এবারে রসায়নে নোবেল পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন সেই বিজ্ঞানীরা যারা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে জীবন তৈরির প্রধান উপাদান বা বিল্ডিং ব্লকগুলোকে দেখার উপায় উদ্ভাবন করেছেন। জ্যাক দুবোশেট, জোয়াকিম ফ্র্যাংক এবং রিচার্ড হেন্ডারসন এই তিনজন এবারে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। এই তিনজনই হলেন ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির পথপ্রদর্শক। রয়াল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর মতে এটা একই সাথে বায়োলজিকাল মলিক্যুল বা বায়োমলিক্যুল দেখার উপায়কে সহজ ও উন্নত করেছে। এই গবেষণা বায়োকেমিস্ট্রিকে একটি নতুন যুগে নিয়ে গেছে। এই প্রযুক্তির কল্যাণে বায়োমলিক্যুলগুলো যখন প্রাকৃতিক অবস্থায় থাকে তখনই এদের হাই রেজোল্যুশন ছবি তৈরি করা সম্ভব হয়।
নোবেল পুরষ্কারের ৯ মিলিয়ন ক্রোনর (১.৪ মিলিয়নি ইউএস ডলার) সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ লজান এর দুবোশেট, নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ফ্র্যাংক এবং যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের এমআরসি ল্যাবরেটরি অফ মলিক্যুলার বায়োলজি এর হেন্ডারসনের কাছে সমানভাবে বণ্টিত হবে।
জীববিজ্ঞানগত তালা-চাবি
মানব দেহ অদ্ভুত রকমের জটিল এবং এখানে অনেক ধরণের বায়োকেমিকাল মেকানিজম বা জৈবরাসায়নিক কার্যপদ্ধতি দেখা যায়, যেমন হজম, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদি। এই সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াগুলোর সাথে বায়োমলিক্যুলগুলোর ব্যবহার জড়িত, যেগুলোর বিশাল অংশ তৈরি হয় এমিনো এসিড দিয়ে, যাকে জীবনের গাঠনিক একক বা বিল্ডিং ব্লক বলা হয়ে থাকে। যেকোন ইটের তৈরি দালান নির্মানের ক্ষেত্রে ইটগুলোর বৈশিষ্ট্য ও অবস্থানের উপর যেমন গোটা দালানের টিকে থাকার ব্যাপারটি নির্ভর করে, তেমনি এই বায়োমলিক্যুলগুলোর বৈশিষ্ট্য ও অবস্থানের উপর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমগুলোর কার্যকারিতা নির্ভর করে।
আবার এই বায়োমলিক্যুলগুলো অন্যান্য রাসায়নিক যেমন এনজাইমের সাথে মিথস্ক্রিয়ার সাহায্যেও গুরুত্বপূর্ণ কার্য সাধন করে থাকে। এই সব রাসায়নিকের সাথে বায়োমলিক্যুলগুলোর একটা তালা চাবির মত সম্পর্ক আছে। বায়োমলিক্যুলগুলো তালার মত। একটা তালাকে খুলতে যেমন একটা নির্দিষ্ট আকৃতির চাবি লাগে, তেমনি একটি বায়োমলিক্যুলও দেখা যায় নির্দিষ্ট কিছু এনজাইম বা রাসায়নিকের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, বা এই বায়োমলিক্যুলের কার্যক্রম সেই রাসায়নিক দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। আর তাই প্রতিটি বায়োমলিক্যুল সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে জানা প্রয়োজন যাতে এর সাথে সম্পর্কযুক্ত রাসায়নিকগুলো সম্পর্কেও জানা যায়। আর এই বায়োমলিক্যুলগুলো সম্পর্কে জানতে এগুলোর স্পষ্ট ও প্রকৃত চিত্র পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করা সম্ভব করেছেন এই নোবেল বিজয়ী দলটি। এরা এমন একটি প্রযুক্তি প্রস্তুত করতে সক্ষম হন যার দ্বারা এই বায়োমলিক্যুলগুলোকে এদের প্রাকৃতিক অবস্থাতেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। এই ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির আবিষ্কারের পূর্বে এই বায়োমলিক্যুলগুলোকে এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি এর মাধ্যমে দেখা হত।
পূর্বে এও ভাবা হত যে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ কেবল মৃত বস্তুর জন্যই উপযুক্ত, কারণ শক্তিশালী ইলেকট্রন রশ্মি সব বায়োলজিকাল বা প্রাণজ বস্তুকে মেরে ফেলে। কিন্তু এই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দ্বারাই প্রাণজ বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করার অসাধ্যটি সাধিত হল একটি পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে যার দ্বারা স্যাম্পলটিকে খুব দ্রুত ঠাণ্ডা করে জমিয়ে ফেলা হয়। আর এর ফলেই বায়োমলিক্যুলের ছবি তার প্রাকৃতিক অবস্থাতেই ধারণ করা সম্ভব হয়। ঠাণ্ডায় জমিয়ে ফেলার মাধ্যমে এই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ কাজ করে বলে এই পদ্ধতির নাম হচ্ছে ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি। এই গবেষকগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেখার আগে যদি বায়োমলিক্যুলকে জমিয়ে ফেলা যায় তাহলে এদের পূর্ণাঙ্গভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
সঠিক সময়ে জমাট বাঁধা
এখানেই আসল মজার শুরু। শুনতে খুব সহজ মনে হলেও একটা স্যাম্পলকে খুব দ্রুত জমিয়ে ফেলা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। যদি এই প্রক্রিয়াটিতে স্যাম্পল থেকে জল সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে বায়োমলিক্যুল ভেঙ্গে যায়, আর তার ফলে গবেষকগণ বায়োমলিক্যুলটির যে প্রাকৃতিক অবস্থাটি চাচ্ছেন তা আর থাকে না। যদি স্যাম্পলটাকে ধীরে ধীরে জমানো হয় তাহলে ধীরে ধীরে আইস ক্রিস্টাল বা বরফ তৈরি হয়, আর এটাও সেই বায়োমলিক্যুল এর অবস্থাটি নষ্ট করে দেয়। দলটি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যার নাম হচ্ছে ভিট্রিফিকেশন। এটার ফলে স্যাম্পলটিকে কোন তারের জালে রাখলে এর তাপমাত্রা -১৯০℃ তে নেমে আসে। আর এটাই এত কঠিন সমস্যাকে খুব সহজভাবে সমাধান করার পথ।
বেশিরভাগ নোবেল প্রাইজ পাওয়া বৈজ্ঞানিক অর্জনের মতই এই পদ্ধতিটির আবিষ্কারও হয়ে ধীরে ধীরে। এই জমানোর পদ্ধতিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। এরপর এই পদ্ধতিকেই বার বার পরিবর্তন করে এই পর্যায়ে আনা, আর এই মাইক্রোস্কোপি টেকনোলজি পূর্ণাঙ্গভাবে জানা সম্ভব হয় ২০১৩ সালে। এই দুইয়ের সমন্বয় এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলেই বায়োমলিক্যুল এর এই উচ্চ রেজোল্যুশনের ছবি ধারণ করা সম্ভব হয়।
ভাইরাসের তালা খোলা
সুতরাং এটা কী নির্দেশ করছে? যদি কোন তালার অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় তাহলে সেই তালাকে খোলার জন্য ঠিক কী ধরণের চাবি দরকার সেটাও জানা সম্ভব হয়। ভাইরাস হচ্ছে এরকমই বিশাল বায়োমলিক্যুল। একবার যদি এদেরকে দেখা সম্ভব হয়, তাহলে বিজ্ঞানীগণ সেই ভাইরাসগুলোকে নাশ করতে অথবা তার কার্যক্রমকে বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ফারমাসিউটিকল চাবিও তৈরি করতে সক্ষম হবেন।
এই ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির ক্ষমতার একটি উদাহরণ পাওয়া যায় জিকা ভাইরাসের দ্রুত নির্ণয়ের মাধ্যমে। একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হবার খুব কম সময়ের মধ্যেই এটা করা সম্ভব হয়। এই ভাইরাসটির গঠন ও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা এবং সেই বিশেষ বায়োমলিক্যুলটির যে অংশটি তার হস্ট মানুষের সাথে যুক্ত থাকে সেটার সম্পর্কে জানাই হচ্ছে বর্তমানে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করার প্রধান ভিত্তি।
আমাদের খাবার টেবিলেও এই প্রযুক্তির তার প্রভাব রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষক দল জিভের তাপ-সংবেদী অংশ সম্পর্কে গবেষণা করেছে। এই গবেষণাই এই ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাথা নাশ করার সম্পর্কে আরও ভাল জ্ঞান পাওয়া যাবে, আর ব্যাথা নাশ করার নতুন ভাল উপায় আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। অস্ট্রেলিয়ায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত অসুখগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করার জন্যেও এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করার চিন্তা ভাবনা চলছে।
যাই হোক, বোঝাই যাচ্ছে যে আগামী দিনে জৈব-রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান সহ বিভিন্ন খাতে এই ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করতে যাচ্ছে। আর তাই এই বিশ্ব এবারের এই তিনজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
তথ্যসূত্র:
- https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/chemistry/laureates/2017/press.html
- https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/chemistry/laureates/2017/dubochet-facts.html
- https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/chemistry/laureates/2017/frank-facts.html
- https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/chemistry/laureates/2017/henderson-facts.html
- https://www.britannica.com/science/amino-acid
- https://theconversation.com/explainer-what-is-x-ray-crystallography-22143
- https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/chemistry/laureates/2017/fig_ke_en_17_dubochetspreparationmethod.pdf
- https://theconversation.com/au/topics/zika-18991
- https://www.ucsf.edu/news/2015/04/124956/first-look-wasabi-receptor-brings-insights-pain-drug-development
- https://www.massive.org.au/news/234-massive-research-stories-australia-s-most-powerful-biological-microscope
Leave a Reply