আপনি কি কঠোর আনুগত্য পরায়ণ বাবা বা মা, নাকি আরো বেশি উদারনৈতিক স্বাধীনতাপ্রদানকারী বাবা বা মা? আপনি যদি প্রথম দলভুক্ত হয়ে থাকেন,তাহলে একটি নতুন গবেষণা আপনাদের জন্য একটু খারাপ খবর নিয়ে এসেছে। আর তা হল- আপনার কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব সন্তানদেরকে মিথ্যাবাদী করে তুলছে।
ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুর সামাজিক-মনস্ততাত্ত্বিক বিকাশ বিষয়ক সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ ভিক্টোরিয়া তালওয়ারের মতে, যেসব বাবা-মা যে কোন ভুল কাজের জন্য নিশ্চিত শাস্তির পরিবেশ তৈরি করেন,তাদের সন্তানেরা সেই ভুল কাজের ক্ষেত্রে প্রাপ্য শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যা বলতে শেখে।
বিবিসি রেডিও ফোরকে দেওয়া সাইকোথেরাপিস্ট ফিলিপ্পা পেরির সাক্ষাৎকারে জানান যে, তালওয়ার ও তার সহকর্মীরা Peeping Game নামের একটি পরীক্ষা উদ্ভাবন করেছেন, যেটা দিয়ে কার্যকরী মিথ্যাবাদীদের চিহ্নিত করা যাবে। দুইটি পশ্চিম আফ্রিকান স্কুল – যার একটি নিয়মনীতির ক্ষেত্রে খুবই কঠোর এবং অন্যটি শিথিল, এমন দুইটি স্কুলে এই পরীক্ষা চালানো হয়। এই পরীক্ষায় বাচ্চাদেরকে তাদের পিছনের দিকে আড়ালে একটি আওয়াজ সৃষ্টিকারী বস্তু রাখা হয়, না দেখে সেটি সম্পর্কে আন্দাজ করতে বলা হয়।
প্রয়োজনের স্বার্থেই, সর্বশেষ বস্তুটি স্বাভাবিক যে শব্দ উৎপন্ন করতে পারে তার চাইতে আলাদা শব্দ তৈরি করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একটি বেসবল কোঁ কোঁ শব্দ তৈরি করে। যখন বাচ্চাদেরকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয় না, তখন তারা পিছনে উঁকি দিয়ে একবার দেখে নেয় যদি বস্তুটি সম্পর্কে আগে থেকে জেনে থাকে। এই পরীক্ষা চলাকালে, পরীক্ষকরা ঘর ছেড়ে চলে যান এবং ফিরে এসে বাচ্চাদের দুইটি করে প্রশ্ন করেন। ১.বস্তুটি কী? ২. তারা উঁকি দিয়ে দেখেছে কি না? তালওয়ার তার পরীক্ষা থেকে দেখেন যে, শিথিল নিয়মনীতির স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীদের অনুপাত পশ্চিমা দেশসমূহের স্কুল গুলোর ন্যায়। অপরদিকে কঠোর নিয়মানুবর্তী স্কুলের বাচ্চারা খুবই দ্রুত এবং কার্যকরী মিথ্যা বলে সেটা প্রমাণিত হয়।
শাস্তির ভয়ে ভীত, মিথ্যাবাদী বাচ্চারা সত্যকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উপস্থাপন করতে দক্ষ হয়। পরিহাসের বিষয় এই যে, কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে সন্তান লালন পালন কিংবা শিক্ষাদান সেরা মিথ্যাবাদী তৈরি করে থাকে। মিথ্যা বলা নেহাতই কোন খারাপ কিছু নয়। সেটা স্বভাবজাত হোক কিংবা কঠোর শাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠার ফলেই হোক না কেন। স্লেট উল্লেখ করেন যে, যখন বাচ্চারা মিথ্যা বলে তার মানে এই নয় যে তারা কুপথে চলে যাচ্ছে। বরং তাদের যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানসিক দক্ষতার বিকাশ ঘটছে এটা তার লক্ষণ। প্রকৃতপক্ষে, শিশুদের মানসিক সক্ষমতা ও তাদের ধোঁকা দেওয়ার সক্ষমতার ভিতরে সম্পর্ক রয়েছে। শুধুমাত্র তাদের অরৈখিক চিন্তাভাবনার সক্ষমতাকেই এটি দেখায় না, বরং এটা আরো দেখায় যে তাদের অবশ্যই বেশ ভালো মানের স্মৃতিশক্তিরও অধিকারী হতে হয়, কারণ তাদের মিথ্যাগুলোকে তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে হয়।
তালওয়ার ও তাদের সহকর্মীদের তৈরি ” মিথ্যার বিকাশ মডেল ” অনুসারে, বাচ্চারা দুইবছর বয়সের কাছাকাছি সময় থেকে প্রাথমিক পর্যায়ের মিথ্যা বলা শুরু করে। এইসব টুকরো মিথ্যা তাদের দুষ্টুমি গোপন করার উদ্দ্যেশে বলে। যা জিজ্ঞাসু বাবা-মায়েরা বিবেচনায় আনেনা এবং এগুলো খুব বিশ্বাসযোগ্যও নয়। চার বছর বয়সের ভিতরে, মধ্যম পর্যায়ের মিথ্যা বলতে দেখা যায়। এগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের তুলনায় অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। যা তার ব্যক্তিত্ব, আচরণ এবং মানসিকতাকে তুলে ধরে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের মিথ্যা বলতে দেখা যায় সাত বা আট বছর বয়সের দিকে। যেগুলো সত্যের সাথে মিথ্যা মিলিয়ে বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরির করার উদ্দ্যেশে বলা হয়ে থাকে। এই ধাপ বা পর্যায় গুলো যত কমবয়সে আপনার সন্তানের মাঝে দেখা দেবে ততই অন্য বাচ্চাদের তুলনায় তার বুদ্ধিমান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কার্যকরী মিথ্যা বলা একটি ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা আবেগী বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন। এক টুকরো কথা অথবা শারীরিক ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত ম্যাকিয়াভেলিয়ান ইনটুইশন বা ম্যাকিয়াভেলিয়ান উপলব্ধির দক্ষতার ক্ষেত্রে আরো একমাত্রা যোগ করে। যদি আপনার সন্তান মিথ্যা বলে এবং বেশ ভালোভাবেই বলতে পারে, তাহলে তাদের বুদ্ধিমান এবং সফল হিসাবে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। তারা তাদের মস্তিষ্ক প্রকৃত তথ্য এবং কাল্পনিক বিষয়ের মাঝে অন্যদের তুলনায় সহজে পার্থক্য করতে পারে। তাই বাবা-মা হিসাবে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আপনাদের হাতে ছোট্ট একটা সৃজনশীল প্রতিভা আর একইসাথে একটা ক্ষুদ্র দুর্বৃত্তও আছে। তাই অবশ্যই তাদের সাথে সেইরুপ আচরণ করতে হবে,যেমনটা আপনি আশা করেন।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply