আয়াহুয়াস্কা- একটি সাইকোট্রপিক পানীয় যা দেহবহির্ভূত অভিজ্ঞতা তৈরি করে

আয়াহুয়াস্কা (Ayahuasca) হচ্ছে এক ধরণের সাইকোএক্টিভ পানীয় যা দক্ষিণ আমেরিকার Banisteriopsis caapi নামের একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়। এই উদ্ভিদকে আয়াহুয়াস্কা উদ্ভিদও বলা হয়। উত্তর আন্দিজের কুয়েচুয়া ভাষা থেকে আয়াহুয়াস্কাকে অনুবাদ করলে পাওয়া যায় “সোল ভাইন” বা “ভাইন অব দ্য ডেড”। প্রথাগতভাবে আয়াহুয়াস্কা আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যেমন আরুয়ক, চোকো, জিভারো, পানো এবং টুকানো যারা আমাজন নদীর উচ্চ অংশে বলিভিয়া, ব্রাজিল, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর এবং পেরু তে থাকে তারা পান করে।

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো শামানিক রীতির (shamanic rituals) অংশ হিসেবে সচরাচর আয়াহুয়াস্কাকে তরল আকারে পান করে থাকে। তারা মনে করে তাতে মহাজগতের অলৌকিক প্রাকৃতিক শক্তির সাথে অথবা জঙ্গলের আত্মাগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এই পানীয়ের মনস্তাত্তিক প্রভাব বা সাইকোট্রপিক এফেক্ট ঘটে থাকে থ্রি বেটা-কার্বোলিন আলকালয়ড গ্রুপের রাসায়নিক যেমন হারমাইন, হারমোলাইন এবং টেট্রাহাইড্রোহারমাইন এর জন্য। আয়াহুয়াস্কার এই সাইকোট্রপিক এফেক্টকে তীব্র এবং দীর্ঘ করার ক্ষমতা থাকায় অন্যান্য প্রাকৃতি উপাদান যেমন গাছের বাকল এবং কোকা অথবা তামাকের পাতা একত্র করে পানীয়টির সাথে যুক্ত করা হয়।

আদিবাসীদের বাইরে যারা আছেন তারাও বিভিন্ন কারণে বা ভিভিন্ন রীতির অংশ হিসেবে আয়াহুয়াস্কা গ্রহণ করতে পারেন। এই কারণ বা রীতিগুলোর মধ্যে আছে নিউ রেলিজিয়াস মুভমেন্ট বা নব ধর্মীয় আন্দোলন, এনলাইটেনমেন্ট রিট্রিটস (যারা আধুনিক যুগ পছন্দ করেনা এমন সমাজ), নিও-শামানিক ওয়ার্কশপ, সেলফ ডিসকভারি উইকেন্ডস এবং স্পিরিচুয়াল ট্যুরিজম এর জন্য ইকো-লজ ইত্যাদি। সম্প্রতি ইউনাইস গোমেজ নামে এক ব্যাক্তি মৃত্যু বরণ করে যখন তিনি পেরুর ইক্যুটোস অঞ্চলের সামানিক অনুষ্ঠানে হত্যা করা হয়। তার প্রতি এই নৃশংসতার সাথে এরকম অবৈধ ও বারবার অনুষ্ঠিত হওয়া অনুষ্ঠানে আয়াহুয়াস্কা গ্রহণের রীতি জড়িত।

আইয়ুস্কার ব্যবহার ১৯ শতকের শেষ দিকে আন্ত-বিবাহ সম্পর্কের মাধ্যমে অ-আদিবাসীদের সাথে আদিবাসীরা এই অঞ্চলের স্পর্শে এসে তা ছড়িয়ে পরে ।

আদিবাসীদের সাথে আন্তবৈবাহিক সম্পর্ক এবং আদিবাসী অঞ্চলে অন্যদের কাজ করার চুক্তির ফলে উনিশ শতকের শেষের দিকে আয়াহুয়াস্কার ব্যবহার আদিবাসী সমাজের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।

সবচাইতে বেশি যে আকারে অ-আদিবাসী লোকদের মধ্যে এই আয়াহুয়াস্কা ছড়িয়ে পড়েছিল তা ছিল Banisteriopsis caapi এর ভাইনের সাথে Psychotria viridis নামক শ্রাব বা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের পাতার একটি মিশ্রণ। এই P. viridis গাছের পাতায়  এন, এন – ডাইমিথাইলট্রিপ্টামিন (N,N-Dimethyltryptamine) বা ডিএমটি থাকে, যা আয়াহুস্কার সাইকোট্রপিক এফেক্টকে আরও তীব্র ও দীর্ঘ করে। ডিএমটির রাসায়নিক গঠন সিলোসাইবিন (psilocybin) এর রাসায়নিক গঠনের মতই, যা সাইকেডেলিক মাশরুমে পাওয়া যায়।

সাইকাডেলিক মাশরুম

উচু আমাজন অববাহিকার আদিবাসীদের বাইরের সম্প্রদায়গুলোতে মূলত দুই ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে আয়াহুয়াস্কা গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। প্রথমটা অনুষ্ঠানটি হয় ব্রাজিলের “আয়াহুয়াস্কা ধর্মগুলোতে ” যেমন বারকুইনহা (Barquinha), সান্তো ডেইমে (Santo Daime) এবং এ উনিয়াও ডো ভেজেটাল (A União do Vegetal) সম্প্রদায়ে। এই ধর্মগুলোতে মূলধারার খ্রিষ্টীয় রীতির সাথে অনেক ঐতিহ্যগত রীতি জড়িত আছে ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে “আয়ুস্কা ধর্মগুলোর মধ্যে” যেমন বারকুইনা, সান্টো ডাইমে ও এ ইউনিয়াও ডু ভেজেটাল। এই ধর্মগুলোতে ঐতিহ্যগত রীতিগুলোর সাথে সাথে বর্তমান মূলধারার ধর্ম যেমন খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। যেমন তাদের ঐতিহ্যগত রীতি নীতির  সাথে এইসব মূলধারার ধর্মগুলোর প্রার্থনা, সংগীত এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রীতি নীতির মধ্যে সংশ্লেষ দেখা যায়।

এছাড়াও আয়াহুয়াস্কা কম-বেশী বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক প্রেক্ষাপটে গ্রহণ করা হয়ে থাকে যা আগেই বলা হয়েছে, যেমন- নিউ রেলিজিয়াস মুভমেন্ট বা নব ধর্মীয় আন্দোলন, এনলাইটেনমেন্ট রিট্রিটস (যারা আধুনিক যুগ পছন্দ করেনা এমন সমাজ), নিও-শামানিক ওয়ার্কশপ, সেলফ ডিসকভারি উইকেন্ডস এবং স্পিরিচুয়াল ট্যুরিজম এর জন্য ইকো-লজ ইত্যাদি।

 

ব্রিউ (brew) এর প্রভাবঃ

আয়াহুয়াস্কার যে ধরণটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত তা হচ্ছে একটি তিক্ত স্বাদের শক্তিশালী গন্ধের বাদামী তরল। গাছের বয়স গুণাগুণ, ধরণের সাথে সাথে পরিবেশের কিরকম অবস্থার সংস্পর্ষে গাছটি বড় হয়েছে, পরিবেশের যেসব অবস্থার কম্বিনেশনে গাছটি বড় হয়েছে সেগুলোর অনুপাত কিরকম ছিল আর এই ব্রিউ তৈরি হবার সময় কিরকম প্রোসেসিং করা হয়েছে এগুলোর উপরেও আয়াহুয়াস্কার সাইকোএক্টিভ ক্ষমতা নির্ভর করে। আয়াহুয়াস্কার ডোজ এবং কতক্ষণ পর পর এটা নেয়া হবে তা নির্ভর করে কিরকম অনুষ্ঠানে এটা গ্রহণ করা হচ্ছে তার উপর। একেকজনের সাইকোলজি অনুসারে আয়াহুয়াস্কার প্রভাব এটির প্রথমবার গ্রহণের ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর শুরু হয়, পর পর এটার গ্রহণের ফলে এর সাইকোট্রপিক এফেক্ট বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ভিজুয়াল ইমেজারি বা দৃশ্যমান অনুভূতি (বিভিন্ন বস্তুকে দেখা যা বাস্তবে নেই) জন্যই আয়াহুয়াস্কা সবচেয়ে বেশি পরিচিত। কিন্তু এতি শ্রবণ ও ঘ্রাণের অনুভূতিও জাগাতে পারে। প্রাথমিক প্রভাবে এটি পেটের উঞ্চতা ছড়িয়ে পরে শরীরকে শিথিলায়ন ও মনকে শান্ত অনুভব করায়। তবুও শরীরের শক্তি বা মনোযোগের কোন অভাববোধ তখন হয় না।

আয়াহুয়াস্কার অল্প পরিমাণ বা উইকার ডোজে শরীর ও আশপাশের পরিবেশ থেকে হালকা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিটেইলস, অনুভূতি, চাইন্তায় একধরণের মেন্টাল অবজেক্টিফিকেশন ও ক্রিটিকাল এক্সামিনেশনের সুযোগ করে দেয়। বেশী পরিমাণ বা স্ট্রং ডোজে ইররেগুলার শেপ বা অনিয়মিত আকারের বিভিন্ন দৃশ্যমান বস্তু, রঙ্গীন জ্যামিতিক নকশা বিভিন্ন ছবির বিকৃত ও ভাসমান অবস্থা দেখা যায়। এছাড়া আউট অব বডি এক্সপেরিয়েন্স বা দেহ বহির্ভূত অভিজ্ঞতা এবং স্বপ্নের মত দৃশ্যের ব্যাপারটা তো যথেষ্ট প্রখ্যাত এবং পরিচিত।

আশেপাশের শব্দগুলো বিকৃত হয়ে এসময় শোনা যেতে পারে, আবার নিজের ভেতরে থাকা শব্দের অভিজ্ঞতা থেকেও শব্দ এসে এসময় কানে বাজতে পারে। একইভাবে গন্ধ এবং স্বাদও কম বেশি প্রভাবিত হতে পারে। এর বমনোদ্রেককর বা বমিবমি ভাব তৈরির বৈশিষ্ট্যের জন্য অনেক সময় এটি গ্রহণের পর বমি হতে পারে, আবার পেটের ইনভলান্টারি ইভ্যাকুয়েশন বা অনৈচ্ছিক মলত্যাগও হতে পারে। এই প্রভাবগুলো অনুশীলন এবং খাদ্যতালিকার বাঁধাধরা নিয়মের মাধ্যমে সহনশীল করা যেতে পারে। আয়াহুয়াস্কার এই পারগেটিভ বা পেট পরিষ্কার হবার এই প্রকৃতিকে আধাত্মিক বিশুদ্ধতার প্রক্রিয়া হিসেবে ইতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ডিএমটি-কে ওষুধ হিসেবে নির্দেশনা দেয়া হয়। একে যুক্তরাজ্যে “ক্লাস এ” ক্যাটাগরির ওষুধ এবং জাতিসংঘের রীতি অনুযায়ী “শিডিউল ১ ড্রাগ” (Schedule I drug ) ক্যাটাগরির ওষুধ হিসেবে ধরা হয়। হেরোইন এবং কোকেইনের মতই প্রায়ই আয়াহুয়াস্কাকে একইরকম বাঁধা এবং অনুমোদনের নীতিতে ফেলা হয়। তবুও বিশ্বায়নের প্রভাবে আয়াহুয়াস্কার গ্রহণ এর ঐতিহ্যগত ভৌগলিক অঞ্চলকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। এর ফলে ধীরে ধীরে অনেক দেশেই (এদের মধ্যে হল্যান্ড, ইতালি, স্পেইন এবং যুক্তরাষ্ট্র আছে) আনুষ্ঠানিক ব্যবহারে আয়াহুয়াস্কা গ্রহণকে বৈধতা দেয়া হয়েছে (যদিও উৎপাদনে বৈধতা দেয়া হয় নি)।

আয়াহুয়াস্কা যেহেতু একটি সাইকোএক্টিভ বস্তু, তাই একে অন্যান্য সাইকোট্রপিক সামগ্রীর মত যত্ন সহকারেই ব্যবহার করা উচিৎ, এবং বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় থাকা ব্যক্তির এটি ব্যবহার করা উচিৎ নয়।

 

তথ্যসূত্র:

  1. http://www.bbc.co.uk/news/uk-35133580
  2. https://www.erowid.org/chemicals/ayahuasca/ayahuasca_timeline.php
  3. https://theconversation.com/magic-mushrooms-expand-your-mind-and-amplify-your-brains-dreaming-areas-heres-how-28754
  4. http://www.legislation.gov.uk/ukpga/1971/38/schedule/2
  5. https://www.erowid.org/chemicals/ayahuasca/ayahuasca_death.shtml

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.