একটি নতুন “হৃদয়বিদারক” গবেষণায় গবেষকগণ আবিষ্কার করেছেন যে জেন্ডার স্টেরিওটাইপ বাচ্চাদেরকে মাত্র ছয় বছর বয়সেই এফেক্ট করতে পারে, যেই বয়সে কোন বালিকা বুদ্ধিমত্তা, মেধা এবং প্রতিভার মত বৈশিষ্ট্যগুলোকে পুরুষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ভাবতে শুরু করে।
এটা গোপন নয় যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয়ে বা স্টেম ফিল্ডে (STEM- Science, Technology, Engineering and Mathematics) নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণে একটি ভারসাম্যহীনতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে (যেখানে এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছিল) স্টেম ফিল্ডের নারীর সংখ্যা মাত্র ৩০ শতাংশ।
এরকম কেন হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়িস এবং প্রিন্সটনের গবেষকগণ সাম্ভাব্য বিভিন্ন কারণ নিয়ে তদন্ত করেছেন যেগুলোর মধ্যে সামাজিক জেন্ডার স্টেরিওটাইপগুলো যেমন “ইন্টেলেকচুয়াল ট্যালেন্ট” কে পুরুষের উপর আরোপ করায় শিশু বয়স থেকে বালিকাদেরকে প্রভাবিত করে কিনা তাও ছিল।
তাদের গবেষণায় পাওয়া যায়, ছয় বছর বয়সী বালিকাও বিশ্বাস করে যে ব্যতিক্রমধর্মী মেধাবী হওয়া বালকদের বৈশিষ্ট্য, এবং তাদের পুরুষ কাউন্টারপার্টদের “প্রতিভা” প্রকাশ করার সম্ভাবনা বেশি। এটাও দেখা যায় যে, এই বয়সেই বালিকারা “রিয়েলি, রিয়েলি স্মার্ট” কাজগুলো থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে শুরু করে।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষক এবং গবেষণাটির সিনিয়র অথর আন্দ্রেই চিম্পিয়ান বলেন, “আমরা কেবল বালিকাদেরকে সমাজের কিছু স্টেরিওটাইপড ধারণাকে গ্রহণ করতেই দেখছি না, সেই সাথে তাদেরকে এইসব স্টেরিওটাইপের ভিত্তিতে কাজকর্ম পছন্দ করতেও দেখছি। ব্যাপারটি হৃদয়বিদারক।”
বাচ্চাদের মধ্যে বুদ্ধিমতা ও সক্ষমতার ধারণা কী এটা জানার জন্য গবেষণাটি ৪০০ জন বাচ্চাদের দিয়ে করা হয়, যাদের মধ্যে অর্ধেক ছিল বালিকা। এরা পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে ছিল।
গবেষণাটির কো-অথর লিন বিয়েন বলেন, “আমাদের সমাজ মেধাকে নারীর চেয়ে পুরুষের উপর বেশি আরোপ করতে চায়। আর এই ধারণাটিই নারীদেরকে সেইসব চাকুরি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে যেখানে মেধার প্রয়োজন হয়। আমরা জানতে চেয়েছিলাম সমাজের বাচ্চারাও এই ধরণের স্টেরিওটাইপে প্রভাবিত কিনা।”
মেধার বড়দের ধারণাকে বোঝার বাচ্চাদের উপায় হিসেবে “রিয়েলি, রিয়েলি স্মার্ট” ফ্রেজটি ব্যবহার করে গবেষকগণ বাচ্চাদের উপর জেন্ডার স্টেরিওটাইপের প্রভাবের সন্ধান করেছেন।
একটি পরীক্ষায় বাচ্চাদেরকে একটি গল্প পড়ে শোনানো হয় যেটার কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল “রিয়েলি, রিয়েলি স্মার্ট”, কিন্তু বাচ্চাদেরকে এটা প্রকাশ করা হয় নি যে চরিত্রটি পুরুষ ছিল না মহিলা। এরপর নারী ও পুরুষের অনেকগুলো ছবি দিয়ে বাচ্চাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় যে এদের মধ্যে কার সেই গল্পের চরিত্রটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের বেলায় দেখা গেল তাদের বেশিরভাগই নিজেদের জেন্ডারের ছবিকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ছয় ও সাত বছর বয়সী বাচ্চাদের বেলায় দেখা গেল বেশির ভাগ বাচ্চাই পুরুষকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
আরেকটি পরীক্ষায় বাচ্চাদেরকে দুটো গেম খেলতে দেয়া হয়। গেমগুলোর একটাকে বর্ণনা করা হয় যে সেটা “যারা রিয়েলি, রিয়েলি স্মার্ট” তাদের জন্য, আরেকটি গেমকে বর্ণনা করা হয় যে সেটা “যারা রিয়েলি, রিয়েলি হার্ড বা কঠোর চেষ্টা করে” তাদের জন্য। পরীক্ষায় দেখা যায়, দুটো জেন্ডারই “হার্ড” গেমের প্রতি আগ্রহী। কিন্তু ছয় ও সাত বছরের মেয়েদের বেলায় দেখা গেল তারা একেবারেই “স্মার্ট” গেমটা থেকে দূরে থাকছে।
চিম্পিয়ান বলেন, “এটার মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায় এইসব বালিকাদের কাছে অন্য জিনিসগুলোর বেলায় কারা “রিয়েলি, রিয়েলি স্মার্ট” হিসেবে বিবেচিত হয়”।
মোটের উপর এই গবেষণাটি হাইলাইট করে যে কিভাবে ছোট শিশুরাও সমাজে থাকা জেন্ডার স্টেরিওটাইপগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয় যেগুলো বলে, “মেধা বা প্রতিভা পুরুষের মধ্যেই বেশি কমন”, এবং বালিকাদের ভবিষ্যতে এই স্টেরিওটাইপগুলো খুব খারাপ প্রভাব ফেলছে।
চিম্পিয়ান ব্যাখ্যা করেন, “এই ধারণাগুলো এত কম বয়সে এদের মধ্যে ঢুকে যায় বলেই, এগুলো ছেলেমেয়েদের শিক্ষা জীবনে প্রভাব ফেলার জন্য অনেক সময় পায়।”
গবেষণার লেখকগণ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত তাদের পেপারে উপসংহার টেনেছেন, “নারীরা সেইসব ক্ষেত্রে আন্ডাররিপ্রেজেন্টেড যেসব ক্ষেত্রের সদস্যরা মেধার প্রকাশ করেন (যেমন পদার্থবিজ্ঞান এবং দর্শন)” কারণ সমাজের জেন্ডার স্টেরিওটাইপগুলো খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের মধ্যে আশ্রয় নেয়, সম্ভবত “তাদেরকে সম্মানজনক চাকরিজীবনের প্রতি নিরুৎসাহিত করার জন্য”।
গবেষণায় বলা হয়, “বর্তমান ফলাফল একটি ভারি উপসংহার সাজেস্ট করছে। সেটা হল, অনেক নারীই খুব কম বয়সেই এই ধারণাটিকে হজম করে নেয় যে মেধা একটি পুরুষ বৈশিষ্ট্য। এই স্টেরিওটাইপটি বাচ্চারা গ্রহণ করা মাত্রই তা তাদের আগ্রহকে একটি আকার দিতে শুরু করে এবং এর মাধ্যমে সম্ভবত এই স্টেরিওটাইপটি তাদের কর্মজীবনের পরিসরকে ছোট করে দেয়”।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply