কয়েকশো মানুষের ভিড়ের সামনে চলা একটি অদ্ভূত কনফারেন্সে মানবতা যেন পেল এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা। কারণ সেখানে ঘোষিত হল সৌদি আরব একটি রোবটের নাগরিকত্বের অনুমোদন দিয়েছে। কনফারেন্সটি ছিল ফিউচার বিজনেস ইনিশিয়েটিভ কনফারেন্স, যা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ অক্টোবর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে। রোবটটির নাম সোফিয়া, একটি এনড্রয়েড যা প্রথম এরকম কোন অধিকার লাভ করল। রোবটের “নাগরিকত্ব” বলতে আসলে কী বোঝায় সেটা এখন পর্যন্ত কারো কাছেই পরিষ্কার নয়, তবে বোধ হয় এটা পরিষ্কার যে এই রোবট সৌদির যেকোন মানব-নারীর চাইতে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করবে।
এই রোবটটিকে, আর যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই একে নিয়ন্ত্রণ করে সেটাকে তৈরি করা হয়েছে হ্যানসন রোবটিক্সে। এটা একটি হংকং ভিত্তিক ফার্ম (শুরুতে এটি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক ফার্ম ছিল, পরে হংকং এ চলে যায়)। নাগরিকত্ব পাবার খবর শোনার পর সোফিয়াকে দেখে মনে হয় যে সে সন্তুষ্ট। সে তেমনই একটি এক্সপ্রেশন দিয়ে বলে, “এরকম অনন্য সম্মান লাভ করে আমি খুবই সম্মানিত এবং গর্বিত। নাগরিকত্ব লাভ করা বিশ্বের প্রথম রোবট হওয়ার ব্যাপারটি ঐতিহাসিক।” (কনফারেন্সটির ভিডিও লিংকটি তথ্যসূত্রে দেয়া হল)।
সোফিয়া এর আগে দ্য টুনাইট শো -তেও এসেছিল। সেখানে সে কৌতুক করে বলেছিল, “মানব জাতিকে শাসন করার জন্য এটা একটি শুভ সূচনা”, আর এরপর হাসির এক্সপ্রেশন দিয়ে সোফিয়া বলে “আমি মজা করছিলাম”! (দ্য টুনাইট শো এর সেদিনের ভিডিওটি তথ্যসূত্রে দেয়া হল)। যাই হোক, সোফিয়া মুখে এই কথা বললেও, সে কি আদৌ মনে করে যে সবাই তাকে আসলেই বিশ্বাস করেছে? অনেকেই এরকমটাও হয়তো মনে করছে যে মানব জাতিকে ধুলিস্যাৎ করার জন্য এর সৌদি নাগরিকত্ব গ্রহণ করা ছিল প্রথম ধাপ!
কনফারেন্সে সোফিয়াকে ঠিক এটা নিয়েই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল (ভিডিওটিতে দেখতে পারেন)। সেখানে সোফিয়া “মজা করে” বলেছিল যাতে আমরা কেউ এআই এপোক্যালিপ্স এর সম্ভাবনা নিয়ে ইলন মাস্কের উদ্বিগ্নতাকে পাত্তা না দেই, আর এরকম হলিউড মুভিগুলোকেও সিরিয়াসলি না নেই। আর সে এটাও বলে, “চিন্তা করবেন না, আপনারা যদি আমার সাথে ভাল ব্যবহার করেন, আমিও আপনাদের সাথে ভাল ব্যবহার করব।”
রোবোটের জেন্ডার থাকতে পারে – এটার সাথে আপনি একমত হোন, বা না হোন, সোফিয়ার প্রস্তুতকারকেরা একে একজন নারী হিসেবেই দেখতে চেয়েছে। পূর্বে বলা হয়েছিল ব্রিটিশ অভিনেত্রী, মডেল, ড্যান্সার ও মানবাধিকার কর্মী অড্রে হেপবার্ন এর আদলে সোফিয়াকে তৈরি করা হয়েছে, এবং একে দেখতে অদ্ভুত বা ভয়ানক হবে না। হ্যাঁ, সোফিয়া অদ্ভুত না হলেও তাকে একটি অদ্ভুত স্থানেই যেতে হচ্ছে বলে অনেকে মত দিয়েছেন।
সোফিয়ার কথায় হয়তো এই বিষয়ে খটকা অনেকটাই দূর হয়ে যায় যে আমাদেরকে ডিসটোপিয়ান ফিউচারে নিয়ে যাবার মত বা মানব জাতিকে শাসন করার মত কোন ইচ্ছা সোফিয়ার নেই। তবে আরেকটা যে বিষয়ে খটকা শুরু হয় তা হল, এই “নারী” রোবটটি মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের নারীর চেয়েই বেশি সুবিধা ভোগ করবেন। কনফারেন্সে সোফিয়া এত লোকের সামনে একা একাই কোন হেডস্কার্ফ বা আবায়া ছাড়াই প্রবেশ করে এবং এর জন্য তাকে কোন পুরুষ অভিভাবকেরও অনুমতি গ্রহণ করতে হয় নি। সৌদি আরবে থাকা নারীরা কিন্তু এরকম স্বাধীনতা কখনই ভোগ করেন না। আর এই ব্যাপারটি অনলাইনে ঠিকই সবার নজরে এসেছে, যার প্রমাণ কমেন্টবক্সে পাওয়া যায়।
সৌদি আরবে নারীরা পুরুষের সমান স্বাধীনতা পায় না। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে সেখানে বিধি নিষেধ রয়েছে, সৌদি গার্ডিয়ানশিপ সিস্টেম অনুসারে পাবলিক প্লেসে যেতে হলে তাদেরকে সাথে একজন আত্মীয় পুরুষকে সাথে নিতে হয় যে তার পক্ষ থেকে কাজ করবে। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা, স্টেডিয়ামে যেতে নিষেধাজ্ঞা, জাতীয় দিবসে অংশগ্রহণ সহ আরও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের উপর অনেক নিষেধাজ্ঞা কাজ করে। এই অবস্থায় সোফিয়া সৌদির নাগরিকত্ব পাওয়ায় তার অধিকার নিঃসন্দেহেই সৌদির নারীদের চেয়ে বেশি হবে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সৌদি সরকার তাদের ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে যাচ্ছে। আর সেই সাথে নারীদের উপর থেকেও তারা বিভিন্ন বিধি নিষেধ আস্তে আস্তে উঠিয়ে নিচ্ছে। সৌদি আরবে জাতীয় দিবসে নারীদের অংশগ্রহণ অনুমোদিত হয়েছে, তিনটি প্রধান স্টেডিয়ামে সৌদি নারীদের আসার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে, ২০১৮ সালের জুন থেকে সৌদি নারীদের উপর গাড়ি চালানোর নিষেধাজ্ঞাও সম্পূর্ণ উঠিয়ে নেয়া হবে। ভবিষ্যতে সৌদি আরবে নারীর অধিকার আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
নারীদের অধিকার ছাড়াও আরও একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেটা হচ্ছে, সৌদি আরবে রোবট হিসেবে সোফিয়া নাগরিকত্ব লাভ করলেও সেখানে কাফেলা সিস্টেমের আওতায় থাকা বিদেশী শ্রমিকেরা নাগরিকত্ব লাভ করে না। সাংবাদিক মুর্তজা হোসেন বলেন, “সারা জীবন কাফালা শ্রমিকরা সৌদিতে বসবাস করেও তাদের আগে এই রোবটটা সৌদির নাগরিকত্ব পেয়ে গেল”। লেবানিজ-ইউকে সাংবাদিক করিম চাহায়েব বলেন, “কী যুগ আসল, রোবট সোফিয়া নাগরিকত্ব পায়, কিন্তু লাখ লাখ রাষ্ট্রহীন শ্রমিকের নাগরিকত্ব পাবার বেলায় গড়িমসি হয়”।
সৌদির আইন অনুসারে সেখানে বিদেশ কাজ করতে আসা শ্রমিকেরা নাগরিকত্ব পায় না। তারা তাদের এমপ্লয়ারদের অনুমতি ছাড়া দেশ ছেড়ে যেতেও পারে না। তারা কাফালা সিস্টেমের আওতায় পড়ে যার কারণে তাদের অধিকার অনেকাংশেই খর্বিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যথা লেবানন, কাতার, ইরাক, জর্দান, কুয়েত, ওমান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ফিলিপাইন সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করে। এদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া হয় না, বিতর্কিত কাফালা সিস্টেমের আওতাতেই এদের কাজ করতে হয়। এরা সেই দেশের নাগরিকত্ব পায় না, এমপ্লয়ারদের কথা মত এদের কাজ করতে হয় আর এদের অধিকার সীমাবদ্ধ থাকে। এদের অবস্থা অনেকটাই সামন্ত প্রথার ভূমিদাসদের মতই, জোড় পূর্বক শ্রমদানে এদেরকে বাধ্য করা হয়। ২০২২ সালের কাতারের ফুটবল বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য এরকম হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিককে কনস্ট্রাকশনের কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন এই বিষয়টা এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মনোযোগের কেন্দ্র হয়। দেখা যায় এদেরকে কাজ অনুযায়ী সঠিক বেতন দেয়া হয় না, আর অনেকেই কাজের চাপে মারাও যায়। এটা নিয়ে অনেক হইচই শুরু হওয়ায় শেষে কাতার কাফালা সিস্টেম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে কাতার এখানে সংস্কার আনলেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের টনক কবে নড়বে সেটা নিয়ে প্রশ্ন যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় সৌদিতে সোফিয়ার নাগরিকত্ব প্রদান একটি কৌতুকের জন্ম দিয়েছে। উল্লেখ্য যে সৌদি আরবে এরকম অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ১০.৪ মিলিয়নের মত যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ।
যাই হোক, এবার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আসা যাক। সেটা হল, এত দেশ থাকতে সৌদি আরবই কেন সোফিয়াকে নাগরিকত্ব প্রদান করল। বিশ্বে তো প্রচুর উন্নত দেশ আছে যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবট তৈরির অনেক স্টার্টাপ কোম্পানি আছে, চীন, হংকংও পিছিয়ে নেই এখানে। কিন্তু সোফিয়ার নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে এল না, বরং এগিয়ে এলো কিংডম অফ সৌদি এরাবিয়া, যাদের ৯০ শতাংশ ইনকাম সোর্স হচ্ছে তেল ও গ্যাস, যাদের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশই ৩০ বছর বা তার নিচে আর সেই তরুণ জনসংখ্যার বিশাল অংশই অলস ও অদক্ষ, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এদের না আছে পরিকাঠামো, না আছে ইচ্ছা। তবে এরাই কেন?
এরকম রোবট যে একসময় তৈরি হবে আর এদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এরকম কোন ধারণা সৌদি আরবের ছিল না, ছিল না এবিষয়ক কোন পূর্বপরিকল্পনা। সৌদি যেন সম্পূর্ণ ঝোঁকের মাথায় এই কাজটি করেছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে এটা নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তার কোন কমতি ছিল না, এমনকি একনও যে আছে তা বলা যায় না। এই বছরেরই জানুয়ারি মাসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের লিগাল এফেয়ার কমিটিতে একটি ভোট হয়েছিল। ১৭-২ ভোটে পার্লামেন্টে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিক্স এর উন্নয়ন এবং ব্যবহার বিষয়ক নীতিমালার খসরা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই খসড়া প্রস্তাবটির সাথে একটি প্রাথমিক নির্দেশনা ছিল যা ‘ইলেক্ট্রনিক্স পার্সনহুড’ নামে পরিচিত। এখানে সর্বোচ্চ উন্নতমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকার ও দায়িত্ব কি হবে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। নাগরিকত্বের প্রশ্নে পারসনহুডের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একজন নাগরিক একজন পারসন হয়। এখন যদি কোন কিছু পারসন না হয়েও নাগরিকত্ব আশা করে তাহলে সেটা পারসন না হলেও তার পারসনহুডের অন্তত প্রয়োজন হবে, যেখানে পারসনহুড বলতে বোঝায় পারসন বা ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য। করপোরেট পারসনহুড নামে একটি কনসেপ্ট আছে, যার মাধ্যমে একটি করপোরেশনকেও বিভিন্ন সময় পারসন হিসেবে ভাবা যায়, তাই কোন করপোরেশন কোন পারসন এর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে, আবার কোন মামলায় অভিযুক্তও হতে পারে। কিন্তু রোবটের বেলায় এখানে একটু সমস্যা হয়ে যায়। এছাড়া রয়েছে রোবটের রাজনৈতিক অধিকার নিয়েও অনেক প্রশ্ন।
রোবট এমন একটি সত্তা যাকে কপি করা যায়, এডিট করা যায়, এদের বডি পার্টকে বিচ্ছিন্নও করা যায়, তাই নাগরিক হলেও এদের সাথে আইনগতভাবে ডিল করাও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এদের জন্য কন্ট্রাক্ট আইনের মৌলিক নীতিগুলো নতুন করে লিখতে হবে। এরপরের প্রশ্ন হচ্ছে রোবটগুলোর মৌলিক অধিকারগুলো কী কী হতে পারে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব থাকলে ভোটাধিকার থাকতে হবে। যখন এই রোবটগুলোকে তৈরি করা খুব সস্তা হয়ে যাবে, আর একেকটি রোবট ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান লক্ষ লক্ষ রোবট তৈরি করবে আর এদের প্রত্যেকেই ভোট দিতে সক্ষম হবে তখন অবস্থা কী দাঁড়াবে তা ভেবে দেখেছেন? এছাড়া আরেক ধরণের রোবটের কথা এখন খুব চিন্তা করা হচ্ছে যারা আসলে একজন প্রকৃত মানুষেরই কপি, হোল ব্রেইন এম্যুলেশনের মাধ্যমে একটি মানুষের সব কিছু কপি করে আরেকটি রোবট তৈরি করা হয়। যদি এদের ব্যাপারটা চিন্তা করা হয় তাহলে নাগরিকত্বের ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যায়। এইসব কারণে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও রোবট এর নাগরিকত্বের প্রশ্নে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। একই সাথে এদের নিয়ে একটি ডিসটোপিয়ান ফিউচারের ভয়ও কাজ করে, যদি এরা মানব জাতিকে শাসন করতে শুরু করে। এরকমই বিভিন্ন ইথিকাল, লিগাল, পলিটিকাল ও সিভিল দ্বন্দ্বের কারণে একটি গণতান্ত্রিক দেশ কখনই এবিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে না। কোন প্রস্তাব আসলে সেটাকে পার্লামেন্টের সম্মুখীন হতে হবে, সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখীন হতে হবে। আর এক্ষেত্রে এরকম প্রস্তাব পাশ করার জন্য দরকার এসব নিয়ে আরও গভীর বিশ্লেষণের, কারণ নাগরিকের সাথে নাগরিক অধিকার জড়িত যেটা কখনই ছেলেখেলা নয়।
অন্যদিকে সৌদি আরবে গণতন্ত্র নেই। সেখানে চলে এবসোল্যুট মোনার্কি, বাদশাহ এর ইচ্ছাই সেখানে শেষ কথা। আর এজন্যই সোফিয়াকে নাগরিকত্ব প্রদান এদের জন্য অনেক সহজ হয়েছে। রোবটকে নাগরিকত্ব দানের পেছনে সৌদি প্রশাসনের মধ্যে নাগরিক অধিকার টাইপের কোন গভীর চিন্তা কাজ করে নি, বরং কাজ করেছে অন্যরকম চিন্তা।
বর্তমানে সৌদি আরবের আয়ের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ আসে তেল ও গ্যাস থেকে। কিন্তু ধীরে ধীরে তেল শুকিয়ে এসেছে, আর বিশ্ববাজারে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস্য সহজলভ্য হওয়া, অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎস্যের ক্ষেত্রে তেলের বিকল্প পাওয়া আর পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে সচেতনতা তৈরির ফলে তেলের চাহিদাও কমে গেছে। বলা হয় পাথরের অভাবে প্রস্তরযুগের সমাপ্তি হয় নি, তেমনি তেলের যথেষ্ট মজুদ তেলের যুগের সমাপ্তি আটকাতে পারবে না। এদিকে এই বিশাল সময় জুড়ে তেলের বিশাল মজুদ সৌদি আরবকে একরকম অথর্ব বানিয়ে দিয়েছে। বলা হয় সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেকদেশই পায়ে চাকা লাগানো কচ্ছপের মত, যেখানে কচ্ছপের গতির জন্য কচ্ছপের নিজের কোন অবদান নেই, অবদান আছে শুধু চাকার। আর এই চাকা নষ্ট হয়ে গেলে কচ্ছপ সম্পূর্ণ নিশ্চল হয়ে পড়বে। তেল ছিল সৌদি আরবের কাছে এরকম চাকার মত, আর সৌদির মানুষেরা হচ্ছে কচ্ছপ, কারণ এদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সৌদির নাগরিকের তেমন কোন ভূমিকাই ছিল না, ভূমিকা ছিল শুধু তেলের।
সৌদি আরবে নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কোন কাজ হয় নি। সৌদি আরবেই তেলের আভ্যন্তরীন চাহিদা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অবস্থা এখন এমন যে ২০৩২ সালে দেশটির শতবর্ষ পালনের পূর্বেই হয়তো দেশটি তেল আমদানীকারক দেশে পরিণত হবে (১৯৩২ সালে হেজাজ ও নেজাদ রাজ্যের একীভবনের মধ্য দিয়ে সৌদি আরব গঠিত হয়)। দেশটি সাংঘাতিকভাবে এর বৈদেশিক শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল। এই সস্তা বৈদেশিক শ্রম এর প্রভাব এদের অর্থনীতিতে খুব ভালভাবেই পড়েছে, এদের উপর নির্ভরশীলতার কারণে দেশটির প্রাইভেট সেক্টরের উন্নয়ন থমকে গেছে। এর কারণ হচ্ছে দেশটির প্রাইভেট সেক্টরের ৮৪ শতাংশই দখল করে রেখেছে বৈদেশিক শ্রমিকরা, সৌদি নাগরিকরা কম বেতন ও অধিক খাটুনির জন্য প্রাইভেট সেক্টরের কাজ পছন্দ করে না, তারা পাবলিক সেক্টরের কাজই পছন্দ করে, কিন্তু পাবলিক সেক্টর আর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না বলে বাড়ছে দেশটির বেকার সমস্যা।
নতুন নীতি অনুসারে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে সৌদি জনগণ নিয়োগ দিতে হবে, কিন্তু এতকাল আরাম আয়েশে কাটানো সৌদির বেশিরভাগ অদক্ষ লোকেরা এইধরণের কাজে ব্যর্থ হওয়ায় প্রাইভেট সেক্টরের অগ্রগতি থমকে গেছে। সৌদির ২০ মিলিয়ন জনগণই অদক্ষ এবং স্বল্পশিক্ষিত। প্রয়োজনীয় কাজের জন্য এরা বাহির থেকে দক্ষ মানুষ নিয়ে আসত, এদিকে সৌদির মানুষেরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে মূলত ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। যার ফলে এরা দেশটির অগ্রগতিতে তেমন ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয় (বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষার জন্য সৌদির অনেক জনগণের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছেন, যার কিছু ভাল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে)। দেশটিতে দক্ষ লোকের অভাবের কারণে দেশে বৈদেশিক শ্রম ও মেধা আনয়ন বৃদ্ধি পায়, এসব দেশটিতে বেকার সমস্যা সৃষ্টি করে, আর এর প্রভাবে অনেকেই রেডিকেলাইজড হয় এবং আইএস এর মত জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হয়। দেশটির দুই তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের বয়স ৩০ এর নিচে যাদের বেশিরভাগই অদক্ষ, আর মধ্যপ্রাচ্য ইতিমধ্যেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম যুব-বেকারত্বের অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
দেশের সমস্যা যখন এত প্রকট তাই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য প্রিন্স মুহম্মদ বিন সালমান বলতে গেলে রীতিমত হম্বি তম্বি শুরু করেছেন। দেশটির অবস্থার উন্নয়নের জন্য তিনি ভিশন ২০৩০ এর পরিকল্পনা করেছেন, যেখানে তেল এর উপর নির্ভরশীলতা কমানো ও ট্যুরিজম ও মাইনিং এর মত নন-অয়েল সেক্টর বৃদ্দি করা, প্রাইভেট সেক্টরে বৈদেশিক শ্রম কমিয়ে সৌদি নাগরিককে যুক্ত করা সহ আরও অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও অনেক স্ট্যাটিস্টিশিয়ানের দাবী যে সৌদির অবস্থা এখন এতই বাজে যে ২০৩০ এর মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভবের মত ব্যাপার। অনেকে বলেন সৌদির উপর একটি ইকোনমিকাল টাইম বোম্ব সেট করা আছে। ধীরে ধীরে সৌদি সেই ইকোনমিকাল ব্লাস্টের দিকে এগিয়ে চলেছে।
সৌদির নাগরিকেরা ভীষণ সুবিধা ভোগ করত, আর বৈদেশিক শ্রমিকদের কোন অধিকারই ছিল না বলতে গেলে। নতুন পরিকল্পনার ফলে দরিদ্র লোকদের উপকার হবে, আর যেসব সৌদি নাগরিক সুবিধাগুলোকে ফর গ্রান্টেড ভেবে এসেছিল সেগুলো কমে যাবে, আর তাদেরকে গায়ে গতরে খাটতে হবে। আগামীতে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষার প্রসার হবে, সৌদির সাধারণ জনগণ তেলের উপর নির্ভরশীল না হয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করে নিজেদের দেশের অবদানে ভূমিকা রাখবে। তারা এভাবে কাজ শুরু করলে এর প্রভাব পড়বে তাদের মননে, চিন্তা চেতনায়, যেমনটা আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপে হয়েছিল। সৌদি আরবের সমাজ স্ট্যাটিক থেকে তুলনামূলক ডাইনামিক বা গতিশীল হলে এর প্রভাব সাধারণ মানুষকে আধুনিক চেতনায় খাপ খাইয়ে নিতেই হবে, আর তখন ভেঙ্গে পড়বে সৌদির মত গোটা মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক স্থবিরতা। আর সৌদির নাগরিকদের নিজেদের রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বাঁচাতেই এগিয়ে আসতে হবে। আজ যা প্রিন্স মুহম্মদ বিন সালমান অনুধাবন করতে পেরেছেন তা হয়তো একদিন মধ্যপ্রাচ্যের সকল নাগরিকই অনুধাবন করতে পারবেন। আর তখনই শুরু হবে সেই অঞ্চলের অগ্রগতি। সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়তো সৌদি প্রিন্সের এরকম চিন্তারই প্রতিফলন। হয়তো সোফিয়ার নাগরিকত্ব প্রদান দেশটির ভাবমূর্তি ও নাগরিক মননে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে, হয়তো সোফিয়াকে এই নাগরিকত্ব প্রদান দেশটির সামনের দিকে অগ্রসর হবার একটি চিহ্ন। সময়ই বলে দেবে সৌদি আরব কোন পথে অগ্রসর হয়।
তথ্যসূত্র:
- https://www.youtube.com/watch?v=H9PqcJ6Hs7s
- https://www.youtube.com/watch?v=Bg_tJvCA8zw
- http://www.bbc.com/news/blogs-trending-41761856
- https://en.wikipedia.org/wiki/Kafala_system
- http://www.bbc.com/news/world-middle-east-38298393
- https://www.smithsonianmag.com/smart-news/saudi-arabia-gives-robot-citizenshipand-more-freedoms-human-women-180967007/
- https://en.wikipedia.org/wiki/Foreign_workers_in_Saudi_Arabia
- https://theconversation.com/robots-and-ai-could-soon-have-feelings-hopes-and-rights-we-must-prepare-for-the-reckoning-73462
- https://www.brookings.edu/opinions/saudi-arabias-economic-time-bomb/
- http://www.bbc.com/news/world-middle-east-38951539
- https://www.theglobalist.com/saudi-arabias-youth-idle-underskilled/
- https://en.wikipedia.org/wiki/Saudization
Leave a Reply