প্রথমবারের মত গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ এর সনাক্তকরণ

সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞান এগিয়ে যায়। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের তাৎপূর্যপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি সম্ভবত গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সনাক্তকরণ।

যুক্তরাষ্ট্রের লেজার ইনটারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি (LIGO বা লিগো) প্রথমবারের মত গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কার করে। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড আবিষ্কারের পর থেকে এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক আবিষ্কার।

ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এর লিগো ল্যাবরেটরি এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডেভিড রাইজা বলেন, “আমরা পেরেছি! আমরা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি!”

আইনস্টাইনের বিখ্যাত থিওরি অব জেনারেল রিলেটিভিটি এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী ছিল এই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। আইনস্টাইনের মতে গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ স্পেস-টাইমকে বাঁকিয়ে দেয়। আর বস্তুর ভর যত বেশি হবে এর এফেক্টও তত বেশি হবে। যখন ভারি বস্তু চলাচল করে তখন স্পেসটাইমে এটা একটি কম্পন বা অসিলেশন তৈরি করে, ঠিক যেমনটা একটি চলমান জাহাজ সামনের দিকে পানিতে তরঙ্গের সৃষ্টি করে থাকে।

গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভকে পর্যবেক্ষণ করা হয় ২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বরে। আর এই ওয়েভ তৈরি হয়েছিল যখন এক জোড়া ব্ল্যাকহোল একে অপরের সাথে জুড়ে যাচ্ছিল। গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ তৈরির জন্য হাতে গোণা যে কয়টি ঘটনা রয়েছে, এটা ছিল সেগুলোর মধ্যে একটি। এই ফুটো বস্তু ১৫০ কিলোমিটার কাছাকাছি এবং এরা জুড়ে গিয়েছিল ১.৩ বিলিয়ন বছর আগে। তাদের মোটামুটি সমপরিমাণ ভর ছিল। একটির ভর সূর্যের চেয়ে ৩৬ গুণ বেশি আর একটির ভর হল সূর্যের ভরের ২৯ গুণ। এর আবিষ্কারের স্ট্যাটিসটিকাল সিগনিফিকেন্স হুল ৫.১ সিগমা। এর অর্থ হল এই সনাক্তকরণটির ভুল হবার সম্ভাবনা ৬ মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ! গবেষণাটি ফিজিকাল রিভিউ লেটার  জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

এই যুক্ত হতে থাকা বা মার্জিং ব্ল্যাকহোল কর্তৃক নিঃসৃত শক্তি ছিল যেকোন দৃশ্যমান নক্ষত্র হতে নিঃসৃত শক্তির তুলনায় ৫০ গুণ বেশি। সেই ২০ মিলিসেকেন্ডে বের হওয়া তরঙ্গের শক্তি ৩টি সূর্যের ভরকে নির্মুল করার শক্তির সমান ছিল।

গবেষকদের এটা খুঁজে পেতে কয়েক দশক লেগে গেছে। তারা বিভিন্নভাবে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ সনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু এই অসিলেশনগুলো এতই ক্ষুদ্র ছিল যে এদেরকে সনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। আর সেজন্যই দরকার ছিল LIGO নামের একটি অবিশ্বাস্য সংবেদনশীল যন্ত্রের।

যুক্তরাজ্যের সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ফ্যাসিলিটিজ কাউন্সিলের পদার্থবিদ প্রফেসর বব বিংহাম বলেন, “গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের সনাক্তকরণ এবং হিসাব করা ছিল প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এই আবিষ্কারটি আমাদেরকে মহাবিশ্বের উদ্ভব এর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে সাহায্য করবে, সেই সাথে বর্তমানে চলা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায়ও সহায়তা করবে”।

লিগো দুটো ডিটেক্টর নিয়ে তৈরি। একটি হল ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ডে, আরেকটা লুইজিয়ানার লিভিংস্টোনে। দুটো ডিটেকটরেই লেজার সিস্টেম আছে যেগুলো স্পেসটাইমের অনেক নির্ভুল হিসাব দিতে পারে। প্রতিটি লিগো ফ্যাসিলিটিতেই একটি লেজার বিম দুভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং দুটো পরষ্পর লম্ব টানেলে পাঠানো হয়। এই দুটো টানেল ৪ কিলোমিটার লম্বা এবং এদের প্রান্তে আয়না সংযুক্ত আছে। লেজারগুলো এই আয়না বা দর্পনে প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় একত্রে মিলিত হয়। যদি একটি গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ একটি বা উভয় লেজারেই ক্রস করে তাহলে এটা আলোকে পথটি অতিক্রম করতে হয় তাকে পরিবর্তিত করে দেবে এবং পুনর্গঠিত আলোক রশ্মি পূর্বের আসল বিমের চেয়ে ভিন্ন হবে।

দুটো ফ্যাসিলিটিতেই পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয় যে হিসাবে কোন ভুল রয়েছে কিনা। এছাড়া লিগো থেকে অন্যান্য এস্ট্রোনমিকাল অবজার্ভেটরির সাথে যোগাযোগও রাখা হত যাতে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ তৈরির জন্য কোন সন্দেহভাজন মার্জিং ব্ল্যাকহোলকে সনাক্ত করার ব্যাপারে তাদের সাথে তথ্যের আদান প্রদান করা যায়।

ভিকি কালোগেরা বলেন, “লিগো ডিটেক্টর এবং এর পর্যবেক্ষণগুলোর দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য হল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের কাজে সহায়তা করা। এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার জন্যই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ এর পর্যবেক্ষণ করাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ”।

এই পর্যবেক্ষণের ফলে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। এটা হল গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ আলোর গতিতে চলে। তাত্ত্বিকভাবে এটাই আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এটার সত্যতা নিশ্চিত করা ভবিষ্যতের থিওরিগুলোকে তৈরি করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর এই পর্যবেক্ষণের ফলে প্রথমবারের মত ইন্টারমিডিয়েট মাস ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া গেল। স্টেলার ব্ল্যাকহোলগুলো সাধারণত অনেক কম ভরের হয়, বড়জোড় সৌরভরের ১৫ গুণ বেশি ভারি। কিন্তু যে  ব্ল্যকহোলকে এক্ষেত্রে দেখা গেল তা এগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ভারি। গবেষকগণ মনে করছেন এগুলো মহাবিশ্বের প্রথমদিকের নক্ষত্রগুলোর ধ্বংসাবশেষ।  এই ইন্টারমিডিয়েট মাস ব্ল্যাকহোলের মার্জিং বা সংযুক্তির ফলে সুপারমেসিভ ব্ল্যাকহোল তৈরি হয় যেগুলো আমরা কোন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে দেখি।

পরবর্তীতে ২০১৬ সালে, ইতালিতে VIRGO (ভারগো) ফ্যাসিলিটি (লিগো ফ্যাসিলিটির অনুরূপ) চালু করা হয়। এবং তাদের ডেটাগুলোর সাথে লিগো এর ডেটাগুলোকে একত্রিত করে তারা ব্ল্যাকহোলের অবস্থান খোঁজার কাজ শুরু করে। আর বর্তমানে LISA (লিসা) পাথফাইন্ডার মিশন বর্তমানে বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে তদন্ত করছে যা আরেকটি গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ এক্সপেরিমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছিল। গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ সম্পর্কিত আরও বেশি তথ্য অনুসন্ধানের জন্য আউটার স্পেসে এই লিসা অবজার্ভেটরি তৈরি করা হবে।

গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের সনাক্তকরণ শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, সমগ্র বিজ্ঞানের ইতিহাসের একটি অন্যতম সাফল্য। এটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন একটি যুগের সৃষ্টি করেছে।

 

তথ্যসূত্র:

  1. http://www.ligo.org/
  2. http://public.virgo-gw.eu/language/en/

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.