হয়তো আরেক পৃথিবী চক্কর কাটছে আমাদের খুবই কাছের প্রতিবেশী আরেকটি নক্ষত্রকে ঘিরে।
এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হাজারো এক্সোপ্লানেটের ভিড়ে প্রতিনিয়ত “পৃথিবীর সহোদর” খুঁজে পাওয়াটা এখন আর নতুন কিছু নয়, তবে এরা সবাই পাক খাচ্ছে বহু দূরের সব নক্ষত্রকে ঘিরে। সত্যি বলতে, মহাবিশ্বের অন্য গ্রহগুলোতে জীবনের অস্তিত্ব থাকার সমূহ সম্ভাবনা যতটা উত্তেজনাপূর্ণ, আমাদের থেকে তাদের বিস্তর দূরত্ব ঠিক ততটাই হতাশাজনক। অদূর ভবিষ্যতে সেসব গ্রহে পৌঁছানো আমাদের জন্য সম্ভব নয়।
তাহলে কেমন হবে, যদি আমরা পৃথিবীর মত ঠিক আরেকটি পৃথিবীকে খুঁজে পাই, আমাদের প্রতিবেশীদের মাঝেই? গত ২৪শে আগস্ট, জ্যোতির্বিদেরা ঘোষণা করেছেন যে প্রক্সিমা সেন্টোরি, আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তনরত একটি গ্রহ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি আছে নক্ষত্রটির “গোল্ডিলক জোনে”, যা কিনা প্রাণ ধারণের পক্ষে খুব বেশি শীতল বা খুব বেশি উষ্ণ নয়। এর মানে হল, গ্রহটির উপরিভাগে পানির অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা প্রবল, এবং একই সাথে প্রাণের অস্তিত্বও। সদ্যপ্রাপ্ত গ্রহটির নাম দেয়া হয়েছে প্রক্সিমা সেন্টোরি বি (সংক্ষেপে প্রক্সিমা বি)।
প্রক্সিমা সেন্টোরি, একটি অনুজ্জ্বল লাল বামন নক্ষত্র, এটি পৃথিবী থেকে ৪.২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। সূর্যের তুলনায় এর ভর মাত্র ১২% এবং উজ্জ্বলতা ১/৬০০ ভাগ। আমাদের খুবই কাছে থাকা সত্ত্বেও এটি খালি চোখে দেখার পক্ষে খুবই নিষ্প্রভ, যার কারণে এরই আরেক প্রতিবেশী, আলফা সেন্টোরিই হল সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র যা টেলিস্কোপ ছাড়াই দৃশ্যমান। প্রক্সিমা অবস্থান করছে প্রায় আলফা সেন্টোরির এলাকাতেই, যা নিজেও একটি বাইনারি নক্ষত্র। এক্সোপ্লানেট যুগের শুরু থেকেই প্রক্সিমাকে গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নতুন আবিষ্কারটি করা হয়েছে ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের পর্যবেক্ষণের সাহায্যে, আরো কিছু তথ্য নেয়া হয়েছে এ বছরের ১৯শে জানুয়ারি থেক ৩১শে মার্চের মধ্যে। আবিষ্কারটির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে Doppler Wobble পদ্ধতি, যাতে পর্যবেক্ষকরা একটি নক্ষত্রের লাইন-অফ-সাইট গতির অতি সূক্ষ্ণ ও নির্ভুল পরিমাপ করেন, এবং মহাকশে সেটির এদিক সেদিক যেকোন নড়াচড়ার দিকে কড়া নজর রাখেন।
গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে নাসার কেপলার খোঁজার মিশনের বদৌলতে, এ গ্যালাক্সি জুড়ে অনেকগুলো পৃথিবীর মত গ্রহ পাওয়া গেছে। তথাপি প্রক্সিমা বি কে নিয়ে এতটা আশাবাদী হবার কারণ হল, এখন থেকে কয়েক যুগের মধ্যেই হয়তো আমরা এটাতে পৌঁছাতে সক্ষম হব। মহাজাগতিক ক্ষেত্রে ৪.২ আলোকবর্ষ বা ২৫ ট্রিলিয়ন মাইলের দূরত্ব খুবই নগণ্য।
Guillem Aglada- Escudé, লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির একজন জ্যোতির্বিদ এবং আবিষ্কারক দলটির প্রধান, বলেন, “আমরা জানি অনেক নক্ষত্রেরই পৃথিবীর মত গ্রহ আছে, এবং আমরা কিছুটা আশা করেছিলাম যে আমাদের কাছের নক্ষত্রগুলোরও এমন গ্রহ থাকতে পারে। এ কারণে এটা অতটা উত্তেজক কিছু নয়। এটা এজন্যই উত্তেজনার যে এটা আমাদের সবচেয়ে কাছের।”
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, দলটি প্রক্সিমা বি এর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছে। এটি এর নক্ষত্রকে ঘিরে প্রতি ১১.২ দিনে একবার ঘুরে আসে, দূরত্বের হিসাবে সাত মিলিয়ন কিলোমিটার। তাই ধারণা করা হচ্ছে নতুন গ্রহটি থেকে এর নক্ষত্রের দূরত্ব পাঁচ মিলিয়ন মাইল, যেখানে সূর্য থেকে পৃথিবী ও বুধের দূরত্ব ৯৩ মিলিয়ন মাইল এবং ৩৬ মিলিয়ন মাইল। দূরত্বের মাত্রা কম হলেও গ্রহটি অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতা পাচ্ছে। আমাদের সৌরমণ্ডলের জন্য না হলেও প্রক্সিমা সেন্টোরির ক্ষেত্রে এটাই “বাসযোগ্য স্থান”- যেখানে গ্রহের উপরিভাগে তরল পানি থাকার সম্ভাবনা আছে। পর্যবেক্ষন থেকে আমরা বলতে পারি যে প্রক্সিমা বি তুলনামূলক ভাবে ছোট। এটি আমাদের গ্রহের চেয়ে ৩০% বেশি ভারী এবং যদি এটি পাথুরে গ্রহ হয় তবে এর গ্র্যাভিটি আমাদের গ্রহের মাত্র ১০% বেশি হবার কথা।
পানির অস্তিত্বের সম্ভাবনাই প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে জাগ্রত করে। গ্রহটি আবহমণ্ডলে তরল পানি আছে কিনা তা “এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ চিন্তনীয় বিষয়,” এক সংবাদ সম্মেলনে জানান Dr. Guillem Aglada- Escudé।
যদিওবা প্রক্সিমা বি বাসযোগ্য হয়, যেসকল বিজ্ঞানী অন্যত্র প্রাণের বিকাশের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের মধ্যে এসব লাল বামুন নক্ষত্রের আশেপাশে প্রাণের সন্ধান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
প্রক্সিমা বি প্রাণের বিকাশের জন্য আদর্শ আয়তন এবং আদর্শ স্থানের অধিকারী, কিন্তু এটি কি আসলেই বাসযোগ্য? সম্ভবত, কিন্তু বাসযোগ্যতার জন্য আদর্শ কক্ষপথ ছাড়াও আরো কিছু জিনিসের প্রয়োজন হয়।
যদি গ্রহটি নক্ষত্রের কাছে গঠিত হয় তবে এটি শুষ্ক এবং বায়ুবিহীন হতে পারে, তবে এটি দূরেও গঠিত হতে পারে এবং বর্তমান কক্ষপথে সরে আসতে পারে। এটাও সম্ভব যে গ্রহটি শুষ্ক অবস্থাতেই জন্ম নেয় এবং পরে কোন ধুমকেতু বা পানিময় গ্রহাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়।
যেহেতু প্রক্সিমা বি এর নক্ষত্রের খুব কাছে অবস্থান করছে, এটা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই টাইডালি লকড। এর মানে হল, এর এক পাশ স্থায়ীভাবে এর নক্ষত্রের দিকে ঘোরানো এবং সুর্যালোকে পূর্ণ, এবং অন্য পাশ বিপরীত দিকে ঘোরানো, যেখানে রাত চিরস্থায়ী।
বহু বছর ধরে গবেষকরা ভেবে এসেছেন যে এমন অবস্থা কোনভাবেই বাসযোগ্যতার উপযোগী নয়, যেখানে গ্রহের রাতের অংশ এতই ঠাণ্ডা হবে যে গ্রহটির ঐ অংশে যে বায়ুমণ্ডলই ছিল তা জমে যাবে এবং এটি বায়ুশূণ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের ক্লাইমেট মডেলে দেখা গেছে যে সঠিক বায়ুমণ্ডল এবং সঠিক আবহাওয়া থাকলে, গ্রহের তাপ উজ্জ্বল অংশ থেকে অন্ধকার অংশে যেতে পারে, যা বাসযোগ্যতার জন্য সঠিক তাপমাত্রা তৈরি করতে পারে।
আরেকটি ব্যাপার হল, প্রক্সিমা সেন্টোরি বেশ সক্রিয় একটি নক্ষত্র, এবং এতে প্রচুর বড় বড় বিস্ফোরণ (megaflares) চলতেই থাকে যা থেকে আগত রশ্মি যেকোন গ্রহের আবহমণ্ডল ধ্বংস করে দিতে পারে। যদিও, এটি অত বিপজ্জনক নাও হতে পারে, যদি গ্রহটি শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড থাকে, পৃথিবীর মত, যা একটি চৌম্বক বর্ম হিসেবে কাজ করবে, গ্রহটির আবহমণ্ডলকে রক্ষা করবে প্রক্সিমার আক্রমণ থেকে।
গ্রহটির ভর বলে যে, পৃথিবীর মত গঠন থাকার কারণে গ্রহটির ম্যাগনেটিক ফিল্ড থাকার কথা। অতিরিক্ত ভরের কারণে অতিরিক্ত রেডিওজেনিক ম্যাটেরিয়াল থাকবে, যা গ্রহটির অভ্যন্তরকে তরল রাখবে এবং সেটাই এর যান্ত্রিক শক্তিকে সচল রেখে আবহমণ্ডলকে রক্ষা করার মত চৌম্বক বর্ম গঠন করবে।
আপাতত প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রক্সিমা বি সম্পর্কে আরো ভালভাবে জানা। প্রথমত, সম্ভবত, গ্রহটির কক্ষপথের ঢালকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করা হবে। এটি কি প্রক্সিমাকে অতিক্রম করার সময়ে ঠিকভাবে অবস্থান করছে? বিপরীত কিছু হওয়াটাও অসম্ভব না, কিন্তু এখন যেহেতু আমরা গ্রহটির আবর্তনের সময়কাল জানি, আমরা ধারণা করতে পারি কখন এটি তার নক্ষত্রকে ঠিক কিভাবে অতিক্রম করবে, এবং আমাদের সবচেয়ে ভাল টেলিস্কোপ দিয়ে নজর রাখতে পারি যে কখন অনুজ্জ্বল লাল বামুন তারাটি মিটমিট করে ওঠে। যদি এটি করে, তাহলে গ্রহটির কক্ষপথের ঢাল এবং গ্রহটির ভর সঙ্গে সঙ্গেই অনুমেয় হয়ে পড়বে। এছাড়াও, এ ধরণের অতিক্রমণ জ্যোতির্বিদদের সুযোগ করে দেবে প্রক্সিমা বি এর আবহমণ্ডলক নিয়া গবেষণা করার জন্য।
আরোও হতে পারে যে আমরা গ্রহটির অতিক্রমণ দেখতে সক্ষম নাও হতে পারি। যদি হত, তাহলে আমরা আরো আগেই এটিকে খুঁজে বের করতে পারতাম! সেক্ষেত্রে, পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ার কিছু নেই। আসন্ন বছরগুলোয়, গ্রহটির আলোকে এর নক্ষত্র থেকে আলাদা করে আমরা হয়তো সরাসরি ছবিও তুলতে পারব। প্রক্সিমার দূরত্ব এক্ষেত্রে আমাদের অনুকূলে। গ্রহটির কক্ষপথের রেডিয়াস একে প্রক্সিমা থেকে সর্বোচ্চ ০.৪ arcseconds দূরে অবস্থিত করবে। খুবই ক্ষুদ্র দূরত্ব হলেও চিলির বিশাল টেলিস্কোপ, SPHERE এর মত যন্ত্রপাতির জন্য যথেষ্ট। সমস্যা হল, গ্রহটি তার নক্ষত্রের তুলনায় খুবই খুবই অনুজ্জ্বল থাকবে। যদি SPHERE প্রক্সিমা বি এর ছবি নিতে না পারে, তবে পরবর্তী জেনারেশনের টেলিস্কোপগুলোর, পৃথিবীতে বা স্পেসে, এ ছবি নেয়ার জন্য উপযুক্ত হওয়া উচিত।
তবে আসল পরীক্ষা হবে ওখানে পৌঁছানোর চেষ্টা। প্রচলিত স্পেস টেকনোলজি (মানুষ সহ বা ছাড়া) এবং কিছু উন্নত রণকৌশল ব্যবহার করলে প্রক্সিমা সেন্টোরি পৌঁছাতে কমপক্ষে ১৫০০০ বছর লাগবে। কিন্তু একটি নিজস্ব অনুদিত বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের দল, যার পরিচালনায় আছেন রাশিয়ান উদ্যোক্তা Yuri Milner এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ Stephen Hawking, একটি Breakthrough Starshot Initiative এর ঘোষণা দিয়েছেন। শক্তিশালী Earth-based লেজারের সাহায্যে সেখানে আইফোন সাইজের ছোট রোবটের দল পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। তাদের প্রস্তাবিত লক্ষ্য হল আলফা সেন্টোরির স্টার সিস্টেম, যা প্রক্সিমা সেন্টোরির সাথে সূর্যের মত আরো দুইটা নক্ষত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে। তাদের ধারণামতে, এইভাবে প্রতি সেকেন্ডে ৬০০০০ কিলোমিটার গতিবেগে প্রক্সিমা সেন্টোরিতে পৌঁছাতে মাত্র বিশ বছর সময় লাগবে। রোবটগুলো ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য, এমনকি প্রক্সিমা বি এর পরিষ্কার ছবিও পাঠাতে পারবে।
“আমরা অবশ্যই প্রক্সিমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি,” বলেন Alvi Loeb, একজন হার্ভার্ড জ্যোতির্বিদ যিনি Breakthrough Starshot এর উপদেষ্টা মণ্ডলীর চেয়ারম্যান। “এটা অনেকটা আমাদের আশেপাশে প্রাইম রিয়েল এস্টেট পেয়ে যাওয়ার মত।”
স্পষ্টত, আমরা আমাদের জীবদ্দশাতেই এই বিশ্ব থেকে কিছু পেতে যাচ্ছি।
তথ্যসূত্রঃ
বেশ হয়েছে।