পেনিট্রেটিভ সেক্স (পিনিস-ভাজাইনা ভিত্তিক যৌনতা) লক্ষ লক্ষ বছর জুড়ে এগ বা ডিম্বাণুতে স্পার্ম বা শুক্রাণু পৌঁছে দেবার এবং গর্ভধারণের সূচনা করার কৌশল হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সেক্স বা যৌনতা বলতে দুই সেট জিনের মিলন ছাড়াও আরও অনেক কিছু বোঝায়। এই “কেন যৌনতা” নামক আর্টিকেলে যৌনতা এবং লিঙ্গের উপর বিভিন্ন জীববিজ্ঞানগত, শারীরিক এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
Table of Contents
সন্তানধারণের ক্ষেত্রে নারীদেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে যৌনতার ভূমিকা
প্রথমে আলোচনা করা হবে কিভাবে একজন নারীর ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তার যৌনক্রিয়ার প্রতি সাড়া দেয় এবং স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণকে সহজতর করে।
যাদের জীববিজ্ঞান সম্পর্কে একটু আধটু ধারণা আছে তারা জানেন যে, নারীর ডিম্বাণুকে ফারটিলাইজ বা নিষিক্ত করতে এবং একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণকে নিশ্চিত করতে কেবল একটি স্পার্ম বা শুক্রাণুর প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই কথাটার মাধ্যমে যেন সকলে এই ইংগিত করেন, সেই নিষিক্তকারী শুক্রাণু ছাড়া বাদবাকি সব স্পার্মের কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই, গর্ভধারণের ক্ষেত্রে তো একেবারেই না।
যাইহোক, জীববিজ্ঞানীগণ এখন বিশ্বাস করেন, যৌনক্রিয়া কেবলমাত্র স্পার্ম ডেলিভারি প্রোসেস নয়, বরং সেই সাথে এটা একধরণের জীববিজ্ঞানগত আদান প্রদান বা যোগাযোগ। ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করা হোক আর নাই হোক, ইজাক্যুলেটেড ফ্লুইড বা বীর্যরসের স্পার্ম এবং অন্যান্য অংশগুলো নারীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটায়। আর পরবর্তীতে সেই নারী যদি গর্ভধারণ করেন, তাহলে তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম এই পরিবর্তনগুলোর ফল পাওয়া যায়। আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে, ফারটাইলিটি প্ল্যানিং এর ক্ষেত্রে নিয়মিত যৌনক্রিয়ার গুরুত্ব আছে, এমনকি ইন ভিট্রো ফারটিলাইজেশন (IVF) বা এরকম অন্যান্য সহায়ক প্রজননক্রিয়াতেও নিয়মিত যৌনক্রিয়ার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে যেখানে প্রজননের জন্য কোন ধরণের যৌনক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না।
শুক্রাণু আণবিক বার্তার একটি জলাশয়ে সাঁতরে বেড়ায়
এনিমেল রিসার্চ এবং ক্লিনিকাল স্টাডির মাধ্যমে গবেষকগণ মন্তব্য করেছেন, যে তরলে শুক্রাণুরা ভেসে বেড়ায় তা নারীর উর্বরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বীর্যরসে বা সেমিনাল ফ্লুইডে ক্ষুদ্র অণু থাকে যা বায়োলজিকাল সিগনাল বা জীববিজ্ঞানগত বার্তা হিসেবে কাজ করে। একবার তা নারীর ভাজাইনা বা যোনি এবং সারভিক্সে জমা হলে তা নারীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্ররোচিত করে যাতে সেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এমন একটি অবস্থা গ্রহণ করে যা “ট্রান্সপ্লান্টেশন অ্যান্টিজেনস” নামক স্পার্ম প্রোটিনকে সহ্য করতে (এক্ষেত্রে সনাক্তকরণ এবং স্বীকার) সক্ষম হয়। স্পার্ম প্রোটিনের প্রতি এই সহনশীল অবস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন ফার্টিলাইজেশন বা নিষিক্তকরণ ঘটে। রোগপ্রতিরোধী কোষগুলো বর্ধিষ্ণু সন্তানের দেহের একই ট্রান্সপ্লান্টেশন অ্যান্টিজেনকে সনাক্ত করতে পারে, আর তাই যে প্রক্রিয়ার সাহায্যে ভ্রূণটি জরায়ু বা ইউটেরাসের দেয়ালে প্রোথিত হয় এবং একটি স্বাস্থ্যকর প্লাসেন্টা এবং ফিটাস গঠন করে সেই প্রক্রিয়াটি একটি মজবুত ভিত্তি ও অনেক সহায়তা লাভ করে।
সুতরাং, সময়ের সাথে সাথে বারবার একই যৌন সঙ্গীর সাথে যৌন সম্পর্কের ফলে পুরুষ সঙ্গীটির ট্রান্সপ্লান্টেশন অ্যান্টিজেনের প্রতি নারীদেহের সহনশীল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উদ্দীপিত এবং শক্তিশালী হয়। কয়েক মাস নিয়মিত যৌনক্রিয়ার দ্বারা ধীরে ধীরে একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণের জন্য একজন নারীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তার সঙ্গীর সেমিনাল ফ্লুইডের প্রতি সাড়া দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবের ফলে দেখা যায় এরকম কয়েক ধরণের ইনফারটাইলিটি এবং গর্ভধারণ সমস্যা আছে। এসব ক্ষেত্রে এই সহনশীলতার প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে স্থাপিত হয় না।
কয়েক মাসের যৌনতার পর স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণ
প্রিক্লাম্পসিয়া নামে একটি হেলথ কন্ডিশন আছে যা আমাদের দেখায়, কিভাবে সেমিনাল ফ্লুইড সার্থক গর্ভধারণকে প্রভাবিত করে। প্রিক্লাম্পসিয়া হল গর্ভধারণের একটি ইমফ্লেমেটরি রোগ (শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে যায়) যাতে ফিটাসের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এর কারণে প্রায়ই প্রিম্যাচিওর বার্থ বা অপরিণত প্রসব দেখা যায়। যদি চিকিৎসা না করা হয় তাহলে তা মায়ের জন্য জীবনহানিরও কারণ হতে পারে। বেশিরভাগ প্রিক্লাম্পসিয়া রোগই দেখা যায় যখন গর্ভধারণের পূর্বে সন্তানের বাবার সাথে মার যৌন ক্রিয়া কম হয়। সেই সাথে এটা মায়ের শরীরে রোগপ্রতিরোধ সহনশীলতা তৈরির অপর্যাপ্ততার সাথে সম্পর্কিত।
যৌনসংসর্গের ফ্রিকোয়েন্সি বা পৌনঃপুনিকতার চেয়ে (যেমন সপ্তাহে কয়বার যৌনক্রিয়া করা হয়) একটি কাপল কত সময় ধরে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন (যেমন গর্ভধারণের পূর্বে কত মাস ধরে যৌনক্রিয়া করা হয়েছে) তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ২৫০৭ জন প্রথম গর্ভধারণ করা নারীদের উপর একটি গবেষণা চালিয়ে দেখা যায় তাদের ৫% এর প্রিক্ল্যাম্পসিয়া হয়েছে। এই প্রিক্ল্যাম্পসিয়ায় আক্রান্ত নারীদের মাঝে শর্ট সেক্সুয়াল রিলেশনশিপ (ছয় মাসের কম) এর সম্ভাবনা অনাক্রান্ত নারীদের দ্বিগুণ ছিল। কনসিভিং পার্টনারের (সন্তানের বায়োলজিকাল পিতা) সাথে তিন মাসেরও কম যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা নারীদের ক্ষেত্রে প্রিক্যাম্পসিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ, যা গড় সাম্ভাব্যতার দ্বিগুণেরও বেশি। খুব কম নারীই সন্তানের বায়োলজিকাল পিতার সাথে প্রথম যৌন ক্রিয়ায় গর্ভধারণ করে। এক্ষেত্রে প্রিক্ল্যাম্পসিয়ার সম্ভাবনা বেড়ে দাঁড়ায় ২২ শতাংশে, যা গড় সাম্ভাব্যতার তিনগুণেরও বেশি। এদের ক্ষেত্রে সদ্যজাত সন্তানের ওজনও কম হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি হয়। এদিকে গর্ভধারণের সময় যৌনক্রিয়ার ফ্রিকোয়েন্সি বা পৌনঃপুনিকতার সাথে প্রিক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকির মধ্যে কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় নি, তাই এর গর্ভধারণের আগে কত সময় ধরে যৌনক্রিয়া করা হয় তাকেই সবচেয়ে বেশি ধরা হয়।
স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণে সহায়তা করতে রোগপ্রতিরোধী সহনশীলতার অবস্থা তৈরি করাটা কনসিভিং পার্টনার বা সন্তানের বায়োলজিকাল পিতার বেলাতেই স্পেসিফিক হয়। কোন নারী তার পার্টনার বা যৌনসঙ্গীকে পরিবর্তন করলে তিনি আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসেন, এবং সন্তান ধারণের পূর্বে তাকে অবশ্যই আবার নতুন পার্টনারের সাথে ইমিউন টোলারেন্স বা রোগপ্রতিরোধী সহনশীলতা তৈরি করতে হয়।
যেসব নারী কোন বেরিয়ার মেথড যেমন কনডোম অথবা সারভিকাল ক্যাপ ব্যবহার করেন (যা যোনি এবং সারভিক্সে সেমিনাল ফ্লুইড এবং স্পার্ম এর সংস্পর্শ হতে দেয় না), এবং এরপর কনট্রাসেপশন বন্ধ করার কিছুদিন পরেই গর্ভধারণ করেন, তাদের বেলাতেও প্রিক্লাম্পসিয়ার উচ্চ হার থাকে। তুলনায়, যেসব নারী গর্ভধারণের পূর্বে ইনট্রাইউটারাইন ডিভাইস (IUD- Intrauterine device) ব্যবহার করেন তাদের প্রিক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
IVF এর সময় যৌনতা গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ায়
IVF বা ইন ভিট্রো ফারটিলাইজেশন ও সহায়ক প্রজননের অন্যান্য পদ্ধতির ক্লিনিকাল স্টাডিগুলোতেও সুস্বাস্থ্যকর গর্ভধারণের জন্য সঠিক পরিবেশ তৈরি করার গুরুত্ব পর্যবেক্ষণ করা যায়। ভ্রুণ জরায়ুতে স্থানান্তরিত হবার সময় কাপল যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হলে নারীদেহে ফারটাইলিটি উন্নত হয়। সাতটি গবেষণায় থাকা ২০০০ এরও বেশি রোগীর সমন্বিত ডেটা দেখায় যে, এগ কালেকশন এবং এমব্রায়ো ট্রান্সফারের সময় সেমিনাল ফ্লুইড ভাজাইনাল কনটাক্টে আসলে ডিটেক্টেবল প্রেগনেন্সি বা সনাক্তযোগ্য গর্ভধারনের সম্ভাবনা ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অস্ট্রেলিয়ান ও স্প্যানিশ কাপলদের নিয়ে করা একটি গবেষণা বলছে যে, এমব্রায়ো ট্রান্সফার বা ভ্রূণ স্থানান্তরণের ঠিক আগের বা ঠিক পরের দিনগুলোতে যৌনক্রিয়ার ফলে প্রেগনেন্সির সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই গবেষণাগুলো প্রেগনেন্সি বা গর্ভধারণের প্রাথমিক ধাপগুলোকে ফোকাস করে করা হয়েছে। এরকম এসিস্টেড রিপ্রোডাকশন বা সহায়ক প্রজননের পর যৌনক্রিয়া ফুল টাইম প্রেগনেন্সি বা গর্ভধারণের সকল স্তরেই প্রভাব ফেলে কিনা এটা জানার জন্য আরও গবেষণা দরকার।
ডোনেটেড এগ বা ডোনর স্পার্মের ব্যবহারের বেলায় প্রিক্লাম্পসিয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এর একটি কারণ হতে পারে সেমিনাল ফ্লুইডের সাথে সংস্পর্শের অভাব যেখানে ডোনরের ট্রান্সপ্লান্টেশন এন্টিজেনের সাথে নারীর প্রাথমিক সংযোগ ঘটেনি। ডোনর সিমেন ব্যবহারের পর এই ঝুঁকি কমানো যায় যদি এর পূর্বে একই ডোনরের সাথে মাল্টিপল প্রায়র ইনসেমিনেশন সাইকেল চালানো হয় (যেমন ইনট্রাইউটারাইন ইনসেমিনেশন যেখানে ডোনর স্পার্মকে পূর্বে কয়েকবার সন্তানধারণের সম্ভাবনা ছাড়াই যোনি এবং সারভিক্স এর সংস্পর্শে আনা হয়)। যারা IVF এর মোডিফাইড ভারশন ICSI বা ইনট্রাসাইটোপ্লাসজিমক স্পার্ম ইনজেকশনের মাধ্যমে সন্তানধারন করতে চান, তাদের বেলাতেও একই রকম প্রিক্লাম্পসিয়ার সমস্যা দেখা যায়। যারা পার্টনারের খুব কম স্পার্ম কাউন্টের জন্য তাদের পার্টনারের ট্রান্সপ্লান্টেশন এন্টিজেন কম লাভ করেন তাদের বেলাতেও প্রিক্লাম্পসিয়া রোগের সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।
কোন কোন কাপলের বেলায়, সেমিনাল ফ্লুইডের উপাদানের ভারসাম্যহীনতা অথবা ইমিউন সিস্টেম ফ্যাক্টরগুলোও নারীদেহে টোলারেন্ট ইমিউন প্রোফাইল বা সহনশীল রোগপ্রতিরোধী অবস্থা তৈরি করতে বাঁধা দান বা প্রক্রিয়াটি ধীর করে দিতে পারে। কোন কোন কাপলের বেলায়, ইমিউনোলজিকাল ইনকম্প্যাটিবিলিটি বা রোগপ্রতিরোধী অসামঞ্জস্যতা নারীদেহে এই রোগপ্রতিরোধী সহনশীলতাকে দুর্বল করে দেয়, তা তারা সন্তানধারণের পূর্বে যত সময় ধরেই যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করুক না কেন। আবার কোন কোন কাপলের বেলায় নারীর সন্তানধারণের জন্য তুলনামূলক বেশি সময় ধরে যৌনক্রিয়ার প্রয়োজন হয়।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সন্তানধারণের ক্ষেত্রে দ্বাররক্ষী হিসেবে কাজ করে
কেন প্রজননের ক্ষেত্রে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এতটা গুরুত্বপূর্ণ, এই বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। একটি থিওরি অনুসারে পুরুষ পার্টনারের জেনেটিক্স সম্পর্কে উপলব্ধি করার জন্য নারীদেহে সেমিনাল ফ্লুইডের ভেতরে থাকা সিগনালকে অনুভব করা এবং এতে সাড়া দেয়ার ক্ষমতা বিবর্তিত হয়েছে। বিজ্ঞানীগণ এখন নারী ও পুরুষের মধ্যে থাকা মূল সিগনালগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেই সিগনালগুলো সহনশীলতা বৃদ্ধি করে।
আবার পুরুষের ধূমপান করা, বেশি ওজনের হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো, কিভাবে একজন নারী বায়োলজিকাল সেন্সে যৌনক্রিয়ায় সাড়া দেবে বা কিভাবে নারীর মাঝে কিভাবে কিরকম রোগপ্রতিরোধী সহনশীলতা তৈরি হবে এসব ঠিক করে দেয়। তাই এখান থেকে বলা যায়, সন্তানধারণের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে মায়ের স্বাস্থ্যের সাথে সাথে বাবার স্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর যৌনতার ভূমিকা
এবারে পারস্পরিক সম্মতিতে হওয়া যৌনসম্পর্কের ফলাফল হিসেবে শারীরিক, সামাজিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপকার সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
সমাজে আপনি যৌনতার ব্যাপারে কথা বলুন বা নাই বলুন, যৌনতা আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি আমাদের জন্মের সাথেও নারী পুরুষের অর্থবহ চেহারা, আন্তরিক কিছু মুহূর্ত, হাত ধরাধরি, অরগাজম ইত্যাদির ব্যাপার জড়িয়ে আছে।
তাহলে যৌনতা কি কেবল প্রজননের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ? না, বিবর্তনগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বরং মানবজীবনে যৌনতাকে আরও ভালভাবে তুলে ধরা যায়। বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যায়, শারীরিক এবং সামাজিক স্তরে যৌনতা প্রজননের চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
বেশিরভাগ অমানব প্রাণীরই রিপ্রোডাকটিভ কনটেক্সট বা প্রজননগত বিষয়ের বাইরে যৌনতায় কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু মানবনারীরা প্রতি মাসের মাত্র কয়েক দিন সময় জুড়ে ফারটাইল বা উর্বর থাকলেও তারা তাদের সম্পূর্ণ মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল বা মাসিকচক্রের যে কোন সময়েই যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে, এমনকি তারা মেনোপাউসের পরে ইনফারটাইল বা অনুর্বর থাকলেও যৌনক্রিয়ায় অংশ নেয়। এছাড়াও প্রজননকেন্দ্রিক যৌনতার মত সমলৈঙ্গিক যৌনতা, গর্ভনিরোধক ব্যবহার করে যৌনতাও অনেক দেখা যায়।
আসলে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, এই সব ধরণের যৌনতার কারণটা কী। কিন্তু এই যৌনতার জীববিজ্ঞানগত ফলাফলগুলো আমাদেরকে এর সম্পর্কে অনেক ধারণা দেয়।
যৌনতা মানুষকে একতাবদ্ধ করে
আপনি কি কাগজে কলমে লেখা এমন কোন বিধি দেখেছেন যা আপনাকে বলে দেয় কোন ব্যক্তিটি আপনার জীবন সঙ্গী হিসেবে সঠিক? বা কোথাও কোন লেখা বা নির্দেশনা পড়ে আপনি আপনার জন্য সেখানে উল্লিখিত সঠিক ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যান? না, সঙ্গি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি এরকম হয় না, আপনাকেই বরং সামনে এগিয়ে যেতে হয়, এরপর ভিতর থেকেই একটা ধাক্কা আসে যা বলে, এই ব্যক্তির গন্ধকে সঠিক মনে হচ্ছে না, বা ভিতরের কোন কিছুর অভাব আপনাকে জানান দেয়, এই ব্যক্তির ক্ষেত্রে আপনার মধ্যে আশানুরূপ উন্মাদনার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এরকম বিভিন্ন সিগনালের মাধ্যমে আপনি জেনে বা না জেনে আপনার জন্য সঠিক সঙ্গীকে নির্বাচন করেন। আমাদের শরীর আমাদের মনকে বলে, ঠিক কার সাথে আমরা থাকতে চাই। একইভাবে, আমরা কারো সাথে ঘনিষ্ট হতে চাই কি চাই না, এ বিষয়ে আমাদের শরীর আমাদেরকে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করে।
যখন আমরা স্পর্শ করি, চুম্বন করি ও যৌনতায় লিপ্ত হই, আমাদের শরীর কিছু হরমোন নিঃসরণ করে যা বন্ডিং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই হরমোনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল অক্সিটোসিন ও ভ্যাসোপ্রেসিন। হরমোনের এরকম নিঃসরণ বিশেষ করে দেখা যায় যৌন উত্তেজনা এবং অরগাজমের সময়। এই নিঃসরণ কাপলের মধ্যে ভালবাসা ও কমিটমেন্ট বা অঙ্গীকার বৃদ্ধি করে। এছাড়া এটি তাদের একসাথে থাকার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করে বলে মনে করা হয়।
রোডেন্ট বা এক ধরণের ইঁদুর নিয়ে করা গবেষণা এই ধারণাকে সমর্থন করছে। যেমন, নারী ভোলদেরকে (ক্ষুদ্র ইঁদুরের মত প্রাণী) পুরুষ ভোলদের সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা গেছে যখন তাদের যৌনতার সময় অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়েছিল।
মানুষের বেলায় দেখা যায়, যেসব কাপল কম যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছেন তাদের সম্পর্ক ভাঙ্গনের সম্ভাবনা অধিক যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হওয়া কাপলের থেকে বেশি থাকে। কিন্তু অক্সিটোসিন যে কেবল কাপলের জন্য বন্ধনের জন্যই ভাল তা নয়, অনেক সামাজিক পরিস্থিতিতেই এটা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে রক্তধারায় বাহিত হয়, যেমন বুকের দুধ খাওয়ানো, গান গাওয়া এবং একত্রে থেকে আনন্দের সাথে বিভিন্ন কাজ করা। সুতরাং দেখা যায়, দলবদ্ধ ও সামাজিক কাজে অক্সিটোসিনের গুরুত্ব অনেক, এবং এটা অলট্রুইজম বা হিতবাদ বা অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করার সাথেও এটি সম্পর্কযুক্ত।
বনোবোদেরকে (গ্রেট এপদের একটি প্রজাতি) যৌনতা এবং সামাজিক সমন্বয়তার মধ্যকার সম্পর্কের পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করতে দেখা যায়। তারা প্রায়ই বিভিন্ন সেক্সুয়াল এক্টিভিটি বা যৌনক্রিয়ার দ্বারা নিজেদের মাধ্যমে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায়। এই সেক্সুয়াল এক্টিভিটির মধ্যে আছে যৌনাঙ্গে ঘর্ষণ, সঙ্গম, হস্তমৈথুন, মৌখিক যৌনতা বা ওরাল সেক্স ইত্যাদি। এগুলো অবশ্যই আমাদের সমাজে চেষ্টা করার মত কোন ঘটনা নয়, কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে একটি ধারনা দেয় যে, যৌনতা কাপলের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
যৌনতা একটি স্বাস্থ্যকর ক্রিয়া
যৌনতা একধরণের শরীরচর্চা: আপনি গত যৌনমিলনে কি পরিমাণ ক্যালরি বার্ন করেছেন তা sexcalculator এর মত মজার কোন অনলাইন ক্যালকুলেটর ব্যবহার করেই জানতে পারবেন (তথ্যসূত্রে একটি লিংক দেয়া আছে)। দুর্বল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের লোকদের মাঝে বিভিন্ন যৌন সমস্যা থাকতে দেখা যায়। এখানে কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন। স্বাস্থ্যকর ব্যক্তি বেশি যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার প্রবণ হন। এও দেখা যায়, শারীরিক পরিশ্রম এবং সন্তোষজনক যৌনতা উভয় মিলে ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যকর এবং সুখী জীবনের দিকে চালিত করতে পারে।
আবার দেখা যায়, মানুষের যৌন ক্রিয়া অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ, এনারজেটিক। আর এদের যৌনক্রিয়ার রীতিও এমন যাতে বেশি শক্তির খরচ হয়। এটা খুব সম্ভব যে, মানবযৌনতার এই ধরণ সাম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী সঙ্গীকে মূল্যায়ন করার জন্যই বিবর্তিত হয়েছে।
যৌনতা আমাদেরকে সৃজনশীল বানাতে পারে
কিছু তাত্ত্বিক প্রস্তাব করেন, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা প্রভৃতি কলা সঙ্গমের তাড়না থেকে জন্মলাভ করেছে। প্রাণীজগতে কোন সমাজে যদি সঙ্গী নির্ধারণের জন্য অন্তত কিছু চয়েস থাকে, সেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করে। আর এর কারণে প্রাণীকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতে হয় যা তাদেরকে বিপরীত লিঙ্গের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে।
ধারণা করা হয়, এই প্রতিযোগিতার জন্য মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সৃজনশীল প্রদর্শনের জন্ম হয়েছে। আবার সেই সাথে হাস্যরস বা হিউমারের জন্মও এভাবেই হয়েছে। বিভিন্ন সৃজনশীল ব্যক্তি যে তুলনামূলকভাবে সহজে সম্ভাবনাময় সঙ্গী লাভ করেন তা আমরা আমাদের সমাজেই অনেক দেখে থাকি। যেমন পিকাসোর জীবনে সবচাইতে সৃজনশীল এবং উৎপাদনশীল সময় ছিল তখনই, যখন তার জীবনে একজন নারীর আবির্ভাব ঘটে।
তাহলে বিজ্ঞান অনুসারে এক কথায় বলা যায়, নন-রিপ্রোডাক্টিভ সেক্স বা প্রজননহীন যৌনতা আমাদেরকে বিভিন্ন জীববিজ্ঞানগত পুরষ্কার প্রদান করতে পারে। এটা মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে, সৃজনশীল প্রচেষ্টার তাড়না দিতে পারে এবং সুস্বাস্থ্যেও ভূমিকা রাখতে পারে।
উপরের আলোচনায় যৌনতার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে আমাদের উপর যৌনতার প্রভাব ও ফলাফলকে কেন্দ্র করে। এখান থেকে আমরা যেমন দেখি যৌনতার গুরুত্ব যেমন শুধুমাত্র প্রজননেই নিহিত নয়, তেমনি সাময়িক বিনোদনেও এটি সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক বিজ্ঞান যৌনতা সম্পর্কে আমাদের মাঝে যে অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করছে তা অনুসারে মানবজীবনে যৌনতার ভূমিকা, প্রভাব, গুরুত্ব ও ফলাফলা আরও প্রগাঢ়, বিস্তৃত ও ব্যাপক।
তথ্যসূত্র:
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/26178848
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/27485480
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/23480148
- http://esa-srb-2013.m.asnevents.com.au/schedule/session/1518/abstract/7382
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/25023687
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/20331588
- https://www.betterhealth.vic.gov.au/health/healthyliving/pregnancy-pre-eclampsia
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/19679359
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/12748491
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/21529966
- http://www.biomedsearch.com/nih/paternal-role-in-pre-eclampsia/22936817.html
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/2810672
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/25854682
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/2810672
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/25281684
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/11098040
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/10469693
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/19232411
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/11879865
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/22114108
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/20347158
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/25124428
- http://science.sciencemag.org/content/322/5903/900
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/8135652
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/7576222
- https://asu.pure.elsevier.com/en/publications/sexual-frequency-and-the-stability-of-marital-and-cohabiting-unio
- http://www.pnas.org/content/93/21/11699.short
- http://link.springer.com/article/10.1007/BF02734261
- http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0018506X12000098
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/20538951
- http://jamanetwork.com/journals/jamainternalmedicine/article-abstract/604787
- http://www.sexcalculator.co.uk/
- http://jamanetwork.com/journals/jama/fullarticle/188762
- http://www.counter-currents.com/2010/12/darwins-other-idea-geoffrey-millers-the-mating-mind/
- https://asu.pure.elsevier.com/en/publications/peacocks-picasso-and-parental-investment-the-effects-of-romantic-
- https://books.google.com.au/books?id=cEDVUT4TvYcC&redir_esc=y
Leave a Reply