শেষ পর্যন্ত বাজারে আসল আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাস। সান ফ্রান্সিসকোর বিল গ্রাহাম সিভিক অডিটরিয়ামে এপল এদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ইতিমধ্যেই অনেকেই হ্যান্ডসেটই বের হওয়ারও ২ মাস পূর্ব থেকেই iOS 10 অপারেটিং সিস্টেমের বেটা ভারশন ব্যবহার করে আসছেন, কিন্তু এই আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাস iOS 10 নিয়েই তাদের যাত্রা শুরু করেছে। যাই হোক, আমরা আসল ফোনটি নিয়ে জানতে অনেক বেশি আগ্রহী। এখানে আপনি নতুন আইফোন সম্পর্কে যা যা জানতে আগ্রহী সেসম্পর্কে কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
ওয়াটারপ্রুফ ডিজাইন এবং ডিউরেবিলিটি
আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাস এপলের মেজর আপডেট সাইকেলের পার্ট নয়, অর্থাৎ আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাস এর ক্ষেত্রে এপল খুব একটা বেশি পরিবর্তন আনে নি। এটার জন্য আপনাকে পরের বছরের মডেলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, আর এটা নিয়ে এখন যথেষ্ট গুঞ্জনও চলছে। কিন্তু এই আইফোন ৭ ও ৭ প্লাসে কিছু নতুন নতুন বিষয় অবশ্যই আছে।
আইফোন ৭ এবং আইফোন ৭ প্লাস দুটোই ওয়াটার এবং ডাস্ট রেজিস্টেন্ট (IP67)। এর অর্থ হল আপনি কোন রকম চিন্তা ছাড়াই এদেরকে ভিজিয়ে রাখতে পারবেন। এরা উভয়ই পানিতে ১ মিটার গভীরে ৩০ মিনিট সময় ধরে ভিজতে সক্ষম।
এই দুটো নতুন ডিভাইসে একই রকম এলুমিনিয়াম বডি আছে এবং এদেরকে ২০১৫ সালের আইফোন ৬এস এবং ৬এস প্লাস এর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন লাগে না। এমনকি এদের স্ক্রিন সাইজও একই রকম। আইফোন ৭ এর রয়েছে ৪.৭ ইঞ্চি ডিসপ্লে এবং আইফোন ৭ প্লাস এর ডিসপ্লে ৫.৫ ইঞ্চি। ৭ প্লাসে রেজোল্যুশন 1,920 x 1,080 পিক্সেল, যেখানে আইফোন আইফোন ৭ এর রেজোল্যুশন 1,334 x 750 পিক্সেল। দুটো স্ক্রিনই আইফোন ৬এস এর চেয়ে ২৫ শতাংশ উজ্জ্বল এবং এদের কালার গ্যামট বা বর্ণের বৈচিত্রতাও আগের গুলোর চেয়ে বেশি।
কিন্তু প্রায় একই হওয়া সত্ত্বেও পার্থক্যটা তাও বোঝা যায়। এই নতুন দুই ফোনেই “প্রিস্টিন, মিরর লাইক সারফেস” এবং হাই গ্লস ফিনিশ রয়েছে।
এদের ওয়েবসাইটটি থেকে জানানো হয়, “জেট ব্ল্যাক আইফোন ৭ এর ক্ষেত্রে নয় ধাপে করা এনোডাইজেশন এবং পলিশিং প্রোসেসের মাধ্যমে হাই গ্লস ফিনিশ তৈরি করা হয়েছে। এর সারফেস অন্যান্য এনোডাইজড এপল প্রোডাক্টের মতই হার্ড, কিন্তু এর হাই শাইন বা বেশি উজ্জ্বলতার কারণে সেটটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফাইন মাইক্রো এব্রেশন দেখা যেতে পারে। যদি সেটার ক্ষেত্রে আপনার কোন সমস্যা থাকে তাহলে আপনার আইফোনটি প্রোটেক্ট করার জন্য বাজারে থাকা অনেকগুলো কেসের মধ্যে একটি কিনে নিন”।
হ্যাঁ, এপল আপনাকে জেট ব্ল্যাক আইফোন ৭ এর জন্য একটি কেস রিকমেন্ড করছে, কারণ এতে স্ক্র্যাচ পড়ার প্রবণতা আছে।
এই নতুন আইফোন দুটোতে উপরে ও নিচে এন্টেনা ব্যান্ডও নেই, বরং এই ব্যান্ডগুলো টপ ও বটম এজে খুব কমই চোখে পড়ছে।
এপল আইফোন ৭ এ আরও বেশি রং নিয়ে এসেছে। তাই রূপালি ও সোনালি রং ছাড়াও একে দেখা যাবে রোজ গোল্ড কালারে। আপনি গ্লসি জেট ব্ল্যাক পছন্দ করতে পারেন, আবার ম্যাট ব্ল্যাক কালারও পছন্দ করতে পারেন। এই জেট ব্ল্যাক রংটি বিখ্যাত স্পে গ্রে কালারের পরিবর্তে এসেছে।
পিছন দিকে ক্যামেরা এখনও সামান্য বেরিয়ে থাকে, কিন্তু আইফোন ৭ প্লাসে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়। এখানে LG G5 এর মত স্মার্টফোনের মত পিছন দিকে ডুয়েল ক্যামেরা রয়েছে যা ডিভাইসটির পেছনের দিকে সহজেই সনাক্ত করা যায়। পরে এই আর্টিকেলে ক্যামেরা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
সর্বশেষ পয়েন্টটি হল, এর বিশেষ হোম বাটনটিতে প্রেশার সেন্সিটিভ এবং টাচ আইডি সেন্সরের একটি নতুন ভারশন যোগ করা হয়েছে। এটা আর ক্লিক করে না, কিন্তু ম্যাকবুকের ট্র্যাকপ্যাডে ফোর্স টাচের মত ভাইব্রেশনের মাধ্যমে সিমুলেট করে। এই ফোর্স টাচ হোম বাটন ট্যাপটিক ফিডব্যাকের সুযোগ রেখেছে এবং নতুন ধরণের ফিলিংস এবং এক্সপেরিয়েন্সের জন্য এটা থার্ড পার্টি এপলিকেশন দ্বারাও প্রোগ্রাম করা যায়।
কোন হেডফোন জ্যাক নেই
নতুন দুটো আইফোনেই একই সাথে ডিভাইসটির টপ ও বটমে স্টেরিও স্পিকার ব্যবহার করা হয়েছে। আর এপল বলছে এদের ক্ষেত্রে রয়েছে “ইনক্রিসড ডাইনামিক রেঞ্জ”। কিন্তু এই স্পিকারগুলো রয়েছে ঠিক সেখানেই যেখানে আগে হেডফোন জ্যাক থাকত।
এই নতুন আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাসে আর আগের মত ৩.৫ মিলিমিটারের হেডফোন জ্যাক থাকছে না। এর অর্থ হল আপনি আর আপনার বর্তমান হেডফোনের জন্য কোন লাইটনিং কনভার্টারের উপর নির্ভর করতে হবে, অথবা কোন ব্লুটুথ এয়ারবাড ব্যবহার করতে হবে।
এই হেডফোন জ্যাকের অভাব পূরণ করার জন্য, এপল এক্ষেত্রে একটি বক্সে একজোড়া লাইটনিং-কানেক্টেড (তার যুক্ত) এয়ারপড দিচ্ছে এবং আপনার ৩.৫ মিলিমিটারের হেডফোন প্লাগের জন্য একটি লাইটনিং কনভার্টার দিচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে, আপনি একই সাথে আপনার আইফোনে চার্জ দিতে এবং গান শুনতে পারবেন না।
হেডফোন জ্যাকের অভাবের কারণে এপল তাদের অয়ারলেস অডিও এর আরও উন্নতি করেছে। এক্ষেত্রে তারা W1 অয়ারলেস চিপ ব্যবহার করেছে। এটাকে আরেকটি এপল প্রোডাক্ট এয়ারপডসে ব্যবহার করা হয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে অয়ারলেস বা তারবিহীন এবং এতে রয়েছে ৫ ঘণ্টা ব্যাটারি লাইফ।
অধিক প্রোসেসিং পাওয়ার
নতুন হাই গ্লস ফিনিশ এবং ওয়াটার রেজিস্ট্যান্ট রেটিং ছাড়াও, আইফোনের হুডের ভেতরে আরও কিছু নতুন পরিবর্তন এসেছে।
এই আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাসে ব্যবহার করা হয়েছে এপলের এপর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী প্রোসেসর- A10 ফিউশন। এটা একটি ৬৪ বিট কোয়াড কোর প্রোসেসর যা আইফোন ৬এস এবং ৬এস প্লাসের A9 প্রোসেসরের চাইতেও ৪০ শতাংশ বেশি দ্রুত। এপল বলেছে এটা অরিজিনাল আইফোনের চেয়েও ১২০ গুণ বেশি দ্রুত।
ডুয়েল ক্যামেরা
আইফোন ৭ এর রয়েছে একটি আকর্ষণীয় ক্যামেরা। কিন্তু আপনি যদি একটু বেশি টাকা দিয়ে আইফোন ৭ প্লাস কেনেন তাহলে আপনি তার চেয়েও ভাল একটি ক্যামেরা পাবেন। আইফোন ৭ প্লাস হল প্রথম আইফোন যার ডুয়েল ক্যামেরা সিস্টেম রয়েছে।
কিন্তু আইফোন ৭ দিয়েই শুরু করা যাক। ধরে নেয়া যাক এটা আইফোন ৭ প্লাসের সিস্টেমের একটা অংশ। এই ১২ মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় রয়েছে অপটিকাল ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন, একটি ২৮ মিমি ওয়াইড এংগেল লেন্স যার এপারচার f/1.8, এবং রয়েছে একটি হাই-স্পিড সেন্সর যা এপলের পূর্বের স্মার্টফোনগুলো থেকে ৬০ শতাংশ বেশি দ্রুত। একই সাথে এটা ৩০ শতাংশ বেশি এনার্জি এফিশিয়েন্ট।
আইফোন ৭ এ ব্যবহার হওয়া এপলের নতুন ইমেজ সিগনাল প্রোসেসর এপলের আগে যে কোন স্মার্টফোনের চেয়ে ইমেজ সিগনাল প্রোসেসর বা আইএসপি এর চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষমতাশালী। এর রয়েছে ট্রু টোন ফ্ল্যাশ এবং এতে একটি আপগ্রেডও হয়েছে। এতে চারটি LED রয়েছে যা পূর্বের চেয়ে ৫০ শতাংশ আলো বেশি দেয়। একটি নতুন ফ্লিকার সেন্সরও আছে যা কৃত্রিম আলো যোগ করে কম আলোর দৃশ্যের ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতর ছবির জন্য।
ক্যামেরা ফেস বা মুখমণ্ডল এবং বডি বা দেহ ডিটেক্ট করতে পারে এবং আরও বিস্তৃত কালার ক্যাপচারের সুবিধা দেয়। যখন আপনি ছবি তোলার জন্য একটি শট নেবেন তখন একসাথে অনেক কিছুই ঘটবে, যেমন হোয়াইড ব্যালেন্স, নয়েস রিডাকশন এবং মাল্টিপল ইমেজকে কম্বাইন করা। এপল থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ছবি তোলার সময়ে ১০০ বিলিয়ন কাজ চলে, আর তাই মাত্র ২৫ মিলিসেকেন্ডের ভেতরে। এই কথাটা মার্কেটিং এর জন্য বলা হয়েছে সত্যি, কিন্তু এটা ভেবে সত্যি অবাক হতে হয় যে এই ফোনটি সেকেন্ডের সামান্য একটি অংশে কত কাজ করে ফেলতে পারে।
প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফাররা এটা দেখে খুশি হবেন যে, আইফোন ৭ এ শেষ পর্যন্ত RAW ইমেজ ফরমেট সাপোর্ট করবে, যার ফলে ফটো এডিট করায় আরও বেশি কন্ট্রোলের অনুমতি থাকবে।
আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাসে ফোনের সামনের সেলফি ক্যামেরা জাম্প করে ৭ মেগাপিক্সেলের হয়ে গেছে আর সেখানেও রয়েছে ওয়াইড কালার ক্যাপচার এবং অটোমেটিক ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন।
আইফোন ৭ প্লাসের রিয়ার বা পেছনের ক্যামেরাটা বেশি ভাল অবশ্য। এক্ষেত্রেও আইফোন ৭ এর মতই একই ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এখানে পূর্বের ১২ মেগাপিক্সেল ক্যামেরার পাশে আরেকটি ১২ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা রয়েছে। এটা একটি ৫৬ মিমি টেলিফটো লেন্স যার এপারচার f/2.8।
এছাড়া এর বিল্ট ইন জুম ফিচারটাও দারুন। যখন আপনি ছবি তোলেন, ক্যামেরায় একটি 1x আইকন দেখা যাবে। এরপর চাইলে এই স্লাইডারে ট্যাপ ও ড্র্যাগ করে 1x থেকে 10x এ আনা যায় যার ফলে ভাল ক্রপের জন্য আকর্শনীয় ডিটেইলড ইমেজ পাওয়া সম্ভব হয়। ক্যামেরাটি 2x অপটিকাল জুম ব্যবহার করে, কিন্তু যখন এটি 10x এর কাছাকাছি চলে আসে তখন এটা ডিজিটাল জুমে সুইচ করে।
আবার বোকাহ এফেক্ট (Bokeh effect) নামে একটি নতুন বিষয় এসেছে যেটা নিয়ে এপলের ক্যামেরা ইঞ্জিনিয়ারগণ কাজ করছেন। এটা ছবির ব্যাকড্রপে একটি ব্লার এফেক্ট তৈরি করে যা ডিএসএলআর ক্যামেরার মত ডেপথ এফেক্ট তৈরি করে। আপনি এই ফিচারটি অন বা অফ করতে পারবেন। আবার ছবিটি তোলার আগে আপনি এর একটি লাইভ প্রিভিউও দেখে নিতে পারবেন। এই ফিচারটি একটি সফটঅয়ার আপডেটের মাধ্যমে এই বছরের শেষের দিকে আসবে।
প্রাপ্যতা এবং বাজারদর
ডিভাইসটি অফিশিয়ালি এভেইলেবল হয় ১৬ই সেপ্টেম্বর থেকে। আর কোম্পানিটি iOS 10 ছেড়েছে তারও ৩ দিন আগে ১৩ই সেপ্টেম্বরে।
আইফোন ৭ এর দাম শুরু হয়েছে ৬৪৯ ইউএস ডলার মূল্যে, আর প্রথমবারের জন্য এক্ষেত্রে আর ১৬ জিবি স্টোরেজ অপশন নেই। এর বদলে আপনাকে ৩২ জিবি, ১২৮ জিবি বা ২৫৬ জিবি বাছাই করতে হবে। এরমধ্যে জেট ব্ল্যাক কালারের বেলায় কেবল ১২৮ জিবি আর ২৫৬ জিবি ইন্টারনাল স্টোরেজ অপশনই রয়েছে। আইফোন ৭ প্লাস এর মূল্য শুরু হচ্ছে ৭৬৯ ইউ এস ডলার থেকে।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply