সম্প্রতি একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে সোনা এবং প্লাটিনামের মত মূল্যবান ধাতু খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে যেত যদি ৪.৪৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবী এবং একটি বড় বস্তুর মধ্যে একটি সংঘর্ষ না ঘটত। পৃথিবীর প্রথম দিকের ইতিহাসের ক্ষেত্রে, সৌরজগতে অন্যান্য পাথুরে গ্রহ তৈরিতে এবং অন্যান্য নক্ষত্রে পৃথিবীর মত গ্রহ তৈরি হবার ক্ষেত্রে এই থিওরিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ আছে।
টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ডঃ রামন ব্রেসার কিছু ভিন্ন ভিন্ন মডেল প্রস্তাব করেছেন, যেগুলোর একটিতে জুপিটার বা বৃহস্পতি গ্রহ বেশির ভাগ ইনার সোলার সিস্টেম রাবল বা সৌরজগতের ভেতরের পাথুরে টুকরাগুলোকে শোষণ করে নেয় এবং এর ফলে অন্যান্য গ্রহের ভাগে অনেক কম রাবল জোটে।
ব্রেসারের এই আইডিয়াটি বর্তমান প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে যায়। বর্তমান মতবাদ অনুসারে পৃথিবীতে কয়েকশো মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে এস্টারয়েডরা আঘাত হানে। এই মতবাদটি এই গ্রহের সারফেসে মিনারেলদের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করে, আবার সেই সাথে ঠিক কোন অবস্থায় পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ঘটে সেটারও ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু তারপরেও কিছু বিষয় এটা ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
প্রাথমিক পৃথিবী এতটাই উষ্ণ ছিল যে, ভারি ধারু যেমন সোনা, প্লাটিনাম এবং প্যালাডিয়াম লোহার সাথে মিশ্রিত ও গলিত হয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে প্রবেশ করে। তাই এই গ্রহের উপরের দিকের ক্রাস্টে এইসব ভারি মূল্যবান ধাতু তখনই চলে আসতে পারে যদি পৃথিবীর উপর কোন এস্টারয়েড আঘাত হানে। বর্তমান প্রচলিত মডেল বলছে যে পৃথিবী কয়েকশো মিলিয়ন বছর ধরে বারবার এস্টারয়েড কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আর আগেই জানানো হয়েছে যে এই মডেলটিতে কিছু অসঙ্গতি থাকলেও অনেক বিষয়কে এটা ব্যাখ্যা করতে পারে বলে এটা বর্তমানে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ব্রেসারের নতুন মডেলটি বলছে পৃথিবী এত ঘনঘন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়ে একবার প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়, আর এই আঘাতের কারণে ক্রাস্টে মূল্যবান ধাতু তো উঠে আসেই, সেই সাথে জন্ম হয় চাঁদের। আর এই মডেলকে সাপোর্ট করা এভিডেন্সও নেহাত কম না।
ব্রেসার মনে করেন, আর্থ ক্রাস্ট (পৃথিবীর সবচেয়ে বাহিরের স্তর) এর কঠিন হবার পরেই পৃথিবীতে মূল্যবান ধাতুগুলো এসেছিল। তিনি আর্থ এন্ড প্লানেটারি সায়েন্স লেটারস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় যে নতুন মতবাদটি প্রদান করেছেন তা বিতর্কিত “গ্র্যান্ড ট্যাক থিওরি”কে সমর্থন করে। গ্র্যান্ড ট্যাক থিওরি অনুসারে বৃহস্পতিকে এখন সূর্য থেকে যতটা দূরত্বে দেখা যায়, এটা তার থেকে অনেক কাছে ছিল। এই গ্রহটি সূর্য থেকে বাইরে চলে যাবার পূর্বে সূর্যের আরও কাছাকাছি চলে এসেছিল।
গ্র্যান্ড ট্যাক থিওরিকে মেনে নেয়া কিছুটা কঠিন হলেও এটা বেশ কিছু অসঙ্গতির ব্যাখ্যা দান করে। যেমন, বৃহস্পতি গ্রহের এই অবস্থানের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারে যে কেন বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের ভেতরের দিকের ছোট ও মাঝারি আকারের বস্তুগুলো থেকে পৃথিবীর সমান ভরের একটি গ্রহ তৈরি করে নি। এই অসঙ্গতিকে গ্র্যান্ড ট্যাক থিওরি ছাড়া অন্যান্য বেশিরভাগ মডেলই ব্যাখ্যা করতে পারে না।
এই গ্র্যান্ড ট্যাক থিওরিকে ভিত্তি করে বানানো ব্রেসারের নতুন মডেলটিতে বৃহস্পতি গ্রহের অবস্থান পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসায়, এই মডেল অনুসারে পৃথিবীতে অনেক কম বস্তুই আঘাত করার সুযোগ পায়। কিন্তু তারপরেও তিনি বলেন যে, একটি প্রচণ্ড বড় আঘাতই পৃথিবীতে বেশিরভাগ মূল্যবান ধাতু দান করে যা আজকে পাওয়া যায়। আর সম্ভবত এই আঘাতের কারণেই চাঁদের সৃষ্টি হয়েছে।
যেহেতু ব্রেসারের মডেল অনুসারে পৃথিবীতে আঘাত তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়েছে, তাই চাঁদের গঠনের পর পৃথিবীর পরিবেশ অনেকটাই শান্ত ছিল। আর এই শান্ত পরিবেশটি চাঁদের উপর করা অনেক পর্যবেক্ষণের সাথেও মিলে যায়। যদি ৪.৪৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে চাঁদ সৃষ্টি হবার পরও পরিবেশ এতটা শান্ত না হয়ে বারবার পৃথিবী এস্টারয়েড কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত হত, তাহলে এই আঘাতের চিহ্নটা পৃথিবীর সাথে সাথে চাঁদেও পাওয়া যেত কারণ ততক্ষণে চাঁদের জন্ম হয়ে গেছে। কিন্তু চাঁদের বেসিনগুলো দেখে আর এর ক্রাস্টে প্রিশিয়াস মেটাল বা মূল্যবান ধাতুর অভাব দেখে বোঝা যায় যে সত্যি সত্যি পরিবেশটা শান্তই ছিল, অর্থাৎ এরপরে আর তেমন কোন আঘাত পৃথিবীতে ঘটে নি।
সুতরাং এক্ষেত্রে ব্রেসারের মডেলটা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে, এবং মনে হচ্ছে চাঁদ সৃষ্টিকারী ওই একটা প্রচণ্ড এস্টারয়েডের আঘাতেই পৃথিবীর ক্রাস্টে এতগুলো প্রিশিয়াস মেটাল বা মূল্যবান ধাতু চলে এসেছে যেটা না হলে আমরা না পেতাম এত সোনা দান আর না পেতাম এত সুন্দর চাঁদের আলো!
যাই হোক, যদি ব্রেসার সঠিক হয়েই থাকেন, তাহলে চাঁদের উৎপত্তির ঘটনাটিকে সকলে যতটা সহজ ভেবেছিলেন বিষয়টা দেখা যাচ্ছে তার থেকেও অনেক জটিল। আর সেই সাথে এটা পূর্বের ধারণার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণও বটে।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply