মানুষের আফ্রিকা থেকে মাইগ্রেট করার ব্যাপারে নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হল

আধুনিক মানুষ প্রায় ২০০,০০০ বছর আগে আফ্রিকায় বিবর্তিত হয়েছিল বলেই আমরা জানি। তবে কীভাবে আমরা একটি বৈশ্বিক সভ্যতার রূপ পেলাম? ডিএনএ পরীক্ষণ আমাদের সে উত্তরটাই দিতে পারে।

এই প্রশ্নটি, মানব বিবর্তনের সবচেয়ে বড় শাখা; আর এটাই জীববিজ্ঞানীদের কয়েক দশক ধরে ভাবাচ্ছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত হওয়া কিছু জিন বিশ্লেষণের ফলাফল পাওয়ার পর গবেষকরা অনেকটা আশাবাদী যে তারা উত্তরটি পেয়ে গেছেন।

নেচার জার্নালে, জিনবিজ্ঞানীদের তিনটি স্বাধীন দল ডিএনএ সংগ্রহ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতা আর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি থেকে, যাদের অনেকেরই ডিএনএ তথ্য এই প্রথমবারের মতো সংগৃহীত হলো। আর উপসংহার হিসেবে তারা বলছেন সকল অ-আফ্রিকানরা একটি গোষ্ঠি থেকে এসেছে যা ৫০ থেকে ৮০ হাজার বছর আগে ছিল।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের যশুয়া এম আকেই জানান- “আমার মনে হত তিনটি গবেষণাই মূলত একই জিনিস বলছে”, নতুন এই প্রকাশনার সাথে তার প্রকাশিত বক্তব্যে তিনি আরো লেখেন- “আমরা জানি যে আফ্রিকা থেকে ধাপে ধাপে, দলে দলে আমাদের পূর্বপুরুষরা বের হয়ে এসেছেন, তবে এখানে আমরা একটি পূর্বপুরুষের দিকে ইঙ্গিত পাচ্ছি”।

দল তিনটি ৭৮৭ জনের ডিএনএ সংগ্রহ করেছিল, যারা প্রায় একশ ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির সদস্য, যাদের মধ্যে বুস্কস, আফ্রিকান পিগমি, মায়ান, বেদুঈন, শেরপা, ক্রি ইন্ডিয়ানরাও ছিলেন।

এই ডিএনএগুলো মানুষের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে অনেক জিনবিজ্ঞানী মনে করেন। তারপরও এই পরীক্ষার আগে বিজ্ঞানীরা জনসংখ্যার কেন্দ্র- যেমন চীন বা ইউরোপের বাইরে থেকে ডিএনএ সংগ্রহ বা বিশ্লেষন খুব কমই করেছেন।

এই নতুন তথ্যগুলো আমাদের ডিএনএ সম্পর্কিত জ্ঞানের বিরাট পরিবর্তন আনছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, এগুলো আরো অনেক ব্যতিক্রম আনছে আমাদের জিনের নকশায়।

প্রত্যেকটি দলই আমাদের বিবর্তনের ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন শাখা নিয়ে কাজ করছিল, যেমন কীভাবে মানুষ আফ্রিকায় ছড়িয়েছে, বা কীভাবে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত মানুষ পৌঁছেছে। তবে সবার একটিই লক্ষ্য ছিল, সেটা হল আফ্রিকা থেকে মানুষের ছড়িয়ে পড়ার বিতর্কিত প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা।

১৯৮০ সালে জীবাশ্মনৃতাত্ত্বিকদের একটি দল একটি মতবাদকে নিয়ে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, যে আধুনিক মানুষের একটি দলই শুধু আফিকা থেকে বের হয়ে এসেছিল, প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে। কঙ্কাল আর হাতিয়ারের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার পরিষ্কারভাবে দেখায় যে আধুনিক মানুষ এর পরে ইউরোপ, এশিয়া আর অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করা শুরু করে।

পূর্ববর্তী ডিএনএর গবেষণায় এই ধারণার পক্ষে প্রমাণ পাওয়াও যায়, কারণ সেগুলো খুব বেশী নমুনা সংগ্রহ করে করা হয় নি। জিনবিজ্ঞানীরা আবি সকল অ-আফ্রিকানরা একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত, আর তারা একটি একক বংশবৃক্ষ থেকে আসে।

তবুও অনেক ইঙ্গিত আছে যা নির্দেশ করে যে কিছু আধুনিক মানুষ ৫০,০০০ বছরেরও আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়, হয়তো আরেকটি বড় গৃহত্যাগীদের দলের সাথে।

ইসরাইলে যেমন গবেষকরা ১২০,০০০ থেকে ৯০,০০০ বছর আগের আধুনিক মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। সৌদি আরব আর ভারতে জটিল তৈরীপ্রণালীর হাতিয়ার পাওয়া গেছে যার বয়স কম করে হলেও ১০০,০০০ বছর হবে।

ইসরাইলে প্রাপ্ত ফসিলের Reconstructed নমুনা
ইসরাইলে প্রাপ্ত ফসিলের Reconstructed নমুনা

গত অক্টোবরে চীনা বিজ্ঞানীরা হোমো সেপিয়েন্সদের দাঁতের সন্ধান পেয়েছেন যার বয়স কমপক্ষে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর হবে।

২০১১তে, এস্কি উইলারস্লেভ, কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ জিনবিজ্ঞানী আর তার সাথীরা অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের জিন গবেষণা করে আফ্রিকা থেকে তাদের আসার কিছু ইঙ্গিত পান, যা এর আগে কেউ চিন্তাও করতে পারে নি। ডঃ উইলস্লেভ আর তার সহকর্মীরা যাদুঘরে রাখা শতবর্ষী একগোছা চুল নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে এর কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ঠ্য আছে যা ইউরোপিও বা এশীয়দের মধ্যে নেই, আর এটি গোলমেলে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয় অস্ট্রেলীয়দের মূল আর তাদের অস্ট্রেলিয়ায় আগমনের সময়ের ব্যাপারে।

এই ব্যাপারে চিন্তিত ডঃ উইলস্লেভ আদিবাসীদের বংশধরদের সাথে যোগাযোগ করার চিন্তা করেন, আর তাদের জিন নিয়ে পরীক্ষা করার কথা ভাবেন। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ডব্লিউ ল্যামবার্টের সাথে তিনি যোগ দেন, যিনি কি না ইতিমধ্যে আদিবাসীদের সাথে এই নিয়ে যোগাযোগ করছিলেন।

অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের সাথে মিলে এই গবেষকরা তাদের গবেষণার পরিধি বাড়িয়ে পাপুয়া নিউ গিনি থেকেও ডিএনএ সংগ্রহ করেন। দলটি অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ৮৩টি, পাপুয়া নিউ গিনির ২৫টি ডিএনএ নমুনা সম্পূর্ণরূপে বিশ্লেষণ করেন, যা কিনা গুনগত দিক দিয়ে উইলস্লেভের ২০১১তে করা গবেষণার চেয়ে ভালো আর নিখুঁতভাবে করা হয়েছিল।

একই সময়ে মেইট মেটস্পালু, এস্তোনিয়ার বায়োসেন্টারের বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে ৯৮জন বিজ্ঞানী আরেকটি জিন সংগ্রহের প্রকল্প শুরু করেন। তারা ১৪৮টি জনপদ, মূলত ইউরোপিও আর এশীয়, আফ্রিকার আর অস্ট্রেলিয়া মিলিয়ে ৪৮৩টি জিনের নিখুঁত নমুনা বিশ্লেষণ করেন।

ডেভিড রাইখ, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জিনবিজ্ঞানী আর তাঁর সহকর্মীরা ছয়টি মহাদেশ থেকেই তৃতীয় প্রকল্পের জিন সংগ্রহ করেন। তারা মোট ৩০০ জিন, ১৪২টি জনপদ থেকে নিয়ে, নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন।

তিনটি স্বাধীন পরীক্ষার ফলাফল বিবেচনা করার পর তিনটি দলই স্বাধীনভাবে উপসংহার দেন যে সকল মানুষ আফ্রিকা থেকে বের হয়ে আসা একটি দল থেকেই বিবর্তিত হয়েছে। অনুমান করা হয় এই মাইগ্রেশনটি হয়েছিল ৮০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বছর আগে।

ডঃ উইলস্লেভ আর ডঃ রাইখের আগের ধারণা যে এর আগেও একটি মাইগ্রেশনে অস্ট্রেলীয় আর পাপুয়া নিউ গিনির জনসংখ্যা সৃষ্টি হয়েছে, এটি কোনো জিনগত প্রমাণ না থাকার কারণে বাতিল হয়ে যায়।

 

 

বিভিন্ন মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের SGDP মডেল
বিভিন্ন মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের SGDP মডেল

“এদের অনেকে, হতে পারে সবাই- আফ্রিকা ত্যাগী একটি দলেরই বংশদ্ভুত, এশীয় আর আফ্রিকানদের মতোই”- বলেন ডঃ উইলস্লেভ।

একই প্রশ্নে ডঃ মেটস্পালু আর তাঁর সহকর্মীরা ভিন্ন ফলাফল পান।

পাপুয়া নিউ গিনিতে ডঃ মেটস্পালুরা পান যে ৯৮% মানুষের ডিএনএই আফ্রিকাত্যাগী

একটি দল থেকে আসে। তবে বাকি ২%’র ডিএনএ আরো পুরোনো।

ডঃ মেটস্পালু উপসংহার টানেন যে সকল নিউ গিনিয়ান মানুষ প্রাচীনকালে আফ্রিকাত্যাগী একটি জনগোষ্ঠির ডিএনএ বহন করে, যারা প্রায় ১৪০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা ত্যাগ করেছিল, আর পরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকা পাগানি, ডঃ মেটস্পালুর সহকর্মী বলেন- যদি এই পূর্বপুরুষরা থেকে থাকে তারা প্রায় ১০,০০০ বছর স্বাধীনভাবে বেঁচে ছিল।

পরবর্তীতে আফ্রিকাত্যাগী আরেকটি দলের আগমনের পরেই তাদের বংশধরেরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। “তারা হয়তো এতোটা উন্নত ছিল না, যতটা আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলো,” ডঃ পাগানি বলেন। “হয়তো পরের দলটি অন্যদের হারিয়ে দিতে বেশী পারদর্শী ছিল”। মানুষের অস্ট্রেলিয়া আগমনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার বড় প্রাণীদের বিলুপ্তির ব্যাপারে নোয়াহ হারারীও তাঁর ‘সেপিয়েন্স’ বইয়ে লিখেছেন। আর একই সাথে অন্য পাঁচটি হোমিনিডদের বিলুপ্ত করতে মানুষের দক্ষতা ডঃ পাগানির এই মতামতের পক্ষেই প্রমাণ দেয়।

নতুন এই গবেষণা আরো দেখায় যে মানুষের বংশবৃক্ষের ডালপালা বিস্তার বিশেষজ্ঞদের ধারণা করা সময়ের আরো অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

ডঃ রাইখ আর তাঁর সহকর্মীরা তাদের প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে আরো বিশ্লেষণ করেছিলেন মানুষের বিভিন্ন দলের জিনগত ভিন্নতার প্রমাণের জন্য। তারা দেখেন যে খইসান, দক্ষিণ আফ্রিকার শিকারি জনগোষ্ঠী, প্রায় ২০০,০০০ বছর আগে অন্য মানবগোত্র থেকে আলাদা হতে শুরু করে, আর ১০০,০০০ বছর আগে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আলাদা করে ফেলে। এটা ইঙ্গিত করে যে আমাদের পূর্বপুরুষরা আধুনিক মানুষের মত আচার ব্যবহার আর বৈশিষ্ঠ্য লাভ করেন প্রায় ২০০,০০০ বছর আগেই।

কেন তারা আফ্রিকা ছেড়েছিল সেটা আরেকটা বড় প্রশ্ন হয়তো, বিজ্ঞানীরা সে ব্যাপারেও কিছু চিহ্ন পেতে শুরু করেছেন, সেটা থাক না হয় অন্য এক সময়ের জন্য।

মডার্ন হিউম্যান এবং আর্কাইক হিউম্যান এর মাঝের সম্পর্কের একটি গ্রাফিকাল রিপ্রেজেন্টেশন, এখানে মডার্ন সাহুল পপুলেশনের জিনোমে আর্লি আউট অব আফ্রিকা মাইগ্রেশনের ট্রেস দেখানো হয়েছে, Dr Mait Metspalu at the Estonian Biocentre, Tartu, Estonia।

মডার্ন হিউম্যান এবং আর্কাইক হিউম্যান এর মাঝের সম্পর্কের একটি গ্রাফিকাল রিপ্রেজেন্টেশন, এখানে মডার্ন সাহুল পপুলেশনের জিনোমে আর্লি আউট অব আফ্রিকা মাইগ্রেশনের ট্রেস দেখানো হয়েছে, Dr Mait Metspalu at the Estonian Biocentre, Tartu, Estonia
মডার্ন হিউম্যান এবং আর্কাইক হিউম্যান এর মাঝের সম্পর্কের একটি গ্রাফিকাল রিপ্রেজেন্টেশন, এখানে মডার্ন সাহুল পপুলেশনের জিনোমে আর্লি আউট অব আফ্রিকা মাইগ্রেশনের ট্রেস দেখানো হয়েছে, Dr Mait Metspalu at the Estonian Biocentre, Tartu, Estonia

 

তথ্যসূত্রঃ

১)রিসার্চ পেপার ১- http://www.nature.com/nature/journal/vaop/ncurrent/full/nature19472.html

২) রিসার্চ পেপার ২ http://www.nature.com/nature/journal/vaop/ncurrent/full/nature18299.html

৩) রিসার্চ পেপার ৩- http://www.nature.com/nature/journal/vaop/ncurrent/full/nature19792.html

৪) রিসার্চ পেপার ৪- http://www.nature.com/nature/journal/v526/n7575/full/nature15696.html

৫) রিসার্চ পেপার ৫- http://www.nature.com/nature/journal/vaop/ncurrent/full/nature18964.html

৬)  ইসরাইলে প্রাপ্ত ফসিলঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Skhul_and_Qafzeh_hominids

৭)  সৌদি আরবে প্রাপ্ত ফসিল   http://www.nsf.gov/news/news_summ.jsp?cntn_id=117334

৮) মোট প্রাপ্ত ফসিলঃ https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_human_evolution_fossils

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.