আমাদের অবিভাবকেরা আমাদেরকে মানুষ হতে বলেন। কখনো কখনো বলেন মানুষের মতো মানুষ হবি, তবেই না বড় হওয়া বুঝাবে। ছোটবেলা এধরণের কথা অবিভাবকদের কাছে কম বেশী আমরা সকলেই শুনেছি। এবং শুনে মনে হয়েছে তাহলে কি মানুষ হিসেবে জন্ম হইনি? ঠিক তাই, অন্যান্য প্রাণীর মতো আমাদেরও সাধারণভাবে জন্ম হয়েছে। এর পর ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারের বড়রা আমাদের মানুষ হতে বলেছে এবং তারা নিজেরাও আমাদের মানুষ হতে সাহায্য করেছে। একবারো কি ভেবে দেখেছেন আপনি কিভাবে মানুষ হবেন? মানুষ হতে কি কি লাগে? খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন।
বিবর্তনবাদীরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আসছেন তাদের মেধা ও প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। ‘মানুষ হওয়া’ বা বিং হিউম্যান এর নির্দশক গুলোর একটা হচ্ছে ‘সহযোগিতা’। প্রাণীজগতের অন্য প্রজাতিগুলোর তুলনায় আমরা অত্যন্ত সামাজিক। সব সময় আমরা অন্যকে সাহায্য করে থাকি। হতে পারে এটা কম বা বেশী। কিন্তু এর গুরুত্ব যথেষ্ট মানুষ হওয়ার জন্য। যেমন কাউকে রাস্তা পার করা অথবা রেস্টুরেন্টে বা হোটেলের বয় ভাল সার্ভিস দিলে তাকে বকশিশ দেই । আবার কেউ বড় কোন সমস্যায় পড়লো সেখানেও কেউ সাহায্য নিতে আসলে আমরা দেই। সেই সাহায্যটা ছোট বা অল্প হতে পারে। কিন্তু সকলে মিলে করলে অনেক বড় অংকের হয়ে যায়।
আমরা এগুলো করি যেগুলোর আদৌ পরিশোধের কোন গ্যারান্টি নেই। অনুদান বা ডোনেশন আমাদের ব্যক্তিগত অল্প অল্প টাকা দিয়েই হয়, কিন্তু এর উপকারিতা গ্রহীতার কাছে অনেক বড়। সহযোগিতার গঠন বা অন্যকে অনুদান এগুলো বলা হয় পরোক্ষভাবে পারস্পরিক সুবিধাদানের নীতি এবং যেগুলো মানব সমাজকে উন্নত করতে সাহায্য করে ।
মানুষের মধ্যে দলভিত্তিক আচরণ উদ্ভব হয়েছে মূলত বড় বড় শিকারীর ভয় হতে বাঁচতে। এভাবেই আমারা সামাজিক সক্ষমতা ও আধুনিক মস্তিষ্ক সম্পন্ন হয়েছি এবং অন্যান্য প্রজাতির থেকে আমাদের মস্তিষ্কের আকারে অনুপাতহীনভাবে বড় হয়েছে। স্যোসাল ব্রেইন হাইপোথেসিসে এটা পাওয়া যায় । এটা প্রস্তাব করে যে মানুষের মস্তিষ্ক জটিল সমাজিক দলের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত হয় আর এই ‘সহযোগিতা’ হচ্ছে এই বিবর্তনের অনন্য উপাদান।
পরোক্ষ পারস্পরিক সহায়তা করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারন আমরা ফ্রি রাইডারসদের (ফ্রি-রাইডার হচ্ছে যারা অন্যের নামে অনুদান তুলে অথবা মিথ্যা কথা বলে অনুদান যারা তুলে) সমস্যা থাকা থাকা সত্ত্বেও সমাজে ডোনেশন বা দান এর কাজটা ঘটে। অংশগ্রহণকারীরা নির্দিধায় দান গ্রহণ করে, কিন্তু দান করে না। বর্তমানে এই ধারণা একটা জটিল আন্ত-নিয়মানুবর্তিতামূলক ধাঁধাঃ প্রকৃতিতে এর কারন কী? ফ্রি-রাইডিং থাকা সত্ত্বে অনুদান চলছে।
অর্থনীতিবিদ, জীববিজ্ঞানী, গণিতবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং অন্যান্যরা ডোনেশন আচরণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করায় অবদান রেখেছেন। পরীক্ষা করা আসলেই কঠিন কারন এটার মধ্যে বিবর্তন জড়িত, আর কম্পিউটার সাইন্স এটা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সফটওয়ার ব্যবহার করে আমরা মানুষের দলগুলোকে সহজিকরণ করে সিম্যুলেট করতে পারি যেখানে ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন অনুদানের মাধ্যমে একে অপরকে সাহায্য করার বিষয়টা নিজেরাই নির্বাচন করতে পারে। সরলীকৃত দল হতে পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করার মাধ্যমে অনুদান আচরণের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা যায়। আরো সফল অনুদান পদ্ধতির অনুমোদনের মাধ্যমে বিবর্তনকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে দলের বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। এটা আসলে বড় একটা সুযোগ।
আধুনিক যুগে সহযোগিতার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে প্রকৌশলি এবং প্রযুক্তিবিদ্যায়। অনেক বুদ্ধিমান এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র যেমন চালক-বিহীন গাড়ি, ড্রোন এবং স্মার্টফোন বেশ উত্থান এর সাথে রোবট গুলো আরো অত্যাধুনিক হচ্ছে এবং যে এসব আধুনিক যন্ত্রের সাথে যন্ত্রের অথবা মানুষের সংস্পর্শে আসায় এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সহযোগিতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এসব যন্ত্র একে অপরকে কিভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা উচিত? কিভাবে ফ্রি-রাইডারস শোষণ হতে বের হওয়া যায়? চিরাচরিত শিক্ষা নীতির বাধা অতিক্রম করে, উদীয়মান প্রযুক্তির জন্য আমাদের গবেষণা তথ্যগুলো দিতে পারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এটা জ্ঞান উন্নয়নে সহায়ক এবং এর ফলে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিবিদ্যায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হতে পারে।
মূল লেখাটি Roger Whitaker (প্রফেসর, মোবাইল এবং বায়োসোসাল কম্পিউটিং, Cardiff University,) এর কম্পিউটার সিমুলেশনে বিবর্তনের মডেলিং টা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
বিবর্তন এর ভিত্তিতে মডেল
কিভাবে সামাজিক দল গুলোয় ‘সহযোগিতা’ বিকশিত হতে পারে তা জানতে আমরা লক্ষবার কম্পিউটার সিম্যুলেটেড “ডোনেশন গেইম” গুলো চালিয়েছি। গেইম গুলো চালানো হয়েছে এলেমেলোভাবে ভার্চুয়াল খেলোয়ারের যুগলগুলোর মধ্যে। প্রত্যেক যুগলের প্রথম খেলোয়ারটি আরেক খেলোয়ারকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হতো যে সে অনুদান দিবে অথবা অনুদান দিবে না । এটার ভিত্তি তাদের সুনাম বিচার্য উপরই ছিল। যদি কোন খেলোয়ার দান করতে চাইতো, তারা এর ফল স্বরুপ মূল্য পেত এবং গ্রহীতা লাভবান হতো। তাদের কাজের আলোকে প্রত্যেক সুখ্যাতি হালনাগাদ করা হতো, অন্যান্য খেলাও এভাবে শুরু হতো। তুলনামূলক সামাজিক সিদ্ধান্তে যে উত্তম পারিতোষিক আসতো তা পর্যবেক্ষণ করা আমাদের অনুমোদন ছিল।
সামাজিক তুলনা মানুষের আচরণের অন্য মূল বৈশিষ্ট্য যেটা এর মধ্যে অন্তভূর্ক্ত করা উচিত। দল গুলোর শুরু হতে আমরা নিজেদের মধ্যে ও অন্যদের মধ্যে তুলনায় পারদর্শী হয়েছি এবং এটা অনুদান সিদ্ধান্তে তথ্যের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। এটা বিবেচিত কগনিশন চ্যালেঞ্জ যখন সামাজিক দল গুলো বড় হতো, ও আরো বড় হতে থাকতো এভাবে এবং এই উপায়ে মানুষের বড় ব্রেইন বিবর্তনে সহায়তা করতো।
আমরা খেলোয়ারদের সুখ্যাতির স্ব-তুলনার উপর ভিত্তি করে আমদের গবেষণাটিতে বিশেষ ‘অনুদান আচরণ’ ব্যবহার করতাম। এখান থেকে ফলাফল বেশ কম আসতো, যেমন আমার তুলনায় তোমার সুখ্যাতি বিবেচনা করা হতো বিস্তারিত, বেশী অথবা কম। চিন্তাভাবনার মূল উপাদানটি আসে কারো’র সুখ্যাতি হিসাব হতে, অবশ্যই অর্থবোধক উপায়ে।
আমাদের ফলাফল দেখাতো যারা নিজেরাই সুখ্যাতি অর্জন করেছে, অনুদানের কৌশলের ক্ষেত্রে বিবর্তন তাদের অনুকুলে থাকতো। আমরা এটাকে aspirational homophily বলি। (অনেকের আকাংক্ষা থাকে তাদের লেভেলের মানুষদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার, এটাকেই হমোফিলি বলা হয়) এটার মধ্যে দুইটা উপাদান আছে। প্রথমত, উদার হওয়াটা উচ্চ মর্যাদা বহন করে। দ্বিতীয়ত, নিম্ন মর্যাদা সম্পন্নদের অনুদান না করা যাতে ফ্রি-রাইডারদের প্রতিরোধে সাহায্য হয়।
মনে রাখতে হবে আমাদের ফলাফল গুলো একটা সিমপ্লিফাইড মডেল হতে নেওয়া: অনুদানের সিদ্ধান্ত জড়িত বাস্তব জীবনে ব্যতিক্রম হতে পারে। অর্থনৈতিক সম্পদ আবেগ বা সংস্কৃত ফ্যাক্টর গুলোর চেয়ে বরং আচরণের উপর গৃহীত। তথাপি এমন সিমপ্লিফিকেশন বা সরলীকরণ আমাদের স্বচ্ছতা লাভে সাহায্য করে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে সামাজিক ব্রেইন থাইপোথেসিসটি আমাদের গবেষণা সমর্থন দেয়। মানুষের ক্রমবিবর্তিনে জটিল সামাজিক দলের প্রভাব মানুষের বড় মস্তিষ্ক, এখানে সহযোগিতা একটি ব্যতিক্রমি উপাদান। কম্পিউটিং সিমুলেশনে চিন্তার নতুন দার খুলেছে । অত্যাধুনিক সামাজিক বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন ও স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের জন্যও কম্পিউটিং সিমুলেশ দিয়ে চিন্তার নতুন দার খুলেছে।
তথ্যসূত্র:
https://theconversation.com/how-cooperative-behaviour-could-make-artificial-intelligence-more-human-64177
Leave a Reply