্টিক উৎপাদন হয়, তার এক তৃতীয়াংশ কোন না কোনভাবে মহাসাগরে চলে আসে।

১৯৬৪ সাল এর পর প্লাস্টিক উৎপাদন ২০ গুণ বৃদ্ধি পায়, আর বর্তমানে এটি বছরে হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪৩ মিলিয়ন টনে। এভাবেই চলতে থাকলে ২০ বছর পর এই উৎপাদন দ্বিগুণ হবে, আর ২০৫০ সালে এটি চারগুণ হবে, কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার করছে, আর ভবিষ্যতে এটা আরও বৃদ্ধি পাবে। এই প্লাস্টিক যেভাবে মহাসাগরে গিয়ে বন্যপ্রাণকে ক্ষতি করে ও প্লাস্টিকগুলো এদের পাকস্থলিতে দেখা যায়, তেমনি মাইক্রোপ্লাস্টিক, যেগুলোকে চোখে দেখা যায় না, সেগুলোকেও মাছেরা গ্রহণ করে, যেগুলোকে আমরা খাই। এছাড়া এরকম অপ্রত্যক্ষভাবে ছাড়াও প্রত্যক্ষভাবেও আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক দ্বারা আক্রান্ত হই, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে কেবল প্লাস্টিকই কিন্তু মহাসাগরে হারিয়ে যাচ্ছে না, সেই সাথে যাচ্ছে বিশাল পরিমাণে ফসিল ফুয়েলও যা এইসব প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। বর্তমানে তেলের মোট গ্লোবাল কনজাম্পশনের ৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিক উৎপাদনের কাজে। এভাবে চলতে থাকলে, আর সব অপরিবর্তিত থাকলে, ২০৫০ সালে তেলের মোট গ্লোবাল কনজাম্পশনের ২০ শতাংশ যাবে এই প্লাস্টিক উৎপাদনে। আর এর ৯৫ শতাংশ হারিয়ে ফেলা মানে হচ্ছে, এই বিশাল পরিমাণে ফসিল ফুয়েলেরও ৯৫ শতাংশ হারিয়ে ফেলা। অর্থাৎ ২০৫০ সালে মোট প্রতি বছর মোট ফসিল ফুয়েলের ২০ শতাংশই প্লাস্টিকের মাত্র একবার ব্যবহারের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে, যাকে পুনর্ব্যবহার করতে পারলে প্লাস্টিকের সাথে ফসিল ফুয়েলও অনেকটাই বেঁচে যেত, কার্বন এমিশনও অনেকটাই কমে যেত। আর এসব কারণেই রিপোর্টটি প্লাস্টিকের ব্যাপারে আমাদেরকে আবার চিন্তা করতে বলছে। এই বিশাল প্লাস্টিক বর্জ নিয়ে আমরা কি করব, আর প্লাস্টিক উৎপাদন ঠিক কোন পথে করব তা নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে বলছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের Dominic Waughray ব্যাখ্যা করেন, এই রিপোর্টটি দেখাচ্ছে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোসিস্টেমে শীঘ্রই একটা বিপ্লব ঘটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আর প্লাস্টিক আমাদের অর্থনীতিকে যেভাবে প্রভাবিত করছে তার অবস্থা কিভাবে পালটে দেয়া যায় তা অনুসন্ধানে এই রিপোর্টটি প্রথম পদক্ষেপ। এই অন্তর্দৃষ্টিকে বৃহৎ কার্যক্রমে পরিণত করতে গেলে কারও একার অবদান যথেষ্ট নয়। পাবলিক, প্রাইভেট উভয় সেক্টর, সিভিল সোসাইটি সকলকেই নতুন সারকুলার প্লাস্টিক ইকোনমি তৈরি করার কাজে এগিয়ে আসতে হবে।”

এর সমাধানটি সহজ নয়। সমস্যাটা হচ্ছে, এখন তেলের দাম অনেক কম, যেকারণে পুরনো প্লাস্টিককে রিসাইকল করার চেয়ে নতুন প্লাস্টিক উৎপাদন করাটা সাশ্রয়ী হয়। আর এখন উন্নয়নশীল বিশ্বে ইকোনমি বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে সমান তালে প্লাস্টিকের মারকেটও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেকারণে এখন প্লাস্টিকের চাহিদা তুঙ্গে। আর এসব কারণে প্লাস্টিক রিসাইকলিং-এ ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করা যাচ্ছে না। তবে এর কিছুটা সমাধান আসতে পারে যদি কিভাবে প্লাস্টিককে আমরা ব্যবহার করব, এটা নিয়ে সাধারণ মানুষ নতুন করে ভাবে। প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার যদি কমিয়ে ফেলা হয়, আর আমরা যদি যতটা সম্ভব প্লাস্টিক এর রিইউজ করি (একবারের বদলে বারবার ব্যবহার, রিইউজ ও রিসাইকল এক নয়) তাহলে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও ডিমান্ড অনেক কমে আসবে, আর তাতে কমে আসবে প্লাস্টিক প্রোডাকশনও। প্লাস্টিক উৎপাদকরাও এমনভাবে প্লাস্টিক তৈরি করতে পারেন, যাতে একে রিইউজ বা পুনর্ব্যবহার করা যায়, এছাড়া এরা পচনযোগ্য প্লাস্টিকও প্রস্তুত করতে পারে। যেভাবেই হোক, আমরা আজ যেভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার করছি, এই সমাধানগুলো তার বিশাল পরিবর্তন সাধন করতে পারে।

খেয়াল করে দেখুন, এখানে প্লাস্টিক ব্যানিং, প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করার উপর জোড় দেয়া হয়নি। প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একরকম অবিচ্ছেদ্য। প্যাকেজিং এর জন্য বা বিভিন্ন টেকনোলজির সুবিধা পেতে আমাদেরকে প্লাস্টিক ব্যবহার করতেই হয়। এখান থেকে বের হয়ে আসার কোন উপায় নেই। আর তাই রিপোর্টে রিকমেন্ড করা হচ্ছে প্লাস্টিক রিইউজ, রিসাইকলিং ও কম্পোস্টেবল বা পচনশীল অ রিইউজেবল বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদনেই। শুধু এই রিপোর্ট নয়, এখন এরকম সমাধানের পথে এগোনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে সব জায়গায়। একটু পরে জি৭ সম্মেলনে উঠে আসা ওশিন প্লাস্টিক চার্টারেও এটাই দেখা যাবে। সমাধানের এই পথগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে পৃথিবী ধীরে ধীরে প্লাস্টিক দূষণ থেকে রক্ষা পেতে পারে।

 

প্রধান ব্র্যান্ডগুলোর বোতলজাত জলের ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ

একটু আগেই বলেছিলাম, প্লাস্টিক দূষণ কেবল মহাসাগরের প্রাণীরই ক্ষতি করছে না, ক্ষতি করছে আমাদেরও। নিউ ইয়র্কের স্টেড ইউনিভার্সিটি এর একটি রিপোর্টে এটাই সামনে উঠে আসছে। এখানে উঠে এসেছে যে বোতলজাত জলের ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ এর চিহ্ন ধরা পড়েছে! এই দুষণীয় পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে পলিপ্রোপিলিন, নাইলন এবং পলিথিলিন টেরেফথেলেট। ৫টি ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে পাঠানো ১১টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোট ২৫৯টি বোতল পরীক্ষা করে এটা পাওয়া যায়।

গবেষকগণ ইনফ্রারেড মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে জলে মাইক্রোপ্লাস্টিক অনুসন্ধান করেছেন। দেখা যায় এখানে প্রতি লিটারে গড়ে ১০.৪টি করে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায় যার আকার মোটামুটি ০.১ মিলিমিটার মাত্রার। পূর্বে ট্যাপের জলের মাইক্রোপ্লাস্টিক এর সন্ধান করে যে রেজাল্ট পাওয়া গিয়েছিল বোতলজাত জলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি (ট্যাপের জল নিয়ে পরে লিখব)। অবশ্য এই সংখ্যাটা গড়ে বের করা, কোন কোন ক্ষেত্রে এর চেয়ে কম মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, আবার কোন কোন জায়গায় এর চেয়েও বেশি।

রিপোর্টটিতে অবশ্য আরেক ধরণের ক্ষুদ্র পারটিকেলের কথা বলা হয়েছে। প্লাস্টিক এর সাথে লেগে যায় এমন রঙ ব্যবহার করে একে চিহ্নিত করা গেছে। বোতলজাত জলে এর পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিকের চেয়েও অনেক বেশি, প্রতি লিটারে প্রায় ৩২৫টি করে। কিন্তু এখনও এটা পরিষ্কার নয় যে এগুলো আসলেই প্লাস্টিক কিনা, এরা আসলে যে কী তাও মাইক্রোস্কোপে নিশ্চিত করা যায় নি।

যাই হোক, এই রিপোর্টটি বলছে, বোতলজাত জলের এই দূষণের একটা অংশ আসছে বোতলের প্যাকেজিং ও প্রোসেসিং বা উৎপাদন থেকেই। যেসব ব্র্যান্ডের জলে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে আছে Nestle Pure Life, Dasani, Gerolsteiner, E-Pura, Evian, Aquafina এর মত আরও বিখ্যাত সব ব্র্যান্ড।

প্লাস্টিক দূষণের ব্যাপারে আমরা এখন কমবেশি সকলেই অবগত হলেও, মানুষের স্বাস্থ্যে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ কী প্রভাব ফেলে তা এখনও অনিশ্চিত। এর কারণ হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যে এর প্রভাব নিয়ে খুব একটা গবেষণা হচ্ছে না, আর এখনও আমরা জানিনা যে দীর্ঘ দিন ধরে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করতে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যে কী প্রভাব পড়ে। কিন্তু এটা বোঝাই যায় যে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের সর্বব্যাপীতা, সব পানীয় জলে, এমনকি নুন বা খাবার লবনেও এর উপস্থিতি (পরে এটা নিয়ে লিখব) ভাল কিছু নয়। সৌভাগ্যের কথা এই যে, এই রিপোর্ট দেখে ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (WHO) ঘোষণা করেছে যে, তারা খাবার জলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির দীর্ঘ মেয়াদী ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করবেন।

বর্তমানে শুধু মানুষের উপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নয়, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়েও আমাদের ধারণা খুব একটা স্পষ্ট নয়। গবেষকগণ এখন সামুদ্রিক প্রাণী কতটা মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছে, আর এটা তাদের স্বাস্থ্যে কী প্রভাব গেলে সেটা নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। প্রাণীদের স্বাস্থ্যের উপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিষাক্ত প্রভাবের সম্ভাবনা আছেই, কিন্তু এটা এদের জন্য কতখানি বিপজ্জনক তা বের করার জন্য আরও গবেষণা দরকার।

 

প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে তৈরি জি৭ এগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করল না যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান

জি৭ সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই অবগত। কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে জি৭ (Group of Seven) গঠিত। পৃথিবীর ৬২% গ্লোবাল নেট ওয়েলথ (২৮০ ট্রিলিয়ন ইউএসডি) ও ৪৬ শতাংশ জিডিপি (পিপিপি বিবেচনায় নিলে ৩২%)  এই কয়েকটি দেশ রিপ্রেজেন্ট করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও এখানে যুক্ত। পূর্বে রাশিয়া এখানে যুক্ত ছিল, তখন একে জি৮ বলা হত, কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া এখান থেকে বের হয়ে যায়। যাই হোক, এই মাসের (জুন, ১৮) ৮-৯ তারিখ কানাডার লা মালবেতে অনুষ্ঠিত হয় ৪৪তম জি৭ সম্মেলন। এখানে এই ৭ দেশের প্রধান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রধানদ্বয় উপস্থিত ছিলেন।  আমন্ত্রিত অতিছি ছিলেন বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, হাইতি, নরওয়ে সহ ১২টি দেশের প্রধানগণ, ইউনাইটেড ন্যাশনস, বিশ্বব্যাংক, ওইসিডি, ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড এর প্রধানগণও।

দুইদিনের এই সম্মেলন কেমন ছিল তা হয়তো এতক্ষণে জেনে গেছেন। সম্মেলন বিষয়ক আলোচনাগুলোর কেন্দ্রে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য দেশের বাণিজ্যবিরোধ, ট্রাম্প-ট্রুডো দ্বন্দ্ব, ট্রাম্পের সম্মেলন ছেড়ে চলে যাওয়া ও তার টুইটবার্তা। এখানে যে ছবিটি দেয়া হল তা পৃথিবীর ডিপ্লোমেটিক ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই ছবিকে অনেকেই তুলনা করছেন রেনেসাঁর চিত্রকর্মের সাথে।

যাই হোক, এই চাঞ্চল্যকর সব আলোচনার মধ্যে যে বিষয়টি একরকম হারিয়ে গেছে তা হল, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান জি৭ এর ওশিন প্লাস্টিক চার্টারে স্বাক্ষর করেনি, যেটা পূর্ণাঙ্গ জি৭ ব্লুপ্রিন্ট এর একটি অংশ ছিল। মিডিয়ায় এই ওশিন প্লাস্টিক চার্টার জি৭ এগ্রিমেন্ট নামে পরিচিতি পেয়েছে (অনেকটা প্যারিস এগ্রিমেন্ট এর সাথে মিলিয়ে)। এই চার্টারের ফুটনোটে যুক্তরাষ্ট্রের সামান্য কিছু প্রতিনিধিত্বের কথা লেখা হয়েছে এভাবে, “যুক্তরাষ্ট্র মহাসাগর, সাগর এবং উপকুলীয় গোষ্ঠীকে সাপোর্ট করে।” যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র এরকম কিছু করবে তা হয়তো আঁচ করা গিয়েছিল, ট্রাম্প প্রশাসন বলে কথা, কিন্তু হতাশার খবরটি হল জাপানও এটি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে। কানাডা এর সংবাদ সংস্থা দ্য গ্লোব এন্ড মেইল জানায়, জাপানের এই স্বাক্ষরে প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি এই মুহূর্তে অস্পষ্ট।

এটা পরিষ্কার যে, আমরা মহাসাগরে বর্জ্য ফেলছি আর তার মাধ্যমে মহাসাগরের পরিবেশেরও অনেক ক্ষতি করছি। জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষিজ কীটনাশক-সার ও শিল্পবর্জ্য মিলে মহাসাগরের অক্সিজেন কমিয়ে দিচ্ছে, সেখানকার প্রাণের ক্ষতি করছে, তার উপরে আছে প্লাস্টিক, যা মহাসাগরীয় মোট বর্জ্যের ৭০ শতাংশ, যার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে, এবং মহাসাগরীয় বাস্তুসংস্থানের ক্ষতিও করে চলেছে। সেই সাথে আছে সমুদ্র থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে মাছ ধরা, যার ক্ষতিও জীববৈচিত্র্যের জন্য অনেক বেশি, সেই সাথে কোন রাষ্ট্রের তার জনগণের খাদ্যের জোগান দেবার ক্ষমতাও এই অতিরিক্ত মাছ ধরা বা ওভারফিশিং কমিয়ে দেয়। এতগুলো সমস্যার মাঝে প্লাস্টিক সমস্যাটি অনেক দেরি করে সকলের নজরে এসেছে, আর এটার মাতাত্মক প্রভাব দেখে সম্প্রতি অনেক গবেষণা, আলোচনা শুরু হয়েছে এটা নিয়ে। ইউনাইটেড ন্যাশনসও এটা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং আগ্রহের সাথে বিষয়টি দেখছে। যাই হোক, এই সমস্যাটি সমস্ত পৃথিবীরই সমস্যা যার মোকাবেলা করতে হবে সকল রাষ্ট্রকেই, তাই কোন একটি দেশের পদক্ষেপই এর জন্য যথেষ্ট হবে না। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত- প্রত্যেকটি দেশকেই এখানে এগিয়ে আসতে হবে, আর তাই জি৭ সম্মেলনের মত আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলো এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য এত গুরুত্বপুর্ণ, যেখানে অনেকগুলো রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে ঐকমত্যে পৌঁছবে এবং নির্দিষ্ট কিছু চুক্তি সকলেই স্বাক্ষর করে সেই উদ্দেশ্যে নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করবেন।

গত বছর ডিসেম্বরে (ডিসেম্বর, ১৭) একটি সভা হয়েছিল। জাতিসংঘ মহাসাগরে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করতে একটি রেজোল্যুশনের জন্য রাজি হয়, আর সকল দেশকেই এর জন্য এগিয়ে আসতে বলে। মহাসাগরে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধের জন্য এটাই হত প্রথম পদক্ষেপ, সকল দেশের জন্য এটা বন্ধের জন্য একটি সময়সীমা বেঁধে দেয়া হত। কিন্তু এই প্রস্তাবটি দুর্বল হয়ে যায় একটি দেশের প্রতিরোধে… যুক্তরাষ্ট্র, আর কে? (পরের পর্বে এটা নিয়ে আলোচনা করব)।

জি৭ এর ওশিন প্লাস্টিক চার্টার যে সব দেশে আইনগতভাবে বলবৎ হবে তা নয়, কিন্তু এটা কিছু আশার জন্ম দেয়। প্লাস্টিক আমাদের জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়তো কিছুই না, কিন্তু আমাদের এটার ব্যবহার ও পরিবেশে তার পরিত্যাগ করা পরিবেশ, জীবন ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এরই প্রতিক্রিয়ায় জি৭ এর দেশগুলোর মধ্যে কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্লাস্টিক নিয়ে আরও কার্যকরী ও টেকশই পন্থা অবলম্বন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এই প্রতিশ্রুতিগুলোতে অনেক কিছুই আছে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে কিছু যদি বলতে চাই তাহলে প্রথমত বলতে হয়, তারা ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিককে ১০০ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য (reusable), পুনর্প্রস্তুতযোগ্য (recyclable), পুনরুদ্ধারযোগ্য (recoverable) বানাতে চান, যা ভবিষ্যৎকে একবার ব্যবহার করা প্লাস্টিক থেকে মুক্ত করবে। অনেক দেশই বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে কিছু আকারে প্লাস্টিককে একবার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেছে। দ্বিতীয়ত, তারা আঞ্চলিক সচেতনতা সৃষ্টি ও গবেষণার দ্বারা প্লাস্টিকের পুনর্প্রতিগ্রহণ (recapture – প্লাস্টিকের ব্যবহার শেষে ফেলে দেবার পরে তা সংগ্রহ করা) ও পুনর্প্রসুত (recycle) করতে এবং সামুদ্রিক ও মানব স্বাস্থ্যে প্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে গবেষণা ও তদন্দকে উৎসাহিত করতে চান।

একই সময়ে, জি৭ সম্মেলনের ইশতেহারে উঠে আসে যে, আমাদের বর্জ্য সংক্রান্ত অভ্যাসগুলো মূল্যবোধ, সম্পদ ও শক্তির জন্য ক্ষতিকর। এটা আসলেই সত্য, এবং এর জন্যই এখন এই বিষয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। কেউ কেউ যুক্তি দেন বায়োপ্লাস্টিক এর প্রচলন একটা সমাধান হতে পারে, যদিও এখনও এগুলো পরিত্যাগের পর কিছু মাত্রায় বর্জ্য হয়ে থাকে। আবার অনেকে অনুকল্পিত অসীম পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলিমার (ইনফিনিটলি রিইউজেবল পলিমার, পরে আলোচনা করব) এর কথা বলে, যা এখনও প্রুফ-অফ-কনসেপ্ট স্টেজে আছে। যাই হোক, এই চার্টার সকল বিকল্প সম্ভাবনা নিয়ে আরও বেশি করে গবেষণার কথাই বলে। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, প্লাস্টিক ব্যান করার কথা কোথাও বলা হচ্ছে না। টেকশই উন্নয়ন বা সাস্টেইনেবল ডেভলপমেন্ট এবং প্লাস্টিক ব্যবহার করেই দুষণহীন পৃথিবী সৃষ্টির কথা ভাবা হচ্ছে। তথ্যসূত্রে এই ওশিন প্লাস্টিক চার্টারের নথিটির লিংক দেয়া হল। সেখানে মহাসাগরে প্লাস্টিক বিষয়ক প্রতিশ্রুতিগুলোকে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: 1. Sustainable design, production and after-use markets, 2. Collection, management and other systems and infrastructure, 3. Sustainable lifestyles and education, 4. Research, innovation and new technologies, 5. Coastal and shoreline action. আগ্রহীগণ পুরোটা পড়ে দেখতে পারেন।

এই চার্টার কিছু আশাবাদী কথা বলছে, কিন্তু উন্নতির জন্য এখন অনেক কিছুই করতে হবে। কোন কোন পরিবেশবাদী ইতিমধ্যেই বলা শুরু করেছেন যে, আইনগত বলবৎ হওয়া নিয়ম ছাড়া এটা পরিবেশের জন্য খুব একটা ভাল হবে না। তবুও দেখা যাক, কিছু হয় কিনা।

(চলবে)

 

তথ্যসূত্র:

  1. Foresight Future of the Sea : https://assets.publishing.service.gov.uk/government/uploads/system/uploads/attachment_data/file/706956/foresight-future-of-the-sea-report.pdf
  2. রিপোর্টটি নিয়ে অফিশিয়াল প্রেস রিলিজ: https://www.gov.uk/government/news/great-opportunities-for-uk-from-oceans
  3. ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট: http://www3.weforum.org/docs/WEF_The_New_Plastics_Economy.pdf
  4. বোতলজাত জলে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে রিপোর্ট: https://orbmedia.org/sites/default/files/FinalBottledWaterReport.pdf
  5. The Charlevoix G7 Summit Communique: https://www.reuters.com/article/us-g7-summit-communique-text/the-charlevoix-g7-summit-communique-idUSKCN1J5107
  6. জি৭ ওশিন প্লাস্টিক চার্টার: https://g7.gc.ca/en/official-documents/charlevoix-blueprint-healthy-oceans-seas-resilient-coastal-communities/

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.