আমাদের শরীরের সারকেডিয়ান রিদম এবং এবারের শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার

এবারে শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কারটা গেছে আমাদের বডি ক্লক বা শারীরিক ঘড়ি এবং মস্তিষ্কের ঠিক কোন স্থানে এটি কাজ করে বিষয়ে গবেষণার জন্য। জেফ্রি সি. হল, মাইকেল রসবাখ এবং মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং আমাদের শরীরের বায়োলজিকাল ক্লক বা জীববিজ্ঞানগত ঘড়ির আণবিক মাত্রার ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য এবার শারীরবিদ্যা ও চিকিৎস্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

অষ্টাদশ শতকে Jean Jacques d’Ortuous de Marian নামের এক জ্যোতির্বিদ দেখেন, তার চাড়াগাছগুলোর পাতাগুলো আলো এবং অন্ধকারের একটি চক্র অনুযায়ী খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে অভিভূত হয়ে তিনি তার গাছগুলোকে একবার অবিরাম অন্ধকারের মধ্যে রাখেন, আবার একবার অবিরাম আলোর মধ্যে রাখেন। দেখা গেল গাছগুলোর পাতায় তখনও আগের মতই বন্ধ ও খোলার পর্যায় চলছে। এর থেকে তখন বোঝা গেল যে গাছগুলোর ভেতরে একটি ইন্টারনাল ক্লক বা অন্তস্থ ঘড়ি আছে যা স্বাধীনভাবে এর বিভিন্ন কার্যক্রমের চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।

এরপর এটা নিয়ে আরও অনেক কাজ হল, অনুসন্ধান হল, গবেষণা হল। দেখা গেল অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যেও এরকম একটি অন্তস্থ দৈনিক ছন্দের উপস্থিতি থাকে। কিন্তু শরীরের ঠিক কোথায় কোথা থেকে এই ছন্দের উৎপত্তি, কিভাবে এটা কাজ করে – এসব বিষয় সম্পূর্ণ রহস্যমণ্ডিত হয়েই ছিল। কিন্তু এই রহস্যের উদঘাটন সম্ভব হয় একটি ভুলের সাহায্যে। হ্যাঁ, সেটা ভুলই ছিল। ফ্রুট ফ্লাইদের শরীরে একটি ভুল জিন পাওয়া যায় যা এদের শরীরের দৈনন্দিক ছন্দকে বাঁধাগ্রস্ত করে। আর এখান থেকেই পাওয়া যায় এই ছন্দের প্রথম সূত্র। এর পরের কয়েকটি বছরেই হল, রসবাখ আর ইয়ং মিলে এই জীববিজ্ঞানগত ঘড়ির রহস্যের সমাধান করেন। আর এটা লুকিয়ে আছে আপনার জিনেই।

যাই হোক, এই ছন্দের আরেক নাম হল সারকেডিয়ান রিদম। এই সারকেডিয়ান শব্দটি এসেছে দুটো ল্যাতিন শব্দ সিরকা ও ডিয়েম থেকে। সিরকা শব্দের অর্থ হচ্ছে “প্রায়”, আর ডিয়েম শব্দটির অর্থ হচ্ছে “এক দিন”। সারকেডিয়ান রিদম হচ্ছে মানুষ সহ সকল জীবের দেহে থাকা একটি অন্তঃস্থচালিত চক্র যা বহিঃস্থ কোন সূত্র ছাড়াই অনবরত চালিত হতে পারে। ঘুমানো ও জাগার চক্রটি হল দৈনিক ছন্দগুলোর মধ্যে একটি, আমাদের শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের চক্র আরেকটি। এইসব চক্রের কথা আমরা অনেক আগেই জেনে ফেলেছিলাম, কিন্তু কিভাবে এই ঘড়িটা কাজ করে সেটাই আসল রহস্য হয়ে ছিল।

এই বায়োলজিকাল ঘড়ির সাইকেলটি একটি ফিডব্যাক লুপের মাধ্যমে তৈরি হয়। এটার জন্য প্রথমে এমন সব জিন সক্রিয় হয় যেগুলো প্রোটিন তৈরির সূচনা করে। যখন কোষে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন তৈরি হয়ে যায় তখন জিনগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এরপর সময়ের সাথে সাথে এই প্রোটিনগুলো ক্ষয় হয়ে কমতে শুরু করে। প্রোটিনের পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে কমে গেলে এই জিনগুলো আবার সক্রিয় হয়ে যায়। এভাবেই এই সাইকেল বা চক্রটি চলতে থাকে। আর একটি সাইকেল পূর্ণ হতে সময় লাগে প্রায়  ২৪ ঘণ্টা।

এই ঘটনাটি একটি, দুটি বা কয়েকটি জিনের ব্যাপার নয়। হল, রসবাখ ও ইয়ং মিলে এই বায়োলজিকাল ক্লকের সাথে সম্পর্কিত অসংখ্য জিন, প্রোটিন ও রেগুলেটর খুঁজে পেয়েছেন। এদের কেউ কেউ জিনের সক্রিয়করণের সাথে জড়িত, কেউ কেউ চোখ থেকে আলোর সংকেতের অনুবাদের সাথে জড়িত, কেউ কেউ এই ঘড়ির স্থায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত যারা বহিস্থ পরিবেশের সাথে এই ঘড়ির মধ্যকার একটি সংযোগ বা সম্পর্ক বজায় রাখে।

শরীরের ভেতরে তৈরি হওয়া অন্তস্থ চক্র সম্পর্কে আগে থেকে আমরা জানলেও কেন এই চক্র তৈরি হয়, আর আণবিক স্তরে এটি কিভাবে কাজ করে তা আমাদের জানান এই নোবেল বিজয়ী হল, রসবাখ আর ইয়ং। এদের গবেষণার জন্যই আজ আমরা জানি যে কিভাবে আমাদের শরীরের ভেতরের ছন্দগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়, আর বাইরের পরিবেশের সাথে এগুলো কিভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়।

যারা তাদের শরীরের অন্তস্থ ঘড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করে তাদের স্বাস্থ্যের সমস্যা সম্পর্কে আমরা জানতে শুরু করেছি। শিফট ওয়ার্কারদের (যারা রাত জেগে কাজ করে) স্বাস্থ্য সমস্যার কথা এখন অহরহ শোনা যায়। আমরা এখন কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার দিন ও রাতের মধ্যে সেই সময়গুলো বলে দিতে পারি যখন ব্যক্তির সচেতনতা এবং কর্মক্ষমতা সব থেকে বেশি হবে, আর এর মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমিয়ে দেয়া সম্ভব।

শিফট ওয়ার্কাররা দিনের বেলায় ঘুমানোর চেষ্টা কর, কিন্তু সাধারণত রাতে যারা ঘুমান তাদের তুলনায় তাদের ঘুম কম এবং খারাপ মানের হয়। এর কারণ হচ্ছে, এই দিনে ঘুমানোর সময়ে তারা ক্লান্ত হলেও তাদের শরীরের সারকেডিয়ান সিস্টেম তাদের শরীরকে নির্দেশ দিতে থাকে যে তাদের তখন জেগে থাকা উচিৎ। এরপর তারা যখন রাতের বেলায় কাজ করে তখন তাদের সারকেডিয়ান সিস্টেম তাদেরকে নির্দেশ দেয় যে, তাদের তখন ঘুমানো উচিৎ, আর এরফলে তাদের সচেতনতা (alertness) এবং কর্মক্ষমতা (performance) খারাপ হয়।

স্বল্পমেয়াদী সারকেডিয়ান ছন্দের ব্যাঘাতের ফলে শরীরে বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এরফলে স্মৃতি, সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা, আবেগীয় সারাপ্রদান (emotional responses), এবং মনোযোগে প্রভাব পড়ে। আর দীর্ঘমেয়াদে রাত জেগে কাজ করা লোকদের মধ্যে হৃদরোগ, সংক্রমণ, ক্যানসার, টাইপ টু ডায়াবেটিস এবং ওবিসিটি এর ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। এই সারকেডিয়ান রিদমের ব্যাঘাতের সাথে আরও বিভিন্ন রোগ সম্পর্কযুক্ত। বিভিন্ন মানসিক সমস্যা যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজর্ডার, বাইপোলার ডিজর্ডার, ডিপ্রেশন; নিউরোলজিকাল কন্ডিশন যেমন আলঝেইমারস, স্ট্রোক, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস; ডেভেলপমেন্টাল ডিজর্ডার যেমন অটিজম; এবং চোখের বিভিন্ন অসুখের সাথেও এই সারকেডিয়ান রিদমের ব্যাঘাতের সম্পর্ক পাওয়া যায়।

এখন গবেষকদের কাজ হল নতুন আবিষ্কৃত এই জ্ঞানের সাহায্যে এটা বের করা যে কিভাবে এই সারকেডিয়ান রিদম এই সব রোগ ও ডিজর্ডারে প্রভাব ফেলছে এবং নতুন ধরণের ড্রাগ ও চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন করা যা আমাদের শরীরের অন্তস্থ সময় নিয়ন্ত্রণকারী ঘড়িটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদেরকে সাহায্য করবে, এবং সারকেডিয়ান রিদমের ব্যাঘাতের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আমাদেরকে সাহায্য করবে।

এখন এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় যে কেন দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ভোরের প্রথম মুহূর্তেই ঘুম থেকে ওঠা এতটা কঠিন। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই। আমাদের শরীরের এই ঘড়িটির মেকানিজম খুব সুন্দর। বাইরের পরিবেশ থেকে আমাদের শরীর ঠিক কিরকম তথ্য নিচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে এই বায়োলজিকাল ক্লক নিজেদের মধ্যে এডজাস্টমেন্ট করে নেয়। তাই যেকোন পরিবর্তিত পরিবেশে আমাদের শরীর কয়েক দিনের মধ্যেই খাপ খেয়ে নিতে পারে।

সারকেডিয়ান রিদম আমাদের শরীরকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে – এই বিষয়ক জ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও যথেষ্ট পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। যেমন, আমরা যারা নিজেদের ঘুমের সময়কে জোড় করে যথেচ্ছ পরিবর্তন করি তারা এই বিষয়ে সচেতন হতে পারি। অনেকেই হয়তো এই বিষয়ে জানার পর নিজেদের শরীরের প্রাকৃতিক ছন্দে ফিরে যাবার জন্য ঘুম ও কাজের সময়ে পরিবর্তন আনবেন। বিশেষ করে যেসব তরুণ-তরুণীদের মধ্যে “নাইট আউল” হয়ে রাত জেগে পড়ার প্রবণতা দেখা যায় তারা রাত জাগা বন্ধ করে তাদের একাডেমিক পারফরমেন্স ভাল করার চেষ্টা করতে পারে।

 

তথ্যসূত্র:

  1. https://www.nytimes.com/2017/10/02/health/nobel-prize-medicine.html
  2. https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/medicine/laureates/2017/
  3. https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/medicine/laureates/2017/press.html?utm_source=twitter&utm_medium=social&utm_campaign=twitter_tweet
  4. https://theconversation.com/the-ancient-clock-that-rules-our-lives-and-determines-our-health-85034
  5. https://theconversation.com/circadian-rhythm-nobel-what-they-discovered-and-why-it-matters-85072
  6. https://doi.org/10.1111/mbe.12056
  7. https://theconversation.com/nobel-winners-identified-molecular-cogs-in-the-biological-clocks-that-control-our-circadian-rhythms-85061

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.