ডাইনোসরর পৃথিবীতে তাদের আধিপত্যের জন্য অগ্ন্যুৎপাতকে ধন্যবাদ দিতে পারে, অবাক লাগলেও একটা তত্ত্ব অনুসারে এটাই সত্যি। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে, ২০০ মিলিওন বছর আগে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপের ফলে একটি মাস এক্সটিংকশন বা গণবিলুপ্তি ঘটে যা ডাইনোসরদেরকে উত্থানের পথ করে দেয়। এখন নতুন সাক্ষ্য-প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে যা এই ধারণাকে শক্তিশালী করছে। এটা অনুসারে, ঠিক যে সময় বিলুপ্তি হচ্ছিল তখন একটি বৈশ্বিক ভূতাত্ত্বিক “ফিঙ্গারপ্রিন্ট” নির্দেশক ভলকানিক গ্যাস সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করেছিল।
জিওলজিস্টগণ পূর্বে আবিষ্কার করেছেন যে, পৃথিবীর ভূত্বক বা আর্থ ক্রাস্টে ২০০ মিলিওন বছর আগে ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকের বিপুল পরিমাণ আগ্নেয় শিলা বা ভলকানিক রক আছে। আমরা ফসিল রেকর্ড থেকে জানি, একই সময়ে পৃথিবীর প্রজাতির একটি খুব বড় অংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, যা অবশিষ্ট ডাইনোসরের (এবং অন্যান্য প্রজাতি) জন্য স্থান তৈরি করেছিল। যেহেতু আগ্নেয়গিরি বৃহৎ পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন করতে পারে, এটি সম্ভব যে এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট বিশাল লাভার প্রবাহ বিশ্বব্যাপী জলবায়ুতে পরিবর্তনও এনেছিল যার ফলে গণবিলুপ্তি ঘটে।
তবে আগ্নেয় কার্যকলাপটি সত্যিই যে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছিল তার প্রমাণটা মিসিং ছিল। সারা বিশ্বের জিওলজিকাল রেকর্ড পরীক্ষা করে জানা গেছে যে, গণবিলুপ্তির সময় বায়ুমন্ডলে বৃহৎ পরিমান মারকিউরি বা পারদ বায়ুমণ্ডলে মু্ক্ত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু মারকিউরি আগ্নেওগিরি থেকেও নির্গত হয়, তাই এটি নির্দেশ করে যে, সেই সময়ের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সত্যিই সমগ্র পৃথিবীকে প্রভাবিত করার মতো যথেষ্ট তীব্র ছিল এবং এটি সাম্ভাব্য গণবিলুপ্তির কারণও হতে পারে।
ভলকানিক রক বা আগ্নেও শিলা বিশাল এলাকা আবৃত করেছে, যা বর্তমান চারটি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত। এগুলো হচ্ছে একটি বিশাল সময়ের আগ্নেও কার্যাবলি বা ভলকানিক এক্টিভিটির ফলাফল, যে আগ্নেও কার্যাবলি প্রায় এক মিলিয়ন বছর জুড়ে বর্তমান ছিল। এই অঞ্চলটিকে সেন্ট্রাল আটলান্টিক ম্যাগনেটিক প্রোভিন্স বা CAMP বলা হয়।
পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে দেখানো হয়েছে যে, পর্যয়ক্রমে এই অগ্ন্যুৎপাতটি ঘটতে পারে। কিন্তু আমরা জানতাম না যে কিভাবে এই নির্গমনের সময় এবং ফ্রিকোয়েন্সিকে বিলুপ্তি ঘটনার সময় এবং জীবনের পরবর্তী পুনরুদ্ধারের সাথে তুলনা ও সম্পর্কিত করা যায়, বা আগ্নেয়গিরিগুলোর একটি বিশ্বব্যাপী প্রভাব ছিল কিনা। তাই যেধরণের সেডিমেন্ট বা মাটিতে গণবিলুপ্তির রেকর্ড আছে, একই ধরণের মাটিতে অগ্ন্যুৎপাতের “ফিংগারপ্রিন্ট” খোঁজার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মারকিউরি মার্কার
এখনকার আগ্নেয়গিরি অনেক ধরণের গ্যাস নির্গত করে, সবচেয়ে বেশি নির্গত হয় সালফার ডাই অক্সাইড এবং কার্বন ডাই অক্সাইড, কিন্তু সামান্য ধাতব পারদও এতে পাওয়া যায়। এই পারদ ছয় মাস থেকে দুই বছর বায়ুমন্ডলে থাকতে পারে এবং এর মানে হল যে এটি হ্রদ, নদী ও সমুদ্রের তলদেশে জমা হওয়ার আগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরতে পারে।
এই একই সেডিমেন্টে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং গণবিলুপ্তির রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে। সুতরাং, যদি একটি সেডিমেন্ট লেয়ারে গণবিলুপ্তির রেকর্ড থাকে, তা সেই সাথে মারকিউরি বা পারদের কনসেন্ট্রেশনেরও রেকর্ড থাকবে। এখান থেকে প্রমাণ করা যায় যে অগ্ন্যুৎপাতের ফলেই খুব সম্ভব সেই বিলুপ্তি ঘটেছিল।
এক্সেটর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকের বিলুপ্তি নির্দেশক ছয়টি সেডিমেন্টারি রেকর্ডকে পারদের উপস্থিতির জন্য পরীক্ষা করেছেন। এই শিলাগুলো ইউকে, অস্ট্রিয়া, আর্জেন্টিনা, গ্রীনল্যান্ড, কানাডা এবং মরক্কো থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। এগুলো চারটি মহাদেশ ও উত্তর ও দক্ষিণ উভয় গোলার্ধ জুড়েই অবস্থিত যা আমাদেরকে ট্রায়াসিক যুগের শেষের দিকের গণবিলুপ্তির সময়কার ভলকানিক গ্যাসের নির্গমনের বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দান করে।
আগ্নেয়গিরির যোগসূত্র
জানা গেছে যে, ছয়টির মধ্যে পাঁচটি রেকর্ডে ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকে পারদের পরিমাণ প্রচুর পরিমাণে বাড়তে শুরু করে এবং বিলুপ্তির সময় এর পরিমান আরও বৃদ্ধি পায়। মরোক্কো নমুনার বিলুপ্তি স্তর CAMP এর আগ্নেয় শিলা সঙ্গে ওভারল্যাপ করে। এর মানে হলো আমরা বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলে বিশাল পরিমাণ পারদ নির্গমনের সাথে একটি নির্দিষ্ট অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনার যোগসূত্র আছে বলে ধরে নিতে পারি যদিও তা ২০০ মিলিয়ন বছর আগে ঘটেছিলো।
অধিকন্তু, এই প্রমাণটি এই উপসংহারকে আরও দৃঢ় করে যে, পারদের পরিমাণ বৃদ্ধি আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপের দ্বারা সৃষ্টি। বিলুপ্তির স্তর এবং জুরাসিক যুগের সূচনা স্তরের মাঝেও পারদের পরিমাণ বেশি হবার প্রমাণ পাওয়া গেছে যা প্রায় ১০০,০০ থেকে ২০০,০০ বছর পরে ঘটেছিলো। এটা নির্দেশ করছে, ট্রায়াসিক যুগের শেষের দিকে এবং এর পরে বিশালাকারের অগ্ন্যুৎপাতের একাধিক ঘটনা ঘটেছিল।
আরকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের বৃদ্ধির সঙ্গে উচ্চ হারে পারদ নির্গমন সম্পর্কযুক্ত। এই তত্ত্বটি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে যে, আগ্নেয়গিরির কারণে ঘটা কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকের গণবিলুপ্তির কারণ ছিল।
ট্রায়াসিক যুগের শেষের দিকের বিলুপ্তির সময়ে বায়ুমণ্ডলে পারদের ও কার্বন ডাই অক্সাইডের বিশাল পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক আমাদেরকে কিছু বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয় যা আমাদের গ্রহে প্রাণের বিবর্তনকে পরিচালিত করেছিল। ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, এটি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যান্য বিলুপ্তির ঘটনাগুলোতে পারদের সাম্ভাব্য গুরুত্বকে তুলে ধরে।
তথ্যসূত্র:
- http://www.pnas.org/content/early/2017/06/13/1705378114.abstract
- http://news.bbc.co.uk/1/hi/sci/tech/8580444.stm
- https://science.sciencemag.org/content/284/5414/616.full
- http://science.sciencemag.org/content/340/6135/941.full
- https://volcano.oregonstate.edu/book/export/html/151
- https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0031018211003063
Leave a Reply